৩১. ফ্রি আমেরিকা

চ্যাপ্টার

চ্যাপ্টার

ওয়াশিংটনের ভোর।
সকালের কুয়াশা তখন গভীর।
এরই মধ্যে ফেডারেল পুলিশ প্রধান বিল বেকারের মনে হল কুয়াশায় জড়িয়ে একজন মানুষ যেন পড়ে আছে রাস্তার পাশে।
‘ড্রাইভার গাড়ি দাঁড় করাও।’ সংগে সংগেই ড্রাইভারকে নির্দেশ দিল বেকার।
গাড়ি দাঁড়াল।
ফেডারেল পুলিশ প্রধান বিল বেকার পাশের লোকটির দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, ‘স্যার রাস্তার পাশে একটা মানুষ পড়ে আছে বলে মনে হচ্ছে।’
পাশে বসা লোকটি এফবিআই-এর প্রধান জর্জ আব্রাহাম জনসন।
জর্জ আব্রাহাম জনসন ও বিল বেকার ফিরছিল ভার্জিনিয়ার অরলিংটন থেকে। জরুরী প্রয়োজনে ভোর রাতে গিয়েছিল সেখানে। এখন ফিরছে।
বিল বেকারের কথা শুনে ভ্রুকুঞ্চিত হল জর্জ আব্রাহাম জনসনের। বলল, ‘চলুন তো, নেমে দেখি।’
কাছাকাছি হয়ে তারা নিশ্চিত হল, ঠিক একজন মানুষ রাস্তার পাশে পড়ে আছে।
আরও কাছাকাছি হয়ে তারা আঁৎকে উঠল, একজন মানুষের রক্তাক্ত লাশ এটা। আরও কাছাকাছি গেল তারা।
লাশটি চিৎ হয়ে পড়ে আছে। পরনে কমপ্লিট স্যুট।
লাশের মুখের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল জর্জ আব্রাহাম ও বিল বেকার দুজনেই।
লাশটি জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনের।
উদ্বেগ উৎকন্ঠা নিয়ে লাশের উপর একটু ঝুঁকে পড়ল তারা।
বুকে গুলীবিদ্ধ হওয়ার কেন্দ্র দুটি। আর এই দুটি গুলীতেই সে নিহত হয়েছে।
দেহে যা রক্ত লেগে আছে তা জমাট বাধা। মাটিতে রক্তের তেমন কোন চিহ্ন নেই। তার মানে অন্য জায়গায় হত্যা করে এখানে এনে ফেলে রাখা হয়েছে।
আরেকবার ভ্রুকুঞ্চিত হল জর্জ আব্রাহাম জনসনের। হত্যা করে সদর রাস্তার পাশে এনে লাশ ফেলে রাখবে কেন?
এই প্রশ্নটা দেখা দিয়েছে ফেডারেল পুলিশ প্রধান বিল বেকারের মনেও।
হঠাৎ তাদের নজর পড়ল লাশের বুকে রক্তের সাথে লেপটে থাকা একটা চিরকুটের দিকে।
তারা আরও ঝুঁকে পড়ল চিরকুটটা কি ও কেন তা দেখার জন্য।
চিরকুটে একটা মাত্র লাইন টাইপ করে লেখা। চিরকুটটা স্পর্শ না করে রক্তের ফাঁক দিয়ে যতটা পড়া গেল তাতে এই লেখাঃ ‘দেশের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে ইহুদীদের সহযোগিতার এটাই পরিণাম।’
লেখা পড়ে চমকে উঠল জর্জ আব্রাহাম ও পুলিশ প্রধান বিল বেকার দুজনেই।
উঠে দাঁড়াল দুজনেই।
বিল বেকার তাকাল জর্জ আব্রাহাম জনসনের দিকে। বলল, ‘আমি কিছু বুঝতে পারছি না স্যার। ওরা কি এধরনের কান্ড ঘটাতে পারে? ‘ফ্রি আমেরিকা মুভমেন্ট’ ও ‘হোয়াইট ঈগল’ এতটা পাগল হতে পারে যে, এই কান্ড ঘটিয়ে তা আবার সদর রাস্তার ধারে এনে তাতে এই সাইনবোর্ড দিয়ে রাখবে!’
এই প্রশ্নগুলো ভীষণভাবে পীড়া দিচ্ছিল জর্জ আব্রাহাম জনসনকেও। কিছুতেই হিসাব মেলাতে পারছিল না। বিশেষ করে আহমদ; মুসা যেখানে সারা জেফারসন ও গোল্ডওয়াটারের পাশে আছে, সেখানে এই ধরনের কান্ড ঘটতে পারে কি করে? তাহলে কি তাদের অজান্তে অতি উৎসাহী কেউ এই কান্ড ঘটিয়েছে? এটাও জর্জ আব্রাহামের মন মেনে নিতে পারছে না।
জর্জ আব্রাহাম জনসন বিল বেকারের প্রশ্নের উত্তরে বলল, ‘আমাকেও ব্যাপারটা অবাক করেছে। কিছু বুঝতে পারছি না বেকার।’
‘ঝামেলার এই চিরকুটটি তাহলে সরিয়ে ফেলব কি স্যার?’ বলল বিল বেকার আগ্রহী কন্ঠে।
জর্জ আব্রাহাম তাকাল বিল বেকারের দিকে। বলল, ‘না বেকার, চিরকুট না নিয়ে যেভাবে আছে সেভাবেই থাকবে। অপরাধীকে আড়াল করা নয়, তাকে আইনের হাতে সোপর্দ করাই আমাদের দায়িত্ব।’
‘ধন্যবাদ স্যার। আমি চিরকুটটাকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না তাই কথাটা বলেছি।’ বলল বেকার।
‘ধন্যবাদ বেকার। তুমি ওদের ডেকে পুলিশ কন্ট্রোলে টেলিফোন করতে বল। ওরা আসুক।’
জর্জ আব্রাহাম জনসনের গাড়ির পেছনেই ছিল তাদের টীম-পুলিশের গাড়ি।
বিল বেকার ডাকল তাদের।
গাড়ি থেকে ছয়জন পুলিশ নেমে দ্রুত এগিয়ে এল।
বিল বেকার ওদের মধ্যে যে অফিসার তাকে বলল, ‘ডিউটি পুলিশকে টেলিফোন কর, ওরা আসুক।’
সংগে সংগেই পুলিশ অফিসার তার অয়্যারলেস নিয়ে একটু দুরে সরে দাঁড়াল কথা বলার জন্যে।
এ সময় জর্জ আব্রাহাম জনসন চারদিকে একবার তাকিয়ে দ্রুত বলে উঠল, ‘বিল বেকার, এইতো সামনে আলেকজান্ডার হ্যামিলটনের বাড়ি। এতক্ষনে লাশের দিকে সব মনোযোগ থাকায় কোন দিকে তাকাবার ফুরসৎ হয়নি।’
‘ঠিক স্যার। তাহলে কি পুলিশ পাঠাব ওদের খবর দেয়ার জন্যে?’ বলল বিল বেকার।
‘পুলিশ নয়, তুমি নিজে যাও বেকার। মিসেস হ্যামিল্টনকে তুমি নিজে এ খবরটা দাও।’ জর্জ আব্রাহাম জনসন বলল।
‘অলরাইট স্যার।’
বলে বিল বেকার একজন পুলিশকে সাথে নিয়ে পা বাড়াল জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনের বাড়ির দিকে।
অল্পক্ষন পরে মিসেস আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনকে সাথে নিয়ে ফিরে এল বিল বেকার। মিসেস হ্যামিল্টন কাঁদছিলেন। তার সাথে তার এক মেয়ে, সেও কাঁদছিল।
মিসেস হ্যামিল্টন লাশ দেখে কান্নায় ভেঙে পড়ে আছড়ে পড়তে যাচ্ছিলেন মিঃ হ্যামিল্টনের লাশের উপর।
জর্জ আব্রাহাম তাকে ধরে ফেলে বলল, ‘ম্যাডাম ধৈর্য্য ধরুন, তদন্তের স্বার্থে লাশটা এমনই রাখতে চাই। দয়া করে একটু ধৈর্য্য ধরুন, আমাদের সাহায্য করুন।’
মিসেস হ্যামিল্টন বুঝল। সে লাশ আর স্পর্শ করতে গেল না। কিন্তু বাঁধভাঙা কান্নায় তার দেহ লুটিয়ে পড়ল মাটির উপর।
জর্জ আব্রাহাম সদ্য আসা অপেক্ষমান সংশ্লিষ্ট পুলিশ অফিসারকে সুরত হাল রিপোর্ট তৈরী করতে নির্দেশ দিল।
কাজে লেগে গেল পুলিশ অফিসার।
প্রথমেই চিরকুটটি জব্দ করল পুলিশ।
মিসেস হ্যামিল্টনও পড়ল চিরকুটটি। পড়ে কেঁদে উঠল। বলল, ‘ও গড, তাহলে ‘ফ্রি আমেরিকা’ ও ‘হোয়াইট ঈগল’রাই হত্যা করল আমার স্বামীকে আহমদ মুসার কুমন্ত্রনায়! ও গড, আমি কত নিষেধ করেছি তাকে এই সব রাজনীতিতে না জড়ানোর জন্য।’
মিসেস হ্যামিল্টনের চোখের সামনে নিহত মিঃ হ্যামিল্টনের পকেটের মানি ব্যাগ, কলম, চিরুনীসহ ছোট খাট সব জিনিসকেই জব্দ তালিকায় নিয়ে আসা হলো।
মিঃ হ্যামিল্টনের নীচের পকেট ঘড়ি জব্দ করতে গিয়ে পুলিশ অফিসারের মধ্যে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হলো। ভালো করে পরীক্ষা করতে গিয়ে অকস্মাৎ তার ভ্রুকুঞ্চিত হলো। সে ঘড়িটি পুলিশ প্রধান বিল বেকারের হাতে তুলে দিতে দিতে বলল, ‘স্যার ঘড়ির ছদ্মবেশে এটা একটা টেপ রেকর্ডার।’
বিল বেকার ঘড়িটির উপর একটু নজর বুলিয়ে পুলিশ অফিসারের কথায় সায় দিয়ে তা জর্জ আব্রাহাম জনসনের হাতে দিয়ে বলল, ‘আপনি দেখুন স্যার।’
রেকর্ডারটি পরীক্ষা করতে গিয়ে নতুন করে ভ্রুকুঞ্চিত হলো জর্জ আব্রাহাম জনসনের। বলল বিল বেকারকে লক্ষ্য করে, ‘থ্যাংকস গড! বেকার টেপটা অন করা আছে। তার মানে যা ঘটেছে, তার সবই অডিও রেকর্ডার এই টেপে আছে।’
বলতে বলতে মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল জর্জ আব্রাহামের।
‘এটা এই ঘটনার সবচেয়ে মূল্যবান দলিল স্যার।’ বলল বিল বেকার।
‘থ্যাংকস গড! আমি চাই ঐ দুর্বৃত্তদের শাস্তি হোক।’ বলল মিসেস হ্যামিল্টন।
‘অবশ্যই হবে ম্যাডাম।’ মুখে এই কথা বলল বটে জর্জ আব্রাহাম জনসন ও বিল বেকার দুজনেই, কিন্তু জর্জ আব্রাহাম ও বিল বেকার দুজনেরই মনের কোথায় যেন খচ করে উঠল। এতবড় ভুল ‘ফ্রি আমেরিকা’ মুভমেন্ট ও ‘হোয়াইট ঈগলে’র লোকরা করতে পারল, তা ভাবতে তাদের কষ্ট লাগছে।
সুরতহাল রিপোর্ট তৈরী শেষে জর্জ আব্রাহাম বলল, ‘এরা লাশ নিয়ে পুলিশ হেডকোয়ার্টারে যাক এবং লাশের ময়নাতদন্তের ব্যবস্থা করুক। চল আমরা মিসেস হ্যামিল্টনকে পৌছে দিয়ে পুলিশ হেডকোয়ার্টারে যাব। টেপটা শুনে তার কপি নিয়ে তবেই আমি ফিরব অফিসে।’
জর্জ আব্রাহাম জনসন ও বিল বেকার যখন পুলিশ হেডকোয়ার্টারে পৌছল তখন সকাল ৭টা।
পুলিশ প্রধান বিল বেকারের টেবিলে বসে রেকর্ডপ্লেয়ার বাজিয়ে টেপ শুনল তারা দুজন।
টেপ শুনে তারা বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে পড়েছিল। তারপর ভয়ানক উত্তেজিত হয়ে উঠল তারা দুজন।
‘স্যার, ডেভিড উইলিয়াম জোনস এবং জেনারেল শ্যারন খুন করেছে আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনকে। এখনি, আমি মনে করি, ওদের গ্রেফতার করা প্রয়োজন।’ বলল পুলিশ প্রধান বিল বেকার জর্জ আব্রাহাম জনসনকে লক্ষ্য করে।
‘আমি তোমার সাথে একমত বেকার। কিন্তু জানত ডেভিড উইলিয়াম জোনস কে? তিনি কাউন্সিল অব আমেরিকান জুইস এ্যাসোসিয়েশনসে’র সভাপতি। সেদিক থেকে সে রাজনৈতিক ক্ষমতাধর ব্যক্তি। আর জেনারেল শ্যারন আন্তর্জাতিক ইহুদী গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান।তার গায়ে হাত দেয়ার মধ্যে বাইরের রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ার ভয় আছে। সুতরাং তাদেরকে গ্রেফতারের জন্যে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত প্রয়োজন।’
‘তাহলে?’
‘প্রেসিডেন্টের অনুমতি নিতে হবে। দেখি প্রেসিডেন্টকে পাই কিনা।’
বলে জর্জ আব্রাহাম পকেট থেকে তার এফবিআই-এর মোবাইলটা বের করল।
প্রেসিডেন্টের বেড টেলিফোনে রিং করল।
এ টেলিফোন সরাসরি প্রেসিডেন্ট ধরেন।
ওপ্রান্তে প্রেসিডেন্টের গলা পেল জর্জ আব্রাহাম। বলল জর্জ আব্রাহাম দ্রুত নরম কন্ঠে, ‘মিঃ প্রেসিডেন্ট, স্যরি। এসময় টেলিফোন করলাম খুব জরুরী প্রয়োজনে।’
‘ধন্যবাদ মিঃ জর্জ। আমারও জরুরী প্রয়োজন। এই মুহুর্তে আপনাকে আশা করছিলাম। বলুন, আপনার প্রয়োজনটা কি?’
‘আমি এবং মিঃ বিল বেকার আপনার সাথে দেখা করতে চাই।’
‘এখন?’ প্রেসিডেন্ট বলল।
‘আমরা খুব উপকৃত হব মিঃ প্রেসিডেন্ট। বলল জর্জ আব্রাহাম
‘ভালই হলো। উইলিয়াম রুজভেল্ট, রোনাল্ড ওয়াশিংটন, ম্যাক আর্থারকে ডেকেছি। আপনাকে খুঁজছিলাম। শুনলাম অরলিংটন গেছেন। আপনি বিলকে নিয়ে এখনি চলে আসুন।’ বলল প্রেসিডেন্ট।
টেলিফোন রেখে দিয়ে জর্জ আব্রাহাম বিল বেকারকে প্রেসিডেন্টের কথা ব্রিফ করল এবং টেপটা পকেটে নিয়ে বলল, ‘চলুন উঠি।’
তারা বেরিয়ে এল অফিস থেকে।
তাদের গাড়ি ছুটল হোয়াইট হাউজের উদ্দেশ্যে।

হোয়াইট হাউজে প্রেসিডেন্টের ওভাল অফিস। ওভাল টেবিলে প্রেসিডেন্টের চেয়ারে প্রেসিডেন্ট এ্যাডামস হ্যারিসন আসীন।
তার সামনে ওভাল টেবিলের ওপাশে বসেছে প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা উপদেষ্টা উইলিয়াম রুজভেল্ট, জর্জ আব্রাহাম জনসন, এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার, বিল বেকার এবং জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন।
বৈঠকে প্রেসিডেন্টই কথা শুরু করেছে। বলছিল সে, ‘দেশ ও জনগনের স্বার্থের সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত একটা বিষয়ে পরামর্শের জন্যে আমরা এখানে বসেছি। ইহুদী গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান জেনারেল শ্যারনরা যে নিউজ সংবাদপত্র ও ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ায় প্রচার করেছিল তার জবাবে আহমদ মুসা, সারা জেফারসন ও গোল্ড ওয়াটাররা যে বক্তব্য সংবাদপত্র ও টিভি নেটওয়ার্কে পাঠিয়েছেন তার কপি এবং এ্যাডওয়ার্ড হ্যারি ময়নিহানের উদ্ধার সম্পর্কিত যে রিপোর্ট মিঃ জর্জ আব্রাহাম পাঠিয়েছেন তারও কপি রাতেই আপনারা সকলে পেয়েছেন। সব মিলিয়ে বিষয়টা এখন পরিষ্কার হয়ে গেছে। এ সম্পর্কে এখন আমাদের করনীয় কি? আপনাদের কাছে সে পরামর্শই জানতে চাই।’
প্রেসিডেন্ট থামতেই জর্জ আব্রাহাম জনসন বলল, ‘মিঃ প্রেসিডেন্ট, একটা বড় ঘটনা ঘটে গেছে। যে বিষয়ে কথা বলার জন্যে আপনার সাথে দেখা করতে চেয়েছিলাম। তা হচ্ছে, জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন গতরাতে খুন হয়েছেন। খুন……।’
জর্জ আব্রাহাম জনসনের কথার মাঝখানেই প্রেসিডেন্ট বলে উঠল, ‘আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন খুন হয়েছে!’
অন্য সবার চোখেও বিস্ময়। সবাই সোজা হয়ে বসেছে।
‘ইয়েস, মিঃ হ্যামিল্টন খুন হয়েছেন। খুন করেছে জেনারেল শ্যারন ও ডেভিড উইলিয়াম জোনস। আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন যখন ষড়যন্ত্রের কথা জানতে পারে, তখন আমেরিকার স্বার্থের বিরুদ্ধে যেতে সে অস্বীকার করে। আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন সব ফাঁস করে দেবে এই ভয়েই জেনারেল শ্যারনরা তাকে খুন করে।’
বলে জর্জ আব্রাহাম পকেট থেকে একটা টেপ বের করে টেবিলে রাখল। বলল, ‘এই টেপে জেনারেল আলেকজান্ডারের হত্যা ও হত্যাকালীন সকলের কথঅ বার্তার রেকর্ড আছে।’
‘রেকর্ডটা বাজিয়ে শুনান মিঃ জর্জ।’ বলে প্রেসিডেন্ট তার বাঁ হাত দিয়ে টেবিলের নিচের তলায় গোপন একটা সুইচ প্যানেলের একটিতে চাপ দিল।
সংগে সংগে জর্জ আব্রাহামের সামনে টেবিল ফুঁড়ে বেরিয়ে এল একটা ক্ষুদ্র ক্যাসেট প্লেয়ার।
জর্জ আব্রাহাম টেবিল থেকে মাইক্রো ক্যাসেটটা নিয়ে প্লেয়ারে বসিয়ে দিল।
প্লেয়ারটি কথা বলে উঠল। সাথে সাথে প্রেসিডেন্ট বলল, ‘জেনারেল শ্যারনের কথার মাঝখানে থেকে কথা শুরু হলো কেন মিঃ জর্জ?’
‘মিঃ প্রেসিডেন্ট, মনে হয়, জেনারেল হ্যামিল্টন ক্যাসেট অন করতে ভুলে গিয়েছিলেন, অথবা হতে পারে তিনি ওদের সন্দেহ করার পর ক্যাসেটটি অন করেন দলিল হিসেবে ওদের কথা রেকর্ডের জন্যে।’ বলল জর্জ আব্রাহাম।
‘ধন্যবাদ মিঃ জর্জ। ওইরকমই একটা কিছু ঘটে থাকতে পারে।’ প্রেসিডেন্ট বলল।
ক্যাসেট কথা বলে চলল।
সবার মনোযোগ হুমড়ি খেয়ে পড়েছে ক্যাসেট থেকে বেরিয়ে আসা শব্দগুলোর ওপর।
জেনারেল শ্যারন, ডেভিড উইলিয়াম জোনস এবং জেনারের হ্যামিল্টনের বাক বিনিময় তারা শুনল। শুনল জেনারেল হ্যামিল্টনের ভয়ার্ত কন্ঠ। তার জবাব শুনল জেনারেল শ্যারনের কন্ঠে। পরপরই তাদের কানের এল দুবার গুলীর শব্দ এবং জেনারেল হ্যামিল্টনের আর্তনাদ। জেনারেল হ্যামিল্টনের শেষ স্বগোতক্তি। সবশেষে ডেভিড উইলিয়াম জোনস জেনারেল হ্যামিল্টনের লাশ একটি চিরকুটসহ তার বাড়ির সামনে রেখে আসার যে নির্দেশ দিল সেটাও সকলে শুনল।
এরপর প্রেসিডেন্ট নিজেই ক্যাসেট প্লেয়ার বন্ধ করে দিল। বলল স্বগতকন্ঠে, ‘ঈশ্বর তার আত্মার মঙ্গল করুন। বেচারা বিভ্রান্ত হয়েছিল জেনারেল শ্যারনদের দ্বারা। কিন্তু জীবন দিয়ে সে প্রমাণ করে গেল সে একজন দেশ প্রেমিক আমেরিকান।’
‘নতুন বিশ্বব্যবস্থা(New World Order) প্রশ্নে ওদের মিষ্টি কথা অনেক আমেরিকানকেই বিভ্রান্ত করেছে। আমেরিকানদের কাছে বিষয়টি পরিষ্কার হওয়া দরকার।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
‘শুধু ‘অনেক আমেরিকানে’র কথা বলছেন কেন? সেদিন সারা জেফারসনের সাথে কথা বলার পর বিষয়টা নিয়ে আমি নতুন করে গভীরভাবে ভাবছি। জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন জীবন দিয়ে ঈশ্বরের কাছে তার যে প্রার্থনা রেখে গেলেন তা আমার হৃদয়কে আজ তীরের মত বিদ্ধ করছে মিঃ জর্জ।’ বলল প্রেসিডেন্ট। তার কন্ঠে গভীর আবেগ।
বলেই প্রেসিডেন্ট সোজা হয়ে বসল। বলল উইলিয়াম রুজভেল্টের দিকে তাকিয়ে, ‘বলুন মিঃ রুজভেল্ট আপনি কি ভাবছেন?’
উইলিয়াম রুজভেল্ট নড়ে-চড়ে সোজা হয়ে বসল। বলল, ‘আইনকে তার নিজস্ব গতিতে চলতে দেয়ার আমি পক্ষে। তবে মিঃ প্রেসিডেন্ট আপনি এই সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে রাজনৈতিক ফ্রন্টের শীর্ষ ইহুদী নেতাদের ব্রীফ করতে পারেন।’
তারপর প্রেসিডেন্ট তাকালেন জর্জ আব্রাহাম জনসনের দিকে। এইভাবে একে একে সবার মত নিলেন প্রেসিডেন্ট। সবাই সমর্থন করল উইলিয়াম রুজভেল্টকে।
সবার মত শোনার পর প্রেসিডেন্ট বলল, ‘আইনের গতিকে যদি শর্ত সাপেক্ষ করা হয় তাহলে তার নিজস্ব গতি থাকে না। সুতরাং শর্তের প্রয়োজন নেই।’
‘মিঃ প্রেসিডেন্ট আমি আলোচনার প্রস্তাব এজন্যে করেছিলাম যে, রাজনৈতিক ফ্রন্টে আমরা যাতে ক্ষতিগ্রস্থ না হই।’ বলল উইলিয়াম রুজভেল্ট।
‘মিঃ উইলিয়াম রুজভেল্ট ওদেরকে সব ব্যাপারে সম্মত করতে গেলে ওদের কিছু ব্যাপারে আমাদেরকে সম্মত হতে হবে। এই ভাবে সমঝোতা করলে আইনের নিজস্ব গতি বাধাগ্রস্থ হয়। রাজনৈতিক স্বার্থে এই সমঝোতা ঠিক নয়। ‘ফ্রি আমেরিকা’ ঠিকই বলছে যে, আমাদের রাজনীতি, আমাদের গনতন্ত্র, অর্থনীতি এর অনেক কিছু স্বার্থবাদী গ্রুপের হাতে পণবন্দী হয়ে পড়েছে। এই পণবন্দী অবস্থা শুধু আমাদের নয়, আমাদের জাতির স্বাধীন গতিকেও বাধাগ্রস্থ করেছে। আমাদের রাজনীতিকে এখন এখান থেকে সরিয়ে আনা দরকার।’
বলে প্রেসিডেন্ট একটু থামল। তাকাল জর্জ আব্রাহাম ও বিল বেকারের দিকে। বলল, ‘আপনারা বোধ হয় আমার সাক্ষাত চেয়েছিলেন তাদের গ্রেফতার করার অনুমতির জন্যে। আমি আদেশ দিচ্ছি, আপনারা আপাতত জেনারেল হ্যামিল্টনকে হত্যার অপরাধে ডেভিড উইলিয়াম জোনস এবং জেনারেল শ্যারনকে গ্রেফতার করতে পারেন। তবে হ্যারিকে কিডন্যাপ ও লস আলামোসের ঘটনা তদন্ত শেষ হওয়ার পর নতুন গ্রেফতারের সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে।’
‘মিঃ প্রেসিডেন্ট, ব্যাঙ্কার আইজ্যাক বেন গুরিয়ান ও সাবা বেন গুরিয়ানকে কিডন্যাপের ব্যাপারও আমরা সামনে আনতে পারি।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
‘অবশ্যই। ‘ফ্রি আমেরিকা’ ও ‘হোয়াইট ঈগল’রা যে প্রতিবাদ পত্রিকায় পাঠিয়েছে তাতেও এ প্রসঙ্গ এসেছে। সুতরাং অবশ্যই এরও তদন্ত শেষ করতে হবে এবং অপরাধীদের পাকড়াও করতে হবে। তার সাথে জর্জ জুনিয়রকে কিডন্যাপ করার ব্যাপারটাও আমরা সামনে আনতে পারি। মোট কথা হলো, সংশ্লিষ্ট কোন কিছুই বাদ দেয়া যাবে না।’ বলল প্রেসিডেন্ট।
‘মিঃ প্রেসিডেন্ট, শুরুতেই গ্রেফতারে না গিয়েও আমরা আইনকে এগিয়ে নিতে পারি।’ বলল প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা উপদেষ্টা উইলিয়াম রুজভেল্ট।
‘শুরু কোথায়? লস আলামোস নিয়ে যে ঘটনা তার তো এটা মাঝপথ! আর শুরু হলেই বা ক্ষতি কি? খুনি এবং জঘন্য গোয়েন্দা বৃত্তিতে লিপ্ত কাউকে গ্রেফতার করা যাবে না, মার্কিন বিবেক এতটা অন্ধ, মার্কিন আইন এতটা দুর্বল হয়ে যায়নি।’ প্রেসিডেন্ট বলল।
‘মিঃ প্রেসিডেন্ট আজ সকাল আটটায় সিনেট ও হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভ নেতৃবৃন্দের একটা গোপন বৈঠক আছে জেনারেল শ্যারনদের সাথে। প্রেসিডেন্টের আদেশ আমরা গ্রহন করলাম। কিন্তু আদেশটির বাস্তবায়ন হবে বৈঠকটির পর।’ জর্জ আব্রাহাম জনসন বলল।
‘তার মানে সিদ্ধান্তকে আপনি ঐ বৈঠকের ফল সাপেক্ষ করতে চান মিঃ জর্জ?’ বলল প্রেসিডেন্ট। তার কন্ঠে বিরক্তির সুর।
‘ঠিক বৈঠকের ফল সাপেক্ষ নয়। তবে আদেশ বাস্তবায়নের পন্থার মধ্যে নতুন কোন চিন্তা আসতে পারে মিঃ প্রেসিডেন্ট।’
প্রেসিডেন্টের মুখে এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘একটা নতুন চিন্তা আমি যোগ করছি মিঃ জর্জ। ঐ গোপন বৈঠক থেকে ফেরার পথে জেনারেল শ্যারন ও মিঃ ডেভিডকে গ্রেফতার করুন।’
প্রেসিডেন্ট থামল। কিন্তু থেমেই আবার হঠাৎ বলে উঠল, ‘ঠিক আছে মিঃ জর্জ বেলা ১২ টা পর্যন্ত এই আলোচনা আমরা মূলতবী করলাম। ঠিক ১২ টায় আমি আপনাদের এখানে চাই।’
‘ধন্যবাদ মিঃ প্রেসিডেন্ট।’ বলল জর্জ আব্রাহাম।
‘ধন্যবাদ সকলকে।’ প্রেসিডেন্ট বলল। তারপর উঠে দাঁড়াল।
সকলে হ্যান্ডশেক করে বিদায় নিল।

‘বৈঠক বসেছে ইন্টেলিজেন্স বিষয়ক হাউজ সিলেক্ট কমিটির চেয়ারম্যান এ্যান্ড্রু জ্যাকবস এর বাসায়।
ঠিক আটটাতেই মিটিং-এ উপস্থিত হয়েছে সিনেট চীফ চার্লস ডব্লিউ ওয়ারনার, হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভ চীফ বে রিচার্ডসন, সিনেট ইন্টেলিজেন্স স্পেশাল কমিটির চেয়ারম্যান আনা প্যাট্রসিয়া এবং ফরেন রিলেশনস হাউজ সিলেক্ট কমিটির চেয়ারম্যান বব এইচ ব্রুস। তাদের একটু পরেই এসেছে সিনেট ও হাউজের ডেমোক্র্যাট দলের সংসদীয় দুই দলনেতা জন টার্নার ও স্ল্যাড গার্টন।
সিনেট ও হাউজের রিপাবলিকান দুই সংসদীয় দলনেতা আসার কথা, কিন্তু এসে পৌঁছাননি।
মিটিং-এর হোস্ট এ্যান্ড্রু জ্যাকবস সবাইকে জানায়, সিনেটর দানিয়েল ময়নিহান পারিবারিক সমস্যার কারনে একটু দেরীতে আসবেন।
যারা মিটিং-এ এসেছেন, তাদের সবারই চোখে-মুখে প্রবল উত্তেজনার ছাপ।
মিটিং-এর হোস্ট এ্যান্ড্রু জ্যাকবস সবাইকে হাসি মুখে তার বাড়িতে স্বাগত জানান বটে, কিন্তু দেখা যায় তাকে দারুন বিব্রত।
সবাই বসার পর প্রথমেই কথা বলে সিনেট চীফ চার্লস ডব্লিউ ওয়ারনার। বলে এ্যান্ড্রু জ্যাকবসকে লক্ষ্য করে, ‘মিঃ জ্যাকবস জানলাম মিঃ ময়নিহান একটু দেরীতে আসবেন, মিঃ টার্নার ও গার্টনও নিশ্চয় এসেছেন। কিন্তু মিটিং যারা ডাকলেন, সেই মিঃ জোনসরা কোথায়?’
মুখটা মলিন হয়ে যায় এ্যান্ড্রু জ্যাকবসের। বলে সে, ‘স্যরি মিঃ ওয়ারনার, স্যরি টু অল, মিনিট বিশেক আগে আমি মিঃ ডেভিড উইলিয়াম জোনসের টেলিফোন পেলাম। তিনি জানালেন, ‘ফ্রি আমেরিকা’ ও ‘হোয়াইট ঈগল’-এর যে প্রতিবাদ পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়েছে ও টেলিভিশন নেটওয়ার্কে গেছে, তার পাল্টা প্রতিবাদ তৈরী নিয়ে তারা ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। তারা সবার কাছে মাফ চেয়েছেন এবং আগামীকাল সকাল ৮টা পর্যন্ত মিটিং মূলতবী করার জন্যে সবার কাছে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানিয়েছেন।’ থামে এ্যান্ড্রু জ্যাকবস।
কিন্তু কোন কথা কারো কাছ থেকে আসে না। গম্ভীর সবাই। অবশেষে কথা বলে বয়সে সবার প্রবীণ সিনেট চীফ চার্লস ডব্লিউ ওয়ারনার। বলে, ‘আপনাদের মত বলুন।’
আবার নিরবতা।
সবার চোখে-মুখে একটা বিরক্তির ভাব।
এবার কথা বলে সিনেট ইন্টেলিজেন্স কমিটির চেয়ারম্যান আনা প্যাট্রসিয়া। বলে, ‘আমরা মিটিং মূলতবী করবো কিনা, সে বিষয়ে কিছু বলার আগে আমি সকলকে আহবান জানাচ্ছি বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্যে। আমাদের এই একত্র হওয়া এতে কাজে লাগবে এবং কালকের সিদ্ধান্ত নেয়াও সহজ হবে।’
‘ভালো প্রস্তাব কিন্তু মিঃ জোনসের অনুপস্থিতিতে এই ব্যাপারে কি ফলপ্রসূ আলোচনা করা যাবে? তার চেয়ে আলোচনা তাদের প্রস্তাবমত কাল পর্যন্ত মূলতবী করাই কি ভালো নয়?’ বলে এ্যান্ড্রু জ্যাকবস অনেকটা দ্বিধাজড়িত কন্ঠে।
তার কথা শেষ হতেই স্ল্যাড গার্টন এ্যান্ড্রু জ্যাকবসকে সমর্থন করে বলে, ‘সত্যি মূল পক্ষের অনুপস্থিতিতে আলোচনা তেমন কাজে আসবে না। অনেক কিছুরই ব্যাখ্যা প্রয়োজন হবে।’ গার্টনের কন্ঠও শক্তিশালী নয়, দ্বিধাজড়িত।
জন টার্নার কথা বলার জন্য মুখ খুলছিল, কিন্তু তার আগেই আনা প্র্যাট্রসিয়া বলে ওঠে, ‘আমরা বিচার করতে বসছি না। সুতরাং কোন পক্ষের শোনানি নেবার প্রয়োজন পড়ে না। আমরা স্বাধীন নাগরিক হিসাবে চলমান একটা অবস্থা পর্যালোচনা করব। যে পর্যালোচনাটা সময়ের জন্যে খুবই প্রয়োজনীয়।’
আনা প্র্যাট্রসিয়ার কথা শেষ হবার সাথে সাথেই চার্লস ডব্লিউ ওয়ারনার, জন জে রিচার্ডসন এবং বব এইচ ব্রুস এক সঙ্গেই বলে ওঠে, ‘ঠিক আছে। আলোচনায় দোষ কি! সময়টা কাজে লাগুক।’
এই কথার সাথে চার্লস ওয়ারনার আরও যোগ করে, ‘আমার মনে হয় মিঃ শ্যারনরা আসেননি ভালই হয়েছে। ভোরে ‘ফ্রি আমেরিকা’র প্রতিবাদ পড়ার পর মনে হয়েছে, মিঃ শ্যারনদের সাথে কথা বলার আগে আমাদের একটা পৃথক আলোচনা দরকার। মনে হচ্ছে ঈশ্বরও চান এ আলোচনা হোক।’
‘ধন্যবাদ আপনাদের। ধন্যবাদ মিঃ ওয়ারনার। আমি ফ্রি আমেরিকার প্রতিবাদটা একবার নয়, কয়েকবার পড়েছি। সরকার, ফ্রি আমেরিকা সবাইকে অভিযুক্ত করে যে রিপোর্ট ছাপা হয়েছিল তার সাথে মিলিয়ে পড়েছি। এভাবে পড়তে গিয়ে আমি এত উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলাম যে সংগে সংগে আমি অনেকগুলো জায়গায় টেলিফোন করে কিছু বিষয়ে যাচাই করার চেষ্টা করেছি। আর তাতে আমার উদ্বেগ আরও বেড়েছে। এই বিষয়গুলো আমি মনে করি দেশের স্বার্থেই আলোচন হওয়া প্রয়োজন। মিঃ ওয়ারনারের মত আমারও মনে হয়েছে এনিয়ে আমাদের একটা পৃথক আলোচনা হওয়া দরকার।’ বলে প্যাট্রসিয়া।
আনা প্যাট্রসিয়ার কথা শেষ হতেই সিনেটের ডেমোক্র্যাট দলীয় নেতা জন টার্নার বলে ওঠে, ‘ঠিক আছে মিস প্যাট্রসিয়া। আলোচনায় নতুন কিছু পেলে সেটা আনন্দেরই হবে মনে হচ্ছে আপনি বিষয়টা নিয়ে বিশেষভাবে ভেবেছেন। সুতরাং আমি প্রস্তাব করছি, আপনিই প্রথমে আলোচনা শুরু করুন।’
অন্য সবাই জন টার্নারকে সমর্থন করে মাথা নাড়ে। শুধু এ্যান্ড্রু জ্যাকবস ও স্ল্যাড গার্টনের মুখ মলিন হয়ে উঠে।
‘থ্যাংকস অল।’ বলে কথা শুরু করে আনা প্যাট্রসিয়া, ‘আপনারা সকলেই পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট, টিভি চ্যানেলের সচিত্র বিবরণ দেখেছেন এবং এর প্রতিবাদটাও আপনারা আজ পড়েছেন। প্রথমে গোটা বিষয়ের উপর আমার ভাবনাটা তুলে ধরছি।’
বলে আনা প্যাট্রসিয়া একটু থামে। মুখটা নিচু করে বোধ হয় নিজেকে একটু আত্মস্থ করে, চিন্তাকে গুছিয়ে নেয়। তারপর শুরু করে, ‘গোটা বিষয়ের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো লস আলামোসের সুড়ঙ্গ।’ আমাদের বুঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে গোয়েন্দা সুড়ঙ্গ হওয়ার ব্যাপারটা আহমদ মুসার অপপ্রচার, এটা আসলেই এক্সিট সুড়ঙ্গ। ‘ফ্রি আমেরিকা’ ও ‘হোয়াইট ঈগল’-এর প্রতিবাদে এটা প্রকৃতই যে গোয়েন্দা সুড়ঙ্গ তার পক্ষে কতকগুলো প্রমাণ পেশ করা হয়েছে। প্রথম প্রমাণ হিসাবে সুড়ঙ্গের মাটি ও পাথরের কার্বন টেস্টের বরাত দিয়ে বলেছে, লস আলামোস স্ট্রাটেজিক রিসার্চ ল্যাবরেটরী যখন তৈরী হয়েছে, তখন সুড়ঙ্গ তৈরী হয়নি। সুড়ঙ্গ তৈরী হয়েছে সবুজ পাহাড়ে ইহুদী বিজ্ঞানী জন জ্যাকবের বাড়ি যখন তৈরী হয় তখন। দ্বিতীয় প্রমান হিসেবে সুড়ঙ্গের নির্মাণ-প্রকৃতির ব্যাপারে নির্মাণ-বিশেষজ্ঞদের বরাত দিয়ে বলেছে যে, সুড়ঙ্গটির নির্মাণ শুরু হয় সবুজ পাহাড়ের বিজ্ঞানী জন জ্যাকবের বাড়ি থেকে, লস আলামোস থেকে নয়। তৃতীয় প্রমাণ তারা দিয়েছে, সুড়ঙ্গে প্রবেশ-নিয়ন্ত্রনের ম্যাকানিজম রয়েছে সবুজ পাহাড়-প্রান্তের সুড়ঙ্গ মুখে। সবুজ পাহাড়ে জন জ্যাকবের বাড়িতে যিনি থাকবেন, তারই নিয়ন্ত্রণে থাকবে সুড়ঙ্গে প্রবেশ এবং বেরিয়ে আসার অধিকার। তাদের চতুর্থ প্রমাণ হলো, স্নায়ু-যুদ্ধকালীন সময়ের প্রেসিডেন্ট যারা বেঁচে আছেন এবং লস আলামোস স্ট্রাটেজিক রিসার্চ ল্যাবের সাবেক ডাইরেক্টরদের কেউই জানেন না এ ধরনের একটা সুড়ঙ্গের কথা।’
হাতের গ্লাসটা রেখে আসার জন্যে একটু থেমেছিলো আনা প্যাট্রসিয়া।
প্যাট্রসিয়া থামতেই সিনেট ডেমোক্র্যাট দলীয় নেতা জন টার্নার বলে ওঠে, ‘প্রমান চারটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু যাচাই-এর প্রশ্ন আছে।’
গ্লাস রেখে এসে বসছিলো আনা প্যাট্রসিয়া। সে কথা বলার জন্যে মুখ খোলে। কিন্তু তার আগেই সিনেট সভাপতি চার্লস ওয়ারনার বলে ওঠে, ‘ইয়েস মিঃ টার্নার। প্রমাণগুলো একেবারে সঠিক। এখন চাই এগুলো যে ফ্যাক্ট তার কনফারমেশন।’
‘ধন্যবাদ মিঃ ওয়ারনার, জন টার্নার। যদিও আমি জানি, সরকারী রিপোর্ট সব কথাকেই কনফার্ম করেছে। তবু আমি যাচাই করতে চেষ্টা করেছি। আমি লস আলামোসে ডঃ হাওয়ার্ডকে টেলিফোন করেছিলাম। তিনি সুড়ঙ্গে ঢুকেছিলেন। বললেন, তৃতীয় প্রমাণের কথাগুলো সত্য। সুড়ঙ্গটি শেষ হয়েছে সবুজ পাহাড়ের একটা অন্ধকূপে। সুড়ঙ্গমুখের এবড়ো-থেবড়ো একটা পাথুরে দরজা খুলে সে অন্ধকূপে ঢোকা যায়। কিন্তু এ দরজা খোলার চাবিকাঠি রয়েছে অন্ধকূপে। অন্ধকূপের দিক থেকে দরজা খুলে যে সুড়ঙ্গে ঢোকে সেই শুধু পারে সুড়ঙ্গ থেকে দরজা খুলে অন্ধকূপে ঢুকে বাইরে বেরিয়ে যেতে। এরপর…..।’
আনা প্যাট্রসিয়ার কথায় বাধা দিয়ে হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভের ফরেন রিলেশন্স কমিটির চেয়ারম্যান বব এইচ ব্রুস বলে, ‘আর কোন প্রমাণের দরকার নেই মিস প্যাট্রসিয়া। সুড়ঙ্গটি এক্সিট সুড়ঙ্গ হলে এর নিয়ন্ত্রন থাকতো লস আলামোসে। এর নিয়ন্ত্রন সবুজ পাহাড়ে থাকা নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে এটা গোয়েন্দা সুড়ঙ্গ। দুর্ভাগ্য আমাদের!’ বব এইচ ব্রুসের কন্ঠ ভারী ও মুখ মলিন।
‘তবু শোনা যাক না। সব বিষয়ে নিশ্চিন্ত হওয়ার মধ্যে কোন ক্ষতি নেই।’ ব্রুস থামতেই বলে ওঠে এ্যান্ড্রু জ্যাকবস। তার চোখে মুখে হতাশা।
এ্যান্ড্রুর কথা শেষ হলে আনা প্যাট্রসিয়া বলে, ‘যাচাই-এর জন্যে অন্য যে কয় জায়গায় আমি টেলিফোন করেছি , সব জায়গা থেকেই প্রমাণের পক্ষে ইতিবাচক জবাব মিলেছে। সুড়ঙ্গের সয়েল টেস্ট ও নির্মাণ টেস্ট দুটোই করেছে লস এঞ্জেলসের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার বিজ্ঞানী ও ইঞ্জিনিয়াররা। ‘ফ্রি আমেরিকা’ প্রতিবাদে যা বলেছে, সে কথা তাদের কাছ থেকেও শুনেছি। আর ডঃ হাওয়ার্ড বলেছেন, লস আলামোস স্ট্যাটেজিক ল্যাবের সাবেক পরিচালকরা কেউই জানতেন না এ ধরনের সুড়ঙ্গের কথা। এমনকি স্নায়ু যুদ্ধের সবচেয়ে চরম মুহূর্ত ষাটের দশকে লস আলামোস ল্যাবের পরিচালক ছিলেন শতায়ু মিঃ বেঞ্জামিন বাকনুর। তিনি নিজেই টেলিফোন করেছিলেন ডঃ হাওয়ার্ডকে। তিনি ঐ ধরনের কোন এক্সিট সুড়ঙ্গ থাকার কথা অস্বীকার করেছেন।’
‘ধন্যবাদ মিস প্যাট্রসিয়া। অন্তত আমার কাছে আর কোন অস্পষ্টতা নেই। সব ঘটনার মূল ঘটনা হলো সুড়ঙ্গ। সুড়ঙ্গটা যেহেতু গোয়েন্দা সুড়ঙ্গ, সেহেতু ফ্রি আমেরিকার প্রতিবাদের সব কথাই সত্য বলে ধরে নিতে হবে।’ বলে ওঠে বব এইচ ব্রুস।
কিন্তু মিঃ ব্রুস, তার অর্থ এই নয় যে মিঃ শ্যারন ও মিঃ ডেভিড জোনসরা মানে ইহুদীরা আসামী হবেন।’ ক্ষুদ্ধ কন্ঠে বলে ওঠে এ্যান্ড্রু জ্যাকবস।
‘তা ঠিক। কিন্তু আমরা এখানে আসামী নির্ধারন করছি না। দু’রকম তধ্যের মধ্যে থেকে সত্যটা বের করে নেয়ার চেষ্টা করছি।’ বলে আনা প্যাট্রসিয়া।
‘মিস প্যাট্রসিয়া, লস আলামোস রোড ও সান্তাফে বিমান বন্দরের দুই সন্ত্রাসী ঘটনা সম্পর্কে আপনি কি ভেবেছেন সেটা বলুন।’ বলে ওঠে হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভ ডেমোক্র্যাট দলীয় নেতা স্ল্যাড গার্টন। আলোচনার মধ্যে এই প্রথম কথা বলে সে।
‘লস আলামোস-সান্তাফে রোডে যে সন্ত্রাসীরা নিহত হয়েছিল, তাদের কাছে তাদের পরিচয় প্রমাণ করার মত কিছু পাওয়া যায়নি। তারা কেউই আমেরিকান ব্ল্যাক বা শ্বেতাঙ্গ নয়। তাদের জাতিগত উদ্ভব সম্বন্ধীয় (Anthropology) টেস্ট হয়েছে জর্জ ওয়াশিংটন টেস্ট ইউনিভার্সিটির অ্যানথ্রোপলজি বিভাগে। পরীক্ষা করেছেন বিজ্ঞানী ডঃ লি এইচ হ্যামিল্টন। তাঁর কাছে জেনেছি তারা সবাই সাবেক ইসরাইল এলাকার ইহুদী বংশোদ্ভুত বলে পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে। অন্যদিকে সান্তাফে বিমান বন্দরে এফবিআই-এর যে বিমান বিস্ফোরণে ধ্বংস হয়, সে বিমান যার চালানোর কথা ছিল এবং বিমানটি টেক অফের কয়েক মিনিট আগে যিনি অসুস্থ হয়েছেন বলে চলে যান। পরে প্রমানিত হয় অসুস্থতার ভান করে তিনি পালিয়ে যান, তিনি ধরা পড়েছেন। তিনি স্বীকার করেছেন বোমা পাতার কথা। জেনারেল শ্যারনরাই সে বোমা তাকে সরবরাহ করে অহমদ মুসাসহ তদন্ত টীমের কর্মকর্তাদের হত্যার জন্যে।’ বলে আনা প্যাট্রসিয়া।
আনা প্যাট্রসিয়া কথা শেষ করলে একটা নিরবতা নেমে আসে।
সবাই ভাবছে।
নিরবতা ভংগ করল এ্যান্ড্রু জ্যাকবস। বলল, ‘আমরা এভাবে ইহুদীদের প্রতিপক্ষ হিসাবে দাঁড় করাচ্ছি এটা কি ঠিক? আর দু’একজনের স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে জেনারেল শ্যারনের মত সম্মানিত ব্যক্তিকে আমরা আসামী হিসাবে দাঁড় করাব এটাও ঠিক নয়।’
‘না, না, ইহুদীরা অবশ্যই প্রতিপক্ষ নয়। মাত্র একটা গ্রুপ ষড়যন্ত্রকারী হিসাবে আমাদের সামনে আসছে। এদের সাথে দেশপ্রেমিক ইহুদীদের কোনই সম্পর্ক নেই। আর জেনারেল শ্যারনের মত সম্মানিত লোককে বিনা তদন্তে, বিনা প্রমাণে আসামী….।’
কথা শেষ করতে পারল না চার্লস ওয়ারনার। ড্রইং রুমে প্রবেশ করল দানিয়েল ময়নিহান এবং সেই সাথে তার ছেলে হ্যারি এ্যাডওয়ার্ড ময়নিহান।
হ্যারি এ্যাডওয়ার্ডের বিধ্বস্থ চেহারা।
তার কপালে ও হাতে ব্যান্ডেজ।
ঘরে প্রবেশ করেই দানিয়েল ময়নিহান বলল, ‘গুড মর্নিং টু অল। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ মধ্যরাতে হ্যারিকে ফিরে পেয়েছি। আমি….।’
ময়নিহানের কথার মাঝখানেই কথা বলে উঠল আনা প্যাট্রসিয়া, ‘মাফ করবেন মিঃ ময়নিহান। হ্যারি মুক্ত হওয়ার সংবাদ আমরা পেয়েছি। কিন্তু মুক্ত করল কে? কিভাবে?’
‘হ্যারিকে আমায় বাসায় নিয়ে এসেছে এফবিআই-এর লোকেরা। কিন্তু হ্যারিকে মুক্ত করার অভিযান চালিয়েছিল স্বয়ং আহমদ মুসা এবং সারা জেফারসন। হ্যারিকে মুক্ত করার পূর্ব মুহুর্তে তারা এফবিআইকে ডাকে ক্রিমিনালদের গ্রেফতার করার জন্য।’
‘আহমদ মুসা ওকে উদ্ধার করেছে? তাহলে ওকে কিডন্যাপ করেছিল কে?’ বলল এ্যান্ড্রু জ্যাকবস।
‘কিডন্যাপ করেছিল জেনারেল শ্যারনরা।’ বলল দানিয়েল ময়নিহান।
চোখ ছানাবড়া হয়ে গেছে এ্যান্ড্রু জ্যাকবসের। বিস্ময় ফুটে উঠেছে অন্য সবার চোখে মুখে।
‘এটা কি বিশ্বাসযোগ্য মিঃ ময়নিহান? স্বীকার করতেই হবে ডেভিড উইলিয়াম জোনসের মত ইহুদী নেতাদের সাথে এবং সেই সুবাদে জেনারেল শ্যারনের সাথে আমাদের সম্পর্ক খারাপ নয়। কেন তারা কিডন্যাপ করবে আপনার ছেলেকে?’ চোখে মুখে প্রবল অবিশ্বাস নিয়ে বলল এ্যান্ড্রু জ্যাকবস।
‘মিঃ জ্যাকবস, অনেক সত্য আছে যা বিশ্বাসের আওতায় পড়ে না। এটা সে ধরনেরই একটা সত্য।’ বলল দানিয়েল ময়নিহান। গম্ভীর কন্ঠ তার।
‘তাহলে ফিলিপকে খুন করেছে জেনারেল শ্যারনরাই?’ উত্তেজিত কন্ঠে বলল এ্যান্ড্রু জ্যাকবস। তার দুচোখ লাল হয়ে উঠেছে।
‘হ্যাঁ তারাই খুন করেছে।’ বলল দানিয়েল ময়নিহান।
‘কিন্তু কেন? ফিলিপ একজন সামান্য হাউজ সেক্রেটারী। তাকে খুন করতে যাবে তারা কোন স্বার্থে?’ বলল এ্যান্ড্রু জ্যাকবস।
‘এর মূলে আছে একটা রেকর্ডেড ক্যাসেট।’ বলল দানিয়েল ময়নিহান।
‘বুঝলাম না।’ এ্যান্ড্রু জ্যাকবস বলল।
‘সেদিন আমরা জেনারেল শ্যারনদের সাথে যে বৈঠক করেছিলাম, তার গোটা আলোচনা আমাদের অজান্তে গোপনে রেকর্ড করে জেনারেল শ্যারন। সেটাই সে ভুলে ফেলে যায়। যেহেতু মিটিং-এর পর ঘরে একমাত্র ফিলিপই যাবার কথা এবং তারই ক্যাসেটটি পাবার কথা। আমরা যখন ঘুমিয়ে, তখন ক্যাসেটটি উদ্ধারের জন্যে জেনারেল শ্যারনরা আমার বাড়িতে ফিলিপের কাছে আসে।’ দানিয়েল ময়নিহান বলল।
‘কিন্তু ক্যাসেটটি ফিলিপ পেলে দিয়ে দেবার কথা। সে খুন হেবে কেন? আর হ্যারিইবা কিডন্যাপ হবে কেন?’ বলল এ্যান্ড্রু জ্যাকবস।
‘ক্যাসেটের কথা গোপন রাখতে হলে ফিলিপ ও হ্যারিকে সরিয়ে দেয়া ছাড়া তাদের উপায় ছিল না।’ বলল দানিয়েল ময়নিহান।
‘সাংঘাতিক ঘটনা। গোটা ব্যাপার একটু খুলে বলুন তো?’ বলল চর্লস ওয়ারনার।
‘ঘটনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল হ্যারি। এ জন্যেই ওকে নিয়ে এসেছি।’ বলে দানিয়েল ময়নিহান তাকাল হ্যারির দিকে। বলল, ‘বেটা বলত সেদিন কি ঘটেছিল?
হ্যারি সেদিন রাতে সেই মিটিং রুমে যাওয়া থেকে শুরু করে তার কিডন্যাপ হওয়া, তার বন্দী সময়ের অবস্থা, তার উদ্ধারের ঘটনা সব সংক্ষেপে বর্ননা করল।
সকলেই গভীর আগ্রহে হ্যারির কথা শুনল। হ্যারির কথা শেষ হতেই আনা প্যাট্রসিয়া বলল, ‘সাংঘাতিক দু্ঃসাহস জেনারেল শ্যারনদের। কিন্তু হ্যারি ক্যাসেটটা তোমার কাছে এতটা গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছিল কেন?’
‘গোপনে রেকর্ড করা হয়েছে বুঝতে পেরে এবং জেনারেল শ্যারন ক্যাসেটটাকে অত গুরুত্ব দেয়ায় আমার কৌতুহল সৃষ্টি হয়। নিশ্চয় এতে এমন কিছু থাকতে পারে যা দিয়ে আমার আব্বাদের সে বিপদে ফেলতে পারে। তারপর ক্যাসেটটা শোনার পর আমি নিশ্চিত হই যে, শ্যারনরা একটা ষড়যন্ত্র করছে যা আমাদের আমেরিকান স্বার্থের পরিপন্থী।’ বলল হ্যারি।
‘কিন্তু ক্যাসেটটা তোমার আব্বাকে না দিয়ে রবিন নিক্সনকে দিলে কেন?’ জিজ্ঞেস করল জন রিচার্ডসন।
হ্যারি তার আব্বার দিকে একবার তাকিয়ে মুখ নিচু করল। চোখে-মুখে নেমে এল তার বিব্রতভাব। জবাব দিল না প্রশ্নের।
হ্যারির আব্বা দানিয়েল ময়নিহান হাসল। বলল, ‘তারা দু’ভাইবোন মনে করেছে ক্যাসেটটা পেলে আমি একে কাজে লাগাব না, এমনকি ব্যাপারটা জেনারেল শ্যারনরা জেনেও ফেলতে পারে। সে জন্যে ক্যাসেটটা রবিন নিক্সনকে পৌছিয়েছে এবং রবিন সেটা সংগে সংগেই ‘ফ্রি আমেরিকা’র হাতে তুলে দিয়েছে।’
চর্লস ওয়ারনারের মুখে মিষ্টি হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘হ্যারি, তোমরা দু’ভাই-বোন কি তাহলে ‘ফ্রি আমেরিকা’ মুভমেন্টের সাথে আছ?’
হ্যারির বিব্রত অবস্থা বেড়ে গেল। সে মাথা তুলল না, জবাবও দিল না।
‘মিঃ ময়নিহান, আপনার বাড়িই দেখছি আপনার বেদখল হয়ে গেছে।’ বলল জন রিচার্ডসন।
হাসল দানিয়েল ময়নিহান।
অসহায় অবস্থা দাঁড়াল হ্যারির।
মিষ্টি হাসি ফুটে উঠল আনা প্যাট্রসিয়ার ঠোঁটে। বলল, ‘ভেবনা হ্যারি, আমরা কিন্তু সবাই খুশী।’
বলে একটু থামল আনা প্যাট্রসিয়া। মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল তার। বলল আবার, ‘আমেরিকা তোমাদের জন্য গর্ববোধ করবে হ্যারি। তেমার পিতার চেয়ে বেশী গুরুত্ব দিয়েছ দেশকে। তোমরাই প্রকৃত আমেরিকান। সত্যিই ফ্রি আমেরিকা তোমাদের দ্বারাই পুনর্জীবিত হবে।’
‘ধন্যবাদ মিস প্যাট্রসিয়া। আমিও গর্বিত হ্যারিদের জন্যে। বলল দানিয়েল ময়নিহান।
আবেগে উজ্জীবিত তরুণ হ্যারির দুগন্ড বেয়ে অশ্রু গড়াল। আনন্দের অশ্রু।
দানিয়েল ময়নিহান ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে তার পিঠ চাপড়ে বলল, ‘ধন্যবাদ বেটা।’
দানিয়েল তার আসনে ফিরে এলে চার্লস ওয়ারনার বলল, ‘ধন্যবাদ হ্যারি। তুমি এখন একটু বাইরে থেকে বেড়িয়ে এস?’
মুখ তুলল হ্যারি। তার ঠোঁটে হাসি। বলল, ‘অবশ্যই স্যার। সকলকে ধন্যবাদ।’
বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল হ্যারি।
হ্যারি বেরিয়ে যেতেই চার্লস ওয়ারনার কলে উঠল, ‘আমরা আমাদের আলোচনায় এবার উপসংহার টানতে পারি।’
কিছু বলতে যাচ্ছিল জন রিচার্ডসন।
এসময় মোবাইলে কল এল আনা প্যাট্রসিয়ার।
থেমে গেল রিচার্ডসন।
‘মাফ করুন।’ বলে মোবাইল তুলে নিল আনা প্যাট্রসিয়া।
টেলিফোনে কথা বলতে গিয়ে, ভ্রুকুঞ্চিত হল আনা প্যাট্রসিয়ার। ‘ও গড!’ বলে আর্তনাদ করে উঠল সে। শেষ দিকে চোখ-মুখ তার উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, ‘ঈশ্বর আমাদের সাহায্য করুন।’
মোবাইল অফ করে দিয়েই সবার দিকে চেয়ে সে বলে উঠল, ‘একটা দু্ঃসংবাদ। জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন খুন হয়েছেন আজ রাতে। জর্জ আব্রাহাম জানালেন।’
‘ও গড!’ বলে সকলে বুকে ক্রস আঁকল। মলিন হয়ে উঠল সকলের মুখ।
কয়েকমুহূর্ত কেউ কোন কথা বলল না।
নিরবতা ভাঙল এ্যান্ড্রু জ্যাকবস। বলল, ‘আর কিছু বলেছেন মিঃ জর্জ আব্রাহাম?’
‘বলেছেন, নিহত জেনারেল আলেকজান্ডারের কাছ থেকে যে দলিল উদ্ধার হয়েছে তাতে জেনারেল শ্যারনদের সাথে তার মতানৈক্যের কারনেই তিনি নিহত হয়েছেন। সম্ভবত জেনারেল আলেকজান্ডার তার বিপদ আঁচ করতে পেরে তাঁর পকেটের গোপন রেকর্ডার অন করে রেখেছিলেন। তাতে খুনীদের সাথে গোটা কথপোকথন, এমনকি গুলীর শব্দ এবং মুমূর্ষু জেনারেল আলেকজান্ডারের শেষ স্বগোতোক্তি পর্যন্ত ধরা পড়েছে।’
‘ও গড! কে তার খুনী? জেনারেল শ্যারন?’ আর্তনাদ করে ঊঠল চার্লস ওয়ারনারের কন্ঠ।
‘ক্যাসেটে জেনারেল আলেকজান্ডার ছাড়াও আরও দুজন জেনারেল শ্যারন ও ডেভিড উইলিয়াম জোনসের কন্ঠ রয়েছে। ক্যাসেট অনুসারে জেনারেল শ্যারন গুলী করেছে জেনারেল আলেকজান্ডারকে।’ বলল আনা প্যাট্রসিয়া।
‘ও গড! জর্জ আব্রাহামরা এখনও কি বসে আছেন?’ প্রায় একসংগেই বলে উঠল সিনেট ও প্রতিনিধি পরিষদের ডেমোক্র্যাট দলীয় নেতা জন টার্নার ও স্ল্যাড গার্টন।
‘না ওরা বসে নেই। ওরা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে বেরিয়ে পড়েছেন। পথ থেকে টেলিফোন করেছেন জর্জ আব্রাহাম।’ বলল আনা প্যাট্রসিয়া।
‘ঈশ্বর সাহায্য করুন!’ বলে উঠল সকলেই। এ্যান্ড্রু জ্যাকবসও এদের মধ্যে রয়েছেন।
এ সময় ঝড়ের মত কক্ষে প্রবেশ করল সিনেট ও প্রতিনিধি পরিষদে রিপাবলিকান দলীয় নেতা ডন এ্যাডওয়ার্ড ও স্টিভ বায়ার।
ঘরে ঢুকেই ডন এ্যাডওয়ার্ড বলল, ‘গুড মর্নিং টু অল, কিন্তু গুড নিউজ ও ব্যাড নিউজ আছে সকলের জন্যে এবং স্যরি ফর আওয়ার লেট।’ এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলল ডন এ্যাডওয়ার্ড।
‘গুড মর্নিং মিঃ এ্যাডওয়ার্ড ও মিঃ বায়ার। ব্যাড নিউজটা বোধ হয় আমরা জানি। গুড নিউজটা কি?’ বলল চার্লস ওয়ারনার।
‘গুড নিউজটা হলো ফ্রি আমেরিকার একটা চমৎকার প্রতিবাদ এসেছে পত্রিকায়।’
বলেই একটু থেমে আবার শুরু করল ডন এ্যাডওয়ার্ড, ‘ব্যাড নিউজটা কি শুনেছেন আপনারা? জেনারেল আলেকজান্ডারের নিহত হওয়া?’
‘হ্যাঁ।’ বলল চার্লস ওয়ারনারই।
‘কিন্তু খুনীরা কে জানেন?’
‘জানি, জেনারেল শ্রারন ও ডেভিড উইলিয়াম জোনসকে সন্দেহ করা হয়েছে।’ বলল চার্লস ওয়ারনার।
‘সন্দেহ কি, একেবারে হাতে নাতে ধরা পড়ার মত ঘটনা। আমরা এফ বি আই অফিসে গিয়েছিলাম। রেকর্ড শুনে এলাম। টেপে জেনারেল হ্যামিল্টন, জেনারেল শ্যারন এবং ডেভিড উইলিয়াম জোনসের গলা একদম পরিষ্কার। সন্দেহের সামান্যও কোন অবকাশ নেই।’
‘কিন্তু মিঃ এ্যাডওয়ার্ড, নিহত জেনারেল হ্যামিল্টনের পকেটে এ ধরনের টেপ পাওয়া কি অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে না?’ বলল এ্যান্ড্রু জ্যাকবস।
‘না, অস্বাভাবিক নয়। টেপ শুনলে আপনার কাছেও বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। টেপে তাদের গোটা আলোচনার রেকর্ড নেই। টেপে কথা হঠাৎ করে জেনারেল হ্যামিল্টনের একটা বক্তব্যের মাঝখান থেকে শুরু হয়েছে। এর অর্থ জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন যখনই জেনারেল শ্যারনদের সন্দেহ করেছেন, তখনই তার পকেটে রাখা মাইক্রো রেকর্ডারটা অন করেছেন। সম্ভবত তিনি চেয়েছিলেন জেনারেল শ্যারনদের ষড়যন্ত্রের দলিল যোগাড় করতে।’
আনা প্যাট্রসিয়া কিছু বলার জন্য মুখ খুলেছিল, কিন্তু তার আগেই ডন এ্যাডওয়ার্ড আবার শুরু করল, ‘জেনারেল শ্যারনদের যে ষড়যন্ত্র জেনারেল আলেকজান্ডার জানতে পারেন সেটা যাতে তিনি বাইরে প্রকাশ করতে না পারেন এজন্যে তাকে খুন করা হয়েছে। সম্ভবত জেনারেল শ্যারনকে রিভলবার বের করতে দেখেই জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন ভীতকন্ঠে চিৎকার করে উঠেছিলেন, ‘একি করছেন মিঃ শ্যারন। আমি একটা সত্য আপনাদের জানিয়েছি মাত্র। আমি আপনাদের শত্রু নই।’ জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনের এই আকুল আবেদনের জবাবে জেনারেল শ্যারন কি বলেছিলেন জানেন? বলেছিলেন ‘এই সত্যই আমাদের শত্রু হ্যামিল্টন। এই সত্য আপনার মুখ দিয়ে বাইরে যাক আমরা তা চাই না।’ জেনারেল শ্যারনের এই কথার পর পরই দুবার গুলীর শব্দ শোনা গেছে। তার সাথে সাথেই শোনা গেছে জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনের আর্তনাদ। মুমূর্ষু জেনারেল হ্যামিল্টনের শেষ কথা কি ছিল জানেন? তাঁর শেষ কথা ছিল, ‘আমার আমেরিকাকে ঈশ্বর রক্ষা করুন এই ষড়যন্ত্রের হাত থেকে। আমি আমেরিকার জন্যে নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখতাম, আমেরিকার সে নতুন পৃথিবী হোক আমাদের ফাউন্ডার ফাদারসদের, কোন ষড়যন্ত্রকারীদের নয়।’
থামল ডন এ্যাডওয়ার্ড। শেষের দিকে আবেগে ভারী হয়ে উঠেছিল ডন এ্যাডওয়ার্ডের কন্ঠ। তার দুচোখের কোণ সিক্ত হয়ে উঠেছিল অশ্রুতে।
সে কথা বলতে পারল না।
কথা বলে উঠল হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভের রিপাবলিকান দলীয় নেতা স্টিভ বায়ার। বলল, ‘জানেন জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনের এই কথার পর ডেভিড উইরিয়াম জোনস কি বলেছিল? বলেছিল, ‘থ্যাংকস জেনারেল শ্যারন। প্যাট্রিওটিজমের বীজগুলোকে এইভাবেই ধ্বংস করা উচিত।’ থামল স্টিভ বায়ার।
সে থামতেই সিনেট ও হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভের ডেমোক্র্যাট দলীয় নেতা জন টার্নার ও স্ল্যাড গার্টন প্রায় একসাথেই বলে উঠল, ‘বিশ্বাসঘাতক জোনস প্যাট্রিওটিজমের বীজ উপড়ে ফেলতে চায়! তার দুঃসাহস কোথায় গিয়ে ঠেকেছে!’
‘এই বিশ্বাসঘাতকদের কুমন্ত্রনাতেই আজ আমরা এখানে জমায়েত হয়েছিলাম। দুর্ভাগ্য আমাদের!’ বলল সিনেটে রিপাবলিকান দলীয় নেতা ডন এ্যাডওয়ার্ড।
‘শুধু জমায়েত নয়, আমরা প্রেসিডেন্ট এবং এফ বি আই ও সি আই এ চীফকে ইমপীচ করার সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছিলাম।’ বলল দানিয়েল ময়নিহান।
‘আমরা জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনের মতই প্রতারিত হয়েছিলাম। ঈশ্বর আমাদের রক্ষা করেছেন।’ এ্যান্ড্রু জ্যাকবস বলল। তার কন্ঠে অনুশোচনার সুর।
‘এর দ্বারা আমরা জাতির ভবিষ্যত নিয়ে কত কম ভাবি সেটাও প্রমাণ হয়ে গেল। শহীদ জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনের শেষ কথাটাকে আমাদের খুবই গুরুত্ব দিতে হবে। তিনি কামনা করেছেন, আমেরিকার নতুন পৃথিবী যেন হয় আমাদের ফাউন্ডারস ফাদারসদের, কোন ষড়যন্ত্রকারীদের নয়। তাঁর কথিত এই ‘ষড়যন্ত্রকারীদের নতুন পৃথিবীটা’ কি, সেটা সম্পর্কে আমাদের জানতে হবে।’ বলল চার্লস ওয়ারনার।
‘শহীদ আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনের ঐ টেপ থেকেই পরিষ্কার, জেনারেল শ্যারন ও জোনসরা ‘নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার’-এর নামে যে নতুন পৃথিবী গড়ার স্বপ্ন আমেরিকার মাথায় চাপিয়ে দিয়েছে, সেটাই ঐ ষড়যন্ত্র।’ বলল ডন এ্যাডওর্য়াড।
‘কিন্তু কেন এটা ষড়যন্ত্র আমি বুঝতে পারছি না। বরং আমি তো দেখছি, এই নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন আমেরিকার জন্যে বিশ্বনেতৃত্বের মুকুট নিয়ে আসবে। এতে দোষ কোথায়?’ বলল এ্যান্ড্রু জ্যাকবস।
‘এর একটা উত্তর আমি দিতে পারি আমার ছেলে হ্যারি এ্যাডওয়ার্ডের ভাষায়। কিছুদিন আগে আমাদের ফ্যামিলি গ্যাদারিং-এ নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার নিয়ে বিতর্ক উঠলে সে বলেছিল, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বনেতৃত্বের লোভ দেখিয়ে তাকে বিশ্বের ‘খল নায়ক’-এ পরিনত করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, জাতিসংঘের বিশ্বায়ন কর্মসূচীর পেছনের সকল কলকাঠি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতে। অর্থনীতি, সংস্কৃতি, রাজনীতি প্রভৃতির বিশ্বায়নকে যতই লোভনীয় মোড়কে বাজারজাত করা হোক, অধিকাংশ জাতি রাষ্ট্র এর বিরুদ্ধে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা, তার সাথে আই এম এফ ও বিশ্বব্যাংক ক্রমবর্ধমান অসন্তোষের মুখে পড়াই এর একটি প্রমাণ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে এই বিতর্কিত বিশ্বায়নের নেতা সাজিয়ে ও বিশ্বপুলিশের তকমা পরিয়ে তাকে বিতর্কিত ও বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে। আমেরিকার বন্ধুর বেশ পরে আমেরিকার বিরুদ্ধে এটা সাংঘাতিক ষড়যন্ত্র। জেনারেল শ্যারনরা হিটলারকে ঘৃনা করেন, কিন্তু তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ‘হিটলারের জার্মানী’ বানাতে চাচ্ছে। এর অর্থ তারা আমেরিকার জন্যে হিটলারের পরিনতি আশা করে।’ বলল দানিয়েল ময়নিহান।
দানিয়েল ময়নিহান থামতেই এ্যান্ড্রু জ্যাকবস বলে উঠল, ‘ভবিষ্যত সম্পর্কে এটা একটা ধারনা মাত্র।’
হাসল আনা প্যাট্রসিয়া। বলল, ‘ধারনা বলে একে এড়িয়ে যাওয়া যাবে না মিঃ জ্যাকবস। দেখুন গোটা দুনিয়ায় ইউরোপ আমাদের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র। তার মধ্যে আবার বৃটিশরা আমাদের সবচেয়ে কাছের। সেই বৃটেনের শীর্ষ নীতি-নির্ধারকরা আড়ালে কি বলে থাকে জানেন? বলে, ‘সবাই সব জায়গায় আজ দেখছে আমেরিকার বেপরোয়া জেদপনা ও একলা চল নীতিকে।’ আমাদেরই হার্ভার্ডের একজন বিদেশ-নীতি বিশেষজ্ঞ (স্যামুয়েল হান্টিংটন) বলেছে, ‘বিশ্বের জাতি-রাষ্ট্রসমূহ এবং জনগনের বিপরীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ক্রমবর্ধমানভাবে একাকী হয়ে পড়েছে।’ তার মত হলো, ‘আমেরিকা কখনই বিচ্ছিন্ন আর বন্ধু হারানোর নীতি গ্রহন করবে না।, কিন্তু তার পদক্ষেপই অবশিষ্ট দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে।’ ‘ফ্রি আমেরিকা’র হ্যারি এ্যাডওয়ার্ডরা ‘নতুন বিশ্ব ব্যবস্থাকে’ এই বিচ্ছিন্নকারী পদক্ষেপ হিসাবে অভিহিত করছে। তাদের এই মত ফেলে দেবার মত নয় যে, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক গ্লোবালাইজেশন বা একক স্ট্যান্ডারডাইজেশন জাতি-রাষ্ট্রসমূহকে বৈরী করে তুলবেই এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বেই। অন্তিম মুহূর্তে জেনারেল হ্যামিল্টন এই বোধ থেকেই একে ‘ষড়যন্ত্রের বিশ্ব ব্যবস্থা’ বলে অভিহিত করেছেন এবং এর জায়গায় চেয়েছেন ফাউন্ডার ফাদারসরা যে বিশ্বব্যবস্থার স্বপ্ন দেখেছেন সেই বিশ্ব ব্যবস্থা।’
নিরূপায়ের একটা হাসি ফুটে উঠল এ্যান্ড্রু জ্যাকবসের মুখে। বলল, ‘আমাদের ফাউন্ডার ফাদারসদের আলাদা বিশ্ব ব্যবস্থাটা কি?’
‘সেটা হলো, তোমার হাত তুমি ততটা সম্প্রসারিত করো, যতটা করলে অন্যের নাক স্পর্শ না করে। অর্থাৎ কারো স্বার্থে হস্তক্ষেপ না করে। যদি এ নীতিবোধে মানুষ উজ্জীবিত হয়, তাহলেই শুধু পারস্পরিক সমতা, সম্মান ও সহযোগিতা ভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থা গঠন সম্ভব। আমাদের ফাউন্ডার ফাদারসরা এ বিশ্ব ব্যবস্থারই স্বপ্ন দেখেছেন।’
আনা প্যাট্রসিয়া থামতেই চার্লস ওয়ারনার বলে উঠল, ‘এবার আমাদের বৈঠকের আমরা উপসংহার টানতে পারি।’
‘আমরা দুজন শেষ মুহূর্তে এসেছি। জানিনা আগে আরও কি আলোচনা হয়েছে। তবে আমি মনে করি, এই বৈঠকের সমাপ্তি ঘটাতে পারি একটা প্রার্থনার মধ্য দিয়ে। সেটা হলো, ‘ঈশ্বর যেন আহমদ মুসাকে দীর্ঘ জীবন দান করেন। তিনি মৌলবাদী হলেও আমেরিকাকে একটা অক্টোপাসের কবল থেকে মুক্ত করার ব্যবস্থা করলেন। তিনি শুধু ইহুদীদের ষড়যন্ত্র ধরেছেন তাই নয়, ষড়যন্ত্রকারীদের আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবার সব ব্যবস্থাই সম্পন্ন করেছেন।’ বরর ডন এ্যাডওয়ার্ড।
‘মিঃ এ্যাডওয়ার্ডের সব কথা সাথে আমি একমত। তবে ষড়যন্ত্রটাকে ইহুদী ষড়যন্ত্র বলা ঠিক নয়। বিজ্ঞানী জন জ্যাকবস, ডেভিড উইলিয়াম জোনসও জেনারেল শ্যারনরা একটা ষড়যন্ত্রকারী গ্রুপ এং ইহুদী গ্রুপ বটে কিন্তু আমেরিকার যারা দেশপ্রেমিক ইহুদী তাদের প্রতিনিধি তারা নয়। সুতরাং একে ইহুদী ষড়যন্ত্র না বলে ইহুদীবাদী একটা গ্রুপের ষড়যন্ত্র বলা উচিত। দেখুন পত্রিকায় ফ্রি আমেরিকার যে প্রতিবাদ আজ প্রকাশিত হয়েছে তাতেই আছে ইহুদী ব্যাংকার আইজ্যাক বেনগুরিয়ান ও তাঁর মেয়ে সাবা বেনগুরিয়ান জেনারেল শ্যারনদের বিরোধিতায় জীবনের ঝুঁকি নিয়েছেন, তবু আমেরিকার স্বার্থ জলাঞ্জলী দিতে চাননি।’ বলল আনা প্যাট্রসিয়া।
‘ধন্যবাদ মিস প্যাট্রসিয়া। আপনার সাথে আমি একমত। তবে আহমদ মুসা সম্পর্কে বেশী বলার পক্ষে আমি নই। ঘটনাচক্রে তাঁর সাহায্য আমরা পেয়েছি। কিন্তু তাঁর মেীলবাদী চরিত্র সহজে যাবার নয়।’ বলল এ্যান্ড্রু জ্যাকবস।
হাসল ডন এ্যাডওয়ার্ড। বলল, ‘মৌলবাদ দেখে আমরা অভ্যস্তই। ইহুদীদের চেয়ে বড় মৌলবাদী দুনিয়াতে আর কেউ নেই। দুনিয়ার সবাইকে বুকে টেনে নেবার জন্য ইসলাম দুহাত বাড়িয়ে আছে। কিন্তু কোন নন-ইহুদী ইহুদী হতে পারে না, ইহুদী হওয়া চিরদিনের জন্য শুধু বনি ইসরাইলের জন্যে বরাদ্দ। আর আহমদ মুসা যেটুকু মৌলবাদী, সেটুকু মৌলবাদী আমরা অনেকেই। বাইবেলের মৌলবিধানকে আমরা অনেকেই দৃঢ়ভাবে মেনে চলতে চাই।’
ডন এ্যাডওয়ার্ড থামতেই চার্লস ওয়ারনার বলে উঠল, ‘প্লিজ কথা না বাড়িয়ে আমরা আলোচনার উপসংহার টানতে চাই। মিস আনা প্যাট্রসিয়া ঠিকই বলেছেন শ্যারন-জোনসদের ষড়যন্ত্রকে আমরা ইহুদী ষড়যন্ত্র বলবনা। আমেরিকা ও আমেরিকার বাইরে এ ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তৃত হলেও ইহুদীবাদী একটা গ্রুপ মাত্র এর সাথে জড়িত। আর মিঃ এ্যাডওয়ার্ড উপসংহার সম্পর্কে যে পরামর্শ দিয়েছেন, সেটা ভালো। তবে আহমদ মুসার জন্যে ঐ প্রার্থনার প্রয়োজন নেই, আমরা আহমদ মুসাকে ধন্যবাদ জানাব, স্থান-কাল-পাত্র নির্বিশেষে ন্যায়ের পক্ষে ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে আহমদ মুসা হলো উন্মুক্ত তরবারী। আমরা আজ এখানে দুটি ব্যাপারে একমত হতে পারি, এক. আহমদ মুসা সম্পর্কে আমাদের এই অনুভুতি সরকারের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক ভাবে তাকে আমরা জ্ঞাপন করবো, দুই. আমেরিকা থেকে এই ইহুদীবাদী ষড়যন্ত্র সমূলে উৎপাটনের জন্যে সব ব্যবস্থাই আমাদের সরকারকে গ্রহন করতে বলব এবং সরকার রাজনৈতিক ঝুঁকি নিয়েও যে ত্বরিত এই ষড়যন্ত্র উদঘাটনে এগিয়ে এসেছেন, এজন্যে আমরা সরকারকে ধন্যবাদ জানাব।’ থামল চার্লস ওয়ারনার।
আনা প্যাট্রসিয়া, দানিয়েল ময়নিহান ও ডন এ্যাডওয়ার্ডসহ প্রায় সকলেই একবাক্যে বলে উঠল, ‘হ্যাঁ এই দুই বিষয়ে আমরা একমত হতে পারি।’
‘আমার আপত্তি নেই, তবে আমরা ইনফরমাল বসেছিলাম। আমরা সম্মিলিতভাবে এসব কথা কি বলব?’ বলল এ্যান্ড্রু জ্যাকবস।
‘অবশ্যই মিঃ জ্যাকবস। আমরা জেনারেল শ্যারনদের দ্বারা প্রতারিত হয়ে এই যে এখানে বৈঠকের আয়োজন করেছিলাম তার প্রায়শ্চিত্ত হওয়া দরকার। আমি এখানে আসার আগে ফ্রি আমেরিকার সারা জেফারসন দেখতে এসেছিল হ্যারিকে। দেখলাম, তারা বৈঠকের খবর জানে। সারা জেফারসন আমার মাধ্যমে আপনাদের সবার কাছে আপীল করেছেন তাদেরকে সাহায্য করার জন্যে। আমি মনে করি, বৈঠকে আমরা যদি ঐ দুটি বিষয়ে একমত হই, তাহলে তাদেরকে সাহায্য করা হয়, আমাদেরও প্রায়শ্চিত্ত হয়।’ বলল দানিয়েল ময়নিহান আবেগ জড়িত কন্ঠে।
আরও ভালো হতো, যদি আপনি সারা জেফারসনকে দাওয়াত দিতেন এ মিটিং-এ আসার জন্যে। তার জন্যে সত্যিই গর্ববোধ হয়। তিনি ইয়ং আমেরিকার যোগ্য নেত্রী।’ বলল ডন এ্যাডওয়ার্ড।
‘তাঁকে দাওয়াত দেয়ার কথাই আমার মাথায় আসেনি। তাছাড়া তাঁরও সময় ছিল না। তিনি এফ বি আই হেড কোয়ার্টারে যাবার পথে আমার বাসায় উঠেছিলেন।’ বলল দানিয়েল ময়নিহান।
‘আচ্ছা তাহলে আমরা উঠতে পারি।’ বলে চর্ালস ওয়ারনার এ্যান্ড্রু জ্যাকবসের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মিঃ জ্যাকবস আপনাকে সবার পক্ষ থেকে সুন্দর আতিথেয়তার জন্যে ধন্যবাদ’
বলতে বলতে উঠে দাঁড়াল চার্লস ওয়ারনার। তার সাথে সাথে সবাই উঠে দাঁড়াল।

কাউন্সিল অব আমেরিকান জুইস এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ডেভিড উইলিয়াম জোনস এতটাই উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল যে মোবাইলটা কানে ধরে রেখেই চিৎকার করে উঠল, ‘মিঃ শ্যারন, মিঃ শ্যারন।’
বাম হাত গাড়ির স্টিয়ারিং হুইলে রেখে ডান হাত দিয়ে মোবাইলটা ডান কানে ধরে চিৎকার করছিল ডেভিড জোনস।
জেনারেল শ্যারনের গাড়ি লনের এক্সিট সার্কেল ঘুরে গেটে এসে পৌছেছিল বাইরে বেরুবার জন্যে। জেনারেল শ্যারন নিজেই ড্রাইভ করছিল গাড়ি।
ডভিড জোনসের চিৎকারে সে মাথা ঘুরিয়ে তাকাল। দেখল, মিঃ জোনস তাকে হাত নেড়ে ডাকছে।
জেনারেল শ্যারন তার গাড়ি ঘুরিয়ে নিল। গাড়ি নিয়ে গিয়ে দাঁড়াল মিঃ জোনসের গাড়ির পাশে।
মিঃ জোনস গাড়ি থেকে নেমে এল।
তার চোখে মুখে উত্তেজনা।
জেনারেল শ্যারনও গাড়ি থেকে নামল।
‘কি ব্যাপার মিঃ জোনস?’ উদ্বিগ্ন কন্ঠ জেনারেল শ্যারনের।’
‘অনেক দুঃসংবাদের পর একটা ভাল খবর পাওয়া গেছে। আমাদের বেন ইয়ামিন এইমাত্র জানাল, পার্লামেন্ট ভবন থেকে একটু দক্ষিন-পূর্বে পটোম্যাক নদীর তীরে একটা বাড়িতে আহমদ মুসা ও সারা জেফারসন বাস করছে। তবে সেখানে পুলিশ ও এফ বি আই-এর লোকেরা পাহারায় রয়েছে।’ বলল ডেভিড উইলিয়াম জোনস।
‘দারুন খবর। আমরা যদি দুজনকে হগাত করতে পারি, তাহলে আমাদের বিরুদ্ধে সরকারী তদন্ত থামিয়ে দেয়া যাবে। এখনি এই রাতে আমাদের অভিযানে যাওয়া দরকার।’ বলল জেনারেল শ্যারন।
‘না এভাবে অভিযান করা যাবে না। পুলিশ ও এফ বি আই-এর সাথে লড়াইকরে তাদের ধরে আনা যাবে বলে আমি মনে করি না। কে তাদের উপর হামলা করেছে এটা জানতে পারলে আহমদ মুসা একাই একশ হবে। আমরা ব্যর্থ হবো। আপনি আহমদ মুসাকে চেনার পর এরকম প্রস্তাব দিলেন কেমন করে?’ বলল ডেভিড জোনস।
‘ঠিক বলেছেন মিঃ জোনস। আমি উত্তেজিত হয়ে বিচার বুদ্ধি হারিয়ে ফেলেছি। তাকে ফাঁদে ফেলতে হবে কৌশলে। বলুন আপনার কোনর প্রস্তাব আছে? বলল জেনারেল শ্যারন।
‘সারা জেফারসনকে আমাদের দরকার নেই। তাকে কিডন্যাপ করলে পুরো আমেরিকায় হৈ চৈ পড়ে যাবে। লাভের চেয়ে ক্ষতি হবে আমাদের বেশী। এক আহমদ মুসাকে আমাদের হাতে আনতে পারলেই সরকার, ফ্রি আমেরিকা, হোয়াইট ঈগল, সবাই অন্ধ হয়ে পড়বে।’ ডেভিড জোনস বলল।
‘আপনার যুক্তির সাথে একমত।’ বলল জেনারেল শ্যারন।
‘আমি বলে দিয়েছি, বেন ইয়ামিন বাড়ির উপর নজর রাখবে। উপযুক্ত সুযোগ সৃষ্টি হলেই সে আমাদের জানাবে। আমরা তৈরী থাকব যে কোন মুহূর্তে অভিযান চালানোর জন্যে। আমি ঐ বাড়ি ও তার আশপাশের রাস্তাঘাটের একটা নকশা এঁকে দিচ্ছি, আপনি একটা নিখুঁত পরিকল্পনা তৈরী করুন।’ ডেভিড জোনস বলল।
‘পরিকল্পনা সকাল, বিকাল, দিন, রাত, কোন সময়ের হবে? সময় অনুসারে পরিকল্পনা হবে আলাদা।’ বলল জেনারেল শ্যারন।
‘যে এলাকায় বাড়ি, সেটা টাইট সিকিউরিটি জোন। রাতের বেলা কোন পাখি উড়লেও সেটা তাদের নজর এড়ায় না। দিনের বেলা এমন টাইট অবস্থা থাকে না। সকাল ও বিকেলের কথা আপনি ভাবতে পারেন। তবে সবকিছুই নির্ভর করছে বেন ইয়ামিনের খবরের উপর।’ ডেভিড জোনস বলল।
‘বাড়ি গিয়ে আর কাজ নেই। চলুন আপনার ওখানে গিয়ে বসি। আপনার ওখান থেকে পটোম্যাকের ঐ এলাকায় সরাসরি রাস্তা আছে।’ বলল জেনারেল শ্যারন।
‘ওয়েলকাম। চলুন যাই। পরামর্শ করে পরিকল্পনাটা তৈরী করতে হবে।’ বলে ডেভিড উইলিয়াম তার গাড়ির দিকে এগোল। জেনারেল শ্যারনও গিয়ে তার গাড়িতে বসল।
দুই গাড়িই স্টার্ট নিয়ে চলতে শুরু করল।

বাড়িটার নাম পটোম্যাক লজ।
বাড়িটার সামনে সুন্দর সবুজ চত্বর। দুপাশ এবং পেছন দিকে বাগান।
চত্বর ও বাগান নিচু বাউন্ডারী ওয়াল দিয়ে ঘেরা।
বাউন্ডারী ওয়ালের সাথে বাড়িতে প্রবেশের হালকা একটি গেট। গ্রীলের তৈরী এবং তার উপর আয়রন শীট দিয়ে ঢাকা।
বাড়ির সামনে দাঁড়ালে ওয়ালের উপর দিয়ে চত্বর ও বাগানের অনেকখানি দেখা যায়।
এই বাড়িতেই এখন বাস করছে আহমদ মুসা, সারা জেফারসন ও সারা জেফারসনের মা জিনা জেফারসন। এফ বি আই-এর মেজর জো স্কিন বসেছিল গেটের বাইরে বেশ এবটু দুরে রাস্তার পাশে ঘাসে ঢাকা সবুজ একটা টিলায়।
তখন বেলা ৯ টা।
পটোম্যাক লজ থেকে বেরিয়ে একটা কনফেকশনারীর গাড়ি মেজর জো’র সামনের রাস্তা ধরে চলে যাচ্ছিল।
মেজর জো মুখ তুলে বলল, ‘বিক্রি হলো কিছু?’
ট্রাকরে মত কনফেকশনারীর গাড়িটার ড্রাইভিং সিটসহ ইঞ্জিন অংশ আলাদা এবং তার পেছনে বিরাট কনটেইনার।
ড্রইভারের মাথায় ফেল্ট হ্যাট। মুখে কাঁচা-পাকা গোঁফ ও দাড়ি। মুখের গোঁফ-দাড়ি বড়ই অপরিপাটি, ব্যাস্ত ও কাজ পাগল মানুষের নিদর্শন।
ড্রাইভারটি মুখ ঘুরিয়ে মেজর জো’র দিকে তাকিয়ে বলল, ‘গুড মর্নিং স্যার। এরা স্থায়ী কাস্টমার, আমাদের বিক্রি তো হবেই। আজ আমরা খুশী। ধন্যবাদ।’
গাড়িটা চলে গেল।
গাড়িটা যাওয়ার কিছুক্ষন পর পটোম্যাক লজের অন্যতম কেয়ারটেকার উইলিয়াম এল। হাতে কয়েকটা কনফেকশনারীর প্যাকেট ও কাগজের ব্যাগ ভর্তি জিনিসপত্র নিয়ে হাঁটছিল পটোম্যাক লজের দিকে।
মেজর জো স্কিন বসা থেকে তড়াক করে উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘হ্যালো উইলিয়াম, তুমি একগাদা কনফেকশনারীর জিনিস নিয়ে আসছ, আবার কনফেকশনারীর গাড়ি গিয়ে দিয়ে এল অনেক জিনিস। ডাবল শপিং কেন?’
উইলিয়াম চোখ কপালে তুলে বলল, ‘কি বলছ মেজর, আমাদের কনফেকশনারীর গাড়ি সপ্তাহে দুদিন আসে। আজতো আসার দিন নয়!’
‘কিন্তু গাড়িতো এসেছিল।’ বলল মেজর জো শুকনো কন্ঠে। তার চোখে-মুখে ভাবনার চিহ্ন।
‘কিন্তু এভাবে তো গাড়ি কোন দিন আসে না! যাই দেখি।’
বলে উইলিয়াম হাঁটতে শূরু করল।
মেজর জো স্কিনও হাঁটতে শুরু করেছে উইলিয়ামের সাথে। তার চোখে-মুখে ভাবনার চিহ্ন আরও গভীর।
উইলিয়াম বাইরের গেট পেরিয়ে বাড়ির ভেতর প্রবেশের দরজায় গিয়ে চাবি ঢুকাল তালা খুলার জন্যে দরজার কি হোলে।
কিন্তু চাবি ঘুরিয়ে দেখল দরজা খোলা। বিস্ময় ফুটে উঠল তার চোখে-মুখে। ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলে ফেলল সে।
পেছনে একবার তাকিয়ে সে দ্রুত প্রবেশ করল ভেতরে।
মেজর জো স্কিন উইলিয়ামের পেছনেই ছিল। উইলিয়ামের চোখ-মুখের বিস্ময় ও উদ্বেগ তার নজর এড়াল না। দরজা খোলা দেখে মেজর জো’র বুকও ছ্যাঁৎ করে উঠেছিল।
উইলিয়ামের সাথে সাথে মেজর জো স্কিনও দ্রুত ভেতরে ঢুকে গেল।
ভেতরে সব শূন্য।
দৌড়ে উইলিয়াম বাবুর্চিখানায় গেল, কেউ নেই। সার্ভেন্টস কোয়ার্টার দেখল, কেউ নেই। ফিরে এল আবার বাবুর্চি খানায়। হাতের প্যাকেটগুলো রেখে বাধরুমরে দিকে এগুলো। দেখল বাথরুম বন্ধ। তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, ভাবল নিশ্চয় কেউ বাথরুমে গেছে, আর অন্যরা নিশ্চয় ম্যাডামের সাথে পেছনের দিকে গেছে। কিন্তু শয়তানরা দরজা বন্ধ করেনি কেন?
কিন্তু পাক ঘরে ঢুকেই মেজর জো স্কিনের ভ্রু কুঁচকে গেল। সে বাতাসে ক্লোরোফরম গ্যাসের গন্ধ পেল। পাক ঘরের বাইরে তো এ গন্ধ পায়নি। পাক ঘরে এ গন্ধ কোত্থেকে এল!
এ ভাবনা তার মনে আসতেই সে জিজ্ঞেস করল উইলিয়ামকে, ‘তোমার একজন না হয় বাথরুমে অন্য লোকরা কোথায়?’
‘নিশ্চয় ম্যাডামের সাথে বাগানে হবে।’ বলল উইলিয়াম।
‘চল দেখি বাগানে।’
দুজন বাগানের দিকে এগুলো।
পেছন দিকে বেরুবার জন্যে একটা দরজা আছে। সে দরজা দিয়ে তারা পেছনের বাগানে প্রবেশ করল।
বাগানে কাউকেই চোখে পড়ল না।
হঠাৎ বাঁ পাশে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠল উইলিয়াম।
উইলিয়ামের দৃষ্টি অনুসরণ করে জো সেদিকে তাকাল। দেখল ম্যাডাম জিনা জেফারসনের দেহ পড়ে আছে একটা ফুল গাছের ওপাশে।
দেখার সাথে সাথে সে লাফ দিয়ে ফুলের গাছ ডিঙিয়ে গিয়ে পৌছল পড়ে থাকা দেহের কাছে।
ঝুঁকে পড়ে নাক পরীক্ষা করল জিনা জেফারসনের। দেখল বেঁচে আছে, নিঃশ্বাস বইছে।
ঝুঁকে পড়তে গিয়ে সেই ক্লোরোফরমের গন্ধ আবার পেল মেজর জো। এবার বুঝল সে সংজ্ঞাহীন করারা জন্যেই কেউ ক্লোরোফরম গ্যাস ব্যবহার করেছে।
সে আরও বুঝল, নিশ্চয়ই আরও সর্বনাশ তারা করে গেছে।
চিন্তা করতেই বুকের রক্ত যেন তার হিম হয়ে গেল।
ঝুঁকে পড়া অবস্থা থেকে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েই বাড়ির ভেতর দিকে ছুটল। ছুটতে ছুটতেই বলল, ‘ভয় নেই উইলিয়াম ম্যাডাম বেঁচে আছে। এসো মিঃ আহমদ মুসার খবর নিই।’
দুজনেই বাড়িতে ঢুকে ছুটল দোতালায় উঠার সিঁড়ির দিকে।
দৌড়ানো অবস্থায়ই উইলিয়াম বলল, ‘সিঁড়ি গিয়ে উঠেছে ড্রইংরুমে। ড্রইংরুমের ঠিক পূর্ব পাশে থাকে আহমদ মুসা। আর সিঁড়ির পশ্চিম পাশে পাশপাশি দুটি রুমে থাকে সারা জেফারসন ও জিনা জেফারসন।’
ড্রইংরুমে উঠে তারা ছুটল আহমদ মুসার ঘরের দিকে।
দুজনেই গিয়ে দাঁড়াল আহমদ মুসার খোলা দরজায়। তাদের দুজনের চারটি চোখ গিয়ে আছড়ে পড়ল আহমদ মুসার শূন্য বেডের উপর।
দরজায় গিয়ে দাঁড়াতেই সেই ক্লোরোফরম সিক্ত ভারী বাতাস এস প্রবেশ করল তাদের নাকে।
মেজর জো ঘরের চারদিকে একবার নজর বুলাল।
দেখল ঘরের সবই ঠিক আছে। শুধু বিছানার চাদরের নিচের অংশের কিছুটা বেশী ঝুলে গেছে।
‘এই আধা ঘন্টা আগে যখন বাইরে যাই, তখন তাঁকে আমি ঘুমানো দেখে গেছি। কি হলো ওঁর? কেউ কি ওঁকে….।’
কথা শেষ করতে পারল না। কথা গলায় আটকে গেল একটা উচ্ছ্বাস দমন করতে গিয়ে।
‘হ্যাঁ উইলিয়াম, ঠিকই অনুমান করেছ। সর্বনাশ হয়ে গেছে। কোন শত্রু তাঁকে কিডন্যাপ করেছে বলে মনে হচ্ছে।’
বলে মেজর জো পকেট থেকে অয়্যারলেস বের করল। খবরটা জানিয়ে দিল সে এফ বি আই অপারেশন কমান্ডার বব কার্টারকে। খবরটা দিতে গিয়ে কন্ঠ ভারী হয়ে উঠেছিল মেজর জো’র। দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার চেয়ে যে ক্ষতি হলো তার অনুভূতিই তাকে পীড়া দিচ্ছে বেশী। কিন্তু কি দোষ তার! অস্বাভাবিকতা কিছুই সে দেখেনি।
কনফেকশনারীর এমন গাড়ি তো বাড়ির দরজায় দরজায় গিয়েই থাকে। কিন্তু ঐ গাড়িই যে এত বড় কান্ড ঘটাবে, তা ভাববে কেমন করে!
টেলিফোন শেষ করেই মেজর জো বলল, ‘চল উইলিয়াম, ম্যাডামকে ভেতরে নিয়ে আসি।’
তারা দুজনে ধরাধরি করে জিনা জেফারসনকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে এল।
জিনা জেফারসনকে বিছানায় শুইয়ে মেজর জো বলল, ‘উইলিয়াম যাও গিয়ে কিচেনের পাশের বাথরুমটা খোল। নিশ্চয় ওখানে তোমাদের কিছু লোককে আটকে রেখেছে। আমি দেখি এঁর সংজ্ঞা ফেরানো যায় কিনা।’
বাড়ির অবশিষ্ট সবাইকে পাওয়া গেল সংজ্ঞাহীন অবস্থায় কিচেনের সাথের বাথরুমটিতে।
পনের মিনিট পার হয়েছে।
কারও সংজ্ঞা ফেরানো যায়নি।
এ সময় এক ঝাঁক গাড়ি পর পর এসে দাঁড়াল পটোম্যাক লজের সবুজ চত্বরে।
তিনটি পুলিশের গাড়ি। একটি জীপ এফ বি আই-এর। তাদের সামনে আরও দুটি কার। একটি এফ বি আই চীফ জর্জ আব্রাহামের। আরেকটা সারা জেফারসনের।
পটোম্যাক লজের দুঃসংবাদ যখন মেজর জো এফবিআই হেড কোয়ার্টারে দেয়, তখন সারা জেফারসন সেখানেই ছিল। খবর পেয়ে জর্জ আব্রাহামদের সাথেই চলে এসেছে।
দুই কার থেকে জর্জ আব্রাহাম ও সারা জেফারসন প্রায় এক সাথেই নামল।
নেমেই সারা জেফারসন ছুটল বাড়ির দরজার দিকে। তার পেছনে পেছনে জর্জ আব্রাহাম। জর্জ আব্রাহাম সারা জেফারসনের মত না দৌড়ালেও দ্রুত এগোল।
সারা জেফারসন বাড়িতে ঢুকেই পেল উইলিয়ামকে। গাড়ির শব্দ পেয়ে সে বাইরে আসছিল।
উইলিয়াম সারা জেফারসনকে দেখেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। কাঁদতে কাঁদতেই বলল, ‘বড় ম্যাডামকে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় পাওয়া গেছে পেছনের বাগানে। আর স্যার নেই……।’
সারা জেফারসনের মুখ মড়ার মত ফ্যাকাসে। রক্তিম ঠোঁট দুটো তার কাঁপছে বুক থেকে উঠে আসা কোন এক ঝড় চাপতে গিয়ে।
কোন কথা বলল না। দৌড়ে প্রায় টলতে টলতে সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেল সারা জেফারসন।
আহমদ মুসার ঘরের দরজায় গিয়ে মুহূর্তের জন্যে দাঁড়াল। ঘরের চারদিকটা মনে হয় দেখল সে। তারপর ছূটে গেল আহমদ মুসার বেডে।
ব্যাকুলভাবে বালিশটা তুলল। বালিশের নিচে একটা রিভলবার ঠিকঠাকভাবে পড়ে আছে। তারপর সারা জেফারসনের চোখ দুটি আছড়ে পড়ল বেডের পেছনের হ্যাংগারে। না, সেখানে বাইরে বেরুবার সব সার্ট, টি-সার্ট, কোট-প্যান্ট সবই ঠিকঠাক আছে। এমনকি তাঁর শখের কলমটি পর্যন্ত জামার পকেটে শোভা পাচ্ছে।
সারা জেফারসনের ঠোঁটের কম্পন বেড়ে গিয়েছিল। তার চোখ খোলা, কিন্তু দৃষ্টি কোথায় যেন হারিয়ে গেছে।
এ সময় ঘরে প্রবেশ করল জর্জ আব্রাহাম।
জর্জ আব্রাহাম সারা জেফারসনের বিহ্বল অবস্থা দেখে বলল, ‘স্যরি মিস জেফারসন। আমরা বোধ হয়….।’
কথা শেষ করতে পারল না জর্জ আব্রাহাম। সারা জেফারসন ‘না’ বলে চিৎকার করে উঠে বোঁটা থেকে ফল খসে পড়ার মত ঢলে পড়ল আহমদ মুসার বিছানার উপর।
ছুটে গেল জর্জ আব্রাহাম সারা জেফারসনের দিকে।
সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেছে সারা জেফারসন।
জর্জ আব্রাহামের পরপরই ঘরে প্রবেশ করল পুলিশ প্রধান বিল বেকার।
‘মিস সারা সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেছে মিঃ বিল। হুইস্কি, বিয়ার, শ্যাম্পেন যা পাও দেখ নিয়ে এস অন্য ঘর থেকে। আহমদ মুসার ঘরে তো এসব পাওয়া যাবে না।’
বিল বেকার বেরিয়ে যাচ্ছিল। ঘরে প্রবেশ করল উইলিয়াম। বলল, ‘স্যার বড় ম্যাডামের সংজ্ঞা ফিরেছে। সব শুনে উনি সাংঘাতিক কান্না শুরু করেছেন।’
‘ঠিক আছে আমরা দেখছি্ তুমি বিয়ার হুইস্কির মত কিছু নিয়ে এস পাশের ঘর থেকে। তোমার ছোট ম্যাডাম সংজ্ঞা হারিয়েছে। তার সংজ্ঞা ফিরাতে হবে। যাও।’ বলল জর্জ আব্রাহাম।
‘কিন্তু স্যার মদ জাতীয় কিছুতো পাওয়া যাবে না এ বাড়িতে।’ বলল উইলিয়াম।
‘কেন?’
‘স্যার এ বাড়িতে কেউ মদ খায় না। ছোট ম্যাডাম নন, বড় ম্যাডাম নন। আমরাও কেউ খাই না।’
‘কি বলছ তুমি?’
‘ঠিকই বলছি স্যার। স্যার মদ খেতেন না। তাই অন্য সবাইও মদ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন।’
‘বুঝলাম। তুমি ঠিকই বলেছ। যাও রেফ্রিজারেটর থেকে ঠান্ডা পানি নিয়ে এস।’ বলল জর্জ আব্রাহাম।
উইলিয়াম ছুটল পানি আনার জন্যে।
‘আহমদ মুসা সম্পর্কে যে সব অবাক করা কথা শুনেছি, তাহলে সব সত্যি। মাত্র কয়েক দিনের সান্নিধ্যে যদি জেফারসন পরিবার মদ ছাড়তে পারে, তাহলে ইস্টের মানুষ তার যাদু স্পর্শে অনেক কিছূই করতে পারে।’ বলল বিল বেকার।
‘আহমদ মুসার যাদু তার চরিত্র। তার চরিত্রে এমন একটা শক্তি আছে যা অতিশক্ত মানুষকেও নরম করে দিতে পারে। স্বীকার করতে লজ্জা নেই বিল, সে মদ খায় না বলে তার উপস্থিতিতে কোন মদের পাত্র আশে-পাশে থাকলেও আমার লজ্জাবোধ হয়।’ জর্জ আব্রাহাম বলল।
উইলিয়াম পানি নিয়ে ফিরে এল।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই জ্ঞান ফিরে পেল সারা জেফারসন। উঠে বসতে বসতে বলল, ‘স্যরি।’
তারপর তোয়ালে দিয়ে চোক মুখ মুছে বিছানায় পড়ে থাকা রুমালটা মাথায় দিয়ে বলল, ‘স্যরি। এমন ঘটনার জন্যে কোন ভাবেই প্রস্তুত ছিলাম না।ও আমার সাথে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু আমি নিষেধ করেছিলাম। চেয়েছিলাম গত রাতের বড় একটা ধকলের পর ও একটু রেস্টে থাক। তখন কি জানতাম এমন কিছু ঘটবে।’ বলতে বলতে কেঁদে ফেলল সারা জেফারসন।
কাঁদতে কাঁদতেই বলল, ‘এখনই কিছু করতে হবে। তাঁকে উদ্ধার করতে হবে বর্বর, পাষান্ড, খুনীদের হাত থেকে।’
বলে সারা জেফারসন তার মোবাইল বের করল।
জর্জ আব্রাহাম জনসন ও পুলিশ প্রধানের দিকে মুখ তুলে ‘এক্সকিউজ মি স্যার’ বলে মোবাইলে একটা কল করল। ওপার থেকে সাড়া পাওয়ায় বলল, ‘হ্যাঁ আমি সারা জেফারসন। গুড মর্নিং বেঞ্জামিন। কিন্তু আমাদের সবার জন্যে খারাপ খবর, আজ সকাল সাড়ে ৮টায় আহমদ মুসা তার কক্ষে ঘুমন্ত অবস্থায় কিডন্যাপ হয়েছেন। তুমি সবাইকে জানিয়ে দাও। কাজে নেমে পড়। এটাই এখন আমাদের একমাত্র কাজ।’
আরও কয়েকটি কথা বলে টেলিফোন রেখে দিয়ে সারা জেফারসন বলল, ‘স্যারি মিঃ জর্জ আব্রাহাম, মিঃ বিল বেকার। টেলিফোনটা আমার জন্যে খুব জরুরী ছিল। বলুন, আপনারা কি ভাবছেন?’
‘না মিস জেফারসন, টেলিফোনটা শুধু আপনার জন্যে নয়, আমাদের জন্যেও জরুরী। সবাই একসাথে এগুতে হবে।’ বলে একটু থামল আব্রাহাম জনসন। পরক্ষনেই আবার বলে উঠল, ‘আমাদের প্রথম ভাবনা হলো আহমদ মুসাকে কিভাবে কিডন্যাপ করা হয়েছে। আলামত থেকে পরিষ্কার আপনি যেটা বলেছেন ঘুমন্ত অবস্থায় ক্লোরোফরম গ্যাস স্প্রে করে তাকে সংজ্ঞাহীন করে ফেলা হয়। তারপর তাকে কনফেকশনারীর ভ্যানে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিডন্যাপকারী মূল বাহিনী প্রবেশ করে বাড়ির পেছন দিক দিয়ে। আপনার মাকে ঐ স্প্রে করেই সংজ্ঞাহীন করে। আমাদের দ্বিতীয় ভাবনা হলেঅ কারা একাজ করেছে। আপনার আম্মা ও কিচেন ক্রুরা কিডন্যাপকারীদের যাদের দেখেছে, তারা সবাই মুখোশ পরা ছিল। মেজর জো স্কিন কনফেকশনারীর গাড়ির ড্রাইভারকে দেখেছে, লম্বা লাল মুখ। নিশ্চিত ওটা ইহুদী চেহারা। তবে দেখার কথা বাদ দিয়ে চোখ বন্ধ করেই বলা যায়, এই ঘটনা জেনারেল শ্যারনের লোকরা ঘটিয়েছে।’
‘প্রেসিডেন্ট কি এই খবর পেয়েছেণ?’ জিজ্ঞেস করল সারা জেফারসন।
‘আপনাকে বলা হয়নি, গাড়িতে বসেই আমি প্রেসিডেন্টকে ঘটনা জানিয়েছি। প্রেসিডেন্ট খুবই শক পেয়েছেন। তিনি জেনারেল শ্যারনদের গ্রেফতার ও আহমদ মুসাকে উদ্ধারের সর্বাত্মক উদ্যাগের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটনকে বলে দেবেন সশস্ত্র বাহিনী এবং তাদের গোয়েন্দা বিভাগও এই কাজে আমাদের সাহায্য করবে।’
‘এখন আমাদের কি করণীয়? ওদের সব রাগের কেন্দ্র বিন্দু আহমদ মুসা। আমার ভয় হচ্ছে, প্রতিহিংসা পাগল হয়ে ওরা…।’
কথা শেষ করতে পারল না সারা জেফারসন। কান্নায় রুদ্ধ হয়ে গেল তার গলা।
‘না মিস জেফারসন আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, আপনি যা আশংকা করছেন তেমন কিছু ঘটবে না। এর কনসিকুয়েন্স কি জেনারেল শ্যারনরা নিশ্চয় উপলব্ধি করে।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
সারা জেফারসন চোখ মুছে বলল, ‘জানেন গতকাল রাতের অভিযান থেকে ফিরে যখন বললাম, মাথাটা এবার হাল্কা হলো। তখন উনি বলেছিলেন, ওরা এখন ক্ষ্যাপা কুকুরের মত। আগামী কয়েকদিন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভাগ্যের পরিহাস যিনি জানতেন ওরা হবে ক্ষ্যাপা কুকুরের মত, সেই তিনিই সেই ক্ষ্যাপা কুকুরদের হাতে….।’ সারা জেফারসনের কথা আবার কান্নায় আটকে গেল।
জর্জ আব্রাহাম ও বিল বেকারের মুখও ম্লান হয়ে গেছে। আহমদ মুসার উক্তি ও সারা জেফারসনের আশংকার প্রতিটি বর্ণ সত্য। সারা জেফারসনের এভাবে ভেঙে পড়াও যে খুবই স্বাভাবিক তাও তারা উপলব্ধি করে। তবু জর্জ আব্রাহাম সান্ত্বনার সুরে বলল, ‘মিস জেফারসন, আহমদ মুসা নেই। আপনাকে শক্ত হতে হবে। আপনার উপর অনেক দায়িত্ব। ‘ফ্রি আমেরিকা’র ইপর আমাদের অনেক নির্ভরতা।’
‘স্যরি আংকল। আমার এভাবে কাঁদা ঠিক নয়।কিন্তু আহমদ মুসা নেই, সে জেনারেল শ্যারনদের মত খুনী শত্রুদের হাতে, এ কথা ভাবলেই মনকে আর ধরে রাখতে পারছি না। যদি …. যদি তার কিছু হয়ে যায়।’
আবারও কান্নায় জড়িয়ে গেল সারা জেফারসনের শেষের কথাগুলো।
‘এমনটা ভাবা খুবই স্বাভাবিক। তবে আমি বলছি, তেমন কিছু ঘটা খূব সহজ নয়। আর আহমদ মুসাও সাধারন কেউ নন। খারাপ না ভেবে ভালটা ভাবুন। আহমদ মুসা ওদের হজম হবার মত কোন বন্দী নন।’ বললজর্জ আব্রাহাম।
বলে একটু থেমেই আবার বলল, ‘চলুন মিস জেফারসন, বাইরে যাই। কিছু কাজ, কিছু কথা এখনও বাকি আছে। চলুন পুলিশ কতদুর কি করল দেখি।’
বলে উঠে দাঁড়াল জর্জ আব্রাহাম।
বিল বেকারও উঠল।
উঠল সারা জেফারসনও।
পুলিশ ও গোয়েন্দাদের একটা দলকে পটোম্যাক লজের সার্বক্ষনিক পাহারায় বসিয়ে জর্জ আব্রাহাম ও বিল বেকার পটোম্যাক লজ থেকে যখন বের হলো, তখন ২ ঘন্টা পেরিয়ে গেছে।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে জর্জ আব্রাহাম ও বিল বেকার পাশাপাশি হাঁটছিল।
‘সত্যি মিস জেফারসন একবোরেই ভেঙে পড়েছেন।’ বলল জর্জ আব্রাহাম।
‘এটা কি সহযোদ্ধার প্রতি আন্তরিকতা বশত না এখানে হৃদয়ের কোন ব্যাপার আছে?’ বলল বিল বেকার।
‘দুজনে সোনায় সোহাগা। হৃদয় ঘটিত কিছূ থাকাটাই স্বাভাবিক, না থাকাটা অস্বাভাবিক।’ জর্জ আব্রাহাম বলল।
‘তাহলে কিন্তু মহাব্যাপার হবে। বাঘের ঘরে একদম ঘোঘের বাসা।’ বলল বিল বেকার।
‘আহমদ মুসা ঘোঘ নয় মিঃ বিল। সেও বাঘ। বাঘের সাথে বাঘের মিলন।’
‘মিলন নয়, বলুন মহামিলন। একেবারে দুই সভ্যতার মিলন।’
দুজন গাড়ির কাছে এসে হিয়েছিল।
বিল বেকার নিজের গাড়ির দিকে এগুতে এগুতে বলল, ‘তাহলে এই মুহূর্তে আমরা কি করতে যাচ্ছি?’
জর্জ আব্রাহাম নিজের গাড়ির দরজা খোলার জন্যে হাত বাড়িয়েছিল। একটু থমকে গিয়ে মুখটা ঘুরিয়ে বলল, ‘অল্পক্ষনের মধ্যেই প্রাথমিক রিপোর্ট আমরা পেয়ে যাব। কিডন্যাপকারী কনফেকশনারী ভ্যানটি কোথায়, জেনারেল শ্যারন ও ডেভিড জোনসকে তাদের বাড়িতে পাওয়া গেল কিনা, ওয়াশিংটন শহরের প্রকাশ্য ও গোপন ইহুদী কেন্দ্র ও প্রতিষ্ঠানের সার্চ রিপোর্ট অল্পক্ষনের মধ্যেই পেয়ে যাব। আহমদ মুসাকে বন্দী করে রাখতে পারে, ওয়াশিংটন শহর উপকন্ঠের সম্ভাব্য এমন স্থানগুলোর একটা রিপোর্ট খুব সত্ত্বর আশা করছি। গোটা দেশ থেকেও এ ধরনের রিপোর্ট অল্পক্ষনের মধ্যেই আসা শুরু করবে বলে মনে করছি্ এসব হাতে আসার পর ভবিষ্যত কর্মপন্থা ঠিক করা যাবে।’
‘ঠিক আছে। আমি আপনার কলের অপেক্ষা করব। আর আমি কিছু জানতে পারলে সংগে সংগেই আপনাকে জানাব। গোটা দেশেই পুলিশ কাজে লেগে গেছে।’ বলে বিল বেকার গাড়িতে উঠে গেল।
জর্জ আব্রাহাম গাড়িতে ঢুকে তার ড্রাইভিং সিটে আসন নিয়েছে।
দুই গাড়িই পটোম্যাক লজ থেকে বেরিয়ে ছুটতে আরম্ভ করল।

এস এস সেন বলছিল, ‘সব রকম সহযোগিতা আমরা করব, কিন্তু একটাই শর্ত ব্যাপারটা গোপন রাখতে হবে।’
‘অবশ্যই গোপন রাখব। আমাদের স্বার্থেই গোপন রাখব। একটা মহাদুঃসময়ে আপনাদের আশ্রয় পেয়েছি। জানেন আহমদ মুসাকে কিডন্যাপ করে ফেরার পথে টেলিফোনে হোয়াইট হাউজ থেকে ইভা ব্রাউন জানাল যে, আমাকে ও ডেভিড উইলিয়াম জোনসকে গ্রেফতারের নির্দেশ প্রেসিডেন্ট দিয়েছেন। শুনে আকাশ থেকে পড়লাম। চারদিকে অন্ধকার দেখলাম। একদিকে আমাদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা, অন্যদিকে এর চেয়েও বড় প্রশ্ন দাঁড়াল আহমদ মুসাকে কোথায় রাখব। প্রেসিডেন্টের ঐ আদেশ থেকে বুঝেছিলাম, ইহুদীদের কোন বাড়ি, কোন সিনাগগ কিংবা ইহুদীদের কোন প্রতিষ্ঠানই আর নিরাপদ নয়। সরকারী পুলিশ ও গোয়েন্দারা সবটার উপর নজর রাখবে। এই অবস্থায় প্রথমেই আপনার কথা মনে পড়ল। সংগে সংগে গাড়ি ঘুরিয়ে আপনার এখানে চলে এলাম। আপনি আমাদের স্বাগত জানিয়েছেন। আমরা কৃতজ্ঞ। আপ…….।’
জেনারেল শ্যারনকে কথা শেষ করতে না দিয়েই এস এস সেন বলে উঠল, ‘জেনারেল এত বিনয়ী হওয়ার দরকার নেই। এ সাহায্যের পেছনে আমাদেরও স্বার্থ আছে। আহমদ মুসারা যেমন আপনাদের জানের শত্রু, তেমনি তারা আমাদের প্রানের শত্রু। আমাদের ভারতকে কম জ্বালায়নি ওরা। এখনও কম জ্বালাচ্ছে না। আমাদের মাতৃসম ভারতকে তিন টুকরো করেছে। সেই জ্বালায় আমরা তড়পাচ্ছি। আমাদের অসহনীয় জ্বালা থামবে না যতদিন না ঐ দুটো রাষ্ট্রকে আমরা হজম করতে পারছি। আহমদ মুসারা আমাদের লক্ষ্য অর্ঝনের পথে প্রধান বাধা। আমরা চাচ্ছি আধুনিকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতার আবরনে ঐ দুই রাষ্ট্র থেকে মুসলমানদের মুসলিম পরিচয় ভুলিয়ে দিতে। আর আহমদ মুসারা এই মুসলিম পরিচয়কে আরও শাণিত করছে। তার উপর আহমদ মুসারা এসেছে আমেরিকায়। এরা এখানে সুবিধা পাওয়ার অর্থ আমাদের সর্বনাশ হওয়া। সুতরাং আপনাদের মত আমরাও আহমদ মুসাদের বিনাশ চাই।’
এস এস সেন এর পুরো নাম। শিব সংকর সেন। তার বাপ ছিল ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর একজন ডাকসাইটে অফিসার। শিব সংকর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কম্পিউটার পড়তে এসে এখানেই থেকে যায়। সে একজন প্রতিভাবান কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। দেশ প্রেমিক শঙকর চায়নি আমিরিকায় সেটলড হতে। কিন্তু তার বাবা শিব দাশ সেন তাকে বুঝিয়েছে, হিন্দুস্তানের স্বার্থেই তার স্থায়ীভাবে আমেরিকায় বাস করা প্রয়োজন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আগামী দিনের এক বিশ্ব। এ বিশ্বে আমরা ভাগ বসাতে চাই, এ বিশ্বকে আমাদের হিন্দুস্তানের স্বার্থে পেতে চাই। তা পেতে হলে মিভ শংকরদের মত হিন্দুস্তানগত প্রাণ ছেলেদের আমেরিকায় থেকে যাওয়া প্রয়োজন। পিতার এই কথায় সে সানন্দেই রাজী হয়েছে। ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করার পর সে চাকরী নেয় বিখ্যাত আই বি এম কোম্পানীতে। এখন সে নিজেই বড় একটি কোম্পানীর মালিক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মোট সফটওয়্যার বিজনেসের প্রায় ২০ ভাগ তার পকেটে আসে। আমেরিকার অর্থনৈতিক ভাগ্যের চাকা যাদের হাতে তার মধ্যে সেও একজন। সে মনে করে তার বিত্ত-বৈভব তার হিন্দুস্তানের জন্যে।
তার সবচেয়ে বড় তৃপ্তি হলো, আমেরিকান সফটওয়্যার টেকনলজি সে পাচার করতে পেরেছে তার হিন্দুস্তানে। হিন্দুস্তানের হায়দারাবাদ সফটওয়্যার টেকনলজিতে এখন এক মিনি আমেরিকা।
শিব সংকরের এই বাড়িটি পেন্টাগনের ঠিক অপজিটে পটোম্যাক নদীর উত্তর তীরে। চার বিঘা জমির উপর বিশাল বাড়ি। বাড়ির চারদিকটা কৃত্রিম লেক আর বাগানে সজ্জিত।
বাড়িটা চারতলা। মাটির নিচে আরও দুটি ফ্লোর। পারমানবিক যুদ্ধের আশংকা সামনে রেখেই এ ফ্লোর দুটি তৈরী। মাটির তলায় সর্বশেষ ফ্লোর থেকে পটোম্যাক নদীতে বের হওয়ার একটা আধুনিক সুড়ঙ্গ পথও রয়েছে। যুদ্ধ শুরু হলে মাটির মাটির সারফেসের পথ কোন কারনে বন্ধ হয়ে গেলে সুড়ঙ্গটি পালাবার বিকল্প পথ।
পরিবার নিয়ে শিব শংকর এ বাড়িতেই বাস করে। আহমদ মুসা এই বাড়িরই ভূগর্ভস্থ শেষ তলার বাম পাশের একটি ঘরে বন্দী।
শিব শংকরের কথা শুনে জেনারেল শ্যারন ও ডেভিড জোনসের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
‘আপনাকে ধন্যবাদ মিঃ সেন। আমাদের একেবারে নিশ্চিন্ত করলেন। দেখা যাচ্ছে আমরা ও আপনারা একই লক্ষ্যে আমেরিকায় কাজ করছি। আপনাদের লক্ষ্য হিন্দুস্তান, আর আমাদের লক্ষ্য প্রোমিজড ল্যান্ড ইসরাইল। আর আমাদের সাধারন শত্রুও এক। আসুন আমরা এই শত্রুর বিরুদ্ধে এক সাথে লড়াই করি।’ বলল ডেভিড উইলিয়াম জোনস। আবেগে ভারী ছিল তার কন্ঠ।
‘লড়াই তো শুরু করেছি মিঃ জোনস। কিন্তু এটাতো লুজিং ব্যাটল। লস আলামোসের সুড়ঙ্গটা যে গোয়েন্দা সুড়ঙ্গ, তদন্ত টীমের সদস্যদের হত্যার জন্যে লস আলামোসের পথে আপনারাই যে সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছিলেন এবং একই লক্ষ্যে এফ বি আই বিমানে বোমা পেতে তা ধ্বংস করেছেন, তা তো প্রমাণ হয়েই গেছে।’ বলল শিব শংকর সেন।
‘হ্যাঁ। এগুলো সব শয়তান আহমদ মুসার কাজ।’
‘কিন্তু আজকের নিউজ আরও মারাত্মক। জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনের হত্যাকারী হিসাবে আপনাদের দুজনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। মিঃ হ্যামিল্টনের পকেটে পাওয়া একটা টেপ থেকে হত্যাকান্ডের গোটা বিবরণ নাকি তারা পেয়ে গেছে। দ্বিতীয়ত সিনেটর ময়নিহানের ছেলে হ্যারিকে কিডন্যাপের কিডন্যাপ নাকি আপনারাই করেছিলেন। হ্যারি এবং আপনাদের যারা ধরা পড়েছে, তাদের জবানবন্দী ছেপেছে পত্রিকাগুলো।’ বলল আবার শিব শংকর সেন।
‘ভাগ্য আমাদের বিরুদ্ধে গেছে মিঃ সেন। এক আহমদ মুসা এসে আমেরিকায় আমাদের সাজানো সংসারকে লন্ড-ভন্ড করে দিল।’ ডেভিড উইলিয়াম জোনস বলল।
‘আহমদ মুসাকে ধরে রেখে কি পেতে চান আপনারা? যা করার তার সবকিছুই সে করে ফেলেছে। কি লাভ হয়েছে এখন তাকে ধরে?’ বলল এস এস সেন।
‘আপনি ঠিকই বলেছেন। তাকে ধরে আমেরিকায় কোন লাভ আমরা করতে পারবো না। কিন্তু আমরা একটা প্রতিশোধ তো নিতে পারলাম! আমরা দুর্বল হয়ে পড়িনি তাও বোঝানো গেল।’ বলল জেনারেল শ্যারন।
‘কিন্তু এর মূল্যটা অনেক বড় দিতে হবে। তাকে ধরে মার্কিন সরকারকেই একটা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়া হয়েছে। এ চ্যালেঞ্জ অবশ্যই মার্কিন সরকার গ্রহন করবে। তার ফলে আপনাদের মুভমেন্ট এবং আহমদ মুসাকে বাইরে কোথাও সরিয়ে নেয়া কঠিন হয়ে দাঁড়াতে পারে।’
‘কিন্তু যে কোন মূল্যের চেয়ে আহমদ মুসা আমাদের কাছে মূল্যবান। তাকে নিয়ে আমেরিকার হয়তো দর কষাকষির কিছু নেই বটে, কিন্তু এশিয়ায় আছে। তাকে হত্যা করলে আমাদের জাতি যেন একটা স্থায়ী বিপদ থেকে মুক্ত হতে পারে, তেমনি তাকে হত্যা না করার শর্তে এশিয়া ও আফ্রিকার মুসলিম দেশগুলোর কাছ থেকে বড় বড় স্বার্থ আদায় হতে পারে। এমনকি ফিলিস্তিন উপকূলে ‘গুড হোপ’ দ্বীপে ইসরাইল রাষ্ট্রের নতুন যে প্রতিষ্ঠা হয়েছে তার প্রতিও স্বীকৃতি আমরা আদায় করতে পারি। তা পারা সম্ভব হলে ফিলিস্তিনের উপরও গিয়ে ইসরাইল রাষ্ট্রের পরোক্ষ অধিকার বর্তাবে।’ বলল জেনারেল শ্যারন।
‘কিন্তু সেটা করতে হলে তো আহমদ মুসাকে আমেরিকার বাইরে নেয়া চাই।’ বলল এস এস সেন।
‘আহমদ মুসাকে যদি কোন রকমে ইসরাইল দুতাবাসে নেয়া যায়, তাহলে সহজেই বাইরে পাচার করা যাবে।’ ডেভিড উইলিয়াম জোনস বলে উঠল।
‘খবরদার, এখন তাকে ইসরাইল দুতাবাসে নেয়ার নামও করবেন না। যে জায়গাগুলোতে সরকার এখন সার্বক্ষনিক চোখ রেখেছে, তার মধ্যে অবশ্যই শীর্ষে আছে ইসরাইল দুতাবাস। তাদের নজর এড়িয়ে এখন সেখানে একটা সুঁচও পাচার করতে পারবেন না।’ বলল এস এস সেন।
‘ধন্যবাদ। আমরা সেটা আঁচ করেছি বলেই সেদিকে না গিয়ে আপনার আশ্রয়ে এসেছি।’
‘আপনাদের সেবা করার এটুকু সুযোগ দেয়ার জন্যে ধন্যবাদ।’
বলে একটু থেমে একটু চিন্তা করে এস এস সেন পুনরায় বলে উঠল, অবশ্য আমি অনেকটা একক সিদ্ধান্তেই এটা করেছি। আমাদের কম্যুনিটি ফোরামে একটা ফরমাল সিদ্ধান্ত এ ব্যাপারে হওয়া দরকার।’
‘কেউ কি আপত্তি করতে পারে বলে মনে করেন?’ জিজ্ঞেস করল উইলিয়াম জোনস।
‘সে রকম সম্ভাবনা নেই। আপনাদের সাথে আমাদের ভারতের সম্পর্কতো আজকের নয়, সেই আদিকালের। ভারত নানা ভাবে কৃতজ্ঞ আপনাদের কাছে। ভারতের আজকের যে পারমানবিক শক্তি, কনভেশনাল অস্ত্র তৈরীতে যে উন্নতি, তার ভিত্তিতো আপনারাই গড়ে দিয়েছেন। আপনাদের সহযোগিতা না পেলে বহু আগেই আমাদের কাশ্মীর থেকে পাততাড়ি গুটাতে হতো। আমাদের কম্যুনিটির কেউই এসব কথা তুলতে পারে না। তাছাড়া ইতিমধ্যেই আমি অনেকের সাথে আলোচনা করেছি। তারা সকলেই সোৎসাহে এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। সুতরাং চিন্তার কিছু নেই।’
‘ধন্যবাদ মিঃ সেন।’ বলল ডেভিড উইলিয়াম জোনস।
‘আরেকটা কথা মিঃ জোনস, আপনারা আহমদ মুসাকে কিডন্যাপ করেছেন, এটা কি আপনারা কাউকে বলেছেন বা এ সম্পর্কে কোন ঘোষনা দিয়েছেন?’ জিজ্ঞেস করল এস এস সেন।
‘মাথা খারাপ! আমরা স্বীকার করতে যাব কেন? বরং আমরা আমাদের মিডিয়াকে বলে দিয়েছি, আমরা আমাদের সন্দেহ করার প্রতিবাদ করছি, এটা যেন তারা জানিয়ে দেয়। তাছাড়া তারা যেন এ রকম স্টোরী করে যে, আহমদ মুসা ইহুদী বিরোধী তার স্বার্থ হাসিল করারা পর নিজের ইচ্ছাতেই আত্মগোপন করেছে। এটা তার পুরনো অভ্যাস। যে জায়গাতেই তার মিশন শেষ হয়ে যায়, সেখান থেকে সে এভাবেই সরে পড়ে।’ বলল জেনারেল শ্যারন।
‘ব্রাভো! ব্রাভো! অনেক ধন্যবাদ আপনাদের। তারা বিশ্বাস করবে না একথা ঠিক। কিন্তু আপনাদেরও নির্দোষ দাবী করার একটা পথ হলো এর ফলে। জনগনের অন্তত একটা অংশকে বুঝ দেয়ার মত একটা কথা পাওয়া গেল।’ এস এস সেন বলল।
কথা শেষ করেই উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে এস এস সেন বলল, ‘এখনকার মত উঠি।’
‘অবশ্যই। অনেক সময় দিয়েছেন। অশেষ ধন্যবাদ।’
বাইরের ড্রইং রুম থেকে বেরিয়ে গেল এস এস সেন।

লিফটটি বেজমেন্ট লাইব্রেরীর প্রায় দরজায় এসে দাঁড়ায়।
শশাংক সেন ও সাগরিকা সেন লিফট থেকে লাইব্রেরীর দরজায় নামল।
শশাংক সেন শিব শংকর সেনের একমাত্র ছেলে এবং সাগরিকা সেন তার একমাত্র মেয়ে।
দুই ভাইবোনের মধ্যে সাগরিকা সেন বড় এবং শশাংক সেন বয়সে ছোট।
দুজনেই ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সিটির ছাত্র। একজন ইতিহাস ও একজন কম্পিউটার বিজ্ঞানের ছাত্র।
সাগরিকা সেন ইতিহাস এবং শশাংক সেন কম্পিউটার বিজ্ঞানে পড়ে।
মাঝে মাঝেই বেজমেন্টের লাইব্রেরীতে তাদের আসতে হয়।
বাড়ির আন্ডারগ্রাউন্ড দুটি ফ্লোর বাড়ির উপরের অংশের একদম বিকল্প হিসাবে গড়ে তোলা হয়। বোমায় যদি বাড়ির উপরের অংশ সম্পুর্ন উড়ে যায় তাহলেও প্রাত্যহিক জীবন পরিচালনার সবকিছু সহ আন্ডার গ্রাউন্ড ফ্লোর দুটি অবশিষ্ট থাকবে।
আন্ডার গ্রাউন্ড দুটি ফ্লোরের উপরেরটি স্টোর, কিচেন, অফিস ইত্যাদি। আর নিচের ফ্লোরটি শয়ন, লাইব্রেরী, ড্রইং এবং পারমানবিক ধ্বংসযজ্ঞ সময়ের জন্যে বিশেষভাবে তৈরী আশ্রয় কেন্দ্র নিয়ে গঠিত।
দুর্লভ ও দুষ্প্রাপ্য ধরনের বই পুস্তক, ডকুমেন্ট রাখা হয়েছে আন্ডার গ্রাউন্ড ফ্লোরের লাইব্রেরীতে। এসব বই ও ডকুমেন্টের খোঁজেই তার প্রায়ই আসতে হয় আন্ডার গ্রাউন্ড ফ্লোরের লাইব্রেরীতে।
সাগরিকা সেন ও শশাংক সেন দুই ভাই বোন আজ দুষ্প্রাপ্য সেই বইয়ের খোঁজেই আন্ডার গ্রাউন্ড লাইব্রেরীতে এসেছে।
লাইব্রেরীর দরজা খুলতে খুলতে সাগরিকা সেন বলল, ‘মনটা আজ ভাল লাগছে না। মনে হচ্ছে মাথায় যেন অশ্বস্তিকর বোঝারএকটা চাপ। বাবা কেন বাড়তি বোঝা মাথা পেতে নেন।’
‘তুমি কিসের কথা বলছ দিদি, বুঝলাম না আমি?’ বলল শশাংক সেন।
‘ভুলে গেলে কেমন করে এরই মধ্যে। বাবা একজন বন্দীকে এন রেখেছেন না বেজমেন্টের এই ফ্লোরে!’ সাগরিকা বলল।
‘না ভুলিনি। এখন বুঝতে পেরেছি।’
বলে একটু থেমেই আবার বলল শশাংক সেন, ‘সত্যিই বলেছ দিদি, আমার মনে হচ্ছে কি জান? মনে হচ্ছে এই ফ্লোরটা যেন এখন আর আমাদের নয়। কেমন একটা পর পর লাগছে।’
‘ঠিক বলেছ শশাংক, এই অনুভূতিটা আমারও।’ বলল সাগরিকা সেন।
‘আসলে ঘটনাটা কি দিদি? কে এই বন্দী? কেন বন্দী? এবং আমাদের এখানে কেন?’
‘মা বলতে চাচ্ছেন না। তবে মার সাথে বাবার কথা বার্তা আড়াল থেকে যতটুকু শুনেছি এবং মা দু একটা কথা যা বলেছেন, তাতে বুঝেছি বন্দীটি ডেভিড জোনস আংকেলদের। ওদের অসুবিধার কারনে বাবা সাময়িক আশ্রয় দিয়েছেন মাত্র।’
‘ডেভিড জোনস আংকেল মানে এ বন্দী তাহলে ইহুদীদের।’ বিস্ময় জড়িত কন্ঠে বলল শশাংক সেন।
একটু থেমে ঢোক গিলে আবার কথা বলে উঠল শশাংক সেন। বলল, ‘তুমি গত কয়েকদিনের নিউজ লক্ষ্য করেছ দিদি?’
‘কোন নিউজের কথা বলছ?’ বলল সাগরিকা সেন।
‘ঐ যে আহমদ মুসার উপর ষড়যন্ত্রের ব্লেম দিয়ে খবর বেরুল। খবরটা যদিও ছিল পত্রিকাগুলোর এক্সক্লুসিভ আইটেম, তবুও বোঝা গেছে খবরটার সরবরাহকারী ছিল ইহুদীরা। একদিন পর এই খবরের প্রতিবাদ বের হলো। দারুন চাঞ্চল্যকর। তাতে লস আলামোসের গোয়েন্দা সুড়ঙ্গসহ সবুকছুর জন্যে দায়ী করা হলো ইহুদী গোয়েন্দা সংস্থার ষড়যন্ত্রকে। খবরটা সাংঘাতিক হৈ চৈ এর সৃষ্টি করেছে।’
‘আরও তো দারুন খবর বের হয়েছে কাল।’ বলল সাগরিকা সেন।
‘কোন খবরটার কথা বলছ দিদি?’ জিজ্ঞেস করল শশাংক সেন।
‘কেন জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন খুন হওয়ার কথা।’ বলল সাগরিকা সেন।
‘ও পড়েছি, পড়েছি। ও খুনের জন্যেও তো সরাসরি দায়ী করা হয়েছে ডেভিড জোনস আংকেল ও জেনারেল শ্যারন নামে ইহুদী গোয়েন্দা সংস্থার একজনকে।’ শশাংক সেন বলল।
‘তাহলে তো দেখা যাচ্ছে, ইহুদী গোয়েন্দা সংস্থা মানে ইহুদীরা অনেকগুলো ষড়যন্ত্রের ফাঁদে জড়িয়ে পড়ল। আচ্ছা শশাংক, বিজ্ঞানী জন জ্যাকবের ব্যাপারটা কি? তুমি দ্বিতীয় দিনে প্রতিবাদমূলক যে নিউজের কথা বললে তাতে তো হাটে হাঁড়ি ভেঙে দেয়া হয়েছে। গোয়েন্দা সুড়ঙ্গ তৈরী করেছে ইহুদী বিজ্ঞানী জন জ্যাকব এবং তিনি লস আলামোস থেকে গবেষণা তথ্য অব্যাহতভাবে পাচারও করেছেন ঐ গোয়েন্দা সুড়ঙ্গ দিয়ে। এ ঘটনা সত্য হলে তো তা বিড়াট ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে।’ বলল সাগরিকা সেন।
‘বিরাট ব্যাপারই তো! বিজ্ঞানী জন জ্যাকবের মত লোক যদি ইহুদী স্বার্থের পক্ষে গোয়েন্দাগিরি করে থাকে, তাহলে কোন ইহুদীকে আর বিশ্বাস করা যাবে? এ প্রশ্ন কোন আমেরিকানই এড়িয়ে যেতে পারবে না।’ শশাংক সেন বলল।
লাইব্রেরীর একটা ডেস্কের চেয়ারে বসতে বসতে সাগরিকা সেন বলল, ‘নিউজে যেসব প্রমাণের কথা তুলে ধরেছে তা অকাট্য। আমি বুঝতে পারছি না হঠাৎ করে এমন সেনসিটিভ নিউজ এভাবে পত্রিকায় এল কেন? তাও আবার সরকারী সুত্রে নয়। ‘ফ্রি আমেরিকা’ ও ‘হোয়াইট ঈগলে’র মত সংগঠন এসব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে, সরকার নয় কেন?’
‘দিদি, প্রথম দিনের নিউজে মনে হয় এর উত্তর আছে। প্রথম দিনের নিউজে ইহুদীদেরকে ব্লেম দেয়া, ইহুদীদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করারা জন্যে আহমদ মুসার সাথে ‘ফ্রি আমেরিকা’ ও ‘হোয়াইট ঈগল’কে দায়ী করা হয়েছিল। এমনকি বলা হয়েছিল, আহমদ মুসার অর্থের লোভে এ দুই সংগঠন আহমদ মুসার দিকে চলে গেছে। আরও বলা হয়েছিল, মৌলবাদী আহমদ মুসা সরকারের উপরও ভর করেছে। এতেই সম্ভবত ক্ষিপ্ত হয়ে ‘ফ্রি আমেরিকা’ ও ‘হোয়াইট ঈগল’ একবারে হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিয়েছে।’ বলল শশাংক সেন।
শশাংক ও সাগরিকা মুখোমুখি বসেছে।
‘ফ্রি আমেরিকা’ খুব পপুলার সংগঠন। সবাই জানে, প্যাট্রিওটদের এ সংগঠনটি দেশের স্বার্থ ছাড়া অন্য কোন স্বার্থে কাজ করে না। ‘হোয়াইট ঈগল’ও আগে বর্ণবাদী সংগঠন ছিল, এখন তা আর নেই। এদের ছোবল দেয়া ইহুদীদের ঠিক হয়নি।’ বলল সাগরিকা সেন।
‘ঠিকই হয়েছে দিদি। সত্য প্রকাশের একটা পথ হয়েছে। ওদের ছোবল না দিলে ইহুদীদের এ ষড়যন্ত্রের কথা এভাবে জনসমক্ষে আসতো না।’ শশাংক সেন বলল।
‘এভাবে ‘ইহুদীদের’ বলে সব ইহুদীদের এক সাথে শামিল করা ঠিক নয়।’ বলল সাগরিকা সেন।
‘ঠিক দিদি। দেশের মেজরিটি ইহুদী এ ষড়যন্ত্রে সাথে নেই। কিন্তু বাস্তবতা হলো বদনামটা তাদেরকেও স্পর্শ করবে। নির্দোষ হয়েও অনেকে দুর্ভাগ্যের শিকার হবে।’
‘অন্যের কথা না ভেবে, আমাদের নিজেদের কথাটাই ভাব না শশাংক। খুনের দায়ে অভিযুক্ত সেই মিঃ ডেভিড জোনসই আামাদের বাড়িতে এন্ট্রান্স পেয়ে গেল।’
‘না সে তো পায়নি।’
‘একই কথা। তার বন্দীকে আশ্রয় দেয়ার অর্থ কি? অর্থ কি এটা নয় যে আমরা মিঃ ডেভিড জোনসের পক্ষ নিলাম?’
‘ঠিক বলেছ দিদি। ড্যাডি এটা কোন বিবেচনায় করলেন বুঝতে পারছি না। তিনি তো এসব ব্যাপারে খুবই সতর্ক।’
‘সতর্ক বটে, কিন্তু তুমি তো জান, আমাদের পিতৃভূমি ভারতের সাথে ইসরাইল রাষ্ট্র ও ইহুদীদের সম্পর্ক খুবই গভীর এবং পুরোনো। অনুকূল, প্রতিকূল কোন অবস্থাতেই এই সম্পর্ক নষ্ট হয়নি। আমেরিকাতেও ইহুদীরা ভারতীয়দের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। ভারতীয়রা যে আজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবসায়-বানিজ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে উঠে আসতে পেরেছে তার পেছনেও ইহুদীদের আন্তরিক সহযোগিতা রয়েছে।’
‘কিন্তু তাই বলে জলজ্যান্ত ক্রাইমের সাথে তো আপোস করা যায় না। তাও সাধারন ক্রাইম নয়, দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। যা পরিস্কার রাষ্ট্রদ্রোহিতার পর্যায়ে পড়ে।’
‘ড্যাডি ওদের একজন বন্দীকে আশ্রয় দিয়েছেন, এর বেশী তো আর কিছু করা হয়নি। সম্ভবত বন্দীকে রাখার মত ওদের কোন জায়গায়ই আজ আর নিরাপদ নয়। এই অবস্থায় ওদের একটা অনুরোধ আমাদের রক্ষা করতে হয়েছে। এমন ক্ষেত্রে তো ‘না’ বলা যায় না।’
‘বন্দী লোকটা কে? কেন বন্দী সে?’ প্রশ্ন করল শশাংক সেন।
‘কথা প্রসঙ্গে মাকে একবার বলতে শুনেছি যে, বন্দীকে নাকি কোন শূল্য দিয়ে মাপা যাবে না, এমন অমূল্য সে। ইহুদীদের সকল দুর্ভাগ্যের কারনও নাকি এই লোকটাই।’ বলল সাগরিকা সেন।
‘তুমি যে বর্ণনা দিলে দিদি, তাতে তো লোকটিকে দেখতে ইচ্ছা করছে। অমূল্য বন্দীটি দেখতে তাহলে কেমন!’
‘ঠিক বলেছ শশাংক। মা’র মুখ থেকে শোনার পর আমার মধ্যেও এই কৌতুহলের সৃষ্টি হয়েছে। একজন মানুষ এমন অমূল্য হতে পারে কেমন করে! আর একজন মাত্র একটা জাতির সকল দুর্ভাগ্যের কারণ হতে পারে কিভাবে! কিন্তু দেখার সুযোগ কিভাবে হতে পারে বলত?’
চিন্তা করছিল শশাংক সেন।
একটু পর হাসল। বিজয়ীর হাসি। বলল, ‘উপায় পেয়েছি দিদি।’
‘উপায়টা কি?’
‘উপায় হলো ভেন্টিলেটর। আমাদের পারমানবিক শেল্টারগুলোরই কোন একটাতে তাকে রাখঅ হয়েছে। আর আমাদের পারমাণবিক শেল্টারের প্রত্যেকটা মূল কক্ষ বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত। তার মানে চার দিকের যে কোন দিক দিয়ে ঘরে যাওয়া যায়। ঞরের চার দেয়ালের তিন দেয়ালেরই প্রায় ছাদ সমান উঁচু জায়গায় তিনটি ভেন্টিলেটরের ব্যবস্থা আছে, কিন্তু অন্য সময় ভেন্টিলেটর খোলা থাকার কথা। নিচে আমাদের অটো ল্যাডার আছে। সেটা দিয়ে উপরে উঠে ভেন্টিলেটর দিয়ে সহজেই আমরা ঘরের ভেতর দেখতে পারি।’
সাগরিকা সেনেরও মুখ হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, ‘ধন্যবাদ শশাংক। খুঁজে পেতে তুমি একটা ভাল পথ বের করেছ। চল ওঠ, এখনি যাব।’
সোৎসাহে সংগে সংগেই উঠে দাঁড়াল শশাংক। সাগরিকাও উঠল।
অটো ল্যাডারটি তারা দুজনে শেল্টারের পেছনের দেয়ালে নিয়ে এল।
পরপর পাঁচটি ঘর। অথবা বলা যায় একটা বড় কক্ষকে পাঁচটি কক্ষে বিভক্ত করা হয়েছে।
একদম শেষের ঘর থেকে বন্দী অনুসন্ধান শুরু করার সিদ্ধান্ত নিল তারা দুজন।
অটো ল্যাডারে একসাথে দুজন উঠা যায়। ল্যাডারে অটোমেটিক কন্ট্রোল প্যানেল রয়েছে। ল্যাডারে বসেই তারা অটো কন্ট্রোল প্যানেলের একটা কি’তে চাপ দিল এবং ল্যাডার বক্সকে পেছনের দেয়ালের এমন জায়গায় সেট করল যেখান থেকে দাঁড়িয়ে ভেন্টিলেটর দিয়ে ঘরের ভেতরটা পুরোপুরি দেখার সুযোগ নেয়া যায়।
তাদের প্রথম উদ্যোগই সাফল্যের মুখ দেখল। ভেন্টিলেটরে দুজন চোখ লাগাতেই বন্দীকে ঘরের মেঝেতে একটা খাটিয়ায় শোয়া অবস্থায় দেখতে পেল।
বন্দীর মাথাটা বিপরীত দিকে থাকায় তারা বন্দীর মুখসহ গোটা চেহারাটাই দেখতে পেল। বন্দীকে দেখে তারা দুজনেই হতাশ হলো।
বিশল দেহের, বিকট চেহারার কাউকে দেখবে এ রকমই তারা আশা করেছিল। তারা আরও আশা করেছিল, বন্দীকে ক্রুদ্ধ চেহারা বা হতাশ বদন নিয়ে বসে থাকতে দেখবে। তার বদলে তারা দেখল একজন ভদ্রলোককে, যাকে এই বন্দীখানার চেয়ে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাশে তাদের পাশে মানায় বেশী। ক্রুদ্ধ বা হতাশার বদলে প্রসন্ন মুখ নিয়ে শুয়ে আছে। তার চেহারার প্রসন্নতা ও নিরুদ্বিগ্নতা দেখে মনে হচ্ছে সে যেন তার নিজের ঘরে নিজের বেডে শুয়ে একটু রেস্ট নিচ্ছে।
‘এমন ভদ্র একজন ছেলে সাংঘাতিক বিপজ্জনক বন্দী কি করে হয়?’ বলল শশাংক সেন।
‘আমাদের ভুল হচ্ছে না তো? বন্দী হয়তো অন্য কোথাও আছে, যাকে দেখছি সে মনে হয় বন্দী নয়।’ বলল সাগরিকা সেন।
‘হতে পারে। তাহলে অন্য ঘরগুলো কি দেখব?’ বলল শশাংক সেন।
‘না এখন নয়, পরে আসব। এর মধ্যে জানার সুযোগ হতে পারে যে, বন্দী ছাড়া আরও কেউ আছে কি না।’
‘ঠিক আছে। তাহলে চল দিদি। খবর নিয়ে পরেই আসা যাবে।’
ল্যাডার বক্স চালিয়ে দুজনে নেমে এল নিচে।
ফিরে এল তারা লাইব্রেরীতে।

জেনারেল শ্যারন বলছিল, ‘মিঃ আহমদ মুসা আপনি আমাদের জানেন, আমরাও আপনাকে জানি। আমরা আপনার সাথে একটা সন্ধিতে আসতে চাই, যদি আপনি রাজি হন।’
জেনারেল শ্যারন ও ডেভিড উইলিয়াম জোনস দুজনে আহমদ মুসার সামনে দুটি চেয়ারে বসে ছিল। দুজনের হাতেই রিভলবার। আর তাদের পেছনে আরও চারজন আহমদ মুসার দিকে স্টেনগান তাকক করে দাঁড়িয়ে আছে।
আহমদ মুসা বসে আছে তার খাটে দু পা উপরে তুলে অনেকটা যোগাসনের মত।
আহমদ মুসার গায়ে টি-সার্ট। পরনে ঢিলা ঢালা একটা ট্রাউজার। সেদিন সারা জেফারসনের বাড়িতে সকালে এই পোশাক পরেই নাস্তার পরে ঘুমিয়ে ছিল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার টি সার্ট ও ট্রাউজারে কোথাও কোথাও রক্তের দাগ।তার বাহু, বাজু, ঘাড়ে কয়েকটা ছোট ব্যান্ডেজ দেখা যাচ্ছে। টি- সার্ট ও ট্রাউজারের নিচে এ ধরনের আরও ব্যান্ডেজ আছে।
জেনারেল শ্যারন কথা বলছিল। আহমদ মুসা ভাবলেশহীন, নির্লিপ্ত। সে যেন জেনারেল শ্যারনের কথা শুনছিল না। তার কথা আহমদ মুসার কানে ঢুকছিল মাত্র।
জেনারেল শ্যারনের কথা শেষ হলেও আহমদ মুসা জবাবে কোন কথা বলল না। উত্তর দেবার কোন ভাবও তার চেহারায় নেই।
একটু অপেক্ষা করে জেনারেল শ্যারনই আবার বলে উঠল, ‘মিঃ আহমদ মুসা আপনার সাথে আমাদের লোকরা যে আচরন করেছে আমরা তার জন্যে দুঃখিত। বলুন, ওদেরই বা দোষ কি? যুক্তরাষ্ট্র ছিল গোটা দুনিয়ায় আমাদের সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়। সে আশ্রয়ে আপনি আগুন দিয়েছেন।আমাদের লোকরা কেমন করে নিজেদের সামলাবে বলুন? এই কারনে সেদির জ্ঞান ফেরার সাথে সাথে ওরা ক্ষুধার্ত নেকড়ের মত আপনার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। আমরা উপস্থিত থাকলে এমনটা হতে পারতো না। যাক, এ ধরনের অনাকাঙ্খিত গন-পিটুনির জন্যে আমরা দুঃখিত।’ থামল জেনারেল শ্যারন।
শ্যারন যে কথা বলেছে সেটা ঠিক। সেদিন আহমদ মুসাকে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় কিডন্যাপ করে ইহুদী গোয়েন্দা সংস্থার একটা নামহীন ঘাঁটিতে নিয়ে তোলে। তারপর সংজ্ঞাহীন আহমদ মুসাকে রেখে জেনারেল শ্যারন ও জোনস গিয়েছিল জরুরী একটা বিষয়ে আলোচনার জন্যে পাশেই। ইতিমধ্যে আহমদ মুসার জ্ঞান ফিরে আসে। এই সুযোগে শ্যারন ও জোনসের উত্তেজিত লোকরা আহমদ মুসার উপর চড়াও হয়। ব্যাপারটা ঘটে মধ্যযুগীয় ইউরোপের রাজা-বাদশাহদের কায়দায়। তারা যেমন অনেক আসামীকে ক্ষুধার্ত নেকড়ের হাতে ছেড়ে দিত। তারপর দেখত নেকড়ের দ্বারা কিভাবে তাদের দেহ ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়। আহমদ মুসার দেহ ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়নি বটে, কিন্তু অমানুষিক ভাবে নির্যাতিত হয়েছে সে। আহমদ মুসা আবার জ্ঞান হারালে তবেই লোকেরা ক্ষান্ত হয়। তবে এটা ঠিক শ্যারনরা এস তাকে দেখার পর তারা ভাল চিকিৎসার ব্যবস্থা করে।
এবার জেনারেল শ্যারন থামতেই আহমদ মুসা বলল, ‘মেকি দুঃখ প্রকাশের কোন প্রয়োজন নেই জেনারেল শ্যারন। আপনারা যাই করছেন তা আপনাদের পরাজয়ের কারন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আপনারা যা করেছেন, একটা পরাজিত বাহিনী এটাই করে থাকে। আপনাদের এই অধঃপতনের জন্যে দুঃখ প্রকাশ করতে হয়।’
জেনারেল শ্যারনের দুটি চোখ জ্বলে উঠেও আবার নিভে গেল। মুখে কষ্টে-সৃষ্টে হাসি টেনে বলল, ‘রাগ করেছেন আহমদ মুসা? আপনার মেজাজ ভাল করার জন্যে কিছূ সুখবর আপনাকে শোনাতে পারি।’
বলে একটু থেমেই আবার শুরু করল, ‘আপনার নতুন প্রেমিকা সারা জেফারসন আপনাকে হারিয়ে পাগলের মত হয়ে গেছে। তাকে হাসপাতালে নিতে হয়েছে। তার টেনশন কমানোর জন্যে তাকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হচ্ছে। তার ‘ফ্রি আমেরিকা’ পাগল হয়ে উঠেছে আপনাকে উদ্ধারের জন্যে। অন্যদিকে মার্কিন সরকার রাষ্ট্রীয়ভাবে কেসটাকে গ্রহন করেছে। আপনাকে উদ্ধারের জন্যে পুলিশ, এফবিআই, সিআইএ, সেনাবাহিনী, কোস্টাল গার্ড, সীমান্ত রক্ষী প্রভৃতি সকল বাহিনীতে জরুরী অবস্থা ঘোষনা করা হয়েছে। তারা চষে ফিরছে গোটা দেশ। ইহুদীদের কোন সংস্থা, প্রতিষ্ঠান তারা সার্চ করতে বাদ রাখেনি। সীমান্ত সীল করা হয়েছে শুরুতেই। আপনি ভাগ্যবান আহমদ মুসা। মার্কিন সরকার আপনাকে ধরার জন্যে এক সময় যে শক্তি নিয়োগ করেছিল, তার শতগুন শক্তি তারা নিয়োগ করেছে আপনাকে উদ্ধারের জন্যে।’ থামল জেনারেল শ্যারন।
শ্যারন থামতেই মুখে হাসি টেনে উইলিয়াম জোনস বলে উঠল, ‘যা বলেছেন তার চেয়েও আহমদ মুসা ভাগ্যবান। সারা জেফারসন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অঘোষিত ফার্স্টলেডি। যার ফার্স্ট পারসন নেই। এই ফার্স্ট পারসন হওয়ার জন্যে অনেক আমেরিকান বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করতে রাজি। আহমদ মুসা বিনা পয়সায় শুধু তাকে নয়, তার হৃদয়টাও পেয়ে গেছেন।’
‘মিঃ ডেভিড উইলিয়াম জোনস আমি আপনাকে ভদ্রলোক মনে করতাম। কিন্তু কিছু না জেনে শুনে অশ্লীল কথা বলতে পারেন এই বয়সে তা জানতাম না। মিস জেফারসন একজন সম্মানিতা আমেরিকান। আপনি আমেরিকান হিসাবে তার মর্যাদা রাখা আপনার উচিত ছিল।’ বলল বিক্ষুদ্ধ কন্ঠে আহমদ মুসা।
‘আমি আর আমেরিকান হতে পারলাম কই। ইহুদীই তো থেকে গেলাম। সুতরাং সে উচিত্যবোধের তোয়াক্কা আমি করি না।’ বলল ডেভিড জোনস।
‘ইহুদী হলেও ভদ্র হতে তো দোষ নেই।’ বলল আহমদ মুসা।
‘মুখ সামলে কথা বলুন মিঃ আহমদ মুসা। আপনি আমাদের বন্দী ভুলে যাবেন না।’ বলল ডেভিড জোনস।
ডেভিড জোনস থামতেই জেনারেল শ্যারন বলে উঠল আহমদ মুসাকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়েই, ‘আমাদের আলোচনা অনেকখানি অন্য দিকে চলে গেছে। আমার মনে হয় মিঃ জোনস আমরা আলোচনায় ফিরে যেতে পারি।’
বলেই সে আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আহমদ মুসা আমার প্রশ্নে আমি ফিরে যাচ্ছি। আমি বলছিলাম, ‘আমরা আপনার সাথে একটা সন্ধিতে আসতে চাই। আপনার মত কি?’
আহমদ মুসা মনে মনে হাসল। মনে মনেই বলল, জেনারেল আমার সাথে সন্ধিতে আসতে চায়, এর চেয়ে ফেরেববাজী আর কি হতে পারে। তবু মুখে বলল, ‘কি সন্ধি মিঃ শ্যারন? সন্ধি তো হয় যুদ্ধক্ষেত্রে। কিন্তু আমি তো আপনাদের বন্দী। বন্দীর কাছে সন্ধির প্রস্তাব কিসের?’
‘আপনি বন্দী হলেও বন্দী নন। আপনি লড়াইয়ের ময়দানে আছেন, আমরাও। সুতরাং সন্ধি হতে পারে।’ বলল জেনারেল শ্যারন।
‘এই তো মিঃ জোনস এখনই বললেন আমি বন্দী আমি যেন এ কথা ভুলে না যাই।’ আহমদ মুসা বলল। তার মুখে হাসি।
হাসল ডেভিড জোনসও। বলল, ‘ঠিকই বলেছি। কিন্তু এর অর্থ এ নয় যে, আপনি বন্দী মানেই বন্দী। আনি বন্দী হয়েও মুক্ত মানুষের চেয়ে শক্তিশালী। সে কথাই জেনারেল শ্যারন আপনাকে বলছেন।’
‘আমি কি করতে পারি বলুন।’ জেনারেল শ্যারনদের দিকে তাকিয়ে বলল আহমদ মুসা।
‘একটা সন্ধিতে আসতে পারেন।’ জেনারেল শ্যারন বলল।
‘কি সন্ধিতে?’
‘আমরা কিছু পেতে চাই এবং কিছু দিতেও চাই।’
‘কি পেতে চান?’
‘আমাদের ইসরাইল রাষ্ট্রের উৎখাতের পর হাইফা থেকে ৫০ মাইল সাগরের ভেতরে ফাক্কো বা ‘গুড হোপ’ দ্বীপে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত আছে, আপনি জানেন। আমাদের দাবী হলো এক. ‘হাইফা থেকে তেল আবিব’ পর্যন্ত এই এক চিলতে উপকূল ভুমি আমাদের দিতে হবে। দুই. ইসরাইল দখলে নেবার সময় ফিলিস্তিনিরা যে ‘সেন্ট্রাল স্টেট লাইব্রেরী ও আরকাইভ’ দখল করেছে, সেটা আমাদেরকে যেমন ছিল তেমন ফেরৎ দিতে হবে। তিন. আপনি আমেরিকা ত্যাগ করবেন এবং তার আগে আমেরিকার সাথে আমাদের আপোশ করিয়ে দিয়ে যাবেন।’
আহমদ মুসা তাদের দাবী শুনে মনে মনে হাসল এবং বুঝল, ইহুদীরা কঠিন বেকায়দায় না পড়লে এমন প্রস্তাব নিয়ে তার কাছে আসতো না। বলল, ‘আর আপনারা আমাকে কি দিতে চান?’
‘বিনিময়ে আমরা আপনাকে মুক্তি দিতে চাই এবং শত্রুতার বদলে সহাবস্থান অফার করতে চাই।’ বলল জেনারেল শ্যারন।
‘আপনারা আমার মুক্তির যে বিনিময় দাবী করেছেন, আমার মূল্য অত নয় মিঃ শ্যারন।’
‘মিঃ আহমদ মুসা আমাকে শেখাবার চেষ্টা করবেন না। আমরা আপনার বিনিময়ে সাবেক গোটা ইসরাইল রাষ্ট্র যদি দাবী করি, তাও পেতে পারি।’
‘কেমন করে? কে দেবে?’
‘আপনার প্রানের মূল্য সাবেক ইরাইল রাষ্ট্রের চেয়ে অনেক বেশী ফিলিস্তিন সরকারের কাছে।’
‘এসব আপনাদের কল্পনা বিলাস। একজন ব্যক্তি একটা রাষ্ট্রের সমান হয় না, বিনিময় তো হয়ই না।’
‘সেটা আমরা দেখব। আপনি রাজি কিনা বলুন?’
‘আমার রাজি হওয়ার প্রশ্ন নেই। অন্যের সম্পত্তি, আমি দিতে রাজি হব কিভাবে?’
ফিলিস্তিন রাষ্ট্র অন্যের নয়। আপনি ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের জনক। জনকের প্রাণ বাঁচাবার জন্যে ফিলিস্তিন তার অর্ধেক ছেড়ে দিতে পারেই। আমরা অর্ধেক চাইনি। চেয়েছি হাইফা থেকে তেল আবিব পর্যন্ত ছোট্ট একটা করিডোর। এটা দেয়া তাদের জন্যে কিছুই নয়।’
‘আমি আমার মুক্তি বা বাঁচার জন্যে ফিলিস্তিনের এক ইঞ্চি ভূমিও অন্য কারো হাতে দিতে রাজি হবো না।’
‘বিষয়টা আপনার অবগতি ও সম্মতির জন্যে আপনার কাছে তুলেছিলাম। কিন্তু আপনি রাজি হওয়া, না হওয়াতে আমাদের কিছু এসে যায় না। আমরা দাবী করবো ফিলিস্তিন সরকারের কাছে, আপনার কাছে নয়। দাবী পুরণ করবে ফিলিস্তিন সরকার, আপনি নন।’
‘ভূমি ফিলিস্তিন সরকারের নয়, ফিলিস্তিন জনগনের। যাক সে কথা, আমার মুক্তির বিনিময়েও আমি আপনাদের ব্যাপারে কোন মিথ্যা কথা মার্কিন সরকারকে বলব না। সুতরাং তৃতীয় শর্তও আপনাদের পূরণ হবে না।’
‘এ ব্যাপারে এখন আমরা আপনার সাথে কথা বলব না। আপনার মত ভবিষ্যতে পাল্টাতে পারে। একজন মানুষের কতদিন বন্দী থাকতে ভালো লাগে বলুন?’
‘কিন্তু আমি বললেই কি আপনাদের ব্যাপারে মার্কিন সরকার ও জনগনের ধারনা পাল্টাবে, তাদের আগের বিশ্বাস ফিরে আসবে?’
‘গনতন্ত্রে ব্যক্তি বা সরকার বড় কথা নয়। ব্যক্তি ও সরকার পাল্টালে নতুন সরকার এলে নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। বিশ্বাসের মানদন্ড পাল্টে যায়। অবিশ্বাসী বিশ্বাসী হয়, আবার বিশ্বাসী অবিশ্বাসী হয়ে যায়। সেই জন্যেই তো গনতন্ত্র আমাদের কাছে এক প্রিয়।’
বলে জেনারেল শ্যারন একটু থামল তারপর বলল, ‘আপনাকে শুধু বিজ্ঞানী জ্যাকবের ব্যাপারে বললেই চলবে। আপনি বলবেন, আপনার বিশ্বাস বিজ্ঞানী জন জ্যাকবের সময় সুড়ঙ্গটি গোয়েন্দা কাজে ব্যবহার হয়নি। তার অনুপস্থিতিকালে পরিবর্তন হতে পারে। বিজ্ঞানী জন জ্যাকবের উপর থেকে সন্দেহ চলে গেলে পরবর্তী কাজটা আমরা করতে পারব। মুক্তি যদি পেতে চান এই সহযোগিতাটা আপনাকে অবশ্যই করতে হবে।’
‘আমার মুক্তির জন্যে আমি মিথ্যা কথা বলব একথা আপনারা ভাবলেন কি করে?’ বলল বিদ্রূপকন্ঠে আহমদ মুসা।
হাসল জেনারেল শ্যারন। বলল, ‘আপনার এই মনোভাব ভবিষ্যতে নাও থাকতে পারে। আপনি নিজ ইচ্ছাতেই আমরা যেভাবে বলব, সেভাবে আমাদের সহযোগিতা করবেন।’
‘কেন করবো?’ বিস্মিত কন্ঠে বলল আহমদ মুসা।
‘কেন, বিজ্ঞান এত কিছু পারে, মানুষকে ইচ্ছা মত কথা বলাতে পারে না?’
‘মানুষ যন্ত্রের দাস নয়, যন্ত্র মানুষের দাস। এজন্যেই পারে না।’
‘ঠিক আছে, ভবিষ্যৎ কি বলে দেখবেন?’ বলল ভাবলেশহীন কন্ঠে জেনারেল শ্যারন। এমন ভাব যেন নিশ্চিত ভবিষ্যৎটা সে দেখতে পাচ্ছে।
বিস্মিত হলো আহমদ মুসা।
বিজ্ঞান কথা বলাতে পারে ইচ্ছামত, এ কথার অর্থ কি? এমন যন্ত্র কি আবিষ্কৃত হয়েছে যা মানুষের উপর এমন প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে, যার ফলে যন্ত্র যেমনটা চায় সেভাবে মানুষকে কথা বলাতে পারে? হঠাৎ আহমদ মুসার মনে পড়ল ওমর বায়ার কথা। ওমর বায়ার প্রতিপক্ষরা যান্ত্রিক ইলেক্ট্রোওয়েভের মাধ্যমে ওমর বায়ার চিন্তাকে সম্পূর্ন ভিন্ন দিকে পরিচালিত করে তার কাছ থেকে স্টেটমেন্ট যোগাড়ের চেষ্টা করেছিল। এরাও কি এমন কিছুর ব্যবস্থা করেছে?
মনে মনে শিউরে উঠল আহমদ মুসা। আহমদ মুসাকে নির্যাতন করে মেরে ফেলা যাবে, কিন্তু তার কাছ থেকে কিছু আদায় করা যাবে না। এই আদায়ের জন্যে কে তারা ভিন্ন পথ নিয়েছে? এই জন্যেই কি আজ তারা মিষ্টি মিষ্টি কথা বলছে ও সন্ধির প্রস্তাব দিচ্ছে? ওমর বায়ার মত তার ক্ষেত্রেও কি এ ধরনের কোন ব্যবস্থা তারা গ্রহন করেছে? কি সে ব্যবস্থা? আহমদ মুসার মনে পড়ল হেলসিংকি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী অধ্যাপক বি. কন. চু-এর ১৩৪ পৃষ্ঠার দীর্ঘ প্রবন্ধের কথা। প্রবন্ধটির নাম, ‘The Social Reality of Artificial Mind and Body Control.’ এ প্রবন্ধের ভূমিকায় লিখেছেন, ‘ইহুদীবাদীরা তাদের নিজেদের হাত নিরাপদ রাখার জন্যে ‘মনোদৈহিক নিয়ন্ত্রণ’ ব্যবহারের মাধ্যমে অন্যকে তারা বাঞ্চিত হত্যা ও অন্যান্য অপরাধ সংঘটনে বাধ্য করে। কেনেডি, রবার্ট কেনেডি, মার্টিন লুথার কিং, জর্জ ওয়ালেস প্রমুখের হত্যাকান্ড এই ব্যবস্থারই ফল। ইহুদীবাদ বিরোধী বহু নেতাকে রাজনৈতিক ও সামাজিক মর্যাদা বিসর্জন দিতে হয়েছে, এমনকি অনেকে জীবন দিয়েছে এই ব্যবস্থার ফাঁদে পড়েই।’ বিজ্ঞানী চু-এর নিবন্ধ থেকেই আহমদ মুসার আরও মনে পড়ল ‘মনোদৈহিক নিয়ন্ত্রণ’-এর ব্যাপারটা একটা জটিল বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ায় যাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাওয়া হয় ‘ব্রেইনওয়ে ট্রান্সমিশন’ ও ‘অপটোইলেক্ট্রনিক্যাল কন্ট্রোল’ কৌশলের মাধ্যমে তার মানব দৈহিক ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনতে হয়। তবে আহমদ মুসার একটা কথা মনে পড়ল যে, এই নিয়ন্ত্রন ব্যবস্থা চরিত্রহীন বা শিথিল চরিত্রের লোকদের উপর যতটা কার্যকরীহয়, চুরত্রবান বা দৃঢ় চরিত্রের লোকদের উপর ততটা কার্যকরী হয় না। কিন্তু আহমদ মুসার এই জানাটা বহুদিন আগের। তারপর বিজ্ঞান অনেক দূর এগিয়েছে। নিয়ন্ত্রন ব্যবস্থাতেও আরও পরিবর্তণ এসেছে। নিশ্চয় আরও কার্যকর করা হয়েছে এই ব্যবস্থাকে। এই ব্যবস্থাই কি তারা প্রয়োগ করবে তার উপর? আবার শিউরে উঠল আহমদ মুসা। এই অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে সে কিভাবে লড়াই করবে?
আহমদ মুসাকে অনেক্ষন কোন জবাব দিতে না দেখে জেনারেল শ্যারন বলে উঠল, ‘কি কথা বলছেন না কেন মিঃ আহমদ মুসা? ভয় পেয়ে গেলেন নাকি?’
‘ভয় নয়, ভাবছি ভবিষ্যতে কি দেখব তা নিয়ে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কিছুই দেখবেন না। কিছু করবেন মাত্র।’ জেনারেল শ্যারন বলল।
‘কিছু তো অবশ্যই করব, কিন্তু সেটা আপনারা বলছেন কি করে?’ আহমদ মুসার প্রশ্ন।
‘আমরা বলছি কারন, আমরা যা চাই, তাই আপনি করবেন।’ জেনারেল শ্যারন বলল।
বলেই উঠে দাঁড়াল জেনারেল শ্যারন। বলল, ‘চলুন মিঃ জোনস। আহমদ মুসাকে অনেক বিরক্ত করেছি আর নয়। আমাদের সন্ধি প্রস্তাব নিয়ে অবশ্যই উনি ভাববেন।’
উঠে দাঁড়াল ডেভিড উইলিয়াম জোনসও।
জেনারেল শ্যারন যাবার জন্যে ফিরে দাঁড়াতে গিয়ে বলল, ‘মিঃ আহমদ মুসা আপনার বন্দী অবস্থাকে সুখদায়ক করতে সর্বোচ্চ যা করা যায়, তা আমরা করেছি। কোন অসুবিধা হলে বলবেন আমরা ভেবে দেখব।’
ওরা নিজ নিজ চেয়ার হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেল। ওরা ঘর থেকে বের হবার সাথে সাথে ঘরের দরজাও বন্ধ হয়ে গেল।
রো চলে গেলে আরো অনেক চিন্তা এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল আহমদ মুসার মাথায়।
বন্দীখানার এই সুব্যবস্থা আহমদ মুসার কাছ কিছুক্ষন আগ পর্যন্তও ভল লেগেছিল, কিন্তু সেই সুব্যবস্থা এখন আহমদ মুসার কাছে ষড়যন্ত্রমূলক বলে মনে হচ্ছে।
বন্দীখানায় তাকে আরামদায়ক বিছানা দেয়া হয়েছে।
বলা যায়, আনবিক বোমা প্রুফ একটি আশ্রয় কেন্দ্রে তাকে বন্দী করে রাখা হয়েছে।
এই কথা মনে হতেই একটা ভাবনা বিদ্যুত চমকের মত আহমদ মুসার মনে এসে প্রবেশ করল। এ ধরনের আশ্রয় কেন্দ্র থেকে বের হবারও একটা আন্ডারগ্রাউন্ড পথ থাকে। কারন, আণবিক বোমার আঘাতে উপরের সব কিছু যখন নষ্ট হয়ে যাবে, তখন আন্ডারগ্রাউন্ড আশ্রয়স্থল যতটা জরুরী, ততটাই জরুরী বের হবার জন্যে আন্ডার প্যাসেজ। সুতরাং এ আশ্রয় কেন্দ্রেরও নিশ্চয় সে ধরনের আন্ডার গ্রাউন্ড প্যাসেজ রয়েছে। খুশী হয়ে উঠল আহমদ মুসার মন।
এই সিদ্ধান্তে পৌঁছার সাথে সাথেই আহমদ মুসার মনে ঝড়ের মত প্রবেশ করল একটি চিন্তা। তাহলে কি মৃত পাখি বাইরের সম্ভাব্য আণবিক বিপর্যয়ের প্রতীক? মৃত পাখি একটাই দেখা যাচ্ছে। আর তা উপরের ফ্লোরের ছাদে চিহ্নিত এবং তা উপরে উঠে যাবার দরজা-চিহ্নিত স্থানে রয়েছে। এর অর্থ নিশ্চয় উপরে উঠার পথ ধ্বংস হয়ে যাওয়া বুঝাচ্ছে। এই ভাবনা থেকে আহমদ মুসার মনে হলো, নকশায় বের হবার মূল পথ বন্ধ বা বিনষ্ট দেখানো হয়ছে। অতএব আশ্রয় কেন্দ্র থেকে বের হবার বিকল্প পথও নিশ্চয়নকশায় চিহ্নিত থাকবে এবং সেখানে অবশ্যই পাখিকে দেখা যাবে। এই চিন্তার সাথে সাথেই তার মন বলে উঠল, তাহলে কি দক্ষিণ প্রান্তের দেয়ালে করিডোর যেখানে শেষ হয়েছে, সেখানে চিহ্নিত দরজাই বের হওয়ার গোপন পথ? সেখানে দরজা চিহ্নিত স্থানে একটা মুক্ত ডানার পাখি আঁকা রয়েছে। এখানে অঙ্কিত পাখি জীবিত ও মুক্ত ডানা অলা হওয়ার অর্থ নিশ্চয় এটাই যে, বের হবার জন্যে এ পথ নিরাপদ।
আল্লাহর অশেষ শুকরিয়া আদায় করল আহমদ মুসা। তার এই চিহ্না ও অনুমান যদি সত্যি হয়, তাহলে এ জিন্দানখানা থেকে বের হওয়ার একটা উপায় সে পেয়ে গেছে।
আনন্দে মন ভরে গেল আহমদ মুসার।
এই প্রথমবারের মত নিজের বন্দী দশা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিল আহমদ মুসা। সে এ বিজ্ঞানকে বিশ্বাস করে যে, বৈদ্যুতিক বা রেডিও ওয়েভ কিংবা অতিকার্যকরী কোন আলট্রাসনিক ওয়েভের ব্যবহার করে মানুষের চিন্তা ও মননে বৈকল্য এনে নতুন পথে একে প্রবাহিত করার পদ্ধতি বৈজ্ঞানিক ভাবে সম্ভব হতে পারে। এধরনের কমান্ড কম্পিউটার শুনলে মানুষের ব্রেনের কোষও শুনতে পারে। এখানেই আহমদ মুসার ভয়। হিপনোটাইজড হওয়ার মত অন্যের হাতের পুতুলে পরিনত হওয়ার কথা আহমদ মুসা চিন্তাই করতে পারে না। এমন দুর্ভাগ্য আমার আগেই তাকে মুক্ত হতে হবে। উঠে বসল আহমদ মুসা।
এ বন্দীখানা থেকে বের হবার যে পথের কথা সে চিন্তা করছে তা যে ঠিক, তা দেখতেও তাকে এই কক্ষ থেকে বের হতে হবে। কিন্তু বের হবার পথ কি?
এবার উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা।
দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
দেখল নকশাটা আবার।
দুটি ফ্লোরের সবগুলো ঘরের মুক্ত ডানার পাখি আঁকা। এর অর্থ বুঝতে পারছে আহমদ মুসা, দরজা অতিক্রম করাই বের হবার একমাত্র পথ। দরজায় পাখির উপস্থিতি একথাই বলছে।
কিন্তু দরজা অতিক্রম করবে কিভাবে?
আহমদ মুসা এই ঘরে ঢুকার সময় লক্ষ্য করেছে, দরজা খুলেছে ও বন্ধ হয়েছে স্বয়ংক্রিয় ভাবে।
আহমদ মুসা ঘরের দরজা ও তার আশ-পাশ আবার গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করল, কোন গোপন সুইচ বা কোন বোতাম আছে কিনা।
না তেমন কিছুই কোথাও নেই। অনেক সময় দরজার বটম ফ্লোরে ওয়েট নিয়ন্ত্রিত স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা থাকে। এই চিন্তা করে দরজায় বটম ফ্লোরে অনেক চাপাচাপি ও নাচানাচি করল, কিন্তু কোন ফল হলো না। দরজার দুপাশের সাইড ওয়াল এবং দরজার উপরের ওয়ালটাও অনেক টিপাটিপি করল আহমদ মুসা। কাজে এল না কিছুই।
হতাশ মনে আহমদ মুসা আবার ফিরে এল বিছানায়। ছুড়ে দিল দেহকে বিছানার উপর।
ভাবল, হতে পারে দরজা দুর নিয়ন্ত্রিত।
কিন্তু পরক্ষনেই লাফ দিয়ে উঠে বসল। আপন মনে বলল, এটা তো পারমাণবিক আশ্রয় কেন্দ্র। এখানে মূল ব্যবস্থাই থাকতে হবে ভেতর থেকে খোলার। সবাই ঘরে আশ্রয় নিলে বাইরে থেকে খোলার লোক পাবে কোথায়? আবার দৌড় দিল দরজার দিকে।
আতি-পাতি করে আবার খুঁজল, সন্দেহজনক কিছু পাওয়া যায় কিনা। না কিছুই পেল না।
তাহলে দেয়ালের অন্য কোন জায়গায় কি দরজা খোলার কোন ব্যবস্থা গোপন রাখা হয়েছে?
এ চিন্তার সাথে সাথে আহমদ মুসা আবার চার দেয়ালের পরীক্ষায় লেগে গেল। আতি-পাতি করে খুঁজল চার দেয়ালের প্রতিটি ইঞ্চি জায়গা। না কোথাও কিছু পেল না। দেয়ালগুলোতে টোকা দিয়েও দেখেছে, কোথাও ফাঁপা কেতান জায়গা আছে কিনা, যেখানে সুইচ বা বোতাম লুকানো থাকতে পারে। সেরকম জায়গা কোথাও পেল না। পরিশেষে আহমদ মুসা বিছানা উল্টিয়ে খাট সরিয়েও দেখল সন্দেহ করার মত কোথাও কিছু পাওয়া যায় কিনা? কিন্তু কোন কিছুই চোখে পড়ল না।
ক্লান্ত হয়ে পড়েছে আহমদ মুসা।
শুয়ে পড়ল আবার। বলল মনে মনে স্রষ্টার উদ্দেশ্যে, ‘হে আল্লাহ, আমার চেষ্টা শেষ। এবার তোমার সাহায্যের প্রত্যাশা করছি। তুমি সাহায্য কর।’
প্রার্থনা শেষ হয়নি, এ সময় হঠাৎ আহমদ মুসার মনে উদয় হলো দরজাগুলোতে মুক্ত ডানার ক্ষুদে পাখিগুলোর সেটিং নিখুঁতভাবে দরজাগুলোর একই জায়গায়। অপরিকল্পিত বা রেনডম সেটিং হলে এরকম হবার কথা নয়। কিন্তু পরিকল্পিত ভাবে একই জায়গায় একই কায়দায় পাখিগুলোর সেটিং কেন? এর মধ্যে কি ইংগিত আছে?
ভাবার সাথে সাথেই আহমদ মুসা লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। ছুটল দরজার দিকে।
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে স্থির দৃষ্টিতে তাকাল ক্ষুদে পাখিটার দিকে মুহূর্তকাল। তারপর ‘বিসমিল্লাহ’ বলে তর্জনি দিয়ে জোরে চাপ দিল পাখির উপর।
চাপ দেয়র সাথে সাথেই নড়ে উঠল দরজা। এক প্রকার হিস হিস শব্দ তুলে দরজাটি ডান দিকে সরে গিয়ে ঢুকে গেল ডান দিকের দেয়ালের ভেতর।
আনন্দের আকস্মিকতায় আহমদ মুসা কিছুক্ষনের জন্যে চলৎশক্তি হারিয়ে ফেলেছিল। পরক্ষনেই সাবধান হয়ে দুপা এগিয়ে বাইরে উঁকি দিল, দেখল বাইরে প্রশস্ত করিডোর। কেউ নেই।
নিরস্ত্র আহমদ মুসা অত্যন্ত সতর্ক হয়ে এক পা দুপা করে করিডোরে বেরিয়ে এল।
করিডোরটা পশ্চিমে অল্প গিয়ে শেষ হয়েছে।
আহমদ মুসা করিডোর ধরে দ্রুত পূর্বদিকে এগুলো। দেখা নকশঅ থেকে আহমদ মুসা অনুমান করছে পূর্বমুখী এই করিডোরটাই তাকে নিয়ে যাবে দক্ষিনমুখী করিডোরে যা শেষ দক্ষিন প্রান্তের দেয়ালে চিহ্নিত আছে দরজা এবং অংকিত আছে মুক্ত ডানার অতিক্ষুদ্র সেই পাখি। যা তার জন্যে মুক্তির বার্তাবহ হতে পারে।
আহমদ মুসা যে ঘরে বন্দী ছিল তার অনুরূপ কয়েকটা ঘর পার হতেই করিডোরটা একটা প্রশস্ত চত্বরে গিয়ে পড়ল। তারও চারদিকে ঘর। আহমদ মুসা দেখতে পেল চত্বরটির দক্ষিন পাশ থেকে একটি করিডোর আরও দক্ষিন দিকে এগিয়ে গেছে।
খুশী হলো আহমদ মুসা। ওটাই তার বাঞ্চিত দক্ষিনমুখী করিডোর।
কিন্তু দক্ষিন থেকে তার দৃষ্টি সামনে প্রসারিত হতেই আনন্দটা উবে গেল। দেখল, যমদূতের মত দুই স্টেনগানধারী তাদের উদ্যত স্টেনগান তার দিকে তাক করে মাত্র গজ পাঁচেক দূরে কোত্থেকে যেন ভুতের মত আবির্ভূত হয়েছে।
স্টেনগানধারীরা চোখে পড়ার পর আহমদ মুসা এক মুহূর্তও বিলম্ব করেনি।
তার মাথাটা একটু পেছনে ঝুঁকে পড়তে দেখা গেল। তার সাথে তার দেহটা একটু চিৎ হলো। তারপর তার দুপা মেঝে ঘেঁষে বিদ্যুৎ গতিতে ছুটল পাশাপাশি দাঁড়ানো স্টেনগানধারীদের দিকে।
আহমদ মুসার দেহ যখন ঝুঁকে পড়ছিল, তখন গুলী বৃষ্টি শুরু হলো দুজনের স্টেনগান থেকেই।
কিন্তু যখন বুলেটের ঝাঁক আহমদ মুসার দেহ লক্ষ্য করে ছূটে এল, তখন আহমদ মুসার দেহ মেঝে স্পর্শ করে ছুটে যাচ্ছে দুই স্টেনগানধারীকে লক্ষ্য করে।
মুহূর্তেই দৃশ্যপট পাল্টে গেল।
আহমদ মুসার চলন্ত দেহটা স্টেনগানধারীদের পায়ে গিয়ে আঘাত করেছে।
দুজন স্টেনগানধারীর দেহ মেঝেতে ছিটকে পড়েছে। স্টেনগান খসে পড়েছে তাদের হাত থেকে।
আর আহমদ মুসা তাদের দুই স্টেনগান কুড়িয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। দুজনের দিকে স্টেনগান তাক করে বলল, ‘দুই হাত মাথার উপর তুলে উঠে দাঁড়াও।’
অনিচ্ছা সত্বেও দুহাত উপরে তুলে তারা উঠে দাঁড়াল।
আহমদ মুসা তাদের লক্ষ্য করে বলল, ‘আমি নির্দেশ দেব, সংগে সংগে তা পালন করবে। অযথা রক্তারক্তি আমি পছন্দ করি না, কিন্তু নির্দেশের অন্যথা হলে তারপর এক মুহূর্তও তোমরা বেঁচে থাকবে না। তোমরা অনেক বুলেট নষ্ট করেছ, আমার বুলেট কিন্তু একটাও নষ্ট হয় না মনে রেখ।’
কথাটা শেষ করেই আহমদ মুসা একবার চারদিকে তাকাল। তাকাতে গিয়ে দেখতে পেল তার বাঁ দিকের বন্দীখানার ঘরগুলোর পূর্ব-উত্তর কোণে একজন তরুণ ও একজন তরুণী মূর্তির মত স্থির দাঁড়িয়ে আছে। তাদের চোখগুলোও পাথরের মত স্থির।
আহমদ মুসা দু’ধাপ পেছনে সরে গিয়ে একটি স্টেনগানের ব্যারেল তরুণ-তরুনীর দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে ভয়ংকর ঠান্ডা কন্ঠে বলল, ‘স্টেনগানের ট্রিগার আশা করি আমার টিপতে হবে না।’
বলেই আহমদ মুসা মাথার উপরে হাত তুলে দাঁড়ানো দুজনকে বলল, ‘তোমাদের জামা ও জুতা খুলে ফেল।’
সংগে সংগে তারা নির্দেশ পালন করল।
তারপর তাদের দুজনের একজনকে বলল, ‘তুমি তোমার জামা দিয়ে ওর দুহাত পিছমোড়া করে ভেঁধে ফেল এবং জুতার ফিতা দিয়ে ওর দু’পা বেঁধে ফেল।’
লোকটি আহমদ মুসার নির্দেশ পালন করল। একজন বাঁধা হয়ে গেল।
দ্বিতীয় লোকটিকে আহমদ মুসা বলল, ‘তুমি উপুড় হয়ে শুয়ে পড়।’ শুয়ে পড়ল লোকটি।
মূর্তির মত দাঁড়িয়ে থাকা তরুণ-তরুণীকে লক্ষ্য করে আহমদ মুসা বলল, ‘মিঃ.. আপনি এখানে আসুন। আমাকে একটু সাহায্য করুন।’
সংগে সংগেই তরুনটি এল কম্পিত পায়ে। বলল, ‘আমার নাম শশাংক সেন।’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘মিঃ শশাংক সেন, আপনি দয়া করে ঐ লোকটির মত এ লোকটিকে বেঁধে ফেলুন।
শশাংক সেন তৎক্ষনাৎ তার নির্দেশ পালন করল।
‘ধন্যবাদ মিঃ শশাংক সেন। বলল আহমদ মুসা।
তরুনীটি ততক্ষনে তরুনটির পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
দুজনেই ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আহমদ মুসার দিকে। বোধ হয় ভাবছে, এরপর শুরু হবে তাদের পালা।
কিন্তু আহমদ মুসা সেরকম কোন নির্দেশ দিল না। বলল তাদের দিকে চেয়ে, ‘আমার অনুমান মিথ্যা না হলে বলতে পারি, আপনারা আমার শত্রু নন?’
‘ঠিক বলেছেন, আমরা আপনার শত্রু পক্ষের বটে, কিন্তু আপনার শত্রু নই আমরা।’ বলল তরুনীটি।
‘কেন শত্রু নন শত্রু পক্ষের হয়েও?’
‘আমরা দুজনের কেউই আপনাকে চিনি না, জানি না। অজানা, অচেনা লোক শত্রু হতে পারে কেমন করে? বলল তরুনীটিই।
‘কিন্তু পরিচয় পেলে?’ আহমদ মুসা বলল।
‘সেটা জানি না। তবে আপনার সাথে অন্তত আমাদের দুজনের এমন কিছু ঘটেনি যাতে আপনি শত্রু হবেন।’ তরুনীটিই বলল।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘আপনাদের পিতার যদি আমি শত্রু হই, তাহলে আপনাদের দু’ভাইবোনেরও কি শত্রু হয়ে যাব না?
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা আবার বলে উঠল, ‘শত্রু না হলে বলুন তো, এরা দু’জন হঠাৎ কোত্থেকে এল?’
‘উপরে ভূগর্ভস্থ শেল্টার গেটের ওরা প্রহরী। ভুগর্ভস্থ বিশেষ কিছূ কক্ষের দরজা খুললে ঐ গেটে এ্যালার্ম বাজে। এই এ্যালার্ম শুনেই এরা এসেছে। সামনে দেয়ালটির পরেই লিফট রুম। লিফট থেকে নেমে তারা এখানে এসেছে।’
‘উপরে কজন প্রহরী থাকে? জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘এ দুজনই ছিল। তাও এরা আগে ছিল না। কদিন থেকে থাকছে।’ তরুনটি বলল।
‘তার মানে আমি বন্দী হবার আগে কোন দিন কোন বন্দী ছিল না।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কোনদিনই ছিল না। এটা তো কোন বন্দীখানা নয়।’ বলল এবার তরুণীটি।
‘আমি এখানে এলাম কি করে? আপনারা তো ভারতীয় অরিজিন। তাহলে ভারতীয় হিন্দু স্বার্থ ও ইহুদী স্বার্থ কি এক হয়ে গেছে?’
‘আমরা জানি না।’ বলল তরুনীটি।
‘ভূগর্ভস্থ বিশেষ বিশেষ কক্ষের দরজা খুললে এ্যালার্ম বাজার ব্যবস্থা আর কোথায় কোথায় আছে?’
‘আরও কোথাও আছে নিশ্চয়, কিন্তু আমরা জানি না।’ বলল তরুণীটি।’
‘আপনাদের কোথায় বন্দী করি বলুন তো?’
‘কেন?’ প্রশ্ন তরুণের।
‘আমি এখন বেরিয়ে যাব। কিন্তু এভাবে আপনাদের রেখে আমি যাব কি করে?’
‘কেন, আমরা তো আপনার কোন ক্ষতি করছি না।’
‘আমার ক্ষতি নয়, আপনাদেরকে ক্ষতি থেকে রক্ষা করতে চাচ্ছি।’
‘আমাদের কি ক্ষতি?’
‘আমাকে পালানোর সহযোহিতা করার দায়ে আপনারা অভিযুক্থ হতে পারেন।’
বলেই আহমদ মুসা তার স্টেনগান তুলে নির্দেশের ভংগিতে বলল, ‘তাড়াতাড়ি করুন। হয় আমার বন্দীখানায় বন্দী হবেন, নয়তো অন্য কোথাও। তাড়াতাড়ি বলুন।’
‘তাহলে আমাদের লাইব্রেরী কক্ষে।’ বলল তরুলটি।
‘চলুন লাইব্রেরীতে।’
ওরা দু’জন আগে আগে হাঁটল, পেছনে আহমদ মুসা।
ওদের লাইব্রেরীতে তুলে যখন দরজা লক করতে যাচ্ছিল, তখন তরুণীটি বলল, ‘আপনার পরিচয় তো আপনি দেননি?’
‘আপনাদের পরিচয়ও তো আমি পাইনি।’
‘আমি সাগরিকা সেন। ওর নাম তো জেনেছেন। শিল্পপতি শিব শংকর সেন আমাদের পিতা। আমরা দুজনেই ছাত্র। এবার আপনার পরিচয় বলুন?’
হাসল আহমদ মুসা। শেষ মুহূর্তে শত্রুতা সৃষ্টি করে লাভ নেই। এখনও আমরা শত্রু নই, সেটাই থাক। পরে আমার পরিচয় আপনাদের পিতা, কিংবা যে কারো কাছ থেকে অবশ্যই জানতে পারবেন। তখন শত্রু হলেও আমি জানতে পারবো না।’
আহমদ মুসা দরজা লক করল।
তারপর চাবিটা নিচে পেলে রেখে বেরিয়ে যাচ্ছিল। সাগরিকা সেন জানালা দিয়ে বলল, ‘আপনি যাবেন কিভাবে?’
‘আন্ডার গ্রাউন্ড প্যাসেজ দিয়ে অথবা উপর দিয়ে। ধন্যবাদ। বাই।’
বেরিয়ে এসে আহমদ মুসা চত্বরটি পেরিয়ে প্রবেশ করল দক্ষিণমুখী সেই করিডোরে।
আহমদ মুসা সিশ্চিত যে আন্ডার গ্রাউন্ড প্যাসেজে বড় কোন জটিলতা থাকা স্বাভাবিক নয়।
আহমদ মুসার অনুমান সত্য হলো। করিডোরের দক্ষিণ প্রান্তের দেয়ালে যেখানে মুক্ত ডানার পাখি আঁকা আছে, তার উপর চাপ দিতেই দেয়াল সরে গিয়ে একটা প্যাসেজ বেরিয়ে পড়ল।
প্যাসেজটি অন্ধকার।
আহমদ মুসা বিসমিল্লাহ বলে প্রবেশ করল প্যাসেজে।
প্যাসেজে প্রবেশ করতেই পেছনের দরজা বন্ধ হয়ে গেল। আর দরজা বন্ধ হওয়ার সাথে সাথেই প্যাসেজটি আলোকিত হয়ে উঠল।
আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল আহমদ মুসা। অন্ধকার প্যাসেজ নিয়ে ভীষণ চিন্তায় পড়েছিল। কাছে টর্চ নেই, কি করে সে অন্ধকার প্যাসেজ দিয়ে সামনে এগুব! আল্লাহ সে সমস্যার সমাধান করে দিয়েছেন।
কিন্তু একটা বিষয় আহমদ মুসার মনে প্রবল অস্বস্তির সুষ্টি করল। সাগরিকা সেনদের কথায় আহমদ মুসা বুঝেছে, বন্দীখানার দরজা খুললে যে এ্যালার্ম বাজার ব্যবস্থা তা একাধিক জায়গায় রয়েছে। তাহলে মাত্র দুই প্রহরীই এল, আর কেউ খোঁজ নিল না কেন? বন্দীখানা থেকে বেরুলে আহমদ মুসাকে পালাবার জন্যে উপরে উঠতেই হবে এই নিশ্চিত বিশ্বাস নিয়ে কি ওরা ওপরেই প্রস্তুত হয়ে বসে আছে? কিংবা আন্ডারগ্রাউন্ড প্যাসেজ দিয়ে আহমদ মুসা পালাতে পারে এই বিষয়টা তারা কি বিবেচনাতেই আনেনি? আহমদ মুসা সম্পর্কে তারা এতটা নিশ্চিত হবে, এটা কি করে সম্ভব?
উত্তরহীন এ প্রশ্নগুলো থেকে সৃষ্ট অস্বস্তি নিয়েই আহমদ মুসা এগুচ্ছে প্যাসেজ দিয়ে।
এক জায়গায় এসে প্যাসেজ শেষ হয়ে গেল। সামনে দেয়াল। আহমদ মুসা বুঝল, এ দেয়ালেও একটা দরজা আছে এবং এটাই শেষ দরজা। এর পর তার মুক্তি।
আহমদ মুসা দরজার মুখোমুখি দাঁড়াল। দেখে খুশী হলো যে, এ দেয়ালেও নির্দিষ্ট স্থানে ক্ষুদ্রাকারে সেই মুক্ত ডানার পাখী আঁকা।
পাখিতে চাপ দিল আহমদ মুসা।
সংগে সংগে দেয়াল সরে গেল।
দেয়াল সরে যেতেই আহমদ মুসা দেখতে পেল একটা সিঁড়ি। সিঁড়িটা নিচে পানি পর্যন্ত নেমে গেছে।
সিঁড়ির গোড়ায় একটা বড় ধরনের মোটর বোট বাঁধা।
বোট দেখে আহমদ মুসা ভাবল, বোটটা বোধ হয় পারমাণবিক শেল্টার থেকে বেরুবার শেষ মাধ্যম।
আহমদ মুসা প্যাসেজ থেকে বেরিয়ে সিঁড়িতে এসে দাঁড়াল।
সংগে সংগেই পেছনে প্যাসেজের পথ বন্ধ হয়ে গেল।
সিঁড়ি হয়ে বোটে নামার জন্যে পা বাড়িয়েছে আহমদ মুসা, এই সময় বোটের কক্ষ থেকে ডেকে বেরিয়ে এল জেনারেল শ্যারন, ডেভিড উইলিয়াম জোনস এবং শিব শংকর সেন। তাদের তিনজনের পেছনে আরও চারজন স্টেনগানধারী।
‘আসুন আহমদ মুসা। আপনাকে আমরা স্বাগত জানাচ্ছি। আসুন।’ দুই হাত প্রসারিত করে আগ বাড়ানোর ভংগিতে বলল জেনারেল শ্যারন।
‘আমরা আপনার প্রশংসা করছি আহমদ মুসা। আপনি বলেই সম্ভব হয়েছে পারমাণবিক শেল্টার থেকে এভাবে বেরিয়ে আসা। আপনি সত্যিই অনন্য।’ বলল ডেভিড উইলিয়াম জোনস।
‘আপনার মত প্রতিদ্বন্দ্বী থাকাও গৌরবের। সত্যিই আমার বিশ্বাস হতে চাইছিল না যে, আমার অতি সাবধানে তৈরী পারমাণবিক শেল্টার থেকে বের হওয়ার কোড আপনি ভাঙতে পারবেন। আপনি সত্যিই অপ্রতিরোধ্য।’ শিব শংকর সেন বলল।
‘দেরী করে লাভ নেই আহমদ মুসা। আসুন। আপনার পেছনে ফেরার পথ বন্ধ। সামনেই আপনাকে এগুতে হবে। আর আপনি সামনে এগুতে ভালও বাসেন।’ বলল জেনারেল শ্যারন।
তার কথা শেষ হবার আগেই দুজন করে স্টেনগানধারী সিঁড়ির দুপাশ দিয়ে উঠে গিয়ে আহমদ মুসাকে ঘিরে ফেলল এবং ঘিরে রেখেই তাকে বোটে নামিয়ে নিয়ে এল।
‘মিঃ আহমদ মুসা, আধুনিক কোন কলাকৌশল দিয়ে আপনাকে আটকানো সম্ভব নয়। তাই আমরা ভাবছি প্রাচীন পদ্ধতিতেই আপনাকে বন্দী রাখতে হবে। যদিও তা একটু অমানবিক হয়। আর তাতো হতেই হবে। আপনি তো মানুষ নন, অতিমানুষ। অতিমানুষের জন্যে অমানবিক পদ্ধতিই দরকার।’ বলল জেনারেল শ্যারন।
‘সে জন্যে আমরা যেখানে যাচ্ছি, সেই ব্রাইট ফিল্ডে আমার গোডাউনটাই ওর উপযুক্ত জায়গা হবে।’ শিব শংকর সেন বলল।
‘আপনার ব্রাইট ফিল্ডটা কোথায় আমি চিনতে পারছি না।’ বলল ডেভিড উইলিয়াম জোনস।
‘আমার গ্রীষ্মকালীন অবকাশকেন্দ্র যেখানে সেই ‘আনাপোলিশ’ তো আপনি চেনেন। ঐ আনাপোলিশ থেকে যে প্রধান সড়কটি ওয়াশিংটন গেছে, সেই সড়কটির সাথে বাল্টিমোর থেকে আসা সড়কটি যেখানে মিলেছে সেটাই ব্রাইট ফিল্ড। এই ব্রাইট ফিল্ডে আমার একটি সফটওয়্যার ফ্যাক্টরী ও একটি গোডাউন আছে। এখানে প্রধানত রিমডেলিং ও রিএ্যাসেম্বলের কাজ হয়। এখানকার গোডাউনটা বিশাল ও বিচিত্র। ওখানে আহমদ মুসার মত শত লোককে হজম করা যায়।’
‘ধন্যবাদ মিঃ সেন। এরকমটাই আমরা চেয়েছিলাম।’
‘ধন্যবাদ।’ বলল শিব শংকর সেন।
আহমদ মুসাকে ততক্ষণে কোরবানীর গরুর মত আস্টে-পৃস্টে বাঁধা হয়েছে।
সেদিকে তাকিয়ে ডেভিড জোনস বলল, ‘স্যরি, মিঃ আহমদ মুসা, এর চেয়ে ভালো কোন ব্যবস্থা আপনার জন্যে সম্ভব নয়। তবে এই দুঃখের মধ্যে একটা সুসংবাদ শুনাই। আপনার প্রেমিকাকে হাসপাতাল থেকে ছাড়া হয়েছে। তবে পুলিশ বেস্টনী থেকে ছাড়া পায়নি। এক ঝাঁক এফ বি আই-এর লোক সর্বক্ষণ তার বাড়ি ঘিরে রেখেছে। তাদের আশংকা আমরা তাকে কিডন্যাপের পরিকল্পনা করেছি। সরকার তার একাকী কিংবা অবাধ যাতায়াত একেবারেই বন্ধ করে দিয়েছে। চিন্তা নেই, সে কিছূ করতে না পারলেও তার দল ‘ফ্রি আমেরিকা’ ভয়ংকর রকম তৎপর। তবে আফসোস, ইহুদী প্রতিষ্ঠান ও বাড়ি-ঘর তারা খঁজে মরছে। আপনি যে ভারতীয় আশ্যয়ে এটা তারা কল্পনাই করছে না। অতএব আপনি মুক্ত হবেন, কেউ আপনাকে মুক্ত করবে এ আশা এবার ছাড়তে পারেন। আফসোস সারা জেফারসনের জন্যে। আপনাকে না পেলে বেচারা মরেই যাবে।’
আহমদ মুসা কোন কথা বলল না। ঘৃনার ভাব ফুটে উঠেছে তার মুখে। সে মুখ ফিরিয়ে নিল ডেভিড জোনসের দিক থেকে।
উটে দাঁড়াল জেনারেল শ্যারন, ডেভিড জোনস এবং শিব সংকর সেন।
আহমদ মুসাকে টেনে নিয়ে চলল বোটে তার বন্দীখানার দিকে।

হোয়াইট হাউজের ‘Meet the Citizens’ কক্ষে বসে আছে আমেরিকান ভারতীয় এ্যাসোসিয়েশনের(ABA) সভাপতি ভারত ভূষণ শিবাজী, নির্বাহী পরিচালক বিনোদ বিহারী মালাকর, এই এসোসিয়েশনের প্রধান উপদেষ্টা শরৎসিং বর্মন এবং চীফ প্যাট্রন শিব শংকর সেন।
এরা সবাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশিষ্ট নাগরিক। সবাই এরা বিজনেস ম্যাগনেট এবং টাকার কুমীর।
এরা বড় একটা টেবিল ঘিরে বসে আছে। হোস্টের চেয়ার তখনও খালি। হোস্ট স্বয়ং প্রেসিডেন্ট এ্যাডামস হ্যারিসন। প্রেসিডেন্ট তখনও আসেনি।
প্রেসিডেন্ট এলো। সবাই দাঁড়িয়ে তাকে স্বাগত জানালভ
প্রেসিডেন্ট বসতে বসতে বলল, ‘স্যরি, একটা জরুরী টেলিফোন এ্যাটেন্ড করতে যেয়ে ২ মিনিট দেরী হয়েছে।’
‘এ কিছুই নয় মহামান্য প্রেসিডেন্ট। আমরা বরং ভয়ে ভয়ে আছি মহামান্য প্রেসিডেন্ট আমাদের চিনবেন কিনা?’ বলল এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ভারত ভূষণ শিবাজী।
প্রেসিডেন্ট হাসল। বলল, ‘আমি কি মিঃ শিবাজী, মিঃ সেন, মিঃ বর্মন ও মিঃ মালাকরদের মত লোকদের ভূলতে পারি, না ভুলা উচিত! আমি ভুলব কি করে যে, একদিনের একটা অনুষ্ঠানে আমার ইলেকশন ফান্ডে আপনারা ৩০ লাখ ডলার ডোনেট করেছিলেন। ওটাই ছিল সে বছর আমার ইলেকশন ফান্ডের সর্বোচ্চ ডোনেশন। আপনাদের এ্যাপয়েন্টমেন্ট ঠিক করা দেখে আমিই বরং লজ্জা পেয়েছি। যেখানে আমার ডাকা উচিত ছিল, সেখানে আপনারাই আমাকে ডেকেছেন। সত্যিই আমি দুঃখিত।’
‘মহামান্য প্রেসিডেন্ট, এই বিনয়ের জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ। আমরা খুশী হয়েছি যে, আপনার স্মৃতি থেকে আমরা কেউই মুছে যাইনি।’ বলল মিঃ শিবাজী।
‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে, তিনি ভুলিয়ে দেননি।’
বলে প্রেসিডেন্ট একটু থেমে সকলের উপর একবার চোখ বুলিয়ে বলল, ‘বলুন, আমি আপনাদের জন্যে কি করতে পারি?’
‘মহামান্য প্রেসিডেন্ট, আমরা একটা বড় বিষয় নিয়ে এসেছি। আমরা আপনার ফেভার চাই।’ বলল শিব শংকর সেন।
‘আমার ফেভার আপনাদের প্রতি রয়েছে, বলুন বড় ব্যাপারটা কি?’ প্রেসিডেন্ট বলল।
‘মহামন্য প্রেসিডেন্ট, আপনার সরকার ইহুদীদের উপর ক্র্যাক ডাউন করছে, এ বিষয়টি আমরা পুনর্বিবেচনার জন্যে অনুরোধ জানাতে চাই। ডেভিড উইলিয়াম জোনস ও জেনারেল শ্যারনের উপর ওয়ারেন্ট জারীর কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে চাই। আমাদের অনুরোধ তাদের ওয়ারেন্ট প্রত্যাহার করুন।’
প্রেসিডেন্টর হাসি মুখ হঠাৎ গম্ভীর হয়ে উঠল। বলল, ‘আপনারা এই চাওয়াটা চাচ্ছেন কেন, বলুন?’
‘তারা আমাদের দীর্ঘ দিনের সহযোগী। সীমাহীন উপকার তাদের কাছ থেকে পেয়েছি। আমেরিকার শান্তি-সমৃদ্ধিতে তাদের অবদান বিরাট। আমরা যারা আমেরিকাকে ভালবাসি এই বিপর্যয়ে তাদের পাশে না দাঁড়িয়ে আমাদের উপায় নেই।’ বলল ভারত ভূষণ শিবাজী।
‘আপনারা সাম্প্রতিক রিপোর্টগুলো কি দেখেছেন? প্রেসিডেন্ট বলল।
‘দেখেছি মহামান্য প্রেসিডেন্ট। পত্রিকার দলিল দস্তাবেজ সব সময় ঠিক হয় না। তাছাড়া মহামান্য প্রেসিডেন্ট আমাদের মনে হচ্ছে, কোথাও যেন একটা ভুল হয়ে যাচ্ছে। তা না হলে জন জ্যাকবের মত সর্বজন শ্রদ্ধেয় বিজ্ঞানী বিশ্বাসঘাতক হয়ে যাবেন, এ কেমন কথা!’ বলল শিব শংকর সেন।
‘ভুল হওয়ার সুযোগ কোথায়? লস আলামোসে যে গোয়েন্দা সুড়ঙ্গ রয়েছে তা জন জ্যাকবের বাড়ি থেকে এবং তা তার সময়েই তৈরী। এই জলজ্যান্ত সত্যকে কিভাবে মিথ্যা প্রমাণ করা যাবে?’ বলল প্রেসিডেন্ট।
‘আপনার কথা ঠিক মিঃ প্রেসিডেন্ট। কিন্তু এর মধ্যেও কোথাও একটা ফাঁক থেকে যাচ্ছে, যা বলার জন্যে আজ বিজ্ঞানী জন জ্যাকব বেঁচে নেই। যখন বেঁচে নেই, তখন তাকে বিশ্বাসঘাতক না সাজিয়ে ঠান্ডা মাথায় আরও চিন্তা করা দরকার। তাহলে আমরা মনে করি, ঠান্ডা যুদ্ধের সেই ঘোরতর দিনে ঐ সুড়ঙ্গ খোঁড়ার নতুন কোন তাৎপর্য বেরিয়ে আসবে।’ বলল ভারত ভূষণ শিবাজী।
‘শুধু তো ঐ সুড়ঙ্গই নয়, আরও অনেক কিছুর মধ্যে আচে আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনের হত্যা। সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ হয়েছে যে, এই হত্যাকান্ড ঘটিয়েছেন জেনারেল শ্যারন এবং উইলিয়াম ডেভিড জোনস। তাদের পক্ষে এখন আর বলঅর কি আছে?’ প্রেসিডেন্ট বলল।
‘ভিডিও টেপ কিংবা অডিও টেপ কোন সন্দেহাতীত প্রমাণ নয়।’ বলল শিব শংকর সেন।’ বলল শিব শংকর সেন।
‘শুধু তো অডিও টেপ নয়, আমাদের গোয়েন্দারা প্রমাণ পেয়েছে, যেখানে আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন খুন হয়েছেন, সে বাড়ির মালিক মিঃ ডেভিড জোনস। তাছাড়ড়া যে বুলেটে মারা গেছে সে বুলেটের স্পেসিফিকেশনের সাথে জেনারেল শ্যারনের রিভলবার মিলে যায়। আরও কথা হলো, হ্যারি ময়নিহানের কিডন্যাপের কি ব্যাখ্যা দেয়া যাবে?’ প্রেসিডেন্ট বলল।
‘এসব কথা আমরা পত্রিকায় পড়েছি। তারপরও আমরা বলছি, কারও শতবছরের সেবা ও অবদান মাত্র এ কয়টি ঘটনা দিয়ে মুছে ফেলা যায় না, তা ঠিকও নয় মহামান্য প্রেসিডেন্ট।’ বলল আবার শিব শংকর সেনই।’আপনাদের কথায় যুক্তি আছে। কিন্তু ঘটনা কয়টি যাই হোক তা এখন অনুসন্ধান ও আদালতের বিচার্য বিষয়। আসুন, আমরা বিচারের রায় পর্যন্ত অপেক্ষা করি।’ বলল প্রেসিডেন্ট।
‘অবশ্যই করব মহামান্য প্রেসিডেন্ট। কিন্তু তার আগে মহামান্য প্রেসিডেন্ট, জেনারেল শ্যারন ও মিঃ জোনসের জন্যে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিন এবং তাদের বিরুদ্ধে, ইহুদীদের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী যে অপপ্রচার চলছে, তা বন্ধ করুন মহামান্য প্রেসিডেন্ট।’ বলল ভারত ভূষণ শিবাজী।
‘স্যরি মিঃ শিবাজী, আপনিও জানেন ব্যক্তি বিশেষের স্বার্থে আমেরিকায় আেনের স্বাভাবিক গতিরুদ্ধ করার কোন সুযোগ নেই। অন্যদিকে স্বাধীন প্রেসের মুখে হাত চাপা দেবার কোন শক্তি তো মার্কিন সরকারের নেই।’
বলে প্রেসিডেন্ট থামল। একটু থেমেই আবার বলে উঠল, ‘ওরা আহমদ মুসাকে কিডন্যাপ করেছে, এটা একটা বড় ইস্যু হয়ে পড়েছে। সরকার খুবই বেকায়দায় পড়েছে মুসলিম দেশগুলোর কাছে। এই কাজ কেন করল ওরা?’
‘মহামান্য প্রেসিডেন্ট, ওরা অভিযোগ অস্বীকার করেছে। এ অস্বীকৃতির পর ওরা ঐ কাজ করেছে তা প্রমাণ হবার আগে তাদেরকে আর অভিযুক্ত করা ঠিক নয়।’ বলল ভারত ভূষণ শিবাজী।
‘আপনার এ কথা যেমন ঠিক, তেমনি শুধু অস্বীকার করেছে বলেই কাদেরকে সন্দেহ থেকে মুক্ত রাখা যাচ্ছে না। এই বাস্তবতাকেও আপনাদের জানতে হবে।’ প্রেসিডেন্ট বলল।
‘ঠিক মহামান্য প্রেসিডেন্ট।’ বলে একটু থামল ভারত ভূষণ শিবাজী। তারপর বলল, ‘মহামান্য প্রেসিডেন্ট, তাহলে আমরা কি নিয়ে ফিরছি?’
‘আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা।’ বলল প্রেসিডেন্ট ।
‘শুভেচ্ছা আমাদের যে বিষয়ে অনুরোধ সে পর্যন্ত সম্প্রসারিত হতে পারে না মহামান্য প্রেসিডেন্ট?’
‘এই ক্ষেত্রে আমি এ টুকু আশ্বাস দিতে পারি যে, আমি কোন অন্যায় ও উদ্দেশ্যমূলক কিছুকে প্রশ্রয় দেব না।’
‘ধন্যবাদ মিঃ প্রেসিডেন্ট। আমাদের শুভেচ্ছা সব সময় আপনার সাথে থাকবে।’ বলল ভারত ভূষণ শিবাজী।
‘ধন্যবাদ, আপনাদের কথা ভুলবো না।’ প্রেসিডেন্ট বলল।
সবাই উঠে দাঁড়াল।

বাল্টিমোর থেকে ছুটে আসছে তিনটি গাড়ি ওয়াশিংটনের দিকে। তিনটি গাড়ির দুটি এফ বি আই-এর। অন্য গাড়িটি সারা জেফারসনের।
গাড়ি তিনটির সামনেরটিতে আছে এফ বি আই প্রধান জর্জ আব্রাহান জনসন। আব্রাহাম জনসনের গাড়ি ড্রাইভ করছে এফ বি আই-এর একজন ড্রাইভার। জর্জ আব্রাহাম জনসন বসে আছে পেছনের সিটে। তার সিটের পেছনে ধাঁধা এফ বি আই ডগ স্কোয়াডের শ্রেষ্ঠ কুকুর ‘সোর্জ’।
রিচার্ড সোর্জ ছিলেন সফল গোয়েন্দা এজেন্ট, যে দিত্বীয় বিশ্বযুদ্ধের গতি পাল্টে দিয়েছিল এবং ফ্যাসিবাদের পতনের কারণ হয়েছিল।
‘সোর্জ’ সুপার সেনসেটিভ শিকারী কুকুর। এক বর্গমাইলের মধ্যে টার্গেট থাকলে গন্ধ থেকে তাকে টার্গেট করতে পারে সোর্জ।
দ্বিতীয় গাড়িতে সারা জেফারসন ও তার প্রাইভেট সেক্রেটারী ক্লারা কার্টার। তৃতীয় গাড়িতে ভর্তি এফ বি আই পুলিশ।
এফ বি আই-এর কোন গাড়িতেই এফ বি আই-এর চিহ্ন নেই। এফ বি আই পুলিশরাও সারা পোশাকে।
গাড়ি তিনটি সারিবদ্ধভাবে এগুচ্ছে।
সারা জেফারসনের গাড়ি মাঝে।
বাল্টিমোর ওয়াশিংটন রোড ও আনাপোলিষ ওয়াশিংটন রোড যেখানে মিলিত হয়েছে, সে সন্ধিতে পৌঁছতে যাচ্ছে গাড়ি।
ঠিক সেই সন্ধিতে আনাপোলিশ রোডে বাল্টিমোর রোডের মোহনায় একটা বিশাল এলাকা জুড়ে ‘সেন সফটঅয়্যার ইন্ডাস্ট্রিজ (প্রাঃ) লিমিটেড’ অবস্থিত।
কারখানাটির পশ্চিম প্রান্ত জুড়ে বাল্টিমোর রোড এবং দক্ষিন প্রান্ত জুড়ে আনাপোলিশ রোড।
জর্জ আব্রাহাম জনসনের গাড়ি যখন সেন সফটঅয়্যার কারখানার পাশে বাল্টিমোর রোডের উপর পৌঁছল, তখন জর্জ আব্রাহামের পেছনে বাঁধা শিকারী কুকুর সোর্জ শেকল ছেঁড়ার জন্যে ভয়ানক বিদ্রোহ শুরু করে দিল।
পেছনে তাকাল জর্জ আব্রাহাম। দেখল কুকুরটির দৃষ্টি পাশের কারখানাটির উপর নিবদ্ধ। ছুটতে চাচ্ছে সেদিকেই।
ভ্রুকুঁচকালো জর্জ আব্রাহাম জনসন।
গাড়ি সংগে সংগেই দাঁড় করাল জর্জ আব্রাহাম।
পেছনের দুটি গাড়িও দাঁড়িয়ে পড়েছে।
গাড়ি থেকে নেমেছে আব্রাহাম জনসন। তাকাল সে ফ্যাক্টরীর দিকে আবার।
বিশাল ফ্যাক্টরী। সামনের দিকে ফ্যাক্টরী, পেছনের অংশে গোডাউন। গোডাউনটাও বিশাল।
গাড়ি থেকে নামল সারা জেফারসন এবং পুলিশরাও। একজন পুলিশ অফিসার ও সারা জেফারসন গিয়ে দাঁড়িয়েছে জর্জ আব্রাহামের পাশে। কুকুরের বিদ্রোহের বিষয়টি তারাও গাড়ি থেকে নামার আগেই টের পেয়েছে।
‘ঘটনা কি? ওদিকে কি দেখছেন জনাব?’ ফ্যাক্টরীর দিকে ইংগিত করে জিজ্ঞেস করল সারা জেফারসন।
‘কুকুর এ ফ্যাক্টরীকে সন্দেহ করেছে।’
‘সন্দেহটা কি আহমদ মুসার ব্যাপারে?’ প্রশ্ন করতে গিয়ে বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল সারা জেফারসনের। আহমদ মুসার কথা মনে হলেই তার গোটা দেহে অসহনীয় এক জ্বালা ছড়িয়ে পড়ে। শয়তানদের হাতে পড়ে আহমদ মুসা কেমন আছে, এই চিন্তা মনে এলেই গোটা দেহ মন ঢুকরে কেঁদে উঠতে চায় সারা জেফারসনের ।
‘আমার তাই মনে হচ্ছে। কুকুরের মাথায় তো এখন আহমদ মুসা ছাড়া অন্য কিছু নেই।’
‘তাহলে এখন?’ বলল সারা জেফারসন।
সারা জেফারনের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে জর্জ আব্রাহাম তার অধঃস্তন অফিসারকে নির্দেশ দিল, ‘সোর্জকে নামিয়ে আনুন মিঃ নোভাক।’
সংগে সংগেই আদেশ পালন করল নোভাক।
কুকুর সোর্জকে নামিয়ে আনতেই সে ছুটে যেতে লাগল ফ্যাক্টরীর দিকে। অফিসার নোভাক শক্ত হাতে চেন ধরে আটকাল সোর্জকে। সামনে ছোটার গতি বন্ধ হলে সোর্জের গতি আকাশমুখী হলো। লাফিয়ে উঠতে লাগল আকাশের দিকে।
কুকুর সোর্জকে নামিয়ে পর্যবেক্ষন করার পর কুকুরের চেনটি হাতে নিল জর্জ আব্রাহাম। নির্দেশ দিল অফিসার নোভাককে, ‘তোমার হাতে এখন ছয়জন পুলিশ রয়েছে। এই ছয়জনের পাঁচজনকে বল পেছনের গোডাউন ও এই ফ্যাক্টরী ঘিরে ফেলতে। অবশিষ্ট একজন আমাদের সাথে থাকবে।’
অফিসার নোভাক নির্দেশ পেয়ে ছুটল তার গাড়ির দিকে।
নির্দেশ পেয়ে পাঁচজন এফ বি আই এজেন্ট প্রত্যেকেই স্টেনগান হাতে নিয়ে ছুটল ফ্যাক্টরী ঘিরে ফেলার জন্যে।
অবশিষ্ট একজন এল অফিসার নোভাকের সাথে জর্জ আব্রাহামের কাছে।
নোভাক ফিরে এলে তাকে উদ্দেশ্য করে জর্জ আব্রাহাম বলল, ‘এই এফ বি আই কর্মীকে সাথে নিয়ে যাও ফ্যাক্টরী অফিসে। যেই অফিসে থাক নিজের পরিচয় দিয়ে তাকে তুমি বল আমরা এই মুহূর্তে গোটা এলাকা সার্চ করব। তারপর তাকে সাথে নিয়ে চলে এস।’
নোভাক চলে গেল।
মিনিট তিনেকের মধ্যেই ফিরে এল একজনকে সাথে নিয়ে। তারা কাছে এলে সাথে আনা লোকটাকে লক্ষ্য করে জর্জ আব্রাহাম বলল,’আপনাকে কষ্ট দেয়ার জন্যে আমরা দুঃখিত। আমরা নিখোঁজ হওয়া একজন লোককে খুঁজছি। আমাদের গোয়েন্দা কুকুর এই এলাকাকে সন্দেহ করে বসেছে। তাই এলাকা সার্চ করতে হচ্ছে আমাদের। আমি আপনাদের মালিক শিব শংকর সেনকে চিনি। তিনি খুব ভাল লোক। তিনিও আমাকে জানেন। তিনি এই ঘটনাকে ওয়েলকামই করবেন।’
সাথে আসা লোকটি বলল, ‘আমাদের কোন আপত্তি নেই স্যার। তবে গোডাউন এলাকায় যাওয়ার মনে হয় দরকার হবে না। ওদিকে কোন লোক থাকে না।
‘গোডাউন, ফ্যাক্টরী বলে কোন কথা নেই। কুকুর যেখানে যাবে, আমরা সেখানে যাব।’ বলল জর্জ আব্রাহাম।
বলেই জর্জ আব্রাহাম কুকুরের চেনটি এফ বি আই অফিসার নোভাকের হাতে তুলে দিল। বলল, ‘স্টার্ট কর।’
নোভাক কুকুরের পিঠে হাত বুলিয়ে আদর করে চেন লুজ করে দিল।
কুকুর চলতে শুরু করল।
চেন এক হাতে ধরে রেখে তার পেছনে পেছনে হাঁটতে শুরু করল এফ বি আই অফিসার নোভাক।
নোভাকের পেছনে জর্জ আব্রাহাম জনসন। আব্রাহাম জনসনের পাশে সারা জেফারসন। তার পাশে সারা জেফারসনের সেক্রেটারী ক্লারা কার্টার। সবার পেছনে এফ বি আই-এর পুলিশ কর্মী। তার সাথে ফ্যাক্টরীর লোকটি।
বুক কাঁপছে সারা জেফারসনের। বলল জর্জ আব্রাহামকে লক্ষ্য করে, ‘কুকুরের সন্দেহ নিয়ে কি ভাবছেন জনাব?’
‘কুকুর ভুল করেনি।’
‘এর অর্থ ক্রমেই তার কাছাকাছি হচ্ছি? এত সহজেই কি উদ্ধার সম্ভব? কিছু ঘটতে পারে সেখানে?’ বলল সারা জেফারসন।
‘আমরা তার জন্যে প্রস্তুত আছি। আপনারা প্রস্তুত থাকুন।’ বলল জর্জ আব্রাহাম।
‘অবশ্যই জনাব। কিছু না পারলে জান দিতে তো পারব।’
কুকুর কিছুক্ষন চলার পর ফ্যাক্টরীকে পাশে রেখে গোডাউন লক্ষ্যে চলতে শুরু করেছে।
নোভাক বলে ইঠল, ‘আমরা ফ্যাক্টরী নয়, গোডাউনে যাচ্ছি স্যার।’
‘কিন্তু গোডাউনগুলোর চাবি তো আমার কাছে নেই। তাছাড়া গোডাউন খোলার ক্ষমতাও আমার নেই।’ বলল সাথে আসা ফ্যাক্টরীর লোকটি।
‘চাবি থাকলে ভল হতো, না থাকলেও চলবে। তালা ভাঙার জন্যে আমাদের কাছে রিভলবার আছে।’ বলল জর্জ আব্রাহাম।
‘তাহলে স্যার আপনারা যান, আমি মালিকের কাছে গিয়ে টেলিফোন করি। তিনি এসে পড়তে পারেন।’ কাঁপা কন্ঠে বলল লোকটি।
‘না, কোথাও আপনি যেতে পারবেন না। আমাদের সাথে থাকবেন। টেলিফোনের দরকার হলে আরও লোক আছে তারা করবে।’ বলল শক্ত আদেশের সুরে জর্জ আব্রাহাম জনসন।
কুকুর গোডাউনের দিকে যাত্রা শুরু করার পর সারা জেফারসন ও ক্লারা কার্টার দুজনের মন খুশী হয়ে উঠেছে। গোডাউনের মত জায়গায় আহমদ মুসা বন্দী থাকতে অবশ্যই পারে।
কিন্তু ফ্যাক্টরীর কথা মনে হতেই সারা জেফারসনের মনে প্রশ্ন জাগল, ফ্যাক্টরীর মালিকের নাম শুনে মনে হলো, উনি একজন ভারতীয় বংশোদ্ভুত শিল্পপতি। তার এখানে আহমদ মুসা বন্ধী থাকবে কেন? আমেরিকান ভারতীয়রা ইহুদীদের ভাগ্যের সাথে তাদের ভাগ্য জড়াবে কেন? এটা একেবারেই অবিশ্বাস্য ব্যাপার। মনের এই অবস্থায় প্রশ্ন করল সারা জেফারসন, ‘জনাব আমেরিকান ভারতীয়দের এখানে আহমদ মুসা আসবে কি করে?’
‘এটা তোমার একটা সংগত প্রশ্ন। কিন্তু তুমি তো জান না, এই ফ্যাক্টরীর মালিক শিব শংকর সেন সহ আমেরিকান ভারতীয় কমুঃনিটির লিডাররা কয়েকদিন আগে প্রেসিডেন্টের সাথে সাক্ষাৎ করেছে জেনারেল শ্যারন ও ডেভিড উইলিয়াম জোনসের পক্ষে তৎবির বরার জন্যে। এটা সত্যি হলে আমেরিকান ভারতীয়দের কাছে আহমদ মুসা বন্দী থাকতে পারবে না কেন?’ বলল আব্রাহাম জনসন।
‘সর্বনাশ। কথঅটা সত্যি হলে এটা হবে এটা হবে আমেরিকার জন্যে একটা অতি বড় ঘটনা। আমেরিকায় ভারতীয় কম্যুনিটি এবং ইহুদী কম্যুনিটি দুপক্ষই আমেরিকানদের মাথায় হাত বুলিয়ে অর্থ-বিত্ত ও সুযোগ সুবিধা অর্জনের ক্ষেত্রে সবার চেয়ে অর্থাৎ আমেরিকানদের চেয়েও এগিয়ে গেছে। অবস্থান ও সুযোগ সুবিধা লাভের এ সাদৃশ্যই কি দুই কম্যুনিটিকে ঐক্যবদ্ধ করেছে? তাহলে তো আমাদের লড়াই-এর ফ্রন্ট আরো একটা বাড়ল।’ বলল সারা জফারসন উদ্বিগ্ন কন্ঠে।
‘কিন্তু এই সাথে আহমদ মুসারে উদ্ধার আগের চেয়ে আরও জটিল হয়ে গেল।’ বলল জর্জ আব্রাহাম।
‘আপনি এ কথা বলবেন না। বরং বলুন ঈশ্বর আজ যে সুযোগ আমাদের হাতে তুলে দিয়েছেন, সেই সুযোগেই আহমদ মুসা উদ্ধার হয়ে যাবে।’ প্রায় আর্ত কন্ঠে বলে উঠল সারা জেফারসন।
‘আমি ঈশ্বরের কাছে এই প্রার্থনাই করছি মিস জেফারসন।’ বলল জর্জ আব্রাহাম।
‘ঈশ্বর আমাদের সাহায্য করুন।’ বলল সারা জেফারসন।
গোডাউনের এ ব্লক সে ব্লক পেরিয়ে একটা দরজা খোলা গোডাউনের দরজায় ছুটে গেল শিকারী কুকুর সোর্জ।
বুকটা তোলপাড় করে উঠল সারা জেফারসনের। এখানেই কি আহমদ মুসা বন্দী? কিন্তু ঘরের দরজা খোলা কেন?
কুকুরের ফেছনে পেছনে সবাই গোডাউনের দরজায় গেল।
দরজার বাইরের অংশটার উপর ভল করে নজর পড়তেই আঁৎকে উঠল সবাই।
দরজার বাইরে দু’জায়গায় চাপ চাপ রক্ত। রক্তের উপরটা শুকিয়ে গেছে।
কিন্তু কুকুর রক্তগুলো লাফ দিয়ে ডিঙিয়ে দরজায় গিয়ে পৌছল। দরজার চৌকাঠের কাছে কুকুর সোর্জ মুখ নিচু করে লেজ নাড়তে লাগল।
সকলে দরজায় গিয়ে পৌছল।
গোডাউনের ভেতর আলো জ্বলছে।
দরজাও আলোকিত।
দরজার ওপাশেও দেখা গেল কিছু রক্ত। সেই রক্তই শুকছে কুকুর সোর্জ।
কারোরই বুঝতে বাকি রইল না দরজার পাশের রক্ত আহমদ মুসার। আহমদ মুসার বলেই কুকুর সোর্জ তা শুকছে ও লেজ নাড়ছে।
গোডাউন শূন্য।
বুকটা হাহাকার করে উঠল সারা জেফারসনের।
যে আশায় এতক্ষন সে বুক বেঁধে ছিল, সে আশা ঘরের শূন্যতার মধ্যে দিয়ে উবে যাওয়ায় বুকটা একদম দুমড়ে মুচড়ে গেল। তার উপর আহমদ মুসার রক্ত দেখে আশংকা ও আতঙ্কে দম বন্ধ হওয়ার যোগাড় হলো সারা জেফারসনের।
ক্লারা কার্টার তা বুঝতে পেরেছিল। ক্লারা কার্টার তাকাল সারা জেফারসনের দিকে।
ক্লারা কার্টার তার দিকে এগিয়ে এসে প্রথমে কাঁধে হাত রেখে তাকে সচেতন করল। তারপর তাকে নিজের দেহের সাথে জড়িয়ে রাখল।
কুকুর সোর্জ দরজা থেকে ছুটল গোডাউনের মাঝখানে।
সেখানে মেঝের উপর একটা কার্পেট। কার্পেটের উপর পড়ে আছে কম্বল। এটা হলো একটা বিছনা। বিছানার উপর পড়ে আছে সিল্কের সরু কর্ডের অনেকগুলো খন্ড।
সোর্জ সেই বিছানায় উঠে কার্পেট ও কম্বল শুকতে লাকল আর নাড়তে লাগল তার লেজ।
সবাই এগুলো বিছানার দিকে।
‘বুঝা যাচ্ছে, এই বিছানাতেই আহমদ মুসাকে রাখা হয়েছিল।’ বলল জর্জ আব্রাহাম।
‘কর্ডের এই খন্ডগুলো কেন?’ জিজ্ঞেস করল সারা জেফারসন। কন্ঠ তার শুকনো, কম্পিত।
‘আমার মনে হচ্ছে, আহমদ মুসা হাত-পা বাঁধা অবস্থায় ছিল। পরে সে কোনভাবে বাঁধনগুলো কেটে মুক্ত হয়। খন্ড-বিখন্ড হওয়া কর্ডগুলো তারই প্রমাণ।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
কুকুর সোর্জকে নিয়ে জর্জ আব্রাহাম বেরিয়ে এল।
সবাই বেরিয়ে এল গোডাউন থেকে।
বাইরে বেরিয়ে কুকুর সোর্জ মাটি শুকতে শুকতে দক্ষিণ দিকে চলতে লাগল।
‘আহমদ মুসা সম্ভবত এ পথ দিয়েই বেরিয়ে গেছে। সোর্জ নিশ্চয় সে পথই অনুসরণ করছে। চল সবাই সোর্জকে অনুসরণ করি।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
সবাই কুকুর সোর্জের পেছনে পেছনে চলতে লাগল।
হঠাৎ সারা জেফারসন আর্তকন্ঠে বলে উঠল, ‘মিঃ জর্জ আব্রাহাম! ঘাসের উপর দেখুন রক্তের ফোঁটা।’
সবাই দেখল ঘাসের উপর ফোঁটা ফোঁটা রক্তের একটা ধারা সামনে এগিয়ে গেছে।
‘সোর্জ রক্তের এই ধারাই অনুসরণ করছে মিস জেফারসন। নিশ্চিত, আহমদ মুসা এ পথ ধরেই এগিয়ে গেছে।’
সারা জেফারসনের চোখে-মুখে আষাঢ়ে মেঘের ঘনঘটা।
সবাই নিরবে কুকুরকে অনুসরণ করে এগুলো।
কুকুর সোর্জ ঘাসের কাছাকাছি পর্যন্ত মুখ নিচু করে এক গতিতে সামনে এগুচ্ছে।
আনাপোলিশ সড়কে উঠে গেল সোর্জ।
সড়কে উঠে একজায়গায় এসে সোর্জ থমকে দাঁড়াল। মুখ উপরে তুলে চারদিকে তাকাল।
জর্জ আব্রাহাম, সারা জেফারসনসহ সবাই ওখানে পৌঁছল দেখল, সেখানে রাস্তার একপ্রান্তে কুকুর সোর্জ এর সামনে বেশ কিছূ পরিমান রক্ত জমা হয়ে আছে।
রক্তের দাগ আর সামনে এগুয়নি।
‘এই সড়কে উঠার পর আহমদ মুসা এখানে বসে বা শুয়ে ছিল। এই রক্ত জমা হয়েছে তার ফলেই। তারপর কেউ বা কোন গাড়ি তাকে উঠিয়ে নিয়ে গেছে।’ বলল জর্জ আব্রাহাম।
‘কারা উঠিয়ে নিয়ে গেছে, অনুমান করা যায়?’ বলল সারা জেফাসন। তার কন্ঠ ভেজা।
‘বলা মুস্কল। এটুকু বলা যায় কোন গাড়ি যদি তাকে উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে তারা শত্রু নাও হতে পারে। আর যাদের কারণে সে আহত হয়েছে তারা যদি তাকে ফলো করে এসে উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে তিনি আবার শতুর হাতেই পড়েছেন।’
শেষ বাক্যটা শুনে সারা জেফারসনের মুখে একটা পান্ডুর ছায়া নেমে এল। তার ঠোঁট কেঁপে উঠল থর থর করে। পেছন দিকে মুখ একটু ঘুরিয়ে নিল সারা জেফারসন।
কথা বলেই জর্জ আব্রাহাম মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে তাদের সাথে আসা ফ্যাক্টরীর লোকটির দিকে। বলল, ‘আপনি আমাদের সাহায্য করতে পারেন।’
‘আমি ঘন্টা তিনেক হলো অফিসে এসেছি। আমি কিছূই দেখিনি, কিছুই শুনিনি।’ বলল লোকটি।
‘কিন্তু গোডাউনে রক্তপাতের ঘটনা ঘটেছে, তা এক ঘন্টার বেশী আগে নয়। আপনি কোন গোলা-গুলীর শব্দ শুনেননি?’
‘না, সেরকম কোন শব্দ শুনুন।’ বলল সেই লোকটি।
‘ঠিক আছে, আপনি একটা স্টেটমেন্ট লিখে দেবেন।’ বলে জর্জ আব্রাহাম এফ বি আই অফিসার নোভাকের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুমি এর সাথে এর অফিসে যাও। উনি আমাদের সাথে থেকে যা যা দেখেছেন, তার উপর একটা স্টেটমেন্ট লিখে দেবেন।’
কথা শেষ করেই আবার তাকাল ফ্যাক্টরীর লোকটির দিকে। বলল, ‘ঠিক আছে?’
‘জ্বি স্যার। আমি লিখে দিচ্ছি।’
ওরা দু’জন চলে গেল।
জর্জ আব্রাহাম ঘুরে দাঁড়াল সারা জেফারসনের দিকে। বলল, ‘স্যরি সারা জেফারসন, মাত্র এক ঘন্টার ব্যবধান আমাদেরকে আহমদ মুসার সাক্ষাৎ পাওয়া থেকে বঞ্চিত করল।’
‘দুর্ভগ্য আমাদের, এক ঘন্টা আগে আসতে পারলে আহমদ মুসাকে আহত ওয়া থেকেও বোধহয় আমরা বাঁচাতে পারতাম।’ বলল সারা জেফারসন।
একটু থামল সারা জেফারসন। থেমেই আবার শুরু করল, ‘গোটা বিষয় পর্যবেক্ষন করে আপনার কি মনে হচ্ছে?’
‘কি ঘটেছে, সেই ব্যাপারটা?’ বলল জর্জ আব্রাহাম।
‘হ্যাঁ।’ বলল সারা জেফারসন।
‘ঘটনা খুবই সরল। হাত পা বেঁধে আহমদ মুসাকে ওরা বন্দী করে রেখেছিল। আজকে কোনওভাবে আহমদ মুসা হাত পায়ের বাঁধন কাটতে সমর্থ হয়। বাঁধন মুক্ত হয়ে আহমদ মুসা সম্ভবত দরজার সামনে শত্রুর আগমদনের অপেক্ষা করছিল। দরজা খোলার পর তাদের সাথে ধ্বস্তা ধ্বস্তি হয়। শত্রুরা সম্ভবত ছিল দু’জন। ওদের একজনের রিভলবার আহমদ মুসা কেড়ে নিয়ে ওদের গুলী করে। ওদের দু’জনের একজন অথবা দু’জনই আহত বা নিহত হয়। কিন্তু তাদের একজন আহমদ মুসাকে আঘাত করতে সমর্থ হয়। সে আঘাত আহমদ মুসার পা, বুক, মাথা ছাড়া অন্য কোথাও লাগে। এর ফলে আহমদ মুসা গুরুতর আহত হলেও রাস্তা পর্যন্ত হাঁটতে সমর্থ হয়। রাস্তায় পৌঁছার পর রাস্তার এক জায়গায় বসে গাড়ির অপেক্ষা করেছে সে। তারপর সে শত্রুর হাতে পড়ল, না কোন গাড়ি তাকে নিয়ে গেল, তা অনুমান করা মুস্কিল। তবে আহমদ মুসা যে গাড়ির জন্যে বসেছিল, একজায়গায় ঐ পরিমান জমাট রক্ত তারই প্রমাণ।’
‘আহমদ মুসা বন্দী হলে তাকে তো আবার বন্দীখানাতেই ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথঅ। তাতো তারা তকরেনি।’ সারা জেফারসন বলল।
‘হ্যাঁ। সেটাই হবার কথা। কিন্তু এর ব্যতিক্রমও হতে পারে। চিকিৎসা ও নিরাপত্তার জন্য তাকে অন্যত্র সরিয়েও নিতে পারে। তবে সব দেখে-শুনে আমার এখন মনে হচ্ছে, আহমদ মুসাকে অন্য কেউ তুলে নিয়ে গেছে।, এ দিকটাই প্রবল।’
থামল জর্জ আব্রাহাম।
‘ঈশ্বর করুন, এই শেষ কথাটাই যেন সত্য হয়।’ বলল সারা জেফারসন।
পাশ থেকে সারা জেফারসনের পিএ ক্লারা কার্টার বলে উঠল, ‘আমেন।’
‘চল আমার গাড়ির দিকে হাঁটি।’
বলে ওপারের বাল্টিমোর রোডের দিকে গাড়ির জন্যে হাঁটতে শুরু করল জর্জ আব্রাহাম।
সারা জেফারসনরাও হাঁটা শুরু করল।
সারা জেফারসন ও ক্লারা কার্টার পাশাপাশি হাঁটছে।
গোটা রাস্তায় একটা কথাও বলল না সারা জেফারসন। উদ্বিগ্ন ক্লারা কার্টারও। এ ধরনের নিরবতা সারা জেফারসনের স্বভাব বিরুদ্ধ।
গাড়িতে বসেও ঐ একই অবস্থা।
গাড়ির সিটে গা এলিয়ে চোখ বুজেছে সারা জেফারসন।
পাশেই বসেছে ক্লারা কার্টার। কিন্তু ঘাঁটাতে সাহস করছে না সারা জেফারসনকে। তার মন খারাপ সেটা তো ক্লারা কার্টার জানে। কিন্তু ভয় হচ্ছে তার অসুখ-বিসুখ করল কিনা। এই তো মাত্র ক’দিন আগে সে হাসপাতাল থেকে ফিরেছে।
পরীক্ষা করার জন্যে ক্লারা কার্টার তার হাত সারা জেফারসনের কপালে রাখল।
ধীরে ধীরে চোখ খুলল সারা জেফারসন।
বলল, ‘না ক্লারা আমি অসুস্থ হয়ে পড়িনি। ভাল আছি।’
‘কে বলল ভাল আছেন? গায়ের উত্তাপ অন্তত ডিগ্রি খানেক বেড়েছে।’
‘অবস্থার পার্থক্যে অমন ফ্লাকচুয়েশণ হয়েই থাকে।’
‘আসলে আপনার আসা ঠিক হয়নি। আন্টি ঠিকই বাধা দিয়েছিলেন।’
‘ওকথা বলো না ক্লারা। না এল কেমন করে দেখতাম আহমদ মুসা মেঝেতে একটা কার্পেটের ওপর একটা কম্বল গায়ে দিয়ে কি সুখে বন্দী জীবন কাটিয়েছে! না এলে কেমন করে দেখা হতো তার দেহের জমাট রক্ত! কেমন করে দেখতাম আহমদ মুসা মুক্ত হবার প্রানান্ত চেষ্টা করেও….।’
কান্নায় জড়িয়ে গেল সারা জেফারসনের শেষের কথাগুলো। দু’হাতে মুখ ঢাকল সে। ক্লারা তার একটা হাত সারা জেফারসনের কাঁধে রেখে বলল, ‘বৃথাই ভাবছেন। দেখবেন, উনি ঠিক মুক্ত হয়েছেন। আংকেল জর্জ আব্রাহাম ঠিকই বলেছেন, তার মুক্ত হবার সম্ভাবনার দিকটাই প্রবল।’
‘সবাই আমরা এটাই কামনা করছি। কিন্তু আমরা যা চাচ্ছি সেটাই ঘটেছে তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছি না। কষ্টটা এখানেই।’
সরা জেফারসন থামলেও ক্লারা কার্টার সংগে সংগে কোন জবাব দিল না। একটু সময় নিয়ে ধীরে ধীরে বলল, ‘একটা কথা বলি মিস জেফারসন।’
‘বল।’ বলল সারা জেফারসন।
‘আহমদ মুসা সম্পর্কিত আপনার সিদ্ধান্তকে আমি শ্রদ্ধা করি। কিন্তু তারপরও বলতে চাই, আহমদ মুসা একটা বুনো পাখি। পোষ মানবার মত নয়।’ ক্লারা কার্টার বলল।
সারা জেফারসনও সংগে সংগে জবাব দিল না। বলল ধীরে ধীরে একটু সময় নিয়ে, ‘আমি তো তাকে পোষ মানাতে চাইনি ক্লারা। কিংবা আমি তাকে আমার বানাতেও চাইনি। আমি শুধু চেয়েছি তার হতে।’
‘ঐ একই কথা হলো। আপনি তার হতে গেলে তিনি আপনার হতে হবে।’ বলল ক্লারা কার্টার।
‘না, একই কথা নয়। নদী যখন সাগরে মিশে যায়, তখন নদী সাগরের হয় কিন্তু সাগর নদীর হয় না।’
‘সাগরের ঘর-সংসার নেই। কিন্তু আপনার সংসার চাই, তারও সংসার চাই।’
‘আমি এতকিছু ভাবিনি, ভাববার সময়ও পাইনি। তাকে দেখার আগে আমি তাকে স্বপ্নে পেয়েছি। এটা আমার নিয়তি ক্লারা। ঈশ্বর যা করেন, তার উপর তো হাত নেই কারও।’
‘তাকে আপনার জানার দরকার ছিল।’
‘কি দরকার ক্লারা। না জেনেই তো ভালবেসেছি। জানার কি প্রয়োজন আর।
‘তিনি আপনাকে কিছু বলেন নি?’
‘সেদিন অভিযান থেকে ফিরে আমাকে ‘মিস সারা জেফারসন’ বলায় আমি কেঁদে ফেলেছিলাস। তিনি গম্ভীর হয়ে গিয়েছিলেন। পরে একসময় তিনি আমাকে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু আমি টেলিফোন ধরতে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় এবং তারপর আব্বা এসে পড়ায় তার বলা আর হয়নি।’
‘তার সম্পর্কে কি ধরনের কথা তিনি বলতে শুরু করেছিলেন?’
‘সবে তিনি বলতে শুরু করেছিলেন, ‘স্যরি মিস সারা, মাত্র আমার নামটি ছাড়া আর কিছুই আপনাকে জানানো হয়নি।’ একথা শেষ করেই তিনি কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। এই সময় আমার টেলিফোন আসে।’
‘বোঝা যাচ্ছে তার কিছু বলার আছে। অথচ আপনি কিছুই শোনেননি, জানেননি।’
‘আমি তার সাথে কোন লেন-দেন করতে চাইনি যে, আমি হিসেব-নিকেশ করব। যা ঘটেছে তা একান্তই আমার, এতে তারও কোন শরিকানা নেই।
কথা শেষ করতেই সারা জেফারসন দেখল জর্জ আব্রাহাম তাদের দিকে এগিয়ে আসছে।
সারা জেফারসন গাড়ি থেকে নামল।
জর্জ আব্রাহাম একটু নিকটবর্তী হলে সারা জেফারসন বলল, ‘মিঃ নোভাক ফিরেছে। এখন করনীয়?’
‘এখন ফেরা ছাড়া আর কি করার আছে।’ বলল জর্জ আব্রাহাম।
‘আপনি আপনার লোকদের আনাপোলিশসহ আশে-পাশের এবং ওয়াশিংটনের সকল হাসপাতাল ও ক্লিনিকে চোখ রাখতে বলুন। আমার বিশ্বাস, অন্য কেউ আহত আহমদ মুসাকে নিশ্চয় কোন হাসপাতাল বা ক্লিনিকে নিয়ে যেতে পারে।’ বলল সারা জেফারসন।
খুশী হয়ে উঠল জর্জ আব্রাহাম। বলল, ‘বর্তমান নিয়ে বেশী ব্যস্ত থাকায় ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছু ভাবতেই ভুলে গেছি। ধন্যবাদ মিস সারা জেফারসন।’
বলেই পা বাড়াল নোভাকের গাড়ির দিকে। বলল, ‘যাই নোভাককে বলি এখনই মেসেজটা সব জায়গায় জানিয়ে দেবার জন্যে।’
জর্জ আব্রাহাম চলে গেল।
‘মোবাইলটা দাও ক্লারা।’
মোবাইলটা সারা জেফারসনের হাতে দিতে দিতে ক্লারা বলল, ‘বিষয়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এতক্ষনে মেসেজটা সবাই জেনে গেলে ভাল হতো।’
‘আমারও এইমাত্র মনে পড়ল।’
বলে সারা জেফারসন ‘ফ্রি আমেরিকা’র ওয়াশিংটন অফিসে জানিয়ে দিল মেসেজটা।
এসময় জর্জ আব্রাহাম সারা জেফারসনের গাড়ির পাশ দিয়ে ফেরার সময় বলল, ‘প্রস্তুত মিস সারা। আমরা এখনি স্টার্ট করব।’
অল্প কিছুক্ষনের মধ্যে সামনে জর্জ আব্রাহামের গাড়ি স্টার্ট নেবার শব্দ পাওয়া গেল।
স্টার্ট নিল সারা জেফারসনদের গাড়িও।
তিনটি গাড়ি আবার চলতে শুরু করল ওয়াশিংটনের উদ্দেশ্যে।

নোয়ান নাবিলা গাড়ি ড্রাইভ করছিল। তার পাশে বসেছিল সাগরিকা সেন।
ইহুদী মেয়ে নোয়ান নাবিলা ও সাগরিকা সেন দু’জন ঘনিষ্ঠ বান্ধবী।
নোয়ান নাবিলারা আনাপোলিশের স্থায়ী বাসিন্দা। তাদের বাড়ি থেকে অল্পদূরে একেবারে সমুদ্র তীরে একটি টিলার উপর সাগরিকা সেনদের গ্রীষ্মাবাস।
সামনের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ নোয়ান নাবিলাই প্রথম দেখতে পেয়েছিল মাটিতে পড়ে থাকা লোকটিকে।
‘সাগরিকা দেখ একজন লোক পড়ে আছে রাস্তার পাশে।’ বলে উঠল নোয়ান নাবিলা।
তার বলা শেষ হতে না হতেই গাড়ি লোকটির সমান্তরালে চলে এল।
নোয়ান নাবিলার মত সাগরিকা সেনও তাকিয়ে ছিল লোকটির দিকে।
লোকটির কুকড়ানো দেহ পড়েছিল মাটির উপর। তার মুখ রাস্তার দিকে। রক্তাক্ত দেহের একটা অংশ।
লোকটির মুখের উপর চোখ পড়তেই ভীষণ চমকে উঠল সাগরিকা সেন। অন্তরের গভীর থেকে উচ্চারিত হলো, ‘এ যে আহমদ মুসা!’
অন্তরের গভীর থেকে এ কথা উচ্চারিত হবার সাথে সাথেই সাগরিকা সেন এল উঠল চিৎকার করে, ‘গাড়ি দাঁড় করাও নাবিলা।’
গাড়ি ডেড স্টপ হয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়ল।
‘লোকটিকে কি সাহায্য করবে? বেঁচে আছে কি লোকটি?’ জিজ্ঞাসা উচ্চারিত হলো নাবিলার কন্ঠে।
কোন উত্তর না দিয়ে লাফ দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে সাগরিকা সেন।
সে ছুটে গেল আহমদ মুসার কাছে।
প্রথমে তার একটা আঙুল দিল আহমদ মুসার নাকে।
বেঁচে আছে আহমদ মুসা, খুশী হলো সাগরিকা সেন।
এসময় আহমদ মুসা চোখ খুলল আচ্ছন্নের মত।
সাগরিকা সেন উঠে দাঁড়াল। বলল নাবিলাকে লক্ষ্য করে, ‘একে গাড়িতে নিতে হবে নাবিলা।’
‘তোমার পরিচিত নাকি?’
গাড়ি থেকে নামতে নামতে জিজ্ঞেস করল নাবিলা।
‘হ্যাঁ।’ সংক্ষিপ্ত উত্তর দিল সাগরিকা সেন।
‘তাহলে গাড়িতে নিয়ে কাজ কি? এই তো তোমাদের ফ্যাক্টরী। কাউকে ডাক দিয়ে বল। তারা এসে ব্যবস্থা করবে। তোমাকে কিছুই ভাবতে হবে না।’ বলল নাবিলা।
‘না। এ শুধু পরিচিত নয়, আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। একে আমি এদের হাতে দিতে পারি না। একে আমি গাড়িতে নেব।’
‘তথাস্তু মিস সেন।’ বলে নোয়ান নাবিলা সাগরিকা সেনের পাশে এসে দাঁড়াল।
তারপর দুজনে ধরাধরি করে আহমদ মুসাকে গাড়ির পেছনের সিটে তুলল।
গাড়িতে তুলে শুইয়ে দিতে দিতে নাবিলা বলল, ‘আমি প্রথমে মেন করেছিরাম গাড়ির এ্যাকসিডেন্ট। কিন্তু এখন দেখছি তা নয়। হয় গুরী, না হয় সাংঘাতিক ধরনের ছুরিকাহতের ঘটনা। ভীষণ ব্লিডিং হচ্ছে। প্রথমেই রক্ত বন্ধ হওয়া দরকার।’
‘ঠিক বলেছ নাবিলা। তুমি ড্রাইভিং সিটে যাও। গাড়ি স্টার্ট দাও। আর ফাষ্ট এইড বক্স থেকে তুলার বান্ডিল এবং ব্যান্ডেজ টেপটা আমাকে দাও।’ বলল সাগরিকা সেন।
‘তুমি পারবে কিছু করতে?’ তুলার বান্ডিল এবং ব্যান্ডেজ টেপ নিয়ে গাড়ি থেকে নামতে নামতে বলল নোয়ান নাবিলা।
‘অভ্যেস নেই, কিন্তু কমন সেন্স তো আছে।’
ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসল নোয়ন নাবিলা।
‘কোথায় গাড়ি নেবো সাগরিকা, কোন ক্লিনিকে?’ বলল নোয়ান নাবিলা।
‘সোজা আনাপোলিশ চল।’
‘আনাপোলিশের কোন ক্লিনিকে নেবে?’
‘পরে বলছি।’
আহমদ মুসা চোখ খুলেছিল। কিছু বলতে যাচ্ছিল।
সাগরিকা সেন ঠোঁটে আঙুল ঠেকিয়ে কথা বলতে নিষেধ করল এবং সাথে সাথে অন্য দিকে তাকাল।
সাগরিকা সেন একদলা তুলা নিয়ে মূল ক্ষতস্থানের রক্ত মুছেই আবার সেখানে প্রকান্ড একদলা তুলা লাগিয়ে চেপে ধরল এবং চেপে ধরেই থাকল।
সাগরিকা সেন এতটুকু অন্তত জানে এভাবে কিছুক্ষন ধরে রাখলে সারফেসের রক্ত জমাট বাধলে ভেতর থেকে রক্ত বেরিয়ে আসা বন্ধ হবে। তাই হয় কিনা সেটাই দেখতে চায় সে।
আহমদ মুসা চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিল। সাগরিকা সেন যেমন বিস্মিত হয়েছে আহমদ মুসাকে দেখে, আহমদ মুসাও তেমনি বিস্মিত হয়েছে সাগরিকা সেনকে দেখে। প্রথমে তার চিন্তা হয়েছিল যে, সাগরিকা সেন তাকে নিয়ে কি করে ঠিক নেই। সে নিশ্চিক হলো তখন, যখন সে দেখল এখানকার লোকদের হাতে তাকে ছেড়ে দিল না এবং এখানকার কোন ক্লিনিকেও তাকে নিল না। আহমদ মুসা বুঝল, তার বিপদ সাগরিকা সেন বুঝেছে। সম্ভবত সে আহমদ মুসাকে বিপদ থেকে বাঁচাবার চেষ্টা করছে। অথচ তারই পিতার গোডাউনের অমানবিক পরিবেশে বন্দী ছিল আহমদ মুসা। বুকের উপরে কাঁধের একটু নিচের ছুরিকাঘাতটা খুবই মারাত্মক নিঃসন্দেহে, কিন্তু এই আঘাত তাকে এত কাবু করতে পারতো না, যদি পেটে খাবার থাকতো। দু’একদিন পর পর আহমদ মুসাকে তারা যে খাবার দিয়েছে তা না দেবার মতই। দেহটা তার দুর্বল হয়ে পড়েছে এ কারনেই। তারা আহমদ মুসার সমস্ত শক্তি কেড়ে নিয়ে মুমূর্ষু অবস্থায় বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিল। যাতে মুক্ত হবার শক্তি তার না থাকে। সাগরিকা সেনের সাথের মেয়েটির কথা মনে পড়ল আহমদ মুসার। আহমদ মুসাকে তার সামনে কথা বলতে নিষেধ করল কেন সাগরিকা সেন? অবাঞ্চিত কোন কথা বলে ফেলি কিনা এজন্যে? আর সাগরিকা সেন মেয়েটিকে আহমদ মুসার মিথ্যা পরিচয় দিয়েছে। আহমদ মুসা তো সাগরিকা সেনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু নয়। সব মিলিয়ে আহমদ মুসার পরিচয় সে গোপন করে গেছে।
যখন আহমদ মুসা এসব ভাবছিল, তখন সাগরিকাও আহমদ মুসার শিয়রে বসে চিন্তা করছিল। ভাবছিল আহমদ মুসার কথাই। সেদিন আহমদ মুসা তাদের দুভাই-বোনকে নিজের পরিচয় দেয়নি। পরের দিনই তারা তাদের মায়ের কাছ থেকে আহমদ মুসার পরিচয় জানতে পেরেছিল। জানতে পেরেছিল তাদের ভূগর্ভস্থ কক্ষে যিনি বন্দী ছিলেন তিনি বিশ্বখ্যাত বিপ্লবী আহমদ মুসা। নাম শুনে শিহরিত হয়েছিল সাগরিকা সেন। পত্র-পত্রিকা পড়ে সাগরিকা সেনের ধারনা হয়েছিল আহমদ মুসা হবে ভীম সদৃশ রুক্ষ চরিত্রের, যে হবে শুধু ভয়েরই পাত্র। কিন্তু যে আহমদ মুসাকে তারা দেখল, সে একেবারেই ভিন্ন। সরল, সুদর্শন এক ভদ্রলোক সে। যে কয়েক মিনিটের দেখায় একেবারে কাছে এসে গিয়েছিল, সমর্থন ও সহানুভূতি আদায় করে নিয়েছিল। এমন লোককে শুধু বন্ধুই ভাবা যায়, শত্রু নয়। বিস্মিত হয়েছিল সাগরিকা সেন। এমন একজন লোক বিশ্ব বিপ্লবী হয়েছে কিসের জোরে। শক্তি ও সন্ত্রাসের জোরে অবশ্যই নয়। শক্তি ও সন্ত্রাস তার অবলম্বন হলে সেদিন দু’জন প্রহরীকে সে হত্যা করত এবং তাদের উপরও নির্যাতন হতো, কিন্তু তা সে করেনি। তাদের দুই ভাই বোনকে আটকে রেখে গিয়েছিল তাদেরই ভালোর জন্যে তা পরে প্রমাণিত হয়েছে। তারা মুক্ত থাকলে তাদেরকে অনেক রকম প্রশ্নের শিকার হতে হতো। তারা তাদের পিতার কাছে তেকেই শুনেছিল আহমদ মুসা পালাতে পারেনি, ধরা পড়েছে। কিভাবে ধরা পড়েছে তাও তাদের বলেছে। ধরা পড়ার খবর শুনে মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল সাগরিকা সেন ও তার ভাই শশাংক সেন দুজনেরই। এ নিয়ে দু’ভাই-বোন অনেক আলোচনা করেছে। ভেবেছে তারা, তারা যদি আহমদ মুসাকে মুক্ত করার জন্যে কিছু করতে পারতো। আজ সাগরিকা সেন সেই সুযোগই পেয়েছে।
সাগরিকা সেন মুখ ঘুরিয়ে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। চোখবন্ধ করে আছে আহমদ মুসা। নতুন করে আহমদ মুসার দিকে তাকাতে গিয়ে শিউরে উঠল সাগরিকা সেন। কিন্তু এমন সাধারন লোক এতবড় অসাধারন হয় কেমন করে! যে মুক সে দেখছে সেমুখে কোন মলিনতা, কোন আবিলতা, কোন পাপের স্পর্শ নেই। শিশুর মত নিষ্কলুষ এক মুখ। এই মুখ ও মুখের আড়ালে যে মন-এই তো সাধু-সন্তত্ব এবং শক্তি দু’য়েরই সম্মিলন ঘটেছে। এ কারনেই কি সাধারন হয়েও অসাধারন! শ্রদ্ধায় যেন নুয়ে পড়তে চাইল সাগরিকা সেনের মন।
আহমদ মুসার মুখ দেখে বিস্মিত হলো সাগিরকা সেন আরেকটা কারণেও। সেটা হলো, আহমদ মুসার দেহে যে বিপর্যয় ঘটে গেছে তার কোন প্রকাশ তার মুখে নেই। নিশ্চয় আহমদ মুসা এখন চেতন আছে। কিন্তু তার দেহ এখন যন্ত্রনায় যে জর্জরিত হচ্ছে, তার কোন প্রকাশ তার মুখে দেখা যাচ্ছে না। হয় তার নার্ভ পাথরের মত শক্ত, নয়তো এই যন্ত্রণা হজম করার মত মানসিক শক্তি তার আছে। অথবা সাধু-সন্ত বিপ্লবী হিসাবে তার দুটিই আছে।
সাগরিকা সেনের ভাবনার এই ভেলা আর কতদূর বয়ে চলত কে জানে। কিন্তু সামনের ড্রাইভিং সিট থেকে নোয়ান নাবিলা কথা বলে উঠল, ‘আনাপোলিশ তো এসে গেলাম। বল কোথায় যাব। কোন হাসপাতালে? কোন ক্লিনিকে?’
‘না কোথাও না।’
‘তাহলে কোথায়? তোমার বাড়িতে?’
‘না।’
‘তাহলে?’
‘নাবিলা তুমি তো আনাপোলিশের মেয়ে। তোমার কি এমন কোন ডাক্তারের কথা জানা আছে যিনি বাড়িতে চিকিৎসা করেন, বাড়িতে তার চিকিৎসার ফ্যাসিলিটি আছে, যেখানে একে চিকিৎসার জন্যে নিয়ে যেতে পারি।’
‘কিন্তু হাসপাতালে, ক্লিনিকে অসুবিধা কি? সেখানে আরও বেটার হবে।’
‘এর শত্রু আছে। খুব শক্তিশালী শত্রু । তারা হাসপাতালে-ক্লিনিকে নিশ্চয় খুঁজবে।’
‘সে রকম ভয় থাকলে পুলিশের সাহায্য নাও না।’
‘নিরাপদ নয়। বড় বড় পুলিশ অফিসার শত্রুর পক্ষে কাজ করতে অনেক সময় বাধ্য হয়।’
‘তোমার বন্ধু কি এতবড় কেউ?’
‘তার শত্রু বড়।’ বলেই সাগরিকা সেন তার আগের প্রশ্নে ফিরে গেল। বলল, ‘যা বললাম, তোমার পরিচিত তেমন কোন ডাক্তার আছে?
‘আছেন একজন রাব্বী ডাক্তার। তিনি ভাল ডাক্তার, ভাল সার্জন। বাড়িতে চিকিৎসা করেন। জরুরী রোগী তার বাড়িতে রাখার ব্যবস্থাও আছে। তবে নার্স ভাড়া করতে হয়। আর ডাক্তারের ফি’টা একটু বেশী।’
‘তা হোক। যত টাকা চান দেব। নার্স ভাড়া করব ক্ষতি নেই।
ধন্যবাদ তোমাকে নাবিলা। এখন তাহলে সেই ডাক্তারের ওখানেই চল।’
‘অল রাইট।’ বলে গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিতে দিতে বলল, ‘শশাংক আজ কখন আসছে সাগরিকা?’
নাবিলা ও শশাংক সেন দু’জনে বন্ধু। শুধু বন্ধুই নয়, দু’জন দু’জনকে গভীরভাবে ভালবাসে। শশাংকের মাধ্যমেই এক পার্টিতে নোয়ান নাবিলার সাথে সাগরিকা সেনের পরিচয়।
‘হয়তো এতক্ষনে এসেই গেছে। ভেব না নাবিলঅ। দেখি তাকে টেলিফোন করছি। এর কথা যদি ওকে বলি, দেখবে আমরা ডাক্তারের কাছে পৌঁছার আগেই সে পৌঁছে গেছে।’
‘এত ভালবাসে?’
‘ভালবাসে মানে একেবারে ভক্ত।’
‘কিন্তু ইনি দেখছি এশিয়ান, আর তোমরা আমেরিকান। বন্ধুত্বটা কিভাবে?’
‘এটা আবার কোন বাধা হলো নাকি? এক দেখাতেই অনেক সময় শতবার দেখার কাজ হয়ে যায়।’
‘সে রকম কাজ তোমার হয়েছে নাকি?’
‘বলতে পার।’
‘আরও কিছু বলতে পারি না?’ নোয়ান নাবিলার চোখে দুষ্টুমীর হাসি।
‘দেখ ভিন্ন অর্থ খোঁজার কোন অবকাশ নেই। আর তার সময়ও এটা নয়।’ কৃত্রিম গম্ভীর হবার চেষ্টা করে বলল সাগরিকা সেন।
‘ঠিক আচে, সময়েই বলব।’
বলে স্লো হয়ে পড়া গাড়ির গতি আবার বাড়িয়ে দিল।
ছুটে চলল গাড়ি আনাপোলিশের দিকে।

‘সাগরিকা মামনি কেবিনে যাচ্ছ?’ বলল ডাঃ বেগিন বারাক।
ডাঃ বেগিন বারাকের কাছেই আহমদ মুসার চিকিৎসা হচ্ছে। ডাঃ বেগিন বারাকের বাড়ির বিরাট বাড়ির একটা অংশ নিয়ে সে তার মিনি ক্লিনিক সাজিয়েছে। সামনের বড় ঘরে তার ডাক্তারখানা। সে ডাক্তারখানার পেছনে বিভিন্ন আকারের পাঁচটি কেবিন আছে। অর্থাৎ আউটডোর চিকিৎসার বাইরে মাত্র পাঁচজন রোগী এক সংগে তার মিনি ক্লিনিকে ভর্তি হতে পারে। এ কেবিনগুলোতে চিকিৎসা সেবা ছাড়া ডাক্তারের পক্ষ থেকে শুশ্রুসা ও খাবার সুযোগের ব্যবস্থা নেই। শুশ্রুসার জন্যে নার্স ভাড়া করা ও খাবার সরবরাহের ব্যবস্থা রোগীদের পক্ষ থেকে করতে হয়। যাদের সামর্থ নেই তাদের খাবার ব্যবস্থা পাশের চ্যারিটেবল অরফানেজ থেকে করা হয়্ আর শুশ্রুসার ব্যবস্থা ডাক্তার নিজের তহবিল থেকে করে থাকেন।
ডাঃ বেগিন বারাকের চিকিৎসা কাজ তার ধর্মজীবনের অংশ। ডাঃ বারাক ইহুদী রাব্বী পরিবারের সন্তান এবং নিজেও একজন রাব্বী বা ধর্মগুরু। তার এবং তার স্ত্রীর গোটা জীবনটাই ধর্মের কাজে উৎসর্গীত।ভ একজন নিষ্ঠাবান ইগুদী এবং বহুদর্শী ধর্মগুরু হিসাবে চারদিকে তার সুনাম আছে।
ডাঃ বেগিন বারাকের ডাক্তার খানার সামনে দিয়েই কেবিনগুলোতে যাবার করিডোর। কেউ কেবিনে যেতে চাইলে ডাক্তারখানার দরজা অতিক্রম করে যেতে হয়। আর ডাঃ বারাক তার ডাক্তারী চেয়ারে বসে বাইরের দরজার দিকে মুখ করেই। সযতরাং কেবিনের দিকে যেই যাক তার নজর এড়ায় না।
ডাঃ বেগিন বারাকের প্রশ্ন শুনে সাগরিকা সেন দাঁড়িয়ে গেল। ডাঃ বারাকের দিকে ফিরে বলল, ‘গুড ইভনিং ডক্টর আংকেল। আমি কেবিনে একটু সুধাংশুর কাছে যাচ্ছি।’
আহমদ মুসাকে সাগরিকা সেন সুধাংশু সেন নামে ভর্তি করেছে ডাক্তারের ক্লিনিকে।
‘যাবে, এদিকে একটু এস।’ বলল ডাঃ বেগিন বারাক।
সাগরিকা সেন ডাক্তার খানায় প্রবেশ করল। দাঁড়াল গিয়ে ডাঃ বারাকের টেবিলের সামনে।
‘বস মামনি একটু গল্প করি। রোগী-পত্র এখন নেই।’
সাগরিকা সেন একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল।
‘তোমার আব্বাকে গতকাল টেলিভিশনে একটা ব্যবসায় সম্মেলনে দেখলাম, উনি কোথায়?’ বলল ডাঃ বেগিন বারাক।
‘ওয়াশিংটনে।’
‘আচ্ছা, তোমার এ বন্ধুটিকে তুমি কতদিন থেকে চেন?’
হঠাৎ এমন প্রশ্নে সাগরিকা সেন বিব্রত হয়ে পড়ল। কিন্তু তাড়াতাড়ি প্রশ্নের উত্তর দিল, ‘খুব বেশী দিন নয়।’
‘কিভাবে পরিচয় হয়?’
আরও বিপদে পড়ল সাগরিকা সেন। এখন তো মিথ্যা কথা বলতে হবে। মিথ্যা কথাটা কি হবে তা গুছিয়ে নিয়ে বলল, ‘হোটেলে একত নাচের পার্টিতে।’
জবাবটা দিয়েই প্রসঙ্গান্তরে যাবার জন্যে সাগরিকা প্রশ্ন করল, ‘তাকে কেমন দেখছেন আংকেল, কতদিনে সেরে উঠতে পারে?’
‘আমার চিকিৎসা জীবনে এমন রোগী পাইনি। অন্য রোগী হলে কমপক্ষে তিরিশ দিন তাকে শুয়েই কাটাতে হতো। কিন্তু সে তো তিনদিনেই উঠে দাঁড়িয়েছে। একটা মিরাকল বলতে পার।’
‘কারন কি আংকেল?’
‘কারন যেটুকু বুঝেছি সেটা হলো, তার মানসিক শক্তি প্রচন্ড। চিকিৎসা বিজ্ঞান বলে, এই মানসিক শক্তি অব্যার্থ মেডিসিনের কাজ করে। এই রকম প্রচন্ড মানসিক শক্তি সম্পন্ন মানুষ প্রথিবীতে বিরল।’
কথা শেষ করেই ডাঃ বেগিন বারাক তার প্রসংগে ফিরে এল্ বলল, ‘তোমার এ বন্ধু তোমাদের বাড়িতে গেছে?’
‘জি না আংকেল।’
‘তোমার আব্বা কখনও তাকে দেখেছে?’
‘না আংকেল।’
‘বলছ এ তোমার ঘনিষ্ঠ বন্ধূ, তাহলে তো এর সম্পর্কে তোমার অনেক কিছুই জানার কথা। তাই না?’
প্রমাদ গুনল সাগরিকা সেন। তার সম্পর্কে যা জানে তা বলা যাবেনা। এখন কিছু জানি না বললেও বিশ্বাস করবে না। অবশেষে বলল, ‘নাম-ধাম ছাড়া তেমন কিছুই জানি আংকেল।
‘নাম জান, কিন্তু ধাম জান না।’
‘কেমন বলে বলছেন?
‘বল সত্য কিনা?’
সাগরিকা সেন জবাবা দিল না। প্রথমবারের মত নিরুত্তর হলো সে।
হাসল ডাঃ বেগিন বারাক। বলল, ‘মামনি আমার কাছে যেটা লুকাচ্ছ, আমি সেটা জানি।’
আতংকিত হয়ে উঠল সাগরিকা সেন। সেটা তার চোখ-মুখের ভাবে প্রকাশও পেল। ধীরে ধীরে দ্বিধাজড়িত কন্ঠে বলল, ‘আপনিও কি জানতে পেরেছেন আংকেল?’
‘আমি জানি যে সে সুধাংশু সেন নয়। সে আহমদ মুসা।’
নামটি ডাঃ বেগিন বারাকের কন্ঠে উচ্চারিত হবার সাথে সাথে সাগরিকা সেনের চেহারা পাল্টে গেল। বাঘের সামনে পড়া হরিণীর মত হয়ে গেল তার চেহারা। কোনকথা বলতে পারল না সে।
হাসল ডাঃ বেগিন বারাক। বলল, ‘ভয় নেই, আমি তাকে ধরিয়ে দেব না। আমি ডাক্তার। তার উপরে জেনারেল শ্যারন ও ডেভিড উইলিয়াম জোনসরা যা করে আসছেন তার আমি ঘোর বিরোধী।
‘কেমন?’ সাগরিকা সেনের চোখে যেন আশার একটা তরঙ্গ এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ল।
‘জেনারেল শ্যারন ও মিঃ জোনসরা ইহুদী জাতিকে নিছক একটা পলিটিক্যাল ইউনিট হিসেবে ধরে বিশ্বব্যাপি যে রাজনৈতিক ও গোয়েন্দা তৎপরতা চালাচ্ছে তার সাথে আমি শুরু থেকেই একমত নই। আমি ইহুদী জাতিকে সম্পূর্নভাবে ধর্মীয় ইউনিট মনে করি। অন্যের মাথায় বাড়ি দেবার মত রাজনীতি করার ইহুদীদের কোন অবকাশ নেই। ফিলিস্তিনিদের উপর জুলুম অত্যাচার করে শুধু ফিলিস্তিনিদের ক্ষতি নয় ইহুদী ধর্মের মাথায়ও বাড়ি দেয়া হয়েছে। ফিলিস্তিনে ইসরাইলীদের ‘পিতৃভূমি’ তত্ত্বের সাথেও আমি একমত নই। ইহুদীরা যে দেশের নাগরিক সেটাই তাদের পিতৃভূমি। জাতীয় কোন পিতৃভূমি থাকা অবান্তর। যেমন মুসলমানরা যে দেশে থাকে, সেটাই তাদের পিতৃভূমি, মাতৃভূমি। মক্কা বা আরব তাদের পিতৃভূমি বা মাতৃভূমি নয়, তীর্থকেন্দ্র মাত্র। এ নীতিগত বিরোধ তাদের সাথে থাকা ছাড়াও সম্প্রতি লস আলামোসে গোয়েন্দা সুড়ঙ্গকে কেন্দ্র করে আহমদ মুসা ইহুদীবাদীদের মুখোশ যে উন্মোচন করেছেন, তাতে আমি তার প্রশংসা করি। এতে আমেরিকায় প্রকৃত ইহুদীদের পরিণামে উপকারই হবে।’
‘ধন্যবাদ ডাক্তার আংকেল। আমাকে বাঁচালেন। আমি মরেই যাচ্ছিলাম ভয়ে। আমি ভাবছিলাম, আপনি যখন চিনতে পেরেছেন, তখন নিশ্চয় জেনারেল শ্যারনদের কিংবা আব্বাদের কাছে তার কথা জানিয়ে দিয়েছেন।’
‘প্রথম দিন দেখেই আমি তাকে চিনতে পেরেছি।’
‘কিভাবে?’
‘আহমদ মুসার ফটো আমি কয়েকবার দেখেছি। সর্ব শেষে দিন কয়েক আগে সিনাগগে গিয়ে আহমদ মুসার ফটো নোটিশ বোর্ডে টাঙানো দেখে এসেছি।’
‘জেনারেল শ্যারনদের ইহুদীবাদ সম্পর্কে আপনার মনোভাবের কথা কি সবাই জানে?’
‘সবাই জানে। জেনারেল শ্যারনরাও জানে।’
‘তাহলে আপনি তো তাদের শত্রু হয়ে পড়ার কথা।’
‘এ মনোভাব তো আমার একার নয়। ধর্মপ্রান ইহুদীরা সবাই আমার মত একউ মনোভাব পোষণ করে। কিন্তু এরা ভোকাল নয় এবং তাদের কোন প্লাটফরম নেই বলে তাদের কথা মানুষ জানতে পারে না।’
‘ধর্মপ্রাণ ইহুদীরা যদি শ্যারন ও জোনসদের পেছনে না থেকে থাকে, তাহলে ওরা শক্তি এবং অর্থবিত্তে এমন সমৃদ্ধ হয়ে উঠল কি করে?’
‘সকলকে তারা ব্যবহার করে। ভয়ে কেউ কিছু বলে না। তারা পাইকারীভাবে বড় বড় অংকের চাঁদা তুলে। সবাই মুখ বুজে চাঁদা দেয়। সন্ত্রাসী শক্তির সাথে শান্তিপ্রিয় জনগন পারবে কেমন করে!’ বলল ডাঃ বেগিন বারাক।
‘কিন্তু আমি আশ্চর্য হচ্ছি শ্যারন ও জোনসরা আমাদের ভারতীয় আমেরিকানদের কাছে টানল কেমন করে?’ বলল সাগরিকা সেন।
‘আমাদের একেশ্বরবাদী ইহুদীদের ও পৌত্তলিক হিন্দুদের বিশ্বাসে বিপরীতমুখী হলেও রাজনৈতিক সখ্যতা খুব পুরানো। ফিলিস্তিনে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর ভারত রাষ্ট্র ইসরাইলের সহযোগী হয়ে যায়। মুসলমানরা উভয়ের কমন শত্রু হয়ে দাঁড়ায়। তখন থেকে দুই রাষ্ট্র, তথা দুই জাতির মধ্যে গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠে। এ বিষয়টা বিশ্বের সব ইহুদী এবং ভারতের হিন্দু জনগন জানে। ফলে পরবর্তীকালে হিন্দু যারা আমেরিকায় এল তারা এখানকার ইহুদীদেরকে বন্ধু হিসেবেই পেল। এই বন্ধুত্ব এখন কৌশলগত মৈত্রীতে পরিনত হয়েছে। আমেরিকায় যেমন ক্ষুদ্র একটা কম্যুনিটি হয়েও ইহুদীরা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভাবে আমেরিকাকে ডোমিনেট করছে, তেমনি আমেরিকায় হিন্দুরা তার চেয়ে ছোট কম্যুনিটি হয়েও অর্থনৈতিক ভাবে আমেরিকানদের মাথার উপর আসীন হয়েছে। উভয় কম্যুনিটি আমেরিকায় তাদের স্ব স্ব আসন ঠিক রাখার জন্যে আজ সহযোগী হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই ইহুদীদের বিপদ মুহূর্তে ভারতীয় আমেরিকানরা তাদের রক্ষার জন্যে এগিয়ে এসেছে।’
‘ডঃ আংকেল এই যে বললেন, হিন্দুরা মানে ভারতীয় হিন্দুরা আমেরিকায় ছোট একটি কম্যুনিটি হয়েও অর্থনৈতিক ভাবে আমেরিকানদের মাথা উপর উঠে বসেছে, এটা এক শ্যেনীর শত্রুর রাজনৈতিক প্রপাগান্ডা নয় কি? আমি তাই মনে করি।’ বলল সাগরিকা সেন।
‘ফ্যাক্টকে তো স্বীকার না করে পারবে না মা মনি। গত আদম শুমারীতে এ তথ্য ধরা পড়েছে যে, শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানদের গড় গৃহস্থালী আয়ের চেয়ে ভারতীয় আমেরিকানদের গড় গৃহস্থালী আয় বেশী। গত আদম শুমারীকালে ভারতীয় আমেরিকানদের গড় আয় দাঁড়িয়েছে ৬১ হাজার মার্কিন ডলার। ভারতীয় আমেরিকানরা বছরে যে সম্পদ উপার্জন করে তার পরিমান ২৫০ বিলিয়ন আমেরিকান ডলার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘ ইউনাইটেড এয়ারলাইনস’ ও ‘ইউএস এয়ারওয়েজ’হস প্রায় ৫০০টি প্রথম শেনীর কোম্পানী ভারতীয় আমেরিকানরা পরিচালনা করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যত ইমিগ্র্যান্ট কম্যুনিটি রয়েছে তাদের মধ্যে ভারতীয় আমেরিকানরা সবচেয়ে স্বচ্ছল। একটা উদাহরন দিলেই বুঝা যাবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মাত্র শতকরা ৬ ভাগ ভারতীয় আমেরিকানরা দরিদ্র সীমার নিচে বাস করছে, অথচ বৃটেনের মত দেশ থেকে আসা ইমিগ্র্যান্টদের ক্ষেত্রে ও এই হার শতকরা ৮ ভাগ। আমার কথা বাদ দাও, কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর তোমাদেরই একজন জগদ্বীশ ভগবতী কি লিখেছেন জান? লিখেছেন ‘ভারতীয় কম্যুনিটি বলা যায় আমেরিকার ‘পরবর্তী ইহুদী’ (Next Jews) হতে যাচ্ছে। তাছাড়া….’
সাগরিকা সেন ডাঃ বেগিন বারাককে বাধা দিয়ে বলল, ‘থাক ডাঃ আংকেল। আর নয়। আপনি বলতে চাচ্ছেন, ইহুদী ও ভারতীয় আমেরিকানদের মধ্যে স্বার্থের ঐক্য হয়েছে।’
‘বলতে পার।’
সাগরিকা সেন সংগে সংগে কথা বলল না। একটু ভাবল। তারপর বলল, ‘আমারও তাই মনে হয় আংকেল। তা না হলে আমার আব্বার মত লোক জেনারেল শ্যারনদের বন্দীকে এভাবে আশ্রয় দেবেন কেন?’
‘তোমার আব্বা খুব বাস্তববাদী ও বুদ্ধিমান মানুষ। জেনারেল শ্যারনদের সাথে তার সায় দেয়াটা সত্যিই বিস্ময়কর।’ বলল ডাঃ বেগিন বারাক।
‘আমার ভয় হচ্ছে আপনাদের কম্যুনিটি যে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে, সে ধরনের বিপর্যয়কে আমরাও যেন স্বাগত জানাচ্ছি।’ সাগরিকা সেন বলল।
‘ঠিকই বলেছ। ব্যাপারটা খাল কেটে কুমির আনার মত। তোমর এ কথাটাও ঠিক যে, আমাদের কম্যুনিটি বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। তবে জেনে রাখ জেনারেল শ্যারনও মিঃ জোনসদের অপরাধের দায় আমাদের কম্যুনিটি নিচ্ছে না। আমি যে মত পোষণ করি, সে মতের লোকদের সংখ্যাই আমাদের কম্যুনিটিতে বেশী। কিন্তু তারা অসংগঠিত। তারা সংগঠিত হচ্ছে। শীঘ্রই তারা জেনারেল শ্যারনদের মুখোশ উন্মোচন করে নিজেদের অবস্থান পরিস্কার করবে। তারা পরিষ্কার বলে দিতে যাচ্ছে, ধর্মে আমরা ইহুদী, কিন্তু জাতিতে আমরা আমেরিকান। আমেরিকা আমাদের মাতৃভূমি, পিতৃভূমি সব, কোন ‘প্রমিজড ল্যান্ড’ নয়।’ ডাঃ বেগিন বারাক বলল।
‘ধন্যবাদ ডাঃ আংকেল। আপনার সাথে এই আলোচনা করে খুশী হলাম। যে কথা কোথাও বলতে পারি না তা বলতে পারলাম। আপনার শেষ কথাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এভাবে আমাদেরও চিন্তা করা দরকার।’ সাগরিকা সেন বলল।
‘ধন্যবাদ মা মনি। তোমাকে দেরী করিয়ে দিলাম। আহমদ মুসার জন্যে তুমি যা করছ, তার জন্যে ঈশ্বর তোমার প্রতি খুশী হবেন। আহমদ মুসার পরিচয় যাই হোক, অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিধাতার একটি অস্ত্র সে। সে তার জাতির জন্যে কাজ করছে বটে, কিন্তু সব জাতির জন্যে সে ণ্যায়পরায়নতার একজন শিক্ষক। আমি আনন্দিত যে, তার সেবা করার একটা সুযোগ আমি পেয়েছি।’
‘সত্যি ডাঃ আংকেল, যতই তাকে দেখছি ততই অভিভূত হয়ে পড়ছি। এতগুনের সমাহার একজন মানুষের মধ্যে হয় কি করে? আমি সেদিন আমার আব্বার উইজডোম সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করেছিলাম। সংগে সংগে তিনি তার পুতিবাদ করলেন। পিতা সম্পর্কে এই ধরনের মন্তব্য ঠিক নয়। আপনার পিতা যা করেছেন জাতীয় স্বার্থ সামনে রেখেই করেছেন। জাতির বন্ধু-জাতিকে সাহায্য করাকে তিনি প্রয়োজন হিসাবে দেখেছেন। প্রয়োজন অনেক সময় নীতিবোধের উপরে উঠতে পারে। তা এই বাধ্যবাধকতার পতি সন্তান হিসাবে আপনি সমর্থন না দিলেও সহানুভূতিশীল হওয়া প্রয়োজন।’ সাগরিকা সেন বলল। বলতে বলতে তার কথা আবেগপূর্ণ হয়ে উঠেছিল।
‘এ জন্যেই বলছিলাম, আহমদ মুসা তার জাতির জন্যে কাজ করলেও সব মানুষেণ শিক্ষক হতে পারেন।’
‘ধন্যবাদ ডাঃ আংকেল। আমি উঠি।’
‘ধন্যবাদ, এস।’
সাগরিকা সেন বেরিয়ে এল।
চলল আহমদ মুসার কেবিনের দিকে।
ঘরে ঢুকতে গিয়ে দেখল আহমদমুসা নামাজ পড়ছে।
কেবিনের দরজা পূর্ব দিকে। আহমদ মুসা নামাজে দাঁড়িয়েছে পূর্বমুখী হয়ে।
দরজা থেকে আহমদ মুসার গোটা সম্মুখ দিকটা ভালোভাবে দেখা যাচ্ছে।
সাগরিকা সেন আহমদ মুসার দিকে একবার তাকিয়েই বুঝল গভীর তন্ময়তায় ডুবে আছে আহমদ মুসা। এই তন্ময়তা ভাঙতে চাইল না সাগরিকা সেন। মোনাজাতের মাধ্যমে নামাজ শেষ হলে সাগরিকা সেন ঘরে ঢুকল।
নামাজ শেষে উঠে দাঁড়িয়েছিল আহমদ মুসা। সাগরিকা সেনকে ঘরে ঢুকতে দেখে বলল, ‘আসুন মিস সেন।’
বেডের সামনে কোণাকুণি কের বসানো দু’টি সোফা এবং সামনে একটা টিপয়।
সাগরিকা সেন গিয়ে একটি সোফায় বসল।
অন্য সোফাটিতে বসল আহমদ মুসা।
প্রথম কথা বলল সাগরিকা সেন। বলল, ‘প্রার্থনায় স্রষ্টার কাছে কি চাইলেন?’ মুখে হাসি সাগরিকা সেনের।
‘যা প্রয়োজন সব চেয়েছি।’ বলল আহমদ মুসা। তার ঠোঁটে হাসি। কিন্তু মুখ নিচু।
‘আপনার আবার কোন প্রয়োজন আছে নাকি?’
‘শুধু নিজের জন্যে নয়, অন্যের প্রয়োজনও আমার প্রয়োজন।’
‘এই ‘অন্য’ কে বা কারা?
‘যিনি মুমূর্ষু একজনকে পথ থেকে তুলে এনে এই সুন্দর চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, তিনিও একজন।’
হাসল সাগরিকা সেন, লজ্জামিশ্রিত হাসি। বলল, ‘তার জন্যে কি প্রার্থনা করেছেন?’
‘বলেছি, তাকে মুক্তি ও চির মঙ্গলের পথে পরিচালনা করুন।’
সাগরিকা সেনের মুখ তেকে হাসি উবে গিয়ে সেখানে আবেগ জড়িত এক গাম্ভীর্য নেমে এল। বলল, ‘মুক্তি কি থেকে? আর চির মঙ্গলের পথটা কি?’
‘মানুষ যদি এ পৃথিবীতে ভাল করে, এজন্যে স্রষ্টার কাছে তার পুরষ্কার আছে। আর যদি অবাঞ্চিত, অনুচিত খারাপ কাজ করে, তাহলে স্রষ্টার কাছে জবাবদিহী করতে হবে এবং অপরাধী হলে শাস্তি পেতে হবে। এ থেকে আমি মুক্তি চেয়েছি। আর চিত মঙ্গলের পথ হলো যে পথে চললে মৃত্যপরবর্তী অনন্ত জীবনে অনন্ত যুরস্কার লাভ হবে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তাহলে মুক্তি পাওয়া এবং অনন্তঝীবনে অনন্ত পুরসকার লাভ করা তো একই বিষয় হলো।’
‘হ্যাঁ তাই।’
‘যে পথে চললে অনন্ত জীবনে অনন্ত পুস্কার লাভ করা যাবে, সেই পথ কোনটি?’
‘স্রষ্টার প্রতিনিধি নবী-রাসুলরা যে পথ মানুষকে দেখিয়ে গেছেন।’
হাসল সাগরিকা সেন। বলল, ‘নাম বলুন।’
‘যেমন স্রষ্টার সর্বশেষ রসুলের আনা পথ ইসলাম।’
‘তার মানে আপনি আমাকে আপনার ধর্মের পথে চলার জন্যে প্রার্থনা করেছেন।’
‘ঠিক তাই। কারন, নিজের জন্যে যা পছন্দ করি, অন্যের জন্যেও তা পছন্দ করতে হয়।’
হাসল সাগরিকা সেন। বলল, ‘আমিও যদি এ কথাই বলি, আমার যে পথ পছন্দ সে পথ আপনারও হোক।’
‘কিন্তু আপনি সে প্রার্থনা করেননি।’
সাগরিকা সেন তত্ক্ষণাৎ জবাব দিল না।একটু ভাবল। তারপর বলল, ‘আপনি ঠিকই বলেছেন। আমি নিজেযে মন্দিরে যাই না, সেখানে আপনাকে ডাকব কি করে?’
বলে একটু থামল। ভাবল। তারপর আবার বলল, ‘আচ্ছা বলুন তো, কোন ধর্মের অনুসরণ কি মানুষের অপরিহার্য?’
‘যে কোন ধর্মের নয়, সত্য ধর্মের অনুসরণ মানুষের জন্যে অপরিহার্য।’
‘কেন?’
‘দুনিয়ার জীবন পরিচালনায় পক্ষপাতহীন ও আখেরাতমুখী ব্যবস্থা লাভের জন্যে।’
‘কোন মানুষ তার জীবন পরিচালনায় নিরপেক্ষ ব্যবস্থা নিজে তৈরী করতে পারে না?’
‘মানুষ সাধারনভাবে আত্মকেন্দ্রিক। তার উপর মানুষের নিজের সম্পর্কে, জগত্-জীবন সম্পর্কে জ্ঞান খুবই সীমাবদ্ধ। সবচেয়ে বড় কথা, আখেরাত বা মৃত্যু পরবর্তী জীবন সম্পর্কে মানুষ কিছুই জানে না।’ আহমদ মুসা বলল।
‘পৃথিবীর জীবন পরিচালনায় মৃত্যু পরবর্তী জীবন সম্পর্কে জানা প্রয়োজন কেন?’ বলল সাগরিকা সেন।
‘দুনিয়ার জীবনটা কাজ করার আর আখেরাতের চিরন্তন জীবন সেই কাজের ফল ভোগ করার। দুনিয়ার সসীম জীবনে মানুষ যে কাজ করবে, আখেরাতের অসীম জীবন ধরে তারই ফল ভোগ করবে। সুতরাং দুনিয়ায় মানুষের সীমিত জীবনটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দুনিয়ার জীবনটা আসলেই আখেরাতের অনন্ত জীবনের সূচনাকাল। আখেরাতের কি সাফল্যের জন্যে কি ধরনের জীবন চাই, তা না জানলে এ পৃথিবীতে সফল জীবন পরিচালনা করা যাবে না। সুতরাং আখেরাতের জ্ঞান দরকার। সে জ্ঞানের ভিত্তিতেই দুনিয়ার জীবন পরিচালনা করতে হবে।
‘আখেরাতের ব্যাপারটা তো আপপনাদের ধর্মের কথা।’
‘আমার ধর্মের কথা নয়, সত্য ধর্মের কথা।’
‘আপনার ধর্মই একমাত্র ধর্ম একথা আমি মানব কেন?’
‘মানবেন কারণ, আমার ধর্মই সর্বশেষ ধর্ম এবং আমার ধর্মের রাসুলই সর্বশেষ রাসুল।’
‘সর্বশেষ হওয়া কি সত্য হওয়ার শর্ত?’
‘একটা শর্ত।’
‘অন্যান্য শর্তের কি হবে?’
‘অন্যান্য শর্তও পূরণ হয়েছে। একমাত্র ইসলামের ধর্মগ্রন্থ ছাড়া আর কোন ধর্মগ্রন্থ অবিকৃত নেই। যেহেতু ধর্মগ্রন্থই অবিকৃত নেই তাই অন্য কোন ধর্মই আর সত্য নয়। সুতরাং অবিকৃত ধর্মগ্রন্থ ও অবিকৃত ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে ইসলামই এখন একমাত্র সত্য ধর্ম।’
হাসল সাগরিকা সেন। বলল, ‘ধন্যবাদ সুন্দর যুক্তির জন্যে। তবে আমার হজম শক্তি দুর্বল। শক্ত জিনিস হজম করতেত আমার সসময় লাগবে।’
‘সময় লাগুক, হজমের সম্ভাবনা আছে কিনা?’
আবার হাসল সাগিরিকা সেন। বলল, ‘বলব না। ওটা একান্ত আমার ববব্যাপার।’
বলে একটু থেমে বলল, ‘তবে একটা মজার খবর শোনাতে পারি আপনাকে।’
‘কি সেটা?’
‘ডা: আংকেল শুরু থেকেই আপনাকে চিনতে পেরেছেন।’
‘ডা: বেগিন বারাক আমাকে শুরুতেই চিনেছেন?’ বিস্ময় ফুটে উঠল আহমদ মুসার কন্ঠে। তার বিস্মিত দৃষ্টি সাগরিকা সেনের মুখের উপর নিবদ্ধ।
মুখে হাসি সাগরিকা সেনের। বলল, ‘নিশ্চয়।’
‘উনি ধরিয়ে দেননি কেন আমাকে এখনও?’
হাসল সাগরিকা সেন। বলল, ‘উনি আপনাকে ভালবেসে ফেলেছেন।’
আহমদ মুসার মুখের গাম্ভীর্য তখনও কাটেনি। বলল, ‘বলুন তো ঘটনাটা কি?
‘আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না?’
হাসল আহমদ মুসা। প্রশ্ন এড়িয়ে বলল, ‘আসল কথাটা বলুন।’
‘কিন্তু সত্যিই তিনি আপনাকে ভালবাসেন।’
‘কারন কি?’
‘কারন ছাড়া কেউ ভালবাসতে পারে না?’
‘ডা: বেগিন বারাক নিশ্চয় সেই লোক নন?’
‘তিনি ইহুদী বলেই কি এই কথা বলছেন?’
‘কতকটা তাই।’
‘ইহুদীরা সব এক ধরনের নয় ও এক মতেরও নয়। ডাঃ আংকেল জেনারেল শ্যারনদের ঘোর বিরোধী।’
‘আমি এরকম একটা কিছু ধারনা করেছিলাম। ডাঃ বারাক কি মত পোষণ করেন বলুন তো?’
সাগরিকা সেন কিছুক্ষন আগে তার সাথে ডা: বেগিন বারাকের যে আলোচনা হলো, তা বিস্তারিত আহমদ মুসাকে জানাল। সবশেষে বলল, ‘সত্যি ডাঃ আংকেলের নীতিনিষ্ঠতা ও মহানুভবতার কোন তুলনা নেই।’
‘সত্যি ডা: বেগিন বারাক একজন আদর্শ মানুষ, অনুকরনীয় ও বরনীয় একজন ব্যক্তিত্ব। কিন্তু মিস সেন আপনার শেষ কথাটার ব্যাপারে আমার আপত্তি আছে। তুলনার যদি কেউ না থাকে, তাহলে যিনি আমাকে তাঁর গোটা কম্যুনিটির স্বার্থের বিরুদ্ধে শুধু নয়, পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে আমাকে মমূর্ষু অবস্থায় তুলে এনে চিকিত্সার এমন দূর্লভ ব্যবস্থা করেছেন, তাকে কোথায় রাখব?’
সাগরিকা সেন গম্ভীর হয়ে উঠেছে। আরক্ত হয়ে উঠেছে তার দুই গন্ড। লজ্ঝা জড়িত তার দুই চোখ নিচু হয়েছে। বলল, ‘ধন্যবাদ, ডাঃ আংকেলের প্রতিযোগী আমি হতে যাচ্ছি না। সুতরাং স্থান সন্ধানের প্রয়োজন আছে কি?’
‘স্যরি মিস সেন, আমি এই অর্থে কথাটা বলিনি। আমি ঘটনাটা স্মরণ করতে চেয়েছি মাত্র। আমি…।’
কথঅ থেমে গেল আহমদ মুসার। খোলা দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে ডাঃ বেগিন বারাক।
‘একটা কথা মিস সেনের উপস্থিতিতে আপনাকে বলা দরকার তাই এলাম। কিন্তু দরজা খোলা কেন?’ বলল ডা: বেগিন বারাক।
‘ডাঃ আংকেল এটা মিঃ আহমদ মুসাদের সংস্কৃতি। পারিবারিকভাবে সম্পর্কত নয় এমন একজন নারী ও একজন পুরুষ যখন কোন ঘরে একত্রিত হন, তখন দরজা খোলা রাখেন।’ সাগরিকা সেন বলল। হাসল ডা: বেগিন বারাক। তারপর হঠাৎ গম্ভীর হয়ে উঠল। বলল, ‘এজন্যেই ইসলাম মানুষের স্বাভাবিক ধর্ম। ঠিকই নির্জন একটি ঘরে একজন নারী ও একজন পুরুষের একত্রিত হওয়া স্বভাব পরিপন্থী এবং অস্বাভাবিকতার জন্ম দিতে পারে। ইসলাম তার
প্রতিবিধান করতে চেয়েছে।’ আহমদ মুসাকে টেনে এনে সোফায় বসিয়ে নিজে আহমদ মুসার বেডে বসতে বসতে বলল।
ডাঃ বেগিন বারাককে স্থান করে দেবার জন্যে আহমদ মুসা সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের বেডের দিকে যাচ্ছিল।
সাগরিকা সেনও উঠে দাঁড়িয়েছিল। সে গিয়ে বেডে বসে ডাঃ বেগিন বারাককে সোফায় বসার জন্যে অনুরোধ করল।
ডাঃ বারাক সোফায় এসে বসল।
বসেই বলল, ‘আমার কথাটা বলে ফেলি।’
বলে একটু দম নিয়ে বলল, ‘মিস সেন কাল রোববার সকালে আমি আহমদ মুসার ব্যান্ডেজ খুলব। আমার মনে হচ্ছে আহমদ মুসাকে অন্য কোথাও শিফট করা দরকার। কিন্তু আগামী তিন চার দিন তার ভাল রেস্ট দরকার। সে জন্যে যেখানে শিফট করা হবে তা একটু নিরিবিলি হতে হবে।’
‘কেন ডা: আংকেল, তিন চারদিন উনি তো এখানে থাকতে পারেন। টাকার জন্যে চিন্তা করবেন না আংকেল।’ বলল সাগরিকা সেন।
‘আহমদ মুসার ব্যাপারে কোন টাকার প্রশ্ন নেই মিস সেন। আহমদ মুসা চাইলে তার থাকার জন্যে আমার গোটা বাড়ি দিয়ে দিতে পারি। সেটা হবে আমার সৌভাগ্য। কিন্তু আমি অন্য চিন্তা করছি। আমি ভাবছি আহমদ মুসার নিরাপত্তার কথা। আমার ক্লিনিক তো বাজারের মত।’ বলল ডাঃ বারাক।
ভাবছিল সাগরিকা সেন। একটু পর বলল, ‘আমার তো ভয় ধরিয়ে দিলেন ডাঃ আংকেল। আমার বুক কাঁপছে। মনে হচ্ছে আজই কোথাও শিফট করি।’
‘তার দরকার নেই। আমি কাল সকালে ব্যান্ডেজ খুলব। দুপুরের দিকে শিফট করলেই চলবে।’
বলে ডাঃ বেগিন বারাক উঠে দাঁড়াল।
সাথে সাথে আহমদ মুসাও উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘ ডাঃ বারাক আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। মিস সেনের কাছে শুনলাম প্রথম দিনই আপনি আমাকে চিনতে পেরেছেন।’
হাসল ডা: বারাক। বলল, ‘মিঃ আহমদ মুসা, আমি ঈশ্বরের কাছে কৃতজ্ঞ যে, ঈশ্বর আমাকে আপনার কিছু সেবা করার সুযোগ দিয়েছেন। আমার জাতির কিছু পথভ্রষ্ট লোক আপনার এ অবস্থার জন্যে দায়ী। আমি আপনার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।’
বলে ডাঃ বারাক আহমদ মুসার সাথে হ্যান্ডশেক করে যাবার জন্যে ঘুরে দাঁড়াল।
ঘর থেকে বেরিয়ে গেল ডা: বারাক।
‘তাহলে আমিও চলি মি: আহমদ মুসা। কালকের শিফটের ব্যাপার নিয়ে কিছু ভাবতে হবে।’ বলল সাগরিকা সেন।
‘মিস সেন আমি একটা কথা বলতে চাই।’ আহমদ মুসা বলল।
‘বলুন।’
‘আমি সুস্থ। কাল ব্যান্ডেজও খোলা হবে। আমি যেতে চাই।’
‘কেন, ডাক্তার আংকেল বলেছেন কয়েকদিন আপনার সম্পূর্ন রেস্ট দরকার। আপনি সম্পূর্ন সুস্থ নন।’
‘কোন অসুবিধা হবে না মিস সেন।
‘না, এভাবে আপনাকে আমি পালাতে দেব না। মনে করেছেন আমি আপনাকে শিফট করা নিয়ে ঝামেলায় পড়ব। তাই না? তা হবে না।’
সাগরিকা সেন বসেছিল। আবার উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘মাথা থেকে ওসব চিন্তা বাদ দিন। আমি চলি। সালাম।’
বলে সাগরিকা সেন দরজার দিকে হাঁটা শুরু করল। তার মুখে হাসি। ‘সালাম’ বলার সময় তার মুখে এই মিষ্টি হাসি ফুটে উঠেছিল।

মেডিলিন মার্গারেট ও তার বয়ফ্রেন্ড ললয়েড ল্যাজিও রেস্টুরেন্টের একটা টেবিলে বসে আছে। ওদের খাওয়া-দাওয়া শেষ। এখন চা খাচ্ছে।
মেডিলিন মার্গারেট পেশায় নার্স। এখন সে কাজ করছে ডা: বেগিন বারাকের ক্লিনিকে। আহমদ মুসার নার্সিং-এর জন্যে ডাঃ বেগিন বারাক তাকেই কাজে লাগিয়েছেন। মেডেলিনের বয়ফ্রেন্ড একজন খেলোয়াড়।
খেলোয়াড় ললয়েডকে দেখেই তিনজন যুবক এগিয়ে এল তাদের টেবিলের দিকে। ললয়েড উঠে দাঁড়িয়ে তাদের স্বাগত জানাল। তারা ললয়েডের পরিচিত।
বসল তারা তিনজন টেবিলে।
তাদের তিনজনের একজনের হাতে একটি ফটো ছিল। তার হাতের ফটো সে টেবিলে রাখল।
সে বসেছিল মেডিলিন মার্গারেটের পাশে।
স্বাভাবিকভাবেই ফটোটির দিকে চোখ গিয়েছিল মেডিলিন মার্গারেটের।
ফটোটির দিকে চোখ পড়তেই অবাক হলো মেডিলিন। মি: সুধাংশুর ফটো এদের হাতে কেন? বলল, ‘এ ফটো আপনাদের হাতে কেন?’
যুবকটি মুখ ঘুরিয়ে তাকাল মেডিলিনের দিকে। বলল, ‘কেন বলছেন এ কথা? চেনেন একে?’
‘ঠিক চিনি বলা ঠিক হবে না। আমি একটা ক্লিনিকে ওর নার্সিং করছি।’
‘কোন ক্লিনিকে?’
‘ডাঃ বেগিন বারাকের মিনি ক্লিনিকে।’
‘আমাদের রাব্বী ডাঃ বেগিন বারাক?’
‘হ্যাঁ।’
‘কিন্তু লোকটি কে? আপনাদের কাছে ছবি কেন?’ বলল মেডিলিন মার্গারেট।
‘আমাদের লোক। খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আপনার কাছে খোঁজ পেলাম। ধন্যবাদ আপনাকে।’ ওদের একজন বলল। ওদের সকলের চোখ আনন্দে উজ্জ্বল।
ওরা উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘চলি।’
‘চা খাবেন না?’ বলল ললয়েড।
‘সময় হচ্ছে না। পরে দেখা হবে। গুড মর্নিং।’
বলে ওরা বেরিয়ে গেল।
‘বুঝলাম না। ওরা এলন, আবার চলে গেলেন!’ বলল মেডিলিন।
‘ওরা এ ধরনেরই। সারা শহর ঘুরে বেড়পয় দল বেঁধে। ওদের অসাধ্য কিছু নেই। কিন্তু শুনেচি তোমার ঐ লোকটি খুব ভাল মানুষ, তাহলে এদের লোক হয় কি করে?’
‘কিছু বুঝছি না। চল আমরা উঠি।’
তারা উঠে দাঁড়াল।
বেরিয়ে এল রেস্টুরেন্ট থেকে।

ঠিক তখন দুপুর বারটা।
ওদের তিনজনের জীপ এসে থামল ডাঃ বেগিন বারাকের ডাক্তার খানার গাড়ি বারান্দায়।
তিনজনের মধ্যে লিডার গোছের লোকটি ছিল ড্রাইভিং সিটে।
গাড়ি দাঁড়াতেই সে বলল, ‘বেভিন, বেরেটা তোমরা শোন, ডাক্তার যদি সহযোগিতা করে ভাল। সহযোগিতা না করলে ডাক্তারকেও আমরা ছাড়ব না।’
‘তা কি আর বলতে হয়, স্যামুয়েল।’ বলল বেভিন নামের লোকটি।।
‘বলছি এ কারণে যে ডাঃ বেগিন বারাক খুবই সম্মানী লোক। তাকে যত কম ঘাটানো যায় ততই ভাল। নেহায়েত যেটুকু না করলে আমাদের কার্যসিদ্ধি হবে না, সেটুকুই করব, তার বেশী নয়।’ বলল লিডার গোছের স্যামুয়েল।
‘যতই সম্মানী হোক, আহমদ মুসার পক্ষ নেবার পর তার আর সম্মান থাকে কোথায়?’ বলল বেরেটা।
‘আহমদ মুসা নিশ্চয় নাম ভাঁড়িয়ে এখানে ভর্তি হয়েছে। ডা: বেগিন বারাকের কোন দোষ নাও থাকতে পারে।’ স্যামুয়েল বলল।
গাড়ি থেকে নামার আগে তিনজনই সিটের তলা হতে মিনি সাইজের ভয়ংকর শক্তিশালী কারবাইন বের করে কোটের ভেতর কাঁধে ঝুলিয়ে নিল। হাতের রিভলবার পকেটে রেখে তারা গাড়ি থেকে নেমে এল।
রোগী-পত্র তখন ছিল না। ডা: বেগিন বারাক ডাক্তার খানায় তার চেয়ারে বসে একটা মেডিক্যাল জার্নালে চোখ বুলাচ্ছিল।
ওরা তিজন প্রবেশ করল ঘরে।
ডাঃ বারাক জার্নাল থেকে মুখ তুলে তাকাল তিনজনের দিকে। তাকিয়ে বিস্মিত হলো ডা: বারাক। তিনজনের কেউই তার রোগীর মত নয়। তাদের হাঁটার মধ্যে একটা উদ্ধত ভাব।
ডাঃ বারাক উঠে দাঁড়াল। স্বাগত জানাল তাদেরক। বলল, ‘কোন সমস্যা? বসুন।’
‘ধন্যবাদ ডক্টর। বসব না, আমাদের সময় খুব কম। একটা জরুরী প্রয়োজনে আপনার কাছে এসেছি।’
‘ওয়েলকাম। বলুন কি প্রয়োজন?’
‘আপনি হয়তো জানেন না, আাপনার ক্লিনিকে আহমদ মুসা চিকিত্সাধীন আছে। আমরা তাকে নিয়ে যেতে এসেছি।’ বলল স্যামুয়েল নামের লোকটি।
চমকে উঠল ডাঃ বেগিন বারাক। থরথর করে কেঁপে উঠল তার বুক। এমন ভয়ই সে করে আসছে। এজন্যেই আহমদ মুসাকে সে এখান থেকে সরিয়ে দেবার চেষ্টা করছিল সাগরিকা সেন, নিতেও এসেছে। আর এক ঘন্টা সময় পেলেই আহমদ মুসাকে সরানো যেত। বিধাতা সে সময়টুকু দিলেন না।
উত্তর দিতে একটু দেরী হয়েছিল ডা: বেগিন বারাকের। স্যামুয়েল আবার বলে উঠল, ‘ডাঃ বেগিন বারাক আমাদেরকে সহযোগিতা করুন।’
ডা: বারাক উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘অবশ্যই। কিন্তু আমার এখানে যারা চিকিত্সা করাতে আসে, তারা সবাই আমার রোগী। তাদের পরিচয়, নাম ইত্যাদি আমার কাছে বড় নয়।’
‘আপনার এই পেশা-দায়িত্বকে আমরা ওয়েলকাম করি ডক্টর। আমরা পরিচয়টা দিলাম একারণে যে, তাকে আমরা চাই।’
‘কিন্তু আমার কোন অসুস্থ রোগীকে এইভাবে কারো হাতে আমি তুলে দিই না।’
বলতে বলতে ডা:বেগিন বারাক তার চেয়ার থেকে উঠে টেবিলের পাশে সরে এল।
‘আপনি তো তুলে দেবেন না। আমরা তুলে নিয়ে যাব। আপনি সম্মানী ব্যক্তি। আপনাকে কিছু না বলে নিয়ে যাওয়াটা ভাল দেকায় না। তাই বলা।’ স্যামুয়েল বলল।
ডাঃ বেগিন বারাক কয়েক ধাপ এগয়ে তাদের তনজনের সামনে এসে দাঁড়াল। বলল, ‘না, তা তোমরা করতে পার না। রোগী সুস্থ হয়ে আমার এখান থেকে বেরিয়ে যাবে, তারপর তোমরা যা ইচ্ছে তাই কর।’
একটা ক্রুর হাসি ফুটে উঠল স্যামুয়েল এবং অন্য দু’জনের মুখে। বলল স্যামুয়েল, ‘আমরা এধরনের কোন চুক্তি করতে আসিনি ডাঃ বেগিন বারাক। শুধু আমরা আপনাকে সম্মান প্রদর্শন করতে চেয়েছিলাম। আপনি থাকুন, আমরা যাচ্ছি আমাদের কাজে।
বলে স্যামুয়েল পা বাড়াল ঘর থেকে বেরুবার জন্যে।
ডা: বারাক ছুটে তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। দুই হাত সম্প্রসারিত করে বলল, ‘না আমি যেতে দেব না। আমি বেঁচে থাকতে তোমরা যেতে পারবে না।’
স্যামুয়েল পকেট থেকে রিভলবার বের করল। বলল, ‘ডাঃ বেগিন বারাক, পাগলামি করলে আমি গুলী করতে বাধ্য হবো।’
‘তোমার গুলী আমার নীতি ও দায়িত্বের চেয়ে বড় নয়।’ বলে ডাঃ বেগিন বারাক আরো দৃঢ় ভাবে দাঁড়াল।
চোখদু’টি জ্বলে উঠল স্যামুয়েলের। সে তার রিভলবার তুলল। গুলী করল। গুলী উরুবিদ্ধ করল ডাঃ বেগিন বারাকের।
ডাঃ বেগিন বারাক বসে পড়ল যেখানে সে দাঁড়িয়ে ছিল সেখানেই।
তাকে ডিঙিয়ে তারা সবাই ছুটে বেরুতে গেল।
ডাঃ বেগিন বারাক তার বাম হাত দিয়ে উরু চেপে ধরে ডান হাত দিয়েয় কোটের ভেতরের পকেট থেকে একটা রিভলবার বের করল।
ডাঃ বারাকের মুখ পাথরের মত শক্ত। চোখ দু’টি স্থির প্রতিজ্ঞায় দৃঢ়।
দ্রুত হাতে সে রিভলবার তুলল। গুলী করল পর পর তিনটি। অব্যর্থ লক্ষ্য। তিনটি গুলী গিয়ে তিনজনের মাথা গুড়ো করে দিল। কেউই দরজা পার হতে পারল না। ঘরের মেঝেতে ঝরে পরল তিনটি দেহ।
পরক্ষনেই দরজায় এসে দাঁড়াল আহমদ মুসা ও সাগরিকা সেন। তাদের চোখে-মুখে উদ্বেগ ও বিস্ময়।
চিত্কার করে বলে উঠল ডাক্তার বেগিন বারাক, ‘আহমদ মুসা আপনি তাড়াতাড়ি এখান থেকে চলে যান। সাগরিকা মা ওকে নিয়ে চলে যাও এনি। ওরা এসেছিল ওকে ধরে নিয়ে যেতে। আবারও কিছু ঘটতে পারে।’
ডাঃ বেগিন বারাক থামতেই সাগরিকা সেন বলে উঠল, ‘উনি ঠিক বলেছেন মি: আহমদ মুসা। চলুন। সব ব্যবস্থা আমি ঠিক করে রেখে এসেছি।’
আহমদ মুসার মুখে ফুটে উটল একটা শুষ্ক হাসি। বলল, ‘গুলীবিদ্ধ ডাঃ বারাককে ফেলে রেখে আমি কোথাও যাব না।’ আহমদ মুসার কন্ঠ স্থির ও দৃঢ়।
ঘরে প্রবেশ করল আহমদ মুসা।
ডাঃ বেগিন বারাক আর্তকন্ঠে অনুরোধের স্বরে ববেল উঠল, ‘প্লিজ মিঃ আহমদ মুসা, ওরা আপনাকে ধরে নিয়ে যাবে অথবা মেরে ফেলবে।। আপনার জীববন অনেক মূল্যবান। আপনি যান।’
আহমদ মুসা ওদের তিনজনের কাছ থেকে মিনি কারবাইন কুড়িয়ে নিঢে নিজের কাঁধে ঝুলাল। তারপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়েই বলল, ‘ডক্টর বারাক আমার চিন্তা আল্লাহর উপর ছেড়ে দিয়ে দিন। আমার মৃত্যু বা বন্দী হওয়া যদি ওদের হাতে থাকে তবে কেউ আমাকে রক্ষা করতে পারবে না। আর যদি না থাকে তাহলে ওরা আমার কিছুই করতে পারবে না।’
কিন্তু আহমদ মুসা, তাই বলে কি মানুষ আত্মরক্ষার ব্যবস্থা করে না, সাবধানতা অবলম্বন করে সা? আপনি আসুন।’ কান্না জড়িত কন্ঠে বলে উঠল সাগরিকা সেন।
‘ঠিক আছে মিস সেন চলুন আমরা ডাঃ বারাককে অপারেশন থিয়েটারে নিই। তারপর চলে যাবার সুযোগ আমরা পাব।’
বলে আহমদ মুসা ডাঃ বেগিন বারাককে পাঁজাকোলা করে তুলে নিল। নিয়ে চলল অপারেশন থিয়েটারের দিকে।
অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিল অপারেশন টেবিলে।
‘মিঃ আহমদ মুসা, আপনি কি অপারেশন করতে পারেন?’ বলল ডাঃ বেগিন বারাক।
‘অপারেশন করতে জানি না, কিন্তু গুলীটা বের করার মত জ্ঞান আমার আছে।’ বলল আহমদ মুসা।
কিছু বলতে যাচ্ছিল ডাঃ বেগিন বারাক।
এমন সময় একজন এ্যাটেনডেন্ট ছুটে এল ঘরে। বলর হাঁপাতে হাঁপাতে, ‘দুই গাড়ি ভর্তি লোক এসছে। হাতে বন্দুক। বাড়ি ঘিরে ফেলেছে তারা। গাড়ি থেকে ম্যাডাম নোয়ন নাবিলাকেও নামতে দেখলাম।’
‘নোয়ান নাবিলা?’ এ্যাটেনডেন্টের দিকে তাকিয়ে ভ্রুকুঁচকে জিজ্ঞেস করল সাগরিকা সেন।
‘হ্যাঁ ম্যাডাম।’ বলল এ্যাটেনডেন্ট।
‘নোয়ান নাবিলাকে কি ওরা ধরে নিয়ে এল?’ প্রশ্নটা অনেকটা স্বগতোক্তির মত হল সাগরিকা সেনের।
‘নাবিলা ম্যাডাম হাসিখুশী। হেসে হেসে সাথের বন্দুকধারীদের সাথে আলাপ করছে দেখলাম।’ এ্যাটেডেন্ট বলল।
‘কোথায় ওরা?’
‘আমাদের গেটের সামনেই ওদের গাড়ি।’ বলল এ্যাটেনডেন্ট।
‘ঠিক আছে আমি দেখছি।’ বলল সাগরিকা সেন।
‘মিস সেন, আমার অনুমান মিথ্যা না হয়ে থাকলে, নোয়ান নাবিলাই জেনারেল শ্যারনের লোকদের নিয়ে এসেছে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘শেষে আমাকেও অবিশ্বাস করবেন নাতো?’ সাগরিকা সেন বলল।
‘আপনি ও নোয়ান নাবিলা এক নন।’ আহমদ মুসা বলল।
‘না, ওদের সামনে আপনার যাওয়া চলবে না।’
‘আপনি কথা বলবেন, আমি আড়ালে থাকব।’
সাগরিকা সেন আর কোন কথা বলল না। সে হাঁটতে শুরু করল।
‘ডা: বেগিন বারাক, আপনার একটু কষ্ট হবে, আমি আসছি।’ ডা: বারাককে লক্ষ্য করে বলল আহমদ মুসা।
‘নোয়ান নাবিলা সম্পর্কে আপনার কথাই ঠিক আহমদ মুসা। আপনি ওদিকটা দেখুন। এই ইমারজেন্সী ফেস করাই এখন বেশী জরুলী। ঈশ্বর আপনাকে সাহায্য করুন।’ বলল ডাঃ বেগিন বারাক।
আহমদ মুসা তখন সাগরিকা সেনের পিছে পিছে হাঁটতে শুরু করেছে।
সাগরিকা সেন অনেকটা সামনে চলে গিয়েছিল। আহমদ মুসা কিছুটা এগিয়েই শুনতে পেল নোয়ান নাবিলার কন্ঠ।
বলছে সে, ‘সাগরিকা এস। শোন। তোমার বন্ধুকে তুমি চেন না। সে তো সাংঘাতিক একজন, নাম আহমদ মুসা। আমি আজ সিনাগগে গিয়ে ফটো দেখে তাকে চিনতে পেরেছি। আমার কাছে এরা শুন সংগে সংগেই চলে এসেছে। ওরা ভেতরে ঢুকছে। তুমি বেরিয়ে এস।’
‘নাবিলা, তোমার লোকদের ভেতরে ঢুকতে নিষেধ করো। ফিরিয়ে নাও ওদের। আমি তোমার সাথে কথা বলি, তারপর যা করার করবে।’ বলল শক্ত কন্ঠে সাগরিকা সেন।
আহমদ মুসা আর একটু এগিয়ে এটা দরজার আড়ালে গিয়ে লুকালো। সেখান থেকে নোয়ান নাবিলাকে একটু একটু করে দেখা যাচ্ছে। সাগরিকা সেন ও তিন স্টেনগানধারী যারা করিডোর ধরে এগিয়ে আসছিল, তাদের খুব ভাল করে দেখতে পাচ্ছে সে।
স্টেনগানধারী তিনজন সাগরিকা সেন ও নোয়ান নাবিলার মাঝখানে ছিল। তারা দাঁড়িয়ে পড়েছিল নোয়ান নাবিলাকে সাগরিকা সেনের সাথে কথা বলতে দেখে।
সাগরিকা সেন থামতেই নোয়ান নাবিলা বলে উঠল, ‘ঠিক আছে ওরা যাচ্ছে না। বল তোমার কথা।’
সাগরিকা সেন বলল, ‘আমার বন্ধূর যে নামই হোক, যে পরিচয়ই হোক, সে আমার মেহমান। আমার লাশ না মাড়িয়ে তোমরা তার কাছে যেতে পারবে না।’
‘তুমি পাগল হয়েছ সাগরিকা? তুমি আহমদ মুসাকে চেন না? বিষধর সাপ কি কথনও বন্ধু হয়?’ বলল নোয়ান নাবিলা।
‘দেখ আমি আহমদ মুসাকে চিনি, যেমন চিনি জেনারেল শ্য্যারন ও মিঃ জোনসদেরকে। আহমদ মুসা আমার মেহমান। আমার মেহমানের কোন ক্ষতি করতে দেব না।’
‘মেহমান যদি জাতির শত্রু হয়?’ বলল নাবিলা।
‘আমি বিচারক নই। বিচারক যখন রায় দেবে, তখন আমি দেখব।’
‘তুমি আমাদের আংকেল মানে তোমার আব্বার বিরুদ্ধেও যাচ্ছ, তাকি তুমি জান?’
‘জানি।’
‘কিন্তু এ তোমার অন্যায় জেদ সাগরিকা।’
‘ন্যায়-অন্যায় বোঝার বয়স আমার হয়েছে নাবিলা। তুমি একটা গোষ্ঠীস্বার্থের পক্ষে কথা বলছ, এটা ঠিক নয়।’
‘সাগরিকা, সে গোষ্ঠী যদি আমার হয়, তুমি তাদের সাহায্য করবে না?’
‘ডাঃ বেগিন বারাক কি তোমার গোষ্ঠীর নয়? উনি তো আহমদ মুসার পক্ষ নেয়ায় গুলীবিদ্ধ হয়ে কাতরাচ্ছেন ।’
‘কেমন করে গুলীবিদ্ধ হলেন?’ বিস্মিত কন্ঠে প্রশ্ন করল নোয়ান নাবিলা।
‘আহমদ মুসাকে নিয়ে যাবার জন্যে এর আগেও তিনজন এসেছিল।’ বলল সাগরিকা সেন।
‘তারা কোথায়?’
‘তারা ডাঃ আংকেলকে গুলী করলে ডাঃ আংকেলও তাদের গুলী হরে হত্যা করেছেন।’ বলল সাগরিকা সেন।
‘ম্যাডাম নাবিলা, আপনারা কথা বলুন। আমরা যাচ্ছি ভেতরে।’
বলে তিনজন স্টেনগানধারী তাদের স্টেনগান উদ্যত করে ভেতরের দিকে যাবার জন্যে পা বাড়াল।
সংগে সংগে সাগরিকা সেন তাদের সামনে চলে এল এবং দু’হাত প্রসারিত করে তাদের সামনে দাঁড়াল। বলল, ‘আমি যেতে দেব না।’
একজন স্টেনগানধারী ছুটে গিয়ে ধাক্কা দিয়ে সামনে থেকে সরিয়ে দিল সাগরিকা সেনকে।
সাগরিকা সেন ছিটকে পাশে পড়ে গেল। দেয়ালের সাথে ঠুকে গেল তার মাথা।
সংগে সংগে আহমদ মুসা বেরিয়ে এল আড়াল থেকে। হাতে উদ্যত কারবাইন। স্টেনগানধারী তিনজনের দিকে তাক করা।
আহমদ মুসাকে দেখেই ওরা তাদের স্টেনগানের নল ঘুরাতে গেল আহমদ মুসার দিকে। শক্ত কন্ঠে নির্দেশ দিল আহমদ মুসা, ‘স্টেনগান তোমরা ফেলে দাও, তা না হলে….’
আহমদ মুসা কথা শেষ করতে পরলো। ওদের স্টেনগানের নল শা তরে ঘুরল তার দিকে। আহমদ মুুসার তর্জ্জনি ট্রিগারেই ছিল। কথা বন্ধ করে আহমদ মুসা ট্রিগার চেপে কারবাইনটা ঘুরিয়ে নিল ওদের তিনজনের উপর দিয়ে। এক ঝাঁক গুলী ওদরে ঝাঁঝরা করে দিল। পড়ে গেল তিনটি লাশ করিডোরের উপর।
আহমদ মুসা একহাতে তার কারবাইন ধরে রেখে অন্য হাত দিয়ে টেনে তুলল সাগরিকা সেনকে।
উঠে দাঁড়াল সাগরিকা সেন।
এ সময় নোযান নাবিলার কন্ঠ শোনা গেল। সে চিত্কার করে বলছে, ‘তোমরা এদিকে এস। আমাদের লোকরা গুলী খেয়েছে।’
সাগরিকা সেনের কপালের একটা পাশ থেঁতলে গিয়েছিল। রক্ত বেরুচ্ছে সেখান থেকে। আহমদ মুসা পকেট থেকে রুমাল বের করে সাগরিকা সেনের ক্ষতের উপর চাপা দিয়ে বলল, ‘রুমালটা চেপে ধরে থাকুন। রক্ত বন্ধ হয়ে যাবে।’
‘এ সামান্য ব্যাপার। ভাববেন না আপনি। দিকে দেখুন। নাবিলা ওদের রোকদের ডেকেছে।’
‘ওদিকটা আমি দেখছি।’
বলে আহমদ মুসা একটা টেলিফোন নাম্বারের উল্লেখ করে বলল, ‘এটা এফবিআই প্রদান জর্জ আব্রাহাম জনসনের টেলিফোন। আপনি এই ক্লিনিকের ঠিকানা দিয়ে এখানে যা ঘটছে তাকে বলুন।’
‘তাতে আপনার কোন বিপদ হবে না তো?’ উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল সাগরিকা সেন।
‘না সে রকম কোনা ভয় নেই।’ আহমদ মুসা বলল।
কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছিল সাগরিকা সেন, এমন সময় করিডোরের সামনে থেকে গুলীবৃষ্টির শব্দ এলা। কয়েকটা গুলী তাদের সামনে এসেও পড়ল।
আহমদ মুসা দ্রুত যে দরজার আড়াল থেকে বেরিয়ে এসেছিল। এক দৌড়ে সাগরিকা সেনকে টেনে নিয়েয সে দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল।
অব্যাহতভাবে চলছে গুলী। এবং গুলীর শব্দ দ্রুত নিকটবর্তী হচ্ছে। তার মানে ওরা গুলী রতে করতে এগিগেয় আসছে।
আহমদ মুসা সাগরিকা সেনকে ঘরের ভেতর দিকে ঠেলে দিয়েই দেয়ালের আড়াল নিয়ে দরজায় এসে দাঁড়াল।
ওরা গুলীর দেয়াল সৃষ্টি করে এগিয়ে আছে। এখনও কোন গুলী দরজার লক্ষ্যে আসেনি। তার মানে দরজা এখনও ওরা খেয়াল করেনি।
আহমদ মুসা মনে করল, এটাই সুযোগ ওদের পাল্টা আক্রমনের। দরজা একবার ওরা দেখতে পেলে দরজা হবে তখন বড় টার্গেট। সে অব্থায় সরাসরি আত্রমন কঠিন হবে।
এই চিন্তার সাথে সাথে আহদ মুসা তার অটোমেটিক কারবাইনের নল দরজার কিনারে নিয়ে এসে ট্রিগারে আঙুল চেপে এক ঝটকায় মুখটা বাইরে নিয়ে এল। কারবাইন ধরা দু’হাত বাইরে এসছে আগেই কারবাইনের অবিরাম গুলী বৃষ্টির সাথে সাথে।
ওরা চারজন এগিয়ে আসছিল করিডোর ধরে। ওরা গুলীবৃষ্টি করছির করিডোর বরাবর। আহমদ মুসাকে যখন ওরা দেখতে পেল, তখন আহমদ মুসার কারবাইনের গুলীর ঝাঁক এসে তাদের ঘিরে ধরেছে। তারা তাদের স্টেনগানের নল ঘুরাবার আর সুযোগ পেল না। গুলীতে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া দেহ নিয়ে তারা লুটিয়ে পড়ল করিডোরে।
আহমদ মুসা কিরিডোরে বেরিয়ে এল।
গুলী করতে করতে আরও কিছুটা সামনে এগুলো। দেখল করিডোরে আর কেউ নেই। আহমদ মুসা উঁকি দিয়ে দেখল, করিডোরের সামনে ডাক্তারখানার গা ঘেঁষে যে গাড়িটা দাঁড়িয়েছিল তার আড়াল থেকে বেরিয়ে নোয়ান নাবিলা দ্রুত সরে গেল চত্বরের প্রান্তের দিকে।
সাগরিকা সেনও বেরিয়ে এসেছে করিডোরে। ভয় ও উদ্বেগে তার মুখ পাংশূ হয়ে উঠেছে।
‘মিস সেন, নোয়ান নাবিলা ওদিকে আছে। আপনি বরং তার কাছে যান। ওকান থেকে আপনি বাড়িতে ফিরে যাবেন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আর আপনি?’
‘আমার কাছে আছে তিনটি কারবাইন। আরও সাতটি স্টেনগান ঐ দেখুন পড়ে আছে। এগুলোতে গুলী থাকা পর্যন্ত আমি আত্মরক্ষা করব।’
‘তারপর?’
‘গুলী যখন থাকবে না, তখন আমার প্রতিরোধের দায়িত্বও থাকবে না। তখন আল্লাহর যা ইচ্ছা তা হবে।’
‘ওরা আপনাকে হত্যা করতে পারে, ধরে নিয়েও যেতে পারে।’
‘ও দু’টির কোনটিতেই তখন আমা আপত্তি থাকবে না।’
‘মিঃ আহমদ মুসা, আপনি কি মানুষ! মানুষ কেমন করে নিজের সম্পর্কে এম নির্বিকার হতে পারে? আপনার কথায় মনে হচ্ছে মৃত্যুটা পুতুল খেলার চেয়ে বেশী কিছু নয়।’
ববলে একটু থেমে আবার বলে উঠল, ‘আমি যাচ্ছি না।’ গম্ভীর ভারি কন্ঠ সাগরিকা সেনের।
ঠিক এই সময় বাইরে থেকে একজন লোক চিত্কার করে বলে উঠল, ‘আহমদ মুসা, বাড়িটা আমরা ঘিরে রেখেছি। তুমি পালাতে পারবে না। আমাদের আরও লোক আসছে। দরকার পড়লে বাড়িড়র সব ইট খুলে হলেও আমরা তোমাকে ধরব। হয় তুমি মরবে, না হয় ধরা পড়বে। এ দু’এর কোন বিকল্প নেই।’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, মিস সেন আপনি না গেলে ঐ দুই খারাপ পরিনিতির যে কোন একটা আপনাকে দেখতে হবে।’
‘আমি টেলিফোনটা করে আসি, তারপর জবাব দেব।’
বলে সাগরিকা সেন ক্লিনিকের অফিসের দিকে ্এগুলো।
টেলিফোন করে ফিরে এল সাগরিকা সেন। বলল, ‘মি: জর্জ আব্রাহামকে পেয়েছি। খবরটা মনে হয় তার হজম করতে সময় লেগেছে।কারণ, খবর শুনে মুহূর্তকাল উনি কথা বলতে পারেননি। তারপর উনি দ্রুত কন্ঠে বললেন, ‘আহমদ মুসা ভাল আছে তো? তাকে কিছুক্ষন আত্মরক্ষা করতে বলুন।’ বলেই টেলিফোন রেখে দিয়েছেন।’
‘জানতাম উনি এই কথাই বলবেন।’
‘কিছুক্ষনের কথা বললেন কেন?’
‘দেখা যাক মিস সেন, তার কিছুক্ষনের অর্থ কি?’
‘এদের ৭ জন লোক নিহত হবার পর মনে হয় এদের আর তেমন বেশী লোক এখানে নেই। তাই বেশী সংখ্যায় লোক আনাচ্ছে। আমরা এখন বেরিয়ে যেতে পারি না ওদের লোক আসার আগে?
‘প্রথমত আমরা জানি না ওদের লোক আছে কি নেই। সুতরাং নিশ্চিত না হয়ে পা বাড়ানো মুশকিল। দ্বিতীয়ত আমরা ডাঃ বেগিন বারাককে এভাবে ফেলে রেখে যেতে পারি না।’ বল দৃঢ় কন্ঠে আহমদ মুসা।
কথা শেষ করে মুহূর্তকাল থেমেই আবার বলল, ‘মিস সেন, আপনি গিয়ে একটু ডাঃ বারাকের খবর নিয়ে আসুন। এদিকের খবরও বলুন।’
‘ঠিক আছে।’
বলে সাগরিকা সেন চলল অপারেশন থিয়েটারের দিকে।
ফিরে এল অল্পক্ষন পরেই।
এল দৌড়াতে দৌড়াতে। বলল, ‘মি: আহমদ মুসা, ওরা বিভিন্ন দরজা জানালা ভাঙার চেষ্টা শুরু করেছে।’
‘টের পেয়েছি মিস সেন। ওরা করিডোরের মুখেও পজিশন নিয়েছে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তাহলে?’ পাংশু মুখে বলল সাগরিকা সেন।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘স্টেনগান চালাতে পারবেন?’
‘পারব। কিন্তু মানুষকে গুলী করতে পারব না।’
‘মানুষ মারতে হবে না। এই করিডোরে স্টেনগান নিয়ে বসে থাকবেন। ওদের এগুনোর লক্ষণ পেলে শুধু অবিরাম গুলী চালিয়ে যাবেন।
তা পারব। কিন্তু আপনি থাকবেন না?’
‘আমাকে দরজা-জানালা পাহারা দিতে হবে। প্রয়োজনে আমি আপনাকেও সহযোগিতা করতে পারবো।’
‘আপনাকে শুধু দেখতে পেলেই চলবে।’
‘দেখতে না পেলে?’
‘ভয় করবে।’
‘ভয় নেই। ওরা গুলী না করে সামনে এগুবে না। ওরা গুলী শুরু করলে আপনিও গুলী শুরু করবেন।’
‘বুঝেছি।’
‘কিন্তু এইটুকুই সব কথা নয়। ওরা কোন দরজা বা জানালা খুলতে পারলে এবং সেদিকে আমাকে ব্যস্ত দেখলে কোন প্রকার গুলী না করে গেরিলা কায়দায় প্রবেশ করার চেষ্টা করবে। এজন্যে করিডোরের দিকে আপনার তীক্ষ দৃষ্টি রাখতে হবে।’
‘আমি আপ্রাণ চেষ্টা করব।’ বলর সাগরিকা সেন।
‘আপ্রাণ চেষ্টা করার কথা যদি বলেন, তাহলে কিন্তু আপনাকে পাহারায় বসাব না। আপনার কোন ক্ষতি হোক তা আমি চাই না। আমার সাথে ওদের শত্রুতা, আপনার সাথে নয়। আমি যে কোন পরিনতির জন্যে প্রস্তুত আছি। জীবন-মৃত্যুর এই খেলায় আপনি জড়িয়ে পড়ুন, তা আমি চাইতে পারি না।’
‘আমি আপনার কেউ নই ধরেই তো এমন ভাবে বলছেন?/’
‘না, ‘কেউ’ ধরেই বলছি।’
আহমদ মুসার মুখে এই কথা শুনেই সাগরিকা সেন দু’চোখে রাজ্যের তৃষ্ঞা নিয়ে দু’চোখ তুলে ধরল আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসা তার দু’চোখ নামিয়ে নিল। দুই ঠোঁটে তার মিষ্টি হাসি ফুটিয়ে তুলল। বলল, ‘বড় ভাই বেঁচে থাকতে ছোট বোনের গায়ে কোন আঁচড় লাগতে দিতে পারে না।’
হঠাৎ আছড়ে পড়লে যে অবস্থা হয়, সেই রকম মুখের অবস্থা হলো সাগরিকা সেনের। কথা বলতে পারলো না। খুশী হয়নি এমন একটা অস্বস্তি তার চোখে মুখে।
ঠিক এই সময় চারদিক থেকে পুলিশের গাড়ির একটানা শব্দ ভেসে এল।
‘সাগরিকা সেন, জর্জ আব্রাহামের লোকরা এসে গেছে।
সাগরিকা সেনের ম্লান মুখে কোন পরিবর্তন এল না। অনেকটা স্বগতোক্তির মত বলল, ‘কিন্তু পুলিশের সাথে তো ওদের সখ্যতা।’
‘না সাগরিকা সেদিন চলে গেছে।’ বলর আহহমদ মুসা।
বাইরে করিডোরের মুখের দিকে গাড়ি স্টার্টের শব্দ পেল আহমদ মুসা।
‘সাগরিকা ওরা পালাচ্ছে, এস দেখি।’
বলে সাগরিকার হাত ধরে টেনে নিয়ে চলল করিডোরের মুখের দিকে।
তারা দেখল, গাড়িগুলো স্টার্ট নিয়ে চলে যাচ্ছে।
‘অভিনন্দন সাগরিকা তোমাকে, তোমার এক টেলিফোনে কি কাজ হয়েছে দেখ।’
‘টেলিফোনটা তো প্রকৃতপক্ষে আমার নয়, আপনার ছিল।’ ভাবলেশহীন নির্বিকার কন্ঠে জবাব দিল সাগরিকা সেন।
‘কথা আমার ছিল, কিন্তু টেলিফোন করেছ তুমি।’
কিছু বলতে যাচ্ছিল সাগরিকা সেন। এ সময় বাইরে প্রচন্ড গোলাগুলী শুরু হয়ে গেগল।
‘ওদের পালাতে পুলি বাধা দিচ্ছে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘পুলিশ কি ওদের এ্যারেস্ট করবে বলে মনে করেন?’ কিছুটা উত্গ্রীব কন্ঠে বলল সাগরিকা সেন।
‘আমার তাই মনে হয়।’ বলর আহমদ মুসা।
কথা শেষ কেরেই আকাশে হেলিকপ্টারের শব্দে উত্কর্ণ হয়ে উঠল আহমদ মুসা।
হেলিকপ্টারের শব্দ ক্রমেই নিকটবর্তী হতে লাগল। একসময় তা মাথার উপরে চলে এল। শব্দটা নেমে এল ক্লিনিকের চত্বরে।
‘সাগরিকা আমার অনুমান মিথ্যা না হলে এফবিআই প্রধান জর্জ আব্রাহাম জনসন আসছেন এ হেলিকপ্টারে।’
‘উনি নিজে আসছেন?’ কন্ঠে বিস্ময় প্রকাশ করল সাগরিকা সেন।
‘আমি মনে করি তাই।’
সাগরকা সেনের মুখে ম্লান হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘আপনি যে আহমদ মুসা ভুলে গিয়েছিলাম। তার জন্যে তো জর্জ আব্রাহামই আসবেন।’
সাগরিকা সেনর কথার ঢংয়ে আহমদ মুসার মুখ একটু ম্লান হলো। বলল, ‘সাগরিকা তুমি আমার প্রতি সন্তষ্ট নও।’
‘আমি খুবই সামান্য একজন মেয়ে।’
সাগরিকার এই কথার সাথে সাথেই বাইরে একটা কন্ঠ শোনা গেল, ‘আহমদ মুসা কি ভেতরে?’
‘আমরা তাই মনে করছি। ওরা তাই বলেছে।’ একটা বিনীত কন্ঠ বলে উঠল।
আহমদ মুসা বুঝল আগের কন্ঠ জর্জ আব্রাহাম জনসনের এবং েশেষের কন্ঠটি কোন পুলিশ অফিসারের।
‘চল বেকার ভেতরে যাই। তোমরাও এস।’ বাইরে থেকে একই কন্ঠে ভেসে এল।
‘জর্জ আব্রাহাম ভেতরে আসছেন। সংগে পুলিশ প্রধান মি: বেকারও আছেন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘মি: আহমদ মুসা, দেখবেন আমাদের যেন গুলী করবেন না।’ জর্জ আব্রাহামের গলা শোনা গেল।
ওরা ভেতরে ঢুকছে। করিডোরে ঢুকে পড়েছে।
আহমদ মা ও সাগরিকা সেন দু’জনেই সামনে এগুলো।
করিডোরের যেখানে লাশগুলো পড়েছিল সেখানে উভয় পক্ষ মুখোমুখি হলো।
জর্জ আব্রাহাম জনসন ছুটে এসে আহমদ মুসাকে জড়িয়ে ধরল। বলল, ‘স্বয়ং প্রেসিডেন্টও আপনার জন্যে উদ্বিগ্ন ছিলেন। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে, আপনাকে সুস্থ পেয়েছি।’
বলে জর্জ আব্রাহাম জনসন ফেডারেল পুলিশ প্রধান বেকারের সাথে আহমদ মুসার পরিচয় করিয়ে দিল।
আহমদ মুসা তার সাথে হ্যান্ড শেক করল।
পরে আহমদ মুসা সাগরিকা সেনের সাথে তাদের পরিচয় করিয়ে দিল। বলল, ‘ইনি বিখ্যাত শিব শংকর সেনের একমাত্র মেয়ে সাগরিকা সেন।আমাকে ওয়াশিংটন-আনাপোলিশ সড়ক থেকে মুমূর্ষু অবস্থায় তুলে এনে অত্যন্ত গোপনে এই ক্লিনিকে ভর্তি করে দিয়েছিলেন। তারপর থেকে তিনিই আমার তত্ত্বাবধান করছেন।’
‘মা, তুমিই আমার কাছে টেলিফোন করেছিলে তাই না?’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন সাগরিকা সেনকে লক্ষ্য করে।
‘জি, মিঃ আহমদ মুসাই আমাকে টেলিফোন করতে বলেছিলেন।’
‘তোমাকে অনেক ধন্যবাদ মা।’
বলে জর্জ আব্রাহাম জনসন আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোমাকে সেদিন সাগরিকা সেন ওয়াশিংটন-আনাপোলিশ সড়ক থেকে তুলে আনার পর পরই তোমার সন্ধানে আমি ও মিস সারা জেফারসন সেখানে পৌঁছেছিলাম।’
‘আপনারা? কিভাবে? কি ঘটনা?’ বিস্মিতত কন্ঠে প্রশ্ন করল আহমদ মুসা।
জর্জ আব্রাহাম জনসন আহমদ মুসাকে বাল্টিমোরে খোঁজ করে ফেরার পথে সাগরিকাদের ব্রাইট ফিল্ড কম্পিউটার কমপ্লেক্সে এসে কিভাবে শিকারী কুকুরের দ্বারা আহমদ মুসার খোঁজ পেল, কিভাবে বন্ধীখানায় পৌঁছল, কিভাবে বন্দীখানা থেকে রক্তের দাগ ধরে কুকুরের পেছনে পেছনে রাস্তার সেই স্থানে এসে পৌঁছল সব জানিয়ে বলল, ‘আমরা সেদিন ভীষণ উদ্বেগ নিয়ে ওয়াশিংটন ফিরি। মিস সারা জেফারসন তো অসুস্থ হযে পড়েন। উনি এখনও হাসপাতালে।’
‘মিস সারা জেফারসন হাসপাতালে? কেমন আছেন তিনি?’ আহমদ মুসার কন্ঠে উদ্বেগ।
‘তার অসুখের কারণই হলো, তার বদ্ধমূল ধারণা আপনার কিছূ ঘটেছে। তাকে কিছুতেই স্বাভাবিক চিন্তায় ফিরিয়ে আনা যাচ্ছে না। আমি আসার সময় টেরিফোনে আপনার খবর তাকে দিয়ে এসেছি।’ বলল আব্রাহাম জনসন।
আহমদ মুসা প্রসংগটা এড়িয়ে বলল, ‘আসুন, এই ক্লিনিকের মালিক ও ডাক্তার আমাকে রক্ষা করতে গিয়ে গুলীবিদ্ধ হয়েছেন। তাড়াতাড়ি তার ব্যবস্থা হওয়া দরকার।’
‘ভেতরে কয়টা লাশ আছে? আাপনাদের আর কোন ক্ষতি হয়নি তো? বলর ফেডারেল পুলিশ প্রধান বেকার।
‘আল্লাহর অশেষ দয়া। আর কোন ক্ষতি আমাদের হয়নি। ভেতরে ওদের দশটা লাশ রয়েছে।’
পুলিশ প্রধান পাশে দাঁড়ানো পুলিশ অফিসারকে লাশগুলো সরিয়ে নেবার নির্দেশ দিল।
অপারেশন থিয়েটারের দিকে হাঁটতে তখন শুরু করেছে আহমদ মুসা।
সবাই চলল আহমদ মুসার পেছনে পেছনে।
জর্জ আব্রাহাম জনসন এবং পুলিশ প্রধান বেকার দুজনেই ডা: বেগিন বারাককে চিনতে পারল। বছর খানেক আগে ডা: বারাক আমেরিকান পিস এ্যাওয়ার্ড পায়। সেই উপলক্ষে তাদের সাথে ডা: বারাকের পরিচয় হয়।
জর্জ আব্রাহাম ডাঃ বারাককে অভিনন্দন জানাল আহমদ মুসার পপ্রতি তার সেবা ও সাহসী পদক্ষেপের জন্যে। তারপর একজন পুলিশ অফিসারকে নির্দেশ দিল, ‘এ্যাম্বুলেনেসর লোকজনকে ডাকুন। ওনাকে এখুনি হাসপাতালে নিতে হবে।’
পুলিশ অফিসার দ্রুত বেরিয়ে গেল।
‘ধন্যবাদ মিঃ জর্জ ও মিঃ বেকার, আহমদ মুসাকে সেবা করার সুযোগ পেয়ে আমি ধণ্য হয়েছি। তিনি যে অক্ষত আছেন সে জন্যে ঈশ্বরের শুকরিয়া আদায় করছি।’ বলল ডা: বেগিন বারাক।
‘ডাঃ বারাক আপনার সাথে আমরাও ঈশ্বরের কৃতজ্ঞতা আদায় করছি। আমরা এবং স্বয়ং প্রেসিডেন্টও উদ্বিগ্ন ছিলেন। আমরা মিস সেনেরও শুকরিয়া আদায় করছি যে তিনি আপনার মত একজন উদার ও নিরাপদ ডাক্তারের কাছে তাকে চিকিত্সার জন্যে নিয়ে এসেছিলেন।’ জর্জ আব্রাহাম জনসন বলল।
এ্যাম্বুলেন্সের লোকজন নিয়ে পুলিশ অফিসারটি এসে পৌঁছল।
সবাই ধরাধরি করে ডাঃ বেগিন বারাককে স্ট্রেচারে তুলল।
স্ট্রেচারে শোয়ার পর যখন এ্যাম্বুলেন্সেন স্টেট্রচারটা তুলে নিচ্ছে, তখন ডা: বেগিন বারাক আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘মিঃ আহমদ মুসা, আবার কবে দেখা হবে?’
‘আপনি সুস্থ হয়ে উঠুন। আমি আশা করছি, আপনার সাথে সাক্ষাত না করে আমি আমেরিকা থেকে যাব না।’
‘ধন্যবাদ মি: আহমদ মুসা।’
‘ধন্যবাদ ডা: বারাক।’
ডাঃ বারাককে নিয়ে যাবার পর জর্জ আব্রাহাম জনসন বলল, ‘চলুন আমরাও চলি।’
সবাই ক্লিনিক থেকে বেরিয়ে আসার জন্যে হাঁটা শুরু করল।
আহমদ মুসার কক্ষ বরাবর এল সাগরিকা সেন আহমদ মুসার কক্ষে ঢুকে গেল।
ঘরে ঢুকে সাগরিকা সেন আহমদ মুসার কাপড় চোপড় ও ব্যবহার্য জিনিস ব্যাগে পুরল। এগুলো সাগরিকাই কিনে দিয়েছিল আহমদ মুসাকে।
ব্যাগটি নিয়ে সাগরিকা সেন যখন ক্লিনিকের বাইরে বেরিয়ে এল, তখন দেখল হেলিকপ্টারের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সবাই ক্লিনিকের দকে তাকিয়ে আছে। সাগরিকা সেন বুঝল, সবাই তারই জন্যে অপেক্ষা করছে।
সাগরিকা সেন সেখানে পৌঁছলে জর্জ আব্রাহাম জনসন বলে উঠল, ‘মা সাগরিকা আমাদের এখন যেতে হয়। আহমদ মুসা তোমার তত্বাবধানে ছিল। অনুমতি দাও, তাকে নিয়ে যেতে চাই মা।’
মুখ ম্লান হয়ে গেল সাগরিকা সেনের।
এগুলো সে আহমদ মুসার দিকে। হাতের ব্যাগটি আহমদ মুসার দিকে তুলে ধরে বলল, ‘দাদা নাও তোমার কাপড় চোপড়।’
আহমদ মুসা ব্যাগটি সাগরিকার হাত থেকে নিয়ে নিল।
ব্যাগটি আহমদ মুসা নিলে সাগরিকা সেন আহমদ মুসার পায়ের কাছে বসে পড়ল। দুহাত দিয়ে বাহমদ মুসার পা স্পর্শ করে প্রণাম করে উঠে দাঁড়াল। তা মুখ নিচু।
‘বিদায়টা খুবই আকস্মিক হয়ে গেল সাগরিকা। তুমি আমাকে গুডবাই বলবে না?’ আহমদ মুসা হাসার চেষ্টা করল।
সাগরিকা মুখ তুলল।
অশ্রুতে তার দুই গন্ড ভেসে যাচ্ছে।
তার দুই ঠোঁট কাঁপল। ফাঁক হলো। বলল সে, ‘গুডবাই নয়, তুমি এস দাদা।’ অশ্রুভেজা কম্পিত কন্ঠস্বর সাগরিকা সেনের।
সাগরিকা সেনের অশ্রু আহমদ মুসাকে বিব্রত করে তুলল। একটা আবেগগ এসে তাকেও ঘিরে ধরল। বলল, ‘ধন্যবাদ সাগরিকা। তোমাদের ওয়াশিংটন এবং এখানকার বাড়ি আমি চিনি। আমিই তোমাকে খুঁজে নেব। তুমি ঠিকই বলেছ। তোমার ভাই সত্যি বিদায় নিচ্ছে না।’ ভারী কন্ঠস্বর আহমদ মুসার।
‘ধন্যবাদ দাদা।’ অশ্রুভেজা কন্ঠে বলল সাগরিকা সেন।
আহমদ মুসা উঠে গেল হেলিকপ্টারে।
একজন পুলিশ অফিসারের দিকে তাকিয়ে পুলিশ প্রধান বেকার বলল, ‘ক’জন পুলিশ সাথে নিয়ে তুমি সাগরিকা সেনকে তার বাড়িতে পৌঁছে দাও।’
‘আমার গাড়ি আছে।’ বলল সাগরিকা সেন।
‘তাহলে ওর গাড়ির সাথে সাথে তোমরা ওর বাড়ি পর্যন্ত যাবে।’ পুলিশ প্রধান বেবকার বলল।
জর্জ আব্রাহাম জনসন, বেকার এবং সাথের অন্যান্য সবাই হেলিকপ্টারে উঠল।
হেলিকপ্টারে উঠতে উঠতে পুলিশ প্রধান বেকার চিত্কার করে নিচে দাঁড়ানো তার পুলিশ অফিসারকে বলল, ‘ওদের অস্ত্রধারী যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে, তাদের সাবধানে রাখবে। করণীয় সম্পর্কে আমি জানাচ্ছি।’
হেলিকপ্টারে সবাই উঠে গেল।
স্টার্ট নিল হেলিকপ্টার।

‘আমাদের যে পরিনতি হয়, হবে। আমরা প্রতিশোধ নিতে চাই, প্রতিশোধ।’ বোমা বিস্ফোরনের মত গর্জন করে উঠল জেনারেল শ্যারন।
‘কিন্তু সে প্রতিশোধটা কি? আমাদের লোকরা যেখানে একা অক্যাত ক্লিনিকে অরক্ষিত অবস্থায় পেয়েও আহমদ মুসাকে পাকড়াও করতে পারলো, সেখানে আমাদের লোকেরা কি প্রতিশোধ নেবে?’ ক্ষুদ্ধ কন্ঠে বলল ডেবিড উইলিয়াম জোনস।
‘ঠিক বলেছেন মিঃ জোনস। বিস্ময়ের ব্যাপার, অসুস্থ আহমদ মুসাকে অরক্ষিত পেয়েও আমাদের লোকরা তাকে পাকড়াও করতে পারলো না। শুসলাম আমাদের লোকরা সেখানে পৌছার প্রায় ৪০ মিনিট পরে পুলিশ পৌঁছেছে। এই চল্লিশ মিনিটে আমাদের এক ডজন লাক এক আহমদ মুসার সাথে পেরে উঠল না। মাঝখান থেকে লোক খোয়াল দশজন।’ বলল জ্ঞাণী গয্গাধর তিলক।
জ্ঞানী গঙ্গাধর তিলক আমেরিকায় ভারতীয় আমেরিকান সোসাইটির যুব উইং এর প্রধান। আমেরিকান ভারতীয়-আমেরিকান ও ইগুদীরা এক সাথে কাজ করার ব্য্যাপারে সে খুব উত্সাহী। তার মতে, প্রতিভাবান ও বুদ্ধিমান এই দুই জাতি যদি আমেরিকায় এক সাথে কাজ করে, তাহলে আমেরিকার ভবিষ্যতের তারাই হবে নিয়ন্তা।
জ্ঞানী গঙ্গাধর তিলক থামতেই ডেভিড উইলিয়াম জোনস বলে উঠল, ‘এক ডজন লোক পেলেন কোথায়। সাতজনের মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর আরও দুই ডজন লোক পাঠানো হয়েছিল। তারা গিয়ে সবাই বীরদর্পে বন্দী হয়েছে।, এক পয়সার উপকার করতে পারেনি।’
‘বন্দী কি হয়েছে মাত্র ২৪জন? টিভি বলল বন্দীর সংখ্যা ঊনত্রিশ জন?’ বলল জ্ঞানী গঙ্গাধর তিলক।
‘ঊনত্রিশ জনই ঠিক। আগের ৫জন, পরে পাঠানো ২৪জন, এই মোট ঊনত্রিশ জন। ডেভিড উইলিয়াম জোনস বলল।
‘আফসোস, ঊনত্রিশ জন লোক তো বিল্ডি-এর ইট খুলেও ক্লিনিকে ঢুকতে পারতো। এই লজ্জা আমরা কোথায় রাখব, বলুন?’ বলল জ্ঞানী গঙ্গাধর তিলক।
জেনারেল শ্যারনের মুখ লাল হয়ে উঠেছিল অস্বস্তি ও অপমানে। বলল, ‘আপনাদের কথা ঠিক। কিন্তু সেই সাথে আপনাদের বিবচার করতে হবে যাকে তারা পাকড়াও করতে গিয়েছিল সে কে? সে এমন একজন লোক যে একা একটা রাস্ট্রের বিরুদ্ধে লড়ে বিজয়ী হয়। যেমন সোভিয়েত ইউনিয়ন। বুদ্ধি ও শক্তি উভয় ক্ষেত্রেই সোভিয়েত ইউনিয়ন তার কাছে পরাজিত হয়েছে। বুদ্ধিতে তার কাছে পরাজিত হওয়ায় সোভিয়েতের শক্তি কাজে লাগেনি। এই ঘটনাই ঘটেছে চীনে, মিন্দানাওয়ে, ইসরাইলে, ককেশাসে, স্পেনে প্রভৃতি স্থানে। সুতরাং আমাদের লেকরা যদি তার কাছে পরজিত হয়ে থাকে, তাহলে সেটা কি খুবই অস্বাভাবিক?’
‘এই যদি ঘটনা হয়, তাহলে তার বিরুদ্ধে আর লড়ছি কেন?/ পারাই যখন যাবে না, তখন লড়ে কি লাভ! তার চেয়ে….।’
জেনারেল শ্যারন কথা বলে উঠায় বাধা পেয়ে জ্ঞানী গঙ্গাধর তিলক থেমে গেল। জেনারেল শ্যারন তখন বলছিল, ‘আমরা লড়ছি আমাদের অস্তিত্বের জন্যে, লড়াইয়ের কোন বিকল্প নেই বলে।’
বলে একটু থামল জেনারেল শ্যারন। সামনের গ্লাস থেকে এক ঢোক মদ গিলে আবার শুরু করল, ‘বিজয় তার বহু একথা ঠিক, কিন্তু আমরাও তাকে পরাজিত করেছি। বহুবার ফাঁদে আটকেছি। সে ফাঁদ কেটে বেরিয়ে গেছে একথাও ঠিক, যেমন এবার গেল। কিন্তু সব সময় যােেবে, তা ঠিক নয়। সুতরাং লড়াই আমাদের চালিয়ে যেতে হবে।’
‘এখন আমরা কি করব, সেটা বলুন।’ বলল জ্ঞহানী গঙ্গাধর তিলক।
‘কিছূ করার জন্যে আমি একটা খবরের অপেক্ষা করছি।’ জেনারেল শ্যারন বলল।
‘কি খবর? উদগ্রীব কন্ঠে জিজ্ঞেস করল ডেভিড উইলিয়াম জোনস।
‘খবর পেয়েছি, সারা জেফারসন জর্জ ওয়াশিংটন স্টেট হাসপাতালে চিকিত্সাধীন রয়েছে। আমি লোক পাঠিয়েছিছ বিস্তারিত জানার জন্যে যে, কোন ওয়ার্ডে কোথায় কোন ডাক্তারের অধীনে চিকিতত্সাধীন রয়েছে। ডাক্তারের ডিউটি আওয়ার কিরকম, কোন সময় তাদের ডিউটি চেঞ্জ হয়। যেখানে সারা জেফারসন ভর্তি রয়েছে, সেখান থেকে বের হবার সহজ ও সংক্ষিপ্ত পথ কি?’ বলল জেনারেল শ্যারন।
‘তারপর?’ জ্ঞানী গঙ্গাধর তিলক বলল।
‘ঐ হাসপাতালের ডাক্তারের কয়েকটা এ্যাপ্রোন ও নার্সের পোমাক যোগাড় করতে বলেছি।’ বলল জেনারেল শ্যারন।
‘তারপর?’ ডেভিড উইলিয়াম জোনস বলল।
‘গীর্জার ফাদারের একসেট পোশাকও আনিয়ে রেখেছি।’ বলল জেনারেল শ্যারন।
‘আসল কথা বলুন, এসব দিয়ে কি হবে?’ বলল জ্ঞানী গঙ্গাধর তিলক।
‘বলা এখানেই শেষ। আর বলব না।, দেখাব।’
‘কি দেখাবেন?’ বলল ডেভিড উইলিয়াম জোনস।
‘যখন দেখাব, ততখন দেখেবেন।’ জেনারেল শ্যারন বলল।
তার কথা শেষ হতেই তার হাতের মোবাইল বেজে উঠল।
টেলিফোন ধরল জেনারেল শ্যারন।
ওপারের ‘হ্যালো’ শুনেই জেনারেল শ্যারন বলল, ‘সব তথ্য পেয়েছ এবং যা যোগাড় করার তা করেছ?’
‘সব জোগাড় হয়েছে।’ ওপার থেকে বলল।
জনারেল শ্যারন হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এখন সকাল ৯টা। তুমি তাড়াতাড়ি চলে এস। আমরা দশটায বের হতে চাই। ১২টায় ডিউটি বদলের অনেক আগে সব কাজ শেষ করতে চাই।’
‘আপনার ওখানে সব রেডি?’ বলল ওপার থেকে।
‘ওসব চিন্তা করো না। সবাই রেডি হয়ে আছে। তুমি এলই যাত্রা শুরু করব।’ জেনাারেল শ্যারন বলল।
‘ওকে। আমি আসছি।’
‘এস। বাই।’
বলে টেলিফোন অফ করে দিল জেনারেল শ্যারন।
‘অপেক্ষার খবর তাহলে পেয়ে গেলেন?’ বলল জ্ঞানী গঙ্গাধর তিলক।
‘হ্যাঁ, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ।’
বলে জেনারেল শ্যারন উঠে দাঁড়াল।

তখন বেলা দশটা পয়তাল্লিশ মিনিট।
অভিজাত জর্জ ওয়াশিংটন স্টেট হাসপাতালের ৩৩ নাম্বার কেবিন ওয়ার্ডের ডক্টর’স লাউঞ্জ থেকে তিনজন ডাক্তার বেরিয়ে এল। অল্প দূরে দাঁড়ানো একজন নার্স তাদের সাথে এসে যোগ দিল।
তারা গিয়ে প্রবেশ করল ৩৩ নাম্বার কেবিন ওয়ার্ডের অফিসে।
অফিসটি কেবিন ওয়ার্ডের প্রবেশ মুখেই। এর সামনে দিয়ে একটা করিডোর দরজা পেরিয়ে ভেতরে চলে গেছে। এই করিডোরের দু’পাশে কেবিন।
কেবিন ওয়ার্ডের অফিসে তখন বসেছিল শুধু হেড নার্স। ডাক্তারের আসন খালি।
একজন নার্সসহ তিনজন ডাক্তার অফিসে প্রবেশ করতেই হেড নার্স উঠে দাঁড়াল। বলল ডাক্তারকে লক্ষ্য করে, ‘গুড মর্নিং স্যার। কিছু প্রযোজন? আম কি সাহায্য করেতে পারি?’
তিনজন ডাক্তারের দুজন এবং নার্সটি সামনের কাঁচের দেয়াল আড়াল করে দাঁড়িয়েছে।
তৃতীয় ডাক্তার অফিসের হেড নার্সের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল। হেড নার্সের প্রশ্নের জবাবে সে বলল, ‘এ্যাটেন্ডিং ডাক্তার স্টিফেন কোথায়?’
‘তাকে দরকার? উনি গিয়েছেন ২১ নাম্বার কেবিনে। রুটিন…’
কথা শেষ করতে ারল না হেড নার্স। তার সামনে দাঁড়ানো ডাক্তার একটা ক্লোরোফরম ভেজা রুমাল চেপে ধরল হেড নার্সের নাকে।
মাত্র কয়েক সেকেন্ড।
নার্সের সংজ্ঞাহীন দেহ পড়ে যাচ্ছিল। ডাক্তার দু’হাতে তুলে নিল তার দেহ। তারপর দেহ নিয়ে সে প্রবেশ করল এটাচড বাথে। বাথরুমে দেহটা রেখে বাইরে বেরিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল ডাক্তার।
ডাক্তারদের সাথে আসা নার্স ইতিমধ্যেই হেড নার্সের চেয়ারে বসেছে।
ডাক্তার বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে বলল, ‘মিস নোয়ান নাবিলা, আমরা সারা জেফারসনকে নিয়ে বাইরে বেরুনো পর্যন্ত এই অফিস আপনাকে দখলে রাখতে হবে।’
এই সময় একজন ফাদার প্রবেশ করল অফিসে। বলল, ”আইজাক, আমি নাবিলার সাথে অফিসে বসছি। আমি একটা প্যাশেন্ট ট্রলি নিয়ে এসেছি। ওটা নিয়ে তোমরা দ্রুত চলে যাও ২১ নাম্বার কেবিনে। একজন আগে যাবে ডাক্তারকে ট্যাকল করার জন্যে। অবশিষ্ট দু’জন যাবে ট্রলি নিয়ে।
ডাক্তার তিনজন বেরিয়ে গেল।
ওরা বেরিয়ে যাবার দু’মিনিট পরেই দুজন লোক এল কেবিনের অফিসে। তারা ডিউটি টেবিলের নার্স অর্থাত্ নোয়ান নাবিলাকে দু’টি কার্ডৃ দেখিয়ে বলল, ‘আমরা এফবিআইেয়ের লোক। এই নিন সারা জেফারসনের রিলিজ অর্ডার। রিলিজ সার্টিফিকেট দিন। আমরা তাকে নিয়ে যাব। গেটে সবাই অপেক্ষা….’
এফবিআই-এর লোকটি কথা শেষ করতে পারল না। ফাদার-এর পোশাক পরা লোকটি পেছন দিক থেকে তার ভারী মেশিন রিভলবারের দুটি ঘা মারলো দুজনের মাথায় পূর্ণ শক্তিতে। দুজনেই টলে উঠে পড়ে গেল মেঝেতে।
সংগে সংগেই চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল নোয়ান নাবিলা। দৌড়ে গিয়ে বাথরুমের দরজা খুলে ফেলল। তারপর দুজন দ্রুত সংজ্ঞাহীন এফবিআই-এর দুজনের দেহ নিয়ে বাথরুমে ঢুকল।
ওদিকে তিনজন যাক্তারের একজন আগেই ঢুকে গিয়েছিল কেবিনে।
গট গট করে হেঁটে সোজা গিয়ে সে ঢোকে ২১ নাম্বার কেবিনে। দেখে, ডাঃ স্টিফেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সারা জেফারসনের কেসকার্ডে কিছু লিখছেন।
পায়ের শব্দ পেয়ে ডাঃ স্টিফেন মুখ তুলল। অপরিচিত একজন ডাক্তারকে তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখে বলল, ‘ডক্টর…. কোন খবর?’
‘হ্যাঁ মিঃ স্টিফেন। ডাঃ এলিস আপনাকে জরুরী কল করেছেন।’
ডাঃ এলিস হাসপাতালের মেডিকেল বিভাগের ডাইরেক্টর।
‘জরূরী কল’-এর কথা শুনেই ডাঃ স্টিফেন তড়িঘড়ি করে সারা জেফারসনের কেসকার্ডটা ঝুলিয়ে রেখে দরজার দিকে হাঁটা শুরু করে বলল, ‘চলি তাহলে।’
ডাঃ স্টিফেন আগন্তুক ডাক্তারকে অতিক্রম করার সাথে সাথেই আগন্তুক ডাক্তার পেছন থেকে অদ্ভুত ক্ষিপ্রতার সাথে বাম হাত দিয়ে ডাঃ স্টিফেনের গলা পেঁচিয়ে ধরল এবং ডান হাত দিয়ে ক্লোরোফরম ভেজা রুমাল ডাঃ স্টিফেনের নাকে চেপে ধরল।
ডাঃ স্টিফেন ছাড়া পাওয়ার জন্যে কিছু সময় ধ্বস্তাধ্বস্তি করল। তারপর ধীরে ধীরে তার শরীর নিস্তেজ হয়ে পড়ল।
আগন্তুক ডাক্তার সংজ্ঞাহীন স্টিফেনের দেহ টেনে নিয়ে এটাচ্ড বাথরুমে রাখল।
বাথরুমের দরজা বন্ধকরেই সে ছুটে এল সারা জেফারসনের কাছে। হাতের ক্লোরোফরম ভেজা রুমালটি এবার সে চেপে ধরল ঘুমন্ত সারা জেফারসনের নাকে।
সারা জেফারসন ঘুম ভেঙে যাওয়ায় চোখ মেলল ও নাক ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু অল্প কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই তারও দেহ নিস্তেজ হয়ে গেল। সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলল সে।
ডাক্তার বেমের অপর দু’জন এসময় ট্রলি নিয়ে সারা জেফারসনের কক্ষে পৌছে গেল।
দ্রুত তিনজন ধরাধরি করে সারা জেফারসনের দেহ ট্রলিতে তুলল এবং একটা সাদা চাদর দিয়ে সারা জেফারসনের আপাদমস্তক ঢেকে দিল।
ওরা বেরিয়ে এল কেবিন থেকে।
এসে পৌঁছল কেবিনের বাইরের করিডোরটিতে।
কেবিন ওয়ার্ডের অফিস অতিক্রম করতেই অফিস থেকে বেরিয়ে এল ফাদার–এর পোশাক পরা লোকটি এবং নার্স-এর পোশাক পরা নোয়ান নাবিলা।
ফাদার হাঁটতে শুরু করল ট্রলির আগে আগে। ট্রলির আগে দুজন ডাক্তার, পেছনে একজন। আর নার্স হাঁঁটছে ট্রলির মাঝ বরাবর।
ডাক্তারবেশী একজন জজ্ঞেস করল ফাদারকে, ‘ডেথ সার্টিফিকেট তৈরী করে নেয়া হয়েছে তো?’
‘হ্যাঁ। ওটা আমার কাছে আছে। আমিই গেটে দেখাব। আমি বলব, আমার একজন আত্মীয়া মারা গেছে। তোমরা লাশ পৌাছাতে আমাকে সাহায্যকরছ।’
তারা এসে পৌঁছল হাসপাতালের ডিপারচার লাউঞ্জে। ডিপারচার লাউঞ্জে বেশ অনেক পুলিশ। লাউঞ্জের ডিপারচার গেটে দুজন গেটরক্ষী ছাড়াও অনেক কজন পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে।
একদম দ্বিধাহীন ভাবে তারা ট্রলি নিয়ে গেটে পৌছল।
‘ফাদার ডেথ সার্টিফিকেট বের কের গেটম্যানের হাতে দিল। বলল, ‘আমার বোন মারা গেছে। আমি একা মানুষ। ওরা আমাকে সহযোগিতা করছেন।’
গেটম্যানটি ডেথ সার্টিফিকেট অন্য গেটম্যানের হাতে দিয়ে বলল, ‘রিলিজ সার্টিফিকেট দিন।’
ফাদার রিলিজ সার্টিফিকেট পকেট থেকে বের করে গেটম্যানের হাতে দিল।
গেটের পুলিশরাও ডেথ ও রিলিজ সার্টিফিকেট দেখল।
একজন গেটম্যান ওকে বলে গেট খুলে দিল।
ট্রলি নিয়ে বের হয়ে এল তারা।
বাইরেই ধীর্ঘ ও প্রশস্ত গাড়ি বারান্দা।
ডিপারচার গেট-সোজা গাড়ি বারান্দায় রাখা আছে তাদের গাড়ি।
গাড়িতে তোলা হয়েছে সারা জেফারসনকে।
গাড়ির পেছনটা লক করেদুজন এগিয়ে যাচ্ছে গাড়ির সামনের দিকে উঠার জন্যে। নোয়ান নাবিলা এবং আরেকজন আগেই গাড়িতে উঠেছে। ফাদারের পোশাকধারী শুধু দাঁড়িয়ে তখনও গড়ি বারান্দায়।
এ সময় অনেক কয়জন পুলিশকে ছুটে আসতে দেখা গেল গাড়ির দিকে।
আসতে আসতে একজন চিত্কার করে বলল, ‘একটু দাঁড়ান ফাদার।’
ওরা এল।
চারজন এসে ফাদারের সামনে দাঁড়াল এবং আরও দু’জন গিয়ে গাড়ির সামনে দাঁড়াল গাড়ির গতিরোধ করে।
একজন পুলিশ ফাদারকে বলল, ‘গাড়ি খুলুন, আমরা লাশ দেখব।’
ফাদার দেখল আরও কয়েকজন পুলিশ এগিয়ে আসছে।
ভেতরটা জ্বলে ্উঠল ফাদারের। দাঁতে দাঁত চাপল সে। শক্ত হয়ে উঠল মুখমন্ডল। দ্রুত তার হাত চলে গেল আলখাল্লার ভেতরে। সামনে দাঁড়ানো পুলিশরা কিছু বুঝে উঠার আগেই মেশন রিভলবারের নর তাদের উপর দিয়ে ঘুরে এল।
চারজন পুলিশই গাড়ি বারান্দায় লুটিয়ে পড়ল।
গুলী করেই ফাদার ছুটে এসে গাড়িতে উঠল।
এদিকে গাড়ির সামনে দাঁড়ানো দুজন পুলিশ ফাদারকে গুলী করতে দেখে তাদের বন্দুক তুলেছিল ফাদারকে লক্ষ্য করে।
কিনন্তু গাড়ির ভেতর থেকে দুটি গুলী এসে তাদের নিরব করে দিল। ছিটকে পড়ল তাদের দেহ দু’টি রাস্তার উপর। তাদের উপর দিয়ে ফাদারদের গাড়িটা তীর বেগে বেরিয়ে এল হাসপাতালের এলাকা থেকে।
গাড়ি স্টার্ট নেবার সময় পেছনে চোখ রাখা ফাদারের চোখে পড়ল, এইমাত্র গাড়ি বারান্দায় প্রবেশ করল একটি গাড়ি। গাড়ি থেকে নেমে এল আহমদ মুসা এবং জর্জ আব্রাহাম জনসন।
একটা ক্রুর হাহসি ফুটে উঠল ফাদারের মুখে। গা থেকে ফাদার আরখাল্লাখুলে ছুড়ে ফেলে গাড়ির সকলকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘একটা সুখবর তোমার তোমাদের জন্যে, আহমদ মুসা ও জর্জ আব্রাহাম জনসন এইমাত্র হাসপাতালের গাড়ি বারান্দায় গাড়ি থেকে নামল।’
‘মি: জেনারেল শ্যারন আমাদের সেদিনকার ব্যর্থতার ছেঅট হলেও একটা প্রতিশোধ নেয়া হলো।’ বলল নোয়ান নাবিলা।
‘এটা খুব ছোট প্রতিশোধ নয় মিস নাবিলা। আহমদ মুসা যখন গিয়ে দেখবে তার প্রেমিকা সারা জেফারসন নেই এবং যখন জানবে তর চোখের সামনে দিয়েই আমরা তাকে নিয়ে গেছি, তখন হৃদয়টা তার খসে যাবে।’ জেনারেল শ্যারন বলল।
‘প্রেমিকা, না বন্ধু?’ বলল নোয়ান নাবিলা।
‘বন্ধুর শোকে অসুস্থ হয়ে কেউ হাসপাতালে আসে? আহত আহমদ মুসা আবার শত্রুর হাতে পড়েছে, অথবা কোথায় গিয়ে কি হলো এই চিন্তাতেই সারা জেফারসন অসুস্থ হয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত তার অবস্থার অবনতি ঘটলে তাকে হাসপালালে নিয়ে আসতে হয়।’ জেনারেল শ্যারন বলল।
‘একজন ক্রিমিনালের জন্যে এটা কি স্বাভাবিক? জেফারসন কন্যা এমন একজন লোকের জন্যে পাগল হবেন?’ বলল নোয়ান নাবিলা।
‘কাকে ক্রিমিনাল বলছেন? আহমদ মুসা আমাদের জানি দুশমন, তাকে আবার হাতে পেলে হত্যাও করতে পারি, কিন্তু তাকে ক্রিমিনাল বলতে পারবো না। অত্যন্ত বর্নঢ্য বিপ্লবী জীবন তার। শুধু জেফারসন কন্যা কেন যে কোন কন্যাই তার সান্নিধ্যে আসতে গৌরব বোধ করবে।’ জেনারেল শ্যারন বলল।
‘তাহলে সে চরিত্রহীন?’ বলল নাবিলা।
‘তাও হয়তো নয়। আমরা যতদুর জানি, কন্যারা তার সান্নিধ্যে যায় বটে, কিন্তু সে কারও দিকে ফিরে তাকায় না। সে স্ত্রীর প্রতি অত্যন্ত বিশ্বস্ত, আইডিয়ালিস্ট।’
নাবিলা একটু চিন্তা করে বলর, ‘আপনার কথা বোধ হয় ঠিক। আমাদের সাগরিকা সেন নিশ্চয় বোল্ড আউট হয়েছে। তার মধ্যে আগের সেই উত্সাহ নেই। সে একেবারে ম্লান হয়ে গেছে। ঘটনার পর একবার দেখা হওয়াতেই এটা আমি বুঝেছি।’
বরৈ একটু থেমে আবার শুরু করল, ‘তাহলে সারা জেফারসনের ব্যাপার কি?’
‘বিষয়টা আমাদের কাছে এখনও দুর্বোধ্য।’ বলর জেনারেল শ্যারন।
‘নিশ্চিত না হয়ে সারা জেফারসনকে কিডন্যাপ করলেন?’ নাবিলা বলল।
‘কিডন্যাপ আমাদের ঠিক হয়েছে। সারা জেফারসনকে আমাদের হাত থেকে উদ্ধারের জন্যে আহমদ মুসা নিজের জীবনও বাজী রাখবে। এ বিষয়ে আমাদের কোন সন্দেহ নেই। দেখুন বন্দীত্ব থেকে মুক্ত হবার পর আহমদ মুসা প্রথম সুযোগেই ছুটে এসেছে সারা জেফারসনের কাছে।’
‘আমরা যেখান থেকে এসেছি, সেখানেই যাব স্যার?’ জিজ্ঞেস করল ড্রাইভিং সিটে বসা আইজ্যাক।
‘না, মিঃ জোনসের নতুন কেনা ওয়ামিংটন এভেনিউ-এর নতুন বাড়িতে নিয়ে চল। ওখানেই ওকে রাখা হবে।’ বলল জেনারেল শ্যারন। থামল সে।
সবাই চুপচাপ।
ছুটে চলেছে গাড়ি।

নিজের বেডের পাশে একটা ইজি চেয়ারে বসেছিল সারা জেফারসন। বলছিল সে, ‘আমাকে কিডন্যাপ করলেই কি আপনাদের কালো কাজ সাদা হয়ে যাবে?’
‘তা হবে না, কিন্তু আহমদ মুসার শাস্তি হবে। যাতনা-যন্ত্রনায় তাকে যতটুকু বিপর্যস্ত করা যায় সেটুকুই আমাদের লাভ।’ জেনারেল শ্যারন বলল।
‘আমাকে কিডন্যাপ করে আহমদ মুসাকে কিভাবে শাস্তি দেবেন? যাতনা-যন্ত্রনায় কেন সে বিপর্যস্ত হবে?’ বলল সারা জেফারসন।
হাসল জেনারেল শ্যারন। হাসল ডেভিড উইলিয়াম জোনসও।
উত্তরটা দিল ডেভিড উইলিয়াম জোনস। বলল, ‘এ উত্তর কি আমাদের কাছ থেকে শুনতে চান? আপনি কি জানেন না মিস জেফারসন আপনার কাছে আহমদ মুসা কি? আর আহমদ মৃসার কাছে আপনি কি?’
ম্লান হাসল সারা জেফারসন। বলল, ‘আপনারা আহমদ মুসাকে জানেন না। দায়িত্ববোধের কাছে কোন দুর্বলতা তার কাছে প্রশ্রয় পায় না। আর সে রকম কোন দুর্বলতা তার আছে বলে আমি জানি না।’
শ্যারন হাসল। বলল, ‘আহমদ মুসাকে আমি বহু বছর ধরে চিনি। যে দায়িত্ববোধের কথা আপনি বললেন, সেই দায়িত্ববোধই এখানে তাকে হিড় হিড় করে টেনে আনবে।আমরা হিসেবে একটুও ভুল করিনি মিস জেফারসন। আহমদ মুসার কাছে আপনি কতটুকু তা আপনি জানেন, আহমদ মুসা আপনার কাছে কতটুকু তাও সে জানে। আর আহমদ মুসার কারনেই যে আপনার এ অবস্থা তা বুঝতে আহমদ মুসার এক মুহূর্তও দেরী হয়নি। এই অনুভূতি তাকে অসহনীয় যন্ত্রনায় জর্জরিত করছে। এই যন্ত্রনা তাকে পাগলের মত টেনে নিয়ে আসবে। নিজেকে যে কোন ঝুঁকির মধ্যে নিক্ষেপ করে সে আপনাকে মুক্ত করতে চাইবে। আমরা এটাই চাই।’
‘আপনারা যা চান ঈশ্বর তা চান না। আপনাদের সব অপকীর্তি ঈশ্বর প্রকাশ করে দিয়েছেন।’ বলল সারা জেফারসন।
‘ঈশ্বর করেন নি, আহমদ মুসা করেছে। আহমদ মুসা আমেরিকায় না এলে আমাদের কিছু হতো না। আপনাদের ফ্রি আমেরিকা, এফ বি আই আমাদের কিছুই করতে পারতো না। আহমদ মুসা আমাদের সকল সর্বনাশের মূল। তাকে হাতে পেয়েছিলাম, হত্যা না করে আমরা ভুল করেছি। এ ভুল আর আমরা করব না। এবার আর বন্দী করে রাখা নয়, প্রথম সুযোগেই তাকে আমরা এবার হত্যা করব।’ তীব্র কন্ঠে বলল জেনারেল শ্যারন।
সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠল সারা জেফারসনের। জেনারেল শ্যারনের কথার একবিন্দুও তার অবিশ্বাস হলো না। জেনারেল শ্যারন ফ্রাস্ট্রেশনের যে পর্যায়ে পৌঁচেছে, সেখানে এমন কিছু করা তাদের জন্যে স্বাভাবিক। সারা জেফারসন নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘আহমদ মুসার উপর এই রাগ ঝেড়ে আপনাদের কি লাব হবে? তার হাতে তো এখন কিছু নেই। আপনাদের বিরুদ্ধে বিচারের আয়োজন করছে সরকার, আহমদ মুসা নয়।’
‘কিন্তু আহমদ মুসার জন্যেই এসব হচ্ছে।’ বলর শ্যারন।
‘কিন্তু আহমদ মুসাকে হত্যা করলে তো এসব বন্ধ হচ্ছে না।’ সারা জেফারসন বলল।
‘আহমদ মুসাকে সরিয়ে দিতে পারলে আমাদের জন্যে অনেক কিছু করার সুযোগ আসবে। মার্কিন পলিটিশিয়ান ও মার্কিন আমলাদের মধ্যে আমাদের লোক কম নেই।’ বলল জেনারেল শ্যারন।
‘আচ্ছা মিঃ শ্যারন, আমেরিকা ও আমেরিকানদের ক্ষতি আপনারা কেন করছেন?’
‘আমরা কারও ক্ষতি করছি না। আমরা আমাদের কিছু উপকার করছি। নিজের উপকারের জন্যে কিছু করার অধিকার সকলেরই আছে।’ শ্যারন বলল।
‘তাহলে আহমদ মুসাকে দোষ দিচ্ছেন কেন? সে আমেরিকানদের উপকারের জন্যে কিছু করেছে।’
‘সে আমাদের সর্বনাশ করেছে।’ বলল জেনারেল শ্যারন।
‘তাহলে দেখা যাচ্ছে, আমেরিকানদের উপকার মানে আপনাদের সর্বনাশ। আর আপনাদের উপকার মানে আমেরিকানদের সর্বনাশ। আমেরিকা ও আমেরিকানদের মোকাবেলায় এমন অবস্থান আপনারা বেছে নিলেন কেন?’
‘আপনাদের ফ্রি আমেরিকা যে কারনে বলে আমেরিকা আমেরিকানদের। আপনাদের কাজকে আপনারা জাতিপ্রেম বলেন, আমাদের কাজকেও আমরা বলি জাতিপ্রেম।’ বলল জেনারেল শ্যারন।
‘এটা ঠিক নয়, আমরা করছি আমাদের দেশপ্রেম থেকে। কিন্তু আপনাদের কাজ পরিষ্কার ষড়যন্ত্র। এ ষড়যন্ত্রের সাথে শতকরা আশিভাগ আমেরিকান ইহুদী নেই। দেখছেন তো চারদিক থেকে অবিরাম বিবৃতি আসছে আমেরিকান ইহুদী সম্প্রদায়ের। তারা আপনাদের নিন্দা করছে এবয় বলছে, আপনাদের সাথে তাদের কোন সম্পর্ক নেই। সুতরাং জাতিপ্রেম থেকে আপনারা কাজ করছেন, এটা ঠিক নয়। আপনারা শুধু আমেরিকানদের সাতে বিশ্বাসঘাতকতা করেন নি, নিজ সম্প্রদায়ের সাথের আপনারা বিম্বসঘাতকতা করেছেন।’
ক্রোধে জ্বলে উঠল জেনারেল শ্যারনের দুই চোখ। উঠে দাঁড়াল সে। আবার বসল। তার লাল চোখে-মুখে তীব্র রাগ ও অপমানের চিহ্ন।কথা ভলল না কিছুক্ষন। পরিশেষে বোমা ফাটার মত তীব্র কন্ঠে বলল, ‘মিস জেফারসন, এটা আপনার বাড়ির ড্রইং রুম নয়। আপনি আমাদের বন্দী এবং বন্দীর মতই কথা বলবেন। আপনি জেফারসন কন্যা বলে আপনাকে আমি যথেষ্ঠ সম্মান করছি। আপনার গ্রেট গ্রান্ড ফাদার টমাস জেফারসনের উদার গনতন্ত্র আমাদের অসীম উপকার করেছে। তাই জেফারসন পরিবারকে আমরা শ্রদ্ধা করি। কিন্তু দেখছি সে শ্রদ্ধার পাত্র আপনি নন। আহমদ মুসা আপনাকে গিলে খেয়েছে। সাবধান করে দিচ্ছি আপনার কোন ওদ্ধ্যত্য আমরা বরদাশত করবো না।’
‘কিন্তু মিঃ শ্যারন, আহমদ মুসার সাথে আমার পরিচয় হওয়ার আগে আপনারা আমাকে কয়েকবার খুন করার চেষ্টা করেছেন।’ বলল দৃঢ়কন্ঠে সারা জেফারসন।
‘সেটা ছিল একটা ভুল বোঝাবুঝির ফল। আমরা বলেছিলাম আপনাকে ভয় দেখাবার জন্যে কিছু করার। কিন্তু আঞ্চলিক নেতারা বুঝেছিল অন্যরকম।’
‘ধন্যবাদ জেনারেল শ্যারন।’ বলল সারা জেফারসন।
‘মিস জেফারসন আপনি কি আহমদ মুসাকে চিঠি লিকতে চান?’
‘তাতে আপনাদের স্বার্থ?’
‘আমাদের স্বার্থ তেমন নেই। তবে প্রিয়তমার চিঠি পেলে প্রিয়তমার কথা নতুন করে মনে পড়বে।, প্রিয়তমাকে উদ্দারের জন্যে অস্থির হয়ে উঠবে, এটা আমাদের লাভ।’
‘আরেকটা লাভ আছে। সেটা হলো চিঠিতে আমার অনুরূপ হস্তক্ষরে এটা ভুয়া ঠিকানা লিখা থাকবে। যে ঠিকানায় আমাকে উদ্ধারের জন্যে আহমদ মুসা ছুটে যাবে এবং আপনাদের ফাঁদে আটকা পড়বে।’
‘কিন্তু আহমদ মুসা যত তাড়াতাড়ি ধরা পড়বে, তত তাড়াতাড়ি আপনার মুক্তি। আহমদ মুসা আমাদের হাতে না আসা পর্যন্ত আমরা আপনাকে ছাড়ছি না। আহমদ মুসাকে আপিনি রক্ষা করতে পারবেন না। তাকে আসতেই হবে। আর ফ্লোরিডার জ্যাকসন ভিলে আমাদের যে ভুল হয়েছে, যার কারনে লায়লা জেনিফার ও ডঃ মার্গারেটকে সে মুক্ত করে নিয়ে যায়, সেই ভুল এবার আমরা করছি না।’
বলে উঠে দাঁড়াল জেনারেল শ্যারন।
ডেভিড উইলিয়াম জোনস উঠতে উঠতে বলল, ‘শেষ কথাটাও ওকে বলে দিন মিঃ শ্যারন। আমরা এক মাসের বেশী আহমদ মুসার জন্যে ওয়েট করবো না। আহমদ মুসাকে একটা আলটেমেটাম দেয়ার পর সে না এলে এবং এক মাস পার হয়ে গেলে কি হবে সেটাও মিস জেফারসনকে বলে দিন।’
জেনারেল শ্যারন যাবার জন্যে পা বাড়িয়েছিল, থেমে গেল। বলল, ‘ভাল কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন মিঃ জোনস। দন্যবাদ আপনাকে।’
বলে ফিরল সে মিস সারা জেফারসনের দিকে। বলল, ‘আমরা তো অনির্দিষ্টকাল আপনার মত সুন্দরী ও বিবাহযোগ্যা মেয়েকে আমাদের সামষ্টিক কেয়ারে রাকতে পারবো না। তাই আমরা ঠিক করেছি, ৩০ দিন পার হওয়ার পর একত্রিশতম দিনে আপনাকে নিয়ে একটা লটারী হবে। লটারী হবে এইজন্যে যে, আমাদের সবাই আপনাকে চায়। কেউই তাদের দাবী ছাড়তে রাজী নয়। তাই আমরা যারা প্রার্থী তাদের মধ্যে লটারীর ব্যবস্থা করা হয়েছে। যার ভাগ্যে আপনার নাম উঠবে, সে ভাগ্যবানই হবে আপনার মালিক। আমরা তার হাতে তুলে দেব আপনাকে। আপনার মর্যাদার কথা চিন্তা করে বিয়ের চির বন্ধনে আপনাকে না বাধার সিদ্ধান্ত হয়েছে। লিভ টুগেদারের সুবিধা হলো আপনারা কোন উপযুক্ত সময়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারবেন। আপাতত এই বন্দীখানাই হবে আপনাদের লিভ টুগেদারের ঠিকানা।’
কথাগুলো একটা একটা করে অত্যন্ত শীতল কন্ঠে বলল জেনারেল শ্যারন। প্রতিটি কথা চাবুকের মত আঘাত করল সারা জেফারসনকে। একজন নারীর দুর্বলতম স্থান যেটা সেখানেই আঘাত করেছে সে। জেনারেল শ্যারন ও ডেভিড উইলিয়াম জোনসের লোলুপ দৃষ্টি দেখেই সারা জেফারসনের মন বুঝল জেনারেল শ্যারনের একটা কথাও মিথ্যা নয়।
বুকের ভেতরটা কাঁপতে শুরু করেছে সারা জেফারসনের।
কথা শেষ করেই জেনারেল শ্যারন আবার ঘুরে দা৭ড়াল। চলতে শুরু করল।
ডেভিড উইলিয়াম জোনস হাঁটার জন্যে পা বাড়িয়ে আবার মুকটি ঘুরিয়ে সারা জেপারসনের দিকে চেয়ে বলল, ‘একমাসের মধ্যে মুক্তি চাইলে আমাদের মতে আপনাকে চলতে হবে মিস জেফারসন। আপনি ভাবুন।’
বলে ডেভিড উইলিয়াম জোনসও হাঁটতে শুরু করল।
ঘর থেকে বেরিয়ে গেল ওরা।
দরজা বন্ধ হয়ে গেল ঘরের।
বুকের কাঁপুনি সারা জেফারসনের গোট দেহকেই অসাঢ় করে তুলতে চাইল। তার মনে হলো, গেটা পৃথিবী তার সামনে বদলে যাচ্ছে।
সারা জেফারসন ইজি চেয়ার তেকে উঠে টলতে টলতে বিছানায় গিযে লুটিয়ে পড়ল। অসহায় এই সময়ে আহমদ মুসার অনুরূপ ছবিটিহুদয় জুড়ে দেখা দেয়ার সাথে সাথে তার হৃদয় জুড়ে নেমে এল এক প্রশান্তিও। মন থেকে স্বস্তির এক কন্ঠ বলল, ৩০ দিনের মধ্যেই তার আহমদ মুসা তাকে উদ্ধার করবে।
তার আহমদ মুসা তাকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে কথাটা ভাবতে গিয়ে আবার কেঁপে উঠল সারা জেফারসন। কেমন করে আহমদ মুসার সামনে গিয়ে দাঁড়াবে সে? আহমদ মুসাকে এখন তার মনে হচ্ছে এক নিষিদ্ধ ফলের মত। ওদিকে তার হাত বাড়াবার কোন অধিকার নেই। আহমদ মুসা বিবাহিত সে জানতো না। লায়লা জেনিফাররা তাকে হাসপাতালে দেকতে না এলে এতদিনেও কথাটা তার জানা হতো না। এ কথাই বোধ হয় আহমদ মুসা বার বার বলতে চেয়েছে, কিন্তু বলা হয়নি। শেষে কথাটা বলা আহমদ মুসার জন্যে বোধ হয় কঠিন হয়ে গিয়েছিল। এই আহমদ মুসার সামনে সে তার অসীম অপরাধ নিয়ে কেমন করে দাঁড়াবে? আহমদ মুসাকে বিব্রত করা আর তার ঠিক হবে না।
তাহলে কি করবে সে? দুচোখ বেয়ে আবার অশ্রু গড়াল তার। তার অপরাধ নিয়ে তাকে হামদ মুসার চোখের আড়ালে সরে যেতে হবে। কিন্তু তারপর কি হবে? তার অপরাধের প্রতিকার কিসে? সে কি আহমদ মুসাকে ভুলে যেতে পারবে? কেমন করে ভুলে যাবে? নিজের হৃৎপিন্ড ছিড়ে ফেলে কেউ কি বাঁচতে পারে?
বালিশে মুখ গুঁজল সারা জেফারসন।
নিরব কান্নার স্রোত নামছে তার দুচোখে।

আহমদ মুসা ও জর্জ আব্রাহাম জনসন গাড়ি থেকে গাড়ি বারান্দায় পা দিয়েই বিস্ময়ের সাগরে হাবুডুবু খেতে লাগল।
চারজন পুলিশের লাশ তাদের সামনে। আরও দুজন পুলিশের পিষ্ট হওয়া লাশ তারা দেখতে পাচ্ছে একটু দুরে রাস্তায়। দুরে একটা গাড়িকে পাগলের মত ছুটে পালাতে দেখতে পেল তারা।
এফ বি আই চীফ জর্জ আব্রাহাম জনসনকে দেখে এফ বি আই ও পুলিশ অফিসাররা ছুটে এল।
একজন এফ বি আই অফিসার ব্যস্ত কন্ঠে জর্জ আব্রাহামকে জানাল, ‘স্যার, সাংঘাতিক ঘটনা ভোজবাজীর মত ঘটে গেল।’
‘পুলিশদের কে মারল? কি করে ঘটল বলত?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
এফ বি আই অফিসারটি কিভাবে তিনজন ডাক্তার, একজন নার্স ও একজন ফাদার কাপড়ে ঢাকা একটা ডেডবডি নিয়ে এল এবং ডেথ ও রিলিজ সার্টিফিকেট দেখিয়ে গেট দিয়ে নিয়ে চলে গেল, তার বিবরন দিয়ে বলল, ‘তারা চলে যাবার পরই একজন ডাক্তার বলল দুটি সার্টিফিকেটেরই সই জাল। তারপরই পুলিশ পাঠানো হয় গাড়ি থামাবার জন্যে। আমরা মনে করেছিলাম ডেডবডি চেক করতে হবে। পুলিশ যাবার পরই এমন ঘটনা ঘটল।’
তার কথা শেষ হতেই আহমদ মুসা বলল, ‘মিস সারা জেফারসনকে নিয়ে যাবার জন্যে আপনারা এসেছেন শুনলাম। কি হল? তার রিলিজ হয়েছে।?
‘তার রিলিজ নেবার জন্যে দুজন এফ বি আই অফিসার গেছেন। আমরা তাদেরই অপেক্ষা করছি।’ বলর এফ বি আই অফিসারটি।
‘মিস সারা জেফারসন কত নাম্বার কেবিনে আছেন? আহমদ মুসা জিজ্ঞেস করল।
‘তিনি ২১ নাম্বার কেবিনে আছেন।’ বলল এফ বি আই অফিসারটি।
‘আর ডেডবডি কত নাম্বার কেবিন থেকে এসেছিল?’ আহমদ মুসা জিজ্ঞেস করল।
‘ঐ ২১ নাম্বার কেবিন থেকেই।’ বলল অফিসারটি।
‘আপনার অফিসারদের এতক্ষনে ফেরার কথা তাই না?’ দ্রুত কন্ঠে বলে উঠল আহমদ মুসা।
‘অবশ্যই। কাগজপত্র সব রেডি আছে, এখন শুধু নিযে আসা।’ বলর অফিসারটি।
আহমদ মুসা দ্রুত মুখ ঘুরাল জর্জ আব্রাহাম জনসনের দিকে। বলল, ‘আমার মনে হচ্ছে, একটা বড় ঘটনা ঘটে গেছে। চলুন ২১ নাম্বার কেবিনে কি ঘটেছে দেখি।’
ভ্রুকুঁচকে গেল জর্জ আব্রাহাম জনসনের। বলল আহমদ মুসাকে, ‘তার মানে আপনি মিস জেফারসন সম্পর্কে খারাপ কিছু ভাবছেন?’
বলেই জর্জ আব্রাহাম জনসন হাসপাতালের দিকে হাঁটতে শুরু করল।
সবাই চলল তার সাথে।
২১ নাম্বার কেবিন হাসপাতালের মাঝ বরাবর ভি আই পি সেকশনে অবস্থিত।
২১ নাম্বার কেবিনের কাছাকাছি হতেই আহমদ মুসারা ডাক্তার ও নার্সদের ছুটাছুটি দেখতে পেল।
আহমদ মুসারা আরও কাছাকাছি হতেই একজন প্রবীন ডাক্তার ছুটে এল এফ বি আই প্রধান জর্জ আব্রাহাম জনসনের দিকে। বোধ হয় সে চিনেছে জর্জ আব্রাহাম জনসনকে। বলর সে হাঁপাতে হাঁপাতে, ‘স্যার মিস সারা জেফারসনকে তার কেবিনে পাওয়া যাচ্ছে না। তার কেবিনের ডাক্তারকে বাথরুমে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় পাওয়া গেছে। এদিকে এই ওয়ার্ডের হেড নার্স ও দুজন এফ বি আই অফিসারকে পাওয়া গেছে ওয়ার্ড অফিসের বাথরুমে সংজ্ঞাহীন অবস্থায়।’
মুখ ম্লান হয়ে গেল জর্জ আব্রাহাম জনসনের। তাকাল সে আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসার ভাবলেশহীন মুখ। বলল, ‘বুঝা গেছে মিঃ জর্জ আব্রাহাম। তবু চলুন ওয়ার্ড অফিস এবং মিস সারা জেফারসনের কেবিন দেখে আসি।’
ওয়ার্ড অফিস এবং মিস সারা জেফারসনের কেবিন দেখে ফেরার পথে এফ বি আই প্রধান আহমদ মুসাকে বলল, ‘নতুন কিছু বোঝা গেল মিঃ আহমদ মুসা?’
‘তেমন কিছু না। অন্যদের মত মিস জেফারসনকেও তারা ক্লোরফরম করে কিডন্যাপ করেছে। মসি জেফারসন সেসময় ঘুমিয়ে ছিলেন।’
‘দেখা যাচ্ছে, ওরা ছিল পাঁচজন লোক। কিন্তু এতজন লোককে ওরা ক্লোরফরম করল, কোন গোলাগুলী হলো না, ধ্বস্তাধ্বস্তি হরো না? কেমন করে ঘটল?’ বলল আব্রাহাম জনসন।
‘ডাক্তারের ছদ্মবেশ নেয়ার কারনে সুবিধা হয়েছে। অতর্কিত চড়াও হয়ে কাজ সেরেছে। সবাই বলছে ফাদার হোয়াইট নয়। অন্যরাও পিওর হোয়াইট নয়। আমার ধারনা ‘ফাদার’ ছদ্মবেশে জেনারেল শ্যারন এসছিল। অন্যরাও আমেরিকান ইহুদী।’ আহমদ মুসা বলল।
‘গাড়ির নাম্বারও কেউ বলতে পারছে না।’ জর্জ আব্রাহাম বলল।
‘তাতে লাভ হতো না মিঃ জর্জ আব্রাহাম। গাড়ির নাম্বার ভুয়া ছিল।’
‘একরন কি করনীয় বলুন তো? ইহুদীদের পরিচিত সব সামাজিক ও ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠানের উপর আমাদের চোখ আছে।’
‘আমার ধারনা ইহুদীদের কোন পরিচিত বাড়ি বা প্রতিষ্ঠানে মিস জেফারসনকে রাখা হবে না। যেমন আমাকেও তারা রাখেনি। আমাকে সবসময় তারা ভারতীয় আমেরিকানদের আশ্রয়ে রেখেছে।’
‘আমি অবাক হচ্ছি ভারতীয় আমেরিকানরা কেন এভাবে ইহুদী একটি গ্রুপের সকল কুকর্মের সহযোগী হয়ে গেল?’
‘এই দুটি জাতির জাতিগত বৈশিষ্ট্য ও রাজনৈতিক লক্ষ্যের মধ্যে প্রচুর মিল আছে। দুটি জাতিই বিশ্বাসগত ভাবে সাম্প্রদায়িক। জন্মগত হলেই কেউ যেমন ইহুদী হতে পারে, তেমনি হিন্দুদেরকেও জন্মগতভাবে হিন্দু হতে হয়। হিন্দুদের কাস্ট সিস্টেমটা জন্মগত। কনভারশনের মাধ্যমে কেউ হিন্দু বা ইহুদী হতে পারে না। আমেরিকায় দুই জাতির রাজনৈতিক লক্ষ্যও এক। অর্থনীতি ও তথ্য-মাধ্যমের মত ক্ষমতার কেন্দ্রগুলোকে দখল করে তাদের সংখ্যালঘু আধিপত্য কায়েম করা।’ আহমদ মুসা বলল।
‘হ্যাঁ মিঃ আহমদ মুসা, তাদের আচরন দ্বারা এটাই তারা আমাদের বলে দিচ্ছে।’
বলে একটু থামল জর্জ আব্রাহাম। একটু ভাবল। বলল, ‘মিঃ আহমদ মুসা প্লিজ আমাদের অফিসে চলুন, আলোচনা আছে।’
তারা এফ বি আই হেড কোয়ার্টারে পৌছল।
অফিসে বসেই জর্জ আব্রাহাম প্রেসিডেন্টসহ প্রয়োজনীয় সবার কাছেমিস জেফারসনের কিডন্যাপ হওয়ার খবর জানিয়ে দিল।
তারপর আহমদ মুসার মুখোমুখি হয়ে বলল, ‘মিঃ আহমদ মুসা সারা জেফারসন কিডন্যাপ হওয়ার খবর এখনি জনগনকে জানানো ঠিক হবে না বলে মনে করছি।’
‘কেন?’ বলল আহমদ মুসা।
‘সারা জেফারসন কিডন্যাপের সংবাদ মার্কিন জনগন ও ‘ফ্রি আমেরিকা’ আন্দোলনের সংগঠনের সদস্যদের মধ্যে ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে এবং তা খারাপ দিকে টার্ণ নেতে পারে বলে আমি, আশংকা করুছি।’
জর্জ আব্রাহাম জনসন বলল।
‘খারাপ টার্ণটা কি?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘খবর প্রচারিত হওয়ার সংগে সংগেই সবাই ধরে নেবে এই কিডন্যাপের কাজ শ্যারন ও উইলিয়াম জোনসদের। ক্ষুদ্র একটি ইহুদী গ্রুপ কিডন্যাপের সাথে জড়িত, কিন্তু মানুষের ক্রোধ গিয়ে ড়পতে পারে সাদারনভাবে ইহুদি কম্যুনিটির উপর। বিশেষ করে ‘ফ্রি আমেরিকা’র সদস্যরা ত্বরিত প্রতিশোধ গ্রহনে এগিয়ে আসতে পারে।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন। চিন্তিতি কন্ঠ তার।
‘আপনার অনুমান ঠিক মিঃ জর্জ আব্রাহাম। আমারও এখন তাই মনে হচ্ছে। কিন্তু এখন তাহলে কি করনীয়? খবরটি তো গোপন রাখা যাবে না।’ বলল আহমদ মুসা।
‘না, যাবে না। আমরা সরকারী ভাবে কিছু না জানালেও হাসপাতাল সহ বিভিন্ন সুত্রে খবরের কাগজগুলো নিউজটি পেয়ে যাবে।’ জর্জ আব্রাহাম বলল।
‘তাহলে?’ বলল আহমদ মুসা।
‘আপনাকে দ্রুত কিছু কাজ সারতে হবে আহমদ মুসা।’ জর্জ আব্রাহাম বলল।
‘কি কাজ?’
‘বেঞ্জামিন বেকনসহ ‘ফ্রি আমেরিকা’র শীর্ষ নেতাদের সাথে আপনি অবিলম্বে বসুন। তাদের মাধ্যমে আঞ্চলিক নেতাদের কাছে আপনি একটা মেসেজ পাঠান। তাদের কাছে আপনি আবেদন করে বলুন, সারা জেফারসনকে মুক্ত করার সার্বিক ব্যাবস্থা গ্রহন করা হচ্ছে। আপনারা শান্ত থেকে এই কাজে সহযোগিতা করুন। বিশেষ করে কেউ যেন ইহুদীদের উপর কোন প্রতিশোধ নিতে না যায়।’
থামল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
আহমদ মুসা বলল, ‘আমি বুঝতে পারছি না আমি এ আবেদন করব কেন? তারা আমার এ আবেদন শুনবে কেন?’
জর্জ আব্রাহাম একটু নড়ে চড়ে বসল। একটা বিব্রতভাব দেখা গেল তার চোখে-মুখে। পরক্ষনেই তার চোখে-মুখে নেমে এল দায়িত্বের গাম্ভীর্য। বলল, ‘আপনি জানেন না মিঃ আহমদ মুসা, ‘ফ্রি আমেরিকা’ আন্দোলনের নেতা কর্মী সকলেই জানে তাদের প্রাণ প্রিয় নেত্রী সারা জেফারসন আপনাকে ভালবাসে। আপনি জেনারেল শ্যারনদের হাতে বন্দী হলে সারা জেফারসনের অবস্থা সবাই দেখেছে। ‘ফ্রি আমেরিকা’ আন্দোলনের নেতা কর্মীরা সারা জেফারসনের মত আপনাকেও ভালবাসতে শুরু করেছে। আপনার এই মুহূর্তের যে কোন আবেদনকে তারা তাদের নেত্রীর নির্দেশ বলেই মনে করবে।’ থামল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
আহমদ মুসার চোখে-মুখে বিব্রত ভাব। তার মুখে লজ্জার একটা লাল আভাও ফুটে উঠেছে। বলল আহমদ মুসা, ‘আমি দুঃখিত মিঃ জর্জ আব্রাহাম। সবাই যেভাবে ভাবছে, ব্যাপারটা তেমন নয় মোটেই। তবে, আপনি যে আবেদন জানানোর কথা বলছেন, সে আবেদন আমি অবশ্যই জানাব।
কিছু বলতে যাচ্ছিল জর্জ আব্রাহাম জনসন। তার টেলিফোন বেজে উঠল। মোবাইলটা হাতে তুলে নিল জর্জ আব্রাহাম জনসন। ওপারের হ্যালো শুনেই জর্জ আব্রাহাম জনসন সোজা হয়ে বসল। বলল, ‘গুড মর্নিং মিঃ প্রেসিডেন্ট।’
‘গুড মর্নিং জর্জ। আমি সারা জেফারসনের কিডন্যাপরে খবরে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছি। খবরটা আমার কাছে পৌঁছার পর তোমাকে টেলিফোন করছি। কি ভাবছ তোমরা এখন?’ বলল ওপার থেকে প্রেসিডেন্ট।
‘আমি আহমদ মুসাকে নিয়ে বসেছি। কোন ভাবেই চেষ্টার কোন ত্রুটি হবে না মিঃ প্রেসিডেন্ট। এটা এখন আমাদের নাম্বার ওয়ান অগ্রাধিকার।’ জর্জ আব্রাহাম বলল।
‘দেখুন জেফারসন পরিবারের মেয়ে মানে আমারও মেয়ে। সে উদ্ধার না পাওয়া পর্যন্ত স্বস্তি পাব না।’ বলল প্রেসিডেন্ট।
‘আমরা অনুভব করছি মিঃ প্রেসিডেন্ট। সর্বশক্তি ও সকল উপায় প্রয়োগ করে আমরা চেষ্টা করব।’ জর্জ আব্রাহাম বলল।
‘আর শ্যারন-জোনসদের কেসের অগ্রগতি কি? ওদের অপরাধ তো আরও একটা বাড়ল।’
‘আশা করছি দুএকদিনের মধ্যেই কোর্টে কেস উঠবে মিঃ প্রেসিডেন্ট। আসামীদের অনুপস্থিত রেখেই বিচার কাজ শুরু হবে।’
‘ধন্যবাদ মিঃ জর্জ। টেলিফোনটা আহমদ মুসাকে দিন।’
আহমদ মুসা টেলিফোন নিয়ে বলল, ‘গুড মর্নিং মিঃ প্রেসিডেন্ট।’
‘গুড মর্নিং আহমদ মুসা। ওয়েলকাম।’
‘ধন্যবাদ মিঃ প্রেসিডেন্ট।’
‘মিঃ আহমদ মুসা, আপনার মুক্তির জন্যে যে সবচেয়ে উৎগ্রীব ছিল, তার কিন্তু আপনার মুক্তি দেখা হলো না। তার আগে সে নিজেই কিডন্যাপ হলো।’
‘খুবই দুঃখজনক, উদ্বেগজনক ঘটনা মিঃ প্রেসিডেন্ট।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তার উদ্ধারের ব্যাপারে আমরা আপনার উপর অনেকখানি নির্ভর করছি আহমদ মুসা।’
‘এটা আমার দায়িত্বও মিঃ প্রেসিডেন্ট।’
‘আমি জানি মিঃ আহমদ মুসা। ধন্যবাদ আপনাকে।’
‘ধন্যবাদ মিঃ প্রেসিডেন্ট।’
টেলিফোন অফ করে জর্জ আব্রাহামের হাতে দিতে দিতে আহমদ মুসা বলল, ‘প্রেসিডেন্ট সারাকে নিয়ে খুব উদ্বিগ্ন। কি করা যায় বলুন তো?’
‘আমি সেটাই ভাবছি। ইহুদী গ্রুপটির সাথে ভারতীয় আমেরিকানরা যুক্ত হওয়ায় বিষয়টি আরও জটিল হয়েছে।’ বলল জর্জ আব্রাহাম।
জর্জ আব্রাহাম থামলেও আহমদ মুসা কথা বলল না। ভাবছিল সে। অনেক্ষন পর সে বলল, ‘এগুবার এখন একটাই পথ আমি দেখতে পাচ্ছি।’
‘সেটা কি?’ উদগ্রীব কন্ঠে বলল জর্জ আব্রাহাম।
‘আমি আমার নিজেকে ওদের হাতের নাগালের মধ্যে নিয়ে যাওয়া।’
‘তাতে কি হবে?’
‘তাতে আমি ওদের ধরার সুযোগ পাব, কিংবা আমি ওদের হাতে ধরা পড়ব।’
‘এর অর্থ?’
‘আমি ওদের ধরতে পারলে সারাকে মুক্ত করতে পারবো। আর যদি ধরা পড়ি, তাহল্রে সারা মুক্তি পাবে।’
‘ওদের ধরতে পারলে সারাকে মুক্ত করার সুযোগ পাবেন, এটা বুঝলাম। কিন্তু আপনি ওদের হাতে ধরা পড়লে সারা কিভাবে মুক্তি পাবে?’
আহমদ মুসা ম্লান হাসল। বলল, ‘জেনারেল শ্যারনকে আমি জানি। আমি নিশ্চিত যে, আমাকে ফাঁদে ফেলার টোপ হিসেবে ওরা সারা জেফারসনকে বন্দী করেছে। ওদরে বিশ্বস সারাকে উদ্ধার করার জন্যে অবশ্যই আমি যাব এবং সেই সুযোগ তারা গ্রহন করবে। সারা একজন জনপ্রিয় আমেরিকান। সারার উপর কিছু ক্রোধ থাকলেও তারা সারার কোন ক্ষতি করতে চাইবে না জনমতের ভয়ে। আমাকে ধরার সংগে সংগেই তারা সারাকে মুক্তি দেবে।’
‘বুঝলাম আহমদ মুসা। আমি আপনার যুক্তির সাথে একমতও। কিন্তু আমরা তো এটা চাই না। আমরা চাই সারাকে মুক্ত করতে, ওদের হাতে সারার সাথে আপনাকে বিনিময় করতে নয়।’
‘আমিও চাই না। কিন্তু আমি এছাড়া কোন উপায় দেখছি না। সারা ওদের হাতে একদিনও থাকুক তা আমাদের কারও কাম্য নয়।’
‘তা নয়, ঠিক। কিন্তু আহমদ মুসার মূল্যে আমরা সারা জেফারসনকে উদ্ধার করব, এটা আমি মেনে নিচ্ছি না।’ বলল জর্জ আব্রাহাম দৃঢ় কন্ঠে।
‘কিন্তু আমার সামনে এটাই এখন একমাত্র পথ। এই পথেই আমাকে অগ্রসর হতে হবে। আমার কারনেই সারা জেফারসন আজ চরস বিপদগ্রস্থ। তাকে উদ্ধার করার নৈতিক দায়িত্ব আমার উপরই সবচেয়ে বেশী বর্তায়।’ থামল আহমদ মুসা।
জর্জ আব্রাহাম উঠল। উঠে গিয়ে আহমদ মুসার পেছনে দাঁড়াল। একটা হাত রাখল আহমদ মুসার কাঁধে। বলল, ‘তাহলে আমরাও বলতে পারি আহমদ মুসা, আমরেকিার কারনে, আমেরিকার জন্যেই আজ আপনি একটি ইহুদী গ্রুপের চরম শত্রুতে পরিনত হয়েছেন। সুতরাং ওদের হাত থেকে আপনাকে রক্ষা করা আমাদেরও প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব।’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘আমি আমেরিকার কাছে কৃতজ্ঞ। আমি বন্দী হবার পর আমাকে মুক্ত করার কোন চেষ্টাই সে বাদ রাখেনি। আবারও যদি বিপদে পড়ি আবারও তা করবে। কিন্তু আমি বিপদে পড়ব এই যুক্তি তুলে আমেরিকা সারাকে উদ্দার করার আমার চেষ্টায় বাধা দেবে, তা হয় না, হওয়া উচিত নয়।
জর্জ আব্রাহামের মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল। বলল, আপনি সিদ্ধান্ত নিলে সেখান থেকে আপনাকে ফেরানো যাবে না সেটা আমি জানি। পরার্থে এমন করে নিজেকে বিলিয়ে দেয়াই বোদহয় আপনার বৈশিষ্ট্য। মনে পড়ছে অনেকদিন আগের কথা আহমদ মুসা। আমার বালক নাতিকে রক্ষার জন্য সেদিন ওহাইও নদীর বিপজ্জনক ঘূর্ণি স্রোতে আপনাকে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখেছিলাম। সেই আপনি আজ আরও মহৎ হয়েছেন। আমি আপনাকে অভিবাদন করি আহমদ মুসা।’ আবেগ কম্পিত ভারী কন্ঠে বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
মুখোমুখি হলো জর্জ আব্রাহাম জনসনের। বলল, ‘আপনার স্নেহের দৃষ্টির জন্যে আমি কৃতজ্ঞ মিঃ জর্জ আব্রাহাম জনসন।’
জর্জ আব্রাহাম জনসন দুহাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরল আহমদ মুসাকে। বলল, ‘আমি প্রেসিডেন্টকে সব বলে দেব। তিনি খুশী হবেন। অমানুষের ভীড়ে মানুষের সাক্ষাৎ আজ দুর্লভ হয়ে উঠেছে।’

মার্কিন ফেডারেল কোর্ট।
‘রাষ্ট্র বনাম শ্যারন-জোনস এন্ড আদারস’ কেসের চার্জশীটের শুনানী চলছে।
আসামীদের ডায়াস খালি। জেনারেল শ্যারন ও ডেভিড উইলিয়ামের অনুপস্থিতিতেই তাদের বিচার শুরু হলো।
আসামীদের বিরুদ্ধে ভিন্ন ভিন্ন শিরোনামে ভিন্ন ভিন্ন মামলার ভিন্ন ভিন্ন চার্জশীট সরকারী প্রসিকিউটরের ফাইলে।
প্রথমে চলছে ‘জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন হত্যা মামলা’র চার্জশীট পাঠ।
দীর্ঘ চার্জশীট পাঠ শেষ করে সরকারী প্রসিকিউটর তার এই উপসংহার পাঠ করল, ‘ এটা নিছক একটা হত্যা মামলা নয়। এর সাথে জড়িত হয়েছে জাতি ও রাষ্ট্রের সুদূর প্রসারী স্বার্থের কথা এবং জাতি ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে চাঞ্চল্যকর ষড়যন্ত্রের বিষয়। আমেরিকার একজন শ্রেষ্ঠ সন্তান জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনকে প্রাণ দিতে হয়েছে অবশেষে তিনি আমেরিকার বুকে ছুরি মারতে রাজি হননি বলে। জেনারেল শ্যারনের নিজ উক্তিই প্রমান করে তারা আমেরিকার বুকে ছুরি মারছেন। এই ভয়ানক ‘সত্য’টিই জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন জানতে পেরেছিলেন। তাঁর মাধ্যমে যাতে ষড়যন্ত্রের এই সত্যটি বাইরে না যায়, তাই চিরতরে তার মুখ বন্ধ করার জন্যেই তাকে হত্যা করা হয়েছে। ষড়যন্ত্রের সব সত্য বিবরণ জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন প্রকাশ করে দেংয়ার সুযোগ পাননি বটে, কিন্তু মৃত্যু-মুহূর্তে তার শেষ কথায় তিনি সেই ষড়যন্ত্রের হাত থেকে আমেরিকাকে রক্ষার জন্যে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছেন এবং সর্বশেষ দুটি কাক্যে ষড়যন্ত্র সম্পর্কে কিছু ইংগিতও দিয়ে গেছেন। সর্বশেষ দুটি বাক্যে তিনি বলেছেন আমেরিকার জন্যে যে নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন তিনি দেখতেন, সে নতুন পৃথিবী যেন হয় ফাউন্ডার ফাদার্সদের, ষড়যন্ত্রের নয়। এর অর্থ আমেরিকার জন্যে ষড়যন্ত্রের এক নতুন পৃথিবী অর্থাৎ নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার-এর পরিকল্পনাও আছে, যার সাথে জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন যুক্ত ছিলেন এবং শেষ মুহূর্তে যখন তিনি টের পেলেন এটা ষড়যন্ত্র,তখনই তাকে জীবন দিতে হলো। তাহলে আমেরিকার জন্যে ষড়যন্ত্রের নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার পরিকল্পনার প্রণেতা মিঃ শ্যারন ও মিঃ জোনসরা। এই কথাই ‘ফ্রি আমেরিকা’ মুভমেন্টও বলে থাকে। তাদের অভিযোগ হলো, জেনারেল শ্যারন ও ডেভিড উইলিয়াম জোনসদের মত অশুভ নেতৃত্বের অধীন শক্তিশালী ও সক্রিয় একটা ইহুদী গ্রুপ তাদের বিত্ত ও প্রচারের জোরে আমেরিকার ঘাড়ে ষড়যন্ত্রমূলক নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার চাপিয়ে দিয়েছে। যা জাতি-রাষ্ট্র, জাতি-সংস্কৃতি ও জাতি-অর্থনীতির বিলোপ সাধন করে এক কেন্দ্রিক এক বিশ্বায়নের দিকে পৃথিবীকে নিয়ে যাবার চেষ্টা করছে। এই চেষ্টা পরিণামে আমেরিকাকে সবার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করবে। ‘ফ্রি আমেরিকা’ মুভমেন্ট বলে এবং জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনও তার অন্তিম বার্তা হিসেবে বলেছেন, আমেরিকাকে এই লক্ষ্যের দিকে পরিচালনা করা আমেরিকার ফাউন্ডার্স ফাদার্সদের চিন্তার একেবারেই পরিপন্থী। ‘ফ্রি আমেরিকা’ মুভমেন্ট তাই এক ফ্রি আমেরিকা’র দাবী করছে, যে আমেরিকা ফাউন্ডার্স ফাদার্সদের ইচ্ছা অনুসারে হবে বিশ্বে শান্তির পুরাধা, জাতিসমূহের পারিস্পরিক সমতাভিত্তিক সহাবস্থানের সহযোগী এবং দেশ-কাল-পাত্র-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আমেরিকান জীবনের এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি এখানে উত্থাপিত হত্যা-মামলার হত্যা-মোটিভের সাথে অংগাংগিভাবে জড়িত। সুতরাং হত্যার সাথে এটাও পৃথক ভাবে বিচার্য বিষয় হওয়া উচিত। জেনারেল হ্যামিল্টনের আত্মদানের দাবীও এটা। ফাউন্ডার্স ফাদার্সদের চাওয়া ‘ফ্রি আমেরিকা’ গঠন ও জেঁকে বসা অক্টোপাশের বিদায়ের মাধ্যমেই শুধু জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনের মহান আত্মত্যাগকে সম্মানিত করা যেতে পারে।’
জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনের হত্যা-মামলার চার্জশীট উত্থাপন শেষে এর উপসংহার পাঠ করার পর সরকারী প্রসিকিউটর ‘লস আলামোসের গোয়েন্দা সুড়ঙ্গ মামলা’র চার্জশীট পেশ করা শুরু করল।
‘আরও চারটি মামলার চার্জশীট রয়েছে সরকারী প্রসিকিউটরের ফাইলে। তার প্রথমটি হলো, ‘আইজ্যাক বেনগুরিয়ান ও সাবাহ বেনগুরিয়ান কিডন্যাপ মামলা’, দ্বিতীয়টি হলো, ‘হ্যারি ময়নিহান কিডন্যাপ মামলা।’ অন্যটি ‘আহমদ মুসা কিডন্যাপ মামলা।’ সর্বশেষে রয়েছে, ‘সারা জেফারসন কিডন্যাপ মামলা’র উপস্থাপনা।
সরকারী প্রসিকিউটরের সহকারী ফিস ফিস করে মামলার এই তথ্যগুলো দিল একজন সাংবাদিককে তার একটা প্রশ্নের জবাবে।
সরকারী প্রধান প্রসিকিউটর তখন পড়ে চলছিল ‘লস আলামোস গোয়েন্দা সুড়ঙ্গ মামলা’র দীর্ঘ চাঞ্চল্যকর চার্জশীট।

এফ বি আই হেড কোয়ার্টার।
এফ বি আই প্রধানের খাস ড্রইং রুমে দুটি মুখোমুখি সোফায় বসেছিল আহমদ মুসা ও জর্জ আব্রাহাম জনসন। আব্রাহাম জনসনের কোলে তার নাতি জর্জ জনসন জুনিয়র।
‘উনি কে বলত দাদু?’ আহমদ মুসাকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল জর্জ আব্রাহাম জনসন তার নাতিকে।
‘আংকেল।’ বলল জর্জ জুনিয়র।
‘ওকে তুমি জান?’
‘হ্যাঁ’
‘কি জান?’
‘আমি ওহাইও নদীতে ডুবে গিয়েছিলাম। উনি ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাকে বাঁচিয়ে ছিলেন।’ বলল জর্জ জনসন জুনিয়র।
‘তুমি সংজ্ঞাহীন ছিলে। জান না। কার কাছে শুনেছ তুমি এ কথা?’
‘কেন, আম্মু বলেন, আব্বু বলেন।’
‘তুমি কেমন করে জান যে ইনি সেই লোক?’
‘বারে, আমাদের বাড়িতে আংকেলের ফটো টাঙানো আছে না?’
‘ফটো টাঙানো আছে? কোথায় পেয়েছ?’
‘কেন, আব্বা এনেছেন।’
‘তোমার আংকেলকে ধন্যবাদ দাও জনসন।’
‘সিওর।’
বলে দাদুর কোলে থেকেই মুখ ঘুরিয়ে আহমদ মুসার দিকে চেয়ে বলল, ‘ধন্যবাদ আংকেল।’
আহমদ মুসা ‘ওয়েল কাম সুইট বয়’ বলে কিছু বলতে যাচ্ছিল।
এসময় জর্জ আব্রাহাম জনসনের টেলিফোন বেজে উঠল।
‘এক্সকিউজ মি’ বলে টেলিফোন ধরল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
টেলিফোনে কথা বলেই জর্জ আব্রাহাম জনসন টেলিফোনটা আহমদ মুসার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘মিস সাগরিকা সেনের টেলিফোন।’
আহমদ মুসা টেলিফোন ধরেই বলল ‘গুড মর্নিং সাগরিকা। কেমন আছ?’
‘আসসালামু আলাইকুম দাদা, না মানে ভাইয়া ভাল আছি।’
‘খুশী হয়েছি সাগরিকা, তুমি টেলিফোন করেছ।’
‘খুশী হয়েছি তোমকে পেয়ে ভাইয়া। ভাইতেই পারিনি, মিঃ জর্জ আব্রাহামকে টেলিফোন করে তোমাকে পেয়ে যাব। ভেবেছিলাম ওনার কাছ থেকে তোমার টেলিফোন নাম্বার জোগাড় করব।’
‘আল্লাহ আমাদের সাহায্য করেছেন। একন বল সালাম কোত্থেকে শিখলে?’
‘কেন, ইসলামের উপর দখল বুঝি আপনার একার? আমার থাকতে পারে না?’
‘অবশ্যই পারে। আমি সেটাই জানতে চাচ্ছি।’
‘যাক ভাইয়া। আমি যে জন্যে আপনাকে টেলিফোন করেছি। নোয়ান নাবিলা আমাকে টেলিফোন করেছিল। বলল, ‘তোমার বন্ধু আহমদ মুসাকে শীঘ্রই আমাদের হাতের মুঠোয় আসতে হবে। সে ব্যবস্থা হয়ে গেছে।’ আমি বললাম কি ব্যবস্থা হয়ে গেছে? সে প্রশ্নের জবাব দিল না। বলল, ‘জান জেফারসন পরিবারের মিস সারা জেফারসনও আহমদ মুসাকে ভালবাসে?’ আমি বললাম, ‘দাদাকে সবাই ভালবাসতে পারে, তুমিও ভালবাসতে পার।’ তার সাথে আরও অনেক কথা হয়েছে ভাইয়া। কিন্তু ভাইয়া বলুন, কি ঘটনা? নাবিলা কেমন করে বলে যে আপনি তাদের হাতের মুঠোয় যাচ্ছেন?’
থামল সাগরিকা।
ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে উঠেছে আহমদ মুসার। চোখে-মুখে তার ভাবনার প্রকাশ। বলল, ‘ও কিছুনা সাগরিকা, তাদের অনুমান। জেনারেল শ্যারনের লোকরা সারা জেফারসনকে কিডন্যাপ করেছে। তাই তারা মনে করতে পারেসারা জেফারসনকে উদ্ধার করতে গিয়ে ওদের হাতে গিয়ে পড়ব। কিন্তু বলতো সাগরিকা, নোয়ান নাবিলা সারা জেফারসনের কথা জানল কি করে? আর এ প্রসঙ্গ হঠাৎ তোমার কাছে তুলল কেন?’
থামল আহমদ মুসা।
‘এ সংক্রান্ত কোন প্রশ্নের সে জবাব দেয়নি ভাইয়া’ বলল সাগরিকা সেন।
‘সে জবাব না দিলেও বুঝেছি সাগরিকা। সারা জেফারসনকে কিডন্যাপ করা, আমার সম্পর্কে জেনারেল শ্যারনদের পরিকল্পনা সবই সে জানে।
বলতে বলতে আহমদ মুসার মুখ প্রফুল্ল হয়ে উঠল। শ্যারনদের কাছে পৌছার অবলম্বন পেয়ে গেছে সে।
‘হতে পারে ভাইয়া। আমি তো তার বন্ধু। জানি আমি যে সে রহস্যজনক মেয়ে।’ সাগরিকা সেন বলল।
‘রহস্যজনক বলছ কেন?’
‘মাঝে মাঝে কোথাও উধাও হয়ে যায়। জিজ্ঞেস করলে বলে না।’
‘ধন্যবাদ সাগরিকা। আমি তোমাদের ওদিকে আসব।’
‘আসবেন? কবে? কখন? খুব খুশী হবো আমি।’
‘হঠাৎ করেই একদিন হাজির হবো।’
‘কিন্তু ভাইয়া, আমার ছুটি যে শেষ হয়ে যাচ্ছে। এখন তো ওয়াশিংটনেই বেশী থাকব।’
‘কিন্তু আনাপোলিশে আমাকে যেতে হবে।’
‘বুঝেছি। কিন্তু আমি না থাকলে নাবিলাকে নাও পেতে পারেন।’
‘তাহলে?’
‘আমি যাব ভাইয়া।’

পরবর্তী বই
অক্টোপাশের বিদায়

Top