২৮. আমেরিকার এক অন্ধকারে

চ্যাপ্টার

কম্পন উঠল পেন্টাগন, সি. আই. এ, এফ.বি. আই সব মহলে। দেশের সবচেয়ে নিরাপদ স্থানে প্রতিষ্ঠিত ও সবদিক থেকে সংরক্ষিত তাদের সবচেয়ে মূল্যবান গবেষণাগার লস আলামোসে ইঁদুর ঢুকেছে। ঢুকলো কি করে?
লস আলামোস স্ট্রাটেজিক রিসার্চ ল্যাবরেটরীর চারদিকে কয়েক বর্গমাইল এলাকা জুড়ে সংরক্ষিত বনাঞ্চল। এ বনাঞ্চলে বিনা অনুমতিতে প্রবেশ নিষেধ। কেউ যদি প্রহরীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে প্রবেশ করেও, কয়েক মিনিটের মধ্যে তার উপস্থিতি ও অবস্থান ধরা পড়ে যাবে। সূক্ষ্ণ ইলেকট্রনিক ক্যারিয়ার ছেয়ে রয়েছে গোটা বনাঞ্চল।
রাজধানী সান্তাফে থেকে একটা সড়ক গেছে লস আলামোসে। সে সড়কেরও শেষের দু’মাইল সংরক্ষিত। বিশেষ অনুমতি প্রাপ্ত নয়, অথবা লস আলামোসের নিজস্ব রেজিস্ট্রিকৃত গাড়ি নয় এমন গাড়ি এ সংরক্ষিত সড়কে প্রবেশ করতে পারে না।
এস্পানোলা থেকে ক্লিফ ডোয়েলিং হয়ে একটা প্রাইভেট রোড লস আলামোস পর্যন্ত এসেছে। এ পথে অনেকগুলো চেকিং পার হতে হয়। আর এ পথে লস আলামোসের স্টাফরা ছাড়া কেউ আসতে পারে না।
এই অবস্থায় একজন লোক কিভাবে ঢুকল লস আলামোস ল্যাবরেটরীতে?
খবর পাওয়ার সংগে সংগেই প্রাপ্ত তথ্যাবলী নিয়ে বৈঠক বসেছিল এফ.বি.আই সদর দফতরে। এসেছিল সেখানে সি.আই.এ ও পেন্টাগনের প্রতিনিধি।
বৈঠকের শুরুতেই পেন্টাগনের স্ট্রাটেজিক উইনস ডেভলপমেন্ট চীফ উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল, ‘কোন ঘরে সে প্রবেশ করেছিল, কিছু খোয়া গেছে কিনা আমাদের?’
এফ.বি.আই চীফ জর্জ আব্রাহাম জনসন বললেন, ‘গ্রাউন্ড ফ্লোরের একটা করিডোরে প্রথম তাকে ডিটেক্ট করা হয়। উপর তলার কোন ঘরে এবং কম্পিউটার রুমে সে প্রবেশ করেছে কিনা তার কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কম্পিউটার অপারেশনে কোন ভিন্ন হাত পড়ার প্রমাণ মেলেনি। তবে আরও অনুসন্ধান না করে শেষ কথাটা বলা যাবে না’।
‘কোন দিক দিয়ে ঢুকেছে তার প্রমাণ পাওয়া গেছে?’ জিজ্ঞেস করে সি.আই.এ’র প্রতিনিধি।
‘না পাওয়া যায়নি। তবে সম্মুখ গেট দিয়ে নয়, এটা নিশ্চিত। সম্মুখ গেটের ক্যামেরা মনিটরিং এবং মূল ভবনে প্রবেশ মুখের ক্যামেরা মনিটরিং এ প্রমাণ হয়েছে সম্মুখ দিয়ে সে প্রবেশ করেনি’। বলল এফ. বি.আই চীফ জর্জ আব্রাহাম জনসন।
‘যে লোকটি ঢুকেছিল, তার ফটো পাওয়া গেছে?’ জিজ্ঞেস করল সি.আই.এ প্রতিনিধি।
‘লস আলামোসের কক্ষ ও করিডোরের ক্যামেরাগুলো অফিস আওয়ারে বন্ধ থাকে। মূল ভবনের প্রবেশ মুখের ক্যামেরা থেকে তার মুখের ডান দিকের একাংশ ও পেছন দিকটার ফটো পাওয়া গেছে এবং গেটের ক্যামেরা থেকে তার সিঁড়িতে ও লনে গড়ানো ছবি পাওয়া গেছে, তাতে তার মুখাবয়বের পূর্ণ চিত্র পাওয়া যাচ্ছে না’।
‘ব্যাড লাক, এখন কি করবেন ভাবছেন?’ বলল পেন্টাগন প্রতিনিধি।
এ মিটিং শেষেই আমি যাচ্ছি লস আলামোসে। সেখানে গেলে হয়তো আরও কিছু বিষয় পরিষ্কার হবে। বলল আব্রাহাম জনসন।
আমাদের লোকরা যারা তাকে ফলো করেছিল, তাদের শেষ খবর কি?’ বলল সি.আই.এ প্রতিনিধি।
খবর ভাল নয়। ক্লীফ ডোয়েলিং এবং এস্পানোলার মাঝখানে লস আলামোস থেকে যে গাড়ি নিয়ে পালিয়েছিল, সে গাড়ি আমরা পেয়েছি। কিন্তু তাকে পা্ওয়া যায়নি’। বলল এফ.বি.আই চীফ।
‘কেমন করে যে গাড়ি রেখে নিরাপদে পালাতে পারল?’ বলল পেন্টাগন প্রতিনিধি।
‘আমাদের তেরজন কমান্ডো গার্ড ছিল লস আলামোসের গেটে। এই তেরজনের নয় জনই পায়ে গুলিবিদ্ধ। মাত্র তিনজন সুস্থ ছিল। এরা তিনজন আবার ছিল বিভিন্ন জায়গায়। একত্রিত হয়ে তারা যখন লোকটিকে তাড়া করে, তখন তারা বেশ পেছনে পড়ে যায়। আর প্রমাণ হয়েছে লোকটির মত এক্সপার্ট ড্রাইভার আমাদের কমান্ডোরাও নয়’।
‘ব্যাড লাক। লোকটি যখন সান্তাফের মেইন রোডে না গিয়ে অনেক ঘোরা পথ ক্লীফ ডোয়েলিং ও এস্পানোলার পথ বেছে নিয়েছে, তখন মনে হয় ঐ পথেই সে এসেছে’। বলল পেন্টাগন প্রতিনিধি।
‘আমাদেরও সেই ধারণা। আমি ইতোমধ্যেই নির্দেশ দিয়েছি, ঘটনার দিন এবং তার আগের দিন যত গাড়ি ঐ পথে লস আলামোসের দিকে এসেছে, সে সবের হদিস বের করে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্যে’। বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
‘ধন্যবাদ’। বলল পেন্টাগন প্রতিনিধি।
পেন্টাগন প্রতিনিধি থামতেই সি.আই.এ প্রতিনিধি বলে উঠল, ‘কিন্তু একটা বিষয় খুবই বিষ্ময়কর, কেউ নিহত হয়নি, নয় জনই আহত হয়েছে এবং আহতরা সবাই পা থেকে হাঁটুর নিচ পর্যন্ত স্থানে গুলিবিদ্ধ’।
‘ঠিক বলেছেন, এ ব্যাপারটা আমাকেও খুব বিষ্মিত করেছে। পা টার্গেট না করলে তো আহতরা প্রায় সবাই নিহত হওয়ার কথা কিন্তু পা লক্ষ্য করে গুলি করল কেন, তার জীবনের ঝুকিঁ নিয়েও?’
‘এ ধরণের ঘটনা আমি এর আগে কখনো শুনিনি। প্রতিপক্ষের গোয়েন্দার কাজ তো এটাই যে যত পারা যায় শত্রু নিধন করে পালাবার পথ পরিষ্কার করা। কিন্তু সে যেন হত্যা নয়, বাধাকে নিষ্ক্রীয় করে পালাবার পথ করে নিতে চেয়েছে’। বলল সি.আই.এ প্রতিনিধি।
‘ঠিক তাই’। বলল এফ.বি.আই চীফ।
এই মিটিং শেষ হয়েছিল অপরাহ্ন ৫টায়।
বিকেল সোয়া পাঁচটায় বিশেষ বিমানে চড়ে এফ.বি.আই চীফ জর্জ আব্রাহাম জনসন যাত্রা করে লস আলামোসের উদ্দেশ্যে।
রাত সোয়া আটটায় সে পৌঁছে লস আলামোস স্ট্রাটেজিক রিসার্চ ল্যাবরেটরীতে।
ল্যাবরেটরীতে পৌঁছেই এফ.বি.আ্ই চীফ লস আলামোস ল্যাবরেটরীর প্রধান পরিচালক ডঃ হাওয়ার্ডকে বলে, ‘আমি ঘটনার স্থানগুলোতে যেতে চাই এবং সেখানেই আমি ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলতে চাই’।
‘সবাই হাজির আছে চলুন’।
জর্জ আব্রাহাম জনসন প্রথম কথা বলল একজন প্রহরীর সাথে। ঐ প্রহরী আহমদ মুসাকে করিডোরে প্রথম দেখে। আহমদ মুসা তাকে পাশেই এক ঘরে নিয়ে সংজ্ঞাহীন করে ফেলে চলে যায়। তার মতে, ‘আক্রমনকারী উত্তর অথবা পশ্চিমের কম্পিউটার রুমের দিক থেকে আসতে পারে। লোকটি শ্বেতাংগ নয়’।
ছবিতে যতটুকু তাকে দেখা যায়, তাতেও মনে হয় লোকটি শ্বেতাংগ নয়। মনে মনে চিন্তা করল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
মিস সারা জেফারসনের কক্ষে এল জর্জ আব্রাহাম জনসন। আত্মগোপনের জন্যে এই সারা জেফারসনের অফিস কক্ষেই আহমদ মুসা প্রবেশ করেছিল।
মিস সারা জেফারসন লস আলামোস ল্যাবরেটরীর রিসার্চ লগ অফিসার। খুবই গোপন ও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সারা জেফারসনের।
সারা জেফারসনকে বসতে বলে নিজে বসতে বসতে জর্জ আব্রাহাম জনসন বলল, ‘এক উপলক্ষে আপনার সাথে দেখা হল। আপনাদের পরিবার আমাদের খুব শ্রদ্ধার পাত্র। প্রেসিডেন্ট জেফারসন ছিলেন আমেরিকার নিজস্ব চিন্তার জনক’।
‘ধন্যবাদ স্যার’। বলল মিস সারা জেফারসন।
‘ধন্যবাদ’ বলে একটু থেমে জর্জ আব্রাহাম জনসন বলল, ‘আপনি নাকি অনুপ্রবেশকারীকে বাইরে বেরুবার পথ বলে দেন?’
একটু হাসল সারা জেফারসন। তারপর গম্ভীর হলো বলল, ‘জি স্যার’।
‘কেন?’
‘অদ্ভূত শত্রুটিকে দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি স্যার’।
‘কেমন?’
‘কারবাইন হাতে লোকটি আমার রুমে ঢুকল, আমি আতংকে চিৎকার করতে যাচ্ছিলাম। লোকটি তার ঠোটেঁ আঙুল ঠেকিয়ে নিষেধ করল। তার চোখে মুখে খুনির রুদ্ররূপ দেখলাম না, খুব শান্ত অচঞ্চল সে। আমাদের কয়েকজন গার্ডকে যখন দৌড়ে যেতে দেখলাম পশ্চিম দিকে, বুঝলাম তারা এ লোকটিরই সন্ধান করছে। আমি ওদের সংকেত দিলাম। এ সময় লোকটি আমাকে বিল্ডিংটির গেট কোনদিকে জিজ্ঞেস করল। আমি বললাম না। আমি ভয় করছিলাম যে, এবার সে কিছু একটা করবে। কিন্তু ‘ধন্যবাদ ম্যাডাম’ বলে বাইরে বেরুবার উদ্যোগ নিল সে। এ সময়ই আমাদের গার্ডরা ছুটে এল এ দরজায়। লোকটি আমার দিকে এমন একটা সবজান্তা দৃষ্টি নিয়ে তাকাল যে, আমি বুঝতে পারলাম আমি গার্ডদের সংকেত দিয়ে ডেকে এনেছি সে সেটা বুঝতে পেরেছে। আমি ভয়ে কাঠ হয়ে গেলাম। কাঁপতে শুরু করলাম। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে লোকটি বলল, ‘ভয় নেই, সংকেত দিয়ে ওদের ডেকে এনে দেশের প্রতি আপনি অনুপম দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছেন’। তারপর দেখলাম, দরজা খুলে প্রবেশ করা আমাদের পাঁচজন গার্ডকেই সে হত্যা করতে পারতো, কিন্তু করলো না। আমাদের লোকরা পায়ে গুলি খাবার পর পড়ে গিয়ে আবার যখন কারবাইন তুলে নিচ্ছিল তখন সে বলে, ‘তোমাদের হত্যা কতে চাইনি। কিন্তু আবার কারবাইনে হাত দিলে গুলি এবার পা নয় বক্ষ ভেদ করবে’। শত্রুর এই মানবিকতা, বদান্যতা আমাকে মুগ্ধ করেছে। এজন্যে দ্বিতীয় বার বেরুবার পথ সে জিজ্ঞেস না করলেও পথ বলে দেয়াকে আমি দায়িত্ব মনে করলাম’। দীর্ঘ বক্তব্য দিয়ে থামল মিস জেফারসন।
‘ধন্যবাদ মিস জেফারসন। আমাদের ক্ষতি হয়েছে, কিন্তু আপনি তাকে উপযুক্ত বিনিময় দিয়ে দিয়েছেন’।
‘খুব কি ক্ষতি করেছি? সে যেমন অসাধারণ বুদ্ধিমান, তাতে গেট বের করা তার জন্য কঠিন হতো না’।
‘তাও ঠিক’। বলে জর্জ আব্রাহাম জনসন কিছুটা চিন্তান্বিত হয়ে পড়ল। বলল, ‘আপনার কথায় শত্রুর যে কয়টা বৈশিষ্ট ফুটে উঠল, তাতে রহস্যের জটিলতা আরও বাড়ল’।
‘কিভাবে?’ প্রায় একসাথেই কথাটা বলে উঠল লস আলামোসের প্রধান পরিচালক ডঃ হাওয়ার্ড এবং পেন্টাগনের আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা প্রধান জেনারেল শেরউইন।
‘যে লোক এখানে প্রবেশ করেছিল, সে লস আলামোসে ইতিপূর্বে আসেনি, এর ছবিও দেখেনি এবং এর ইন্টারন্যাল ডিজাইন সম্বন্ধেও তার জ্ঞান ছিল না। এমন একজন লোককে কোন শত্রুপক্ষই লস আলামোসে পাঠাতে পারেনা। দ্বিতীয়তঃ, লোকটির সাথে সরাসরি শত্রুতা হলে মিস জেফারসনের শত্রুতামূলক কাজকে দায়িত্বশীলতা বলা এবং গার্ডদের কাউকেই হত্যা না করা আমার কাছে খুবই রহস্যপূর্ণ মনে হচ্ছে। একজন শত্রুর এই ধরণের আচরণ হওয়া অস্বাভাবিক’।
‘কিন্তু সে লস আলামোসে অনুপ্রবেশ করেছে এটাতো ঠিক?’ বলল জেনারেল শেরউড।
‘অবশ্যই’।
বলে একটু ভাবল জর্জ আব্রাহাম জনসন। তারপর বলল, ‘দুই সত্যের মাঝখানে একটা মিসিং লিংক আছে, যা আমাদের সামনে নেই। লোকটিকে ধরতে পারলেই এর সমাধান হতে পারে’।
কথা শেষ করেই সে চট করে তাকাল মিস জেফারসনের দিকে। বলল, ‘আপনি তো লোকটিকে খুব কাছে থেকে ঘনিষ্ঠভাবে দেখেছেন। তার সম্পর্কে বলুন তো’।
লোকটি অবশ্যই এশিয়ান অরিজিন। লোকটিকে আরবী মনে হয়েছে, আবার কখনও মনে হয়েছে তুর্কি চাইনিজ মিশ্রণ। চোখ কালো, কালো চুল। সব সময় শান্ত নিরুদ্বিগ্ন মুখ। গায়ের রং উজ্জ্বল স্বর্ণাভ। আমি অবাক হয়েছি, দরজায় আমার ডেকে আনা তার শত্রুদের দেখেও স্বাভাবিক কন্ঠে আমাকে ধন্যবাদ দিচ্ছে এবং শত্রুর সাথে যখন মোকাবিলার জন্যে দাঁড়াচ্ছে তখন তার মুখ দেখে আমার মনে হয়েছে এটা যেন তার কাছে খেলা’।
মিস জেফারসনের চেহারার বর্ণনায় হঠাৎ করেই জর্জ আব্রাহাম জনসনের চোখের সামনে একটা মানুষের ছবি ভেসে উঠল। সে লোকটি ওহাইও নদীর প্রবল স্রোতে ডুবে যাওয়া তার নাতিকে উদ্ধার করেছিল। আবার মিস জেফারসন লোকটার যে চরিত্রের বর্ণনা দিল তাতে তার চোখে ভেসে উঠেছে সেই আহমদ মুসার ছবি। এফ.বি.আই-এর ফাইলে আহমদ মুসার ডসিয়ারে তার এই অস্বাভাবিক গুণের কথা লেখা হয়েছে।
মনের এ কথাগুলোকে চেপে গিয়ে জর্জ আব্রাহাম জনসন বলল, ‘মিস জেফারসন আমি জানি আপনি ড্রইং-এ অত্যন্ত ভাল। আপনি যে ছবিটা ভাষায় তুলে ধরলেন, তা দয়া করে আমাদের এঁকে দিন’।
‘দিতে পারি একটা শর্তে’।
‘কি শর্ত?’
‘তিনি ধরা পড়লে তার সাথে দেখা করে তাকে ধন্যবাদ দেবার আমাকে একটু সুযোগ দেবেন’।
‘মঞ্জুর’, হেসে বলল এফ.বি.আই চীফ।
জর্জ আব্রাহাম জনসন তার কথা শেষ করতেই মিস জেফারসন ড্রয়্যার থেকে দুই শিট কাগজ বের করে মেলে ধরল টেবিলে। বলল, ‘কোনটি নেবেন নিন’।
একই লোকের দু’টি স্কেচ।
স্কেচ দেখে চমকে উঠল জর্জ আব্রাহাম জনসন, ‘এ যে তাঁর নাতিকে উদ্ধার করা সেই লোকের মত’।
দু’টি থেকে একটি স্কেচ তুলে নিলেন জর্জ আব্রাহাম জনসন।
‘ধন্যবাদ মিস জেফারসন’ বলে উঠে দাঁড়াল জর্জ আব্রাহাম। তার সাথে সাথে সবাই।

ক্লিফ ডোয়েলিং এলাকা পেরিয়ে আহমদ মুসার জীপ তীর বেগে ছুটছে এবার এস্পানোলার দিকে।
কিন্তু কোথায় যাচ্ছে সে? এই রক্তভেজা শরীর আর রক্তে প্লাবিত জীপ নিয়ে শহরে ঢুকবে সে কেমন করে?
আহত বাহুর সন্ধি থেকে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে, এখনও হচ্ছে। ব্যান্ডেজ তো দূরে, আহত জায়গা বাঁধবারও সময় সে পায়নি। পেছনে তাড়া করে আসছে সিকিউরিটির লোকেরা।
প্রচুর রক্তক্ষরণে দুর্বলও হয়ে পড়েছে আহমদ মুসা। মাথা ঝিমঝিম করছে অনেকক্ষণ থেকে। দৃষ্টিও তার ঝাপসা হয়ে আসছে যেন।
আহমদ মুসা বুঝতে পারল, এই অবস্থায় বেশীক্ষণ সে ড্রাইভ করতে পারবে না। আর এ গাড়িতে থাকলে সে মারা পড়ে যাবে।
বনাঞ্চল প্রায় পার হয়ে এসেছে। পাতলা হয়ে এসেছে গাছপালা। সামনেই মাঠ। কভার নেবার জায়গা সেখানে কম।
ক্লীফ ডোয়েলিং থেকে এস্পানোলা পর্যন্ত আসা ও যাওয়ার পথ পাশাপাশি, কিন্তু আলাদা। মাঝখানে আইল্যান্ড। তাতে গাছ পালা, ঝোপঝাড়ও আছে।
আহমদ মুসা সিদ্ধান্ত নিল। কারও সাহায্য তাকে নিতে হবে। এ জন্যে এস্পানোলা থেকে আসা গাড়ির জন্যে অপেক্ষা করা তার জন্যে নিরাপদ। এ রাস্তায় সিকিউরিটির লোকরা যে কোন সময় এসে পড়তে পারে।
আহমদ মুসা গাড়ি দাঁড় করাল।
এস্পানোলা থেকে আসা গাড়ির রাস্তা ডান দিকে। কিন্তু আহমদ মুসা নামল বাঁ দিকে। গাড়ি থেকে নেমে সে রাস্তা অতিক্রম করে বাঁদিকের জংগলের পাশে এসে দাঁড়াল। পেছন ফিরে দেখল, ফোটা ফোটা রক্ত রাস্তার উপর পড়েছে, তারপর রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আরও রক্ত পড়ার সুযোগ দিল।
এরপর আহমদ মুসা রুমাল দিয়ে ক্ষতস্থান চেপে ধরে রক্তপড়া যথাসম্ভব বন্ধ করে জংগলের ভেতরে ঢুকে গেল। টলতে টলতে এগোলো পেছনের দিকে।
কিছুটা এগিয়ে আবার এস্পানোলাগামী রাস্তা অতিক্রম করে এস্পানোলা থেকে আসা রাস্তাও অতিক্রম করল। সে রাস্তার ডানপাশে এক ঝোঁপের আড়ালে আশ্রয় নিল। একটা কারবাইন তখনও তার ডান কাঁধে ঝুলছে। যদি সে ধরা পড়েই যায়, তাহলে তার শেষ রক্ষার অস্ত্র এটা।
বেশী দেরী করতে হলো না। মাত্র দু’মিনিট পরেই লস আলামোসের সিকুরিটি ক্যারিয়ারটা তীর বেগে এসে তার ফেলে আসা জীপের পাশে দাঁড়াল।
জীপ ফাঁকা দেখার পর তারা হৈচৈ করে উঠল। তারা রাস্তার ওপাশে নেমে গেল। খুঁজতে লাগল তারা আশে পাশে। কিছুক্ষণ পর একজনের উচ্চ কন্ঠ চিৎকার করে উঠল, ‘তোমরা সবাই চলে এস। এখানে দেখ জমাট বাঁধা অনেক রক্ত। নিশ্চয় তাকে কেউ গাড়ি করে তুলে নিয়ে গেছে এখান থেকে’।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা রক্তাক্ত জীপটাকে ক্যারিয়ারের পেছনে বেঁধে রাস্তার সামনের একটু অংশ ঘুরে আহমদ মুসার সামনের রাস্তা দিয়েই লস আলামোসের দিকে চলে গেল।
আহমদ মুসা শুনতে পেল অয়্যারলেসে কাউকে যেন তারা ব্রিফ করছে, ‘লোকটি এস্পানোলার দিকেই গেছে কোন প্রাইভেট গাড়িতে। সবগুলো গাড়ির উপর নজর রাখতে হবে এবং সবগুলো ক্নিনিক হাসপাতাল পাহারা দিতে হবে। সে গুরুতর আহত, নিশ্চয় কোন হাসপাতাল বা ক্নিনিকে সে যাবে’।
ওরা চলে গেল।
ধরা পড়া থেকে বাঁচল আহমদ মুসা।
কিন্তু এরপর সে কি করবে? এখনো রক্ত পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটার সাধ্য তার নেই। তার উপর বুক ফাটা তৃষ্ঞা তাকে পাগল করে তুলেছে। মনে হচ্ছে এক সাগর পানিতেও তার তৃষ্ঞা মিটবে না।
তৃষ্ঞার এ অকথ্য যন্ত্রণা তার দেহের সব শক্তি যেন শুষে খাচ্ছে। কিন্তু তবু তাকে এগোতে হবে। একটা গাড়ি তাকে খুঁজে পেতে হবে। যে কাজ নিয়ে সে এসেছে, তার তো কিছুই হয়নি।
ঝোঁপ থেকে বেরিয়ে আহমদ মুসা এগোলো রাস্তার দিকে। ঝাপসা চোখে টলতে টলতে যাচ্ছে আহমদ মুসা।
রাস্তায় উঠে সে মনে করল, এস্পানোলা গামী গাড়িতে তাকে উঠতে হবে এবং এ জন্যে ওপারের ঐ রাস্তায় তার যাওয়া দরকার।
রাস্তা পার হবার জন্যে পা বাড়াল আহমদ মুসা।
তার বাম কাঁধে এখনো ঝুলছে কারবাইনটা।
আহত কাঁধে কারবাইনটাকে দশগুণ ভারী মনে হচ্ছে। আর এ কারবাইনটা তার জন্যে এখন বিপজ্জনক।
হাঁটতে হাঁটতেই আহমদ মুসার ডান হাত বাম কাঁধ থেকে কারবাইনটা নামাবার কাজ শুরু করে দিল।
বাম হাত একটু উপরে তুলতে গিয়ে তীব্র ব্যথা পেল আহমদ মুসা। সে একটু অমনোযোগী হয়ে পড়েছিল।
ব্যথা পাওয়ার পর দাঁড়িয়ে পড়েছিল সে।
ঠিক এ সময়েই কাছেই একটা হর্ণ বেজে উঠল। চমকে উঠে দ্রুত তাকাতে গিয়ে মাথা ঘুরে উঠল আহমদ মুসার। অন্ধকার হয়ে গেল তার চারদিকের পৃথিবীটা।
নিজের উপর তার সব নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গেল।
এস্পানোলা থেকে ক্লীফ ডোয়েলিং হয়ে যে রাস্তা কিউবো শহর পর্যন্ত গেছে, তা এক্সপ্রেস ওয়ে না হলেও কার্যত এক্সপ্রেস ওয়ে হিসেবেই ব্যবহৃত হয়।
একটা গাড়ি তীব্র বেগে চলছিল ক্লীফ ডোয়েলিং এর দিকে। একজন লোককে রাজার হালে রাস্তা পার হতে দেখে ড্রাইভার হর্ন দিল একটু বিরক্ত হয়েই।
কিন্তু লোকটি দ্রুত সরে যাবার বদলে রাস্তায় ঢলে পড়ে গেল।
যথাসময়ে গাড়ির ব্রেক কষলেও গাড়িটা লোকটির প্রায় গা স্পর্শ করে দাঁড়ালো।
একজন তরুনী ড্রাইভ করছিল গাড়িটা।
তরুণীটি সান্তা আনা পাবলো।
তার পাশে তার দাদা, সেই বৃদ্ধ রসওয়েল পাবলো।
পেছনের সীটে সান্তা আনার দাদী।
গাড়ি থামিয়েই একবার বিরক্তি ও উদ্বেগ নিয়ে গাড়ি থেকে নামল সান্তা আনা। বৃদ্ধ রসওয়েল পাবলোও নামল গাড়ি থেকে।
সান্তা আনাই প্রথম পৌঁছেছিল পড়ে যাওয়া লোকটির কাছে।
পড়ে যাওয়া লোকটি আহমদ মুসা।
সান্তা আনা রক্তাক্ত আহমদ মুসাকে দেখেই ‘দাদু’ বলে চিৎকার করে উঠল।
বৃদ্ধ রসওয়েল পাবলোও সেখানে পৌঁছেছে।
আহমদ মুসার মুখের উপর চোখ পড়তেই চমকে উঠল বৃদ্ধ রসওয়েল। বলল দ্রুত কন্ঠে, ‘আরে এযে সেই ছেলেটা, এর এ দশা কেন?’
‘দাদু তুমি চেন এঁকে?’ জিজ্ঞেস করল সান্তা আনা।
‘হ্যাঁ, খুব ভাল ছেলে। আমরা এক সঙ্গে প্লেনে এসেছি’।
‘ভাল ছেলে বলছ, কিন্তু সাথে কারবাইন কেন? গুলিবিদ্ধ হয়েছে নিশ্চয় গোলাগুলি করতে গিয়ে’।
সান্তা আনার দাদী বৃদ্ধাও এসে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। বলল, ‘তোমরা দাঁড়ায়ে কেন? ছেলেটা তো মারা যাবে। তাড়াতাড়ি গাড়িতে তোল’।
‘একটা ঝামেলায় পড়া কি ঠিক হবে? কেন, কি ঘটেছে আমরা কিছুই জানি না’। সান্তা আনা বলল।
‘কিছু জানার দরকার নেই, আমার চেনায় অবশ্যই ভূল হয়নি। ছেলেটি ভাল। নিশ্চয় কোন মারাত্মক বিপদে জড়িয়ে পড়েছে’।
বলে বৃদ্ধ আহমদ মুসাকে পাঁজা কোলা করে তুলে নেবার উদ্যোগ নিল।
আর কিছু না বলে সান্তা আনাও এগিয়ে এল। বলল, ‘দাদু ওঁর সামনের দিকটা ধর, আমি পেছনটা ধরছি’।
দাদা নাতনি দু’জনে মিলে আহমদ মুসাকে পেছনে সিটে তুলে নিল।
বৃদ্ধা কারবাইনটাও গাড়িতে তুলছিল।
সান্তা আনা না না করে উঠল। বলল, ‘দাদী, ঐ আপদ তুমি গাড়িতে তুলো না’।
‘ঠিক আছে। বাছাটার জ্ঞান ফিরুক। তারপর ফেলে দেয়া যাবে। জিনিষটা ওর তো’।
আহমদ মুসাকে গাড়িতে তুলেই বৃদ্ধ রসওয়েল বোতল থেকে ঠান্ডা পানি আহমদ মুসার মুখে ছিটাতে লাগল।
সান্তা আনা তার গাড়ি রাস্তার পাশে একটা গাছের ছায়ায় নিয়ে দাঁড় করিয়েছে।
সামনে দুই সিটে দাদী ও নাতনী এবং পেছনের সিটে বৃদ্ধ রসওয়েল। সবাই তাকিয়ে আহমদ মুসার মুখের দিকে।
‘আঘাত তার বাহু সন্ধিতে। আঘাতে সে সংজ্ঞা হারায়নি। সংজ্ঞা হারাবার কারণ হতে পারে রক্তক্ষরণজনিত দুর্বলতা। বলল বৃদ্ধ রসওয়েল।
‘দাদু, তুমি লোকটাকে ভাল বলছ কিসের ভিত্তিতে?’
‘ছেলেটার মুখ দেখ তো। এ কোন খারাপ লোকের চেহারা?’
‘খারাবিটা মানুষের ভেতরের ব্যাপার, দেহের ব্যাপার নয়’। বলল সান্তা আনা।
‘দেহের ব্যাপার নয় বোন, কিন্তু চেহারার ব্যাপার অবশ্যই। মানুষের চেহারায় তার পাপ অথবা পুণ্যের প্রকাশ অবশ্যই ঘটে’।
সান্তা আনা কিছু বলতে যাচ্ছিল।
নড়ে উঠল আহমদ মুসা। চোখ খুলল সে। আচ্ছন্নের মত তার দৃষ্টি।
শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাওয়া ঠোঁট। সে দু’ঠোঁটের ফাঁক গলিয়ে অস্ফুট একটা শব্দ বেরিয়ে এল, ‘পানি, পা….নি’।
বৃদ্ধ রসওয়েল আহমদ মুসার মাথা একটু উঁচু করে তুলে ধরে পানির বোতল তার মুখে ধরল।
একবারেই এক বোতল পানির সবটুকু খেয়ে ফেলল আহমদ মুসা।
পানির বোতল মুখ থেকে সরাতেই আহমদ মুসা মুখ ঘুরিয়ে যার কোলে তার মাথা তার দিকে তাকাল।
তাকিয়েই বিষ্মিত আহমদ মুসা ডান হাত দিয়ে বাম হাত চেপে ধরে উঠে বসল। বলল, ‘স্যার আপনি?’
তারপর চারদিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি গাড়িতে কি করে এলাম?’ দুর্বল কন্ঠ আহমদ মুসার।
‘এসব পরে শুনো। তোমাকে এখন তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নেয়া দরকার’।
‘না জনাব, হাসপাতাল কিংবা ক্লিনিকে নয়। এতক্ষণে আশপাশের শহরসহ সব হাসপাতাল ও ক্লিনিকে পুলিশ নিশ্চয় পাহারা বসিয়েছে’।
‘কেন তাদের সাথে তোমার বিরোধ কি, কি ঘটেছে?’ উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল বৃদ্ধ রসওয়েল।
‘ঘটনা অনেক বড়। তবে এটুকু জেনে রাখুন আমি নির্দোষ, কিন্তু সরকারের সিকিউরিটি ফোর্সের সাথে আমার সংঘাত ঘটেছে, এটা ঠিক। আমি তাদের গুলিতে আহত, তাদেরও অনেকে আমার গুলিতে আহত হয়েছে। এই কারবাইনটাও আমি সিকিউরিটি ফোর্সদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছি। আরও শুনুন, আমি হয়তো এখন তাদের তালিকায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি যাকে তাদের অবশ্যই ধরা প্রয়োজন। আমি সম্পূর্ণ নিরপরাধ হবার পরেও এসব কিছু সত্য। এখন আপনারা আমাকে বিশ্বাসও করতে পারেন, অথবা আমাকে পুলিশের হাতেও দিতে পারেন’।
‘দাদু মনে হচ্ছে গুরুতর কিছু ঘটেছে। তবে ওঁর কাছ থেকে সবকিছু না শুনে ওকেঁ আমরা পুলিশের হাতে দিতে পারিনা’। বলল সান্তা আনা।
‘ও তো দুটি বিকল্প দিয়েছে। আমি প্রথমটিকেই গ্রহন করেছি। ওর প্রতি বিশ্বাস আমার নষ্ট হয়নি’। বলল বৃদ্ধ রসওয়েল পাবলো।
‘তাহলে আমরা এখন এস্পানোলা ফিরি দাদু?’ বলল সান্তা আনা।
‘আমার মনে হয় সান্তা ক্লারা এবং এস্পানোলাগামী প্রতিটি গাড়ি আজ চেক করা হবে’। আহমদ মুসা বলল।
ভাবছিল বৃদ্ধ রসওয়েল।
‘তাহলে দাদু ওঁকে আমরা আমাদের কম্যুনিটি হাসপাতালে নিয়ে যাই। ওটা এস্পানোলার বাইরেও হবে। ওখানে হোয়াইট পুলিশ মাতব্বরী করতে পারবেনা’।
‘ঠিক বলেছিস বোন। কিন্তু কোন পথে যাবি?’ বলল রসওয়েল।
‘ভেব না দাদু। আমি এস্পানোলা রোড ও এস্পানোলার আশে পাশে যাব না’।
বলে গাড়ি স্টার্ট দিল সান্তা আনা। গাড়ি ছুটে চলল।
‘কোথায় যাচ্ছিলাম, কোথায় যা্চ্ছি। একেই বলে ঈশ্বরের কাজ’। বলল বৃদ্ধা, সান্তা আনার দাদী।
‘তুমি তো খুশীই হয়েছ দাদী’। সান্তা আনা বলল।
‘ঈশ্বর যা করেন ভালোর জন্যই করেন’। দাদী বলল।
‘তোমরা আমাকে লুকিয়ে রাখছিলে, এটা বোধ হয় ঈশ্বর ভালোর জন্যেই করেছেন?’ সান্তা আনা মুখে ম্লান হাসি টেনে বলল।
‘নিশ্চয় তাই’। বলল সান্তার দাদী।
‘সত্যকে মিথ্যা দিয়ে ঢাকা বোধ হয় ঈশ্বরের কাজ?’ ভারি গলায় বলল সান্তা আনা।
আহমদ মুসা বিষ্মিত হলো আলোচনার এই সিরিয়াস মোড় পরিবর্তনে এবং সান্তা আনাকে কান্নার কাছাকাছি পৌঁছতে দেখে। পটভূমিতে কোন বড় ঘটনা আছে কি?
বৃদ্ধ রসওয়েল হাসল। বলল, ‘এ দিক ভেবে ড্রাইভ খারাপ করো না বোন। নিশ্চিত থাক, ঈশ্বর সত্যকে সত্যই রাখেন’।
সান্তা আনা কিছু বলল না।
তার দাদীও নয়।
কিন্তু সবার মনেই একটা তোলপাড়।
সান্তা আনার আব্বা আম্মা জোর করেই সান্তা আনাকে পাঠিয়ৈ দিচ্ছে তার দাদা দাদীর সাথে তাদের পূর্বপুরুষের নিবাস জেমিস পাবলোতে।
জেমিস পাবলো সান্তাফে জাতীয় বনাঞ্চলের দক্ষিণ পশ্চিম অংশে পাবলো রেড ইন্ডিয়ান সংরক্ষিত এলাকায়।
বনবাসের মতই ব্যাপার অনেকটা। সান্তার বাবা মা এবং ইন্ডিয়ানরা চায়, সান্তা আনা মাস খানেকের মত নাবালুসি পরিবারের সংস্পর্শ থেকে দুরে থাক এবং মামলায় সাক্ষী দেয়ার কোন সুযোগ না পাক। এজন্যে সন্তাফে এবং এস্পানোলার কোন জায়গায় সান্তা আনার অবস্থান তারা নিরাপদ মনে করে নি।
অনেকক্ষণ পর সান্তা আনার দাদা রসওয়েল পাবলোই বলল, ‘বুঝলে সান্তা, হতে পারে ঈশ্বরের হাতই তোমাকে এস্পানোলা ফিরিয়ে নিচ্ছে’।
‘ধন্যবাদ দাদু’। বলল সান্তা আনা। তার শুষ্ক ঠোঁটের কোণে একটা বেদনার হাসি।
তার দৃষ্টি সামনে প্রসারিত।
কিন্তু তাতে একটা অসহ্য যন্ত্রণা।
সেই যে সান ঘানেমকে পুলিশ নেয়ে গেল, তারপর সান ঘানেমের আর কোন খবর সে পায় নি। দেখা করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু বাড়ি থেকে কোন মতেই তাকে বের হতে দেয়া হয়নি। কি ভাবছে সান ঘানেম তাকে? ভাবছে কি সে যে, সবার মত আমিও তাকে ভাইয়ার খুনি ভেবে তার কাছ থেকে সরে গেছি।
হঠাৎ কান্নার একটা জোয়ার উথলে উঠলো সান্তা আনার বুক থেকে।
সান্তা আনা ঠোঁট কামড়ে তা রোধ করার চেষ্টা করল।
কান্না চাপতে গিয়ে থরথর করে কেঁপে উঠল সান্তা আনার দেহ।
পাশ থেকে তার দাদী বুঝল সান্তা আনার মনের অবস্থা। ধীরে ধীরে সে তার বাম হাত সান্তার পিঠে রাখল। বলল, সব ঠিক হয়ে যাবে বোন। ঈশ্বর আছেন’।
দাদীর এ সান্ত্বনায় সান্তা আনার দু’চোখ বেয়ে নেমে এল নিরব অশ্রুর বন্যা।

এস্পানোলা শহর। বৃদ্ধ রসওয়েলের বাড়ি।
| ← Previous | | | Next → | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top