২৬. ক্যারিবিয়ানের দ্বীপদেশে

চ্যাপ্টার

পরদিন হাসপাতালে যাওয়ার জন্যে তৈরি হয়েছে ডা: মার্গারেট।
হাসপাতালে ডিউটিতে যাচ্ছে বটে, কিন্তু তার মন খারাপ। ডা: মার্গারেট শিশু বিশেষজ্ঞ না হওয়ার অভিযোগ তুলে তাকে প্রসূতি ওয়ার্ড থেকে বদলীর জন্যে ডা: ওয়াভেল গতকালই এক সুপারিশ পাঠিয়েছে ডিজি ডাক্তার ক্লার্কের কাছে।
ডা: মার্গারেট শিশু বিশেষজ্ঞ নয়, এ কথা ঠিক। কিন্তু সে মেডিসিনের ডাক্তার। হাসপাতালের অর্গানোগ্রাম অনুসারে প্রত্যেক ওয়ার্ডেই অন্তত একজন করে মেডিসিনের ডাক্তার থাকবে। তাছাড়া প্রসূতি ও শিশু রোগের উপর ডাক্তার মার্গারেটের একটা বিশেষ ট্রেনিং আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন মেডিকেল ইনষ্টিটিউট থেকে।
ডা: মার্গারেট কিছুতেই বুঝতে পারছে না ডা: ওয়াভেল কেন তার প্রতি বিরূপ। দু’তিন দিন আগে তিনটি শিশু নিয়ে যা ঘটেছে, তা প্রতিটি ওয়ার্ডে প্রতিদিনের সাধারণ দৃশ্য। একে তার অন্যভাবে নেবার কারণ নেই। তাহলে? এই তাহলের কোন উত্তর মার্গারেটের কাছে নেই।
প্রস্তুত হয়ে হাসপাতালে যাবার জন্যে হাতব্যাগটা নিয়ে উঠে দাঁড়াল ডা: মার্গারেট।
টেলিফোন বেজে উঠল। যাবার জন্যে পা তুলেও আবার ফিরে দাঁড়াল ডা: মার্গারেট। টেলিফোন ধরল। টেলিফোন ধরেই সচকিত হলো ডা: মার্গারেট। ডিজি ডা: ক্লার্কের টেলিফোন।
‘স্যার আপনি। কিছু ঘটেনি তো?’ ডা: ক্লার্কের কণ্ঠ শুনেই শশব্যস্তে জিজ্ঞেস করল ডা: মার্গারেট।
‘কিছু তো ঘটেছেই। তোমাকে অভিনন্দন জানাচ্ছি মার্গারেট। এখনই ল্যাবরেটরি থেকে ডা: বিশপ জানালেন, তিনটি শিশুর রক্তেই অস্বাভাবিক ও ভয়ংকর ধরনের উপাদান পাওয়া গেছে। তিনটি শিশুর কেউ বাঁচেনি বটে, কিন্তু তারা ভয়ংকর কোন রোগের বিষয়ে আমাদের চোখ খুলে দিয়ে গেল। তোমার সচেতনতার ফলেই তাড়াতাড়ি বিষয়টা জানা সম্ভব হয়েছে।’ বলল ডা: ক্লার্ক।
‘ধন্যবাদ স্যার। একজন ডাক্তারের যা করণীয় তার বেশি কিছু করিনি স্যার।’
‘ধন্যবাদ, মার্গারেট। রাখি, বাই।’
‘বাই, স্যার।’
টেলিফোন রাখল মার্গারেট।
চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে মার্গারেটের। গত দু’তিন দিনের উদ্বেগ ও বিষণœতা, ধুয়ে-মুছে সাফ হয়ে গেল মন থেকে। তার একটা ভয় ছিল, প্যাথেলজিক্যাল টেস্টে যদি কিছু না পাওয়া যায়, তাহলে তার বিরুদ্বে ডা: ওয়াভেলের অভিযোগ আরও মজবুত হবে এবং প্রসূতি ওয়ার্ড তাকে অবশ্যই ছাড়তে হবে। তা যদি হয়, তাহলে আহমদ সুসার কাছে তার মুখ দেখাবার মত থাকবে না। আহমদ মুসা হয়তো ভাববে, আমার নির্বুদ্ধিতার কারণেই আহমদ মুসার একটা পরিকল্পনা মাঠে মারা গেল।
এই দু:সহ অবস্থায় তাকে যে পড়তে হলো না এ জন্যে সে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল। শিশু তিনটির প্যাথোলজিক্যাল টেস্টের এই রেজাল্ট পেলে আহমদ মুসা দারুণ খুশি হবে। কিভাবে মুসলিম পুরুষ শিশুগুলো মরছে তার কারণ সে চিহ্নিত করতে চায়। কারণ চিহ্নিত হলে কারণের উতস সে খুঁজে বের করতে চেষ্টা করবে।
এটা ভাবেত গিয়ে আহমদ মুসার হাস্যোজ্জ্বল মুখ ডা:মার্গারেটের চোখে ভেসে উঠল। তার সাথে সাথে তার হৃদয় এল প্রশান্তির একটা পরশ। তার মনে হলো,হৃদয়ের ফ্রেমে এ মুখটা এভাবেই সব সময় বাঁধা থাকতো! এটা ভাবতে গিয়ে চমকে উঠল ডা:মার্গারেট। একটা অনধিকার চর্চার ভয় ও লজ্জা এসে তাকে ঘিরে ধরল।
মন থেকে এসব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে হাসপাতালে যাবার জন্যে পা বাড়াল সে।
কিন্তু সংগে সংগেই পা আবার থেমে গেল। ভাবল, আহমদ মুসাকে বিষয়টা সে তো টেলিফেনে জানাতে পারে। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবল হাসপাতারৈ গিয়ে রিপোর্ট দেখে বিস্তারিত জানানোই ঠিক হবে।
পা বাড়াল আবার সে হাসপাতালে যাবার জন্যে। নিজস্ব গাড়িতে করে যাচ্ছে সে হাসপাতালে।
ডা:মার্গারেটের আব্বা ছিল একজন বৃটিশ সেনা অফিসার। সুতরাং নিজেদের গাড়ি, বাড়ি নিয়ে তারা গ্রান্ড টার্কস দ্বীপের সচ্ছল পরিবারের একটি।
তাদের বাড়িকে সবাই কর্নেলের বাড়ি বলে জানে। তার আব্বা কর্নেল র‌্যাংক থেকে রিটায়ার করে। ডাক্তার মার্গারেট ও জর্জ দু’টি সন্তানই মাত্র তার।
চলছে মার্গারেটের গাড়ি। গাড়িটা সুন্দর নতুন একটা কার। রাস্তায় তেমন ভীড় নেই।
ডা:মার্গারেট তার গাড়ির রিয়ারভিউতে দেখল, পিছন থেকে একটা ট্রাক আসছে নির্ধারিত গতির চেয়ে অনেক বেশি তীব্র বেগে।
ডা: মার্গারেট সাবধানতা হিসাবে তার গাড়িটাকে রাস্তার পাশ বরাবর চাপিয়ে নিয়ে ট্রাককে বেশি জায়গা দিয়ে দিল।
পরবর্তী কয়েক সেকেন্ড কি ঘটল ডা:মার্গারেট কিছুই বুঝল না। শুধু তার মনে হলো, ট্রাকটি এসে তার গাড়ির উপর পড়েছে। তারপর কিছুই মনে নেই তার। রাস্তার পাশ বরাবর ছিল রেলিং-এর পর খাল।
খালটি প্রাকৃতিক নয়, তৈরি করা। রাজধানী শহরের মধ্য দিয়ে খালটি দ্বীপের বুক চিরে সাগরে গিয়ে পড়েছে।
ট্রাকের প্রচন্ড ধাক্কায় ডা: মার্গারেটের গাড়িটা রেলিং ভেঙে ছিটকে গড়িয়ে পড়ল খালে।

হাসপাতাল বেডে জ্ঞান ফিরে পেয়ে ডা: মার্গারেট দেখতে পেল জর্জকে।
জর্জের চোখ দু’টি উজ্জ্বল হয়ে উঠল এবং ঠোঁটে ফুটে উঠল হাসি। মুখে ফুটে উঠল স্বস্তির চিহ্ন।
ডা: মার্গারেটের ঠোঁটেও ফুটে উঠল ম্লান হাসি। ধীর কণ্ঠে বলল, ‘এখন সময় কতরে জর্জ?’
‘বিকেল পাঁচটা।’
উত্তরটা দিয়েই জর্জ আবার শুরু করল, ‘মাথার আঘাতটাই বড়, কিন্তু তাতে বড় ধরনের ক্ষতি হয়নি। খুব অল্পের জন্যে খুব বড় ক্ষতি থেকে আল্লাহ তোমাকে বাঁচিয়েছেন। সবাই খুশী হয়েছে। ডা: ক্লার্ক, ডা: কনরাড দু’জনেই অপারেশনের সময় হাজির ছিলেন।’
‘ডা: ওয়াভেল ছিলেন না?’
‘উনি এসেছিলেন, কিন্তু বেশিক্ষণ থাকেননি। কি কাজ থাকায় চলে যান।’
‘আর কেউ আসেনি?’
‘কেন, হাসপাতালের সব ডাক্তারই এসেছিল।’
‘আর কেউ?’ মার্গারেটের ঠোঁটে ম্লান হাসি।
জর্জ ডা: মার্গারেটের মুখের দিকে চাইল, তারপর চিন্তা করল।
পরক্ষণেই হেসে উঠল। বলল, ‘হ্যাঁ ভাইয়া এসেছিলেন। দু’জন এক সাথে এসেছিলাম। তোমাকে দেখে তো উনিই প্রথম বলেন, ‘আল্লাহ মার্গারেটেকে বাঁচিয়েছেন।’
ম্লান হাসল মার্গারেট। বলল, ‘উনি আছেন?’
‘না আপা। উনি তোমাকে দেখেই দুর্ঘটনার স্পটে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে আবার হাসপাতালে এসেছিলেন। এসে আমার সাথে কিছু কথা বলেই আবার চলে গেছেন।’
বলে জর্জ তার গলার স্বরটা আর একটু নামাল এবং ডা: মার্গারেটের দিকে আর একটু ঝুকে পড়ে বলল, ‘শুরু থেকেই পুলিশ বলছে তোমার ওটা এ্যাকসিডেন্ট, সবাই বিশ্বাসও করেছে। কিন্তু আহমদ মুসা ভাই এ্যাকসিডেন্টের স্পট দেখে এসে আমাকে বলে গেলেন, ‘ট্রাকটি রাস্তার যেখানে এসে মার্গারেটের গাড়ির যে জায়গায় আঘাত করেছে, তাতে এই আঘাত নি:সন্দেহে পরিকল্পিত। সুতরাং এ্যাকসিডেন্ট নয়।’
ডা: মার্গারেটের মুখের আলোটা হঠাৎ দপ করে নিভে গেল। তার ভ্রু কুঞ্চিত হলো। বলল উদ্বিগ্ন কণ্ঠে, ‘ঠিক, আমারও এখন তাই মনে হচ্ছে। ট্রাকটার তীব্র গতি দেখে আমি আমার গাড়ি রাস্তার কিনার বরাবর সরিয়ে নিয়েছিলাম। কিন্তু সেখানে এসেই ট্রাকটি আঘাত করে আমার গাড়িকে। ট্রাকটি কি এ্যাকসিডেন্টে পড়েছে?’
‘না পালিয়েছে।’
‘একমাত্র ব্রেক ফেল হলেই ট্রাকটা ঐভাবে আমাকে পাগলের মত আঘাত করতে পারতো। সে ক্ষেত্রে ট্রাকটিও এ্যাকসিডেন্টে পড়ত। তা যখন হয়নি, তখন ঠিকই ওটা এ্যাকসিডেন্ট নয়।’
‘কিন্তু আপা ওটা যদি এ্যাকসিডেন্ট না হয়, তাহলে প্রশ্ন জাগে কে তোমাকে ওভাবে হত্যা করতে চেয়েছিল?’
‘জানি না জর্জ। আমার কোন শত্রু আছে বলে হয় না।’
বলে একটু থেমেই ডা: মার্গারেট আবার বলল, ‘উনি কোথায় গেলেন?’
‘ভাইয়া?’
‘হ্যাঁ।’
‘যে ট্রাকটা এ্যাকসিডেন্ট ঘটিয়েছে, তার খোঁজ পাওয়া যায় কিনা উনি বলেছিলেন। কিন্তু কোথায় কি কাজে গেছেন আমি জানি না।’
ডা: মার্গারেট কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু বলা হলো না। ঘরে প্রবেশ করলেন ডা: ক্লার্ক। তার সাথে ছিল ওয়ার্ডের ডাক্তার।
‘এই তো সেরে গেছ মার্গারেট। তুমি খুব লাকি। মাত্র দেড়-দু’ইঞ্চির জন্যে ভয়ানক পরিণতি থেকে বেঁচে গেছ।’
বলতে বলতে ডা: ক্লার্ক ডা: মার্গারেটের সামনে এসে দাঁড়াল।
জর্জ উঠে আগেই পাশে সরে গেছে।
ডা: ক্লার্ক মার্গারেটের একটা হাত তুলে নিয়ে নাড়ী দেখে বলল, ‘বাঃ সবকিছুই নরমাল।’
‘ধন্যবাদ স্যার।’ বলল মার্গারেট।
‘শুনলাম, এ্যাকসিডেন্ট খুব মারাত্মক ছিল। অবশ্য তোমার কোন দোষ ছিল না। ট্রাকটাই হঠাৎ নাকি নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছিল।’ ডা: ক্লার্ক থামল।
ডা: মার্গারেট একটু দ্বিধা করল। তারপর বলল, ‘স্যার মাফ করবেন, ঐ রিপোর্টগুলো আপনি পেয়েছেন?’
মার্গারেটের প্রশ্নের সাথে সাথেই ডা: ক্লার্কের মুখ মলিন হয়ে গেল। মুহূর্ত কয়েক বাকহীন হয়ে থাকার পর ডা: ক্লার্ক বলল, ‘ও তুমি ঘটনাটা এখনও জানতে পারনি। রিপোর্টগুলো এবং রিপোর্টের সাথে সংশ্লিষ্ট সবকিছু চুরি গেছে।’
‘চুরি গেছে?’
‘হ্যাঁ। ডা: বিশপ রাতে ডিউটি থেকে যাবার সময় রিপোর্ট তার ফাইলে রেখে গিয়েছিল এবং পরীক্ষিত ব্লাড, ইউরিন ইত্যাদি রীতি অনুসারে ল্যাবেই রাখা ছিল। তোমাকে টেলিফোন করার ক’মিনিট আগে ডা: বিশপ-এর টেলিফোন পাই। টেলিফোন করেই অফিসে যান। অফিসে গিয়ে রিপোর্ট এবং ওগুলোর কিছুই পাননি।’
বিষয়টা ডা: মার্গারেটের জন্যে শ্বাসরুদ্ধকর বিস্ময়ের। কিছুক্ষণ সে কথা বলতে পারল না। ডা: ক্লার্কই আবার কথা বলল বলল, ‘আরও কিছু ঘটনা ঘটেছে। তুমি আমার ছাত্রী এবং মেয়ের মত। বলতে বাধা নেই। বিষয়টা খুব জটিল মনে হচ্ছে। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।’
একটু থামল ডা: ক্লার্ক। দু’পাশে তাকাল। দেখল সাথের ডাক্তার ও নার্স ওদিকের টেবিলের দিকে গিয়ে ডা: মার্গারেটের ফাইল নিয়ে আলোচনা করছে।
ডাক্তার ক্লার্ক বলল, ‘চুরির খবর জানার সাথে সাথে আমি বিষয়টাকে গুরুত্ব দিয়ে দেখি এবং থানায় কেস করার সিদ্ধান্ত নেই এবং পুনরায় লাশ তিনটিকে টেষ্টের চিন্তা করি। সংগে সংগেই বিষয়টা আমি ডা: ওয়াভেল ও ডা: বিশপকে জানিয়ে দেই। মাত্র আধ ঘণ্টা পরে আমি টেলিফোন পাই। একটা ভারি কণ্ঠ যান্ত্রিক স্বরে বলে, ‘ডাক্তার সাহেব, তিনটি শিশুর প্যাথোলজিক্যাল টেষ্টের রিপোর্ট এবং আনুসঙ্গিক জিনিসগুলো হারানোর ব্যাপারে থানায় নাকি মামলা করছেন এবং লাশগুলোকে আবার নাকি পরীক্ষা করাবেন শুনলাম। শুনুন ডাক্তার, বিশেষ প্রয়োজনে ওগুলো আমরা নিয়েছি। আমরা চাই, নতুন টেষ্ট এবং থানায় মামলা করার ব্যাপারে এক ইঞ্চি এগুবেন না। এগুলে রিপোর্টগুলো যেভাবে গায়েব হয়েছে, সেভাবে আপনিও গায়েব হয়ে যাবেন।’
শুকনো কণ্ঠে কথাগুলো বলল ডা: ক্লার্ক। তার চোখে-মুখে ভয়ের চিহ্ন।
‘তারপর স্যার?’ ভয় মেশানো উদগ্রীব কণ্ঠে বলল ডা: মার্গারেট।
‘ডা: ওয়াভেলের সাথে আলাপ করলাম। ডা: বিশপ-এর সাথেও। ডা: ওয়াভল এই ছোট্ট বিষয় নিয়ে কোন ঝুঁকি নেয়ার বিরোধীতা করলেন। অন্যদিকে ডা: বিশপ ভীত হয়ে পড়েন। তবে মামলা ও টেষ্টের পক্ষে তিনি। কিন্তু আবার মামলার জড়িত হয়ে বিপদ ডেকে আনতে চান না। এই অবস্থায় মামলা করা ও নতুন পরীক্ষায় সাহস পাচ্ছি না।’ বলল ডা: ক্লার্ক।
হতাশা নেমে এল ডা: মার্গারেটের চোখে মুখে। বলল, ‘তাহলে শিশু তিনটির মৃত্যুর কারণ জানার আর উপায় রইল না স্যার। তার ফলে এভাবে হয়তো শিশু মৃত্যু ঘটেই চলবে।’
‘স্যরি, মাই ডটার।’
বলে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে ডা: ক্লার্ক বলল, ‘তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠো। ঈশ্বর আছেন মার্গারেট।’
ডা: ক্লার্ক চলে যাবার অনেক সময় পর। ডা: মার্গারেট তার বেডে শুয়ে। আহমদ মুসা তার পাশে চেয়ারে বসে। জর্জ দাড়িয়েছিল আহমদ মুসার পেছনে। ডাক্তার, নার্স, কেউ তখন ঘরে নেই।
ডাক্তার মার্গারেট গত তিনদিনের কাহিনী বলছিল আহমদ মুসাকে। বলছিল কিভাবে সেদিন প্রথম মুসলিম শিশুটির মৃত্যু হওয়ায় সন্দেহ জাগে, কিভাবে মৃত শিশুর পোষ্টমর্টেম মার্গারেট দাবী করলে ডাক্তার ওয়াভেল তার বিরোধীতা করেন, কিভাবে ডাক্তার ক্লার্কের সমর্থনে শিশুটির লাশ পোষ্টমর্টেমে যায়, কিভাবে ১দিন পরে দু’টি মুসলিম শিশু দুর্বোধ্য রোগে সংকটজনক অবস্থায় পড়ে। ডা: মার্গারেট তার প্যাথোলজিক্যাল টেষ্টের সুপারিশ করেন এবং ডাক্তার ওয়াভেলের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হন, কিভাবে তাদের টেষ্ট অবশেষে হয়, কিভাবে তিনটি টেষ্টের রিপোর্ট ও পরীক্ষিত আইটেম মিসিং হয়েছে, কিভাবে তার এ্যাকসিডেন্ট হয় এবং কিছুক্ষণ আগে ডা: ক্লার্ক তার উপর হুমকি আসার বিষয়ে কি বলে গেলেন।
গভীর মনোযোগ দিয়ে কথাগুলো শুনছিল আহমদ মুসা।
কাহিনী শেষ করে ডা: মার্গারেট থামলেও আহমদ মুসা কথা বলল না।
ভাবছিল সে। তার চোখ দু’টি উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
বলল সে ডাক্তার মার্গারেটকে লক্ষ্য করে, ‘তুমি দু’দিনে বহুদূর এগিয়েছ। শিশু তিনটির মৃত্যুর কারণ জানা গেল না, কিন্তু কারণের উৎস চিহ্নিত হয়ে গেছে। তোমাকে ধন্যবাদ মার্গারেট।’
ডা: মার্গারেটের চোখ-মুখ আনন্দের বন্যায় ভেসে গেল। আহমদ মুসা তার কাজের স্বীকৃতি দিয়েছে, প্রশংসা করেছে, এটুকু পাওয়ায় তার সব ব্যথা-বেদনা ভুলিয়ে দিল। দুর্বোধ্য একটা আনন্দের সুখ-শিহরণ খেলে গেল তার দেহ, মনে এবং প্রতিটি রক্ত কণিকায়।
একটু সময় নিয়ে ডাক্তার মার্গারেট বলল, ‘উৎস চিহ্নিত হয়েছে? আমি কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছি না।’
‘এটুকু জেনে রাখ আইসবার্গের অনেক মাথার একটা মাথা ডা: ওয়াভেল হতে পারেন।’
বিস্মিত ডা: মার্গারেট কিছু বলতে যাচ্ছিল। আহমদ মুসা তাকে বাধা দিয়ে বলল, ‘ডা: ওয়াভেলের বাসা কোথায়?’
‘হাসপাতালের পাশেই ডাক্তারদের রেসিডেন্সিয়াল ব্লকে। নম্বার এফ-১৩।’
‘ওর কোন ক্লিনিক আছে?’
‘নিজস্ব ক্লিনিক নেই, কিন্তু একটা ক্লিনিকে তিনি বসেন। বাসায় আমার টেলিফোন ইনডেক্সে ঠিকানা আছে।’
‘মার্গারেট তিনটি শিশুর নাম আমার দরকার। রিপোর্টে তাদের নাম যেভাবে আছে।’
মার্গারেট তাকাল জর্জের দিকে। কাগজ কলম নিতে বলল জর্জকে। মার্গারেট নাম তিনটি বলল লিখে নিল জর্জ। নাম লেখা স্লিপটা হাতে নিয়ে ভাঁজ করে পকেটে রাখতে রাখতে বলল, ‘ধন্যবাদ মার্গারেট।’
‘এসব নিলেন, কিছু করতে চাচ্ছেন?’ বলল মার্গারেট উদ্বিগ্ন কণ্ঠে।
‘কতটুকু কি করতে পারব জানি না। কিছু করতে তো হবেই এবং সেটা কাল সকালের আগেই।’
‘কি সেটা?’ উদ্বিগ্ন কণ্ঠ মার্গারেটের।
‘সবই জানবে, তবে এখন নয়, এখানে নয়।’
বলে উঠে দাঁড়াচ্ছিল আহমদ মুসা।
রুমে প্রবেশ করল লায়লা জেনিফার এবং সারা উইলিয়াম। কথা না বললে ওদের চিনতেই পারতো না আহমদ মুসা। দু’জনের পরণে ছেলের পোশাক। মাথায় হ্যাটও ছেলেদের। বলা যায় নিখুঁত ছদ্মবেশ।
বাইরে বেরুলে লায়লা জেনিফারকে ছদ্মবেশ নিতে বলা হয়েছে। এটা আহমদ মুসারই নির্দেশ।
বা! তোমরা সুন্দর ছদ্মবেশ নিয়েছ।’ বলল জেনিফারদের আহমদ মুসা।
‘না ভাইয়া, এ আমি পারব না। কি লজ্জা, তার চেয়ে ভাল আমি বাইরেই বেরুব না।’ মুখ লাল করে বলল জেনিফার।
‘বেশিদিন এ কষ্ট করতে হবে না জেনিফার। দেখ তোমার তালিকায় এবার মার্গারেটও পড়েছে। আজ আল্লাহ তাকে বাঁচিয়েছেন। মার্গারেটকেও সাবধান থাকতে হবে।’
বলে আহমদ মুসা মার্গারেটের দিকে তাকিয়ে বলল, ’যে কয়দিন তুমি হাসপাতালে আছ, তেমন কোন ভয় নেই। কিন্তু তারপর আমার মনে হয় একটা বিপজ্জনক সময় তোমাকে পাড়ি দিতে হবে।’
‘কেমন?’ বলল মার্গারেট।
‘সামনে তুমি শত্রুর আরও বড় টার্গেট হয়ে দাঁড়াতে পার।’
‘জানি, আপনি বেশি বেশি ভয় দেখাচ্ছেন, যাতে আমি সাবধান হই।’
‘না মার্গারেট, সাউথ টার্কো দ্বীপের এক পর্যায়ের লড়াই সমাপ্ত হলো। আরেক লড়াই শুরু হয়ে গেছে।’ বলল গম্ভীর কণ্ঠে আহমদ মুসা।
থামল আহমদ মুসা। একটু থেমেই আবার শুরু করল, ‘সত্যি আমি একটু স্লো হয়ে গিয়েছিলাম, বুঝতে পারিনি, আঘাতটা দ্রুত আসবে। সবই আল্লাহর ইচ্ছা, কিন্তু আমার অসাবধানতার জন্যে মার্গারেটের জীবন বিপন্ন হয়েছিল।’
বিষন্ন হয়ে উঠল মার্গারেটের মুখ। বলল, ‘না পরিস্থিতিটা আপনাকে জানাইনি, এটা আমারই দোষ।’
‘না মার্গারেট, আমার এখন মনে হচ্ছে, খুব একটা চিন্তা না করেই তোমাকে কঠিন এক বিপদে ঠেলে দিয়েছি। হয়তো এই কাজটা অন্যভাবে করতে পারতাম।’
ডা: মার্গারেটের মুখে ক্ষোভের চিহ্ন ফুটে উঠল। চোখের দৃষ্টি আবেগে ভারি হয়ে উঠেছে তার। বলল, ‘সব বিপদ আপনি আপনার জন্যে বরাদ্দ করে নেবেন। কেন বিপদ মোকাবিলার মন, শক্তি কিছুই বুঝি আমাদের নেই। আদেশ দিয়ে দেখুন না, আগুনেও ঝাপ দিতে পারি কিনা।’ কণ্ঠ ভারি মার্গারেটের। কথা শেষ করেই ওপাশে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে মার্গারেট।
আহমদ মুসা হাসল। উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘ধন্যবাদ মার্গারেট তোমাদের। আমি নিশ্চিত, লড়াইয়ে আমরা জিতব। ক্যারিবিয়ান দ্বীপাঞ্চল তোমাদের যে পেয়েছে, এ জন্যে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি।’
কথা শেষ করে আহমদ মুসা ফিরল জেনিফারের দিকে। আহমদ মুসা কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছিল। কিন্তু আহমদ মুসার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে জেনিফার বলল, ‘ভাইয়া মার্গারেট আপা’র মত সাহসীদের লক্ষ্য করে ‘তোমাদের’ শব্দ বললেন, তার মধ্যে আমি আছি কিনা?’
‘কেমন করে থাকবে? একটা ছদ্মবেশ পরার ভয়ে বাইরে বেরুতে চাচ্ছ না। তাহলে কি পারবে তুমি বল?’ হেসে বলল আহমদ মুসা।
‘ঠিক আছে পারব না। একদিন একটা গাড়ি এ্যাকসিডেন্ট করে দেখাব।’
‘এ্যাকসিডেন্ট করো, কিন্তু আহত, নিহত না হও সেটা দেখো।’
‘তাতে কার কি ক্ষতি?’
‘এ প্রশ্নের জবাব জর্জ দিতে পারবে। তবে আমার একটা ক্ষতি আছে, ঝগড়া করা ও ঝামেলা পাকাবার লোক থাকবে না।’
‘আমি ঝামেলা পাকাই?’
‘তুমি ঝামেলা পাকিয়েই তো আমাকে নিয়ে এসেছ।’
বলেই আহমদ মুসা ‘চলি’ বলে হাঁটা শুরু করল কক্ষ থেকে বেরুবার জন্যে।
জেনিফার ছুটে গিয়ে আহমদ মুসার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমার তো আরও কথা আছে। যেতে দেব না।’
আহমদ মুসা তাকে পাশ কাটিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলল, ‘সাউথ টার্কো দ্বীপে পুলিশ প্রহরা ভালো চলছে। শত্রুদের চররা কিছুদিন সাউথ টার্কো দ্বীপে সক্রিয় ছিল, কিন্তু কোন খবর সংগ্রহ করতে না পেরে, তারা হাল ছেড়ে দিয়েছে, ইত্যাদি কথা বলবে তো আমি জানি।’
আহমদ মুসা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
ডা: মার্গারেট আবার এ পাশ ফিরেছে। জেনিফারকে লক্ষ্য করে বলল, ‘তোমাকে উনি এত ¯েœহ করেন তাতো জানতাম না।’
‘আর আপনাকে যে উনি আকাশে তুললেন সেটা কি?’
‘আকাশে তোলা আর কাছে টানা এক জিনিস নয়।’
কথাটা বলেই মার্গারেট বুঝতে পারল মুখ ফসকে যা বলার নয় তাই বেরিয়ে গেছে। কথাটা সংশোধন করার জন্যে মার্গারেট সংগে সংগেই আবার বলল, ‘তোমার মত অমন কাছে হতে পারা সবার জন্যেই সৌভাগ্যের।’
জেনিফার জর্জের দিকে চেয়ে একটা দুষ্টুমি হেসে ডাঃ মার্গারেটকে কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু ডাক্তার ও নার্স ঘরে এসে প্রবেশ করায় মুখ তেতো করে নীরব হয়ে যেতে হলো জেনিফারকে।
ডাঃ মার্গারেটের কক্ষ থেকে বের হয়ে আহমদ মুসা প্রথম কাজ ঠিক করল, ডাঃ ওয়াভেল কোথায় তা জানা।
আহমদ মুসা নিঃসন্দেহ যে, হয় ডাঃ ওয়াভেল নিজে রিপোর্টগুলো চুরি করেছে, না হয় সে চুরি করতে সাহায্য করেছে। সুতরাং তাকে পাওয়া দরকার।
আহমদ মুসা ছুটল ডিউটি রুমের দিকে।
ওয়ার্ডগুলোর প্রবেশ মুখে সিঁড়ি ও লিফট রুমের পাশেই ডিউটি রুম।
ওয়ার্ডে প্রবেশের আগে ডাক্তার ও ষ্টাফরা তাদের ডিউটি কার্ড রেজিষ্টার মেশিনে ঢুকিয়ে ডেট ও টাইম এন্ট্রি করিয়ে নেয়। ডিউটি থেকে ফেরার সময়ও তাই করে।
ডিউটি রুমে ডিউটি অফিসারের চেয়ারে একটি মেয়ে। কক্ষে সেই একমাত্র লোক।
আহমদ মুসা ঘরে ঢুকে গুড ইভনিং জানিয়ে ডিউটি অফিসার মেয়েটিকে বলল, ‘একটা ব্যাপারে আপনার সাহায্য পেতে পারি?’
‘অবশ্যই। কি করতে পারি বলুন?’ গোঁফওয়ালা আনকমন একজন যুবকের দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে চেয়ে বলল মেয়েটি।
‘আমি ডাঃ ওয়াভেল সম্পর্কে জানতে চাই। তিনি ডিউটিতে আছেন কিনা।’
মেয়েটি বলল, ‘প্লিজ বসুন, এখনি জানাচ্ছি।’
বলে মেয়েটি তার সামনের কম্পুটারের দিকে মনোযোগ দিল। তার হাতের দুটো আঙুল কয়েকটি কম্পুটার নব-এর উপর ঘুরে এল।
কম্পুটার স্ক্রিনে ভেসে উঠল কয়েকটি শব্দ, কয়েকটি অংক। সেদিকে একবার চোখ বুলিয়েই মেয়েটি বলল, ‘ডাঃ ওয়াভেল আধ ঘণ্টা আগে রাত ৭টায় চলে গেছেন। শরীর খারাপ বলে আজ একটু আগেই চলে গেছেন।’
শরীর খারাপ হওয়ার কথা শুনে হঠাৎ আহমদ মুসার মনে প্রশ্ন জাগল, এর মধ্যে কোন তাৎপর্য নেই তো!
আহমদ মুসা চট করে প্রশ্ন করল, ‘অসুস্থ ছিলেন! কিন্তু আমাকে তো আসতে বলেছিলেন!’
‘অসুস্থ ছিলেন না। হঠাৎ করেই খারাপ ফিল করে চলে গেছেন।’ বলল মেয়েটি।
‘এ রকম প্রায়ই তাঁর হয় বুঝি?’ বলল আহমদ মুসা।
‘না, এভাবে তার চলে যাবার দৃষ্টান্ত নেই।’
‘তাহলে তাঁকে বাড়িতে পাওয়া যেতে পারে।’
‘সম্ভবত।’
‘অনেক ধন্যবাদ।’ বলে আহমদ মুসা ডিউটি রুম থেকে বেরিয়ে এল।
হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে ভাবল আহমদ মুসা, ‘ডাঃ ওয়াভেল নিশ্চয় অসুস্থ নন। কিন্তু অসুস্থতার কথা বলে আগেই চলে গেছেন কেন, যা তিনি কখনই করেননি। কোন জরুরী কাজে কি গেছেন? সে কাজটা কি?
আহমদ মুসা এই মুহূর্তেই ডাঃ ওয়াভেলের বাসায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল।
হাসপাতালের উত্তর পাশে ডাক্তারদের জন্যে নির্দিষ্ট রেসিডেন্সিয়াল ব্লকে ডাঃ ওয়াভেলের বাড়ি।
রেসিডেন্সিয়াল ব্লকের উত্তর প্রান্তের শেষ বাড়িটা ডাঃ ওয়াভেলের। এর পরেই শুরু হয়েছে আরেকটা রেসিডেন্সিয়াল ব্লক।
বাড়িটা খুবই নিরিবিলি।
আহমদ মুসা বাড়ির চারদিক দেখল। ব্লকের সব বাড়িই এক রকম। বাড়িতে ঢোকার প্রধান প্যাসেজ একটা। বাড়ির অন্য পাশে চাকর-বাকরদের জন্যে আরও একটা ছোট প্যাসেজ রয়েছে।
ডাক্তারের দর্শনার্থী একজন রোগীর মত স্বাভাবিক হেঁটে আহমদ মুসা বাড়িটার দরজায় গিয়ে দাঁড়াল।
রাত তখন ৮টা।
আহমদ মুসা তেমন একটা ছদ্মবেশ নেয়নি। মুখে একটা গোঁফ লাগিয়েছে মাত্র। মাথার হ্যাটটা কপালের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত নামানো।
দরজায় নক করল আহমদ মুসা।
আধা মিনিটের মধ্যেই দরজা খুলে গেল।
বার-তের বছরের একটা ছেলে দরজায় দাঁড়ানো।
দরজা খুলে যাওয়ার সাথে সাথে আহমদ মুসার দৃষ্টি ছুটে গেল ভেতরে।
দরজার পরেই একটা করিডোর। করিডোরটি প্রশস্ত।
করিডোরের দক্ষিণ দেয়ালে একটা দরজা। উত্তর দেয়ালেও আরেকটা। উত্তর দরজার উপরে শিরোনাম ‘টয়লেট’। অল্প পশ্চিমে এগিয়ে করিডোরটি বড়, ফাঁকা একটা স্পেসে গিয়ে শেষ হয়েছে।
‘কে আপনি? কাকে চাই?’ ছেলেটি প্রশ্ন করল।
‘আমি ডাঃ ওয়াভেলের সাথে সাক্ষাত করতে চাই। আছেন তিনি?’
‘আছেন। কি বলব তাকে?’
‘হাসপাতালে গিয়ে ওকে পাইনি, তাই এখানে এসেছি। খুব জরুরী দরকার।’
ছেলেটি করিডোরের দক্ষিণ পাশের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল।
এক মিনিটের মধ্যে ফিরে এসে বলল, ‘উনি এখন ব্যস্ত। আধঘণ্টা পরে আসুন, নয়তো কাল হাসপাতালে দেখা করতে বলেছেন।’
‘ঠিক আছে তুমি গিয়ে বল, আমি আধঘণ্টা দাঁড়াচ্ছি।’
ছেলেটি আবার গেল সেই কক্ষে। আহমদ মুসার মনে হলো, কক্ষটি বাইরের ড্রইং রুম, নয়তো ডাঃ ওয়াভেলের পার্সোনাল কোন ঘর। করিডোরের সামনে যে সুদৃশ্য কার্পেট মোড়া স্পেস দেখা যাচ্ছে, ওটাই মূল ড্রইং রুম।
ছেলেটি ফিরে এসে বারান্দায় চেয়ার দেখিয়ে বলল, ‘এখানে তাহলে বসুন।’
বলেই ছেলেটি করিডোর দিয়ে বাড়ির ভেতরে চলে গেল।
ছেলেটি চলে যেতেই আহমদ মুসা ভেতরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিল। তারপর পকেটে হাত দিয়ে রিভলবার স্পর্শ করে দক্ষিণ দিকের দরজা দিয়ে ঘরটিতে প্রবেশ করল।
ঘরে তিনজন লোক। একদিকের সোফায় দু’জন, অন্যদিকে একজন।
একজন মধ্য বয়সী। অন্য দু’জন যুবক। আহমদ মুসা বুঝতে পারলো মধ্য বয়সী জনই ডাঃ ওয়াভেল। তারা মুখো-মুখি বসে। তাদের মাঝখানে টেবিলের উপর একটা ছোট ফাইল। আহমদ মুসা ঢুকেই দরজা লাগিয়ে দিল।
আহমদ মুসাকে ঢুকতে দেখেই ডাঃ ওয়াভেল ফাইলটি টেবিল থেকে সোফায় সরিয়ে এক ঝটকায় উঠে দাঁড়িয়েছে। তার চোখে তীব্র দৃষ্টি। বলল, ‘কে আপনি?’
আহমদ মুসার দু’হাতই পকেটে।
ধীরে ধীরে এগুলো ওয়াভেলের দিকে।
ডাক্তার ওয়াভেলের সামনে বসা দু’জন লোক তখনও বসে। তাদের চোখ-মুখ দেখলে মনে হয় তারা ব্যাপারটা বুঝার চেষ্টা করছে।
আহমদ মুসা ডাঃ ওয়াভেলের কাছাকছি পৌছে ডাঃ ওয়াভেলকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘কি চাই বলছি ডাঃ ওয়াভেল, তার আগে ঐ ফাইলটা একটু দেখে নেই।’
আহমদ মুসার কথার সাথে সাথেই ডাঃ ওয়াভেলের মুখ মরার মত পাংশু হয়ে উঠল।
সোফায় বসা যুবক দু’জনও সংগে সংগে উঠে দাঁড়িয়েছে।
‘ফাইলটি দিন ডাঃ ওয়াভেল। দু’বার বললাম। আমি এক আদেশ কিন্তু দু’বার দেই না।’ চাপা কণ্ঠে বলল আহমদ মুসা কথাগুলো।
ডাক্তার ওয়াভেলকে কথা বলার সময় আহমদ মুসা খেয়াল করেনি যে, যুবক দু’জন সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তাদের দু’জনেরই দুই পা তীব্র গতিতে এগুলো ভারি টিপয় লক্ষ্যে।
মুহূর্তেই টিপয় টেবিলটি উপরে উঠে তীব্র বেগে এল আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসা যখন টের পেল, তখন সময় ছিল না।
আহমদ মুসা টিপয়টির আঘাত খেয়ে পাশের সোফার উপর ছিটকে পড়ে গেল।
টিপয় ছুঁড়ে দেয়ার পর ওরাও ঝাঁপিয়ে পড়ল আহমদ মুসার ওপর। কিন্তু আহমদ মুসা টিপয়ের আড়ালে থাকায় তাকে বাগে আনা ওদের পক্ষে অসুবিধা হচ্ছিল।
ওদিকে আহমদ মুসা টিপয়ের ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেলেও দু’হাত দিয়ে টিপয়টি সে অবশেষে ধরতে পেরেছিল। সুতরাং তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়া দু’জনকে টিপয় দিয়ে ধাক্কা মেরে তার উপর থেকে সরিয়ে দিয়ে সংগে সংগে উঠে দাঁড়াল এবং পকেট থেকে রিভলবার হাতে তুলে নিল।
যুবক দু’জনও নিজেদের সামলে নেবার পর পকেট থেকে রিভলবার বের করেছিল এবং রিভলবার তুলছিল আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে।
কিন্তু আহমদ মুসার রিভলবার আগেই উঠেছিল।
আহমদ মুসার সাইলেন্সার লাগানো রিভলবার পর পর দু’বার অগ্নি বৃষ্টি করল।
গুলী দু’টি যুবক দু’জনের রিভলবার ধরা হাত গুড়ো করে দিল।
ওদেরহাত থেকে রিভলবার ছিটকে পড়ল।
দু’জনেই আহত হাত চেপে ধরে বসে পড়ল।
আহমদ মুসা ওদের দু’টি রিভলবার কুড়িয়ে নিয়ে ঘুরে দাঁড়াল ডাঃ ওয়াভেলের দিকে।
ডাঃ ওয়াভেল তখন দাঁড়িয়ে কাঁপছিল।
আহমদ মুসা তাঁর দিকে রিভলবার তাক করে বাম হাত বাড়াল ফাইল নেবার জন্যে।
ডাঃ ওয়াভেল আহত যুবক দু’জনের দিকে একবার তাকিয়ে কম্পিত হাতে ফাইলটি সোফার উপর থেকে নিয়ে আহমদ মুসার হাতে তুলে দিল।
আহমদ মুসা তার দিকে রিভলবার তাক করে থেকেই ফাইলের উপর নজর বুলাল। দেখল, কম্পুটারে টাইপ করা চার-পাঁচ শিট কাগজ হোয়াইট ঈগল নামক সংস্থার প্যাডে। শিরোনাম দেখে চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল আহমদ মুসার। শিরোনামে বড় বড় অক্ষরে লিখা, ‘এ রিভিউ অব মুসলিম পপুলেশন কনট্রোল প্রজেক্ট অব ক্যারিবিয়ান রিজিওন।’
কিন্তু আহমদ মুসা ফাইলে শিশু তিনটির প্যাথোলজিক্যাল রিপোর্ট পেল না।
ফাইল বন্ধ করে আহমদ মুসা তীব্র চোখে তাকাল ডাঃ ওয়াভেলে দিকে। বলল, ‘চুরি করে আনা তিনটি প্যাথোলজিক্যাল রিপোর্ট কোথায়?’
কাঁপতে কাঁপতে মরার মত মুখ করে ডাঃ ওয়াভেল বলল, ‘আমি আনিনি, আমি জানিনা।’
আহমদ মুসার তর্জনি চাপ দিল রিভলবারের ট্রিগারে। বেরিয়ে গেল একটা গুলী নিঃশব্দে। গুলীটা ডাঃ ওয়াভেলের কানের উপর দিয়ে মাথার এক টুকরো চামড়া তুলে নিয়ে চলে গেল।
শক খাওয়া মানুষের মত কেঁপে উঠল ডাঃ ওয়াভেল।
আর এক মুহূর্ত দেরী করলে গুলী এবার মাথা গুড়ো করে দেবে।’ স্থির, কঠোর কণ্ঠে বলল আহমদ মুসা।
সংগে সংগেই ডাঃ ওয়াভেল কম্পিত হাতে পকেট থেকে কাগজের কয়েকটা শিট বের করে টিপয়ের উপর রাখল।
আহমদ মুসা কাগজের শিটগুলো তুলে নিয়ে দেখল, তিনটি শিশুরই পরীক্ষাগুলোর উপাত্ত এবং ডাক্তারের ডায়াগনসিস রয়েছে।
‘ধন্যবাদ ডাঃ ওয়াভেল।’
বলে আহমদ মুসা পিছু হটে বেরুবার দরজার দিকে আসতে শুরু করল। আহত যুবকদের একজন জিজ্ঞেস করল, ‘কে আপনি?’
‘মানুষ এবং চোর আর অত্যাচারীদের যম।’
আহমদ মুসা ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে করিডোরে পথে বাড়ির ভেতর দিকে তাকাল। দেখল, করিডোরের মাথায় ফাঁকা স্পেসটাতে একজন বয়ষ্ক মহিলা সহ কয়েকজন ছেলেমেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের চোখে-মুখে ভয়ার্ত দৃষ্টি। আহমদ মুসা বুঝল, ভেতরের কথা তারা কিছু জানতে পেরেছে।
পরক্ষণেই আহমদ মুসা ভাবল, ওরা কি পুলিশে খবর দিয়েছে?
এই কথা ভাবার সাথে সাথেই আহমদ মুসা তাকাল বাইরের দরজার দিকে। দেখল, দরজা ভেতর থেকে লক করা। অথচ আহমদ মুসা দরজা তখন লক করে যায়নি।
আহমদ মুসার কাছে বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে গেল। এই সময় আহমদ মুসা বাইরে বাড়ির সামনে গাড়ির শব্দ পেল।
আহমদ মুসা দ্রুত এগুলো মহিলাদের দিকে। তাদের সামনে দাঁড়িয়ে দ্রুত বলল, ‘মিসেস ওয়াভেল এই ফাইল আপনার স্বামী হাসপাতাল থেকে চুরি করে শত্রুদের দিতে যাচ্ছিল। আমি এটা উদ্ধার করে নিয়ে গেলাম। দেখুন আমার দু’হাতে গ্লাভস। এ ফাইলে এবং ভেতরের কাগজ-পত্রে আপনার স্বামীর ফিংগার প্রিন্ট আছে। পুলিশের হাতে আমি এখন ফাইলটি দিলে আপনার স্বামী দেশদ্রোহীতার অভিযোগে জেলে যাবে। বাইরে পুলিশ এসেছে, আপনি তাদের কি বলবেন ভেবে দেখুন।’
মিসেস ওয়াভেলের ভয়-কাতর মুখে উদ্বেগের ছায়া ফুটে উঠল। তার সামনে দাঁড়ানো শত্রু যুবকটির ঋজু কথাকে তার মন সত্য বলে মেনে নিতে বাধ্য হলো। তাছাড়া তার স্বামীর কিছু অস্বাভাবিক আচরণ এবং আজ দেখা একটা ফাইলের কথা তার মনে পড়ে গেল।
বাইরে থেকে নক হতে শুরু করেছে।
আহমদ মুসার দিকে একবার তাকাল মিসেস ওয়াভেল। আহমদ মুসার হাতের রিভলবারও দেখল সে। তারপর এগুলো বাইরের দরজার দিকে।
দরজা খুলল মিসেস ওয়াভেল।
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে একজন পুলিশ অফিসার। বারান্দার নিচে দাঁড়িয়ে আরও দু’জন। আরেকজন পুলিশ গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে তখনও।
‘গুড ইভনিং। আপনারা?’ পুলিশদের দিকে তাকিয়ে পুলিশ অফিসারকে লক্ষ্য করে বিস্মিত কণ্ঠে বলল মিসেস ওয়াভেল।
‘কেন, আপনারা পুলিশকে টেলিফোন করেননি? আপনার বাসার নম্বার ১৫-এর এ নয়?’
‘হ্যাঁ। কিন্তু আমরা তো এ ধরনের টেলিফোন করিনি?’
‘এটা কি ডাঃ ওয়াভেলের বাড়ি নয়?’
‘হ্যাঁ।’
‘আমাদের তো বলা হয়েছে ডাঃ ওয়াভেল সন্ত্রাসীদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে।’
হেসে উঠল মিসেস ওয়াভেল। বলল, ‘কেউ নিশ্চয় আপনাদের মিস গাইড করেছে। দুঃখিত।’
‘স্যরি, আপনাদের বিরক্ত করার জন্যে।’ বিষণœ কণ্ঠে বলল পুলিশ অফিসারটি।
পুলিশের গাড়ি চলে গেল।
পুলিশ চলে গেলে মিসেস ওয়াভেল ফিরে এল।
‘ধন্যবাদ মিসেস ওয়াভেল। পুলিশ চলে যাওয়ায় আমি বাড়তি ঝামেলা থেকে বাঁচলাম। আপনার স্বামীও বাঁচল। ঐ ঘরে আপনার স্বামীর সাথে দু’জন ক্রিমিনাল রয়েছে। ওদের স্বার্থেই আপনার স্বামী হাসপাতাল থেকে এই ফাইল চুরি করেছিল।’ বলে আহমদ মুসা যাবার জন্যে পা বাড়াল।
‘থামুন।’ পেছন থেকে বলল মিসেস ওয়াভেল।
ফিরে দাঁড়াল আহমদ মুসা।
‘আপনি কে? আপনি হাসপাতালের লোক?’
‘আমি মিথ্যা বলব না। তাই আপনার এ প্রশ্নের উত্তর আমি দেব না। এটুকু জেনে রাখুন, আমি আপনাদের শত্রু নই। আপনারাও আমার শত্রু নন। এক ক্ষতিকর ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে গিয়েই আমাকে এখানে এভাবে আসতে হয়েছে।’
‘কি ষড়যন্ত্র?’
‘আমি এখন বলতে পারবো না।’
‘আমি বলি?’
চমকে উঠে আহমদ মুসা মিসেস ওয়াভেলের মুখের দিকে তাকাল। বলল, ‘আপনি জানেন?’
‘জানি। ক্যারিবিয়ান এলাকা থেকে মুসলিম জনসংখ্যা বিনাশের ষড়যন্ত্র। একটা গোপন ফাইল হঠাৎ আমার হাতে আসায় আমি জেনেছি।’
‘ষড়যন্ত্র আপনি সমর্থন করেন?’
‘না। আমার স্বামীও করেন না। কিন্তু বাঁচতে হলে ষড়যন্ত্রে সহযোগিতা না করে তাঁর উপায় নেই।’
একটু থামল মিসেস ওয়াভেল। একটা ঢোক গিলেই আবার শুরু করল, ‘কিন্তু আপনি এমন একটা দু’টো ফাইল উদ্ধার করে, দু’চারজনকে মেরে বা হত্যা করে এ ষড়যন্ত্রের সামান্য গতিরোধও করতে পারবেন না। এ পন্ডশ্রম হবে মাত্র।’
কৌতুহলী চোখে আহমদ মুসা মিসেস ওয়াভেলে দিকে তাকাল। বলল, ‘তাহলে এ ষড়যন্ত্র অপ্রতিরুদ্ধ আপনি মনে করেন?’
‘তা মনে করি না। কিন্তু যে আন্তর্জাতিক প্রচার-প্রতিক্রিয়া এর গতিরোধ করতে পারে, তা এখানে কারো হাতে নেই।’
বিস্মিত হলো আহমদ মুসা মিসেস ওয়াভেলের কথা শুনে। বলল, ‘আপনি শুধু মিসেস ওয়াভেল নন, কে আপনি?’
‘আমি মিসেস ওয়াভেল, সেই সাথে চার্লস বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ের অধ্যাপিকা।’ গম্ভীর কণ্ঠে বলল মিসেস ওয়াভেল।
‘আপনি কেন আমাকে সহযোগিতা করলেন? ঐ ষড়যন্ত্র পছন্দ করেন না বলেই কি?’
‘সেটা তো বটেই। আরও কারণ আছে?’
‘কি সেটা?’
‘আমি টার্কস দ্বীপপুঞ্জের সকল মানুষের ঐক্য ও মিলনে বিশ্বাসী।’
‘কেন?’
‘আপনি কে না জানলে এ প্রশ্নের উত্তর দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’
আহমদ মুসা গভীরভাবে দেখছিল মিসেস ওয়াভেলকে। যেন তার দৃষ্টি প্রবেশ করেছে মিসেস ওয়াভেলের অন্তরেও। বলল আহমদ মুসা, ‘আপনার উত্তরটা আমিই দেই?’
কিছুটা বিস্ময় মিসেস ওয়াভেলের চোখে। বলল, ‘বলুন।’
‘আপনি এই দ্বীপপুঞ্জের স্বাধীনতা চান।’
চমকে উঠল মিসেস ওয়াভেল। তার চোখে এবার রাজ্যের বিস্ময়। বিস্ময়ের ধাক্কায় কিছুক্ষণ সে কথা বলতে পারল না। একটু পর বলল, ‘কে আপনি?’ অনেক প্রশ্ন ও কৌতুহলের ভীড় তার চোখে এবং কিছুটা ভয়ও।
‘ভয় নেই। আমি সরকারী গোয়েন্দা নই।’
‘কিন্তু কে আপনি?’
‘দুঃখিত, আপনার এ প্রশ্নটার উত্তর এখন দিতে পারছি না। তবে পরিচয়টা আপনাকে দেয়া যাবে।’
‘আরেকটা প্রশ্ন, আপনি অনুমানটা কিসের ভিত্তিতে করলেন?’
‘অনুমানটা সত্যি কিনা?’
‘দয়া করে আমার প্রশ্নের উত্তর দিন।’
‘খুব সহজ উত্তর। আপনি ‘হোয়াইট ন্যাশনালিজম ষড়যন্ত্রের বিরোধী, অন্যদিকে টার্কস দ্বীপপুঞ্জের সব মানুষের ঐক্য চান। কেন চান? কোন স্বার্থে চান? কোন লক্ষ্য অর্জনের জন্য চান? এসব প্রশ্নের উত্তর একটাই, আপনি ঐ দ্বীপপুঞ্জের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। দ্বীপপুঞ্জের সব মানুষের ঐক্যের মাধ্যমেই এই লক্ষ্য অর্জন সম্ভব।’
বিস্ময়ে ছানাবড়া হয়ে উঠল মিসেস ওয়াভেলের চোখ। বলল, ‘সত্যি কে আপনি? না বললে আমি উদ্বেগে থাকবো।’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘উদ্বেগের কারণ নেই। আমি বৃটিশ সরকারের লোক নই। আমি মিথ্যা কথা বলি না।’
বলে আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়িয়ে বেরুবার জন্যে দরজার দিকে হাঁটা শুরু করল।
আহমদ মুসার চলার পথের দিকে তাকিয়ে ছিল মিসেস ওয়াভেল।
‘অদ্ভুত লোক তো আম্মা?’
‘অদ্ভুত শুধু নয়, অকল্পনীয় এক চরিত্র।’
বলেই মিসেস ওয়াভেল ছুটল বন্ধ ড্রইং রুমের দিকে যেখানে তার স্বামী বন্ধ আছে।

ফার্ডিন্যান্ড মাথা নিচু করে তিনটি মুসলিম পুরুষ শিশুর মৃত্যু নিয়ে ডাঃ মার্গারেট ও ডাঃ ওয়াভেলের কাহিনী, ডাঃ ওয়াভেল কর্তৃক প্যাথোলজিক্যাল রিপোর্ট চুরির কথা এবং সর্বশেষ ডাক্তার ওয়াভেলের বাড়িতে একজন মাত্র যুবক এসে কিভাবে তিনজনকে আহত করে মুসলিম পপুলেশন কনট্রোল রিভিউ রিপোর্ট ও প্যাথোলজিক্যাল রিপোর্টগুলো নিয়ে গেল তার কাহিনী শুনছিল।
তার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল ডাঃ ওয়াভেলের ড্রইং রুম থেকে ফিরে আসা সেই দুই যুবক এবং পাশের একটি সোফায় বসেছিল অপারেশন চীফ হিসেবে নতুন দায়িত্ব প্রাপ্ত হের বোরম্যান।
যুবক দু’জনের কথা শেষ হলে মাথা তুলল ফার্ডিন্যান্ড। তার দুই চোখ রক্তের মত লাল। তীব্র কণ্ঠে বলল, ‘একজন লোক এসে তোমাদের জীবনের চেয়ে মূল্যবান রিপোর্ট নিয়ে তোমাদের ঘরে বন্ধ করে বেরিয়ে গেল। আর তোমরা এটা জানাতে এসেছ?’
বলে ফার্ডিন্যান্ড পকেট থেকে রিভলবার বের করে যুবক দু’জনকে লক্ষ্য করে দু’টি গুলী করল। দু’জনেই বুকে গুলী খেয়ে ছিটকে পড়ল মেঝেয়।
উঠে দাঁড়াল ফার্ডিন্যান্ড। বলল বোরম্যানকে লক্ষ্য করে, ‘জায়গাটা পরিষ্কার করতে বলে তুমি এস আমার অফিসে।’
অফিসে এসে নিজের চেয়ারে বসল ফার্ডিন্যান্ড। ভীষণ অস্থির সে। একের পর এক বিপর্যয়, সর্বশেষে অত্যন্ত গোপনীয় রিভিউ রিপোর্টসহ গুরুত্বপূর্ণ প্যাথোলজিক্যাল রিপোর্ট হাত ছাড়া হয়ে যাওয়াকে সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না।
চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজল সে। না, তাতে করে অস্থিরতা আরও কিলবিলিয়ে উঠছে।
উঠে দাঁড়িয়ে পায়চারি করতে লাগল ফার্ডিন্যান্ড। ঘরে ঢুকল হের বোরম্যান। ফার্ডিন্যান্ড তার চেয়ারে ফিরে এল। বসল বোরম্যানও।
‘কি বুঝছ বোরম্যান?’ গম্ভীর কণ্ঠে বলল ফার্ডিন্যান্ড।
‘আমার মনে হয় সেই এশীয় যুবকই সব অনর্থের মূল। চেহারার যে বিবরণ ওদের দু’জনের কাছে পাওয়া গেছে তাতে সেই এশীয়ই সেদিন রিপোর্টগুলো ছিনিয়ে নেবার মত অঘটন ঘটিয়েছে।’
‘কিন্তু এই এশীয় কে? তাকে কোথায় পাওয়া যাবে? সে কেন আমাদের পেছনে লেগেছে? ওখানকার পুলিশ কি বলে?’
‘পুলিশের কাছে কোন এশীয় সম্পর্কে কোন রিপোর্ট নেই, তথ্যও নেই।’
‘সে থাকছে কোথায় কিংবা কাদের সাথে যোগাযোগ রাখছে তা না জানলে তো আমরা এগুতেই পারছি না।’
‘ডাঃ মার্গারেট আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হবার পর তার কক্ষে একজন এশীয়কে ঢুকতে দেখা গেছে।’
চেয়ারে সোজা হয়ে বসল ফার্ডিন্যান্ড। তার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। বলল, ‘এ খবর তো আমাকে দাওনি?’
‘ওদের দু’জনের কাছ থেকে আজই তো শুনলাম।’
‘ডাঃ মার্গারেটের কক্ষে এশীয়টির যাওয়ার খবরকে তুমি কিভাবে দেখছ?’
‘পেশেন্ট হিসেবে পরিচয়ের কারণে ডাক্তারের এ্যাকসিডেন্টের খবরে তার কাছে যেতে পারে। আবার কোন সম্পর্কের সূত্র ধরেও যেতে পারে।’
‘আমি জিজ্ঞেস করছি, তুমি কি ভাবছ?’
‘আমার মনে হয়, সম্পর্কের সূত্র ধরেই গেছে।’
‘তোমার এই মনে হওয়ার কারণ?’
‘তিনটি মুসলিম পুরুষ শিশুর প্যাথোলজিক্যাল টেষ্ট করাবার যে জেদ ডাঃ মার্গারেটের এবং এ নিয়ে ডাঃ ওয়াভেলের সাথে তার যে আচরণ তা থেকে মনে হয় নিছক ডাক্তার হিসেবে নয় কোন উদ্দেশ্য নিয়েই এটা তিনি করেছেন। এই সন্দেহ হওয়ার কারণেই ডাঃ ওয়াভেলের পরামর্শে টার্কস দ্বীপপুঞ্জের হোয়াইট ঈগল শাখা তাকে হত্যা করার চেষ্টা করেছিল।’
‘তোমাকে ধন্যবাদ বোরম্যান। তুমি অবশেষে ঠিক ভেবেছ। আসলে আমরা ভুল করছি, ডাঃ মার্গারেটকে টার্কস দ্বীপপুঞ্জের হোয়াইট ঈগল সন্দেহ করার সংগে সংগে আমাদের সক্রিয় হওয়া দরকার ছিল।’
‘কিন্তু টার্কস দ্বীপপুঞ্জের হোয়াইট ঈগল তো যথাসময়ে সক্রিয় হয়েছে এবং দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে চেষ্টা করেছে ডাঃ মার্গারেটকে।’ বলল বোরম্যান।
‘এখানেই তাদের ভুল হয়েছে এবং এ ভুল আমরা শুধরে দেইনি।’
‘ভুলটা কি?’
‘ডাঃ মার্গারেটকে হত্যা করে কি হবে? ডাঃ মার্গারেট গেলে আরেক ডাক্তার মার্গারেট তৈরি হবে। আসল হলো, ডাঃ মার্গারেটকে দিয়ে এসব যে করাচ্ছে তাকে চিহ্নিত করা এবং তাকে হত্যা করা। তাহলেই ডাঃ মার্গারেট আর তৈরি হবে না।’
‘ঠিক বলেছেন।’
‘ঠিক বললাম, কিন্তু সেটা ক্ষতি হবার পর।’
‘এশীয়টা ঐ রিপোর্টগুলো নিয়ে কি করতে পারবে! মিডিয়া তো আমাদের দখলে। সরকারকে এসব জানিয়েও কোন লাভ হবে না।’
‘কি করবে, সেটা আমার কাছেও স্পষ্ট নয়। অপেক্ষা করতে হবে এ জন্যে। কিন্তু একটা ক্ষতি হয়েছে, আমাদের পরিকল্পনা আমাদের হাতের বাইরে চলে গেছে।’
ফার্ডিন্যান্ড থামলেও বোরম্যান কিছু বলল না। ভাবছিল সে।
কিছুক্ষণ পর ফার্ডিন্যান্ডই মুখ খুলল। বলল, ‘কি ভাবছ বোরম্যান?’
‘ভাবছি এখন কি করণীয়।’
‘এটা নিয়ে এত চিন্তা করতে হয়? কি করতে হবে তা কি পরিষ্কার নয়?’
‘কি সেটা স্যার?’
‘আগের ভুলের সংশোধন।’
‘কিভাবে?’
‘ডাঃ মার্গারেটকে হত্যা নয়, তাকে হাতের মুঠোয় নিয়ে আসতে হবে। বের করতে হবে ঐ এশীয়টির পরিচয় তার কাছ থেকে।’
মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল বোরম্যানের। বলল, ‘ধন্যবাদ স্যার। এটাই এখন একমাত্র পথ।’
ফার্ডিন্যান্ড কিছু বলতে গিয়েও চুপ করে গেল। তাকাল ইন্টারকমের দিকে। সেখানে একটা সবুজ সংকেত।
ইন্টারকমের একটা বোতামে চাপ দিল ফার্ডিন্যান্ড। ওপার থেকে তথ্য চীফ মার্ক পল-এর গলা শুনা গেল। বলল, ‘কেন্দ্র থেকে একটা ডকুমেন্ট এসেছে স্যার।’
‘নিয়ে এস।’ বলল ফার্ডিন্যান্ড।
তথ্য চীফ মার্ক পল কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ঘরে প্রবেশ করে একটা ইনভেলাপ তুলে দিল ফার্ডিন্যান্ডের হাতে।
হাতে নিয়েই খুলল ইনভেলাপ ফার্ডিন্যান্ড। ভেতরের কাগজের উপর চোখ পড়তেই বুঝল, হোয়াইট ঈগল-এর হেড কোয়ার্টার থেকে আসা মাসিক সিচুয়েশন রিপোর্ট। সমকালিন পরিস্থিতির উপর এই রিপোর্টে থাকে আমেরিকান মহাদেশের উপর বিগত মাসের পর্যবেক্ষণ।
ফার্ডিন্যান্ড হের বোরম্যান-এর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বস, রিপোর্টে কি আছে দেখা যাক।’
বলে রিপোর্টটা পড়তে লাগল ফার্ডিন্যান্ড,
“গত মাসে গোটা আমেরিকা বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন এলাকা থেকে আমাদের প্রতিনিধিরা হেড কোয়ার্টারকে যা জানিয়েছে, তা উদ্বেগজনক কিছু পুরাতন প্রবণতা নতুন করে তীব্র হওয়া এবং আমাদের পরিকল্পনা বাচনাল করার লক্ষ্যে পরিচালিত কিছু মারাত্মক ঘটানা ঘটেছে। গত মাসের পরিস্থিতির প্রধান দিকগুলো হলো: এক. রেড ইন্ডিয়ানদের সাথে মুসলিম সখ্যতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত মাসে ১০ জন রেড ইন্ডিয়ান তরুণীর সাথে মুসলিম তরুণের এবং ৮ জন মুসলিম তরুণীর সাথে রেড ইন্ডিয়ান তরুনের বিয়ে হয়েছে। সব ক্ষেত্রেই রেড ইন্ডিয়ান পরিবার ইসলাম গ্রহণ করেছে স্বতস্ফুর্তভাবে। উদ্বেগজনক হলো, আগে মুসলিম তরুণীরা রেডইন্ডিয়ানদের ঘরে যায়নি, কিন্তু এখন যাওয়া শুরু করেছে। অন্যদিকে গত এক বছরে মাত্র তিনজন রেড ইন্ডিয়ান তরুণী আমেরিকান শ্বেতাংগ তরুণের সাথে বিয়ে হয়েছে, কিন্তু একজন রেডইন্ডিয়ান তরুণও শ্বেতাংগ তরুণীকে বিয়ে করেনি। আর উল্লেখিত তিনটি বিয়ের কোন রেড ইন্ডিয়ান তরুণীই খৃষ্টান ধর্ম গ্রহণ করেনি। দুই. মুসলিম রেড ইন্ডিয়ান বিয়ের ৫০ ভাগ হয়েছে আমেরিকায় জন্মগ্রহণকারী এশীয় ও আফ্রো-আমেরিকান ব্ল্যাক মুসলমানের সাথে। আর ৫০ ভাগ চীন, কোরিয়া, জাপান, ফিলিপাইন ও তুর্কিস্থান এলাকা থেকে সদ্য আসা আমেরিকান নাগরিকত্ব পাওয়া মুসলমানদের সাথে হয়েছে। তিন. আমেরিকানস ইন্ডিয়ানস মুভমেন্ট (AIM) নতুন করে জোরদার হওয়ার লক্ষণ প্রকাশ পেয়েছে। গত মাসের ২৫ তারিখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিয়ন ষ্টেটের প্রাচীন রেডইন্ডিয়ান নগরী ‘কাহোকিয়া’তে ‘এইম’ (AIM) এর বিরাট সম্মেলন হয়েছে। সে সম্মেলনে প্রধান যে দাবী তারা তুলেছে তা হলো, মিসিসিপি ও সংলগ্ন অন্যান্য নদীর তীর বরাবর সতের শ’ রেড ইন্ডিয়ান নগরী ছিল যা ইউরোপিয়ানরা ধ্বংস করেছে, সে সব রেড ইন্ডিয়ান নগরীর পুনস্থাপন করতে হবে এবং রেড ইন্ডিয়ানদেরকে তা ফেরত দিতে হবে। দ্বিতীয় যে দাবী তারা করেছে তা হলো, ইউরোপিয়ানরা আমেরিকায় আগমনের সময় অর্থাৎ ১৪৯২ সালের দিকে আমেরিকায় রেড ইন্ডিয়ানদের সংখ্যা ছিল দুই কোটি যার মধ্যে ৫০ লাখ ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই রেড ইন্ডিয়ান জনসংখ্যা গত ৫শ’ বছরে সাড়ে সাত কোটিতে উন্নীত হবার কথা ছিল। কিন্তু ইউরোপীয় গণহত্যার শিকার হয়ে তাদের সংখ্যা বাড়ার বদলে তা ৫০ লাখ থেকে আজ ১৪ লাখে নেমে এসেছে। এই গণহত্যার বিচার তারা চাচ্ছে না, কিন্তু রেড ইন্ডিয়ানদের ন্যায্য ভূখন্ডগত অধিকার রক্ষার জন্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উত্তরাংশে মিসিসিপি নদীর পশ্চিম ও পূর্ব এলাকায় তাদের রিজার্ভ এলাকার সংখ্যা ২৮৫ থেকে ১০০০-এ উন্নীত করতে হবে। চার. বিশেষ উদ্বেগজনক ঘটনা ঘটেছে ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের টার্কস দ্বীপপুঞ্জে। গত মাসে এই দ্বীপাঞ্চল হোয়াইট ঈগলের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে আমাদের দেড়শ’ লোক হারিয়ে গেছে অর্থাৎ প্রাণ হারিয়েছে। কিন্তু যাদের দ্বারা এতবড় ঘটনা ঘটল তাদের চিহ্নিত করা যায়নি। উপরন্তু ঐ অঞ্চলে এখন বৃটিশ পুলিশ এমন তৎপরতা শুরু করেছে যার ফলে আমাদের প্রতিশোধমূলক সশস্ত্র পদক্ষেপের কর্মসূচী বাদ দিতে হয়েছে। পাঁচ. গত মাসে আমেরিকায় অশ্বেতাংগ জনসংখ্যা বেড়েছে শূন্য দশমিক দুই পাঁচ (০.২৫) ভাগ, আর শ্বেতাংগ জনসংখ্যা বেড়েছে শূন্য দশমিক শূন্য পাঁচ (০.০৫) ভাগ। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গত মাসে অশ্বেতাংগ বৃদ্ধি পেয়েছে শূন্য দশমিক এক পাঁচ (০.১৫) ভাগ এবং শ্বেতাংগ জনসংখ্যা কমেছে শূন্য দশমিক শূন্য পাঁচ (০.০৫) ভাগ।
উল্লেখিত এসব তথ্য প্রমাণ করছে শত শত বছরের চেষ্টায় শ্বেতাংগরা যে অধিকার অর্জন করেছে, তাতে ভাগ বসাতে আসছে অশ্বেতাংগরা। আর এ পরিস্থিতি ‘হোয়াইট ঈগল’-এর প্রয়োজনকে সর্বোচ্চে তুলে ধরেছে।’
রিপোর্ট পড়া শেষ করল ফার্ডিন্যান্ড। পড়তে পড়তেই তার মুখটা শক্ত হয়ে উঠেছিল।
পড়া শেষ করেই ফার্ডিন্যান্ড টেবিলে একটা প্রচন্ড মুষ্টাঘাত করে বলল, ‘কয়েক ঘন্ডা রেড ইন্ডিয়ানকে বাঁচিয়ে রাখার কি দরকার ছিল? দাস প্রথা উচ্ছেদের আগে বা পরে কেন আমরা ব্ল্যাকদেরকে আফ্রিকায় ঠেলে দেইনি? এরাই তো অশ্বেতাংগ জনসংখ্যা বাড়াচ্ছে আমেরিকায়। আর এরাই তো আবার ইসলাম গ্রহণ করে আমেরিকায় মুসলমানদের সংখ্যা বাড়াচ্ছে। এদের কারণেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মুসলমানরা দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় জাতি গোষ্ঠীতে পরিণত হতে যাচ্ছে।’
‘স্যার, রেডইন্ডিয়ানদের বাঁচিয়ে রাখা এবং ব্ল্যাকদের শুধু দেশে রাখা নয়, তাদেরকে আমরা আমেরিকায় বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন অধিকার দিয়ে মাথায় তুলেছি। আজ রেড ইন্ডিয়ানরা এত বড় দাবী তুলতে পারছে কারণ অতীতে মার্কিন সরকার রেড ইন্ডিয়ানদের এ ধরনেরই দাবী নানাভাবে মেনে নিয়েছে। সত্তর দশকের শুরুর দিকে হঠাৎ করে রেড ইন্ডিয়ানরা শত শত বছর আগে শ্বেতাংগদের হাতে তাদের যে জমি চলে গেছে তা উদ্ধারের জন্যে মামলা করতে শুরু করে। পাসামোকাই ও পেনরস্কট নামে দু’টি রেড ইন্ডিয়ান গোত্র মামলা করে ‘মেইন’ ষ্টেট-এর ১২ মিলিয়ন একর অর্থাৎ রাজ্যটির দুই তৃতীয়াংশের দখল দাবী করে বসে। মার্কিন সরকার অনেক অনুরোধ করে ৮২ মিলিয়ন ডলার দিয়ে রেড ইন্ডিয়ানদেরকে মামলা প্রত্যাহারে রাজী করে। আবার ১৯৮৭ সালের দিকে ম্যাসাচুসেটস ষ্টেটে ওয়ামপানগ রেড ইন্ডিয়ান গোত্রের অনুরূপ দাবী প্রায় ৫ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে রফা করে। এর আগের আরেকটা বড় ঘটনা ঘটে। ১৯৮০ সালে মার্কিন সুপ্রীমকোর্ট ১৯৮৭ সালে সাউথ ডাকোটার রেড ইন্ডিয়ানদের যে জমি শ্বেতাংগরা জোর করে কুক্ষিগত করে তার জন্যে রেড ইন্ডিয়ানদেরকে প্রায় ১২৩ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দিতে মার্কিন সরকারকে বাধ্য করে। এইভাবে রেড ইন্ডিয়ানদের দাবীর যৌক্তিকতা সরকার এবং কোর্ট স্বীকার করে নিয়েছে। সন্দেহ নেই, এর উপর ভিত্তি করেই তাদের জন্যে বরাদ্দ রিজার্ভ এলাকার পরিমাণ ২৮৫ থেকে ১০০০-এ উন্নিত করার দাবী করেছে।’ বলল বোরম্যান।
‘ধন্যবাদ বোরম্যান। ঠিকই বলেছ তুমি। সরকারের আইন ও মানবতাবাদী এই সর্বনাশা চেহারা শ্বেতাংগ জনগণের কাছে উন্মুক্ত করে দিতে হবে। কিন্তু রেড ইন্ডিয়ানদের ও মুসলমানদের সাথে এই দহরম-মহরমের কি করা যাবে?’ বলল ফার্ডিন্যান্ড।
‘স্যার, এটা ঐতিহাসিক সম্পর্কের একটা ফল। মূলের দিকে ফিরে যাওয়া মানুষের একটা স্বভাব বা প্রবণতা। রেড ইন্ডিয়ানরা তাই করছে। রেড ইন্ডিয়ানদের পূর্ব পুরুষ এশিয়া থেকে আমেরিকায় আসে। বিশেষ করে পূর্ব এশিয়ার চীন, জাপান, কোরিয়া, মঙ্গোলিয়া, তুর্কিস্থান এলাকার মঙ্গোলীয় ও মিশ্র মঙ্গোলীয় জাতি-গোষ্ঠী বরফ ঢাকা বেরিং প্রণালী পথে আমেরিকায় আসে। এরাই আমেরিকার প্রথম মানুষ। রেড ইন্ডিয়ানরা এদেরই বংশধর। সুতরাং এশিয়ানদের প্রতি, এশিয়ান কালচারের প্রতি তাদের দূর্বলতা রয়েছে।’
‘কিন্তু প্রশ্নটা এশিয়ানদের নিয়ে নয়, মুসলমানদের নিয়ে।’
‘একই কথা স্যার। এশিয়ানরাই তাদের কাছে ইসলাম নিয়ে আসে। ৮ম থেকে দ্বাদশ খৃষ্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে মুসলিম নাবিকরা, তাদের সাথে মুসলিম পর্যটক, ব্যবসায়ী ও মিশনারীরা পৃথিবীর গোটা সমুদ্র এলাকা চষে ফিরেছে। তাদেরই অনেকে আফ্রিকা থেকে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে এবং বেরিং প্রণালী হয়ে বা ফিলিপাইন থেকে প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে আমেরিকায় আসে। এরা ছিল এশিয়ান এবং প্রশান্ত মহাসাগর পথে যারা আসে তাদের অধিকাংশই মঙ্গোলীয় জাতি গোষ্ঠীর মুসলমান, যাদের সাথে রেড ইন্ডিয়ানদের মিল রয়েছে। রেডইন্ডিয়ানরা অনেক ক্ষেত্রে তাদের এশিয়ান ভাইদের বুকে জড়াবার সাথে সাথে ইসলামকেও বুকে জড়িয়ে নেয়। মুসলামানদের প্রতি রেডইন্ডিয়ানদের বিশেষ দুর্বলতার কারণ এটাই।’
‘জানি বোরম্যান। কিন্তু এটা যে সর্বনাশা প্রবণতা। রেডইন্ডিয়ানদের ঘরে শ্বেতাংগ মেয়ে যাওয়া বন্ধ হয়েছে, এটা একটা ভালো প্রবণতা। কিন্তু রেড ইন্ডিয়ান ও মুসলমানদের মিলন বন্ধ করা যাবে কি করে?’
‘পথ একটাই রেড ইন্ডিয়ান ও মুসলমানদের ঘরে কোন মেয়ে দেযা যাবে না এবং তাদের মেয়ে আনাও যাবে না। উভয় ক্ষেত্রেই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ বংশ বৃদ্ধির সম্ভাবনা। মুসলমান ও রেড ইন্ডিয়ানদের জনসংখ্যা বৃদ্ধি শূন্যে নামিয়ে আনতে হবে অবিলম্বে। তাহলে অশ্বেতাংগ জনসংখ্যা বৃদ্ধি শূন্য দশমিক পাঁচের দিকে নেমে আসবে। অন্যদিকে শ্বেতাংগ জনসংখ্যা প্রতি মাসে অনুরূপ পরিমাণ বাড়াতে হবে।’
‘কিভাবে? সন্তান নেয়ার প্রতি শ্বেতাংগ মেয়েদের যে অনিহা তার মোকাবিলা তো বন্দুক দিয়ে করা যাবে না।’
‘বন্দুক দিয়ে পারা যাবে না, কিন্তু বুদ্ধি দিয়ে যাবে।’
‘সে বুদ্ধিটা কি?’
‘খুব সহজ। মার্কিন মেয়েরা যে ব্রান্ডের জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল ব্যবহার করছে, সে সব ব্রান্ডের কোম্পানীগুলোতে ঢুকতে হবে এবং শতকরা ২৫ ভাগ পিলে ভেজাল ঢুকাতে হবে। অন্য দিকে যে সব ক্লিনিক সৌখিন এ্যাবরশন করায়, তাদের ঘাড় মটকাতে হবে।’
‘ঠিক বলেছ বোরম্যান। এই কাজ এখনি আমরা শুরু করতে পারি। গোল্ড ওয়াটারকে জানাতে হবে ব্যাপারটা। এ কর্মসূচী কেন্দ্রীয়ভাবে গ্রহণ করা উচিত।’
কথা শেষ করে একটু সোজা হয়ে বসে বলল, ‘এস আমাদের কথায় ফিরি। রিপোর্টে বলেছে, টার্কস দ্বীপপুঞ্জে আমাদের দেড়শ’ লোক হত্যার জন্যে যারা দায়ী, তাদের চিহ্নিত করা যায়নি। কিন্তু চিহ্নিত আমরা করেছি। আমরা নিশ্চিত এশিয়ানটাই সব কিছুর মূলে রয়েছে। এই মূলকে ধরার জন্যে ডাঃ মার্গারেটকে আমরা হাতে নিয়ে আসছি। এ কথাটা গোল্ড ওয়াটারকে জানাতে হবে।’
‘জ্বি, আজকেই টেলিফোনে কথা বলা যায়।’
‘এখন ডাঃ মার্গারেটকে নিয়ে আসার ব্যাপারে কি চিন্তা করছ?’
‘স্যার, একটু ভেবে দেখি। আর গ্রান্ড টার্কস থেকে আরও কিছু জানারও প্রয়োজন আছে। তারপরে সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে।’
‘কিন্তু দেরী করা যাবে না। পরশু দিনের মধ্যে তাকে এখানে চাই।’
‘তাই হবে স্যার।’
ফার্ডিন্যান্ড উঠে দাঁড়াল। উঠে দাঁড়াল হের বোরম্যানও।

টেবিলে নাস্তা সাজিয়ে রেখে সোফায় এসে বসতে বসতে ডাঃ মার্গারেট জর্জকে বলল, ‘আমার অবাক লাগছে, হঠাৎ করে উনি বিশেষ এ সময়ে টিভি প্রোগ্রাম দেখতে আসতে চাইলেন কেন!’
| ← Previous | | | Next → | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top