২
কাউন্সিল অব আমেরিকান জুইস এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ডেভিড উইলিয়াম জোনস এতটাই উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল যে মোবাইলটা কানে ধরে রেখেই চিৎকার করে উঠল, ‘মিঃ শ্যারন, মিঃ শ্যারন।’
বাম হাত গাড়ির স্টিয়ারিং হুইলে রেখে ডান হাত দিয়ে মোবাইলটা ডান কানে ধরে চিৎকার করছিল ডেভিড জোনস।
জেনারেল শ্যারনের গাড়ি লনের এক্সিট সার্কেল ঘুরে গেটে এসে পৌছেছিল বাইরে বেরুবার জন্যে। জেনারেল শ্যারন নিজেই ড্রাইভ করছিল গাড়ি।
ডভিড জোনসের চিৎকারে সে মাথা ঘুরিয়ে তাকাল। দেখল, মিঃ জোনস তাকে হাত নেড়ে ডাকছে।
জেনারেল শ্যারন তার গাড়ি ঘুরিয়ে নিল। গাড়ি নিয়ে গিয়ে দাঁড়াল মিঃ জোনসের গাড়ির পাশে।
মিঃ জোনস গাড়ি থেকে নেমে এল।
তার চোখে মুখে উত্তেজনা।
জেনারেল শ্যারনও গাড়ি থেকে নামল।
‘কি ব্যাপার মিঃ জোনস?’ উদ্বিগ্ন কন্ঠ জেনারেল শ্যারনের।’
‘অনেক দুঃসংবাদের পর একটা ভাল খবর পাওয়া গেছে। আমাদের বেন ইয়ামিন এইমাত্র জানাল, পার্লামেন্ট ভবন থেকে একটু দক্ষিন-পূর্বে পটোম্যাক নদীর তীরে একটা বাড়িতে আহমদ মুসা ও সারা জেফারসন বাস করছে। তবে সেখানে পুলিশ ও এফ বি আই-এর লোকেরা পাহারায় রয়েছে।’ বলল ডেভিড উইলিয়াম জোনস।
‘দারুন খবর। আমরা যদি দুজনকে হগাত করতে পারি, তাহলে আমাদের বিরুদ্ধে সরকারী তদন্ত থামিয়ে দেয়া যাবে। এখনি এই রাতে আমাদের অভিযানে যাওয়া দরকার।’ বলল জেনারেল শ্যারন।
‘না এভাবে অভিযান করা যাবে না। পুলিশ ও এফ বি আই-এর সাথে লড়াইকরে তাদের ধরে আনা যাবে বলে আমি মনে করি না। কে তাদের উপর হামলা করেছে এটা জানতে পারলে আহমদ মুসা একাই একশ হবে। আমরা ব্যর্থ হবো। আপনি আহমদ মুসাকে চেনার পর এরকম প্রস্তাব দিলেন কেমন করে?’ বলল ডেভিড জোনস।
‘ঠিক বলেছেন মিঃ জোনস। আমি উত্তেজিত হয়ে বিচার বুদ্ধি হারিয়ে ফেলেছি। তাকে ফাঁদে ফেলতে হবে কৌশলে। বলুন আপনার কোনর প্রস্তাব আছে? বলল জেনারেল শ্যারন।
‘সারা জেফারসনকে আমাদের দরকার নেই। তাকে কিডন্যাপ করলে পুরো আমেরিকায় হৈ চৈ পড়ে যাবে। লাভের চেয়ে ক্ষতি হবে আমাদের বেশী। এক আহমদ মুসাকে আমাদের হাতে আনতে পারলেই সরকার, ফ্রি আমেরিকা, হোয়াইট ঈগল, সবাই অন্ধ হয়ে পড়বে।’ ডেভিড জোনস বলল।
‘আপনার যুক্তির সাথে একমত।’ বলল জেনারেল শ্যারন।
‘আমি বলে দিয়েছি, বেন ইয়ামিন বাড়ির উপর নজর রাখবে। উপযুক্ত সুযোগ সৃষ্টি হলেই সে আমাদের জানাবে। আমরা তৈরী থাকব যে কোন মুহূর্তে অভিযান চালানোর জন্যে। আমি ঐ বাড়ি ও তার আশপাশের রাস্তাঘাটের একটা নকশা এঁকে দিচ্ছি, আপনি একটা নিখুঁত পরিকল্পনা তৈরী করুন।’ ডেভিড জোনস বলল।
‘পরিকল্পনা সকাল, বিকাল, দিন, রাত, কোন সময়ের হবে? সময় অনুসারে পরিকল্পনা হবে আলাদা।’ বলল জেনারেল শ্যারন।
‘যে এলাকায় বাড়ি, সেটা টাইট সিকিউরিটি জোন। রাতের বেলা কোন পাখি উড়লেও সেটা তাদের নজর এড়ায় না। দিনের বেলা এমন টাইট অবস্থা থাকে না। সকাল ও বিকেলের কথা আপনি ভাবতে পারেন। তবে সবকিছুই নির্ভর করছে বেন ইয়ামিনের খবরের উপর।’ ডেভিড জোনস বলল।
‘বাড়ি গিয়ে আর কাজ নেই। চলুন আপনার ওখানে গিয়ে বসি। আপনার ওখান থেকে পটোম্যাকের ঐ এলাকায় সরাসরি রাস্তা আছে।’ বলল জেনারেল শ্যারন।
‘ওয়েলকাম। চলুন যাই। পরামর্শ করে পরিকল্পনাটা তৈরী করতে হবে।’ বলে ডেভিড উইলিয়াম তার গাড়ির দিকে এগোল। জেনারেল শ্যারনও গিয়ে তার গাড়িতে বসল।
দুই গাড়িই স্টার্ট নিয়ে চলতে শুরু করল।
বাড়িটার নাম পটোম্যাক লজ।
বাড়িটার সামনে সুন্দর সবুজ চত্বর। দুপাশ এবং পেছন দিকে বাগান।
চত্বর ও বাগান নিচু বাউন্ডারী ওয়াল দিয়ে ঘেরা।
বাউন্ডারী ওয়ালের সাথে বাড়িতে প্রবেশের হালকা একটি গেট। গ্রীলের তৈরী এবং তার উপর আয়রন শীট দিয়ে ঢাকা।
বাড়ির সামনে দাঁড়ালে ওয়ালের উপর দিয়ে চত্বর ও বাগানের অনেকখানি দেখা যায়।
এই বাড়িতেই এখন বাস করছে আহমদ মুসা, সারা জেফারসন ও সারা জেফারসনের মা জিনা জেফারসন। এফ বি আই-এর মেজর জো স্কিন বসেছিল গেটের বাইরে বেশ এবটু দুরে রাস্তার পাশে ঘাসে ঢাকা সবুজ একটা টিলায়।
তখন বেলা ৯ টা।
পটোম্যাক লজ থেকে বেরিয়ে একটা কনফেকশনারীর গাড়ি মেজর জো’র সামনের রাস্তা ধরে চলে যাচ্ছিল।
মেজর জো মুখ তুলে বলল, ‘বিক্রি হলো কিছু?’
ট্রাকরে মত কনফেকশনারীর গাড়িটার ড্রাইভিং সিটসহ ইঞ্জিন অংশ আলাদা এবং তার পেছনে বিরাট কনটেইনার।
ড্রইভারের মাথায় ফেল্ট হ্যাট। মুখে কাঁচা-পাকা গোঁফ ও দাড়ি। মুখের গোঁফ-দাড়ি বড়ই অপরিপাটি, ব্যাস্ত ও কাজ পাগল মানুষের নিদর্শন।
ড্রাইভারটি মুখ ঘুরিয়ে মেজর জো’র দিকে তাকিয়ে বলল, ‘গুড মর্নিং স্যার। এরা স্থায়ী কাস্টমার, আমাদের বিক্রি তো হবেই। আজ আমরা খুশী। ধন্যবাদ।’
গাড়িটা চলে গেল।
গাড়িটা যাওয়ার কিছুক্ষন পর পটোম্যাক লজের অন্যতম কেয়ারটেকার উইলিয়াম এল। হাতে কয়েকটা কনফেকশনারীর প্যাকেট ও কাগজের ব্যাগ ভর্তি জিনিসপত্র নিয়ে হাঁটছিল পটোম্যাক লজের দিকে।
মেজর জো স্কিন বসা থেকে তড়াক করে উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘হ্যালো উইলিয়াম, তুমি একগাদা কনফেকশনারীর জিনিস নিয়ে আসছ, আবার কনফেকশনারীর গাড়ি গিয়ে দিয়ে এল অনেক জিনিস। ডাবল শপিং কেন?’
উইলিয়াম চোখ কপালে তুলে বলল, ‘কি বলছ মেজর, আমাদের কনফেকশনারীর গাড়ি সপ্তাহে দুদিন আসে। আজতো আসার দিন নয়!’
‘কিন্তু গাড়িতো এসেছিল।’ বলল মেজর জো শুকনো কন্ঠে। তার চোখে-মুখে ভাবনার চিহ্ন।
‘কিন্তু এভাবে তো গাড়ি কোন দিন আসে না! যাই দেখি।’
বলে উইলিয়াম হাঁটতে শূরু করল।
মেজর জো স্কিনও হাঁটতে শুরু করেছে উইলিয়ামের সাথে। তার চোখে-মুখে ভাবনার চিহ্ন আরও গভীর।
উইলিয়াম বাইরের গেট পেরিয়ে বাড়ির ভেতর প্রবেশের দরজায় গিয়ে চাবি ঢুকাল তালা খুলার জন্যে দরজার কি হোলে।
কিন্তু চাবি ঘুরিয়ে দেখল দরজা খোলা। বিস্ময় ফুটে উঠল তার চোখে-মুখে। ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলে ফেলল সে।
পেছনে একবার তাকিয়ে সে দ্রুত প্রবেশ করল ভেতরে।
মেজর জো স্কিন উইলিয়ামের পেছনেই ছিল। উইলিয়ামের চোখ-মুখের বিস্ময় ও উদ্বেগ তার নজর এড়াল না। দরজা খোলা দেখে মেজর জো’র বুকও ছ্যাঁৎ করে উঠেছিল।
উইলিয়ামের সাথে সাথে মেজর জো স্কিনও দ্রুত ভেতরে ঢুকে গেল।
ভেতরে সব শূন্য।
দৌড়ে উইলিয়াম বাবুর্চিখানায় গেল, কেউ নেই। সার্ভেন্টস কোয়ার্টার দেখল, কেউ নেই। ফিরে এল আবার বাবুর্চি খানায়। হাতের প্যাকেটগুলো রেখে বাধরুমরে দিকে এগুলো। দেখল বাথরুম বন্ধ। তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, ভাবল নিশ্চয় কেউ বাথরুমে গেছে, আর অন্যরা নিশ্চয় ম্যাডামের সাথে পেছনের দিকে গেছে। কিন্তু শয়তানরা দরজা বন্ধ করেনি কেন?
কিন্তু পাক ঘরে ঢুকেই মেজর জো স্কিনের ভ্রু কুঁচকে গেল। সে বাতাসে ক্লোরোফরম গ্যাসের গন্ধ পেল। পাক ঘরের বাইরে তো এ গন্ধ পায়নি। পাক ঘরে এ গন্ধ কোত্থেকে এল!
এ ভাবনা তার মনে আসতেই সে জিজ্ঞেস করল উইলিয়ামকে, ‘তোমার একজন না হয় বাথরুমে অন্য লোকরা কোথায়?’
‘নিশ্চয় ম্যাডামের সাথে বাগানে হবে।’ বলল উইলিয়াম।
‘চল দেখি বাগানে।’
দুজন বাগানের দিকে এগুলো।
পেছন দিকে বেরুবার জন্যে একটা দরজা আছে। সে দরজা দিয়ে তারা পেছনের বাগানে প্রবেশ করল।
বাগানে কাউকেই চোখে পড়ল না।
হঠাৎ বাঁ পাশে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠল উইলিয়াম।
উইলিয়ামের দৃষ্টি অনুসরণ করে জো সেদিকে তাকাল। দেখল ম্যাডাম জিনা জেফারসনের দেহ পড়ে আছে একটা ফুল গাছের ওপাশে।
দেখার সাথে সাথে সে লাফ দিয়ে ফুলের গাছ ডিঙিয়ে গিয়ে পৌছল পড়ে থাকা দেহের কাছে।
ঝুঁকে পড়ে নাক পরীক্ষা করল জিনা জেফারসনের। দেখল বেঁচে আছে, নিঃশ্বাস বইছে।
ঝুঁকে পড়তে গিয়ে সেই ক্লোরোফরমের গন্ধ আবার পেল মেজর জো। এবার বুঝল সে সংজ্ঞাহীন করারা জন্যেই কেউ ক্লোরোফরম গ্যাস ব্যবহার করেছে।
সে আরও বুঝল, নিশ্চয়ই আরও সর্বনাশ তারা করে গেছে।
চিন্তা করতেই বুকের রক্ত যেন তার হিম হয়ে গেল।
ঝুঁকে পড়া অবস্থা থেকে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েই বাড়ির ভেতর দিকে ছুটল। ছুটতে ছুটতেই বলল, ‘ভয় নেই উইলিয়াম ম্যাডাম বেঁচে আছে। এসো মিঃ আহমদ মুসার খবর নিই।’
দুজনেই বাড়িতে ঢুকে ছুটল দোতালায় উঠার সিঁড়ির দিকে।
দৌড়ানো অবস্থায়ই উইলিয়াম বলল, ‘সিঁড়ি গিয়ে উঠেছে ড্রইংরুমে। ড্রইংরুমের ঠিক পূর্ব পাশে থাকে আহমদ মুসা। আর সিঁড়ির পশ্চিম পাশে পাশপাশি দুটি রুমে থাকে সারা জেফারসন ও জিনা জেফারসন।’
ড্রইংরুমে উঠে তারা ছুটল আহমদ মুসার ঘরের দিকে।
দুজনেই গিয়ে দাঁড়াল আহমদ মুসার খোলা দরজায়। তাদের দুজনের চারটি চোখ গিয়ে আছড়ে পড়ল আহমদ মুসার শূন্য বেডের উপর।
দরজায় গিয়ে দাঁড়াতেই সেই ক্লোরোফরম সিক্ত ভারী বাতাস এস প্রবেশ করল তাদের নাকে।
মেজর জো ঘরের চারদিকে একবার নজর বুলাল।
দেখল ঘরের সবই ঠিক আছে। শুধু বিছানার চাদরের নিচের অংশের কিছুটা বেশী ঝুলে গেছে।
‘এই আধা ঘন্টা আগে যখন বাইরে যাই, তখন তাঁকে আমি ঘুমানো দেখে গেছি। কি হলো ওঁর? কেউ কি ওঁকে….।’
কথা শেষ করতে পারল না। কথা গলায় আটকে গেল একটা উচ্ছ্বাস দমন করতে গিয়ে।
‘হ্যাঁ উইলিয়াম, ঠিকই অনুমান করেছ। সর্বনাশ হয়ে গেছে। কোন শত্রু তাঁকে কিডন্যাপ করেছে বলে মনে হচ্ছে।’
বলে মেজর জো পকেট থেকে অয়্যারলেস বের করল। খবরটা জানিয়ে দিল সে এফ বি আই অপারেশন কমান্ডার বব কার্টারকে। খবরটা দিতে গিয়ে কন্ঠ ভারী হয়ে উঠেছিল মেজর জো’র। দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার চেয়ে যে ক্ষতি হলো তার অনুভূতিই তাকে পীড়া দিচ্ছে বেশী। কিন্তু কি দোষ তার! অস্বাভাবিকতা কিছুই সে দেখেনি।
কনফেকশনারীর এমন গাড়ি তো বাড়ির দরজায় দরজায় গিয়েই থাকে। কিন্তু ঐ গাড়িই যে এত বড় কান্ড ঘটাবে, তা ভাববে কেমন করে!
টেলিফোন শেষ করেই মেজর জো বলল, ‘চল উইলিয়াম, ম্যাডামকে ভেতরে নিয়ে আসি।’
তারা দুজনে ধরাধরি করে জিনা জেফারসনকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে এল।
জিনা জেফারসনকে বিছানায় শুইয়ে মেজর জো বলল, ‘উইলিয়াম যাও গিয়ে কিচেনের পাশের বাথরুমটা খোল। নিশ্চয় ওখানে তোমাদের কিছু লোককে আটকে রেখেছে। আমি দেখি এঁর সংজ্ঞা ফেরানো যায় কিনা।’
বাড়ির অবশিষ্ট সবাইকে পাওয়া গেল সংজ্ঞাহীন অবস্থায় কিচেনের সাথের বাথরুমটিতে।
পনের মিনিট পার হয়েছে।
কারও সংজ্ঞা ফেরানো যায়নি।
এ সময় এক ঝাঁক গাড়ি পর পর এসে দাঁড়াল পটোম্যাক লজের সবুজ চত্বরে।
তিনটি পুলিশের গাড়ি। একটি জীপ এফ বি আই-এর। তাদের সামনে আরও দুটি কার। একটি এফ বি আই চীফ জর্জ আব্রাহামের। আরেকটা সারা জেফারসনের।
পটোম্যাক লজের দুঃসংবাদ যখন মেজর জো এফবিআই হেড কোয়ার্টারে দেয়, তখন সারা জেফারসন সেখানেই ছিল। খবর পেয়ে জর্জ আব্রাহামদের সাথেই চলে এসেছে।
দুই কার থেকে জর্জ আব্রাহাম ও সারা জেফারসন প্রায় এক সাথেই নামল।
নেমেই সারা জেফারসন ছুটল বাড়ির দরজার দিকে। তার পেছনে পেছনে জর্জ আব্রাহাম। জর্জ আব্রাহাম সারা জেফারসনের মত না দৌড়ালেও দ্রুত এগোল।
সারা জেফারসন বাড়িতে ঢুকেই পেল উইলিয়ামকে। গাড়ির শব্দ পেয়ে সে বাইরে আসছিল।
উইলিয়াম সারা জেফারসনকে দেখেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। কাঁদতে কাঁদতেই বলল, ‘বড় ম্যাডামকে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় পাওয়া গেছে পেছনের বাগানে। আর স্যার নেই……।’
সারা জেফারসনের মুখ মড়ার মত ফ্যাকাসে। রক্তিম ঠোঁট দুটো তার কাঁপছে বুক থেকে উঠে আসা কোন এক ঝড় চাপতে গিয়ে।
কোন কথা বলল না। দৌড়ে প্রায় টলতে টলতে সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেল সারা জেফারসন।
আহমদ মুসার ঘরের দরজায় গিয়ে মুহূর্তের জন্যে দাঁড়াল। ঘরের চারদিকটা মনে হয় দেখল সে। তারপর ছূটে গেল আহমদ মুসার বেডে।
ব্যাকুলভাবে বালিশটা তুলল। বালিশের নিচে একটা রিভলবার ঠিকঠাকভাবে পড়ে আছে। তারপর সারা জেফারসনের চোখ দুটি আছড়ে পড়ল বেডের পেছনের হ্যাংগারে। না, সেখানে বাইরে বেরুবার সব সার্ট, টি-সার্ট, কোট-প্যান্ট সবই ঠিকঠাক আছে। এমনকি তাঁর শখের কলমটি পর্যন্ত জামার পকেটে শোভা পাচ্ছে।
সারা জেফারসনের ঠোঁটের কম্পন বেড়ে গিয়েছিল। তার চোখ খোলা, কিন্তু দৃষ্টি কোথায় যেন হারিয়ে গেছে।
এ সময় ঘরে প্রবেশ করল জর্জ আব্রাহাম।
জর্জ আব্রাহাম সারা জেফারসনের বিহ্বল অবস্থা দেখে বলল, ‘স্যরি মিস জেফারসন। আমরা বোধ হয়….।’
কথা শেষ করতে পারল না জর্জ আব্রাহাম। সারা জেফারসন ‘না’ বলে চিৎকার করে উঠে বোঁটা থেকে ফল খসে পড়ার মত ঢলে পড়ল আহমদ মুসার বিছানার উপর।
ছুটে গেল জর্জ আব্রাহাম সারা জেফারসনের দিকে।
সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেছে সারা জেফারসন।
জর্জ আব্রাহামের পরপরই ঘরে প্রবেশ করল পুলিশ প্রধান বিল বেকার।
‘মিস সারা সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেছে মিঃ বিল। হুইস্কি, বিয়ার, শ্যাম্পেন যা পাও দেখ নিয়ে এস অন্য ঘর থেকে। আহমদ মুসার ঘরে তো এসব পাওয়া যাবে না।’
বিল বেকার বেরিয়ে যাচ্ছিল। ঘরে প্রবেশ করল উইলিয়াম। বলল, ‘স্যার বড় ম্যাডামের সংজ্ঞা ফিরেছে। সব শুনে উনি সাংঘাতিক কান্না শুরু করেছেন।’
‘ঠিক আছে আমরা দেখছি্ তুমি বিয়ার হুইস্কির মত কিছু নিয়ে এস পাশের ঘর থেকে। তোমার ছোট ম্যাডাম সংজ্ঞা হারিয়েছে। তার সংজ্ঞা ফিরাতে হবে। যাও।’ বলল জর্জ আব্রাহাম।
‘কিন্তু স্যার মদ জাতীয় কিছুতো পাওয়া যাবে না এ বাড়িতে।’ বলল উইলিয়াম।
‘কেন?’
‘স্যার এ বাড়িতে কেউ মদ খায় না। ছোট ম্যাডাম নন, বড় ম্যাডাম নন। আমরাও কেউ খাই না।’
‘কি বলছ তুমি?’
‘ঠিকই বলছি স্যার। স্যার মদ খেতেন না। তাই অন্য সবাইও মদ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন।’
‘বুঝলাম। তুমি ঠিকই বলেছ। যাও রেফ্রিজারেটর থেকে ঠান্ডা পানি নিয়ে এস।’ বলল জর্জ আব্রাহাম।
উইলিয়াম ছুটল পানি আনার জন্যে।
‘আহমদ মুসা সম্পর্কে যে সব অবাক করা কথা শুনেছি, তাহলে সব সত্যি। মাত্র কয়েক দিনের সান্নিধ্যে যদি জেফারসন পরিবার মদ ছাড়তে পারে, তাহলে ইস্টের মানুষ তার যাদু স্পর্শে অনেক কিছূই করতে পারে।’ বলল বিল বেকার।
‘আহমদ মুসার যাদু তার চরিত্র। তার চরিত্রে এমন একটা শক্তি আছে যা অতিশক্ত মানুষকেও নরম করে দিতে পারে। স্বীকার করতে লজ্জা নেই বিল, সে মদ খায় না বলে তার উপস্থিতিতে কোন মদের পাত্র আশে-পাশে থাকলেও আমার লজ্জাবোধ হয়।’ জর্জ আব্রাহাম বলল।
উইলিয়াম পানি নিয়ে ফিরে এল।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই জ্ঞান ফিরে পেল সারা জেফারসন। উঠে বসতে বসতে বলল, ‘স্যরি।’
তারপর তোয়ালে দিয়ে চোক মুখ মুছে বিছানায় পড়ে থাকা রুমালটা মাথায় দিয়ে বলল, ‘স্যরি। এমন ঘটনার জন্যে কোন ভাবেই প্রস্তুত ছিলাম না।ও আমার সাথে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু আমি নিষেধ করেছিলাম। চেয়েছিলাম গত রাতের বড় একটা ধকলের পর ও একটু রেস্টে থাক। তখন কি জানতাম এমন কিছু ঘটবে।’ বলতে বলতে কেঁদে ফেলল সারা জেফারসন।
কাঁদতে কাঁদতেই বলল, ‘এখনই কিছু করতে হবে। তাঁকে উদ্ধার করতে হবে বর্বর, পাষান্ড, খুনীদের হাত থেকে।’
বলে সারা জেফারসন তার মোবাইল বের করল।
জর্জ আব্রাহাম জনসন ও পুলিশ প্রধানের দিকে মুখ তুলে ‘এক্সকিউজ মি স্যার’ বলে মোবাইলে একটা কল করল। ওপার থেকে সাড়া পাওয়ায় বলল, ‘হ্যাঁ আমি সারা জেফারসন। গুড মর্নিং বেঞ্জামিন। কিন্তু আমাদের সবার জন্যে খারাপ খবর, আজ সকাল সাড়ে ৮টায় আহমদ মুসা তার কক্ষে ঘুমন্ত অবস্থায় কিডন্যাপ হয়েছেন। তুমি সবাইকে জানিয়ে দাও। কাজে নেমে পড়। এটাই এখন আমাদের একমাত্র কাজ।’
আরও কয়েকটি কথা বলে টেলিফোন রেখে দিয়ে সারা জেফারসন বলল, ‘স্যারি মিঃ জর্জ আব্রাহাম, মিঃ বিল বেকার। টেলিফোনটা আমার জন্যে খুব জরুরী ছিল। বলুন, আপনারা কি ভাবছেন?’
‘না মিস জেফারসন, টেলিফোনটা শুধু আপনার জন্যে নয়, আমাদের জন্যেও জরুরী। সবাই একসাথে এগুতে হবে।’ বলে একটু থামল আব্রাহাম জনসন। পরক্ষনেই আবার বলে উঠল, ‘আমাদের প্রথম ভাবনা হলো আহমদ মুসাকে কিভাবে কিডন্যাপ করা হয়েছে। আলামত থেকে পরিষ্কার আপনি যেটা বলেছেন ঘুমন্ত অবস্থায় ক্লোরোফরম গ্যাস স্প্রে করে তাকে সংজ্ঞাহীন করে ফেলা হয়। তারপর তাকে কনফেকশনারীর ভ্যানে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিডন্যাপকারী মূল বাহিনী প্রবেশ করে বাড়ির পেছন দিক দিয়ে। আপনার মাকে ঐ স্প্রে করেই সংজ্ঞাহীন করে। আমাদের দ্বিতীয় ভাবনা হলেঅ কারা একাজ করেছে। আপনার আম্মা ও কিচেন ক্রুরা কিডন্যাপকারীদের যাদের দেখেছে, তারা সবাই মুখোশ পরা ছিল। মেজর জো স্কিন কনফেকশনারীর গাড়ির ড্রাইভারকে দেখেছে, লম্বা লাল মুখ। নিশ্চিত ওটা ইহুদী চেহারা। তবে দেখার কথা বাদ দিয়ে চোখ বন্ধ করেই বলা যায়, এই ঘটনা জেনারেল শ্যারনের লোকরা ঘটিয়েছে।’
‘প্রেসিডেন্ট কি এই খবর পেয়েছেণ?’ জিজ্ঞেস করল সারা জেফারসন।
‘আপনাকে বলা হয়নি, গাড়িতে বসেই আমি প্রেসিডেন্টকে ঘটনা জানিয়েছি। প্রেসিডেন্ট খুবই শক পেয়েছেন। তিনি জেনারেল শ্যারনদের গ্রেফতার ও আহমদ মুসাকে উদ্ধারের সর্বাত্মক উদ্যাগের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটনকে বলে দেবেন সশস্ত্র বাহিনী এবং তাদের গোয়েন্দা বিভাগও এই কাজে আমাদের সাহায্য করবে।’
‘এখন আমাদের কি করণীয়? ওদের সব রাগের কেন্দ্র বিন্দু আহমদ মুসা। আমার ভয় হচ্ছে, প্রতিহিংসা পাগল হয়ে ওরা…।’
কথা শেষ করতে পারল না সারা জেফারসন। কান্নায় রুদ্ধ হয়ে গেল তার গলা।
‘না মিস জেফারসন আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, আপনি যা আশংকা করছেন তেমন কিছু ঘটবে না। এর কনসিকুয়েন্স কি জেনারেল শ্যারনরা নিশ্চয় উপলব্ধি করে।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
সারা জেফারসন চোখ মুছে বলল, ‘জানেন গতকাল রাতের অভিযান থেকে ফিরে যখন বললাম, মাথাটা এবার হাল্কা হলো। তখন উনি বলেছিলেন, ওরা এখন ক্ষ্যাপা কুকুরের মত। আগামী কয়েকদিন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভাগ্যের পরিহাস যিনি জানতেন ওরা হবে ক্ষ্যাপা কুকুরের মত, সেই তিনিই সেই ক্ষ্যাপা কুকুরদের হাতে….।’ সারা জেফারসনের কথা আবার কান্নায় আটকে গেল।
জর্জ আব্রাহাম ও বিল বেকারের মুখও ম্লান হয়ে গেছে। আহমদ মুসার উক্তি ও সারা জেফারসনের আশংকার প্রতিটি বর্ণ সত্য। সারা জেফারসনের এভাবে ভেঙে পড়াও যে খুবই স্বাভাবিক তাও তারা উপলব্ধি করে। তবু জর্জ আব্রাহাম সান্ত্বনার সুরে বলল, ‘মিস জেফারসন, আহমদ মুসা নেই। আপনাকে শক্ত হতে হবে। আপনার উপর অনেক দায়িত্ব। ‘ফ্রি আমেরিকা’র ইপর আমাদের অনেক নির্ভরতা।’
‘স্যরি আংকল। আমার এভাবে কাঁদা ঠিক নয়।কিন্তু আহমদ মুসা নেই, সে জেনারেল শ্যারনদের মত খুনী শত্রুদের হাতে, এ কথা ভাবলেই মনকে আর ধরে রাখতে পারছি না। যদি …. যদি তার কিছু হয়ে যায়।’
আবারও কান্নায় জড়িয়ে গেল সারা জেফারসনের শেষের কথাগুলো।
‘এমনটা ভাবা খুবই স্বাভাবিক। তবে আমি বলছি, তেমন কিছু ঘটা খূব সহজ নয়। আর আহমদ মুসাও সাধারন কেউ নন। খারাপ না ভেবে ভালটা ভাবুন। আহমদ মুসা ওদের হজম হবার মত কোন বন্দী নন।’ বললজর্জ আব্রাহাম।
বলে একটু থেমেই আবার বলল, ‘চলুন মিস জেফারসন, বাইরে যাই। কিছু কাজ, কিছু কথা এখনও বাকি আছে। চলুন পুলিশ কতদুর কি করল দেখি।’
বলে উঠে দাঁড়াল জর্জ আব্রাহাম।
বিল বেকারও উঠল।
উঠল সারা জেফারসনও।
পুলিশ ও গোয়েন্দাদের একটা দলকে পটোম্যাক লজের সার্বক্ষনিক পাহারায় বসিয়ে জর্জ আব্রাহাম ও বিল বেকার পটোম্যাক লজ থেকে যখন বের হলো, তখন ২ ঘন্টা পেরিয়ে গেছে।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে জর্জ আব্রাহাম ও বিল বেকার পাশাপাশি হাঁটছিল।
‘সত্যি মিস জেফারসন একবোরেই ভেঙে পড়েছেন।’ বলল জর্জ আব্রাহাম।
‘এটা কি সহযোদ্ধার প্রতি আন্তরিকতা বশত না এখানে হৃদয়ের কোন ব্যাপার আছে?’ বলল বিল বেকার।
‘দুজনে সোনায় সোহাগা। হৃদয় ঘটিত কিছূ থাকাটাই স্বাভাবিক, না থাকাটা অস্বাভাবিক।’ জর্জ আব্রাহাম বলল।
‘তাহলে কিন্তু মহাব্যাপার হবে। বাঘের ঘরে একদম ঘোঘের বাসা।’ বলল বিল বেকার।
‘আহমদ মুসা ঘোঘ নয় মিঃ বিল। সেও বাঘ। বাঘের সাথে বাঘের মিলন।’
‘মিলন নয়, বলুন মহামিলন। একেবারে দুই সভ্যতার মিলন।’
দুজন গাড়ির কাছে এসে হিয়েছিল।
বিল বেকার নিজের গাড়ির দিকে এগুতে এগুতে বলল, ‘তাহলে এই মুহূর্তে আমরা কি করতে যাচ্ছি?’
জর্জ আব্রাহাম নিজের গাড়ির দরজা খোলার জন্যে হাত বাড়িয়েছিল। একটু থমকে গিয়ে মুখটা ঘুরিয়ে বলল, ‘অল্পক্ষনের মধ্যেই প্রাথমিক রিপোর্ট আমরা পেয়ে যাব। কিডন্যাপকারী কনফেকশনারী ভ্যানটি কোথায়, জেনারেল শ্যারন ও ডেভিড জোনসকে তাদের বাড়িতে পাওয়া গেল কিনা, ওয়াশিংটন শহরের প্রকাশ্য ও গোপন ইহুদী কেন্দ্র ও প্রতিষ্ঠানের সার্চ রিপোর্ট অল্পক্ষনের মধ্যেই পেয়ে যাব। আহমদ মুসাকে বন্দী করে রাখতে পারে, ওয়াশিংটন শহর উপকন্ঠের সম্ভাব্য এমন স্থানগুলোর একটা রিপোর্ট খুব সত্ত্বর আশা করছি। গোটা দেশ থেকেও এ ধরনের রিপোর্ট অল্পক্ষনের মধ্যেই আসা শুরু করবে বলে মনে করছি্ এসব হাতে আসার পর ভবিষ্যত কর্মপন্থা ঠিক করা যাবে।’
‘ঠিক আছে। আমি আপনার কলের অপেক্ষা করব। আর আমি কিছু জানতে পারলে সংগে সংগেই আপনাকে জানাব। গোটা দেশেই পুলিশ কাজে লেগে গেছে।’ বলে বিল বেকার গাড়িতে উঠে গেল।
জর্জ আব্রাহাম গাড়িতে ঢুকে তার ড্রাইভিং সিটে আসন নিয়েছে।
দুই গাড়িই পটোম্যাক লজ থেকে বেরিয়ে ছুটতে আরম্ভ করল।
এস এস সেন বলছিল, ‘সব রকম সহযোগিতা আমরা করব, কিন্তু একটাই শর্ত ব্যাপারটা গোপন রাখতে হবে।’
‘অবশ্যই গোপন রাখব। আমাদের স্বার্থেই গোপন রাখব। একটা মহাদুঃসময়ে আপনাদের আশ্রয় পেয়েছি। জানেন আহমদ মুসাকে কিডন্যাপ করে ফেরার পথে টেলিফোনে হোয়াইট হাউজ থেকে ইভা ব্রাউন জানাল যে, আমাকে ও ডেভিড উইলিয়াম জোনসকে গ্রেফতারের নির্দেশ প্রেসিডেন্ট দিয়েছেন। শুনে আকাশ থেকে পড়লাম। চারদিকে অন্ধকার দেখলাম। একদিকে আমাদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা, অন্যদিকে এর চেয়েও বড় প্রশ্ন দাঁড়াল আহমদ মুসাকে কোথায় রাখব। প্রেসিডেন্টের ঐ আদেশ থেকে বুঝেছিলাম, ইহুদীদের কোন বাড়ি, কোন সিনাগগ কিংবা ইহুদীদের কোন প্রতিষ্ঠানই আর নিরাপদ নয়। সরকারী পুলিশ ও গোয়েন্দারা সবটার উপর নজর রাখবে। এই অবস্থায় প্রথমেই আপনার কথা মনে পড়ল। সংগে সংগে গাড়ি ঘুরিয়ে আপনার এখানে চলে এলাম। আপনি আমাদের স্বাগত জানিয়েছেন। আমরা কৃতজ্ঞ। আপ…….।’
জেনারেল শ্যারনকে কথা শেষ করতে না দিয়েই এস এস সেন বলে উঠল, ‘জেনারেল এত বিনয়ী হওয়ার দরকার নেই। এ সাহায্যের পেছনে আমাদেরও স্বার্থ আছে। আহমদ মুসারা যেমন আপনাদের জানের শত্রু, তেমনি তারা আমাদের প্রানের শত্রু। আমাদের ভারতকে কম জ্বালায়নি ওরা। এখনও কম জ্বালাচ্ছে না। আমাদের মাতৃসম ভারতকে তিন টুকরো করেছে। সেই জ্বালায় আমরা তড়পাচ্ছি। আমাদের অসহনীয় জ্বালা থামবে না যতদিন না ঐ দুটো রাষ্ট্রকে আমরা হজম করতে পারছি। আহমদ মুসারা আমাদের লক্ষ্য অর্ঝনের পথে প্রধান বাধা। আমরা চাচ্ছি আধুনিকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতার আবরনে ঐ দুই রাষ্ট্র থেকে মুসলমানদের মুসলিম পরিচয় ভুলিয়ে দিতে। আর আহমদ মুসারা এই মুসলিম পরিচয়কে আরও শাণিত করছে। তার উপর আহমদ মুসারা এসেছে আমেরিকায়। এরা এখানে সুবিধা পাওয়ার অর্থ আমাদের সর্বনাশ হওয়া। সুতরাং আপনাদের মত আমরাও আহমদ মুসাদের বিনাশ চাই।’
এস এস সেন এর পুরো নাম। শিব সংকর সেন। তার বাপ ছিল ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর একজন ডাকসাইটে অফিসার। শিব সংকর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কম্পিউটার পড়তে এসে এখানেই থেকে যায়। সে একজন প্রতিভাবান কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। দেশ প্রেমিক শঙকর চায়নি আমিরিকায় সেটলড হতে। কিন্তু তার বাবা শিব দাশ সেন তাকে বুঝিয়েছে, হিন্দুস্তানের স্বার্থেই তার স্থায়ীভাবে আমেরিকায় বাস করা প্রয়োজন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আগামী দিনের এক বিশ্ব। এ বিশ্বে আমরা ভাগ বসাতে চাই, এ বিশ্বকে আমাদের হিন্দুস্তানের স্বার্থে পেতে চাই। তা পেতে হলে মিভ শংকরদের মত হিন্দুস্তানগত প্রাণ ছেলেদের আমেরিকায় থেকে যাওয়া প্রয়োজন। পিতার এই কথায় সে সানন্দেই রাজী হয়েছে। ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করার পর সে চাকরী নেয় বিখ্যাত আই বি এম কোম্পানীতে। এখন সে নিজেই বড় একটি কোম্পানীর মালিক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মোট সফটওয়্যার বিজনেসের প্রায় ২০ ভাগ তার পকেটে আসে। আমেরিকার অর্থনৈতিক ভাগ্যের চাকা যাদের হাতে তার মধ্যে সেও একজন। সে মনে করে তার বিত্ত-বৈভব তার হিন্দুস্তানের জন্যে।
তার সবচেয়ে বড় তৃপ্তি হলো, আমেরিকান সফটওয়্যার টেকনলজি সে পাচার করতে পেরেছে তার হিন্দুস্তানে। হিন্দুস্তানের হায়দারাবাদ সফটওয়্যার টেকনলজিতে এখন এক মিনি আমেরিকা।
শিব সংকরের এই বাড়িটি পেন্টাগনের ঠিক অপজিটে পটোম্যাক নদীর উত্তর তীরে। চার বিঘা জমির উপর বিশাল বাড়ি। বাড়ির চারদিকটা কৃত্রিম লেক আর বাগানে সজ্জিত।
বাড়িটা চারতলা। মাটির নিচে আরও দুটি ফ্লোর। পারমানবিক যুদ্ধের আশংকা সামনে রেখেই এ ফ্লোর দুটি তৈরী। মাটির তলায় সর্বশেষ ফ্লোর থেকে পটোম্যাক নদীতে বের হওয়ার একটা আধুনিক সুড়ঙ্গ পথও রয়েছে। যুদ্ধ শুরু হলে মাটির মাটির সারফেসের পথ কোন কারনে বন্ধ হয়ে গেলে সুড়ঙ্গটি পালাবার বিকল্প পথ।
পরিবার নিয়ে শিব শংকর এ বাড়িতেই বাস করে। আহমদ মুসা এই বাড়িরই ভূগর্ভস্থ শেষ তলার বাম পাশের একটি ঘরে বন্দী।
শিব শংকরের কথা শুনে জেনারেল শ্যারন ও ডেভিড জোনসের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
‘আপনাকে ধন্যবাদ মিঃ সেন। আমাদের একেবারে নিশ্চিন্ত করলেন। দেখা যাচ্ছে আমরা ও আপনারা একই লক্ষ্যে আমেরিকায় কাজ করছি। আপনাদের লক্ষ্য হিন্দুস্তান, আর আমাদের লক্ষ্য প্রোমিজড ল্যান্ড ইসরাইল। আর আমাদের সাধারন শত্রুও এক। আসুন আমরা এই শত্রুর বিরুদ্ধে এক সাথে লড়াই করি।’ বলল ডেভিড উইলিয়াম জোনস। আবেগে ভারী ছিল তার কন্ঠ।
‘লড়াই তো শুরু করেছি মিঃ জোনস। কিন্তু এটাতো লুজিং ব্যাটল। লস আলামোসের সুড়ঙ্গটা যে গোয়েন্দা সুড়ঙ্গ, তদন্ত টীমের সদস্যদের হত্যার জন্যে লস আলামোসের পথে আপনারাই যে সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছিলেন এবং একই লক্ষ্যে এফ বি আই বিমানে বোমা পেতে তা ধ্বংস করেছেন, তা তো প্রমাণ হয়েই গেছে।’ বলল শিব শংকর সেন।
‘হ্যাঁ। এগুলো সব শয়তান আহমদ মুসার কাজ।’
‘কিন্তু আজকের নিউজ আরও মারাত্মক। জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনের হত্যাকারী হিসাবে আপনাদের দুজনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। মিঃ হ্যামিল্টনের পকেটে পাওয়া একটা টেপ থেকে হত্যাকান্ডের গোটা বিবরণ নাকি তারা পেয়ে গেছে। দ্বিতীয়ত সিনেটর ময়নিহানের ছেলে হ্যারিকে কিডন্যাপের কিডন্যাপ নাকি আপনারাই করেছিলেন। হ্যারি এবং আপনাদের যারা ধরা পড়েছে, তাদের জবানবন্দী ছেপেছে পত্রিকাগুলো।’ বলল আবার শিব শংকর সেন।
‘ভাগ্য আমাদের বিরুদ্ধে গেছে মিঃ সেন। এক আহমদ মুসা এসে আমেরিকায় আমাদের সাজানো সংসারকে লন্ড-ভন্ড করে দিল।’ ডেভিড উইলিয়াম জোনস বলল।
‘আহমদ মুসাকে ধরে রেখে কি পেতে চান আপনারা? যা করার তার সবকিছুই সে করে ফেলেছে। কি লাভ হয়েছে এখন তাকে ধরে?’ বলল এস এস সেন।
‘আপনি ঠিকই বলেছেন। তাকে ধরে আমেরিকায় কোন লাভ আমরা করতে পারবো না। কিন্তু আমরা একটা প্রতিশোধ তো নিতে পারলাম! আমরা দুর্বল হয়ে পড়িনি তাও বোঝানো গেল।’ বলল জেনারেল শ্যারন।
‘কিন্তু এর মূল্যটা অনেক বড় দিতে হবে। তাকে ধরে মার্কিন সরকারকেই একটা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়া হয়েছে। এ চ্যালেঞ্জ অবশ্যই মার্কিন সরকার গ্রহন করবে। তার ফলে আপনাদের মুভমেন্ট এবং আহমদ মুসাকে বাইরে কোথাও সরিয়ে নেয়া কঠিন হয়ে দাঁড়াতে পারে।’
‘কিন্তু যে কোন মূল্যের চেয়ে আহমদ মুসা আমাদের কাছে মূল্যবান। তাকে নিয়ে আমেরিকার হয়তো দর কষাকষির কিছু নেই বটে, কিন্তু এশিয়ায় আছে। তাকে হত্যা করলে আমাদের জাতি যেন একটা স্থায়ী বিপদ থেকে মুক্ত হতে পারে, তেমনি তাকে হত্যা না করার শর্তে এশিয়া ও আফ্রিকার মুসলিম দেশগুলোর কাছ থেকে বড় বড় স্বার্থ আদায় হতে পারে। এমনকি ফিলিস্তিন উপকূলে ‘গুড হোপ’ দ্বীপে ইসরাইল রাষ্ট্রের নতুন যে প্রতিষ্ঠা হয়েছে তার প্রতিও স্বীকৃতি আমরা আদায় করতে পারি। তা পারা সম্ভব হলে ফিলিস্তিনের উপরও গিয়ে ইসরাইল রাষ্ট্রের পরোক্ষ অধিকার বর্তাবে।’ বলল জেনারেল শ্যারন।
‘কিন্তু সেটা করতে হলে তো আহমদ মুসাকে আমেরিকার বাইরে নেয়া চাই।’ বলল এস এস সেন।
‘আহমদ মুসাকে যদি কোন রকমে ইসরাইল দুতাবাসে নেয়া যায়, তাহলে সহজেই বাইরে পাচার করা যাবে।’ ডেভিড উইলিয়াম জোনস বলে উঠল।
‘খবরদার, এখন তাকে ইসরাইল দুতাবাসে নেয়ার নামও করবেন না। যে জায়গাগুলোতে সরকার এখন সার্বক্ষনিক চোখ রেখেছে, তার মধ্যে অবশ্যই শীর্ষে আছে ইসরাইল দুতাবাস। তাদের নজর এড়িয়ে এখন সেখানে একটা সুঁচও পাচার করতে পারবেন না।’ বলল এস এস সেন।
‘ধন্যবাদ। আমরা সেটা আঁচ করেছি বলেই সেদিকে না গিয়ে আপনার আশ্রয়ে এসেছি।’
‘আপনাদের সেবা করার এটুকু সুযোগ দেয়ার জন্যে ধন্যবাদ।’
বলে একটু থেমে একটু চিন্তা করে এস এস সেন পুনরায় বলে উঠল, অবশ্য আমি অনেকটা একক সিদ্ধান্তেই এটা করেছি। আমাদের কম্যুনিটি ফোরামে একটা ফরমাল সিদ্ধান্ত এ ব্যাপারে হওয়া দরকার।’
‘কেউ কি আপত্তি করতে পারে বলে মনে করেন?’ জিজ্ঞেস করল উইলিয়াম জোনস।
‘সে রকম সম্ভাবনা নেই। আপনাদের সাথে আমাদের ভারতের সম্পর্কতো আজকের নয়, সেই আদিকালের। ভারত নানা ভাবে কৃতজ্ঞ আপনাদের কাছে। ভারতের আজকের যে পারমানবিক শক্তি, কনভেশনাল অস্ত্র তৈরীতে যে উন্নতি, তার ভিত্তিতো আপনারাই গড়ে দিয়েছেন। আপনাদের সহযোগিতা না পেলে বহু আগেই আমাদের কাশ্মীর থেকে পাততাড়ি গুটাতে হতো। আমাদের কম্যুনিটির কেউই এসব কথা তুলতে পারে না। তাছাড়া ইতিমধ্যেই আমি অনেকের সাথে আলোচনা করেছি। তারা সকলেই সোৎসাহে এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। সুতরাং চিন্তার কিছু নেই।’
‘ধন্যবাদ মিঃ সেন।’ বলল ডেভিড উইলিয়াম জোনস।
‘আরেকটা কথা মিঃ জোনস, আপনারা আহমদ মুসাকে কিডন্যাপ করেছেন, এটা কি আপনারা কাউকে বলেছেন বা এ সম্পর্কে কোন ঘোষনা দিয়েছেন?’ জিজ্ঞেস করল এস এস সেন।
‘মাথা খারাপ! আমরা স্বীকার করতে যাব কেন? বরং আমরা আমাদের মিডিয়াকে বলে দিয়েছি, আমরা আমাদের সন্দেহ করার প্রতিবাদ করছি, এটা যেন তারা জানিয়ে দেয়। তাছাড়া তারা যেন এ রকম স্টোরী করে যে, আহমদ মুসা ইহুদী বিরোধী তার স্বার্থ হাসিল করারা পর নিজের ইচ্ছাতেই আত্মগোপন করেছে। এটা তার পুরনো অভ্যাস। যে জায়গাতেই তার মিশন শেষ হয়ে যায়, সেখান থেকে সে এভাবেই সরে পড়ে।’ বলল জেনারেল শ্যারন।
‘ব্রাভো! ব্রাভো! অনেক ধন্যবাদ আপনাদের। তারা বিশ্বাস করবে না একথা ঠিক। কিন্তু আপনাদেরও নির্দোষ দাবী করার একটা পথ হলো এর ফলে। জনগনের অন্তত একটা অংশকে বুঝ দেয়ার মত একটা কথা পাওয়া গেল।’ এস এস সেন বলল।
কথা শেষ করেই উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে এস এস সেন বলল, ‘এখনকার মত উঠি।’
‘অবশ্যই। অনেক সময় দিয়েছেন। অশেষ ধন্যবাদ।’
বাইরের ড্রইং রুম থেকে বেরিয়ে গেল এস এস সেন।
লিফটটি বেজমেন্ট লাইব্রেরীর প্রায় দরজায় এসে দাঁড়ায়।
শশাংক সেন ও সাগরিকা সেন লিফট থেকে লাইব্রেরীর দরজায় নামল।
শশাংক সেন শিব শংকর সেনের একমাত্র ছেলে এবং সাগরিকা সেন তার একমাত্র মেয়ে।
দুই ভাইবোনের মধ্যে সাগরিকা সেন বড় এবং শশাংক সেন বয়সে ছোট।
দুজনেই ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সিটির ছাত্র। একজন ইতিহাস ও একজন কম্পিউটার বিজ্ঞানের ছাত্র।
সাগরিকা সেন ইতিহাস এবং শশাংক সেন কম্পিউটার বিজ্ঞানে পড়ে।
মাঝে মাঝেই বেজমেন্টের লাইব্রেরীতে তাদের আসতে হয়।
বাড়ির আন্ডারগ্রাউন্ড দুটি ফ্লোর বাড়ির উপরের অংশের একদম বিকল্প হিসাবে গড়ে তোলা হয়। বোমায় যদি বাড়ির উপরের অংশ সম্পুর্ন উড়ে যায় তাহলেও প্রাত্যহিক জীবন পরিচালনার সবকিছু সহ আন্ডার গ্রাউন্ড ফ্লোর দুটি অবশিষ্ট থাকবে।
আন্ডার গ্রাউন্ড দুটি ফ্লোরের উপরেরটি স্টোর, কিচেন, অফিস ইত্যাদি। আর নিচের ফ্লোরটি শয়ন, লাইব্রেরী, ড্রইং এবং পারমানবিক ধ্বংসযজ্ঞ সময়ের জন্যে বিশেষভাবে তৈরী আশ্রয় কেন্দ্র নিয়ে গঠিত।
দুর্লভ ও দুষ্প্রাপ্য ধরনের বই পুস্তক, ডকুমেন্ট রাখা হয়েছে আন্ডার গ্রাউন্ড ফ্লোরের লাইব্রেরীতে। এসব বই ও ডকুমেন্টের খোঁজেই তার প্রায়ই আসতে হয় আন্ডার গ্রাউন্ড ফ্লোরের লাইব্রেরীতে।
সাগরিকা সেন ও শশাংক সেন দুই ভাই বোন আজ দুষ্প্রাপ্য সেই বইয়ের খোঁজেই আন্ডার গ্রাউন্ড লাইব্রেরীতে এসেছে।
লাইব্রেরীর দরজা খুলতে খুলতে সাগরিকা সেন বলল, ‘মনটা আজ ভাল লাগছে না। মনে হচ্ছে মাথায় যেন অশ্বস্তিকর বোঝারএকটা চাপ। বাবা কেন বাড়তি বোঝা মাথা পেতে নেন।’
‘তুমি কিসের কথা বলছ দিদি, বুঝলাম না আমি?’ বলল শশাংক সেন।
‘ভুলে গেলে কেমন করে এরই মধ্যে। বাবা একজন বন্দীকে এন রেখেছেন না বেজমেন্টের এই ফ্লোরে!’ সাগরিকা বলল।
‘না ভুলিনি। এখন বুঝতে পেরেছি।’
বলে একটু থেমেই আবার বলল শশাংক সেন, ‘সত্যিই বলেছ দিদি, আমার মনে হচ্ছে কি জান? মনে হচ্ছে এই ফ্লোরটা যেন এখন আর আমাদের নয়। কেমন একটা পর পর লাগছে।’
‘ঠিক বলেছ শশাংক, এই অনুভূতিটা আমারও।’ বলল সাগরিকা সেন।
‘আসলে ঘটনাটা কি দিদি? কে এই বন্দী? কেন বন্দী? এবং আমাদের এখানে কেন?’
‘মা বলতে চাচ্ছেন না। তবে মার সাথে বাবার কথা বার্তা আড়াল থেকে যতটুকু শুনেছি এবং মা দু একটা কথা যা বলেছেন, তাতে বুঝেছি বন্দীটি ডেভিড জোনস আংকেলদের। ওদের অসুবিধার কারনে বাবা সাময়িক আশ্রয় দিয়েছেন মাত্র।’
‘ডেভিড জোনস আংকেল মানে এ বন্দী তাহলে ইহুদীদের।’ বিস্ময় জড়িত কন্ঠে বলল শশাংক সেন।
একটু থেমে ঢোক গিলে আবার কথা বলে উঠল শশাংক সেন। বলল, ‘তুমি গত কয়েকদিনের নিউজ লক্ষ্য করেছ দিদি?’
‘কোন নিউজের কথা বলছ?’ বলল সাগরিকা সেন।
‘ঐ যে আহমদ মুসার উপর ষড়যন্ত্রের ব্লেম দিয়ে খবর বেরুল। খবরটা যদিও ছিল পত্রিকাগুলোর এক্সক্লুসিভ আইটেম, তবুও বোঝা গেছে খবরটার সরবরাহকারী ছিল ইহুদীরা। একদিন পর এই খবরের প্রতিবাদ বের হলো। দারুন চাঞ্চল্যকর। তাতে লস আলামোসের গোয়েন্দা সুড়ঙ্গসহ সবুকছুর জন্যে দায়ী করা হলো ইহুদী গোয়েন্দা সংস্থার ষড়যন্ত্রকে। খবরটা সাংঘাতিক হৈ চৈ এর সৃষ্টি করেছে।’
‘আরও তো দারুন খবর বের হয়েছে কাল।’ বলল সাগরিকা সেন।
‘কোন খবরটার কথা বলছ দিদি?’ জিজ্ঞেস করল শশাংক সেন।
‘কেন জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন খুন হওয়ার কথা।’ বলল সাগরিকা সেন।
‘ও পড়েছি, পড়েছি। ও খুনের জন্যেও তো সরাসরি দায়ী করা হয়েছে ডেভিড জোনস আংকেল ও জেনারেল শ্যারন নামে ইহুদী গোয়েন্দা সংস্থার একজনকে।’ শশাংক সেন বলল।
‘তাহলে তো দেখা যাচ্ছে, ইহুদী গোয়েন্দা সংস্থা মানে ইহুদীরা অনেকগুলো ষড়যন্ত্রের ফাঁদে জড়িয়ে পড়ল। আচ্ছা শশাংক, বিজ্ঞানী জন জ্যাকবের ব্যাপারটা কি? তুমি দ্বিতীয় দিনে প্রতিবাদমূলক যে নিউজের কথা বললে তাতে তো হাটে হাঁড়ি ভেঙে দেয়া হয়েছে। গোয়েন্দা সুড়ঙ্গ তৈরী করেছে ইহুদী বিজ্ঞানী জন জ্যাকব এবং তিনি লস আলামোস থেকে গবেষণা তথ্য অব্যাহতভাবে পাচারও করেছেন ঐ গোয়েন্দা সুড়ঙ্গ দিয়ে। এ ঘটনা সত্য হলে তো তা বিড়াট ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে।’ বলল সাগরিকা সেন।
‘বিরাট ব্যাপারই তো! বিজ্ঞানী জন জ্যাকবের মত লোক যদি ইহুদী স্বার্থের পক্ষে গোয়েন্দাগিরি করে থাকে, তাহলে কোন ইহুদীকে আর বিশ্বাস করা যাবে? এ প্রশ্ন কোন আমেরিকানই এড়িয়ে যেতে পারবে না।’ শশাংক সেন বলল।
লাইব্রেরীর একটা ডেস্কের চেয়ারে বসতে বসতে সাগরিকা সেন বলল, ‘নিউজে যেসব প্রমাণের কথা তুলে ধরেছে তা অকাট্য। আমি বুঝতে পারছি না হঠাৎ করে এমন সেনসিটিভ নিউজ এভাবে পত্রিকায় এল কেন? তাও আবার সরকারী সুত্রে নয়। ‘ফ্রি আমেরিকা’ ও ‘হোয়াইট ঈগলে’র মত সংগঠন এসব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে, সরকার নয় কেন?’
‘দিদি, প্রথম দিনের নিউজে মনে হয় এর উত্তর আছে। প্রথম দিনের নিউজে ইহুদীদেরকে ব্লেম দেয়া, ইহুদীদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করারা জন্যে আহমদ মুসার সাথে ‘ফ্রি আমেরিকা’ ও ‘হোয়াইট ঈগল’কে দায়ী করা হয়েছিল। এমনকি বলা হয়েছিল, আহমদ মুসার অর্থের লোভে এ দুই সংগঠন আহমদ মুসার দিকে চলে গেছে। আরও বলা হয়েছিল, মৌলবাদী আহমদ মুসা সরকারের উপরও ভর করেছে। এতেই সম্ভবত ক্ষিপ্ত হয়ে ‘ফ্রি আমেরিকা’ ও ‘হোয়াইট ঈগল’ একবারে হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিয়েছে।’ বলল শশাংক সেন।
শশাংক ও সাগরিকা মুখোমুখি বসেছে।
‘ফ্রি আমেরিকা’ খুব পপুলার সংগঠন। সবাই জানে, প্যাট্রিওটদের এ সংগঠনটি দেশের স্বার্থ ছাড়া অন্য কোন স্বার্থে কাজ করে না। ‘হোয়াইট ঈগল’ও আগে বর্ণবাদী সংগঠন ছিল, এখন তা আর নেই। এদের ছোবল দেয়া ইহুদীদের ঠিক হয়নি।’ বলল সাগরিকা সেন।
‘ঠিকই হয়েছে দিদি। সত্য প্রকাশের একটা পথ হয়েছে। ওদের ছোবল না দিলে ইহুদীদের এ ষড়যন্ত্রের কথা এভাবে জনসমক্ষে আসতো না।’ শশাংক সেন বলল।
‘এভাবে ‘ইহুদীদের’ বলে সব ইহুদীদের এক সাথে শামিল করা ঠিক নয়।’ বলল সাগরিকা সেন।
‘ঠিক দিদি। দেশের মেজরিটি ইহুদী এ ষড়যন্ত্রে সাথে নেই। কিন্তু বাস্তবতা হলো বদনামটা তাদেরকেও স্পর্শ করবে। নির্দোষ হয়েও অনেকে দুর্ভাগ্যের শিকার হবে।’
‘অন্যের কথা না ভেবে, আমাদের নিজেদের কথাটাই ভাব না শশাংক। খুনের দায়ে অভিযুক্ত সেই মিঃ ডেভিড জোনসই আামাদের বাড়িতে এন্ট্রান্স পেয়ে গেল।’
‘না সে তো পায়নি।’
‘একই কথা। তার বন্দীকে আশ্রয় দেয়ার অর্থ কি? অর্থ কি এটা নয় যে আমরা মিঃ ডেভিড জোনসের পক্ষ নিলাম?’
‘ঠিক বলেছ দিদি। ড্যাডি এটা কোন বিবেচনায় করলেন বুঝতে পারছি না। তিনি তো এসব ব্যাপারে খুবই সতর্ক।’
‘সতর্ক বটে, কিন্তু তুমি তো জান, আমাদের পিতৃভূমি ভারতের সাথে ইসরাইল রাষ্ট্র ও ইহুদীদের সম্পর্ক খুবই গভীর এবং পুরোনো। অনুকূল, প্রতিকূল কোন অবস্থাতেই এই সম্পর্ক নষ্ট হয়নি। আমেরিকাতেও ইহুদীরা ভারতীয়দের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। ভারতীয়রা যে আজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবসায়-বানিজ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে উঠে আসতে পেরেছে তার পেছনেও ইহুদীদের আন্তরিক সহযোগিতা রয়েছে।’
‘কিন্তু তাই বলে জলজ্যান্ত ক্রাইমের সাথে তো আপোস করা যায় না। তাও সাধারন ক্রাইম নয়, দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। যা পরিস্কার রাষ্ট্রদ্রোহিতার পর্যায়ে পড়ে।’
‘ড্যাডি ওদের একজন বন্দীকে আশ্রয় দিয়েছেন, এর বেশী তো আর কিছু করা হয়নি। সম্ভবত বন্দীকে রাখার মত ওদের কোন জায়গায়ই আজ আর নিরাপদ নয়। এই অবস্থায় ওদের একটা অনুরোধ আমাদের রক্ষা করতে হয়েছে। এমন ক্ষেত্রে তো ‘না’ বলা যায় না।’
‘বন্দী লোকটা কে? কেন বন্দী সে?’ প্রশ্ন করল শশাংক সেন।
‘কথা প্রসঙ্গে মাকে একবার বলতে শুনেছি যে, বন্দীকে নাকি কোন শূল্য দিয়ে মাপা যাবে না, এমন অমূল্য সে। ইহুদীদের সকল দুর্ভাগ্যের কারনও নাকি এই লোকটাই।’ বলল সাগরিকা সেন।
‘তুমি যে বর্ণনা দিলে দিদি, তাতে তো লোকটিকে দেখতে ইচ্ছা করছে। অমূল্য বন্দীটি দেখতে তাহলে কেমন!’
‘ঠিক বলেছ শশাংক। মা’র মুখ থেকে শোনার পর আমার মধ্যেও এই কৌতুহলের সৃষ্টি হয়েছে। একজন মানুষ এমন অমূল্য হতে পারে কেমন করে! আর একজন মাত্র একটা জাতির সকল দুর্ভাগ্যের কারণ হতে পারে কিভাবে! কিন্তু দেখার সুযোগ কিভাবে হতে পারে বলত?’
চিন্তা করছিল শশাংক সেন।
একটু পর হাসল। বিজয়ীর হাসি। বলল, ‘উপায় পেয়েছি দিদি।’
‘উপায়টা কি?’
‘উপায় হলো ভেন্টিলেটর। আমাদের পারমানবিক শেল্টারগুলোরই কোন একটাতে তাকে রাখঅ হয়েছে। আর আমাদের পারমাণবিক শেল্টারের প্রত্যেকটা মূল কক্ষ বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত। তার মানে চার দিকের যে কোন দিক দিয়ে ঘরে যাওয়া যায়। ঞরের চার দেয়ালের তিন দেয়ালেরই প্রায় ছাদ সমান উঁচু জায়গায় তিনটি ভেন্টিলেটরের ব্যবস্থা আছে, কিন্তু অন্য সময় ভেন্টিলেটর খোলা থাকার কথা। নিচে আমাদের অটো ল্যাডার আছে। সেটা দিয়ে উপরে উঠে ভেন্টিলেটর দিয়ে সহজেই আমরা ঘরের ভেতর দেখতে পারি।’
সাগরিকা সেনেরও মুখ হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, ‘ধন্যবাদ শশাংক। খুঁজে পেতে তুমি একটা ভাল পথ বের করেছ। চল ওঠ, এখনি যাব।’
সোৎসাহে সংগে সংগেই উঠে দাঁড়াল শশাংক। সাগরিকাও উঠল।
অটো ল্যাডারটি তারা দুজনে শেল্টারের পেছনের দেয়ালে নিয়ে এল।
পরপর পাঁচটি ঘর। অথবা বলা যায় একটা বড় কক্ষকে পাঁচটি কক্ষে বিভক্ত করা হয়েছে।
একদম শেষের ঘর থেকে বন্দী অনুসন্ধান শুরু করার সিদ্ধান্ত নিল তারা দুজন।
অটো ল্যাডারে একসাথে দুজন উঠা যায়। ল্যাডারে অটোমেটিক কন্ট্রোল প্যানেল রয়েছে। ল্যাডারে বসেই তারা অটো কন্ট্রোল প্যানেলের একটা কি’তে চাপ দিল এবং ল্যাডার বক্সকে পেছনের দেয়ালের এমন জায়গায় সেট করল যেখান থেকে দাঁড়িয়ে ভেন্টিলেটর দিয়ে ঘরের ভেতরটা পুরোপুরি দেখার সুযোগ নেয়া যায়।
তাদের প্রথম উদ্যোগই সাফল্যের মুখ দেখল। ভেন্টিলেটরে দুজন চোখ লাগাতেই বন্দীকে ঘরের মেঝেতে একটা খাটিয়ায় শোয়া অবস্থায় দেখতে পেল।
বন্দীর মাথাটা বিপরীত দিকে থাকায় তারা বন্দীর মুখসহ গোটা চেহারাটাই দেখতে পেল। বন্দীকে দেখে তারা দুজনেই হতাশ হলো।
বিশল দেহের, বিকট চেহারার কাউকে দেখবে এ রকমই তারা আশা করেছিল। তারা আরও আশা করেছিল, বন্দীকে ক্রুদ্ধ চেহারা বা হতাশ বদন নিয়ে বসে থাকতে দেখবে। তার বদলে তারা দেখল একজন ভদ্রলোককে, যাকে এই বন্দীখানার চেয়ে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাশে তাদের পাশে মানায় বেশী। ক্রুদ্ধ বা হতাশার বদলে প্রসন্ন মুখ নিয়ে শুয়ে আছে। তার চেহারার প্রসন্নতা ও নিরুদ্বিগ্নতা দেখে মনে হচ্ছে সে যেন তার নিজের ঘরে নিজের বেডে শুয়ে একটু রেস্ট নিচ্ছে।
‘এমন ভদ্র একজন ছেলে সাংঘাতিক বিপজ্জনক বন্দী কি করে হয়?’ বলল শশাংক সেন।
‘আমাদের ভুল হচ্ছে না তো? বন্দী হয়তো অন্য কোথাও আছে, যাকে দেখছি সে মনে হয় বন্দী নয়।’ বলল সাগরিকা সেন।
‘হতে পারে। তাহলে অন্য ঘরগুলো কি দেখব?’ বলল শশাংক সেন।
‘না এখন নয়, পরে আসব। এর মধ্যে জানার সুযোগ হতে পারে যে, বন্দী ছাড়া আরও কেউ আছে কি না।’
‘ঠিক আছে। তাহলে চল দিদি। খবর নিয়ে পরেই আসা যাবে।’
ল্যাডার বক্স চালিয়ে দুজনে নেমে এল নিচে।
ফিরে এল তারা লাইব্রেরীতে।