৩. মিন্দানাওয়ের বন্দী

চ্যাপ্টার

১১

আহমদ মুসা শুয়েছিল।
ক্লান্ত সে। কাগায়ান থেকে ৩০০ কিলোমিটার পথ ঘোড়া খেদিয়ে এসেছে সে আপো পর্বতে শিরীর অপহরণের সংবাদ পেয়ে। মুহূর্তও সে নষ্ট করেনি কাগায়ানে। আহমদ মুসা এ্যালেনটোর হাতে কাগায়ানের প্রশাসনিক দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে ছুটে এসেছে এখানে। চোখ দু’টি তার বুজে আছে, কিন্তু বড় অশান্ত তার মন। পিছনের এমন আঘাত আসবে কল্পনাও করেনি কোনদিন আহমদ মুসা।
মুর হামসার আহমদ মুসার পাশেই বসেছিল। তার চোখে দুর্ভাবনার কালো ছায়া। একদিন এক রাত্রির মধ্যে বয়স যেন বিশ বছর বেড়ে গেছে মুর হামসারের।
অপহরণের কাহিনী ধীরে ধীরে সে বলে যাচ্ছিল আহমদ মুসার কাছে।
অবশেষে সে বলল, ভুল আমারই হয়েছে মুসা ভাই শেষের দিকে স্মার্থার ব্যাপারে আমি বেশ linient হয়ে পড়েছিলাম। যদি আমি তার প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখতাম, তাহলে ডাইনিং রুমের পানির ট্যাংকে ঘুমের ঔষধ মেশানোর সুযোগ সে পেত না।
আহমদ মুসা চোখ খুলল। বলল, ভুল তোমার নয় বন্ধু। ভুল আমিই করেছি। প্রথম ভুল করেছিলাম জাহাজে ওকেও কামরায় বেঁধে রেখে না এসে। সে ভুলের জন্য অনেক প্রতিকূলতার মোকাবিলা করতে হয়েছে আমাকে। দ্বিতীয় ভুল করলাম ওর দ্বারা শিরীর চিকিৎসার নির্দেশ দিয়ে। জানি না এ ভুলের জন্য কি খেসারত দিতে হবে আমাদের।
আহমদ মুসার কথা শুনে কেঁপে উঠল মুর হামসার। অন্ধকার এসে যেন ছায়া ফেলল তার চোখে মুখে। আহম মুসার তা দৃষ্টি এড়ালো না। মুর হামসারের একটি হাত তুলে নিয়ে সে বলল, জানি, তোমার ব্যথা বুঝতে পারছি। কিন্তু ভেবনা বন্ধু। মনে রেখ, আহমদ মুসাকে ফাঁদে ফেলার জন্যই শিরীকে অপহরণ করা হয়েছে। তারা ভেবেছে…………। আহমদ মুসা কথা শেষ করতে পারলো না। অভাবনীয় সংকোচ এসে তার কন্ঠ রোধ করে দিল।
-তারা কি ভেবেছে মুসা ভাই?
-অপ্রাসঙ্গিক কথা বলে সময় নষ্ট করে লাভ নেই মুর হামসার। চলো উঠি। সবগুলো জায়গা আমাকে দেখতে হবে আর একবার। বলে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। মুর হামসারও উঠল। যেতে যেতে আহমদ মুসা বলল, স্মার্থা চুরি করা স্পিড বোটে চড়ে শিরীকে নিয়ে পালিয়েছে। সাথে ছিল আলী আকছাদ। প্রশ্ন হলো কোথায় গেল তারা?
আহমদ মুসা মুর হামসারকে নিয়ে শিরীর ঘরে প্রবেশ করল।
বাহুল্য বর্জিত ঘর। একটি খাট। মাথার কাছে একটি ছোট টেবিল। পাশে একটি চেয়ার। খাটের পিছন দিকের চাদর অনেক খানি নীচে ঝুলে পড়েছে।
আহমদ মুসা বলল, সংজ্ঞাহীন শিরীকে টেনে তোলার সময় চাদর এমনভাবে নীচে নেমে গেছে নিশ্চয়।
মুর হামসার দেখাল জুমলাক ও আহমদ জালুত কোথায় পড়েছিল। সেদিকে চাইতে গিয়ে খাটের কোণায় পড়ে থাকা একখন্ড দলা পাকানো কাগজের দিকে আহমদ মুসার দৃষ্টি আকৃষ্ট হলো।
কৌতুহলবসে কাগজ খন্ডটি তুলে নিয়ে ভাজ ভেংগে চোখের সামনে মেলে ধরলো। কাগজের লেখার দিকে চোখ বুলাতেই চোখ দু’টি তার উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ‘ইউরেকা’ ‘ইউরেকা’ বলে সে চিৎকার করে উঠল।
মুর হামসার আহমদ মুসার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকাল। আহমদ মুসার এ ধরনের উচ্ছাস স্বাভাবিক নয়। উদগ্রীব কন্ঠে সে বলল, কি পেয়েছেন, কি আছে ওতে মুসা ভাই?
-শিরীর সন্ধান পেয়ে গেছি মুর হামসার।
-শিরীন সন্ধান? কোথায় শিরী?
আহমদ মুসা কাগজটি মুর হামসারের হাতে তুলে দিতে দিতে বলল, শিরীকে জাম্বুয়াঙ্গোতে নিয়ে গেছে ওরা।
মুর হামসার কাগজটির উপর নজর বুলিয়ে বলল, কাগজ তো তাই বলছে।
-আসলেও তাই। শিরীকে মিন্দানাওয়ের বাইরে নিয়ে যেতে পারেনি। ওদের ষড়যন্ত্র তেমন ডিপ রুটেড ছিল না। যদি তা হতো তাহলে ওদের জন্য জাহাজের ব্যবস্থা হতো। আলী আকছাদকে স্পিড বোট চুরি করতে হতো না। আর মিন্দানাওয়ে জাম্বুয়াঙ্গো ছাড়া তাদের আর কোন নিকটবর্তী ঘাটি আমি দেখি না।
থামল আহমদ মুসা । পরে আবার বলল, ভালই হলো মুর হাসমার।
-কি ভাল হলো?
-আমাদের জাম্বুয়াঙ্গো অপারেশন পিছিয়ে দেয়া হয়েছিল। এখন আমি নিজেই যাব জাম্বুয়াঙ্গোতে।
-মুসা ভাই?
-বলো।
-আমিও যাব জাম্বুয়াঙ্গো।
-যেতে চাও?
-যদি আপনার অনুমতি মিলে।
-আমি জানি সেখানে তুমি উপস্থিত থাকলে অনেক কাজ হবে, কিন্তু আপো পর্বত তো অরক্ষিত থাকবে। এখানকার ষড়যন্ত্রের মুলোচ্ছেদ করা গেল না এখনো। দেখ, রুনার মার মুখ থেকে কোন কথা বের করতে না পারলেও এখন বোঝা যাচ্ছে রুনার মার সাথে আলী আকছাদের কোন প্রকার যোগাযোগ ছিল। সম্ভবতঃ আলী আকছাদই কাগায়ানে খবর পাঠিয়েছে আমাদের সম্পর্কে।
-রুনার মাকে তাহলে আর কি করা যায়?
আহমদ মুসা হাসল। বলল, শিরী রুনার মাকে খুব ভালবাসে। রুনার মা’র মুখ থেকে কথা বের করার ক্ষেত্রে এই ভালবাসাই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। কিন্তু জাতীয় প্রয়োজনের স্থান ব্যক্তিগত ভালো লাগা না লাগার অনেক উর্ধে মুর হামসার।
মূহূর্তকাল থেমে আহমদ মুসা বলল, আমি ঘুরে আসি জাম্বুয়াঙ্গো থেকে। তার পর দেখব কি করা যায় রুনার মাকে নিয়ে।
-আপনি জাম্বুয়াঙ্গোতে কবে যাত্রা করছেন তাহলে?
-কবে নয় আজই।
-কিন্তু এই আহত শরীর নিয়ে, এইভাবে………..
-তাতে কি হলো। সময় নষ্ট করা যায় না একমুহূর্তও। ক্লু-ক্লাক্স-ক্লানের মত নরপিশাচের চক্র আর দু’টি নেই মুর হামসার। আমার উপর ওরা ক্ষেপে আছে ভয়ানকভাবে।
আহমদ মুসার কথা শুনে মুর হামসারের চোখে দু’টি উদ্বেগাকুল হয়ে উঠল। পিতৃ-মাতৃহারা ছোট বোনটি তার কোথায় কিভাবে আছে কে জানে। নরপিশাচদের হাতে যদি কিছু হয়ে যায় ওর? আর ভাবতে পারে না মুর হামসার। চোখের কোণ দু’টি তার চিক চিক করে উঠে।
আহমদ মুসা সেদিকে চেয়ে বলল, চিন্তা করো না মুর হামসার। বলেছি তো আমাকে ফাঁদে ফেলার টোপ হিসাবে শিরীকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। যদিও আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না, তবু আমার বিশ্বাস আমাকে ফাদে ফেলার পূর্বে শিরীর গায়ে হাত তুলতে তারা সাহস পাবে না। তারা জানে এর পরিণাম কত ভীষণ হতে পারে।
কথা বলতে বলতে আহমদ মুসার চোখ দুটি জ্বলে উঠল। এক অজেয় শপথে দৃঢ় হয়ে উঠল তার মুখ।
ফিলিস্তিন বিজয়ী আহমদ মুসা পরিপূর্ণ রূপ নিয়ে যেন প্রতিভাত হল মুর হামসারের চোখে। আর এর মাঝে মুর হামসার যেন খুঁজে পেল এক পরম নির্ভরতা।

পড়ন্ত বেলা। সোলো সাগরের বুকে ধূরে ধীরে নেমে যাচ্ছে সুর্য। মোটরচালিত একটি বোট মিন্দানাওয়ের পশ্চিম উপকূল ঘেঁষে তীর গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে দক্ষিণ দিকে। বোটের ডেকের উপর দু’টি মাঝারী ধরনের কামান। দু’পাশে চেয়ে যেন ওরা হা করে আছে। বোটে মোট পাঁচজন ক্রু। স্টিয়ারিং হুইল ধরে বসা ড্রাইভারের পাশে বসে আছে আহমদ মুসা। তার সামনে জাম্বুয়াঙ্গো শহরের একটি ম্যাপ। ম্যাপের পাতায় যেন ডুবে গেছে আহমদ মুসা। বামে বনানীর সবুজ সমুদ্র, আর ডাইনে সোলো সাগরের অন্তহীন জল। এরই মাঝ দিয়ে এগিয়ে চলেছে আহমদ মুসার এক দুঃসাহসিক অভিযান।

পরবর্তী কাহিনীর জন্য পড়ুন
‘পামীরের আর্তনাদ’

Top