৩২. অক্টোপাশের বিদায়

চ্যাপ্টার

গায়ানা এয়ারলাইনসের একটা ডোমিষ্টিক ফ্লাইট ল্যান্ড করল নিউ আমষ্টারডাম এয়ারপোর্টে।
নিউ আমষ্টারডাম গায়ানা উপকূলের দক্ষেণাংশের একমাত্র বড় শহর।
বিমান থেকে সবশেষে নামল দু’জন এশিয়ান। তাদের একজন শিখ। দু’জনের পরনেই ইউরোপীয় ট্যুরিষ্টের পোশাক। তাদের হাতে ট্যুরিষ্ট ব্যাগ এবং পায়েও ট্যুরিষ্ট জুতা।
শিখ লোকটা আহমদ হাত্তা নাসুমন, আর অন্য লোকটি আহমদ মুসা।
ওরা দু’জন বাইরের লাউঞ্জে বেরিয়ে এল। লাউঞ্জে কয়েকটি ট্যুরিষ্ট কোম্পানীর কাউন্টার দেখল।
সবচেয়ে সামনের যে ট্যুরিষ্ট কাউন্টারটি ছিল তার নাম ‘সেভেন হেভেন ট্যুরস’।
নামটি মজার।
আহমদ মুসা এগুলো কাউন্টারটির দিকে। কাউন্টারে হাস্যোজ্জ্বল একজন মাঝবয়েসি লোক বসে।
আহমদ মুসা কাউন্টারে পৌছতেই মাঝবয়েসি লোকটি উঠে দাঁড়িয়ে স্বাগত জানাল, ‘গুড মর্নিং, ওয়েলকাম ইয়ংম্যান।’
‘গুড মর্নিং স্যার।’ হেসে জবাব দিল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা কাউন্টারে একটু ঠেস দিয়ে দাঁড়াল। আগের হাসিটি অব্যাহত রেখেই বলল, ‘সেভেন হেভেন ট্যুরস মানে সাত স্বর্গ আপনারা সফর করাতে পারেন?’
লোকটিও হাসল। বলল, ‘চুড়ান্ত হিসেবে আটটির বেশি স্বর্গ নেই। আমরা সাতটি স্বর্গ সফর করাতে পারি মানে সবকিছুই আমরা সফর করাতে পারি দু’একটি ব্যতিক্রম ছাড়া। যেমন, দক্ষেণ সীমান্তে কেলডন পর্যন্ত আপনাদের আমরা হেসে-খেলে নিয়ে যেতে পারি। কিন্তু যদি বলেন, কেলডনের এক ইঞ্চি দক্ষেণে যাবেন। আমরা নিয়ে যেতে পারব না। যদি বলেন গায়ানা-সুরিনাম সীমান্তের সুন্দর নদী ‘কোরাজ’ এ আপনারা নামবেন, আমরা মাফ চাইব।’
আহমদ মুসা লোকটির কথার ভংগিতে হাসল, কিন্তু ভেতরে ভেতরে শংকিত হয়ে উঠল কেলডনের দক্ষেণে এক ইঞ্চি যাওয়া যাবে না শুনে।
কেলডন গায়ানার দক্ষেণ সীমান্তের সর্বশেষ শহর। এখান থেকে সুরিনামের সীমান্ত এক কিলোমিটারও নয়। আহমদ মুসাদের লক্ষ হলো কেলডন থেকে দক্ষেণে এগিয়ে ‘কোরাজ’ নদী পার হয়ে সুরিনামে প্রবেশ করা। কিন্তু ট্যুরিষ্ট কোম্পানীর লোকটির কথা শুনে তারা আকাশ থেকে পড়ল।
‘কেলডনের দক্ষেণে এক ইঞ্চিও যাওয়া যাবে না কেন?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘ও আপনারা তাহলে জানেন না। সুরিনাম সরকার বেশ কয়েকদিন হলো তাদের সীমান্ত সীল করে দিয়েছে। পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে গায়ানা সরকারও গতকাল তার সীমান্ত সীল করেছে।’ বলল লোকটি।
বিস্মিত হলো আহমদ মুসা। তাকাল সে আহমদ হাত্তা নাসুমনের দিকে। হাত্তা নাসুমনের চোখে-মুখেও বিস্ময়।
আহমদ মুসা আবার মুখ ঘুরালো ট্যুরিষ্ট কাউন্টারের লোকটির দিকে। বলল, ‘এসব সীল করা করি কেন? পাল্টা পাল্টি কেন?’
‘সুরিনামে তো নির্বাচন। সেখানে গন্ডগোল হচ্ছে। অনেক কথা শোনা যাচ্ছে। যাই হোক, লোক যাতে পালাতে না পারে, কিংবা অবাঞ্চিত কেউ যাতে প্রবেশও করতে না পারে, এজন্যেই সুরিনাম সরকার সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে। গায়ানার পাল্টা ব্যবস্থা স্বাভাবিক।’
লোকটির কথা শুনে ভ্রু কুঞ্চিত হলো আহমদ মুসার। চিন্তার ছায়া জেগে উঠল মুখে। একটু ভাবল, তারপর বলল, ‘নানা কথা শোনা যাচ্ছে বললেন, কি কথা শোনা যাচ্ছে?’
লোকটি এদিক ওদিক তাকাল। গলার স্বর একটু নিচে নামিয়ে বলল, ‘ওখানে দেদারসে লোক হারিয়ে যাচ্ছে, লোক খুন হচ্ছে।’
আহমদ মুসা ও হাত্তা নাসুমন মুখের ভাব এমন করল যেন সাংঘাতিক একটা খবর তারা শুনেছে। তারা কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে থাকল। তারপর আহমদ মুসা, ‘মহা ঝামেলায় পড়া গেল মশায়।’ বলতে বলতে তেতো খাওয়ার মত মুখ করল।
‘কি ঝামেলা?’ ট্যুরিষ্ট কাউন্টারের লোকটি জিজ্ঞেস করল।
‘দেখুন স্থল পথে উপকূল সফর করা আমাদের হবি। ক’বছর আগেই এই নিউ আমষ্টারডাম পর্যন্ত আমরা কভার করেছি। এবার এসেছি নিউ আমষ্টারডাম থেকে উপকূল পথে সুরিনামের পারামারিবো পর্যন্ত যাবে বলে।’ বলল আহমদ মুসা। কণ্ঠে তার কৃত্রিম হতাশার সুর।
লোকটি বিস্মিত হলো। বলল, ‘যাবেন কি করে? বর্ডার সীল তো আছেই। তার উপর কেলডন থেকে সুরিনামের ‘নিও নিকারী’ শহর পর্যন্ত এই চল্লিশ মাইলে কোন রাস্তা নেই।
‘এটাই তো মজার মশাই। রাস্তা নেই, কিন্তু আমরা রাস্তা বের করে যাব- এটাই তো রোমাঞ্চ।’ বলল আহমদ মুসা।
‘বুঝেছি, আপনারা জাত ট্যুরিষ্ট।’ বলল লোকটি।
‘জাত ট্যুরিষ্ট হলে কি হবে! বিপদে তো পড়লাম। কিন্তু আমরা তো ফিরতে পারিনা। একটা পথ বের করুন। আমরা আগামীকাল সন্ধ্যায় পারামারিবো পৌছতে চাই।’ আহমদ মুসা জোর দিয়ে বলল।
‘আজ উনিশ তারিখ, কাল বিশ তারিখ।’ স্বগত কণ্ঠে উচ্চারণ করল লোকটি। মুহূর্ত কয় চিন্তা করে আহমদ মুসার দিকে মুখ তুলে বলল, ‘কেলডনে চলুন। ওখানে একটা গ্রুপের সাথে পরিচয় করিয়ে দেব। ওরা আপনাদের নিও নিকারীতে পৌছে দেবার ব্যবস্থা করবে। কিছু বেশি খরচ হবে। রাজী আছেন?’
‘হ্যাঁ আমরা রাজী।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ। আমি আপনাদের কেলডনে নেবার ব্যবস্থা করছি।
সেদিনই বেলা ১২টার দিকে আহমদ মুসারা কেলডনে পৌছেছে। একটা হোটেলে উঠে গোসল ও খাওয়া সেরে আহমদ মুসারা একটা লম্বা ঘুম দিয়েছে।
ঘুম ভাঙতেই তার হাত ঘড়িতে দেখল বেলা সাড়ে তিনটা বাজে।
উঠে বসল আহমদ মুসা। ‘সেড্ডি’ নামক লোকটা সাড়ে তিনটার দিকেই তো আসার কথা।
সেভেন হেভেন ট্যুরসের পক্ষ থেকে ‘সেড্ডি’ আহমদ মুসাদের সাথে কেলডনে এসেছে। তাকেই সব নির্দেশ দিয়ে পাঠিয়েছে সেভেন হেভেন ট্যুরসের পক্ষ থেকে।
বিছানায় উঠে বসেছিল আহমদ হাত্তা নাসুমনও।
আহমদ মুসা হাত্তার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মি. হাত্তা দুই দেশের সরকার সীমান্ত সীল করে দেয়ার পরিস্থিতিতে আমাদের সুরিনামে প্রবেশ নিয়ে আপনি কি ভাবছেন?’
‘এই সীমান্ত নিয়ে বিরোধ আছে। সীমান্ত সীল হওয়ার ঘটনা আগেও ঘটেছে। এবার ঘটেছে সুরিনামের অভ্যন্তরীণ কারণে। সুরিনামে যা ঘটছে, বাইরের দুনিয়াকে তা তারা জানতে দিতে চায় না। বর্ডার সীল করে যাতায়াত, বিশেষ করে অবৈধ যাতায়াত বন্ধ করা যায় না। এবার কি ঘটেছে জানি না। পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর পাশে রাজনৈতিক ক্যাডাররা এবার বেশি তৎপর হবে।’ বলল আহমদ হাত্তা নাসুমন।
হাত্তা নাসুমনের কথা শেষ হতেই দরজায় নক হলো।
আহমদ মুসা গিয়ে দরজা খুলল। দেখল দরজায় দাঁড়িয়ে সেড্ডি ও আরেকজন লোক।
‘গুড ইভনিং, আসুন।’ বলে আহমদ মুসা দরজার একপাশে সরে দাঁড়াল।
ঘরে প্রবেশ করল ওরা দু’জন।
আহমদ মুসা দরজা বন্ধ করে ফিরে এল। ইতিমধ্যে হাত্তা নাসুমন উঠে দাঁড়িয়ে ওদের স্বাগত জানিয়েছে এবং বসতে দিয়েছে।
ওরা যে সোফায় বসেছে তার বিপরীত দিকের সোফায় পাশা পাশি আহমদ মুসা ও হাত্তা নাসুমন বসল।
সেড্ডি তার সাথীর পরিচয় দিতে গিয়ে বলল, ‘নাম জিগান। সে সুরিনামের নাগরিক, আবার গায়ানারও নাগরিক। দু’দেশেই তার অবাধ গতি। তার অসাধ্য কিছু নেই।’
জিগান লোকটি তাকাল আহমদ মুসাদের দিকে। আহমদ মুসাও তাকে দেখছিল। জাত ক্রিমিনালের চেহারা জিগানের। তার দৃষ্টি দেখে মনে হচ্ছে সে শুধু আহমদ মুসাদের দেখছে না, তাদের ভেতরটাও সে যেন পাঠ করছে।
জিগান তার চোখের সার্চ আহমদ মুসাদের উপর অব্যাহত রেখে জিজ্ঞেস করল ভাঙা ইংরেজীতে, ‘আপনাদের সাথে মালামাল কি আছে?’
‘কোন মালামাল নেই, দু’জনের শুধু দু’টি হ্যান্ড ব্যাগ।’ আহমদ মুসা বলল।
জিগান দাঁত বের করে হাসল। বলল, ‘ও ভুলে গিয়েছিলাম, আপনারা তো ট্যুরিষ্ট। কিন্তু বিনা লাভে এত কষ্ট করবেন?’
‘কষ্টের অভিজ্ঞতাই আমাদের লাভ।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আপনারা কোন পথে যাবেন?’ জিজ্ঞেস করল জিগান।
‘আমাদের কোন ধারণা নেই, আপনিই বলুন কোন পথে যাওয়া ভাল হবে?’ আহমদ মুসা বলল।
‘দু’পথের যে কোন একটা পছন্দ করতে পারেন- জল পথ ও স্থল পথ। জল পথ কোরাজ নদী হয়ে গায়ানা উপসাগর পথে নিও নিকারীতে যাওয়া যাবে। জল পথটা আরামদায়ক, কিন্তু কোষ্ট গার্ডদের হাতে ধরা পড়ার ভয় আছে। আর স্থল পথ কোন পথ নয়। কোরাজ নদী পার হয়ে ৪০ মাইল হাঁটতে হবে জঙ্গল জলাভূমি ও উঁচু-নিচু পথ ধরে নিও নিকারী পর্যন্ত। এ পথ তুলনামুলকভাবে নিরাপদ। নিও নিকারী পর্যন্ত দুই পথের খরচ একই, আড়াই হাজার মার্কিন ডলার।’ কথাগুলো মুখস্থের মত গড় গড় করে বলে গেল জিগান।
আহমদ মুসা একবার আহমদ হাত্তার দিকে চাইল। তারপর বলল, ‘খরচটা বেশি হলো না?’
হো হো করে হাসল জিগান। বলল, ‘খরচ সর্বনিম্ন ধরেছি। এর মধ্যে খাওয়া, যাওয়া ও কমিশন সবই রয়েছে।’
‘কমিশন কি?’ মুখে কৃত্রিম বিস্ময় টেনে বলল আহমদ মুসা।
সব জান্তার হাসি হাসল জিগান। বলল, ‘নতুন আপনারা জানবেন কি করে? সীমান্তের দুই পাশে সরকারী-বেসরকারী অনেক গ্রুপ ও গ্যাং আছে যাদের আমাদের সন্তুষ্ট রাখতে হয়। এই সন্তুষ্টির ফি অনেক বড়।’
‘ঠিক আছে মি. জিগান। দাবী অনুসারে খরচ পাবে। কিন্তু আগামী কাল সন্ধ্যার মধ্যে আমাদের পারামারিবো পৌছতে হবে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘চিন্তা নেই বিকেলের আগেই আপনারা সেখানে পৌছে যাবেন।’ জিগান বলল।
‘আমরা যাত্রা করছি কখন?’ আহমদ মুসা জিজ্ঞেস করল।
‘আপনারা প্রস্তুত থাকলে এক ঘন্টার মধ্যেই।’ জিগান বলল।
‘আমরা প্রস্তুত।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আমাদের প্রস্ত্ততিও এক ঘন্টার মধ্যে হয়ে যাবে। বলে উঠে দাঁড়াল জিগান। নিজের হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমরা ঠিক সাড়ে চারটায় যাত্রা করব। সেড্ডি আপনাদেরকে আমাদের ওখানে নিয়ে যাবে।’
‘ঠিক আছে।’ বলল আহমদ মুসা।
কথা শেষ করেই জিগান ঘুরে দাঁড়িয়ে হাঁটা শুরু করেছে।

কোরাজ নদী দুই ঘন্টা আগে পেরিয়ে এসেছে তারা।
রাত ৮টায় তারা এক টিলায় পৌছেছে।
টিলাটি ছোট-খাট একটা পাহাড়। ঘন গাছ-গাছড়ায় আচ্ছাদিত।
এই পাহাড়ের মাথায় ঘন গাছ-গাছড়ার মধ্যে টিনের তৈরী একটা বিশাল বাড়ি। দেয়াল ও চাল সবই টিনের তৈরী।
এই বাড়ির একটা বড় কক্ষে দু’টি বিছানা পাতা। সেখানে আহমদ মুসা ও হাত্তা নাসুমনের থাকার স্থান নির্ধারিত হয়েছে।
আহমদ মুসা ও হাত্তা নাসুমন দু’জনেই বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে।
কোরাজ নদী পার হয়ে তারা সুরিনামে প্রবেশ করেছে এবং এ পর্যন্ত দু’ঘন্টার পথ তারা পাড়ি দিয়েছে বড় চাকার রিক্সা ভ্যানে। এ রিক্সা ভ্যানটি রাস্তাছাড়াও এবড়ো-থেবড়ো জমি ও জলজভূমির উপর দিয়েও চলতে পারে।
রিক্সা ভ্যান টেনেছে দু’জন নিগ্রো। আর ভ্যানের আরোহী ছিল চারজন। আহমদ মুসারা দু’জন এবং জিগান ও তার সাথী জয়সা।
আহমদ মুসা ও হাত্তা নাসুমন দু’জনেই চোখ বন্ধ করে বিশ্রাম উপভোগ করছে। প্রায় ২৪ ঘন্টা পর তাদের পিঠ বিছানার সাক্ষাত পেয়েছে।
দরজায় নক হলো।
আহমদ মুসা চোখ খুলল। বলল, ‘আসুন।’
ঘরে প্রবেশ করল জিগান।
আহমদ মুসা উঠে বসে তাকে স্বাগত জানাল ও বসতে বলল।
দুই বেডের মাঝখানে বিরাট খালি জায়গায় একটা টেবিল ও দু’টি চেয়ার ছিল। তারই একটিতে বসল জিগান। বসে আহমদ মুসা হাত্তা নাসুমন দু’জনের দিকে একবার তাকিয়ে বলল, ‘স্যাররা কেমন আছেন, কেমন লাগছে।’
‘না, বেশ ভালো। ভ্যান বেশ জোরেই এসেছে। খুব ভাল টেনেছে ওরা। নিগ্রোদের কোথায় পেলেন? গায়ানা ও সুরিনামের এ অঞ্চলে যা দেখলাম সবই তো এশিয়ান অরিজিন।’ বলল আহমদ মুসা।
জিগান হাসল। বলল, ‘এরা দারুণ পরিশ্রমী শ্রমিক। অনেক পশ্চিমে সুরিনামের ওয়েলহেলমিনা পর্বত এলাকায় এদের বাস। কাবালোবা নদী বেয়ে এরা প্রায়ই নেমে আসে অর্থ উপার্জনের জন্যে। খুব সস্তায় কেনা যায় এদের শ্রম।’
‘এই জংগলে এই সুন্দর বাড়ি কি করে পেলেন?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘হবেই তো। এটা নিকারী জমিদারদের একটা তহশিল অফিস ছিল কিছুদিন আগেও। এখান থেকে এই এলাকার বনজ ও জলজ সম্পদের এবং কিছু কৃষি জমি আছে তার খাজনা আদায় হতো। সেই সাথে এটা ছিল পুলিশ ফাঁড়িও।’ বলল জিগান।
‘ছিল মানে, এখন নেই?’ প্রশ্ন আহমদ মুসার।
‘নেই। জমিদারের পুলিশ মানে পাইক-পিয়াদা ও খাজনা আদায়কারীরা পালিয়ে গেছে না হারিয়ে গেছে কিছু একটা হয়েছে।’ বলল জিগান।
‘এখন কে থাকেন এখানে?’ বলল আহমদ মুসা।
‘নতুন সরকারের লোকরা।’ জিগান বলল।
‘সরকারের লোকরা মানে সরকারী কর্মচারীরা? তাহলে তো সুবিধাই হবে।’ আহমদ মুসা কৃত্রিম উৎসাহ দেখিয়ে বলল।
‘না সরকারী কর্মচারীরা কেউ নেই। সরকার পক্ষের লোক আছে। ওরা নতুন জমিদার। দেখছেন না এলাকায় লোকজন নেই বললেই চলে। নতুন জমিদারের লোকজনরা পুরানো প্রজাদের উচ্ছেদ করেছে।’ বলল জিগান।
আহমদ মুসার মুখ-চোখ লাল হয়ে উঠেছে। তার কাছে এটা পরিষ্কার হয়ে উঠেছে, হাত্তা নাসুমন ও ওয়াং আলীরা যে কালো থাবার শিকার সে কালো থাবা এখানেও এসে পৌছেছে। বলল সে, পুরাতন প্রজারা কোথায় গেল?’
‘কেউ বলে নিখোঁজ হয়েছে, কেউ বলে পালিয়েছে, কেউ কেউ বলে সীমান্তের ওপারে চলে গেছে। সবাই বলে, নির্বাচন পর্যন্ত এই অবস্থা চলবে।’ জিগান বলল।
কথা শেষ করেই জিগান দ্রুত আবার বলল, ‘তবে নতুন জমিদারের লোকরা আসায় আমাদের সুবিধা হয়েছে। এরা শুধু পয়সা চায়। পয়সা দিয়ে যা ইচ্ছে তাই করা যায়। আগে তহসিলের মেহমান খানায় আমরা বিনা পয়সায় থাকতে পারতাম বটে, কিন্তু অন্য কোন সুযোগ নেয়া যেত না। এখন দেখুন পয়সা দিয়ে তহসিল অফিসের সবচেয়ে ভালো রুম আমরা পেয়ে গেছি।’
‘তাহলে তো লোকরা ভালই। কি বলেন?’ আহমদ মুসা বলল।
‘টাকা খোর স্যার। এখন পয়সা না দিলে মেহমান খানাতেও থাকা যায় না।’
কথা শেষ করে একটু থেমে প্রসংগ পাল্টিয়ে সে বলল, ‘স্যার ভোর পাঁচটায় আমরা যাত্রা করব। দশটার মধ্যেই নিও নিকারীতে পৌছে যাব।’ বলে উঠে দাঁড়াল জিগান।
বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
আহমদ মুসা উঠে গিয়ে দরজা বন্ধ করে এসে বিছানায় বসল।
আহমদ মুসা জিগানের সাথে কথা বলার সময় শিখবেশী হাত্তা নাসুমন একটি কথাও বলেনি।
আহমদ মুসা এসে তার বিছানায় বসতেই কথা বলে উঠল হাত্তা নাসুমন। বলল, ‘আহমদ মুসা এই এলাকা ছিল নিকারীর এক জমিদার নাসের সুকামোর রাজ্য। দু’মাস আগেও এই এলাকা তারই দখলে ছিল।’
বলে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ল হাত্তা নাসুমন। বলল, এই ভাবেই ওরা হিটলারী কায়দায় দেশের মুসলিম কম্যুনিটির প্রভাব, প্রতিপত্তি, শক্তি সব ধ্বংস করতে চাচ্ছে।
‘মি. হাত্তা, আমি যতটা আঁচ করছিলাম তার চেয়েও পরিস্থিতি ভয়াবহ। তবে শহরাঞ্চলে এই ভয়াবহতা একটু কম হবে। শহরে তারা লোকদের গুম করার মাধ্যমে মুসলমানদের ভিত ও দুর্বল করেছে। কিন্তু প্রত্যন্ত গ্রাম এলাকা তারা দখল করে নিচ্ছে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ঠিক। পরিস্থিতি এটাই মি. আহমদ মুসা।’
আহমদ মুসা শুয়ে পড়ল। বলল, ‘আল্লাহ ভরসা। শুয়ে পড়ুন মি. হাত্তা। পাঁচটায় যেতে হলে আমাদের চারটায় উঠতে হবে।’
‘ঠিক।’ বলে হাত্তা নাসুমনও শুয়ে পড়ল।
গভীর রাত।
আহমদ মুসা ও হাত্তা নাসুমন ঘুমিয়ে।
তাদের দরজায় ধীরে ধীরে নক হলো।
একবার। দু’বার। তিনবার। তৃতীয় বারের সময় আহমদ মুসা চোখ খুলল। উঠে বসল বিছানায়। দেখল, হাত্তা নাসুমনও চোখ খুলেছে।
‘কে দরজায়?’ দরজার দিকে তাকিয়ে অনুচ্চ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
জবাব এল না, কিন্তু দরজায় আরেকবার নক হলো।
আহমদ মুসা বালিশের তলা থেকে রিভলবার নিয়ে উঠে দাঁড়াল।
‘না মি. আহমদ মুসা, কথা না বললে দরজা খুলবেন না। শুনেছেন তো, এদিকের অবস্থাও ভাল নয়।’ অনুচ্চ কণ্ঠে বলল হাত্তা নাসুমন।
‘মি. হাত্তা, আমার মনে হচ্ছে দরজায় যে নক করছে, সে আমাদের শত্রু নয়। শত্রু হলে দরজা খুলবার জন্যে কথা বলত। তবু আমি রিভলবার নিলাম।’
বলে আহমদ মুসা দরজার দিকে এগুল।
ডান হাতে রিভলবার বাগিয়ে রেখে বাঁ হাতে দরজা খুলল আহমদ মুসা।
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে একজন নিগ্রো। আহমদ মুসার হাতে রিভলবার দেখে ভীষণ ভয় পেয়ে গেছে। সংগে সংগেই সে দু’হাত উপরে তুলেছে। তারপর সে ডান হাত একটু নিচে নামিয়ে তর্জনি তার ঠোঁটে ঠেকিয়ে আহমদ মুসাকে কথা বলতে নিষেধ করল।
আহমদ মুসা নিগ্রোর চেহারা দেখেই বুঝেছে সে শত্রুতা করতে আসেনি এবং আরও বুঝল সে আহমদ মুসা ছাড়াও অন্য কাউকে ভয় করছে এবং তার আসাকে গোপন করতে চাচ্ছে।
আহমদ মুসা দরজার একটু পাশে সরে গিয়ে তাকে লক্ষ করে ফিস ফিস কণ্ঠে বলল, ‘ভেতরে এস।’
নিগ্রোটি যেন এ কথারই অপেক্ষা করছিল। আহমদ মুসা ভেতরে আসার আহবান করার সাথে সাথে সে ভেতরে ঢুকে গেল।
আহমদ মুসা বাঁ হাতে দরজা বন্ধ করে ডান হাতের রিভলবারটা নিগ্রোর দিক থেকে সরিয়ে নিয়ে চেয়ার দেখিয়ে তাকে বসতে বলল।
সে চেয়ারে বসল না। বলল, ‘স্যার জিগান ও জয়সাকে ওরা মেরে ফেলেছে। আপনাদেরকেও ধরা বা মারার জন্যে যে কোন সময় এসে পড়বে।’ ভয় ও উত্তেজনায় গলা কাঁপছে নিগ্রোটির।
তার কথা শুনে আহমদ মুসা আকাশ থেকে পড়ল। বিস্ময়ের ধাক্কা কাটাতে তার মুহুর্ত খানেক সময় লাগল। তারপর বলল, ‘কারা মেরে ফেলেছে?’ আহমদ মুসার কণ্ঠ কঠোর। তার চোখে নিগ্রোর প্রতি সন্দেহ দৃষ্টি।
‘স্যার, নতুন জমিদারের লোকরা।’ জবাব দিল নিগ্রোটি।
‘নতুন জমিদারদের লোকরা? কেন মেরেছে?’ বলল আহমদ মুসা। তার ভ্রু দু’টি কুঞ্চিত হয়ে উঠেছে। ভাবছে সে।
‘নতুন জমিদাররা জানতে পেরেছে আপনারা মুসলমান। তাই জিগানকে তারা বলেছিল আপনাদেরকে তাদের হাতে তুলে দিতে এবং বিষয়টা গোপন রাখতে। কিন্তু জিগান তাতে রাজী হয়নি কিছুতেই। কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে ওরা জিগান ও জয়সা দু’জনকেই গুলী করে মেরেছে।’ বলল নিগ্রোটি ভয় জড়িত কণ্ঠে।
‘ওরা এখন কোথায়?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘সবাইকে ডেকে নিয়ে ঘরে ঢুকেছে। মনে হয় পরামর্শ করতে বসেছে।’ বলল নিগ্রোটি।
‘কেমন করে বুঝলে, ওরা যে কোন সময় আক্রমণে আসবে?’
‘ওরা বলেছে স্যার। জিগানদের খুন করেই ওদের একজন চিৎকার করে বলেছে, ‘চল তাড়াতাড়ি ছদ্মবেশী শয়তান দু’টোকে ধরতে হবে। কিন্তু অন্য একজন বলেছে, চল তার আগে একটু পরামর্শ করে নেই। এরপর ওরা ঘরে ঢুকেছে।’
‘ধন্যবাদ………। কি যেন তোমার নাম বলেছিলে?’
‘বোংগো। ওমর বোংগো।’
তার নাম শুনে চমকে উঠল আহমদ মুসা। তার উপর সন্ধানী দৃষ্টি রেখে আহমদ মুসা বলল, ‘তুমি মুসলিম? কিন্তু আগে তো বোংগো নাম বলেছিল, ওমর বোংগো বলনি?’
‘কাজের জন্যে এলে আমরা আমাদের মুসলিম পরিচয় গোপন করি। আপনারা মুসলিম জেনেই আমাদের মুসলিম পরিচয় দিলাম।’ বলল ওমর বোংগো।
‘তোমার সাথী কোথায়? তার নাম কি?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘সে ওদের ঘরের বাইরে এক স্থানে লুকিয়ে ওদের উপর চোখ রাখছে। তার নাম ‘কাসিমী ওয়ে এমবা।’ বলল ওমর বোংগো্
‘আমরা মুসলমান বলেই তোমরা আমাদের সাহায্য করেছ?’ আহমদ মুসা বলল।
‘জি স্যার। তাছাড়া আমরা আপনাদেরই সাথী। আপনাদের নিউ নিকারীতে পৌছানো আমাদের দায়িত্ব।’ বলল ওমর বোংগো।
আহমদ মুসা দু’ধাপ এগিয়ে গভীর আবেগে জড়িয়ে ধরল ওমর বোংগোকে। বলল, ‘ধন্যবাদ ওমর বোংগো। আমরা খুব খুশি হয়েছি তোমরা মুসলমান জেনে।’
আহমদ মুসা ওমর বোংগোকে আলিংগন থেকে ছেড়ে দিয়ে বলল, ‘ওমর বোংগো, আমাদের স্যার বলবে না, ভাই বলবে। আর শোন তুমি এখন তোমার সাথীর কাছে ফিরে যাও এবং ওদের উপর নজর রাখ। কোন ভয় নেই, ওদেরকে আমাদের এখানে আসতে দাও।’
ওমর বোংগোর চোখে-মুখে আনন্দ ও কৃতজ্ঞ দৃষ্টি।
কথা শেষ করে আহমদ মুসা হাত্তা নাসুমনকে বলল, ‘আপনি কিছু বলবেন ওমরকে?’
‘ধন্যবাদ ওমর। আমরা খুব খুশি হয়েছি। জান ওরা কতজন লোক আছে?’ হাত্তা নাসুমন বলল।
‘ওরা চারজন। দু’জন নতুন জমিদারের লোক। আর দু’জন প্রহরী।’ বলল ওমর বোংগো।
‘ধন্যবাদ ওমর।’ হাত্তা নাসুমন বলল।
‘ধন্যবাদ, আসসালাম।’ বলে ঘুরে দাঁড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল ওমর বোংগো।
আহমদ মুসা হাত্তা নাসুমনের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আপনার প্রশ্নের জন্যে ধন্যবাদ। ওদের সংখ্যা জানা আমাদের খুব প্রয়োজন ছিল।’
‘ওয়েলকাম। মি. আহমদ মুসা, আপনি এ ঘটনাকে কোন দৃষ্টিতে দেখছেন?’ বলল হাত্তা নাসুমন।
‘জিগানদের মৃত্যু খুবই বেদনাদায়ক। তবে শত্রুদের এত তাড়াতাড়ি দেখা পাওয়ায় খুব খুশি হয়েছি।’
‘ওদের জন্যে অপেক্ষা না করে আমরাই ওদের খুঁজে নিলে হতো না?’
‘ওরাই প্রথম আক্রমণ করুক মি.হাত্তা।’
বলে আহমদ মুসা গিয়ে দরজা বন্ধ করে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিল এবং বলল, ‘আসুন মি. হাত্তা একটু ঘুমিয়ে নেয়া যাক।’
‘এই অবস্থায় আপনার ঘুম ধরবে?’ হাত্তা নাসুমনের কণ্ঠে বিস্ময়।
‘চিন্তার কিছু নেই, ওরাই তো এসে ডেকে তুলবে।’ বলল আহমদ মুসা ঠোঁটে হাসি টেনে।
বলে আহমদ মুসা চোখ বুজল।
হাত্তা নাসুমনও শুয়ে পড়ল।
কিন্তু ঘুমাতে পারল না সে।
রাজ্যের ভাবনার আনাগোনা মাথায় নিয়ে কত সময় তার গেল কে জানে।
হঠাৎ তার মনে হলো দরজার বাইরে অনেকগুলো পায়ের শব্দ। উৎকর্ণ হলো সে। ঠিক পায়ের শব্দগুলো একদম দরজার গোড়ায় এসে গেছে।
উঠে বসল হাত্তা নাসুমন।
আহমদ মুসাকে ডাকবে বলে দ্রুত নামতে গেল। এমন সময় দরজায় যেন বাজ পড়ল।
সেই ভীষণ শব্দের রেশ বাতাসে মিলাবার আগেই দেখা গেল ঘরের দরজা মেঝেয় এসে ছিটকে পড়েছে।
ঘরের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে দু’জন। তাদের হাতে রিভলবার। তাদের পেছনে আরও দু’জন দাঁড়িয়ে। তাদের হাতে ষ্টেনগান।
দরজা ভাঙার শব্দে আহমদ মুসাও ঘুম থেকে জেগে গেছে। সে উঠে বসেনি।
বালিশে ঠেস দিয়ে আধ বসা অবস্থায় সে। তার দু’হাতও বালিশের দু’পাশে ঠেস দেয়া।
আর হাত্তা নাসুমন তার বিছানায় বসে। তার দু’পা নিচে নামানো।
দরজায় দাঁড়ানো দু’জন মাঝ বয়সী রিভলবারধারী। চেহারা এ্যাংলো ইন্ডিয়ান। শক্ত-সমর্থ ক্রিমিনাল আকৃতির দেখতে।
দু’জনের একজন চিৎকার করে বলল, ‘তোমরা নাম ভাঙিয়ে ছদ্ম পরিচয় নিয়ে বেআইনিভাবে সুরিনামে প্রবেশ করেছ। তোমাদের…………।’
আহমদ মুসা তার কথায় বাঁধা দিয়ে নেহায়েত গোবেচারার মত শান্ত গলায় বলল, ‘কিছুই বুঝতে পারছি না আপনাদের কথা। আমাদের কথা শোনেননি। আমাদের কাগজপত্র দেখেননি। কি করে বুঝলেন আমরা বেআইনিভাবে প্রবেশ করেছি?’
আহমদ মুসা একদিকে কথা বলছে, অন্যদিকে তার ডান হাত এক সুতা এক সুতা করে বালিশের তলায় এগিয়ে যাচ্ছে তার এম-১০ হাত করার জন্যে।
আহমদ মুসা থামলে সেই দু’জনের একজন চিৎকার করে উঠল, ‘কোন কাগজপত্র আমাদের দেখার দরকার নেই। তোমরা মুসলমান। পরিচয় ভাড়িয়ে তোমরা সুরিনামে প্রবেশ করেছ।’
‘না কোন পরিচয় ভাড়ানো হয়নি। আমাদের পাসপোর্ট-ভিসায় আমার নাম পরিষ্কার লেখা আছে। দেখুন কাগজ পত্র’। বলল আহমদ মুসা একেবারে শান্ত কণ্ঠে।
‘তোমাদের একজনের শিখের চেহারা ও পোশাক। এটা কি পরিচয় ভাড়ানো নয়?’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘আপনারা দেখছি, মুসলমানদের কিছুই জানেন না। শিখদের অনেক অনেক আগে থেকে মুসলমানরা এই ধরনের দাড়ি রাখে ও পাগড়ি পরে।’
আহমদ মুসার হাসি দেখে ওরা আরও জ্বলে উঠল। বলল, ‘শয়তান মুসলমানের বাচ্চা। দেখাচ্ছি মজা।’
বলে লোকটি তার রিভলবার তুলছিল আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসার ডান হাত তখন তার এম-১০ এর বাঁটে। আহমদ মুসা বলে উঠল, ‘তোমরা এসব কি কথা বলছ। আমরা তোমাদের………..।’
আহমদ মুসার এ কথার সাথে সাথে তার ডান হাত এম-১০ নিয়ে বিদ্যুত বেগে বেরিয়ে এল।
ওরা আহমদ মুসাদের তরফ থেকে পাল্টা আক্রমণের কল্পনাও করেনি। তাই তারা খাঁচায় পোরা পাখির মতই খেলছিল আহমদ মুসাদের নিয়ে। আহমদ মুসার এম-১০ মেশিন রিভলবারকে যখন তাদের দিকে ঘুরে আসতে দেখল, তখন অবিশ্বাস্য এই পরিস্থিতি তাৎক্ষণিকভাবে তাদের বিমূঢ় করে দিল। তাদের হাতের রিভলবার কাজে লাগাতে পারল না।
আহমদ মুসার এম-১০ মেশিন রিভলবার থেকে বেরিয়ে আসা গুলীর ঝাঁক এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল ওদের উপর।
সামনের দু’জন রিভলবারধারী, পরে পেছনের দু’জন ষ্টেনগানধারী গুলীবিদ্ধ হয়ে ভূলুন্ঠিত হলো।
আহমদ মুসা লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নেমে ওদের দিকে এগুল। ওদের কাউকে জীবন্ত তার চাই।
কিন্তু চারজনের মধ্যে পেছনের ষ্টেনগানধারী একজনকে কথা বলার পর্যায় পেল। কিন্তু সে লড়ছিল মৃত্যুর সাথে। কোন প্রশ্নের জবাব সে দিল না। কিছুক্ষণের মধ্যে সেও মারা গেল।
হতাশভাবে উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা। হাত্তা নাসুমনও এসে আহমদ মুসার পাশে দাঁড়িয়েছিল।
‘ওদের এই চারজনকে প্রথম পাওয়া গেল, কিন্তু জীবিত পাওয়া গেল না। অথচ নিখোঁজ হওয়া মানুষ কোথায় যাচ্ছে, এটা জানা খুবই দরকার।’ হতাশ কণ্ঠ আহমদ মুসার।
এ সময় ওমর বোংগো তার সাথী কাসিমী ওয়ে এমবাকে নিয়ে ছুটে এল। আহমদ মুসার কাছে এসে ওমর বোংগো বলল দ্রুত কণ্ঠে, ‘আমি আড়ালে দাঁড়িয়েছিলাম। সব দেখেছি স্যার। আল্লাহ আপনাকে আরও শক্তি দিন। একটা খবর আছে স্যার।’
‘কি খবর?’ আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘আমি গিয়েছিলাম ওয়ে এমবাকে ডাকতে। আমি তাকে বাইরে পাহারায় রেখেছিলাম। সে একটা খবর বলল।’
তারপর ওমর বোংগো ওয়ে এমবার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘স্যারকে বল খবরটা।’
ওয়ে এমবার বয়স কম। তারুণ্য এখনও কাটেনি। তার চোখে-মুখে ভয় ও জড়তা। সে আহমদ মুসার দিকে চোখ তুলে একবার তাকাল এবং বলল, ‘স্যার একটা বড় আলো এদিকে এ বাড়ির দিকে এগিয়ে আসছিল। গুলীর শব্দ হওয়ার সাথে সাথে সে আলো নিভে গেছে। আর জ্বলেনি।’
ভ্রু কুঞ্চিত হলো আহমদ মুসার।
‘স্যার একদল বা কিছু লোক এদিকে আসছিল। গুলীর শব্দ শুনে এ বাড়িকে সন্দেহ করে তারা আলো নিভিয়ে দিয়েছে।’ বলল ওমর বোংগো।
‘কি করে বুঝলে একদল লোক আসছিল?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘আমাদের জংগল পথে এ ধরনের বড় আলো কোন দল না হলে জ্বালায় না। দু’একজন হলে টর্চ ব্যবহার করতো।’
‘কেন জ্বালায় না?’
‘রাতে জংগলে আলো নিয়ে চলা বিপদের কারণ ঘটায়। তাই আলো সবাই পরহেজ করে চলে। আর বেশি লোক হলে আলো প্রয়োজন হয়। আর তখন আলো জ্বালানোও হয়। এ আলো তখন এই সংকেতও দেয় যে, আমাদের শক্তি কারও চেয়ে কম নেই। আবার হঠাৎ যখন এ আলো নিভে যায়, তার অর্থ দাড়ায় তারা ভয় পেয়েছে বা কোন ষড়যন্ত্র আঁটছে।’ ওমর বোংগো বলল।
‘তাহলে একদল লোক বা কিছু লোক আসছিল, ভয়ে তারা আলো নিভিয়ে দিয়েছে?’ প্রশ্ন করল আহমদ মুসা।
‘তাই মনে হচ্ছে।’ বলল ওমর বোংগো।
‘ওরা কারা বলতে পার?’ আহমদ মুসা বলল।
একটু চিন্তা করল ওমর বোংগো। বলল, ‘স্যার, হয় ওরা চোরা চালানী, না হয় কোন গোপন কাজে লিপ্ত।’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘তোমার বুদ্ধির প্রশংসা করছি বোংগো। এখন বলত, দুই ধরনের মধ্যে কোন ধরনের লোক ওরা?’
‘বলতে পারছি না স্যার। দু’দিকেই আমার সমান সন্দেহ।’ বলল ওমর বোংগো।
‘আমার বিশ্বাস ওরা কোন গোপন কাজে লিপ্ত। চল দেখি।’
বলে আহমদ মুসা বাইরে যাওয়ার জন্যে হাঁটা শুরু করল।
আহমদ হাত্তা নাসুমন ও ওমর বোংগোরা আহমদ মুসার পেছন পেছন চলল।
বাড়ির গেটে গিয়ে আহমদ মুসা ঘর থেকে কুড়িয়ে আনা মৃত একজনের রিভলবার হাত্তা নাসুমনের হাতে দিয়ে বলল, ‘আপনি গেটের ভেতরে দাঁড়ান যাতে নজর এড়িয়ে কেউ ভেতরে আত্মগোপন করতে না পারে।’
আহমদ মুসা ওমর বোংগোদের দু’জনকে নিয়ে সামনে হাঁটতে শুরু করল।
গেটের সামনে ছোট-খাট একটা খালি চত্বর। তারপর বড় বড় গাছ-পালা ও ঝোপ-ঝাড়ের শুরু। এই গাছ-পালা ঝোপ-ঝাড়ের মধ্যে একটা মেঠো পথ টিলার নিচে সমভূমিতে নেমে গেছে।
চত্বরের মাঝে দাঁড়িয়ে আহমদ মুসা জিজ্ঞেস করল ওয়ে এমবাকে, ‘তুমি বড় আলোটা কোথায় দেখেছিলে?’
ওয়ে এমবা একটু পেছনে সরে গেল। গেটের পাশে বড় একটা গাছের গুড়ির উপর দাঁড়িয়ে বলল, ‘ঐখানে টিলার নিচে।’
আহমদ মুসাও গাছের গুড়িতে উঠল। দেখে বলল, ‘সমতলের যেখান থেকে রাস্তাটা টিলায় উঠে এসেছে, সেখানেই তাহলে আলোটা দেখা গেছে। তার অর্থ ওরা টিলায় উঠতে আসছিল।’
আহমদ মুসা লাফ দিয়ে নামল গাছের গুড়ি থেকে।
ওমর বোংগোদের বলল, ‘তোমরা এস আমার সাথে।’
বলে আহমদ মুসা হাঁটতে শুরু করল চত্বর দিয়ে টিলা থেকে নেমে যাওয়া রাস্তার দিকে।
ওমর বোংগোরাও চলল তার পেছনে।
চারদিকে ঘন অন্ধকার।
চত্বরটায় অন্ধকার একটু ফিকে, কিন্তু টিলা থেকে সমতলে নেমে যাবার রাস্তাটা ঘুটঘুটে অন্ধকারে ঢাকা।
সেই রাস্তার মুখে পৌছল আহমদ মুসা।
পেছনে একবার তাকিয়ে দেখল, ওমর বোংগোরা কতটা পেছনে। তারপর মেশিন রিভলবারটা হাতে তুলে নিয়ে রাস্তা দিয়ে নামা শুরু করল।
দু’পাশে উঁচু গাছ-পালা ও ঝোপ ঝাড়।
দশ বারো গজ সবে এগিয়েছে।
হঠাৎ এ সময় আহমদ মুসার মনে হলো ওপর থেকে কি একটা তার দেহের উপর পড়ে তাকে জাপটে ধরল। তার সাথে সাথেই প্রবল একটা হ্যাচকা টানে পড়ে গেল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার প্রথমে মনে হয়েছিল গাছের উপর থেকে কেউ তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। কিন্তু পরক্ষণেই বুঝল কোন মানুষ নয় জালের ফাঁদ তাকে আটকে ফেলেছে। সে আরও বুঝল, গাছ থেকেই কেউ তার উপর জালের ফাঁদ নিক্ষেপ করেছে।
আহমদ মুসা মাটিতে পড়েই ওমর বোংগো ও ওয়ে এমবার চিৎকার শুনতে পেল। আহমদ মুসা বুঝল ওরাও জালের ফাঁদে আটকা পড়েছে।
মাটিতে পড়ে স্থির হবার পর আহমদ মুসা খুশি হলো তার ডান হাতে রিভলবার ঠিকমতই আছে।
ওমর বোংগো এবং ওয়ে এমবার চেঁচামেচি তখনও চলছিল। তারা সম্ভবত লড়াই করছে জালের বাঁধন থেকে বের হবার জন্যে। আহমদ মুসা বুঝল এই চেঁচামেচি, হাত-পা ছুড়োছুড়িতে কোন লাভ নেই, বরং তাতে জালের বাঁধন আরও শক্ত হবে।
আহমদ মুসা নিরবে অপেক্ষা করতে লাগল জালের পেছনে যে মানুষ আছে সেই মানুষের জন্যে।
ঘুটঘুটে অন্ধকার। পাশে মানুষ দাঁড়িয়ে থাকলেও তা চোখে পড়ার মত নয়।
কিছু দেখতে পেল না, কিন্তু শব্দ শুনতে পেল আহমদ মুসা। ভারী কিছু মাটিতে পড়ার শব্দ। তাহলে ওরা কি গাছ থেকে নামল, ভাবল আহমদ মুসা।
এই সময় একটা চাপা কণ্ঠ কথা বলে উঠল সুরিনামের কথ্য টাকি টাকি ভাষায়, ‘ফাঁদগুলো তোমরা লক করেছ?’
ফাঁদ লক করার অর্থ হলো ফাঁদে শিকার আটকাবার পর জালের খোলা মুখ বেঁধে ফেলা।
‘হ্যাঁ, লক করা হয়েছে।’ প্রায় একই সংগে অন্ধকারের মধ্য থেকে তিনটি কন্ঠ কথা বলে উঠল।
‘তাহলে জানোয়ারদের টেনে চত্বরে নিয়ে চল।’ আগের সেই কণ্ঠ নির্দেশ দিল।
আহমদ মুসা বুঝল এখানে ওরা চারজন রয়েছে। এই চারজনই কি, না ওরা আরও আছে?
আহমদ মুসার ভাবনা হোঁচট খেল। তাকে টেনে নিয়ে যাওয়া শুরু হয়েছে। উঁচু-নিচু মাটিতে হোঁচট খেয়ে ধাক্কা খেয়ে তার দেহ চলতে শুরু করেছে।
ফাঁদ জালের মুখের প্রান্ত ধরে অল্প সামনে থেকে কেউ তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, এটা বুঝল আহমদ মুসা। লোকটি তখনও তার চোখে পড়েনি।
আহমদ মুসা সামনে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে লোকটিকে চোখের আওতায় আনার চেষ্টা করতে লাগল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর অল্প সামনে একটা জমাট অন্ধকারকে চলন্ত দেখল। আহমদ মুসা নিশ্চিত হলো, এটা সেই লোকের অবয়ব যে তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।
আহমদ মুসা তার মেশিন রিভলবার পজিশনে নিয়ে এল। এখন ইচ্ছা করলে এই লোকটিকে সে হত্যা করতে পারে। কিন্তু তাতে লাভ হবে না। আরও তিনজন আছে। তারা প্রতিশোধ নেবে। সুতরাং তাদেরকে এক সংগে না পেলে তাদের উপর চড়াও হওয়া ঠিক হবে না।
এক সময় তাকে টেনে নেয়া বন্ধ হলো।
আহমদ মুসা বুঝল তাদেরকে চত্বরে নিয়ে আসা হয়েছে।
চত্বরের ফিকে অন্ধকারের আহমদ মুসা ওদের দু’জনকে দেখতে পেল জমাট অন্ধকারের মত তাদের কিছু দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে।
তাদের দু’জনের একজন বলে উঠল, সুদীপ ও সম্বা আমরা এদের দেখছি। তোমরা দু’জনে ভেতরে যাও। দেখে এস কি ঘটেছে। মনে হয় এদের কোন লোক ভেতরে নেই। থাকলে এদের চেঁচামেচিতে নিশ্চয় এতক্ষণ বেরিয়ে আসার কথা।’
চত্বরের অন্ধকার তখন আহমদ মুসার অনেকখানি চোখসহা হয়ে গেছে। সে দেখল, যেখানে ওমর বোংগো ও ওয়ে এমবাকে রাখা হয়েছে, সেখান থেকে দু’টি ছায়ামুর্তি বাড়িতে প্রবেশের জন্য গেটের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।
খুশি হলো আহমদ মুসা। হাত্তা নাসুমনকে গেটে রেখে আসা হয়েছে। সে ঐ দু’জনকে কাবু করতে পারবে। তাহলে………..।
আহমদ মুসার চিন্তা শেষ হতে পারলো না। গেটের ভেতর পরপর দু’টি গুলীর আওয়াজ হলো।
গেটের সামনে পৌছে গিয়েছিল ওরা দু’জন। দু’জনের কণ্ঠ থেকেই আর্তনাদের শব্দ বেরিয়ে এল।
গুলীর শব্দ শুনেই আহমদ মুসার সামনে যারা দাঁড়িয়েছিল, তারা নড়ে উঠল। অন্ধকারকে খান খান করে দিয়ে গর্জে উঠল ওদের ষ্টেনগান।
আহমদ মুসা দেখল, এরা দু’জন গুলী করতে করতে এগুচ্ছে গেটের দিকে।
আহমদ মুসা ওদের আর সুযোগ দিল না। তার এম-১০ ওদের দিকে তাক করে ট্রিগার চাপল।
বেরিয়ে গেল এক ঝাঁক গুলী।
ছায়ামূর্তি দু’টি আর্তনাদ করে উঠারও সুযোগ পেল না। নিরবে ভূমি শয্যা নিল চত্বরে।
তারপর সব নিরব।
মুহূর্ত কয়েক উৎকর্ণ হয়ে থেকে আহমদ মুসা ওমর বোংগোকে ডাকল। বলল, ‘তোমরা ভাল আছ তো?’
‘জি স্যার। কিন্তু বের হতে পারছি না। শালারা কোথায় কিভাবে গিরে দিয়েছে বুঝতে পারছি না।’ বলল ওমর বোংগো।
‘মি. আহমদ মুসা, আমি আসছি। ওরা তাহলে আপনাদের জালের ফাঁদে আটকেছে?’ গেটের দিক থেকে শোনা গেল হাত্তা নাসুমনের কণ্ঠ।
আহমদ মুসা তখন তার মোজার ভেতর থেকে ছুরি বের করে জালের নাইলনের কর্ড কাটতে শুরু করেছে।
‘কোথায় আপনি মি. আহমদ মুসা। আমি এসেছি।’ চত্বরের মাঝামাঝি থেকে হাত্তা নাসুমনের কণ্ঠ শোনা গেল।
‘মি. হাত্তা আমি জাল কাটা শুরু করেছি। আপনি ওমর বোংগোদের সাহায্য করুন।
সবাই মুক্ত হয়ে উঠে দাঁড়াল।
হাত্তা নাসুমন আহমদ মুসাকে জড়িয়ে ধরল। প্রায় কাঁদ কাঁদ কণ্ঠে বলল, আমি ওমর বোংগো এবং ওয়ে এমবার অব্যাহত চিৎকার শুনে এবং আপনার কোন কণ্ঠ না শুনে প্রায় মরেই গিয়েছিলাম। মনে হয়েছিল, আপনার কোন বড় রকমের ক্ষতি করে ওরা ওমর বোংগো ও ওয়ে এমবাকে ধরেছে। তারপর ওদের একজন যখন চিৎকার করে বলল, আমরা এদের দেখছি, তোমরা দু’জন ভেতরে যাও, তখন বুঝলাম যেভাবেই হোক আপনারা আছেন। তখন মনে হলো, প্রাণটা যেন আমার ফিরে এল।’
‘ধন্যবাদ মি. হাত্তা, আপনার কাজ আপনি ঠিকভাবে করেছেন। ওদের আমি এক সাথে পাচ্ছিলাম না বলে গুলী করতে পারছিলাম না।’
হাত্তা নাসুমনকে কথাটা বলেই আহমদ মুসা ফিরল ওমর বোংগোর দিকে। বলল, ‘ওমর তোমরা চিৎকারটা একটু বেশি করেছ।’
‘স্যার এটা জংগলের একটা গোপন নিয়ম। ধরা পড়লে চিৎকার ও কান্নাকাটি ঠিকভাবে করতে পারলে শত্রুর আঘাতটা একটু দেরীতে আসে এবং আত্মরক্ষার জন্যে কিছু সময় পাওয়া যায়।’ বলল ওমর বোংগো।
‘এই কারণেই কি যে, শত্রুরা তার শিকারকে ভীতু ও দুর্বল মনে করে তাকে আর আঘাত করার প্রয়োজন মনে করে না এবং তাদের দিক থেকে নিশ্চিন্ত থাকে?’ আহমদ মুসা বলল।
‘ঠিক স্যার।’ বলল ওমর বোংগো।
‘মি. আহমদ মুসা, আমার মনে হয় এদের আরও লোক আছে।’ বলল হাত্তা নাসুমন।
‘কিভাবে বুঝলেন?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা। ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে উঠেছে তার।
‘আমি গেট থেকে টিলার গোড়ায় একটা টর্চের আলো জ্বলে উঠতে দেখেছি।’ হাত্তা নাসুমন বলল।
আহমদ মুসা চিন্তা করছিল। বলল, ‘ওদের আরো লোক থাকাই স্বাভাবিক। ওরা চারজন এসেছিল এদিকের খোঁজ নিতে।’
একটু থামল আহমদ মুসা। বলল আবার, ‘মি. হাত্তা, আপনি ও ওয়ে এমবা দু’জন ষ্টেনগান নিয়ে দরজায় দাঁড়ান। ওরা রাস্তা ছাড়া অন্য কোন দিক দিয়ে আসতে পারে এবং তাহলে বাড়িতে ঢোকার চেষ্টা করবে। আপনারা তাদের আটকাবেন। আমি ওমর বোংগোকে নিয়ে টিলার গোড়ায় যাচ্ছি।’
বলে আহমদ মুসা তার সামনের মৃত দু’জনের ষ্টেনগান একটি নিজে নিয়ে অন্যটি ওমর বোংগোর হাতে তুলে দিল।
তারপর সবাইকে সালাম দিয়ে রাস্তার দিকে হাঁটতে শুরু করল। রাস্তার মুখে গিয়ে ওমর বোংগো ফিস ফিস করে বলল, ‘স্যার আবার যদি ফাঁদে পড়ি?’
আহমদ মুসা থমকে দাঁড়াল। বলল, ‘ঠিক বলেছো ওমর বোংগো। সাবধান হওয়া ভালো?’
থামল একটু। ভাবল আহমদ মুসা। বলল বোংগোকে, ‘শোন রাস্তার মাঝখানে দিয়ে যাবে না। তুমি যাবে রাস্তার বাম কিনার দিয়ে, আর আমি যাব রাস্তার ডান কিনার দিয়ে। রাস্তার এত কিনারে ফাঁদ পাতা হয় না।’
চলতে শুরু করল ওরা দু’জন।
টিলার গোড়ায় নেমে এল আহমদ মুসা ও ওমর বোংগো। এখানে ছোট-খাট ঝোপ-ঝাড়। বড় গাছ-পালা নেই। এর মধ্যে দিয়ে তারা হামাগুড়ি দিয়ে এগুচ্ছে।
এক জায়গায় এসে ছোট খাট ঝোপ ঝাড়ও শেষ হয়ে গেল।
এরপর সমতল ঘাসে ঢাকা জমি। তবে দু’একটা ছোট-খাট গাছ আছে।
সমতলে নেমে যাওয়া রাস্তার পাশে ঝোপের আড়ালে শুয়ে তাকাল আহমদ মুসারা সামনের দিকে।
এখানে অন্ধকার অনেক ফিকে। আকাশে চাঁদ নেই, কিন্তু মেঘহীন আকাশে তারার মেলা বসেছে। ধীরে ধীরে আহমদ মুসাদের সামনে চারদিকটা স্বচ্ছ হয়ে এল।
আহমদ মুসা দেখতে পেল, ‘খুব কাছেই দু’জন লোক পায়চারী করছে এবং অনেকগুলো লোক বসে আছে।’
আরও ভালো করে দেখার চেষ্টা করল আহমদ মুসা। দেখতে পেল, পায়চারীরত দু’জনের হাতে ষ্টেনগান।
তাকিয়ে আছে আহমদ মুসা ওদের দিকে
আরও কিছুটা সময় পার হয়ে গেল।
আহমদ মুসা বুঝতে পারলো না, মাত্র দু’জন দাড়িয়ে আর সবাই বসে কেন? আর বসে থাকা লোকদের আশে-পাশে ষ্টেনগানধারী দু’জনের পায়চারী করার অর্থও বুঝল না আহমদ মুসা।
বিষয়টির দিকে ওমর বোংগোর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল, ‘এর অর্থ বলতো?’
‘স্যার আমাদের জংগলের রীতি অনুসারে মনে হচ্ছে ওরা হয় বন্দী, না হয় পরাজিত ও আত্মসমর্পিত কেউ। আর ষ্টেনগান নিয়ে যারা পাহারা দিচ্ছে তারা ওদের মনিব।’ বলল ওমর বোংগো।
ওমর বোংগোর কথা চাবুকের মত ঘা দিয়ে জাগিয়ে তুলল আহমদ মুসাকে। চমকে উঠল সে। হঠাৎ তার মনে হলো, ঐ বসে থাকা লোকরা কি তাহলে সুরিনামের হারিয়ে যাওয়া লোকদেরই কেউ হবে?
কথাটা মনে আসার সাথে সাথে গোটা দেহ শক্ত হয়ে উঠল আহমদ মুসার। অজান্তেই তার তর্জনিটা চলে গেল তার মেশিন রিভলবারের ট্রিগারে।
কিন্তু আহমদ মুসা তর্জনি সরিয়ে নিল ট্রিগার থেকে। সিদ্ধান্ত নিল আরও কিছুটা এগুতে হবে।
চিন্তা করেই আহমদ মুসা ওমর বোংগোকে বলল, ‘আড়াল নিয়ে ক্রলিং করে আরও কিছুটা সামনে এগোও।’
ক্রলিং করে শিকারী বাঘের মত নিঃশব্দে এগুতে লাগল আহমদ মুসা। একেতো রাত, তার উপর মাঝে মাঝেই দু’একটা ছোট গাছ, লম্বা ঘাস। ফলে আহমদ মুসারা কারও দৃষ্টি গোচর হলো না।
ষ্টেনগানধারীরা আর মাত্র দশ গজের মত দূরে। আর এভাবে এগুনোর দরকার নেই, ভাবল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা তার মেশিন রিভলবার ডান হাত থেকে বাঁ হাতে নিল এবং পকেট থেকে ছোট রিভলবার ডান হাতে তুলে নিল।
ষ্টেনগানধারী দু’জন তাদের ষ্টেনগান ডান হাতে ঝুলিয়ে পায়চারী করছে। আহমদ মুসার ইচ্ছা এদের জীবন্ত ধরা, হত্যা না করা। এজন্যে এদের সাথে মুখোমুখি লড়াই এড়ানো দরকার। সেটা করতে হলে তাদের নিরস্ত্র করতে হবে।
ওদের ষ্টেনগান ঝুলানো হাত তাক করল আহমদ মুসা। ওদের দু’জনের ডান হাতকে একই সাথে তাক করার জন্য অপেক্ষা করতে হলো তাকে।
পেয়ে গেল এক সময়।
তাক করা রিভলবার থেকে ধীরে সুস্থে দু’টি গুলী ছুড়ল আহমদ মুসা।
ওদের দু’জনের হাত থেকেই ষ্টেনগান খসে পড়ল। ওরা আহত হাত চেপে ধরে গুলীর লক্ষে এদিকে ঘুরে দাঁড়াল।
আহমদ মুসা ততক্ষণে লাফ দিয়ে উঠে দু’হাতে দুই রিভলবার বাগিয়ে ওদের সামনে হাজির হয়েছে। বলল কঠোর স্বরে, ‘দেখ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাক। কোন চালাকির চেষ্টা করো না। একটা করে হাত গেছে, এবার কিন্তু প্রাণটাও যাবে।’
বিস্ময় ও ভয়ে ওদের দু’জনের চোখ বিস্ফোরিত। গোবেচারার মত দাড়িয়ে থাকল ওরা।
আহমদ মুসার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল ওমর বোংগো। আহমদ মুসা তাকে বলল, ‘ওমর তুমি ওদের জামা ছিড়ে নিয়ে ওদের হাত ব্যান্ডেজ করে দাও যাতে রক্ত পড়া বন্ধ হয়। তারপর ওদের পিছমোড়া করে বাঁধ।’
ওমর বোংগো কাজে লেগে গেল।
আহমদ মুসা রিভলবার বাগিয়ে পাহারা দিচ্ছিল।
হাত বাঁধা হয়ে গেলে ওদের দু’জনকে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়তে নির্দেশ দিল আহমদ মুসা।
তারপর আহমদ মুসা বসে থাকা লোকদের দিকে এগুল।
আহমদ মুসাকে ওদিকে যেতে দেখে বসে থাকা লোকদের মধ্য থেকে একজন যুবক বলে উঠল, ‘আমাদের বাঁচান স্যার। আমরা নির্দোষ। এরা আমাদের ধরে নিয়ে যাচ্ছিল।’
আহমদ মুসা ওদের কাছে গিয়ে দেখল, ‘ওদের প্রত্যেকের দু’হাত বাঁধা। প্রত্যেকের কোমরে দড়ি পেঁচিয়ে একে অপরের সাথে বাঁধা ওরা। এমনভাবে বাঁধা যে, একজন উঠলে সবাইকে উঠতে হবে, আবার একজন বসলে সবাইকে বসতে হবে। চললে সবাইকে সমানতালে চলতে হবে।
আহমদ মুসার যদিও এখন বোঝার বাকি নেই। তবু যুবকটির আবেদনের উত্তরে আহমদ মুসা বলল, ‘তোমরা কে? তোমাদেরকে গরু ছাগলের মত বেঁধে এরা কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?’
‘খুব বেশি দূরে নয়, পশ্চিম নিকারী এলাকায় আমাদের বাড়ি। আমাদের বিভিন্ন স্থান থেকে অপহরণ করেছে। কয়দিন যাবত আমাদের খেতে দেয়নি, অকথ্য নির্যাতন করেছে। এখন কোথায় নিয়ে যাচ্ছে জানিনা স্যার।’ বলল সেই আগের যুবকটি।
‘কেন তোমাদের অপহরণ করেছে?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘আমরা ঠিক জানি না স্যার। বিভিন্ন স্থান থেকে অপহরণ আরও হয়েছে। শোনা যাচ্ছে, আহমদ হাত্তা নাসুমনকে প্রধানমন্ত্রী হতে দেবে না, এজন্যেই বেছে বেছে লোক অপহরণ করা হচ্ছে। আহমদ হাত্তা নাসুমনকেও অপহরণ করা হয়েছে। তাকে মেরেই ফেলা হয়েছে বলে মানুষ মনে করছে।’ যুবকটি বলল।
‘বেছে বেছে কাদেরকে অপহরণ করছে?’ বলল আহমদ মুসা।
কথা বলল না যুবকটি।
আহমদ মুসা বুঝল বেছে বেছে মুসলমানদের অপহরণ করছে, একথা বলতে যুবকটি ভয় করছে। তার মানে মুসলিম পরিচয় যুবকটি দিতে চায় না।
আহমদ মুসা বলল, ‘বেছে বেছে কি মুসলমানদের অপহরণ করছে?’
‘জি স্যার।’ নরম ও ভীত কণ্ঠস্বর ছেলেটির।
‘তোমার নাম কি?’
যুবকটি এবারও কথা বলল না। একবার মাথা তুলে আবার নিচু করল।
আহমদ মুসা প্রবল একটা খোঁচা খেল বুকে। অবস্থা কোন পর্যায়ে গেলে একজন মানুষ এভাবে তার পরিচয় দিতে ভয় করে! সুরিনামের অবস্থা এই পর্যায়ে গেছে!
আহমদ মুসা ওমর বোংগোর দিকে তাকিয়ে একটি ছুরি তার হাতে দিয়ে বলল, ‘ওদের সকলের বাঁধন কেটে দাও।’
সবাই মুক্ত হয়ে গেলে আহমদ মুসা যুবকটির কাছে গেল। বলল, ‘আমিও মুসলমান। মুসলিম পরিচয় দিতে ভয় পাচ্ছ কেন?’
যুবকটি কেঁদে ফেলল। বলল, ‘ওরা আমাদের উপর নির্যাতন করেছে আর বলেছে, মুসলমান নাম নিতে পারে এমন কাউকে তারা এদেশে রাখবে না।’
আহমদ মুসা যুবকটির পিঠ চাপড়ে বলল, ‘আল্লাহ আছেন, আল্লাহর শক্তি সবার চেয়ে বড়। কি নাম তোমার?’
যুবকটি চোখ মুছে বলল, ‘হাবিব থিয়াম।’
‘খুব সুন্দর নাম।’ বলে আহমদ মুসা যুবকটির আরেকবার পিঠ চাপড়ে দিয়ে সবাইকে লক্ষ করে উচ্চ কণ্ঠে বলল, ‘আমি আপনাদের একজন ভাই। আপনাদের আর কোন ভয় নেই। যারা আপনাদের বন্দী করে এনেছিল তাদের মধ্যে এই দুইজন ছাড়া সবাই নিহত হয়েছে। আপনারা সবাই টিলার উপরে চলুন। ওখানে একটা বাড়ি আছে।’
কথা শেষ করে আহমদ মুসা ওমর বোংগোকে বলল, ‘তুমি দেখ ওদের লাইটটা কোথায় আছে। ওটা জ্বেলে দাও।’
আহমদ মুসা কথা শেষ করার সাথে সাথে আরেক জন যুবক একটা হ্যাজাক জাতীয় লাইট হাতে তুলে বলল, ‘এই যে লাইট স্যার। জ্বালব?’
‘ধন্যবাদ। জ্বেলে দাও।’ বলল আহমদ মুসা।
মাটিতে উপুড় হয়ে থাকা বন্দী দু’জনের কাছে এল আহমদ মুসা। ওদের টেনে তুলে বসাল সে। তারপর রিভলবার ওদের একজনের দিকে তাক করে বলল, ‘দেখ এক প্রশ্ন আমি দু’বার জিজ্ঞেস করি না। এখন বল, এদেরকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছিলে?’
দু’জনেই মুখ তুলে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। ভয়ে তাদের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। কিন্তু কথা বলল না তারা।
ওমর বোংগোসহ মুক্তি পাওয়া লোকজন সবাই চারদিকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে। দেখছে সবাই।
আহমদ মুসার রিভলবারের নল নড়ে উঠল। গর্জন করে উঠল রিভলবার। একটা বুলেট লোকটির কানের ক্ষুদ্র একটা অংশ ছিড়ে নিয়ে বেরিয়ে গেল।
লোকটি আর্তনাদ করে উঠল। রক্তের একটা ধারা নেমে এল তার আহত কান থেকে।
‘এখন আর্তনাদ করছ। এরপর আর্তনাদ করারও আর অবসর পাবে না। পরের বুলেট তোমার মাথা গুড়ো করে দেবে।’
আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই তার রিভলবারের নল ঘুরে এসে স্থির হলো লোকটির কপাল লক্ষে।
‘বলছি স্যার বলছি, আমাকে মারবেন না।’ বলে চিৎকার করে উঠল লোকটি।
‘বল।’ বলল আহমদ মুসা।
লোকটি কেঁদে উঠল। বলল, ‘স্যার আমাদের কোন দোষ নেই। আমরা গায়ানার লোক। মোটা টাকার লোভ দেখিয়ে আমাদের শরীক করেছে।’
‘আমার জিজ্ঞাসার জবাব দাও।’ কঠোর কণ্ঠে বলল আহমদ মুসা।
‘স্যার আজ রাতে এদের এখানে রাখা হতো। কাল সকালে এদেরকে এখান থেকে দু’মাইল পশ্চিমে জংগলের গভীরে জনমানবশূন্য ‘সিকিমা’ হৃদের তীরে নিয়ে যাওয়া হতো। ওখানে ওদের হত্যা করে পাথর বেঁধে পানিতে ডুবিয়ে দেয়া হতো।’
বুকটা কেঁপে উঠল আহমদ মুসার।
চারদিকে দাঁড়িয়ে যারা শুনছে তারাও কেঁপে উঠল। মুখ শুকিয়ে গেল সবার।
‘ওখানে এভাবে এ পর্যন্ত কত লোককে ডুবিয়ে মারা হয়েছে?’ প্রশ্ন করল আহমদ মুসা।
‘স্যার আমরা নতুন। এই প্রথম এই অপারেশনে এসেছি।’ বলল আহত লোকটি।
‘আচ্ছা বলত, যখন মারবেই, তখন এতদূরে এনে কেন?’
লোকটি বলল, ‘আমাদের বলা হয়েছে কোন লাশ কারও চোখে পড়া চলবে না, কোন লাশ যেন কেউ কোন দিনে খুঁজে না পায়।’
‘ধন্যবাদ।’ বলে আহমদ মুসা ওমর বোংগোকে বলল, ‘এর কানে একটা ব্যান্ডেজ বেঁধে দাও।’
ওমর বোংগোর ব্যান্ডেজ বাঁধা হলে টিলায় ওঠার শুরুতে সবার দিকে লক্ষ করে আহমদ মুসা বলল, ‘তোমরা সকলে একবার ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি দাও এবং আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করো, তোমাদেরকে যেভাবে আজ আল্লাহ বাঁচিয়েছেন, সেভাবে সব মজলুমকে আল্লাহ যেন রক্ষা করেন।’
সংগে সংগেই সম্মিলিত কণ্ঠের ‘আল্লাহু আকবার’ শেস্নাগান রাতের নিরবতাকে ভেঙে খান খান করে দিল।
সবার আগে আলো নিয়ে চলল উমর বোংগো। তার পেছনে সবাই। সবার পেছনে আহমদ মুসা। উঠছে সকলে টিলার উপরে।

Top