৩১. ফ্রি আমেরিকা

চ্যাপ্টার

জেনারেল শ্যারন বলছিল, ‘মিঃ আহমদ মুসা আপনি আমাদের জানেন, আমরাও আপনাকে জানি। আমরা আপনার সাথে একটা সন্ধিতে আসতে চাই, যদি আপনি রাজি হন।’
জেনারেল শ্যারন ও ডেভিড উইলিয়াম জোনস দুজনে আহমদ মুসার সামনে দুটি চেয়ারে বসে ছিল। দুজনের হাতেই রিভলবার। আর তাদের পেছনে আরও চারজন আহমদ মুসার দিকে স্টেনগান তাকক করে দাঁড়িয়ে আছে।
আহমদ মুসা বসে আছে তার খাটে দু পা উপরে তুলে অনেকটা যোগাসনের মত।
আহমদ মুসার গায়ে টি-সার্ট। পরনে ঢিলা ঢালা একটা ট্রাউজার। সেদিন সারা জেফারসনের বাড়িতে সকালে এই পোশাক পরেই নাস্তার পরে ঘুমিয়ে ছিল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার টি সার্ট ও ট্রাউজারে কোথাও কোথাও রক্তের দাগ।তার বাহু, বাজু, ঘাড়ে কয়েকটা ছোট ব্যান্ডেজ দেখা যাচ্ছে। টি- সার্ট ও ট্রাউজারের নিচে এ ধরনের আরও ব্যান্ডেজ আছে।
জেনারেল শ্যারন কথা বলছিল। আহমদ মুসা ভাবলেশহীন, নির্লিপ্ত। সে যেন জেনারেল শ্যারনের কথা শুনছিল না। তার কথা আহমদ মুসার কানে ঢুকছিল মাত্র।
জেনারেল শ্যারনের কথা শেষ হলেও আহমদ মুসা জবাবে কোন কথা বলল না। উত্তর দেবার কোন ভাবও তার চেহারায় নেই।
একটু অপেক্ষা করে জেনারেল শ্যারনই আবার বলে উঠল, ‘মিঃ আহমদ মুসা আপনার সাথে আমাদের লোকরা যে আচরন করেছে আমরা তার জন্যে দুঃখিত। বলুন, ওদেরই বা দোষ কি? যুক্তরাষ্ট্র ছিল গোটা দুনিয়ায় আমাদের সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়। সে আশ্রয়ে আপনি আগুন দিয়েছেন।আমাদের লোকরা কেমন করে নিজেদের সামলাবে বলুন? এই কারনে সেদির জ্ঞান ফেরার সাথে সাথে ওরা ক্ষুধার্ত নেকড়ের মত আপনার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। আমরা উপস্থিত থাকলে এমনটা হতে পারতো না। যাক, এ ধরনের অনাকাঙ্খিত গন-পিটুনির জন্যে আমরা দুঃখিত।’ থামল জেনারেল শ্যারন।
শ্যারন যে কথা বলেছে সেটা ঠিক। সেদিন আহমদ মুসাকে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় কিডন্যাপ করে ইহুদী গোয়েন্দা সংস্থার একটা নামহীন ঘাঁটিতে নিয়ে তোলে। তারপর সংজ্ঞাহীন আহমদ মুসাকে রেখে জেনারেল শ্যারন ও জোনস গিয়েছিল জরুরী একটা বিষয়ে আলোচনার জন্যে পাশেই। ইতিমধ্যে আহমদ মুসার জ্ঞান ফিরে আসে। এই সুযোগে শ্যারন ও জোনসের উত্তেজিত লোকরা আহমদ মুসার উপর চড়াও হয়। ব্যাপারটা ঘটে মধ্যযুগীয় ইউরোপের রাজা-বাদশাহদের কায়দায়। তারা যেমন অনেক আসামীকে ক্ষুধার্ত নেকড়ের হাতে ছেড়ে দিত। তারপর দেখত নেকড়ের দ্বারা কিভাবে তাদের দেহ ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়। আহমদ মুসার দেহ ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়নি বটে, কিন্তু অমানুষিক ভাবে নির্যাতিত হয়েছে সে। আহমদ মুসা আবার জ্ঞান হারালে তবেই লোকেরা ক্ষান্ত হয়। তবে এটা ঠিক শ্যারনরা এস তাকে দেখার পর তারা ভাল চিকিৎসার ব্যবস্থা করে।
এবার জেনারেল শ্যারন থামতেই আহমদ মুসা বলল, ‘মেকি দুঃখ প্রকাশের কোন প্রয়োজন নেই জেনারেল শ্যারন। আপনারা যাই করছেন তা আপনাদের পরাজয়ের কারন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আপনারা যা করেছেন, একটা পরাজিত বাহিনী এটাই করে থাকে। আপনাদের এই অধঃপতনের জন্যে দুঃখ প্রকাশ করতে হয়।’
জেনারেল শ্যারনের দুটি চোখ জ্বলে উঠেও আবার নিভে গেল। মুখে কষ্টে-সৃষ্টে হাসি টেনে বলল, ‘রাগ করেছেন আহমদ মুসা? আপনার মেজাজ ভাল করার জন্যে কিছূ সুখবর আপনাকে শোনাতে পারি।’
বলে একটু থেমেই আবার শুরু করল, ‘আপনার নতুন প্রেমিকা সারা জেফারসন আপনাকে হারিয়ে পাগলের মত হয়ে গেছে। তাকে হাসপাতালে নিতে হয়েছে। তার টেনশন কমানোর জন্যে তাকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হচ্ছে। তার ‘ফ্রি আমেরিকা’ পাগল হয়ে উঠেছে আপনাকে উদ্ধারের জন্যে। অন্যদিকে মার্কিন সরকার রাষ্ট্রীয়ভাবে কেসটাকে গ্রহন করেছে। আপনাকে উদ্ধারের জন্যে পুলিশ, এফবিআই, সিআইএ, সেনাবাহিনী, কোস্টাল গার্ড, সীমান্ত রক্ষী প্রভৃতি সকল বাহিনীতে জরুরী অবস্থা ঘোষনা করা হয়েছে। তারা চষে ফিরছে গোটা দেশ। ইহুদীদের কোন সংস্থা, প্রতিষ্ঠান তারা সার্চ করতে বাদ রাখেনি। সীমান্ত সীল করা হয়েছে শুরুতেই। আপনি ভাগ্যবান আহমদ মুসা। মার্কিন সরকার আপনাকে ধরার জন্যে এক সময় যে শক্তি নিয়োগ করেছিল, তার শতগুন শক্তি তারা নিয়োগ করেছে আপনাকে উদ্ধারের জন্যে।’ থামল জেনারেল শ্যারন।
শ্যারন থামতেই মুখে হাসি টেনে উইলিয়াম জোনস বলে উঠল, ‘যা বলেছেন তার চেয়েও আহমদ মুসা ভাগ্যবান। সারা জেফারসন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অঘোষিত ফার্স্টলেডি। যার ফার্স্ট পারসন নেই। এই ফার্স্ট পারসন হওয়ার জন্যে অনেক আমেরিকান বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করতে রাজি। আহমদ মুসা বিনা পয়সায় শুধু তাকে নয়, তার হৃদয়টাও পেয়ে গেছেন।’
‘মিঃ ডেভিড উইলিয়াম জোনস আমি আপনাকে ভদ্রলোক মনে করতাম। কিন্তু কিছু না জেনে শুনে অশ্লীল কথা বলতে পারেন এই বয়সে তা জানতাম না। মিস জেফারসন একজন সম্মানিতা আমেরিকান। আপনি আমেরিকান হিসাবে তার মর্যাদা রাখা আপনার উচিত ছিল।’ বলল বিক্ষুদ্ধ কন্ঠে আহমদ মুসা।
‘আমি আর আমেরিকান হতে পারলাম কই। ইহুদীই তো থেকে গেলাম। সুতরাং সে উচিত্যবোধের তোয়াক্কা আমি করি না।’ বলল ডেভিড জোনস।
‘ইহুদী হলেও ভদ্র হতে তো দোষ নেই।’ বলল আহমদ মুসা।
‘মুখ সামলে কথা বলুন মিঃ আহমদ মুসা। আপনি আমাদের বন্দী ভুলে যাবেন না।’ বলল ডেভিড জোনস।
ডেভিড জোনস থামতেই জেনারেল শ্যারন বলে উঠল আহমদ মুসাকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়েই, ‘আমাদের আলোচনা অনেকখানি অন্য দিকে চলে গেছে। আমার মনে হয় মিঃ জোনস আমরা আলোচনায় ফিরে যেতে পারি।’
বলেই সে আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আহমদ মুসা আমার প্রশ্নে আমি ফিরে যাচ্ছি। আমি বলছিলাম, ‘আমরা আপনার সাথে একটা সন্ধিতে আসতে চাই। আপনার মত কি?’
আহমদ মুসা মনে মনে হাসল। মনে মনেই বলল, জেনারেল আমার সাথে সন্ধিতে আসতে চায়, এর চেয়ে ফেরেববাজী আর কি হতে পারে। তবু মুখে বলল, ‘কি সন্ধি মিঃ শ্যারন? সন্ধি তো হয় যুদ্ধক্ষেত্রে। কিন্তু আমি তো আপনাদের বন্দী। বন্দীর কাছে সন্ধির প্রস্তাব কিসের?’
‘আপনি বন্দী হলেও বন্দী নন। আপনি লড়াইয়ের ময়দানে আছেন, আমরাও। সুতরাং সন্ধি হতে পারে।’ বলল জেনারেল শ্যারন।
‘এই তো মিঃ জোনস এখনই বললেন আমি বন্দী আমি যেন এ কথা ভুলে না যাই।’ আহমদ মুসা বলল। তার মুখে হাসি।
হাসল ডেভিড জোনসও। বলল, ‘ঠিকই বলেছি। কিন্তু এর অর্থ এ নয় যে, আপনি বন্দী মানেই বন্দী। আনি বন্দী হয়েও মুক্ত মানুষের চেয়ে শক্তিশালী। সে কথাই জেনারেল শ্যারন আপনাকে বলছেন।’
‘আমি কি করতে পারি বলুন।’ জেনারেল শ্যারনদের দিকে তাকিয়ে বলল আহমদ মুসা।
‘একটা সন্ধিতে আসতে পারেন।’ জেনারেল শ্যারন বলল।
‘কি সন্ধিতে?’
‘আমরা কিছু পেতে চাই এবং কিছু দিতেও চাই।’
‘কি পেতে চান?’
‘আমাদের ইসরাইল রাষ্ট্রের উৎখাতের পর হাইফা থেকে ৫০ মাইল সাগরের ভেতরে ফাক্কো বা ‘গুড হোপ’ দ্বীপে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত আছে, আপনি জানেন। আমাদের দাবী হলো এক. ‘হাইফা থেকে তেল আবিব’ পর্যন্ত এই এক চিলতে উপকূল ভুমি আমাদের দিতে হবে। দুই. ইসরাইল দখলে নেবার সময় ফিলিস্তিনিরা যে ‘সেন্ট্রাল স্টেট লাইব্রেরী ও আরকাইভ’ দখল করেছে, সেটা আমাদেরকে যেমন ছিল তেমন ফেরৎ দিতে হবে। তিন. আপনি আমেরিকা ত্যাগ করবেন এবং তার আগে আমেরিকার সাথে আমাদের আপোশ করিয়ে দিয়ে যাবেন।’
আহমদ মুসা তাদের দাবী শুনে মনে মনে হাসল এবং বুঝল, ইহুদীরা কঠিন বেকায়দায় না পড়লে এমন প্রস্তাব নিয়ে তার কাছে আসতো না। বলল, ‘আর আপনারা আমাকে কি দিতে চান?’
‘বিনিময়ে আমরা আপনাকে মুক্তি দিতে চাই এবং শত্রুতার বদলে সহাবস্থান অফার করতে চাই।’ বলল জেনারেল শ্যারন।
‘আপনারা আমার মুক্তির যে বিনিময় দাবী করেছেন, আমার মূল্য অত নয় মিঃ শ্যারন।’
‘মিঃ আহমদ মুসা আমাকে শেখাবার চেষ্টা করবেন না। আমরা আপনার বিনিময়ে সাবেক গোটা ইসরাইল রাষ্ট্র যদি দাবী করি, তাও পেতে পারি।’
‘কেমন করে? কে দেবে?’
‘আপনার প্রানের মূল্য সাবেক ইরাইল রাষ্ট্রের চেয়ে অনেক বেশী ফিলিস্তিন সরকারের কাছে।’
‘এসব আপনাদের কল্পনা বিলাস। একজন ব্যক্তি একটা রাষ্ট্রের সমান হয় না, বিনিময় তো হয়ই না।’
‘সেটা আমরা দেখব। আপনি রাজি কিনা বলুন?’
‘আমার রাজি হওয়ার প্রশ্ন নেই। অন্যের সম্পত্তি, আমি দিতে রাজি হব কিভাবে?’
ফিলিস্তিন রাষ্ট্র অন্যের নয়। আপনি ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের জনক। জনকের প্রাণ বাঁচাবার জন্যে ফিলিস্তিন তার অর্ধেক ছেড়ে দিতে পারেই। আমরা অর্ধেক চাইনি। চেয়েছি হাইফা থেকে তেল আবিব পর্যন্ত ছোট্ট একটা করিডোর। এটা দেয়া তাদের জন্যে কিছুই নয়।’
‘আমি আমার মুক্তি বা বাঁচার জন্যে ফিলিস্তিনের এক ইঞ্চি ভূমিও অন্য কারো হাতে দিতে রাজি হবো না।’
‘বিষয়টা আপনার অবগতি ও সম্মতির জন্যে আপনার কাছে তুলেছিলাম। কিন্তু আপনি রাজি হওয়া, না হওয়াতে আমাদের কিছু এসে যায় না। আমরা দাবী করবো ফিলিস্তিন সরকারের কাছে, আপনার কাছে নয়। দাবী পুরণ করবে ফিলিস্তিন সরকার, আপনি নন।’
‘ভূমি ফিলিস্তিন সরকারের নয়, ফিলিস্তিন জনগনের। যাক সে কথা, আমার মুক্তির বিনিময়েও আমি আপনাদের ব্যাপারে কোন মিথ্যা কথা মার্কিন সরকারকে বলব না। সুতরাং তৃতীয় শর্তও আপনাদের পূরণ হবে না।’
‘এ ব্যাপারে এখন আমরা আপনার সাথে কথা বলব না। আপনার মত ভবিষ্যতে পাল্টাতে পারে। একজন মানুষের কতদিন বন্দী থাকতে ভালো লাগে বলুন?’
‘কিন্তু আমি বললেই কি আপনাদের ব্যাপারে মার্কিন সরকার ও জনগনের ধারনা পাল্টাবে, তাদের আগের বিশ্বাস ফিরে আসবে?’
‘গনতন্ত্রে ব্যক্তি বা সরকার বড় কথা নয়। ব্যক্তি ও সরকার পাল্টালে নতুন সরকার এলে নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। বিশ্বাসের মানদন্ড পাল্টে যায়। অবিশ্বাসী বিশ্বাসী হয়, আবার বিশ্বাসী অবিশ্বাসী হয়ে যায়। সেই জন্যেই তো গনতন্ত্র আমাদের কাছে এক প্রিয়।’
বলে জেনারেল শ্যারন একটু থামল তারপর বলল, ‘আপনাকে শুধু বিজ্ঞানী জ্যাকবের ব্যাপারে বললেই চলবে। আপনি বলবেন, আপনার বিশ্বাস বিজ্ঞানী জন জ্যাকবের সময় সুড়ঙ্গটি গোয়েন্দা কাজে ব্যবহার হয়নি। তার অনুপস্থিতিকালে পরিবর্তন হতে পারে। বিজ্ঞানী জন জ্যাকবের উপর থেকে সন্দেহ চলে গেলে পরবর্তী কাজটা আমরা করতে পারব। মুক্তি যদি পেতে চান এই সহযোগিতাটা আপনাকে অবশ্যই করতে হবে।’
‘আমার মুক্তির জন্যে আমি মিথ্যা কথা বলব একথা আপনারা ভাবলেন কি করে?’ বলল বিদ্রূপকন্ঠে আহমদ মুসা।
হাসল জেনারেল শ্যারন। বলল, ‘আপনার এই মনোভাব ভবিষ্যতে নাও থাকতে পারে। আপনি নিজ ইচ্ছাতেই আমরা যেভাবে বলব, সেভাবে আমাদের সহযোগিতা করবেন।’
‘কেন করবো?’ বিস্মিত কন্ঠে বলল আহমদ মুসা।
‘কেন, বিজ্ঞান এত কিছু পারে, মানুষকে ইচ্ছা মত কথা বলাতে পারে না?’
‘মানুষ যন্ত্রের দাস নয়, যন্ত্র মানুষের দাস। এজন্যেই পারে না।’
‘ঠিক আছে, ভবিষ্যৎ কি বলে দেখবেন?’ বলল ভাবলেশহীন কন্ঠে জেনারেল শ্যারন। এমন ভাব যেন নিশ্চিত ভবিষ্যৎটা সে দেখতে পাচ্ছে।
বিস্মিত হলো আহমদ মুসা।
বিজ্ঞান কথা বলাতে পারে ইচ্ছামত, এ কথার অর্থ কি? এমন যন্ত্র কি আবিষ্কৃত হয়েছে যা মানুষের উপর এমন প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে, যার ফলে যন্ত্র যেমনটা চায় সেভাবে মানুষকে কথা বলাতে পারে? হঠাৎ আহমদ মুসার মনে পড়ল ওমর বায়ার কথা। ওমর বায়ার প্রতিপক্ষরা যান্ত্রিক ইলেক্ট্রোওয়েভের মাধ্যমে ওমর বায়ার চিন্তাকে সম্পূর্ন ভিন্ন দিকে পরিচালিত করে তার কাছ থেকে স্টেটমেন্ট যোগাড়ের চেষ্টা করেছিল। এরাও কি এমন কিছুর ব্যবস্থা করেছে?
মনে মনে শিউরে উঠল আহমদ মুসা। আহমদ মুসাকে নির্যাতন করে মেরে ফেলা যাবে, কিন্তু তার কাছ থেকে কিছু আদায় করা যাবে না। এই আদায়ের জন্যে কে তারা ভিন্ন পথ নিয়েছে? এই জন্যেই কি আজ তারা মিষ্টি মিষ্টি কথা বলছে ও সন্ধির প্রস্তাব দিচ্ছে? ওমর বায়ার মত তার ক্ষেত্রেও কি এ ধরনের কোন ব্যবস্থা তারা গ্রহন করেছে? কি সে ব্যবস্থা? আহমদ মুসার মনে পড়ল হেলসিংকি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী অধ্যাপক বি. কন. চু-এর ১৩৪ পৃষ্ঠার দীর্ঘ প্রবন্ধের কথা। প্রবন্ধটির নাম, ‘The Social Reality of Artificial Mind and Body Control.’ এ প্রবন্ধের ভূমিকায় লিখেছেন, ‘ইহুদীবাদীরা তাদের নিজেদের হাত নিরাপদ রাখার জন্যে ‘মনোদৈহিক নিয়ন্ত্রণ’ ব্যবহারের মাধ্যমে অন্যকে তারা বাঞ্চিত হত্যা ও অন্যান্য অপরাধ সংঘটনে বাধ্য করে। কেনেডি, রবার্ট কেনেডি, মার্টিন লুথার কিং, জর্জ ওয়ালেস প্রমুখের হত্যাকান্ড এই ব্যবস্থারই ফল। ইহুদীবাদ বিরোধী বহু নেতাকে রাজনৈতিক ও সামাজিক মর্যাদা বিসর্জন দিতে হয়েছে, এমনকি অনেকে জীবন দিয়েছে এই ব্যবস্থার ফাঁদে পড়েই।’ বিজ্ঞানী চু-এর নিবন্ধ থেকেই আহমদ মুসার আরও মনে পড়ল ‘মনোদৈহিক নিয়ন্ত্রণ’-এর ব্যাপারটা একটা জটিল বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ায় যাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাওয়া হয় ‘ব্রেইনওয়ে ট্রান্সমিশন’ ও ‘অপটোইলেক্ট্রনিক্যাল কন্ট্রোল’ কৌশলের মাধ্যমে তার মানব দৈহিক ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনতে হয়। তবে আহমদ মুসার একটা কথা মনে পড়ল যে, এই নিয়ন্ত্রন ব্যবস্থা চরিত্রহীন বা শিথিল চরিত্রের লোকদের উপর যতটা কার্যকরীহয়, চুরত্রবান বা দৃঢ় চরিত্রের লোকদের উপর ততটা কার্যকরী হয় না। কিন্তু আহমদ মুসার এই জানাটা বহুদিন আগের। তারপর বিজ্ঞান অনেক দূর এগিয়েছে। নিয়ন্ত্রন ব্যবস্থাতেও আরও পরিবর্তণ এসেছে। নিশ্চয় আরও কার্যকর করা হয়েছে এই ব্যবস্থাকে। এই ব্যবস্থাই কি তারা প্রয়োগ করবে তার উপর? আবার শিউরে উঠল আহমদ মুসা। এই অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে সে কিভাবে লড়াই করবে?
আহমদ মুসাকে অনেক্ষন কোন জবাব দিতে না দেখে জেনারেল শ্যারন বলে উঠল, ‘কি কথা বলছেন না কেন মিঃ আহমদ মুসা? ভয় পেয়ে গেলেন নাকি?’
‘ভয় নয়, ভাবছি ভবিষ্যতে কি দেখব তা নিয়ে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কিছুই দেখবেন না। কিছু করবেন মাত্র।’ জেনারেল শ্যারন বলল।
‘কিছু তো অবশ্যই করব, কিন্তু সেটা আপনারা বলছেন কি করে?’ আহমদ মুসার প্রশ্ন।
‘আমরা বলছি কারন, আমরা যা চাই, তাই আপনি করবেন।’ জেনারেল শ্যারন বলল।
বলেই উঠে দাঁড়াল জেনারেল শ্যারন। বলল, ‘চলুন মিঃ জোনস। আহমদ মুসাকে অনেক বিরক্ত করেছি আর নয়। আমাদের সন্ধি প্রস্তাব নিয়ে অবশ্যই উনি ভাববেন।’
উঠে দাঁড়াল ডেভিড উইলিয়াম জোনসও।
জেনারেল শ্যারন যাবার জন্যে ফিরে দাঁড়াতে গিয়ে বলল, ‘মিঃ আহমদ মুসা আপনার বন্দী অবস্থাকে সুখদায়ক করতে সর্বোচ্চ যা করা যায়, তা আমরা করেছি। কোন অসুবিধা হলে বলবেন আমরা ভেবে দেখব।’
ওরা নিজ নিজ চেয়ার হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেল। ওরা ঘর থেকে বের হবার সাথে সাথে ঘরের দরজাও বন্ধ হয়ে গেল।
রো চলে গেলে আরো অনেক চিন্তা এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল আহমদ মুসার মাথায়।
বন্দীখানার এই সুব্যবস্থা আহমদ মুসার কাছ কিছুক্ষন আগ পর্যন্তও ভল লেগেছিল, কিন্তু সেই সুব্যবস্থা এখন আহমদ মুসার কাছে ষড়যন্ত্রমূলক বলে মনে হচ্ছে।
বন্দীখানায় তাকে আরামদায়ক বিছানা দেয়া হয়েছে।
বলা যায়, আনবিক বোমা প্রুফ একটি আশ্রয় কেন্দ্রে তাকে বন্দী করে রাখা হয়েছে।
এই কথা মনে হতেই একটা ভাবনা বিদ্যুত চমকের মত আহমদ মুসার মনে এসে প্রবেশ করল। এ ধরনের আশ্রয় কেন্দ্র থেকে বের হবারও একটা আন্ডারগ্রাউন্ড পথ থাকে। কারন, আণবিক বোমার আঘাতে উপরের সব কিছু যখন নষ্ট হয়ে যাবে, তখন আন্ডারগ্রাউন্ড আশ্রয়স্থল যতটা জরুরী, ততটাই জরুরী বের হবার জন্যে আন্ডার প্যাসেজ। সুতরাং এ আশ্রয় কেন্দ্রেরও নিশ্চয় সে ধরনের আন্ডার গ্রাউন্ড প্যাসেজ রয়েছে। খুশী হয়ে উঠল আহমদ মুসার মন।
এই সিদ্ধান্তে পৌঁছার সাথে সাথেই আহমদ মুসার মনে ঝড়ের মত প্রবেশ করল একটি চিন্তা। তাহলে কি মৃত পাখি বাইরের সম্ভাব্য আণবিক বিপর্যয়ের প্রতীক? মৃত পাখি একটাই দেখা যাচ্ছে। আর তা উপরের ফ্লোরের ছাদে চিহ্নিত এবং তা উপরে উঠে যাবার দরজা-চিহ্নিত স্থানে রয়েছে। এর অর্থ নিশ্চয় উপরে উঠার পথ ধ্বংস হয়ে যাওয়া বুঝাচ্ছে। এই ভাবনা থেকে আহমদ মুসার মনে হলো, নকশায় বের হবার মূল পথ বন্ধ বা বিনষ্ট দেখানো হয়ছে। অতএব আশ্রয় কেন্দ্র থেকে বের হবার বিকল্প পথও নিশ্চয়নকশায় চিহ্নিত থাকবে এবং সেখানে অবশ্যই পাখিকে দেখা যাবে। এই চিন্তার সাথে সাথেই তার মন বলে উঠল, তাহলে কি দক্ষিণ প্রান্তের দেয়ালে করিডোর যেখানে শেষ হয়েছে, সেখানে চিহ্নিত দরজাই বের হওয়ার গোপন পথ? সেখানে দরজা চিহ্নিত স্থানে একটা মুক্ত ডানার পাখি আঁকা রয়েছে। এখানে অঙ্কিত পাখি জীবিত ও মুক্ত ডানা অলা হওয়ার অর্থ নিশ্চয় এটাই যে, বের হবার জন্যে এ পথ নিরাপদ।
আল্লাহর অশেষ শুকরিয়া আদায় করল আহমদ মুসা। তার এই চিহ্না ও অনুমান যদি সত্যি হয়, তাহলে এ জিন্দানখানা থেকে বের হওয়ার একটা উপায় সে পেয়ে গেছে।
আনন্দে মন ভরে গেল আহমদ মুসার।
এই প্রথমবারের মত নিজের বন্দী দশা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিল আহমদ মুসা। সে এ বিজ্ঞানকে বিশ্বাস করে যে, বৈদ্যুতিক বা রেডিও ওয়েভ কিংবা অতিকার্যকরী কোন আলট্রাসনিক ওয়েভের ব্যবহার করে মানুষের চিন্তা ও মননে বৈকল্য এনে নতুন পথে একে প্রবাহিত করার পদ্ধতি বৈজ্ঞানিক ভাবে সম্ভব হতে পারে। এধরনের কমান্ড কম্পিউটার শুনলে মানুষের ব্রেনের কোষও শুনতে পারে। এখানেই আহমদ মুসার ভয়। হিপনোটাইজড হওয়ার মত অন্যের হাতের পুতুলে পরিনত হওয়ার কথা আহমদ মুসা চিন্তাই করতে পারে না। এমন দুর্ভাগ্য আমার আগেই তাকে মুক্ত হতে হবে। উঠে বসল আহমদ মুসা।
এ বন্দীখানা থেকে বের হবার যে পথের কথা সে চিন্তা করছে তা যে ঠিক, তা দেখতেও তাকে এই কক্ষ থেকে বের হতে হবে। কিন্তু বের হবার পথ কি?
এবার উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা।
দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
দেখল নকশাটা আবার।
দুটি ফ্লোরের সবগুলো ঘরের মুক্ত ডানার পাখি আঁকা। এর অর্থ বুঝতে পারছে আহমদ মুসা, দরজা অতিক্রম করাই বের হবার একমাত্র পথ। দরজায় পাখির উপস্থিতি একথাই বলছে।
কিন্তু দরজা অতিক্রম করবে কিভাবে?
আহমদ মুসা এই ঘরে ঢুকার সময় লক্ষ্য করেছে, দরজা খুলেছে ও বন্ধ হয়েছে স্বয়ংক্রিয় ভাবে।
আহমদ মুসা ঘরের দরজা ও তার আশ-পাশ আবার গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করল, কোন গোপন সুইচ বা কোন বোতাম আছে কিনা।
না তেমন কিছুই কোথাও নেই। অনেক সময় দরজার বটম ফ্লোরে ওয়েট নিয়ন্ত্রিত স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা থাকে। এই চিন্তা করে দরজায় বটম ফ্লোরে অনেক চাপাচাপি ও নাচানাচি করল, কিন্তু কোন ফল হলো না। দরজার দুপাশের সাইড ওয়াল এবং দরজার উপরের ওয়ালটাও অনেক টিপাটিপি করল আহমদ মুসা। কাজে এল না কিছুই।
হতাশ মনে আহমদ মুসা আবার ফিরে এল বিছানায়। ছুড়ে দিল দেহকে বিছানার উপর।
ভাবল, হতে পারে দরজা দুর নিয়ন্ত্রিত।
কিন্তু পরক্ষনেই লাফ দিয়ে উঠে বসল। আপন মনে বলল, এটা তো পারমাণবিক আশ্রয় কেন্দ্র। এখানে মূল ব্যবস্থাই থাকতে হবে ভেতর থেকে খোলার। সবাই ঘরে আশ্রয় নিলে বাইরে থেকে খোলার লোক পাবে কোথায়? আবার দৌড় দিল দরজার দিকে।
আতি-পাতি করে আবার খুঁজল, সন্দেহজনক কিছু পাওয়া যায় কিনা। না কিছুই পেল না।
তাহলে দেয়ালের অন্য কোন জায়গায় কি দরজা খোলার কোন ব্যবস্থা গোপন রাখা হয়েছে?
এ চিন্তার সাথে সাথে আহমদ মুসা আবার চার দেয়ালের পরীক্ষায় লেগে গেল। আতি-পাতি করে খুঁজল চার দেয়ালের প্রতিটি ইঞ্চি জায়গা। না কোথাও কিছু পেল না। দেয়ালগুলোতে টোকা দিয়েও দেখেছে, কোথাও ফাঁপা কেতান জায়গা আছে কিনা, যেখানে সুইচ বা বোতাম লুকানো থাকতে পারে। সেরকম জায়গা কোথাও পেল না। পরিশেষে আহমদ মুসা বিছানা উল্টিয়ে খাট সরিয়েও দেখল সন্দেহ করার মত কোথাও কিছু পাওয়া যায় কিনা? কিন্তু কোন কিছুই চোখে পড়ল না।
ক্লান্ত হয়ে পড়েছে আহমদ মুসা।
শুয়ে পড়ল আবার। বলল মনে মনে স্রষ্টার উদ্দেশ্যে, ‘হে আল্লাহ, আমার চেষ্টা শেষ। এবার তোমার সাহায্যের প্রত্যাশা করছি। তুমি সাহায্য কর।’
প্রার্থনা শেষ হয়নি, এ সময় হঠাৎ আহমদ মুসার মনে উদয় হলো দরজাগুলোতে মুক্ত ডানার ক্ষুদে পাখিগুলোর সেটিং নিখুঁতভাবে দরজাগুলোর একই জায়গায়। অপরিকল্পিত বা রেনডম সেটিং হলে এরকম হবার কথা নয়। কিন্তু পরিকল্পিত ভাবে একই জায়গায় একই কায়দায় পাখিগুলোর সেটিং কেন? এর মধ্যে কি ইংগিত আছে?
ভাবার সাথে সাথেই আহমদ মুসা লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। ছুটল দরজার দিকে।
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে স্থির দৃষ্টিতে তাকাল ক্ষুদে পাখিটার দিকে মুহূর্তকাল। তারপর ‘বিসমিল্লাহ’ বলে তর্জনি দিয়ে জোরে চাপ দিল পাখির উপর।
চাপ দেয়র সাথে সাথেই নড়ে উঠল দরজা। এক প্রকার হিস হিস শব্দ তুলে দরজাটি ডান দিকে সরে গিয়ে ঢুকে গেল ডান দিকের দেয়ালের ভেতর।
আনন্দের আকস্মিকতায় আহমদ মুসা কিছুক্ষনের জন্যে চলৎশক্তি হারিয়ে ফেলেছিল। পরক্ষনেই সাবধান হয়ে দুপা এগিয়ে বাইরে উঁকি দিল, দেখল বাইরে প্রশস্ত করিডোর। কেউ নেই।
নিরস্ত্র আহমদ মুসা অত্যন্ত সতর্ক হয়ে এক পা দুপা করে করিডোরে বেরিয়ে এল।
করিডোরটা পশ্চিমে অল্প গিয়ে শেষ হয়েছে।
আহমদ মুসা করিডোর ধরে দ্রুত পূর্বদিকে এগুলো। দেখা নকশঅ থেকে আহমদ মুসা অনুমান করছে পূর্বমুখী এই করিডোরটাই তাকে নিয়ে যাবে দক্ষিনমুখী করিডোরে যা শেষ দক্ষিন প্রান্তের দেয়ালে চিহ্নিত আছে দরজা এবং অংকিত আছে মুক্ত ডানার অতিক্ষুদ্র সেই পাখি। যা তার জন্যে মুক্তির বার্তাবহ হতে পারে।
আহমদ মুসা যে ঘরে বন্দী ছিল তার অনুরূপ কয়েকটা ঘর পার হতেই করিডোরটা একটা প্রশস্ত চত্বরে গিয়ে পড়ল। তারও চারদিকে ঘর। আহমদ মুসা দেখতে পেল চত্বরটির দক্ষিন পাশ থেকে একটি করিডোর আরও দক্ষিন দিকে এগিয়ে গেছে।
খুশী হলো আহমদ মুসা। ওটাই তার বাঞ্চিত দক্ষিনমুখী করিডোর।
কিন্তু দক্ষিন থেকে তার দৃষ্টি সামনে প্রসারিত হতেই আনন্দটা উবে গেল। দেখল, যমদূতের মত দুই স্টেনগানধারী তাদের উদ্যত স্টেনগান তার দিকে তাক করে মাত্র গজ পাঁচেক দূরে কোত্থেকে যেন ভুতের মত আবির্ভূত হয়েছে।
স্টেনগানধারীরা চোখে পড়ার পর আহমদ মুসা এক মুহূর্তও বিলম্ব করেনি।
তার মাথাটা একটু পেছনে ঝুঁকে পড়তে দেখা গেল। তার সাথে তার দেহটা একটু চিৎ হলো। তারপর তার দুপা মেঝে ঘেঁষে বিদ্যুৎ গতিতে ছুটল পাশাপাশি দাঁড়ানো স্টেনগানধারীদের দিকে।
আহমদ মুসার দেহ যখন ঝুঁকে পড়ছিল, তখন গুলী বৃষ্টি শুরু হলো দুজনের স্টেনগান থেকেই।
কিন্তু যখন বুলেটের ঝাঁক আহমদ মুসার দেহ লক্ষ্য করে ছূটে এল, তখন আহমদ মুসার দেহ মেঝে স্পর্শ করে ছুটে যাচ্ছে দুই স্টেনগানধারীকে লক্ষ্য করে।
মুহূর্তেই দৃশ্যপট পাল্টে গেল।
আহমদ মুসার চলন্ত দেহটা স্টেনগানধারীদের পায়ে গিয়ে আঘাত করেছে।
দুজন স্টেনগানধারীর দেহ মেঝেতে ছিটকে পড়েছে। স্টেনগান খসে পড়েছে তাদের হাত থেকে।
আর আহমদ মুসা তাদের দুই স্টেনগান কুড়িয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। দুজনের দিকে স্টেনগান তাক করে বলল, ‘দুই হাত মাথার উপর তুলে উঠে দাঁড়াও।’
অনিচ্ছা সত্বেও দুহাত উপরে তুলে তারা উঠে দাঁড়াল।
আহমদ মুসা তাদের লক্ষ্য করে বলল, ‘আমি নির্দেশ দেব, সংগে সংগে তা পালন করবে। অযথা রক্তারক্তি আমি পছন্দ করি না, কিন্তু নির্দেশের অন্যথা হলে তারপর এক মুহূর্তও তোমরা বেঁচে থাকবে না। তোমরা অনেক বুলেট নষ্ট করেছ, আমার বুলেট কিন্তু একটাও নষ্ট হয় না মনে রেখ।’
কথাটা শেষ করেই আহমদ মুসা একবার চারদিকে তাকাল। তাকাতে গিয়ে দেখতে পেল তার বাঁ দিকের বন্দীখানার ঘরগুলোর পূর্ব-উত্তর কোণে একজন তরুণ ও একজন তরুণী মূর্তির মত স্থির দাঁড়িয়ে আছে। তাদের চোখগুলোও পাথরের মত স্থির।
আহমদ মুসা দু’ধাপ পেছনে সরে গিয়ে একটি স্টেনগানের ব্যারেল তরুণ-তরুনীর দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে ভয়ংকর ঠান্ডা কন্ঠে বলল, ‘স্টেনগানের ট্রিগার আশা করি আমার টিপতে হবে না।’
বলেই আহমদ মুসা মাথার উপরে হাত তুলে দাঁড়ানো দুজনকে বলল, ‘তোমাদের জামা ও জুতা খুলে ফেল।’
সংগে সংগে তারা নির্দেশ পালন করল।
তারপর তাদের দুজনের একজনকে বলল, ‘তুমি তোমার জামা দিয়ে ওর দুহাত পিছমোড়া করে ভেঁধে ফেল এবং জুতার ফিতা দিয়ে ওর দু’পা বেঁধে ফেল।’
লোকটি আহমদ মুসার নির্দেশ পালন করল। একজন বাঁধা হয়ে গেল।
দ্বিতীয় লোকটিকে আহমদ মুসা বলল, ‘তুমি উপুড় হয়ে শুয়ে পড়।’ শুয়ে পড়ল লোকটি।
মূর্তির মত দাঁড়িয়ে থাকা তরুণ-তরুণীকে লক্ষ্য করে আহমদ মুসা বলল, ‘মিঃ.. আপনি এখানে আসুন। আমাকে একটু সাহায্য করুন।’
সংগে সংগেই তরুনটি এল কম্পিত পায়ে। বলল, ‘আমার নাম শশাংক সেন।’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘মিঃ শশাংক সেন, আপনি দয়া করে ঐ লোকটির মত এ লোকটিকে বেঁধে ফেলুন।
শশাংক সেন তৎক্ষনাৎ তার নির্দেশ পালন করল।
‘ধন্যবাদ মিঃ শশাংক সেন। বলল আহমদ মুসা।
তরুনীটি ততক্ষনে তরুনটির পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
দুজনেই ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আহমদ মুসার দিকে। বোধ হয় ভাবছে, এরপর শুরু হবে তাদের পালা।
কিন্তু আহমদ মুসা সেরকম কোন নির্দেশ দিল না। বলল তাদের দিকে চেয়ে, ‘আমার অনুমান মিথ্যা না হলে বলতে পারি, আপনারা আমার শত্রু নন?’
‘ঠিক বলেছেন, আমরা আপনার শত্রু পক্ষের বটে, কিন্তু আপনার শত্রু নই আমরা।’ বলল তরুনীটি।
‘কেন শত্রু নন শত্রু পক্ষের হয়েও?’
‘আমরা দুজনের কেউই আপনাকে চিনি না, জানি না। অজানা, অচেনা লোক শত্রু হতে পারে কেমন করে? বলল তরুনীটিই।
‘কিন্তু পরিচয় পেলে?’ আহমদ মুসা বলল।
‘সেটা জানি না। তবে আপনার সাথে অন্তত আমাদের দুজনের এমন কিছু ঘটেনি যাতে আপনি শত্রু হবেন।’ তরুনীটিই বলল।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘আপনাদের পিতার যদি আমি শত্রু হই, তাহলে আপনাদের দু’ভাইবোনেরও কি শত্রু হয়ে যাব না?
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা আবার বলে উঠল, ‘শত্রু না হলে বলুন তো, এরা দু’জন হঠাৎ কোত্থেকে এল?’
‘উপরে ভূগর্ভস্থ শেল্টার গেটের ওরা প্রহরী। ভুগর্ভস্থ বিশেষ কিছূ কক্ষের দরজা খুললে ঐ গেটে এ্যালার্ম বাজে। এই এ্যালার্ম শুনেই এরা এসেছে। সামনে দেয়ালটির পরেই লিফট রুম। লিফট থেকে নেমে তারা এখানে এসেছে।’
‘উপরে কজন প্রহরী থাকে? জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘এ দুজনই ছিল। তাও এরা আগে ছিল না। কদিন থেকে থাকছে।’ তরুনটি বলল।
‘তার মানে আমি বন্দী হবার আগে কোন দিন কোন বন্দী ছিল না।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কোনদিনই ছিল না। এটা তো কোন বন্দীখানা নয়।’ বলল এবার তরুণীটি।
‘আমি এখানে এলাম কি করে? আপনারা তো ভারতীয় অরিজিন। তাহলে ভারতীয় হিন্দু স্বার্থ ও ইহুদী স্বার্থ কি এক হয়ে গেছে?’
‘আমরা জানি না।’ বলল তরুনীটি।
‘ভূগর্ভস্থ বিশেষ বিশেষ কক্ষের দরজা খুললে এ্যালার্ম বাজার ব্যবস্থা আর কোথায় কোথায় আছে?’
‘আরও কোথাও আছে নিশ্চয়, কিন্তু আমরা জানি না।’ বলল তরুণীটি।’
‘আপনাদের কোথায় বন্দী করি বলুন তো?’
‘কেন?’ প্রশ্ন তরুণের।
‘আমি এখন বেরিয়ে যাব। কিন্তু এভাবে আপনাদের রেখে আমি যাব কি করে?’
‘কেন, আমরা তো আপনার কোন ক্ষতি করছি না।’
‘আমার ক্ষতি নয়, আপনাদেরকে ক্ষতি থেকে রক্ষা করতে চাচ্ছি।’
‘আমাদের কি ক্ষতি?’
‘আমাকে পালানোর সহযোহিতা করার দায়ে আপনারা অভিযুক্থ হতে পারেন।’
বলেই আহমদ মুসা তার স্টেনগান তুলে নির্দেশের ভংগিতে বলল, ‘তাড়াতাড়ি করুন। হয় আমার বন্দীখানায় বন্দী হবেন, নয়তো অন্য কোথাও। তাড়াতাড়ি বলুন।’
‘তাহলে আমাদের লাইব্রেরী কক্ষে।’ বলল তরুলটি।
‘চলুন লাইব্রেরীতে।’
ওরা দু’জন আগে আগে হাঁটল, পেছনে আহমদ মুসা।
ওদের লাইব্রেরীতে তুলে যখন দরজা লক করতে যাচ্ছিল, তখন তরুণীটি বলল, ‘আপনার পরিচয় তো আপনি দেননি?’
‘আপনাদের পরিচয়ও তো আমি পাইনি।’
‘আমি সাগরিকা সেন। ওর নাম তো জেনেছেন। শিল্পপতি শিব শংকর সেন আমাদের পিতা। আমরা দুজনেই ছাত্র। এবার আপনার পরিচয় বলুন?’
হাসল আহমদ মুসা। শেষ মুহূর্তে শত্রুতা সৃষ্টি করে লাভ নেই। এখনও আমরা শত্রু নই, সেটাই থাক। পরে আমার পরিচয় আপনাদের পিতা, কিংবা যে কারো কাছ থেকে অবশ্যই জানতে পারবেন। তখন শত্রু হলেও আমি জানতে পারবো না।’
আহমদ মুসা দরজা লক করল।
তারপর চাবিটা নিচে পেলে রেখে বেরিয়ে যাচ্ছিল। সাগরিকা সেন জানালা দিয়ে বলল, ‘আপনি যাবেন কিভাবে?’
‘আন্ডার গ্রাউন্ড প্যাসেজ দিয়ে অথবা উপর দিয়ে। ধন্যবাদ। বাই।’
বেরিয়ে এসে আহমদ মুসা চত্বরটি পেরিয়ে প্রবেশ করল দক্ষিণমুখী সেই করিডোরে।
আহমদ মুসা সিশ্চিত যে আন্ডার গ্রাউন্ড প্যাসেজে বড় কোন জটিলতা থাকা স্বাভাবিক নয়।
আহমদ মুসার অনুমান সত্য হলো। করিডোরের দক্ষিণ প্রান্তের দেয়ালে যেখানে মুক্ত ডানার পাখি আঁকা আছে, তার উপর চাপ দিতেই দেয়াল সরে গিয়ে একটা প্যাসেজ বেরিয়ে পড়ল।
প্যাসেজটি অন্ধকার।
আহমদ মুসা বিসমিল্লাহ বলে প্রবেশ করল প্যাসেজে।
প্যাসেজে প্রবেশ করতেই পেছনের দরজা বন্ধ হয়ে গেল। আর দরজা বন্ধ হওয়ার সাথে সাথেই প্যাসেজটি আলোকিত হয়ে উঠল।
আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল আহমদ মুসা। অন্ধকার প্যাসেজ নিয়ে ভীষণ চিন্তায় পড়েছিল। কাছে টর্চ নেই, কি করে সে অন্ধকার প্যাসেজ দিয়ে সামনে এগুব! আল্লাহ সে সমস্যার সমাধান করে দিয়েছেন।
কিন্তু একটা বিষয় আহমদ মুসার মনে প্রবল অস্বস্তির সুষ্টি করল। সাগরিকা সেনদের কথায় আহমদ মুসা বুঝেছে, বন্দীখানার দরজা খুললে যে এ্যালার্ম বাজার ব্যবস্থা তা একাধিক জায়গায় রয়েছে। তাহলে মাত্র দুই প্রহরীই এল, আর কেউ খোঁজ নিল না কেন? বন্দীখানা থেকে বেরুলে আহমদ মুসাকে পালাবার জন্যে উপরে উঠতেই হবে এই নিশ্চিত বিশ্বাস নিয়ে কি ওরা ওপরেই প্রস্তুত হয়ে বসে আছে? কিংবা আন্ডারগ্রাউন্ড প্যাসেজ দিয়ে আহমদ মুসা পালাতে পারে এই বিষয়টা তারা কি বিবেচনাতেই আনেনি? আহমদ মুসা সম্পর্কে তারা এতটা নিশ্চিত হবে, এটা কি করে সম্ভব?
উত্তরহীন এ প্রশ্নগুলো থেকে সৃষ্ট অস্বস্তি নিয়েই আহমদ মুসা এগুচ্ছে প্যাসেজ দিয়ে।
এক জায়গায় এসে প্যাসেজ শেষ হয়ে গেল। সামনে দেয়াল। আহমদ মুসা বুঝল, এ দেয়ালেও একটা দরজা আছে এবং এটাই শেষ দরজা। এর পর তার মুক্তি।
আহমদ মুসা দরজার মুখোমুখি দাঁড়াল। দেখে খুশী হলো যে, এ দেয়ালেও নির্দিষ্ট স্থানে ক্ষুদ্রাকারে সেই মুক্ত ডানার পাখী আঁকা।
পাখিতে চাপ দিল আহমদ মুসা।
সংগে সংগে দেয়াল সরে গেল।
দেয়াল সরে যেতেই আহমদ মুসা দেখতে পেল একটা সিঁড়ি। সিঁড়িটা নিচে পানি পর্যন্ত নেমে গেছে।
সিঁড়ির গোড়ায় একটা বড় ধরনের মোটর বোট বাঁধা।
বোট দেখে আহমদ মুসা ভাবল, বোটটা বোধ হয় পারমাণবিক শেল্টার থেকে বেরুবার শেষ মাধ্যম।
আহমদ মুসা প্যাসেজ থেকে বেরিয়ে সিঁড়িতে এসে দাঁড়াল।
সংগে সংগেই পেছনে প্যাসেজের পথ বন্ধ হয়ে গেল।
সিঁড়ি হয়ে বোটে নামার জন্যে পা বাড়িয়েছে আহমদ মুসা, এই সময় বোটের কক্ষ থেকে ডেকে বেরিয়ে এল জেনারেল শ্যারন, ডেভিড উইলিয়াম জোনস এবং শিব শংকর সেন। তাদের তিনজনের পেছনে আরও চারজন স্টেনগানধারী।
‘আসুন আহমদ মুসা। আপনাকে আমরা স্বাগত জানাচ্ছি। আসুন।’ দুই হাত প্রসারিত করে আগ বাড়ানোর ভংগিতে বলল জেনারেল শ্যারন।
‘আমরা আপনার প্রশংসা করছি আহমদ মুসা। আপনি বলেই সম্ভব হয়েছে পারমাণবিক শেল্টার থেকে এভাবে বেরিয়ে আসা। আপনি সত্যিই অনন্য।’ বলল ডেভিড উইলিয়াম জোনস।
‘আপনার মত প্রতিদ্বন্দ্বী থাকাও গৌরবের। সত্যিই আমার বিশ্বাস হতে চাইছিল না যে, আমার অতি সাবধানে তৈরী পারমাণবিক শেল্টার থেকে বের হওয়ার কোড আপনি ভাঙতে পারবেন। আপনি সত্যিই অপ্রতিরোধ্য।’ শিব শংকর সেন বলল।
‘দেরী করে লাভ নেই আহমদ মুসা। আসুন। আপনার পেছনে ফেরার পথ বন্ধ। সামনেই আপনাকে এগুতে হবে। আর আপনি সামনে এগুতে ভালও বাসেন।’ বলল জেনারেল শ্যারন।
তার কথা শেষ হবার আগেই দুজন করে স্টেনগানধারী সিঁড়ির দুপাশ দিয়ে উঠে গিয়ে আহমদ মুসাকে ঘিরে ফেলল এবং ঘিরে রেখেই তাকে বোটে নামিয়ে নিয়ে এল।
‘মিঃ আহমদ মুসা, আধুনিক কোন কলাকৌশল দিয়ে আপনাকে আটকানো সম্ভব নয়। তাই আমরা ভাবছি প্রাচীন পদ্ধতিতেই আপনাকে বন্দী রাখতে হবে। যদিও তা একটু অমানবিক হয়। আর তাতো হতেই হবে। আপনি তো মানুষ নন, অতিমানুষ। অতিমানুষের জন্যে অমানবিক পদ্ধতিই দরকার।’ বলল জেনারেল শ্যারন।
‘সে জন্যে আমরা যেখানে যাচ্ছি, সেই ব্রাইট ফিল্ডে আমার গোডাউনটাই ওর উপযুক্ত জায়গা হবে।’ শিব শংকর সেন বলল।
‘আপনার ব্রাইট ফিল্ডটা কোথায় আমি চিনতে পারছি না।’ বলল ডেভিড উইলিয়াম জোনস।
‘আমার গ্রীষ্মকালীন অবকাশকেন্দ্র যেখানে সেই ‘আনাপোলিশ’ তো আপনি চেনেন। ঐ আনাপোলিশ থেকে যে প্রধান সড়কটি ওয়াশিংটন গেছে, সেই সড়কটির সাথে বাল্টিমোর থেকে আসা সড়কটি যেখানে মিলেছে সেটাই ব্রাইট ফিল্ড। এই ব্রাইট ফিল্ডে আমার একটি সফটওয়্যার ফ্যাক্টরী ও একটি গোডাউন আছে। এখানে প্রধানত রিমডেলিং ও রিএ্যাসেম্বলের কাজ হয়। এখানকার গোডাউনটা বিশাল ও বিচিত্র। ওখানে আহমদ মুসার মত শত লোককে হজম করা যায়।’
‘ধন্যবাদ মিঃ সেন। এরকমটাই আমরা চেয়েছিলাম।’
‘ধন্যবাদ।’ বলল শিব শংকর সেন।
আহমদ মুসাকে ততক্ষণে কোরবানীর গরুর মত আস্টে-পৃস্টে বাঁধা হয়েছে।
সেদিকে তাকিয়ে ডেভিড জোনস বলল, ‘স্যরি, মিঃ আহমদ মুসা, এর চেয়ে ভালো কোন ব্যবস্থা আপনার জন্যে সম্ভব নয়। তবে এই দুঃখের মধ্যে একটা সুসংবাদ শুনাই। আপনার প্রেমিকাকে হাসপাতাল থেকে ছাড়া হয়েছে। তবে পুলিশ বেস্টনী থেকে ছাড়া পায়নি। এক ঝাঁক এফ বি আই-এর লোক সর্বক্ষণ তার বাড়ি ঘিরে রেখেছে। তাদের আশংকা আমরা তাকে কিডন্যাপের পরিকল্পনা করেছি। সরকার তার একাকী কিংবা অবাধ যাতায়াত একেবারেই বন্ধ করে দিয়েছে। চিন্তা নেই, সে কিছূ করতে না পারলেও তার দল ‘ফ্রি আমেরিকা’ ভয়ংকর রকম তৎপর। তবে আফসোস, ইহুদী প্রতিষ্ঠান ও বাড়ি-ঘর তারা খঁজে মরছে। আপনি যে ভারতীয় আশ্যয়ে এটা তারা কল্পনাই করছে না। অতএব আপনি মুক্ত হবেন, কেউ আপনাকে মুক্ত করবে এ আশা এবার ছাড়তে পারেন। আফসোস সারা জেফারসনের জন্যে। আপনাকে না পেলে বেচারা মরেই যাবে।’
আহমদ মুসা কোন কথা বলল না। ঘৃনার ভাব ফুটে উঠেছে তার মুখে। সে মুখ ফিরিয়ে নিল ডেভিড জোনসের দিক থেকে।
উটে দাঁড়াল জেনারেল শ্যারন, ডেভিড জোনস এবং শিব সংকর সেন।
আহমদ মুসাকে টেনে নিয়ে চলল বোটে তার বন্দীখানার দিকে।

হোয়াইট হাউজের ‘Meet the Citizens’ কক্ষে বসে আছে আমেরিকান ভারতীয় এ্যাসোসিয়েশনের(ABA) সভাপতি ভারত ভূষণ শিবাজী, নির্বাহী পরিচালক বিনোদ বিহারী মালাকর, এই এসোসিয়েশনের প্রধান উপদেষ্টা শরৎসিং বর্মন এবং চীফ প্যাট্রন শিব শংকর সেন।
এরা সবাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশিষ্ট নাগরিক। সবাই এরা বিজনেস ম্যাগনেট এবং টাকার কুমীর।
এরা বড় একটা টেবিল ঘিরে বসে আছে। হোস্টের চেয়ার তখনও খালি। হোস্ট স্বয়ং প্রেসিডেন্ট এ্যাডামস হ্যারিসন। প্রেসিডেন্ট তখনও আসেনি।
প্রেসিডেন্ট এলো। সবাই দাঁড়িয়ে তাকে স্বাগত জানালভ
প্রেসিডেন্ট বসতে বসতে বলল, ‘স্যরি, একটা জরুরী টেলিফোন এ্যাটেন্ড করতে যেয়ে ২ মিনিট দেরী হয়েছে।’
‘এ কিছুই নয় মহামান্য প্রেসিডেন্ট। আমরা বরং ভয়ে ভয়ে আছি মহামান্য প্রেসিডেন্ট আমাদের চিনবেন কিনা?’ বলল এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ভারত ভূষণ শিবাজী।
প্রেসিডেন্ট হাসল। বলল, ‘আমি কি মিঃ শিবাজী, মিঃ সেন, মিঃ বর্মন ও মিঃ মালাকরদের মত লোকদের ভূলতে পারি, না ভুলা উচিত! আমি ভুলব কি করে যে, একদিনের একটা অনুষ্ঠানে আমার ইলেকশন ফান্ডে আপনারা ৩০ লাখ ডলার ডোনেট করেছিলেন। ওটাই ছিল সে বছর আমার ইলেকশন ফান্ডের সর্বোচ্চ ডোনেশন। আপনাদের এ্যাপয়েন্টমেন্ট ঠিক করা দেখে আমিই বরং লজ্জা পেয়েছি। যেখানে আমার ডাকা উচিত ছিল, সেখানে আপনারাই আমাকে ডেকেছেন। সত্যিই আমি দুঃখিত।’
‘মহামান্য প্রেসিডেন্ট, এই বিনয়ের জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ। আমরা খুশী হয়েছি যে, আপনার স্মৃতি থেকে আমরা কেউই মুছে যাইনি।’ বলল মিঃ শিবাজী।
‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে, তিনি ভুলিয়ে দেননি।’
বলে প্রেসিডেন্ট একটু থেমে সকলের উপর একবার চোখ বুলিয়ে বলল, ‘বলুন, আমি আপনাদের জন্যে কি করতে পারি?’
‘মহামান্য প্রেসিডেন্ট, আমরা একটা বড় বিষয় নিয়ে এসেছি। আমরা আপনার ফেভার চাই।’ বলল শিব শংকর সেন।
‘আমার ফেভার আপনাদের প্রতি রয়েছে, বলুন বড় ব্যাপারটা কি?’ প্রেসিডেন্ট বলল।
‘মহামন্য প্রেসিডেন্ট, আপনার সরকার ইহুদীদের উপর ক্র্যাক ডাউন করছে, এ বিষয়টি আমরা পুনর্বিবেচনার জন্যে অনুরোধ জানাতে চাই। ডেভিড উইলিয়াম জোনস ও জেনারেল শ্যারনের উপর ওয়ারেন্ট জারীর কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে চাই। আমাদের অনুরোধ তাদের ওয়ারেন্ট প্রত্যাহার করুন।’
প্রেসিডেন্টর হাসি মুখ হঠাৎ গম্ভীর হয়ে উঠল। বলল, ‘আপনারা এই চাওয়াটা চাচ্ছেন কেন, বলুন?’
‘তারা আমাদের দীর্ঘ দিনের সহযোগী। সীমাহীন উপকার তাদের কাছ থেকে পেয়েছি। আমেরিকার শান্তি-সমৃদ্ধিতে তাদের অবদান বিরাট। আমরা যারা আমেরিকাকে ভালবাসি এই বিপর্যয়ে তাদের পাশে না দাঁড়িয়ে আমাদের উপায় নেই।’ বলল ভারত ভূষণ শিবাজী।
‘আপনারা সাম্প্রতিক রিপোর্টগুলো কি দেখেছেন? প্রেসিডেন্ট বলল।
‘দেখেছি মহামান্য প্রেসিডেন্ট। পত্রিকার দলিল দস্তাবেজ সব সময় ঠিক হয় না। তাছাড়া মহামান্য প্রেসিডেন্ট আমাদের মনে হচ্ছে, কোথাও যেন একটা ভুল হয়ে যাচ্ছে। তা না হলে জন জ্যাকবের মত সর্বজন শ্রদ্ধেয় বিজ্ঞানী বিশ্বাসঘাতক হয়ে যাবেন, এ কেমন কথা!’ বলল শিব শংকর সেন।
‘ভুল হওয়ার সুযোগ কোথায়? লস আলামোসে যে গোয়েন্দা সুড়ঙ্গ রয়েছে তা জন জ্যাকবের বাড়ি থেকে এবং তা তার সময়েই তৈরী। এই জলজ্যান্ত সত্যকে কিভাবে মিথ্যা প্রমাণ করা যাবে?’ বলল প্রেসিডেন্ট।
‘আপনার কথা ঠিক মিঃ প্রেসিডেন্ট। কিন্তু এর মধ্যেও কোথাও একটা ফাঁক থেকে যাচ্ছে, যা বলার জন্যে আজ বিজ্ঞানী জন জ্যাকব বেঁচে নেই। যখন বেঁচে নেই, তখন তাকে বিশ্বাসঘাতক না সাজিয়ে ঠান্ডা মাথায় আরও চিন্তা করা দরকার। তাহলে আমরা মনে করি, ঠান্ডা যুদ্ধের সেই ঘোরতর দিনে ঐ সুড়ঙ্গ খোঁড়ার নতুন কোন তাৎপর্য বেরিয়ে আসবে।’ বলল ভারত ভূষণ শিবাজী।
‘শুধু তো ঐ সুড়ঙ্গই নয়, আরও অনেক কিছুর মধ্যে আচে আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনের হত্যা। সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ হয়েছে যে, এই হত্যাকান্ড ঘটিয়েছেন জেনারেল শ্যারন এবং উইলিয়াম ডেভিড জোনস। তাদের পক্ষে এখন আর বলঅর কি আছে?’ প্রেসিডেন্ট বলল।
‘ভিডিও টেপ কিংবা অডিও টেপ কোন সন্দেহাতীত প্রমাণ নয়।’ বলল শিব শংকর সেন।’ বলল শিব শংকর সেন।
‘শুধু তো অডিও টেপ নয়, আমাদের গোয়েন্দারা প্রমাণ পেয়েছে, যেখানে আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন খুন হয়েছেন, সে বাড়ির মালিক মিঃ ডেভিড জোনস। তাছাড়ড়া যে বুলেটে মারা গেছে সে বুলেটের স্পেসিফিকেশনের সাথে জেনারেল শ্যারনের রিভলবার মিলে যায়। আরও কথা হলো, হ্যারি ময়নিহানের কিডন্যাপের কি ব্যাখ্যা দেয়া যাবে?’ প্রেসিডেন্ট বলল।
‘এসব কথা আমরা পত্রিকায় পড়েছি। তারপরও আমরা বলছি, কারও শতবছরের সেবা ও অবদান মাত্র এ কয়টি ঘটনা দিয়ে মুছে ফেলা যায় না, তা ঠিকও নয় মহামান্য প্রেসিডেন্ট।’ বলল আবার শিব শংকর সেনই।’আপনাদের কথায় যুক্তি আছে। কিন্তু ঘটনা কয়টি যাই হোক তা এখন অনুসন্ধান ও আদালতের বিচার্য বিষয়। আসুন, আমরা বিচারের রায় পর্যন্ত অপেক্ষা করি।’ বলল প্রেসিডেন্ট।
‘অবশ্যই করব মহামান্য প্রেসিডেন্ট। কিন্তু তার আগে মহামান্য প্রেসিডেন্ট, জেনারেল শ্যারন ও মিঃ জোনসের জন্যে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিন এবং তাদের বিরুদ্ধে, ইহুদীদের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী যে অপপ্রচার চলছে, তা বন্ধ করুন মহামান্য প্রেসিডেন্ট।’ বলল ভারত ভূষণ শিবাজী।
‘স্যরি মিঃ শিবাজী, আপনিও জানেন ব্যক্তি বিশেষের স্বার্থে আমেরিকায় আেনের স্বাভাবিক গতিরুদ্ধ করার কোন সুযোগ নেই। অন্যদিকে স্বাধীন প্রেসের মুখে হাত চাপা দেবার কোন শক্তি তো মার্কিন সরকারের নেই।’
বলে প্রেসিডেন্ট থামল। একটু থেমেই আবার বলে উঠল, ‘ওরা আহমদ মুসাকে কিডন্যাপ করেছে, এটা একটা বড় ইস্যু হয়ে পড়েছে। সরকার খুবই বেকায়দায় পড়েছে মুসলিম দেশগুলোর কাছে। এই কাজ কেন করল ওরা?’
‘মহামান্য প্রেসিডেন্ট, ওরা অভিযোগ অস্বীকার করেছে। এ অস্বীকৃতির পর ওরা ঐ কাজ করেছে তা প্রমাণ হবার আগে তাদেরকে আর অভিযুক্ত করা ঠিক নয়।’ বলল ভারত ভূষণ শিবাজী।
‘আপনার এ কথা যেমন ঠিক, তেমনি শুধু অস্বীকার করেছে বলেই কাদেরকে সন্দেহ থেকে মুক্ত রাখা যাচ্ছে না। এই বাস্তবতাকেও আপনাদের জানতে হবে।’ প্রেসিডেন্ট বলল।
‘ঠিক মহামান্য প্রেসিডেন্ট।’ বলে একটু থামল ভারত ভূষণ শিবাজী। তারপর বলল, ‘মহামান্য প্রেসিডেন্ট, তাহলে আমরা কি নিয়ে ফিরছি?’
‘আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা।’ বলল প্রেসিডেন্ট ।
‘শুভেচ্ছা আমাদের যে বিষয়ে অনুরোধ সে পর্যন্ত সম্প্রসারিত হতে পারে না মহামান্য প্রেসিডেন্ট?’
‘এই ক্ষেত্রে আমি এ টুকু আশ্বাস দিতে পারি যে, আমি কোন অন্যায় ও উদ্দেশ্যমূলক কিছুকে প্রশ্রয় দেব না।’
‘ধন্যবাদ মিঃ প্রেসিডেন্ট। আমাদের শুভেচ্ছা সব সময় আপনার সাথে থাকবে।’ বলল ভারত ভূষণ শিবাজী।
‘ধন্যবাদ, আপনাদের কথা ভুলবো না।’ প্রেসিডেন্ট বলল।
সবাই উঠে দাঁড়াল।