৩১. ফ্রি আমেরিকা

চ্যাপ্টার

ওয়াশিংটনের ভোর।
সকালের কুয়াশা তখন গভীর।
এরই মধ্যে ফেডারেল পুলিশ প্রধান বিল বেকারের মনে হল কুয়াশায় জড়িয়ে একজন মানুষ যেন পড়ে আছে রাস্তার পাশে।
‘ড্রাইভার গাড়ি দাঁড় করাও।’ সংগে সংগেই ড্রাইভারকে নির্দেশ দিল বেকার।
গাড়ি দাঁড়াল।
ফেডারেল পুলিশ প্রধান বিল বেকার পাশের লোকটির দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, ‘স্যার রাস্তার পাশে একটা মানুষ পড়ে আছে বলে মনে হচ্ছে।’
পাশে বসা লোকটি এফবিআই-এর প্রধান জর্জ আব্রাহাম জনসন।
জর্জ আব্রাহাম জনসন ও বিল বেকার ফিরছিল ভার্জিনিয়ার অরলিংটন থেকে। জরুরী প্রয়োজনে ভোর রাতে গিয়েছিল সেখানে। এখন ফিরছে।
বিল বেকারের কথা শুনে ভ্রুকুঞ্চিত হল জর্জ আব্রাহাম জনসনের। বলল, ‘চলুন তো, নেমে দেখি।’
কাছাকাছি হয়ে তারা নিশ্চিত হল, ঠিক একজন মানুষ রাস্তার পাশে পড়ে আছে।
আরও কাছাকাছি হয়ে তারা আঁৎকে উঠল, একজন মানুষের রক্তাক্ত লাশ এটা। আরও কাছাকাছি গেল তারা।
লাশটি চিৎ হয়ে পড়ে আছে। পরনে কমপ্লিট স্যুট।
লাশের মুখের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল জর্জ আব্রাহাম ও বিল বেকার দুজনেই।
লাশটি জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনের।
উদ্বেগ উৎকন্ঠা নিয়ে লাশের উপর একটু ঝুঁকে পড়ল তারা।
বুকে গুলীবিদ্ধ হওয়ার কেন্দ্র দুটি। আর এই দুটি গুলীতেই সে নিহত হয়েছে।
দেহে যা রক্ত লেগে আছে তা জমাট বাধা। মাটিতে রক্তের তেমন কোন চিহ্ন নেই। তার মানে অন্য জায়গায় হত্যা করে এখানে এনে ফেলে রাখা হয়েছে।
আরেকবার ভ্রুকুঞ্চিত হল জর্জ আব্রাহাম জনসনের। হত্যা করে সদর রাস্তার পাশে এনে লাশ ফেলে রাখবে কেন?
এই প্রশ্নটা দেখা দিয়েছে ফেডারেল পুলিশ প্রধান বিল বেকারের মনেও।
হঠাৎ তাদের নজর পড়ল লাশের বুকে রক্তের সাথে লেপটে থাকা একটা চিরকুটের দিকে।
তারা আরও ঝুঁকে পড়ল চিরকুটটা কি ও কেন তা দেখার জন্য।
চিরকুটে একটা মাত্র লাইন টাইপ করে লেখা। চিরকুটটা স্পর্শ না করে রক্তের ফাঁক দিয়ে যতটা পড়া গেল তাতে এই লেখাঃ ‘দেশের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে ইহুদীদের সহযোগিতার এটাই পরিণাম।’
লেখা পড়ে চমকে উঠল জর্জ আব্রাহাম ও পুলিশ প্রধান বিল বেকার দুজনেই।
উঠে দাঁড়াল দুজনেই।
বিল বেকার তাকাল জর্জ আব্রাহাম জনসনের দিকে। বলল, ‘আমি কিছু বুঝতে পারছি না স্যার। ওরা কি এধরনের কান্ড ঘটাতে পারে? ‘ফ্রি আমেরিকা মুভমেন্ট’ ও ‘হোয়াইট ঈগল’ এতটা পাগল হতে পারে যে, এই কান্ড ঘটিয়ে তা আবার সদর রাস্তার ধারে এনে তাতে এই সাইনবোর্ড দিয়ে রাখবে!’
এই প্রশ্নগুলো ভীষণভাবে পীড়া দিচ্ছিল জর্জ আব্রাহাম জনসনকেও। কিছুতেই হিসাব মেলাতে পারছিল না। বিশেষ করে আহমদ; মুসা যেখানে সারা জেফারসন ও গোল্ডওয়াটারের পাশে আছে, সেখানে এই ধরনের কান্ড ঘটতে পারে কি করে? তাহলে কি তাদের অজান্তে অতি উৎসাহী কেউ এই কান্ড ঘটিয়েছে? এটাও জর্জ আব্রাহামের মন মেনে নিতে পারছে না।
জর্জ আব্রাহাম জনসন বিল বেকারের প্রশ্নের উত্তরে বলল, ‘আমাকেও ব্যাপারটা অবাক করেছে। কিছু বুঝতে পারছি না বেকার।’
‘ঝামেলার এই চিরকুটটি তাহলে সরিয়ে ফেলব কি স্যার?’ বলল বিল বেকার আগ্রহী কন্ঠে।
জর্জ আব্রাহাম তাকাল বিল বেকারের দিকে। বলল, ‘না বেকার, চিরকুট না নিয়ে যেভাবে আছে সেভাবেই থাকবে। অপরাধীকে আড়াল করা নয়, তাকে আইনের হাতে সোপর্দ করাই আমাদের দায়িত্ব।’
‘ধন্যবাদ স্যার। আমি চিরকুটটাকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না তাই কথাটা বলেছি।’ বলল বেকার।
‘ধন্যবাদ বেকার। তুমি ওদের ডেকে পুলিশ কন্ট্রোলে টেলিফোন করতে বল। ওরা আসুক।’
জর্জ আব্রাহাম জনসনের গাড়ির পেছনেই ছিল তাদের টীম-পুলিশের গাড়ি।
বিল বেকার ডাকল তাদের।
গাড়ি থেকে ছয়জন পুলিশ নেমে দ্রুত এগিয়ে এল।
বিল বেকার ওদের মধ্যে যে অফিসার তাকে বলল, ‘ডিউটি পুলিশকে টেলিফোন কর, ওরা আসুক।’
সংগে সংগেই পুলিশ অফিসার তার অয়্যারলেস নিয়ে একটু দুরে সরে দাঁড়াল কথা বলার জন্যে।
এ সময় জর্জ আব্রাহাম জনসন চারদিকে একবার তাকিয়ে দ্রুত বলে উঠল, ‘বিল বেকার, এইতো সামনে আলেকজান্ডার হ্যামিলটনের বাড়ি। এতক্ষনে লাশের দিকে সব মনোযোগ থাকায় কোন দিকে তাকাবার ফুরসৎ হয়নি।’
‘ঠিক স্যার। তাহলে কি পুলিশ পাঠাব ওদের খবর দেয়ার জন্যে?’ বলল বিল বেকার।
‘পুলিশ নয়, তুমি নিজে যাও বেকার। মিসেস হ্যামিল্টনকে তুমি নিজে এ খবরটা দাও।’ জর্জ আব্রাহাম জনসন বলল।
‘অলরাইট স্যার।’
বলে বিল বেকার একজন পুলিশকে সাথে নিয়ে পা বাড়াল জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনের বাড়ির দিকে।
অল্পক্ষন পরে মিসেস আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনকে সাথে নিয়ে ফিরে এল বিল বেকার। মিসেস হ্যামিল্টন কাঁদছিলেন। তার সাথে তার এক মেয়ে, সেও কাঁদছিল।
মিসেস হ্যামিল্টন লাশ দেখে কান্নায় ভেঙে পড়ে আছড়ে পড়তে যাচ্ছিলেন মিঃ হ্যামিল্টনের লাশের উপর।
জর্জ আব্রাহাম তাকে ধরে ফেলে বলল, ‘ম্যাডাম ধৈর্য্য ধরুন, তদন্তের স্বার্থে লাশটা এমনই রাখতে চাই। দয়া করে একটু ধৈর্য্য ধরুন, আমাদের সাহায্য করুন।’
মিসেস হ্যামিল্টন বুঝল। সে লাশ আর স্পর্শ করতে গেল না। কিন্তু বাঁধভাঙা কান্নায় তার দেহ লুটিয়ে পড়ল মাটির উপর।
জর্জ আব্রাহাম সদ্য আসা অপেক্ষমান সংশ্লিষ্ট পুলিশ অফিসারকে সুরত হাল রিপোর্ট তৈরী করতে নির্দেশ দিল।
কাজে লেগে গেল পুলিশ অফিসার।
প্রথমেই চিরকুটটি জব্দ করল পুলিশ।
মিসেস হ্যামিল্টনও পড়ল চিরকুটটি। পড়ে কেঁদে উঠল। বলল, ‘ও গড, তাহলে ‘ফ্রি আমেরিকা’ ও ‘হোয়াইট ঈগল’রাই হত্যা করল আমার স্বামীকে আহমদ মুসার কুমন্ত্রনায়! ও গড, আমি কত নিষেধ করেছি তাকে এই সব রাজনীতিতে না জড়ানোর জন্য।’
মিসেস হ্যামিল্টনের চোখের সামনে নিহত মিঃ হ্যামিল্টনের পকেটের মানি ব্যাগ, কলম, চিরুনীসহ ছোট খাট সব জিনিসকেই জব্দ তালিকায় নিয়ে আসা হলো।
মিঃ হ্যামিল্টনের নীচের পকেট ঘড়ি জব্দ করতে গিয়ে পুলিশ অফিসারের মধ্যে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হলো। ভালো করে পরীক্ষা করতে গিয়ে অকস্মাৎ তার ভ্রুকুঞ্চিত হলো। সে ঘড়িটি পুলিশ প্রধান বিল বেকারের হাতে তুলে দিতে দিতে বলল, ‘স্যার ঘড়ির ছদ্মবেশে এটা একটা টেপ রেকর্ডার।’
বিল বেকার ঘড়িটির উপর একটু নজর বুলিয়ে পুলিশ অফিসারের কথায় সায় দিয়ে তা জর্জ আব্রাহাম জনসনের হাতে দিয়ে বলল, ‘আপনি দেখুন স্যার।’
রেকর্ডারটি পরীক্ষা করতে গিয়ে নতুন করে ভ্রুকুঞ্চিত হলো জর্জ আব্রাহাম জনসনের। বলল বিল বেকারকে লক্ষ্য করে, ‘থ্যাংকস গড! বেকার টেপটা অন করা আছে। তার মানে যা ঘটেছে, তার সবই অডিও রেকর্ডার এই টেপে আছে।’
বলতে বলতে মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল জর্জ আব্রাহামের।
‘এটা এই ঘটনার সবচেয়ে মূল্যবান দলিল স্যার।’ বলল বিল বেকার।
‘থ্যাংকস গড! আমি চাই ঐ দুর্বৃত্তদের শাস্তি হোক।’ বলল মিসেস হ্যামিল্টন।
‘অবশ্যই হবে ম্যাডাম।’ মুখে এই কথা বলল বটে জর্জ আব্রাহাম জনসন ও বিল বেকার দুজনেই, কিন্তু জর্জ আব্রাহাম ও বিল বেকার দুজনেরই মনের কোথায় যেন খচ করে উঠল। এতবড় ভুল ‘ফ্রি আমেরিকা’ মুভমেন্ট ও ‘হোয়াইট ঈগলে’র লোকরা করতে পারল, তা ভাবতে তাদের কষ্ট লাগছে।
সুরতহাল রিপোর্ট তৈরী শেষে জর্জ আব্রাহাম বলল, ‘এরা লাশ নিয়ে পুলিশ হেডকোয়ার্টারে যাক এবং লাশের ময়নাতদন্তের ব্যবস্থা করুক। চল আমরা মিসেস হ্যামিল্টনকে পৌছে দিয়ে পুলিশ হেডকোয়ার্টারে যাব। টেপটা শুনে তার কপি নিয়ে তবেই আমি ফিরব অফিসে।’
জর্জ আব্রাহাম জনসন ও বিল বেকার যখন পুলিশ হেডকোয়ার্টারে পৌছল তখন সকাল ৭টা।
পুলিশ প্রধান বিল বেকারের টেবিলে বসে রেকর্ডপ্লেয়ার বাজিয়ে টেপ শুনল তারা দুজন।
টেপ শুনে তারা বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে পড়েছিল। তারপর ভয়ানক উত্তেজিত হয়ে উঠল তারা দুজন।
‘স্যার, ডেভিড উইলিয়াম জোনস এবং জেনারেল শ্যারন খুন করেছে আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনকে। এখনি, আমি মনে করি, ওদের গ্রেফতার করা প্রয়োজন।’ বলল পুলিশ প্রধান বিল বেকার জর্জ আব্রাহাম জনসনকে লক্ষ্য করে।
‘আমি তোমার সাথে একমত বেকার। কিন্তু জানত ডেভিড উইলিয়াম জোনস কে? তিনি কাউন্সিল অব আমেরিকান জুইস এ্যাসোসিয়েশনসে’র সভাপতি। সেদিক থেকে সে রাজনৈতিক ক্ষমতাধর ব্যক্তি। আর জেনারেল শ্যারন আন্তর্জাতিক ইহুদী গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান।তার গায়ে হাত দেয়ার মধ্যে বাইরের রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ার ভয় আছে। সুতরাং তাদেরকে গ্রেফতারের জন্যে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত প্রয়োজন।’
‘তাহলে?’
‘প্রেসিডেন্টের অনুমতি নিতে হবে। দেখি প্রেসিডেন্টকে পাই কিনা।’
বলে জর্জ আব্রাহাম পকেট থেকে তার এফবিআই-এর মোবাইলটা বের করল।
প্রেসিডেন্টের বেড টেলিফোনে রিং করল।
এ টেলিফোন সরাসরি প্রেসিডেন্ট ধরেন।
ওপ্রান্তে প্রেসিডেন্টের গলা পেল জর্জ আব্রাহাম। বলল জর্জ আব্রাহাম দ্রুত নরম কন্ঠে, ‘মিঃ প্রেসিডেন্ট, স্যরি। এসময় টেলিফোন করলাম খুব জরুরী প্রয়োজনে।’
‘ধন্যবাদ মিঃ জর্জ। আমারও জরুরী প্রয়োজন। এই মুহুর্তে আপনাকে আশা করছিলাম। বলুন, আপনার প্রয়োজনটা কি?’
‘আমি এবং মিঃ বিল বেকার আপনার সাথে দেখা করতে চাই।’
‘এখন?’ প্রেসিডেন্ট বলল।
‘আমরা খুব উপকৃত হব মিঃ প্রেসিডেন্ট। বলল জর্জ আব্রাহাম
‘ভালই হলো। উইলিয়াম রুজভেল্ট, রোনাল্ড ওয়াশিংটন, ম্যাক আর্থারকে ডেকেছি। আপনাকে খুঁজছিলাম। শুনলাম অরলিংটন গেছেন। আপনি বিলকে নিয়ে এখনি চলে আসুন।’ বলল প্রেসিডেন্ট।
টেলিফোন রেখে দিয়ে জর্জ আব্রাহাম বিল বেকারকে প্রেসিডেন্টের কথা ব্রিফ করল এবং টেপটা পকেটে নিয়ে বলল, ‘চলুন উঠি।’
তারা বেরিয়ে এল অফিস থেকে।
তাদের গাড়ি ছুটল হোয়াইট হাউজের উদ্দেশ্যে।

হোয়াইট হাউজে প্রেসিডেন্টের ওভাল অফিস। ওভাল টেবিলে প্রেসিডেন্টের চেয়ারে প্রেসিডেন্ট এ্যাডামস হ্যারিসন আসীন।
তার সামনে ওভাল টেবিলের ওপাশে বসেছে প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা উপদেষ্টা উইলিয়াম রুজভেল্ট, জর্জ আব্রাহাম জনসন, এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার, বিল বেকার এবং জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন।
বৈঠকে প্রেসিডেন্টই কথা শুরু করেছে। বলছিল সে, ‘দেশ ও জনগনের স্বার্থের সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত একটা বিষয়ে পরামর্শের জন্যে আমরা এখানে বসেছি। ইহুদী গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান জেনারেল শ্যারনরা যে নিউজ সংবাদপত্র ও ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ায় প্রচার করেছিল তার জবাবে আহমদ মুসা, সারা জেফারসন ও গোল্ড ওয়াটাররা যে বক্তব্য সংবাদপত্র ও টিভি নেটওয়ার্কে পাঠিয়েছেন তার কপি এবং এ্যাডওয়ার্ড হ্যারি ময়নিহানের উদ্ধার সম্পর্কিত যে রিপোর্ট মিঃ জর্জ আব্রাহাম পাঠিয়েছেন তারও কপি রাতেই আপনারা সকলে পেয়েছেন। সব মিলিয়ে বিষয়টা এখন পরিষ্কার হয়ে গেছে। এ সম্পর্কে এখন আমাদের করনীয় কি? আপনাদের কাছে সে পরামর্শই জানতে চাই।’
প্রেসিডেন্ট থামতেই জর্জ আব্রাহাম জনসন বলল, ‘মিঃ প্রেসিডেন্ট, একটা বড় ঘটনা ঘটে গেছে। যে বিষয়ে কথা বলার জন্যে আপনার সাথে দেখা করতে চেয়েছিলাম। তা হচ্ছে, জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন গতরাতে খুন হয়েছেন। খুন……।’
জর্জ আব্রাহাম জনসনের কথার মাঝখানেই প্রেসিডেন্ট বলে উঠল, ‘আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন খুন হয়েছে!’
অন্য সবার চোখেও বিস্ময়। সবাই সোজা হয়ে বসেছে।
‘ইয়েস, মিঃ হ্যামিল্টন খুন হয়েছেন। খুন করেছে জেনারেল শ্যারন ও ডেভিড উইলিয়াম জোনস। আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন যখন ষড়যন্ত্রের কথা জানতে পারে, তখন আমেরিকার স্বার্থের বিরুদ্ধে যেতে সে অস্বীকার করে। আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন সব ফাঁস করে দেবে এই ভয়েই জেনারেল শ্যারনরা তাকে খুন করে।’
বলে জর্জ আব্রাহাম পকেট থেকে একটা টেপ বের করে টেবিলে রাখল। বলল, ‘এই টেপে জেনারেল আলেকজান্ডারের হত্যা ও হত্যাকালীন সকলের কথঅ বার্তার রেকর্ড আছে।’
‘রেকর্ডটা বাজিয়ে শুনান মিঃ জর্জ।’ বলে প্রেসিডেন্ট তার বাঁ হাত দিয়ে টেবিলের নিচের তলায় গোপন একটা সুইচ প্যানেলের একটিতে চাপ দিল।
সংগে সংগে জর্জ আব্রাহামের সামনে টেবিল ফুঁড়ে বেরিয়ে এল একটা ক্ষুদ্র ক্যাসেট প্লেয়ার।
জর্জ আব্রাহাম টেবিল থেকে মাইক্রো ক্যাসেটটা নিয়ে প্লেয়ারে বসিয়ে দিল।
প্লেয়ারটি কথা বলে উঠল। সাথে সাথে প্রেসিডেন্ট বলল, ‘জেনারেল শ্যারনের কথার মাঝখানে থেকে কথা শুরু হলো কেন মিঃ জর্জ?’
‘মিঃ প্রেসিডেন্ট, মনে হয়, জেনারেল হ্যামিল্টন ক্যাসেট অন করতে ভুলে গিয়েছিলেন, অথবা হতে পারে তিনি ওদের সন্দেহ করার পর ক্যাসেটটি অন করেন দলিল হিসেবে ওদের কথা রেকর্ডের জন্যে।’ বলল জর্জ আব্রাহাম।
‘ধন্যবাদ মিঃ জর্জ। ওইরকমই একটা কিছু ঘটে থাকতে পারে।’ প্রেসিডেন্ট বলল।
ক্যাসেট কথা বলে চলল।
সবার মনোযোগ হুমড়ি খেয়ে পড়েছে ক্যাসেট থেকে বেরিয়ে আসা শব্দগুলোর ওপর।
জেনারেল শ্যারন, ডেভিড উইলিয়াম জোনস এবং জেনারের হ্যামিল্টনের বাক বিনিময় তারা শুনল। শুনল জেনারেল হ্যামিল্টনের ভয়ার্ত কন্ঠ। তার জবাব শুনল জেনারেল শ্যারনের কন্ঠে। পরপরই তাদের কানের এল দুবার গুলীর শব্দ এবং জেনারেল হ্যামিল্টনের আর্তনাদ। জেনারেল হ্যামিল্টনের শেষ স্বগোতক্তি। সবশেষে ডেভিড উইলিয়াম জোনস জেনারেল হ্যামিল্টনের লাশ একটি চিরকুটসহ তার বাড়ির সামনে রেখে আসার যে নির্দেশ দিল সেটাও সকলে শুনল।
এরপর প্রেসিডেন্ট নিজেই ক্যাসেট প্লেয়ার বন্ধ করে দিল। বলল স্বগতকন্ঠে, ‘ঈশ্বর তার আত্মার মঙ্গল করুন। বেচারা বিভ্রান্ত হয়েছিল জেনারেল শ্যারনদের দ্বারা। কিন্তু জীবন দিয়ে সে প্রমাণ করে গেল সে একজন দেশ প্রেমিক আমেরিকান।’
‘নতুন বিশ্বব্যবস্থা(New World Order) প্রশ্নে ওদের মিষ্টি কথা অনেক আমেরিকানকেই বিভ্রান্ত করেছে। আমেরিকানদের কাছে বিষয়টি পরিষ্কার হওয়া দরকার।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
‘শুধু ‘অনেক আমেরিকানে’র কথা বলছেন কেন? সেদিন সারা জেফারসনের সাথে কথা বলার পর বিষয়টা নিয়ে আমি নতুন করে গভীরভাবে ভাবছি। জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন জীবন দিয়ে ঈশ্বরের কাছে তার যে প্রার্থনা রেখে গেলেন তা আমার হৃদয়কে আজ তীরের মত বিদ্ধ করছে মিঃ জর্জ।’ বলল প্রেসিডেন্ট। তার কন্ঠে গভীর আবেগ।
বলেই প্রেসিডেন্ট সোজা হয়ে বসল। বলল উইলিয়াম রুজভেল্টের দিকে তাকিয়ে, ‘বলুন মিঃ রুজভেল্ট আপনি কি ভাবছেন?’
উইলিয়াম রুজভেল্ট নড়ে-চড়ে সোজা হয়ে বসল। বলল, ‘আইনকে তার নিজস্ব গতিতে চলতে দেয়ার আমি পক্ষে। তবে মিঃ প্রেসিডেন্ট আপনি এই সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে রাজনৈতিক ফ্রন্টের শীর্ষ ইহুদী নেতাদের ব্রীফ করতে পারেন।’
তারপর প্রেসিডেন্ট তাকালেন জর্জ আব্রাহাম জনসনের দিকে। এইভাবে একে একে সবার মত নিলেন প্রেসিডেন্ট। সবাই সমর্থন করল উইলিয়াম রুজভেল্টকে।
সবার মত শোনার পর প্রেসিডেন্ট বলল, ‘আইনের গতিকে যদি শর্ত সাপেক্ষ করা হয় তাহলে তার নিজস্ব গতি থাকে না। সুতরাং শর্তের প্রয়োজন নেই।’
‘মিঃ প্রেসিডেন্ট আমি আলোচনার প্রস্তাব এজন্যে করেছিলাম যে, রাজনৈতিক ফ্রন্টে আমরা যাতে ক্ষতিগ্রস্থ না হই।’ বলল উইলিয়াম রুজভেল্ট।
‘মিঃ উইলিয়াম রুজভেল্ট ওদেরকে সব ব্যাপারে সম্মত করতে গেলে ওদের কিছু ব্যাপারে আমাদেরকে সম্মত হতে হবে। এই ভাবে সমঝোতা করলে আইনের নিজস্ব গতি বাধাগ্রস্থ হয়। রাজনৈতিক স্বার্থে এই সমঝোতা ঠিক নয়। ‘ফ্রি আমেরিকা’ ঠিকই বলছে যে, আমাদের রাজনীতি, আমাদের গনতন্ত্র, অর্থনীতি এর অনেক কিছু স্বার্থবাদী গ্রুপের হাতে পণবন্দী হয়ে পড়েছে। এই পণবন্দী অবস্থা শুধু আমাদের নয়, আমাদের জাতির স্বাধীন গতিকেও বাধাগ্রস্থ করেছে। আমাদের রাজনীতিকে এখন এখান থেকে সরিয়ে আনা দরকার।’
বলে প্রেসিডেন্ট একটু থামল। তাকাল জর্জ আব্রাহাম ও বিল বেকারের দিকে। বলল, ‘আপনারা বোধ হয় আমার সাক্ষাত চেয়েছিলেন তাদের গ্রেফতার করার অনুমতির জন্যে। আমি আদেশ দিচ্ছি, আপনারা আপাতত জেনারেল হ্যামিল্টনকে হত্যার অপরাধে ডেভিড উইলিয়াম জোনস এবং জেনারেল শ্যারনকে গ্রেফতার করতে পারেন। তবে হ্যারিকে কিডন্যাপ ও লস আলামোসের ঘটনা তদন্ত শেষ হওয়ার পর নতুন গ্রেফতারের সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে।’
‘মিঃ প্রেসিডেন্ট, ব্যাঙ্কার আইজ্যাক বেন গুরিয়ান ও সাবা বেন গুরিয়ানকে কিডন্যাপের ব্যাপারও আমরা সামনে আনতে পারি।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
‘অবশ্যই। ‘ফ্রি আমেরিকা’ ও ‘হোয়াইট ঈগল’রা যে প্রতিবাদ পত্রিকায় পাঠিয়েছে তাতেও এ প্রসঙ্গ এসেছে। সুতরাং অবশ্যই এরও তদন্ত শেষ করতে হবে এবং অপরাধীদের পাকড়াও করতে হবে। তার সাথে জর্জ জুনিয়রকে কিডন্যাপ করার ব্যাপারটাও আমরা সামনে আনতে পারি। মোট কথা হলো, সংশ্লিষ্ট কোন কিছুই বাদ দেয়া যাবে না।’ বলল প্রেসিডেন্ট।
‘মিঃ প্রেসিডেন্ট, শুরুতেই গ্রেফতারে না গিয়েও আমরা আইনকে এগিয়ে নিতে পারি।’ বলল প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা উপদেষ্টা উইলিয়াম রুজভেল্ট।
‘শুরু কোথায়? লস আলামোস নিয়ে যে ঘটনা তার তো এটা মাঝপথ! আর শুরু হলেই বা ক্ষতি কি? খুনি এবং জঘন্য গোয়েন্দা বৃত্তিতে লিপ্ত কাউকে গ্রেফতার করা যাবে না, মার্কিন বিবেক এতটা অন্ধ, মার্কিন আইন এতটা দুর্বল হয়ে যায়নি।’ প্রেসিডেন্ট বলল।
‘মিঃ প্রেসিডেন্ট আজ সকাল আটটায় সিনেট ও হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভ নেতৃবৃন্দের একটা গোপন বৈঠক আছে জেনারেল শ্যারনদের সাথে। প্রেসিডেন্টের আদেশ আমরা গ্রহন করলাম। কিন্তু আদেশটির বাস্তবায়ন হবে বৈঠকটির পর।’ জর্জ আব্রাহাম জনসন বলল।
‘তার মানে সিদ্ধান্তকে আপনি ঐ বৈঠকের ফল সাপেক্ষ করতে চান মিঃ জর্জ?’ বলল প্রেসিডেন্ট। তার কন্ঠে বিরক্তির সুর।
‘ঠিক বৈঠকের ফল সাপেক্ষ নয়। তবে আদেশ বাস্তবায়নের পন্থার মধ্যে নতুন কোন চিন্তা আসতে পারে মিঃ প্রেসিডেন্ট।’
প্রেসিডেন্টের মুখে এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘একটা নতুন চিন্তা আমি যোগ করছি মিঃ জর্জ। ঐ গোপন বৈঠক থেকে ফেরার পথে জেনারেল শ্যারন ও মিঃ ডেভিডকে গ্রেফতার করুন।’
প্রেসিডেন্ট থামল। কিন্তু থেমেই আবার হঠাৎ বলে উঠল, ‘ঠিক আছে মিঃ জর্জ বেলা ১২ টা পর্যন্ত এই আলোচনা আমরা মূলতবী করলাম। ঠিক ১২ টায় আমি আপনাদের এখানে চাই।’
‘ধন্যবাদ মিঃ প্রেসিডেন্ট।’ বলল জর্জ আব্রাহাম।
‘ধন্যবাদ সকলকে।’ প্রেসিডেন্ট বলল। তারপর উঠে দাঁড়াল।
সকলে হ্যান্ডশেক করে বিদায় নিল।

‘বৈঠক বসেছে ইন্টেলিজেন্স বিষয়ক হাউজ সিলেক্ট কমিটির চেয়ারম্যান এ্যান্ড্রু জ্যাকবস এর বাসায়।
ঠিক আটটাতেই মিটিং-এ উপস্থিত হয়েছে সিনেট চীফ চার্লস ডব্লিউ ওয়ারনার, হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভ চীফ বে রিচার্ডসন, সিনেট ইন্টেলিজেন্স স্পেশাল কমিটির চেয়ারম্যান আনা প্যাট্রসিয়া এবং ফরেন রিলেশনস হাউজ সিলেক্ট কমিটির চেয়ারম্যান বব এইচ ব্রুস। তাদের একটু পরেই এসেছে সিনেট ও হাউজের ডেমোক্র্যাট দলের সংসদীয় দুই দলনেতা জন টার্নার ও স্ল্যাড গার্টন।
সিনেট ও হাউজের রিপাবলিকান দুই সংসদীয় দলনেতা আসার কথা, কিন্তু এসে পৌঁছাননি।
মিটিং-এর হোস্ট এ্যান্ড্রু জ্যাকবস সবাইকে জানায়, সিনেটর দানিয়েল ময়নিহান পারিবারিক সমস্যার কারনে একটু দেরীতে আসবেন।
যারা মিটিং-এ এসেছেন, তাদের সবারই চোখে-মুখে প্রবল উত্তেজনার ছাপ।
মিটিং-এর হোস্ট এ্যান্ড্রু জ্যাকবস সবাইকে হাসি মুখে তার বাড়িতে স্বাগত জানান বটে, কিন্তু দেখা যায় তাকে দারুন বিব্রত।
সবাই বসার পর প্রথমেই কথা বলে সিনেট চীফ চার্লস ডব্লিউ ওয়ারনার। বলে এ্যান্ড্রু জ্যাকবসকে লক্ষ্য করে, ‘মিঃ জ্যাকবস জানলাম মিঃ ময়নিহান একটু দেরীতে আসবেন, মিঃ টার্নার ও গার্টনও নিশ্চয় এসেছেন। কিন্তু মিটিং যারা ডাকলেন, সেই মিঃ জোনসরা কোথায়?’
মুখটা মলিন হয়ে যায় এ্যান্ড্রু জ্যাকবসের। বলে সে, ‘স্যরি মিঃ ওয়ারনার, স্যরি টু অল, মিনিট বিশেক আগে আমি মিঃ ডেভিড উইলিয়াম জোনসের টেলিফোন পেলাম। তিনি জানালেন, ‘ফ্রি আমেরিকা’ ও ‘হোয়াইট ঈগল’-এর যে প্রতিবাদ পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়েছে ও টেলিভিশন নেটওয়ার্কে গেছে, তার পাল্টা প্রতিবাদ তৈরী নিয়ে তারা ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। তারা সবার কাছে মাফ চেয়েছেন এবং আগামীকাল সকাল ৮টা পর্যন্ত মিটিং মূলতবী করার জন্যে সবার কাছে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানিয়েছেন।’ থামে এ্যান্ড্রু জ্যাকবস।
কিন্তু কোন কথা কারো কাছ থেকে আসে না। গম্ভীর সবাই। অবশেষে কথা বলে বয়সে সবার প্রবীণ সিনেট চীফ চার্লস ডব্লিউ ওয়ারনার। বলে, ‘আপনাদের মত বলুন।’
আবার নিরবতা।
সবার চোখে-মুখে একটা বিরক্তির ভাব।
এবার কথা বলে সিনেট ইন্টেলিজেন্স কমিটির চেয়ারম্যান আনা প্যাট্রসিয়া। বলে, ‘আমরা মিটিং মূলতবী করবো কিনা, সে বিষয়ে কিছু বলার আগে আমি সকলকে আহবান জানাচ্ছি বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্যে। আমাদের এই একত্র হওয়া এতে কাজে লাগবে এবং কালকের সিদ্ধান্ত নেয়াও সহজ হবে।’
‘ভালো প্রস্তাব কিন্তু মিঃ জোনসের অনুপস্থিতিতে এই ব্যাপারে কি ফলপ্রসূ আলোচনা করা যাবে? তার চেয়ে আলোচনা তাদের প্রস্তাবমত কাল পর্যন্ত মূলতবী করাই কি ভালো নয়?’ বলে এ্যান্ড্রু জ্যাকবস অনেকটা দ্বিধাজড়িত কন্ঠে।
তার কথা শেষ হতেই স্ল্যাড গার্টন এ্যান্ড্রু জ্যাকবসকে সমর্থন করে বলে, ‘সত্যি মূল পক্ষের অনুপস্থিতিতে আলোচনা তেমন কাজে আসবে না। অনেক কিছুরই ব্যাখ্যা প্রয়োজন হবে।’ গার্টনের কন্ঠও শক্তিশালী নয়, দ্বিধাজড়িত।
জন টার্নার কথা বলার জন্য মুখ খুলছিল, কিন্তু তার আগেই আনা প্র্যাট্রসিয়া বলে ওঠে, ‘আমরা বিচার করতে বসছি না। সুতরাং কোন পক্ষের শোনানি নেবার প্রয়োজন পড়ে না। আমরা স্বাধীন নাগরিক হিসাবে চলমান একটা অবস্থা পর্যালোচনা করব। যে পর্যালোচনাটা সময়ের জন্যে খুবই প্রয়োজনীয়।’
আনা প্র্যাট্রসিয়ার কথা শেষ হবার সাথে সাথেই চার্লস ডব্লিউ ওয়ারনার, জন জে রিচার্ডসন এবং বব এইচ ব্রুস এক সঙ্গেই বলে ওঠে, ‘ঠিক আছে। আলোচনায় দোষ কি! সময়টা কাজে লাগুক।’
এই কথার সাথে চার্লস ওয়ারনার আরও যোগ করে, ‘আমার মনে হয় মিঃ শ্যারনরা আসেননি ভালই হয়েছে। ভোরে ‘ফ্রি আমেরিকা’র প্রতিবাদ পড়ার পর মনে হয়েছে, মিঃ শ্যারনদের সাথে কথা বলার আগে আমাদের একটা পৃথক আলোচনা দরকার। মনে হচ্ছে ঈশ্বরও চান এ আলোচনা হোক।’
‘ধন্যবাদ আপনাদের। ধন্যবাদ মিঃ ওয়ারনার। আমি ফ্রি আমেরিকার প্রতিবাদটা একবার নয়, কয়েকবার পড়েছি। সরকার, ফ্রি আমেরিকা সবাইকে অভিযুক্ত করে যে রিপোর্ট ছাপা হয়েছিল তার সাথে মিলিয়ে পড়েছি। এভাবে পড়তে গিয়ে আমি এত উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলাম যে সংগে সংগে আমি অনেকগুলো জায়গায় টেলিফোন করে কিছু বিষয়ে যাচাই করার চেষ্টা করেছি। আর তাতে আমার উদ্বেগ আরও বেড়েছে। এই বিষয়গুলো আমি মনে করি দেশের স্বার্থেই আলোচন হওয়া প্রয়োজন। মিঃ ওয়ারনারের মত আমারও মনে হয়েছে এনিয়ে আমাদের একটা পৃথক আলোচনা হওয়া দরকার।’ বলে প্যাট্রসিয়া।
আনা প্যাট্রসিয়ার কথা শেষ হতেই সিনেটের ডেমোক্র্যাট দলীয় নেতা জন টার্নার বলে ওঠে, ‘ঠিক আছে মিস প্যাট্রসিয়া। আলোচনায় নতুন কিছু পেলে সেটা আনন্দেরই হবে মনে হচ্ছে আপনি বিষয়টা নিয়ে বিশেষভাবে ভেবেছেন। সুতরাং আমি প্রস্তাব করছি, আপনিই প্রথমে আলোচনা শুরু করুন।’
অন্য সবাই জন টার্নারকে সমর্থন করে মাথা নাড়ে। শুধু এ্যান্ড্রু জ্যাকবস ও স্ল্যাড গার্টনের মুখ মলিন হয়ে উঠে।
‘থ্যাংকস অল।’ বলে কথা শুরু করে আনা প্যাট্রসিয়া, ‘আপনারা সকলেই পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট, টিভি চ্যানেলের সচিত্র বিবরণ দেখেছেন এবং এর প্রতিবাদটাও আপনারা আজ পড়েছেন। প্রথমে গোটা বিষয়ের উপর আমার ভাবনাটা তুলে ধরছি।’
বলে আনা প্যাট্রসিয়া একটু থামে। মুখটা নিচু করে বোধ হয় নিজেকে একটু আত্মস্থ করে, চিন্তাকে গুছিয়ে নেয়। তারপর শুরু করে, ‘গোটা বিষয়ের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো লস আলামোসের সুড়ঙ্গ।’ আমাদের বুঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে গোয়েন্দা সুড়ঙ্গ হওয়ার ব্যাপারটা আহমদ মুসার অপপ্রচার, এটা আসলেই এক্সিট সুড়ঙ্গ। ‘ফ্রি আমেরিকা’ ও ‘হোয়াইট ঈগল’-এর প্রতিবাদে এটা প্রকৃতই যে গোয়েন্দা সুড়ঙ্গ তার পক্ষে কতকগুলো প্রমাণ পেশ করা হয়েছে। প্রথম প্রমাণ হিসাবে সুড়ঙ্গের মাটি ও পাথরের কার্বন টেস্টের বরাত দিয়ে বলেছে, লস আলামোস স্ট্রাটেজিক রিসার্চ ল্যাবরেটরী যখন তৈরী হয়েছে, তখন সুড়ঙ্গ তৈরী হয়নি। সুড়ঙ্গ তৈরী হয়েছে সবুজ পাহাড়ে ইহুদী বিজ্ঞানী জন জ্যাকবের বাড়ি যখন তৈরী হয় তখন। দ্বিতীয় প্রমান হিসেবে সুড়ঙ্গের নির্মাণ-প্রকৃতির ব্যাপারে নির্মাণ-বিশেষজ্ঞদের বরাত দিয়ে বলেছে যে, সুড়ঙ্গটির নির্মাণ শুরু হয় সবুজ পাহাড়ের বিজ্ঞানী জন জ্যাকবের বাড়ি থেকে, লস আলামোস থেকে নয়। তৃতীয় প্রমাণ তারা দিয়েছে, সুড়ঙ্গে প্রবেশ-নিয়ন্ত্রনের ম্যাকানিজম রয়েছে সবুজ পাহাড়-প্রান্তের সুড়ঙ্গ মুখে। সবুজ পাহাড়ে জন জ্যাকবের বাড়িতে যিনি থাকবেন, তারই নিয়ন্ত্রণে থাকবে সুড়ঙ্গে প্রবেশ এবং বেরিয়ে আসার অধিকার। তাদের চতুর্থ প্রমাণ হলো, স্নায়ু-যুদ্ধকালীন সময়ের প্রেসিডেন্ট যারা বেঁচে আছেন এবং লস আলামোস স্ট্রাটেজিক রিসার্চ ল্যাবের সাবেক ডাইরেক্টরদের কেউই জানেন না এ ধরনের একটা সুড়ঙ্গের কথা।’
হাতের গ্লাসটা রেখে আসার জন্যে একটু থেমেছিলো আনা প্যাট্রসিয়া।
প্যাট্রসিয়া থামতেই সিনেট ডেমোক্র্যাট দলীয় নেতা জন টার্নার বলে ওঠে, ‘প্রমান চারটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু যাচাই-এর প্রশ্ন আছে।’
গ্লাস রেখে এসে বসছিলো আনা প্যাট্রসিয়া। সে কথা বলার জন্যে মুখ খোলে। কিন্তু তার আগেই সিনেট সভাপতি চার্লস ওয়ারনার বলে ওঠে, ‘ইয়েস মিঃ টার্নার। প্রমাণগুলো একেবারে সঠিক। এখন চাই এগুলো যে ফ্যাক্ট তার কনফারমেশন।’
‘ধন্যবাদ মিঃ ওয়ারনার, জন টার্নার। যদিও আমি জানি, সরকারী রিপোর্ট সব কথাকেই কনফার্ম করেছে। তবু আমি যাচাই করতে চেষ্টা করেছি। আমি লস আলামোসে ডঃ হাওয়ার্ডকে টেলিফোন করেছিলাম। তিনি সুড়ঙ্গে ঢুকেছিলেন। বললেন, তৃতীয় প্রমাণের কথাগুলো সত্য। সুড়ঙ্গটি শেষ হয়েছে সবুজ পাহাড়ের একটা অন্ধকূপে। সুড়ঙ্গমুখের এবড়ো-থেবড়ো একটা পাথুরে দরজা খুলে সে অন্ধকূপে ঢোকা যায়। কিন্তু এ দরজা খোলার চাবিকাঠি রয়েছে অন্ধকূপে। অন্ধকূপের দিক থেকে দরজা খুলে যে সুড়ঙ্গে ঢোকে সেই শুধু পারে সুড়ঙ্গ থেকে দরজা খুলে অন্ধকূপে ঢুকে বাইরে বেরিয়ে যেতে। এরপর…..।’
আনা প্যাট্রসিয়ার কথায় বাধা দিয়ে হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভের ফরেন রিলেশন্স কমিটির চেয়ারম্যান বব এইচ ব্রুস বলে, ‘আর কোন প্রমাণের দরকার নেই মিস প্যাট্রসিয়া। সুড়ঙ্গটি এক্সিট সুড়ঙ্গ হলে এর নিয়ন্ত্রন থাকতো লস আলামোসে। এর নিয়ন্ত্রন সবুজ পাহাড়ে থাকা নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে এটা গোয়েন্দা সুড়ঙ্গ। দুর্ভাগ্য আমাদের!’ বব এইচ ব্রুসের কন্ঠ ভারী ও মুখ মলিন।
‘তবু শোনা যাক না। সব বিষয়ে নিশ্চিন্ত হওয়ার মধ্যে কোন ক্ষতি নেই।’ ব্রুস থামতেই বলে ওঠে এ্যান্ড্রু জ্যাকবস। তার চোখে মুখে হতাশা।
এ্যান্ড্রুর কথা শেষ হলে আনা প্যাট্রসিয়া বলে, ‘যাচাই-এর জন্যে অন্য যে কয় জায়গায় আমি টেলিফোন করেছি , সব জায়গা থেকেই প্রমাণের পক্ষে ইতিবাচক জবাব মিলেছে। সুড়ঙ্গের সয়েল টেস্ট ও নির্মাণ টেস্ট দুটোই করেছে লস এঞ্জেলসের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার বিজ্ঞানী ও ইঞ্জিনিয়াররা। ‘ফ্রি আমেরিকা’ প্রতিবাদে যা বলেছে, সে কথা তাদের কাছ থেকেও শুনেছি। আর ডঃ হাওয়ার্ড বলেছেন, লস আলামোস স্ট্যাটেজিক ল্যাবের সাবেক পরিচালকরা কেউই জানতেন না এ ধরনের সুড়ঙ্গের কথা। এমনকি স্নায়ু যুদ্ধের সবচেয়ে চরম মুহূর্ত ষাটের দশকে লস আলামোস ল্যাবের পরিচালক ছিলেন শতায়ু মিঃ বেঞ্জামিন বাকনুর। তিনি নিজেই টেলিফোন করেছিলেন ডঃ হাওয়ার্ডকে। তিনি ঐ ধরনের কোন এক্সিট সুড়ঙ্গ থাকার কথা অস্বীকার করেছেন।’
‘ধন্যবাদ মিস প্যাট্রসিয়া। অন্তত আমার কাছে আর কোন অস্পষ্টতা নেই। সব ঘটনার মূল ঘটনা হলো সুড়ঙ্গ। সুড়ঙ্গটা যেহেতু গোয়েন্দা সুড়ঙ্গ, সেহেতু ফ্রি আমেরিকার প্রতিবাদের সব কথাই সত্য বলে ধরে নিতে হবে।’ বলে ওঠে বব এইচ ব্রুস।
কিন্তু মিঃ ব্রুস, তার অর্থ এই নয় যে মিঃ শ্যারন ও মিঃ ডেভিড জোনসরা মানে ইহুদীরা আসামী হবেন।’ ক্ষুদ্ধ কন্ঠে বলে ওঠে এ্যান্ড্রু জ্যাকবস।
‘তা ঠিক। কিন্তু আমরা এখানে আসামী নির্ধারন করছি না। দু’রকম তধ্যের মধ্যে থেকে সত্যটা বের করে নেয়ার চেষ্টা করছি।’ বলে আনা প্যাট্রসিয়া।
‘মিস প্যাট্রসিয়া, লস আলামোস রোড ও সান্তাফে বিমান বন্দরের দুই সন্ত্রাসী ঘটনা সম্পর্কে আপনি কি ভেবেছেন সেটা বলুন।’ বলে ওঠে হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভ ডেমোক্র্যাট দলীয় নেতা স্ল্যাড গার্টন। আলোচনার মধ্যে এই প্রথম কথা বলে সে।
‘লস আলামোস-সান্তাফে রোডে যে সন্ত্রাসীরা নিহত হয়েছিল, তাদের কাছে তাদের পরিচয় প্রমাণ করার মত কিছু পাওয়া যায়নি। তারা কেউই আমেরিকান ব্ল্যাক বা শ্বেতাঙ্গ নয়। তাদের জাতিগত উদ্ভব সম্বন্ধীয় (Anthropology) টেস্ট হয়েছে জর্জ ওয়াশিংটন টেস্ট ইউনিভার্সিটির অ্যানথ্রোপলজি বিভাগে। পরীক্ষা করেছেন বিজ্ঞানী ডঃ লি এইচ হ্যামিল্টন। তাঁর কাছে জেনেছি তারা সবাই সাবেক ইসরাইল এলাকার ইহুদী বংশোদ্ভুত বলে পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে। অন্যদিকে সান্তাফে বিমান বন্দরে এফবিআই-এর যে বিমান বিস্ফোরণে ধ্বংস হয়, সে বিমান যার চালানোর কথা ছিল এবং বিমানটি টেক অফের কয়েক মিনিট আগে যিনি অসুস্থ হয়েছেন বলে চলে যান। পরে প্রমানিত হয় অসুস্থতার ভান করে তিনি পালিয়ে যান, তিনি ধরা পড়েছেন। তিনি স্বীকার করেছেন বোমা পাতার কথা। জেনারেল শ্যারনরাই সে বোমা তাকে সরবরাহ করে অহমদ মুসাসহ তদন্ত টীমের কর্মকর্তাদের হত্যার জন্যে।’ বলে আনা প্যাট্রসিয়া।
আনা প্যাট্রসিয়া কথা শেষ করলে একটা নিরবতা নেমে আসে।
সবাই ভাবছে।
নিরবতা ভংগ করল এ্যান্ড্রু জ্যাকবস। বলল, ‘আমরা এভাবে ইহুদীদের প্রতিপক্ষ হিসাবে দাঁড় করাচ্ছি এটা কি ঠিক? আর দু’একজনের স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে জেনারেল শ্যারনের মত সম্মানিত ব্যক্তিকে আমরা আসামী হিসাবে দাঁড় করাব এটাও ঠিক নয়।’
‘না, না, ইহুদীরা অবশ্যই প্রতিপক্ষ নয়। মাত্র একটা গ্রুপ ষড়যন্ত্রকারী হিসাবে আমাদের সামনে আসছে। এদের সাথে দেশপ্রেমিক ইহুদীদের কোনই সম্পর্ক নেই। আর জেনারেল শ্যারনের মত সম্মানিত লোককে বিনা তদন্তে, বিনা প্রমাণে আসামী….।’
কথা শেষ করতে পারল না চার্লস ওয়ারনার। ড্রইং রুমে প্রবেশ করল দানিয়েল ময়নিহান এবং সেই সাথে তার ছেলে হ্যারি এ্যাডওয়ার্ড ময়নিহান।
হ্যারি এ্যাডওয়ার্ডের বিধ্বস্থ চেহারা।
তার কপালে ও হাতে ব্যান্ডেজ।
ঘরে প্রবেশ করেই দানিয়েল ময়নিহান বলল, ‘গুড মর্নিং টু অল। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ মধ্যরাতে হ্যারিকে ফিরে পেয়েছি। আমি….।’
ময়নিহানের কথার মাঝখানেই কথা বলে উঠল আনা প্যাট্রসিয়া, ‘মাফ করবেন মিঃ ময়নিহান। হ্যারি মুক্ত হওয়ার সংবাদ আমরা পেয়েছি। কিন্তু মুক্ত করল কে? কিভাবে?’
‘হ্যারিকে আমায় বাসায় নিয়ে এসেছে এফবিআই-এর লোকেরা। কিন্তু হ্যারিকে মুক্ত করার অভিযান চালিয়েছিল স্বয়ং আহমদ মুসা এবং সারা জেফারসন। হ্যারিকে মুক্ত করার পূর্ব মুহুর্তে তারা এফবিআইকে ডাকে ক্রিমিনালদের গ্রেফতার করার জন্য।’
‘আহমদ মুসা ওকে উদ্ধার করেছে? তাহলে ওকে কিডন্যাপ করেছিল কে?’ বলল এ্যান্ড্রু জ্যাকবস।
‘কিডন্যাপ করেছিল জেনারেল শ্যারনরা।’ বলল দানিয়েল ময়নিহান।
চোখ ছানাবড়া হয়ে গেছে এ্যান্ড্রু জ্যাকবসের। বিস্ময় ফুটে উঠেছে অন্য সবার চোখে মুখে।
‘এটা কি বিশ্বাসযোগ্য মিঃ ময়নিহান? স্বীকার করতেই হবে ডেভিড উইলিয়াম জোনসের মত ইহুদী নেতাদের সাথে এবং সেই সুবাদে জেনারেল শ্যারনের সাথে আমাদের সম্পর্ক খারাপ নয়। কেন তারা কিডন্যাপ করবে আপনার ছেলেকে?’ চোখে মুখে প্রবল অবিশ্বাস নিয়ে বলল এ্যান্ড্রু জ্যাকবস।
‘মিঃ জ্যাকবস, অনেক সত্য আছে যা বিশ্বাসের আওতায় পড়ে না। এটা সে ধরনেরই একটা সত্য।’ বলল দানিয়েল ময়নিহান। গম্ভীর কন্ঠ তার।
‘তাহলে ফিলিপকে খুন করেছে জেনারেল শ্যারনরাই?’ উত্তেজিত কন্ঠে বলল এ্যান্ড্রু জ্যাকবস। তার দুচোখ লাল হয়ে উঠেছে।
‘হ্যাঁ তারাই খুন করেছে।’ বলল দানিয়েল ময়নিহান।
‘কিন্তু কেন? ফিলিপ একজন সামান্য হাউজ সেক্রেটারী। তাকে খুন করতে যাবে তারা কোন স্বার্থে?’ বলল এ্যান্ড্রু জ্যাকবস।
‘এর মূলে আছে একটা রেকর্ডেড ক্যাসেট।’ বলল দানিয়েল ময়নিহান।
‘বুঝলাম না।’ এ্যান্ড্রু জ্যাকবস বলল।
‘সেদিন আমরা জেনারেল শ্যারনদের সাথে যে বৈঠক করেছিলাম, তার গোটা আলোচনা আমাদের অজান্তে গোপনে রেকর্ড করে জেনারেল শ্যারন। সেটাই সে ভুলে ফেলে যায়। যেহেতু মিটিং-এর পর ঘরে একমাত্র ফিলিপই যাবার কথা এবং তারই ক্যাসেটটি পাবার কথা। আমরা যখন ঘুমিয়ে, তখন ক্যাসেটটি উদ্ধারের জন্যে জেনারেল শ্যারনরা আমার বাড়িতে ফিলিপের কাছে আসে।’ দানিয়েল ময়নিহান বলল।
‘কিন্তু ক্যাসেটটি ফিলিপ পেলে দিয়ে দেবার কথা। সে খুন হেবে কেন? আর হ্যারিইবা কিডন্যাপ হবে কেন?’ বলল এ্যান্ড্রু জ্যাকবস।
‘ক্যাসেটের কথা গোপন রাখতে হলে ফিলিপ ও হ্যারিকে সরিয়ে দেয়া ছাড়া তাদের উপায় ছিল না।’ বলল দানিয়েল ময়নিহান।
‘সাংঘাতিক ঘটনা। গোটা ব্যাপার একটু খুলে বলুন তো?’ বলল চর্লস ওয়ারনার।
‘ঘটনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল হ্যারি। এ জন্যেই ওকে নিয়ে এসেছি।’ বলে দানিয়েল ময়নিহান তাকাল হ্যারির দিকে। বলল, ‘বেটা বলত সেদিন কি ঘটেছিল?
হ্যারি সেদিন রাতে সেই মিটিং রুমে যাওয়া থেকে শুরু করে তার কিডন্যাপ হওয়া, তার বন্দী সময়ের অবস্থা, তার উদ্ধারের ঘটনা সব সংক্ষেপে বর্ননা করল।
সকলেই গভীর আগ্রহে হ্যারির কথা শুনল। হ্যারির কথা শেষ হতেই আনা প্যাট্রসিয়া বলল, ‘সাংঘাতিক দু্ঃসাহস জেনারেল শ্যারনদের। কিন্তু হ্যারি ক্যাসেটটা তোমার কাছে এতটা গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছিল কেন?’
‘গোপনে রেকর্ড করা হয়েছে বুঝতে পেরে এবং জেনারেল শ্যারন ক্যাসেটটাকে অত গুরুত্ব দেয়ায় আমার কৌতুহল সৃষ্টি হয়। নিশ্চয় এতে এমন কিছু থাকতে পারে যা দিয়ে আমার আব্বাদের সে বিপদে ফেলতে পারে। তারপর ক্যাসেটটা শোনার পর আমি নিশ্চিত হই যে, শ্যারনরা একটা ষড়যন্ত্র করছে যা আমাদের আমেরিকান স্বার্থের পরিপন্থী।’ বলল হ্যারি।
‘কিন্তু ক্যাসেটটা তোমার আব্বাকে না দিয়ে রবিন নিক্সনকে দিলে কেন?’ জিজ্ঞেস করল জন রিচার্ডসন।
হ্যারি তার আব্বার দিকে একবার তাকিয়ে মুখ নিচু করল। চোখে-মুখে নেমে এল তার বিব্রতভাব। জবাব দিল না প্রশ্নের।
হ্যারির আব্বা দানিয়েল ময়নিহান হাসল। বলল, ‘তারা দু’ভাইবোন মনে করেছে ক্যাসেটটা পেলে আমি একে কাজে লাগাব না, এমনকি ব্যাপারটা জেনারেল শ্যারনরা জেনেও ফেলতে পারে। সে জন্যে ক্যাসেটটা রবিন নিক্সনকে পৌছিয়েছে এবং রবিন সেটা সংগে সংগেই ‘ফ্রি আমেরিকা’র হাতে তুলে দিয়েছে।’
চর্লস ওয়ারনারের মুখে মিষ্টি হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘হ্যারি, তোমরা দু’ভাই-বোন কি তাহলে ‘ফ্রি আমেরিকা’ মুভমেন্টের সাথে আছ?’
হ্যারির বিব্রত অবস্থা বেড়ে গেল। সে মাথা তুলল না, জবাবও দিল না।
‘মিঃ ময়নিহান, আপনার বাড়িই দেখছি আপনার বেদখল হয়ে গেছে।’ বলল জন রিচার্ডসন।
হাসল দানিয়েল ময়নিহান।
অসহায় অবস্থা দাঁড়াল হ্যারির।
মিষ্টি হাসি ফুটে উঠল আনা প্যাট্রসিয়ার ঠোঁটে। বলল, ‘ভেবনা হ্যারি, আমরা কিন্তু সবাই খুশী।’
বলে একটু থামল আনা প্যাট্রসিয়া। মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল তার। বলল আবার, ‘আমেরিকা তোমাদের জন্য গর্ববোধ করবে হ্যারি। তেমার পিতার চেয়ে বেশী গুরুত্ব দিয়েছ দেশকে। তোমরাই প্রকৃত আমেরিকান। সত্যিই ফ্রি আমেরিকা তোমাদের দ্বারাই পুনর্জীবিত হবে।’
‘ধন্যবাদ মিস প্যাট্রসিয়া। আমিও গর্বিত হ্যারিদের জন্যে। বলল দানিয়েল ময়নিহান।
আবেগে উজ্জীবিত তরুণ হ্যারির দুগন্ড বেয়ে অশ্রু গড়াল। আনন্দের অশ্রু।
দানিয়েল ময়নিহান ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে তার পিঠ চাপড়ে বলল, ‘ধন্যবাদ বেটা।’
দানিয়েল তার আসনে ফিরে এলে চার্লস ওয়ারনার বলল, ‘ধন্যবাদ হ্যারি। তুমি এখন একটু বাইরে থেকে বেড়িয়ে এস?’
মুখ তুলল হ্যারি। তার ঠোঁটে হাসি। বলল, ‘অবশ্যই স্যার। সকলকে ধন্যবাদ।’
বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল হ্যারি।
হ্যারি বেরিয়ে যেতেই চার্লস ওয়ারনার কলে উঠল, ‘আমরা আমাদের আলোচনায় এবার উপসংহার টানতে পারি।’
কিছু বলতে যাচ্ছিল জন রিচার্ডসন।
এসময় মোবাইলে কল এল আনা প্যাট্রসিয়ার।
থেমে গেল রিচার্ডসন।
‘মাফ করুন।’ বলে মোবাইল তুলে নিল আনা প্যাট্রসিয়া।
টেলিফোনে কথা বলতে গিয়ে, ভ্রুকুঞ্চিত হল আনা প্যাট্রসিয়ার। ‘ও গড!’ বলে আর্তনাদ করে উঠল সে। শেষ দিকে চোখ-মুখ তার উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, ‘ঈশ্বর আমাদের সাহায্য করুন।’
মোবাইল অফ করে দিয়েই সবার দিকে চেয়ে সে বলে উঠল, ‘একটা দু্ঃসংবাদ। জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন খুন হয়েছেন আজ রাতে। জর্জ আব্রাহাম জানালেন।’
‘ও গড!’ বলে সকলে বুকে ক্রস আঁকল। মলিন হয়ে উঠল সকলের মুখ।
কয়েকমুহূর্ত কেউ কোন কথা বলল না।
নিরবতা ভাঙল এ্যান্ড্রু জ্যাকবস। বলল, ‘আর কিছু বলেছেন মিঃ জর্জ আব্রাহাম?’
‘বলেছেন, নিহত জেনারেল আলেকজান্ডারের কাছ থেকে যে দলিল উদ্ধার হয়েছে তাতে জেনারেল শ্যারনদের সাথে তার মতানৈক্যের কারনেই তিনি নিহত হয়েছেন। সম্ভবত জেনারেল আলেকজান্ডার তার বিপদ আঁচ করতে পেরে তাঁর পকেটের গোপন রেকর্ডার অন করে রেখেছিলেন। তাতে খুনীদের সাথে গোটা কথপোকথন, এমনকি গুলীর শব্দ এবং মুমূর্ষু জেনারেল আলেকজান্ডারের শেষ স্বগোতোক্তি পর্যন্ত ধরা পড়েছে।’
‘ও গড! কে তার খুনী? জেনারেল শ্যারন?’ আর্তনাদ করে ঊঠল চার্লস ওয়ারনারের কন্ঠ।
‘ক্যাসেটে জেনারেল আলেকজান্ডার ছাড়াও আরও দুজন জেনারেল শ্যারন ও ডেভিড উইলিয়াম জোনসের কন্ঠ রয়েছে। ক্যাসেট অনুসারে জেনারেল শ্যারন গুলী করেছে জেনারেল আলেকজান্ডারকে।’ বলল আনা প্যাট্রসিয়া।
‘ও গড! জর্জ আব্রাহামরা এখনও কি বসে আছেন?’ প্রায় একসংগেই বলে উঠল সিনেট ও প্রতিনিধি পরিষদের ডেমোক্র্যাট দলীয় নেতা জন টার্নার ও স্ল্যাড গার্টন।
‘না ওরা বসে নেই। ওরা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে বেরিয়ে পড়েছেন। পথ থেকে টেলিফোন করেছেন জর্জ আব্রাহাম।’ বলল আনা প্যাট্রসিয়া।
‘ঈশ্বর সাহায্য করুন!’ বলে উঠল সকলেই। এ্যান্ড্রু জ্যাকবসও এদের মধ্যে রয়েছেন।
এ সময় ঝড়ের মত কক্ষে প্রবেশ করল সিনেট ও প্রতিনিধি পরিষদে রিপাবলিকান দলীয় নেতা ডন এ্যাডওয়ার্ড ও স্টিভ বায়ার।
ঘরে ঢুকেই ডন এ্যাডওয়ার্ড বলল, ‘গুড মর্নিং টু অল, কিন্তু গুড নিউজ ও ব্যাড নিউজ আছে সকলের জন্যে এবং স্যরি ফর আওয়ার লেট।’ এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলল ডন এ্যাডওয়ার্ড।
‘গুড মর্নিং মিঃ এ্যাডওয়ার্ড ও মিঃ বায়ার। ব্যাড নিউজটা বোধ হয় আমরা জানি। গুড নিউজটা কি?’ বলল চার্লস ওয়ারনার।
‘গুড নিউজটা হলো ফ্রি আমেরিকার একটা চমৎকার প্রতিবাদ এসেছে পত্রিকায়।’
বলেই একটু থেমে আবার শুরু করল ডন এ্যাডওয়ার্ড, ‘ব্যাড নিউজটা কি শুনেছেন আপনারা? জেনারেল আলেকজান্ডারের নিহত হওয়া?’
‘হ্যাঁ।’ বলল চার্লস ওয়ারনারই।
‘কিন্তু খুনীরা কে জানেন?’
‘জানি, জেনারেল শ্রারন ও ডেভিড উইলিয়াম জোনসকে সন্দেহ করা হয়েছে।’ বলল চার্লস ওয়ারনার।
‘সন্দেহ কি, একেবারে হাতে নাতে ধরা পড়ার মত ঘটনা। আমরা এফ বি আই অফিসে গিয়েছিলাম। রেকর্ড শুনে এলাম। টেপে জেনারেল হ্যামিল্টন, জেনারেল শ্যারন এবং ডেভিড উইলিয়াম জোনসের গলা একদম পরিষ্কার। সন্দেহের সামান্যও কোন অবকাশ নেই।’
‘কিন্তু মিঃ এ্যাডওয়ার্ড, নিহত জেনারেল হ্যামিল্টনের পকেটে এ ধরনের টেপ পাওয়া কি অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে না?’ বলল এ্যান্ড্রু জ্যাকবস।
‘না, অস্বাভাবিক নয়। টেপ শুনলে আপনার কাছেও বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। টেপে তাদের গোটা আলোচনার রেকর্ড নেই। টেপে কথা হঠাৎ করে জেনারেল হ্যামিল্টনের একটা বক্তব্যের মাঝখান থেকে শুরু হয়েছে। এর অর্থ জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন যখনই জেনারেল শ্যারনদের সন্দেহ করেছেন, তখনই তার পকেটে রাখা মাইক্রো রেকর্ডারটা অন করেছেন। সম্ভবত তিনি চেয়েছিলেন জেনারেল শ্যারনদের ষড়যন্ত্রের দলিল যোগাড় করতে।’
আনা প্যাট্রসিয়া কিছু বলার জন্য মুখ খুলেছিল, কিন্তু তার আগেই ডন এ্যাডওয়ার্ড আবার শুরু করল, ‘জেনারেল শ্যারনদের যে ষড়যন্ত্র জেনারেল আলেকজান্ডার জানতে পারেন সেটা যাতে তিনি বাইরে প্রকাশ করতে না পারেন এজন্যে তাকে খুন করা হয়েছে। সম্ভবত জেনারেল শ্যারনকে রিভলবার বের করতে দেখেই জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন ভীতকন্ঠে চিৎকার করে উঠেছিলেন, ‘একি করছেন মিঃ শ্যারন। আমি একটা সত্য আপনাদের জানিয়েছি মাত্র। আমি আপনাদের শত্রু নই।’ জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনের এই আকুল আবেদনের জবাবে জেনারেল শ্যারন কি বলেছিলেন জানেন? বলেছিলেন ‘এই সত্যই আমাদের শত্রু হ্যামিল্টন। এই সত্য আপনার মুখ দিয়ে বাইরে যাক আমরা তা চাই না।’ জেনারেল শ্যারনের এই কথার পর পরই দুবার গুলীর শব্দ শোনা গেছে। তার সাথে সাথেই শোনা গেছে জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনের আর্তনাদ। মুমূর্ষু জেনারেল হ্যামিল্টনের শেষ কথা কি ছিল জানেন? তাঁর শেষ কথা ছিল, ‘আমার আমেরিকাকে ঈশ্বর রক্ষা করুন এই ষড়যন্ত্রের হাত থেকে। আমি আমেরিকার জন্যে নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখতাম, আমেরিকার সে নতুন পৃথিবী হোক আমাদের ফাউন্ডার ফাদারসদের, কোন ষড়যন্ত্রকারীদের নয়।’
থামল ডন এ্যাডওয়ার্ড। শেষের দিকে আবেগে ভারী হয়ে উঠেছিল ডন এ্যাডওয়ার্ডের কন্ঠ। তার দুচোখের কোণ সিক্ত হয়ে উঠেছিল অশ্রুতে।
সে কথা বলতে পারল না।
কথা বলে উঠল হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভের রিপাবলিকান দলীয় নেতা স্টিভ বায়ার। বলল, ‘জানেন জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনের এই কথার পর ডেভিড উইরিয়াম জোনস কি বলেছিল? বলেছিল, ‘থ্যাংকস জেনারেল শ্যারন। প্যাট্রিওটিজমের বীজগুলোকে এইভাবেই ধ্বংস করা উচিত।’ থামল স্টিভ বায়ার।
সে থামতেই সিনেট ও হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভের ডেমোক্র্যাট দলীয় নেতা জন টার্নার ও স্ল্যাড গার্টন প্রায় একসাথেই বলে উঠল, ‘বিশ্বাসঘাতক জোনস প্যাট্রিওটিজমের বীজ উপড়ে ফেলতে চায়! তার দুঃসাহস কোথায় গিয়ে ঠেকেছে!’
‘এই বিশ্বাসঘাতকদের কুমন্ত্রনাতেই আজ আমরা এখানে জমায়েত হয়েছিলাম। দুর্ভাগ্য আমাদের!’ বলল সিনেটে রিপাবলিকান দলীয় নেতা ডন এ্যাডওয়ার্ড।
‘শুধু জমায়েত নয়, আমরা প্রেসিডেন্ট এবং এফ বি আই ও সি আই এ চীফকে ইমপীচ করার সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছিলাম।’ বলল দানিয়েল ময়নিহান।
‘আমরা জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনের মতই প্রতারিত হয়েছিলাম। ঈশ্বর আমাদের রক্ষা করেছেন।’ এ্যান্ড্রু জ্যাকবস বলল। তার কন্ঠে অনুশোচনার সুর।
‘এর দ্বারা আমরা জাতির ভবিষ্যত নিয়ে কত কম ভাবি সেটাও প্রমাণ হয়ে গেল। শহীদ জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনের শেষ কথাটাকে আমাদের খুবই গুরুত্ব দিতে হবে। তিনি কামনা করেছেন, আমেরিকার নতুন পৃথিবী যেন হয় আমাদের ফাউন্ডারস ফাদারসদের, কোন ষড়যন্ত্রকারীদের নয়। তাঁর কথিত এই ‘ষড়যন্ত্রকারীদের নতুন পৃথিবীটা’ কি, সেটা সম্পর্কে আমাদের জানতে হবে।’ বলল চার্লস ওয়ারনার।
‘শহীদ আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনের ঐ টেপ থেকেই পরিষ্কার, জেনারেল শ্যারন ও জোনসরা ‘নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার’-এর নামে যে নতুন পৃথিবী গড়ার স্বপ্ন আমেরিকার মাথায় চাপিয়ে দিয়েছে, সেটাই ঐ ষড়যন্ত্র।’ বলল ডন এ্যাডওর্য়াড।
‘কিন্তু কেন এটা ষড়যন্ত্র আমি বুঝতে পারছি না। বরং আমি তো দেখছি, এই নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন আমেরিকার জন্যে বিশ্বনেতৃত্বের মুকুট নিয়ে আসবে। এতে দোষ কোথায়?’ বলল এ্যান্ড্রু জ্যাকবস।
‘এর একটা উত্তর আমি দিতে পারি আমার ছেলে হ্যারি এ্যাডওয়ার্ডের ভাষায়। কিছুদিন আগে আমাদের ফ্যামিলি গ্যাদারিং-এ নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার নিয়ে বিতর্ক উঠলে সে বলেছিল, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বনেতৃত্বের লোভ দেখিয়ে তাকে বিশ্বের ‘খল নায়ক’-এ পরিনত করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, জাতিসংঘের বিশ্বায়ন কর্মসূচীর পেছনের সকল কলকাঠি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতে। অর্থনীতি, সংস্কৃতি, রাজনীতি প্রভৃতির বিশ্বায়নকে যতই লোভনীয় মোড়কে বাজারজাত করা হোক, অধিকাংশ জাতি রাষ্ট্র এর বিরুদ্ধে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা, তার সাথে আই এম এফ ও বিশ্বব্যাংক ক্রমবর্ধমান অসন্তোষের মুখে পড়াই এর একটি প্রমাণ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে এই বিতর্কিত বিশ্বায়নের নেতা সাজিয়ে ও বিশ্বপুলিশের তকমা পরিয়ে তাকে বিতর্কিত ও বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে। আমেরিকার বন্ধুর বেশ পরে আমেরিকার বিরুদ্ধে এটা সাংঘাতিক ষড়যন্ত্র। জেনারেল শ্যারনরা হিটলারকে ঘৃনা করেন, কিন্তু তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ‘হিটলারের জার্মানী’ বানাতে চাচ্ছে। এর অর্থ তারা আমেরিকার জন্যে হিটলারের পরিনতি আশা করে।’ বলল দানিয়েল ময়নিহান।
দানিয়েল ময়নিহান থামতেই এ্যান্ড্রু জ্যাকবস বলে উঠল, ‘ভবিষ্যত সম্পর্কে এটা একটা ধারনা মাত্র।’
হাসল আনা প্যাট্রসিয়া। বলল, ‘ধারনা বলে একে এড়িয়ে যাওয়া যাবে না মিঃ জ্যাকবস। দেখুন গোটা দুনিয়ায় ইউরোপ আমাদের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র। তার মধ্যে আবার বৃটিশরা আমাদের সবচেয়ে কাছের। সেই বৃটেনের শীর্ষ নীতি-নির্ধারকরা আড়ালে কি বলে থাকে জানেন? বলে, ‘সবাই সব জায়গায় আজ দেখছে আমেরিকার বেপরোয়া জেদপনা ও একলা চল নীতিকে।’ আমাদেরই হার্ভার্ডের একজন বিদেশ-নীতি বিশেষজ্ঞ (স্যামুয়েল হান্টিংটন) বলেছে, ‘বিশ্বের জাতি-রাষ্ট্রসমূহ এবং জনগনের বিপরীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ক্রমবর্ধমানভাবে একাকী হয়ে পড়েছে।’ তার মত হলো, ‘আমেরিকা কখনই বিচ্ছিন্ন আর বন্ধু হারানোর নীতি গ্রহন করবে না।, কিন্তু তার পদক্ষেপই অবশিষ্ট দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে।’ ‘ফ্রি আমেরিকা’র হ্যারি এ্যাডওয়ার্ডরা ‘নতুন বিশ্ব ব্যবস্থাকে’ এই বিচ্ছিন্নকারী পদক্ষেপ হিসাবে অভিহিত করছে। তাদের এই মত ফেলে দেবার মত নয় যে, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক গ্লোবালাইজেশন বা একক স্ট্যান্ডারডাইজেশন জাতি-রাষ্ট্রসমূহকে বৈরী করে তুলবেই এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বেই। অন্তিম মুহূর্তে জেনারেল হ্যামিল্টন এই বোধ থেকেই একে ‘ষড়যন্ত্রের বিশ্ব ব্যবস্থা’ বলে অভিহিত করেছেন এবং এর জায়গায় চেয়েছেন ফাউন্ডার ফাদারসরা যে বিশ্বব্যবস্থার স্বপ্ন দেখেছেন সেই বিশ্ব ব্যবস্থা।’
নিরূপায়ের একটা হাসি ফুটে উঠল এ্যান্ড্রু জ্যাকবসের মুখে। বলল, ‘আমাদের ফাউন্ডার ফাদারসদের আলাদা বিশ্ব ব্যবস্থাটা কি?’
‘সেটা হলো, তোমার হাত তুমি ততটা সম্প্রসারিত করো, যতটা করলে অন্যের নাক স্পর্শ না করে। অর্থাৎ কারো স্বার্থে হস্তক্ষেপ না করে। যদি এ নীতিবোধে মানুষ উজ্জীবিত হয়, তাহলেই শুধু পারস্পরিক সমতা, সম্মান ও সহযোগিতা ভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থা গঠন সম্ভব। আমাদের ফাউন্ডার ফাদারসরা এ বিশ্ব ব্যবস্থারই স্বপ্ন দেখেছেন।’
আনা প্যাট্রসিয়া থামতেই চার্লস ওয়ারনার বলে উঠল, ‘এবার আমাদের বৈঠকের আমরা উপসংহার টানতে পারি।’
‘আমরা দুজন শেষ মুহূর্তে এসেছি। জানিনা আগে আরও কি আলোচনা হয়েছে। তবে আমি মনে করি, এই বৈঠকের সমাপ্তি ঘটাতে পারি একটা প্রার্থনার মধ্য দিয়ে। সেটা হলো, ‘ঈশ্বর যেন আহমদ মুসাকে দীর্ঘ জীবন দান করেন। তিনি মৌলবাদী হলেও আমেরিকাকে একটা অক্টোপাসের কবল থেকে মুক্ত করার ব্যবস্থা করলেন। তিনি শুধু ইহুদীদের ষড়যন্ত্র ধরেছেন তাই নয়, ষড়যন্ত্রকারীদের আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবার সব ব্যবস্থাই সম্পন্ন করেছেন।’ বরর ডন এ্যাডওয়ার্ড।
‘মিঃ এ্যাডওয়ার্ডের সব কথা সাথে আমি একমত। তবে ষড়যন্ত্রটাকে ইহুদী ষড়যন্ত্র বলা ঠিক নয়। বিজ্ঞানী জন জ্যাকবস, ডেভিড উইলিয়াম জোনসও জেনারেল শ্যারনরা একটা ষড়যন্ত্রকারী গ্রুপ এং ইহুদী গ্রুপ বটে কিন্তু আমেরিকার যারা দেশপ্রেমিক ইহুদী তাদের প্রতিনিধি তারা নয়। সুতরাং একে ইহুদী ষড়যন্ত্র না বলে ইহুদীবাদী একটা গ্রুপের ষড়যন্ত্র বলা উচিত। দেখুন পত্রিকায় ফ্রি আমেরিকার যে প্রতিবাদ আজ প্রকাশিত হয়েছে তাতেই আছে ইহুদী ব্যাংকার আইজ্যাক বেনগুরিয়ান ও তাঁর মেয়ে সাবা বেনগুরিয়ান জেনারেল শ্যারনদের বিরোধিতায় জীবনের ঝুঁকি নিয়েছেন, তবু আমেরিকার স্বার্থ জলাঞ্জলী দিতে চাননি।’ বলল আনা প্যাট্রসিয়া।
‘ধন্যবাদ মিস প্যাট্রসিয়া। আপনার সাথে আমি একমত। তবে আহমদ মুসা সম্পর্কে বেশী বলার পক্ষে আমি নই। ঘটনাচক্রে তাঁর সাহায্য আমরা পেয়েছি। কিন্তু তাঁর মেীলবাদী চরিত্র সহজে যাবার নয়।’ বলল এ্যান্ড্রু জ্যাকবস।
হাসল ডন এ্যাডওয়ার্ড। বলল, ‘মৌলবাদ দেখে আমরা অভ্যস্তই। ইহুদীদের চেয়ে বড় মৌলবাদী দুনিয়াতে আর কেউ নেই। দুনিয়ার সবাইকে বুকে টেনে নেবার জন্য ইসলাম দুহাত বাড়িয়ে আছে। কিন্তু কোন নন-ইহুদী ইহুদী হতে পারে না, ইহুদী হওয়া চিরদিনের জন্য শুধু বনি ইসরাইলের জন্যে বরাদ্দ। আর আহমদ মুসা যেটুকু মৌলবাদী, সেটুকু মৌলবাদী আমরা অনেকেই। বাইবেলের মৌলবিধানকে আমরা অনেকেই দৃঢ়ভাবে মেনে চলতে চাই।’
ডন এ্যাডওয়ার্ড থামতেই চার্লস ওয়ারনার বলে উঠল, ‘প্লিজ কথা না বাড়িয়ে আমরা আলোচনার উপসংহার টানতে চাই। মিস আনা প্যাট্রসিয়া ঠিকই বলেছেন শ্যারন-জোনসদের ষড়যন্ত্রকে আমরা ইহুদী ষড়যন্ত্র বলবনা। আমেরিকা ও আমেরিকার বাইরে এ ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তৃত হলেও ইহুদীবাদী একটা গ্রুপ মাত্র এর সাথে জড়িত। আর মিঃ এ্যাডওয়ার্ড উপসংহার সম্পর্কে যে পরামর্শ দিয়েছেন, সেটা ভালো। তবে আহমদ মুসার জন্যে ঐ প্রার্থনার প্রয়োজন নেই, আমরা আহমদ মুসাকে ধন্যবাদ জানাব, স্থান-কাল-পাত্র নির্বিশেষে ন্যায়ের পক্ষে ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে আহমদ মুসা হলো উন্মুক্ত তরবারী। আমরা আজ এখানে দুটি ব্যাপারে একমত হতে পারি, এক. আহমদ মুসা সম্পর্কে আমাদের এই অনুভুতি সরকারের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক ভাবে তাকে আমরা জ্ঞাপন করবো, দুই. আমেরিকা থেকে এই ইহুদীবাদী ষড়যন্ত্র সমূলে উৎপাটনের জন্যে সব ব্যবস্থাই আমাদের সরকারকে গ্রহন করতে বলব এবং সরকার রাজনৈতিক ঝুঁকি নিয়েও যে ত্বরিত এই ষড়যন্ত্র উদঘাটনে এগিয়ে এসেছেন, এজন্যে আমরা সরকারকে ধন্যবাদ জানাব।’ থামল চার্লস ওয়ারনার।
আনা প্যাট্রসিয়া, দানিয়েল ময়নিহান ও ডন এ্যাডওয়ার্ডসহ প্রায় সকলেই একবাক্যে বলে উঠল, ‘হ্যাঁ এই দুই বিষয়ে আমরা একমত হতে পারি।’
‘আমার আপত্তি নেই, তবে আমরা ইনফরমাল বসেছিলাম। আমরা সম্মিলিতভাবে এসব কথা কি বলব?’ বলল এ্যান্ড্রু জ্যাকবস।
‘অবশ্যই মিঃ জ্যাকবস। আমরা জেনারেল শ্যারনদের দ্বারা প্রতারিত হয়ে এই যে এখানে বৈঠকের আয়োজন করেছিলাম তার প্রায়শ্চিত্ত হওয়া দরকার। আমি এখানে আসার আগে ফ্রি আমেরিকার সারা জেফারসন দেখতে এসেছিল হ্যারিকে। দেখলাম, তারা বৈঠকের খবর জানে। সারা জেফারসন আমার মাধ্যমে আপনাদের সবার কাছে আপীল করেছেন তাদেরকে সাহায্য করার জন্যে। আমি মনে করি, বৈঠকে আমরা যদি ঐ দুটি বিষয়ে একমত হই, তাহলে তাদেরকে সাহায্য করা হয়, আমাদেরও প্রায়শ্চিত্ত হয়।’ বলল দানিয়েল ময়নিহান আবেগ জড়িত কন্ঠে।
আরও ভালো হতো, যদি আপনি সারা জেফারসনকে দাওয়াত দিতেন এ মিটিং-এ আসার জন্যে। তার জন্যে সত্যিই গর্ববোধ হয়। তিনি ইয়ং আমেরিকার যোগ্য নেত্রী।’ বলল ডন এ্যাডওয়ার্ড।
‘তাঁকে দাওয়াত দেয়ার কথাই আমার মাথায় আসেনি। তাছাড়া তাঁরও সময় ছিল না। তিনি এফ বি আই হেড কোয়ার্টারে যাবার পথে আমার বাসায় উঠেছিলেন।’ বলল দানিয়েল ময়নিহান।
‘আচ্ছা তাহলে আমরা উঠতে পারি।’ বলে চর্ালস ওয়ারনার এ্যান্ড্রু জ্যাকবসের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মিঃ জ্যাকবস আপনাকে সবার পক্ষ থেকে সুন্দর আতিথেয়তার জন্যে ধন্যবাদ’
বলতে বলতে উঠে দাঁড়াল চার্লস ওয়ারনার। তার সাথে সাথে সবাই উঠে দাঁড়াল।