৩০. এক নিউ ওয়ার্ল্ড

চ্যাপ্টার

বেরুবার জন্যে প্রস্তুত হয়ে বসে আছে আহমদ মুসা। আজ ওয়াশিংটনে ফিরছে সে। অপেক্ষা করছে আহমদ মুসা সারা জেফারসনের জন্যে।
ঘুরে ঢুকল জিনা জেফারসন, সারা জেফারসনের মা।
‘খালাম্মা, মিস জেফারসন কোথায়? আমি ওর জন্য অপেক্ষা করছি।’
হাসল জিনা জেফারসন। বলল, ‘ওর মনটা বোধ হয় খারাপ। দেখলাম, ফ্যামেলি এ্যালবামের পাতা উল্টাচ্ছে।’
‘মন খারাপের সাথে এ্যালবামের কি সম্পর্ক? জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা। আহমদ মুসার মুখেও হাসি।
‘হ্যাঁ, ওর মন খারাপ হলে সে ফ্যামিলি এ্যালবামের পাতা উল্টায়।’
‘চমৎকার। তার মানে তখন তিনি অতীতমুখী হন অথবা যারা ছিলেন কিন্তু এখন নেই, তাদের দৃষ্টান্ত সামনে এনে সান্তনা খোঁজেন। আহমদ মুসা বলল।
‘তাই হবে।’ জিনা জেফারসন বলল।
‘কিন্তু মন খারাপ হলো কখন, এইতো তার সাথে কথা বললাম?
‘সব ব্যাপারেই সে শক্ত, কিন্তু কাউকে বিদায় দেয়ার ব্যাপারে খুব নরম। আজ মনে হচ্ছে বেশি নরম হয়ে পড়েছে। তার উপর তোমাকে সে আরও একদিন থেকে যেতে বলেছিল, থাকছ না। শুধু তার কেন, আমারও মনটা খারাপ। আমি সবার মুখের হাসি দেখতে চাই। তার মনে যে আনন্দ দেখতে চাই, তুমি আসার পর গদ দুদিন আমি তা দেখেছি। ভয় হচ্ছে তুমি চলে যাবার পর আবার তার সেই বয়সোত্তার গাম্ভীর্য ফিরে আসে কি না।
মুখের আলো হঠাৎ নিভে গেল আহমদ মুসার। এখানে আসার পর থেকে যে অস্বস্তিটা তাকে পীড়া দিচ্ছে, সেটা আবার জেগে উঠল তার মনে। একটা বিব্রতকর ভাব ফুটে উঠল তার চেহারায়।
আহমদ মুসা কি বলবে তা খুঁজছিল। এমন সময় ঘরে প্রবেশ করল সারা জেফারসন।
তার মুখে হাসি। কিন্তু তার চোখে দুটো হাসছে না। কালো বিষণ্ণতা সেখানে। ঘরে ঢুকেই সে বলল, ‘স্যরি একটু দেরী হয়ে গেল।’
আহমদ মুসা কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই সারা জেফারসনের মা বলে উঠল, ‘বেটা আহমদ মুসা, সারাকে বলে যেও মায়েরা সব সময় সন্তানের হাসিমুখ দেখতে চায়।’
সারা জেফারসন মিষ্টি হেসে মায়ের দিকে তাকাল। বলল, ‘কি কথা বলছ মা, আমি কি হাসি না?’
‘বেটি সারা, যখন তুমি তোমার মত একজন সন্তানের মা হবে, তখন বুঝবে সেই সন্তানের মুখে মা কি ধরনের হাসি দেখতে চায়। গত দুদিন তোমার যে হাসি, তোমার যে পরিতৃপ্ত চোখ, তোমার যে আনন্দ-রাঙা মুখ দেখেছি, তা আমি হারাতে চাই না। আমি সে কথাই আহমদ মুসাকে বলছিলাম।’ সন্তান বাৎসল্যের গভীর আবেগ জিনা জেফারসনের কন্ঠকে ভারী করে তুলেছিল।
লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠেছে সারা জেফারসনের মুখ। সেই সাথে কিছুটা বিব্রত ভাবও। তার মা তাকে এতটা নগ্ন করে দেবে সে ভাবেনি। এমন ক্ষেত্রে সব মা বোধ হয় এমন পাগল হয়ে যায়!
লজ্জায় ভারী হয়ে ওঠা সারা জেফারসনের দুটি চোখ জোর করেই ছুটে গেল আহমদ মুসার মুখের উপর। সে দৃষ্টি যেন ছড়িয়ে দিল অশরীরী অজস্র চুম্বন। একটা যন্ত্রণার প্রশান্তি নেমে এল সারা জেফারসনের কম্পিত বুকে।
কিন্তু আহমদ মুসার আনত চোখের বদ্ধ দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে সারা জেফারসনের সে দৃষ্টি অবশেষে ফিরে এল। তার শুকনো ঠোঁটে ফুটে উঠল এক টুকরো বেদনার হাসি। বলল, ‘আম্মা তুমি তো ওঁকে জান। ওঁর পৃথিবী কত বড়! একজনের মুখের হাসি উনি দেখবেন এমন আশা করা ওর প্রতি অবিচার।’
‘কিন্তু মা, আহমদ মুসা যখন সন্তান হিসেবে সামনে আসে তখন মায়ের কোন দাবীই অবিচার নয়।’ বলল জিনা জেফারসন, সারা জেফারসনের মা।
কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছিল আহমদ মুসা ও সারা জেফারসন দুজনেই। এ সময় এ দিনের দৈনিক কাগজগুলো নিয়ে প্রবেশ করল পরিচারিকা।
সবাই সেদিকে তাকাল।
আহমদ মুসা ও সারা জেফারসনের কথা তাদের মুখেই থেকে গেল।
পরিচারিকা ঘরের মধ্যে এসে কাগজগুলো সারা জেফারসনের হাতে দিয়ে বেরিয়ে গেল।
অনেক কয়টা দৈনিক। সবার উপরে ছিল ‘ওয়াশিংটন পোস্ট।’
ওয়াশিংটন পোস্টের প্রধান শিরোনানের উপর আঠার মত লেগে গেল সারা জেফারসনের চোখ। প্রধান শিরোনামের উপরে লাল অক্ষরে একটা শোল্ডার। তারপর কালো অক্ষরে প্রধান শিরোনাম চার কলামব্যাপি। প্রধান শিরোনামের নিচে নিল কালিতে আরেকটা শোল্ডার। পড়ল সারা জেফারসন উপরের শোল্ডারে, ‘মৌলবাদী আহমদ মুসার কালো হাত এবার আমেরিকায়।’ আর প্রধান শিরোনাম পড়ল, ‘প্রেসিডেন্ট এবং তার প্রশাসন মদদ দিচ্ছে সন্ত্রাসে।’ বটম শোল্ডারের লেখা পড়ল সারা জেফারসন, ‘মানবতাবাদী আমেরিকায় ভয়াবহ এ্যান্টি সেমেটিক ষড়যন্ত্র।’
পড়ে কেঁপে উঠল সারা জেফারসন। তার মুখের সব আলো এক সংগে দপ করে নিভে গেল। সেখানে ঝড়ের বেগে নেমে এল উৎকন্ঠা ও উদ্বেগের কালো ছায়া।
সারা জেফারসন দ্রুত একে একে ‘নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়ালষ্ট্রিট জার্নাল ও নিউইয়র্ক পোষ্টে’র উপর নজর বুলাল। ঐ একই বিষয়ের লিড শিরোনাম সব পত্রিকায়। হেডিং ভিন্ন ভিন্ন কিন্তু একই কথা বলেছে চারটি পত্রিকাই।
হাত কাঁপছে সারা জেফারসনের। কাঁপছে গোটা শরীর। চোখে অন্ধকার দেখছে সারা জেফারসন।
আহমদ মুসা লক্ষ্য করছিল সারা জেফারসনের এই পরিবর্তন এবং এও বুঝেছিল পত্রিকার কোন খবর পড়েই তার এই অবস্থা।
তাড়াতাড়ি আহমদ মুসা হাত বাড়াল সারা জেফারসনের দিকে পত্রিকাগুলো নেয়ার জন্যে।
সারা জেফারসন তাকাল আহমদ মুসার দিকে।
রাজ্যের সব উৎকন্ঠা, উদ্বেগ এসে যেন বাসা বেধেছে সারা জেফারসনের চোশে, দেখল আহমদ মুসা।
সারা জেফারসন কম্পিত হাতে তুলে দিল পত্রিকাগুলো আহমদ মুসার হাতে।
ওয়াশিংটন পোষ্ট-এর লীড নিউজের উপর চোখ পড়তেই চমকে উঠল আহমদ মুসা।
দ্রুত আহমদ মুসা চারটি দৈনিকের উপরই চোখ বুলাল।
ওয়াশিংটন পোষ্ট ও নিউইয়র্ক টাইমস নিউজটিকে লীড করেছে। কিন্তু ওয়ালষ্ট্রিট জার্নাল ও নিউইয়র্ক পোষ্ট নিউজটিকে যথাক্রমে চতুর্থ ও তৃতীয় প্রধান শিরোনাম হিসেবে ছেপেছে।
নিউজটা দেখে প্রথমে চমকে উঠেছিল আহমদ মুসা। কিন্তু তা পরক্ষণেই দূর হয়ে গেল। ঠোঁটে তার ফুটে উঠল হাসি।
আহমদ মুসার দিকে তাকিয়েছিল সারা জেফারসন। আহমদ মুসার ঠোঁটে হাসি ফুঠে উঠতে দেখে বিস্ময় ফুটে উঠল তার চোখে। বলল, ‘আপনার ঠোঁটে হাসি দেছি। সত্যিই কি আপনি হাসছেন?’
সারা জেফারসনের প্রশ্নের ধরন দেখে আহমদ মুসা সশব্দে হেসে উঠল। বলল, ‘হাসির পেছনে অনেক সময় কান্না থাকে। আমার হাসির পেছনে কান্না নেই। সুতরাং এটা হাসিই।’
‘আমি বুঝতে পারছি না। এ নিউজে হাসার কিছু আছে? আমি কিন্তু উদ্বিগ্ন।’ বলল সারা জেফারসন শুকনো কন্ঠে।
‘নিউজে হাসির কিছু নেই। কিন্তু শত্রুর শেষ কথা, শত্রুর শেষ পদক্ষেপ জেনে ফেলার মধ্যে আনন্দ আছে। আমি সেই আনন্দেই হেসেছি।’
‘আমাকে উপলক্ষ বানিয়ে প্রেসিডেন্টের উপর প্রচন্ড রাজনৈতিক প্রেসার সৃষ্টি করা, যাতে করে তিনি ইহুদীবাদীদের বিরুদ্ধে সকল প্রকার তদন্ত থেকে বিরত থাকেন। যদি প্রেসিডেন্ট এতেও বিরত না হন, তাহলে প্রেসিডেন্টকে ইমপীচ পর্যন্ত তারা অগ্রসর হবে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘অতদূর পর্যন্ত তারা যাবে?’ সারা জেফারসনের কন্ঠে বিস্ময়।
‘সে প্রস্তুতি না থাকলে তারা প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে এভাবে যুদ্ধ ঘোষণা করতো না।’ আহমদ মুসা বলল।
সারা জেফারসন সংগে সংগেই কিছু বলল না। ভাবছিল সে। বলল, ‘নিউজ না পড়েই তোমরা আলোচনা শুরু করেছ। আমি পড়ছি তোমরা শোন। হেডিং যত বড় নিউজটা তত বড় নয়।’
বলে পড়ে শুরু করল জিনা জেফারসনঃ
‘‘আমেরিকায় অনুপ্রবেশকারী মৌলবাদী সন্ত্রাসী নেতা আহমদ মুসা ইহুদীদের প্রতি তার স্বভাব-বিদ্বেষ দ্বারা তাড়িত হয়ে এবং আমেরিকান স্বার্থের ক্ষতি ও তার আভ্যন্তরীণ শান্তি বিনষ্ট করার লক্ষ্যে ইহুদী কম্যুনিটি ও মার্কিন প্রশাসনের মধ্যে বিভেদ ও সংঘাত সৃষ্টির হীন ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে।
ইহুদীদের বিরুদ্ধে অমুলক একটি অভিযোগ দাঁড় করিয়ে এবং অদ্ভুত কৌশলে রক্তক্ষয়ী ও ধ্বংসাত্মক ঘটনা একের পর এক সৃষ্টি করে তারও দায় ইহুদী কম্যুনিটির উপর চাপিয়ে দেশে বড় ধরনের দ্বন্দ্ব-সংঘাত সৃষ্টি করতে চায়।
দৃষ্টান্ত তুলে ধরতে গিয়ে সূত্র বলছে, কৌশলগত গবেষণাগার ‘লস আলামোসে’র একটা এমারজেন্সী এক্সিট সুড়ঙ্গ রয়েছে, এই সুড়ঙ্গকে আহমদ মুসা ইহুদীদের তৈরি গোয়েন্দা সুড়ঙ্গ হিসাবে মার্কিন প্রশাসনের কাছে তুলে ধরেছে।
এই অভিযোগ তোলার পর পরই বড় ধরনের দুটি সন্ত্রাসী ঘটনা সে ঘটিয়েছে। লস আলামোসে সুড়ঙ্গ বিষয়ে তদন্তে যাওয়া উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত টীমটি যখন ফিরছিল, তখন লস আলামোস ও সান্তাফে’র মধ্যবর্তীস্থানে এক সন্ত্রাসী ঘটনার মাধ্যমে টীমের সাথে সফররত ৬ জনেরও বেশি নিরাপত্তা প্রহরীকে হত্যা করা হয়। উল্লেখ্য এই তদন্ত টীমের সাথে আহমদ মুসাও ছিল। আহমদ মুসা ও টীম সদস্যরা অক্ষত থাকল, কিন্তু নিহত হল হতভাগ্য নিরাপত্তা প্রহরীরা।
অনুরূপভাবে সান্তা ফে’ বিমান বন্দর থেকে যে বিমানে করে টীম সদস্যরা ওয়াশিংটনে ফেরার কথা, সে বিমানও যাত্রার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে বিস্ফোরনে ধ্বংস হয়। এবারও আহমদ মুসা ও টীম সদস্যরা অক্ষত থাকলেন, ধ্বংস হয়ে গেল বিমান।
সূত্রমতে দুটি ঘটনাই সন্ত্রাসী আহমদ মুসা ঘটিয়েছে সুপরিকল্পিতভাবে এবং এর দায় তুলে দিয়েছে ইহুদী কম্যুনিটির কাঁধে। তার মতলব মার্কিন প্রশাসনকে এটা বুঝানো যে, লস আলামোস সুড়ঙ্গ তন্দন্তে যাওয়া টীমকে ইহুদীরা ধ্বংস করতে চেয়েছে তাদের ফাইল্ডিং ধামা চাপা দেয়ার জন্যেই।
সূত্রমতে, আহমদ মুসার পরিকল্পনা ও কৌশল পুরোপুরিই কার্যকরী হয়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ও প্রশাসনের উপর। শৃগালের মত ধূর্ত আহমদ মুসা সম্মোহিত করেছে প্রেসিডেন্টকে, সি আই এ ও এফ বি আই চীফকে এবং মার্কিন প্রশাসনের একটা অংশকে।
আহমদ মুসাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা দিতে এগিয়ে এসেছে ইহুদী বিদ্বেষী ‘ফ্রি আমেরিকা’ মুভমেন্ট এবং জানা গেছে গোল্ড ওয়াটারের ‘হোয়াইট ঈগল’ ও আহমদ মুসার পক্ষে যোগ দিয়েছে।
এ সবের পেছনে পেট্রোডলার বিরাট ভূমিকা পালন করছে বলে সূত্র মনে করছেন।
বলা হচ্ছে, আহমদ মুসা গোটা পরিকল্পনার লক্ষ্য হলো, ঘরে সংঘাত বাধিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে দুর্বল করে ও তাঁর আকাশ স্পর্শী ইমেজকে ধ্বংস করে দিয়ে আমেরিকার বিশ্ব নেতৃত্বের আসন কেড়ে নেয়া ও তার নতুন বিশ্ব গড়ার মহান স্বপ্নকে বানচাল করা।
এই অবস্থায় দেশের মান, ইজ্জত ও ভবিষ্যত রক্ষার জন্যে সচেতন সকলেই মৌলবাদী সন্ত্রাসী নেতা আহমদ মুসা এবং আমাদের প্রেসিডেন্ট ও তার প্রশাসনের মধ্যেকার সর্বনাশা হানিমুনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবেন বলে ওয়াকিফহাল মহল মনে করেছেন’’
পড়া শেষ করে জিনা জেফারসন বলল, ‘বাকি তিনটি পত্রিকাতেও দেখা যাচ্ছে একই রিপোর্ট এসেছে। শব্দের কিছু পার্থক্য আছে, বক্তব্যে তেমন কিছু পার্থক্য নেই।’ বলছিল আর কাগজগুলোর উপর নজর বুলাচ্ছিল জিনা জেফারসন।
পড়া শেষ হলে সারা জেফারসন তাকাল আহমদ মুসার দিকে সম্ভত প্রতিক্রিয়া হিসাবে আহমদ মুসা কি বলে তা জানার জন্যেই।
নিউজ শুনে উদ্বেগ আরও বেড়ে গিয়েছিল সারা জেফারসনের। প্রেসিডেন্ট এবং প্রশাসনকেও নিউজে এইভাবে আক্রমণ করা হবে তা সারা জেফারসনের কাছে অকল্পনীয় ছিল। যা নিউজ হয়েছে তাতে এখন প্রেসিডেন্টকে আত্মরক্ষার জন্যে ব্যতিব্যস্ত হতে হবে এবং বলতে হবে আহমদ মুসার সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই, তাঁর প্রশাসনও আহমদ মুসাকে কোন সহযোগিতা করছে না। এমনকি দোষ স্থালনের জন্যে আহমদ মুসাকে সরকার গ্রেফতারও তো করতে পারে। এ সব ভাবতে ভাবতে বুকের কাপুনি সারা জেফারসনের আরও বেড়ে গেল। আহমদ মুসার উপর নিবদ্ধ তার দৃষ্টি অসহায় হয়ে উঠেছে।
আহমদ মুসা চোখ বন্ধ করে জিনা জেফারসনের পড়া শুনছিল।
পড়া শেষ হলে চোখ খুলল আহমদ মুসা।
জিনা জেফারসন কথা শেষ করতেই আহমদ মুসা বলে উঠল ‘খালাম্মা একটু দেখুন, কোন কাগজে এ ঘোষণা আছে কিনা যে, আজ কোন সময় বি বি এস (CBS) এন বি সি (NBC), এ বি বি (ABC)-দের কেই অথবা সকলেই মৌলবাদী সন্ত্রাসী নেতা আহমদ মুসা ও প্রেসিডেন্ট প্রশাসন ইহুদীদের বিরুদ্ধে যে যোগসাজস করেছে তার কাহিনী প্রচারিত হবে।
জিনা জেফারসন চোখ বুলাচ্ছিল ওয়াশিংটন পোষ্টের প্রথম পৃষ্ঠায়। সে চিৎকার করে উঠল, ‘বেটা তুমি কি ভবিষ্যত রক্তা নাকি? এই তো দেখ সেই বিজ্ঞপ্তি। এখানে বলা হয়েছে, আজ রাত ৭টা ও ১১টায় সি বি এস, এন বি সি ও এ বি সি’র ‘বিশেষ অনুসন্ধান’ প্রোগ্রামে আমেরিকায় অনুপ্রবেশকারী মৌলবাদী ও সন্ত্রাসী নেতা আহমদ মুসার ধ্বংসাত্মক তৎপরতা সম্পর্কে বিশেষ রিপোর্ট প্রচারিত হবে।’
‘বিজ্ঞপ্তিটি কে দিয়েছে খালাম্মা? কার নাম লেখা, কার বরাত দেয়া হয়েছে বিজ্ঞপ্তিতে? জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা। ‘বিজ্ঞপ্তির একেবারে বটমে মাত্র তিনটি অক্ষল ‘EMC’ ছাপা হয়েছে।’ বলল জিনা জেফারসন।
‘EMC মানে Electronic Media Club’ এটা ইহুদী গোয়েন্দা সংস্থা পরিচালিত ক্লাব যা টিভি নেটওয়ার্কগুলোর উপর চোখ রাখে, বিভিন্ন অনুষ্ঠান প্রমোট করে, আবার তাদের স্বার্থের পরিপন্থী কোন অনুষ্ঠান কোনভাবে প্রচারিত হয়ে গেলে তার বিরুদ্ধে জনমত সমীক্ষার মাধ্যমে বিরুদ্ধ জনমতের প্রকাশ ঘটায়।’
‘তার মানে আপনি বলছেন তিনটি টিভি নেটওয়ার্কে যে অনুষ্ঠান প্রচার হতে যাচ্ছে, তা ইহুদীবাদীরাই প্রমোট করতে যাচ্ছে।’ জিজ্ঞেস করল সারা জেফারসন।
‘অবশ্যই।’
‘নিউজ পেপারের এ নিউজগুলোর ক্ষেত্রেও তো তাহলে একই কথা?’ বলল সারা জেফারসন।
‘তাই।’ আহমদ মুসা বলল।
প্রশ্নটা করেই চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়েছে সারা জেফারসন। তার মুখ শুকনো। আট-ঘাট বেধেই এবার যুদ্ধে নেমেছে ইহুদীবাদীরা। ‘ফ্রি আমেরিকা’ মুভমেন্ট ও ‘হোয়াইট ঈগল’ কাউকেই ছাড়েনি। সবার বিরুদ্ধেই যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। আর অত্যন্ত নাজুক ফ্রন্টে তারা যুদ্ধ শুরু করেছে। তাদের মিডিয়া ফ্রন্টে যুদ্ধ শুরু করার অর্থ তারা রাজনৈতিক যুদ্ধ শুরু করেছে। আর ওরা মিডিয়া ও রাজনীতি দুই ফ্রন্টেই শাক্তিশালী। সুতরাং যুদ্ধে জিততে হলে এখন প্রচুর কাজ করতে হবে। কি করতে হবে সেটাও সিনেমার পর্দার মত তার সামনে উদয় হতে লাগল। ওদের মিডিয়া অফেনসিভের বিরুদ্ধে তাদেরকেও অফেনসিভে যেতে হবে। কিন্তু মিডিয়া অফেনসিভে যেতে হবে, এটা যেমন সত্য, তেমনি এটা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে এটাও সত্য। কারণ, মিডি…..।
চিন্তা আর এগুতে পারল না সারা জেফারসনের। আহমদ মুসার কথায় ছিন্ন হয়ে গেল তার চিন্তাসূত্র।
আহমদ মুসা বলছিল, ‘কি ভাবছেন মিস জেফারসন?’
চিন্তার জগত থেকে ফিরে এল সারা জেফারসন। কিন্তু মুখটা তার ম্লান হয়ে গেছে আহমদ মুসার সম্বোধন শুনে। ‘মিস’ সম্বোধন আহমদ মুসার কাছ থেকে এলে বুকের কোথায় যেন লাগে তার। মনে হয় তার বুকের কোন নরম তন্ত্রীতে নির্দয় এক চাবুক যেন আঘাত হানছে।
বেদনা কম্পিত এক টুকরো হাসি ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল সারা জেফারসনের ঠোঁট থেকে। সে চোখ তুলল আহমদ মুসার দিকে। হাসল। নির্মল হাসি। বলল, ‘কি ভাবছি বলুন তো?’
‘ফ্রি আমেরিকা’ নেত্রীর যা ভাবা উচিত।’ গম্ভীর কন্ঠ আহমদ মুসার।
‘একটা বিষয় ভাবতে পেরেছি। সেটা হলো আমাদের কাউন্টার অফেনসিভে যেতে হবে। মিডিয়া ওয়ার দিয়ে মিডিয়া ওয়ারের মোকাবিলা। কিন্তু যুদ্ধে রসদ কি হবে আমার মাথায় আসেনি।’
বলে মুহূর্তের জন্যে থামল সারা জেফারসন। মুখটা একটু নিচু করল। তারপর বলে উঠল, ‘আপনার নির্দেশ চাচ্ছি।’
আহমদ মুসার চোখ ছিল নিচু। চোখ তুলল সে সারা জেফারসনের দিকে। বলল, ‘ফ্রি আমেরিকা’র নেত্রীকে নির্দেশ?
‘না, সারাকে।’
‘সারা এবং ফ্রি আমেরিকার নেত্রী কি আলাদা?’
‘তা নয়। কিন্তু সারা ফ্রি আমেরিকার নেত্রী বলে নির্দেশ দিতে পারেন।’
সারা জেফারসনের এই একান্ত ‘নারী’ রূপের প্রকাশ আহমদ মুসাকে বিব্রত করে তোলে। এই পুরানো বিব্রতকর অবস্থা বুক বেয়ে আহমদ মুসার চোখে-মুখে উঠে আসতে চাইল। সামলে নিয়ে আহমদ মুসা বলল, ‘মিস জেফারসন মিডিয়া অফেনসিভের জন্যে মিডিয়া কি আপনার আছে? আমাদের সামনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই যে চারটি শীর্ষ জাতীয় দৈনিক রয়েছে। এদের দুটির মালিকানায় ইহুদী আধিপত্য রয়েছে, অবশিষ্ট দুটিতে শীর্ষ কয়েকটি পদে ইহুদী স্বার্থের প্রতি কমিটেড সাংবাদিক কাজ করছে। যে তিনটি চ্যানেল আজ রাতে আমাদের নিয়ে অনুষ্ঠান প্রচার করছে, সে তিনটি টিভি চ্যানেলের মালিকানাতেও ইহুদী আধিপত্য বর্তমান।’
হাসলা সারা জেফারসন। বলল, ‘আমাদের আলাদা কোন মিডিয়া নেই, তবে সব আমেরিকান মিডিয়াই আমাদের মিডিয়া। আমেরিকার পক্ষে তাদের অবশ্যই কাজ করতে হবে।’
‘এটা তো তত্ত্ব কথা, মিস জেফারসন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘প্রত্যেক বাস্তবতা প্রাসাদ একটা করে তাত্ত্বিক ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে থাকে।’ সারা জেফারসন বলল।
‘ঠিক।’
‘ঠিক বলে কথা শেষ করলে চলবে না জনাব। অভিযোগের শক্ত জবাব চাই। আমার মাথায় কিছু নেই। যা আদেশ হবে তাই করব।’
‘বড়দের বিনয় তাদের আরও বড় করে।’ বলল আহমদ মুসা হাসি মুখে।
‘তর্ক করব না। কারণ তর্কেও পারব না।’
বলে একটু থেমে কিছু বলার জন্যে আবার মুখ খুলেছিল, এ সময় তার টেলিফোন থেকে কল সিগন্যাল এল। তাড়াতাড়ি টেলিফোন তুলে নিল সারা জেফারসন।
টেলিফোন ধরেই বলল, ‘গুড মর্নিং মি. বেকন।’
ওপারের কথা শুনে বলল, ‘অডিও টেপ কার?’
ওপারের উত্তর শুনে বলল আবার,‘ ব্রাভো! নাইস। কোথায় পেলেন?’
‘মিরাকল’ শুনেছেন আপনারা টেপটা?
‘বিষয়টা বলুন।’
‘থ্যাংকস গড। কিন্তু পেলেন কি করে?’
‘হ্যাঁ, ঘটনাটা আমি পত্রিকায় পড়লাম। ঘটনার ব্যাকগ্রাইন্ড তাহলে এটাই? বেচারাকে যে কোন মূল্যে উদ্ধার করতে হবে। বলেছেন বিষয়টা জর্জ আব্রাহামকে?
‘বলে ঠিক করেছেন।’
‘হ্যাঁ, এইমাত্র পড়লাম। ওঁর সাথে আমি এ বিষয় নিয়েই আলাপ করছিলাম।’
‘হ্যাঁ, আমরা এটাই চিন্তা করছি। মিডিয়ার মাধ্যমেই ওদের এক্সপোজ করতে হবে। কাজে নেমে পড়ুন এখনি। আমাদের মিডিয়া-সদস্যদের নিয়ে বসুন। কাগজ গুলোর কালকের ইস্যুতেই স্টোরি আনতে হবে। কি করতে হবে আপনারা করুন। আমি জর্জ আব্রাহাম, এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার, জেনারেল ওয়াশিংটন সবার সাথেই কথা বলল।’ ‘না, এ্যান্ড্র জ্যাকবস ও মি. ময়নিহানের সাথে কথা বলতে হবে। আমাদের নিউজটা বেরুবার পর। ইতিমধ্যে হ্যারিকে উদ্ধার করার চেষ্টা করতে হবে।
‘মিডিয়াতে আমরা কি বলল, ওটা আমি জানি না। আপনার স্যারের সাথে কথা বলুন। তাঁকে দিচ্ছি আমি।’
বলে সারা জেফারসন টেলিফোন আহমদ মুসার হাতে দিল।
আহমদ মুসা টেলিফোন ধরে বলল, ‘ওয়া আলাইকুম সালাম। মি. বেঞ্জামিন কেমন আছেন?
ওপারের কথা বেশ কিছুক্ষণ শুনল আহমদ মুসা। তারপর বলল ‘ঠিক আছে সব জেনে নেব আমি মিস জেফারসনের কাছ থেকে মিডিয়ায় বক্তব্যের কথা বলছ? আমি চিন্তা করছি। ইতিমধ্যে কিছু কাজ করতে হবে। যেমন, লস আলামোস থেকে সান্তা ফে’র পথে সন্ত্রাসী ঘটনায় নিহত সন্ত্রাসীদের জাতিগত পরিচয় উদ্ধার, সান্তা ফে বিমান বন্দরে বিস্ফোরিত বিমানের অসুস্থতার অজুহাতে সরে পড়া পাইলট আটক করা, ইত্যাদি যা করতে হবে সবই আমি জানাচ্ছি।’
‘সে পাইলটকে আপনারা আটক করেছেন? ব্রাভো।’
‘ঠিক আছে, ওদের জবাবের ব্যাপারটা আমি দেছি। জানাচ্ছি সব।’
‘আমি আসব।’
‘কখন? তোমাদের নেত্রীকে বল। আমি তো ওঁর কমান্ডে।’
‘তাহলে এপর্যন্তই।’
‘ওকে, ওয়াচ্ছালাম।’
টেলিফোন রেখে দিল আহমদ মুসা।
টেলিফোন চলার সময়ই জিনা জেফারসন বলল, ‘জটিল রাজনীতি শুরু হয়েছে, আমি এখন যাই।’ বলে সারা জেফারসনের মা জিনা জেফারসন উঠে গিয়েছিল।
আহমদ মুসা টেলিফোন রাখতেই সারা জেফারসন বলল, ‘আপনি কি সত্যি আমার কমান্ডে?’
সারা জেফারসনের মুখে কিছুটা দুস্টুমির হাসি।
‘আপনি শুধু আপনি নন, ‘ফ্রি আমেরিকা’র নেত্রী আপনি।’
‘নেত্রী সারা এবং ব্যক্তি সারা একই সত্তা। নেত্রী সারা কমান্ডা করতে পারে, ব্যক্তি কি পারে না?’
মুখ থেকে সেই দুষ্টুমির হাসি মিলিয়ে গেছে। সারার কন্ঠ হয়ে উঠেছে আবেগ জড়িত।
‘সত্তা একটা বলেই ব্যক্তি সারার কমান্ডও নেত্রী সারার হয়ে দাঁড়াল।’ বলল আহমদ মুসা।
‘সারার যে একটা ব্যক্তিগত পৃথিবী আছে, সেখানে অনেক কথা আছে, অনেক বলার, অনেক শুনার আছে, সেটা তাহলে যাবে কোথায়? ভারী কন্ঠস্বর সারা জেফারসনের।
‘বড়দের ক্ষেত্রে এটাই হয়।’
‘তাই বুঝি ‘মিস জেফারসন’ আর ‘সারা’ হতে পারছে না। আবেগে রুদ্ধ হয়ে গেল সারা জেফারসনের কন্ঠ। ছলছলে হয়ে উঠ সারা জেফারসনের দুচোখ।
আহমদ মুসার মুখ মলিন হয়ে পড়ল। তার পুরনো সেই বিব্রতকর অবস্থা তাকে আচ্ছন্ন করে দিতে চাইল। সুন্দরী, অপরূপা প্রিয়দর্শিনী একজন শীর্ষ মার্কিন তরুণীর অশ্রু ভেজা কন্ঠ ও ছলছলে চোখের আবেদন টর্নেডো হয়ে প্রবেশ করল আহমদ মুসার হৃদয়ে। টর্নেডোর প্রচন্ডগতি সব দুমড়ে-মুচড়ে গিয়ে হৃদয়রাজ্য জয় করে নিতে চাইল। কিন্তু হৃদয় সিংহাসনের গোড়ায় গিয়ে টর্নেডোর সব শক্তি মুখ থুবড়ে পড়ল। সেখানে সমাসীন প্রসন্ন, প্রশান্ত, প্রদীপ্ত আর এক মানবী।
আচ্ছন্নভাবে কাটিয়ে উঠে চোখ তুলে আহমদ মুসা কিছু বলতে যাচ্ছিল, সে সময় সারা জেফারসনের মোবাইল টেলিফোন কলের সংকেত দিয়ে উঠল।
সারা জেফারসন আবার তুলে নিল তার টেলিফোন। সারার ছলছলে চোখ থেকে দুই গন্ডে দুফোটা অশ্রু খসে পড়ল। কিন্তু অশ্রু মোছার চেষ্টা করলো না সারা।
মাত্র ঐ দুফোটা অশ্রুই আহমদ মুসার কাছে নিদারুণ অস্বস্তির দুই পাহাড় হয়ে দাঁড়াল।
সারা জেফারসন টেলিফোন ধরে ওপারের কথা শুনেই ব্যস্ত কন্ঠে বলে উঠল, ‘থ্যাংকস গড, আংকল আমি আপনাকে খুব বেশি আশা করছিলাম।
ও প্রান্তের কথা শুনল এবং উত্তরে বলল, ‘আমরা পড়েছি আংকল। আমি ওঁর সাথে এ বিষয় নিয়েই আলাপ করছিলাম।’
‘জি আংকল, আমরা ভেবেছি সংবাদপত্রে এবং টিভি চ্যানেলে এর জবাব দিতে হবে এবং আজই।’
‘জি আংকল। এ কাজ কঠিন হবে। কিন্তু কোন বিকল্প নেই।’
‘জি আংকল। এ কঠিন কাজ আমাদের-আপনাদের যৌথ হতে হবে।’
‘হ্যাঁ, উনি আমার পাশেই আছেন। বিষয়টা আপনি ওঁকেই বলুন। টেলিফোন দিচ্ছি ওঁকে। বাই আংকল।’
বলে সারা জেফারসন টেলিফোন আহমদ মুসার হাতে দিল।
আহমদ মুসা টেলিফোন ধরে গুডমর্নিং বিনিময়ের পর ওপারের কথা শুনে বলল, ‘আপনি আসবেন? এখানে? কখন?’
ওপারের উত্তর শুনে আহমদ মুসা আবার বলল, ‘ঠিক আছে আসুন, এলেই সব শুনব। কিন্তু সময় অল্প, কাজ অনেক করতে হবে।’
‘ও কে, আমি আপনার অপেক্ষা করছি। আসুন, বাই।’
টেলিফোন রাখল আহমদ মুসা।
‘জর্জ আব্রাহাম আংকল কি এখানে আসছেন?’ টেলিফোনে আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই বলল সারা জেফারসন।
‘হ্যাঁ, আসছেন। উনি এখন যাচ্ছেন প্রেসিডেন্টের কাছে। প্রেসিডেন্ট ডেকেছেন। ওখান থেকেই আসবেন এখানে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘নিউজের ব্যাপারে কিছু বললেন তিনি।’ জিজ্ঞেবস করল সারা জেফারসন।
‘কথা-বার্তায় তাঁকে খুব দুর্বল মনে হলো। এই ব্যাপারেই নাকি প্রেসিডেন্ট তাঁকে ডেকেছেন।
‘যতই হোক জর্জ আব্রাহাম একজন আমলা। নিউজ পেপারের এই রিপোর্ট তাকে ভড়কে দেবেই। এখন প্রেসিডেন্ট দুর্বল না হলেই হয়। বলল সারা জেফারসন।
‘প্রেসিডেন্টকে দুর্বল করার জন্যে এই চাপ সৃষ্টি করেছে। প্রেসিডেন্ট সারেন্ডার করে জেনারেল শ্যারনদের সম্পর্কে তদন্ত বাতিল ও অভিযোগ প্রত্যাহার করলেই তাদের বাজিমাত হয়ে যায়।’ আহমদ মুসা বলল।
‘প্রেসিডেন্টের আত্মসমর্পণ মানে কি আমাদেরও পরাজয়?’ জিজ্ঞেস করল সারা জেফারসন।
‘তা হবে কেন? প্রেসিডেন্ট ইহুদীবাদীদের কাছে আত্মসমর্পণ করলে আমাদেরকে দুই প্রতিপক্ষরে বিরুদ্ধে লড়তে হবে, এই যা।’
‘আপনার কি মনে হয় প্রেসিডেন্ট আত্মসমর্পণ করবেন?’ জিজ্ঞাসা সারা জেফারসনের।
‘আমেরিকান রাজনীতির এই দিকটা নিয়ে এই মুহূর্তে আমর কোন ভাবনা নেই। জর্জ আব্রাহাম এখানে এলেই সব বোঝা যাবে। প্রেসিডেন্টের আত্মসমর্পণ মানেই হলো জর্জ আব্রাহাম ও এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থারের বরখাস্ত।
‘ঠিক।’ বলে সারা জেফারসন একটু থেমে আহমদ মুসার দিকে পরিপূর্ণভাবে তাকিয়ে বলল, ‘আপনি কি ভাবছেন?’
প্রশ্ন শুনে আহমদ মুসা চেয়ারের গা এলিয়ে দিল। চোখ বুঝে গেল তার। একটু পরে ধীরে সুস্থে বলল, ‘আপনাদের চিন্তা ঠিক পথেই চলছে। যে দায়িত্ব দিয়েছেন, সে দায়িত্ব আমি পালন করব। নিউজ পেপার ও টিভি চ্যানেলের জন্যে স্ক্রিপ আমি তৈরি করে দেব। এ বিষয়ে জর্জ আব্রাহামের সাথেও আমার আলোচনা প্রয়োজন।’
মুহূর্তকালের জন্যে থামল আহমদ মুসা। তারপর আবার শুরু করল, ‘তবে আমার মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে জেনারেল শ্যারনদেরকে হাতে-নাতে পাকড়াও করার মত কিছু ঘটনা আমাদের চাই।’
থামল, আবার একটু ভাবল আহমদ মুসা। তারপর বলল, ‘আচ্ছা মিস জেফারসন, বেঞ্জামিন বেকনের সাথে কথা বলার সময় আপনি ‘টেপ পাওয়া’ কাউকে ‘উদ্ধার করা’ সম্পর্কে কিছু বললেন। ঘটনাটা কিন্তু আমাকে বলেননি।’
আবার সেই ‘মিস জেফারসন’ সম্বোধন। তার বুকের পুরনো কষ্টটা আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। বেদনায় মুখটা ম্লান হয়ে গেল তার। দুচোখও ভারী হয়ে উঠল।
মুখ নিচু করে দাঁত চেপে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করল সারা জেফারসন। এ সময় অভিমানে প্রচন্ড এক তরঙ্গ এসে তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। স্বাভাবিক কথা বলার সাধ্য তার থাকল না।
মুখ নিচু রেখেই ‘এক্সকিউজ মি’ বলে উঠে গেল সারা জেফারসন।
টেবিলে গিয়ে ঢক ঢক করে দুই গ্লাস পানি খেল সে। তারপর বেসিনে গিয়ে মুখে পানির ছিটা দিল। এরপর তোয়ালে দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে ফিলে এল চেয়ারে। বলল, ‘স্যারি।’
আহমদ মুসার ব্যাপারটা লক্ষ করেছিল। সারা জেফারসনের এই কষ্ট দারুনভাবে বিব্রত করল আহমদ মুসাকে। কিন্তু বিষয়টাকে এড়িয়ে গেল আহমদ মুসা। এ ধরনের বিষয় নিয়ে আলোচনার সময় এটা নয়। ডোনা জোসেফাইনের কথা সারাকে বলবে আহমদ মুসা, কিন্তু তার কোন প্রসংগ আহমদ মুসা পায়নি।
আহমদ মুসা বিষয়টা এড়িয়ে গেলেও তার মুখের বিব্রতভাব চাপা দিতে পারল না।
সারা ফিরে এসে বসলেও আহমদ মুসা মুখ তুলতে পারলো না।
সারাও ‘স্যরি’ বলে মুখ নিচু করেই ছিল।
কিন্তু তা মুহূর্ত কয়েকের জন্য নিজেকে সামলে নেবার লক্ষ্যে। পরে ধীর ধীরে বরল হ্যারির টেপ পাওয়া ও তার কিডন্যাপ হওয়ার কথা।
আহমদ মুসার চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, ‘আল-হামদুলিল্লাহ। খারাপ খবরটা যত বড়, তার চেয়ে বড় এই সুখবর।’
এ সময় সারা জেফারসনের মা ঘরে প্রবেশ করতে করতে বলল, ‘কি সুখবর বেটা?’
আহমদ মুসা কিছু বলার আগে সারা জেফারসনই বলল, ‘সত্যিই বড় খবর মা। সিনেটর দানিয়েল ময়নিহান ইহুদীবাদীদের প্রতি সহানুভূতিশীল। তার সাথে আলোচনার একটা গোপন টেপ করেছিল জেনারেল শ্যারন। সেটা মি. ময়নিহানের ছেলে আমাদের কর্মী হ্যারি এডওয়ার্ডের মাধ্যমে আমাদের হাতে এসেছে। এটা একটা দিক। অন্যদিক হলো, হ্যারিকে টেপ উদ্ধারের লক্ষ্যে জেনারেল শ্যারনরা কিডন্যাপ করেছে। এই দুটি দিক যদি ময়নিহানের নজরে আনা যায় তাহলে দারুন একটা রাজনৈতিক লাভ হবে আমাদের।
‘সৌভাগ্য দেখছি আহমদ মুসার। হিসেব করে দেখ, আহমদ মুসা আমেরিকার মাটিতে পা দেবার পর থেকেই তোমাদের একের পর এক বিজয়ের ঘটনা ঘটতে শুরু করেছে।’ বলল সারা জেফারসনের মা।
‘তা নয় খালাম্মা, ওদের বিজয়ের যুগে আমি আমেরিকায় পা দিয়েছি।’
এতক্ষণে হাসল সারা জেফারসন। বলল, ‘জানি এটাই আপনি বলবেন। আমেরিকান কোন কিছুর সাথে আপনাকে সম্পৃক্ত না করলে, আপনি আরও খুশি হন। আমেরিকায় আপনি নিজের অনিচ্ছায় এসেছেন তো!
‘কি বলছিস সারা! বাছা এ রকম ভাববে কেন? আমেরিকা থেকে সে কি যাবে, না তাকে যেতে দেব? তার জন্যে পায়ের বেড়ি আমি রেডি রেখেছি।’ বলল সারা জেফারসনের মা।
প্রথমে আহমদ মুসার মুখে হাসি ফুটে উঠেছিল। কিন্তু সারা জেফারসনের মায়ের শেষ কথায় তার হাসিটা মলিন হয়ে গেল।
আর সারা জেফারসনের চোখে মুখে মায়ের ইংগিতমূলক কথায় লজ্জিত ও বিব্রত ভাব ফুটে উঠল। মায়ের কথা শেষ হতে না হতেই কিছু বলার জন্যে দ্রুত মুখ খুলেছিল সারা জেফারসন।
ঠিক এ সময়ই ঘরে প্রবেশ করল একজন পুলিশ অফিসার। বলল, ‘মাফ চাচ্ছি সকলের কাছে বিরক্ত করার জন্য। এইমাত্র ওয়াশিংটন থেকে আমাকে জানানো হয়েছে, এফ বি আই প্রধান এখানে আসছেন। আমাকে জানানোর জন্যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, ম্যাডাম সারা জেফারসন ও তার মেহমানকে জরুরী প্রয়োজনে তাদের সাথে ওয়াশিংটন যেতে হবে।’ পুলিশ অফিসার চলে গেল।
সারা জেফারসন তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বরল, ‘আমি কেন? সরকারী কোন প্রোগ্রামে তো আমি যাই না। যাওয়ার কথা তো শুধু আপনার।’
আহমদ মুসা হাসল। অনেক্ষণ পর হাসার সুযোগ পেল। বলল, ‘ঘটনার ঘটক হয়ে বুঝি একথা বলা যায়?’
‘অন্তত আপনি আমাকে এত উঁচুতে তুলবেন না। আছাড় খেলে মরে যাব।’ সারা জেফারসনের কন্ঠ হঠাৎ ভারী হয়ে উঠেছে।
একটু থেমে দ্রুত সে নিজেকে সামলে নিয়ে আবার বলে উঠল, ‘আমি ঘটক হলে আপনি কি?’ হাসির চেষ্টা সারা জেফারসনের ঠোঁটে।
সারা জেফারসনের আগের কথাটা আহমদ মুসাকেও হঠাৎ একটা ধাক্কা দিয়েছিল। একটা শক ওয়েভ সৃষ্টি হয়েছিল তার মনে।
সারা জেফারসনের শেষের কথা আবার পরিবেশকে হাল্কা করে তুলল। আহমদ মুসা পরিবেশকে আরও হাল্কা করার জন্যেই বলল, ‘অভিনেতার পাশে তো সহঅভিনেতা থাকে?’
‘সহঅভিনেতা না বলে ‘সাথী’ বললে ক্ষতি কি?’ বলল সারা জেফারসন। মুখে তার ম্লান হাসি।
‘কোন ক্ষতি নেই।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আছে ক্ষতি, সহঅভিনেতা পেছনে থাকে, সাথীকে কিন্তু পাশে রাখতে হয়।’ বলেই সারা জেফারসন উঠে দাঁড়াল। তারপর বলল, ‘আম্মা ওনারা যে কোন সময় এসে পড়তে পারেন। কিছু গোছ-গাছ করে নেয়া প্রয়োজন।’
সারা জেফারসনের মা জিনা জেফারসনও উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘নিচটা পরিস্কার করতে বলে এসেছি। ওদিকটা দেখে আমি কিচেনের খোঁজ-খবর নেব। তুমি এদিকে তোমার গোছ-গাছটা করে নাও।’
বলে নিচ তলায় নামার জন্যে ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির দিকে অগ্রসর হলো সারা জেফারসনের মা।
সারা জেফারসন যাবার জন্যে পা বাড়িয়ে আবার ঘুরে দাঁড়াল। বলল আহমদ মুসাকে, ‘আমার ওয়াশিংটন যাবার ব্যাপারে আপনি কিন্তু কিছু বলেননি।’
আহমদ মুসা গম্ভীর হলো। বলল, ‘ফ্রি আমেরিকা’ মুভমেন্টের এসব সিদ্ধান্ত আমাকে নিতে হবে তা কিন্তু আমি বুঝিনি।’
‘এ নির্দেশ আমি সংগঠনকে দিয়েছি। আপনার সিদ্ধান্ত সংগঠনের সিদ্ধান্ত হিসাবে গণ্য হবে।’
‘আমাকে এ সম্মান দেয়ার জন্যে ধন্যবাদ। কিন্তু আপনার এ সিদ্ধান্ত কি স্বাভাবিক?’
আবেগের এক উচ্ছ্বাস এসে সারা জেফারসনের চোখ-মুখ ভারী করে তুলল। বলল, ‘আমার দেখা স্বপ্ন এ পর্যন্ত সত্য প্রমাণিত হয়েছে।
আমার সে স্বপ্নেরই নির্দেশ এটা যে, আমার দায়িত্ব আপনার হাতে তুলে দেব।’ আবেগে কম্পিত কন্ঠস্বর সারা জেফারসনের।
আহমদ মুসার ভেতরটা কেঁপে উঠল। যুক্তিবাদ ও বাস্তববাদের পীঠন্থান আমেরিকার শীর্ষ একটি পরিবারের সুশিক্ষিত তরুনী এমন অদৃষ্টবাদী হয়ে পড়ল কেমন করে! আহমদ মুসা তার এই অন্ধ আবেগের মোকাবিলা করবে কিভাবে!
আহমদ মুসা কথা বাড়াতে চাইল না।
বলল, ‘ওদের ডাক যথার্থ। আপনার ওয়াশিংটনে অবশ্যই যেতে হবে।’
‘ধন্যবাদ, স্যার।’ সারা জেফারসনের মুখে তখন ফুটে উঠেছে দুষ্টুমির হাসি।
ঘুরে দাঁড়িয়ে আবার হাঁটা দিল সারা জেফারসন।

হোয়াইট হাউজের দক্ষিণ অলিন্দে ল্যান্ড করল ছোট্ট একটি হেলিকপ্টার। অলিন্দটা নির্জন।
হেলিকপ্টারের ড্রাইভিং সিট থেকে নেমে এল এফ বি আই প্রধান জর্জ আব্রাহাম জনসন।
তার পরে নেমে এল আহমদ মুসা এবং সারা জেফারসন।
জর্জ আব্রাহাম জনসন একাই হেলিকপ্টার ড্রাইভ করে গিয়েছিল ভার্জিনিয়ার মন্টিসেলোতে। এমন একক সফরের কারণ হিসাবে বলেছিল, আলোচনার জন্য আরও কয়েকজনের আসার কথা ছিল। কিন্তু হোয়াইট হাউজ থেকে তার অনুমতি দেয়া হয়নি। সেখান থেকে জানানো হয়, আহমদ মুসা হোয়াইট হাউজে আসছেন। এ খবর জর্জ আব্রাহাম জনসন ও সারা জেফারসনের বাইরে এফ বি আই ও ‘ফেম’ এর কেউ যেন না জানে। সে জন্যে জর্জ আব্রাহাম জনসনকেই হেলিকপ্টার ড্রাইভ করতে হয়েছে।
হেলিকপ্টার ল্যান্ড করার পর আরোহীদের স্বাগত জানাতে কেউ আসেনি।
জর্জ আব্রাহাম জনসন নিজেই স্বাগত জানাল আহমদ মুসা ও সারা জেফারসনকে। জর্জ আব্রাহামই তাদের নিয়ে চলল হোয়াইট হাউজের ভেতরে।
জর্জ আব্রাহাম তাদেরকে এ করিডোর সে করিডোর ঘুরিয়ে, অনেক সিঁড়ি উঠানামা করিয়ে একটি কক্ষে নিয়ে ঢুকাল। মাঝারি সাইজের বর্গাকৃতি কক্ষ।
কক্ষের ঠিক মাঝখানে অর্থ বৃত্তাকার সুদৃশ্য একটা টেবিল। টেবিলের তিন দিক ঘিরে ছয়টি চেয়ার। আর টেবিলের অবশিষ্ট অন্য পাশটিতে একটিমাত্র আসন। সে আসনের সোজা পেছনে একটা দরজা।
আহমদ মুসারা এ দরজাটির বিপরীত দিকের দরজা দিয়ে ঘরে প্রবেশ করেছে।
কক্ষটি একটি মিটিং রুম। আহমদ মুসারা কক্ষে প্রবেশ করে দেখল তিনজন লোক বসে আছে। টেবিলের এ পাশে বসা বলে তাদের পেছনটা দেখা যাচ্ছে। বোধ হয় পায়ের শব্দ পেয়েছিল ওরা। তিনজনই এক সাথে পেছন ফিরে তাকাল।
তাকিয়েই তিনজন সহাস্যে উঠে দাঁড়াল। প্রায় একসাথেই দুজন বলে উঠল, ‘ওয়েলকাম আহমদ মুসা। গুড মর্নিং টু অল।’
পূর্ব থেকে বসে থাকা তিনজনের একজন হলো এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার, সি আই এ প্রধান, দ্বিতীয় জন মার্কিন সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন এবং তৃতীয়জন হোয়াইট ঈগলের প্রধান গোল্ড ওয়াটার। সবাই বসল।
ছয়জনের ঠিক মাঝখানে বসানো হয়েছে আহমদ মুসাকে। তার ডান পাশে সারা জেফারসন, বাম পাশে গোল্ড ওয়াটার। সারা জেফারসনের ডান পাশে একেবারে প্রান্তের চেয়ারে বসেছে জর্জ আব্রাহাম জনসন। আর গোল্ড ওয়াটারের বামপাশে বসেছে রোনাল্ড ওয়াশিংটন এবং তারপরে প্রান্তের চেয়ারটিতে বসেছে এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার।
সবাই বসলে সারা জেফারসন আহমদ মুসার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, ‘বি রেডি, আপনিই চীফ গেষ্ট। আপনাকে বসানো হয়েছে প্রেসিডেন্টের চেয়ারের সোজা সামনে।
সকাল ১১টা বাজার সাথে সাথে টেবিলের ওপাশের খালি চেয়ারটার পেছনের দরজাটা ধীরে ধীরে খুলে গেল।
সে দরজা দিয়ে প্রেসিডেন্ট প্রবেশ করল। তার মুখে হাসি। দৃঢ় পদক্ষেপ।
কক্ষে পা দিয়েই হাসি মুখে সকলের উপর দিয়ে একবার চোখ বুলিয়ে নিল প্রেসিডেন্ট।
চেয়ারের কাছাকাছি এসে প্রেসিডেন্ট বলল, ‘গুডমর্নিং টু অল।’
প্রেসিডেন্ট কক্ষে প্রবেশ করার সাথে সাথেই সবাই উঠে দাঁড়িয়েছে। প্রেসিডেন্ট চেয়ারে এল।
প্রেসিডেন্ট বসার আগে চেয়ারের সামনে দাঁড়িয়ে। প্রথম হাত বাড়িয়ে দিল আহমদ মুসার সাথে হ্যান্ডশেকের জন্যে। বলল মিষ্টি হেসে ‘মি. আহমদ মুসা। নামের তুলনায় আপনি টু ইয়ং।
‘ধন্যবাদ এক্সেলেন্সি। এটা আমার সৌভাগ্য।’ হ্যান্ডশেক করতে করতে ঠোঁটে হাসি টেনে বলল আহমদ মুসা।
‘দ্যাট’স ট্রু ইয়ংম্যান।’ বলে প্রেসিডেন্ট হাত বাড়াল সারা জেফারসনের দিকে।
সারা জেফারসনের সাথে হ্যান্ডশেক করতে করতে বলল, ‘নাইস টু সি ইউ মিস জেফারসন। আপনার নতুন পরিচয় আমাকে আনন্দিত করেছে।
‘ধন্যবাদ মি. প্রেসিডেন্ট।’ বলল সারা জেফারসন।
তারপর প্রেসিডেন্ট হ্যান্ডশেক করল এফ বি আই চীফ জর্জ আব্রাহাম জনসনের সাথে। বলল, ‘আপনি অনেক কষ্ট করেছেন, ধন্যবাদ মি. জর্জ আব্রাহাম।’
আর গোল্ড ওয়াটারের সাথে হ্যান্ডশেক করতে করতে প্রেসিডেন্ট বলল, ‘মি গোল্ড ওয়াটার আপনিই না, মি. আহমদ মুসাকে ক্যারিবিয়ান থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এনে যত গন্ডগোল পাকিয়েছেন।’ প্রেসিডেন্টের মুখে হাসি।
‘আমার ধন্যবাদ পাওয়া উচিত মি. প্রেসিডেন্ট। কারণ এ গন্ডগোল সৃষ্টি না করলে অনেক সর্বনাশা গন্ডগোল দূর করা যেত না।’ বলল গোল্ড ওয়াটার।
‘সময়ই তা বলে দেবে মি. গোল্ড ওয়াটার।’ প্রেসিডেন্টের কন্ঠ কিছুটা গম্ভীর।
জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন ও এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থারের সাথে হ্যান্ডশেক করে প্রেসিডেন্ট এ্যাডামস হ্যারিসন তার চেআরে গিয়ে বসে পড়ল।
প্রেসিডেন্ট পঞ্চাশোর্ধ। কিন্তু তাকে দেখলে চল্লিশোর্ধের বেশি মনে হয় না।
শক্ত নার্ভের যতগুলো প্রেসিডেন্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এসেছে, তাদের মধ্যে এই প্রেসিডেন্টও স্থান পাবেন। সাংঘাতিক টেনশনের সময়ও এ্যাডামস হ্যারিসন হাসতে পারে। তার আর একটি গুণ হলো তার কথায় স্বচ্ছতা আছে। মানুষ তার সাথে একবার কথা বললেই তাকে চিনতে পারে। প্রেসিডেন্ট বসেই বরল, এখনকার এই মিটিং ফরমাল ও ইনফরমাল দুইই। এই মিটিং এর আমার পাশে কাউকে রাখিনি। এই মিটিং এর কোন কিছুই নোট হবে না। এই মিটিং এ সাক্ষী হবার মত হোয়াইট হাউজে কেই নেই। প্রেসিডেন্টের সিকিউরিটি কমব্যাট ফোর্সই শুধু এখন হোয়াইট হাউজে আছে। সব স্টাফকে আমি ছুটি দিয়েছি আজ অবসর কাটাব বলে। সুতরাং আমাদের কথা-বার্তা পোশাক-আশাকহীন স্পষ্ট হলেই ভাল হয়।’
বলে প্রেসিডেন্ট মুহূর্তের জন্যে একটু থামল। একটু যেন আত্মস্থ হলো। তারপর মুখ তুলে সোজা তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বরল ‘আমেরিকায় আপনাকে খোশ আহমদেদ আহমদ মুসা।’
‘ধন্যবাদ মি. প্রেসিডেন্ট।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আমি দুঃখিত, মৌলবাদী শব্দের কদর্থ হচ্ছে। যা হওয়া উচিত ছিল পুরস্কারের নিমিত্ত, তাকে করা হয়েছে তিরস্কারের বাহন। খ্রীষ্টের মৌল শিক্ষায় আমি অবিশ্বাসী নই, বাইবেল ছুঁয়ে শপথ নিয়ে আমি প্রেসিডেন্ট হয়েছি। তাই আমিও মৌলবাদী।’ বলল প্রেসিডেন্ট শান্ত স্বরে।
‘আমাকে ‘সন্ত্রাসীও’ বলা হয়েছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘এটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। ‘অমুক সন্ত্রাসী’ কিংবা ‘আমি সন্ত্রাসী নই’ কোনটারই মূল্য নেই। সত্য উদঘাটন থেকেই এর জবাব হয়ে যাবে।’
বলে একটু থেমেই প্রেসিডেন্ট আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘মি. আহমদ মুসা, আপনি কি ভয় পাচ্ছেন?’
‘ভয় আসে হারানোর আশংকা থেকে। আমার কিছু হারাবার নেই মি. প্রেসিডেন্ট।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কিন্তু সবচেয়ে মূল্যবান হলো জীবন। জীবনটা তো আপনার আছে।’
‘জীবনটা আমি ধারণ করি মাত্র। কিন্তু এই জীবন থাকা, না থাকা আমার হাতে নয়, স্রষ্টার হাতে। তাই এ নিয়ে আমার কোন চিন্তা নেই মি. প্রেসিডেন্ট।’
‘কিন্তু এ চিন্তা মানুষের সহজাত।’ প্রেসিডেন্ট বলল।
‘জীব হিসেবে তা সত্য, কিন্তু মানুষ হিসাবে আমাদেরকে এ শিক্ষা নিতে হয় যে, কোন শক্তির মৃত্যুর তারিখ এগিয়েও যেমন আনতে পারে না, তেমনি কোন-প্রয়াস মৃত্যুর সময়কে পিছিয়েও দিতে পারে না।’
প্রেসিডেন্টের মুখে এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘ধন্যবাদ আহমদ মুসা আপনি সত্যিই দেখছি একজন অনুকরণীয় মৌলবাদী।’
বলে প্রেসিডেন্ট মুহূর্তের জন্যে থামল। তার মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল। পরক্ষণেই সকলের দিকে চেয়ে বলে উঠল, ‘আহমদ মুসা নানাদিক দিয়ে একজন আলোচিত ব্যক্তিত্ব তাই প্রথম সাক্ষাতে তারসাথে একটু আলোচনার সুযোগ নিলাম। এখন কাজের কথায় আসি।’
থামল প্রেসিডেন্ট। তাকাল জর্জ আব্রাহাম জনসনের দিকে। জর্জ আব্রাহাম জনসন মার্কিন নিরাপত্তা সিস্টেমের সবচেয়ে সিনিয়র আমলা।
জর্জ আব্রাহাম জনসন প্রেসিডেন্টকে তার দিকে তাকাতে দেখে নড়ে-চড়ে বসল। বুঝল প্রেসিডেন্টের ইংগিত যে, তাকেই একটা ভূমিকা নিতে হবে। বলল সে ‘বিশেষ এক পরিস্থিতিতে হোয়াইট হাউজে মহামান্য প্রেসিডেন্টের সামনে আমরা উপস্থিত হয়েছি। আজ দেশের প্রধান সংবাদপত্রগুলোতে একটা নিউজ পরিকল্পিতভাবে প্রকাশ করা হয়েছে। এর মূল কথা, আহমদ মুসার যোগ-সাজসের শিকার হয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ও তার প্রশাসন এবং মার্কিন দুটি সংগঠন, হোয়াইট ঈগল ও ‘ফেম’, ইহুদীদের সাথে সংঘাত সৃষ্টির জন্যে উঠে পড়ে লেগেছে। ওদের ঘোষণা থেকে মনে হচ্ছে, আজ সন্ধ্যায় কয়েকটি টিভি চ্যানেলেও এই কথাগুলো প্রচার করা হবে। এই অবস্থায় মত বিনিময়ের জন্যেই এই মিটিং। প্রেসিডেন্ট সরাসরি আপনাদের কাছ থেকে কিছু জানতে চান।’ থামল জর্জ আব্রাহাম।
থামার সংগে সংগেই প্রেসিডেন্ট বলে উঠল, ‘ধন্যবাদ মি. জর্জ।’
বলেই প্রেসিডেন্ট সরাসরি আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘মি. আহমদ মুসা, যে অভিযোগ ওরা নিয়ে আসছে তার প্রধান আসামী আপনার মতে কে?’
আহমদ মুসার দুচোখও প্রেসিডেন্টের চোখে ন্বিদ্ধ। প্রশ্নের ধরনেই বোধ হয় এক টুকরো হাসি ফুটে উঠেছে আহমদ মুসার ঠোঁটে। বরল, ‘মহামান্য প্রেসিডেন্ট যাকে এই প্রশ্নটি জিজ্ঞেস করেছেন, সেই আহমদ মুসাই প্রধান আসামী। নিউজে যা বলা হয়েছে তার সবটাই প্রেসিডেন্ট ও তা প্রশাসনের উপর চাপ সৃষ্টির লক্ষ্যে, যাতে প্রেসিডেন্ট সংশ্লিষ্ট সব ঘটনাকে ইহুদী বিদ্বেষজাত সাজানো ঘটনা ধরে নিয়ে ইহুদীদের বিরুদ্ধে তদন্ত বন্ধ করে আহমদ মুসার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন।’
‘প্রেসিডেন্ট যদি দেশের সংবাদপত্র ও টিভি নেটওয়ার্কের এই সাজেশনকে গ্রহণ করেন?’ বলল প্রেসিডেন্ট গম্ভীর কন্ঠে।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘প্রেসিডেন্ট তা করতে পারেন।
‘সেক্ষেত্রে আপনার ভূমিকা কি হবে?’ বরল প্রেসিডেন্ট।
‘কোন ভূমিকায় আমি অবতীর্ণ হব, তা নির্ভর করবে মিস জেফারসন ও মি. গোল্ড ওয়াটারের ভূমিকার উপর। ওরা যদি আমাকে সহযোগিতা করেন, তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থেকেই জেনারেল শ্যারনদের ষড়যন্ত্র নস্যাতের চেষ্টা করব। আর ওরা যদি প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্তের সাথে থাকেন, তাহলে আমি মার্কিন সরকারের গ্রেফতার এড়িয়ে যুক্তিটাকে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নিয়ে যাব।’
‘আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নিয়ে যাবার অর্থ?’ প্রেসিডেন্ট জিজ্ঞেস করল।
‘জেনারেল শ্যারনরা যে লড়াই মার্কিন মিডিয়াতে শুরু করেছে, তা আমি আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে নিয়ে যাব এবং ওদের মুখোশ ছিঁড়ে ওদের নগ্ন চেহারা বিশ্ববাসীর সামনে নগ্ন করে দেব।’ বলল আহমদ মুসা।
প্রেসিডেন্টের চোখ দুটি উজ্জ্বল হয়ে উঠল। কিন্তু মুখের গাম্ভীর্য ঠিকই থাকল। বলল প্রেসিডেন্ট, ‘মার্কিন গ্রেফতার এড়াবেন কি করে? আপনি হোয়াইট হাউজে, কার্যত বন্দীই বলতে পারেন।’
আহমদ মুসার হাসল। বলল, ‘আমি কার্যত বন্দী যেমন বলা যায়, তেমনি বন্দী মুক্তির পথ কার্যত খোলা আছে বলা যায়।’
প্রেসিডেন্টের ভ্রুকুঞ্চিত হলো। তারপর মুখে ফুটে উঠল কৌতুল। বলল, ‘সে পথ কেমন?’
আহমদ মুসার হাসল। বলল আমার শোল্ডার হোলস্টারে মেশিন রিভলবার এম ১০ আছে, কেউ সার্চ করেনি। এই ঘরে সবাইকে বন্দী করে আমি বেরিয়ে যেতে পারি। হেলিকপ্টার ল্যান্ড করা আছে সিঁড়ির প্রায় গা ঘেষেই। জর্জ আব্রাহাম চাবি রেখে এসেছে ড্যাশ বোর্ডের এ্যাসট্রেতে। প্রেসিডেন্টের অয়্যারলেস সংকেত পেয়ে হোয়াইট হাউজের সিকিউরিটি কমব্যাট ফোর্স হেলিকপ্টার লক্ষ্যে যখন প্রথম গুলী বৃষ্টি করবে তখন হেলিকপ্টার অন্তত পঞ্চাশ ফুট উপরে উঠে যাবে।’
প্রেসিডেন্টের ঠোঁটে হাসি।
জর্জ আব্রাহামের চোখে-মুখে বিস্ময়। বলল, ‘কেউ দেখেনি নিশ্চিত হয়ে চাবিটা আমি ওখানে রেখেছি।’
জর্জ আব্রাহাম থামতেই জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন বলল, ‘হেলিকপ্টার গুলী কবে নামাবো, ওটা হোয়াইট হাউজের এলাকা পার হবার আগেই।’
‘জনাব জর্জ আব্রাহামের হেলিকপ্টারটি বুলেট প্রুফ। গোলা বর্ষণ করে যদি পাখা ফেলে দেয়া হয়, তবু এ বিশেষ হেলিকপ্টারটি ফ্লাই করতে পারে।’ বলল আহমদ মুসা হাসি মুখে।
এবার প্রেসিডেন্টসহ সকলের চোখে মুখে বিস্ময়ের চিহ্ন। বলল এফ বি আই চীফ জর্জ আব্রাহাম জনসন, ‘হেলিকপ্টারের এই বৈশিষ্ট্য একটা ক্ল্যাসিফাইড ইনফরমেশন। আপনার জানার কথা নয়।’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘হেলিকপ্টারের ড্রাইভিং ডোরের ভেতরের পাশে মেক-আপ প্লেটে হেলিকপ্টারের স্পেসিফিকেশন লেখা আছে। ওটা থেকে তো যে কেউ ক্ল্যাসিফাইড ইনফরমেশন জেনে নিতে পারে।’
‘ধন্যবাদ আহমদ মুসা। সত্যই বিস্ময়ের যে, হোয়াইট হাউজের গ্রেফতার এড়িয়ে সরে পড়ার চিন্তাও আপনি করে রেখেছেন।’
প্রেসিডেন্ট আহমদ মুসাকে এই কথা বলার পর সারা জেফারসন ও গোল্ড ওয়াটারকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘সরকার যদি মিডিয়ার সাজেশনকে গ্রহণ করে নেয়, তাহলে আহমদ মুসা তার পদক্ষেপ হিসাবে দুই বিকল্পের কথা বলেছে। একটিতে আপনাদের সহযোগিতা দরকার, অন্যটিতে তার নিজস্ব। আপনারা তাকে সহযোগিতা করছেন কি না?’
‘মি. প্রেসিডেন্ট বলেছেন, আমি আহমদ মুসাকে আমেরিকায় এনে এই গন্ডগোল পাকিয়েছি। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে তাঁকে এনে গন্ডগোল দূর করার ব্যবস্থা করেছি। সুতরাং আমি এবং আমার সংগঠন তাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করব।’ বলল গোল্ড ওয়াটার।
প্রেসিডেন্ট তাকালেন সারা জেফারসনের দিকে।
সারা জেফারসনের মুখ গম্ভীর। বলল, ‘যুদ্ধ বা লড়াই যেটা শুরু হয়েছে, সেটা আমাদের লড়াই, আমেরিকানদের লড়াই। মি. আহমদ মুসার লড়াই নয়। তিনি ঘটনাক্রমে এর সাথে জড়িত হয়ে পড়েছেন এবং সবরকম সহযোগিতা করছেন। আমি আমেরিকার পক্ষ থেকে তাঁকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি যে, আমেরিকা না চাইলেও এ লড়াই তিনি চালাবেন আমেরিকার বাইরে গিয়ে। এটা তাঁর পরম মানবিকতার প্রকাশ।’
সারা জেফারসনের কথা শেষে দিকে এসে আবেগে রুদ্ধ হয়ে পড়েছিল। একটু থামল সারা জেফারসন।
‘স্যরি’ বলে মুখটা একটু ঘুরিয়ে একটু কেসে পরিস্কার করে নিয়ে আবার বলল, ‘আমেরিকানদের সরকার না চাইলেও আমেরিকানরা এ লড়াই চালাবে। আবেদন করব, এ লড়াই এ মি. আহমদ মুসা আমেরিকানদের সাথে থাকবেন।’
কন্ঠ আবার আবেগে রুদ্ধ হয়ে পড়ল সারা জেফারসনের।
থামল সারা জেফারসন। মুখ নিচু করল সে।
প্রেসিডেন্টের চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। একটা আবেগের কম্পন তারও চোখে-মুখে।
প্রেসিডেন্ট সোজা হয়ে বসল। বলল, ‘ধন্যবাদ মিস জেফারসন। প্রেসিডেন্ট হিসাবে নয়, একজন আমেরিকান হিসাবে আপনাকে অভিনন্দিত করছি। আমি গর্বিত যে, আমেরিকানদেরই এক প্রিয় পূর্ব পুরুষের পরিবারের আপনি সন্তান।’ প্রেসিডেন্ট একটু থামল।
প্রেসিডেন্টের কথাও আবেগে ভারী হয়ে উঠেছিল।
থামার সাথে সাথে প্রেসিডেন্টের চোখ মুহূর্তের জন্যে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বোধ হয় প্রেসিডেন্ট আবেগ দূরে সরাতে চাইল। মুহূর্তকাল পরে প্রেসিডেন্ট বলল, ‘কিন্তু সব নাগরিকের সরকার হিসাবে, দেশের প্রেসিডেন্ট হিসাবে কোন জাতিগত দ্বন্দ্বে আমি কোন পক্ষ হতে পারি না।’
‘জাতিগত দ্বন্দ্ব কোথায় মি. প্রেসিডেন্ট?’ বলল সারা জেফারসন।
‘পরিস্কার যে, এই সংঘাতে ইহুদীরা এক পক্ষ হয়ে গিয়েছে।’
প্রেসিডেন্ট বলল।
‘পরিকল্পিতভাবে ওদের একটা পক্ষ করা হয়েছে মি. প্রেসিডেন্ট। দেশের বাইরে আন্তর্জাতিক একটি ইহুদী গোয়েন্দা গ্রুপ আমাদের দেশের ইহুদীদের একটা ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর যোগসাজসে একটা ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে। এটা হলো প্রকৃত ঘটনা। এই ঘটনার সাথে দেশের সাধারণ ইহুদীদের কোনই সম্পর্ক নেই। সুতরাং যে সংঘাত বেধেছে সেটা জাতিগত সংঘাত নয়। সংঘাত বেধেছে ষড়যন্ত্রকারী একটা চক্রের সাথে। ঘটনাক্রমে ষড়যন্ত্রকারী এই গোষ্ঠী দেশের ইহুদীদের একটা অংশ। আর এই ষড়যন্ত্রকারীরা ধরা পড়ার পর এখন চেষ্টা করছে দেশেসব ইহুদীদের তাদের সাথে টানার এবং একে জাতিগত রূপ দেয়ার। তারা দুটো অন্যায় করছে। প্রথমটা ওদের ষড়যন্ত্র, অন্যটা হলো তাদের কুকীর্তির সাথে গোটা ইহুদী কম্যুনিটিকে জড়িয়ে ফেলার। এইভাবে ইহুদী কম্যুনিটিকে ঢাল বানিয়ে তারা তাদের জঘন্য কুকীর্তিকে ঢাকতে চাচ্ছে। এটা আমরা হতে দিতে পারি না।
‘মিস জেফারসন আপনার সাথে আমি একমত। কিন্তু এ কথাগুলো সবই এখন মানুষের কাছে প্রমাণ সাপেক্ষ্য। প্রমানিত হবার আগে জনগণ যেমন পক্ষ নেবে না, তেমনি সরকারে এখন এক পক্ষে গিয়ে দাঁড়ানো কঠিন।’ প্রেসিডেন্ট বলল।
‘স্যরি মি. প্রেসিডেন্ট, এখানে পক্ষ নেবার প্রশ্ন উঠছে না। আপনার প্রশাসন একটা তদন্তে হাত দিয়েছে, সেটা এখন এগিয়ে নেয়ার প্রশ্ন।’ বলল সারা জেফারসন।
‘সেটা এগিয়ে যাবে মিস জেফারসন। কিন্তু সরকারকে এখন কথা বলতে হবে। সে কথায় সরকার বলবে, আহমদ মুসার পক্ষ এবং ইহুদীদের বিপক্ষ-কোন ব্যাপারেই এমন কোন বিবেচনা সরকারের মধ্যে নেই। প্রশাসন কিছু গুরুত্বপুর্ণ ব্যাপারে তদন্ত করছে। ব্যক্তি, পরিচয় নির্বিশেষে যে কারো কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতাকে ওয়েলকাম করা হয়েছে। এক্ষেত্রে সম্মানিত ইহুদী নাগরিকদের সহযোগিতাকে বিশেষ মূল্যবান বিবেচনা করা হবে উপযুক্ত সময়ে সবকিছুই জনসমক্ষ্যে আনা হবে।’ প্রেসিডেন্টের দপ্তর থেকে আজই একথা ঘোষণা করা হবে।
‘মি. প্রেসিডেন্ট তদন্ত বানচাল করার জন্যেই জেনারেল শ্যারনরা এতকিছু করছে। সুতরাং এই ঘোষণা কোনই কাজ দেবে না। এ তদন্ত তারা আগাতে দেবে না। প্রেসিডেন্টের উপর রাজনৈতিক চাপ কোন কাজ না দিলে তারা আরও বড় কিছু ঘটাবে। মি. প্রেসিডেন্ট নিশ্চিত থাকুন তারা সরকারের পতন পর্যন্ত যাবে।’ সারা জেফারসন বলল।
‘আমি জানি মিস জেফারসন। জর্জ আব্রাহাম ও ম্যাক আর্থাররাও একথা বলছেন।’ বলল প্রেসিডেন্ট।
‘তাহলে মি. প্রেসিডেন্ট ওদের আক্রমণের জবাবে আপনি অকার্যকর এই আত্মরক্ষার পথ নিচ্ছেন কেন?’ বলল সারা জেফারসন।
‘সরকার এর বেশি কিছু করতে পারবে না।’ প্রেসিডেন্ট বলল।
‘তাহলে?’ হতাশ কন্ঠে গোল্ড ওয়াটার বলল।
‘এ প্রশ্নের সমাধানের জন্যেই তো আপনাদের ডেকেছি। থ্যাংকস গড। যা চেয়েছিলাম তা পেয়েছি।’ বলল প্রেসিডেন্ট।
‘কি পেয়েছেন মি. প্রেসিডেন্ট?’ জিজ্ঞেস করল সারা জেফারসন।
‘আহমদ মুসা আমাকে নিশ্চিত করেছেন। তার এগিয়ে যাওয়াটা সরকার নির্ভর নয়। মি. গোল্ড ওয়াটার তাকে সহযোগিতা করবেন জেনে খুশি হয়েছি। আর মিস জেফারসন আপনার মধ্যে আমেরিকার সংগ্রামী নতুন প্রজন্মকে দেখছি। আমি আশান্বিত আপনারা ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে জয়ী হবেন।’ বলল প্রেসিডেন্ট। তার কন্ঠে আবেগের সুর।
‘কিন্তু মি. প্রেসিডেন্ট, জনগণের সংকট মোচনে জনগণের সরকার কিছু না করে সমাধান জনগণের উপর ছেড়ে দিলে সেটা কেমন হয়।’ বলল সারা জেফারসন।
‘দেশের বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন ধরনের কূটনীতির আশ্রয় নিতে হয়। একে প্রয়োজনীয় একটি কূটনীতি হিসেবেই দেখুন। তবে সরকার ওদের উপর ক্র্যাকডাউন করছে না ঠিকই, তবে প্রশাসনের সব ধরনের সহযোগিতা আপনারা পাবেন। সেটা নেয়ার দায়িত্ব আপনাদের, দেয়ার দায়িত্ব প্রশাসনের থাকবে না।’
প্রেসিডেন্ট সারা জেফারসনের উদ্দেশ্যে কথাগুলো বলেই তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘মি. আহমদ মুসা, সামনে এগোনোর ব্যাপারে আপনারা কি চিন্তা করছেন, কিছু কি জানতে পারি?’
‘এ প্রশ্নের উত্তর মিস সারা জেফারসন ভাল দিতে পারবেন। ওরা কিছু চিন্তা করেছেন মি. প্রেসিডেন্ট।’
প্রেসিডেন্টের চোখ ঘুরে গেল সারা জেফারসনের দিকে।
আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই সারা জেফারসন শুরু করেছে তার কথা। বলছিল, ‘বিস্তারিত আমরা কিছু ভাবিনি। তবে যে অস্ত্র দিয়ে ওরা আমেরিকানদের আঘাত করেছে, সে অস্ত্র দিয়ে আমরা ওদের আঘাত করব। অস্ত্র রেডি করার দায়িত্ব আমাদের, কিন্তু রসদ যোগাবেন জনাব আহমদ মুসা।’
‘বুঝতে পারছি, কাজ আমাদেরই করতে হবে। কিন্তু সরকার আমাদের কোন দায় দায়িত্ব নেবেন না। বরং দরকার হলে সরকার আমাদের কাউকে গ্রেফতারও দেখাবেন।’
কথার মাঝখানে আহমদ মুসা একটু থামল। আবার শুরু করল। বলল, ‘রসদ তৈরীর ব্যাপারে মি. জর্জ আব্রাহাম মি.ম্যাক আর্থার ও মি. রোনাল্ড ওয়াশিংটনদের কারো কারো সহযোগিতা দরকার হবে। ওদের সাথে যোগাযোগের কোন সুযোগ থাকছে কিনা?
‘সত্যিই আপনি অসাধারণ আহমদ মুসা। আপনাকে গ্রেফতার দেখাবার মত পরিস্থিতি হতে পারে। জেনারেল শ্যারনদের রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র ঠেকাবার জন্যে শেষ পর্যন্ত প্রশাসনকে ঐ পর্যন্ত যেতে হতে পারে। আপনি এটা বুঝেছেন মানে মার্কিন রাজনীতির কিছুই বুঝা আপনার বাকি নেই। আপনাকে ধন্যবাদ।’
শেষ শব্দ উচ্চারণের পর প্রেসিডেন্ট একটা দম নিয়ে আবার শূরু করল, ‘না ওদের কারো সাথে আপনি যোগাযোগের সুযোগ পাবেন না। আমাদের গোটা পুলিশ ও গোয়েন্দা এজেন্সীগুলোর চোখের বাইরে আপনাকে কাজ করতে হবে। যাতে জেনারেল শ্যারন ও সংশ্লিষ্টরা বোঝে আপনাদের কাজের সাথে সরকারের কোন সম্পর্ক নেই। লড়াই থেকে সরকার সরে দাঁড়িয়েছে। লড়াই চালাচ্ছেন আপনারা। তবে জর্জ আব্রাহাম, মি. ম্যাক আর্থার ও জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন ব্যক্তিগতভাবে আপনার সাথে যোগাযোগ করবেন প্রয়োজন হলে।’
‘কিন্তু আমার প্রয়োজন হলে?’ প্রেসিডেন্ট থামতেই বলে উঠল আহমদ মুসা।
‘আমার সাথে বৈঠকের পর এখানেই ওদের সাথে আপনি বসবেন। আপনার প্রশ্নের জবাব ওরাই দেবেন।’ বলল প্রেসিডেন্ট।
এ কথা শেষ করেই প্রেসিডেন্ট বলে উঠল, ‘লেডিজ এন্ড জেন্টেলম্যান, আপনারা কষ্ট করে এখানে এসে আমাকে আলোচনার সুযোগ দেয়ায় আপনাদের সকলকে ধন্যবাদ। আমি এখন উঠতে চাই।’
উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে প্রেসিডেন্ট বলল, ‘পাশের ঘরে আপনাদের চা অপেক্ষা করছে। সেখানে সকলকে আমি দাওয়াত দিচ্ছি। মি. জর্জ আব্রাহাম জনসনকে আমি অনুরোধ করছি তিনি আমার পক্ষ থেকে সম্মানিত মেহমানদের সাথে এ্যাটেন্ড করবেন।’
বলে প্রেসিডেন্ট উঠে দাঁড়িয়ে সকলের সাথে হ্যান্ডশেক করে যেমন এসেছিল, তেমনি পেছনের সেই দরজার দিকে এগুলো।
দরজায় গিয়ে আবার ফিরে দাঁড়াল প্রেসিডেন্ট। বলল সারা জেফারসনকে লক্ষ্য করে। বলল, ‘সারা জেফারসন ফরমাল মিটিং শেষ, এখন তোমাকে মা বলতে পারি। শুন মা সারা জেফারসন, তোমার মন্টিসেলোতে থাকা ঠিক হবে না। লস আলামোস থেকেও তোমার এক মাসের ছুটি হয়েছে। তুমি এখন ওয়াশিংটনে থাকবে। তোমার মাকেও আনার জন্যে আমি বলে দিয়েছি। আহমদ মুসাও অবশ্যই ওয়াশিংটনে থাকবেন। জর্জ আব্রাহাম জনসন সব ব্যবস্থা করে দেবেন, এক বাড়ি কিংবা দুই বাড়ি যেটাই তোমার প্রেফার কর।’
প্রেসিডেন্ট চলে গেল।
সারা জেফারসন ঠোঁটে এক টুকরো হাসি নিয়ে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। তারপর চোখ ঘুরাল জর্জ আব্রাহাম জনসনের দিকে। বলল, ‘আংকল আমাদের এক বাড়িই বোধয় আমার জন্যে নিরাপদ হবে, তাই না?’ সারা জেফারসনের চোখ উজ্জ্বল।
জর্জ আব্রাহাম কথা বলার আগেই আহমদ মুসা মুখ খুলতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই সারা জেফারসন দ্রুত বলে উঠল, ‘আমরা এখন উঠতে পারি।’ উঠে দাঁড়াল সারা জেফারসন।
উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে আরও বলল সারা জেফারসন, ‘আংকল জর্জ আব্রাহাম জনসনের পক্ষ থেকে আমি আপনাদের সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছি চায়ের টেবিলে।’
‘ধন্যবাদ মা, প্রেসিডেন্ট যখন পাওয়ার ডেলিগেট করেছেন মি. জর্জকে তখন মি. জর্জও পারেন তা করতে।’ বলল এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার হাসতে হাসতে।
সবাই হেসে উঠল। উঠে দাঁড়াল সবাই।