৩১. ফ্রি আমেরিকা

চ্যাপ্টার

মার্কিন ফেডারেল কোর্ট।
‘রাষ্ট্র বনাম শ্যারন-জোনস এন্ড আদারস’ কেসের চার্জশীটের শুনানী চলছে।
আসামীদের ডায়াস খালি। জেনারেল শ্যারন ও ডেভিড উইলিয়ামের অনুপস্থিতিতেই তাদের বিচার শুরু হলো।
আসামীদের বিরুদ্ধে ভিন্ন ভিন্ন শিরোনামে ভিন্ন ভিন্ন মামলার ভিন্ন ভিন্ন চার্জশীট সরকারী প্রসিকিউটরের ফাইলে।
প্রথমে চলছে ‘জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন হত্যা মামলা’র চার্জশীট পাঠ।
দীর্ঘ চার্জশীট পাঠ শেষ করে সরকারী প্রসিকিউটর তার এই উপসংহার পাঠ করল, ‘ এটা নিছক একটা হত্যা মামলা নয়। এর সাথে জড়িত হয়েছে জাতি ও রাষ্ট্রের সুদূর প্রসারী স্বার্থের কথা এবং জাতি ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে চাঞ্চল্যকর ষড়যন্ত্রের বিষয়। আমেরিকার একজন শ্রেষ্ঠ সন্তান জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনকে প্রাণ দিতে হয়েছে অবশেষে তিনি আমেরিকার বুকে ছুরি মারতে রাজি হননি বলে। জেনারেল শ্যারনের নিজ উক্তিই প্রমান করে তারা আমেরিকার বুকে ছুরি মারছেন। এই ভয়ানক ‘সত্য’টিই জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন জানতে পেরেছিলেন। তাঁর মাধ্যমে যাতে ষড়যন্ত্রের এই সত্যটি বাইরে না যায়, তাই চিরতরে তার মুখ বন্ধ করার জন্যেই তাকে হত্যা করা হয়েছে। ষড়যন্ত্রের সব সত্য বিবরণ জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন প্রকাশ করে দেংয়ার সুযোগ পাননি বটে, কিন্তু মৃত্যু-মুহূর্তে তার শেষ কথায় তিনি সেই ষড়যন্ত্রের হাত থেকে আমেরিকাকে রক্ষার জন্যে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছেন এবং সর্বশেষ দুটি কাক্যে ষড়যন্ত্র সম্পর্কে কিছু ইংগিতও দিয়ে গেছেন। সর্বশেষ দুটি বাক্যে তিনি বলেছেন আমেরিকার জন্যে যে নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন তিনি দেখতেন, সে নতুন পৃথিবী যেন হয় ফাউন্ডার ফাদার্সদের, ষড়যন্ত্রের নয়। এর অর্থ আমেরিকার জন্যে ষড়যন্ত্রের এক নতুন পৃথিবী অর্থাৎ নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার-এর পরিকল্পনাও আছে, যার সাথে জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন যুক্ত ছিলেন এবং শেষ মুহূর্তে যখন তিনি টের পেলেন এটা ষড়যন্ত্র,তখনই তাকে জীবন দিতে হলো। তাহলে আমেরিকার জন্যে ষড়যন্ত্রের নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার পরিকল্পনার প্রণেতা মিঃ শ্যারন ও মিঃ জোনসরা। এই কথাই ‘ফ্রি আমেরিকা’ মুভমেন্টও বলে থাকে। তাদের অভিযোগ হলো, জেনারেল শ্যারন ও ডেভিড উইলিয়াম জোনসদের মত অশুভ নেতৃত্বের অধীন শক্তিশালী ও সক্রিয় একটা ইহুদী গ্রুপ তাদের বিত্ত ও প্রচারের জোরে আমেরিকার ঘাড়ে ষড়যন্ত্রমূলক নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার চাপিয়ে দিয়েছে। যা জাতি-রাষ্ট্র, জাতি-সংস্কৃতি ও জাতি-অর্থনীতির বিলোপ সাধন করে এক কেন্দ্রিক এক বিশ্বায়নের দিকে পৃথিবীকে নিয়ে যাবার চেষ্টা করছে। এই চেষ্টা পরিণামে আমেরিকাকে সবার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করবে। ‘ফ্রি আমেরিকা’ মুভমেন্ট বলে এবং জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনও তার অন্তিম বার্তা হিসেবে বলেছেন, আমেরিকাকে এই লক্ষ্যের দিকে পরিচালনা করা আমেরিকার ফাউন্ডার্স ফাদার্সদের চিন্তার একেবারেই পরিপন্থী। ‘ফ্রি আমেরিকা’ মুভমেন্ট তাই এক ফ্রি আমেরিকা’র দাবী করছে, যে আমেরিকা ফাউন্ডার্স ফাদার্সদের ইচ্ছা অনুসারে হবে বিশ্বে শান্তির পুরাধা, জাতিসমূহের পারিস্পরিক সমতাভিত্তিক সহাবস্থানের সহযোগী এবং দেশ-কাল-পাত্র-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আমেরিকান জীবনের এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি এখানে উত্থাপিত হত্যা-মামলার হত্যা-মোটিভের সাথে অংগাংগিভাবে জড়িত। সুতরাং হত্যার সাথে এটাও পৃথক ভাবে বিচার্য বিষয় হওয়া উচিত। জেনারেল হ্যামিল্টনের আত্মদানের দাবীও এটা। ফাউন্ডার্স ফাদার্সদের চাওয়া ‘ফ্রি আমেরিকা’ গঠন ও জেঁকে বসা অক্টোপাশের বিদায়ের মাধ্যমেই শুধু জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনের মহান আত্মত্যাগকে সম্মানিত করা যেতে পারে।’
জেনারেল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনের হত্যা-মামলার চার্জশীট উত্থাপন শেষে এর উপসংহার পাঠ করার পর সরকারী প্রসিকিউটর ‘লস আলামোসের গোয়েন্দা সুড়ঙ্গ মামলা’র চার্জশীট পেশ করা শুরু করল।
‘আরও চারটি মামলার চার্জশীট রয়েছে সরকারী প্রসিকিউটরের ফাইলে। তার প্রথমটি হলো, ‘আইজ্যাক বেনগুরিয়ান ও সাবাহ বেনগুরিয়ান কিডন্যাপ মামলা’, দ্বিতীয়টি হলো, ‘হ্যারি ময়নিহান কিডন্যাপ মামলা।’ অন্যটি ‘আহমদ মুসা কিডন্যাপ মামলা।’ সর্বশেষে রয়েছে, ‘সারা জেফারসন কিডন্যাপ মামলা’র উপস্থাপনা।
সরকারী প্রসিকিউটরের সহকারী ফিস ফিস করে মামলার এই তথ্যগুলো দিল একজন সাংবাদিককে তার একটা প্রশ্নের জবাবে।
সরকারী প্রধান প্রসিকিউটর তখন পড়ে চলছিল ‘লস আলামোস গোয়েন্দা সুড়ঙ্গ মামলা’র দীর্ঘ চাঞ্চল্যকর চার্জশীট।

এফ বি আই হেড কোয়ার্টার।
এফ বি আই প্রধানের খাস ড্রইং রুমে দুটি মুখোমুখি সোফায় বসেছিল আহমদ মুসা ও জর্জ আব্রাহাম জনসন। আব্রাহাম জনসনের কোলে তার নাতি জর্জ জনসন জুনিয়র।
‘উনি কে বলত দাদু?’ আহমদ মুসাকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল জর্জ আব্রাহাম জনসন তার নাতিকে।
‘আংকেল।’ বলল জর্জ জুনিয়র।
‘ওকে তুমি জান?’
‘হ্যাঁ’
‘কি জান?’
‘আমি ওহাইও নদীতে ডুবে গিয়েছিলাম। উনি ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাকে বাঁচিয়ে ছিলেন।’ বলল জর্জ জনসন জুনিয়র।
‘তুমি সংজ্ঞাহীন ছিলে। জান না। কার কাছে শুনেছ তুমি এ কথা?’
‘কেন, আম্মু বলেন, আব্বু বলেন।’
‘তুমি কেমন করে জান যে ইনি সেই লোক?’
‘বারে, আমাদের বাড়িতে আংকেলের ফটো টাঙানো আছে না?’
‘ফটো টাঙানো আছে? কোথায় পেয়েছ?’
‘কেন, আব্বা এনেছেন।’
‘তোমার আংকেলকে ধন্যবাদ দাও জনসন।’
‘সিওর।’
বলে দাদুর কোলে থেকেই মুখ ঘুরিয়ে আহমদ মুসার দিকে চেয়ে বলল, ‘ধন্যবাদ আংকেল।’
আহমদ মুসা ‘ওয়েল কাম সুইট বয়’ বলে কিছু বলতে যাচ্ছিল।
এসময় জর্জ আব্রাহাম জনসনের টেলিফোন বেজে উঠল।
‘এক্সকিউজ মি’ বলে টেলিফোন ধরল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
টেলিফোনে কথা বলেই জর্জ আব্রাহাম জনসন টেলিফোনটা আহমদ মুসার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘মিস সাগরিকা সেনের টেলিফোন।’
আহমদ মুসা টেলিফোন ধরেই বলল ‘গুড মর্নিং সাগরিকা। কেমন আছ?’
‘আসসালামু আলাইকুম দাদা, না মানে ভাইয়া ভাল আছি।’
‘খুশী হয়েছি সাগরিকা, তুমি টেলিফোন করেছ।’
‘খুশী হয়েছি তোমকে পেয়ে ভাইয়া। ভাইতেই পারিনি, মিঃ জর্জ আব্রাহামকে টেলিফোন করে তোমাকে পেয়ে যাব। ভেবেছিলাম ওনার কাছ থেকে তোমার টেলিফোন নাম্বার জোগাড় করব।’
‘আল্লাহ আমাদের সাহায্য করেছেন। একন বল সালাম কোত্থেকে শিখলে?’
‘কেন, ইসলামের উপর দখল বুঝি আপনার একার? আমার থাকতে পারে না?’
‘অবশ্যই পারে। আমি সেটাই জানতে চাচ্ছি।’
‘যাক ভাইয়া। আমি যে জন্যে আপনাকে টেলিফোন করেছি। নোয়ান নাবিলা আমাকে টেলিফোন করেছিল। বলল, ‘তোমার বন্ধু আহমদ মুসাকে শীঘ্রই আমাদের হাতের মুঠোয় আসতে হবে। সে ব্যবস্থা হয়ে গেছে।’ আমি বললাম কি ব্যবস্থা হয়ে গেছে? সে প্রশ্নের জবাব দিল না। বলল, ‘জান জেফারসন পরিবারের মিস সারা জেফারসনও আহমদ মুসাকে ভালবাসে?’ আমি বললাম, ‘দাদাকে সবাই ভালবাসতে পারে, তুমিও ভালবাসতে পার।’ তার সাথে আরও অনেক কথা হয়েছে ভাইয়া। কিন্তু ভাইয়া বলুন, কি ঘটনা? নাবিলা কেমন করে বলে যে আপনি তাদের হাতের মুঠোয় যাচ্ছেন?’
থামল সাগরিকা।
ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে উঠেছে আহমদ মুসার। চোখে-মুখে তার ভাবনার প্রকাশ। বলল, ‘ও কিছুনা সাগরিকা, তাদের অনুমান। জেনারেল শ্যারনের লোকরা সারা জেফারসনকে কিডন্যাপ করেছে। তাই তারা মনে করতে পারেসারা জেফারসনকে উদ্ধার করতে গিয়ে ওদের হাতে গিয়ে পড়ব। কিন্তু বলতো সাগরিকা, নোয়ান নাবিলা সারা জেফারসনের কথা জানল কি করে? আর এ প্রসঙ্গ হঠাৎ তোমার কাছে তুলল কেন?’
থামল আহমদ মুসা।
‘এ সংক্রান্ত কোন প্রশ্নের সে জবাব দেয়নি ভাইয়া’ বলল সাগরিকা সেন।
‘সে জবাব না দিলেও বুঝেছি সাগরিকা। সারা জেফারসনকে কিডন্যাপ করা, আমার সম্পর্কে জেনারেল শ্যারনদের পরিকল্পনা সবই সে জানে।
বলতে বলতে আহমদ মুসার মুখ প্রফুল্ল হয়ে উঠল। শ্যারনদের কাছে পৌছার অবলম্বন পেয়ে গেছে সে।
‘হতে পারে ভাইয়া। আমি তো তার বন্ধু। জানি আমি যে সে রহস্যজনক মেয়ে।’ সাগরিকা সেন বলল।
‘রহস্যজনক বলছ কেন?’
‘মাঝে মাঝে কোথাও উধাও হয়ে যায়। জিজ্ঞেস করলে বলে না।’
‘ধন্যবাদ সাগরিকা। আমি তোমাদের ওদিকে আসব।’
‘আসবেন? কবে? কখন? খুব খুশী হবো আমি।’
‘হঠাৎ করেই একদিন হাজির হবো।’
‘কিন্তু ভাইয়া, আমার ছুটি যে শেষ হয়ে যাচ্ছে। এখন তো ওয়াশিংটনেই বেশী থাকব।’
‘কিন্তু আনাপোলিশে আমাকে যেতে হবে।’
‘বুঝেছি। কিন্তু আমি না থাকলে নাবিলাকে নাও পেতে পারেন।’
‘তাহলে?’
‘আমি যাব ভাইয়া।’

পরবর্তী বই
অক্টোপাশের বিদায়

Top