৩২. অক্টোপাশের বিদায়

চ্যাপ্টার

আহমদ মুসা লাফ দিয়ে একটা চলন্ত এক্সালেটরে গিয়ে পড়ল। নরম স্পঞ্জে ঢাকা এক্সালেটর না হলে তার মাথা শরীর আস্ত থাকতো না।
এক্সালেটর চলছে ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে।
জেনারেল শ্যারন এই এক্সালেটরেই আছে। পাঁচ ছয় সেকেন্ডর বেশী ব্যবধান হয়নি তাদের দু’জনের লাফ দেয়ার মধ্যে। সুতরাং খুব বেশী দুরে নয় জেনারেল শ্যারন।
এই ভাবনার মধ্যেই আহমদ মুসা ছিটকে পড়ল একটা শক্ত মেঝেতে।
জায়গাটা একটা ছোট্ট চত্বর, দেখল আহমদ মুসা।
পড়েই লাফ দিয়ে উঠে বসল সে। দেখতে পেল জেনারেল শ্যারন চত্বরে দাঁড়ানো একটা গাড়িতে উঠছে।
আহমদ মুসা আশে-পাশে তাকিয়ে দেখল আর কোন গাড়ি নেই। আহমদ মুসা উঠে দাঁড়িয়ে ছুটল জেনারেল শ্যারনের দিকে। ততক্ষণে ষ্টার্ট নিয়েছে শ্যারনের গাড়ি।
আহমদ মুসা গাড়ির পেছনে ছুটে গিয়ে রাস্তায় উঠল।
তার সামনেই পড়ল একটা গাড়ি। স্পোর্টস কার। একজন তরুনী চালাচ্ছে। হাত দিয়ে ইশারা করে গাড়ি থামাতে আবেদন করল আহমদ মুসা।
গাড়ি থামাল তরুণী।
‘আপনি কি হাসপাতালে যাচ্ছেন?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘না।’ বলল তরুণীটি
‘কোন জরুরী কাজে?’
‘না।’
‘তাহলে আমাকে গাড়িটি দিন। ঐ গাড়িতে বড় একজন ক্রিমিনাল যাচ্ছে, তাকে আমি ফলো করব।’
তরুণীটি চোখ তুলে আহমদ মুসাকে একবার দেখল। তারপর নেমে এল ড্রাইভিং সিট থেকে।
আহমদ মুসা ড্রাইভিং সিটে বসতে বসতে বলল, ‘ধন্যবাদ বোন। এফবিআই প্রধান জর্জ আব্রাহামকে টেলিফোন করলে সব জানতে পারবেন।’
কথা শেষ হওয়ার আগেই চলতে শুরু করেছে আহমদ মুসার গাড়ি।
চলছে দুটি গাড়ি।
খুশি হলো আহমদ মুসা যে, শ্যারনের গাড়িটা নজরের মধ্যেই রয়েছে।
আরও খুশি হলো আহমদ মুসা গাড়িটা একেবারে নতুন আমেরিকান গাড়ি। ভালো স্পীড আছে।
শ্যারনের গাড়ি ছুটছে অরলিংটনকে ডাইনে রেখে হাইওয়ে ধরে স্পিংফিল্ডের দিকে।
ভার্জিনিয়ার প্রান্তর দিয়ে চলছে তখন দু’টি গাড়ি। গাছ-গাছালিতে ভরা চড়াই উতরাই এর মধ্য দিয়ে। মাঝে মাঝেই দু’পাশে ছবির মত সবুজ বসতি চোখে পড়ছে।
কোথায় যাচ্ছে শ্যারন? তার ডান হাত বিধ্বস্ত। বাম হাত মাত্র সচল। গাড়ি চালানো অবস্থায় রিভলবার চালাতে পারবে না। টেলিফোন করতে চাইলেও তাকে থামতে হবে। এ অবস্থায় দ্রুত তাকে কোন আশ্রয়ের সন্ধান করতে হবে।
গাড়ির গতির মতই দ্রুত এই চিন্তাগুলো আবর্তিত হচ্ছে আহমদ মুসার মাথায়।
সন্ধ্যা নামার খুব দেরী নেই।
আহমদ মুসা গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিল।
গাড়ি চলছিল উপত্যকার মত এক নিচু এলাকা দিয়ে। সামনেই একটা টিলা। সুন্দর সাজানো একটা বাড়ি দেখা যাচ্ছে টিলার মাথায়।
টিলার পাশ দিয়ে চলে গেছে হাইওয়ে। হাইওয়ে থেকে একটা রাস্তা উঠে গেছে টিলার বাড়িটার দিকে।
আহমদ মুসা বিস্ময়ের সাথে লক্ষ করল আহমদ মুসার গাড়ির স্পীড বাড়লেও শ্যারনের গাড়ি একই গতিতে চলছে।
স্পীড বাড়ালো না মানে এখন সে লড়াই করতে চায়? কিন্তু কি ভাবে? তার তো লড়াই করার অবস্থা নেই। ভাবল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার গাড়ি জেনারেল শ্যারনের গাড়ির বিশ পঁচিশ গজের মধ্যে পৌছে গেছে।
আহমদ মুসা পায়ের মোজার সাথে গুজে রাখা রিভলবারটা হাতে নিল।
হঠাৎ আহমদ মুসা লক্ষ করলো জেনারেল শ্যারনের গাড়ির পেছনের টপটা উঠে যাচ্ছে। তার আড়াল থেকে বেরিয়ে এল কয়েকটা ব্যারেল।
আঁতকে উঠল আহমদ মুসা। মেশিন গান ও গ্রেনেড লাঞ্চারের ব্যারেল দেখেই সে চিনতে পেরেছে। মাত্র সুইচ টিপে ওগুলো অপারেট করা যায়।
আহমদ মুসার চিন্তা শেষ হবার আগেই সামনে থেকে গর্জন করে উঠল মেশিনগান। এক ঝাঁক গুলী এসে আহমদ মুসার গাড়ির উইন্ডস্ক্রিন উড়িয়ে নিয়ে গেল। ঝাঁঝরা করে দিল গাড়ির সামনের দিকটা।
আহমদ মুসা সিটের উপর কাত হয়ে পড়ে নিজেকে রক্ষা করল। কিন্তু সেই সাথে বুঝল আরও কি ঘটতে পারে।
আহমদ মুসা গাড়ির ষ্টার্ট বন্ধ করে দিয়ে তাড়াতাড়ি হাতড়িয়ে গাড়ির কাগজপত্র যা পেল নিয়ে দেহটাকে নিচে গড়িয়ে দিল।
কিন্তু তার দেহটা মাটিতে পড়ার আগেই তার ডান বাহুর একটা মাসল ছিড়ে নিয়ে গেল বুলেট।
আহমদ মুসা সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে দেহটাকে গাড়ির রাস্তার পাশে নিয়ে গেল।
ঠিক সে সময়েই একটা গ্রেনেড বিস্ফোরিত হলো আহমদ মুসার গাড়িতে। মুহূর্তেই টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ল গাড়ি। দাউ দাউ করে জ্বলতে লাগল আগুন।
শুয়ে থেকেই আহমদ মুসা দেখল জেনারেল শ্যারনের গাড়ি দ্রুত এগিয়ে বাঁক নিয়ে টিলার রাস্তা ধরে উপরে উঠে গেল।
আহমদ মুসা বাঁ হাত দিয়ে ডান বাহু চেপে ধরে উঠে দাঁড়াল।
উঠে দাঁড়িয়েই দেখতে পেল বিপরীত দিক থেকে একটা গাড়ি ছুটে আসছে।
আহমদ মুসা একটু এগিয়ে হাত তুলল। সেই সাথে দেখল গাড়ি একটি নয় দুটি। একটি জীপ, আরেকটি পিকআপ।
গাড়ি দু’টি আহমদ মুসার বরাবর এসেই থেমে গেল। সংগে সংগেই খুলে গেল গাড়ির দরজা। গাড়ি থেকে নেমে এল সামরিক ইউনিফর্ম পরা একজন লোক। ছুটছে সে আহমদ মুসার দিকে। তার পেছনে আরও দু’জন অফিসার।
আহমদ মুসা ছুটে আসা সামনের জনকে দেখেই চিনতে পারল। খুশি হলো এই দুঃসময়ে মার্কিন সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটনকে দেখে।
‘গুড ইভনিং।’ বলে স্বাগত জানাল আহমদ মুসা রোনাল্ড ওয়াশিংটনকে।
কিন্তু জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন আহমদ মুসার কথার দিকে খেয়াল করল না। সে দ্রুত আহমদ মুসার কাছে এসে তার আহত বাহুটা একবার দেখে গোটা দেহের দিকে নজর বুলিয়ে বলল, ‘মি. আহমদ মুসা আর কোন ক্ষতি হয়নি তো? আপনি ঠিক আছেন তো? কি ঘটেছে? কেন এমন ঘটল? আপনি………..।’ জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটনের কণ্ঠে উদ্বেগ।
আহমদ মুসা জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটনের কথায় বাধা দিয়ে বলল, ‘মি. জেনারেল, আমি ভাল আছি। সব বলছি আমি। কিন্তু তার আগে আপনি দয়া করে ঐ টিলার বাড়িটা ঘিরে ফেলার নির্দেশ দিন। জেনারেল শ্যারন ওখানে পালিয়েছে্’।
আহমদ মুসা যখন এ কথাগুলো বলছিল, তখন আরও একটা গাড়ি এসে দাঁড়াল এবং তা থেকে ২ জন নারী পুরুষ নেমে ছুটে এসে আহমদ মুসার পাশে দাঁড়িয়েছিল।
আহমদ মুসা কথা বলতে বলতেই তাদের দিকে তাকিয়েছিল। সান ওয়াকার ও মেরী রোজ আলেকজান্ডারকে দেখে হাসিতে মুখ ভরে গিয়েছিল আহমদ মুসার।
‘জেনারেল শ্যারন দি কালপ্রিট?’ আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই ফুসে উঠল জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটনের কণ্ঠ।
বলেই জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন তার পাশে দাড়ানো দু’জন অফিসারের একজনকে বলল, ‘কর্ণেল বব আপনি কর্ণেল ষ্টিভেনকে বলুন তিনি লোকদের নিয়ে যেন টিলার বাড়িটা চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেন।’
নির্দেশের সাথে সাথে কর্ণেল বব ছুটল পিকআপ গাড়িটার দিকে। জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন যখন ববকে নির্দেশ দিচ্ছিল, সেই সময় আহমদ মুসা সান ওয়াকারের দিকে ফিরে বলল, ‘তোমরা? এ সময় কোত্থেকে? ভাল আছ তো? ওগলালা কেমন আছে?’
আহমদ মুসার এত প্রশ্নের কোনটির জবাব না দিয়ে সান ওয়াকার বলল, ‘আহমদ মুসা ভাই, আপনি সাংঘাতিক আহত। মারাত্মক ব্লিডিং হচ্ছে।’ কণ্ঠে উদ্বেগ সান ওয়াকারের।
ববকে নির্দেশ দিয়েই জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন তার দ্বিতীয় অফিসারকে বলল, ‘কর্ণেল টনি স্মিথ তুমি গিয়ে গাড়ি থেকে ফাস্ট এইড নিয়ে এসে ওর আহত জায়গাটা বেঁধে দাও, রক্ত বন্ধ হওয়া দরকার।’
কথা শেষ করে জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন আহমদ মুসার দিকে ফিরতেই আহমদ মুসা সান ওয়াকারদের দেখিয়ে তাকে বলল, ‘এ সান ওয়াকার, তুখোড় ছাত্র, রেডইন্ডিয়ান মুভমেন্ডের একজন নেতা এবং ও মেরী রোজ আলেকজান্ডার, চীফ জাষ্টিস আলেকজান্ডারের মেয়ে। এরা আমার ভাই বোন।’
জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন ওদের সাথে সম্ভাষণ বিনিময় করে আহমদ মুসার দিকে ফিরে বলল, ‘ঘটনা কি মি. আহমদ মুসা?’
জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটনের অফিসার কর্ণেল টনি স্মিথ তখন আহমদ মুসার ডান বাহুর আহত জায়গাটা বাঁধছিল। আহমদ মুসা জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটনের জিজ্ঞাসার জবাবে বলল, ‘জেনারেল শ্যারনদের এক ঘাটিতে অভিযান চালিয়ে সারা জেফারসন ও নোয়ান নাবিলাকে উদ্ধার করা হয়েছে। ডেভিড উইলিয়াম জোনস বন্দী হয়েছেন। আহত অবস্থায় পালাতে পেরেছিলেন জেনারেল শ্যারন। তাকে ফলো করেই আমি এখানে এসেছি।’
জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটনের চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, ‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ।’
বলে মুহুর্তকাল থেমেই আবার শুরু করল, ‘কিন্তু আপনার গাড়ি ও আপনার এই অবস্থা হলো কি করে?’
‘জেনারেল শ্যারনের গাড়িটা ছিল বিশেষ ধরনের। গাড়ির পেছনে টপের কভারে অটোমেটিক মেশিনগান ও গ্রেনেড লাঞ্চার ফিট করা ছিল। আমি সেটা বুঝতে পারিনি। তাকে ধরার জন্যে তার গাড়ির কাছে এসে পড়েছিলাম। তারপর যা ঘটার তাই ঘটেছে। আমি মাটিতে পড়ে থেকেই দেখতে পেলাম, শ্যারন গাড়ি নিয়ে টিলার বাড়িটিতে উঠে গেল।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। মৃত্যুর মুখ থেকে তিনি আপনাকে বাঁচিয়েছেন।’ এক সাথেই বলে উঠল জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন এবং সান ওয়াকাররা।
কথা শেষ করেই জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন তাকাল সান ওয়াকারের দিকে। বলল, ‘মি. সান ওয়াকার, আমি একজন ষ্টাফ সার্জেন্টকে সাথে দিচ্ছি। আপনারা আহমদ মুসাকে পেন্টাগনের সামরিক হাসপাতালে দয়া করে পৌছে দিন।’
‘কিন্তু আমি জেনারেল শ্যারনের শেষটা না দেখে যাই কি করে?’ জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটনের প্রস্তাব শুনেই বলে উঠল আহমদ মুসা।
‘প্লিজ মি. আহমদ মুসা, প্লিজ। আপনার এখনই ট্রিটমেন্ট দরকার। শ্যারনকে খুঁজে বের করতে এবং ধরতে কতটা সময় যাবে বলা যাচ্ছে না। আপনাকে সে সময় পর্যন্ত রাখা যায় না, উচিত নয়। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, নিউ হারমানের দুষকর্মই তার শেষ দুষকর্ম। ওকে আমরা ধরে নিয়ে আসছি। আপত্তি করবেন না। যান এদের সাথে। প্লিজ।’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘ঠিক আছে জেনারেল। আল্লাহ আপনাদের সফল করুন।’
খুশি হয়ে উঠল সান ওয়াকার ও মেরী রোজ আলেকজান্ডারের মুখ। ওরা আহমদ মুসাকে নিয়ে চলল ওদের গাড়ির দিকে।
সান ওয়াকার ড্রাইভিং সিটে বসে আহমদ মুসাকে বলল, ‘ভাইয়া মেরী আপনার সাথে পেছনে উঠুক।’
‘না সান ওয়াকার, সাথী হিসেবে অস্ত্রধারী এবং সার্জেন্ট আমার জন্যে ভাল হবে।’ বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার কথা শুনেই সান ওয়াকার তার ভুল বুঝতে পারল। বিকল্প থাকা অবস্থায় কোন মেয়েকে আহমদ মুসা তার পাশে বসা এ্যালাউ করবেন না।
সান ওয়াকার হাসল। বলল, ‘ভুল হয়েছে আমার ভাইয়া। ইসলামের সব এটিকেট এখনও শিখে উঠতে পারিনি। পদে পদেই ভুল হয়।’
হাসল আহমদ মুসাও। বলল, ‘মেরী রোজ দেখবে তোমাকে ছাড়িয়ে যাবে এ ব্যাপারে।’
‘ভাইয়া সান ওয়াকারকে জিজ্ঞেস করুন তো, সে প্রতিদিন কতটুকু কোরআন শরীফ পড়ে, এ পর্যন্ত কতগুলো হাদিস ও পড়েছে।’ বলল মেরী রোজ গাড়িতে উঠতে উঠতে।
‘এখন পড়ার খুব চাপ যাচ্ছে। এ কারণেই কিছুটা পিছিয়ে পড়েছি ভাইয়া।’ বলল গম্ভীর মুখে সান ওয়াকার।
‘কোন চিন্তা নেই সান ওয়াকার। মেরী রোজ দেখবে তোমাকে ঠিক করে দেবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ধন্যবাদ ভাইয়া। আগাম কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি মেরীকে।’ বলল সান ওয়াকার।
সবাই গাড়িতে উঠেছে।
ছুটতে শুরু করল গাড়ি।

হোয়াইট হাউজের একটি কমিটি কক্ষ।
প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা কমিটির একটা বৈঠক চলছে। অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত আছেন প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা উপদেষ্টাসহ সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন, সিআইএ প্রধান এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার, এফবিআই প্রধান জর্জ আব্রাহাম জনসন, পুলিশ প্রধান বিল বেকার। আজ বিশেষ আমন্ত্রণে উপস্থিত আছেন সিনেটের গোয়েন্দা বিষয়ক স্পেশাল কমিটির চেয়ারম্যান আনা প্যাট্রেসিয়া, প্রতিনিধি পরিষদের গোয়েন্দা বিষয়ক সিলেক্ট কমিটির চেয়ারম্যান এ্যান্ড্রু জ্যাকবস এবং সিনেটের পররাষ্ট্র বিষয়ক বিশেষ কমিটির চেয়ারম্যান বব এইচ ব্রুস।
আলোচনা চলছিল।
কথা বলছিল তখন সিনেট ইনটেলিজেন্স কমিটির চেয়ারম্যান আনা প্যাট্রেসিয়া। বলছিল যে, ‘আমি উদ্বিগ্ন, আমাদের মিডিয়ার ক্রেডিবিলিটি মারাত্মক হুমকির মুখে। সেবার আমাদের ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়াতে দারুণ ফলাও করে খবর বেরুলো যে, লস আলামোসের গোয়েন্দা সুড়ঙ্গের ব্যাপারটা ভুয়া। ওটা আহমদ মুসার কল্পনার সৃষ্টি, মার্কিন ইহুদীদের বিপদে ফেলার জন্যে এবং তার সাথে সাথে বলা হলো লস আলামোসের ঘটনার পরবর্তী যে কিলিং ও সান্তাফে বিমান বন্দরে বিমান ধ্বংস হওয়ার যে ঘটনা ঘটাল, তা আহমদ মুসার নৃশংসতা। কিন্তু একদিন পরেই মূলত আহমদ মুসা ও ফ্রি আমেরিকার চেষ্টায় মিডিয়াতে একদম বিপরীত খবর বেরুল। একেবারে অকাট্য দলিল দস্তাবেজ দিয়ে প্রমাণ করা হলো যে, লস আলামোস ও সবুজ পাহাড়ের সংযোগকারী গোয়েন্দা সুড়ঙ্গটা ইহুদীদের তৈরী এবং পরবর্তী কিলিং ও বিমান ধ্বংসের ঘটনা ইহুদীবাদী শ্যারনরাই ঘটিয়েছে লস আলামোস ঘটনার তদন্তকারী টিমকে হত্যার জন্যে। আবার গতকালই মিডিয়া সাংঘাতিক খবর দিল, আহমদ মুসাই নিউ হারমানে গণহত্যা ঘটিয়েছে। এই অভিযোগে আহমদ মুসাকে গ্রেপ্তারও করা হলো। কিন্তু আজকেই আবার আমাদের মিডিয়া সম্পূর্ণ উল্টো খবর প্রকাশ করতে বাধ্য হলো। যাতে ভিডিও টেপের মাধ্যমে প্রমাণ করা হলো মার্কিন ইতিহাসের এই জঘন্য হত্যাকান্ড ইহুদীবাদী জেনারেল শ্যারনরাই ঘটিয়েছে। সেই সাথে খবর বেরুল, আহমদ মুসা সারা জেফারসন ও নাবিলাকে উদ্ধার এবং ডেভিড উইলিয়াম জোনস ও জেনারেল শ্যারনকে বন্দী করার ব্যাপারে প্রধান ভূমিকা পালন করেছে।’
একটু থামল আনা প্যাট্রেসিয়া, তারপর আবার বলল, ‘আমি একথাগুলো বললাম এজন্যে যে, নিজেরা কিছু অনুসন্ধান না করে, মোটামুটি নিশ্চিত না হয়ে খবর ছাপানোর ফলে মিডিয়ার এই যে ক্রেডিবিলিটি বিপর্যয় তার কারণ হচ্ছে আমাদের মিডিয়ার বৃহত্তর অংশ আজ ইহুদীবাদী শ্যারনদের দখলে।’ থামল আনা প্যাট্রেসিয়া।
‘আমি মিস আনা প্যাট্রেসিয়া সাথে একমত। কিন্তু সমস্যা হলো মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করার কোন আইন মার্কিন গণতন্ত্রে নেই। একটাই বিকল্প, সেটা হলো দেশ প্রেমিক মিডিয়া সৃষ্টি করা। যাহোক, বিষয়টা এখানেই থাক। আমার মনে হয় প্রসঙ্গ থেকে আমরা একটু সরে এসেছি।’ বলল সিনেটের পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান বব এইচ ব্রুস।
প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা উপদেষ্টা দ্রুত ফ্লোর নিল। বলল, ‘লস আলামোস ও নিউ হারমানের ঘটনা মার্কিন জনগনের বিশ্বাস ও সেন্টিমেন্টে মারাত্মক ঘা দিয়েছে। জেনারেল শ্যারন, ডেভিড উইলিয়াম জোনস ও বেন ইয়ামনিসহ প্রধান কালপ্রিটরা ধরা পড়েছে। অবশিষ্টরাও ধরা পড়বে। আইন অনুসারে তাদের বিচার হবে। ইহুদীবাদী যে প্রবণতা নিউ হারমানে গণহত্যা চালাল নিজ কম্যুনিটির উপর এবং লস আলামোসে বিশ্বাসের ঘরে ডাকাতি করল, তা এ ধরনের ডাকাতি কত করেছে, আরও কত করবে কে জানে! এরা বিপদে ফেলেছে মার্কিন জনগণকে, বিপদে ফেলেছে মার্কিন ইহুদী জনগোষ্ঠিকেও। এখন ভাববার বিষয় হলো, এদের হাত থেকে মার্কিন জনগণকে উদ্ধারের জন্যে আমরা কি করব?’ থামল প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা উপদেষ্টা।
‘কিছু একটা অবশ্যই করতে হবে। ডেভিড উইলিয়াম জোনস মার্কা ইহুদীবাদীরা আমেরিকান নয়, প্যাট্টিয়ট তো নয়ই। এদের আনুগত্য প্রমিজড ল্যান্ড ইসরাইলের প্রতি। তারা ইসরাইলের জন্যেই কাজ করে। টাকা-পয়সা থেকে বৈজ্ঞানিক তথ্য পর্যন্ত সবই তারা ইসরাইলের জন্য যোগাড় করে। জন জ্যাকবসের মত সম্মানিত বিজ্ঞানীও আমেরিকান হতে পারেননি। গোয়েন্দা সুড়ঙ্গ গড়ে লস আলামোস থেকে ইসরাইলের জন্যে বৈজ্ঞানিক তথ্য পাচার করে তিনি বিশ্বাসের ঘরে চরম ডাকাতি করেছেন। জন জ্যাকব যখন বিশ্বাসী হননি, তখন কোন ইহুদীবাদীকেই বিশ্বাস করা যায় না। এরা অক্টোপাশের মত। এই অক্টোপাশের বিদায় করা ছাড়া আমেরিকানদের মুক্তির কোন উপায় দেখি না।’ বলল সিনেট ইনটেলিজেন্স কমিটির চেয়ারম্যান আনা প্যাট্রেসিয়া।’
‘ধন্যবাদ মিস আনা প্যাট্রেসিয়া। আপনি যেটা বললেন, সেই বিদায়টা কি? কিভাবে? বলল প্রেসিডেন্ট।
‘এই বিদায় আক্ষরিক, অনাক্ষরিক দুই-ই হতে পারে মি. প্রেসিডেন্ট। অনাক্ষরিক বিষয়টা হলো, আমরা আমাদের প্রশাসন, অর্থনীতি, ব্যবসায়-বাণিজ্য, শিক্ষা-স্বাস্থ্যে কোন ক্ষেত্রেই ইহুদীবাদীদের কোন আশ্রয় প্রশ্রয় দেব না। তাহলে তারা নিজেরাই ধীরে ধীরে আমাদের দেশ ত্যাগ করবে। দ্বিতীয়ত, ইহুদীবাদীদের প্রমিজড ল্যান্ড ইসরাইলের সাথে সর্বনিম্ন পর্যায়ের কূটনৈতিক সম্পর্কের বাইরে কোন সহযোগিতা, সমঝোতায় আমরা থাকব না।’ আনা প্যাট্রেসিয়া বলল।
‘এটা শুধু অনুকূল জনমত, গণসচেতনতা ও গণ পর্যায়ের প্রতিরোধের মাধ্যমেই সম্ভব। সরকারের এখানে বেশি কিছু করার সুযোগ খুবই কম।’ বলল প্রেসিডেন্ট এ্যাডামস হ্যারিসন।
‘মি. প্রেসিডেন্ট ঠিক বলেছেন। আমার মনে হয় এই গণ সচেতনতা ও জনমত সৃষ্টি হবে। ইতিমধ্যেই যে মামলাগুলো ইহুদীবাদীদের বিরুদ্ধে হয়েছে এবং নিউ হারমানের গণহত্যা, সারা জেফারসন ও নাবিলার কিডন্যাপকে কেন্দ্র করে আরও যে কেসগুলো হতে যাচ্ছে সে সবই এই সচেতনতা সৃষ্টি করবে। কেসের প্রসিডিংসগুলো যেভাবে মিডিয়াতে আসবে তাতে আমরা যা চাই সেই জনমতের সৃষ্টি হয়ে যাবে। প্রতিরোধ উঠে আসবে জনগণের পর্যায় থেকেই।’ বলল এফবিআই প্রধান আব্রাহাম জনসন।
‘এমন যদি শুরু হয়, তাহলে মুসলমানদের নিয়েও তো প্রশ্ন উঠতে পারে?’ প্রেসিডেন্ট এ্যাডামস হ্যারিসন বলল।
‘না মি. প্রেসিডেন্ট, এ ধরনের প্রশ্ন তোলার কোন সুযোগ হবে না। মুসলিম জাতীয়তার একটা আন্তর্জাতিক রূপ আছে সত্য, কিন্তু মুসলমানদের ভূমিগত কোন আন্তর্জাতিক কেন্দ্র নেই। মক্কা মুসলমানদের প্রার্থনা ও তীর্থ কেন্দ্র, কিন্তু মক্কা বা আরবের প্রতি মুসলমানদের কোন রাজনৈতিক আনুগত্য বা কমিটমেন্ট নেই। আরবকে তারা তাদের জাতীয় আবাসভূমি মনে করে না এবং সেজন্য অর্থ-বিত্ত, শ্রম, বুদ্ধি ইত্যাদি দিয়ে একে গড়ে তোলারও কোন প্রয়োজনীয়তা তারা অনুভব করে না। মুসলমানরা গোটা দুনিয়াকেই আল্লাহর ভূমি মনে করে এবং তাই যে দেশেই তারা বসতি স্থাপন করে সে দেশকেই তারা নিজের দেশ হিসেবে গ্রহণ করে। সুতরাং মুসলমান আমেরিকানরা সত্যিকারের আমেরিকান। ইহুদীবাদীদের সাথে তাদের তুলনা হয় না। তাই তাদের ব্যাপারে কোন প্রশ্ন উঠবে না। পৃথিবীতে মাত্র দুটি জাতি আছে, ইহুদী ও হিন্দু, যারা তাদের ধর্ম বিশ্বাসের সাথে তাদের ভূমিকে এক করে ফেলেছে। ইসরাইল ইহুদীদের প্রমিজড ল্যান্ড। তেমনি হিন্দুস্তানকে হিন্দুরা তাদের জাতীয় আবাসভূমি মনে করে। এ জন্যে হিন্দুরা হিন্দুস্তানে অন্যজাতির অস্তিত্ব বরদাশত করতে পারে না। হিন্দুস্তানে আসা সব জাতিকেই তারা গ্রাস করেছে। বৌদ্ধদের মত বড় জাতিকেও তারা ভারত থেকে নির্মূল করেছে। পারেনি শুধু মুসলমানদের। তাই বলে চেষ্টা তারা পরিত্যাগ করেনি।’ বলল আনা প্যাট্রেসিয়া।
‘ধন্যবাদ মিস প্যাট্রেসিয়া, আপনি ভাল কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন। শ্যারনদের তৎপরতার সাথে ভারতীয় আমেরিকানদেরও তো জড়িত দেখা যাচ্ছে। এ ব্যাপারটাও আমাদের বিবেচনায় আসা দরকার।’ প্রেসিডেন্ট বলল।
‘ইয়েস মি. প্রেসিডেন্ট ইহুদীবাদী শ্যারনদের সাথে ইন্ডিয়ান আমেরিকানরা দেখা যাচ্ছে গভীরভাবেই জড়িয়ে পড়েছে। শ্যারনরা আহমদ মুসাকে বন্দী করে রেখেছিল ভারতীয় আমেরিকান এ্যাসোসিয়েশনের চীফ প্যাট্রোন শিব শংকর সেনের বাড়িতে ও তার ফ্যাক্টরী গোডাউনে, আবার সারা জেফারসন ও নাবিলাকেও বন্দী অবস্থায় পাওয়া গেছে তারই আরেক বাসায়। সর্বশেষে আমরা শ্যারনকে যেখান থেকে উদ্ধার করলাম, সে বাড়িটাও ঐ এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ভারত ভূষণ শিবাজীর। প্রেসিডেন্টের মনে আছে জেনারেল শ্যারনদের পক্ষে তদ্বির করতে এসেছিলেন ভারতীয় আমেরিকান এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ভারত ভূষণ শিবাজী, নির্বাহী ডাইরেক্টর বিনোদ বিহারী মালাকার, উপদেষ্টা শরৎসিং বর্মন এবং চীফ প্যাট্রোন শিব শংকর সেন। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে ভারতীয় আমেরিকানরা ব্যক্তিগতভাবে নয়, সামষ্টিকভাবে জেনারেল শ্যারনদের ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
‘মি. প্রেসিডেন্ট, জেনারেল শ্যারনদের বিরুদ্ধে যে সব মামলা দায়ের হয়েছে, তার সাথে শিব শংকর সেন এবং ভারত ভূষণ শিবাজী জড়িত হয়ে পড়েছেন।’ পুলিশ প্রধান বিল বেকার বলল।
‘আমার মনে হয় এখনকার জন্যে এতটুকুই যথেষ্ট। দেখা যাক আইন তাদের কতটা জড়ায়। তাদের এ ভূমিকা তাদের ভুল বোঝার কারণেও হতে পারে।’ প্রেসিডেন্ট বলল।
‘ধন্যবাদ মি. প্রেসিডেন্ট, এভাবেই চিন্তা করা হবে। তবে তাদের এই আতাতটা ট্রেডিশনাল। এই দুই কম্যুনিটির মধ্যে সম্পর্ক ও সহযোগিতার বিষয়টা খুবই পুরানো। ইহুদীবাদী শ্যারনদের আজকের বিপর্যয়ে তাদের কোন প্রকার ভূমিকা অব্যাহত থাকতে পারে। এমনকি ওদের কাজ কিছুটা এরাও আনজাম দিতে পারে।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
‘ধন্যবাদ মি. জর্জ। এদের উপর চোখ রাখতে হবে এবং এদের মধ্যে আবার শ্যারনদের সৃষ্টি না হয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।’ প্রেসিডেন্ট বলল।
‘ইয়েস মি. প্রেসিডেন্ট।’ জর্জ আব্রাহাম জনসন বলল।
‘অবাক লাগছে মি. প্রেসিডেন্ট। ঈশ্বর কখন কাকে দিয়ে কি কাজ করান! আমরা কি কেউ ভাবতে পেরেছিলাম, আহমদ মুসা এদেশে এসে যুগ যুগ ধরে চলে আসা একটি প্রাণঘাতি ষড়যন্ত্রজাল ছিন্ন করে আমেরিকাকে রক্ষা করবেন!’ বলল আনা প্যাট্রোসিয়া।
‘সত্যিই অভাবনীয় মিস আনা প্যাট্রোসিয়া। শ্যারনদের ষড়যন্ত্রে আমরা বারবার তাকে সন্দেহ করেছি, তাকে গ্রেপ্তার করেছি, গ্রেপ্তারের জন্যে পুলিশ লেলিয়ে দিয়েছি। কিন্তু তার কাজ সে করেই গেছে। লাখ লাখ টাকা দিয়ে নিয়োগ করলেও কারো কাছ থেকে এই ধরনের কাজ পাওয়া দুষ্কর। সত্যি আহমদ মুসা অতুলনীয়। এ ধরনের লোক পৃথিবীর সম্পদ, পৃথিবীর মানুষের সম্পদ।’ প্রেসিডেন্ট শেষোক্ত বাক্যটা পূর্ণ করেই পানির গ্লাস তুলে নিলেন। পানি খেলেন। মনে হয় পানি খাওয়ার জন্যেই তিনি থেমেছিলেন।
প্রেসিডেন্ট তার হাতের গ্লাসটা টেবিলে রাখার আগেই জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন বলল, ‘এই লোকটি মৌলবাদী বলে তার কি ভয়ংকর রূপ আমাদের সামনে তুলে ধরা হয়েছিল! অথচ তার মধ্যে যে মানবিকতা দেখেছি তা অনন্য। তিনি তার ধর্মের প্রতি অত্যন্ত নিষ্ঠাবান, তিনি ধর্মের ছোট-খাট নির্দেশও অত্যন্ত যত্নের সাথে পালন করেন। তিনি তার জাতিকে ভালোবাসেন, জাতির কাজেই তিনি তার জীবনকে বিলিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু এই সাথে তিনি অন্য ধর্মকে অশ্রদ্ধা করেন না। অন্য ধর্মের লোকদের তিনি ভালোবাসেন, নিজের লোকদের যেমন ভালোবাসেন। মানুষ হিসেবে সবাই তার কাছে সমান। তাঁর এই অবস্থানকে বিপরীতমুখী এক দ্বৈত রূপ মনে হতে পারে। কিন্তু আহমদ মুসা এই বৈপরিত্যকে জয় করেছেন। তিনি অত্যন্ত গোঁড়া ধার্মিক এবং অত্যন্ত গোঁড়া এক মানবতাবাদী।’
জর্জ আব্রাহাম জনসনের মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। বলল সে, ‘মি. প্রেসিডেন্ট আহমদ মুসা কি বলেন জানেন। তিনি বলেন, যে যত ভালো মুসলমান, সে তত ভালো মানবতাবাদী। তার যুক্তি হলো, ‘আল্লাহ সকলের স্রষ্টা, সকলের পালনকর্তা, সকলের প্রত্যাবর্তন তাঁরই কাছে। তিনি সকল মানুষকে ভালোবাসেন। অন্যদিকে একজন ভালো মুসলমান আল্লাহকে ভালোবাসে নিজের জীবনের চেয়ে বেশি এবং এ কারণেই দুনিয়ার মানুষকেও সে ভালোবাসে অনুরূপভাবে। এটা তাদের রাসুলেরও শিক্ষা। আহমদ মুসা তাদের রাসুলের মানব প্রেমের অনেক কাহিনী বলেন। তার মধ্যে একটি হলো, অন্য ধর্মের এক বৃদ্ধা রাসুল মোহাম্মদকে কষ্ট দেবার জন্যে তার চলার পথে প্রতিদিন কাঁটা বিছিয়ে রাখত। একদিন রাসুল তার চলার পথে কাঁটা দেখলেন না। তিনি বৃদ্ধের খোঁজ নিলেন। জানলেন, বৃদ্ধা অসুস্থ। সংগে সংগে রাসুল বৃদ্ধার বাড়িতে গেলেন। রাসুলের সাহায্য ও শুশ্রুসাতেই বৃদ্ধা ভালো হয়ে উঠে। আহমদ মুসা বলেন, মানুষকে ভালোবাসা আল্লাহকে ভালোবাসারই অংগ।’ থামল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
‘চমৎকার মি. জর্জ। এই আহমদ মুসা যদি মৌলবাদী হয়, তাহলে এই মৌলবাদ দুনিয়ার জন্যে সবচেয়ে বেশি কাম্য।’ বলল প্রেসিডেন্ট।
‘কিন্তু একটা জিনিস আমি বুঝতে পারি না মি. প্রেসিডেন্ট, ইসলাম প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অব্যাহত যুদ্ধের নির্দেশ দিয়েছে এবং আল্লাহর ধর্ম প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ অব্যাহত রাখতে বলেছে। ইসলামের শান্তিবাদিতার সাথে এটা মিলে কি করে?’ বলল প্রতিনিধি পরিষদের গোয়েন্দা কমিটির চেয়ারম্যান এ্যান্ড্রু জ্যাকবস।
‘কিন্তু মিঃ জ্যাকবস আমরা আলোচনা করছি আহমদ মুসাকে নিয়ে, ইসলামকে নিয়ে নয়।’
এ কথা বলে প্রেসিডেন্ট জর্জ আব্রাহাম জনসনের দিকে চেয়ে বলল, ‘মি. জর্জ, মি. জ্যাকবস যা বললেন সে ব্যাপারে আপনি কি কিছু বলবেন?’
‘ইয়েস মি. প্রেসিডেন্ট।’ বলে একটু থামল জর্জ আব্রাহাম। তারপর আবার শুরু করল, ‘আহমদ মুসা ও ইসলাম আলাদা নয়। আহমদ মুসা ইসলামেরই প্রতিকৃতি, প্রতিটি সত্যিকার মুসলমানও তাই। মি. জ্যাকবস যে বিষয়ে বলেছেন সেটা পরিভাষাগত ভুল বুঝাবুঝির ফল। ইসলাম কোন ব্যক্তি বা গ্রুপ কিংবা কোন ধর্মকে লড়াইয়ের প্রতিপক্ষ মনে করেনা। ইসলামের লড়াই জুলুম, অশান্তি ও অবিচারের বিরুদ্ধে। এ হিসেবে জালেম ও শান্তিভংগকারীরাই ইসলামের প্রতিপক্ষ। মি. প্রেসিডেন্ট, মুসলিম রাষ্ট্র আরব সীমান্তে রোমান শাসনকর্তা সুহরাবিল বহুদিন রাজত্ব করেন। ইসলামের নবী তাকে আক্রমণ করেননি, তার সাথে কোন বিরোধও বাধেনি। কিন্তু সুহরাবিল যখন বিনা কারণে আন্তর্জাতিক রীতি লংঘন করে একজন মুসলিম দূতকে হত্যা করল, তখন ইসলামের নবী এই জুলুম ও অবিচারের প্রতিকারের জন্যে যুদ্ধ যাত্রার নির্দেশ দিলেন। সুহরাবিলের অধীনে তখন লক্ষাধিক সৈন্য, কিন্তু মুসলমানরা তিন হাজারের বেশি সৈন্য যোগাড় করতে পারেনি। এরপরও ইসলামের নবী পরিণতির কথা চিন্তা না করে অবিচারের প্রতিকারকেই বড় করে দেখেন। প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ইসলামের যুদ্ধের হুকুমের অর্থ এটাই। আল্লাহর ধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্যে অব্যাহত লড়াইয়ের নির্দেশের অর্থও এই ধরনের। ইসলামে ইহকালীন ও পরকালীন শান্তি, স্বস্তি ও মুক্তির পথকেই আল্লাহর ধর্ম বলা হয়েছে। জুলুম, অশান্তি ও অবিচারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নীতি হিসাবেই ইসলাম মানুষের জন্যে শান্তি, স্বস্তি ও সুবিচারের প্রতিষ্ঠা চায় এবং এ জন্যে অব্যাহত লড়াইয়ের নির্দেশ দেয়। এ লড়াইকে তারা মানবতার জন্যে অপরিহার্য মনে করে। আর এ লড়াই কলমের লড়াই এবং বুদ্ধি ও যুক্তির লড়াই। প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে অস্ত্রের লড়াইও এর সাথে শামিল। এ অস্ত্রের লড়াইয়ের দৃষ্টান্ত সুহরাবিলের সাথে মুসলমানদের যুদ্ধ যাত্রা।’
দীর্ঘ বক্তব্যের পর থামল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
‘ধন্যবাদ মি. জর্জ। ভালো বলেছেন। দেখছি, ইসলাম যে কারণে যুদ্ধ করে তা সার্বজনীন। এ কারণে সবাই যুদ্ধ করে এবং করতে বাধ্য। ‘আল্লাহর ধর্ম’ এর যে অর্থ করেছেন তা চমৎকার। তাঁর শান্তি, সুবিচার, ইত্যাদির কথাতো সব ধর্মই বলে। তাহলে ইসলামের আলাদা বৈশিষ্ট্য কোথায়?’ বলল প্রেসিডেন্ট।
‘সব একত্ববাদী ধর্মই ঈশ্বরের। তবে ওদের দাবী হলো, ইসলাম সর্বকনিষ্ঠ ও পূর্ণাংগ। মানব জীবনের সকল বিভাগে শান্তি ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার পূর্ণাংগ দার্শনিক ও প্রায়োগিক বিধান ইসলাম দেয়, যা অন্য কোন ধর্মে নেই।’ জর্জ আব্রাহাম বলল।
‘এ বিষয়গুলো খুবই নাজুক মি. জর্জ, আসুন আমরা আমাদের আলোচনার মূল প্রসংগে ফিরে যাই। অক্টোপাশের মত যারা আমাদের আবদ্ধ করে রেখেছিল, শ্যারনের সেই ইহুদীবাদীরা শুধু আমেরিকায় নয় বাইরেও আসন গেড়ে বসে আছে। তারা প্রভাবশালীও। তাদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া অবশ্যই হবে। চাপও আসবে শ্যারনদের ছেড়ে দেবার। এ দিকটি নিয়ে আপনারা কেউ কিছু বলেননি।’ বলল প্রেসিডেন্ট।
‘মি. প্রেসিডেন্ট, এটা বড় কোন সমস্যা হবে না। আমরা জনগণের স্বার্থে কঠোর ভূমিকা গ্রহণ করবো। বিশ্ব জনমতের কাছে তাদের স্বরূপ আমরা বিস্তারিতভাবে তুলে ধরব। এর ফলে তারা আত্মরক্ষামূলক অবস্থানে যেতে বাধ্য হবে। তারা বেশি কিছু করার অবকাশ পাবে না। তারা এক সময়ের চরম অবিশ্বস্ত ও নিন্দিত অবস্থানে আবার ফিরে যেতে বাধ্য হবে।’ বলল সিনেটের ফরেন রিলেশন্স কমিটির চেয়ারম্যান বব এইচ ব্রুস।
‘সকলকে ধন্যবাদ। আমরা এখন উঠতে পারি। তার আগে মি. জর্জ বলুন, আহমদ মুসা কেমন আছেন? সুরিনামের আরেকজন লোককে উদ্ধার করেছিলেন, তার খবর কি?’ প্রেসিডেন্ট বলল।
‘আহমদ মুসা সুস্থ হয়ে উঠেছেন মি. প্রেসিডেন্ট। দু’একদিনের মধ্যেই ছাড়া পাবেন। সুরিনামের লোকটি সেখানকার সাবেক প্রধানমন্ত্রী আহমদ হাত্তা নাসুমন। দৈহিক নির্যাতন ছিল তার অসুস্থতার কারণ। সেও সুস্থ হয়ে উঠেছে। আহমদ মুসার পাশের ঘরে তাকে রাখা হয়েছে।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
প্রেসিডেন্ট সকলের দিকে একবার তাকিয়ে বলল, ‘দেখুন আমি মনে করছি, আহমদ মুসাকে মার্কিন নাগরিকত্ব অফার করা উচিত। সে যে এলাকা প্রেফার করবে সেখানে একটা বাড়িও দিতে চাই। আমি যতদূর জানি সৌদি সরকার মক্কা ও মদিনায় তাকে দু’টি বাড়ি দিয়েছে। এ ছাড়া কোন দেশে তার কিছু নেই। তার অবদান মার্কিন জাতি কোন দিন ভুলবে না। ইহুদীবাদী অক্টোপাশ আমাদেরকে আমাদের ফাউন্ডার ফাদারসদের নির্দেশিত জাতীয় লক্ষ থেকে অনেক দূর সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। সেখান থেকে আমরা ফিরে আসছি। অবশ্য সারা জেফারসনের ‘ফ্রি আমেরিকা’ এই লক্ষে আগে থেকেই কাজ করছিল। কিন্তু আহমদ মুসা না এলে, তাঁর সহযোগিতা না হলে এই কামিয়াবী আসতো না। সত্যিকার ‘ফ্রি আমেরিকা’ তার পরশ পেয়েই ধন্য হয়েছে। এই কথা মার্কিন জাতির ভোলা উচিত নয়।’ থামল প্রেসিডেন্ট।
‘আমরা মি. প্রেসিডেন্টের সাথে একমত। সবাই খুশি হবে এই প্রস্তাবে। সবচেয়ে বেশি খুশি হবে ‘ফ্রি আমেরিকা’ ও সারা জেফারসন।’ সমবেত কণ্ঠে বলে উঠল সবাই।
‘ধন্যবাদ সকলকে।’ বলেই প্রেসিডেন্ট তাকাল জর্জ আব্রাহামের দিকে। বলল, ‘সারা জেফারসন ও আহমদ মুসার সম্পর্কের ব্যাপারে মি. জর্জ কি নতুন কিছু জানেন?’
‘দু’জনই এতটা চাপা, এতটা সংযত, এতটা সতর্ক যে আমরা কিছুই জানতে পারছি না। মি. প্রেসেডিন্ট।’ বলল জর্জ আব্রাহাম।
‘মি. জর্জ ওরা দুই সাগর। পৃথক একটা সংযোগ খাল তৈরী ছাড়া ওদের মিলন হবে না। এই সংযোগের জন্যে তৃতীয় পক্ষ চাই।’ প্রেসিডেন্ট বলল।
হাসল জর্জ আব্রাহাম। বলল, ‘মি. প্রেসিডেন্টের ইচ্ছা আমি বুঝেছি। এই দায়িত্ব আমি নিলাম।’
‘সকলকে আবারও ধন্যবাদ।’ বলে প্রেসিডেন্ট উঠে দাড়াল।
উঠে দাঁড়াল সবাই।

পেন্টাগন মিলিটারী হাসপাতাল। হাসপাতালের ভিআইপি উইং।
আহমদ মুসা তার কক্ষের বাইরে দক্ষেণমুখী প্রশস্ত বারান্দায় একটা সোফায় বসে। তার সামনে টি টেবিল।
টি টেবিলের ওপারে আরেক সোফায় বসে আছে পঞ্চাশোর্ধ একজন মানুষ। মুখের আদলটা তার ইন্দোনেশীয় ধরণের। চেহারায় আভিজাত্য। নাম আহমদ হাত্তা নাসুমন।
আহমদ হাত্তা নাসুমন দক্ষেণ আমেরিকার আটলান্টিক তীরের দেশ সুরিনামের একটি প্রাচীন ও সম্মানিত পরিবারের সন্তান এবং সেখানকার একজন প্রভাবশালী রাজনীতিক।
সেদিন জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন সেই টিলার বাড়িটিতে জেনারেল শ্যারনকে ধরার জন্যে যে অভিযান চালিয়েছিল, সেই অভিযানে তারা আহমদ হাত্তা নাসুমনকেও উদ্ধার করে বন্দীদশা থেকে।
আহমদ হাত্তা নাসুমনের ম্লান মুখে শংকার ছায়া। কথা বলছিল সে। বলছিল, ‘গত নির্বাচন সুরিানামের মুসলমানদের জন্যে বিপদ ডেকে আনে। ঐ নির্বাচনে জাতীয় পরিষদের শতকরা ৪৫ ভাগ আসনে মুসলমানরা নির্বাচিত হয়। জাতীয় পরিষদের প্রথম অধিবেশনে আমাকে পরিষদ নেতা নির্বাচিত করে। ফলে সংবিধান অনুসারে আমিই হই দেশের প্রধানমন্ত্রী। আর জাতীয় পরিষদের বিরোধী দলীয় নেতা নির্বাচিত হন রমেশ আগরওয়াল। ইউরোপিয়ান কম্যুনিটির সাহায্য নিয়ে তিনি চেষ্টা করছিলেন প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্যে। পারেনি। তখন থেকেই…।’
‘জাতীয় পরিষদে মুসলমানরা এত সীট পেল কি করে?’ আহমদ হাত্তা নাসুমনকে থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘সুরিনামে জনসংখ্যার আবাসিক বিভাজনটা নৃতত্বীয় জাতি ভিত্তিক। যেমন হিন্দুস্তানী, ক্রোলস (ইউরোপীয় ও আফ্রিকানদের মিশ্রণ), ইন্দোনেশীয়ানস, নিগ্রো, আমেরিকান, ইন্ডিয়ানস, চাইনীজ ইত্যাদি। সেখানে ভোট হয় এই জাতি ভিত্তিক বিভাজন অনুসারে। ঐ নির্বাচনে মুসলমানরা হঠাৎ বিশেষ একটা সুবিধা লাভ করে। হিন্দুস্তানী, ক্রোলস ও ইন্দোনেশীয়ানদের একটা বড় অংশ মুসলমান। যখন শিক্ষার প্রসার কম ছিল, সচেতনতা কম ছিল, তখন নির্বাচনে ধর্ম পরিচয় তেমন একটা প্রভাব বিস্তার করতো না। কিন্তু শিক্ষার হার যত বাড়ছে, ধর্মীয় প্রভাব ততই শক্তিশালী হয়ে উঠছে। গত নির্বাচনে এটা পরিষ্কার বোঝা গেছে। বড় প্রত্যেক জাতির গ্রুপ থেকে মুসলমানরা প্রচুর পরিমাণে নির্বাচিত হয়েছে। এমনকি চীনাদের মধ্যে থেকেও দু’জন নির্বাচিত হয়েছে। সব মিলিয়ে মুসলিম সদস্যদের সংখ্যা দাঁড়ায় পয়তাল্লিশ।’ বলল আহমদ হাত্তা নাসুমন।
‘তার মানে মুসলিম বোধ সেখানে বাড়ছে?’ আহমদ মুসা বলল।
‘হ্যাঁ, তাই।’
‘শিক্ষার প্রসারই কি এর কারণ, ইসলামের পক্ষে সেখানে কোন কাজ হচ্ছে!’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘রাবেতা আলমে আল ইসলামীর একটা অফিস সুরিনামের রাজধানী পারামারিবো’তে রয়েছে। রাবেতা কোরআন, হাদিসসহ কিছু বইয়ের অনুবাদ সুরিনামের সাধারণভাবে কথিত ভাষা ‘টাকি টাকি’তেও করেছে। ইংরেজী, ডাচ, হিন্দী, উর্দু বিভিন্ন আফ্রিকান ভাষার ইসলামী বইও রাবেতা সেখানে বিতরণ করেছে। সুরিনামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পর্যন্ত রাবেতা মসজিদ, মাদ্রাসা তৈরী করেছে। এ সবের বড় একটা প্রভাব অবশ্যই আছে। কিন্তু মুসলমানদের সচেতন করে তোলার সবচেয়ে বড় কাজ করেছে হিন্দুস্তানী হিন্দুরা। তারা ব্যবসায়-বাণিজ্য ও শিল্প কারখানায় খুব প্রভাবশালী। তাদের মধ্যে স্বজনপ্রীতি খুব বেশি থাকে এবং তারা মুসলমানদেরকে বিদ্বেষের চোখে দেখে। তারা যেখানেই থাকে, সেখানে মুসলমানরা প্রবেশাধিকার পায় না। তাদের দেখাদেখি ইউরোপীয়রাও অনেক ক্ষেত্রে মুসলমানদের সাথে বৈষম্যমুলক আচরণ করে। এর ফলে মুসলমানরা চাকরী-বাকরী ও ব্যবসায়-বাণিজ্যে বহুল পরিমাণে বঞ্চনার শিকার হচ্ছে। উদ্ভুত এই বিরূপ পরিস্থিতিই মুসলমানদেরকে তাদের স্বার্থ সম্পর্কে সচেতন করেছে।’
‘ব্যবসায়-বাণিজ্য ও চাকরী-বাকরীতে মুসলমানরা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে নেই?’ প্রশ্ন করল আহমদ মুসা।
‘চাকরী-বাকরীতে যা কিছু আছে ক্রোলস জাতীয় মুসলমানরাই আছে। হিন্দুস্তানী মুসলমানরা চাকরী-বাকরিতে নেই বললেই চলে, কিছু আছে ব্যবসায়-বাণিজ্যে। ইন্দোনেশীয় মুসলমানরা প্রায় সকলেই কৃষিক্ষেত্রে। আর নিগ্রো মুসলমানদের অবস্থা আরও খারাপ। তারা থাকে জংগলে ও পাহাড় এলাকায়। সব মিলিয়ে শহর জীবনে মুসলমানদের প্রভাব উল্লেখযোগ্য নয়।’ আহমদ হাত্তা নাসুমন বলল।
‘বর্তমান বিরোধের সূত্রপাত কিভাবে হলো?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘আজ থেকে ছয় মাস আগে সংবিধান অনুসারে মেয়াদ শেষে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্যে আমার নেতৃত্বাধীন মন্ত্রী সভা ভেঙে দেয়া হয়। প্রেসিডেন্ট ইউরোপীয় জাতি গোষ্ঠির। তিনি তত্বাবধায়ক সরকার গঠন করেন এবং তার প্রধান হিসবে নিয়োগ করেন আরেকজন ইউরোপীয় বংশোদ্ভুত সাবেক আমলাকে। মহাখুশি হয় হিন্দুস্তানী বংশোদ্ভুত হিন্দু জাতিগোষ্ঠিরা। ইউরোপীয় ও তারা এক হয়ে যায়। শুরু হয় ষড়যন্ত্র। মাত্র একমাসে বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রায় ৪শ’ মুসলিম রাজনৈতিক নেতা ও কর্মী হারিয়ে যায়। তারা বেঁচে আছে কিনা তাও জানা যায়নি, আর মরে যাবার কোন চিহ্নও পাওয়া যায়নি। তারপর শুরু হয় আমার পরিবারের উপর হামলা। আমার একমাত্র সন্তান ফাতিমা নাসুমন পারামারিবো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। সেই আমার সবচেয় দুর্বলতম স্থান। এই দুর্বলতম স্থানেই তারা আঘাত করে। মিথ্যা প্রেমের খবর রটনা করে হিন্দুস্তানী এক রাজনীতিকের ছেলে তাকে জোর করে বিয়ে করতে চেষ্টা করে। কিন্তু ব্যর্থ হয়। এরপর তাকে দু’বার কিডন্যাপ করার চেষ্টা করে। এই অবস্থায় দিশেহারা হয়ে আমি ফাতিমাকে গোপনে ওয়াশিংটনে পাঠিয়ে দেই। এতে তারা ভীষণ ক্ষীপ্ত হয়ে ওঠে। তারা আমার হবু জামাতা, অত্যন্ত সম্ভাবনাময় যুবনেতা ওয়াং আলীকে কিডন্যাপ করে। তারা দাবী করেছে ফাতিমাকে ওদের হাতে তুলে না দিলে ওরা ওয়াং আলীকে হত্যা করবে। ওদিকে মন্ত্রীসভা ভেঙে দেয়ার তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন হওয়ার কথা, কিন্তু তা হলো না। আইন শৃংখলার কথা তুলে নির্বাচন তিন মাসের জন্যে পিছিয়ে দেয়া হলো। উদ্দেশ্য, নির্বাচনের আগে আরও সময় নেয়া যাতে মুসলমানদের শিক্ষিত ও সক্রিয় অংশকে ধ্বংস করা যায়। তাই হলো। মুসলমানদের শিক্ষিত ও সক্রিয় অংশ, বিশেষ করে যুবকরা হারিয়ে যেতে থাকল। আতংক সৃষ্টি হলো দেশ জুড়ে। মুসলিম যুবকরা দেশ থেকে পালাতে লাগল। পুলিশ নির্বিকার। পুলিশ ও সরকার স্বীকারই করল না যে, দেশ থেকে কেউ হারিয়ে গেছে। তারা একে নির্বাচন সামনে রেখে অপপ্রচারের একটা কৌশল হিসেবে প্রচার করল। কোন কোন ক্ষেত্রে লুকিয়ে রেখে, দেশ থেকে বাইরে পাঠিয়ে দিয়ে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপাবার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে, এমন কথাও বলা হতে লাগল। এই সূত্র ধরে যে পরিবারের যুবক ছেলে হারিয়ে গেল সেই পরিবারের উপর জুলুমও নেমে এল। শিক্ষিত ও সচেতন শত শত মুসলিম ঘরে আজ কান্নার রোল। মুসলিম পরিবারগুলো বিপুল সংখ্যায় পার্শ্ববর্তী দেশ ব্রাজিল, গায়না, ফ্রেঞ্চ গায়না প্রভৃতি দেশে পালিয়ে যাচ্ছিল। ব্যাপারটা বহিরবিশ্বে জানা-জানি হয়ে যাবে এই ভয়ে সরকার ও হিন্দুস্তানীদের প্রাইভেট বাহিনী সীমান্ত পথগুলোতে পাহারা বসাল। ফলে পালাবার পথও মুসলমানদের বন্ধ হয়ে গেল। খাঁচায় পুরা গিনিপিগের মতই মরতে লাগল মুসলমানরা। নির্বাচন পিছিয়ে দেয়ার দুমাস পর একদিন আমিও কিডন্যাপ হলাম। কিডন্যাপের পর ওরা আমাকে ছেড়ে দেয়ার জন্যে তিনটি শর্ত দিলঃ এক. আমাকে রাজনীতি ছাড়তে হবে, দুই. আমাকে দেশ ত্যাগ করতে হবে এবং তিন. আমার মেয়ে ফাতিমা নাসুমনকে ওদের হাতে তুলে দিতে হবে। আমি অস্বীকার করলে ওরা আমার উপর অকথ্য নির্যাতন চালায় এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে আসে। ওদের পরিকল্পনা ছিল, সুরিনামে নতুন নির্বাচন হওয়া ও ফাতিমাকে উদ্ধার করার পর আমাকে হত্যা করবে।’
‘আপনার মেয়ে ফাতিমাকে হাতে পেতে ওরা এতটা মরিয়া কেন? শুধুই কি নারী দেহ টার্গেট?’ বলল আহমদ মুসা।
‘না তা নয়। ফাতিমাকে বাইরে রেখে আমাকে হত্যা করলে আমার কথা ও সুরিনামের পরিস্থিতি প্রকাশ হয়ে পড়ার ভয় থাকে। দ্বিতীয়ত, আমার মেয়েকে বাগে এনে আমার বিরাট জমিদারী তারা কব্জা করতে চায়। সুরিনাম উপকূলে কৃষিযোগ্য এলাকার মধ্যে আমাদের জমিদারীটাই সবচেয়ে বড় ও প্রাচীন। তৃতীয়ত, আমাকে ও আমার মেয়েকে শেষ করার মাধ্যমে আমাদের পরিবার ধ্বংস করতে পারলে তারা মনে করে, সুরিনামে মুসলিম রাজনীতির মেরুদন্ড আপাতত ভেঙে পড়বে।’ আহমদ হাত্তা নাসুমন বলল।
‘ইন্দোনেশীয়, হিন্দুস্তানী, ক্রোলস, চীনা ইত্যাদি সব কম্যুনিটি থেকেই যেহেতু লোক হারাচ্ছে এর কোন প্রতিক্রিয়া নেই? সংবাদপত্রগুলো কিছু লেখে না?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘প্রতিক্রিয়া আছে, কিন্তু তা ভীতিতে রূপান্তরিত হয়েছে। আর প্রতিক্রিয়া জানাবে কার বিরুদ্ধে? সরকার, হিন্দুস্তানী ও ইউরোপীয়রা এর সাথে জড়িত, তার কোন প্রমাণ নেই। কিডন্যাপগুলো হচ্ছে খুবই পরিকল্পিতভাবে। বাড়ি থেকে কেউই হারাচ্ছে না। হয়তো একজন শহরে গেল, আর ফিরে এল না। হয়তো কেউ গঞ্জ-বাজারে গেছে, সেই যাওয়া তার শেষ যাওয়া হলো। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনেক সময় গায়েব হয়ে যাচ্ছে মুসলিম যুবকরা।’ থামল আহমদ হাত্তা নাসুমন।
‘তার মানে কিডন্যাপগুলো একটি সংঘবদ্ধ কোন গ্রুপের কাজ, যারা তাদের টার্গেটেড ব্যক্তির প্রতিদিনের গতিবিধি পাহারা দিয়ে একদিন সুযোগ মত তাকে কিডন্যাপ করে। আপনি প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, বলতে পারেন এ ধরনের কোন গ্রুপ সুরিনামে আছে?’ আহমদ মুসা বলল।
‘না এ ধরনের কোন গ্রুপ ছিল না। ক্রিমিনালদের ছোট ছোট গ্যাং ছিল, কিন্তু কোন পলিটিক্যাল মটিভে তারা উদ্বুদ্ধ ছিল না। তবে ‘মাতৃ সন্তান’ নামে একটা গ্রুপ ছিল। এরা সীমাবদ্ধ ছিল হিন্দুস্তানী হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে। তরুণ ও যুবকরাই এই গ্রুপের সদস্য। গ্রুপটা সাংস্কৃতিক। প্রতিদিন সকালে ঈশ্বর বন্দনা, ইতিহাস থেকে গল্পের আসর পরিচালনা ও শরীর চর্চা তাদের একমাত্র কাজ।’
বলে একটু থামল আহমদ হাত্তা নাসুমন। তারপর শুরু করল আবার, ‘আমার মনে হয় কিডন্যাপকারী গ্রুপটা বিদেশী, হায়ার করা। আমাকে যারা কিডন্যাপ করেছিল তাদের প্রায় সবাই বিদেশী। সুরিনামের মাত্র একজন যুবক ছিল তাদের সাথে। তাদের কথা শুনে মনে হয় তারা কারও পক্ষে কাজ করছে।’ থামল আহমদ হাত্তা নাসুমন।
‘সেই বিদেশীরা কি শ্বেতাংগ, না কৃষ্ণাংগ?’ প্রশ্ন করল আহমদ মুসা।
‘কৃষ্ণাংগ কেউ ছিল না। তবে শ্বেতাংগরাও পিউর শ্বেতাংগ কেউ ছিল না। দেহের রং ও গড়ন এশিয়ার কোন কোন এলাকার মানুষের মত।’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘আর তাদের সাথে সুরিনামের যে লোকটি ছিল, সে নিশ্চয় হিন্দুস্তানী ছিল?’
‘হ্যাঁ, তাই।’ বলল আহমদ হাত্তা নাসুমন।
‘তার মানে হিন্দুস্তানীরা হায়ার করেছিল ইহুদী সন্ত্রাসীদের ক’জনকে?’ আহমদ মুসা বলল।
‘ওরা ইহুদী ছিল?’ হাত্তা নাসুমনের কণ্ঠে বিস্ময়।
‘আপনি যেখানে বন্দী ছিলেন, সে বাড়িটা ছিল ভারতীয় আমেরিকানদের নেতা ভারত ভূষণ শিবাজীর। আর ঐ বাড়ি থেকে পুলিশ যে দু’জনকে গ্রেপ্তার করেছে, তাদের একজন বিশ্ব ইহুদী গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান জেনারেল শ্যারন, অন্যজন দুর্ধর্ষ্য ইহুদী গোয়েন্দা বেন ইয়ামিন।’ বলল আহমদ মুসা।
বিস্ময়ে চোখ দু’টি বড় বড় হয়ে উঠেছে আহমদ হাত্তা নাসুমনের। বিস্ময়-বিমূঢ় সে। কিছু বলতে পারল না।
আহমদ মুসাই শুরু করল। বলল, ‘বিস্ময়ের কিছু নেই মি. হাত্তা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় আমেরিকানরা সহযোগিতা করছে ইহুদীবাদীদের, আর সুরিনামের ইহুদীবাদীরা সহযোগিতা করতে পারে ভারতীয় সুরিনামীদের।’
‘আশ্চর্য আতাঁত। কিন্তু আমাদের সুরিনামে তো ইহুদী নেই! কিভাবে আতাঁত গড়ে উঠল?’ বলল আহমদ হাত্তা নাসুমন।
‘আমার ধারণা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভারতীয় কম্যুনিটির সাথে আপনাদের ভারতীয় কম্যুনিটির যোগাযোগ আছে। এই যোগাযোগ থেকেই ওরা ইহুদীবাদীদের সাহায্য পেয়েছে।’ । আহমদ মুসা বলল।
‘দুর্ভাগ্য সুরিনামের।’ বলল আহমদ হাত্তা নাসুমন। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল তার বুক থেকে।
‘নির্বাচনের আর কত দেরী?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘তিন মাস।’
‘এখন আপনি কি করবেন?’
‘এই অবস্থায় আমরা সেখানে নির্বাচন করতে পারব না। আমাদের পাঁচ ছ’শ সক্রিয় নেতা-কর্মী হারিয়ে গেছে। আর এর সাথে সংশিস্নষ্ট করে এর চেয়েও বেশি নেতা-কর্মীকে জেলে পুরা হয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা হলো, নিরাপত্তার অভাব। কেউ সক্রিয় হলেই তার আর রক্ষা থাকবে না। হারিয়ে যেতে হবে, নয়তো জেলে যেতে হবে মামলায় পড়ে। আমাদের মুসলিম কম্যুনিটির প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই কান্নার রোল, বিষাদের ছায়া। সাহস করে দাঁড়াবার শক্ত মেরুদন্ড কারোর নেই। এই অবস্থায় তারা নির্বাচন করবে কি করে?’
বলতে বলতে কণ্ঠ ভারী হয়ে উঠেছে আহমদ হাত্তা নাসুমনের তার দু’চোখের কোণায় জমে উঠেছে অশ্রু।
আহমদ মুসার মনও ভারী হয়ে উঠেছে। তার চোখের সামনে ফুটে উঠল সুরিনামের ক্রন্দন কাতর মুসলিম জনপদের দৃশ্য। একটা অদৃশ্য কালো থাবা সেই জনপদগুলোকে গ্রাস করছে, ভেসে উঠল তার চোখে সেই দৃশ্যও। হৃদয়টা মোচড় দিয়ে উঠল আহমদ মুসার।
ভাবছিল আহমদ মুসা। বেশ একটু পর ধীরে ধীরে বলল, ‘আচ্ছা বলুন তো এতগুলো লোক নিখোঁজ হলো বা অপহৃত হলো, কোন ক্ষেত্রেই কি ওরা বাঁধা পায়নি, ধরা পড়েনি?’
‘না। ভোজবাজীর মতই ঘটে গেছে সব ঘটনা। মনে হয় তারা উপযুক্ত সুযোগের জন্যে অপেক্ষা করেছে। সুযোগ পাওয়ার পর বাধা দেবার আর কোন সুযোগ দেয়নি।’
‘এই অদৃশ্য শত্রুকে আপনারা খুঁজে বের করার কোন সংঘবদ্ধ উদ্যোগ নেননি!’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
ম্লান হাসল আহমদ হাত্তা নাসুমন। বলল, ‘তা করা হয়েছে। একাধিকবার কমিটি গঠন করা হয়েছে। মুসলিম পুলিশ ও আমলাদের সাহায্য নেয়া হয়েছে। কিন্তু পা বাড়াবার পর তারাই আক্রান্ত হয়েছে। কমিটির সদস্যরাই কিডন্যাপের শিকার হয়েছে। এ ধরনের কয়েকটি ঘটনার পর কোন লোক এমন উদ্যোগ গ্রহণেও আর সাহস পায়নি।’
‘নিখোঁজরা কি সব নিহত বলে মনে করেন?’ আহমদ মুসা বলল।
‘এমন মনে করতে ভয় হয়। কিন্তু মেরে না ফেললে এত লোককে তারা রাখবে কোথায়? কেন রাখবে?’
‘মেরেই যদি ফেলে থাকে, তাহলে কিডন্যাপ করে কেন? মেরে ফেলে চলে যেতে পারে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘একই কম্যুনিটির এত লোক নিহত হলে দেশ ছাড়াও বিদেশে এর প্রতিক্রিয়া হবে। এই অসুবিধা বোধ হয় তারা এড়াতে চেয়েছে।’
‘এতবড় ঘটনা ঘটাবার ওদের প্রধান উদ্দেশ্য কি?’ প্রশ্ন করল আহমদ মুসা।
‘প্রথমত, মুসলমানদের নির্বাচন থেকে বিরত রাখা এবং যে মুসলমানরা রাজনীতিতে প্রধান শক্তি হতে যাচ্ছিল, তাদেরকে পেছনে ঠেলে দেয়া। কিন্তু আসল লক্ষ হলো, সুরিনামের হিন্দুস্তানীকরণের পথ সুগম করা। ইউরোপীয়দেরকে তারা হাত করেছে। এখন মুসলমানদের রাজনীতির মঞ্চ থেকে সরিয়ে দিতে পারলেই তারা নিরাপদ।’ বলল আহমদ হাত্তা নাসুমন।
‘ধন্যবাদ মি. হাত্তা। আমারও তাই মত।’ বলে একটু থামল আহমদ মুসা। তারপর আবার শুরু করল, ‘সুরিনামের এই মহাবিপদে আপনি এখন কি করবেন ভাবছেন?’
‘আমার ওখানে যাওয়াই বিপজ্জনক। কিভাবে কি করব বুঝতে পারছি না।’ বলল হাত্তা নাসুমন হতাশ কণ্ঠে।
‘একটা সন্ত্রাসই তাহলে সেখানে জয়ী হয়ে যাবে?’ আহমদ মুসা বলল।
‘ওরা সংগঠিত, অন্যেরা অসংগঠিত।’ বলল হাত্তা নাসুমন।
আহমদ হাত্তা নাসুমন থামলেও আহমদ মুসা কোন কথা বলল না। ভাবছিল সে। অনেক্ষণ পর মাথা তুলল আহমদ মুসা। বলল, ‘আপনি এখন সুস্থ। হাসপাতাল থেকে কোথায় যাবেন, কি করবেন?’
‘আমার মেয়েকে খুঁজে বের করব। তারপর চিন্তা করব কি করা যায়। এখনো কিছু ভাবিনি।’ বলল হাত্তা নাসুমন।
‘আপনার মেয়ের কি নাম বলেছিলেন?’
‘ফাতিমা নাসুমন।’
‘পড়ছেন? কোথায় থাকেন?’
‘না এখনও ভর্তি হয়নি। কোথায় আছে আমি জানি না। যেখানে ছিল, সেখানে নিশ্চয় নেই। আমি কিডন্যাপ হবার পর নিশ্চয় সে জায়গা পরিবর্তন করেছে।
হাত্তা নাসুমন তার কথা শেষ করতেই তার এ্যাটেনডেন্ট এসে বলল, ‘স্যার ডাক্তার এসেছেন।’
শুনেই ‘স্যরি’ বলে উঠে দাঁড়াল।
আহমদ মুসা তাকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘শুনুন, আমি হাসপাতাল থেকে রিলিজ নিয়ে নিচ্ছি। হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে প্রথমেই যাব আমি যার গাড়ি নিয়ে শ্যারনকে ফলো করেছিলাম তার কাছে। গাড়ির ক্ষতিপূরণ দিতে। আপনিও আমার সাথে থাকবেন। আপনার মেয়েকে খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত আপনি আমার মেহমান।’
খুশিতে মুখ ভরে উঠল আহমদ হাত্তা নাসুমনের। ধপ করে সে আবার সোফায় বসে পড়ল। দু’হাত চেপে ধরল সে আহমদ মুসার। বলল, ‘এতবড় সৌভাগ্য হবে আমার? আমি আহমদ মুসার মেহমান হতে পারব? আমাকে নিয়ে, আমাদের নিয়ে ভাবছেন আপনি?’
বলে আহমদ মুসার দু’হাত ছেড়ে দিয়ে হাত দু’টি উপরে তুলে বলল, ‘হে আল্লাহ, অসহায় আমরা, আমাদের সাহায্য করুন।’
কথা শেষ করেই উঠে দাঁড়াল হাত্তা নাসুমন। আহমদ মুসাকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে দ্রুত তার কক্ষের দিকে এগুলো। তার দু’চোখের কোণায় অশ্রু চিক চিক করছিল।
আহমদ মুসা উঠতে যাচ্ছিল। কিন্তু দেখল বারান্দা দিয়ে তার দিকে এগিয়ে আসছে লায়লা জেনিফার ও তার স্বামী জর্জ এবং সান ওয়াকার ও তার স্ত্রী মেরী রোজ। লায়লা জেনিফার ও মেরি রোজ দু’জনের গায়েই ফুল হাতা জামা। মাথার রুমাল ওদের গলা ও বুক জড়িয়ে আছে।
খুশি হলো আহমদ মুসা। নড়ে-চড়ে বসল সোফায় আবার।
ওরা এসে পড়লে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়িয়ে ওদের স্বাগত জানাল সালাম দিয়ে এবং বলল, ‘মনে পড়ল বুঝি আমার কথা?’
‘ভাইয়া, জানি একথা আপনি বলবেন। কিন্তু জানেন, আমরা দু’দিন এসে ফিরে গেছি। আপনি ঘুমিয়ে ছিলেন।’ অভিমান ক্ষুব্ধ কণ্ঠ জেনিফারের।
‘জানি জেনিফার। তোমাদের স্লিপ তো পড়েছি। কিন্তু টেলিফোন নাম্বার ছিল না কোন স্লিপে?’ আহমদ মুসা সোফায় বসতে বসতে বলল।
‘আপনি যেহেতু ঘুমিয়ে ছিলেন ভাইয়া, টেলিফোন নাম্বারটা অন্যের হাতে পড়ার সম্ভাবনা ছিল। সেজন্যেই……..।’
জেনিফারের কথার মাঝখানেই আহমদ মুসা বলে উঠল, ‘বাঁ চমৎকার তুমি তো গোয়েন্দা হয়ে উঠছ জেনিফার।’ আহমদ মুসার মুখে হাসি।
‘কখনো না। আপনাকে যা দেখছি। তারপর ঐ পথে পা বাড়াব আমি?’ বলল জেনিফার কৃত্রিম ভয়ের সুরে।
‘ভাইয়া, জেনিফার কিন্তু এখন আমেরিকান ক্রিসেন্টের টার্কস দ্বীপপুঞ্জ শাখার সভানেত্রী।’ জেনিফার থামতেই বলে উঠল জর্জ।
‘অভিনন্দন জেনিফার। যতই মুখে বল, বোন কি ভাইয়ার পথ ছাড়তে পারে? ’ বলে হেসে উঠল আহমদ মুসা। তারপর কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সবাইকে লক্ষ করে বলল, ‘আমি এই হাসপাতালে তোমরা জানলে কি করে?’
‘ভাইয়া নিউ হারমানের আগের দিনের কাহিনী পড়ে আমাদের শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা হয়েছিল। এরপর কি ঘটে? এ ষড়যন্ত্রই কি সত্য হবে? এমন হাজারো প্রশ্ন আর মনের আকুলতা নিয়ে আমরা তাকিয়ে ছিলাম টিভি চ্যানেল ও সংবাদপত্রের দিকে। আলহামদুলিল্লাহ, পরের দিনই আমরা জানলাম আপনার সব কাহিনী এবং সত্য ঘটনা। সংবাদপত্রেই জানলাম আপনি আহতাবস্থায় হাসপাতালে। আপনি কোন হাসপাতালে তা বহুকষ্টে জোগাড় করে আমরা সেদিন সকালেই এখানে ছুটে এসছিলাম। কথা বলতে না পারলেও দেখেছিলাম আপনাকে। সেদিন আমাদের সাথে ওগলালাও ছিল।’
‘ওগলালা কেমন আছে?’ আহমদ মুসা বলল।
‘ভাল।’ বলল সান ওয়াকার।
‘ওকে আমার সালাম দিও। আর আসতে বলো।’ আহমদ মুসা বলল।
‘অবশ্যই ভাইয়া।’ বলল সান ওয়াকার।
‘ভাইয়া সারা জেফারসন আপা কেমন আছেন? ওর হাসপাতালে গিয়েছিলাম, কিন্তু সিকুরিটির লোকরা দেখা করতে দেয়নি।’ লায়লা জেনিফার বলল।
‘তুমি সারা জেফারসনকে চিনলে কি করে?’ আহমদ মুসার কণ্ঠে কিছুটা বিস্ময়।
‘ওঁর মত মহান নেত্রী ও বিখ্যাত এক আমেরিকানকে আমরা জানব না কেন? জানেন, আপনি যখন শ্যারনদের হাতে বন্দী, সারা জেফারসন যখন হাসপাতালে তখন আমরা সবাই, ওগলালাও ওঁর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। প্রায়……..।’
জেনিফারের কথায় বাধা দিয়ে আহমদ মুসা বলে উঠল, ‘দেখাও করেছ ওর সাথে?’
‘অবশ্যই। প্রায় দু’ঘন্টা ছিলাম ওঁর সাথে। কত গল্প আমরা করেছি। খুব খুশি হয়েছেন উনি। আপনাকে নিয়ে কত যে প্রশ্ন করেছেন তিনি। খুঁটে খুঁটে আপনার সব কথা জেনে নিয়েছেন। সারা আপা খুব আবেগ প্রবণ। ভাবীর সাথে কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন? সত্যিই ভাইয়া……..।’
জেনিফারকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে আহমদ মুসা আবার বলল, ‘তার মানে ‘ভাবী’ মানে ডোনা জোসেফাইনের সাথে সারা কথা বলেছে! কেঁদেছে!’ আহমদ মুসার কণ্ঠে শুস্কতা, মুখ ম্লান।
‘হ্যাঁ ভাইয়া। আমরা ভাবীর গল্প করার পর উনি কিছুতেই কথা না বলে ছাড়বেন না।’
বলে একটু থামল লায়লা জেনিফার। বলে উঠল পরক্ষণেই, ‘সত্যি ভাইয়া সারা জেফারসন আপার মত এত মিষ্টি মানুষ আমি দেখিনি। শুধু থাকতেই ইচ্ছে করে ওঁর কাছে। আর আপনি ওঁর কাছে দেবতার চেয়ে বড়। আমরা বিদায়ের সময় উনি কি বললেন জানেন, ‘তোমরা তোমাদের ভাইয়ার প্রতি সুবিচার করছ না জেনিফার। যে লোক নিজের দিকে দেখে না, তাঁকে সবাই মিলে দেখা উচিত।’ এ কথা বলার সময় হাসতে গিয়ে কেঁদে ফেলেছিলেন সারা আপা।’
লায়লা জেনিফারের কথাগুলো তীরের মত বিদ্ধ করল আহমদ মুসার হৃদয়কে। কেঁপে উঠল আহমদ মুসা। অসহনীয় যন্ত্রণা ছড়িয়ে পড়ল তার গোটা দেহে। সারা জেফারসনের ক্ষত-বিক্ষত রক্তাক্ত হৃদয় যেন তার সামনে একেবারে উন্মুক্ত।
আহমদ মুসা বহুকষ্টে নিজেকে সম্বরণ করে প্রসঙ্গটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেবার জন্যে বলল, ‘সারা জেফারসন ভালো আছে। ও হাসপাতাল থেকে ক’দিন আগেই বাসায় ফেরার কথা। যাক। এখন বল, তোমাদের কাজকর্ম কেমন চলছে?’
‘কিন্তু ভাইয়া, আমাদের কথা বলার আগে আপনার কথা আমরা জানতে চাই।’ আক্রমণের মুড নিয়ে বলল জেনিফার।
‘কি কথা?’
‘ভাবী কেমন আছেন?’
‘ভাল।’
‘প্রতিদিনই কথা বলি। আজও সকালে বলেছি।’
‘হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে কোথায় যাবেন?’
‘একজনের গাড়ি কেড়ে নিয়ে জেনারেল শ্যারনকে ফলো করেছিলাম। সে গাড়ির ক্ষতিপূরন দেয়ার জন্যে তার কাছে যাব। তারপর যাব সারা জেফারসনকে দেখতে। সেখানে আমার ব্যাগ-ব্যাগেজও আছে।’
‘তারপর?’
সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল না আহমদ মুসা। সোফায় গা এলিয়ে দিল। চোখ বন্ধ করল। বেশ কিছুক্ষণ পর ধীরে ধীরে বলল, ‘তারপর অনিশ্চিত এক যাত্রা।’
অস্বস্তিকর এক নিরবতা নামল।
নিরবতা ভাঙল জেনিফারই। বলল, ‘কোথায়?’
চোখ খুলল। ম্লান হাসল।
তারপর সোজা হয়ে সোফায় বসল। বলল, ‘বলার মত হয়নি এখনও। পরে বলব তোমাদের।’
লায়লা জেনিফার এ কথায় সন্তুষ্ট হয়নি। কিছু বলতে যাচ্ছিল।
আহমদ মুসা তাকে বাধা দিয়ে বলল, ‘এখন আর কোন কথা নয়। চল কিছু খাই।’
বলে উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা।
তার সাথে সবাই উঠে দাঁড়াল।
আধ ঘন্টা পর ওরা ক্যান্টিন থেকে ফিরে এসে আবার বসল সেই বারান্দায়। ঠিক এ সময় আহমদ মুসা দেখল জর্জ আব্রাহাম জনসন তার দিকে আসছে।
আহমদ মুসা তাকে স্বাগত জানিয়ে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল।
‘সবাইকে তো দেখেছি। ধন্যবাদ সবাইকে।’ বলে বসল জর্জ আব্রাহাম।
‘তোমরা একটু ভেতরে যাও, আমি মি. জর্জের সাথে কথা সেরে নেই।’ বলল আহমদ মুসা জেনিফারদের লক্ষ করে।
‘অবশ্যই।’ বলে উঠে দাঁড়াল জেনিফার এবং সকলে। বলল জেনিফার, ‘আমরা ওদিক থেকে একটু ঘুরে আসি ভাইয়া।’
বারান্দা ধরে লিফটের দিকে এগুলো সবাই।
‘স্যরি, আপনাদের কথার মাঝখানে এসে পড়েছি আমি।’ বলল জর্জ আব্রাহাম।
‘না, না। ওরা দেখতে এসেছে। বসে বসে খোশ গল্প করছিলাম।’
আহমদ মুসা একটু নড়ে চড়ে বসে বলল, ‘ধন্যবাদ মি. জর্জ। হাসপাতালের ব্যবস্থা এত ভাল যে একমাসের কিউর এক সপ্তাহে হয়ে গেছে।’
‘কিন্তু ডাক্তাররা তো অন্য কথা বলেন মি. আহমদ মুসা। তাদের মতে আপনার শরীরে বিধাতার দেয়া কোন মেডিসিন বক্স আছে, যা থেকে শরীর তার নিজের চিকিৎসা নিজেই করতে পারে।’ বলল জর্জ আব্রাহাম।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘ঘটনা তা নয়, কারও শরীরে কিউর তাড়াতাড়ি হয়, কারও হয় ধীরে ধীরে। এটা সবারই জানা।’
‘থাক ওসব। আপনার ও আমাদের সকলের জন্যে সুখবর আহমদ মুসা। প্রেসিডেন্ট আপনাকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। তিনি আপনাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব অফার করেছেন। সেই সাথে এক খন্ড জমি। আপনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যেখানে চান, সেখানেই আপনাকে জমি খন্ডটি দেয়া হবে।’ বলল জর্জ আব্রাহাম।
বিব্রতকর এক লজ্জায় ছেয়ে গেল আহমদ মুসার চোখ-মুখ। বলল, ‘আল হামদুলিল্লাহ। আমার প্রতি প্রেসিডেন্টের এই শুভেচ্ছাকে গ্রহণ করলাম। তার এই শুভেচ্ছা আমার কাছে অমূল্য। আল্লাহ তার ও আমেরিকার মঙ্গল করুন।’
‘ধন্যবাদ আহমদ মুসা। প্রেসিডেন্টকে আপনার এই সুন্দর আবেগের কথা আমি জানাব।’ বলল জর্জ আব্রাহাম।
‘ধন্যবাদ মি. জর্জ।’ বলে একটু থেমেই আবার মুখ খুলল, ‘জেনারেল শ্যারনদের খবর কি?’
‘তিনি এখন সুস্থ। বেন ইয়ামিনও। তাদের রাখা হয়েছে ফেডারেল কারাগারে। নতুন করে আরও দুটি কেস তাদের বিরুদ্ধে করা হয়েছে। একটা নিউ হারমানের ঘটনার বিষয়ে, আরেকটা সারা জেফারসন ও নাবিলাকে কিডন্যাপ করার দায়ে।’ বলল জর্জ আব্রাহাম।
‘চাপ আসছে না আপনাদের উপর?’
‘এসেছে। তার জবাবও দেয়া হয়েছে। জবাবে একজন জঘন্য ক্রিমিনালের পক্ষে ওকালতি করার জন্যে দুঃখ প্রকাশ করা হয়েছে। আর সিদ্ধান্ত হয়েছে সকল চাপকে উপেক্ষা করার।’
‘ধন্যবাদ। কিন্তু আপনারা কি সত্যই ইহুদীবাদী অক্টোপাশকে আমেরিকা থেকে বিদায় করতে পারবেন?’ আহমদ মুসা বলল।
হাসল জর্জ আব্রাহাম। বলল, ‘বিষয়টা যতটা কঠিন ভাবছেন, তা নয়। ইতিমধ্যেই দেশের সকল অঞ্চল থেকে সাধারণ ও ধার্মিক ইহুদীদের প্রতিক্রিয়া এসেছে প্রেসিডেন্টের কাছে। তারা সকলেই জেনারেল শ্যারন ও ডেভিড উইলিয়াম জোনসের ষড়যন্ত্রের সাথে নিজেদের সম্পৃক্ত থাকার কথা অস্বীকার করেছে। তারা তীব্র সমালোচনা করেছে নিউ হারমানের ঘটনার। তারা জেনারেল শ্যারন ও তার সহযোগীদের কঠোর শাস্তি দাবী করেছে। আর মার্কিন জনগণ এ ব্যাপারে এক পায়ে খাড়া। তাদের কাছে আপনি এখন এক ‘মহান হিরো’ আহমদ মুসা।’
‘ধন্যবাদ মি. জর্জ। আমি ভাবছি, কেসগুলোর মাধ্যমে সব ইহুদীদের তো আপনারা চিহ্নিত করতে পারছেন না।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তা সম্ভবও নয়। তবে ইহুদীবাদীদের মেরুদন্ড ভেঙে দেয়া হচ্ছে, তাদের উঠে দাঁড়াবার শক্তি আর রাখা হচ্ছে না। ইহুদীবাদীদের সকল সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। যে কমিটি এই সুপারিশ করবে, সেই কমিটিতে ডা. বেগিন বারাক, আইজ্যাক বেনগুরিয়ানের মত বেশ কয়েকজন সম্মানিত ইহুদী নাগরিক থাকছেন। তাছাড়া ইসরাইল রাষ্ট্রের দূতাবাস ছাড়া ইসরাইল রাষ্ট্রের অন্যসব প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। যে দূতাবাস থাকছে, সেখানে সমাজ-সংস্কৃতি, শিক্ষা ও সমর বিষয়ক কোন বিভাগ ও কোন প্রতিনিধি থাকছে না। ইসরাইলের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক কোন সম্পর্ক থাকছে না। এ সব সিদ্ধান্ত ইহুদীবাদীদের গোড়া কেটে দেবে। উপরন্তু আমেরিকান জুইস এ্যাসোসিয়েশন ও আমেরিকান জুইস কনফারেন্স সিদ্ধান্ত নিয়েছে, কোন ইহুদীবাদীকে তারা তাদের সমিতির সদস্য করবে না, কোন ইহুদীবাদী তাদের সমিতির সদস্য থাকতে পারবে না।’ থামল জর্জ আব্রাহাম।
‘আল্লাহ আমেরিকার মঙ্গল করুন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ।’ বলে জর্জ আব্রাহাম একটু নড়ে-চড়ে বসে বলল, ‘মি. আহমদ মুসা আজ আপনি ছাড়া পাচ্ছেন, তারপর সোজা কিন্তু আমার বাড়িতে গিয়ে উঠবেন।’
‘কেন?’ ঠোঁটে হাসি টেনে বলল আহমদ মুসা।
‘আমার ছেলে জন মুর ও নাতি জুনিয়র আব্রাহাম আসছে। নাতি এসেই আপনার কাছে নিয়ে আসার জন্য জুলুম শুরু করবে। আমার স্ত্রী আপনাকে নিয়ে যেতে বলেছে।’ জর্জ আব্রাহাম জনসন বলল স্নেহপূর্ণ হাসি হেসে।
আহমদ মুসার মুখ এক মিষ্টি হাসিতে ভরে গেল। বলল, ‘জুনিয়র আব্রাহামরা ক’দিন থাকছে?’
‘দিন সাতেক। জন মুরের কিছু কাজ আছে ওয়াশিংটনে।’ বলল জর্জ আব্রাহাম।
‘তাহলে আজ আমি যাচ্ছি না, জরুরী কিছু কাজ আছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘সবে রিলিজ হচ্ছেন, এখনি কোন ‘জরুরী’ কাজে লেগে পড়া ঠিক নয়। ক’দিন আপনার বিশ্রাম চাই।’ বলল জর্জ আব্রাহাম।
‘সে রকম কোন ঝুঁকির কাজ নয়। আমি হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে যাব সেই মেয়েটির বাসায় যার গাড়ি আমি বলতে গেলে কেড়ে নিয়ে এসেছিলাম। গাড়ির ক্ষতিপূরণ আমি নিজে গিয়ে দিয়ে আসতে চাই।’ আহমদ মুসা বলল।
‘হ্যাঁ, এটা একটা বড় কাজ অবশ্যই। আপনি কি ক্ষতি পূরণের টাকাটা পেয়েছেন এফবিআই থেকে?’
‘হ্যাঁ পেয়েছি। ধন্যবাদ আপনাকে।’
‘আমি বিস্মিত হয়েছি। আমেরিকান মেয়েরা সাধারণত এভাবে গাড়ি দেয় না। তাকে আমাদের তরফ থেকেও ধন্যবাদ দেবেন।’ জর্জ আব্রাহাম বলল।
‘ক্ষণিকের দেখা, তবু যতটুকু দেখেছি তাতে মেয়েটিকে আমার ইউরোপীয় বা আফ্রিকান শ্রেণীর আমেরিকান বলে মনে হয়নি।’
‘ইউরোপীয়ান, আফ্রিকান শ্রেণীর ছাড়াও বহু জাতির আমেরিকান আছে এদেশে ইয়ংম্যান।’
‘তা আছে।’
‘হাসপাতাল থেকে গিয়ে উঠছেন তো সারা জেফারসনদের ওখানেই? না লায়লা জেনিফাররা ধরে নিয়ে যাবে?’ জর্জ আব্রাহাম বলল।
‘এসেছে ওরা এ উদ্দেশ্যেই। কিন্তু আমি মেয়েটির সাথে দেখা করে সারা জেফারসনদের ওখানেই যাচ্ছি। ও সুস্থ হওয়ার পর ওর সাথে দেখা হয়নি। আমার ব্যাগ-ব্যাগেজও আছে ওখানে।’ বলল আহমদ মুসা একটু হেসে।
জর্জ আব্রাহাম আহমদ মুসার দিকে পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। একবার ভাবল সারা জেফারসন ও আহমদ মুসার ব্যাপারে যে দায়িত্ব প্রেসিডেন্ট তাকে দিয়েছেন সে কথা আহমদ মুসার কাছে এখনই পাড়বে কিনা। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবল, না তাকে বাসায় নিয়ে গিয়ে ভাল পরিবেশে বলতে হবে। প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে জর্জ আব্রাহাম বলল, ‘আমেরিকান সরকার যে একখন্ড জমি আপনাকে দিতে চান, সেটা কোথায় নেবেন জানতে চাই মি. আহমদ মুসা।’
লজ্জা মিশ্রিত বিব্রতকর এক হাসি ফুটে উঠল আহমদ মুসার মুখে। বলল, ‘ঠিক আছে। আমেরিকার তো আমি সবকিছু চিনি না। সারা জেফারসনের সাথে একটু আলোচনা করে নেই।’
মিষ্টি হাসি ফুটে উঠল জর্জ আব্রাহামের ঠোঁটে। বলল, ‘ওকে ইয়ংম্যান।’
কথা শেষ করেই জর্জ আব্রাহাম মোবাইলটা হাতে তুলে নিয়ে বলল, ‘উঠি মি. আহমদ মুসা।’
‘দু’মিনিট, একটা কথা আছে।’ সচকিত হয়ে উঠে বলল আহমদ মুসা।
তারপর সে আহমদ হাত্তা নাসুমনের সমস্যার কথা সংক্ষেপে জর্জ আব্রাহামকে জানাল এবং বলল, ‘ওঁকেও আমার সাথে রিলিজের ব্যবস্থা করুন। আমি তাঁকে সাথে নিয়ে বেরুব।’ আহমদ মুসা থামল।
ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে উঠেছে জর্জ আব্রাহাম জনসনের। দ্রুত তার মুখে নামল ভাবনার একটা ছায়া। বলল, ‘তার মানে মি. আহমদ মুসা আপনি মি. হাত্তার কেসটা টেক আপ করছেন?’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘এখন প্রথম কাজ হলো তাঁর মেয়েকে খুঁজে দেয়া।’
‘তারপর?’
‘তারপর কি ঘটে দেখতে হবে।’
গম্ভীর হলো জর্জ আব্রাহাম জনসনের মুখ। সে দু’হাতে আহমদ মুসার একটা হাত চেপে ধরে বলল, ‘মি. আহমদ মুসা, বয়সে ছোট হয়েও আপনি অনেক বড়, কিন্তু আমার ছেলের মত। আমার স্ত্রী আপনাকে তার দ্বিতীয় ছেলে দাবী করে। আমি বলছি, দীর্ঘ ধকল গেছে আপনার উপর দিয়ে। দীর্ঘ একটা বিশ্রাম বা ছুটি আপনার প্রয়োজন। আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ চিন্তা আমরা করছি। এ জন্য আমাদেরকে সময় দিতে হবে আপনার।’
আহমদ মুসা তাকাল জর্জ আব্রাহামের দিকে। আবেগে ভারী হয়ে উঠেছে আহমদ মুসার চোখ-মুখ। বলল, ‘জানি আপনারা খুব ভালোবাসেন আমাকে, খালাম্মা আমাকে খুবই আদর করেন। এটা আমার সৌভাগ্য। কিন্তু আপনি তো বুঝবেন, কিছু কাজ, কিছু দায়িত্ব এমন আছে যা এড়ানো যায় না, উচিতও নয়।’
বলে মুহূর্তকালের জন্যে থামল আহমদ মুসা। তারপর বলল, ‘আমি যাই করি, খালাম্মার অনুমতি না নিয়ে করব না।’
স্নেহের আবেগে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে জর্জ আব্রাহাম জনসনের চোখ-মুখ।
‘ধন্যবাদ, বেটা।’ বলে উঠে দাঁড়াল জর্জ আব্রাহাম। উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, ‘জানেন, আপনার খালাম্মা আপনার ধর্মের উপর অনেক বই যোগাড় করেছে। বলে কি জানেন, যে ধর্ম আমার ছেলেকে এতবড় বানিয়েছে, সেটা আমারও ধর্ম। আর এ বিষয়ে তার সবচেয়ে উৎসাহী ছাত্র হলো আমাদের নাতি।’
আহমদ মুসাও উঠে দাঁড়িয়েছে। মিষ্টি হাসি তার মুখে। বলল, ‘আল হামদুলিল্লাহ। খালাম্মাকে বলবেন, আমি দারুণ খুশি হয়েছি। আমি গিয়ে তাঁকে মোবারকবাদ জানাব।’
‘অবশ্যই আহমদ মুসা। আসি। ভালো থাকুন। গুড মর্নিং, আসসালাম।’
ঘুরে দাঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
আহমদ মুসাও হাঁটতে লাগল তার সাথে কিছুটা এগিয়ে দেবার জন্যে।

Top