৩. মিন্দানাওয়ের বন্দী

চ্যাপ্টার

কয়েকদিন খুবই ব্যস্ত ছিল আহমদ মুসা। মিন্দানাও, সোলো, পালওয়াং ও বাসিলান দ্বীপপুঞ্জের পিসিডার প্রশাসন ইউনিটের যে ট্রেনিং এক মাস আগে শুরু হয়েছিল, তা শেষ হয়ে গেল। ‘সুস্থ ও সফল জন-প্রশাসন ব্যবস্থা প্রশাসন কর্মীর চরিত্র ও দক্ষতার উপর নির্ভরশীল’- এরই অনুশীলন চলেছে ট্রেনিং শিবিরে। আহমদ মুসার পরিকল্পনা অনুযায়ী এই প্রশাসন কর্মীদেরকে তাদের স্ব স্ব অঞ্চলে গিয়ে ‘আইনের উৎস আইন ও আইনের ব্যবহার’ শীর্ষক শিক্ষা কোর্সে আরও ছয়মাস করে কাটাতে হবে।
ট্রেনিং কর্মিদের বিদায় দিয়ে সেদিন দুপুরে আহমদ মুসা ফিরে এলো তার কক্ষে। ক্লান্ত দেহ এলিয়ে দিল বিছানায়।
হঠাৎ টেবিলের ফুলদানির দিকে দৃষ্টি আকৃষ্ট হল তার। সঙ্গে সঙ্গে সে উঠে বসলো।
ফুলদানির ফুলগুলো অমন শুকনো কেন? মনে হচ্ছে কয়দিন থেকে ফুল বদলানো হয়নি। এতদিনের মধ্যে এমনটি তো কখনো হয়নি?
আহমদ মুসা লক্ষ্য করল, আলনার কাপড়গুলোও বেশ অগোছালো। যে কাপড় যেভাবে সে রেখেছে, সেই ভাবেই আছে। বিছানারও সেই অবস্থা। চাদর ঠিকাভাবে পাড়া নেই। একদিকে বেশী ঝুলে আছে, অন্যদিকে কম।
এই সময় রুনার মা ঘরে ঢুকল। বলল, জনাবের খাবার তৈরী। আহমদ মুসা ওদিকে কর্ণপাত না করে বলল, ফুলদানিতে শুকনা ফুল কেন রুনার মা?
-আপা মনির অসুখ তো।
-কার শিরীর?
-জি।
-কতদিন ধরে অসুখ?
-আজ চারদিন।
-কি অসুখ?
-জ্বর।
-চারদিন থেকে জ্বর? মুর হামসারকে বাইরে পাঠালাম, সেদিনও কি জ্বর ছিল।
-মুর হামসার তো আমাকে কিছু বলেনি, সে গেল কেন? এটুকু থেমে সে বলল আবার, কি ওষুধ খাচ্ছে?
-ছোট সাহেব ডিসপেনসারী থেকে ওষুধ এনে দিতে বলে গিয়েছিলেন, এনেছি।
-জ্বর কমেনি?
-না, আরও বাড়ছেই যেন?
-রুনার মা, আমাকে এ সংবাদ কেন বলনি? আহমদ মুসার কন্ঠে কঠোরতা ঝরে পড়ল।
রুনার মা ভিত হয়ে পড়ল। ধীরে ধীরে সে বলল, আপামনিও কিছু বলেনি, আমিও বুঝতে পারিনি। মাফ করবেন জনাব।
-শিরীকে কি খেতে দিচ্ছ?
-কিছুই খায় না। মাঝে মাঝে একটু আধটু গ্লুকোজ খায়।
আহমদ মুসা তাড়াতাড়ি একটি স্লিপ লিখে রুনার মাকে দিয়ে বলল, এটা নিয়ে গার্ডরুমের খলিলকে দাও। সে যেন এখনি গিয়ে ব্যারাকের হসপিটাল থেকে ডাক্তার নিয়ে আসে। আর তুমি গিয়ে ওর কাছে বস। কোথাও যাবে না। রুনার মা সিস্নপ নিয়ে বেরিয়ে গেল। আহমদ মুসা অয়্যারলেসের সামনে গিয়ে বসল। দক্ষিণ মিন্দানাওয়ে মরো উপসাগরের তীরে সাহেলী ঘাঁটির সাথে যোগাযোগ করল সে। মুর হামসার ওখানেই গেছে।

-মুখ এখনও শুকনা কেন? কোথেকে আসছো রুনার মা?
-আপনার অসুখের কথা বড় সাহেবকে জানানো হয়নি, বড় সাহেব রাগ করেছেন? শিরীর চোখ দু’টি উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, আমার অসুখের কথা কেমন করে উনি জানলেন?
-আমি বলেছি।
-তুমিই তো বলেছে, তাহলে রাগ করলেন কেন উনি?
-আমি তো বলিনি, উনিই জিজ্ঞেস করেছিলেন।
-হঠাৎ কেমন করে জিজ্ঞেস করলেন উনি?
-না, উনি জিজ্ঞেস করছিলেন-রুনার মা, ফুলদানিতে শুকনো ফুল কেন?
-তুমি কি বললে?
-আমি বললাম, আপামনির অসুখ।
-তারপর?
-আমাকে বকাবকি করলেন। খলিলকে ব্যারাকে পাঠালেন ডাক্তার আনতে।
শিরী আর কিছু বললো না। চোখ বুজলো সে। তার মনে আনন্দ বেদনার ঢেউ। ওর কাছ থেকে আর কি চাই। একটু স্মরণ করেছেন, করুণা করেছেন এই তো যথেষ্ট। উনি কাছে আসবেন আমাকে দেখতে অমন দুঃসাহসিক আকাংখা কি আমার সাজে।
খলিল সংবাদ দিল ডাক্তার এসেছে। রুনার মা গিয়ে ডাক্তার নিয়ে এলো।
সব শুনে ঔষধ দিয়ে চলে গেল ডাক্তার।
পাশেই বসে রয়েছে রুনার রুনার মা। শিরী এপাশ ওপাশ ফিরছে, স্বস্তি পাচ্ছে না কিছুতেই। রুনার মা বলল, কষ্ট লাগছে আপামনি?
-না রুনার মা। একটু থেমে বলল, তুমি বসে বসে কষ্ট করছো কেন? শুয়ে আরাম করগে যাও।
-না। বড় সাহেব তোমার কাছে কাছেই থাকতে বলেছেন আমাকে। শিরী কিছু বলল না। অনেকক্ষণ পরে এক সময় ধীরে ধীরে বলল, উনি ঘরে আছেন রুনার মা?
-কে?
-তোমার বড় সাহেব?
-না, বাইরে গেছেন।
-আমি দাঁড়াতে পারব হাঁটতে পারব না। তুমি ধরে আমাকে একটু ওঁর ঘরে নিয়ে যাবে?
-কেন?
-আগে বল, পারবে কি না?
-তোমার হুকুম কোনটা না মেনেছি?
-তাহলে যাও বাগান থেকে ফুলদানির জন্য কয়েকটি গোলাপ নিয়ে এসো।
শিরী রুনার মা’র কাঁধে হেলান দিয়ে আহমদ মুসার কক্ষে গেল। দুর্বল হাতে ধীরে ধীরে ফুল সাজিয়ে রাখল। বিছানায় চাদর পাড়ার ঢং দেখে হাসল শিরী। বলল, এতদিনেও কাজ শিখলে না রুনার মা!
শিরী চাদর ঠিক করতে যাবে, এমন সময় আহমদ মুসার টেবিলের অয়্যারলেস যন্ত্রে লাল সংকেত জ্বলে উঠল, সাথে সাথে একটানা সংকেত শব্দ।
শিরী একটু দ্বিধা করল। একটু ভাবল। হয়তো কোন জরুরী মেসেজ। শিরী গিয়ে অয়্যারলেস রিসিভার তুলে নিল।
ওপার থেকে কন্ঠ ভেসে এলো, আবদুল্লাহ জাবের স্পিকিং।
-আমি শিরী বলছি। মুর হামসারের বোন।
-আমি মুসা ভাইকে চাই।
-উনি বাইরে গেছেন।
-আপনি কি মেসেজ রিসিভ করবেন? একটু দ্বিধা করলো শিরী। তারপর বলল, নিশ্চয় করব।
এই সময় আহমদ মুসা এসে দরজায় দাঁড়াল। শিরীকে অয়্যারলেসে দেখে আহমদ মুসা প্রথমে অবাক হলো। কিন্তু টেবিলের ফুলদানির দিকে চেয়ে ব্যাপারটা কিঞ্চিৎ আঁচ করতে পারলো। অলক্ষ্যে এক হাসির রেখা খেলা গেল যেন তাঁর ঠোঁটে।
ছোট্ট একটি কাশি দিয়ে ধীর পদে ঘরে ঢুকল আহমদ মুসা। চকিতে মুখ তুলল শিরী। আহমদ মুসাকে দেখেই সে উঠে দাঁড়াল। হাত থেকে পড়ে গেল অয়্যারলেস রিসিভার। অবশ হয়ে গেল তার গোটা শরীর। পড়ে যাচ্ছিল সে। আহমদ মুসা তাড়াতাড়ি ধরে ফেলল তাকে। নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিল তার বিছানায়।
অজ্ঞান হয়ে গেছে শিরী। মুখে তার পানির ছিটা দিল আহমদ মুসা। মিনিট তিনেকের মধ্যেই তার জ্ঞান ফিরে এলো।
এমন অবস্থার জন্য রুনার মা প্রস্তুত ছিল না। সে মেঝের মাঝখানে দাড়িয়ে কাঁপছিল। আহমদ মুসা তাকে বলল, শিরীকে একটু বাতাস কর রুনার মা, আমি ওদিকে একটু দেখি। তারপর উঠতে উঠতে শিরীকে বলল, আর একটু রেষ্ট নাও, তারপর উঠবে।
আহমদ মুসা গিয়ে রিসিভার তুলে নিল। ওদিকে আবদুল্লাহ জাবেরের উৎকন্ঠা সপ্তমে উঠেছিল। আহমদ মুসার কন্ঠস্বর পেয়েই সে জিজ্ঞেস করল, কিছু ঘটেছে জনাব?
-না কিছু ঘটেনি। অসুস্থ শিরী হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে গেছে। ভাল আছে এখন। বল, কি খবর?
-আজ দুপুরে কাগায়ানে সোভিয়েট এয়ার ফোর্সের প্রতীক চিহ্নিত দু’টি মাউন্টেন ট্রান্সপোর্ট জেট ল্যান্ড করছে। কিন্তু আরোহীদের প্রত্যেকেই ইহুদী প্যারাট্রুপারস। চারজন সোভিয়েট অফিসারকে ওদের সাথে দেখা গেছে।
-প্যারাট্রুপারসদের সংখ্যা কত?
-দুই জেটে বিশজন। আরও দু’টি নাকি আছে।
-তাহলে আরও বিশজন। তুমি কি আচঁ করছ?
-আমি বুঝতে পারছি না, এই সব অত্যাধুনিক মাউন্টে জেট এখানে কেন?
হাসলো আহমদ মুসা। বলল, কারণ ঐ জেটগুলোর পক্ষেই শুধু আপো-পর্বতের অসমতল উপত্যকায় ল্যন্ড করা সম্ভব।
-বুঝেছি জনাব, অসম্ভব দুঃসাহস।
-কাজের জন্য অসম্ভব দুঃসাহসই প্রয়োজন।
একটু থেমে আহমদ মুসা আবার বলল, সোভিয়েট ইউনিয়ন ও ইরগুন জাই লিউমির এটা এক যৌথ ব্লিৎস-ক্রিগ-পরিকল্পনা। কিন্তু এ পরিকল্পনাকে আপো-পর্বত পর্যন্ত গড়াতে দেয়া যাবে না। আমি আসছি।
-আজই আসছেন?
-খোদা করেন ভোর হবার আগেই আমি কাগায়ানে পৌছে যাব।
আহমদ মুসা লাইন কেটে দিল। ওদিকে শিরী আহমদ মুসার বিছানায় শুয়ে লজ্জায় মরে যাচ্ছিল। গোটা দেহে অপরিচিত এক অদৃশ্য মধুর ছোঁয়াছ যেন অনুভব করছে সে। শিরীর মনে পড়ল, অয়্যারলেস টেবিল থেকে সে পড়ে যাচ্ছিল, কে যেন এসে তাকে ধরল, তারপর আর কিছুই মনে পড়ে না। ওখান থেকে তাঁকে বিছানায় আনল কে? রুনার মা? অসম্ভব তার পক্ষে। তাহলে উনি? কথাটা মনে হতেই গোটা দেহ তার থর থর করে কেঁপে উঠল। চোখ খুলে চাইবার সাধ্যও যেন নেই তার। আহমদ মুসার সবগুলো কথা সে শুনতে পাচ্ছিল, কিন্তু চোখ খুলে একবারও ওর দিকে চাইতে পারছিল না।
আহমদ মুসা অয়্যারলেস টেবিল থেকে উঠে দাড়িয়ে রুনার মাকে লক্ষ্য করে বলল, রুনার মা, শিরীর দিকে লক্ষ্য রেখ। যখন যেটা হয়, হসপিটাল থেকে ওষুধ এনে দেবে। আমি বলে যাব সবাইকে। আর মুর হামসার আজ কিংবা কালের মধ্যেই এসে পড়বে।
আহমদ মুসা বাথরুমে প্রবেশ করল। সেখান থেকে বেরিয়ে এসে দেখল শিরীও নেই, রুনার মাও নেই। ঠোঁটে তার একটুকরো হাসি ফুটে উঠলো। কিন্তু মন তার কেঁপে উঠলে ভীষণ ভাবে। সজ্ঞানে কিংবা অজ্ঞানে কোন প্রশ্রয় কি সে দিয়েছে শিরীকে? না কখনও না। শিরীর সাথে তার দেখা এবং যা যা ঘটেছে সবই ঘটনা প্রবাহের স্বাভাবিক ফলশ্রুতি। এমন কতই তো ঘটতে পারে-ঘটে থাকে। তবু আহমদ মুসা মেনে নিল, সাবধান হতে হবে। সোলো রাজকুমারীর দুঃখের বোঝা যেন সে আর না বাড়ায়।
আহমদ মুসা পোশাক পরে তার সেই পরিচিত ব্যগটি তুলে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। উঠার সময় ফুলদানি থেকে একটি গোলাপ তুলে নিল, কিন্তু পরক্ষনেই কিছুটা কম্পিত হাতে সে গোলাপটি রেখে দিল ফুলদানিতে। কিন্তু রেখে দিয়েও স্বস্তি পেল না সে। মন যেন অতি স্পষ্ট কন্ঠে বলল, ফুলটি রেখে দিয়েই কি তুমি তোমার দুর্বলতাকে মুছে ফেলতে চাইছ? আবার কেঁপে উঠার পালা আহমদ মুসার। বিবেকের আলো যেখানে পৌছে না মনের এমন অবচেতন জগতে সে কি কোন অন্যায় করে বসে আছে তাহলে?
পা দু’টি তার থেমে গেল। উপরের দিকে চেয়ে বলল, ‘প্রভূ আমার মনকে তো আমি তোমার আনুগত্য থেকে পৃথক করে রাখিনি?
তারপর সে আবার পা’ দুটি চালিয়ে দিল সামনে।