২৬. ক্যারিবিয়ানের দ্বীপদেশে

চ্যাপ্টার

ডা: মার্গারেটের চোখের সামনেই শিশুটি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল।
দ্রুত ঘুমিয়ে পড়ার মতই মৃত্যুটিকে মনে হলো ডা: মার্গারেটের কাছে।
রাজধানী গ্রান্ড টার্কস-এর একজন মুসলিম ব্যবসায়ীর ছেলে এই শিশুটি।
ডা: মার্গারেট পলকহীন চোখে তাকিয়ে আছে শিশুটির দিকে। মৃত্যুটি তার কাছে অবিশ্বাস্য। সকালে ডিউটিতে এসেই সে পরীক্ষা করেছে শিশুটিকে। সব ঠিক আছে। তার শারীরিক অন্যান্য পরীক্ষার রিপোর্টও ভাল। কিন্তু কয়েক ঘণ্টায় কি ঘটে গেল। মরেই গেল শিশুটি।
চিন্তার মধ্যে ডুবে গিয়েছিল ডা: মার্গারেট।
ওয়ার্ডের ষ্টুয়ার্ড মেয়েটির কথায় সম্বিত ফিরে পেল ডা: মার্গারেট। সে বলছিল, ‘ম্যাডাম, ছেলেটিকে সরিয়ে ফেলতে হয়।’
ডা: মার্গারেট তাকাল ষ্টুয়ার্ডের দিকে। ভাবল অল্পক্ষণ। তারপর বলল, ‘ষ্টুয়ার্ড, আমি ছেলেটিকে মর্গে পরীক্ষা করাতে চাই।’
‘কেন?’ অস্বাভাবিক কিছু সন্দেহ করেন?’
‘ঠিক তা নয়, কিন্তু সকালে পরীক্ষার সময় একে যেমন পেয়েছি, তাতে এভাবে মরার কথা নয়। তাই কারণ জানতে চাই।’
‘ম্যাডাম, তাহলে আপনি নোট দিন। ওয়ার্ডের হেড স্যার এবং হাসপাতালের ডিজি নোট অনুমোদন করলে তবেই মর্গে এই পরীক্ষা সম্ভব।’
ডা: মার্গারেট ভাবল কিছুক্ষণ। তার চোখের সামনে ভেসে উঠল আহমদ মুসার মনোহর অবয়বটি। আহমদ মুসার নির্দেশেই সে হাসপাতালের ইমারজেন্সী ওয়ার্ড থেকে অনেক তদবির করে বদলী নিয়ে প্রসূতি ও শিশু ওয়ার্ডে এসেছে। তাকে অনুরোধ করা হয়েছে, ওয়ার্ডের মুসলিম পুরুষ শিশুর উপর নজর রাখতে, তাদের কারো মৃত্যু হলে তার কারণ সন্ধান করতে। আহমদ মুসার এই অনুরোধ তার কাছে এক অলঙ্ঘনীয় নির্দেশ। সে এই নির্দেশ পালন থেকে পিছাতে পারে না।
ডা: মার্গারেট মুখ তুলল ষ্টুয়ার্ডের দিকে। বলল, ‘আসুন আমি নোট দিচ্ছি।’
ডা: মার্গারেট ওয়ার্ডে তার অফিসে এসে তার প্যাডে অফিসিয়াল একটা নোট লিখে ষ্টুয়ার্ডের হাতে তুলে দিল।
নোট নিয়ে ষ্টুয়ার্ড চলে গেলে চেয়ারে গা এলিয়ে দিল ডা: মার্গারেট। তার এই পদক্ষেপ সাধারণ দৃষ্টিতে অস্বাভাবিক। অস্বাভাবিক মৃত্যুর পক্ষে সুস্পষ্ট কারণ ঘটলেই শুধু এই ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়। একমাত্র প্রমাণহীন সন্দেহ ছাড়া তার দাবীর পক্ষে আর কিছু যুক্তি নেই। তাঁর উর্ধ্বতনরা তার সুপারিশকে কি দৃষ্টিতে দেখবেন?
ডা: মার্গারেট যখন এসব ভাবনায় ডুবে আছে, তখন হন্ত-দন্ত হয়ে তার ঘরে প্রবেশ করল ডা: ওয়াভেল। প্রবেশ করেই বলল, ‘ডা: মার্গারেট আপনি কি নোট দিয়েছেন? এর কি প্রয়োজন?’
ডা: মার্গারেট উঠে দাঁড়াল চেয়ার থেকে। বলল, ‘আমি যা মনে করেছি, সেটাই আমি নোটে লিখেছি স্যার।’
‘ঠিক আছে। কিন্তু আপনার যুক্তি কি?’
‘স্যার রোগীর রোগের ধরন, তার পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্ট কোন কিছুই শিশুটির মৃত্যু সমর্থন করে না। এটাই অস্বাভাবিকতা। এই অস্বাভাবিকতা কেন ডাক্তার হিসেবে আমাদের জানা কর্তব্য। এই কর্তব্যবোধ থেকেই আমি এই নোট দিয়েছি।’ বলল ডা: মার্গারেট।
‘হতে পারে রোগ নতুন কোন দিকে টার্ন নেয়ায় তার মৃত্যু ঘটেছে। যাই হোক রোগেই তার মৃত্যু ঘটেছে। এটা অস্বাভাবিক নয়। সুতরাং পরীক্ষা নিরীক্ষার প্রয়োজন নেই। নোট ফেরত নিন ডা: মার্গারেট।’
‘ফেরত নেবার প্রয়োজন নেই স্যার। আপনি এবং ডিজি যে সিদ্ধান্ত নেবেন সেটাই তো হবে।’
‘ডা: মার্গারেট, আমরা ছোটখাট ব্যাপার নিয়ে বাড়াবাড়ি করছি বলে মনে হয়।’
‘দু:খিত স্যার, নোট আমার হাত থেকে চলে গেছে, এটা এখন আপনাদের এক্তিয়ারে। যা ভাল মনে করছেন, তাই করুন।’
‘একটা নোট আমার কাছে পৌছার পর তা আমি ডিজিকে না দিয়ে পারি না। তাই বলছিলাম আপনি নোটটা প্রত্যাহার করলে ঝামেলা চুকে যায়।’ নরম সুরে বলল ডা: ওয়াভেল।
‘আপনি নোটে প্রয়োজন নেই লিখে দিন, তাহলেই তো হল।’
‘আমি আপনার সাথে ঝগড়ায় নামতে চাচ্ছিলাম না ডা: মার্গারেট।’
‘ঝগড়ার তো কিছু নেই। এটা মত পার্থক্যের ব্যাপার এবং এ মত পার্থক্য খুবই স্বাভাবিক।’
‘এই মত পার্থক্যের প্রয়োজন কি? আমি এটা চাই না। আবার অনুরোধ করছি, নোটটা আপনি প্রত্যাহার করুন।’
স্তম্ভিত হলো ডা: মার্গারেট ডা: ওয়াভেলের এই অনুরোধে। তার চেয়ে বেশি আশ্চর্য হলো, ডা: ওয়াভেলের মধ্যে কাকুতি মিনতির ভাব দেখে। একটা সামান্য বিষয় নিয়ে ডা: ওয়াভেলের মত একজন অত্যন্ত সিনিয়র ডাক্তার তার মত নবীন ডাক্তারের কাছে কাকুতি মিনতির পর্যায়ে নামবে কেন? এ বিষয়টাও ডা: মার্গারেটের কাছে শিশুটির মৃত্যুর মতই অস্বাভাবিক মনে হলো। এই চিন্তার সাথেই তার মনে হলো অস্বাভাবিকতার গ্রন্থি মোচন অবশ্যই হওয়া প্রয়োজন।
অবশেষে বলল, ‘স্যার নোটের কথাই আবার বলছি, ডাক্তার হিসেবে আমাদের সকলেরই জানা দরকার কি কারণে বা কি রোগে তার মৃত্যু হলো। এতে আমরা জানতে পারবো আমাদের করণীয় কি।’
‘এটাই তাহলে আপনার শেষ কথা?’
‘আমি দু:খিত স্যার।’
‘আপনি ভাল করলেন না ডা: মার্গারেট। আমি যা বলেছি, সব আপনার ভালোর জন্যেই বলেছি।’
‘দু:খিত স্যার।’
‘দু:খিত আমি আপনার জন্যে।’ বলে উঠে দাঁড়াল ডা: ওয়াভেল।
ডা: ওয়াভেল চলে যাবার পর এলেমেলো চিন্তার মধ্যে আবার ডুবে গেল ডা: মার্গারেট। মন তার খারাপ হয়ে গেল একজন সিনিয়র ডাক্তারের অনুরোধ এভাবে প্রত্যাখ্যান করায়। ডা: ওয়াভেল এই ওয়ার্ডে আছেন ৫ বছরেরও বেশী কাল ধরে। পুরনো লোক উনি। কিন্তু ডা: মার্গারেট বুঝতে পারছে না, এমন পুরনো ও অভিজ্ঞ ডাক্তার অমন অযৌক্তিক অনুরোধ করতে পারলেন কেমন করে! তার চেয়ে বড় কথা হলো, তার অনুরোধের ধরন দেখে মনে হয়েছে আমি তার বিরুদ্ধে ক্ষতিকর যেন কিছু করেছি, যা থেকে আমিই তাকে উদ্ধার করতে পারি। আবার শেষের দিকে ‘আমি দু:খিত আপনার জন্যে’ বলে যে শক্ত কথা বললেন, সেটাও তাঁর ব্যক্তিগত অসন্তুষ্টি থেকে এসেছে। বিষয়টাকে এভাবে তিনি ব্যক্তিগত নিলেন কেন?
মাথার চিন্তাটাকে হাল্কা করার জন্যে ওয়ার্ডে বের হলো ডা: মার্গারেট। রোগীদের খোঁজ খবর নিতে শুরু করল।
এক সময় একজন এ্যাটেনডেন্ট ছুটে এল ডা: মার্গারেটের কাছে। বলল, ‘শীঘ্রী চলুন, ডি জি স্যারের টেলিফোন।’
নিজের অফিসে ফিরে এসে টেলিফোন ধরল ডা: মার্গারেট।
ওপার থেকে ডিজি বলল, ‘তুমি যে নোট দিয়েছ, তা ডা: ওয়াভেল সমর্থন করেননি। শিশুটির মৃত্যুর অস্বাভাবিকতা সম্পর্কে তুমি কতটা নিশ্চিত?’
‘আমার দাবীর ব্যাপারে আমার কোন সন্দেহ নেই। শুরু থেকেই আমি শিশুটির রোগের ধারাবাহিকতা অনুসরণ করছি। এবং আজ সকালেও যা দেখেছি, তাতে ঐ রোগে মৃত্যুটা একেবারেই অস্বাভাবিক।’
‘তাহলে আমি সার্বিক পরীক্ষার অর্ডার দেব?’
‘স্যার যদি আমার উপর আস্থা রাখতে পারেন।’
‘তোমার রেকর্ড আমি জানি। সে জন্যেই টেলিফোন করলাম তোমাকে। আমি ওয়ার্ড-এর ইনচার্জের মতকেই তো ও,কে করতে পারতাম।’
‘ধন্যবাদ স্যার।’
‘ও.কে মাই ডটার। তোমার সাফল্য কামনা করি। ধন্যবাদ।’
টেলিফোন রেখে চেয়ারে গা এলিয়ে দিল ডা: মার্গারেট।

পরদিন বিকেল।
ওয়ার্ডে ঘুরতে গিয়ে দুটি শিশুর অবস্থার আকস্মিক পরিবর্তন দেখে চমকে উঠল ডা: মার্গারেট।
এ দু’টি শিশুর উপরও ডা: মার্গারেট ঘনিষ্ঠ দৃষ্টি রেখে আসছিল, শিশু দু’টি ভূমিষ্ঠ হয়ে বেডে আসার পর থেকে। শিশু দু’টি মুসলিম পুরুষ শিশু।
গতকাল রাতে ডিউটি থেকে যাবার সময় ডা: মার্গারেট শিশু দু’টিকে দেখে গেছে। সবদিক দিয়েই ভাল ছিল। কিন্তু আজ এসে দেখছে, শিশু দু’টির প্রাণশক্তি যেন দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। বাইরে রোগের তেমন কোন লক্ষণ নেই, ভেতরে থাকলেও তা বলার শক্তি শিশুর নেই। অবসাদগ্রস্থতা একমাত্র লক্ষণ। ধীরে ধীরে বাড়ছে শিশু দু’টির অবসাদগ্রস্থতা। আগের শিশুটির সাথে এর দু’টি শিশুর যেটুকু পার্থক্য তা হলো, ঐ শিশুটি নীরব ঘুমের মধ্যে দিয়ে শেষ হয়ে গেছে, আর এ দু’টি শিশু ঘুম নয়, এমনিতেই নিশ্চল হয়ে পড়ছে, যেন ধীরে ধীরে মৃত্যু এসে গ্রাস করছে শিশু দু’টিকে।
ডা: মার্গারেট দ্রুত শিশু দু’টির ফাইলে তাদের প্যাথোলজিক্যাল টেষ্ট সুপারিশ করল এবং লাল কালিতে টপ প্রায়োরিটি লিখল।
ফাইলটি আয়ার হাতে তুলে দিয়ে ডা: মার্গারেট সহকারী ডাক্তারকে ওয়ার্ডের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে বলল, ‘আমি একটু হাসপাতাল লাইব্রেরীতে যাচ্ছি। কেউ খোঁজ করলে বলো।’
আধ ঘণ্টা পর ওয়ার্ডে ফিরে এল ডা: মার্গারেট। ওয়ার্ডে ঢুকতেই তার সহকারী ডাক্তার মুখ শুকনো করে বলল, ‘ডা: ওয়াভেল স্যার আপনার নোট গ্রহণ না করে নিউরো টেষ্ট রিকোসেন্ড করে শিশু দু’টিকে নিউরো বিভাগে স্থানান্তরিত করেছে।’
চমকে উঠল ডা: মার্গারেট। বলল, ‘নিউরো প্রোব্লেম এখানে মূল ইস্যু নয়। নিউরো টেষ্ট দিয়ে কি হবে?’
বলে হতাশভাবে চেয়ারে বসে পড়ল ধপ করে।
আর কোন কথা না বলে ডা: মার্গারেট চেয়ারে গা এলিয়ে চোখ বুজল। চোখ বুজতেই শিশু দু’টির ছবি তার চোখের সামনে ভেসে উঠল। শিশু দু’টির যা অবস্থা তাদের প্যাথোলজিক্যাল টেষ্ট দরকার। তাতে শিশু দু’টিকে বাঁচানো যেত কিনা বলা মুষ্কিল, কিন্তু রোগটা জানা যাবে, রোগের কারণ জানা যাবে, জানা যাবে কেন কেমন করে দু’টি শিশু একই সময়ে একই রোগে আক্রান্ত হলো। কিন্তু কি করবে সে! এই ছোট ব্যাপার নিয়ে সে ওয়ার্ড প্রধানকে ডিঙিয়ে ডিজি’র কাছে যেতে পারে না।
ওয়ার্ডে সেদিনের শেষ রাউন্ডটা শেষ করে ডা: মার্গারেট অফিস কক্ষে ফিরে হাত ব্যাগ নিয়ে বেরুচ্ছিল এমন সময় তার টেবিলের টেলিফোন বেজে উঠল।
টেলিফোন ধরল ডা: মার্গারেট।
‘আমি ডা: কনরাড। আমি ডা: ওয়াভেলকে না পেয়ে তোমার কাছে টেলিফোন করলাম।’ ওপার থেকে কণ্ঠ ভেসে এল।
নাম শুনেই শশব্যস্ত হয়ে উঠল ডা: মার্গারেট। বলল, ‘স্যার আমি ডা: মার্গারেট।’
ডা: কনরাড নিউরোলজীর প্রফেসর। নিউরো ওয়ার্ডের প্রধান তিনি।
‘তোমাকেই চাচ্ছি আমি। যে শিশু দু’টিকে ডা: ওয়াভেল এ ওয়ার্ডে রেফার করেছিলেন, আমি ওদের দেখেছি। আমি ওদের ফেরত পাঠালাম। তোমার নোটই ঠিক। প্রোব্লেমটা আমার ধারণায় প্যাথোলজিক্যাল। তোমরা তাড়াতাড়ি দেখ ওদিকটা। খুবই সংকটাপন্ন ওদের অবস্থা।’ বলল ডা: কনরাড।
ডা: মার্গারেট খুশী হলো, উদ্বিগ্নও হলো সেই সাথে শিশু দু’টির ভবিষ্যত নিয়ে।
টেলিফোন রেখে দ্রুত ওয়ার্ডে ফিরে এল ডা: মার্গারেট। ইতিমধ্যে শিশু দু’টিকে পৌছানো হয়েছে ওয়ার্ডে।
ডা: মার্গারেট তাড়াতাড়ি ডা: কনরাড-এর রেফারেন্স দিয়ে আরেকটা নোট লিখল শিশু দু’টির ফাইলে।
নোট লেখা শেষ করেই ডা: মার্গারেট সহকারী ডাক্তারকে বলল, ‘নোট অনুসারে এদের টেষ্টের ব্যবস্থা কর। পরবর্তী ডাক্তার ডিউটিতে না আসা পর্যন্ত আমি আছি।’
হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে বাড়ি আসার জন্যে যখন গাড়িতে উঠল ডা: মার্গারেট, তখন মনটা তার অনেক হালকা মনে হলো। শিশু দু’টির উপযুক্ত টেষ্টের ব্যবস্থা হয়েছে। মনে মনে ধন্যবাদ দিল ডা: কনরাডকে।

| ← Previous | | | Next → | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top