২৬. ক্যারিবিয়ানের দ্বীপদেশে

চ্যাপ্টার

আহমদ মুসার মন চঞ্চল হয়ে উঠল। বুঝল, আলী নিশ্চয় সন্দেহজনক কারও দেখা পেয়েছে। তাহলে হোয়াইট ঈগল এই পথেই দ্বীপের মুসলিম অবস্থানের উপর আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ওদের পথকে এত তাড়াতাড়ি চি‎িহ্ণত করতে পারায় আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসাকে রাস্তায় কথা বলতে দেখে মসজিদ থেকে দ্রুত বেরিয়ে এল ইসহাক আব্দুল্লাহ, কলিন কামাল এবং ফরিদ নোয়ানকো।
আহমদ মুসার সামনে আসতে আসতে ইসহাক আব্দুল্লাহ বলল, ‘আবু বকর দশ মিনিট আগে তিনজনকে সাথে নিয়ে আলীর সাথে দেখা করতে গেছে।’
আহমদ মুসা তার কথার দিকে কান না দিয়ে বলল, ‘তোমার আব্বা কোথায়?’
ইসহাক আব্দুল্লাহ মুখ খুলতে যাচ্ছিল। সেই সময় তার আব্বা আব্দুর রহমান ওকারীকে আহমদ মুসার দিকে আসতে দেখা গেল।
সে আসতেই আহমদ মুসা তাকে সালাম দিয়ে বলল, ‘জনাব হোয়াইট ঈগল বড় ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে এ দ্বীপে আসছে। আজ রাতেই কোন এক সময় আক্রমণ হবে এবং মনে হচ্ছে এ ঘাটেই তারা ল্যা- করবে।’
আব্দুর রহমান ওকারীর চোখে-মুখে উদ্বেগ ফুটে উঠল। বলল, ‘আলী কিংবা আবু বকর কেউতো ফেরেনি। এটা জানা গেল কিভাবে?’
‘আজ সন্ধ্যায় জর্জের বোন এসেছে ‘গ্রান্ড টার্কস’ থেকে। তাকেই একজন টেলিফোন করে জানিয়েছে। তার উপর আলী দশটার মধ্যে না ফেরায় প্রমাণিত হচ্ছে সেও সন্দেহজনক কিছু দেখেছে।’ বলল আহমদ মুসা।
সকলের চোখে-মুখে চিন্তা ও উদ্বেগের ছায়া।
আহমদ মুসা সকলের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে বলল, ‘কি ব্যাপার, তোমরা কি ভয় করছ?’
ম্লান হাসল ইসহাক আব্দুল্লাহ। তাড়াতাড়ি বলল, ‘না ভাইয়া, আমরা ভাবছি, আপনি পাশে থাকলে, যে কোন কিছুর মোকাবিলায় আমরা দাঁড়াতে পারি।’
‘অবশ্যই।’ বলে উঠল কলিন কামাল ও নোয়ানকো একযোগে।
‘আলহামদুলিল্লাহ। আমাদের এখন দু’টি কাজ। এক, গ্রামের ট্রেনিং প্রাপ্ত সকলকে এই মসজিদ চত্বরে এনে জমা করা। দুই, কয়েকজনকে এখনি আবু বকরের সাথে যোগ দিতে হবে। ওদিকের সব অবস্থা জেনে এখানে এসে আমাদের কৌশল ঠিক করতে হবে। আমি, কলিন ও নোয়ানকো আবু বকরের ওদিকে যাই। ইসহাক আবদুল্লাহ এদিকটা দেখ।’
‘আমিও যাব।’ ইসহাক আবদুল্লাহ বলল।
‘অসুবিধা নেই। আমি অন্যদের নিয়ে এ দিকটা ম্যানেজ করবো। আমি গ্রামের দিকে বেরুচ্ছি।’ বলল ইসহাক আবদুল্লাহর আব্বা আবদুর রহমান ওকারী।
‘জর্জকে দায়িত্ব দিয়ে এসেছি সিডি কাকেম এলাকার।’
বলে একটু থামল আহমদ মুসা। তারপর আবার শুরু করল, ‘আমি যতদূর জানতে পেরেছি, ওরা বড় ধরনের দল নিয়ে আসছে। এ বিষয়টা কারও কাছে লুকানো ঠিক হবে না। তবে কেউ যদি ওদের মোকাবিলার প্রশ্নে দ্বিধাগ্রস্ততা অনুভব করে, তাহলে তাকে আমাদের সাথে শামিল হতে বাধ্য করা ঠিক হবে না। নিজেদের বিশ্বাস, নিজেদের সমাজ স্বজাতি, নিজেদের মাটি রক্ষার জন্যে যারা জীবন দিতে প্রস্তুত, তাদের সংখ্যা কম হলে ক্ষতি নেই। এঁরা আল্লাহর সাহায্য পাবেন।’
আবদুর রহমান ওকারী আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে ছিল। তাঁর চোখে ধীরে ধীরে ফুটে উঠল অবাক বিস্ময়।
কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর বলল আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে, ‘এমন করে কেউ কোনদিন আমাদের বলেনি। এমন বিশ্বাসের কথা, এমন আবেগের কথা আমাদের জানাই ছিল না। আল্লাহর সাহায্য এভাবে পাওয়া যায়, ভাবনায়ও আসেনি কোনদিন আমাদের। এতকিছু তুমি জান, এমনভাবে তুমি বলতে পার, কে তুমি বাবা?’
আহমদ মুসা বলল, ‘আমি আপনাদের ভিনদেশী এক ভাই। আর কিছুর কি দরকার আছে?’
বলে আহমদ মুসা ইসহাক আবদুল্লাহর দিকে চেয়ে বলল, ‘তোমরা কি প্রস্তুত? আমরা এখনি যাত্রা করব।’
‘আমরা প্রস্তুত।’ বলল ইসহাক আবদুল্লাহ।
‘তোমাদের তিনজনের পকেটেই কি রিভলবার আছে? আহমদ মুসা বলল।
ইসহাক আবদুল্লাহ উত্তর দিল না। তারা তিনজন পরষ্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল। একটু পর ইসহাক আবদুল্লাহ বলল, ‘না ভাইয়া, আমাদের কারো পকেটেই রিভলবার নেই।’
‘চাকু বা ছোরা আছে?’
ইসহাক আবদুল্লাহ আবার অন্য দু’জনের সাথে দৃষ্টি বিনিময় করে বলল, ‘না নেই।’
‘তাহলে প্রস্তুত কেমন করে তোমরা?’
‘আমরা মনে করছি, কি অবস্থা তার খোঁজ নিতে যাচ্ছি, লড়াইয়ে তো যাচ্ছি না। তাই….।’
কথা শেষ না করেই থেমে গেল ইসহাক আবদুল্লাহ।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘দেখ বর্তমান অবস্থায় একজন মুসলিমকে সব সময় পুলিশ ও সৈনিকের ভূমিকায় থাকতে হবে। আমরা যুদ্ধাবস্থায় আছি। রিভলবার ও চাকুর মত অস্ত্র সব সময় সাথে থাকতে হবে। যাও তৈরি হয়ে এসো।’
ওরা তিনজনই ছুটে চলে গেল।
আবদুর রহমান ওকারীও আহমদ মুসাকে সালাম দিয়ে ‘যাই ওদিকের ব্যবস্থা করি’ বলে হাঁটাতে শুরু করল।
মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই ওরা তিনজনই ফিরে এল।
আহমদ মুসা হাঁটতে শুরু করল। তার পেছনে পেছনে ওরা তিনজন।
হাঁটতে হাঁটতে ইসহাক আবদুল্লাহ, ‘আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি?’
‘সেটাই ভাবছি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কেন সেই গাছতলায়, যেখানে আলীর সাথে আবু বকরদের দেখা করার কথা, সেখানেই কি প্রথমে যাব না?’ বলল ইসহাক আবদুল্লাহ।
‘সেখানেই তো যাওয়ার কথা। ভাবছি, আলী আর আবু বকরের দেখা হলো কিনা? দেখা হলে তারা সেখানে এখনও আছে কিনা। যা পরিস্থিতি, তাতে আমার মনে হচ্ছে আলীর দেখা পাওয়ার পর আবু বকর প্রস্তুতির জন্যে বা খবর দেয়ার জন্যে এতক্ষণ ফেরার কথা। কিন্তু ফিরল না কেন?’
‘তাহলে?’ বলল ইসহাক আবদুল্লাহ।
‘তবু ওখানেই প্রথম যেতে হবে আমাদের।’ আহমদ মুসা বলল।
সেই গাছতলা ঘাটের খুব কাছাকাছি। এখান থেকে গন্তব্যস্থল এখনও বেশ দূরে। আহমদ মুসা আগে চলছিল। পেছনে ওরা তিনজন। আহমদ মুসা চারদিকে সাবধানী দৃষ্টি রেখে সামনে এগিয়ে চলছিল।
আহমদ মুসার দৃষ্টি তখন নিবদ্ধ ছিল সামনে বেশ দূরে। ক্ষুদ্র একটি আলোক শিখাকে সে জ্বলে উঠেই আবার নিভে যেতে দেখেছে। সেটা দিয়াশলাই-এর কাঠি বা সিগারেট লাইটারের আলো, না দৃষ্টি বিভ্রম! এ নিয়ে আহমদ মুসা মুহূর্তের জন্যে আনমনা হয়ে পড়েছিল।
কোন কিছুর সাথে হোঁচট খেয়ে পড়ে যেতে যেতে দাঁড়িয়ে গেল আহমদ মুসা।
নিচের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল আহমদ মুসা। মানুষের দেহ। ঘুমন্ত না মৃত।
পেন্সিল টর্চ জ্বেলে পরীক্ষা করতেই আরেক দফা চমকে উঠল আহমদ মুসা। এতো ওকারী গ্রামের! একি আবু বকরের সাথী ছিল?
কথাটা মনে আসতেই উদ্বেগের একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল আহমদ মুসার গোটা দেহে।
সোজা হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে আহমদ মুসা চাপা কণ্ঠে বলল, ‘ইসহাক তাড়াতাড়ি এদিকে এস। সাংঘাতিক ঘটনা ঘটে গেছে।’
বলে আহমদ মুসা সামনে ও আশেপাশে চোখ বুলাল। রাস্তার উপর পড়ে থাকা আরও তিনটি দেহ দেখতে পেল সে।
এই সময় একটা কণ্ঠ ভেসে এল সামনে মাটিতে পড়ে থাকা দেহ তিনটির দিক থেকে, ‘আহমদ আবদুল্লাহ ভাই, আমি পারিনি। সব শেষ হয়ে গেছে।’
আবু বকরের গলা! সে জীবিত কথাটা ভাবতেই আহমদ মুসা ছুটল দেহটির দিকে। ততক্ষণে আবু বকর তার ডান হাতটা বাম হাত দিয়ে চেপে ধরে উঠে বসেছে।
আহমদ মুসা ছুটে গিয়ে বসল তার পাশে।
বসেই বলল, ‘তুমি কেমন আছ, আর কোথাও গুলী লেগেছে?’
একে একে সবাই এসে ঘিরে দাঁড়াল আবু বকরকে।
‘ভাইয়া, আবু বকরের সাথের ওরা তিনজনই মারা গেছে।’ আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল ইসহাক আবদুল্লাহ।
কেঁদে উঠল আবু বকর। বলল, ‘পারিনি ওদের সাথে। ওরা ছিল তিনজন। প্রথম গুলীতে ওদের একজনকে মেরেছিলাম। দ্বিতীয় গুলী ছুড়বার আগেই গুলী খেলাম আমি। রিভলবার হাত থেকে ছিটকে পড়ে গেল। তারপরেই এল ওদের ব্রাশ ফায়ার। আমি মাটিতে পড়েছিলাম। ওরা মনে করেছিল গুলীতে আমিও ঝাঁঝরা হয়ে গেছি। চলে যায় ওরা।’
‘ওদের মৃত লোকটিকে তো দেখছি না। কোথায় সে?’ বলল আহমদ মুসা।
রাস্তার পাশে একটা জায়গার দিকে অংগুলি সংকেত করে বলল, ‘ঐখানে পড়েছিল। ওরা যাবার সময় লাশ নিয়ে গেছে।’
আহমদ মুসা উঠে গিয়ে জায়গাটা পরীক্ষা করল। অনেক জায়গা জুড়ে জমাট রক্ত।
আহমদ মুসা আঙুলের ডগা দিয়ে কিঞ্চিত রক্ত তুলে নিয়ে পরখ করে দেখল, কমপক্ষে ১৫ মিনিট আগে এ লোকটি নিহত হয়েছে। তার মানে ওরা তের চৌদ্দ মিনিট আগে এখান থেকে চলে গেছে।
আহমদ মুসা ফিরে এল আবু বকরের কাছে। বলল, ‘সংক্ষেপে বল কি ঘটেছিল?’
‘আকাশ থেকে বাজ পড়ার মত ওরা উদ্যত রিভলবার ও ষ্টেনগান হাতে আমাদের সামনে আবির্ভূত হয়। শুধু একটা গুলী করারই সুযোগ পেয়েছিলাম। তারপরেই সবশেষ। ’ বলল কান্না ভরা কণ্ঠে আবু বকর।
ভাবছিল আহমদ মুসা। বলল, ‘আমার মনে হচ্ছে তোমাদের অপেক্ষায় ওরা ওঁৎপেতে বসেছিল।’
‘কিন্তু জানল কি করে?’ বলল ইসহাক আবদুল্লাহ।
‘আমি নিশ্চিত আমাদের আলী হয় ওদের হাতে নিহত, নয়তো বন্দী।’
সকলেই চমকে উঠল আহমদ মুসার কথায়। আবু বকর বলল, ‘তাহলে আপনি বলতে চাচ্ছেন, বন্দী বা নিহত আলীর কাছ থেকে খবর পেয়ে বা সন্দেহ করেই তারা এখানে এসে ওঁৎপেতে বসেছিল?’
‘আমি তাই মনে করি।’ আহমদ মুসা বলল।
বলেই আহমদ মুসা কলিন কামালের দিকে চেয়ে বলে উঠল, ‘তুমি তো বলা যায় ডাক্তার। তুমি আবু বকরকে নিয়ে যাও। আমি এদিকে দেখছি।’
‘তিনটি লাশের আমরা কি করব?’ বলল কলিন কামাল।
‘ওগুলেঅ এখানেই থাকবে। গাড়ি এনে ওদের নিয়ে যেতে গেলে আমরা শত্রুর নজরে পড়ে যাব।’
বলে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। হাঁটতে শুরু করল আহমদ মুসা সড়ক ধরে ঘাট লক্ষ্যে। তার পেছনে ইসহাক ও নোয়ানকে।
ভাবছিল আহমদ মুসা, শত্রু দু’জন এখন কোথায় থাকতে পারে, কি করছে এখন তারা। এভাবে বিকেল থেকে ঘাটে থাকার তাদের উদ্দেশ্য কি? হঠাৎ আহমদ মুসার মনে হলো, তারা কি হোয়াইট ঈগলের আজকের অভিযানের অগ্রবাহিনী? হতে পারে। তারা এ এলাকায় খোঁজ-খবর রাখছে যা হোয়াইট ঈগলের অভিযানের সাহায্যে আসবে।
সুতরাং তারা শত্রুর গুপ্তচর। তাদের হত্যা করলে ওদের অভিযান অনেক মূল্যবান তথ্য থেকে বঞ্চিত হবে। আর যদি ওদের ধরতে পারা যায়, তাহলে অনেক মূল্যবান তথ্য আমরা পাব, ভাবল আহমদ মুসা।
ওরা এই মুহূর্তে কোথায় কি কাজ করতে পারে? আলী এবং এদেরকে হত্যা করার পর নিশ্চয় এদের খোঁজে আরও কেউ আসবে, এ নিশ্চিত আশংকা তারা করবে। সুতরাং তারা সড়কের উপর অবশ্যই চোখ রাখবে।
এ বিষয়টা চিন্তা করার সাথে সাথেই আহমদ মুসা থমকে দাঁড়াল। তার সাথে সাথে ইসহাকরাও।
‘কিছু ঘটেছে?’ ফিস ফিস করে বলল ইসহাক আবদুল্লাহ।
‘ঘটেনি। ঘটতে পারে, সে বিষয়েই চিন্তা করছি।’
চলা শেষ করেই আহমদ মুসা আবার বলল, ‘সড়ক দিয়ে এভাবে যাওয়া আর নয়। ইসহাক তুমি আর নোয়ানকো রাস্তার পশ্চিম পাশে নেমে হামাগুড়ি দিয়ে চলতে থাকো। আমি পুব পাশে নামছি।
যে গাছ তলায় আলী ও আবু বকরদের দেখা করার কথা, সে গাছ তলা আহমদ মুসারা পার হয়ে এসেছে। সে গাছ তলায় গিয়ে আহমদ মুসা চকিতে চোখ বুলিয়েও এসেছে। না সেখানে কিছু নেই। সেখানে আসার আগেই আলীর কিছু হয়েছে নিশ্চয়।
ঘাট খুব বেশি দূরে নয়।
একটা টিলার গোড়া দিয়ে যাচ্ছিল আহমদ মুসা। টিলার একাংশ কেটে রাস্তাটা তৈরি হয়েছে।
টিলা এবং রাস্তার মাঝখান দিয়ে নালা। সম্ভবত বৃষ্টির পানি সরানোর জন্যেই এ নালার সৃষ্টি।
এই নালা ধরেই দক্ষিণে ঘাটের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল আহমদ মুসা।
টিলাটির গোড়ায় পৌছতেই হঠাৎ আক্রান্ত হলো আহমদ মুসা। তার মনে হলো গোটা টিলাটাই যেন তার মাথায় হুমড়ি খেয়ে পড়েছে।
হাত থেকে ষ্টেনগানটা ছিটকে পড়ল আহমদ মুসার। সে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল নালায়।
পড়ে যাবার পরক্ষণেই আহমদ মুসা বুঝতে পারল টিলা ভেঙে তার মাথায় পড়েনি। দু’জন লোক তার উপর লাফিয়ে পড়েছে টিলার উপর থেকে। নিশ্চয় এরা সেই দু’জন। এরা ওঁৎপেতে ছিল টিলার উপর। ভাবল আহমদ মুসা।
এরা দু’জন আহমদ মুসার উপর লাফিয়ে পড়েই জাঁপটে ধরেছিল আহমদ মুসাকে।
একজন টিপে ধরেছিল আহমদ মুসার গলা। অন্যজন মুখ, নাক চেপে ধরে তার শ্বাস বন্ধ করার চেষ্টা করছিল।
নালাটা খুব প্রশস্ত ছিল না।
আহমদ মুসার হাত দু’টি পড়ে গিয়েছিল তার দেহের নিচে। উপর থেকে দু’জন চেপে ধরে থাকায় হাত দু’টি বের করার উপায় ছিল না।
গলা, মুখ ও নাকে ওদের হাতের চাপ বাড়ছে। মুখ এদিক ওদিক সরিয়ে মুখ ও নাক বাঁচাবার চেষ্টা করেছিল আহমদ মুসা। কিন্তু কতক্ষণ?
শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে আহমদ মুসার।
প্রদীপও নেভার আগে জ্বলে। অনেকটা যেন সে ধরনেরই ঘটনা ঘটল।
আহমদ মুসা দু’পা জোড়া করে যতটা পারা যায় ওপরে তুলে দ্রুত নিচে নামিয়ে দেহে একটা ঢেউ এর সৃষ্টি করে কটিদেশটা প্রবল বেগে উপরে তুলল। তার ফলে দেহের মধ্য অঞ্চলে একটা প্রবল ঝাঁকুনির সৃষ্টি হলো। মাথা আকস্মিক সক্রিয় হয়ে মাটির সাথে সেঁটে গেল এবং পিঠ ও কটিদেশটা বেশ তীব্র গতিতে অনেকখানি উপরে উঠল।
আকস্মিক এই প্রবল ঝাঁকুনিতে ওদের দু’জনের হাতই আহমদ মুসার গলা, মুখ ও নাক থেকে কিছুটা শিথিল হয়ে পড়ল এবং আহমদ মুসার উপর চেপে বসা তাদের দেহ পাশে সরে গেল।
মুক্ত বাতাসে বুক ভরে গেল আহমদ মুসার এবং সংগে সংগেই হাত দু’টি সক্রিয় হলো তার।
আহমদ মুসা দুই হাতে ভর দিয়ে দেহের সামনের অংশকে উপর দিকে ছুঁড়ে দিল।
আগের ঝাঁকুনিতেই ওদের হাত কিছুটা ঢিলা হয়ে পড়েছিল। আহমদ মুসার পিঠ থেকে এবার দু’জন দু’পাশে ঝুলে পড়ল। তারা আহমদ মুসার গলা ও মাথা তাদের হাতের মুঠোয় রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করছিল।
আহমদ মুসা তার দুই কনুই চালাল ওদের দু’জনের পাঁজরে। গুলী খাওয়ার মতই ওরা কেঁপে উঠল। টলে উঠল তাদের দেহ। আহমদ মুসাকে ছেড়ে দিয়ে ওরা নিজেদের সামলে নেবার চেষ্টা করল। কিন্তু তারা সময় নষ্ট করল না। এক হাত দিয়ে তারা পাঁজরটা চেপে ধরে অন্য হাত দিয়ে দ্রুত রিভলবার বের করল।
ওদের কবল থেকে মুক্ত হয়ে আহমদ মুসাও রিভলবার বের করেছে। কিন্তু আঘাত সামলে ওরা এতটা ক্ষিপ্রতা দেখাবে, তা সে ভাবেনি। আহমদ মুসা যখন ওদের দিকে চাইল, দেখল ওদের রিভলবারের দু’টি নলই তাকে লক্ষ্য করে উঠে এসেছে। তখন আহমদ মুসা তার রিভলবার সবে হাতে নিয়েছে মাত্র।
দ্বিতীয়বার বেকায়দায় পড়ল আহমদ মুসা। ওরা দু’জনেই দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। তবে বেশ দূরত্ব ওদের মধ্যে। একজন দক্ষিণ-পূর্ব কোণে, অন্যজন দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে। দু’জনকে গুলী করতে হলে রিভলবার বেশ ঘুরিয়ে নিতে হবে। এই অবস্থায় একজনকে গুলী করার পর আরেকজনকে গুলী করার সুযোগ সে কি পাবে?
বিকল্প হিসেবে তার পুরনো কৌশলের কথা চিন্তা করল। আহমদ মুসা তার চোখ ওদের দিক থেকে সরিয়ে আরও পেছনে তাকিয়ে দ্রুত মাথা নাড়ল যেন ওদের পেছনে দাঁড়ানো কাউকে কিছু বলছে সে। কাজ হলো।
ওরা দু’জনেই চমকে উঠে চকিতের জন্যে পেছন দিকে তাকাল।
সংগে সংগেই আহমদ মুসার রিভলবার বিদ্যুত বেগে উঠে এল এবং পর পর দু’বার গর্জন করে উঠল।
ওদের দু’জনেরই মাথায় গুলী লাগল। ওদিকে ফিরে তাকানো অবস্থাতেই মাটির উপর ছিটকে পড়ল ওদের দেহ।
আহমদ মুসা ধীরে ধীরে গিয়ে ওদের পকেট সার্চ করল। পেয়ে গেল একজনের পকেটে বাঞ্চিত বস্তু, ইনফ্রারেড গগলস। এই গগলসটি আহমদ মুসা দিয়েছিল আলীকে। কিন্তু অন্ধকারে দেখার এই গগলস দিয়ে আলী শত্রুদের খুঁজে পায়নি, বরং শত্রুরাই সম্ভবত তাকে প্রথম চি‎িহ্ণত করে। নিশ্চয় এই গগলস দিয়েই এরা আহমদ মুসাকে দূরে থাকতেই চি‎িহ্ণত করেছিল এবং ওঁৎপেতে ছিল। তবু ভাল, ওরা প্রথমেই গুলী করেনি।
গুলীর শব্দ পেয়ে ইসহাক আবদুল্লাহ এবং নোয়ানকো রাস্তার উপর দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে দ্রুত চলে এসেছে রাস্তার এ প্রান্তে। উদ্বেগ, আতংক ফেটে পড়ছে তাদের চোখ-মুখ থেকে।
রাস্তার প্রান্ত দিয়ে ছোট ছোট গাছ-গাছড়া। ইসহাক আবদুল্লাহ ও নোয়ানকো গাছ-গাছড়ার পাশ দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখতে পেল আহমদ মুসাকে।
উঠে দাঁড়িয়ে তারা ছুটে এল আহমদ মুসার কাছে। বলল ইসহাক আবদুল্লাহ আনন্দের সাথে, আলহামদুলিল্লাহ, অবশিষ্ট দু’একজনকে আপনি শেষ করেছেন। এখন নিশ্চয় আমাদের লুকিয়ে এগুতে হবে না?’
আহমদ মুসা ওদিকে কান দিয়ে বলল, ‘ইসহাক, আমাদের আরেক ভাই আলী নিহত হয়েছে।’ গম্ভীর কণ্ঠ আহমদ মুসার।
‘পাওয়া গেছে তার লাশ? কোথায়?’ বলল ইসহাক আবদুল্লাহ।
‘লাশ দেখিনি। তবে সে নিহতই হয়েছে।’
বলে আহমদ মুসা হাতের গগলসটা তাদের দেখিয়ে বলল, ‘এটা আলীর কাছে ছিল। হত্যার পর নিশ্চয় আলীর কাছ থেকে এটা ওরা পেয়েছে।’
‘তাই হবে ভাইয়া।’ বলল ইসহাক আবদুল্লাহ।
আহমদ মুসার মুখমন্ডল আরও গম্ভীর হয়ে উঠেছে। বলল, ‘আজ যাত্রার শুরুতেই চারজন শহীদের রক্তে স্নাত হলো আমাদের ভুখন্ড।’
‘কিন্তু ওদের মারা গেছে তো আমাদের সংখ্যার চেয়ে এগার গুণ বেশী।’ বলল ইসহাক আবদুল্লাহ সান্ত¦নার সুরে।
‘হ্যাঁ। শত্রুর তুলনায় অংকটা আনন্দিত হবার মত। কিন্তু এই চারজন তাদের পরিবারেই শুধু নয় আমাদের এখানকার এই ছোট্ট সমাজেও ছিল অমূল্য।’
‘আল্লাহর ইচ্ছা ভাইয়া। আপনার পরিকল্পনায় কোন ত্রুটি ছিল না।’ বলল ইসহাক আবদুল্লাহ।
আহমদ মুসা কোন উত্তর দিল না। সে তাকাল পাশের টিলার মাথার দিকে। বলল, ‘চল টিলার উপরটা দেখি। ওখানেই ওরা দু’জন ওঁৎপেতে ছিল।’
বলেই আহমদ মুসা টিলায় উঠতে শুরু করল। ওরাও দু’জন আহমদ মুসার পেছনে পেছনে চলল।
টিলার উপরে জায়গাটা খুব প্রশস্ত নয়। ৪ বর্গগজের বেশি হবে না। শীর্ষটাও ছোট ছোট গাছ-গাছড়ায় ঢাকা।
টিলার মাথার মাঝামাঝি জায়গাটার গাছ-গাছড়াগুলো ছেটে ফেলা। সেখানে একটা তোয়ালে বিছানো।
আহমদ মুসা সেদিকে এগিয়ে গেল। দেখল, তোয়ালের ওপর একটা হ্যাট, একটা টর্চ। তার পাশে একটা সাইড ব্যাগ।
ব্যাগ হাতে তুলে নিল আহমদ মুসা।
ব্যাগ খালি, মাত্র দু’ই শিট পাতলা কাগজ পেল। একটা শীট নীল, অন্যটি লাল।
আহমদ মুসা বুঝতে পারল ষ্টেনগান বহনের জন্যেই ওরা এই ব্যাগ ব্যবহার করেছিল।
কাগজের একটা শিট হাতে তুলে নিল আহমদ মুসা।
শিটটি হাতে তুলে নিতেই কাগজের ভাঁজ থেকে একটা ছোট্ট ইনভেলপ বেরিয়ে পড়ল।
ইনভেলপটি কুড়িয়ে নিল আহমদ মুসা। ইনভেলপটি খুলে ভাঁজ করা ছোট একটা শিট কাগজ পেল। আহমদ মুসা ভাঁজ খুলে চোখের সামনে মেলে ধরল কাগজটি।
পর পর চারটি লাইনের মাত্র ছয়টি শব্দ।
প্রথম লাইনে ‘পর্যবেক্ষণ ও খবর সংগ্রহ’, দ্বিতীয় লাইনে ‘সংকেত’, তৃতীয় লাইনে ‘ব্রিফিং’ এবং চতুর্থ লাইনে ‘শুরু’ লিখা।
আহমদ মুসার বুঝতে বাকি রইল না যে, যারা এদের নিয়োগ করেছে, তাদের তরফ থেকেই এই চিরকুট। অর্থাৎ যারা অভিযানে আসছে তাদেরই এ ব্রিফিং। কিন্তু ব্রিফিং সবটা খুব স্পষ্ট নয়।
ভাবল আহমদ মুসা এ বিষয়ে।
প্রথম লাইনের বক্তব্য পরিষ্কার। টর্চ ও লাল নীল কাগজ দেখে দ্বিতীয় লাইনের ‘সংকেত’-এর অর্থও মাথায় এল। বুঝতে পারল, যারা আসছে তাদেরকে সবুজ বা লাল সংকেত দিতে হবে। কখন, কোন অবস্থায় তা অবশ্য বলা হয়নি। চতুর্থ লাইনের ‘শুরু’-এর অর্থ অপারেশন শুরু ধরা যায়, তৃতীয় লাইনের ‘ব্রিফিং’ দুর্বোধ্য। ‘ব্রিফিং’ কি অপারেশন শুরুর আগে আলোচনা? আহমদ মুসা এ বিষয়ে কোন নিশ্চিত সিদ্ধান্তে পৌছতে পারল না।
আহমদ মুসা টর্চ হাতে নিয়ে ইসহাক আবদুল্লাহদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘যা বুঝলাম এই টর্চ দিয়ে সংকেত দিতে হবে যারা আসছে তাদেরকে। টর্চের মাথায় লাল কাগজ জড়িয়ে লাল সংকেত দেয়ার অর্থ হবে এদিকে বিপদ আছে। আসাটা বিপজ্জনক। আর নীল কাগজ জড়িয়ে নীল সংকেত দেয়ার অর্থ হবে সব ঠিক আছে, আসুন।’
কথাটা শেষ করেই আহমদ মুসা বলল, ‘আমার মনে হচ্ছে, এই টিলার আশে-পাশেই কোথাও আলীর লাশ পাওয়া যাবে। ওরা তিনজন এখানেই বসেছিল। এখানে বসেই রাস্তার দিকে নজর রেখেছিল এবং এখান থেকেই তারা সংকেত দিত। উভয় উদ্দেশ্যেই ওরা এই টিলা বেছে নিয়েছিল। আলী এই টিলার আশে-পাশে আসার পর আমার মতই ওদের দ্বারা আক্রান্ত হয়।’
‘তাহলে খুঁজে দেখতে হয়।’ বলল ইসহাক আবদুল্লাহ।
‘চল দেখি।’
আহমদ মুসারা তিনজনই নেমে এল টিলা থেকে।
নিচে নেমে আহমদ মুসা ইসহাক আবদুল্লাহ ও নোয়ানকোকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘ইসহাক রাত ১২টা বাজতে যাচ্ছে। এক মূহূর্ত আর নষ্ট করা যাবে না। আমি আলীকে খুঁজছি। তুমি আর নোয়ানকো গ্রামে ফিরে যাও। সব অস্ত্র, সব গোলা-গুলী ও সব মানুষকে নিয়ে এস। তোমার আব্বা আসবেন না। তিনি গ্রামের নারী, শিশু ও অবশিষ্ট লোকদের নিয়ে সজাগ থাকবেন।’
‘আমি একা যাই। নোয়ানকো আপনার সাথে থাকুক।’ বলল ইসহাক আবদুল্লাহ।
‘তোমার একা যাওয়া ঠিক মনে করছি না। আগাম সাবধানতা ভাল।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কিন্তু আপনি তো একা থাকবেন।’ ইসহাক আবদুল্লাহ বলল।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘জীবনের অধিকাংশ সময় একাই আমাকে পথ চলতে হয়েছে।’
বলে আহমদ মুসা ইসহাক আবদুল্লাহদের সালাম দিয়ে টিলার পেছন দিক লক্ষ্যে হাঁটা শুরু করল।
ইসহাক আবদুল্লাহ ও নোয়ানকো আহমদ মুসার যাত্রা পথের দিকে মুহূর্ত কয়েক চেয়ে থেকে হাঁটতে শুরু করল গ্রাম লক্ষ্যে।
হাঁটতে হাঁটতে নোয়ানকো বলল, ‘আহম আবদুল্লাহ ভাইকে যতই দেখছি, বিস্ময় আর প্রশ্ন বাড়ছে।’
‘আমারও।’ বলল ইসহাক আবদুল্লাহ।
‘আহমদ আবদুল্লাহ নামের একজন মানুষ মাত্র তিনি নন। আমার মাঝে মাঝে মনে হয় কি জান, কোন ফেরেশতাকে হয়তো আল্লাহ মানুষের রূপ দিয়ে পাঠিয়েছেন আমাদের প্রত্যক্ষ সাহায্যের জন্যে। তা না হলে এত সাহস, বহুমুখী এমন দক্ষতা এবং পরার্থে উৎসর্গীত এমন জীবন হঠাৎ একজন মানুষের মধ্যে কোত্থেকে এল। এমন লোক থাকলে তার নাম অবশ্যই শোনা যেত।’ বলল নোয়ানকো।
‘নোয়ানকো তুমি সত্যই বলেছ। এই মাত্র যা ঘটল তার কথাই ধরনা! উনি তাঁর নিরাপত্তার কথা ভাবলেন না, ভাবলেন আমাদের নিরাপত্তার কথা।’ বলল ইসহাক।
‘আর ফেরেশতাই বা তাঁকে বলা যাবে কেমন করে। জর্জের কাছে শুনেছি, মদীনায় তিনি স্ত্রী রেখে এসেছেন। তাই প্রশ্নটা তীব্রতর হচ্ছে, তিনি আসলে কে?’ বলল নোয়ানকো।
‘আমরা এর কিনারা করতে পারব না। থাক আলোচনা। চল দ্রুত হাঁটি। লোকজনকে নিয়ে তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে।
দু’জনেই দ্রুত পা চালাল গ্রামের উদ্দেশ্যে। | ← Previous | | | Next → | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »
Top