কলম্বাস বন্দরে হোয়াইট ঈগলের সেই অফিস সংলগ্ন একটা সুন্দর বাড়ি। বাড়ির ড্রইং রুম।
সোফায় বসে আছে মাঝ বয়সের রাশভারি একজন আমেরিকান।
চেহারায় কাঠিন্য। চোখ ঠান্ডা। বিরাট শরীর।
এই ব্যক্তিটিই আমেরিকান কন্টিনেন্ট হোয়াইট ঈগল-এর চীফ। নাম ডেভিড গোল্ড ওয়াটার।
তার চোখে-মুখে কিছুটা অস্থিরতা। কারও যেন অপেক্ষা করছে সে।
এই সময় অনেকটা ঝড়ের বেগেই প্রবেশ করল ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের হোয়াইট ঈগল-এর প্রধান জি,জে, ফার্ডিন্যান্ড।
ঢুকে সম্ভাষণ বিনিময়ের পর সোফায় বসতে বসতে দ্রুত কণ্ঠে বলল, ‘আপনি এসেছেন শুনে প্রথমে আমার বিশ্বাস হয়নি। এভাবে তো আপনি আসেন না। কোত্থেকে, কিভাবে বলুন, কেমন আছেন আপনি?’ এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে চুপ করল ফার্ডিন্যান্ড।
‘সত্যিই আমিও ভাবিনি আসব। আমার ফ্লাইট সিডিউল ছিল সোজা প্রিটোরিয়া (দক্ষিণ আফ্রিকা) থেকে ওয়াশিংটন। বিমান বন্দরে এসে শুনলাম সানসালভাদরের নতুন আন্তর্জাতিক বিমান বন্দ ‘কলম্বাস’-এ বিমানটি সৌজন্য অবতরণ করবে। সুযোগ পেয়ে আমি টিকিট চেঞ্জ করলাম। ঠিক করলাম কয়েক ঘণ্টা সানসালভাদরে কাটিয়ে পরে মিয়ামী হয়ে ওয়াশিংটন যাব।’ একটু থামল।
একটা হ্যাভানা চুরুট ধরিয়ে মুখে পুরে বলল, ‘তোমার সাথে বেশ অনেক দিন দেখা নেই। ভাবলাম তোমাদের কিছু খবর নিয়ে যাই। নতুন ডেমোগ্রাফিক রিষ্ট্রাকচার প্রোগ্রামে মুসলিম জনসংখ্যা বিলোপ কর্মসূচী এখানে কতদূর এগুলো সরেজমিন জানতে পারলে ভালই লাগবে।’ থামল ডেভিড গোল্ড ওয়াটার।
‘ধন্যবাদ। অগ্রগতি উৎসাহব্যঞ্জক। বলা যায় আশার চেয়ে বেশি। চলতি বছর মুসলিম পুরুষ শিশুর মৃত্যুর হার ২৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এই অগ্রগতি রাখতে পারলে, আগামী দশ বছরের মধ্যে ১৫ বছর পর্যন্ত মুসলিম বালকের সংখ্যা প্রায় শূন্যের কোঠায় চলে যাবে। পরবর্তী দশ বছরের মধ্যে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের মুসলিম মেয়েরা বিয়ের জন্যে মুসলিম যুবক খুঁজে পাবে না। পরবর্তী পাঁচ বছরের মধ্যে শতকরা প্রায় ১০০ ভাগ মুসলিম মেয়ের বিয়ে হবে খৃষ্টান অথবা অন্য কোন ধর্মের ছেলের সাথে। এর বছর দুয়েকের মধ্যে কোন মুসলিম শিশু খুঁজে পাওয়া যাবে না ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে। তারপর দুই তিন দশকের মধ্যে এই দ্বীপপুঞ্জে মুসলিম জনসংখ্যা শূন্যের কোঠায় নেমে যাবে।’
‘ব্রাভো! ব্রাভো! ফার্ডিন্যান্ড। যদি তা হয় তাহলে বলে দিচ্ছি, নোবল পিস প্রাইজ তুমি পেয়ে যাবে।’ বলল গোল্ড ওয়াটার।
‘নোবেল পিস প্রাইজ? কেমন করে?’ বলল ফার্ডিন্যান্ড।
‘ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জকে ধর্ম ও জাতিগত সংঘাত থেকে মুক্ত করে শান্তি স্থাপনের জন্যে।’ বলল গোল্ড ওয়াটার।
‘অশান্তির মাধ্যমে শান্তি!’ বলে হো হো করে হেসে উঠল ফার্ডিন্যান্ড।
‘কথাটা মনে হয় তুমি নতুন শুনলে! আমাদের পশ্চিমীদের রাজনীতি তো এটাই। এ রাজনীতির বিভিন্ন নাম আছে। কিন্তু লক্ষ্য একটাই পশ্চিমী আদর্শ নিয়ন্ত্রিত এক মতের, এক পথের, এক বিশ্ব।’
‘নোবেল পুরষ্কার কথা পরে। একটা সংকটের কথা বলা হয়নি আপনাকে।’
‘সংকট? কি সেটা?’
‘বলেছিলাম আপনাকে যে, গ্রান্ড টার্কস-এর চার্লস বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কয়েকজন ছাত্রের সমীক্ষায় মুসলিম পুরুষ শিশুদের সংখ্যা হ্রাস ধরা পড়েছিল, তাদেরসহ একজন সাংবাদিককে আমরা হত্যা করেছি। কিন্তু সমীক্ষার সাথে জড়িত এক মুসলিম ছাত্রী পলাতক ছিল। তাকে ধরতে গিয়ে আমাদের চারজন লোক রহস্যজনকভাবে খুন হয়। সেই…………’
ফার্ডিন্যান্ডকে বাধা দিয়ে গোল্ড ওয়াটার বলল, ‘রহস্যজনক বলছেন কেন?’
‘রহস্যজনক এই কারণে যে, হত্যাকান্ডটি এলাকার গ্রামবাসীদের দ্বারা হয়নি। হয়েছে একজন এশিয়ানের হাতে।’
‘এশিয়ান? কে সে?’
‘কে জানি না, কিন্তু লোকটি গ্রান্ড টার্কস দ্বীপে এসে প্রথমেই সেই মুসলিম মেয়েটির খোঁজ করে। আমাদের লোকেরা তাকে সন্দেহ করে তাকে মারপিট করে।’
‘তারপর?’
‘তার খোঁজ আমরা রাখিনি। খুব সাধারণ কেউ তাকে আমরা মনে করেছিলাম।’
‘আচ্ছা বল, কি বলছিলে।’
‘আমাদের চারজন লোক হত্যার প্রতিশোধ নেবার জন্যে আমরা তিরিশজন লোকের একটা শক্তিশালী দল পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু তারা হারিয়ে গেছে। তাদের জীবিত অথবা মৃত কোন চিহ্ণ আমরা খুঁজে পাইনি।’
‘কি বলছ তুমি, এটা কি সত্য?’
‘সত্য। আমরা লোক পাঠিয়ে গোটা দ্বীপ তন্ন তন্ন করে দেখেছি। কোথাও সন্দেহ করার মত কিছু পাইনি।’
‘অসম্ভব ব্যাপার। দ্বীপের কেউ কিছু বলতে পারেনি?’
‘না, পারেনি।’
‘বোটগুলো?’
‘বোটগুলোও পাওয়া যায়নি!’
কিছু বলতে যাচ্ছিল গোল্ড ওয়াটার। এ সময় ঘরে প্রবেশ করল শিলা সুসান। ফার্ডিন্যান্ডের একমাত্র মেয়ে।
ঢুকেই বলল, ‘স্যরি ড্যাডি। তোমরা গল্প করছ তাই কেউ আসতে সাহস করছে না। গ্রান্ড টার্কস থেকে দু’জন লোক এসে আপনার অপেক্ষা করছে।’
শিলা সুসান-এর হাতে রঙের তুলি। পাশেই আর্ট রুমে বসে সে আর্ট করছিল। সেখান থেকে রিসেপশন রুমের কথাবার্তা শোনা যায়। শুনেই ওদের সাহায্য করতে এসেছে।
কথা শেষ করেই শিলা সুসান গোল্ড ওয়াটারকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘গুড মর্নিং স্যার।’
শিলা সুসানের কথা শেষ হতেই ফার্ডিন্যান্ড সুসানের দিকে ইংগিত করে বলল, ‘এ আমার মেয়ে শিলা সুসান, ওয়াশিংটনের জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। আর্ট ওর বিশেষ সখ।’
‘ওয়েলকাম বেটি। বস।’ বলল গোল্ড ওয়াটার।
‘ধন্যবাদ।’ বলে বসল সুসান।
ইন্টারকমে রিসেপশনে খবর পাঠিয়েছিল ফার্ডিন্যান্ড।
দু’জন লোক প্রবেশ করল ড্রইং রুমে।
তারা সম্ভাষণ বিনিময়ের পর বলল ফার্ডিন্যান্ডকে, ‘আমরা গ্রান্ড টার্কস থেকে এসেছি জরুরী খবর নিয়ে।’
ফার্ডিন্যান্ডের ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে উঠল। বলল, ‘জন ব্ল্যাংকরা কোথায়?’
ফার্ডিন্যান্ডের কথা শেষ হতেই শিলা সুসান বলে উঠল, ‘ড্যাডি আমি যাই। যেসব মারামারির কথা চলছিল, সে রকম মারামারির কথাই আবার শুরু হবে। আমি এসব শুনতে পারব না। বলে উঠে দাঁড়াল শিলা সুসান।
শিলা সুসানের কথা শুনে হেসে উঠেছিল গোল্ড ওয়াটার। বলল, ‘যে মারামারি জীবনের জন্যে, সে মারামারিতে বিতৃষ্ণা থাকলে চলবে কেন বেটি?’
‘মারামারিটা জীবনের জন্যে অর্থাৎ আত্মরক্ষার জন্যে হচ্ছে কি?’ বলল শিলা সুসান।
‘অবশ্যই বেটি।’ গোল্ড ওয়াটার।
সুসান কিছু বলতে যাচ্ছিল তার আগেই ফার্ডিন্যান্ড বলল সুসানকে, ‘তোমাকে আইন না পড়িয়ে ভুল করেছি মা। ভাল আইনজীবি হতে।’ হাসতে হাসতে কথা বলছিল ফার্ডিন্যান্ড।
সুসান উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, ‘ড্যাডি আজ নয়, আরেকদিন ঝগড়া করব। চলি।’
বলে সুসান ড্রইং রুম থেকে বেরিয়ে তার আর্ট রুম ঢুকল।
সুসান বেরিয়ে যেতেই প্রশ্নবোধক দৃষ্টি তুলে ধরল ফার্ডিন্যান্ড গ্রান্ড টার্কস থেকে আসা লোক দু’টির দিকে।
লোক দু’টির মুখ শুকনো এবং চোখে উদ্বেগ। চারদিকের কোন কথার দিকেই তাদের মনোযোগ নেই।
ফার্ডিন্যান্ড তাদের দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টি তুলে ধরতেই তাদের একজন বলল, ‘সাংঘাতিক ঘটনা ঘটে গেছে আমাদের ওখানে।’
‘ভনিতা নয়, ঘটনা বল।’ কিছুটা শক্ত কণ্ঠে বলল ফার্ডিন্যান্ড।
‘সাউথ টার্কো দ্বীপে যারা অভিযানে গিয়েছিল, তাদের কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।’ বলল তাদের একজন কম্পিত কণ্ঠে।
‘কি?’ চিৎকার করে উঠল ফার্ডিন্যান্ডের কণ্ঠ। যেন বাজ পড়ল ঘরে।
চমকে উঠেছে ওরা দু’জনও। ভ্রু কুঁচকে উঠেছে গোল্ড ওয়াটারেরও।
অবিশ্বাস্য বিস্ময়ে আচ্ছন্ন হয়ে উঠেছে ফার্ডিন্যান্ডের মুখ।
চিৎকারের শব্দ মিলিয়ে যাবার আগেই ফার্ডিন্যান্ড বলল, ‘ওরা ফিরে আসেনি?’
‘আসেনি।’
‘কোন খবর দেয়নি?’
‘না।’
‘তারপর?’
‘দুপুর পর্যন্ত আমরা মনে করেছি, অপারেশনের পর তারা পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে ব্যস্ত রয়েছে। কিন্তু দুপুরেই টেলিফোন পেলাম সাউথ টার্কো দ্বীপের আমাদের অফিস থেকে। জানাল, অভিযানের আগে যে তিনজনকে পরিস্থিতি সম্পর্কে খবর সংগ্রহের জন্যে পাঠানো হয়েছিল, কেউ ফিরেনি, অভিযানে যাদের আসার কথা তাদেরও কোন চিহ্ণ পাওয়া যায়নি।’
‘অভিযানে আসার কথা’ বলেছে কেন, অভিযানে ওরা যায়নি?’
‘সে কথা তারা জানে না।’
‘চিহ্ণ খুঁজে পেল না কেন? ওরা কি ওখানে গিয়েছিল?
‘সাউথ টার্কো পুলিশ ষ্টেশন থেকে বিষয়টা তারা জানতে পারে।’
‘পুলিশ ষ্টেশন থেকে?’
‘হ্যাঁ। গ্রামবাসীদের তরফ থেকে খুব সকালে থানায় কেস হয় যে, ডাকাতরা তাদের গ্রাম আক্রমণ করতে এসেছিল। পথে তিনজনকে পেয়ে ডাকাতরা তাদের হত্যা করে। পরে গ্রামবাসীরা জেগে উঠলে ওরা পালিয়ে যায় তাদের বোটে চড়ে।’
লোকটি থামলেও ফার্ডিন্যান্ড কথা বলতে পারলো না। সে স্তম্ভিত চোখে তাকিয়ে আছে লোকটির দিকে। এ ধরনের অবিশ্বাস্য ঘটনা ঐ দ্বীপে এর আগেও একবার ঘটেছে। সে ঘটনায় হাওয়া হয়ে গিয়েছিল ৩০ জন লোক। কিন্তু আজকের ঘটনায় কথা বলার শক্তি যেন সে হারিয়ে ফেলেছে। একশ’ জনেরও বেশি সশস্ত্র লোক সেখানে নেই, ফিরেও আসেনি, তাদের নিহত হবার ঘটনাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, তাহলে ওরা গেল কোথায়! এবারের ঘটনায় একটাই শুধু নতুন বিষয়, ওদের পক্ষের তিনজন লোক নিহত হয়েছে এ পক্ষের লোকদের হাতে।
‘ওদের পক্ষের যে তিনজন লোক নিহত হয়েছে, তারা কিভাবে নিহত হয়েছে?’ অনেকক্ষণ পর বলল ফার্ডিন্যান্ড।
‘ষ্টেনগানের ব্রাশ ফায়ারে নিহত হয়েছে।’
‘থানা তদন্তে গিয়েছিল?’
‘হ্যাঁ। আমাদেরও লোক গিয়েছিল পুলিশের সাথে। তারা গ্রাম, ঘাট এলাকা, ঘাট পর্যন্ত রাস্তা, আশপাশ এলাকা সবই তারা পুলিশের সাথে ঘুরে ঘুরে দেখেছে, কিন্তু সন্দেহজনক কোথাও কিছু দেখতে পায়নি।’
‘কি চিহ্ণ তারা খুঁজেছে?’
‘কোন বড় সংঘাত-সংঘর্ষ ও রক্তারক্তি হলে তার একটা চিহ্ণ থাকবেই। সে রকম কিছু তারা পায়নি।’
লোকটি কথা শেষ করলেও ফার্ডিন্যান্ড কথা বলল না। ভাবছিল সে। বলল এক সময়, ‘থানা কি বলেছে?’
‘পুলিশরা তিনটা খুনকেই বড় করে দেখছে। তারা মনে করছে, রাতে কোন জলদস্যু গ্রামগুলোর উপর চড়াও হতে এসেছিল। গ্রামবাসীদের আবেদনে দ্বীপের দক্ষিণাঞ্চলে দু’টি পুলিশ বক্স বসেছে এবং রাতে পুলিশ এলাকায় টহল দিচ্ছে।’
‘গ্রান্ড টার্কস-এর পুলিশকে কিংবা পুলিশে আমাদের যারা আছে তাদের কিছু বলা হয়নি?’
‘না বলা হয়নি। বললে তো সব কথাই বলতে হবে। এ সিদ্ধান্ত আমরা নিতে পারিনি।’
‘ঠিক করেছ। ওখানকার বৃটিশ পুলিশের মধ্যে বেয়াড়া পুলিশ অফিসার অনেক আছে যাদের কাছে ঘটনার প্রকাশ ঘটলে আমাদের ক্ষতি হবে।’ বলল গোল্ড ওয়াটার।
বলে গোল্ড ওয়াটার তাকাল ফার্ডিন্যান্ডের দিকে এবং বলল, ‘ওর কাছ থেকে আর কিছু জানার আছে?’
‘সামান্য দু’একটা কথা।’ বলে ফার্ডিন্যান্ড লোকটিকে আবার জিজ্ঞেস করল, ‘ওদের কাছে অনেকগুলো মোবাইল টেলিফোন ছিল। ওদের কোন টেলিফোন পাওয়া যায়নি?’
‘না স্যার।’
‘তোমরা কি সাগরে সন্ধান করেছ?’
‘জ্বি। আমাদের কয়েকটা বোট দ্বীপটির চারদিকের গোটা সমুদ্র এলাকা তন্ন তন্ন করে দেখেছে। সেখানেও কিছু পাওয়া যায়নি।
লোকটি কথা শেষ করতেই ফার্ডিন্যান্ড তাকে বলল, ‘তোমরা গিয়ে রেষ্ট নাও। দরকার হলেই ডাকব তোমাদের।’
লোক দু’জন বেরিয়ে গেলে ফার্ডিন্যান্ড বিমূঢ় দৃষ্টি তুলে তাকাল গোল্ড ওয়াটারের দিকে। বলল, ‘আপনি কিছু বুঝলেন?’
‘আমি মনে করি সেখানে অলৌকিক কিছু ঘটেনি। আমাদের লোকেরা হয় বন্দী হয়েছে, নয়তো সবাই নিহত হয়েছে।’ বলল গোল্ড ওয়াটার।
‘এটা কি সম্ভব? সর্বোধুনিক অস্ত্রসজ্জিত আমাদের ১০০ জন লোককে ওখানকার গ্রামবাসীরা হত্যা বা বন্দী করবে কেমন করে?’
‘তা আমি জানি না। কিন্তু বন্দী বা হত্যা ছাড়া অন্য কোন ব্যাখ্যা বাস্তব নয়।’
‘বন্দী বা নিহত হওয়ার ঘটনাই বা বাস্তব হয় কি করে?’
‘আমারও এটা প্রশ্ন। কিন্তু হত্যা বা বন্দী হওয়া ছাড়া অন্য কিছুর কথা আমি চিন্তাও করতে পারছি না।’
‘পাঁচটা বোট গেল কোথায়?’
‘ওরা ওগুলো সাগরে ডুবিয়ে দিতে পারে।’
‘কেন? এ ধরনের বোট তো তাদের জন্যে খুব লোভনীয়।’
‘শত্রুকে তুমি গেঁয়ো বললেও আমার মনে হচ্ছে ওরা খুব বুদ্ধিমান। আমাদের লোকদের ওরা হত্যা বা বন্দী করেছে এটা তারা কোনভাবেই প্রমাণ হতে দিতে চায় না। থানায় তারা ডাকাত পড়ার ইজাহার দিয়ে দারুণ বুদ্ধিমানের কাজ করেছে। নিজেদের মজলুম প্রমাণ করে পুলিশকেও তারা তাদের পক্ষে নিতে চায়।’
‘কিন্তু হঠাত এ বুদ্ধি তাদের মাথায় এলো কি করে? এ গ্রামবাসীদের জানি আমরা। এরা প্রতিবাদ করা তো দূরে থাক প্রতিবাদের ভাষাও জানতো না। এদের এমন সাহস, শক্তি ও বুদ্ধি আসবে কোত্থেকে?’
‘এই উত্তর আমার কাছেও নেই।’
গোল্ড ওয়াটার থামলেও ফার্ডিন্যান্ড কিছুক্ষণ কথা বলল না।
বেশ কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর ফার্ডিন্যান্ড বলল, ‘আমাদের জিজ্ঞাসার জবাব পাওয়ার জন্যে এবং শত্রুকে আর বাড়িতে না দেবার জন্যে এখনই সর্বাত্মক অভিযান পরিচালনা করতে হবে বলে আমি মনে করছি।’
‘না ফার্ডিন্যান্ড এ ধরনের অভিযান করে আমরা যে সংকটে পড়েছি তাকে আরও বৃদ্ধি করবে। এ পর্যন্ত দুই ঘটনায় আমাদের লোকবলের ক্ষতি হয়েছে, আর্থিক ক্ষতি হয়েছে, কিন্তু ইমেজের ক্ষতি হয়নি। আমাদের এই আক্রমণের ঘটনা প্রকাশিত হবার সাথে সাথে আমরা সন্ত্রাসী বলে চিহ্নিত হবো বিশ্বের সকলের কাছে।’ বলল গোল্ড ওয়াটার।
‘আমরা পুলিশের সহযোগিতা পাব। সুতরাং খুব অসুবিধা কি হবে?’
‘কিছু পুলিশের বা বেশিরভাগ পুলিশের পাবে, সব পুলিশের পাবে না। সুতরাং বিষয়টা প্রকাশ পাবে। এ নিয়ে হৈ চৈ হবে। হৈ চৈ করবে বৃটেনবাসীরাও। সুতরাং বৃটিশ পুলিশকে প্রকাশ্যে আমরা পক্ষে পাব না।’
‘ঠিক বলেছেন। প্রকাশ্য অভিযান ক্ষতিকর হবে। আগের মতই গোপনে পুনরায় একটা চেষ্টা করতে আমরা পারি।’
‘পারি। কিন্তু আগের চেয়ে তা কঠিন হবে। আগে পুলিশ পাহারা ছিল না, এখন পুলিশ আছে। তাছাড়া কিছু না জেনে অন্ধকারে ঝাঁপ দেয়াকে যুক্তিসঙ্গত মনে করি না।’
‘তাহলে?’
‘আমার মতে ব্যাপক হত্যাকান্ড চালিয়ে কোন জনগোষ্ঠীকে দমন করা এখন বিপজ্জনক। এ বিষয়টা খুব তাড়াতাড়ি জানাজানি হয়ে যায় এবং চারদিক থেকে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ওঠে, এমনকি বিভিন্ন মানবাধিকার গ্রুপ ও জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন থেকে এর তদন্তও হয়। সুতরাং সামরিক অভিযানের পথে অগ্রসর হওয়া যাবে না। আমি মনে করি, আমরা যে পথে অর্থাৎ মুসলিম জনসংখ্যা হ্রাস করার যে পথে অগ্রসর হচ্ছি, সেটা দীর্ঘ মেয়াদী হলেও এটাই নিরাপদ। এ কার্যক্রমটাই আমাদের আরও জোরদার করা দরকার।’ বলল গোল্ড ওয়াটার।
‘তাহলে সাউথ টার্কো দ্বীপে আমরা এখন কিছুই করব না? এত বড় পরাজয় মেনে নেয়া খুবই কষ্টকর হবে।’ বলল ফার্ডিন্যান্ড।
‘কিছুই করব না, এ কথা ঠিক নয়। আমাদের গোয়েন্দা ইউনিটের লোকদের সেখানে ছড়িয়ে দাও। জানতে চেষ্টা কর, সেখানে কি ঘটেছে, কারা দায়ী। যারা দায়ী, তাদের এক এক করে কিডন্যাপ কর এবং শেষ করে দাও। আমাদের লোকেরা এক সাথে হারিয়ে গেছে, আর ওরা এক এক করে হারিয়ে যাবে।’
ফার্ডিন্যান্ডের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, ‘যিশুকে ধন্যবাদ, আমাদের লোকেরা খুশী হবে এ কর্মসূচী পেলে। আর মুসলিম পুরুষ শিশু জন্মের পরেই শেষ করে দেয়ার ব্যাপারটা আমরা জোরদার করব।‘
‘কিন্তু সাবধান, খুব গোপনে বুদ্ধিমত্তার সাথে এ কর্মসূচী এগিয়ে নিতে হবে। এটাও খুব বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়াবে, যদি জানাজানি হয়ে যায়।’
‘আমরা খুব সাবধান এ ব্যাপারে। আমাদের বিশ্বস্ত লোকদের দিয়ে আমরা এ কাজ করাচ্ছি। চিন্তার কোন কারণ নেই।’
‘খুশী হলাম।’
‘কিন্তু মারাত্মক কিছু দু:সংবাদও শুনলেন’
‘এ রকম কিছু দু:সংবাদের জন্যে তৈরি থাকতে হয়, এক তরফা একটা কাজ হয়ে চলবে, এটা স্বাভাবিক নয় ফার্ডিন্যান্ড।’ চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিতে দিতে বলল গোল্ড ওয়াটার। থামল একটু।
তারপর চায়ের কাপটা পিরিচে রাখতে রাখতে বলল, ‘এখন উঠি ফার্ডিন্যান্ড। কলম্বাস গীর্জার ফাদারের সাথে একটু কাজ আছে। সেটা সেরে রেষ্ট হাউজে ফিরব।’
বলে উঠে দাঁড়াল গোল্ড ওয়াটার।
ফার্ডিন্যান্ড তার সাথে হ্যান্ডশেক করতে করতে বলল, ‘ঈশ্বরই আজ আপনাকে এখানে নিয়ে এসেছিল। আপনার মূল্যবান পরামর্শ গোটা পরিস্থিতি পাল্টে দিয়েছে। কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।’
গোল্ড ওয়াটার বলল, ‘কাকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছ, এটা তোমার কাজ, আমার কাজ শুধু নয়, সকলের কাজ।’
ফার্ডিন্যান্ড গাড়ি বারান্দায় গোল্ড ওয়াটারকে গাড়িতে তুলে দিয়ে ফিরে এল। নিজের ষ্টাডি রুমে যাবার পথে ফার্ডিন্যান্ড তার মেয়ে শিলা সুসানের আর্ট রুমে উঁকি দিল। বলল, ‘স্কেচটা শেষ করতে পেরেছ সুসান?’
শিলা সুসান একটা স্কেচের দিকে তাকিয়ে গালে হাত দিয়ে বসেছিল। তার আব্বার কথা কানে যেতেই ফিরে তাকাল তার আব্বার দিকে। হাসল। বলল, ‘আর্টের একটা রঙ লাল বটে, ড্যাডি, কিন্তু মানুষের লাল রক্তের সাথে এর আকাশ-পাতাল পার্থক্য।’
‘তাতো বটেই। কিন্তু তারপর কি?’ বলল সুসানের আব্বা ঠোঁটে হাসি টেনে।
‘ওপাশে তোমাদের রক্তারক্তির গল্পে আমার রঙের কাজ আমি করতে পারিনি। আমার আর্ট রুম অনেকটা ড্রইং-এর অংশ। আমার এ রুম পাল্টে দাও।’
শিলা সুসানের আব্বা ফার্ডিন্যান্ড সুসানের শেষের কথাগুলো যেন শুনতেই পায়নি। বলল, ‘পাগল মেয়ে, রক্তারক্তির গল্প কোথায় শুনলে। খবর এসেছে আমাদের একশ’ লোককে ওরা সম্ভবত হত্যা করেছে। এ বিষয় নিয়েই আমরা আলোচনা করছিলাম।’
‘একশ’ লোক হত্যা হওয়া মানে রীতিমত একটা যুদ্ধ। এটা কি রক্তারক্তি নয়? ‘ওরা’ কারা ড্যাডি?’
‘সাউথ টার্কো দ্বীপের মুসলমানরা।’
‘কিন্তু ওদের সাথে তোমাদের বিরোধ কেন? কেন একশ’ লোকের বাহিনী পাঠিয়েছিল ওদের বিরুদ্ধে?’
‘এটা অস্তিত্বের রাজনীতি। তুমি এখন ছোট, পড়াশুনা করছ। আরও বড় হও বুঝবে মা। ধন্যবাদ।’
বলে ঘুরে দাঁড়িয়ে তার ষ্ট্যাডি রুমের দিকে হাঁটতে শুরু করল।
তার আব্বা চলে গেলেও শিলা সুসান দরজার দিকেই তাকিয়ে রইল। তার চোখের শূন্য দৃষ্টি বাইরে প্রসারিত। তার আব্বার শেষ কথাই তার মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। তার আব্বার শেষ কথা থেকে সুসান এটুকু বুঝেছে, বিষয়টা বড় রাজনীতির ব্যাপার। কিন্তু রাজনীতির সাথে এই হত্যাকান্ড কেন? বিভেদের এই হানাহানি ভাল লাগে না তার। তার বিশ্ববিদ্যালয়ে নিগ্রো ছাত্রদের ক্যান্টিন ও ক্লাসে বসার জায়গা আগে আলাদা ছিল। এখন এক হয়েছে। কিন্তু মন, সম্পর্ক ও সামাজিকতা তো হয়নি। সেই বিভেদের দেয়াল এখনও খাড়াই আছে। এ থেকে হানাহানি ও রক্তারক্তির ঘটনাও ঘটেছে। এই ক’দিন আগে একজন কৃষ্ণাংগ ছাত্রের সাথে শ্বেতাংগ ছাত্রীর প্রেম নিয়ে যে গন্ডগোল ও হানাহানি হয়েছে তা দেখে মনে হয়েছে কৃষ্ণাংগ ছাত্রটি যেন মানুষ নয়, পশু। শেষে তাকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়তে হয়েছে। এটাকেও নিশ্চয় বলা হবে অস্তিত্বের রাজনীতি। তাহলে দেখা যাচ্ছে, স্বতন্ত্র অস্তিত্বই আসল সমস্যা। কিন্তু স্বতন্ত্র তো একটা বাস্তবতা। এই বাস্তবতা সমস্যা হয়ে দাঁড়ালে তো বিপদ! এর সমাধান কোথায়? সকল ধর্ম, জাতীয়তা, স্বত্তা-স্বাতন্ত্রের উর্ধে ওঠা? মাথা ব্যথা বলে কি মাথা কেটে ফেলতে হবে?
মাথা ঘুরে গেল শিলা সুসানের। আর চিন্তা করতে পারল না।
হাতের স্কেচ এবং তুলিটা টেবিলে ছুঁড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াল সে। | ← Previous | | | Next → | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »
২৬. ক্যারিবিয়ানের দ্বীপদেশে

Tags