৩০. এক নিউ ওয়ার্ল্ড

চ্যাপ্টার

চ্যাপ্টার

আহমদ মুসার চোখ পটোম্যাক নদীর উপর নিবদ্ধ। কিন্তু তার দৃষ্টি পটোম্যাক নদীর কিছুই দেখছে না।
আহমদ মুসার শূন্য দৃষ্টিতে ভাসছে উদ্বেগের এক অশরীরী ছবি। লায়লা জেনিফার ও ডাক্তার মার্গারেট কেমন আছে? ওদের প্রতি দায়িত্বে হয়তো সে অবহেলা করেনি, কিন্তু যতটা তৎপর হওয়া উচিত ছিল তা কি সে হতে পেরেছে? পারেনি হয়তো। কিন্তু আহমদ মুসার করার কিছুই ছিল না। ঘটনা প্রবাহ তাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। আহমদ মুসা একে আল্লাহর ইচ্ছা বলেই মনে করেছে। লায়লাদের নিশ্চয়ই কোন ক্ষতি হবে না এবং তাদের উদ্ধারে আল্লাহ নিশ্চয়ই তাকে সাহায্য করবেন।
আহমদ মুসা তার ফ্লাটের সাউথ ব্যালকনিতে বসে নদীর দিকে তাকিয়ে আছে।
জর্জ ওয়াশিংটন মনুমেন্টের পুবে ও মার্কিন পার্লামেন্ট হাউসের দক্ষিণে পটোম্যাকের তীরে এই ফ্ল্যাটটি। যোগাড় করেছ বেঞ্জামিন বেকন জর্জ আব্রাহামের সাহায্যে। ফ্ল্যাটটি অফিসিয়াল এলাকায়। এই দিক থেকে অনেক নিরাপদ জায়গাটা।
একটা গাড়ির হর্নের শব্দ এল আহমদ মুসার কানে। শব্দটি এল নিচের গাড়ি বারান্দা থেকে। হর্নের শব্দ আহমদ মুসাকে চিন্তার জগত থেকে ফিরিয়ে আনতে পারল না।
হঠাৎ আহমদ মুসার অনুভব করল একটা হাত তার ঘাড়ে এসে থেকে গেল।
প্রথমটায় চমকে উঠেছিল আহমদ মুসা। ফিরে এসছিল চিন্তার আচ্ছন্নতা থেকে। চমকে উঠলেও পরক্ষণেই অনুভব করল হাতটি বেঞ্জামিন বেকনের। পেছন দিকে না তাকিয়েই আহমদ মুসা বলল, ‘মি. বেঞ্জামিন বেকন, এই অসময়ে যখন, নিশ্চয় কোন খবর এনেছেন?’
‘হ্যা, একটা ভাল খবর।’
‘কি সেটা?’
‘আমার সাথে আপনাকে এখনি বেরুতে হবে।’
‘কোথায়?’ পেছন ফিরে বেঞ্জামিন বেকনের দিকে তাকিয়ে বলল আহমদ মুসা।
‘শোনার দরকার নেই, উঠুন।’
‘সত্যিই উঠব?’
‘সত্যি না হলে এই সাত সকালে এভাবে আসি?’
আহমদ মুসা উঠল। বেঞ্জামিন বেকনের উপর তার আস্থা আছে। অকাজে সে সময় খরচ করে না।
আহমদ মুসা তৈরী হয়ে বেঞ্জামিন বেকনের সাথে বেরিয়ে এল।
তারা গাড়িতে উঠল। গাড়ি ছুটল উত্তর ওয়াশিংটনের দিকে।
গাড়ি গিয়ে থামল সুন্দর একটা বাড়ির সামনে।
লাফ দিয়ে গাড়ি থেকে নামল বেঞ্জামিন বেকন। বলল, ‘আসুন মি. আহমদ মুসা।’
আহমদ মুসাও নামল।
চত্ত্বর থেকে এক ধাপ পেরিয়ে করিডোরে উঠে সামনে দরজার উপর নজর ফেলতেই দেখল, দরজা দিয়ে সান ওয়াকার ও জর্জ বেরিয়ে এল।
টার্কস দ্বীপের এই জর্জ ডা. মার্গারেটের ভাই ও লায়লা জেনিফারের স্বামী।
বিস্মত আহমদ মুসা দাঁড়িয়ে পড়েছিল।
ওরা এসে দুজনেই জড়িয়ে ধরল আহমদ মুসাকে।
আহমদ মুসা দুজনের পিঠ চাপড়ে বলল, ‘সালাম দিতে বুঝি এভাবে ভুলে যায়?’
দুজনে আহমদ মুসাকে ছেড়ে দিয়ে হেসে উঠল। বলল দুজনেই, ‘আসসালামু আলাইকুম।’
আহমদ মুসা সালাম নিল। সে কিছুই বলতে যাচ্ছিল।
তার আগেই বেঞ্জামিন কথা বলে উঠল। তার চোখে-মুখে বিস্ময়। বলল, ‘মি. জর্জ, মি. সানওয়াকার আপনাদের এই নতুন ধর্মীয় পরিচয়ের কথা আমাকে বলেননি?’
‘পরিচয় অনেক পুরানো হয়ে গেছে।’ বলল সানওয়াকার।
‘মি. আহমদ মুসা আপনি দেখছি যাদুকর! মনে করেছিলাম মাত্র আমরা এখানকার কজনই আপনার দলে ভিড়েছি। কিন্তু দেখছি, ওরা অনেক আগেই আপনার শিকার হয়ে গেছে।’ বলল বেঞ্জামিন বেকন।
‘মি. বেঞ্জামিন, সত্যের শক্তি যাদুর চেয়ে লক্ষ কোটি গুণ বেশি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘সত্য যদি সত্য হয়।’ বেঞ্জামিন বলল।
‘কিন্তু সত্য একটা বিমূর্ত জিনিস। সত্য মূর্ত হয়ে ওঠে সত্যের যারা সাক্ষ্য দেন বা সত্যের যারা বাহক তাদের মাধ্যমে। সত্য মূর্ত হয়ে ওঠা বা সত্যকে মূর্ত করে তোলার বিষয়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং সত্য সত্য হওয়াই যথেষ্ট নয়।’
‘সত্যিই তাই মি. আহমদ মুসা। সত্য যদি গুণের নাম হয়, তাহলে সত্যের বাহক হবেন গুণী। গুণীকে বাদ দিলে গুণ দৃশ্যমান হয়না।’
‘ধন্যবাদ মি. বেঞ্জামিন। আপনার উদাহরণটা খুবই সুন্দর।’
বলে আহমদ মুসা মুহূর্তকাল থেমেই বেঞ্জামিনের দিকে চেয়ে বলল, ‘মি. বেঞ্জামিন আপনার ভাল খবর যে জর্জ ও সানওয়াকারদের সাথে সাক্ষাত করিয়ে দেয়া, তা কল্পনাতেও আমার আসেনি। সত্যিই আমার জন্যে এটা একটা অসম্ভব ভাল খবর। কিন্তু এদের সাথে পরিচয় হলো আপনার কেমন করে?’
‘ভাল খবর শুধু এই একটাই নয় মি. আহমদ মুসা। আরও আছে। কিন্তু তার আগে আপনার শেষ প্রশ্নটার জবাব দিয়ে নেই।’
বলে বেঞ্জামিন বেকন একটু থামল। পরক্ষণেই শুরু করল আবার। বলল, ‘ফ্রি আমেরিকা’র পক্ষ থেকে আমরা আমেরিকার সকল দেশপ্রেমিক সংগঠন ও সংস্থার সাথে যোগাযোগ করছি ইহুদীবাদীদের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে তাদের অবহিত করার জন্যে। এ কাজ করতে গিয়েই ‘আমেরিকান ক্রিসেন্ট’-এর জর্জের সাথে আমার পরিচয় হয়। পরিচয় করতে গিয়ে বুঝলাম যে আমাদের সব পক্ষেরই নেতা আহমদ মুসা। তারপর আপনাকে নিয়ে এলাম সারপ্রাইজ দেবার জন্যে।’
‘ধন্যবাদ মি. বেঞ্জামিন এই ধরনের সারপ্রাইজ দেবার জন্যে।’ সবাইকে নিয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল আহমদ মুসা।
দুতলা বাড়ির নিচে তলার বিশাল ড্রইংরুমে বসল সবাই।
বসার পর মুহূর্তের জন্যে বুজে গিয়েছিল আহমদ মুসার দুই চোখ। গম্ভীর হয়ে উঠেছিল তার মুখমন্ডল।
পরে তাকাল আহমদ মুসা জর্জের দিকে। বলল, ‘তোমাকে জিজ্ঞেস করতে ভয় করছে যে তোমরা কেমন আছ। আমি দুঃখিত জর্জ।’
জর্জের মুখ মলিন হয়ে উঠল। মুখটা তার নিচু হয়ে পড়েছিল। বোধ হয় ভাবান্তরটা গোপন করার জন্যে। সংগে সংগেই আবার মাথা তুলল। বলল, ‘যা ঘটবার তা ঘটেছে। কারোই কিছু করার ছিল না। ওরা বরং আপনার নির্দেশ ভংগ করেছিল।
জর্জের কথাগুলো যেন আহমদ মুসার কানেই গোলো না। যেন কতকটা স্বগোতক্তির মতই বলে উঠল, ‘শ্যারনরা যে নতুন ডেট লাইন দিয়েছে, তাতে আরও কয়েকটা দিন হাতে আছে। এবার এ দিকে নজর দেবার সময় এসেছে জর্জ। দুঃখিত জর্জ, অনেক দেরী হয়েছে। তবে তাদের কোন ক্ষতি করতে সাহস পাবে না শ্যারনরা।’
‘বৃথাই আপনি কষ্ট পাচ্ছেন ভাইয়া। কোন দেরী হয়নি। বিস্তারিত আমি শুনেছি মি. বেঞ্জামিনের কাছে। যা আশু করার আল্লাহ আপনাকে দিয়ে তাই করিয়েছেন। ওদের মুক্তির পথ এখন অনেক সহজ হয়েছে ভাইয়া।’
‘তোমার কথা আল্লাহ সত্য করুন জর্জ।’ বলল আহমদ মুসা। কথা শেষ করে আহমদ মুসা তাকাল সানওয়াকারের দিকে। বলল, ‘প্রফেসর আরাপাহো কেমন আছেন?’
‘ভালো আছেন। আমি আসার সময় আমার প্রতি তাঁর নির্দেশ ছিল আমি যেন প্রথম সাক্ষাতেই আপনাকে তার কাছে টেলিফোন করার জন্যে অনুরোধ করি।’ বলল সানওয়াকার।
‘আচ্ছা সানওয়াকার, আমি আজই তার কাছে টেলিফোন করব। আমি দুঃখিত, কিছুদিন এমন গেল যে, চারপাশের বর্তমান ছাড়া দূরের কোন কিছুর দিকে মনযোগই দিতে পারিনি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ভাবীর কথা, ভাইয়া?’ বলল জর্জ।
‘ওকে অনেক বার মনে পড়েছে, কিন্তু ওর সাথে যোগাযোগ করতে পারিনি। প্রথম গত রাতে ওর সাথে কথা বলেছি।’
‘যা ঘটেছে, ঘটছে সব কি তাঁকে আপনি জানান?’ আবার জিজ্ঞাসা জর্জের।
‘সব জানাই না, তবে আমি কি করছি তা জানতে খুব আগ্রহী তাই একটা ব্রীফ তাকে করতে হয়।’
‘মাফ করবেন, এ ব্রীফ-এর মধ্যে কতটুকু থাকে ভাইয়া?’ আবার জর্জেরই প্রশ্ন।
‘এটুকু জেনে রাখ, মুল ঘটনাগুলো ছাড়াও জর্জ ও লায়লা জেনিফারের কথা, সানওয়াকার ও মেরী রোজের কথা, সানঘানেম নাবালুসি ও সান্তা আনা পাবলোর কথা তিনি জানেন। ঠিক এমনি ভাবেই জানেন তিনি প্রফেসর আরাপাহো, ওগলালা কারসেন ঘানেম নাবালুসি পরিবার, পাবলো পরিবার, ডা. আহমদ আশরাফ পরিবার, বেঞ্জামিন বেকন, জর্জ জুনিয়র ও সাবা বেনগুরিয়ান, জর্জ আব্রাহাম জনসন, সারা জেফারসন প্রমুখ সবাইকে।’ থামল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা থামতেই বেঞ্জামিন বেকন বলে উঠ, ‘আমাদের পরম সম্মানিতা ভাবী সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। কিন্তু আমি অবাক হচ্ছি এতকিছু জানার ধৈর্য্য তাঁর আছে?’
কথা বলতে যাচ্ছিল আহমদ মুসা। আহমদ মুসার মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বলল জর্জ, ‘ভাবীও কম নন মি. বেঞ্জামিন বেকন। ফ্রান্সের লুই রাজ পরিবারের একমাত্র উত্তরাধিকারী রাজকুমারী তিনি।’
‘কি বল জর্জ তুমি। সে রাজ্য নেই, সে রাজপরিবার নেই, রাজকুমারীও তিনি নন।’ আহমদ মুসা লাজুক কণ্ঠে বলল।
‘দেখুন ভাইয়া, হায়কালের লেখা মহানবী (সঃ) এর জীবনী আমি ইতিমধ্যে পড়ে ফেলেছি। বংশীয় সম্মান, বংশ পরিচয়কে ইসলাম গুরুত্ব দিয়েছে। সম্মানও দিয়েছে। এ পরিচয় পরিত্যাগ করতে নিষেধ করেছে।’ বলল জর্জ প্রতিবাদের কণ্ঠে। জর্জের কথা শেষ হবার সাথে সাথে বেঞ্জামিন বেকন বলে উঠল, ‘আমার এখন মনে হচ্ছে, জোড়া মেলানোর ক্ষেত্রেও স্রষ্টার সবিশেষ একটা পরিকল্পনা আছে। মি. আহমদ মুসার জোড়া শুধু ফরাসী রাজকুমারী ধরনেই কেউ হতে পারেন। তিনি শুধু স্ত্রী নন, সহযোগী, সহকর্মীও। তা না হলে সব ব্যাপারে এমন আগ্রহ তাঁর থাকবে কেন!’
‘আপনারা আলোচনা অন্যদিকে নিয়ে গেছেন। আসলে বিষয়গুলো জানার ওর আগ্রহের কারণ উনি ধারাবাহিক নোট রাখেন। ইতিহাসের গতিধারার উনি একজন অত্যন্ত সিরিয়াস পর্যবেক্ষক।’ বলল আহমদ মুসা।
একটু থেমেই আহমদ মুসা আবার বলল, ‘সানওয়াকার, ওদিকের অবস্থা কি? ওগলালা কি করছে?’
‘ভাইয়া, সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই জিভারো ও ওগলালা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসছে। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া শুরু করেছি। মেরী রোজও আসছে।’ বলল সানওয়াকার।
‘ওগলালা ও জিভারো বিশ্ববিদ্যালয়ে আসছে? তুমি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া শুরু করেছ? মেরী রোজও? তারপর? কিছু ঘটেনি?’ আহমদ মুসার কণ্ঠে বিস্ময়।
‘না ভাইয়া যারা মানে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ছেলেরা আমাদেরকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া করেছিল, ধরে নিয়ে গিয়েছিল, তারাই আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে গেছে। তারা সবাই এখন বন্ধু হয়ে গেছে।’ বলল সানওয়াকার।
‘এ বিস্ময়কর পরিবর্তনটা কিভাবে ঘটল? আমার বিশ্বাস হতে চাইছে না।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ভাইয়া, এ কীর্তি বেঞ্জামিন বেকনের। আমি কিছুই জানি না। আমি ও জর্জ এখানে গোপনে ছিলাম এবং আপনার খোঁজ করছিলাম। হঠাৎ একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই বৈরী ছেলেরা এল এবং আমাদেরকে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে গেল।’ বলল সানওয়াকার।
‘বেঞ্জামিন ও জর্জের সাথে তোমার পরিচয় হলো কিভাবে?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ।
‘কাহোকিয়ায় আমাদের পুলিশ অফিসার এবং ‘এইম’ (AIM-American Red Indian Movement)-এর সেক্রেটারী জেনারেল ‘চিনক’-এর রেফারেন্স নিয়ে মি. বেঞ্জামিন বেকন আমার এখানে আসেন। আর শিলা সুসান জর্জের সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেন। শিলা সুসানও বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করছে।’ বলল সানওয়াকার।
সানওয়াকারের কথা শেষ হলে আহমদ মুসা তাকাল বেঞ্জামিন বেকনের দিকে। বলল, ‘কি ব্যাপার মি. বেকন। এ মিরাকল কিভাবে ঘটল?
হাসল বেঞ্জামিন বেকন। বলল, ‘আরেকটা সারপ্রাইজ বাকি আছে। তার আগে কিছু বলা যাবে না। এখানকার কাজ শেষ। এবার চলুন সেখানে।’
‘কোথায়?’ বলল আহমদ মুসা।
‘যেখানে সারপ্রাইজটা অপেক্ষা করছে সেখানে।’ বলল বেঞ্জামিন বেকন।
‘আপনার সারপ্রাইজের প্রতি আমার লোভ সৃষ্টি হয়েছে। সুতরাং চলুন।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ধন্যবাদ। আসছে সারপ্রাইজটা কিন্তু এই সারপ্রাইজের চেয়ে অনেক বড় হবে।’
বলতে বলতে উঠে দাঁড়াল বেঞ্জামিন বেকন।
সবাই উঠে দাঁড়াল। সবাই গিয়ে গাড়িতে উঠল। এক গাড়িতেই চারজন।
আগের মত বেঞ্জামিন বেকনই গাড়ি ড্রাইভ করল।
পনের মিনিট চলার গাড়ি চারতলা একটা বিশাল বিল্ডিং-এর সামনে এসে দাঁড়াল।
বিল্ডিং-এ ইলেকট্রনিক একটা সাইনবোর্ড। তাতে বড় সাদা একটি ঈগল। তার নিচে লেখা ‘আমেরিকান কনসাসনেস সোসাইটি’ (ACS)।
সাইনবোর্ড দেখে ভ্রু কুঞ্চিত হলো আহমদ মুসার। ‘হোয়াইট ঈগলে’র সাইনকে আহমদ মুসা চেনে। আহমদ মুসা এও জানে, ‘হোয়াইট ঈগলে’র প্রকৃত নাম ‘আমেরিকান কনসাসনেস সোসাইটি’। কিন্তু এ নাম একেবারেই চাপা পড়ে গেছে। সাইন ‘হোয়াইট ঈগল’ অনুসারে তার নাম হয়ে গেছে ‘হোয়াইট ঈগল’।
গাড়ি থেকে নেমে সেই বিল্ডিং-এর গেটের দিকে এগোলো তারা সকলে।
বেঞ্জামিন বেকনের সারপ্রাইজিং সারপ্রাইজ তাহলে কি …। চিন্তা আর সামনে এগোল না আহমদ মুসার। এমন অসম্ভব কখনও সম্ভব হতে পারে না। তাহলে হোয়াইট ঈগল অফিসের কোথায় যাচ্ছে তারা?
আহমদ মুসা দেখল, বেঞ্জামিন বেকন এখানে পরিচিত। তাকে দেখেই প্রহরীরা স্যালুট দিয়ে সরে দাঁড়িয়েছে। আরও তার মনে হলো, প্রহরীরা সবাই যেন তাদেরই অপেক্ষা করছিল।
গোটা বিষয়টা আহমদ মুসার কাছে স্বপ্নের মতই অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে।
দুতলার মেষ প্রান্তের একটা দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল বেঞ্জামিন বেকন।
দরজার সামনে স্টেনগান হাতে দাঁড়িয়েছিল একজন প্রহরী।
বেঞ্জামিন বেকন তার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই প্রহরী দরজা খুলে ধরে বলল, ‘স্যার আছেন। আপনাদের জন্যে অপেক্ষা করছেন।’
প্রহরীকে ধন্যবাদ দিয়ে আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আসুন মি. আহমদ মুসা, আসুন সকলে।’
বলে বেঞ্জামিন বেকন ভেতরে প্রবেশ করল।
তার সাথে সাথে আহমদ মুসা এবং সকলে।
ঘরে প্রবেশ করার পর আহমদ মুসার নজর প্রথম গিয়ে পড়ল একটা বিশাল টেবিলের উপর। দেখতে পেল আহমদ মুসা, টেবিলের ওপার থেকে হোয়াইট ঈগলের প্রধান ডেভিড গোল্ড ওয়াটার শশব্যস্তে দরজার দিকে আসছেন।
সত্যিই আহমদ মুসা স্তম্ভিত হয়েছে আকস্মিক এই ঘটনায়।
এগিয়ে আসা ডেভিড গোল্ড ওয়াটার বেঞ্জামিন বেকনকে পাশে ঠেলে দিয়ে পথ পরিষ্কার করে হাত বাড়াল স্তম্ভিত আহমদ মুসার দিকে।
স্বপ্নাচ্ছন্যের মতই আহমদ মুসা হাত বাড়াল গোল্ড ওয়াটারের দিকে। দুই হাত মিলিত হলো। হলো দুজনের হ্যান্ডশেক।
ডেভিড গোল্ড ওয়াটার আহমদ মুসার হাত ছাড়ল না। হাত ধরে টেনে নিয়ে এসে বসাল চেয়ারে এবং ফিরে গেল নিজের চেয়ারে।
‘মি. গোল্ড ওয়াটার, মনে হচ্ছে আপনি যেন আমাকে চেনেন না এবং আহমদ মুসা ছাড়া আর কেউ যেন এ ঘরে আসেনি। আমরা স্বাগত সম্ভাষণও পেলাম না, বসতেও বললেন না আমাদের।’ বলল বেঞ্জামিন বেকন ঠোঁটের কোণায় হাসি টেনে।
সংগে সংগেই ডেভিড গোল্ড ওয়াটার আবার উঠে দাঁড়াল। সলজ্জ হেসে বলল, ‘সরি, ওয়েলকাম টু অল। মি. বেঞ্জামিন এবং আপনারা দয়া করে বসুন।’
‘ধন্যবাদ মি. গোল্ড ওয়াটার।’ বলে বেঞ্জামিন বেকন জর্জকে দেখিয়ে বলল, ‘বলতে পারেন ইনি মি. আহমদ মুসার ছোট ভাই, জর্জ। আর ….’
‘বলতে হবে না মি. বেঞ্জামিন বেকন। ওকে আমি জানি ‘আমেরিকান ক্রিসেন্ট’-এর ও সভাপতি। ওর ফাদার ছিল আমার পরম উপকারী একজন।
বেঞ্জামিন বেকন সানওয়াকারের পরিচয় দিতে যাচ্ছিল। বেঞ্জামিনকে থামিয়ে দিয়ে গোল্ড ওয়াটার বলে উঠল, ‘সারওয়াকারকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে আমাকে লজ্জা দেবেন না। অত্যন্ত এক খারাপ অবস্থায় আমরা একে অপরকে জেনেছি।’
ডেভিড গোল্ড ওয়াটার কথা শেষ করার পর মুহূর্ত কয়েকের জন্যে একটা নিরবতা নেমে এল। সে নিরবতা ভাঙল আহমদ মুসা। আহমদ মুসা একবার বেঞ্জামিন বেকন, একবার ডেভিড গোল্ড ওয়াটারের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি বুঝতে পারছি না কি ঘটছে!’
‘কিছুই বুঝতে পারছেন না মি. আহমদ মুসা?’ বলল ডেভিড গোল্ড ওয়াটার। তার ঠোঁটের কোণায় হাসি।
‘এটুকু বুঝতে পারছি, ‘ফ্রি আমেরিকা’র (FAME) সাথে ‘হোয়াইট ঈগল’-এর নিশ্চয় কোন ডায়ালগ হয়েছে। যার ফলে সানওয়াকার ও জর্জরা কনসেসন পেয়েছে এবং আমাদেরও এখানে আসার মত পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু বুঝতে পারছি না মিরাকলটা কি, যা এটা ঘটাল।’ বলল আহমদ মুসা।
‘মিরাকল আপনিই ঘটিয়েছেন আহমদ।’ বলল গম্ভীর কণ্ঠে ডেভিড গোল্ড ওয়াটার।
‘আমি ঘটিয়েছি? বুঝলাম না।’ বলল বিস্মিত কণ্ঠে।
‘আপনি ঘটাননি? ঘটনা আপনি উদঘাটন করেছেন। লস আলামোসের সুড়ঙ্গ আবিষ্কার এবং তার পরবর্তী ঘটনাগুলো আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে।’ বলল ডেভিড গোল্ড ওয়াটার।
‘কিন্তু আপনি তো জেনারেল শ্যারনের সাথেই ছিলেন। তারপর কি ঘটল?’
‘এই মিরাকলের কৃতিত্ব অবশ্য বেঞ্জামিন বেকনের। আমি জেনারেলর শ্যারনের সাথে ওয়াশিংটন ফেরার সময় পর্যন্ত বিষয়গুলো আমার কাছে স্বচ্ছ ছিল না। বরং বলতে পারেন বিভ্রান্তির মধ্যে ছিলাম। লস আলামোস থেকে সান্তা ফে আসার পথে যে হত্যাকান্ড- এবং সান্তাফে বিমান বন্দরে এফ বি আই’র বিমানে যে বিস্ফোরণ ঘটে, তার ব্যাখ্যায় জেনারেল শ্যারন যা বলেছিলেন তাতে আমি সন্তুষ্ট ছিলাম। সর্বশেষ তার কাছ থেকে আমি লস আলামোস সুড়ঙ্গের কাহিনী শুনি।
প্রথমবারের মত আমার মধ্যে আশংকার সৃষ্টি হয় যে, আমাদের সবচেয়ে স্পর্শকাতর গবেষণাগারের কোন সুড়ঙ্গ সংযোগ একটি ইহুদী প্রতিষ্ঠান বা সর্বসাধারণের প্রবেশযোগ্য একটা বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে থাকবে কেন! এই প্রশ্নের মুখোমুখি হবার সাথে সাথে আমি আমার লোকদের অনুন্ধানের নির্দেশ দিলাম। এফ বি আই প্রধান জর্জ আব্রাহাম ও সি আই এ চীফ এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থারের বরখাস্তের সংবাদ আমাকে আহত করে। কারণ, তখন আমেরিকার স্বার্থের ব্যাপারে তাদের চেয়ে একনিষ্ঠ লোক আমার চোখে পড়েনি। কথা বলি প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেনারেল হ্যামিলটনের সাথে তার যুক্তি ও জেনারেল শ্যারনের কথার মধ্যে আমি কোন পার্থক্য দেখিনি। জাতীয় স্বার্থের পক্ষের কে আর কে বিপক্ষে এ নিয়ে সংকটে পড়ে যাই। সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি সব বিষয় জানানর আগে কোন কাজে আর হাত দেব না। এই সময় জেনারেল শ্যারন তার সাথে কাজ করার জন্যে পরোক্ষভাবে আমাকে বিরাট অর্থের লোভ দেখান। আমার মনে বড় একটা ধাক্কা লাগে, একজন ইহুদী স্বার্থের প্রতিভূ এত টাকা আমাকে অফার করছে কেন? আমি তাকে স্পষ্ট বলে দেই, আমার টাকার দরকার তবে তা আমেরিকার স্বার্থে কাজ করার জন্যে। টাকা নেয়ার আগে আমাকে জানতে হবে এই টাকা আমেরিকার স্বার্থের পক্ষে যাবে কি না।
এ রকম অবস্থায় বেঞ্জামিন বেকন আমার সাথে দেখা করেন। তাঁর কাছেই আমি সব শুনি। শোনার সাথে সাথেই আমার সব কথা বিশ্বাস হয়। এরপর আমি প্রথমে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান জেনারেল শেরউডের সাথে যোগাযোগ করি। তিনি বেঞ্জামিন বেকনের সব কথাই কনফার্ম করেন। পরে কথা বলি সি এই-এর প্রধান এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার এবং এফ বি আই-এর প্রধান জর্জ আব্রাহামের সাথে। তাঁদের কাছেও সব শুনি। তারপরেই আমি নিঃসন্দেহ হয়ে যাই যে, জেনারেল শ্যারনরা আমাদের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খাচ্ছেন, আমাদের ঘাড়ে বসে আমাদেরই মাথা ভাঙার চেষ্টা করছেন। বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠা মন আরও নিশ্চিত হলো, ইহুদীবাদীদের আমরা বুকে টেনে নিয়ে যতই আদর করি, তাদের প্রয়োজনে তারা আমাদের বুকে ছুরি মারবেই। এসব মনে আসার সাথে সাথে আরও অনেক কথা মনে পড়ে গেল। আমেরিকান এক ইতিহাসবিদের সাথে আমার পরিচয় ছিল। তিনি বলতেন, জার্মানীতে ইহুদী হত্যার যে প্রেক্ষাপট বলা হয়, তার গোটাটাই সাজানো। তাঁর কথা শুনে আমি বিশ্বাস করতাম না। ভাবতাম, বলতাম, আপনার মধ্যে এ্যান্টি সেমিটিক মনোভাব প্রবল। আজকের যুগে এমন সাম্প্রদায়িক মনোভাব চলে না। পরবর্তীকে ঐ ইতিহাসবিদ তার কয়েকজন সমমনা বন্ধুদের নিয়ে একটি ‘হিস্টোরিক্যাল ফাউন্ডেশন’ গঠন করেছিলেন। এই ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে জার্মানীর গণহত্যা বিষয়ে প্রকৃত দলিল দস্তাবেজ যোগাড় করেছিলেন এবং এই বিষয়ে তারা গবেষণা করছিলেন। কাজ অনেকখানি এগুবার পর তারা ঘোষণা দেন যে, জার্মানীতে ষাট লক্ষ বা অনুরূপ অংকের ইহুদী হত্যার উপযুক্ত প্রমাণ যে হাজির করতে পারবে, তাকে পঞ্চাশ হাজার ডলার পুরষ্কার দেয়া হবে। শুনেছিলাম পুরষ্কার নেবার জন্যে কেউ তাদের কাছে প্রমাণ নিয়ে হাজির হয়নি। তার বদলে তাদের গবষণা ফাউন্ডেশনের গোটা কমপ্লেক্সটাই বিষ্ফোরণে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ইহুদীবাদীদের দাবীকে বানোয়াট প্রমাণ করার জন্যে যোগাড় করা অমূল্য সব তথ্য ও দলিল-দস্তাবেজ। এই ঘটনার পর ঐ ইতিহাসবিদকে আমি কাঁদতে দেখেছি ও বলতে শুনেছি, ইহুদীবাদীরা বিষ্ফোরণ ঘটিয়ে আমাদের ‘হিস্টোরিক্যাল ফাইন্ডেশন’ ধ্বংস করেছে তাই নয়, ধ্বংস করেছে আমেরিকান সচেতন ও স্বাধীন বিবেককে। সেদিন ঐ ঐতিহাসিকের প্রতি কিছু করুণা সৃষ্টি হওয়া ছাড়া তার কথার এক বর্ণও আমি বিশ্বাস করি।। বেঞ্জামিন বেকন ও অন্যান্যদের কথা শোনার পর ঐ ঐতিহাসিকের কথাই খুব বেশি করে মনে পড়েছিল। বুকের ভেতরে খুব বেদনার সঞ্চার হেয়ছিল। বুঝতে পেরেছিলাম, কত দুঃখে ঐ অভিজ্ঞ ইতিহাসবিদ কেঁদেছিলেন। এই বিষয়গুলো নিয়ে আমি যতই ভাবতে লাগলাম, আপনার প্রতি, মুসলমানদের প্রতি আমার মন ততই প্রসন্ন হয়ে উঠতে লাগল। শেষে আমার অজান্তেই আপনি জর্জ আব্রাহাম, এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার, জেনারেল শেরউড প্রমুখ শীর্ষ আমেরিকানদের মত আমার বন্ধু হয়ে গেলেন। এই পরিবর্তন নিঃসন্দেহে একটা মিরাকল এবং এই মিরাকলের নট হলেন বেঞ্জামিন বেকন।’
ডেভিড গোল্ড ওয়াটারের দীর্ঘ বক্তব্য শেষ হবার সাথে সাথে বেঞ্জামিন বেকন গোল্ড ওয়াটারকে লক্ষ্য করে বলল, ঠিকই বলেছেন আমি নট বা অভিনেতা। কিন্তু অভিনয়কারী তো আসল লোক নয়, যারা ভূমিকায় অভিনয় করা হয়, সেই আসল। আসল লোক আহমদ মুসা, যা আপনিও বলেছেন।’
ডেভিড গোল্ড ওয়াটার কিছু বলতে যাচ্ছিল। তার আগেই আহমদ মুসা বলে উঠল, ‘আমি মি. ডেভিড গোল্ড ওয়াটারকে মোবারকবাদ জানাচ্ছি এবং সেই সাথে আমার জানার খুব আগ্রহ যে, ক্যারিবয়ান দ্বীপে যা ঘটেছে, সে ব্যাপারে কিছু ভেবেছেন কি না?’
ডেভিড গোল্ড ওয়াটার সংগে সংগে উত্তর দিল না। চেয়ারে গা এলিয়ে দিল। বুজে গেল তার চোখ দুটি। ভাবছে সে। অল্পক্ষণ পরে বলল, ‘মি. আহমদ মুসা আপনার এই প্রশ্নের উত্তর আমি এখন দিতে পারবো না। বিষয়টা নিয়ে আমি অনুসন্ধান শুরু করেছি। এখন পর্যন্ত যা জানতে পেরেছি, আমার আগে হোয়াইট ঈগলের চেয়ারম্যান ছিলেন গোল্ডম্যান। তাঁর সময়ে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে জনসংখ্যা নীতি অর্থাৎ মুসলিম জনসংখ্যা হ্রাসকরণ প্রোগ্রাম হোয়াইট ঈগল গ্রহণ করে। এই প্রোগ্রাম যার মাথা থেকে আসে তিনি হলেন হেনরী হ্যানসেন। একজন জনপ্রিয় ক্যাথলিক খৃষ্টান স্যোশ্যাল ওয়ার্কার ছিলেন তিনি। গোল্ডম্যান এবং ‘হোয়াইট ঈগল’- এর অন্যান্যরা লুফে নেয়, হেনরী হ্যানসেনের পরিকল্পনা। শুরু হয়ে যায় তার বাস্তবায়ন ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে। পরবর্তীকালে এক ঘটনায় হঠাৎ প্রকাশ হয়ে পড়ে হেনরী হ্যানসেন ইহুদী এবং তাঁর প্রকৃত নাম সাবাত সালেম। সে সময় যখন তার এই ইহুদী পরিচয় পাই, তখন আমার কিছুই মনে হয়নি। কিন্তু আজ একে আমার কাছে খুব বড় বিষয় বলে মনে হয়েছে। ইহুদীরা কাঁকা দিয়ে কাঁটা তুলে সব কাঁটাকেই পথ থেকে সরাতে চায়। ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে তাই হয়েছে। ওখানে মুসলমান ও খৃস্টানরা সাপ ও নেউলের লড়াইয়ের মত একে অপরকে ধ্বংস করতে এক পায়ে খাঁড়া। ইশ্বরকে ধন্যবাদ, মি. আহমদ মুসা শুধু ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের মুসলমানদের রক্ষা করেননি, আজ আমাদের চোখও খুলে দেয়ার ব্যবস্থা করেছেন। আমি ইতিমধ্যেই ফার্ডিন্যান্ডকে বলেছি ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে মুসলমানদের সাথে সকল বৈরিতার অবসান ঘটাতে।’ থামল গোল্ড ওয়াটার।
‘ধন্যবাদ মি. গোল্ড ওয়াটার। কিন্তু ফার্ডিন্যান্ডের জন্যে বিষয়টা মেনে নেয়া বোধহয় কঠিন হবে। সে দারুণ মুসলিম বিদ্বেষী।’
হাসল গোল্ড ওয়াটার। বলল, ‘আপনি তো ফার্ডিন্যান্ডের ঘরকেই দখল করে বসে আছেন।’
‘কেমন?’
‘কেন? শিলা সুসান। শিলা সুসান তো ফার্ডিন্যান্ডের সব। আপনি জানেন না শিলা সুসান ইতিমধ্যেই তার বাপকে তৈরী করে ফেলেছে। আমি যখন ফার্ডিন্যান্ডকে বললনাম আমার কথা, তখন মনে হলো সে যেন বড় বিপদ থেকে বেঁচে গেল। বলল, ‘আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ স্যার, আমি ও কথাটা আপনাকে বলব বলে ভাবছিলাম। কিন্তু সাহস পাচ্ছিলাম না।’ থামল ডেভিড গোল্ড ওয়াটার।
আহমদ মুসা তাকাল সানওয়াকারের দিকে। বলল, ‘শিলা সুসান কোথায় মেরী রোজ জানে?’
‘ও বিশ্ববিদ্যালয়ে। কদিন আগে সে সানসালভাদর থেকে এসেছে।’ বলল সানওয়াকার।
‘ওকে আমার ধন্যবাদ দিও।’ আহমদ মুসা বলল।
হাসল সানওয়াকার। বলল, ‘ধন্যবাদ নেবে বলে মনে হয় না। ওরা সবাই ক্ষেপে আছে।’
‘কেন?’
‘সবাইকে আপনি উদ্বেগ-আতংকের মধ্যে রেখেছেন। কোন খবরও কাউকে দেননি, কাউকে খবর নেবার সুযোগও দেননি।’
‘ওদের অভিযোগ সত্য। ওদের বলবে, আমার দিন কাটছে পর্বত প্রমাণ এক উদ্বেগ মাথায় নিয়ে। কাহোকিয়া থেকে যে উদ্দেশ্যে দ্রুত বের হয়েছিলাম, তার এখনও কিছুই করতে পারিনি। ডাক্তার মার্গারেট ও লায়লা জেনিফারকে এখনও মুক্ত করা যায়নি।’ বলল আহমদ মুসা। তার কণ্ঠ ভারী।
আহমদ মুসা থামতেই ডেভিড গোল্ড ওয়াটার বলল, ‘মি. আহমদ মুসা, আমি ডা. মার্গারেট ও লায়লা জেনিফারের বিষয় নিয়েই আপনাকে আশা করছিলাম বেশি।’ গম্ভীর কণ্ঠ গোল্ড ওয়াটারের।
চমকে উঠে ফিরে তাকাল আহমদ মুসা গোল্ড ওয়াটারের দিকে। বলল, ‘ওদের কোন খবর আছে? আমি যতদূর জানি ওরা এখন শ্যারনদের হাতে।’
‘হ্যাঁ তাই। তাদের আগ্রহে আমরা ওদেরকে তাদের হাতে তুলে দিয়েছিলাম। তবে ওদের খবর আমরা রেখেছি। বিশেষ করে মার্গারেটের প্রতি আমার একটা দুর্বলতা আছে। সে আমার এক উপকারী বন্ধুর কন্যা। আমার মন চায়নি তার কোন সর্বনাশ হোক। তাই ওদের খবর রাখার একটা ব্যবস্থা রেখেছিলাম। কিন্তু ……’। বলতে বলতে থেমে গেল গোল্ড ওয়াটার।
‘কিন্তু কিছুক্ষণ আগে খবর পেলাম,’ আবার বলতে শুরু করল গোল্ড ওয়াটার। ‘আমার সেই লোকটিকে খুন করা হয়েছে। এর অর্থ সে ধরা পড়ে গেছে এবং ওখানকার খবর বাইরে যাবার পথ বন্ধ করার জন্যেই তাকে খুন করা হয়েছে।’ থামল গোল্ড ওয়াটার।
চমকে উঠল আহমদ মুসা। প্রবল একটা আশংকা এসে মনটাকে তার ঘিরে ধরল। শ্যারনরা খ্যাপা কুকুরের চেয়েও ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। প্রতিশ্রুতির তোয়াক্কা না করে লায়লা জেনিফার ও ডা. মার্গারেটের কোন ক্ষতি তারা করে ফেলতে পারে। আহমদ মুসা তাদের হাতে ধরা দেবে এটা নিশ্চয় তারা এখন মনে করছে না। সুতরাং ভাবতে গিযে বুকটা কেঁপে উঠল আহমদ মুসার। তাকাল সে একবার জর্জের দিকে নিজেকে বড় অপরাধী মনে হচ্ছে তার নিজের কাছেই শেষে আহমদ মুসা তাকাল ডেভিড গোল্ড ওয়াটারের দিকে। বলল, ‘আপনি কি ভাবছেন?’
গোল্ড ওয়াটার উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল আহমদ মুসাকে, ‘আপনি এখন কি মনে করছেন? আমি আপনাকে নিয়ে আসার জন্য বেঞ্জামিন বেকনকে অনুরোধ করেছিলাম, একথা বলার জন্যেই।’
‘আপনি তাদের ঠিকানা দয়া করে দিন। আমি এখনি সেখানে যাব।’ আহমদ মুসা বলল। আবেগে ভারী আহমদ মুসার কণ্ঠ।
‘ধন্যবাদ মি. আহমদ মুসা। কিন্তু আপনি একা নন, আমরাও যাব। পাপটা আমার, তাদের জন্যে কিছু করতে পারলে কিছুটা প্রায়শ্চিত্য হতে পারে।’ বলল গোল্ড ওয়াটার।
‘আপনারা কি প্রস্তুত?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘কিন্তু আপনি তো প্রস্তুত নন।’ বলল ডেভিড গোল্ড ওয়াটার।
‘আমি এটা জানি ইয়ংম্যান। সেজন্যে আমরা প্রস্তুত হয়েই আছি। প্লেন রেডি। আপনার সিদ্ধান্তের জন্যে আমরা সবাই অপেক্ষা করছি।’ ‘আমি আসব কি করে আপনি নিশ্চিত ছিলেন?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘আপনি আসবেন না এ চিন্তা আমার মাথা আসেইনি। আর আমি নিশ্চিত ছিলাম লায়লা জেনিফারদের খবর জানার পর আপনি এক মুর্হূতও দেরী করবেননা।’ গোল্ড ওয়াটার বলল।
‘ধন্যবাদ মি. গোল্ড ওয়াটার।’
বলে আহমদ মুসা তাকাল বেঞ্জামিন বেকনের দিকে। বলল, ‘আপনি যাচ্ছেন আমাদের সাথে?
‘আপনি কি মনে করছেন?’ বলল বেঞ্জামিন বেকন।
আহমদ হাসল। বলল, ‘প্রশ্ন আমি আগে করেছি। অতএব আপকি ভাবছেন সেটা আগে বলবেন।’
গম্ভীর হলো বেঞ্জামিন বেকন। বলল, ‘আমার উপর নির্দেশ এসেছে, চলমান ইস্যু ও এর সাথে সংশ্লিষ্ট সকল বিষয়ে আপনার সিদ্ধান্তই ‘ফেম’ মানে ‘ফ্রি আমেরিকা’র সিদ্ধান্ত।’
ভ্রু কুঞ্চিত হলো আহমদ মুসার। বলল, ‘কে নির্দেশ দিয়েছে।’
হাসল বেঞ্জামিন বেকন। বলল, ‘জনাব, এটা আমাদের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার।’
আহমদ মুসা হেলে তাকাল গাল্ড ওয়াটারের দিকে। বলল, ‘তাহলে আমরা সাবইতো এখন উঠতে পারি।’
‘আমরা মানে কি সানওয়াকার ও জর্জও যাচ্ছে আমাদের সাথে?’ বলল ডেভিব গোল্ড ওয়াটার।
‘সানওয়াকার নয়। ওর পড়াশুনার অনেক ক্ষতি হয়েছে।’
আহমদ মুসার কথায় মুখ মলিন হলো সানওয়াকারের। কিন্তু কোন প্রতিবাদ করল না। মনটা তার প্রতিবাদী হলেও সে ভাবল, আহমদ মুসার কোন সিদ্ধান্তই অনর্থক নয়।
সবাই উঠল।
উঠে দাঁড়ানোর সময় আহমদ মুসার চোখ পড়েছিল গোল্ড ওয়াটারের বাম পাশ সোজা দেয়ালে একটা পর্দা বুঝছিল তার দিকে। আহমদ মুসার মনে হলো, পর্দার রংটা যেন হঠাৎ বদলে গেল। পর্দার মাঝখানের স্যাডো রংটা সরে গিয়ে তা যেন উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
চট করে প্রশ্ন জাগল আহমদ মুসার মাথায়, পর্দার ওপারে কি কেউ দাঁড়িয়েছিল?’
আহমদ মুসা চোখ ফিরাল গোল্ড ওয়াটারের দিকে। বলল, ‘মাফ করবেন মি. গোল্ড ওয়াটার আপনার পি, এ কি আছেন?’
‘হ্যাঁ, আছেন। কেন?’ বলল গোল্ড ওয়াটার।
‘একটা কথা বলব।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আচ্ছা ডাকছি’ বলে মি. গোল্ড ওয়াটার ইন্টারকমের একটা বোতামে চাপ দিল। কিন্তু কোন রেসপন্স হলো না ওদিক থেকে। হঠাৎ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল গোল্ড ওয়াটার, ‘স্যরি, মি. আহমদ মুসা, ও বলেছিল পাশেই কোথাও যেন যাবে। বোধহয় তাহলে সেখানেই গেছে। কোন জরুরী কিছু বলার ছিল?’
আহমদ মুসা একটু ভাবল। কথা যেন সাজিয়ে নিল। বলল, ‘না ঠিক আছে। মনে করেছিলাম, সানওয়াকারের সাথে ওর পরিচয় করিয়ে দেব।’
কথাগুলো বলতে পেরে খুশি হলো আহমদ মুসা। তাৎক্ষণিকভাবে সাজানো কথাগুলো অসংগত হয়নি। কিন্তু সেই সাথে তার মনে পুরনো প্রশ্নটা আবার জেগে উঠল, সত্যিই পর্দার ওপারে কি কেউ আড়ি পেতে ছিল, না তার দেখার ভুল, কিন্তু চোখের সামনে জলজ্যান্ত যা ঘটল তা ভুল হতে পারে কেমন করে?
গুরুত্বপূর্ণ অভিযানের মুখে মনে সন্দেহের একটা কালো মেঘ উদয় হওয়ায় স্বস্তিবোধ করল না আহমদ মুসা। তবে এখন আলোচনার যোগ্য নয় বলে বিষয়টাকে চেপে যাওয়াই ঠিক মনে করল আহমদ মুসা।
‘পরিচয় না হলেও অসুবিধা হবে না। আমি বলে যাচ্ছি, সানওয়াকার আমার পি.এ’সহ যে কোন কারও সাথে যোগাযোগ করতে পারবে।’
বলে ডেভিড গোল্ড ওয়াটার ইন্টারকমে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিল। সবাই বেরিয়ে আসছিল গোল্ড ওয়াটারের অফিস কক্ষ থেকে। হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এল ডিউটি অফিসার। ডেভিড গোল্ড ওয়াটারের হাতে এক শিট কাগজ তুলে দিতে দিতে বলল, ‘এই মাত্র এল স্যার মিয়ামী থেকে। খুব জরুরী বলা হয়েছে।’
সবাই থমকে দাঁড়িয়েছিল।
ডেভিড গোল্ড ওয়াটার ডিউটি অফিসারের হাত থেকে কাগজটি নিল।
সবার চোখ গোল্ড ওয়াটারের দিকে।
কাগজটির উপর নজর বুলাচ্ছিল গোল্ড ওয়াটার। পড়ার সাথে সাথেই গোল্ড ওয়াটারের মুখটা মলিন হয়ে গেল।
গোল্ড ওয়াটারের এই পরিবর্তন আহমদ মুসার চোখে পড়ল। উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল আহমদ মুসা। ডা. মার্গারেটদের কোন খারাপ খবর নয় তো?
দ্রুত কণ্ঠে আহমদ মুসা জিজ্ঞেস করল, ‘কি খবর মি. গোল্ড ওয়াটার? কোন দুঃসংবাদ নয়তো?’
‘পড়ে দেখুন আহমদ মুসা। আপনার জন্যেও মেসেজ রয়েছে।’ বলে গোল্ড ওয়াটার কাগজ খন্ডটি তুলে আহমদ মুসার হাতে দিল এবং বলল, ‘আসুন বসা যাক। কিছুটা ভাবতে হবে এখন।’
কথা শেষ করেই গোল্ড ওয়াটার ভেতরে ঢুকে গেল।
আহমদ মুসাও চিঠির উপর নজর রেখেই ফিরে চলল এবং গিয়ে গোল্ড ওয়াটারের পাশেই বসল।
পড়তে পড়তে তার মুখেও মলিনতার একটা ছায়া নামল।
পড়া শেষ করে তাকাল আহমদ মুসা গোল্ড ওয়াটারের দিকে। বলল, ‘তার মানে ওরা লায়লা জেনিফার ও ডা. মার্গারেটকে অন্য কোথাও সরিয়ে নিয়েছে।’
‘তাই বুঝা যাচ্ছে আহমদ মুসা। হঠাৎ আজ তাড়াহুড়া করে এটা করল কেন তা?’ বলল গোল্ড ওয়াটার চিন্তিত কণ্ঠে।
‘করল কারণ আপনার লোককে হত্যা করার মাধ্যমে আপনার সাথে যুদ্ধে নামার পর আপনার জানা জায়গায় ওদের রাখবে সেটা স্বাভাবিক নয়।’ বলর আহমদ মুসা।
‘ঠিক বলেছেন আহমদ মুস।’ গোল্ড ওয়াটার বলল।
‘আপনার জন্যে ওতে কি মেসেজ আছে মি. আহমদ মুসা?’ বলল বেঞ্জামিন বেকন।
‘মেসেজটা একটা আপোশ প্রস্তাব, সেই সাথে কঠোর এক হুমকিও। বলা হয়েছে, আমি তাদের ভয়ানক ক্ষতি করলেও ডাক্তার মার্গারেট ও লায়লা জেনিফারকে তারা সম্মানের সাথে রেখেছে। আমি যদি অবিলম্বে আমেরিকা ত্যাগ করতে রাজী হই, তাহলে আমি প্লেনে উঠার সংগে সংগেই ওরা দুজনকে ছেড়ে দেবে। আর আমি যদি আগামী তিন দিনের মধ্যে আমেরিকা ত্যাগ না করি, তাহলে ৪র্থ দিন ভোর বেলায় তাদের লাশ পাওয়া যাবে ফ্লোরিডার কোন বীচে।’ বলল আহমদ মুসা। চোখে-মুখে তার চিন্তার ছাপ।
‘বুঝা যাচ্ছে, শ্যারনরা আহমদ মুসাকে আর হাতে পেতে চায় না। আহমদ মুসা আমেরিকা ছাড়লেই তারা বেঁচে যায়। ঠিকই এটা একটা আপোশ প্রস্তাব।’ বলল গোল্ড ওয়াটার।
কথা শেষ করে একটু থামল সে। নড়ে-চড়ে সোজা হয়ে বসে বলল, ‘মি. আহমদ মুসা, এই আপোশ প্রস্তাব নিয়ে কি ভাবছেন বলুন।’ ‘একজন বিশেষ আমেরিকান হিসাবে আপনি এ ব্যাপারে কি ভাবছেন বলুন।’ গম্ভীর কণ্ঠে পাল্টা প্রশ্ন করল আহমদ মুসা।
‘একটুও ভাবার প্রয়োজন নেই এ ব্যাপারে। ইহুদীবাদী শ্যারনরা যে কারণে চাইছেন আপনি তাড়াতাড়ি আমেরিকা ত্যাগ করুন, সেই একই কারণে আমেরিকা আপনাকে ছাড়তে পারে না।’ বলল গোল্ড ওয়াটার স্থির ও গম্ভীর কণ্ঠে।
নতুন উত্তরের জন্যে আহমদ মুসা একে একে তাকাল বেঞ্জামিন বেকন, সান ওয়াকার ও জর্জের দিকে। একই জবাব দিল সকলে। জর্জ তার সাথে আরও যোগ করল, ‘এখন মহাবিপদে পড়ে ওরা এসব আপোশের কথা বলছে। কিন্তু বিপদ কাটলে সবার উপর সুদে-আসলে দেবে, এরও নিশ্চয়তা নেই। আমার মাঝে মাঝে ভয় হয়, ওরা বেঁচেই আছে কিনা। তাই আমি মনে করি শেষ দেখার জন্যে এগোনই দরকার। আল্লাহ আমাদের ভরসা।’
‘ধন্যবাদ জর্জ। ধন্যবাদ সকলকে। আমারও এটাই মত।’
‘ধন্যবাদ মি. আহমদ মুসা। ধন্যবাদ সকলকে।’
বলে একটা দম নিয়ে আবার বলে উঠল গোল্ড ওয়াটার, ‘আমরা যাচ্ছিলাম মিয়ামীতে। কিন্তু নতুন পরিস্থিতিতে আমরা কি করব, কোথায় যাব?’ কিছু চিন্তা করেছেন মি. আহমদ মুসা?’
‘ও বিষয়টা মিয়ামীতে গিয়েই চিন্তা করা যাবে মি. গোল্ড ওয়াটার। ওরা মিয়ামী থেকে গাড়িতে করে উত্তরে গেছে, প্লেনে যায়নি। তার অর্থ ওরা ফ্লোরিডাতেই থাকবে আর উপকূল এলাকাতেই তারা থাকবে, কারণ তিন দিন পর ডাক্তার মার্গারেটদের লাশ তারা ফ্লোরিডার কোন বীচে ফেলে রাখবে।’
‘ঠিক আহমদ মুসা। তাহলে চলুন দেরী না করে যাত্রা করি।’ গোল্ড ওয়াটার বলল। বলতে উঠে দাঁড়াল গোল্ড ওয়াটার।
উঠে দাঁড়াল সাবই।

আটলান্টিকের নীলজল স্নাত মিয়ামী নগরী।
গ্লামার নগরী মিয়ামীর পূর্ব পাশে সাগর। উত্তর দিক থেকে উপকূল বরাবর হয়ে কয়েকটা রাস্তা প্রবেশ করেছে মিয়ামীতে। আবার একাধিক রাস্তা বেরিয়ে গেছে মিয়ামী থেকে দক্ষিণে। দুটি নদী পশ্চিম দিক থেকে ‘v’ আকারে এগিয়ে এসে অতিক্রম করেছে মিয়ামীকে। ‘v’-এর বটমটাই মিয়ামী নগরী।
মিয়ামীর পশ্চিম দিকে বেশ কিছুটা দূর থেকে দুটি উত্তর দক্ষিণ সমান্তরাল রাস্তা নদী দুটিকে ক্রস করেছে। দুই রাস্তা ও দুই নদীর মাঝখানের বিশাল ভূখন্ডই মিয়ামী বিমান বন্দর।
বিশাল বিমান বন্দরে ল্যান্ড করল ডেভিড গোল্ড ওয়াটারের ব্যক্তিগত বিমানটি।
বিমান সফরে আহমদ মুসার পাশেই বসেছিল গোল্ড ওয়াটার। আহমদ মুসার অন্য পাশে বসেছিল বেঞ্জামিন বেকন।
বিমান তখন টারমাকে গিয়ে স্থির হয়েছে। বিমানের দরজাও খুলে গেছে।
গোল্ড ওয়াটার সকলকে বাইরে বেরুবার জন্য প্রস্তুত হবার আহবান জানিয়ে নিজে উঠে দাঁড়িয়েছিল।
আহমদ মুসার মধ্যে নড়াচড়ার কোন লক্ষণ দেখা গেল না। বরং সে গোল্ড ওয়াটারকে বসতে অনুরোধ করল।
গোল্ড ওয়াটার তার সিটে বসে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘কিছু বলবেন মি. আহমদ মুসা?’
‘হ্যাঁ।’ বলে আহমদ মুসা একটু ঘুরে বসল গোল্ড ওয়াটারের দিকে। বলল, ‘আমরা ডা. মার্গারেটদের উদ্ধারের জন্য জেনারেল শ্যারনদের বিরুদ্ধে একটা অভিযানের লক্ষ্য নিয়ে এখানে এসেছি, এ বিষয়টা কি এখানকার কাউকে জানিয়েছেন?’
‘অবশ্যই না। কারণ কোনভাবে এ কথা এখানে জানাজানি হয়ে গেলে শুরুতেই বাধা আসতে পারে।’ বলল ডেভিট গোল্ড ওয়াটার।
‘কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, আমাদের এ পরিকল্পনার কথা জেনারেল শ্যারনের কাছে পৌছে গেছে।’ আহমদ মুসা একটু চিন্তিত কণ্ঠে বলল।
‘অসম্ভব! কিভাবে? আপনার এমনটা মনে হচ্ছে কেন?’ সিটে সোজা হয়ে বসে দ্রুত কণ্ঠে প্রত্যয়ের সাথে বলল গোল্ড ওয়াটার।
আমি নিশ্চিত, আপনার অফিসে বসে আমরা যখন এ পরিকল্পনা করছিলাম তখন কেউ একজন পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে আমাদের সব কথা শুনেছে।’ আহমদ মুসা বলল।
বিস্ময়ে মুখ হা হয়ে গেল মি. গোল্ড ওয়াটারের।
কিন্তু গোল্ড ওয়াটারের কিছু বলার আগেই গোল্ড ওয়াটারের অফিস কক্ষ ও তার পিএ’র অফিস কক্ষের মাঝখানের খোলা দরজার পর্দার আড়াল থেকে একটা ছায়া সরে যেতে দেখার কথা বিস্তারিত বলল আহমদ মুসা।
‘এ জন্যেই কি আপনি আমার পিএ’র খোঁজ করেছিলেন?’ আপনি কি আমার পিএ’কেই সন্দেহ করছেন?’ বলল গোল্ড ওয়াটার। তার চোখে মুখে চিন্তা ও উদ্বেগের চিহ্ন।
‘আপনার পিএ হতে পারে আবার অন্য কেউও হতে পারেন। সেদিন সে সময়ে আপনার অফিস স্টাফদের মুভমেন্ট মনিটরিং থেকেই আপনি এটা বের করতে পারবেন। কিন্তু এখন এই মুহূর্তের বড় বিষয় হলো, আমাদের করণীয় কি তা ঠিক করা। পর্দার আড়াল থেকে ছায়া মূর্তিকে সরে যেতে দেখার পরমুহূর্তেও খোঁজ করে আপনার অফিস কক্ষের আশে পাশে কাউকে পাওয়া যায়নি। তার অর্থ এও হতে পারে যে, খবরটা যথাস্থানে দ্রুত পাচার করার জন্যই সে দ্রুত সরে গিয়েছিল।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তাহলে আপনি বলছেন, আমাদের অভিযানের কথা, আমরা এখানে আসছি, একথা ইতিমধ্যেই এখানে পৌছে গেছে?’ গোল্ড ওয়াটার বলল।
‘আমার তাই মনে হয়।’ বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা থামার পর সঙ্গে সঙ্গেই কথা বলল না ডেভিড গোল্ড ওয়াটার। ভাবছিল সে। কিছুক্ষণ পর সে বলল, ‘পর্দার আড়ালে আপনার ছায়ামুর্তি দেখা সত্য হলে যা বললেন সবটাই সত্য।’
বলে একটু থামল। তারপর আর শুরু করল সে, ‘এ সময় আপনি নিশ্চয় একটা কিছু চিন্তা করে বিষয়টা তুলেছেন। সে চিন্তাটা কি আহমদ মুসা?’
‘আমাদের এখান থেকে যাওয়ার এ্যারেঞ্জমেন্টটা কি হয়েছে?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার কথা শেষ হলো সেই সময় প্লেনের খোলা দরজায় একজন যুবক প্রবেশ করল। তাকে দেখে গোল্ড ওয়াটার উঠে দাঁড়িয়ে স্বাগত জানিয়ে বলল, ‘গুড ডে মি. জ্যাক।’
তারপর আহমদ মুসার সাথে তাকে পরিচয় করিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘এ মি. জ্যাকসন। হোয়াইট ঈগল মিয়ামীর স্টেশন কমান্ডার।’ আর আহমদ মুসার পরিচয় দিতে গিয়ে তার নাম বলল, ‘আহমদ আবদুল্লা। আমাদের মূল্যবান সাথী।’
আব্দুল্লা ছদ্ম পরিচয় দেয়ায় আহমদ মুসা খুশি হলো। মনে মনে গোল্ড ওয়াটারের পরিস্থিতি, সচেতনতার প্রশংসা করল আহমদ মুসা।
পরিচয় পর্ব শেষ করেই গোল্ড ওয়াটার মি. জ্যাককে লক্ষ্য করে বলল, ‘আমার গাড়িটা এবং সাত সিটের বড় জীপটা নিয়ে এসেছি।’ বলল জ্যাক।
‘জীপের কাঁচগুলো কি শ্যাডো কাঁচ?’ গোল্ড ওয়াটার কিছু বলার আগেই জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘শ্যাডো ও স্বচ্ছ দুই কাঁচের ব্যবস্থাই গাড়িতে আছে।’ বলল জ্যাক।
‘গুড। বলল আহমদ মুসা।
‘গাড়িগুলো কি টারমাকে নিয়ে এসেছ’ জ্যাককে জিজ্ঞেস করল গোল্ড ওয়াটার।
‘হ্যাঁ।’ বলল জ্যাক।
‘তাহলে উঠা যাক।’ সবাইকে লক্ষ্য করে বলল গোল্ড ওয়াটার। আহমদ মুসা উঠার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করল না। তার কপাল কুঞ্চিত। ভাবছিল সে।
গোল্ড ওয়াটার ব্যাপারটা খেয়াল করল। বলল, ‘কিছু ভাবছেন মিস্টার …….।’ কথা শেষ করল না গোল্ড ওয়াটার।
‘আমি ভাবছি মি. গোল্ড ওয়াটার, আমরা এয়ারপোর্ট লাউঞ্জে গিয়ে একটু বসি। চা খাব, কিছু কাজও আছে। আর মি. জ্যাক দুটি গাড়ি নিয়ে ফেরত যাবেন। ঘন্টা খানেক পরে ফিরে এসে লাউঞ্জে আমাদের সাথে মিলিত হবেন।’
কথা শেষ করেই দ্রুত কণ্ঠে আবার বলে উঠল আহমদ মুসা, ‘হ্যাঁ, জীপের শ্যাডো কাঁচ তুলে টারমাক থেকে বের হতে হবে।’
প্রবল জিজ্ঞাসা ও বিস্ময়ের একটা ছায়া খেলে গেল গোল্ড ওয়াটারের চোখে-মুখে। কিন্তু পরক্ষণেই স্বাভাবিক হয়ে এল গোল্ড ওয়াটার। তার জ্যাকের দিকে ফিরে বলল, ‘ঠিক আছে জ্যাক, বুঝেছো কি করতে হবে?’
‘জি স্যার।’ বলল জ্যাক।
‘তাহলে যাও, গুড ডে। গুড বাই।’
জ্যাকদের গাড়ি স্টার্ট নেবার শব্দ হলো।
‘কি ব্যাপার মি. আহমদ মুসা? জ্যাককে এভাবে বিদ্যায় করলেন কেন? ওরা তো ওয়েট করতে পারতো।’ বলল গোল্ড ওয়াটার।
‘ক্ষতি নেই। জ্যাকরা একটু ঘুরে আসুক! চলুন আমরা লাউঞ্জে যাই।’
বলে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
‘চলুন। তথাস্তু। নিশ্চয় কোন কথা আপনার মনে আছে, বলছেন না। লাউঞ্জে আপনার কাজ দেখলেই বুঝবো। চলুন।’
উঠতে উঠতে বলল গোল্ড ওয়াটার।
লাউঞ্জে গিয়ে টয়লেট থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে সবাই চা খেল।
চা খাওয়ার পর গোল্ড ওয়াটার আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল,
‘মি. আহমদ মুসা কি যেন করবেন বলেছিলেন?’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘অপেক্ষা করাটাই এখনকার কাজ। এই অবসরে আপনি একটু ভাবুন, মিয়ামীর উত্তরে ফ্লোরিডার কোন শহরের সাথে জেনারেল শ্যারনের বিশেষ সম্পর্ক আছে কি না।’
সোফায় হেলান দিল গোল্ড ওয়াটার। ভাবল একটু। বলল, ‘আমার জানা নেই। তবে কিছু দিন আগে জ্যাকসনভিল থেকে তার কাছে একটা টেলিফোন গিয়েছিল। শ্যারন ছিলেন না। আমি কথা বলেছিলাম। লোকটি তার পরিচয়ে বলেছিল, সে হাইম শামির, জ্যাকসনভিল সিনাগগের প্রধান। শুধু এই পরিচয়টাই শ্যারনকে বলতে বলেছিল, আর কিছু বলেনি।’
গোল্ড ওয়াটার কথা শেষ করতেই মি. জ্যাক হন্তদন্ত হয়ে প্রবেশ করল লাউঞ্জে। তার চোখ-মুখে উত্তেজনা। চাপা কণ্ঠে অনেকটা চিৎকারের মত করে গোল্ড ওয়াটারকে লক্ষ্য করে বলে উঠল, ‘সাংঘাতিক ঘটনা ঘটেছে স্যার। আহমদ আবদুল্লাহ আপনাদের সকলকে বাঁচিয়েছেন। তা না হলে সর্বনাশ হয়ে যেত স্যার।’
বিস্মিত, উৎকণ্ঠত সবাই সোজা হয়ে বসল। উদগ্রীব হলো সব কথা শোনার জন্যে।
‘ঘটনা কি বল?’ উৎকণ্ঠিত, উদ্বিগ্ন গোল্ড ওয়াটার ধমকের সুরে বলল।
‘স্যার, শহরে প্রবেশ করার মুখে ব্রীজের উপর আমাদের বড় গাড়িটা ধ্বংস হয়ে গেছে।’ কম্পিত গলায় বলল জ্যাক।
‘ধ্বংস হয়ে গেছে? কিভাবে?’ জিজ্ঞেস করল গোল্ড ওয়াটার।
‘বড় গাড়িটা আমার গাড়ির পেছনে আসছিল। ভয়ংকর শব্দ শুনে পেছনে ফিরে দেখলাম, প্রবল বিস্ফোরণে আমাদের গাড়িটা শূন্যে উঠে ছিন্ন বিছিন্ন ও ধ্বংস হয়ে গেল। ড্রাইভারও পুড়ে ছাই হযে গেছে।’ বলল জ্যাক। ভয়ে পান্ডুর তার মুখমন্ডল।
‘বিস্ফোরণে ধ্বংস ………!’
কথা মেষ করতে পারল না গোল্ড ওয়াটার। মাঝ পথেই থেমে গেল।
বিস্ময়, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠায় সে যেন বোবা হয়ে গেল। তার বোবা দৃষ্টিতে ড্রাইভারের পোড়া লাশের দৃশ্য ভেসে উঠল। তাদেরও ঐ দশাই হতো, যদি আহমদ মুসা বাঁধা দিয়ে তাদের লাউঞ্জে না নিয়ে আসত।
মুহূর্তকাল পরেই গোল্ড ওয়াটারের শূন্য বোবা দৃষ্টি গিয়ে পড়ল আহমদ মুসার চোখের উপর।
আহমদ মুসা বুঝতে পারল তার চোখের ভাষা।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘বিস্ময়ের কিছু নেই মি. গোল্ড ওয়াটার। আমরা কোন উদ্দেশ্যে কখন কিসে এখানে আসছি, শ্যারনের এখানকার লোকদের তা জানানো হয়েছে এবং তারাই হত্যার এই পরিকল্পনা এঁটেছিল।’
‘আমাদের গাড়িতেই সেই ব্যবস্থা করেছে তা আপনি জানলেন কেমন করে?’ বলল গোল্ড ওয়াটার।’
‘যখনই বুঝলাম, শত্রুপক্ষ আমাদের এখানে আসার সব কথা জানতে পেরেছে, তখনই আমার মনে হলো, তাদের প্রথম কাজ হবে, আমাদের হত্যার চেষ্টা করা। বিশেষ করে আমি এ অভিযানে শামিল হচ্ছি জানার পর হত্যারই সিদ্ধান্ত নেয়া স্বাভাবিক। আমাকে সরিয়ে দেয়া হবে তাদের জন্যে সবচেয়ে লাভজনক। তারপর চিন্তা করলাম, হত্যার সুযোগ তারা কোথায় নিতে পারে। আমার মনে হলো, ওয়াশিংটনে বিমানে উঠার আগে, বিমানে এবং মিয়ামীতে বিমান থেকে নামার পর হত্যার ব্যবস্থা করাই তাদের প্রাথমিক ও গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সুযোগ। যখন ওয়াশিংটনে বিমানে উঠার আগে এবং বিমানে কিছুই ঘটনা না, তখন মায়ামীতে বিমান থেকে নামার পর শহরে পৌছার সময়টাকে আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে হলো। আমি ভাবলাম, আমাদের গাড়ি বহরে হামলা করে তারা আমাদের হত্যা করার সযোগ নিতে পারে, অথবা খোদ গাড়িতে বোমা পেতে রেখে তা বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে। গাড়িতে বোমা পেতে রাখার ব্যাপারটা তাদের জন্যে আমার কাছে অসম্ভব মনে হয়নি। খোদ গোল্ড ওয়াটারের পিএ যদি শ্যারনদের লোক হতে পারে, তাহলে এখানেও হোয়াইট ঈগলের মধ্যে তাদের লোক থাকতে পারে। এসব চিন্তা করেই ভাবলাম আমাদের নিয়ে যাবার জন্যে আসা গাড়ির শ্যাডো কাঁচ তুলে খালি পাঠিয়ে দেয়া হোক। যাতে শত্রু পক্ষ বুঝে আমরাই যাচ্ছি গাড়িতে। তাতে সন্দেহের টেস্ট হয়ে যাবে।’ থামল আহমদ মুসা।
গোল্ড ওয়াটার কোন কথা বলল না।
তার দৃষ্টি তখনও আহমদ মুসার উপর নিবদ্ধ। তার চোখের দৃষ্টিতে এবার যুক্ত হয়েছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার সাথে বিস্ময় বিমুগ্ধতা।
আহমদ মুসাই আবার কথা বলল। বলল জ্যাকসনের দিকে তাকিয়ে, ‘বলুনতো ড্রাইভারের লাশ কি দেখা গেছে?’
‘না দেখা যায়নি। কয়েকটা টুকরো মাত্র ব্রীজের উপর দেখা গেছে। আর সব নদীতে ছিটকে পড়েছে।’ বলল জ্যাক।
‘কয়জন আরোহী ছিল, কেউ তোমাকে জিজ্ঞেস করেছে।
‘সে সুযোগ কেউ পায়নি। ঐ গাড়ি যে আমার সাথের গাড়ি তা বুঝেনি। পরে কাউকে কিছু না বলে আমি অন্য রাস্তা দিয়ে এসেছি।’
‘ধন্যবাদ জ্যাকসন। খুব ভাল হয়েছে। এখন শত্রু পক্ষ বুঝবে, আমরা সবাই গাড়িতে ছিলাম এবং সবাই নিহত হয়েছি। অনুসন্ধান করেও এর বিপরীত কোন প্রমাণ তারা পাবে না। ডুবোরীরা নিহতদের লাশের টুকরো নদীতে পাবে না। কারণ নদীর স্রোত ততক্ষণে লাশের টুকরোগুলো সাগরে নিয়ে ফেলবে।’ বলল আহমদ মুসা।
এতক্ষণে গোল্ড ওয়াটারের মুখে এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘আপনার এত বুদ্ধি! এত চুলচেরা ভাবেন আপনি? আপনাকে ধন্যবাদ আহমদ মুসা আমাদের সকলের প্রাণ বাঁচাবার জন্যে।’
‘আপনাদের বাঁচালাম কই আমি আমাকে বাঁচাবার জন্যেই এত কিছু করলাম। আমার সাথে আপনারাও বেঁচেছেন।’ আহমদ মুসার মুখে হাসি।
‘বুদ্ধির মত কথা প্যাঁচও দারুণ। আপনার সাথে পারা যাবে না। এখন বলুন, করণীয় কি?’ গোল্ড ওয়াটার বলল।
চোখে-মুখে গাম্ভীর্য নেমে এল আহমদ মুসার। ভাবল। বলল, ‘পরিস্থিতি সম্ভবত এমন দাঁড়াল যে, শত্রু পক্ষ কিছু সময়ের জন্যে ভাবছে গোল্ড ওয়াটারসহ আমরা বিস্ফোরণে নিহত হয়েছি। এই সময়ের মধ্যে তাদের অসতর্কতার সুযোগ নিয়ে তাদের ঘাঁটিতে পৌঁছাতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু সে ঘাঁটি কোথায়? দ্বিতীয় যে কাজটি করা যায় তা হলো, অফিসে গিয়ে নিজেদেরকে প্রকাশ করে দেয়া, যাতে শত্রু পক্ষ এখনই জানতে পারে আমরা বেঁচে আছি। তাহলে সংঘাতের নতুন সূত্রপাত ঘটবে, যার মাধ্যমে তাদের ঘাঁটিতে পৌঁছার আমার সুযোগ সৃষ্টি হবে।’
‘ওদের একটা ঘাঁটির সন্ধান তো সেদিন আপনাকে বলেছিলাম।’ বলল গোল্ড ওয়াটার।
‘মনে আছে, ‘জ্যাকসন ভিল সিনাগগে’র হাইম শামিরের কথা আপনি বলেছিলেন। হ্যাঁ, ওটা জেনারেল শ্যারনের একটা আস্তানা হতে পারে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আমার মনে হয়, ওদের অসতর্ক রেখে আমরা এগোতে পারি। জ্যাকসন ভিল সিনাগগ থেকে আর কিছু না হলেও পথের সন্ধান মিলতে পারে।’ গোল্ড ওয়াটার বলল।
‘আপনি কি প্রস্তুত? আমরা কি এখন জ্যাকসন ভিল রওয়ানা হতে পারি?’
জ্যাকসন ভিল উত্তর ফ্লোরিডার সবচেয়ে বড় শহর। শহরটি আটলান্টিকের সাথে সেন্ট জন নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত। সেন্ট জন নদীটি মধ্য ফ্লোরিডার একগুচ্ছ হ্রদ থেকে উৎপন্ন হয়ে জ্যাকসন ভিলে গিয়ে আটলান্টিকে পড়েছে। জ্যাকসন ভিলের মোহনা থেকে দক্ষিণ দিকে বিস্তৃত সুদীর্ঘ জ্যাকসন ভিল বীচ।
‘অবশ্যই রওনা হতে পারি। পথে কোথাও আমরা লাঞ্চ সংগ্রহ করব। গাড়ির জন্যেও আমাদের অফিসে যাবার দরকার নেই। জ্যাকসনের গাড়িটা ভালো, ওতেই চলবে।
তাহলে ওঠা যাক।
উঠে দাঁড়াল সবাই।
লাউঞ্জ থেকে বেরিয়ে সবাই গিয়ে গাড়িতে উঠল।
‘অভিযানের প্রস্তুতি নিয়ে তো কিছু বললেন না মি. গোল্ড ওয়াটার।’ বলল আহম মুসা।
‘কি বলব? আপনি, বেঞ্জামিন ও জর্জ প্রস্তুতি না নিয়ে নিশ্চয় আমার অফিসে আসেননি। আর আমি সশস্ত্র আছি, জ্যাকসনও তাই।’
‘ধন্যবাদ মি. গোল্ড ওয়াটার।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ওয়েলকাম আহমদ মুসা।’ গোল্ড ওয়াটার বলল।
গাড়ি তখন ছুটতে শুরু করেছে।
লক্ষ্য ফ্লোরিডার সর্ব উত্তরের আটলান্টিকের ফেনিল গর্জন মুখরিত জ্যাকসন ভিল, হাইম শামিরের জ্যাকসন ভিল সিনাগগ।

‘আমাদের সতর্কতা কি একটু বেশি পরিমাণে হয়ে যাচ্ছে না?’ বলল বেগিন লিকুড। তার কণ্ঠে বিরক্তির প্রকাশ।
বেগিন লিকুড আমেরিকান জুইস পিপলস লীগের যুব বিভাগের একজন বেপরোয়া গোছের নেতা। ফ্লোরিডা অঞ্চলের যুব গ্রুপের দায়িত্বে সে।
বেগিন লিকুড যাকে লক্ষ্য করে কথা বলল সে হল হাইম শামির। সে জ্যাকসন ভিল সিনাগগের প্রধান এবং আমেরিকান জুইস পিপলস লীগের ফ্লোরিডা অঞ্চলের সভাপতি।
বেগিন লিকুডের কথা শুনে হাইম শামির একটু ম্লান হাসল। বলল, ‘কোন সতর্কতার কথা বলছ? ডা. মার্গারেট ও লায়লা জেনিফারকে সরিয়ে রাখার কথা?’
‘হ্যাঁ।’ বলল বেগিন লিকুড।
‘যে কারণে মিয়ামী থেকে সরিয়ে তাদের এ সিনাগগে আনা হয়েছিল, সে ধরনের কারনেই আবার পাশের আমাদের মিত্র ভারতীয়ের বাসায় তাদের সরিয়ে রাখা হলো।’ বলল হাইম শামির।
‘মিয়ামীর ঘাটি ওদের কাছে ধরা পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু এখানকার সন্ধান তো ওরা জানে না।’ উত্তরে বলল বেগিন লিকুড।
‘জানে না, একথা বলা যাবে না। আমাকে জেনারেল শ্যারন জানিয়েছেন, সিনাগগ, ক্লাব বা সমিতি জাতীয় ইহুদী কোন স্থান বা স্থাপনাই আজ নিরাপদ নয়। জেনারেল শ্যারনের কাছ থেকে এই সংকেত পাওয়ার পর এবং যখন শুনতে পেলাম যে, আহমদ মুসা ও গোল্ড ওয়াটার মিলিত হয়েছে এবং তারা অন্যান্যদের নিয়ে মায়ামীতে ল্যান্ড করেছে, তখন ওদের সিনাগগে রাখার আর সাহস পাইনি। বলল হাইম শামির।
‘এই সতকর্ততার কি প্রয়োজন এবং তাদের জামাই আদরে রাখার কি দরকার? আহমদ মুসা ধরা দেবে, আমেরিকা ত্যাগ করবে? এসব অবাস্তব কল্পনা। আমাদের হাতে ছেড়ে দিন ও দুজনকে! আমরা ওদের উপর প্রতিশোধ তুলব ইহুদীদের প্রতি ফোটা রক্তের, যা আহমদ মুসা ঝরিয়েছে। তারপর ছবিগুলি এক এক করে পাঠিয়ে দিতে থাকব আহমদ মুসার কাছে। তাহলেই না সে পাগল হবে, পাগল হলেই সে ভুল করবে। সেই ভুলের সুযোগ আমরা নিয়ে তাকে শেষ করতে পারব। বিক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলল বেগিন লিকুড।
‘শোন, আমাদের চেয়ে জেনারেল শ্যারন আহমদ মুসাকে অনেক বেশি চেনে। তিনি আহমদ মুসাকে হাতে পেতে চান, অথবা চান আমেরিকা থেকে সে চলে যাক, তাকে ক্ষেপাতে চান না।’ বলল হাইম শামির শান্ত কণ্ঠে।
‘দেখুন, জেনারেল শ্যারনকে আমরা শ্রদ্ধা করি, সম্মান করি। কিন্তু তাঁর সতর্কতা তাকে জেতায়নি কোন সময়। আমেরিকাতেও তিনি হারছেন আহমদ মুসার কাছে। সুতরাং সতর্কতা নামের দুর্বলতা নয়, আমরা সোজা আঘাত করতে চাই আহমদ মুসাকে। মার্গারেট ও জেনিফার হবে আমাদের প্রথম শিকার। ওদের শতধা লাঞ্ছিতা ও ধর্ষিতা লাশ আমরা আহমদ মুসাকে উপহার দিতে চাই। যন্ত্রণার আগুনে আমরা আহমদ মুসার দেহের প্রতিটি অণু-পরমাণুকে পোড়াতে চাই, ব্যর্থতার আগুনে জ্বালিয়ে ওকে আমরা উন্মাদ করে তুলতে চাই। দিন এখনি ওদের আমাদের হাতে তুলে দিন।’ বলল বেগিন লিকুড।
‘তোমরা তো পাচ্ছই। আর দুদিন। তিন দিনের সময় দেয়া হয়েছে আহমদ মুসাকে আমেরিকা ছাড়ার।’ হাইম শামির বলল।
‘তাকে বলা হয়েছিল আমেরিকা ছেড়ে যেতে, আর সে অভিযানে আসছে ফ্লোরিডায় আমাদের বিরুদ্ধে। আর আমরা আরও দুদিন তার আমেরিকা ছাড়ার অপেক্ষায় থাকব। ঠিক আছে আপনারা অপেক্ষায় থাকুন, আমাদের কাজ আমাদের করতে দিন। আমরা যাচ্ছি ভারতীয়ের বাসায় ওদের তুলে নিয়ে আসতে।’
এই সময়ে ঝড়ের মত ঘরে প্রবেশ করল শিমন। শিমন ইহুদী গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মী, ফ্লোরিডায় জেনারেল শ্যারনের একজন প্রতিনিধি।
প্রবেশ করেই চিৎকার করে উঠল, ‘হিপ হিপ, হুররে।’
‘কি ব্যাপার শিমন? মিয়ামীর কি খবর?’ বলল হাইম শামির।
‘সব খতম, আনন্দ কর, সব খতম।’ দুই হাত তুলে নাচতে নাচতে আবার চিৎকার করল শিমন।
‘কে খতম, কারা খতম? আহমদ মুসারা কি………?’
কথা শেষ না করেই থেমে গেল বেগিন লিকুড। কি উচ্ছ্বাসে কথা তার গলায় আটকে গেল।
শিমন চেয়ারে বসে টেবিলে মুষ্ঠাঘাত করতে করতে বলল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, আহমদ মুসা, গোল্ড ওয়াটারসহ তাদের টিমের সবাই খতম হয়ে গেছে।’
শিমনের কথাটা ঘরে বজ্রপাতের মতই শক ওয়েভের সৃষ্টি করল। হাইম শামির, বেগিন লিকুড সবাই কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলো না।
নিরবতা ভাঙল প্রথমে হাইম শামির। বলল, ‘তুমি যা বলছ বুঝে বলছ? সত্য বলছ? আবার বলত কানকে বিশ্বাস হচ্ছে না।
শিমন আনন্দে হাত দিয়ে টেবিল বাজাতে বাজাতে বলল, ‘যে গাড়ি নিয়ে আহমদ মুসা ও গোল্ড ওয়াটারদেরকে বিমান বন্দর থেকে আনতে যাবার কথা ছিল, সে গাড়িতে ভয়ংকর দূর নিয়ন্ত্রিত গাড়ি বোমা পেতে রেখেছিলাম। সেই বোমার বিস্ফোরণে তাদের নিয়ে গাড়িটা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
আনন্দে মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল হাইম শামির ও বেগিন লিকুডের। বলল বেগিন লিকুড, ‘ঘটনা বিস্তারিত বলল দুকানকে সার্থক করি। তাদের লাশ-টাশ দেখে এসেছ?’
‘তাদের লাশ পাবে কোথায়? সাথে সাথে পুড়ে টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে পানিতে। কিছু টুকরো পড়ে থাকতে দেখেছি ব্রীজের উপর।’
বলে একটা দম নিয়ে আবার শুরু করল শিমন, ‘আমরা হোয়াইট ঈগলের মিয়ামী অফিসের গ্যারেজেই বোমা পাতার কাজ সেরেছিলাম। তারপর ব্রীজের কিছু দূরে নদীতে একটা বোটে বসে ওদের অপেক্ষা করছিলাম। আমাদের চোখের সামনে দিয়েই ব্রীজ পার হয়ে ওরা বিমান বন্দরে গেল। বিমান বন্দর থেকে ফেরার পথে গাড়িটা ব্রীজে উঠল। দেখলাম গাড়ির শ্যাডো কাঁচ তুলে দেয়া। আমরা খুশি হলাম, আহমদ মুসাদের মানুষের চোখ থেকে আড়ালে রাখার জন্যেই শ্যাডো কাঁচ তুলে রাখা হয়েছে। গাড়িটা যখন ঠিক ব্রীজের মাঝ বরাবর পৌছল, তখন কনট্রোল সিস্টেমের লাল বোতামে আমরা চাপ দিলাম। সংগে সংগেই ঘটে গেল কিয়ামত কান্ড। শালারা কেউ বাঁচেনি।’
‘গাড়িতে ওরা ছিল তোমরা নিশ্চিত?’ বলল হাইম শামির।
‘এয়ারপোর্টের বাইরে যে লোক আমাদের পাহারায় সেও আমাদের মোবাইলে জানায়, টারমাকে যাওয়া গাড়ি ওদের নিয়ে বেরিয়ে এল এবং চলে যাচ্ছে।’ বলল শিমন।
‘যদি তাই হয়, তাহলে তুমি যে পুরস্কার পাবে তা কল্পনাও করতে পার না। জান, আজকের জগতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হবে এটা, পুরস্কারও তেমনি বড় হবে।’ বলল হাইম শামির।
‘ওসব বাকি পুরস্কার বাকিতেই থাক। নগদ পুরস্কার এখনই চাই।’ বলল শিমন।
‘কি সেটা?’
‘ডা. মার্গারেট ও লায়লা জেনিফার। সেই শুরুর দিন থেকে শালিদের পেছনে আছি। গায়ে ওদের হাত দিতে পারলাম না। বস আহমদ মুসার ভয় দেখিয়ে আর আশা দিয়ে আমাদের থামিয়ে রেখেছে। আর নয়। শালিদের মুসলমানিত্বের দেমাগ বের করে দিতে চাই। আহমদ মুসা শান্তিতে মরে গেছে। এদের উপর প্রতিশোধ নেব আহমদ মুসার সব জ্বালাতনের।’
হাসল হাইম শামির। বলল, ‘বেগিন লিকুডরাও এ দাবী নিয়ে বসে আছে। ঠিক আছে। পুরস্কার পরে। আপতত এই বোনাস তোমরা নিয়ে যাও। আজকের আনন্দে এই বোনাস তোমাদের যোগ্য প্রাপ্য। তবে তোমরা একটু বস, আমি মায়ামী ও হোয়াইট ঈগলের অফিসে টেলিফোন করে ঘটনার শেষটা জেনে নেই।’
বলে হাইম শামির মোবাইলটা হাতে তুলে নিল।
হাইম শামির তার কথা শেষ করার আগেই বেগিন লিকুড ও শিমনরা উঠে দাঁড়িয়ে আনন্দে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে নাচতে শুরু করেছে। বলছে আশ্রাব্য সব কথা ডা. মার্গারেট ও জেনিফারের উদ্দেশ্যে।
এই হৈচৈ এর মধ্যেই টেলিফোনে কথা বলতে শুরু করেছে হাইম শামির।

ঘরের তালা খোলার শব্দ হলো।
ভয়ের চিহ্ন ফুটে উঠল ডা. মার্গারেট ও লায়লা জেনিফার দুজনের মুখেই।
উঠে বসল দুজনেই।
দরজা খুলে ঘরে প্রবেশ করল ভ্যানিসা নেল।
ভ্যানিসা হাইম শামিরের সিনাগগের একজন পরিচারিকা। বয়স হবে পঞ্চাশের কাছাকাছি।
মার্গারেটরা তাদের গোটা বন্দী জীবনে একজন মাত্র মানুষের সন্ধান পেয়েছে, সে হলো এই ভ্যানিসা। আন্তরিক ব্যবহার, সহানুভুতির কথা শুধু তার কাছ থেকেই শুনেছে।
ভ্যানিসাকে ঘরে প্রবেশ করতে দেখে খুশি হলো, আবার উদ্বিগ্নও হলো দুজনে। বলল, ‘কি ব্যাপার ভ্যানিসা আন্টি?’
‘তোমাদের পালাতে হবে, না হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।’ উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল ভ্যানিসা নেল।
‘ওরা আসছে। তোমাদের দুজনকে নিয়ে যাবে। আড়াল থেকে সব শুনেছি। ওরা আজ মহোৎসব করবে তোমাদের নিয়ে।’ দ্রুত কণ্ঠে বলল ভ্যানিসা নেল।
মার্গারেটের চোখে-মুখে আতংক দেখা দিল। ভয়ে চুপসে গেল তাদের মুখ। তাদের মনে হলো, হঠাৎ যেন তাদের চারদিকের পৃথিবীটা সংকীর্ণ হয়ে গেল। শ্বাসরুদ্ধকর একটা অন্ধকার যেন তাদের দিকে ধেয়ে এল।
কোন কথা তাদের মুখে যোগাল না। বোবা দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে রইল ভ্যানিসার দিকে।
‘দেখ সময় নষ্ট করো না। চল তোমাদের বাইরে বের করে দেব।’ বলল ভ্যানিসা।
‘কিভাবে? কেউ নেই এদিকে?’ বলল মার্গারেট।
‘আছে। তবে ওরা মনে করেছে আমাকে ওরা পাঠিয়েছে। তাই ওরা আপাতত অপেক্ষা করবে। আর এটাই সুযোগ।’ বলল ভ্যানিসা নেল।
ভয় ও উদ্বেগে আড়ষ্ট ডা. মার্গারেট ও লায়লা জেনিফার পুতুলের মত উঠে দাঁড়াল।
দ্রুত বের হলো তারা ঘর থেকে ভ্যানিসার সাথে।
ঘর থেকে বের হবার সময় ভ্যানিসা একটা রিভলবার তুলে দিল ডা. মার্গারেটের হাতে। বল, ‘লুকিয়ে রাখ, যদি দরকার হয় তাহলে……।’
ভ্যানিসা আগে, পেছনে ওরা দুজন।
ভ্যানিসা হঠাৎ মুখোমুখি হলো রবিন সেনে’র সাথে। সে সিঁড়ি দিয়ে উঠছিল।
রবিন সেন একজন ভারতীয়। আমেরিকায় এসেছে তিরিশ বছর আগে। এখন আমেরিকান। কম্যুনিকেশন ইঞ্জিনিয়ার রবিন সেন একটি আমেরিকান এয়ার লাইনসের অর্ধেকেরও বেশি শেয়ারের মালিক এবং সেই সাথে ব্যবস্থাপনা পরিচালকও। ইহুদী পুঁজিপতিদের সাথে তার গভীর সম্পর্ক। শুধু অর্থনৈতিভাবে নয়, তারা পরস্পর রাজনৈতিক মিত্রও। ব্যবসায়ের একটা রাজনৈতিক বিনিয়োগ আছে। সেই বিনিয়োগ রবিন সেন ইহুদী বন্ধুদের মাধ্যমেই সমাধান করে থাকে।
এসব বহুদর্শী ভ্যানিসা জানে। জানে বলেই স্বয়ং রবিন সেনের সাথে দেখা হওয়ার সাথে সাথে সে আড়ষ্ট হয়ে পড়ল। তুব মনের সমস্ত জোর একত্রিত করে ভ্যানিসা বলল, ‘গুড ইভনিং স্যার। ভালো আছেন?’
‘গুড ইভনিং। কিন্তু তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? এ সাপের বাচ্চাদের নিয়ে কোথায় দৌড়াচ্ছো? কোন বিপদ হয়নি তো?’ বলল রসিন সেন। তার চোখে-মুখে কিছুটা উদ্বেগের ছায়া।
‘ওদের সিনাগগে নিয়ে যাচ্ছি স্যার। খুব তাড়া ওদিক থেকে।’ বলল ভ্যানিসা।
‘আচ্ছা।’ বলে রবিন সেন সিঁড়ি দিয়ে আবার উপরে উঠা শুরু করল।
আর ভ্যানিসারাও তখন আবার ছুটতে শুরু করল।
সিঁড়ি মুখের পরেই প্রশস্ত লাউঞ্জ। নানা আকারের সোফায় সাজানো। লাউঞ্জের তিনটি ধাপ পেরিয়ে উপরে উঠলে আবার একটা করিডোর। এ প্রশস্ত করিডোরের শেষ প্রান্তে বিরাট দরজা। দরজার পর আবার প্রশস্ত বারান্দা। এ বারান্দা থেকে সিঁড়ি নেমে গেছে বাইরের লনে। তারপর প্রাইভেট রাস্তা। রাস্তার ওপাশে ঠিক এ বাড়ির বিপরীতেই সিনাগগটি। তবে সিনাগগের গেট আরও একটু সামনে। রাস্তাটা দিয়ে সামনে এগুলে সিনাগগের গেটের পাশ দিয়ে সরকারী রাস্তায় পড়া যায়।
লাউঞ্জ পেরিয়ে করিডোর হয়ে ভ্যানিসারা বাইরের বারান্দায় বেরুবার দরজায় গিয়ে পৌছতেই ভ্যানিসা দেখল লন থেকে সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসছে হাইম শামির, বেগিন লিকুড, মিশন ও আরও দুজন। তারা সিঁড়ি দিয়ে দরজার দিকে উঠে আসছে।
ওদের দেখে আতংকিত ভ্যানিসারা দরজায় দাঁড়িয়ে গেল।
হাইম শামিররাও দেখতে পেয়েছে ভ্যানিসাদেরকে। তারাও প্রথমে চমকে উঠেছে। তারপরেই তারা ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরেছে। সংগে সংগেই চিৎকার করে উঠল হাইম শামির। বলে উঠল, ‘তুমি শেষ পর্যন্ত বিশ্বাসঘাতকতা করলেই ভ্যানিসা………।’
হাইম শামিরের কথা শেষ হতে না হতেই ছুটল বেগিন লিকুড ও শিমন ভ্যানিসাদের দিকে। টার্গেট ডা. মার্গারেট ও লায়লা জেনিফার।
কিন্তু সিঁড়ি থেকে তারা বারান্দায় পা রাখা পর্যন্তই। আর সামনে তারা এগুতে পারলো না। ভ্যানিসার রিভলবার তাদের দিকে উদ্যত হয়ে উঠেছে।
ভ্যানিসার দেখাদেখি ডা. মার্গারেটও তার রিভলবার বের করে তাক করল ওদের দিকে। ডা. মার্গারেট তার কম্পিত দেহটাকে ঠেস দিয়ে রেখেছে দরজার ডান দিকের চৌকাঠে। আর ভ্যানিসা বাম হাতে আঁকড়ে ধরে আছে দরজার ওপাশের চৌকাঠ। তার ডান হাতে রিভলবার।
হাইম শামিমের কথায় ভ্যানিসা চিৎকার করে উঠল, ‘বিশ্বাসের কথা বলছ শামির! আমার সংসার বিরান করেছ, আমার জীবন বিরান করেছ তোমরা। ক্রীতদাসী হয়ে আছি তোমাদের। জীবনের নিস্ফলতাকে মেনে নিয়ে বেঁচে আছি আমি। কিন্তু এই ঈশ্বর ভক্ত দুই মেয়েকে আমার ভাগ্য বরণ করতে আমি কিছুতেই দেব না।’
‘তোমার ভাগ্য বরণের কথা বলছ কেন? ওদেরকে আমরা অন্য জায়গায় নিয়ে যাব। তোমার ভয় মিথ্যা। দেখ না ওদের গায়ে কেউ হাত দেয়নি।’ বলল নরম কণ্ঠে শামির।
‘মিথ্যা বলো না শামির। আমি সব কথা মোতাদের শুনেছি। তুমি ওদেরকে এই কুকুরদের হাতে তুলে দেবার আয়োজন করেছো। সব হারালেও আমি মেয়েই আছি। সুন্দর জীবনের দুই মেয়ের সর্বনাশ আমি হতে দেব না।’ বলল ভ্যানিসা চিৎকার করে।
ভ্যানিসার কথা শেষ হতেই ক্রোধে উম্মত্ত বেগিন লিকুড চিৎকার করে বলল, ‘বুড়ি হারামজাদী, তোর রিভলবারের ভয় আমরা করি না। শয়তান আহমদ মুসাকে আজ আমরা শেষ করেছি, বিশ্বাসঘাতক গোল্ড ওয়াটারকেও। তুই আমাদের কি করছি?’
বলে বেগিন লিকুড দ্রুত পকেট থেকে রিভলবার বের করতে গেল।
সংগে সংগে গর্জে উঠেছিল ভ্যানিসার রিভলবার।
বুক চেপে ধরে বেগিন লিকুড আছড়ে পড়ল সিঁড়ির উপর।
পরক্ষণেই বাড়ির ভেতর দিক থেকে দুটি গুলীর শব্দ হলো।
ভ্যানিসা ও ডা. মার্গারেট উভয়ের আহত হাত থেকে রিভলবার পড়ে গেল। দুজনেই তাদের আহত হাত অন্য হাত দিয়ে চেপে ধরে কঁকিয়ে উঠল।
ভীত লায়লা জেনিফার পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখল দুই হাতে দুই রিভলবার নিয়ে করিডোরের মুখে দাঁড়িয়ে আছে রবিন সেন। তার দুই রিভলবারের নলে তখনও ধোঁয়া।
লায়লা জেনিফার যখন পেছন ফিরে তাকিয়েছে, তখন আহত হাত চেপে যন্ত্রণাকাতর ডা. মার্গারেট সামনের দিকে তাকিয়ে দেখল গুলীবিদ্ধ হয়ে পড়ে যাওয়া লোকের পাশের লোকটি রিভলবার তুলে তাক করেছে ভ্যানিসাকে।
সঙ্গে সঙ্গেই ডা. মার্গারেট ছুটে গিয়ে নিজেদের দেহ দিয়ে ভ্যানিসাকে আড়া করে দাঁড়াল।
ভ্যানিসাকে লক্ষ্য করে নিক্ষিপ্ত শিমনের গুলীটা গিয়ে বিদ্ধ করল ডা. মার্গারেটের বুক।
একটা আর্তনাদ উঠল মার্গারেটের কন্ঠে। তার সাথে সাথেই লুটিয়ে পড়ল তার দেহ দরজার উপর।
লায়লা জেনিফার চিৎকার করে উঠে ছুটে গিয়ে আছাড়ে পড়ল ডা. মার্গারেটের উপর।
আর ঠিক সে সময়েই লনের দিক থেকে গুলী বৃষ্টির শব্দ ভেসে এল।
লায়লা জেনিফার চোখ বন্ধ করে ডা. মার্গারেটের দেহ আঁকড়ে ধরে অপেক্ষা করছিল। তার দেহও ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়ার অপেক্ষা করছিল সে আন্তরিকভাবেই। কারণ এটাই তার এখন একমাত্র পথ।
কিন্তু গুলী এল না।
তার বদলে ভেসে এল মমতা জড়ানো এক ডাক ‘লায়লা জেনিফার।’
এযে আহমদ মুসার কণ্ঠ!
বিস্ময়ে চোখ খুলল লায়লা জেনিফার। দেখল তার সামনে দাঁড়িয়ে আহমদ মুসা ও তার স্বামী জর্জ।
আবার চোখ বন্ধ করে চিৎকার করে কেঁদে উঠল, ‘হে আল্লাহ, আমি কি স্বপ্ন দেখছি!’
‘না স্বপ্ন নয়, উঠ বোন। মার্গারেটেকে নিতে হবে। সে আহত।’
জেনিফার উঠে দাঁড়িয়ে জড়িয়ে ধরল জর্জকে কান্না জড়িত কণ্ঠে বলল, ‘আমার মার্গারেট আপা…..।’
কথা শেষ করতে পারল না কান্নার উচ্ছ্বাসে।
আহমদ মুসা তুলে নিল মার্গারেটের দেহ গাড়িতে নেয়ার জন্যে। এসময় পরপর দুটি গুলীর শব্দ হলো।
বেকন গুলী করেছে করিডোরে দাঁড়ানো একজন অশ্বেতাংগ এশীয়কে।
‘মি. আহমদ মুসা, ওর দুই রিভলবার টার্গেট করেছিল আপনাকে ও ভ্যানিসাকে। তাকে হত্যা না করে উপায় ছিল না।’ বলল বেঞ্জামিন বেকন।
আহমদ মুসা বেঞ্জামিনের কথার দিকে কান না দিয়ে বলল, ‘মি. বেঞ্জামিন এদের একটা গাড়িতে আপনি গোল্ড ওয়াটারদের নিয়ে উঠে বসুন। আমি এদের নিয়ে বাইরে দাঁড়ানো গাড়িতে উঠছি।’
বলে আহমদ মুসা ড. মার্গারেটকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে ছুটল লনের ওপাশের রাস্তায় রাখা তাদের গাড়ির দিকে।
দুটি গাড়িই স্টার্ট নিল।
গাড়ির জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে গোল্ড ওয়াটার বলল, ‘মন্দ হলো না মি. আহমদ মুসা, পুলি এসে দেখবে বাড়িওয়ালার সাথে সিনাগগের লড়াই? না কিভাবে ব্যাখ্যা করবে তারা ঘটনার?’
‘পত্রিকায় একটা নিউজ করিয়ে দিন, তাহলে পুলিশ তদন্তের লাইন খুঁজে পাবে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আমার বন্ধুর কন্যা মার্গারেট কেমন আছে? তাকে কোথায় নিচ্ছি আমরা?’ উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল গোল্ড ওয়াটার।
পাশ থেকে ভ্যানিসা বলে উঠল, ‘চলুন আমি ক্লিনিক দেখিয়ে দেব।’
আহমদ মুসা ও তার কথাটা জানাল গোল্ড ওয়াটারকে।
ভ্যানিসা বসে আছে আহমদ মুসার পাশের সিটে। আর পেছনের সিটে ডা. মার্গারেটকে শুইয়ে তিয়ে তার পাশে গাড়ির মেঝেতে বসেছিল জেনিফার ও জর্জ।
ডা. মার্গারেট জ্ঞান হারায়নি।
গোল্ড ওয়াটারকে লক্ষ্য করে বলা আহমদ মুসার কণ্ঠ থামলেই জেনিফার আহমদ মুসাকে বলে উঠল আর্ত কন্ঠে, ‘ভাইয়া মার্গারেট আপা আপনার সাথে কথা বলতে চান। এখনি।’
গাড়ি তখন এগিয়ে চলছিল সেন্টজন নদীর তীর বরাবরের ব্যস্ত হাইওয়ে ধরে।
জ্যাকসন ভিল সিনাগগটি নদীর তীর ঘেঁষেই। মাঝাখানে শুধু হাইওয়েটা।
আহমদ মুসা গাড়ি দাঁড় করবার জন্যে একটা জায়গা খোঁজ করতে লাগল।
ভ্যানিসা বলে উঠল, ‘এই সামনেই রাস্তার পাশে নদীর উপর একটা ‘হেলথ রিজোর্ট’ আছে। ওখানে দাঁড়ানো যায়।’
আহমদ মুসা গাড়ির গতি আরও বাড়িয়ে দিল। বলল, ‘জেনিফার তাড়াতাড়ি কোন ক্লিনিকে পৌছা দরকার। সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না।’
বলতে বলতেই সামনে দেখতে পেল একটা এক্সিট লেন। সংগে সংগে আহমদ মুসা গাড়ি এক্সিট লেনে নিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড় করাল।
তারপর মুখ ঘুরিয়ে বলল, ‘জর্জ তুমি ড্রাইভিং সিটে এস। আমি ওদিকে দেখছি।’
বলে আহমদ মুসা গাড়ি থেকে দ্রুত নামল।
জর্জও নেমে এল।
আহমদ মুসা পেছনের সিটে উঠে রক্তে ভাসা ডা. মার্গারেটের মাথার কাছে গাড়ির মেঝেতে বসল।
ওদিকে জর্জ ড্রাইভিং সিটে উঠে গাড়ি স্টার্ট দিল।
নিঃশব্দ ঝড়ের গতিতে গাড়ি চলতে শুরু করল আবার।
চোখ বুজে ছিল ডা. মার্গারেট।
লায়লা জেনিফার সিটের নিচে বসে বাম হাত দিয়ে ডা. মার্গারেটকে জড়িয়ে ধরেছিল। আর তার ডান হাত চেপে ধরেছিল ডা. মার্গারেটের রক্তক্ষরণরত বুকের বাম পাশটা।
আহমদ মুসা বসলে সে ধীরে ধীরে চোখ খুলল। চাইল আহমদ মুসার দিকে। বলল ক্ষীণ কন্ঠে, ‘ওরা বলেছিল আপনাকে ও গোল্ড ওয়াটারসহ সবাইকে নাকি আজ ওরা শেষ করে দিয়েছে। ভেবেছিলাম, আর দেখা হলো না আপনার সাথে। আল্লাহর হাজার শুকরিয়া, আপনার দেখা পেলাম। বন্দী হবার পর সব সময় মৃত্যুর জন্যে তৈরী ছিলাম। কিন্তু একটা প্রার্থনা করেই চলেছিলাম আল্লাহর কাছে, মৃত্যুর আগে যেন একবার আপনার দেখা পাই। আল্লাহ আমার প্রার্থনা মঞ্জুর করেছেন। আলহামদুলিল্লাহ। একটা……….।’
আহমদ মুসা ডা. মার্গারেটের কথার মাঝখানেই বলে উঠল, ‘মার্গারেট এসব কথা এখন নয়। তুমি ভাল হয়ে যাবে। আমরা ক্লিনিকে যাচ্ছি। কথা বলো না এখন, ক্ষতি হবে।’
ডা. মার্গারেটের দুই চোখ আহমদ মুসার দুই চোখ থেকে সরেনি। তার ঠোঁটে ফুটে উঠল ম্লান হাসির রেখা। বলল, ‘কথা বলার আর সময় আমি পাবো না। জনাব, আমি ডাক্তার। আমি জানি একটুও সময় নেই আমার হাতে।’
একটু থামল ডা. মার্গারেট। তার চোখের দুই কোনায় দুই ফোটা অশ্রু এসে জমেছে।
বোধ হয় অশ্রু রোধ করার জন্যেই ডা. মার্গারেট চোখ বুজল। কিন্তু তাতে অশ্রু রোধ হলো না। অশ্রু তার গড়িয়ে পড়ল দুই গন্ড দিয়ে। ডান হাতটি তুলতে চেষ্টা করল ডা. মার্গারেট, বোধ হয় চোখ মোছার জন্যেই। কিন্তু হাত তুলতে পারল না।
অশ্রু সিক্ত দুচোখ আবার তুলল ডা. মার্গারেট আহমদ মুসার দিকে। ঠোঁট দুটি তার ফাঁক হয়েছিল কিছু বলার জন্যে, কিন্তু পরক্ষণেই প্রবল যন্ত্রণায় মুখ আড়ষ্ট হয়ে গেল তার। হাত কাঁপছে, গোটা শরীর কাঁপছে ডা. মার্গারেটের। সে আবার চোখ বুজেছে। তার মুখ শক্ত হয়ে উঠেছে, দাঁতে দাঁত চেপেছে সে। বুঝা যাচ্ছে, লড়াই করছে নিজেকে ধরে রাখার জন্য।
কেঁদে উঠল লায়লা জেনিফার।
আহমদ মুসা চেপে ধরল ডা. মার্গারেটের কম্পমান দুই হাত ডাকল, ‘মিস মার্গারেট।’
চোখ খুলল মার্গারেট। তাকাল আহমদ মুসার চোখে।
ঠোঁট দুটি কাঁপছে মার্গারেটের।
চেষ্টা করছে কিছু বলার।
ফিস ফিসে কণ্ঠ আবার শোনা গেল মার্গারেটের। বলল, ‘একটা প্রশ্ন, মুসলমান হিসাবে আমার তো কোনই সঞ্চয় নেই। জান্নাত কি আমার হবে? দেখা কি পাব সেখানে আপনার? খুব জানতে ইচ্ছা করছে আমার।’
ক্ষীণ থেকে ক্ষীনতর কণ্ঠ থেমে গেল ডা. মার্গারেটের।
আহমদ মুসা একটু ঝুঁকে পড়ল ডা. মার্গারেটের মুখের দিকে। ‘মার্গারেট’ ‘মার্গারেট’ বলে ডাকল দুবার। বলল কানের কাছে মুখ নিয়ে, ‘মার্গারেট, তোমার এ মৃত্যু শহীদের মৃত্যু। আল্লাহ নিশ্চয় তোমাকে জান্নাত মঞ্জুর করবেন।’ আহমদ মুসার কণ্ঠ অশ্রু সিক্ত, ভারী।
চোখ খুলল না আর ডা. মার্গারেট।
কিন্তু তার ঠোঁটে ফুটে উঠল ফুলের মত নিষ্পাপ এক টুকরো হাসির রেখা।
পরক্ষণেই তার মাথাটা এক পাশে কাত হয়ে পড়ল। কিন্তু ঠোঁটে থেকেই গেল ফুলের মত সুন্দর সেই এক টুকরো হাসি। ডুকরে কেঁদে উঠল লায়লা জেনিফার। আছড়ে পড়ল সে মার্গারেটের বুকে। ড্রাইভিং সিট থেকে জর্জ মুহূর্তের জন্যে পেছন ফিরে তার আপা মার্গারেটের স্পন্দনহীন দেহের উপর চোখ বুলাল। তারপর কান্নার প্রবল উচ্ছ্বাস রোধের জন্যে ঠোঁট কামড়ে ধরে সামনে দৃষ্টি প্রসারিত করল সে। পাশ থেকে ভ্যানিসা নেল পেছন দিকে একবার তাকিয়ে বুকে ক্রস এঁকে প্রার্থনা করে উঠল, ‘ঈশ্বর! আমাকে বাঁচাতে গিয়ে তিনি জীবন দিলেন। তাঁর মঙ্গল করুন ঈশ্বর।’
আর আহমদ মুসা বলে উঠল, ‘ইন্নালিল্লাহ ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন’ আমরা সকলে আল্লাহর জন্যে এবং আল্লাহর দিকেই আমাদের প্রত্যাবর্তন।’

পরদিন ‘ফ্লোরিডা হোরাইজন’- এর একটি খবর গতকাল সেন্টজন নদী তীরে অভিজাত ‘রিভার ভিউ’ এলাকায় এক মর্মান্তিক হত্যাকান্ড ৬ জন লোক নিহত হয়েছে। এর মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে লাভজনক এয়ারলাইন্স ‘ব্লু বার্ড’ -এর বড় অংশীদার রবিন সেনও রয়েছে। তার লাশ তার বাসভবনে নিচের তলায় লাউঞ্জে পাওয়া গেছে। অবশিষ্ট ৫ জন পার্শ্ববর্তী সিনাগগের সদস্য বলে অনুমান করা হচ্ছে। এই ৫ জনের মধ্যে সিনাগগের পরিচালক হাইম শামিরও রয়েছে। এদের লাশ রবিন সেনের বাসভবনের উক্তর লাউঞ্জের সিঁড়িতে পাওয়া গেছে। এই হত্যাকান্ডের জন্যে কাউকে সন্দেহ করা যায়নি, কেউ গ্রেফতারও হয়নি।
অনুসন্ধান থেকে জানা গেছে নিহত রবিন সেনের উক্ত বাড়িটি তার একটি অবকাশ ভিলা। এ ভিলায় চাকর-বাকর ছাড়া পরিবারের কোন সদস্য স্থায়ীভাবে থাকেন না। ঘটনার দিন রবিন সেন ছাড়া ঐ বাড়িতে তার পরিবারের কোন সদস্য ছিলেন না।
বাড়ির চাকর-বাকরদের জিজ্ঞাসাবাদ থেকে ঘটনার মূলে নারীঘটিত কোন ব্যাপার রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। চাকর-বাকরদের সূত্রে প্রকাশ, ঘটনার দিন সকালে পার্শ্ববর্তী সিনাগগের পরিচালক হাইম শামির ও তার কয়েকজন সঙ্গী দুজন মেয়েকে ধরে এনে রবিন সেনের ভিলার একটি ঘরে বন্দী করে রাখে। বিকেলে মেয়ে দুটিকে সিনাগগের লোকেরা কোথাও নিয়ে যাচ্ছিল। এ সময় মেয়ে দুটিকে উদ্ধার করতে আসা জনাপাঁচেক লোকের সাথে তাদের সংঘর্ষ বাধে। এই সংঘর্ষেই রবিন সেন ও সিনাগগের লোকেরা নিহত হয়েছে।
মনে করা হচ্ছে ভারতীয় বংশোদ্ভুত রবিন সেনের সাথে সিনাগগের অবৈধ সহযোগিতার কোন সম্পর্ক ছিল। অভিজ্ঞ-মহল এই হত্যাকান্ডের চেয়ে এর উৎস হিসেবে এই অবৈধ সহযোগিতার সম্পর্ককেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।
খবরটি পড়ে আহমদ মুসা তাকাল বেঞ্জামিন বেকনের দিকে। বলল, ‘মনে হচ্ছে এ আপনার কীর্তি।’
‘কীর্তি নয়, একটা চেষ্টার ফল মাত্র।’ বলল বেঞ্জামিন।
‘ফেম মানে ‘ফ্রি আমেরিকা’র কোন লোক আছে নাকি ঐ পত্রিকায়?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘আছে। তবে দেখুন একটা শব্দও কিন্তু মিথ্যা লেখেনি।’
‘ও শেষ বাক্যটার কথা বলছেন? হ্যাঁ, ওটা কমেন্ট বটে, আবার ইনফরমেশনও। এই ইনফরমেশন দিয়ে একটি অশুভ সহযোগিতার প্রতি পুলিশ ও সরকারের দৃষ্টি আকৃষ্ট করা হয়েছে।’ বলল বেঞ্জামিন বেকন।
‘ধন্যবাদ বেঞ্জামিন বেকন। এই ঘটনায় আমিও অবাক হয়েছি। ভারতীয় একজন ইঞ্জিনিয়ার। অত বড় ব্যবসায় ও পদের মালিক হয়েও সিনাগগের একটা জঘন্য কাজের সাথী হলো কেমন করে।’ বলল আহমদ মুসা বিস্ময়ের সুরে।
উত্তরে বেঞ্জামিন বেকন কিছু বলতে যাচ্ছিল । কিন্তু বলা হলো না। তার টেলিফোন বেজে উঠল।
বেঞ্জামিন বেকন তার মোবাইল হাতে তুলে নিল।
টেলিফোন কানে ধরেই বেঞ্জামিন বেকন সচকিত কন্ঠে বলে উঠল, ‘ম্যাডাম ক্লারা? গুড মর্নিং।’
ওপার থেকে ক্লারার কথা শুনতে গিয়ে মুখ মলিন হয়ে গেল বেঞ্জামিন বেকনের। একবার তাকাল সে আহমদ মুসার দিকেও। চোখে মুখে তার উদ্বেগের চিহ্ন। বলল সে, ‘কোথায় উনি?’
আহমদ মুসার সন্দেহ হলো, কোন খারাপ খবর আসছে নিশ্চয়, কোত্থেকে? কে এই ম্যাডাম ক্লারা।
‘নির্দেশ না দিলেও জানাতাম।’ ইয়েস ম্যাডাম, অবশ্যই জানাব’ বলে টেলিফোন রাখল বেঞ্জামিন বেকন।
‘কি ব্যাপার? কার টেলিফোন? মনে হয় খারাপ খবর আছে!’ বলল আহমদ মুসা।
‘মিস ক্লারা কার্টারের টেলিফোন। খুব খারাপ খবর।’ উদ্বিগ্ন কণ্ঠ বেঞ্জামিন বেকনের।
‘মিস ক্লারা কার্টার কে?’
‘উনি ম্যাডাম সারা জেফারসনের পার্সোনাল সেক্রেটারী।’ বলল বেঞ্জামিন বেকন।
‘খারাপ কোন খবর আছে কি মিস সারা জেফারসনের?’ আহমদ মুসার কণ্ঠেও উদ্বেগ।
‘হ্যাঁ। গত সন্ধ্যায় ম্যাডাম সারা জেফারসন মারাত্মক দুর্ঘটনায় পড়েন। উনি শার্লট ভিল থেকে মন্টিসেলোতে যাচ্ছিলেন। তার দুই গাড়ির সামনেরটা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একটা গভীর খাদে পড়ে তাতে আগুন ধরে যায়। আর পেছনের গাড়িটা সেই অবস্থায় হার্ড ব্রেক কষতে গিয়ে কাত হয়ে পড়ে যায়। ম্যাডাম কপালে আঘাত পেয়েছেন। আর সামনের গাড়ির কেউ বাঁচেনি।’
‘ঐ গাড়িতে কে ছিল?’
‘ম্যাডাম কে রিসিভ করতে আসা দুজন হাউজ স্টাফ ছিলেন। ম্যাডামের মন্টিসেলোর বাড়িতে তার মা থাকেন, আর তিনি। বাড়ি দেখাশোনার দায়িত্ব হাউজ স্টাফের।’ বলল বেঞ্জামিন বেকন।
‘আচ্ছা বলতে পারেন, এমন ঘটনা ঐ অঞ্চলে আরও কি ঘটেছে?’ প্রশ্ন আহমদ মুসার।
‘সম্ভবত ঘটেনি। কারণ মিস ক্লারা প্রথমেই একে বেনজির দুর্ঘটনা বলেছেন।’ বলল বেঞ্জামিন বেকন।
‘কেন? আমেরিকায় তো প্রচুর দুর্ঘটনা ঘটে। ওখানে ঘটবে না কেন?’ আহমদ মুসা প্রশ্ন করল।
‘আমি গ্রেট ভ্যালির ঐ এলাকায় গেছি। এ ধরনের এলাকায় গাড়ির স্পীড কম হয় এবং ড্রাইভারও বেশি সতর্ক থাকে। আর গাড়ির সংখ্যাও কম হয়। এসব কারণেই এমন এলাকাগুলোতে দুর্ঘটনা খুবই কম।’ বলল বেঞ্জামিন বেকন।
‘উনি এখন কোথায়?’
‘মন্টিসেলোতে। শার্লট ভিলে চিকিৎসা নেয়ার পর তিনি মন্টিসেলোতে ফিরে গেছেন।
বলে একটু থেমেই বেঞ্জামিন বেকন বলল আহমদ মুসাকে, ‘ম্যাডাম সারা জেফারসন বলেছেন এ বিষয়টা আপনাকে জানাবার জন্যে। এবং এজন্যেই মিস ক্লারা আমাকে টেলিফোন করেছিলেন।’
ভাবছিল আহমদ মুসা। বেঞ্জামিনের কথায় বলে উঠল, ‘মি. বেঞ্জামিন, আমার কি মনে হচ্ছে জানেন। মনে হচ্ছে, বেনজির দুর্ঘটনাটা আমি একটু দেখে আসি।’
খুশি হলো বেঞ্জামিন বেকন। বলল, ‘আমার ধারণা ম্যাডামও এটা চাচ্ছেন। আপনাকে জানাতে বলার মধ্যে দিয়ে তার এ চাওয়ারই প্রকাশ ঘটেছে।
‘প্রসঙ্গক্রমে বলছি মি. বেঞ্জামিন, আপনাদের নেতাকে এমন অরক্ষিত রেখেছেন কেন আপনারা?’ বলল আহমদ মুসা।
‘এ প্রশ্ন আমারও মি. আহমদ মুসা। কিন্তু তাকে এ কথা বুঝাবে কে? তিনি টমাস জেফারসনের সাক্ষাত প্রতিবিম্ব। কোন বাড়তি আয়োজনই তিনি বরদাশত করেন না। চাকুরী না করলেও উনি পারেন। কিন্তু তার যুক্তি হলো, জাতিকে প্রত্যক্ষভাবে তার কিছু দেয়া দরকার। বেঞ্জামিন বেকন বলল।
‘ধন্যবাদ আপনাদের নেতাকে। একজন অনুকরণযোগ্য দেশপ্রেমিক তিনি। বলল আহমদ মুসা।
‘তাহলে আপনি যাচ্ছেন? ব্যবস্থা করব?’
‘আপনি যাবেন না?’
‘তাঁর সেরকম নির্দেশ নেই। তাছাড়া আমার এখন ওয়াশিংটনে থাকা প্রয়োজন। নিশ্চয় শ্যারনরা বড় কিছু করছেন। এদিকে নজর রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।’
বলেই উঠে দাঁড়াল বেঞ্জামিন বেকন। বলল, ‘আপনি তৈরী হোন। আমি প্লেনের টিকিটের ব্যবস্থা করছি। ওয়াশিংটন থেকে ভার্জিনিয়ার শার্লট ভিল পৌনে দু’শ কিলোমিটারের বেশি হবে না। শার্লট ভিল থেকে মন্টিসেলো ২০ কিলোমিটারের মত। ঐ পথটুকু গাড়িতে যাবেন।’
‘মিস ক্লারা কার্টারকে কি আপনি জানাচ্ছেন, আমি যাচ্ছি সেখানে?’ বলল আহমদ মুসা।
‘অবশ্যই।’ বেঞ্জামিন বেকন বলল।
‘আমার মনে হয় জানানোর দরকার নেই।
‘ম্যাডাম সারা জেফারসন যদি হঠাৎ কোন প্রোগ্রামের অন্য কোথাও যান।’
‘ক্ষতি নেই, আমি তো যাচ্ছি এ্যাকসিডেন্ট দেখতে। তারপর একান্তই ওঁকে দরকার হলে আমি খুঁজে নেব।’
‘না জানালে ম্যাডাম যদি আমাকে এজন্যে দায়ী করেন?’ আপত্তি জানিয়ে বলল বেঞ্জামিন বেকন।
‘বলবেন জানাতে আমি রাজী হইনি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কিন্তু না জানানোর যুক্তি আমি বুঝতে পারছি না।’
‘কোন যুক্তি নেই। আমি নিজের সিদ্ধান্তে যাচ্ছি, কি দরকার জানিয়ে। জানিয়ে গেলে অতিথি সাজতে হবে।’
‘মনে আছে, আপনি বলেছিলেন ম্যাডাম আপনাকে মন্টিসেলোতে দাওয়াত দিয়ে রেখেছেন।
‘না জানিয়ে গেলে কি সেখানে হাজির হয়ে তার দাওয়াত নিতে পারবো না?
‘তথাস্তু, আপনার সিদ্ধান্তই বহাল।’ হেসে উঠে বলল বেঞ্জামিন বেকন। তারপর বেরিয়ে গেল।

ট্যাক্সি করে মন্টিসেলোর দিকে এগুচ্ছে আহমদ মুসা।
শার্লট ভিল বিমান বন্দরে নেমে আহমদ মুসা ঘন্টা চুক্তিতে এ ট্যাক্সি ভাড়া করেছে মন্টিসেলো যাবার জন্যে।
ঘন্টা চুক্তির কথা শুনে ট্যাক্সিওয়ালা চোখ কপালে তুলে বরেছে, ‘মন্টিসেলো পনের বিশ মিনিটের পথ, ঘন্টা দিয়ে কি হবে স্যার?’
হেসে বলেছে আহমদ মুসা, ‘পথ তোমার পনের বিশ মিনিটের ঠিক আছে। কিন্তু পথে আমি দেরী করতে পারি, এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াতে পারি, এমনকি যার কাছে যাচ্ছি তার দেখা না পেলে আবার শার্লট ভিলে সংগে সংগে ফিরেও আসতে পারি।’
‘বুঝেছি স্যার, ধন্যবাদ।’ হেসে বলেছে ট্যাক্সি ড্রাইভার।
আয়নার মতই মসৃণ রাস্তা।
যাওয়া ও আসার রাস্তা পাশাপাশি। মাঝ খান দিয়ে উুঁচ, নিচু, এবড়ো থেবড়ো মাটি, পাথর এবং গাছ ও ঝোপ-ঝড়ের স্বাভাবিক ব্যারিয়ার।
রাস্তাটি মন্টিসেলোর পাহাড়ের পাদদেশ ঘেঁষে চলেগেছে তার আরও পশ্চিমে গ্রেট ভ্যালির বিখ্যাত হাইওয়ের দিকে।
আহমদ মুসা ডিপারচার লাউঞ্জ থেকে বের হবার মুখেই পেয়ে যায় ট্যুরিষ্ট ষ্টল। সেখান থেকে আহমদ মুসা সংগ্রহ করে নেয় ভার্জিনিয়ার একটি রোড কমুনিকেশন মানচিত্র এবং গ্রেট ভ্যালি এলাকার একটা ট্যুারিষ্ট গাইড।
ট্যুরিস্ট স্টলের কথা মনে পড়তেই আহমদ মুসার চোখের সামনে ভেসে উঠে স্টলের সেলস গার্ল তরুণীটির চেহারা। আহমদ মুসার উপর চোখ পড়তেই তরুণীটি চমকে উঠেছিল। আহমদ মুসা নিশ্চিত সে আহমদ মুসাকে চিনেছে। মেয়েটিকে? এফ বি আই এর লোক? তার ছবির মাধ্যমে এফ বি আই এর অনেকেই তাকে এখন চেনে।
মন্টিসেলোতে যাতায়াতের এটাই একমাত্র পথ।
আহমদ মুসা এ বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছিল ট্যুরিষ্ট গাইড দেখে। আবার ড্রাইভারকেও জিজ্ঞেস করেছিল। ড্রাইভার বলেছিল, গাড়ির রাস্তা এই একটাই, তবে পায়ে হাঁটার পথ অনেক আছে।
আহমদ মুসার ট্যাক্সি চলছিল মাঝারি গতিতে রাস্তার সর্বশেষ একজিট ওয়ে’র লেন ধরে।
ব্যস্ত রাস্তা এটা নয়। গাড়ি চলছে, তবে দুই গাড়িকে কোথাও একত্রে দেখা যাচ্ছে না। এই হিসাবে রাস্তাটি গাড়ি বিরল এবং জনবিরলই।
গাড়ির ভেতর থেকে দেখা যাচ্ছে, চারদিকটা সবুজ পাহাড় আর সবুজ উপত্যকার সুন্দর চাদরে মোড়া। চোখ ফেরানো যায় না এ সবুজ সুন্দরের বুক থেকে।
আহমদ মুসার মুগ্ধ দুই চোখ আঠার মত লেগে আছে এ সুন্দরের বুকে।
অপরূপ ভার্জিনিয়ার এ এলাকাটি ‘আপালোসিয়ান পর্বতমালা’র বিখ্যাত নীল শৈল শিলায় সাজানো সুন্দর পূর্বাচল। আবার আপালোসিয়ানের বুক চিরে প্রলম্বিত গ্রেট ভ্যালিরও অংশ একে বলা যায়।
বাইরের মৌন সবুজের বুকে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল আহমদ মুসা।
ড্রাইভারের কথায় সম্বিত ফিরে পেল সে। ড্রা্ভার বলছিল, ‘স্যার আপনি যে একসিডেন্টের কথা বলেছিলেন, সেখানে আমরা এসে গেছি।’
আহমদ মুসা সোজা হয়ে বসল। চোখ ফিরিয়ে নিল রাস্তার পাশে। বলল, ‘ওখানে কি দাঁড়ানো যাবে না ড্রাইভার?’
‘জি স্যার। একসিডেন্ট পয়েন্টের পেছনেই পার্ক করার মত অনেক জায়গা আছে।
‘ঠিক আছে গাড়ি ওখানে পার্ক করো।’ নির্দেশ দিল আহমদ মুসা।
গাড়ি পার্ক করলো ড্রাইভার।
আহমদ মুসা গাড়ি থেকে নামল। বলল, ‘দেখবো একসিডেন্ট এরিয়াটা।’
ড্রাইভারও নামল।
ড্রাইভার নিয়ে গেল আহমদ মুসাকে সেখানে গাড়ি রাস্তা থেকে ছিটকে এসে পড়েছিল, তারপর গড়িয়ে গিয়েছিল নিচে।
জায়গাটা দেখে বিস্মিত হলো আহমদ মুসা। এখানে ঢালটা অস্বাভাবিক রকম খাড়া। আর এখানে এসেই জায়গা হঠাৎ বড় রকমের বাঁক নিয়ে রাস্তার কাছাকাছি চলে এসেছে। একসিডেন্টের খুবই উপযুক্ত একটা জায়গা। আর এখানে এসেই একসিডেন্টটা হয়েছে।
এমন ঘটা অস্বাভাবিক নয়। কাকতলীয় এমন অনেক কিছুই ঘটে।
কিন্তু মন বড় খুঁত খুঁত করছে আহমদ মুসার। কাকতলীয় কিছু ঘটতে পারে, কিন্তু এখানে যা ঘটেছে সেটা ঐ কাকতলীয় ঘটনা কিনা?
আহমদ মুসা ঝুকে পড়ে তাকাল ঢালের নিচে। দেখল এক’শ ফুটের মত নিচে নালার মত খাদের তলায় পোড়া গাড়ির অবশিষ্ট কাঠামো উল্টে পড়ে আছে।
কোটের পকেট থেকে ছোট্ট একটা দূরবীন বের করল আহমদ মুসা। চোখে লাগিয়ে আবার তাকাল নিচের দিকে।
খুটিয়ে দেখতে লাগল গাড়িটা।
ছোট হলেও দূরবীনটা অত্যন্ত পাওয়ারফুল। একমাইল দূরে পড়ে থাকা আলপিন পর্যন্ত এর নজর এড়ায় না।
এক সময় আহমদ মুসা চোখ থেকে দূরবীন নামিয়ে চোখে-মুখে কিছুটা বিস্ময় নিয়ে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল ড্রাইভারকে।
এ সময় তাদের পেছনে একটা গাড়ি দাঁড়ানোর শব্দে আহমদ মুসা পেছনে ফিরে তাকাল। তাকিয়ে দেখতে পেল, তাদের ট্যাক্সির পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে একটি কার। কার থেকে নামছে সারা জেফারসন।
সারা জেফারসনকে এভাবে এখানে দেখে অনেকটা ভুত ধোর মতই চমকে উঠল আহমদ মুসা।
সারা জেফারসন ধীরে ধীরে আহমদ মুসার সামনে এসে দাঁড়াল।
সারা জেফারসনের পরনে সাদা ফুল প্যান্ট, গায়ে হাল্কা গোলাপী কোট এবং মাথায় প্রাচীন অভিজাত আমেরিকানদের মত কারুকাজ করা গোলাপী হেডক্যাপ। হেডক্যাপের আড়াল থেকে দেখা যাচ্ছে তার কপালে ব্যান্ডেজের একটাংশ।
মুখটাও সাদা ও লালে মেশানো। গোটা মুখে প্রসাধনী ব্যবহারের কোন চিহ্ন নেই। আছে শিশু সুলভ সারল্যের স্নিগ্ধ লাবন্য। লিপিস্টিকহীন রক্তিম ঠোঁটে আনন্দের হাসি।
ড্রাইভার সারা জেফারসনকে এসে দাঁড়াতে দেখেই ‘গুড ইভনিং ম্যাডাম মিস জেফারসন’ বলে মাথা সামান্য ঝুকিয়ে বাউ করে সম্মানের সাথে পেছনে সরে গেল।
সারা জেফারসন তার দিকে তাকিয়ে হেসে জবাব দিল তার সম্বোধনের।
সারা জেফারসন ড্রাইভারের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে আহমদ মুসার দিকে মুখ তুলে বলল, ‘গুড ইভনিং। আসসালামু আলাইকুম।’
বলে হেসে উঠল সারা জেফারসন। হাসতে হাসতেই বলল, ‘দেখলেন, আপনাদের আপনাদের স্বাগত সম্বোধনটা আমি মুখস্ত করে ফেলেছি। অর্থও জানি। সত্যি, আপনাদের এ শুভ কামনার কোন তুলনা হয় না।’
‘ধন্যবাদ মিস সারা জেফারসন। গুড ইভনিং।’ আহমদ মুসার ঠোঁটেও টুকরো হাসি।
‘বাহ, আপনাদের স্বাগত সম্ভাষণ ‘সালাম’ বলবেন না!’ বলল সারা জেফারসন হাসি মুখে।
আহমদ মুসা তার চোখ নামিয়ে নিয়েছিল সারা জেফারসনের মুখ থেকে। হাসল আহমদ মুসা সারা জেফারসনের কথায়। বলল, ‘আপনি আমাকে স্বাগত জানিয়েছেন আমাদের সম্বোধন দিয়ে, আর আমি জানলাম আপনাদের সম্বোধন দিয়ে।’
‘তা ঠিক। কিন্তু আসল ঘটনা এটা নয়।’ বলল সারা জেফারসন। মুখ টিপে হাসল সে।
‘তাহলে কি?’ মুখ তুলে হেসে বলল আহমদ মুসা।
‘আসল ঘটনা হলো, শুভকামনাসূচক আপনাদের স্বাগত সম্বোধনটা মুসলমানদের জন্যে এক্সক্লুসিভ। কোন অমুসলমানকে এ দিয়ে স্বাগত জানানো হয় না।’
‘আপনি এতো জানেন?’
‘আমার আম্মা কি বলেন জানেন, আমি আমার গ্রান্ড গ্রান্ড গ্রান্ড ফাদার টমাস জেফারসনের মতই নাকি বুক ওয়ার্ম। আসলে কিন্তু কিছুই না।’
কথা শেষ করে একটা দম নিয়ে সারা জেফারসন আবার বুলে উঠল, ‘আমাকে এখানে এভাবে দেখে খুব বিস্মিত হয়েছেন, তাই না?’
‘হয়েছিলাম, কিন্তু সেটা কেটে গেছে।’
‘কিভাবে?’
‘আমার মনে হয়েছে, এয়ারপোর্টের ট্যুরিষ্ট ষ্টলের মেয়েটি আমার আসার ব্যাপারে আপনাকে জানিয়েছে।
‘কি করে বুঝলেন? মেয়েটিকে চেনেন?’
‘চিনি না। কিন্তু তার তাকানো দেখে বুঝেছিলাম সে আমাকে চিনে ফেলেছে। তখন ভেবেছিলাম সে এফ বি আই-এর লোক হবে। এখন বুঝলাম সে ‘ফেম (FAME) মানে ‘ফ্রি আমেরিকা’র লোক।’
‘তারপর?’
‘আমি ট্যাক্সিতে আসছি সে কথাও আপনি জেনে ফেলেছেন।
তারপর আপনি এখানে চলে এসেছেন। আমাদেরকে পাস করার সময় আমাদের ট্যাক্সি দেখে এখানে থেমে গেলেন।
‘ধন্যবাদ। তাহলে এখন চলুন। এখানে কি দেখছিলেন, একসিডেন্ট?’
‘এই বেনজির একসিডেন্ট দেখে আপনার কিছু মনে হয়েছে?’
‘বেনজির আপনি ঠিক বলেছেন। এ ধরনের একসিডেন্ট এই এলাকায় এটাই প্রথম।’
বলে একটু থামল সারা জেফারসন। তারপর বলল, ‘একসিডেন্টকে আমার কাছে একসিডেন্টই মনে হয়েছে। আপনি এ প্রশ্ন করছেন কেন?’
এই বেনজির একসিডেন্টের কথা শুনে হঠাৎই আমার মনে হয়, একসিডেন্টটা একসিডেন্ট নাও হতে পারে। এখন মনে হচ্ছে, আমার ধারণাই ঠিক।’
সারা জেফারসনের মুখের আলো হঠাৎ দপ করে নিভে গেল। চোখে-মুখে ফুটে উঠল বিস্ময়। কথা বলতেও যেন সে ভুলে গেল।
আহমদ মুসাই কথা বলল। বলল, ‘এ পর্যন্ত যতটুকু দেখেছি তাতে আমি অনেকটাই নিশ্চিত, এটা একসিডেন্ট ছিল না।’
কথা শেষ করে আহমদ মুসা পরিপূর্ণভাবে সারা জেফারসনের দিকে তাকাল। বলল, ‘বলুন তো সেদিন দুই গাড়ির যেটিতে আপনি চড়েছিলেন, সেটিতেই কি আপনার চড়ার কথা ছিল?’
চমকে উঠল সারা জেফারসন। মুহূর্তের জন্যে তার উদ্বিগ্ন দৃষ্টি স্থির থাকলো আহমদ মুসার মুখে। তারপর বলল, ‘যে গাড়িটা সেদিন ধ্বংস হয়েছে ওটাই আমার পার্সোনাল গাড়ি। ওটাতেই আমার চড়ার কথা ছিল। কিন্তু কেন জানি সেদিন আমি হঠাৎই উঠে বসি পেছনের গাড়িতে।’
‘আল্লাহ আপনাকে বাঁচাবেন বলে উঠিয়েছিলেন পেছনের গাড়িতে।’
‘তাহলে আপনি বলছেন ওটা ছিল আমাকে হত্যার পরিকল্পিত একটা ঘটনা?’
‘আমার তাই মনে হচ্ছে।’
‘কিন্তু কোন প্রমাণের ভিত্তিতে?’
‘আপাতত অবস্থাগত কারণের ভিত্তিতে।’
‘সেটা কি?’
আহমদ মুসা তার দূরবীন তুলে দিল সারা জেফারসনের হাতে। বলল, ‘গাড়িটা গড়িয়ে পড়ার জায়গা থেকে শুরু করে পুড়ে যাওয়া গাড়ির বডিটা ভালো করে দেখুন।’
দূরবীন চোখে লাগাল সারা জেফারসন। কিছুক্ষণ দেখার পর দূরবীন চোখ থেকে নামিয়ে বলল, ‘দেখলাম। এবার বলুন।’
‘আপনি দেখেছেন, গাড়ির তিনটি চাকা পুড়ে গাড়ির সাথে লেপ্টে আছে। বাম পাশের সামনের চাকাটা গাড়ির সাথে নেই। ওটা দেখেছেন মাঝপথে একটা পাথরের সাথে আটকে আছে।’
‘জি, দেখেছি।’ বলল সারা জেফারসন।
‘আটকে থাকা এই চতুর্থ চাকাটা পুড়েনি। এবং গাড়ির সাথে খাদের তলাতেও পড়েনি। এর অর্থ চাকাটা শুরুতেই গাড়ি থেকে খসে গেছে। আমার মত হলো, চাকাটা গাড়ি থেকে খুলে যাওয়ার কারণেই ধ্বংসাত্মক এই দুর্ঘটনা ঘটেছে।’ আহমদ মুসা বলল।
আহমদ মুসা থামলেও সংগে সংগে কথা বলল না সারা জেফারসন। ভাবছিল সে। বলল কিছুক্ষণ পর, ‘অবস্থাগত দিকগুলোর যে ব্যাখ্যা আপনি দিয়েছেন তার সাথে আমি একমত। চাকা খুলে যাওয়ার ফলে একসিডেন্ট ঘটেছে এটাও ঠিক। কিন্তু ভাবছি, গাড়ির চাকা খুলে যাবার সাথে কোন পরিকল্পনার যোগসূত্র আছে কিভাবে? চাকা আগে থেকে অবশ্যই খোলা ছিল না, তাহলে গাড়ি শুরু থেকেই চলতে পারতো না। আর চাকা নড়বড়ে থাকলে গাড়ি এতদূর আসতে পারতো না।’
‘ঠিক বলেছেন। আচ্ছা বলুন তো ঠিক দুর্ঘটনার মুহূর্তের কথা। কি দেখেছেন, কি শুনেছেন তখন?’
সারা জেফারসন বলল, ‘টায়ার ফাটার মত একটা বিকট শব্দ শুনেছি। তারপরই গাড়িটা যেন লাফ দিয়ে খাদে পড়ে গেল।’
‘খুবই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন মিস জেফারসন। টায়ার ফাটলে তো যেদিকে গাড়িটি ছিটকে পড়েছে সে দিকের, বিশেষ করে খসে পড়া চাকাই ফেটে যাবার কথা।’
বলে একটু থেমেই আহমদ মুসা আবার বলল, ‘একটু দাঁড়ান মিস জেফারসন, আমি চাকাটা নিয়ে আসছি।’
আহমদ মুসা নামতে যাচ্ছিল ঢালে। সারা জেফারসন বাধা দিয়ে বলে উঠল, ‘এ কষ্টের কোন প্রয়োজন নেই মি. আহমদ মুসা। ধরুন, টায়ারটি ফেটেছে। কিংবা ধরুন, টায়ারটি ফাটেনি।’
‘তাতে আমরা কোন একটা নির্দিষ্ট উপসংহারে পৌছাতে পারবো না মিস জেফারসন। অথচ এ ধরনের একটা সিদ্ধান্তে আমাদের পৌছতে হবেই।’ বলল আহমদ মুসা।
সারা জেফারসনের মুখটা ম্লান হয়ে গেল। কিছু বলল না।
আহমদ মুসা নামল ঢাল বেয়ে।
অত্যন্ত খাড়া বলে সোজা নামা গেল না, অনেকটা ঘুরে পথে তাকে নামতে হলো।
দশ মিনিটের মধ্যেই চাকা হাতে উঠে এল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ মি. আহমদ মুসা। আপনাকে আমার ভোগানো বোধ হয় সবে শুরু। দেখছিতো টায়ারটি ফাটেনি।’ একটু বিব্রত কণ্ঠ সারা জেফারসনের।
‘ঠিকই বলেছেন মিস জেফারসন। টায়ারটি ফাটেনি। কিন্তু লক্ষ্য করুন চাকার স্টিল ফ্রেমের যে দিকটা বাইরে ছিল তার রং ও স্বাভাবিকতা ঠিকই আছে, আর যে দিকটা ভেতরের পাশে ছিল তার রং বিবর্ণ হয়ে গেছে এবং মসৃণ স্টিল সারফেসটা অমসৃণ হয়েছে।’ আহমদ মুসা বলল।
সারা জেফারসনও ব্যাপারটা পরীক্ষা করল। বলল, ‘এর অর্থ কি মি. আহমদ মুসা?’
‘আমার মনে হচ্ছে, ‘প্রেসার একপ্লোশন’- এর কাজ হতে পারে। ’
‘প্রেসার এক্সপ্লোশন’ কি?’
‘আল্ট্রা প্রেসার মাইক্রো সিলিন্ডার’ (APMC) নামে বিশেষ ধরনের একটি অস্ত্র আবিস্কার হয়েছে। সাবান কেসের চেয়ে বড় নয় যন্ত্রটা। কিন্তু অবিশ্বাস্য তার শক্তি। বোমায় ঘটে আগুনের বিস্ফোরণ, আর ওতে ঘটে চাপের বিস্ফোরণ। একটা ইস্পাতের দেয়ালে এটা সেট করলেও যন্ত্রটির চারদিকের এক বর্গফুট এলাকা পর্যন্ত ইস্পাতের দেয়াল প্রচন্ড চাপে খসে ছিটকে বেরিয়ে যায় বুলেটের মত। যন্ত্রটা স্বয়ংক্রিয় হয়, আবার দূরনিয়ন্ত্রিতও হতে পারে। আমার মনে হয় আপনার গাড়ির সামনের বাম চাকার ভেতরের পাশে যন্ত্রটি ফিট করা হয়েছিল। চাপের বিস্ফোরণে চাকা ছিটকে বেরিয়ে যায়। গাড়িও লাফিয়ে ওঠে এবং পড়ে ভয়ানক দুর্ঘটনায়।’
থামল আহমদ মুসা।
সম্বোহিতের মত তাকিয়েছিল সারা জেফারসন আহমদ মুসার মুখের দিকে। আহমদ মুসা থামলেও কথা বলতে পারলো না সারা জেফারসন। তার চোখে-মুখে বিস্ময়, উদ্বেগ, বিমুগ্ধতাও।
আহমদ মুসা চোখ নামিয়ে নিয়েছে অনেকক্ষণ। কিন্ত বুঝতে পারছে যে, সারা জেফারসনের অপলক দৃষ্টির বাধনে বন্দী।
আহমদ মুসা তাকাল ড্রাইভারের দিকে। সে একটু দূরে ভিন্ন দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বলল আহমদ মুসা, মিস জেফারসন, ‘ড্রাইভার অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে।’
আহমদ মুসার কথা মনে হয় সারা জেফারসন শুনতেই পায়নি। সারা জেফারসন বলল, ‘প্রেসার এক্সপ্লোশন ডিভাইস’ (APMC)টি কারা সেট করতে পারে গাড়িতে আমাকে হত্যা করার জন্যে?’ সারা জেফারসনের কথা দূর থেকে ভেসে আসা নিস্তেজ, নিস্পৃহ, ঘুম জড়ানো এক কণ্ঠের মত শোনাল আহমদ মুসার কানে।
‘বিষয়টি নিয়ে পরে আলোচনা করা যাবে।’ বলল আহমদ মুসা। আহমদ মুসার একথাও সারা জেফারসন শুনল বলে মনে হলো না। সে বলল, ‘মি. আহমদ মুসা আমি দেশের শীর্ষ স্ট্রাটেজিক রিসার্চ ল্যাব- এর রিসার্চ রেজিষ্ট্রেশন ডাইরেক্টর হিসেবে এর কেন্দ্র বিন্দুতে আছি, সহযোগী প্রতিষ্ঠানসমূহের রিসার্চ তালিকাও আমরা যোগাড় করি। কিন্তু APMC এর মত গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র সম্পর্কে আমি কিছু জানি না! সারা জেফারসনের কণ্ঠ আগের মতই শুনাল।
‘মিস জেফারসন, ‘ইউ এস ডিফেন্স এ্যালাটনেস’ শীর্ষক গোপন রিপোর্টের দুমাসের আগের সংখ্যায় এই অস্ত্রের কথা আছে। মনে হয় অস্ত্রটি তৈরী করেছে মিলিটারী সাইনটিষ্টদের কেউ, ডিফেন্স ল্যাবরেটরী থেকে।’ রিপোর্টটি মার্কিন ডিফেন্স কমান্ড এবং প্রেসিডেন্টের মধ্যেই সীমাবদ্ধ বলে আমার ধারণা।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কিন্তু আপনি তো জানতে পেরেছেন।’ বলল সারা জেফারসন। তার মুগ্ধ চোখে কৌতুহল।
‘জানাটা একটা একসিডেন্ট। কদিন আগে সান্তাফে’ নগরীতে হোয়াইট ঈগলের একটা ঘাটি আমরা দখল করেছিলাম। সেখানে গোল্ড ওয়াটারের সাথে জেনারেল শ্যারণও ছিলেন।। সে ঘাটিতে একটা ম্যাগাজিনের মধ্যে জেনারেল শ্যারনের নাম যুক্ত একটা ইনভেলাপ পেয়েছিলাম। সে ইনভেলাপের মধ্যেই পাই রিপোর্টটি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তার মানে ইহুদী গোয়েন্দা প্রধান জেনারেল শ্যারন রিপোর্টটি পেয়েছিল?’ বিস্ময়ে ভ্রু কুচকে উঠেছে সারা জেফারসনের।
হাসি ফুটে উঠল আহমদ মুসার ঠোঁটে। বলল, ‘মিস জেফারসন, শুধু APMC কেন, মার্কিনীদের কোন গোপন তথ্যটি ইহুদী প্রধানদের কাছে নেই?’
মুখটি ম্লান হয়ে গেল সারা জেফারসনের। অনেকটা স্বগত কণ্ঠেই বলল, ‘ওরা তো এখন আমাদের সরকারের মধ্যে আরেকটি সরকার চালাচ্ছে।’
কথাটি বলার সাথে সাথে জেফারসনের ম্লান মুখে ক্রোধ ফুটে উঠল। বলল, ‘আপনি কি ইনভেলাপসহ রিপোর্টটা আমাকে দিতে পারেন?’
‘অবশ্যই মিস জেফারসন।’
‘ধন্যবাদ।’
বলেই সারা জেফারসন তাকাল ট্যাক্সি ড্রাইভারের দিকে। বলল, ‘ওহ! ওকে আমরা বেকার বসিয়ে রেখেছি।’
বলে সারা জেফারসন এগুলো ট্যাক্সির দিকে।
সারা জেফারসনকে আসতে দেখে ড্রাইভার এ্যাটেনশন হয়ে দাঁড়াল।
সারা জেফারসন ঘড়ির দিকে তাকিয়ে পকেট থেকে টাকা বের করে ড্রাইভারের হাতে তুলে দিল। বলল, ‘ঘন্টা হিসাবে নিয়ে যা থাকে সেটা আপনার পরিবারের জন্যে আমার শুভেচ্ছা।’
ড্রাইভার টাকাগুলো নিয়ে গুণার পর টাকার একটা অংশ সারা জেফারসনকে ফেরত দিয়ে বলল, ‘আপনার কাছে থেকে মজুরী নেয়া আমাদের জন্যে কষ্টের। মজুরীটা ফেরত দিলাম, শুভেচ্ছা- অর্থটা রাখলাম। আপনার শুভেচ্ছা আমাদের জন্যে গৌরবের।
‘ধন্যবাদ ম্যাডাম।’
বলে ড্রাইভার সারা জেফারসন ও আহমদ মুসার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে গিয়ে উঠল।
ট্যাক্সি চলে গেলে সারা জেফারসন আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘আপনার অভিযান শেষ, এবার আপনি আমার মেহমান।’ মুখে হাসি সারা জেফারসনের।’
‘দাওয়াত অনেক আগেই দিয়ে রেখেছেন। মেহমান অবশ্যই হবো। কিন্তু আমার অভিযান শেষ হয়নি।’ বলল আহমদ মুসা।
সারা জেফারসন হাসল। মনে মনে বলল, আপনার বিনোদনের কথাটা ভূয়া। ‘ফ্রি আমেরিকা’ (FAME) এর নেত্রী সারা জেফারসনের জীবনে যে অলস বিনোদন নেই, তা আমি জানি।
মুখে আহমদ মুসা কিছু বলল না।
সারা জেফারসন তার গাড়ির দিকে এগিয়ে গাড়ির দরজা মেলে ধরে বলল, ‘আসুন মি. আহমদ মুসা।’
‘মিস জেফারসন আপনি অনুমতি দিলে গাড়ির ঐ চাকাটা আপনার গাড়িতে তুলে নিতে পারি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘অল রাইট মুসা, আপনি গাড়িতে উঠুন। চাকাটা আমিই গাড়িতে তুলছি।’
বলে সারা জেফারসন এগুলো গাড়ির সেই চাকার দিকে।
আহমদ মুসাও এগুলো।
সারা জেফারসন চাকায় হাত দেবার আগেই আহমদ মুসা গাড়ির চাকাটা তুলে নিয়ে বলল, ‘দেখুন মিস জেফারসন, নারীদের অন্যায়ভাবে খাটানো এবং তাদেরকে ক্ষমতা না দেয়ার অভিযোগ রয়েছে পুরুষদের বিরুদ্ধে, আপনি দয়া করে আর এ অভিযোগ বাড়াবেন না।’
সারা জেফারসন হাসল। বলল, ‘আপনি উল্টো কাজ করছেন মি. আহমদ মুসা। নারীরা ক্ষমতা চায় মানে কাজ চায়। আপনিতো কাজ কেড়ে নিয়ে ক্ষমতা কেড়ে নিচ্ছেন।’
হাসল সারা জেফারসন। বলল ‘ঠিক আছে এ বিতর্কের ফায়সালা আমার মাকে সামনে রেখে হবে। ফায়সালার জন্য একজন বিচারকতো দরকার! চলুন গাড়িতে উঠি।
‘আমি রাজী।’ বলে আহমদ মুসা চাকাটা গাড়িতে তুলে দিয়ে গাড়িতে উঠে বসল।
সারা জেফারসন গিয়ে বসল গাড়ির ড্রাইভিং সিটে।
গাড়ি চলতে শুরু করল।
পাশের সিটেই আহমদ মুসা বসেছিল। সে বলে উঠল, ‘মিস জেফারসন, আপনাদের মানে আপনার মাকে বিরক্ত করলাম নাতো?’
হাসল জেফারসন। বলল, ‘আমার মা আপনাকে আমার চেয়ে বেশি জানেন। দেখবেন তিনি কত খুশি হবেন।’
‘আমি এসেছি জানিয়েছেন তাঁকে?’ আহমদ মুসা বলল।
‘হ্যাঁ, বলেছি। মন্টিসেলোতে আপনাকে আমি দাওয়াত করেছিলাম সেটাও আমি বলেছি। উনি কি বলেছেন, তিনি দাওয়াত খেতে যান নাকি? এমন সময় তাঁর আছে বলে মনে হয় না। আমি বলেছিলাম, এই তো আসছেন তিনি।
আম্মা বলেছিলেন, আমি বুঝতে পারছি না। হতেও পারে তিনি জেফারসন তনয়াকে আলাদা গুরুত্ব দিয়েছেন।’
‘আপনার আম্মা অনেক অভিজ্ঞ।’
‘কিন্তু শেষ কথাটা কি তিনি ঠিক বলেছেন?’ বলল সারা জেফারসন তনয়া আমার কাছে শুধুই জেফারসন। তার চোখে-মুখে আনন্দ বিস্ময় দুটোই।
‘জেফারসন তনয়া তা জানেন।’ আহমদ মুসা তার দৃষ্টি সামনে প্রসারিত রেখেই কিছুটা গম্ভীর কণ্ঠে বলল।
সারা জেফারসনের মুখ হঠাৎ যেন যন্ত্রণার অপূর্ব শিহরণে রাঙা হয়ে উঠল। তার মনে হলো, তার বাইশ বছরের জীবনে তার শোনা কোন কথাই তাকে এতটা শিহরিত করতে পারেনি, তার সত্তাকে এতটা গৌরবান্বিত কেউ কখনও করেনি।
কিছুক্ষণ কথা বলতে পারল না সারা জেফারসন।
অসস্তিকর এক নিরবতা।
আহমদ মুসা তখন ভাবছিল অন্য কথা। মিস জেফারসনকে ওরা খুন করতে চেয়েছিল, এটা এখন নিশ্চিত। ‘ওরা’ কারা সেটাও স্পষ্ট। মিস জেফারসন খুন হননি, সেটাও তারা নিশ্চয় জেনে ফেলেছে সংগে সংগেই। এখন ওরা কি ভাবছে? হাত ফসকে যাওয়া শিকার ছেড়ে দিয়ে বসে থাকা ওদের দর্ম নয়। তাহলে?
এই ‘তাহলে’র উত্তর এখন আহমদ মুসার কাছে নেই। তবে আহমদ মুসা ভেবে খুশি হলো যে, মন্টিসেলোতে আসা তার বৃথা যায়নি। সারা জেফারসন শুধু জেফারসন তনয়া নন, তিনি আজকের আমেরিকার একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। ‘ফ্রি আমেরিকা’ (ফেম) মুভমেন্টের তিনি প্রধান। তার জীবনের আজ অনেক মূল্য। ‘স্বাধীন আমেরিকার মানস’ এর তিনি তরুণ প্রতিনিধি। আমেরিকার ফাউন্ডার ফাদারসরা যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, বিশেষ করে টমাস জেফারসন যে নতুন আমেরিকা ও নতুন পৃথিবীর আমেরিকান স্বপ্নকে সবাক রূপ দিয়েছিলেন, সে স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে সারা জেফারসনরাই পারেন। আর সে স্বপ্ন বাস্তবে রূপ পেলে শান্তির সে পরিবেশে নতুন আমেরিকার সাথে মুসলমানদের সম্পর্কই সবচেয়ে গভীর হবে। সুতরাং আহমদ মুসা জেফারসনদের কোন কাজে এসে সেটা আহমদ মুসার জন্যে আনন্দেরই হবে। আহমদ মুসা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল যে, সে একটা ভালো সময়ে মন্টিসেলোতে আসতে পেরেছে।
সারা জেফারসন অল্প সময় পরে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। রাঙা তখনও তার মুখ।
আহমদ মুসাকে ভাবনায় নিমজ্জিত দেখে বলল সারা জেফারসন, ‘কি ভাবছেন মি. আহমদ মুসা?’
‘ভাবছি না, স্বপ্ন দেখছি।’ আহমদ মুসা হাসি মুখে সারা জেফারসনের দিকে না তাকিয়েই বলল।
সারা জেফারসনের চোখ দুটি উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তার রাঙা মুখটি আলো ঝল মল করে উঠল। বলল, ‘কি স্বপ্ন? বিপ্লবীরা কি স্বপ্ন দেখে?’
আহমদ মুসা কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু বলা হলো না। হঠাৎ রিয়ার ভিউ মিররে নিবদ্ধ হয়ে গেল তার চোখ। তাড়াতাড়ি দূরবীন চোখে লাগিয়ে পেছন ফিরে গাড়িটাকে কয়েক মুহূর্ত দেখে বলে উঠল, ‘মিস জেফারসন, একটা গাড়ি দ্রুত আমাদের পেছনে আসছে। মনে হচ্ছে যেন আমাদের গাড়িকে ধরার চেষ্টা করছে।’
‘কেন ওভারটেক করার প্রয়োজনও তো হতে পারে তার?’ সহজ কণ্ঠে বলল সারা জেফারসন।
‘কিন্তু একটা মজার ঘটনা ঘটল। গাড়িটা ফাস্ট লেন দিয়ে দ্রুত আসছিল। তার পেছনে আরেকটা দ্রুতগামী গাড়ি এসে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গেই ঐ গাড়িটি গতি স্লো করে আমাদের লেন অর্থাৎ সেকেন্ড লেনে চলে এসে পেছনের গাড়িকে চলে যাবার রাস্তা করে দেয়। পেছনের গাড়িটা চলে যাবার পর আবার সে স্পীড বাড়িয়ে ছুটে আসছে।’ আহমদ মুসা বলল।
ভ্রু কুঞ্চিত হলো সারা জেফারসনের। বলল, ‘বুঝেছি মি. আহমদ মুসা। ওভারটেক ওর লক্ষ্য হলে সে লেন চেঞ্জ করতো না এবং গতিও স্লো করতো না।’
বলে মুহূর্তকাল থেমে আবার বলল সারা জেফারসন, ‘কিন্তু ফলো যদি করে, কোত্থেকে করল। আমরা একসিডেন্টের ওখানে অনেকক্ষণ ছিলাম। সে সময় নিশ্চয় ওরা সেখানে ছিল না। ওরা তো সেখানেই কিছু করার চেষ্টা করতে পারতো।’
‘আমার মনে হয় ওরা বাড়ি থেকে আপনাকে ফলো করেনি। মনে হচ্ছে, ওরা খবর পেয়েছে কে একজন শার্লট ভিলে নেমে মন্টিসেলো যাচ্ছে। আরও বোধ হয় খবর পেয়েছে লোকটি মন্টিসেলো যাবার পথে একসিডেন্ট সাইট তদন্ত করেছে এবং একটি ডকুমেন্ট সেখান থেকে তুলে নিয়েছে। আরও খবর পেয়ে থাকতে পারে যে, মিস জেফারসন তাকে এগিয়ে নিতে এসেছে। এসব খবর পাওয়ার পর আগন্তুকটি কে সে সম্পর্কে জানা এবং সুযোগ পেলে কিছু করার জন্যেই ওরা এসেছে।’
কথা শেষ করে আহমদ মুসা তার সিটে সোজা হয়ে বসল। বলল, ‘মিস জেফারসন আপনি গাড়িটা ডেড স্টপ করুন। দেখা যাক ওরা কি করে।’
সংগে সংগেই সারা জেফারসন শেষ লেনটিতে নিয়ে গিয়ে গাড়ি দাঁড় করাল।
গাড়ি দাঁড়াতেই আহমদ মুসা বলল, ‘মিস জেফারসন আপনি একটু সাবধানে বসুন। আমি দেখি ইঞ্জিনটার কি হলো।’
আহমদ মুসা নেমে পড়ল গাড়ি থেকে।
‘আপনার পরিকল্পনা আমি বুঝতে পারিনি। কিন্তু সাবধান, ওদের আন্ডারইস্টিমেট করবেন না।’ গাড়ির জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে অনুরোধ করল সারা জেফারসন।
ইঞ্জিন সামনে।
আহমদ মুসা কভারটি খুলল।
কভারটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে স্প্রিং-এর উপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেল।
আহমদ মুসা রাস্তার দিকটাকে সামনে রেখে একটু ঝুঁকে বাম হাত দিয়ে ইঞ্জিন পরীক্ষা করছে। আর তার ডান হাতটি তখন কোটের বুকের বোতাম নিয়ে খেলা করছে। হাতের তিন ইঞ্জি ব্যবধানে ঝুলছে তার মেশিন রিভলবার।
বিশ সেকেন্ডও পার হলো না।
পেছনের গাড়িটা আহমদ মুসাদের সমান্তরালে চলে এল।
কিন্তু সমান্তরালে আসার আগেই গাড়িটার গতি স্লো হয়ে গিয়েছিল।
ভ্রু কুঞ্চিত হয়েছিল আহমদ মুসার। ওরা তাহলে গাড়ি দাঁড় করাচ্ছে না? তারা দেখেই চলে যাবে? এমন প্লিজার ট্রিপে তারা কষ্ট করে এসেছে বলে মনে হয় না, বিশেষ করে তাদের প্রথম উদ্যোগ ব্যর্থ হবার পর। তাহলে?
সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছিল আহমদ মুসা।
ঠিক এসময় সারা জেফারসনের কথা সে শুনতে পেয়েছিল, ‘বি কিয়ারফুল মি. আহমদ মুসা। ওরা…….।’
কথা শেষ করেনি সারা জেফারসন। সাথে সাথে একটা গুলীর শব্দ শুনল আহমদ মুসা। গুলী ছুড়ছে সারা জেফারসন।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়িয়েই দেখতে পেয়েছিল এগিয়ে আসা গাড়ির দুজানালা দিয়ে হ্যান্ড রকেট লাঞ্চারের দুটি অগ্রভাগ বেরিয়ে আসছে।
বুঝেছিল আহমদ মুসা কি ঘটতে যাচ্ছে।
আহমদ মুসার ডান হাত আগেই চলে গিয়েছিল মেশিন রিভলবারের বাঁটে।
ট্রিগারে আঙুল রেখেই বের করে নিয়ে এসেছিল সে রিভলবার।
দুই রকেট লাঞ্চারের ‘ফায়ার টিপ’ জানালা দিয়ে বের হয়ে আসছে, এ দৃশ্য দেখার সংগে সংগেই আহমদ মুসা ফায়ার করল প্রথমে সামনের দুই সিট লক্ষ করে। রিভলবারের নল আর নড়াতে হয়নি আহমদ মুসার। গাড়ি সামনে এগিয়ে আসায় মেশিন রিভলবারের অবিরাম গুলী বৃষ্টি গিয়ে ঘিরে ফেলেছে পেছনের সিটের দুজনকেও।
প্রথম গুলী আহমদ মুসা ও সারা জেফারসন এক সাথেই করেছিল।
রকেট লাঞ্চারের শর্ট ডিস্ট্যান্স এ্যাডজাস্ট করতে গিয়ে সে দেরীটা তাদের হয়েছিল, তা আহমদ মুসাদের পক্ষে এসে গিয়েছিল। আহমদ মুসা ও সারা জেফারসনের প্রথম দুটি গুলী প্রথমেই দুই রকেট লাঞ্চারধারীকে আহত করেছিল।
ও গাড়ির রকেট লাঞ্চারধারী আহমদ মুসাদের গাড়ি খারাপ হওয়াও ইঞ্জিন পরীক্ষা করার মহড়াকে সম্ভবত সত্য মনে করেছিল এবং মনে করেছিল তাদেরকে আহমদ মুসারা মোটেই সন্দেহ করেনি। এই ভুলই তাদের জন্যে কাল হয়ে দেখা দিল।
আহমদ মুসা রিভলবারের ট্রিগার থেকে হাত সরিয়েই ইঞ্জিনের উপর ঢাকনা সেট করে ছুটল ঐ গাড়ির দিকে। দেখল গাড়িতে নিহত চারজনই মুখ্যত সেমিটিক চেহারার মানুষ।
আহমদ মুসা গাড়ির কোন কিছুতে হাত না দিয়ে সামনের সিটের নিহত একজনের শার্টের কলার ব্যান্ড উল্টিয়ে দেখল কলার ব্যান্ডের একটা সাদা বোতামে ছয় তারা আঁকা। অর্থাৎ এরা সবাই জেনারেল শ্যারনের বাহিনী।
বিস্মিত হলো আহমদ মুসা। জেনারেল শ্যারন সারা জেফারসনের এতটা বৈরী, তাকে হত্যার জন্যে এতটা মরিয়া হয়ে উঠেছে কেন? তাহলে সারা জেফারসনের আসল পরিচয় ওরা জেনে ফেলেছে?
ফিরে এল আহমদ মুসা গাড়িতে।
‘কি দেখলেন মি. আহমদ মুসা?’ জিজ্ঞেস করল সারা জেফারসন। তার চোখে-মুখে উদ্বেগ।
‘ওদের পরিচয়ের সন্ধ্যানে গিয়েছিলাম। দেখলাম অনুমান ঠিক। ওরা জেনারেল শ্যারনের লোক। ওদের শার্টের কলার ব্যান্ডে দেখলাম সেই ছয় তারকার বোতাম।’ আহমদ মুসা বলল।
আহমদ মুসা থামতেই সারা জেফারসন বলে উঠল, ‘পুলিশের ইনফরম করা দরকার।’
‘অবশ্যই উচিত, কিন্তু মেশিন রিভলবারের গুলীর কি ব্যাখ্যা দেবেন?’
‘ওঠা ঠিক আছে। আমি যে মেশিন রিভলবার আপনাকে দিয়েছি, ওটা আমার নামেই লাইসেন্স করা।’ বলল সারা জেফারসন।
‘তাহলে ঠিক আছে। ধন্যবাদ আপনাকে।’
‘ওয়েলকাম’ বলে হাসল সারা জেফারসন। তারপর মোবাইল তুলে নিয়ে টেলিফোন করল পুলিশকে। গোটা ঘটনা পুলিশকে। গোটা ঘটনা পুলিশকে জানাল। অবশেষে বলল, ‘সেদিনের একসিডেন্টটা কিন্তু আমি এখন কোন শত্রুর অন্তর্ঘাতি কাজ বলে মনে করছি।’
পুলিশ এসে গাড়িটার দায়িত্ব নিলে আনুসাঙ্গিক ফর্মালিটি শেষ করে সারা জেফারসন আবার যাত্রা করল।
আহমদ মুসাকে পুলিশের কাছে তার বন্ধু বলে পরিচয় দিয়েছিল সারা জেফারসন। আহমদ মুসার গোঁফ তার চেহারায় অনেক পরিবর্তন এনেছিল।
পুলিশ প্রশংসা করেছিল সারা জেফারসন ও তার বন্ধুর। বলেছিল তারা সাহসের সাথে তাৎক্ষণিকভাবে পাল্টা আক্রমণে না গেলে সাংঘাতিক ঘটনা ঘটে যেত। পুলিশের ভারপ্রাপ্ত অফিসারটি সারা জেফারসনকে অভয় দিয়ে বলেছিল, ‘আমরা বুঝতে পারছি লস আলামোস নিয়ে যা ঘটেছে, তারই একটা প্রতিক্রিয়া হয়তো আপনার উপর এসেছে। আপনি ভাববেন না, আপনার বাড়ির আশে-পাশে পুলিশ থাকবে, যে কয়দিন আপনি মন্টিসেলোতে থাকবেন। আর আপনিও একটু সাবধানে থাকবেন।’
আবার গাড়ি ছুটে চলছিল, মন্টিসেলোর দিকে।
গাড়ি ড্রাইভ করছে সারা জেফারসনই।
তার দৃষ্টি সামনে পথের উপর নিবদ্ধ। বলল এক সময় সামনে চোখ রেখেই, ‘আমি বিস্মিত মি. আহমদ মুসা, একজন মানুষও একটা গাড়ির বিরুদ্ধে তারা রকেট লাঞ্চার নিয়ে এসেছে?’
‘দূর কিংবা কাছে যে কোন জায়গা থেকে ব্যবহারের ক্ষেত্রে রকেট লাঞ্চার একটা ভালো অস্ত্র। ওরা ব্যর্থ হতে চায়নি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আগের আক্রমণও তাহলে জেনারেল শ্যারনদেরই ছিল?’ সামনে চোখ নিবদ্ধ রেখেই বলল সারা জেফারসন।
‘আমার তাই মনে হয়।’ আহমদ মুসা বলল।
‘প্রত্যেক আক্রমণের পেছনে একটা পরিকল্পনা লাগে। ওরা সেই সময় আজ পেল কখন?’ জিজ্ঞেস করল সারা জেফারসন।
‘প্রথম আক্রমণ ব্যর্থ হবার পর পরবর্তী আক্রমণের জন্যে তারা ওৎ পেতেই বসেছিল। কোথাও বেরুলে আপনি গাড়ি নিয়ে বেরুবেন, এটা জানাই ছিল ওদের। সুতরাং কি প্রস্তুতি নিতে হবে সেটা আগে থেকে তাদের ঠিক করা ছিল।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ওরা হঠাৎ এমন মরিয়া হয়ে উঠল কেন?’ সারা জেফারসন বলল।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘জেনারেল শ্যারন আমার খুব খারাপ শত্রু। কিন্তু একটা বিষয়ে তার প্রশংসা করি, সময়ের কাজ সময়ে করতে সে একটুও দেরী করে না।’
সংগে সংগেই সারা জেফারসন মুখ ফিরাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘অর্থাৎ এই সময়ের সবচেয়ে বড় টার্গেট আমি!’ সারা জেফারসনের ঠোঁটে হাসি।
‘তাই তো মনে হচ্ছে?’ আহমদ মুসা বলল।
‘মনে হওয়ার কারণ?’ জিজ্ঞেস করল সারা জেফারসন। তার ঠোঁটে আগের সেই হাসিই।
‘যাকে প্রশ্ন করা হয়েছে তার চেয়ে প্রশ্নকারীই ভাল জানেন এর জবাব।’ বলল আহমদ মুসা।
তড়িত মুখ ঘুরিয়েছিল সারা জেফারসন কিছু বলার জন্যে। কিন্তু তার মোবাইলে কল এল এ সময়।
কথা তার বলা হলো না। সে মোবাইল তুলে নিল হাতে।
টেলিফোনে কথা শেষ করে সারা জেফারসন সামনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমরা এসে গেছি মি. আহমদ মুসা। ঐ দেখুন পাহাড়টার মাথায় মন্টিসেলো।
তাকাল আহমদ মুসা।
পাহাড়টা খুব উুঁচু নয়। সাধারণ ওয়াকিং সীমার মধ্যেই।
পাহাড়ের গা সবুজ গাছ ও ছোট ছোট আগাছায় ঢাকা। মন্টিসেলো পাহাড়ের শীর্ষে। বাড়ির তিন দিক জুড়ে বাগান। আর সামনে একটা সুন্দর ছোট লেক।
পাহাড়ের সবুজ গা বেয়ে উঠতে লাগল গাড়ি।
আহমদ মুসার চোখ দুটি নিবদ্ধ আমেরিকার তৃর্তীয় প্রেসিডেন্ট টমাস জেফারসনের অতি আদরের মন্টিসেলোর প্রতি।

‘সারা’র কথা কি বলব বেটা, ও তার গ্রান্ড ফাদার টমাস জেফারসনের মতই যেমন জনগণত প্রাণ, তেমনি ঐতিহ্যবাদী এবং তেমনি আপোষহীনও। এই মন্টিসেলোর কথাই ধর। সারা বলল, তার মহান পূর্ব পুরুষ টমাস জেফারসনের প্রিয় মন্টিসেলো যে কোন মূল্যে সে ফেরত নেবে। সে নিয়েই ছেড়েছে। এর জন্যে ‘পিডমন্ট’ ও ‘স্যাডওয়েল’ এলাকার মূল্যবান সম্পত্তির অধিকাংশই তাকে বিক্রি করতে হয়েছে। পরিবারের কেউই তার এ মত সমর্থন করেনি। কিন্তু কারও মতকে সে তোয়াক্কা করেনি। তার এক কথা, পরিবার অতীতে মহান গ্রান্ড দাদুর স্বপ্নের মন্টিসেলোকে রক্ষা করেনি, এটা পরিবারেরই ব্যর্থতা। এ ব্যর্থতার প্রতিবিধান সে করবে। সবকিছুর বিনিময়েই সে তা করেছে।’
বলে থামল জিনা জেফারসন। সারা জেফারসনের মা।
জিনা জেফারসন ও আহমদ মুসা বসে আছে মন্টিসেলোর চত্তরে, সুন্দর লেকটার একেবারে ধার ঘেষে।
মন্টিসেলোর বাড়তি ছাদটা লেকের ধার পর্যন্ত এসেছে।
সারা জেফারসনের মা জিনা জেফারসন একটু থেমেই আবারও তার কথা শুরু করতে যাচ্ছিল, ‘পেছনে থামের আড়াল থেকে বেরিয়ে সারা জেফারসন মায়ের পেছনে এসে দাঁড়াল। দুহাতে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আম্মা এক ঘন্টা ধরে মেহমানকে আমার ব্যাপারে এসব কথাই বলছ বুঝি!’
জিনা জেফারসন কিছু বলার আগেই কথা বলে উঠল আহমদ মুসা। বলল, না মিস জেফারসন আপনার আম্মা আমাকে শুধু জেফারসন পরিবার নয়, শুধু এই সুন্দর ভার্জিনিয়া নয়, গোটা আমেরিকাকেই পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। আমেরিকার এই অন্তরচিত্র আমার জানা ছিল না। আপনার সম্পর্কে না বললে তো এই বলা সম্পূর্ণ হয় না। তাই সেটাও বলেছেন।’ আহমদ মুসার মুখে হাসি।
জিনা জেফারসন দুই হাত দিয়ে তার ঘলায় পেচানো সারা জেফারসনেরই দুই হাত ধরে টেনে সামনে নিয়ে এল। বসাল নিজের কোলে। বলল, ‘তোমার সম্পর্কে আজ কি বলতে পারি বল। আজ আমি খুব আনন্দিত। তোমাকে এমন হাসতে বহুদিন দেখিনি মা।’
তারপর সারা জেফারসনের মা চাইল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘বেটা এই সারাকে দেখে আমিই মাঝে মাঝে হাঁপিয়ে উঠি। তুমি তার প্রথম বন্ধু যাকে সে বসায় নিয়ে এসেছে। তার……….।’
জিনা জেফারসনের কথা বন্ধ হয়ে গেল। সারা জেফারসন তার হাত চাপা দিয়েছে মায়ের মুখে। বলল, ‘এই তো মা তুমি আমার বদনাম করছ। আমার কত বন্ধু আমেরিকা জুড়ে। আমেরিকানরা সবাই আমার বন্ধু।’
জিনা জেফারসন মেয়ের পিঠে আদরের একটা থাবা দিয়ে বলল, ‘যার বন্ধু সবাই, তার কোন বন্ধু নেই, এই উদ্বেগের কথাই তো আমি বলছি।’
‘আমি বুঝছি না আম্মা, কাকে তাহলে তুমি বন্ধু বলছ?’ বলল সারা জেফারসন মায়ের বুক থেকে মুখ তুলে।
‘এই দেখ আহমদ মুসাকে।’ বলল জিনা জেফারসন।
সারা জেফারসন মিষ্টি হাসল। বলল, ‘উনি তো মাত্র বন্ধু নন, বন্ধুর চেয়ে বড়। বন্ধুকে সব বলা যায় না, কিন্তু ওঁকে সব বলা যায় মা।’
জিনা জেফারসনও হাসল। বলল, ‘আসলেই তোমার কোন বন্ধু ছিল না। তাই জান না যে, বন্ধুকে সব বলা যায়।’
‘ঠিক আছে আম্মা। তোমার সব কথাই মানলাম। এবার চলো, টিজে (টমাস জেফারসন) দাদুর স্টাডিতে যাব ওঁকে নিয়ে। তুমিও যাবে।’ বলল সারা জেফারসন।
‘আমি কেন?’
‘একা একা গিয়ে শুয়ে থাকার চেয়ে তোমার ওখানেই ভাল লাগবে।’ সারা জেফারসন বলল।
জিনা জেফারসন ঘড়ির দিকে তাকাল। বলল, ‘রাত এগারটা। ঠিক আছে ওষুধটা খেয়ে নিয়ে একটা কাজ সেরে আসছি। তোমরা যাও।’
বলে জিনা জেফারসন উঠে দাঁড়াল।
উঠে দাঁড়াল সারা জেফারসন এবং আহমদ মুসা।
জিনা জেফারসন হাঁটতে শুরু করে আহমদ মুসার দিকে ফিরে বলল, ‘আসছি বেটা।’
‘ওয়েলকাম।’ বলল আহমদ মুসা।
জিনা জেফারসন এগুলো দুতলার সিঁড়ির দিকে। আর সারা জেফারসন ও আহমদ মুসা এগুলো একতলার জেফারসন স্টাডি রুমের দিকে।
পাশাপাশি হাঁটছিল আহমদ মুসা ও সারা জেফারসন।
‘আম্মাকে আসতে বললাম কেন বলুন তো?’ জিজ্ঞেস করল সারা জেফাসরন। তার মুখে হাসি।
‘কেন?’
‘আপনি স্বাচ্ছন্দ বোধ করবেন তাই। মুসলিম নীতিবোধ অনুসারে কোন নির্জন কক্ষে দম্পতি নয় এমন নারী-পুরুষের একান্ত সাক্ষাত বৈধ নয়।’
‘ধন্যবাদ মিস জেফারসন।
আপনি আমাদেরকে এত জানেন?’
‘শুধু জানি নয় মিস্টার, মানিও যে এটা খুব ভাল একটা নীতিবোধ।’
‘কারণ ইসলামের অনুশাসনগুলো মানব প্রবণতার সাথে সংগতিশীল।’ আহমদ মুসা বলল।
‘সবগুলোই কি?’
‘সবগুলোই?’
‘জানি না, তাই ভেবে দেখারও সুযোগ হয়নি।’
‘জানার জন্য আগ্রহ দরকার।’
‘আপনাকে দেখার পর এ আগ্রহ মনে হচ্ছে দরুণভাবে বাড়ছে।’ মুখে একটা সলজ্জ হাসি ফুটে উঠল সারা জেফারসনের।
কথা শেষ করেই সারা জেফারসন সম্ভবত কথার মোড় অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেবার জন্যেই বলল, ‘মন্টিসেলো আপনার কেমন লাগছে?’
‘নামের মতই সুন্দর।’
‘নাম ভাল লেগেছে আপনার?’
‘অবশ্যই। ‘মন্টিসেলো’ মানে পাহাড়ে সঙ্গীত’। সুন্দর নাম। এই তো চত্তের বসে চারদিক দেখে মনে হচ্ছিল, গ্রেডভ্যালির মাথায় নীল পাহাড়-মেলার কোলে সবুজ-সমুদ্রের জমাট এক মৌনতার মাঝে সফেদ মন্টিসেলো যেন এক প্রশান্তির নাম।’
দাঁড়িয়ে পড়েছে সারা জেফারসন।
সারা জেফারসন দাঁড়িয়ে পড়ায় আহমদ মুসাও দাঁড়িয়েছে।
সারা জেফারসনের মুগ্ধ দুই চোখ আহমদ মুসাকে যেন নতুন করে দেখছে। তার ঠোঁটে মুগ্ন এক হাসি। বলল, ‘আপনি যা বললেন তা কবিতার এক অমর লাইন হতে পারে। ধন্যবাদ আপনাকে। মন্টিসেলোর স্রষ্টা ‘টিজে (T.J) দাদুও মনে হয় মন্টিসেলোকে এভাবে দেখেননি। বিপ্লবী দেখছি কবিও হয়।
‘আমি যা দেখেছি, সবাই তা দেখে। এর জন্যে কবি হবার কি প্রয়োজন আছে। ‘মন্টিসেলো’ নামটাই প্রমান করে সৌন্দর্যের এই পটভূমিই আপনার টিজে দাদুকে আকৃষ্ট করেছিল।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কবি হবার প্রয়োজন আছে। তা না হলে আমাদের এক পুরুষ এই স্বপ্নের মন্টিসেলো বিক্রি করে দিয়েছিল কি করে? তাদের কাছে এর মূল জনবিচ্ছিন্ন এক প্রসাদ ছাড়া আর কিছুই ছিল না।’ সারা জেফারসন বলল।
‘তাহলে যিনি তার সর্বস্ব দিয়ে আবার এটা কিনেছে, তাকে কি বলতে হয় বলুন তো?’ আহমদ মুসা বলল।
সারা জেফারসনের মুখ রাঙা হয়ে উঠল লজ্জায়।
মাথার হ্যাটটা সে মুখের উপর আর একটু টেনে দিয়ে বলল ‘চলুন।’
সারা জেফারসনের পরনে হালকা নীল রঙের ফুল স্কার্ট, সাদা ফুল সার্ট, গলায় একটা সাদা স্কার্ফ পেচানো এবং মাথায় সাদা হ্যাট।
সারা জেফারসন চলতে শুরু করেছে।
আহমদ মুসাও।
টিজে মানে টমাস জেফারসনের বিশাল স্টাডি কক্ষটা গ্রাউন্ড ফ্লোরের শেষ প্রান্তে, দক্ষিণ পশ্চিম কোণায়।
স্টাডি রুমের দরজা কাঠের কারুকাজ করা।
দরজার ঠিক উপরে দরজার প্রস্থের সমান একটা সাইনবোর্ড। সাইনবোর্ডটা সুন্দর নীল। তার উপর সাদা অক্ষরে লেখাঃ ‘নিপীড়কের প্রতিরোধ করা হলো ঈশ্বরের আনুগত্য। ঈশ্বরের শপথ, মানব মনের উপর সকল পীড়নের বিরুদ্ধে আমার চিরন্তন সংগ্রাম’
কোটেশনটির নিচে দরখাস্ত আকারে ‘টমাস জেফারসন’-এর নাম লিখা।
নিচে টমাস জেফারসনের নাম পড়ার আগেই আহমদ মুসা বুঝেছিল এটা টমাস জেফারসনের বিখ্যাত একটা উক্তি। কিন্তু আহমদ মুসার কাছে প্রথম বাক্যটা পরিচিত নয়, দ্বিতীয় বাক্যটা খুবই পরিচিত, সকলেই জানে।
আহমদ মুসা পাশেই সারা জেফারসনের দিকে তাকাল। বলল, ‘প্রথম বাক্যটা আমার কাছে অপরিচিত। কোথায় তিনি বলেছিলেন কথাটা?
বাক্যটা পাওয়া গেছে তার অপ্রকাশিত একটা নোটে। পরে এটা তার ‘লেখা ও বক্তিতাগুলি’র কোন এক অডিশনে শামিল হয়েছে।’ বলল সারা জেফারসন।
‘মিস জেফারসন, আপনার টিজে দাদুর একথাগুলো পড়ে আমার কি মনে হচ্ছে জানেন? মনে হচ্ছে, ‘আমাদের ধর্মের মৌল কথাগুলোর দুটি আপনার টিজে দাদুর কথায় নতুন ভাষা পেয়েছে।’ আহমদ মুসা বলল।
সে দুটি কথা কি?
‘ইসলামে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসকে যতখানি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, ততখানিই গুরুত্ব দেয়া হয়েছে ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের প্রতিরোধ করার কাজকে। ইসলামের সর্বশ্রেষ্ঠগ্রন্থ আল-কোরআন বলেছে, ‘মানুষকে ন্যায়ের আদেশ দাও, অন্যায় থেকে বিরত রাখ এবং আল্লাহকে বিশ্বাস কর।’
‘চমৎকার। টিজে দাদুর প্রথম বাক্য বরং দায়িত্বের অর্ধেক বলা হয়েছে, কিন্তু এখানে পুরো দায়িত্বের কথা বলা হয়েছে। নিপীড়কদের প্রতিরোধের সাথে সাথে ন্যায়কাজের নির্দেশ দেয়ার বিষয়ও আছে। এতো গেল একটা কথা, অন্য কথাটা কি?’
‘ইসলাম প্রতিটি মানুষের সার্বভৌম স্বাধীনতা ও সম্মান নিশ্চিত করেছে। ইসলাম বলে, মানুষ শুধু আল্লাহর অধীন হবে আর কারও নয়। এর মাধ্যমে ইসলাম মানুষের উপর মানুষের শারীরিক ও মানসিক সকল পীড়নকে নিষিদ্ধ করেছে। শুধু তাই নয়, মানুষকে তার নিজের উপর জুলুম করার অধিকারও দেয়া হয়নি।’
‘চমৎকার। কিন্তু মানুষ শুধু আল্লাহর অধীন হলেই কিভাবে মানুষের উপর মানুষের জুলুম বন্ধ হয়ে যায়?’
‘সকল মানুষ এক আল্লাহর অধীন হয়ে যাওয়া মানে সকল মানুষ সমান হওয়া। জুলুম যেখানে থাকে, সেখানে এই সমান মর্যাদার অনুভূতি থাকে না। অর্থ্যাৎ সকলে সমান মর্যাদার হলে জুলুমের সুযোগ থাকে না। নাম্বার ওয়ান। নাম্বার টু হলো, সকলে এক আল্লাহর অধীন হওয়ার অর্থ সকল মানুষ এক আল্লাহর আইনের অধীন হয়ে পড়া এখানে মানুষের আইন মানুষকে রুল করে না। তাই স্বেচ্ছাচারিতার কোন অবকাশ থাকে না। স্বেচ্ছাচারিতা বন্ধ হলে মানুষের উপর মানুষের জুলুমও বন্ধ হয়ে যায়।’
থামল আহমদ মুসা।
ভাবছির সারা জেফারসন। একটু সময় নিয়ে বলল, ‘মানুষের আইন মানুষকে রুল করবে না, কথাটা কি ইউটোপিয়ান হয়ে গেল না। বাস্তবতা হলো, মানুষ মানুষকে রুল করবেই, মানুষের আইন মানুষকে রুল করেই।’
হাসল আহমদ মুস। বলল, ‘আপনার কথা ঠিক মিস জেফারসন। কিন্তু রুলকারী মানুষ যদি আল্লাহর অধীন হয়, রুলকারী মানুষের আইন যদি আল্লাহর আইনের অধীন হয়, তাহলে মানুষের ‘রুল প্রকৃত অর্থে তখন মানুষের ‘রুল’ থাকে না এবং মানুষের আইনও তখন প্রকৃতপক্ষে মানুষের আইন থাকে না।’
হাসল সারা জেফারসনও। বলল, ‘এটাই কি তাহলে ‘রুল অব গড’?
‘হ্যাঁ, মিস জেফারসন। মানুষসহ এই ইউনিভার্সের প্রকৃত রুলার আল্লাহ। মানুষ তাঁর প্রতিনিধি। আমাদের কোরআনের ভাষায় ‘খলিফা’। একজন প্রতিনিধি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রতিনিধিদের উপর শাসন পরিচালনা করেন। এটাই আল্লাহর শাসন বান ‘রুল অব গড’।
সারা জেফারসনের চোখে মুগ্ধ দুষ্টি, তার ঠোঁটে মুগ্ধ হাসি। বলল, ‘অনেক ধন্যবাদ আহমদ মুসা। একটা কঠিন জিনিসকে পানির মত সহজ করে দিয়েছেন আমার কাছে। বিশ্বাস করুন, পৃথিবী এবং পৃথিবীর মানুষ এখন এক নতুন অর্থ নিয়ে আমার সামনে আসছে।’
‘স্বাভাবিক মিস জেফারসন। কারণ আপনি আল্লাহর শ্রেষ্ঠ বান্দাহদের একজন।’
সারা জেফারসন তখন চলতে শুরু করেছে। দরজা খুলতে খুলতে বলল, তাই কি?’
সারা জেফারসন প্রবেশ করেছে স্টাডিতে।
আহমদ মুসাও প্রবেশ করল। বলল, ‘তাই মিস জেফারসন। ন্যাচারাল লিডারশীপ সব সময় শ্রেষ্ঠ বান্দাদের কাঁধে গিয়েই অর্পিত হয়।’
ঘরের মাঝখানে রাউন্ড টেবিলটার কাছে পৌছেছিল সারা জেফারসন।
টেবিল ঘিরে তিনটি চেয়ার। এ চেয়ারগুলো আধুনিক ডিজাইনের এবং ঘরের কারুকাজপূর্ণ পরিবেশের সাথে একেবারেই বেমানান। আহমদ মুসা বুঝল, চেয়ারগুলো ঘরের অংশ নয়। ঘরের বাইরে থেকে সদ্য আমদানি। ঘরের একপাশে একটা বেদীর উপর আরেকটা বড় চেয়ার সুদৃশ্য কারুকাজ করা। খুবই যত্ন করে রাখা। আহমদ মুসার বুঝতে বাকি রইল না যে একটা টমাস জেফারসনের স্টাডি চেয়ার।
স্টাডি রুমের বুক শেলফগুলো, শতব্দীর পুরানো সুদৃশ্য আলমারি, ইত্যাদি সব জিনিস ঘুরে আহমদ মুসার দৃষ্টি এসে নিবদ্ধ হলো অবশেষে সারা জেফারসনের দিকে।
সারা জেফারসন ঘুরে দাঁড়িয়েছে আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসাকে বসতে বলে সে নিজেও একটা চেয়ারে বসল। বসল আহমদ মুসাও।
সারা জেফারসনের সামনে সুদৃশ্য একটি চামড়ার ফাইল।
সারা জেফারসনের দুটি হাত ফাইলের উপর। তার চোখে আহমদ মুসার উপর নিবদ্ধ। চোখে প্রশ্ন জ্বলজ্বল করছে।
আহমদ মুসা বসতেই সারা জেফারসন বলল, ‘আপনার শেষ বাক্যটা বুঝলাম না মি. আহমদ মুসা। ‘মুখে হাসি সারা জেফারসনের।
‘নিশ্চয় জানেন এর অর্থ আপনি।’ বলল আহমদ মুসা। আহমদ মুসার ঠোঁটেও হাসি।
সারা জেফারসন পরিপূর্ণভাবে আহমদ মুসার দিকে তাকাল। হাসল সে। বলল, ‘এ নিয়ে তিনবার আপনি কোনা বিশেষ পরিচয়ের দিকে ইংগিত করেছেন। বলুন তো সেটা কি?’
‘এসব বিষয় থাক। আমি আমার কথা প্রত্যাহার করলাম। এখন আপনার কথা বলুন।’
গম্ভীর হলো সারা জেফারসন। বলল, ‘আমার ক্ষুদ্র একটা পরিচয় আছে। আহমদ মুসার কাছে তা গোপন থাকেবে এবং গোপন থাকা উচিত, তা আমি মনে করি না। আমি দুঃখিত যে, বিষয়টা আমি নিজের থেকে আপনাকে বলিনি। প্রকৃতপক্ষে বলার সুযোগও পাইনি।
গম্ভীর হলো আহমদ মুসাও। বলল, ‘মিস জেফারসন, আপনি ‘ফ্রি আমেরিক’ (ফেম) মুভমেন্টের চেয়ারম্যান, এটা ছোট পরিচয় নয়। আমিও দুঃখিত মিস জেফারসন, বিষয়টি আমার সরাসরি আপনার কাছে না জেনে বারবার সে দিকে ইংগিত করা শোভন হয়নি। ’
‘না জনাব, আপনার ইংগিত যথার্থই হয়েছে। এ ধরনের ক্ষেত্রে এটাই স্বাভাবিক। আমি হলেও এটাই করতাম। আমার পরিচয়টা এতটা গোপন করে আসা অনেকটা অবিশ্বস্ততার পরিচায়ক হয়েছে। আমি লজ্জিত জনাব।’
কথা শেষ করে মুহূর্তের জন্যে থেমেই আবার বলে উঠল, ‘আসলে কি জানেন, আমি ভেবেছিলাম যেদিন আমার স্বপ্ন সফল হবে, সেদিন আপনি সব জানবেন। শুধু জানবেন না, জানার অধিকার আপনার উপরই বর্তে যাবে। স্বপ্নটাকে আমি মনে করি ঈশ্বরের বিধিলিপি।’
সারা জেফারসনের গম্ভীর কন্ঠ ধীরে ধীরে ভারী হয়ে উঠল। তারপর তার ভারী কন্ঠ কক্ষের পরিবেশকেই ভারী করে তুলল।
আহমদ মুসা কি বলবে সেই মুহূর্তে খুঁজে পেল না।
কথা বলতে বলতে সারা জেফারসনের মুখ নিচু হয়ে গিয়েছিল। মুখে নিচু রেখেই সে বলতে শুরু করল, ‘মি. আহমদ মুসা, আমাদের প্রিয় আমেরিকা, আমাদের পিতামহদের প্রিয় আমেরিকায় সবই আছে, কিন্তু আমাদের গণতন্ত্রটা ব্যয়বহুল হয়ে পড়ায় ইহুদীদের ইহুদীবাদী ষড়যন্ত্রকারী শ্রেণীটি এর সুযোগ গ্রহণ করেছে। আমাদের ফাউন্ডার ফাদাররা স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি তাদের প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্র কিনে ফেলা যাবে বা কিনে ফেলা হবে। কিন্তু সেই অভাবনীয় ঘটনাই ঘটছে এখন। আমাদের গণতন্ত্র বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হচ্ছে। উন্নয়…………
কথা গলায় আটকে গেল সারা জেফারসনের। ‘স্যরি’ বলে সে থেমে গেল।
খুব নরম কন্ঠে কথা বলছিল সারা জেফারসন। তার ভারী হয়ে ওঠা কন্ঠ অবশেষে আবেগে রুদ্ধ হয়ে গেল।
‘মাফ করবেন আহমদ মুসা। এই আলোচনা আমাকে খুবই ইমোশনাল করে তোলে।’ আবার বলতে শুরু করল সারা জেফারসন, ‘যা বলছিলাম, উন্নয়নশীল দেশে স্বার্থান্ধ মহাজনরা যেমন দরিদ্র কৃষকদেরকে তাদের ক্ষেতের ফসলের উপর দাদন দেয় এবং ফসল উঠলে পানির দরে সিংহভাগ ফসল নিয়ে নেয়, তেমনি আমাদের দেশে ইহুদীবাদীরা নির্বাচন সুফল কিনে ফেলে। যা তারা দাদন দেয় তার সহস্রগুন সুবিধা তারা আদায় করে নেয়। ব্যয়বহুল গণতন্ত্রের এই রন্ধ্র পথে সিন্দাবাদের ভূতের মত ইহুদীবাদীরা আমাদের ঘাড়ে চেপে বসেছে। তাদের স্বার্থে বাহন হয়ে পড়েছে আমাদের প্রিয় আমেরিকা।
থামল সারা জেফারসন। আবার আবেগ রুদ্ধ হয়ে গেল তার গলা।
‘আপনার অনুভূতি আমিও শেয়ার করি মিস জেফারসন। আমিও কিছু কিছু জানি।’ বলল আহমদ মুসা।
একটু থেমে গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে সারা জেফারসন বলল, ‘আরও জানুন মি.আহমদ মুসা। আমাদের ক্ষতি বিশ্বের বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর ক্ষতি ডেকে আনছে। আমাদের গণতন্ত্রকে পণবন্দী করে ওরা একে বাহন সাজিয়ে উন্নয়নশীল দেশের গণতন্ত্র, অর্থনীতিক সব কিছুকেই কুক্ষিগত করতে চাচ্ছে। এর শেষ পরিণতি কোথায় আমি জানি না, কিন্তু সকলের সব রোষের শিকার হবে মার্কিনীরা, একথা দিবালোকের মত সত্য। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত মার্কিন স্বার্থ, মার্কিনীরা, ক্ষতিগ্রস্ত হবে দুনিয়ার আর সবাই, সবদেশ। কিন্তু নাটের গুরু ইহুদীবাদীরা থাকবে অক্ষত। এ রকম নতুন একটা বিশ্বব্যবস্থা তারা চাচ্ছে। সব দুঃখ, সব বেদনা এবং সব হতাশার কেন্দ্র বিন্দু এটাই। এই বোধ থেকেই সৃষ্টি হয়েছে, ‘ফ্রি আমেরিকা’ মুভমেন্ট। আমাদের প্রিয় আমেরিকাকে বাঁচাতে হলে এই ভয়াল ষড়যন্ত্রের হাত থেকে তাকে রক্ষা করতে হবে। এই কাজেই আমরা নেমেছি। আমরা আপনার সাহায্য চাই আহমদ মুসা।’
থামল সার জেফারসন।
মুখ নিচু করে শুনছিল আহমদ মুসা সারা জেফারসনের কথা। মুগ্ধ-বিস্মিত হচ্ছিল আহমদ মুসা সারা জেফারসনের পরিস্থিতি বিশ্লেষণ দেখে। আহমদ মুসা আরও খুশি হলো এটা বুঝে যে, তারা বাইরে থেকে যে আমেরিকাকে দেখে তার ভেতরে আর এক আমেরিকা আছে। যেখানে আছে নিশ্চয় হাজারো সারা জেফারসন কিংবা হাজারো বেঞ্জামিন বেকন। কিন্তু সারা জেফারসন যে সাহায্যের আহবান জানাচ্ছে তার উত্তরে কি বলবে সে! বলল আহমদ মুসা, ‘আমি এক ব্যক্তিমাত্র আমেরিকায় এসেছি ঘটনাচক্রে। আর আপনার মিশন একটা ‘মহামিশন’।’
ধন্যবাদ আপনার বিনয়ের জন্যে। আপনি ইতিমধ্যেই যা করেছেন, তাতে মূল কাজটা হয়ে গেছে। এখন দরকার একে সম্পূর্ণ রূপ দেয়া যাতে ওরা আমেরিকানদের কাছে মুখ দেখবার যোগ্য না থাকে। এর পরের কাজটা কঠিন হবে না।’
‘পরের কাজটা কি?’
‘এর পরের কাজ হলো আমাদের ফাউন্ডার ফাদারদের আমেরিকা গঠন ও বিশ্ব-ব্যবস্থার স্বপ্ন সফল করা।’ বলল সারা জেফারসন।
বলেই সারা জেফারসন তার সামনের চামড়ার সুদৃশ্য ফাইলটা খুলল। বের করল লম্বা কয়েক প্রস্ত কাগজ। এক গুচ্ছ কাগজ দেখিয়ে বলল, এটা টিজে দাদুর নিজ হাতের লেখা ডিক্লারেশন অব ইন্ডিপেনডেন্স এর প্রথম খসড়া। এই খসড়ায় টিজে দাদু কতকগুলো বিষয়কে বোল্ড টাইপে (মোটা অক্ষরে) লিখেছেন। তার মানে এই বিষয়গুলোকে আমাদের আমেরিকান জিবনের জন্যে তিনি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছেন। যে বিষয়গুলোকে টিজে দাদু বোল্ড টাইপে লিখেছেন, তাকে মৌল তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন, (ক) জাতিসমূহের স্বধীনতার সত্যিকার দাবী প্রাকৃতিক বিধি ও ঐশ্বরিক বিধান কর্তৃক স্বীকৃত (Laws of Nature and Nature’s of good entitle) অধিকার, (খ) স্রষ্টা মানুষকে সমান করে সৃষ্টি করেছেন এবং স্রষ্টা তাদের প্রত্যেকের জন্যে জীবন, স্বাধীনতা, সুখের সন্ধান, প্রভৃতিকে অবিচ্ছেদ্য অধিকারে পরিণত করেছেন, যা থেকে তাদের বিচ্ছিন্ন করা যাবে না। সরকার আসলে স্রষ্টা প্রদত্ত এ অধিকার সংরক্ষণের জন্যেই, এবং (গ) জাতিসমূহ স্বাধীকার বা শাসনদন্ড পাওয়ার সাথে ঐশ্বরিক অর্থরিটির অধীনে এর আশ্রয় (a firm reliance on the protection of Divine providence) নিশ্চিত করার জন্যে তাদের বিশ্বের সর্বোচ্চ বিচারকের মুখাপেক্ষী (appealing to the supreme Judge of the world) হতে হবে।
থামল সারা জেফারসন। তার ঠোঁটে ফুটে উঠেছে মিষ্টি এক টুকরো হাসি। বলল, ‘মি. আহমদ মুসা, ‘আপনার রুল অব গড. ‘মানুষ আল্লাহর খলিফা হওয়া,’ ‘মানুষের মর্যাদা ও অধিকার সমান হওয়া, ইত্যাদি বিষয়ের সাথে টিজে দাদুর বোল্ড টাইপে লেখা আমাদের ডিক্লারেশন অব ইন্ডিপেনডেন্স’-এর অংশ উপরোক্ত বিষয়গুলো মিলিয়ে নিন। দেখবেন, আপনাদের ধর্মের সর্বশ্রেষ্ঠগ্রন্থ কোরআন দেড় হাজার বছর আগে যা বলেছে, আমাদের ফাউন্ডার ফাদাররা ২শ ২৪ বছর আগে জাতি গঠন ও স্বাধীনতা ঘোষণার এক মহান সন্ধিক্ষণে ভিন্নভাষায় কতকটা সেই কথাই উচ্চরণ করেছেন। অতএব বলতে পারেন, আমাদের দুজনের এই সম্মিলনের মত আমাদের দুজনের মিশনও এক হয়ে যাচ্ছে। প্রায় এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে বড় একটা দম নিল সারা জেফারসন।
গম্ভীর হয়ে উঠেছে তার মুখ।
আহমদ মুসাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আবার বলে উঠল সে ‘মি. আহমদ মুসা, আমাদের ডিক্লারেশন অব ইন্ডিপেনডেন্স’-এর শুধু এই মৌল বিষয়গুলোকেই, যাকে টিজে দাদু বোল্ড টাইপে লিখেছেন, যদি আমরা বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখবো, ইহুদীবাদীদের চক্রান্ত আমাদেরকে আমাদের ফাউন্ডার ফাদারদের দেখানোর পথ থেকে বহুদূরে সরিয়ে নিয়ে গেছে। আমরা আজ অন্যান্য সার্বভৌম জাতির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক অধিকারেই শুধু হস্তক্ষেপ করছি না, নিজ জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারকেও তাদের কাছে আমরা দূর্মল্য করে তুলেছি।
থামল সারা জেফারসন।
‘ধন্যবাদ মিস জেফারসন অনেক মূল্যবান মন্তব্যের জন্যে। আপনাদের ডিক্লারেশন অব ইন্ডিপেনডেন্স’-এর কিছু বিষয়ের যে ইন্টারপ্রিটেশন দিয়েছেন তা সত্যই আমাকে আনন্দিত ও উৎসাহিত করেছে। বিশেষ করে এই ইন্টারপ্রিটেশনটা জেফারসন তনয়ার কাছ থেকে আসায় একে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছি। এখন বলুন মিশন-এর কথা, সমস্যা আমি বুঝেছি।’
হাসল সারা জেফারসন। বলল, জেফারসন তনয়া না বললে কি গুরুত্ব থাকতো না। সত্য কি কোন ব্যক্তি নির্ভর?
‘তা নয় মিস জেফারসন। কিন্তু মতের সাথে মতদানকারীর সম্পর্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যে অভিমত দিলেন তা আপনার পি এস ক্লারা কার্টার দিলে কি একই ওজনের হতো? অবশ্যই হতো না।’
‘ধন্যবাদ মি. আহমদ মুসা। আমার মিশনের কথা জিজ্ঞেস করছিলেন। আমার মিশনের কথা তো বলেছি। যে সিন্দাবাদের ভূত আমাদের আমেরিকানদের ঘাড়ে চেপে বসেসে, তাকে নামাতে হবে। দ্বিতীয়ত, আমাদের গণতন্ত্রকে বিলোনিয়ারের ড্রইংরুম থেকে সাধারণ আমেরিকানের দোর গড়ায় নিয়ে যেতে হবে। এই দুটি জাতীয় লক্ষ্য অর্জিত হবার পর আমাদের তৃতীয় লক্ষ্য হলো, পৃথিবীর জাতিসমূহের সার্বভৌম মর্যাদা ও অধিকার নিশ্চিত করা, যার নিশ্চয়তা দিয়েছে আমাদের ডিক্লারেশন অব ইনডিপেনডেন্স। এই অধিকার নিশ্চিত হবার পর কাজ হবে জাতিসমূহের সমতা ও সহযোগীতাভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলা। সে ব্যবস্থায় জাতিসংঘ হবে সত্যিকার এ্যাসোসিয়েশন অব স্টেটস। এখনকার মত তখন সে তার আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, ইউনেস্কো, ইউনিসেফ, ইত্যাদির মাধ্যমে জাতিসমূতের রাজনীতিন, অর্থনীতি, সংস্কৃতি-সমাজ, ইত্যাদি ধ্বংসের বরকন্দাজ হিসেবে কাজ করবে না।’
থামলো সারা জেফারসন।
আনন্দে মুখ ভরে গেছে আহমদ মুসার। বলে উঠল, আমিন।’
‘শুধু আমিন নয় মিস্টার, বলুন যে কোন অবস্থায় তোমার সাথে আছেন।’ বলে হেসে উঠল সারা জেফারসন।
‘সাথে যখন আছিই, তখন ‘সাথে আছি’ বলার কোন অর্থ হয় না।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ঠিক বলেছেন।’
বলে সারা জেফারসন হঠাৎ নিজের ডান হাত আহমদ মুসার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘আসুন হাতে হাত রেখে কথাটা আর একবার বলি।’
লাউ লতিকার লকলকে ডগার মত অপরূপ কমনীয়, নরম হাত আহমদ মুসার সামনে প্রসারিত।
বিব্রত আহমদ মুসা বলে উঠল, ‘স্যরি মিস জেফারসন।’
সারা জেফারসন লজ্জায় চুপসে গিয়ে দ্রুত হাতটা টেনে নিয়ে বলল, ‘স্যরি মি. আহমদ মুসা। ভুলেই গিয়েছিলাম আপনার মুসলিম কালচারের কথা।’
আহমদ মুসা কিছু বলতে যাচ্ছিল।
এ সময সশব্দে দরজা ঠেলে ঘরে প্রবেশ করল সারা জেফারসনের মা জিনা জেফারসন।
তার চোখে-মুখে উদ্বেগ। তিনি হাঁপাচ্ছিলেন।
বলল সে, ‘বেটা আহমদ মুসা, বাইরে কিছু ঘটেছে। আমি দুতালা থেকে নামছিলাম। দেখলাম রেড টাইগার (শিকারী কুকুর) পাগলের মত ছুটে বাইরে বেরিয়ে গেল। আমি নেমে এসে দাঁড়ালাম। বেশ সময় পার হয়ে গেল। টাইগার একবার মাত্র গর্জন করে উঠেছিল। তারপর সব নিরব। টাইগার ফিরে এল না। ব্যাপার কি দেখার জন্য শেলটনকে পাঠালাম। সেও ফিরে আসেনি। গেটের দিকে মনে হলো একটা আর্ত চিৎকার শোনা গেল।’
জিনা জেফারসনের কথা শেষ হতেই আহমদ মুসা তার চেয়ার থেকে স্প্রিং-এর মত উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘মিস জেফারসন আপনি আপনার মাকে নিয়ে উপরে যান, আমার মনে হচ্ছে………..’।
আহমদ মুসার কথা শেষ হতে পারল না, কক্ষের বাইরে অনেকগুলো পায়ের শব্দ কানে এল।
মুখের কথা বন্ধ করে আহমদ মুসা তার বুকের পাশে ঝুলে থাকা মেশিন রিভলবারাটা বের করে আনল ডান হাত দিয়ে।
কিন্তু ওরা ততক্ষনে দরজায় এসে পড়েছে ঝড়ের বেগে।
ওরা তিনজন। দুজনের হাতে রিভলবার এবং একজনের হাতে স্টেনগান। ব্যারেলগুলো উদ্যত।
‘মিস জেফারসন আপনারা শুয়ে পড়ন’ বলে চিৎকার করে উঠেই আহমদ মুসা দুহাতে মেশিন রিভলবার ওদের দিকে তাক করে ট্রিগার চেপে রেখে ঝাঁপিয়ে পড়ল মেঝের উপর।
আহমদ মুসাকে দাঁড়ানো এবং তার হাতে রিভলবার দেখে তিনজনের গান-ব্যারেল এক সাথেই তাক করেছিল আহমদ মুসাকে।
উভয় পক্ষের গুলী এক সাথেই হয়েছিল। আহমদ মুসা ঝাঁপিয়ে পড়তে সেকেন্ড পরিমাণ দেরী করলে তার দেহ ঝাঁঝরা হয়ে যেত।
গুলী বর্ষণরত মেশিন রিভলবারের ট্রিগারে চেপে থাকায় আহমদ মুসার হাত দেহ থেকে উঁচুতে ছিল। ওদের একটা গুলী এসে আঘাত করল আহমদ মুসার বাম কব্জীর উপরের পাশটায়।
তার আহত বাম হাতটা ছিটকে গিয়েছিল রিভলবারের বাট থেকে।
তবে এক হাত আহত হওয়ার বিনিময়ে আহমদ মুসা ওদের তিনটি লাশ পেয়ে গেল।
লাশ তিনটি ছিটকে পেড়েছিল দরজার উপরে।
আহমদ মুসা মেঝের উপর ছিটকে উপর ছিটকে পড়ে দ্রুত দরজার দিকে গড়িয়ে গিয়ে উঠে দাঁড়াল।
সারা জেফারসন ও তার মা জিনা জেফারসন চেয়ারে বসা অবস্থা থেকে গড়িয়ে পড়েছিল টেবিলের নিচে।
উঠে দাঁড়িয়েই আহমদ মুসা বলল, ‘মিস জেফারসন আপনারা ঠিক আছেন?
‘জি হ্যাঁ।’ মেঝের উপর উঠে বসতে বসতে বলল সারা জেফারসন।
‘আপনার কাছে রিভলবার আছে?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘জি, না।’ বলল সারা জেফারসন।
আহমদ মুসা দ্রুত দরজার উপর পড়ে থাকা ওদের দুটি রিভলবার কুড়িয়ে নিয়ে সারা জেফারসনের দিকে ছুড়ে দিয়ে বলল, আপনারা এ ঘরেই থাকুন। দরজা রক্ষা করা আপনার দায়িত্ব। দরজায় কাউকে দেখলেই গুলী করবেন।
বলে আহমদ মুসা বেরিয়ে যাচ্ছিল।
সারা জেফারসনের আর্তকন্ঠ পেছন থেকে ধ্বণিত হলো, ‘আপনি তো আহত মি. আহমদ মুসা।’
কথাগুলো আহমদ মুসার কানে গেল। কিন্তু জবাব দেবার সময় ছিল না। ততক্ষণে সে দরজার বাইরে পৌছে গেছে।
কিন্তু দরজার বাইরে পৌছে দেখল, বিভিন্ন দিক থেকে সাত আটজন ছুটে আসছে এদিকে।
সম্ভবত গুলীর শব্দ পেয়েই ওরা ছুটে আসছে। দরজার বাইরে পড়ে থাকা তাদের সাথীর লাশও তারা দেখতে পেয়েছে।
আহমদ মুসা একদম ওদের গুলীর মুখে। পেছন ফিরে ঘরে যাবার সময় নেই। আশ্রয় নেবারও কোন জায়গা নেই।
আহমদ মুসার মেশিন রিভলবার সামনের দিকে তাক করাই ছিল। সে দুহাতে রিভালবার শক্ত করে ধরে ডান হাতের তর্জনি দিয়ে ট্রিগারচেপে বাঁ দিকের মেঝের উপর ড্রাইভ দিল।
যেখানে দাঁড়িয়েছিল আহমদ মুসা, সেখান দিয়ে এক ঝাঁক গুলী উড়ে গেল। কিছু বিদ্ধ করল দেয়াল। কয়েকটা ঘরের ভিতরেও প্রবেশ করল।
আহমদ মুসা গুলী করতে করতেই গড়িয়ে ছুটল কিছু দূরের বিশাল পিলারটার দিকে।
ওরাও সবাই একটা উন্মুক্ত অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছিল। আহমদ মুসার অব্যাহত গুলীবর্ষণ ওদেরকেও ঘিরে ধরেছিল। ওরাও আত্নরক্ষার জন্যে শুয়ে পড়েছিল মেঝেয়। সুতরাং গড়িয়ে যাওয়া আহমদ মুসাকে ওরা ইচ্ছামত টার্গেট বানাতে পারেনি।
অন্যদিকে আহমদ মুসা পিলারের শেল্টার পাওয়ায় সুবিধা পেয়ে গেল।
আহমদ মুসা এবার ওদের দিকে নজর দেবার সুযোগ পেল। গুলীবর্ষণ অব্যাহত রেখে সে তাকিয়ে দেখল, তার এতক্ষণে ছুঁড়া গুলী একেবারে বৃথা যায়নি। কয়েকটা লাশ পড়ে আছে।
আর অবশিষ্টরা শুয়ে থেকে গুলী করছে। বুঝা যাচ্ছে না আহত হয়েছে কজন।
গুলী করতে করতে ওরা কয়জন দোতলায় উঠার সিড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। লক্ষ্য সিঁড়ির আশ্রয় নেয়া।
পিলারের আড়াল থেকে আহমদ মুসাও লক্ষ্য ঠিক করে গুলী করতে পারছে না।
এসময় ‘আহমদ মুসা পেছনে’-সারা জেফারসনের এই চিৎকার শুনতে পেল আহমদ মুসা।
চিৎকার কানে আসার সাথে সাথেই আহমদ মুসা নিজের দেহকে ছুড়ে দিল মেঝেয়। একই সময়ে গুলীর শব্দ তার কানে এল।
মেঝেয় পড়ে আহমদ মুসা অনুভব করতে চেষ্টা করছিল গুলী তার লেগেছে কি না।
সে সাথে তাকাল সে পেছনে। দেখল একজন লোক গুরীবিদ্ধ হয়ে কাতরাচ্ছে।
আহমদ মুসা বুঝল সারা জেফারসন শুধু চিৎকারই করেনি গুলীও করেছে লোকটিকে। তা না হলে লোকটির গুলীর নিশ্চিত শিকার হতে হতো আহমদ মুসাকেই। লোকটির যে দশা হয়েছে সেই দশা আহমদ মুসার হতে পারতো।
আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল আহমদ মুসা।
ওদের গুলীর লক্ষ্য পাল্টে গেছে। এবার ওদের গুলী বৃষ্টি সারা জেফারসনের ঘরকে লক্ষ্য করেও ছুটে আসছে। সারা জেফারসনও দুএকটা করে গুলী করছে।
আহমদ মুসার মাথায় তখন নতুন বুদ্ধি এসেছে।
পেছনে থেকে আক্রমণকারী লোকটি নিশ্চয় দুতলা থেকে পেছনের কোন সিঁড়ি দিয়ে নেমেছে নিরাপদ আক্রমণের সুযোগ নেয়ার জন্যে। এখন আহমদ মুসা পেছনের সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে সামনের ওদেরকে পেছন থেকে আক্রমণ করতে পারে।
চিন্তাটা সম্পূর্ণ হতেই আহমদ মুসা দ্রুত গড়িয়ে এগুলো পেছনে। পেছনের প্রান্তে পৌছে সে দেখল একটা ঘরের দরজা উন্মুক্ত। দেখা গেল সে ঘর থেকেই একটা সিঁড়ি দোতলায় উঠে গেছে।
আহমদ মুসা গড়িয়ে ঢুকে গের ঘরে। তারপর ছুটল সিঁড়ি বেয়ে।
আহমদ মুসা দোতলা হয়ে পুবের প্রধান সিঁড়ি মুখে এসে দেখল ওরা কয়েকজন সিঁড়ি বেয়ে হামাগুড়ি দিয়ে উপরে উঠে আসছে। সম্ভবত ওরাও চাচ্ছিল আবার পেছন থেকেই আক্রমণ রচনা করতে।
আহমদ মুসা যখন ওদের দেখল, ওরাও তখন আহমদ মুসাকে দেখে ফেলেছে।
কিন্তু ওরা আহমদ মুসার উদ্যত মেশিন রিভলবার হাতে দেখেই হকচকিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আহমদ মুসার তা হয়নি। আহমদ মুসা ওদের দেখেই তর্জ্জনি চাপল তার মেশিন রিভলবারের ট্রিগারে।
মুহূর্তেই লাশ হয়ে গেল সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসা তিনজনের দেহ।
আহমদ মুসা খেয়াল করেনি সিঁড়ির গোড়ায় অবস্থান নিয়েছিল ওদের আরও কয়েকজন।
যখন ওদেরকে দেখতে পেল, আহমদ মুসার তখন কিছুটা দেরী হয়ে গেছে।
উপায়ান্তর না দেখে আহমদ মুসা চিৎ হয়ে পেছন দিকে দেহটাকে ছুড়ে দিল।
পড়তে গিয়ে রিভলবার ধরা হাত তার উঁচু হয়ে উঠেছিল। একটা গুলী এসে উঁচু হয়ে উঠা রিভলবারে আঘাত করল। গুলীটা আহমদ মুসার ডান হাতের বৃদ্ধা অঙ্গুলিকেও স্পর্শ করে গেল।
‘আহমদ মুসার হাত থেকে ছিটকে পড়ল তার রিভলবার।
ছিটকে গেলেও রিভলবারটা কিন্তু গিয়ে পড়ল আহমদ মুসার মাথার কাছে।
আহমদ মুসা কুড়িয়ে নিল রিভলবার। মাথায় বুদ্ধি তার এসে গেছে। আহমদ মুসা ঠিক করল রিভলবার মুঠোয় নিয়ে গড়িয়ে পড়বে সে সিঁড়ি দিয়ে। ওরা বুঝবে আমি গুলী বিদ্ধ হয়ে গড়িয়ে পড়ছি। এই সুযোগে ওদেরকে টার্গেট করার একটা নিরাপদ সময় পাওয়া যাবে।
তাই করল আহমদ মুসা। গড়িয়ে পড়ল সে সিঁড়ি দিয়ে।
শেষ ধাপ থেকে মেছেতে গড়িয়ে পড়েই আহমদ মুসা সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়ানো লোকদের লক্ষ্যে তার মেশিন রিভলবারের ট্রিগার চেপে ধরল।
আর ওরা আহমদ মুসার দেহ গড়িয়ে পড়তে দেখে আনন্দ বিস্ময় নিয়ে ওদিকে তাকিয়েছিল। তারপর হঠাৎ যখন আহমদ মুসার রিভলবার তাদের দিকে তাক হতে দেখল, তখন আর সময় পেল না। আহমদ মুসার মেশিন রিভলবার থেকে ছুটে আসা এক ঝাঁক বুলেটের অসহায় শিকারে পরিণত হলো তারা।
ওরা চারজন ভূমি শয্যা নিলেও আহমদ মুসা শুয়েই থাকল। বুঝতে চেষ্টা করল ওদের আর কেউ কোথাও আছে কি না।
গুলী কোন দিক থেকে এল না। কিন্তু পেছন দিক থেকে ছুটে আসতে শুনল পায়ের শব্দ।
শুয়ে থেকেই বিদ্যুৎ বেগে মাথা ঘুরাল আহমদ মুসা পেছন দিকে, সেই সাথে ঘুরল তার হাতের উদ্যত রিভলবারও।
কিন্তু দেখল কোন শত্রু নয়, ছুটে আসছে সারা জেফারসন।
ছুটে এসে সে হাটু গেড়ে বসে পড়ল আহমদ মুসার পাশে। দুহাত দিয়ে আহমদ মুসাকে আঁকড়ে ধরে বলল, ‘এভাবে আপনি পড়ে গেলেন কেন? কিছু হয়নি তো আপনার? ভাল আছেন তো আপনি?’ আর্ত চিৎকারের মত শুনাল সারা জেফারসনের কন্ঠ।
ততক্ষণে সারা জেফারসনের মাও এসে পড়েছে। তারও উদ্বিগ্ন কণ্ঠ, ‘বেটা কেমন আছ তুমি? ভাল আছ তো?’
আহমদ মুসা উঠে বসল। হাসল, বলল, ‘ভাল আছি আমি। ওদের বোকা বানাবার জন্যে গুলীবিদ্ধ হবার মত গড়িয়ে পড়েছিলাম সিঁড়ি দিয়ে। বোকা হয়েছে ওরা। জীবন দিয়ে খেসারত দিয়েছে বোকামির।’
‘কে বলল আপনি ভাল আছেন। আপনার বাঁ হাতের কব্জি আগেই গুলীবিদ্ধ হয়েছে, এখন দেখছি ডান হাতের বুড়ো আঙুলও।’
বলে টেনে তুলল সারা জেফারসন আহমদ মুসাকে।
পকেট থেকে রুমাল বের করে সারা জেফারসন আহমদ মুসার আহত কব্জি জড়িয়ে বলল, ‘চলুন উপরে। ফাস্ট এইড-এর ব্যবস্থা আছে। ইতিমধ্যে ডাক্তার এসে পড়বে।’
বলে আহমদ মুসার হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগল সিঁড়ির দিকে।
আহমদ মুসা হাঁটার জন্যে পা তুলতে তুলতে বলল, ‘কিন্তু নিচে এখন থাকা প্রয়োজন। শত্রু কোথাও লুকিয়ে থাকতে পারে।’
‘একটু ভালো করে শুনুন। পুলিশের গাড়ির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। ওরা এখনি এসে পড়বে। সুতরাং চিন্তা নেই। মা নিচে থাকছেন পুলিশকে রিসিভ করার জন্যে।’ বলল সারা জেফারসন।
‘পুলিশকে কে খবর দিয়েছে? আপনারা? আহমদ মুসা বলল।
আমি টেলিফোন করেছিলাম। আমি এফ বি আইকেও জানিয়েছি।’ বলল সারা জেফারসন।
‘ধন্যবাদ মিস জেফারসন।’
‘ধন্যবাদ কি এজন্যে যে, যুদ্ধে দর্শক সেজে বিরাট বীরত্বের কাজ করেছি! সারা জেফারসনের কণ্ঠ একটু ভারী শোনাল।
আহমদ মুসার কিছু বলতে যাচ্ছিল।
কিন্তু সারা জেফারসন বলল, ‘আর কোন কথা নয় আসুন।’
বলে হাত ধরে টেনে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে লাগল।
নিয়ে বসাল আহমদ মুসাকে ফ্যামিলি ড্রইং রুমে। তারপর ফাস্ট এইড বক্স ও বড় এক গামলা পানি নিয়ে এল।
আহমদ মুসা বুঝলো বাধা দিয়ে কিছু হবে না। আর কব্জীর ক্ষতটা বেশ বড় ও গভীর হয়েছে। এক হাত দিয়ে ক্ষতের শুশ্রুষা সম্ভব হবে না।
তাই আহমদ মুাসা তার হাত ছেড়ে দিল সারা জেফারসনের হাতে।
আহমদ মুসার কব্জীর ক্ষত পরিষ্কার করে তাতে ঔষধ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিতে দিতে বলল, ‘আচ্ছা একটা কথা বলি?’ জিজ্ঞেস করল সারা জেফারসন আহমদ মুসার দিকে মুখ না তুলেই।
‘বলুন।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আপনার নার্ভ কি লোহা দিয়ে তৈরী যে তাতে চাঞ্চল্য আসে না কোন কিছুতেই?
‘কেন একথা বলছেন?’
‘এ রকম ক্ষত যদি আমার হতো এবং তা এইভাবে পরিষ্কার করতে গেলে আমি চিৎকার করে, কেঁদে লোক জোটাবার মত ব্যাপার করে ফেলতাম। কিন্তু আমি আপনার মুখের সামান্য পরিবর্তনও হতে দেখিনি। মানুষের নার্ভ এত শক্ত হয়।’
‘তাহলে আমি অমানুষ নাকি?’
‘অমানুষ নয়, অতিমানব।’ বলল সারা জেফারসন। তার ঠোঁটে রক্তিম হাসি।
‘অতিমানব বলে কোন কিছু নেই।’
‘অতিমানব বলে আলাদা কিছু অবশ্যই নেই, কিন্তু মানুষই অতিমানব হন।’
‘এসব কল্পনা মিস জেফারসন। অতিমানব কেউ হলে নবী-রাসূলরা তা হতেন। কিন্তু তাঁরাও নিজেকে ‘মানুষ’ বলেছেন।’
‘আপনি এটা বলেছেন অসাধারণ চিন্তা থেকে। কিন্তু আমি তো সাধারণ একজন মানুষ। আমরা অনেক কিছুই ভাবতে পারি।’
বলে সারা জেফারসন আহমদ মুসার ডান হাত টেনে নিল। বাম হাতের কব্জীর ব্যান্ডেজ শেষ।
‘কিন্তু মিস জেফারসন, সাধারণরা কখনই নিজেকে সাধারণ মনে করে না।’
‘আবার এটাও ঠিক অসাধারণরা নিজেকে অসাধারণ ভাবেন না।’
আহমদ মুসা ভাবছিল পরবর্তী কথাটা বলার জন্যে। কিন্তু তার আগেই সারা জেফারসন বলে উঠল, ‘আর একটা কথা বলি।’
‘অবশ্যই বলবেন।’
‘আপনার হাত স্পর্শ করলে কেউ আপনাকে বিপ্লবী বলবে না।’ আঙুলে ব্যান্ডেজ পরাতে পরাতে বলল সারা জেফারসন।
‘কি বলবে তাহলে?’
‘শিল্পী বলবে। যে শিল্পীর নরম মন কঠোরতার থেকে অনেক দূরে বসে সুন্দরের সাধনায় ব্যস্ত থাকে।
‘তাহলে মিস জেফারসন আপনিওতো ‘ফ্রি আমেরিকা’র মত বিপ্লবী সংগঠনের প্রধান হতে পারেন না। কারণ আপনার হাত বলছে, আমি শিল্পী হলে আপনি ডাবল শিল্পী।’
জোসে হেসে উঠল সারা জেফারসন।
আহমদ মুসার ডান হাতের বুড়ো আঙুলের ড্রেসিং হয়ে গিয়েছিল।
সারা জেফারসন হেসে উঠল আহমদ মুসার হাত ছেড়ে দিয়ে নিজের হাত দুটি নিজের কোলের মধ্যে টেনে নিয়ে বলল, ‘আমি আপনার হাত দেখেছি, আপনি কখন দেখলেন আমার হাত?’
বলেই উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘আসুন।’
সারা জেফারসন আহমদ মুসাকে নিয়ে প্রবেশ করল একটা বড় বেড রুমে।
কক্ষে বেড ছাড়াও যেসব জিনিস আছে তার মধ্যে রয়েছে একটা ছোট লেখার টেবিল, পাশাপাশি দুটি সুদৃশ্য সোফা, ডিভানের সাথে মানানসই এবং লেখার টেবিলের উপরেই দেয়ালে সুন্দর একটা বিলবোর্ড।
আহমদ মুসাকে সোফায় বসিয়ে পাশের ড্রেসিং রুম থেকে এক সেট পোশাক এনে আহমদ মুসার হাত দিয়ে বলল, ‘আপনি পোশাক পাল্টে আসুন। আমি বেডটা একটু ঠিক করে দেই।’
আহমদ মুসা শার্ট প্যান্ট নেড়ে চেড়ে বলল, ‘আপনাদের বাসায় তো কোন পুরুষ আত্মীয় থাকে না। পুরুষের এ পোশাক আপনি পেলেন কোথায়?’ আহমদ মুসার চোখে বিস্ময়।
‘ওটা ছাড়াও এক সেট স্যুটও আছে।’ বলল সারা জেফারসন।
‘কিন্তু কোত্থেকে এল?’
‘দোকান থেকে।’
‘কিন্তু এক সন্ধ্যার মধ্যে তো এমন অর্ডার সাপ্লাই হয় না।’
‘অনেক আগেই এসে আছে।’ বলল সারা জেফারসন। তার ঠোঁটে হাসি।
‘আগেই? কিভাবে?’
গম্ভীর হলো সারা জেফারসন। বলল, ‘আমার স্বপ্নের কথা আপনাকে বলেছি। আমি জানতাম আমার স্বপ্ন সত্য হবে। আমার ডাক আপনি উপেক্ষা করবেন না। আপনি আসবেন। সেই আসার অপেক্ষায় আমি এগুলো তৈরী রেখেছি।’ থামল সারা জেফারসন।
সারা জেফারসনের কথাগুলো আহমদ মুসার কান দিয়ে প্রবেশ করার পর তার চেতনার সত্ত্বার কোথাও যেন একটা শর বিদ্ধ হলো। চমকে উঠল আহমদ মুসা। আর মনে হলো, সারা জেফারসনের কথাগুলো যেন এক ব্যাকুল হৃদয়ের দুহাত বাড়ানো এক আকুল পিপাসার্ত কান্না। কেঁপে উঠল আহমদ মুসা। ঠিক এ সময় তার সামনে ভেসে উঠল ডোনা জোসেফাইনের স্নিগ্ধ, সুন্দর, প্রশান্ত মুখচ্ছবিটি। কেঁপে ওঠা তার হৃদয় আশ্রয় খুঁজে পেল।
আহমদ মুসাকে তার নিজের মধ্যে হারিয়ে যেতে দেখে এবং কোন উত্তর না পেয়ে সারা জেফারসন বলে উঠল, কি ভাবছেন আহমদ মুসা?’
সম্বিত ফিলে পেল আহমদ মুসা। নিজেকে সামলে নিল। হাসল একটু। বলল, ‘ধন্যবাদ, মিস জেফারসন।
বলে আহমদ মুসা পোশাক পাল্টাবার জন্যে ড্রেসিংরুমে ঢুকে গেল।
বেড ঠিক করে সারা জেফারসন একটু বাইরে গিয়েছিল। ফিরে এসে দেখল আহমদ মুসা ড্রেসিংরুম থেকে বেরিয়ে এসে সোফায় বসে আছে।
ঘরে ঢুকেই বলল সারা জেফারসন, ‘একটু নিচে গিয়েছিলাম খোঁজ নিতে। আমাদের বাড়িতে ৩ জন পুলিশের একটা টিম পাহারায় ছিল। শ্যারনের লোকেরা তিন জন পুলিশ, আমাদের কুকুর এবং আমাদের নিরাপত্তা কর্মচারী শেলটনকে খুন করে আমাদের বাড়িতে প্রবেশ করে।’
‘এরা জেনারেল শ্যারনদের লোক একথা কি পুলিশও বলছে?’
‘না, এটা আমি বলছি। ওদেরকে একথা বলা হয়নি। পুলিশ নিশ্চয় খুঁজে বের করবে।’ বলল সারা জেফারসন।
‘একটা প্রমাণের কথা বলছি। পুলিশকে গিয়ে বলুন। ওদের কলার ব্যান্ডের ভেতরের পাশে ছয়তারা একটা সিম্বল আছে।এটা ইহুদী গোয়েন্দা এবং তাদের প্রাইভেট আর্মির সিম্বল।’
‘ধন্যবাদ। আমি বলব। কিন্তু তার আগে দেখে নিতে চাই সত্যিই তা আছে কি না।’ কথা শেষ করেই সারা জেফারসন আবার বলে উঠল, ‘আপনি শুয়ে পড়ুন। একটু রেষ্ট নিন। ডাক্তার এখনি এসে পড়বেন। ’
আহমদ মুসা বলল, ‘ঠিক আছে। শুয়ে পড়ছি। কিন্তু তার আগে বলুন ঐ বিল বোর্ডে টমাস জেফারসনের যে উক্তি লেখা আছে, তা কি পছন্দ করে ওখানে রেখেছেন, না নিছক তার কথা হিসেবে ওটা রেখেছেন?
ঘরে লেখার টেবিলের উপরের দেয়ালে টাঙানো একটা বিলবোর্ডের দিকে ইংগিত করে আহমদ মুসা কথাগুলো বলল।
বিলবোর্ডটিতে সুন্দর অক্ষরে টমাস জেফারসনের একটি উক্তি লেখা। উক্তিটি হলো, ‘স্বাধীনতার বৃক্ষকে অবশ্যই মাঝে মাঝে দেশপ্রেমিক ও জালেমদের রক্তে গোসল করতে হবে। তার স্বাভাবিক ম্যাচিউরিটির এটাই পথ (The tree of liberty must be refreshed from time to time with the blood of partie-ots and tyrants. It is its natural nature)
আহমদ মুসার কথা শুনে সারা জেফারসনও বিলবোর্ডটির দিকে তাকাল। তাকিয়ে হেসে উঠল। বলল, ‘এ নিয়ে আবার ঝগড়া বাধাবেন বুঝি! ঝগড়ার কোন প্রয়োজন নেই। আমি স্বীকার করছি, টিজে দাদুর এই কথাটা আমার ভীষন পছন্দ। আপনার কথা বলুনতো?’
‘তার আগে আপনার কেন পছন্দ?’ আহমদ মুসা সোফা থেকে উঠে শোবার জন্য বেডে গিয়ে বসতে বসতে বলল।
আবার হাসল সারা জেফারসন। বলল, ‘শত্রুর বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াইয়ে আপনি অদ্বিতীয়। আপনি আইনজীবি হলে, বা ডিপ্লোম্যাট অথবা স্টেটম্যান হলেও দুনিয়াতে অদ্বিতীয় হতেন। মানুষের পেট থেকে কথা বের করায় আপনার জুড়ি নেই। আপনি সত্যিই মিরাকল।’
বলে মুহূর্তকাল থেমেই আবার শুরু করল, ‘টিজে দাদু তার অন্য একটা উক্তিতে বলেছেন, ‘সময় সময় দেশে ছোটখাট বিদ্রোহ বিপ্লব ঘটা ভাল জিনিস। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এর প্রয়োজন তেমনি, যেমন প্রয়োজন প্রকৃতিতে ঝড়ের (I hold that a little rebelion now and then is a good thind and as necessary in the physical)।’ দেশে সংঘঠিত বিশৃংখলা বিপ্লব দেশের দেশপ্রেমিকদের চিন্তা চেতনা দায়িত্ববোধ শানিত করে এবং বিশ্বাসঘাতক ও বিভেদকারীদেরকে চিহ্নিত করার মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতাকে সংহত ও শক্তিশালী করে। স্রোত যেমন নদীর জীবন, তেমনি দেশপ্রেমিকদের শাণিত চিন্তা, চেতনা ও দায়িত্ববোধ একটি স্বাধীন দেশের প্রাণ। এই প্রাণ দেহে আছে কিনা মাঝে মাঝেই তার টেস্ট হওয়া প্রয়োজন।’ থামল সারা জেফারসন।
আহমদ মুসার চোখে মুদ্ধ দৃষ্টি। বলল, ‘ধন্যবাদ মিস জেফারসন। আপানর টিজে দাদুর কথার মতই আপনার ব্যখ্যা চমৎকার।’
‘থাক ওসব। এবার আমার প্রশ্নের জবাব দিন।’ সলজ্জ কন্ঠে বলল সারা জেফারসন।
আহমদ মুসার চোখে মুখে নেমে এল গাম্ভীর্য। বলল, ‘আমাদের ধর্মগ্রন্থ আল কুরআনে স্রষ্টা বলছেন, ‘লড়াই কর যতক্ষন না বিশৃংখলা, বিদ্রোহ ও জুলুম নিপীড়নের মূলোচ্ছেদ হয় এবং আল্লাহর রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়।’ এ ধরনের আরও অনেক কথার মধ্যে তিনি একথাও বলেছেন, ‘নিরপরাধ মানুষের হন্তাকে হত্যা করার মধ্যে রয়েছে মানুষের জীবন।’ আমাদের ইসলামী জীবন-দর্শনের মূল কথাই হলো, পৃথিবীতে মানুষের মধ্যে কল্যাণের শক্তি ও অকল্যাণের শক্তির মধ্যে দ্বন্দ্ব চিরন্তন। এই লড়াই অবিরাম চলবে পৃথিবীর শেষ দিন পর্যন্ত। আল্লাহ চান, কল্যাণের শক্তি অকল্যাণের শক্তিকে পরাভূত করে মানুষের জন্যে শান্তি ও স্বস্তির রাজত্ব কায়েম করবে। এখন মিস জেফারসন আপনিই বলুন আপনার টিজে দাদুর উক্তি আমার কেমন লাগবে?
হাসল সারা জেফারসন।
চোখ বন্ধ করল সে।
একটু পর চোখ খুলে বলল, ‘আল কোরআন যদি মহা পর্বতগাত্রের মহাহিমবাহ হয়, তাহলে টিজে দাদুর উক্তি সেই মহাহিমবাহ থেকে নেমে আসা একটা নির্ঝরিনী। সে নির্ঝরিণীকে তো আপনি আপানর বলেই দাবী করবেন।’ মুগ্ধ চোখে, ঠোঁটে রক্তিম এক হাসি টেনে বলল সারা জেফারসন।
‘চমৎকার আপনার উদাহরণ, মিস জেফারসন।’ বলল আহমদ মুসা বিমুগ্ধভাবে।
‘তাহলে এ কৃতিত্বের জন্যে একটা পুরষ্কার চাইব।’ বলল সারা জেফারসন। ঠোঁটে তার সলজ্জ হাসি।
‘বলূন কি পুরষ্কার।’ বলল বটে আহমদ মুসা, কিন্তু তার ভেতরে তখন বিব্রতভাব।
সারা জেফারসন চোখ নামিয়ে নিল আহমদ মুসার দিক থেকে। মুখ তার নিচু হলো একটু। শান্ত নরম কন্ঠে বলল, ‘আমি ‘মিস জেফারসন’ নই। আমি শুধুই ‘সারা’।’
বলেই ঘুরে দাঁড়িয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল সারা জেফারসন।
দরজায় গিয়ে ঘুরে দাঁড়াল সারা জেফারসন। বলর ‘আপনি শুয়ে পড়ন। ডাক্তার এলে আমি আসব। আর শুনুন, কোন স্বাধীন চিন্তা ভাবনা কিন্তু আপনার এখন নেই, আপনি এখন ডাক্তারের অধীন।’
ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সারা জেফারসন।
আহমদ মুসা তখন বালিশে হেলান দিয়ে সারা জেফারসনের শেস দিকের কথাগুলো ব্যাখ্যা খুঁজছিল আর ভাবছিল, মানুষের ভাবনা কত সীমিত। দৃষ্টি তাদের কত সীমাবদ্ধ। সব না জেনেই জানা হয়ে গেছে বলে সিদ্ধান্ত নেয়।
হৃদয়ে একটা নতুন বেদনা অনুভব করলো আহমদ মুসা।

সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে। পটোম্যাক বে’র একটি ছোট্ট দ্বীপ। দ্বীপের পুব প্রান্তের পানি ঘেঁষে একটা সুন্দর বাংলো।
ওয়াশিংটনের বে’ এলাকায় এধরনের বাংলোগুলোর মালিক রাজনৈতিক ও অর্থনেতিক ভিআইপি’রা।
বাংলোটির ঘাটে একটা সুদৃশ্য বোট এসে ভিড়ল।
বোট থেকে নামল জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন। তিনি এখন রিটায়ার্ড। কদিন আগেও জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন ছিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট এ্যাডমাস হ্যারিসনের নিরাপত্তা উপদেষ্টা। ইহুদীবাদীদের সাথে অন্যায় অপরাধমূলক যোগসাজসের কারণে তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে।
জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন একাই বোট ড্রাইভ করে এসেছে। বোট থেকে তীরে নেমে সে একবার বে’র দিকে তাকিয়ে দেখল কেউ তাকে অনুসরন করছে কি না, কাউকে সে দেখল না। নিশ্চিন্ত হয়ে পা বাড়াল বাংলোর দিকে।
বাংলোটি ‘কাউন্সিল অব আমেরিকান জুইস এসোসিয়েশনে’র চেয়ারম্যান ডেভিড উইলিয়াম জোনস এর একটি অবকাশ কেন্দ্র।
বাংলোটির চারদিকেই বাগান। বাগানের চারদিকে উঁচু প্রাচীর।
বাগানের মাজখানে টিলামত উঁচু বেদির উপর তৈরী দুতলা বাংলোটি।
বে থেকে বাংলোটিকে দেখা যায় ছবির মত সুন্দর। আবার বাংলো থেকে বে’র সৌন্দর্য উপভোগ করা যায় খুব ঘনিষ্ঠভাবে।
ঘাটের উপর দাঁড়িয়েছিল একজন সুবেশধারী লোক। জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন বোট থেকে নেমে এগুতেই লোকটি এগিয়ে এল তার দিকে। সসম্মানে সম্ভাষণ বিনিময় করে বলল, ‘স্যার আমি মি. জোনস-এর সেক্রেটারী। জেনারেল শ্যারন এসেছেন। ওরা আলোচনায় বসে গেছেন।’
‘গুড। আমার একটু দেরী হলো পৌঁছাতে।’ বলল জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন।
‘চলুন স্যার’
দুজনে হাঁটতে শুরু করল বাংলোর দিকে।
বাংলোতে প্রবেশ করে কয়েকটা দরজা ও কয়েকটা করিডোর পেরিয়ে অবশেষে একটা দরজার সামনে এসে দাঁড়াল ডেভিড উইলিয়াম জোনস- এর সেক্রেটারী।
দরজায় নক করল মি. জোনস-এর সেক্রেটারী।
মুহূর্তকাল পরে দরজা খুলে গেল। দরজায় দেখা গেল স্বয়ং মি. জোনসকে।
মি. জোনস স্বাগত জানাল জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনকে এবং হাত ধরে ভেতরে নিয়ে গেল।
দরজা আবার বন্ধ হয়ে গেল।
বেশ বড়-সড় ঘর।
একা সোফায় বসে আছে শ্যারন।
উঠে দাঁড়িয়ে স্বাগত জানাল জেনারেল শ্যারন জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনকে।
ঘরে অনেকগুলো সোফার সেট বিভিন্ন ডিজাইনে সাজানো। তারা গিয়ে বসল মুখোমুখি সাজানো তিনটি সোফায়।
একটু নিরবতা।
নিরবতা ভাঙল জেনারেল শ্যারন। বলল, ‘মি. জেনারেল হ্যামিল্টন, আপনার যোগাযোগের কতদূর?’
‘বলল, কিন্তু তার আগে বলুন এসব কি ঘটছে, আহমদ মুসা ও ‘ফ্রি আমেরিকা’ মুভমেন্ট-এর সংযোগ আগেই ঘটেছিল, এখন দেখা যাচ্ছে হোয়াইট ইগলও আহমদ মুসার সাথে এক হয়ে গেছে। আপনারা জানালেন, মিয়ামী বন্দরের পথে আহমদ মুসা, গোল্ড ওয়াটার, বেঞ্জামিন বেকনরা গাড়ি বিস্ফোরণে শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু উল্টো দেখা গেল তারাই জ্যাকসন ভীলে গিয়ে আপনাদের লোকজনদের হত্যাকরে আপনাদের মূল্যবান বন্দিনীদ্বয়কে মুক্ত করে নিয়ে গেল। তারপর ….।
জেনারেল শ্যারন আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘মি. জেনারেল হ্যামিল্টন, এটা আমাদের সাংঘাতিক একটা সেট ব্যাক। কিন্তু মি. হ্যামিল্টন আপনাকে স্মরণ রাখতে হবে, আমাদের সাথে সংঘাতে এসেছে আহমদ মুসা। যার বিবেচনা শক্তিটা অলৌকিক। মিয়ামী বিমান বন্দরের বাইরে আহমদ মুসার টিমটাকে ধ্বংস করার পরিকল্পনায় আমাদের ত্রুটি ছিল না। আহমদ মুসার টিমকে যে গাড়ি বহন করার কথা সে গাড়ি ঠিকই বিমান বন্দরে গেছে ওদের আনার জন্যে। বিমান বন্দরের টারমাকে ঢুকেছে ওদের বিমানের কাছে। তারপর শেড দেয়া কাঁচ তুলে গাড়িটি বেরিয়ে এসেছে বিমান বন্দর থেকে। তারা গাড়িতে নেই, বা উঠেনি এটা ধারণা করার কোনই অবকাশ ছিল না। গাড়িটা পরিকল্পিত স্থানেই এসে ধ্বংস হয়েছে। সুতরাং আমাদের লোকদের পরিকল্পনা ও চেষ্টার কোন ফাঁক ছিল না। কিন্তু আহমদ মুসারা কেন যে গাড়িতে উঠল না, কেন যে তারা খালি গাড়িটি ঐ ভাবে পাঠিয়েছিল সেটা একটা বিস্ময়। এমন বিস্ময়কর কান্ড ঘটাবার শক্তি আহমদ মুসার আছে এবং এটাই আমাদের বিপর্যয়ের কারণ। আর জ্যাকসন ভীলে যা ঘটেছে তা খুবই সোজা। মিয়ামীর খবর তাদের কাছে পৌছার পর তারা স্বাভাবিকভাবেই অসতর্ক ছিল। তার উপর বিশ্বাসঘাতকতা করেছে আমাদের পুরনো একজন পরিচারিকা।’
থামল জেনারেল শ্যারন।
সে থামতেই জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন বলে উঠল, ‘কিন্তু মি. জেনারেল, মন্টিসেলোর কি ব্যাখ্যা দেবেন। আমার মতে সর্বজনমান্য জেফারসন-পরিবারে আপনাদের এইভাবে হাত দেয়া ঠিক হয়নি। তারপর সেখানে লজ্জাজনক ব্যর্থতা, আপনাদের ডজন-দেড়ডজন লোকের লাশ সরকারের হাতে যাওয়া আমাদের জন্যে খুবই ড্যামেজিং হয়েছে। সারা জেফারসনের বিরুদ্ধে একবার নয়, দুবার নয়, আপনাদের তিনটা আক্রমণই ব্যর্থ হলো। শেষবারে আপনাদের সবাই সেখানে লাশ হয়ে পড়ে থাকল। জ্যাকসন ভীলে অসতর্ক থাকার কারণে হঠাৎ আক্রান্ত হয়ে আপনাদের বিপর্যয় ঘটল। কিন্তু মন্টিসেলোতে কি ঘটল? ওখানে আপনারা ছিলেন পরিকল্পিত আক্রমণে। আর ওপক্ষে ছিল কার্যত দুজন মহিলা একজন পুরুষ।’ থামল জেনারেল হ্যামিল্টন।
জেনারেল শ্যারন বিব্রত, বিমর্ষ। ধীরে ধীরে বলল, ‘মন্ডিসেলোতে সারা জেফারসনকে হত্যার উদ্যোগ নেয়া ছাড়া আমাদের কোন উপায় ছিল না। ‘ফ্রি আমেরিকা’ মুভমেন্ট আমাদের সামনে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে আসছে। আহমদ মুসা ও হোয়াইট ঈগলের শক্তি মূলত অস্ত্র ও বুদ্ধির লড়াইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু ‘ফ্রি আমেরিকা’ মুভমেন্ট রাজনৈতিকভাবেও অত্যন্ত শক্তিশালী ও প্রভাবশালী। অথচ আমাদেরকে বাঁচাতে হলে রাজনৈতিক লড়াই-এ আমাদের জিততে হবে। সুতরাং ‘ফ্রি আমেরিকান’ মুভমেন্টকে পঙ্গু করে দেয়া এখন আমাদের প্রধান কাজ। এ জন্যেই ‘ফ্রি আমেরিকা’র নেত্রী সারা জেফারসনকে আমরা হত্যা করতে চেয়েছিলাম। আমরা জানি, ‘ফ্রি আমেরিকা’ মুভমেন্টের মূল শক্তি হলো সারা জেফারসনের নতুন আমেরিকা গড়ার স্বপ্ন। এ স্বপ্ন সারা জেফারসন আহরণ করেছে তার গ্রান্ড দাদু টমাস জেফারসন এবং আমেরিকান ফাউন্ডার ফাদারদের ‘ডিক্লারেশন অব ইনডিপেডেন্স’ থেকে। এই স্বপ্নই আমেরিকায় আমাদের মূল শত্রু। তাদের স্বপ্ন সার্থক হলে আমেরিকা ঘিরে আমাদের যে স্বপ্ন সে স্বপ্ন ব্যর্থ হবে। সুতরাং আমাদের মূল আদর্শিক শত্রু সারা জেফারসন। তাই তাকে হত্যার একটা সর্বাত্মক আয়োজন আমরা করেছিলাম। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য যে, আহমদ মুসা সেখানে গিয়ে ঠিক সময়ে হাজির হয়েছে।’ থামল জেনালের শ্যারন।
জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই কথা বলে উঠল ডেভিড উইলিয়াম জোনস। বলল, ‘মি. শ্যারন, আমাদের নতুন আমেরিকা ও নতুন বিশ্ব গড়ার স্বপ্ন এবং নতুন বিশ্ব ব্যবস্থার মাথায় নতুন আমেরিকাকে স্থাপন করার যে কর্মসূচি সে বিষয়ে কি জেনারেল হ্যামিল্টন অবহিত? হাসল জেনারেল শ্যারন। বলল, জেনারেল হ্যামিল্টন বিষয়টি আমাদের অনেকের চেয়ে বেশি জানেন শুধু তাই নয়, এ স্বপ্ন সফল করার ব্যাপারে আমাদের অনেকের চেয়ে তিনি অনেক বেশি একনিষ্ঠ।
বিস্ময় ফুঠে উঠল ডেভিড উইলিয়াম জোনসের চোখে মুখে। বলল, ‘অবাক করলেন জেনারেল শ্যারন। ঘটনাটা কি?
‘জেনারেল হ্যামিল্টনের মা তাকে এ তালিম দিয়ে গেছেন। তাঁর কাছ থেকেই জেনারেল হ্যামিল্টন পান আমাদের ঐতিহাসিক দলিলের একটা কপি। সুতরাং জেনারেল হ্যামিল্টন তাঁর ইহুদী মা’র কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছেন আমাদের নতুন বিশ্ব ব্যবস্থার কর্মসূচী।’ বলল জেনারেল শ্যারন।
‘নিঃসন্দেহে বড় একটা সুখবর এটা। আমার মনে হয়, ফরেন রিলেশন্স বিষয়ক ‘সিনেট স্ট্যান্ডিং কমিটি’র চেয়ারম্যান দানিয়েল ময়নিহান এবং ইন্টেলিজেন্স বিষয়ক ‘হাউজ সিলেক্ট কমিটির চেয়ারম্যান এ্যান্ড্রু জ্যাকবসকে এ বিষয়ে বিস্তারিত বলা দরকার। তাহলে তাদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সাহায্য আরও বেশি পাওয়া যাবে। দুজনেই কিন্তু প্রকৃতির দিক দিয়ে হিটলারের মতই ওভার এ্যাম্বিশাস।’ ডেভিড উইলিয়াম জোনস বলল।
সংগে সংগেই কথা বলে উঠল জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন, ‘মি. জোনস ওদের সাথেই তো যোগাযোগের দায়িত্ব আমাকে দিয়েছিলেন জেনারেল শ্যারন।’
‘ব্রাভো, ব্রাভো!’ বলে চিৎকার করে উঠল ডেভিড উইলিয়াম জোনস এবং বলল, ‘যোগাযোগ আপনার হয়েছে?
‘হ্যাঁ, গত রাতে ওদের দুজনের সাথেই কথা বলেছি। আজ রাত এগারটায় ওদের সাথে আপনাদের নিয়ে এ্যাপয়েন্টমেন্ট।’
‘ওয়ান্ডারফুল, ওয়ান্ডারফুল মি. জেনারেল হ্যামিল্টন। এজেন্ডা ঠিক হয়েছে? ডেভিড উইলিয়াম জোনস বলল।
‘হ্যাঁ, ঠিক হয়েছে। প্রেসিডেন্টকে ইমপিচ করার জন্যে পরিকল্পনা প্রণয়ন। এ এজেন্ডার কথা জেনারেল শ্যারন আগেই আমাকে বলে দিয়েছিলেন।’ বলল জেনারেল হ্যামিল্টন।
‘কিন্তু এজেন্ডার সাথে ‘নতুন আমেরিকা’ ও ‘নতুন বিশ্ব-ব্যবস্থা’র বিষয়টিকেও রাখতে হবে। তারা উৎসাহিত হবেন।’ ডেভিড উইলিয়াম জোনস বলল।
‘দেখবেন বিষয়টা আলোচনায় এমনিতেই এসে যাবে।’ বলল জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন।
কথাটা শেষ করেই জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন আবার বলে উঠল, এজেন্ডা নিয়ে আপনারা যথেষ্ট ভেবেছেন তো? সাপের লেজে পা দিলে কিন্তু বিপদ। একচোটেই সাপের মাথাটা ধরে ফেলতে হবে। জনমত হবে সবচেয়ে বড় ফ্যাক্টর। এজন্যে জনবল, অর্থবল দুই-ই কিন্তু লাগবে।’
‘ভাববেন না। আমরা সবদিক দিয়েই প্রস্তুত।’ বলল জেনারেল শ্যারন।
‘ইহুদী নয় এমন সংস্থা সংগঠনের সমর্থন ও সহযোগিতা পাওয়া হবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ ব্যাপারে আপনারা কি ভেবেছেন? জেনারেল হ্যামিল্টন বলল।
‘আপনি জানেন, প্রটেস্ট্যান্টদের সবচেয়ে জনপ্রিয় সংগঠন সেফ ওয়ে সেভিয়ার’ গ্রুপ আমাদের দীর্ঘ দিনের সহযোগী। তাদের নেতা ‘জন জেরা’ টেলিভিশন অনুষ্ঠান ‘টাইম উইথ গড’- এর জনপ্রিয় টকার হিসাবে আমাদেরকে অমূল্য সাহায্য দিয়ে আসছেন। তবে বর্তমান সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খবর হলো, আমাদের প্রতি ভারতীয় গ্রুপের সমর্থন। তাদের একটা শীর্ষ বৈঠকে আজ আমি গিয়েছিলাম। আহমদ মুসার আমেরিকায় আগমন এবং তার প্রতি এফ বি আই ও সি আই এ প্রধান ও প্রেসিডেন্টের সমর্থনের সংবাদে তারা আমাদের চেয়ে উত্তেজিত। তারা জনবল, অর্থবল, তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি সবকিছু দিয়ে আমাদের সাহায্য করবে। সব সময়ই এই ভারতীয়রা আমাদের সহযোগী। কিন্তু এখন তাদের একটি সাহায্য পাওয়া যাবে এ বিষয়টা নিশ্চিত।’ জেনারেল শ্যারন বলল।
‘থ্যাংক গড, জেনারেল শ্যারন। আজকের সময়ের জন্য খবরগুলো সত্যিই অমুল্য।’ বলল জেনারেল আলেকজান্ডার।
‘কিন্তু সমস্যা হলো, সেনাবাহিনীতে বিশেষ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও শীর্ষ অপারেশন পর্যায়ে আমাদের কোন লোক নেই।’ বলল ডেভিড উইলিয়াম জোনস।
‘বিগ্রেডিয়ার স্টিভকে হারানো আপনাদের ঠিক হয়নি। সেও খুব বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল। পেন্টাগন যে কতবড় সেনসেটিভ জায়গা সেটা সে মনে রাখেনি। তার ফলেই এই সেট ব্যাকটা।’ জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন বলল।
‘এখানেও সর্বনাশের হোতা আহমদ মুসাই। অনুসন্ধান থেকে আমরা জেনেছি, টেলিফোনে আঙুলের মুভমেন্ট দেখেই আহমদ মুসা ধরে ফেলে পেন্টাগনের বাইরে কোথাও সে টেলিফোন করছে। তারপর টেলিফোনে বিগ্রেডিয়ার স্টিভের কথার দুএকটা থেকেই সে সন্দেহ করে বলে’ বলল জেনারেল শ্যারন।
‘যাই হোক, এই ঘটনা সেনাবাহিনীর মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। সেনাবাহিনীর ইহুদী অফিসারদের মধ্যে ইহুদীবাদী কারা তা চিহ্নিত করার জন্যে জরুরী তৎপরতা শুরু হয়ে গেছে। এক বিগ্রেডিয়ার স্টিভের ঘটনা সব ইহুদী অফিসারকেই আজ সন্দেহের মুখে ঠেলে দিয়েছে।’ জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন বলল।
‘আমাদের দুর্ভাগ্য জেনারেল। আহমদ মুসা আমাদের শনি হিসাবে আমেরিকায় আবির্ভূত হবে কে জানত। যাক, যা হবার হয়েছে। আর যাতে ওরা এগুতে না পারে সেটাই নিশ্চিত করতে হবে। বলল জেনারেল শ্যারন।
‘আমরা যে পুরো ঘটনাকে প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াতে দিতে চাই, এ ব্যাপারে এ্যান্ড্রু জ্যাকবস এবং দানিয়েল ময়নিহান কিছু বলেছেন? জিজ্ঞেস করল ডেভিড উইলিয়াম জোনস জেনারেল হ্যামিল্টনকে।
‘প্রসঙ্গটি এ্যান্ড্রু জ্যাকবস নিজেই তুলেছিলেন। বলেছিলেন, বিষয়টা মিডিয়াতে যাচ্ছে না কেন? আমি বলেছিলাম, এ ব্যাপারে একটা পরিকল্পনা তৈরী হয়েছে। আপনাদের সাথে বৈঠকের পরই তা মিডিয়াতে যাবে। দানিয়েল ময়নিহানও এ ব্যাপারে কথা বলেছিলেন। তারও মত ছিল, ওদের বিরুদ্ধে জনমতকে যতটা বিক্ষুব্ধ করা যাবে, আমাদের কাজ তত সহজ হবে। সুতরাং মিডিয়াকেই প্রধান অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করতে হবে।’ থামল জেনারেল হ্যামিল্টন।
জেনারেল হ্যামিল্টন থামতেই ডেভিড উইলিয়াম জোনস সহাস্যে বলে উঠল, ‘ওদের সাথে চূড়ান্ত আলোচনারই শুধু অপেক্ষা। টিভি নেট ওয়ার্ক ও নিউজ পেপারের জন্যে ভিন্ন ভিন্ন দুটি রিপোর্ট রেডি হয়ে আছে। ওদের সাথে আজ আমাদের আলোচনা সফল হলে আজকেই রিপোর্টগুলো মিডিয়াতে দিয়ে দেয়া হবে। আমাদের টিভি নেট ওয়ার্ক ও নিউজ পেপারগুলোকে এ্যালার্ট থাকার জন্যে অলরেডি ইংগিত দেয়া হয়েছে।’
জেনারেল হ্যামিল্টনের চেহারা কিছুটা প্রশ্নবোধক হয়ে উঠল। বলল, ‘আলোচনায় সফল হওয়ার প্রশ্ন উঠছে কেন? অসফলতারও কি কোন সুযোগ আছে?
হাসল জেনারেল শ্যারন। বলল, ‘আমাদের আলোচনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ হবে। গোটা বিষয় আমরা ওদের সাথে খোলাখুলি আলোচনা করতে চাই। সফলতার অর্থ হলো, যে পরিকল্পনা আমরা করেছি, তা বাস্তবায়নের জন্যে ওরা শুধু সমর্থন দেবেন ও নিজে কাজ করবেন তাই নয়, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ওদের সর্বশক্তি কাজে লাগাতে হবে। প্রতিনিধি পরিষদ ও সিনেটে আমাদের শুভাকাঙ্খী সদস্যরা তো কাজ করবেনই, কিন্তু তাদের কাজ হবে খুবই গুরত্বপূর্ণ। আমাদের বেশি ভয় সিনেট চীফ চালর্স ডব্লিউ ওয়ারনার, হাউজ (হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভ) চীফ জন জে, রিচার্ডসন, সিনেট ইনটেলিজেন্স স্পেশাল কমিটির চীফ আনা প্যাট্রেসিয়া এবং সিনেট ফরেন রিলেশনস স্ট্যান্ডিং কমিটির চীফ বব এইচ ব্রুসকে নিয়ে। স্বাধীন মতামত পোষণের ক্ষেত্রে এরা এতই বেপরোয়া যে এদের বাগে আনা মুশকিল। কিন্তু এদের পক্ষে আনতে হবে। সিনেট চীফ মি. ওয়ারনারের সাথে আমাদের মি. ডেভিড উইলিয়াম জোনস এর ভাল সম্পর্ক আছে, ব্যবসায়িক সম্পর্কও আছে, কিন্তু তিনি নিজে কিছু বললে উল্টো ফল হওয়ার ভয় আছে। অন্যদিকে দানিয়েল ময়নিহান তার এক সময়ের সহপাঠি শুধু নন, মি. ওয়ারনার রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নানাভাবে ময়নিহানের উপর নির্ভরশীল। অনুরুপভাবে সৌভাগ্যক্রমে জন জে রিচার্ডসন, আনা প্যাট্রোসিয়া ও এ্যান্ড্রু জ্যাকবস তিন জনই ক্যালিফোর্নিয়ার মানুষ। আর বব এইচ ব্রুস এ্যান্ড্রু জ্যাকবস-এর বন্ধু। সুতরাং মি. এ্যান্ড্রু জ্যাকবস ও মি. দানিয়েল ময়নিহানকে চূড়ান্ত প্রচেষ্টা চালাতে হবে।’ দীর্ঘ বক্তব্য দেয়ার পর থামল জেনারেল শ্যারন।
শ্যারন থামতেই কথা বলে উঠল জেনারেল হ্যামিল্টন। বলল, ‘আপনি মি. ময়নিহান ও মি. জ্যাকবস-এর যতটা ভূমিকা প্রয়োজন বলে ভাবছেন তা না লাগতে পারে। প্রতিনিধি পরিষদ ও সিনেটে আপনাদের শুভাকাঙ্খী সদস্যদের যে বিরাট শক্তি আছে এবং প্রেসের পক্ষ থেকে যে চাপের সৃষ্টি হবে, তাতে মি. রিচার্ডসন, ওয়ারনার, ব্রুস ও মিস প্যাট্রেসিয়ারা অনেকটাই কাত হয়ে পড়বেন বলে আমার বিশ্বাস।’
‘ঠিকই বলেছেন মি. হ্যামিল্টন। মিডিয়ার সমর্থন আমরা একতরফা পেয়ে যাব। টিভি ও নিউজ পেপার এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে যে, প্রেসিডেন্ট এ্যাডামস হ্যারিসন ও তার গ্যাংরা বাইরে মুখ দেখাতেই পারবে না। তবে যেটা আমাদের প্রথম টার্গেট প্রেসিডেন্টের ইমপিচমেন্ট খুব সহজ হবে না। সিনেট ও প্রতিনিধি পরিষদে দুই তৃতীয়াংশের সমর্থন হাসিল করতে হবে।’ বলল ডেভিড উইলিয়াম জোনস। তাঁর কন্ঠে চিন্তার সুর।
‘কেন, সহজ হবে না কেন? প্রেসিডেন্টের দুর্নীতি, অসদাচরণ, যোগসাজস, ইত্যাদি সম্পর্কিত যে দারুন সব দলিলের কথা বলেছিলেন, সে সব তো আছে আপনাদের কাছে।’
মিষ্টি হাসল ডেভিড উইলিয়াম জোনস। বলল, ‘আছে। রাজনৈতিক অফিসে তার সুন্দরী রাজনৈতিক সেক্রেটারী মিসেস শিলা জোসন এবং হোয়াইট হাউজে তাঁর প্রাইভেট সেক্রেটারী মিসেস উভা ব্রাউন আমার লোক। সুতরাং কি ধরনের সব ডকুমেন্ট থাকতে পারে তা চিন্তা করুন।’
‘ধন্যবাদ মি. জোনস। যেদিন কলংকের কালিমায় প্রেসিডেন্টের মুখটা কালো হয়ে যাবে এবং পরাজয়ের গ্লানিতে তার মাথাটা নুয়ে পড়বে, সেদিন আমি সবাইকে নিয়ে এমন একটা গ্র্যান্ড পার্টি করব যা স্মরণীয় হয়ে থাকবে।’ বলল জেনারেল হ্যামিল্টন।
হাসল জেনারেল শ্যারন। বলল, ‘মি. জোনস যে দলিল দস্তাবেজের কথা বলেছেন, সে সব দলিল দস্তাবেজ বের করার প্রয়োজন হবে না। পত্র-পত্রিকায় একটা ইশারা এবং তাঁর সামনে নিয়ে কয়েকটা নমুনা তুলে ধরলেই পায়ে এসে পড়বে পদ রক্ষার জন্য। দেখবেন, কোথায় উড়ে যাবে আহমদ মুসা, জর্জ আব্রাহাম, এ্যাডমিরাল ম্যাক, আর্থার, জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন এবং সারা জেফারসনদের দল’।
‘আপনার কথা সত্য হোক মি. শ্যারন। আমরা ইতিহাসের এক মহা মুহূর্তে দাঁড়িয়ে। আমরা সময়ের কাছে পরাজিত হলে মহা এক বিপর্যয়ের মুখোমুখি আমাদের দাঁড়াতে হতে পারে। আর সময় যদি আমাদের বিজয় এনে দেয়, তাহলে শতাব্দীর সাধনা দিয়ে আমেরিকায় ভবিষ্যতের যে বীজ বপন আমরা করেছি, তা এক নতুন পৃথিবীর মুখ আমাদের দেখাতে পারে। যা শুধু এক আমেরিকার মাধ্যমেই আমরা দেখতে পারি।’ বলল ডেভিড উইলিয়াম জোনস।
‘আপনার মূল্যায়নটা একটু বেশি প্রান্তিক হয়ে গলে না? বর্তমান পরিস্থিতি কি এতটাই গুরুতর? বলল জেনারেল হ্যামিল্টন।
‘মি. হ্যামিল্টন, আমি পরিস্থিকে যতটা গরুত্বপূর্ণ বলেছি, পরিস্থিতি মনে করি তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। তারা যা বলছে তা যদি প্রমান করতে পারে, তাহলে জার্মানীর মতই আমেরিকা আমাদের জন্যে এক দুঃস্বপ্নের দেশে পরিণত হতে পারে। মনে হবে আমি হতাশার কথা বলছি, কিন্তু না, সর্বোচ্চ সাবধানতা, সর্বোচ্চ সক্রিয়তা অবলম্বেনের জন্যেই একথা বলছি আমি।’ বলল ডেভিড ইউলিয়াম জোনস শুকনো কন্ঠে।
ভ্রু কুঞ্চিত হলো জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনের! বলল, ‘যা সত্য নয়, যা সাজানো, তা কি প্রমান করা যায়? বিশেষ করে আমেরিকায়?
উত্তরে কোন কথা বলল না ডেভিড জোনস।
জেনারেল হ্যামিল্টনের কথা শেষ হতেই জেনারেল শ্যারণ নিজের হাতঘড়ির দিকে চেয়ে বলে উঠল, ‘সময় হয়ে গেছে। মনে করি আমাদের যাত্রা করা উচিত।’
জেনারেল হ্যামিল্টন ও ডেভিড জোনস দুজনেই তাদের ঘড়ির দিকে তাকাল।
জেনারেল হ্যামিল্টন বলল, ‘আরো পরেও যাত্রা করলে পারি। তবু ঠিক আছে। আমাদেরকে ঘুরা পথেই যেতে হবে। সরকারী গোয়েন্দাদের নজর এড়াবার প্রয়োজন আছে।’ বলে উঠে দাঁড়াল জেনারেল হ্যামিল্টন। উঠে দাঁড়াল সবাই।

‘এই হ্যারি এই তো এলি, তাড়াহুড়ো করে আবার এক রাতে বেরুচ্ছিস কোথায়। শোন, কথা আছে।’ বলল ন্যান্সি ময়নিহান।
ন্যান্সি ময়নিহান সিনেটর ও সিনেটর পররাষ্ট্র বিষয়ক স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান দানিয়েল ময়নিহানের বড় মেয়ে। আর হ্যারি, মানে হ্যারি এডওয়ার্ড, দানিয়েল ময়নিহানের ছেলে। এবং একমাত্র ছেলে। ন্যান্সি ময়নিহান এবার ওয়াশিংটন ষ্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে গ্রাজুয়েট হয়েছে এবং হ্যারি এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্র।
বড় বোনের ডাকে থমকে দাঁড়ালো হ্যারি। ফিরলো বোনের দিকে। বলল, ‘বাইরে বেরুচ্ছি না আপা। আব্বার স্টাডিতে যাচ্ছি। জরুরী। এসে তোমার কথা শুনব। ঠিক আছে।
‘আব্বার স্টাডিতে এ সময়? রাত দুপুরে? ঠিক আছে, তোমার জন্যে অপেক্ষা করছি।’ বরল ন্যান্সি ময়নিহান।
হ্যারি এডওয়ার্ড তার হাত ঘড়ির দিকে তাকাল। রাত ১২টার কিছু বেশি।
ঘড়ি দেখেই ছুটল আবার হ্যারি।
পটোম্যাক নদীর তীরে ‘প্যাসেফিক ব্লু’ এলাকায় দানিয়েল ময়নিহানের বিশাল বাড়ি।
বাড়িটা বাংলো সাইজের দুতলা। নদীর সমান্তরালে তৈরী।
বাড়িটা প্রধান গেট দুটি, একটা পটোম্যাকের দিকে, অন্যটি বিপরীত দিকে, উত্তর পাশে।
উত্তর পাশের গেটটাই ব্যবহার হয় বেশি। পাবলিক রোড থেকে লাল পাথরের একটা প্রাইভেট রাস্তা এসে স্পর্শ করেছে গেটকে।
দুপাশে দুটি বাড়িকে বলা যায় দুভাগে ভাগ করে ফেলেছে। ব্যবহারে দিক দিয়েও বাড়িটা বিভক্ত।
বাড়ির পুব অংশের দুতলায় থাকেন দানিয়েল ময়নিহান। আর তার স্টাডি ও রাজনৈতিক অফিসগুলো পুব অংশের নিচতলায়। বাড়ির পশ্চিম অংশের দুতলায় ছেলে-মেয়েদের বেড, স্টাডি, ইত্যাদি। আর এদিকের নিচতলায় কিচেন, স্টোর ধরনের এ্যাকোমোডেশন।
পুব দিকের এক তলায় মেনে হ্যারি সোজা চলে গেল তার আব্বার পি এ ফিলিফের কক্ষে।
ফিলিফ ছাড়া আর কোন স্টাফ নিচে নেই। সবাই বিদেয় হয়েছে এগারটার মধ্যেই।
বিশেষ বা গোপন কোন বৈঠক এখানে হলে সেটা রাত দশটার পরই হয়।
পিএ ফিলিফ ছাড়া নিঃশর্ত বিশ্বাস আর কারও উপর দানিয়েল ময়নিহানের নেই। কৃষ্ণাংগ ফিলিফের পরিবার পুরুষানুক্রমে ময়নিহানদের পরিবারে আছে। আগে ছিল ক্রীতদাস হিসাবে, এখন আছে স্টাফ হিসাবে।
ফিলিফের ঘরে ঢুকে হ্যারি ফিস ফিস করে বলল, ‘আংকল, শ্যাবন সাহেবদের সাথে আব্বা কোথায় বসেছেন? স্টাডিতে না?
ফিলিফের চোখ বিস্ময়ে বড় বড় হয়ে উঠল। বলল, ‘শ্যারন সাহেবরা এসেছেন, এ কথা তোমাকে কে বলল?
কেন এই তো দশটার দিকে আব্বাকে টেলিফোন করল। তখনই আব্বা ইন্টারকমে আপনাকে বললো, জেনারেল শ্যারনরা আসবেন, কোন লেট নাইট কাজ হবে না। এগারটার মধ্যে সবই যেন চলে যায়।
বলে একটু থামল হ্যারি। বলল আবার, ‘আমার খুব ইচ্ছা জেনারেল শ্যারণকে দেখার । কিন্তু আসতে দেরী করে ফেলেছি।’
হাসল ফিলিফ। বলল, ‘স্যার, দেরী করে ফেলেছেন। ট্রেন মিস।’
তার মানে চলে গেছেন? বিশ্বাস হচ্ছে না। আপনি আমাকে ঠকাচ্ছেন।আমি দেখে আসি।’ বলে ঘুরে দাঁড়াল হ্যারি।
‘ঠিক আছে, একবার স্টাডি ঘুরে এস।’
হ্যারি ছুটে গেল স্টাডিতে। স্টাডিকক্ষ শূন্য। খালি চেয়ারগুলো খাঁ খাঁ করছে।
স্টাডিতে ছোট্ট একটা কনফারেন্স টেবিল আছে। দরজা দিয়ে ঢুকতে সামনেই সে টেবিল।
দরজা পা হয়ে ঘরে ঢুকতেই হঠাৎ হ্যারির নজরে পড়ে গেল সামনের চেয়ারের নিচে পড়ে থাকা একটা লাইটার। লাইটারটা সুন্দর, রিয়ার মডেলের। লাইটারটা তুলে নিল হ্যারি। উল্টে-পাল্টে দেখল লাইটারটা।
দেখতে গিয়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করল লাইটিং ম্যাকানিজমের সাথে সম্পর্কহীন একটা সুইচ। সুইচে চাপ দিল হ্যারি।
চাপ দেয়ার সাথে সাথে একটা ডাকনা সরে যাওয়ায় একটা কেবিন উন্মুক্ত হয়ে পড়ল। কেবিন থেকে ভ্রু কুঞ্চিত হলো কম্যুনিকেশন সাইন্সের ছাত্র হ্যারির। দেখল কেবিনে মাইক্রো রেকর্ডার সেট করা। রেকর্ডারটা তখনও কাজ করছে।
বুঝল হ্যারি, বৈঠকে যারা এসেছিলেন তাদেরই কেউ বৈঠকের প্রসেডিং গোপনে রেকর্ড করেছেন। এ কথা মনে আসার সাথে সাথে খুশি হয়ে উঠল হ্যারি, এতে নিশ্চয় জেনারেল শ্যারনের কথাও পাওয়া যাবে।
হ্যারি এডওয়ার্ড লাইটারের কেবিনটা আবার বন্ধ করে পকেটে পুরল লাইটারটা। স্টাডি থেকে বেরিয়ে এল হ্যারি। দরজা থেকে বেরোতেই দেখা হলো ফিলিপের সাথে। ফিলিপ দ্রুত আসছে স্টাডির দিকে।
‘কি ব্যাপার, আংকল?
‘তুমি যাও, স্টাডিতে একটু কাজ আছে আমার।’ বলে ফিলিপ দ্রুত ঢুকে গেল স্টাডিতে। এই লাইটারটিই কি?
কৌতূহলী হলো হ্যারি। ফিলিপ যদি লাইটারটাই খুঁজতে গিয়ে থাকে, তাহলে তো জানা যাবে কে লাইটারটার খোঁজ করেছিল এবং কে সেই লোক যে বৈঠকের বিবরণ গোপনে রেকর্ড করেছিল। লোক কে জানা গেলে তার উদ্দেশ্যেও জানা যাবে। হ্যারি মনে মনে এ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, রেকর্ডে কি আছে না জেনে এটা ফেরত দেয়া যাবে না।
এসব ভেবে হ্যারি এডওয়ার্ড গিয়ে ফিলিপের কক্ষে বসল।
কমিনিট পরে হন্ত-দন্ত, হয়ে ফিরে এল ফিলিপ। ঘরে ঢুকে হ্যারিকে বসে থাকতে দেখে খুশি হয়ে বলল, ‘ধন্যবাদ যে, তুমি এখনও আছ।’
থেকে একটা দম নিয়ে আবার বলল, ‘হ্যারি ঘরে তুমি কোন লাইটার পড়ে থাকতে দেখেছে?
‘লাইটার? লাইটার ওখানে পড়ে থাকবে কেন?
‘হ্যাঁ। এখনি জেনারেল শ্যারন টেলিফোন করলেন। তার মনে হচ্ছে তার লাইটারটা তিনি স্টাডিতে ফেলে গেছেন। যদি পেয়ে যাই, তাহলে এখনি উনি এসে তা নিয়ে যাবেন।’
হো হো করে হেসে উঠল হ্যারি এডওয়ার্ড। বলল, ‘একটা লাইটারের জন্যে তিনি টেলিফোন করেছেন। আবার এই রাতে সেই লাইটারটা তিনি নিতেও আসতে পারেন। আপনি হাসালেন আংকল।’
‘লাইটারটা ওনার নাকি খুব শখের।’ বলল ফিলিপ।
মনে মনে উদ্বিগ্ন হয়ে এঠেছে হ্যারি। শ্যারন সম্পর্কে যা সে শুনেছে তার চেয়েও দেখা যাচ্ছে ভয়ংকর এই শ্যারন। তার আব্বা নিশ্চয় শ্যারনকে সরল বিশ্বাসে সাক্ষাতকার দিয়েছিলেন। তাঁর ইনফরমাল কথাবার্তা নিশ্চয় খুব খোলামেলা হয়েছে। এগুলোই রেকর্ড করেছিল সে। নিশ্চয় তার আব্বাকে তিনি ব্ল্যাকমেইল করতেন। ঈশ্বর রক্ষা করেছেন তার আব্বাকে।
এসব চিন্তা চেপে রেখে প্রকাশ্যে বলল সে সহাস্যে, ‘তাহলে আংকল স্টাডিটা আরও একবার ভালো করে খুঁজে দেখুন। তাঁর যখন শখের জিনিস, তখন আরও একটু কষ্ট করুন। আমি যাই।
বলে উঠল হ্যারি।
উঠে এল দোতলায়।
ন্যান্সি সত্যিই অপেক্ষা করছিল।
হ্যারি আসতেই তাকে ধরল ন্যান্সি।
বোনের পাশে সোফায় বসেই সে বলে উঠল, ‘আপা একটা সাংঘাতিক ঘটনা ঘটেছে।’
‘থাক তোর সাংঘাতিক ঘটনা আগে বল, যা শুনেছি তা সত্যি কিনা?
‘কি শুনেছ?’
‘তুই নাকি ‘ফ্রি আমেরিকা’ মুভমেন্টের ওয়াশিংটন ষ্টেট ইউনিভার্সিটি শাখার সভাপতি হলি?’
‘আপা, এটা তোমার এমন করে জিজ্ঞেস করার মত কোন খবর? ‘বলিস কি তুই? ‘ফ্রি আমেরিকা’ মুভমেন্টে তুই কবে যোগ দিলি সেটাই তো জানি না। তার উপর একটা শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের তোর সভাপতি হবার মত খবর যখন আসে, তখন সেটা কি আমাদের জন্যে বড় খবর নয়?
‘এ খবরটা তোমাদেরকে কে দিল আপা?
‘সেটা দিয়ে তোর কি দরকার?
‘বরিস নিক্সন বলেছে, না?
‘হ্যা।
‘দেখ আপা বরিস তোমাকে কত ভালোবাসে, আমার কথা তোমাকে বলতে তার দেরী হয়নি, কিন্তু তোমার কথা আমাকে চার বছরেও সে বলেনি।’
‘আমার কোন কথা?’
‘তুমি চার বছর আগে ‘ফ্রি আমেরিকা’ এর সদস্য হওনি?’
হাসল ন্যান্সি। বলল, ‘হয়েছি। কিন্তু কাজ তো কিছু করি না। তাই বলে বেড়বার কিছু নেই।’
কথা শেষ করেই ন্যান্সি বলে, ‘আমি তোকে অভিনন্দিত করছি হ্যারি। তুই আমার ছোট ভাই বলে আমর গর্ব হচ্ছে। তুই যে দায়িত্ব পেয়েছিস তা তোর বয়সের চেয়ে বড়।
‘ধন্যবাদ আপা।’
‘ওয়েলকাম। এখন তোর সাংঘাতিক কথাটা বল।
হ্যারি পকেট থেকে বের করে লাইটারটা ন্যান্সির হাতে দিল। তারপর লাইটারের সব কাহিনী খুলে বলল জেনারেল শ্যারনের টেলিফোনের কথা সহ।’
লাইটারটা খুলে ন্যান্সিও দেখল।
গম্ভীর হয়ে উঠল তার মুখ। বলল, ‘এই গোপন রেকর্ডই প্রমাণ করে এই রেকর্ডে আব্বার এমন কোন কথা আছে, যা জেনারেল শ্যারন কাজে লাগাতে পারে। তার মধ্যে, তুই ঠিকই বলেছিস, ব্ল্যাকমেইল করাটাই বড়।’
‘তাহলে তো দেখতে হয় এতে কি আছে?’ হ্যারি বলল।
দেখতে হবে এবং এখনি?’
‘তাহলে চল আমার স্টাডিতে। আমার মাস্টার রেকর্ড প্লেয়ারে সব ধরনের ক্যাসেট সেট করা যায়।’ বলল হ্যারি।
বলেই উঠে দাঁড়াল সে। ন্যান্সিও উঠল। ক্ষুদ্র ক্যাসিটটি রেকর্ড প্লেয়ারে চড়িয়ে ন্যান্সি হ্যারি দুজনে দুটি চেয়ার নিয়ে রেকর্ড প্লেয়ারের সামনে বসল। দুজনের মুখেই একটা হাল্কা হাসি। টেপে রেকর্ড হয়েছে একদম শুরু থেকেই।
তার পিতা জেনারেল শ্যারনদেরকে স্বাগত জানাল। সম্ভাষণ বিনিময়রে পর অতিথিরা তাদের পরিচয় জানাল। জেনারেল শ্যারন ও ডেভিড উইলিয়াম জোনস নিজেদের পরিচয় দিল। জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন নিজের পরিচয় দিতে শুরু করলে সবাই হেসে উঠল। বলল, না আপনাকে আমরা দেখিনি এবং চিনিও না।
পরিচয় পর্ব শেষ হলে কথা শুরু করল ন্যান্সিদের আব্বা দানিয়েল ময়নিহান। বলল, মি. শ্যারন ও মি. জোনস, আমি মি. হ্যামিল্টনের কাছ থেকে সব শুনেছি, তবু আপনাদের কাছ থেকে আরো ভাল করে জানতে চাই আমাদের এ্যাডামস হ্যারিসন-সরকারের বিরুদ্ধে প্রকৃতপক্ষে অভিযোগটা কি। তাহলে প্রতিকারের পথটাও সুস্পষ্ট হয়ে যাবে। সরকারকে সংশোধন করার পথ অবশ্যই আছে। প্রেসিডেন্টের ইমপিচমেন্ট সর্বশেষ একটা পদক্ষেপ। একটা কথা আমাদের সবাইকেই জানতে হবে, প্রেসিডেন্ট রিপাবলিকান দল থেকে নির্বাচিত। কিন্তু তিনি প্রেসিডেন্ট গোটা দেশের। তাঁর সুনাম দেশের মর্যদা বাড়ায়, আমাদের ডেমোক্র্যাটদেরও। আবার তাঁর অন্যায় যেমন দেশকে আহত করে, তেমনি আমাদেরকেও! সুতরাং তার ভাল কাজের জন্যে বাহবা সব সময় না দিলেও, তাঁর অন্যায় আমরা এক মুহূর্তও বরদাশত করতে রাজী নই।
দানিয়েল ময়নিহান থামলে কথা বলে উঠল শ্যারন। সে দানিয়েল ময়নিহানকে ধন্যবাদ দিয়ে শুরু করল। এক নাগাড়ে দীর্ঘ বিশ মিনিট কথা বলল, জেনারেল শ্যারন। তার দীর্ঘ কথার সমাপ্তি টানতে গিয়ে বলল, ‘মৌলবাদী সন্ত্রাসী নেতা আহমদ মুসা এভাবে আমাদের বিরুদ্ধে অমূলক একটা অভিযোগ আবিস্কার করে এবং অদ্ভুত কৌশলে রক্তক্ষয়ী ও ধ্বংসাত্মক ঘটনা একের পর এক সৃষ্টি করে তার দায় ইহুদী কম্যুনিটির উপর চাপিয়ে দিয়ে দেশে একটা বড় ধরনের বিভেদ সংঘাত সৃষ্টি করতে চায়। সে চায় আমেরিকাকে দুর্বল করে ও তার আকাশস্পর্শী ইমেজকে ধ্বংস করে দিয়ে আমেরিকার বিশ্ব নেতৃত্বের আসন ও তার নতুন বিশ্ব গড়ার মহান স্বপ্নকে বানচাল করতে। শৃগালের মত ধূর্ত আহমদ মুসা সম্মোহিত করেছে প্রেসিডেন্টকে, সম্মোহিত করেছে সশস্ত্র বাহিনী প্রধান, সি আই এ চীফ এফ বি আই প্রধানকে। আহমদ মুসাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা দিতে এগিয়ে এসেছে ইহুদী বিদ্বেষী ‘ফ্রি আমেরিকা’ মুভমেন্ট। টাকার অংকে বিক্রি হয়ে গেছে গোল্ড ওয়াটারের ‘হোয়াইট ঈগল’ও। এই অবস্থায় দেশের মান, ইজ্জত ও ভবিষ্যত রক্ষার জন্যে আপনাদের মত রাজনীতিককেই এগিয়ে আসতে হবে।’ থামল জেনারেল শ্যারন।
এরপর আলোচনা শুরু হলো।
অনেক প্রশ্ন, অনেক উত্তর অনেক মন্তব্য ও পর্যালোচনা-পরামর্শের বিবরণ দিয়ে চলল ক্যাসেটের মাইক্রোটেপটি।
ন্যান্সি ও হ্যারি হালকা হাসির মধ্য দিয়ে টেপের বিবরণ শোনা শুরু করেছিল। কিন্তু হাসি তাদের এখন উবে গেছে। তারা এখন স্তম্ভিত, আতংকিত, রুদ্ধবাক প্রায়! জেনারেল শ্যারন শুধু আহমদ মুসার বিরুদ্ধে বিষোদগার নয়, ‘ফ্রি আমেরিকা’ ও ‘হোয়াইট ঈগল’ এর বদনামই শুধু নয়, গোটা আমেরিকান মিশনকেই সে বিকৃত করছে এবং এমন সব কথা বলেছে যা পরিস্কার রাজনৈতিক ঘুষের পর্যায়ে পড়ে। জেনারেল শ্যারন তার কথা শেষ করল এভাবে, ‘সব শেষ আমি এইভাবে বলতে চাই, আমাদের উভয় পক্ষের বেনিফিটের জন্যে আমরা পারস্পরিক সহযোগিতার আবেদন করছি। আপনি মি. দানিয়েল ময়নিহান ও এ্যান্ড্রি জ্যাকবস আপনাদের কমিটিগুলোকে ম্যানেজ করাসহ সিনেট চীফ চার্লস ডব্লিউ ওয়ারনার, হাউজ চীফ জন জে, রিচার্ডসন, সিনেট ইন্টিলিজেন্স স্পেশাল কমিটির চীফ আনা প্যাট্রেসিয়া এবং ফরেন রিলেশন্স সিনেট স্ট্যান্ডিং কমিটির চীফ বব এইচ ব্রুসকে আমাদের পক্ষে এনে দিতে হবে। যাতে প্রেসিডেন্টকে রাজনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন করা যায়, যাতে প্রয়োজনে তাকে ইমপিচ করার জন্যে প্রয়োজনীয় সদস্য যোগাড় সহজ হয়। আমাদের লাভ হবে আমরা ভয়াবহ ষড়যন্ত্রের হাত থেকে রক্ষা পাব। আর আপনাদের লাভ হবে, আগামী নির্বাচন আপনাদের হবে। এর জন্যে যা কিছু করার, যত অর্থের প্রয়োজন হয় তার ব্যবস্থা আমরা করব। গ্যারান্টি হিসাবে ব্যাংক সার্টিফিকেটসহ তিনটি সাইন্ড ব্ল্যাংক চেক রেখে যাচ্ছি।’
টেপের বিবরণ শেষ হয়ে গেলে দানিয়েল ময়নিহানের কথার মাধ্যমে। সে বলল, ‘আমাদের লাভের প্রশ্ন থাক, গ্যারান্টি, সিকুইরিটির প্রশ্ন ওঠে না। আপনাদের বিপদটা আমাদেরও বিপদ। সরকার যদি ভুল করে তার মাসুল জনগণকেই দিতে হবে। সর্বাত্মক সহযোগিতার ব্যাপারে নীতিগতভাবে আমরা একমত।’ টেপের কথা শেষ হলো।
ক্যাসেট প্লেয়ার ক্লোজ করল হ্যারি। দুজনেই কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে বসে রইল।
নিরবতা ভাঙল ন্যান্সি। বলল, ‘ওরা একটা বড় ঘটনা ঘটাতে যাচ্ছে, হ্যারি।’
‘সে ঘটনার সাথে জড়িত করছে আব্বাকে।’ হ্যারি বলল।
‘হ্যাঁ তাই। আমরা প্রকৃত ঘটনার খুব অল্পই জানি। আব্বা তো কিছুই জানেন না। সুতরাং তিনি ওদের কথা বিশ্বাস করবেন সেটাই স্বাভাবিক।’ বলল ন্যান্সি।
‘ঘটনা সম্পর্কে তোমার ব্যাখ্যা কি আপা? আমাকে শুধু এইটুকু বলা হয়েছে। আহমদ মুসা এখন আর আমাদের শুত্রু নয়, বন্ধু। সে আমেরিকানদের যে উপকার করেছে তার পরিমাপ করা যাবে না। আর প্রমাণ হয়েছে ইহুদীদের একটা গ্রুপ আমাদের জাতীয় শত্রু। শীঘ্রই এটা আদালতে প্রমাণ হবে।’ হ্যারি বলল।
‘তুমি ঠিকই শুনেছ হ্যারি। জাতির জরুরী প্রয়োজনেই ‘ফ্রি আমেরিকা’ আহমদ মুসাকে সহযোগিতা দিচ্ছে এবং তার সহযোগিতা নিচ্ছে। ঠিক এই একই কারণেই কিন্তু হোয়াইট ঈগলও আহমদ মুসাকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করেছে। অথচ দেখ, এই আহমদ মুসাকে হোয়াইট ঈগলই কিডন্যাপ করে আমেরিকায় আনে প্রতিশোধ নেবার জন্যে।’ বলল ন্যান্সি।
‘আরেকটা বিষয় আপা, ঘুষ হিসাবে তাদের ব্ল্যাংক চেক অফার করা প্রমাণ করে ইহুদীবাদীরা কি ধরনের বিপদে পড়েছে। তাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ যদি মিথ্যা হতো, তাহলে এভাবে পেছন দরজা দিয়ে সিনেট ও প্রতিনিধি পরিষদের সদস্যদের হাত করার চেষ্টা না করে তারা আইনি মোকাবিলায় নামতো।’ হ্যারি বলল।
‘এখন কি করা যায় বলত। এই টেপ কিন্তু একটা সাংঘাতিক দলিল।’ বলল ন্যান্সি।
‘আমার মনে হয় টেপটা দুলাভাইয়ের হাতে পৌছে দাও। উনি ওটা মুভমেন্টের নেতাদের কাছে পৌছে দেবেন।’
ন্যান্সির চোখে-মুখে ফুটে উঠল কৃত্রিম ক্রোধ। সে হ্যারির পিঠে একটা কিল দিয়ে বলল, ‘সিরিয়াস বিষয়ের মধ্যে ইয়ার্কি কেন?’
‘দুটোই সিরিয়াস। ওটা দেশের জন্যে, আর এটা তোমার জন্যে।’ দম নিয়েই আবার শুরু করল, ‘বরিসকে কি টেলিফোন করবি?’
‘টেলিফোন কেন?’
‘ও এসে টেপটা নিয়ে যাক।’
‘ঠিক বলেছ আপা, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এটা ঠিক জায়গায় পৌছে দেয়াই উচিত হবে।’
‘তাহলে টেলিফোন করি।’
‘হ্যা, ডাক তাকে আপা। তবে আপা, রথ দেখার সাথে সাথে কলা বেচার মতলব করছ না তো?’ আবার ন্যান্সি বড় ধরনের কিল তুলল হ্যারির পিঠ লক্ষ্যে।
দেখে লাফ দিয়ে ছুটে পালাল হ্যারি।
ন্যান্সি ক্যাসেট প্লেয়ার থেকে ক্যাসেটটা খুলে হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াল মোবাইলটা নেয়াজেন্যে।
‘আপা, আমি শুতে গেলাম।’
‘কেন, ও আসুক। টেপটা উদ্ধার করার কৃতিত্ব তো তোরই।’
‘না আপা, বোন ও হবু দুলাভাইয়ের আসরে শালারা সব সময় আওয়ান্টেড। আর ও কৃতিত্বটা তোমাকেই দিয়ে গেলাম। ‘কই’ খাওয়া আর ‘বিল সেচা’র লোক সব সময় আলাদাই থাকে আপা। গুড নাইট।’
বলে হ্যারি হাসতে হাসতে ছুটে চলে গেল তার শোবার ঘরের দিকে।
হ্যারির এ স্টাডি রুমের ওপাশে তার শোবার ঘর। হ্যারি ও ন্যান্সির শোবার ঘরের মাঝখানে স্টাডি রুম ও বসার ঘরের ব্যবধান।
ন্যান্সি হ্যারির স্টাডি রুম থেকে বেরিয়ে পাশেই বসার ঘরে গিয়ে বসল।
টেলিফোন করল বরিস নিক্সনকে। পেল তাকে। টেপের কথা শুনে লাফিয়ে উঠল সে। বলল, ‘রাতে আসতে পারবো না মানে? এর জন্যে এ মুহূর্তে চাঁদে যাত্রা করতেও বললেও আমি রাজি। তার উপর ন্যাশনাল ইন্টারেষ্টের বাইরে এখানে একটা পার্সোনাল ইন্টারেষ্ট ও আছে।’
‘পার্সোনাল ইন্টারেষ্টকে পাশে রাখতে চাও? এটাই বোধ হয় তোমার দেশপ্রেম।?’
‘দেখ, দেশপ্রেম কাউকে বৈরাগী হতে বলে না। ও, কে। আসছি। বাই।’
বলে ওপাশে টেলিফোন রেখে দিল বরিস নিক্সন।
ন্যান্সিও মোবাইলটা রেখে দিয়ে সোফায় গা এলিয়ে দিল। কমপক্ষে বিশ মিনিট তাকে অপেক্ষা করতে হবে বরিসের জন্যে।
‘বিশ মিনিট’ কেন বিশ ঘন্টাও ওর জন্যে অপেক্ষা করতে তার একটুকুও ক্লান্তি আসবে না।
ন্যান্সি কেমন করে অস্বীকার করবে যে, বরিসকে কাল সকালে ডাকলেও চলত, কিন্তু একটা উপলক্ষ যখন পেয়েছে তখন বরিসকে কাছে পেতে সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে তার মন চায়নি।
বরিস আসছে এই চিন্তা ন্যান্সির হৃদয় মনকে সজীব করে দিয়েছে।
হাসল ন্যান্সি। সে বরিসকে পার্সোনাল ইন্টারেস্টের জন্যে অভিযুক্ত করল। কিন্তু তার চাওয়া কি বরিসের চেয়ে কম? বরিসরা যা খোলামেলা বলে। ন্যান্সিরা তা চেপে থাকে এটাই মাত্র পার্থক্য।
নিচ থেকে একটা গাড়ির হর্ন বেজে উঠল।
চিনতে ন্যান্সির কষ্ট হলো না বরিসের গাড়ির হর্ণ।
উঠে দাঁড়িয়ে ন্যান্সি ছুটল সিঁড়ির দিকে বরিসকে নিয়ে আসার জন্যে।

ন্যান্সি ময়নিহান যখন চোখ খুলল, প্রথমেই চোখ পড়ল তার ডাক্তারের উপর। পাশেই দেখল তার আব্বা-আম্মাকে। দেখে চমকে উঠল। বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত তাদের চেহারা। আর এক দফা সে চমকে উঠল তার ঘরের দরজার বাইরে পুলিশ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে।
মনে হচ্ছে কিছু ঘটেছে। কি ঘটেছে? লাফ দিয়ে উঠে বসল সে। কিছুই বুঝতে পাছে না সে। বরিসকে বিদায় দিয়ে সে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম তার ভাল হয়েছে। কিন্তু শরীল খুব দুর্বল লাগছে। কিন্তু তার পাশে ডাক্তার কেন?
উঠে বসেই ন্যান্সি তার পিতার দিকে চেয়ে বলল, ‘কিছু বুঝতে পারছি না আব্বা। কি হয়েছে? পুলিশ কেন? ডাক্তার কেন?
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলল ন্যান্সি।
ন্যান্সির আব্বা দানিয়েল ময়নিহান কোন উত্তর দিল না। তার মুখে গাম্ভীর্য যেন আরও গভীর হলো।
কেঁদে উঠল ন্যান্সির আম্মা।
সে এসে জড়িয়ে ধরল ন্যান্সিকে। বলল কান্না চাপার চেষ্টা করে, ‘সর্বনাশ হয়েছে মা। হ্যারিকে কেউ কিডন্যাপ করেছে, খুন হয়েছে ফিলিফ।’
‘হ্যারি কিডন্যাপ হয়েছে? ফিলিফ আংকল খুন হয়েছেন? চিৎকার করে উঠল ন্যান্সি। তড়িতাহতের মতই কেঁপে উঠল ন্যান্সি গোটা শরীল, মাইক্রোটেপের কথা মনে পড়ে গেছে তার। ন্যান্সির গোটা সত্তা জুড়ে একটা চিৎকার উঠল। জেনারেল শ্যারনরা তাহলে ঐ টেপের জন্যে কিডন্যাপ করল হ্যারিকে? খুন করল ফিলিফকে?
সমগ্র স্নায়ুতন্ত্রে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত এই চিৎকার ন্যান্সির মুখ-ফেঁড়ে বেরিয়ে আসছিল। বহুকষ্টে তা রোধ করল ন্যান্সি।
চিৎকার রোধ হলো, কিন্তু সেই চিৎকার অসহায় কান্নার প্রবল বেগ নিয়ে বেরিয়ে এল ন্যান্সির ভেতর থেকে। ন্যান্সি কেঁদে উঠল তার মাকে জড়িয়ে ধরে।
ন্যান্সি সংগা ফিরে পাওয়ায় ডাক্তার বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। তার আব্বাও চলে গেল পুলিশের সাথে কথা বলতে বলতে।
ন্যান্সির আম্মা চোখ মুছে বলল, ‘তোকে নিয়েও আমরা মহাচিন্তায় পড়েছিলাম। তোর সংগা ফিরতেই সবচেয়ে বেশি দেরী হলো। ডাক্তার বলেছিল, নির্দিষ্ট সময়ে সংগা না ফিরলে বা সংগা ফেরাতে না পারলে জীবনহানিও ঘটে।
‘তার মানে তোমারও সংগা হারিয়েছিলে? কেন? কিভাবে? তাহলে কি ওরা ….।’
কথা শেষ না করেই থেমে গেল ন্যান্সি।
‘হ্যাঁ মা, খুনিরা এক বিশেষ ধরনের ক্লোরোফরম স্প্রে করে সবাইকে ঘুমিয়ে রেখে নিরাপদে কাজ সেরে গেছে।’
‘গেটের সিকিউরিটিরা কোথায়?’
‘তারাও সংগা হারিয়েছিল। কিন্তু তারাই প্রথম সংগা ফিরে পায়। ওরা বাইরে ছিল বলে ক্লোরোফরম ওদের উপর খুব গভীর ক্রিয়া করতে পারেনি। ওদের সংগা ফের পর ওরাই পুলিশকে খবর দেয়। পুলিশ এসে আমাদের ও তোদের ঘরের দরজা খোলে এবং ডাক্তারও ডাকে তারাই। ডাক্তার বলেছে, আমাদের ও তোর ঘর খুলে দিতে আরও দেরী হলে আমাদের জীবনহানি ঘটতে পারতো।’
বলে একটু থেমেই আবার কেঁদে উঠল। বলল, ‘হ্যারির ঘরে রক্ত দেখা গেছে। নিশ্চয় তাকে খুনিরা মারধোর করেছে। আমার সোনামনি বেঁচে…..।’
কথা শেষ করতে পারলো না ন্যান্সির মা। কান্নায় ভেঙে পড়ল সে।
কথা শেষ না করলেও ন্যান্সি বুঝল তার মা কি আশংকা করছে। ন্যান্সি ভেতরটা থর থর করে কেঁপে উঠল। কিন্তু এবার কান্নার বদলে ন্যান্সির মধ্যে হ্যারির জন্য প্রচন্ড ভয় ও উদ্বেগের সৃষ্টি হলো এবং জেগে উঠল তার মধ্যে কিছু করার প্রেরণা। ন্যান্সি এতটুকু বুঝল, ফিলিফের মত হ্যারিকে খুন না করে ওরা ওকে কিডন্যাপ করেছে এবং তাকে কিডন্যাপ করেছে ওরা টেপের জন্যেই।
আবার বুকটা কেঁপে উঠল ন্যান্সির। টেপ তো তার কাছে পায়নি, পাবে না। না পেলে কি খুন করবে ওরা হ্যারিকে?
আতংক ও উদ্বেগে ভেতরটা যেন কাঠ হয়ে উঠতে চাচ্ছে তার। ভাবল, টেপের খবর বলবে কি সে তার পিতাকে, পুলিশকে? তাহলে তো বলতে হবে বরিস নিক্সনদের কথা। কিন্তু তাতে কি লাভ হবে? টেপ ফেরত পেলেও সে টেপ কি পুলিশ দেবে শ্যারনদেরকে? দেবে না। তাহলে ফলই একই হচ্ছে।
এসব চিন্তা করতে গিয়ে ন্যান্সির মনে হলো, এই ঘটনার কথা এখন তার বরিসকে জানানো দরকার। হ্যারিকে উদ্ধার করার ক্ষেত্রে পুলিশের চেয়ে ফেম’ই (Free America) বেশি কার্যকরী হবে।
এ চিন্তার সাথে সাথেই ন্যান্সি উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘চল মা, ‘হ্যারির ঘরটা একটু দেখব। কয়জন বন্ধু বান্ধবকে টেলিফোন করব। পুলিশ তার খোঁজ করবে, সাথে সাথে আমাদেরও কিছু করতে হবে মা।’ বলে সে নেমে এল বেড থেকে।
তার মাও উঠল।
হ্যারির ঘর দেখে আঁৎকে উঠল ন্যান্সি। গোটা ঘর লন্ড-ভন্ড। ড্রয়ার, সেল্ফ, বেড কিছুই আস্ত নেই। ঘরের প্রতিটি ইঞ্চি জায়গা তছনছ করেছে কেউ। ন্যান্সির বুঝতে বাকি রইল না। ওরা এভাবে টেপটাই খুঁজেছে।
ন্যান্সি ফিরল মায়ের দিকে। বলল, ‘হ্যারির স্টাডি’র দিকে তো খেয়াল করলাম না। ওটারও কি এই অবস্থা আম্মা?’
‘হ্যাঁ, মা, স্টাডিরও কোন জিনিস আস্ত নেই। কম্পিউটার, আলমারি, সেলফ, বই-পুস্তক সব কিছুই ছড়ানো-ছিটানো। পুলিশ বলছে, খুনিরা কিছু একটা খোঁজ করেছে। পরে সে জিনিসসহ হ্যারিকে তারা কিডন্যাপ করেছে। অথবা সে জিনিস না পেয়ে হ্যারিকেই নিয়ে গেছে।’
একটু থেমে আবার বলল, ন্যান্সির মা, ‘পুলিশ আরও বলছে, ‘জিনিসটা না পেয়ে হ্যারিকে ওরা নিয়ে গেছে। কিন্তু জিনিসটা পেলে হ্যারিকে হয়তো তারা ফিলিপের মতই খুন করে রেখে যেত।’
নিজেকে সামলে নিয়ে চোখ মুছে আবার সে বলল, ‘কিন্তু ফিলিফকে হত্যার সাথে হ্যারির কিডন্যাপ হওয়ার বিষয়টাকে মিলাতে পারছে না পুলিশ। তবে অনুমান করছে, যে জিনিসের সন্ধানে খুনিরা হ্যারির কাছে এসেছিল সে জিনিসের কথা ফিলিপও জানত। ফিলিপকে ওরা হত্যা করেছে বুকে গুলী করে। কিন্তু তার আগে তাকে নির্যাতন করেছে। মুখেই তার আঘাত বেশি। পুলিশ মনে করছে তাকে কিছু বালানোর চেষ্টা করা হয়েছে। সম্ভবত কথা আদায় করার পর তাকে হত্যা করা হয়েছে। সেখান থেকেই খুনিরা এসেছে হ্যারির ঘরে।’
ন্যান্সি মনে মনে পুলিশের অনুমানের প্রশংসা করল। তাদের অনুমানের প্রতিটা বর্ন সত্য। ফিলিপের কাছে শ্যারনের লোকরা এসেছিল টেপের খোঁজ করতে। তার কাছ থেকেই জানতে পারে মিটিং- এর পর প্রথমে হ্যারিই সেখানে যায়। সুতরাং তারা ধরে নেয়, টেপটা যখন ফিলিপের কাছে নেই, তখন নিশ্চয় সেটা হ্যারিই প্রথমে গিয়ে খুঁজে পেয়েছে।
‘কি ভাবছিস ন্যান্সি?’ ন্যান্সিকে গম্ভীর হয়ে যেতে দেখে বলল তার মা।
‘আম্মা আমি ভাবছি, কিছু করার কথা। যাই কয়েকটা টেলিফোন করে নেই।’ বলে ন্যান্সি হ্যারির ঘর থেকে বেরিয়ে এল।
নিজের ঘরে ফিরে ন্যান্সি টেলিফোন করল বরিস নিক্সনকে। প্রথম চেষ্টাতেই পেলো বরিসকে। বরিসকে জানাল সব ঘটনা ন্যান্সি। কাঁদল অনেক।
ওপার থেকে বরিস ন্যান্সিকে সান্তবনা দিয়ে বলল, ‘কেঁদো না ন্যান্সি। তুমি এবং হ্যারি দেশের অমূল্য উপকার করেছ। ঈশ্বর হ্যারিকে অবশ্যই সাহায্য করবেন। আমি এখনি চীফকে এটা জানিয়ে দিচ্ছি। FBI বিষয়টা এখনি জেনে যাবেন। পুলিশ যা করছে করুক, ওদিক থেকে উদ্ধার প্রচেষ্টা এখনি শুরু হয়ে যাবে।’
ন্যান্সি কিংবা বরিস কেউই টেপ-এর প্রসংগ তাদের কথায় আনল না। ‘ফ্রি আমেরিকা’ মুভমেন্টের নামও নয়। তারা সতর্ক যে, ন্যান্সিদের টেলিফোনে এখন আড়ি পাতা হবে জেনারেল শ্যারণদের পক্ষ থেকে তোব বটেই, পুলিশের পক্ষ থেকেও আড়িপাতা হতে পারে।
বরিসের কথা শেষ হলে ন্যান্সি বলল, ‘যা কিছু করার বরিস তাড়াতাড়ি করতে হবে। আব্বা-আম্মা খুবই ভেঙ্গে পড়েছেন।’
‘খুবই স্বাভাবিক। চিন্তা করো না। ঈশ্বর আছেন। তোমার সাথে আমার দেখা হওয়ার দরকার।’ বলল বরিস।
‘আমিও চাই। তুমি এস এখানে, আব্বাদের সাথেও কথা বলবে।’ ন্যান্সি বলল।
‘ঠিক আছে। আসব।’
‘কখন?’
‘দেখি হ্যারির ব্যাপারটা সবার সাথে আলোচনা করি। তার ব্যাপারে দ্রুত কিছু একটা করতে হবে। আজ সন্ধ্যার দিকে চেষ্টা করব।’ বলল বরিস।
‘ধন্যবাদ, আমাকে টেলিফোন করো।’ ন্যান্সি বলল।
‘ঠিক আছে। ওকে। বাই’ বলল বরিস।
‘বাই।’ বলে ন্যান্সিও টেলিফোন রেখে দিল।
টেলিফোন সেরে হ্যারির ঘরে দিকে আসতেই হ্যারির স্টাডির সামনে ন্যান্সির দেখা হলো তার আব্বা দানিয়েল ময়নিহানের সাথে।
‘আব্বা, বরিসকে টেলিফোন করেছিলাম। আসতে বললাম। সন্ধ্যায় আসবে। হ্যারিকে খুব স্নেহ করে সে। গত রাতেও এসেছিল। সবারই সাহায্য আমাদের দরকার আব্বা।’
বরিসের নাম শুনে ভ্রু কুঞ্চিত হলো ন্যান্সির আব্বা দানিয়েল ময়নিহানের। বলল, ‘হ্যাঁ দেখেছি তাকে। প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা উপদেষ্টার পি, এস ছেলেটাতো?’
বলে একটু থামল। ভাবল বোধ হয় একটু। তারপর বলল, ‘এস মা, তোমার সাথে একটু কথা বলি।’
বলে দানিয়েল ময়নিহান এগুলো সামনের বসার ঘরটার দিকে। দানিয়েল ময়নিহান ও ন্যান্সি সোফায় পাশাপাশি বসল।
দানিয়েল ময়নিহানের মুখ বিষন্ন। বেদনাক্লিষ্ট তার চোখের দৃষ্টি। ধীরে ধীরে বলল, ‘কিছুক্ষণ আগে আমার এক গুরুত্বপূর্ণ বন্ধু আমাকে টেলিফোনে বলল যে ‘ফ্রি আমেরিকা’ (ফ্রেম) মুভমেন্ট এবং সরকারের প্রভাবশালী অংশ আমাকে ইহুদীপন্থী বলে মনে করে। বর্তমানে কয়েকটা ঘটনা নিয়ে সরকার ও ‘ফ্রেম’ ইহুদীদের বিরুদ্ধে খড়গহস্ত হয়েছে। এ নিয়ে খুব শীঘ্রই প্রতিনিধি পরিষদ ও সিনেটে শক্তির লড়াই হতে যাচ্ছে। পারিবারিক সংকট ও চাপে পড়ে যাতে আমি ঐ লড়াইতে কোন ভূমিকা না রাখতে পারি তারই একটা কৌশল হিসাবে এই ঘটনা ঘটানো হতে পারে। সেই আমাকে প্রথমে জানাল, গত রাত ১২টার পর বরিস নিক্সন আমার বাসায় এসেছিল। আর বরিস নিক্সনের সাথে ‘ফ্রেম’ (ফি আমেরিকা মুভমেন্ট)- এর খুব গভীর সম্পর্ক আছে।’
দানিয়েল ময়নিহান কথাগুলো বলে একটা দম নিয়ে পুনরায় বলল, ‘এই মুহূর্তে ভেতরের দৃশ্যপট যে রকম সংঘাত-মুখর তাতে আমার বন্ধুর কথাগুলো শুনেই ন্যান্সি বুঝল তার পিতার এই বন্ধু নিশ্চয় জেনারেল শ্যারন হবেন। সে বিস্মিত ও আতংকিত বোধ করল যে, জেনারেল শ্যারনরা কিভাবে কত দ্রুত কাহিনী সৃষ্টি করতে পারে। সে বিস্মিত হলো এই ভেবেও যে, বরিস এখানে পাহারা বসিয়েছিল, না পুলিশের কাছ থেকে ওরা জেনেছে। পুলিশ নিশ্চয় গেটের লোকদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছে এবং নিশ্চয় ওরা জানতে পেরেছে বরিস এখানে এসেছিল। পুলিশের কাছ থেকেও শ্যারনরা এই তথ্য জানতে পারে। পুলিশের মধ্যে ওদের প্রচুর লোক আছে।
এসব চিন্তা করে ন্যান্সি ভাবল, টেপের কথা, বরিসকে টেপ দেয়ার কথা তার আব্বাকে এখন বলা ঠিক হবে না। টেপ ‘ফ্রি আমেরিকা’ মুভমেন্টের হাতে দেয়ার ব্যাপার তার আব্বা মেনে নেবেন না। তাছাড়া টেপ হস্তান্তরের এই কথা তার আব্বার মাধ্যমে জেনারেল শ্যারনদের কানে চলে যেতে পারে। তাতে বরিসেরও বিপদ ঘটতে পারে। আবার ভাবল ন্যান্সি, টেপের ব্যাপারটা হ্যারির কাছ থেকেও শ্যারনরা জেনে নিতে পারে এবং এজন্যেই তাকে কিডন্যাপ করেছে। পরক্ষণেই তার মনে একটা আশা জাগল যে, হ্যারি টেপ পেয়েছে এটা ফিলিফও জানত না। সুতরাং ফিলিফ তাদেরকে একথা বলতেও পারেনি। অতএব হ্যারিকে তারা ধরে নিয়ে গেছে সন্দেহ বশতই। আর হ্যারি মুখ না খুললে তাদের সন্দেহ সন্দেহই থেকে যাবে। নিছক সন্দেহ থেকেই কি তারা হ্যারিকে খুন করতে পারে!’
চিন্তা হয়তো ন্যান্সির আরও সামনে গড়াত। কিন্তু তার আব্বার কথায় তার চিন্তার সূত্রটা কেটে গেল। তার আব্বা বলছিল, ‘কি মা কিছু বলছ না যে?’
‘ভাবছিলাম আব্বা’
‘কি ভাবছিলে?’
‘প্রকৃত ঘটনা জানা না থাকলে কত অমূলক সন্দেহ মানুষ করে।’
‘কি রকম? বলল ন্যান্সির আব্বা দানিয়েল ময়নিহান।
‘আব্বা ঘটনা হলো, বরিস নিক্সন এদিক দিয়ে যাচ্ছিল, আমিই ডেকে তাকে বাড়িতে নিয়ে এসেছিলাম। হ্যারিও ছিল আর আব্বা, বরিস আমাদের ফিলিফ আংকলকে চেনেই না। তাকে খুন করতে যাবে কেন সে? গেটের নিরাপত্তা প্রহরীদের কাছে আপনি নিশ্চয় শুনেছেন এবং পুলিশও বলেছে, খুনিদের প্রথম টার্গেট ছিল ফিলিফ। সেখান থেকে এসেছে হ্যারির এখানে। আপনার বন্ধুর কথা সত্য হলে আব্বা, তাদের আক্রমণের শিকার আমরা হতাম, ফিলিফ নয় এবং ঐ কথা সত্য হলে ফিলিফ হত্যার কোন যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। আব্বা, আর এই হত্যার দায় যদি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে আপনার উপর চাপাতে চাইত আপনাকে বিপদে ফেলার জন্যে তাহলে খুনিরা হ্যারিকে কিডন্যাপ করতো না এবং সকলকে সংগাহীনও করতো না।
‘তোমার কথার যুক্তি আছে মা। তাহলে এই খুন ও কিডন্যাপের মটিভ কি, কারা খুন করেছে?’
‘আমার বিশ্বাস আব্বা, খুব শীঘ্রই তা জানা যাবে এবং খুনিরাও চিহ্নিত হবে।’
‘এত নিশ্চিত করে বলছ কি করে মা?’
‘আমার মন বলছে আব্বা’
ন্যান্সি থামলেও ন্যান্সির আব্বা সংগে সংগে কিছু বলল না। ভাবছিল। একটু পর বলল, ‘তবু সব কিছু পরিস্কার হওয়ার আগে বরিসকে এখানে আসতে নিষেধ করো মা। আমি চাই না এনিয়ে কোন কথা উঠুক এবং তুমি তাতে জড়িয়ে যাও।’
‘ঠিক আছে আব্বা তাকে বলে দিচ্ছি। কিন্তু আমি তার সাহায্য চেয়েছি। আপনি জেনেছেন সে ‘ফ্রি আমেরিকা’ মুভমেন্টের সাথে আছে। হ্যারিকে উদ্ধার করার ব্যাপারে তারা কিছু করতে পারে।’
‘কেউ যদি সাহায্য করে আমাদের আপত্তি থাকবে কেন? কিন্তু ‘ ফ্রি আমেরিকা’ এটা করছে, তা বলার দরকার নেই। একটা কথা তোমাকে বলি মা, ভেতরের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভাল নয়। প্রেসিডেন্ট এবং তার প্রশাসন একজন কূখ্যাত মৌলবাদীকে রক্ষা করার জন্যে ইহুদীদের বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লেগেছে। এটা আমেরিকার স্বার্থের পরিপন্থী। আমেরিকার এই স্বার্থ বিরোধী কাজে প্রেসিডেন্টকে যারা সাহায্য করছে তাদের মধ্যে ‘ফ্রি আমেরিকা’ মুভমেন্টও রয়েছে। সুতরাং ‘ফ্রি আমেরিকা’ মুভমেন্ট বা তার কোন লোকের সংস্পর্শে যাওয়া আমাদের ঠিক হবে না। যেহেতু দেশের প্রতি আমার একটা বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে তাই দেশের স্বার্থেই আমাকে প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে যেতে হচ্ছে। এ সময় ‘ফ্রি আমেরিকার’ সাথে আমাদের কোন প্রকার সংশ্লিষ্টতা আমার রাজনীতির ক্ষতি করবে।’
ন্যান্সি বুঝল, তার পিতা তার রাজনীতিকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। প্রকৃত ব্যাপার তার আব্বাকে বুঝাতে চেষ্টা করবে কি ন্যান্সি? কিন্তু না, তা করতে গেলে বিপরীত ঘটতে পারে। তবু ন্যান্সি বলল, ‘মাফ করবেন আব্বা, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কি রকম সে বিষয়ে আমি খুব বেশি জানি না। কিন্তু তবু আমি বলব একজন মুসলিম মৌলবাদী এসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ও তার প্রশাসনকে তার পক্ষে নিয়ে যাবে, আপনাদের মত শীর্ষ পর্যায়ের আমেরিকান বিবেককে নিশ্চয় এত ছোট, এত ভংগুর করে আপনি দেখবেন না।’
ভ্রু কুঞ্চিত হলো দানিয়েল ময়নিহানের। ভাবল সে। তারপর তার চোখে ফিরে এল মুগ্ধ দৃষ্টি। বলল ন্যান্সিকে, ‘তুমি যা বলেছ মা যুক্তির দিক দিয়ে তা ঠিক। কিন্তু যুক্তিতে আসে না, এমন দুর্ঘটনা রাজনীতিতে ঘটতে পারে। যখন এ ধরনের পরিস্থিতি আসে, তখন ঘটেনি প্রমাণ হওয়ার আগ পর্যন্ত ঘটেছেই ধরে নিতে হবে।’
‘কিন্তু সেক্ষেত্রে আমি মনে করি আপনাদের মত শীর্ষ রাজনীতিকরা কোন এক পক্ষে জড়িয়ে না পড়ে সত্য উদ্ধারে সচেষ্ট হওয়া উচিত।
হাসল দানিয়েল ময়নিহান। বলল, ধন্যবাদ ন্যান্সি। তুমি যা বলেছ সাধারণভাবে তা ঠিক। কিন্তু যখন যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়, তখন এই ধরনের নিরপেক্ষতা সত্যের ক্ষতি করতে পারে। এই ধরনেরই পরিস্থিতি আজ। তবু তুমি যা বলেছ তা মনে রাখব মা। সত্য অনুসন্ধানে আমি চেষ্টা করব। প্রেসিডেন্টের পক্ষের বক্তব্যও আমি শোনা ও বুঝার চেষ্টা করব।
‘ধন্যবাদ আব্বা।’ বলে একটু দম নিল ন্যান্সি। তারপর বলল, ‘তাহলে হ্যারির ব্যাপারে আমরা কি করছি আব্বা?’
‘সব কিছুই করব মা। পুলিশ তো কাজ করছেই। এই মাত্র FBI চীফ জর্জ আব্রাহাম জনসন আমাকে টেলিফোন করেছিলেন। তিনি শুনেছেন সব। বললেন তিনি, আমরা কাজ শুরু করেছি। এফ বি আই এর একটা টীম যাচ্ছে আপনাদের ওখানে। আমিও আসব। কিছু তারা আঁচ করেছেন কি না আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি বললেন, কোন পথে আমাদের এগুতে হবে সেটা আমাদের কাছে পরিস্কার হয়ে গেছে এবং কতটা এগুতে পারছি, আপনাকে সব জানাব।’
‘জর্জ আব্রাহাম খুবই ভালো মানুষ আব্বা। আমাদের ক্লাসে কানাডার একজন ভিজিটিং প্রফেসর ‘লয়ালটি টু নেশন ইন ক্রাইসিস’ (সংকটের মুখে জাতীয় আনুগত্য) বক্তৃতায় জর্জ আব্রাহাম জনসনের নাম দিয়ে বলেছিলেন, এরা দেশ প্রেমের ক্লাসিকাল দৃষ্টান্ত। এঁদের দেশ প্রেমের নিকট ব্যক্তি স্বার্থ, স্বজন প্রীতি, গোষ্ঠী চিন্তা সবই কুরবানী হয়ে যায়।’
‘আমিও তাই জানতাম মা। প্রেসিডেন্ট যখন FBI চীফ হিসেবে তাঁর নাম প্রস্তাব করেন, তখন আমিই তাকে সবচেয়ে বেশি সমর্থন দিয়েছিলাম। কিন্তু একজন মৌলবাদী আহমদ মুসা কেমন করে তাঁকে গিলে ফেলল তাই বুঝছি না।’ বলল দানিয়েল ময়নিহান নরম কন্ঠে।
‘আব্বা, এটাই আগে বুঝার চেষ্টা করলে হয়তো জর্জ আব্রাহাম সম্পর্কে আজ আপনার ভিন্ন ধারণার সৃষ্টি হতো না।’
ন্যান্সি থামলেও সংগে সংগে কথা এল না দানিয়েল ময়নিহানের মুখে। ভাবছিল। হাসল সে অবশেষে। বলল, ‘ধন্যবাদ ন্যান্সি। তুমি সত্যিই আমার মা। মায়ের বকুনি আমি গ্রহণ করলাম। আগে না হলেও এখন আমি ব্যাপারটা বুঝার চেষ্টা করব।’
‘ধন্যবাদ আব্বা। আমি………।’
ন্যান্সির কথার মাঝখানেই কথা বলে উঠল দানিয়েল ময়নিহান। বলল, ‘আরেকটা খবর ন্যান্সি। এদিকের কিছু খবর আগামীকাল নিউজ পেপার ও টেলিভিশন নেটওয়ার্কে আসছে। সেটা উপলক্ষ করে ওদিকের প্রকৃত ব্যাপার আমার জানার বিষয়টা খুবই প্রাসঙ্গিক হবে।’
‘ঠিক তাই আব্বা।’ বলে একটু থেমেই অনুমতি প্রার্থনা করল, ‘আমি তাহলে উঠি আব্বা!’
‘এস।’ বলল তার আব্বা।
ন্যান্সি উঠে দাঁড়িয়ে চলে যাচ্ছিল।
‘ন্যান্সি শুন।’ পেছন থেকে ডেকে উঠল দানিয়েল ময়নিহান।
ফিরে দাঁড়াল ন্যান্সি।
‘দেখ মা, বরিস নিক্সন ছেলেটাকে আমি খুব ভালো মনে করি। আমি যেটা বলেছি, সেটা রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথা।’ দানিয়েল ময়নিহানের মুখে মিষ্টি হাসি।
ন্যান্সির মুখ রাঙা হয়ে উঠল। ঠোঁটে ভেসে উঠল সলজ্জ এক টুকরো হাসি। বলল, ‘অনেক ধন্যবাদ আব্বা।’
বলেই ঘুরে দাঁড়িয়ে ছুটে পালাল সে।

বেরুবার জন্যে প্রস্তুত হয়ে বসে আছে আহমদ মুসা। আজ ওয়াশিংটনে ফিরছে সে। অপেক্ষা করছে আহমদ মুসা সারা জেফারসনের জন্যে।
ঘুরে ঢুকল জিনা জেফারসন, সারা জেফারসনের মা।
‘খালাম্মা, মিস জেফারসন কোথায়? আমি ওর জন্য অপেক্ষা করছি।’
হাসল জিনা জেফারসন। বলল, ‘ওর মনটা বোধ হয় খারাপ। দেখলাম, ফ্যামেলি এ্যালবামের পাতা উল্টাচ্ছে।’
‘মন খারাপের সাথে এ্যালবামের কি সম্পর্ক? জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা। আহমদ মুসার মুখেও হাসি।
‘হ্যাঁ, ওর মন খারাপ হলে সে ফ্যামিলি এ্যালবামের পাতা উল্টায়।’
‘চমৎকার। তার মানে তখন তিনি অতীতমুখী হন অথবা যারা ছিলেন কিন্তু এখন নেই, তাদের দৃষ্টান্ত সামনে এনে সান্তনা খোঁজেন। আহমদ মুসা বলল।
‘তাই হবে।’ জিনা জেফারসন বলল।
‘কিন্তু মন খারাপ হলো কখন, এইতো তার সাথে কথা বললাম?
‘সব ব্যাপারেই সে শক্ত, কিন্তু কাউকে বিদায় দেয়ার ব্যাপারে খুব নরম। আজ মনে হচ্ছে বেশি নরম হয়ে পড়েছে। তার উপর তোমাকে সে আরও একদিন থেকে যেতে বলেছিল, থাকছ না। শুধু তার কেন, আমারও মনটা খারাপ। আমি সবার মুখের হাসি দেখতে চাই। তার মনে যে আনন্দ দেখতে চাই, তুমি আসার পর গদ দুদিন আমি তা দেখেছি। ভয় হচ্ছে তুমি চলে যাবার পর আবার তার সেই বয়সোত্তার গাম্ভীর্য ফিরে আসে কি না।
মুখের আলো হঠাৎ নিভে গেল আহমদ মুসার। এখানে আসার পর থেকে যে অস্বস্তিটা তাকে পীড়া দিচ্ছে, সেটা আবার জেগে উঠল তার মনে। একটা বিব্রতকর ভাব ফুটে উঠল তার চেহারায়।
আহমদ মুসা কি বলবে তা খুঁজছিল। এমন সময় ঘরে প্রবেশ করল সারা জেফারসন।
তার মুখে হাসি। কিন্তু তার চোখে দুটো হাসছে না। কালো বিষণ্ণতা সেখানে। ঘরে ঢুকেই সে বলল, ‘স্যরি একটু দেরী হয়ে গেল।’
আহমদ মুসা কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই সারা জেফারসনের মা বলে উঠল, ‘বেটা আহমদ মুসা, সারাকে বলে যেও মায়েরা সব সময় সন্তানের হাসিমুখ দেখতে চায়।’
সারা জেফারসন মিষ্টি হেসে মায়ের দিকে তাকাল। বলল, ‘কি কথা বলছ মা, আমি কি হাসি না?’
‘বেটি সারা, যখন তুমি তোমার মত একজন সন্তানের মা হবে, তখন বুঝবে সেই সন্তানের মুখে মা কি ধরনের হাসি দেখতে চায়। গত দুদিন তোমার যে হাসি, তোমার যে পরিতৃপ্ত চোখ, তোমার যে আনন্দ-রাঙা মুখ দেখেছি, তা আমি হারাতে চাই না। আমি সে কথাই আহমদ মুসাকে বলছিলাম।’ সন্তান বাৎসল্যের গভীর আবেগ জিনা জেফারসনের কন্ঠকে ভারী করে তুলেছিল।
লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠেছে সারা জেফারসনের মুখ। সেই সাথে কিছুটা বিব্রত ভাবও। তার মা তাকে এতটা নগ্ন করে দেবে সে ভাবেনি। এমন ক্ষেত্রে সব মা বোধ হয় এমন পাগল হয়ে যায়!
লজ্জায় ভারী হয়ে ওঠা সারা জেফারসনের দুটি চোখ জোর করেই ছুটে গেল আহমদ মুসার মুখের উপর। সে দৃষ্টি যেন ছড়িয়ে দিল অশরীরী অজস্র চুম্বন। একটা যন্ত্রণার প্রশান্তি নেমে এল সারা জেফারসনের কম্পিত বুকে।
কিন্তু আহমদ মুসার আনত চোখের বদ্ধ দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে সারা জেফারসনের সে দৃষ্টি অবশেষে ফিরে এল। তার শুকনো ঠোঁটে ফুটে উঠল এক টুকরো বেদনার হাসি। বলল, ‘আম্মা তুমি তো ওঁকে জান। ওঁর পৃথিবী কত বড়! একজনের মুখের হাসি উনি দেখবেন এমন আশা করা ওর প্রতি অবিচার।’
‘কিন্তু মা, আহমদ মুসা যখন সন্তান হিসেবে সামনে আসে তখন মায়ের কোন দাবীই অবিচার নয়।’ বলল জিনা জেফারসন, সারা জেফারসনের মা।
কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছিল আহমদ মুসা ও সারা জেফারসন দুজনেই। এ সময় এ দিনের দৈনিক কাগজগুলো নিয়ে প্রবেশ করল পরিচারিকা।
সবাই সেদিকে তাকাল।
আহমদ মুসা ও সারা জেফারসনের কথা তাদের মুখেই থেকে গেল।
পরিচারিকা ঘরের মধ্যে এসে কাগজগুলো সারা জেফারসনের হাতে দিয়ে বেরিয়ে গেল।
অনেক কয়টা দৈনিক। সবার উপরে ছিল ‘ওয়াশিংটন পোস্ট।’
ওয়াশিংটন পোস্টের প্রধান শিরোনানের উপর আঠার মত লেগে গেল সারা জেফারসনের চোখ। প্রধান শিরোনামের উপরে লাল অক্ষরে একটা শোল্ডার। তারপর কালো অক্ষরে প্রধান শিরোনাম চার কলামব্যাপি। প্রধান শিরোনামের নিচে নিল কালিতে আরেকটা শোল্ডার। পড়ল সারা জেফারসন উপরের শোল্ডারে, ‘মৌলবাদী আহমদ মুসার কালো হাত এবার আমেরিকায়।’ আর প্রধান শিরোনাম পড়ল, ‘প্রেসিডেন্ট এবং তার প্রশাসন মদদ দিচ্ছে সন্ত্রাসে।’ বটম শোল্ডারের লেখা পড়ল সারা জেফারসন, ‘মানবতাবাদী আমেরিকায় ভয়াবহ এ্যান্টি সেমেটিক ষড়যন্ত্র।’
পড়ে কেঁপে উঠল সারা জেফারসন। তার মুখের সব আলো এক সংগে দপ করে নিভে গেল। সেখানে ঝড়ের বেগে নেমে এল উৎকন্ঠা ও উদ্বেগের কালো ছায়া।
সারা জেফারসন দ্রুত একে একে ‘নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়ালষ্ট্রিট জার্নাল ও নিউইয়র্ক পোষ্টে’র উপর নজর বুলাল। ঐ একই বিষয়ের লিড শিরোনাম সব পত্রিকায়। হেডিং ভিন্ন ভিন্ন কিন্তু একই কথা বলেছে চারটি পত্রিকাই।
হাত কাঁপছে সারা জেফারসনের। কাঁপছে গোটা শরীর। চোখে অন্ধকার দেখছে সারা জেফারসন।
আহমদ মুসা লক্ষ্য করছিল সারা জেফারসনের এই পরিবর্তন এবং এও বুঝেছিল পত্রিকার কোন খবর পড়েই তার এই অবস্থা।
তাড়াতাড়ি আহমদ মুসা হাত বাড়াল সারা জেফারসনের দিকে পত্রিকাগুলো নেয়ার জন্যে।
সারা জেফারসন তাকাল আহমদ মুসার দিকে।
রাজ্যের সব উৎকন্ঠা, উদ্বেগ এসে যেন বাসা বেধেছে সারা জেফারসনের চোশে, দেখল আহমদ মুসা।
সারা জেফারসন কম্পিত হাতে তুলে দিল পত্রিকাগুলো আহমদ মুসার হাতে।
ওয়াশিংটন পোষ্ট-এর লীড নিউজের উপর চোখ পড়তেই চমকে উঠল আহমদ মুসা।
দ্রুত আহমদ মুসা চারটি দৈনিকের উপরই চোখ বুলাল।
ওয়াশিংটন পোষ্ট ও নিউইয়র্ক টাইমস নিউজটিকে লীড করেছে। কিন্তু ওয়ালষ্ট্রিট জার্নাল ও নিউইয়র্ক পোষ্ট নিউজটিকে যথাক্রমে চতুর্থ ও তৃতীয় প্রধান শিরোনাম হিসেবে ছেপেছে।
নিউজটা দেখে প্রথমে চমকে উঠেছিল আহমদ মুসা। কিন্তু তা পরক্ষণেই দূর হয়ে গেল। ঠোঁটে তার ফুটে উঠল হাসি।
আহমদ মুসার দিকে তাকিয়েছিল সারা জেফারসন। আহমদ মুসার ঠোঁটে হাসি ফুঠে উঠতে দেখে বিস্ময় ফুটে উঠল তার চোখে। বলল, ‘আপনার ঠোঁটে হাসি দেছি। সত্যিই কি আপনি হাসছেন?’
সারা জেফারসনের প্রশ্নের ধরন দেখে আহমদ মুসা সশব্দে হেসে উঠল। বলল, ‘হাসির পেছনে অনেক সময় কান্না থাকে। আমার হাসির পেছনে কান্না নেই। সুতরাং এটা হাসিই।’
‘আমি বুঝতে পারছি না। এ নিউজে হাসার কিছু আছে? আমি কিন্তু উদ্বিগ্ন।’ বলল সারা জেফারসন শুকনো কন্ঠে।
‘নিউজে হাসির কিছু নেই। কিন্তু শত্রুর শেষ কথা, শত্রুর শেষ পদক্ষেপ জেনে ফেলার মধ্যে আনন্দ আছে। আমি সেই আনন্দেই হেসেছি।’
‘আমাকে উপলক্ষ বানিয়ে প্রেসিডেন্টের উপর প্রচন্ড রাজনৈতিক প্রেসার সৃষ্টি করা, যাতে করে তিনি ইহুদীবাদীদের বিরুদ্ধে সকল প্রকার তদন্ত থেকে বিরত থাকেন। যদি প্রেসিডেন্ট এতেও বিরত না হন, তাহলে প্রেসিডেন্টকে ইমপীচ পর্যন্ত তারা অগ্রসর হবে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘অতদূর পর্যন্ত তারা যাবে?’ সারা জেফারসনের কন্ঠে বিস্ময়।
‘সে প্রস্তুতি না থাকলে তারা প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে এভাবে যুদ্ধ ঘোষণা করতো না।’ আহমদ মুসা বলল।
সারা জেফারসন সংগে সংগেই কিছু বলল না। ভাবছিল সে। বলল, ‘নিউজ না পড়েই তোমরা আলোচনা শুরু করেছ। আমি পড়ছি তোমরা শোন। হেডিং যত বড় নিউজটা তত বড় নয়।’
বলে পড়ে শুরু করল জিনা জেফারসনঃ
‘‘আমেরিকায় অনুপ্রবেশকারী মৌলবাদী সন্ত্রাসী নেতা আহমদ মুসা ইহুদীদের প্রতি তার স্বভাব-বিদ্বেষ দ্বারা তাড়িত হয়ে এবং আমেরিকান স্বার্থের ক্ষতি ও তার আভ্যন্তরীণ শান্তি বিনষ্ট করার লক্ষ্যে ইহুদী কম্যুনিটি ও মার্কিন প্রশাসনের মধ্যে বিভেদ ও সংঘাত সৃষ্টির হীন ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে।
ইহুদীদের বিরুদ্ধে অমুলক একটি অভিযোগ দাঁড় করিয়ে এবং অদ্ভুত কৌশলে রক্তক্ষয়ী ও ধ্বংসাত্মক ঘটনা একের পর এক সৃষ্টি করে তারও দায় ইহুদী কম্যুনিটির উপর চাপিয়ে দেশে বড় ধরনের দ্বন্দ্ব-সংঘাত সৃষ্টি করতে চায়।
দৃষ্টান্ত তুলে ধরতে গিয়ে সূত্র বলছে, কৌশলগত গবেষণাগার ‘লস আলামোসে’র একটা এমারজেন্সী এক্সিট সুড়ঙ্গ রয়েছে, এই সুড়ঙ্গকে আহমদ মুসা ইহুদীদের তৈরি গোয়েন্দা সুড়ঙ্গ হিসাবে মার্কিন প্রশাসনের কাছে তুলে ধরেছে।
এই অভিযোগ তোলার পর পরই বড় ধরনের দুটি সন্ত্রাসী ঘটনা সে ঘটিয়েছে। লস আলামোসে সুড়ঙ্গ বিষয়ে তদন্তে যাওয়া উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত টীমটি যখন ফিরছিল, তখন লস আলামোস ও সান্তাফে’র মধ্যবর্তীস্থানে এক সন্ত্রাসী ঘটনার মাধ্যমে টীমের সাথে সফররত ৬ জনেরও বেশি নিরাপত্তা প্রহরীকে হত্যা করা হয়। উল্লেখ্য এই তদন্ত টীমের সাথে আহমদ মুসাও ছিল। আহমদ মুসা ও টীম সদস্যরা অক্ষত থাকল, কিন্তু নিহত হল হতভাগ্য নিরাপত্তা প্রহরীরা।
অনুরূপভাবে সান্তা ফে’ বিমান বন্দর থেকে যে বিমানে করে টীম সদস্যরা ওয়াশিংটনে ফেরার কথা, সে বিমানও যাত্রার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে বিস্ফোরনে ধ্বংস হয়। এবারও আহমদ মুসা ও টীম সদস্যরা অক্ষত থাকলেন, ধ্বংস হয়ে গেল বিমান।
সূত্রমতে দুটি ঘটনাই সন্ত্রাসী আহমদ মুসা ঘটিয়েছে সুপরিকল্পিতভাবে এবং এর দায় তুলে দিয়েছে ইহুদী কম্যুনিটির কাঁধে। তার মতলব মার্কিন প্রশাসনকে এটা বুঝানো যে, লস আলামোস সুড়ঙ্গ তন্দন্তে যাওয়া টীমকে ইহুদীরা ধ্বংস করতে চেয়েছে তাদের ফাইল্ডিং ধামা চাপা দেয়ার জন্যেই।
সূত্রমতে, আহমদ মুসার পরিকল্পনা ও কৌশল পুরোপুরিই কার্যকরী হয়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ও প্রশাসনের উপর। শৃগালের মত ধূর্ত আহমদ মুসা সম্মোহিত করেছে প্রেসিডেন্টকে, সি আই এ ও এফ বি আই চীফকে এবং মার্কিন প্রশাসনের একটা অংশকে।
আহমদ মুসাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা দিতে এগিয়ে এসেছে ইহুদী বিদ্বেষী ‘ফ্রি আমেরিকা’ মুভমেন্ট এবং জানা গেছে গোল্ড ওয়াটারের ‘হোয়াইট ঈগল’ ও আহমদ মুসার পক্ষে যোগ দিয়েছে।
এ সবের পেছনে পেট্রোডলার বিরাট ভূমিকা পালন করছে বলে সূত্র মনে করছেন।
বলা হচ্ছে, আহমদ মুসা গোটা পরিকল্পনার লক্ষ্য হলো, ঘরে সংঘাত বাধিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে দুর্বল করে ও তাঁর আকাশ স্পর্শী ইমেজকে ধ্বংস করে দিয়ে আমেরিকার বিশ্ব নেতৃত্বের আসন কেড়ে নেয়া ও তার নতুন বিশ্ব গড়ার মহান স্বপ্নকে বানচাল করা।
এই অবস্থায় দেশের মান, ইজ্জত ও ভবিষ্যত রক্ষার জন্যে সচেতন সকলেই মৌলবাদী সন্ত্রাসী নেতা আহমদ মুসা এবং আমাদের প্রেসিডেন্ট ও তার প্রশাসনের মধ্যেকার সর্বনাশা হানিমুনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবেন বলে ওয়াকিফহাল মহল মনে করেছেন’’
পড়া শেষ করে জিনা জেফারসন বলল, ‘বাকি তিনটি পত্রিকাতেও দেখা যাচ্ছে একই রিপোর্ট এসেছে। শব্দের কিছু পার্থক্য আছে, বক্তব্যে তেমন কিছু পার্থক্য নেই।’ বলছিল আর কাগজগুলোর উপর নজর বুলাচ্ছিল জিনা জেফারসন।
পড়া শেষ হলে সারা জেফারসন তাকাল আহমদ মুসার দিকে সম্ভত প্রতিক্রিয়া হিসাবে আহমদ মুসা কি বলে তা জানার জন্যেই।
নিউজ শুনে উদ্বেগ আরও বেড়ে গিয়েছিল সারা জেফারসনের। প্রেসিডেন্ট এবং প্রশাসনকেও নিউজে এইভাবে আক্রমণ করা হবে তা সারা জেফারসনের কাছে অকল্পনীয় ছিল। যা নিউজ হয়েছে তাতে এখন প্রেসিডেন্টকে আত্মরক্ষার জন্যে ব্যতিব্যস্ত হতে হবে এবং বলতে হবে আহমদ মুসার সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই, তাঁর প্রশাসনও আহমদ মুসাকে কোন সহযোগিতা করছে না। এমনকি দোষ স্থালনের জন্যে আহমদ মুসাকে সরকার গ্রেফতারও তো করতে পারে। এ সব ভাবতে ভাবতে বুকের কাপুনি সারা জেফারসনের আরও বেড়ে গেল। আহমদ মুসার উপর নিবদ্ধ তার দৃষ্টি অসহায় হয়ে উঠেছে।
আহমদ মুসা চোখ বন্ধ করে জিনা জেফারসনের পড়া শুনছিল।
পড়া শেষ হলে চোখ খুলল আহমদ মুসা।
জিনা জেফারসন কথা শেষ করতেই আহমদ মুসা বলে উঠল ‘খালাম্মা একটু দেখুন, কোন কাগজে এ ঘোষণা আছে কিনা যে, আজ কোন সময় বি বি এস (CBS) এন বি সি (NBC), এ বি বি (ABC)-দের কেই অথবা সকলেই মৌলবাদী সন্ত্রাসী নেতা আহমদ মুসা ও প্রেসিডেন্ট প্রশাসন ইহুদীদের বিরুদ্ধে যে যোগসাজস করেছে তার কাহিনী প্রচারিত হবে।
জিনা জেফারসন চোখ বুলাচ্ছিল ওয়াশিংটন পোষ্টের প্রথম পৃষ্ঠায়। সে চিৎকার করে উঠল, ‘বেটা তুমি কি ভবিষ্যত রক্তা নাকি? এই তো দেখ সেই বিজ্ঞপ্তি। এখানে বলা হয়েছে, আজ রাত ৭টা ও ১১টায় সি বি এস, এন বি সি ও এ বি সি’র ‘বিশেষ অনুসন্ধান’ প্রোগ্রামে আমেরিকায় অনুপ্রবেশকারী মৌলবাদী ও সন্ত্রাসী নেতা আহমদ মুসার ধ্বংসাত্মক তৎপরতা সম্পর্কে বিশেষ রিপোর্ট প্রচারিত হবে।’
‘বিজ্ঞপ্তিটি কে দিয়েছে খালাম্মা? কার নাম লেখা, কার বরাত দেয়া হয়েছে বিজ্ঞপ্তিতে? জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা। ‘বিজ্ঞপ্তির একেবারে বটমে মাত্র তিনটি অক্ষল ‘EMC’ ছাপা হয়েছে।’ বলল জিনা জেফারসন।
‘EMC মানে Electronic Media Club’ এটা ইহুদী গোয়েন্দা সংস্থা পরিচালিত ক্লাব যা টিভি নেটওয়ার্কগুলোর উপর চোখ রাখে, বিভিন্ন অনুষ্ঠান প্রমোট করে, আবার তাদের স্বার্থের পরিপন্থী কোন অনুষ্ঠান কোনভাবে প্রচারিত হয়ে গেলে তার বিরুদ্ধে জনমত সমীক্ষার মাধ্যমে বিরুদ্ধ জনমতের প্রকাশ ঘটায়।’
‘তার মানে আপনি বলছেন তিনটি টিভি নেটওয়ার্কে যে অনুষ্ঠান প্রচার হতে যাচ্ছে, তা ইহুদীবাদীরাই প্রমোট করতে যাচ্ছে।’ জিজ্ঞেস করল সারা জেফারসন।
‘অবশ্যই।’
‘নিউজ পেপারের এ নিউজগুলোর ক্ষেত্রেও তো তাহলে একই কথা?’ বলল সারা জেফারসন।
‘তাই।’ আহমদ মুসা বলল।
প্রশ্নটা করেই চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়েছে সারা জেফারসন। তার মুখ শুকনো। আট-ঘাট বেধেই এবার যুদ্ধে নেমেছে ইহুদীবাদীরা। ‘ফ্রি আমেরিকা’ মুভমেন্ট ও ‘হোয়াইট ঈগল’ কাউকেই ছাড়েনি। সবার বিরুদ্ধেই যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। আর অত্যন্ত নাজুক ফ্রন্টে তারা যুদ্ধ শুরু করেছে। তাদের মিডিয়া ফ্রন্টে যুদ্ধ শুরু করার অর্থ তারা রাজনৈতিক যুদ্ধ শুরু করেছে। আর ওরা মিডিয়া ও রাজনীতি দুই ফ্রন্টেই শাক্তিশালী। সুতরাং যুদ্ধে জিততে হলে এখন প্রচুর কাজ করতে হবে। কি করতে হবে সেটাও সিনেমার পর্দার মত তার সামনে উদয় হতে লাগল। ওদের মিডিয়া অফেনসিভের বিরুদ্ধে তাদেরকেও অফেনসিভে যেতে হবে। কিন্তু মিডিয়া অফেনসিভে যেতে হবে, এটা যেমন সত্য, তেমনি এটা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে এটাও সত্য। কারণ, মিডি…..।
চিন্তা আর এগুতে পারল না সারা জেফারসনের। আহমদ মুসার কথায় ছিন্ন হয়ে গেল তার চিন্তাসূত্র।
আহমদ মুসা বলছিল, ‘কি ভাবছেন মিস জেফারসন?’
চিন্তার জগত থেকে ফিরে এল সারা জেফারসন। কিন্তু মুখটা তার ম্লান হয়ে গেছে আহমদ মুসার সম্বোধন শুনে। ‘মিস’ সম্বোধন আহমদ মুসার কাছ থেকে এলে বুকের কোথায় যেন লাগে তার। মনে হয় তার বুকের কোন নরম তন্ত্রীতে নির্দয় এক চাবুক যেন আঘাত হানছে।
বেদনা কম্পিত এক টুকরো হাসি ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল সারা জেফারসনের ঠোঁট থেকে। সে চোখ তুলল আহমদ মুসার দিকে। হাসল। নির্মল হাসি। বলল, ‘কি ভাবছি বলুন তো?’
‘ফ্রি আমেরিকা’ নেত্রীর যা ভাবা উচিত।’ গম্ভীর কন্ঠ আহমদ মুসার।
‘একটা বিষয় ভাবতে পেরেছি। সেটা হলো আমাদের কাউন্টার অফেনসিভে যেতে হবে। মিডিয়া ওয়ার দিয়ে মিডিয়া ওয়ারের মোকাবিলা। কিন্তু যুদ্ধে রসদ কি হবে আমার মাথায় আসেনি।’
বলে মুহূর্তের জন্যে থামল সারা জেফারসন। মুখটা একটু নিচু করল। তারপর বলে উঠল, ‘আপনার নির্দেশ চাচ্ছি।’
আহমদ মুসার চোখ ছিল নিচু। চোখ তুলল সে সারা জেফারসনের দিকে। বলল, ‘ফ্রি আমেরিকা’র নেত্রীকে নির্দেশ?
‘না, সারাকে।’
‘সারা এবং ফ্রি আমেরিকার নেত্রী কি আলাদা?’
‘তা নয়। কিন্তু সারা ফ্রি আমেরিকার নেত্রী বলে নির্দেশ দিতে পারেন।’
সারা জেফারসনের এই একান্ত ‘নারী’ রূপের প্রকাশ আহমদ মুসাকে বিব্রত করে তোলে। এই পুরানো বিব্রতকর অবস্থা বুক বেয়ে আহমদ মুসার চোখে-মুখে উঠে আসতে চাইল। সামলে নিয়ে আহমদ মুসা বলল, ‘মিস জেফারসন মিডিয়া অফেনসিভের জন্যে মিডিয়া কি আপনার আছে? আমাদের সামনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই যে চারটি শীর্ষ জাতীয় দৈনিক রয়েছে। এদের দুটির মালিকানায় ইহুদী আধিপত্য রয়েছে, অবশিষ্ট দুটিতে শীর্ষ কয়েকটি পদে ইহুদী স্বার্থের প্রতি কমিটেড সাংবাদিক কাজ করছে। যে তিনটি চ্যানেল আজ রাতে আমাদের নিয়ে অনুষ্ঠান প্রচার করছে, সে তিনটি টিভি চ্যানেলের মালিকানাতেও ইহুদী আধিপত্য বর্তমান।’
হাসলা সারা জেফারসন। বলল, ‘আমাদের আলাদা কোন মিডিয়া নেই, তবে সব আমেরিকান মিডিয়াই আমাদের মিডিয়া। আমেরিকার পক্ষে তাদের অবশ্যই কাজ করতে হবে।’
‘এটা তো তত্ত্ব কথা, মিস জেফারসন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘প্রত্যেক বাস্তবতা প্রাসাদ একটা করে তাত্ত্বিক ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে থাকে।’ সারা জেফারসন বলল।
‘ঠিক।’
‘ঠিক বলে কথা শেষ করলে চলবে না জনাব। অভিযোগের শক্ত জবাব চাই। আমার মাথায় কিছু নেই। যা আদেশ হবে তাই করব।’
‘বড়দের বিনয় তাদের আরও বড় করে।’ বলল আহমদ মুসা হাসি মুখে।
‘তর্ক করব না। কারণ তর্কেও পারব না।’
বলে একটু থেমে কিছু বলার জন্যে আবার মুখ খুলেছিল, এ সময় তার টেলিফোন থেকে কল সিগন্যাল এল। তাড়াতাড়ি টেলিফোন তুলে নিল সারা জেফারসন।
টেলিফোন ধরেই বলল, ‘গুড মর্নিং মি. বেকন।’
ওপারের কথা শুনে বলল, ‘অডিও টেপ কার?’
ওপারের উত্তর শুনে বলল আবার,‘ ব্রাভো! নাইস। কোথায় পেলেন?’
‘মিরাকল’ শুনেছেন আপনারা টেপটা?
‘বিষয়টা বলুন।’
‘থ্যাংকস গড। কিন্তু পেলেন কি করে?’
‘হ্যাঁ, ঘটনাটা আমি পত্রিকায় পড়লাম। ঘটনার ব্যাকগ্রাইন্ড তাহলে এটাই? বেচারাকে যে কোন মূল্যে উদ্ধার করতে হবে। বলেছেন বিষয়টা জর্জ আব্রাহামকে?
‘বলে ঠিক করেছেন।’
‘হ্যাঁ, এইমাত্র পড়লাম। ওঁর সাথে আমি এ বিষয় নিয়েই আলাপ করছিলাম।’
‘হ্যাঁ, আমরা এটাই চিন্তা করছি। মিডিয়ার মাধ্যমেই ওদের এক্সপোজ করতে হবে। কাজে নেমে পড়ুন এখনি। আমাদের মিডিয়া-সদস্যদের নিয়ে বসুন। কাগজ গুলোর কালকের ইস্যুতেই স্টোরি আনতে হবে। কি করতে হবে আপনারা করুন। আমি জর্জ আব্রাহাম, এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার, জেনারেল ওয়াশিংটন সবার সাথেই কথা বলল।’ ‘না, এ্যান্ড্র জ্যাকবস ও মি. ময়নিহানের সাথে কথা বলতে হবে। আমাদের নিউজটা বেরুবার পর। ইতিমধ্যে হ্যারিকে উদ্ধার করার চেষ্টা করতে হবে।
‘মিডিয়াতে আমরা কি বলল, ওটা আমি জানি না। আপনার স্যারের সাথে কথা বলুন। তাঁকে দিচ্ছি আমি।’
বলে সারা জেফারসন টেলিফোন আহমদ মুসার হাতে দিল।
আহমদ মুসা টেলিফোন ধরে বলল, ‘ওয়া আলাইকুম সালাম। মি. বেঞ্জামিন কেমন আছেন?
ওপারের কথা বেশ কিছুক্ষণ শুনল আহমদ মুসা। তারপর বলল ‘ঠিক আছে সব জেনে নেব আমি মিস জেফারসনের কাছ থেকে মিডিয়ায় বক্তব্যের কথা বলছ? আমি চিন্তা করছি। ইতিমধ্যে কিছু কাজ করতে হবে। যেমন, লস আলামোস থেকে সান্তা ফে’র পথে সন্ত্রাসী ঘটনায় নিহত সন্ত্রাসীদের জাতিগত পরিচয় উদ্ধার, সান্তা ফে বিমান বন্দরে বিস্ফোরিত বিমানের অসুস্থতার অজুহাতে সরে পড়া পাইলট আটক করা, ইত্যাদি যা করতে হবে সবই আমি জানাচ্ছি।’
‘সে পাইলটকে আপনারা আটক করেছেন? ব্রাভো।’
‘ঠিক আছে, ওদের জবাবের ব্যাপারটা আমি দেছি। জানাচ্ছি সব।’
‘আমি আসব।’
‘কখন? তোমাদের নেত্রীকে বল। আমি তো ওঁর কমান্ডে।’
‘তাহলে এপর্যন্তই।’
‘ওকে, ওয়াচ্ছালাম।’
টেলিফোন রেখে দিল আহমদ মুসা।
টেলিফোন চলার সময়ই জিনা জেফারসন বলল, ‘জটিল রাজনীতি শুরু হয়েছে, আমি এখন যাই।’ বলে সারা জেফারসনের মা জিনা জেফারসন উঠে গিয়েছিল।
আহমদ মুসা টেলিফোন রাখতেই সারা জেফারসন বলল, ‘আপনি কি সত্যি আমার কমান্ডে?’
সারা জেফারসনের মুখে কিছুটা দুস্টুমির হাসি।
‘আপনি শুধু আপনি নন, ‘ফ্রি আমেরিকা’র নেত্রী আপনি।’
‘নেত্রী সারা এবং ব্যক্তি সারা একই সত্তা। নেত্রী সারা কমান্ডা করতে পারে, ব্যক্তি কি পারে না?’
মুখ থেকে সেই দুষ্টুমির হাসি মিলিয়ে গেছে। সারার কন্ঠ হয়ে উঠেছে আবেগ জড়িত।
‘সত্তা একটা বলেই ব্যক্তি সারার কমান্ডও নেত্রী সারার হয়ে দাঁড়াল।’ বলল আহমদ মুসা।
‘সারার যে একটা ব্যক্তিগত পৃথিবী আছে, সেখানে অনেক কথা আছে, অনেক বলার, অনেক শুনার আছে, সেটা তাহলে যাবে কোথায়? ভারী কন্ঠস্বর সারা জেফারসনের।
‘বড়দের ক্ষেত্রে এটাই হয়।’
‘তাই বুঝি ‘মিস জেফারসন’ আর ‘সারা’ হতে পারছে না। আবেগে রুদ্ধ হয়ে গেল সারা জেফারসনের কন্ঠ। ছলছলে হয়ে উঠ সারা জেফারসনের দুচোখ।
আহমদ মুসার মুখ মলিন হয়ে পড়ল। তার পুরনো সেই বিব্রতকর অবস্থা তাকে আচ্ছন্ন করে দিতে চাইল। সুন্দরী, অপরূপা প্রিয়দর্শিনী একজন শীর্ষ মার্কিন তরুণীর অশ্রু ভেজা কন্ঠ ও ছলছলে চোখের আবেদন টর্নেডো হয়ে প্রবেশ করল আহমদ মুসার হৃদয়ে। টর্নেডোর প্রচন্ডগতি সব দুমড়ে-মুচড়ে গিয়ে হৃদয়রাজ্য জয় করে নিতে চাইল। কিন্তু হৃদয় সিংহাসনের গোড়ায় গিয়ে টর্নেডোর সব শক্তি মুখ থুবড়ে পড়ল। সেখানে সমাসীন প্রসন্ন, প্রশান্ত, প্রদীপ্ত আর এক মানবী।
আচ্ছন্নভাবে কাটিয়ে উঠে চোখ তুলে আহমদ মুসা কিছু বলতে যাচ্ছিল, সে সময় সারা জেফারসনের মোবাইল টেলিফোন কলের সংকেত দিয়ে উঠল।
সারা জেফারসন আবার তুলে নিল তার টেলিফোন। সারার ছলছলে চোখ থেকে দুই গন্ডে দুফোটা অশ্রু খসে পড়ল। কিন্তু অশ্রু মোছার চেষ্টা করলো না সারা।
মাত্র ঐ দুফোটা অশ্রুই আহমদ মুসার কাছে নিদারুণ অস্বস্তির দুই পাহাড় হয়ে দাঁড়াল।
সারা জেফারসন টেলিফোন ধরে ওপারের কথা শুনেই ব্যস্ত কন্ঠে বলে উঠল, ‘থ্যাংকস গড, আংকল আমি আপনাকে খুব বেশি আশা করছিলাম।
ও প্রান্তের কথা শুনল এবং উত্তরে বলল, ‘আমরা পড়েছি আংকল। আমি ওঁর সাথে এ বিষয় নিয়েই আলাপ করছিলাম।’
‘জি আংকল, আমরা ভেবেছি সংবাদপত্রে এবং টিভি চ্যানেলে এর জবাব দিতে হবে এবং আজই।’
‘জি আংকল। এ কাজ কঠিন হবে। কিন্তু কোন বিকল্প নেই।’
‘জি আংকল। এ কঠিন কাজ আমাদের-আপনাদের যৌথ হতে হবে।’
‘হ্যাঁ, উনি আমার পাশেই আছেন। বিষয়টা আপনি ওঁকেই বলুন। টেলিফোন দিচ্ছি ওঁকে। বাই আংকল।’
বলে সারা জেফারসন টেলিফোন আহমদ মুসার হাতে দিল।
আহমদ মুসা টেলিফোন ধরে গুডমর্নিং বিনিময়ের পর ওপারের কথা শুনে বলল, ‘আপনি আসবেন? এখানে? কখন?’
ওপারের উত্তর শুনে আহমদ মুসা আবার বলল, ‘ঠিক আছে আসুন, এলেই সব শুনব। কিন্তু সময় অল্প, কাজ অনেক করতে হবে।’
‘ও কে, আমি আপনার অপেক্ষা করছি। আসুন, বাই।’
টেলিফোন রাখল আহমদ মুসা।
‘জর্জ আব্রাহাম আংকল কি এখানে আসছেন?’ টেলিফোনে আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই বলল সারা জেফারসন।
‘হ্যাঁ, আসছেন। উনি এখন যাচ্ছেন প্রেসিডেন্টের কাছে। প্রেসিডেন্ট ডেকেছেন। ওখান থেকেই আসবেন এখানে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘নিউজের ব্যাপারে কিছু বললেন তিনি।’ জিজ্ঞেবস করল সারা জেফারসন।
‘কথা-বার্তায় তাঁকে খুব দুর্বল মনে হলো। এই ব্যাপারেই নাকি প্রেসিডেন্ট তাঁকে ডেকেছেন।
‘যতই হোক জর্জ আব্রাহাম একজন আমলা। নিউজ পেপারের এই রিপোর্ট তাকে ভড়কে দেবেই। এখন প্রেসিডেন্ট দুর্বল না হলেই হয়। বলল সারা জেফারসন।
‘প্রেসিডেন্টকে দুর্বল করার জন্যে এই চাপ সৃষ্টি করেছে। প্রেসিডেন্ট সারেন্ডার করে জেনারেল শ্যারনদের সম্পর্কে তদন্ত বাতিল ও অভিযোগ প্রত্যাহার করলেই তাদের বাজিমাত হয়ে যায়।’ আহমদ মুসা বলল।
‘প্রেসিডেন্টের আত্মসমর্পণ মানে কি আমাদেরও পরাজয়?’ জিজ্ঞেস করল সারা জেফারসন।
‘তা হবে কেন? প্রেসিডেন্ট ইহুদীবাদীদের কাছে আত্মসমর্পণ করলে আমাদেরকে দুই প্রতিপক্ষরে বিরুদ্ধে লড়তে হবে, এই যা।’
‘আপনার কি মনে হয় প্রেসিডেন্ট আত্মসমর্পণ করবেন?’ জিজ্ঞাসা সারা জেফারসনের।
‘আমেরিকান রাজনীতির এই দিকটা নিয়ে এই মুহূর্তে আমর কোন ভাবনা নেই। জর্জ আব্রাহাম এখানে এলেই সব বোঝা যাবে। প্রেসিডেন্টের আত্মসমর্পণ মানেই হলো জর্জ আব্রাহাম ও এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থারের বরখাস্ত।
‘ঠিক।’ বলে সারা জেফারসন একটু থেমে আহমদ মুসার দিকে পরিপূর্ণভাবে তাকিয়ে বলল, ‘আপনি কি ভাবছেন?’
প্রশ্ন শুনে আহমদ মুসা চেয়ারের গা এলিয়ে দিল। চোখ বুঝে গেল তার। একটু পরে ধীরে সুস্থে বলল, ‘আপনাদের চিন্তা ঠিক পথেই চলছে। যে দায়িত্ব দিয়েছেন, সে দায়িত্ব আমি পালন করব। নিউজ পেপার ও টিভি চ্যানেলের জন্যে স্ক্রিপ আমি তৈরি করে দেব। এ বিষয়ে জর্জ আব্রাহামের সাথেও আমার আলোচনা প্রয়োজন।’
মুহূর্তকালের জন্যে থামল আহমদ মুসা। তারপর আবার শুরু করল, ‘তবে আমার মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে জেনারেল শ্যারনদেরকে হাতে-নাতে পাকড়াও করার মত কিছু ঘটনা আমাদের চাই।’
থামল, আবার একটু ভাবল আহমদ মুসা। তারপর বলল, ‘আচ্ছা মিস জেফারসন, বেঞ্জামিন বেকনের সাথে কথা বলার সময় আপনি ‘টেপ পাওয়া’ কাউকে ‘উদ্ধার করা’ সম্পর্কে কিছু বললেন। ঘটনাটা কিন্তু আমাকে বলেননি।’
আবার সেই ‘মিস জেফারসন’ সম্বোধন। তার বুকের পুরনো কষ্টটা আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। বেদনায় মুখটা ম্লান হয়ে গেল তার। দুচোখও ভারী হয়ে উঠল।
মুখ নিচু করে দাঁত চেপে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করল সারা জেফারসন। এ সময় অভিমানে প্রচন্ড এক তরঙ্গ এসে তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। স্বাভাবিক কথা বলার সাধ্য তার থাকল না।
মুখ নিচু রেখেই ‘এক্সকিউজ মি’ বলে উঠে গেল সারা জেফারসন।
টেবিলে গিয়ে ঢক ঢক করে দুই গ্লাস পানি খেল সে। তারপর বেসিনে গিয়ে মুখে পানির ছিটা দিল। এরপর তোয়ালে দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে ফিলে এল চেয়ারে। বলল, ‘স্যারি।’
আহমদ মুসার ব্যাপারটা লক্ষ করেছিল। সারা জেফারসনের এই কষ্ট দারুনভাবে বিব্রত করল আহমদ মুসাকে। কিন্তু বিষয়টাকে এড়িয়ে গেল আহমদ মুসা। এ ধরনের বিষয় নিয়ে আলোচনার সময় এটা নয়। ডোনা জোসেফাইনের কথা সারাকে বলবে আহমদ মুসা, কিন্তু তার কোন প্রসংগ আহমদ মুসা পায়নি।
আহমদ মুসা বিষয়টা এড়িয়ে গেলেও তার মুখের বিব্রতভাব চাপা দিতে পারল না।
সারা ফিরে এসে বসলেও আহমদ মুসা মুখ তুলতে পারলো না।
সারাও ‘স্যরি’ বলে মুখ নিচু করেই ছিল।
কিন্তু তা মুহূর্ত কয়েকের জন্য নিজেকে সামলে নেবার লক্ষ্যে। পরে ধীর ধীরে বরল হ্যারির টেপ পাওয়া ও তার কিডন্যাপ হওয়ার কথা।
আহমদ মুসার চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, ‘আল-হামদুলিল্লাহ। খারাপ খবরটা যত বড়, তার চেয়ে বড় এই সুখবর।’
এ সময় সারা জেফারসনের মা ঘরে প্রবেশ করতে করতে বলল, ‘কি সুখবর বেটা?’
আহমদ মুসা কিছু বলার আগে সারা জেফারসনই বলল, ‘সত্যিই বড় খবর মা। সিনেটর দানিয়েল ময়নিহান ইহুদীবাদীদের প্রতি সহানুভূতিশীল। তার সাথে আলোচনার একটা গোপন টেপ করেছিল জেনারেল শ্যারন। সেটা মি. ময়নিহানের ছেলে আমাদের কর্মী হ্যারি এডওয়ার্ডের মাধ্যমে আমাদের হাতে এসেছে। এটা একটা দিক। অন্যদিক হলো, হ্যারিকে টেপ উদ্ধারের লক্ষ্যে জেনারেল শ্যারনরা কিডন্যাপ করেছে। এই দুটি দিক যদি ময়নিহানের নজরে আনা যায় তাহলে দারুন একটা রাজনৈতিক লাভ হবে আমাদের।
‘সৌভাগ্য দেখছি আহমদ মুসার। হিসেব করে দেখ, আহমদ মুসা আমেরিকার মাটিতে পা দেবার পর থেকেই তোমাদের একের পর এক বিজয়ের ঘটনা ঘটতে শুরু করেছে।’ বলল সারা জেফারসনের মা।
‘তা নয় খালাম্মা, ওদের বিজয়ের যুগে আমি আমেরিকায় পা দিয়েছি।’
এতক্ষণে হাসল সারা জেফারসন। বলল, ‘জানি এটাই আপনি বলবেন। আমেরিকান কোন কিছুর সাথে আপনাকে সম্পৃক্ত না করলে, আপনি আরও খুশি হন। আমেরিকায় আপনি নিজের অনিচ্ছায় এসেছেন তো!
‘কি বলছিস সারা! বাছা এ রকম ভাববে কেন? আমেরিকা থেকে সে কি যাবে, না তাকে যেতে দেব? তার জন্যে পায়ের বেড়ি আমি রেডি রেখেছি।’ বলল সারা জেফারসনের মা।
প্রথমে আহমদ মুসার মুখে হাসি ফুটে উঠেছিল। কিন্তু সারা জেফারসনের মায়ের শেষ কথায় তার হাসিটা মলিন হয়ে গেল।
আর সারা জেফারসনের চোখে মুখে মায়ের ইংগিতমূলক কথায় লজ্জিত ও বিব্রত ভাব ফুটে উঠল। মায়ের কথা শেষ হতে না হতেই কিছু বলার জন্যে দ্রুত মুখ খুলেছিল সারা জেফারসন।
ঠিক এ সময়ই ঘরে প্রবেশ করল একজন পুলিশ অফিসার। বলল, ‘মাফ চাচ্ছি সকলের কাছে বিরক্ত করার জন্য। এইমাত্র ওয়াশিংটন থেকে আমাকে জানানো হয়েছে, এফ বি আই প্রধান এখানে আসছেন। আমাকে জানানোর জন্যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, ম্যাডাম সারা জেফারসন ও তার মেহমানকে জরুরী প্রয়োজনে তাদের সাথে ওয়াশিংটন যেতে হবে।’ পুলিশ অফিসার চলে গেল।
সারা জেফারসন তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বরল, ‘আমি কেন? সরকারী কোন প্রোগ্রামে তো আমি যাই না। যাওয়ার কথা তো শুধু আপনার।’
আহমদ মুসা হাসল। অনেক্ষণ পর হাসার সুযোগ পেল। বলল, ‘ঘটনার ঘটক হয়ে বুঝি একথা বলা যায়?’
‘অন্তত আপনি আমাকে এত উঁচুতে তুলবেন না। আছাড় খেলে মরে যাব।’ সারা জেফারসনের কন্ঠ হঠাৎ ভারী হয়ে উঠেছে।
একটু থেমে দ্রুত সে নিজেকে সামলে নিয়ে আবার বলে উঠল, ‘আমি ঘটক হলে আপনি কি?’ হাসির চেষ্টা সারা জেফারসনের ঠোঁটে।
সারা জেফারসনের আগের কথাটা আহমদ মুসাকেও হঠাৎ একটা ধাক্কা দিয়েছিল। একটা শক ওয়েভ সৃষ্টি হয়েছিল তার মনে।
সারা জেফারসনের শেষের কথা আবার পরিবেশকে হাল্কা করে তুলল। আহমদ মুসা পরিবেশকে আরও হাল্কা করার জন্যেই বলল, ‘অভিনেতার পাশে তো সহঅভিনেতা থাকে?’
‘সহঅভিনেতা না বলে ‘সাথী’ বললে ক্ষতি কি?’ বলল সারা জেফারসন। মুখে তার ম্লান হাসি।
‘কোন ক্ষতি নেই।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আছে ক্ষতি, সহঅভিনেতা পেছনে থাকে, সাথীকে কিন্তু পাশে রাখতে হয়।’ বলেই সারা জেফারসন উঠে দাঁড়াল। তারপর বলল, ‘আম্মা ওনারা যে কোন সময় এসে পড়তে পারেন। কিছু গোছ-গাছ করে নেয়া প্রয়োজন।’
সারা জেফারসনের মা জিনা জেফারসনও উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘নিচটা পরিস্কার করতে বলে এসেছি। ওদিকটা দেখে আমি কিচেনের খোঁজ-খবর নেব। তুমি এদিকে তোমার গোছ-গাছটা করে নাও।’
বলে নিচ তলায় নামার জন্যে ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির দিকে অগ্রসর হলো সারা জেফারসনের মা।
সারা জেফারসন যাবার জন্যে পা বাড়িয়ে আবার ঘুরে দাঁড়াল। বলল আহমদ মুসাকে, ‘আমার ওয়াশিংটন যাবার ব্যাপারে আপনি কিন্তু কিছু বলেননি।’
আহমদ মুসা গম্ভীর হলো। বলল, ‘ফ্রি আমেরিকা’ মুভমেন্টের এসব সিদ্ধান্ত আমাকে নিতে হবে তা কিন্তু আমি বুঝিনি।’
‘এ নির্দেশ আমি সংগঠনকে দিয়েছি। আপনার সিদ্ধান্ত সংগঠনের সিদ্ধান্ত হিসাবে গণ্য হবে।’
‘আমাকে এ সম্মান দেয়ার জন্যে ধন্যবাদ। কিন্তু আপনার এ সিদ্ধান্ত কি স্বাভাবিক?’
আবেগের এক উচ্ছ্বাস এসে সারা জেফারসনের চোখ-মুখ ভারী করে তুলল। বলল, ‘আমার দেখা স্বপ্ন এ পর্যন্ত সত্য প্রমাণিত হয়েছে।
আমার সে স্বপ্নেরই নির্দেশ এটা যে, আমার দায়িত্ব আপনার হাতে তুলে দেব।’ আবেগে কম্পিত কন্ঠস্বর সারা জেফারসনের।
আহমদ মুসার ভেতরটা কেঁপে উঠল। যুক্তিবাদ ও বাস্তববাদের পীঠন্থান আমেরিকার শীর্ষ একটি পরিবারের সুশিক্ষিত তরুনী এমন অদৃষ্টবাদী হয়ে পড়ল কেমন করে! আহমদ মুসা তার এই অন্ধ আবেগের মোকাবিলা করবে কিভাবে!
আহমদ মুসা কথা বাড়াতে চাইল না।
বলল, ‘ওদের ডাক যথার্থ। আপনার ওয়াশিংটনে অবশ্যই যেতে হবে।’
‘ধন্যবাদ, স্যার।’ সারা জেফারসনের মুখে তখন ফুটে উঠেছে দুষ্টুমির হাসি।
ঘুরে দাঁড়িয়ে আবার হাঁটা দিল সারা জেফারসন।

হোয়াইট হাউজের দক্ষিণ অলিন্দে ল্যান্ড করল ছোট্ট একটি হেলিকপ্টার। অলিন্দটা নির্জন।
হেলিকপ্টারের ড্রাইভিং সিট থেকে নেমে এল এফ বি আই প্রধান জর্জ আব্রাহাম জনসন।
তার পরে নেমে এল আহমদ মুসা এবং সারা জেফারসন।
জর্জ আব্রাহাম জনসন একাই হেলিকপ্টার ড্রাইভ করে গিয়েছিল ভার্জিনিয়ার মন্টিসেলোতে। এমন একক সফরের কারণ হিসাবে বলেছিল, আলোচনার জন্য আরও কয়েকজনের আসার কথা ছিল। কিন্তু হোয়াইট হাউজ থেকে তার অনুমতি দেয়া হয়নি। সেখান থেকে জানানো হয়, আহমদ মুসা হোয়াইট হাউজে আসছেন। এ খবর জর্জ আব্রাহাম জনসন ও সারা জেফারসনের বাইরে এফ বি আই ও ‘ফেম’ এর কেউ যেন না জানে। সে জন্যে জর্জ আব্রাহাম জনসনকেই হেলিকপ্টার ড্রাইভ করতে হয়েছে।
হেলিকপ্টার ল্যান্ড করার পর আরোহীদের স্বাগত জানাতে কেউ আসেনি।
জর্জ আব্রাহাম জনসন নিজেই স্বাগত জানাল আহমদ মুসা ও সারা জেফারসনকে। জর্জ আব্রাহামই তাদের নিয়ে চলল হোয়াইট হাউজের ভেতরে।
জর্জ আব্রাহাম তাদেরকে এ করিডোর সে করিডোর ঘুরিয়ে, অনেক সিঁড়ি উঠানামা করিয়ে একটি কক্ষে নিয়ে ঢুকাল। মাঝারি সাইজের বর্গাকৃতি কক্ষ।
কক্ষের ঠিক মাঝখানে অর্থ বৃত্তাকার সুদৃশ্য একটা টেবিল। টেবিলের তিন দিক ঘিরে ছয়টি চেয়ার। আর টেবিলের অবশিষ্ট অন্য পাশটিতে একটিমাত্র আসন। সে আসনের সোজা পেছনে একটা দরজা।
আহমদ মুসারা এ দরজাটির বিপরীত দিকের দরজা দিয়ে ঘরে প্রবেশ করেছে।
কক্ষটি একটি মিটিং রুম। আহমদ মুসারা কক্ষে প্রবেশ করে দেখল তিনজন লোক বসে আছে। টেবিলের এ পাশে বসা বলে তাদের পেছনটা দেখা যাচ্ছে। বোধ হয় পায়ের শব্দ পেয়েছিল ওরা। তিনজনই এক সাথে পেছন ফিরে তাকাল।
তাকিয়েই তিনজন সহাস্যে উঠে দাঁড়াল। প্রায় একসাথেই দুজন বলে উঠল, ‘ওয়েলকাম আহমদ মুসা। গুড মর্নিং টু অল।’
পূর্ব থেকে বসে থাকা তিনজনের একজন হলো এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার, সি আই এ প্রধান, দ্বিতীয় জন মার্কিন সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন এবং তৃতীয়জন হোয়াইট ঈগলের প্রধান গোল্ড ওয়াটার। সবাই বসল।
ছয়জনের ঠিক মাঝখানে বসানো হয়েছে আহমদ মুসাকে। তার ডান পাশে সারা জেফারসন, বাম পাশে গোল্ড ওয়াটার। সারা জেফারসনের ডান পাশে একেবারে প্রান্তের চেয়ারে বসেছে জর্জ আব্রাহাম জনসন। আর গোল্ড ওয়াটারের বামপাশে বসেছে রোনাল্ড ওয়াশিংটন এবং তারপরে প্রান্তের চেয়ারটিতে বসেছে এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার।
সবাই বসলে সারা জেফারসন আহমদ মুসার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, ‘বি রেডি, আপনিই চীফ গেষ্ট। আপনাকে বসানো হয়েছে প্রেসিডেন্টের চেয়ারের সোজা সামনে।
সকাল ১১টা বাজার সাথে সাথে টেবিলের ওপাশের খালি চেয়ারটার পেছনের দরজাটা ধীরে ধীরে খুলে গেল।
সে দরজা দিয়ে প্রেসিডেন্ট প্রবেশ করল। তার মুখে হাসি। দৃঢ় পদক্ষেপ।
কক্ষে পা দিয়েই হাসি মুখে সকলের উপর দিয়ে একবার চোখ বুলিয়ে নিল প্রেসিডেন্ট।
চেয়ারের কাছাকাছি এসে প্রেসিডেন্ট বলল, ‘গুডমর্নিং টু অল।’
প্রেসিডেন্ট কক্ষে প্রবেশ করার সাথে সাথেই সবাই উঠে দাঁড়িয়েছে। প্রেসিডেন্ট চেয়ারে এল।
প্রেসিডেন্ট বসার আগে চেয়ারের সামনে দাঁড়িয়ে। প্রথম হাত বাড়িয়ে দিল আহমদ মুসার সাথে হ্যান্ডশেকের জন্যে। বলল মিষ্টি হেসে ‘মি. আহমদ মুসা। নামের তুলনায় আপনি টু ইয়ং।
‘ধন্যবাদ এক্সেলেন্সি। এটা আমার সৌভাগ্য।’ হ্যান্ডশেক করতে করতে ঠোঁটে হাসি টেনে বলল আহমদ মুসা।
‘দ্যাট’স ট্রু ইয়ংম্যান।’ বলে প্রেসিডেন্ট হাত বাড়াল সারা জেফারসনের দিকে।
সারা জেফারসনের সাথে হ্যান্ডশেক করতে করতে বলল, ‘নাইস টু সি ইউ মিস জেফারসন। আপনার নতুন পরিচয় আমাকে আনন্দিত করেছে।
‘ধন্যবাদ মি. প্রেসিডেন্ট।’ বলল সারা জেফারসন।
তারপর প্রেসিডেন্ট হ্যান্ডশেক করল এফ বি আই চীফ জর্জ আব্রাহাম জনসনের সাথে। বলল, ‘আপনি অনেক কষ্ট করেছেন, ধন্যবাদ মি. জর্জ আব্রাহাম।’
আর গোল্ড ওয়াটারের সাথে হ্যান্ডশেক করতে করতে প্রেসিডেন্ট বলল, ‘মি গোল্ড ওয়াটার আপনিই না, মি. আহমদ মুসাকে ক্যারিবিয়ান থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এনে যত গন্ডগোল পাকিয়েছেন।’ প্রেসিডেন্টের মুখে হাসি।
‘আমার ধন্যবাদ পাওয়া উচিত মি. প্রেসিডেন্ট। কারণ এ গন্ডগোল সৃষ্টি না করলে অনেক সর্বনাশা গন্ডগোল দূর করা যেত না।’ বলল গোল্ড ওয়াটার।
‘সময়ই তা বলে দেবে মি. গোল্ড ওয়াটার।’ প্রেসিডেন্টের কন্ঠ কিছুটা গম্ভীর।
জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন ও এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থারের সাথে হ্যান্ডশেক করে প্রেসিডেন্ট এ্যাডামস হ্যারিসন তার চেআরে গিয়ে বসে পড়ল।
প্রেসিডেন্ট পঞ্চাশোর্ধ। কিন্তু তাকে দেখলে চল্লিশোর্ধের বেশি মনে হয় না।
শক্ত নার্ভের যতগুলো প্রেসিডেন্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এসেছে, তাদের মধ্যে এই প্রেসিডেন্টও স্থান পাবেন। সাংঘাতিক টেনশনের সময়ও এ্যাডামস হ্যারিসন হাসতে পারে। তার আর একটি গুণ হলো তার কথায় স্বচ্ছতা আছে। মানুষ তার সাথে একবার কথা বললেই তাকে চিনতে পারে। প্রেসিডেন্ট বসেই বরল, এখনকার এই মিটিং ফরমাল ও ইনফরমাল দুইই। এই মিটিং এর আমার পাশে কাউকে রাখিনি। এই মিটিং এর কোন কিছুই নোট হবে না। এই মিটিং এ সাক্ষী হবার মত হোয়াইট হাউজে কেই নেই। প্রেসিডেন্টের সিকিউরিটি কমব্যাট ফোর্সই শুধু এখন হোয়াইট হাউজে আছে। সব স্টাফকে আমি ছুটি দিয়েছি আজ অবসর কাটাব বলে। সুতরাং আমাদের কথা-বার্তা পোশাক-আশাকহীন স্পষ্ট হলেই ভাল হয়।’
বলে প্রেসিডেন্ট মুহূর্তের জন্যে একটু থামল। একটু যেন আত্মস্থ হলো। তারপর মুখ তুলে সোজা তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বরল ‘আমেরিকায় আপনাকে খোশ আহমদেদ আহমদ মুসা।’
‘ধন্যবাদ মি. প্রেসিডেন্ট।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আমি দুঃখিত, মৌলবাদী শব্দের কদর্থ হচ্ছে। যা হওয়া উচিত ছিল পুরস্কারের নিমিত্ত, তাকে করা হয়েছে তিরস্কারের বাহন। খ্রীষ্টের মৌল শিক্ষায় আমি অবিশ্বাসী নই, বাইবেল ছুঁয়ে শপথ নিয়ে আমি প্রেসিডেন্ট হয়েছি। তাই আমিও মৌলবাদী।’ বলল প্রেসিডেন্ট শান্ত স্বরে।
‘আমাকে ‘সন্ত্রাসীও’ বলা হয়েছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘এটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। ‘অমুক সন্ত্রাসী’ কিংবা ‘আমি সন্ত্রাসী নই’ কোনটারই মূল্য নেই। সত্য উদঘাটন থেকেই এর জবাব হয়ে যাবে।’
বলে একটু থেমেই প্রেসিডেন্ট আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘মি. আহমদ মুসা, আপনি কি ভয় পাচ্ছেন?’
‘ভয় আসে হারানোর আশংকা থেকে। আমার কিছু হারাবার নেই মি. প্রেসিডেন্ট।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কিন্তু সবচেয়ে মূল্যবান হলো জীবন। জীবনটা তো আপনার আছে।’
‘জীবনটা আমি ধারণ করি মাত্র। কিন্তু এই জীবন থাকা, না থাকা আমার হাতে নয়, স্রষ্টার হাতে। তাই এ নিয়ে আমার কোন চিন্তা নেই মি. প্রেসিডেন্ট।’
‘কিন্তু এ চিন্তা মানুষের সহজাত।’ প্রেসিডেন্ট বলল।
‘জীব হিসেবে তা সত্য, কিন্তু মানুষ হিসাবে আমাদেরকে এ শিক্ষা নিতে হয় যে, কোন শক্তির মৃত্যুর তারিখ এগিয়েও যেমন আনতে পারে না, তেমনি কোন-প্রয়াস মৃত্যুর সময়কে পিছিয়েও দিতে পারে না।’
প্রেসিডেন্টের মুখে এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘ধন্যবাদ আহমদ মুসা আপনি সত্যিই দেখছি একজন অনুকরণীয় মৌলবাদী।’
বলে প্রেসিডেন্ট মুহূর্তের জন্যে থামল। তার মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল। পরক্ষণেই সকলের দিকে চেয়ে বলে উঠল, ‘আহমদ মুসা নানাদিক দিয়ে একজন আলোচিত ব্যক্তিত্ব তাই প্রথম সাক্ষাতে তারসাথে একটু আলোচনার সুযোগ নিলাম। এখন কাজের কথায় আসি।’
থামল প্রেসিডেন্ট। তাকাল জর্জ আব্রাহাম জনসনের দিকে। জর্জ আব্রাহাম জনসন মার্কিন নিরাপত্তা সিস্টেমের সবচেয়ে সিনিয়র আমলা।
জর্জ আব্রাহাম জনসন প্রেসিডেন্টকে তার দিকে তাকাতে দেখে নড়ে-চড়ে বসল। বুঝল প্রেসিডেন্টের ইংগিত যে, তাকেই একটা ভূমিকা নিতে হবে। বলল সে ‘বিশেষ এক পরিস্থিতিতে হোয়াইট হাউজে মহামান্য প্রেসিডেন্টের সামনে আমরা উপস্থিত হয়েছি। আজ দেশের প্রধান সংবাদপত্রগুলোতে একটা নিউজ পরিকল্পিতভাবে প্রকাশ করা হয়েছে। এর মূল কথা, আহমদ মুসার যোগ-সাজসের শিকার হয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ও তার প্রশাসন এবং মার্কিন দুটি সংগঠন, হোয়াইট ঈগল ও ‘ফেম’, ইহুদীদের সাথে সংঘাত সৃষ্টির জন্যে উঠে পড়ে লেগেছে। ওদের ঘোষণা থেকে মনে হচ্ছে, আজ সন্ধ্যায় কয়েকটি টিভি চ্যানেলেও এই কথাগুলো প্রচার করা হবে। এই অবস্থায় মত বিনিময়ের জন্যেই এই মিটিং। প্রেসিডেন্ট সরাসরি আপনাদের কাছ থেকে কিছু জানতে চান।’ থামল জর্জ আব্রাহাম।
থামার সংগে সংগেই প্রেসিডেন্ট বলে উঠল, ‘ধন্যবাদ মি. জর্জ।’
বলেই প্রেসিডেন্ট সরাসরি আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘মি. আহমদ মুসা, যে অভিযোগ ওরা নিয়ে আসছে তার প্রধান আসামী আপনার মতে কে?’
আহমদ মুসার দুচোখও প্রেসিডেন্টের চোখে ন্বিদ্ধ। প্রশ্নের ধরনেই বোধ হয় এক টুকরো হাসি ফুটে উঠেছে আহমদ মুসার ঠোঁটে। বরল, ‘মহামান্য প্রেসিডেন্ট যাকে এই প্রশ্নটি জিজ্ঞেস করেছেন, সেই আহমদ মুসাই প্রধান আসামী। নিউজে যা বলা হয়েছে তার সবটাই প্রেসিডেন্ট ও তা প্রশাসনের উপর চাপ সৃষ্টির লক্ষ্যে, যাতে প্রেসিডেন্ট সংশ্লিষ্ট সব ঘটনাকে ইহুদী বিদ্বেষজাত সাজানো ঘটনা ধরে নিয়ে ইহুদীদের বিরুদ্ধে তদন্ত বন্ধ করে আহমদ মুসার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন।’
‘প্রেসিডেন্ট যদি দেশের সংবাদপত্র ও টিভি নেটওয়ার্কের এই সাজেশনকে গ্রহণ করেন?’ বলল প্রেসিডেন্ট গম্ভীর কন্ঠে।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘প্রেসিডেন্ট তা করতে পারেন।
‘সেক্ষেত্রে আপনার ভূমিকা কি হবে?’ বরল প্রেসিডেন্ট।
‘কোন ভূমিকায় আমি অবতীর্ণ হব, তা নির্ভর করবে মিস জেফারসন ও মি. গোল্ড ওয়াটারের ভূমিকার উপর। ওরা যদি আমাকে সহযোগিতা করেন, তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থেকেই জেনারেল শ্যারনদের ষড়যন্ত্র নস্যাতের চেষ্টা করব। আর ওরা যদি প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্তের সাথে থাকেন, তাহলে আমি মার্কিন সরকারের গ্রেফতার এড়িয়ে যুক্তিটাকে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নিয়ে যাব।’
‘আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নিয়ে যাবার অর্থ?’ প্রেসিডেন্ট জিজ্ঞেস করল।
‘জেনারেল শ্যারনরা যে লড়াই মার্কিন মিডিয়াতে শুরু করেছে, তা আমি আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে নিয়ে যাব এবং ওদের মুখোশ ছিঁড়ে ওদের নগ্ন চেহারা বিশ্ববাসীর সামনে নগ্ন করে দেব।’ বলল আহমদ মুসা।
প্রেসিডেন্টের চোখ দুটি উজ্জ্বল হয়ে উঠল। কিন্তু মুখের গাম্ভীর্য ঠিকই থাকল। বলল প্রেসিডেন্ট, ‘মার্কিন গ্রেফতার এড়াবেন কি করে? আপনি হোয়াইট হাউজে, কার্যত বন্দীই বলতে পারেন।’
আহমদ মুসার হাসল। বলল, ‘আমি কার্যত বন্দী যেমন বলা যায়, তেমনি বন্দী মুক্তির পথ কার্যত খোলা আছে বলা যায়।’
প্রেসিডেন্টের ভ্রুকুঞ্চিত হলো। তারপর মুখে ফুটে উঠল কৌতুল। বলল, ‘সে পথ কেমন?’
আহমদ মুসার হাসল। বলল আমার শোল্ডার হোলস্টারে মেশিন রিভলবার এম ১০ আছে, কেউ সার্চ করেনি। এই ঘরে সবাইকে বন্দী করে আমি বেরিয়ে যেতে পারি। হেলিকপ্টার ল্যান্ড করা আছে সিঁড়ির প্রায় গা ঘেষেই। জর্জ আব্রাহাম চাবি রেখে এসেছে ড্যাশ বোর্ডের এ্যাসট্রেতে। প্রেসিডেন্টের অয়্যারলেস সংকেত পেয়ে হোয়াইট হাউজের সিকিউরিটি কমব্যাট ফোর্স হেলিকপ্টার লক্ষ্যে যখন প্রথম গুলী বৃষ্টি করবে তখন হেলিকপ্টার অন্তত পঞ্চাশ ফুট উপরে উঠে যাবে।’
প্রেসিডেন্টের ঠোঁটে হাসি।
জর্জ আব্রাহামের চোখে-মুখে বিস্ময়। বলল, ‘কেউ দেখেনি নিশ্চিত হয়ে চাবিটা আমি ওখানে রেখেছি।’
জর্জ আব্রাহাম থামতেই জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন বলল, ‘হেলিকপ্টার গুলী কবে নামাবো, ওটা হোয়াইট হাউজের এলাকা পার হবার আগেই।’
‘জনাব জর্জ আব্রাহামের হেলিকপ্টারটি বুলেট প্রুফ। গোলা বর্ষণ করে যদি পাখা ফেলে দেয়া হয়, তবু এ বিশেষ হেলিকপ্টারটি ফ্লাই করতে পারে।’ বলল আহমদ মুসা হাসি মুখে।
এবার প্রেসিডেন্টসহ সকলের চোখে মুখে বিস্ময়ের চিহ্ন। বলল এফ বি আই চীফ জর্জ আব্রাহাম জনসন, ‘হেলিকপ্টারের এই বৈশিষ্ট্য একটা ক্ল্যাসিফাইড ইনফরমেশন। আপনার জানার কথা নয়।’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘হেলিকপ্টারের ড্রাইভিং ডোরের ভেতরের পাশে মেক-আপ প্লেটে হেলিকপ্টারের স্পেসিফিকেশন লেখা আছে। ওটা থেকে তো যে কেউ ক্ল্যাসিফাইড ইনফরমেশন জেনে নিতে পারে।’
‘ধন্যবাদ আহমদ মুসা। সত্যই বিস্ময়ের যে, হোয়াইট হাউজের গ্রেফতার এড়িয়ে সরে পড়ার চিন্তাও আপনি করে রেখেছেন।’
প্রেসিডেন্ট আহমদ মুসাকে এই কথা বলার পর সারা জেফারসন ও গোল্ড ওয়াটারকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘সরকার যদি মিডিয়ার সাজেশনকে গ্রহণ করে নেয়, তাহলে আহমদ মুসা তার পদক্ষেপ হিসাবে দুই বিকল্পের কথা বলেছে। একটিতে আপনাদের সহযোগিতা দরকার, অন্যটিতে তার নিজস্ব। আপনারা তাকে সহযোগিতা করছেন কি না?’
‘মি. প্রেসিডেন্ট বলেছেন, আমি আহমদ মুসাকে আমেরিকায় এনে এই গন্ডগোল পাকিয়েছি। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে তাঁকে এনে গন্ডগোল দূর করার ব্যবস্থা করেছি। সুতরাং আমি এবং আমার সংগঠন তাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করব।’ বলল গোল্ড ওয়াটার।
প্রেসিডেন্ট তাকালেন সারা জেফারসনের দিকে।
সারা জেফারসনের মুখ গম্ভীর। বলল, ‘যুদ্ধ বা লড়াই যেটা শুরু হয়েছে, সেটা আমাদের লড়াই, আমেরিকানদের লড়াই। মি. আহমদ মুসার লড়াই নয়। তিনি ঘটনাক্রমে এর সাথে জড়িত হয়ে পড়েছেন এবং সবরকম সহযোগিতা করছেন। আমি আমেরিকার পক্ষ থেকে তাঁকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি যে, আমেরিকা না চাইলেও এ লড়াই তিনি চালাবেন আমেরিকার বাইরে গিয়ে। এটা তাঁর পরম মানবিকতার প্রকাশ।’
সারা জেফারসনের কথা শেষে দিকে এসে আবেগে রুদ্ধ হয়ে পড়েছিল। একটু থামল সারা জেফারসন।
‘স্যরি’ বলে মুখটা একটু ঘুরিয়ে একটু কেসে পরিস্কার করে নিয়ে আবার বলল, ‘আমেরিকানদের সরকার না চাইলেও আমেরিকানরা এ লড়াই চালাবে। আবেদন করব, এ লড়াই এ মি. আহমদ মুসা আমেরিকানদের সাথে থাকবেন।’
কন্ঠ আবার আবেগে রুদ্ধ হয়ে পড়ল সারা জেফারসনের।
থামল সারা জেফারসন। মুখ নিচু করল সে।
প্রেসিডেন্টের চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। একটা আবেগের কম্পন তারও চোখে-মুখে।
প্রেসিডেন্ট সোজা হয়ে বসল। বলল, ‘ধন্যবাদ মিস জেফারসন। প্রেসিডেন্ট হিসাবে নয়, একজন আমেরিকান হিসাবে আপনাকে অভিনন্দিত করছি। আমি গর্বিত যে, আমেরিকানদেরই এক প্রিয় পূর্ব পুরুষের পরিবারের আপনি সন্তান।’ প্রেসিডেন্ট একটু থামল।
প্রেসিডেন্টের কথাও আবেগে ভারী হয়ে উঠেছিল।
থামার সাথে সাথে প্রেসিডেন্টের চোখ মুহূর্তের জন্যে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বোধ হয় প্রেসিডেন্ট আবেগ দূরে সরাতে চাইল। মুহূর্তকাল পরে প্রেসিডেন্ট বলল, ‘কিন্তু সব নাগরিকের সরকার হিসাবে, দেশের প্রেসিডেন্ট হিসাবে কোন জাতিগত দ্বন্দ্বে আমি কোন পক্ষ হতে পারি না।’
‘জাতিগত দ্বন্দ্ব কোথায় মি. প্রেসিডেন্ট?’ বলল সারা জেফারসন।
‘পরিস্কার যে, এই সংঘাতে ইহুদীরা এক পক্ষ হয়ে গিয়েছে।’
প্রেসিডেন্ট বলল।
‘পরিকল্পিতভাবে ওদের একটা পক্ষ করা হয়েছে মি. প্রেসিডেন্ট। দেশের বাইরে আন্তর্জাতিক একটি ইহুদী গোয়েন্দা গ্রুপ আমাদের দেশের ইহুদীদের একটা ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর যোগসাজসে একটা ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে। এটা হলো প্রকৃত ঘটনা। এই ঘটনার সাথে দেশের সাধারণ ইহুদীদের কোনই সম্পর্ক নেই। সুতরাং যে সংঘাত বেধেছে সেটা জাতিগত সংঘাত নয়। সংঘাত বেধেছে ষড়যন্ত্রকারী একটা চক্রের সাথে। ঘটনাক্রমে ষড়যন্ত্রকারী এই গোষ্ঠী দেশের ইহুদীদের একটা অংশ। আর এই ষড়যন্ত্রকারীরা ধরা পড়ার পর এখন চেষ্টা করছে দেশেসব ইহুদীদের তাদের সাথে টানার এবং একে জাতিগত রূপ দেয়ার। তারা দুটো অন্যায় করছে। প্রথমটা ওদের ষড়যন্ত্র, অন্যটা হলো তাদের কুকীর্তির সাথে গোটা ইহুদী কম্যুনিটিকে জড়িয়ে ফেলার। এইভাবে ইহুদী কম্যুনিটিকে ঢাল বানিয়ে তারা তাদের জঘন্য কুকীর্তিকে ঢাকতে চাচ্ছে। এটা আমরা হতে দিতে পারি না।
‘মিস জেফারসন আপনার সাথে আমি একমত। কিন্তু এ কথাগুলো সবই এখন মানুষের কাছে প্রমাণ সাপেক্ষ্য। প্রমানিত হবার আগে জনগণ যেমন পক্ষ নেবে না, তেমনি সরকারে এখন এক পক্ষে গিয়ে দাঁড়ানো কঠিন।’ প্রেসিডেন্ট বলল।
‘স্যরি মি. প্রেসিডেন্ট, এখানে পক্ষ নেবার প্রশ্ন উঠছে না। আপনার প্রশাসন একটা তদন্তে হাত দিয়েছে, সেটা এখন এগিয়ে নেয়ার প্রশ্ন।’ বলল সারা জেফারসন।
‘সেটা এগিয়ে যাবে মিস জেফারসন। কিন্তু সরকারকে এখন কথা বলতে হবে। সে কথায় সরকার বলবে, আহমদ মুসার পক্ষ এবং ইহুদীদের বিপক্ষ-কোন ব্যাপারেই এমন কোন বিবেচনা সরকারের মধ্যে নেই। প্রশাসন কিছু গুরুত্বপুর্ণ ব্যাপারে তদন্ত করছে। ব্যক্তি, পরিচয় নির্বিশেষে যে কারো কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতাকে ওয়েলকাম করা হয়েছে। এক্ষেত্রে সম্মানিত ইহুদী নাগরিকদের সহযোগিতাকে বিশেষ মূল্যবান বিবেচনা করা হবে উপযুক্ত সময়ে সবকিছুই জনসমক্ষ্যে আনা হবে।’ প্রেসিডেন্টের দপ্তর থেকে আজই একথা ঘোষণা করা হবে।
‘মি. প্রেসিডেন্ট তদন্ত বানচাল করার জন্যেই জেনারেল শ্যারনরা এতকিছু করছে। সুতরাং এই ঘোষণা কোনই কাজ দেবে না। এ তদন্ত তারা আগাতে দেবে না। প্রেসিডেন্টের উপর রাজনৈতিক চাপ কোন কাজ না দিলে তারা আরও বড় কিছু ঘটাবে। মি. প্রেসিডেন্ট নিশ্চিত থাকুন তারা সরকারের পতন পর্যন্ত যাবে।’ সারা জেফারসন বলল।
‘আমি জানি মিস জেফারসন। জর্জ আব্রাহাম ও ম্যাক আর্থাররাও একথা বলছেন।’ বলল প্রেসিডেন্ট।
‘তাহলে মি. প্রেসিডেন্ট ওদের আক্রমণের জবাবে আপনি অকার্যকর এই আত্মরক্ষার পথ নিচ্ছেন কেন?’ বলল সারা জেফারসন।
‘সরকার এর বেশি কিছু করতে পারবে না।’ প্রেসিডেন্ট বলল।
‘তাহলে?’ হতাশ কন্ঠে গোল্ড ওয়াটার বলল।
‘এ প্রশ্নের সমাধানের জন্যেই তো আপনাদের ডেকেছি। থ্যাংকস গড। যা চেয়েছিলাম তা পেয়েছি।’ বলল প্রেসিডেন্ট।
‘কি পেয়েছেন মি. প্রেসিডেন্ট?’ জিজ্ঞেস করল সারা জেফারসন।
‘আহমদ মুসা আমাকে নিশ্চিত করেছেন। তার এগিয়ে যাওয়াটা সরকার নির্ভর নয়। মি. গোল্ড ওয়াটার তাকে সহযোগিতা করবেন জেনে খুশি হয়েছি। আর মিস জেফারসন আপনার মধ্যে আমেরিকার সংগ্রামী নতুন প্রজন্মকে দেখছি। আমি আশান্বিত আপনারা ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে জয়ী হবেন।’ বলল প্রেসিডেন্ট। তার কন্ঠে আবেগের সুর।
‘কিন্তু মি. প্রেসিডেন্ট, জনগণের সংকট মোচনে জনগণের সরকার কিছু না করে সমাধান জনগণের উপর ছেড়ে দিলে সেটা কেমন হয়।’ বলল সারা জেফারসন।
‘দেশের বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন ধরনের কূটনীতির আশ্রয় নিতে হয়। একে প্রয়োজনীয় একটি কূটনীতি হিসেবেই দেখুন। তবে সরকার ওদের উপর ক্র্যাকডাউন করছে না ঠিকই, তবে প্রশাসনের সব ধরনের সহযোগিতা আপনারা পাবেন। সেটা নেয়ার দায়িত্ব আপনাদের, দেয়ার দায়িত্ব প্রশাসনের থাকবে না।’
প্রেসিডেন্ট সারা জেফারসনের উদ্দেশ্যে কথাগুলো বলেই তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘মি. আহমদ মুসা, সামনে এগোনোর ব্যাপারে আপনারা কি চিন্তা করছেন, কিছু কি জানতে পারি?’
‘এ প্রশ্নের উত্তর মিস সারা জেফারসন ভাল দিতে পারবেন। ওরা কিছু চিন্তা করেছেন মি. প্রেসিডেন্ট।’
প্রেসিডেন্টের চোখ ঘুরে গেল সারা জেফারসনের দিকে।
আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই সারা জেফারসন শুরু করেছে তার কথা। বলছিল, ‘বিস্তারিত আমরা কিছু ভাবিনি। তবে যে অস্ত্র দিয়ে ওরা আমেরিকানদের আঘাত করেছে, সে অস্ত্র দিয়ে আমরা ওদের আঘাত করব। অস্ত্র রেডি করার দায়িত্ব আমাদের, কিন্তু রসদ যোগাবেন জনাব আহমদ মুসা।’
‘বুঝতে পারছি, কাজ আমাদেরই করতে হবে। কিন্তু সরকার আমাদের কোন দায় দায়িত্ব নেবেন না। বরং দরকার হলে সরকার আমাদের কাউকে গ্রেফতারও দেখাবেন।’
কথার মাঝখানে আহমদ মুসা একটু থামল। আবার শুরু করল। বলল, ‘রসদ তৈরীর ব্যাপারে মি. জর্জ আব্রাহাম মি.ম্যাক আর্থার ও মি. রোনাল্ড ওয়াশিংটনদের কারো কারো সহযোগিতা দরকার হবে। ওদের সাথে যোগাযোগের কোন সুযোগ থাকছে কিনা?
‘সত্যিই আপনি অসাধারণ আহমদ মুসা। আপনাকে গ্রেফতার দেখাবার মত পরিস্থিতি হতে পারে। জেনারেল শ্যারনদের রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র ঠেকাবার জন্যে শেষ পর্যন্ত প্রশাসনকে ঐ পর্যন্ত যেতে হতে পারে। আপনি এটা বুঝেছেন মানে মার্কিন রাজনীতির কিছুই বুঝা আপনার বাকি নেই। আপনাকে ধন্যবাদ।’
শেষ শব্দ উচ্চারণের পর প্রেসিডেন্ট একটা দম নিয়ে আবার শূরু করল, ‘না ওদের কারো সাথে আপনি যোগাযোগের সুযোগ পাবেন না। আমাদের গোটা পুলিশ ও গোয়েন্দা এজেন্সীগুলোর চোখের বাইরে আপনাকে কাজ করতে হবে। যাতে জেনারেল শ্যারন ও সংশ্লিষ্টরা বোঝে আপনাদের কাজের সাথে সরকারের কোন সম্পর্ক নেই। লড়াই থেকে সরকার সরে দাঁড়িয়েছে। লড়াই চালাচ্ছেন আপনারা। তবে জর্জ আব্রাহাম, মি. ম্যাক আর্থার ও জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন ব্যক্তিগতভাবে আপনার সাথে যোগাযোগ করবেন প্রয়োজন হলে।’
‘কিন্তু আমার প্রয়োজন হলে?’ প্রেসিডেন্ট থামতেই বলে উঠল আহমদ মুসা।
‘আমার সাথে বৈঠকের পর এখানেই ওদের সাথে আপনি বসবেন। আপনার প্রশ্নের জবাব ওরাই দেবেন।’ বলল প্রেসিডেন্ট।
এ কথা শেষ করেই প্রেসিডেন্ট বলে উঠল, ‘লেডিজ এন্ড জেন্টেলম্যান, আপনারা কষ্ট করে এখানে এসে আমাকে আলোচনার সুযোগ দেয়ায় আপনাদের সকলকে ধন্যবাদ। আমি এখন উঠতে চাই।’
উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে প্রেসিডেন্ট বলল, ‘পাশের ঘরে আপনাদের চা অপেক্ষা করছে। সেখানে সকলকে আমি দাওয়াত দিচ্ছি। মি. জর্জ আব্রাহাম জনসনকে আমি অনুরোধ করছি তিনি আমার পক্ষ থেকে সম্মানিত মেহমানদের সাথে এ্যাটেন্ড করবেন।’
বলে প্রেসিডেন্ট উঠে দাঁড়িয়ে সকলের সাথে হ্যান্ডশেক করে যেমন এসেছিল, তেমনি পেছনের সেই দরজার দিকে এগুলো।
দরজায় গিয়ে আবার ফিরে দাঁড়াল প্রেসিডেন্ট। বলল সারা জেফারসনকে লক্ষ্য করে। বলল, ‘সারা জেফারসন ফরমাল মিটিং শেষ, এখন তোমাকে মা বলতে পারি। শুন মা সারা জেফারসন, তোমার মন্টিসেলোতে থাকা ঠিক হবে না। লস আলামোস থেকেও তোমার এক মাসের ছুটি হয়েছে। তুমি এখন ওয়াশিংটনে থাকবে। তোমার মাকেও আনার জন্যে আমি বলে দিয়েছি। আহমদ মুসাও অবশ্যই ওয়াশিংটনে থাকবেন। জর্জ আব্রাহাম জনসন সব ব্যবস্থা করে দেবেন, এক বাড়ি কিংবা দুই বাড়ি যেটাই তোমার প্রেফার কর।’
প্রেসিডেন্ট চলে গেল।
সারা জেফারসন ঠোঁটে এক টুকরো হাসি নিয়ে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। তারপর চোখ ঘুরাল জর্জ আব্রাহাম জনসনের দিকে। বলল, ‘আংকল আমাদের এক বাড়িই বোধয় আমার জন্যে নিরাপদ হবে, তাই না?’ সারা জেফারসনের চোখ উজ্জ্বল।
জর্জ আব্রাহাম কথা বলার আগেই আহমদ মুসা মুখ খুলতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই সারা জেফারসন দ্রুত বলে উঠল, ‘আমরা এখন উঠতে পারি।’ উঠে দাঁড়াল সারা জেফারসন।
উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে আরও বলল সারা জেফারসন, ‘আংকল জর্জ আব্রাহাম জনসনের পক্ষ থেকে আমি আপনাদের সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছি চায়ের টেবিলে।’
‘ধন্যবাদ মা, প্রেসিডেন্ট যখন পাওয়ার ডেলিগেট করেছেন মি. জর্জকে তখন মি. জর্জও পারেন তা করতে।’ বলল এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার হাসতে হাসতে।
সবাই হেসে উঠল। উঠে দাঁড়াল সবাই।

পটোম্যাক বে’র মুখে সুন্দর একটা দুতলা বাংলো। বাড়ির চারদিকের বাগানের গাছ-পালা এতই গভীর যে দূর থেকে বাড়িটার কোন অস্তিত্বই চোখে পড়ে না।
সুন্দর বাংলো বাড়িটার মালিক হাওয়ার্ড হেফলিন। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের বড় শেয়ারের মালিক এবং চেয়ারম্যান।
তখন সন্ধ্যা ৮টা। একটি বড় হাইল্যান্ডার জীপ গাড়ি এসে দাঁড়াল গেটে। গেটম্যান বেরিয়ে এল।
গাড়িটার ড্রাইভিং সিট থেকে নামল একজন। বলল, ‘ম্যাডাম সারা জেফারসনের গাড়ি।’
সংগে সংগে খুলে গেল প্রধান গেট।
গাড়ি ভেতরে প্রবেশ করে দাঁড়াল গাড়ি বারান্দায়।
ঠিক এ সময়ই ভেতর থেকে বেরিয়ে এল মধ্যবয়সী একজন লোক। হাওয়ার্ড হেফলিন।
সে সকলকে স্বাগত জানিয়ে প্রথমে হ্যান্ডশেক করল সারা জেফারসনের সাথে। বলল, ‘আপনার সাথে আমার এটা দ্বিতীয় দেখা মিস জেফারসন। প্রথম আপনাকে দেখেছিলাম টমাস জেফারসন মেমোরিয়ালের একটা অনুষ্ঠানে।’
‘ধন্যবাদ স্যার, এই মনে রাখার জন্যে।’
বলে সারা জেফারসন হাওয়ার্ড হেফলিনকে একে একে পরিচয় করিয়ে দিল আহমদ মুসা, গোল্ড ওয়াটার, বেঞ্জামিন বেকন এবং নিজের পি এস ক্লারা কার্টারের সাথে।
আহমদ মুসার সাথে হ্যান্ডশেক করার সময় হাওয়ার্ড হেফলিন বলল, ‘আপনার সাথে হ্যান্ডশেক করায় আনন্দ ও ভয় দুটোই অনুভব করছি। আনন্দ অনুভভ করছি এই ভেবে যে, অভাবিত এক সৌভাগ্য আমার হলো। আর ভয়ের কারণ হলো আপনি যেখানেই পা দেন, সেখানেই নাকি পরিবর্তন আসে।’
আহমদ মুসাসহ সবাই হেসে উঠেছিল, মি. হাওয়ার্ড হেফলিনের এই কথায়। আহমদ মুসা বলল, পরিবর্তন ভালো হলে তো ভয়ের কিছু নেই।’
‘জনাব, সেটা তো ফল পাবার পরের কথা।’ বলল হাওয়ার্ড হেফলিন।
হাওয়ার্ড হেফলিন সকলকে নিয়ে ড্রইং রুমে এসে বসল। বসেই মিস জেফারসনকে লক্ষ্য করে বলল, ‘মিস জেফারসন প্রতিবাদের যে একটা কপি আমার কাছে পাঠিয়েছিলেন। তা আমি পড়েছি। দেখছি ভয়নাক ব্যাপার। পড়ার সময় মনে হয়েছে, আমি অবিশ্বাস্য এক স্বপ্ন দেখছি। কিন্তু প্রমাণগুলো এতই প্রশ্নাতীত যে অবিশ্বাসের কোন সুযোগ নেই। ভাবছি, দেশে বড় কিছু ঘটে যাবে।’
‘ধন্যবাদ স্যার, সিদ্ধান্ত নিশ্চয় নিয়ে নিয়েছেন?’ বলল সারা জেফারসন।
‘ঐ তো ভয় করছি কিছু ঘটার আশংকা নিয়ে।’
বলে হাওয়ার্ড হেফলিন মুহূর্তের জন্য থামল। আরও একটু আত্মস্থ হবার ভাব ফুটে উঠল তার চোখে-মুখে। বলল, ‘আরও একটু আলোচনার সুযোগ নেবার জন্যেই আপনাদের এভাবে কষ্ট দিয়েছি। আমি বলতে চাচ্ছিলাম, এই ভয়ানক সেনসেটিভ ব্যাপারটা জনসমক্ষে না এনে সরকারকে জানালেই হয়ে যায় না?’
‘আমরা তো সেটাই চেয়েছিলাম। কিন্তু শ্যারন-চক্রই তো একে মিডিয়াতে নিয়ে এল। আমাদেরকেই বানাল জঘন্য ষড়যন্ত্রের আসামী। এখন শুধু আমাদের আত্মরক্ষা নয়, দেশ জনগণের স্বার্থেই গোটা বিষয় জনসমক্ষে আসা দরকার।’ বলল সারা জেফারসন।
‘এটাও স্বীকার করছি মিস জেফারসন। আগে কিছুটা আঁচ করতে পারলে আমি ওটা ছাপতে দিতাম না। আমার এডিটররা মনে করেছে শতাব্দীর সেরা জিনিস তারা হাতে পেয়েছে। তাই পাওয়ার সংগে সংগেই ছেপে দিয়েছে। এখন ওরা পড়েছে মহা সংকটে। এই মাত্র সম্পাদক সাহেব জনালেন, দেশ ও জাতিগত সম্প্রীতি মারাত্মকভাবে ভেঙে পড়বে যদি ওটা ছাপা হয়।’
থামল হাওয়ার্ড হেফলিন। তার চোখে মুখে গভীর চিন্তার ছাপ।
‘মাফ করবেন স্যার, আপনি কি জবাব দিয়েছেন?’ জিজ্ঞেস করল সারা জেফারসন।
‘জবাব দেইনি। ভাবছি। এ নিয়ে আরও সংকট দেখা দিয়েছে। প্রতিবাদটা আমাদের পত্রিকা অফিসে আসার পরই এর কপি সাংবাদিক কর্মচারীদের হাতেও দেখা গেছে। ভয়নাক উত্তেজনা এখন তাদের মধ্যেও। অধিকাংশ সাংবাদিক বলছে প্রতিবাদ না ছাপলে তারা প্রতিবাদের ভিত্তিতে নিউজ করবে। নিউজ না ছাপলে তারা পত্রিকা প্রকাশ হতে দেবে না। অন্যদিকে কিছু সিনিয়র এডিটরসহ সাংবাদিকদের একটা গ্রুপ এর বিরোধিতা করছে। এখন দেখছি আমার ঘরেই আগুন লাগার দশা। আমার অনুরোধ আপনারা একটা উপায় বের করুন।’ বলল খুব নরম কন্ঠে হাওয়ার্ড হেফলিন।
‘কি উপায়ের কথা বলছেন বুঝলাম না।’ বলল গোল্ড ওয়াটার।
‘কিছু মনে করবেন না আপনারা, আমি জানতে পেরেছি আমাদের তরুন ও যুবক সাংবাদিকদের উপর ‘ফেম’ মানে ‘ফ্রি আমেরিকা’ মুভমেন্টের দারুন প্রভাব। ‘ফেম’ ওদেরকে শান্ত করতে পারে।’ বলল হাওয়ার্ড হেফলিন দ্বিধা জড়িত কন্ঠে।
ভ্রুকুঞ্চিত হলো সারা জেফারসনের। তার মুখ লাল হয়ে উঠেছে। সে তাকালো আহমদ মুসার দিকে। তারপর হাওয়ার্ড হেফলিনের দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, ‘মি. হাওয়ার্ড আমাকে মাফ করবেন, সাংবাদিকদের শান্ত করা আপনার কাছে বড় হয়ে উঠল কেন? আপনি…….।’
সারা জেফারসনের কথার মধ্যেই হাওয়ার্ড হেফলিন বলে উঠল, ‘অন্যকিছু না মিস জেফারসন আমি আমার অফিসকে শান্ত করতে চাচ্ছি। দুএকদিন পর প্রতিবাদটা আমরা ছেপে দেব। অফিসের ঘটনায় আমি উদ্বিগ্ন এ কারণে যে, এ ধরনের ঘটনা কখনই ঘটেনি আমার অফিসে।’
‘স্যার বলুন, জেনারেল শ্যারনরা যা করেছে, সে ধরনের ঘটনাও কি এর আগে কখনও ঘটেছে?’ বলল সারা জেফারসন মি. হাওয়ার্ডকে লক্ষ করে।
‘না ঘটেনি।’ হাওয়ার্ড হেফলিন বলল।
‘স্যার, কোনদিন না ঘটা ঘটনা যখন ঘটে বসে, তখন তার প্রতিক্রিয়াও এমন হয় যা আগে কখনো হয়নি। সুতরাং আপনার অফিসে যা ঘটছে তা অস্বাভাবিক নয়।’
বলে একটু থেমে একটু চিন্তা করে আবার বলল, ‘স্যার এ সময়ের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন হলো সত্য প্রকাশ করা। জাতিগত বৈরিতার যে ভয় করছেন, সেটা দূর হবে সত্য প্রকাশ হলে। ওরা তো ইহুদী কম্যুনিটিকে একটা পক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়েছে। অথচ ঘটনা এটা নয়। ঘটনা হলো আন্তর্জাতিক একটা ইহুদী গোয়েন্দা চক্র, আমাদের দেশের ইহুদীদের একটা ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর যোগসাজসে ষড়যন্ত্র পাকিয়েছে। এই চক্র ও গোষ্ঠীর সাথে আমাদের ইহুদী নাগরিকদের কোন সম্পর্ক নেই। সত্য প্রকাশ হলেই শুধু এ বিষয়টা সকলের কাছে পরিস্কার হবে। সুতরাং সত্য যত তাড়াতাড়ি প্রকাশ হয় ততই ভাল।’ থামল সারা জেফারসন।
হাওয়ার্ড হেফলিন কোন জবাব দিল না। তাকিয়ে ছিল সারা জেফারসনের দিকে। যেন সারা জেফারসনের কথাগুলো বোঝা তার এখনও শেষ হয়নি।
সারা জেফারবসনই কথা বলে উঠল আবার। বলল, ‘আংকল হাওয়ার্ড, সবাইকে বিশেষ করে আহমদ মুসাকে নিয়ে আপনার কাছে এসেছি আপনাকে আমি জানি বলে। আংকল, আন্তর্জাতিকভাবে সক্রিয় একটা ইহুদীবাদী গোষ্ঠী আমেরিকানদেরকে যে আমেরিকানদের ঘরেই পরবাসী করে তুলছে এবং ব্যাপারটা অসহনীয় মাত্রায় পৌঁছে যাচ্ছে, এ বিষয়টা। মুষ্টিমেয় যে আমেরিকানরা বোঝে তাদের মধ্যে আপনিও একজন। জনাব আহমদ মুসা ইহুদী গোয়েন্দাদের ষড়যন্ত্র আবিস্কার করে আমেরিকানদের যে কি অমূল্য উপকার করেছেন তাও আপনি নিশ্চয় উপলব্ধি করেছেন। অথচ তাকেই সন্ত্রাসী সাজানো হয়েছে, ক্ষেপিয়ে তুলতে চেষ্টা করা হচ্ছে আমেরিকানদের তার বিরুদ্ধে। এই অবস্থায়ও কি আমরা সত্য প্রকাশ করব না? আপনার বিবেকের কাছে আমি এর ফায়সালা চাচ্ছি আংকল।’ থামল সারা জেফারসন।
ভাবনা ও বিষণ্ণতার কালো ছায়া কেটে যাচ্ছিল হাওয়ার্ড হেফলিনের মুখ থেকে। উজ্জ্বল হয়ে উঠল তার চোখ-মুখ। বলল, ‘ধন্যবাদ সারা জেফারসন। আমি আপনাদের সাথে আছি। আমি এখনি নির্দেশ দিচ্ছি আমার অফিসকে। আজই ছাপা হবে ঐ প্রতিবাদ।’
বলেই হাওয়ার্ড হেফলিন মুখ ঘুরালো আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘মি. আহমদ মুসা, এই ষড়যন্ত্র-সংঘাতের শেষ কিভাবে হবে আমি জানি না। কিন্তু প্রতিবাদের প্রতিটি শব্দ আমি বিশ্বাস করেছি। আমার মনে হচ্ছে, ঈশ্বর আপনাকে দিয়ে আমেরিকানদের জীবন এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা ঘটাল।’
আহমদ মুসা কিছু বলতে যাচ্ছিল এ সময় পাশে বসা বেঞ্জামিন বেকনের মোবাইলে টেলিফোন কল বেজে উঠল।
সে দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে হাওয়ার্ড হেফলিনের দিকে চেয়ে বলল, ‘মাফ করবেন স্যার, আমি টেলিফোন এ্যাটেন্ড করে আসছি।’ বলে বেঞ্জামিন বেকন দরজার দিকে চলে গেল।
আহমদ মুসা তার কথা বলার জন্যে আবার মুখ তুলল হাওয়ার্ড হেফলিনের দিকে। বলল, ‘ঠিকই বলেছেন জনাব, এটা ঈশ্বরই ঘটিয়েছেন। তাই আশা হয় জয় সত্যের দিকেই আসবে।’
আহমদ মুসা কথা শেষ করতেই সারা জেফারসন বলে উঠল, ‘আংকল, তাহলে এখন আমাদের উঠতে হয়। সামনের কয়েক ঘন্টা আমাদের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ।’
‘আর কোথায় যাচ্ছেন?’ জিজ্ঞেস করল হাওয়ার্ড হেফলিন।
‘ওয়াশিংটন পোষ্টে যেতে চাচ্ছিলাম।’ বলল সারা জেফারসন।
‘তবে চেয়ারম্যান বব বেনহামের কাছে নয়।’ বলল হাওয়ার্ড হেফলিন।
‘আমরা যাব ঠিক করেছি সম্পাদক ‘ওয়েন এ্যালার্ড’- এর কাছে।’
বলল সারা জেফারসন।
‘ওয়েন এ্যালার্ড ঠিক আছে। এ্যালার্ড প্যাট্রিয়ট এবং প্রফেশনাল। তারা সাহায্য আপনারা পাবেন। এতো গেল দুই পত্রিকার ব্যাপার, অন্যান্য পত্রিকার কি খবর?’ বলল হাওয়ার্ড হেফলিন।
‘সব পত্রিকায় প্রতিবাদ গেছে। আমাদের লোকও অফিসগুলোতে আছে। আমরা কথা বলেছি নিউইয়র্ক টাইমস ও নিউইয়র্ক পোষ্টের সাথে। আমাদের লোক সেখানে যাচ্ছে।’ সারা জেফারসন বলল।
এ সময় কক্ষে ফিরে এল বেঞ্জামিন বেকন।
‘ঈশ্বর আপনাদের সফল করুন’ বলেই হাওয়ার্ড হেফলিন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আসুন আমরা একটু চা খাই’
‘এ সময় চা না হলেও চলত। আমরা খুব ব্যস্ততার মধ্যে আছি।
বলল সারা জেফারসন উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে। সবাই উঠল নাস্তার জন্যে। নাস্তা শেষে হাওয়ার্ডের কাছে বিদায় নিয়ে আহমদ মুসারা গাড়িতে উঠল। গাড়ি বেরিয়ে এল হাওয়ার্ড হেফলিনের বাড়ি থেকে। ড্রাইভ করছিল বেঞ্জামিন বেকন। হাওয়ার্ডের বাড়ি থেকে কিছুটা এসে গাড়ি দাঁড় করাল সে।
বেঞ্জামিনের পাশের সিটে বসেছিল আহমদ মুসা। পেছনের সিটে গোল্ড ওয়াটার। তারও পেছনের সিটে পাশাপাশি বসেছে সারা জেফারসন ও তার পিএস ক্লারা কার্টার।
গাড়ি দাঁড় করিয়েই বেঞ্জামিন বেকন আহমদ মুসাকে বলল, ‘ম্যাডামকে একটা ইনফরমেশন দিতে হবে জনাব। আপনিও শুনুন।’
বলে বেঞ্জামিন বেকন পেছনে সারা জেফারসনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ম্যাডাম, এখনি যে টেলিফোন পেলাম ওটা ন্যান্সি ময়নিহানের। সে দুটো ইনফরমেশন দিল। একটা হলো, মিনিট পাঁচেক আগে সে হ্যারির টেলিফোন পায়। হ্যারি বলে, ‘আমি হ্যারি, বে’ভিউ স্ট্রিট, সেভ …….।’ এ শব্দ একটি বলার পর তার কথা বন্ধ হয়ে যায়। তার বদলে টেলিফোনে ভেসে আসে হ্যারির আর্তচিৎকার।’ ন্যান্সির মত হলো, হ্যারিকে যেখানে বন্দী করে রেখেছে, সুযোগ পেয়ে সেখান থেকে সে টেলিফোনে তার ঠিকানা বলতে গিয়েছিল, কিন্তু পারেনি ধরা পড়ে যাওয়ায় সে নিশ্চয় বাড়তি নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ন্যান্সির দ্বিতীয় ইনফরমেশন হলো, আগামীকাল সকাল ৮টায় জেনারেল শ্যারনদের সাথে ইন্টেলিজেন্স বিষয়ক হাউজ সিলেক্ট কমিটির চেয়ারম্যান এ্যান্ড্র জ্যাকবস ও ফরেন রিলেশন্স বিষয়ক হাউজ স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান দানিয়েল ময়নিহানের গোপন ও গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক। এ বৈঠকে দাওয়াত দেয়া হয়েছে ইন্টেলিজেন্স বিষয়ক সিনেট স্পেশাল কমিটির চেয়ারম্যান আনা প্যাট্রসিয়া, সিনেট ফরেন রিলেশন্স কমিটির চেয়ারম্যান বব ব্রুস, সিনেট স্পিকার চালর্স ডব্লিউ ওয়ারনার। প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার জন জে রিচার্ডসনসহ সিনেট ও প্রতিনিধি পরিষদের দুই সংখ্যাগুরু ও দুই সংখ্যালঘু নেতারাও উপস্থিত থাকবেন। এই বৈঠকে প্রেসিডেন্টকে ইমপীচ করার নীলনক্সা চূড়ান্ত করা হবে।’ থামল বেঞ্জামিন বেকন।
‘অত্যন্ত মূল্যবান খবর বেঞ্জামিন বেকন’। মিটিংটা কোথায় হবে? বলল আহমদ মুসা।
‘আজ রাতের মধ্যেই ন্যান্সি তা জানাবে বলেছে।’ বলল বেঞ্জামিন।
‘ধন্যবাদ মি. বেঞ্জামিন বেকন।’
বলে সারা জেফারসন আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল ‘মি. আহমদ মুসা, আমরা কি হ্যারিকে নিয়ে এখন কিছু ভাবতে পারি? ওকে উদ্ধার করা গেলে এই মুহূর্তে মূল্যবান তুরুপের তাস হতো সে।’
‘অবশ্যই ভাবা উচিত। বে’ভিউ স্ট্রিট চেনা গেল। কিন্তু ‘সেভ…..’ বলতে ‘সেভেন’, ‘সেভেনটিন, ‘সেভেনটি থেকে সেভেনটি নাইন’ ও ‘সেভেন হানড্রেড’ পর্যন্ত বুঝাতে পারে। বে’ভিউ স্ট্রিটের নাম্বার সেভেন হানড্রেড পর্যন্ত অবশ্যই যাবে না। তাহলে সেভেন হানড্রেড বাদ দিলে বাকি থাকে ১২টি নাম্বার। এই বারটি নাম্বার আমরা চেক করতে পারি। তার মধ্যে সেভেন ও সেভেনটিন আলাদা আলাদা, কিন্তু সেভেনটি থেকে সেভেনটি নাইন পর্যন্ত নাম্বার এক সাথেই পাওয়া যাবে। সুতরাং ওয়াশিংটন পোষ্টের সম্পাদকের বাসা থেকে ফেরার পথে বে’ভিউতে আমরা যেতে পারি একবার।’
সারা জেফারসনের মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে এঠেছে। বলল, ‘মি. আহমদ মুসা ধন্যবাদ আপনাকে। জটিল একটা সমস্যাকে, সম্পূর্ণ অনিশ্চিত একটা বিষয়কে ১২টি পয়েন্টে সীমাবদ্ধ করে ফেলেছেন আপনি। এখন আমার মনে হচ্ছে, সাফল্য আমাদের মুঠোয়।’ আনন্দে উচ্ছসিত কন্ঠে বলল সারা জেফারসন।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, এর মধ্যেও অনেকগুলো ‘যদি’ আছে মিস জেফারসন। যদি হ্যারি ‘বে ভিউ স্ট্রিট’ নামটি ঠিক বলে থাকে। কারণ সেখানে ‘বে ভিউ এভেনিউ’ ‘বে ভিউ লেন’ এবং ‘বে ভিউ ফি ওয়ে’ নামে আরও তিনটি রাস্তা আছে। যদি হ্যারি…….।’
আহমদ মুসার কথার মাঝখানেই কথা বলে উঠল সারা জেফারসন। বলল, ‘মি. আহমদ মুসা ওয়াশিংটনকে আপনি এত ভাল জানেন? আমার জীবনের অধিকাংশ সময় কেটেছে ওয়াশিংটনে। এর মধ্যে শত শতবার গেছি বে’ এলাকায়। কিন্তু ‘বে’ নামের একাধিক রাস্তা আছে কি না কখনও লক্ষ্য করিনি, নাম জানা তো দূরের কথা।
‘আপনি আমেরিকার নাগরিক, আর আহমদ মুসা প্রয়োজনে আমেরিকা এসেছেন। সুতরাং দুজনের আমেরিকা দেখা তো এক হবে না।’ বলল বেঞ্জামিন বেকন।
আহমদ মুসা পিঠ চাপড়ে বেঞ্জামিনকে বলল, ‘ঠিক বলেছেন মি. বেঞ্জামিন বেকন। এখন গাড়ি স্টার্ট করুন।’
গাড়ি চলতে শুরু করল আবার।
‘তাহলে আমরা বে ভিউ’ তে যাচ্ছি তো?’ বলল সারা জেফারসন আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে।
‘অবশ্যই, আমি মনে করি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ।’ বলল সারা জেফারসন।
নিরব সবাই।
ছুটে চলেছে গাড়ি।
ক্লারা কার্টার সারা জেফারসনের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল ‘উনি অবশ্যই’ বলে থেমে যেতে পারতেন। এর সাথে ‘আমি মনে করি’ যোগ করলেন কেন?’
সারা জেফারসন হাসল। বলল ক্লারা কার্টারের কানে কাছে মুখ নিয়ে, ‘অবশ্যই’ সিদ্ধান্তটি উনি সবার উপর চাপাতে চান না। ‘আমি মনে করি’ বলে ‘অবশ্যই’ এর কার্যকারিতা তিনি নিজের উপর সীমাবদ্ধ রাখলেন।’
‘বাব্বা! কি সচেতন আর সুক্ষদর্শীরে বাবা! বলল ক্লারা কার্টার চোখ কপালে তুলে।
‘ও যে কদিন আমাদের মন্টিসেলোতে ছিল, তুমি তো ছিলে না। থাকলে দেখতে। সুক্ষদর্শী, দূরদর্শী, প্রিয়দর্শী-কি নন উনি!’ বলল সারা জেফারসন মিষ্টি হেসে।
‘প্রিয়দর্শীও বলছেন? মুখ টিপে হেসে বলল ক্লারা কার্টার।
তোমার চোখে কি বলে?‘ বলল সারা জেফারসন।
‘আমার চোখ কি আপনার মত অত উপরে উঠতে পারে!’ বলল ক্লারা কার্টার দুষ্টমির হাসি হেসে।
সারা জেফারসন ক্লারা কার্টারের পিঠে একটা কিল দিয়ে বলল, ‘তার মানে? কি বলতে চাচ্ছ তুমি?
‘কিছু নয়, এক্সকিউজ মি ম্যাডাম।’
বলে একটু থেমেই আবার বলল ক্লারা কার্টার, ‘তাহলে বে’ভিউতে সত্যি আমরা যাচ্ছি? এই রাতে।
‘হ্যাঁ।’ বলল সারা জেফারসন।
‘আমার কিন্তু ভয় করছে। কিছু যদি ঘটে সেখানে।’ ক্লারা কার্টার বলল।
‘ভয় করছে আহমদ মুসার সাথে থাকার পরেও? ও সাথে থাকলে আমি আগুনেও ঝাঁপ দিতে পারি এই বিশ্বাসে সে আগুনও পানি হয়ে যাবে ওঁর স্পর্শে।’ সারা জেফারসনের হাল্কা কন্ঠ হঠাৎ ভারী হয়ে উঠল।
ক্লারা কার্টার স্তম্ভিত দৃষ্টিতে তাকাল সারা জেফারসনের দিকে। পাথরের মত শক্ত ও অনড় যার ব্যক্তিত্ব, বরফের মত ঠান্ডা যার আবেগ, সেই সারা জেফারসনের আজ এ দশা!
কোন কথা বলতে পারল না ক্লারা কার্টার।
হাসল সারা জেফারসন। বলল, ‘অবাক হয়েছ না। অবাক হওয়ার কিছু নেই। মাধ্যাহ্নের শক্তি নিয়ে সূর্য যদি আসে, বরফের সব শক্তি তখন পানি হয়ে যায়।’
‘এটাই বুঝতে চেষ্টা করছি ম্যাডাম।’ বলল ক্লারা কার্টার।
‘কিন্তু বুঝবে না তুমি ক্লারা। মধ্যাহ্ন সূর্যের সেই দহন জ্বালা যে কি বরফকে তা কেমন করে পোড়ায়, গলায়, নিজে তা উপলবদ্ধি করা ছাড়া বুঝবে না।’ বলল সারা জেফারসন। তার ঠোঁটে এক টুকরো বেদনার হাসি।
ক্লারা কার্টার কিছু বলতে পারল না। সারা জেফারসনের একটা হাত তুলে নিল হাতে।
ক্লারা কার্টারের এই মমতার স্পর্শে সারা জেফারসনের পিয়াসা-বুভুক্ষ হৃদয়টা লজ্জাবতী গাছের মত নেতিয়ে পড়ল। সারা জেফারসনের মাথা ধীরে ধীরে নুয়ে পড়ল ক্লারা কার্টারের কাঁধে।
ক্লারা কার্টার আরেক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল সারা জেফারসনকে।
অনেক্ষণ পর ক্লারা কার্টার সারা জেফারসনের কানে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘বরফবক্ষের এই বন্যাকে নিয়ে সূর্য কি ভাবছেন?’
‘ওদিকের কথা রাখ। সূর্যটা দৃষ্টিহীন, বাকহীন, অনুভুতিহীন এক পাথর। বন্যার আছড়ে পড়া শত আকুতি সে পাথরে কোন স্পন্দন তোলে না।’ বলল অস্ফুট, ম্লান কন্ঠে সারা জেফারসন।
‘এ অবিশ্বাস্য কথা।’
‘না এটা বিশ্বাস্য।
‘কারণ?’
‘কারণ আহমদ মুসা শুধু মানুষ নন, তিনি ‘মুসলিম মানুষ’। মুসলিম নৈতিকতা আমাদের জন্যে একটা অবিশ্বাস্য বস্তু। আর এই অবিশ্বাস্য বস্তুটিই আমাকে আরও পাগল করে তুলেছে।’ বলল সারা জেফারসন।
‘তাহলে?’
‘এই তাহলের উত্তর ভবিষ্যত বলবে, আমি কিছু জানি না, কিছু ভাবতে পারি না আমি।’
কাঁপা গলায় কথাগুলো বলতে বলতে সারা জেফারসন ক্লারা কার্টারের কাঁধ থেকে মাথা তুলে শরীরটা এলিয়ে দিল গাড়ির সিটে।
ক্লারাও নির্বাক হয়ে গেল।
চলছে তখনও গাড়ি ফুল স্পীডে।

পটোম্যাক বে’র ফ্রি ওয়ে’ ধরে ছুটে চলেছে আহমদ মুসাদের গাড়ি।
বে’ভিউ ফ্রি ওয়ে থেকে প্রবেশ করা যাবে বে ভিউ এভেনিউতে এবং বে’ভিউ এভেনিউ দিয়ে প্রবেশ করতে হবে বে ভিউ স্ট্রিটে।
এই বে ভিউ স্ট্রিট আহমদ মুসাদের লক্ষ্য।
ঘড়ির দিকে তাকাল আহমদ মুসা। দেখল ১০টা পার হয়ে গেছে। আসলে ওয়াশিংটন পোস্টের সম্পাদক ওয়েন এ্যালার্ড -এর ওখানে সময়টা একটু বেশিই গেছে। তবে আহমদ মুসা খুশি যে, ওয়েন এ্যালার্ড এর কানে সব কথা তুলে দেয়া গেছে। আরও খুশি হয়েছে সে এটা দেখে যে, আমেরিকানদের মাথায় কাঠাল ভেঙে খাওয়া এবং আমেরিকানরা নিজ দেশে পরবাসী হওয়ার ব্যাপারটা ওয়েন এ্যালার্ডদের কাছে পরিস্কার। তিনি জানিয়েছেন, তার সাংবাদিকদের শতকরা আশিজনই ‘ফ্রি আমেরিকা’ মুভমেন্ট ও ‘হোয়াইট ঈগল’- বিরোধী ঐ নিউজ বিশ্বাস করেনি। নিউজে মার্কিন প্রেসিডেন্ট, প্রশাসন ও আহমদ মুসার সাথে ‘ফ্রি আমেরিকা’ ও ‘হোয়াইট ঈগল’কে ব্রাকেটেড করায় প্রেসিডেন্ট ও আহমদ মুসার প্রতিও সাধারণভাবে সমর্থন ও সিমপেথি বেড়েছে।
ওয়েন এ্যালার্ড’- এর সাথে আলোচনার কথা ভাবতে গিয়ে আহমদ মুসার সামনে এসে দাঁড়াল সারা জেফারসন। হাওয়ার্ড হেফলিন ও ওয়েন এ্যালার্ড- এর সাথে আলোচনায় সারা জেফারসন যে ভূমিকা পালন করেছে তা মুগ্ধ করেছে আহমদ মুসাকে। সারার কথা ছিল যেমন শক্ত ও তেমনি হৃদয়স্পর্শী। সত্যি সে টমাস জেফারসনের যোগ্য উত্তরসুরী। দুর্লভ সব মানবিক গুণাবলীর অধিকারী না হলে শুধু দেশপ্রেম দিয়ে এ ধরনের মানুষ তৈরি হয় না। ভাবী আমেরিকার সে হবে এক বিস্মকর নেত্রী।
হঠাৎ মন খারাপ হয়ে গেল আহমদ মুসার। অপরূপ চরিত্রের এ ধরনের অতুল সম্ভাবনাময় এক মেয়ে না জেনে না বুঝে অন্ধকার-বক্ষে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে কেমন করে!। আহমদ মুসা কখনও কোন সময় সারা জেফারসনের প্রতি কোন দুর্বলতা দেখিয়েছে বলে মনে পড়ে না। একটি স্বপ্নকে সে তার জন্যে অবধারিত সত্য বলে ধরে নিয়েছে। মন কেঁপে উঠল আহমদ মুসার। সর্বাধুনিক মানুষও এভাবে কোন বিশ্বাসে বাঁধা পড়ে যেতে পারে, ভাবতেও বিস্ময়বোধ হয় তার।
আহমদ মুসার চিন্তায় ছেদ পড়ে গেল বেঞ্জামিন বেকনের কথায়। বেঞ্জামিন বেকন বলছিল, ‘জনাব, আমরা বে ভিউ এভেনিউ- এর মাঝামাঝি এসে গেছি।’
আহমদ মুসা সম্বিত ফিরে পেয়ে তাকাল চারিদিকে। বলল, ‘ঐ তো সামনে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে সবুজের গুচ্ছ। ওটা বে বিউটি পার্কের মুখ। বে’পর্যন্ত নেমে গেছে পার্কটি। পার্কের এ পাশ মানে পূর্ব পাশ বরাবর উত্তরে বে পর্যন্ত বিলম্বিত বে ভিউ স্ট্রিট। এ স্ট্রিটে ঢুকে যান, তারপর রাস্তার সাইড লাইন দিয়ে ধীরে ধীরে গাড়ি চালান। প্রথমে দেখতে হবে রাস্তার নাম্বারিং এ্যারেজমেন্টা কি।
গাড়ি গিয়ে পৌঁছল বে ভিউ স্ট্রিটের মুখে।
স্ট্রিটের মুখে একটা গোল চক্কর। গোল চক্করটি একটা ছোট্ট বাগান। চক্করটির পূর্ব পাশ দিয়ে বে ভিউ স্ট্রিটে ঢোকার পথ, আর পশ্চিম পাশ স্ট্রিট থেকে গাড়ি বেরিয়ে আসার পথ। চারদিকটা অনেকটাই নির্জন। বিশেষ করে বে ভিউ স্ট্রিটে গাড়ি তেমন দেখা যাচ্ছে না।
আহমদ মুসাদের গাড়ি বে ভিউ স্ট্রিটে প্রবেশ করে দুশ গজের মত এগিয়েছে। এ সময় আহমদ মুসা দেখল দুটি গাড়ি এই পথ ধরে পাগলের মত ছুটে আসছে।
আহমদ মুসা এই বেআইনি ও অস্বাভাবিক ঘটনা দেখেই বুঝল, হয় দুই গাড়িই পালাচ্ছে, নয়তো সামনেরটা পালাচ্ছে পেছনের গাড়িটা তাকে তাড়া করছে।
আহমদ মুসা বেঞ্জামিন বেকনকে গাড়ি দাঁড় করাতে বলল।
সংগে সংগেই দাঁড়িয়ে পড়ল আহমদ মুসাদের গাড়ি।
আর প্রায় সাথে সাথেই সামনে থেকে ছুটে আসা সামনের গাড়িটা আহমদ মুসাদের গাড়ির প্রায় নাক ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়ল এবং সংগে সংগেই একটা নারীকন্ঠ ‘বাঁচাও’ ‘বাঁচাও’ বলে চিৎকার করে উঠল।
সামনে থেকে আসা দ্বিতীয় গাড়িটাও তখন এসে পথম গাড়িটার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে।
আহমদ মুসা ও বেঞ্জামিন বেকন দুজন দুদিক থেকে নেমে পড়েছে।
আহমদ মুসা দেখল, দ্বিতীয় গাড়ি থেকে একজন লোক হাতে রিভলবার নিয়ে লাফিয়ে পড়ছে প্রথম গাড়িটার উপর।
মেয়েটার তখন চিৎকার বন্ধ হয়ে গেছে। সে কাঁপছে থর থর করে।
রিভলবারধারী লোকটা মেয়েটাকে বলল, ‘তোমার কোন ভয় নেই। তোমাকে হাইজ্যাক করতে আসিনি। তোমার গাড়িতে আমাদের একটা জিনিস উপর থেকে ছিটকে এসে পড়েছে। ওটা নিয়েই আমি চলে যাব।’
আহমদ মুসা ও বেঞ্জামিন বেকন এসে দাঁড়িয়েছে মেয়েটির গাড়ির পশ্চিম পাশে। মেয়েটির বয়স চব্বিশ পঁচিশ বছরের মত হবে। তার গাড়িটা একটা ওপেনটপ কার। টপটা ফোল্ড হয়ে আছে পেছন দিকে।
মেয়েটা আহমদ মুসা ও বেঞ্জামিন বেকনকে দেখে কিছুটা সাহস পেয়েছে। সে গাড়ির এ প্রান্তে সরে এসেছে। এক পা সে নিচে নামিয়ে দিয়েছে। যাতে দরকার হলেই সে দৌড় দিয়ে আহমদ মুসাদের কাছে আসতে পারে।
‘কি ঘটেছে ম্যাডাম?’ বলল আহমদ মুসা মেয়েটির দিকে তাকিয়ে।
মেয়েটি ভয়ে রিভলবারধারীর দিকে একবার তাকাল। তারপর বলল, ‘সেভেনটি থ্রি বে ভিউ স্ট্রিটে আমার বান্ধবী থাকেন। সে বাইরে থেকে তখনও বাড়ি এসে পৌছায়নি। আমি তার অপেক্ষা করছিলাম। হঠাৎ এই লোকটি এসে বলে সে আমার গাড়ি দেখবে। বলে সে গাড়িতে উঠতে চেষ্টা করে। আমি প্রতিবাদ করি, বাধা দেই। সে রিভলবার বের করে। আমি সংগে সংগে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে পালাবার চেষ্টা করি।’
মেয়েটির বলা ‘সেভেনটি থ্রি’ শব্দটি আহমদ মুসার বুকটাকে ছ্যাঁত করে তোলে। আহমদ মুসারা যে নাম্বারগুলো খুঁজছে তার মধ্যে সেভেনটি থ্রিও রয়েছে।
‘উনি বলছেন, আপনার গাড়িতে উপর থেকে কিছু ছিটকে এসে পড়েছে, এ কথাটি কি ঠিক?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা মেয়েটিকে।
‘এ রকম কিছু ঘটেছে বলে আমার মনে পড়ছে না। আমি কোন শব্দ শুনিনি। ’ বলল মেয়েটি দৃঢ়তার সাথে।
মেয়েটির কথা শেষ হতেই রিভলবারধারী লোকটি আহমদ মুসা ও বেঞ্জামিন বেকনের দিকে রিভলবার উচিয়ে বলল, তোমরা এখানে নাক গলাতে এস না। মানে মানে সরে পড়। না হলে ভাল হবে না।
আহমদ মুসা যেন রিভলবারধারীর কথা শুনতেই পায়নি এমন একটা ভাব নিয়ে লোকটিকে বলল, আপনিই বলুন তো এর গাড়িতে আপনাদের কি এসে পড়েছে?
লোকটি এমন প্রশ্ন যেন আশাই করেনি। মুখে তার বিব্রতভাব ফুটে উঠল। কিন্তু পরক্ষনেই তার মুখের বিব্রতভাব কেটে গিয়ে প্রচন্ড ক্রোধের চিহ্ন ফুটে উঠল চোখে মুখে। লোকটা তীব্র কণ্ঠে বলল, ‘আপনারা এখান থেকে সরে না গেলে আমি কিন্তু এরপর কথা বলব না, গুলী করব।’
কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই লোকটার রিভলবার থেকে একটা ‘ক্লিক’ শব্দ উঠল। এর অর্থ তার রিভলবার এখন গুলী করার জন্যে প্রস্তুত।
আহমদ মুসা আবারও তার কথা শুনতেই পায়নি এমন ভাব করে বলল, ‘আপনার জিনিসের আপনি নাম জানেন না। ঠিক আছে জিনিসটি আপনি খুঁজে বের করুন। তবে শর্ত হলো, আপনি আপনার জিনিসটা নিয়ে যেতে পারবেন আমাদেরকে ও মেয়েটাকে তা দেখানোর পর।’
ক্রোধে জ্বলে উঠল রিভলবারধারী লোকটি। তার তর্জ্জনি সক্রিয় হয়ে উঠল তার রিভলবারে…….।
আগে থেকেই আহমদ মুসার ডান হাতটি খেলা করছিল কোটের বোতাম নিয়ে।
চোখের পলকে তার হাতটি চলে গিয়েছিল কোটের নিচে। তার হতাটা সেখান থেকে বের হওয়া ও গুলী বর্ষণের ঘটনা এক সাথেই ঘটল।
রিভলবারধারীর হাত থেকে ছিটকে পড়ে গেল রিভলবার। আহমদ মুসার গুলী তার হাত গুড়িয়ে দিয়েছে।
লোকটির কাছে ঘটনাটা ভূত দেখার মতই সংঘটিত হয়েছে। লোকটির চোখে মুখে যন্ত্রণা ও বিস্ময়ের ছাপ।
আহমদ মুসার রিভলবার উদ্যত তখনও লোকটির প্রতি।
‘নেমে আসুন গাড়ি থেকে।’ নির্দেশ দিল আহমদ মুসা লোকটিকে। লোকটি একবার আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে নেমে এল গাড়ি থেকে।
‘মি. বেঞ্জামিন দেখুন তো গাড়িতে কিছু পান কি না, যা বাইরে থেকে ছিটকে এসে পড়তে পারে।’ বলল আহমদ মুসা বেঞ্জামিনকে লক্ষ্য করে।
মেয়েটা গাড়ি থেকে নেমে এসেছে। বেঞ্জামিন বেকন উঠে গেল গাড়িতে।
গাড়ির সিট এবং গাড়ির ফ্লোর সে তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখতে লাগল।
এমন সময় সে আনন্দে বলে উঠল, ‘পেয়েছি মি. আহমদ মুসা। কিন্তু মজার জিনিস।
বেঞ্জামিন বেকন জিনিসটি নিয়ে উঠে দাঁড়াল। তার হাতে একটা পেন্সিল ব্যাটারি। ব্যাটারির সাথে একটা ভাজ করা কাগজ বাঁধা।
ভ্রুকুঞ্চিত হলো আহমদ মুসার। পরক্ষণেই স্বাভাবিক হলো এই ভেবে যে, নিশ্চয়ই বান্ধবীর বাসার কেউ এই কায়দায় চিঠি পাঠিয়েছিল মেয়েটিকে। আবার কেউ মজাও করতে পারে এইভাবে।
‘ম্যাডাম দেখুন তো, কাগজটা কি জিনিস। আপনার কি না।’
আহমদ মুসা বলল মেয়েটিকে।
মেয়েটি কম্পিত হাতে ব্যাটারির সাথে বাঁধা কাগজটি হাতে নিল।
এ সময় লোকটি মরিয়া হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল মেয়েটির উপর।
সম্ভবত মেয়েটির হাত থেকে জিনিসটিকে কেড়ে নেয়ার জন্যে।
মেয়েটির হাত থেকে ছিঠকে পড়ল জিনিসটি। মেয়েটিও কাত হয়ে পড়ে গেল।
লোকটি তুলে নিচ্ছিল জিনিসটি।
আহমদ মুসা রিভলবারটি পকেটে রেখে নিচু হয়ে লোকটিকে টেনে তুলল।
তার হাত থেকে জিনিসটি কেড়ে নিয়ে তার ঘাড়ে একটা চাটি মেরে বলল, ঠিক ঠাক দাঁড়িয়ে থাক, আবার বেয়াদবী করলে আরও শাস্তি পাবে।’
বলে আহমদ মুসা কাগজটি খুলে নিল ব্যাটারি থেকে। ভাজ করা কাগজটি খুলে চোখের সামনে মেলে ধরল।
লেখার উপর চোখ পড়তেই প্রথমে তার চোখে মুখে বিস্ময় এবং পরে আনন্দে ভরে উঠল তার মুখ। ভাজ করা কাগজটির লেখা সে পড়লঃ
‘‘আমি, হ্যারি, সেভেনটি টু বে ভিউ স্ট্রিটে বন্দী। পুলিশকে বলুন অথবা ৩৩৭-৫৩৯৫০ অথবা ৮৭৯-৯৭৯৫০তে টেলিফোন করুন।’’
আহমদ মুসা কিছু না বলে কাগজটি বেঞ্জামিন বেকনের হাতে তুলে দিল। সে পড়েই চিৎকার করে উঠল, ‘ইজ আলমাইটি।’
সারা জেফারসন ও গোল্ড ওয়াটার এসে আহমদ মুসার পাশে দাঁড়িয়েছে। দুজনেই প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়েছে আহমদ মুসার দিকে।
‘মি. বেঞ্জামিন ওকে বেঁধে নিয়ে ওর গাড়িতে উঠুন।’
একথা বলার সময়ই আহমদ মুসা বেঞ্জামিনের হাতের কাগজটি নিয়ে সারা জেফারসনের হাতে দিল এবং তাড়া খেয়ে ছুটে আসা সেই মেয়েটিকে লক্ষ্য করে বলল, ‘আপনি হ্যারি এডওয়ার্ড নামের কোন ছেলেকে নিশ্চয় চেনেন না। বিপদগ্রস্থ সেই হ্যারিরই ওটা একটা আবেদন।’
‘না ও নামের কোন ছেলেকে আমি জানিনে।’ ভীত চোখে শুকনো কন্ঠে বলল মেয়েটি।’
‘অহেতুক আপনার একটা ধকল গেল, আপনি এখন যেতে পারেন বোন।’ আহমদ মুসা বলল।
‘যাব? আর কিছু ভয় নেই তো?’ বলল মেয়েটি।
‘লোকটিকে আমরা ধরে রাখছি। তাকে দরকার আমাদের। আপনার কোন ভয় নেই।’ আহমদ মুসা বলল।
‘পুলিশকে আমি কিছু বলব স্যার?’ মেয়েটি বলল।
‘যা ঘটেছে সেটা বলে একটা ডাইরী আপনি অবশ্যই করতে পারেন। আপনাকে তাড়া করা এ লোকটির ঠিকানা এই চিঠি অনুসারে আপনার বান্ধবীর বাসার আগের বাসাটি মানে ‘সেভেনটি টু’।’
‘থ্যাংকস স্যার। থ্যাংকস অল।’ বলে মেয়েটি গিয়ে গাড়িতে উঠল।
‘থ্যাংকস গড। এযে আল্লাহর অভাবিত সাহায্য মি. আহমদ মুসা। সন্দেহ নেই আল্লাহ আমাদের বিজয়ী করবেন।’ বলল সারা জেফারসন আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে।
‘এখন তাহলে কি করণীয় মি. আহমদ মুসা?’ গোল্ড ওয়াটার বলল।
‘আমরা এখন হ্যারিকে উদ্ধার করতে যাব। বেঞ্জামিন লোকটাকে নিয়ে ঐ গাড়িতে উঠবে। ওরা আগে যাবে আমরা ফলো করবো। ‘সেভনটি টু’র পাশেই কোথাও গাড়ি দাঁড় করাতে হবে।’
কথাগুলো শেষ করেই আহমদ মুসা তাকাল বেঞ্জামিন বেকনের দিকে। বেঞ্জামিন বেকন লোকটিকে বেঁধে পাশের সিটে তুলে নিজে ড্রাইভিং সিঠে উঠে বসেছে। আহমদ মুসা তাকে বলল, ‘মি. বেঞ্জামিন, ওর কাছ থেকে দুএক মিনিটের মধ্যে সব কথা শুনতে চাই। ওর এক হাত গেছে, দরকার হলে আরেক হাত যাবে। দরকার হলে ওর মাথাটাও। সব কথা আমরা চাই।’ নরম কিন্তু অত্যন্ত শক্ত উচ্চারণে কথাগুলো বলল আহমদ মুসা।
লোকটি তার বাম হাত দিয়ে আহত ডানহান চেপে ধরে বসে আছে। বেঞ্জামিন বেকন পকেট থেকে রিভলবার বের করে সামনে ড্যাশ বোর্ডের উপর রাখতে রাখতে লোকটিকে লক্ষ্য করে বলল, ‘হ্যারি ও সেভনটি টু বাবা সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানালে রিভলবার ব্যবহারের দরকার হবে না।’
বেঞ্জামিন গাড়ি ঘুরিয়ে নেবার জন্যে গাড়ি স্টার্ট দিল।
আহমদ মুসারাও গাড়ির দিকে এগুলো।
বেঞ্জামিন বেকনের গাড়ি সেভনটি টু বাসাটির সামনে প্রাইভেট ওয়াকিং প্লেসে গিয়ে দাঁড়াল।
আহমদ মুসাও তার গাড়ি বেঞ্জামিন বেকনের গাড়ির পাশে নিয়ে দাঁড় করাল।
আহমদ মুসা গাড়ির জানালা দিয়ে মুখ বাড়াল বেঞ্জামিন বেকনের দিকে।
বেঞ্জামিন বেকনও মুখ বাড়িয়েছে। বলল আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে, ‘সহজেই কাজ হয়ে গেছে মি. আহমদ মুসা। সে বলছে, আজ বিকেলে ওদের পবিত্র সাবাত দিবসের অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। সবাই চলে গেছে। সেই শুধু বাসায় ছিল। সুতরাং বাসা এখন খালি।’ থামল বেঞ্জামিন বেকন।
আহমদ মুসার ভ্রুকুঞ্চিত হলো।
‘তারপর’? বলল আহমদ মুসা।
‘আমি পরীক্ষা করার জন্যে মোবাইল দিয়ে টেলিফোন করেছিলাম। কেউ ধরেনি। চারবার রিং হবার পর এ্যানসার মেশিন বলছে, সবাই বাইরে, মেসেজ থাকলে বলুন।’
‘মেসেজ কিছু দিয়েছেন?’ বলল আহমদ মুসা।
‘না’। বলল বেঞ্জামিন বেকন।
আহমদ মুসার ঠোঁটে এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল। রহস্যময় হাসি।
‘টেলিফোন করতে কি লোকটিই বলেছিল?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘কথাটা সত্য কিনা পরীক্ষা করার জন্যে সেই বলেছিল। কেন জিজ্ঞেস করছেন এ কথা?’ বেঞ্জামিন বেকনের চোখে সন্দেহের ছায়া।
আহমদ মুসা বেঞ্জামিন বেকনের জিজ্ঞাসার দিকে কান না দিয়ে পেছনে তাকিয়ে গোল্ড ওয়াটারকে বলল, আপনি ড্রাইভিং-এ আসুন এবং এ গাড়ি সামনে এগিয়ে নিয়ে নিরাপদ কোথাও পার্ক করুন। আমি এই গাড়িতে যাচ্ছি। ওগাড়ি এখানেই থাকবে।’
নেমে যাচ্ছিল আহমদ মুসা।
‘জনাব, কি ঘটছে জানতে পারি কিনা?’ পেছন থেকে গম্ভীর কণ্ঠে বলল সারা জেফারসন।
আহমদ মুসা না নেমে সিটে ফিরে এল। হাসল। বলল, ‘স্যরি সিম জেফারসন, তাড়াহুড়ার মধ্যে আমি ভুলে গেছি। আমার মনে হচ্ছে, আমাদের উপস্থিতি শত্রুদের জানা হয়ে গেছে। ‘বাড়িতে কেউ নেই, সবাই সাবাত অনুষ্ঠানে গেছে’ লোকটির এই কথা সত্য নয়। এবং লোকটি ঐ ভাবে টেলিফোন করিয়ে আমাদের মানে শত্রুর উপস্থিতি তাদের জানিয়ে দিয়েছে। এই অবস্থায় আমি চাচ্ছি আপনারা একটু দূরে গিয়ে অপেক্ষা করুন। আমরা এখানে ওদের অপেক্ষায় থাকব।’
‘আমাদের করণীয়?’ জিজ্ঞেস করল সারা জেফারসন।
‘ঘটনা কোনদিকে গড়ায়……..।’ কথা শেষ করতে পারলো না আহমদ মুসা।
পাশের গাড়ি থেকে বেঞ্জামিন বেকন চিৎকার করে উঠল, ‘মি. আহমদ মুসা, আমার মনে হচ্ছে সামনে ও পেছন থেকে ওরা আসছে।’
বেঞ্জামিন বেকনের কথা কানে আসার সাথে সাথেই গুলীর শব্দও কানে এল আহমদ মুসার।
আহমদ মুসা মুখ ঘুরিয়ে সামনে ও পেছনটা একবার দেখে নিল, পেছন থেকে একটা মাইক্রো এবং সামনে থেকে একটা জীপ গুলী করতে করতে ছুটে আসছে।
আহমদ মুসা একবার তাকাল সেভেনটি টু নাম্বার বাড়ির দিকে। বাড়ির সামনেটা নিচু প্রাচীর ঘেরা। ভেতরে বাগান। প্রাচীরের সামনের ওয়ালে গ্রিলের হাল্কা গেট। গেটের পর একটা রাস্তা বাগানের মধ্যে দিয়ে সোজা এগিয়ে মূল গেটে গিয়ে ঠেকেছে।
আহমদ মুসা গাড়ির দরজা বন্ধ করে সোজা হয়ে বসল সিটে। শক্ত হাতে ধরল স্টেয়ারিং হুইল।
মুখ ঘুরিয়ে জানালা দিয়ে বলল, ‘মি. বেঞ্জামিন, ফলো মি।’
আর পেছন দিকে মুখ না ঘুরিয়েই বলল, ‘মিস জেফারসন আপনারা সিটে শুয়ে পড়ুন। শক্ত করে সিট ধরে রাখুন।’
কথা বলার সাথে সাথে আহমদ মুসা গাড়ি ঘুরিয়ে প্রচন্ড গতিতে ছুটা শুরু করেছে ‘সেভেনটি টু’ নাম্বার বাড়ির গেট লক্ষ্যে। কয়েক মুহূর্তে।
আহমদ মুসার ছয় সিটের বিরাট হাইল্যান্ডার জীপটি ‘সেভেনটি টু’ নাম্বার বাড়ির বহিঃ প্রাচীরের গ্রিলের গেটটি ভেঙে বাগানের পথটুকু পাড়ি দিয়ে তীব্র গতিতে বারান্দায় উঠে মূল গেটে আঘাত হানল।
মূল গেটটি সাবেক আমলের দুই পাল্লার বিরাট কাটের দরজা। তার গায়ে সাধারণ যাতায়াতের জন্যে উইনডো ডোর রয়েছে।
তীব্র গতিতে এসে ঝাঁপিয়ে পড়া কয়েকটা ওজনের গাড়ির প্রচন্ড আঘাতে দুপাশের দেয়ালের একাংশ ধ্বসিয়ে নিয়ে গেট ভূমিশয্যা নিল।
গেট পেরিয়ে আহমদ মুসার গাড়ি বাড়ির ভেতরে প্রকান্ড এক করিডোরে এসে দাঁড়াল।
গাড়ির বাম পাশ দিয়ে কয়েক ধাপ এগুলেই দুতলায় ওঠার সিঁড়ি।
গাড়ি দাঁড় করিয়েই আহমদ মুসা পেছন দিকে লক্ষ্য করে বলল, ‘মি. গোল্ড ওয়াটার আপনার সিটের নিচের দুটি ষ্টেনগান নিয়ে নেমে যান। আপনি এবং বেঞ্জামিন গেট রক্ষা করবেন। আমি ভেতরটা দেখছি।’
সংগে সংগে গোল্ড ওয়াটার স্টেনগান নিয়ে ভাঙা গেটের দিকে ছুটল। বেঞ্জামিনে গাড়ি তখন ভেতরের ভাঙা গেট পর্যন্ত এসে ঠেকেছে।
আহমদ মুসা গাড়ি থেকে মাটিতে পা রাখতেই উপরে সিঁড়িতে অনেকগুলো পায়ের শব্দ পেল। আহমদ মুসা চট করে দুপা পেছনে সরে এসে সামনের গাড়ির আড়াল নিয়ে বসল।
দ্রুত নেমে আসা পায়ের শব্দ আরও নিকটবর্তী হলো। আহমদ মুসা দেখল, ষ্টেনগান হাতে নিয়ে তিনজন লোক নেমে আসছে। সিঁড়ির শেষ ল্যান্ডিং- এ এসে ওরা গাড়ি দেখতে পেল। সংগে সংগে ওরা গাড়ি লক্ষ্যে শুরু করল গুলীবৃষ্টি।
এ অবস্থায় আহমদ মুসার পক্ষে দাঁড়ানো বিপজ্জনক। ল্যান্ডিং এ দাঁড়ানো ওদের ষ্টেনগানের গুলী যে এ্যাংগেলে আসছে, তাতে গুলীর টার্গেট হচ্ছে গাড়ির মাথার দিকটা।
আহমদ মুসা তার মেশিন রিভলবার বাগিয়ে মাটিতে গড়িয়ে গড়িয়ে ইঞ্চি ইঞ্চি করে এগুলো ল্যান্ডিং-এ দাঁড়ানো ওদেরকে টার্গেটে আনার জন্যে।
আহমদ মুসা গাড়ির মাথার দিকে বাম পাশের চাকার আড়ালে মুখ নিয়ে উঁকি দিল সিঁড়ির দিকে। খুশি হলো আহমদ মুসা। ওদের পায়ের দিকটা দেখা যাচ্ছে না বটে, কিন্তু তাদের দেহের উপরের অংশটা দেখা যাচ্ছে। আহমদ মুসা তার মেশিন রিভলবারের নল ওদের দিকে ঘুরিয়ে নিল।
এই সময় আহমদ মুসা দেখল ওরা তিনজন নামতে শুরু করেছে। গুলী কিন্তু ওদের চলছেই। সম্ভবত গুলীর কোন রিপ্লাই না পেয়ে ওরা নেমে আসছে।
ওরা সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করায় ওদের গুলীর গতি ডান দিকে একটু সরে গেছে। গাড়ির মাথা বরাবর আর গুলী আসছে না।
আহমদ মুসা চট করে উঠে দাঁড়াল। আহমদ মুসার রিভলবারের নল ওদের তিন জনের লক্ষ্যে উদ্যত।
আহমদ মুসার তর্জ্জনি রিভলবার ট্রিগারে। আহমদ মুসা দাঁড়ানোর সংগে সংগে ওরা দেখতে পেয়েছে আহমদ মুসাকে। চমকে উঠে ওরা ওদের ষ্টেনগানের নল ঘুরিয়ে নিচ্ছিল আহমদ মুসার দিকে।
‘দেখ, মৃত্যু না চাইলে তোমরা ষ্টেনগান ফেলে দাও। হেরে গেছ তোমরা।’ আহমদ মুসার গম্ভীর কণ্ঠে ধ্বনিত হলো কঠোর এই নির্দেশ।
কিন্তু ষ্টেনগানের নল ওদের ঘুরিয়ে নেয়া বন্ধ হয়নি।
আহমদ মুসার তর্জ্জনি চেপে বসল তার এম ১০ রিভলবারের ট্রিগারে। অবিরাম গুলীর বৃষ্টি গিয়ে ছেঁকে ধরল ওদের তিনজনকে।
ওদের ষ্টেনগানের নল পুরোপুরি ঘুরে স্থির হবার আগেই ঝরে পড়ে গেল ওদের তিনটি দেহ সিঁড়ির উপর।
আহমদ মুসা তার রিভলবার ঐ ভাবে ধরে রেখে মুহূর্তকাল অপেক্ষা করল। না কেউ এল না।
আহমদ মুসা তার রিভলবার বাগিয়ে ধরে সরে এল গাড়ির দরজার দিকে। সরা জেফারসনদের দরজা খুলে ফেলল বাম হাত দিয়ে। দেখল সারা জেফারসন ও ক্লারা কার্টার উঠে বসছে গাড়ির মেঝে থেকে।
জ্বলে উঠা গাড়ির ভতরের আলোতে আহমদ মুসা দেখল সারা জেফারসনের কপালের বাম পাশে একটা জায়গা থেঁতলে গেছে। রক্ত বেরুচ্ছে।
‘মিস জেফারসন, ভাল আছেন আপনি? আর কোনও আঘাত লাগেনি তো?’ উদ্বিগ্ন কণ্ঠ আহমদ মুসার।
‘না । ভাল আছি।’ বলল সারা জেফারসন নরম গলায়।
আহমদ মুসা তার হাত ধরে গাড়ি থেকে বের করে আনল।
তাড়াতাড়ি পকেট থেকে রুমাল বের করে কপালের আহত জায়গা থেকে গড়িয়ে আসা রক্ত মুছে ফেলে ক্ষতের উপর রুমালটা চাপা দিয়ে বরল, ‘রুমালটা এভাবে কিছুক্ষণ ধরে রাখুন রক্ত পড়া বন্ধ হয়ে যাবে।
গাড়ি থেকে বেরিয়ে এল ক্লারা কার্টার।
বলল, ‘গাড়িটা বারান্দায় লাফিয়ে ওঠার সময় সাইডের গ্লাস লকের পয়েন্টটা ওর কপালে লেগেছে।’
গেটে তখন উভয় পক্ষের প্রচন্ড গোলাগুলী শুরু হয়ে গেছে।
‘মিস জেফারসন, মোবাইলটা আপনার ব্যাগে আছে?’ দ্রুত জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘জি আছে।’ বলল সারা জেফারসন।
‘আপনি জর্জ আব্রাহামকে টেলিফোন করুন। হ্যারিকে উদ্ধারের এই স্পটে ওদের আসা প্রয়োজন।’
সারা জেফারসন দ্রুত তার মোবাইল বের করল। কিন্তু টেলিফোন করার আগেই আহমদ মুসা বলল, ‘মিস জেফারসন ও মিস কার্টার আপনারা আমার সাথে আসুন। এখানে থাকা নিরাপদ নয়। উপরে আরও লোক থাকতে পারে। খুঁজে বের করতে হবে হ্যারিকে।’
বলে আহমদ মুসা ছুটল সিঁড়ির দিকে।
মিস জেফারসন ও মিস ক্লারা কার্টারও তার পেছনে পেছনে ছুটল।
সিঁড়ির উপর পড়ে থাকা ওদের তিনজেনর লাশ পার হয়ে যাবার সময় আহমদ মুসা বলল, ‘আমার অনুমান আরও একজন লোক ওদের আছে এবং সে হ্যারিকে পাহারা দিচ্ছে।’
দুতলায় উঠে ওরা দেখতে পেল সোফা সাজানো বিশাল ড্রইং রুম।
এই ড্রইং রুম থেকে কয়েকটি করিডোর এদিক ওদিক হয়ে বিভিন্ন কক্ষের দিকে চলে গেছে।
আহমদ মুসারা সারা জেফারসনকে বলল, ‘আপনি এ সিঁড়ি মুখটায় বসে জরুরী টেলিফোন সেরে নিন। আমি এদিক ওদিক ঘুরে একটু দেখে নেই।
সারা জেফারসন জর্জ আব্রাহামের নাম্বারগুলোর উপর নক করে মুখ তুলল আহমদ মুসার দিকে। তার মুখ গম্ভীর। বলল, ‘আপনাকে একা ছাড়ব না, আমিও একা থাকব না।’
হাসল আহমদ মুসা। বলল ‘ঠিক আছে কথা সেরে নিন। আমি এখানেই আছি।’
বলে আহমদ মুসা আশ-পাশটা দেখার জন্যে এগিয়ে গেল।
আহমদ মুসা অনুমান করল, রাস্তার দিকে জানালা আছে এমন একটা কক্ষে হ্যারিকে রাখা হয়েছে। এই অনুমান করে বাড়ির কক্ষগুলোর অবস্থান বুঝার চেষ্টা করল।
আহমদ মুসার মনে হলো, দুতলার সিঁড়ির মুখ থেকে যে করিডোর লম্বালম্বী দুদিকে চলে গেছে, তার পশ্চিম পাশের কোন একটা কক্ষেই হ্যারিকে রাখা হয়েছে।
হঠাৎ আহমদ মুসার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তার মনে পড়ল, হ্যারি চিঠি ছুঁড়ে দিয়েছিল ‘সেভেনটি থ্রি’ নাম্বার বাড়ির পাশে দাঁড়ানো গাড়িতে। তাহলে হ্যারি বন্দী আছে নিশ্চয় ‘সেভেনটি থ্রি’ নাম্বার বাড়ির দিকের যে কোন কক্ষে। এর অর্থ সিঁড়ির-মুখ হয়ে যে করিডোর উত্তর দিকে গেছে, সেই করিডোর দিয়ে এগুলেই বাম পাশে কোথাও হ্যারির কক্ষ পাওয়া যাবে।
আহমদ মুসা ফিরে এল সারা জেফারসনদের কাছে।
আহমদ মুসা আসতেই সারা জেফারসন হাসি মুখে আহমদ মুসাকে বলল, ‘আংকেলের সাথে কথা বলেছি। সব শুনেছেন উনি। আসছেন এখনি।’
‘ধন্যবাদ। এদিকে আরেক সমস্যার সমাধানও হয়ে গেছে। আমি মনে করি উত্তর দিকে যাওয়া এই যে করিডোরটা, এর পাশে কোথাও কোন কক্ষে আমরা হ্যারিকে খুঁজে পাব।’
আহমদ মুসা উত্তরমুখী হয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। আর সারা জেফারসন ও মিস ক্লারা দক্ষিণমুখী হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
হঠাৎ আহমদ মুসার চোখে পড়ল উত্তরের সেই করিডোরে একজন লোক যেন ভুতের মত এসে আবির্ভুত হলো। তার হাতে ষ্টেনগান। তার হাতের ষ্টেনগানের নল উঠে আসছে এদিকে লক্ষ্যে।
‘মিস জেফারসন আপনারা শুয়ে পড়ুন, পেছনে গুলী।’ চিৎকার করে বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা তার এই চিৎকারের সাথে সাথে নিজের দেহ পাশে মেঝের উপর ছুড়ে দিয়ে রিভলবার ঘুরিয়ে নিল করিডোরের দিকে। রিভলবার ট্রিগার চাপল করিডোর লম্বালম্বী টার্গেট করে।
ওদিক থেকেও ব্রাশ ফায়ারের শব্দ কানে এল। গুলীগুলো আহমদ মুসাদের মাথার উপর দিয়ে চলে গেল।
আহমদ মুসা শুয়ে থেকেই তাকিয়ে দেখল লোকটি করিডোর থেকে উধাও হয়ে গেছে।
আহমদ মুসা নিশ্চিত হলো, এত তাড়াতাড়ি দৌড়ে কোথাও সে পালাতে পারে না, নিশ্চয় যেখানে সে দাঁড়িয়ে ছিল, সেখানেই পাশে কোন দিকে দরজা আছে। ঐ দরজা পথেই সে সরে গেছে এবং সে দরজা নিশ্চয়ই করিডোরের বাম পাশে হবে।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। উঠে দাঁড়াচ্ছিল সারা জেফারসনও।
‘আপনারা ঠিক আছেন তো?’ সারা জেফারসনের দিকে তাকিয়ে বলল আহমদ মুসা।
হ্যাঁ সুচক মাথা নাড়ল সারা জেফারসন। কথা বলতে গিয়ে তাকিয়ে ছিল আহমদ মুসা সারা জেফারসনের মুখের দিকে। দেখল, সারা জেফারসনের কপালের ক্ষত দিয়ে তখনও রক্ত ঝরছে। নিশ্চয় আহত জায়গাটায় আবার আঘাত লেগেছে, ভাবল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা সেই উত্তর করিডোরের দিকে একবার তাকিয়ে সরে এল সারা জেফারসনদের কাছে। বলল, ‘ভুলে গিয়েছিলাম আমার পকেটে অটো ব্যান্ডেজ আছে। আপনার কপালের ক্ষত দিয়ে দেখছি রক্ত ঝরছে।’
আহমদ মুসা পকেট থেকে ক্ষুদ্র একটা প্যাকেট বের করে তার মধ্যে থেকে একটা ব্যান্ডেজ বেছে নিয়ে সারা জেফারসনের মুখোমুখি দাঁড়াল। সারা জেফারসনের কাছ থেকে রুমালটি চেয়ে নিয়ে তার চোখের প্রান্ত দিয়ে নেমে আসা রক্ত মুছে দিল। তারপর দ্রুত ক্ষতটা ভালো করে মুছে নিয়ে ব্যান্ডেজটা ভালো করে বসিয়ে তার চারদিকটা ভালো করে পেষ্ট করে দিল।
ব্যান্ডেজ লাগানোর সময় চোখ বুঁজে ছিলা সারা জেফারসন। প্রশান্তিতে প্রদীপ্ত হয়ে উঠেছিল তার চেহারা।
ব্যান্ডেজ পেষ্টিং শেষে আহমদ মুসা বলল, ‘আপনার নার্ভ দারুন শক্ত। আপনার মুখ দেখে মনে হলো না এ ধরনের একটা ক্ষতের ড্রেসিং আপনার হলো।’
তখন চোখ খুলেছে সারা জেফারসন। বলল, ‘কোন কোন ব্যাথা কখনও কখনও আনন্দ দেয়। আমার তো মনে হচ্ছিল, এমন ক্ষত যদি আমার গোটা শরীরে হতো।!’
সারা জেফারসনের কথাগুলো আহমদ মুসার মুখে ঔজ্জ্বল্য যেন ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিল।
আহমদ মুসা তাড়াতাড়ি ঘুরে দাঁড়িয়ে দ্রুত কণ্ঠে বলল, ‘মিস জেফারসন, আপনারা আমার সাথে আসুন।’
বলেই আহমদ মুসা উত্তর করিডোর ধরে ছোটা শুরু করল।
তার পেছনে পেছনে ছুটল সারা জেফারসন ও ক্লারা কার্টার।
লোকটিকে যেখানে দাঁড়ানো দেখেছিল, সেখানে গিয়ে দাঁড়াল আহমদ মুসা।
খুশি হলো আহমদ মুসা। দেখল, পাশেই পশ্চিম দিকে একটা দরজা। এই দরজা দিয়ে লোকটি ভেতরে ঢুকে গেছে।
দরজায় আহমদ মুসা চাপ দিয়ে দেখল দরজা বন্ধ। সারা জেফারসনরা আহমদ মুসার পেছনে এসে দাঁড়াল।
আহমদ মুসা পেছনে তাকিয়ে সারা জেফারসনকে বলল, ‘এই ঘরে শত্রুদের একজন রয়েছে।’
আহমদ মুসা ফিরে তাকাল দরজার দিকে। তার রিভলবারের নল সে সেট করল দরজার কি হোলে তারপর ট্রিগার চেপে রাখল কয়েক সেকেন্ড। এবং সংগে সংগেই এক ঝটকায় সরিয়ে দিল দরজা এবং সেই সাথেই বিস্ময়কর দ্রুততার সাথে নিজের দেহটা কয়েকবার শূন্যে ডিগবাজি খেয়ে এগিয়ে গেল। দাঁড়াল গিয়ে ঘরের মাঝখানে।
ঘরের ভেতরে ষ্টেনগানধারী লোকটি ষ্টেনগান হাতে দাঁড়িয়েছিল চেয়ারে বেঁধে রাখা হ্যারির কাছে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ভোজবাজির মত ঘটনা ঘটে গেল এবং ঘরের মাঝখানে এসে দাঁড়ানো শত্রুর রিভলবার হ্যারির দিকে স্থির লক্ষ্যে উদ্যত এবং বিহব্বল হয়ে পড়া লোকটি শেষ মুহূর্তে মরিয়া হয়ে তার ষ্টেনগানের নল হ্যারির মাথায় ঠেকিয়ে চিৎকার করে উঠল, ‘এই মুহূর্তে তোমরা বেরিয়ে না গেলে হ্যারির মাথা গুড়ো হয়ে যাবে।’
ইতিমধ্যে সারা জেফারসনরাও ঘরে প্রবেশ করেছিল। সারা জেফারসনের হাতে রিভলবার।
কথা বলার সময় লোকটির দুচোখ নিবদ্ধ ছিল আহমদ মুসার দুচোখের দিকে।
লোকটির কথা শেষ হবার আগেই আহমদ মুসা লোকটির সোজা পেছনে জানালার দিকে তাকিয়ে দ্রুত একটা ইশারা করল। যেন জানালার দাঁড়ানো কাউকে কিছু নির্দেশ দিল আহমদ মুসা।
ষ্টেনগানধারী লোকটি আহমদ মুসার ইশারার প্রায় সংগে সংগেই কোন অমোঘ টানে পেছন দিকে তাকাল।
এই সুযোগটাই চাচ্ছিল আহমদ মুসা। লোকটির চোখ পেছন দিকে ঘুরতে শুরু করার সংগে সংগেই আহমদ মুসার প্রস্তুত রিভলবার গুলী করল লোকটির ষ্টেনগানের বাট লক্ষ্যে।
লোকটি যে বোকা বনেছে তা বুঝে চোখ আবার ঘুরিয়ে নেবার আগেই তার হাত থেকে ষ্টেনগান ছিটকে পড়ে গেল এবং তার দুই হাতও বিধ্বস্ত হয়ে গেল আহমদ মুসার মেশিন রিভলবারের গুলীতে।
লোকটি একটি আর্তচিৎকার করে বসে পড়ল মেঝেতে।
আহমদ মুসা রিভলবার পকেটে রেখে হ্যারির কাছে গিয়ে তার বাঁধন খুলে দিল।
হ্যারির চোখে মুখে আঘাতের চিহ্ন। গায়ের জামা ছেঁড়া। যে নাইট পোশাকে সে ঘুমিয়ে ছিল, সেই পোশাক এখনও তার পরনে। মাথার চুল তার পাগলের মত উস্কো খুস্কো।
আহমদ মুসা তার বাঁধন খুলে দিতেই হ্যারি কেঁদে উঠে জড়িয়ে ধরল আহমদ মুসাকে।
আহমদ মুসা হ্যারির পিঠ চাপড়ে আদর করে বলল, ‘তোমার অনেক কষ্ট হয়েছে, কিন্তু তোমার জাতির তুমি অসম্ভব উপকার করেছ হ্যারি।’
হ্যারিকে বুক থেকে ছেড়ে দিয়ে বলল, তোমাদের নেত্রীকে চেন হ্যারি?
‘কে, ম্যাডাম সারা জেফারসন?’ চোখ মুছে বলল হ্যারি।
‘হ্যাঁ।’ বলে আহমদ মুসা সারা জেফারসনকে দেখিয়ে বলল, ‘ইনি তোমাদের ম্যাডাম সারা জেফারসন।’
হ্যারির বিস্ময় ও অপার শ্রদ্ধা মিশ্রিত দুই চোখ মুহূর্তের জন্য স্থির হলো সারা জেফারসনের প্রতি। তারপর চোখ দুটি নিচু হলো তার। মাথা ঝুঁকিয়ে দীর্ঘ বাউ করল হ্যারি সারা জেফারসনকে। বরল, ‘ম্যাডাম আমরা গর্বিত আপনার জন্যে।’
‘ওয়েলকাম হ্যারি। তোমরা আমেরিকার গর্ব।’
বলে একটু থামল সারা জেফারসন। পরক্ষণেই আবার বলল হ্যারিকে লক্ষ্য করে, ‘ওঁকে চেন, যিনি তোমাকে মুক্ত করলেন?’
হ্যারি আহমদ মুসার দিকে তাকাল।
বলল, ‘জি না।’
‘আহমদ মুসাকে চেন? উনি সবার স্বপ্নের সেই আহমদ মুসা।’ বলল সারা জেফারসন।
শুনেই হ্যারি মুহূর্তের জন্যে পাথরের মত স্থির হয়ে গেল। তারপর ঝাঁপিয়ে পড়ল আহমদ মুসার পায়ের উপর। বলতে লাগল, ‘থ্যাংকস গড। আমি ভাগ্যবান স্যার।’
আহমদ মুসা তাকে টেনে তুলল।
এই সময় ঘরে প্রবেশ করল জর্জ আব্রাহাম, গোল্ড ওয়াটার ও বেঞ্জামিন বেকন।
জর্জ আব্রাহাম সোজা এসে আহমদ মুসার সাথে হ্যান্ডশেক করে বলল, ‘আমি সব শুনলাম। কৃতজ্ঞ আমরা আপনার কাছে আহমদ মুসা।’
‘ধন্যবাদ জনাব। কিন্তু যা হচ্ছে তা সবই আল্লাহর কাজ।’ বলল আহমদ মুসা। তারপর বেঞ্জামিন বেকনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ওদিকের খবর কি?’
উত্তর দিল বেঞ্জামিন বেকন। বলল, ‘আগেই একজন ছিল আমাদের হাতে। এখানে একজন ধরা পড়েছে। আর দুই গাড়ি থেকৈ ধরা পড়েছে আও ৮ জন। আর মারা পড়েছে পাঁচজন।
বেঞ্জামিন বেকন থামতেই জর্জ আব্রাহাম বলে উঠল, ‘আমরা C.B.S ও C.B.C টেলিভিশন নেটওয়ার্ককে খবর দিয়েছি। ওরা আসছে। এখানে আমাদের হ্যারি, মিস জেফারসন, গোল্ড ওয়াটার ও বেঞ্জামিন বেকনকে দরকার তাদের বক্তব্যের জন্যে। আমরা চাই এটা বড় একটা স্টোরি হোক।’
‘অসংখ্য ধন্যবাদ মি. জর্জ আব্রাহাম। সময়ের একটা গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে আল্লাহর সাহায্য এটা।’
থামল একটু আহমদ মুসা। আবার বলল, ‘তাহলে মি. জর্জ আব্রাহাম, আমি এখন এখান থেকে ছুটি পেতে পারি।’
‘ছুটি নয় একটু আড়ালে যাওয়া আর কি।’ বলল জর্জ আব্রাহাম।
‘তাহলে আমি চলি, ওরা হয়তো এসে পড়বে এখনি।’ বলে হ্যান্ডশেকের জন্যে হাত বাড়াল জর্জ আব্রাহামের দিকে।
মুখ মলিন হয়ে গেছে সারা জেফারসনের। আহমদ মুসাকে আড়ালে পাঠাবার সিদ্ধান্ত তার মন মেনে নিতে পারেনি।
জর্জ আব্রাহাম আহমদ মুসাকে কিছু বলতে যাচ্ছিল। তার আগেই সারা জেফারসন বলে উঠল, ‘আংকল আমিও এসব ফরমালিটির মধ্যে থাকতে চাই না।’ বেঞ্জামিন বেকন ‘ফ্রি আমেরিকা’ মুভমেন্টের প্রতিনিধিত্ব করবে। আমি এখনি চলে যেতে চাই।’
জর্জ আব্রাহাম তাকাল আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসা কিছু না বলে তাকাল সারা জেফারসনের দিকে।
সারা জেফারসন বলল, ‘ফ্রি আমেরিকার পক্ষ থেকে আমি কখনই জন সমক্ষে আসিনি। আজও আসতে চাই না। তাছাড়া সংশ্লিষ্ট সবার থাকা বা কথা বলার দরকার নেই, যেমন আপনি থাকতে পারছেন না।’
জর্জ আব্রাহাম আবার তাকাল আহমদ মুসার দিকে।
‘ঠিক আছে। আমার মনে হয় মিস জেফারসন ঠিকই বলেছেন।
তাছাড়া উনি আহতও।’ বলল আহমদ মুসা।
জর্জ আব্রাহাম এবার মাথা নেড়ে সায় দিল আহমদ মুসার কথায়।
জর্জ আব্রাহাম থামতেই সারা জেফারসন বলে উঠল, ‘চলুন মি. আহমদ মুসা, চল ক্লারা।’
‘বেঞ্জামিন বেকন একটি ট্যাক্সি ডেকে দাঁড় করিয়ে রেখেছে ‘সেভেনটি থ্রি’ নাম্বার বাড়ির সামনে। আপনারা বের হবেন পেছনের একটা বিকল্প দরজা দিয়ে। বেঞ্জামিন আপনাদের পৌছে দিয়ে আসবে।’ বলল জর্জ আব্রাহাম।
সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আহমদ মুসা আর একদফা হ্যারির পিঠ চাপড়ে দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে এল।
‘সেভেনটি থ্রি’ নাম্বার বাসার সামনে আহমদ মুসারা যখন গাড়িতে উঠল, তখন ঘড়িতে রাত সাড়ে ১১টা বাজে।

আহমদ মুসারা ওয়াশিংটন পোষ্টের সম্পাদক ‘ওয়েন এ্যালার্ড’ এর বাসা থেকে বের হয়ে আসার আধ ঘন্টা পরে ওয়াশিংটন পোষ্টের চেয়ারম্যানের কক্ষে জরুরী মিটিং বসেছে।
বড় টেবিলটার একপাশে বসেছেন ওয়াশিংটন পোষ্টের শেয়ারের বৃহত্তর অংশের মালিক ও পরিচালনা পরিষদের চেয়ারম্যান বব বেনহাম। এবং অন্যপাশে বসেছেন পত্রিকার সম্পাদক ওয়েন এ্যালার্ড। টেবিলে আরও হাজির আছেন পত্রিকার বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপক বিল গ্রাহাম এবং ল’ অফিসার শিফার সিমশন।
খুবই অস্বাভাবিক ধরনের মিটিং এটা।
চেয়ারম্যান বব বেনহাম তার গোটা কার্যকালে এই প্রথমবার পত্রিকায় প্রকাশিতব্য একটা বিষয়ে আলোচনার জন্যে তার টেবিলে কল করছেন সম্পাদক এবং পত্রিকার আরও দুজন গুরুত্বপূর্ণ অফিসারকে।
চেয়ারম্যান বব বেনহাম পরিস্থিতি সম্পর্কে দীর্ঘ ব্রিফিং দেয়ার পর। সম্পাদক ওয়েন এ্যালার্ড বলল, ‘পরিস্থিতি খুবই নাজুক নিঃসন্দেহে। আমরা যদি ‘ফ্রি আমেরিকা’ মুভমেন্ট ও ‘হোয়াইট ঈগল’ এর দেয়া প্রতিবাদ ছাপি, তাহলে মার্কিন জাতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ ইহুদী কম্যুনিটির স্বার্থকে ও তাদের ভবিষ্যতকে একটা বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেয়া হবে একথা সত্য। কিন্তু সমস্যা দাঁড়িয়েছে আমরা আমেরিকান জুইস পিপলস লগী (AJPL) এর সরবরাহ করা আহমদ মুসা সম্পর্কিত যে নিউজ ছেপেছি, তাতে ‘ফ্রি আমেরিকা’ মুভমেন্ট ও ‘হেয়াইট ঈগল কে প্রত্যক্ষভাবে জড়ানো হয়েছে। সুতরাং তাদের কথা বলা এবং আমাদের তা প্রকাশ করা তাদের লিগ্যাল রাইট হয়ে দাঁড়িয়েছে। দ্বিতীয় বিষয় তাদের প্রতিবাদ ছাপার সময়। আমরা তা আজও ছাপতে পারি, দুদিন পরেও ছাপতে পারি। কিন্তু সমস্যা দাঁড়িয়েছে, ওরা নগদ টাকা পে করে আমাদের প্রথম পাতার এক চতুর্থাংশ স্পেস আজকের জন্যে কিনে নিয়েছে প্রতিবাদটা বিজ্ঞাপন আকারে ছাপার জন্যে। আমরা প্রতিবাদ না ছাপলেও এই স্পেস তারা আজ ব্যবহার করবে। সুতরাং নিউজ আকারে না ছাপলেও প্রতিবাদটা বিজ্ঞাপন আকারে যাচ্ছেই। প্রতিবাদটা যখন এভাবে যাচ্ছেই, তখন প্রতিবাদটা নিউজ আকারে না ছেপে আমরা আমাদের ক্রেডিবিলিটি হারাতে যাবো কেন? তৃতীয় যে বিষয়টা আমাদের এই মুহূর্তে বিবেচ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে সেটা হলো আমাদের সাংবাদিক কর্মচারীদের সাধারণ সেন্টিমেন্ট। প্রতিবাদটার কপি তারা সকলে পেয়ে গেছে। তারা প্রতিবাদটা ছাপার জন্যে প্রবল চাপ সৃষ্টি করছে। তারা হুমকি দিয়েছে আমেরিকার জনগণের স্বার্থ ও জাতীয় নিরাপত্তার সাথে সাংঘাতিকভাবে জড়িত ও প্রতিবাদ নিউজ যদি না ছাপা হয়, তাহলে আজ তারা পত্রিকা বের হতে দেবে না এবং তারা আইনেরও আশ্রয় নেবে। আমাদের জন্যে শেষ বিবেচ্য বিষয়টি হলো, আমাদের সহযোগী পত্রিকাগুলো কি করছে।’ থামল সম্পাদক ওয়েন এ্যালার্ড।
কিছুক্ষণ নিরবতা। ভাবছিল সবাই।
অবশেষে নিরবতা ভাঙল বব বেনহাম। বলল ল’ অফিসার শিফার সিমশনকে লক্ষ্য করে, ‘আলোচনায় কতগুলো লিগ্যাল প্রশ্ন এসেছে, তোমার মত কি?’
‘স্যার, প্রথম প্রশ্ন সম্পর্কে একথা আমরা সকলেই জানি, প্রতিবাদ ছাপা ওদের লিগ্যাল রাইট, তবে কবে, কতখানি ছাপা হবে এটা সম্পাদকের এখতিয়ার। দ্বিতীয়ত ওরা যদি সব ফর্মালিটি পূর্ণ করে স্পেস কিনে থাকে আজকের জন্যে, তাহলে ওদের বিজ্ঞাপনটি না ছাপা হলে ওরা কোটি কোটি ডলারের ক্ষতিপূরণ দাবী করে মামলা করতে পারে। তৃতীয় হলো সাংবাদিক কর্মচারীদের ইউনিয়ন দাবীর ব্যাপারা। আইনত ওদের পত্রিকা বন্ধ রাখার কোন এখতিয়ার নেই তবে তারা জাতীয় স্বার্থে ও নিরাপত্তার ইস্যু তুলে আইনের আশ্রয় নিতে পারে।’ থামল ল’ অফিসার শিফার সিমশন।
ল, অফিসারের ওপিনিয়নে সম্পাদক ওয়েন এ্যালার্ডের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। কিন্তু মলিন হয়ে পড়ল চেয়ারম্যান বব বেনহানের মুখমন্ডল।
চেয়ারম্যান বব বেনহাম তাকাল বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপক বিল গ্রাহামের দিকে। বলল, ‘ওদের স্পেস কেনার ব্যাপারটা কি?’
বিল গ্রাহাম নড়ে চড়ে বসল। বলল, ‘স্যার, আইন মাফিক নগদ টাকায় আজকের জন্যে স্পেস কিনেছে ওরা।’
‘বিজ্ঞাপনের বিষয়বস্তুও কি তোমরা ও.কে করে দিয়েছো? বলল বব বেনহাম ক্ষিপ্ত কণ্ঠে।
‘জি স্যার।’ শুকনো কণ্ঠে বলল বিল গ্রাহাম।
‘যে কোন বিজ্ঞাপনকেই কি ও.কে করা যায়?’ বব বেনহামের কণ্ঠে বিরক্তি।
‘রাষ্ট্র বিরোধী ও জাতীয় স্বার্থের পক্ষে ক্ষতিকারক হলে তা ও.কে করা যায় না স্যার। কিন্তু ওটা ছিল একটা নিউজ ক্ল্যারিফিকেশন বা প্রতিবাদ।’
জবাবে আর কোন কথা বলল না চেয়ারম্যান বব বেনহাম। চেয়ারে গা এলিয়ে দিল। চোখে মুখে তার হতাশার চিহ্ন। আর ভেতরে তার উদ্বেগের ঝড়। সে আমেরিকান জুইস পিপলস লীগের শীর্ষ উপদেষ্টাদের একজন। জুইস লীগের উপর যে আঘাত আসবে, তার একটা অংশ তার উপরও এসে পড়বে। কিন্তু কি করবে সে! আর এর দায় আমরা আমেরিকার শান্তিবাদী ইহুদীরা নেব কেন? কিন্তু উপায় কি? ঘরে আগুন লাগলে যে সবাই পুড়ব। তাহলে কি করা যায়?
সোজা হয়ে আবার বসল চেয়ারম্যান বব বেনহাম। বলল সম্পাদককে উদ্দেশ্য করে, ‘আইনগত সমস্যা আছে। কিন্তু আইনকে ভয় পাই না। এর মোকাবিলা করার সময় পাব। এখন মি. ওয়েন এ্যালার্ড আপনি দেখুন অন্য পত্রিকাগুলো কি করছে। এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।’
‘আমি মিটিং এর আসার আগে নিউইয়র্ক টাইমস ও নিউইয়র্ক পোষ্টের সাথে কথা বলে এসেছি। ওরা আলোচনা করার পর প্রতিবাদ ছাপার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আজ ওরা প্রতিবাদ ছাপছে। ওয়াল স্ট্রিট শুনেছি, তখন পর্যন্ত ওদের ছাপার সিন্ধান্ত হয়নি।’
মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল বব বেনহামের। বলল, ‘ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের হাওয়ার্ড হেফলিন খুব শক্ত ও বিবেচক লোক। সে নাও ছাপতে পারে। তাহলে আমরা দুটি পত্রিকা অন্তত এক সাথে থাকতে পারি।’
বলে টেলিফোন তুলল বব বেনহাম। টেলিফোন করল ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের চেয়ারম্যান হাওয়ার্ড হেফলিনকে।
কথা শুরু করল বব বেনহাম খুব আনন্দের সাথে পরে মুখ তার অন্ধকার হয়ে গেল।
আলোচনা শেষ করে শিথিল হাতে টেলিফোনটা রেখে হতাশভাবে চেয়ারে গা এলিয়ে দিল। মুহূর্তখানেকের জন্যে চোখ বুজল।
তারপর চোখ খুলে হতাশভাবে তাকাল সম্পাদক ওয়েন এ্যালার্ড এর দিকে। বলল, ‘মি. এ্যালার্ড, সবাই প্রতিবাদ ছাপছে। আপনি না ছেপে কেমন করে পারবেন? ঠিক আছে ছেপে দিন।’
বলে আবার চোখ বুজল বব বেনহাম।
ঘরে নামল এক অস্বস্তিকর নিরবতা।
প্রতিবাদ ছাপার সিদ্ধান্তে খুশি হয়েছে সম্পাদক ওয়েন এ্যালার্ড, ল’ অফিসার সিমশন এবং বিজ্ঞাপন ব্যবস্থাপক বিল গ্রাহাম। তবে চেয়ারম্যান বব বেনহামের কথা ভেবে তারা মনে খুবই পীড়া অনুভব করছে।
নিরবতা ভেঙে সম্পাদক ওয়েন এ্যালার্ড ধীর কণ্ঠে বলল, ‘আমরা এখন উঠতে পারি? আর কোন নির্দেশ আমাদের প্রতি?’
চোখ বন্ধ রেখেই বব বেনহাম বরল, ‘না মি. এ্যালার্ড আর কোন কথা নেই। আপনারা আসুন। গুড নাইট।’
উঠে দাঁড়াল ওরা তিনজন। ঘর থেকে বেরিয়ে আসার জন্যে পা বাড়াল তারা সবাই।

গভীর রাত। পশ্চিম ওয়াশিংটনের নিউ এজ সিনাগগের বিপরীত দিকে রাস্তার ওপারের একটা বিশাল বাড়ির ভেতরের একটি কক্ষ কয়েকটি সোফায় মুখোমুখি বসে আছে জেনারেল শ্যারন, কাউন্সিল অফ আমেরিকান জুইস এ্যাসোসিয়েশনস- এর চীফ ডেভিড উইলিয়াম জোনস এবং জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনের হাতে ‘ফ্রি আমেরিকা’ ও ‘হোয়াইট ঈগল’ থেকে যে প্রতিবাদ পাঠানো হয়েছে পত্রিকাগুলোতে সেই প্রতিবাদলিপির একটা কপি। এই কপির উপরই চোখ বুলাচ্ছিল জেনারেল হ্যামিল্টন।
পড়া শেষ করে মুখ তুলল সে। তার বিমর্ষ চোখে মুখে এবার চরম বিস্ময়। বলল সে, ‘মি. শ্যারন, আপনি তো প্রতিবাদের এ কপিটা পড়েছেন। আপনার অভিমত কি এ সম্পর্কে?’
‘মি. হ্যামিল্টন ওতে যা আছে তা ওদের অভিমত।’ বলল জেনারেল শ্যারন।
‘সেটা বুঝেছি। কিন্তু এ অভিমত সত্য কিনা? তারা যে প্রমাণসমূহ উল্লেখ করেছে তা মিথ্যা প্রমাণ করতে আমরা পারব কিনা?’ বলল জেনারেল হ্যামিল্টন।
‘সেটা তো বিচারের প্রশ্ন। আমাদের প্রতিবাদ আমরা অবশ্যই করব।’ জেনারেল শ্যারন বলল।
জেনারেল হ্যামিল্টনের মুখ ম্লান হয়ে গেল। বলল, ‘মি. শ্যারন আমি বিচারের কথা বলছি না। আমি বলতে চাচ্ছি, আমাদের বক্তব্যকে আমরা সত্য বলছি কিনা? সত্য একটাই থাকে। আমাদের কথা সত্য হলে ওদের কথা মিথ্যা অবশ্যই হবে।’
জেনারেল শ্যারন তৎক্ষণাৎ জবাব দিল না। তাকাল ডেভিড উইলিয়াম জোনসের দিকে। তারপর বলল, ‘জেনারেল হ্যামিল্টন আমাদের কথাকে সত্য আমাদের বলতেই হবে।’
‘এর অর্থ আমরা যা বলছি তা সত্য নয়’। জেনারেল হ্যামিল্টন মুখ ম্লান করে বলল।
‘মি. হ্যামিল্টন বিজ্ঞানী জন জ্যাকবের মত আমাদের পূর্ব পুরুষরা আমাদের জাতির জন্যে যা করে গেছেন, তাই ন্যায় ও সত্য। সে সত্যকে রক্ষার জন্য আমরা লাখো মিথ্যা বললেও তা আমাদের জন্য সত্য।’ একটু শক্ত কণ্ঠে বলল ডেভিড উইলিয়াম জোনস।
উদ্বেগ ফুঠে উঠল জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনের চোখে মুখে। সে দ্রুত কম্পিত কণ্ঠে বলল, ‘তাহলে গোয়েন্দা সুড়ঙ্গের যে অভিযোগ উঠেছে, সেটা সত্য?
কিছু বলতে যাচ্ছিল জেনারেল শ্যারন। এ সময় টেলিফোন বেজে উঠল ডেভিড উইলিয়াম জোনসের। টেলিফোন ধরল সে।
টেলিফোনে ওপারের কথা শুনেই অন্ধকার হয়ে গেল ডেভিড উইলিয়াম জোনসের মুখ।
ওপারের সাথে কথা শেষ করে ডেভিড উইলিয়াম জোনস টেলিফোন রেখে প্রায় আর্তকণ্ঠে বলে, উঠল, ‘সর্বনাশ হয়ে গেছে, মি. শ্যারন। হ্যারিকে ওরা নিয়ে গেছে। আমাদের দশজন লোক ওদের হাতে ধরা পড়েছে। মারা গেছে আরও পাঁচজন।’
‘অসম্ভব! কি করে ঘটল? কারা ঘটাল? পুলিশ? এফ বি আই? আর্তকণ্ঠে চিৎকার করে উঠল জেনারেল শ্যারন।
‘পুলিশ নয়, এফ বি আইও নয়। কারা যেন করেছে। পরে তারা আমাদের লোকদের তুলে দিয়েছে এফ বি আই-এর হাতে।’ বলল ডেভিড উইলিয়াম জোনস।
‘তাহলে ওরা আহমদ মুসা ছাড়া আর কেউ নয়। শয়তানের বাচ্চা, সে সব সর্বনাশের মূল। চিবিয়ে খাব আমরা ওকে।’ চিৎকার করে বলে উঠল জেনারেল শ্যারন।
‘সেটা পরের কথা জেনারেল। এখন হ্যারি যদি মুক্তি পেয়ে থাকে তাহলে আমাদের গোমর ফাঁক হয়ে যাবে। আগামী কালের ৮টার মিটিং এ গিয়ে আমরা কি বলব?’ বলল জেনারেল হ্যামিল্টন।
জেনারেল হ্যামিল্টনের কথা শেষ হতেই আবার টেলিফোন বেজে উঠল। টেলিফোন বেজে উঠেছে এবার জেনারেল শ্যারনের। জেনারেল শ্যারন টেলিফোন ধরর।
টেলিফোনে ওপারের কথা শুনে মুখের চেহারাই পাল্টে গেল তার।
বলল, ‘ওয়াশিংটন পোষ্ট ও নিউইয়র্ক টাইমসও প্রতিবাদ ছাপছে?’ শুকনো কন্ঠ জেনারেল শ্যারনের।
ওপারের কথা শুনে আবার সে বলল, ‘কি বলছ তুমি, জাতিকে জবাই করার মত নিউজ ছাপার অনুমতি দিয়েছে আমাদের সব বেনহামরা?’
‘এ সব হচ্ছে কি মি. শ্যারন? তাহলে সরকারের চাপের কাছে পত্রিকাগুলো নতিস্বীকার করলো?’ চিৎকার করে বলে উঠল ডেভিড উইলিয়াম জোনস।
জেনারেল শ্যারন সোজা হয়ে বসল। বলল, ‘সরকার কোথায়? সরকারের ডিক্টেশন কি বব বেনহামরা শুনবেন! আসলে এ গুলো সবই শয়তান আহমদ মুসার পরিকল্পনা। একদিকে সাংবাদিক কর্মচারীদের ক্ষেপিয়েছে ওরা, অন্যদিকে সব পত্রিকার প্রথম পাতার বিরাট অংশ বিজ্ঞাপনের জন্য আগেই কিনে ফেলেছে। পত্রিকাগুলো প্রতিবাদ নিউজ আকারে না ছাপলেও বিজ্ঞাপন আকারে ছাপতে যাতে বাধ্য হয়ে পড়ে। এসব বুদ্ধি আহমদ মুসার মাথায়ই শুধু গজাতে পারে।’ থামল জেনারেল শ্যারন।
উত্তরে কেউ কোন কথা বলল না। আবার নিরবতা।
নিরবতা ভাঙল জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন। বলল, ‘মিথ্যা সব সময় মিথ্যাই প্রমাণিত হয় মি. শ্যারন। আর মিথ্যার পরিণতি এটাই হয়। আমি দুঃখিত জেনারেল শ্যারন ও মি. জোনস, আমি জানতাম না এটা মিথ্যার ব্যাপারটা। আমাকে নতুন করে সব কিছু ভাবতে হবে।’
‘কি ভাববেন?’ বলল ডেভিড উইলিয়াম জোনস। কণ্ঠ কঠোর তার।
‘আমি আপনাদেরকে ভালোবাসি, আপনাদের লক্ষ্য উদ্দেশ্যকে ভালোবাসি। কিন্তু সে ভালোবাসা আমার আমেরিকার স্বার্থেই। কিন্তু এখন……………?’ কথা শেষ করল না জেনারেল হ্যামিল্টন।
জেনারেল শ্যারনের ঠোঁটে ফুটে উঠেছে ক্রুর হাসি। বলল, ‘কথা শেষ করুন মি. হ্যামিল্টন। বলুন যে, এখন সে আমেরিকার বুকেই আমরা ছুরি মারছি।’
এই কথা বলার সাথে সাথে জেনারেল শ্যারনের হাত বেরিয়ে এল পকেট থেকে রিভলবার নিয়ে। রিভলবার তার উদ্যত হলো জেনারেল হ্যামিল্টনের বুক লক্ষ্যে।
‘একি করছেন মি. শ্যারন। আমি একটা সত্য আপনাদের জানিয়েছি মাত্র। আমি আপনাদের শত্রু নই।’ চিৎকার করে কম্পিত কণ্ঠে বলল জেনারেল হ্যামিল্টন।
‘এই সত্যই আমাদের শত্রু হ্যামিল্টন। এই সত্য আপনার মুখ দিয়ে বাইরে যাক আমরা তা চাই না।’
এই কথার সাথে সাথে জেনারেল শ্যারনের রিভলবার পর পর দুটি গুলী বর্ষণ করল।
বুক চেপে ধরে জেনারেল হ্যামিল্টন লুটিয়ে পড়ল সোফার উপর।
শেষ নিঃশ্বাসের আগে এ কথাটুকুই শুধু সে বলতে পারল, ‘আমার আমেরিকাকে ঈশ্বর রক্ষা করুন এই ষড়যন্ত্রের হাত থেকে। আমি আমেরিকার জন্যে নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখতাম। আমেরিকার সে নতুন পৃথিবী হোক আমাদের ফাউন্ডার ফাদার্সদের, কোন ষড়যন্ত্রের নয়।’
‘থ্যাংকস জেনারেল শ্যারন। প্যাট্রিওটিজম-এর বীজগুলোকে এভাবেই ধ্বংস করা উচিত।’ বলে একটা দম নিল ডেভিড উইলিয়াম জোনস।
একটু পরে বলল, ‘মি শ্যারন কাউকে ডেকে বলুন একে রেখে দিয়ে আসুক এর বাড়ির কাছে কোথাও। লাশের উপর যেন একটা চিরকুট রেখে আসে লেখা থাকবে, ‘দেশের বিরুদ্ধে জেনারেল শ্যারনদের সহযোগিতা করার এটাই শাস্তি।’
লাশ সরিয়ে নিয়ে গেলে পাশের ঘরে গিয়ে বসল ডেভিড উইলিয়াম জোনস এবং জেনারেল শ্যারন।
বলল ডেভিড উইলিয়াম জোনস, ‘মি. শ্যারন, এই বিপর্যয়টা খুবই বড়। কিন্তু আমরা শেষ হয়ে গেছি, তা হতে পারে না।
‘অবশ্যই নয়। আমাদের এই মুহূর্তের কাজ হলো, একটা পাল্টা প্রতিবাদ তৈরি করা এবং পরশুই তা ছাপাবার ব্যবস্থা করা। দ্বিতীয় কাজ হলো, যে কোন মূল্যে আহমদ মুসাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়া। কাল থেকেই আমাদের সর্বশক্তি এই কাজে নিয়োগ করতে হবে। একাজে ভারতীয় আমেরিকানদের কাজে লাগাতে হবে। তৃতীয় কাজ হলো, গোল্ড ওয়াটার ও সারা জেফারসনকে উপযুক্ত শাস্তি দেয় এবং চতুর্থ কাজ রাজনৈতিক সমর্থন এখন আমাদের উচ্চমূল্যে কিনতে হবে। কেউ সমর্থক না হলে তাকে নিরপেক্ষ রাখতে হবে।’ বলল জেনারেল শ্যারন।
‘এই শেষ কাজটা অবশ্যই কঠিন হবে।’ বলল ডেভিড উইলিয়াম জোনস।
‘কঠিন হবে কেন? দুনিয়া টাকার বশ হলে মানুষ হবে না কেন? আমলাদের টাকার প্রতি খুব লোভ, আর রাজনীতিকদের টাকা খুব বেশী প্রয়োজন।’ বলল জেনারেল শ্যারন।
‘আর সিনেটরদের সাথে কাল ৮টার মিটিং এর কি হবে?’
‘মিটিং পরশু পর্যন্ত পিছিয়ে দেয়ার প্রস্তাব করুন। বলুন, আমাদের পাল্টা প্রতিবাদ পত্রিকায় আসার পর বৈঠকে বসা উপযুক্ত হবে।’ বলল জেনালে শ্যারন।
‘ঠিক তাই’ ডেভিড জোনস বলল।
‘এখনকার মত উঠা যাক।’ বলল জেনারেল শ্যারন।
‘চলুন।’ বলে উঠে দাঁড়াল ডেভিড উইলিয়াম জোনস।
দুজন বেরিয়ে এল ঘর থেকে।

গাড়ি থেকে নেমে আহমদ মুসা ও সারা জেফারসন পাশাপাশি হেঁটে বাড়ির ভেতর দিকে এগুচ্ছে।
‘আমার খুব আনন্দ লাগছে আহমদ মুসা, টিজে দাদুরা যে নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখেছিলেন, আর জেনারেল শ্যারনরা আমেরিকার মাথায় যে নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন চাপিয়ে দিয়েছিলেন তার মধ্যে টিজে দাদুদের স্বপ্নই জিতে যাচ্ছে। তার মানে মুক্তি পাচ্ছে আমেরিকার মানুষ, মুক্তি পাচ্ছে পৃথিবীর মানুষ এক কালো অক্টোপাশের কবল থেকে।’ বলল সারা জেফারসন।
‘আগামী কয়েকটা দিন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এদিনগুলো ক্ষ্যাপা কুকুরের মত ওদের পাল্টা আঘাত হানার দিন, সর্বস্ব দিয়ে ময়দানে টিকে থাকার ওদের ব্যবস্থা করার দিন। আমরাও যা অর্জন করেছি তা, যেমন- প্রতিবাদ ছাপার সাফল্য, হ্যারিকে উদ্ধার করার সাফল্য, ইত্যাদি কাজে লাগাবারও দিন।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমি ভাবছিলাম, আপনার মাথা এবার হাল্কা হবে, কিন্তু দেখছি আরও ভারী হয়েছে।’ বলল সারা জেফারসন মিষ্টি হেসে।
‘সংসার সমরাঙ্গনের সৈনিকদের পরস্পরের এগুলো এক অশরীরী বাধন মিস জেফারসন।’
আহমদ মুসা কথা শেষ করতেই থমকে দাঁড়াল সারা জেফারসন
তার সাথে আহমদ মুসাও থমকে দাঁড়িয়েছে।
সারা জেফারসন মুখ তুলেছে আহমদ মুসার দিকে। হরিণীর মত টানা তার নীল দুটি চোখ আহমদ মুসার দুচোখে নিবদ্ধ। তীব্র এক যন্ত্রণার প্রকাশ তার চোখে মুখে। বলল, ‘আপনার ‘মিস’ শব্দটি নিষ্ঠুর টর্নেডোর মত বার বার আমাকে তাড়া করে পৃথিবীর কোন এক প্রান্তে নিয়ে আছড়ে ফেলে আহমদ মুসা। আপনার কথিত সংসার সমরাঙ্গনের আমিও তো আপনার পাশের একজন সৈনিক। দুর্ভাগা ‘মিস’ কি ‘সারা’ হতেই পারল না!’
শেষ দিকে আবেগে রুদ্ধ হয়ে উঠেছিল সারা জেফারসনের কণ্ঠ। তার দুচোখ ভরে উঠেছে অশ্রুতে।
এ সময় সারা জেফারসনের মা জিনা জেফারসন ‘বাছা তোমরা এতক্ষণে এলে, আমি সাত-পাঁচ চিন্তায় একদম শেষ হয়ে গেছি, আর দেরী নয় খাবার টেবিলে এস।’ বলতে বলতে আহমদ মুসাদের সামনে এসে দাঁড়াল। সারা জেফারসনের উপর চোখ পড়তেই বলে উঠল, ‘কি হয়েছে সারা? চোখে পানি কে?’
সারা জেফারসন কোন কথা বলল না। দুহাতে মুখ ঢেকে ছুটল তার ঘরের দিকে।
‘কি হয়েছে? কিছু ঘটেছে বাছা?’ জিনা জেফারসন জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসাকে। তার কণ্ঠে উদ্বেগ।
আহমদ মুসার জন্য এটা ছিল কঠিন বিব্রতকর এক অবস্থা। কিন্তু নিজেকে সামলে নিল আহমদ মুসা। বলল জিনা জেফারসনের প্রশ্নের জবাবে, ‘না খালাম্মা, বাইরে কিছু ঘটেনি। একটু ভুল বুঝাবুঝি। ঠিক হয়ে যাবে। চলুন।’ আহমদ মুসার মুখে কষ্ট-সৃষ্ট হাসি।
‘চল বাছা’ বলে হাঁটতে শুরু করল জিনা জেফারসন।
খাবার টেবিলে গিয়ে জানা জেফারসন বলল, ‘তুমি বস বাছা। আমি সারাকে নিয়ে আসি।’
জিনা জেফারসন এগুলো সারার ঘরের দিকে।
আহমদ মুসা ডাইনিং চেয়ারে গা এলিয়ে দিল। উর্ধ্বমুখী হলো তার চোখ।
ধীরে ধীর তার দুচোখ আচ্ছন্ন করে নেমে এল একরাশ বেদনা। মনে হলো কারো হৃদয় দলিত করার চেয়ে কঠিন কাজ দুনিয়াতে আর কিছু নেই।
সারার ঘরের ওদিক থেকে আসা পায়ের শব্দে চিন্তা সূত্র ছিন্ন হয়ে গেল আহমদ মুসার। সোজা হয়ে বসল সে।

পরবর্তী বই
ফ্রি আমেরিকা

Top