১
‘বল তোকে ওয়াশিংটন ছাড়তে বলা হয়েছে, আমেরিকার ছাড়তে বলা হয়েছিল, ছাড়িসনি কেন?’ কথাগুলো বলতে বলতে দৈর্ঘ্য-প্রস্থে দৈত্যাকার একজন লোক ঘুষি ছুড়ে মারল সান ওয়াকারের মুখে
মেঝের উপর ছিটকে পড়ে গেল সান ওয়াকারের দেহ। ঠোঁটে ফেটে ঝর ঝর করে রক্ত বেরুল।
কপালটাও তার থেঁতলে যাওয়া। মনে হয়। ভোতা জিনিস দিয়ে তার মাথায় আঘাত করা হয়েছিল। মেঝের উপর দের ফুট লম্বা একটা ব্যাট পড়ে আছে। ওটারও আঘাত হতে পারে।
লোকটা আঘাত করে গিয়ে চেয়ারে বসল। দৈত্যাকার বপু এ লোকটার নাম গ্রিংগো। সে হোয়াইট ঈগলের ওয়াশিংটন হেড অফিসে টর্চার ইউনিটের সবচেয়ে কার্যকর হাত।
তার দু’পাশে দাঁড়িয়ে আছে খুনি আকৃতির ষন্ডা মার্কা আরো দু’জন লোক।
ঘুষি খেয়ে পড়ে যাবার পর ধীরে ধীরে উঠে বসল সান ওয়াকার। বলল, ‘কিন্তু আমি ওয়াশিংটন ছাড়ব কেন, আমিরিকা ছাড়ব কেন? আমার দোষ কি?
‘দোষ কি আবার জিজ্ঞেস কা হচ্ছে! ন্যাকা, যেন কিছুই বোঝে না’।
বলে গ্রিংগো একটু থামল। শুরু করল আবার, ‘তুই মেরী রোজকে বিপদগামী করেছিস। তোর কারণেই মেরী রোজ আমাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে।’
‘মিথ্যে কথা। স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেবার বয়স রোজ-এর হয়েছে। এবং সে বুদ্ধি তার আছে।’ কপাল থেকে চোখের উপর দিয়ে গড়িয়ে আসা রক্ত মুছতে মুছতে সান ওয়াকার বলল।
‘এসব কেতাবী কথা রাখ। সব আমরা বুঝি। ‘বলতে বলতে উঠে দাঁড়িয়ে সান ওয়াকারের পাঁজরে একটা সজোরে লাথি কষে আবার গ্রিংগো মুখ বাকিয়ে বলল, ‘আহা! প্রেম করেছে। ব্লাডি ব্লাক হয়ে শ্বেতাংগিনী রোজ-এর দিকে হাত বাড়াবার মাজা এবার পাইয়ে দেব।’
সান ওয়াকার কিছুই বললনা। সে জানে এসব প্রলাপ, হিংসার অস্ত্র। জবাব দেবার কিছু নেই।
কিন্তু সান ওয়াকারেরর নীরবতা গ্রিংগোকে ক্ষেপিয়ে তুলল। বলল সে গর্জে ওঠে, ‘বল হারামজাদা ওয়াশিংটন এবং আমেরিকা ছাড়ছিস কিনা!’
আমি এমন কিছু করিনি যে আমাকে নিজের বিশ্ববিদ্যালয় ও নিজের দেশ ছাড়তে হবে।’ বলল সান ওয়াকার শান্ত ও দৃঢ় কণ্ঠে।
জ্বলে উঠল যেন গ্রিংগোর মুখ। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল চেয়ার থেকে। বলল চিrকার করে, ‘দেশ ফলানো হচ্ছে! কোথায় তোর দেশ? আমেরিকা? এখানো তেআ পরাজিত হয়েছিস। উrখাত হয়েছিস এখান থেকে। তোদের সবাইকে পালাতে হবে যদি বাঁচতে চাস।’
‘আমেরিকা ও আমেরিকান জনগণের কথা নয়। আর পালাব কেন? সবার মত আমরাও আমেরিকান।’
‘গোল্লায় যাক তোর আমেরিকান আইন আর জনগণ। আমরা শ্বেতাংগরা নতুন আইন করেছি আমেরিকায়। তোরা এশিয়া থেকে এসেছিস, এশিয়ায় ফিরে যেতে হবে।’
‘কিন্তু আপনারা এসেছেন ইউরোপ থেকে আমাদের পরে।’
‘কিন্তু আমরা জিতেছি। আমেরিকা এখন আমাদের।’
‘আমেরিকান জনগণ এটা মানবে না।’
‘গোল্লায় যাক জনগন। তোর জনগণ মানে তো হোয়াইট, নন হোয়াইট সব। আমরা এ জনগণ তত্ত্ব মানি না। আমরা জনগণের বাপ। আমরা যা বলব তাই হবে।’
বলে একটা ঢোক গিলেই আবার বলল, ‘বল, দেশ ছাড়ছিস কিনা?’
‘না’ আমি দেশ ছাড়ছি না। তাছাড়া আমি ছাত্র, আমি লেখাপড়া করছি এখানে।’ শক্ত কণ্ঠে বলার চেষ্টা করল সান ওয়াকার।
‘কি এত বড় স্পর্ধা! শিক্ষা তাহলে তোর এখনও হয়নি।’ বলে গ্রিংগো সান ওয়াকারের কাছে ছুটে গিয়ে পাঁজরে একটা লাথি চালিয়ে পা দিয়ে মেঝেয় ঢলে পড়া সান ওয়াকারের গলা চেপে ধরে বলল, ‘তুই স্টুডেন্ট নোবেল প্রাইজ’ পেয়েছিস। তোকে আর বাড়তে দেয়া যায় না। তোকে মরতে হবে। তোকে বাইরে পাঠানোর প্রস্তাব ছিল আমাদের একটা উদারতা।’
সান ওয়াকারের শ্বাস রুদ্ধ হওয়ার উপক্রম হলো। তখন চিrকার করে বলছিল গ্রিংগো, ‘বল হারামজাদা, স্বেচ্ছায় দেশ ছাড়বি কিনা?’
ঠিক এই সময় ঘরে প্রবেশ করল হোয়াইট ঈগল-এর প্রধান গোল্ড ওয়াটার-এর ডিপুটি জর্জ আব্রাহাম।
ঢুকে গ্রিংগোর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘গ্রিংগো মেরে ফেলো না। মুল্যবান লোক ও। অনেক জানার আছে তার কাছ তেকে। ছেড়ে দাও ওকে।’
গ্রিংগো সরে দাঁড়াল।
জর্জ আব্রাহাম সান ওয়াকারের হাত ধরে টেনে তুলে বসাল। বলল, ঈগল সান ওয়াকার আমরা দুঃখিত এজন্য যে, তোমার উপর এসব অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে।’
বলে জর্জ আব্রাহাম দাঁড়িয়ে থাকা একজনকে আরেকটা চেয়ার আনতে বলল।
চেয়ার এল।
জর্জ আব্রাহাম সান ওয়াকারকে বলর, ‘চেয়ারে উঠে বস।’
সান ওয়াকার ম্লান হাসল। বলল, ‘প্রশস্থ মেঝেতেই ভাল আছি স্যার। বলুন, আপনার প্রশ্নের জবাব দেব।’
‘ধন্যবাদ সান ওয়াকার, জবাব পেলে খুশী হবো। তুমি ভাল ছাত্র।তোমার বিরাট ভবিষ্যত আছে। তুমি যদি আমাদের সহযোগিতা বরো, তাহলে তোমার ব্যাপারটা আমরা নতুন করে ভেবে দেখবো।’ নরম কন্ঠে বলল জর্জ আব্রাহাম।
সান ওয়াকার জবাবে কিছু বলল না। শুধু তার ঠোঁটের কোণে একটা তীক্ত হাসি ক্ষনীকের জন্য ফুটে উঠে মিলিয়ে গেল।
জর্জ আব্রাহামের হাতে একটা ফাইল। ফাইলের ভেতরটায় একটু চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, তোমার বিষয়ে আমরা এ ফাইলটা চুরি করেছি কিংবা বলতে পার, ম্যানেজ করে এনেছি এফবিআই-এর পলিটিক্যাল সেকশন থেকে এখানে তোমার সম্পর্কে এমন অনেক কতা আছে যা আমরা স্বপ্নেও কল্পনা করিনি। রেড ইন্ডিয়ানরা নতুন করে সংগঠিত হওয়া এবং তাদের সাথে মুসলমান ও আফ্রিকান আমেরিকান সখ্যতা, ইত্যাদি বিষয়ে তোমার গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকার কথা এখানে আছে। এসব বিষয়ে তোমার কাছে কিছু জানতে চাই।’
বলে একটু থামল জর্জ আব্রাহাম।
একটু ভাবল। যেন চিন্তাটা গুছিয়ে নিল সে। তারপর বলল, ‘আমেরিকায় ইন্ডিয়ান মুভমেন্ট (AIM) কে জান?’
‘অবশ্যই।’
‘ধন্যবাদ। মুভমেন্টের সাথে তুমি শরিক আছ?’
‘সকল ইন্ডিয়ানই আছে। আমিও আছে।’
‘তোমার কি দায়িত্ব সেখানে?,
‘কর্মি মাত্র।’
‘গত মাসের কাহেকিয়া সম্মেলনে (AIM) এর দাবীনামা কে ড্রাফট করেছে?’
‘আমি।’
‘একজন কর্মি কি এই দায়িত্ব পায়?
‘হয়ত পায় না, কিন্তু আমাকে তারা এ দায়িত্ব দিয়েছিল।’
‘দাবীগুলোর মূল উদ্দেশ্য কি?’
‘রেড ইন্ডিয়ানদের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া অধিকার ফিরে পাওয়া।’
‘মিথ্যে কথা।’
‘তাহলে সত্যিটা কি?’
‘আমেরিকান নেশনকে দু’ভাগ করে সংঘাত বাধানো।’
‘এটা একেবারেই বানানো কথা।’
‘কাহোকিয়ায় রেড ইন্ডিয়ানদের ১ লাক প্রতিনিধিদের যে সম্মেলন হলো, তাতে কত খরচ হয়েছে জান?’
‘জানি না।’
‘৫ কোটি ডলার। এবং সব টাকাই দিয়েছে আন্তর্জাতিক একটি মুসলিম সংস্থা।’
চমকে উঠল সান ওয়াকার। এ ধরনের কোন তথ্য তারা জানা নেই এবং সত্যও নয়। সান ওয়াকার জানে, সম্মেলনের খরচ সংকুলান হয়েছে ডেলিগেট ফি এবং চাঁদা আদায় থেকে। সকলের জানা বিষয়টি এরাও জানে অবশ্যই। কিন্তু এক অবিশ্বাস্য অভিযোগ তুলছে কেন? সন্দেহ নেই, রেড ইন্ডিয়ানদের বদনাম ও তাদের উপর কোন পদেক্ষেপকে জাস্টিফাই করার জন্যেই এই অভিযোগ। সান ওয়াকার দৃঢ় কন্ঠে বলল, ‘আপনি শেষ যে তথ্যটি দিলেন তা সত্য নয়।এবং এটা রেড ইন্ডিয়ানদের জন্য খুবই অপমানজনক। আর কোন মুসলিম সংস্থা এমন অর্থ দেবেই না কেন?’
‘দেবে কেন? মুসলমানদের সাথে রেড ইন্ডিয়ানদের যে দহরম-মহরম তার মূল্যের ক্ষেত্রে ৫ কোটি টাকা কিছুই নয়।’
‘মুসলমানদের সাথে দহরম-মহরম? কোথায়?
‘মুসলমানদের সাথে তোমাদের বিয়ে-শাদী ও সামাজিক সম্পর্ক দারূণভাবে বেড়েছে। কাহোকিয়া সম্মেলনে ১ লাখ প্রতিনিধির মধ্যে প্রচুর মুসলিম ছিল।’
‘তারা মুসলিম হিসেবে আসেনি, এসেছিল রেড ইন্ডিয়ান হিসেবে। যেমন এসেছিল প্রচুর খৃষ্টান রেড ইন্ডিয়ান। আর বিয়ে-শাদীর ব্যাপারটা সামাজিক সম্পর্কের ভিত্তিতে হয়, বিশেষ কোন ধর্ম বিচার করে হয় না।’
আমি এই সামাজিক সম্পর্কের কথাই বলছি। মুসলমানদের সাথে সামাজিক ঘনিষ্ঠতা রেড ইন্ডিয়ানদের মধ্যে সাংঘাতিক ভাবে বেড়েছে।’
‘বেড়েছে একথা ঠিক নয়। ঐতিহাসিক কারণে ইউরোপীয়রা এদেশে আসার অনেক আগে থেকে মুসলমানদের সাথে সামাজিক সম্পর্ক ছিল, সেই সম্পর্ক এখনও আছে। বিয়ে-শাদীর ব্যাপারটা আগে হয়তো প্রচার হতো না। এখন হচ্ছে।’
‘কাহোকিয়া সম্মেলনে ইসলামী ইসলামী সম্মেলন সংস্থার প্রতিনিধি এসেছিল কেন?’
‘যে নীতির ভিত্তিতে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, ভ্যাটিক্যান, ইত্যাদি বিশ্ব সংগঠনের প্রতিনিধিদের ডাকা হয়েছিল, সে নীতির ভিত্তিতেই দাওয়াত দেয়া হয় ওআইসি’কে।
‘আসলে কাহোকিয়া সম্মেলন ছিল আমেরিকান নেশনকে ভাগ করার এক বিশ্বমহড়া।’
‘না এটা ঠিক নয়। মার্কিন সংবিধান তার মার্কিন নাগরিকদের যে অধিকার দিয়েছে তার এক ইঞ্চি বাইরে রেড ইন্ডিয়ানরা যায়নি।’
রাগে মুখ লাল হয়ে উঠেছে জর্জ আব্রাহামের। লাল ক্রুদ্ধ স্বরে, ‘এই রেড ইন্ডিয়ানের বাচ্চা, সব কথা সব আইন সংবিধানে লেখা থাকে না। বাস্তবতা কি? পরাজিত ও বিজয়ী কি এক আসন পাবে? একই অধিকার পাবে?’ থামল জর্জ আব্রাহাম।
কোন উত্তর দিল না সান ওয়াকার।
জর্জ আব্রাহামই আবার কথা বলল। বলল সে, ‘বুঝা গেছে আমার কথা? তোদের কাহোকিয়া সম্মেলন, দাবি-দাওয়া সবই অনধিকার চর্চা। মার্কিন সরকার সংবিধান দেখে তোদের চোখ দিয়ে। তোদের মত ওরাও শ্বেতাঙ্গ জাতির শত্রু। তোদের ধ্বংস করার পর ওদেরকেও আমরা শেষ করব। শত্রুরা কেউ বাঁচবে না আমাদের হাত থেকে।’ বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল জর্জ আব্রাহাম।
জর্জ আব্রাহাম থামলেও সান ওয়াকার চুপ করে থাকল। কি উত্তর দেবে এসব কথার? কোন যুক্তি দিয়ে হিংসার আগুন নেভানো যাবে না। জর্জ আব্রাহামের কথার মধ্য দিয়ে যে বর্ণবাদী দৈত্যের চেহারা নগ্ন হয়ে উঠল, তা দেখে সান ওয়াকার সত্যিই আrকে উঠেছে।
উত্তেজিত জর্জ আব্রাহাম চেয়ার থেকে উঠে পায়চারি করছিল। দু’টি হাত তার পেছনে মুষ্টিবদ্ধ।
এক সময় সান ওয়াকারের মুখোমুখি দাঁড়াল। বলল শক্ত কন্ঠে, ‘তুমি মৃত্যু থেকে বাঁচতে পার তিনটি শর্তে। এক, কাহোকিয়া সম্মেলনে গোপন ভোটে তিনশ’ সদস্যের যে ‘রিজিওনাল কাউন্সিল’ গঠিত হয়েছে তার তালিকা আমরা চাই। দুই, মেরী রোজ-এর সাথে কোন সম্পর্ক রাখবেনা তার প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। এবং তিন, তোমাকে আমেরিকা ত্যাগ করতে হবে। এশিয়ায় যাওয়া এবং সেখানে থাকার ব্যবস্থা আমরা করে দেব। এখন তুমি বল, মৃত্যু এবং শর্তগুলোর কোনটা পছন্দনীয়।’
শর্তগুলো শুনে বিস্মিত হলো সান ওয়াকার। বিস্মিত হলো এই কারনে যে, তার মত একজন ছাত্রকে এত ভয় করে ওরা? আরও বিস্মিত হলো তাদের অসহনশীলতার ভয়াবহ রুপ দেখে। গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের শ্রেষ্ঠতম নিশান বরদার দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমাজ জীবনের অভ্যন্তরে এই ধরনের সংঘবদ্ধ দুর্বৃত্তরাও বাস করছে? জর্জ আব্রাহামের জবাবে বলল সান ওয়াকার, ‘মৃত্যু জীবনে একবার আসবেই। মৃত্যু আমার কাছে ভয়ের বস্তু নয়। তবে মৃত্যুকে ভয় করলেও আপনাদের তিন শর্তে রাজী হতাম না।’
আগুন ঝরে পড়ল জর্জ আব্রাহামের চোখ থেকে। বলল, ‘তোরা সব শ্বেতাংগ বিরোধী আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের এজেন্ট।’ বলে সে পাশে দাঁড়ানো গুন্ডামার্কা দু’জন লোকের একজনের দিকে চেয়ে বলল, ‘এর মুখটা একটু ঠিক করে দাও যাতে এই ধরনের বেয়াদবী আর না করে।’
জর্জ আব্রাহামের কথা শেষ হবার আগেই লোকটির ঘুষি গিয়ে পড়ল সান ওয়াকারের মুখে।
সান ওয়াকার ‘তেল ঢালা স্নিগ্ধ তনু তন্দ্রা রসে ভরা’ ধরনের ছেলে নয়। কিন্তু আঘাতটা এতটাই আকস্মিক হয়েছে যে, সতর্ক হবার বিন্দুমাত্র সুযোগও সে পায়নি।
লোকটির ঘুষি গিয়ে সান ওয়াকারের একেবারে মুখে আঘাত করেছিল। আহত ঠোট আবার ফেটে গিয়ে রক্ত বেরিয়ে এল ঝরঝর করে।
পড়তে গিয়ে আবার সোজা হয়ে দাঁড়াল সান ওয়াকার।
সান ওয়াকারের রক্তাক্ত মুখের দিকে তাকিয়ে জর্জ আব্রাহাম ক্রুর হেসে বলল, ‘মরার আগে এ ধরনের আরও বহু ডোজ আসবে। শত্রুর আরামদায়ক মৃত্যু হোয়াইট ঈগলের অভিধানে নেই। এখন ভেবে দেখ মৃত্যু সহজ, না শর্তগুলো সহজ। মৃত্যু পর্যন্ত ভাববার সুযোগ দেয়া হলো। এরা প্রতিদিনই আসবে। প্রতিদিনই তোমার দেহের উপর কাজ চলবে মৃত্যুকে এগিয়ে আনার জন্যে।’
বলে চলে যাবার জন্যে ঘুরে দাঁড়াল জর্জ আব্রাহাম।
জর্জের সাথে বেরিয়ে গেল গুন্ডা দু’জনও। কক্ষের দরজা বন্ধ হয়ে গেল।
সম্ভবত ভুল করে ওরা ঘর থেকে চেয়ার দু’টো বের করে নিয়ে যায়নি। সান ওয়াকার গিয়ে বসল চেয়ারে।
চেয়ারে গিয়ে বসতেই মনে পড়ল মেরী রোজ-এর কথা। তার কোন বিপদ হয়নি তো? পরক্ষণেই আবার ভাবল সে চীফ জাস্টিসের মেয়ে। তাকে অবশ্যই কেউ এমনভাবে ঘাঁটাবে না যা মার্কিন ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী ও প্রভাবশালী প্রধান বিচারপতিকে বিরক্ত করতে পারে। কি করছে মেরী রোজ? সে অবশ্যই জানতে পেরেছে সান ওয়াকারের ঘটনা। কিন্তু অবশ্যই জানতে পারেনি কারা তাকে কিডন্যাপ করেছে কোন কারণে। সান ওয়াকার নিশ্চিত এদের হাত থেকে তাকে উদ্ধার করার কেউ নেই। রেড ইন্ডিয়ানরা বিষয়টা জানতেই পারবে না। পুলিশ কিছু করলে? কিন্তু পুলিশের উপর তার কোন আস্থা নেই। ওদের নিষ্ক্রিয় করতে হোয়াইট ঈগলের মত সংগঠনের বেগ পেতে হবে না। চারদিকে হতাশার অন্ধকারের মধ্যেও দু’টি বিষয় আনন্দের সূর্য হয়ে তার সামনে এল। একটি মেরী রোজ-এর প্রেম, আরেকটি রেড ইন্ডিয়ানদের জাগরণ যা খুনী বর্ণবাদীদের আতংকিত করেছে।
‘রেড ইন্ডিয়ানরা আমেরিকান জাতিকে দ্বিধাবিভক্ত করছে’- জর্জ আব্রাহামের এই কথা মনে হতেই বিদ্রূপের একটা হাসি ফুটে উঠল সান ওয়াকারের মুখে। মনে মনে সে বলল রেড ইন্ডিয়ানরা তোমাদের চেয়ে বেশি আমেরিকান। ছিনিয়ে নেয়া অধিকার ফিরিয়ে চাওয়া আমেরিকানদের বিভক্ত করা নয়। বরং এই অবিচারের অবসান হলে আমেরিকানরা আরও সংহত হবে।
ঠোঁটের ব্যথায় তার চিন্তায় ছেদ পড়ল।
জামার আস্তিন দিয়ে ঠোঁট মোছার জন্যে হাতটা উপরে তুলল সান ওয়াকার।
তাকাল সে চাদর ছাড়া শুধু ফোম বিছানো খাটিয়ার দিকে। শোয়ার এটুকু আয়োজনকেই তার কাছে অমৃত মনে হচ্ছে। ক্লান্ত, বেদনা কাতর দেহ জুড়ে নেমে আসছে অবসাদ। তার কাছে এখন ঘুমের চেয়ে মূল্যবান কিছু দুনিয়াতে আছে বলে মনে হচ্ছে না। সে চেয়ার থেকে উঠে ধীরে ধীরে এগুলো খাটিয়ার দিকে।
কক্ষের দরজা খুলে যেতেই দু’জন স্টেনগানধারী দরজায় এসে দাঁড়াল।
তারপর দরজা দিয়ে প্রবেশ করল মধ্যবয়সী সুবেশধারী ভারী চেহারার একজন লোক। তার সাথে একজন যুবক। তাদের পেছনে পেছনে প্রবেশ করল আরও দু’জন স্টেনগানধারী।
আহমদ মুসা বলেই বোধহয় নিরাপত্তার এই বাড়তি ব্যবস্থা।
আহমদ মুসা উঠে বসেছিল বিছানায়।
স্টেনগানধারী দু’জন খাটের দু’পাশে গিয়ে দাঁড়াল।
সুবেশধারী মাঝ বয়সী লোকটি দৃঢ় পদক্ষেপে এসে আহমদ মুসার সামনে দাঁড়াল। বলল, ‘আমি ডেভিড গোল্ড ওয়াটার। আমি…..।’
ডেভিড গোল্ড ওয়াটারের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে আহমদ মুসা বলল, ‘হোয়াইট ঈগলের প্রধান।’
‘আপনি জানলেন কি করে?’
‘জানতে পেরেছি সানসালভাদর দ্বীপে থাকতেই।’
‘এখন আপনি কোথায়? সানসালভাদর দ্বীপে নেই এখন?’
‘আপনাকে এবং বন্দীখানা দেখে এখন মনে হচ্ছে আমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে।’
‘ধন্যবাদ আহমদ মুসা। আপনাকে ধন্যবাদ। এই দ্বিতীয় ধন্যবাদটা কেন দিলাম জানেন?’
আহমদ মুসা কোন জবাব দিল না। গোল্ড ওয়াটার নিজেই কথা বলল আবার। বলল, ‘দ্বিতীয় ধন্যবাদ এই কারণে যে আপনি হোয়াইট ঈগল-এর বন্দীখানাকে ধন্য করেছেন। আজ ক্লু ক্ল্যাক্স ক্ল্যান, সিনবেথ, ব্ল্যাক ক্রস, ফ্র, ইত্যাদি বিশ্ব বিখ্যাত সংগঠনগুলো আমাদের এ বন্দীখানার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।’
‘ওদের বন্দীখানাতেও ছিলাম।’
‘ছিলেন হয়তো, কিন্তু তখন এত সাড়া পড়েনি। এখন সবাই ছুটে আসছে এ বন্দীখানার দিকে।’
‘ওরা জানল কি করে?’
‘জানিয়েছি আমি ক্লু ক্ল্যাক্স ক্ল্যানের মি: বেনজামিলকে। উনিই জানিয়েছেন সবাইকে। এতে আমার ভালই হয়েছে।’
‘কি ভাল হয়েছে?’
হাসল ডেভিড গোল্ড ওয়াটার। বলল, ‘এতে দর কষাকষির সুবিধা হয়েছে।’
‘কিসের দর কষাকষি?’
আবার একটা ক্রুর হাসি ফুটে উঠল গোল্ড ওয়াটারের ঠোঁটে। বলল, ‘আপনাকে কে কত দামে কিনতে পারে, সেইটা। ইতিমধ্যেই বেনজামিল ১ বিলিয়ন ডলার দিতে চেয়েছে। কিন্তু আমি মনে করছি, এর চেয়ে অনেক বেশী দাম আমি পাব। দেখা যাচ্ছে সবাই দারুণ আগ্রহী। সবচেয়ে আগ্রহী দেখা যাচ্ছে ইসরাইলী গোয়েন্দা সংস্থা সিনবেথকে। আমি তার কাছে মূল্য চেয়েছি ৩ বিলিয়ন ডলার।’
‘ব্যবসায়ের সুন্দর সুযোগ পেয়েছেন।’
‘আপনার প্রতিক্রিয়া কি?’
‘আমার কোন সমস্যা নেই। সব বন্দীখানা বন্দীখানাই। শত্রুর মধ্যে বড় ছোট আছে, কিন্তু ভাল-মন্দ নেই।’
‘না ভাল-মন্দ আছে। দেখুন, আমরা আপনাকে মারছি না কিংবা মেরেও ফেলছি না। বিক্রি করছি মাত্র। আমাদের উদ্যোগটা নির্দোষই বলা যায়।’ বলল গোল্ড ওয়াটার মুখে ক্রুর হাসি টেনে।
বলেই একটু থামল। তারপর আবার শুরু করল, ‘সে যাক, ‘কাজের কথায় আসি। কখন বিক্রি হয়ে যান, ঠিক তো নেই, আমাদের কয়েকটা কথা জানা দরকার।’ বলে একটু থামল।
আহমদ মুসা কোন জবাব দিল না।
গোল্ড ওয়াটারই আবার বলল, ‘আপনি আমাদের দু’শরও বেশী লোক হত্যা করেছেন। কিন্তু এটা আমার কাছে কোন বড় বিষয় নয়?’
‘কেন?’
‘এই কারণে যে আহমদ মুসা প্রতিপক্ষ যেখানে, সেখানে দু’শো, তিনশ, লোক গায়েব হওয়া বা নিহত হওয়া বিস্ময়ের ছিল না। আমাদের কাছে বড় বিষয় হলো, আমাদের লোকগুলোকে কি করে গায়েব করলেন?’
‘না এটা বলবো না। শত্রুকে কৌশল জানানো যাবে না।’
‘একজন বন্দীর মুখে এই কথা মানায় না। জানেন আমরা কি করতে পারি?’
‘সব জেনেই বলছি।’
‘কতটুকু জানেন আপনি? বলুন তো এই মুহূর্তে আমি কি করতে পারি?’
‘আপনার হাতে ইলেকট্রনিক্যাল যে হ্যান্ড ডাইরী দেখছি, ওটা হ্যান্ড ডাইরী নয়। অত্যন্ত পাওয়ারফুল বিদ্যুত জেনারেটর ওটা। ডাইরী ওপেনের যে ‘কী’টা সামনে দেখা যাচ্ছে ওটায় চাপ দিলেই দু’পাশ থেকে দু’টো বৈদ্যুতিক তার বেরিয়ে আসবে। ঐ তারের মাথায় মানুষের চামড়া কামড়ে ধরার মত প্লাগ আছে। প্লাগ দু’টো কারো দেহে আটকে দিয়ে সুইট টিপলেই প্রবাহমান বিদ্যুতের যন্ত্রণাদায়ক অব্যাহত চাবুকে সে বাঁদর নাচ শুরু করে দেবে।’
বিস্ময়ে মুখ হা হয়ে গেছে গোল্ড ওয়াটারের। কিছুক্ষণ সে কথা বলতেই যেন ভুলে গেল।
অনেকক্ষণ পর বিস্মিত কণ্ঠে সে বলল, ‘ইলেকট্রনিক্যাল যে ডাটা ডায়েরী আছে, তার সাথে এর সামান্য পার্থক্যও নেই। একে আপনি ডায়েরী না ভেবে অস্ত্র ভাবলেন কি করে?’
‘খুবই সোজা হিসাব। ঐ ধরনের কোন ডাটা ডায়েরী নিয়ে এই বন্দীখানায় আমার কাছে আপনার আসার কোন যৌক্তিকতা নেই। সুতরাং যেটা এনেছেন সেটা একজন বন্দীকে ভয় দেখাবার মত কোন জিনিসই হবে।’
গোল্ড ওয়াটারের চোখে-মুখে সপ্রশংস ভাব ফুটে উঠল। বলল সে পরক্ষণেই, ‘ধন্যবাদ, আরেকটা প্রশ্নের জবাব দিন। এই যন্ত্রটা মাত্র গতকাল বাজারে এসেছে এক আমেরিকান কোম্পানীর তরফ থেকে। সুতরাং এই যন্ত্রটা কোনভাবেই আপনি দেখেননি, জানেন না, কিন্তু ঐ নিখুঁত বিবরণ দিলেন কি করে?’
‘দেখিনি বটে, জানি না একথা টিক নয়। আজ থেকে ৬মাস আগে ‘ইনভেনশন’ ম্যাগাজিনের একটি সংখ্যায় এই অস্ত্রের সাইজ এবং বিবরণ পড়েছিলাম।’
হাসল গোল্ড ওয়াটার। বলল, ‘মিঃ আহমদ মুসা, সত্যি আপনি এক বিস্ময়কর শত্রু। আপনি যদি বন্ধু হতেন, তাহলে কতই না ভাল হতো!’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘আপনি আমার শত্রু কিন্তু আমি আপনার শত্রু নই। আপনি বা আপনারা মুসলমান বা অশ্বেতাংগদের উপর বৈরিতা ছাড়ুন, আপনারাও আমাদের বন্ধু হয়ে যাবেন।’
‘বন্ধুত্বের চেয়ে এখন আমাদের কাছে কাজ বড়। কাজের কথা বলুন।’
‘বলেছি, যে তথ্য মুসলমান ও কৃষ্ণাংগদের বিরুদ্ধে যাবে, সে তথ্য আপনারা আমার কাছ থেকে পাবেন না।’
‘সে দেখা যাবে। এখন বলুন, ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের ঐসব গোপন তথ্য FWTV টেলিভেশন নেটওয়ার্ক এবং WNA নিউজ এজেন্সীতে গেল কি করে?’
‘আমি পাঠিয়েছি।’
‘আপনি পাঠিয়েছেন?’ চোখ কপালে তুলে প্রশ্ন করল গোল্ড ওয়াটার।
প্রশ্ন করে মুহুর্তকাল থেমেই আবার প্রশ্ন করল, ‘আপনি পাঠালেই তা ওরা বিশ্বাস করবে কেন?’
‘অনেক সময় কে পাঠাল তা বড় বিষয় হয় না, কি পাঠানো হয়েছে তাই বড় বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। আমাকে নয় আমার পাঠানো দলিলকে তারা বিশ্বাস করেছে।’
‘আহমদ মুসা আপনি যে অপরাধ করেছেন, কয়েকবার আপনাকে হত্যা করলেও তার শাস্তি সম্পূর্ণ হবে না। কিন্তু আমাদের ভাগ্য মন্দ।’
‘কেন?’
‘উপযুক্ত মূল্যে আমরা আপনাকে বিক্রি করছি। যারা টাকা দিয়ে কিনছে, তাদের এখন হক হয়ে গেছে আপনাকে বানানো তারা যেমন চায়।’
‘তাহলে আপনাদের জন্যে দুঃখেরই।’
‘লাভের তুলনাই তা কিছুই নয়। যে কয় বিলিয়ন ডলার আমরা পাচ্ছি আপনাকে বিক্রি করে, তা আমাদের আন্দোলনের চেহারা পাল্টে দেবে। সুতরাং আপনার প্রতি আমরা খুশীই বলতে পারেন।’
‘খুশী থাকার কোন চিহ্ন দেখছি না।’
‘কেন এত সুন্দর বন্দীখানা, এত সুন্দর বিছানা। আমাদের বন্দীখানার কোন কক্ষেই এ ব্যবস্থা নেই।’
বলে গোল্ড ওয়াটার হাতের ইলেকট্রনিক ডায়েরীটা পকেটে রেখে পকেট থেকে যা বের করল তা একটা ছোট্ট ইলেকট্রনিক ক্যালকুলেটরের মত জিনিস। তাতে বড় একটা স্ক্রিন এবং ছোট্ট একটা কী-বোর্ড।
সে একটা কী-বোর্ডে চাপ দিয়ে জিনিসটা আহমদ মুসার দিকে তুলে ধরল।
জিনিসটা একটা মিনি টেলিভিশন।
আহমদ মুসা টেলিভিশনটা হাতে নিয়ে স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে দেখল, বন্দীখানার কক্ষগুলো একের পর এক পর্দায় ভেসে উঠছে।
কক্ষগুলোর সবগুলোই একটি করে সংকীর্ণ সেল। লোহার খাটিয়ায় নগ্ন ফোম বিছানো। তার এক পাশে গোটানো খসখসে কম্বল।
একটা কক্ষে গিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়াল টেলিভিশনের ফোকাস।
আহমদ মুসার দৃষ্টি আছড়ে পড়ল আহত রক্তাক্ত একজন মানুষের উপর। শুয়ে আছে সে খাটিয়ার উপর। বন্দীটি একজন রেড ইন্ডিয়ান তরুণ।
‘কে এই বন্দীটি?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘দেখেছেন তো কি অবস্থায় সে আছে, আর কি অবস্থায় আপনি আছেন?’
আহমদ মুসা তার কথার দিকে কান না দিয়ে আবার জিজ্ঞেস করল, ‘কে এই বন্দি ছেলেটি?’
‘সে সান ওয়াকার। তার অনেক অপরাধ।’
‘চুরি, ডাকাতি, হাইজ্যাক, খুন ইত্যাদি নিশ্চয় নয়।’
‘তার চেয়েও বড় অপরাধ। সে ‘আমেরিকান ইন্ডিয়ানস মুভমেন্ট’ (AIM) – এর একেবারে ভেতরের লোক। গত মাসে কাহোকিয়াতে ইন্ডিয়ানদের যে সম্মেলন হয়েছে, সে সম্মেলনের যে সাংঘাতিক দাবীনামা তার ড্রাফট এই ছেলেটিই করেছে। আরও অপরাধ তার আছে। রেড ইন্ডিয়ানদের একটা গোপন রিজিওনাল কাউন্সিল গঠিত হয়েছে। সদস্যদের নাম তার কাছ থেকে আমরা চেয়েছিলাম, নামগুলো সে দিলে তাকে দেশ ত্যাগের একটা সুযোগ দিতাম, ছেলেটি খুব প্রতিভাবান শুধু এই বিবেচনায়।’
‘কেমন প্রতিভাবান?’
‘সে স্টুডেন্ট নোবল প্রাইজ পেয়েছে বিজ্ঞানে, এ বছর।’
‘এমন একটা প্রতিভাকে এভাবে বন্দী করে রেখেছেন?’
‘আমরা তো একজন বিজ্ঞানী ছাত্রকে বন্দী করে রাখিনি, আমরা বন্দী করে রেখেছি শয়তান রেড ইন্ডিয়ানদের এক শয়তান বাচ্চাকে। তাছাড়া সে বাইরে থাকলে সে একটা শ্বেতাংগ বিজ্ঞান প্রতিভাকে নষ্ট করত।’
‘কেমন?’
‘এরই ক্লাসমেট মেরী রোজ। সে স্টুডেন্ট নোবল প্রাইজ পায়নি বটে, কিন্তু উদীয়মান একটা বিজ্ঞান প্রতিভা। এ পর্যন্ত সে সকল পরীক্ষায় প্রথম হয়ে এসেছে। তার সাথে এ সম্প্রতি ফষ্টিনষ্টি শুরু করেছে।’
‘আপনারা ছেলেটিকে মেরে ফেলবেন?’
‘আমাদের শর্ত মানতে সে অস্বীকার করেছে, সুতরাং মৃত্যু তার অবধারিত।’
‘একটা বিরল বিজ্ঞান প্রতিভাকে আপনারা এভাবে ধ্বংস করবেন?’
‘ও রেড ইন্ডিয়ানদের বিজ্ঞান প্রতিভা, আমাদের নয়। তার প্রতিভা আমাদের বিরুদ্ধে যেতে শুরু করেছে, সে ভবিষ্যতে একজন প্রতিভাবান শত্রু হয়ে দাঁড়াবে। সুতরাং শুরুতেই শেষ হলে আমাদের সবার ভাল।’
‘কিন্তু আপনাদের এই কথা তো মার্কিন সরকার ও মার্কিন জনগণের নয়।’
‘হোয়াইট ঈগলই মার্কিন সরকার এবং মার্কিন জনগণ। এর বাইরে কিছুই নেই।’
‘কিন্তু এসব কথা একদিন প্রকাশ হবেই।’
‘হোয়াইট ঈগল-এর হোয়াইট আমেরিকা কাউকেই তোয়াক্কা করে না।’
‘মার্কিন জনগণকেও তোয়াক্কা করেন না?’
‘মার্কিন জনগণ আমাদের সাথে আছে।’
‘তাহলে আপনাদের আন্দোলনে এত রাখ-ঢাক কেন? গোপন কেন?’
‘গোপন অন্য কারণে। বাইরের প্রতিক্রিয়া এড়িয়ে আমরা লক্ষ্যে পৌছুতে চাই।’
কথা শেষ করেই গোল্ড ওয়াটার বলে উঠল, ‘এত কথা দিয়ে আপনার কাজ কি?’
বলে একটু থামল। শুরু করল আবার, ‘ভদ্রভাবে যে বিষয় দু’টো জানতে চাইলাম। ভেবে দেখবেন। আবার আসব। আর এদের সাথে ব্যবসাটা আমাদের না হলে আমাদের অন্যভাবেও আসতে হতে পারে।’
কথা শেষ করে আহমদ মুসার হাত থেকে পকেট টিভি ছো মেরে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসার জন্যে ঘুরে দাঁড়াল।
আহমদ মুসা মনে মনে হাসল। মনে মনেই বলল, ‘ধন্যবাদ টিভি যন্ত্রটি হাতে দেবার জন্যে।’
টিভি যন্ত্রটি ছিল বন্দীখানাসহ গোটা অফিস বিল্ডিং-এর সর্ট সার্কিট টিভির মনিটর।
টিভি মনিটরিং ‘কী’ প্যানেলের প্রত্যেকটি ‘কী’-এর কোনটি ‘প্রিজন রুমস’, কোনটি ‘অফিস রুমস’, কোনটি ‘করিডোরস’, কোনটি ‘এক্সিটস’ বা বের হবার পথ, ইত্যাদির নির্দেশক।
আহমদ মুসা গোল্ড ওয়াটারের সাথে কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে প্যানেলের ‘কী’গুলোর টিপে প্রয়োজনীয় জায়গাগুলো দেখে নিচ্ছিল। সে প্রথমেই দেখেছে করিডোর, তারপর বের হবার পথ। বের হবার পথ দেখল সে দুটি। একটা সামনের গেট। আরেকটা পথ পেছনে বন্দীখানার একটা করিডোর থেকে সুড়ঙ্গ সিঁড়ি ধরে উপরে উঠে গেছে। কিন্তু সিঁড়ি মুখ বন্ধ। সিঁড়ি মুখের বাইরের দিকটাও দেখা গেল। সেটা এক তলার ছাদ।
সবশেষে আহমদ মুসা দেখছিল অফিস রুমগুলো। এই সময়ই টিভি মনিটরটি আহমদ মুসার হাত থেকে ছো মেরে নিয়ে নিল। গোল্ড ওয়াটার বেরিয়ে যাবার পর প্রহরীরা বেরিয়ে যেতেই দরজা বন্ধ হয়ে গেল। আহমদ মুসা লক্ষ্য করল দরজা ভেতর থেকে খোলার কোন ব্যবস্থা নেই।
এই হতাশার মধ্যেও আহমদ মুসা আনন্দিত হলো হোয়াইট ঈগলের এই ঘাটি সম্পর্কে একটা ধারণা লাভ করে।
ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন এন্ড লিগ্যাল এ্যাসিস্ট্যান্ট ব্যুরো (CI & LAB) এর সুসজ্জিত ড্রইং রুমে বসে আছে মেরী রোজ এবং শিলা সুসান। তারা অপেক্ষা করছে তাদের ডাক পড়ার।
| | | Next → | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »