২৯. আমেরিকায় আরেক যুদ্ধ

চ্যাপ্টার

‘মিঃ জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন, আপনার রিপোর্ট পড়লাম। তার সাথে সাথে এফ.বি.আই ও সি.আই.এ’র জর্জ আব্রাহাম ও অ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থারের পাঠানো রিপোর্ট আবার দেখলাম। তাদের রিপোর্ট থেকে আপনার রিপোর্টে কিছু ঘটনা বেশি আছে। এফ.বি.আই হেড অফিসে কম্পিউটার ধ্বংসের ঘটনা, সাবা বেনগুরিয়ান ও আইজ্যাক বেনগুরিয়ানের কাহিনী, জর্জ আব্রাহামের বাড়ি থেকে কম্পিউটার চুরির ঘটনা এবং সর্বশেষে পেন্টাগনের পাশের একটা ঘটনায় জর্জ জুনিয়র ও সাবা বেনগুরিয়ান উদ্ধার হওয়া ও আহমদ মুসার সাক্ষাৎ পাওয়ার এই ঘটনাগুলো জর্জ আব্রাহাম ও অ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থারের রিপোর্টে নেই। কিন্তু তাদের রিপোর্টের সাথে আপনার রিপোর্টের অন্য কোন পার্থক্য নেই। তাদের মত আপনিও সব দায় চাপিয়েছেন জেনারেল শ্যারন অর্থাৎ ইহুদীদের উপরে। এ বিষয়টা আমাকে বিস্মিত করেছে। সেই সাথে আমাদের এফ.বি.আই চীফ, সি.আই.এ চীফ, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা ব্যবস্থা ও সশস্ত্র বাহিনী প্রধান সকলেই আহমদ মুসার ফাঁদে পড়েছেন, এটাও আমি মনে করতে পারছি না। বিষয়টা আমাকে খুব ভাবিত করেছে বলেই যে সময়ে আপনি সাক্ষাৎ চেয়েছিলেন, তার আগেই আমাদের এ সাক্ষাৎ হচ্ছে। আমি উদ্বিগ্ন। আমি সত্যে পৌঁছাতে চাই জেনারেল।’
দীর্ঘ কথা শেষ করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট অ্যাডামস হ্যারিসন থামলেন। তার কপাল কুঞ্চিত। চোখে মুখে গভীর জিজ্ঞাসার ছাপ।
‘ধন্যবাদ স্যার দ্রুত সাক্ষাতের সুযোগ দেয়ার জন্যে। স্যার আপনাকে আশ্বস্ত করতে পারি, সত্য দুই রকম হয় না বলেই আমি মনে করি ওদের রিপোর্টের সাথে আমাদের রিপোর্ট মিলে গেছে।’ বিনীত কন্ঠ জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটনের।
‘কিন্তু আপনার জেনারেল শেরউড তো জর্জ আব্রাহাম ও অ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থারদেরই সাথী ছিলেন।’ বলল প্রেসিডেন্ট অ্যাডামস হ্যারিসন জেনারেল ওয়াশিংটনের মুখের উপর সন্ধানী দৃষ্টি ফেলে।
‘মহামান্য প্রেসিডেন্ট আমি টেলিফোনে আপনাকে জানিয়েছি, কেউকে ডিফেন্ড বা ডিফেম করা আমার লক্ষ্য নয়। ভয়াবহ যে সত্য আমার সামনে এসেছে, তা মহামান্য প্রেসিডেন্টের অবগতিতে আনা আমি প্রয়োজন মনে করেছি।’
‘ধন্যবাদ জেনারেল।’ বলে একটু থামল প্রেসিডেন্ট এ্যাডামস হ্যারিসন। কপাল তার নতুন করে আবার কুঞ্চিত হলো। ফুটে উঠল চোখে মুখে জিজ্ঞাসা। বলল, ‘আহমদ মুসা সম্পর্কে আপনার অভিমত বলুন তো?’
মুখটা একটু ম্লান হলো জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটনের। আহমদ মুসার ব্যাপারে প্রেসিডেন্টের প্রবল বিরক্তির কথা সে জানে। কি জবাব দেবে সে প্রেসিডেন্টের প্রশ্নের। কোন পক্ষে ঢলে পড়ার মত কথা বলা কি এই সময় ঠিক হবে।
উত্তর দিতে একটু দেরী হয়েছিল জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটনের।
আপনাকে খুবই স্পষ্টবাদী বলে জানি জেনারেল। না হলে এ প্রশ্ন আপনাকে করতাম না।’
‘ধন্যবাদ মহামান্য প্রেসিডেন্ট।’ বলে একটু থামল জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন। একটু ভাবল। মনে হয় গুছিয়ে নিল কথা। তারপর বলল, ‘একজন পারফেক্ট জেন্টলম্যান মনে হয়েছে তাকে আমার কাছে। বিপ্লবীর কোন কঠোরতা তার চেহারা ও কথার মধ্যে সামান্যও নেই। লস আলামোসের ঘটনা তদন্তসহ গোটা মিশনে তিনি আমাদেরকে আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করেছেন বলে মনে হয়েছে।’
‘সেটা তো নিজে বাঁচার জন্যে। দায়টা যাতে ইহুদীদের ঘাড়ে চাপানো যায়।’ বলল প্রেসিডেন্ট এ্যাডমস হ্যারিসন।
‘মহামান্য প্রেসিডেন্ট ঠিকই বলেছেন। আর দোষ স্খলন, আমাদেরকে সহযোগিতা এবং সত্য উদ্ধার পরস্পর পরিপূরক হয়েছে।’
‘আপনার কথায় মনে হচ্ছে তাকে গ্রেফতার করা ঠিক নয়। জানেন তো, সে আইনের হাত থেকে পালিয়েছে?’
‘অবশ্যই আইন সবার উপরে মহামান্য প্রেসিডেন্ট। তিনি এখন আমাদের হাতেই পেন্টাগনে আছেন। তবে মাননীয় প্রেসিডেন্ট, সেদিন আইনের হাত থেকে পালিয়ে আসায় আমাদের অমূল্য লাভ হয়েছে। বলতে গেলে তার জন্যেই জর্জ জুনিয়র, সাবা বেনগুরিয়ানসহ ঘটনার অব্যর্থ দুটি প্রমাণ আমাদের হাতে এসেছে।’
‘তবু জেনারেল, আইন ভাঙাকে আইন ভাঙা হিসেবেই দেখতে হবে।’ হাসি মুখে বলল প্রেসিডেন্ট।
‘মাফ করবেন মহামান্য প্রেসিডেন্ট, আমি যা শুনেছি তাতে বুঝেছি তার সহযোগিতা নিতে গিয়ে তাকে গ্রেফতার করা হয়নি। সেদিন বিমান বন্দরে তাকে জানানো হয়নি যে, পুলিশ তাকে গ্রেফতার করতে গেছে। সে চলে যাবার পর পুলিশ তাকে ঢালাওভাবে দোষ দেবার চেষ্টা করেছে।’
প্রেসিডেন্ট আবার হাসল। বলল, ‘তাঁর পক্ষে আপনার উপস্থাপনা সুন্দর হয়েছে। কিন্তু জেনে রাখুন জেনারেল, সে চরমপন্থী উৎকট এক মৌলবাদী। ছোবল দেওয়াই তার কাজ। তাকে ভদ্রলোক বলছেন। কোন ভদ্রলোক কি অবৈধভাবে কোন দেশে প্রবেশ করে। সে অবৈধভাবে আমেরিকায় প্রবেশ করেছে।’
‘আমি যতদূর জানি মহামান্য প্রেসিডেন্ট, হোয়াইট ঈগলরা তাকে কিডন্যাপ করে আমেরিকায় এনেছে। তারপর ঘটনাচক্র তাকে কোথাও স্থিরভাবে দাঁড়াতেই দেয়নি।’ বলল জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন খুব নরম কন্ঠে।
‘সে ইতিহাস আমি এফ.বি.আই ও সি.আই.এ দুই তরফ থেকেই পেয়েছি। জানি সে কাহিনী। কিন্তু সে সুযোগ পেলে ছোবল মারবে, এ ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ নিশ্চয় করবেন না।’
‘আমি যতদূর জানি, তার জাতির স্বার্থের ব্যাপারে সে আপোষহীন। তবে সবগুলো অপারেশনই তার আত্মরক্ষামূলক। মহামান্য প্রেসিডেন্ট, যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জেনারেল শ্যারনরা তাকে হত্যা বা কিডন্যাপ করার জন্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে তখন আহমদ মুসা সান ওয়াকার, কারসেন ঘানেম, ডাঃ মার্গারেট ও লায়লা জেনিফারকে উদ্ধারের জন্যে নিজেকে বিপন্ন করেও কাজ করে যাচ্ছে।’ বলল জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন নরম কন্ঠে।
‘তার মানে আপনি বলছেন, সমবেদনা তার প্রাপ্য?’ গম্ভীর কন্ঠ প্রেসিডেন্টের।
‘স্যরি মহামান্য প্রেসিডেন্ট, তা আমি বলতে পারি না। আমি শুধু ঘটনার কথাই বলেছি। তবে আহমদ মুসা ডেঞ্জারাস, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। এত শার্প? এত সুক্ষ্মদর্শী কাউকে আমি দেখিনি মহামান্য প্রেসিডেন্ট। লস আলামোস থেকে আসার পথে তার সুক্ষ্মদর্শিতা যেভাবে আমাদের দলকে দুবার সাক্ষাত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করেছে, যেভাবে পেন্টাগনে ব্রিগেডিয়ার স্টিভকে ধরিয়ে দিয়েছে তা অবিশ্বাস্য।’ বলল জেনারেল ওয়াশিংটন।
‘সত্যিই অবিশ্বাস্য জেনারেল। এজন্যেই তার ব্যাপারে সাবধান হতে হবে। সে এক মৌলবাদী এবং কুশলী সেভিয়ার সেই সাথে নিষ্ঠুর হত্যাকারীও।’ প্রেসিডেন্ট বলল।
‘তবে একটা সুবিচার তার প্রতি করতে হবে মহামান্য প্রেসিডেন্ট। আত্মরক্ষা ছাড়া হত্যার দৃষ্টান্ত তার খুব কমই আছে। আক্রমণকারী শত্রুকেও সে প্রয়োজনে সাহায্য করে। ন্যাসভিলের ঘটনা তো তার একটা দৃষ্টান্ত। এফ.বি.আই-এর একটি টিম তাকে তাড়া করেছিল গ্রেফতারের জন্যে। তাদের গাড়ি মারাত্মক এ্যাকসিডেন্ট করে। সংগে সংগেই দুজন মারা যায়। অবশিষ্টরাও ছিল মুমূর্ষ। আহমদ মুসা ওদেরকে নিজে গাড়ি ডেকে গাড়িতে তুলে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়। আহমদ মুসার এ মানবিক রূপ অস্বীকার করলে তার প্রতি অবিচার করা হবে।’ বলল জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন।
প্রেসিডেন্টের মুখে প্রসন্ন হাসি ফুটে উঠল। তারপর গম্ভীর হয়ে উঠল সে। বলল, ‘আসল কথা কি জানেন। ওরা সমস্যা নয়, ওদের মৌলবাদটাকেই সমস্যা বলে মনে করা হয়। মুসলিম মৌলবাদীদের চরিত্র সম্পর্কে কোন অভিযোগ নেই। সকল অভিযোগের লক্ষ্যই তাদের মৌলবাদ।’
‘মহামান্য প্রেসিডেন্ট আইনের প্রতি একান্ত অনুগত কিংবা শেকড় সন্ধানী হওয়ায় সকলেই তো আমরা মৌলবাদী।’
‘আপনার মৌলবাদ ভয়ের নয়, ওদেরটা ভয়ের। দারুণ শক্তিশালী ওদের মৌলবাদ। দেখছেন না, আমরা গীর্জা বিক্রি করার পর্যায়ে গেছি, আর ওরা গীর্জা কিনে নিয়ে মসজিদ বানানোর পর্যায়ে এসেছে।’
‘গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এটা ভয়ের বিষয় তো নয় মহামান্য প্রেসিডেন্ট। স্বাভাবিক যা , মানুষ যা চায় আমরা তো তারই পক্ষে।’
‘এটা আমার আপনার কথা হতে পারে, কিন্তু সবার নয়।’
হাসল জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন। বলল, ‘আপনার সহযোগিতা পেলে তার আর কিছুর দরকার হয় না।’
‘কিন্তু জানেন তো, গনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ভোটাররা স্বাধীন , আর প্রেসিডেন্ট ভোটারদের অধীন। সুতরাং আমার ক্ষমতা খুবই সীমাবদ্ধ।’
বলেই প্রেসিডেন্ট তার এ্যাপয়েন্টমেন্ট ওয়াচের দিকে তাকাল। বলল, ‘সময় হয়ে গেছে। প্রসঙ্গ থেকে আমরা দূরে সরে গেছি। এবার কাজের কথায় আসি। বলুন।’
‘মহামান্য প্রেসিডেন্ট আপনি বলেছেন, সত্য যা, আপনি সেখানে পৌছাতে চান। এটাই আমাদের সকলের কথা।’
একটু থামল জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন। পরক্ষণেই আবার শুরু করল, ‘মহামান্য প্রেসিডেন্ট জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনের নিরাপত্তা অফিস থেকে আমাদের কাছে ঘটনার উপর যে ব্রীফ পৌঁছেছে, তার সাথে দেখা সত্যের কোন সম্পর্ক নেই। এ পর্যন্ত যে ডকুমেন্ট সংগৃহীত হয়েছে, তাতে প্রত্যক্ষ ভাবে প্রমাণিত হচ্ছে ইহুদী গোয়েন্দা প্রধান জেনারেল শ্যারন সব ঘটনার সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত এবং আমাদের সকল সিক্রেট গবেষণা ও স্থান তাদের অব্যাহত গোয়েন্দাগিরীর শিকার।’
থামল জেনারেল ওয়াশিংটন।
প্রেসিডেন্ট গভীর মনোযোগের সাথে জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটনের কথা শুনছিল। তার চোখে মুখে বিস্ময় এবং কিছুটা অস্বস্তিও।
জেনারেল ওয়াশিংটন থামতেই প্রেসিডেন্ট বলে উঠল, ‘আপনার প্রাথমিক রিপোর্টে যে কথা এসেছে, তার পক্ষে যে ডকুমেন্টগুলো রয়েছে তা সামনে নিয়ে আসুন।’
প্রেসিডেন্টের বাম পাশে একটা টেবিলটপ কম্পিউটার আগেই রেডি করে রাখা হয়েছিল।
জেনারেল ওয়াশিংটন তার হ্যান্ড ব্যাগ থেকে তিনটি কম্পিউটার ডিস্ক বের করে টেবিলে রাখল। তারপর এ থেকে একটি ডিস্ক নিয়ে সে টেবিলটপ কম্পিউটারে সেট করেল।
এসে বসল জেনারেল ওয়াশিংটন তার চেয়ারে।
কম্পিউটার স্ক্রীনে ভেসে উঠল একটা বাড়ি তার পর একটা বৈঠকখানার দৃশ্য।
‘মহামান্য প্রেসিডেন্ট কম্পিউটার স্ক্রীনে ওটা সাবা বেনগুরিয়ানদের বৈঠকখানার দৃশ্য। এই ভিডিও ফিল্মের দৃশ্যে আছে ইহুদী গোয়েন্দা এজেন্ট বেনইয়ামিনের সাথে জেনারেল শ্যারনের কথোপকথন, সাবা বেনগুরিয়ানের সাথে জেনারেল শ্যারনের কথোপকথন এবং আইজ্যাক বেনগুরিয়ানের সাথে জেনারেল শ্যারনের কথোপকথন।’
চলতে লাগল ভিডিও ফিল্মটি।
প্রেসিডেন্টের দুই চোখ কম্পিউটার স্ক্রীনে নিবদ্ধ।
এক সময় হঠাৎ চেয়ারে সোজা হয়ে বসল প্রেসিডেন্ট। বলল, ‘জেনারেল ডি.এস.কিউ মানে ডেথ স্কোয়াড পাঠাচ্ছেন জেনারেল শ্যারন লস আলামোসে?’
‘ঠিক বলেছেন মহামান্য প্রেসিডেন্ট।’ বলল জেনারেল ওয়াশিংটন।
‘তারিখটা?’
‘স্ক্রীনের নিচে বামে কোণায় দেখুন তারিখ ও সময়।’ জেনারেল ওয়াশিংটন।
‘সর্বনাশ এই তারিখে এই সময়ের দুঘন্টা পরেই তো লস আলামোস থেকে সান্তাফে পথে আমাদের তদন্ত টীমে আক্রান্ত হয়েছিল এবং আমাদের সিকিউরিটির আধ ডজন লোক নিহত হয়েছিল।’ প্রেসিডেন্টের কথায় বিস্ময় ও বেদনার সুর।
‘জি , মহামান্য প্রেসিডেন্ট।’
আবার নিরবতা। চলছে ভিডিও ফিল্ম।
প্রেসিডেন্টের দুই চোখ আঠার মত লেগে আছে কম্পিউটার স্ক্রীনে।
জেনারেল শ্যারন যখন ইহুদী জাতির চরম দুঃসময়ের কথা বলে জার্মানীর ঘটনার পুনরাবৃত্তির আশংকা করে জর্জ আব্রাহামের পার্সোনাল কম্পিউটারের লস আলামোস বিষয়ক এন্ট্রিগুলো মুছে ফেলার দায়িত্ব নিতে সাবা বেনগুরিয়ানকে বাধ্য করছিল, তখন বিস্মিত কন্ঠে প্রেসিডেন্ট বলল, ‘জেনারেল ওয়াশিংটন এন্ট্রিগুলো তাহলে সত্য। না হলে জেনারেল শ্যারন এত মরিয়া হয়ে উঠেছেন কেন এগুলো জর্জ আব্রাহামের কম্পিউটার থেকে মুছে ফেলার জন্যে!’
‘মহামান্য প্রেসিডেন্ট উনি একদিকে ডেথ স্কোয়াড পাঠিয়েছেন জর্জ আব্রাহামদেরকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়ার জন্যে, অন্যদিকে সাবা বেনগুরিয়ানকে পাঠাচ্ছেন কম্পিউটারের দলিল মুছে ফেলার লক্ষ্যে।’ বলল জেনারেল ওয়াশিংটন।
‘কি সাংঘাতিক! তাহলে তো বোঝাই যাচ্ছে এফ.বি.আই হেড কোয়ার্টারের মাস্টার কম্পিউটারগুলো শ্যারনের লোকরাই ধ্বংস করেছে।’ বিস্ময়ে দুচোখ কপালে তুলে বলল প্রেসিডেন্ট।
‘অবশ্যই মহামান্য প্রেসিডেন্ট। জর্জ আব্রাহাম দায়িত্ব থেকে চলে যাবার পর তদন্ত ঠিকমত চলছে না। না হলে জড়িত লোকগুলোও ধরা পড়ে যেত।’ বলল জেনারেল ওয়াশিংটন।
কিছু বলল না প্রেসিডেন্ট। চেয়ারে গা এলিয়ে দিল। তার চোখে মুখে একটা হতাশা।
আবার নিরবতা। চলছে ভিডিও ফিল্ম।
প্রেসিডেন্টের সমস্ত মনোযোগ সেদিকে।
ভিডিও ফিল্মে তখন চলছে দায়িত্বপালনে ব্যর্থতার জন্যে জেনারেল শ্যারন কর্তৃক সাবা বেনগুরিয়ানকে ধমকানোর দৃশ্য। তার পর এল সাবা বেনগুরিয়ান ও তার আব্বা আইজ্যাক বেনগুরিয়ানকে বাড়ি ছেড়ে জেনারেল শ্যারনদের তত্ত্বাবধানে চলে যেতে বাধ্য করা সংক্রান্ত কথোকপকথনের দৃশ্য। যখন জেনারেল শ্যারন বলছিল, ‘সাবা বেনগুরিয়ান জাতির পক্ষে দায়িত্বপালনে অস্বীকার করেছে, তখন সে জাতির বিশ্বাসঘাতকতাও করতে পারে, আমি তাকে যা বলেছিলাম এবং যা সে জানে সব বলে দিতে পারে পুলিশকে, সুতরাং তাকে আমাদের কাস্টডিতে থাকতে হবে, যাতে সে কথা বলতে না পারে, আপনাকেও আমাদের সাথে যেতে হবে, যাতে আপনিও কিছু বলতে না পারেন’, তখন প্রেসিডেন্ট বলে উঠল, ‘তাহলে আপনাদের রিপোর্টে সাবা বেনগুরিয়ান ঘটনার যে বিবরণ দিয়েছে এবং জর্জ জুনিয়র ঘটনার যে বর্ণনা দিয়েছে তার সবই তাহলে সত্য। দেখছি, জেনারেল শ্যারনরা উন্মাদ হয়ে গিয়েছিল সেদিন।’
‘সত্য যা উদ্ঘাটিত হয়েছে তা ওদেরকে উন্মাদ করার মতই মহামান্য প্রেসিডেন্ট।’ বলল জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন।
প্রেসিডেন্ট কোন কথা বলল না। চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়েছে আবার।
আবার সেই নিরবতা।
এবার কম্পিউটারে নতুন ডিস্ক ভরেছে জেনারেল ওয়াশিংটন। এ ভিডিও ফিল্মে রয়েছে প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন ও জেনারেল শ্যারনের মধ্যকার কথোপকথনের দৃশ্য।
চলছে ভিডিও ফিল্ম।
জেনারেল শ্যারন যখন জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনকে বলছিল, ‘প্রেসিডেন্টের সাথে জর্জ আব্রাহাম ও এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থারের সাক্ষাতের পথ বন্ধ করতে হবে, ওরা আসছে প্লেনে ওয়াশিংটনে..’, তখন প্রেসিডেন্ট সোজা হয়ে বসল চেয়ারে। তার চোখ ছানাবড়া। তারপর প্রেসিডেন্টের সাথে সাক্ষাত করতে গিয়ে প্রেসিডেন্টকে কি বুঝাতে হবে, ঘটনার কি ব্যাখ্যা তাকে দিতে হবে, সে বিষয়ে জেনারেল শ্যারন যে ব্রিফিং দিচ্ছিল জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনকে, তা গোগ্রাসে গিলছিল প্রেসিডেন্ট। তার চোখ দুটি বিস্ময় বিস্ফোরিত। শেষে বলল প্রেসিডেন্ট, ‘জেনারেল ওয়াশিংটন ধন্যবাদ দিতে হয় জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনকে। যেভাবে জেনারেল শ্যারন তাকে ব্রিফ করতে বলেছিল, ঠিক সেভাবেই যে আমাকে ব্রিফ করতে পেরেছে। মিথ্যাকে সত্যের মত এত সুন্দর করে বলা যায় তাহলে!’
‘মহামান্য প্রেসিডেন্ট কাহিনী তৈরীতে ইহুদীদের চেয়ে দক্ষ আর কেউ নেই দুনিয়ায়। জার্মানীর ঘটনা নিয়ে যে হাজারো কাহিনী তারা সৃষ্টি করেছে, তা অভিভূত করেছে পশ্চিমের লোকদের। যার সুফল তারা ভোগ করছে অর্ধ শতাব্দী ধরে।’ বলল জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন।
‘লস আলামোসের সবুজ পাহাড়ের সুড়ঙ্গ সম্পর্কে যে ব্যাখ্যা দিল সে সম্পর্কে আপনার মত কি?’ প্রেসিডেন্ট জিজ্ঞাসা করল জেনারেল ওয়াশিংটনকে।

‘ওটা একটা গাঁজাখুরি কথা মহামান্য প্রেসিডেন্ট। আপনি জানেন মহামান্য প্রেসিডেন্ট, আপনার কাছে একটা ‘সেফ ভল্ট’ আছে। ওটা খোলা যায় না, ভাঙা যায়। বিদেশী আগ্রাসনের সময় জরুরী মুহূর্তে ওটা আপনাকে ভাঙতে হবে এবং শেষ মুহূর্তের নির্ধারিত করণীয় ওতে পাবেন। অনুরূপভাবে লস আলামোসের মত জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের কাছেও ঐ ধরনের একটি করে ‘সেফ ভল্ট’ আছে। বিদেশী আগ্রাসনের জাতীয় জরুরী মুহূর্তে প্রতিষ্ঠানের প্রধানকে কি করতে হবে সেজন্যে তো ঐ ‘সেফ ভল্ট’ রয়েছে। মৌখিকভাবে থাকার বিষয়টা একেবারেই গাঁজাখুরি।’ জেনারেল ওয়াশিংটন বলল।
‘যাই হোক, সেফ ভল্টে যদি ঐ সুড়ঙ্গের কথা থেকে থাকে জেনারেল?’ প্রশ্ন তুলল প্রেসিডেন্ট।
‘সুড়ঙ্গটাই প্রমাণ যে ওটা অফিসিয়াল সুড়ঙ্গ নয়।’ বলল জেনারেল ওয়াশিংটন।
‘কেমন করে?’ বলল প্রেসিডেন্ট।
‘অফিসিয়াল হলে সুড়ঙ্গ হলে সুড়ঙ্গ মুখ আরও গোপন , নিরাপদ ও আরও স্থায়ী ধরনের জায়গায় হত। কম্পিউটার সরালেই , কার্পেট তুললেই ধরা পড়ে যাবে, এমন জায়গায় অফিসিয়াল সুড়ঙ্গ মুখ অবশ্যই হবার নয়। আর সুড়ঙ্গের শেষপ্রান্ত স্বাধীন জায়গায় না হয়ে ইহুদী অধিকারভুক্ত একটা জায়গায় হতে পারে না। তৃতীয়ত, ইহুদী বিজ্ঞানী জন জ্যাকব লস আলামোস ও সরকারের কেউ না হয়েও অফিসিয়াল সুড়ঙ্গের বিষয়টা জানবেন কোন সূত্রে? তাকে বিশ্বাসই বা করা হবে কেন? আপনার ভালোভাবেই জানার কথা মহামান্য প্রেসিডেন্ট, ইহুদীরা আমাদের কাছ থেকে সুযোগ-সুবিধা পেয়েছে ,কিন্তু আমাদের দায়িত্বশীল অগ্রজদের অখন্ড বিশ্বাস তারা কোন সময়ই পায়নি।’ বলল জেনারেল ওয়াশিংটন।
‘ধন্যবাদ জেনারেল। আমি বুঝেছি।’
নিরবতা নামল আবার।
ভিডিও ফিল্ম এগিয়ে চলছে একের পর এক দৃশ্য। যখন জেনারেল শ্যারন বলছিল জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনকে যে ‘এইবার সে ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং আগামীবারেই প্রেসিডেন্ট’, তখন প্রেসিডেন্ট চেয়ারে হেলান দেয়া অবস্থাতেই হো হো করে হেসে উঠল। বলল, ‘জেনারেল এতক্ষনে খুলল রহস্যের জট। আমার নিরাপত্তা উপদেষ্টা ইহুদীদের সাথে রাজনৈতিক ব্যবসায় নেমেছেন। ওর এত আগ্রহের কারণ এখানেই।’
‘ইহুদীরা তাদের এই রাজনৈতিক অস্ত্র সব রাজনীতিকের উপরই প্রয়োগ করেন, মহামান্য প্রেসিডেন্ট।’
‘কিন্তু সবাই তাদের শিকার হন না।’
জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু হঠাৎ প্রেসিডেন্ট কম্পিউটার স্ক্রীনের দিকে মনযোগী হওয়ায় সে থেমে গেল।
ভিডিও ফিল্মে তখন জেনারেল শ্যারন ইহুদীদের বিশ্বায়ন পরিকল্পনার কথা বলছিল।
শ্যারনের কথা শেষ হলে জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন যখন তার ইহুদী মায়ের হাত থেকে ইহুদীদের বিশ্বায়ন পরিকল্পনা পাওয়া ও তার আব্বা সম্পর্কে মায়ের কথা বলছিল, তখন প্রেসিডেন্ট তার চেয়ারে সোজা হয়ে বসে বলল, ‘জেনারেল হ্যামিল্টনদের আব্বা সিনেটর বব হ্যামিল্টন ছিলেন একজন খাঁটি আমেরিকান। সেই কারণেই তার মত স্বামীকে বিশ্বাস করেননি, আর ছেলেকে জানিয়েছেন নিজের মত দ্বৈত আনুগত্যের কথা।’
‘ঠিক বলেছেন মহামান্য প্রেসিডেন্ট।’ বলল জেনারেল ওয়াশিংটন।
‘ওদের ঐ বিশ্বায়নটা কি জানেন জেনারেল?’ বলল প্রেসিডেন্ট।
‘ওই দলিল দেখিনি স্যার। জানা উচিত আমাদের।’
কথা শেষ করেই উঠে দাঁড়াল জেনারেল ওয়াশিংটন কম্পিউটার ডিক্স পরিবর্তনের জন্যে।
‘এখন কম্পিউটারে কি তুলবেন?’ জিজ্ঞেস করল প্রেসিডেন্ট।
‘আমাদের ব্রিগেডিয়ার যে তথ্য পাচার করেছিল জেনারেল শ্যারনের কাছে, তারই ভিডিও ফিল্ম।’ বলল জেনারেল ওয়াশিংটন।
‘ওটা আপনার রিপোর্ট আমি পড়েছি আর দেখার দরকার নেই।’
‘মহামান্য প্রেসিডেন্ট, ঐ ভিডিও ফিল্মে পরিষ্কার দেখা যায় আমাদের ব্রিগেডিয়ার পদের দায়িত্বশীল অফিসাররাও জেনারেল শ্যারনের মত বাইরের লোকদের স্বার্থের কাছে কতখানি নতজানু।’
‘বাগানে আগাছা কিছু জমতেই পারে।’ প্রেসিডেন্ট বলল।
‘কিন্তু মহামান্য প্রেসিডেন্ট, ওরা ওদের কালোহাত আমাদের জাতীয় জীবন ও জাতীয় স্বার্থের অনেক গভীরে প্রবেশ করাতে সমর্থ হয়েছে।’
‘ঠিক বলেছেন, এটা স্বীকার করতেই হবে, ওদের কথা প্রেসিডেন্টের কান পর্যন্ত পৌঁছাতে ওরা সাফল্যের সাথে সমর্থ হয়েছে। এ বিষয়টার দিকে অবশ্যই আমাদের নজর দিতে হবে। কিন্তু সেটা কৌশলের সাথে জেনারেল।’ প্রেসিডেন্ট এ্যাডামস হ্যারিসন বলল।
‘অবশ্যই মহামান্য প্রেসিডেন্ট।‘ বলল জেনারেল ওয়াশিংটন।
প্রেসিডেন্ট নড়ে চড়ে বসল। বলল, ‘জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, আমাদের প্রতিরক্ষা বাহিনীকে ধন্যবাদ, আপনাদের সংগৃহিত অমূল্য ডকুমেন্ট জাতির অশেষ উপকারে আসবে।’
‘ওয়েলকাম মহামান্য প্রেসিডেন্ট। এ কৃতিত্বের অধিকাংশ ‘ফ্রি আমেরিকা’, আহমদ মুসা ও সাবা বেনগুরিয়ানদের প্রাপ্য।’
‘সে কৃতজ্ঞতা আপনারা ওদের জানাবেন।’
বলে একটু থেমেই প্রেসিডেন্ট আবার বলল, ‘আচ্ছা, ফ্রি আমেরিকা আন্দোলন সম্পর্কে আপনারা কি ভাবেন?’
‘ফ্রি আমেরিকা দেশপ্রেমিক সংগঠন। আমরা মনে করি, এ ধরনের প্রেসার গ্রুপ দেশে থাকা প্রয়োজন।’
‘কেন?’
‘ফ্রি আমেরিকা বা সকল অপপ্রভাবমুক্ত আমেরিকা’র শ্লোগান দেশকে জাতীয় স্বার্থ পরিপন্থী ও ক্ষতিকর বাইরের ঘটনার সাথে জড়িয়ে পড়ার হাত থেকে রক্ষা করতে পারে।’
‘এমন প্রভাব কি আমাদের জাতীয় জীবনে আছে?’
‘অনেকেই মনে করেন, আমাদের জাতীয় জীবনে ইহুদীদের প্রভাব কোন কোন ক্ষেত্রে অপপ্রভাবের পর্যায়ে পৌঁছেছে। তারা মনে করেন, জাতির ফাউন্ডার ফাদারসরা ইহুদীদের সম্পর্কে যা ভাবতেন সেখান থেকে আমরা সরে গেছি।’
‘হ্যাঁ, এরকম কথা আছে।’
থামল এবং একটু ভাবল প্রেসিডেন্ট। তারপর বলল, ‘আচ্ছা, ফ্রি আমেরিকা আন্দোলনের স্ট্রেনথ কেমন? ওদের প্রধান কে?’
‘ওদের শক্তির বিষয়টা বলা মুস্কিল। বিশেষ করে তরুণ ও যুবকদের মধ্যে খুব পপুলার। সরকারী ও বেসরকারী সব ক্ষেত্রেই ওদের সমর্থক ছড়িয়ে আছে। ওদের প্রধান কে আমি জানি না।’
‘জনমতের ক্ষেত্রে ওরা একটা বড় ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়াচ্ছে, কি বলেন?’ প্রেসিডেন্টের কন্ঠে উতসুক্য।
‘ওদের প্রভাব বিবেচনা করলে তাই মনে হয়।’
‘আমি রিপোর্ট পেয়েছি, আমাদের দলেও ওদের সংখ্যা বাড়ছে। প্রতিপক্ষ দলেও নিশ্চয় ওরা কিছু আছে। ভাবছি, ওরা ভোট দেয় কাকে?’
‘শুনেছি ওদের ভোট ব্যক্তিকেন্দ্রিক। প্রার্থীর দৃষ্টিভংগী ও মতামতকেই তারা বেশি গুরুত্ব দেয়।’
‘বিষয়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একে আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে।’ বলে প্রেসিডেন্ট তার সামনে ফেলে রাখা একটা শিটের দিকে একবার তাকিয়ে বলল, ‘জেনারেল ওয়াশিংটন,আপনি কি জানেন জর্জ আব্রাহামের নাতিকে ওহাইও নদীতে ডুবে যাওয়া থেকে রক্ষা করায় আহমদ মুসার প্রতি জর্জ আব্রাহাম দুর্বল?’
‘মহামান্য প্রেসিডেন্ট, এই অভিযোগ আর যাদের ক্ষেত্রেই সত্য হোক, জর্জ আব্রাহামের ক্ষেত্রে নয়। তার কাছে ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবন এবং প্রফেশন সম্পূর্ণ আলাদা। তার গোটা সার্ভিস লাইফে আত্মীয়-স্বজন ও আপনজনদের সামান্য প্রশ্রয় দেয়ারও কোন নজীর নেই।’ থামল জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন।
প্রেসিডেন্ট কথা বলল না। ভাবছিল।
একটু পর বলল, ‘আরো একটা বিষয় জেনারেল, আহমদ মুসার মত ব্যক্তি এধরনের একটি কাজের বিনিময়ের মুখোমুখি হবে, এটাও স্বাভাবিক নয়। আর জর্জ আব্রাহামরা যে আহমদ মুসাকে সাথে করে লস আলামোসে নিয়ে গেলেন,এটা আহমদ মুসার স্বার্থে নয়, আমাদের স্বার্থে। বরং আহমদ মুসাই আমাদের উপকারে এসেছেন। সুতরাং জর্জ আব্রাহাম তাকে কোথায় কোন অন্যায় সুবিধা দিলেন?’
‘আমিও এ ধরনেরই ভেবেছি মহামান্য প্রেসিডেন্ট।’
‘জেনারেল আলোচনার আরও কোন বিষয় আছে?’ বলল প্রেসিডেন্ট।
জেনারেল ওয়াশিংটন সোজা হয়ে বসল। বলল, ‘অশেষ ধন্যবাদ মহামান্য প্রেসিডেন্ট আমাকে সময় দেয়ার জন্যে। আমার আর কোন বিষয় নেই আলোচনার।’
‘ধন্যবাদ তো আমি আপনাকে দেব। বলা যায় সাজানো তথ্যের ভিত্তিতে মারাত্মক একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, অকাট্য প্রমাণ এনে আপনি সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করে রাষ্ট্রকে সাহায্য করলেন সঠিক সিদ্ধান্ত নেবার। আমি আপনাদের জন্যে গর্বিত।’ বলল প্রেসিডেন্ট।
‘আমাদের প্রতি আপনার এটা বিশেষ ভালোবাসা মহামান্য প্রেসিডেন্ট। আমরা কৃতজ্ঞ।’
বলে একটু থেমে বিনীত কন্ঠে আবার বলল, ‘আমাকে উঠার অনুমতি দিন মহামান্য প্রেসিডেন্ট।’
প্রেসিডেন্ট উঠে দাঁড়াল। জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটনও উঠে দাঁড়াল।
প্রেসিডেন্ট হাত বাড়িয়ে জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটনের সাথে হ্যান্ডশেক করতে করতে বলল, ‘আমি নিশ্চিত জাতির পক্ষে আপনাদের এ প্রশংসনীয় তৎপরতা আপনারা আরও জোরদার করবেন। আশ্বাস দিচ্ছি, আমার কাছে জাতি যা চায়, আপনারা যা চান, আইন যা চায়, তা আমি করব। তা করতে গিয়ে কোন সিদ্ধান্তকেই বড় বলে মনে করব না।’
‘মহামান্য প্রেসিডেন্ট, এই কাজে আমরা আপনার সাথী।’
বলে জেনারেল ওয়াশিংটন চলে যাবার জন্যে পা বাড়াচ্ছিল। প্রেসিডেন্ট বলল, ‘জেনারেল, আহমদ মুসাকে আমার পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানাবেন। অহেতুক তাঁর উপর অনেক ধকল গেছে। আমরা দুঃখিত।’
‘ধন্যবাদ মহামান্য প্রেসিডেন্ট।’ বলে জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন ঘর থেকে বেরিয়ে এল।

এফ.বি.আই-এর দুটি গাড়ি তীর বেগে এগিয়ে যাচ্ছে ওয়াশিংটনের একদম পূর্বপ্রান্তের বে রোড ধরে। দুই গাড়িতে মিলে এফ.বি.আই-এর নিরাপত্তা কর্মী মোট ষোলজন। এফ.বি.আই-এর চৌকশ অপারেশন কমান্ডার, জর্জ আব্রাহামের একটি বিশ্বস্ত হাত কমান্ডার বব কার্টার বসে আছেন সামনের গাড়ির সামনের সিটে। বাজপাখির মত তার শ্যেন দৃষ্টি সামনে নিবদ্ধ।
ভোর হবার খুব বেশী নেই। নির্জন পথ। কমান্ডার বব কার্টারের চোখ সামনে প্রসারিত। কিন্তু চোখের পেছনে মাথাটায় অনেক চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। এফ.বি.আই খবর পেয়েছে রাত ১২টায় জেনারেল শ্যারনকে বে-ভিউ রেসিডেন্সিয়াল ব্লকের একটা বাড়িতে প্রবেশ করতে দেখা গেছে, সে বাড়িটা পাহারা দিচ্ছে এফ.বি.আই-এর একজন লোক। খবর পাওয়ার পরই জর্জ আব্রাহাম সরাসরি নির্দেশ দিয়েছে জেনারেল শ্যারনকে গ্রেফতারের জন্যে।
বিরাট দায়িত্ব পেয়েছে সে তার চীফ বসের কাছ থেকে। তার স্বল্পভাষী চীফ বস দায়িত্ব দেবার সময় বলেছে, ‘এই সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিকার লক্ষ্যে তুমি জাম্প দিচ্ছ, মূল্যবান সুযোগটা খুব কষ্টে কিন্তু আমরা পেয়েছি।’ চীফের এই কথার অর্থ, বড় এই শিকার হাতছাড়া করা যাবে না। কারনটা সেও জানে। মাঝখানে জেনারেল শ্যারন এফ.বি.আই-এর চোখের বাইরে ছিল। জর্জ আব্রাহাম দায়িত্বে ফিরে আসার পর জেনারেল শ্যারনকে পুনরায় দৃষ্টিসীমায় আনার অনেক চেষ্টার পর আজ তাকে নজরবন্দী করা গেছে। নজর থেকে এখন তাকে হাতে পেতে হবে।
কমান্ডার বব কার্টারের বাহিনী বে-ভিউ রেসিডেন্সিয়াল ব্লকের কিছুটা সামনে চৌমাথায় গিয়ে পৌছল। এ চৌমাথা থেকে পুবমুখী রাস্তা দিয়ে বে-ভিউ রেসিডেন্সিয়াল ব্লকে যাওয়া যায়। চৌমাথা থেকে বের হওয়া আরও দুটি রাস্তার একটি উত্তরে, আরেকটি পশ্চিমে চলে গেছে। বব কার্টারের বাহিনী আসছিল দক্ষিণ দিকে থেকে আসা রাস্তা দিয়ে। চৌমাথার মাঝখানে একটা বিরাট সার্কেল। পুবদিক থেকে আসা গাড়ি সার্কেলটির দক্ষিণ পাশ ঘুরে যেকোন দিকে যেতে পারে। অনুরূপ দক্ষিণ থেকে আসা গাড়ি দক্ষিণ হয়ে পশ্চিমে ঘুরে যেকোন দিকে যেতে পারে।
বব কার্টারদের গাড়ি সার্কেলটির দক্ষিণ হয়ে পশ্চিম উত্তর ঘুরে পুবমুখী রাস্তায় যাওয়ার জন্যে বাঁক নিতে যাবে, এমন সময় পুর্বদিকে একটা গাড়িকে পাগলের মত ছুটে আসতে দেখা দেখল। গাড়িটি বব কার্টারদের গাড়ির প্রায় পাশ ঘেঁষে সার্কেলটির দক্ষিণ দিক ঘুরে পশ্চিমমুখী রাস্তায় তীর বেগে ঢুকে গেল।
বব কার্টারদের থমকে যাওয়া গাড়ি সবে টার্ন নিয়ে পশ্চিম দিকে বাঁক নিতে যাচ্ছে। এমন সময় আরেকটি গাড়িকে আগের মতই উন্মত্ত স্পিডে ছুটে আসতে দেখল। বব কার্টারদের গাড়ি এটা দেখে আবারও ডেড স্লো হয়ে গেল।
কিন্তু উন্মত্ত স্পিডের গাড়িটি বব কার্টারদের গাড়ি পেরিয়ে কয়েকগজ যাবার পর হঠাৎ ডেড স্টপ হয়ে গেল।
সংগে সংগেই গাড়ি থেকে নামল একজন লোক লাফ দিয়ে। লোকটি গাড়ি থেকে নেমেই বব কার্টারদের গাড়ির দিকে মুখ করে ডাকতে লাগল।
বব কার্টার তার দিকে চোখ ফেলেই চিৎকার করে উঠল, ‘এতো আমাদের এফ.বি.আই-এর কলিন্স। গাড়ি ওদিকে আগাও, কুইক।’
গাড়ি কলিন্সের কাছাকাছি হতেই সে চিৎকার করে বলল, ‘জেনারেল শ্যারন পালাচ্ছে। তোমরা এস আমার সাথে।’
বলেই লাফ দিয়ে কলিন্স তার গাড়িতে উঠল। সংগে সংগেই ছুটতে শুরু করল তার গাড়ি।
বব কার্টারের বুঝতে বাকি রইল না আগের পাগলের মত ছুটে চলে যাওয়া গাড়িটাই তাহলে ছিল জেনারেল শ্যারনের।
বুঝে উঠার সাথে সাথেই বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল বব কার্টারের। নজরবন্দী শিকার তাহলে পালাল?
বসের কথা ও কঠিন মুখটা ভেসে উঠল বব কার্টারের চোখের সামনে, গাড়ি আগেই স্টার্ট নিয়েছিল বব কার্টারের। বব কার্টার বলল ড্রাইভারের দিকে চেয়ে, ‘কলিন্সের গাড়ির আগে ছুটছিল যে গাড়িটা, সেটা আমাদের ধরতে হবে।’
ঝড়ের বেগে ছুটতে লাগল বব কার্টারদের গাড়িও। তখন সকাল হয়ে গেছে। রাস্তা-ঘাট তখনও প্রায় গাড়ি শুন্য। তিনটি গাড়িই চলছে ঝড়ের গতিতে। কলিন্সের গাড়ি এবং বব কার্টারের দুটি গাড়ি পর পর চলছে। জেনারেল শ্যারনের গাড়ি কিছুক্ষণের জন্যে দৃষ্টির বাইরে চলে গিয়েছিল, এখন শ্যারনের গাড়ি শুধু দেখা যাওয়া নয়, তার সাথে ব্যবধানও অনেক কমেছে।
হঠাৎ একটা অঘটন ঘটে গেল, একটা চৌমাথা ক্রস করতে যাচ্ছিল কলিন্সের গাড়ি। শ্যারনের গাড়ি চৌমাথা ক্রস করে চলে গেছে।
ঠিক সেই সময় রোড কনস্ট্রাকশন কোম্পানীর একটা ভারি রোলার গাড়ি রাস্তার ক্রসিং-এ এসে পৌঁছল, একেবারে মুখের উপর।
দুঘর্টনা এড়াতে হার্ড ব্রেক কষতে গিয়ে কলিন্সের গাড়ি উলটে গেল। কতকটা একই দশা হলো পেছনে বব কার্টারদের দুটি গাড়িরও।
বব কার্টারের গাড়ি একটা শার্প বাঁক নিয়ে ব্রেক কষতে গিয়ে রাস্তার পাশের গার্ডারের সাথে ধাক্কা খেল। আর কমান্ডার বব কার্টারের পেছনের গাড়ি ভারি রোলারটার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়তে গিয়ে কোন মতে নিজেকে রক্ষা করল, কিন্তু কাত হয়ে পড়ে গেল।
ধাক্কা খেয়ে গাড়ি থামতেই লাফ দিয়ে নেমেছে বব কার্টার গাড়ি থেকে।
তার চোখের সামনে দিয়েই কনস্ট্রাকশন কোম্পানীর রোলার গাড়িটি চলে গেল। তাড়া করবারও কোন সুযোগ পেল না। কারণ রাস্তার ঐ লাইনে তখনও জ্বলছিল গ্রীন সিগন্যাল, বব কার্টারদের জন্যে রেড সিগন্যাল।
বব কার্টার হতাশ হয়ে তাকাল জেনারেল শ্যারনের গাড়ির দিকে। ওটা দৃষ্টি সীমার বাইরে চলে গেল।
বব কার্টার এবার নজর দিল দুঘর্টনায় পড়া সহকর্মীদের দিকে।
এ সময় রোলার গাড়িটির চ্যানেল অর্থাৎ দক্ষিণ দিক থেকে আরেকটা গাড়ি রোড ক্রসিং এ এসে পৌছল।
তিনটি গাড়ির লন্ড-ভন্ড দশা দেখেই সম্ভবত গাড়িটা রাস্তার এক প্রান্তে দাঁড়াল।
গাড়ি থেকে নামল তিনজন মানুষ। নেমেই তারা প্রথমে ছুটে গেল উল্টে যাওয়া কলিন্সের গাড়ির দিকে।
কলিন্স তখন তার উল্টে যাওয়া গাড়ি থেকে বের হচ্ছিল। ছুটে আসা তিনজন লোক তাকে ধরাধরি করে বের করল।
কলিন্স উঠে দাঁড়িয়ে যে তাকে তুলে দাঁড় করাল তার দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে গেল মুহূর্তের জন্যে। পরক্ষণেই আনন্দিত কন্ঠে বলে উঠল, ‘স্যার আপনি?’
তার পর পাশের দাঁড়ানো লোকটির দিকে নজর পড়তেই কলিন্স চিৎকার করে উঠল, ‘বেঞ্জামিন বেকন তুমি?’
বলে কলিন্স জড়িয়ে ধরল বেঞ্জামিন বেকনকে।
এদিকে বব কার্টারের দুটি গাড়ি থেকে সবাই বেরিয়ে এসেছে। কাত হয়ে যাওয়া গাড়িও দাঁড় করানো হয়েছে।
বব কার্টার ও অন্যান্যরা এসে দাঁড়াল কলিন্স ও বেঞ্জামিন বেকনদের কাছে।
বব কার্টার বেঞ্জামিন বেকনকে চিনতে পারছে, কিন্তু অন্য দুজনকে চিনতে পারেনি।
বব কার্টার এসে দাঁড়াতেই কলিন্স সোৎসাহে যে লোককে সে স্যার বলেছিল তাকে দেখিয়ে বলে উঠল, ‘বব ইনিই আহমদ মুসা।’
নামটা শুনে বব কার্টার চমকে উঠল। অভাবিত একটা বিস্ময় আকস্মিকভাবে সামনে এসে দাঁড়ালে যেমন মানুষ বিমূঢ় হয়, কতকটা তেমনি দশা হলো বব কার্টারের। অজ্ঞাতসারেই যেন বব কার্টার স্যালুট দিয়ে বসল আহমদ মুসাকে। তার সাথে সাথে দুই গাড়ি থেকে নেমে আসা অন্যান্য এফ.বি.আই কর্মীরাও স্যালুট করল আহমদ মুসাকে।
আহমদ মুসা হ্যান্ডশেকের জন্যে হাত বাড়াল বব কার্টারের দিকে।
‘ইনি, এই অপারেশনের কমান্ডার বব কার্টার।’ বব কার্টারকে দেখিয়ে আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল কলিন্স।
কলিন্স থামতেই বেঞ্জামিন বেকন তাদের তৃতীয় সাথীকে দেখিয়ে বব কার্টারদের লক্ষ্য করে বলল, ‘ইনি প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা উপদেষ্টার পার্সোনাল সেক্রেটারি রবিন নিক্সন।’
বব কার্টার আহমদ মুসার সাথে হ্যান্ডশেক করার পর রবিন নিক্সনের সাথেও হ্যান্ডশেক করল। কলিন্সও হ্যান্ডশেক করল রবিন নিক্সনদের সাথে।
কলিন্স রবিন নিক্সনের সাথে হ্যান্ডশেক শেষ করলে আহমদ মুসা বব কার্টারকে লক্ষ্য করে বলল, ‘মিঃ বব কার্টার মিঃ কলিন্স যে অপারেশনের কথা বলল সেটা কি? আপনাদের এ অবস্থা কেন?’
বব কার্টার বে-ভিউ রেসিডেন্সিয়াল ব্লকের একটা বাড়ি থেকে জেনারেল শ্যারনকে ধরতে আসার বিবরণ দিয়ে বলল, ‘কিন্তু স্যার, আমরা আসার আগেই জেনারেল শ্যারন পালায়। তাকে পাহারায় থাকা মিঃ কলিন্স তার পিছু নেয়। পথে দেখা হলে আমরাও পিছু নিই। এ পর্যন্ত পৌছার পর কনস্ট্রাকশন কোম্পানীর একটা রোলার গাড়ি আমাদের সব কিছু ভন্ডুল করে দেয়।’ কিভাবে কি ঘটল তারও বিবরণ দিয়ে থামল বব কার্টার।
‘সারারাত পালাল না, ভোরে পালাল কেন জেনারেল শ্যারন? এমন ভোরে তো জেনারেল শ্যারন জেগে থাকে না। আর আপনাকে দেখতে পাওয়ার মত জায়গায় অবশ্যই আপনি ছিলেন না?’ বলল আহমদ মুসা কলিন্সকে লক্ষ্য করে। আহমদ মুসার ভ্রু কুঞ্চিত হলো।
‘তার কিছুতেই আমাকে দেখতে পাওয়ার কথা নয়।’
‘জেনারেল শ্যারন যখন পালায় তখন আপনার মনে হয়েছিল কি যে আপনি পাহারায় আছেন জেনারেল শ্যারন সেটা জানে?’
‘জি, আমার তাই মনে হয়েছে। সে পেছন দরজা দিয়ে বেরিয়ে গাড়িতে উঠেছিল। গাড়িতে উঠেই পাগলের মত ছুটতে শুরু করে।’ বলল কলিন্স।
‘আমার মনে হচ্ছে একটা টেলিফোন পেয়ে জেনারেল শ্যারন ঘুম থেকে জাগে। টেলিফোনে তাকে বলে হয় মিঃ কলিন্স তার বাড়ির বাইরে পাহারা দিচ্ছে । আর বব কার্টারের বাহিনী তাকে ধরতে আসছে। নিশ্চয় কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।’
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা বব কার্টারের দিকে চেয়ে বলল, ‘আপনার এ অপারেশনের বিষয় নিশ্চয় গোপন রাখা হয়েছিল?’
‘জি স্যার, তার সাড়ে তিনটায় আমাদের চীফ জর্জ আব্রাহাম নিজে তাঁর মোবাইল টেলিফোনে আমাকে অপারেশনের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তার আগে আমিও কিছু জানতাম না।’
‘আপনি অপারেশনে বেরুনোর আগে বা পরে কাউকে কিছু বলেছিলেন?’ বলল আহমদ মুসা।
‘আমার সাথে আসা লোকজনদেরও বলিনি। তবে গোপন অপারেশন রেজিস্টারে আমি লিখে এসেছি।’ বলল বব কার্টার।
‘আমার বিশ্বাস জর্জ আব্রাহামের টেলিফোন এবং আপনাদের গোপন রেজিস্টার দুটোই শত্রু পক্ষ মনিটর করেছে।’
ভ্রু কুঞ্চিত হলো কমান্ডার বব কার্টার ও কলিন্স দুজনেরই।
ওরা কিছু বলার আগে আহমদ মুসাই কথা বলে উঠল, ‘এখন কি করবেন বলে ভাবছেন আপনারা?’
বব কার্টার ও কলিন্সরা কিছু বলার আগেই কথা বলে উঠল রবিন নিক্সন। বলল, ‘ওদের খুব নতুন একটা গোপন ঘাটির খবর আমি জানি। প্রেসিডেন্টের সাবেক নিরাপত্তা প্রধান জেনারেল হ্যামিল্টনের নির্দেশে আমাদের গাড়িতে করে জেনারেল শ্যারনকে ঐ ঘাটিতে আমি নামিয়ে দিয়েছিলাম।’
আহমদ মুসা তাকাল বব কার্টারের দিকে।
বব কার্টার বুঝল আহমদ মুসার এ তাকানোর অর্থ। সংগে সঙ্গেই সে বলল, ‘আমরা যেতে চাই সেখানে।’
‘সে ঘাটিটা কোথায়?’ আহমদ মুসা বলল রবিন নিক্সনের দিকে তাকিয়ে।
রবিন নিক্সন ঠিকানা বললে আহমদ মুসা বব কার্টারকে লক্ষ্য করে বলে উঠল, ‘মিঃ বব কার্টার, জেনারেল শ্যারনের গাড়ি যদি পশ্চিম দিকেই গিয়ে থাকে, তাহলে সে ঐ ঘাটির দিকেই গেছে বলে মনে হচ্ছে।’
‘আমারও তাই মনে হচ্ছে স্যার।’ বলল বব কার্টার।
‘তাহলে আমরা যাত্রা করতে পারি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আপনি যাবেন স্যার?’ বলল বব কার্টার। আনন্দে তার চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
‘অবশ্যই।’ বলল আহমদ মুসা।
চারটি গাড়ি আবার যাত্রা শুরু করল।
আহমদ মুসা ও বব কার্টারদের গাড়ি যখন জেনারেল শ্যারনদের নতুন ঘাটির গেটে গিয়ে পৌছল, তখন সকালের নির্জনতা কেটে গেছে।
রাস্তায় তখন সচল গাড়ির মিছিল সরব হয়ে উঠেছে।
ঘাটির গেটে প্রথম গিয়ে থামল আহমদ মুসা ও বেঞ্জামিন বেকনের গাড়ি। পরক্ষণেই তার পাশে গিয়ে দাঁড়াল বব কার্টারের গাড়ি এবং তার সাথেই কলিন্সের গাড়ি।
আহমদ মুসা গাড়ির জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বব কার্টারকে বলল , ‘মিঃ বব কার্টার, আপনার চিড়িয়া উড়ে গেছে।’
‘কি করে বুঝলেন স্যার?’
‘দেখুন প্রধান গেটের দরজা খোলা। এর প্রথম অর্থ হলো জেনারেল শ্যারন আমাদের চ্যালেঞ্জ করছে। বলছে দরজা খোলা রেখেছি, প্রবেশ কর সাহস থাকলে। দ্বিতীয় অর্থ হলো, জেনারেল শ্যারন আমাদের কাঁচকলা দেখাচ্ছে। বলছে, সব ফাঁকা করে গেছি, এস হাওয়া খেয়ে যাও।’
‘তাহলে কি দ্বিতীয়টাই ঠিক?’ বলল বব কার্টার।
‘অবশ্যই। কারণ, রাস্তার ধারে দিনের বেলায় সে এফ.বি.আই-এর সাথে বন্দুক যুদ্ধে আসবে না।’
‘এখন কি করব স্যার?’ বলল বব কার্টার হতাশ কন্ঠ।
‘চলুন নামি। তার ঘাটিটা দেখে যাই।’
বলে আহমদ মুসা গাড়ি থেকে নামল। সকলেই নেমে পড়ল গাড়ি থেকে। রবিন নিক্সনও। আহমদ মুসা রবিন নিক্সনকে লক্ষ্য করে দ্রুত কন্ঠ বলল, ‘না মিঃ রবিন নিক্সন আপনি নামবেন না। আপনি নিরাপত্তা উপদেষ্টার পিএস। জেনারেল শ্যারনের জানা ঠিক হবে না যে, আপনি অপারেশনে নেমেছেন। আপনার নিরপেক্ষ পরিচয় থাকা ভাল।’
‘বুঝেছি, অনেক ধন্যবাদ স্যার।’ বলে আবার সে গাড়িতে প্রবেশ করল।
বব কার্টার বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘ধন্যবাদ স্যার, এতদূর আপনি দেখেন। কিন্তু একটা কথা স্যার, শ্যারনরা তো কেউ নেই। উনি নামলেও তো ওরা দেখতো না।’
‘মিঃ বব কার্টার, আপনারা সত্যিই ঘাটিতে এলেন কিনা, পেলেন কিনা, সেটা দেখার জন্যে জেনারেল শ্যারন অবশ্যই কাউকে কোথাও রাখবে বা পাঠাবে।’
‘বুঝলাম স্যার।’ হাসি মুখে বলল বব কার্টার।
সবাই ঢুকল ভেতরে। আহমদ মুসার কথাই সত্য হলো। একদম শূন্য ঘাটি। সব দরজা-জানালা খোলা। চেয়ার, টেবিল, খাট, শূন্য ফাইল কেবিনেট ছাড়া ঘরে আর কিছুই নেই।
ভ্রু কুঞ্চিত হলো আহমদ মুসার।
জেনারেল পালিয়ে ঘাটিতে পৌছার পর যেটুকু সময় পেয়েছে তাতে ফাইলপত্র, কম্পিউটার, নানা ব্যবহার্য দ্রব্য ইত্যাদি নেয়া, গোছানো, সরানো এবং নিয়ে যাওয়া কি সম্ভব? সবচেয়ে বড় কথা হলো, এত সব জিনিস গেট দিয়ে বের করে নিয়ে গেলে যে আবর্জনা পড়ে থাকার কথা। তার কোন চিহ্ন গেট এলাকায় নেই। এ সব ভাবতে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়েছিল আহমদ মুসা।
হঠাৎ আহমদ মুসাকে এভাবে ভাবনায় পড়তে দেখে বেঞ্জামিন বেকন, বব কার্টার ও কলিন্স এসে তার পাশে দাঁড়াল। বলল বব কার্টার, ‘কিছু ভাবছেন স্যার?’
‘ভাবছি বব কার্টার। ভাবছি, যেসব জিনিস ওরা এ বাড়ি থেকে সরিয়েছে, তা অধিকাংশই বাইরে নিয়ে যায়নি। সেগুলো তাহলে রাখল কোথায়?’
‘একথা কেন বলছেন স্যার?’ বলল কলিন্স।
‘প্রথম হলো, জেনারেল শ্যারন যে সময়টুকু পেয়েছিল, সে সময়ের মধ্যে জিনিসগুলো বাইরে নিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। দ্বিতীয়, এতসব জিনিস বাড়ি থেকে বের করলে বাড়ি থেকে বের হবার পথে যেসব চিহ্ন থাকার কথা তা নেই।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ঠিক।’ বেঞ্জামিন বেকন ও কলিন্স এক সাথে বলে উঠল।
‘তাহলে আসুন সকলে খুঁজি এত জিনিস লুকিয়ে রাখা যায়, সেই জায়গাটা কোথায়।’ বলল আহমদ মুসা।
গোটা বাড়ি খোঁজার পর বিভিন্ন দিক থেকে সকলে গিয়ে হাজির হলো নিচের ড্রইং রুমে। এ ড্রইং রুম থেকেই সিঁড়ি উঠেছে উপরে।
সবাই বলল, বাড়ির এক ইঞ্চি জায়গাও বাকি রাখা হয়নি। সব খোঁজা হয়েছে। দেয়ালগুলো বাজিয়ে দেখা হয়েছে, কিন্তু কোথাও কিছু নেই।
আহমদ মুসা সিঁড়ির দিকে মুখ করে একটা সোফায় বসে ছিল। ভাবছিল সে। ভাবছিল সে সামনের দিকে তার অলস দৃষ্টি মেলে। তার চোখে ভাসছিল সিঁড়িটার কারুকাজ।
সিঁড়িটা বাইরে থেকে ড্রইং রুমে প্রবেশ করার পর হাতের ডান পাশে পড়ে।
সিঁড়ি ও বাইরে বেরুবার দরজার মাঝখানে আরেকটি দরজা। দরজাটা সিঁড়ির শেষ ধাপের সমান্তরালে। সিঁড়ির ধাপ ও দরজাটির মাঝখানে দশ ইঞ্চির মত ব্যবধান। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, সিঁড়ির প্রস্থ ও দরজার প্রস্থ সমান। কেন? আর সিঁড়ি আর পাশের দরজার ব্যবধান মাত্র দশ ইঞ্চি কেন? প্রশ্ন জাগল আহমদ মুসার মনে। ব্যবধান দশ ইঞ্চি এই কারণে কি যে সিঁড়ির প্রান্ত ঘেঁষে যে দেয়াল উঠে গেছে তা দশ ইঞ্চি পুরু? যদি তাই হয় তাহলে এর অর্থ দাঁড়ায় দরজাটি দাঁড়িয়ে আছে সিঁড়ির প্রান্ত ঘেঁষে তৈরী হওয়া প্রটেকশন দেয়ালের পরেই। আর যেহেতু সিঁড়ির প্রস্থ ও দরজার প্রস্থ সমান , তাই ধরে নেয়া যায়, যে ল্যান্ডিং-এ সিঁড়িটি শেষ হয়েছে, সে ল্যান্ডিং-এরই আরেকটা অংশে দরজাটা দাঁড়িয়ে আছে।
চিন্তাটা এ পর্যন্ত আসতেই চমকে উঠল আহমদ মুসা। ল্যান্ডিং-এর এ অংশটা কেন তৈরী হলো? তাহলে দরজা ল্যান্ডিং-এর যে অংশের উপর দাঁড়িয়ে আছে, তার সাথে কোন সিঁড়ির যোগ আছে? কোন সিঁড়ি নিচে নেমেছে সেখান থেকে?
আহমদ মুসার মনটা আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠল। তার মনে পড়ল ওয়াশিংটনের প্রায় সব ভাল বাড়িরই বেসমেন্টে ঘর থাকে। সে ঘর অনেক ক্ষেত্রেই দুতলা তিন তলা পর্যন্ত নিচে গিয়ে থাকে।
আহমদ মুসা সোফায় সোজা হয়ে বসল। বলল বব কার্টারর দিকে তাকিয়ে, ‘সিঁড়ির পাশে ঐ দরজা খুলে দেখেছেন?’
‘জি স্যার। ওটা সুইচ রুম।’ বলল বব কার্টার।
‘দরজা খোলার পর মেইন সুইচগুলো দু’পাশের দেয়ালে, না শেষ প্রান্তের দেয়ালে?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা উৎসুক কন্ঠে।
‘দু’পাশের দেয়ালে, শেষ প্রান্তের দেয়ালে কোন সুইচ নেই।’ বব কার্টার বলল।
‘দু’পাশের দেয়ালে সুইচগুলো সামনের দিকে, না ভেতরের প্রান্তের দিকে?’
‘সবগুলো মেইন সুইচই দুপাশের দেয়ালে সামনের দিকে গাদাগাদি করে বসানো। ভেতরদিকে দুপাশের দেয়ালই এক দম ফাঁকা’ বলল বব কার্টার। তার চোখে মুখে তখন বিস্ময়।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘আমি নিশ্চিত এ দরজাটা একটা সিঁড়ির টপ ল্যান্ডিং-এর উপর দাঁড়িয়ে আছে।’
কথাটা শেষ করে আহমদ মুসা সোফায় হেলান দিয়ে বলল, ‘মিঃ বেঞ্জামিন বেকন, মিঃ কলিন্স, মিঃ বব কার্টার আপনারা একটু খুঁজে দেখুন তো।’
সকলেরই চোখে মুখে বিস্ময় , সেই সাথে আনন্দও।
তিনজনই ছুটল সে দরজার দিকে। অন্যেরাও গিয়ে দাঁড়াল দরজার সামনে।
মিনিট পনের পর বেঞ্জামিন বেকন, কলিন্স এবং বব কার্টার তিনজনেই দরজার বাইরে বেরিয়ে এল। বলল বেঞ্জামিন বেকন, ‘মিঃ আহমদ মুসা কোন ক্লু-ই খুঁজে পাওয়া গেল না। মেঝের কার্পেট উঠিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছে। দেয়ালের প্রতি ইঞ্চি জায়গা পরখ করা হয়েছে। দরজার চৌকাঠের সবটা গা তিল তিল করে দেখা হয়েছে, কোথাও কিছু খুঁজে পাওয়া যায়নি। আমাদের মনে হয়, সিঁড়ি এখানে থাকলেও তার কন্ট্রোল বাইরে কোথাও।’
আহমদ মুসা কোন কথা না বলে চোখ বুজল। মুহূর্ত কয় পরে চোখ খুলে বব কার্টারের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘দেখে আসুন তো মিঃ বব কার্টার সবগুলো মেইন সুইচ অন কি না।’
‘ইয়েস স্যার।’ বলে ছুটল বব কার্টার দরজার দিকে। দরজা দিয়ে ঢুকল ঘরে।
মুহূর্ত কয়েক পর ফিরে এসে বলল, ‘স্যার সবগুলো মেইন সুইচ অন, মাত্র একটা মেইন সুইচ অফ করা।’
‘মিঃ বব কার্টার কাউকে বলুন ঐ মেইন সুইচ অন করতে। দেখবেন সিঁড়ির মুখ খুলে গেছে।’
সকলেই আহমদ মুসার কথা শুনছিল। সকলেরই বিস্ময় বিমুগ্ধ দৃষ্টি তার প্রতি নিবদ্ধ।
কয়েকজন এফ.বি.আই কর্মী দাঁড়িয়েছিল দরজার সামনেই। তাদের দিকে তাকিয়ে বব কার্টার একজনকে নির্দেশ দিল, ‘টমাস অফ করা সুইচটা অন করে দাও তো।’
টমাস নামের লোকটি ছুটল। ঢুকলো ঘরে।
পরক্ষণেই সুইচ অন করার খট করে একটা শব্দ হলো। বাইরে থেকেও সবাই শুনল।
খট করে শব্দ উঠার পরেই চিৎকার শোনা গেল টমাস নামের লোকটির, ‘পাওয়া গেছে স্যা……’
তার চিৎকার শেষ হলো না। স্টেনগানের আওয়াজ তার কন্ঠ ডুবিয়ে দিল। হারিয়ে গেল তার কন্ঠ।
দরজার সামনেই এফ.বি.আই-এর যারা দাঁড়িয়েছিল, তারা শুয়ে পড়ে তাদের স্টেনগান বাগিয়ে ধরল সেই দরজার দিকে।
ঝট করে উঠে দাঁড়িয়েছে আহমদ মুসা। বব কার্টার, বেঞ্জামিন বেকন ও কলিন্সও ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বব কার্টারের হাতে স্টেনগান। বেঞ্জামিন বেকন ও কলিন্সের হাতে উঠে এসেছে রিভলবার।
আহমদ মুসা এগুচ্ছে দরজার দিকে। তার হাত খালি।
‘স্যার, নিচে শত্রু আছে। সিঁড়ি পথে ওরা গুলী চালিয়েছে।’ উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল বব কার্টার আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে।
‘ওরা উঠে আসার সাহস পাবে না এত তাড়াতাড়ি। চিৎকার করায় ভীত শত্রুর নির্বিচার গুলীর শিকার হলো বেচারা টমাস।’
বলতে বলতে এগুলো আহমদ মুসা দরজার দিকে।
আহমদ মুসার পেছনে বেঞ্জামিন বেকন, বব কার্টার ও কলিন্স।
দরজার চৌকাঠের আড়ালে দাঁড়িয়ে ভেতরে উঁকি দিল আহমদ মুসা। দেখল, টমাসের ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া দেহটা পড়ে আছে ল্যান্ডিং-এর উপর। সেই সাথে আহমদ মুসা দেখল কনক্রিটের একটা সিঁড়ি নেমে গেছে নিচে। সিঁড়িতে কোন রেলিং নেই। সিঁড়ির নিচে আলো। এক ঝলক দৃষ্টিতে কাউকেই দেখতে পায়নি আহমদ মুসা।
তার মানে, ভাবল আহমদ মুসা, শত্রুরা প্রথম দৃষ্টিতে চোখে পড়ার মত জায়গায় নেই।
আহমদ মুসা ফিরে দাঁড়াল বেঞ্জামিনদের দিকে। বলল, ‘টমাস মারা গেছে।’
মুহূর্তের জন্যে থামল আহমদ মুসা। তার পরেই বলে উঠল, ‘এ বাড়ির মাস্টার সুইচ কোথায়?’
‘কেন এখানেই সব সুইচ নয়?’ বলল বব কার্টার।
‘এটা সুইচ ঘর নয়। মেইন সুইচগুলো এখানে রাখা হয়েছে গোপন সিঁড়ির কনট্রোলকে ক্যামোফ্লেজ করার জন্যে। নিশ্চয় রিডিং মিটার সহ বাড়ির মাস্টার সুইচ অন্য কোথাও আছে।’ বলল আহমদ মুসা।
এফ.বি.আই কর্মীদের একজন বলে উঠল, ‘স্যার বাড়ির মূল প্রবেশ দরজায় পাশেই একটা ঘর আছে। ওখানেই একটা বড় মাস্টার সুইচ ও মিটারগুলো দেখেছি।’
সে কথা শেষ করতেই আহমদ মুসা তাকে বলল, ‘দেখে আসুন সেটা অন না অফ আছে।’
দৌড়ে চলে গেল লোকটি, ফিরে এলো মিনিট খানেকের মধ্যেই। বলল, ‘স্যার অন আছে সুইচটি।’
আহমদ মুসা লোকটিকে ধন্যবাদ দিয়ে সবাইকে কাছে ডাকল এবং তার পরিকল্পনা সবাইকে বুঝিয়ে বলল। এই পরিকল্পনায় কার কি দায়িত্ব তা বুঝিয়ে দিল।
শেষে কলিন্সের দিকে চেয়ে বলল, ‘মিঃ কলিন্স, আপনি যান মাস্টার সুইচের কাছে। বব কার্টার সংকেতটি বাজাবার পর সুইচ অফ করবেন এবং দ্বিতীয় সংকেতটি বাজাবার পর সুইচটি আবার অন করবেন।’
‘মিঃ আহমদ মুসা আপনি একা নামছেন নিচে, এটা ঠিক নয়। আমিও নামতে চাই।’ বলল বেঞ্জামিন বেকন।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘এটা যুদ্ধের প্রথম পর্যায়, এ পর্যায়ে যদি আমি ব্যর্থ হই। তাহলে দ্বিতীয় পর্যায়ে আপনি নামবেন।’
বেঞ্জামিন বেকন মুখ ভার করল। কিছু বলল না।
নির্দেশ পাওয়ার সংগে সংগেই কলিন্স বাইরে মাস্টার সুইচ বোর্ডের দিকে ছুটল।
বেঞ্জামিন বেকন এফ.বি.আই-এর একজন সৈনিক কর্মীকে সাথে করে স্টেনগান নিয়ে বসল দরজার ঠিক মাঝখানে। তাদের স্টেনগানের ব্যারেল রাখা হলো দরজার দুই প্রান্তের দুই কোণায়। ব্যারেলের মাথা সিঁড়ি এড়িয়ে নিচের দিকে কোণাকুণি তাক করা হলো। যাতে গুলী বৃষ্টি শুরু করলে সিঁড়ি সোজা মেঝে এলাকায় আঘাত না করে।
আহমদ মুসা মাথায় পাগড়ির মত করে একটা লম্বা কালো কাপড় পেঁচিয়ে নিয়েছে। সিঁড়ি থেকে গড়িয়ে নিচে পড়ার সময় মাথায় আঘাত না লাগে তার জন্যেই এই ব্যবস্থা। কাপড়টা যোগাড় হয়েছে বাড়িটিরই এক আলমারি থেকে। সম্ভবত কিছু তৈরীর জন্যে কেনা হয়েছিল, কিন্তু তা আর তৈরী হয়নি।
আহমদ মুসার শোল্ডার হোলস্টারে ছিল সারা জেফারসনের দেয়া মেশিন রিভলবার। সেটা বের করে হাতে নিল। তারপর আহমদ মুসা দরজার মাঝ বরাবর বসা স্টেনগানধারী দুজনের মাঝে মাথাটা নিচু করে দরজার চৌকাঠের বরাবরে নিয়ে এল।
কিছুটা পেছনে দাঁড়িয়েছিল বব কার্টার।
আহমদ মুসা তার মাথা নিচু করে চৌকাঠ বরাবর নেয়ার সাথে সাথেই বব কার্টার একটা তীক্ষ্ণ শীষ দিয়ে উঠল।
সংগে সঙ্গেই নিভে গেল সব আলো, নিচে নেমে যাওয়া সিঁড়ি এবং সিঁড়ির নিচের ঘরেরও।
আলো নিভে যাওয়ার সাথে সাথেই আহমদ মুসা মাথা চৌকাঠে ঠেকিয়ে দেহের পেছনটা শূন্যে ছুঁড়ে দিল ল্যান্ডিং-এর উপর দিয়ে নিচের সিঁড়ির দিকে।
আহমদ মুসার দেহ সিঁড়িতে পড়ার শব্দ পাওয়ার পঁচিশ সেকেন্ড, যে সময়ের মধ্যে আহমদ মুসার দেহ সিঁড়ি দিয়ে নিচে গড়ানো শুরু করেছে, তখন গর্জে উঠল বেঞ্জামিন বেকন ও এফ.বি.আই-এর সৈনিক কর্মীটির স্টেনগান। বেঞ্জামিন বেকনের স্টেনগান কভার করল সিঁড়ির বাম পাশের এবং এফ.বি.আই-এর কর্মীর স্টেনগান কভার করল সিঁড়ির ডান পাশের এলাকা। লক্ষ্য হলো নিচে বেজমেন্টের ঘরে যে শত্রুরা আছে তারা যেন সিঁড়ির দিকে ছুটে আসতে না পারে এবং আহমদ মুসা যাতে নিরাপদে সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে নিচে মেঝেতে গিয়ে সিঁড়ি বরাবর সামনে এগিয়ে কোথাও আশ্রয় নিতে পারে। আহমদ মুসার পরিকল্পনার বক্তব্য হলো, শত্রুরা যখন দেখবে আলো নিভে যাওয়ার সংগে সংগে গুলী শুরু হয়েছে দরজা থেকে, তখন তাদেরও প্রাথমিক লক্ষ্য হবে দরজা। শত্রুর স্টেনগানকে দরজার দিকে আটকে রেখে সেই সুযোগ আহমদ মুসা সিঁড়ি বরাবর সামনে এগিয়ে কোথাও আশ্রয় নেবে। এরপরের লক্ষ্য হলো পেছন থেকে শত্রুর উপর আকস্মিক আক্রমণের সুযোগ নেয়া।
আলো নিভে যাবার পচিশ সেকেন্ড পর জ্বলে উঠল আবার আলো।
তখনও দরজার উপর চলছে মুষলধারে গুলী বর্ষণ।
আলো জ্বলার সংগে সংগে আহমদ মুসার পরিকল্পনা অনুসারেই গুলী বন্ধ করে দিয়েছিল বেঞ্জামিন বেকন ও এফ.বি.আই-এর সৈনিক কর্মী।
ওদিকে আহমদ মুসা অন্ধকারের সেই পচিশ সেকেন্ডে সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে পড়ে গড়িয়েই দ্রুত এগোলো মেঝের উপর দিয়ে সিঁড়ি বরাবর সামনের দিকে। তার মাথার উপর দিয়ে তখন চলছে গুলী বৃষ্টি। আহমদ মুসা বুঝল, সে গড়িয়ে যেদিকে যাচ্ছে সেদিক থেকেও গুলী সিঁড়ির দিকে যাচ্ছে। তার অর্থ এ দিকেও শত্রুপক্ষের লোক আছে।
আহমদ মুসা একটা দেয়ালে গিয়ে ধাক্কা খেল।
আহমদ মুসা দেয়াল ধরে উঠে বসে ডানে-বামে হাতড়াতে গিয়ে দেখল বাম দিকে হাত দুয়েক পরেই দেয়াল শেষ হয়ে গেছে। তবে সেটা দরজা নয়। দরজা হলে চৌকাঠ বা চৌকাঠ ধরনের কিছু থাকত। কিন্তু তা নেই। তাহলে এটা করিডোর? তাই হবে ভাবল, আহমদ মুসা। অনুমানে আরও বুঝল এ করিডোরটি সিঁড়ির ঠিক বরাবর। আহমদ মুসা গড়াবার সময় একটু ডান দিকে সরে গিয়েছিল সিঁড়ি বরাবর আসা গুলী এড়াবার জন্যে।
তখনও দু’পক্ষের মধ্যে চলছে তুমুল গুলী বৃষ্টি।
আহমদ মুসা বাম পাশে খুঁজে পাওয়া করিডোরে মুখ বাড়াতে গিয়ে বুঝল, এ করিডোর থেকেও স্টেনগানের শব্দ আসছে। অখন্ড শব্দের মাঝে এই শব্দকে এতক্ষণ আহমদ মুসা আলাদা করতে পারেনি। সাবধান হলো আহমদ মুসা।
মেশিন রিভালবারের মুখ করিডোরে তাক করে করিডোর থেকে উত্থিত স্টেনগানের শব্দের উৎসকে চিহ্নিত করার চেষ্টা করল আহমদ মুসা। বুঝল স্টেনগানের শব্দ করিডোরের মাঝ বরাবর একই উৎস থেকে আসছে। শব্দ একাধিক স্টেনগানের।
আহমদ মুসা তার মেশিন রিভলবারের নল সে শব্দ লক্ষ্যে তাক করে ট্রিগার চেপে ধরল তর্জনি দিয়ে।
ট্রিগারে তর্জনি চেপেই আহমদ মুসা মেশিন রিভালবারের নল বৃত্তাকারে ঘুরিয়ে নিল করিডোরের প্রস্থ আনুমানিকভাবে আন্দাজ করে নিয়ে। আর সেই মুহূর্তেই আলো জ্বলে উঠেছিল।
আলোর বন্যায় ভেসে গেল চারদিক।
আহমদ মুসা তার সামনের করিডোরের দিকে একবার চেয়েই দেহটাকে বাঁকিয়ে নিয়ে ছুড়ে দিল করিডোরের ভেতর।
করিডোরর পড়েই আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
আগেই চোখে পড়েছিল করিডোরের মাঝ বরাবর তিনটি লাশ পরে আছে। আর একবার ভালো করে দেখল, তার মেশিন রিভলবারের প্রথম তিন শিকারকে।
আহমদ মুসা তার মেশিন রিভলবার পকেটে রেখে লাশের কাছে পড়ে থাকা তিনটি স্টেনগানের দুটি তুলে নিল। একটা ঘাড়ে ফেলে অন্যটি হাতে রাখল।
গুলী বৃষ্টির তীব্রতা তখন কমে গেছে। উপর থেকে গুলী পরিকল্পনা অনুসারেই থামিয়ে দেয়া হয়েছে অল্পক্ষণের জন্যে, যাতে আলো জ্বলে উঠার পর আহমদ মুসা প্রয়োজনে যে কোন দিকে মুভ করার সুবিধা পায়। কিন্তু এদিক থেকে গুলী বৃষ্টি বন্ধ হয়নি।
সিঁড়ির উপর দিয়ে গুলী গুলো হচ্ছে ঘরের ডান ও বাম দুই প্রান্ত থেকে। মাঝ বরাবার এলাকা থেকে কোন গুলী হচ্ছে না। আহমদ মুসা নিশ্চিত হলো, ঘরের মাঝ এলাকায় ঘাপটি মেরে নিশ্চয় কেউ বসে নেই।
ঘরের ডান ও বাম এলাকা থেকে যারা গুলী করছে সিঁড়ি লক্ষ্যে, তারা কি দেখতে পেয়েছে আহমদ মুসাকে? প্রশ্ন জাগল আহমদ মুসার মনে।
এক ঝলক দেখে আহমদ মুসা যতটুকু বুঝেছে, সিঁড়ির নিচে ফাঁকা একটা প্রশস্থ চত্তর। চত্তরটির সামনের দিকে চত্তর থেকে একটি করিডোর বেরিয়ে এগিয়ে গেছে। সেই করিডোরটিতেই আহমদ মুসা দাঁড়িয়ে। অনুরূপভাবে চত্বরটি ডান ও বাম দিকে বেশ কিছুটা এগুবার পর চত্বর থেকে দুদিকেই করিডোর বেরিয়ে গেছে। আহমদ মুসার বিশ্বাস, ঐ দুই করিডোরের মুখ থেকে দেয়ালের আড়াল নিয়ে সিঁড়ির দিকে গুলী করা হচ্ছে।
ওরা আহমদ মুসাকে দেখতে পায়নি বলে মনে হচ্ছে আহমদ মুসার। আলো জ্বলার সময় স্বাভাবিকভাবেই ওদের চমকিত দৃষ্টি সিঁড়ি মুখের দিকে নিবদ্ধ হবার কথা। তাছাড়া এক ঝলক দেখতে পেলেও তাকে এ করিডোর থেকে বেরিয়ে যাওয়া নিজেদের লোক মনে করাটাই স্বাভাবিক। শত্রু মনে করলে অবশ্যই তাদের স্টেনগানের গুলী এদিকেও ছুটে আসত। চারদিকে স্টেনগানের আওয়াজের মধ্যে আহমদ মুসার মেশিন রিভলবারের অপেক্ষাকৃত মিঠা আওয়াজ নিশ্চয় তারা শুনতে পায়নি।
আহমদ মুসা খুশি হয়েছে, তবে করিডোরটির পেছন দিকে বেশি এগোয়নি।
পেছনের দিকে নিরাপত্তা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে আহমদ মুসা ধীরে ধীরে এগোলো করিডোরের মুখের দিকে।
উপর থেকে আবার একটি দুটি করে গুলী বর্ষণ শুরু হয়ে গেছে ঘরের ডান ও বাম প্রান্তের দিকে পরিকল্পনা অনুসারেই। এ গুলী বর্ষণের লক্ষ্য শত্রুদেরকে গুলী বর্ষণে ব্যস্ত রাখা যাতে তারা অন্যদিকে মনোযোগ দিতে না পারে এবং তাদের অবস্থান চিহ্নিত করাও সহজ হয়।
আহমদ মুসা বিড়ালের মত অতিসন্তর্পণে এগিয়ে দেয়ালের আড়াল থেকে প্রথম উঁকি দিল বাম দিকে। দেখল চত্বরের প্রান্তে করিডোরের মুখে ওরা চারজন বসে। ওরা দেয়ালের আড়ালে, কিন্তু তাদের স্টেনগানের ব্যারেল অর্ধেক দেয়ালের বাইরে।
এরপর আহমদ মুসা একটু সময় নিয়ে উকি দিল ডান চত্ত্বরের দিকে। ওখানে দেখল দুজনকে। ওরাও ঐ একই পজিশনে স্টেনগান বাগিয়ে গুলী করছে। আহমদ মুসা সরে এল। হাতের স্টেনগানের গুলীর চেম্বার পরীক্ষা করল।
তারপর আহমদ মুসা স্টেনগানের ট্রিগার হাত রেখে এগোলো প্রথমে বাঁদিকে।
দেয়ালের গা ঘেঁষে হাঁটু গেড়ে বসে স্টেনগানের ব্যারেল চোখের পলকে বাইরে নিয়ে ট্রিগার চাপল আহমদ মুসা বাঁদিকের চারজনকে লক্ষ্য করে। এক পশলা গুলী করেই আহমদ মুসা বিদ্যুৎবেগে ঘুরে দাঁড়িয়ে স্টেনগান তাক করল ডান করিডোরের দুজনের দিকে।
ওরা দুজন গুলীর শব্দে চমকে উঠে তাকিয়ে আহমদ মুসাকে দেখতে পেয়েই স্টেনগান ঘুরিয়ে নিচ্ছিল।
আহমদ মুসার হাত স্টেনগানের ট্রিগারেই ছিল। সূতরাং স্টেনগানের নল তাদের দুজনের দিকে ঘুরার সাথে সাথেই এক ঝাঁক গুলী গিয়ে ঘিরে ধরল তাদেরকে।
বিশ সেকেন্ডও গেল না। খেলা সাঙ্গ হয়ে গেল। ছয়জনই মুহূর্তে লাশ হয়ে রক্তে ভাসতে লাগল।
সিঁড়ির মাথায় দেখা গেল বেঞ্জামিন বেকন, বব কার্টার ও কলিন্সকে।
আহমদ মুসাকে স্টেনগান হাতে চত্বরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ওরা ছুটে নেমে এল নিচে সিঁড়ি দিয়ে। তাদের পেছনে এফ.বি.আই-এর অন্যান্য সৈনিকরাও।
তারা পড়ে থাকতে দেখল নয়টি লাশকে।
বেঞ্জামিন বেকন জড়িয়ে ধরল আহমদ মুসাকে। বব কার্টার, কলিন্স আহমদ মুসাকে স্যালুট দিয়ে তাদের হৃদয়ের আবেগ প্রকাশ করল।
আর সৈনিকদের চোখে বিস্ময় ও আনন্দ।
‘জেনারেল শ্যারন তো তাহলে এখানে নেই।’ বলল বব কার্টার।
‘অবশ্যই। তিনি এখানে থাকার কথা নয় মিঃ বব কার্টার। তিনি এমন খোপে আশ্রয় নেবার মত লোক নন।’
‘ঠিক স্যার।’ বলল বব কার্টার। কথাটা শেষ করেই বব কার্টার আবার বলে উঠল , ‘স্যার আমরা এখন সার্চ করতে পারি?’
‘অবশ্যই সার্চ করে আপনারা উপরে আসুন। লাশগুলো নেয়ার ব্যবস্থা করুন। আমি ওদিকে দেখি রবিন নিক্সন কি করছে।’
বলে আহমদ মুসা উপরে উঠে এল। উপরে উঠে বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে।
আহমদ মুসাকে গেটে দেখেই রবিন নিক্সন গাড়ির জানালা নামিয়ে হাত নেড়ে ডাকল আহমদ মুসাকে। আহমদ মুসা গিয়ে উঠল রবিন নিক্সনের গাড়িতে।
‘স্যার অনেকক্ষণ ধরে গুলীর শব্দ শুনলাম। খারাপ কিছু ঘটেনি তো? ওরা সবাই কোথায়?’ বলল উদ্বিগ্ন রবিন নিক্সন।
‘বড় ধরনের খারাপ কিছু ঘটেনি, আমাদের একজন সৈনিক মারা গেছে। ওদের কয়েকজন মারা গেছে। সার্চ শেষ করে আসছে সবাই।’ বলল আহমদ মুসা।
‘স্যার এদিকে আরেক ঘটনা। যাকে খুঁজতে গেছেন তিনিই তো বাইরে।’
‘কেমন?’
‘স্যার, এর মধ্যে জেনারেল শ্যারন এ রাস্তা দিয়ে দু’বার পাস করেছে।’
‘জেনারেল শ্যারন?’
‘জি স্যার।’
‘দুবার?’
‘জি স্যার।’
‘তাহলে তো এ ঘাটিতে মূল্যবান কিছু আছে, যার জন্যে সে খুবই উদ্বিগ্ন।’
‘তাই হবে স্যার।’
‘তার গাড়ির নাম্বার নিয়েছ?’
‘জি স্যার।’ বলে গাড়ির নাম্বারটা আহমদ মুসার হাতে তুলে দিল রবিন।
‘আরো একবার জেনারেল শ্যারন আসবে নাকি?’
‘আসতেও পারে স্যার।’
‘কিংবা নাও আসতে পারে। কোথাও দাঁড়িয়ে শেষ পর্যন্ত কি ঘটে তা দেখতে পারে।’
‘জি স্যার, সেটাও স্বাভাবিক।’
এসব বিষয় নিয়ে কথা চলছিল আহমদ মুসা ও রবিন নিক্সনের মধ্যে।
অবশেষে বব কার্টাররা এল। বব কার্টার গাড়ির জানালা দিয়ে আহমদ মুসাকে বলল, ‘স্যার, কম্পিউটার ছাড়া নেবার মত ডকুমেন্ট কিছু পেলাম না।’
‘আমার বিশ্বাস কম্পিউটারগুলোর মধ্যে মূল্যবান দলিল থাকতে পারে মিঃ বব কার্টার। আপনার শিকার জেনারেল শ্যারন কিন্তু এ রাস্তায় ঘুর ঘুর করছে।’
‘তাই স্যার? তাহলে তো………’
‘এখন নেই। দুবার এ রাস্তা দিয়ে গেছে। অবশ্য যদি তৃতীয়বার আসে ,তাহলে আপনার একটা সুযোগ হতে পারে।’
‘ঈশ্বরের করুণা হোক স্যার।’
‘আমি স্যারকে টেলিফোন করেছিলাম। সব জানিয়েছি। তিনি পুলিশকে খবর দিতে বলেছেন। আমি পুলিশকে খবর দিয়েছি। ওরা আসছে। স্যার আপনাকে ধন্যবাদ দিয়েছেন।’
‘কোন স্যার? জর্জ আব্রাহাম?’
‘জি স্যার।’
‘আপনি সব কথা তাকে বলেছেন?’
‘উনিই খুঁটে খুঁটে জিজ্ঞেস করে জেনেছেন। আপনার মত উনি বলেছেন, কম্পিউটারগুলো খুব মূল্যবান হবে।’
‘মুল্যবান না হলে সরাতো না এবং এভাবে পাহারায় লোকও বসাতো না।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ডকুমেন্টগুলো ডেস্ট্রয়ও তো করতে পারে।’ বলল বেঞ্জামিন বেকন।
‘করতে পারত , কিন্তু করেনি। কারণ জেনারেল শ্যারনরা মনে করেছিল যে, তাদের গোপন আশ্রয়ে পৌঁছার পথ এফ.বি.আই খুঁজে পাবে না।’ আহমদ মুসা বলল।
‘জেনারেল শ্যারনের মনে করা ঠিক হয়েছিল। পথটা তো এফ.বি.আই খুঁজে পায়নি। পেয়েছে আহমদ মুসা।’ বলল কলিন্স।
‘এভাবে কথা বলা ঠিক নয়। আহমদ মুসা হাজির না থাকলে আপনারা ঠিকই খুঁজে পেতেন। সে ছিল বলে আপনারা যথাযথ দায়িত্ব নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করেননি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ধন্যবাদ স্যার। অন্যকে মর্যাদা দেবার, অন্যকে বড় করে দেখবার আপনার এই দুর্লভ গুনের কারণে শত্রুরাও আপনাকে মর্যাদা দেয় স্যার। আমি জেনারেল শ্যারন ও গোল্ড ওয়াটারের সাথে বেশ কয়েকদিন থেকে দেখলাম, তারা আপনাকে যতটা ঘৃনা করে, তার চেয়ে অনেক বেশি মর্যাদা তারা আপনাকে দেয়। আপনাকে তারা যমের মত ভয় করে, কিন্তু সেই সাথে তারা মনে করে আপনার দ্বারা কোন অন্যায় তাদের হতে পারে না। আজকের দুনিয়ায় এমন শত্রু দুর্লভ।’ বলল কলিন্স।
‘না কলিন্স। মানুষ যদি আল্লাহকে ভালোবাসে, আল্লাহর হুকুম মেনে চলে, তাহলে মানুষ প্রকৃত ‘মানুষ’ হয়ে যায়। আর মানুষ ‘মানুষ’ হলে সে মানুষকে নিজের মত করেই ভালোবাসবে।’
‘স্যার, আপনি খুব ঈশ্বর বিশ্বাসী, না?’ বলল কমান্ডার বব কার্টার।
‘অবশ্যই। কারণ আমি চাই এই জীবনে আমি যেমন আছি, তার চেয়ে অনেক ভাল থাকি পরকালে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘মিঃ আহমদ মুসা, আমার খৃস্টান ধর্ম যদি আপনার ধর্মের মত কাজের ধর্ম হতো, সক্রিয় ধর্ম হতো, তাহলে আমিও ঈশ্বরে বিশ্বাসী বা ধর্ম পালনকারী হতে পারতাম। খৃস্টান ধর্মে আমি করার কিছু পাই না।’ বলল বেঞ্জামিন বেকন।
‘স্যারের ধর্মই তাহলে গ্রহণ করে ফেল।’ বলল বব কার্টার।
‘বলতে হবে না, আমি অর্ধেক মুসলমান হয়ে গেছি। দেখে দেখে আমি নামাজ প্রায় শিখে ফেলেছি। মিঃ আহমদ মুসার মত দিনে পাঁচবার নামাজ পড়ে দেখেছি শরীর ও মন দুটোই ভাল লাগছে।’ বলল বেঞ্জামিন বেকন।
হেসে উঠল কলিন্স। বলল, ‘শুনেছি নামাজে অনেক কিছু পড়তে হয়। শিখেছেন সেগুলো?’
‘শিখব কোত্থেকে, মিঃ আহমদ মুসা হাসবেন বলে আমি কিছু বলিনি।’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘হাসব কেন? ভালো কাজে অবশ্যই সহযোগিতা করব।’
‘মুসলমান হওয়ার কোন নিয়ম আছে খৃস্টানদের ব্যাপটাইজের মত?’ বলল বব কার্টার আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে।
‘ও রকম কোন নিয়ম নেই। শুধু একটা ঘোষনা দিতে হয়, তারপর আল্লাহর আদেশ-নিষেধ জীবনের সবক্ষেত্রে মেনে চলতে হয়।’
‘ঘোষনাটা কি?’ আগ্রহের সাথে বলল বেঞ্জামিন বেকন।
‘ঘোষনাটা হলোঃ কোনই উপাস্য নেই আল্লাহ ছাড়া। মুহাম্মদ (সা) তাঁর বার্তাবাহক।’ আহমদ মুসা বলল।
‘এ ঘোষনা দেয়ার অর্থ কি?’ বলল কলিন্স।
‘ঘোষনার অর্থ হলো, আল্লাহ ছাড়া দুনিয়ার আর কাউকেই, শাসক বা সমাজপতি যেই হোন, উপাস্য, মুনিব, মালিক, বিধান দাতা, রিজিক দাতা ইত্যাদি হিসাবে মানা যাবে না। আর আল্লাহ জগতের শেষ নবী মুহাম্মদ (সা) এর মাধ্যমে যে জীবন-বিধান পাঠিয়েছেন তা মেনে চলতে হবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘এ ঘোষনা যদি আমি এখনই দেই?’ বলল বেঞ্জামিন বেকন, কলিন্স, বব কার্টার প্রায় একই সাথে।
আহমদ মুসা হাসি মুখে কিছু বলতে যাচ্ছিল, সেই সময় পুলিশের দুটি গাড়ি এসে দাঁড়াল তাদের গাড়ির পাশে।
আহমদ মুসা থেমে গেল এবং প্রসংগ পাল্টে দ্রুত কন্ঠে বব কার্টারকে বলল, ‘তাড়াতাড়ি বাড়ি ও লাশ ওদের বুঝিয়ে দিন।’
‘জি স্যার, দিচ্ছি। কম্পিউটার ও অন্যান্য ডকুমেন্ট সবই গাড়িতে তোলা হয়েছে। ওদেরকে বাড়ির দায়িত্বটা বুঝিয়ে দিয়েই আমরা চলে যাব।’ বলল বব কার্টার।
‘আমরা তো এখন চলে যেতে পারি মিঃ বব কার্টার।’
বব কার্টার আহমদ মুসার দিকে আবার পরিপূর্ণভাবে ঘুরে দাঁড়িয়ে শশব্যস্তে বলে উঠল, ‘না স্যার। আমি বলতে ভুলে গেছি। স্যার আপনাকে অনুরোধ করেছেন আমাদের সাথে হেড কোয়ার্টারে যেতে। জর্জ এডওয়ার্ড মুরকে নিয়ে তার স্ত্রী বাড়ি এসেছেন। স্যার বলেছেন এডওয়ার্ড মুরের সাথেও দেখা করার কথা।’
হাসল আহমদ মুসা। মনে মনে বলল, লোভ দেখিয়েছেন এডওয়ার্ড মুরের সাথে সাক্ষাতের। আসল মতলব, নিশ্চয় কোন আলোচনার বিষয় আছে। প্রকাশ্যে বলল আহমদ মুসা, ‘ঠিক আছে বব কার্টার। আপনার স্যারের হুকুম তো আর আমি ফেলতে পারি না। যাব।’
‘হুকুম নয় স্যার। অনুরোধ করেছেন আপনাকে।’
‘ঠিক আছে। আপনি কাজ সেরে নিন।’ আহমদ মুসা বলল।
বব কার্টার চলল গাড়ি থেকে নেমে আসা এক পুলিশ অফিসারের দিকে।
আহমদ মুসা মুখ ফিরিয়ে নিল গাড়ির ভেতরে।
রবিন নিক্সনের সাথে আবার গল্প শুরু হলো তার।

Top