৩২. অক্টোপাশের বিদায়

চ্যাপ্টার

চ্যাপ্টার

আহমদ মুসার রক্ষা নেই। তাকে ফাঁদে পড়তেই হবে।’ বলল জেনারেল শ্যারন।
‘কিছুক্ষণ আগে শশাংকের সাথে কথা হলো। সে বলল, ‘আজ সন্ধ্যার দিকে নাকি আহমদ মুসা আনাপোলিশে যাচ্ছে। অথচ তার যাওয়ার কথা ছিল না। শশাংক ও সাগরিকাই ওয়াশিংটনে যাবে শুনেছিলাম।’ বলল নোয়ান নাবিলা।
‘ধন্যবাদ নাবিলা। এখন দেখবে আহমদ মুসার পরবর্তী কাজ হবে তোমাকে ফলো করা। সে নিশ্চিত মনে করেছে তুমি আমাদের সাথে জড়িত এবং তুমি সারা জেফারসন সম্পর্কে সবকিছু জান।’ বলল জেনারেল শ্যারন।
‘এটাইতো চাই। আমাকে ফলো করবে আর আমি তাকে ফাঁদের মধ্যে নিয়ে যাব।’ নোয়ান নাবিলা বলল।
‘আর আমরা তাকে টুক করে খাঁচায় পুরব।’ বলে হেসে উঠল জেনারেল শ্যারন।
‘আমি সবচেয়ে বেশি খুশি, সাগরিকাকে তার হাত থেকে রক্ষা করার এটা একটা পথ হবে।’ নাবিলা বলল।
‘শুধু তো সাগরিকা সেন নয়, আমাদের তথ্য মতে শশাংক সেনও আহমদ মুসার দারুণ ভক্ত হয়ে উঠেছে।’ বলল জেনারেল শ্যারন।
‘সেটা আহমদ মুসা সাগরিকার বন্ধু হওয়ার কারণে। সাগরিকাকে সরাতে পারলে শশাংক এমনি সরে যাবে।’ নাবিলা বলল।
‘মি. শ্যারন, আহমদ মুসাকে আটকাবার আরও সুযোগ পাচ্ছি, এটা আশার কথা। কিন্তু আমি মামলা নিয়ে সত্যিই উদ্বিগ্ন। মামলার চার্জশিটগুলো আমি পড়েছি। আমাদের জন্য আইনি লড়াই চালাবার কোন সুযোগই নেই।’ বলল আমেরিকান কাউন্সিলর জুইস এ্যাসোসিয়েশনস এর প্রধান ডেভিড উইলিয়াম জোনস। তার কন্ঠে উদ্বেগ।
‘এ জন্যেই আইনের চোখকে অন্যদিকে ঘুরাতে হবে।’ বলল জেনারেল শ্যারন।
‘কিভাবে?’ জিজ্ঞেস করল ডেভিড উইলিয়াম জোনস।
‘কেন আপনিও তো জানেন, বিজয়ের আনন্দে আহমদ মুসা এমন কিছু করে বসবে যা তাকে আমেরিকানদের কাছে ঘৃণার পাত্রে পরিণত করবে।’ বলল জেনারেল শ্যারন।
‘সেটা কি? কি রকম? দারুণ উৎসুক কন্ঠে জানতে চাইল নোয়ান নাবিলা।
জেনারেল শ্যারন ও ডেভিড জোনস দু’জনেই তাকাল নোয়ান নাবিলার দিকে। কিছুটা বিব্রত ভাব দু’জনের চোখে-মুখেই। জবাব দিল জেনারেল শ্যারন। বলল মুখে হাসি টেনে, ‘ও কিছুনা । আহমদ মুসা আমেরিকার ইহুদীদের বিরুদ্ধে আরেকটা ষড়যন্ত্র করছে।’
‘কি ষড়যন্ত্র?’ নোয়ান নাবিলা বলল।
‘সবই জানতে পারবে। এইটুকু জেনে রাখ, বিজয়ের আনন্দে অন্ধ হয়ে সে হিটলার সাজতে চাচ্ছে।’
দরজায় এ সময় নক হলো।
সেদিকে না তাকিয়েই জেনারেল শ্যারন বলল, ‘এস বেন ইয়ামিন।’
দরজা ঠেলে ঘরে প্রবেশ করল বেন ইয়ামিন।
নিরেট ইহুদী চেহারা বেন ইয়ামিনের। স্পাই হিসেবে, যে কোন ষড়যন্ত্রের সফল অপারেটর হিসেবে জেনারেল শ্যারনের অস্ত্রশালায় সে অদ্বিতীয়।
সে ঘরে ঢুকতেই জেনারেল শ্যারন বলল, ‘কি খবর বেন?’
‘সব ঠিক-ঠাক।’
‘মিশন কয়টায় যাচ্ছে?’
‘সন্ধ্যা ছ’টায়।’
‘কি বুঝলে কোন রেসিষ্ট্যান্স হবে? কিংবা কোন অসুবিধা?’
‘তেমন সম্ভাবনা নেই। তবে সমস্যা হলো, দু’জন সাংবাদিক সেখানে থাকে। তবে যে সময় আমাদের অপারেশন, সে সময় তারা অফিসে থাকবে।’
‘গুড।’ উচ্ছসিত কন্ঠে বলে উঠল জেনারেল শ্যারন।
একটু থেমেই সে আবার বলল, ‘ওখানে সাংবাদিকের বাসা থাকায় সুবিধাই হলো। মিডিয়াগুলো ইস্যুটাকে সাংঘাতিকভাবে হাতে তুলে নেবে।’
‘আরেকটা সুবিধা আছে স্যার। আমেরিকার পূর্ব উপকূলে এটাই ইহুদীদের প্রথম বসতি। মার্কিন ইহুদীদের পিতা বলে কথিত দি গ্রেট ডেভিড দানিয়েল এই বসতিতেই জন্মগ্রহন করেন। তার জন্মস্থানটা এখন সিনাগগে পরিণত হয়েছে। সিনাগগের পাশেই তার ভূমিষ্ট হওয়ার ঘরটি এখনও বর্তমান। ওটা মার্কিন ইহুদীদের একটা পবিত্র স্থান। ওখানে কেউ হাত দিলে মার্কিন ইহুদীদের কলিজায় হাত দেয়া হবে।’
‘ব্রাভো, ব্রাভো। ওটায় শুধু হাত দেয়া নয়, নিশ্চয় ওটা আগুনের গ্রাসে যাবে।’ বলতে বলতে জেনারেল শ্যারনের মুখে একটা ক্রুর হাসি ফুটে উঠল।
নোয়ান নাবিলা জেনারেল শ্যারনের সামনে মুখোমুখি এক শোফায় বসেছিল। তার ভ্রুদুটি কুঞ্চিত হয়ে উঠেছে। অনাহুতভাবে এ রকম আলোচনায় অংশগ্রহন অসংগত বলে নোয়ান নাবিলা কিছু বলল না। কিন্তু মনটি তার খুব উৎসুক হয়ে উঠল।
কথা শেষ করে একটু দম নিয়েছিল জেনারেল শ্যারন। তারপর একটু নড়ে-চড়ে বসে পকেট থেকে একটা অদ্ভুত লাল মোড়ক বের করে বেন ইয়ামিনের দিকে তুলে ধরে বলল, ‘এটা তোমার মিশনের কমান্ডারকে দিয়ে দিও। পরিকল্পনার সাথে এটাও যুক্ত হবে। অপারেশন শেষে ফেরার সময় সে যেন এটা ওখানে ফেলে রেখে আসে।’
বেন ইয়ামিন ওটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বলল, ‘ভয়ংকর বিস্ফোরক। তৈরী হয়েছে লিবিয়ার ত্রিপোলীতে। অতএব…………।’
কথা শেষ না করেই হো হো করে হেসে উঠল বেন ইয়ামিন।
‘অতএব বেরিয়ে পড়বে আহমদ মুসার কানেশন। শুধু এটাই নয় আরও কিছু জিনিস এটা প্রমাণ করবে।’ বেন ইয়ামিনের সাথে হাসিতে যোগ দিয়ে বলল জেনারেল শ্যারন।
বেন ইয়ামিন বেরিয়ে গেল।
নোয়ান নাবিলাও বেরুতে চাচ্ছিল। জেনারেল শ্যারন তাকে লক্ষ করে বলল, ‘নাবিলা আনাপোলিশে তুমি কখন ফিরছ?’
‘বিকেলে একটা প্রোগ্রাম আছে। সন্ধ্যায় যাব আমি।’ বলল নাবিলা।
‘তুমি তো বললে আহমদ মুসাও সন্ধ্যায় আনাপোলিশে পৌছবে। রোড না ইয়ারে যাচ্ছে জানতে পেরেছো কিছু?’
‘না জানতে পারিনি। সাগরিকা জানে কি না জানি না।’
‘খুব ভালো হতো যদি আহমদ মুসা সাড়ে আটটা নয়টা পর্যন্ত রাস্তায় থাকতো।’ বলল জেনারেল শ্যারন।
‘কেন?’
‘আমাদের পরিকল্পনাকে পাকা-পোক্ত করার জন্য এটা প্রয়োজন।’
একটু থেমেই আবার বলে উঠল জেনারেল শ্যারন, ‘সন্ধ্যা ক’টায় আহমদ মুসা আনাপোলিশে পৌছবে সেটা আমাদের জানা প্রয়োজন।’
‘আমি জানাতে পারি, আপনারাও টেলিফোন করতে পারেন।’
‘ধন্যবাদ নাবিলা, তোমার টেলিফোন না পেলে ন’টার দিকে আমি টেলিফোন করব।’
‘আমাকে কোন কারণে না পেলে শশাংককে জিজ্ঞেস করলেও জানতে পারবেন।’ বলল নোয়ান নাবিলা।
বলে নোয়ান নাবিলা উঠে দাড়াল।

সন্ধ্যা তখন সাড়ে সাতটা।
নোয়ান নাবিলার গাড়ি তীর বেগে এগিয়ে চলছিল আনাপোলিশের দিকে।
এক্সপ্রেস হাইওয়ে থেকে কাউন্টি রোডে পড়ার পর গাড়ির গতি কমে গিয়েছিল। তার উপর সেভেরা নদীর খাড়ি অতিক্রম করার সময় ব্রীজের উপর গাড়ির গতি আরও কমে যায়। এই আয়েশি গতিতেই নোয়ান নাবিলার গাড়ি নিউ হারমানে প্রবেশ করল।
প্রবেশ করেই বন্দুকের বিক্ষিপ্ত গুলীর শব্দে চমকে উঠল নোয়ান নাবিলা। আরও কিছুটা অগ্রসর হলো তার গাড়ি। রাস্তার দু’পাশ থেকেই মানুষের আর্ত চিৎকার কানে এল তার।
উৎকর্ণ হলো নোয়ান নাবিলা।
আপনাতেই যেন থেমে গেল তার গাড়ি।
ঠিক এ সময় কয়েকটা গাড়ি দু’পাশের বসতি থেকে মাতালের গতিতে বেরিয়ে উত্তরের এক্সপ্রেস হাইওয়ের দিকে ছুটে গেল। সবগুলো গাড়ির আলো নেভানো। শুধু তার কাছের একটা বাইলেন দিয়ে ছুটে যাওয়া একটা গাড়ির পেছনের নেমপ্লেটে আলো দেখতে পেল। নাম্বারটাও পড়তে পারল সে।
প্রবল সন্দেহ নিয়ে গাড়ি থেকে নামল নোয়ান নাবিলা।
নিউ হারমান এলাকা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটা প্রাচীন ইহুদী বসতি। নিউইয়র্ক নগরীর পত্তনের সময়ই আনাপোলিশের প্রতিষ্ঠা হয়। আনাপোলিশের পরেই মেরিল্যান্ডে যে প্রথম জনবসতি গড়ে ওঠে, সেটা নিউ হারমান। এখানে প্রথম বসতি গড়ে কিছু জার্মান ক্যাথলিক। পরে জার্মান ক্যাথলিকরা নিউ হারমান বিক্রি করে দিয়ে আরও উত্তরে উৎকৃষ্টতর জায়গায় সরে যায়। ইহুদীরা ক্যাথলিকের ছদ্ম পরিচয়ে নিউ হারমান কিনেছিল। অনেক পরে তাদের পরিচয় প্রকাশ হয়ে পড়ে। এখন নিউ হারমান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটা বনেদী ইহুদী বসতি।
নিউ হারমান বসতিটা খুবই সুন্দর লোকেশনে। নিউ হারমান থেকে আধা কিলোমিটার পুবে আনাপোলিশের গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহ্যবাহী নৌ-ঘাঁটি। আর পৌনে এক কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে মেরিল্যান্ডের ঐতিহাসিক ষ্টেট হাউজ। নিউ হারমান থেকে আনাপোলিশের দূরত্ব এক কিলোমিটারের কম।
নিউ হারমান নোয়ান নাবিলার পরিচিত। তার এক আত্মীয় পরিবার এখানে থাকে। নাবিলা এখানে আসে।
নোয়ান নাবিলা এক পা দু’পা করে কিছুটা এগিয়েছিল। সে দেখল, একজন লোক এদিকে টলতে টলতে এগিয়ে আসছে।
নোয়ান নাবিলা এগুলো তার দিকে।
কিন্তু নাবিলা লোকটার কাছে পৌছার আগেই লোকটা লুটিয়ে পড়ল মাটির উপর।
নোয়ান নাবিলা ছুটে গিয়ে তার পাশে বসল।
লোকটা রক্তাক্ত।
দেখেই বুঝল নোয়ান নাবিলা, লোকটা বুলেট বিদ্ধ হয়েছে।
মারা গেল নাকি লোকটা?
নোয়ান নাবিলা তাড়াতাড়ি লোকটার একটা হাত তুলে নিয়ে নাড়ি দেখল। নাড়ি নেই। মারা গেছে লোকটা।
উঠে দাড়াচ্ছিল নাবিলা। হঠাৎ তার চোখে পড়ল, লোকটার হাতে একটা ক্যাসেট-ভিডিও ক্যাসেট। ভ্রুকুঞ্চিত হলো নাবিলার।
নাবিলা লোকটার হাত থেকে ক্যাসেটটা নিয়ে উঠে দাঁড়াল।
শংকা ও উদ্বেগে মন তখন অস্থির হয়ে উঠেছে নাবিলার। নিউ হারমানে বড় কিছু ঘটেনি তো! গাড়িগুলো ওভাবে আলো নিভিয়ে পালালো কেন?
নাবিলা দ্রুত গাড়িতে উঠে গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে আত্মীয়ের বাসার দিকে চলল।
দু’পাশে বাড়ি, মাঝ দিয়ে চলছে নাবিলার গাড়ি। ঘর বাড়িতে আলো জ্বলছে। কিন্তু চারদিকে মৃতের স্তব্ধতা। বাতাস যেন ভারী। কিসের গন্ধ! তাজা রক্তের? লোকটার রক্তের গন্ধ কি তার নাকে লেগে আছে এখনও?
চলছে তার গাড়ি।
দেখল একটা বাড়ির বারান্দার পাশ দিয়ে একটা লাল স্রোত গড়িয়ে মাটিতে এসে পড়ছে।
শিউরে উঠল নাবিলা। চলছে তার গাড়ি।
সামনেই দু’টো বাড়ি।
আনমনা হয়ে পড়া নাবিলা হঠাৎ সামনের একটা দৃশ্যে আঁৎকে উঠে ব্রেক করল গাড়ির। একবারে গাড়ির মুখের কাছে রাস্তার উপর দু’টো রক্তাক্ত লাশ।
সামনে আশে-পাশে তাকাল নাবিলা কম্পিত বুকে। দেখল, দু’পাশের বাড়ির লনে আরও রক্তাক্ত মানুষ পড়ে আছে।
রাজ্যের আতংক এসে ঘিরে ধরল নাবিলাকে। কোন লোকজন নেই কেন? মানুষ এভাবে খুন হয়েছে দেখেও মানুষ আসছে না কেন? কোথাও কারো কোন কথা নেই কেন? সবাই মরে গেছে নাকি?
থর থর করে কেঁপে উঠল নাবিলার গোটা শরীর। গাড়ি ঘুরিয়ে লাশ দু’টিকে পাশ কাটিয়ে সামনে এগুলো নাবিলা। সামনেই তার আত্মীয়ের বাড়ি।
তার ফুফুর বাড়ি এটা।
গাড়ি নিয়ে খোলা গেট দিয়ে প্রবেশ করল।
কারো কোন সাড়া শব্দ নেই বাড়িতে।
লাফ দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে বারান্দায় উঠল।
ভেতরে ঢোকার দরজা খোলা।
ভেতরে ঢুকতে গিয়ে রক্তের স্রোতে ধাক্কা খেল নাবিলা।
রক্তে ভেসে যাচ্ছে ঘরের মেঝে। রক্তে ভাসছে কয়েকটি মানুষ।
ভীত নাবিলার কন্ঠে আপনা থেকেই একটা আর্ত-চিৎকার বেরিয়ে এল, ‘আন্টি’।
তার এ চিৎকার উঠার সাথে সাথে ঘরের মেঝেতে লুটোপুটি খাওয়া একটা লাশের মাথা নড়ে উঠল। একটু উপরে উঠল মাথা। ধ্বনিত হলো একটা আর্তনাদ, ‘কে, বাঁচাও আমাদের, বাঁচাও।’ মেয়েলি কন্ঠ।
নাবিলা চিনতে পারল তার আন্টির কন্ঠ।
নাবিলা পাগলের মত ছুটল তার আন্টির কাছে।
তার আন্টির মাথার কাছে বসে পড়ে কোলে তুলে নিল তার মাথা।
‘ওরা সবাইকে মেরে ফেলেছে। আমি কেন মরলাম না। আমি গুলী বৃষ্টির মুখে পড়ে গেলে ওরা মনে করেছে আমিও মরে গেছি।’ কান্নায় ভেঙে পড়ে বলল নাবিলার আন্টি।
‘ওরা কারা আন্টি? তুমি এখানে কখন এলে? তুমি তো আনাপোলিশে ছিলে?’ বলল নোয়ান নাবিলা।
‘সন্ধ্যায় এসেছি।’
বলে মাথাটা নাবিলার কোলে এলিয়ে দিয়ে বলল, ‘ওরা শয়তান কশাই। যাবার সময় আবার বলে গেল, তোদের কোরবানী দিলাম আমেরিকার ইহুদীদের বাঁচাবার জন্যে।’
কথাগুলো নোয়ান নাবিলার কানে গেল, কিন্তু তার মনোযোগ তখন অন্যদিকে। সে দেখল তার আন্টির কাঁধ, বাহু ও উরুতে গুলী লেগেছে।
বলে উঠল দ্রুত নোয়ান নাবিলা, ‘আন্টি তুমি মারাত্মক আহত। আর কথা বলো না তুমি। এখনি তোমাকে ক্লিনিকে নিতে হবে।’
বলে নাবিলা তার আন্টিকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিল।
বহুকষ্টে টলতে টলতে তার আন্টিকে নিয়ে গাড়িতে তুলল।
গাড়ি ষ্টার্ট দিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে এল।
এ সময় চারদিক থেকে সাইরেনের শব্দ এল। পুলিশ আসছে। এবার মনে সাহস পেল নাবিলা।
চলতে লাগল নাবিলার গাড়ি।
কয়েক গজ সামনে এগুতেই পথ রোধ করে দাঁড়াল পুলিশের গাড়ি।
গাড়ি থেকে নামল এক পুলিশ অফিসার।
নাবিলাও নামল গাড়ি থেকে।
পুলিশ কথা বলার আগেই নোয়ান নাবিলা নিজের পরিচয় দিয়ে বলল, ‘আমি আমার গুলীবিদ্ধ মূমুর্ষ আন্টিকে নিয়ে যাচ্ছি।’
পুলিশ অফিসারটিও আনাপোলিশের। চিনতে পারল নোয়ান নাবিলাকে। বলল, ‘কিন্তু আপনি এখানে কোত্থেকে?’
নোয়ান নাবিলা সংক্ষেপে তার সব কথা বলল। শুধু ভুলে গেল ভিডিও ক্যাসেট ও গাড়ির নাম্বারের কথা বলতে। উদ্বেগ-উত্তেজনায় সব কথা সে গুছিয়েও বলতে পারছিল না।
‘আপনার ও আপনার আন্টির ষ্টেটমেন্ট আমাদের দরকার হবে। তাকে কোন ক্লিনিকে রাখছেন দয়া করে জানাবেন। আপনাদের দেরী করাবার জন্য দুঃখিত। বাই।’
বলে পুলিশ অফিসারটি তার গাড়িটি নাবিলার গাড়ির সামনে থেকে সরিয়ে নিয়ে আরও সামনে এগুলো।
গাড়ি আবার ষ্টার্ট দিল নোয়ান নাবিলা। ছুটে চলল তার গাড়ি আনাপোলিশ হাসপাতালের উদ্দেশ্যে।

জর্জ আব্রাহাম জনসন পাথরের মত বসে আছে তার চেয়ারে।
তার বিশাল অফিস-টেবিলের উপর তার সামনেই পড়ে আছে সেদিনের খবরের কাগজগুলো। দেখেই বুঝা যাচ্ছে পড়েই কাগজগুলো আলু-থালু করে ভাঁজ করে রাখা হয়েছে।
জর্জ আব্রাহাম জনসনের মুখ পাথরের মত স্থির, নিশ্চল দেহটা চেয়ারে হেলান দেয়া। চোখে-মুখে একটা বিহবল ভাব।
ইন্টারকম কথা বলে উঠল, ‘স্যার পুলিশ প্রধান বিল বেকার এসেছেন।’ কন্ঠ জর্জ আব্রাহামের পিএ’র।
‘নিয়ে এস।’ বলে জর্জ আব্রাহাম জনসন সোজা হয়ে বসল।
একটু পরেই দরজায় নক হলো।
জর্জ আব্রাহাম উঠে দাঁড়িয়েছিল আগেই। কয়েক ধাপ এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে স্বাগত জানাল পুলিশ প্রধান বিল বেকারকে।
বিল বেকারকে বসতে বলে জর্জ আব্রাহাম তার চেয়ারে ফিরে এল।
‘থ্যাংক ইউ ফর কলিং। আমি আপনাকে টেলিফোন করতে যাচ্ছিলাম, সে সময় আপনার টেলিফোন পেয়েছি।’ বসেই বলল পুলিশ প্রধান বিল বেকার।
‘থ্যাংকস মি. বেকার। আজকের কাগজের নিউজগুলো পড়েছেন?’ জিজ্ঞেস করল আব্রাহাম জনসন।
‘পড়েছি। ঐ বিষয়েই তো আপনাকে টেলিফোন করতে যাচ্ছিলাম।’ বিল বেকার বলল।
কথা শেষ করে একটু থেমেই আবার বলে উঠল, ‘কি ভয়াবহ খবর! আমি তো চোখে অন্ধকার দেখছি মি. জর্জ। আপনি কি ভাবছেন বিষয়টা নিয়ে?’
‘খুব বেশি ভাবার নেই। আইন তার নিজের গতিতে চলবে। আহমদ মুসা কিংবা কেউই আইনের চেয়ে বড় নয়।’ বলল জর্জ আব্রাহাম গম্ভীর কন্ঠে।
একটু থেমে একটা খবরের কাগজ বিল বেকারের দিকে তুলে ধরে বলল, ‘এ সম্পর্কে আরও কথা বলার আগে আসুন নিউজটা আর একবার পড়ে নেই। নিউজটা আপনি পড়লে বাধিত হবো।’
কাগজ হাতে নিল বিল বেকার। বলল, ‘শিওর।’
বলে ওয়াশিংটন পোস্ট থেকে নিউজ পড়া শুরু করল বিল বেকার।
‘‘নিউ হারমানে গণহত্যা। নারী-শিশু যুবক-বৃদ্ধসহ ৮০ জন ইহুদী নিহত। বিড়াল তপস্বী ভুমিকার অবসান ঘটিয়ে আহমদ মুসার স্বরূপে আবির্ভাব।’’ আনাপোলিশ থেকে জন হ্যানসন।
গত সন্ধ্যায় গণহত্যার এক নৃশংস ঘটনায় ৮০ জন ইহুদী নারী-শিশু যুবা-বৃদ্ধ নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে ২০ জন। অবস্থা দৃষ্টে মনে হয়, সকলকেই হত্যা করার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু ভাগ্যজোরে এ কয়জন বেঁচে যায়। আহতদেরকে মৃতের স্তুপের মধ্যে পাওয়া গেছে।
আহতদের বক্তব্য থেকে জানা গেছে, অস্ত্রধারীরা অতর্কিতে প্রবেশ করে নির্বিচারে গুলী বর্ষণ শুরু করে। সবাই নিহত হয়েছে নিশ্চিত হবার পরই শুধু তাদের গুলী বর্ষণ বন্ধ হয়। হন্তারা কোন জিনিসে হাত দেয়নি, তাকিয়েও দেখেনি কোন জিনিসের দিকে। এ থেকে ধারণা করা হচ্ছে গণহত্যার উদ্দেশ্যেই তারা আসে।
অস্ত্রধারীরা একই ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করে। নিউ হারমানের বাড়িগুলো থেকে উদ্ধারকৃত বুলেট থেকেই এটা জানা গেছে।
হন্তারা সংখ্যায় কতছিল তা জানা না গেলেও সব বাড়ি একই সাথে আক্রান্ত হওয়া থেকে অনুমান করা হচ্ছে তারা কমপক্ষে ২৫ জনের মত ছিল।
ঘটনাটিকে সাম্প্রতিক ইতিহাসের সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর, নৃশংস ও তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হিসেবে মানুষ মনে করছে। কাউন্টি পুলিশ, সেই সাথে ফেডারেল পুলিশ ও এফবিআই একই সঙ্গে তদন্ত শুরু করেছে।
এই তদন্ত কাজে পুলিশ ও এফবিআই ঘটনাস্থল থেকে প্রাপ্ত কয়েকটি জিনিস ও একটি লাশকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছে। ঘটনাস্থল থেকে কুড়িয়ে পাওয়া লিবিয়ায় তৈরী বিস্ফোরকের একটি প্যাকেট, একটি মানিব্যাগ থেকে একটি নেমকার্ড ও কম্পিউটার প্রিন্ট করা একটি চিরকুট পাওয়া গেছে। তদন্তের স্বার্থে নেম কার্ড ও চিরকুটের বিষয়বস্তু গোপন রাখা হয়েছে। তবে এটুকু জানা গেছে কম্পিউটার মেসেজটি আরবী ভাষায় এবং এর সাথে আহমদ মুসার প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে। অন্যদিকে ৮০টি লাশের বাইরে আরেকটি লাশ ঘটনাস্থলে পাওয়া গেছে। তাকে আক্রমনকারীদের একজন বলে মনে করা হচ্ছে। তার পকেটে একটি মোবাইল পাওয়া গেছে। মোবাইল সূত্রে তার যে নাম উদ্ধার করা গেছে তা হলো ‘আব্দুল্লাহ’।
সব মিলিয়ে পুলিশ নিশ্চিত যে, এই গণহত্যার পেছনে আহমদ মুসার প্রত্যক্ষ হাত রয়েছে। মনে করা হচ্ছে, বিভিন্ন ঘটনার সাথে সংশিস্নষ্ট করে আইনে প্যাঁচে ইহুদী নেতৃবৃন্দকে জড়িয়ে এখন ইহুদীদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী অভিযান শুরু করা হয়েছে। এ হিটলারী অভিযানের মাধ্যমে আহমদ মুসার বিড়াল তপস্বী রূপ উবে গিয়ে তার আসল রূপ প্রকাশ হয়ে পড়েছে বলে সচেতন মহল মনে করছেন।’’
খবরটি পড়া শেষ করে পুলিশ প্রধান বিল বেকার খবরের কাগজটি টেবিলে রেখে চেয়ারে হেলান দিল হতাশ ভংগিতে। বলল, ‘আমি কিছু বুঝতে পারছি না মি. জর্জ।’
জর্জ আব্রাহাম জনসনের দৃষ্টিতে বিমর্ষতা। বিল বেকারের কথায় সে নড়ে-চড়ে বসল। এক টুকরো হাসি মুখে ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করল। বলল, ‘সত্য অনেক সময় অবিশ্বাস্য আকারেও সামনে আসে।’
‘কিন্তু আহমদ মুসা এই কাজ করল?’ প্রশ্ন তুলল বিল বেকার।
‘হ্যাঁ না-কোনটাই বলতে পারব না মি. বেকার। আমরা পুলিশ, বিচারক নই। আসুন আমরা আমাদের কাজ করি।’ বলল জর্জ আব্রাহাম ম্লান হেসে।
‘এ ব্যাপারে আপনি কিছু চিন্তা করেছেন?’
‘আমি প্রেসিডেন্টের সাথে কথা বলেছি। তিনিও মনে করেন এই মুহূর্তে আহমদ মুসাকে গ্রেপ্তার করা ছাড়া কোন বিকল্প নেই।’ বলল শুস্ক কন্ঠে জর্জ আব্রাহাম।
পুলিশ প্রধান বিল বেকার মুহূর্তকয় জর্জ আব্রাহাম জনসনের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর ধীরে ধীরে বলল, ‘ঠিক আছে স্যার। আমি এখনি পদক্ষিপ নিচ্ছি। কিন্তু আমি বলছি, এ ব্যাপারে এতটা তাড়াহুড়া না করলে হতো না? ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত পুলিশ রিপোর্ট পাওয়ার পর আমরা এগুতে পারি।’
‘আহমদ মুসা গা ঢাকা দেবে না, পালাবে না, এ কথা নিশ্চিত করে আমি আপনি কেউ বলতে পারি না।’
আহত হওয়ার চিহ্ন ফুটে উঠল পুলিশ প্রধান বিল বেকারের চোখে-মুখে। বলল, ‘আহমদ মুসা পালাবে? পালাবার ইচ্ছা থাকলে তো ইতিমধ্যেই পালিয়েছে।’
‘না পালাতে পারেনি। আমি খবর পেয়েছি রাতেই। খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ব্যবস্থা নিয়েছি। আমাদের লোকরা রাত দশটার মধ্যেই আহমদ মুসাকে আনাপোলিশে ডা. বেগিন বারাকের বাড়িতে খুঁজে পেয়েছে। তখন থেকেই বাড়ির চারদিকে আমরা গোপন পাহারার ব্যবস্থা করেছি। সে পালাতে চাইলেও পালাতে পারতো না।’ বলল জর্জ আব্রাহাম। তার কন্ঠ শুস্ক।
ম্লান হাসল বিল বেকার। বলল, ‘স্যার, পুলিশ নয়, মানুষ হিসেবে আপনাকে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করি। একজন মানুষ হিসেবে আপনার মন কি বলে, আহমদ মুসা এই ঘটনা ঘটিয়েছে?’
এক টুকরো বেদনার হাসি ফুটে উঠল আব্রাহাম জনসনের মুখে। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর বলল, ‘আহমদ মুসার জন্যে ভালো আইনজীবী পাওয়া না গেলে চাকুরী ছেড়ে দিয়ে আমি তার পক্ষে দাঁড়াব। কিন্তু এখন যতটুকুই প্রমাণ মিলেছে, তাতে আহমদ মুসা নির্দোষ প্রমাণিত হওয়া ছাড়া তাকে আমি নির্দোষ বলতে পারবোনা।’
‘ঠিক আছে। কিন্তু মি. জর্জ আমার মনে হচ্ছে প্রাথমিক তদন্ত ছাড়া আহমদ মুসাকে গ্রেপ্তার করা উচিত হচ্ছে না। ঘটনাস্থলে মানিব্যাগ থেকে পাওয়া নেমকার্ড, মেসেজ এবং কিলারদের একজনের লাশের ছবি আমি দেখেছি। তার পরও মন আমার আশ্বস্ত হয়নি। কতকগুলো প্রশ্ন আমাকে পীড়া দিচ্ছে। কিলাররা ধীরে-সুস্থে চলে গেল, অথচ তাদের একজনের লাশ ফেলে গেলে কেন? মানি ব্যাগটাও আমার কাছে রহস্যপূর্ণ। এ ধরনের অপারেশনে কেউ পকেটে ঐ ধরনের মানি ব্যাগ নিয়ে যায় না।’ বলল পুলিশ প্রধান বিল বেকার।
‘লাশসহ জিনিসগুলো আমিও পেয়েছি। কিন্তু প্রশ্ন উঠলেই কোন কিছু মিথ্যে হয়ে যায় না। তাছাড়া প্রেসিডেন্ট বলছেন, আমেরিকার জন্যে এই গণহত্যার ঘটনাটা খুবই বড়। ইতিমধ্যেই তিনি ডজন খানেক টেলিফোন পেয়েছেন। যার মধ্যে সিনেট ও প্রতিনিধি পরিষদের প্রভাবশালী সদস্যও রয়েছেন। ঘটনাটা অপরাধমূলক হওয়ার চাইতে রাজনৈতিক রূপই বেশি পাবে। সুতরাং আহমদ মুসাকে গ্রেফতার না করে কোন উপায় নেই। আর যে প্রমাণগুলো মিলেছে তা প্রত্যক্ষ ও পাওয়ারফুল। আহমদ মুসাকে রক্ষা করার কোন উপায় দেখা যাচ্ছে না।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
‘আর একটা বিষয়, আহমদ মুসা এখান থেকে গেছেন ক’টায়, আর আনাপোলিশে পৌছেছেন ক’টায়? জিজ্ঞেস করল বিল বেকার।
‘ঐ হিসাব ঠিক আছে মি.বেকার। আহমদ মুসা ওয়াশিংটন থেকে বেরিয়েছে সাড়ে ৫টার দিকে। আনা পোলিশ পৌছেছে ৭ টার আগেই। ওঁর সাথে ছিল বেঞ্জামিন বেকন। বেঞ্জামিন বেকনকে টেলিফোন করে আমি জেনেছি, স্বাভাবিক সময়ের আগেই তারা আনাপোলিশ পৌছেছে।’ বলল জর্জ আব্রাহাম।
‘আর বেঞ্জামিন বেকন তার সাথে ছিল, সে পথিমধ্যে আহমদ মুসাকে সন্দেহজনক কিছু করতেও তো দেখি নি।’ বিল বেকার বলল।
‘সব হিসাবই ঠিক আছে মি. বেকার। তবু নিউ হারমানে গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে এবং সেখানে একজন মুসলমানের লাশ, একজন মুসলমানের নেমকার্ড এবং আহমদ মুসার একটি ফ্যাক্স মেসেজ পাওয়া গেছে এবং আহমদ মুসা ঐ দিন ঘটনার সামান্য আগে নিউ হারমান অতিক্রম করেছে। সুতরাং আহমদ মুসা সবদিক থেকেই ঘটনার সাথে জড়িয়ে পড়ছে।’ বলল জর্জ আব্রাহাম। শেষের দিকে তার কন্ঠ আরও শুষ্ক হয়ে উঠেছিল।
‘ঠিক বলেছেন মি. জর্জ। ঈশ্বর তাঁকে রক্ষা করুন।’ বিল বেকার বলল। তার কন্ঠ ভেজা।
বিল বেকারের কথা শেষ হতেই জর্জ আব্রাহাম জনসনের বিশেষ অয়্যারলেস মোবাইলটি বেজে উঠল। লাল রংয়ের সিগারেট লাইটারের মত যন্ত্র ওটা।
মোবাইলটা হাতে তুলে কানের কাছে নিয়ে ওপারের কথা শুনেই শশব্যস্ত বলে উঠল, ‘গুড মর্নিং মি. প্রেসিডেন্ট।’
তারপর ওপারের কথা শুনল। তারপর বলে উঠল, ‘ইয়েস মি. প্রেসিডেন্ট, ওদিকের সব ব্যাবস্থা করেছি। আহমদ মুসা যেখানে আছে, সে বাড়িটা ঘিরে আছে আমাদের সিকুরিটির লোকেরা।’
আবার ওপারের কথা শুনল সে। মুখটা তার ম্লান হয়ে উঠল। বলল, ‘স্যরি মি. প্রেসিডেন্ট, গ্রেপ্তারের নির্দেশ এখনও দেইনি। তবে সে নিশ্চয় পালাবার চেষ্টা করবে না মি. প্রেসিডেন্ট। আর আমি তাকে টেলিফোন করব আত্মসমর্পণ করার জন্যে।’
তারপর ‘গুড মর্নিং মি. প্রেসিডেন্ট।’ বলে মোবাইল নামিয়ে রাখল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
পুলিশ প্রধান বিল বেকার এ্যাটেনশন কায়দায় উন্মুখ দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল জর্জ আব্রাহামের দিকে।
জর্জ আব্রাহাম মোবাইলটা রেখে মুহূর্তকাল আত্মস্থ থেকে তাকাল বিল বেকারের দিকে। বলল, ‘মি. বেকার, প্রেসিডেন্ট ঘটনা নিয়ে খুব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। দেশের ভেতর ও বাইরে থেকে তিনি মারাত্মক চাপের মধ্যে পড়েছেন। তিনি ভয় করছেন, আহমদ মুসা কোনক্রমে যদি হাত থেকে বেরিয়ে যায়, তাহলে বড় রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হতে পারে।’
‘আমরা দেখতে চাচ্ছি ঘটনার ভেতরের দিকটা, আর প্রেসিডেন্ট দেখছেন ঘটনার ফলাফলের দিকটা। আমার মনে হয় তিনি ঠিকই করছেন।’ বলল বিল বেকার।
‘হ্যাঁ, ইহুদী লবিটা প্রপাগান্ডার একটা অমুল্য অস্ত্র পেয়ে গেল। এখন তারা চেষ্টা করবে মি. শ্যারনদের বিরুদ্ধে আনিত কেসগুলো নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি করতে। তারা বলবে, কেসগুলোর পক্ষে যে ডকুমেন্ট যোগাড় করা হয়েছে, তার সবই ইহুদী বিদ্বেষী খুনি আহমদ মুসার সুদূর প্রসারী ষড়যন্ত্রের সৃষ্টি।’ কথা শেষ করার সাথে সাথে জর্জ আব্রাহামের একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল।
পাশ থেকে মোবাইলটা তুলে নিল জর্জ আব্রাহাম। ‘ওখানকার পুলিশকে আহমদ মুসাকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়ে দেই, আর আহমদ মুসার সাথেও কথা বলি।’ বলে জর্জ আব্রাহাম তার মোবাইলের ‘কি’ বোর্ডের দিকে তর্জনি এগিয়ে নিল।

তখন সকাল ৮টা।
সাগরিকা সেন ডা. বেগিন বারাকের গাড়ি বারান্দায় তার গাড়িটা পার্ক করে এক ঝটকায় গাড়ি থেকে বেরিয়ে গাড়ির দরজা বন্ধ না করেই পাগলের মত ছুটে গিয়ে প্রবেশ করল ডা. বারাকের ড্রইং রুমে। দেখল ডাক্তার বারাক সোফায় বসে আছে। দু’হাতের দু’কনুই হাটুতে রেখে দুহাতে মাথা চেপে ধরে সোফায় বসে আছে সে। তার সামনে টিপয়ে সেদিনের অনেকগুলো কাগজ।
সাগরিকা সেনের পায়ের শব্দে মুখ তুলল ডাক্তার বারাক। তার দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো সাগরিকা সেনের দিকে। কিন্তু তার মুখে সব সময়ের সেই হাসিটি ফুটে উঠল না। চোখে তার শূন্য দৃষ্টি। বিপর্যস্ত তার চেহারা।
সে উঠে দাঁড়িয়ে সাগরিকা সেনকে স্বাগতও জানাল না।
সাগরিকা সেন গিয়ে ডাক্তার বারাকের পাশের এক সোফায় মুখোমুখি হয়ে বসল। বসেই বলে উঠল, ‘আংকল পত্রিকা এসব কি লিখেছে?’
সংগে সংগেই উত্তর দিল না ডা. বারাক। ধীরে ধীরে সে মুখ ঘুরাল সাগরিকা সেনের দিকে। তার চোখে ভাবলেশহীন দৃষ্টি।
বেশ অনেক পরে ধীর কন্ঠে বলল, ‘শুধু তো পত্রিকা নয় সাগরিকা, সবগুলো টিভি চ্যানেল এই একই কথা বলেছে।’ শুষ্ক কন্ঠ ডাক্তার বারাকের।
‘কিন্তু এগুলো তো সত্য নয়, সত্য হতে পারে না।’ কান্নাজড়িত আর্তকণ্ঠ সাগরিকা সেনের।
‘একথা আমিও জানি। কিন্তু কে বিশ্বাস করবে?’ শুষ্ক দুর্বল কণ্ঠ ডাক্তার বারাকের।
‘ঘটনা ঘটেছে সাড়ে সাতটার দিকে। কিন্তু আহমদ মুসা সন্ধ্যা সোয়া ৭টা থেকে আনাপোলিশে আমাদের মাঝে ছিলেন। কি করে তিনি এই ঘটনার সাথে যুক্ত থাকতে পারেন?’ বলল সাগরিকা সেন তীব্র প্রতিবাদী কণ্ঠে।
জবাবে কোন কথা বলল না ডা. বারাক। তার মুখ নিচু। ভাবছিল সে। একটু পর মুখ তুলে ধীরে ধীরে বলল, ‘আমি খুবই উদ্বেগ বোধ করছি সাগরিকা। পত্র-পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলগুলোর রিপোর্ট আগুনের মত ছড়িয়ে পড়বে গোটা দেশে। আর সংগে সংগেই হিটলারী গণ-হত্যার সাথে ব্রাকেটেড করা হবে আহমদ মুসাকে। এক মুহুর্তেই তিনি হয়ে দাঁড়াবেন ইহুদী হন্তা এক হিটলার। হয়ে দাঁড়াবেন তিনি সভ্যতা ও মানবতার শত্রু। কাকে ক’জনকে বুঝাব আমরা আমাদের কথা!’
ভয় ও উদ্বেগে ফ্যাকাসে হয়ে উঠেছে সাগরিকা সেনের মুখ। সে কিছুক্ষণ কথা বলতে পারল না। বলল একটু সময় নিয়ে, ‘কিন্তু কিছু একটা করতে হবে। কি করা যায়………….।’ অসহায় কণ্ঠস্বর সাগরিকার। ভেঙে পড়েছে সে।
‘করার একটাই আছে। সেটা হলো আহমদ মুসার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণ করা।’ বলল ডা. বারাক। হতাশ কণ্ঠ তার।
‘কিভাবে?’ ত্বরিত প্রশ্ন ভেসে এল সাগরিকা সেনের কণ্ঠ থেকে।
‘জানি না।’ ডা. বারাক বলল।
খোলা দরজা দিয়ে ড্রইং রুমে প্রবেশ করল আহমদ মুসা। তার মুখে হাসি। এসে বসল ডা. বারাকের সামনের এক সোফায়। বলল, ‘সব কাগজের রিপোর্ট পড়া শেষ করে এলাম। রিপোর্টগুলোর তথ্য একই, উপস্থাপনা শুধু ভিন্ন।’
ডাক্তার বারাক ও সাগরিকা সেন কেউই কোন কথা বলল না। তাদের মুখ নিচু। তারা তাকাতে পারছিল না আহমদ মুসার দিকে। কি বলবে তাও মুখে আসছিল না।
আহমদ মুসাই আবার কথা বলল। বলল, ‘আমাকে নিয়ে আপনারা খুবই বিপদে পড়েছেন ডা. বারাক, তাই না?’ আহমদ মুসার মুখে নিশ্চিন্ত এক টুকরো হাসি।
ডা. বারাক এবং সাগরিকা সেন দু’জন একই সাথে মুখ তুলে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। তারা দেখল আহমদ মুসার মুখের নিশ্চিন্ত হাসিটা। বিস্ময় ফুটে উঠল দু’জনের মুখেই।
সোজা হয়ে বসল ডা. বারাক। বলল, ‘কি ঘটেছে আপনি কি ঠিক বুঝতে পেরেছেন মি. আহমদ মুসা?’ কণ্ঠে তার উদ্বেগ ঝরে পড়ল।
‘হ্যাঁ। আমেরিকানদের, কোটি কোটি পাশ্চাত্য ও বিশ্ববাসির ক্রোধ ও ঘৃণা প্রবলবেগে ধেয়ে আসছে আমার দিকে।’
‘তবু হাসতে পারছেন?’ প্রায় কান্না জড়িত কণ্ঠ সাগরিকা সেনের।
সংগে সংগে জবাব দিল না আহমদ মুসা।
ধীরে ধীরে তার মুখটা গম্ভীর হয়ে উঠল। সোজা হয়ে বসল আহমদ মুসা। বলল, ‘হাসতে পারছি কারণ, আল্লাহর উপর নির্ভর করা ছাড়া আমার এখন কোন করণীয় নেই। তাই আমি নিশ্চিন্ত। যা করার আল্লাহই করবেন।’
‘করণীয় নেই কেন?’ প্রশ্ন ছুটে এল সাগরিকা সেনের মুখ থেকে। আর্ত কণ্ঠ তার।
‘আমার করণীয় নেই।’
‘নেই কেন?’ আবার জিজ্ঞেস করল সাগরিকা সেন।
‘কিছু করতে হলে আমাকে বাইরে বেরুতে হবে। যেতে হবে নিউ হারমানে এবং অনেক জায়গায়। মিথ্যা প্রমাণ করতে হবে ডকুমেন্টগুলোকে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘বাইরে বেরুতে পারবেন না কেন?’ জিজ্ঞেস করল ডা. বারাক।
‘আমি কার্যত জর্জ আব্রাহাম জনসনের আতিথ্যে রয়েছি। সেখান থেকেই তাঁর গাড়ি নিয়ে আমি এখানে এসেছি। বর্তমান অবস্থায় আমি যদি তাঁকে কিছু না জানিয়ে এখান থেকে সরে পড়ি, তাহলে সেটা পালানো হবে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কেন টেলিফোনে তাঁকে এখনই জানিয়ে দিতে পারেন।’ সাগরিকা সেন বলল।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘আমি যদি জর্জ আব্রাহাম জনসন হতাম এবং তিনি আহমদ মুসা হতেন, তাহলে আমি আহমদ মুসাকে আমার হাতের মুঠোর বাইরে চলে যেতে দিতাম না। আমি ঠিক জানি না জর্জ আব্রাহাম জনসন এই মুহূর্তে কি ভাবছেন। কিন্তু আমাকে তাঁর গ্রেপ্তার করা বর্তমান পরিস্থিতির অপরিহার্য দাবী। আমার মনে হচ্ছে, আমি যদি তাকে এখন টেলিফোন করি, তবে তিনি আমাকে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বলবেন।’
বিস্ময় ফুটে উঠল ডা. বারাক ও সাগরিকা সেন দু’জনের চোখে-মুখেই। বলল সাগরিকা সেন, ‘জর্জ আব্রাহাম জনসন আপনাকে গ্রেপ্তার করবেন?’
‘এ ছাড়া তার কোন উপায় নেই। আমি তাদের কাষ্টোডিতে গেলে সরকারের উপর মানুষের রোষ কিছু কমবে। আর পালিয়ে গেলে সরকার নানা রকম অপপ্রচারের শিকার হবেন এবং বিপদে পড়বেন।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তিনি তার বিপদের কথা ভাববেন, আপনি আপনার বিপদের কথা ভাববেন না? তাঁকে বা সরকারকে বিপদ থেকে রক্ষার জন্যে আপনি গ্রেপ্তারী বরণ করবেন কেন?’ বলল সাগরিকা সেন। তীব্র ক্ষোভ ফুটে উঠল তার কণ্ঠে।
আহমদ মুসা কিছু বলতে যাচ্ছিল, এ সময় ঘরে প্রবেশ করল ডা. বারাকের কর্মচারী। তার চোখে-মুখে উদ্বেগ। বলল সে ডা. বারাককে লক্ষ করে, ‘স্যার ভোর থেকেই কিছু লোক বাড়ির চারদিকে ঘুরঘুর করছিল। এইমাত্র পুলিশ এসে বাড়ির চারদিকটা ঘিরে ফেলেছে।’
‘কি বলছ তুমি?’ ভীত স্বরে কথাটা বলেই তড়াক করে উঠে দাঁড়াল ডা. বারাক।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘প্লিজ ডা. বারাক উদ্বিগ্ন হবেন না। যা স্বাভাবিক, সেটাই ঘটেছে।’
সাগরিকা সেনের মুখ কাগজের মত সাদা হয়ে গেছে।
ডা. বারাক ধপ করে শোফায় বসে পড়ে বলল, ‘আমি এখনি জর্জ আব্রাহামকে টেলিফোন করব। তিনি কি আহমদ মুসাকে বন্দী করে এক পক্ষের মুখ বন্ধ করে দিয়ে একতরফাভাবে কেস চালাতে চান।’
বলে টেলিফোনের দিকে হাত বাড়াল ডা. বারাক।
ঠিক এ সময়েই টেলিফোনটা বেজে উঠল।
ডা. বারাক টেলিফোনের দিকে একটু ঝুঁকে পড়ে, স্পিকার-এর ‘কি’তে চাপ দিল।
সংগে সংগেই ওপার থেকে কণ্ঠ ভেসে এল, ‘হ্যালো, ডা. বারাক।’ কণ্ঠ জর্জ আব্রাহাম জনসনের।
‘হ্যালো, মি. জর্জ। গুড মর্নিং।’ বলল ডা. বারাক।
‘গুড মর্নিং। কেমন আছেন ডাক্তার?’
‘ভালো নেই। আপনার পুলিশ আমার বাড়ি ঘিরে বসে আছে।’ ডা. বারাকের কণ্ঠে ক্ষোভ ফুটে উঠল।
‘আমি দুঃখিত ডা. বারাক। খুবই দুঃখিত। আমি……।’
জর্জ আব্রাহামের কথায় বাধা দিয়ে ডা. বারাক বলল, ‘এসব ঢাক ঢোলের কিছুই প্রয়োজন ছিল না মি. জর্জ আব্রাহাম। ভোর থেকেই আহমদ মুসা গ্রেপ্তারী বরণ করার জন্যে বসে আছেন। আমরা হাজার চেষ্টা করেও তাকে সরে যেতে রাজী করাতে পারিনি।’ ডা. বারাকের ক্ষোভ এবার প্রায় কান্নায় রূপান্তরিত হলো।
‘আমি জানি ডা. বারাক। আমি আহমদ মুসাকে চিনি। যে আহমদ মুসা নিজের জীবন বিপন্ন করে মানুষের বিপদ মোচন করেন, সেই আহমদ মুসা কি করে চাইবেন আমার গায়ে আচড় লাগুক।’ ভারী কণ্ঠস্বর জর্জ আব্রাহাম জনসনের।
‘সেই আহমদ মুসাকে তাহলে গণহত্যার দায়ে গ্রেপ্তার করছেন কি করে?’ ক্ষোভের সাথে বলল ডা. বারাক।
‘আইনের দিক থেকে আপনি যেটা বলছেন, সেটাই ঠিক। কিন্তু আসল কথা হলো, আমরা তাঁকে গ্রেপ্তার দেখাচ্ছি পরিস্থিতিকে ঠান্ডা করার জন্যে। সামনে অবস্থা কি দাঁড়াবে জানি না, তবে আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি ডা. বারাক প্রয়োজনে আমি চাকুরী ছেড়ে দিয়ে আহমদ মুসার পক্ষে আইনি লড়াই-এ নামব।’ বলল জর্জ আব্রাহাম। প্রত্যয়দীপ্ত তার কণ্ঠস্বর।
মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল ডা. বারাকের এবং সাগরিকা সেনের। বলল ডা. বারাক, ‘ধন্যবাদ মি. জর্জ, অনেক ধন্যবাদ। আমার আর কোন ক্ষোভ নেই।’
‘ধন্যবাদ ডাক্তার। আহমদ মুসা কি আপনার পাশে?’
‘হ্যাঁ, আমার পাশে।’
‘তাঁকে টেলিফোনটা দিন।’
‘দিচ্ছি। আবার আপনাকে ধন্যবাদ।’ বলে ডা. বারাক টেলিফোন এগিয়ে দিল আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসা টেলিফোনটা সামনে নিয়ে সেদিকে একটু ঝুঁকে পড়ে বলল, ‘হ্যালো মি. জর্জ আব্রাহাম, কেমন আছেন?’
‘ভালো আছি বলতে পারছি না। জীবনে মনে হচ্ছে এতবড় সংকটে পড়িনি। নিউ হারমানের হত্যাকান্ড সরকারকে পাগল করে তুলেছে।’ জর্জ আব্রাহাম জনসন বলল।
‘আমি গ্রেপ্তার হয়েছি প্রচার হলে মানুষ কিছু শান্ত হবে, পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তা ঘটবে। কিন্তু আমার মত অনেকের সংকট বাড়বে। তবে আনন্দের বিষয় হবে যে, আপনি হাতের কাছে থাকায় আপনার সাহায়্য পাব।’ বলল জর্জ আব্রাহাম।
‘যদি বন্দীর সাহায্য করার মত আরো কিছু থাকে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘নিউ হারমানের গণহত্যার ঘটনা সম্পর্কে আপনার প্রাথমিক ধারণা কি মি. আহমদ মুসা?’
‘নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রা ভঙ্গের চেষ্টা করা হয়েছে।’ এক মুহূর্ত দেরী না করে বলল আহমদ মুসা।
‘নিজের নাক কাটা’র এই লোকরা কারা?’
‘নাক যাদের তারাই তো হবে।’
‘বুঝেছি। কিন্তু প্রমাণের কোন পথ দেখি না।’
‘তাহলে যার বা যাদের যাত্রা ভংগ হবার কথা, তাদের যাত্রা ভংগ হবে।’ বলল আহমদ মুসা। তার মুখে হাসি।
‘মি. আহমদ মুসা, একটা কঠিন কথা খুব সহজভাবে বললেন। জানেন, যা ঘটেছে তার শাস্তি কি হতে পারে?’
‘মিথ্যা প্রমাণ করতে না পারলে যা পরিণতি হবার তা হতেই হবে।’
‘মিথ্যা প্রমাণ করার ব্যাপারে আপনারও কিন্তু দায়িত্ব আছে।’ জর্জ আব্রাহাম বলল।
‘প্রমাণের বিষয়টা বাইরের ব্যাপার। আমি গ্রেপ্তার হবার পর বাইরের কোন কাজের দায়িত্ব আমার উপর বর্তায় না।’ বলল আহমদ মুসা।
‘মি. আহমদ মুসা, আপনি আইনত অন্তরীণ থাকলেও কার্যত আপনি আমাদের সহযোগী হবেন। আমরা আপনার সাহায্য চাই। আপনিই শুধু বিপদগ্রস্ত নন, আমেরিকাও বিপদগ্রস্ত। নিউ হারমানে যা ঘটেছে তার মূল যদি আমরা উপড়ে ফেলতে না পারি তাহলে ইহুদী প্রপাগান্ডা নিউ হারমানকে জার্মানীর ‘আসউইথ’-এ পরিণত করবে। আমেরিকায় আমরা এমন কিছু হতে দিতে পারি না।’ জর্জ আব্রাহাম বলল। আবেগ জড়িত উদ্বিগ্ন কণ্ঠ জর্জ আব্রাহামের।
আহমদ মুসার ঠোঁটে বেদনাজড়িত এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘মি. জর্জ জার্মানীর আসউইথে ইহুদী গণহত্যার রহস্য অর্ধশতাব্দীর বেশী সময়েও বের করা যায়নি। যারাই বের করতে গেছে তারা এক অদৃশ্য শক্তির দ্বারা বাধাগ্রস্ত হয়ে থেমে যেতে বাধ্য হয়েছে। নিউ হারমানে ইহুদী গণহত্যার এই রহস্যও উদ্ধার করা সহজ হবে না। আমি পত্রিকাগুলো পড়েছি। তাতে যে ডকুমেন্টগুলো তারা এনেছে, সেগুলো তারা সবদিক থেকেই অকাট্য করার চেষ্টা করেছে।’
‘তা ঠিক মি. আহমদ মুসা। কিন্তু অপরাধীরা কোন না কোন দূর্বলতা বা ফাঁক রেখে যায়ই। সেটাই আমাদের ভরসা।’
‘আল্লাহ আপনাদের সহায় হোন।’ বলে আহমদ মুসা মুহূর্তের জন্য থামল। পরক্ষণেই বলল, ‘আমি সারা জেফারসনের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন মি. জর্জ। আমি তাড়াতাড়ি আনাপোলিশে চলে এসেছি তার উদ্ধারের কাজ শুরু করার জন্যে।’
‘আমরা দুঃখিত আহমদ মুসা। তবে আমাদের সবগুলো নিরাপত্তা বিভাগ সারা জেফারসনের উদ্ধারের জন্যে কাজ করছে। আনাপোলিশে আপনি যদি কোন ক্লু পেয়ে থাকেন, আমাদের সাহায্য করতে পারেন।’ বলল জর্জ আব্রাহাম।
‘আমি আনাপোলিশে এসেছিলাম সাগরিকার বান্ধবী ও শশাংকের প্রেমিকা ইহুদী মেয়ে নোয়ান নাবিলাকে ফলো করার জন্যে। আমার বিশ্বাস সারা জেফারসন সম্পর্কে সে সবকিছু জানে। এ ব্যাপারে সাগরিকা আপনাদের সাহায্য করতে পারবে।’ থামল আহমদ মুসা।
বলল জর্জ আব্রাহাম ওপার থেকে, ‘সাগরিকা ওখানে আছে?’
‘আছে।’
‘ওকে দিন।’
বলেই জর্জ আব্রাহাম একটা দম নিয়ে আবার বলল, ‘তার আগে শুনুন মি. আহমদ মুসা, এখনি আপনি ওয়াশিংটনে আমাদের কাছে আসছেন।’
‘আমার দু’হাত হাতকড়া পরার জন্যে প্রস্তুত হয়ে আছে মি. জর্জ।’
বলে হেসে উঠল আহমদ মুসা।
‘আমি দুঃখিত মি. আহমদ মুসা।’ গম্ভীর ও বেদনাহত কন্ঠ জর্জ আব্রাহামের।
‘ধন্যবাদ জর্জ আব্রাহাম।’ বলে আহমদ মুসা টেলিফোন তুলে দিল সাগরিকা সেনের হাতে।

নোয়ান নাবিলার চোখ দু’টি খবরের কাগজের উপর নিবদ্ধ।
গোগ্রাসে গিলছে নোয়ান নাবিলা নিউজটা।
নিউজ পড়া শেষ হয়েছে।
কিন্তু তার চোখ দু’টি উঠে আসেনি খবরের কাগজ থেকে। তার শূন্য দৃষ্টি নিবদ্ধ খবরের কাগজে। বসে আছে সে পাথরের মত স্থির হয়ে।
তার সামনে গরম চা ঠান্ডা পানি হয়ে গেছে।
নোয়ান নাবিলার শূন্য দৃষ্টিতে ফুটে উঠেছে তখন গতকাল সন্ধ্যায় তার দেখা নিউ হারমানের গণহত্যার দৃশ্য। খবরের কাগজে যা লিখেছে তার চেয়ে সহস্রগুণ ভয়াবহ তা। লাল রক্তের স্রোত এবং লাশের স্তুপ তার চোখের সামনে আবার জীবন্ত হয়ে উঠল। শিউরে উঠলো নোয়ান নাবিলা। তার গোটা সণায়ুতন্ত্রীতে জাগল একটা শীতল শিহরণ। তার সাথে তার মনে ছুটে এল প্রশ্নের এক তীর-বিদ্ধ-ধাক্কা। আহমদ মুসা এই গণহত্যা সংঘটিত করেছে? ঠান্ডা মাথায় এক এক করে এই মানুষ মারার কাজ আহমদ মুসা করেছে?
জগত জোড়া ক্রোধ, ঘৃণায় ভরে গেল নোয়ান নাবিলার মন। হিটলার যেমন ছিল, আহমদ মুসাও তো সে ধরনেরই কশাই। কিন্তু কেন? হিটলারের একটা রাজ্য ছিল, কমপক্ষে গোটা ইউরোপ নিয়ে তার রাজ্য গড়ার শখ ছিল। তাই ইহুদীদের হত্যা করে তার দেশের, জাতির, রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি নিষ্কন্টক করা তার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু আহমদ মুসা মার্কিন ইহুদীদের উপর এই গণহত্যা চালাল কিসের আশায়? কোন প্রয়োজনে?
বিস্ময়ের শেষ নেই নোয়ান নাবিলার। আহমদ মুসাই, মার্কিন ইহুদীদের আজ কাঠগড়ায় তুলেছে। তার হিংসারতো প্রশমন ঘটার কথা। কিন্তু তা না হয়ে হিংসায় আরও উদ্দীপ্ত হয়ে উঠল কি করে?
কিন্তু আহমদ মুসা কি রক্ষা পাবে?
অপরাধ সে চাপা রাখতে পারেনি। ঘটনার নিউজের সাথে তার অপরাধও প্রকাশ হয়ে পড়েছে। তাকেও আইনের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে এবং সেটা গণহত্যার দায়ে। তার বাঁচার পথ নেই।
হঠাৎ নোয়ান নাবিলা প্রচন্ড ধাক্কা খেল তার চিন্তায়। তার মনে পড়ল গতকাল বিকেলে জেনারেল শ্যারন ও উইলিয়াম জোনসের আলোচনার কথা। জেনারেল শ্যারন তাকে বলেছিল, আহমদ মুসা মার্কিন ইহুদীদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। এই গণহত্যাই কি সেই ষড়যন্ত্র? আর জেনারেল শ্যারন উইলিয়াম জোনসের সাথে আলোচনায় বলেছিলেন, বিজয়ের আনন্দে আহমদ মুসা এমন কিছু করে বসবে যাতে সে আমেরিকানদের কাছে ঘৃণার পাত্রে পরিণত হবে। ‘এমন কিছু’ বলতে কি এই ঘটনার দিকেই ইংগিত করা হয়েছিল? এই ঘটনাতো নিশ্চিতই আহমদ মুসাকে আমেরিকানদের ঘৃণার পাত্রে পরিণত করবে। দেখা যাচ্ছে জেনারেল শ্যারনের গতকাল বিকেলের বলা কথা পরবর্তী রাতেই ফলে গেল। এমন নিশ্চিত কথা তিনি বললেন কি করে? এত নিখুঁতভাবে তিনি জানলেন কি করে আহমদ মুসার ষড়যন্ত্র এবং কি ষড়যন্ত্র সেই কথাও? তাছাড়া ষড়যন্ত্রের কথা জানার পর তো প্রতিকার-প্রতিরোধের পদক্ষেপ নেয়া উচিত ছিল। তা তিনি করেননি কেন?
আরেকটি ধাক্কা খেল নোয়ান নাবিলা তার চিন্তায়। খুব বড় হয়ে তার সামনে এসে দাড়াল জেনারেল শ্যারন ও শ্যারনের দক্ষিণ হস্ত ইহুদী স্পাই মাষ্টার বেন ইয়ামিনের কথোপকথন। ওরা একটা মিশনের কথা বলেছিলেন। যে মিশনটা যাত্রা করার কথা গতকাল সন্ধ্যা ৬টায়। যে মিশনটা কোন রেসিষ্ট্যান্সের সম্মুখীন হবে না ওরা বলছিলেন। এই ‘রেসিষ্ট্যান্স হবে না’ কথাটার ব্যবহার প্রমাণ করে মিশনটা আক্রমণাত্মক। ভাবল নোয়ান নাবিলা। ওদের কথোপকথনের মাধ্যমে একথা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে, মিশনটা যেখানে যাবে সেটা ইহুদী বসতি। এবং তা পূর্ব উপকূলের প্রথম ইহুদী বসতি যেখানে দি গ্রেট ডেভিড দানিয়েল জন্মগ্রহণ করেন।
এ কথা মনে হতেই শিউরে উঠল নোয়ান নাবিলা। দি গ্রেট ডেভিড দানিয়েল তো নিউ হারমানে জন্মগ্রহণ করেন এবং নিউ হারমানই এ অঞ্চলের সবচেয়ে পুরোনো ইহুদী বসতি। ভ্রু কুঞ্চিত হলো নোয়ান নাবিলার। তাহলে কি জেনারেল শ্যারন গত সন্ধ্যায় বেন ইয়ামিনদেরকে নিউ হারমানে কোন আক্রমণাত্মক মিশনে পাঠিয়েছিলেন যা আহমদ মুসার বিরুদ্ধে আমেরিকানদের মনে ঘৃণার সৃষ্টি করবে? ভীষণ কেপে উঠল নোয়ান নাবিলার বুক। নিউ হারমানের ইহুদী বসতিতে কি বেন ইয়ামিনরাই আক্রমণ করেছিল? সেখানকার গণহত্যা কি তাদের কাজ? নোয়ান নাবিলা মরিয়া হয়ে ভাবতে চেষ্টা করল, বেন ইয়ামিনদের মিশন ছিল নিউ হারমানে আহমদ মুসাদের আক্রমণ প্রতিরোধ করা কি। কিন্তু যুক্তিটা নোয়ান নাবিলা মেলাতে পারল না। অভিযানটা নিউ হারমানে আহমদ মুসার আক্রমণ ঠেকানোর জন্যে হলে বেন ইয়ামিন কেমন করে নিশ্চিতভাবে বলেছিল যে, সেখানে কোন রেসিষ্ট্যান্স হবে না। বেন ইয়ামিনের এই কথার অর্থ হলো, নিউ হারমান থেকে তাদের অভিযানের বিরুদ্ধে কোন রেসিষ্ট্যান্স হবে না এবং এটাই প্রমাণ হয়েছে নিউ হারমানের ইহুদী অধিবাসিরা কোন রেসিষ্ট্যান্স করতে পারেনি। জেনারেল শ্যারন ও বেন ইয়ামিনের গোটা কথোপকথনে তাদের মিশন আহমদ মুসাদের বিরুদ্ধে কিংবা তাদের মিশন মোকাবিলায় আহমদ মুসার কোন ভূমিকা থাকবে তার উল্লেখ নেই। বরং যে কথাটা তাদের বক্তব্যে এসেছে সেটা হলো, এমন কিছু ঘটবে যাতে আহমদ মুসা আমেরিকানদের ঘৃণার পাত্র হবে। অন্যকথায় নিউ হারমানের গণহত্যা ঘটনার দায় আহমদ মুসার উপর বর্তাবে। সেটাই বর্তেছে। এবং জেনারেল শ্যারনাই তাদের গণহত্যার দায় চাপিয়েছে আহমদ মুসার উপর।
তাহলে নিউ হারমানের কাজ কি কোন আত্মঘাতি কাজ? জেনারেল শ্যারনরা ইহুদী স্বার্থের রক্ষক সেজে নিরপরাধ ইহুদীদের ছাগল-ভেড়ার মত করে হত্যা করল? এই প্রশ্ন নোয়ান নাবিলার গোটা সত্তা, সমস্ত সণায়ুতন্ত্রীতে যেন আগুন ধরিয়ে দিল।
হাতের কাগজটা ছুড়ে ফেলে লাফ দিয়ে উঠে দাড়াল নোয়ান নাবিলা।
অস্থিরভাবে সে পায়চারি করতে লাগল।
তার কাছে অসহনীয় হয়ে উঠেছে এই জ্বালা যে, আমাদের কম্যুনিটির শীর্ষস্থানীয় যারা কম্যুনিটির স্বার্থরক্ষার জন্যে কাজ করছে তারাই নৃশংসভাবে হত্যা করল কম্যুনিটির লোকদের। অবিশ্বাস্য এটা! কি করে এটা সম্ভব হতে পারে! তার হিসেবে কি কোন ভুল হচ্ছে? সে কি জেনারেল শ্যারন ও বেন ইয়ামিনের কথার ভুল অর্থ করছে? আসলেই বেন ইয়ামিনের মিশন নিউ হারমান না হয়ে অন্য কোথাও ছিল? আহমদ মুসাকে ঘৃণার পাত্র করার মত ঘটনা আরও কোথাও ঘটবে? নিউ হারমানের ঘটনা কি কাকতালীয়ভাবে মিলে গেছে জেনারেল শ্যারন ও বেন ইয়ামিনের কথার সাথে?
নিউ হারমানকে নিয়ে এইভাবে হাজারো কথা ভাবতে গিয়ে হঠাৎ নোয়ান নাবিলার মনে পড়ল নিউ হারমানে একজন নিহত ব্যক্তির কাছ থেকে নেয়া ভিডিও ক্যাসেটের কথা। ওতে কি আছে? কেন মৃত লোকটির হাতে ওটা ছিল?
ক্যাসেটটা জ্যাকেটের পকেটেই ছিল।
ছুটে গেল নোয়ান নাবিলা। ক্যাসেট নিয়ে ফিরে এল। ওটা কম্পিউটারে ঢুকিয়ে সুইচ অন করে সোফায় এসে বসল সে।
কম্পিউটার স্ক্রীনে দৃশ্য ফুটে উঠার সাথে সাথেই গুলীর অনেকগুলো শব্দ শুনতে পেল নোয়ান নাবিলা। শব্দগুলোর কোনটা খুব কাছের, কোনটা অপেক্ষাকৃত দূর থেকে ভেসে আসা। সেই সাথে শুনতে পেল মানুষের কান্না ও চিৎকার।
শব্দের সাথে সাথে স্ক্রীনে যে দৃশ্যটি ফুটে উঠল তাতে সে দেখল দু’জন পৌঢ় নারী পুরুষ, একজন যুবতি ও একজন শিশু একটা দরজা দিয়ে ছুটে এসে একটা বড় ঘরে প্রবেশ করল।
ঘরটি একটা বড় শোবার ঘর।
ঘরে একটা বড় খাট। ঘরের এক কোণে ছোট একটা রাইটিং টেবিল। খাটের শিয়রে দেয়ালে টাঙানো একটা পেইন্টিং। রাইটিং টেবিলের পাশে দেয়ালে একটা আলমিরা।
দৌড়ে সবচেয়ে শেষ ঘরে প্রবেশ করেছে প্রৌঢ় লোকটি। সে ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করতে চাইল। কিন্তু পারল না। এক ঝাঁক গুলী এসে দরজাটাকে ছিটকে খুলে দিল। আর গুলীর ঝাঁকে পড়ে গেল পৌঢ় লোকটি।
গুলীতে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া দেহ নিয়ে দরজাতেই পড়ে গেল লোকটি।
প্রৌঢ়ের সাথের অন্যেরা তখন মেঝেতে শুয়ে পড়েছে।
গুলী ছুড়তে ছুড়তে একজন লোক ঘরে ঢুকল। লাথি মেরে দরজার সামনে থেকে প্রৌঢ়ের লাশটি এক পাশে একটু ঠেলে দিয়ে মেঝেয় শুয়ে পড়া প্রৌঢ়া মহিলা, যুবতি ও শিশুর দিকে এগুলো। তার ষ্টেনগানের ব্যারেল একটু নিচু করে তাক করল তাদেরকে।
ওদের কারো মুখে তখন আর কান্না নেই।
ভয়ে কুঁকড়ে গেছে ওরা সবাই। ভয়ে চোখগুলো ওদের যেন বেরিয়ে আসতে চাইছে।
লোকটার ষ্টেনগানের নল গুলী বর্ষণ করল। গুলীর ঝাঁক গিয়ে ঘিরে ধরল ওদের তিনজনকে।
মুহুর্তেই রক্তের বন্যায় ডুবে গেল ওরা।
হঠাৎ মাথা ঘুরিয়ে ষ্টেনগানধারী লোকটি ডানদিকে ডাকাল এবং তীব্র কণ্ঠে বলে উঠল, ‘কোন হারামজাদার বাচ্চা তুমি দেখাচ্ছি মজা।’ তার ষ্টেনগানের নল চোখের পলকে ডানদিকে ঘুরে গেল। আর সেই সাথেই নড়ে গেল দৃশ্য। অন্তর্হিত হয়ে গেল ঘরের দৃশ্য। তার বদলে ঝড়ের বেগে একের পর এক দৃশ্য আসছে আর মিলিয়ে যাচ্ছে। কখনও দেয়ালের ছবি কখনো করিডোরের ছবি, ইত্যাদি।
বুঝা গেল ক্যামেরাম্যান পালাচ্ছে।
এক সময় দৃশ্য উঠে গেল।
অন্ধকার নেমে এল কম্পিউটার স্ক্রীনে।
এসব দেখছিল বটে নোয়ান নাবিলা। কিন্তু ষ্টেনগানধারীকে দেখার পর বিস্ময় বিস্ফোরিত নোয়ান নাবিলার শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা।
কম্পিউটার স্ক্রীনে ষ্টেনগান হাতে গুলী করতে করতে বেন ইয়ামিনকে ঘরে ঢুকতে দেখে প্রথমে ভুত দেখার মত আঁৎকে ওঠে নোয়ান নাবিলা। দৃশ্যটা তার বিশ্বাস হতে চায়নি। মনে হয়েছে সে যেন এক দুঃস্বপ্ন দেখছে।
কিন্তু দুঃস্বপ্ন তো নয়।
সে সকাল থেকে নিজের বাড়িতে বসে গত সন্ধ্যায় নিউ হারমান থেকে উদ্ধারকৃত ভিডিও ক্যাসেটটি বারবার দেখছে তার নিজের কম্পিউটার স্ক্রীনে।
আরও অবাক হলো নোয়ান নাবিলা যে, গতকাল বিকেলে জেনারেল শ্যারনের সাথে সাক্ষাতের সময় বেন ইয়ামিনকে যে কালো পোশাকে দেখেছিল, এখানে সে পোশাকেই দেখছে।
দৃশ্যটার দর্শন শুরু হলে নোয়ান নাবিলা উত্তেজিত অবস্থায় দাঁড়িয়ে পড়েছিল, এখন ধপ করে বসে পড়ল। তার দেহের সমস্ত শক্তি যেন কোথায় উবে গেল। দেহের যেন এক ফোটা ওজনও তার নেই। তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লেও এতটা বিস্মিত হতো না যতটা বিস্মিত হয়েছে সে বেন ইয়ামিনকে নিজ হাতে তার ইহুদী ভাইদের নৃশংসভাবে খুন করতে দেখে।
তার কেবলই মনে হতে লাগল, জেনারেল শ্যারন, বেন ইয়ামিনরা কারা? তাদের আসল পরিচয় কি? ওরা ইহুদী, কিন্তু কি চায় ওরা? ওরা আহমদ মুসাকে ধ্বংস করতে চায়, কিন্তু সেটা কি নিউ হারমানের নারী, শিশু বৃদ্ধ নির্বিশেষে সকলকে হত্যা করে তার দায় আহমদ মুসার ঘাড়ে চাপিয়ে? এদের তুলনায় আহমদ মুসা তো দেবতুল্য নিষ্পাপ। আহমদ মুসা এক মুসলমান হওয়া ছাড়া তার কোন অপরাধ দেখি না। সে তার জাতির জন্যে কাজ করে বটে, কিন্তু অন্য জাতির ক্ষতি করে নয়। দু’একটি ঘটনায় সে আহমদ মুসাকে নিকট থেকে দেখেছে। আহমদ মুসা আত্মরক্ষার প্রয়োজন ছাড়া কাউকে হত্যা করেনা। আহমদ মুসাকে ধরা অথবা হত্যা করার জন্যেই নাবিলা ইহুদী কমান্ডোদের নিয়ে এসেছিল ডা. বেগিন বারাকের বাড়িতে। এদিক থেকে নোয়ান নাবিলাকে আহমদ মুসা জানের শত্রু মনে করার কথা। কিন্তুও সে সাগরিকাকে বলেছে, নোয়ান নাবিলা যেটা করেছে, তার জায়গায় আমি হলে আমিও সেটাই করতাম। কোন দিক দিয়েই সে অন্যায় কিছু করেনি। আহমদ মুসার এই মানবিকতার পাশে জেনারেল শ্যারন বেন ইয়ামিনরা একেবারেই অমানুষ।
ভীষণ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠল নোয়ান নাবিলার মন। ডা. বারাক আংকেলরা ঠিকই বলেন, জেনারেল শ্যারন, ডেভিড উইলিয়াম জোনস এবং বিজ্ঞানী জন জ্যাকবরা মার্কিন ইহুদীদের জন্যে ‘শনি’ হিসাবে আবির্ভূত হয়েছেন। ওরা মার্কিন ইহুদীদের একটা পলিটিক্যাল ইউনিটে পরিণত করতে চাচ্ছে যাদের একমাত্র লক্ষ মার্কিন জনগণের উপর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা। নোয়ান নাবিলার মনে হলো, এটা অন্যায় ও অসংগত একটা অভিলাষ। অন্যায় অসংগত বলেই এই লক্ষ অর্জনের পথে নিউ হারমানের নিরপরাধ স্বজাতিকে তাদের খুন করতে হলো। ডা. বারাক ইহুদী হয়েও ঘৃণা করেন জেনারেল শ্যারনদের এবং ভালোবাসেন আহমদ মুসাকে। মনে পড়ল ডা. বারাকের কথা। তিনি বলেন, মুসলমানদের কোন ইসরাইল নেই, প্রমিজড ল্যান্ড নেই। তাই তাদের নেই কোন পিছু টান। তারা যে দেশে যায়, সে দেশেরই হয়ে যায়…………।
‘নাবিলা।’ পেছন থেকে ডেকে উঠল শশাংক সেন।
চিন্তা সূত্র ছিন্ন হয়ে গেল নোয়ান নাবিলার।
ঘুরে বসল সে।
‘হ্যালো নাবিলা কেমন আছ?’ বলে শশাংক এসে নাবিলার পাশে বসে তাকে জড়িয়ে ধরল। বলল, ‘ডার্লিং তোমাকে কিন্তু খুব বিমর্ষ দেখাচ্ছে।’
প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে নোয়ান নাবিলা বলল, ‘তুমি তো এ সময় আস না, ব্যাপার কি?’
‘তুমি খুব খুশী হবে, এমন একটা খবর তোমাকে দিতে এসেছি।’
‘কি খবর?’ বলল নাবিলা।
‘আহমদ মুসার খুব বিপদ। খবর তুমি নিশ্চয় আজকের কাগজে পড়েছো। সাগরিকা কিছুক্ষণ আগে টেলিফোনে বলল, আহমদ মুসা নিউ হারমানে গণহত্যার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়ে যাচ্ছে। এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম। ভাবলাম বলে যাই তোমাকে খবরটা।’
চমকে উঠল নোয়ান নাবিলা।
কিন্তুও নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘তোমার জন্যে এটা তো খুশীর খবর নয়।’
‘অবশ্যই না। আমি মনে করি আহমদ মুসাকে অন্যায়ভাবে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। সে এ কাজ করতেই পারে না।’
মনে আবার একটা খোঁচা খেল নোয়ান নাবিলা। অস্থির একটা ভাবনা জাগল তার মনে, কে অপরাধ করেছে, আর কে পাকড়াও হচ্ছে। এই প্রথম বারের মত আহমদ মুসার জন্যে একটা দরদের সৃষ্টি হলো নোয়ান নাবিলার মনে। সে ভাবল নিউ হারমান থেকে পাওয়া ক্যাসেটের কথা শশাংক সেনকে বলা দরকার।
মুখ খুলেছিল নাবিলা শশাংককে বলার জন্যে। এ সময় কলিংবেল বেজে উঠল।
কথা বলা হলো না নাবিলার। সে উঠে গিয়ে গেট-ইন্টারকমের সুইচে চাপ দিয়ে বলল, ‘হ্যালো ওখানে কে?’
‘গুড মর্নিং। আমি জেনারেল শ্যারন ম্যাডাম। আপনার সাথে আমার জরুরী কাজ আছে।’ ও প্রান্ত থেকে কথা ভেসে এল।
জেনারেল শ্যারনের কণ্ঠ শুনেই মুখ অন্ধকার হয়ে গেল নোয়ান নাবিলার।
কিন্তু মুহুর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে গেট ওপেনের সুইচে চাপ দিয়ে বলল ‘গুড মর্নিং স্যার। ভেতরে এসে ড্রইং-এ বসুন। আমি নিচে আসছি।’ বলে অফ করে দিল গেট-ইন্টারকম।
নোয়ান নাবিলার দিকে বিস্মিত চোখে তাকিয়ে আছে শশাংক সেন। বলল, ‘নাবিলা তোমাকে খুব বিমর্ষ ও ভীত দেখাচ্ছে। তুমি কি অসুস্থ? শশাংকের কণ্ঠে উদ্বেগ।
নাবিলা ধীরে ধীরে চোখ তুলল শশাংকের দিকে বলল, ‘বিপদ শুধু আহমদ মুসার নয়। বিপদ মার্কিন ইহুদীদেরও। জেনারেল শ্যারনদের ষড়যন্ত্র আমাদের ধ্বংস করবে। তোমাকে সব কথা বলার সময় নেই। জেনারেল শ্যারন এসেছেন, আমি নিচে যাচ্ছি।’
কথা শেষ করেই নাবিলা কম্পিউটারের দিকে এগুলো। কম্পিউটার থেকে একটা ক্যাসেট বের করে শশাংকের দিকে তুলে ধরে বলল, ‘এই ক্যাসেটটা নাও। ক্যাসেটটা সাগরিকা অথবা আহমদ মুসার হাতে পৌছাতে হবে। মনে রেখ? এই ক্যাসেটের মুল্য আমার, তোমার জীবনের চেয়ে অনেক বেশী।’
নোয়ান নাবিলার অবস্থা দেখে শশাংকের মুখে বিস্ময় লেগেই ছিল। এবার সেখানে উদ্বেগ দেখা দিল। বলল, ‘এত মুল্যবান জিনিস। তাড়াহুড়া কেন। তুমিই ওদের কাছে এটা পৌছে দিও। আমি অন্য এক জায়গায় যাবার জন্যে বেরিয়েছি।’
নোয়ান নাবিলার চোখ-মুখ উদ্বেগে ভরে গেল। বলল, ‘না শশাংক। ক্যাসেটটা নিয়ে এক্ষনি তোমাকে চলে যেতে হবে। হঠাৎ করে এখানে এ সময় জেনারেল শ্যারনের আগমনের কারণ বুঝতে পারছি না। আমার ভয় করছে। জেনারেল শ্যারন যে কোন মুল্যে এই ক্যাসেট হাত করতে চাইবে। তুমি এই মুহুর্তে ক্যাসেটটি এই বাড়ি থেকে সরিয়ে নিয়ে যাও।’
শশাংকের চোখেও ভয়ের চিহ্ন ফুটে উঠল। বলল, ‘তোমার কোন বিপদ হবে না তো?’
‘আমি কিছুই বুঝতে পারছি না শশাংক। যাই হোক। আহমদ মুসাকে এবং মার্কিন ইহুদীদের বাঁচাতে হবে। ক্যাসেট তুমি তাড়াতাড়ি আহমদ মুসার হাতে পৌছাও।’
‘আমিও তোমার কিছুই বুঝতে পারছি না নাবিলা।’
‘ক্যাসেটটি আহমদ মুসাকে দাও, উনিই সব বুঝিয়ে দেবেন। যাও তুমি, আমি নিচে নামার আগেই তোমাকে বেরিয়ে যেতে হবে।’ অনুনয়ের সুরে বলল নোয়ান নাবিলা।
ক্যাসেটটি হাতে নিয়ে নোয়ান নাবিলার দিকে একবার গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘যাচ্ছি ডার্লিং। গড ব্লেস ইউ।’
শশাংক ঘুরে দাঁড়িয়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
শশাংক বেরিয়ে যাবার কিছু পরে নোয়ান নাবিলা নিচে নেমে এল।
সিড়ি মুখের বিরাট হল ঘরটাই ড্রইং রুম।
‘দুঃখিত স্যার। একটু ঝামেলায় ছিলাম। সেরে আসতে দেরী হলো।’ মুখে হাসি টেনে বিনয়ের সাথে বলল নোয়ান নাবিলা।
‘না, না। অল রাইট। আমিই বরং অসময়ে বিনা নোটিশে এসে গেছি। এটা ঠিক হয়নি। কিন্তু কি করব জরুরী পরিস্থিতি তো!’ বলল জেনারেল শ্যারন।
জেনারেল শ্যারনের কথায় পুরান অস্বস্তিটা বাড়ল নোয়ান নাবিলার।
ভেতরের ভাবটা চেপে নাবিলা বলল, ‘বলুন স্যার। নিশ্চয় কোন জরুরী ব্যাপার?’
‘নাবিলা, আমরা নিউ হারমানের ব্যাপারে তথ্য যোগাড় করতে শুরু করেছি। খবর পেয়েছি, শয়তান আহমদ মুসা জঘন্য গণহত্যা সংঘটিত করার পর তুমিই প্রথম নিউ হারমানে গেছ সেই জন্যেই তোমার কাছে ছুটে এসেছি। তোমার কাছ থেকে কিছু জানা দরকার।’
‘হ্যাঁ, আপনার ওখান থেকে বেরিয়ে একজন ফ্রেন্ডের বাসায় গিয়েছিলাম। সেখান থেকে বাসায় ফেরার পথে ঐ ঘটনার মুখে পড়েছিলাম।’ খুব সহজ কণ্ঠে বলল নোয়ান নাবিলা।
‘তুমি কি দেখলে, কি বুঝলে, তোমার এই কথাগুলো আমাদের জন্য খুবই মুল্যবান।’ জেনারেল শ্যারন শান্ত ও উদগ্রীব কণ্ঠে বলল।
নোয়ান নাবিলা ভাবল, ধড়িবাজ শ্যারনের লোকরা হয়তো তাকে দেখে থাকবে, এমনকি তাকে হয়তো ফলোও করেছে। সবই তারা দেখেছে। এখন তাকে বাজিয়ে দেখতে এসেছে, আমি তাদেরকে কতটুকু দেখেছি। সুতরাং তার সব কথাই বলা দরকার। এই চিন্তা করে নোয়ান নাবিলা বলল, ‘দু’একটা গুলীর শব্দ ও চিৎকারের শব্দে আমি গাড়ি থামাই। যেহেতু শব্দগুলো নিউ হারমানের বিভিন্ন দিক থেকে আসছিল। আমার সন্দেহ হওয়ায় গাড়ি থেকে নামি। এই সময় নিউ হারমানের বিভিন্ন স্থান থেকে কয়েকটা গাড়িকে আমি দ্রুত বের হয়ে যেতে দেখি। এর পরই দেখতে পাই, একজন লোক টলতে টলতে রাস্তার দিকে এগিয়ে আসছে। দেখে আমার মনে হলো, লোকটি আহত। আমি দ্রুত তার দিকে এগুলাম। কিন্তু আমি তার কাছে পৌছার আগেই সে মাটিতে পড়ে গেল। আমি ছুটে গিয়ে তার কাছে যখন বসলাম তখন তার দেহ নিশ্চল-নিথর। আমি হাত দিয়ে পরীক্ষা করে বুঝলাম যুবকটি মারা গেছে। সে ছিল গুলী বিদ্ধ।
আমি উঠে দাড়ালাম। সেই সময় আমার চোখে পড়ল, যুবকটির ডান হাত সামনের দিকে ছড়ানো। তার হাতে একটি ক্যাসেট……………।’
নোয়ান নাবিলার মুখের কথা শেষ না হতেই জেনারেল শ্যারন দ্রুত কণ্ঠে বলে উঠল, ‘ক্যাসেট?’
নোয়ান নাবিলা ধীর কণ্ঠে বলল, ‘হ্যা ক্যাসেট।’
‘ক্যাসেট তোমার কাছে?’ হাতে আকাশের চাঁদ পাওয়ার মত বলে উঠল জেনারেল শ্যারন।
‘বলছি।’
বলে নোয়ান নাবিলা আবার শুরু করল, ‘গুলীর শব্দ শোনা চিৎকার, তারপর এই যুবককে গুলীবিদ্ধ দেখে আমার আন্টির কথা মনে……।’
‘এসব কথা পরে শুনব, আগে বল ক্যাসেটটা কোথায়, তোমার কাছে?’ জেনারেল শ্যারন নোয়ান নাবিলার কথায় বাধা দিয়ে বলে উঠল। তার অধৈর্য্য কণ্ঠ।
এই ভাবে বাধা পেয়ে নোয়ান নাবিলা বিব্রত হয়ে পড়েছিল। তাছাড়া জবাবে কি বলবে, সেটাও রেডি ছিল না। কি বলবে তা ঠিক করতে একটু সময় গেল। বলল সে, ‘আমি ওটা পুলিশকে দিয়েছি। আমি আহত আন্টিকে নিয়ে ফেরার পথে পুলিশ আমাকে আটকেছিল। আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল। আমি তাদের ক্যাসেট দিয়ে বলেছিলাম। একজন মুমুর্ষ লোক মনে হয় এটা কাউকে পৌছবার চেষ্টা করছিল। আমার মনে হয়েছিল পুলিশের ওটা কাজে লাগতে পারে।’
ক্রোধে জেনারেল শ্যারনের চোখ মুখ লাল হয়ে উঠেছিল। ক্রোধ ও ক্ষোভের একটা তীব্র ঝড় এক সাথে তার ভেতর থেকে বের হতে যাচ্ছিল। ফলে সে প্রায় বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিল। মুহূর্ত কয়েক পরে বলল, ‘পুলিশকে দিয়েছ? পুলিশের নাম চেহারা মনে আছে?’ গর্জন করে উঠল জেনারেল শ্যারনের কণ্ঠ।
‘চারদিকের অবস্থায় তখন আমি দারুণ ভীত। আহত আন্টিকে নিয়ে ব্যস্ত। তার উপর পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করায় আমি আরও বিব্রত হয়ে পড়েছিলাম। মনের এ অবস্থা নিয়ে আমি পুলিশের মুখের দিকে মাত্র একবার তাকিয়েছিলাম। তার চেহারা আমার মনে নেই।’ কথাটা এইভাবে বলতে পেরে খুশি হলো নোয়ান নাবিলা। মিথ্যাটা সত্যের মতই হয়েছে।
নোয়ান নাবিলার কথা শুনে মুখটি চুপসে গেল জেনারেল শ্যারনের। উদ্বেগের চিহ্নও তার চোখে-মুখে স্পষ্ট হয়ে উঠল। বলল, ‘ঐ মৃত লোকটি একজন সাংবাদিক। ঐ ক্যাসেটে শয়তান আহমদ মুসাদের সম্পর্কে জীবন্ত সাক্ষ্য পাওয়া যাবে। ক্যাসেটটা আমাদের অবশ্যই চাই। নিউ হারমানে গতকাল যেসব পুলিশ অফিসার গিয়েছিল, তাদের যদি ছবি দেখ বলতে পারবে না?’
‘বলা মুষ্কিল। একেতো রাত, তার উপর তার মাথায় হ্যাট ছিল। হ্যাটের ছায়া ছিল তার চোখে-মুখে। উপরন্তু মুখটা তার আমি ভাল করে দেখিনি।’ দ্বিধাগ্রস্ত কণ্ঠে বলল নোয়ান নাবিলা।
‘না তাকে খুঁজে পেতেই হবে নাবিলা এবং আজকেই। তুমি তার কণ্ঠ শুনলে অবশ্যই চিনতে পারবে।’ কণ্ঠটা কঠোর শুনাল জেনারেল শ্যারনের।
কথা শেষ করেই জেনারেল শ্যারন তার হাতের মোবাইলে একটা কল করল।
তারপর মোবাইলটা কানে তুলে নিয়ে বলল, ‘গুড মর্নিং বেন ইয়ামিন। শুন, গতকাল যে পুলিশ অফিসাররা নিউ হারমানে গিয়েছিল, তাদের সবার কণ্ঠ আমাদের দরকার। কারা গিয়েছিল তা তো আমরা জেনেই গেছি। আমাদের অডিও লাইব্রেরীতে যদি তাদের কণ্ঠ না থাকে, তাহলে পুলিশ রেকর্ড থেকে এখনি তোমাকে যোগাড় করে আনতে হবে। পারবে না?’
‘অবশ্যই। রেকর্ড কিপার অফিসার আমাদের লোক। বলে দিচ্ছি। আপনি এলেই পেয়ে যাবেন।’ বলল ওপার থেকে বেন ইয়ামিন।
‘ধন্যবাদ বেন। আমি আসছি। বাই।’
বলে জেনারেল শ্যারন মোবাইল অফ করে দিয়ে তাকাল নোয়ান নাবিলার দিকে। বলল, ‘নাবিলা, তোমাকে যেতে হবে আমার সাথে।’ তার কণ্ঠে সুস্পষ্ট নির্দেশ।
নোয়ান নাবিলার মুখ চুপসে গেল। ভয়ও পেল সে। বলল সে, ‘কিন্তু স্যার। এখন তো আমার যাওয়া হবে না।’
‘না, কোন কথা নয়। তোমাকে যেতেই হবে।’ গর্জন করে উঠল যেন জেনারেল শ্যারনের গলা।
‘আমার আব্বা আম্মা দু’জনেই সকালে বাইরে গেছেন, তারা না ফেরা পর্যন্ত……..।’ কথা শেষ না করেই থেমে গেল নোয়ান নাবিলা। ভয় মিশ্রিত তার কণ্ঠ।
‘না নাবিলা। এখনি আমার সাথে তোমাকে যেতে হবে। এখন প্রতিটি সেকেন্ড আমাদের কাছে এক একটি বছর।’
বলে উঠে দাড়াল জেনারেল শ্যারন।
শুধু ভয় পাওয়া নয়, ভেতরটা তখন কাঁপতে শুরু করেছে নোয়ান নাবিলার। তার চোখে ফুটে উঠেছে নিউ হারমান হত্যার দৃশ্য। নাবিলার চোখে জেনারেল শ্যারনরা কশাই ছাড়া আর কিছুই নয়। তার মিথ্যা ধরা পড়লে তাকে হত্যা করতে এক মুহুর্তও দেরী করবে না।
আনমনা হয়ে পড়েছিল নোয়ান নাবিলা।
জেনারেল শ্যারন তাকে হাত ধরে টেনে তুলল। বলল, ‘এক মুহূর্তও আমি দেরী করতে পারছি না।’
নোয়ান নাবিলা শংকিত হয়ে পড়ল। তাকে জেনারেল শ্যারন জোর করেই নিয়ে যাবে। নিজের ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বেগ বোধ করল নোয়ান নাবিলা। হঠাৎ তার মাথায় একটা চিন্তা ঝিলিক দিয়ে উঠল, তাকে যেখানে যেখানে নিয়ে যেতে পারে, তার ঠিকানা শশাংকের কাছে রেখে যাওয়া দরকার। তাহলে উপরে গিয়ে তাকে টেলিফোন করতে হবে মোবাইলে। এবার মনে একটু সাহস ফিরে পেল সে। বলল, ‘স্যার, আপনি একটু দাঁড়ান। আমি কাপড় পাল্টে আসি।’
নোয়ান নাবিলার পরণে তখনও ব্রেকফাস্টের পোশাক। সুতরাং জেনারেল শ্যারন সময় দিতে আপত্তি করল না।
নোয়ান নাবিলা উপরে উঠে গেল।

ডা. বেগিন বারাক ও সাগরিকা সেন পাথরের মত বসেছিল।
শশাংক প্রবেশ করল।
শশাংককে দেখেই সাগরিকা সেন বলে উঠল, ‘শশাংক আহমদ মুসাকে এফবিআই পুলিশরা গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেল।’ ভারী কণ্ঠস্বর সাগরিকা সেনের।
শশাংক সাগরিকা সেনের পাশে বসতে বসতে বলল, ‘আমি কিছু বুঝতে পারছি না দিদি। ওদিকে জেনারেল শ্যারন নাবিলাকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে গেল।’ শুষ্ক কণ্ঠে বলল শশাংক সেন।
‘জেনারেল শ্যারন নাবিলাকে ধরে নিয়ে গেল? অবিশ্বাস্য কথা বলছ তুমি শশাংক।’ বিস্মিত কণ্ঠে বলল সাগরিকা সেন।
‘অবিশ্বাস্য, কিন্তু সত্য দিদি। একটা ভিডিও ক্যাসেটের সন্ধানে এসেছিল জেনারেল শ্যারন নাবিলার কাছে। তার আসার কথা জানতে পেরেই নাবিলা তাড়াতাড়ি ক্যাসেটটি আমার হাতে পাঠিয়ে দিয়েছে তোমাকে অথবা আহমদ মুসাকে দেবার জন্যে। ক্যাসেটটি উদ্ধারের জন্যে নাবিলাকে জেনারেল শ্যারন ধরে নিয়ে গেছে।’
‘ক্যাসেটে কি আছে শশাংক?’ বিস্মিত কণ্ঠে দ্রুত জিজ্ঞেস করল সাগরিকা সেন।
‘জানি না। জেনে নেবার সময়ও দেয়নি আমাকে নাবিলা। তবে নাবিলা বলেছে, তার ও আমার জীবনের চেয়েও ক্যাসেটটি মুল্যবান। জেনারেল শ্যারন যে কোন মুল্যে ক্যাসেটটি উদ্ধার করতে চাইবে।’ শশাংক বলল।
ভ্রুকুঞ্চিত হলো সাগরিকা সেন ও ডা. বেগিন বারাকের। উদগ্রীব কণ্ঠে ডা. বারাক বলল, ‘ক্যাসেট কাকে দিতে বলেছে, সাগরিকা বা আহমদ মুসাকে?’
‘হ্যাঁ।’ বলল শশাংক।
‘তাহলে ওতে সাংঘাতিক কিছু আছে সাগরিকা।’ ডা. বারাক বলল।
‘আমারও তাই মনে হয়। চলুন ক্যাসেটে কি আছে দেখা যাক।’ বলল সাগরিকা সেন।
তারা উঠে এল কম্পিউটার টেবিলে।
শশাংক কম্পিউটার চালু করে দিয়ে ক্যাসেটটা কম্পিউটারে সেট করে তারপর সাগরিকা সেনের পাশে এসে বসল।
নিউ হারমানের সেই দৃশ্যাবলী কম্পিউটার স্ক্রীনে একের পর এক ফুটে উঠতে লাগল।
ঘরে পিনপতন নিরবতা।
ওরা গোগ্রাসে গিলছে দৃশ্যগুলো।
এক সময় নিরবতা ভেঙে খান খান হয়ে গেল ডা. বারাকের চিৎকারে। সে চিৎকার করে বলে উঠল, ‘গুলী করছে ঐ লোকটি বেন ইয়ামিন। জগৎবিখ্যাত ইহুদী গোয়েন্দা। জেনারেল শ্যারনের দক্ষেণ হস্ত।’ উত্তেজিত কণ্ঠস্বর ডা. বারাকের।
ডা. বারাকের উত্তেজিত কণ্ঠ আবার ধ্বনিত হলো, ‘ঘটনা কোথাকার? নিউ হারমানের?’
চমকে উঠল সাগরিকা ও শশাংক সেন দু’জনেই। তারা এক সাথেই মাথা ঘুরিয়ে তাকাল ডা. বারাকের দিকে। বলল তারা দু’জনেই বিস্ময়মিশ্রিত দ্রুত কণ্ঠে, ‘নিউ হারমানের? তাহলে যে বললেন গুলী করছে ইহুদী গোয়েন্দা, জেনারেল শ্যারনের লোক!’
‘আমি ঠিক ঠিক বলতে পারছি না দৃশ্যগুলো নিউ হারমানের কিনা। কিন্তুও খবরের কাগজে নিউ হারমানের হত্যাকান্ডের যে বিবরণ বেরিয়েছে, তার সাথে দৃশ্যগুলো মিলে যায়।’ ডাক্তার বারাকের কন্ঠ শুষ্ক ও উত্তেজিত। চোখে-মুখে তার বিস্ময় বিমূঢ় ভাব।
কোন কথা বলতে পারল না সাগরিকা ও শশাংক। প্রশ্ন ঠিকরে বেরুচ্ছে তাদের চোখ-মুখ থেকেও।
ডাক্তার বারাকই আবার বলে উঠল, ‘ঘটনা কোথাকার নাবিলা জানত এবং সে জন্যেই ক্যাসেটটি আহমদ মুসার কাছে পাঠিয়েছে। এ থেকে প্রমাণ হয় ক্যাসেটটি আহমদ মুসার খুবই প্রয়োজন। অন্যদিকে জেনারেল শ্যারনও ক্যাসেটটি যে কোন মূল্যে পেতে চায় এবং ক্যাসেট উদ্ধারের জন্য নাবিলাকে পর্যন্ত ধরে নিয়ে গেছে। আর এই ঘটনা ঘটেছে নিউ হারমানের ঘটনার একদিন পরে। সুতরাং নিউ হারমানের ঘটনার সাথে এই ক্যাসেটের সম্পর্ক আছে আমরা ধরে নিতে পারি।’
‘এর অর্থ কি দাঁড়ায় ডাক্তার আংকেল? প্রশ্ন করল শশাংক। তার কণ্ঠে উত্তেজনা।
বিস্ময় বিমূঢ় ভাব আরও গভীর হয়ে উঠল ডাক্তার বারাকের চোখে-মুখে। বলল, ‘অর্থ পরিষ্কার জেনারেল শ্যারনরা খুন করেছে আমাদের একটি ইহুদী বসতির কিছু নিরপরাধ মানুষকে।’
‘কেন করেছে? উদ্দেশ্য কি?’ বলল শশাংক।
ডা. বারাকের মনে পড়ল জর্জ আব্রাহামকে বলা আহমদ মুসার কথা। আহমদ মুসার কথার পুনরাবৃত্তি করে ডাক্তার বারাক বলল, ‘নিজেদের নাক কেটে আহমদ মুসার যাত্রা ভংগ করতে চেয়েছে। আহমদ মুসার ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করতে সমর্থ হয়েছে।’
‘তাহলে তো এই ক্যাসেট অবিলম্বে ওয়াশিংটনে আহমদ মুসা বা জর্জ আব্রাহাম জনসনের হাতে পৌছাতে হয়।’ বলল দ্রুত কণ্ঠে সাগরিকা সেন।
‘অবশ্যই সাগরিকা। আমরা এখনই রওয়ানা হতে পারি।’ ডাক্তার বারাক বলল সোজা হয়ে বসে।
‘আমিও যাব।’ বলল শশাংক।
‘হ্যা, তোমাকে যেতেই হবে, তুমিই ক্যাসেট এনেছ নাবিলার কাছ থেকে।’ সাগরিকা সেন বলল।
উঠে দাড়াল ডাক্তার বারাক। বলল, ‘আমি গাড়িটা ঠিকঠাক করে নিচ্ছি। তোমরা এস।’
দশ মিনিটের মধ্যেই ডাক্তার বারাকের গেট দিয়ে একটা গাড়ি বেরিয়ে এল। গাড়ির ড্রাইভিং সিটে শশাংক। তার পাশের সিটে ডা. বারাক। পেছনের সিটে বসেছে সাগরিকা সেন।
ওয়াশিংটন-আনাপোলিশ ফ্রি ওয়ে ধরে ঝড়ের গতিতে চলেছে গাড়িটি।
ডিষ্ট্রিক্ট অব কলামবিয়া অর্থাৎ ওয়াশিংটনে প্রবেশের আগে মেরিল্যান্ডের শেষ শহর হলো শিভারলী।
শিভারলীতে ঢুকতে যাচ্ছে ডা. বারাকের গাড়ি। ফ্রিওয়ের লেনের বাইরে ফুটপাতের উপর একটা গাড়ি দাড়িয়েছিল। গাড়ির গায়ে ঠেস দিয়ে দাড়িয়েছিল একজন লোক।
ডা. বারাকের গাড়ি কাছাকাছি আসতেই লোকটি হাত তুলল।
শশাংক ডা. বারাকের দিকে একবার তাকিয়ে গাড়ি দাড় করাল ফুটপাতে দাঁড়ানো গাড়ির পাশে।
শশাংকরা দেখল গাড়ির ভেতরে আরও তিনজন লোক। তাদের একজনের হাতে দূরবীন।
শশাংক গাড়ি দাড় করাতেই গাড়ি থেকে আরও একজন লোক বেরিয়ে এল। চোখের পলকে তারা দু’জন ডা. বারাকের গাড়ির দু’পাশে এসে দাঁড়াল। শশাংকরা কিছু বুঝে উঠার আগেই দু’জন দু’পাশ থেকে সাগরিকার দু’পাশে উঠে এসে বসল।
বসেই দু’জন রিভলবার বের করে একজন তাক করল ড্রাইভিং সিটে বসা শশাংককে। বলল তাকে লক্ষ করে, ‘চালাও গাড়ি।’
কি ঘটতে যাচ্ছে শশাংক বুঝতে পেরেছিল। লোকটির কথা শেষ হবার আগেই শশাংক দেহটাকে গুটিয়ে সিটের আড়ালে নিয়ে গাড়ির দরজা খুলে বাইরে গড়িয়ে পড়ল।
পেছনে যে লোকটি শশাংকের দিকে রিভলবার তাক করেছিল সে বুঝতে পারল ড্রাইভিং সিটের লোকটি পালাল। সেও দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে পড়ল এবং এগুলো শশাংকের দিকে।
শশাংক পড়ে গিয়ে পা গুটিয়ে ছিল। ভাবটা এই রকম যেন সে ভীষণ ভয় পেয়েছে।
লোকটি কাছাকাছি আসতেই শশাংক গুটানো পা স্প্রিঙের মত পেছনে ঠেলে আঘাত করল লোকটির পায়ের গোড়ালির উপরের জায়গাটায়।
লোকটি অপ্রস্তুত ছিল। এই আঘাত খেয়ে লোকটি পড়ে গেল।
সংগে সংগে শশাংক লোকটির হাতের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে রিভলবার কেড়ে নিল।
রিভলবার হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়েই শশাংক দেখল পাশের গাড়ি থেকে দু’জন রিভলবার হাতে নিয়ে বেরিয়ে আসছে।
ঠিক এই সময়েই পুলিশের একটা গাড়ি শশাংকের গাড়ির ঠিক পেছনে এসে দাঁড়াল এবং সংগে সংগেই দু’জন পুলিশ রিভলবার বাগিয়ে বেরিয়ে এল।
পুলিশের গাড়ি দেখে পাশের গাড়ির যে দু’জন রিভলবার হাতে বেরিয়ে আসছিল তারা আবার গাড়িতে উঠে গাড়ি ষ্টার্ট দিয়ে ছুটতে লাগল।
পুলিশের গাড়ি দেখে পাশের গাড়ির যে দু’জন রিভলবার হাতে বেরিয়ে আসছিল তারা আবার গাড়িতে উঠে গাড়ি ষ্টার্ট দিয়ে ছুটতে লাগল।
আর শশাংকের সামনে মাটিতে পড়ে যাওয়া লোকটি উঠে দাঁড়িয়ে দৌড়ে পালাতে লাগল। রিভলবার হাতে যে লোকটি গাড়িতে সাগরিকা ও ডাক্তার বারাককে পাহারা দিচ্ছিল, সেও গাড়ি থেকে বেরিয়ে দৌড় দিল।
পুলিশ দু’জন ফাকা ফায়ার করে উচ্চ স্বরে আদেশ দিল, এরপরও পালাতে চেষ্টা করলে গুলী করব।
লোক দু’টি দাঁড়িয়ে গেল।
পুলিশ দু’জন এগিয়ে গিয়ে লোক দু’টির হাতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে তাদের গাড়িতে নিয়ে এল।
ততক্ষণে ডা. বারাক ও সাগরিকা গাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিল। ডা. বারাক পুলিশকে তাদের পরিচয় দিল এবং বলল, ‘ওরা হাত তুলে আমাদের গাড়ি থামিয়ে আকস্মিকভাবে আমাদের গাড়িতে উঠে রিভলবার বাগিয়ে তাদের নির্দেশ মত গাড়ি চালাবার হুকুম দিয়েছিল। শশাংকের বুদ্ধিতে ওরা বাধা পায়। আপনারা এসে আমাদের বাঁচিয়েছেন। অনেক ধন্যবাদ আপনাদের।’
‘স্যার কারণ কি বলুন তো? আপনাদের এরা চেনে? না, এটা কোন ছিনতাই-এর ঘটনামাত্র?’ একজন পুলিশ বলল।
ডা. বারাক সংগে সংগে জবাব দিল না। একটু চিন্তা করে বলল, ‘নিছক কোন ছিনতাই-এর ঘটনা নয় বলেই আমার বিশ্বাস। কোন বড় কারো দ্বারা নিয়োজিত লোক এরা হতে পারে। ওদের একজনের হাতে দূরবীন ছিল। ওরা আগে থেকে দেখে-শুনেই আমাদের গাড়ি থামিয়েছে। আমরা এফবিআই চীফ আব্রাহাম জনসনের কাছে যাচ্ছি। আমাদের বাধা দেয়াই ওদের লক্ষ হতে পারে বলে আমার মনে হচ্ছে।’
এফবিআই চীফের কাছে যাওয়ার কথা শুনে পুলিশ অফিসারটি নড়ে-চড়ে দাঁড়াল। একটু সমীহের সুরে বলল, ‘স্যার, তাহলে এদেরকে একটি ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে অপহরণ ও হত্যা প্রচেষ্টা’র অভিযোগে গ্রেপ্তার দেখাতে পারি। অভিযোগকারী হিসাবে আপনাদের নাম থাকবে।’
‘ঠিক আছে।’
‘ধন্যবাদ। চলুন স্যার, আপনাদের পৌছে দিয়ে আমরা অফিসে ফিরব।’ বলল পুলিশ অফিসারটি।
‘কিন্তু এর কি দরকার হবে?’
‘স্যার, যা ঘটেছে তার পরিপ্রেক্ষেতে এটাকে আমরা আমাদের দায়িত্ব মনে করছি। ওদের দু’জন পালাতে পেরেছে বলেই এই প্রয়োজনটা আমরা বেশি অনুভব করছি।’
‘ধন্যবাদ অফিসার, চলুন।’
সবাই গাড়িতে উঠল। চলতে শুরু করল গাড়ি।
আগে ডা. বারাকের গাড়ি, পেছনে চলছে পুলিশের গাড়ি।
‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ আংকেল। আপনি ঠিকই বলেছেন ক্যাসেটের ঘটনার সাথে এর সম্পর্ক আছে।’ ডা. বারাকের দিকে চেয়ে বলল সাগরিকা সেন।
‘কিভাবে সেটা সম্ভব দিদি? আমরা সন্দেহের মধ্যে পড়ব কেন? বলল শশাংক।
‘নাবিলার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে জেনারেল শ্যারন তোমাকে দেখেছে না?’ সাগরিকা বলল।
‘দেখেছে।’ বলল শশাংক।
‘জেনারেল শ্যারন তোমাকে চেনে না?’
‘চেনে’
‘সুতরাং অবস্থার প্রেক্ষিতে নাবিলার পর দ্বিতীয় সন্দেহ তোমাকে করবে। তাছাড়া, কোন চাপে পড়ে নাবিলা তোমার নাম বলে দিতে বাধ্য হতে পারে।’
মুখ শুকনো হয়ে গেল শশাংকের। উদ্বেগ ফুটে উঠল তার চোখে-মুখে। বলল, ‘তা হতে পারে দিদি?’
‘ইচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক আমরা একটা বড় যুদ্ধে জড়িয়ে গেছি শশাংক।’ বলল ডা. বারাক।
‘ওরা কি নাবিলার সাথে খারাপ ব্যবহার করবে?’ শশাংকের কণ্ঠে উদ্বেগ।
‘ভেব না শশাংক, ঈশ্বর আছেন।’ সান্তনার সুরে বলল সাগরিকা সেন।
‘ওরা কিন্তু আমাদের আব্বাকে এবং আমাদের ইন্ডিয়ান-আমেরিকান কম্যুনিটিকে ব্যবহার করছে দিদি। এটা আমরা হতে দিতে পারি না।’ ক্ষুব্ধ কণ্ঠ শশাংকের।
‘জেনারেল শ্যারন ও ইহুদীবাদীরা মার্কিন ইহুদীদেরও ব্যবহার করছে শশাংক।’ বলল ডা. বারাক।
‘তবু তারা একই কম্যুনিটি ভুক্ত। কিন্তু ইন্ডিয়ান-আমেরিকান কম্যুনিটি তাদের স্বার্থের বলি হবে কেন?’ শশাংক বলল।
‘কারণ ইহুদীবাদীদের আধিপত্যবাদী অভিলাষের সাথে ইন্ডিয়ান-আমেরিকান কম্যুনিটির অনেকের আকাঙ্খার মিল আছে।’ বলল ডা. বারাক।
‘আমাদের আব্বাও কি এই আকাঙ্খা পোষণ করেন?’ শশাংক বলল।
‘এই প্রশ্নের উত্তর তুমি দাও সাগরিকা?’ ডা. বারাক সাগরিকাকে উদ্দেশ্য করে বলল।
‘নিজের স্বার্থ দেখা মানুষের একটা প্রকৃতি। এই প্রকৃতি ইন্ডিয়ান-আমেরিকান কম্যুনিটির আছে। আব্বারও আছে। স্বার্থের একটা ঐক্য ইহুদীবাদীদের সাথে ইন্ডিয়ান-আমেরিকান কম্যুনিটির রয়েছে। কিন্তু আব্বা ইহুদীবাদীদের কোন ষড়যন্ত্রে যুক্ত আছেন বলে আমি বিশ্বাস করি না। ওদের বিপদে আব্বা সাহায্য করেছেন মাত্র।’ বলল সাগরিকা সেন।
‘আমারও তাই বিশ্বাস সাগরিকা।’ ডা. বারাক বলল।
ডা. বারাক থামল।
কোন কথা কেউ বলল না।
সবার দৃষ্টি সামনে। এফবিআই হেড কোয়ার্টার প্রায় এসে গেছে। চলছে দু’টি গাড়ি পরপর একই গতিতে।

জর্জ আব্রাহাম জনসনের অফিস কক্ষ।
জর্জ আব্রাহাম তার চেয়ারে বসে।
তার টেবিলের সামনে বসে আছে পুলিশ প্রধান বিল বেকার, আহমদ মুসা, সাগরিকা সেন, শশাংক ও ডা. বেগিন বারাক।
টেবিলের এক পাশে কম্পিউটার স্ক্রীনে ডা. বারাকদের নিয়ে আসা ভিডিও ক্যাসেটের শেষ দৃশ্য এই মাত্র কম্পিউটার স্ক্রীন থেকে মিলিয়ে গেল।
ঘরে পিনপতন নিরবতা।
জর্জ আব্রাহাম জনসন ও পুলিশ প্রধান বিল বেকারের চোখে-মুখে আনন্দের উজ্জ্বল্য ঝিকমিক করে উঠেছে। আহমদ মুসার চেহারা ভাবলেশহীন।
ডা. বারাক, সাগরিকা ও শশাংক তাকিয়ে আছে এখন তাদের মুখের দিকে।
‘ধন্যবাদ ডা. বারাক, সাগরিকা ও শশাংক। অনেক ধন্যবাদ আপনাদের সর্বকালের জঘন্য এক ষড়যন্ত্রের মুখোশ উন্মোচনে আপনারা সাহায্য করেছেন।’ নিরবতা ভেঙে প্রথম কথা বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
‘ধন্যবাদ নাবিলার প্রাপ্য। সে নিজেকে বিপদের মধ্যে ঠেলে দিয়ে এই কাজ করেছে।’ বলল ডা. বারাক।
‘ঠিক বলেছেন ডাক্তার বারাক। সে মিত্র পক্ষের বিরুদ্ধে যাবার ঝুঁকি নিয়ে নিজের কম্যুনিটি ও নিজ দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছে। এই ভিডিও ক্যাসেট না পেলে জঘন্য ষড়যন্ত্রের মুখোশ উন্মোচনের আর কোন পথ ছিল না। নিরপরাধ হয়েও আহমদ মুসা শুধু নয়, মুসলমানদের ঘাড়ে সর্বকালের জঘন্য এক অপরাধের দায় চেপে বসত।’
‘বেন ইয়ামিনকে দেখে ঘটনার সাথে জেনারেল শ্যারন ও ইহুদীবাদীদের জড়িত থাকার কথা বুঝা গেল, কিন্তু দৃশ্যের ঘটনা যে নিউ হারমানের তা কি করে প্রমাণ হবে?’ বলল ডা. বারাক।
‘প্রথমতঃ নাবিলার স্বাক্ষ্য। দ্বিতীয়ত, দৃশ্যে যাদের পালাতে ও নিহত হতে দেখা যাচ্ছে, নিউ হারমানের নিহতদের মধ্য থেকে তাদের চিহ্নিত করা। তৃতীয়ত, যে ঘরগুলোর দৃশ্য ছবিতে দেখা যাচ্ছে, নিউ হারমানের সে ঘরগুলো খুঁজে বের করা। এই প্রমাণই যথেষ্ট হবে।’
বলে জর্জ আব্রাহাম জনসন একটু থামল এবং বিল বেকারের দিকে তাকাল। বলল, ‘আপনি শিঘ্রই এই ক্যাসেটের একটা কপি পুলিশ হেড কোয়ার্টারে পাঠান এবং একজন দায়িত্বশীল অফিসারকে নির্দেশ দিন প্রমাণগুলো রেকর্ডে আনার জন্যে। ফিল্মে ঘরগুলো ও মানুষের ছবি যে এ্যাংগলে, সে এ্যাংগলেই যেন ছবিগুলো নেয়া হয়। ফিল্মের ছবির লোকদের নাম, ঠিকানাও রেকর্ডে আনতে হবে। ঘরে যে রক্তের আলামত পাওয়া যাবে, তা যে এই ফটোর লোকদেরই তাও নিশ্চিত করতে হবে।’
‘ধন্যবাদ মি. জর্জ। এখনই ব্যবস্থা করছি।’
বলেই সে মোবাইল তুলে নিয়ে হেড কোয়ার্টারে টেলিফোন করল। প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিল এবং এখনি আসতে বলল এফবিআই হেড কোয়ার্টারে।
টেলিফোনে কথা শেষ করে বিল বেকার বলল, ‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। আমরা চোখে অন্ধকার দেখছিলাম। তিনি আলো জ্বেলে দিলেন অন্ধকারে।’
বলে বিল বেকার তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘আপনি ভাগ্যবান আহমদ মুসা। ঈশ্বর আপনার পক্ষে কাজ করেছেন।’
‘আল-হামদুলিল্লাহ। আল্লাহ সত্যপন্থীদের সব সময়ই সাহায্য করেন। আল্লাহ এবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেও বিশেষভাবে সাহায্য করেছেন।’ দীর্ঘ নিবরতা ভেঙে বলল আহমদ মুসা।
‘বিশেষ সাহায্যটা কি?’ প্রশ্ন করল পুলিশ প্রধান বিল বেকার।
‘লস আলামোসের গোয়েন্দা সুড়ঙ্গ উদঘাটন ও সংশিস্নষ্ট ঘটনার মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপর যে অদৃশ্য ষড়যন্ত্র চেপে বসেছিল তার মুখোশ উন্মোচিত হয়েছে এবং অবশেষে নিউ হারমানের ঘটনার মধ্যে দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ধার্মিক শান্তি প্রিয় ইহুদী এবং ষড়যন্ত্রকারী ইহুদীবাদীদের আল্লাহ আলাদা করে দিলেন। এর মাধ্যমে আল্লাহ মার্কিন জাতীয় সংহতিকে আরও নিরুপদ্রব করে দিলেন।’ আহমদ মুসা বলল।
‘সুন্দর ব্যখ্যা দিয়েছেন আহমদ মুসা। আমি প্রেসিডেন্টকে এটা জানাব।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
‘ধন্যবাদ। মি. জর্জ আব্রাহাম, আমি উদ্বিগ্ন সারা জেফারসন ও নোয়ান নাবিলাকে নিয়ে। জেনারেল শ্যারন কতটা জঘন্য, খুনি হয়ে উঠেছে নিউ হারমানের ঘটনা তার প্রমাণ। সারা জেফারসন ও নোয়ান নাবিলাকে যা ইচ্ছে তাই করতে তার একটুও বিবেকে বাধবে না।’ আহমদ মুসা বলল। তার কণ্ঠস্বর ভারী।
গম্ভীর হয়ে উঠল জর্জ আব্রাহাম ও পুলিশ প্রধান দু’জনেরই মুখ।
জর্জ আব্রাহাম বলল, ‘আমি এখনি প্রেসিডেন্টের কাছে যাচ্ছি। তাঁকে সব জানাব। তার নির্দেশ বলে আজই এই ক্যাসেটের সচিত্র বিবরণ সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেলে যাবে। আমি আশা করছি, আজই আপনি মুক্ত মানুষ হিসেবে আপনার বাসায় ফিরে যাবেন। সারা জেফারসন ও নোয়ান নাবিলাকে উদ্ধার করার জন্যে আপনার সাহায্য আমরা চাই।’
‘ধন্যবাদ মি. জর্জ।’ বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা থামতেই শশাংক বলে উঠল দ্রুত কণ্ঠে, ‘নাবিলা জেনারেল শ্যারনদের হাতে পড়ার পূর্বক্ষণে আমাকে টেলিফোন করে ওয়াশিংটনের দু’টি ঠিকানা দিয়েছে। বলেছে, এখানেই নাবিলাকে এবং সারা জেফারসনকেও পাওয়া যাবে।’
শশাংক থামার প্রায় আগেই আহমদ মুসা বলে উঠল, ‘ঠিকানা তোমার কাছে এখন আছে?’
‘আছে।’ বলল শশাংক।
শশাংক পকেটে হাত দিয়ে এক টুকরো কাগজ বের করল এবং আহমদ মুসার দিকে তুলে ধরল।
আগ্রহের সাথে আহমদ মুসা কাগজটি হাতে নিয়ে ঠিকানা দু’টির উপর ভালোভাবে চোখ বুলিয়ে নিল। স্মৃতিতে তার গেঁথে নিল ঠিকানা দু’টো। তারপর আহমদ মুসা কাগজটি এগিয়ে ধরল জর্জ আব্রাহামের দিকে।
জর্জ আব্রাহাম ঠিকানা দু’টির উপর চোখ বুলিয়ে নিয়ে তা এগিয়ে দিল বেকারের দিকে। বলল, ‘টুকে নিন ঠিকানা দু’টো বিল বেকার।’
তারপর দ্রুত আব্রাহাম জনসন নক করল ইন্টারকমের একটা কি’তে।
সংগে সংগেই কথা বলে উঠল এফবিআই-এর অপারেশন কমান্ডার। জর্জ আব্রাহাম তাকে ঠিকানা দু’টো দিয়ে নির্দেশ দিল, কারো সন্দেহের সৃষ্টি না হয় এভাবে ঠিকানা দু’টোর উপর সার্বক্ষণিক নজর রাখ। কেউ সেখানে ঢুকুক ক্ষতি নেই, কিন্তু কেউ বেরুলে তাকে দূরে সরিয়ে এনে সবার অলক্ষে গ্রেপ্তার করতে হবে। এর অর্থ কেউ যেন ঠিকানা দু’টো থেকে বেরিয়ে পালিয়ে যেতে না পারে।’
কথা শেষ করে জর্জ আব্রাহাম তাকাল বিল বেকারের দিকে। বলল, ‘বলুন মি. বেকার। আর কি করণীয়।’
‘ঠিকানা দু’টোতে আজই অভিযান হওয়া দরকার এবং এই অভিযান আহমদ মুসার হাতে দিলে কেমন হয়।’ বলল বিল বেকার।
‘ধন্যবাদ মি. বেকার। আমিও একথাই ভাবছিলাম। আহমদ মুসা আমাদের সাথে থাকবেন শুধু নয়, সব দায়িত্ব তাকেই পালন করতে হবে।
কথাগুলো বলে একটু থেমে আহমদ মুসার দিকে চেয়ে বলল, ‘এবার আপনি বলুন আহমদ মুসা।’
‘আমি সাথে থাকব অবশ্যই।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আপনি এর বেশী কিছু বলবেন না তা জানি।’
বলে জর্জ আব্রাহাম জনসন তাকাল শশাংকের দিকে। বলল, ‘শশাংক তোমাকে সহস্র ধন্যবাদ দিলেও ধন্যবাদ শেষ হবে না। দেশ তোমার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে।’
‘স্যার আমি বাহক মাত্র। যা করার সব করেছে নাবিলা।’ বলল শশাংক।
‘নাবিলা এ দেশের ইহুদীদের আদর্শ হতে পারে। তার কম্যুনিটির স্বার্থে, দেশের স্বার্থে আমাকে ধরিয়ে দেয়াকে যখন সে ঠিক মনে করেছে, তখন আমার সাথে তার পরিচয়, সাগরিকার সাথে তার বন্ধুত্ব, শশাংকের সাথে তার সম্পর্ক সব ভুলে গিয়ে সে ইহুদী কমান্ডোদের সাথে নিয়ে আমাকে ধরতে ছুটে এসেছিল। আর আজ দেশ ও তার কম্যুনিটির স্বার্থেই সে একান্ত মিত্র জেনারেল শ্যারনদের মৃত্যুবান শুধু আমাদের হাতে তুলে দেয়া নয়, নিজেকেও বিপদের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। ধন্যবাদ নাবিলাকে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমাদের ডা. বারাক আংকলের প্রকৃত শিষ্য সে।’ বলল সাগরিকা সেন।
‘আমরা তার জন্যে গর্বিত।’ ডা. বারাক বলল।
‘মানুষে মানুষে কত পার্থক্য। একই কম্যুনিটির, কিন্তু নাবিলাকে যদি বলা হয় ফেরেশতা, তাহলে জেনারেল শ্যারনকে বলতে হয় শয়তান।’
‘জার্মানীতে যে ইহুদী হত্যাকান্ড ঘটেছে, তা শুধু নাজীদের কাজ নয়, তার মধ্যে এই শয়তানদের হাত ছিল।’ বলল আহমদ মুসা।
‘নিউ হারমানে হত্যাকান্ডের উদ্দেশ্য ছিল আপনাকে ফাঁদে ফেলা, জার্মানীর হত্যাকান্ডে যদি তাদের হাত থাকে, তাহলে তার উদ্দেশ্য কি ছিল?’ সাগরিকা সেন বলল।
‘ইহুদীদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করে ফিলিস্তিনে মাইগ্রেট করতে বাধ্য করা। দ্বিতীয় আর একটি কারণ ছিল, বিশ্বের মানুষের মধ্যে ইহুদীদের প্রতি দরদ সৃষ্টি করা এবং ফিলিস্তিনে ইহুদী রাষ্ট্রের পক্ষে বিশ্ব জনমত সৃষ্টি করা। দুই উদ্দেশ্যই তাদের সফল হয়েছে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘জার্মানীর ব্যাপারটা অনেক আগের, যুদ্ধকালীন অবস্থায় তা ঘটেছিল। সে সব আমাদের কাছে খুব স্পষ্ট নয়। কিন্তু নিউ হারমানের ঘটনা আমেরিকানদের হতবাক করে দেবে।’ বিল বেকার বলল।
‘শুধু হতবাক নয়, অর্ধশতকেরও বেশি কাল ধরে ইহুদীবাদীরা যে ইমেজ গড়ে তুলেছিল তা ধুলিস্মাত হয়ে যাবে। আর আমেরিকানদের জন্যে এর খুব বেশী প্রয়োজন ছিল।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
জর্জ আব্রাহাম থামতেই আহমদ মুসা বলে উঠল, ‘বেঞ্জামিন বেকনের সাথে আমার জরুরী যোগাযোগ প্রয়োজন মি. জর্জ।’
‘অল রাইট আহমদ মুসা আপনি আপনার রেষ্ট রুমে ফিরে যান। ওখানে গিয়েই সুসজ্জিত একটা ব্যাগ পেয়ে যাবেন। তাতে সবরকম যোগাযোগ এবং আপনার অভিযানের রশদ-পত্রও পেয়ে যাবেন। আমিও এখন উঠছি। প্রেসিডেন্টের ওখানে যাব।’
একটু থামল জর্জ আব্রাহাম। তারপর সাগরিকা সেনদের দিকে চেয়ে বলল, ‘অনুগ্রহ করে আপনারাও কি মি. আহমদ মুসার সাথে যাবেন। সেখানে আপনাদের রেষ্টের ব্যবস্থা হচ্ছে। অন্তত প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে ফিরে আসা পর্যন্ত আপনারা আমাকে সময় দিন।
‘অবশ্যই মি. জর্জ। আমরা যাচ্ছি আহমদ মুসার সাথে।’
‘ধন্যবাদ আপনাদের সকলকে।’
আহমদ মুসা, ডা. বারাকসহ সকলে উঠে দাড়াল।
উঠে দাড়াল জর্জ আব্রাহাম জনসন এবং পুলিশ প্রধান বিল বেকারও।
জর্জ আব্রাহাম বিল বেকারের দিকে চেয়ে বলল, ‘আপনি একটু বসুন মি. বেকার। আপনি আমার সাথে প্রেসিডেন্টের কাছে যাবেন। আমি তৈরী হয়ে আসছি।’
আহমদ মুসারা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আর জর্জ আব্রাহাম জনসন কয়েকটা ফাইল, ক্যাসেট, কয়েকটা টুকিটাকি জিনিস ব্রীফকেসে পুরে তার পাশের কক্ষের দিকে এগুলো।
বিল বেকার মনোযোগ দিল খবরের কাগজের দিকে।

‘নাবিলা তুমি আমাদের সাথে অসহযোগিতা করছ। যে পুলিশ তোমার সাথে কথা বলেছে, যে পুলিশের সাথে তুমি কথা বলেছ, তার ফটো দেখে, কণ্ঠস্বর শুনেও চিনতে পারবে না, এটা অসম্ভব।’ কর্কশ কণ্ঠে বলল জেনারেল শ্যারন।
‘দুঃখিত আমি চিনতে পারছি না। আমি তার স্বাভাবিক কণ্ঠ শুনেছি, আর এখানে শুনছি যান্ত্রিক কণ্ঠ। সে কারণেই আমি আইডেন্টিফাই করতে পারছি না।’ বলল স্বাভাবিক কণ্ঠে নাবিলা।
জেনারেল শ্যারন চেয়ারে বসেছিল। উঠে দাঁড়াল। কক্ষে পায়চারি করতে লাগল অস্থিরভাবে।
কক্ষটা বলা যায় একটা হল ঘর।
কক্ষের মাঝখানে একটা ডিম্বাকৃতি টেবিল। টেবিলের চারপাশে চেয়ার।
এরই একটা চেয়ারে বসেছিল জেনারেল শ্যারন। তার চেয়ারের ঠিক বিপরীত দিকের চেয়ারে বসে আছে নোয়ান নাবিলা। টেবিলে আরও কয়েকজন বসে আছে। তাদের মধ্যে একজন হলো বেন ইয়ামিন। তার পাশেই বড় চেয়ারটায় বসে আছে আমেরিকান কাউন্সিল অব জুইস এ্যাসোসিয়েশনসের চেয়ারম্যান ডেভিড উইলিয়াম জোনস। জোনসের পাশে বসে আছে আমেরিকান জুইস পিপলস লীগের যুব বিভাগের প্রধান শামির লিকুদ।
পায়চারিরত অস্থির জেনারেল শ্যারন বেন ইয়ামিনের পাশে এসে দাঁড়াল। বলল, ‘বেন, ভিডিওতে কি আছে বলে মনে কর?’
‘ওকে দেখতে পেয়েছি আমি শেষ মুহুর্তে। তখন ওখানকার অপারেশন শেষ। আমার মনে হয় ঐ বাড়িতে অপারেশনের গোটা দৃশ্যই সে ধারণ করতে পেরেছে।’ বলল বেন ইয়ামিন চিন্তিত কণ্ঠে।
‘তার মানে বাড়ির নিহত লোকদের ছবি, ঘরগুলোর ছবি, তার সাথে গুলী বর্ষণরত তোমার ছবিও উঠেছে।’ উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল জেনারেল শ্যারন।
‘আমার তাই আশংকা হয়।’ বেন ইয়ামিনের কণ্ঠে অপরাধীর সুর।
‘সর্বনাশ এই ভিডিও ক্যাসেট পুলিশ বা শত্রু কারও হাতে গেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। বলল ডেভিড উইলিয়াম জোনস। ডেভিড জোনসের কথার পর গোটা কক্ষ জুড়ে নতুন করে আতংকের পরিবেশ নেমে এল।
ভীতিকর এক থমথমে নিরবতা।
‘মিস নাবিলা, আপনি আমাদের সাহায্য করুন। পুলিশকে আইডেন্টিফাই করে দিন। আমরা যে কোন মূল্যে ক্যাসেট উদ্ধার করে আনব। এ জন্যে আমরা সবাই মরতে রাজি আছি এবং সবাইকে মারতেও আমরা প্রস্তুত। আমাদের শত লোকের জীবনের চেয়ে ঐ ক্যাসেটের মূল্য অনেক বেশী।’ বলল শামির লিকুদ বিনয়ের সুরে।
‘আমি দুঃখিত। না চিনেই কাউকে চিহ্নিত করে তো কোন লাভ হবে না।’ নাবিলা বলল।
এ সময় জেনারেল শ্যারনের মোবাইলে টেলিফোন এল। মোবাইলে কথা বলল সে।
কথা শেষ করেই ঝট করে ফিরল নাবিলার দিকে। বলল তীব্র কণ্ঠে, ‘নাবিলা তুমি মিথ্যা কথা বলছ, কোন পুলিশকে তুমি সেদিন কোন ক্যাসেট দাওনি।’
জেনারেল শ্যারন থামতেই কথা বলল ডেভিড উইলিয়াম জোনস। বলল, ‘কার টেলিফোন ছিল ওটা। কি বলল সে?’
‘আমাদের একজন পুলিশ কর্মীকে দায়িত্ব দিয়েছিলাম, যে পুলিশরা সেদিন রাতে নিউ হারমানে গিয়েছিল তাদের সকলকে কৌশলে জিজ্ঞেস করতে যে ভিডিও ক্যাসেটের মত কোন প্রমাণ তারা যোগাড় করতে পেরেছে কিনা। সে এক এক করে সকলের সাথে দেখা করেছে, জিজ্ঞেস করেছে। কিন্তু কোন পুলিশই সে ধরনের কিছু পায়নি।’ বলল জেনারেল শ্যারন।
‘পুলিশ সে রকম কিছু পেলে ঘটা করেই বলার কথা, কৃতিত্ব জাহিরের জন্যে, গোপন করার কথা নয়। আর পুলিশ সেদিন ওখানে প্রমাণ হিসেবে যা পেয়েছিল, তার সবই পত্রিকায় এসেছে। কিন্তু ভিডিও ক্যাসেটের কথা আসেনি। তার মানে এটাই ঠিক যে, পুলিশ এ ধরনের কিছু পায়নি।’
‘ঠিক বলেছেন মি. জোনস। নাবিলা নিশ্চয় মিথ্যা কথা বলছে।’
বলে জেনারেল দৃঢ় পদক্ষেপে গিয়ে নাবিলার সামনে দাঁড়াল। আকস্মিকভাবে জোরে একটা থাপ্পড় কষল সে নাবিলার গালে। তার সাথে সাথে বলে উঠল, ‘তোকে বলতে হবে কাকে দিয়েছিস ক্যাসেট।’
আকস্মিক থাপ্পড় খেয়ে পড়ে গিয়েছিল নোয়ান নাবিলা।
নিজেকে সামলে নিয়ে সে মেঝেয় উঠে বসল। প্রথমে তার দুই চোখ ছানাবড়া হয়ে উঠেছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে সে ভাব তার চলে গেল। সেখানে ফুটে উঠল এক দৃঢ়তা।
নাবিলাকে থাপ্পড় মারার ঘটনা ঘরের সবাইকে চমকে দিয়েছিল। সবাই নিরব।
গোটা কক্ষ ঘিরে নিরবতা।
আবার মোবাইল বেজে উঠল জেনারেল শ্যারনের।
কথা বলল মোবাইলে সে।
কথা বলার সময়ই তার চোখ-মুখ আবার জ্বলে উঠল।
কথা শেষ করে অগ্নি ঝরা দৃষ্টিতে সে তাকাল নোয়ান নাবিলার দিকে। সে নাবিলার কাছেই দাঁড়িয়েছিল। জেনারেল শ্যারনের একটা পা ছুটল নাবিলার দিকে।
নাবিলা মেঝেয় বসেছিল। জেনারেল শ্যারনের বিদ্যুত গতির লাথি নাবিলার কাঁধ হয়ে মুখে গিয়ে আঘাত করল।
পড়ে গেল নাবিলা।
ঠোঁট ও নাক তার থেঁথলে গেছে।
নাক ও ঠোট থেকে ঝর ঝর করে রক্ত বেরিয়ে এল তার।
লাথি মেরেই ডেভিড জোনসের দিকে তাকিয়ে জেনারেল শ্যারন বলল, ‘আমরা যাদেরকে পাঠিয়েছিলাম শশাংক ও সাগরিকার উপর চোখ রাখার জন্যে তাদের মধ্যে দু’জন পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে।’
‘পুলিশের হাতে? কিভাবে?’ বলল ডেভিড জোনস।
‘শশাংক, সাগরিকা ও ডাক্তার বারাক ওয়াশিংটনে ঢুকছিল। নির্দেশ অনুসারে ওরা গাড়ি সমেত তাদেরকে হাইজ্যাক করতে চেষ্টা করে। হঠাৎ পুলিশ এসে পড়ায় তাদের চেষ্টা ভন্ডুল হয়ে যায় এবং আমাদের দু’জন লোক ধরা পড়ে যায়। অবশিষ্ট দু’জন পালায় এবং ওদের ফলো করে। পুলিশ পাহারায় শশাংকরা এফবিআই হেড কোয়ার্টারে যায়। শশাংকরা বেরুবে এই অপেক্ষায় আমাদের লোকেরা প্রায় দু’ঘন্টা ওৎ পেতে থাকে। কিন্তু দু’ঘন্টাতেও তারা বের হয়নি। আমাদের লোকেরা এখনও সেখানে পাহারায় আছে। আমি ওদের চলে আসতে নির্দেশ দিয়েছি। ওদের ওখানে যাবার পথেই বাধা দেয়ার দরকার ছিল, এখন পাহারা দিয়ে লাভ নেই।’
কথাগুলো বলে জেনারেল শ্যারন আবার তীব্র দৃষ্টিতে তাকাল নাবিলার দিকে। বলল, ‘বল শশাংকরা কেন দল বেঁধে এফবিআই হেড কোয়ার্টারে গেল? কাকে দিয়েছিলি তুই ক্যাসেট?’
নাবিলা ধীরে ধীরে মেঝেয় উঠে বসেছিল। তার মুখ ভেসে যাচ্ছে রক্তে। সে রক্ত মুছার চেষ্টা করেনি। তার চোখে-মুখে আগের সেই দৃঢ়তা। শ্যারনের প্রশ্নের জবাবে সে বলল, ‘আমি যা বলেছি তার বাইরে আমার আর কিছু বলার নেই। শশাংকদের কথা আমি জানি না।’
‘বলতে হবে তোকে, সবই বলতে হবে। জানবি তুই সবই।’
বলে জেনারেল শ্যারন পাশের ওয়াল ক্যাবিনেট থেকে একটা চাবুক বের করে নিল এবং চাবুক দিয়ে নির্দয়ভাবে প্রহার শুরু করল নাবিলাকে।
নাবিলা দাঁতে দাঁত চেপে চোখ বন্ধ করে নিয়েছে। চিৎকার করে আর্তনাদ করে এদের করুণা পাওয়া যাবে না। যারা নিউ হারমানে ঠান্ডা মাথায় নিজের কম্যুনিটির লোককে খুন করেছে, তারা মানুষ নয়। এদের কাছে কান্নার কোন অর্থ নেই।
এতটুকুও কাঁদল না নাবিলা।
গা ফেটে ঝর ঝর করে রক্ত বেরিয়ে এল। দাঁতে দাঁত চেপে সব সহ্য করল নাবিলা।
চাবুকের কয়েকটা ঘা পড়তেই নাবিলা নাক গুঁজে মেঝেয় পড়ে গেল।
‘আশ্চর্য, এই চাবুকের ঘা খেয়ে ঘোড়াও চিৎকার করতো। কিন্তু নাবিলার মুখে একটি রা’ও উচ্চারিত হলো না। বড় শক্ত চীজ জেনারেল শ্যারন।’ বলল ডেভিড জোনস।
জ্বলে উঠল জেনারেল শ্যারনের চোখ। তার হাতের চাবুক আরও দ্রুত হলো, আরও নির্মম হলো।
মুখ তুলল নাবিলা। বিপর্যস্ত চেহারা। কিন্তু চোখ দু’টি জ্বলছে। বলল, ‘তোমরা মানুষ নও। তোমরা আমেরিকার শত্রু। নিউ হারমানের নিরপরাধ মানুষদের তোমরা খুন করেছ।’
থেমে গেল জেনারেল শ্যারনের চাবুক।
তার চোখে বিস্ময় ফুটে উঠল। চাবুক হাতে গুটাতে গুটাতে বলল, ‘কে বলল আমরা খুন করেছি। কে বলল তোকে। তুই জানলি কেমন করে?’
‘আমেরিকার শত্রু শয়তান। মনে করেছিলি কেউ জানবে না। ভিডিও ক্যাসেট তোদের মুখোশ খুলে দেবে, নগ্ন করে দেবে তোদেরকে।’ বলল তীব্র কণ্ঠে নোয়ান নাবিলা।
পাগল হয়ে উঠল যেন জেনারেল শ্যারন। তার হাতের চাবুক শপাং করে ছোবল হানল নাবিলার মুখে। বলল চিৎকার করে, ‘বল হারামজাদি, ক্যাসেট কোথায়? বলতে হবে তোকে?’
‘বলব না আমি। আমাকে মেরে ফেললেও না। আমি মরে যাব কিন্তু তোরা কেউ বাঁচবি না।’ বলল নাবিলা আর্ত কণ্ঠে। রক্তে জড়িয়ে গেল তার কথা।
আবার চাবুকটি হাতে গুটিয়ে নিয়ে জেনারেল শ্যারন চেয়ারে বসল। চাবুক তার ব্যর্থ হয়েছে বুঝে নিয়েছে সে। তার চোখে-মুখে ভাবনার চিহ্ন।
‘মি. শ্যারন, চাবুক তার কিছু করতে পারেনি, পারবেও না তা পরিষ্কার। ভিন্ন পথে নিন। যার দেহ শক্ত, তার মান ও মর্যাদায় ঘা দিতে হয়। আদর্শবাদীরা জীবনের চেয়ে মানকে বড় করে দেখে।’ বলল ডেভিড জোনস।
শুনেই লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল জেনারেল শ্যারন। বলল, ‘ধন্যবাদ মি. জোনস। পেয়েছি, হারামজাদিকে কথা বলাবার অস্ত্র পেয়েছি।’
বলে উঠে গেল নাবিলার কাছে। নাবিলারই কাপড়ের এক প্রান্ত নিয়ে তার মুখের রক্ত পরিষ্কার করল। বলল, ‘নাবিলা তোমার সুন্দর মুখ একটু আহত হয়েছে বটে, দেহটাও কিছু ক্ষতবিক্ষত হয়েছে, কিন্তু তোমার অপরূপ সুন্দর, নরম দেহটা যে কোন পুরুষের কাছে লোভনীয়। বিশেষ করে আমাদের গেটের সিকুরিটি সাড়ে ছয় ফুট উচ্চতার পর্বতসম মানুষ কৃষ্ণাংগ আলফ্রেডের কাছে তোমার দেহটা খুবই মজার খাদ্য হবে। তুমি এই মুহূর্তে ক্যাসেট কোথায় না বললে তাকে ডাকব। ভেবেছ তুমি মরে রক্ষা পাবে? না তোমাকে মারব না। আলফ্রেডদের দিয়ে তোকে কুরে কুরে খাওয়াব।’
বলে উঠে দাঁড়াল জেনারেল শ্যারন।
‘শয়তান তোদের কোন সাহায্য আমি চাইব না, ঈশ্বর আমাকে রক্ষা করবেন।’ নাবিলা কিন্তু কথাটা খুব দৃঢ় কণ্ঠে বলতে পারল না। তার যে দেহ-মন চাবুকের নির্দয় আঘাত সহ্য করেছে নিরবে, কিন্তু সেই মন তার এখন কেঁপে উঠেছে জেনারেল শ্যারনের কথায়। এই অপমান তার মন সইতে পারবে না। কিন্তু কি করবে সে।
নাবিলার চিন্তা বাধা পেল জেনারেল শ্যারনের কথায়। শ্যারন বলছে, ‘এই তোর শেষ কথা? ডাকব আলফ্রেডকে?’
‘আমি কোন কথা তোমাদের বলব না। ঈশ্বর আমাকে রক্ষা করবেন।’ কম্পিত কণ্ঠে কথাগুলো বলল নাবিলা। বুক কাঁপছে তার।
‘ঈশ্বর তোকে বাঁচাবে না নাবিলা। ঈশ্বর তোর কপালে যা লিখেছেন, তাই এখন ঘটবে।’
বলে শামির লিকুদের দিকে চেয়ে জেনারেল শ্যারন বলল, ‘যাও তুমি আলফ্রেডকে নিয়ে এস শামির লিকুদ।’
শামির লিকুদ গিয়ে আলফ্রেডকে নিয়ে এল।
আলফ্রেডকে দেখেই জেনারেল শ্যারন বলল, ‘আলফ্রেড, তোমার জন্যে ভাল ভোজের ব্যবস্থা করেছি। নাবিলা ম্যাডামকে নিশ্চয় তোমার পছন্দ হবে।’
আলফ্রেডের কুত কুতে চোখ চক চক করে উঠল। তাতে ঝরে পড়ল লালসার আগুন। আলফ্রেডকে দেখেই চোখ বন্ধ করেছে নাবিলা।
‘চোখ বন্ধ করলেও তোমার দেহ রক্ষা পাবে না নাবিলা। জেনে রাখ আলফ্রেড মাথা ধোলাই করা এক কুকুর। আদেশ পালন ছাড়া আর কিছু বুঝে না। কারো প্রতি কোন দয়া-মায়াও তার নেই। এখনও ভেবে দেখ।’
নাবিলা চোখ বন্ধ করেই থাকল। কোন কথা বলল না।
‘আলফ্রেড যাও, নাবিলা এখন তোমার। শুধু দেখবে হারামজাদি যাতে জ্ঞান হারিয়ে না ফেলে। সজ্ঞানে রেখে তাকে ভোগ করতে হবে।’
আলফ্রেড হেলে দুলে এগুলো তার দিকে। বাঘ যেন এগুচ্ছে হাতের মধ্যে পাওয়া শিকারের দিকে।
হঠাৎ কথা বলে উঠল শ্যারন। বলল, ‘থাম আলফ্রেড। এত বড় মহোৎসবের এটা উপযুক্ত জায়গা নয়। ওকে নিয়ে চল সারা জেফারসনের ঘরে। সেখানেই অনুষ্ঠিত হবে তোমার ভোজের মহোৎসব।’
বলে ডেভিড জোনসের দিকে তাকিয়ে জেনারেল শ্যারন বলল, ‘এটাই ভাল মি. জোনস। আমরা সারা জেফারসনেরও সাহায্য দাবী করব নাবিলাকে কথা বলাবার জন্যে।’
‘ভাল আইডিয়া, চলুন।’
শ্যারন ও ডেভিড জোনস উঠে চলে এল সারা জেফারসনের কক্ষে। বেন ইয়ামিন শ্যারনের কানে কানে কিছু বলে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
সারা জেফারসন শুয়ে ছিল।
দরজা খুলতেই সে উঠে বসেছে।
রক্তাক্ত নাবিলাকে দেখে সে চমকে উঠল।
নাবিলাকে সারা জেফারসন চেনে না।
জেনারেল শ্যারন নাবিলাকে ধাক্কা দিয়ে সারা জেফারসনের দিকে ঠেলে দিল। বলল, ‘তোমার আহমদ মুসার ভক্ত শশাংকের প্রেমিকা এ নাবিলা। আমাদের একটি ভিডিও ক্যাসেট চুরি করে কাকে দিয়েছে বলছে না। শেষ পর্যন্ত আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি তাকে আমাদের এ ক্ষুধার্ত আলফ্রেডের হাতে ছেড়ে দেব। আলফ্রেড তাকে কুরে কুরে খাবে, দেখি কত সহ্য করে, কথা বলে কিনা। তার আগে তোমার কাছে নিয়ে এলাম। তুমি একে কথা বলাতে পারো কিনা। এ মুহূর্তে আমাদের জানা দরকার ক্যাসেটটি কার কাছে। পাঁচ মিনিট সময় দিলাম তোমাকে। এ সময়ের মধ্যে কথা না বললে তোমার সামনে এখানেই আলফ্রেড তার কাজ শুরু করবে।’
জেনারেল শ্যারনের কথা শুনে ভীষণভাবে কেঁপে উঠল সারা জেফারসন। তার দেহের সমস্ত রক্ত জমে যাওয়ার অবস্থা হলো। এ ভয়ংকর অবস্থা কোন নারী সহ্য করতে পারে না, কোন নারীর চোখ তা দেখতে পারে না। মুহূর্তেই সারা জেফারসন তার দেহের সব শক্তি, সব ওজন যেন হারিয়ে ফেলল। তাকাল সে নাবিলার দিকে।
নাবিলা সারা জেফারসনের পায়ের কাছে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে।
সারা জেফারসন উঠে দাঁড়িয়ে টেনে তুলল নাবিলাকে। নাবিলা সারা জেফারসনকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠল। সারা জেফারসনও তাকে জড়িয়ে ধরল।
বলল সারা জেফারসন নাবিলাকে বুকে জড়িয়ে ধরে রেখেই, ‘বোন ভিডিও ক্যাসেটের কথা ওদের বলে দাও।’
নাবিলা ধীরে ধীরে মুখ তুলল সারা জেফারসনের বুক থেকে। বলল, ‘আপা আপনাকে দিয়ে চিঠি লিখিয়ে আহমদ মুসাকে ফাঁদে আটকাতে চাচ্ছে। এরপর আহমদ মুসাকে মার্কিন সরকার ও মার্কিন জনগণের কাছে ঘৃণিত অপরাধী প্রমাণের জন্যে ওরা নিজেরাই নিউ হারমানের ইহুদী জনপদে যে গণহত্যা চালিয়েছে সেই দায় চাপিয়ে দিতে চাইছে আহমদ মুসার উপর। সেখানকার বাসিন্দা এক সাংবাদিকের একটা ভিডিও ক্যাসেট পেয়েছি আমি, যা প্রমাণ করে ঐ হত্যাকান্ড জেনারেল শ্যারন ঘটিয়েছে, আহমদ মুসা নয়। এদেরকে অপরাধী প্রমাণের এবং আহমদ মুসাকে নির্দোষ প্রমাণিত করার একমাত্র অবলম্বন এই ভিডিও ক্যাসেট। আমি বলব না এটা আমি কাকে দিয়েছি। শুধু আহমদ মুসাকে নির্দোষ প্রমাণ নয়, আমেরিকান ইহুদীদেরকে এদের ষড়যন্ত্রের হাত থেকে বাঁচাতেও চাই আমি। আমার জীবন দিয়ে আমি এটা করব।’
নিউ হারমানের কাহিনী সারা জেফারসনও আজ পড়েছে। সে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল নাবিলার কথায়। সেই সাথে নাবিলার প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধায় ভরে গেল তার মন। পরক্ষণেই কেঁপে উঠল তার হৃদয় নাবিলার পরিণতি চিন্তা করে। সারা জেফারসন নিশ্চিত, ঐ ক্যাসেট উদ্ধারের জন্যে কোন কিছু করতেই তাদের বাধবে না। এক নারী মন নিয়ে নারী নাবিলার এই দিকটা চিন্তা করতে গিয়ে এটাই তার কাছে বড় হয়ে উঠল। সারা জেফারসন আরও ভাবল, ক্যাসেটটি কাকে দিয়েছে তা বলে দেয়ার অর্থ ক্যাসেটটি জেনারেল শ্যারনরা পেয়ে যাওয়া নয় কিংবা সেই লোকটি শ্যারনদের হাতে ধরা পড়ে যাওয়া নয়। নাবিলা ধরা পড়ার পর সে লোকটি নিশ্চয় ইতিমধ্যে নিজেকে ও ক্যাসেটকে রক্ষার ব্যবস্থা করেছে। সুতরাং নাবিলা কথাটা বলে দিলে ক্ষতি নেই। এই কথা চিন্তা করে সারা জেফারসন নাবিলাকে বলল, ‘নাবিলা, বোন, আমি ভেবে দেখলাম নামটা তুমি বলতে পার।’
‘না, আপা। এদের কোন সহযোগীতা আমি করব না। নাম বললেও এরা আমাকে বাঁচতে দেবে না, আমার মর্যাদা রক্ষা করবে না। যারা অন্যকে ফাঁসাবার জন্যে নিজের স্বজাতির উপর গণহত্যা চালায়, তাদের আমি বিশ্বাস করি না।’ কাঁদতে কাঁদতে বলল নাবিলা।
নাবিলার কথা শেষ হতেই জেনারেল শ্যারন ঝাঁপিয়ে পড়ল নাবিলার উপর এবং নাবিলাকে সারা জেফারসনের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে ছুড়ে দিল আলফ্রেডের কাছে।
আলফ্রেড তাকে বুকে জড়িয়ে কামড় বসাল নাবিলার রক্তাক্ত গালে। জেনারেল শ্যারন সারা জেফারসনের এক ফুটের ব্যবধানে দাঁড়িয়েছিল। তার কোটের সাইড পকেটে রিভলবার। রিভলবারের ভারীতে পকেটের মুখ কিছুটা ফাঁক হয়ে আছে।
সারা জেফারসন এটা লক্ষ করার সংগে সংগে চোখের পলকে ডান হাত দিয়ে তার পকেট থেকে রিভলবারটি তুলে নিয়ে রিভলবারের নল জেনারেল শ্যারনের মাথায় ঠেকিয়ে বলল, ‘জেনারেল শ্যারন, নাবিলাকে ছেড়ে দিতে বল আলফ্রেডকে। না হলে এখনি তোমার মাথা উড়ে যাবে।’
ঘটনার আকস্মিকতায় বিমূঢ় হয়ে পড়েছিল জেনারেল শ্যারন। সে দ্রুত বলল, ‘আলফ্রেড ছেড়ে দাও নাবিলাকে।’
আলফ্রেড নাবিলাকে ছেড়ে দিল।
ছাড়া পেয়ে ডেভিড উইলিয়াম জোনসের সামনে দিয়ে নাবিলা আসছিল সারা জেফারসনের কাছে।
হঠাৎ ডেভিড জোনস একটু নিচু হয়ে দু’হাত নাবিলার কোমর বরাবর নিয়ে দেহের সমস্ত শক্তি দিয়ে তাকে ছুঁড়ে দিল সারা জেফারসনের দিকে।
নাবিলা হুমড়ি খেয়ে গিয়ে পড়ল সারা জেফারসনের উপর।
ঘটনা এতটাই আকস্মিকভাবে ঘটে গেল যে, সারা জেফারসন সাবধান হবারও সুযোগ পেল না। নাবিলা তার গায়ের উপর এসে পড়ায় সারা জেফারসন ভারসাম্য রক্ষা করতে না পেরে পড়ে গেল।
সংগে সংগে জেনারেল শ্যারন ঝাঁপিয়ে পড়ে রিভলবার কেড়ে নিল সারা জেফারসনের হাত থেকে।
উঠে দাঁড়াল জেনারেল শ্যারন।
বিকট শব্দে হো হো করে হেসে উঠল সে। বলল সে, ‘ধন্যবাদ ডেভিড জোনস।’
তারপর সে ফিরে দাঁড়াল সারা জেফারসনের দিকে শয়তানের মত ক্রুর দৃষ্টি নিয়ে। বলল, ‘শয়তানি। তোকে আমরা যথেষ্ট সম্মান দিয়েছি, আর নয়। তুই বাঁচাতে চেয়েছিলি নাবিলাকে আলফ্রেডের হাত থেকে। এবার তাহলে তুইই প্রথমে আলফ্রেডের স্বাদটা গ্রহণ কর।’
বলে জেনারেল শ্যারন নিচু হলো সারা জেফারসনকে ধরার জন্যে।
সারা জেফারসন তখন মাটিতে পড়েছিল। সে লক্ষ করছিল জেনারেল শ্যারনকে।
হঠাৎ সারা জেফারসনের একটি পা বিদ্যুত বেগে ছুটে গেল জেনারেল শ্যারনের রিভলবার ধরা হাত লক্ষে।
জেনারেল শ্যারনের হাত থেকে রিভলবার ছিটকে গিয়ে পড়ল সারা জেফারসনের মাথার পেছনে।
রিভলবার মাথার পেছনে পড়তেই সারা জেফারসন তার দু’পা পেছন দিকে ছুড়ে দিয়ে দেহটা উল্টিয়ে রিভলবারের উপর গিয়ে পড়ল।
রিভলবার হাতে নিয়েই উঠে দাঁড়াল সারা জেফারসন। তার রিভলবারের নল তাক করা জেনারেল শ্যারনের দিকে।
কিন্তু সারা জেফারসন লক্ষ করেনি ডেভিড উইলিয়াম জোনস তার রিভলবার বের করে নিয়েছে হাতে। তার রিভলবারের নল উঠে আসছে সারা জেফারসনের লক্ষে।
ডেভিড জোনসের গুলী এসে বিদ্ধ করল সারা জেফারসনের রিভলবার ধরা হাতকে।
হাত থেকে রিভলবার ছিটকে পড়ে গেল।
আকস্মিক এই গুলী খেয়ে সারা জেফারসন কঁকিয়ে উঠে বাঁ হাত দিয়ে চেপে ধরল আহত ডান হাতটা।
জেনারেল শ্যারন ক্ষীপ্র গতিতে মেঝে থেকে তুলে নিল রিভলবার।
আবার সেই অট্টহাসি জেনারেল শ্যারনের। বলল সারা জেফারসনকে লক্ষ করে, ‘তুই যে এতবড় বাঘিনী তা জানতাম না। ‘ফ্রি আমেরিকার’ নেত্রী যে তুই ভুলেই গিয়েছিলাম।’
বলে একটু দম নিল জেনারেল শ্যারন। তারপর হেসে উঠে বলল, ‘সারা জেফারসন, তোর মত বাঘিনী আলফ্রেডের মত গেরিলার বাহু বন্ধনে পড়লে কেমন হয় দেখতে ভালই লাগবে আমাদের।’
কথা শেষ করে জেনারেল শ্যারন সারা জেফারসনকে হিড় হিড় করে টেনে নিয়ে ছুড়ে দিল আলফ্রেডের কাছে।
আলফ্রেড গেরিলার মত দু’হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরল তাকে।
চিৎকার করে উঠল নাবিলা, ‘জেনারেল শ্যারন ছেড়ে দাও সারা জেফারসনকে। ক্যাসেটের খবর তোমাদেরকে দিচ্ছি।’
‘বল।’ বলল জেনারেল শ্যারন।
‘শশাংককে দিয়েছি।’
‘শশাংককে দিয়েছ? সে তো এখন জর্জ আব্রাহাম জনসনের কাছে। সন্দেহ হয়েছিল। কিন্তু ধরতে চেষ্টা করেও আমরা পারিনি।’
বলেই পাগলের মত হেসে উঠল। বলল, ‘শয়তানি আমাদের সর্বনাশ করেছিস, তোদের সর্বনাশ আমরা করব।’
তারপর আলফ্রেডকে বলল, ‘তুমি ছেড় না আলফ্রেড, ও বড় শয়তানি। আমরা চাই, শয়তানির শাস্তি যেন সে সারা জীবন মাথায় বয়ে বেড়ায়।’
ঘুরে দাঁড়াল আবার সে নাবিলার দিকে। নাবিলাকে তাক করে তুলল তার রিভলবার।
অন্যদিকে আলফ্রেড সারা জেফারসনকে মেঝেয় ছুড়ে ফেলে ঝাঁপিয়ে পড়ল তার উপর।
এ সময় তার রিভলবারের একটা গর্জন জেনারেল শ্যারনের কানে এসে পৌছল। রিভলবারের ট্রিগারে জেনারেল শ্যারনের তর্জনি স্থির হয়ে গেল। সে তাকাল দরজায় দাঁড়ানো ষ্টেনগানধারীর দিকে। দেখতে পেল দু’জন ষ্টেনগানধারীর মধ্যে একজনকে। বলল,‘দেখ হারজেল কোথায় গেল? শব্দটা তার রিভলবারের?
ষ্টেনগানধারী দরজার দিকে ঘুরে দাঁড়াল।
আলফ্রেডও তখন থমকে গেছে।
মুখ ঘুরিয়ে তাকাল আলফ্রেড জেনারেল শ্যারনের দিকে।

টার্গেট বাড়িটার আর একটা বাড়ির পরেই জর্জ আব্রাহাম জনসন গাড়ি দাঁড় করাতে বলল।
দাঁড়াল গাড়ি। গাড়িতে আরোহী পাঁচ জন।
ড্রাইভিং সিটে আহমদ মুসা। তার পাশের সিটে আব্রাহাম জনসন। পেছনের সিটে বেঞ্জামিন বেকন এবং সাদা পোশাকে একজন পুলিশ ও একজন এফবিআই অফিসার।
পেছনে আরেকটা মাইক্রো। তাতে রয়েছে আরও দশ বারোজন এফবিআই ও পুলিশের লোক।
গাড়ি দাঁড়াতেই আব্রাহাম জনসন তার ওয়াকিটকিতে বলল, ‘স্টিফেন গত দু’ঘন্টার রিপোর্ট বল।’
ওপার থেকে বলল, ‘স্যার ১ ঘন্টা ৪০ মিনিট আগে জেনারেল শ্যারন নাবিলাকে নিয়ে এ বাড়িতে ঢুকেছে। তার সাথে ছিল ডেভিড উইলিয়াম জোনস এবং আরও দু’জন। গত দু’ঘন্টায় তারাই শুধু বাড়িতে ঢুকেছে কেউ বের হয়নি। সারাদিনই গেটের সিকুরিটি বক্সে পর্বতাকার নিগ্রো লোকটা বসেছিল। মিনিট পনের বিশ আগে একজন এসে তাকে ভেতরে ডেকে নিয়ে গেছে। গেটে অন্য একজন লোক বসেছে।’
‘ওভার।’ বলে ওপ্রান্তের কণ্ঠ থামলে জর্জ আব্রাহাম বলল, ‘বাড়ি সম্পর্কে খোঁজ নিতে বলা হয়েছিল। কোন তথ্য তোমার কাছে এসেছে?’
ওপারের কণ্ঠ আবার ভেসে এল, ‘স্যার, বাড়িটা শিব শংকর সেনের। একটা প্রাইভেট ডিটেকটিভ ফার্মের কাছে বাড়িটা ভাড়া ছিল দীর্ঘদিন। দিন পনের আগে খালি হয়েছে। নতুন কোন ভাড়াটিয়া আসেনি। শিব শংকর সেনের লোকদেরই এখানে দেখা গেছে। ওভার।’
কথা শেষ করে ওয়াকিটকি অফ করে জর্জ আব্রাহাম বলল, ‘তাহলে মি. আহমদ মুসা, অবস্থা দাঁড়াচ্ছে, সারাদিন কেউ বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়নি, ঘন্টা দু’য়েকের মধ্যে ঢুকেছে নাবিলাসহ পাঁচজন। আপনার ভাবনা কি বলুন মি. আহমদ মুসা।’
‘আমার মনে হয় এটা জেনারেল শ্যারনদের কোন ঘাঁটি নয়। তাদের একটা সাময়িক আশ্রয় এটা। খুব বড় কোন নিরাপত্তার ব্যবস্থা আছে বলে আমার মনে হয় না।’
‘ধন্যবাদ আহমদ মুসা। এখন আমরা কি করব?’ বলল জর্জ আব্রাহাম।
‘আমাদের এ গাড়িটা গেট পর্যন্ত নেব। পেছনের গাড়ির ওরা এখানে কোথাও গাড়ি পার্ক করে বাড়ির চারদিকে অবস্থান নিক। পরে যেভাবে বলা হয়েছে, সেভাবে কাজ করবে।’ বলল আহমদ মুসা।
পেছনের পুলিশ অফিসার আহমদ মুসার এ নির্দেশ ওয়াকিটকিতে জানিয়ে দিল পেছনের গাড়িকে।
আহমদ মুসার গাড়ি ষ্টার্ট নিল আবার।
গাড়ি গিয়ে গেটের মুখোমুখি দাঁড়াল।
লাফ দিয়ে আহমদ মুসা গাড়ি থেকে নামল।
গেটের পাশে গেটের সাথে লাগানো সিকুরিটি বক্স।
গাড়ি দাঁড়াতেই সিকুরিটি বক্সের দরজায় একজন লোক এসে দাঁড়াল। যুবক একহারা পেটা শরীর। কিন্তু দাঁড়ানোর মধ্যে একটা গাছাড়া ভাব। আহমদ মুসা বুঝল এ পেশাদার কেউ নয়।
আহমদ মুসা গেটের কাছে তাকে ডাকল। লোকটি এলে সে বলল, ‘আমি শিব শংকর সেনের পরিচিত। তোমার গেট বক্সে কি টেলিফোন আছে। আমি জেনারেল শ্যারনের সাথে একটু কথা বলব।’
আহমদ মুসার কথাগুলো এত সহজ, স্বাভাবিক ছিল যে কোন কিছু ভাববার তার সুযোগই হলো না। নিজেদের লোককে যেভাবে স্বাগত জানায়, সেভাবেই স্বাগত জানিয়ে আহমদ মুসাকে সেই বক্সে নিয়ে গেল।
লোকটি আগে আগে যাচ্ছিল, আহমদ মুসা পেছনে।
গেট বক্সে ঢুকেই আহমদ মুসা পেছন থেকে দরজাটা ঠেলে দিয়ে বাঁ হাতে লোকটির গলা পেঁচিয়ে ধরে ডান হাতে ক্লোরোফরম প্যাড তার নাকে চেপে ধরল।
কিছুক্ষণ দু’হাতের বাঁধন খোলার চেষ্টা করে লোকটি নেতিয়ে পড়ল। সংজ্ঞাহীন লোকটিকে আহমদ মুসা চেয়ারে বসিয়ে টেবিলে ঠেস দিয়ে রেখে দিল, যেন সে ঘুমোচ্ছে এই ভাবে।
বেরিয়ে এসে আহমদ মুসা গেট খুলে গাড়ি ভেতরে নিল। তারপর গেট বন্ধ করে গাড়ি নিয়ে গাড়ি বারান্দায় দাঁড় করাল।
‘ধন্যবাদ আহমদ মুসা, গেটকে যেভাবে সহজে ম্যানেজ করেছেন, সেভাবেই সামনের কাজ ইশ্বর সহজ করে দেবেন।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন আহমদ মুসাকে লক্ষ করে।
আহমদ মুসা গাড়ি থেকে নামার জন্যে পা বাড়িয়ে জর্জ আব্রাহামের দিকে ফিরে বলল, ‘মি. জর্জ সব কথাই তো হয়েছে। আপনারা আসুন। আমি ভেতরে ঢুকছি।’
আহমদ মুসা নামল গাড়ি থেকে।
গাড়ি বারান্দা থেকে কয়েকটা ধাপ পেরিয়ে উপরের বারান্দায় উঠল আহমদ মুসা। সামনেই বড় একটা দরজা। ভেতরে ঢোকার এটাই প্রধান গেট।
আস্তে দরজার নবে চাপ দিল আহমদ মুসা। নব ঘুরে গেল। তার মানে দরজা খোলা।
নব ঘুরিয়ে আহমদ মুসা আসেত্ম আসেত্ম দরজা ফাঁক করে উঁকি দিল। ভেতরে কার্পেট মোড়া সোফা সাজানো বিরাট হলঘর। হলঘরের শেষ প্রান্তটা থেকে একটা সিঁড়ি দোতালায় উঠে গেছে। সিঁড়ির এ পাশে মাঝখানের ফাঁকা জায়গাটায় কয়েকজন গোল হয়ে বসে খবরের কাগজ দেখছে। ওরা ছয়জন। তাদের প্রত্যেকের কাঁধে ছোট ব্যারেলের হালকা সাইজের আধুনিকতম ষ্টেনগান।
আহমদ মুসা সোল্ডার হোলষ্টার থেকে তার প্রিয় এম-১০ মেশিন রিভলবারটা ডান হাতে নিয়ে বাঁ হাতে নিঃশব্দে দরজা ফাঁক করে ভেতরে ঢুকে গেল। বেড়ালের মত কয়েক ধাপ এগুলো সামনে। এবার গোটা হলঘর তার নজরে এল। চারদিকে তাকিয়ে দেখল আর কেউ কোথাও নেই।
আরও কয়েক ধাপ এগুলো আহমদ মুসা। ওদের সাথে ব্যবধান এখন মাত্র দু’তিন গজের।
এক সাথেই ওদের সবার নজরে পড়ে গেল আহমদ মুসা। সংগে সংগে সবাই হাত দিয়েছিল তাদের ষ্টেনগানে।
‘হাত আর কেউ একতিল নড়াবে না। যে যে অবস্থায় আছ উপুড় হয়ে শুয়ে পড়।’ অনুচ্চ কণ্ঠে বলল আহমদ মুসা।
ওরা একবার আহমদ মুসার দিকে, আরেকবার তার এম-১০ মেশিন গানটার দিকে তাকিয়ে শুয়ে পড়ল মেঝের উপর।
এ সময় জর্জ আব্রাহাম ঘরে ঢুকল অবশিষ্ট দু’জনকে নিয়ে।
আহমদ মুসা অফিসার দু’জনকে বলল, ‘আসুন ওদের গায়ের জামা ছিড়ে মুখে পুরে দিয়ে ওদেরকে বেঁধে ফেলুন।’
বলে আহমদ মুসা এগুলো ওদের দিকে।
একজনের কাছে গিয়ে বসল। তার চুল ধরে মাথাটা ঘুরিয়ে মুখ সামনে এনে বলল, ‘বল জেনারেল শ্যারন এখন কোথায় রয়েছে? কোন ঘরে, কোন দিকে?
লোকটি মিট মিট করে তাকাল। কথা বলল না।
আহমদ মুসা বাঁ হাত দিয়ে পকেট থেকে ছোট একটা রিভলবার বের করল। তার মাথায় ঠেকিয়ে বলল, ‘এখনি জবাব না দিলে গুলী করব।’
লোকটির চেহারা বদলে গেল।
মৃত্যুভয় ফুটে উঠল তার চোখে-মুখে। বলল, ‘দু’তলার দক্ষেণে করিডোর ধরে গিয়ে একেবারে মুখোমুখি যে দরজা পড়বে সেই ঘরে উনি আছেন।’
‘আর তোদের কয়জন লোক আছে এ বাড়িতে?’
কথা বলতে দ্বিধা করল লোকটি।
আহমদ মুসা তার রিভলবারের ব্যারেলে চাপ বাড়াল।
লোকটি ‘বলছি’ বলে আবার শুরু করল, ‘উপরে জেনারেল শ্যারন ও ডেভিড জোনসসহ চারজন আছেন।’
‘থ্যাংকস।’ বলে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
দু’জন অফিসার তখন ওদের ছয়জনকে বাঁধছিল।
‘আসুন আমরা উপরে যাই।’
জর্জ আব্রাহাম ও বেঞ্জামিন বেকনকে লক্ষ করে কথাটা বলে আহমদ মুসা এগুল সিড়ির দিকে।
জর্জ আব্রাহাম আহমদ মুসার পেছনে চলতে শুরু করল।
সিড়ির কয়েক ধাপ উঠতেই আহমদ মুসা শুনতে পেল ‘রবিন’ নাম ধরে ডাকতে ডাকতে কেউ এগিয়ে আসছে।
শুনেই আহমদ মুসা তার এম-১০ বাগিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে উপরে উঠতে লাগল। আহমদ মুসার লক্ষ, আসছে যে লোকটি সে মার্ক করার আগেই তাকে মার্ক করতে হবে।
দু’তলায় উঠতে আরও দু’ধাপ বাকি।
লোকটির সাথে মুখোমুখি হলো আহমদ মুসা। দু’জন দু’জনকে একই সাথে দেখতে পেয়েছে। কিন্তু লোকটির ষ্টেনগান হাতে নেই, কাঁধে আছে, আর আহমদ মুসার দু’হাতের দু’রিভলবার তার দিকে উদ্যত।
লোকটি আহমদ মুসাকে দেখে ভুত দেখার মত চমকে উঠে থমকে দাঁড়িয়েছে।
উদ্যত রিভলবারের মুখে পড়ে বিমূঢ় হয়ে পড়েছে সে।
আহমদ মুসা জেনারেল শ্যারনদের কাছে পৌছার আগে গুলী বর্ষণের মত কোন শব্দ করতে চায় না। তাকে সাবধান হবার কোন সুযোগই দিতে চায় না আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা রিভলবার বাগিয়ে লোকটির দিকে অগ্রসর হলো। লোকটির কাছে পৌছে গেছে আহমদ মুসা। আহমদ মুসার ইচ্ছা, লোকটির কাঁধ থেকে ষ্টেনগান কেড়ে নিয়ে নিচতলায় ঠেলে দেবে বেঁধে ফেলার জন্যে।
আহমদ মুসা লোকটির কাছে পৌছতেই অকস্মাৎ লোকটি পড়ে গেল মেঝের উপর। দেখে মনে হলো সে ভিমরি খেয়ে পড়ে গেল।
কিন্তু পড়ার পর তার একটা পা প্রচন্ড শক্তিতে আঘাত করল আহমদ মুসার পায়ের টাকনুর উপরের জায়গায়।
আহমদ মুসা আকস্মিক এই আঘাতে ভারসাম্য হারিয়ে আছড়ে পড়ল মেঝের উপর।
লোকটি প্রস্তুত করে নিয়েছিল নিজেকে। ঝাঁপিয়ে পড়ল আহমদ মুসার উপর।
আহমদ মুসা পড়ে গেল বটে, কিন্তু রিভলবার ছাড়েনি হাত থেকে। লোকটি রিভলবার হাত করার জন্যে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল রিভলবার লক্ষ করেই।
কিন্তু সে রিভলবারটি ধরে ফেলার আগেই রিভলবার সমেত হাত টেনে নিয়েছিল আহমদ মুসা। তার ফলে আহমদ মুসার রিভলবার সমেত হাত লোকটির বুকের নিচে পড়ে গেল।
আহমদ মুসা যা চাচ্ছিল না তাই করতে হলো তাকে। রিভলবার একটু ঘুরিয়ে পজিশনে নিয়ে ট্রিগার টিপলো সে রিভলবারের। রিভলবারের নল প্রায় বুক স্পর্শ করেছিল লোকটির।
লোকটি প্রচন্ড কেঁপে উঠে কাত হয়ে পড়ল।
আহমদ মুসা লোকটিকে ঠেলে ফেলে দ্রুত উঠে দাঁড়াল। ছুটল করিডোর ধরে সর্ব দক্ষেণের সেই কক্ষের দিকে।
ততক্ষণে জর্জ আব্রাহাম জনসন ও বেঞ্জামিন বেকন সিঁড়ির উপর এসে পৌছেছিল। তারাও ছুটল আহমদ মুসার পেছনে।
করিডোর ধরে দৌড়ে আহমদ মুসা দরজার কাছে পৌছে গেছে।
দরজা খোলা।
দরজায় দাঁড়ানো একজন লোক ঘুরে দাঁড়াচ্ছে দেখতে পেল আহমদ মুসা। তার হাতে ষ্টেনগান।
আহমদ মুসার দু’হাতের রিভলবার উদ্যত ছিল দরজার লক্ষে।
আহমদ মুসা ট্রিগার টিপলে তার ডান হাতের রিভলবারের কয়েকটা গুলী ছুটল দরজার দিকে।
দরজার ষ্টেনগানধারী ঘুরে দাঁড়িয়েই ছুটে আসা আহমদ মুসাকে দেখতে পেয়েছিল। ষ্টেনগান তুলতে যাচ্ছিল সে, কিন্তু তার আগেই গুলী খেয়ে পড়ে গেল।
ষ্টেনগানধারী পড়ে যেতেই উন্মুক্ত দরজায় আহমদ মুসা দেখতে পেল জেনারেল শ্যারনকে। শ্যারনও দেখতে পেয়েছে আহমদ মুসাকে।
সে ভূত দেখার মত চমকে উঠেই ঘুরিয়ে নিচ্ছিল তার রিভলবার। কিন্তু আহমদ মুসার রিভলবার ওদিকে হা করেই ছিল। তার তর্জনি আবার চেপে বসল মেশিন রিভলবারের ট্রিগারে সেকেন্ডের জন্যে।
কয়েকটি ক্ষুধার্ত বুলেট ছুটে গেল জেনারেল শ্যারনকে লক্ষ করে।
একটি গুলী জেনারেল শ্যারনের ডান হাতের কব্জি বিদ্ধ করল।
তার হাত থেকে রিভলবার পড়ে গেল। বাঁ হাত দিয়ে ডান হাত চেপে ধরল শ্যারন।
আহমদ মুসা দরজায় এসে দাঁড়াল।
তার আগেই মেঝেয় বসা নাবিলা জেনারেল শ্যারনের ছিটকে পড়া রিভলবার তুলে নিয়েছে। সে দেখছিল ডেভিড উইলিয়াম জোনস তার রিভলবার দরজার দিকে ঘুরিয়ে নিচ্ছে। সে দরজার বাম পাশে একটু দেয়াল ঘেষে থাকায় আহমদ মুসা তাকে দেখতে পায়নি। নাবিলা রিভলবার তুলে নিয়েই গুলী করল ডেভিড উইলিয়াম জোনসকে।
তাড়াহুড়া করে ছোঁড়া নাবিলার গুলী বিদ্ধ করল উইলিয়াম জোনসের ডান কাঁধকে।
রিভলবার পড়ে গেল উইলিয়াম জোনসের ডান হাত থেকে।
বাঁ হাতে কাঁধ চেপে ধরে বসে পড়ল সে মেঝের উপর।
দরজায় এসে দাঁড়ানো আহমদ মুসা গুলী অনুসরণ করে তাকিয়ে দেখতে পেল জোনসকে, দেখতে পেল সারা জেফারসনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়া আলফ্রেডকে।
সর্বাঙ্গ জ্বলে উঠল আহমদ মুসার।
তার বাঁ হাতের তর্জনি চেপে বসল রিভলবারের ট্রিগারে, একবার নয় কয়েকবার।
একের পর এক কয়েকটা গুলী গিয়ে বিদ্ধ করল পর্বতসম-মানুষ আলফ্রেডের পৃষ্ঠদেশকে।
ভুমিকম্পের কবলে পড়ার মত তার দেহটা প্রবলভাবে ঝাঁকুনি দিয়ে উঠে ছিটকে পড়ে গেল এক পাশে।
সারা জেফারসন উঠে দাঁড়িয়ে পাগলের মত ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল আহমদ মুসাকে। সর্বশক্তি দিয়ে আঁকড়ে ধরতে চাইছে আহমদ মুসাকে।
আহমদ মুসা রিভলবার পকেটে রেখে ডান হাত সারা জেফারসনের পিঠে বুলিয়ে বলল, ‘তুমি ঠিক আছ তো সারা। আর ভয় নেই।’
ডুকরে কেঁদে উঠল সারা।
দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে তখন জর্জ আব্রাহাম জনসন ও বেঞ্জামিন বেকন।
বেঞ্জামিন বেকন আহমদ মুসাকে জড়িয়ে থাকা সারা জেফারসনের গুলীবিদ্ধ রক্তাক্ত ও ভীষণভাবে কম্পমান ডান হাতটা দেখতে পেল। দ্রুত কণ্ঠে বলল, ‘আহমদ মুসা ভাই মিস সারা জেফারসন আহত, তার ডান হাত গুলীবিদ্ধ।’
আহমদ মুসা পাগলের মত কাঁদতে থাকা সারা জেফারসনকে বুক থেকে তুলে দাঁড় করিয়ে টেনে নিল তার ডান হাত। হাতের অবস্থা দেখে আঁৎকে উঠল আহমদ মুসা। বলল, ‘সারা, তুমি এভাবে আহত হয়েছ?’
‘মি. আহমদ মুসা, ডেভিড জোনস তাকে গুলী করে তার হাত থেকে রিভলবার ফেলে দিয়েছিল। প্রচন্ড লড়াই করেছে সে। আমাকে সেই মরার হাত থেকে বাঁচিয়েছে।’ বলল নাবিলা।
আহমদ মুসা তাকাল সারা জেফারসনের দিকে। আহমদ মুসার দিকে চোখ তুলেছে সারা জেফারসনও।
সারার চোখে এখন ভয়ের চিহ্ন নেই। হঠাৎ যেন তার দু’চোখে এসে ঝাঁপিয়ে পড়েছে লজ্জা ও রক্তিম অনুরাগের প্রবল বন্যা।
শুকনো ঠোঁট কাঁপছে তার।
আহমদ মুসা বলল, ‘ধন্যবাদ সারা।’
বলে দু’হাতের দু’তর্জনি দিয়ে আলতোভাবে সারা জেফারসনের দু’চোখের নিচে দু’টো অশ্রুর ধারা মুছে দিয়ে বলল, ‘তোমার চোখে অশ্রু নয়, আগুন চাই সারা।’
এক স্বর্গীয় ঔজ্জ্বল্যে ভরে গেল সারার দু’চোখ। নামিয়ে নিল সে চোখ দু’টি।
জর্জ আব্রাহাম জনসন এ সময় চিৎকার করে উঠল, ‘জেনারেল শ্যারন পালাচ্ছে।’
বিদ্যুত বেগে চোখ ঘুরালো আহমদ মুসা। দেখল, দেয়ালের গা ঘেষে মেঝেতে সৃষ্ট হওয়া একটা সুড়ঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ল জেনারেল শ্যারন।
দেখেই আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়িয়ে দেহের সব শক্তি দু’পায়ে এনে লাফিয়ে উঠল এবং ঝাঁপিয়ে পড়ল সুড়ঙ্গে।
চোখের নিমিষে ঘটে গেল ঘটনা।
বেঞ্জামিন বেকন লাফ দিয়ে ছুটে গেল সেই সুড়ঙ্গের দিকে। কিন্তু সে সুড়ঙ্গে পৌছার আগেই সুড়ঙ্গ পথ বন্ধ হয়ে গেল। দেখা গেল নিরেট মেঝে ছাড়া সুড়ঙ্গের চিহ্ন কোথাও নেই।
হতবাক বেঞ্জামিন বেকন মেঝের উপর পরপর কয়েকটি লাথি চালাল, লাফালাফি করল। কিন্তু সুড়ঙ্গ পথ খুলল না।
জর্জ আব্রাহাম জনসন হাসল। এগিয়ে গেল সেদিকে। বলল, ‘বেঞ্জামিন লাথি দিলে বা লাফালাফি করলে ঐ পথ খুলবে না। জেনারেল শ্যারনের সাথে রিমোট কন্ট্রোল ছিল। সুড়ঙ্গ খুলেছিল সেটা ব্যবহার করে। এই ব্যবস্থায় সুড়ঙ্গ খুলে যাবার পর নির্দিষ্ট কয়েক সেকেন্ড খোলা থাকে। তারপর আপনিই বন্ধ হয়ে যায়। আহমদ মুসা আর একটু দেরী করলে সে সুড়ঙ্গ খোলা পেত না।’
‘সত্যি, সৌভাগ্য শুধু আহমদ মুসার জন্যেই অপেক্ষা করে।’ বলল হতাশ কণ্ঠে বেঞ্জামিন বেকন।
হাসল জর্জ আব্রাহাম জনসন। বলল, ‘সৌভাগ্য তার জন্যে অপেক্ষা করে না, সৌভাগ্যকে সে ছিনিয়ে আনে। আমরা সবাই জেনারেল শ্যারনকে লাফিয়ে পড়তে দেখলাম। কিন্তু সেই শুধু সঠিক সময়ে জেনারেল শ্যারনকে অনুসরণ করার সিদ্ধান্ত নিতে পারল, আমরা পারলাম না।’
বলেই জর্জ আব্রাহাম জনসন পকেট থেকে ওয়াকিটকি বের করে কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই সারা জেফারসন বলল, ‘জর্জ আংকেল, দেখুন দু’টি রিভলবারই উনি ফেলে গেছেন। খালি হাতে উনি পিছু নিয়েছেন জেনারেল শ্যারনের। এই সুড়ঙ্গ তাদের কোন ফাঁদও হতে পারে।’
কণ্ঠে উদ্বেগ ঝরে পড়ল সারা জেফারসনের।
‘ঠিকই বলেছ মা। সুড়ঙ্গের সন্ধানে আমরা এখনই কাজ শুরু করব। তার আগে এদিকের ব্যবস্থা হওয়া দরকার। আর আহমদ মুসার জন্যে ভেব না মা। সে এতটাই আত্মবিশ্বাসী ও ঈশ্বর বিশ্বাসী যে, তার সুযোগ ও সাহায্যের অভাব হয় না।’
বলে ওয়াকিটকিতে নির্দেশ দিল, ‘তোমরা চলে এস। গেটে গাড়িগুলো ও এ্যাম্বুলেন্স লাগাও। বন্দী ও আহতদের নিতে হবে।’
কথা শেষ করে ওয়াকিটকি পকেটে রেখে বেঞ্জামিনকে লক্ষ করে বলল, ‘কয়েকজন পুলিশ নিয়ে একটা পুলিশের গাড়ি করে সারা মাকে তুমি তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে যাও। আমি এদিকে সব ব্যবস্থা করে আসছি। নাবিলা মা, তুমিও সারার সাথে যাও। আমি না যাওয়া পর্যন্ত সারা মার সাথে তুমি হাসপাতালেই থাকবে। তোমার সাথে অনেক কাজ আছে।’
নাবিলা উঠে এসে সারা জেফারসনকে ধরে হাঁটতে শুরু করল। পেছনে পেছনে হাঁটতে লাগল বেঞ্জামিন বেকন।
সারা জেফারসনরা যখন বেরিয়ে যাচ্ছে, তখন জর্জ আব্রাহাম জনসন ওয়াকিটকিতে পুলিশ প্রধান বিল বেকারকে বলছে, ‘এদিকের খবর খুব ভাল। সারা জেফারসন ও নাবিলা মুক্ত। ডেভিড উইলিয়াম জোনস আহত এবং বন্দী। ওদের দু’জন মারা গেছে, আরও ছয়জন বন্দী হয়েছে। আহত জেনারেল শ্যারন পালাতে পারলেও আহমদ মুসা তাকে অনুসরণ করছে। এখন……।’
জর্জ আব্রাহামকে বাধা দিয়ে ওপার থেকে বিল বেকার বলল, ‘অভিনন্দন মি. জর্জ। আপনাদের সাথে এ ঐতিহাসিক অভিযানে থাকতে পারলাম না শেষ মুহূর্তে কাজে আটকা পড়ে। আমার দুর্ভাগ্য।’
বিল বেকার থামতেই জর্জ আব্রাহাম বলে উঠল, ‘তাহলে সৌভাগ্যের কিছু কাজ কর। শোন, এ বাড়িটা যে প্রাইভেট গোয়েন্দা সংস্থা ব্যবহার করেছে, তাদের কর্তা ব্যক্তিকে এখনি ফোন কর বাড়িটার ইন্টারন্যাল ডিজাইনটা পাওয়ার জন্যে। শ্যারন কিভাবে কোথায় কোন দিকে পালাল তা জানার জন্যে এখনি এটা প্রয়োজন।’
‘ঠিক আছে জর্জ, এখনি ব্যবস্থা করছি।’ ওপার থেকে কণ্ঠ ভেসে এল বিল বেকারের।
‘ধন্যবাদ বেকার।’
কথা শেষ করে রিভলবারের নল ডেভিড জোনসের দিকে তাক করে বলল, ‘উঠুন, চলুন।’
ডেভিড জোনস উঠে হাঁটতে হাঁটতে বলল, ‘আমরা, অন্তত আমি এসব চাইনি মি. জর্জ।’
রিভলবার বাগিয়ে ধরে ডেভিড জোনসের পেছনে হাঁটতে হাঁটতে জর্জ আব্রাহাম বলল, ‘এসব কিছু চাননি, কিন্তু সব কিছুই হয়েছে, নিউ হারমানের গণহত্যা পর্যন্ত।’
‘বিশ্বাস করুন জর্জ, ইহুদীবাদীদের কাজ-কর্মের সাথে আমি আছি। সেটা আমাদের কম্যুনিটির স্বার্থ সৌভাগ্য গড়ার জন্যে। কিন্তু নিউ হারমানের ঘটনা ঘটুক, মনে প্রাণে আমি চাইনি। আমি চেয়েছিলাম সারা জেফারসনকে টোপ বানিয়ে আহমদ মুসাকে ধরার যে ব্যবস্থা করা হয়েছে, সেটা নিয়েই থাকা হোক। আহমদ মুসার উপর প্রতিশোধ নিতে পারলেই আমাদের সবকিছু হয়ে যাবে। কিন্তু শ্যারনসহ সবাই জোর দিল যে, আহমদ মুসাকে আমরা বন্দী বা হত্যা করলে কোন লাভ হবে না। বরং তাতে সে আরও ‘হিরো’ হবে আমেরিকানদের কাছে, আর আমরা হবো নিন্দিত। আমেরিকানদের কাছে আহমদ মুসাকে ঘৃণার পাত্র করতে পারলেই শুধু আমেরিকায় আমাদের অবস্থান ফিরে পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে। এই যুক্তির মোকাবিলা আমি করতে পারিনি।’
আব্রাহাম জনসনরা এক তলায় পৌছে গিয়েছিল। বাইরে পুলিশ ও এফবিআই কর্মীরা সবাই এসে গেছে। গাড়ি বারান্দায় কতকগুলো গাড়ি দাঁড়াবার শব্দ পাওয়া গেল।
একজন পুলিশ অফিসারকে ডাকল জর্জ আব্রাহাম জনসন প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেবার জন্যে।

আহমদ মুসা লাফ দিয়ে একটা চলন্ত এক্সালেটরে গিয়ে পড়ল। নরম স্পঞ্জে ঢাকা এক্সালেটর না হলে তার মাথা শরীর আস্ত থাকতো না।
এক্সালেটর চলছে ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে।
জেনারেল শ্যারন এই এক্সালেটরেই আছে। পাঁচ ছয় সেকেন্ডর বেশী ব্যবধান হয়নি তাদের দু’জনের লাফ দেয়ার মধ্যে। সুতরাং খুব বেশী দুরে নয় জেনারেল শ্যারন।
এই ভাবনার মধ্যেই আহমদ মুসা ছিটকে পড়ল একটা শক্ত মেঝেতে।
জায়গাটা একটা ছোট্ট চত্বর, দেখল আহমদ মুসা।
পড়েই লাফ দিয়ে উঠে বসল সে। দেখতে পেল জেনারেল শ্যারন চত্বরে দাঁড়ানো একটা গাড়িতে উঠছে।
আহমদ মুসা আশে-পাশে তাকিয়ে দেখল আর কোন গাড়ি নেই। আহমদ মুসা উঠে দাঁড়িয়ে ছুটল জেনারেল শ্যারনের দিকে। ততক্ষণে ষ্টার্ট নিয়েছে শ্যারনের গাড়ি।
আহমদ মুসা গাড়ির পেছনে ছুটে গিয়ে রাস্তায় উঠল।
তার সামনেই পড়ল একটা গাড়ি। স্পোর্টস কার। একজন তরুনী চালাচ্ছে। হাত দিয়ে ইশারা করে গাড়ি থামাতে আবেদন করল আহমদ মুসা।
গাড়ি থামাল তরুণী।
‘আপনি কি হাসপাতালে যাচ্ছেন?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘না।’ বলল তরুণীটি
‘কোন জরুরী কাজে?’
‘না।’
‘তাহলে আমাকে গাড়িটি দিন। ঐ গাড়িতে বড় একজন ক্রিমিনাল যাচ্ছে, তাকে আমি ফলো করব।’
তরুণীটি চোখ তুলে আহমদ মুসাকে একবার দেখল। তারপর নেমে এল ড্রাইভিং সিট থেকে।
আহমদ মুসা ড্রাইভিং সিটে বসতে বসতে বলল, ‘ধন্যবাদ বোন। এফবিআই প্রধান জর্জ আব্রাহামকে টেলিফোন করলে সব জানতে পারবেন।’
কথা শেষ হওয়ার আগেই চলতে শুরু করেছে আহমদ মুসার গাড়ি।
চলছে দুটি গাড়ি।
খুশি হলো আহমদ মুসা যে, শ্যারনের গাড়িটা নজরের মধ্যেই রয়েছে।
আরও খুশি হলো আহমদ মুসা গাড়িটা একেবারে নতুন আমেরিকান গাড়ি। ভালো স্পীড আছে।
শ্যারনের গাড়ি ছুটছে অরলিংটনকে ডাইনে রেখে হাইওয়ে ধরে স্পিংফিল্ডের দিকে।
ভার্জিনিয়ার প্রান্তর দিয়ে চলছে তখন দু’টি গাড়ি। গাছ-গাছালিতে ভরা চড়াই উতরাই এর মধ্য দিয়ে। মাঝে মাঝেই দু’পাশে ছবির মত সবুজ বসতি চোখে পড়ছে।
কোথায় যাচ্ছে শ্যারন? তার ডান হাত বিধ্বস্ত। বাম হাত মাত্র সচল। গাড়ি চালানো অবস্থায় রিভলবার চালাতে পারবে না। টেলিফোন করতে চাইলেও তাকে থামতে হবে। এ অবস্থায় দ্রুত তাকে কোন আশ্রয়ের সন্ধান করতে হবে।
গাড়ির গতির মতই দ্রুত এই চিন্তাগুলো আবর্তিত হচ্ছে আহমদ মুসার মাথায়।
সন্ধ্যা নামার খুব দেরী নেই।
আহমদ মুসা গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিল।
গাড়ি চলছিল উপত্যকার মত এক নিচু এলাকা দিয়ে। সামনেই একটা টিলা। সুন্দর সাজানো একটা বাড়ি দেখা যাচ্ছে টিলার মাথায়।
টিলার পাশ দিয়ে চলে গেছে হাইওয়ে। হাইওয়ে থেকে একটা রাস্তা উঠে গেছে টিলার বাড়িটার দিকে।
আহমদ মুসা বিস্ময়ের সাথে লক্ষ করল আহমদ মুসার গাড়ির স্পীড বাড়লেও শ্যারনের গাড়ি একই গতিতে চলছে।
স্পীড বাড়ালো না মানে এখন সে লড়াই করতে চায়? কিন্তু কি ভাবে? তার তো লড়াই করার অবস্থা নেই। ভাবল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার গাড়ি জেনারেল শ্যারনের গাড়ির বিশ পঁচিশ গজের মধ্যে পৌছে গেছে।
আহমদ মুসা পায়ের মোজার সাথে গুজে রাখা রিভলবারটা হাতে নিল।
হঠাৎ আহমদ মুসা লক্ষ করলো জেনারেল শ্যারনের গাড়ির পেছনের টপটা উঠে যাচ্ছে। তার আড়াল থেকে বেরিয়ে এল কয়েকটা ব্যারেল।
আঁতকে উঠল আহমদ মুসা। মেশিন গান ও গ্রেনেড লাঞ্চারের ব্যারেল দেখেই সে চিনতে পেরেছে। মাত্র সুইচ টিপে ওগুলো অপারেট করা যায়।
আহমদ মুসার চিন্তা শেষ হবার আগেই সামনে থেকে গর্জন করে উঠল মেশিনগান। এক ঝাঁক গুলী এসে আহমদ মুসার গাড়ির উইন্ডস্ক্রিন উড়িয়ে নিয়ে গেল। ঝাঁঝরা করে দিল গাড়ির সামনের দিকটা।
আহমদ মুসা সিটের উপর কাত হয়ে পড়ে নিজেকে রক্ষা করল। কিন্তু সেই সাথে বুঝল আরও কি ঘটতে পারে।
আহমদ মুসা গাড়ির ষ্টার্ট বন্ধ করে দিয়ে তাড়াতাড়ি হাতড়িয়ে গাড়ির কাগজপত্র যা পেল নিয়ে দেহটাকে নিচে গড়িয়ে দিল।
কিন্তু তার দেহটা মাটিতে পড়ার আগেই তার ডান বাহুর একটা মাসল ছিড়ে নিয়ে গেল বুলেট।
আহমদ মুসা সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে দেহটাকে গাড়ির রাস্তার পাশে নিয়ে গেল।
ঠিক সে সময়েই একটা গ্রেনেড বিস্ফোরিত হলো আহমদ মুসার গাড়িতে। মুহূর্তেই টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ল গাড়ি। দাউ দাউ করে জ্বলতে লাগল আগুন।
শুয়ে থেকেই আহমদ মুসা দেখল জেনারেল শ্যারনের গাড়ি দ্রুত এগিয়ে বাঁক নিয়ে টিলার রাস্তা ধরে উপরে উঠে গেল।
আহমদ মুসা বাঁ হাত দিয়ে ডান বাহু চেপে ধরে উঠে দাঁড়াল।
উঠে দাঁড়িয়েই দেখতে পেল বিপরীত দিক থেকে একটা গাড়ি ছুটে আসছে।
আহমদ মুসা একটু এগিয়ে হাত তুলল। সেই সাথে দেখল গাড়ি একটি নয় দুটি। একটি জীপ, আরেকটি পিকআপ।
গাড়ি দু’টি আহমদ মুসার বরাবর এসেই থেমে গেল। সংগে সংগেই খুলে গেল গাড়ির দরজা। গাড়ি থেকে নেমে এল সামরিক ইউনিফর্ম পরা একজন লোক। ছুটছে সে আহমদ মুসার দিকে। তার পেছনে আরও দু’জন অফিসার।
আহমদ মুসা ছুটে আসা সামনের জনকে দেখেই চিনতে পারল। খুশি হলো এই দুঃসময়ে মার্কিন সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটনকে দেখে।
‘গুড ইভনিং।’ বলে স্বাগত জানাল আহমদ মুসা রোনাল্ড ওয়াশিংটনকে।
কিন্তু জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন আহমদ মুসার কথার দিকে খেয়াল করল না। সে দ্রুত আহমদ মুসার কাছে এসে তার আহত বাহুটা একবার দেখে গোটা দেহের দিকে নজর বুলিয়ে বলল, ‘মি. আহমদ মুসা আর কোন ক্ষতি হয়নি তো? আপনি ঠিক আছেন তো? কি ঘটেছে? কেন এমন ঘটল? আপনি………..।’ জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটনের কণ্ঠে উদ্বেগ।
আহমদ মুসা জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটনের কথায় বাধা দিয়ে বলল, ‘মি. জেনারেল, আমি ভাল আছি। সব বলছি আমি। কিন্তু তার আগে আপনি দয়া করে ঐ টিলার বাড়িটা ঘিরে ফেলার নির্দেশ দিন। জেনারেল শ্যারন ওখানে পালিয়েছে্’।
আহমদ মুসা যখন এ কথাগুলো বলছিল, তখন আরও একটা গাড়ি এসে দাঁড়াল এবং তা থেকে ২ জন নারী পুরুষ নেমে ছুটে এসে আহমদ মুসার পাশে দাঁড়িয়েছিল।
আহমদ মুসা কথা বলতে বলতেই তাদের দিকে তাকিয়েছিল। সান ওয়াকার ও মেরী রোজ আলেকজান্ডারকে দেখে হাসিতে মুখ ভরে গিয়েছিল আহমদ মুসার।
‘জেনারেল শ্যারন দি কালপ্রিট?’ আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই ফুসে উঠল জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটনের কণ্ঠ।
বলেই জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন তার পাশে দাড়ানো দু’জন অফিসারের একজনকে বলল, ‘কর্ণেল বব আপনি কর্ণেল ষ্টিভেনকে বলুন তিনি লোকদের নিয়ে যেন টিলার বাড়িটা চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেন।’
নির্দেশের সাথে সাথে কর্ণেল বব ছুটল পিকআপ গাড়িটার দিকে। জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন যখন ববকে নির্দেশ দিচ্ছিল, সেই সময় আহমদ মুসা সান ওয়াকারের দিকে ফিরে বলল, ‘তোমরা? এ সময় কোত্থেকে? ভাল আছ তো? ওগলালা কেমন আছে?’
আহমদ মুসার এত প্রশ্নের কোনটির জবাব না দিয়ে সান ওয়াকার বলল, ‘আহমদ মুসা ভাই, আপনি সাংঘাতিক আহত। মারাত্মক ব্লিডিং হচ্ছে।’ কণ্ঠে উদ্বেগ সান ওয়াকারের।
ববকে নির্দেশ দিয়েই জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন তার দ্বিতীয় অফিসারকে বলল, ‘কর্ণেল টনি স্মিথ তুমি গিয়ে গাড়ি থেকে ফাস্ট এইড নিয়ে এসে ওর আহত জায়গাটা বেঁধে দাও, রক্ত বন্ধ হওয়া দরকার।’
কথা শেষ করে জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন আহমদ মুসার দিকে ফিরতেই আহমদ মুসা সান ওয়াকারদের দেখিয়ে তাকে বলল, ‘এ সান ওয়াকার, তুখোড় ছাত্র, রেডইন্ডিয়ান মুভমেন্ডের একজন নেতা এবং ও মেরী রোজ আলেকজান্ডার, চীফ জাষ্টিস আলেকজান্ডারের মেয়ে। এরা আমার ভাই বোন।’
জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন ওদের সাথে সম্ভাষণ বিনিময় করে আহমদ মুসার দিকে ফিরে বলল, ‘ঘটনা কি মি. আহমদ মুসা?’
জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটনের অফিসার কর্ণেল টনি স্মিথ তখন আহমদ মুসার ডান বাহুর আহত জায়গাটা বাঁধছিল। আহমদ মুসা জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটনের জিজ্ঞাসার জবাবে বলল, ‘জেনারেল শ্যারনদের এক ঘাটিতে অভিযান চালিয়ে সারা জেফারসন ও নোয়ান নাবিলাকে উদ্ধার করা হয়েছে। ডেভিড উইলিয়াম জোনস বন্দী হয়েছেন। আহত অবস্থায় পালাতে পেরেছিলেন জেনারেল শ্যারন। তাকে ফলো করেই আমি এখানে এসেছি।’
জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটনের চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, ‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ।’
বলে মুহুর্তকাল থেমেই আবার শুরু করল, ‘কিন্তু আপনার গাড়ি ও আপনার এই অবস্থা হলো কি করে?’
‘জেনারেল শ্যারনের গাড়িটা ছিল বিশেষ ধরনের। গাড়ির পেছনে টপের কভারে অটোমেটিক মেশিনগান ও গ্রেনেড লাঞ্চার ফিট করা ছিল। আমি সেটা বুঝতে পারিনি। তাকে ধরার জন্যে তার গাড়ির কাছে এসে পড়েছিলাম। তারপর যা ঘটার তাই ঘটেছে। আমি মাটিতে পড়ে থেকেই দেখতে পেলাম, শ্যারন গাড়ি নিয়ে টিলার বাড়িটিতে উঠে গেল।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। মৃত্যুর মুখ থেকে তিনি আপনাকে বাঁচিয়েছেন।’ এক সাথেই বলে উঠল জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন এবং সান ওয়াকাররা।
কথা শেষ করেই জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন তাকাল সান ওয়াকারের দিকে। বলল, ‘মি. সান ওয়াকার, আমি একজন ষ্টাফ সার্জেন্টকে সাথে দিচ্ছি। আপনারা আহমদ মুসাকে পেন্টাগনের সামরিক হাসপাতালে দয়া করে পৌছে দিন।’
‘কিন্তু আমি জেনারেল শ্যারনের শেষটা না দেখে যাই কি করে?’ জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটনের প্রস্তাব শুনেই বলে উঠল আহমদ মুসা।
‘প্লিজ মি. আহমদ মুসা, প্লিজ। আপনার এখনই ট্রিটমেন্ট দরকার। শ্যারনকে খুঁজে বের করতে এবং ধরতে কতটা সময় যাবে বলা যাচ্ছে না। আপনাকে সে সময় পর্যন্ত রাখা যায় না, উচিত নয়। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, নিউ হারমানের দুষকর্মই তার শেষ দুষকর্ম। ওকে আমরা ধরে নিয়ে আসছি। আপত্তি করবেন না। যান এদের সাথে। প্লিজ।’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘ঠিক আছে জেনারেল। আল্লাহ আপনাদের সফল করুন।’
খুশি হয়ে উঠল সান ওয়াকার ও মেরী রোজ আলেকজান্ডারের মুখ। ওরা আহমদ মুসাকে নিয়ে চলল ওদের গাড়ির দিকে।
সান ওয়াকার ড্রাইভিং সিটে বসে আহমদ মুসাকে বলল, ‘ভাইয়া মেরী আপনার সাথে পেছনে উঠুক।’
‘না সান ওয়াকার, সাথী হিসেবে অস্ত্রধারী এবং সার্জেন্ট আমার জন্যে ভাল হবে।’ বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার কথা শুনেই সান ওয়াকার তার ভুল বুঝতে পারল। বিকল্প থাকা অবস্থায় কোন মেয়েকে আহমদ মুসা তার পাশে বসা এ্যালাউ করবেন না।
সান ওয়াকার হাসল। বলল, ‘ভুল হয়েছে আমার ভাইয়া। ইসলামের সব এটিকেট এখনও শিখে উঠতে পারিনি। পদে পদেই ভুল হয়।’
হাসল আহমদ মুসাও। বলল, ‘মেরী রোজ দেখবে তোমাকে ছাড়িয়ে যাবে এ ব্যাপারে।’
‘ভাইয়া সান ওয়াকারকে জিজ্ঞেস করুন তো, সে প্রতিদিন কতটুকু কোরআন শরীফ পড়ে, এ পর্যন্ত কতগুলো হাদিস ও পড়েছে।’ বলল মেরী রোজ গাড়িতে উঠতে উঠতে।
‘এখন পড়ার খুব চাপ যাচ্ছে। এ কারণেই কিছুটা পিছিয়ে পড়েছি ভাইয়া।’ বলল গম্ভীর মুখে সান ওয়াকার।
‘কোন চিন্তা নেই সান ওয়াকার। মেরী রোজ দেখবে তোমাকে ঠিক করে দেবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ধন্যবাদ ভাইয়া। আগাম কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি মেরীকে।’ বলল সান ওয়াকার।
সবাই গাড়িতে উঠেছে।
ছুটতে শুরু করল গাড়ি।

হোয়াইট হাউজের একটি কমিটি কক্ষ।
প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা কমিটির একটা বৈঠক চলছে। অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত আছেন প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা উপদেষ্টাসহ সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন, সিআইএ প্রধান এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার, এফবিআই প্রধান জর্জ আব্রাহাম জনসন, পুলিশ প্রধান বিল বেকার। আজ বিশেষ আমন্ত্রণে উপস্থিত আছেন সিনেটের গোয়েন্দা বিষয়ক স্পেশাল কমিটির চেয়ারম্যান আনা প্যাট্রেসিয়া, প্রতিনিধি পরিষদের গোয়েন্দা বিষয়ক সিলেক্ট কমিটির চেয়ারম্যান এ্যান্ড্রু জ্যাকবস এবং সিনেটের পররাষ্ট্র বিষয়ক বিশেষ কমিটির চেয়ারম্যান বব এইচ ব্রুস।
আলোচনা চলছিল।
কথা বলছিল তখন সিনেট ইনটেলিজেন্স কমিটির চেয়ারম্যান আনা প্যাট্রেসিয়া। বলছিল যে, ‘আমি উদ্বিগ্ন, আমাদের মিডিয়ার ক্রেডিবিলিটি মারাত্মক হুমকির মুখে। সেবার আমাদের ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়াতে দারুণ ফলাও করে খবর বেরুলো যে, লস আলামোসের গোয়েন্দা সুড়ঙ্গের ব্যাপারটা ভুয়া। ওটা আহমদ মুসার কল্পনার সৃষ্টি, মার্কিন ইহুদীদের বিপদে ফেলার জন্যে এবং তার সাথে সাথে বলা হলো লস আলামোসের ঘটনার পরবর্তী যে কিলিং ও সান্তাফে বিমান বন্দরে বিমান ধ্বংস হওয়ার যে ঘটনা ঘটাল, তা আহমদ মুসার নৃশংসতা। কিন্তু একদিন পরেই মূলত আহমদ মুসা ও ফ্রি আমেরিকার চেষ্টায় মিডিয়াতে একদম বিপরীত খবর বেরুল। একেবারে অকাট্য দলিল দস্তাবেজ দিয়ে প্রমাণ করা হলো যে, লস আলামোস ও সবুজ পাহাড়ের সংযোগকারী গোয়েন্দা সুড়ঙ্গটা ইহুদীদের তৈরী এবং পরবর্তী কিলিং ও বিমান ধ্বংসের ঘটনা ইহুদীবাদী শ্যারনরাই ঘটিয়েছে লস আলামোস ঘটনার তদন্তকারী টিমকে হত্যার জন্যে। আবার গতকালই মিডিয়া সাংঘাতিক খবর দিল, আহমদ মুসাই নিউ হারমানে গণহত্যা ঘটিয়েছে। এই অভিযোগে আহমদ মুসাকে গ্রেপ্তারও করা হলো। কিন্তু আজকেই আবার আমাদের মিডিয়া সম্পূর্ণ উল্টো খবর প্রকাশ করতে বাধ্য হলো। যাতে ভিডিও টেপের মাধ্যমে প্রমাণ করা হলো মার্কিন ইতিহাসের এই জঘন্য হত্যাকান্ড ইহুদীবাদী জেনারেল শ্যারনরাই ঘটিয়েছে। সেই সাথে খবর বেরুল, আহমদ মুসা সারা জেফারসন ও নাবিলাকে উদ্ধার এবং ডেভিড উইলিয়াম জোনস ও জেনারেল শ্যারনকে বন্দী করার ব্যাপারে প্রধান ভূমিকা পালন করেছে।’
একটু থামল আনা প্যাট্রেসিয়া, তারপর আবার বলল, ‘আমি একথাগুলো বললাম এজন্যে যে, নিজেরা কিছু অনুসন্ধান না করে, মোটামুটি নিশ্চিত না হয়ে খবর ছাপানোর ফলে মিডিয়ার এই যে ক্রেডিবিলিটি বিপর্যয় তার কারণ হচ্ছে আমাদের মিডিয়ার বৃহত্তর অংশ আজ ইহুদীবাদী শ্যারনদের দখলে।’ থামল আনা প্যাট্রেসিয়া।
‘আমি মিস আনা প্যাট্রেসিয়া সাথে একমত। কিন্তু সমস্যা হলো মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করার কোন আইন মার্কিন গণতন্ত্রে নেই। একটাই বিকল্প, সেটা হলো দেশ প্রেমিক মিডিয়া সৃষ্টি করা। যাহোক, বিষয়টা এখানেই থাক। আমার মনে হয় প্রসঙ্গ থেকে আমরা একটু সরে এসেছি।’ বলল সিনেটের পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান বব এইচ ব্রুস।
প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা উপদেষ্টা দ্রুত ফ্লোর নিল। বলল, ‘লস আলামোস ও নিউ হারমানের ঘটনা মার্কিন জনগনের বিশ্বাস ও সেন্টিমেন্টে মারাত্মক ঘা দিয়েছে। জেনারেল শ্যারন, ডেভিড উইলিয়াম জোনস ও বেন ইয়ামনিসহ প্রধান কালপ্রিটরা ধরা পড়েছে। অবশিষ্টরাও ধরা পড়বে। আইন অনুসারে তাদের বিচার হবে। ইহুদীবাদী যে প্রবণতা নিউ হারমানে গণহত্যা চালাল নিজ কম্যুনিটির উপর এবং লস আলামোসে বিশ্বাসের ঘরে ডাকাতি করল, তা এ ধরনের ডাকাতি কত করেছে, আরও কত করবে কে জানে! এরা বিপদে ফেলেছে মার্কিন জনগণকে, বিপদে ফেলেছে মার্কিন ইহুদী জনগোষ্ঠিকেও। এখন ভাববার বিষয় হলো, এদের হাত থেকে মার্কিন জনগণকে উদ্ধারের জন্যে আমরা কি করব?’ থামল প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা উপদেষ্টা।
‘কিছু একটা অবশ্যই করতে হবে। ডেভিড উইলিয়াম জোনস মার্কা ইহুদীবাদীরা আমেরিকান নয়, প্যাট্টিয়ট তো নয়ই। এদের আনুগত্য প্রমিজড ল্যান্ড ইসরাইলের প্রতি। তারা ইসরাইলের জন্যেই কাজ করে। টাকা-পয়সা থেকে বৈজ্ঞানিক তথ্য পর্যন্ত সবই তারা ইসরাইলের জন্য যোগাড় করে। জন জ্যাকবসের মত সম্মানিত বিজ্ঞানীও আমেরিকান হতে পারেননি। গোয়েন্দা সুড়ঙ্গ গড়ে লস আলামোস থেকে ইসরাইলের জন্যে বৈজ্ঞানিক তথ্য পাচার করে তিনি বিশ্বাসের ঘরে চরম ডাকাতি করেছেন। জন জ্যাকব যখন বিশ্বাসী হননি, তখন কোন ইহুদীবাদীকেই বিশ্বাস করা যায় না। এরা অক্টোপাশের মত। এই অক্টোপাশের বিদায় করা ছাড়া আমেরিকানদের মুক্তির কোন উপায় দেখি না।’ বলল সিনেট ইনটেলিজেন্স কমিটির চেয়ারম্যান আনা প্যাট্রেসিয়া।’
‘ধন্যবাদ মিস আনা প্যাট্রেসিয়া। আপনি যেটা বললেন, সেই বিদায়টা কি? কিভাবে? বলল প্রেসিডেন্ট।
‘এই বিদায় আক্ষরিক, অনাক্ষরিক দুই-ই হতে পারে মি. প্রেসিডেন্ট। অনাক্ষরিক বিষয়টা হলো, আমরা আমাদের প্রশাসন, অর্থনীতি, ব্যবসায়-বাণিজ্য, শিক্ষা-স্বাস্থ্যে কোন ক্ষেত্রেই ইহুদীবাদীদের কোন আশ্রয় প্রশ্রয় দেব না। তাহলে তারা নিজেরাই ধীরে ধীরে আমাদের দেশ ত্যাগ করবে। দ্বিতীয়ত, ইহুদীবাদীদের প্রমিজড ল্যান্ড ইসরাইলের সাথে সর্বনিম্ন পর্যায়ের কূটনৈতিক সম্পর্কের বাইরে কোন সহযোগিতা, সমঝোতায় আমরা থাকব না।’ আনা প্যাট্রেসিয়া বলল।
‘এটা শুধু অনুকূল জনমত, গণসচেতনতা ও গণ পর্যায়ের প্রতিরোধের মাধ্যমেই সম্ভব। সরকারের এখানে বেশি কিছু করার সুযোগ খুবই কম।’ বলল প্রেসিডেন্ট এ্যাডামস হ্যারিসন।
‘মি. প্রেসিডেন্ট ঠিক বলেছেন। আমার মনে হয় এই গণ সচেতনতা ও জনমত সৃষ্টি হবে। ইতিমধ্যেই যে মামলাগুলো ইহুদীবাদীদের বিরুদ্ধে হয়েছে এবং নিউ হারমানের গণহত্যা, সারা জেফারসন ও নাবিলার কিডন্যাপকে কেন্দ্র করে আরও যে কেসগুলো হতে যাচ্ছে সে সবই এই সচেতনতা সৃষ্টি করবে। কেসের প্রসিডিংসগুলো যেভাবে মিডিয়াতে আসবে তাতে আমরা যা চাই সেই জনমতের সৃষ্টি হয়ে যাবে। প্রতিরোধ উঠে আসবে জনগণের পর্যায় থেকেই।’ বলল এফবিআই প্রধান আব্রাহাম জনসন।
‘এমন যদি শুরু হয়, তাহলে মুসলমানদের নিয়েও তো প্রশ্ন উঠতে পারে?’ প্রেসিডেন্ট এ্যাডামস হ্যারিসন বলল।
‘না মি. প্রেসিডেন্ট, এ ধরনের প্রশ্ন তোলার কোন সুযোগ হবে না। মুসলিম জাতীয়তার একটা আন্তর্জাতিক রূপ আছে সত্য, কিন্তু মুসলমানদের ভূমিগত কোন আন্তর্জাতিক কেন্দ্র নেই। মক্কা মুসলমানদের প্রার্থনা ও তীর্থ কেন্দ্র, কিন্তু মক্কা বা আরবের প্রতি মুসলমানদের কোন রাজনৈতিক আনুগত্য বা কমিটমেন্ট নেই। আরবকে তারা তাদের জাতীয় আবাসভূমি মনে করে না এবং সেজন্য অর্থ-বিত্ত, শ্রম, বুদ্ধি ইত্যাদি দিয়ে একে গড়ে তোলারও কোন প্রয়োজনীয়তা তারা অনুভব করে না। মুসলমানরা গোটা দুনিয়াকেই আল্লাহর ভূমি মনে করে এবং তাই যে দেশেই তারা বসতি স্থাপন করে সে দেশকেই তারা নিজের দেশ হিসেবে গ্রহণ করে। সুতরাং মুসলমান আমেরিকানরা সত্যিকারের আমেরিকান। ইহুদীবাদীদের সাথে তাদের তুলনা হয় না। তাই তাদের ব্যাপারে কোন প্রশ্ন উঠবে না। পৃথিবীতে মাত্র দুটি জাতি আছে, ইহুদী ও হিন্দু, যারা তাদের ধর্ম বিশ্বাসের সাথে তাদের ভূমিকে এক করে ফেলেছে। ইসরাইল ইহুদীদের প্রমিজড ল্যান্ড। তেমনি হিন্দুস্তানকে হিন্দুরা তাদের জাতীয় আবাসভূমি মনে করে। এ জন্যে হিন্দুরা হিন্দুস্তানে অন্যজাতির অস্তিত্ব বরদাশত করতে পারে না। হিন্দুস্তানে আসা সব জাতিকেই তারা গ্রাস করেছে। বৌদ্ধদের মত বড় জাতিকেও তারা ভারত থেকে নির্মূল করেছে। পারেনি শুধু মুসলমানদের। তাই বলে চেষ্টা তারা পরিত্যাগ করেনি।’ বলল আনা প্যাট্রেসিয়া।
‘ধন্যবাদ মিস প্যাট্রেসিয়া, আপনি ভাল কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন। শ্যারনদের তৎপরতার সাথে ভারতীয় আমেরিকানদেরও তো জড়িত দেখা যাচ্ছে। এ ব্যাপারটাও আমাদের বিবেচনায় আসা দরকার।’ প্রেসিডেন্ট বলল।
‘ইয়েস মি. প্রেসিডেন্ট ইহুদীবাদী শ্যারনদের সাথে ইন্ডিয়ান আমেরিকানরা দেখা যাচ্ছে গভীরভাবেই জড়িয়ে পড়েছে। শ্যারনরা আহমদ মুসাকে বন্দী করে রেখেছিল ভারতীয় আমেরিকান এ্যাসোসিয়েশনের চীফ প্যাট্রোন শিব শংকর সেনের বাড়িতে ও তার ফ্যাক্টরী গোডাউনে, আবার সারা জেফারসন ও নাবিলাকেও বন্দী অবস্থায় পাওয়া গেছে তারই আরেক বাসায়। সর্বশেষে আমরা শ্যারনকে যেখান থেকে উদ্ধার করলাম, সে বাড়িটাও ঐ এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ভারত ভূষণ শিবাজীর। প্রেসিডেন্টের মনে আছে জেনারেল শ্যারনদের পক্ষে তদ্বির করতে এসেছিলেন ভারতীয় আমেরিকান এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ভারত ভূষণ শিবাজী, নির্বাহী ডাইরেক্টর বিনোদ বিহারী মালাকার, উপদেষ্টা শরৎসিং বর্মন এবং চীফ প্যাট্রোন শিব শংকর সেন। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে ভারতীয় আমেরিকানরা ব্যক্তিগতভাবে নয়, সামষ্টিকভাবে জেনারেল শ্যারনদের ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
‘মি. প্রেসিডেন্ট, জেনারেল শ্যারনদের বিরুদ্ধে যে সব মামলা দায়ের হয়েছে, তার সাথে শিব শংকর সেন এবং ভারত ভূষণ শিবাজী জড়িত হয়ে পড়েছেন।’ পুলিশ প্রধান বিল বেকার বলল।
‘আমার মনে হয় এখনকার জন্যে এতটুকুই যথেষ্ট। দেখা যাক আইন তাদের কতটা জড়ায়। তাদের এ ভূমিকা তাদের ভুল বোঝার কারণেও হতে পারে।’ প্রেসিডেন্ট বলল।
‘ধন্যবাদ মি. প্রেসিডেন্ট, এভাবেই চিন্তা করা হবে। তবে তাদের এই আতাতটা ট্রেডিশনাল। এই দুই কম্যুনিটির মধ্যে সম্পর্ক ও সহযোগিতার বিষয়টা খুবই পুরানো। ইহুদীবাদী শ্যারনদের আজকের বিপর্যয়ে তাদের কোন প্রকার ভূমিকা অব্যাহত থাকতে পারে। এমনকি ওদের কাজ কিছুটা এরাও আনজাম দিতে পারে।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
‘ধন্যবাদ মি. জর্জ। এদের উপর চোখ রাখতে হবে এবং এদের মধ্যে আবার শ্যারনদের সৃষ্টি না হয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।’ প্রেসিডেন্ট বলল।
‘ইয়েস মি. প্রেসিডেন্ট।’ জর্জ আব্রাহাম জনসন বলল।
‘অবাক লাগছে মি. প্রেসিডেন্ট। ঈশ্বর কখন কাকে দিয়ে কি কাজ করান! আমরা কি কেউ ভাবতে পেরেছিলাম, আহমদ মুসা এদেশে এসে যুগ যুগ ধরে চলে আসা একটি প্রাণঘাতি ষড়যন্ত্রজাল ছিন্ন করে আমেরিকাকে রক্ষা করবেন!’ বলল আনা প্যাট্রোসিয়া।
‘সত্যিই অভাবনীয় মিস আনা প্যাট্রোসিয়া। শ্যারনদের ষড়যন্ত্রে আমরা বারবার তাকে সন্দেহ করেছি, তাকে গ্রেপ্তার করেছি, গ্রেপ্তারের জন্যে পুলিশ লেলিয়ে দিয়েছি। কিন্তু তার কাজ সে করেই গেছে। লাখ লাখ টাকা দিয়ে নিয়োগ করলেও কারো কাছ থেকে এই ধরনের কাজ পাওয়া দুষ্কর। সত্যি আহমদ মুসা অতুলনীয়। এ ধরনের লোক পৃথিবীর সম্পদ, পৃথিবীর মানুষের সম্পদ।’ প্রেসিডেন্ট শেষোক্ত বাক্যটা পূর্ণ করেই পানির গ্লাস তুলে নিলেন। পানি খেলেন। মনে হয় পানি খাওয়ার জন্যেই তিনি থেমেছিলেন।
প্রেসিডেন্ট তার হাতের গ্লাসটা টেবিলে রাখার আগেই জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন বলল, ‘এই লোকটি মৌলবাদী বলে তার কি ভয়ংকর রূপ আমাদের সামনে তুলে ধরা হয়েছিল! অথচ তার মধ্যে যে মানবিকতা দেখেছি তা অনন্য। তিনি তার ধর্মের প্রতি অত্যন্ত নিষ্ঠাবান, তিনি ধর্মের ছোট-খাট নির্দেশও অত্যন্ত যত্নের সাথে পালন করেন। তিনি তার জাতিকে ভালোবাসেন, জাতির কাজেই তিনি তার জীবনকে বিলিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু এই সাথে তিনি অন্য ধর্মকে অশ্রদ্ধা করেন না। অন্য ধর্মের লোকদের তিনি ভালোবাসেন, নিজের লোকদের যেমন ভালোবাসেন। মানুষ হিসেবে সবাই তার কাছে সমান। তাঁর এই অবস্থানকে বিপরীতমুখী এক দ্বৈত রূপ মনে হতে পারে। কিন্তু আহমদ মুসা এই বৈপরিত্যকে জয় করেছেন। তিনি অত্যন্ত গোঁড়া ধার্মিক এবং অত্যন্ত গোঁড়া এক মানবতাবাদী।’
জর্জ আব্রাহাম জনসনের মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। বলল সে, ‘মি. প্রেসিডেন্ট আহমদ মুসা কি বলেন জানেন। তিনি বলেন, যে যত ভালো মুসলমান, সে তত ভালো মানবতাবাদী। তার যুক্তি হলো, ‘আল্লাহ সকলের স্রষ্টা, সকলের পালনকর্তা, সকলের প্রত্যাবর্তন তাঁরই কাছে। তিনি সকল মানুষকে ভালোবাসেন। অন্যদিকে একজন ভালো মুসলমান আল্লাহকে ভালোবাসে নিজের জীবনের চেয়ে বেশি এবং এ কারণেই দুনিয়ার মানুষকেও সে ভালোবাসে অনুরূপভাবে। এটা তাদের রাসুলেরও শিক্ষা। আহমদ মুসা তাদের রাসুলের মানব প্রেমের অনেক কাহিনী বলেন। তার মধ্যে একটি হলো, অন্য ধর্মের এক বৃদ্ধা রাসুল মোহাম্মদকে কষ্ট দেবার জন্যে তার চলার পথে প্রতিদিন কাঁটা বিছিয়ে রাখত। একদিন রাসুল তার চলার পথে কাঁটা দেখলেন না। তিনি বৃদ্ধের খোঁজ নিলেন। জানলেন, বৃদ্ধা অসুস্থ। সংগে সংগে রাসুল বৃদ্ধার বাড়িতে গেলেন। রাসুলের সাহায্য ও শুশ্রুসাতেই বৃদ্ধা ভালো হয়ে উঠে। আহমদ মুসা বলেন, মানুষকে ভালোবাসা আল্লাহকে ভালোবাসারই অংগ।’ থামল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
‘চমৎকার মি. জর্জ। এই আহমদ মুসা যদি মৌলবাদী হয়, তাহলে এই মৌলবাদ দুনিয়ার জন্যে সবচেয়ে বেশি কাম্য।’ বলল প্রেসিডেন্ট।
‘কিন্তু একটা জিনিস আমি বুঝতে পারি না মি. প্রেসিডেন্ট, ইসলাম প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অব্যাহত যুদ্ধের নির্দেশ দিয়েছে এবং আল্লাহর ধর্ম প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ অব্যাহত রাখতে বলেছে। ইসলামের শান্তিবাদিতার সাথে এটা মিলে কি করে?’ বলল প্রতিনিধি পরিষদের গোয়েন্দা কমিটির চেয়ারম্যান এ্যান্ড্রু জ্যাকবস।
‘কিন্তু মিঃ জ্যাকবস আমরা আলোচনা করছি আহমদ মুসাকে নিয়ে, ইসলামকে নিয়ে নয়।’
এ কথা বলে প্রেসিডেন্ট জর্জ আব্রাহাম জনসনের দিকে চেয়ে বলল, ‘মি. জর্জ, মি. জ্যাকবস যা বললেন সে ব্যাপারে আপনি কি কিছু বলবেন?’
‘ইয়েস মি. প্রেসিডেন্ট।’ বলে একটু থামল জর্জ আব্রাহাম। তারপর আবার শুরু করল, ‘আহমদ মুসা ও ইসলাম আলাদা নয়। আহমদ মুসা ইসলামেরই প্রতিকৃতি, প্রতিটি সত্যিকার মুসলমানও তাই। মি. জ্যাকবস যে বিষয়ে বলেছেন সেটা পরিভাষাগত ভুল বুঝাবুঝির ফল। ইসলাম কোন ব্যক্তি বা গ্রুপ কিংবা কোন ধর্মকে লড়াইয়ের প্রতিপক্ষ মনে করেনা। ইসলামের লড়াই জুলুম, অশান্তি ও অবিচারের বিরুদ্ধে। এ হিসেবে জালেম ও শান্তিভংগকারীরাই ইসলামের প্রতিপক্ষ। মি. প্রেসিডেন্ট, মুসলিম রাষ্ট্র আরব সীমান্তে রোমান শাসনকর্তা সুহরাবিল বহুদিন রাজত্ব করেন। ইসলামের নবী তাকে আক্রমণ করেননি, তার সাথে কোন বিরোধও বাধেনি। কিন্তু সুহরাবিল যখন বিনা কারণে আন্তর্জাতিক রীতি লংঘন করে একজন মুসলিম দূতকে হত্যা করল, তখন ইসলামের নবী এই জুলুম ও অবিচারের প্রতিকারের জন্যে যুদ্ধ যাত্রার নির্দেশ দিলেন। সুহরাবিলের অধীনে তখন লক্ষাধিক সৈন্য, কিন্তু মুসলমানরা তিন হাজারের বেশি সৈন্য যোগাড় করতে পারেনি। এরপরও ইসলামের নবী পরিণতির কথা চিন্তা না করে অবিচারের প্রতিকারকেই বড় করে দেখেন। প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ইসলামের যুদ্ধের হুকুমের অর্থ এটাই। আল্লাহর ধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্যে অব্যাহত লড়াইয়ের নির্দেশের অর্থও এই ধরনের। ইসলামে ইহকালীন ও পরকালীন শান্তি, স্বস্তি ও মুক্তির পথকেই আল্লাহর ধর্ম বলা হয়েছে। জুলুম, অশান্তি ও অবিচারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নীতি হিসাবেই ইসলাম মানুষের জন্যে শান্তি, স্বস্তি ও সুবিচারের প্রতিষ্ঠা চায় এবং এ জন্যে অব্যাহত লড়াইয়ের নির্দেশ দেয়। এ লড়াইকে তারা মানবতার জন্যে অপরিহার্য মনে করে। আর এ লড়াই কলমের লড়াই এবং বুদ্ধি ও যুক্তির লড়াই। প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে অস্ত্রের লড়াইও এর সাথে শামিল। এ অস্ত্রের লড়াইয়ের দৃষ্টান্ত সুহরাবিলের সাথে মুসলমানদের যুদ্ধ যাত্রা।’
দীর্ঘ বক্তব্যের পর থামল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
‘ধন্যবাদ মি. জর্জ। ভালো বলেছেন। দেখছি, ইসলাম যে কারণে যুদ্ধ করে তা সার্বজনীন। এ কারণে সবাই যুদ্ধ করে এবং করতে বাধ্য। ‘আল্লাহর ধর্ম’ এর যে অর্থ করেছেন তা চমৎকার। তাঁর শান্তি, সুবিচার, ইত্যাদির কথাতো সব ধর্মই বলে। তাহলে ইসলামের আলাদা বৈশিষ্ট্য কোথায়?’ বলল প্রেসিডেন্ট।
‘সব একত্ববাদী ধর্মই ঈশ্বরের। তবে ওদের দাবী হলো, ইসলাম সর্বকনিষ্ঠ ও পূর্ণাংগ। মানব জীবনের সকল বিভাগে শান্তি ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার পূর্ণাংগ দার্শনিক ও প্রায়োগিক বিধান ইসলাম দেয়, যা অন্য কোন ধর্মে নেই।’ জর্জ আব্রাহাম বলল।
‘এ বিষয়গুলো খুবই নাজুক মি. জর্জ, আসুন আমরা আমাদের আলোচনার মূল প্রসংগে ফিরে যাই। অক্টোপাশের মত যারা আমাদের আবদ্ধ করে রেখেছিল, শ্যারনের সেই ইহুদীবাদীরা শুধু আমেরিকায় নয় বাইরেও আসন গেড়ে বসে আছে। তারা প্রভাবশালীও। তাদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া অবশ্যই হবে। চাপও আসবে শ্যারনদের ছেড়ে দেবার। এ দিকটি নিয়ে আপনারা কেউ কিছু বলেননি।’ বলল প্রেসিডেন্ট।
‘মি. প্রেসিডেন্ট, এটা বড় কোন সমস্যা হবে না। আমরা জনগণের স্বার্থে কঠোর ভূমিকা গ্রহণ করবো। বিশ্ব জনমতের কাছে তাদের স্বরূপ আমরা বিস্তারিতভাবে তুলে ধরব। এর ফলে তারা আত্মরক্ষামূলক অবস্থানে যেতে বাধ্য হবে। তারা বেশি কিছু করার অবকাশ পাবে না। তারা এক সময়ের চরম অবিশ্বস্ত ও নিন্দিত অবস্থানে আবার ফিরে যেতে বাধ্য হবে।’ বলল সিনেটের ফরেন রিলেশন্স কমিটির চেয়ারম্যান বব এইচ ব্রুস।
‘সকলকে ধন্যবাদ। আমরা এখন উঠতে পারি। তার আগে মি. জর্জ বলুন, আহমদ মুসা কেমন আছেন? সুরিনামের আরেকজন লোককে উদ্ধার করেছিলেন, তার খবর কি?’ প্রেসিডেন্ট বলল।
‘আহমদ মুসা সুস্থ হয়ে উঠেছেন মি. প্রেসিডেন্ট। দু’একদিনের মধ্যেই ছাড়া পাবেন। সুরিনামের লোকটি সেখানকার সাবেক প্রধানমন্ত্রী আহমদ হাত্তা নাসুমন। দৈহিক নির্যাতন ছিল তার অসুস্থতার কারণ। সেও সুস্থ হয়ে উঠেছে। আহমদ মুসার পাশের ঘরে তাকে রাখা হয়েছে।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
প্রেসিডেন্ট সকলের দিকে একবার তাকিয়ে বলল, ‘দেখুন আমি মনে করছি, আহমদ মুসাকে মার্কিন নাগরিকত্ব অফার করা উচিত। সে যে এলাকা প্রেফার করবে সেখানে একটা বাড়িও দিতে চাই। আমি যতদূর জানি সৌদি সরকার মক্কা ও মদিনায় তাকে দু’টি বাড়ি দিয়েছে। এ ছাড়া কোন দেশে তার কিছু নেই। তার অবদান মার্কিন জাতি কোন দিন ভুলবে না। ইহুদীবাদী অক্টোপাশ আমাদেরকে আমাদের ফাউন্ডার ফাদারসদের নির্দেশিত জাতীয় লক্ষ থেকে অনেক দূর সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। সেখান থেকে আমরা ফিরে আসছি। অবশ্য সারা জেফারসনের ‘ফ্রি আমেরিকা’ এই লক্ষে আগে থেকেই কাজ করছিল। কিন্তু আহমদ মুসা না এলে, তাঁর সহযোগিতা না হলে এই কামিয়াবী আসতো না। সত্যিকার ‘ফ্রি আমেরিকা’ তার পরশ পেয়েই ধন্য হয়েছে। এই কথা মার্কিন জাতির ভোলা উচিত নয়।’ থামল প্রেসিডেন্ট।
‘আমরা মি. প্রেসিডেন্টের সাথে একমত। সবাই খুশি হবে এই প্রস্তাবে। সবচেয়ে বেশি খুশি হবে ‘ফ্রি আমেরিকা’ ও সারা জেফারসন।’ সমবেত কণ্ঠে বলে উঠল সবাই।
‘ধন্যবাদ সকলকে।’ বলেই প্রেসিডেন্ট তাকাল জর্জ আব্রাহামের দিকে। বলল, ‘সারা জেফারসন ও আহমদ মুসার সম্পর্কের ব্যাপারে মি. জর্জ কি নতুন কিছু জানেন?’
‘দু’জনই এতটা চাপা, এতটা সংযত, এতটা সতর্ক যে আমরা কিছুই জানতে পারছি না। মি. প্রেসেডিন্ট।’ বলল জর্জ আব্রাহাম।
‘মি. জর্জ ওরা দুই সাগর। পৃথক একটা সংযোগ খাল তৈরী ছাড়া ওদের মিলন হবে না। এই সংযোগের জন্যে তৃতীয় পক্ষ চাই।’ প্রেসিডেন্ট বলল।
হাসল জর্জ আব্রাহাম। বলল, ‘মি. প্রেসিডেন্টের ইচ্ছা আমি বুঝেছি। এই দায়িত্ব আমি নিলাম।’
‘সকলকে আবারও ধন্যবাদ।’ বলে প্রেসিডেন্ট উঠে দাড়াল।
উঠে দাঁড়াল সবাই।

পেন্টাগন মিলিটারী হাসপাতাল। হাসপাতালের ভিআইপি উইং।
আহমদ মুসা তার কক্ষের বাইরে দক্ষেণমুখী প্রশস্ত বারান্দায় একটা সোফায় বসে। তার সামনে টি টেবিল।
টি টেবিলের ওপারে আরেক সোফায় বসে আছে পঞ্চাশোর্ধ একজন মানুষ। মুখের আদলটা তার ইন্দোনেশীয় ধরণের। চেহারায় আভিজাত্য। নাম আহমদ হাত্তা নাসুমন।
আহমদ হাত্তা নাসুমন দক্ষেণ আমেরিকার আটলান্টিক তীরের দেশ সুরিনামের একটি প্রাচীন ও সম্মানিত পরিবারের সন্তান এবং সেখানকার একজন প্রভাবশালী রাজনীতিক।
সেদিন জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন সেই টিলার বাড়িটিতে জেনারেল শ্যারনকে ধরার জন্যে যে অভিযান চালিয়েছিল, সেই অভিযানে তারা আহমদ হাত্তা নাসুমনকেও উদ্ধার করে বন্দীদশা থেকে।
আহমদ হাত্তা নাসুমনের ম্লান মুখে শংকার ছায়া। কথা বলছিল সে। বলছিল, ‘গত নির্বাচন সুরিানামের মুসলমানদের জন্যে বিপদ ডেকে আনে। ঐ নির্বাচনে জাতীয় পরিষদের শতকরা ৪৫ ভাগ আসনে মুসলমানরা নির্বাচিত হয়। জাতীয় পরিষদের প্রথম অধিবেশনে আমাকে পরিষদ নেতা নির্বাচিত করে। ফলে সংবিধান অনুসারে আমিই হই দেশের প্রধানমন্ত্রী। আর জাতীয় পরিষদের বিরোধী দলীয় নেতা নির্বাচিত হন রমেশ আগরওয়াল। ইউরোপিয়ান কম্যুনিটির সাহায্য নিয়ে তিনি চেষ্টা করছিলেন প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্যে। পারেনি। তখন থেকেই…।’
‘জাতীয় পরিষদে মুসলমানরা এত সীট পেল কি করে?’ আহমদ হাত্তা নাসুমনকে থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘সুরিনামে জনসংখ্যার আবাসিক বিভাজনটা নৃতত্বীয় জাতি ভিত্তিক। যেমন হিন্দুস্তানী, ক্রোলস (ইউরোপীয় ও আফ্রিকানদের মিশ্রণ), ইন্দোনেশীয়ানস, নিগ্রো, আমেরিকান, ইন্ডিয়ানস, চাইনীজ ইত্যাদি। সেখানে ভোট হয় এই জাতি ভিত্তিক বিভাজন অনুসারে। ঐ নির্বাচনে মুসলমানরা হঠাৎ বিশেষ একটা সুবিধা লাভ করে। হিন্দুস্তানী, ক্রোলস ও ইন্দোনেশীয়ানদের একটা বড় অংশ মুসলমান। যখন শিক্ষার প্রসার কম ছিল, সচেতনতা কম ছিল, তখন নির্বাচনে ধর্ম পরিচয় তেমন একটা প্রভাব বিস্তার করতো না। কিন্তু শিক্ষার হার যত বাড়ছে, ধর্মীয় প্রভাব ততই শক্তিশালী হয়ে উঠছে। গত নির্বাচনে এটা পরিষ্কার বোঝা গেছে। বড় প্রত্যেক জাতির গ্রুপ থেকে মুসলমানরা প্রচুর পরিমাণে নির্বাচিত হয়েছে। এমনকি চীনাদের মধ্যে থেকেও দু’জন নির্বাচিত হয়েছে। সব মিলিয়ে মুসলিম সদস্যদের সংখ্যা দাঁড়ায় পয়তাল্লিশ।’ বলল আহমদ হাত্তা নাসুমন।
‘তার মানে মুসলিম বোধ সেখানে বাড়ছে?’ আহমদ মুসা বলল।
‘হ্যাঁ, তাই।’
‘শিক্ষার প্রসারই কি এর কারণ, ইসলামের পক্ষে সেখানে কোন কাজ হচ্ছে!’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘রাবেতা আলমে আল ইসলামীর একটা অফিস সুরিনামের রাজধানী পারামারিবো’তে রয়েছে। রাবেতা কোরআন, হাদিসসহ কিছু বইয়ের অনুবাদ সুরিনামের সাধারণভাবে কথিত ভাষা ‘টাকি টাকি’তেও করেছে। ইংরেজী, ডাচ, হিন্দী, উর্দু বিভিন্ন আফ্রিকান ভাষার ইসলামী বইও রাবেতা সেখানে বিতরণ করেছে। সুরিনামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পর্যন্ত রাবেতা মসজিদ, মাদ্রাসা তৈরী করেছে। এ সবের বড় একটা প্রভাব অবশ্যই আছে। কিন্তু মুসলমানদের সচেতন করে তোলার সবচেয়ে বড় কাজ করেছে হিন্দুস্তানী হিন্দুরা। তারা ব্যবসায়-বাণিজ্য ও শিল্প কারখানায় খুব প্রভাবশালী। তাদের মধ্যে স্বজনপ্রীতি খুব বেশি থাকে এবং তারা মুসলমানদেরকে বিদ্বেষের চোখে দেখে। তারা যেখানেই থাকে, সেখানে মুসলমানরা প্রবেশাধিকার পায় না। তাদের দেখাদেখি ইউরোপীয়রাও অনেক ক্ষেত্রে মুসলমানদের সাথে বৈষম্যমুলক আচরণ করে। এর ফলে মুসলমানরা চাকরী-বাকরী ও ব্যবসায়-বাণিজ্যে বহুল পরিমাণে বঞ্চনার শিকার হচ্ছে। উদ্ভুত এই বিরূপ পরিস্থিতিই মুসলমানদেরকে তাদের স্বার্থ সম্পর্কে সচেতন করেছে।’
‘ব্যবসায়-বাণিজ্য ও চাকরী-বাকরীতে মুসলমানরা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে নেই?’ প্রশ্ন করল আহমদ মুসা।
‘চাকরী-বাকরীতে যা কিছু আছে ক্রোলস জাতীয় মুসলমানরাই আছে। হিন্দুস্তানী মুসলমানরা চাকরী-বাকরিতে নেই বললেই চলে, কিছু আছে ব্যবসায়-বাণিজ্যে। ইন্দোনেশীয় মুসলমানরা প্রায় সকলেই কৃষিক্ষেত্রে। আর নিগ্রো মুসলমানদের অবস্থা আরও খারাপ। তারা থাকে জংগলে ও পাহাড় এলাকায়। সব মিলিয়ে শহর জীবনে মুসলমানদের প্রভাব উল্লেখযোগ্য নয়।’ আহমদ হাত্তা নাসুমন বলল।
‘বর্তমান বিরোধের সূত্রপাত কিভাবে হলো?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘আজ থেকে ছয় মাস আগে সংবিধান অনুসারে মেয়াদ শেষে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্যে আমার নেতৃত্বাধীন মন্ত্রী সভা ভেঙে দেয়া হয়। প্রেসিডেন্ট ইউরোপীয় জাতি গোষ্ঠির। তিনি তত্বাবধায়ক সরকার গঠন করেন এবং তার প্রধান হিসবে নিয়োগ করেন আরেকজন ইউরোপীয় বংশোদ্ভুত সাবেক আমলাকে। মহাখুশি হয় হিন্দুস্তানী বংশোদ্ভুত হিন্দু জাতিগোষ্ঠিরা। ইউরোপীয় ও তারা এক হয়ে যায়। শুরু হয় ষড়যন্ত্র। মাত্র একমাসে বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রায় ৪শ’ মুসলিম রাজনৈতিক নেতা ও কর্মী হারিয়ে যায়। তারা বেঁচে আছে কিনা তাও জানা যায়নি, আর মরে যাবার কোন চিহ্নও পাওয়া যায়নি। তারপর শুরু হয় আমার পরিবারের উপর হামলা। আমার একমাত্র সন্তান ফাতিমা নাসুমন পারামারিবো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। সেই আমার সবচেয় দুর্বলতম স্থান। এই দুর্বলতম স্থানেই তারা আঘাত করে। মিথ্যা প্রেমের খবর রটনা করে হিন্দুস্তানী এক রাজনীতিকের ছেলে তাকে জোর করে বিয়ে করতে চেষ্টা করে। কিন্তু ব্যর্থ হয়। এরপর তাকে দু’বার কিডন্যাপ করার চেষ্টা করে। এই অবস্থায় দিশেহারা হয়ে আমি ফাতিমাকে গোপনে ওয়াশিংটনে পাঠিয়ে দেই। এতে তারা ভীষণ ক্ষীপ্ত হয়ে ওঠে। তারা আমার হবু জামাতা, অত্যন্ত সম্ভাবনাময় যুবনেতা ওয়াং আলীকে কিডন্যাপ করে। তারা দাবী করেছে ফাতিমাকে ওদের হাতে তুলে না দিলে ওরা ওয়াং আলীকে হত্যা করবে। ওদিকে মন্ত্রীসভা ভেঙে দেয়ার তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন হওয়ার কথা, কিন্তু তা হলো না। আইন শৃংখলার কথা তুলে নির্বাচন তিন মাসের জন্যে পিছিয়ে দেয়া হলো। উদ্দেশ্য, নির্বাচনের আগে আরও সময় নেয়া যাতে মুসলমানদের শিক্ষিত ও সক্রিয় অংশকে ধ্বংস করা যায়। তাই হলো। মুসলমানদের শিক্ষিত ও সক্রিয় অংশ, বিশেষ করে যুবকরা হারিয়ে যেতে থাকল। আতংক সৃষ্টি হলো দেশ জুড়ে। মুসলিম যুবকরা দেশ থেকে পালাতে লাগল। পুলিশ নির্বিকার। পুলিশ ও সরকার স্বীকারই করল না যে, দেশ থেকে কেউ হারিয়ে গেছে। তারা একে নির্বাচন সামনে রেখে অপপ্রচারের একটা কৌশল হিসেবে প্রচার করল। কোন কোন ক্ষেত্রে লুকিয়ে রেখে, দেশ থেকে বাইরে পাঠিয়ে দিয়ে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপাবার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে, এমন কথাও বলা হতে লাগল। এই সূত্র ধরে যে পরিবারের যুবক ছেলে হারিয়ে গেল সেই পরিবারের উপর জুলুমও নেমে এল। শিক্ষিত ও সচেতন শত শত মুসলিম ঘরে আজ কান্নার রোল। মুসলিম পরিবারগুলো বিপুল সংখ্যায় পার্শ্ববর্তী দেশ ব্রাজিল, গায়না, ফ্রেঞ্চ গায়না প্রভৃতি দেশে পালিয়ে যাচ্ছিল। ব্যাপারটা বহিরবিশ্বে জানা-জানি হয়ে যাবে এই ভয়ে সরকার ও হিন্দুস্তানীদের প্রাইভেট বাহিনী সীমান্ত পথগুলোতে পাহারা বসাল। ফলে পালাবার পথও মুসলমানদের বন্ধ হয়ে গেল। খাঁচায় পুরা গিনিপিগের মতই মরতে লাগল মুসলমানরা। নির্বাচন পিছিয়ে দেয়ার দুমাস পর একদিন আমিও কিডন্যাপ হলাম। কিডন্যাপের পর ওরা আমাকে ছেড়ে দেয়ার জন্যে তিনটি শর্ত দিলঃ এক. আমাকে রাজনীতি ছাড়তে হবে, দুই. আমাকে দেশ ত্যাগ করতে হবে এবং তিন. আমার মেয়ে ফাতিমা নাসুমনকে ওদের হাতে তুলে দিতে হবে। আমি অস্বীকার করলে ওরা আমার উপর অকথ্য নির্যাতন চালায় এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে আসে। ওদের পরিকল্পনা ছিল, সুরিনামে নতুন নির্বাচন হওয়া ও ফাতিমাকে উদ্ধার করার পর আমাকে হত্যা করবে।’
‘আপনার মেয়ে ফাতিমাকে হাতে পেতে ওরা এতটা মরিয়া কেন? শুধুই কি নারী দেহ টার্গেট?’ বলল আহমদ মুসা।
‘না তা নয়। ফাতিমাকে বাইরে রেখে আমাকে হত্যা করলে আমার কথা ও সুরিনামের পরিস্থিতি প্রকাশ হয়ে পড়ার ভয় থাকে। দ্বিতীয়ত, আমার মেয়েকে বাগে এনে আমার বিরাট জমিদারী তারা কব্জা করতে চায়। সুরিনাম উপকূলে কৃষিযোগ্য এলাকার মধ্যে আমাদের জমিদারীটাই সবচেয়ে বড় ও প্রাচীন। তৃতীয়ত, আমাকে ও আমার মেয়েকে শেষ করার মাধ্যমে আমাদের পরিবার ধ্বংস করতে পারলে তারা মনে করে, সুরিনামে মুসলিম রাজনীতির মেরুদন্ড আপাতত ভেঙে পড়বে।’ আহমদ হাত্তা নাসুমন বলল।
‘ইন্দোনেশীয়, হিন্দুস্তানী, ক্রোলস, চীনা ইত্যাদি সব কম্যুনিটি থেকেই যেহেতু লোক হারাচ্ছে এর কোন প্রতিক্রিয়া নেই? সংবাদপত্রগুলো কিছু লেখে না?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘প্রতিক্রিয়া আছে, কিন্তু তা ভীতিতে রূপান্তরিত হয়েছে। আর প্রতিক্রিয়া জানাবে কার বিরুদ্ধে? সরকার, হিন্দুস্তানী ও ইউরোপীয়রা এর সাথে জড়িত, তার কোন প্রমাণ নেই। কিডন্যাপগুলো হচ্ছে খুবই পরিকল্পিতভাবে। বাড়ি থেকে কেউই হারাচ্ছে না। হয়তো একজন শহরে গেল, আর ফিরে এল না। হয়তো কেউ গঞ্জ-বাজারে গেছে, সেই যাওয়া তার শেষ যাওয়া হলো। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনেক সময় গায়েব হয়ে যাচ্ছে মুসলিম যুবকরা।’ থামল আহমদ হাত্তা নাসুমন।
‘তার মানে কিডন্যাপগুলো একটি সংঘবদ্ধ কোন গ্রুপের কাজ, যারা তাদের টার্গেটেড ব্যক্তির প্রতিদিনের গতিবিধি পাহারা দিয়ে একদিন সুযোগ মত তাকে কিডন্যাপ করে। আপনি প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, বলতে পারেন এ ধরনের কোন গ্রুপ সুরিনামে আছে?’ আহমদ মুসা বলল।
‘না এ ধরনের কোন গ্রুপ ছিল না। ক্রিমিনালদের ছোট ছোট গ্যাং ছিল, কিন্তু কোন পলিটিক্যাল মটিভে তারা উদ্বুদ্ধ ছিল না। তবে ‘মাতৃ সন্তান’ নামে একটা গ্রুপ ছিল। এরা সীমাবদ্ধ ছিল হিন্দুস্তানী হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে। তরুণ ও যুবকরাই এই গ্রুপের সদস্য। গ্রুপটা সাংস্কৃতিক। প্রতিদিন সকালে ঈশ্বর বন্দনা, ইতিহাস থেকে গল্পের আসর পরিচালনা ও শরীর চর্চা তাদের একমাত্র কাজ।’
বলে একটু থামল আহমদ হাত্তা নাসুমন। তারপর শুরু করল আবার, ‘আমার মনে হয় কিডন্যাপকারী গ্রুপটা বিদেশী, হায়ার করা। আমাকে যারা কিডন্যাপ করেছিল তাদের প্রায় সবাই বিদেশী। সুরিনামের মাত্র একজন যুবক ছিল তাদের সাথে। তাদের কথা শুনে মনে হয় তারা কারও পক্ষে কাজ করছে।’ থামল আহমদ হাত্তা নাসুমন।
‘সেই বিদেশীরা কি শ্বেতাংগ, না কৃষ্ণাংগ?’ প্রশ্ন করল আহমদ মুসা।
‘কৃষ্ণাংগ কেউ ছিল না। তবে শ্বেতাংগরাও পিউর শ্বেতাংগ কেউ ছিল না। দেহের রং ও গড়ন এশিয়ার কোন কোন এলাকার মানুষের মত।’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘আর তাদের সাথে সুরিনামের যে লোকটি ছিল, সে নিশ্চয় হিন্দুস্তানী ছিল?’
‘হ্যাঁ, তাই।’ বলল আহমদ হাত্তা নাসুমন।
‘তার মানে হিন্দুস্তানীরা হায়ার করেছিল ইহুদী সন্ত্রাসীদের ক’জনকে?’ আহমদ মুসা বলল।
‘ওরা ইহুদী ছিল?’ হাত্তা নাসুমনের কণ্ঠে বিস্ময়।
‘আপনি যেখানে বন্দী ছিলেন, সে বাড়িটা ছিল ভারতীয় আমেরিকানদের নেতা ভারত ভূষণ শিবাজীর। আর ঐ বাড়ি থেকে পুলিশ যে দু’জনকে গ্রেপ্তার করেছে, তাদের একজন বিশ্ব ইহুদী গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান জেনারেল শ্যারন, অন্যজন দুর্ধর্ষ্য ইহুদী গোয়েন্দা বেন ইয়ামিন।’ বলল আহমদ মুসা।
বিস্ময়ে চোখ দু’টি বড় বড় হয়ে উঠেছে আহমদ হাত্তা নাসুমনের। বিস্ময়-বিমূঢ় সে। কিছু বলতে পারল না।
আহমদ মুসাই শুরু করল। বলল, ‘বিস্ময়ের কিছু নেই মি. হাত্তা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় আমেরিকানরা সহযোগিতা করছে ইহুদীবাদীদের, আর সুরিনামের ইহুদীবাদীরা সহযোগিতা করতে পারে ভারতীয় সুরিনামীদের।’
‘আশ্চর্য আতাঁত। কিন্তু আমাদের সুরিনামে তো ইহুদী নেই! কিভাবে আতাঁত গড়ে উঠল?’ বলল আহমদ হাত্তা নাসুমন।
‘আমার ধারণা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভারতীয় কম্যুনিটির সাথে আপনাদের ভারতীয় কম্যুনিটির যোগাযোগ আছে। এই যোগাযোগ থেকেই ওরা ইহুদীবাদীদের সাহায্য পেয়েছে।’ । আহমদ মুসা বলল।
‘দুর্ভাগ্য সুরিনামের।’ বলল আহমদ হাত্তা নাসুমন। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল তার বুক থেকে।
‘নির্বাচনের আর কত দেরী?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘তিন মাস।’
‘এখন আপনি কি করবেন?’
‘এই অবস্থায় আমরা সেখানে নির্বাচন করতে পারব না। আমাদের পাঁচ ছ’শ সক্রিয় নেতা-কর্মী হারিয়ে গেছে। আর এর সাথে সংশিস্নষ্ট করে এর চেয়েও বেশি নেতা-কর্মীকে জেলে পুরা হয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা হলো, নিরাপত্তার অভাব। কেউ সক্রিয় হলেই তার আর রক্ষা থাকবে না। হারিয়ে যেতে হবে, নয়তো জেলে যেতে হবে মামলায় পড়ে। আমাদের মুসলিম কম্যুনিটির প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই কান্নার রোল, বিষাদের ছায়া। সাহস করে দাঁড়াবার শক্ত মেরুদন্ড কারোর নেই। এই অবস্থায় তারা নির্বাচন করবে কি করে?’
বলতে বলতে কণ্ঠ ভারী হয়ে উঠেছে আহমদ হাত্তা নাসুমনের তার দু’চোখের কোণায় জমে উঠেছে অশ্রু।
আহমদ মুসার মনও ভারী হয়ে উঠেছে। তার চোখের সামনে ফুটে উঠল সুরিনামের ক্রন্দন কাতর মুসলিম জনপদের দৃশ্য। একটা অদৃশ্য কালো থাবা সেই জনপদগুলোকে গ্রাস করছে, ভেসে উঠল তার চোখে সেই দৃশ্যও। হৃদয়টা মোচড় দিয়ে উঠল আহমদ মুসার।
ভাবছিল আহমদ মুসা। বেশ একটু পর ধীরে ধীরে বলল, ‘আচ্ছা বলুন তো এতগুলো লোক নিখোঁজ হলো বা অপহৃত হলো, কোন ক্ষেত্রেই কি ওরা বাঁধা পায়নি, ধরা পড়েনি?’
‘না। ভোজবাজীর মতই ঘটে গেছে সব ঘটনা। মনে হয় তারা উপযুক্ত সুযোগের জন্যে অপেক্ষা করেছে। সুযোগ পাওয়ার পর বাধা দেবার আর কোন সুযোগ দেয়নি।’
‘এই অদৃশ্য শত্রুকে আপনারা খুঁজে বের করার কোন সংঘবদ্ধ উদ্যোগ নেননি!’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
ম্লান হাসল আহমদ হাত্তা নাসুমন। বলল, ‘তা করা হয়েছে। একাধিকবার কমিটি গঠন করা হয়েছে। মুসলিম পুলিশ ও আমলাদের সাহায্য নেয়া হয়েছে। কিন্তু পা বাড়াবার পর তারাই আক্রান্ত হয়েছে। কমিটির সদস্যরাই কিডন্যাপের শিকার হয়েছে। এ ধরনের কয়েকটি ঘটনার পর কোন লোক এমন উদ্যোগ গ্রহণেও আর সাহস পায়নি।’
‘নিখোঁজরা কি সব নিহত বলে মনে করেন?’ আহমদ মুসা বলল।
‘এমন মনে করতে ভয় হয়। কিন্তু মেরে না ফেললে এত লোককে তারা রাখবে কোথায়? কেন রাখবে?’
‘মেরেই যদি ফেলে থাকে, তাহলে কিডন্যাপ করে কেন? মেরে ফেলে চলে যেতে পারে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘একই কম্যুনিটির এত লোক নিহত হলে দেশ ছাড়াও বিদেশে এর প্রতিক্রিয়া হবে। এই অসুবিধা বোধ হয় তারা এড়াতে চেয়েছে।’
‘এতবড় ঘটনা ঘটাবার ওদের প্রধান উদ্দেশ্য কি?’ প্রশ্ন করল আহমদ মুসা।
‘প্রথমত, মুসলমানদের নির্বাচন থেকে বিরত রাখা এবং যে মুসলমানরা রাজনীতিতে প্রধান শক্তি হতে যাচ্ছিল, তাদেরকে পেছনে ঠেলে দেয়া। কিন্তু আসল লক্ষ হলো, সুরিনামের হিন্দুস্তানীকরণের পথ সুগম করা। ইউরোপীয়দেরকে তারা হাত করেছে। এখন মুসলমানদের রাজনীতির মঞ্চ থেকে সরিয়ে দিতে পারলেই তারা নিরাপদ।’ বলল আহমদ হাত্তা নাসুমন।
‘ধন্যবাদ মি. হাত্তা। আমারও তাই মত।’ বলে একটু থামল আহমদ মুসা। তারপর আবার শুরু করল, ‘সুরিনামের এই মহাবিপদে আপনি এখন কি করবেন ভাবছেন?’
‘আমার ওখানে যাওয়াই বিপজ্জনক। কিভাবে কি করব বুঝতে পারছি না।’ বলল হাত্তা নাসুমন হতাশ কণ্ঠে।
‘একটা সন্ত্রাসই তাহলে সেখানে জয়ী হয়ে যাবে?’ আহমদ মুসা বলল।
‘ওরা সংগঠিত, অন্যেরা অসংগঠিত।’ বলল হাত্তা নাসুমন।
আহমদ হাত্তা নাসুমন থামলেও আহমদ মুসা কোন কথা বলল না। ভাবছিল সে। অনেক্ষণ পর মাথা তুলল আহমদ মুসা। বলল, ‘আপনি এখন সুস্থ। হাসপাতাল থেকে কোথায় যাবেন, কি করবেন?’
‘আমার মেয়েকে খুঁজে বের করব। তারপর চিন্তা করব কি করা যায়। এখনো কিছু ভাবিনি।’ বলল হাত্তা নাসুমন।
‘আপনার মেয়ের কি নাম বলেছিলেন?’
‘ফাতিমা নাসুমন।’
‘পড়ছেন? কোথায় থাকেন?’
‘না এখনও ভর্তি হয়নি। কোথায় আছে আমি জানি না। যেখানে ছিল, সেখানে নিশ্চয় নেই। আমি কিডন্যাপ হবার পর নিশ্চয় সে জায়গা পরিবর্তন করেছে।
হাত্তা নাসুমন তার কথা শেষ করতেই তার এ্যাটেনডেন্ট এসে বলল, ‘স্যার ডাক্তার এসেছেন।’
শুনেই ‘স্যরি’ বলে উঠে দাঁড়াল।
আহমদ মুসা তাকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘শুনুন, আমি হাসপাতাল থেকে রিলিজ নিয়ে নিচ্ছি। হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে প্রথমেই যাব আমি যার গাড়ি নিয়ে শ্যারনকে ফলো করেছিলাম তার কাছে। গাড়ির ক্ষতিপূরণ দিতে। আপনিও আমার সাথে থাকবেন। আপনার মেয়েকে খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত আপনি আমার মেহমান।’
খুশিতে মুখ ভরে উঠল আহমদ হাত্তা নাসুমনের। ধপ করে সে আবার সোফায় বসে পড়ল। দু’হাত চেপে ধরল সে আহমদ মুসার। বলল, ‘এতবড় সৌভাগ্য হবে আমার? আমি আহমদ মুসার মেহমান হতে পারব? আমাকে নিয়ে, আমাদের নিয়ে ভাবছেন আপনি?’
বলে আহমদ মুসার দু’হাত ছেড়ে দিয়ে হাত দু’টি উপরে তুলে বলল, ‘হে আল্লাহ, অসহায় আমরা, আমাদের সাহায্য করুন।’
কথা শেষ করেই উঠে দাঁড়াল হাত্তা নাসুমন। আহমদ মুসাকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে দ্রুত তার কক্ষের দিকে এগুলো। তার দু’চোখের কোণায় অশ্রু চিক চিক করছিল।
আহমদ মুসা উঠতে যাচ্ছিল। কিন্তু দেখল বারান্দা দিয়ে তার দিকে এগিয়ে আসছে লায়লা জেনিফার ও তার স্বামী জর্জ এবং সান ওয়াকার ও তার স্ত্রী মেরী রোজ। লায়লা জেনিফার ও মেরি রোজ দু’জনের গায়েই ফুল হাতা জামা। মাথার রুমাল ওদের গলা ও বুক জড়িয়ে আছে।
খুশি হলো আহমদ মুসা। নড়ে-চড়ে বসল সোফায় আবার।
ওরা এসে পড়লে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়িয়ে ওদের স্বাগত জানাল সালাম দিয়ে এবং বলল, ‘মনে পড়ল বুঝি আমার কথা?’
‘ভাইয়া, জানি একথা আপনি বলবেন। কিন্তু জানেন, আমরা দু’দিন এসে ফিরে গেছি। আপনি ঘুমিয়ে ছিলেন।’ অভিমান ক্ষুব্ধ কণ্ঠ জেনিফারের।
‘জানি জেনিফার। তোমাদের স্লিপ তো পড়েছি। কিন্তু টেলিফোন নাম্বার ছিল না কোন স্লিপে?’ আহমদ মুসা সোফায় বসতে বসতে বলল।
‘আপনি যেহেতু ঘুমিয়ে ছিলেন ভাইয়া, টেলিফোন নাম্বারটা অন্যের হাতে পড়ার সম্ভাবনা ছিল। সেজন্যেই……..।’
জেনিফারের কথার মাঝখানেই আহমদ মুসা বলে উঠল, ‘বাঁ চমৎকার তুমি তো গোয়েন্দা হয়ে উঠছ জেনিফার।’ আহমদ মুসার মুখে হাসি।
‘কখনো না। আপনাকে যা দেখছি। তারপর ঐ পথে পা বাড়াব আমি?’ বলল জেনিফার কৃত্রিম ভয়ের সুরে।
‘ভাইয়া, জেনিফার কিন্তু এখন আমেরিকান ক্রিসেন্টের টার্কস দ্বীপপুঞ্জ শাখার সভানেত্রী।’ জেনিফার থামতেই বলে উঠল জর্জ।
‘অভিনন্দন জেনিফার। যতই মুখে বল, বোন কি ভাইয়ার পথ ছাড়তে পারে? ’ বলে হেসে উঠল আহমদ মুসা। তারপর কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সবাইকে লক্ষ করে বলল, ‘আমি এই হাসপাতালে তোমরা জানলে কি করে?’
‘ভাইয়া নিউ হারমানের আগের দিনের কাহিনী পড়ে আমাদের শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা হয়েছিল। এরপর কি ঘটে? এ ষড়যন্ত্রই কি সত্য হবে? এমন হাজারো প্রশ্ন আর মনের আকুলতা নিয়ে আমরা তাকিয়ে ছিলাম টিভি চ্যানেল ও সংবাদপত্রের দিকে। আলহামদুলিল্লাহ, পরের দিনই আমরা জানলাম আপনার সব কাহিনী এবং সত্য ঘটনা। সংবাদপত্রেই জানলাম আপনি আহতাবস্থায় হাসপাতালে। আপনি কোন হাসপাতালে তা বহুকষ্টে জোগাড় করে আমরা সেদিন সকালেই এখানে ছুটে এসছিলাম। কথা বলতে না পারলেও দেখেছিলাম আপনাকে। সেদিন আমাদের সাথে ওগলালাও ছিল।’
‘ওগলালা কেমন আছে?’ আহমদ মুসা বলল।
‘ভাল।’ বলল সান ওয়াকার।
‘ওকে আমার সালাম দিও। আর আসতে বলো।’ আহমদ মুসা বলল।
‘অবশ্যই ভাইয়া।’ বলল সান ওয়াকার।
‘ভাইয়া সারা জেফারসন আপা কেমন আছেন? ওর হাসপাতালে গিয়েছিলাম, কিন্তু সিকুরিটির লোকরা দেখা করতে দেয়নি।’ লায়লা জেনিফার বলল।
‘তুমি সারা জেফারসনকে চিনলে কি করে?’ আহমদ মুসার কণ্ঠে কিছুটা বিস্ময়।
‘ওঁর মত মহান নেত্রী ও বিখ্যাত এক আমেরিকানকে আমরা জানব না কেন? জানেন, আপনি যখন শ্যারনদের হাতে বন্দী, সারা জেফারসন যখন হাসপাতালে তখন আমরা সবাই, ওগলালাও ওঁর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। প্রায়……..।’
জেনিফারের কথায় বাধা দিয়ে আহমদ মুসা বলে উঠল, ‘দেখাও করেছ ওর সাথে?’
‘অবশ্যই। প্রায় দু’ঘন্টা ছিলাম ওঁর সাথে। কত গল্প আমরা করেছি। খুব খুশি হয়েছেন উনি। আপনাকে নিয়ে কত যে প্রশ্ন করেছেন তিনি। খুঁটে খুঁটে আপনার সব কথা জেনে নিয়েছেন। সারা আপা খুব আবেগ প্রবণ। ভাবীর সাথে কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন? সত্যিই ভাইয়া……..।’
জেনিফারকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে আহমদ মুসা আবার বলল, ‘তার মানে ‘ভাবী’ মানে ডোনা জোসেফাইনের সাথে সারা কথা বলেছে! কেঁদেছে!’ আহমদ মুসার কণ্ঠে শুস্কতা, মুখ ম্লান।
‘হ্যাঁ ভাইয়া। আমরা ভাবীর গল্প করার পর উনি কিছুতেই কথা না বলে ছাড়বেন না।’
বলে একটু থামল লায়লা জেনিফার। বলে উঠল পরক্ষণেই, ‘সত্যি ভাইয়া সারা জেফারসন আপার মত এত মিষ্টি মানুষ আমি দেখিনি। শুধু থাকতেই ইচ্ছে করে ওঁর কাছে। আর আপনি ওঁর কাছে দেবতার চেয়ে বড়। আমরা বিদায়ের সময় উনি কি বললেন জানেন, ‘তোমরা তোমাদের ভাইয়ার প্রতি সুবিচার করছ না জেনিফার। যে লোক নিজের দিকে দেখে না, তাঁকে সবাই মিলে দেখা উচিত।’ এ কথা বলার সময় হাসতে গিয়ে কেঁদে ফেলেছিলেন সারা আপা।’
লায়লা জেনিফারের কথাগুলো তীরের মত বিদ্ধ করল আহমদ মুসার হৃদয়কে। কেঁপে উঠল আহমদ মুসা। অসহনীয় যন্ত্রণা ছড়িয়ে পড়ল তার গোটা দেহে। সারা জেফারসনের ক্ষত-বিক্ষত রক্তাক্ত হৃদয় যেন তার সামনে একেবারে উন্মুক্ত।
আহমদ মুসা বহুকষ্টে নিজেকে সম্বরণ করে প্রসঙ্গটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেবার জন্যে বলল, ‘সারা জেফারসন ভালো আছে। ও হাসপাতাল থেকে ক’দিন আগেই বাসায় ফেরার কথা। যাক। এখন বল, তোমাদের কাজকর্ম কেমন চলছে?’
‘কিন্তু ভাইয়া, আমাদের কথা বলার আগে আপনার কথা আমরা জানতে চাই।’ আক্রমণের মুড নিয়ে বলল জেনিফার।
‘কি কথা?’
‘ভাবী কেমন আছেন?’
‘ভাল।’
‘প্রতিদিনই কথা বলি। আজও সকালে বলেছি।’
‘হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে কোথায় যাবেন?’
‘একজনের গাড়ি কেড়ে নিয়ে জেনারেল শ্যারনকে ফলো করেছিলাম। সে গাড়ির ক্ষতিপূরন দেয়ার জন্যে তার কাছে যাব। তারপর যাব সারা জেফারসনকে দেখতে। সেখানে আমার ব্যাগ-ব্যাগেজও আছে।’
‘তারপর?’
সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল না আহমদ মুসা। সোফায় গা এলিয়ে দিল। চোখ বন্ধ করল। বেশ কিছুক্ষণ পর ধীরে ধীরে বলল, ‘তারপর অনিশ্চিত এক যাত্রা।’
অস্বস্তিকর এক নিরবতা নামল।
নিরবতা ভাঙল জেনিফারই। বলল, ‘কোথায়?’
চোখ খুলল। ম্লান হাসল।
তারপর সোজা হয়ে সোফায় বসল। বলল, ‘বলার মত হয়নি এখনও। পরে বলব তোমাদের।’
লায়লা জেনিফার এ কথায় সন্তুষ্ট হয়নি। কিছু বলতে যাচ্ছিল।
আহমদ মুসা তাকে বাধা দিয়ে বলল, ‘এখন আর কোন কথা নয়। চল কিছু খাই।’
বলে উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা।
তার সাথে সবাই উঠে দাঁড়াল।
আধ ঘন্টা পর ওরা ক্যান্টিন থেকে ফিরে এসে আবার বসল সেই বারান্দায়। ঠিক এ সময় আহমদ মুসা দেখল জর্জ আব্রাহাম জনসন তার দিকে আসছে।
আহমদ মুসা তাকে স্বাগত জানিয়ে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল।
‘সবাইকে তো দেখেছি। ধন্যবাদ সবাইকে।’ বলে বসল জর্জ আব্রাহাম।
‘তোমরা একটু ভেতরে যাও, আমি মি. জর্জের সাথে কথা সেরে নেই।’ বলল আহমদ মুসা জেনিফারদের লক্ষ করে।
‘অবশ্যই।’ বলে উঠে দাঁড়াল জেনিফার এবং সকলে। বলল জেনিফার, ‘আমরা ওদিক থেকে একটু ঘুরে আসি ভাইয়া।’
বারান্দা ধরে লিফটের দিকে এগুলো সবাই।
‘স্যরি, আপনাদের কথার মাঝখানে এসে পড়েছি আমি।’ বলল জর্জ আব্রাহাম।
‘না, না। ওরা দেখতে এসেছে। বসে বসে খোশ গল্প করছিলাম।’
আহমদ মুসা একটু নড়ে চড়ে বসে বলল, ‘ধন্যবাদ মি. জর্জ। হাসপাতালের ব্যবস্থা এত ভাল যে একমাসের কিউর এক সপ্তাহে হয়ে গেছে।’
‘কিন্তু ডাক্তাররা তো অন্য কথা বলেন মি. আহমদ মুসা। তাদের মতে আপনার শরীরে বিধাতার দেয়া কোন মেডিসিন বক্স আছে, যা থেকে শরীর তার নিজের চিকিৎসা নিজেই করতে পারে।’ বলল জর্জ আব্রাহাম।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘ঘটনা তা নয়, কারও শরীরে কিউর তাড়াতাড়ি হয়, কারও হয় ধীরে ধীরে। এটা সবারই জানা।’
‘থাক ওসব। আপনার ও আমাদের সকলের জন্যে সুখবর আহমদ মুসা। প্রেসিডেন্ট আপনাকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। তিনি আপনাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব অফার করেছেন। সেই সাথে এক খন্ড জমি। আপনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যেখানে চান, সেখানেই আপনাকে জমি খন্ডটি দেয়া হবে।’ বলল জর্জ আব্রাহাম।
বিব্রতকর এক লজ্জায় ছেয়ে গেল আহমদ মুসার চোখ-মুখ। বলল, ‘আল হামদুলিল্লাহ। আমার প্রতি প্রেসিডেন্টের এই শুভেচ্ছাকে গ্রহণ করলাম। তার এই শুভেচ্ছা আমার কাছে অমূল্য। আল্লাহ তার ও আমেরিকার মঙ্গল করুন।’
‘ধন্যবাদ আহমদ মুসা। প্রেসিডেন্টকে আপনার এই সুন্দর আবেগের কথা আমি জানাব।’ বলল জর্জ আব্রাহাম।
‘ধন্যবাদ মি. জর্জ।’ বলে একটু থেমেই আবার মুখ খুলল, ‘জেনারেল শ্যারনদের খবর কি?’
‘তিনি এখন সুস্থ। বেন ইয়ামিনও। তাদের রাখা হয়েছে ফেডারেল কারাগারে। নতুন করে আরও দুটি কেস তাদের বিরুদ্ধে করা হয়েছে। একটা নিউ হারমানের ঘটনার বিষয়ে, আরেকটা সারা জেফারসন ও নাবিলাকে কিডন্যাপ করার দায়ে।’ বলল জর্জ আব্রাহাম।
‘চাপ আসছে না আপনাদের উপর?’
‘এসেছে। তার জবাবও দেয়া হয়েছে। জবাবে একজন জঘন্য ক্রিমিনালের পক্ষে ওকালতি করার জন্যে দুঃখ প্রকাশ করা হয়েছে। আর সিদ্ধান্ত হয়েছে সকল চাপকে উপেক্ষা করার।’
‘ধন্যবাদ। কিন্তু আপনারা কি সত্যই ইহুদীবাদী অক্টোপাশকে আমেরিকা থেকে বিদায় করতে পারবেন?’ আহমদ মুসা বলল।
হাসল জর্জ আব্রাহাম। বলল, ‘বিষয়টা যতটা কঠিন ভাবছেন, তা নয়। ইতিমধ্যেই দেশের সকল অঞ্চল থেকে সাধারণ ও ধার্মিক ইহুদীদের প্রতিক্রিয়া এসেছে প্রেসিডেন্টের কাছে। তারা সকলেই জেনারেল শ্যারন ও ডেভিড উইলিয়াম জোনসের ষড়যন্ত্রের সাথে নিজেদের সম্পৃক্ত থাকার কথা অস্বীকার করেছে। তারা তীব্র সমালোচনা করেছে নিউ হারমানের ঘটনার। তারা জেনারেল শ্যারন ও তার সহযোগীদের কঠোর শাস্তি দাবী করেছে। আর মার্কিন জনগণ এ ব্যাপারে এক পায়ে খাড়া। তাদের কাছে আপনি এখন এক ‘মহান হিরো’ আহমদ মুসা।’
‘ধন্যবাদ মি. জর্জ। আমি ভাবছি, কেসগুলোর মাধ্যমে সব ইহুদীদের তো আপনারা চিহ্নিত করতে পারছেন না।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তা সম্ভবও নয়। তবে ইহুদীবাদীদের মেরুদন্ড ভেঙে দেয়া হচ্ছে, তাদের উঠে দাঁড়াবার শক্তি আর রাখা হচ্ছে না। ইহুদীবাদীদের সকল সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। যে কমিটি এই সুপারিশ করবে, সেই কমিটিতে ডা. বেগিন বারাক, আইজ্যাক বেনগুরিয়ানের মত বেশ কয়েকজন সম্মানিত ইহুদী নাগরিক থাকছেন। তাছাড়া ইসরাইল রাষ্ট্রের দূতাবাস ছাড়া ইসরাইল রাষ্ট্রের অন্যসব প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। যে দূতাবাস থাকছে, সেখানে সমাজ-সংস্কৃতি, শিক্ষা ও সমর বিষয়ক কোন বিভাগ ও কোন প্রতিনিধি থাকছে না। ইসরাইলের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক কোন সম্পর্ক থাকছে না। এ সব সিদ্ধান্ত ইহুদীবাদীদের গোড়া কেটে দেবে। উপরন্তু আমেরিকান জুইস এ্যাসোসিয়েশন ও আমেরিকান জুইস কনফারেন্স সিদ্ধান্ত নিয়েছে, কোন ইহুদীবাদীকে তারা তাদের সমিতির সদস্য করবে না, কোন ইহুদীবাদী তাদের সমিতির সদস্য থাকতে পারবে না।’ থামল জর্জ আব্রাহাম।
‘আল্লাহ আমেরিকার মঙ্গল করুন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ।’ বলে জর্জ আব্রাহাম একটু নড়ে-চড়ে বসে বলল, ‘মি. আহমদ মুসা আজ আপনি ছাড়া পাচ্ছেন, তারপর সোজা কিন্তু আমার বাড়িতে গিয়ে উঠবেন।’
‘কেন?’ ঠোঁটে হাসি টেনে বলল আহমদ মুসা।
‘আমার ছেলে জন মুর ও নাতি জুনিয়র আব্রাহাম আসছে। নাতি এসেই আপনার কাছে নিয়ে আসার জন্য জুলুম শুরু করবে। আমার স্ত্রী আপনাকে নিয়ে যেতে বলেছে।’ জর্জ আব্রাহাম জনসন বলল স্নেহপূর্ণ হাসি হেসে।
আহমদ মুসার মুখ এক মিষ্টি হাসিতে ভরে গেল। বলল, ‘জুনিয়র আব্রাহামরা ক’দিন থাকছে?’
‘দিন সাতেক। জন মুরের কিছু কাজ আছে ওয়াশিংটনে।’ বলল জর্জ আব্রাহাম।
‘তাহলে আজ আমি যাচ্ছি না, জরুরী কিছু কাজ আছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘সবে রিলিজ হচ্ছেন, এখনি কোন ‘জরুরী’ কাজে লেগে পড়া ঠিক নয়। ক’দিন আপনার বিশ্রাম চাই।’ বলল জর্জ আব্রাহাম।
‘সে রকম কোন ঝুঁকির কাজ নয়। আমি হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে যাব সেই মেয়েটির বাসায় যার গাড়ি আমি বলতে গেলে কেড়ে নিয়ে এসেছিলাম। গাড়ির ক্ষতিপূরণ আমি নিজে গিয়ে দিয়ে আসতে চাই।’ আহমদ মুসা বলল।
‘হ্যাঁ, এটা একটা বড় কাজ অবশ্যই। আপনি কি ক্ষতি পূরণের টাকাটা পেয়েছেন এফবিআই থেকে?’
‘হ্যাঁ পেয়েছি। ধন্যবাদ আপনাকে।’
‘আমি বিস্মিত হয়েছি। আমেরিকান মেয়েরা সাধারণত এভাবে গাড়ি দেয় না। তাকে আমাদের তরফ থেকেও ধন্যবাদ দেবেন।’ জর্জ আব্রাহাম বলল।
‘ক্ষণিকের দেখা, তবু যতটুকু দেখেছি তাতে মেয়েটিকে আমার ইউরোপীয় বা আফ্রিকান শ্রেণীর আমেরিকান বলে মনে হয়নি।’
‘ইউরোপীয়ান, আফ্রিকান শ্রেণীর ছাড়াও বহু জাতির আমেরিকান আছে এদেশে ইয়ংম্যান।’
‘তা আছে।’
‘হাসপাতাল থেকে গিয়ে উঠছেন তো সারা জেফারসনদের ওখানেই? না লায়লা জেনিফাররা ধরে নিয়ে যাবে?’ জর্জ আব্রাহাম বলল।
‘এসেছে ওরা এ উদ্দেশ্যেই। কিন্তু আমি মেয়েটির সাথে দেখা করে সারা জেফারসনদের ওখানেই যাচ্ছি। ও সুস্থ হওয়ার পর ওর সাথে দেখা হয়নি। আমার ব্যাগ-ব্যাগেজও আছে ওখানে।’ বলল আহমদ মুসা একটু হেসে।
জর্জ আব্রাহাম আহমদ মুসার দিকে পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। একবার ভাবল সারা জেফারসন ও আহমদ মুসার ব্যাপারে যে দায়িত্ব প্রেসিডেন্ট তাকে দিয়েছেন সে কথা আহমদ মুসার কাছে এখনই পাড়বে কিনা। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবল, না তাকে বাসায় নিয়ে গিয়ে ভাল পরিবেশে বলতে হবে। প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে জর্জ আব্রাহাম বলল, ‘আমেরিকান সরকার যে একখন্ড জমি আপনাকে দিতে চান, সেটা কোথায় নেবেন জানতে চাই মি. আহমদ মুসা।’
লজ্জা মিশ্রিত বিব্রতকর এক হাসি ফুটে উঠল আহমদ মুসার মুখে। বলল, ‘ঠিক আছে। আমেরিকার তো আমি সবকিছু চিনি না। সারা জেফারসনের সাথে একটু আলোচনা করে নেই।’
মিষ্টি হাসি ফুটে উঠল জর্জ আব্রাহামের ঠোঁটে। বলল, ‘ওকে ইয়ংম্যান।’
কথা শেষ করেই জর্জ আব্রাহাম মোবাইলটা হাতে তুলে নিয়ে বলল, ‘উঠি মি. আহমদ মুসা।’
‘দু’মিনিট, একটা কথা আছে।’ সচকিত হয়ে উঠে বলল আহমদ মুসা।
তারপর সে আহমদ হাত্তা নাসুমনের সমস্যার কথা সংক্ষেপে জর্জ আব্রাহামকে জানাল এবং বলল, ‘ওঁকেও আমার সাথে রিলিজের ব্যবস্থা করুন। আমি তাঁকে সাথে নিয়ে বেরুব।’ আহমদ মুসা থামল।
ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে উঠেছে জর্জ আব্রাহাম জনসনের। দ্রুত তার মুখে নামল ভাবনার একটা ছায়া। বলল, ‘তার মানে মি. আহমদ মুসা আপনি মি. হাত্তার কেসটা টেক আপ করছেন?’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘এখন প্রথম কাজ হলো তাঁর মেয়েকে খুঁজে দেয়া।’
‘তারপর?’
‘তারপর কি ঘটে দেখতে হবে।’
গম্ভীর হলো জর্জ আব্রাহাম জনসনের মুখ। সে দু’হাতে আহমদ মুসার একটা হাত চেপে ধরে বলল, ‘মি. আহমদ মুসা, বয়সে ছোট হয়েও আপনি অনেক বড়, কিন্তু আমার ছেলের মত। আমার স্ত্রী আপনাকে তার দ্বিতীয় ছেলে দাবী করে। আমি বলছি, দীর্ঘ ধকল গেছে আপনার উপর দিয়ে। দীর্ঘ একটা বিশ্রাম বা ছুটি আপনার প্রয়োজন। আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ চিন্তা আমরা করছি। এ জন্য আমাদেরকে সময় দিতে হবে আপনার।’
আহমদ মুসা তাকাল জর্জ আব্রাহামের দিকে। আবেগে ভারী হয়ে উঠেছে আহমদ মুসার চোখ-মুখ। বলল, ‘জানি আপনারা খুব ভালোবাসেন আমাকে, খালাম্মা আমাকে খুবই আদর করেন। এটা আমার সৌভাগ্য। কিন্তু আপনি তো বুঝবেন, কিছু কাজ, কিছু দায়িত্ব এমন আছে যা এড়ানো যায় না, উচিতও নয়।’
বলে মুহূর্তকালের জন্যে থামল আহমদ মুসা। তারপর বলল, ‘আমি যাই করি, খালাম্মার অনুমতি না নিয়ে করব না।’
স্নেহের আবেগে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে জর্জ আব্রাহাম জনসনের চোখ-মুখ।
‘ধন্যবাদ, বেটা।’ বলে উঠে দাঁড়াল জর্জ আব্রাহাম। উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, ‘জানেন, আপনার খালাম্মা আপনার ধর্মের উপর অনেক বই যোগাড় করেছে। বলে কি জানেন, যে ধর্ম আমার ছেলেকে এতবড় বানিয়েছে, সেটা আমারও ধর্ম। আর এ বিষয়ে তার সবচেয়ে উৎসাহী ছাত্র হলো আমাদের নাতি।’
আহমদ মুসাও উঠে দাঁড়িয়েছে। মিষ্টি হাসি তার মুখে। বলল, ‘আল হামদুলিল্লাহ। খালাম্মাকে বলবেন, আমি দারুণ খুশি হয়েছি। আমি গিয়ে তাঁকে মোবারকবাদ জানাব।’
‘অবশ্যই আহমদ মুসা। আসি। ভালো থাকুন। গুড মর্নিং, আসসালাম।’
ঘুরে দাঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
আহমদ মুসাও হাঁটতে লাগল তার সাথে কিছুটা এগিয়ে দেবার জন্যে।

চারতলা একটা বাড়ির গাড়ি বারান্দায় গাড়ি থেকে নামল আহমদ মুসা।
গাড়িতে বসা ছিল হাত্তা নাসুমন।
আহমদ মুসা গাড়ি থেকে নেমে গাড়ির দরজা বন্ধ করতে করতে বলল, ‘মি. হাত্তা, আপনি একটু বসুন। দেখি মেয়েটি বাড়ি আছে কিনা।’
বলে আহমদ মুসা ছুটল গেটের দিকে। বন্ধ গেট।
দরজার ডানপাশে দেয়ালে ইন্টারকম।
ইন্টারকমের দিকে হাত বাড়াল আহমদ মুসা। কিন্তু সমস্যায় পড়ে গেল। কোন ফ্ল্যাটে কল করবে সে। ৪ তলা বাড়ি। ৪টি ফ্ল্যাট। গাড়ির ব্লু বুকে শুধু মেয়েটির নাম ‘এ্যানি এন্ডারসন’ ও বাড়ির নাম্বার আছে। ফ্ল্যাট নাম্বার নেই।
ভাবল আহমদ মুসা, দু’তলার ফ্ল্যাট সিকুরিটির জন্যে ভালো। প্রথমে দু’তলায় দেখা করব। না হলে সব তলায় নক করতে হবে।
‘বিসমিল্লাহ’ বলে আহমদ মুসা দু’তলার ইন্টারকমে ক্লিক করল।
সেকেন্ডের মধ্যেই ওপর থেকে সাড়া এল। একটা তরুণী কণ্ঠ কথা বলে উঠল, ‘কে ওখানে?’
‘আমি আহমদ মুসা। সেদিন জোর করে আপনার গাড়ি নিয়ে গিয়েছিলাম। গাড়ি ফেরত দেয়ার ব্যাপারে এসেছি।’
‘আহমদ মুসা মানে আপনি মুসলিম?’
‘হ্যাঁ, আমি মুসলিম।’
‘ঠিক আছে, আপনি আসুন।’
তরুণীটির এই কথার সাথে সাথে গেটের তালায় একটা ক্লিক শব্দ উঠল। তার অর্থ গেট খুলে দেয়া হয়েছে।
আহমদ মুসা মুখ ঘুরিয়ে তার গাড়ির দিকে চেয়ে বলল, ‘মি. হাত্তা আসুন।’
হাত্তা নাসুমন এসে গেল।
আহমদ মুসা প্রবেশ করল তাকে নিয়ে।
আহমদ মুসা দু’তলার ল্যান্ডিং-এ সবে এসে দাঁড়িয়েছে। তার পেছনে হাত্তা নাসুমনও।
একটা তরুণী দু’তলার দরজা খুলে বেরিয়ে এল।
নীল রংয়ের ঢিলা ফুলহাতা একটা গাউন তার গোটা দেহ ঢেকে আছে। মাথায় একটা রুমাল।
দরজা খুলেই সে তাকিয়েছে আহমদ মুসার দিকে। কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার দৃষ্টি পেছনের আহমদ হাত্তার উপর পড়তেই বিস্ময়ে তার চোখ বিস্ফোরিত ও মুখ হা হয়ে উঠল। ‘আব্বা’ বলে একটা চিৎকার দিয়ে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল আহমদ হাত্তা নাসুমনকে।
‘মা, একি তুমি!’ বলে হাত্তা নাসুমনও জড়িয়ে ধরেছে তরুণীটিকে।
আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়াল তাদের দিকে। তার চোখে-মুখেও বিষ্ময় ও আনন্দের খেলা। আহমদ মুসা বুঝে নিয়েছে সে যার কাছে এসেছে অর্থাৎ এই তরুণী এ্যানি এন্ডারসনই ফাতিমা নাসুমন, হাত্তা নাসুমনের মেয়ে।
একটা বিরাট স্বস্তি নেমে এল আহমদ মুসার চোখে-মুখে। খুশি হলো সে।
পিতা ও কন্যা দু’জনের চোখেই অশ্রুর ঢল। কাঁদছে দু’জনেই।
প্রাথমিক আবেগটা সামলে নেবার পর হাত্তা নাসুমন মেয়েকে আহমদ মুসার দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বলল অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে, ‘মি. আহমদ মুসা, এই আমার মেয়ে ফাতিমা নাসুমন। আল্লাহ আমার মেয়েকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিয়েছেন আহমদ মুসা।’
বলেই হাত্তা নাসুমন ল্যান্ডিং-এর উপরই সিজদায় পড়ে গেল। পিতার সাথে সাথে সিজদা করল ফাতিমা নাসুমনও।
তারা সিজদা থেকে উঠে দাঁড়াল।
‘আপনারা, পিতা-কন্যা, দু’জনকেই মোবারকবাদ।’ বলল আহমদ মুসা তাদের লক্ষ করে।
‘শুকরিয়া।’ বলল মেয়েটি। তার দু’চোখ তখনও অশ্রুতে ভাসছে।
‘লক্ষ বার শুকরিয়া আদায় করলেও আপনার শুকরিয়া আদায় হবে না আহমদ মুসা।’ প্রায় মেয়ের সঙ্গে সঙ্গেই বলে উঠল হাত্তা নাসুমন।
‘দেখুন, মি. হাত্তা, আল্লাহর নিরংকুশ অধিকারে কারও ভাগ বসাতে চাচ্ছেন আপনি।’ আহমদ মুসার ঠোঁটে হাসি, কিন্তু কণ্ঠে একটা মিষ্টি শাসনের সুর।
কিছু বলতে যাচ্ছিল হাত্তা নাসুমন।
ফাতিমা নাসুমন তাকে বাঁধা দিয়ে বলল, ‘ভেতরে চলুন আব্বা।’ তারপর আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আসুন জনাব।’
সবাই ভেতরে ঢুকল।
দরজা দিয়ে ভেতরে ঢোকার পর ছোট্ট একটা করিডোর, দু’পাশে দেয়াল।
করিডোর গিয়ে পড়েছে বিশাল একটা ড্রইংরুমে।
ড্রইংরুমে প্রবেশ করল তারা।
সমস্ত ড্রইং রুম জুড়ে কয়েক সেট সোফা গুচ্ছাকারে সাজানো। হালকা নীল কার্পেটের উপর সাদা সোফার গুচ্ছগুলোকে সাগর বুকের সফেদ তিলক বলে মনে হচ্ছে।
ড্রইং রুমে আহমদ মুসাকে একটা সোফায় বসার অনুরোধ করে ফাতিমা নাসুমন তার আব্বাকে নিয়ে মুখোমুখি আরেকটা সোফায় গিয়ে বসল।
বসেই ফাতিমা নাসুমন আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মাফ করবেন জনাব, শুরুতেই আমি একটা প্রশ্ন করতে চাচ্ছি।’
‘করুন।’ বলল আহমদ মুসা।
ফাতিমা নাসুমন ত্বরিত তাকাল তার পিতার দিকে। বলল, ‘আব্বা ওঁকে বলুন আমাকে ‘তুমি’ বলার জন্যে। আমি নিশ্চয় ছোট হব।’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘ঠিক আছে ছোট বোন, তোমার শুরুর প্রশ্নটা কর।’
সলজ্জ আনন্দে মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল ফাতিমা নাসুমনের। সে দ্রুত উঠে দাঁড়াল। ছুটে গেল আহমদ মুসার দিকে। তার পায়ের কাছে বসল এবং দু’হাত আহমদ মুসার দু’পায়ে ঠেকিয়ে সালাম করল।
আহমদ মুসা তার দু’পা টেনে নিতে নিতে বলল, ‘এ কি করছ ফাতিমা? পায়ে হাত দিয়ে তো সালাম করে না।’
‘না, আমাদের সুরিনামে আমরা গুরুজনকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করি।’
বলে ফাতিমা নাসুমন ফিরে এল তার আসনে, পিতার পাশে।
বসেই সে আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘জনাব আমি জানতে চাচ্ছি, গত কিছুদিন ধরে আমেরিকার পত্র-পত্রিকায় যে আহমদ মুসার কথা লেখা হচ্ছে, ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের ইতিহাস সৃষ্টিকারী ঘটনাগুলোতে যে আহমদ মুসার নাম শুনেছি এবং চীন, রাশিয়া, ফ্রান্স, আফ্রিকা, ফিলিপাইন, ফিলিস্তিন, ককেশাস, বলকান প্রভৃতি দেশের নানা ঘটনায় যে আহমদ মুসাকে পেয়েছি, সেই আহমদ মুসাই তো আপনি?’
আহমদ মুসা মুখ খোলার আগেই আহমদ হাত্তা নাসুমন মুখ খুলল। বলল, ‘হ্যাঁ মা আমরা ভাগ্যবান। সেই আহমদ মুসাই তোমার গাড়ি নিয়ে গিয়েছিলেন, সেই আহমদ মুসাই আমাকে মুক্ত করেছেন এবং সেই আহমদ মুসাই এখন আমাদের সামনে বসে আছেন।’
‘ও গড!’ বলে বিষ্ময়-বিমুগ্ধ ফাতিমা নাসুমন উঠে দাঁড়াল। দ্রুত আহমদ মুসার দিকে ছুটে গিয়ে আগের মতই তার পায়ের কাছে বসে দু’হাতে আহমদ মুসার দু’পা স্পর্শ করে উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘এটা সালাম নয়। পায়ের ধুলো নিলাম।’
ফাতিমা নাসুমন তার আসনে ফিরে আসছিল। আহমদ মুসা বলল, ‘পায়ের ধুলো নেয়ার প্রচলনও কি সুরিনামে আছে?’
‘হিন্দুস্তানীদের মধ্যে এটা খুব বেশি প্রচলিত। দেখাদেখি মুসলিম সমাজেও এর কিছু চল আছে।’ বলল হাত্তা নাসুমন।
হাত্তা থামতেই ফাতিমা নাসুমন বলে উঠল, ‘আব্বা একটা কথা বলি। সেদিন আমি ওভাবে গাড়ি দেবার কথা নয়। ওঁর হাতে অস্ত্র ছিল না। আমি চেঁচামেঁচি করে লোক ডাকার কথা। কিন্তু আমি পারিনি। মনে হয়েছিল, উনি যা বলছেন সব সত্যি। তাঁর কথা আমার মানা দরকার। আমি তাঁকে গাড়ি দিয়ে দিয়েছি। পরে আমি অনেক ভেবেছি, আমি তখন ঐ ভাবে চিন্তা করেছিলাম কেন? কেন পুতুলের মত ওঁর হাতে গাড়ি তুলে দিলাম। আজ বুঝতে পারছি, উনি আহমদ মুসা ছিলেন বলেই ওঁর নির্দেশ না মেনে উপায় ছিল না।’
বলেই ফাতিমা নাসুমন ওপর দিকে মুখ তুলল। বলতে লাগল, ‘ও আল্লাহ, জনাব আহমদ মুসাকে অসাধ্য সাধনের আরও শক্তি দান করুন। তাঁকে জর্জ ওয়াশিংটনের মত সফল করুন।’ আবেগে ভারী হয়ে গেল ফাতিমা নাসুমনের কণ্ঠ।
‘ধন্যবাদ বোন। সেদিন তোমার সাহায্য আমাদের বিরাট উপকার করেছে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ। আমার খুব ইচ্ছা করছে সেদিন গাড়ি নিয়ে যাবার পর কি ঘটেছিল তা জানতে।’ বলল ফাতিমা নাসুমন আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে।
‘এ ইচ্ছা খুবই স্বাভাবিক।’ বলে আহমদ মুসা সেদিন গাড়ি নিয়ে জেনারেল শ্যারনকে ফলো করা, শ্যারনদের গাড়ি থেকে গোলা-গ্রেনেড নিক্ষেপ, ফাতিমার গাড়ি ধ্বংস হওয়া, আহমদ মুসার গাড়ি থেকে নেমে যাওয়া ও গুলীবিদ্ধ হওয়া, জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন ও সান ওয়াকারদের আগমন, জেনারেল শ্যারনদের গ্রেপ্তারের দায়িত্ব জেনারেল ওয়াশিংটনের নেয়া এবং আহমদ মুসা হাসপাতালে যাওয়ার সব কথা সংক্ষেপে জানিয়ে বলল, ‘তোমার গাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে। গাড়ির ক্ষতিপূরণ দেবার জন্যেই আজ আমার এখানে আসা।’
বলে আহমদ মুসা পকেট থেকে টাকার কয়েকটা বান্ডিল বের করল এবং সামনের টিপয়ের উপর বান্ডিলগুলা রেখে বলল, ‘তোমার গাড়িটা নতুন ছিল। নতুন একটা স্পোর্টস কারের দাম এতে আছে।’
ফাতিমা নাসুমন হাসল। বলল, ‘আপনি গাড়িতে থাকা অবস্থায় গ্রেনেডটা যদি গাড়িতে পড়ত, আপনার জীবনের ক্ষতিপূরণ কিভাবে হতো বলুন তো?’
আহমদ মুসাও হাসল। বলল, ‘ঐ ক্ষতিপূরণ করা যেত না বলেই ক্ষতিটা হয়নি ফাতিমা।’
গম্ভীর হলো ফাতিমা। বলল, ‘আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন আমাদের সবার উপর।’
একটু থেমেই আবার প্রশ্ন করল, ‘আব্বার মুক্তির ঘটনা কিভাবে ঘটল?’
‘ওটা খোদ মি. হাত্তাই বলতে পারবেন।’ বলল আহমদ মুসা।
আহমদ হাত্তা নাসুমন সংক্ষেপে বলল জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন, জেনারেল শ্যারন ও বেন ইয়ামিনকে আহতাবস্থায় বন্দী করার পর কিভাবে গোটা বাড়ি সার্চ করতে গিয়ে বন্দীখানা থেকে তাকে উদ্ধার করা হয়। সে আরও বলল পেন্টাগন সামরিক হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর কিভাবে একজন জেনারেলের কাছে আহমদ মুসার কাহিনী শুনে এবং আহমদ মুসার সাথে পরিচয় হয়। আরও বলল, কি আগ্রহের সাথে আহমদ মুসা সুরিনামের সব কথা শুনে এবং হাসপাতাল থেকে রিলিজ হওয়ার সময় তাকেও সাথে করে নিয়ে এসেছে ফাতিমা নাসুমনকে খুঁজে দেয়ার জন্য। উচ্ছসিত আবেগ নিয়ে কথা শেষ করল সে এই ভাবে, ‘আমার কেবলই মনে হচ্ছে আহমদ মুসার সাথে আমার দেখা হওয়াটা আমাদের সৌভাগ্যের সুর্যোদয়।’
‘ঠিকই বলেছেন আব্বা, ওঁর সাথে দেখা হওয়ার পর আমি তোমাকে খুঁজে পেয়েছি, যে আশা আমি কল্পনাতেও করতে পারিনি।’ বলল ফাতিমা নাসুমন। তারও কণ্ঠ আবেগে ভারী।
বিব্রত আহমদ মুসা প্রসঙ্গ পাল্টাবার জন্যে বলল, ‘ফাতিমা এ টাকাগুলো তোমার নেয়া প্রয়োজন।’
‘না আমি নিতে পারি না।’ বলল ফাতিমা নাসুমন।
‘এ টাকা আমার নয়, আমি তোমাকে দিচ্ছি না। মার্কিন সরকার এ টাকা দিয়েছে তাদের আইন অনুসারেই।’ আহমদ মুসা বলল।
‘এ টাকা দিয়েছে তারা জনৈক এ্যানি এন্ডারসনকে, আহমদ হাত্তা নাসুমনের মেযে ফাতিমা নাসুমনকে নয়। তারা আমার পিতার প্রতি যে এহসান করেছে এবং আমার গাড়ি দেয়াতে যে কাজ হয়েছে, তাতে এ টাকা গ্রহণ করলে আমার বিবেক মরে যাবে।’ বলল ফাতিমা নাসুমন। আবেগে তার চোখ-মুখ লাল হয়ে উঠেছে।
খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল আহমদ মুসার মুখ। বলল, ‘ধন্যবাদ ফাতিমা, আমি আমার অনুরোধ ফিরিয়ে নিচ্ছি। তোমার যুক্তি আমি গ্রহণ করেছি।’
‘ধন্যবাদ ভাইয়া, আমি জানতাম আপনি বুঝবেন।’
বলে একটু থামল ফাতিমা নাসুমন। তারপর পিতার দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, ‘আব্বা আপনি ওয়াং আলীর শেষ খবর বোধ হয় জানেন না।’
‘না, জানি না। কোন খারাপ খবর নেই তো?’ দ্রুত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল হাত্তা নাসুমন। তার কণ্ঠে উদ্বেগ।
‘আগের চেয়ে খারাপ।’ বলল ফাতিমা নাসুমন।
‘কি?’
‘গতকাল ইয়াং আমিরের একটা মেসেজ পেয়েছি। তাতে সে লিখেছে, গত পরশু ওয়াং আলীকে অপহরণকারীরা একটা ক্লিনিকে নিয়ে যায়। সে অসুস্থ না আহত জানা যায়নি। মেসেজের সাথে সে গত পরশুর ছাপা হওয়া একটা বিজ্ঞাপন পাঠিয়েছে। বুঝা যাচ্ছে বিজ্ঞাপনটা ছাপিয়েছে অপহরণকারীরা ওয়াং আলীর নামে। আর সম্বোধন করা হয়েছে নিখোঁজ ফাতিমা নাসুমনকে। বলা হয়েছে, আগামী ২১ তারিখের মধ্যে যদি তার কাছে না ফিরি, তাহলে সেও হারিয়ে যাবে, কোনদিনই আর তাকে দেখা যাবে না। বিজ্ঞাপনে আরও লেখা হয়েছে, ‘২১ তারিখ সন্ধ্যা ৬টা সহ প্রত্যেকদিন সন্ধ্যা ৬টায় পারামারিবো এয়ারপোর্টের কারপার্কে তোমার জন্যে গাড়ি অপেক্ষা করবে। অভিমান ভুলে ফিরে এস। তোমার উপস্থিতিই শুধু আমাকে বাঁচাতে পারে।’ শেষ দিকে ফাতিমা নাসুমনের কণ্ঠ অশ্রুরুদ্ধ হয়ে পড়ল।
ইয়াং আমির ওয়াং আলীর ছোট ভাই।
ফাতিমা নাসুমনের কথা শোনার পর আহমদ হাত্তা নাসুমনের মুখ উদ্বেগ আতংকে ফ্যাকাসে হয়ে গেল। বলল সে, ‘তার মানে ২১ তারিখে পর ওয়াং আলীকে ওরা মেরে ফেলবে।’
ফাতিমা নাসুমন কিছু বলল না।
দু’হাতে মুখ ঢাকল সে।
তার দু’গন্ড থেকে দু’হাতের ফাঁক দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল।
আহমদ মুসা গভীর মনোযোগ দিয়ে ওদের কথা শুনছিল। সে তাদের আলোচনায় যোগ দেয়নি।
অল্পক্ষণ পর ফাতিমা নাসুমন রুমাল দিয়ে চোখ মুছে ধীরে ধীরে মুখ তুলল।
বলল, ‘স্যরি।’
তারপর পিতার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আব্বা ইয়াং আমির আরও জানিয়েছে, নির্বাচন সিডিউল অনুসারেই অনুষ্ঠিত হবে। মনোনয়ন পত্র জমা দেবার শেষ দিন ২২ তারিখ বিকেল পাঁচটা। সে আরও জানিয়েছে, ওরা অদৃশ্য এমন একটা ব্যবস্থা করেছে যার ফলে কোন কম্যুনিটিরই উল্লেখযোগ্য কোন মুসলমান মনোনয়ন পত্র জমাই দিতে পারবে না।’
আহমদ হাত্তা নাসুমনের দু’চোখও অশ্রুতে ভরে উঠেছিল। সে চোখ মুছে বলল, ‘কিছু করার নেই মা। ওরা ওয়াক ওভার নিতে চায়। তা নিক বলে এটা মেনে নেয়া যেতো, কিন্তু প্রশ্ন হলো তাদের উদ্দেশ্যের এটা শেষ নয়, শুরুমাত্র। তারা যদি একচেটিয়া পার্লামেন্ট দখল করতে পারে, তাহলে তাদের পরবর্তী কাজ হবে সুরিনাম থেকে ধীরে ধীরে মুসলমানদের উচ্ছেদ করা। আঘাতটা প্রথম আসবে ইন্দোনেশীয় মুসলমানদের উপর। আমাদের জমিদারীসহ কয়েকটা জমিদারী তারা দখল করতে পারলে খুব সহজেই তারা মুসলিম চাষীদের ভূমি কেড়ে নিয়ে তাদের উচ্ছেদ করতে পারবে।’
‘উচ্ছেদ করে সমস্যা বাড়ানোর চাইতে তারা একটা দু’টা করে মুসলমানদের মেরেই শেষ করবে। এই ক’দিনে ছ’শরও বেশি মানুষকে তারা মেরেছে। একটা খবরও বেরুল না, একটা লাশও পাওয়া গেল না, দুনিয়াও জানতে পারল না। শত শত পরিবারের নিরন্তর কান্না ও অশ্রুর পস্নাবন কোন মূল্য পেল না।’
বলতে বলতে আবার কেঁদে ফেলল ফাতিমা নাসুমন। কাঁদতে কাঁদতেই বলল, ‘ওয়াং আলীরও দিন ঘনিয়ে আসছে, সবার অলক্ষে সবার মত সেও হারিয়ে যাবে।’ কান্নায় রুদ্ধ হয়ে গেল ফাতিমা নাসুমনের শেষ কথাগুলো।
ফাতিমা নাসুমনের কথাগুলো ছবি হয়ে ভেসে উঠেছিল আহমদ মুসার চোখে। আহমদ মুসা দেখতে পাচ্ছিল যেন সুরিনাম-উপকূলের কৃষিগ্রামগুলো এবং পাহাড় ও বনাঞ্চলে সংগ্রাম করে বাঁচা মানুষগুলোকে। সেখানকার গ্রাম-জনপদ থেকে ভেসে আসা কান্না যেন শুনতে পাচ্ছিল সে। এই কান্না তার প্রতিটি রক্ত কণিকায়, অস্তিত্বের প্রতি রন্ধ্রে অক্ষমের আর্তনাদ নয়, বিক্ষোভের জ্বালা ছড়িয়ে দিল। যেন অজান্তেই তার ঠোঁটের বাধন ভেদ করে বের হয়ে এল প্রতিবাদী কয়েকটি শব্দ, ‘না ফাতিমা ওয়াং আলী হারিয়ে যাবে না।’
ঘরের অশ্রু সজল নরম পরিবেশে বেসুরে কর্কশ হয়ে বেজে উঠল আহমদ মুসার কথা।
ফাতিমা নাসুমন ও আহমদ হাত্তা নাসুমন অনেকটা চমকে উঠে তাকাল আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসা তার আসনে নড়ে-চড়ে সোজা হয়ে বসল। তার চোখে-মুখে স্থির সিদ্ধান্তের একটা দ্যুতি। ঠোঁটে তার ফুটে উঠল কঠিন এক টুকরো হাসি। তাকিয়েছিল ফাতিমা নাসুমনদের দিকে। বলল, ‘মি. হাত্তা, ফাতিমা, হ্যাঁ, আমি চেষ্টা করব ওয়াং আলী যাতে হারিয়ে না যায়, চেষ্টা করব সুরিনাম থেকে আর কেউ যাতে না হারায়।’
বিস্ময় ফুটে উঠল হাত্তা নাসুমন ও ফাতিমার চোখে-মুখে। বলল হাত্তা নাসুমন, ‘কিভাবে, কেমন করে?’
সোফায় গা এলিয়ে দিল আহমদ মুসা। বলল, ‘আমি সুরিনাম যাচ্ছি।’
হঠাৎ যদি আকাশের চাঁদটা আকাশ থেকে হাতে এসে পড়ে, তাহলে যে অবস্থা দাঁড়ায় সেই অবস্থা হলো হাত্তা নাসুমন ও ফাতিমার। তাদের দৃষ্টি স্থির হয়ে গেল আহমদ মুসার মুখের উপর। বিস্ময়ের ধাক্কায় তারা কথা বলতে ভুলে গেল।
বিস্ময়ের ঘোর কাটলে প্রথমে কথা বলল ফাতিমা নাসুমন, ‘আপনি যাবেন সুরিনামে?’ তার দুই চোখ আনন্দ ও বিস্ময়ের আলোয় চিক চিক করছে।
‘কেন বিস্মিত হচ্ছ ফাতিমা?’ প্রশ্ন আহমদ মুসার।
‘অখ্যাত এক গরীব দেশ আমাদের। অবহেলিত ও অজ্ঞাত কিছু মানুষ আমরা। এমন দেশে আমরা আহমদ মুসাকে আশা করতে পারি?’ বলল ফাতিমা নাসুমন।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘এর অর্থ আহমদ মুসার প্রতি তোমরা সুবিচার করছ না। আহমদ মুসাকে তোমাদের পাশ থেকে দুরে সরিয়ে দিচ্ছ।’
‘ঘটনা তা নয় আহমদ মুসা। আপনি আমাদের দেশ সুরিনামে যাবেন এটা কল্পনার চেয়েও অবিশ্বাস্য এক ব্যাপার। তাই বিশ্বাস করতে আমাদের কষ্ট হচ্ছে।’ বলল হাত্তা নাসুমন।
‘আমিও তো কোনদিন কল্পনায় ভাবিনি সুরিনামে আমি যাব। বাস্তবতা সব সময় কল্পনার চেয়ে বিস্ময়কর।’ বলল আহমদ মুসা।
ফাতিমা নাসুমন সোফা থেকে উঠে আহমদ মুসার সামনে কার্পেটের উপর হাঁটু মুড়ে প্রার্থনার ভংগিতে বসে বলল, ‘আপনি সত্যিই সুরিনামে যাবেন?’ আবেগের আকুলতায় গলা কাঁপছিল তার।
‘অবশ্যই এবং তা ২১ তারিখের আগে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আল্লাহু আকবর। বলে কাবামুখী হয়ে সিজদায় পড়ে গেল ফাতিমা নাসুমন।
অনেক্ষণ পর মুখ তুলল সে।
অশ্রুতে ধুয়ে গেছে তার মুখ। বলল, ‘অনেকদিন পর আমার মনে হচ্ছে, বুকের উপর থেকে একটা জগদ্দল পাথর নেমে গেল। বুক ভরে নিশ্বাস নিতে পারছি আজ আমি।’
উঠে দাঁড়াল ফাতিমা নাসুমন। বলল, ‘আব্বা আপনারা একটু বসুন। আমি চা নিয়ে আসছি।’
চলে গেল ফাতিমা।
‘মেয়েটার উপর দিয়ে খুব ধকল গেছে। আমি কিডন্যাপড হলাম, তার পর পরই ওয়াং আলীকেও তারা অপহরণ করল। দেশ তার জন্যে হয়ে উঠেছিল মৃত্যুর উপত্যকা। মৃত্যু সব সময় তাকে তাড়া করে ফিরেছে। এই পরিস্থিতিতে বারবার ঠিকানা পরিবর্তন করে সে স্বজনহীন এই বিদেশে বাস করত।’ বলল হাত্তা নাসুমন।
‘রাত যত গভীর হয়, সোবহে সাদেক ততই এগিয়ে আসে।’ আহমদ মুসা বলল।
ক’মিনিটের মধ্যেই ফাতিমা ফিরে এল একটা ট্রলি ঠেলে নিয়ে। আহমদ মুসা সেদিকে চেয়ে বলল, ‘তুমি চা আনতে গিয়ে নিয়ে এলে খাবার।’
‘আমার ক্ষুধা লেগেছে, আপনাদেরও ক্ষুধা লাগার কথা।’ বলল ফাতিমা।
‘দাও, ক্ষুধা না লাগলেও খেতে পারব। ক’দিন ধরে হাসপাতালের খানা খেয়েছি তো। বাড়ির খাবার অমৃত লাগার কথা।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ভাইয়া অমৃত না হলেও সুরিনামের খাবার অরুচিকর হবে না।’
ফাতিমা খাবার পরিবেশন করল।
তিন জনই খাচ্ছে।
‘একুশ তারিখ আসতে মাত্র দিন কয়েক বাকি। আমার মনে হয় চিন্তা করার অনেক বিষয়ই থাকতে পারে।’ ফাতিমা বলল।
‘ঠিক বলেছ ফাতিমা। অনেক কিছুই ভাবতে হবে। তার জন্যে সময় আমি মনে করি কম নেই। এই মুহূর্তে যে সিদ্ধান্তটা হয়ে যেতে পারে তা হলো, আমি ১৯ তারিখে মি. হাত্তাকে নিয়ে সুরিনামে যাবার জন্যে গায়নার নিউ আমষ্টারডামে নামব। সেখান থেকে জলপথ-স্থলপথে যাব সুরিনামের পারামারিবো। আর একুশ তারিখে ফাতিমা নামবে সুরিনামের পারামারিবো এয়ারপোর্টে। ঠিক ছ’টায় সে প্রবেশ করবে এয়ারপোর্টের কারপার্কে।’ বলল আহমদ মুসা।
ফাতিমা নাসুমনের মুখ ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেল আহমদ মুসার কথা শুনে। বলল, ‘আমি একা যাব? ছ’টায় কারপার্কে তো ওরা থাকবে? কারপার্কে গেলেই তো ওরা ধরে ফেলবে আমাকে।’
আহমদ হাত্তা নাসুমনের চোখে-মুখেও উদ্বেগের ছায়া।
আহমদ মুসা বলল, ‘আমি তো সেটাই চাই তুমি ওদের হাতে পড়। ভয় নেই আমি আশে পাশেই থাকব।’
‘তবু আমার ভয় করছে। ওরা কশাই, মানুষ নয় ভাইয়া।’ ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল ফাতিমা।
‘আমি জানি। কিন্তু এ ছাড়া কোন বিকল্প নেই বোন। তুমি আমার উপর আস্থা রাখতে পার।’
সংগে সংগেই কথা বললো না ফাতিমা নাসুমন। মুখ নিচু করেছিল সে।
কয়েক মুহূর্ত পরেই মুখ তুলল। বলল সে, ‘মাফ করবেন ভাইয়া। নির্দেশ দিচ্ছেন, আপনি যে আহমদ মুসা তা ভুলে গিয়েছিলাম। আপনার নির্দেশ আমি পালন করব, যেভাবে বলবেন ঠিক সেভাবেই।’ ফাতিমা ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করল। তার চোখে-মুখে দৃঢ়তা।
খুশি হলো আহমদ মুসা। বলল, ‘ধন্যবাদ বোন। দেখবে তুমি যত সাহসী হয়েছ, শত্রুরা তত দূর্বল হয়ে পড়েছে।’
‘ধন্যবাদ ভাইয়া।’ বলে একটু থামল ফাতিমা নাসুমন। বলল, ‘আমার জানতে ইচ্ছা করছে ভাইয়া, আপনি গায়ানা, সুরিনামে যাননি। নিউ আমষ্টারডাম দেখেননি। নিউ আমষ্টারডাম হয়ে সুরিনাম প্রবেশের এই পরিকল্পনা হঠাৎ কেন, কিভাবে করলেন?’
‘আমি খুব ভেবে করিনি। আমি নিশ্চিত হয়েছি যে, তোমার আব্বাকে নিয়ে পারামারিবো এয়ারপোর্ট হয়ে দেশে প্রবেশ করা যাবে না। চাই না এই মুহুর্তে শত্রুরা তাকে দেখে ফেলুক। তারা এটা জেনে নিশ্চিন্ত থাকুক যে, মি. হাত্তা এখনো বন্দী আছেন। দেশে ফিরতে পারছেন না। তাদের নির্বাচন নির্বিঘ্নেই হয়ে যাবে। এ অবস্থায় দেশে ফেরার জন্যে জল ও স্থল পথ বাকি থাকল। হঠাৎ তোমার আব্বার মত অতি পরিচিত লোককে নিয়ে দেশের কোন বন্দরে নামাও ঠিক হবে না। প্রথমে গায়ানা গিয়ে সেখান থেকে সুরিনামে প্রবেশ করব। সুরিনাম উপকূলের সবচেয়ে নিকটবর্তী বড় শহর হলো নিউ আমষ্টারডাম। তাই প্রথমে সেখানে নেমে সুরিনামে প্রবেশের চিন্তা করেছি।’
চোখ দু’টি উজ্জ্বল হয়ে উঠল ফাতিমার। বলল, ‘ভাইয়া অবাক ব্যাপার, আপনি না জেনে সুরিনামে প্রবেশের যে রুট ঠিক করেছেন, তার কোন বিকল্প নেই। গায়ানার পূর্বাঞ্চলে একমাত্র নিউ আমষ্টারডাম থেকেই সুরিনামে প্রবেশের জল পথ স্থল পথ দুই-ই আছে। আপনার চিন্তা একেবারেই নির্ভূল।’
‘আল হামদুলিল্লাহ। এভাবেই আল্লাহ সাহায্য করেন ফাতিমা।’ আহমদ মুসা বলল।
ফাতিমা উচ্ছসিত হয়ে উঠল। বলল, ‘ভাইয়া খুব আনন্দ লাগছে। মনে হচ্ছে নতুন জীবন ফিরে পেলাম।’
‘আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ আমাদের সকলের উপর সদয় হোন।’ বলল আহমদ হাত্তা নাসুমন।
তারপর একটু থেমে একটু পানি খেয়ে নিয়ে সে আবার বলল, ‘মি. আহমদ মুসা, আমরা কি জর্জ আব্রাহাম মানে মার্কিন সরকারের কাছে কোন সাহায্য চাইতে পারি?’
‘হ্যাঁ চাইতে পারি। তারা আন-অফিসিয়ালী সাহায্য করতে পারে। কিন্তু এই মুহূর্তে তার প্রয়োজন নেই। আমরা গিয়ে কাজ শুরু করি। প্রয়োজন হলে ওদের বলব।’
‘ধন্যবাদ মি. আহমদ মুসা। একটা কথা বলি আহমদ মুসা, ওরা কিন্তু সাংঘাতিক দুর্ধর্ষ্য, বিশাল ওদের সংখ্যা। হঠাৎ করে ফাতিমাকে ওদের হাতে তুলে দিলে বিপদ হবে না তো!’ বলল নরম ও বিনীত কণ্ঠে হাত্তা নাসুমন।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘আপনার কথা সত্য, উদ্বেগ স্বাভাবিক। কিন্তু ওয়াং আলীকে বাঁচাতে হলে, দ্রুত ওদের পরিচয় পেতে হলে, ২১ তারিখে ফাতিমাকে ওদের মুখোমুখি দাঁড় করাতে হবে। ২১ তারিখের পর এই সুযোগ আমরা হারিয়ে ফেলব।’
‘আব্বা বিপদের বিষয়টি না ভেবে আপনি দেখুন যে এটা কার পরিকল্পনা। স্বপ্নের সেই আহমদ মুসা বিমূর্ত হয়ে নেমে এসেছেন আমাদের মাঝে। তিনি আমাদের চালিত করছেন। আমার আর কোন ভয় নেই আব্বা। এখন আমার মনে হচ্ছে, তার নির্দেশ পালন করতে গিয়ে মৃত্যু এলেও আমি তা হাসি মুখে বরণ করতে পারবো।’
‘ঠিক বলেছ মা। আহমদ মুসা যে আমাদের সামনে বসে, তিনি স্বয়ং যে সুরিনামে যাচ্ছেন, একথা আমি ভুলে গিয়েছিলাম।’
একটু থেমে হাত্তা নাসুমন তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘আমরা সুরিনামে যাবার জন্যে প্রস্তুত আহমদ মুসা।’
‘ধন্যবাদ মি. হাত্তা, ধন্যবাদ বোন ফাতিমা।’
‘ধন্যবাদ ভাইয়া।’ বলে উঠে দাঁড়াল ফাতিমা। তারপর বলল, ‘আপনারা গল্প করুন আমি ট্রলিটা রেখে আসি এবং দুপুরের খাবারের ব্যবস্থাটাও দেখে আসি।’
‘ফাতিমা আমার জন্যে ভেব না। আমি কিন্তু দুপুরে খাচ্ছি না। আমি এখনি বেরুব।’
‘কোথায়?’
‘সারা জেফারসনদের ওখানে যাব।’
‘আপনি কোথায় থাকছেন?’
‘ওখানেই আমার ব্যাগ-ব্যাগেজ আছে।’
‘তাহলে?’
‘আমি যেখানেই থাকি, আজ বিকেলেই এখানে একবার আসব। অনেক কথা আছে, অনেক বিষয় নিয়ে ভাবতে হবে।’
‘ধন্যবাদ ভাইয়া।’ বলে ফাতিমা নাসুমন ট্রলিটা ঠেলে নিয়ে চলে গেল।
আহমদ মুসাও উঠে দাঁড়াল যাবার জন্যে।

দরজা খুলেই আহমদ মুসাকে দেখে জিনা জেফারসন, সারা জেফারসনের মা আনন্দে জড়িয়ে ধরল আহমদ মুসাকে। বলল, ‘বাছা আমি হাসপাতালে টেলিফোন করেছিলাম। ওরা বলল তুমি সেই কোন সকালে রিলিজ নিয়েছ। এখন বেলা ১টা। এত দেরী হলো কেন বাছা আসতে? আর রিলিজ নেবে আমাকে জানাওনি কেন? আমি তো প্রতিদিনই টেলিফোন করছি।’
এতগুলো প্রশ্নের জবাবে আহমদ মুসা বলল, ‘আমার সাথে আরেকজন রিলিজ নিয়েছিল। তাকে পৌছে দিয়ে এলাম।’
‘ঠিক আছে, চল বাছা। তোমার উপর দিয়ে অনেক ধকল গেল। তুমি অনেক শুকিয়ে গেছ।’ বলল জিনা জেফারসন আহমদ মুসাকে টেনে নিয়ে এগুতে এগুতে।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘খালাম্মা মাত্র এই দেড় সপ্তাহে আমার ওজন ১ কেজি বেড়েছে।’
‘তা বাড়লে কি হবে, আয়নাতে গিয়ে দেখ একবার তোমাকে।’ বলল জিনা জেফারসন।
আহমদ মুসা ড্রইংরুমে বসতে যাচ্ছিল। কিন্তু জিনা জেফারসন আহমদ মুসাকে হাত ধরে টেনে তার ঘরের দিকে নিতে নিতে বলল, ‘এখন আর বসাবসি নয় বাছা। সোজা ঘরে গিয়ে কাপড় ছাড়। তারপর গোসল কর। আমি টেবিলে খাবার আনছি।’
বলে জিনা জেফারসন আহমদ মুসার ঘরের দরজা টেনে দিয়ে চলল ডাইনিং-এর দিকে।
আরও এক ঘন্টা পর।
আহমদ মুসা এসে খাবার টেবিলে বসল।
গোসল করে ফ্রেস জামা-কাপড় পরে বেশ ভাল বোধ হচ্ছে আহমদ মুসার।
কিছুক্ষণ পর ফিরে এল জিনা জেফারসন।
বসল আহমদ মুসার বিপরীত দিকের চেয়ারে। আহমদ মুসার প্লেটে খাবার তুলে দিতে দিতে বলল, ‘এখন অনেক ফ্রেশ লাগছে বাছা তোমাকে। তুমি শরীরের উপর খুব অবিচার কর। খাওয়ার পর কিন্তু লম্বা ঘুম দেবে।’
আহমদ মুসা কাঁটা চামচ একবার হাতে তুলে নিয়ে আবার রেখে দিয়ে বলল, ‘খালাম্মা, সারা এল না? ও নেই?’
জিনা জেফারসন কাঁটা চামচ হাতে নিয়ে আহমদ মুসার দিকে না তাকিয়েই বলর, ‘না। তুমি খেয়ে নাও বাছা। কি করব, তোমরা কেউ তো কথা শোননা। নিজের ইচ্ছাকেই বড় ভাব।’ জিনা জেফারসনের কণ্ঠে ক্ষোভের প্রকাশ।
আহমদ মুসা কথা বাড়ালো না। বুঝল, সারা নিশ্চয় খালাম্মার নিষেধ না মেনে এই অসময়ে কোথাও বেরিয়েছে। তাই রেগে আছেন তিনি।
খাওয়ার পর আহমদ মুসা তার ঘরে চলে এল।
তখন বিকেল সাড়ে চারটা।
আহমদ মুসা ঘুম থেকে উঠে টয়লেট সেরে ফ্রেশ হয়ে এসে বসেছে।
ঘরে ঢুকল জিনা জেফারসন।
তার মুখ মলিন।
সেই মলিন মুখেই হাসি টেনে বলল, ‘বাছা রেষ্ট হয়েছে তো?’
‘হ্যাঁ, খালাম্মা। সারা এসেছে?’
জবাব না দিয়ে জিনা জেফারসন আহমদ মুসার সামনের সোফায় বসল। ধীরে ধীরে বলল, ‘সারা আসবে না বাছা।’ জিনা জেফারসনের কণ্ঠ কান্নার মত ভেজা।
আহমদ মুসা চমকে উঠে তাকাল জিনা জেফারসনের দিকে। বলল, ‘আসবে না? সারা কোথায় খালাম্মা?’
‘লস আলামোসে।’
‘লস আলামোসে?’ এই জিজ্ঞাসা উচ্চারণ করার সাথে সাথে আহমদ মুসা যেন আকাশ থেকে পড়ল। অবিশ্বাস্য মনে হল জিনা জেফারসনের কথা।
প্রশ্নটা উচ্চারণ করার পর একটু থেমে আহমদ মুসা আবার বলল, ‘কই আমাকে তো কিছু বলেনি! এ সময়ে হঠাৎ লস আলামোসে কেন? সে তো আরও দু’মাস ছুটি পেয়েছে! আর সম্পূর্ণ সুস্থ কি সে হয়েছে?’
মুখ তুলল জিনা জেফারসন।
তার মুখ বেদনায় জীর্ণ।
ভেঙে পড়া অবস্থা তার।
বিস্মিত হলো আহমদ মুসা।
জিনা জেফারসন আহমদ মুসার কোন প্রশ্নের জবাব না দিয়ে একটা ইনভেলাপ তুলে ধরল আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসা ইনভেলাপটি হাতে নিল। ইনভেলাপে আহমদ মুসার নাম লেখা। দেখেই বুঝল হস্তাক্ষর সারা জেফারসনের।
সারা জেফারসনের চিঠি? বুকের ভেতরটায় ধক করে উঠল আহমদ মুসার। না জানিয়ে, অন্তত টেলিফোনে একটা কথাও না বলে এভাবে চিঠি রেখে গেছে?
বুকের কোন অজানা প্রান্ত থেকে একটা অপরিচিত অভিমান প্রবল বেগে মাথা তুলতে চাইল।
তা সত্ত্বেও চিঠি খুলল আহমদ মুসা।
ইনভেলাপের ভেতর থেকে বেরিয়ে পড়ল সারা জেফারসনের প্যাডের পরিচিত সেই নীল কাগজ।
সারা জেফারসনের চিঠি।
চিঠিটি মেলে ধরল আহমদ মুসা চোখের সামনে।
পড়তে লাগলঃ

‘‘আসসালামু আলায়কুম।
অনেক চিন্তা করেও সম্বোধনের কোন ভাষা খুঁজে পেলাম না।
তাই সম্বোধন ছাড়াই এই চিঠি লিখছি।
আমি লস আলামোসে যাচ্ছি। আরও দু’মাস ছুটি মঞ্জুর হয়েছে। কিন্তু ছুটি এখন আমার কাছে অসহনীয় লাগছে। আমি কাজের মধ্যে ডুবে যেতে চাই, ডুবে থাকতে চাই। ভুলতে চাই আমার অস্তিত্বকে।
আপনি আহত অবস্থায় হাসপাতালে। আপনাকে বলে যেতে পারলাম না বলে বুক আমার ভেঙে যাচ্ছে। কিন্তু আমার বুক ভাঙার চেয়ে আপনাকে বলা আমার জন্যে কঠিন ছিল।
না বুঝে আপনাকে আমি অনেক কষ্ট দিয়েছি। আপনার কোন দোষ নেই। আপনি আমাকে এভয়েড করতেন। কিন্তু এটাই আমার কাছে আপনাকে আরও মূল্যবান করে তুলেছিল। আপনি সামান্য প্রশ্রয়ও আমাকে কোনদিন দেননি। আপনার এই অসাধারণ গুণই আপনাকে আমার কাছে আরও গৌরবদীপ্ত করে তুলেছিল। আমি আমাকে আরও জড়িয়ে ফেলেছিলাম। কষ্টও আপনার বাড়িয়ে দিয়েছিলাম। অনেকবার আপনি আপনার সম্পর্কে বলার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু আমি সুযোগ দেইনি। অবশেষে অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালের বেডে শুয়ে একদিন সব শুনলাম লায়লা জেনিফারদের কাছে। শুনে এতদিন যে কষ্ট আপনাকে দিয়েছি সব কষ্ট শতগুণ আকারে ফিরে পেলাম আমার বুকে। আমার অন্যায়ের এ শাস্তি আমি মাথা পেতে নিয়েছি।
আমার বুকে জেগে উঠেছিল আকাশস্পর্শী আকাঙ্খা, সে আকাঙ্খা এখন নেই। আমার বুকে ছিল এক সাগর তৃষ্ণা, সে তৃষ্ণার জ্বালাও এখন নিভে গেছে। একদিন আমি আপনার ‘সারা’ হবার জন্যে পাগল হয়ে উঠেছিলাম, কিন্তু হতে পারিনি। যখন সব আকাঙ্খা, সব তৃষ্ণা আমার শেষ হয়ে গেছে, তখন সেদিন জেনারেল শ্যারনের বন্দীখানায় আপনি আমাকে ‘সারা’ বলে সম্বোধন করলেন। সেদিন আমি আপনাকে আমার সব শক্তি দিয়ে জড়িয়ে ধরেছিলাম আতংক তাড়িত হয়ে প্রাণ ভয়ে। আপনি আমাকে জড়িয়ে ধরেননি। পিঠে হাত বুলিয়ে সান্তনা দিয়েছিলেন মাত্র। আপনার এই নিবিড় স্পর্শ এবং ‘সারা’ সম্বোধন তখন পেলাম যখন চাইনি। আমার আল্লাহর এই মর্জির আমি অর্থ বুঝতে চেষ্টা করেছি। অবশেষে বুঝেছি, এই পাওয়াটুকুকে আল্লাহ আমার জীবনের পাথেয় বানাতে চান। আমি এই পাথেয়কে পরম পাওয়া হিসেবে গ্রহণ করেছি। আমি জানি, এতে আপনার আপত্তি থাকবে, জোসেফাইন আপারও আপত্তি থাকবে। কিন্তু আমি এও জানি যে, একজন মানুষের বাঁচার অবলম্বনকে আপনারা কেড়ে নেবেন না। আপনাদের দু’জনের কাছেই আমি ক্ষমাপ্রার্থী।
সব শেষে আমার প্রার্থনা, সারা জেফারসন নামের কোন মেয়ের সাথে আপনার কখনও দেখা হয়েছিল, একথা দয়া করে ভুলে যাবেন। কিন্তু আমরা আমেরিকানরা আপনাকে ভুলতে পারবো না। কারণ আপনি আজকের আমেরিকার একজন ভ্রাতা। আমাদের ফাউন্ডার ফাদারসদের আমেরিকাকে আপনি আবার আমেরিকানদের মাঝে ফিরিয়ে এনেছেন।’’
একজন আমেরিকান মেয়ে,
‘সারা জেফারসন’
চিঠি পড়া শেষ হলো, কিন্তু চিঠি থেকে মুখ তুলতে পারল না আহমদ মুসা। দু’চোখ থেকে তার গড়ানো অশ্রু ফোটায় ফোটায় ঝরে পড়তে লাগল চিঠির বুকে।
জিনা জেফারসন ধীরে ধীরে উঠে এল তার আসন থেকে। আহমদ মুসার পেছনে দাঁড়িয়ে আস্তে একটা হাত রাখল আহমদ মুসার কাঁধে। বলল নরম কণ্ঠে, ‘বেটা তুমি কাঁদলে সারা আরও কষ্ট পাবে।’
আহমদ মুসা জিনা জেফারসনের হাত আঁকড়ে ধরে বলল, ‘খালাম্মা আমি সারার সর্বনাশ করেছি, ওকে সাবধান করার সুযোগ পাইনি।’ অশ্রুজড়িত কণ্ঠ আহমদ মুসার।
‘না বেটা, দোষ তোমার নয়, দোষ সারারও নয়। এটাই ছিল আমার মেয়ের ভাগ্য।’ নরম ও উদাস কণ্ঠ জিনা জেফারসনের।
‘এখন কি হবে খালাম্মা। ওকে কিছু বলতেও পারলাম না।’ বলল আহমদ মুসা।
জিনা জেফারসন আহমদ মুসার পেছন থেকে সোফা ঘুরে এসে আহমদ মুসার পাশে বসল। বলল, ‘বলে কোন লাভ হবে না বেটা। আমি সারাকে তো চিনি। হতভাগী যা বলেছে তাই সে করবে।’ কান্নায় জড়ানো জিনা জেফারসনের কথা।
একটু থেমেছিল, আবার শুরু করল জিনা জেফারসন, ‘আমি ওর মা। আমি ওকে বুঝিয়েছি, অনুরোধ করেছি। সব কথার জবাবে একটা কথাই সে বলেছে, মা আমাকে যদি বাঁচতে দিতে চাও, তাহলে বাঁচার অবলম্বন আমার কাছ থেকে কেড়ে নিও না। তারপর সেও কেঁদেছে, আমিও কেঁদেছি। আর কিছু বলার ছিল না তাকে।’
‘খালাম্মা আমার এখন কি কর্তব্য?’ আহমদ মুসা বলল।
‘কিছু করার নেই বেটা। তুমি সবকিছু ভুলে যাও। একদিন সেও সবকিছু ভুলে গিয়ে স্বাভাবিক হতেও পারে। আমি সেদিনেরই অপেক্ষা করব। তবে বেটা তোমার এ মাকে ভুলে যেও না। সারার ব্যাপারে কোন সাহায্যের দরকার হলে তা আমি তোমার কাছে চাইব।’ বলল জিনা জেফারসন।
‘অবশ্যই খালাম্মা। আপনার এ ছেলেকে যখনই ডাকবেন, হাজির হবো।’
‘ধন্যবাদ বেটা।’ বলে উঠে দাঁড়াল জিনা জেফারসন। তারপর বলল, ‘নামাজ পড়ে চায়ের টেবিলে এস বেটা।’
জিনা জেফারসন চলে গেল।
আহমদ মুসা সারার চিঠিটা সুন্দর করে ভাজ করে ইনভেলাপে ভরে উঠে দাঁড়াল। মনে মনে ভাবল, সারার চিঠিটা ডোনা জোসেফাইনের কাছে পাঠিয়ে দিতে হবে দু’একদিনের মধ্যেই।

গায়ানা এয়ারলাইনসের একটা ডোমিষ্টিক ফ্লাইট ল্যান্ড করল নিউ আমষ্টারডাম এয়ারপোর্টে।
নিউ আমষ্টারডাম গায়ানা উপকূলের দক্ষেণাংশের একমাত্র বড় শহর।
বিমান থেকে সবশেষে নামল দু’জন এশিয়ান। তাদের একজন শিখ। দু’জনের পরনেই ইউরোপীয় ট্যুরিষ্টের পোশাক। তাদের হাতে ট্যুরিষ্ট ব্যাগ এবং পায়েও ট্যুরিষ্ট জুতা।
শিখ লোকটা আহমদ হাত্তা নাসুমন, আর অন্য লোকটি আহমদ মুসা।
ওরা দু’জন বাইরের লাউঞ্জে বেরিয়ে এল। লাউঞ্জে কয়েকটি ট্যুরিষ্ট কোম্পানীর কাউন্টার দেখল।
সবচেয়ে সামনের যে ট্যুরিষ্ট কাউন্টারটি ছিল তার নাম ‘সেভেন হেভেন ট্যুরস’।
নামটি মজার।
আহমদ মুসা এগুলো কাউন্টারটির দিকে। কাউন্টারে হাস্যোজ্জ্বল একজন মাঝবয়েসি লোক বসে।
আহমদ মুসা কাউন্টারে পৌছতেই মাঝবয়েসি লোকটি উঠে দাঁড়িয়ে স্বাগত জানাল, ‘গুড মর্নিং, ওয়েলকাম ইয়ংম্যান।’
‘গুড মর্নিং স্যার।’ হেসে জবাব দিল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা কাউন্টারে একটু ঠেস দিয়ে দাঁড়াল। আগের হাসিটি অব্যাহত রেখেই বলল, ‘সেভেন হেভেন ট্যুরস মানে সাত স্বর্গ আপনারা সফর করাতে পারেন?’
লোকটিও হাসল। বলল, ‘চুড়ান্ত হিসেবে আটটির বেশি স্বর্গ নেই। আমরা সাতটি স্বর্গ সফর করাতে পারি মানে সবকিছুই আমরা সফর করাতে পারি দু’একটি ব্যতিক্রম ছাড়া। যেমন, দক্ষেণ সীমান্তে কেলডন পর্যন্ত আপনাদের আমরা হেসে-খেলে নিয়ে যেতে পারি। কিন্তু যদি বলেন, কেলডনের এক ইঞ্চি দক্ষেণে যাবেন। আমরা নিয়ে যেতে পারব না। যদি বলেন গায়ানা-সুরিনাম সীমান্তের সুন্দর নদী ‘কোরাজ’ এ আপনারা নামবেন, আমরা মাফ চাইব।’
আহমদ মুসা লোকটির কথার ভংগিতে হাসল, কিন্তু ভেতরে ভেতরে শংকিত হয়ে উঠল কেলডনের দক্ষেণে এক ইঞ্চি যাওয়া যাবে না শুনে।
কেলডন গায়ানার দক্ষেণ সীমান্তের সর্বশেষ শহর। এখান থেকে সুরিনামের সীমান্ত এক কিলোমিটারও নয়। আহমদ মুসাদের লক্ষ হলো কেলডন থেকে দক্ষেণে এগিয়ে ‘কোরাজ’ নদী পার হয়ে সুরিনামে প্রবেশ করা। কিন্তু ট্যুরিষ্ট কোম্পানীর লোকটির কথা শুনে তারা আকাশ থেকে পড়ল।
‘কেলডনের দক্ষেণে এক ইঞ্চিও যাওয়া যাবে না কেন?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘ও আপনারা তাহলে জানেন না। সুরিনাম সরকার বেশ কয়েকদিন হলো তাদের সীমান্ত সীল করে দিয়েছে। পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে গায়ানা সরকারও গতকাল তার সীমান্ত সীল করেছে।’ বলল লোকটি।
বিস্মিত হলো আহমদ মুসা। তাকাল সে আহমদ হাত্তা নাসুমনের দিকে। হাত্তা নাসুমনের চোখে-মুখেও বিস্ময়।
আহমদ মুসা আবার মুখ ঘুরালো ট্যুরিষ্ট কাউন্টারের লোকটির দিকে। বলল, ‘এসব সীল করা করি কেন? পাল্টা পাল্টি কেন?’
‘সুরিনামে তো নির্বাচন। সেখানে গন্ডগোল হচ্ছে। অনেক কথা শোনা যাচ্ছে। যাই হোক, লোক যাতে পালাতে না পারে, কিংবা অবাঞ্চিত কেউ যাতে প্রবেশও করতে না পারে, এজন্যেই সুরিনাম সরকার সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে। গায়ানার পাল্টা ব্যবস্থা স্বাভাবিক।’
লোকটির কথা শুনে ভ্রু কুঞ্চিত হলো আহমদ মুসার। চিন্তার ছায়া জেগে উঠল মুখে। একটু ভাবল, তারপর বলল, ‘নানা কথা শোনা যাচ্ছে বললেন, কি কথা শোনা যাচ্ছে?’
লোকটি এদিক ওদিক তাকাল। গলার স্বর একটু নিচে নামিয়ে বলল, ‘ওখানে দেদারসে লোক হারিয়ে যাচ্ছে, লোক খুন হচ্ছে।’
আহমদ মুসা ও হাত্তা নাসুমন মুখের ভাব এমন করল যেন সাংঘাতিক একটা খবর তারা শুনেছে। তারা কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে থাকল। তারপর আহমদ মুসা, ‘মহা ঝামেলায় পড়া গেল মশায়।’ বলতে বলতে তেতো খাওয়ার মত মুখ করল।
‘কি ঝামেলা?’ ট্যুরিষ্ট কাউন্টারের লোকটি জিজ্ঞেস করল।
‘দেখুন স্থল পথে উপকূল সফর করা আমাদের হবি। ক’বছর আগেই এই নিউ আমষ্টারডাম পর্যন্ত আমরা কভার করেছি। এবার এসেছি নিউ আমষ্টারডাম থেকে উপকূল পথে সুরিনামের পারামারিবো পর্যন্ত যাবে বলে।’ বলল আহমদ মুসা। কণ্ঠে তার কৃত্রিম হতাশার সুর।
লোকটি বিস্মিত হলো। বলল, ‘যাবেন কি করে? বর্ডার সীল তো আছেই। তার উপর কেলডন থেকে সুরিনামের ‘নিও নিকারী’ শহর পর্যন্ত এই চল্লিশ মাইলে কোন রাস্তা নেই।
‘এটাই তো মজার মশাই। রাস্তা নেই, কিন্তু আমরা রাস্তা বের করে যাব- এটাই তো রোমাঞ্চ।’ বলল আহমদ মুসা।
‘বুঝেছি, আপনারা জাত ট্যুরিষ্ট।’ বলল লোকটি।
‘জাত ট্যুরিষ্ট হলে কি হবে! বিপদে তো পড়লাম। কিন্তু আমরা তো ফিরতে পারিনা। একটা পথ বের করুন। আমরা আগামীকাল সন্ধ্যায় পারামারিবো পৌছতে চাই।’ আহমদ মুসা জোর দিয়ে বলল।
‘আজ উনিশ তারিখ, কাল বিশ তারিখ।’ স্বগত কণ্ঠে উচ্চারণ করল লোকটি। মুহূর্ত কয় চিন্তা করে আহমদ মুসার দিকে মুখ তুলে বলল, ‘কেলডনে চলুন। ওখানে একটা গ্রুপের সাথে পরিচয় করিয়ে দেব। ওরা আপনাদের নিও নিকারীতে পৌছে দেবার ব্যবস্থা করবে। কিছু বেশি খরচ হবে। রাজী আছেন?’
‘হ্যাঁ আমরা রাজী।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ। আমি আপনাদের কেলডনে নেবার ব্যবস্থা করছি।
সেদিনই বেলা ১২টার দিকে আহমদ মুসারা কেলডনে পৌছেছে। একটা হোটেলে উঠে গোসল ও খাওয়া সেরে আহমদ মুসারা একটা লম্বা ঘুম দিয়েছে।
ঘুম ভাঙতেই তার হাত ঘড়িতে দেখল বেলা সাড়ে তিনটা বাজে।
উঠে বসল আহমদ মুসা। ‘সেড্ডি’ নামক লোকটা সাড়ে তিনটার দিকেই তো আসার কথা।
সেভেন হেভেন ট্যুরসের পক্ষ থেকে ‘সেড্ডি’ আহমদ মুসাদের সাথে কেলডনে এসেছে। তাকেই সব নির্দেশ দিয়ে পাঠিয়েছে সেভেন হেভেন ট্যুরসের পক্ষ থেকে।
বিছানায় উঠে বসেছিল আহমদ হাত্তা নাসুমনও।
আহমদ মুসা হাত্তার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মি. হাত্তা দুই দেশের সরকার সীমান্ত সীল করে দেয়ার পরিস্থিতিতে আমাদের সুরিনামে প্রবেশ নিয়ে আপনি কি ভাবছেন?’
‘এই সীমান্ত নিয়ে বিরোধ আছে। সীমান্ত সীল হওয়ার ঘটনা আগেও ঘটেছে। এবার ঘটেছে সুরিনামের অভ্যন্তরীণ কারণে। সুরিনামে যা ঘটছে, বাইরের দুনিয়াকে তা তারা জানতে দিতে চায় না। বর্ডার সীল করে যাতায়াত, বিশেষ করে অবৈধ যাতায়াত বন্ধ করা যায় না। এবার কি ঘটেছে জানি না। পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর পাশে রাজনৈতিক ক্যাডাররা এবার বেশি তৎপর হবে।’ বলল আহমদ হাত্তা নাসুমন।
হাত্তা নাসুমনের কথা শেষ হতেই দরজায় নক হলো।
আহমদ মুসা গিয়ে দরজা খুলল। দেখল দরজায় দাঁড়িয়ে সেড্ডি ও আরেকজন লোক।
‘গুড ইভনিং, আসুন।’ বলে আহমদ মুসা দরজার একপাশে সরে দাঁড়াল।
ঘরে প্রবেশ করল ওরা দু’জন।
আহমদ মুসা দরজা বন্ধ করে ফিরে এল। ইতিমধ্যে হাত্তা নাসুমন উঠে দাঁড়িয়ে ওদের স্বাগত জানিয়েছে এবং বসতে দিয়েছে।
ওরা যে সোফায় বসেছে তার বিপরীত দিকের সোফায় পাশা পাশি আহমদ মুসা ও হাত্তা নাসুমন বসল।
সেড্ডি তার সাথীর পরিচয় দিতে গিয়ে বলল, ‘নাম জিগান। সে সুরিনামের নাগরিক, আবার গায়ানারও নাগরিক। দু’দেশেই তার অবাধ গতি। তার অসাধ্য কিছু নেই।’
জিগান লোকটি তাকাল আহমদ মুসাদের দিকে। আহমদ মুসাও তাকে দেখছিল। জাত ক্রিমিনালের চেহারা জিগানের। তার দৃষ্টি দেখে মনে হচ্ছে সে শুধু আহমদ মুসাদের দেখছে না, তাদের ভেতরটাও সে যেন পাঠ করছে।
জিগান তার চোখের সার্চ আহমদ মুসাদের উপর অব্যাহত রেখে জিজ্ঞেস করল ভাঙা ইংরেজীতে, ‘আপনাদের সাথে মালামাল কি আছে?’
‘কোন মালামাল নেই, দু’জনের শুধু দু’টি হ্যান্ড ব্যাগ।’ আহমদ মুসা বলল।
জিগান দাঁত বের করে হাসল। বলল, ‘ও ভুলে গিয়েছিলাম, আপনারা তো ট্যুরিষ্ট। কিন্তু বিনা লাভে এত কষ্ট করবেন?’
‘কষ্টের অভিজ্ঞতাই আমাদের লাভ।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আপনারা কোন পথে যাবেন?’ জিজ্ঞেস করল জিগান।
‘আমাদের কোন ধারণা নেই, আপনিই বলুন কোন পথে যাওয়া ভাল হবে?’ আহমদ মুসা বলল।
‘দু’পথের যে কোন একটা পছন্দ করতে পারেন- জল পথ ও স্থল পথ। জল পথ কোরাজ নদী হয়ে গায়ানা উপসাগর পথে নিও নিকারীতে যাওয়া যাবে। জল পথটা আরামদায়ক, কিন্তু কোষ্ট গার্ডদের হাতে ধরা পড়ার ভয় আছে। আর স্থল পথ কোন পথ নয়। কোরাজ নদী পার হয়ে ৪০ মাইল হাঁটতে হবে জঙ্গল জলাভূমি ও উঁচু-নিচু পথ ধরে নিও নিকারী পর্যন্ত। এ পথ তুলনামুলকভাবে নিরাপদ। নিও নিকারী পর্যন্ত দুই পথের খরচ একই, আড়াই হাজার মার্কিন ডলার।’ কথাগুলো মুখস্থের মত গড় গড় করে বলে গেল জিগান।
আহমদ মুসা একবার আহমদ হাত্তার দিকে চাইল। তারপর বলল, ‘খরচটা বেশি হলো না?’
হো হো করে হাসল জিগান। বলল, ‘খরচ সর্বনিম্ন ধরেছি। এর মধ্যে খাওয়া, যাওয়া ও কমিশন সবই রয়েছে।’
‘কমিশন কি?’ মুখে কৃত্রিম বিস্ময় টেনে বলল আহমদ মুসা।
সব জান্তার হাসি হাসল জিগান। বলল, ‘নতুন আপনারা জানবেন কি করে? সীমান্তের দুই পাশে সরকারী-বেসরকারী অনেক গ্রুপ ও গ্যাং আছে যাদের আমাদের সন্তুষ্ট রাখতে হয়। এই সন্তুষ্টির ফি অনেক বড়।’
‘ঠিক আছে মি. জিগান। দাবী অনুসারে খরচ পাবে। কিন্তু আগামী কাল সন্ধ্যার মধ্যে আমাদের পারামারিবো পৌছতে হবে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘চিন্তা নেই বিকেলের আগেই আপনারা সেখানে পৌছে যাবেন।’ জিগান বলল।
‘আমরা যাত্রা করছি কখন?’ আহমদ মুসা জিজ্ঞেস করল।
‘আপনারা প্রস্তুত থাকলে এক ঘন্টার মধ্যেই।’ জিগান বলল।
‘আমরা প্রস্তুত।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আমাদের প্রস্ত্ততিও এক ঘন্টার মধ্যে হয়ে যাবে। বলে উঠে দাঁড়াল জিগান। নিজের হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমরা ঠিক সাড়ে চারটায় যাত্রা করব। সেড্ডি আপনাদেরকে আমাদের ওখানে নিয়ে যাবে।’
‘ঠিক আছে।’ বলল আহমদ মুসা।
কথা শেষ করেই জিগান ঘুরে দাঁড়িয়ে হাঁটা শুরু করেছে।

কোরাজ নদী দুই ঘন্টা আগে পেরিয়ে এসেছে তারা।
রাত ৮টায় তারা এক টিলায় পৌছেছে।
টিলাটি ছোট-খাট একটা পাহাড়। ঘন গাছ-গাছড়ায় আচ্ছাদিত।
এই পাহাড়ের মাথায় ঘন গাছ-গাছড়ার মধ্যে টিনের তৈরী একটা বিশাল বাড়ি। দেয়াল ও চাল সবই টিনের তৈরী।
এই বাড়ির একটা বড় কক্ষে দু’টি বিছানা পাতা। সেখানে আহমদ মুসা ও হাত্তা নাসুমনের থাকার স্থান নির্ধারিত হয়েছে।
আহমদ মুসা ও হাত্তা নাসুমন দু’জনেই বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে।
কোরাজ নদী পার হয়ে তারা সুরিনামে প্রবেশ করেছে এবং এ পর্যন্ত দু’ঘন্টার পথ তারা পাড়ি দিয়েছে বড় চাকার রিক্সা ভ্যানে। এ রিক্সা ভ্যানটি রাস্তাছাড়াও এবড়ো-থেবড়ো জমি ও জলজভূমির উপর দিয়েও চলতে পারে।
রিক্সা ভ্যান টেনেছে দু’জন নিগ্রো। আর ভ্যানের আরোহী ছিল চারজন। আহমদ মুসারা দু’জন এবং জিগান ও তার সাথী জয়সা।
আহমদ মুসা ও হাত্তা নাসুমন দু’জনেই চোখ বন্ধ করে বিশ্রাম উপভোগ করছে। প্রায় ২৪ ঘন্টা পর তাদের পিঠ বিছানার সাক্ষাত পেয়েছে।
দরজায় নক হলো।
আহমদ মুসা চোখ খুলল। বলল, ‘আসুন।’
ঘরে প্রবেশ করল জিগান।
আহমদ মুসা উঠে বসে তাকে স্বাগত জানাল ও বসতে বলল।
দুই বেডের মাঝখানে বিরাট খালি জায়গায় একটা টেবিল ও দু’টি চেয়ার ছিল। তারই একটিতে বসল জিগান। বসে আহমদ মুসা হাত্তা নাসুমন দু’জনের দিকে একবার তাকিয়ে বলল, ‘স্যাররা কেমন আছেন, কেমন লাগছে।’
‘না, বেশ ভালো। ভ্যান বেশ জোরেই এসেছে। খুব ভাল টেনেছে ওরা। নিগ্রোদের কোথায় পেলেন? গায়ানা ও সুরিনামের এ অঞ্চলে যা দেখলাম সবই তো এশিয়ান অরিজিন।’ বলল আহমদ মুসা।
জিগান হাসল। বলল, ‘এরা দারুণ পরিশ্রমী শ্রমিক। অনেক পশ্চিমে সুরিনামের ওয়েলহেলমিনা পর্বত এলাকায় এদের বাস। কাবালোবা নদী বেয়ে এরা প্রায়ই নেমে আসে অর্থ উপার্জনের জন্যে। খুব সস্তায় কেনা যায় এদের শ্রম।’
‘এই জংগলে এই সুন্দর বাড়ি কি করে পেলেন?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘হবেই তো। এটা নিকারী জমিদারদের একটা তহশিল অফিস ছিল কিছুদিন আগেও। এখান থেকে এই এলাকার বনজ ও জলজ সম্পদের এবং কিছু কৃষি জমি আছে তার খাজনা আদায় হতো। সেই সাথে এটা ছিল পুলিশ ফাঁড়িও।’ বলল জিগান।
‘ছিল মানে, এখন নেই?’ প্রশ্ন আহমদ মুসার।
‘নেই। জমিদারের পুলিশ মানে পাইক-পিয়াদা ও খাজনা আদায়কারীরা পালিয়ে গেছে না হারিয়ে গেছে কিছু একটা হয়েছে।’ বলল জিগান।
‘এখন কে থাকেন এখানে?’ বলল আহমদ মুসা।
‘নতুন সরকারের লোকরা।’ জিগান বলল।
‘সরকারের লোকরা মানে সরকারী কর্মচারীরা? তাহলে তো সুবিধাই হবে।’ আহমদ মুসা কৃত্রিম উৎসাহ দেখিয়ে বলল।
‘না সরকারী কর্মচারীরা কেউ নেই। সরকার পক্ষের লোক আছে। ওরা নতুন জমিদার। দেখছেন না এলাকায় লোকজন নেই বললেই চলে। নতুন জমিদারের লোকজনরা পুরানো প্রজাদের উচ্ছেদ করেছে।’ বলল জিগান।
আহমদ মুসার মুখ-চোখ লাল হয়ে উঠেছে। তার কাছে এটা পরিষ্কার হয়ে উঠেছে, হাত্তা নাসুমন ও ওয়াং আলীরা যে কালো থাবার শিকার সে কালো থাবা এখানেও এসে পৌছেছে। বলল সে, পুরাতন প্রজারা কোথায় গেল?’
‘কেউ বলে নিখোঁজ হয়েছে, কেউ বলে পালিয়েছে, কেউ কেউ বলে সীমান্তের ওপারে চলে গেছে। সবাই বলে, নির্বাচন পর্যন্ত এই অবস্থা চলবে।’ জিগান বলল।
কথা শেষ করেই জিগান দ্রুত আবার বলল, ‘তবে নতুন জমিদারের লোকরা আসায় আমাদের সুবিধা হয়েছে। এরা শুধু পয়সা চায়। পয়সা দিয়ে যা ইচ্ছে তাই করা যায়। আগে তহসিলের মেহমান খানায় আমরা বিনা পয়সায় থাকতে পারতাম বটে, কিন্তু অন্য কোন সুযোগ নেয়া যেত না। এখন দেখুন পয়সা দিয়ে তহসিল অফিসের সবচেয়ে ভালো রুম আমরা পেয়ে গেছি।’
‘তাহলে তো লোকরা ভালই। কি বলেন?’ আহমদ মুসা বলল।
‘টাকা খোর স্যার। এখন পয়সা না দিলে মেহমান খানাতেও থাকা যায় না।’
কথা শেষ করে একটু থেমে প্রসংগ পাল্টিয়ে সে বলল, ‘স্যার ভোর পাঁচটায় আমরা যাত্রা করব। দশটার মধ্যেই নিও নিকারীতে পৌছে যাব।’ বলে উঠে দাঁড়াল জিগান।
বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
আহমদ মুসা উঠে গিয়ে দরজা বন্ধ করে এসে বিছানায় বসল।
আহমদ মুসা জিগানের সাথে কথা বলার সময় শিখবেশী হাত্তা নাসুমন একটি কথাও বলেনি।
আহমদ মুসা এসে তার বিছানায় বসতেই কথা বলে উঠল হাত্তা নাসুমন। বলল, ‘আহমদ মুসা এই এলাকা ছিল নিকারীর এক জমিদার নাসের সুকামোর রাজ্য। দু’মাস আগেও এই এলাকা তারই দখলে ছিল।’
বলে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ল হাত্তা নাসুমন। বলল, এই ভাবেই ওরা হিটলারী কায়দায় দেশের মুসলিম কম্যুনিটির প্রভাব, প্রতিপত্তি, শক্তি সব ধ্বংস করতে চাচ্ছে।
‘মি. হাত্তা, আমি যতটা আঁচ করছিলাম তার চেয়েও পরিস্থিতি ভয়াবহ। তবে শহরাঞ্চলে এই ভয়াবহতা একটু কম হবে। শহরে তারা লোকদের গুম করার মাধ্যমে মুসলমানদের ভিত ও দুর্বল করেছে। কিন্তু প্রত্যন্ত গ্রাম এলাকা তারা দখল করে নিচ্ছে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ঠিক। পরিস্থিতি এটাই মি. আহমদ মুসা।’
আহমদ মুসা শুয়ে পড়ল। বলল, ‘আল্লাহ ভরসা। শুয়ে পড়ুন মি. হাত্তা। পাঁচটায় যেতে হলে আমাদের চারটায় উঠতে হবে।’
‘ঠিক।’ বলে হাত্তা নাসুমনও শুয়ে পড়ল।
গভীর রাত।
আহমদ মুসা ও হাত্তা নাসুমন ঘুমিয়ে।
তাদের দরজায় ধীরে ধীরে নক হলো।
একবার। দু’বার। তিনবার। তৃতীয় বারের সময় আহমদ মুসা চোখ খুলল। উঠে বসল বিছানায়। দেখল, হাত্তা নাসুমনও চোখ খুলেছে।
‘কে দরজায়?’ দরজার দিকে তাকিয়ে অনুচ্চ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
জবাব এল না, কিন্তু দরজায় আরেকবার নক হলো।
আহমদ মুসা বালিশের তলা থেকে রিভলবার নিয়ে উঠে দাঁড়াল।
‘না মি. আহমদ মুসা, কথা না বললে দরজা খুলবেন না। শুনেছেন তো, এদিকের অবস্থাও ভাল নয়।’ অনুচ্চ কণ্ঠে বলল হাত্তা নাসুমন।
‘মি. হাত্তা, আমার মনে হচ্ছে দরজায় যে নক করছে, সে আমাদের শত্রু নয়। শত্রু হলে দরজা খুলবার জন্যে কথা বলত। তবু আমি রিভলবার নিলাম।’
বলে আহমদ মুসা দরজার দিকে এগুল।
ডান হাতে রিভলবার বাগিয়ে রেখে বাঁ হাতে দরজা খুলল আহমদ মুসা।
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে একজন নিগ্রো। আহমদ মুসার হাতে রিভলবার দেখে ভীষণ ভয় পেয়ে গেছে। সংগে সংগেই সে দু’হাত উপরে তুলেছে। তারপর সে ডান হাত একটু নিচে নামিয়ে তর্জনি তার ঠোঁটে ঠেকিয়ে আহমদ মুসাকে কথা বলতে নিষেধ করল।
আহমদ মুসা নিগ্রোর চেহারা দেখেই বুঝেছে সে শত্রুতা করতে আসেনি এবং আরও বুঝল সে আহমদ মুসা ছাড়াও অন্য কাউকে ভয় করছে এবং তার আসাকে গোপন করতে চাচ্ছে।
আহমদ মুসা দরজার একটু পাশে সরে গিয়ে তাকে লক্ষ করে ফিস ফিস কণ্ঠে বলল, ‘ভেতরে এস।’
নিগ্রোটি যেন এ কথারই অপেক্ষা করছিল। আহমদ মুসা ভেতরে আসার আহবান করার সাথে সাথে সে ভেতরে ঢুকে গেল।
আহমদ মুসা বাঁ হাতে দরজা বন্ধ করে ডান হাতের রিভলবারটা নিগ্রোর দিক থেকে সরিয়ে নিয়ে চেয়ার দেখিয়ে তাকে বসতে বলল।
সে চেয়ারে বসল না। বলল, ‘স্যার জিগান ও জয়সাকে ওরা মেরে ফেলেছে। আপনাদেরকেও ধরা বা মারার জন্যে যে কোন সময় এসে পড়বে।’ ভয় ও উত্তেজনায় গলা কাঁপছে নিগ্রোটির।
তার কথা শুনে আহমদ মুসা আকাশ থেকে পড়ল। বিস্ময়ের ধাক্কা কাটাতে তার মুহুর্ত খানেক সময় লাগল। তারপর বলল, ‘কারা মেরে ফেলেছে?’ আহমদ মুসার কণ্ঠ কঠোর। তার চোখে নিগ্রোর প্রতি সন্দেহ দৃষ্টি।
‘স্যার, নতুন জমিদারের লোকরা।’ জবাব দিল নিগ্রোটি।
‘নতুন জমিদারদের লোকরা? কেন মেরেছে?’ বলল আহমদ মুসা। তার ভ্রু দু’টি কুঞ্চিত হয়ে উঠেছে। ভাবছে সে।
‘নতুন জমিদাররা জানতে পেরেছে আপনারা মুসলমান। তাই জিগানকে তারা বলেছিল আপনাদেরকে তাদের হাতে তুলে দিতে এবং বিষয়টা গোপন রাখতে। কিন্তু জিগান তাতে রাজী হয়নি কিছুতেই। কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে ওরা জিগান ও জয়সা দু’জনকেই গুলী করে মেরেছে।’ বলল নিগ্রোটি ভয় জড়িত কণ্ঠে।
‘ওরা এখন কোথায়?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘সবাইকে ডেকে নিয়ে ঘরে ঢুকেছে। মনে হয় পরামর্শ করতে বসেছে।’ বলল নিগ্রোটি।
‘কেমন করে বুঝলে, ওরা যে কোন সময় আক্রমণে আসবে?’
‘ওরা বলেছে স্যার। জিগানদের খুন করেই ওদের একজন চিৎকার করে বলেছে, ‘চল তাড়াতাড়ি ছদ্মবেশী শয়তান দু’টোকে ধরতে হবে। কিন্তু অন্য একজন বলেছে, চল তার আগে একটু পরামর্শ করে নেই। এরপর ওরা ঘরে ঢুকেছে।’
‘ধন্যবাদ………। কি যেন তোমার নাম বলেছিলে?’
‘বোংগো। ওমর বোংগো।’
তার নাম শুনে চমকে উঠল আহমদ মুসা। তার উপর সন্ধানী দৃষ্টি রেখে আহমদ মুসা বলল, ‘তুমি মুসলিম? কিন্তু আগে তো বোংগো নাম বলেছিল, ওমর বোংগো বলনি?’
‘কাজের জন্যে এলে আমরা আমাদের মুসলিম পরিচয় গোপন করি। আপনারা মুসলিম জেনেই আমাদের মুসলিম পরিচয় দিলাম।’ বলল ওমর বোংগো।
‘তোমার সাথী কোথায়? তার নাম কি?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘সে ওদের ঘরের বাইরে এক স্থানে লুকিয়ে ওদের উপর চোখ রাখছে। তার নাম ‘কাসিমী ওয়ে এমবা।’ বলল ওমর বোংগো্
‘আমরা মুসলমান বলেই তোমরা আমাদের সাহায্য করেছ?’ আহমদ মুসা বলল।
‘জি স্যার। তাছাড়া আমরা আপনাদেরই সাথী। আপনাদের নিউ নিকারীতে পৌছানো আমাদের দায়িত্ব।’ বলল ওমর বোংগো।
আহমদ মুসা দু’ধাপ এগিয়ে গভীর আবেগে জড়িয়ে ধরল ওমর বোংগোকে। বলল, ‘ধন্যবাদ ওমর বোংগো। আমরা খুব খুশি হয়েছি তোমরা মুসলমান জেনে।’
আহমদ মুসা ওমর বোংগোকে আলিংগন থেকে ছেড়ে দিয়ে বলল, ‘ওমর বোংগো, আমাদের স্যার বলবে না, ভাই বলবে। আর শোন তুমি এখন তোমার সাথীর কাছে ফিরে যাও এবং ওদের উপর নজর রাখ। কোন ভয় নেই, ওদেরকে আমাদের এখানে আসতে দাও।’
ওমর বোংগোর চোখে-মুখে আনন্দ ও কৃতজ্ঞ দৃষ্টি।
কথা শেষ করে আহমদ মুসা হাত্তা নাসুমনকে বলল, ‘আপনি কিছু বলবেন ওমরকে?’
‘ধন্যবাদ ওমর। আমরা খুব খুশি হয়েছি। জান ওরা কতজন লোক আছে?’ হাত্তা নাসুমন বলল।
‘ওরা চারজন। দু’জন নতুন জমিদারের লোক। আর দু’জন প্রহরী।’ বলল ওমর বোংগো।
‘ধন্যবাদ ওমর।’ হাত্তা নাসুমন বলল।
‘ধন্যবাদ, আসসালাম।’ বলে ঘুরে দাঁড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল ওমর বোংগো।
আহমদ মুসা হাত্তা নাসুমনের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আপনার প্রশ্নের জন্যে ধন্যবাদ। ওদের সংখ্যা জানা আমাদের খুব প্রয়োজন ছিল।’
‘ওয়েলকাম। মি. আহমদ মুসা, আপনি এ ঘটনাকে কোন দৃষ্টিতে দেখছেন?’ বলল হাত্তা নাসুমন।
‘জিগানদের মৃত্যু খুবই বেদনাদায়ক। তবে শত্রুদের এত তাড়াতাড়ি দেখা পাওয়ায় খুব খুশি হয়েছি।’
‘ওদের জন্যে অপেক্ষা না করে আমরাই ওদের খুঁজে নিলে হতো না?’
‘ওরাই প্রথম আক্রমণ করুক মি.হাত্তা।’
বলে আহমদ মুসা গিয়ে দরজা বন্ধ করে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিল এবং বলল, ‘আসুন মি. হাত্তা একটু ঘুমিয়ে নেয়া যাক।’
‘এই অবস্থায় আপনার ঘুম ধরবে?’ হাত্তা নাসুমনের কণ্ঠে বিস্ময়।
‘চিন্তার কিছু নেই, ওরাই তো এসে ডেকে তুলবে।’ বলল আহমদ মুসা ঠোঁটে হাসি টেনে।
বলে আহমদ মুসা চোখ বুজল।
হাত্তা নাসুমনও শুয়ে পড়ল।
কিন্তু ঘুমাতে পারল না সে।
রাজ্যের ভাবনার আনাগোনা মাথায় নিয়ে কত সময় তার গেল কে জানে।
হঠাৎ তার মনে হলো দরজার বাইরে অনেকগুলো পায়ের শব্দ। উৎকর্ণ হলো সে। ঠিক পায়ের শব্দগুলো একদম দরজার গোড়ায় এসে গেছে।
উঠে বসল হাত্তা নাসুমন।
আহমদ মুসাকে ডাকবে বলে দ্রুত নামতে গেল। এমন সময় দরজায় যেন বাজ পড়ল।
সেই ভীষণ শব্দের রেশ বাতাসে মিলাবার আগেই দেখা গেল ঘরের দরজা মেঝেয় এসে ছিটকে পড়েছে।
ঘরের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে দু’জন। তাদের হাতে রিভলবার। তাদের পেছনে আরও দু’জন দাঁড়িয়ে। তাদের হাতে ষ্টেনগান।
দরজা ভাঙার শব্দে আহমদ মুসাও ঘুম থেকে জেগে গেছে। সে উঠে বসেনি।
বালিশে ঠেস দিয়ে আধ বসা অবস্থায় সে। তার দু’হাতও বালিশের দু’পাশে ঠেস দেয়া।
আর হাত্তা নাসুমন তার বিছানায় বসে। তার দু’পা নিচে নামানো।
দরজায় দাঁড়ানো দু’জন মাঝ বয়সী রিভলবারধারী। চেহারা এ্যাংলো ইন্ডিয়ান। শক্ত-সমর্থ ক্রিমিনাল আকৃতির দেখতে।
দু’জনের একজন চিৎকার করে বলল, ‘তোমরা নাম ভাঙিয়ে ছদ্ম পরিচয় নিয়ে বেআইনিভাবে সুরিনামে প্রবেশ করেছ। তোমাদের…………।’
আহমদ মুসা তার কথায় বাঁধা দিয়ে নেহায়েত গোবেচারার মত শান্ত গলায় বলল, ‘কিছুই বুঝতে পারছি না আপনাদের কথা। আমাদের কথা শোনেননি। আমাদের কাগজপত্র দেখেননি। কি করে বুঝলেন আমরা বেআইনিভাবে প্রবেশ করেছি?’
আহমদ মুসা একদিকে কথা বলছে, অন্যদিকে তার ডান হাত এক সুতা এক সুতা করে বালিশের তলায় এগিয়ে যাচ্ছে তার এম-১০ হাত করার জন্যে।
আহমদ মুসা থামলে সেই দু’জনের একজন চিৎকার করে উঠল, ‘কোন কাগজপত্র আমাদের দেখার দরকার নেই। তোমরা মুসলমান। পরিচয় ভাড়িয়ে তোমরা সুরিনামে প্রবেশ করেছ।’
‘না কোন পরিচয় ভাড়ানো হয়নি। আমাদের পাসপোর্ট-ভিসায় আমার নাম পরিষ্কার লেখা আছে। দেখুন কাগজ পত্র’। বলল আহমদ মুসা একেবারে শান্ত কণ্ঠে।
‘তোমাদের একজনের শিখের চেহারা ও পোশাক। এটা কি পরিচয় ভাড়ানো নয়?’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘আপনারা দেখছি, মুসলমানদের কিছুই জানেন না। শিখদের অনেক অনেক আগে থেকে মুসলমানরা এই ধরনের দাড়ি রাখে ও পাগড়ি পরে।’
আহমদ মুসার হাসি দেখে ওরা আরও জ্বলে উঠল। বলল, ‘শয়তান মুসলমানের বাচ্চা। দেখাচ্ছি মজা।’
বলে লোকটি তার রিভলবার তুলছিল আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসার ডান হাত তখন তার এম-১০ এর বাঁটে। আহমদ মুসা বলে উঠল, ‘তোমরা এসব কি কথা বলছ। আমরা তোমাদের………..।’
আহমদ মুসার এ কথার সাথে সাথে তার ডান হাত এম-১০ নিয়ে বিদ্যুত বেগে বেরিয়ে এল।
ওরা আহমদ মুসাদের তরফ থেকে পাল্টা আক্রমণের কল্পনাও করেনি। তাই তারা খাঁচায় পোরা পাখির মতই খেলছিল আহমদ মুসাদের নিয়ে। আহমদ মুসার এম-১০ মেশিন রিভলবারকে যখন তাদের দিকে ঘুরে আসতে দেখল, তখন অবিশ্বাস্য এই পরিস্থিতি তাৎক্ষণিকভাবে তাদের বিমূঢ় করে দিল। তাদের হাতের রিভলবার কাজে লাগাতে পারল না।
আহমদ মুসার এম-১০ মেশিন রিভলবার থেকে বেরিয়ে আসা গুলীর ঝাঁক এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল ওদের উপর।
সামনের দু’জন রিভলবারধারী, পরে পেছনের দু’জন ষ্টেনগানধারী গুলীবিদ্ধ হয়ে ভূলুন্ঠিত হলো।
আহমদ মুসা লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নেমে ওদের দিকে এগুল। ওদের কাউকে জীবন্ত তার চাই।
কিন্তু চারজনের মধ্যে পেছনের ষ্টেনগানধারী একজনকে কথা বলার পর্যায় পেল। কিন্তু সে লড়ছিল মৃত্যুর সাথে। কোন প্রশ্নের জবাব সে দিল না। কিছুক্ষণের মধ্যে সেও মারা গেল।
হতাশভাবে উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা। হাত্তা নাসুমনও এসে আহমদ মুসার পাশে দাঁড়িয়েছিল।
‘ওদের এই চারজনকে প্রথম পাওয়া গেল, কিন্তু জীবিত পাওয়া গেল না। অথচ নিখোঁজ হওয়া মানুষ কোথায় যাচ্ছে, এটা জানা খুবই দরকার।’ হতাশ কণ্ঠ আহমদ মুসার।
এ সময় ওমর বোংগো তার সাথী কাসিমী ওয়ে এমবাকে নিয়ে ছুটে এল। আহমদ মুসার কাছে এসে ওমর বোংগো বলল দ্রুত কণ্ঠে, ‘আমি আড়ালে দাঁড়িয়েছিলাম। সব দেখেছি স্যার। আল্লাহ আপনাকে আরও শক্তি দিন। একটা খবর আছে স্যার।’
‘কি খবর?’ আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘আমি গিয়েছিলাম ওয়ে এমবাকে ডাকতে। আমি তাকে বাইরে পাহারায় রেখেছিলাম। সে একটা খবর বলল।’
তারপর ওমর বোংগো ওয়ে এমবার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘স্যারকে বল খবরটা।’
ওয়ে এমবার বয়স কম। তারুণ্য এখনও কাটেনি। তার চোখে-মুখে ভয় ও জড়তা। সে আহমদ মুসার দিকে চোখ তুলে একবার তাকাল এবং বলল, ‘স্যার একটা বড় আলো এদিকে এ বাড়ির দিকে এগিয়ে আসছিল। গুলীর শব্দ হওয়ার সাথে সাথে সে আলো নিভে গেছে। আর জ্বলেনি।’
ভ্রু কুঞ্চিত হলো আহমদ মুসার।
‘স্যার একদল বা কিছু লোক এদিকে আসছিল। গুলীর শব্দ শুনে এ বাড়িকে সন্দেহ করে তারা আলো নিভিয়ে দিয়েছে।’ বলল ওমর বোংগো।
‘কি করে বুঝলে একদল লোক আসছিল?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘আমাদের জংগল পথে এ ধরনের বড় আলো কোন দল না হলে জ্বালায় না। দু’একজন হলে টর্চ ব্যবহার করতো।’
‘কেন জ্বালায় না?’
‘রাতে জংগলে আলো নিয়ে চলা বিপদের কারণ ঘটায়। তাই আলো সবাই পরহেজ করে চলে। আর বেশি লোক হলে আলো প্রয়োজন হয়। আর তখন আলো জ্বালানোও হয়। এ আলো তখন এই সংকেতও দেয় যে, আমাদের শক্তি কারও চেয়ে কম নেই। আবার হঠাৎ যখন এ আলো নিভে যায়, তার অর্থ দাড়ায় তারা ভয় পেয়েছে বা কোন ষড়যন্ত্র আঁটছে।’ ওমর বোংগো বলল।
‘তাহলে একদল লোক বা কিছু লোক আসছিল, ভয়ে তারা আলো নিভিয়ে দিয়েছে?’ প্রশ্ন করল আহমদ মুসা।
‘তাই মনে হচ্ছে।’ বলল ওমর বোংগো।
‘ওরা কারা বলতে পার?’ আহমদ মুসা বলল।
একটু চিন্তা করল ওমর বোংগো। বলল, ‘স্যার, হয় ওরা চোরা চালানী, না হয় কোন গোপন কাজে লিপ্ত।’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘তোমার বুদ্ধির প্রশংসা করছি বোংগো। এখন বলত, দুই ধরনের মধ্যে কোন ধরনের লোক ওরা?’
‘বলতে পারছি না স্যার। দু’দিকেই আমার সমান সন্দেহ।’ বলল ওমর বোংগো।
‘আমার বিশ্বাস ওরা কোন গোপন কাজে লিপ্ত। চল দেখি।’
বলে আহমদ মুসা বাইরে যাওয়ার জন্যে হাঁটা শুরু করল।
আহমদ হাত্তা নাসুমন ও ওমর বোংগোরা আহমদ মুসার পেছন পেছন চলল।
বাড়ির গেটে গিয়ে আহমদ মুসা ঘর থেকে কুড়িয়ে আনা মৃত একজনের রিভলবার হাত্তা নাসুমনের হাতে দিয়ে বলল, ‘আপনি গেটের ভেতরে দাঁড়ান যাতে নজর এড়িয়ে কেউ ভেতরে আত্মগোপন করতে না পারে।’
আহমদ মুসা ওমর বোংগোদের দু’জনকে নিয়ে সামনে হাঁটতে শুরু করল।
গেটের সামনে ছোট-খাট একটা খালি চত্বর। তারপর বড় বড় গাছ-পালা ও ঝোপ-ঝাড়ের শুরু। এই গাছ-পালা ঝোপ-ঝাড়ের মধ্যে একটা মেঠো পথ টিলার নিচে সমভূমিতে নেমে গেছে।
চত্বরের মাঝে দাঁড়িয়ে আহমদ মুসা জিজ্ঞেস করল ওয়ে এমবাকে, ‘তুমি বড় আলোটা কোথায় দেখেছিলে?’
ওয়ে এমবা একটু পেছনে সরে গেল। গেটের পাশে বড় একটা গাছের গুড়ির উপর দাঁড়িয়ে বলল, ‘ঐখানে টিলার নিচে।’
আহমদ মুসাও গাছের গুড়িতে উঠল। দেখে বলল, ‘সমতলের যেখান থেকে রাস্তাটা টিলায় উঠে এসেছে, সেখানেই তাহলে আলোটা দেখা গেছে। তার অর্থ ওরা টিলায় উঠতে আসছিল।’
আহমদ মুসা লাফ দিয়ে নামল গাছের গুড়ি থেকে।
ওমর বোংগোদের বলল, ‘তোমরা এস আমার সাথে।’
বলে আহমদ মুসা হাঁটতে শুরু করল চত্বর দিয়ে টিলা থেকে নেমে যাওয়া রাস্তার দিকে।
ওমর বোংগোরাও চলল তার পেছনে।
চারদিকে ঘন অন্ধকার।
চত্বরটায় অন্ধকার একটু ফিকে, কিন্তু টিলা থেকে সমতলে নেমে যাবার রাস্তাটা ঘুটঘুটে অন্ধকারে ঢাকা।
সেই রাস্তার মুখে পৌছল আহমদ মুসা।
পেছনে একবার তাকিয়ে দেখল, ওমর বোংগোরা কতটা পেছনে। তারপর মেশিন রিভলবারটা হাতে তুলে নিয়ে রাস্তা দিয়ে নামা শুরু করল।
দু’পাশে উঁচু গাছ-পালা ও ঝোপ ঝাড়।
দশ বারো গজ সবে এগিয়েছে।
হঠাৎ এ সময় আহমদ মুসার মনে হলো ওপর থেকে কি একটা তার দেহের উপর পড়ে তাকে জাপটে ধরল। তার সাথে সাথেই প্রবল একটা হ্যাচকা টানে পড়ে গেল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার প্রথমে মনে হয়েছিল গাছের উপর থেকে কেউ তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। কিন্তু পরক্ষণেই বুঝল কোন মানুষ নয় জালের ফাঁদ তাকে আটকে ফেলেছে। সে আরও বুঝল, গাছ থেকেই কেউ তার উপর জালের ফাঁদ নিক্ষেপ করেছে।
আহমদ মুসা মাটিতে পড়েই ওমর বোংগো ও ওয়ে এমবার চিৎকার শুনতে পেল। আহমদ মুসা বুঝল ওরাও জালের ফাঁদে আটকা পড়েছে।
মাটিতে পড়ে স্থির হবার পর আহমদ মুসা খুশি হলো তার ডান হাতে রিভলবার ঠিকমতই আছে।
ওমর বোংগো এবং ওয়ে এমবার চেঁচামেচি তখনও চলছিল। তারা সম্ভবত লড়াই করছে জালের বাঁধন থেকে বের হবার জন্যে। আহমদ মুসা বুঝল এই চেঁচামেচি, হাত-পা ছুড়োছুড়িতে কোন লাভ নেই, বরং তাতে জালের বাঁধন আরও শক্ত হবে।
আহমদ মুসা নিরবে অপেক্ষা করতে লাগল জালের পেছনে যে মানুষ আছে সেই মানুষের জন্যে।
ঘুটঘুটে অন্ধকার। পাশে মানুষ দাঁড়িয়ে থাকলেও তা চোখে পড়ার মত নয়।
কিছু দেখতে পেল না, কিন্তু শব্দ শুনতে পেল আহমদ মুসা। ভারী কিছু মাটিতে পড়ার শব্দ। তাহলে ওরা কি গাছ থেকে নামল, ভাবল আহমদ মুসা।
এই সময় একটা চাপা কণ্ঠ কথা বলে উঠল সুরিনামের কথ্য টাকি টাকি ভাষায়, ‘ফাঁদগুলো তোমরা লক করেছ?’
ফাঁদ লক করার অর্থ হলো ফাঁদে শিকার আটকাবার পর জালের খোলা মুখ বেঁধে ফেলা।
‘হ্যাঁ, লক করা হয়েছে।’ প্রায় একই সংগে অন্ধকারের মধ্য থেকে তিনটি কন্ঠ কথা বলে উঠল।
‘তাহলে জানোয়ারদের টেনে চত্বরে নিয়ে চল।’ আগের সেই কণ্ঠ নির্দেশ দিল।
আহমদ মুসা বুঝল এখানে ওরা চারজন রয়েছে। এই চারজনই কি, না ওরা আরও আছে?
আহমদ মুসার ভাবনা হোঁচট খেল। তাকে টেনে নিয়ে যাওয়া শুরু হয়েছে। উঁচু-নিচু মাটিতে হোঁচট খেয়ে ধাক্কা খেয়ে তার দেহ চলতে শুরু করেছে।
ফাঁদ জালের মুখের প্রান্ত ধরে অল্প সামনে থেকে কেউ তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, এটা বুঝল আহমদ মুসা। লোকটি তখনও তার চোখে পড়েনি।
আহমদ মুসা সামনে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে লোকটিকে চোখের আওতায় আনার চেষ্টা করতে লাগল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর অল্প সামনে একটা জমাট অন্ধকারকে চলন্ত দেখল। আহমদ মুসা নিশ্চিত হলো, এটা সেই লোকের অবয়ব যে তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।
আহমদ মুসা তার মেশিন রিভলবার পজিশনে নিয়ে এল। এখন ইচ্ছা করলে এই লোকটিকে সে হত্যা করতে পারে। কিন্তু তাতে লাভ হবে না। আরও তিনজন আছে। তারা প্রতিশোধ নেবে। সুতরাং তাদেরকে এক সংগে না পেলে তাদের উপর চড়াও হওয়া ঠিক হবে না।
এক সময় তাকে টেনে নেয়া বন্ধ হলো।
আহমদ মুসা বুঝল তাদেরকে চত্বরে নিয়ে আসা হয়েছে।
চত্বরের ফিকে অন্ধকারের আহমদ মুসা ওদের দু’জনকে দেখতে পেল জমাট অন্ধকারের মত তাদের কিছু দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে।
তাদের দু’জনের একজন বলে উঠল, সুদীপ ও সম্বা আমরা এদের দেখছি। তোমরা দু’জনে ভেতরে যাও। দেখে এস কি ঘটেছে। মনে হয় এদের কোন লোক ভেতরে নেই। থাকলে এদের চেঁচামেচিতে নিশ্চয় এতক্ষণ বেরিয়ে আসার কথা।’
চত্বরের অন্ধকার তখন আহমদ মুসার অনেকখানি চোখসহা হয়ে গেছে। সে দেখল, যেখানে ওমর বোংগো ও ওয়ে এমবাকে রাখা হয়েছে, সেখান থেকে দু’টি ছায়ামুর্তি বাড়িতে প্রবেশের জন্য গেটের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।
খুশি হলো আহমদ মুসা। হাত্তা নাসুমনকে গেটে রেখে আসা হয়েছে। সে ঐ দু’জনকে কাবু করতে পারবে। তাহলে………..।
আহমদ মুসার চিন্তা শেষ হতে পারলো না। গেটের ভেতর পরপর দু’টি গুলীর আওয়াজ হলো।
গেটের সামনে পৌছে গিয়েছিল ওরা দু’জন। দু’জনের কণ্ঠ থেকেই আর্তনাদের শব্দ বেরিয়ে এল।
গুলীর শব্দ শুনেই আহমদ মুসার সামনে যারা দাঁড়িয়েছিল, তারা নড়ে উঠল। অন্ধকারকে খান খান করে দিয়ে গর্জে উঠল ওদের ষ্টেনগান।
আহমদ মুসা দেখল, এরা দু’জন গুলী করতে করতে এগুচ্ছে গেটের দিকে।
আহমদ মুসা ওদের আর সুযোগ দিল না। তার এম-১০ ওদের দিকে তাক করে ট্রিগার চাপল।
বেরিয়ে গেল এক ঝাঁক গুলী।
ছায়ামূর্তি দু’টি আর্তনাদ করে উঠারও সুযোগ পেল না। নিরবে ভূমি শয্যা নিল চত্বরে।
তারপর সব নিরব।
মুহূর্ত কয়েক উৎকর্ণ হয়ে থেকে আহমদ মুসা ওমর বোংগোকে ডাকল। বলল, ‘তোমরা ভাল আছ তো?’
‘জি স্যার। কিন্তু বের হতে পারছি না। শালারা কোথায় কিভাবে গিরে দিয়েছে বুঝতে পারছি না।’ বলল ওমর বোংগো।
‘মি. আহমদ মুসা, আমি আসছি। ওরা তাহলে আপনাদের জালের ফাঁদে আটকেছে?’ গেটের দিক থেকে শোনা গেল হাত্তা নাসুমনের কণ্ঠ।
আহমদ মুসা তখন তার মোজার ভেতর থেকে ছুরি বের করে জালের নাইলনের কর্ড কাটতে শুরু করেছে।
‘কোথায় আপনি মি. আহমদ মুসা। আমি এসেছি।’ চত্বরের মাঝামাঝি থেকে হাত্তা নাসুমনের কণ্ঠ শোনা গেল।
‘মি. হাত্তা আমি জাল কাটা শুরু করেছি। আপনি ওমর বোংগোদের সাহায্য করুন।
সবাই মুক্ত হয়ে উঠে দাঁড়াল।
হাত্তা নাসুমন আহমদ মুসাকে জড়িয়ে ধরল। প্রায় কাঁদ কাঁদ কণ্ঠে বলল, আমি ওমর বোংগো এবং ওয়ে এমবার অব্যাহত চিৎকার শুনে এবং আপনার কোন কণ্ঠ না শুনে প্রায় মরেই গিয়েছিলাম। মনে হয়েছিল, আপনার কোন বড় রকমের ক্ষতি করে ওরা ওমর বোংগো ও ওয়ে এমবাকে ধরেছে। তারপর ওদের একজন যখন চিৎকার করে বলল, আমরা এদের দেখছি, তোমরা দু’জন ভেতরে যাও, তখন বুঝলাম যেভাবেই হোক আপনারা আছেন। তখন মনে হলো, প্রাণটা যেন আমার ফিরে এল।’
‘ধন্যবাদ মি. হাত্তা, আপনার কাজ আপনি ঠিকভাবে করেছেন। ওদের আমি এক সাথে পাচ্ছিলাম না বলে গুলী করতে পারছিলাম না।’
হাত্তা নাসুমনকে কথাটা বলেই আহমদ মুসা ফিরল ওমর বোংগোর দিকে। বলল, ‘ওমর তোমরা চিৎকারটা একটু বেশি করেছ।’
‘স্যার এটা জংগলের একটা গোপন নিয়ম। ধরা পড়লে চিৎকার ও কান্নাকাটি ঠিকভাবে করতে পারলে শত্রুর আঘাতটা একটু দেরীতে আসে এবং আত্মরক্ষার জন্যে কিছু সময় পাওয়া যায়।’ বলল ওমর বোংগো।
‘এই কারণেই কি যে, শত্রুরা তার শিকারকে ভীতু ও দুর্বল মনে করে তাকে আর আঘাত করার প্রয়োজন মনে করে না এবং তাদের দিক থেকে নিশ্চিন্ত থাকে?’ আহমদ মুসা বলল।
‘ঠিক স্যার।’ বলল ওমর বোংগো।
‘মি. আহমদ মুসা, আমার মনে হয় এদের আরও লোক আছে।’ বলল হাত্তা নাসুমন।
‘কিভাবে বুঝলেন?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা। ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে উঠেছে তার।
‘আমি গেট থেকে টিলার গোড়ায় একটা টর্চের আলো জ্বলে উঠতে দেখেছি।’ হাত্তা নাসুমন বলল।
আহমদ মুসা চিন্তা করছিল। বলল, ‘ওদের আরো লোক থাকাই স্বাভাবিক। ওরা চারজন এসেছিল এদিকের খোঁজ নিতে।’
একটু থামল আহমদ মুসা। বলল আবার, ‘মি. হাত্তা, আপনি ও ওয়ে এমবা দু’জন ষ্টেনগান নিয়ে দরজায় দাঁড়ান। ওরা রাস্তা ছাড়া অন্য কোন দিক দিয়ে আসতে পারে এবং তাহলে বাড়িতে ঢোকার চেষ্টা করবে। আপনারা তাদের আটকাবেন। আমি ওমর বোংগোকে নিয়ে টিলার গোড়ায় যাচ্ছি।’
বলে আহমদ মুসা তার সামনের মৃত দু’জনের ষ্টেনগান একটি নিজে নিয়ে অন্যটি ওমর বোংগোর হাতে তুলে দিল।
তারপর সবাইকে সালাম দিয়ে রাস্তার দিকে হাঁটতে শুরু করল। রাস্তার মুখে গিয়ে ওমর বোংগো ফিস ফিস করে বলল, ‘স্যার আবার যদি ফাঁদে পড়ি?’
আহমদ মুসা থমকে দাঁড়াল। বলল, ‘ঠিক বলেছো ওমর বোংগো। সাবধান হওয়া ভালো?’
থামল একটু। ভাবল আহমদ মুসা। বলল বোংগোকে, ‘শোন রাস্তার মাঝখানে দিয়ে যাবে না। তুমি যাবে রাস্তার বাম কিনার দিয়ে, আর আমি যাব রাস্তার ডান কিনার দিয়ে। রাস্তার এত কিনারে ফাঁদ পাতা হয় না।’
চলতে শুরু করল ওরা দু’জন।
টিলার গোড়ায় নেমে এল আহমদ মুসা ও ওমর বোংগো। এখানে ছোট-খাট ঝোপ-ঝাড়। বড় গাছ-পালা নেই। এর মধ্যে দিয়ে তারা হামাগুড়ি দিয়ে এগুচ্ছে।
এক জায়গায় এসে ছোট খাট ঝোপ ঝাড়ও শেষ হয়ে গেল।
এরপর সমতল ঘাসে ঢাকা জমি। তবে দু’একটা ছোট-খাট গাছ আছে।
সমতলে নেমে যাওয়া রাস্তার পাশে ঝোপের আড়ালে শুয়ে তাকাল আহমদ মুসারা সামনের দিকে।
এখানে অন্ধকার অনেক ফিকে। আকাশে চাঁদ নেই, কিন্তু মেঘহীন আকাশে তারার মেলা বসেছে। ধীরে ধীরে আহমদ মুসাদের সামনে চারদিকটা স্বচ্ছ হয়ে এল।
আহমদ মুসা দেখতে পেল, ‘খুব কাছেই দু’জন লোক পায়চারী করছে এবং অনেকগুলো লোক বসে আছে।’
আরও ভালো করে দেখার চেষ্টা করল আহমদ মুসা। দেখতে পেল, পায়চারীরত দু’জনের হাতে ষ্টেনগান।
তাকিয়ে আছে আহমদ মুসা ওদের দিকে
আরও কিছুটা সময় পার হয়ে গেল।
আহমদ মুসা বুঝতে পারলো না, মাত্র দু’জন দাড়িয়ে আর সবাই বসে কেন? আর বসে থাকা লোকদের আশে-পাশে ষ্টেনগানধারী দু’জনের পায়চারী করার অর্থও বুঝল না আহমদ মুসা।
বিষয়টির দিকে ওমর বোংগোর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল, ‘এর অর্থ বলতো?’
‘স্যার আমাদের জংগলের রীতি অনুসারে মনে হচ্ছে ওরা হয় বন্দী, না হয় পরাজিত ও আত্মসমর্পিত কেউ। আর ষ্টেনগান নিয়ে যারা পাহারা দিচ্ছে তারা ওদের মনিব।’ বলল ওমর বোংগো।
ওমর বোংগোর কথা চাবুকের মত ঘা দিয়ে জাগিয়ে তুলল আহমদ মুসাকে। চমকে উঠল সে। হঠাৎ তার মনে হলো, ঐ বসে থাকা লোকরা কি তাহলে সুরিনামের হারিয়ে যাওয়া লোকদেরই কেউ হবে?
কথাটা মনে আসার সাথে সাথে গোটা দেহ শক্ত হয়ে উঠল আহমদ মুসার। অজান্তেই তার তর্জনিটা চলে গেল তার মেশিন রিভলবারের ট্রিগারে।
কিন্তু আহমদ মুসা তর্জনি সরিয়ে নিল ট্রিগার থেকে। সিদ্ধান্ত নিল আরও কিছুটা এগুতে হবে।
চিন্তা করেই আহমদ মুসা ওমর বোংগোকে বলল, ‘আড়াল নিয়ে ক্রলিং করে আরও কিছুটা সামনে এগোও।’
ক্রলিং করে শিকারী বাঘের মত নিঃশব্দে এগুতে লাগল আহমদ মুসা। একেতো রাত, তার উপর মাঝে মাঝেই দু’একটা ছোট গাছ, লম্বা ঘাস। ফলে আহমদ মুসারা কারও দৃষ্টি গোচর হলো না।
ষ্টেনগানধারীরা আর মাত্র দশ গজের মত দূরে। আর এভাবে এগুনোর দরকার নেই, ভাবল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা তার মেশিন রিভলবার ডান হাত থেকে বাঁ হাতে নিল এবং পকেট থেকে ছোট রিভলবার ডান হাতে তুলে নিল।
ষ্টেনগানধারী দু’জন তাদের ষ্টেনগান ডান হাতে ঝুলিয়ে পায়চারী করছে। আহমদ মুসার ইচ্ছা এদের জীবন্ত ধরা, হত্যা না করা। এজন্যে এদের সাথে মুখোমুখি লড়াই এড়ানো দরকার। সেটা করতে হলে তাদের নিরস্ত্র করতে হবে।
ওদের ষ্টেনগান ঝুলানো হাত তাক করল আহমদ মুসা। ওদের দু’জনের ডান হাতকে একই সাথে তাক করার জন্য অপেক্ষা করতে হলো তাকে।
পেয়ে গেল এক সময়।
তাক করা রিভলবার থেকে ধীরে সুস্থে দু’টি গুলী ছুড়ল আহমদ মুসা।
ওদের দু’জনের হাত থেকেই ষ্টেনগান খসে পড়ল। ওরা আহত হাত চেপে ধরে গুলীর লক্ষে এদিকে ঘুরে দাঁড়াল।
আহমদ মুসা ততক্ষণে লাফ দিয়ে উঠে দু’হাতে দুই রিভলবার বাগিয়ে ওদের সামনে হাজির হয়েছে। বলল কঠোর স্বরে, ‘দেখ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাক। কোন চালাকির চেষ্টা করো না। একটা করে হাত গেছে, এবার কিন্তু প্রাণটাও যাবে।’
বিস্ময় ও ভয়ে ওদের দু’জনের চোখ বিস্ফোরিত। গোবেচারার মত দাড়িয়ে থাকল ওরা।
আহমদ মুসার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল ওমর বোংগো। আহমদ মুসা তাকে বলল, ‘ওমর তুমি ওদের জামা ছিড়ে নিয়ে ওদের হাত ব্যান্ডেজ করে দাও যাতে রক্ত পড়া বন্ধ হয়। তারপর ওদের পিছমোড়া করে বাঁধ।’
ওমর বোংগো কাজে লেগে গেল।
আহমদ মুসা রিভলবার বাগিয়ে পাহারা দিচ্ছিল।
হাত বাঁধা হয়ে গেলে ওদের দু’জনকে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়তে নির্দেশ দিল আহমদ মুসা।
তারপর আহমদ মুসা বসে থাকা লোকদের দিকে এগুল।
আহমদ মুসাকে ওদিকে যেতে দেখে বসে থাকা লোকদের মধ্য থেকে একজন যুবক বলে উঠল, ‘আমাদের বাঁচান স্যার। আমরা নির্দোষ। এরা আমাদের ধরে নিয়ে যাচ্ছিল।’
আহমদ মুসা ওদের কাছে গিয়ে দেখল, ‘ওদের প্রত্যেকের দু’হাত বাঁধা। প্রত্যেকের কোমরে দড়ি পেঁচিয়ে একে অপরের সাথে বাঁধা ওরা। এমনভাবে বাঁধা যে, একজন উঠলে সবাইকে উঠতে হবে, আবার একজন বসলে সবাইকে বসতে হবে। চললে সবাইকে সমানতালে চলতে হবে।
আহমদ মুসার যদিও এখন বোঝার বাকি নেই। তবু যুবকটির আবেদনের উত্তরে আহমদ মুসা বলল, ‘তোমরা কে? তোমাদেরকে গরু ছাগলের মত বেঁধে এরা কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?’
‘খুব বেশি দূরে নয়, পশ্চিম নিকারী এলাকায় আমাদের বাড়ি। আমাদের বিভিন্ন স্থান থেকে অপহরণ করেছে। কয়দিন যাবত আমাদের খেতে দেয়নি, অকথ্য নির্যাতন করেছে। এখন কোথায় নিয়ে যাচ্ছে জানিনা স্যার।’ বলল সেই আগের যুবকটি।
‘কেন তোমাদের অপহরণ করেছে?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘আমরা ঠিক জানি না স্যার। বিভিন্ন স্থান থেকে অপহরণ আরও হয়েছে। শোনা যাচ্ছে, আহমদ হাত্তা নাসুমনকে প্রধানমন্ত্রী হতে দেবে না, এজন্যেই বেছে বেছে লোক অপহরণ করা হচ্ছে। আহমদ হাত্তা নাসুমনকেও অপহরণ করা হয়েছে। তাকে মেরেই ফেলা হয়েছে বলে মানুষ মনে করছে।’ যুবকটি বলল।
‘বেছে বেছে কাদেরকে অপহরণ করছে?’ বলল আহমদ মুসা।
কথা বলল না যুবকটি।
আহমদ মুসা বুঝল বেছে বেছে মুসলমানদের অপহরণ করছে, একথা বলতে যুবকটি ভয় করছে। তার মানে মুসলিম পরিচয় যুবকটি দিতে চায় না।
আহমদ মুসা বলল, ‘বেছে বেছে কি মুসলমানদের অপহরণ করছে?’
‘জি স্যার।’ নরম ও ভীত কণ্ঠস্বর ছেলেটির।
‘তোমার নাম কি?’
যুবকটি এবারও কথা বলল না। একবার মাথা তুলে আবার নিচু করল।
আহমদ মুসা প্রবল একটা খোঁচা খেল বুকে। অবস্থা কোন পর্যায়ে গেলে একজন মানুষ এভাবে তার পরিচয় দিতে ভয় করে! সুরিনামের অবস্থা এই পর্যায়ে গেছে!
আহমদ মুসা ওমর বোংগোর দিকে তাকিয়ে একটি ছুরি তার হাতে দিয়ে বলল, ‘ওদের সকলের বাঁধন কেটে দাও।’
সবাই মুক্ত হয়ে গেলে আহমদ মুসা যুবকটির কাছে গেল। বলল, ‘আমিও মুসলমান। মুসলিম পরিচয় দিতে ভয় পাচ্ছ কেন?’
যুবকটি কেঁদে ফেলল। বলল, ‘ওরা আমাদের উপর নির্যাতন করেছে আর বলেছে, মুসলমান নাম নিতে পারে এমন কাউকে তারা এদেশে রাখবে না।’
আহমদ মুসা যুবকটির পিঠ চাপড়ে বলল, ‘আল্লাহ আছেন, আল্লাহর শক্তি সবার চেয়ে বড়। কি নাম তোমার?’
যুবকটি চোখ মুছে বলল, ‘হাবিব থিয়াম।’
‘খুব সুন্দর নাম।’ বলে আহমদ মুসা যুবকটির আরেকবার পিঠ চাপড়ে দিয়ে সবাইকে লক্ষ করে উচ্চ কণ্ঠে বলল, ‘আমি আপনাদের একজন ভাই। আপনাদের আর কোন ভয় নেই। যারা আপনাদের বন্দী করে এনেছিল তাদের মধ্যে এই দুইজন ছাড়া সবাই নিহত হয়েছে। আপনারা সবাই টিলার উপরে চলুন। ওখানে একটা বাড়ি আছে।’
কথা শেষ করে আহমদ মুসা ওমর বোংগোকে বলল, ‘তুমি দেখ ওদের লাইটটা কোথায় আছে। ওটা জ্বেলে দাও।’
আহমদ মুসা কথা শেষ করার সাথে সাথে আরেক জন যুবক একটা হ্যাজাক জাতীয় লাইট হাতে তুলে বলল, ‘এই যে লাইট স্যার। জ্বালব?’
‘ধন্যবাদ। জ্বেলে দাও।’ বলল আহমদ মুসা।
মাটিতে উপুড় হয়ে থাকা বন্দী দু’জনের কাছে এল আহমদ মুসা। ওদের টেনে তুলে বসাল সে। তারপর রিভলবার ওদের একজনের দিকে তাক করে বলল, ‘দেখ এক প্রশ্ন আমি দু’বার জিজ্ঞেস করি না। এখন বল, এদেরকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছিলে?’
দু’জনেই মুখ তুলে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। ভয়ে তাদের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। কিন্তু কথা বলল না তারা।
ওমর বোংগোসহ মুক্তি পাওয়া লোকজন সবাই চারদিকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে। দেখছে সবাই।
আহমদ মুসার রিভলবারের নল নড়ে উঠল। গর্জন করে উঠল রিভলবার। একটা বুলেট লোকটির কানের ক্ষুদ্র একটা অংশ ছিড়ে নিয়ে বেরিয়ে গেল।
লোকটি আর্তনাদ করে উঠল। রক্তের একটা ধারা নেমে এল তার আহত কান থেকে।
‘এখন আর্তনাদ করছ। এরপর আর্তনাদ করারও আর অবসর পাবে না। পরের বুলেট তোমার মাথা গুড়ো করে দেবে।’
আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই তার রিভলবারের নল ঘুরে এসে স্থির হলো লোকটির কপাল লক্ষে।
‘বলছি স্যার বলছি, আমাকে মারবেন না।’ বলে চিৎকার করে উঠল লোকটি।
‘বল।’ বলল আহমদ মুসা।
লোকটি কেঁদে উঠল। বলল, ‘স্যার আমাদের কোন দোষ নেই। আমরা গায়ানার লোক। মোটা টাকার লোভ দেখিয়ে আমাদের শরীক করেছে।’
‘আমার জিজ্ঞাসার জবাব দাও।’ কঠোর কণ্ঠে বলল আহমদ মুসা।
‘স্যার আজ রাতে এদের এখানে রাখা হতো। কাল সকালে এদেরকে এখান থেকে দু’মাইল পশ্চিমে জংগলের গভীরে জনমানবশূন্য ‘সিকিমা’ হৃদের তীরে নিয়ে যাওয়া হতো। ওখানে ওদের হত্যা করে পাথর বেঁধে পানিতে ডুবিয়ে দেয়া হতো।’
বুকটা কেঁপে উঠল আহমদ মুসার।
চারদিকে দাঁড়িয়ে যারা শুনছে তারাও কেঁপে উঠল। মুখ শুকিয়ে গেল সবার।
‘ওখানে এভাবে এ পর্যন্ত কত লোককে ডুবিয়ে মারা হয়েছে?’ প্রশ্ন করল আহমদ মুসা।
‘স্যার আমরা নতুন। এই প্রথম এই অপারেশনে এসেছি।’ বলল আহত লোকটি।
‘আচ্ছা বলত, যখন মারবেই, তখন এতদূরে এনে কেন?’
লোকটি বলল, ‘আমাদের বলা হয়েছে কোন লাশ কারও চোখে পড়া চলবে না, কোন লাশ যেন কেউ কোন দিনে খুঁজে না পায়।’
‘ধন্যবাদ।’ বলে আহমদ মুসা ওমর বোংগোকে বলল, ‘এর কানে একটা ব্যান্ডেজ বেঁধে দাও।’
ওমর বোংগোর ব্যান্ডেজ বাঁধা হলে টিলায় ওঠার শুরুতে সবার দিকে লক্ষ করে আহমদ মুসা বলল, ‘তোমরা সকলে একবার ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি দাও এবং আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করো, তোমাদেরকে যেভাবে আজ আল্লাহ বাঁচিয়েছেন, সেভাবে সব মজলুমকে আল্লাহ যেন রক্ষা করেন।’
সংগে সংগেই সম্মিলিত কণ্ঠের ‘আল্লাহু আকবার’ শেস্নাগান রাতের নিরবতাকে ভেঙে খান খান করে দিল।
সবার আগে আলো নিয়ে চলল উমর বোংগো। তার পেছনে সবাই। সবার পেছনে আহমদ মুসা। উঠছে সকলে টিলার উপরে।

বেলা ১২টার মধ্যেই আহমদ মুসারা নিও নিকারীতে পৌছে গেল।
ওমর বোংগো ও ওয়ে এমবা তাদেরকে নিও নিকারীতে পৌছে দিল।
ওমর বোংগো ও ওয়ে এমবাসহ সেদিন রাতে উদ্ধার করা ২৫ জনকে আহমদ মুসা পরামর্শ দিয়েছে গ্রামে না থেকে নিও নিকারীতে থাকার জন্যে। কারণ আহমদ মুসা আশংকা করেছে এদিন রাতের এই বিপর্যয়ের খবর শত্রুর কানে পৌছবে। সেক্ষেত্রে রক্ষা পাওয়া লোকদের তারা সন্ধান করবে এবং গোটা ঘটনা জানার তারা চেষ্টা করবে। সুতরাং গ্রামে থাকলে তারা বিপদে পড়বে। আহমদ মুসা পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া বা অন্যকোন ব্যবস্থা না করা পর্যন্ত তারা ওখানেই থাকবে। ওমর বোংগোদের মত বুদ্ধিমান ছেলেদের প্রয়োজন বলে ওদেরকেও আহমদ মুসা নিও নিকারীতে থাকতে বলেছে। এদের যাবতীয় খরচ বহনের দায়িত্ব নিয়েছে হাত্তা নাসুমন। তার জমিদারী এলাকা টটনস নিও নিকারী থেকে ৮০ মাইলের মধ্যে।
খাওয়া দাওয়া সেরে হোটেলে একটু বিশ্রাম নিয়ে আহমদ মুসা বেরিয়েছিল ট্যুরিষ্ট অফিসে একটা গাড়ি বন্দোবস্তের জন্যে। কিন্তু সেখানে গিয়ে যা শুনল তাতে তার মাথায় রক্ত উঠে এল। ট্যুরিষ্ট ম্যানেজমেন্ট অফিস থেকে তাকে জানানো হলো, সুরিনামের নাগরিক নয় এবং সুরিনামে কোন চাকুরী বা ব্যবসায় কিংবা বৈধভাবে কর্মরত কোন এনজিওর সাথে যুক্ত নয় এমন সকলকে অবিলম্বে সুরিনাম ত্যাগ করতে বলা হয়েছে। বিশেষ করে রাজধানী পারামারিবোতে এমন কাউকে ঢুকতেই দেয়া হবে না। এই ব্যবস্থার কার্যকারিতা নিশ্চিত করার লক্ষে পারামারিবো পর্যন্ত রাস্তায় অনেকগুলো চেকপোষ্ট বসানো হয়েছে। ট্যুরিষ্ট অফিস থেকে হোটেলে ফেরার পথে এই বিষয় নিয়েই আকাশ পাতাল ভাবছিল আহমদ মুসা। শেষে ভাবল, ট্যাক্সি ক্যাব বা রেন্ট-এ-কার এর একটা গাড়ি যদি হাতে পাওয়া যেত, তাহলে তার ড্রাইভার সেজে হাত্তা নাসুমনকে আরোহী বানিয়ে পারামারিবো যাওয়া যেত। কিন্তু এমন গাড়ি পাওয়া যাবে কোথায়? হঠাৎ তার খেয়াল হলো ঘণ্টা দেড়েক ধরে এই যে ট্যাক্সি ক্যাব নিয়ে সে ঘুরছে, এর ড্রাইভারকে একটু বাজিয়ে দেখা যায়। কোন সাহায্য সে করতে পারে কিনা। ট্যাক্সি ক্যাবটির ড্রাইভার বুদ্ধিদীপ্ত এক তরুণ যুবক। চেহারা মিশ্র বর্ণের। এ্যাংলো-আফ্রিকান হতে পারে, আবার ইন্দো-আফ্রিকানও। চুল ও মুখের কাঠামো আফ্রিকান, কিন্তু রং ফর্সা এবং চোখ অনেকটা এশিয়ানদের মতো কালো ও টানা।
‘তোমার নাম কি ইয়ংম্যান?’ আহমদ মুসা জিজ্ঞেস করল ড্রাইভারকে।
‘জোয়াও বারনারডো।’ বলল ড্রাইভার।
‘তোমার গাড়িটা তোমার নিজের, না কোম্পানীর?’
‘আমার নিজের।’
‘কত দাম গাড়িটার।’
‘সেকেন্ড হ্যান্ড, বিশ হাজার গিল্ডার দিয়ে কিনেছি।’
বলেই সে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। প্রশ্ন করল, ‘দাম জিজ্ঞেস করছেন কেন স্যার?’
জিজ্ঞাসার জবাব না দিয়ে আহমদ মুসা বলল, ‘এই গাড়িটা যদি আমি এখনি কিনতে চাই তাহলে কত দাম নেবে?’
জোয়াও বারনারডো হাসল। বলল, ‘আমার সাথে রসিকতা করছেন।’
আহমদ মুসা গম্ভীর হলো। বলল, ‘রসিকতা নয়। আমি বিপদে পড়েছি। আমাকে আজ সন্ধ্যার মধ্যে পারামারিবো পৌছতে হবে। কিন্তু আমি বিদেশী ট্যুরিষ্ট বলে সেখানে যাওয়া আমার জন্যে নিষিদ্ধ। এ রকম একটা ট্যাক্সি ক্যাব পেলে আমি পারামারিবো যেতে পারি ট্যাক্সি-ক্যাবের ড্রাইভার সেজে।’
গম্ভীর হলো বারনারডো। বলল, ‘বুঝতে পেরেছি স্যার। নতুন গাড়ি নয়, একটা রেজিষ্টার্ড ট্যাক্সি-ক্যাবের ড্রাইভার হওয়া আপনার প্রয়োজন।’
‘ঠিক ধরেছো। এখন বল তোমার কথা।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ড্রাইভারের কাগজপত্র তো চেক হতে পারে।’
‘তোমার গাড়ির সাথে তোমার কাগজপত্রও নিয়ে নেব। তোমাকে উপযুক্ত পয়সা দেব, দরকার হলে নতুন কাগজপত্র করে নেবে। অথবা কয়েকদিন পর সব কাগজপত্র তোমাকে ফেরত দিয়ে দেব।’
‘আমার লাইসেন্সে তো আমার ফটো আছে। যদি ধরা পড়ে যান।’
‘এতটা চেক হবে আশা করি না। আমি নিশ্চয়তা দিতে পারি বারনারডো, তোমার কোন ক্ষতি আমার দ্বারা হবে না।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আপনার পারামারিবো যাওয়া এতটা কেন জরুরী বলুন তো?’ জিজ্ঞেস করল বারনারডো।
‘আগামীকাল সকালের প্লেনে আমার একজন আত্মীয়া আসবেন পারামারিবোতে। আমি তাকে যদি রিসিভ করতে না পারি, সে মহা বিপদে পড়বে। আমি যখন এই এ্যারেঞ্জমেন্টটা করি তখন এখানকার নতুন আইন-কানুন আমার জানা ছিল না। আমি নিউ আমষ্টারডাম হয়ে নিও নিকারীতে এসেছি।’
‘আপনি আপনার আত্মীয়াকে রিসিভ করার পর মানে পারামারিবোতে পৌছার পর তো আপনার গাড়ির কোন প্রয়োজন নেই। তাই তো?’
‘ঠিক তাই।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তাহলে এই সামান্য সময়ের জন্যে আপনি এত টাকা খরচ করবেন কেন? এক কাজ করুন। আপনি গাড়ি নিয়ে যান। গাড়ি ফেরত পেলে আপনার টাকা আমি ফেরত দেব। ইতিমধ্যে যে সময় যাবে, তার উপযুক্ত ভাড়া আপনি দিয়ে দেবেন।’ বলল বারনারডো।
খুশি হলো আহমদ মুসা। বলল, ‘ধন্যবাদ বারনারডো। হোটেলে পৌছে তুমি আমাকে গাড়ির চাবি দিয়ে দেবে, আমি তোমাকে দিয়ে দেব ২০ হাজার গিল্ডার।’
‘ঠিক আছে স্যার। আপনি গাড়ি নিয়ে চলে যান। আমি কাল সকালেই পারামারিবো পৌছব। আপনি ইচ্ছা করলে তখন আমাকে গাড়ি দিয়ে দিতে পারবেন, অথবা পরেও দিতে পারবেন।’
‘ধন্যবাদ বারনারডো। তোমার কাছে আমি কৃতজ্ঞ থাকবো।’
‘কোথায় আমি দেখা করবো, সেটা আমাকে বলে দিন।’
‘কোথায় কোন হোটেলে উঠব, কোন হোটেলে জায়গা পাব এখনও জানি না। তুমি কাল সকাল ৯ টায় এয়ারপোর্টের কারপার্কে আমার সাথে দেখা করবে।’
‘ঠিক আছে।’
‘ধন্যবাদ বারনারডো।’
‘ধন্যবাদ স্যার।’
বারনারডোর গাড়ি ছুটে চলল হোটেলের দিকে।

আহমদ মুসা আহমদ হাত্তা নাসুমনকে সরকারের নতুন আইনের কথা বলতেই উদ্বেগে প্রায় আর্তনাদ করে উঠল। বলল, ‘মি. আহমদ মুসা আমার মেয়ের কি হবে। আপনি যদি পারামারিবো পৌছতে না পারেন, তাহলে আমার ফাতিমা এয়ারপোর্টে পৌছেই নির্ঘাত ওদের হাতে পড়ে যাবে। ওয়াং আলীও শেষ হবে। ফাতিমারও সর্বনাশ হবে।’
হতাশা, উদ্বেগে ভেঙে পড়ল হাত্তা নাসুমন।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘মি. হাত্তা আপনি অর্ধেক কথা শুনেছেন। পুরোটা শুনুন।’
বলে আহমদ মুসা ট্যাক্সি ক্যাবের মালিক জোয়াও বারনারডো’র সাথে তার চুক্তির কথা সব বলল এবং জানাল যে, ‘টাকা তাকে দিয়ে দিয়েছি, চাবি আমার হাতে, গাড়ি হোটেলের কারপার্কে দাঁড়িয়ে আছে।’
‘আল হামদুলিল্লাহ। মি. আহমদ মুসা কি আর বলব। আমি শুধু বলব, আল্লাহ আপনাকে দীর্ঘজীবি করুন।’
একটু থামল হাত্তা নাসুমন। চিন্তা করল। তারপর বলল, ‘ধরে নিলাম ড্রাইভার হিসেবে আপনার কাগজপত্র পুলিশ দেখবে না, কিন্তু আমার পরিচয় কি হবে?’
‘আপনার শিখের পোশাক থাকবে না, কিন্তু দাড়ি থাকবে, মাথায় আলগা চুলও থাকবে। একান্তই প্রয়োজন পড়লে আপনার সঠিক পরিচয় দেয়া হবে।’
‘কিন্তু এতে বিপদ ঘটতে পারে।’
‘হ্যাঁ তা পারে। ড্রাইভার হিসেবে আমার ভূঁয়া পরিচয়ও ধরা পড়ে যেতে পারে। তাতেও বিপদ ঘটতে পারে। কিন্তু ঝুঁকি না নিয়ে উপায় নেই। রাতের মধ্যে আমাদেরকে অবশ্যই পারামারিবো পৌছতে হবে।’
‘কিন্তু রাস্তায় যদি বিপদ ঘটে?’ উদ্বিগ্ন কণ্ঠ হাত্তা নাসুমনের।
‘শত বিপদ মাথায় নিয়েই আমাদেরকে পারামারিবো পৌছতে হবে। ফাতিমা নাসুমনকে বিপদে ফেলা যাবে না।’
‘সত্যিই তাই মি. আহমদ মুসা। আল্লাহ আমাদের সাহায্য করুন।’ অসহায় কণ্ঠস্বর হাত্তা নাসুমনের।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়ালো। বলল, ‘গোছ-গাছ করে নেয়া যাক। মিনিট পনেরোর মধ্যেই আমরা বেরুব।’

বেলা তখন ৪টা।
আহমদ মুসা ট্যাক্সি ক্যাবের ড্রাইভিং সিটে উঠে বসল। পাশে তার ব্যাগটি।
পেছনের সিটে উঠল আহমদ হাত্তা নাসুমন।
‘গাড়ি ছাড়ব স্যার?’ বলল আহমদ মুসা হাত্তা নাসুমনকে লক্ষ করে। মুখে তার মিষ্টি হাসি।
‘মি. আহমদ মুসা আমাকে আর লজ্জা দেবেন না। আসুন আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, তিনি যেন আপনার পরিকল্পনাকে সফল করেন।’ বলল হাত্তা নাসুমন বিব্রত কণ্ঠে।
‘আমিন।’ বলল আহমদ মুসা। গাড়ি ষ্টার্ট নিল।
বেরিয়ে এল হোটেলের কার পার্ক থেকে।
ছুটতে শুরু করল গাড়ি।

পরবর্তী বই
সুরিনামের সংকটে

Top