৭
গভীর রাত। পশ্চিম ওয়াশিংটনের নিউ এজ সিনাগগের বিপরীত দিকে রাস্তার ওপারের একটা বিশাল বাড়ির ভেতরের একটি কক্ষ কয়েকটি সোফায় মুখোমুখি বসে আছে জেনারেল শ্যারন, কাউন্সিল অফ আমেরিকান জুইস এ্যাসোসিয়েশনস- এর চীফ ডেভিড উইলিয়াম জোনস এবং জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনের হাতে ‘ফ্রি আমেরিকা’ ও ‘হোয়াইট ঈগল’ থেকে যে প্রতিবাদ পাঠানো হয়েছে পত্রিকাগুলোতে সেই প্রতিবাদলিপির একটা কপি। এই কপির উপরই চোখ বুলাচ্ছিল জেনারেল হ্যামিল্টন।
পড়া শেষ করে মুখ তুলল সে। তার বিমর্ষ চোখে মুখে এবার চরম বিস্ময়। বলল সে, ‘মি. শ্যারন, আপনি তো প্রতিবাদের এ কপিটা পড়েছেন। আপনার অভিমত কি এ সম্পর্কে?’
‘মি. হ্যামিল্টন ওতে যা আছে তা ওদের অভিমত।’ বলল জেনারেল শ্যারন।
‘সেটা বুঝেছি। কিন্তু এ অভিমত সত্য কিনা? তারা যে প্রমাণসমূহ উল্লেখ করেছে তা মিথ্যা প্রমাণ করতে আমরা পারব কিনা?’ বলল জেনারেল হ্যামিল্টন।
‘সেটা তো বিচারের প্রশ্ন। আমাদের প্রতিবাদ আমরা অবশ্যই করব।’ জেনারেল শ্যারন বলল।
জেনারেল হ্যামিল্টনের মুখ ম্লান হয়ে গেল। বলল, ‘মি. শ্যারন আমি বিচারের কথা বলছি না। আমি বলতে চাচ্ছি, আমাদের বক্তব্যকে আমরা সত্য বলছি কিনা? সত্য একটাই থাকে। আমাদের কথা সত্য হলে ওদের কথা মিথ্যা অবশ্যই হবে।’
জেনারেল শ্যারন তৎক্ষণাৎ জবাব দিল না। তাকাল ডেভিড উইলিয়াম জোনসের দিকে। তারপর বলল, ‘জেনারেল হ্যামিল্টন আমাদের কথাকে সত্য আমাদের বলতেই হবে।’
‘এর অর্থ আমরা যা বলছি তা সত্য নয়’। জেনারেল হ্যামিল্টন মুখ ম্লান করে বলল।
‘মি. হ্যামিল্টন বিজ্ঞানী জন জ্যাকবের মত আমাদের পূর্ব পুরুষরা আমাদের জাতির জন্যে যা করে গেছেন, তাই ন্যায় ও সত্য। সে সত্যকে রক্ষার জন্য আমরা লাখো মিথ্যা বললেও তা আমাদের জন্য সত্য।’ একটু শক্ত কণ্ঠে বলল ডেভিড উইলিয়াম জোনস।
উদ্বেগ ফুঠে উঠল জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনের চোখে মুখে। সে দ্রুত কম্পিত কণ্ঠে বলল, ‘তাহলে গোয়েন্দা সুড়ঙ্গের যে অভিযোগ উঠেছে, সেটা সত্য?
কিছু বলতে যাচ্ছিল জেনারেল শ্যারন। এ সময় টেলিফোন বেজে উঠল ডেভিড উইলিয়াম জোনসের। টেলিফোন ধরল সে।
টেলিফোনে ওপারের কথা শুনেই অন্ধকার হয়ে গেল ডেভিড উইলিয়াম জোনসের মুখ।
ওপারের সাথে কথা শেষ করে ডেভিড উইলিয়াম জোনস টেলিফোন রেখে প্রায় আর্তকণ্ঠে বলে, উঠল, ‘সর্বনাশ হয়ে গেছে, মি. শ্যারন। হ্যারিকে ওরা নিয়ে গেছে। আমাদের দশজন লোক ওদের হাতে ধরা পড়েছে। মারা গেছে আরও পাঁচজন।’
‘অসম্ভব! কি করে ঘটল? কারা ঘটাল? পুলিশ? এফ বি আই? আর্তকণ্ঠে চিৎকার করে উঠল জেনারেল শ্যারন।
‘পুলিশ নয়, এফ বি আইও নয়। কারা যেন করেছে। পরে তারা আমাদের লোকদের তুলে দিয়েছে এফ বি আই-এর হাতে।’ বলল ডেভিড উইলিয়াম জোনস।
‘তাহলে ওরা আহমদ মুসা ছাড়া আর কেউ নয়। শয়তানের বাচ্চা, সে সব সর্বনাশের মূল। চিবিয়ে খাব আমরা ওকে।’ চিৎকার করে বলে উঠল জেনারেল শ্যারন।
‘সেটা পরের কথা জেনারেল। এখন হ্যারি যদি মুক্তি পেয়ে থাকে তাহলে আমাদের গোমর ফাঁক হয়ে যাবে। আগামী কালের ৮টার মিটিং এ গিয়ে আমরা কি বলব?’ বলল জেনারেল হ্যামিল্টন।
জেনারেল হ্যামিল্টনের কথা শেষ হতেই আবার টেলিফোন বেজে উঠল। টেলিফোন বেজে উঠেছে এবার জেনারেল শ্যারনের। জেনারেল শ্যারন টেলিফোন ধরর।
টেলিফোনে ওপারের কথা শুনে মুখের চেহারাই পাল্টে গেল তার।
বলল, ‘ওয়াশিংটন পোষ্ট ও নিউইয়র্ক টাইমসও প্রতিবাদ ছাপছে?’ শুকনো কন্ঠ জেনারেল শ্যারনের।
ওপারের কথা শুনে আবার সে বলল, ‘কি বলছ তুমি, জাতিকে জবাই করার মত নিউজ ছাপার অনুমতি দিয়েছে আমাদের সব বেনহামরা?’
‘এ সব হচ্ছে কি মি. শ্যারন? তাহলে সরকারের চাপের কাছে পত্রিকাগুলো নতিস্বীকার করলো?’ চিৎকার করে বলে উঠল ডেভিড উইলিয়াম জোনস।
জেনারেল শ্যারন সোজা হয়ে বসল। বলল, ‘সরকার কোথায়? সরকারের ডিক্টেশন কি বব বেনহামরা শুনবেন! আসলে এ গুলো সবই শয়তান আহমদ মুসার পরিকল্পনা। একদিকে সাংবাদিক কর্মচারীদের ক্ষেপিয়েছে ওরা, অন্যদিকে সব পত্রিকার প্রথম পাতার বিরাট অংশ বিজ্ঞাপনের জন্য আগেই কিনে ফেলেছে। পত্রিকাগুলো প্রতিবাদ নিউজ আকারে না ছাপলেও বিজ্ঞাপন আকারে ছাপতে যাতে বাধ্য হয়ে পড়ে। এসব বুদ্ধি আহমদ মুসার মাথায়ই শুধু গজাতে পারে।’ থামল জেনারেল শ্যারন।
উত্তরে কেউ কোন কথা বলল না। আবার নিরবতা।
নিরবতা ভাঙল জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন। বলল, ‘মিথ্যা সব সময় মিথ্যাই প্রমাণিত হয় মি. শ্যারন। আর মিথ্যার পরিণতি এটাই হয়। আমি দুঃখিত জেনারেল শ্যারন ও মি. জোনস, আমি জানতাম না এটা মিথ্যার ব্যাপারটা। আমাকে নতুন করে সব কিছু ভাবতে হবে।’
‘কি ভাববেন?’ বলল ডেভিড উইলিয়াম জোনস। কণ্ঠ কঠোর তার।
‘আমি আপনাদেরকে ভালোবাসি, আপনাদের লক্ষ্য উদ্দেশ্যকে ভালোবাসি। কিন্তু সে ভালোবাসা আমার আমেরিকার স্বার্থেই। কিন্তু এখন……………?’ কথা শেষ করল না জেনারেল হ্যামিল্টন।
জেনারেল শ্যারনের ঠোঁটে ফুটে উঠেছে ক্রুর হাসি। বলল, ‘কথা শেষ করুন মি. হ্যামিল্টন। বলুন যে, এখন সে আমেরিকার বুকেই আমরা ছুরি মারছি।’
এই কথা বলার সাথে সাথে জেনারেল শ্যারনের হাত বেরিয়ে এল পকেট থেকে রিভলবার নিয়ে। রিভলবার তার উদ্যত হলো জেনারেল হ্যামিল্টনের বুক লক্ষ্যে।
‘একি করছেন মি. শ্যারন। আমি একটা সত্য আপনাদের জানিয়েছি মাত্র। আমি আপনাদের শত্রু নই।’ চিৎকার করে কম্পিত কণ্ঠে বলল জেনারেল হ্যামিল্টন।
‘এই সত্যই আমাদের শত্রু হ্যামিল্টন। এই সত্য আপনার মুখ দিয়ে বাইরে যাক আমরা তা চাই না।’
এই কথার সাথে সাথে জেনারেল শ্যারনের রিভলবার পর পর দুটি গুলী বর্ষণ করল।
বুক চেপে ধরে জেনারেল হ্যামিল্টন লুটিয়ে পড়ল সোফার উপর।
শেষ নিঃশ্বাসের আগে এ কথাটুকুই শুধু সে বলতে পারল, ‘আমার আমেরিকাকে ঈশ্বর রক্ষা করুন এই ষড়যন্ত্রের হাত থেকে। আমি আমেরিকার জন্যে নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখতাম। আমেরিকার সে নতুন পৃথিবী হোক আমাদের ফাউন্ডার ফাদার্সদের, কোন ষড়যন্ত্রের নয়।’
‘থ্যাংকস জেনারেল শ্যারন। প্যাট্রিওটিজম-এর বীজগুলোকে এভাবেই ধ্বংস করা উচিত।’ বলে একটা দম নিল ডেভিড উইলিয়াম জোনস।
একটু পরে বলল, ‘মি শ্যারন কাউকে ডেকে বলুন একে রেখে দিয়ে আসুক এর বাড়ির কাছে কোথাও। লাশের উপর যেন একটা চিরকুট রেখে আসে লেখা থাকবে, ‘দেশের বিরুদ্ধে জেনারেল শ্যারনদের সহযোগিতা করার এটাই শাস্তি।’
লাশ সরিয়ে নিয়ে গেলে পাশের ঘরে গিয়ে বসল ডেভিড উইলিয়াম জোনস এবং জেনারেল শ্যারন।
বলল ডেভিড উইলিয়াম জোনস, ‘মি. শ্যারন, এই বিপর্যয়টা খুবই বড়। কিন্তু আমরা শেষ হয়ে গেছি, তা হতে পারে না।
‘অবশ্যই নয়। আমাদের এই মুহূর্তের কাজ হলো, একটা পাল্টা প্রতিবাদ তৈরি করা এবং পরশুই তা ছাপাবার ব্যবস্থা করা। দ্বিতীয় কাজ হলো, যে কোন মূল্যে আহমদ মুসাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়া। কাল থেকেই আমাদের সর্বশক্তি এই কাজে নিয়োগ করতে হবে। একাজে ভারতীয় আমেরিকানদের কাজে লাগাতে হবে। তৃতীয় কাজ হলো, গোল্ড ওয়াটার ও সারা জেফারসনকে উপযুক্ত শাস্তি দেয় এবং চতুর্থ কাজ রাজনৈতিক সমর্থন এখন আমাদের উচ্চমূল্যে কিনতে হবে। কেউ সমর্থক না হলে তাকে নিরপেক্ষ রাখতে হবে।’ বলল জেনারেল শ্যারন।
‘এই শেষ কাজটা অবশ্যই কঠিন হবে।’ বলল ডেভিড উইলিয়াম জোনস।
‘কঠিন হবে কেন? দুনিয়া টাকার বশ হলে মানুষ হবে না কেন? আমলাদের টাকার প্রতি খুব লোভ, আর রাজনীতিকদের টাকা খুব বেশী প্রয়োজন।’ বলল জেনারেল শ্যারন।
‘আর সিনেটরদের সাথে কাল ৮টার মিটিং এর কি হবে?’
‘মিটিং পরশু পর্যন্ত পিছিয়ে দেয়ার প্রস্তাব করুন। বলুন, আমাদের পাল্টা প্রতিবাদ পত্রিকায় আসার পর বৈঠকে বসা উপযুক্ত হবে।’ বলল জেনালে শ্যারন।
‘ঠিক তাই’ ডেভিড জোনস বলল।
‘এখনকার মত উঠা যাক।’ বলল জেনারেল শ্যারন।
‘চলুন।’ বলে উঠে দাঁড়াল ডেভিড উইলিয়াম জোনস।
দুজন বেরিয়ে এল ঘর থেকে।
গাড়ি থেকে নেমে আহমদ মুসা ও সারা জেফারসন পাশাপাশি হেঁটে বাড়ির ভেতর দিকে এগুচ্ছে।
‘আমার খুব আনন্দ লাগছে আহমদ মুসা, টিজে দাদুরা যে নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখেছিলেন, আর জেনারেল শ্যারনরা আমেরিকার মাথায় যে নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন চাপিয়ে দিয়েছিলেন তার মধ্যে টিজে দাদুদের স্বপ্নই জিতে যাচ্ছে। তার মানে মুক্তি পাচ্ছে আমেরিকার মানুষ, মুক্তি পাচ্ছে পৃথিবীর মানুষ এক কালো অক্টোপাশের কবল থেকে।’ বলল সারা জেফারসন।
‘আগামী কয়েকটা দিন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এদিনগুলো ক্ষ্যাপা কুকুরের মত ওদের পাল্টা আঘাত হানার দিন, সর্বস্ব দিয়ে ময়দানে টিকে থাকার ওদের ব্যবস্থা করার দিন। আমরাও যা অর্জন করেছি তা, যেমন- প্রতিবাদ ছাপার সাফল্য, হ্যারিকে উদ্ধার করার সাফল্য, ইত্যাদি কাজে লাগাবারও দিন।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমি ভাবছিলাম, আপনার মাথা এবার হাল্কা হবে, কিন্তু দেখছি আরও ভারী হয়েছে।’ বলল সারা জেফারসন মিষ্টি হেসে।
‘সংসার সমরাঙ্গনের সৈনিকদের পরস্পরের এগুলো এক অশরীরী বাধন মিস জেফারসন।’
আহমদ মুসা কথা শেষ করতেই থমকে দাঁড়াল সারা জেফারসন
তার সাথে আহমদ মুসাও থমকে দাঁড়িয়েছে।
সারা জেফারসন মুখ তুলেছে আহমদ মুসার দিকে। হরিণীর মত টানা তার নীল দুটি চোখ আহমদ মুসার দুচোখে নিবদ্ধ। তীব্র এক যন্ত্রণার প্রকাশ তার চোখে মুখে। বলল, ‘আপনার ‘মিস’ শব্দটি নিষ্ঠুর টর্নেডোর মত বার বার আমাকে তাড়া করে পৃথিবীর কোন এক প্রান্তে নিয়ে আছড়ে ফেলে আহমদ মুসা। আপনার কথিত সংসার সমরাঙ্গনের আমিও তো আপনার পাশের একজন সৈনিক। দুর্ভাগা ‘মিস’ কি ‘সারা’ হতেই পারল না!’
শেষ দিকে আবেগে রুদ্ধ হয়ে উঠেছিল সারা জেফারসনের কণ্ঠ। তার দুচোখ ভরে উঠেছে অশ্রুতে।
এ সময় সারা জেফারসনের মা জিনা জেফারসন ‘বাছা তোমরা এতক্ষণে এলে, আমি সাত-পাঁচ চিন্তায় একদম শেষ হয়ে গেছি, আর দেরী নয় খাবার টেবিলে এস।’ বলতে বলতে আহমদ মুসাদের সামনে এসে দাঁড়াল। সারা জেফারসনের উপর চোখ পড়তেই বলে উঠল, ‘কি হয়েছে সারা? চোখে পানি কে?’
সারা জেফারসন কোন কথা বলল না। দুহাতে মুখ ঢেকে ছুটল তার ঘরের দিকে।
‘কি হয়েছে? কিছু ঘটেছে বাছা?’ জিনা জেফারসন জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসাকে। তার কণ্ঠে উদ্বেগ।
আহমদ মুসার জন্য এটা ছিল কঠিন বিব্রতকর এক অবস্থা। কিন্তু নিজেকে সামলে নিল আহমদ মুসা। বলল জিনা জেফারসনের প্রশ্নের জবাবে, ‘না খালাম্মা, বাইরে কিছু ঘটেনি। একটু ভুল বুঝাবুঝি। ঠিক হয়ে যাবে। চলুন।’ আহমদ মুসার মুখে কষ্ট-সৃষ্ট হাসি।
‘চল বাছা’ বলে হাঁটতে শুরু করল জিনা জেফারসন।
খাবার টেবিলে গিয়ে জানা জেফারসন বলল, ‘তুমি বস বাছা। আমি সারাকে নিয়ে আসি।’
জিনা জেফারসন এগুলো সারার ঘরের দিকে।
আহমদ মুসা ডাইনিং চেয়ারে গা এলিয়ে দিল। উর্ধ্বমুখী হলো তার চোখ।
ধীরে ধীর তার দুচোখ আচ্ছন্ন করে নেমে এল একরাশ বেদনা। মনে হলো কারো হৃদয় দলিত করার চেয়ে কঠিন কাজ দুনিয়াতে আর কিছু নেই।
সারার ঘরের ওদিক থেকে আসা পায়ের শব্দে চিন্তা সূত্র ছিন্ন হয়ে গেল আহমদ মুসার। সোজা হয়ে বসল সে।
পরবর্তী বই
ফ্রি আমেরিকা