২৬. ক্যারিবিয়ানের দ্বীপদেশে

চ্যাপ্টার

‘আমারও অবাক লেগেছে আপা। উনি তো অনর্থক কোন কাজ করেন না।’
‘কিন্তু বল তো উনি আমাদের বাড়িতে থাকছেন না গ্রান্ড টার্কসে এসেও, এর পেছনে কি অর্থ আছে?’ বলল মার্গারেট।
‘অর্থ আছে। আমি তার সিদ্ধান্তে আপত্তি করেছিলাম। তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘তোমাদের পরিবারকে সন্দেহের উর্ধে রাখার মধ্যেই আমাদের লাভ। হাসপাতালের ঘটনায় ডাঃ মার্গারেট ওদের সন্দেহের তালিকায় পড়তে পারে বলে আমি আশংকা করছি। আমি বিদেশী, তোমাদের ওখানে থাকলে সন্দেহ আরও গভীরতর হবে।’ বলল জর্জ।
‘আমিও এটাই বুঝেছি। অদ্ভুত এক মানুষ। সব মাথা খালি করে সব বোঝা তিনি নিজের মাথায় নেন। কিন্তু এত করেও তিনি আমাকে সন্দেহমুক্ত রাখতে পারেননি।’
‘কি ব্যাপার?’ জর্জ বিস্ময়ের সাথে বলল।
‘গতকাল ডাঃ ওয়াভেল আমাকে বলেছেন সাবধানে থাকতে। আমি তাঁকে কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ‘যারা প্যাথোলজিক্যাল রিপোর্ট চুরি করতে বাধ্য করেছিল, তারা তোমাকেও সন্দেহ করছে। ওরা সাংঘাতিক। ওরা না পারে এমন কিছু নেই।’
‘উনি কি তোমাকে ভয় দেখালেন, না আন্তরিকভাবে তোমাকে সাবধান হওয়ার জন্যে বললেন?’
‘না জর্জ, সেদিনের ঘটনার পর উনি বদলে গেছেন। এমনকি ওঁর (আহমদ মুসার) প্রতি কোন ক্ষোভ তাঁর নেই। বরং বলেন, সেদিনের ঘটনা তাঁর জন্যে ভালই হয়েছে। এই ঘটনার অজুহাতে ওদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার সুযোগ হয়েছে।’
‘আমি যতটা শুনেছি, ওঁর স্ত্রীর কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে। ঘটনার পর একদিন আহমদ মুসা ভাইয়ের সাথে মিসেস ওয়াভেলের কথা হয়েছে। মিসেস ওয়াভেল তাকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন এবং দেখা করার জন্যে অনুরোধ করেছেন। আহমদ মুসা ভাইয়ের মতে মিসেস ওয়াভেলের রাজনৈতিক চিন্তা আমাদের সাহায্য করতে পারে।’
‘সত্যি ওঁর উপর আল্লাহর বিশেষ রহমত আছে। যে পরিবারটা তার সাংঘাতিক শত্রু হওয়ার কথা, সে পরিবার তার বন্ধু হয়ে গেল।’
‘আপা আমার বিস্ময়টা এখনও কাটেনি। সেদিন তিনি হাসপাতালের রুম থেকে স্বাভাবিকভাবে বের হয়েছিলেন। এত বড় একটা অভিযানে উনি বেরুচ্ছেন তার বিন্দু মাত্র আঁচ করা যায়নি। কি করে উনি বুঝলেন ডাঃ ওয়াভেলের বাসায় অভিযান করলে চুরি যাওয়া ডকুমেন্টগুলো পাওয়া যাবে! সামান্য ভয়ও তাঁর মনে জাগেনি। কি আশ্চর্য, তিনি শুধু ডকুমেন্টগুলো উদ্ধারই করলেন না, কঠিন এক সময়ে গোটা পরিস্থিতিকে নিজের নিয়ন্ত্রণে আনলেন, যার ফলে মিসেস ওয়াভেল পুলিশ ডেকেও মিথ্যা কথা বলে পুলিশকে ফেরত দেন।’
‘বোধ হয় এটাই ওঁর মৌলিকত্ব যে, তিনি যুদ্ধের ময়দানে অস্ত্রের শক্তির চেয়ে বুদ্ধির শক্তির উপর বেশি নির্ভর করেন।’
আটটা বাজার শব্দ হলো ঘড়িতে।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে জর্জ বলল, ‘আহম মুসা ভাই এতক্ষণ এলেন না।’
জর্জের কথা শেষ না হতেই দরজায় নক হলো। ছুটে গেল জর্জ দরজায়। খুলে দিল দরজা। দরজায় আহমদ মুসা।
তারা সালাম বিনিময়ের পর আগে আহমদ মুসা ও পেছন পেছন জর্জ প্রবেশ করল ঘরে।
ঘরে প্রবেশ করে সালাম দিল আহমদ মুসা মার্গারেটকে।
দরজা খোলার সংগে সংগেই ডাঃ মার্গারেট উঠে দাঁড়িয়েছিল। গায়ের কাপড় ঠিক-ঠাক করে মাথার ওড়নাটা টেনে দিয়েছিল কপালের উপর।
‘ওয়া আলাইকুম।’ বলে সালাম গ্রহণ করল ডাঃ মার্গারেট। মার্গারেটের চোখে-মুখে আনন্দ। তার সাথে সেখানে লজ্জার একটা পীড়ন। দুইয়ে মিলে অপরূপ লাবন্যের সৃষ্টি হয়েছে মার্গারেটের চেহারায়।
আহমদ মুসা সালাম দেয়ার সময় ডাঃ মার্গারেটের মুখের উপর একবার চোখ পড়েছিল মাত্র। চোখ নিচু করে নিয়েছিল সংগে সংগেই।
আহমদ মুসা সোফায় এসে বসল। তার পাশে এসে বসল জর্জ। আর মার্গারেট জর্জের ওপাশে আরেকটা সোফায়। টেলিভিশনটা তাদের সামনে।
আহমদ মুসা সেদিকে তাকিয়ে বলল, জর্জ, ‘ফ্রি ওয়ার্ল্ড টিভি’ (FWTV) তে দাও।’
‘আচ্ছা, ওদের তো এখন ‘ওয়ার্ল্ড ইন এক্সক্লুসিভ’ প্রোগ্রাম রয়েছে। ঐ প্রোগ্রামের কথা আপনি বলেছেন?’
‘হ্যাঁ’ বলল আহমদ মুসা।
জর্জ উঠতে উঠতে বলল, ‘ওদের এই প্রোগ্রামটা খুব নাম করেছে ভাইয়া। দেশ-কাল-পাত্র নির্বিশেষে সকল জালেম ও মজলুমের কথা কোন অতিরঞ্জন ছাড়াই এরা নিরপেক্ষভাবে তুলে ধরে। এ কারণেই এটা এখন দুনিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রোগ্রাম। ‘ওয়ার্ল্ড ওয়াচ’-এর সাম্প্রতিক সমীক্ষা অনুসারে বিশ্বের টিভি দর্শকদের শতকরা ৭০ ভাগ নিয়মিত এই প্রোগ্রাম দেখে থাকে, যা একটি প্রোগ্রামের সর্বোচ্চ রেকর্ড।’
রিমোর্ট কনট্রোলটা এনে চ্যানেল চেঞ্জ করে FWTV তে নিয়ে এল জর্জ।
ঠিক আটটা পাঁচ মিনিটে প্রোগ্রাম শুরু হলো।
একজন ঘোষক বলল, আজ আমাদের দৃশ্যপট আমেরিকান কন্টিনেন্ট, বিশেষভাবে ক্যারিবিয়ান দ্বীপাঞ্চল। তারপর সে বলল, ‘রীতি অনুসারে প্রথমে রিপোর্ট সারাংশ। তারপর ‘সরেজমিন’, যাতে থাকবে সাক্ষাতকার ও প্রমাণপঞ্জী। সবশেষে থাকবে ‘মন্তব্য’।
ঘোষণা শুনেই জর্জ বলল, ‘লায়লা জেনিফার ও অন্যান্যদের খবরটা জানানো দরকার। নিশ্চয় বিষয়টা খুব ইন্টারেষ্টিং হবে।’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘ওরা সবাই জানে।’
‘জানে?’ জর্জের মুখে বিস্ময়। বলল, ‘তাহলে এ প্রোগ্রামটা নিশ্চয় খুব গুরুত্বপূর্ণ।’
‘দেখে মন্তব্য করলে ভালো হবে।’ ঈষৎ হেসে বলল আহমদ মুসা।
রিপোর্ট সারাংশ তখন শুরু হয়ে গেছে।
সবারই সব মনোযোগ আছড়ে পড়ল টিভি’র উপর।
রিপোর্টে তখন বলা হচ্ছে,
‘আজ একুশ শতকে মানুষের স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার যখন সবচেয়ে বড় শ্লোগান হতে যাচ্ছে, তখন ক্যারিবিয়ান সাগরের দ্বীপাঞ্চলে চরম মানবাধিকার লংঘনের খবর পাওয়া গেছে। জানা গেছে, সেখানকার অশ্বেতাংগ বিশেষ করে মুসলিম কম্যুনিটির সদ্যজাত পুরুষ সন্তানদের অব্যাহত হত্যা এবং মুসলিশ পুরুষদের হত্যা, গুম, ইত্যাদি কর্মসূচীর মাধ্যমে সেখান থেকে মুসলিম জনসংখ্যা নির্মূলের কাজ উদ্বেগজনক গতিতে অগ্রসর হচ্ছে। গ্রান্ড টার্কস বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ষ্টুডেন্ট গ্রুপের বিশেষ সমীক্ষা এবং এই মানবাধিকার লংঘনের ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত ‘হোয়াইট ঈগল’ নামক গোপন সংগঠনের নিজস্ব দলীল থেকে এই মানবাধিকার লংঘন-ষড়যন্ত্রের নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া গেছে।
চার্লস বিশ্ববিদ্যালয়ের ষ্টুডেন্ট গ্রুপের সমীক্ষা অনুসারে গত ৬ বছরে জনসংখ্যার বিশেষ শ্রেণী মুসলমানদের জনসংখ্যা বৃদ্ধি হ্রাস পেয়েছে গড়ে ১৪ শতাংশ হারে। মুসলিম জনসংখ্যার মধ্যে মুসলিম পুরুষ শিশুর মৃত্যুর হার উদ্বেগজনক। গত ছয় বছরের প্রথম বছর মুসলিম শিশুর মৃত্যু হার শতকরা ৬ ছিল, কিন্তু ষষ্ঠ বছর অর্থাৎ গত বছর এই হার ছিল শতকরা ২৫, তার আগের বছর ছিল শতকরা ২০ এবং তার আগের বছর শতকরা ১৫ ছিল। হোয়াইট ঈগলের নিজস্ব দলিলে গত তিন বছরের একটা মুল্যায়ন পাওয়া গেছে। চার্লস বিশ্ববিদ্যালয়ের ষ্টুডেন্টদের সমীক্ষা ছিল টার্কস দ্বীপপুঞ্জের উপর, কিন্তু হোয়াইট ঈগল-এর মূল্যায়ন গোটা ক্যারিবিয়ান দ্বীপাঞ্চল নিয়ে। এই মূল্যায়নে ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের প্রতিটি দ্বীপ-রাষ্ট্রের চিত্র পৃথক পৃথক ভাবে তুলে ধরা হয়েছে। মূল্যায়ন অনুসারে গত তিন বছরে গোটা ক্যারিবিয়ান দ্বীপাঞ্চলে মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধি হ্রাসের গড় হার ১৫ শতাংশ। এর মধ্যে কিউবাতে সবচেয়ে কম, তিন বছরে গড়ে হ্রাস ১০ শতাংশ এবং সবচেয়ে বেশি টার্কস দ্বীপপুঞ্জে, তিন বছরে গড় হ্রাস ২১ শতাংশ।
‘হোয়াইট ঈগল’ পরিচালিত মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধি হ্রাসের পদ্ধতিটি চরম অমানবিক এবং হৃদয়বিদারক। হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ম্যাটারনিটিতে সদ্য ভূমিষ্ঠ হওয়া মুসলিম শিশু সন্তানদের নানা মেডিকেল পদ্ধতিতে কৌশলে হত্যা করা হচ্ছে। সম্প্রতি গ্রান্ড টার্কস-এর কুইন এলিজাবেথ হাসপাতালে সদ্য মৃত তিনটি মুসলিম শিশুর লাশ পরীক্ষা করে দেখা গেছে, একজনকে ‘স্লিপ পয়জনিং’ এবং অন্য দু’জনকে ভয়ংকর ‘ডেথ ভাইরাস’ দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ‘হোয়াইট ঈগল’ নামের গোপন সংগঠন পরীক্ষার এই রিপোর্টগুলো এবং পরীক্ষার উপকরণসমূহ চুরি করে বিষয়টি ধামাচাপা দেবার চেষ্টা করে। হাসপাতালের শিশু ও প্রসূতি বিভাগের প্রধান ডাঃ ক্লার্ক চুরি ঘটনার কথা স্বীকার করেছেন। মনে করা হচ্ছে, কমপক্ষে গত ৬ বছর ধরে লাখ লাখ মুসলিম পুরুষ শিশুকে এই ধরনের নানা পন্থায় হত্যা করা হয়েছে। এর ফলে সৃষ্টি হয়েছে প্রবল ডেমোগ্রাফিক ভারসাম্যহীনতার। স্যাম্পলিং সমীক্ষা থেকে দেখা গেছে, ক্যারিবিয়ান দ্বীপাঞ্চলে মুসলিম মেয়ে শিশু ও পুরুষ শিশুর গড় অনুপাত দাঁড়িয়েছে ২০:১ এবং সবচেয়ে উপদ্রুত টার্কস দ্বীপপুঞ্জে এই অনুপাত ৩০:১-এ পৌছেছে। মনে করা হচ্ছে, এই প্রজন্ম তাদের বয়স কালে মুসলিম তরুণীরা বিয়ের জন্যে মুসলিম তরুণ পাবে না। ফলে মুসলিম মেয়েরা স্বাভাবিক পারিবারিক জীবন লাভে ব্যর্থ হবে অথবা শতকরা নব্বই ভাগ ক্ষেত্রে তাদেরকে অমুসলিমদের ঘরে প্রবেশ করতে বাধ্য হতে হবে।
প্রাপ্ত তথ্যাবলীর ভিত্তিতে নিশ্চিতভাবে মনে করা হচ্ছে, মানবতা বিরোধী এই জঘন্য অপরাধের সাথে ‘হোয়াইট ঈগল’ নামের গোপন সংগঠন জড়িত। এক শ্রেণীর শ্বেতাংগ পুলিশ, আমলা, ডাক্তার অথবা হাসপাতাল কর্মীরা কোথাও স্বতস্ফূর্তভাবে, কোথাও ভয়ে-প্রলোভনের কারণে বাধ্য হয়ে ‘হোয়াইট ঈগল’কে সহযোগিতা দিচ্ছে। মনে করা হচ্ছে, জাতীয় সরকারগুলো ব্যাপক অনুসন্ধান চালালে ‘হোয়াইট ঈগল‘এর এজেন্ট পুলিশ, আমলা ও অন্যান্যদের চিহ্নিত করা কঠিন হবে না। তবে অভিজ্ঞ মহলের ধারণা, ‘হোয়াইট ঈগল’-এর মত আন্তআমেরিকান সংগঠনের হুমকি ও চাপ মোকাবিলার সাধ্য ছোট ছোট জাতীয় সরকারগুলোর নেই। এ জন্যেই তারা অভিমত প্রকাশ করেছেন যে, জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট এজেন্সিগুলোকে তাদের তৃতীয় বিশ্বের বিশেষজ্ঞ সমন্বয়ে গঠিত টিমের মাধ্যমে তদন্ত ও উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণে এগিয়ে আসতে হবে। অবিলম্বে এদের কালো হাত ভেঙে দিতে না পারলে গোটা আমেরিকার অবস্থাকে তারা ঐ একই পর্যায়ে নিয়ে যাবে বলে আশংকা করা হচ্ছে।’
‘রিপোর্ট সার-সংক্ষেপ’ উপস্থাপনার পর ‘সরেজমিন’ প্রতিবেদন শুরু হলো।
ডা: মার্গারেট ও জর্জের চোখ টিভি’র দৃশ্যে যেন আটকে গেছে আঠার মত। গোগ্রাসে যেন তারা গিলছে সব কথা। দেখছে সবকিছু সম্মোহিত হওয়ার মত।
প্রোগ্রামটি ছিল বিশ মিনিটের।
প্রোগ্রাম শেষ হয়ে গেলেও সম্মোহন যেন তাদের কাটল না। তাদের মুখে কোন কথা নেই। নড়াচড়া করতেও তারা যেন ভুলে গেছে।
টেলিফোন বেজে উঠল। জর্জ তার মোবাইলটা তুলে নিল পাশ থেকে।
টেলিফোন ধরেই তা আহমদ মুসার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘ভাইয়া জেনিফারের টেলিফোন।’
আহমদ মুসা টেলিফোন ধরতেই সালাম দিয়ে জেনিফার বলল, ‘অভিনন্দন ভাইয়া। যে ঘটনা ওরা টার্কস দ্বীপপুঞ্জে আমাদের প্রচার করতে দেয়নি, তা আপনি বিশ্বময় ছড়িয়ে দিলেন। ভাইয়া, কি বলে কি দিয়ে আপনাকে কৃতজ্ঞতা জানাব ভাইয়া।’ আবেগে রুদ্ধ হয়ে গেল জেনিফারের কণ্ঠ।
‘পাগল বোন, ভাইকে বুঝি এভাবে কৃতজ্ঞতা জানাতে হয়?’
‘আমার নয় ভাইয়া, এটা জাতির কৃতজ্ঞতা।’
‘জাতি কি আমার নয়?’
‘তবু ভাইয়া, আমি জাতির মধ্যকার একজন।’
‘আচ্ছা থাক এসব। শোন, একে শুধু আনন্দের নয়, আশংকার দৃষ্টিতেও দেখতে হবে। তোমাকে এবং মার্গারেটকে খুব সাবধানে থাকতে হবে। ওরা এটা শোনার পর এতক্ষণে ক্ষ্যাপা কুকুরের মত হয়ে গেছে। ষ্টুডেন্ট গ্রুপের সমীক্ষার তথ্য পাচার করার জন্যে তোমাকে এবং হাসপাতালের তিনটি শিশুর পরীক্ষা সংক্রান্ত তথ্য সরবরাহ করার জন্যে মার্গারেটকেই ওরা সন্দেহ করবে। সুতরাং তোমাদেরকে খুবই সাবধান থাকতে হবে। রাস্তায় বেরুনো তোমার একেবারেই বন্ধ করে দিতে হবে।’
‘আমি তো লুকিয়েই আছি। ওখানে আপনাদের সাথে এক সাথে টিভি দেখার ইচ্ছা আমার ছিল। কিন্তু রাস্তায় বেরুতে হবে, এ কারণেই তো যেতে পারলাম না। জর্জকে টেলিফোন দিন। আমি ওর সাথে ঝগড়া করবো। আমার সৌভাগ্য সে কেড়ে নিচ্ছে।’
‘জেনিফার, তোমার আর জর্জের সৌভাগ্য আলাদা হয়ে গেল কখন? দিচ্ছি ওকে টেলিফোন, ঝগড়া কর।’
বলে আহমদ মুসা জর্জকে টেলিফোন দিল। দিতে দিতেই শুনল জেনিফার চিৎকার করছে, ‘থাক ওর সাথে আর কথা বলব না।’
জর্জ টেলিফোন ধরে বলল, ‘বেশ জেনিফার, আমি তো কথা বলতে চাইনি।’
ওপারের কথা শুনে জর্জ আবার বলল, ‘তুমি আসতে পারনি, এটা কি আমার দোষ?’
ওপারের কথার পর জর্জ পুনরায় বলল, ‘বা! বা! বা!, আমি গিয়ে তোমাকে নিয়ে এলাম না কেন, তুমি বলনি কেন? আমি তো তোমাকে চালাই না, তুমিই আমাকে চালাও। তাই……..।’
জর্জের কথা শেষ হতে পারল না। ওপার থেকে টেলিফোন রেখে দিয়েছে জেনিফার।
জর্জ টেলিফোন রাখতে রাখতে বলল, ‘রেগে গেছে জেনিফার’
‘তুমি যাতা বলে ওকে রাগাও জর্জ, এটা ভাল নয়।’ বলল ডা: মার্গারেট।
‘আপা, তুমি তো কোন সময়ই জেনিফারের ত্রুটি দেখ না। ওই প্রথম আজ অযৌক্তিক কথা বলেছে।’
আহমদ মুসার ঠোঁটে হাসি। বলল, ‘ঠিক আছে জর্জ, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আজ জেনিফারই ঝগড়াটা প্রথম শুরু করেছে।’
আহমদ মুসা থামতেই ডা: মার্গারেট চকিতে আহমদ মুসার দিকে একবার চোখ তুলল। তারপর কম্পিত চোখটা নামিয়ে গভীর কণ্ঠে বলল, ‘FWTV’-তে এই অসম্ভব ঘটনা কিভাবে ঘটতে পারলো?’
‘এটা তো অসম্ভব ঘটনা নয়!’
‘আমাদের কাছে অসম্ভব। লোকাল খবরের কাগজে যে নিউজ ছাপা যায় না, সে নিউজ বিশ্ব টিভি’তে বিশ্বময় প্রচার হবে এটা অসম্ভব ঘটনা নয়?’
‘তা ঠিক। কিন্তু FWTV –এর মত বিশ্বমানের টিভিগুলো এ ধরনের বিষয় পেলে লুফে নেয়।’
‘কিন্তু পেল কি করে?’
‘আমি ওদের কাছে পাঠিয়েছি।’
‘সেটা আমরা বুঝেছি।’ হেসে বলল ডা: মার্গারেট।
থেমেই ডা: মার্গারেট আবার শুরু করল, ‘কিন্তু পেয়েই ওরা প্রচার করল? BBC কিংবা VOA কে দিলে তারা কি প্রচার করত?’
‘না করত না।’
বলে একটু থামল আহমদ মুসা। তারপর সোফায় হেলান দিয়ে বসল আহমদ মুসা। বলল, ‘আসল কথা ডা: মার্গারেট, FWTV এবং WNA-এই দু’টি সংবাদ মাধ্যম মুসলমানদের তৈরি। বিশ্বমানের সংবাদ মাধ্যম হিসাবে যে দায়িত্ব, সেটা তারা পালন করার সাথে নিজস্ব দায়িত্বও এভাবে তারা পালন করছে।’
‘আলহামদুলিল্লাহ।’ ডা: মার্গারেট ও জর্জ এক সাথেই বলে উঠল।
একটু থেমেই জর্জ আবার বলল, ‘এ সংবাদ মাধ্যম দু’টির এই গোপন পরিচয় কি অন্যেরা জানে?’
‘কেউ কেউ এটা সন্দেহ করে। কিন্তু সবাই এটা জানে, এ সংবাদ মাধ্যম দু’টিতে মুসলিম কিছু পুঁজিপতির পুঁজি আছে। কিন্তু তারা মনে করে অন্যগুলোর মতই এটা ব্যবসায়িক ভিত্তিতে পরিচালিত প্রতিষ্ঠান। বিশেষ করে এ সংস্থা দু’টোর সংবাদ প্রচারে নিরপেক্ষতা এদের সম্পর্কে নেতিবাচক চিন্তার সুযোগ কাউকে দিচ্ছে না। মুসলিম কোন গ্রুপ বা শাসকের দ্বারা কোন অন্যায় হলে তা এ সংবাদ মাধ্যম দু’টো সোচ্চার কণ্ঠেই প্রচার করে থাকে।’
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা ডা: মার্গারেটকে বলল, ‘তুমি কি কিছুদিনের জন্যে ছুটি নিতে পার?’
‘কেন?’
‘হাসপাতালে যাতায়াত তোমার নিরাপদ নয়। তাছাড়া আমি মনে করি কিছুদিন তোমার একটু সরে থাকা দরকার।’
‘আপনি যা আদেশ করবেন তাই হবে।’
‘এটা আমার আদেশ নয়, পরামর্শ।’
মুখ নিচু রেখেই থামল ডা: মার্গারেট। বলল, ‘নেতা যেটা দেন তা পরামর্শ নয়, নির্দেশ।’
‘আদেশ না হয়ে পরামর্শই হওয়া ভাল নয় কি? আদেশ হলে তা তো অপরিহার্য হয়ে যায়।’
‘আদেশ না মানতে পারি, এ ভয় তাহলে আপনার আছে?’
‘মার্গারেট, আমার কথা বিশেষ কারো জন্যে নয়, সাধারণ নীতি হিসাবে বলেছি।’
‘ধন্যবাদ।’ বলে ডা: মার্গারেট উঠে দাঁড়াল এবং বলল, ‘আমি উঠছি। আজ কিন্তু আপনি খেয়ে যাবেন। সব রেডি।’
কথা শেষ করেই আহমদ মুসাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মার্গারেট দ্রুত ড্রইং রুম ত্যাগ করল।
মার্গারেট চলে গেলে জর্জ টিভি বন্ধ করে দিল। মুখোমুখি হলো আহমদ মুসার। বলল, ‘এরপর কি ভাইয়া? হোয়াইট ঈগল তো ক্ষ্যাপা কুকুরের মত হয়ে উঠবে বলছেন। কিন্তু বিশ্ব কিছু বলবে না?’
‘অবশ্যই বলবে। দেখবে আগামী কালের সংবাদপত্র এই নিউজ কমবেশী কভার করবে গোটা দুনিয়ায়। প্রতিক্রিয়াও কালকে থেকেই প্রকাশ হওয়া শুরু করবে। এবং এটা অবশ্যই একটা ইস্যুতে পরিণত হবে।’
‘এর ফল কি হবে?’
‘কি ফল হবে আমি জানি না। তবে এটুকু বলতে পারি বৃটিশ সরকার, টার্কস দ্বীপপুঞ্জের এ ঘটনার জন্যে ঘরে বাইরে প্রবল সমালোচনার মুখে পড়বে। সুতরাং বাধ্য হয়েই তাকে টার্কস দ্বীপপুঞ্জে ‘হোয়াইট ঈগল’-এর মূলোচ্ছেদ করতে এগিয়ে আসতে হবে।’
‘আলহামদুলিল্লাহ। এটা হবে আমাদের জন্যে একটা বড় লাভ। শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল আমাদের জন্যে।’
আহমদ মুসা কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছিল। কিন্তু তার আগেই ভেতর থেকে জর্জের ডাক পড়ল, ‘ওঁকে নিয়ে এস জর্জ।’
সংগে সংগেই জর্জ উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘চলুন ভাইয়া। বাড়িতে আর কেউ নেই, কাজের দু’জন মেয়ে ছাড়া।’
আহমদ মুসাও উঠল। খাবার টেবিলে বসল জর্জ এবং আহমদ মুসা।
খাবারগুলো ঠিক-ঠাক এগিয়ে দিয়ে ডা: মার্গারেট বলল, ‘শুরু করুন সেলফ সার্ভিস।’
‘এটাই নিয়ম, ধন্যবাদ।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আপা, তুমি বস। দাঁড়িয়ে রইলে যে!’ বলল জর্জ।
‘হোষ্ট হিসাবে তুমি তো খাচ্ছই। মেহমানের অস্বস্তির কোন কারণ নেই।’ ঠোঁটে হাসি টেনে বলল মার্গারেট।
জর্জ একটু ভাবল। তারপর আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ভাইয়া, এভাবে একত্রে খাওয়ার ব্যাপারে ইসলামের কোন নিষেধাজ্ঞা আছে?’
‘নিরাপদ পরিবেশে পর্দাসহ বিয়ে নিষিদ্ধ নয় এমন লোককে খাবার পরিবেশন করা, তার সাথে দেখা করা, কথা বলা যায়, কিন্তু একান্ত বাধ্য না হলে এক সাথে খাওয়া যায় কিনা আমার জানা নেই।’
‘নিরাপদ পরিবেশ কি?’ জর্জ বলল।
‘যাদের মধ্যে বিয়ে নিষিদ্ধ নয় এমন দু’জন ছেলে মেয়ে কোন নিভৃত স্থানে বা কোন নির্জন কক্ষে দেখা করতে বা কথা বলতে পারে না। তবে নিরাপদ হলে পারে। অর্থাৎ সাথে যদি স্বামী ও ভাই-এর মত কেউ থাকে তাহলে পারে। সাথে স্বামী ও ভাই-এর মত অতি আপন কেউ থাকাই নিরাপদ পরিবেশ।’
‘এক সাথে খাওয়ার ক্ষেতেও এই একই বিধান হতে পারে না কেন?’
‘আমি মনে করি একান্ত বাধ্য হলে পারে। কিন্তু সাধারণভাবে এটা আমার মনে হয় মুসলিম সংস্কৃতি বিরোধী।’
‘কারণ?’ প্রশ্ন করল জর্জ।
‘জনাব, কারণ বলবেন না। এসব ব্যাপারে কত বই আছে, কোরআনের তফসির এবং হাদীস তো আছেই। লেখাপড়া করবে না, শুধু প্রশ্ন। এত কথা বললে খাওয়া হবে না। খেতে দাও।’ কৃত্রিম শাসনের সুরে বলল ডাঃ মার্গারেট।
জর্জ আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘স্যরি, ভাইয়া। আপা ঠিকই বলেছেন।’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘ঠিক আছে তোমার প্রশ্নটার জবাব আরেকদিন দেব।’
‘জর্জ কিন্তু লেখাপড়া করে না। ওর আবেগ যতটা বেশি, লেখাপড়া ততটাই কম।’ ঠোঁটে হাসি টেনে বলল মার্গারেট।
‘তাই নাকি জর্জ?’
‘ভাইয়া আপা ইসলামের পন্ডিত হচ্ছেন, আমাকে পন্ডিত হতে বলেন।’ বলল জর্জ।
‘পন্ডিত না হও, প্রয়োজনীয় সবকিছু তোমাকে জানতে হবে।’
‘সে চেষ্টা করছি ভাইয়া। কোরআন শরীফ আমি অর্থসহ দু’বার পড়া সম্পন্ন করেছি। মিশকাত শরীফের অর্ধেক পর্যন্ত পড়েছি। তাছাড়া মাসলা-মাসায়েলের বই নিয়মিতই দেখি।’
‘ধন্যবাদ জর্জ। আর তোমার আপা?’
‘সে হিসেব আমি দিতে পারবো না। ওঁর টেবিল ভর্তি বইয়ে। ডাক্তারি বিদ্যা সে ভুলতে বসার পথে।’
আহমদ মুসা তাকাল ডাঃ মার্গারেটের দিকে। বলল, ‘জর্জের অভিযোগ সত্য নয় আশা করি। তোমাকে শ্রেষ্ঠ ডাক্তার হতে হবে, সেই সাথে হতে হবে একজন শ্রেষ্ঠ মুসলমান।’
আহমদ মুসার দিকে মুহূর্তের জন্যে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিল ডাঃ মার্গারেট। তার মুখ রক্তিম হয়ে উঠেছে লজ্জা এবং অপরিচিত এক আবেগে। বলল, ‘দোয়া করুন।’
বলে ডাঃ মার্গারেট কি মনে হওয়ায় দ্রুত রিফ্রেজারেটরের দিকে এগুলো।
আহমদ মুসা মনোযোগ দিল খাওয়ার দিকে।

টেলিফোনের শব্দে আহমদ মুসার ঘুম ভাঙল। রাত তখন ৩টা। ধরল টেলিফোন। লায়লা জেনিফারের কণ্ঠ। কান্নায় কথা বলতে পারছে না জেনিফার।
‘সময় নষ্ট করো না জেনিফার। কি ঘটেছে বল?’ একটু শক্ত কণ্ঠে বলল আহমদ মুসা।
‘মার্গারেট আপাকে কেউ ধরে নিয়ে গেছে। জর্জ আহত হয়ে বাইরে পড়ে আছে।’ কান্না জড়িত কণ্ঠে বলল জেনিফার।
‘কি বলছ তুমি জেনিফার? তুমি বাসা থেকে?’
‘আমি বাসায়। জর্জের বাসায় আর কেউ নেই। কাজের মেয়েটা আমার টেলিফোন নম্বার জানত, এইমাত্র আমাকে জানাল।’
‘তুমি টেলিফোন রেখে দাও। আমি এখনি বেরুচ্ছি।’
‘ভাইয়া, আমি যাব।’
‘বেশ প্রস্তুত থাক। আসছি আমি।’
রাত সাড়ে তিনটার মধ্যেই আহমদ মুসা জেনিফারকে নিয়ে জর্জদের বাড়ি পৌছল।
জর্জকে তখন প্রতিবেশীরা কয়েকজন এসে ধরাধরি করে ড্রইং রুমে এনে তুলেছে।
জর্জ আহমদ মুসাকে দেখে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল।
আহমদ মুসা কোন কথা না বলে জর্জের মাথায় হাত বুলিয়ে জর্জের আঘাত পরীক্ষা করল। দেখল, জর্জের দু’হাত ক্ষত-বিক্ষত। বাধা দেবার জন্যে দুহাতে ছোরা ধরে ফেলারই ফল এটা। তাছাড়া তার ডান বাহুতে এবং কাঁধে মারাত্মক আঘাত।
কাজের মেয়েরাও প্রতিবেশীরা ক্ষতগুলো কাপড় দিয়ে বেঁধে রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে চেষ্টা করছে।
আহমদ মুসা কান্নারত বিমূঢ় জেনিফারের দিকে চেয়ে বলল, ‘জেনিফার তুমি থানায় এবং হাসপাতালে টেলিফোন কর।’
বলে আহমদ মুসা কান্নারত জর্জের দিকে চেয়ে বলল, ‘জর্জ এখন কান্নার সময় নয়। তুমি আমাকে সাহায্য কর।’ আদেশের সুরে কথাগুলো বলল আহমদ মুসা।
জর্জ চোখ মুছল। শান্ত হবার চেষ্টা করল।
‘বল, যারা মার্গারেটকে ধরে নিয়ে গেছে, তাদের সম্পর্কে তুমি কি বুঝেছ?’
‘ওরা দশ বারোজন এসেছিল। সবারই মুখ মুখোশে ঢাকা ছিল। আমার সাথে ধস্তাধস্তির সময় ওদের একজনের মুখোশ খুলে যায়, জামার কয়েকটা অংশ ছিড়ে পড়ে যায়। আমার মনে হয় ওরা সবাই শ্বেতাংগ। যারা কথা বলেছে, সবাই ইংরেজি ভাষায়। ইংরেজির উচ্চারণ উত্তর বাহামা অঞ্চলের মত।’
‘জামার অংশগুলো ছিড়ে খসে পড়েছে তা কোথায়?’
‘আমি আপার চিৎকার শুনে ঘুমে থেকে জেগে ছুটে আসি আপার ঘরের দিকে। ওদের সাথে ঘরের দরজায় আমার ধস্তাধস্তি হয়। সম্ভবত জামার ছিড়ে পড়ে যাওয়া অংশ ও মুখোশ ওখানেই পড়ে আছে।’
শুনেই আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘জর্জ ওটা আমাকে দেখতে হবে। আমি দেখছি।’
বলে ছুটল আহমদ মুসা মার্গারেটের ঘরের দিকে।
মার্গারেটের ঘরের সামনেই প্রশস্ত করিডোরে কালো সার্টের কয়েকটা টুকরো পড়ে থাকতে দেখল।
আহমদ মুসা দ্রুত সেদিকে এগুলো এবং তাড়াতাড়ি জামার টুকরোগুলো কুড়িয়ে নিল।
আহমদ মুসা দেখল, টুকরোগুলো মিলালে গোটা জামাই হয়ে যায়। জামা ছিঁড়ে যাওয়া লোকটি নিশ্চয় গোটা জামা খুলে ফেলে দেয়। সাফারী ধরনের সার্টের উপরে ও নিচের চারটি পকেটই অক্ষত আছে।
আহমদ মুসা পরীক্ষা করল পকেটগুলো। একটা পকেটে টাকার কয়েকটা নোট পেল। টাকাগুলো বাহামার ডলার। তাহলে লোকরো ছিল বাহামার? অন্য একটা পকেটে আহমদ মুসা ভাঁজ করা নীল রঙের পাতলা কাগজ পেল।
ভাঁজ খুলল কাগজটির। একটা রশিদ ধরনের কাগজ। ভালো করে দেখল আহমদ মুসা। একটা এয়ার প্যাসেস সার্টিফিকেট। সানসালভাদরের কলম্বাস এয়ারপোর্ট ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হয়েছে ‘দি ব্লু বার্ড’কে।
তাড়াতাড়ি তারিখের দিকে নজর বুলাল আহমদ মুসা। তারিখ আজকের। টেক অফের সময়ও লেখা আছে রাত দশটা। চমকে উঠল আহমদ মুসা। ওরা কি সানসালভাদর থেকে বিমান নিয়ে এসেছিল! ডাঃ মার্গারেটকে ওরা বিমানেই নিয়ে যাবে। চঞ্চল হয়ে উঠল আহমদ মুসা। ওদের বিমান নিশ্চয় ল্যান্ড করেছে গ্রান্ড টার্কস বিমান বন্দরে। ডাঃ মার্গারেটকে নিয়ে তাহলে ওরা এয়ারপোর্টেই গেছে।
বিষয়টা চিন্তা করেই আহমদ মুসা ছুটল জর্জের কাছে। আহমদ মুসা যেতেই জেনিফার বলল, ‘ভাইয়া, পুলিশ আসছে। হাসপাতাল থেকেও এই শিফটের এ্যাডমিনিষ্ট্রেটিভ অফিসার একজন ডাক্তার নিয়ে আসছেন।’
‘আলহামদুলিল্লাহ। পুলিশ এলে জর্জ তুমি একটা মামলা দায়ের কর।’
তারপর জেনিফারের দিকে তাকিয়ে আহমদ মুসা বলল, ‘ডাক্তার জর্জকে যদি হাসপাতালে নিয়ে যেতে চায়, তুমিও যেও তার সাথে হাসপাতালে। বাড়িতে একা তুমি থাকবে না।’
‘আপনি থাকছেন না?’ বলল জর্জ।
‘আমি এখনি গ্রান্ড টার্কস এয়ারপোর্টে যাচ্ছি।’
‘কেন?’ বিস্ময় ভরা কণ্ঠে বলল জেনিফার।
‘সম্ভবত বিমানে করে মার্গারেটকে টার্কস দ্বীপপুঞ্জের বাইরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। দেখি ওদের নাগাল পাই কিনা?’
বেদনায় অন্ধকার হয়ে উঠেছে জর্জের মুখ। বলল, ‘ওরা কারা ভাইয়া? হোয়াইট ঈগল?’
‘নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তবে সন্দেহ ওদেরকেই।’ কথা শেষ করেই আহমদ মুসা বলল, ‘আসি।’ বলে দ্রুত পা চালাল আহমদ মুসা বাইরে বেরুবার জন্যে।
এক ঘণ্টা পরে ফিরে এল আহমদ মুসা। এসে জর্জ এবং জেনিফারকে পেল না। শুনল, এ্যাম্বুলেন্সেই ওরা হাসপাতালে চলে গেছে। হাতের ঘড়ির দিকে তাকাল আহমদ মুসা। রাত সাড়ে ৪টা।
সময় হাতে বেশি নেই। ছুটল সে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে।
ব্যান্ডেজ ইত্যাদি শেষ করে এইমাত্র জর্জকে বেডে আনা হয়েছে।
আহমদ মুসা যখন কক্ষে ঢুকছিল, তখন বেরিয়ে যাচ্ছিল ডাক্তার ও নার্সরা।
কক্ষে প্রবেশ করল আহমদ মুসা।
জর্জ চোখ বন্ধ করে শুয়েছিল। আর জেনিফার বসেছিল জর্জের মাথার পাশে এক চেয়ারে।
আহমদ মুসা প্রবেশ করতেই আকুল, উৎসুক্য চোখে জেনিফার চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল।
পায়ের শব্দ পেয়ে জর্জও চোখ খুলেছে। আহমদ মুসাকে দেখেই তার চোখ দু’টি চঞ্চল হয়ে উঠল। শত প্রশ্ন ঝরে পড়ল তার চোখ থেকে।
আহমদ মুসা জর্জের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। একটি হাত জর্জের বুকে আস্তে করে রেখে জর্জের শত প্রশ্ন ভরা চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘না জর্জ, তোমাকে মুখে হাসি ফুটানোর মত কোন খবর নিয়ে আসতে পারিনি। যেটা এনেছি সেটা দুঃসংবাদই।’
জর্জ চোখ বুজল।
‘কি খবর ভাইয়া?’ কম্পিত গলায় প্রশ্ন করল জেনিফার।
‘আমার সন্দেহ যদি সত্য হয়, আমি এয়ারপোর্টে পৌছার আধঘণ্টা আগে মার্গারেটকে বহনকারী প্রাইভেট বিমানটি বিমান বন্দর ত্যাগ করেছে।’
‘কোথায় নিয়ে গেছে ভাইয়া?’ জেনিফারই বলল।
‘আমার সন্দেহ সত্য হলে বিমানটি সানসালভাদরে গেছে।’
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা আবার বলল, ‘জেনিফার পুলিশ এসে কি করল?’
‘পুলিশ কেস নিয়েছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও পুলিশকে টেলিফোন করেছে। পুলিশ জানতে চাচ্ছে কাউকে আমাদের সন্দেহ হয় কিনা। জর্জ শুধু এটুকু বলেছিল, যারা সম্প্রতি প্যাথোলজিক্যাল রিপোর্ট চুরি করেছিল তারা জড়িত থাকতে পারে। কারা চুরি করিয়েছিল আমরা জানি না।’
‘ঠিক আছে এটুকু। ধন্যবাদ তোমাদের।’
জর্জ চোখ খুলল। বলল, ‘কিন্তু ভাইয়া, পুলিশ কেস নেয়া পর্যন্তই। কিছুই হবে না।’ জর্জের কণ্ঠে হতাশা।
জর্জের গায়ে সান্ত¦নার হাত বুলিয়ে আহমদ মুসা বলল, ‘পুলিশ কিছু করবে এজন্যে পুলিশকে বলা হয়নি। বলা হয়েছে এজন্যে যে পুলিশের কাছে ঘটনাটা রেকর্ডেড হওয়া দরকার।’
বলে একটু থামল আহমদ মুসা। পরক্ষণেই আবার শুরু করল, ‘আমার হাতে সময় বেশি নেই জর্জ। একটা বোট ঠিক করে এসেছি। ঠিক সাড়ে ছয়টায় আমি যাত্রা করব। ফজরের নামাযও আমি সেরে নিয়েছি।’
‘কোথায় ভাইয়া?’ দুজনেই চমকে উঠে এক সাথে প্রশ্ন করল।
‘সানসালভাদর।’
‘আপনি কি নিশ্চিত ভাইয়া, আপাকে ওরা সানসালভাদর নিয়ে গেছে?’
‘নিশ্চিত নই। তবে যেটুকু প্রমাণ পেয়েছি, তাতে ওরা সানসালভাদর থেকে এসেছিল, ওখানেই ফিরে গেছে। মার্গারেটকে তাদের সাথে নেবারই কথা।’
‘মাফ করবেন, কি প্রমাণ ভাইয়া?’
‘তুমি যে ছেঁড়া জামার কথা বলেছিলে, সে জামার পকেটে একটা এয়ার প্যাসেজ সার্টিফিকেট পাওয়া গেছে। সার্টিফিকেট অনুসারে ‘দি ব্লু বার্ড’ নামক একটা প্রাইভেট এয়ারলাইন্সের একটা বিমান গত রাত দশটায় সানসালভাদর বিমান বন্দর থেকে ‘টেক অফ’ করেছিল। আমার ধারণা এই বিশেষ বিমানেই ওরা এসেছিল এবং ফিরে গেছে। এবং আমার আরো ধারণা, শুধু ডাঃ মার্গারেটকে কিডন্যাপ করার জন্যেই ছিল তাদের এ আয়োজন।’
আহমদ মুসার এই বর্ণনা যেন ভীত করল জর্জকে। তার মুখ কুঁকড়ে গেছে উদ্বেগ ও বেদনায়। কম্পিত গলায় বলল সে, ‘মনে হচ্ছে ওরা বিরাট শক্তিশালী বিশাল দল। আপনি একা। কিভাবে……।’
কথা শেষ করতে পারল না জর্জ। রুদ্ধ হয়ে গেল তার কণ্ঠ।
আহমদ মুসা হো হো করে হেসে উঠল। বলল, ‘জর্জ আমি একা নই। আমার সাথে আল্লাহ আছেন। আর আল্লাহর শক্তির কাছে ঐসব শক্তি কিছুই নয়।’
‘নিশ্চয় আল্লাহ সকলের চেয়ে, সবকিছুর চেয়ে বড়। কিন্তু সবক্ষেত্রেই সাফল্য কি তিনি দেন? আমি যে ভাবনা মন থেকে দূর করতে পারছি না।’ বলে ফুপিয়ে কেঁদে উঠল জর্জ।
আহমদ মুসা হেসে উঠল। সোজা হয়ে দাঁড়াল। বলল, ‘জর্জ, তুমি শুধু ডাঃ মার্গারেটের ভাই এ হিসাবে ভাবলে চলবে না, তুমি আজ ‘আমেরিকান ক্রিসেন্ট’ এর সভাপতি।’
ঠোঁটে হাসি কিন্তু শক্ত কণ্ঠে কথাগুলো বলল আহমদ মুসা।
জর্জ ধীরে ধীরে আহত হাত তুলে গায়ের চাদর দিয়ে চোখের পানি মুছে ফেলল। বলল, ‘দুঃখিত আমি ভাইয়া। আপাকে না নিয়ে আমাকে ওরা ধরে নিয়ে গেলে ভেঙে পড়াতো দূরে থাক কোন ভয়ই করতাম না।’
‘জানি জর্জ। তোমাকে এখন শক্ত হতে হবে। আমি চলে যাচ্ছি। তোমাকে এদিকটা দেখতে হবে।’
থামল আহমদ মুসা। তারপর তাকাল লায়লা জেনিফারের দিকে। সে বিমূঢ় এক পাথরের মত দাঁড়িয়ে আছে। এরপর তাকাল জর্জের দিকে। ধীরে ধীরে বলল আহমদ মুসা, ‘আমি তোমাদের দু’জনকে একটা কথা বলতে চাই।’
‘আদেশ করুন ভাইয়া।’ দুজনেই বলল।
‘FWTV -তে ঐ খবরটি প্রচারিত হবার পর ওরা নিশ্চয় পাগল হয়ে গেছে। তারই একটা প্রমাণ, বিশেষ বিমান নিয়ে এসে তারা ডাঃ মার্গারেটকে ধরে নিয়ে গেছে। আমার বিশ্বাস, লায়লা জেনিফারের উপর তারা আরও বেশি ক্ষেপে আছে। সুতরাং লায়লা জেনিফারের একটা শক্ত আশ্রয় ও সার্বক্ষণিক সাথী দরকার। গ্রামের বাড়ি তার জন্যে নিরাপদ নয়। তার মামার বাড়িও নয়। মেয়ে হওয়ার কারণেই অন্য কোন আশ্রয়ও তার জন্যে নিরাপদ নয়। অপর দিকে জর্জও একা হয়ে পড়েছে। আমি চাই, এই মুহূর্তে না হলেও আজই তোমরা বিয়ে কর। তোমাদের মত বল।’
লজ্জায় লাল হয়ে উঠল জেনিফারের মুখ। মুখ নিচু করেছে সে।
আকস্মিক এই প্রস্তাবে জর্জও লজ্জায় সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে অনেকটা।
‘বলেছি, হাতে আমার সময় নেই। তোমরা কথা বল। আমি মনে করছি, জর্জ অসুস্থ হওয়ায় জেনিফারের সঙ্গ তার জন্যে অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। বিয়ে এই সমস্যারও সমাধান করে দেবে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ভাইয়া আপনার সিদ্ধান্তই আমার সিদ্ধান্ত। আপনি ওকে জিজ্ঞেস করুন। ওকে তার মতের বাইরে একবিন্দুও নড়ানো যায় না।’ বলল জর্জ।
‘ভাইয়া, ও বলতে চাচ্ছে আপনার আদেশ সেই শুধু চোখ বন্ধ করে মানে, আমি মানি না। নিজের মত বলা কি অপরাধ? ওকে জিজ্ঞেস করুন ভাইয়া, কবে কোন আদেশ আপনার আমি মানিনি!’ জেনিফারের রাঙা মুখে ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটেছে।
দুঃখের মধ্যেও আহমদ মুসার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল দু’জনের মধুর ঝগড়া দেখে। বলল, ‘ঠিক আছে তোমাদের দু’জনের মত আমি পেয়ে গেছি। আলহামদুলিল্লাহ।’
মুহূর্তের জন্যে থামল আহমদ মুসা। থেমেই আবার বলল, ‘আমি গাড়িতে করে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও আর একজনকে নিয়ে এসেছি। ওদের বলে দেই, আজ দিনের কোন এক সময় তারা বিয়ে পড়াবার ব্যবস্থা করবে। তোমরাও বন্ধু-বান্ধবদের ডাকতে পার।’
আহমদ মুসা থামার সাথে সাথেই জেনিফার প্রতিবাদ করে উঠল, ‘না ভাইয়া, সবার অনুপস্থিতিতে বিয়ে হতে পারে, আপনার অনুপস্থিতিতে নয়।’
‘তাহলে?’ আমাকে তো অল্পক্ষণের মধ্যেই যেতে হবে।’
‘এই অল্পক্ষণে বিয়ে হতে পারে না? এবং এই কক্ষেই?’ বলল জেনিফার।
‘পারে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘এতেই আমি আনন্দিত হবো ভাইয়া। এখন ওকে জিজ্ঞেস করুন।’ বলল জেনিফার।
আহমদ মুসা তাকাল জর্জের দিকে।
‘ভাইয়া, আমার কোন পৃথক সিদ্ধান্ত নেই। আপনি যা বলবেন, সেটাই আমি করব। কিন্তু দেখলেন তো ভাইয়া, ও নিজের মতের ব্যাপারে কতটা সিরিয়াস। কিভাবে তার মত সে চাপিয়ে দিয়ে ছাড়ল।’ বলল জেনিফার।
জেনিফার তীব্র কণ্ঠে কিছু বলতে যাচ্ছিল। আহমদ মুসা তাকে হাতের ইশারায় বাধা দিয়ে বলল, ‘বোন জেনিফার তোমাকে কিছু বলতে হবে না। আমিই জর্জের কথার প্রতিবাদ করছি।’
বলে আহমদ মুসা জর্জের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘জর্জ, জেনিফারের মতামত আমার কাছে খুবই মূল্যবান। আশা করি তোমার কাছেও। মতামত দেয়ার ক্ষমতা একটা বড় গুণ। এ গুণ আমার এ বোনটির আছে। মতামতকে সম্মান করবে, রাগাবে না কখনও।’
জর্জ গম্ভীর হলো। জেনিফারের দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, ‘স্যরি, রিয়েলি স্যরি জেনিফার।’
জেনিফারের মুখ লজ্জা, সংকোচে একেবারে রাঙা হয়ে গেছে। মুখ নিচু করেছে সে।
‘জর্জ, তোমার অনামিকায় হীরক বসানো যে সোনার আংটি দেখছি, সেটা তুমি জেনিফারকে পরিয়ে দাও। এটাই হবে মোট মোহরানার নগদ অংশ।’
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়িয়ে বাইরে বেরুবার জন্যে হাঁটা শুরু করে বলল, ‘তোমরা তৈরি হও, আমি গাড়ি থেকে ওদের নিয়ে আসি।’
দু’মিনিটের মধ্যেই আহমদ মুসা মসজিদ থেকে আনা ইমামসহ তিনজনকে নিয়ে হাজির হলো।
আহমদ মুসা কক্ষে ঢুকে দেখল, জর্জ বাসা থেকে সাথে করে আনা বাড়তি সার্টটা পরেছে। জেনিফার যা পরেছিল সেটাই। শুধু ডান হাতের অনামিকায় শোভা পাচ্ছে জর্জের দেয়া হীরের আংটি। পোশাকে পার্থক্য শুধু এটুকুই ঘটেছে যে, মাথায় ওড়নাটা কপালের নিচে একটু বেশি পরিমাণে নেমে এসেছে।’
ইমাম সাহেবরা এসে ভেতরে বসলেন।
আহমদ মুসা জর্জ ও জেনিফারের কাছাকাছি এসে একটু নিচু গলায় বলল, ‘বিয়ের জন্যে ইসলামী বিধান মতে অভিভাবকদের উপস্থিতি প্রয়োজন। তোমরা আমাকে অভিভাবকত্ব দিচ্ছ কিনা।’
‘ভাইয়া, আল্লাহ সবচেয়ে বড় অভিভাবক। আর দুনিয়ায় আপনার চেয়ে বড় কোন অভিভাবক আমাদের নেই।’ বলল জেনিফার।
‘আমি জেনিফারের মতকে সম্মান করি ভাইয়া।’ বলল জর্জ, তার ঠোঁটে হাসি।
‘ভাইয়া, ও কি বলল দেখুন।’
হাসল আহমদ মুসা। জর্জের মাথায় আঙুল দিয়ে একটা টোকা দিয়ে বলল, ‘যাই হোক, বিয়ের পর যেন ঝগড়া দিয়ে জীবন শুরু করো না।’
বিয়ের অনুষ্ঠান হলো খুবই সংক্ষিপ্ত।
আহমদ মুসা বর ও কনে দুই পক্ষের নিকট থেকে সম্মতি (এজেন) আদায়ের দায়িত্ব পালন করল। সাক্ষী মসজিদের মুয়াজ্জিন এবং আরও একজন। বিয়ে পড়াল ইমাম সাহেব। সবশেষে দোয়া করল আহমদ মুসা।
এই রাতে মিষ্টি পাওয়া সম্ভব নয়। আহমদ মুসা সকলের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে সকলের হাতে একটা করে আমেরিকান ক্যান্ডি তুলে দিয়ে বলল, ‘হাসপাতালের পাশের একটা শপে এটাই পেয়েছি। আপনারা এটা গ্রহণ করে দম্পতিকে দোয়া করুন।’
‘আপনি যে মিষ্টির কথা বলছেন, সে মিষ্টির চেয়ে অনেক দামী মিষ্টি এটা।’ বলল ইমাম সাহেব।
‘ধন্যবাদ।’ বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা ইমাম সাহেবদের গাড়িতে রেখে কক্ষে ফিরে এল আবার।
এবার আহমদ মুসা কক্ষে প্রবেশের আগে দরজায় নক করল। জেনিফার এসে দরজা খুলে ধরলে তবেই আহমদ মুসা কক্ষে প্রবেশ করল।
জর্জ এবং জেনিফার দু’জনেই লজ্জায় জড়সড়। দু’জনের চোখে মুখেই নতুন এক লজ্জার আবরণ।
‘আমার যাবার সময় হয়েছে। কয়েকটা কথা বলছি মনোযোগ দিয়ে তোমরা শুন।’
বলে আহমদ মুসা একটা দম নিল। তারপর শুরু করল, ‘জেনিফার হাসপাতালের বাইরে বেরুতে পারবে না। কাউকে দিয়ে খাবার আনিয়ে খেতে হবে। এই অবস্থায় হাসপাতালে থাকা কঠিন হবে। সুতরাং আজকেই বিকেলে হাসপাতাল থেকে রিলিজ নেয়ার চেষ্টা করতে হবে। দ্বিতীয় বিষয়টি হলো, জর্জদের বাড়ি ওরা চিনেছে। ওখানে তোমরা দু’জন কেউ নিরাপদ নও। সুতরাং হাসপাতাল থেকে ভিন্ন কোথাও গিয়ে তোমাদের উঠতে হবে। জর্জের কোন আত্মীয়ের বাসা হলে চলবে না। আত্মীয়ের বাসার সন্ধান ওদের জন্যে সহজ হবে। এ রকম জায়গা তোমাদের খোঁজে আছে?’
‘আমার এক ফুফা চাকরী নিয়ে সপরিবারে পোর্টেরিকা চলে যাচ্ছেন আজ, সেখানেই আজ আমার উঠার কথা। আম্মাও আসবেন। আমরা সেখানে উঠতে পারি।’
‘ধন্যবাদ জেনিফার। একটা দুঃশ্চিন্তা থেকে আমাকে বাঁচালে।’
একটু থামল। শুরু করল আবার, ‘জেনিফারের বেরুনই চলবে না বাড়ির বাইরে। জর্জ বেরুলেও কিছু ছদ্মবেশ নিয়ে বেরুতে হবে।’
‘ভাইয়া, আমি তো ওদের টার্গেট নই। হলে আজই তো নিয়ে যেত।’ বলল জর্জ।
‘জর্জ তোমার টার্গেট হওয়া, না হওয়া নির্ভর করছে ডাঃ মার্গারেটকে নিয়ে কি ঘটছে তার উপর। খোদা না করুন, সে যদি সব কথা বলে দিতে বাধ্য হয়, সব কিছু স্বীকার করতে বাধ্য হয়, তাহলে তুমি ওদের একটা প্রধান টার্গেট হয়ে দাঁড়াতে পার।’
উদ্বেগ, আতংকে ছেয়ে গেল জর্জ এবং জেনিফারের মুখ। বলল আর্তকণ্ঠে জেনিফার, ‘আপার উপর কি নির্যাতন করতে পারে?’
‘জর্জ, জেনিফার তোমরা কি হবে, কি ঘটবে এসব নিয়ে ভেব না। ভবিষ্যতটা আল্লাহর উপর ছেড়ে দাও। তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ হেফাজতকারী।’
বলে আহমদ মুসা টেবিলের উপর থেনে নিজের ব্যাগটা তুলে নিল।
আহমদ মুসার যাবার প্রস্তুতি দেখে জর্জ এবং জেনিফার দু’জনেরই মুখ মলিন হয়ে উঠল। বলল জেনিফার, ‘শত শত্রুর মধ্যে গিয়ে আপনি কিভাবে কি করবেন! আপার মত আপনিও যদি বিপদে পড়েন, আমার ভয় করছে ভাইয়া।’ ভারি কণ্ঠ জেনিফারের।
‘বলেছি তো, কি হবে, কি ঘটবে এসব চিন্তাকে বড় করে দেখো না।’ একটু শক্ত কণ্ঠে বলল আহমদ মুসা।
‘আপনার খবরের জন্যে প্রতি মুহূর্তে আমরা উৎকণ্ঠিত থাকব। কিভাবে আমরা জানতে পারব।’ জর্জ অশ্রু ভেজা নরম কণ্ঠে বলল।
আহমদ মুসা একটু চিন্তা করল। বলল, ‘এ ব্যাপারে আমি এখন কিছু বলতে পারবো না। তবে কোন খবর থাকলে সেটা মাকোনির কাছেই থাকবে।’
বলে আহমদ মুসা যাবার জন্যে পা বাড়িয়েও ঘুরে দাঁড়াল। বলল জেনিফারকে, যদি সম্ভব হয় তাহলে আজতেই তোমার ভাবীকে টেলিফোন করে বলবে, ‘আমি সানসালভাদরে গেছি।’
‘আপার কথা তাঁকে বলব?’
‘ওঁর কাছে কোন কথা আমি লুকোই না, তা যত খারাপই হোক।’
আহমদ মুসা সালাম দিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে পা বাড়াল দরজার দিকে।
জর্জ ও জেনিফারের চারটি চোখ আহমদ মুসা চলে গেলেও তার চলার পথের উপর আটকে থাকল। দু’জন যেন হারিয়ে ফেলেছে নিজেদেরকে।
এক সময় ধীরে ধীরে মুখ খুলল জেনিফার। বলল, ‘দেখেছ জর্জ, ভাইয়া ভাবীর কথা মনে করেছেন, কিন্তু তাঁর চোখে মুখে কোন বেদনা, দুশ্চিন্তা নয়, বরং তাতে একটা প্রশান্তি ও পরিতৃপ্তির ছাপ। অথচ তিনি ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছেন একটা জীবন-মৃত্যুর লড়াই-এ।’
‘এটাই আহমদ মুসা জেনিফার। আল্লাহ ওঁকে মানুষের জন্যে সৃষ্টি করেছেন। তাঁর মনও ঐভাবে তৈরি।’ বলল জর্জ।
‘না হলো না জর্জ। উদ্দেশ্য লক্ষ্য স্থির করার এবং মন ঠিক করার দায়িত্ব মানুষের। আহমদ মুসা তা করেছেন।’
‘তুমি ঠিক বলেছ জেনিফার। এ অধিকার আল্লাহ মানুষের হাতেই দিয়েছেন।’ বলল জর্জ।
‘ধন্যবাদ। সত্য তুমি বিনা তর্কে মেনে নিয়েছ জর্জ।’ হেসে বলল জেনিফার জর্জের দিকে তাকিয়ে।
জর্জও চোখ তুলল জেনিফারের দিকে। তারও মুখে হাসি। বলল, ‘বিশ্বাস কর জেনিফার, তোমার মতকে আমি সম্মান করি।’
‘ধন্যবাদ, ভাইয়ার পরামর্শ যে তুমি মানছ!’ মুখে মিষ্টি হাসি জেনিফারের।
‘না জেনিফার, এ শ্রদ্ধা আমার তোমাকে জানার পর থেকেই।’
‘তাহলে কথায় কথায় ঝগড়া বাধাও কেন?’
‘তুমি রাগলে তোমাকে অপরূপ দেখায়।’ বলে জর্জ হাত বাড়াল জেনিফারের দিকে।
‘না মশায়, এটা হাসপাতাল। বেড রুম নয়, বাড়ি নয়।’
বলে জেনিফার দৌড় দিয়ে পালাল জর্জের কাছ থেকে। তার মুখ ভরে গেছে মিষ্টি হাসিতে। রাঙা হয়ে উঠেছে মুখ আপেলের মত। | ← Previous | | | Next → | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top