২৮. আমেরিকার এক অন্ধকারে

চ্যাপ্টার

আকাশে উড়ল হেলিকপ্টার।
জানালা দিয়ে আহমদ মুসা হাত নাড়ল ডাঃ আহমদ আশরাফ ও পরিবারের সদস্যদের উদ্দেশ্যে।
নিউ মেক্সিকো এয়ার ফিল্ডের হেলিপ্যাডে ডাঃ আহমদ আশরাফের পরিবারের সবা্ই এসেছে আহমদ মুসাকে বিদায় জানাবার জন্যে।
আহমদ মুসা খুব খুশী হলো হেলিপ্যাডে আসা ডাঃ আশরাফের স্ত্রী ফায়জা আশরাফ ও মেয়ে সারা সাদিয়ার পোশাক দেখে। ফুলহাতা ও পা পর্যন্ত নামানো গাউন পরেছে, তার উপর পরেছে বড় ওড়না। দেখেই মনে হচ্ছে এর চলমান সাধারণ জনস্রোত থেকে পৃথক, এরা মুসলিম।
আহমদ মুসার খুব কষ্ট লাগছে মনে, পরিবারটা খুবই আহত হয়েছে। ওদের দাবী ছিল দু’একটা দিন অন্তত থাকি। আবার পরিস্থিতির নাজুকতা দেখে বাধা দেয়ারও পথ পাচ্ছে না। এই অবস্থার টানা পোড়নে পরিবারটি ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। ডাঃ আহমদ আশরাফ ও ফায়জা আশরাফ পরিণত বুদ্ধির মানুষ বলে তাদের অবশেষে বুঝানো গেছে। কিন্তু অবুঝ সারা সাদিয়া এবং আহমদ আশফাকের জেদ থামানো যায়নি। যুক্তিতে না পেরে কেঁদে ফেলেছে তারা। কোন যুক্তি না পেয়ে আহমদ আশফাক কাঁদতে কাঁদতে বলেছে, আপনার সাক্ষাত লাভের সুযোগ ও সামর্থ আমাদের অতীতেও ছিল না এবং ভবিষ্যতেও হবে না। আল্লাহই আপনাকে আমাদের মাঝে নিয়ে এসেছেন। আল্লাহ যখন সুযোগ আমাদের দিয়েছেন, তখন আপনার উপর আমাদের একটা অধিকার রয়েছে। মেহমান তিন দিন যেমন থাকতে পারেন, তেমনি মেহমানকে তিন দিন আমরা রাখতেও পারি। মেহমানকে আমরা যেমন তিন দিন রাখতে নীতিগতভাবে বাধ্য, তেমনি মেহমানও তিন দিন থাকতে নীতিগতভাবে বাধ্য’।
যুক্তি শুনে হাসতে হয়েছে আহমদ মুসাকে। আহমদ মুসা বলেছিল তাকে, ‘আমি দোয়া করছি, আল্লাহ তোমাকে একজন নাম করা কুটনীতিক, না হয় সেরা একজন আইনজীবি করুন। তোমার যুক্তির কাছে আমি পরাজিত। কিন্তু থাকা সম্ভব হচ্ছে না ভাই’।
আহমদ আশফাকের যুক্তির চেয়ে সারা সাদিয়ার যুক্তি ছিল আরও প্রবল।
আহমদ মুসার পরিচয় পাওয়া এবং সেদিন আহমদ মুসা তাকে বড় ওড়না পরতে বলার পর সে আহমদ মুসার সামনে আর আসেনি।
কিন্তু বিদায়ের প্রস্তুতির সময় সারা সাদিয়া এসে ড্রইং রুমের দরজায় দাঁড়ায়। পরনে লম্বা গোলাপী গাউন। বড় সাদা চাদরে ঢাকা মাথাসহ গা। দরজায় দাঁড়িয়ে মুখ নিচু করে ভারী কন্ঠে বলেছিল সে, ‘এক ঝলক আলো জ্বেলে পথ দেখিয়ে, আবার অন্ধকারে নিমজ্জিত করে চলে যাচ্ছেন আপনি’।
‘না বোন, যে পথের কথা আমি বলেছি, তা কখনই অন্ধকারে নিমজ্জিত হয় না। কোরআন এবং হাদিস তোমাদের ঘরেই রয়েছে। পথের দিশারী ওগুলোই’।
‘আমাদের কি সে যোগ্যতা আছে? থাকলে আপনি যা বলেছেন, তা আমরা আগে বুঝিনি কেন? কেউ আমাদের বোঝায়নি কেন?’
‘আরও পড়তে হবে। আরও বোঝার চেষ্টা করতে হবে, তাহলে দেখবে চলার পথটা তোমার সামনে সুষ্পষ্ট হয়ে গেছে’।
‘জ্ঞান ও যোগ্যতা অনুসারে মানুষ বোঝে। আমার বা আমাদের সে জ্ঞান ও যোগ্যতা থাকলে আগেই তো বুঝতাম। জ্ঞান ও যোগ্যতা শাণিত করার জন্যে অবশ্যই আপনাদের দরকার হয়’।
‘ঠিক বলেছ বোন। এ এক বাস্তব সমস্যা। এ সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছে মুসলিম নেতৃবৃন্দরা। ওয়াশিংটনের গ্রীন ভ্যালিতে আমেরিকান কাউন্সিল অব মুসলিম এ্যাসোসিয়েশনের যে সম্মেলন হয়ে গেল, তার প্রধান এজেন্ডাই ছিল এটা। এ সমস্যার তারা দ্রুত সমাধানের চেষ্টা করছেন’।
‘আমার অনেক বান্ধবীকে আমি টেলিফোনে বলেছি। তাদের নিয়ে একটা সভা করব। তারা একবারেই অন্ধকারে। আমিহ ভেবেছিলাম আপনি সেখানে কথা বলবেন। তাহলে তাদের নিয়ে আমি এ্যাসোসিয়েশন গড়তে পারব, কিছু কাজ শুরু করতে পারব’।
আহমদ মুসা জুতার ফিতা বাঁধছিল।
সারা সাদিয়ার এই শেষ কথা আহমদ মুসার মনে আঘাত করে। ফিতা বাঁধা বন্ধ করে সে মুখ তুলে একটু ভাব। তারপর বলে, ‘আমি খুবই দুঃখ বোধ করছি বোন থাকতে পারবো না বলে। কিন্তু খুবই খুশী হয়েছি যে, তুমি কাজ শুরু করেছ। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। আমি কথা দিচ্ছি, আমি ওয়াশিংটনে গিয়ে তোমাদের সভার জন্যে একটা মেসেজ পাঠাব তোমার কাছে। আমর পক্ষ থেকে সেটা তুমি সভায় পাঠ করে শোনাবে’।
হাসি ফুটে উঠল সারা সাদিয়ার মুঝে। সে দু’ চোখের পানি মুছে বলল, ‘সত্যি আপনি পাঠাবেন?’
‘কথা দিচ্ছি পাঠাব’।
‘তাহলে আমি শুধু সেটা সভায় পড়েই শোনাব না, আয়না দিয়ে বাঁধিয়ে রাখব। এটা হবে আমাদের সংগঠবের অনুপ্রেরণার উৎস’।
‘তাহলে খুশী তো?’
‘ধন্যবাদ ভাইয়া’।
‘তাহলে ভাইয়া আমার খুশীর কি হবে? বড় বলে এ একটা সান্ত্বনা পুরষ্কার পেল, কিন্তু আমি?’ আহমদ মুসার পাশে বসে থাকা আহমদ আশফাক বলে উঠেছিল অভিমান ক্ষুব্ধ কন্ঠে।
হেসে ছিল আহমদ মুসা। বলেছি, ‘সারা এগিয়েছে। তুমি এগোওনি। ঠিক আছে, তুমি যাতে আগাও এজন্যে তোমাকে একটা চিঠি লিখব’।
‘আপনি আমাকে সত্যিই চিঠি লিখবেন?’ আনন্দে চিৎকার করে বলেছিল আহমদ আশফাক।
হেলিকপ্টার দ্রুত চলছিল। হেলিপ্যাড ছেড়ে ডাঃ আশরাফরা এক সময় চলে গেল চোখের আড়ালে।
আপনাতেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল আহমদ মুসার মুখ থেকে। এভাবেই স্মৃতি অতীতের অন্ধাকারে হারিয়ে যায়। আর ফিরে আসে না। ফিরে যাওয়া যায় না। জীবনটা শুধু সামনে চলারই পথ, ফেরার পথ নয়। কিন্তু অতীত হয়েও তো অতীত হয় না। স্মৃতির আকাশে বেদনার তারা হয়ে অতীত তো জ্বলেই চলে।
পেছন দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে সামনে তাকাল আহমদ মুসা।
বাতাসের স্রোত কেটে দ্রুত এগিয়ে চলেছে জেট হেলিকপ্টার।
এ এক নতুন ধানের পরিবহন হেলিকপ্টার। ছোট বিমানের বিকল্প হিসেবে এগুলো আজ ব্যবহৃত হতে শুরু করেছে।
অন্য হেলিকপ্টারের মত প্রচন্ড শব্দ হয় না। দু’টি শক্তিশালী জেট ইঞ্জিনে চলে এ হেলিকপ্টার।
‘মিঃ আহমদ মুসা, আমার খুব আনন্দ হচ্ছে আপনাকে পেয়ে। মনে হচ্ছে কি জানেন? মনে হচ্ছে, এই প্রথম আমরা ইহুদীবাদীদের বিরুদ্ধে একটা সফল যুদ্ধে অবতীর্ণ হচ্ছি’। বলল বেঞ্জামিন বেকন।
‘কেন তা মনে হচ্ছে?’
‘কারণ ইস্যুটা ভাল এবং আপনার নেতৃত্বে। আপনি যখনই এফ.বি.আই প্রধান জর্জ আব্রাহাম জনসনের সাথে দেখা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তখানই বুঝেছি ছোটখাট কোন বিষয় হলে আপনি এ সিদ্ধান্ত নিতেন না। বড় ঘটনা ও অকাট্য প্রমাণ না থাকলে আপনি জর্জ আব্রাহাম জনসনের সাথে দেখা করার জন্যে এতটা আগ্রহী হতেন না্’।
‘মিঃ বেঞ্জামিন, কোন বিষয়কে আমি বড় মনে করলেই তিনি মনে করবেন তা নাও হতে পারে। তাছাড়া ইহুদীবাদীদের সম্পর্কে তাঁর ব্যক্তিগত ধারণা কি, তার উপরই অনেক কিছু নির্ভর করছে’।
‘এই শেষ বাক্যটা আমাকে উদ্বিগ্ন করল আহমদ মুসা। আমাদের আজকের মার্কিন রাজনীতি ও আমলাতন্ত্রের যে যত উপরে আছে, তার উপর ততটা বেশী ইহুদীবাদীদের কালো হাত চেপে বসে রয়েছে’।
‘শিক্ষিত ও ঐতিহ্যবাহী মার্কিন জাতির জন্যে সত্যিই এটা লজ্জাজনক নয় কি?’
‘অবশ্যই আহমদ মুসা। লজ্জাজনক আরও এই কারণে যে, আমরা মার্কিনীরা আমাদের ইতিহাসকে ভালবাসি, কিন্তু ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহন করি না। আমাদের পূর্ব পুরষরা ইহুদীদের ব্যাপারে যে হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করে গেছেন, সেদিকে আমরা কান দিচ্ছিনা। যেমন আমাদের কাউন্টার ফাদারস্ দের প্রথম ও শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তিহ্ব জর্জ ওয়াশিংটন বলেছেন, ‘তারা (ইহুদীরা) আমাদের শত্রু সৈন্যের চেয়েও অধিক দক্ষতার সাতে আমাদের বিরুদ্ধে কাজ করে। আমরা সার্বিক মুক্তির যে প্রচেষ্টা চালাচ্ছি এবং যে মহৎ উদ্দশ্য সাধনের সংগ্রামে আমরা লিপ্ত তার শতভাগ বৈরী তারা। আমাদের প্রত্যেকটা স্টেট আগে থেকেই এ সামাজিক কীট (ইহুদীবাদীদের) দমনে যে তৎপর হয়নি, এ জন্যে আমাদের অনুশোচনা করতে হবে’। (Maxims of George Washington By A.A. Applaton & Co.) ঠিক অনুরূপ কথাই বলেছেন বেঞ্জামিন ফ্রাংকলীন ১৭৮৭ সালে ফিলাডেলফিয়ার কনস্টিটিউশনাল কনভেনশনে দেয়া তাঁর ভাষণে। তিনিও সে ভাষণে বলেন, ‘আমি জেনারেল ওয়াশিংটনের সাথে একমত যে, আমাদের এই নতুন জাতিকে একটি অপপ্রভাব ও অনুপ্রবেশ থেকে অবশ্যই রক্ষা করতে হবে। ভদ্রমহোদয়গণ, সে ভয়ংকর অনুপ্রবেশের নাম ‘ইহুদী’। যে দেশেই ইহুদীরা কোন বড় সংখ্যায় প্রবেশ করেছে, সে দেশেই তারা সেখানকার নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় সূচিত করেছে ও ব্যবসায়িক সংহতি বিনষ্ট করেছে। ইহুদীরা সেখানে জনগণ থেকে নিজেদের আলাদা করে রেখেছে এবং কোন ক্রমেই সেখানকার মানুষের সাথে একাত্ম হয়নি। সে দেশের জাতীয়তার বুনিয়াদ যে খৃষ্ট ধর্মের উপর তার ক্ষতি করার চেষ্টা তারা করেছে। তারা সৃষ্টি করেছে রাষ্ট্রের মধ্যে আরেক রাষ্ট্র। আর বিরোধিতার সম্মুখীন হলেই তারা সে দেশে আর্থিক বিপর্যয় ঘটিয়েছে। এর দৃষ্টান্ত স্পেন ও পর্তুগাল।…….আমরা যদি তাদের তাড়াতে না পারি, তাহলে দু’শ বছরের মধ্যে আমাদের উত্তর-পুরুষরা এ দেশে কামলায় পরিণত হবে, আর ইহুদীদের হাত থেকে মুক্ত হবার জন্যে যদি চূড়ান্ত ব্যবস্থা আপনারা না করেন, তাহলে আমাদের উত্তর পুরুষরা আমাদের কবরের উপর অভিসম্পাত করবে। ভদ্রমহোদয়গন, ইহুদীরা যেখানেই জম্মগ্রহন করুক, যত জেনারেশনই তারা প্যালেস্টাইন থেকে বাইরে থাকুক, তাদের মধ্যে কোন পরিবর্তন আসবে না। শত জেনারেশন তারা আমেরিকায় থাকলেও তাদের চিন্তাধারা কখনই তাদের আমেরিকান হতে দেবে না’। মিঃ আহমদ মুসা, এ ধরনের শত সহস্র সতর্কবাণী আমাদের পূর্ব পুরুষদের পক্ষ থেকে করা হয়েছে, কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ইহুদী টাকার গোলক ধাঁধাঁয় বন্দী হওয়ায় সে সবই বিফলে গেছে। তাই আমরা নাগরিকরা চেষ্টা করছি কিছু করার জন্যে’। থামল বেঞ্জামিন বেকন দীর্ঘ এক বক্তব্য দেয়ার পর।
‘কি সাংঘাতিকে! আপনাদের জাতির যারা নির্মাতা, তাদের এসব স্পষ্ট সতর্কবাণী সত্ত্বেও আমেরিকান অর্থনীতি, মিডিয়া এবং রাজনীতি ইহুদী কুক্ষিগত হতে পারল কেমন করে?’ বলল আহমদ মুসা।
‘কি বলব জনাব, এ দুঃসহ জ্বালায় আমরা মরছি’। বেঞ্জামিন বেকন বলল।
‘মিঃ বেঞ্জামিন, আপনাদের রাজনীতিকদের কাছে তাদের দেশপ্রেমের চেয়ে ইহুদী টাকাই কি বড় হয়ে গেল?’
‘তা হয়নি জনাব। মার্কিন রাজনীতিকরা নগদ লাভ করতে গিয়ে ইহুদীদের নগদ কিছু কনসেশন দেন। এই কনসেশনগুলোর যোগফল ইহুদীদের জন্যে হয়েছে আশীর্বাদ, মার্কিনীদের জন্যে হয়ে উঠেছে অভিশাপ। মার্কিন রাজনীতিকরা এটা বোঝেন, কিন্তু নগদ লাভের প্রশ্ন তাদেরকে সক্রিয় হতে দেয় না। একটা মজার ব্যাপার দেখুন, মার্কিন সংবিধান দুবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবার সুযোগ আছে। তাই যিনিই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, তিনিই দ্বিতীয় টার্মেও নির্বাচিত হওয়ার আশা করেন। তাই আমরা দেখি প্রথমবার প্রেসিডেন্ট হবার পর প্রত্যেক প্রেসিডেন্টই হ্হুদী স্বার্থের অনুগত থাকেন যাতে দ্বিতীয় টার্মের নির্বাচনে ইহুদী অর্থ ও মিডিয়ার সাপোর্ট মেলে। কিন্তু দ্বিতীয় টার্মে নির্বাচিত হবার পর মার্কিন প্রেসিডেন্টরা স্বাধীন নীতি অনুসরণ করেন। কিন্তু যখনই স্বাধীন নীতি গ্রহন করেন, তখনই তারা ইহুদী চক্রান্ত ও ইহুদী ট্র্যাপে পড়ে নাজেহাল হন, এমনকি অনেককে ক্ষমতাও হারাতে হয়’।
‘এই ভয়ংকর ইহুদী ট্র্যাপ থেকে মার্কিনীদের উদ্ধার কিসে?’ বলল আহমদ মুসা।
‘আমি জানি না জনাব। তবে এবার আপনি একটা কিছু করতে পারেন’।
‘কিন্তু আমরা মুসলমানরাও তো মার্কিনীদের শত্রু’। আহমদ মুসা বলল।
‘না এটা ঠিক নয়। ইহুদী প্রপাগান্ডার ফলে কিছু বিভ্রান্তি আছে অবশ্য। কিন্তু থাকবে না। কারণ মুসলমানদের সোসাইটি ওপেন। আর ষড়যন্ত্র নয়, গণতন্ত্র ইসলামের পথ’।
‘ধন্যবাদ বেঞ্জামিন’।
তাদের এই আলোচনা অবিরাম চললই ওয়াশিংটন না পৌঁছা পর্যন্ত।
আহমদ মুসাদের হেলিকপ্টার যখন ওয়াশিংটনে ল্যান্ড করল, তখন রাত নেমেছে।
বেঞ্জামিন ন্যাসভিল থেকেই ওয়াশিংটনে ‘ফ্রি আমেরিকা’র লোকদের টেলিফোন করে দিয়েছিল।
বেঞ্জামিন বেকনদের হেলিকপ্টার ল্যান্ড করতেই একটা মাইক্রো ছুটে এল।
হেলিকপ্টারের পেমেন্ট আগেই করা হয়েছিল।
আহমদ মুসা ও বেঞ্জামিন বেকন হেলিকপ্টার থেকে নেমে গাড়িতে উঠল।
গাড়ি চলতে শুরু করল।
‘আমার কয়েকজন বন্ধু থাকেন ওয়াশিংটনে। আমি সেখানে উঠতে পারি’। বেঞ্জামিন বেকনকে লক্ষ্য করে বলল আহমদ মুসা।
‘আপনি যেটা ইচ্ছা করবেন, সেটাই হবে। তবে আমার অনুরোধ, জর্জ আব্রাহম জনসনের সাথে দেখা করার পূর্ব পর্যন্ত আপনি আমাদের সাথে থাকুন। আমি আপনার সম্পর্কে একটা এ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে ‘অনডিউটি’ ওয়াশিংটনে এসেছি। সুতরাং আপনার চলাফেরার ব্যাপারে আমি আপনাকে সহযোগিতা করতে পারব’।
‘আমার সম্পর্কে এ্যাসাইনমেন্ট কিভাবে নিলেন?’ বলল আহমদ মুসা বিষ্মিত কন্ঠে?
‘আমি অফিসকে বলেছি, আমি আহমদ মুসাকে ফলো করব। ওয়াশিংটন পর্যন্ত আমাকে যেতে হতে পারে। এই এ্যাসাইনমেন্ট অফিস মঞ্জুর করেছে।
‘ধন্যবাদ বেঞ্জামিন। তাহলে আমি আপনাদের মেহমান হচ্ছি’।
‘ধন্যবাদ জনাব’। বলল বেঞ্জামিন খুশী হয়ে।
ছুটে চলছে তখন গাড়ি নিরবে ওয়াশিংটনের ব্যস্ত রাজপথ ধরে।

ওয়াশিংটনে পৌঁছার পর ৪০ ঘন্টা পার হয়ে গেছে। আজ বিকেল ছয়টায় জর্জ আব্রাহাম জনসনের সাথে আহমদ মুসার সাক্ষাতের সময় নির্দিষ্ট হয়েছে।
ওয়াশিংটনে আসার পরপরই সাক্ষাতের সময় করার জন্যে বেঞ্জামিন বেকন আহমদ মুসাকে বলেছিল। কিন্তু আহমদ মুসা তাকে বলেছিল, তার সাথে দেখা করার আগে ওয়াশিংটনে আমার কিছু কাজ আছে তা সারতে হবে। অনেকের সাথে কিছু কথাবার্তাও বলতে হবে।
আহমদ মুসা তার সে সব কাজ ও কথাবার্তা শেষ করার পর গতরাতে যোগাযোগ করেছিল জর্জ আব্রাহাম জনসনের সাথে।
জর্জ আব্রাহাম জনসনের সাথে সাক্ষাতের ব্যবস্থা হওয়ায় আহমদ মুসা ও বেঞ্জামিন বেকন দু’জনেই খুশী। তবে বেশী খুশী বেঞ্জামিন বেকন। তার ধারণা জর্জ আব্রাহাম জনসনকে কোন কিছু বুঝানো গেলে সি.আই এ এবং পেন্টাগণকে তা বুঝানো খুব সহজ হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আভ্যন্তরীন নিরাপত্তা কমিটিতে জর্জ আব্রাহাম জনসন যেমন সিনিয়র, তেমন গৌরবপূর্ণ রেকর্ডের অধিকারী। সবার সমীহ সে পায়।
জর্জ আব্রাহাম জনসনের সাথে দেখা করার বিষয় ঠিক করতে গিয়ে আহমদ মুসাকে বেশ কথা বলতে হয়েছে।
আহমদ মুসার টেলিফোন পেয়ে প্রথমে ভূত দেখার মতই আঁৎকে উঠেছে জর্জ আব্রাহাম জনসন। প্রথমেই জিজ্ঞেস করেছে, ‘আপনি কি পুলিশ কাস্টডিতে, না মুক্ত অবস্থায় কথা বলছেন?’
আহমদ মুসা বলেছে, আপনার পুলিশ কাস্টডিতে যাওয়ার আগে আমি আপনার সাথে দেখা করতে চাই, অতি গোপনীয় কিছু বলার জন্যে, যে কথা আমি আর কাউকে বলব না’।
‘আপনার বিরুদ্ধে কি অভিযোগ আপনি জানেন?’ বলেছিল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
‘জানি গুরুতর অভিযোগ’। বলেছিল আহমদ মুসা।
‘তাহলে আপনি আত্মসমর্পন করে আমার সাথে সাক্ষাত করতে পারেন’। বলল জর্জ আব্রাহাম।
‘আপনি ব্যবস্থা করে রাখবেন, আপনার সাথে কথা শেষ হওয়ার পরে আপনি আমাকে কাস্টডিতে নেবেন। আপনি সাক্ষাতকার না দেয়া পর্যন্ত আমি ধরা দেব না। আর আপনার পুলিশ ও গোয়েন্দারা ইচ্ছা করলেই যে আমাকে গ্রেপ্তার করতে পারে, ব্যাপারটা তেমন নয়’। বলল আহমদ মুসা।
‘ঠিক আছে, আমি সাক্ষাত করব। কিন্তু একটা বিষয় আপনি বলুন, আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগটা কি সত্যি?’ জর্জ আব্রাহামের কন্ঠে অনুরোধের সুর।
‘এফ.বি.আই চীফ হিসেবে অভিযোগ তো আপনিই দাঁড় করিয়েছেন। আপনি এ প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছেন কেন?’
‘এফ.বি.আই চীফ হিসেবে এ প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছিনা, জিজ্ঞেস করছি ওহাইও নদীর মৃত্যু গহবর থেকে যে শিশুকে আপনি বাঁচিয়েছিলেন, সে শিশুর দাদা হিসেবে। আর এ জিজ্ঞাসা আপনার জন্যে আমার উদ্বিগ্ন স্ত্রীর পক্ষ থেকে’। বলে জর্জ আব্রাহাম।
ওহাইও নদীর সেই দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল আহমদ মুসার। ভেসে উঠেছিল চোখের সামনে জর্জ আব্রাহম জনসন এবং তার স্ত্রীর সেই ছবিও। মনটা ভিজে উঠে আহমদ মুসার। বলে, ‘ঘটনাটা সত্য, অভিযোগ সত্য নয়, জনাব।
‘গড ব্লেস ইউ মাই বয়। যদিও জানি তোমার অপরাধহীনতা তুমি প্রমাণ করতে পারবে না। তবু তোমার কথা আমি শুনব। তুমি এস। স্নেহ সিক্ত হয়ে উঠেছিল জর্জ আব্রাহাম জনসনের কন্ঠ।
‘ধন্যবাদ, বাই’। বলে টেলিফোন রেখে দিয়েছিল আহমদ মুসা।
জর্জ আব্রাহাম জনসনের সাথে আহমদ মুসার সাক্ষাতকার ঠিক হওয়ার আনন্দে বুঁদ হওয়ায় বেঞ্জামিন বেকনকে লক্ষ্য করে আহমদ মুসা বলল, ‘আপনি বলেছেন জর্জ আব্রাহাম সৎ ও দেশপ্রেমিক অফিসার। কিন্তু জানেন কি, এর সুবিধাও আছে, অসুবিধাও আছে?’
‘জানি, কিন্তু অপানার উপর আমার আস্থা আছে। জর্জ আব্রাহামকে বুঝানোর মন্ত্র আপনার কাছে না থাকলে আপনি তার সাথে সাক্ষাত করতে না’।
‘ধন্যবাদ মিঃ বেঞ্জামিন। আল্লাহ আপনার আশা সফল করুন’।
তখন বেলা ৪টা।
আহমদ মুসা বলল, ‘যাই তৈরী হয়ে নেই জর্জ আব্রাহামের ওখানে যাবার জন্যে’।
বেঞ্জামিন বেকন ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, সবে বিকেল চারটা। দেখা করার সময় হলো বিকেল ছয়টা’।
আহমদ মুসা হাসল। উঠে দাঁড়িয়ে ভেতরে চলে গেল।
মিনিট পরেন পর বেরিয়ে এল একজন আরবী শেখের পোশাক পরে। বলল বিষ্ময়ে হা হয়ে যাওয়া বেঞ্জামিন বেকনকে, ‘আমার নাম শাইখ আব্দুল্লাহ আলী আল নজদী। কয়েকদিন আগে আমি ওয়াশিংটন ইসলামিক সেন্টারের ডিরেক্টর হিসেবে সউদি আরব থেকে এসেছি। আজ বিকেল ৫টায় যাচ্ছি এফ.বি.আই চীফ জর্জ আব্রাহাম জনসনের সাথে সৌজন্য সাক্ষাত করতে এবং সেই সাথে সেন্টারের কাজ সম্পর্কে তাকে ব্রীফ করতে’। আহমদ মুসার মুখ ভরা হাসি।
‘ছদ্মবেশ ও নতুন নামের একটা যুক্তি আছে তা বুঝলাম, ক্নিতু সাক্ষাতকার ছয়টায়, পাঁচটায় কেন যাচ্ছেন? বলল বেঞ্জামিন বেকন। তার বিষ্ময় তখনও কাটেনি।
ছয়টায় তো আহমদ মুসার সাথে তার সাক্ষাত, আর পাঁচটায় সাক্ষাত আমার সাথে, মানে শাইখ আব্দুল্লাহ আলী আল নজদীর সাথে’।
‘বুঝলাম না’।
‘খুবই সোজা। আমি এখন শাইখ আব্দুল্লাহ আলী আল নজদী হিসেবে দেখা করতে যাচ্ছি’।
তারপর?
তারপর দরকার হবে না, ছয়টায় যাওয়ার।
‘কিন্তু এর প্রয়োজন কি আমি বুঝতে পারছিনা। বরং আপনি যে শাইখ আব্দুল্লাহ নন, এটা এফ.বি. আই পুলিশ ইন্টেলিজেন্সের কাছে সহজেই ধরা পড়ে যাবে। কারণ এ ধরণের কোন লোক যখন সাক্ষাতকারে যান, তখন আগে থেকেই তাদের খোঁজ খবর রাখা হয়, এমন কি তাদের বাড়ির উপর চোখ রাখা হয়’।
‘দুপুরে খাবার পর পোশাক পরে একটা গাড়িতে শাইখ বেরিয়ে এসেছেন। আমি যতক্ষণ সাক্ষাতকারে থাকব, ততক্ষণ তিনি নিখোঁজ থাকবেন। তিনি যে গাড়ি নিয়ে দুপুরের পর বেরিয়েছেন, সেই গাড়িতেই আমি যাচ্ছি জর্জ আব্রাহামের সাথে দেখা করতে’।
‘সব বুঝলাম, কিন্তু প্রয়োজনটা বুঝছি না’।
বুঝছেন না?
‘না’।
‘দু’টি ঘটনার কথা ভাবুন তো। আমি আপনাকে জানিয়েছি, ন্যাসভিলে টেলিফোন করে ডাঃ আশরাফের কাছে জানতে পেরেছি আমি ও আপনি যে হেলিকপ্টারে ওয়াশিংটনে এসেছি তা ন্যাসভিলের ইহুদী লবী জানতে পেরেছে। আরেকটি ঘটনা আপনি আমাকে বলেছেন। এফ.বি.আই হেড কোয়ার্টারে আপনার ব্যাচমেট অন্যসব ডিউটি অফিসার ন্যাসভিলের সাথে আপনি কথা বললে তিনি জানতে চান বিকেল ছয়টায় আমার সাথে আপনি যাচ্ছেন কি না’। থামল আহমদ মুসা।
‘এ দু’টি ঘটনায় কি বুঝা যায়?’ বলল বেঞ্জামিন।
‘দু’টি জিনিষ পরিষ্কার হয়, আপনার সাথে আমি ওয়াশিংটনে এসেছি, এ গোপন কথা ইহুদী লবীর কারোই অজানা নেই। দ্বীতিয়তঃ, আজ বিকেল ছয়টায় আমি জর্জ আব্রাহামের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি, এটাও ইহুদী লবীর জানা হয়ে গেছে’, আহমদ মুসা বলল।
‘বুঝেছি জনাব, আপনি আশংকা করছেন ছয়টায় দেখা করা আপনার জন্যে নিরাপদ হবে না। এই জন্যে বিকল্প ব্যবস্থা । নির্ধারিত সময়ের আগেই সেখানে চলে যাবেন’।
শুষ্ক কন্ঠে কথাগুলো বলে একটু থামল বেঞ্জামিন বেকন। গলাটা একটু পরিষ্কার করে নিয়ে আবার বলতে শুরু করল, ‘কি সর্বনাশ, ইহুদীদের এত সাহস হয়েছে! তারা এফ.বি.আই প্রধানের মেহমানকেও তাঁর সাথে দেখা করতে দেবে না!’ প্রয়োজন হলে কিডন্যাপ করবে!
একটু থেমে একটা ঢোক গিলে আবার বলল, ‘আপনি যান। আপনার পেছনে আমি থাকছি। আমার এখন রীতিমত ভয় করছে আমাদের প্ল্যান কার্যকরি হওয়ার বিষয়ে।
‘আসুন তবে, সাবধান!’
বলে আহমদ মূসা ব্রিফকেসটি হাতে নিয়ে ফিরে দাঁড়াল। চলতে শুরু করল।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে ওঠল শাইখ আব্দুল্লাহ আলী আল নজদীর গাড়িতে।
দ্রুত একটা টেলিফোন সেরে বেঞ্জামিন বেকনও বাড়ীর গাড়ি বারান্দায় এসে আরেকটা গাড়িতে চড়ে বসল।
কিছু দূরত্বে দু’টি গাড়িই এগিয়ে চলছে FBI হেড কোয়ার্টারের দিকে।

পরবর্তী বই
আমেরিকায় আরেক যুদ্ধ

Top