২৭. মিসিসিপির তীরে

চ্যাপ্টার

দরজার বাইরে কথা শুনতে পেল আহমদ মুসা। কথা বলছে গোল্ড ওয়াটার। বলছে, ‘মিঃ আইজ্যাক শ্যারণ সেদিনের কথা ভেবে আজ আপনার কেমন লাগছে বলুন তো?’
‘কি বলল। সেদিন চোখের সামনে তেলআবিবের পতন শুধু নয়, নিজেকে বাঁচাবার জন্যে প্রাণ নিয়ে পালিয়েছিলাম তেলআবিব থেকে।
সে বেদনার ক্ষতটা আজ দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছে।’
‘মিঃ আইজ্যাক শ্যারণ!’ আহমদ মুসা ভাবল, এ নিশ্চয় সেই জেনারেল আইজ্যাক শ্যারণ? তেলআবিবে সাইমুমের অভ্যুত্থানকালে এ ছিল ইসরাইলী গোয়েব্দা বাহিনীর সহকারী প্রধান। অন্যান্যদের সাথে গোয়েন্দা বাহিনীর চীফও সেদিন মারা যায়। সহকারী চীফ জেনারেল শ্যারণ সেদিন পালিয়ে বাঁচে। পালিয়ে বাঁচা এই আইজ্যাক শ্যারণই আজ আন্তর্জাতিক ইহুদী গোয়েন্দা চক্রের প্রধান। দ্রুত চিন্তা ঘুর পাক খাচ্ছে আহমদ মুসার মাথায়।
এসব ভাবতে ভাবতে আহমদ মুসার মনে প্রশ্ন জাগল, জেনারেল আইজ্যাক শ্যারণ আজ এখানে কেন? তাহলে কি তাঁকে বিক্রির ব্যাপারটা একদম চূড়ান্ত হয়ে গেছে এবং আজ তাঁকে দেলিভারি নিতে এসেছে।
কথাটা মনে হবার সাথে সাথেই আহমদ মুসার গোটা দেহে একটা বিদ্যুr চমক খেলে গেল।
মন বলে উঠল মানুষ কেনা-বেচার এই ব্যাবসাকে সফল হতে দেয়া যাবে না। কিন্তু কিভাবে? নিশ্চয় ওরা আট-ঘাট বেঁধেই আসছে।
এর আগে দু’বার স্থানান্তরের সময় সংজ্ঞাহীন করেছিল।
এবার তারা কি করবে?
আহমার মুসা ভাবল, তার সম্পর্কে গোল্ড ওয়াটার ও তার লোকদের মাঝে যে সুধারনা সৃষ্টি হয়েছে, সেটা তার জন্যে একটা পুঁজি।
এখানে বন্দী থাকার দিনগুলোতে আহমদ মুসা একজন অনুগত গোবেচারা বন্দীর ভূমিকা পালন করেছে। তার আচরণ দেখে গোল্ড ওয়াটার একদিন বলেছে, ‘আপনার সম্পর্কে যা শুনেছি, তার কিছুই তো আপনার মধ্যে দেখছি না।’
আহমদ মুসা বলেছে, ‘কি শুনেছিলেন? ভয়ানক ক্রিমিনাল চরিত্রের?’
‘না। শুনেছি আপনি বাঘের মত ক্ষীপ্র, সিংহের মত সাহসি এবং শৃগালের মত ধূর্ত।’
আহমদ মুসা হেসেছে। বলেছে, ‘ওদের তেজ বনে। আমার মত খাঁচায় বন্দি হবার পরও ওরা আমার মতই গো’ বেচারা।’
এইভাবে আহমদ মুসা সম্পর্কে ওদের একটা ধরনা হয়েছে যে, সে ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিয়েছে। সম্ভবত এই কারনেই আহমদ মুসার উপর ওদের পাহারাদারী অনেক শিথিল। আহমদ মুসা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করল ওদের ঢিলেঢালা ভাব অন্যান্যা দিনের মত আজও যেন থাকে।
আহমদ মুসা শুয়েছিল। শুয়েই থাকল। দরজা খুলে গেল।
দরজা খুলে যাবার পর দরজায় এসে দাঁড়াল দু’জন প্রহরী। তাদের হাতে স্টেনগান। স্টেনগানের ব্যারেল নিম্নমুখী।
তারপর প্রথমেই দরজা দিয়ে প্রবেশ করল গোল্ড ওয়াটার। তার পেছনে পেছেনে লাল তামাটে রঙের দীর্ঘকায় একজন লোক। আহমদ মুসা বুঝল এই লোকটিই গোয়েন্দা প্রধান জেনারেল আইজ্যাক শ্যারণ।
তাদের পেছনে একটা কফিন ধরাধরি করে নিয়ে এল আরও দু’জন লোক। তাদের কাঁধে স্টেনগান ঝুলানো। সে লোক দু’টি লাল তামাটে রঙের। এরা ইহুদী জেনারেলের সাথে এসেছে।
আহমদ মুসা বুঝল, আগের মতই সংজ্ঞাহীন করে এই কফিনে পুরে তাঁকে পাচার করা হবে ইহুদীদের হাতে।
ওদের ঘরে ঢুকতে দেখে উঠল আহমদ মুসা শোয়া থেকে। ঠিক দরজা মুখোমুখি হয়ে পা ঝুলিয়ে বসল খাটিয়ায়।
কফিনটি এনে রাখল ঠিক মাঝখানে। বহনকারী লোক দুজন তার পাঁশেই দাঁড়াল।
ঘরে ঢুকেই জেনারেল জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ।
জেনারেল আইজ্যাক শ্যারনের দিকে তাকিয়ে ঠোঁটে হাসি টেনে বলল, ‘জেনারেল, মনে হচ্ছে তুমি শিকারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। দরকার নেই। শিকার হাতের মুঠোয়। আর কিছুক্ষণ পর চলে যাবে তোমাদের খাঁচায়।’
‘ধন্যাবাদ গোল্ড ওয়াটার, শয়তানের বাচ্চাকে অবশেষে হাতে পাওয়া গেল। মাথায় আমাদের বাড়ি দিয়েছে এই শয়তান।’
‘ঠিক আছে। এর মাথায় বাড়ি দিয়ে তার শোধ তুলে নিবেন।’ বলল গোল্ড ওয়াটার।
‘এর এক মাথা ভেঙ্গে লাভ কি। ভাঙতে হবে ওদের গোষ্ঠী শুদ্ধ মাথা। সে সুযোগ এখন হাতের মুঠোয়।‘
‘কিভাবে?’
‘এই শয়তানের বাচ্চাকে দেখিয়ে সব শয়তানের বাচ্চাকে খোঁয়াড়ে তুলব। তারপর শুধু ওদের মাথা নয়, ওদের দেশ ভাঙ্গারও সুযোগ আসবে।’
‘এ ধরনের স্বপ্ন আপনার কতবার ভংগ হয়েছে জেনারেল?’
বলল আহমদ মুসা খুব শান্ত কণ্ঠে।
জেনারেল আইজ্যাক শ্যারণ পায়চারী করছিল আর কথা বলছিল। সে আহমদ মুসার সামনে এসে স্থির হয়ে দাঁড়াল। তার অগ্নি দৃষ্টি আহমদ মুসার উপর নিবদ্ব। পকেট থেকে সে বের করল রিভালবার। বলল, ‘শয়তানের বাচ্চা সে সব স্বপ্ন ভঙ্গের জন্যে তুই দায়ী।’
বলে সে রিভারবারের বাঁট দিয়ে আহমদ মুসার মাথায় আঘাত করতে গিয়েও থেমে গেল। তাকাল সে স্টেনগান কাঁধে ঝুলানো কফিনের কাছে দাঁড়ানো লোক দুজনের দিকে। বলল, ‘আর দেরী নয়, তোমাদের কাজ শুরু কর। শয়তানের বাচ্চাকে দেখব আমাদের কব্জায় নিয়ে গিয়ে।’
জেনারেল আইজ্যাক শ্যারণ বলার সাথে সাথে দু’জনের একজন কোটের পকেট থেকে ছোট বাঁট ও লম্বা ব্যারেল ওয়ালা স্প্রে গানের মত একটা জিনিস বের করল। দেখেই আহমদ মুসা বুঝল, ওটা স্প্রে গান নয়, কারণ স্প্রে গান হলে সবাই তার কবলে পড়বে।
নিশ্চয় ওটা এ্যানেসথেসিয়া গান। যার বুলেট শুধু চামড়া ভেদ করে এবং বুলেটের এ্যানেসথেসিয়া বিষ সঙ্গে সঙ্গেই মানুষকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। একজন ইহুদী অতি সম্প্রতি এটা আবিস্কার করেছে।
লোকটি এ্যানেসথেসিয়া গান হাতে নিয়েই তাক করল আহমদ মুসাকে।
জেনারেল শ্যারণ তখনও তাকিয়ে আছে লোকটির দিকে। তার হাতে রিভারবাল। বাঁট দিয়ে আহমদ মুসাকে আঘাত করার জন্যে যেভাবে সে রিভারবাল ধরেছিল, সেভাবেই ধরে আছে। দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে আহমদ মুসা। এ্যানেসথেসিয়া বুলেট তাঁকে আঘাত হানার পর তার আর কোন সুযোগ থাকবে না।
আহমদ মুসা বসা অবস্থা থেকেই ঝাঁপিয়ে পড়ল জেনারেল আইজ্যাক শ্যারণ-এর উপর।
বাঁট ধরে কেড়ে নিল তার হাত থেকে রিভারবাল। সেই সাথেই তার পেছনে গিয়ে বাম হাত দিয়ে সাঁড়াশির মত পেছিয়ে ধরল তার গলা। ডান হাতের রিভারবাল চেপে ধরল তার মাথায়। এবং চাপা কণ্ঠে চিৎকার করে বলল, ‘যার কাছে যে রিভারবাল আছে, দরজার দিকে ফেলে দাও। মুহূর্ত দেরী করলে গুড়ো হয়ে যাবে জেনারেল শ্যারণের মাথা।’
বলে আহমদ মুসা জেনারেল শ্যারণকে টেনে পশ্চিম দেয়ালের দিকে সরে গেল।
আহমদ মুসা নির্দেশ দেয়ার সাথে সাথে কফিনের পাঁশে দাঁড়ানো লোক দু’জন তাদের কাঁধের স্টেনগান ছুরে দিয়েছে দরজার দিকে।
গোল্ড ওয়াটারের চোখ দু’টি ছানাবড়া। হতবুদ্ধি তার চেহারা। সেও ধীরে ধীরে তার রিভারবাল ছুড়ে দিল দরজার দিকে।
দরজায় দাঁড়ানো দু’জন স্টেনগানধারী তাদের স্টেনগান তখনও ফেলেনি। কিংকর্তব্যবিমূঢ় ভাবে তারা দাঁড়িয়ে।
গোল্ড ওয়াটার ওদেরকে স্টেনগান ফেলে দিয়ে ভিতরে ঢুকতে বল। অনুচ্চ, কিন্তু কঠোর কণ্ঠে বলল আহমদ মুসা।
গোল্ড ওয়াটার ওদেরকে নির্দেশ দিল।
ওরা হাতের স্টেনগান করিডোরের উপর ফেলে দিয়ে একপা দু’পা করে ঘরে প্রবেশ করল।
আহমদ মুসা জেনারেল শ্যারণকে সামনে রেখে তাঁকে টেনে নিয়ে পিছু হেঁটে দরজার বাইরে চলে এল।আসার সময় দরজার উপর ছড়িয়ে থাকা স্টেনগান ও রিভারবাল পা দিয়ে টেনে নিল দরজার বাইরে।
দরজার বাইরে এসে আহমদ মুসা বাম হাত সরিয়ে নিল জেনারেল শ্যারণের গলা থেকে। কিন্তু তার হাতের রিভারবাল জেনারেল শ্যারণের মাথা স্পর্শ করে থাকল স্থির ভাবে। বলল সে, ‘ তোমরা কেউ সামান্য নড়াচড়া করলে ছাতু হয়ে যাবে জেনারেল শ্যারণের মাথা।
বলে আহমদ মুসা ডোর লকের কী বোর্ডের দিকে তাকাল। দেখল অটো লক সিস্টেম। বন্ধ করার জন্যে একটা লাল বোতাম চাপতে হয় মাত্র।
আহমদ মুসা বাম হাতে লাল বোতাম চেপে ধরে ডান হাত ও হাটু দিয়ে ধাক্কা মেরে জেনারেল শ্যারণ কে ঢুকিয়ে দিল ঘরে। সঙ্গে সঙ্গেই বন্ধ হয়ে গেল দরজা।
দরজা বন্ধ হবার প্রায় সংগে সংগেই আহমদ মুসার কানে এল চারদিক থেকে এ্যালারমের শব্দ।
সচকিত হয়ে উঠল আহমদ মুসা। বুঝল, ঘরে বন্ধ গোল্ড ওয়াটার রিমোর্ট-এর মাধ্যমে এ্যালার্ম বাজিয়ে দিয়েছে। তার মানে এখন যে যেখানে আছে সেখান থেকে ছুটে আসবে। নিশ্চয় সে এই কৌশলে সবাইকে নির্দেশও দিতে পারবে কি ঘটেছে এবং কি করতে হবে।
তাহলে ওদের ঘরে বন্দী করে লাভ খুব একটা হলো না- এই কথা ভাবতে ভাবতে আহমদ মুসা চারদিকে তাকিয়ে সর্ট সার্কিট টিভি স্ক্রীনে দেখে পিছন দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিল।
ছুটল সে করিডোর ধরে পশ্চিম দিকে।
একটা দরজার পাশ দিয়ে যাবার সময় আহমদ মুসা পুরুষ কণ্ঠের আর্ত চিৎকার শুনতে পেল। হঠাৎ তার মনে পড়ল গোল্ড ওয়াটারের সর্ট সার্কিট টিভি স্ক্রীনে দেখা এবং তার কাছ থেকে শোনা সান ওয়াকারের কথা।
এ কি সান ওয়াকারের চিৎকার?
থমকে দাঁড়াল। তাকাল দরজার দিকে। এই দরজার ভেতর থেকেই আসছে চিৎকারটা।
সে ভেতরে প্রবেশ করবে কিনা, ভাবল আহমদ মুসা।
অবস্থার নাজুকতার দিক বিচার করার এবং এক মুহূর্ত নষ্ট করার অবকাশ নেই। সুতরাং কোন কিছুর দিকে না তাকিয়ে প্রথম তাকে শুত্রু পুরি থেকে বের হওয়া দরকার।
কিন্তু পরক্ষণেই কোরআন শরীফের একটা আয়াতের কথা তার মনে পড়ল। যাতে মযলুম মানুষের ফরিয়াদে সাড়া দেয়াকে অপরিহার্য করা হয়েছে।
আহমদ মুসা দাঁড়াল দরজার দিকে।
এখানেও আলফাবেটিক্যাল লক। আহমদ মুসা রিভারবাল পকেটে রেখে ডান হাতে স্টেনগান নিয়ে বাম হাত দিয়ে লক-এর কি-বোর্ডে টাইপ করল ‘হোয়াইট ঈগল’
দরজা খুলে গেল সংগে সংগে।
ভেতরে প্রবেশ করে আহমদ মুসা উদ্বেগের সাথে দেখল, সান ওয়াকার ছাদের সাথে উবু করে টাঙ্গানো। চোখ-মুখ রক্তের মত লাল। চোখ দুটি যেন তার বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। নাক দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে।
আহমদ মুসা সান ওয়াকারকে এক হাতে ধরে অন্য হাতে গুলি করল চামড়ার দড়িটায়।
সান ওয়াকার গড়িয়ে পড়ল আহমদ মুসার হাতে। দুর্বল কণ্ঠে বলল সান ওয়াকার, পানি, পানি চাই।
আহমদ মুসা ঘরে চারদিকে চাইল। পানি কোথাও নেই। বলল, একটু ধৈর্য ধরতে হবে সান ওয়াকার। এখানে থেকে না বেরুলে পানি পাওয়া যাবে না।
সান ওয়াকারের দাঁড়াবার শক্তি নেই আহমদ মুসা তাকে কাঁধে তুলে নিল। বাম হাতে তাকে ধরে রেখে ডান হাতে স্টেনগান বাগিয়ে কক্ষ থেকে বেরুচ্ছিল। পূর্ব দিক থেকে কতকগুলো। পায়ের শব্দ ছুটে আসার শব্দে আহমদ মুসা থমকে দাঁড়াল। উঁকি দিয়ে দেখল, স্টেনগান বাগিয়া ছুটে আসা চারজন দাঁড়াল আহমদ মুসার বন্দিখানার দরজায়, যেখানে এখন বন্দী আছে গোল্ড ওয়াটার, জেনারেল শ্যারণ এবং অন্যান্যরা।
ওরা দরজা খুলতে যাচ্ছে।
ওদের সমস্ত মনোযোগ দরজার দিকে।
আহমদ মুসা বাম পা করিডোরে নামিয়ে পূর্বমুখী হয়ে স্টেনগান পাঁজরে চেপে ডান হাতে ট্রিগার টিপল স্টেনগানের।
ওদের দু’জন শেষ মুহূর্তে দেখতে পেয়েছিল। স্টেনগান ঘুরিয়েও নিয়েছিল ওরা। কিন্তু ততক্ষণে আহমদ মুসার স্টেনগানের গুলীর ঝাঁক ওদের ঘিরে ধরেছে।
আহমদ মুসা গুলী করেই আবার ছুটল করিডোর ধরে পশ্চিম দিকে বাইরে বেরুবার পেছনের দরজা লক্ষে।
করিডোরের শেষ মাথাটা দেখা যাছে আরও কিছুটা পশ্চিমে।
দক্ষিণ দিকে চলে যাওয়া একটা শাখা। করিডোরের মুখে তখন সে।
বেশ পেছন থেকে একটা কণ্ঠ ভেসে এল ‘ঐ যে যায়।
শুনেই আহমদ মুসা পশ্চিমমুখী যে ধামটা টা আর না ফেলে নিজের দেহটাকে কাত করে ছুড়ে দিল দক্ষিণের করিডোরে।
ঠিক সে সময়েই এক ঝাঁক গুলী চলে গেল করিডোর দিকে। তারা দাঁড়িয়ে থাকলে তাদের দু’জনের দেহটাই ঝাঁঝরা হয়ে যেত।
আহমদ মুসা পড়ে যাবার পর সান ওয়াকারের দেহটা ছিটকে গিয়েছিল তার উপর থেক।
আহমদ মুসার বাম কপালটা ঠুকে গিয়েছিল করিডোরের মেঝের সাথে। ছিঁড়ে গিয়েছিল কপাল। রক্ত নেমে এসেছিল কপাল থেকে।
ব্যাথা সামলাবার জন্যে আহমদ মুসা বাম হাতে কপালটা চেপে ধরে পড়ে যাবার সংগে সংগেই আবার উঠে দাঁড়াল। দ্রুত এগিয়ে দেয়ালের আড়ালে দাঁড়িয়ে উঁকি দিল পূর্ব-পশ্চিম করিডোরের দিকে। দেখল ছুটে আসছে তিনজন স্টেনগান বাগিয়ে। মাঝে মাঝে গুলী করছে।
আহমদ মুসা স্টেনগান ঘুরিয়ে নিল ওদের দিকে। অপেক্ষা করল ওদের গুলীর বিরতির সময়টুকুর জন্যে।
সময়টা আসতেই আহমদ মুসা স্টেনগানের মাথা দেয়ালের আড়ালের থেকে বের করে নিজেও কিছুটা এগিয়ে ট্রিগার টিপল স্টেনগানের।
ওদের আড়াল নেবার কোন আশ্রয় ছিল না। অসহায়ভাবে একঝাক গুলীর শিকার হল তিনজনই।
আহমদ মুসা পশ্চিমমুখী করিডোরে আর ফিরে না গিয়ে দক্ষিণের করিডরে ধরে এগুনোর সিদ্ধান্ত নিল। তার মনে পড়ল আঁকা বাঁকা করিডোরের শেষ প্রান্তে পেছনের দরজা দেখেছিল সে গোল্ড ওয়াটারের মিনি টিভি স্ক্রীনে।
উঠে দাঁড়িয়েছিল সান ওয়াকার।
আহমদ মুসা তাকে কাঁধে তুলে নিয়ে গেল।
ধন্যবাদ। কষ্ট হলেও পারব হাঁটতে। বলল সান ওয়াকার।
ধন্যবাদ সান ওয়াকার। চল পেছনের দরজা আমাদের খুজে বের করতে হবে। পালানোর এটাই হবে সহজ পথ।
বলে আহমদ মুসা সান ওয়াকারের একটা হাত ধরে দ্রুত এগুলো দক্ষিণ দিকে।
সান ওয়াকার আহমদ মুসার হাতের উপর শরীরের অনেকখানি ভার ন্যাস্ত করে চলতে লাগল আহমদ মুসার সাথে।
একটু এগিয়ে করিডর পশ্চিম দিকে মোড় নিয়েছে।
পশ্চিম দিকে চলল আহমদ মুসা। কিন্তু কয়েকগজ এগিয়ে সামনে তাকিয়ে হতাশা ও উদবগে ছেয়ে গেল তার মন। করিডোরের সামনে একটা ঘরের দরজা গিয়ে শেষ হয়েছে। সে চায় উপরে উঠার সিঁড়ি দরজা দিয়ে সে কি করবে।
থমকে দাঁড়াল আহমদ মুসা।
ভাবল পেছনে ফিরে আবার পশ্চিমমুখী সেই করিডরে ফিরে যাবে নাকি!
এসময় আহমদ মুসা পিছনে ফেলে আসা করিডরে গুলীর শব্দ অনেকগুলো পায়ের শব্দ শুনতে পেল। পিছনে ফেরার কোন উপায় নাই।
সামনেই তাকে এগুতে হবে। ভাগ্যই যেন তাকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ঠেলে নিয়ে চলছে।
দ্রুত এগিয়ে আহমদ মুসা ঘরটির দরজায় দাঁড়াল। এখানেও সেই আলফাবেটিক্যাল লক।
লকের কী-বোর্ড নক করতে করতে আহমদ মুসা ভাবল, আবার সে নিজ হাতে আরেক বন্দীখানায় প্রবেশ করছে কিনা।
কিন্তু উপায় নাই।
ঈগল-এর ‘L’ এ নক হবার সাথে সাথেই খুলে গেল দরজা।
সান ওয়াকারকে প্রথমে ঘরে ঢুকিয়ে নিজে ঘরে প্রবেশ করল। প্রবেশ করেই দরজা লাগিয়ে দিল।
গুলী এবং ছুটে আসা পায়ের শব্দ অনেক কাছে এসেছে।
দরজা লাগিয়েই আহমদ মুসা দরজা বন্ধ করার উপায় তালাশ করতে গিয়ে হঠাৎ আহমদ মুসার নজরে পড়ল দরজা বন্ধ করার আলীশান ব্যবস্থা।
দরজা সিটকানি ছাড়াও রয়েছে দুই চৌকাঠে আইরন বার দিয়ে দরজা বন্ধ করার গর্ত। মোটা একটা আইরন বারও ঝুলছে দরজার চৌকাঠের সাথে।
আহমদ মুসা দরজার সিটকানি বন্ধ করে আইরন বারটিও লাগিয়ে দিল।
দরজাও দেখল সে লোহার।
দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করার এ ব্যবস্থা দেখে প্রথমে বিস্মিত হয়ে ছিল আহমদ মুসা, কিন্তু পরক্ষণেই ভেবে খুশি হল যে, এই ঘর কোন বন্দীখানা নয়। নিশ্চয় এটা আত্মরক্ষামূলক ঘর। না হলে দরজাটা লোহার এবং ভেতর থেকে ডাবল প্রটেকশনের ব্যবস্থা থাকবে কেন?
কিন্তু একটা ঘরে এই আত্মরক্ষার ব্যবস্থা কেন? একটা ঘরে এভাবে আশ্রয় নিলে আত্মরক্ষা করা যায় না।
পরবর্তী আত্মরক্ষার ব্যবস্থা হিসাবে এ ঘর থেকে নিরাপদ কোন পথে বাইরে যাবার উপায় অবশ্যই থাকতে হবে।
হঠাৎ আহমদ মুসা হলো পেছনের দরজায় পৌছার পথে এটা কোন ঘর নয় তো।
কিন্তু চারিদিকে চেয়ে চার দেয়ালে কোন দরজা দেখতে পেল না।
নিরেট পাথরের দেয়াল।
কিন্তু আহমদ মুসার মন বলল একটা দরজা থাকতেই হবে কোন দেয়ালে।
আহমদ মুসা স্টেনগানের বাঁট দিয়ে দেয়ালে আঘাত করতে লাগল।
উত্তর ও পশ্চিম দেয়ালে ব্যর্থ হবার পর দক্ষিণ দেয়ালে আঘাত করতে লাগল।
দেয়ালের পাশ ঘেঁষে হাঁটছিল আর আঘাত করছিল আহমদ মুসা।
দরজার বাইরে পায়ের শব্দ, গুলিরও শব্দ। সান ওয়াকারের মুখ ভয় ও উদ্বেগে ফ্যাঁকাসে হয়ে উঠেছিল। অসহায় দৃষ্টি তার আহমদ মুসার প্রতি।
অসাধারণ ও অস্বাভাবিক মানুষটি কি শেষ রক্ষা করতে পারবে? পারবে কি তারা বাইরে বেরুতে।
আহমদ মুসা দক্ষিনের দেয়ালে স্টেনগানের বাঁট দিয়ে আঘাত করতে করতে দেয়ালের মাঝামাঝি এক জায়গায় এসে দাঁড়াতেই ভোজবাজির মত দেয়ালটা ফাক হয়ে দু’দিকে সরে গেল এবং বেরিয়ে পড়ল উপরে উঠার একটা সিঁড়ি পথ।
আহমদ মুসা ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলে রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছে ফেলল।
সান ওয়াকার নতুন প্রাণ পাওয়ার মত সজীব হয়ে উঠেছ। আহমদ মুসার প্রতি তার অসীম কৃতজ্ঞ দৃষ্টি।
এস সান ওয়াকার’ বলে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে শুরু করল।
সান ওয়াকারের দুর্বল শরীর। খাড়া সিঁড়ি বেয়ে উঠতে তার কষ্ট হচ্ছিল। দেখে আহমদ মুসা কয়েক ধাপ নেমে এসে তার হাত ধরে টেনে তুলতে লাগল। সিঁড়ির মাথায় পৌঁছে দেখল অন্যন্ত পুরু ইস্পাতের প্লেট দিয়ে তৈরী ঢাকনা দিয়ে সিঁড়ির মুখ বন্ধ।
আহমদ মুসা দেখেই বুঝল, হুড়কো বা সিটকানি জাতীয় কিছু দিয়ে ঢাকনাটি বন্ধ করা নয়। তাহলে নিশ্চয় দরজা খোলার ইলেকট্রনিক কোন ব্যবস্থা আছে ভাবল আহমদ মুসা।
অন্যসব দরজায় ইলেকট্রনিক লকের সব কী-বোর্ড খুজতে লাগল আহমদ মুসা।
খুজল দরজা এবং তার চারপাশে। না কিছুই নেই। তারপর দেখল সিঁড়ির ল্যান্ডিং এবং তিন দিকের দেয়ালে। প্রথম সন্ধানে লকের কী-বোর্ড ধরণের কছুই চোখে পড়ল না।
নিচে দরজায় তখন প্রবল ধাক্কা। দরজা ভাঙার চেষ্টা করা হচ্ছে।
সান ওয়াকারের দুর্বল শরীর কাঁপছে তখন। বলল, ‘দরজা খোলার কোন উপায় পাওয়া যাচ্ছা না।
‘আল্লাহ একটা উপায় বের করে দিবেনই’ বলে আহমদ মুসা আবার চারদিকে চোখ বুলাতে শুরু করল।
এক জায়গায় এসে তার চোখটা আটকে গেল। দেখল, দেয়ালের এক জায়গায় পেন্সিলের অস্পষ্ট আঁচড়ে মুষ্টিবদ্ধ হাত আঁকা।
হঠাৎ আহমদ মুসার মনে পড়ল গ্রীকদের ধাধার প্রাসাদের কাহিনী।
যেখানে ছবির ইংগিত অনুসরণ করে পথ সন্ধান করে ধাঁধার চক্র ভেঙ্গে ফেলা হয়।
এই চিন্তার সাথে সাথে আহমদ মুসা মুষ্টিবদ্ধ ছবির উপর একটা মুষ্ট্যাঘাত করল। সংগে সংগে তার পাশের দেয়াল ফুড়ে বেরিয়ে এল ইলেকট্রনিক লক-এর কী বোর্ড।
মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠক আহমদ মুসার। কী বোর্ডটি আগের গুলোর মতই আলফাবেটিক্যাল।
আহমদ মুসা মুহূর্ত দেরী না করে কী-বোর্ডে টাইপ করল আগের মতি।‘হোয়াইট ঈগল’ কিন্তু দরজা খুলল না।
বিস্ময়ে চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল আহমদ মুসার। ভাবল, এখানে তাহলে ভিন্ন ‘বোর্ড’ ব্যবহার করা হয়েছে। কি সে বোর্ড? এতক্ষণে প্রবল একটা হতাশা এসে ঘিরে ধরল আহমদ মুসাকে।
কিন্তু তা মুহূর্তের জন্যে। পর মুহূর্তেই সান ওয়াকারের দিকে চেয়ে বলল, ‘আমাদের ধর্মে আছে, আল্লাহর সাহায্যের ব্যাপারে কখনও হতাশ হতে নেই। দেখ একটা একটা পথ আল্লাহ বের করে দিবেনই।
হঠাৎ আহমদ মুসার চোখে পড়ল কী-বোর্ডের মাথার হোয়াইট ঈগলের একটা অস্পষ্ট ছবি। সাদা বোর্ডের উপর সাদা ঈগলটি পা উপরে তুলে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে।
দেখেই আহমদ মুসা বুঝল ছবিটি নিরর্থক নয়। কিন্তু ছবিটি এমন অস্বাভাবিক কেন? কোন ইংগিত দিচ্ছে কি ছবিটি?
মুহূর্ত কয়েক ভাবল আহমদ মুসা।
হঠাৎ তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। দ্রুত ‘কী বোর্ডের উপর আবার আঙ্গুল চালাল আহমদ মুসা। এবার টাইপ করল পরের শব্দটা আগে এনে। ঈগল হোয়াইট টাইপ করার সাথে সাথেই সিঁড়ি মুখের দরজা নিঃশব্দে সরে গেল।
স্টেনগান বাগিয়ে আহমদ মুসা আগে উঠল সিঁড়ি থেকে উপরে। গোল্ড ওয়াটারের টিভি স্ক্রীনে দেখা সেই একতলার ছাদ এটা।
ছাদের চারদিকে ভাগাড়, ময়লা আবর্জনা ভর্তি। তার চারদিক দিয়ে কাঁটাতারের বেড়া। চারদিকে আবর্জনার মধ্যে ছোট এক তলাটি পরিত্যক্ত এক আবর্জনার মতই দাঁড়িয়ে আছে।
আহমদ মুসা দেখল, ছাদ থেকে একটা সিঁড়ি ঘরের ভিতরে নেমে গেছে।
আহমদ মুসা সান ওয়াকারকে হাত ধরে টেনে উঠল। তারপর তার হাত ধরেই সিঁড়ি দিয়ে ঘরের ভেতরে নামল।
ঘরের মেঝে পাকা। ধুলোবালি ছাড়া অন্য কোন আবর্জনা নেই।
মেঝেতে নেমেই আহমদ মুসা দেখতে পেল, ঘরের পশ্চিম পাঁশের দেয়ালে একটা সুড়ঙ্গ।
আহমদ মুসা উঁকি দিয়ে দেখল, সুরঙ্গটি একটা কনক্রিটের পাইপের মধ্য দিয়ে বেয়ে গেছে। এটাই কি এখান থেকে বের হবার পথ? এইসময় ঠিক ঘরটির ছাদেই পায়ের শব্দ শুনতে পেলে আহমদ মুসা।
ওরা এসে গেছে আর এক মুহূর্ত দেরী করা যায় না।
আহমদ মুসা সান ওয়াকারকে সুড়ঙ্গ দেখিয়ে বলল, ‘এর ভিতর দিয়ে যেতে পারবে তো?’
‘আপনি ভাববেন না, আমি পারব।’ বলল সান ওয়াকার।
সান ওয়াকারকে ঢুকে গেল আগে। আহমদ মুসা পিছনে।
আহমদ মুসা সুড়ঙ্গে ঢুকে ঘরের দিকে স্টেনগান বাগিয়ে বসল।
সান ওয়াকার কিছুটা এগিয়ে পেছনে তাকিয়ে বলল, ‘আপনি আসছেন না যে?’
‘ওরা এসে গেছে। আমি ওদের আটকাই। তুমি এগোও। আমি তাড়াতাড়ি চলে আসতে পারব।’ আহমদ মুসা বলল।
সান ওয়াকার আবার চলতে শুরু করল।
ওরা ঝড়ের বেগে সিঁড়ি দিয়ে ঘরের মেঝেয় নামল। ছয়জন ওরা। এদিক-ওদিক তাকিয়ে ওরা এগুলো সুরঙ্গের দিকে।
ভেগেছে ওরা সুরঙ্গ দিয়ে। ব্যাটা যাদুকর নাকি! কোন বাঁধাই তাকে আটকতে পাড়ল না। বলল ওদের একজন।
কথা নয় এস তোমরা। শয়তান যাবে কোথায়? বলল ওদের সামনের নেতা গোছের লোকটি। ওরা এল সুরঙ্গের সামনে।
‘এস, শয়তান কোথাও যায়নি।’ বলে আহমদ মুসা সুরঙ্গের মুখে এসে স্টেনগানের ট্রিগারে আঙ্গুল রেখে ঘুরিয়ে নিল অর্ধচন্দ্রাকারে।
ওরা ছয়জন ভুত দেখার মত চমকে উঠল। স্টেনগান ঘুরিয়ে নিচ্ছিল ওরা।
আহমদ মুসা প্রস্তুত স্টেনগান তার আগেই অগ্নি বৃষ্টি করল।
ঝরা পাতার মত মাটিতে আছড়ে পড়ে গড়াগড়ি খেতে লাগল ওদের ছয়টি দেহ।
আহমদ মুসা মুহূর্ত কয়েক অপেক্ষা করল। না কোন শব্দ আসছে না। ওদের পিছনে যারা আসছে। তারা এসে পৌঁছায়নি এখনও। ওরা আসার আগেই তাকে সুরঙ্গ পার হতে হবে। ভাবল আহমদ মুসা। তারপর ছুটল সুরঙ্গ ধরে ক্যাঙ্গারুর মত লাফিয়ে লাফিয়ে। সুরঙ্গের মুখ একটা ঝোপে এসে শেষ হয়েছে।
আহমদ মুসা সুরঙ্গ থেকে বের হয়ে দেখল, ঝোপের মধ্যে শুয়ে পড়েছে সান ওয়াকার। হাঁপাচ্ছে সে। হামাগুড়ি দিয়ে আসতে কষ্ট হয়েছে তার।
আর দেরী করা যাবে না।
আহমদ মুসা কাঁধে তুলে নিল সান ওয়াকারকে। ছুটল তারপর গাছ-গাছড়ার মধ্য দিয়ে।
সামনেই পশ্চিম দিকে গাড়ি চলাচলের শব্দ কানে আসছে।
নিশ্চয় রাস্তা খুব কাছে।
রাস্তা লক্ষ করে ছুটল আহমদ মুসা সান ওয়াকারকে কাঁধে নিয়ে।

রাস্তার পাশে পার্কিং কর্ণারে গাড়ি পার্কিং করে বসে আছে মেরী রোজ।
মেরী রোজ ও শিলা সুসান দু’জনে দুই গাড়ি নিয়ে এসেছে।
গাড়ি নিয়ে তারা দু’জন গোল্ড ওয়াটারের বাড়ির (হোয়াইট ঈগল-এর হেড কোয়ার্টার)আশে পাশে একটা চক্কর দেয়ার পর শিলা সুসান গাড়ি নিয়ে মেরী রোজকে এখানে দাঁড়াতে বলে ফিরে গেছে সে গোল্ড ওয়াটারের বাড়ির সামনে।
বার বার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে মেরী রোজ।
শিলা সুসান যাবার পর আধ ঘন্টা হয়ে গেছে। এতক্ষন সে কোন কাজে দেরী করবে, কোথায় দেরী করবে?
এদিক ওদিক পায়চারী করে আবার সে গাড়ির সিটে এসে বসল। ভাবল সে, অপেক্ষা করার মত কঠিন কাজ কিছু নেই। তবু ভালো লাগছে তার এই ভেবে যে সান ওয়াকারের জন্যেই সে এখানে এসেছে, তার জন্যে কষ্ট করা আসলেই আনন্দের।
সান ওয়াকারের কথা মনে হতেই বেদনায় জর্জরিত হয়ে গেল তার মন। মনে পড়ে গেল তার অতীতের কথা। অত্যন্ত প্রতিভাবান লাজুক এই রেড ইন্ডিয়ান তরুনকে সে কত কষ্ট দিয়েছে, নানাভাবে নাজেহাল করেছে ঘৃণাসুচক ‘কালার’ড নামে ডেকে। কোনদিন কোনকিছুরই প্রতিবাদই করেনি সে। সবকিছুর জবাবে এমনভাবে হেসেছে যেন সেই বিজয়ী আর মেরী রোজ পরাজিত। সে যেন শক্ত এক পাথর। ঘৃণার যে বুলেটই মেরী রোজ ছুড়েছে, সব বুমেরাং হয়ে ফেরত এসেছে মেরী রোজের কাছেই। শেষে মেরী রোজ সত্যিই পরাজিত হয়েছে। নিজের অজান্তেই কখন যেন তার হৃদয় বাধা পড়ে গেছে সান ওয়াকারের কাছে। সমগ্র সত্ত্বা দিয়ে সে ভালোবেসে ফেলেছে সান ওয়াকারকে। যেদিন সে প্রথম এটা বুঝল, অনেক কেঁদেছে সেদিন। কেঁদেছে সে তার অমুলক বর্ণবাদী অহংকারের জন্য। সোজা গিয়ে সে নিজেকে সমর্পণ করেছে সান ওয়াকারের কাছে। সান ওয়াকার অতীতের দিকে একটুও না তাকিয়ে দু’হাত বাড়িয়ে গ্রহণ করেছে মেরী রোজকে। আবেগে কেঁদে ফেলে বলেছে, ‘রোজ, আমি এ দিনেরই অপেক্ষা করেছি।’
ভাবতে ভাবতে মেরী রোজ-এর চোখ দু’টি অশ্রুসজল হয়ে উঠল।
অতীতের স্মৃতির মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলে মেরী রোজ।
পেছনে শব্দ ও গাড়ির ঝাঁকুনীতে সম্বিত ফিরে পেল মেরী রোজ।
চোখ তুলতেই সে দেখতে পেল স্টেনগানধারী একজন যুবককে। সেই গাড়ির পেছনে কাউকে শুইয়ে দিয়েছে। সেদিকে তাকাতেও সাহস পেলনা মেরী রোজ।
দ্রুত এগিয়ে আসছে যুবকটি তার দিকে।
যুবকটি এগিয়ে এসে স্টেনগানের ব্যারেলটি তার দিকে তুলে বলল, ‘গাড়ি আমাদের দরকার, আপনি সহোযোগিতা করুন। আপনি ঠিক সিটে বসে থাকুন। আমি ড্রাইভিং-এ বসছি।’
বলেই যুবকটি একলাফে উঠে ড্রাইভিং সিটে বসল। বসতে বসতে বলল, ‘কোনও প্রকার অসহোযোগিতা করলে কিন্তু আমি গুলি করতে বাধ্য হবো। নিশ্চিত থাকুন আপনার কোন ক্ষতি হবে না।’
গাড়ি স্ট্রার্ট দিল যুবকটি।
কিন্তু গাড়ি চলতে শুরু করার আগেই পেছনে ব্রাশফায়ারের শব্দ হলো।
যুবকটি মাথা নিচু করল এবং মেয়েটিকে সিটে শুয়ে পড়তে বলল।
লাফিয়ে উঠে চলতে শুরু করেছে গাড়ি। তীব্র গতিতে এগিয়ে চলছে গাড়ি। গুলীর শব্দ তখন অনেকটা পেছনে গেছে। কিন্তু গাড়ির গতি স্লো হয়নি।
গুলীর হাত থেকে বাঁচলেও গাড়ির গতি দেখে আতংকিত হলো মেরী রোজ। এভাবে চললে হয় এ্যাকসিডেন্ট করবে, নয়তো পুলিশের হাতে পড়তে হবে। পুলিশের হাতে পড়লে তার জন্যে ভাল। কিন্তু এ্যাকসিডেন্ট করলে জীবন বাঁচবে না।
কিন্তু বিস্মত হলো মেরী রোজ যে, যুবকটি অবিশ্বাস্য দক্ষতার সাথে নিজে বেঁচে এবং সবাইকে বাঁচিয়ে এগিয়ে চলছে ঝড়ের গতিতে। রাস্তার বাঁক অতিক্রম কালে তার দক্ষতা দেখার মত। যেন গাড়ি তার কাছে হাতের একটা খেলনা। যখন ইচ্ছা, যেভাবে ইচ্ছা, যতটা ইচ্ছা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিচ্ছে।
মিনিট সাত আট চলার পর যুবকটি গাড়ির গতি কিছুটা স্লো করল। বলল, ‘ম্যাডাম, আপনার গাড়িতে পানি দেখেছি। পানি কি নিতে পারি? আমার অসুস্থ বন্ধুটি ভয়ানক তৃষ্ণার্ত।’
মেরী রোজ মনে মনে বলল, যুবকটি যেই হোক, ভদ্র। চেহারায় ক্রিমিনাল নয়, শরীরে ভদ্রলোকের ছাপ। কথাও পোশাকী ভদ্রগোচের নয়, কথার মধ্যে সম্মান ও আন্তরিকতার ছাপ আছে।
যুবকটির কথার উত্তর না দিয়ে মেরী রোজ তাকাল পেছনে শুইয়ে রাখা যুবকটির বন্ধুটির দিকে।
পেছনে তাকিয়ে আর্তচিৎকার করে উঠল মেরী রোজ, ‘সান ওয়াকার তুমি! একি তোমার হাল!’
বলে মেরী রোজ লাফ দিয়ে সিট ডিঙ্গিয়ে পেছনে চলে গেল। ঝাঁপিয়ে পড়ল সান ওয়াকারের বুকে।
এতক্ষণ সান ওয়াকার চোখ বুঝে পড়েছিল। মেরী রোজ-এর চিৎকারে সে চোখ খুলল। জড়িয়ে ধরল বুকে ঝাঁপিড়ে পড়া মেরী রোজকে।
বিস্মিত আহমদ মুসা মহুর্তেই বুঝল, নিশ্চয় মেয়েটি সান ওয়াকারের স্ত্রী বা কোন একান্ত আপনজন। খুশি হল এবং আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল আহমদ মুসা। এই মহুর্তে সান ওয়াকারের একটা নিরাপদ আশ্রয় প্রয়োজন।
ওদিকে মেরী রোজ-এর অনেক কথার জবাবে সান ওয়াকার বলল, ‘মরেই যাচ্ছিলাম, অপরিচিত ঐ মহান যুবকটি মৃত্যুর সাথে লড়াই করে অসম্ভবকে সম্ভব করে আমাকে নতুন জীবন দিয়েছেন।’
‘সান ওয়াকার ঈশ্বরকে ডাক। এখনও বিপদ কাটেনি। পেছনে মনে হচ্ছে ওদের কয়েকটা গাড়ি পাগলের মত ছুটে আসছে।’
বলেই আহমদ মুসা তার গাড়ির স্পীডও বাড়িয়ে দিল।
সান ওয়াকার ও মেরী রোজ দু’জনেই পেছনে তাকাল। দেখল ঠিকই দুরে কয়েকটা গাড়ি একই গতিতে পাগলের মত ছুটে আসছে।
দু’জনের মুখই ভয় ও উদ্বেগে পাংশু হয়ে গেল।
‘সান ওয়াকার তোমার তৃষ্ণা কি এখনও আছে?’ পেছনে না তাকিয়েই ঠোঁটে হাসি টেনে বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার কথায় মেরী রোজ তাকাল সান ওয়াকারের দিকে। বলল, ‘স্যরি ভুলে গেছি। দিচ্ছি পানি।’
বলে মেরী রোজ ড্যাশবোর্ডে রাখা বোতল নিয়ে পানি খাওয়াবার জন্যে এগুলো সান ওয়াকারের দিকে।
পানি খেয়ে সান ওয়াকার কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘আপনি কে, জানিনা বন্ধু, কিন্তু ঈশ্বর আপনাকে তার দয়ার সবটুকু ঢেলে দিয়েছেন। সবদিকেই আপনি সমান নজর রাখতে পারেন।’
আহমদ মুসা সান ওয়াকারের কথার দিকে কোন কান না দিয়ে বলল, ‘ম্যাডাম, সান ওয়াকারকে কোথায় নিতে পারি?’
বিপদে পড়ল মেরী রোজ। কোথায় নিতে বলবে সান ওয়াকারকে? বিশ্ববিদ্যালয় কি তার জন্যে নিরাপদ? না। পুলিশের আশ্রয় নেবে? তাও নিরাপদ নয়। পুলিশের আশ্রয় থেকে ওরা সান ওয়াকারকে নিয়ে যাবে। নিজের বাড়িতে নেবে সান ওয়াকারকে মেরী রোজ? সেটাও সম্ভব নয়। তার আব্বা এসব হাঙ্গামা থেকে মেরী রোজকে দুরে থাকতে বলেছেন। কোন উত্তর খুঁজে পেলনা মেরী রোজ। অসহায় দৃষ্টিতে তাকাল সে সান ওয়াকারের দিকে। অশ্রুতে ভরে উঠেছে তার চোখ। নিজের দেশ নিজের নগরীতে কোন নিরাপদ স্থান খুঁজে পেল না সান ওয়াকারের জন্যে।
সান ওয়াকারও নির্বাক।
আহমদ মুসাই কথা বলল আবার। বলল, ‘আমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নতুন। আমাকে শহর থেকে বেরুবার পথ বলে দিন।’
মেরী রোজ চোখ মুছে বলল, ‘যে পথ দিয়ে চলছেন, সে পথ দিয়ে সোজা পশ্চিমে এগুলে পটোম্যাক নদীর ব্রীজে পৌছা যাবে। ব্রীজ পেরোলেই অরলিংটন, প্রবেশ করা যাবে ভার্জিনিয়ায়।’
‘ধন্যবাদ।’ বলে আহমদ মুসা রিয়ার ভিউ-এর দিকে একবার তাকিয়ে সামনের দিকে মনোযোগ দিল।
অনুসরণকারী গাড়ি বলে যাদের সন্দেহ তারা একই দুরুত্বে রয়েছে।
পটোম্যাক ব্রীজ পার হয়ে অরলিংটন সমাধি ভুমিকে বামে রেখে এক্সপ্রেসওয়ে ধরে এগিয়ে চলল আহমদ মুসার গাড়ি।
এক্সপ্রেসওয়ে ধরে ঝড়ের বেগে এগিয়ে চলল সে।
মেরী রোজ-এর গাড়িটি নতুন এবং আমেরিকান গাড়ি। স্পীড ভালো। সুতরাং পেছন থেকে এসে ওরা ধরে ফেলবে, এ সম্ভাবনা কম। আবার সামনে থেকে এসে ঘিরে ফেলবে, নগরী থেকে বেরুবার পর এ সম্ভাবনাও কমে গেছে। কিন্তু এভাবে প্রতিযোগিতার দৌড়ে বাঁচা তো সমস্যার সমাধান নয়।এসব চিন্তা করে বলল আহমদ মুসা, ‘সান ওয়াকার, ওরা আমাদের পিছু ছাড়বেনা।’
‘তাই তো দেখা যাচ্ছে।’ উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল মেরী রোজ।
‘ওদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে সরে পড়া ও তো সম্ভব নয়।’ আহমদ মুসা বলল অনেকটা স্বগত কন্ঠে।
‘তাহলে।’ বলল মেরী রোজ শুকনো কন্ঠে।
‘লড়াইয়ে নামা ছাড়া পথ নেই। তবে ভয় নেই, যুদ্ধ ঘোষণা আমরা করব, সেহেতু যুদ্ধের নেতৃত্ব আমাদের হাতেই থাকবে।’
‘কিন্তু তিন গাড়িতে ওরা অনেক লোক হবে।’ বলল মেরী রোজ ভীত কন্ঠে।
‘ভয় নেই আমাদের হাতে এখন দু’টি স্টেনগান। আর সংখ্যা শক্তি আধুনিক যুদ্ধ জেতার নিয়ামক নয়।’
মেরী রোজ ও সান ওয়াকার বিস্মিত চোখে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। শুরু থেকেই মেরী রোজ দেখছে, বিপদে পড়ার কোন চাপ আহমদ মুসার মুখে নেই। বিপদটা যেন তার কাছে খেলা।এখন লড়াইয়ে নামার কথা এমনভাবে বলছে যেন যুদ্ধে কি হবে তা নিশ্চিতভা্বেই জানে। অন্যদিকে সান ওয়াকার ভাবছে, সাধারণ মাপের এই অসাধারণ যুবকটি কে? লড়াই সম্পর্কে সে যে কথা বলছে তার বিন্দু বিসর্গও অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে না। যে লড়াই করে সে হোয়াইট ঈগলের ঘাটি থেকে বেরিয়ে এসেছে, তাতে করে তার অসাধ্য কিছুই নেই।
হঠাৎ আহমদ মুসা উৎকর্ণ হয়ে উঠল।
পর মুহূর্তেই আহমদ মুসা পেছনে তাকিয়ে বলল, ‘পেছন থেকে বড় একটা বিপদ আসছে সান ওয়াকার।’
মেরী রোজ ও সান ওয়াকার দু’জনেই পেছন দিকে তাকাল উদ্বিগ্ন চোখে। কিছুই না দেখে বলল সান ওয়াকার, ‘কি বিপদ, কিছুই তো দেখছি না তিনটি গাড়ি ছাড়া।’
‘কান পেতে শোন হেলিকপ্টার আসছে।’
সান ওয়াকার ও মেরী রোজ দু’জনেই ‍উৎকর্ণ হয়ে পর মুহূর্তে বলল, ‘হ্যাঁ দূরে হেলিকপ্টারের শব্দ শোনা যাচ্ছে। তাতে কি?’
‘শুধু গাড়ি নয়, এবার হেলিকপ্টারও আমাদের পিছু নেবে। হেলিকপ্টার দিয়ে রোড ব্লক করে আমাদের ধরতে চেষ্টা করবে অবশেষে।’
মুহূর্তে মেরী রোজ ও সান ওয়াকারের চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেল। ভয় ‍ও উদ্বেগে পাংশু হয়ে উঠল তাদের মুখ।
হেলিকপ্টারের শব্দ আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আরও কয়েক মুহূর্ত পর দূর দিগন্তে একটি ছুটে আসা হেলিকপ্টারের অবয়ব স্পষ্ট হয়ে উঠল।
ভাবছিল আহমদ মুসা। সান ওয়াকার ও মেরী রোজ উদ্বেগ-আতংক নির্বাক। তারা জানে, হেলিকপ্টারের সাথে পাল্লা দিয়ে গাড়ি পারবে না। মেরী রোজ-এর মনে পড়ল মার্কিন গোয়েন্দাদের একটা বাস্তব অপারেশনের কাহিনীর কথা। সে কাহিনীতে গোয়েন্দা হেলিকপ্টারের শক্তিশালী চুম্বক রশি নিচে পলায়নপর ক্রিমিনালদের গাড়ি আটকে ফেলেছিল শূন্যে তুলে নিয়ে। হোয়াইট ঈগলের মত সংস্থার এ ধরনের ব্যবস্থা তো থাকতেই পারে।
মেরী রোজ অসহায়ভাবে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। সান ওয়াকারও।
আহমদ মুসার দিকে গভীরভাবে ভাবতে গিয়ে হঠাৎ মেরী রোজ-এর মনে পড়ল শিলা সুসানের কাছে শোনা আহমদ মুসার কথা। চমকে উঠল মেরী রোজ, এ যুবকটিই আহমদ মুসা নয়তো? সে না হলে এ আর কে হবে? বিশেষ করে যুবকটি যখন এশিয়ান চেহারার এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যখন এই প্রথম সে আর তারা আশাও করছিল আহমদ মুসাই সান ওয়াকারকে উদ্ধার করতে পারে বন্দীখানা থেকে।
আহমদ মুসাকে আহমদ মুসা বলে ভাবতে গিয়ে মেরী রোজ-এর মনে আশার সঞ্চার হলো। সে শিলা সুসানের কাছে শুনছে, আহমদ মুসা অসাধ্য সাধন করতে পারে। সে নিশ্চয় বাঁচার একটা পথ বের করবেই।
মেরী রোজের চিন্তা আর এগুতে পারল না। আহমদ মুসা একটু মুখ ঘুরিয়ে মেরী রোজ ও সান ওয়াকারকে লক্ষ্য করে বলল, ‘তোমরা কিছু ভাবছ?’
‘আমরা কিছুই ভাবতে পারছি না।’ বলল সান ওয়াকার।
‘একটাই পথ, আমি নিরাপদ জায়গা দেখে তোমাদের নামিয়ে দেব এবং গাড়ি নিয়ে আমি সামনে এগিয়ে যাব। হেলিকপ্টার ও গাড়িগুলো আমাকে তাড়া করে চলে গেলে তোমরা পালাবার ব্যবস্থা করবে।’
মেরী রোজ ও সান ওয়াকারের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সত্যিই তারা বাঁচতে পারে। কিন্তু পরক্ষনেই নিভে গেল তাদের মুখের আলো। বলল মেরী রোজ, ‘আমাদের বাঁচার ব্যবস্থা হলো, কিন্তু আপনি তো ধরা পড়ে যাবেন।’
‘সবাই এক সাথে বাঁচার চেষ্টা করলে সবাই ধরা পড়ে যাব। ভয় নেই, তোমাদের বাঁচাটা নিশ্চিত হবার পর আমি বাঁচার চেষ্টা করব। চেষ্টা সফল না হলে হয়তো ধরা পড়ব। কিন্তু তাতেও একটা লাভ হবে, সবাই ধরা পড়লাম না।’
স্তম্ভিত হয়ে গেল মেরী রোজ ও সান ওয়াকার দু’জনেই আহমদ মুসার কথা শুনে। নিজের ধরা পড়ার কথা এমনভাবে, এমন নিরুদ্বিগ্ন মুখে বলল যেন ধরা পড়াটা কোন ব্যাপারই নয়। অথচ মেরী রোজ জানে, বিলিয়ন ডলারে বিক্রি করা হবে আহমদ মুসাকে তার চরম শত্রু ইহুদী গোয়েন্দাদের কাছে। মনে কষ্ট লাগল মেরী রোজ-এর। বলল, ‘সব বিপদ আপনার মাথায় চাপিয়ে দিয়ে আমরা কেমন করে সরে পড়ব?’
আহমদ মুসা গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘দেখ, আমি এখন তোমাদের অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করছি। আমার দেয়া সিদ্ধান্ত তোমাদের মানতে হবে। তাছাড়া সান ওয়াকার অসুস্থ। তার নিরাপত্তাই প্রথম বিবেচ্য। আর তার সাথে তুমি না থাকলে সে একা বিপদে পড়বে নিজেকে নিয়েই। সুতরাং তোমাদের দু’জনকেই নামতে হচ্ছে।’
বলে আহমদ মুসা একটা দম নিয়ে তাদেরকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বলল, ‘আমার মনে হচ্ছে আমরা টিলা, আঁকা-বাঁকা ও বনবাদাড় পূর্ণ রাস্তায় প্রবেশ করতে যাচ্ছি। তোমাদের একটা ভালো জায়গায় নামিয়ে দেব। হেলিকপ্টার ও শত্রু গাড়িগুলো চলে না যাওয়া পর্যন্ত তোমাদের খুব সাবধানে ঝোপের আড়ালে আত্মগোপন করতে হবে। ওরা চলে গেলে রাস্তার পাশে কোন ঝোপে আশ্রয় নিয়ে তোমাদেরকে গাড়ি তালাশ করতে হবে।’
গাড়ি প্রবেশ করল টিলাপূর্ণ আঁকা-বাঁকা রাস্তায়। টিলাগুলো গাছ ও ঝোপ-ঝাড়ে ঢাকা।
ফুলস্পীডে চলছিল আহমদ মুসার গাড়ি। সান ওয়াকারদের নামিয়ে দিতে যে সময় যাবে, তা এই ভাবে সঞ্চয় করতে চায় আহমদ মুসা।
আঁকা-বাঁকা রাস্তায় গাড়ির এই গতি দেখে ভয়ে শ্বাস রুদ্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল মেরী রোজ ও সান ওয়াকারের।
গাড়িটা গভীর জংগলে একটা টিলার প্রান্তে উপত্যকার মুখে হার্ড ব্রেক কষে দাঁড়াল তারা যেন প্রাণ ফিরে পেল।
গাড়ি থামতেই আহমদ মুসা দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে গাড়ির টিলার দিকের দরজা খুলে দিয়ে বলল, ‘দ্রুত নাম।’
দ্রুত নামল তারা দু’জন।
থেমেই মেরী রোজ বলল, ‘মাফ করবেন আপনি আহমদ মুসা নন কি?’
আহমদ মুসা চমকে উঠে তাকাল মেরী রোজ-এর দিকে। তারপর গাড়ির দরজা বন্ধ করে এবং সুইচ টিপে ছাদ দিয়ে গাড়ির উন্মুক্ত অংশ ঢেকে দিতে দিতে বলল, ‘সত্যি বলেছেন। ফটো দেখে চেনেন, না শুনেছেন কারও কাছে?’
‘শিলা সুসানের কাছে শুনেছি। সেও আজ আরেকটা গাড়িতে ওখানে আমার সাথে ছিল।’ বলল মেরী রোজ।
আহমদ মুসা গাড়িতে উঠার জন্যে ড্রাইভিং দরজা খুলে ফেলেছিল। মেরী রোজ-এর কথা শুনে সংগে সংগেই ঘুরে দাঁড়াল আহমদ মুসা। বলল, ‘সে ওখানে ছিল আপনার সাথে? তাহলে চিন্তা নেই, সে এদিকে আসবে। তোমরা তার অপেক্ষা কর।’
‘কেমন করে এ কথা বলছেন?’ মেরী রোজ বলল চোখ কপালে তুলে।
আহমদ মুসা ড্রাইভিং সিটে উঠে বসে দরজা বন্ধ করে গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে বলল, ‘বাহামার হোয়াইট ঈগল-এর নেতা জর্জ ফার্ডিনান্ডের মেয়ে শিলা সুসানকে আমি জানি।’
গাড়ি চলতে শুরু করলে মুখ ফিরিয়ে চাপা কণ্ঠে বলল, ‘আবার এতক্ষণ তোমরা দাঁড়িয়ে আছ। যাও যা বলেছি তাই করবে।’
ঝড়ের গতি নিয়ে ছুটে চলে গেল আহমদ মুসার গাড়ি।
গভীর জংগলের দিকে ছুটতে ছুটতে মেরী রোজ বলল, ‘সত্যি মনটা খারাপ হয়ে গেল। মনে হচ্ছে কোন আপনজন যেন আমাদের ছেড়ে চলে গেল।’
‘ঠিক বলেছ রোজ। এমন মানুষ আমি দেখিনি যে মাত্র এক ঘন্টায় হৃদয়ে ঢুকে জয় করে নিতে পারে। এই আহমদ মুসা কে?’
‘চল, বলব। এটুকু জেনে রাখ, শত ক্যাস্ট্রো, শত চেগুয়েভারা এবং শত হোচিমিনকে জোড় দিলেও তার মত বিপ্লবী হবে না।’
ছুটছে তখন আহমদ মুসার গাড়ি।
অরলিংটন এলাকা পার হয়ে ভার্জিনিয়ার মধ্যে দিয়ে পশ্চিমমুখী এক্সপ্রেসওয়ে ধরে এগিয়ে চলছে আহমদ মুসা।
দক্ষিণমুখী আরেকটা এক্সপ্রেসওয়ে সে পেল। কিন্তু সড়কটি উন্মুক্ত সমভুমির মধ্যে দিয়ে চলে গেছে। আহমদ মুসা ঝোপ-ঝাড় ও উঁচু-নিচু টিলার মধ্যে দিয়ে চলে যাওয়া পশ্চিমমুখী সড়ককেই পছন্দ করল।
পেছনের অনুসরণকারী গাড়ি যতখানি দূরত্বে ছিল তার বেশী এগুতে পারেনি। কিন্তু হেলিকপ্টার অনেকখানি কাছে চলে এসেছে। তবু এখনও ১৫ ডিগ্রি কৌণিক দূরত্বে রয়েছে। কিন্তু হেলিকপ্টার অন্তত ৪০ ডিগ্রি কৌণিক অবস্থানে চলে এলে তার চোখকে ফাঁকি দিয়ে সরে পড়া কঠিন হবে।
আরও কিছুটা চলার পর হেলিকপ্টার আহমদ মুসার গাড়ি থেকে ২৫ ডিগ্রি কৌণিক দূরত্বে চলে এল। হেলিকপ্টারটি দ্রুত এগিয়ে আসছে। আহমদ মুসা গাড়ির সর্বোচ্চ স্পীড ব্যবহার করেও দূরত্ব বাড়াতে পারছে না কমছেই।
আহমদ মুসা ভাবল আর কিছুক্ষণের মধ্যে যদি সে সরে পড়ার কোন ব্যবস্থা না করতে পারে তাহলে হেলিকপ্টারের নজরে সে বাঁধা পড়ে যাবে।
কিন্তু কিভাবে সে সরে পড়বে?
গাড়ি নিয়ে পালানো যাচ্ছে না।
গাড়ি থেকে নেমে পালানো কঠিন হবে।
গাড়ি তখন একটা ব্রীজের মুখে এসে পড়েছে। ব্রীজ মানে নদী। নদীর কথা মনে হতেই নতুন প্রাণ পেল আহমদ মুসা। কোন নদী এটা? ভার্জিনিয়ার মানচিত্র যতটুকু স্মরণ আছে তাতে মনে হয় এটা পটোম্যাক নদী থেকে বেরিয়ে আসা সেনেনদোয়া বনাঞ্চলের সেনেনদোয়া নদী।
দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল আহমদ মুসা।
ব্রীজের মাঝখানে পৌঁছে গাড়ির দরজা খুলে গাড়ির স্পীড অব্যাহত রেখেই গাড়ি থেকে নিজেকে ছিটকে দিল ব্রীজের উপর।
নূতন গাড়ি। তার স্টিয়ারিং হুইল আহমদ মুসাকে সহায়তা করল। গাড়িটি তীর বেগে সোজা এগিয়ে ব্রীজ পেরিয়ে রাস্তার এক পাশে গড়িয়ে পড়ে উল্টে গেল। দেখলেই মনে হবে আহমদ মুসা ব্রীজ পেরিয়ে টার্ন নিতে গিয়ে ঢালু রাস্তায় তীব্র গতির কারণে এ্যাকসিডেন্ট করেছে।
ওদিকে আহমদ মুসা ব্রীজে আছড়ে পড়ে আঘাত পেল তার আহত কপালটায় আবার।
তার দু’চোখে অন্ধকার নেমে এল। সে কি সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলছে?
না তাকে এখানে এই মুহূর্তে সংজ্ঞা হারালে চলবে না। পেছনের গাড়ি অল্পক্ষণের মধ্যেই এসে পড়বে এ ব্রীজে এবং হেলিকপ্টারও।
আহমদ মুসা জোর করে চোখ খোলা রেখে সর্বশক্তি দিয়ে অনুভূতিকে জাগ্রত রাখার চেষ্টা করে টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল ব্রীজের রেলিং ধরে। তারপর আচ্ছন্ন অনুভূতির সাহায্যে আহমদ মুসা রেলিং পেরিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল নদীতে। কোথায় পড়ছে, তারপর কি হবে এসব দেখার-বুঝার কোন শক্তি তখন আহমদ মুসার নেই। তার আচ্ছন্ন অনুভূতিতে তখন একটা বিষয়ই ছিল তাকে নদীর পানিতে পড়তে হবে, নদীর স্রোত তাকে কোথাও সরিয়ে নিয়ে যাবে।

এ্যাকসিডেন্টে পড়া আহমদ মুসার গাড়িকে প্রথম দেখতে পেল গোল্ড ওয়াটার। সে চোখে দূরবীন লাগিয়ে বসেছিল হেলিকপ্টারে। তার পাশেই বসে ছিল ইহুদী গোয়েন্দা প্রধান জেনারেল শ্যারণ।
রাস্তার নিচে খাদে উল্টে পড়া আহমদ মুসার গাড়ির উপর চোখ পড়তেই উদ্বিগ্ন কণ্ঠে গোল্ড ওয়াটার বলল, ‘সর্বনাশ জেনারেল শ্যারণ, আহমদ মুসা এ্যাকসিডেন্ট করেছে। মারা গেল নাকি?’
জেনারেল শ্যারণ তার চোখের দূরবীণ সেদিকে ঘুরিয়ে উল্টে পড়া গাড়িটা দেখে বলল, ‘উদ্বিগ্ন হচ্ছেন কেন মি: গোল্ড ওয়াটার। তার এবং তার খয়েরখাঁ মুসলিম দেশগুলোর উপর যে প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলাম, তা না হওয়ায় ক্ষতি আমাদের হবে। কিন্তু ব্যাটা শেষ হলে আমরা বাঁচি। এটাও কম লাভ নয়।’
‘আপনার হিসাবে আপনি ঠিক আছেন জেনারেল। কিন্তু আমাদের হিসাব নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন।’
‘কোন হিসাব? তিন বিলিয়ন ডলারের? হ্যাঁ ঠিক বলেছেন, সে প্রশ্নটা এখন উঠতেই পারে।’
‘কিন্তু জেনারেল, প্রশ্নটা আসলেই উঠতে পারে কি? তাকে তো আপনাদের হাতে দিয়েছি আমরা। সুতরাং বিনিময় তো হয়েই গেছে।’
‘তাই যদি হয়, তাহলে উদ্বিগ্ন কেন বলুন তো আপনার হিসাব নিয়ে? উদ্বেগের কারণ, আপনিও বোঝেন যে, তিন বিলিয়ন ডলারের প্রতি আপনার দাবী এখন খুবই দুর্বল।’
গোল্ড ওয়াটার কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু হেলিকপ্টার তখন এ্যাকসিডেন্টে পড়া আহমদ মুসার গাড়ির পাশেই ল্যান্ড করেছে।
গোল্ড ওয়াটার ও জেনারেল শ্যারণ দ্রুত নেমে এল হেলিকপ্টার থেকে।
হেলিকপ্টার থেকে নেমে আসা অন্যান্যরা ইতিমধ্যেই উল্টানো গাড়ি সোজা করেছে।
গাড়ির দিকে তাকিয়ে গোল্ড ওয়াটার এবং জেনারেল শ্যারণের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। গাড়িতে কেউ নেই।
কিছুক্ষণ তারা কথা বলতে পারল না।
কোথায় গেল জলজ্যান্ত তিনজন লোক? এ্যাকসিডেন্টের পর ওরা কি গাড়ি থেকে বেরিয়ে পালিয়েছে? এত অল্প সময়ে এটা কি সম্ভব? বলল গোল্ড ওয়াটার বিস্ময়ের সাথে, ‘এ্যাকসিডেন্ট হওয়ার দু’চার মিনিটের মধ্যেই স্পটটি আমার নজরে এসেছে। এই অল্প সময়ের মধ্যে এত বড় এ্যাকসিডেন্ট থেকে বেঁচে গাড়ি থেকে বেরিয়ে পালিয়ে যাওয়া বাস্তব নয়।’
‘কিন্তু মি: গোল্ড ওয়াটার, তারা যখন গাড়িতে নেই, তখন পালিয়েছে এটাই বাস্তবতা।’ বলল জেনারেল শ্যারণ।
তিনটি গাড়িও এসে পৌঁছল এ সময়। গাড়ি থেকে নামল ওরা ১৪ জন।
‘পালিয়ে ওরা বেশিদূর যেতে পারেনি অবশ্যই, কথাগুলো স্বগোতোক্তির মত সকলের দিকে তাকিয়ে বলল গোল্ড ওয়াটার, তোমরা চারদিকে ছড়িয়ে পড়। নদীর তীরটাও তোমরা দেখ। তিনজন লোক পালিয়ে বেশিদূর যেতে পারবে না।’
‘মি: গোল্ড ওয়াটার, ওরা এদিকে দেখুক। চলুন আমরা হেলিকপ্টারে যাই। লো-ফ্লাই করে সার্চ করাটা বেশি ফলপ্রসূ হবে।’ বলল জেনারেল শ্যারণ।
হেলিকপ্টারের দিকে চলল গোল্ড ওয়াটার এবং জেনারেল শ্যারণ।

হঠাৎ গোল্ড ওয়াটারের বাড়ির সামনে ছুটাছুটি দেখে রাস্তার পাশে গাড়ি নিয়ে থমকে দাঁড়িয়েছিল শিলা সুসান।
সে দেখল ভীষণ উত্তেজিত ও ব্যস্তসমস্ত ডজনেরও বেশি লোক তিন গাড়ি বোঝাই হয়ে বাড়ির পাশের রোড ধরে ছুটল পশ্চিম দিকে।
ব্যাপারটা দেখে বিস্মিত হলো শিলা সুসান। ভাবল, কিছু একটা ঘটেছে।
আরও কিছুটা সময় পার হলো। বাড়ির দিক থেকে আর কেউ বের হলো না। হৈ চৈ কিছু শোনা গেল না।
বাড়ির দিকে এগুবে। ভাবল শিলা সুসান।
ঠিক এই সময় ব্যস্ত ও উত্তেজিত গোল্ড ওয়াটার আরও কয়েকজনকে নিয়ে প্রধান গেট দিয়ে বেরিয়ে এল। বেরিয়েই ছুটল তারা বাড়ির পুব পাশের উন্মুক্ত লনে দাঁড়ানো হেলিকপ্টারের দিকে।
ওরা সবাই হেলিকপ্টারে উঠল এবং উঠার সাথে সাথেই হেলিকপ্টার উড়ল আকাশে।
শিলা সুসান এবার সত্যি সত্যি উদ্বেগ বোধ করল। কি ঘটেছে? কোথায় যাচ্ছে ওরা?
গেটে স্টেনগানধারী দারওয়ান দাঁড়িয়ে, দেখতে পাচ্ছে সে।
কৌতূহলকে দমিয়ে রাখতে পারলো না শিলা সুসান। ভাবল সে দারোয়ানকে গিয়ে জিজ্ঞেস করবে।
ভাবার সাথে সাথেই শিলা সুসান গাড়ি চালিয়ে গোল্ড ওয়াটারের গেটে গিয়ে দাঁড়াল।
গেটম্যান এগিয়ে এল শিলা সুসানের গাড়ির কাছে। তার হাতে স্টেনগান। বলল, ‘বলুন, কি সাহায্য করতে পারি ম্যাডাম।’
কথা আগেই গুছিয়ে রেখেছিল শিলা সুসান। বলল, ‘আমি গোল্ড ওয়াটার আংকেলের সাথে দেখা করতে এসেছি।’
‘কে আপনি?’
‘শিলা সুসান। উনি আমার বাবার বন্ধু।’
গার্ড একটু চিন্তা করল। বলল, ‘একটা বড় ঘটনা ঘটে গেছে। খুব ব্যস্ত ওরা আজ। উনিও বেরিয়ে গেছেন।’
‘কি ঘটেছে? কারও অসুখ-বিসুখ?’
‘না অসুখ-বিসুখ নয়। একজন আরেকজনকে সাথে নিয়ে পালিয়ে গেছে? তাদেরকে ধরার জন্যেই বেরিয়েছেন ওরা।’
পালাবার কথায় চমকে উঠল শিলা সুসান। কারা পালাল? আহমদ মুসা কি? জিজ্ঞেস করল গোবেচারা ঢংয়ে, ‘কাজের লোক পালিয়েছে কিছু চুরি করে?’
গেটম্যানের চোখে-মুখে বিরক্তির চিহ্ন ফুটে উঠল। বলল, ‘কাজের লোক হবে কেন? তারা আর কি চুরি করবে? দু’জন দুষ্ট লোককে ধরে রাখা হয়েছিল জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে। তারাই পালিয়েছে।’
শিহরিত হলো দেহটা শিলা সুসানের। তাহলে আহমদ মুসা ও সান ওয়াকার পালিয়েছে, তারা যেমনটা ভেবেছিল। মনে আনন্দের একটা ঢেউ খেলে গেল।
কিন্তু গেটম্যানের সামনে মুখটা ভার করে বলল, ‘খুবই দুঃসংবাদ। আমি চলি।’
বলে শিলা সুসান গাড়ি ঘুরিয়ে ফিরে এল রাস্তায়। ছুটল সে মেরী রোজ-এর কাছে তাকে সুখবরটা জানানোর জন্যে।
কিন্তু মেরী রোজ যেখানে ছিল গাড়ি পার্ক করে, সেখানে পেল না তাকে।
শুধু বিস্মিত নয়, উদ্বিগ্নও হলো শিলা সুসান। মেরী রোজ অবশ্যই অন্য কোথাও যাবার কথা নয়। কোন বিপদে পড়েনি তো সে?
হঠাৎ তার মনে হলো, আহমদ মুসা ও সান ওয়াকার পালাবার সাথে তার অন্তর্ধানের কোন যোগ নেই তো? কিংবা হোয়াইট ঈগলের লোকরা মেরী রোজকে চিনতে পেরে তাদের সাথে নিয়ে যায়নি তো?
এই শেষ কথাটা ভাবার সাথে সাথে শিলা সুসানের বুকটা কেঁপে উঠল ভয়ে এবং সিদ্ধান্ত নিল ওদের অনুসরণ অবশ্যই করতে হবে তাকে।
সঙ্গে সঙ্গেই গাড়ি স্টার্ট দিল শিলা সুসান। ঝড়ের বেগে গাড়ি এগিয়ে চলল।