শশাংককে দেখেই সাগরিকা সেন বলে উঠল, ‘শশাংক আহমদ মুসাকে এফবিআই পুলিশরা গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেল।’ ভারী কণ্ঠস্বর সাগরিকা সেনের।
শশাংক সাগরিকা সেনের পাশে বসতে বসতে বলল, ‘আমি কিছু বুঝতে পারছি না দিদি। ওদিকে জেনারেল শ্যারন নাবিলাকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে গেল।’ শুষ্ক কণ্ঠে বলল শশাংক সেন।
‘জেনারেল শ্যারন নাবিলাকে ধরে নিয়ে গেল? অবিশ্বাস্য কথা বলছ তুমি শশাংক।’ বিস্মিত কণ্ঠে বলল সাগরিকা সেন।
‘অবিশ্বাস্য, কিন্তু সত্য দিদি। একটা ভিডিও ক্যাসেটের সন্ধানে এসেছিল জেনারেল শ্যারন নাবিলার কাছে। তার আসার কথা জানতে পেরেই নাবিলা তাড়াতাড়ি ক্যাসেটটি আমার হাতে পাঠিয়ে দিয়েছে তোমাকে অথবা আহমদ মুসাকে দেবার জন্যে। ক্যাসেটটি উদ্ধারের জন্যে নাবিলাকে জেনারেল শ্যারন ধরে নিয়ে গেছে।’
‘ক্যাসেটে কি আছে শশাংক?’ বিস্মিত কণ্ঠে দ্রুত জিজ্ঞেস করল সাগরিকা সেন।
‘জানি না। জেনে নেবার সময়ও দেয়নি আমাকে নাবিলা। তবে নাবিলা বলেছে, তার ও আমার জীবনের চেয়েও ক্যাসেটটি মুল্যবান। জেনারেল শ্যারন যে কোন মুল্যে ক্যাসেটটি উদ্ধার করতে চাইবে।’ শশাংক বলল।
ভ্রুকুঞ্চিত হলো সাগরিকা সেন ও ডা. বেগিন বারাকের। উদগ্রীব কণ্ঠে ডা. বারাক বলল, ‘ক্যাসেট কাকে দিতে বলেছে, সাগরিকা বা আহমদ মুসাকে?’
‘হ্যাঁ।’ বলল শশাংক।
‘তাহলে ওতে সাংঘাতিক কিছু আছে সাগরিকা।’ ডা. বারাক বলল।
‘আমারও তাই মনে হয়। চলুন ক্যাসেটে কি আছে দেখা যাক।’ বলল সাগরিকা সেন।
তারা উঠে এল কম্পিউটার টেবিলে।
শশাংক কম্পিউটার চালু করে দিয়ে ক্যাসেটটা কম্পিউটারে সেট করে তারপর সাগরিকা সেনের পাশে এসে বসল।
নিউ হারমানের সেই দৃশ্যাবলী কম্পিউটার স্ক্রীনে একের পর এক ফুটে উঠতে লাগল।
ঘরে পিনপতন নিরবতা।
ওরা গোগ্রাসে গিলছে দৃশ্যগুলো।
এক সময় নিরবতা ভেঙে খান খান হয়ে গেল ডা. বারাকের চিৎকারে। সে চিৎকার করে বলে উঠল, ‘গুলী করছে ঐ লোকটি বেন ইয়ামিন। জগৎবিখ্যাত ইহুদী গোয়েন্দা। জেনারেল শ্যারনের দক্ষেণ হস্ত।’ উত্তেজিত কণ্ঠস্বর ডা. বারাকের।
ডা. বারাকের উত্তেজিত কণ্ঠ আবার ধ্বনিত হলো, ‘ঘটনা কোথাকার? নিউ হারমানের?’
চমকে উঠল সাগরিকা ও শশাংক সেন দু’জনেই। তারা এক সাথেই মাথা ঘুরিয়ে তাকাল ডা. বারাকের দিকে। বলল তারা দু’জনেই বিস্ময়মিশ্রিত দ্রুত কণ্ঠে, ‘নিউ হারমানের? তাহলে যে বললেন গুলী করছে ইহুদী গোয়েন্দা, জেনারেল শ্যারনের লোক!’
‘আমি ঠিক ঠিক বলতে পারছি না দৃশ্যগুলো নিউ হারমানের কিনা। কিন্তুও খবরের কাগজে নিউ হারমানের হত্যাকান্ডের যে বিবরণ বেরিয়েছে, তার সাথে দৃশ্যগুলো মিলে যায়।’ ডাক্তার বারাকের কন্ঠ শুষ্ক ও উত্তেজিত। চোখে-মুখে তার বিস্ময় বিমূঢ় ভাব।
কোন কথা বলতে পারল না সাগরিকা ও শশাংক। প্রশ্ন ঠিকরে বেরুচ্ছে তাদের চোখ-মুখ থেকেও।
ডাক্তার বারাকই আবার বলে উঠল, ‘ঘটনা কোথাকার নাবিলা জানত এবং সে জন্যেই ক্যাসেটটি আহমদ মুসার কাছে পাঠিয়েছে। এ থেকে প্রমাণ হয় ক্যাসেটটি আহমদ মুসার খুবই প্রয়োজন। অন্যদিকে জেনারেল শ্যারনও ক্যাসেটটি যে কোন মূল্যে পেতে চায় এবং ক্যাসেট উদ্ধারের জন্য নাবিলাকে পর্যন্ত ধরে নিয়ে গেছে। আর এই ঘটনা ঘটেছে নিউ হারমানের ঘটনার একদিন পরে। সুতরাং নিউ হারমানের ঘটনার সাথে এই ক্যাসেটের সম্পর্ক আছে আমরা ধরে নিতে পারি।’
‘এর অর্থ কি দাঁড়ায় ডাক্তার আংকেল? প্রশ্ন করল শশাংক। তার কণ্ঠে উত্তেজনা।
বিস্ময় বিমূঢ় ভাব আরও গভীর হয়ে উঠল ডাক্তার বারাকের চোখে-মুখে। বলল, ‘অর্থ পরিষ্কার জেনারেল শ্যারনরা খুন করেছে আমাদের একটি ইহুদী বসতির কিছু নিরপরাধ মানুষকে।’
‘কেন করেছে? উদ্দেশ্য কি?’ বলল শশাংক।
ডা. বারাকের মনে পড়ল জর্জ আব্রাহামকে বলা আহমদ মুসার কথা। আহমদ মুসার কথার পুনরাবৃত্তি করে ডাক্তার বারাক বলল, ‘নিজেদের নাক কেটে আহমদ মুসার যাত্রা ভংগ করতে চেয়েছে। আহমদ মুসার ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করতে সমর্থ হয়েছে।’
‘তাহলে তো এই ক্যাসেট অবিলম্বে ওয়াশিংটনে আহমদ মুসা বা জর্জ আব্রাহাম জনসনের হাতে পৌছাতে হয়।’ বলল দ্রুত কণ্ঠে সাগরিকা সেন।
‘অবশ্যই সাগরিকা। আমরা এখনই রওয়ানা হতে পারি।’ ডাক্তার বারাক বলল সোজা হয়ে বসে।
‘আমিও যাব।’ বলল শশাংক।
‘হ্যা, তোমাকে যেতেই হবে, তুমিই ক্যাসেট এনেছ নাবিলার কাছ থেকে।’ সাগরিকা সেন বলল।
উঠে দাড়াল ডাক্তার বারাক। বলল, ‘আমি গাড়িটা ঠিকঠাক করে নিচ্ছি। তোমরা এস।’
দশ মিনিটের মধ্যেই ডাক্তার বারাকের গেট দিয়ে একটা গাড়ি বেরিয়ে এল। গাড়ির ড্রাইভিং সিটে শশাংক। তার পাশের সিটে ডা. বারাক। পেছনের সিটে বসেছে সাগরিকা সেন।
ওয়াশিংটন-আনাপোলিশ ফ্রি ওয়ে ধরে ঝড়ের গতিতে চলেছে গাড়িটি।
ডিষ্ট্রিক্ট অব কলামবিয়া অর্থাৎ ওয়াশিংটনে প্রবেশের আগে মেরিল্যান্ডের শেষ শহর হলো শিভারলী।
শিভারলীতে ঢুকতে যাচ্ছে ডা. বারাকের গাড়ি। ফ্রিওয়ের লেনের বাইরে ফুটপাতের উপর একটা গাড়ি দাড়িয়েছিল। গাড়ির গায়ে ঠেস দিয়ে দাড়িয়েছিল একজন লোক।
ডা. বারাকের গাড়ি কাছাকাছি আসতেই লোকটি হাত তুলল।
শশাংক ডা. বারাকের দিকে একবার তাকিয়ে গাড়ি দাড় করাল ফুটপাতে দাঁড়ানো গাড়ির পাশে।
শশাংকরা দেখল গাড়ির ভেতরে আরও তিনজন লোক। তাদের একজনের হাতে দূরবীন।
শশাংক গাড়ি দাড় করাতেই গাড়ি থেকে আরও একজন লোক বেরিয়ে এল। চোখের পলকে তারা দু’জন ডা. বারাকের গাড়ির দু’পাশে এসে দাঁড়াল। শশাংকরা কিছু বুঝে উঠার আগেই দু’জন দু’পাশ থেকে সাগরিকার দু’পাশে উঠে এসে বসল।
বসেই দু’জন রিভলবার বের করে একজন তাক করল ড্রাইভিং সিটে বসা শশাংককে। বলল তাকে লক্ষ করে, ‘চালাও গাড়ি।’
কি ঘটতে যাচ্ছে শশাংক বুঝতে পেরেছিল। লোকটির কথা শেষ হবার আগেই শশাংক দেহটাকে গুটিয়ে সিটের আড়ালে নিয়ে গাড়ির দরজা খুলে বাইরে গড়িয়ে পড়ল।
পেছনে যে লোকটি শশাংকের দিকে রিভলবার তাক করেছিল সে বুঝতে পারল ড্রাইভিং সিটের লোকটি পালাল। সেও দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে পড়ল এবং এগুলো শশাংকের দিকে।
শশাংক পড়ে গিয়ে পা গুটিয়ে ছিল। ভাবটা এই রকম যেন সে ভীষণ ভয় পেয়েছে।
লোকটি কাছাকাছি আসতেই শশাংক গুটানো পা স্প্রিঙের মত পেছনে ঠেলে আঘাত করল লোকটির পায়ের গোড়ালির উপরের জায়গাটায়।
লোকটি অপ্রস্তুত ছিল। এই আঘাত খেয়ে লোকটি পড়ে গেল।
সংগে সংগে শশাংক লোকটির হাতের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে রিভলবার কেড়ে নিল।
রিভলবার হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়েই শশাংক দেখল পাশের গাড়ি থেকে দু’জন রিভলবার হাতে নিয়ে বেরিয়ে আসছে।
ঠিক এই সময়েই পুলিশের একটা গাড়ি শশাংকের গাড়ির ঠিক পেছনে এসে দাঁড়াল এবং সংগে সংগেই দু’জন পুলিশ রিভলবার বাগিয়ে বেরিয়ে এল।
পুলিশের গাড়ি দেখে পাশের গাড়ির যে দু’জন রিভলবার হাতে বেরিয়ে আসছিল তারা আবার গাড়িতে উঠে গাড়ি ষ্টার্ট দিয়ে ছুটতে লাগল।
পুলিশের গাড়ি দেখে পাশের গাড়ির যে দু’জন রিভলবার হাতে বেরিয়ে আসছিল তারা আবার গাড়িতে উঠে গাড়ি ষ্টার্ট দিয়ে ছুটতে লাগল।
আর শশাংকের সামনে মাটিতে পড়ে যাওয়া লোকটি উঠে দাঁড়িয়ে দৌড়ে পালাতে লাগল। রিভলবার হাতে যে লোকটি গাড়িতে সাগরিকা ও ডাক্তার বারাককে পাহারা দিচ্ছিল, সেও গাড়ি থেকে বেরিয়ে দৌড় দিল।
পুলিশ দু’জন ফাকা ফায়ার করে উচ্চ স্বরে আদেশ দিল, এরপরও পালাতে চেষ্টা করলে গুলী করব।
লোক দু’টি দাঁড়িয়ে গেল।
পুলিশ দু’জন এগিয়ে গিয়ে লোক দু’টির হাতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে তাদের গাড়িতে নিয়ে এল।
ততক্ষণে ডা. বারাক ও সাগরিকা গাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিল। ডা. বারাক পুলিশকে তাদের পরিচয় দিল এবং বলল, ‘ওরা হাত তুলে আমাদের গাড়ি থামিয়ে আকস্মিকভাবে আমাদের গাড়িতে উঠে রিভলবার বাগিয়ে তাদের নির্দেশ মত গাড়ি চালাবার হুকুম দিয়েছিল। শশাংকের বুদ্ধিতে ওরা বাধা পায়। আপনারা এসে আমাদের বাঁচিয়েছেন। অনেক ধন্যবাদ আপনাদের।’
‘স্যার কারণ কি বলুন তো? আপনাদের এরা চেনে? না, এটা কোন ছিনতাই-এর ঘটনামাত্র?’ একজন পুলিশ বলল।
ডা. বারাক সংগে সংগে জবাব দিল না। একটু চিন্তা করে বলল, ‘নিছক কোন ছিনতাই-এর ঘটনা নয় বলেই আমার বিশ্বাস। কোন বড় কারো দ্বারা নিয়োজিত লোক এরা হতে পারে। ওদের একজনের হাতে দূরবীন ছিল। ওরা আগে থেকে দেখে-শুনেই আমাদের গাড়ি থামিয়েছে। আমরা এফবিআই চীফ আব্রাহাম জনসনের কাছে যাচ্ছি। আমাদের বাধা দেয়াই ওদের লক্ষ হতে পারে বলে আমার মনে হচ্ছে।’
এফবিআই চীফের কাছে যাওয়ার কথা শুনে পুলিশ অফিসারটি নড়ে-চড়ে দাঁড়াল। একটু সমীহের সুরে বলল, ‘স্যার, তাহলে এদেরকে একটি ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে অপহরণ ও হত্যা প্রচেষ্টা’র অভিযোগে গ্রেপ্তার দেখাতে পারি। অভিযোগকারী হিসাবে আপনাদের নাম থাকবে।’
‘ঠিক আছে।’
‘ধন্যবাদ। চলুন স্যার, আপনাদের পৌছে দিয়ে আমরা অফিসে ফিরব।’ বলল পুলিশ অফিসারটি।
‘কিন্তু এর কি দরকার হবে?’
‘স্যার, যা ঘটেছে তার পরিপ্রেক্ষেতে এটাকে আমরা আমাদের দায়িত্ব মনে করছি। ওদের দু’জন পালাতে পেরেছে বলেই এই প্রয়োজনটা আমরা বেশি অনুভব করছি।’
‘ধন্যবাদ অফিসার, চলুন।’
সবাই গাড়িতে উঠল। চলতে শুরু করল গাড়ি।
আগে ডা. বারাকের গাড়ি, পেছনে চলছে পুলিশের গাড়ি।
‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ আংকেল। আপনি ঠিকই বলেছেন ক্যাসেটের ঘটনার সাথে এর সম্পর্ক আছে।’ ডা. বারাকের দিকে চেয়ে বলল সাগরিকা সেন।
‘কিভাবে সেটা সম্ভব দিদি? আমরা সন্দেহের মধ্যে পড়ব কেন? বলল শশাংক।
‘নাবিলার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে জেনারেল শ্যারন তোমাকে দেখেছে না?’ সাগরিকা বলল।
‘দেখেছে।’ বলল শশাংক।
‘জেনারেল শ্যারন তোমাকে চেনে না?’
‘চেনে’
‘সুতরাং অবস্থার প্রেক্ষিতে নাবিলার পর দ্বিতীয় সন্দেহ তোমাকে করবে। তাছাড়া, কোন চাপে পড়ে নাবিলা তোমার নাম বলে দিতে বাধ্য হতে পারে।’
মুখ শুকনো হয়ে গেল শশাংকের। উদ্বেগ ফুটে উঠল তার চোখে-মুখে। বলল, ‘তা হতে পারে দিদি?’
‘ইচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক আমরা একটা বড় যুদ্ধে জড়িয়ে গেছি শশাংক।’ বলল ডা. বারাক।
‘ওরা কি নাবিলার সাথে খারাপ ব্যবহার করবে?’ শশাংকের কণ্ঠে উদ্বেগ।
‘ভেব না শশাংক, ঈশ্বর আছেন।’ সান্তনার সুরে বলল সাগরিকা সেন।
‘ওরা কিন্তু আমাদের আব্বাকে এবং আমাদের ইন্ডিয়ান-আমেরিকান কম্যুনিটিকে ব্যবহার করছে দিদি। এটা আমরা হতে দিতে পারি না।’ ক্ষুব্ধ কণ্ঠ শশাংকের।
‘জেনারেল শ্যারন ও ইহুদীবাদীরা মার্কিন ইহুদীদেরও ব্যবহার করছে শশাংক।’ বলল ডা. বারাক।
‘তবু তারা একই কম্যুনিটি ভুক্ত। কিন্তু ইন্ডিয়ান-আমেরিকান কম্যুনিটি তাদের স্বার্থের বলি হবে কেন?’ শশাংক বলল।
‘কারণ ইহুদীবাদীদের আধিপত্যবাদী অভিলাষের সাথে ইন্ডিয়ান-আমেরিকান কম্যুনিটির অনেকের আকাঙ্খার মিল আছে।’ বলল ডা. বারাক।
‘আমাদের আব্বাও কি এই আকাঙ্খা পোষণ করেন?’ শশাংক বলল।
‘এই প্রশ্নের উত্তর তুমি দাও সাগরিকা?’ ডা. বারাক সাগরিকাকে উদ্দেশ্য করে বলল।
‘নিজের স্বার্থ দেখা মানুষের একটা প্রকৃতি। এই প্রকৃতি ইন্ডিয়ান-আমেরিকান কম্যুনিটির আছে। আব্বারও আছে। স্বার্থের একটা ঐক্য ইহুদীবাদীদের সাথে ইন্ডিয়ান-আমেরিকান কম্যুনিটির রয়েছে। কিন্তু আব্বা ইহুদীবাদীদের কোন ষড়যন্ত্রে যুক্ত আছেন বলে আমি বিশ্বাস করি না। ওদের বিপদে আব্বা সাহায্য করেছেন মাত্র।’ বলল সাগরিকা সেন।
‘আমারও তাই বিশ্বাস সাগরিকা।’ ডা. বারাক বলল।
ডা. বারাক থামল।
কোন কথা কেউ বলল না।
সবার দৃষ্টি সামনে। এফবিআই হেড কোয়ার্টার প্রায় এসে গেছে। চলছে দু’টি গাড়ি পরপর একই গতিতে।
জর্জ আব্রাহাম জনসনের অফিস কক্ষ।
জর্জ আব্রাহাম তার চেয়ারে বসে।
তার টেবিলের সামনে বসে আছে পুলিশ প্রধান বিল বেকার, আহমদ মুসা, সাগরিকা সেন, শশাংক ও ডা. বেগিন বারাক।
টেবিলের এক পাশে কম্পিউটার স্ক্রীনে ডা. বারাকদের নিয়ে আসা ভিডিও ক্যাসেটের শেষ দৃশ্য এই মাত্র কম্পিউটার স্ক্রীন থেকে মিলিয়ে গেল।
ঘরে পিনপতন নিরবতা।
জর্জ আব্রাহাম জনসন ও পুলিশ প্রধান বিল বেকারের চোখে-মুখে আনন্দের উজ্জ্বল্য ঝিকমিক করে উঠেছে। আহমদ মুসার চেহারা ভাবলেশহীন।
ডা. বারাক, সাগরিকা ও শশাংক তাকিয়ে আছে এখন তাদের মুখের দিকে।
‘ধন্যবাদ ডা. বারাক, সাগরিকা ও শশাংক। অনেক ধন্যবাদ আপনাদের সর্বকালের জঘন্য এক ষড়যন্ত্রের মুখোশ উন্মোচনে আপনারা সাহায্য করেছেন।’ নিরবতা ভেঙে প্রথম কথা বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
‘ধন্যবাদ নাবিলার প্রাপ্য। সে নিজেকে বিপদের মধ্যে ঠেলে দিয়ে এই কাজ করেছে।’ বলল ডা. বারাক।
‘ঠিক বলেছেন ডাক্তার বারাক। সে মিত্র পক্ষের বিরুদ্ধে যাবার ঝুঁকি নিয়ে নিজের কম্যুনিটি ও নিজ দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছে। এই ভিডিও ক্যাসেট না পেলে জঘন্য ষড়যন্ত্রের মুখোশ উন্মোচনের আর কোন পথ ছিল না। নিরপরাধ হয়েও আহমদ মুসা শুধু নয়, মুসলমানদের ঘাড়ে সর্বকালের জঘন্য এক অপরাধের দায় চেপে বসত।’
‘বেন ইয়ামিনকে দেখে ঘটনার সাথে জেনারেল শ্যারন ও ইহুদীবাদীদের জড়িত থাকার কথা বুঝা গেল, কিন্তু দৃশ্যের ঘটনা যে নিউ হারমানের তা কি করে প্রমাণ হবে?’ বলল ডা. বারাক।
‘প্রথমতঃ নাবিলার স্বাক্ষ্য। দ্বিতীয়ত, দৃশ্যে যাদের পালাতে ও নিহত হতে দেখা যাচ্ছে, নিউ হারমানের নিহতদের মধ্য থেকে তাদের চিহ্নিত করা। তৃতীয়ত, যে ঘরগুলোর দৃশ্য ছবিতে দেখা যাচ্ছে, নিউ হারমানের সে ঘরগুলো খুঁজে বের করা। এই প্রমাণই যথেষ্ট হবে।’
বলে জর্জ আব্রাহাম জনসন একটু থামল এবং বিল বেকারের দিকে তাকাল। বলল, ‘আপনি শিঘ্রই এই ক্যাসেটের একটা কপি পুলিশ হেড কোয়ার্টারে পাঠান এবং একজন দায়িত্বশীল অফিসারকে নির্দেশ দিন প্রমাণগুলো রেকর্ডে আনার জন্যে। ফিল্মে ঘরগুলো ও মানুষের ছবি যে এ্যাংগলে, সে এ্যাংগলেই যেন ছবিগুলো নেয়া হয়। ফিল্মের ছবির লোকদের নাম, ঠিকানাও রেকর্ডে আনতে হবে। ঘরে যে রক্তের আলামত পাওয়া যাবে, তা যে এই ফটোর লোকদেরই তাও নিশ্চিত করতে হবে।’
‘ধন্যবাদ মি. জর্জ। এখনই ব্যবস্থা করছি।’
বলেই সে মোবাইল তুলে নিয়ে হেড কোয়ার্টারে টেলিফোন করল। প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিল এবং এখনি আসতে বলল এফবিআই হেড কোয়ার্টারে।
টেলিফোনে কথা শেষ করে বিল বেকার বলল, ‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। আমরা চোখে অন্ধকার দেখছিলাম। তিনি আলো জ্বেলে দিলেন অন্ধকারে।’
বলে বিল বেকার তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘আপনি ভাগ্যবান আহমদ মুসা। ঈশ্বর আপনার পক্ষে কাজ করেছেন।’
‘আল-হামদুলিল্লাহ। আল্লাহ সত্যপন্থীদের সব সময়ই সাহায্য করেন। আল্লাহ এবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেও বিশেষভাবে সাহায্য করেছেন।’ দীর্ঘ নিবরতা ভেঙে বলল আহমদ মুসা।
‘বিশেষ সাহায্যটা কি?’ প্রশ্ন করল পুলিশ প্রধান বিল বেকার।
‘লস আলামোসের গোয়েন্দা সুড়ঙ্গ উদঘাটন ও সংশিস্নষ্ট ঘটনার মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপর যে অদৃশ্য ষড়যন্ত্র চেপে বসেছিল তার মুখোশ উন্মোচিত হয়েছে এবং অবশেষে নিউ হারমানের ঘটনার মধ্যে দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ধার্মিক শান্তি প্রিয় ইহুদী এবং ষড়যন্ত্রকারী ইহুদীবাদীদের আল্লাহ আলাদা করে দিলেন। এর মাধ্যমে আল্লাহ মার্কিন জাতীয় সংহতিকে আরও নিরুপদ্রব করে দিলেন।’ আহমদ মুসা বলল।
‘সুন্দর ব্যখ্যা দিয়েছেন আহমদ মুসা। আমি প্রেসিডেন্টকে এটা জানাব।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
‘ধন্যবাদ। মি. জর্জ আব্রাহাম, আমি উদ্বিগ্ন সারা জেফারসন ও নোয়ান নাবিলাকে নিয়ে। জেনারেল শ্যারন কতটা জঘন্য, খুনি হয়ে উঠেছে নিউ হারমানের ঘটনা তার প্রমাণ। সারা জেফারসন ও নোয়ান নাবিলাকে যা ইচ্ছে তাই করতে তার একটুও বিবেকে বাধবে না।’ আহমদ মুসা বলল। তার কণ্ঠস্বর ভারী।
গম্ভীর হয়ে উঠল জর্জ আব্রাহাম ও পুলিশ প্রধান দু’জনেরই মুখ।
জর্জ আব্রাহাম বলল, ‘আমি এখনি প্রেসিডেন্টের কাছে যাচ্ছি। তাঁকে সব জানাব। তার নির্দেশ বলে আজই এই ক্যাসেটের সচিত্র বিবরণ সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেলে যাবে। আমি আশা করছি, আজই আপনি মুক্ত মানুষ হিসেবে আপনার বাসায় ফিরে যাবেন। সারা জেফারসন ও নোয়ান নাবিলাকে উদ্ধার করার জন্যে আপনার সাহায্য আমরা চাই।’
‘ধন্যবাদ মি. জর্জ।’ বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা থামতেই শশাংক বলে উঠল দ্রুত কণ্ঠে, ‘নাবিলা জেনারেল শ্যারনদের হাতে পড়ার পূর্বক্ষণে আমাকে টেলিফোন করে ওয়াশিংটনের দু’টি ঠিকানা দিয়েছে। বলেছে, এখানেই নাবিলাকে এবং সারা জেফারসনকেও পাওয়া যাবে।’
শশাংক থামার প্রায় আগেই আহমদ মুসা বলে উঠল, ‘ঠিকানা তোমার কাছে এখন আছে?’
‘আছে।’ বলল শশাংক।
শশাংক পকেটে হাত দিয়ে এক টুকরো কাগজ বের করল এবং আহমদ মুসার দিকে তুলে ধরল।
আগ্রহের সাথে আহমদ মুসা কাগজটি হাতে নিয়ে ঠিকানা দু’টির উপর ভালোভাবে চোখ বুলিয়ে নিল। স্মৃতিতে তার গেঁথে নিল ঠিকানা দু’টো। তারপর আহমদ মুসা কাগজটি এগিয়ে ধরল জর্জ আব্রাহামের দিকে।
জর্জ আব্রাহাম ঠিকানা দু’টির উপর চোখ বুলিয়ে নিয়ে তা এগিয়ে দিল বেকারের দিকে। বলল, ‘টুকে নিন ঠিকানা দু’টো বিল বেকার।’
তারপর দ্রুত আব্রাহাম জনসন নক করল ইন্টারকমের একটা কি’তে।
সংগে সংগেই কথা বলে উঠল এফবিআই-এর অপারেশন কমান্ডার। জর্জ আব্রাহাম তাকে ঠিকানা দু’টো দিয়ে নির্দেশ দিল, কারো সন্দেহের সৃষ্টি না হয় এভাবে ঠিকানা দু’টোর উপর সার্বক্ষণিক নজর রাখ। কেউ সেখানে ঢুকুক ক্ষতি নেই, কিন্তু কেউ বেরুলে তাকে দূরে সরিয়ে এনে সবার অলক্ষে গ্রেপ্তার করতে হবে। এর অর্থ কেউ যেন ঠিকানা দু’টো থেকে বেরিয়ে পালিয়ে যেতে না পারে।’
কথা শেষ করে জর্জ আব্রাহাম তাকাল বিল বেকারের দিকে। বলল, ‘বলুন মি. বেকার। আর কি করণীয়।’
‘ঠিকানা দু’টোতে আজই অভিযান হওয়া দরকার এবং এই অভিযান আহমদ মুসার হাতে দিলে কেমন হয়।’ বলল বিল বেকার।
‘ধন্যবাদ মি. বেকার। আমিও একথাই ভাবছিলাম। আহমদ মুসা আমাদের সাথে থাকবেন শুধু নয়, সব দায়িত্ব তাকেই পালন করতে হবে।
কথাগুলো বলে একটু থেমে আহমদ মুসার দিকে চেয়ে বলল, ‘এবার আপনি বলুন আহমদ মুসা।’
‘আমি সাথে থাকব অবশ্যই।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আপনি এর বেশী কিছু বলবেন না তা জানি।’
বলে জর্জ আব্রাহাম জনসন তাকাল শশাংকের দিকে। বলল, ‘শশাংক তোমাকে সহস্র ধন্যবাদ দিলেও ধন্যবাদ শেষ হবে না। দেশ তোমার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে।’
‘স্যার আমি বাহক মাত্র। যা করার সব করেছে নাবিলা।’ বলল শশাংক।
‘নাবিলা এ দেশের ইহুদীদের আদর্শ হতে পারে। তার কম্যুনিটির স্বার্থে, দেশের স্বার্থে আমাকে ধরিয়ে দেয়াকে যখন সে ঠিক মনে করেছে, তখন আমার সাথে তার পরিচয়, সাগরিকার সাথে তার বন্ধুত্ব, শশাংকের সাথে তার সম্পর্ক সব ভুলে গিয়ে সে ইহুদী কমান্ডোদের সাথে নিয়ে আমাকে ধরতে ছুটে এসেছিল। আর আজ দেশ ও তার কম্যুনিটির স্বার্থেই সে একান্ত মিত্র জেনারেল শ্যারনদের মৃত্যুবান শুধু আমাদের হাতে তুলে দেয়া নয়, নিজেকেও বিপদের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। ধন্যবাদ নাবিলাকে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমাদের ডা. বারাক আংকলের প্রকৃত শিষ্য সে।’ বলল সাগরিকা সেন।
‘আমরা তার জন্যে গর্বিত।’ ডা. বারাক বলল।
‘মানুষে মানুষে কত পার্থক্য। একই কম্যুনিটির, কিন্তু নাবিলাকে যদি বলা হয় ফেরেশতা, তাহলে জেনারেল শ্যারনকে বলতে হয় শয়তান।’
‘জার্মানীতে যে ইহুদী হত্যাকান্ড ঘটেছে, তা শুধু নাজীদের কাজ নয়, তার মধ্যে এই শয়তানদের হাত ছিল।’ বলল আহমদ মুসা।
‘নিউ হারমানে হত্যাকান্ডের উদ্দেশ্য ছিল আপনাকে ফাঁদে ফেলা, জার্মানীর হত্যাকান্ডে যদি তাদের হাত থাকে, তাহলে তার উদ্দেশ্য কি ছিল?’ সাগরিকা সেন বলল।
‘ইহুদীদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করে ফিলিস্তিনে মাইগ্রেট করতে বাধ্য করা। দ্বিতীয় আর একটি কারণ ছিল, বিশ্বের মানুষের মধ্যে ইহুদীদের প্রতি দরদ সৃষ্টি করা এবং ফিলিস্তিনে ইহুদী রাষ্ট্রের পক্ষে বিশ্ব জনমত সৃষ্টি করা। দুই উদ্দেশ্যই তাদের সফল হয়েছে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘জার্মানীর ব্যাপারটা অনেক আগের, যুদ্ধকালীন অবস্থায় তা ঘটেছিল। সে সব আমাদের কাছে খুব স্পষ্ট নয়। কিন্তু নিউ হারমানের ঘটনা আমেরিকানদের হতবাক করে দেবে।’ বিল বেকার বলল।
‘শুধু হতবাক নয়, অর্ধশতকেরও বেশি কাল ধরে ইহুদীবাদীরা যে ইমেজ গড়ে তুলেছিল তা ধুলিস্মাত হয়ে যাবে। আর আমেরিকানদের জন্যে এর খুব বেশী প্রয়োজন ছিল।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
জর্জ আব্রাহাম থামতেই আহমদ মুসা বলে উঠল, ‘বেঞ্জামিন বেকনের সাথে আমার জরুরী যোগাযোগ প্রয়োজন মি. জর্জ।’
‘অল রাইট আহমদ মুসা আপনি আপনার রেষ্ট রুমে ফিরে যান। ওখানে গিয়েই সুসজ্জিত একটা ব্যাগ পেয়ে যাবেন। তাতে সবরকম যোগাযোগ এবং আপনার অভিযানের রশদ-পত্রও পেয়ে যাবেন। আমিও এখন উঠছি। প্রেসিডেন্টের ওখানে যাব।’
একটু থামল জর্জ আব্রাহাম। তারপর সাগরিকা সেনদের দিকে চেয়ে বলল, ‘অনুগ্রহ করে আপনারাও কি মি. আহমদ মুসার সাথে যাবেন। সেখানে আপনাদের রেষ্টের ব্যবস্থা হচ্ছে। অন্তত প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে ফিরে আসা পর্যন্ত আপনারা আমাকে সময় দিন।
‘অবশ্যই মি. জর্জ। আমরা যাচ্ছি আহমদ মুসার সাথে।’
‘ধন্যবাদ আপনাদের সকলকে।’
আহমদ মুসা, ডা. বারাকসহ সকলে উঠে দাড়াল।
উঠে দাড়াল জর্জ আব্রাহাম জনসন এবং পুলিশ প্রধান বিল বেকারও।
জর্জ আব্রাহাম বিল বেকারের দিকে চেয়ে বলল, ‘আপনি একটু বসুন মি. বেকার। আপনি আমার সাথে প্রেসিডেন্টের কাছে যাবেন। আমি তৈরী হয়ে আসছি।’
আহমদ মুসারা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আর জর্জ আব্রাহাম জনসন কয়েকটা ফাইল, ক্যাসেট, কয়েকটা টুকিটাকি জিনিস ব্রীফকেসে পুরে তার পাশের কক্ষের দিকে এগুলো।
বিল বেকার মনোযোগ দিল খবরের কাগজের দিকে। | ← Previous | | | Next → | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »