৩. মিন্দানাওয়ের বন্দী

চ্যাপ্টার

১০

শিরী শুয়ে আছে। কয়দিনের জ্বরে একদম শীর্ণ হয়ে গেছে সে। মাথার কাছে টেবিলের উপর কয়েকটি ওষুধের শিশি। স্মার্থার ডাক্তারির হাত মন্দ নয়। তার প্রেসক্রাইব করা ওষুধ খাবার পর থেকেই জ্বর কমতে শুরু করেছে। শিরী ও মুর হামসার স্মার্থার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। মেয়েটির ব্যবহার সত্যই ভাল। বিশেষ করে স্মার্থা আহমদ মুসাকে খুব শ্রদ্ধা করে দেখে মুর হামসার আরও খুশী। স্মার্থার মুখ থেকে আহমদ মুসার অত বেশী প্রশংসা শুনতে ভালো লাগেনি কিন্তু শিরীর। বিশেষ করে স্মার্থা যখন বলেছে যে, জীবন দিয়েও আমি তার ঋণ শোধ করতে পারবো না, তখন কথাটা শিরীর মনের কোণায় যেন খচ্ করে বিঁধেছে। শিরী মনকে শাসিয়েছেঃ ওঁকে যদি কেউ ভালো চোখে দেখে তাহলে তো খুশী হবারই কথা। আর তাছাড়া ওঁর উপর কি অধিকার আছে শিরীর। ভুল করেও কি তিনি কখনও তার প্রতি চোখ তুলে চেয়েছেন। চিন্তা এ পর্যন্ত গড়াতেই শিরীর চোখ জলে ভরে আসে। ভবিষ্যত ভাবনায় শিরীর মন উদ্বেল হয়ে উঠে। ধুলার পৃথিবীতে শুয়ে সে কি আকাশের চাঁদ ধরতে পারবে? কিন্তু কি করবে সে। সজ্ঞানে তো সে এ অপরাধ করেনি। তার হৃদয়ের কোন অপরিচিত উৎস থেকে এসেছে এ প্রেরণা। হৃদয়ের এ একান্ত চাওয়ায় কি কোন পাপ আছে? কেঁপে উঠে শিরী।
শিরীর দু’চোখের কোণায় দু’ফোটা অশ্রু টল টল করছিল।
এ সময় স্মার্থা প্রবেশ করলো ঘরে। স্মার্থাকে পৌছে দিয়ে মুর হামসার বাইরের ঘরে চলে গেল।
স্মার্থা শিরীর দিকে চেয়েই বলল, শিরী তোমার চোখে জল কেন? কাঁদছো কেন তুমি?
শিরী তাড়াতাড়ি চোখের পানি মুছে ফেলল। কিছু বলল না মুখে।
স্মার্থা তার পাশে বসল, কাগায়ান থেকে কোন খবর এসেছে?
-এসেছে।
-কি খবর?
-পিসিডা কাগায়ান দখল করেছে। মাইকেল এ্যাঞ্জেলা এবং ইরগুন জাই লিউমির ডেভিড ইমরান নিহত।
-চমকে উঠলো স্মার্থা এ্যাঞ্জেলা নিহত এক উষ্ণ স্রোত বয়ে গেল ম্মার্থার রক্ত কণিকায়। কিন্তু স্মার্থা মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, আমি কি ওদর খবর জিজ্ঞেস করেছি?
-তাহলে কি?
-আহমদ মুসার খবর।
খচ্ করে উঠল শিরীর হৃদয়ের একান্ত গোপন সেই বেদনাটা। ওর খবর দিয়ে স্মার্থার কি? মুখ ভার করে শিরী বলল, ওঁর কি খবর আমি বলব?
শিরীর একটি হাত হাতে নিয়ে স্মার্থা হেসে বলল. আমার কাছে লুকিয়ো না শিরী। আমি বুঝতে পেরেছি প্রথম থেকেই। কিন্তু নায়ক কি জানেন এটা? হেসে বলল, স্মার্থা।
-জানিনা। মুখ লাল করে বলল, শিরী
-বুঝেছি, শিরীর সুচিকিৎসার জন্য ওঁর এত গরজ কেন? তুমি ভাগ্যবতী শিরী।
শিরীর সরাটা দেহে এক উষ্ণ শিহরণ খেলে গেল। জ্বালাময় এ শিহরণে অসীম পরিতৃপ্তি। আপনাতেই তার চোখ দুটি বুজে গেল এক পরম প্রশান্তিতে। এই প্রথম স্মার্থার কথা ভালো লাগলো তার। চুপ করে রইল শিরী।
স্মার্থা আবার বলল-কই উত্তর দিলে না শিরী?
-কি?
-আহমদ মুসা কবে আসছেন।
বালিশে মুখ গুজে শিরী বলল, উনি অসুস্থ, হাসপাতালে। মাথা ও বাহুতে আঘাত পেয়েছেন উনি।
-তোমার এ দু:খে আমিও দু:খিত শিরী।
শিরী পাশ ফিরে শুয়ে বলল, তুমি আজ চিকিৎসার জন্য নয়, এসব মতলব নিয়েই এসেছ বুঝি?
-আর ওষুধ লাগবে না তোমার। ভাল হয়ে গেছ। এখন শরীরটা সারলেই হয়ে গেল।
তারপর স্মার্থা রুটিন মাফিক জ্বর চার্ট পরীক্ষা করল। হার্টের বিট দেখল। বলল, সব ঠিক আছে।
বলে বিছানা থেকে উঠে চেয়ারে গিয়ে বসল স্মার্থা। বলল, রুনার মা তো এখনও আটকা সোনিয়াকেও তো দেখছি না একটু পানি খেতাম শিরী।
শিরী বলল, ঠিক আছে আমি ডাকছি। বলে সে কলিং বেলের সুইচে চাপ দিতে গেল। স্মার্থা শিরীকে নিষেধ করলো। বলল, এই তো ডাইনিং রুম। আমিই খেয়ে আসি না। বলে সে উঠে দাড়াল।
ডাইনিং রুমের বিরাট এক ট্যাংকিতে পানি জমা থাকে। ট্যাংকে লাগানো আছে নল। নল দিয়ে পানি আসে।
স্মার্থা ডাইনিং রুমে ঢুকে তাড়াতাড়ি একটি চেয়ার টেনে নিয়ে পানির নলে এক পা দিয়ে ট্যাংক ধরে দাঁড়াল। তারপর স্কার্টের ভিতর থেকে একটি কাগজের মোড়ক বের করলো সে। মোড়কটি খুলে সাদা ধরনের অনেকগুলো পাউডার ঢেলে দিল পানির ট্যাংকিতে।
তারপর নেমে চেয়ার যথাস্থানে রেখে জগ থেকে এক গ্লাস পানি খেয়ে মুখ মুছতে মুছতে সে বেরিয়ে এলো।
মুর হামসারও ঘরে প্রবেশ করলো প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। বলল, কি দেখলেন, ওষুধ আর লাগবে?
-না, আর ওষুধের দরকার হবে না। গতকাল থেকে টেমপারেচার একদম নরমাল।
-ধন্যবাদ আপনাকে। অনেক খেটেছেন।
-চলুন। ধন্যবাদ দিয়ে আর কাজ নেই।
মুর হামসার স্মার্থাকে নিয়ে ঘর থেকে বেরুতে বেরুতে বলল, আর কি করতে পারি আপনার জন্য। মুসা ভাই আসলে আপনার মুক্তির জন্য সুপারিশ করব।
স্মার্থা খপ করে মুর হামসারের একটি হাত ধরে বলল, মুক্তি আমি চাই না হামসার।
-চান না মুক্তি? বিস্মিত হয়ে তাকাল স্মার্থার দিকে।
স্মার্থা মুর হামসারের একটি হাত জড়িয়ে কাঁধে মুখ গুজে বলল, চাই না মুক্তি আমি।
মুর হামসার কেঁপে উঠল। এমন অবস্থার জন্য প্রস্তুত ছিল না সে। নারী দেহের এমন নিবিড় উষ্ণ স্পর্শ মুহূর্তের জন্য বিহবল করে তুলল মুর হামসারকে। তার জীবনে এ এক নতুন অভিজ্ঞতা।
স্মার্থা আরও নিবিড়ভাবে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, বল, দেবে আশ্রয় তোমার এ বাহু বন্ধনে।
মুর হামসার সচেতন হলো। সে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, চলুন রাত হয়ে যাবে।
আবার দুজনে হাটতে শুরু করল। স্মার্থা আর কোন কথা বলল না। মুর হামসারও পাথরের মত মৌন।
উপত্যকার বন্দী খানার সেলের দরজায় স্মার্থাকে পৌছে দিল মুর হামসার। প্রহরী দরজা খুলে ধরল। স্মার্থা মুর হামসার দিকে ফিরে দাড়িয়ে বলল, আর যেতে পারব না তোমার ওখানে?
গম্ভীর কন্ঠে মুর হামসার বলল, মুসা ভাইকে আমি এটা জিজ্ঞেস করে দেখব।
সেলের দরজা বন্ধ হয়ে গেল। স্মার্থা নিজেকে ছুড়ে দিল নরম বিছানার উপরে। স্বগতঃ কন্ঠে সে বলল, এরা কি মানুষ না পাথর? আতংকিত হয়ে উঠে সে। আহমদ মুসার সাইমুমের গতি বোধ হয় আর কেউই রোধ করতে পারবে না। অদ্ভুত জীতেন্দ্রীয় মানুষের দল এটা। টাকার স্তুপ, নারী দেহের কামসিক্ত উষ্ণ পরশও এদের চিত্তবিভ্রম ঘটাতে পারে না।
তবু…..। চোখ দু’টি জ্বলে উঠল স্মার্থার। তবু জাহাজ ও কাগায়ানের পরাজয়ের প্রতিশোধ আহমদ মুসার উপর নেয়া যায় কি না দেখবে সে।

গভীর রাত। শয্যা থেকে উঠে বসল স্মার্থা। চোখ মুখ হাত দিয়ে একটু রগড়ে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। রাতের পোশাক বদলে ফেলল সে। এ বন্দীশালায় তার নিজস্ব বলতে ছিল একটি মাত্র ব্যাগ, কিন্তু তার স্পাই ব্যাগটি আজ শূণ্য। কয়েকটি কাপড়-চোপড় রয়েছে মাত্র। তবু আপাতঃ শূন্য ব্যাগটিতেই রয়েছে তার শেষ সম্বলটুকু। স্মার্থা ব্যাগটি হাতে তুলে নিয়ে ওর তলাটা ফেড়ে ফেলল। তলার চারপ্রান্ত ঘিরে রয়েছে লোহার ফাপা নল। ব্যাগের তলাকে শক্ত ও এর আকার ঠিক রাখার জন্যই এটা ব্যবহৃত হয়েছে বলে আপাতঃ দৃষ্টিতে মনে হয়। স্মার্থা নলগুলো খুলে নিয়ে ছোট ধরণের দু’টি পকেটে পুরল এবং অন্য দু’টি থেকে বেরুল কয়েকটি দামী ফিল্টার টিপ্ড সিগারেট। সিগারেটগুলো পকেটে পুরে ব্যাগটি ছুড়ে ফেলে দিল। তারপর টেবিলে বসে একখন্ড কাগজে লিখলঃ
আলী কাওছারের হত্যার প্রতিশোধ পরে নেয়া যাবে। এখন হাঙ্গামা করতে গেলে আমরা আপো পর্বত থেকে বেরুতে পারবো না।
কাগজটি ভাঁজ করে পকেটে পুরে উঠে দাড়াল স্মার্থা। তারপর ধীরে ধীরে দরজার দিকে এগুলো। দ্বিধাহীন চিত্তে সে দরজায় করাঘাত করলো। একবার, দুইবার-কয়েকবার। দরজার চাবি খোলার শব্দ পাওয়ার পরই শুধু সে থামল।
দরজা খুলে গেল। দু’জন প্রহরী। দু’জনের একজনের হাতে উদ্যত স্টেনগান, অন্যজনের হাতে রিভলভার। তারা কোন কথা বলার আগেই স্মার্থা বলল, ক্যাপ্টেন জুমলাককে এক্ষুনি ডাকুন। খুব জরুরী।
স্মার্থার কন্ঠে উদ্বেগ। চোখে-মুখে কেমন বিভ্রান্ত ভাব। সেদিকে মুহূর্তকাল চেয়ে একজন প্রহরী অপর জনকে বলল, তুমি একে দেখো, আমি তাঁকে ডেকে আনি।
মিনিট চারেকের মধ্যেই প্রহরীটি ক্যাপ্টেন জুমলাককে নিয়ে সেখানে উপস্থিত হলো।
জুমলাককে দেখেই স্মার্থা প্রায় আর্ত কন্ঠে বলে উঠল, সর্বনাশ হয়ে গেছে মিঃ জুমলাক, শিরীকে ঔষধ দিতে ওল্টা-পাল্টা হয়ে গেছে। ঔষধটি খেলে তার মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে। এক্ষনি আমার যাওয়া দরকার। আপনি দু’জন প্রহরী দিন আমার সাথে।
বলতে বলতে স্মার্থা প্রায় কেঁদে ফেলল। তার চোখে আতংক। জুমলাক কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ল। প্রথমতঃ তার মুখে কোনই কথা সরল না। শেষে বলল সে, তাহলে আমি খোঁজ নিতে পাঠাই?
স্মার্থা চোখ মুছে বলল, তা করতে পারেন মিঃ জুমলাক, কিন্তু দেরীর জন্য কিছু ঘটলে সে দায়িত্ব তাহলে আপনাকেই নিতে হবে।
জুমলাক পড়ল মহাবিপদে। একদিকে রাত্রিবেলা বন্দীকে দু’জন প্রহরীর উপর ভরসা করে ছেড়ে দেয়া যায় না, অপরদিকে শিরীর সত্যই কিছু ঘটলে তাকেই দায়ী হতে হবে। পরিশেষে জুমলাক ভাবল, আহমদ মুসাই যখন স্মার্থাকে দিয়ে চিকিৎসার নির্দেশ দিয়েছেন , তখন স্মার্থার মধ্যে নিশ্চয় বিপদের তেমন কিছু নেই।
জুমলাক বলল, চলুন, আমিই যাচ্ছি সাথে। বলে জুমলাকে আর একজন প্রহরীকে সাথে ডেকে নিল।
তিনজনেই পর্বতের ঢাল বেয়ে উপরে উঠতে লাগল। সবার আগে স্মার্থা, তারপর প্রহরীটি এবং সবার শেষে জুমলাক।
তারা পর্বতের সমতলে এসে পৌছল। দক্ষিণ পশ্চিম দিক থেকে আর একটি রাস্তা এসে এখানে মিলিত হয়েছে। ঐ রাস্তাটি পর্বতের পশ্চিম ঢাল বেয়ে নিচে নেমে গেছে। আপো পর্বত থেকে সোলো সাগরে পৌছার এটাই পথ।
এখানে পৌছার পর স্মার্থা সবার অলক্ষে একখন্ড কাগজ ফেলে দিল হাত থেকে। পরক্ষনেই স্মার্থা হোচট খাওয়ার মত হয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। লক্ষ্য করলে দেখা যেত স্মার্থা উঠার সময় দলা পাকানো এক টুকরা কাগজ তুলে নিল। সাবধানতাবশতঃ জুমলাকের রিভলভার উদ্যত হয়ে উঠেছিল স্মার্থার দিকে, কিন্তু কোন প্রকার সন্দেহ তার মনে স্থান পেল না।
তারা এগিয়ে চলেছিল। সামনেই মূল ঘাঁটি মুর হামসারের আবাস স্থল। প্রধান গেটের সামনে পৌছতেই সেখান থেকে কঠোর নির্দেশ এলো হাত তুলে দাঁড়ানোর জন্য। দ্বার রক্ষীর অটোমেটিক কারবাইনের নল হা করে আছে তাদের দিকে। হাত তুলে দাঁড়াল তিনজন।
গেট-ক্যাম্প থেকে প্রধান দ্বাররক্ষী আহমদ জালূত তাদের কাছে এলো জুমলাক তাকে সব ঘটনা বুঝিয়ে বলল। আহমদ জালূত একবার ভ্রূ কুচকে স্মার্থার দিকে তাকাল। বলল, চল আমিও যাব।
চারজনেই চলল এবার।
ভিতরের গেটেও প্রহরী দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু জুমলাক ও আহমদ জালুতকে দেখে একপাশে সরে দাঁড়াল। দরজা একটু ঠেলতেই খুলে গেল। বিস্মিত হল জালুত। প্রহরীর দিকে প্রশ্নবোধক চোখ তুলে ধরতেই বলল, দরজা বন্ধ না করেই আজ ওঁরা শুয়ে পড়েছেন।
স্মার্থা গিয়ে তাড়াতাড়ি শিরীর ঘরে প্রবেশ করল। ওরাও তিনজন তার পিছু পিছু প্রবেশ করলো সেই ঘরে। শিরী বিছানায় পড়ে আছে। ঠিক শুয়ে থাকা নয় ওটা। দেখে মনে হচ্ছে যেন হঠাৎ করে জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পড়েছে বিছানায়।
স্মার্থা তাকে পরীক্ষা করলো। জুমলাক, আহমদ জালুত ও প্রহরী তিনজনেই গজ তিনেক দুরে দাড়িয়ে থেকে উদগ্রীবভাবে দেখছে স্মার্থার কাজ। তাদের চোখে-মুখে উদ্বেগ। তারা বুঝতে পারছে শিরীর একটা কিছু হয়েছে।
স্মার্থা উঠে দাড়াল। আহমদ জালুত বলল, কি দেখলেন?
স্মার্থা কোন উত্তর না দিয়ে কপালের ঘাম মুছে পকেট থেকে একটি সিগারেট বের করে মুখে পুরল, টেবিল থেকে দেশলাই নিয়ে অগ্নি সংযোগ করল তাতে। তারপর ওদের দিকে ফিরে সিগারেটে একটি লম্বা টান দিয়ে বলল, শিরী অজ্ঞান হয়ে আছে।
স্মার্থা আবার সিগারেটটি মুখে পুরল।
আহমদ জালুত কিছু বলতে গিয়েছিল। কেবল মুখ হা করেছিল সে, কিন্তু কিছু বলতে পারল না। স্মার্থার সিগারেট থেকে এক ধরনের নিলাভ ধোঁয়া তীরের মত ছুটে গেল ওদের দিকে। পরক্ষণেই তাদের তিনটি দেহই কলাগাছের মত আছড়ে পড়ল মাটিতে। সিগারেটটি আসলে মারাত্মক একটি গ্যাস পাইপ তামাকের ক্যামোফ্লোজে ঢাকা মুখের পর্দাটি পুড়ে গেলে গ্যাস বেরিয়ে ছুটে যায় সামনে। সামনের দুই বর্গ গজ পরিমিত স্থান মুহূর্তের জন্য বিষাক্ত করে দেয়।
স্মার্থা মুহূর্তকালও নষ্ট করলো না আর। রাস্তা থেকে কুড়িয়ে পাওয়া কাগজ খন্ড সে মেলে ধরল চোখের সামনে। তাতে লেখাঃ ‘‘আমি পাহাড়ের পশ্চিম ঢালে অপেক্ষা করছি দু’টি ঘোড়া নিয়ে। জাম্বুয়াঙ্গোর জন্য পেট্রোলও সংগৃহীত হয়েছে।’’
তাড়াতাড়ি কাগজটি মুড়ে দলা পাকিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল স্মার্থা। তারপর কাঁধে তুলে নিল শিরীর সংজ্ঞাহীন দেহ। গেটে গিয়ে প্রহরীকে বলল, ছোট সাহেবও অসুস্থ। ওঁরা তাঁকে নিয়ে আসছেন। তুমি আমার সাথে এসো, শিরীকে ব্যারাকের হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
প্রহরীটি মুহূর্তকাল দ্বিধা করলো, তারপর পিছু নিল। প্রধান ফটকে গিয়েও স্মার্থা এই একই কথা বলল। মনে হয় তারাও কোন সন্দেহ করলো না। বিশেষ করে ভিতরের দ্বাররক্ষীকে সাথে দেখে তাদের মনে কোন প্রশ্নেরও উদয় হলো না। তাছাড়া আহমদ মুসার নির্দেশ মোতাবেক স্মার্থা শিরীর চিকিৎসা করছে এটাও সবাই জানত।
স্মার্থা এগিয়ে চলল শিরীকে নিয়ে। পিছনে প্রহরী। তারা পর্বতের সেই সমতলে এসে পৌছল। স্মার্থা শিরীকে কাঁধ থেকে নামিয়ে শেষে একবার পিছনে ফিরে দেখল, না ……… কেউ এদিকে আসছে না। প্রহরীটি সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। বলল, কি হল চলুন তাড়াতাড়ি।
-যাই। বলে স্মার্থা পকেট থেকে সিগারেট বের করলো। সিগারেটে আগুন দিল। সেই আগর নিয়মে নিলাভ ধোঁয়া ছুটে গেল এক ফলা তীরের মত। মুহূর্তের মধ্যে প্রহরীটির হাত থেকে খসে পড়ল স্টেনগান। সেও আছড়ে পড়ল মাটিতে।
স্মার্থা শিরীকে কাঁধে তুলে নিয়ে এবার ছুটল দক্ষিণ-পশ্চিম পথ দিয়ে পাহাড়ের পশ্চিম ঢালের দিকে। ঘামে ভিজে গেছে তার গোটা দেহ। কিন্তু উপায় নেই জিরিয়ে নেবার। ক্যাপটেন জুমলাক ও আহমদ জালুতকে বেরুতে না দেখে এতক্ষণে নিশ্চয় প্রহরীদের মনে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে। তারা জুমলাক ও আহমদ জালুতের খোজে গৃহে প্রবেশ করার পরই ছুটে আসবে এদিকে শিকারী কুকুরের মত। সুতরাং যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি তাকে পৌছতে হবে আলী আকছাদের কাছে। একবার ঘোড়ায় চড়তে পারলেই হলো। আধ ঘন্টা মধ্যেই তারা পৌছে যাবে সোলো সাগরের তীরে।
কতদূরে আলী আকছাদ? আর চলতে পারে না স্মার্থা শিরীকে নিয়ে। হঠাৎ সামনেই জমাট অন্ধকারের মত মনুষ্য মুর্তিকে নড়ে উঠতে দেখে স্মার্থা থমকে দাঁড়াল। ওকি আলী আকছাদ? বলল সে, কে?
-আমি আলি আকছাদ। বলে সে এসে দাড়াল।
-কোথায় তোমার ঘোড়া?
-এই আর একটু যেতে হবে।
এবার দু’জনে ধরাধরি করে শিরীকে নিয়ে গিয়ে ঘোড়ায় তুলল। স্মার্থা শিরীকে নিয়ে এক ঘোড়ায় উঠল। আলী আকছাদ উঠল আর এক ঘোড়ায়। পর্বতের ঢাল বেয়ে সাবধানে ঘোড়া দু’টি সামনে এগিয়ে চলল। আলী আকছাদের হাতে টর্চ জ্বালাতে সাহস পাচ্ছে না সে। ওদের চোখে পড়ে গেলে নির্ঘাত মারা পড়তে হবে।
ওরা তখন পর্বতের পাদদেশে নেমে এসেছে। এ সময় পর্বতের উপরে বিপদ-ঘণ্টা বেজে উঠল। উপরে তাকিয়ে ওরা টর্চের আলোয় ইতঃস্তত ছুটাছুটি দেখতে পেল।
স্মার্থার ঠোটে ফুটে উঠল বাঁকা হাসি। আহমদ মুসা নেই। মুর হামসারের ঘুম কাল সকালের আগে ভাঙ্গবে না। ক্যাপটেন জুমলাক ও আহমদ জালুতকে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকতে হবে আরও কয়েক ঘণ্টা। আর আপোয়ান উপত্যকার ব্যারাক থেকে তাদের সন্ধানে ওরা যখন পর্বতের এ প্রান্তে এসে পৌছবে, ততক্ষণ তারা অর্ধেকটা পথ পার হয়ে যাবে।
নিঃশঙ্ক চিত্তে দু’টি ঘোড়া তিনটি আরোহী নিয়ে এগিয়ে চলল সামনে। পাথরের বুকে মাঝে মাঝে শব্দ উঠল খট-খট্-খট।