৩০. এক নিউ ওয়ার্ল্ড

চ্যাপ্টার

সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে। পটোম্যাক বে’র একটি ছোট্ট দ্বীপ। দ্বীপের পুব প্রান্তের পানি ঘেঁষে একটা সুন্দর বাংলো।
ওয়াশিংটনের বে’ এলাকায় এধরনের বাংলোগুলোর মালিক রাজনৈতিক ও অর্থনেতিক ভিআইপি’রা।
বাংলোটির ঘাটে একটা সুদৃশ্য বোট এসে ভিড়ল।
বোট থেকে নামল জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন। তিনি এখন রিটায়ার্ড। কদিন আগেও জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন ছিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট এ্যাডমাস হ্যারিসনের নিরাপত্তা উপদেষ্টা। ইহুদীবাদীদের সাথে অন্যায় অপরাধমূলক যোগসাজসের কারণে তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে।
জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন একাই বোট ড্রাইভ করে এসেছে। বোট থেকে তীরে নেমে সে একবার বে’র দিকে তাকিয়ে দেখল কেউ তাকে অনুসরন করছে কি না, কাউকে সে দেখল না। নিশ্চিন্ত হয়ে পা বাড়াল বাংলোর দিকে।
বাংলোটি ‘কাউন্সিল অব আমেরিকান জুইস এসোসিয়েশনে’র চেয়ারম্যান ডেভিড উইলিয়াম জোনস এর একটি অবকাশ কেন্দ্র।
বাংলোটির চারদিকেই বাগান। বাগানের চারদিকে উঁচু প্রাচীর।
বাগানের মাজখানে টিলামত উঁচু বেদির উপর তৈরী দুতলা বাংলোটি।
বে থেকে বাংলোটিকে দেখা যায় ছবির মত সুন্দর। আবার বাংলো থেকে বে’র সৌন্দর্য উপভোগ করা যায় খুব ঘনিষ্ঠভাবে।
ঘাটের উপর দাঁড়িয়েছিল একজন সুবেশধারী লোক। জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন বোট থেকে নেমে এগুতেই লোকটি এগিয়ে এল তার দিকে। সসম্মানে সম্ভাষণ বিনিময় করে বলল, ‘স্যার আমি মি. জোনস-এর সেক্রেটারী। জেনারেল শ্যারন এসেছেন। ওরা আলোচনায় বসে গেছেন।’
‘গুড। আমার একটু দেরী হলো পৌঁছাতে।’ বলল জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন।
‘চলুন স্যার’
দুজনে হাঁটতে শুরু করল বাংলোর দিকে।
বাংলোতে প্রবেশ করে কয়েকটা দরজা ও কয়েকটা করিডোর পেরিয়ে অবশেষে একটা দরজার সামনে এসে দাঁড়াল ডেভিড উইলিয়াম জোনস- এর সেক্রেটারী।
দরজায় নক করল মি. জোনস-এর সেক্রেটারী।
মুহূর্তকাল পরে দরজা খুলে গেল। দরজায় দেখা গেল স্বয়ং মি. জোনসকে।
মি. জোনস স্বাগত জানাল জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনকে এবং হাত ধরে ভেতরে নিয়ে গেল।
দরজা আবার বন্ধ হয়ে গেল।
বেশ বড়-সড় ঘর।
একা সোফায় বসে আছে শ্যারন।
উঠে দাঁড়িয়ে স্বাগত জানাল জেনারেল শ্যারন জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনকে।
ঘরে অনেকগুলো সোফার সেট বিভিন্ন ডিজাইনে সাজানো। তারা গিয়ে বসল মুখোমুখি সাজানো তিনটি সোফায়।
একটু নিরবতা।
নিরবতা ভাঙল জেনারেল শ্যারন। বলল, ‘মি. জেনারেল হ্যামিল্টন, আপনার যোগাযোগের কতদূর?’
‘বলল, কিন্তু তার আগে বলুন এসব কি ঘটছে, আহমদ মুসা ও ‘ফ্রি আমেরিকা’ মুভমেন্ট-এর সংযোগ আগেই ঘটেছিল, এখন দেখা যাচ্ছে হোয়াইট ইগলও আহমদ মুসার সাথে এক হয়ে গেছে। আপনারা জানালেন, মিয়ামী বন্দরের পথে আহমদ মুসা, গোল্ড ওয়াটার, বেঞ্জামিন বেকনরা গাড়ি বিস্ফোরণে শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু উল্টো দেখা গেল তারাই জ্যাকসন ভীলে গিয়ে আপনাদের লোকজনদের হত্যাকরে আপনাদের মূল্যবান বন্দিনীদ্বয়কে মুক্ত করে নিয়ে গেল। তারপর ….।
জেনারেল শ্যারন আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘মি. জেনারেল হ্যামিল্টন, এটা আমাদের সাংঘাতিক একটা সেট ব্যাক। কিন্তু মি. হ্যামিল্টন আপনাকে স্মরণ রাখতে হবে, আমাদের সাথে সংঘাতে এসেছে আহমদ মুসা। যার বিবেচনা শক্তিটা অলৌকিক। মিয়ামী বিমান বন্দরের বাইরে আহমদ মুসার টিমটাকে ধ্বংস করার পরিকল্পনায় আমাদের ত্রুটি ছিল না। আহমদ মুসার টিমকে যে গাড়ি বহন করার কথা সে গাড়ি ঠিকই বিমান বন্দরে গেছে ওদের আনার জন্যে। বিমান বন্দরের টারমাকে ঢুকেছে ওদের বিমানের কাছে। তারপর শেড দেয়া কাঁচ তুলে গাড়িটি বেরিয়ে এসেছে বিমান বন্দর থেকে। তারা গাড়িতে নেই, বা উঠেনি এটা ধারণা করার কোনই অবকাশ ছিল না। গাড়িটা পরিকল্পিত স্থানেই এসে ধ্বংস হয়েছে। সুতরাং আমাদের লোকদের পরিকল্পনা ও চেষ্টার কোন ফাঁক ছিল না। কিন্তু আহমদ মুসারা কেন যে গাড়িতে উঠল না, কেন যে তারা খালি গাড়িটি ঐ ভাবে পাঠিয়েছিল সেটা একটা বিস্ময়। এমন বিস্ময়কর কান্ড ঘটাবার শক্তি আহমদ মুসার আছে এবং এটাই আমাদের বিপর্যয়ের কারণ। আর জ্যাকসন ভীলে যা ঘটেছে তা খুবই সোজা। মিয়ামীর খবর তাদের কাছে পৌছার পর তারা স্বাভাবিকভাবেই অসতর্ক ছিল। তার উপর বিশ্বাসঘাতকতা করেছে আমাদের পুরনো একজন পরিচারিকা।’
থামল জেনারেল শ্যারন।
সে থামতেই জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন বলে উঠল, ‘কিন্তু মি. জেনারেল, মন্টিসেলোর কি ব্যাখ্যা দেবেন। আমার মতে সর্বজনমান্য জেফারসন-পরিবারে আপনাদের এইভাবে হাত দেয়া ঠিক হয়নি। তারপর সেখানে লজ্জাজনক ব্যর্থতা, আপনাদের ডজন-দেড়ডজন লোকের লাশ সরকারের হাতে যাওয়া আমাদের জন্যে খুবই ড্যামেজিং হয়েছে। সারা জেফারসনের বিরুদ্ধে একবার নয়, দুবার নয়, আপনাদের তিনটা আক্রমণই ব্যর্থ হলো। শেষবারে আপনাদের সবাই সেখানে লাশ হয়ে পড়ে থাকল। জ্যাকসন ভীলে অসতর্ক থাকার কারণে হঠাৎ আক্রান্ত হয়ে আপনাদের বিপর্যয় ঘটল। কিন্তু মন্টিসেলোতে কি ঘটল? ওখানে আপনারা ছিলেন পরিকল্পিত আক্রমণে। আর ওপক্ষে ছিল কার্যত দুজন মহিলা একজন পুরুষ।’ থামল জেনারেল হ্যামিল্টন।
জেনারেল শ্যারন বিব্রত, বিমর্ষ। ধীরে ধীরে বলল, ‘মন্ডিসেলোতে সারা জেফারসনকে হত্যার উদ্যোগ নেয়া ছাড়া আমাদের কোন উপায় ছিল না। ‘ফ্রি আমেরিকা’ মুভমেন্ট আমাদের সামনে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে আসছে। আহমদ মুসা ও হোয়াইট ঈগলের শক্তি মূলত অস্ত্র ও বুদ্ধির লড়াইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু ‘ফ্রি আমেরিকা’ মুভমেন্ট রাজনৈতিকভাবেও অত্যন্ত শক্তিশালী ও প্রভাবশালী। অথচ আমাদেরকে বাঁচাতে হলে রাজনৈতিক লড়াই-এ আমাদের জিততে হবে। সুতরাং ‘ফ্রি আমেরিকান’ মুভমেন্টকে পঙ্গু করে দেয়া এখন আমাদের প্রধান কাজ। এ জন্যেই ‘ফ্রি আমেরিকা’র নেত্রী সারা জেফারসনকে আমরা হত্যা করতে চেয়েছিলাম। আমরা জানি, ‘ফ্রি আমেরিকা’ মুভমেন্টের মূল শক্তি হলো সারা জেফারসনের নতুন আমেরিকা গড়ার স্বপ্ন। এ স্বপ্ন সারা জেফারসন আহরণ করেছে তার গ্রান্ড দাদু টমাস জেফারসন এবং আমেরিকান ফাউন্ডার ফাদারদের ‘ডিক্লারেশন অব ইনডিপেডেন্স’ থেকে। এই স্বপ্নই আমেরিকায় আমাদের মূল শত্রু। তাদের স্বপ্ন সার্থক হলে আমেরিকা ঘিরে আমাদের যে স্বপ্ন সে স্বপ্ন ব্যর্থ হবে। সুতরাং আমাদের মূল আদর্শিক শত্রু সারা জেফারসন। তাই তাকে হত্যার একটা সর্বাত্মক আয়োজন আমরা করেছিলাম। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য যে, আহমদ মুসা সেখানে গিয়ে ঠিক সময়ে হাজির হয়েছে।’ থামল জেনালের শ্যারন।
জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই কথা বলে উঠল ডেভিড উইলিয়াম জোনস। বলল, ‘মি. শ্যারন, আমাদের নতুন আমেরিকা ও নতুন বিশ্ব গড়ার স্বপ্ন এবং নতুন বিশ্ব ব্যবস্থার মাথায় নতুন আমেরিকাকে স্থাপন করার যে কর্মসূচি সে বিষয়ে কি জেনারেল হ্যামিল্টন অবহিত? হাসল জেনারেল শ্যারন। বলল, জেনারেল হ্যামিল্টন বিষয়টি আমাদের অনেকের চেয়ে বেশি জানেন শুধু তাই নয়, এ স্বপ্ন সফল করার ব্যাপারে আমাদের অনেকের চেয়ে তিনি অনেক বেশি একনিষ্ঠ।
বিস্ময় ফুঠে উঠল ডেভিড উইলিয়াম জোনসের চোখে মুখে। বলল, ‘অবাক করলেন জেনারেল শ্যারন। ঘটনাটা কি?
‘জেনারেল হ্যামিল্টনের মা তাকে এ তালিম দিয়ে গেছেন। তাঁর কাছ থেকেই জেনারেল হ্যামিল্টন পান আমাদের ঐতিহাসিক দলিলের একটা কপি। সুতরাং জেনারেল হ্যামিল্টন তাঁর ইহুদী মা’র কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছেন আমাদের নতুন বিশ্ব ব্যবস্থার কর্মসূচী।’ বলল জেনারেল শ্যারন।
‘নিঃসন্দেহে বড় একটা সুখবর এটা। আমার মনে হয়, ফরেন রিলেশন্স বিষয়ক ‘সিনেট স্ট্যান্ডিং কমিটি’র চেয়ারম্যান দানিয়েল ময়নিহান এবং ইন্টেলিজেন্স বিষয়ক ‘হাউজ সিলেক্ট কমিটির চেয়ারম্যান এ্যান্ড্রু জ্যাকবসকে এ বিষয়ে বিস্তারিত বলা দরকার। তাহলে তাদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সাহায্য আরও বেশি পাওয়া যাবে। দুজনেই কিন্তু প্রকৃতির দিক দিয়ে হিটলারের মতই ওভার এ্যাম্বিশাস।’ ডেভিড উইলিয়াম জোনস বলল।
সংগে সংগেই কথা বলে উঠল জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন, ‘মি. জোনস ওদের সাথেই তো যোগাযোগের দায়িত্ব আমাকে দিয়েছিলেন জেনারেল শ্যারন।’
‘ব্রাভো, ব্রাভো!’ বলে চিৎকার করে উঠল ডেভিড উইলিয়াম জোনস এবং বলল, ‘যোগাযোগ আপনার হয়েছে?
‘হ্যাঁ, গত রাতে ওদের দুজনের সাথেই কথা বলেছি। আজ রাত এগারটায় ওদের সাথে আপনাদের নিয়ে এ্যাপয়েন্টমেন্ট।’
‘ওয়ান্ডারফুল, ওয়ান্ডারফুল মি. জেনারেল হ্যামিল্টন। এজেন্ডা ঠিক হয়েছে? ডেভিড উইলিয়াম জোনস বলল।
‘হ্যাঁ, ঠিক হয়েছে। প্রেসিডেন্টকে ইমপিচ করার জন্যে পরিকল্পনা প্রণয়ন। এ এজেন্ডার কথা জেনারেল শ্যারন আগেই আমাকে বলে দিয়েছিলেন।’ বলল জেনারেল হ্যামিল্টন।
‘কিন্তু এজেন্ডার সাথে ‘নতুন আমেরিকা’ ও ‘নতুন বিশ্ব-ব্যবস্থা’র বিষয়টিকেও রাখতে হবে। তারা উৎসাহিত হবেন।’ ডেভিড উইলিয়াম জোনস বলল।
‘দেখবেন বিষয়টা আলোচনায় এমনিতেই এসে যাবে।’ বলল জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন।
কথাটা শেষ করেই জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন আবার বলে উঠল, এজেন্ডা নিয়ে আপনারা যথেষ্ট ভেবেছেন তো? সাপের লেজে পা দিলে কিন্তু বিপদ। একচোটেই সাপের মাথাটা ধরে ফেলতে হবে। জনমত হবে সবচেয়ে বড় ফ্যাক্টর। এজন্যে জনবল, অর্থবল দুই-ই কিন্তু লাগবে।’
‘ভাববেন না। আমরা সবদিক দিয়েই প্রস্তুত।’ বলল জেনারেল শ্যারন।
‘ইহুদী নয় এমন সংস্থা সংগঠনের সমর্থন ও সহযোগিতা পাওয়া হবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ ব্যাপারে আপনারা কি ভেবেছেন? জেনারেল হ্যামিল্টন বলল।
‘আপনি জানেন, প্রটেস্ট্যান্টদের সবচেয়ে জনপ্রিয় সংগঠন সেফ ওয়ে সেভিয়ার’ গ্রুপ আমাদের দীর্ঘ দিনের সহযোগী। তাদের নেতা ‘জন জেরা’ টেলিভিশন অনুষ্ঠান ‘টাইম উইথ গড’- এর জনপ্রিয় টকার হিসাবে আমাদেরকে অমূল্য সাহায্য দিয়ে আসছেন। তবে বর্তমান সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খবর হলো, আমাদের প্রতি ভারতীয় গ্রুপের সমর্থন। তাদের একটা শীর্ষ বৈঠকে আজ আমি গিয়েছিলাম। আহমদ মুসার আমেরিকায় আগমন এবং তার প্রতি এফ বি আই ও সি আই এ প্রধান ও প্রেসিডেন্টের সমর্থনের সংবাদে তারা আমাদের চেয়ে উত্তেজিত। তারা জনবল, অর্থবল, তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি সবকিছু দিয়ে আমাদের সাহায্য করবে। সব সময়ই এই ভারতীয়রা আমাদের সহযোগী। কিন্তু এখন তাদের একটি সাহায্য পাওয়া যাবে এ বিষয়টা নিশ্চিত।’ জেনারেল শ্যারন বলল।
‘থ্যাংক গড, জেনারেল শ্যারন। আজকের সময়ের জন্য খবরগুলো সত্যিই অমুল্য।’ বলল জেনারেল আলেকজান্ডার।
‘কিন্তু সমস্যা হলো, সেনাবাহিনীতে বিশেষ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও শীর্ষ অপারেশন পর্যায়ে আমাদের কোন লোক নেই।’ বলল ডেভিড উইলিয়াম জোনস।
‘বিগ্রেডিয়ার স্টিভকে হারানো আপনাদের ঠিক হয়নি। সেও খুব বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল। পেন্টাগন যে কতবড় সেনসেটিভ জায়গা সেটা সে মনে রাখেনি। তার ফলেই এই সেট ব্যাকটা।’ জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন বলল।
‘এখানেও সর্বনাশের হোতা আহমদ মুসাই। অনুসন্ধান থেকে আমরা জেনেছি, টেলিফোনে আঙুলের মুভমেন্ট দেখেই আহমদ মুসা ধরে ফেলে পেন্টাগনের বাইরে কোথাও সে টেলিফোন করছে। তারপর টেলিফোনে বিগ্রেডিয়ার স্টিভের কথার দুএকটা থেকেই সে সন্দেহ করে বলে’ বলল জেনারেল শ্যারন।
‘যাই হোক, এই ঘটনা সেনাবাহিনীর মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। সেনাবাহিনীর ইহুদী অফিসারদের মধ্যে ইহুদীবাদী কারা তা চিহ্নিত করার জন্যে জরুরী তৎপরতা শুরু হয়ে গেছে। এক বিগ্রেডিয়ার স্টিভের ঘটনা সব ইহুদী অফিসারকেই আজ সন্দেহের মুখে ঠেলে দিয়েছে।’ জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন বলল।
‘আমাদের দুর্ভাগ্য জেনারেল। আহমদ মুসা আমাদের শনি হিসাবে আমেরিকায় আবির্ভূত হবে কে জানত। যাক, যা হবার হয়েছে। আর যাতে ওরা এগুতে না পারে সেটাই নিশ্চিত করতে হবে। বলল জেনারেল শ্যারন।
‘আমরা যে পুরো ঘটনাকে প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াতে দিতে চাই, এ ব্যাপারে এ্যান্ড্রু জ্যাকবস এবং দানিয়েল ময়নিহান কিছু বলেছেন? জিজ্ঞেস করল ডেভিড উইলিয়াম জোনস জেনারেল হ্যামিল্টনকে।
‘প্রসঙ্গটি এ্যান্ড্রু জ্যাকবস নিজেই তুলেছিলেন। বলেছিলেন, বিষয়টা মিডিয়াতে যাচ্ছে না কেন? আমি বলেছিলাম, এ ব্যাপারে একটা পরিকল্পনা তৈরী হয়েছে। আপনাদের সাথে বৈঠকের পরই তা মিডিয়াতে যাবে। দানিয়েল ময়নিহানও এ ব্যাপারে কথা বলেছিলেন। তারও মত ছিল, ওদের বিরুদ্ধে জনমতকে যতটা বিক্ষুব্ধ করা যাবে, আমাদের কাজ তত সহজ হবে। সুতরাং মিডিয়াকেই প্রধান অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করতে হবে।’ থামল জেনারেল হ্যামিল্টন।
জেনারেল হ্যামিল্টন থামতেই ডেভিড উইলিয়াম জোনস সহাস্যে বলে উঠল, ‘ওদের সাথে চূড়ান্ত আলোচনারই শুধু অপেক্ষা। টিভি নেট ওয়ার্ক ও নিউজ পেপারের জন্যে ভিন্ন ভিন্ন দুটি রিপোর্ট রেডি হয়ে আছে। ওদের সাথে আজ আমাদের আলোচনা সফল হলে আজকেই রিপোর্টগুলো মিডিয়াতে দিয়ে দেয়া হবে। আমাদের টিভি নেট ওয়ার্ক ও নিউজ পেপারগুলোকে এ্যালার্ট থাকার জন্যে অলরেডি ইংগিত দেয়া হয়েছে।’
জেনারেল হ্যামিল্টনের চেহারা কিছুটা প্রশ্নবোধক হয়ে উঠল। বলল, ‘আলোচনায় সফল হওয়ার প্রশ্ন উঠছে কেন? অসফলতারও কি কোন সুযোগ আছে?
হাসল জেনারেল শ্যারন। বলল, ‘আমাদের আলোচনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ হবে। গোটা বিষয় আমরা ওদের সাথে খোলাখুলি আলোচনা করতে চাই। সফলতার অর্থ হলো, যে পরিকল্পনা আমরা করেছি, তা বাস্তবায়নের জন্যে ওরা শুধু সমর্থন দেবেন ও নিজে কাজ করবেন তাই নয়, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ওদের সর্বশক্তি কাজে লাগাতে হবে। প্রতিনিধি পরিষদ ও সিনেটে আমাদের শুভাকাঙ্খী সদস্যরা তো কাজ করবেনই, কিন্তু তাদের কাজ হবে খুবই গুরত্বপূর্ণ। আমাদের বেশি ভয় সিনেট চীফ চালর্স ডব্লিউ ওয়ারনার, হাউজ (হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভ) চীফ জন জে, রিচার্ডসন, সিনেট ইনটেলিজেন্স স্পেশাল কমিটির চীফ আনা প্যাট্রেসিয়া এবং সিনেট ফরেন রিলেশনস স্ট্যান্ডিং কমিটির চীফ বব এইচ ব্রুসকে নিয়ে। স্বাধীন মতামত পোষণের ক্ষেত্রে এরা এতই বেপরোয়া যে এদের বাগে আনা মুশকিল। কিন্তু এদের পক্ষে আনতে হবে। সিনেট চীফ মি. ওয়ারনারের সাথে আমাদের মি. ডেভিড উইলিয়াম জোনস এর ভাল সম্পর্ক আছে, ব্যবসায়িক সম্পর্কও আছে, কিন্তু তিনি নিজে কিছু বললে উল্টো ফল হওয়ার ভয় আছে। অন্যদিকে দানিয়েল ময়নিহান তার এক সময়ের সহপাঠি শুধু নন, মি. ওয়ারনার রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নানাভাবে ময়নিহানের উপর নির্ভরশীল। অনুরুপভাবে সৌভাগ্যক্রমে জন জে রিচার্ডসন, আনা প্যাট্রোসিয়া ও এ্যান্ড্রু জ্যাকবস তিন জনই ক্যালিফোর্নিয়ার মানুষ। আর বব এইচ ব্রুস এ্যান্ড্রু জ্যাকবস-এর বন্ধু। সুতরাং মি. এ্যান্ড্রু জ্যাকবস ও মি. দানিয়েল ময়নিহানকে চূড়ান্ত প্রচেষ্টা চালাতে হবে।’ দীর্ঘ বক্তব্য দেয়ার পর থামল জেনারেল শ্যারন।
শ্যারন থামতেই কথা বলে উঠল জেনারেল হ্যামিল্টন। বলল, ‘আপনি মি. ময়নিহান ও মি. জ্যাকবস-এর যতটা ভূমিকা প্রয়োজন বলে ভাবছেন তা না লাগতে পারে। প্রতিনিধি পরিষদ ও সিনেটে আপনাদের শুভাকাঙ্খী সদস্যদের যে বিরাট শক্তি আছে এবং প্রেসের পক্ষ থেকে যে চাপের সৃষ্টি হবে, তাতে মি. রিচার্ডসন, ওয়ারনার, ব্রুস ও মিস প্যাট্রেসিয়ারা অনেকটাই কাত হয়ে পড়বেন বলে আমার বিশ্বাস।’
‘ঠিকই বলেছেন মি. হ্যামিল্টন। মিডিয়ার সমর্থন আমরা একতরফা পেয়ে যাব। টিভি ও নিউজ পেপার এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে যে, প্রেসিডেন্ট এ্যাডামস হ্যারিসন ও তার গ্যাংরা বাইরে মুখ দেখাতেই পারবে না। তবে যেটা আমাদের প্রথম টার্গেট প্রেসিডেন্টের ইমপিচমেন্ট খুব সহজ হবে না। সিনেট ও প্রতিনিধি পরিষদে দুই তৃতীয়াংশের সমর্থন হাসিল করতে হবে।’ বলল ডেভিড উইলিয়াম জোনস। তাঁর কন্ঠে চিন্তার সুর।
‘কেন, সহজ হবে না কেন? প্রেসিডেন্টের দুর্নীতি, অসদাচরণ, যোগসাজস, ইত্যাদি সম্পর্কিত যে দারুন সব দলিলের কথা বলেছিলেন, সে সব তো আছে আপনাদের কাছে।’
মিষ্টি হাসল ডেভিড উইলিয়াম জোনস। বলল, ‘আছে। রাজনৈতিক অফিসে তার সুন্দরী রাজনৈতিক সেক্রেটারী মিসেস শিলা জোসন এবং হোয়াইট হাউজে তাঁর প্রাইভেট সেক্রেটারী মিসেস উভা ব্রাউন আমার লোক। সুতরাং কি ধরনের সব ডকুমেন্ট থাকতে পারে তা চিন্তা করুন।’
‘ধন্যবাদ মি. জোনস। যেদিন কলংকের কালিমায় প্রেসিডেন্টের মুখটা কালো হয়ে যাবে এবং পরাজয়ের গ্লানিতে তার মাথাটা নুয়ে পড়বে, সেদিন আমি সবাইকে নিয়ে এমন একটা গ্র্যান্ড পার্টি করব যা স্মরণীয় হয়ে থাকবে।’ বলল জেনারেল হ্যামিল্টন।
হাসল জেনারেল শ্যারন। বলল, ‘মি. জোনস যে দলিল দস্তাবেজের কথা বলেছেন, সে সব দলিল দস্তাবেজ বের করার প্রয়োজন হবে না। পত্র-পত্রিকায় একটা ইশারা এবং তাঁর সামনে নিয়ে কয়েকটা নমুনা তুলে ধরলেই পায়ে এসে পড়বে পদ রক্ষার জন্য। দেখবেন, কোথায় উড়ে যাবে আহমদ মুসা, জর্জ আব্রাহাম, এ্যাডমিরাল ম্যাক, আর্থার, জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন এবং সারা জেফারসনদের দল’।
‘আপনার কথা সত্য হোক মি. শ্যারন। আমরা ইতিহাসের এক মহা মুহূর্তে দাঁড়িয়ে। আমরা সময়ের কাছে পরাজিত হলে মহা এক বিপর্যয়ের মুখোমুখি আমাদের দাঁড়াতে হতে পারে। আর সময় যদি আমাদের বিজয় এনে দেয়, তাহলে শতাব্দীর সাধনা দিয়ে আমেরিকায় ভবিষ্যতের যে বীজ বপন আমরা করেছি, তা এক নতুন পৃথিবীর মুখ আমাদের দেখাতে পারে। যা শুধু এক আমেরিকার মাধ্যমেই আমরা দেখতে পারি।’ বলল ডেভিড উইলিয়াম জোনস।
‘আপনার মূল্যায়নটা একটু বেশি প্রান্তিক হয়ে গলে না? বর্তমান পরিস্থিতি কি এতটাই গুরুতর? বলল জেনারেল হ্যামিল্টন।
‘মি. হ্যামিল্টন, আমি পরিস্থিকে যতটা গরুত্বপূর্ণ বলেছি, পরিস্থিতি মনে করি তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। তারা যা বলছে তা যদি প্রমান করতে পারে, তাহলে জার্মানীর মতই আমেরিকা আমাদের জন্যে এক দুঃস্বপ্নের দেশে পরিণত হতে পারে। মনে হবে আমি হতাশার কথা বলছি, কিন্তু না, সর্বোচ্চ সাবধানতা, সর্বোচ্চ সক্রিয়তা অবলম্বেনের জন্যেই একথা বলছি আমি।’ বলল ডেভিড ইউলিয়াম জোনস শুকনো কন্ঠে।
ভ্রু কুঞ্চিত হলো জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনের! বলল, ‘যা সত্য নয়, যা সাজানো, তা কি প্রমান করা যায়? বিশেষ করে আমেরিকায়?
উত্তরে কোন কথা বলল না ডেভিড জোনস।
জেনারেল হ্যামিল্টনের কথা শেষ হতেই জেনারেল শ্যারণ নিজের হাতঘড়ির দিকে চেয়ে বলে উঠল, ‘সময় হয়ে গেছে। মনে করি আমাদের যাত্রা করা উচিত।’
জেনারেল হ্যামিল্টন ও ডেভিড জোনস দুজনেই তাদের ঘড়ির দিকে তাকাল।
জেনারেল হ্যামিল্টন বলল, ‘আরো পরেও যাত্রা করলে পারি। তবু ঠিক আছে। আমাদেরকে ঘুরা পথেই যেতে হবে। সরকারী গোয়েন্দাদের নজর এড়াবার প্রয়োজন আছে।’ বলে উঠে দাঁড়াল জেনারেল হ্যামিল্টন। উঠে দাঁড়াল সবাই।

‘এই হ্যারি এই তো এলি, তাড়াহুড়ো করে আবার এক রাতে বেরুচ্ছিস কোথায়। শোন, কথা আছে।’ বলল ন্যান্সি ময়নিহান।
ন্যান্সি ময়নিহান সিনেটর ও সিনেটর পররাষ্ট্র বিষয়ক স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান দানিয়েল ময়নিহানের বড় মেয়ে। আর হ্যারি, মানে হ্যারি এডওয়ার্ড, দানিয়েল ময়নিহানের ছেলে। এবং একমাত্র ছেলে। ন্যান্সি ময়নিহান এবার ওয়াশিংটন ষ্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে গ্রাজুয়েট হয়েছে এবং হ্যারি এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্র।
বড় বোনের ডাকে থমকে দাঁড়ালো হ্যারি। ফিরলো বোনের দিকে। বলল, ‘বাইরে বেরুচ্ছি না আপা। আব্বার স্টাডিতে যাচ্ছি। জরুরী। এসে তোমার কথা শুনব। ঠিক আছে।
‘আব্বার স্টাডিতে এ সময়? রাত দুপুরে? ঠিক আছে, তোমার জন্যে অপেক্ষা করছি।’ বরল ন্যান্সি ময়নিহান।
হ্যারি এডওয়ার্ড তার হাত ঘড়ির দিকে তাকাল। রাত ১২টার কিছু বেশি।
ঘড়ি দেখেই ছুটল আবার হ্যারি।
পটোম্যাক নদীর তীরে ‘প্যাসেফিক ব্লু’ এলাকায় দানিয়েল ময়নিহানের বিশাল বাড়ি।
বাড়িটা বাংলো সাইজের দুতলা। নদীর সমান্তরালে তৈরী।
বাড়িটা প্রধান গেট দুটি, একটা পটোম্যাকের দিকে, অন্যটি বিপরীত দিকে, উত্তর পাশে।
উত্তর পাশের গেটটাই ব্যবহার হয় বেশি। পাবলিক রোড থেকে লাল পাথরের একটা প্রাইভেট রাস্তা এসে স্পর্শ করেছে গেটকে।
দুপাশে দুটি বাড়িকে বলা যায় দুভাগে ভাগ করে ফেলেছে। ব্যবহারে দিক দিয়েও বাড়িটা বিভক্ত।
বাড়ির পুব অংশের দুতলায় থাকেন দানিয়েল ময়নিহান। আর তার স্টাডি ও রাজনৈতিক অফিসগুলো পুব অংশের নিচতলায়। বাড়ির পশ্চিম অংশের দুতলায় ছেলে-মেয়েদের বেড, স্টাডি, ইত্যাদি। আর এদিকের নিচতলায় কিচেন, স্টোর ধরনের এ্যাকোমোডেশন।
পুব দিকের এক তলায় মেনে হ্যারি সোজা চলে গেল তার আব্বার পি এ ফিলিফের কক্ষে।
ফিলিফ ছাড়া আর কোন স্টাফ নিচে নেই। সবাই বিদেয় হয়েছে এগারটার মধ্যেই।
বিশেষ বা গোপন কোন বৈঠক এখানে হলে সেটা রাত দশটার পরই হয়।
পিএ ফিলিফ ছাড়া নিঃশর্ত বিশ্বাস আর কারও উপর দানিয়েল ময়নিহানের নেই। কৃষ্ণাংগ ফিলিফের পরিবার পুরুষানুক্রমে ময়নিহানদের পরিবারে আছে। আগে ছিল ক্রীতদাস হিসাবে, এখন আছে স্টাফ হিসাবে।
ফিলিফের ঘরে ঢুকে হ্যারি ফিস ফিস করে বলল, ‘আংকল, শ্যাবন সাহেবদের সাথে আব্বা কোথায় বসেছেন? স্টাডিতে না?
ফিলিফের চোখ বিস্ময়ে বড় বড় হয়ে উঠল। বলল, ‘শ্যারন সাহেবরা এসেছেন, এ কথা তোমাকে কে বলল?
কেন এই তো দশটার দিকে আব্বাকে টেলিফোন করল। তখনই আব্বা ইন্টারকমে আপনাকে বললো, জেনারেল শ্যারনরা আসবেন, কোন লেট নাইট কাজ হবে না। এগারটার মধ্যে সবই যেন চলে যায়।
বলে একটু থামল হ্যারি। বলল আবার, ‘আমার খুব ইচ্ছা জেনারেল শ্যারণকে দেখার । কিন্তু আসতে দেরী করে ফেলেছি।’
হাসল ফিলিফ। বলল, ‘স্যার, দেরী করে ফেলেছেন। ট্রেন মিস।’
তার মানে চলে গেছেন? বিশ্বাস হচ্ছে না। আপনি আমাকে ঠকাচ্ছেন।আমি দেখে আসি।’ বলে ঘুরে দাঁড়াল হ্যারি।
‘ঠিক আছে, একবার স্টাডি ঘুরে এস।’
হ্যারি ছুটে গেল স্টাডিতে। স্টাডিকক্ষ শূন্য। খালি চেয়ারগুলো খাঁ খাঁ করছে।
স্টাডিতে ছোট্ট একটা কনফারেন্স টেবিল আছে। দরজা দিয়ে ঢুকতে সামনেই সে টেবিল।
দরজা পা হয়ে ঘরে ঢুকতেই হঠাৎ হ্যারির নজরে পড়ে গেল সামনের চেয়ারের নিচে পড়ে থাকা একটা লাইটার। লাইটারটা সুন্দর, রিয়ার মডেলের। লাইটারটা তুলে নিল হ্যারি। উল্টে-পাল্টে দেখল লাইটারটা।
দেখতে গিয়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করল লাইটিং ম্যাকানিজমের সাথে সম্পর্কহীন একটা সুইচ। সুইচে চাপ দিল হ্যারি।
চাপ দেয়ার সাথে সাথে একটা ডাকনা সরে যাওয়ায় একটা কেবিন উন্মুক্ত হয়ে পড়ল। কেবিন থেকে ভ্রু কুঞ্চিত হলো কম্যুনিকেশন সাইন্সের ছাত্র হ্যারির। দেখল কেবিনে মাইক্রো রেকর্ডার সেট করা। রেকর্ডারটা তখনও কাজ করছে।
বুঝল হ্যারি, বৈঠকে যারা এসেছিলেন তাদেরই কেউ বৈঠকের প্রসেডিং গোপনে রেকর্ড করেছেন। এ কথা মনে আসার সাথে সাথে খুশি হয়ে উঠল হ্যারি, এতে নিশ্চয় জেনারেল শ্যারনের কথাও পাওয়া যাবে।
হ্যারি এডওয়ার্ড লাইটারের কেবিনটা আবার বন্ধ করে পকেটে পুরল লাইটারটা। স্টাডি থেকে বেরিয়ে এল হ্যারি। দরজা থেকে বেরোতেই দেখা হলো ফিলিপের সাথে। ফিলিপ দ্রুত আসছে স্টাডির দিকে।
‘কি ব্যাপার, আংকল?
‘তুমি যাও, স্টাডিতে একটু কাজ আছে আমার।’ বলে ফিলিপ দ্রুত ঢুকে গেল স্টাডিতে। এই লাইটারটিই কি?
কৌতূহলী হলো হ্যারি। ফিলিপ যদি লাইটারটাই খুঁজতে গিয়ে থাকে, তাহলে তো জানা যাবে কে লাইটারটার খোঁজ করেছিল এবং কে সেই লোক যে বৈঠকের বিবরণ গোপনে রেকর্ড করেছিল। লোক কে জানা গেলে তার উদ্দেশ্যেও জানা যাবে। হ্যারি মনে মনে এ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, রেকর্ডে কি আছে না জেনে এটা ফেরত দেয়া যাবে না।
এসব ভেবে হ্যারি এডওয়ার্ড গিয়ে ফিলিপের কক্ষে বসল।
কমিনিট পরে হন্ত-দন্ত, হয়ে ফিরে এল ফিলিপ। ঘরে ঢুকে হ্যারিকে বসে থাকতে দেখে খুশি হয়ে বলল, ‘ধন্যবাদ যে, তুমি এখনও আছ।’
থেকে একটা দম নিয়ে আবার বলল, ‘হ্যারি ঘরে তুমি কোন লাইটার পড়ে থাকতে দেখেছে?
‘লাইটার? লাইটার ওখানে পড়ে থাকবে কেন?
‘হ্যাঁ। এখনি জেনারেল শ্যারন টেলিফোন করলেন। তার মনে হচ্ছে তার লাইটারটা তিনি স্টাডিতে ফেলে গেছেন। যদি পেয়ে যাই, তাহলে এখনি উনি এসে তা নিয়ে যাবেন।’
হো হো করে হেসে উঠল হ্যারি এডওয়ার্ড। বলল, ‘একটা লাইটারের জন্যে তিনি টেলিফোন করেছেন। আবার এই রাতে সেই লাইটারটা তিনি নিতেও আসতে পারেন। আপনি হাসালেন আংকল।’
‘লাইটারটা ওনার নাকি খুব শখের।’ বলল ফিলিপ।
মনে মনে উদ্বিগ্ন হয়ে এঠেছে হ্যারি। শ্যারন সম্পর্কে যা সে শুনেছে তার চেয়েও দেখা যাচ্ছে ভয়ংকর এই শ্যারন। তার আব্বা নিশ্চয় শ্যারনকে সরল বিশ্বাসে সাক্ষাতকার দিয়েছিলেন। তাঁর ইনফরমাল কথাবার্তা নিশ্চয় খুব খোলামেলা হয়েছে। এগুলোই রেকর্ড করেছিল সে। নিশ্চয় তার আব্বাকে তিনি ব্ল্যাকমেইল করতেন। ঈশ্বর রক্ষা করেছেন তার আব্বাকে।
এসব চিন্তা চেপে রেখে প্রকাশ্যে বলল সে সহাস্যে, ‘তাহলে আংকল স্টাডিটা আরও একবার ভালো করে খুঁজে দেখুন। তাঁর যখন শখের জিনিস, তখন আরও একটু কষ্ট করুন। আমি যাই।
বলে উঠল হ্যারি।
উঠে এল দোতলায়।
ন্যান্সি সত্যিই অপেক্ষা করছিল।
হ্যারি আসতেই তাকে ধরল ন্যান্সি।
বোনের পাশে সোফায় বসেই সে বলে উঠল, ‘আপা একটা সাংঘাতিক ঘটনা ঘটেছে।’
‘থাক তোর সাংঘাতিক ঘটনা আগে বল, যা শুনেছি তা সত্যি কিনা?
‘কি শুনেছ?’
‘তুই নাকি ‘ফ্রি আমেরিকা’ মুভমেন্টের ওয়াশিংটন ষ্টেট ইউনিভার্সিটি শাখার সভাপতি হলি?’
‘আপা, এটা তোমার এমন করে জিজ্ঞেস করার মত কোন খবর? ‘বলিস কি তুই? ‘ফ্রি আমেরিকা’ মুভমেন্টে তুই কবে যোগ দিলি সেটাই তো জানি না। তার উপর একটা শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের তোর সভাপতি হবার মত খবর যখন আসে, তখন সেটা কি আমাদের জন্যে বড় খবর নয়?
‘এ খবরটা তোমাদেরকে কে দিল আপা?
‘সেটা দিয়ে তোর কি দরকার?
‘বরিস নিক্সন বলেছে, না?
‘হ্যা।
‘দেখ আপা বরিস তোমাকে কত ভালোবাসে, আমার কথা তোমাকে বলতে তার দেরী হয়নি, কিন্তু তোমার কথা আমাকে চার বছরেও সে বলেনি।’
‘আমার কোন কথা?’
‘তুমি চার বছর আগে ‘ফ্রি আমেরিকা’ এর সদস্য হওনি?’
হাসল ন্যান্সি। বলল, ‘হয়েছি। কিন্তু কাজ তো কিছু করি না। তাই বলে বেড়বার কিছু নেই।’
কথা শেষ করেই ন্যান্সি বলে, ‘আমি তোকে অভিনন্দিত করছি হ্যারি। তুই আমার ছোট ভাই বলে আমর গর্ব হচ্ছে। তুই যে দায়িত্ব পেয়েছিস তা তোর বয়সের চেয়ে বড়।
‘ধন্যবাদ আপা।’
‘ওয়েলকাম। এখন তোর সাংঘাতিক কথাটা বল।
হ্যারি পকেট থেকে বের করে লাইটারটা ন্যান্সির হাতে দিল। তারপর লাইটারের সব কাহিনী খুলে বলল জেনারেল শ্যারনের টেলিফোনের কথা সহ।’
লাইটারটা খুলে ন্যান্সিও দেখল।
গম্ভীর হয়ে উঠল তার মুখ। বলল, ‘এই গোপন রেকর্ডই প্রমাণ করে এই রেকর্ডে আব্বার এমন কোন কথা আছে, যা জেনারেল শ্যারন কাজে লাগাতে পারে। তার মধ্যে, তুই ঠিকই বলেছিস, ব্ল্যাকমেইল করাটাই বড়।’
‘তাহলে তো দেখতে হয় এতে কি আছে?’ হ্যারি বলল।
দেখতে হবে এবং এখনি?’
‘তাহলে চল আমার স্টাডিতে। আমার মাস্টার রেকর্ড প্লেয়ারে সব ধরনের ক্যাসেট সেট করা যায়।’ বলল হ্যারি।
বলেই উঠে দাঁড়াল সে। ন্যান্সিও উঠল। ক্ষুদ্র ক্যাসিটটি রেকর্ড প্লেয়ারে চড়িয়ে ন্যান্সি হ্যারি দুজনে দুটি চেয়ার নিয়ে রেকর্ড প্লেয়ারের সামনে বসল। দুজনের মুখেই একটা হাল্কা হাসি। টেপে রেকর্ড হয়েছে একদম শুরু থেকেই।
তার পিতা জেনারেল শ্যারনদেরকে স্বাগত জানাল। সম্ভাষণ বিনিময়রে পর অতিথিরা তাদের পরিচয় জানাল। জেনারেল শ্যারন ও ডেভিড উইলিয়াম জোনস নিজেদের পরিচয় দিল। জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন নিজের পরিচয় দিতে শুরু করলে সবাই হেসে উঠল। বলল, না আপনাকে আমরা দেখিনি এবং চিনিও না।
পরিচয় পর্ব শেষ হলে কথা শুরু করল ন্যান্সিদের আব্বা দানিয়েল ময়নিহান। বলল, মি. শ্যারন ও মি. জোনস, আমি মি. হ্যামিল্টনের কাছ থেকে সব শুনেছি, তবু আপনাদের কাছ থেকে আরো ভাল করে জানতে চাই আমাদের এ্যাডামস হ্যারিসন-সরকারের বিরুদ্ধে প্রকৃতপক্ষে অভিযোগটা কি। তাহলে প্রতিকারের পথটাও সুস্পষ্ট হয়ে যাবে। সরকারকে সংশোধন করার পথ অবশ্যই আছে। প্রেসিডেন্টের ইমপিচমেন্ট সর্বশেষ একটা পদক্ষেপ। একটা কথা আমাদের সবাইকেই জানতে হবে, প্রেসিডেন্ট রিপাবলিকান দল থেকে নির্বাচিত। কিন্তু তিনি প্রেসিডেন্ট গোটা দেশের। তাঁর সুনাম দেশের মর্যদা বাড়ায়, আমাদের ডেমোক্র্যাটদেরও। আবার তাঁর অন্যায় যেমন দেশকে আহত করে, তেমনি আমাদেরকেও! সুতরাং তার ভাল কাজের জন্যে বাহবা সব সময় না দিলেও, তাঁর অন্যায় আমরা এক মুহূর্তও বরদাশত করতে রাজী নই।
দানিয়েল ময়নিহান থামলে কথা বলে উঠল শ্যারন। সে দানিয়েল ময়নিহানকে ধন্যবাদ দিয়ে শুরু করল। এক নাগাড়ে দীর্ঘ বিশ মিনিট কথা বলল, জেনারেল শ্যারন। তার দীর্ঘ কথার সমাপ্তি টানতে গিয়ে বলল, ‘মৌলবাদী সন্ত্রাসী নেতা আহমদ মুসা এভাবে আমাদের বিরুদ্ধে অমূলক একটা অভিযোগ আবিস্কার করে এবং অদ্ভুত কৌশলে রক্তক্ষয়ী ও ধ্বংসাত্মক ঘটনা একের পর এক সৃষ্টি করে তার দায় ইহুদী কম্যুনিটির উপর চাপিয়ে দিয়ে দেশে একটা বড় ধরনের বিভেদ সংঘাত সৃষ্টি করতে চায়। সে চায় আমেরিকাকে দুর্বল করে ও তার আকাশস্পর্শী ইমেজকে ধ্বংস করে দিয়ে আমেরিকার বিশ্ব নেতৃত্বের আসন ও তার নতুন বিশ্ব গড়ার মহান স্বপ্নকে বানচাল করতে। শৃগালের মত ধূর্ত আহমদ মুসা সম্মোহিত করেছে প্রেসিডেন্টকে, সম্মোহিত করেছে সশস্ত্র বাহিনী প্রধান, সি আই এ চীফ এফ বি আই প্রধানকে। আহমদ মুসাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা দিতে এগিয়ে এসেছে ইহুদী বিদ্বেষী ‘ফ্রি আমেরিকা’ মুভমেন্ট। টাকার অংকে বিক্রি হয়ে গেছে গোল্ড ওয়াটারের ‘হোয়াইট ঈগল’ও। এই অবস্থায় দেশের মান, ইজ্জত ও ভবিষ্যত রক্ষার জন্যে আপনাদের মত রাজনীতিককেই এগিয়ে আসতে হবে।’ থামল জেনারেল শ্যারন।
এরপর আলোচনা শুরু হলো।
অনেক প্রশ্ন, অনেক উত্তর অনেক মন্তব্য ও পর্যালোচনা-পরামর্শের বিবরণ দিয়ে চলল ক্যাসেটের মাইক্রোটেপটি।
ন্যান্সি ও হ্যারি হালকা হাসির মধ্য দিয়ে টেপের বিবরণ শোনা শুরু করেছিল। কিন্তু হাসি তাদের এখন উবে গেছে। তারা এখন স্তম্ভিত, আতংকিত, রুদ্ধবাক প্রায়! জেনারেল শ্যারন শুধু আহমদ মুসার বিরুদ্ধে বিষোদগার নয়, ‘ফ্রি আমেরিকা’ ও ‘হোয়াইট ঈগল’ এর বদনামই শুধু নয়, গোটা আমেরিকান মিশনকেই সে বিকৃত করছে এবং এমন সব কথা বলেছে যা পরিস্কার রাজনৈতিক ঘুষের পর্যায়ে পড়ে। জেনারেল শ্যারন তার কথা শেষ করল এভাবে, ‘সব শেষ আমি এইভাবে বলতে চাই, আমাদের উভয় পক্ষের বেনিফিটের জন্যে আমরা পারস্পরিক সহযোগিতার আবেদন করছি। আপনি মি. দানিয়েল ময়নিহান ও এ্যান্ড্রি জ্যাকবস আপনাদের কমিটিগুলোকে ম্যানেজ করাসহ সিনেট চীফ চার্লস ডব্লিউ ওয়ারনার, হাউজ চীফ জন জে, রিচার্ডসন, সিনেট ইন্টিলিজেন্স স্পেশাল কমিটির চীফ আনা প্যাট্রেসিয়া এবং ফরেন রিলেশন্স সিনেট স্ট্যান্ডিং কমিটির চীফ বব এইচ ব্রুসকে আমাদের পক্ষে এনে দিতে হবে। যাতে প্রেসিডেন্টকে রাজনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন করা যায়, যাতে প্রয়োজনে তাকে ইমপিচ করার জন্যে প্রয়োজনীয় সদস্য যোগাড় সহজ হয়। আমাদের লাভ হবে আমরা ভয়াবহ ষড়যন্ত্রের হাত থেকে রক্ষা পাব। আর আপনাদের লাভ হবে, আগামী নির্বাচন আপনাদের হবে। এর জন্যে যা কিছু করার, যত অর্থের প্রয়োজন হয় তার ব্যবস্থা আমরা করব। গ্যারান্টি হিসাবে ব্যাংক সার্টিফিকেটসহ তিনটি সাইন্ড ব্ল্যাংক চেক রেখে যাচ্ছি।’
টেপের বিবরণ শেষ হয়ে গেলে দানিয়েল ময়নিহানের কথার মাধ্যমে। সে বলল, ‘আমাদের লাভের প্রশ্ন থাক, গ্যারান্টি, সিকুইরিটির প্রশ্ন ওঠে না। আপনাদের বিপদটা আমাদেরও বিপদ। সরকার যদি ভুল করে তার মাসুল জনগণকেই দিতে হবে। সর্বাত্মক সহযোগিতার ব্যাপারে নীতিগতভাবে আমরা একমত।’ টেপের কথা শেষ হলো।
ক্যাসেট প্লেয়ার ক্লোজ করল হ্যারি। দুজনেই কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে বসে রইল।
নিরবতা ভাঙল ন্যান্সি। বলল, ‘ওরা একটা বড় ঘটনা ঘটাতে যাচ্ছে, হ্যারি।’
‘সে ঘটনার সাথে জড়িত করছে আব্বাকে।’ হ্যারি বলল।
‘হ্যাঁ তাই। আমরা প্রকৃত ঘটনার খুব অল্পই জানি। আব্বা তো কিছুই জানেন না। সুতরাং তিনি ওদের কথা বিশ্বাস করবেন সেটাই স্বাভাবিক।’ বলল ন্যান্সি।
‘ঘটনা সম্পর্কে তোমার ব্যাখ্যা কি আপা? আমাকে শুধু এইটুকু বলা হয়েছে। আহমদ মুসা এখন আর আমাদের শুত্রু নয়, বন্ধু। সে আমেরিকানদের যে উপকার করেছে তার পরিমাপ করা যাবে না। আর প্রমাণ হয়েছে ইহুদীদের একটা গ্রুপ আমাদের জাতীয় শত্রু। শীঘ্রই এটা আদালতে প্রমাণ হবে।’ হ্যারি বলল।
‘তুমি ঠিকই শুনেছ হ্যারি। জাতির জরুরী প্রয়োজনেই ‘ফ্রি আমেরিকা’ আহমদ মুসাকে সহযোগিতা দিচ্ছে এবং তার সহযোগিতা নিচ্ছে। ঠিক এই একই কারণেই কিন্তু হোয়াইট ঈগলও আহমদ মুসাকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করেছে। অথচ দেখ, এই আহমদ মুসাকে হোয়াইট ঈগলই কিডন্যাপ করে আমেরিকায় আনে প্রতিশোধ নেবার জন্যে।’ বলল ন্যান্সি।
‘আরেকটা বিষয় আপা, ঘুষ হিসাবে তাদের ব্ল্যাংক চেক অফার করা প্রমাণ করে ইহুদীবাদীরা কি ধরনের বিপদে পড়েছে। তাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ যদি মিথ্যা হতো, তাহলে এভাবে পেছন দরজা দিয়ে সিনেট ও প্রতিনিধি পরিষদের সদস্যদের হাত করার চেষ্টা না করে তারা আইনি মোকাবিলায় নামতো।’ হ্যারি বলল।
‘এখন কি করা যায় বলত। এই টেপ কিন্তু একটা সাংঘাতিক দলিল।’ বলল ন্যান্সি।
‘আমার মনে হয় টেপটা দুলাভাইয়ের হাতে পৌছে দাও। উনি ওটা মুভমেন্টের নেতাদের কাছে পৌছে দেবেন।’
ন্যান্সির চোখে-মুখে ফুটে উঠল কৃত্রিম ক্রোধ। সে হ্যারির পিঠে একটা কিল দিয়ে বলল, ‘সিরিয়াস বিষয়ের মধ্যে ইয়ার্কি কেন?’
‘দুটোই সিরিয়াস। ওটা দেশের জন্যে, আর এটা তোমার জন্যে।’ দম নিয়েই আবার শুরু করল, ‘বরিসকে কি টেলিফোন করবি?’
‘টেলিফোন কেন?’
‘ও এসে টেপটা নিয়ে যাক।’
‘ঠিক বলেছ আপা, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এটা ঠিক জায়গায় পৌছে দেয়াই উচিত হবে।’
‘তাহলে টেলিফোন করি।’
‘হ্যা, ডাক তাকে আপা। তবে আপা, রথ দেখার সাথে সাথে কলা বেচার মতলব করছ না তো?’ আবার ন্যান্সি বড় ধরনের কিল তুলল হ্যারির পিঠ লক্ষ্যে।
দেখে লাফ দিয়ে ছুটে পালাল হ্যারি।
ন্যান্সি ক্যাসেট প্লেয়ার থেকে ক্যাসেটটা খুলে হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াল মোবাইলটা নেয়াজেন্যে।
‘আপা, আমি শুতে গেলাম।’
‘কেন, ও আসুক। টেপটা উদ্ধার করার কৃতিত্ব তো তোরই।’
‘না আপা, বোন ও হবু দুলাভাইয়ের আসরে শালারা সব সময় আওয়ান্টেড। আর ও কৃতিত্বটা তোমাকেই দিয়ে গেলাম। ‘কই’ খাওয়া আর ‘বিল সেচা’র লোক সব সময় আলাদাই থাকে আপা। গুড নাইট।’
বলে হ্যারি হাসতে হাসতে ছুটে চলে গেল তার শোবার ঘরের দিকে।
হ্যারির এ স্টাডি রুমের ওপাশে তার শোবার ঘর। হ্যারি ও ন্যান্সির শোবার ঘরের মাঝখানে স্টাডি রুম ও বসার ঘরের ব্যবধান।
ন্যান্সি হ্যারির স্টাডি রুম থেকে বেরিয়ে পাশেই বসার ঘরে গিয়ে বসল।
টেলিফোন করল বরিস নিক্সনকে। পেল তাকে। টেপের কথা শুনে লাফিয়ে উঠল সে। বলল, ‘রাতে আসতে পারবো না মানে? এর জন্যে এ মুহূর্তে চাঁদে যাত্রা করতেও বললেও আমি রাজি। তার উপর ন্যাশনাল ইন্টারেষ্টের বাইরে এখানে একটা পার্সোনাল ইন্টারেষ্ট ও আছে।’
‘পার্সোনাল ইন্টারেষ্টকে পাশে রাখতে চাও? এটাই বোধ হয় তোমার দেশপ্রেম।?’
‘দেখ, দেশপ্রেম কাউকে বৈরাগী হতে বলে না। ও, কে। আসছি। বাই।’
বলে ওপাশে টেলিফোন রেখে দিল বরিস নিক্সন।
ন্যান্সিও মোবাইলটা রেখে দিয়ে সোফায় গা এলিয়ে দিল। কমপক্ষে বিশ মিনিট তাকে অপেক্ষা করতে হবে বরিসের জন্যে।
‘বিশ মিনিট’ কেন বিশ ঘন্টাও ওর জন্যে অপেক্ষা করতে তার একটুকুও ক্লান্তি আসবে না।
ন্যান্সি কেমন করে অস্বীকার করবে যে, বরিসকে কাল সকালে ডাকলেও চলত, কিন্তু একটা উপলক্ষ যখন পেয়েছে তখন বরিসকে কাছে পেতে সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে তার মন চায়নি।
বরিস আসছে এই চিন্তা ন্যান্সির হৃদয় মনকে সজীব করে দিয়েছে।
হাসল ন্যান্সি। সে বরিসকে পার্সোনাল ইন্টারেস্টের জন্যে অভিযুক্ত করল। কিন্তু তার চাওয়া কি বরিসের চেয়ে কম? বরিসরা যা খোলামেলা বলে। ন্যান্সিরা তা চেপে থাকে এটাই মাত্র পার্থক্য।
নিচ থেকে একটা গাড়ির হর্ন বেজে উঠল।
চিনতে ন্যান্সির কষ্ট হলো না বরিসের গাড়ির হর্ণ।
উঠে দাঁড়িয়ে ন্যান্সি ছুটল সিঁড়ির দিকে বরিসকে নিয়ে আসার জন্যে।

ন্যান্সি ময়নিহান যখন চোখ খুলল, প্রথমেই চোখ পড়ল তার ডাক্তারের উপর। পাশেই দেখল তার আব্বা-আম্মাকে। দেখে চমকে উঠল। বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত তাদের চেহারা। আর এক দফা সে চমকে উঠল তার ঘরের দরজার বাইরে পুলিশ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে।
মনে হচ্ছে কিছু ঘটেছে। কি ঘটেছে? লাফ দিয়ে উঠে বসল সে। কিছুই বুঝতে পাছে না সে। বরিসকে বিদায় দিয়ে সে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম তার ভাল হয়েছে। কিন্তু শরীল খুব দুর্বল লাগছে। কিন্তু তার পাশে ডাক্তার কেন?
উঠে বসেই ন্যান্সি তার পিতার দিকে চেয়ে বলল, ‘কিছু বুঝতে পারছি না আব্বা। কি হয়েছে? পুলিশ কেন? ডাক্তার কেন?
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলল ন্যান্সি।
ন্যান্সির আব্বা দানিয়েল ময়নিহান কোন উত্তর দিল না। তার মুখে গাম্ভীর্য যেন আরও গভীর হলো।
কেঁদে উঠল ন্যান্সির আম্মা।
সে এসে জড়িয়ে ধরল ন্যান্সিকে। বলল কান্না চাপার চেষ্টা করে, ‘সর্বনাশ হয়েছে মা। হ্যারিকে কেউ কিডন্যাপ করেছে, খুন হয়েছে ফিলিফ।’
‘হ্যারি কিডন্যাপ হয়েছে? ফিলিফ আংকল খুন হয়েছেন? চিৎকার করে উঠল ন্যান্সি। তড়িতাহতের মতই কেঁপে উঠল ন্যান্সি গোটা শরীল, মাইক্রোটেপের কথা মনে পড়ে গেছে তার। ন্যান্সির গোটা সত্তা জুড়ে একটা চিৎকার উঠল। জেনারেল শ্যারনরা তাহলে ঐ টেপের জন্যে কিডন্যাপ করল হ্যারিকে? খুন করল ফিলিফকে?
সমগ্র স্নায়ুতন্ত্রে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত এই চিৎকার ন্যান্সির মুখ-ফেঁড়ে বেরিয়ে আসছিল। বহুকষ্টে তা রোধ করল ন্যান্সি।
চিৎকার রোধ হলো, কিন্তু সেই চিৎকার অসহায় কান্নার প্রবল বেগ নিয়ে বেরিয়ে এল ন্যান্সির ভেতর থেকে। ন্যান্সি কেঁদে উঠল তার মাকে জড়িয়ে ধরে।
ন্যান্সি সংগা ফিরে পাওয়ায় ডাক্তার বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। তার আব্বাও চলে গেল পুলিশের সাথে কথা বলতে বলতে।
ন্যান্সির আম্মা চোখ মুছে বলল, ‘তোকে নিয়েও আমরা মহাচিন্তায় পড়েছিলাম। তোর সংগা ফিরতেই সবচেয়ে বেশি দেরী হলো। ডাক্তার বলেছিল, নির্দিষ্ট সময়ে সংগা না ফিরলে বা সংগা ফেরাতে না পারলে জীবনহানিও ঘটে।
‘তার মানে তোমারও সংগা হারিয়েছিলে? কেন? কিভাবে? তাহলে কি ওরা ….।’
কথা শেষ না করেই থেমে গেল ন্যান্সি।
‘হ্যাঁ মা, খুনিরা এক বিশেষ ধরনের ক্লোরোফরম স্প্রে করে সবাইকে ঘুমিয়ে রেখে নিরাপদে কাজ সেরে গেছে।’
‘গেটের সিকিউরিটিরা কোথায়?’
‘তারাও সংগা হারিয়েছিল। কিন্তু তারাই প্রথম সংগা ফিরে পায়। ওরা বাইরে ছিল বলে ক্লোরোফরম ওদের উপর খুব গভীর ক্রিয়া করতে পারেনি। ওদের সংগা ফের পর ওরাই পুলিশকে খবর দেয়। পুলিশ এসে আমাদের ও তোদের ঘরের দরজা খোলে এবং ডাক্তারও ডাকে তারাই। ডাক্তার বলেছে, আমাদের ও তোর ঘর খুলে দিতে আরও দেরী হলে আমাদের জীবনহানি ঘটতে পারতো।’
বলে একটু থেমেই আবার কেঁদে উঠল। বলল, ‘হ্যারির ঘরে রক্ত দেখা গেছে। নিশ্চয় তাকে খুনিরা মারধোর করেছে। আমার সোনামনি বেঁচে…..।’
কথা শেষ করতে পারলো না ন্যান্সির মা। কান্নায় ভেঙে পড়ল সে।
কথা শেষ না করলেও ন্যান্সি বুঝল তার মা কি আশংকা করছে। ন্যান্সি ভেতরটা থর থর করে কেঁপে উঠল। কিন্তু এবার কান্নার বদলে ন্যান্সির মধ্যে হ্যারির জন্য প্রচন্ড ভয় ও উদ্বেগের সৃষ্টি হলো এবং জেগে উঠল তার মধ্যে কিছু করার প্রেরণা। ন্যান্সি এতটুকু বুঝল, ফিলিফের মত হ্যারিকে খুন না করে ওরা ওকে কিডন্যাপ করেছে এবং তাকে কিডন্যাপ করেছে ওরা টেপের জন্যেই।
আবার বুকটা কেঁপে উঠল ন্যান্সির। টেপ তো তার কাছে পায়নি, পাবে না। না পেলে কি খুন করবে ওরা হ্যারিকে?
আতংক ও উদ্বেগে ভেতরটা যেন কাঠ হয়ে উঠতে চাচ্ছে তার। ভাবল, টেপের খবর বলবে কি সে তার পিতাকে, পুলিশকে? তাহলে তো বলতে হবে বরিস নিক্সনদের কথা। কিন্তু তাতে কি লাভ হবে? টেপ ফেরত পেলেও সে টেপ কি পুলিশ দেবে শ্যারনদেরকে? দেবে না। তাহলে ফলই একই হচ্ছে।
এসব চিন্তা করতে গিয়ে ন্যান্সির মনে হলো, এই ঘটনার কথা এখন তার বরিসকে জানানো দরকার। হ্যারিকে উদ্ধার করার ক্ষেত্রে পুলিশের চেয়ে ফেম’ই (Free America) বেশি কার্যকরী হবে।
এ চিন্তার সাথে সাথেই ন্যান্সি উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘চল মা, ‘হ্যারির ঘরটা একটু দেখব। কয়জন বন্ধু বান্ধবকে টেলিফোন করব। পুলিশ তার খোঁজ করবে, সাথে সাথে আমাদেরও কিছু করতে হবে মা।’ বলে সে নেমে এল বেড থেকে।
তার মাও উঠল।
হ্যারির ঘর দেখে আঁৎকে উঠল ন্যান্সি। গোটা ঘর লন্ড-ভন্ড। ড্রয়ার, সেল্ফ, বেড কিছুই আস্ত নেই। ঘরের প্রতিটি ইঞ্চি জায়গা তছনছ করেছে কেউ। ন্যান্সির বুঝতে বাকি রইল না। ওরা এভাবে টেপটাই খুঁজেছে।
ন্যান্সি ফিরল মায়ের দিকে। বলল, ‘হ্যারির স্টাডি’র দিকে তো খেয়াল করলাম না। ওটারও কি এই অবস্থা আম্মা?’
‘হ্যাঁ, মা, স্টাডিরও কোন জিনিস আস্ত নেই। কম্পিউটার, আলমারি, সেলফ, বই-পুস্তক সব কিছুই ছড়ানো-ছিটানো। পুলিশ বলছে, খুনিরা কিছু একটা খোঁজ করেছে। পরে সে জিনিসসহ হ্যারিকে তারা কিডন্যাপ করেছে। অথবা সে জিনিস না পেয়ে হ্যারিকেই নিয়ে গেছে।’
একটু থেমে আবার বলল, ন্যান্সির মা, ‘পুলিশ আরও বলছে, ‘জিনিসটা না পেয়ে হ্যারিকে ওরা নিয়ে গেছে। কিন্তু জিনিসটা পেলে হ্যারিকে হয়তো তারা ফিলিপের মতই খুন করে রেখে যেত।’
নিজেকে সামলে নিয়ে চোখ মুছে আবার সে বলল, ‘কিন্তু ফিলিফকে হত্যার সাথে হ্যারির কিডন্যাপ হওয়ার বিষয়টাকে মিলাতে পারছে না পুলিশ। তবে অনুমান করছে, যে জিনিসের সন্ধানে খুনিরা হ্যারির কাছে এসেছিল সে জিনিসের কথা ফিলিপও জানত। ফিলিপকে ওরা হত্যা করেছে বুকে গুলী করে। কিন্তু তার আগে তাকে নির্যাতন করেছে। মুখেই তার আঘাত বেশি। পুলিশ মনে করছে তাকে কিছু বালানোর চেষ্টা করা হয়েছে। সম্ভবত কথা আদায় করার পর তাকে হত্যা করা হয়েছে। সেখান থেকেই খুনিরা এসেছে হ্যারির ঘরে।’
ন্যান্সি মনে মনে পুলিশের অনুমানের প্রশংসা করল। তাদের অনুমানের প্রতিটা বর্ন সত্য। ফিলিপের কাছে শ্যারনের লোকরা এসেছিল টেপের খোঁজ করতে। তার কাছ থেকেই জানতে পারে মিটিং- এর পর প্রথমে হ্যারিই সেখানে যায়। সুতরাং তারা ধরে নেয়, টেপটা যখন ফিলিপের কাছে নেই, তখন নিশ্চয় সেটা হ্যারিই প্রথমে গিয়ে খুঁজে পেয়েছে।
‘কি ভাবছিস ন্যান্সি?’ ন্যান্সিকে গম্ভীর হয়ে যেতে দেখে বলল তার মা।
‘আম্মা আমি ভাবছি, কিছু করার কথা। যাই কয়েকটা টেলিফোন করে নেই।’ বলে ন্যান্সি হ্যারির ঘর থেকে বেরিয়ে এল।
নিজের ঘরে ফিরে ন্যান্সি টেলিফোন করল বরিস নিক্সনকে। প্রথম চেষ্টাতেই পেলো বরিসকে। বরিসকে জানাল সব ঘটনা ন্যান্সি। কাঁদল অনেক।
ওপার থেকে বরিস ন্যান্সিকে সান্তবনা দিয়ে বলল, ‘কেঁদো না ন্যান্সি। তুমি এবং হ্যারি দেশের অমূল্য উপকার করেছ। ঈশ্বর হ্যারিকে অবশ্যই সাহায্য করবেন। আমি এখনি চীফকে এটা জানিয়ে দিচ্ছি। FBI বিষয়টা এখনি জেনে যাবেন। পুলিশ যা করছে করুক, ওদিক থেকে উদ্ধার প্রচেষ্টা এখনি শুরু হয়ে যাবে।’
ন্যান্সি কিংবা বরিস কেউই টেপ-এর প্রসংগ তাদের কথায় আনল না। ‘ফ্রি আমেরিকা’ মুভমেন্টের নামও নয়। তারা সতর্ক যে, ন্যান্সিদের টেলিফোনে এখন আড়ি পাতা হবে জেনারেল শ্যারণদের পক্ষ থেকে তোব বটেই, পুলিশের পক্ষ থেকেও আড়িপাতা হতে পারে।
বরিসের কথা শেষ হলে ন্যান্সি বলল, ‘যা কিছু করার বরিস তাড়াতাড়ি করতে হবে। আব্বা-আম্মা খুবই ভেঙ্গে পড়েছেন।’
‘খুবই স্বাভাবিক। চিন্তা করো না। ঈশ্বর আছেন। তোমার সাথে আমার দেখা হওয়ার দরকার।’ বলল বরিস।
‘আমিও চাই। তুমি এস এখানে, আব্বাদের সাথেও কথা বলবে।’ ন্যান্সি বলল।
‘ঠিক আছে। আসব।’
‘কখন?’
‘দেখি হ্যারির ব্যাপারটা সবার সাথে আলোচনা করি। তার ব্যাপারে দ্রুত কিছু একটা করতে হবে। আজ সন্ধ্যার দিকে চেষ্টা করব।’ বলল বরিস।
‘ধন্যবাদ, আমাকে টেলিফোন করো।’ ন্যান্সি বলল।
‘ঠিক আছে। ওকে। বাই’ বলল বরিস।
‘বাই।’ বলে ন্যান্সিও টেলিফোন রেখে দিল।
টেলিফোন সেরে হ্যারির ঘরে দিকে আসতেই হ্যারির স্টাডির সামনে ন্যান্সির দেখা হলো তার আব্বা দানিয়েল ময়নিহানের সাথে।
‘আব্বা, বরিসকে টেলিফোন করেছিলাম। আসতে বললাম। সন্ধ্যায় আসবে। হ্যারিকে খুব স্নেহ করে সে। গত রাতেও এসেছিল। সবারই সাহায্য আমাদের দরকার আব্বা।’
বরিসের নাম শুনে ভ্রু কুঞ্চিত হলো ন্যান্সির আব্বা দানিয়েল ময়নিহানের। বলল, ‘হ্যাঁ দেখেছি তাকে। প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা উপদেষ্টার পি, এস ছেলেটাতো?’
বলে একটু থামল। ভাবল বোধ হয় একটু। তারপর বলল, ‘এস মা, তোমার সাথে একটু কথা বলি।’
বলে দানিয়েল ময়নিহান এগুলো সামনের বসার ঘরটার দিকে। দানিয়েল ময়নিহান ও ন্যান্সি সোফায় পাশাপাশি বসল।
দানিয়েল ময়নিহানের মুখ বিষন্ন। বেদনাক্লিষ্ট তার চোখের দৃষ্টি। ধীরে ধীরে বলল, ‘কিছুক্ষণ আগে আমার এক গুরুত্বপূর্ণ বন্ধু আমাকে টেলিফোনে বলল যে ‘ফ্রি আমেরিকা’ (ফ্রেম) মুভমেন্ট এবং সরকারের প্রভাবশালী অংশ আমাকে ইহুদীপন্থী বলে মনে করে। বর্তমানে কয়েকটা ঘটনা নিয়ে সরকার ও ‘ফ্রেম’ ইহুদীদের বিরুদ্ধে খড়গহস্ত হয়েছে। এ নিয়ে খুব শীঘ্রই প্রতিনিধি পরিষদ ও সিনেটে শক্তির লড়াই হতে যাচ্ছে। পারিবারিক সংকট ও চাপে পড়ে যাতে আমি ঐ লড়াইতে কোন ভূমিকা না রাখতে পারি তারই একটা কৌশল হিসাবে এই ঘটনা ঘটানো হতে পারে। সেই আমাকে প্রথমে জানাল, গত রাত ১২টার পর বরিস নিক্সন আমার বাসায় এসেছিল। আর বরিস নিক্সনের সাথে ‘ফ্রেম’ (ফি আমেরিকা মুভমেন্ট)- এর খুব গভীর সম্পর্ক আছে।’
দানিয়েল ময়নিহান কথাগুলো বলে একটা দম নিয়ে পুনরায় বলল, ‘এই মুহূর্তে ভেতরের দৃশ্যপট যে রকম সংঘাত-মুখর তাতে আমার বন্ধুর কথাগুলো শুনেই ন্যান্সি বুঝল তার পিতার এই বন্ধু নিশ্চয় জেনারেল শ্যারন হবেন। সে বিস্মিত ও আতংকিত বোধ করল যে, জেনারেল শ্যারনরা কিভাবে কত দ্রুত কাহিনী সৃষ্টি করতে পারে। সে বিস্মিত হলো এই ভেবেও যে, বরিস এখানে পাহারা বসিয়েছিল, না পুলিশের কাছ থেকে ওরা জেনেছে। পুলিশ নিশ্চয় গেটের লোকদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছে এবং নিশ্চয় ওরা জানতে পেরেছে বরিস এখানে এসেছিল। পুলিশের কাছ থেকেও শ্যারনরা এই তথ্য জানতে পারে। পুলিশের মধ্যে ওদের প্রচুর লোক আছে।
এসব চিন্তা করে ন্যান্সি ভাবল, টেপের কথা, বরিসকে টেপ দেয়ার কথা তার আব্বাকে এখন বলা ঠিক হবে না। টেপ ‘ফ্রি আমেরিকা’ মুভমেন্টের হাতে দেয়ার ব্যাপার তার আব্বা মেনে নেবেন না। তাছাড়া টেপ হস্তান্তরের এই কথা তার আব্বার মাধ্যমে জেনারেল শ্যারনদের কানে চলে যেতে পারে। তাতে বরিসেরও বিপদ ঘটতে পারে। আবার ভাবল ন্যান্সি, টেপের ব্যাপারটা হ্যারির কাছ থেকেও শ্যারনরা জেনে নিতে পারে এবং এজন্যেই তাকে কিডন্যাপ করেছে। পরক্ষণেই তার মনে একটা আশা জাগল যে, হ্যারি টেপ পেয়েছে এটা ফিলিফও জানত না। সুতরাং ফিলিফ তাদেরকে একথা বলতেও পারেনি। অতএব হ্যারিকে তারা ধরে নিয়ে গেছে সন্দেহ বশতই। আর হ্যারি মুখ না খুললে তাদের সন্দেহ সন্দেহই থেকে যাবে। নিছক সন্দেহ থেকেই কি তারা হ্যারিকে খুন করতে পারে!’
চিন্তা হয়তো ন্যান্সির আরও সামনে গড়াত। কিন্তু তার আব্বার কথায় তার চিন্তার সূত্রটা কেটে গেল। তার আব্বা বলছিল, ‘কি মা কিছু বলছ না যে?’
‘ভাবছিলাম আব্বা’
‘কি ভাবছিলে?’
‘প্রকৃত ঘটনা জানা না থাকলে কত অমূলক সন্দেহ মানুষ করে।’
‘কি রকম? বলল ন্যান্সির আব্বা দানিয়েল ময়নিহান।
‘আব্বা ঘটনা হলো, বরিস নিক্সন এদিক দিয়ে যাচ্ছিল, আমিই ডেকে তাকে বাড়িতে নিয়ে এসেছিলাম। হ্যারিও ছিল আর আব্বা, বরিস আমাদের ফিলিফ আংকলকে চেনেই না। তাকে খুন করতে যাবে কেন সে? গেটের নিরাপত্তা প্রহরীদের কাছে আপনি নিশ্চয় শুনেছেন এবং পুলিশও বলেছে, খুনিদের প্রথম টার্গেট ছিল ফিলিফ। সেখান থেকে এসেছে হ্যারির এখানে। আপনার বন্ধুর কথা সত্য হলে আব্বা, তাদের আক্রমণের শিকার আমরা হতাম, ফিলিফ নয় এবং ঐ কথা সত্য হলে ফিলিফ হত্যার কোন যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। আব্বা, আর এই হত্যার দায় যদি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে আপনার উপর চাপাতে চাইত আপনাকে বিপদে ফেলার জন্যে তাহলে খুনিরা হ্যারিকে কিডন্যাপ করতো না এবং সকলকে সংগাহীনও করতো না।
‘তোমার কথার যুক্তি আছে মা। তাহলে এই খুন ও কিডন্যাপের মটিভ কি, কারা খুন করেছে?’
‘আমার বিশ্বাস আব্বা, খুব শীঘ্রই তা জানা যাবে এবং খুনিরাও চিহ্নিত হবে।’
‘এত নিশ্চিত করে বলছ কি করে মা?’
‘আমার মন বলছে আব্বা’
ন্যান্সি থামলেও ন্যান্সির আব্বা সংগে সংগে কিছু বলল না। ভাবছিল। একটু পর বলল, ‘তবু সব কিছু পরিস্কার হওয়ার আগে বরিসকে এখানে আসতে নিষেধ করো মা। আমি চাই না এনিয়ে কোন কথা উঠুক এবং তুমি তাতে জড়িয়ে যাও।’
‘ঠিক আছে আব্বা তাকে বলে দিচ্ছি। কিন্তু আমি তার সাহায্য চেয়েছি। আপনি জেনেছেন সে ‘ফ্রি আমেরিকা’ মুভমেন্টের সাথে আছে। হ্যারিকে উদ্ধার করার ব্যাপারে তারা কিছু করতে পারে।’
‘কেউ যদি সাহায্য করে আমাদের আপত্তি থাকবে কেন? কিন্তু ‘ ফ্রি আমেরিকা’ এটা করছে, তা বলার দরকার নেই। একটা কথা তোমাকে বলি মা, ভেতরের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভাল নয়। প্রেসিডেন্ট এবং তার প্রশাসন একজন কূখ্যাত মৌলবাদীকে রক্ষা করার জন্যে ইহুদীদের বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লেগেছে। এটা আমেরিকার স্বার্থের পরিপন্থী। আমেরিকার এই স্বার্থ বিরোধী কাজে প্রেসিডেন্টকে যারা সাহায্য করছে তাদের মধ্যে ‘ফ্রি আমেরিকা’ মুভমেন্টও রয়েছে। সুতরাং ‘ফ্রি আমেরিকা’ মুভমেন্ট বা তার কোন লোকের সংস্পর্শে যাওয়া আমাদের ঠিক হবে না। যেহেতু দেশের প্রতি আমার একটা বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে তাই দেশের স্বার্থেই আমাকে প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে যেতে হচ্ছে। এ সময় ‘ফ্রি আমেরিকার’ সাথে আমাদের কোন প্রকার সংশ্লিষ্টতা আমার রাজনীতির ক্ষতি করবে।’
ন্যান্সি বুঝল, তার পিতা তার রাজনীতিকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। প্রকৃত ব্যাপার তার আব্বাকে বুঝাতে চেষ্টা করবে কি ন্যান্সি? কিন্তু না, তা করতে গেলে বিপরীত ঘটতে পারে। তবু ন্যান্সি বলল, ‘মাফ করবেন আব্বা, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কি রকম সে বিষয়ে আমি খুব বেশি জানি না। কিন্তু তবু আমি বলব একজন মুসলিম মৌলবাদী এসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ও তার প্রশাসনকে তার পক্ষে নিয়ে যাবে, আপনাদের মত শীর্ষ পর্যায়ের আমেরিকান বিবেককে নিশ্চয় এত ছোট, এত ভংগুর করে আপনি দেখবেন না।’
ভ্রু কুঞ্চিত হলো দানিয়েল ময়নিহানের। ভাবল সে। তারপর তার চোখে ফিরে এল মুগ্ধ দৃষ্টি। বলল ন্যান্সিকে, ‘তুমি যা বলেছ মা যুক্তির দিক দিয়ে তা ঠিক। কিন্তু যুক্তিতে আসে না, এমন দুর্ঘটনা রাজনীতিতে ঘটতে পারে। যখন এ ধরনের পরিস্থিতি আসে, তখন ঘটেনি প্রমাণ হওয়ার আগ পর্যন্ত ঘটেছেই ধরে নিতে হবে।’
‘কিন্তু সেক্ষেত্রে আমি মনে করি আপনাদের মত শীর্ষ রাজনীতিকরা কোন এক পক্ষে জড়িয়ে না পড়ে সত্য উদ্ধারে সচেষ্ট হওয়া উচিত।
হাসল দানিয়েল ময়নিহান। বলল, ধন্যবাদ ন্যান্সি। তুমি যা বলেছ সাধারণভাবে তা ঠিক। কিন্তু যখন যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়, তখন এই ধরনের নিরপেক্ষতা সত্যের ক্ষতি করতে পারে। এই ধরনেরই পরিস্থিতি আজ। তবু তুমি যা বলেছ তা মনে রাখব মা। সত্য অনুসন্ধানে আমি চেষ্টা করব। প্রেসিডেন্টের পক্ষের বক্তব্যও আমি শোনা ও বুঝার চেষ্টা করব।
‘ধন্যবাদ আব্বা।’ বলে একটু দম নিল ন্যান্সি। তারপর বলল, ‘তাহলে হ্যারির ব্যাপারে আমরা কি করছি আব্বা?’
‘সব কিছুই করব মা। পুলিশ তো কাজ করছেই। এই মাত্র FBI চীফ জর্জ আব্রাহাম জনসন আমাকে টেলিফোন করেছিলেন। তিনি শুনেছেন সব। বললেন তিনি, আমরা কাজ শুরু করেছি। এফ বি আই এর একটা টীম যাচ্ছে আপনাদের ওখানে। আমিও আসব। কিছু তারা আঁচ করেছেন কি না আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি বললেন, কোন পথে আমাদের এগুতে হবে সেটা আমাদের কাছে পরিস্কার হয়ে গেছে এবং কতটা এগুতে পারছি, আপনাকে সব জানাব।’
‘জর্জ আব্রাহাম খুবই ভালো মানুষ আব্বা। আমাদের ক্লাসে কানাডার একজন ভিজিটিং প্রফেসর ‘লয়ালটি টু নেশন ইন ক্রাইসিস’ (সংকটের মুখে জাতীয় আনুগত্য) বক্তৃতায় জর্জ আব্রাহাম জনসনের নাম দিয়ে বলেছিলেন, এরা দেশ প্রেমের ক্লাসিকাল দৃষ্টান্ত। এঁদের দেশ প্রেমের নিকট ব্যক্তি স্বার্থ, স্বজন প্রীতি, গোষ্ঠী চিন্তা সবই কুরবানী হয়ে যায়।’
‘আমিও তাই জানতাম মা। প্রেসিডেন্ট যখন FBI চীফ হিসেবে তাঁর নাম প্রস্তাব করেন, তখন আমিই তাকে সবচেয়ে বেশি সমর্থন দিয়েছিলাম। কিন্তু একজন মৌলবাদী আহমদ মুসা কেমন করে তাঁকে গিলে ফেলল তাই বুঝছি না।’ বলল দানিয়েল ময়নিহান নরম কন্ঠে।
‘আব্বা, এটাই আগে বুঝার চেষ্টা করলে হয়তো জর্জ আব্রাহাম সম্পর্কে আজ আপনার ভিন্ন ধারণার সৃষ্টি হতো না।’
ন্যান্সি থামলেও সংগে সংগে কথা এল না দানিয়েল ময়নিহানের মুখে। ভাবছিল। হাসল সে অবশেষে। বলল, ‘ধন্যবাদ ন্যান্সি। তুমি সত্যিই আমার মা। মায়ের বকুনি আমি গ্রহণ করলাম। আগে না হলেও এখন আমি ব্যাপারটা বুঝার চেষ্টা করব।’
‘ধন্যবাদ আব্বা। আমি………।’
ন্যান্সির কথার মাঝখানেই কথা বলে উঠল দানিয়েল ময়নিহান। বলল, ‘আরেকটা খবর ন্যান্সি। এদিকের কিছু খবর আগামীকাল নিউজ পেপার ও টেলিভিশন নেটওয়ার্কে আসছে। সেটা উপলক্ষ করে ওদিকের প্রকৃত ব্যাপার আমার জানার বিষয়টা খুবই প্রাসঙ্গিক হবে।’
‘ঠিক তাই আব্বা।’ বলে একটু থেমেই অনুমতি প্রার্থনা করল, ‘আমি তাহলে উঠি আব্বা!’
‘এস।’ বলল তার আব্বা।
ন্যান্সি উঠে দাঁড়িয়ে চলে যাচ্ছিল।
‘ন্যান্সি শুন।’ পেছন থেকে ডেকে উঠল দানিয়েল ময়নিহান।
ফিরে দাঁড়াল ন্যান্সি।
‘দেখ মা, বরিস নিক্সন ছেলেটাকে আমি খুব ভালো মনে করি। আমি যেটা বলেছি, সেটা রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথা।’ দানিয়েল ময়নিহানের মুখে মিষ্টি হাসি।
ন্যান্সির মুখ রাঙা হয়ে উঠল। ঠোঁটে ভেসে উঠল সলজ্জ এক টুকরো হাসি। বলল, ‘অনেক ধন্যবাদ আব্বা।’
বলেই ঘুরে দাঁড়িয়ে ছুটে পালাল সে।

Top