২৯. আমেরিকায় আরেক যুদ্ধ

চ্যাপ্টার

বোর্ডিং লাউঞ্জে বসে চা খাচ্ছে আহমদ মুসা, জর্জ আব্রাহাম, এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার এবং জেনারেল শেরউড।
আহমদ মুসার পাশেই বসেছিল জর্জ আব্রাহাম। জর্জ আব্রাহামের পায়ের কাছে কার্পেটের উপর পড়েছিল একটা সিগারেটের প্যাকেট। বার বার তার পা ঠেকছিল সিগারেটের সেই খালি বাক্সটায়।
এক সময় সে ঝুঁকে পড়ে সিগারেটের খালি বাক্সটি তুলে নিয়ে উঠে দাঁড়াচ্ছিল ওয়েস্ট পেপার বক্সে ফেলে দেবার জন্যে।
আহমদ মুসারও দৃষ্টি পড়েছিল প্যাকেটটির উপর। প্রথমেই তার চোখটা আটকে গিয়েছিল প্যাকেটের গায়ে লেখা কয়েকটা হিব্রু অক্ষরের উপর।
আহমদ মুসা দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে প্যাকেটটির দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, ‘মাফ করবে, ওটা আমাকে একটু দেবেন?’
‘না আমিই ফেলে দিয়ে আসছি।’ হেসে বলল জর্জ আব্রাহাম।
‘না । ওটা একটু দেখব আমি।’ বলল আহমদ মুসা।
জর্জ আব্রাহামের হাত থেকে প্যাকেটটি নিয়ে বসে পড়ল আহমদ মুসা। পড়ল হিব্রু লেখা। কয়েকটি হিব্রু অক্ষর এবং কয়েকটি হিব্রু সংখ্যা। অক্ষর ও সংখ্যাগুলোর ইংরেজী অনুবাদ দাঁড়ায় ‘এফ.বি.আই.ভি ০০২১।’ বুঝল আহমদ মুসা এটা এয়ার লাইন্সের নাম্বার। আবার পড়ল নাম্বারটি। এটি কি এফ.বি.আই-এর নিজস্ব বিমান পরিবহন? কিন্তু হিব্রুতে কে লিখল এই এয়ার লাইন্সের নাম্বার? নাম্বারটি কোন বিমানের? তারা যে বিমানে যাচ্ছে, সে বিমানের নাম্বার কি?
প্রশ্নগুলো এক সঙ্গে জট পাকিয়ে তার মনে প্রবল উতসুক্য সৃষ্টি করল।
‘কি ভাবছেন আহমদ মুসা। বাক্সটিতে কি দেখছেন অমন করে?’ প্রশ্ন করল জর্জ আব্রাহাম।
‘আমরা কি এফ.বি.আই-এর নিজস্ব বিমানে যাচ্ছি?’ প্রশ্নের দিকে কান না দিয়ে জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘হ্যাঁ। কেন?’ বলল জর্জ আব্রাহাম।
‘নাম্বার কত?’
জর্জ আব্রাহাম তাকাল পাশেই আরেক সোফায় বসা এফ.বি.আই-এর স্থানীয় এক অফিসারের দিকে। বলল, ‘বল নাম্বারটা।’
নাম্বারটা বলল অফিসারটি।
সিগারেটের বাক্সে লেখা নাম্বারটিই বিমানের নাম্বার।
চমকে উঠল আহমদ মুসা। তাদের বিমানের নাম হিব্রুতে কে লিখল-এ কার্টুনে? কেন লিখল?
কেন লিখল তার জবাব নিজের কাছেই পেল আহমদ মুসা। লেখার আলগোছে ও বিশৃংখলা স্টাইল দেখে বুঝল, লেখক সচেতনভাবে এবং কোন উদ্দেশ্য নিয়ে এটা লেখেনি। নিশ্চয় কারও সাথে খোশগল্প করা অবস্থায় বা কাজহীন বসা অবস্থায় আনমনে কলম চালিয়ে লেখাগুলো লিখেছে। তবে যেই লিখুক, হিব্রুই তার প্রধান ভাষা। লেখার আঁচড়গুলো পাঁকা।
কিন্তু কে সেই লোক? তার হাতে এ নাম্বার এলো কেন? বিমানটির সাথে তার কোন সম্পর্ক আছে?
এই চিন্তা করতে গিয়ে আঁৎকে উঠল আহমদ মুসা। ইহুদী ছাড়া খুব কম লোকই হিব্রু জানে। ইহুদী ছাড়া কারও প্রধান ভাষা তো হিব্রু নয়ই। সুতরাং ধরে নিতে হবে একজন ইহুদী তাদের বিমানের সাথে সম্পর্কিত হয়ে পড়েছে বা এ বিমান নিয়ে ভেবেছে।
আবারও ভীষণভাবে চমকে উঠল আহমদ মুসা। বলল জর্জ আব্রাহামের দিকে তাকিয়ে, ‘আমরা এখানে আসার আগে কে বা কারা এখানে বসেছিল, সেটা কি দয়া করে খোঁজ নিতে পারেন?’
আহমদ মুসার চিন্তান্বিত মুখের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর হলো জর্জ আব্রাহাম। বলল, ‘সেটা নিচ্ছি। কিছু ঘটেছে? অন্যকিছু ভাবছেন আপনি?’
‘বলার মত এখনও কিছু হয়নি। আপনি দয়া করে একটু খোঁজ নিন।’ হেসে বলল আহমদ মুসা।
জর্জ আব্রাহাম পাশের এফ.বি.আই অফিসারের কানে কিছু বলল।
উঠে গেল অফিসারটি।
মিনিট খানেকের মধ্যেই সে ফিরে এল ইউনিফরম পরা একজন লোককে নিয়ে। বলল, ‘ইনি বোর্ডিং লাউঞ্জের সিকিউরিটি অফিসার মিঃ মার্টিন। ইনি বলছেন, আমরা আসার আগে এখানে পাইলট ও ক্রুরা বসেছিল।’
পরিচয় শুনে ভেতরের সন্দেহটা আরও ঘনিভূত হলো আহমদ মুসার মধ্যে। বলল সে মার্টিনকে লক্ষ্য করে, ‘কোন বিমানের ওরা?’
‘স্যাররা এফ.বি.আই-এর যে বিমানে যাচ্ছেন, সেই বিমানের?’
‘সবাই বিমানে । শুধু একজন ফিরে গেছে তার বাসায়।’
‘ফিরে গেছেন কেন? কে তিনি?’
‘সে একজন পাইলট । আমি আর কিছু জানি না স্যার।’ বলল সিকিউরিটির লোকটি।
‘আমি জানি।’ বলে উঠল এফ.বি.আই-এর স্থানীয় অফিসারটি।
এতক্ষণে এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার ও জেনারেল শেরউডও আগ্রহী হয়ে উঠেহে বিষয়টার প্রতি। সবার দৃষ্টি এফ.বি.আই-এর অফিসারটির দিকে।
এফ.বি.আই অফিসার বলতে শুরু করল, ‘ফিরে গেছেন পাইলট জন আলফ্রেড। তারই এই ফ্লাইট চালাবার কথা ছিল। কিন্তু হঠাৎ তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। বিমানেই একবার বমি করেন। পরে তিনি ককপিট থেকে নেমে আসেন। বিকল্প হিসাবে জনসন আসেন। তারা সবাই এখানে একত্রে বসে আলাপ করছিলেন ও চা খাচ্ছিলেন।’
এফ.বি.আই অফিসারের দেয়া এই তথ্যে ভ্রু কুঞ্চি হয়ে উঠল আহমদ মুসার। সন্দেহটা শংকার রূপ নিল। বলল আহমদ মুসা সিকিউরিটি অফিসার মার্টিনকে লক্ষ্য করে, ‘আচ্ছা মিঃ মার্টিন, আপনি কি বলতে পারেন, মিঃ জর্জ আব্রাহাম যেখানে বসে আছেন, সেখানটায় তাদের কে বসেছিলেন?’
লোকটি তৎক্ষনাতই উত্তর দিল, ‘যিনি ফিরে গেছেন মানে পাইলট জন আলফ্রেড এখানে বসেছিলেন।’
‘তার আশে-পাশে আর কারা বসা ছিল?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা
‘কেউ ছিল না। তাঁর সামনের এদিকের সোফায় বসা ছিলেন অন্য ক্যাপটেন যিনি বিমানে উঠেছেন। অন্যান্য ক্রুরা অন্যান্য জায়গায় বসা ছিল।’ বলল মার্টিন।
‘ধন্যবাদ মিঃ মার্টিন।’ বলে আহমদ মুসা জর্জ আব্রাহামের দিকে চেয়ে বলল, ‘ওর সাথে কথা শেষ মিঃ জর্জ আব্রাহাম।’
মার্টিন চলে গেল।
মার্টিন চলে যেতেই জর্জ আব্রাহাম আহমদ মুসাকে কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই আহমদ মুসা কথা বলে উঠল। বলল এফ.বি.আই-এর সেই স্থানীয় অফিসারকে লক্ষ্য করে, ‘জন আলফ্রেড কি আপনার পরিচিত?’
‘জি, হ্যাঁ। তিনি এফ.বি.আই-এর অনেক দিনের পাইলট।’
‘বলতে পারেন, তিনি কয়টি ভাষা জানেন?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘শুধু ইংরেজী। দেশের বাইরেও কখনও উনি যাননি।’
সন্দেহের মধ্যে পড়ে গেল আহমদ মুসা। তাহলে এ হিব্রু লেখা কি ফিরে যাওয়া পাইলটের নয়। তার আগে আর কেউ এখানে বসেছিল? তিনিই লেখা লিখেছেন? কিন্তু এফ.বি.আই-এর নিজস্ব এ ফ্লাইটের নাম্বার সে পাবে কি করে? সেও কি তাহলে এফ.বি.আই-এর কেউ ছিল?
গোলক ধাঁধাঁয় পড়ে গেল আহমদ মুসা। কিন্তু তার মন নিশ্চিত করে বলছে, হিব্রু ভাষায় তাদের এ গুরুত্বপূর্ণ ফ্লাইটের নাম্বার লেখা সময়ের বিচারে একেবারেই নিরর্থক নয়। ইহুদীদের হাত এ ফ্লাইট পর্যন্ত পৌছেছে। সে হাতের উদ্দেশ্যে কি? লোককে চিহ্নিত করতে পারলে উদ্দেশ্যটা বের হয়ে যেতো।
‘কি ব্যাপার আহমদ মুসা? ঘটনা কি বলুন তো?’ উদ্বিগ্ন কন্ঠ জর্জ আব্রাহামের । ভাবছে সে, আহমদ মুসা কোন ছোট ব্যাপার নিয়ে এতটা মাথা ঘামানোর কথা নয়।
‘আমি এখনও কোন কিনারায় পৌছুতে পারিনি জনাব।’
বলে একটু দম নিয়ে বলল, ‘আপনাদের বিমানের ক্যাপটেন ও ক্রুদের মধ্যে কেউ হিব্রু জানে?’
জর্জ আব্রাহামের চোখে মুখে ভাবনার চিহ্ন ফুটে উঠল। তাকাল সে এফ.বি.আই-এর স্থানীয় অফিসারের দিকে। তারপর বলল, এ রকম কেউ আছে বলে আমার জানা নেই। সি.আই.এ’র হিব্রু উইং আছে। আমাদের দরকার হলে সি.আই.এ’র সাহায্য নেই। এফ.বি.আই’তে হিব্রু শিক্ষার কোন ব্যবস্থা নেই।’
জর্জ আব্রাহামে থামলে এফ.বি.আই-এর স্থানীয় অফিসারটিও বলে উঠল, আমাদের এ ধরনের কোন লোক সান্তাফে বা নিউ মেক্সিকোতে ফ্লাইট ক্রুদের মধ্যে নেই।
‘হ্যাঁ তাই। হিব্রু ইহুদীদের জাতীয় ভাষা, ধর্মীয় ভাষা। সাধারণভাবে তারা এ ভাষা শেখে।’
‘আহমদ মুসাকে আমি সমর্থন করছি। কিন্তু আহমদ মুসা, হিব্রু এবং বিমার ক্রুরা আপনার এ আলোচনায় আসছে কেন? খুলে বলুন সব।’ বলল সি.আই.এ চীফ এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার।
আহমদ মুসা তার হাতের সিগারেট কার্টনটি তুলে ধরে বলল, ‘এই কার্টনে হিব্রু ভাষায় আমরা যে ফ্লাইটে এখন যাব সেই ফ্লাইটের নাম ও নাম্বার লেখা। আমার বিশ্বাস এফ.বি.আই-এর ক্যাপটেন ও ক্রুদের কেউ এটা লিখেছে। কিন্তু আপনারা বলছেন তাদের মধ্যে হিব্রু জানা কোন লোক নেই।’
আহমদ মুসার কথা শোনার সাথে সাথে জর্জ আব্রাহাম ও এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থারের চোখে মুখে চাঞ্চল্য ফুটে উঠল। তারা কথা বলল না। ভাবছিল তারা।
কথা বলে উঠল জেনারেল শেরউড, ‘ব্যক্তিগতভাবে কেউ জানতেও পারে হিব্রু। কিন্তু আহমদ মুসা এর দ্বারা আপনি কি বুঝাতে চাচ্ছেন?’
‘মারাত্মক কিছু বুঝাতে চাচ্ছেন জেনারেল। তিনি বলতে চাচ্ছেন, লস আলামোস থেকে আসার পথে আমরা ইহুদী সন্ত্রাসীদের দ্বারা ঘেরাও হয়েছিলাম, আবারও আমরা হতে যাচ্ছি।’ বলল সি.আই. এ চীফ।
জর্জ আব্রাহাম তখনও গম্ভীর। ভাবছেন তিনি, সে আহমদ মুসার হাত থেকে সিগারেট কার্টুনটি নিয়ে লেখার উপরও চোখ বুলিয়েছে। এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থারের কথা শেষ হলে সে বলল গম্ভীর কন্ঠে, ‘এ হস্তাক্ষর পরীক্ষা করলেই লোক পাওয়া যাবে। আপনার কাউকে সন্দেহ হচ্ছে?’
‘আমার অনুমান ভুল না হলে ফিরে যাওয়া ক্যাপটেন জন আলফ্রেড এটা লিখেছেন।’
জর্জ আব্রাহাম একটু ভাবল। তারপর বলল, ‘ঠিক আছে লেখাটা পরীক্ষা করা ও তার সাথে মেলাবার নির্দেশ দিচ্ছি।’
‘সেটা পরের কথা, কিন্তু এখন কি করতে চান?’ বলল আহমদ মুসা।
‘কেন, এখন তো আমাদের রওয়ানা হতে হবে।’ জর্জ আব্রাহাম বলল।
‘না, এই বিমানে এই ফ্লাইটে যাওয়া যাবেনা।’
‘কি বলছেন আপনি?’ বিস্মিত কন্ঠে বলল জর্জ আব্রাহাম।
একটু থেমেই আবার বলল, ‘আপনার সন্দেহ যদি সত্যও হয় তাহলে সে চলে যাওয়ায় কোন ভয় তো এখন আমাদের নেই। সে তো বিমান চালাচ্ছে না।’
‘আমার যুক্তি দু’টি। এক, আমাদের সন্দেহ যাকে সেই ছদ্মবেশী ইহুদী যে জন আলফ্রেড তা এখনও প্রমাণ হয়নি। বিমানটিতে এখন যিনি ক্যাপটেন, তিনি অথবা অন্যকোন ক্রুও তো আমাদের সন্দেহের তালিকায় আসতে পারেন। দ্বিতীয়ত, আমার বিশ্বাস জন আলফ্রেডের অসুখ হওয়ার ব্যাপারটা একটা ভান। তার বিমান থেকে নেমে যাওয়াটা উদ্দেশ্যমূলক।’
আহমদ মুসার কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই আসন থেকে লাফিয়ে উঠল জর্জ আব্রাহাম এবং এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার। দুই জনে প্রায় একই সঙ্গে বলে উঠল, ‘তার মানে বলতে চাচ্ছেন বিমানে কিছু সে পেতে রেখে গেছে?’
‘আমার সেটাই সন্দেহ।’ বলল আহমদ মুসা।
দু’জনেই ধপ করে সোফায় বসে পড়ল। দু’জনেরই মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। একটু দেরীতে বুঝেছেন জেনারেল শেরউড। বুঝতে পেরেই সে চিৎকার করে বলে উঠল, ‘মিঃ আব্রাহাম এখনই গ্রেফতার করার নির্দেশ দিন জন আলফ্রেডকে।’
এফ.বি.আই-এর স্থানীয় অফিসারটি জর্জ আব্রাহামের সাথে সাথে দাঁড়িয়েছিল। আর বসেনি। সে কাঁপছে।
আহমদ মুসা তাকাল অফিসারটির দিকে। বলল, ‘বিমানটি কমপ্লিট চেক করার ব্যবস্থা করুন, বিস্ফোরক ডিটেক্টর দিয়ে। বিমান থেকে কেউ যেন না নামে। দ্বিতীয়ত, হস্তাক্ষর পরীক্ষা ও জন আলফ্রেডের উপর চোখ রাখার ব্যবস্থা করুন, অবিলম্বে।’
অফিসারটি চলে গেল।
‘আমি হেড কোয়ার্টারের সাথে কথা বলে আসি। আমার ই-মেইল ওরা পেলেন কি না।’ বলে উঠে গেল জেনারেল।
জর্জ আব্রাহামও উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘জেনারেল আমরা বিশ্রাম কক্ষে আছি। আপনি ওখানে আসুন।’
বলে হাঁটার জন্যে পা বাড়িয়ে আহমদ মুসা ও এ্যাডমিরালের দিকে চেয়ে বলল, ‘আপনারা আসুন।’

‘বলুন আহমদ মুসা এখন কি করনীয়। বিমানে কোন অস্ত্র কিংবা কোন ধরনের কোন বিস্ফোরকের চিহ্ন পাওয়া যায়নি।’ বলল জর্জ আব্রাহাম।
সার্চ টীমটিকেও সাথে নিয়ে এসেছিল এফ.বি.আই-এর অফিসারটি। টীমটির যিনি অধিনায়ক জিজ্ঞাসার জবাবে তিনিও বললেন, ‘ইঞ্জিন রুম থেকে শুরু করে স্টোর রুম, টয়লেট প্রতিটি সিট মোটকথা বিমানের প্রতি ইঞ্চি জায়গা আলট্রা সেনসেটিভ ডিটেক্টর দিয়ে সার্চ করা হয়েছে। কিছুই পাওয়া যায়নি।’
আহমদ মুসা কিছু বলল না। তাকাল এফ.বি.আই-এর সেই অফিসারের দিকে। বলল, ‘জন আলফ্রেডের খবর কি?’
অফিসারটি জবাব দেবার আগেই তার মোবাইল বেজে উঠল। টেলিফোন কল এসেছে।
মোবাইলে কথা বলল অফিসারটি। কথা বলতে গিয়ে তার মুখ অন্ধকার হয়ে উঠল। কথা বলা শেষ করে সে প্রায় আর্ত কন্ঠে বলল, ‘স্যার, জন আলফ্রেডকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। বাড়ি,হাসপাতাল, ক্লিনিক, ক্লাব , আত্মীয় বাড়ি সব জায়গায় খোঁজ নেয়া হয়েছে।’
‘সর্বশেষ তাকে কে কোথায় দেখেছ।’ উৎকণ্ঠিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল জর্জ আব্রাহাম।
‘সে এয়ারপোর্ট থেকে ফ্ল্যাটে ফেরেনি।’
বোবা এক নিরবতা নেমে এল সবার মধ্যে। প্রবল এক অস্বস্তি, উৎকণ্ঠা সকলের মধ্যে।
নিরবতা ভাঙল আহমদ মুসা। বলল সে বিমান সার্চকারী বিস্ফোরক এক্সপার্টদের লক্ষ্য করে, কত প্রকার বিস্ফোরক পাতা যায় বলুনতো?’
সার্চ টীমের নেতা অনেক প্রকারের বিবরণ দিল।
‘সব বলেছেন, কিন্তু একটা বাদ থেকে গেছে।’ বলেই একটু থেমে আবার বলল, ‘বলুন তো এ বিমানের ইঞ্জিনে রিমোট স্টার্টিং-এর ব্যবস্থা আছে?’
‘আছে।’ বলল সার্চ টীমের চীফ।
‘তাহলে বিমান থেকে সবাইকে নামিয়ে বিমান ইঞ্জিন রিমোট স্টার্টের ব্যবস্থা করুন।’
টীমের চীফ জর্জ আব্রাহামের দিকে তাকিয়ে তার সম্মতি পেয়ে বেরিয়ে গেল তার টীমের লোকদের নিয়ে। টীমের লোকদের সাথে জর্জ আব্রাহামরাও বিশ্রাম কক্ষ থেকে বেরিয়ে আগের সেই বোর্ডিং লাউঞ্জে ফিরে এল।
ওখানে বসেই কাঁচের দেয়ালের মধ্যে দিয়ে দেখল সার্চ টীমকে বিমান থেকে বিমানের ক্যাপটেন ও ক্রু সবাইকে নামিয়ে আনতে। তার আগেই বিমানকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে গ্যাংওয়ে থেকে বেশ দূরে।
ক্যাপ্টেনের হাতেই দেখা গেল রিমোর্ট কন্ট্রোলার।
বিমান থেকে একটু দূরে এসে সবাই দাঁড়াল। ডান হাতের রিমোর্ট কন্ট্রোলার একটু উপরে তুলতে দেখা গেল ক্যাপ্টেনকে। রিমোর্ট স্টার্টের বোতামে চাপ দিয়েছে বোধ হয় ক্যাপ্টেন।
সঙ্গে সঙ্গেই ঘটল ভয়াবহ এক বিস্ফোরণ। প্রথমে বিমানের মধ্য থেকে সামনের অংশ উড়ে গেল। তারপর গোটা বিমানই অগ্নিগোলকের আকারে আকাশে উঠে গেল।
সকলের চোখ সেদিকে নিবদ্ধ। জর্জ আব্রাহাম, এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার ও জেনারেল শেরউডের চেহারা মরার মত পান্ডুর। পাথরের মত তারা স্থির ও নিস্তদ্ধ। চোখে তাদের পলক নেই।
নিরবতা ভাঙল জেনারেল শেরউড। আসন থেকে উঠে সে ছুটে আহমদ মুসার পাশে এসে বসল। বলল, ‘মিঃ আহমদ মুসা গত কয়েক ঘন্টায় আপনি দু’বার আমাদেরকে একেবারে সাক্ষাৎ মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে আনলেন। আমি আপনার অনেক গুনের কথাও শুনেছি, কিন্তু আজ দেখলাম আপনি সর্বদর্শীও।’
‘আল্লাহ মাফ করুন। আল্লাহই একমাত্র সর্বদশী। আমি একটা ক্লু পেয়ে সন্দেহ করেছি মাত্র, এটা এমন কিছু নয়।’
মুখ খুলল এবার জর্জ আব্রাহাম। বলল, ‘মিঃ আহমদ মুসা কোন সন্দেহে আপনি রিমোট স্টার্টের এই ব্যবস্থা করলেন?’
‘আমি তো বলেছিলাম, সার্চ টীমের নেতা বিস্ফোরনের সবগুলো প্রকারের কথা বলছেন, একটাই শুধু বলেননি। সেটা হলো, একটা বিস্ফোরক প্রযুক্তি অতিসম্প্রতি আবিষ্কৃত হয়েছে যা ডিটেক্টর-নিউট্রাল একটা আবরণে মোড়া থাকে। কোন প্রকার ডিটেক্টর দিয়েই তার সন্ধান মেলে না। এই বিস্ফোরক পাতা থাকে ইঞ্জিন অথবা ঘর্ষণসৃষ্টিকারী কোন বস্তুর সাথে। ইঞ্জিন বা ঘর্ষণসৃষ্টিকারী বস্তুটি চালু হলেই বিস্ফোরণ ঘটে যায়। আমার সন্দেহ হয়েছিল, ইহুদীরা যদি কিছু করেই থাকে, তাহলে এই সর্বাধূনিক প্রযুক্তিরই আশ্রয় নিয়েছে।’
‘ধন্যবাদ আহমদ মুসা, আপনি বলার পর ঐ বিস্ফোরক প্রযুক্তির কথা আমার মনে পড়েছে। কিন্তু এই বিস্ফোরক তো এখনও মার্কেটে যায়নি, ওরা পেল কি করে?’
‘যেভাবে রেডিও কম্যুনিকেশন জ্যাম করার সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ওরা পেয়েছে, সেভাবে এটাও ওরা পেয়েছে।’ বলল জেনারেল শেরউড।
বলে একটা দম নিয়েই ক্ষুদ্ধ কন্ঠে বলে উঠল, ‘ইহুদীবাদীদের কাছে মনে হচ্ছে আমাদের গোপন কিছুই আর গোপন নেই। ওদের গোয়েন্দাগিরী মনে হয় আমাদের আপাদ-মস্তক ছেয়ে ফেলেছে। দেখছি ঘরের শত্রু মহাবিভীষণ ওরা।’
‘উদার গণতন্ত্রমনাদের সংসারে যদি কোন কূট কুশলীর অনুপ্রবেশ ঘটে ,তাহলে এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে।’ বলল আহমদ মুসা কিছুটা হালকা সুরে।
‘দুঃখের মধ্যেও হাসালেন আহমদ মুসা। তাহলে আপনি মানে আপনারা স্বীকার করছেন মার্কিন জনগণ উদার ও গনতন্ত্রমনা।’ বলল জর্জ আব্রাহাম। মুখে তার ম্লান হাসি।
‘আমরা মানে মুসলমানরা তো এ কথা কখনও অস্বীকার করিনি যে আজ আমি স্বীকার করছি।’
‘আপনাদের গালির ভাষা কিন্তু তাই বলে, মিঃ আহমদ মুসা।’ বলল এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার।
‘মার্কিন সরকারের পলিসি এবং মার্কিন জনগণ কিন্তু এক নয়। মার্কিন সরকার বদল হয়,তার পলিসিও বদল হয়, কিন্তু মার্কিন জনগণ বদল হয় না। মার্কিন সরকার যে পলিসি নেয় তার সবটা মার্কিন জনগণ মেনে নেয় না। মার্কিন সরকার ভিয়েতনামে সৈন্য পাঠিয়েছিল, মার্কিন জনগণই তা ফেরত এনেছিল।’
‘যা হোক আহমদ মুসা। আপনি যে কথাটা বলেছেন, সেটা কিন্তু খুবই সত্য। ওরা আমাদের বিশ্বাসের ঘরে চুরি করেছে। আমাদের অস্ত্র হাত করে আমাদের উপরই প্রয়োগ করেছে।’ বলল জেনারেল শেরউড।
বলেই উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘যাই ব্যাপারটা হেড কোয়ার্টারে আমি রিপোর্ট করে আসি।’
এফ.বি.আই-এর স্থানীয় সিকিউরিটি যে অফিসার বাইরে গিয়েছিল, সে দ্রুত ফিরে এসে লাউঞ্জে ঢুকল এবং জর্জ আব্রাহামকে লক্ষ্য করে বলল, ‘স্যার, ওয়াশিংটনের আমাদের হেড কোয়ার্টার থেকে লোক আসছে প্লেন নিয়ে। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ল্যান্ড করবে।’
‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, আমি এমনটাই আশা করেছিলাম। যাক ঘটনা তুমি হেড কোয়ার্টারে রিপোর্ট করেছ?’ বলল জর্জ আব্রাহাম।
‘জি স্যার।’ বলল অফিসারটি।
‘আমি আসছি মিঃ আব্রাহাম। আমার ডকুমেন্টগুলো ওরা হেড কোয়ার্টারে পাঠাল কি না’ বলে লাউঞ্জ থেকে বেরিয়ে গেল এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার।
‘ওদিকে দেখে আমি আসছি স্যার।’ বলে বেরিয়ে গেল এফ.বি.আই-এর স্থানীয় অফিসারটিও।
এফ.বি.আই-এর বিমান বিস্ফোরণ নিয়ে তখন বাইরে এয়ারপোর্ট ও পুলিশের মধ্যে হুলুস্থুল চলছে। জন আলফ্রেডের সন্ধানে ছুটাছুটি শুরু করেছে তখন বাঘা বাঘা পুলিশ আর গোয়েন্দার দল।
হাতে কোন কাজ নেই। সোফায় গা এলিয়ে দিয়েছে আহমদ মুসা ও জর্জ আব্রাহাম।
কাঁচের দেয়ালের ভেতর দিয়ে তাদের দু’জনের চোখ নিবদ্ধ ছিল নীল আকাশের দিকে।
এক সময় সেই নীল আকাশের বুকে তাদের চোখে ছোট একটা সাদা বিমান ধরা পড়ল।
ওয়াশিংটন এফ.বি.আই হেড কোয়ার্টার থেকে আসা প্লেন।
ল্যান্ড করছে প্লেনটি। | ← Previous | | | Next → | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top