৩. মিন্দানাওয়ের বন্দী

চ্যাপ্টার

আহমদ মুসা প্রায় মাসাধিকাল ধরে মিন্দানাও ও সোলো দ্বীপপুঞ্জ ভ্রমন করলো। সঙ্গে ছিল মুর হামসার। ভ্রমণকালে পিসিডা কর্মী ও মিন্দানাওবাসীদের সাথে ঘনিষ্ঠ আলাপ হলো আহমদ মুসার। এক হাতে ক্রস ও অন্য হাতে বন্দুক নিয়ে এসে জেঁকে বসা উপনিবেশিক খৃস্টান প্রভূদের বিরুদ্ধে তাদের মধ্যে সীমাহীন অসমেত্মাষ সে লক্ষ্য করলো, মুক্তির জন্য তারা অধীর। মিশনারীরা জ্ঞান বিতরণের নামে যে বিদ্যালয়সমূহ এবং চিকিৎসার নামে যে চিকিৎসালয়সমূহ খুলেছে, সেগুলো কেমন করে মিন্দানাওবাসীদের ধর্ম ও জাতীয়তার সমাধি রচনা করছে তার স্পষ্ট নিদর্শন প্রত্যক্ষ করল আহমদ মুসা। মিশনারীদের প্রেমের বাণী যেখানে মিন্দানাওবাসীদের বশ করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং এর বিরুদ্ধে মিন্দানাওবাসীদের প্রতিরোধ বহ্নি যেখানে জ্বলে উঠছে সেখানে ট্রিপল সি’র বিষাক্ত থাবা গিয়ে মিন্দানাওয়ের অসহায় মানুষের ঘাড়ে চেপে বসছে। এ সবের বহু দৃষ্টান্ত আহমদ মুসা নিজের চোখে প্রত্যক্ষ করলো। আহমদ মুসা অনুভব করলো, মিন্দানাওবাসীদের দুর্জয় সাহস আছে। শুধু এগুলোকে সুপরিকল্পিতভাবে কাজে লাগাতে পারলেই মিন্দানাওবাসীরা মুক্তির স্বাদ পেতে পারবে।
আহমদ মুসা মাস খানেক ধরে শুধু নিরর্থক ভ্রমণ করেই কাটালো না। পিসিডার সংগঠনকে নতুন করে সাজাল। সমগ্র মিন্দানাও ও সোলো দ্বীপপুঞ্জকে ৫০ টি অঞ্চলে ভাগ করা হলো। ফিলিস্তিন থেকে ১০০ জন অভিজ্ঞ সাইমুম কর্মীকে আনা হয়েছিল। তাদের থেকে প্রত্যেক অঞ্চলের জন্য দু’জন করে পাঠানো হলো পিসিডা কর্মী এ স্থানীয় অধিবাসীদের প্রয়োজনীয় গেরিলা ট্রেনিং ও শিক্ষাদানের জন্য। আহমদ মুসা পিসিডার কেন্দ্রীয় কমিটিকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছিল যে, সামরিক শক্তি যদি জাতীয় সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক চেতনা-নির্ভর না হয় তাহলে তার প্রাণ শক্তি থাকে না। আহমদ মুসার এ পদক্ষেপের ফলে গেরিলা ট্রেনিং শিবিরের পাশাপাশি গড়ে উঠল জাতীয় শিক্ষা জন্য জাতীয় বিদ্যালয়। নতুন উৎসাহের প্রাণ বন্যায় উদ্বেল হয়ে উঠল মিন্দানাও সোলো দ্বীপপুঞ্জের জনজীবন।
আহমদ মুসা নৌবাহিনীও গড়ে তুলল। ‘ট্রিপল সি’র কাছ থেকে দখল করা জাহাজে ৫০টি মেরিন ইঞ্জিন পাওয়া গিয়েছিল। তাই দিয়ে ৫০টি বোট সজ্জিত করা হল। মিন্দানাওবাসীরা ঐতিহ্যগতভাবে দুঃসাহসী নাবিক। সুতরাং অল্প সময়ের মধেই ক্ষুদ্র অথচ এক দক্ষ নৌ-ইউনিট গড়ে উঠল। যে মিন্দানাও সাগর, সোলো সাগর, মরো উপসাগর ও দাভাও উপসাগরে একদিন ক্রস পরিশোভিত মিশনারী ‘ট্রিপল সি’র একচেটিয়া রাজত্ব ছিল, সেখানে আজ পিসিডার কর্মীরাও ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ পেল। আহমদ মুসা নৌ-সদর দফতর হিসেবে জাম্বুয়াঙ্গোকে মনোনীত করলো। কিন্তু যেহেতু এ সমুদ্র শহরটি ফিলিপাইন সরকারের নামে ট্রিপল সি’র দখলে, তাই আপততঃ শহরটি মুক্ত করার পূর্ব পর্যন্ত নৌ-সদর দফতর আপো-সমুদ্র সৈকতেই থাকবে।
সাংগঠনিক সফর শেষে আহমদ মুসা ও মুর হামসার গভীর অরণ্য পথে আপো পর্বতের হেড কোয়ার্টারে ফিরছিল। চলতে চলতে মুর হামসার এক সময় বলল, মুসা ভাই, আমরা পনের বছরে যা পারিনি আপনি পনেরোর দুইগুণ তিরিশ দিনে তা করে ফেললেন।
-এমন করে কথা বলো না বন্ধু, তোমাদের সবই ছিল, আমি তাতে রংয়ের পরশ বুলাচ্ছি মাত্র।
-সার্থক শিল্পি আপনি।
-কারণ আমরা মহিমাময় এক মহাশিল্পীর দাস।
মুর হামসার কথা বলল না কিছুক্ষণ। বলল পরে, এই যে দ্বন্দ্ব সংঘাত এর কি অবসান ঘটবে দুনিয়া থেকে?
-ন্যায়ের পাশে অন্যায় যতদিন থাকবে ততদিন নয়।
-ন্যায় কি অন্যায়ের মূলোচ্ছেদ করতে পারবে না?
-পারতো, যদি ইবলিস এই জমিনে না আসতো।
-তাহলে?
-অন্যায়ের প্রতিবিধান ও প্রতিরোধ সত্য ও সত্যসেবীদের শির চির উন্নত থাকবে, আল্লাহ তার বান্দাদের কাছ থেকে এটুকুই তো কামনা করেন।
-এতো এক অনির্বান সংগ্রামের মহা আহবান।
-ইবলিসের সাথে এই অনির্বান সংগ্রামের ভাগ্যলেখা নিয়েই তো বনি আদম তার যাত্রা শুরু করেছিল এই পৃথিবীর বুকে।
-এ ভাগ্যলেখা কি সকলের জন্য অবধারিত?
-নিশ্চয়ই। যারা এ সংগ্রামের পথ থেকে সরে দাঁড়াবে, যারা অন্যায়ের পদতলে সমর্পন করে দেবে নিজেকে, তারা শুধু কাপুরুষ নয়, তারা মানুষ নামের অনুপযুক্ত। এদের প্রতিই বিধাতার সীমাহীন লানত। জাহান্নাম তো এদেরই জন্য।
কেপে উঠল মুর হামসারের গোটা শরীর। আজ সে যেন প্রথমবারের মত বুঝল, কেন পর্বতের উপর কোরআন নাজিল হলে তা মহাশংকায় ধূলায় বিদীর্ণ হয়ে যেত। অনুভব করলো মুর হামসার বনি আদম এ দুরহ দায়িত্ব পালন করে বলেই আল্লাহর বড় প্রিয় সে এবং সৃষ্টি জগতের রাজ শিরোপা এ কারণেই জুটেছে তার মাথায়।
মুর হামসার আর কোন কথা বলতে পারলো না। আহমদ মুসাও নীরব। বনানীর সবুজ সাগরের বুক চিরে আপো পর্বত অভিমুখে তারা এগিয়ে চলেছে দু’টি প্রানী। মাঝে মাঝে ঘোড়ার পায়ের শব্দ উঠছে খট্ খট্ খট্।

আহমদ মুসা আগে, মুর হামসার পিছনে আবার কখনো তারা পাশাপাশি সামনে এগিয়ে চলছিল। সামনেই আপোয়ান উপত্যকা।একটি গিরীখাত পেরিয়ে ওপারে গেলেই তারা গিয়ে পৌছবে আপোয়ান উপত্যকায়।
| ← Previous | | | Next → | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top