৩০. এক নিউ ওয়ার্ল্ড

চ্যাপ্টার

ট্যাক্সি করে মন্টিসেলোর দিকে এগুচ্ছে আহমদ মুসা।
শার্লট ভিল বিমান বন্দরে নেমে আহমদ মুসা ঘন্টা চুক্তিতে এ ট্যাক্সি ভাড়া করেছে মন্টিসেলো যাবার জন্যে।
ঘন্টা চুক্তির কথা শুনে ট্যাক্সিওয়ালা চোখ কপালে তুলে বরেছে, ‘মন্টিসেলো পনের বিশ মিনিটের পথ, ঘন্টা দিয়ে কি হবে স্যার?’
হেসে বলেছে আহমদ মুসা, ‘পথ তোমার পনের বিশ মিনিটের ঠিক আছে। কিন্তু পথে আমি দেরী করতে পারি, এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াতে পারি, এমনকি যার কাছে যাচ্ছি তার দেখা না পেলে আবার শার্লট ভিলে সংগে সংগে ফিরেও আসতে পারি।’
‘বুঝেছি স্যার, ধন্যবাদ।’ হেসে বলেছে ট্যাক্সি ড্রাইভার।
আয়নার মতই মসৃণ রাস্তা।
যাওয়া ও আসার রাস্তা পাশাপাশি। মাঝ খান দিয়ে উুঁচ, নিচু, এবড়ো থেবড়ো মাটি, পাথর এবং গাছ ও ঝোপ-ঝড়ের স্বাভাবিক ব্যারিয়ার।
রাস্তাটি মন্টিসেলোর পাহাড়ের পাদদেশ ঘেঁষে চলেগেছে তার আরও পশ্চিমে গ্রেট ভ্যালির বিখ্যাত হাইওয়ের দিকে।
আহমদ মুসা ডিপারচার লাউঞ্জ থেকে বের হবার মুখেই পেয়ে যায় ট্যুরিষ্ট ষ্টল। সেখান থেকে আহমদ মুসা সংগ্রহ করে নেয় ভার্জিনিয়ার একটি রোড কমুনিকেশন মানচিত্র এবং গ্রেট ভ্যালি এলাকার একটা ট্যুারিষ্ট গাইড।
ট্যুরিস্ট স্টলের কথা মনে পড়তেই আহমদ মুসার চোখের সামনে ভেসে উঠে স্টলের সেলস গার্ল তরুণীটির চেহারা। আহমদ মুসার উপর চোখ পড়তেই তরুণীটি চমকে উঠেছিল। আহমদ মুসা নিশ্চিত সে আহমদ মুসাকে চিনেছে। মেয়েটিকে? এফ বি আই এর লোক? তার ছবির মাধ্যমে এফ বি আই এর অনেকেই তাকে এখন চেনে।
মন্টিসেলোতে যাতায়াতের এটাই একমাত্র পথ।
আহমদ মুসা এ বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছিল ট্যুরিষ্ট গাইড দেখে। আবার ড্রাইভারকেও জিজ্ঞেস করেছিল। ড্রাইভার বলেছিল, গাড়ির রাস্তা এই একটাই, তবে পায়ে হাঁটার পথ অনেক আছে।
আহমদ মুসার ট্যাক্সি চলছিল মাঝারি গতিতে রাস্তার সর্বশেষ একজিট ওয়ে’র লেন ধরে।
ব্যস্ত রাস্তা এটা নয়। গাড়ি চলছে, তবে দুই গাড়িকে কোথাও একত্রে দেখা যাচ্ছে না। এই হিসাবে রাস্তাটি গাড়ি বিরল এবং জনবিরলই।
গাড়ির ভেতর থেকে দেখা যাচ্ছে, চারদিকটা সবুজ পাহাড় আর সবুজ উপত্যকার সুন্দর চাদরে মোড়া। চোখ ফেরানো যায় না এ সবুজ সুন্দরের বুক থেকে।
আহমদ মুসার মুগ্ধ দুই চোখ আঠার মত লেগে আছে এ সুন্দরের বুকে।
অপরূপ ভার্জিনিয়ার এ এলাকাটি ‘আপালোসিয়ান পর্বতমালা’র বিখ্যাত নীল শৈল শিলায় সাজানো সুন্দর পূর্বাচল। আবার আপালোসিয়ানের বুক চিরে প্রলম্বিত গ্রেট ভ্যালিরও অংশ একে বলা যায়।
বাইরের মৌন সবুজের বুকে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল আহমদ মুসা।
ড্রাইভারের কথায় সম্বিত ফিরে পেল সে। ড্রা্ভার বলছিল, ‘স্যার আপনি যে একসিডেন্টের কথা বলেছিলেন, সেখানে আমরা এসে গেছি।’
আহমদ মুসা সোজা হয়ে বসল। চোখ ফিরিয়ে নিল রাস্তার পাশে। বলল, ‘ওখানে কি দাঁড়ানো যাবে না ড্রাইভার?’
‘জি স্যার। একসিডেন্ট পয়েন্টের পেছনেই পার্ক করার মত অনেক জায়গা আছে।
‘ঠিক আছে গাড়ি ওখানে পার্ক করো।’ নির্দেশ দিল আহমদ মুসা।
গাড়ি পার্ক করলো ড্রাইভার।
আহমদ মুসা গাড়ি থেকে নামল। বলল, ‘দেখবো একসিডেন্ট এরিয়াটা।’
ড্রাইভারও নামল।
ড্রাইভার নিয়ে গেল আহমদ মুসাকে সেখানে গাড়ি রাস্তা থেকে ছিটকে এসে পড়েছিল, তারপর গড়িয়ে গিয়েছিল নিচে।
জায়গাটা দেখে বিস্মিত হলো আহমদ মুসা। এখানে ঢালটা অস্বাভাবিক রকম খাড়া। আর এখানে এসেই জায়গা হঠাৎ বড় রকমের বাঁক নিয়ে রাস্তার কাছাকাছি চলে এসেছে। একসিডেন্টের খুবই উপযুক্ত একটা জায়গা। আর এখানে এসেই একসিডেন্টটা হয়েছে।
এমন ঘটা অস্বাভাবিক নয়। কাকতলীয় এমন অনেক কিছুই ঘটে।
কিন্তু মন বড় খুঁত খুঁত করছে আহমদ মুসার। কাকতলীয় কিছু ঘটতে পারে, কিন্তু এখানে যা ঘটেছে সেটা ঐ কাকতলীয় ঘটনা কিনা?
আহমদ মুসা ঝুকে পড়ে তাকাল ঢালের নিচে। দেখল এক’শ ফুটের মত নিচে নালার মত খাদের তলায় পোড়া গাড়ির অবশিষ্ট কাঠামো উল্টে পড়ে আছে।
কোটের পকেট থেকে ছোট্ট একটা দূরবীন বের করল আহমদ মুসা। চোখে লাগিয়ে আবার তাকাল নিচের দিকে।
খুটিয়ে দেখতে লাগল গাড়িটা।
ছোট হলেও দূরবীনটা অত্যন্ত পাওয়ারফুল। একমাইল দূরে পড়ে থাকা আলপিন পর্যন্ত এর নজর এড়ায় না।
এক সময় আহমদ মুসা চোখ থেকে দূরবীন নামিয়ে চোখে-মুখে কিছুটা বিস্ময় নিয়ে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল ড্রাইভারকে।
এ সময় তাদের পেছনে একটা গাড়ি দাঁড়ানোর শব্দে আহমদ মুসা পেছনে ফিরে তাকাল। তাকিয়ে দেখতে পেল, তাদের ট্যাক্সির পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে একটি কার। কার থেকে নামছে সারা জেফারসন।
সারা জেফারসনকে এভাবে এখানে দেখে অনেকটা ভুত ধোর মতই চমকে উঠল আহমদ মুসা।
সারা জেফারসন ধীরে ধীরে আহমদ মুসার সামনে এসে দাঁড়াল।
সারা জেফারসনের পরনে সাদা ফুল প্যান্ট, গায়ে হাল্কা গোলাপী কোট এবং মাথায় প্রাচীন অভিজাত আমেরিকানদের মত কারুকাজ করা গোলাপী হেডক্যাপ। হেডক্যাপের আড়াল থেকে দেখা যাচ্ছে তার কপালে ব্যান্ডেজের একটাংশ।
মুখটাও সাদা ও লালে মেশানো। গোটা মুখে প্রসাধনী ব্যবহারের কোন চিহ্ন নেই। আছে শিশু সুলভ সারল্যের স্নিগ্ধ লাবন্য। লিপিস্টিকহীন রক্তিম ঠোঁটে আনন্দের হাসি।
ড্রাইভার সারা জেফারসনকে এসে দাঁড়াতে দেখেই ‘গুড ইভনিং ম্যাডাম মিস জেফারসন’ বলে মাথা সামান্য ঝুকিয়ে বাউ করে সম্মানের সাথে পেছনে সরে গেল।
সারা জেফারসন তার দিকে তাকিয়ে হেসে জবাব দিল তার সম্বোধনের।
সারা জেফারসন ড্রাইভারের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে আহমদ মুসার দিকে মুখ তুলে বলল, ‘গুড ইভনিং। আসসালামু আলাইকুম।’
বলে হেসে উঠল সারা জেফারসন। হাসতে হাসতেই বলল, ‘দেখলেন, আপনাদের আপনাদের স্বাগত সম্বোধনটা আমি মুখস্ত করে ফেলেছি। অর্থও জানি। সত্যি, আপনাদের এ শুভ কামনার কোন তুলনা হয় না।’
‘ধন্যবাদ মিস সারা জেফারসন। গুড ইভনিং।’ আহমদ মুসার ঠোঁটেও টুকরো হাসি।
‘বাহ, আপনাদের স্বাগত সম্ভাষণ ‘সালাম’ বলবেন না!’ বলল সারা জেফারসন হাসি মুখে।
আহমদ মুসা তার চোখ নামিয়ে নিয়েছিল সারা জেফারসনের মুখ থেকে। হাসল আহমদ মুসা সারা জেফারসনের কথায়। বলল, ‘আপনি আমাকে স্বাগত জানিয়েছেন আমাদের সম্বোধন দিয়ে, আর আমি জানলাম আপনাদের সম্বোধন দিয়ে।’
‘তা ঠিক। কিন্তু আসল ঘটনা এটা নয়।’ বলল সারা জেফারসন। মুখ টিপে হাসল সে।
‘তাহলে কি?’ মুখ তুলে হেসে বলল আহমদ মুসা।
‘আসল ঘটনা হলো, শুভকামনাসূচক আপনাদের স্বাগত সম্বোধনটা মুসলমানদের জন্যে এক্সক্লুসিভ। কোন অমুসলমানকে এ দিয়ে স্বাগত জানানো হয় না।’
‘আপনি এতো জানেন?’
‘আমার আম্মা কি বলেন জানেন, আমি আমার গ্রান্ড গ্রান্ড গ্রান্ড ফাদার টমাস জেফারসনের মতই নাকি বুক ওয়ার্ম। আসলে কিন্তু কিছুই না।’
কথা শেষ করে একটা দম নিয়ে সারা জেফারসন আবার বুলে উঠল, ‘আমাকে এখানে এভাবে দেখে খুব বিস্মিত হয়েছেন, তাই না?’
‘হয়েছিলাম, কিন্তু সেটা কেটে গেছে।’
‘কিভাবে?’
‘আমার মনে হয়েছে, এয়ারপোর্টের ট্যুরিষ্ট ষ্টলের মেয়েটি আমার আসার ব্যাপারে আপনাকে জানিয়েছে।
‘কি করে বুঝলেন? মেয়েটিকে চেনেন?’
‘চিনি না। কিন্তু তার তাকানো দেখে বুঝেছিলাম সে আমাকে চিনে ফেলেছে। তখন ভেবেছিলাম সে এফ বি আই-এর লোক হবে। এখন বুঝলাম সে ‘ফেম (FAME) মানে ‘ফ্রি আমেরিকা’র লোক।’
‘তারপর?’
‘আমি ট্যাক্সিতে আসছি সে কথাও আপনি জেনে ফেলেছেন।
তারপর আপনি এখানে চলে এসেছেন। আমাদেরকে পাস করার সময় আমাদের ট্যাক্সি দেখে এখানে থেমে গেলেন।
‘ধন্যবাদ। তাহলে এখন চলুন। এখানে কি দেখছিলেন, একসিডেন্ট?’
‘এই বেনজির একসিডেন্ট দেখে আপনার কিছু মনে হয়েছে?’
‘বেনজির আপনি ঠিক বলেছেন। এ ধরনের একসিডেন্ট এই এলাকায় এটাই প্রথম।’
বলে একটু থামল সারা জেফারসন। তারপর বলল, ‘একসিডেন্টকে আমার কাছে একসিডেন্টই মনে হয়েছে। আপনি এ প্রশ্ন করছেন কেন?’
এই বেনজির একসিডেন্টের কথা শুনে হঠাৎই আমার মনে হয়, একসিডেন্টটা একসিডেন্ট নাও হতে পারে। এখন মনে হচ্ছে, আমার ধারণাই ঠিক।’
সারা জেফারসনের মুখের আলো হঠাৎ দপ করে নিভে গেল। চোখে-মুখে ফুটে উঠল বিস্ময়। কথা বলতেও যেন সে ভুলে গেল।
আহমদ মুসাই কথা বলল। বলল, ‘এ পর্যন্ত যতটুকু দেখেছি তাতে আমি অনেকটাই নিশ্চিত, এটা একসিডেন্ট ছিল না।’
কথা শেষ করে আহমদ মুসা পরিপূর্ণভাবে সারা জেফারসনের দিকে তাকাল। বলল, ‘বলুন তো সেদিন দুই গাড়ির যেটিতে আপনি চড়েছিলেন, সেটিতেই কি আপনার চড়ার কথা ছিল?’
চমকে উঠল সারা জেফারসন। মুহূর্তের জন্যে তার উদ্বিগ্ন দৃষ্টি স্থির থাকলো আহমদ মুসার মুখে। তারপর বলল, ‘যে গাড়িটা সেদিন ধ্বংস হয়েছে ওটাই আমার পার্সোনাল গাড়ি। ওটাতেই আমার চড়ার কথা ছিল। কিন্তু কেন জানি সেদিন আমি হঠাৎই উঠে বসি পেছনের গাড়িতে।’
‘আল্লাহ আপনাকে বাঁচাবেন বলে উঠিয়েছিলেন পেছনের গাড়িতে।’
‘তাহলে আপনি বলছেন ওটা ছিল আমাকে হত্যার পরিকল্পিত একটা ঘটনা?’
‘আমার তাই মনে হচ্ছে।’
‘কিন্তু কোন প্রমাণের ভিত্তিতে?’
‘আপাতত অবস্থাগত কারণের ভিত্তিতে।’
‘সেটা কি?’
আহমদ মুসা তার দূরবীন তুলে দিল সারা জেফারসনের হাতে। বলল, ‘গাড়িটা গড়িয়ে পড়ার জায়গা থেকে শুরু করে পুড়ে যাওয়া গাড়ির বডিটা ভালো করে দেখুন।’
দূরবীন চোখে লাগাল সারা জেফারসন। কিছুক্ষণ দেখার পর দূরবীন চোখ থেকে নামিয়ে বলল, ‘দেখলাম। এবার বলুন।’
‘আপনি দেখেছেন, গাড়ির তিনটি চাকা পুড়ে গাড়ির সাথে লেপ্টে আছে। বাম পাশের সামনের চাকাটা গাড়ির সাথে নেই। ওটা দেখেছেন মাঝপথে একটা পাথরের সাথে আটকে আছে।’
‘জি, দেখেছি।’ বলল সারা জেফারসন।
‘আটকে থাকা এই চতুর্থ চাকাটা পুড়েনি। এবং গাড়ির সাথে খাদের তলাতেও পড়েনি। এর অর্থ চাকাটা শুরুতেই গাড়ি থেকে খসে গেছে। আমার মত হলো, চাকাটা গাড়ি থেকে খুলে যাওয়ার কারণেই ধ্বংসাত্মক এই দুর্ঘটনা ঘটেছে।’ আহমদ মুসা বলল।
আহমদ মুসা থামলেও সংগে সংগে কথা বলল না সারা জেফারসন। ভাবছিল সে। বলল কিছুক্ষণ পর, ‘অবস্থাগত দিকগুলোর যে ব্যাখ্যা আপনি দিয়েছেন তার সাথে আমি একমত। চাকা খুলে যাওয়ার ফলে একসিডেন্ট ঘটেছে এটাও ঠিক। কিন্তু ভাবছি, গাড়ির চাকা খুলে যাবার সাথে কোন পরিকল্পনার যোগসূত্র আছে কিভাবে? চাকা আগে থেকে অবশ্যই খোলা ছিল না, তাহলে গাড়ি শুরু থেকেই চলতে পারতো না। আর চাকা নড়বড়ে থাকলে গাড়ি এতদূর আসতে পারতো না।’
‘ঠিক বলেছেন। আচ্ছা বলুন তো ঠিক দুর্ঘটনার মুহূর্তের কথা। কি দেখেছেন, কি শুনেছেন তখন?’
সারা জেফারসন বলল, ‘টায়ার ফাটার মত একটা বিকট শব্দ শুনেছি। তারপরই গাড়িটা যেন লাফ দিয়ে খাদে পড়ে গেল।’
‘খুবই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন মিস জেফারসন। টায়ার ফাটলে তো যেদিকে গাড়িটি ছিটকে পড়েছে সে দিকের, বিশেষ করে খসে পড়া চাকাই ফেটে যাবার কথা।’
বলে একটু থেমেই আহমদ মুসা আবার বলল, ‘একটু দাঁড়ান মিস জেফারসন, আমি চাকাটা নিয়ে আসছি।’
আহমদ মুসা নামতে যাচ্ছিল ঢালে। সারা জেফারসন বাধা দিয়ে বলে উঠল, ‘এ কষ্টের কোন প্রয়োজন নেই মি. আহমদ মুসা। ধরুন, টায়ারটি ফেটেছে। কিংবা ধরুন, টায়ারটি ফাটেনি।’
‘তাতে আমরা কোন একটা নির্দিষ্ট উপসংহারে পৌছাতে পারবো না মিস জেফারসন। অথচ এ ধরনের একটা সিদ্ধান্তে আমাদের পৌছতে হবেই।’ বলল আহমদ মুসা।
সারা জেফারসনের মুখটা ম্লান হয়ে গেল। কিছু বলল না।
আহমদ মুসা নামল ঢাল বেয়ে।
অত্যন্ত খাড়া বলে সোজা নামা গেল না, অনেকটা ঘুরে পথে তাকে নামতে হলো।
দশ মিনিটের মধ্যেই চাকা হাতে উঠে এল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ মি. আহমদ মুসা। আপনাকে আমার ভোগানো বোধ হয় সবে শুরু। দেখছিতো টায়ারটি ফাটেনি।’ একটু বিব্রত কণ্ঠ সারা জেফারসনের।
‘ঠিকই বলেছেন মিস জেফারসন। টায়ারটি ফাটেনি। কিন্তু লক্ষ্য করুন চাকার স্টিল ফ্রেমের যে দিকটা বাইরে ছিল তার রং ও স্বাভাবিকতা ঠিকই আছে, আর যে দিকটা ভেতরের পাশে ছিল তার রং বিবর্ণ হয়ে গেছে এবং মসৃণ স্টিল সারফেসটা অমসৃণ হয়েছে।’ আহমদ মুসা বলল।
সারা জেফারসনও ব্যাপারটা পরীক্ষা করল। বলল, ‘এর অর্থ কি মি. আহমদ মুসা?’
‘আমার মনে হচ্ছে, ‘প্রেসার একপ্লোশন’- এর কাজ হতে পারে। ’
‘প্রেসার এক্সপ্লোশন’ কি?’
‘আল্ট্রা প্রেসার মাইক্রো সিলিন্ডার’ (APMC) নামে বিশেষ ধরনের একটি অস্ত্র আবিস্কার হয়েছে। সাবান কেসের চেয়ে বড় নয় যন্ত্রটা। কিন্তু অবিশ্বাস্য তার শক্তি। বোমায় ঘটে আগুনের বিস্ফোরণ, আর ওতে ঘটে চাপের বিস্ফোরণ। একটা ইস্পাতের দেয়ালে এটা সেট করলেও যন্ত্রটির চারদিকের এক বর্গফুট এলাকা পর্যন্ত ইস্পাতের দেয়াল প্রচন্ড চাপে খসে ছিটকে বেরিয়ে যায় বুলেটের মত। যন্ত্রটা স্বয়ংক্রিয় হয়, আবার দূরনিয়ন্ত্রিতও হতে পারে। আমার মনে হয় আপনার গাড়ির সামনের বাম চাকার ভেতরের পাশে যন্ত্রটি ফিট করা হয়েছিল। চাপের বিস্ফোরণে চাকা ছিটকে বেরিয়ে যায়। গাড়িও লাফিয়ে ওঠে এবং পড়ে ভয়ানক দুর্ঘটনায়।’
থামল আহমদ মুসা।
সম্বোহিতের মত তাকিয়েছিল সারা জেফারসন আহমদ মুসার মুখের দিকে। আহমদ মুসা থামলেও কথা বলতে পারলো না সারা জেফারসন। তার চোখে-মুখে বিস্ময়, উদ্বেগ, বিমুগ্ধতাও।
আহমদ মুসা চোখ নামিয়ে নিয়েছে অনেকক্ষণ। কিন্ত বুঝতে পারছে যে, সারা জেফারসনের অপলক দৃষ্টির বাধনে বন্দী।
আহমদ মুসা তাকাল ড্রাইভারের দিকে। সে একটু দূরে ভিন্ন দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বলল আহমদ মুসা, মিস জেফারসন, ‘ড্রাইভার অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে।’
আহমদ মুসার কথা মনে হয় সারা জেফারসন শুনতেই পায়নি। সারা জেফারসন বলল, ‘প্রেসার এক্সপ্লোশন ডিভাইস’ (APMC)টি কারা সেট করতে পারে গাড়িতে আমাকে হত্যা করার জন্যে?’ সারা জেফারসনের কথা দূর থেকে ভেসে আসা নিস্তেজ, নিস্পৃহ, ঘুম জড়ানো এক কণ্ঠের মত শোনাল আহমদ মুসার কানে।
‘বিষয়টি নিয়ে পরে আলোচনা করা যাবে।’ বলল আহমদ মুসা। আহমদ মুসার একথাও সারা জেফারসন শুনল বলে মনে হলো না। সে বলল, ‘মি. আহমদ মুসা আমি দেশের শীর্ষ স্ট্রাটেজিক রিসার্চ ল্যাব- এর রিসার্চ রেজিষ্ট্রেশন ডাইরেক্টর হিসেবে এর কেন্দ্র বিন্দুতে আছি, সহযোগী প্রতিষ্ঠানসমূহের রিসার্চ তালিকাও আমরা যোগাড় করি। কিন্তু APMC এর মত গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র সম্পর্কে আমি কিছু জানি না! সারা জেফারসনের কণ্ঠ আগের মতই শুনাল।
‘মিস জেফারসন, ‘ইউ এস ডিফেন্স এ্যালাটনেস’ শীর্ষক গোপন রিপোর্টের দুমাসের আগের সংখ্যায় এই অস্ত্রের কথা আছে। মনে হয় অস্ত্রটি তৈরী করেছে মিলিটারী সাইনটিষ্টদের কেউ, ডিফেন্স ল্যাবরেটরী থেকে।’ রিপোর্টটি মার্কিন ডিফেন্স কমান্ড এবং প্রেসিডেন্টের মধ্যেই সীমাবদ্ধ বলে আমার ধারণা।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কিন্তু আপনি তো জানতে পেরেছেন।’ বলল সারা জেফারসন। তার মুগ্ধ চোখে কৌতুহল।
‘জানাটা একটা একসিডেন্ট। কদিন আগে সান্তাফে’ নগরীতে হোয়াইট ঈগলের একটা ঘাটি আমরা দখল করেছিলাম। সেখানে গোল্ড ওয়াটারের সাথে জেনারেল শ্যারণও ছিলেন।। সে ঘাটিতে একটা ম্যাগাজিনের মধ্যে জেনারেল শ্যারনের নাম যুক্ত একটা ইনভেলাপ পেয়েছিলাম। সে ইনভেলাপের মধ্যেই পাই রিপোর্টটি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তার মানে ইহুদী গোয়েন্দা প্রধান জেনারেল শ্যারন রিপোর্টটি পেয়েছিল?’ বিস্ময়ে ভ্রু কুচকে উঠেছে সারা জেফারসনের।
হাসি ফুটে উঠল আহমদ মুসার ঠোঁটে। বলল, ‘মিস জেফারসন, শুধু APMC কেন, মার্কিনীদের কোন গোপন তথ্যটি ইহুদী প্রধানদের কাছে নেই?’
মুখটি ম্লান হয়ে গেল সারা জেফারসনের। অনেকটা স্বগত কণ্ঠেই বলল, ‘ওরা তো এখন আমাদের সরকারের মধ্যে আরেকটি সরকার চালাচ্ছে।’
কথাটি বলার সাথে সাথে জেফারসনের ম্লান মুখে ক্রোধ ফুটে উঠল। বলল, ‘আপনি কি ইনভেলাপসহ রিপোর্টটা আমাকে দিতে পারেন?’
‘অবশ্যই মিস জেফারসন।’
‘ধন্যবাদ।’
বলেই সারা জেফারসন তাকাল ট্যাক্সি ড্রাইভারের দিকে। বলল, ‘ওহ! ওকে আমরা বেকার বসিয়ে রেখেছি।’
বলে সারা জেফারসন এগুলো ট্যাক্সির দিকে।
সারা জেফারসনকে আসতে দেখে ড্রাইভার এ্যাটেনশন হয়ে দাঁড়াল।
সারা জেফারসন ঘড়ির দিকে তাকিয়ে পকেট থেকে টাকা বের করে ড্রাইভারের হাতে তুলে দিল। বলল, ‘ঘন্টা হিসাবে নিয়ে যা থাকে সেটা আপনার পরিবারের জন্যে আমার শুভেচ্ছা।’
ড্রাইভার টাকাগুলো নিয়ে গুণার পর টাকার একটা অংশ সারা জেফারসনকে ফেরত দিয়ে বলল, ‘আপনার কাছে থেকে মজুরী নেয়া আমাদের জন্যে কষ্টের। মজুরীটা ফেরত দিলাম, শুভেচ্ছা- অর্থটা রাখলাম। আপনার শুভেচ্ছা আমাদের জন্যে গৌরবের।
‘ধন্যবাদ ম্যাডাম।’
বলে ড্রাইভার সারা জেফারসন ও আহমদ মুসার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে গিয়ে উঠল।
ট্যাক্সি চলে গেলে সারা জেফারসন আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘আপনার অভিযান শেষ, এবার আপনি আমার মেহমান।’ মুখে হাসি সারা জেফারসনের।’
‘দাওয়াত অনেক আগেই দিয়ে রেখেছেন। মেহমান অবশ্যই হবো। কিন্তু আমার অভিযান শেষ হয়নি।’ বলল আহমদ মুসা।
সারা জেফারসন হাসল। মনে মনে বলল, আপনার বিনোদনের কথাটা ভূয়া। ‘ফ্রি আমেরিকা’ (FAME) এর নেত্রী সারা জেফারসনের জীবনে যে অলস বিনোদন নেই, তা আমি জানি।
মুখে আহমদ মুসা কিছু বলল না।
সারা জেফারসন তার গাড়ির দিকে এগিয়ে গাড়ির দরজা মেলে ধরে বলল, ‘আসুন মি. আহমদ মুসা।’
‘মিস জেফারসন আপনি অনুমতি দিলে গাড়ির ঐ চাকাটা আপনার গাড়িতে তুলে নিতে পারি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘অল রাইট মুসা, আপনি গাড়িতে উঠুন। চাকাটা আমিই গাড়িতে তুলছি।’
বলে সারা জেফারসন এগুলো গাড়ির সেই চাকার দিকে।
আহমদ মুসাও এগুলো।
সারা জেফারসন চাকায় হাত দেবার আগেই আহমদ মুসা গাড়ির চাকাটা তুলে নিয়ে বলল, ‘দেখুন মিস জেফারসন, নারীদের অন্যায়ভাবে খাটানো এবং তাদেরকে ক্ষমতা না দেয়ার অভিযোগ রয়েছে পুরুষদের বিরুদ্ধে, আপনি দয়া করে আর এ অভিযোগ বাড়াবেন না।’
সারা জেফারসন হাসল। বলল, ‘আপনি উল্টো কাজ করছেন মি. আহমদ মুসা। নারীরা ক্ষমতা চায় মানে কাজ চায়। আপনিতো কাজ কেড়ে নিয়ে ক্ষমতা কেড়ে নিচ্ছেন।’
হাসল সারা জেফারসন। বলল ‘ঠিক আছে এ বিতর্কের ফায়সালা আমার মাকে সামনে রেখে হবে। ফায়সালার জন্য একজন বিচারকতো দরকার! চলুন গাড়িতে উঠি।
‘আমি রাজী।’ বলে আহমদ মুসা চাকাটা গাড়িতে তুলে দিয়ে গাড়িতে উঠে বসল।
সারা জেফারসন গিয়ে বসল গাড়ির ড্রাইভিং সিটে।
গাড়ি চলতে শুরু করল।
পাশের সিটেই আহমদ মুসা বসেছিল। সে বলে উঠল, ‘মিস জেফারসন, আপনাদের মানে আপনার মাকে বিরক্ত করলাম নাতো?’
হাসল জেফারসন। বলল, ‘আমার মা আপনাকে আমার চেয়ে বেশি জানেন। দেখবেন তিনি কত খুশি হবেন।’
‘আমি এসেছি জানিয়েছেন তাঁকে?’ আহমদ মুসা বলল।
‘হ্যাঁ, বলেছি। মন্টিসেলোতে আপনাকে আমি দাওয়াত করেছিলাম সেটাও আমি বলেছি। উনি কি বলেছেন, তিনি দাওয়াত খেতে যান নাকি? এমন সময় তাঁর আছে বলে মনে হয় না। আমি বলেছিলাম, এই তো আসছেন তিনি।
আম্মা বলেছিলেন, আমি বুঝতে পারছি না। হতেও পারে তিনি জেফারসন তনয়াকে আলাদা গুরুত্ব দিয়েছেন।’
‘আপনার আম্মা অনেক অভিজ্ঞ।’
‘কিন্তু শেষ কথাটা কি তিনি ঠিক বলেছেন?’ বলল সারা জেফারসন তনয়া আমার কাছে শুধুই জেফারসন। তার চোখে-মুখে আনন্দ বিস্ময় দুটোই।
‘জেফারসন তনয়া তা জানেন।’ আহমদ মুসা তার দৃষ্টি সামনে প্রসারিত রেখেই কিছুটা গম্ভীর কণ্ঠে বলল।
সারা জেফারসনের মুখ হঠাৎ যেন যন্ত্রণার অপূর্ব শিহরণে রাঙা হয়ে উঠল। তার মনে হলো, তার বাইশ বছরের জীবনে তার শোনা কোন কথাই তাকে এতটা শিহরিত করতে পারেনি, তার সত্তাকে এতটা গৌরবান্বিত কেউ কখনও করেনি।
কিছুক্ষণ কথা বলতে পারল না সারা জেফারসন।
অসস্তিকর এক নিরবতা।
আহমদ মুসা তখন ভাবছিল অন্য কথা। মিস জেফারসনকে ওরা খুন করতে চেয়েছিল, এটা এখন নিশ্চিত। ‘ওরা’ কারা সেটাও স্পষ্ট। মিস জেফারসন খুন হননি, সেটাও তারা নিশ্চয় জেনে ফেলেছে সংগে সংগেই। এখন ওরা কি ভাবছে? হাত ফসকে যাওয়া শিকার ছেড়ে দিয়ে বসে থাকা ওদের দর্ম নয়। তাহলে?
এই ‘তাহলে’র উত্তর এখন আহমদ মুসার কাছে নেই। তবে আহমদ মুসা ভেবে খুশি হলো যে, মন্টিসেলোতে আসা তার বৃথা যায়নি। সারা জেফারসন শুধু জেফারসন তনয়া নন, তিনি আজকের আমেরিকার একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। ‘ফ্রি আমেরিকা’ (ফেম) মুভমেন্টের তিনি প্রধান। তার জীবনের আজ অনেক মূল্য। ‘স্বাধীন আমেরিকার মানস’ এর তিনি তরুণ প্রতিনিধি। আমেরিকার ফাউন্ডার ফাদারসরা যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, বিশেষ করে টমাস জেফারসন যে নতুন আমেরিকা ও নতুন পৃথিবীর আমেরিকান স্বপ্নকে সবাক রূপ দিয়েছিলেন, সে স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে সারা জেফারসনরাই পারেন। আর সে স্বপ্ন বাস্তবে রূপ পেলে শান্তির সে পরিবেশে নতুন আমেরিকার সাথে মুসলমানদের সম্পর্কই সবচেয়ে গভীর হবে। সুতরাং আহমদ মুসা জেফারসনদের কোন কাজে এসে সেটা আহমদ মুসার জন্যে আনন্দেরই হবে। আহমদ মুসা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল যে, সে একটা ভালো সময়ে মন্টিসেলোতে আসতে পেরেছে।
সারা জেফারসন অল্প সময় পরে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। রাঙা তখনও তার মুখ।
আহমদ মুসাকে ভাবনায় নিমজ্জিত দেখে বলল সারা জেফারসন, ‘কি ভাবছেন মি. আহমদ মুসা?’
‘ভাবছি না, স্বপ্ন দেখছি।’ আহমদ মুসা হাসি মুখে সারা জেফারসনের দিকে না তাকিয়েই বলল।
সারা জেফারসনের চোখ দুটি উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তার রাঙা মুখটি আলো ঝল মল করে উঠল। বলল, ‘কি স্বপ্ন? বিপ্লবীরা কি স্বপ্ন দেখে?’
আহমদ মুসা কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু বলা হলো না। হঠাৎ রিয়ার ভিউ মিররে নিবদ্ধ হয়ে গেল তার চোখ। তাড়াতাড়ি দূরবীন চোখে লাগিয়ে পেছন ফিরে গাড়িটাকে কয়েক মুহূর্ত দেখে বলে উঠল, ‘মিস জেফারসন, একটা গাড়ি দ্রুত আমাদের পেছনে আসছে। মনে হচ্ছে যেন আমাদের গাড়িকে ধরার চেষ্টা করছে।’
‘কেন ওভারটেক করার প্রয়োজনও তো হতে পারে তার?’ সহজ কণ্ঠে বলল সারা জেফারসন।
‘কিন্তু একটা মজার ঘটনা ঘটল। গাড়িটা ফাস্ট লেন দিয়ে দ্রুত আসছিল। তার পেছনে আরেকটা দ্রুতগামী গাড়ি এসে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গেই ঐ গাড়িটি গতি স্লো করে আমাদের লেন অর্থাৎ সেকেন্ড লেনে চলে এসে পেছনের গাড়িকে চলে যাবার রাস্তা করে দেয়। পেছনের গাড়িটা চলে যাবার পর আবার সে স্পীড বাড়িয়ে ছুটে আসছে।’ আহমদ মুসা বলল।
ভ্রু কুঞ্চিত হলো সারা জেফারসনের। বলল, ‘বুঝেছি মি. আহমদ মুসা। ওভারটেক ওর লক্ষ্য হলে সে লেন চেঞ্জ করতো না এবং গতিও স্লো করতো না।’
বলে মুহূর্তকাল থেমে আবার বলল সারা জেফারসন, ‘কিন্তু ফলো যদি করে, কোত্থেকে করল। আমরা একসিডেন্টের ওখানে অনেকক্ষণ ছিলাম। সে সময় নিশ্চয় ওরা সেখানে ছিল না। ওরা তো সেখানেই কিছু করার চেষ্টা করতে পারতো।’
‘আমার মনে হয় ওরা বাড়ি থেকে আপনাকে ফলো করেনি। মনে হচ্ছে, ওরা খবর পেয়েছে কে একজন শার্লট ভিলে নেমে মন্টিসেলো যাচ্ছে। আরও বোধ হয় খবর পেয়েছে লোকটি মন্টিসেলো যাবার পথে একসিডেন্ট সাইট তদন্ত করেছে এবং একটি ডকুমেন্ট সেখান থেকে তুলে নিয়েছে। আরও খবর পেয়ে থাকতে পারে যে, মিস জেফারসন তাকে এগিয়ে নিতে এসেছে। এসব খবর পাওয়ার পর আগন্তুকটি কে সে সম্পর্কে জানা এবং সুযোগ পেলে কিছু করার জন্যেই ওরা এসেছে।’
কথা শেষ করে আহমদ মুসা তার সিটে সোজা হয়ে বসল। বলল, ‘মিস জেফারসন আপনি গাড়িটা ডেড স্টপ করুন। দেখা যাক ওরা কি করে।’
সংগে সংগেই সারা জেফারসন শেষ লেনটিতে নিয়ে গিয়ে গাড়ি দাঁড় করাল।
গাড়ি দাঁড়াতেই আহমদ মুসা বলল, ‘মিস জেফারসন আপনি একটু সাবধানে বসুন। আমি দেখি ইঞ্জিনটার কি হলো।’
আহমদ মুসা নেমে পড়ল গাড়ি থেকে।
‘আপনার পরিকল্পনা আমি বুঝতে পারিনি। কিন্তু সাবধান, ওদের আন্ডারইস্টিমেট করবেন না।’ গাড়ির জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে অনুরোধ করল সারা জেফারসন।
ইঞ্জিন সামনে।
আহমদ মুসা কভারটি খুলল।
কভারটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে স্প্রিং-এর উপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেল।
আহমদ মুসা রাস্তার দিকটাকে সামনে রেখে একটু ঝুঁকে বাম হাত দিয়ে ইঞ্জিন পরীক্ষা করছে। আর তার ডান হাতটি তখন কোটের বুকের বোতাম নিয়ে খেলা করছে। হাতের তিন ইঞ্জি ব্যবধানে ঝুলছে তার মেশিন রিভলবার।
বিশ সেকেন্ডও পার হলো না।
পেছনের গাড়িটা আহমদ মুসাদের সমান্তরালে চলে এল।
কিন্তু সমান্তরালে আসার আগেই গাড়িটার গতি স্লো হয়ে গিয়েছিল।
ভ্রু কুঞ্চিত হয়েছিল আহমদ মুসার। ওরা তাহলে গাড়ি দাঁড় করাচ্ছে না? তারা দেখেই চলে যাবে? এমন প্লিজার ট্রিপে তারা কষ্ট করে এসেছে বলে মনে হয় না, বিশেষ করে তাদের প্রথম উদ্যোগ ব্যর্থ হবার পর। তাহলে?
সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছিল আহমদ মুসা।
ঠিক এসময় সারা জেফারসনের কথা সে শুনতে পেয়েছিল, ‘বি কিয়ারফুল মি. আহমদ মুসা। ওরা…….।’
কথা শেষ করেনি সারা জেফারসন। সাথে সাথে একটা গুলীর শব্দ শুনল আহমদ মুসা। গুলী ছুড়ছে সারা জেফারসন।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়িয়েই দেখতে পেয়েছিল এগিয়ে আসা গাড়ির দুজানালা দিয়ে হ্যান্ড রকেট লাঞ্চারের দুটি অগ্রভাগ বেরিয়ে আসছে।
বুঝেছিল আহমদ মুসা কি ঘটতে যাচ্ছে।
আহমদ মুসার ডান হাত আগেই চলে গিয়েছিল মেশিন রিভলবারের বাঁটে।
ট্রিগারে আঙুল রেখেই বের করে নিয়ে এসেছিল সে রিভলবার।
দুই রকেট লাঞ্চারের ‘ফায়ার টিপ’ জানালা দিয়ে বের হয়ে আসছে, এ দৃশ্য দেখার সংগে সংগেই আহমদ মুসা ফায়ার করল প্রথমে সামনের দুই সিট লক্ষ করে। রিভলবারের নল আর নড়াতে হয়নি আহমদ মুসার। গাড়ি সামনে এগিয়ে আসায় মেশিন রিভলবারের অবিরাম গুলী বৃষ্টি গিয়ে ঘিরে ফেলেছে পেছনের সিটের দুজনকেও।
প্রথম গুলী আহমদ মুসা ও সারা জেফারসন এক সাথেই করেছিল।
রকেট লাঞ্চারের শর্ট ডিস্ট্যান্স এ্যাডজাস্ট করতে গিয়ে সে দেরীটা তাদের হয়েছিল, তা আহমদ মুসাদের পক্ষে এসে গিয়েছিল। আহমদ মুসা ও সারা জেফারসনের প্রথম দুটি গুলী প্রথমেই দুই রকেট লাঞ্চারধারীকে আহত করেছিল।
ও গাড়ির রকেট লাঞ্চারধারী আহমদ মুসাদের গাড়ি খারাপ হওয়াও ইঞ্জিন পরীক্ষা করার মহড়াকে সম্ভবত সত্য মনে করেছিল এবং মনে করেছিল তাদেরকে আহমদ মুসারা মোটেই সন্দেহ করেনি। এই ভুলই তাদের জন্যে কাল হয়ে দেখা দিল।
আহমদ মুসা রিভলবারের ট্রিগার থেকে হাত সরিয়েই ইঞ্জিনের উপর ঢাকনা সেট করে ছুটল ঐ গাড়ির দিকে। দেখল গাড়িতে নিহত চারজনই মুখ্যত সেমিটিক চেহারার মানুষ।
আহমদ মুসা গাড়ির কোন কিছুতে হাত না দিয়ে সামনের সিটের নিহত একজনের শার্টের কলার ব্যান্ড উল্টিয়ে দেখল কলার ব্যান্ডের একটা সাদা বোতামে ছয় তারা আঁকা। অর্থাৎ এরা সবাই জেনারেল শ্যারনের বাহিনী।
বিস্মিত হলো আহমদ মুসা। জেনারেল শ্যারন সারা জেফারসনের এতটা বৈরী, তাকে হত্যার জন্যে এতটা মরিয়া হয়ে উঠেছে কেন? তাহলে সারা জেফারসনের আসল পরিচয় ওরা জেনে ফেলেছে?
ফিরে এল আহমদ মুসা গাড়িতে।
‘কি দেখলেন মি. আহমদ মুসা?’ জিজ্ঞেস করল সারা জেফারসন। তার চোখে-মুখে উদ্বেগ।
‘ওদের পরিচয়ের সন্ধ্যানে গিয়েছিলাম। দেখলাম অনুমান ঠিক। ওরা জেনারেল শ্যারনের লোক। ওদের শার্টের কলার ব্যান্ডে দেখলাম সেই ছয় তারকার বোতাম।’ আহমদ মুসা বলল।
আহমদ মুসা থামতেই সারা জেফারসন বলে উঠল, ‘পুলিশের ইনফরম করা দরকার।’
‘অবশ্যই উচিত, কিন্তু মেশিন রিভলবারের গুলীর কি ব্যাখ্যা দেবেন?’
‘ওঠা ঠিক আছে। আমি যে মেশিন রিভলবার আপনাকে দিয়েছি, ওটা আমার নামেই লাইসেন্স করা।’ বলল সারা জেফারসন।
‘তাহলে ঠিক আছে। ধন্যবাদ আপনাকে।’
‘ওয়েলকাম’ বলে হাসল সারা জেফারসন। তারপর মোবাইল তুলে নিয়ে টেলিফোন করল পুলিশকে। গোটা ঘটনা পুলিশকে। গোটা ঘটনা পুলিশকে জানাল। অবশেষে বলল, ‘সেদিনের একসিডেন্টটা কিন্তু আমি এখন কোন শত্রুর অন্তর্ঘাতি কাজ বলে মনে করছি।’
পুলিশ এসে গাড়িটার দায়িত্ব নিলে আনুসাঙ্গিক ফর্মালিটি শেষ করে সারা জেফারসন আবার যাত্রা করল।
আহমদ মুসাকে পুলিশের কাছে তার বন্ধু বলে পরিচয় দিয়েছিল সারা জেফারসন। আহমদ মুসার গোঁফ তার চেহারায় অনেক পরিবর্তন এনেছিল।
পুলিশ প্রশংসা করেছিল সারা জেফারসন ও তার বন্ধুর। বলেছিল তারা সাহসের সাথে তাৎক্ষণিকভাবে পাল্টা আক্রমণে না গেলে সাংঘাতিক ঘটনা ঘটে যেত। পুলিশের ভারপ্রাপ্ত অফিসারটি সারা জেফারসনকে অভয় দিয়ে বলেছিল, ‘আমরা বুঝতে পারছি লস আলামোস নিয়ে যা ঘটেছে, তারই একটা প্রতিক্রিয়া হয়তো আপনার উপর এসেছে। আপনি ভাববেন না, আপনার বাড়ির আশে-পাশে পুলিশ থাকবে, যে কয়দিন আপনি মন্টিসেলোতে থাকবেন। আর আপনিও একটু সাবধানে থাকবেন।’
আবার গাড়ি ছুটে চলছিল, মন্টিসেলোর দিকে।
গাড়ি ড্রাইভ করছে সারা জেফারসনই।
তার দৃষ্টি সামনে পথের উপর নিবদ্ধ। বলল এক সময় সামনে চোখ রেখেই, ‘আমি বিস্মিত মি. আহমদ মুসা, একজন মানুষও একটা গাড়ির বিরুদ্ধে তারা রকেট লাঞ্চার নিয়ে এসেছে?’
‘দূর কিংবা কাছে যে কোন জায়গা থেকে ব্যবহারের ক্ষেত্রে রকেট লাঞ্চার একটা ভালো অস্ত্র। ওরা ব্যর্থ হতে চায়নি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আগের আক্রমণও তাহলে জেনারেল শ্যারনদেরই ছিল?’ সামনে চোখ নিবদ্ধ রেখেই বলল সারা জেফারসন।
‘আমার তাই মনে হয়।’ আহমদ মুসা বলল।
‘প্রত্যেক আক্রমণের পেছনে একটা পরিকল্পনা লাগে। ওরা সেই সময় আজ পেল কখন?’ জিজ্ঞেস করল সারা জেফারসন।
‘প্রথম আক্রমণ ব্যর্থ হবার পর পরবর্তী আক্রমণের জন্যে তারা ওৎ পেতেই বসেছিল। কোথাও বেরুলে আপনি গাড়ি নিয়ে বেরুবেন, এটা জানাই ছিল ওদের। সুতরাং কি প্রস্তুতি নিতে হবে সেটা আগে থেকে তাদের ঠিক করা ছিল।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ওরা হঠাৎ এমন মরিয়া হয়ে উঠল কেন?’ সারা জেফারসন বলল।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘জেনারেল শ্যারন আমার খুব খারাপ শত্রু। কিন্তু একটা বিষয়ে তার প্রশংসা করি, সময়ের কাজ সময়ে করতে সে একটুও দেরী করে না।’
সংগে সংগেই সারা জেফারসন মুখ ফিরাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘অর্থাৎ এই সময়ের সবচেয়ে বড় টার্গেট আমি!’ সারা জেফারসনের ঠোঁটে হাসি।
‘তাই তো মনে হচ্ছে?’ আহমদ মুসা বলল।
‘মনে হওয়ার কারণ?’ জিজ্ঞেস করল সারা জেফারসন। তার ঠোঁটে আগের সেই হাসিই।
‘যাকে প্রশ্ন করা হয়েছে তার চেয়ে প্রশ্নকারীই ভাল জানেন এর জবাব।’ বলল আহমদ মুসা।
তড়িত মুখ ঘুরিয়েছিল সারা জেফারসন কিছু বলার জন্যে। কিন্তু তার মোবাইলে কল এল এ সময়।
কথা তার বলা হলো না। সে মোবাইল তুলে নিল হাতে।
টেলিফোনে কথা শেষ করে সারা জেফারসন সামনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমরা এসে গেছি মি. আহমদ মুসা। ঐ দেখুন পাহাড়টার মাথায় মন্টিসেলো।
তাকাল আহমদ মুসা।
পাহাড়টা খুব উুঁচু নয়। সাধারণ ওয়াকিং সীমার মধ্যেই।
পাহাড়ের গা সবুজ গাছ ও ছোট ছোট আগাছায় ঢাকা। মন্টিসেলো পাহাড়ের শীর্ষে। বাড়ির তিন দিক জুড়ে বাগান। আর সামনে একটা সুন্দর ছোট লেক।
পাহাড়ের সবুজ গা বেয়ে উঠতে লাগল গাড়ি।
আহমদ মুসার চোখ দুটি নিবদ্ধ আমেরিকার তৃর্তীয় প্রেসিডেন্ট টমাস জেফারসনের অতি আদরের মন্টিসেলোর প্রতি।

‘সারা’র কথা কি বলব বেটা, ও তার গ্রান্ড ফাদার টমাস জেফারসনের মতই যেমন জনগণত প্রাণ, তেমনি ঐতিহ্যবাদী এবং তেমনি আপোষহীনও। এই মন্টিসেলোর কথাই ধর। সারা বলল, তার মহান পূর্ব পুরুষ টমাস জেফারসনের প্রিয় মন্টিসেলো যে কোন মূল্যে সে ফেরত নেবে। সে নিয়েই ছেড়েছে। এর জন্যে ‘পিডমন্ট’ ও ‘স্যাডওয়েল’ এলাকার মূল্যবান সম্পত্তির অধিকাংশই তাকে বিক্রি করতে হয়েছে। পরিবারের কেউই তার এ মত সমর্থন করেনি। কিন্তু কারও মতকে সে তোয়াক্কা করেনি। তার এক কথা, পরিবার অতীতে মহান গ্রান্ড দাদুর স্বপ্নের মন্টিসেলোকে রক্ষা করেনি, এটা পরিবারেরই ব্যর্থতা। এ ব্যর্থতার প্রতিবিধান সে করবে। সবকিছুর বিনিময়েই সে তা করেছে।’
বলে থামল জিনা জেফারসন। সারা জেফারসনের মা।
জিনা জেফারসন ও আহমদ মুসা বসে আছে মন্টিসেলোর চত্তরে, সুন্দর লেকটার একেবারে ধার ঘেষে।
মন্টিসেলোর বাড়তি ছাদটা লেকের ধার পর্যন্ত এসেছে।
সারা জেফারসনের মা জিনা জেফারসন একটু থেমেই আবারও তার কথা শুরু করতে যাচ্ছিল, ‘পেছনে থামের আড়াল থেকে বেরিয়ে সারা জেফারসন মায়ের পেছনে এসে দাঁড়াল। দুহাতে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আম্মা এক ঘন্টা ধরে মেহমানকে আমার ব্যাপারে এসব কথাই বলছ বুঝি!’
জিনা জেফারসন কিছু বলার আগেই কথা বলে উঠল আহমদ মুসা। বলল, না মিস জেফারসন আপনার আম্মা আমাকে শুধু জেফারসন পরিবার নয়, শুধু এই সুন্দর ভার্জিনিয়া নয়, গোটা আমেরিকাকেই পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। আমেরিকার এই অন্তরচিত্র আমার জানা ছিল না। আপনার সম্পর্কে না বললে তো এই বলা সম্পূর্ণ হয় না। তাই সেটাও বলেছেন।’ আহমদ মুসার মুখে হাসি।
জিনা জেফারসন দুই হাত দিয়ে তার ঘলায় পেচানো সারা জেফারসনেরই দুই হাত ধরে টেনে সামনে নিয়ে এল। বসাল নিজের কোলে। বলল, ‘তোমার সম্পর্কে আজ কি বলতে পারি বল। আজ আমি খুব আনন্দিত। তোমাকে এমন হাসতে বহুদিন দেখিনি মা।’
তারপর সারা জেফারসনের মা চাইল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘বেটা এই সারাকে দেখে আমিই মাঝে মাঝে হাঁপিয়ে উঠি। তুমি তার প্রথম বন্ধু যাকে সে বসায় নিয়ে এসেছে। তার……….।’
জিনা জেফারসনের কথা বন্ধ হয়ে গেল। সারা জেফারসন তার হাত চাপা দিয়েছে মায়ের মুখে। বলল, ‘এই তো মা তুমি আমার বদনাম করছ। আমার কত বন্ধু আমেরিকা জুড়ে। আমেরিকানরা সবাই আমার বন্ধু।’
জিনা জেফারসন মেয়ের পিঠে আদরের একটা থাবা দিয়ে বলল, ‘যার বন্ধু সবাই, তার কোন বন্ধু নেই, এই উদ্বেগের কথাই তো আমি বলছি।’
‘আমি বুঝছি না আম্মা, কাকে তাহলে তুমি বন্ধু বলছ?’ বলল সারা জেফারসন মায়ের বুক থেকে মুখ তুলে।
‘এই দেখ আহমদ মুসাকে।’ বলল জিনা জেফারসন।
সারা জেফারসন মিষ্টি হাসল। বলল, ‘উনি তো মাত্র বন্ধু নন, বন্ধুর চেয়ে বড়। বন্ধুকে সব বলা যায় না, কিন্তু ওঁকে সব বলা যায় মা।’
জিনা জেফারসনও হাসল। বলল, ‘আসলেই তোমার কোন বন্ধু ছিল না। তাই জান না যে, বন্ধুকে সব বলা যায়।’
‘ঠিক আছে আম্মা। তোমার সব কথাই মানলাম। এবার চলো, টিজে (টমাস জেফারসন) দাদুর স্টাডিতে যাব ওঁকে নিয়ে। তুমিও যাবে।’ বলল সারা জেফারসন।
‘আমি কেন?’
‘একা একা গিয়ে শুয়ে থাকার চেয়ে তোমার ওখানেই ভাল লাগবে।’ সারা জেফারসন বলল।
জিনা জেফারসন ঘড়ির দিকে তাকাল। বলল, ‘রাত এগারটা। ঠিক আছে ওষুধটা খেয়ে নিয়ে একটা কাজ সেরে আসছি। তোমরা যাও।’
বলে জিনা জেফারসন উঠে দাঁড়াল।
উঠে দাঁড়াল সারা জেফারসন এবং আহমদ মুসা।
জিনা জেফারসন হাঁটতে শুরু করে আহমদ মুসার দিকে ফিরে বলল, ‘আসছি বেটা।’
‘ওয়েলকাম।’ বলল আহমদ মুসা।
জিনা জেফারসন এগুলো দুতলার সিঁড়ির দিকে। আর সারা জেফারসন ও আহমদ মুসা এগুলো একতলার জেফারসন স্টাডি রুমের দিকে।
পাশাপাশি হাঁটছিল আহমদ মুসা ও সারা জেফারসন।
‘আম্মাকে আসতে বললাম কেন বলুন তো?’ জিজ্ঞেস করল সারা জেফাসরন। তার মুখে হাসি।
‘কেন?’
‘আপনি স্বাচ্ছন্দ বোধ করবেন তাই। মুসলিম নীতিবোধ অনুসারে কোন নির্জন কক্ষে দম্পতি নয় এমন নারী-পুরুষের একান্ত সাক্ষাত বৈধ নয়।’
‘ধন্যবাদ মিস জেফারসন।
আপনি আমাদেরকে এত জানেন?’
‘শুধু জানি নয় মিস্টার, মানিও যে এটা খুব ভাল একটা নীতিবোধ।’
‘কারণ ইসলামের অনুশাসনগুলো মানব প্রবণতার সাথে সংগতিশীল।’ আহমদ মুসা বলল।
‘সবগুলোই কি?’
‘সবগুলোই?’
‘জানি না, তাই ভেবে দেখারও সুযোগ হয়নি।’
‘জানার জন্য আগ্রহ দরকার।’
‘আপনাকে দেখার পর এ আগ্রহ মনে হচ্ছে দরুণভাবে বাড়ছে।’ মুখে একটা সলজ্জ হাসি ফুটে উঠল সারা জেফারসনের।
কথা শেষ করেই সারা জেফারসন সম্ভবত কথার মোড় অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেবার জন্যেই বলল, ‘মন্টিসেলো আপনার কেমন লাগছে?’
‘নামের মতই সুন্দর।’
‘নাম ভাল লেগেছে আপনার?’
‘অবশ্যই। ‘মন্টিসেলো’ মানে পাহাড়ে সঙ্গীত’। সুন্দর নাম। এই তো চত্তের বসে চারদিক দেখে মনে হচ্ছিল, গ্রেডভ্যালির মাথায় নীল পাহাড়-মেলার কোলে সবুজ-সমুদ্রের জমাট এক মৌনতার মাঝে সফেদ মন্টিসেলো যেন এক প্রশান্তির নাম।’
দাঁড়িয়ে পড়েছে সারা জেফারসন।
সারা জেফারসন দাঁড়িয়ে পড়ায় আহমদ মুসাও দাঁড়িয়েছে।
সারা জেফারসনের মুগ্ধ দুই চোখ আহমদ মুসাকে যেন নতুন করে দেখছে। তার ঠোঁটে মুগ্ন এক হাসি। বলল, ‘আপনি যা বললেন তা কবিতার এক অমর লাইন হতে পারে। ধন্যবাদ আপনাকে। মন্টিসেলোর স্রষ্টা ‘টিজে (T.J) দাদুও মনে হয় মন্টিসেলোকে এভাবে দেখেননি। বিপ্লবী দেখছি কবিও হয়।
‘আমি যা দেখেছি, সবাই তা দেখে। এর জন্যে কবি হবার কি প্রয়োজন আছে। ‘মন্টিসেলো’ নামটাই প্রমান করে সৌন্দর্যের এই পটভূমিই আপনার টিজে দাদুকে আকৃষ্ট করেছিল।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কবি হবার প্রয়োজন আছে। তা না হলে আমাদের এক পুরুষ এই স্বপ্নের মন্টিসেলো বিক্রি করে দিয়েছিল কি করে? তাদের কাছে এর মূল জনবিচ্ছিন্ন এক প্রসাদ ছাড়া আর কিছুই ছিল না।’ সারা জেফারসন বলল।
‘তাহলে যিনি তার সর্বস্ব দিয়ে আবার এটা কিনেছে, তাকে কি বলতে হয় বলুন তো?’ আহমদ মুসা বলল।
সারা জেফারসনের মুখ রাঙা হয়ে উঠল লজ্জায়।
মাথার হ্যাটটা সে মুখের উপর আর একটু টেনে দিয়ে বলল ‘চলুন।’
সারা জেফারসনের পরনে হালকা নীল রঙের ফুল স্কার্ট, সাদা ফুল সার্ট, গলায় একটা সাদা স্কার্ফ পেচানো এবং মাথায় সাদা হ্যাট।
সারা জেফারসন চলতে শুরু করেছে।
আহমদ মুসাও।
টিজে মানে টমাস জেফারসনের বিশাল স্টাডি কক্ষটা গ্রাউন্ড ফ্লোরের শেষ প্রান্তে, দক্ষিণ পশ্চিম কোণায়।
স্টাডি রুমের দরজা কাঠের কারুকাজ করা।
দরজার ঠিক উপরে দরজার প্রস্থের সমান একটা সাইনবোর্ড। সাইনবোর্ডটা সুন্দর নীল। তার উপর সাদা অক্ষরে লেখাঃ ‘নিপীড়কের প্রতিরোধ করা হলো ঈশ্বরের আনুগত্য। ঈশ্বরের শপথ, মানব মনের উপর সকল পীড়নের বিরুদ্ধে আমার চিরন্তন সংগ্রাম’
কোটেশনটির নিচে দরখাস্ত আকারে ‘টমাস জেফারসন’-এর নাম লিখা।
নিচে টমাস জেফারসনের নাম পড়ার আগেই আহমদ মুসা বুঝেছিল এটা টমাস জেফারসনের বিখ্যাত একটা উক্তি। কিন্তু আহমদ মুসার কাছে প্রথম বাক্যটা পরিচিত নয়, দ্বিতীয় বাক্যটা খুবই পরিচিত, সকলেই জানে।
আহমদ মুসা পাশেই সারা জেফারসনের দিকে তাকাল। বলল, ‘প্রথম বাক্যটা আমার কাছে অপরিচিত। কোথায় তিনি বলেছিলেন কথাটা?
বাক্যটা পাওয়া গেছে তার অপ্রকাশিত একটা নোটে। পরে এটা তার ‘লেখা ও বক্তিতাগুলি’র কোন এক অডিশনে শামিল হয়েছে।’ বলল সারা জেফারসন।
‘মিস জেফারসন, আপনার টিজে দাদুর একথাগুলো পড়ে আমার কি মনে হচ্ছে জানেন? মনে হচ্ছে, ‘আমাদের ধর্মের মৌল কথাগুলোর দুটি আপনার টিজে দাদুর কথায় নতুন ভাষা পেয়েছে।’ আহমদ মুসা বলল।
সে দুটি কথা কি?
‘ইসলামে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসকে যতখানি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, ততখানিই গুরুত্ব দেয়া হয়েছে ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের প্রতিরোধ করার কাজকে। ইসলামের সর্বশ্রেষ্ঠগ্রন্থ আল-কোরআন বলেছে, ‘মানুষকে ন্যায়ের আদেশ দাও, অন্যায় থেকে বিরত রাখ এবং আল্লাহকে বিশ্বাস কর।’
‘চমৎকার। টিজে দাদুর প্রথম বাক্য বরং দায়িত্বের অর্ধেক বলা হয়েছে, কিন্তু এখানে পুরো দায়িত্বের কথা বলা হয়েছে। নিপীড়কদের প্রতিরোধের সাথে সাথে ন্যায়কাজের নির্দেশ দেয়ার বিষয়ও আছে। এতো গেল একটা কথা, অন্য কথাটা কি?’
‘ইসলাম প্রতিটি মানুষের সার্বভৌম স্বাধীনতা ও সম্মান নিশ্চিত করেছে। ইসলাম বলে, মানুষ শুধু আল্লাহর অধীন হবে আর কারও নয়। এর মাধ্যমে ইসলাম মানুষের উপর মানুষের শারীরিক ও মানসিক সকল পীড়নকে নিষিদ্ধ করেছে। শুধু তাই নয়, মানুষকে তার নিজের উপর জুলুম করার অধিকারও দেয়া হয়নি।’
‘চমৎকার। কিন্তু মানুষ শুধু আল্লাহর অধীন হলেই কিভাবে মানুষের উপর মানুষের জুলুম বন্ধ হয়ে যায়?’
‘সকল মানুষ এক আল্লাহর অধীন হয়ে যাওয়া মানে সকল মানুষ সমান হওয়া। জুলুম যেখানে থাকে, সেখানে এই সমান মর্যাদার অনুভূতি থাকে না। অর্থ্যাৎ সকলে সমান মর্যাদার হলে জুলুমের সুযোগ থাকে না। নাম্বার ওয়ান। নাম্বার টু হলো, সকলে এক আল্লাহর অধীন হওয়ার অর্থ সকল মানুষ এক আল্লাহর আইনের অধীন হয়ে পড়া এখানে মানুষের আইন মানুষকে রুল করে না। তাই স্বেচ্ছাচারিতার কোন অবকাশ থাকে না। স্বেচ্ছাচারিতা বন্ধ হলে মানুষের উপর মানুষের জুলুমও বন্ধ হয়ে যায়।’
থামল আহমদ মুসা।
ভাবছির সারা জেফারসন। একটু সময় নিয়ে বলল, ‘মানুষের আইন মানুষকে রুল করবে না, কথাটা কি ইউটোপিয়ান হয়ে গেল না। বাস্তবতা হলো, মানুষ মানুষকে রুল করবেই, মানুষের আইন মানুষকে রুল করেই।’
হাসল আহমদ মুস। বলল, ‘আপনার কথা ঠিক মিস জেফারসন। কিন্তু রুলকারী মানুষ যদি আল্লাহর অধীন হয়, রুলকারী মানুষের আইন যদি আল্লাহর আইনের অধীন হয়, তাহলে মানুষের ‘রুল প্রকৃত অর্থে তখন মানুষের ‘রুল’ থাকে না এবং মানুষের আইনও তখন প্রকৃতপক্ষে মানুষের আইন থাকে না।’
হাসল সারা জেফারসনও। বলল, ‘এটাই কি তাহলে ‘রুল অব গড’?
‘হ্যাঁ, মিস জেফারসন। মানুষসহ এই ইউনিভার্সের প্রকৃত রুলার আল্লাহ। মানুষ তাঁর প্রতিনিধি। আমাদের কোরআনের ভাষায় ‘খলিফা’। একজন প্রতিনিধি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রতিনিধিদের উপর শাসন পরিচালনা করেন। এটাই আল্লাহর শাসন বান ‘রুল অব গড’।
সারা জেফারসনের চোখে মুগ্ধ দুষ্টি, তার ঠোঁটে মুগ্ধ হাসি। বলল, ‘অনেক ধন্যবাদ আহমদ মুসা। একটা কঠিন জিনিসকে পানির মত সহজ করে দিয়েছেন আমার কাছে। বিশ্বাস করুন, পৃথিবী এবং পৃথিবীর মানুষ এখন এক নতুন অর্থ নিয়ে আমার সামনে আসছে।’
‘স্বাভাবিক মিস জেফারসন। কারণ আপনি আল্লাহর শ্রেষ্ঠ বান্দাহদের একজন।’
সারা জেফারসন তখন চলতে শুরু করেছে। দরজা খুলতে খুলতে বলল, তাই কি?’
সারা জেফারসন প্রবেশ করেছে স্টাডিতে।
আহমদ মুসাও প্রবেশ করল। বলল, ‘তাই মিস জেফারসন। ন্যাচারাল লিডারশীপ সব সময় শ্রেষ্ঠ বান্দাদের কাঁধে গিয়েই অর্পিত হয়।’
ঘরের মাঝখানে রাউন্ড টেবিলটার কাছে পৌছেছিল সারা জেফারসন।
টেবিল ঘিরে তিনটি চেয়ার। এ চেয়ারগুলো আধুনিক ডিজাইনের এবং ঘরের কারুকাজপূর্ণ পরিবেশের সাথে একেবারেই বেমানান। আহমদ মুসা বুঝল, চেয়ারগুলো ঘরের অংশ নয়। ঘরের বাইরে থেকে সদ্য আমদানি। ঘরের একপাশে একটা বেদীর উপর আরেকটা বড় চেয়ার সুদৃশ্য কারুকাজ করা। খুবই যত্ন করে রাখা। আহমদ মুসার বুঝতে বাকি রইল না যে একটা টমাস জেফারসনের স্টাডি চেয়ার।
স্টাডি রুমের বুক শেলফগুলো, শতব্দীর পুরানো সুদৃশ্য আলমারি, ইত্যাদি সব জিনিস ঘুরে আহমদ মুসার দৃষ্টি এসে নিবদ্ধ হলো অবশেষে সারা জেফারসনের দিকে।
সারা জেফারসন ঘুরে দাঁড়িয়েছে আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসাকে বসতে বলে সে নিজেও একটা চেয়ারে বসল। বসল আহমদ মুসাও।
সারা জেফারসনের সামনে সুদৃশ্য একটি চামড়ার ফাইল।
সারা জেফারসনের দুটি হাত ফাইলের উপর। তার চোখে আহমদ মুসার উপর নিবদ্ধ। চোখে প্রশ্ন জ্বলজ্বল করছে।
আহমদ মুসা বসতেই সারা জেফারসন বলল, ‘আপনার শেষ বাক্যটা বুঝলাম না মি. আহমদ মুসা। ‘মুখে হাসি সারা জেফারসনের।
‘নিশ্চয় জানেন এর অর্থ আপনি।’ বলল আহমদ মুসা। আহমদ মুসার ঠোঁটেও হাসি।
সারা জেফারসন পরিপূর্ণভাবে আহমদ মুসার দিকে তাকাল। হাসল সে। বলল, ‘এ নিয়ে তিনবার আপনি কোনা বিশেষ পরিচয়ের দিকে ইংগিত করেছেন। বলুন তো সেটা কি?’
‘এসব বিষয় থাক। আমি আমার কথা প্রত্যাহার করলাম। এখন আপনার কথা বলুন।’
গম্ভীর হলো সারা জেফারসন। বলল, ‘আমার ক্ষুদ্র একটা পরিচয় আছে। আহমদ মুসার কাছে তা গোপন থাকেবে এবং গোপন থাকা উচিত, তা আমি মনে করি না। আমি দুঃখিত যে, বিষয়টা আমি নিজের থেকে আপনাকে বলিনি। প্রকৃতপক্ষে বলার সুযোগও পাইনি।
গম্ভীর হলো আহমদ মুসাও। বলল, ‘মিস জেফারসন, আপনি ‘ফ্রি আমেরিক’ (ফেম) মুভমেন্টের চেয়ারম্যান, এটা ছোট পরিচয় নয়। আমিও দুঃখিত মিস জেফারসন, বিষয়টি আমার সরাসরি আপনার কাছে না জেনে বারবার সে দিকে ইংগিত করা শোভন হয়নি। ’
‘না জনাব, আপনার ইংগিত যথার্থই হয়েছে। এ ধরনের ক্ষেত্রে এটাই স্বাভাবিক। আমি হলেও এটাই করতাম। আমার পরিচয়টা এতটা গোপন করে আসা অনেকটা অবিশ্বস্ততার পরিচায়ক হয়েছে। আমি লজ্জিত জনাব।’
কথা শেষ করে মুহূর্তের জন্যে থেমেই আবার বলে উঠল, ‘আসলে কি জানেন, আমি ভেবেছিলাম যেদিন আমার স্বপ্ন সফল হবে, সেদিন আপনি সব জানবেন। শুধু জানবেন না, জানার অধিকার আপনার উপরই বর্তে যাবে। স্বপ্নটাকে আমি মনে করি ঈশ্বরের বিধিলিপি।’
সারা জেফারসনের গম্ভীর কন্ঠ ধীরে ধীরে ভারী হয়ে উঠল। তারপর তার ভারী কন্ঠ কক্ষের পরিবেশকেই ভারী করে তুলল।
আহমদ মুসা কি বলবে সেই মুহূর্তে খুঁজে পেল না।
কথা বলতে বলতে সারা জেফারসনের মুখ নিচু হয়ে গিয়েছিল। মুখে নিচু রেখেই সে বলতে শুরু করল, ‘মি. আহমদ মুসা, আমাদের প্রিয় আমেরিকা, আমাদের পিতামহদের প্রিয় আমেরিকায় সবই আছে, কিন্তু আমাদের গণতন্ত্রটা ব্যয়বহুল হয়ে পড়ায় ইহুদীদের ইহুদীবাদী ষড়যন্ত্রকারী শ্রেণীটি এর সুযোগ গ্রহণ করেছে। আমাদের ফাউন্ডার ফাদাররা স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি তাদের প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্র কিনে ফেলা যাবে বা কিনে ফেলা হবে। কিন্তু সেই অভাবনীয় ঘটনাই ঘটছে এখন। আমাদের গণতন্ত্র বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হচ্ছে। উন্নয়…………
কথা গলায় আটকে গেল সারা জেফারসনের। ‘স্যরি’ বলে সে থেমে গেল।
খুব নরম কন্ঠে কথা বলছিল সারা জেফারসন। তার ভারী হয়ে ওঠা কন্ঠ অবশেষে আবেগে রুদ্ধ হয়ে গেল।
‘মাফ করবেন আহমদ মুসা। এই আলোচনা আমাকে খুবই ইমোশনাল করে তোলে।’ আবার বলতে শুরু করল সারা জেফারসন, ‘যা বলছিলাম, উন্নয়নশীল দেশে স্বার্থান্ধ মহাজনরা যেমন দরিদ্র কৃষকদেরকে তাদের ক্ষেতের ফসলের উপর দাদন দেয় এবং ফসল উঠলে পানির দরে সিংহভাগ ফসল নিয়ে নেয়, তেমনি আমাদের দেশে ইহুদীবাদীরা নির্বাচন সুফল কিনে ফেলে। যা তারা দাদন দেয় তার সহস্রগুন সুবিধা তারা আদায় করে নেয়। ব্যয়বহুল গণতন্ত্রের এই রন্ধ্র পথে সিন্দাবাদের ভূতের মত ইহুদীবাদীরা আমাদের ঘাড়ে চেপে বসেছে। তাদের স্বার্থে বাহন হয়ে পড়েছে আমাদের প্রিয় আমেরিকা।
থামল সারা জেফারসন। আবার আবেগ রুদ্ধ হয়ে গেল তার গলা।
‘আপনার অনুভূতি আমিও শেয়ার করি মিস জেফারসন। আমিও কিছু কিছু জানি।’ বলল আহমদ মুসা।
একটু থেমে গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে সারা জেফারসন বলল, ‘আরও জানুন মি.আহমদ মুসা। আমাদের ক্ষতি বিশ্বের বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর ক্ষতি ডেকে আনছে। আমাদের গণতন্ত্রকে পণবন্দী করে ওরা একে বাহন সাজিয়ে উন্নয়নশীল দেশের গণতন্ত্র, অর্থনীতিক সব কিছুকেই কুক্ষিগত করতে চাচ্ছে। এর শেষ পরিণতি কোথায় আমি জানি না, কিন্তু সকলের সব রোষের শিকার হবে মার্কিনীরা, একথা দিবালোকের মত সত্য। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত মার্কিন স্বার্থ, মার্কিনীরা, ক্ষতিগ্রস্ত হবে দুনিয়ার আর সবাই, সবদেশ। কিন্তু নাটের গুরু ইহুদীবাদীরা থাকবে অক্ষত। এ রকম নতুন একটা বিশ্বব্যবস্থা তারা চাচ্ছে। সব দুঃখ, সব বেদনা এবং সব হতাশার কেন্দ্র বিন্দু এটাই। এই বোধ থেকেই সৃষ্টি হয়েছে, ‘ফ্রি আমেরিকা’ মুভমেন্ট। আমাদের প্রিয় আমেরিকাকে বাঁচাতে হলে এই ভয়াল ষড়যন্ত্রের হাত থেকে তাকে রক্ষা করতে হবে। এই কাজেই আমরা নেমেছি। আমরা আপনার সাহায্য চাই আহমদ মুসা।’
থামল সার জেফারসন।
মুখ নিচু করে শুনছিল আহমদ মুসা সারা জেফারসনের কথা। মুগ্ধ-বিস্মিত হচ্ছিল আহমদ মুসা সারা জেফারসনের পরিস্থিতি বিশ্লেষণ দেখে। আহমদ মুসা আরও খুশি হলো এটা বুঝে যে, তারা বাইরে থেকে যে আমেরিকাকে দেখে তার ভেতরে আর এক আমেরিকা আছে। যেখানে আছে নিশ্চয় হাজারো সারা জেফারসন কিংবা হাজারো বেঞ্জামিন বেকন। কিন্তু সারা জেফারসন যে সাহায্যের আহবান জানাচ্ছে তার উত্তরে কি বলবে সে! বলল আহমদ মুসা, ‘আমি এক ব্যক্তিমাত্র আমেরিকায় এসেছি ঘটনাচক্রে। আর আপনার মিশন একটা ‘মহামিশন’।’
ধন্যবাদ আপনার বিনয়ের জন্যে। আপনি ইতিমধ্যেই যা করেছেন, তাতে মূল কাজটা হয়ে গেছে। এখন দরকার একে সম্পূর্ণ রূপ দেয়া যাতে ওরা আমেরিকানদের কাছে মুখ দেখবার যোগ্য না থাকে। এর পরের কাজটা কঠিন হবে না।’
‘পরের কাজটা কি?’
‘এর পরের কাজ হলো আমাদের ফাউন্ডার ফাদারদের আমেরিকা গঠন ও বিশ্ব-ব্যবস্থার স্বপ্ন সফল করা।’ বলল সারা জেফারসন।
বলেই সারা জেফারসন তার সামনের চামড়ার সুদৃশ্য ফাইলটা খুলল। বের করল লম্বা কয়েক প্রস্ত কাগজ। এক গুচ্ছ কাগজ দেখিয়ে বলল, এটা টিজে দাদুর নিজ হাতের লেখা ডিক্লারেশন অব ইন্ডিপেনডেন্স এর প্রথম খসড়া। এই খসড়ায় টিজে দাদু কতকগুলো বিষয়কে বোল্ড টাইপে (মোটা অক্ষরে) লিখেছেন। তার মানে এই বিষয়গুলোকে আমাদের আমেরিকান জিবনের জন্যে তিনি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছেন। যে বিষয়গুলোকে টিজে দাদু বোল্ড টাইপে লিখেছেন, তাকে মৌল তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন, (ক) জাতিসমূহের স্বধীনতার সত্যিকার দাবী প্রাকৃতিক বিধি ও ঐশ্বরিক বিধান কর্তৃক স্বীকৃত (Laws of Nature and Nature’s of good entitle) অধিকার, (খ) স্রষ্টা মানুষকে সমান করে সৃষ্টি করেছেন এবং স্রষ্টা তাদের প্রত্যেকের জন্যে জীবন, স্বাধীনতা, সুখের সন্ধান, প্রভৃতিকে অবিচ্ছেদ্য অধিকারে পরিণত করেছেন, যা থেকে তাদের বিচ্ছিন্ন করা যাবে না। সরকার আসলে স্রষ্টা প্রদত্ত এ অধিকার সংরক্ষণের জন্যেই, এবং (গ) জাতিসমূহ স্বাধীকার বা শাসনদন্ড পাওয়ার সাথে ঐশ্বরিক অর্থরিটির অধীনে এর আশ্রয় (a firm reliance on the protection of Divine providence) নিশ্চিত করার জন্যে তাদের বিশ্বের সর্বোচ্চ বিচারকের মুখাপেক্ষী (appealing to the supreme Judge of the world) হতে হবে।
থামল সারা জেফারসন। তার ঠোঁটে ফুটে উঠেছে মিষ্টি এক টুকরো হাসি। বলল, ‘মি. আহমদ মুসা, ‘আপনার রুল অব গড. ‘মানুষ আল্লাহর খলিফা হওয়া,’ ‘মানুষের মর্যাদা ও অধিকার সমান হওয়া, ইত্যাদি বিষয়ের সাথে টিজে দাদুর বোল্ড টাইপে লেখা আমাদের ডিক্লারেশন অব ইন্ডিপেনডেন্স’-এর অংশ উপরোক্ত বিষয়গুলো মিলিয়ে নিন। দেখবেন, আপনাদের ধর্মের সর্বশ্রেষ্ঠগ্রন্থ কোরআন দেড় হাজার বছর আগে যা বলেছে, আমাদের ফাউন্ডার ফাদাররা ২শ ২৪ বছর আগে জাতি গঠন ও স্বাধীনতা ঘোষণার এক মহান সন্ধিক্ষণে ভিন্নভাষায় কতকটা সেই কথাই উচ্চরণ করেছেন। অতএব বলতে পারেন, আমাদের দুজনের এই সম্মিলনের মত আমাদের দুজনের মিশনও এক হয়ে যাচ্ছে। প্রায় এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে বড় একটা দম নিল সারা জেফারসন।
গম্ভীর হয়ে উঠেছে তার মুখ।
আহমদ মুসাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আবার বলে উঠল সে ‘মি. আহমদ মুসা, আমাদের ডিক্লারেশন অব ইন্ডিপেনডেন্স’-এর শুধু এই মৌল বিষয়গুলোকেই, যাকে টিজে দাদু বোল্ড টাইপে লিখেছেন, যদি আমরা বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখবো, ইহুদীবাদীদের চক্রান্ত আমাদেরকে আমাদের ফাউন্ডার ফাদারদের দেখানোর পথ থেকে বহুদূরে সরিয়ে নিয়ে গেছে। আমরা আজ অন্যান্য সার্বভৌম জাতির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক অধিকারেই শুধু হস্তক্ষেপ করছি না, নিজ জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারকেও তাদের কাছে আমরা দূর্মল্য করে তুলেছি।
থামল সারা জেফারসন।
‘ধন্যবাদ মিস জেফারসন অনেক মূল্যবান মন্তব্যের জন্যে। আপনাদের ডিক্লারেশন অব ইন্ডিপেনডেন্স’-এর কিছু বিষয়ের যে ইন্টারপ্রিটেশন দিয়েছেন তা সত্যই আমাকে আনন্দিত ও উৎসাহিত করেছে। বিশেষ করে এই ইন্টারপ্রিটেশনটা জেফারসন তনয়ার কাছ থেকে আসায় একে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছি। এখন বলুন মিশন-এর কথা, সমস্যা আমি বুঝেছি।’
হাসল সারা জেফারসন। বলল, জেফারসন তনয়া না বললে কি গুরুত্ব থাকতো না। সত্য কি কোন ব্যক্তি নির্ভর?
‘তা নয় মিস জেফারসন। কিন্তু মতের সাথে মতদানকারীর সম্পর্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যে অভিমত দিলেন তা আপনার পি এস ক্লারা কার্টার দিলে কি একই ওজনের হতো? অবশ্যই হতো না।’
‘ধন্যবাদ মি. আহমদ মুসা। আমার মিশনের কথা জিজ্ঞেস করছিলেন। আমার মিশনের কথা তো বলেছি। যে সিন্দাবাদের ভূত আমাদের আমেরিকানদের ঘাড়ে চেপে বসেসে, তাকে নামাতে হবে। দ্বিতীয়ত, আমাদের গণতন্ত্রকে বিলোনিয়ারের ড্রইংরুম থেকে সাধারণ আমেরিকানের দোর গড়ায় নিয়ে যেতে হবে। এই দুটি জাতীয় লক্ষ্য অর্জিত হবার পর আমাদের তৃতীয় লক্ষ্য হলো, পৃথিবীর জাতিসমূহের সার্বভৌম মর্যাদা ও অধিকার নিশ্চিত করা, যার নিশ্চয়তা দিয়েছে আমাদের ডিক্লারেশন অব ইনডিপেনডেন্স। এই অধিকার নিশ্চিত হবার পর কাজ হবে জাতিসমূহের সমতা ও সহযোগীতাভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলা। সে ব্যবস্থায় জাতিসংঘ হবে সত্যিকার এ্যাসোসিয়েশন অব স্টেটস। এখনকার মত তখন সে তার আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, ইউনেস্কো, ইউনিসেফ, ইত্যাদির মাধ্যমে জাতিসমূতের রাজনীতিন, অর্থনীতি, সংস্কৃতি-সমাজ, ইত্যাদি ধ্বংসের বরকন্দাজ হিসেবে কাজ করবে না।’
থামলো সারা জেফারসন।
আনন্দে মুখ ভরে গেছে আহমদ মুসার। বলে উঠল, আমিন।’
‘শুধু আমিন নয় মিস্টার, বলুন যে কোন অবস্থায় তোমার সাথে আছেন।’ বলে হেসে উঠল সারা জেফারসন।
‘সাথে যখন আছিই, তখন ‘সাথে আছি’ বলার কোন অর্থ হয় না।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ঠিক বলেছেন।’
বলে সারা জেফারসন হঠাৎ নিজের ডান হাত আহমদ মুসার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘আসুন হাতে হাত রেখে কথাটা আর একবার বলি।’
লাউ লতিকার লকলকে ডগার মত অপরূপ কমনীয়, নরম হাত আহমদ মুসার সামনে প্রসারিত।
বিব্রত আহমদ মুসা বলে উঠল, ‘স্যরি মিস জেফারসন।’
সারা জেফারসন লজ্জায় চুপসে গিয়ে দ্রুত হাতটা টেনে নিয়ে বলল, ‘স্যরি মি. আহমদ মুসা। ভুলেই গিয়েছিলাম আপনার মুসলিম কালচারের কথা।’
আহমদ মুসা কিছু বলতে যাচ্ছিল।
এ সময সশব্দে দরজা ঠেলে ঘরে প্রবেশ করল সারা জেফারসনের মা জিনা জেফারসন।
তার চোখে-মুখে উদ্বেগ। তিনি হাঁপাচ্ছিলেন।
বলল সে, ‘বেটা আহমদ মুসা, বাইরে কিছু ঘটেছে। আমি দুতালা থেকে নামছিলাম। দেখলাম রেড টাইগার (শিকারী কুকুর) পাগলের মত ছুটে বাইরে বেরিয়ে গেল। আমি নেমে এসে দাঁড়ালাম। বেশ সময় পার হয়ে গেল। টাইগার একবার মাত্র গর্জন করে উঠেছিল। তারপর সব নিরব। টাইগার ফিরে এল না। ব্যাপার কি দেখার জন্য শেলটনকে পাঠালাম। সেও ফিরে আসেনি। গেটের দিকে মনে হলো একটা আর্ত চিৎকার শোনা গেল।’
জিনা জেফারসনের কথা শেষ হতেই আহমদ মুসা তার চেয়ার থেকে স্প্রিং-এর মত উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘মিস জেফারসন আপনি আপনার মাকে নিয়ে উপরে যান, আমার মনে হচ্ছে………..’।
আহমদ মুসার কথা শেষ হতে পারল না, কক্ষের বাইরে অনেকগুলো পায়ের শব্দ কানে এল।
মুখের কথা বন্ধ করে আহমদ মুসা তার বুকের পাশে ঝুলে থাকা মেশিন রিভলবারাটা বের করে আনল ডান হাত দিয়ে।
কিন্তু ওরা ততক্ষনে দরজায় এসে পড়েছে ঝড়ের বেগে।
ওরা তিনজন। দুজনের হাতে রিভলবার এবং একজনের হাতে স্টেনগান। ব্যারেলগুলো উদ্যত।
‘মিস জেফারসন আপনারা শুয়ে পড়ন’ বলে চিৎকার করে উঠেই আহমদ মুসা দুহাতে মেশিন রিভলবার ওদের দিকে তাক করে ট্রিগার চেপে রেখে ঝাঁপিয়ে পড়ল মেঝের উপর।
আহমদ মুসাকে দাঁড়ানো এবং তার হাতে রিভলবার দেখে তিনজনের গান-ব্যারেল এক সাথেই তাক করেছিল আহমদ মুসাকে।
উভয় পক্ষের গুলী এক সাথেই হয়েছিল। আহমদ মুসা ঝাঁপিয়ে পড়তে সেকেন্ড পরিমাণ দেরী করলে তার দেহ ঝাঁঝরা হয়ে যেত।
গুলী বর্ষণরত মেশিন রিভলবারের ট্রিগারে চেপে থাকায় আহমদ মুসার হাত দেহ থেকে উঁচুতে ছিল। ওদের একটা গুলী এসে আঘাত করল আহমদ মুসার বাম কব্জীর উপরের পাশটায়।
তার আহত বাম হাতটা ছিটকে গিয়েছিল রিভলবারের বাট থেকে।
তবে এক হাত আহত হওয়ার বিনিময়ে আহমদ মুসা ওদের তিনটি লাশ পেয়ে গেল।
লাশ তিনটি ছিটকে পেড়েছিল দরজার উপরে।
আহমদ মুসা মেঝের উপর ছিটকে উপর ছিটকে পড়ে দ্রুত দরজার দিকে গড়িয়ে গিয়ে উঠে দাঁড়াল।
সারা জেফারসন ও তার মা জিনা জেফারসন চেয়ারে বসা অবস্থা থেকে গড়িয়ে পড়েছিল টেবিলের নিচে।
উঠে দাঁড়িয়েই আহমদ মুসা বলল, ‘মিস জেফারসন আপনারা ঠিক আছেন?
‘জি হ্যাঁ।’ মেঝের উপর উঠে বসতে বসতে বলল সারা জেফারসন।
‘আপনার কাছে রিভলবার আছে?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘জি, না।’ বলল সারা জেফারসন।
আহমদ মুসা দ্রুত দরজার উপর পড়ে থাকা ওদের দুটি রিভলবার কুড়িয়ে নিয়ে সারা জেফারসনের দিকে ছুড়ে দিয়ে বলল, আপনারা এ ঘরেই থাকুন। দরজা রক্ষা করা আপনার দায়িত্ব। দরজায় কাউকে দেখলেই গুলী করবেন।
বলে আহমদ মুসা বেরিয়ে যাচ্ছিল।
সারা জেফারসনের আর্তকন্ঠ পেছন থেকে ধ্বণিত হলো, ‘আপনি তো আহত মি. আহমদ মুসা।’
কথাগুলো আহমদ মুসার কানে গেল। কিন্তু জবাব দেবার সময় ছিল না। ততক্ষণে সে দরজার বাইরে পৌছে গেছে।
কিন্তু দরজার বাইরে পৌছে দেখল, বিভিন্ন দিক থেকে সাত আটজন ছুটে আসছে এদিকে।
সম্ভবত গুলীর শব্দ পেয়েই ওরা ছুটে আসছে। দরজার বাইরে পড়ে থাকা তাদের সাথীর লাশও তারা দেখতে পেয়েছে।
আহমদ মুসা একদম ওদের গুলীর মুখে। পেছন ফিরে ঘরে যাবার সময় নেই। আশ্রয় নেবারও কোন জায়গা নেই।
আহমদ মুসার মেশিন রিভলবার সামনের দিকে তাক করাই ছিল। সে দুহাতে রিভালবার শক্ত করে ধরে ডান হাতের তর্জনি দিয়ে ট্রিগারচেপে বাঁ দিকের মেঝের উপর ড্রাইভ দিল।
যেখানে দাঁড়িয়েছিল আহমদ মুসা, সেখান দিয়ে এক ঝাঁক গুলী উড়ে গেল। কিছু বিদ্ধ করল দেয়াল। কয়েকটা ঘরের ভিতরেও প্রবেশ করল।
আহমদ মুসা গুলী করতে করতেই গড়িয়ে ছুটল কিছু দূরের বিশাল পিলারটার দিকে।
ওরাও সবাই একটা উন্মুক্ত অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছিল। আহমদ মুসার অব্যাহত গুলীবর্ষণ ওদেরকেও ঘিরে ধরেছিল। ওরাও আত্নরক্ষার জন্যে শুয়ে পড়েছিল মেঝেয়। সুতরাং গড়িয়ে যাওয়া আহমদ মুসাকে ওরা ইচ্ছামত টার্গেট বানাতে পারেনি।
অন্যদিকে আহমদ মুসা পিলারের শেল্টার পাওয়ায় সুবিধা পেয়ে গেল।
আহমদ মুসা এবার ওদের দিকে নজর দেবার সুযোগ পেল। গুলীবর্ষণ অব্যাহত রেখে সে তাকিয়ে দেখল, তার এতক্ষণে ছুঁড়া গুলী একেবারে বৃথা যায়নি। কয়েকটা লাশ পড়ে আছে।
আর অবশিষ্টরা শুয়ে থেকে গুলী করছে। বুঝা যাচ্ছে না আহত হয়েছে কজন।
গুলী করতে করতে ওরা কয়জন দোতলায় উঠার সিড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। লক্ষ্য সিঁড়ির আশ্রয় নেয়া।
পিলারের আড়াল থেকে আহমদ মুসাও লক্ষ্য ঠিক করে গুলী করতে পারছে না।
এসময় ‘আহমদ মুসা পেছনে’-সারা জেফারসনের এই চিৎকার শুনতে পেল আহমদ মুসা।
চিৎকার কানে আসার সাথে সাথেই আহমদ মুসা নিজের দেহকে ছুড়ে দিল মেঝেয়। একই সময়ে গুলীর শব্দ তার কানে এল।
মেঝেয় পড়ে আহমদ মুসা অনুভব করতে চেষ্টা করছিল গুলী তার লেগেছে কি না।
সে সাথে তাকাল সে পেছনে। দেখল একজন লোক গুরীবিদ্ধ হয়ে কাতরাচ্ছে।
আহমদ মুসা বুঝল সারা জেফারসন শুধু চিৎকারই করেনি গুলীও করেছে লোকটিকে। তা না হলে লোকটির গুলীর নিশ্চিত শিকার হতে হতো আহমদ মুসাকেই। লোকটির যে দশা হয়েছে সেই দশা আহমদ মুসার হতে পারতো।
আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল আহমদ মুসা।
ওদের গুলীর লক্ষ্য পাল্টে গেছে। এবার ওদের গুলী বৃষ্টি সারা জেফারসনের ঘরকে লক্ষ্য করেও ছুটে আসছে। সারা জেফারসনও দুএকটা করে গুলী করছে।
আহমদ মুসার মাথায় তখন নতুন বুদ্ধি এসেছে।
পেছনে থেকে আক্রমণকারী লোকটি নিশ্চয় দুতলা থেকে পেছনের কোন সিঁড়ি দিয়ে নেমেছে নিরাপদ আক্রমণের সুযোগ নেয়ার জন্যে। এখন আহমদ মুসা পেছনের সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে সামনের ওদেরকে পেছন থেকে আক্রমণ করতে পারে।
চিন্তাটা সম্পূর্ণ হতেই আহমদ মুসা দ্রুত গড়িয়ে এগুলো পেছনে। পেছনের প্রান্তে পৌছে সে দেখল একটা ঘরের দরজা উন্মুক্ত। দেখা গেল সে ঘর থেকেই একটা সিঁড়ি দোতলায় উঠে গেছে।
আহমদ মুসা গড়িয়ে ঢুকে গের ঘরে। তারপর ছুটল সিঁড়ি বেয়ে।
আহমদ মুসা দোতলা হয়ে পুবের প্রধান সিঁড়ি মুখে এসে দেখল ওরা কয়েকজন সিঁড়ি বেয়ে হামাগুড়ি দিয়ে উপরে উঠে আসছে। সম্ভবত ওরাও চাচ্ছিল আবার পেছন থেকেই আক্রমণ রচনা করতে।
আহমদ মুসা যখন ওদের দেখল, ওরাও তখন আহমদ মুসাকে দেখে ফেলেছে।
কিন্তু ওরা আহমদ মুসার উদ্যত মেশিন রিভলবার হাতে দেখেই হকচকিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আহমদ মুসার তা হয়নি। আহমদ মুসা ওদের দেখেই তর্জ্জনি চাপল তার মেশিন রিভলবারের ট্রিগারে।
মুহূর্তেই লাশ হয়ে গেল সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসা তিনজনের দেহ।
আহমদ মুসা খেয়াল করেনি সিঁড়ির গোড়ায় অবস্থান নিয়েছিল ওদের আরও কয়েকজন।
যখন ওদেরকে দেখতে পেল, আহমদ মুসার তখন কিছুটা দেরী হয়ে গেছে।
উপায়ান্তর না দেখে আহমদ মুসা চিৎ হয়ে পেছন দিকে দেহটাকে ছুড়ে দিল।
পড়তে গিয়ে রিভলবার ধরা হাত তার উঁচু হয়ে উঠেছিল। একটা গুলী এসে উঁচু হয়ে উঠা রিভলবারে আঘাত করল। গুলীটা আহমদ মুসার ডান হাতের বৃদ্ধা অঙ্গুলিকেও স্পর্শ করে গেল।
‘আহমদ মুসার হাত থেকে ছিটকে পড়ল তার রিভলবার।
ছিটকে গেলেও রিভলবারটা কিন্তু গিয়ে পড়ল আহমদ মুসার মাথার কাছে।
আহমদ মুসা কুড়িয়ে নিল রিভলবার। মাথায় বুদ্ধি তার এসে গেছে। আহমদ মুসা ঠিক করল রিভলবার মুঠোয় নিয়ে গড়িয়ে পড়বে সে সিঁড়ি দিয়ে। ওরা বুঝবে আমি গুলী বিদ্ধ হয়ে গড়িয়ে পড়ছি। এই সুযোগে ওদেরকে টার্গেট করার একটা নিরাপদ সময় পাওয়া যাবে।
তাই করল আহমদ মুসা। গড়িয়ে পড়ল সে সিঁড়ি দিয়ে।
শেষ ধাপ থেকে মেছেতে গড়িয়ে পড়েই আহমদ মুসা সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়ানো লোকদের লক্ষ্যে তার মেশিন রিভলবারের ট্রিগার চেপে ধরল।
আর ওরা আহমদ মুসার দেহ গড়িয়ে পড়তে দেখে আনন্দ বিস্ময় নিয়ে ওদিকে তাকিয়েছিল। তারপর হঠাৎ যখন আহমদ মুসার রিভলবার তাদের দিকে তাক হতে দেখল, তখন আর সময় পেল না। আহমদ মুসার মেশিন রিভলবার থেকে ছুটে আসা এক ঝাঁক বুলেটের অসহায় শিকারে পরিণত হলো তারা।
ওরা চারজন ভূমি শয্যা নিলেও আহমদ মুসা শুয়েই থাকল। বুঝতে চেষ্টা করল ওদের আর কেউ কোথাও আছে কি না।
গুলী কোন দিক থেকে এল না। কিন্তু পেছন দিক থেকে ছুটে আসতে শুনল পায়ের শব্দ।
শুয়ে থেকেই বিদ্যুৎ বেগে মাথা ঘুরাল আহমদ মুসা পেছন দিকে, সেই সাথে ঘুরল তার হাতের উদ্যত রিভলবারও।
কিন্তু দেখল কোন শত্রু নয়, ছুটে আসছে সারা জেফারসন।
ছুটে এসে সে হাটু গেড়ে বসে পড়ল আহমদ মুসার পাশে। দুহাত দিয়ে আহমদ মুসাকে আঁকড়ে ধরে বলল, ‘এভাবে আপনি পড়ে গেলেন কেন? কিছু হয়নি তো আপনার? ভাল আছেন তো আপনি?’ আর্ত চিৎকারের মত শুনাল সারা জেফারসনের কন্ঠ।
ততক্ষণে সারা জেফারসনের মাও এসে পড়েছে। তারও উদ্বিগ্ন কণ্ঠ, ‘বেটা কেমন আছ তুমি? ভাল আছ তো?’
আহমদ মুসা উঠে বসল। হাসল, বলল, ‘ভাল আছি আমি। ওদের বোকা বানাবার জন্যে গুলীবিদ্ধ হবার মত গড়িয়ে পড়েছিলাম সিঁড়ি দিয়ে। বোকা হয়েছে ওরা। জীবন দিয়ে খেসারত দিয়েছে বোকামির।’
‘কে বলল আপনি ভাল আছেন। আপনার বাঁ হাতের কব্জি আগেই গুলীবিদ্ধ হয়েছে, এখন দেখছি ডান হাতের বুড়ো আঙুলও।’
বলে টেনে তুলল সারা জেফারসন আহমদ মুসাকে।
পকেট থেকে রুমাল বের করে সারা জেফারসন আহমদ মুসার আহত কব্জি জড়িয়ে বলল, ‘চলুন উপরে। ফাস্ট এইড-এর ব্যবস্থা আছে। ইতিমধ্যে ডাক্তার এসে পড়বে।’
বলে আহমদ মুসার হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগল সিঁড়ির দিকে।
আহমদ মুসা হাঁটার জন্যে পা তুলতে তুলতে বলল, ‘কিন্তু নিচে এখন থাকা প্রয়োজন। শত্রু কোথাও লুকিয়ে থাকতে পারে।’
‘একটু ভালো করে শুনুন। পুলিশের গাড়ির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। ওরা এখনি এসে পড়বে। সুতরাং চিন্তা নেই। মা নিচে থাকছেন পুলিশকে রিসিভ করার জন্যে।’ বলল সারা জেফারসন।
‘পুলিশকে কে খবর দিয়েছে? আপনারা? আহমদ মুসা বলল।
আমি টেলিফোন করেছিলাম। আমি এফ বি আইকেও জানিয়েছি।’ বলল সারা জেফারসন।
‘ধন্যবাদ মিস জেফারসন।’
‘ধন্যবাদ কি এজন্যে যে, যুদ্ধে দর্শক সেজে বিরাট বীরত্বের কাজ করেছি! সারা জেফারসনের কণ্ঠ একটু ভারী শোনাল।
আহমদ মুসার কিছু বলতে যাচ্ছিল।
কিন্তু সারা জেফারসন বলল, ‘আর কোন কথা নয় আসুন।’
বলে হাত ধরে টেনে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে লাগল।
নিয়ে বসাল আহমদ মুসাকে ফ্যামিলি ড্রইং রুমে। তারপর ফাস্ট এইড বক্স ও বড় এক গামলা পানি নিয়ে এল।
আহমদ মুসা বুঝলো বাধা দিয়ে কিছু হবে না। আর কব্জীর ক্ষতটা বেশ বড় ও গভীর হয়েছে। এক হাত দিয়ে ক্ষতের শুশ্রুষা সম্ভব হবে না।
তাই আহমদ মুাসা তার হাত ছেড়ে দিল সারা জেফারসনের হাতে।
আহমদ মুসার কব্জীর ক্ষত পরিষ্কার করে তাতে ঔষধ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিতে দিতে বলল, ‘আচ্ছা একটা কথা বলি?’ জিজ্ঞেস করল সারা জেফারসন আহমদ মুসার দিকে মুখ না তুলেই।
‘বলুন।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আপনার নার্ভ কি লোহা দিয়ে তৈরী যে তাতে চাঞ্চল্য আসে না কোন কিছুতেই?
‘কেন একথা বলছেন?’
‘এ রকম ক্ষত যদি আমার হতো এবং তা এইভাবে পরিষ্কার করতে গেলে আমি চিৎকার করে, কেঁদে লোক জোটাবার মত ব্যাপার করে ফেলতাম। কিন্তু আমি আপনার মুখের সামান্য পরিবর্তনও হতে দেখিনি। মানুষের নার্ভ এত শক্ত হয়।’
‘তাহলে আমি অমানুষ নাকি?’
‘অমানুষ নয়, অতিমানব।’ বলল সারা জেফারসন। তার ঠোঁটে রক্তিম হাসি।
‘অতিমানব বলে কোন কিছু নেই।’
‘অতিমানব বলে আলাদা কিছু অবশ্যই নেই, কিন্তু মানুষই অতিমানব হন।’
‘এসব কল্পনা মিস জেফারসন। অতিমানব কেউ হলে নবী-রাসূলরা তা হতেন। কিন্তু তাঁরাও নিজেকে ‘মানুষ’ বলেছেন।’
‘আপনি এটা বলেছেন অসাধারণ চিন্তা থেকে। কিন্তু আমি তো সাধারণ একজন মানুষ। আমরা অনেক কিছুই ভাবতে পারি।’
বলে সারা জেফারসন আহমদ মুসার ডান হাত টেনে নিল। বাম হাতের কব্জীর ব্যান্ডেজ শেষ।
‘কিন্তু মিস জেফারসন, সাধারণরা কখনই নিজেকে সাধারণ মনে করে না।’
‘আবার এটাও ঠিক অসাধারণরা নিজেকে অসাধারণ ভাবেন না।’
আহমদ মুসা ভাবছিল পরবর্তী কথাটা বলার জন্যে। কিন্তু তার আগেই সারা জেফারসন বলে উঠল, ‘আর একটা কথা বলি।’
‘অবশ্যই বলবেন।’
‘আপনার হাত স্পর্শ করলে কেউ আপনাকে বিপ্লবী বলবে না।’ আঙুলে ব্যান্ডেজ পরাতে পরাতে বলল সারা জেফারসন।
‘কি বলবে তাহলে?’
‘শিল্পী বলবে। যে শিল্পীর নরম মন কঠোরতার থেকে অনেক দূরে বসে সুন্দরের সাধনায় ব্যস্ত থাকে।
‘তাহলে মিস জেফারসন আপনিওতো ‘ফ্রি আমেরিকা’র মত বিপ্লবী সংগঠনের প্রধান হতে পারেন না। কারণ আপনার হাত বলছে, আমি শিল্পী হলে আপনি ডাবল শিল্পী।’
জোসে হেসে উঠল সারা জেফারসন।
আহমদ মুসার ডান হাতের বুড়ো আঙুলের ড্রেসিং হয়ে গিয়েছিল।
সারা জেফারসন হেসে উঠল আহমদ মুসার হাত ছেড়ে দিয়ে নিজের হাত দুটি নিজের কোলের মধ্যে টেনে নিয়ে বলল, ‘আমি আপনার হাত দেখেছি, আপনি কখন দেখলেন আমার হাত?’
বলেই উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘আসুন।’
সারা জেফারসন আহমদ মুসাকে নিয়ে প্রবেশ করল একটা বড় বেড রুমে।
কক্ষে বেড ছাড়াও যেসব জিনিস আছে তার মধ্যে রয়েছে একটা ছোট লেখার টেবিল, পাশাপাশি দুটি সুদৃশ্য সোফা, ডিভানের সাথে মানানসই এবং লেখার টেবিলের উপরেই দেয়ালে সুন্দর একটা বিলবোর্ড।
আহমদ মুসাকে সোফায় বসিয়ে পাশের ড্রেসিং রুম থেকে এক সেট পোশাক এনে আহমদ মুসার হাত দিয়ে বলল, ‘আপনি পোশাক পাল্টে আসুন। আমি বেডটা একটু ঠিক করে দেই।’
আহমদ মুসা শার্ট প্যান্ট নেড়ে চেড়ে বলল, ‘আপনাদের বাসায় তো কোন পুরুষ আত্মীয় থাকে না। পুরুষের এ পোশাক আপনি পেলেন কোথায়?’ আহমদ মুসার চোখে বিস্ময়।
‘ওটা ছাড়াও এক সেট স্যুটও আছে।’ বলল সারা জেফারসন।
‘কিন্তু কোত্থেকে এল?’
‘দোকান থেকে।’
‘কিন্তু এক সন্ধ্যার মধ্যে তো এমন অর্ডার সাপ্লাই হয় না।’
‘অনেক আগেই এসে আছে।’ বলল সারা জেফারসন। তার ঠোঁটে হাসি।
‘আগেই? কিভাবে?’
গম্ভীর হলো সারা জেফারসন। বলল, ‘আমার স্বপ্নের কথা আপনাকে বলেছি। আমি জানতাম আমার স্বপ্ন সত্য হবে। আমার ডাক আপনি উপেক্ষা করবেন না। আপনি আসবেন। সেই আসার অপেক্ষায় আমি এগুলো তৈরী রেখেছি।’ থামল সারা জেফারসন।
সারা জেফারসনের কথাগুলো আহমদ মুসার কান দিয়ে প্রবেশ করার পর তার চেতনার সত্ত্বার কোথাও যেন একটা শর বিদ্ধ হলো। চমকে উঠল আহমদ মুসা। আর মনে হলো, সারা জেফারসনের কথাগুলো যেন এক ব্যাকুল হৃদয়ের দুহাত বাড়ানো এক আকুল পিপাসার্ত কান্না। কেঁপে উঠল আহমদ মুসা। ঠিক এ সময় তার সামনে ভেসে উঠল ডোনা জোসেফাইনের স্নিগ্ধ, সুন্দর, প্রশান্ত মুখচ্ছবিটি। কেঁপে ওঠা তার হৃদয় আশ্রয় খুঁজে পেল।
আহমদ মুসাকে তার নিজের মধ্যে হারিয়ে যেতে দেখে এবং কোন উত্তর না পেয়ে সারা জেফারসন বলে উঠল, কি ভাবছেন আহমদ মুসা?’
সম্বিত ফিলে পেল আহমদ মুসা। নিজেকে সামলে নিল। হাসল একটু। বলল, ‘ধন্যবাদ, মিস জেফারসন।
বলে আহমদ মুসা পোশাক পাল্টাবার জন্যে ড্রেসিংরুমে ঢুকে গেল।
বেড ঠিক করে সারা জেফারসন একটু বাইরে গিয়েছিল। ফিরে এসে দেখল আহমদ মুসা ড্রেসিংরুম থেকে বেরিয়ে এসে সোফায় বসে আছে।
ঘরে ঢুকেই বলল সারা জেফারসন, ‘একটু নিচে গিয়েছিলাম খোঁজ নিতে। আমাদের বাড়িতে ৩ জন পুলিশের একটা টিম পাহারায় ছিল। শ্যারনের লোকেরা তিন জন পুলিশ, আমাদের কুকুর এবং আমাদের নিরাপত্তা কর্মচারী শেলটনকে খুন করে আমাদের বাড়িতে প্রবেশ করে।’
‘এরা জেনারেল শ্যারনদের লোক একথা কি পুলিশও বলছে?’
‘না, এটা আমি বলছি। ওদেরকে একথা বলা হয়নি। পুলিশ নিশ্চয় খুঁজে বের করবে।’ বলল সারা জেফারসন।
‘একটা প্রমাণের কথা বলছি। পুলিশকে গিয়ে বলুন। ওদের কলার ব্যান্ডের ভেতরের পাশে ছয়তারা একটা সিম্বল আছে।এটা ইহুদী গোয়েন্দা এবং তাদের প্রাইভেট আর্মির সিম্বল।’
‘ধন্যবাদ। আমি বলব। কিন্তু তার আগে দেখে নিতে চাই সত্যিই তা আছে কি না।’ কথা শেষ করেই সারা জেফারসন আবার বলে উঠল, ‘আপনি শুয়ে পড়ুন। একটু রেষ্ট নিন। ডাক্তার এখনি এসে পড়বেন। ’
আহমদ মুসা বলল, ‘ঠিক আছে। শুয়ে পড়ছি। কিন্তু তার আগে বলুন ঐ বিল বোর্ডে টমাস জেফারসনের যে উক্তি লেখা আছে, তা কি পছন্দ করে ওখানে রেখেছেন, না নিছক তার কথা হিসেবে ওটা রেখেছেন?
ঘরে লেখার টেবিলের উপরের দেয়ালে টাঙানো একটা বিলবোর্ডের দিকে ইংগিত করে আহমদ মুসা কথাগুলো বলল।
বিলবোর্ডটিতে সুন্দর অক্ষরে টমাস জেফারসনের একটি উক্তি লেখা। উক্তিটি হলো, ‘স্বাধীনতার বৃক্ষকে অবশ্যই মাঝে মাঝে দেশপ্রেমিক ও জালেমদের রক্তে গোসল করতে হবে। তার স্বাভাবিক ম্যাচিউরিটির এটাই পথ (The tree of liberty must be refreshed from time to time with the blood of partie-ots and tyrants. It is its natural nature)
আহমদ মুসার কথা শুনে সারা জেফারসনও বিলবোর্ডটির দিকে তাকাল। তাকিয়ে হেসে উঠল। বলল, ‘এ নিয়ে আবার ঝগড়া বাধাবেন বুঝি! ঝগড়ার কোন প্রয়োজন নেই। আমি স্বীকার করছি, টিজে দাদুর এই কথাটা আমার ভীষন পছন্দ। আপনার কথা বলুনতো?’
‘তার আগে আপনার কেন পছন্দ?’ আহমদ মুসা সোফা থেকে উঠে শোবার জন্য বেডে গিয়ে বসতে বসতে বলল।
আবার হাসল সারা জেফারসন। বলল, ‘শত্রুর বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াইয়ে আপনি অদ্বিতীয়। আপনি আইনজীবি হলে, বা ডিপ্লোম্যাট অথবা স্টেটম্যান হলেও দুনিয়াতে অদ্বিতীয় হতেন। মানুষের পেট থেকে কথা বের করায় আপনার জুড়ি নেই। আপনি সত্যিই মিরাকল।’
বলে মুহূর্তকাল থেমেই আবার শুরু করল, ‘টিজে দাদু তার অন্য একটা উক্তিতে বলেছেন, ‘সময় সময় দেশে ছোটখাট বিদ্রোহ বিপ্লব ঘটা ভাল জিনিস। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এর প্রয়োজন তেমনি, যেমন প্রয়োজন প্রকৃতিতে ঝড়ের (I hold that a little rebelion now and then is a good thind and as necessary in the physical)।’ দেশে সংঘঠিত বিশৃংখলা বিপ্লব দেশের দেশপ্রেমিকদের চিন্তা চেতনা দায়িত্ববোধ শানিত করে এবং বিশ্বাসঘাতক ও বিভেদকারীদেরকে চিহ্নিত করার মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতাকে সংহত ও শক্তিশালী করে। স্রোত যেমন নদীর জীবন, তেমনি দেশপ্রেমিকদের শাণিত চিন্তা, চেতনা ও দায়িত্ববোধ একটি স্বাধীন দেশের প্রাণ। এই প্রাণ দেহে আছে কিনা মাঝে মাঝেই তার টেস্ট হওয়া প্রয়োজন।’ থামল সারা জেফারসন।
আহমদ মুসার চোখে মুদ্ধ দৃষ্টি। বলল, ‘ধন্যবাদ মিস জেফারসন। আপানর টিজে দাদুর কথার মতই আপনার ব্যখ্যা চমৎকার।’
‘থাক ওসব। এবার আমার প্রশ্নের জবাব দিন।’ সলজ্জ কন্ঠে বলল সারা জেফারসন।
আহমদ মুসার চোখে মুখে নেমে এল গাম্ভীর্য। বলল, ‘আমাদের ধর্মগ্রন্থ আল কুরআনে স্রষ্টা বলছেন, ‘লড়াই কর যতক্ষন না বিশৃংখলা, বিদ্রোহ ও জুলুম নিপীড়নের মূলোচ্ছেদ হয় এবং আল্লাহর রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়।’ এ ধরনের আরও অনেক কথার মধ্যে তিনি একথাও বলেছেন, ‘নিরপরাধ মানুষের হন্তাকে হত্যা করার মধ্যে রয়েছে মানুষের জীবন।’ আমাদের ইসলামী জীবন-দর্শনের মূল কথাই হলো, পৃথিবীতে মানুষের মধ্যে কল্যাণের শক্তি ও অকল্যাণের শক্তির মধ্যে দ্বন্দ্ব চিরন্তন। এই লড়াই অবিরাম চলবে পৃথিবীর শেষ দিন পর্যন্ত। আল্লাহ চান, কল্যাণের শক্তি অকল্যাণের শক্তিকে পরাভূত করে মানুষের জন্যে শান্তি ও স্বস্তির রাজত্ব কায়েম করবে। এখন মিস জেফারসন আপনিই বলুন আপনার টিজে দাদুর উক্তি আমার কেমন লাগবে?
হাসল সারা জেফারসন।
চোখ বন্ধ করল সে।
একটু পর চোখ খুলে বলল, ‘আল কোরআন যদি মহা পর্বতগাত্রের মহাহিমবাহ হয়, তাহলে টিজে দাদুর উক্তি সেই মহাহিমবাহ থেকে নেমে আসা একটা নির্ঝরিনী। সে নির্ঝরিণীকে তো আপনি আপানর বলেই দাবী করবেন।’ মুগ্ধ চোখে, ঠোঁটে রক্তিম এক হাসি টেনে বলল সারা জেফারসন।
‘চমৎকার আপনার উদাহরণ, মিস জেফারসন।’ বলল আহমদ মুসা বিমুগ্ধভাবে।
‘তাহলে এ কৃতিত্বের জন্যে একটা পুরষ্কার চাইব।’ বলল সারা জেফারসন। ঠোঁটে তার সলজ্জ হাসি।
‘বলূন কি পুরষ্কার।’ বলল বটে আহমদ মুসা, কিন্তু তার ভেতরে তখন বিব্রতভাব।
সারা জেফারসন চোখ নামিয়ে নিল আহমদ মুসার দিক থেকে। মুখ তার নিচু হলো একটু। শান্ত নরম কন্ঠে বলল, ‘আমি ‘মিস জেফারসন’ নই। আমি শুধুই ‘সারা’।’
বলেই ঘুরে দাঁড়িয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল সারা জেফারসন।
দরজায় গিয়ে ঘুরে দাঁড়াল সারা জেফারসন। বলর ‘আপনি শুয়ে পড়ন। ডাক্তার এলে আমি আসব। আর শুনুন, কোন স্বাধীন চিন্তা ভাবনা কিন্তু আপনার এখন নেই, আপনি এখন ডাক্তারের অধীন।’
ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সারা জেফারসন।
আহমদ মুসা তখন বালিশে হেলান দিয়ে সারা জেফারসনের শেস দিকের কথাগুলো ব্যাখ্যা খুঁজছিল আর ভাবছিল, মানুষের ভাবনা কত সীমিত। দৃষ্টি তাদের কত সীমাবদ্ধ। সব না জেনেই জানা হয়ে গেছে বলে সিদ্ধান্ত নেয়।
হৃদয়ে একটা নতুন বেদনা অনুভব করলো আহমদ মুসা।