৩২. অক্টোপাশের বিদায়

চ্যাপ্টার

চারতলা একটা বাড়ির গাড়ি বারান্দায় গাড়ি থেকে নামল আহমদ মুসা।
গাড়িতে বসা ছিল হাত্তা নাসুমন।
আহমদ মুসা গাড়ি থেকে নেমে গাড়ির দরজা বন্ধ করতে করতে বলল, ‘মি. হাত্তা, আপনি একটু বসুন। দেখি মেয়েটি বাড়ি আছে কিনা।’
বলে আহমদ মুসা ছুটল গেটের দিকে। বন্ধ গেট।
দরজার ডানপাশে দেয়ালে ইন্টারকম।
ইন্টারকমের দিকে হাত বাড়াল আহমদ মুসা। কিন্তু সমস্যায় পড়ে গেল। কোন ফ্ল্যাটে কল করবে সে। ৪ তলা বাড়ি। ৪টি ফ্ল্যাট। গাড়ির ব্লু বুকে শুধু মেয়েটির নাম ‘এ্যানি এন্ডারসন’ ও বাড়ির নাম্বার আছে। ফ্ল্যাট নাম্বার নেই।
ভাবল আহমদ মুসা, দু’তলার ফ্ল্যাট সিকুরিটির জন্যে ভালো। প্রথমে দু’তলায় দেখা করব। না হলে সব তলায় নক করতে হবে।
‘বিসমিল্লাহ’ বলে আহমদ মুসা দু’তলার ইন্টারকমে ক্লিক করল।
সেকেন্ডের মধ্যেই ওপর থেকে সাড়া এল। একটা তরুণী কণ্ঠ কথা বলে উঠল, ‘কে ওখানে?’
‘আমি আহমদ মুসা। সেদিন জোর করে আপনার গাড়ি নিয়ে গিয়েছিলাম। গাড়ি ফেরত দেয়ার ব্যাপারে এসেছি।’
‘আহমদ মুসা মানে আপনি মুসলিম?’
‘হ্যাঁ, আমি মুসলিম।’
‘ঠিক আছে, আপনি আসুন।’
তরুণীটির এই কথার সাথে সাথে গেটের তালায় একটা ক্লিক শব্দ উঠল। তার অর্থ গেট খুলে দেয়া হয়েছে।
আহমদ মুসা মুখ ঘুরিয়ে তার গাড়ির দিকে চেয়ে বলল, ‘মি. হাত্তা আসুন।’
হাত্তা নাসুমন এসে গেল।
আহমদ মুসা প্রবেশ করল তাকে নিয়ে।
আহমদ মুসা দু’তলার ল্যান্ডিং-এ সবে এসে দাঁড়িয়েছে। তার পেছনে হাত্তা নাসুমনও।
একটা তরুণী দু’তলার দরজা খুলে বেরিয়ে এল।
নীল রংয়ের ঢিলা ফুলহাতা একটা গাউন তার গোটা দেহ ঢেকে আছে। মাথায় একটা রুমাল।
দরজা খুলেই সে তাকিয়েছে আহমদ মুসার দিকে। কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার দৃষ্টি পেছনের আহমদ হাত্তার উপর পড়তেই বিস্ময়ে তার চোখ বিস্ফোরিত ও মুখ হা হয়ে উঠল। ‘আব্বা’ বলে একটা চিৎকার দিয়ে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল আহমদ হাত্তা নাসুমনকে।
‘মা, একি তুমি!’ বলে হাত্তা নাসুমনও জড়িয়ে ধরেছে তরুণীটিকে।
আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়াল তাদের দিকে। তার চোখে-মুখেও বিষ্ময় ও আনন্দের খেলা। আহমদ মুসা বুঝে নিয়েছে সে যার কাছে এসেছে অর্থাৎ এই তরুণী এ্যানি এন্ডারসনই ফাতিমা নাসুমন, হাত্তা নাসুমনের মেয়ে।
একটা বিরাট স্বস্তি নেমে এল আহমদ মুসার চোখে-মুখে। খুশি হলো সে।
পিতা ও কন্যা দু’জনের চোখেই অশ্রুর ঢল। কাঁদছে দু’জনেই।
প্রাথমিক আবেগটা সামলে নেবার পর হাত্তা নাসুমন মেয়েকে আহমদ মুসার দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বলল অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে, ‘মি. আহমদ মুসা, এই আমার মেয়ে ফাতিমা নাসুমন। আল্লাহ আমার মেয়েকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিয়েছেন আহমদ মুসা।’
বলেই হাত্তা নাসুমন ল্যান্ডিং-এর উপরই সিজদায় পড়ে গেল। পিতার সাথে সাথে সিজদা করল ফাতিমা নাসুমনও।
তারা সিজদা থেকে উঠে দাঁড়াল।
‘আপনারা, পিতা-কন্যা, দু’জনকেই মোবারকবাদ।’ বলল আহমদ মুসা তাদের লক্ষ করে।
‘শুকরিয়া।’ বলল মেয়েটি। তার দু’চোখ তখনও অশ্রুতে ভাসছে।
‘লক্ষ বার শুকরিয়া আদায় করলেও আপনার শুকরিয়া আদায় হবে না আহমদ মুসা।’ প্রায় মেয়ের সঙ্গে সঙ্গেই বলে উঠল হাত্তা নাসুমন।
‘দেখুন, মি. হাত্তা, আল্লাহর নিরংকুশ অধিকারে কারও ভাগ বসাতে চাচ্ছেন আপনি।’ আহমদ মুসার ঠোঁটে হাসি, কিন্তু কণ্ঠে একটা মিষ্টি শাসনের সুর।
কিছু বলতে যাচ্ছিল হাত্তা নাসুমন।
ফাতিমা নাসুমন তাকে বাঁধা দিয়ে বলল, ‘ভেতরে চলুন আব্বা।’ তারপর আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আসুন জনাব।’
সবাই ভেতরে ঢুকল।
দরজা দিয়ে ভেতরে ঢোকার পর ছোট্ট একটা করিডোর, দু’পাশে দেয়াল।
করিডোর গিয়ে পড়েছে বিশাল একটা ড্রইংরুমে।
ড্রইংরুমে প্রবেশ করল তারা।
সমস্ত ড্রইং রুম জুড়ে কয়েক সেট সোফা গুচ্ছাকারে সাজানো। হালকা নীল কার্পেটের উপর সাদা সোফার গুচ্ছগুলোকে সাগর বুকের সফেদ তিলক বলে মনে হচ্ছে।
ড্রইং রুমে আহমদ মুসাকে একটা সোফায় বসার অনুরোধ করে ফাতিমা নাসুমন তার আব্বাকে নিয়ে মুখোমুখি আরেকটা সোফায় গিয়ে বসল।
বসেই ফাতিমা নাসুমন আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মাফ করবেন জনাব, শুরুতেই আমি একটা প্রশ্ন করতে চাচ্ছি।’
‘করুন।’ বলল আহমদ মুসা।
ফাতিমা নাসুমন ত্বরিত তাকাল তার পিতার দিকে। বলল, ‘আব্বা ওঁকে বলুন আমাকে ‘তুমি’ বলার জন্যে। আমি নিশ্চয় ছোট হব।’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘ঠিক আছে ছোট বোন, তোমার শুরুর প্রশ্নটা কর।’
সলজ্জ আনন্দে মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল ফাতিমা নাসুমনের। সে দ্রুত উঠে দাঁড়াল। ছুটে গেল আহমদ মুসার দিকে। তার পায়ের কাছে বসল এবং দু’হাত আহমদ মুসার দু’পায়ে ঠেকিয়ে সালাম করল।
আহমদ মুসা তার দু’পা টেনে নিতে নিতে বলল, ‘এ কি করছ ফাতিমা? পায়ে হাত দিয়ে তো সালাম করে না।’
‘না, আমাদের সুরিনামে আমরা গুরুজনকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করি।’
বলে ফাতিমা নাসুমন ফিরে এল তার আসনে, পিতার পাশে।
বসেই সে আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘জনাব আমি জানতে চাচ্ছি, গত কিছুদিন ধরে আমেরিকার পত্র-পত্রিকায় যে আহমদ মুসার কথা লেখা হচ্ছে, ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের ইতিহাস সৃষ্টিকারী ঘটনাগুলোতে যে আহমদ মুসার নাম শুনেছি এবং চীন, রাশিয়া, ফ্রান্স, আফ্রিকা, ফিলিপাইন, ফিলিস্তিন, ককেশাস, বলকান প্রভৃতি দেশের নানা ঘটনায় যে আহমদ মুসাকে পেয়েছি, সেই আহমদ মুসাই তো আপনি?’
আহমদ মুসা মুখ খোলার আগেই আহমদ হাত্তা নাসুমন মুখ খুলল। বলল, ‘হ্যাঁ মা আমরা ভাগ্যবান। সেই আহমদ মুসাই তোমার গাড়ি নিয়ে গিয়েছিলেন, সেই আহমদ মুসাই আমাকে মুক্ত করেছেন এবং সেই আহমদ মুসাই এখন আমাদের সামনে বসে আছেন।’
‘ও গড!’ বলে বিষ্ময়-বিমুগ্ধ ফাতিমা নাসুমন উঠে দাঁড়াল। দ্রুত আহমদ মুসার দিকে ছুটে গিয়ে আগের মতই তার পায়ের কাছে বসে দু’হাতে আহমদ মুসার দু’পা স্পর্শ করে উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘এটা সালাম নয়। পায়ের ধুলো নিলাম।’
ফাতিমা নাসুমন তার আসনে ফিরে আসছিল। আহমদ মুসা বলল, ‘পায়ের ধুলো নেয়ার প্রচলনও কি সুরিনামে আছে?’
‘হিন্দুস্তানীদের মধ্যে এটা খুব বেশি প্রচলিত। দেখাদেখি মুসলিম সমাজেও এর কিছু চল আছে।’ বলল হাত্তা নাসুমন।
হাত্তা থামতেই ফাতিমা নাসুমন বলে উঠল, ‘আব্বা একটা কথা বলি। সেদিন আমি ওভাবে গাড়ি দেবার কথা নয়। ওঁর হাতে অস্ত্র ছিল না। আমি চেঁচামেঁচি করে লোক ডাকার কথা। কিন্তু আমি পারিনি। মনে হয়েছিল, উনি যা বলছেন সব সত্যি। তাঁর কথা আমার মানা দরকার। আমি তাঁকে গাড়ি দিয়ে দিয়েছি। পরে আমি অনেক ভেবেছি, আমি তখন ঐ ভাবে চিন্তা করেছিলাম কেন? কেন পুতুলের মত ওঁর হাতে গাড়ি তুলে দিলাম। আজ বুঝতে পারছি, উনি আহমদ মুসা ছিলেন বলেই ওঁর নির্দেশ না মেনে উপায় ছিল না।’
বলেই ফাতিমা নাসুমন ওপর দিকে মুখ তুলল। বলতে লাগল, ‘ও আল্লাহ, জনাব আহমদ মুসাকে অসাধ্য সাধনের আরও শক্তি দান করুন। তাঁকে জর্জ ওয়াশিংটনের মত সফল করুন।’ আবেগে ভারী হয়ে গেল ফাতিমা নাসুমনের কণ্ঠ।
‘ধন্যবাদ বোন। সেদিন তোমার সাহায্য আমাদের বিরাট উপকার করেছে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ। আমার খুব ইচ্ছা করছে সেদিন গাড়ি নিয়ে যাবার পর কি ঘটেছিল তা জানতে।’ বলল ফাতিমা নাসুমন আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে।
‘এ ইচ্ছা খুবই স্বাভাবিক।’ বলে আহমদ মুসা সেদিন গাড়ি নিয়ে জেনারেল শ্যারনকে ফলো করা, শ্যারনদের গাড়ি থেকে গোলা-গ্রেনেড নিক্ষেপ, ফাতিমার গাড়ি ধ্বংস হওয়া, আহমদ মুসার গাড়ি থেকে নেমে যাওয়া ও গুলীবিদ্ধ হওয়া, জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন ও সান ওয়াকারদের আগমন, জেনারেল শ্যারনদের গ্রেপ্তারের দায়িত্ব জেনারেল ওয়াশিংটনের নেয়া এবং আহমদ মুসা হাসপাতালে যাওয়ার সব কথা সংক্ষেপে জানিয়ে বলল, ‘তোমার গাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে। গাড়ির ক্ষতিপূরণ দেবার জন্যেই আজ আমার এখানে আসা।’
বলে আহমদ মুসা পকেট থেকে টাকার কয়েকটা বান্ডিল বের করল এবং সামনের টিপয়ের উপর বান্ডিলগুলা রেখে বলল, ‘তোমার গাড়িটা নতুন ছিল। নতুন একটা স্পোর্টস কারের দাম এতে আছে।’
ফাতিমা নাসুমন হাসল। বলল, ‘আপনি গাড়িতে থাকা অবস্থায় গ্রেনেডটা যদি গাড়িতে পড়ত, আপনার জীবনের ক্ষতিপূরণ কিভাবে হতো বলুন তো?’
আহমদ মুসাও হাসল। বলল, ‘ঐ ক্ষতিপূরণ করা যেত না বলেই ক্ষতিটা হয়নি ফাতিমা।’
গম্ভীর হলো ফাতিমা। বলল, ‘আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন আমাদের সবার উপর।’
একটু থেমেই আবার প্রশ্ন করল, ‘আব্বার মুক্তির ঘটনা কিভাবে ঘটল?’
‘ওটা খোদ মি. হাত্তাই বলতে পারবেন।’ বলল আহমদ মুসা।
আহমদ হাত্তা নাসুমন সংক্ষেপে বলল জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন, জেনারেল শ্যারন ও বেন ইয়ামিনকে আহতাবস্থায় বন্দী করার পর কিভাবে গোটা বাড়ি সার্চ করতে গিয়ে বন্দীখানা থেকে তাকে উদ্ধার করা হয়। সে আরও বলল পেন্টাগন সামরিক হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর কিভাবে একজন জেনারেলের কাছে আহমদ মুসার কাহিনী শুনে এবং আহমদ মুসার সাথে পরিচয় হয়। আরও বলল, কি আগ্রহের সাথে আহমদ মুসা সুরিনামের সব কথা শুনে এবং হাসপাতাল থেকে রিলিজ হওয়ার সময় তাকেও সাথে করে নিয়ে এসেছে ফাতিমা নাসুমনকে খুঁজে দেয়ার জন্য। উচ্ছসিত আবেগ নিয়ে কথা শেষ করল সে এই ভাবে, ‘আমার কেবলই মনে হচ্ছে আহমদ মুসার সাথে আমার দেখা হওয়াটা আমাদের সৌভাগ্যের সুর্যোদয়।’
‘ঠিকই বলেছেন আব্বা, ওঁর সাথে দেখা হওয়ার পর আমি তোমাকে খুঁজে পেয়েছি, যে আশা আমি কল্পনাতেও করতে পারিনি।’ বলল ফাতিমা নাসুমন। তারও কণ্ঠ আবেগে ভারী।
বিব্রত আহমদ মুসা প্রসঙ্গ পাল্টাবার জন্যে বলল, ‘ফাতিমা এ টাকাগুলো তোমার নেয়া প্রয়োজন।’
‘না আমি নিতে পারি না।’ বলল ফাতিমা নাসুমন।
‘এ টাকা আমার নয়, আমি তোমাকে দিচ্ছি না। মার্কিন সরকার এ টাকা দিয়েছে তাদের আইন অনুসারেই।’ আহমদ মুসা বলল।
‘এ টাকা দিয়েছে তারা জনৈক এ্যানি এন্ডারসনকে, আহমদ হাত্তা নাসুমনের মেযে ফাতিমা নাসুমনকে নয়। তারা আমার পিতার প্রতি যে এহসান করেছে এবং আমার গাড়ি দেয়াতে যে কাজ হয়েছে, তাতে এ টাকা গ্রহণ করলে আমার বিবেক মরে যাবে।’ বলল ফাতিমা নাসুমন। আবেগে তার চোখ-মুখ লাল হয়ে উঠেছে।
খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল আহমদ মুসার মুখ। বলল, ‘ধন্যবাদ ফাতিমা, আমি আমার অনুরোধ ফিরিয়ে নিচ্ছি। তোমার যুক্তি আমি গ্রহণ করেছি।’
‘ধন্যবাদ ভাইয়া, আমি জানতাম আপনি বুঝবেন।’
বলে একটু থামল ফাতিমা নাসুমন। তারপর পিতার দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, ‘আব্বা আপনি ওয়াং আলীর শেষ খবর বোধ হয় জানেন না।’
‘না, জানি না। কোন খারাপ খবর নেই তো?’ দ্রুত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল হাত্তা নাসুমন। তার কণ্ঠে উদ্বেগ।
‘আগের চেয়ে খারাপ।’ বলল ফাতিমা নাসুমন।
‘কি?’
‘গতকাল ইয়াং আমিরের একটা মেসেজ পেয়েছি। তাতে সে লিখেছে, গত পরশু ওয়াং আলীকে অপহরণকারীরা একটা ক্লিনিকে নিয়ে যায়। সে অসুস্থ না আহত জানা যায়নি। মেসেজের সাথে সে গত পরশুর ছাপা হওয়া একটা বিজ্ঞাপন পাঠিয়েছে। বুঝা যাচ্ছে বিজ্ঞাপনটা ছাপিয়েছে অপহরণকারীরা ওয়াং আলীর নামে। আর সম্বোধন করা হয়েছে নিখোঁজ ফাতিমা নাসুমনকে। বলা হয়েছে, আগামী ২১ তারিখের মধ্যে যদি তার কাছে না ফিরি, তাহলে সেও হারিয়ে যাবে, কোনদিনই আর তাকে দেখা যাবে না। বিজ্ঞাপনে আরও লেখা হয়েছে, ‘২১ তারিখ সন্ধ্যা ৬টা সহ প্রত্যেকদিন সন্ধ্যা ৬টায় পারামারিবো এয়ারপোর্টের কারপার্কে তোমার জন্যে গাড়ি অপেক্ষা করবে। অভিমান ভুলে ফিরে এস। তোমার উপস্থিতিই শুধু আমাকে বাঁচাতে পারে।’ শেষ দিকে ফাতিমা নাসুমনের কণ্ঠ অশ্রুরুদ্ধ হয়ে পড়ল।
ইয়াং আমির ওয়াং আলীর ছোট ভাই।
ফাতিমা নাসুমনের কথা শোনার পর আহমদ হাত্তা নাসুমনের মুখ উদ্বেগ আতংকে ফ্যাকাসে হয়ে গেল। বলল সে, ‘তার মানে ২১ তারিখে পর ওয়াং আলীকে ওরা মেরে ফেলবে।’
ফাতিমা নাসুমন কিছু বলল না।
দু’হাতে মুখ ঢাকল সে।
তার দু’গন্ড থেকে দু’হাতের ফাঁক দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল।
আহমদ মুসা গভীর মনোযোগ দিয়ে ওদের কথা শুনছিল। সে তাদের আলোচনায় যোগ দেয়নি।
অল্পক্ষণ পর ফাতিমা নাসুমন রুমাল দিয়ে চোখ মুছে ধীরে ধীরে মুখ তুলল।
বলল, ‘স্যরি।’
তারপর পিতার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আব্বা ইয়াং আমির আরও জানিয়েছে, নির্বাচন সিডিউল অনুসারেই অনুষ্ঠিত হবে। মনোনয়ন পত্র জমা দেবার শেষ দিন ২২ তারিখ বিকেল পাঁচটা। সে আরও জানিয়েছে, ওরা অদৃশ্য এমন একটা ব্যবস্থা করেছে যার ফলে কোন কম্যুনিটিরই উল্লেখযোগ্য কোন মুসলমান মনোনয়ন পত্র জমাই দিতে পারবে না।’
আহমদ হাত্তা নাসুমনের দু’চোখও অশ্রুতে ভরে উঠেছিল। সে চোখ মুছে বলল, ‘কিছু করার নেই মা। ওরা ওয়াক ওভার নিতে চায়। তা নিক বলে এটা মেনে নেয়া যেতো, কিন্তু প্রশ্ন হলো তাদের উদ্দেশ্যের এটা শেষ নয়, শুরুমাত্র। তারা যদি একচেটিয়া পার্লামেন্ট দখল করতে পারে, তাহলে তাদের পরবর্তী কাজ হবে সুরিনাম থেকে ধীরে ধীরে মুসলমানদের উচ্ছেদ করা। আঘাতটা প্রথম আসবে ইন্দোনেশীয় মুসলমানদের উপর। আমাদের জমিদারীসহ কয়েকটা জমিদারী তারা দখল করতে পারলে খুব সহজেই তারা মুসলিম চাষীদের ভূমি কেড়ে নিয়ে তাদের উচ্ছেদ করতে পারবে।’
‘উচ্ছেদ করে সমস্যা বাড়ানোর চাইতে তারা একটা দু’টা করে মুসলমানদের মেরেই শেষ করবে। এই ক’দিনে ছ’শরও বেশি মানুষকে তারা মেরেছে। একটা খবরও বেরুল না, একটা লাশও পাওয়া গেল না, দুনিয়াও জানতে পারল না। শত শত পরিবারের নিরন্তর কান্না ও অশ্রুর পস্নাবন কোন মূল্য পেল না।’
বলতে বলতে আবার কেঁদে ফেলল ফাতিমা নাসুমন। কাঁদতে কাঁদতেই বলল, ‘ওয়াং আলীরও দিন ঘনিয়ে আসছে, সবার অলক্ষে সবার মত সেও হারিয়ে যাবে।’ কান্নায় রুদ্ধ হয়ে গেল ফাতিমা নাসুমনের শেষ কথাগুলো।
ফাতিমা নাসুমনের কথাগুলো ছবি হয়ে ভেসে উঠেছিল আহমদ মুসার চোখে। আহমদ মুসা দেখতে পাচ্ছিল যেন সুরিনাম-উপকূলের কৃষিগ্রামগুলো এবং পাহাড় ও বনাঞ্চলে সংগ্রাম করে বাঁচা মানুষগুলোকে। সেখানকার গ্রাম-জনপদ থেকে ভেসে আসা কান্না যেন শুনতে পাচ্ছিল সে। এই কান্না তার প্রতিটি রক্ত কণিকায়, অস্তিত্বের প্রতি রন্ধ্রে অক্ষমের আর্তনাদ নয়, বিক্ষোভের জ্বালা ছড়িয়ে দিল। যেন অজান্তেই তার ঠোঁটের বাধন ভেদ করে বের হয়ে এল প্রতিবাদী কয়েকটি শব্দ, ‘না ফাতিমা ওয়াং আলী হারিয়ে যাবে না।’
ঘরের অশ্রু সজল নরম পরিবেশে বেসুরে কর্কশ হয়ে বেজে উঠল আহমদ মুসার কথা।
ফাতিমা নাসুমন ও আহমদ হাত্তা নাসুমন অনেকটা চমকে উঠে তাকাল আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসা তার আসনে নড়ে-চড়ে সোজা হয়ে বসল। তার চোখে-মুখে স্থির সিদ্ধান্তের একটা দ্যুতি। ঠোঁটে তার ফুটে উঠল কঠিন এক টুকরো হাসি। তাকিয়েছিল ফাতিমা নাসুমনদের দিকে। বলল, ‘মি. হাত্তা, ফাতিমা, হ্যাঁ, আমি চেষ্টা করব ওয়াং আলী যাতে হারিয়ে না যায়, চেষ্টা করব সুরিনাম থেকে আর কেউ যাতে না হারায়।’
বিস্ময় ফুটে উঠল হাত্তা নাসুমন ও ফাতিমার চোখে-মুখে। বলল হাত্তা নাসুমন, ‘কিভাবে, কেমন করে?’
সোফায় গা এলিয়ে দিল আহমদ মুসা। বলল, ‘আমি সুরিনাম যাচ্ছি।’
হঠাৎ যদি আকাশের চাঁদটা আকাশ থেকে হাতে এসে পড়ে, তাহলে যে অবস্থা দাঁড়ায় সেই অবস্থা হলো হাত্তা নাসুমন ও ফাতিমার। তাদের দৃষ্টি স্থির হয়ে গেল আহমদ মুসার মুখের উপর। বিস্ময়ের ধাক্কায় তারা কথা বলতে ভুলে গেল।
বিস্ময়ের ঘোর কাটলে প্রথমে কথা বলল ফাতিমা নাসুমন, ‘আপনি যাবেন সুরিনামে?’ তার দুই চোখ আনন্দ ও বিস্ময়ের আলোয় চিক চিক করছে।
‘কেন বিস্মিত হচ্ছ ফাতিমা?’ প্রশ্ন আহমদ মুসার।
‘অখ্যাত এক গরীব দেশ আমাদের। অবহেলিত ও অজ্ঞাত কিছু মানুষ আমরা। এমন দেশে আমরা আহমদ মুসাকে আশা করতে পারি?’ বলল ফাতিমা নাসুমন।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘এর অর্থ আহমদ মুসার প্রতি তোমরা সুবিচার করছ না। আহমদ মুসাকে তোমাদের পাশ থেকে দুরে সরিয়ে দিচ্ছ।’
‘ঘটনা তা নয় আহমদ মুসা। আপনি আমাদের দেশ সুরিনামে যাবেন এটা কল্পনার চেয়েও অবিশ্বাস্য এক ব্যাপার। তাই বিশ্বাস করতে আমাদের কষ্ট হচ্ছে।’ বলল হাত্তা নাসুমন।
‘আমিও তো কোনদিন কল্পনায় ভাবিনি সুরিনামে আমি যাব। বাস্তবতা সব সময় কল্পনার চেয়ে বিস্ময়কর।’ বলল আহমদ মুসা।
ফাতিমা নাসুমন সোফা থেকে উঠে আহমদ মুসার সামনে কার্পেটের উপর হাঁটু মুড়ে প্রার্থনার ভংগিতে বসে বলল, ‘আপনি সত্যিই সুরিনামে যাবেন?’ আবেগের আকুলতায় গলা কাঁপছিল তার।
‘অবশ্যই এবং তা ২১ তারিখের আগে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আল্লাহু আকবর। বলে কাবামুখী হয়ে সিজদায় পড়ে গেল ফাতিমা নাসুমন।
অনেক্ষণ পর মুখ তুলল সে।
অশ্রুতে ধুয়ে গেছে তার মুখ। বলল, ‘অনেকদিন পর আমার মনে হচ্ছে, বুকের উপর থেকে একটা জগদ্দল পাথর নেমে গেল। বুক ভরে নিশ্বাস নিতে পারছি আজ আমি।’
উঠে দাঁড়াল ফাতিমা নাসুমন। বলল, ‘আব্বা আপনারা একটু বসুন। আমি চা নিয়ে আসছি।’
চলে গেল ফাতিমা।
‘মেয়েটার উপর দিয়ে খুব ধকল গেছে। আমি কিডন্যাপড হলাম, তার পর পরই ওয়াং আলীকেও তারা অপহরণ করল। দেশ তার জন্যে হয়ে উঠেছিল মৃত্যুর উপত্যকা। মৃত্যু সব সময় তাকে তাড়া করে ফিরেছে। এই পরিস্থিতিতে বারবার ঠিকানা পরিবর্তন করে সে স্বজনহীন এই বিদেশে বাস করত।’ বলল হাত্তা নাসুমন।
‘রাত যত গভীর হয়, সোবহে সাদেক ততই এগিয়ে আসে।’ আহমদ মুসা বলল।
ক’মিনিটের মধ্যেই ফাতিমা ফিরে এল একটা ট্রলি ঠেলে নিয়ে। আহমদ মুসা সেদিকে চেয়ে বলল, ‘তুমি চা আনতে গিয়ে নিয়ে এলে খাবার।’
‘আমার ক্ষুধা লেগেছে, আপনাদেরও ক্ষুধা লাগার কথা।’ বলল ফাতিমা।
‘দাও, ক্ষুধা না লাগলেও খেতে পারব। ক’দিন ধরে হাসপাতালের খানা খেয়েছি তো। বাড়ির খাবার অমৃত লাগার কথা।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ভাইয়া অমৃত না হলেও সুরিনামের খাবার অরুচিকর হবে না।’
ফাতিমা খাবার পরিবেশন করল।
তিন জনই খাচ্ছে।
‘একুশ তারিখ আসতে মাত্র দিন কয়েক বাকি। আমার মনে হয় চিন্তা করার অনেক বিষয়ই থাকতে পারে।’ ফাতিমা বলল।
‘ঠিক বলেছ ফাতিমা। অনেক কিছুই ভাবতে হবে। তার জন্যে সময় আমি মনে করি কম নেই। এই মুহূর্তে যে সিদ্ধান্তটা হয়ে যেতে পারে তা হলো, আমি ১৯ তারিখে মি. হাত্তাকে নিয়ে সুরিনামে যাবার জন্যে গায়নার নিউ আমষ্টারডামে নামব। সেখান থেকে জলপথ-স্থলপথে যাব সুরিনামের পারামারিবো। আর একুশ তারিখে ফাতিমা নামবে সুরিনামের পারামারিবো এয়ারপোর্টে। ঠিক ছ’টায় সে প্রবেশ করবে এয়ারপোর্টের কারপার্কে।’ বলল আহমদ মুসা।
ফাতিমা নাসুমনের মুখ ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেল আহমদ মুসার কথা শুনে। বলল, ‘আমি একা যাব? ছ’টায় কারপার্কে তো ওরা থাকবে? কারপার্কে গেলেই তো ওরা ধরে ফেলবে আমাকে।’
আহমদ হাত্তা নাসুমনের চোখে-মুখেও উদ্বেগের ছায়া।
আহমদ মুসা বলল, ‘আমি তো সেটাই চাই তুমি ওদের হাতে পড়। ভয় নেই আমি আশে পাশেই থাকব।’
‘তবু আমার ভয় করছে। ওরা কশাই, মানুষ নয় ভাইয়া।’ ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল ফাতিমা।
‘আমি জানি। কিন্তু এ ছাড়া কোন বিকল্প নেই বোন। তুমি আমার উপর আস্থা রাখতে পার।’
সংগে সংগেই কথা বললো না ফাতিমা নাসুমন। মুখ নিচু করেছিল সে।
কয়েক মুহূর্ত পরেই মুখ তুলল। বলল সে, ‘মাফ করবেন ভাইয়া। নির্দেশ দিচ্ছেন, আপনি যে আহমদ মুসা তা ভুলে গিয়েছিলাম। আপনার নির্দেশ আমি পালন করব, যেভাবে বলবেন ঠিক সেভাবেই।’ ফাতিমা ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করল। তার চোখে-মুখে দৃঢ়তা।
খুশি হলো আহমদ মুসা। বলল, ‘ধন্যবাদ বোন। দেখবে তুমি যত সাহসী হয়েছ, শত্রুরা তত দূর্বল হয়ে পড়েছে।’
‘ধন্যবাদ ভাইয়া।’ বলে একটু থামল ফাতিমা নাসুমন। বলল, ‘আমার জানতে ইচ্ছা করছে ভাইয়া, আপনি গায়ানা, সুরিনামে যাননি। নিউ আমষ্টারডাম দেখেননি। নিউ আমষ্টারডাম হয়ে সুরিনাম প্রবেশের এই পরিকল্পনা হঠাৎ কেন, কিভাবে করলেন?’
‘আমি খুব ভেবে করিনি। আমি নিশ্চিত হয়েছি যে, তোমার আব্বাকে নিয়ে পারামারিবো এয়ারপোর্ট হয়ে দেশে প্রবেশ করা যাবে না। চাই না এই মুহুর্তে শত্রুরা তাকে দেখে ফেলুক। তারা এটা জেনে নিশ্চিন্ত থাকুক যে, মি. হাত্তা এখনো বন্দী আছেন। দেশে ফিরতে পারছেন না। তাদের নির্বাচন নির্বিঘ্নেই হয়ে যাবে। এ অবস্থায় দেশে ফেরার জন্যে জল ও স্থল পথ বাকি থাকল। হঠাৎ তোমার আব্বার মত অতি পরিচিত লোককে নিয়ে দেশের কোন বন্দরে নামাও ঠিক হবে না। প্রথমে গায়ানা গিয়ে সেখান থেকে সুরিনামে প্রবেশ করব। সুরিনাম উপকূলের সবচেয়ে নিকটবর্তী বড় শহর হলো নিউ আমষ্টারডাম। তাই প্রথমে সেখানে নেমে সুরিনামে প্রবেশের চিন্তা করেছি।’
চোখ দু’টি উজ্জ্বল হয়ে উঠল ফাতিমার। বলল, ‘ভাইয়া অবাক ব্যাপার, আপনি না জেনে সুরিনামে প্রবেশের যে রুট ঠিক করেছেন, তার কোন বিকল্প নেই। গায়ানার পূর্বাঞ্চলে একমাত্র নিউ আমষ্টারডাম থেকেই সুরিনামে প্রবেশের জল পথ স্থল পথ দুই-ই আছে। আপনার চিন্তা একেবারেই নির্ভূল।’
‘আল হামদুলিল্লাহ। এভাবেই আল্লাহ সাহায্য করেন ফাতিমা।’ আহমদ মুসা বলল।
ফাতিমা উচ্ছসিত হয়ে উঠল। বলল, ‘ভাইয়া খুব আনন্দ লাগছে। মনে হচ্ছে নতুন জীবন ফিরে পেলাম।’
‘আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ আমাদের সকলের উপর সদয় হোন।’ বলল আহমদ হাত্তা নাসুমন।
তারপর একটু থেমে একটু পানি খেয়ে নিয়ে সে আবার বলল, ‘মি. আহমদ মুসা, আমরা কি জর্জ আব্রাহাম মানে মার্কিন সরকারের কাছে কোন সাহায্য চাইতে পারি?’
‘হ্যাঁ চাইতে পারি। তারা আন-অফিসিয়ালী সাহায্য করতে পারে। কিন্তু এই মুহূর্তে তার প্রয়োজন নেই। আমরা গিয়ে কাজ শুরু করি। প্রয়োজন হলে ওদের বলব।’
‘ধন্যবাদ মি. আহমদ মুসা। একটা কথা বলি আহমদ মুসা, ওরা কিন্তু সাংঘাতিক দুর্ধর্ষ্য, বিশাল ওদের সংখ্যা। হঠাৎ করে ফাতিমাকে ওদের হাতে তুলে দিলে বিপদ হবে না তো!’ বলল নরম ও বিনীত কণ্ঠে হাত্তা নাসুমন।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘আপনার কথা সত্য, উদ্বেগ স্বাভাবিক। কিন্তু ওয়াং আলীকে বাঁচাতে হলে, দ্রুত ওদের পরিচয় পেতে হলে, ২১ তারিখে ফাতিমাকে ওদের মুখোমুখি দাঁড় করাতে হবে। ২১ তারিখের পর এই সুযোগ আমরা হারিয়ে ফেলব।’
‘আব্বা বিপদের বিষয়টি না ভেবে আপনি দেখুন যে এটা কার পরিকল্পনা। স্বপ্নের সেই আহমদ মুসা বিমূর্ত হয়ে নেমে এসেছেন আমাদের মাঝে। তিনি আমাদের চালিত করছেন। আমার আর কোন ভয় নেই আব্বা। এখন আমার মনে হচ্ছে, তার নির্দেশ পালন করতে গিয়ে মৃত্যু এলেও আমি তা হাসি মুখে বরণ করতে পারবো।’
‘ঠিক বলেছ মা। আহমদ মুসা যে আমাদের সামনে বসে, তিনি স্বয়ং যে সুরিনামে যাচ্ছেন, একথা আমি ভুলে গিয়েছিলাম।’
একটু থেমে হাত্তা নাসুমন তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘আমরা সুরিনামে যাবার জন্যে প্রস্তুত আহমদ মুসা।’
‘ধন্যবাদ মি. হাত্তা, ধন্যবাদ বোন ফাতিমা।’
‘ধন্যবাদ ভাইয়া।’ বলে উঠে দাঁড়াল ফাতিমা। তারপর বলল, ‘আপনারা গল্প করুন আমি ট্রলিটা রেখে আসি এবং দুপুরের খাবারের ব্যবস্থাটাও দেখে আসি।’
‘ফাতিমা আমার জন্যে ভেব না। আমি কিন্তু দুপুরে খাচ্ছি না। আমি এখনি বেরুব।’
‘কোথায়?’
‘সারা জেফারসনদের ওখানে যাব।’
‘আপনি কোথায় থাকছেন?’
‘ওখানেই আমার ব্যাগ-ব্যাগেজ আছে।’
‘তাহলে?’
‘আমি যেখানেই থাকি, আজ বিকেলেই এখানে একবার আসব। অনেক কথা আছে, অনেক বিষয় নিয়ে ভাবতে হবে।’
‘ধন্যবাদ ভাইয়া।’ বলে ফাতিমা নাসুমন ট্রলিটা ঠেলে নিয়ে চলে গেল।
আহমদ মুসাও উঠে দাঁড়াল যাবার জন্যে।

দরজা খুলেই আহমদ মুসাকে দেখে জিনা জেফারসন, সারা জেফারসনের মা আনন্দে জড়িয়ে ধরল আহমদ মুসাকে। বলল, ‘বাছা আমি হাসপাতালে টেলিফোন করেছিলাম। ওরা বলল তুমি সেই কোন সকালে রিলিজ নিয়েছ। এখন বেলা ১টা। এত দেরী হলো কেন বাছা আসতে? আর রিলিজ নেবে আমাকে জানাওনি কেন? আমি তো প্রতিদিনই টেলিফোন করছি।’
এতগুলো প্রশ্নের জবাবে আহমদ মুসা বলল, ‘আমার সাথে আরেকজন রিলিজ নিয়েছিল। তাকে পৌছে দিয়ে এলাম।’
‘ঠিক আছে, চল বাছা। তোমার উপর দিয়ে অনেক ধকল গেল। তুমি অনেক শুকিয়ে গেছ।’ বলল জিনা জেফারসন আহমদ মুসাকে টেনে নিয়ে এগুতে এগুতে।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘খালাম্মা মাত্র এই দেড় সপ্তাহে আমার ওজন ১ কেজি বেড়েছে।’
‘তা বাড়লে কি হবে, আয়নাতে গিয়ে দেখ একবার তোমাকে।’ বলল জিনা জেফারসন।
আহমদ মুসা ড্রইংরুমে বসতে যাচ্ছিল। কিন্তু জিনা জেফারসন আহমদ মুসাকে হাত ধরে টেনে তার ঘরের দিকে নিতে নিতে বলল, ‘এখন আর বসাবসি নয় বাছা। সোজা ঘরে গিয়ে কাপড় ছাড়। তারপর গোসল কর। আমি টেবিলে খাবার আনছি।’
বলে জিনা জেফারসন আহমদ মুসার ঘরের দরজা টেনে দিয়ে চলল ডাইনিং-এর দিকে।
আরও এক ঘন্টা পর।
আহমদ মুসা এসে খাবার টেবিলে বসল।
গোসল করে ফ্রেস জামা-কাপড় পরে বেশ ভাল বোধ হচ্ছে আহমদ মুসার।
কিছুক্ষণ পর ফিরে এল জিনা জেফারসন।
বসল আহমদ মুসার বিপরীত দিকের চেয়ারে। আহমদ মুসার প্লেটে খাবার তুলে দিতে দিতে বলল, ‘এখন অনেক ফ্রেশ লাগছে বাছা তোমাকে। তুমি শরীরের উপর খুব অবিচার কর। খাওয়ার পর কিন্তু লম্বা ঘুম দেবে।’
আহমদ মুসা কাঁটা চামচ একবার হাতে তুলে নিয়ে আবার রেখে দিয়ে বলল, ‘খালাম্মা, সারা এল না? ও নেই?’
জিনা জেফারসন কাঁটা চামচ হাতে নিয়ে আহমদ মুসার দিকে না তাকিয়েই বলর, ‘না। তুমি খেয়ে নাও বাছা। কি করব, তোমরা কেউ তো কথা শোননা। নিজের ইচ্ছাকেই বড় ভাব।’ জিনা জেফারসনের কণ্ঠে ক্ষোভের প্রকাশ।
আহমদ মুসা কথা বাড়ালো না। বুঝল, সারা নিশ্চয় খালাম্মার নিষেধ না মেনে এই অসময়ে কোথাও বেরিয়েছে। তাই রেগে আছেন তিনি।
খাওয়ার পর আহমদ মুসা তার ঘরে চলে এল।
তখন বিকেল সাড়ে চারটা।
আহমদ মুসা ঘুম থেকে উঠে টয়লেট সেরে ফ্রেশ হয়ে এসে বসেছে।
ঘরে ঢুকল জিনা জেফারসন।
তার মুখ মলিন।
সেই মলিন মুখেই হাসি টেনে বলল, ‘বাছা রেষ্ট হয়েছে তো?’
‘হ্যাঁ, খালাম্মা। সারা এসেছে?’
জবাব না দিয়ে জিনা জেফারসন আহমদ মুসার সামনের সোফায় বসল। ধীরে ধীরে বলল, ‘সারা আসবে না বাছা।’ জিনা জেফারসনের কণ্ঠ কান্নার মত ভেজা।
আহমদ মুসা চমকে উঠে তাকাল জিনা জেফারসনের দিকে। বলল, ‘আসবে না? সারা কোথায় খালাম্মা?’
‘লস আলামোসে।’
‘লস আলামোসে?’ এই জিজ্ঞাসা উচ্চারণ করার সাথে সাথে আহমদ মুসা যেন আকাশ থেকে পড়ল। অবিশ্বাস্য মনে হল জিনা জেফারসনের কথা।
প্রশ্নটা উচ্চারণ করার পর একটু থেমে আহমদ মুসা আবার বলল, ‘কই আমাকে তো কিছু বলেনি! এ সময়ে হঠাৎ লস আলামোসে কেন? সে তো আরও দু’মাস ছুটি পেয়েছে! আর সম্পূর্ণ সুস্থ কি সে হয়েছে?’
মুখ তুলল জিনা জেফারসন।
তার মুখ বেদনায় জীর্ণ।
ভেঙে পড়া অবস্থা তার।
বিস্মিত হলো আহমদ মুসা।
জিনা জেফারসন আহমদ মুসার কোন প্রশ্নের জবাব না দিয়ে একটা ইনভেলাপ তুলে ধরল আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসা ইনভেলাপটি হাতে নিল। ইনভেলাপে আহমদ মুসার নাম লেখা। দেখেই বুঝল হস্তাক্ষর সারা জেফারসনের।
সারা জেফারসনের চিঠি? বুকের ভেতরটায় ধক করে উঠল আহমদ মুসার। না জানিয়ে, অন্তত টেলিফোনে একটা কথাও না বলে এভাবে চিঠি রেখে গেছে?
বুকের কোন অজানা প্রান্ত থেকে একটা অপরিচিত অভিমান প্রবল বেগে মাথা তুলতে চাইল।
তা সত্ত্বেও চিঠি খুলল আহমদ মুসা।
ইনভেলাপের ভেতর থেকে বেরিয়ে পড়ল সারা জেফারসনের প্যাডের পরিচিত সেই নীল কাগজ।
সারা জেফারসনের চিঠি।
চিঠিটি মেলে ধরল আহমদ মুসা চোখের সামনে।
পড়তে লাগলঃ

‘‘আসসালামু আলায়কুম।
অনেক চিন্তা করেও সম্বোধনের কোন ভাষা খুঁজে পেলাম না।
তাই সম্বোধন ছাড়াই এই চিঠি লিখছি।
আমি লস আলামোসে যাচ্ছি। আরও দু’মাস ছুটি মঞ্জুর হয়েছে। কিন্তু ছুটি এখন আমার কাছে অসহনীয় লাগছে। আমি কাজের মধ্যে ডুবে যেতে চাই, ডুবে থাকতে চাই। ভুলতে চাই আমার অস্তিত্বকে।
আপনি আহত অবস্থায় হাসপাতালে। আপনাকে বলে যেতে পারলাম না বলে বুক আমার ভেঙে যাচ্ছে। কিন্তু আমার বুক ভাঙার চেয়ে আপনাকে বলা আমার জন্যে কঠিন ছিল।
না বুঝে আপনাকে আমি অনেক কষ্ট দিয়েছি। আপনার কোন দোষ নেই। আপনি আমাকে এভয়েড করতেন। কিন্তু এটাই আমার কাছে আপনাকে আরও মূল্যবান করে তুলেছিল। আপনি সামান্য প্রশ্রয়ও আমাকে কোনদিন দেননি। আপনার এই অসাধারণ গুণই আপনাকে আমার কাছে আরও গৌরবদীপ্ত করে তুলেছিল। আমি আমাকে আরও জড়িয়ে ফেলেছিলাম। কষ্টও আপনার বাড়িয়ে দিয়েছিলাম। অনেকবার আপনি আপনার সম্পর্কে বলার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু আমি সুযোগ দেইনি। অবশেষে অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালের বেডে শুয়ে একদিন সব শুনলাম লায়লা জেনিফারদের কাছে। শুনে এতদিন যে কষ্ট আপনাকে দিয়েছি সব কষ্ট শতগুণ আকারে ফিরে পেলাম আমার বুকে। আমার অন্যায়ের এ শাস্তি আমি মাথা পেতে নিয়েছি।
আমার বুকে জেগে উঠেছিল আকাশস্পর্শী আকাঙ্খা, সে আকাঙ্খা এখন নেই। আমার বুকে ছিল এক সাগর তৃষ্ণা, সে তৃষ্ণার জ্বালাও এখন নিভে গেছে। একদিন আমি আপনার ‘সারা’ হবার জন্যে পাগল হয়ে উঠেছিলাম, কিন্তু হতে পারিনি। যখন সব আকাঙ্খা, সব তৃষ্ণা আমার শেষ হয়ে গেছে, তখন সেদিন জেনারেল শ্যারনের বন্দীখানায় আপনি আমাকে ‘সারা’ বলে সম্বোধন করলেন। সেদিন আমি আপনাকে আমার সব শক্তি দিয়ে জড়িয়ে ধরেছিলাম আতংক তাড়িত হয়ে প্রাণ ভয়ে। আপনি আমাকে জড়িয়ে ধরেননি। পিঠে হাত বুলিয়ে সান্তনা দিয়েছিলেন মাত্র। আপনার এই নিবিড় স্পর্শ এবং ‘সারা’ সম্বোধন তখন পেলাম যখন চাইনি। আমার আল্লাহর এই মর্জির আমি অর্থ বুঝতে চেষ্টা করেছি। অবশেষে বুঝেছি, এই পাওয়াটুকুকে আল্লাহ আমার জীবনের পাথেয় বানাতে চান। আমি এই পাথেয়কে পরম পাওয়া হিসেবে গ্রহণ করেছি। আমি জানি, এতে আপনার আপত্তি থাকবে, জোসেফাইন আপারও আপত্তি থাকবে। কিন্তু আমি এও জানি যে, একজন মানুষের বাঁচার অবলম্বনকে আপনারা কেড়ে নেবেন না। আপনাদের দু’জনের কাছেই আমি ক্ষমাপ্রার্থী।
সব শেষে আমার প্রার্থনা, সারা জেফারসন নামের কোন মেয়ের সাথে আপনার কখনও দেখা হয়েছিল, একথা দয়া করে ভুলে যাবেন। কিন্তু আমরা আমেরিকানরা আপনাকে ভুলতে পারবো না। কারণ আপনি আজকের আমেরিকার একজন ভ্রাতা। আমাদের ফাউন্ডার ফাদারসদের আমেরিকাকে আপনি আবার আমেরিকানদের মাঝে ফিরিয়ে এনেছেন।’’
একজন আমেরিকান মেয়ে,
‘সারা জেফারসন’
চিঠি পড়া শেষ হলো, কিন্তু চিঠি থেকে মুখ তুলতে পারল না আহমদ মুসা। দু’চোখ থেকে তার গড়ানো অশ্রু ফোটায় ফোটায় ঝরে পড়তে লাগল চিঠির বুকে।
জিনা জেফারসন ধীরে ধীরে উঠে এল তার আসন থেকে। আহমদ মুসার পেছনে দাঁড়িয়ে আস্তে একটা হাত রাখল আহমদ মুসার কাঁধে। বলল নরম কণ্ঠে, ‘বেটা তুমি কাঁদলে সারা আরও কষ্ট পাবে।’
আহমদ মুসা জিনা জেফারসনের হাত আঁকড়ে ধরে বলল, ‘খালাম্মা আমি সারার সর্বনাশ করেছি, ওকে সাবধান করার সুযোগ পাইনি।’ অশ্রুজড়িত কণ্ঠ আহমদ মুসার।
‘না বেটা, দোষ তোমার নয়, দোষ সারারও নয়। এটাই ছিল আমার মেয়ের ভাগ্য।’ নরম ও উদাস কণ্ঠ জিনা জেফারসনের।
‘এখন কি হবে খালাম্মা। ওকে কিছু বলতেও পারলাম না।’ বলল আহমদ মুসা।
জিনা জেফারসন আহমদ মুসার পেছন থেকে সোফা ঘুরে এসে আহমদ মুসার পাশে বসল। বলল, ‘বলে কোন লাভ হবে না বেটা। আমি সারাকে তো চিনি। হতভাগী যা বলেছে তাই সে করবে।’ কান্নায় জড়ানো জিনা জেফারসনের কথা।
একটু থেমেছিল, আবার শুরু করল জিনা জেফারসন, ‘আমি ওর মা। আমি ওকে বুঝিয়েছি, অনুরোধ করেছি। সব কথার জবাবে একটা কথাই সে বলেছে, মা আমাকে যদি বাঁচতে দিতে চাও, তাহলে বাঁচার অবলম্বন আমার কাছ থেকে কেড়ে নিও না। তারপর সেও কেঁদেছে, আমিও কেঁদেছি। আর কিছু বলার ছিল না তাকে।’
‘খালাম্মা আমার এখন কি কর্তব্য?’ আহমদ মুসা বলল।
‘কিছু করার নেই বেটা। তুমি সবকিছু ভুলে যাও। একদিন সেও সবকিছু ভুলে গিয়ে স্বাভাবিক হতেও পারে। আমি সেদিনেরই অপেক্ষা করব। তবে বেটা তোমার এ মাকে ভুলে যেও না। সারার ব্যাপারে কোন সাহায্যের দরকার হলে তা আমি তোমার কাছে চাইব।’ বলল জিনা জেফারসন।
‘অবশ্যই খালাম্মা। আপনার এ ছেলেকে যখনই ডাকবেন, হাজির হবো।’
‘ধন্যবাদ বেটা।’ বলে উঠে দাঁড়াল জিনা জেফারসন। তারপর বলল, ‘নামাজ পড়ে চায়ের টেবিলে এস বেটা।’
জিনা জেফারসন চলে গেল।
আহমদ মুসা সারার চিঠিটা সুন্দর করে ভাজ করে ইনভেলাপে ভরে উঠে দাঁড়াল। মনে মনে ভাবল, সারার চিঠিটা ডোনা জোসেফাইনের কাছে পাঠিয়ে দিতে হবে দু’একদিনের মধ্যেই।

Top