৩২. অক্টোপাশের বিদায়

চ্যাপ্টার

‘নাবিলা তুমি আমাদের সাথে অসহযোগিতা করছ। যে পুলিশ তোমার সাথে কথা বলেছে, যে পুলিশের সাথে তুমি কথা বলেছ, তার ফটো দেখে, কণ্ঠস্বর শুনেও চিনতে পারবে না, এটা অসম্ভব।’ কর্কশ কণ্ঠে বলল জেনারেল শ্যারন।
‘দুঃখিত আমি চিনতে পারছি না। আমি তার স্বাভাবিক কণ্ঠ শুনেছি, আর এখানে শুনছি যান্ত্রিক কণ্ঠ। সে কারণেই আমি আইডেন্টিফাই করতে পারছি না।’ বলল স্বাভাবিক কণ্ঠে নাবিলা।
জেনারেল শ্যারন চেয়ারে বসেছিল। উঠে দাঁড়াল। কক্ষে পায়চারি করতে লাগল অস্থিরভাবে।
কক্ষটা বলা যায় একটা হল ঘর।
কক্ষের মাঝখানে একটা ডিম্বাকৃতি টেবিল। টেবিলের চারপাশে চেয়ার।
এরই একটা চেয়ারে বসেছিল জেনারেল শ্যারন। তার চেয়ারের ঠিক বিপরীত দিকের চেয়ারে বসে আছে নোয়ান নাবিলা। টেবিলে আরও কয়েকজন বসে আছে। তাদের মধ্যে একজন হলো বেন ইয়ামিন। তার পাশেই বড় চেয়ারটায় বসে আছে আমেরিকান কাউন্সিল অব জুইস এ্যাসোসিয়েশনসের চেয়ারম্যান ডেভিড উইলিয়াম জোনস। জোনসের পাশে বসে আছে আমেরিকান জুইস পিপলস লীগের যুব বিভাগের প্রধান শামির লিকুদ।
পায়চারিরত অস্থির জেনারেল শ্যারন বেন ইয়ামিনের পাশে এসে দাঁড়াল। বলল, ‘বেন, ভিডিওতে কি আছে বলে মনে কর?’
‘ওকে দেখতে পেয়েছি আমি শেষ মুহুর্তে। তখন ওখানকার অপারেশন শেষ। আমার মনে হয় ঐ বাড়িতে অপারেশনের গোটা দৃশ্যই সে ধারণ করতে পেরেছে।’ বলল বেন ইয়ামিন চিন্তিত কণ্ঠে।
‘তার মানে বাড়ির নিহত লোকদের ছবি, ঘরগুলোর ছবি, তার সাথে গুলী বর্ষণরত তোমার ছবিও উঠেছে।’ উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল জেনারেল শ্যারন।
‘আমার তাই আশংকা হয়।’ বেন ইয়ামিনের কণ্ঠে অপরাধীর সুর।
‘সর্বনাশ এই ভিডিও ক্যাসেট পুলিশ বা শত্রু কারও হাতে গেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। বলল ডেভিড উইলিয়াম জোনস। ডেভিড জোনসের কথার পর গোটা কক্ষ জুড়ে নতুন করে আতংকের পরিবেশ নেমে এল।
ভীতিকর এক থমথমে নিরবতা।
‘মিস নাবিলা, আপনি আমাদের সাহায্য করুন। পুলিশকে আইডেন্টিফাই করে দিন। আমরা যে কোন মূল্যে ক্যাসেট উদ্ধার করে আনব। এ জন্যে আমরা সবাই মরতে রাজি আছি এবং সবাইকে মারতেও আমরা প্রস্তুত। আমাদের শত লোকের জীবনের চেয়ে ঐ ক্যাসেটের মূল্য অনেক বেশী।’ বলল শামির লিকুদ বিনয়ের সুরে।
‘আমি দুঃখিত। না চিনেই কাউকে চিহ্নিত করে তো কোন লাভ হবে না।’ নাবিলা বলল।
এ সময় জেনারেল শ্যারনের মোবাইলে টেলিফোন এল। মোবাইলে কথা বলল সে।
কথা শেষ করেই ঝট করে ফিরল নাবিলার দিকে। বলল তীব্র কণ্ঠে, ‘নাবিলা তুমি মিথ্যা কথা বলছ, কোন পুলিশকে তুমি সেদিন কোন ক্যাসেট দাওনি।’
জেনারেল শ্যারন থামতেই কথা বলল ডেভিড উইলিয়াম জোনস। বলল, ‘কার টেলিফোন ছিল ওটা। কি বলল সে?’
‘আমাদের একজন পুলিশ কর্মীকে দায়িত্ব দিয়েছিলাম, যে পুলিশরা সেদিন রাতে নিউ হারমানে গিয়েছিল তাদের সকলকে কৌশলে জিজ্ঞেস করতে যে ভিডিও ক্যাসেটের মত কোন প্রমাণ তারা যোগাড় করতে পেরেছে কিনা। সে এক এক করে সকলের সাথে দেখা করেছে, জিজ্ঞেস করেছে। কিন্তু কোন পুলিশই সে ধরনের কিছু পায়নি।’ বলল জেনারেল শ্যারন।
‘পুলিশ সে রকম কিছু পেলে ঘটা করেই বলার কথা, কৃতিত্ব জাহিরের জন্যে, গোপন করার কথা নয়। আর পুলিশ সেদিন ওখানে প্রমাণ হিসেবে যা পেয়েছিল, তার সবই পত্রিকায় এসেছে। কিন্তু ভিডিও ক্যাসেটের কথা আসেনি। তার মানে এটাই ঠিক যে, পুলিশ এ ধরনের কিছু পায়নি।’
‘ঠিক বলেছেন মি. জোনস। নাবিলা নিশ্চয় মিথ্যা কথা বলছে।’
বলে জেনারেল দৃঢ় পদক্ষেপে গিয়ে নাবিলার সামনে দাঁড়াল। আকস্মিকভাবে জোরে একটা থাপ্পড় কষল সে নাবিলার গালে। তার সাথে সাথে বলে উঠল, ‘তোকে বলতে হবে কাকে দিয়েছিস ক্যাসেট।’
আকস্মিক থাপ্পড় খেয়ে পড়ে গিয়েছিল নোয়ান নাবিলা।
নিজেকে সামলে নিয়ে সে মেঝেয় উঠে বসল। প্রথমে তার দুই চোখ ছানাবড়া হয়ে উঠেছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে সে ভাব তার চলে গেল। সেখানে ফুটে উঠল এক দৃঢ়তা।
নাবিলাকে থাপ্পড় মারার ঘটনা ঘরের সবাইকে চমকে দিয়েছিল। সবাই নিরব।
গোটা কক্ষ ঘিরে নিরবতা।
আবার মোবাইল বেজে উঠল জেনারেল শ্যারনের।
কথা বলল মোবাইলে সে।
কথা বলার সময়ই তার চোখ-মুখ আবার জ্বলে উঠল।
কথা শেষ করে অগ্নি ঝরা দৃষ্টিতে সে তাকাল নোয়ান নাবিলার দিকে। সে নাবিলার কাছেই দাঁড়িয়েছিল। জেনারেল শ্যারনের একটা পা ছুটল নাবিলার দিকে।
নাবিলা মেঝেয় বসেছিল। জেনারেল শ্যারনের বিদ্যুত গতির লাথি নাবিলার কাঁধ হয়ে মুখে গিয়ে আঘাত করল।
পড়ে গেল নাবিলা।
ঠোঁট ও নাক তার থেঁথলে গেছে।
নাক ও ঠোট থেকে ঝর ঝর করে রক্ত বেরিয়ে এল তার।
লাথি মেরেই ডেভিড জোনসের দিকে তাকিয়ে জেনারেল শ্যারন বলল, ‘আমরা যাদেরকে পাঠিয়েছিলাম শশাংক ও সাগরিকার উপর চোখ রাখার জন্যে তাদের মধ্যে দু’জন পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে।’
‘পুলিশের হাতে? কিভাবে?’ বলল ডেভিড জোনস।
‘শশাংক, সাগরিকা ও ডাক্তার বারাক ওয়াশিংটনে ঢুকছিল। নির্দেশ অনুসারে ওরা গাড়ি সমেত তাদেরকে হাইজ্যাক করতে চেষ্টা করে। হঠাৎ পুলিশ এসে পড়ায় তাদের চেষ্টা ভন্ডুল হয়ে যায় এবং আমাদের দু’জন লোক ধরা পড়ে যায়। অবশিষ্ট দু’জন পালায় এবং ওদের ফলো করে। পুলিশ পাহারায় শশাংকরা এফবিআই হেড কোয়ার্টারে যায়। শশাংকরা বেরুবে এই অপেক্ষায় আমাদের লোকেরা প্রায় দু’ঘন্টা ওৎ পেতে থাকে। কিন্তু দু’ঘন্টাতেও তারা বের হয়নি। আমাদের লোকেরা এখনও সেখানে পাহারায় আছে। আমি ওদের চলে আসতে নির্দেশ দিয়েছি। ওদের ওখানে যাবার পথেই বাধা দেয়ার দরকার ছিল, এখন পাহারা দিয়ে লাভ নেই।’
কথাগুলো বলে জেনারেল শ্যারন আবার তীব্র দৃষ্টিতে তাকাল নাবিলার দিকে। বলল, ‘বল শশাংকরা কেন দল বেঁধে এফবিআই হেড কোয়ার্টারে গেল? কাকে দিয়েছিলি তুই ক্যাসেট?’
নাবিলা ধীরে ধীরে মেঝেয় উঠে বসেছিল। তার মুখ ভেসে যাচ্ছে রক্তে। সে রক্ত মুছার চেষ্টা করেনি। তার চোখে-মুখে আগের সেই দৃঢ়তা। শ্যারনের প্রশ্নের জবাবে সে বলল, ‘আমি যা বলেছি তার বাইরে আমার আর কিছু বলার নেই। শশাংকদের কথা আমি জানি না।’
‘বলতে হবে তোকে, সবই বলতে হবে। জানবি তুই সবই।’
বলে জেনারেল শ্যারন পাশের ওয়াল ক্যাবিনেট থেকে একটা চাবুক বের করে নিল এবং চাবুক দিয়ে নির্দয়ভাবে প্রহার শুরু করল নাবিলাকে।
নাবিলা দাঁতে দাঁত চেপে চোখ বন্ধ করে নিয়েছে। চিৎকার করে আর্তনাদ করে এদের করুণা পাওয়া যাবে না। যারা নিউ হারমানে ঠান্ডা মাথায় নিজের কম্যুনিটির লোককে খুন করেছে, তারা মানুষ নয়। এদের কাছে কান্নার কোন অর্থ নেই।
এতটুকুও কাঁদল না নাবিলা।
গা ফেটে ঝর ঝর করে রক্ত বেরিয়ে এল। দাঁতে দাঁত চেপে সব সহ্য করল নাবিলা।
চাবুকের কয়েকটা ঘা পড়তেই নাবিলা নাক গুঁজে মেঝেয় পড়ে গেল।
‘আশ্চর্য, এই চাবুকের ঘা খেয়ে ঘোড়াও চিৎকার করতো। কিন্তু নাবিলার মুখে একটি রা’ও উচ্চারিত হলো না। বড় শক্ত চীজ জেনারেল শ্যারন।’ বলল ডেভিড জোনস।
জ্বলে উঠল জেনারেল শ্যারনের চোখ। তার হাতের চাবুক আরও দ্রুত হলো, আরও নির্মম হলো।
মুখ তুলল নাবিলা। বিপর্যস্ত চেহারা। কিন্তু চোখ দু’টি জ্বলছে। বলল, ‘তোমরা মানুষ নও। তোমরা আমেরিকার শত্রু। নিউ হারমানের নিরপরাধ মানুষদের তোমরা খুন করেছ।’
থেমে গেল জেনারেল শ্যারনের চাবুক।
তার চোখে বিস্ময় ফুটে উঠল। চাবুক হাতে গুটাতে গুটাতে বলল, ‘কে বলল আমরা খুন করেছি। কে বলল তোকে। তুই জানলি কেমন করে?’
‘আমেরিকার শত্রু শয়তান। মনে করেছিলি কেউ জানবে না। ভিডিও ক্যাসেট তোদের মুখোশ খুলে দেবে, নগ্ন করে দেবে তোদেরকে।’ বলল তীব্র কণ্ঠে নোয়ান নাবিলা।
পাগল হয়ে উঠল যেন জেনারেল শ্যারন। তার হাতের চাবুক শপাং করে ছোবল হানল নাবিলার মুখে। বলল চিৎকার করে, ‘বল হারামজাদি, ক্যাসেট কোথায়? বলতে হবে তোকে?’
‘বলব না আমি। আমাকে মেরে ফেললেও না। আমি মরে যাব কিন্তু তোরা কেউ বাঁচবি না।’ বলল নাবিলা আর্ত কণ্ঠে। রক্তে জড়িয়ে গেল তার কথা।
আবার চাবুকটি হাতে গুটিয়ে নিয়ে জেনারেল শ্যারন চেয়ারে বসল। চাবুক তার ব্যর্থ হয়েছে বুঝে নিয়েছে সে। তার চোখে-মুখে ভাবনার চিহ্ন।
‘মি. শ্যারন, চাবুক তার কিছু করতে পারেনি, পারবেও না তা পরিষ্কার। ভিন্ন পথে নিন। যার দেহ শক্ত, তার মান ও মর্যাদায় ঘা দিতে হয়। আদর্শবাদীরা জীবনের চেয়ে মানকে বড় করে দেখে।’ বলল ডেভিড জোনস।
শুনেই লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল জেনারেল শ্যারন। বলল, ‘ধন্যবাদ মি. জোনস। পেয়েছি, হারামজাদিকে কথা বলাবার অস্ত্র পেয়েছি।’
বলে উঠে গেল নাবিলার কাছে। নাবিলারই কাপড়ের এক প্রান্ত নিয়ে তার মুখের রক্ত পরিষ্কার করল। বলল, ‘নাবিলা তোমার সুন্দর মুখ একটু আহত হয়েছে বটে, দেহটাও কিছু ক্ষতবিক্ষত হয়েছে, কিন্তু তোমার অপরূপ সুন্দর, নরম দেহটা যে কোন পুরুষের কাছে লোভনীয়। বিশেষ করে আমাদের গেটের সিকুরিটি সাড়ে ছয় ফুট উচ্চতার পর্বতসম মানুষ কৃষ্ণাংগ আলফ্রেডের কাছে তোমার দেহটা খুবই মজার খাদ্য হবে। তুমি এই মুহূর্তে ক্যাসেট কোথায় না বললে তাকে ডাকব। ভেবেছ তুমি মরে রক্ষা পাবে? না তোমাকে মারব না। আলফ্রেডদের দিয়ে তোকে কুরে কুরে খাওয়াব।’
বলে উঠে দাঁড়াল জেনারেল শ্যারন।
‘শয়তান তোদের কোন সাহায্য আমি চাইব না, ঈশ্বর আমাকে রক্ষা করবেন।’ নাবিলা কিন্তু কথাটা খুব দৃঢ় কণ্ঠে বলতে পারল না। তার যে দেহ-মন চাবুকের নির্দয় আঘাত সহ্য করেছে নিরবে, কিন্তু সেই মন তার এখন কেঁপে উঠেছে জেনারেল শ্যারনের কথায়। এই অপমান তার মন সইতে পারবে না। কিন্তু কি করবে সে।
নাবিলার চিন্তা বাধা পেল জেনারেল শ্যারনের কথায়। শ্যারন বলছে, ‘এই তোর শেষ কথা? ডাকব আলফ্রেডকে?’
‘আমি কোন কথা তোমাদের বলব না। ঈশ্বর আমাকে রক্ষা করবেন।’ কম্পিত কণ্ঠে কথাগুলো বলল নাবিলা। বুক কাঁপছে তার।
‘ঈশ্বর তোকে বাঁচাবে না নাবিলা। ঈশ্বর তোর কপালে যা লিখেছেন, তাই এখন ঘটবে।’
বলে শামির লিকুদের দিকে চেয়ে জেনারেল শ্যারন বলল, ‘যাও তুমি আলফ্রেডকে নিয়ে এস শামির লিকুদ।’
শামির লিকুদ গিয়ে আলফ্রেডকে নিয়ে এল।
আলফ্রেডকে দেখেই জেনারেল শ্যারন বলল, ‘আলফ্রেড, তোমার জন্যে ভাল ভোজের ব্যবস্থা করেছি। নাবিলা ম্যাডামকে নিশ্চয় তোমার পছন্দ হবে।’
আলফ্রেডের কুত কুতে চোখ চক চক করে উঠল। তাতে ঝরে পড়ল লালসার আগুন। আলফ্রেডকে দেখেই চোখ বন্ধ করেছে নাবিলা।
‘চোখ বন্ধ করলেও তোমার দেহ রক্ষা পাবে না নাবিলা। জেনে রাখ আলফ্রেড মাথা ধোলাই করা এক কুকুর। আদেশ পালন ছাড়া আর কিছু বুঝে না। কারো প্রতি কোন দয়া-মায়াও তার নেই। এখনও ভেবে দেখ।’
নাবিলা চোখ বন্ধ করেই থাকল। কোন কথা বলল না।
‘আলফ্রেড যাও, নাবিলা এখন তোমার। শুধু দেখবে হারামজাদি যাতে জ্ঞান হারিয়ে না ফেলে। সজ্ঞানে রেখে তাকে ভোগ করতে হবে।’
আলফ্রেড হেলে দুলে এগুলো তার দিকে। বাঘ যেন এগুচ্ছে হাতের মধ্যে পাওয়া শিকারের দিকে।
হঠাৎ কথা বলে উঠল শ্যারন। বলল, ‘থাম আলফ্রেড। এত বড় মহোৎসবের এটা উপযুক্ত জায়গা নয়। ওকে নিয়ে চল সারা জেফারসনের ঘরে। সেখানেই অনুষ্ঠিত হবে তোমার ভোজের মহোৎসব।’
বলে ডেভিড জোনসের দিকে তাকিয়ে জেনারেল শ্যারন বলল, ‘এটাই ভাল মি. জোনস। আমরা সারা জেফারসনেরও সাহায্য দাবী করব নাবিলাকে কথা বলাবার জন্যে।’
‘ভাল আইডিয়া, চলুন।’
শ্যারন ও ডেভিড জোনস উঠে চলে এল সারা জেফারসনের কক্ষে। বেন ইয়ামিন শ্যারনের কানে কানে কিছু বলে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
সারা জেফারসন শুয়ে ছিল।
দরজা খুলতেই সে উঠে বসেছে।
রক্তাক্ত নাবিলাকে দেখে সে চমকে উঠল।
নাবিলাকে সারা জেফারসন চেনে না।
জেনারেল শ্যারন নাবিলাকে ধাক্কা দিয়ে সারা জেফারসনের দিকে ঠেলে দিল। বলল, ‘তোমার আহমদ মুসার ভক্ত শশাংকের প্রেমিকা এ নাবিলা। আমাদের একটি ভিডিও ক্যাসেট চুরি করে কাকে দিয়েছে বলছে না। শেষ পর্যন্ত আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি তাকে আমাদের এ ক্ষুধার্ত আলফ্রেডের হাতে ছেড়ে দেব। আলফ্রেড তাকে কুরে কুরে খাবে, দেখি কত সহ্য করে, কথা বলে কিনা। তার আগে তোমার কাছে নিয়ে এলাম। তুমি একে কথা বলাতে পারো কিনা। এ মুহূর্তে আমাদের জানা দরকার ক্যাসেটটি কার কাছে। পাঁচ মিনিট সময় দিলাম তোমাকে। এ সময়ের মধ্যে কথা না বললে তোমার সামনে এখানেই আলফ্রেড তার কাজ শুরু করবে।’
জেনারেল শ্যারনের কথা শুনে ভীষণভাবে কেঁপে উঠল সারা জেফারসন। তার দেহের সমস্ত রক্ত জমে যাওয়ার অবস্থা হলো। এ ভয়ংকর অবস্থা কোন নারী সহ্য করতে পারে না, কোন নারীর চোখ তা দেখতে পারে না। মুহূর্তেই সারা জেফারসন তার দেহের সব শক্তি, সব ওজন যেন হারিয়ে ফেলল। তাকাল সে নাবিলার দিকে।
নাবিলা সারা জেফারসনের পায়ের কাছে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে।
সারা জেফারসন উঠে দাঁড়িয়ে টেনে তুলল নাবিলাকে। নাবিলা সারা জেফারসনকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠল। সারা জেফারসনও তাকে জড়িয়ে ধরল।
বলল সারা জেফারসন নাবিলাকে বুকে জড়িয়ে ধরে রেখেই, ‘বোন ভিডিও ক্যাসেটের কথা ওদের বলে দাও।’
নাবিলা ধীরে ধীরে মুখ তুলল সারা জেফারসনের বুক থেকে। বলল, ‘আপা আপনাকে দিয়ে চিঠি লিখিয়ে আহমদ মুসাকে ফাঁদে আটকাতে চাচ্ছে। এরপর আহমদ মুসাকে মার্কিন সরকার ও মার্কিন জনগণের কাছে ঘৃণিত অপরাধী প্রমাণের জন্যে ওরা নিজেরাই নিউ হারমানের ইহুদী জনপদে যে গণহত্যা চালিয়েছে সেই দায় চাপিয়ে দিতে চাইছে আহমদ মুসার উপর। সেখানকার বাসিন্দা এক সাংবাদিকের একটা ভিডিও ক্যাসেট পেয়েছি আমি, যা প্রমাণ করে ঐ হত্যাকান্ড জেনারেল শ্যারন ঘটিয়েছে, আহমদ মুসা নয়। এদেরকে অপরাধী প্রমাণের এবং আহমদ মুসাকে নির্দোষ প্রমাণিত করার একমাত্র অবলম্বন এই ভিডিও ক্যাসেট। আমি বলব না এটা আমি কাকে দিয়েছি। শুধু আহমদ মুসাকে নির্দোষ প্রমাণ নয়, আমেরিকান ইহুদীদেরকে এদের ষড়যন্ত্রের হাত থেকে বাঁচাতেও চাই আমি। আমার জীবন দিয়ে আমি এটা করব।’
নিউ হারমানের কাহিনী সারা জেফারসনও আজ পড়েছে। সে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল নাবিলার কথায়। সেই সাথে নাবিলার প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধায় ভরে গেল তার মন। পরক্ষণেই কেঁপে উঠল তার হৃদয় নাবিলার পরিণতি চিন্তা করে। সারা জেফারসন নিশ্চিত, ঐ ক্যাসেট উদ্ধারের জন্যে কোন কিছু করতেই তাদের বাধবে না। এক নারী মন নিয়ে নারী নাবিলার এই দিকটা চিন্তা করতে গিয়ে এটাই তার কাছে বড় হয়ে উঠল। সারা জেফারসন আরও ভাবল, ক্যাসেটটি কাকে দিয়েছে তা বলে দেয়ার অর্থ ক্যাসেটটি জেনারেল শ্যারনরা পেয়ে যাওয়া নয় কিংবা সেই লোকটি শ্যারনদের হাতে ধরা পড়ে যাওয়া নয়। নাবিলা ধরা পড়ার পর সে লোকটি নিশ্চয় ইতিমধ্যে নিজেকে ও ক্যাসেটকে রক্ষার ব্যবস্থা করেছে। সুতরাং নাবিলা কথাটা বলে দিলে ক্ষতি নেই। এই কথা চিন্তা করে সারা জেফারসন নাবিলাকে বলল, ‘নাবিলা, বোন, আমি ভেবে দেখলাম নামটা তুমি বলতে পার।’
‘না, আপা। এদের কোন সহযোগীতা আমি করব না। নাম বললেও এরা আমাকে বাঁচতে দেবে না, আমার মর্যাদা রক্ষা করবে না। যারা অন্যকে ফাঁসাবার জন্যে নিজের স্বজাতির উপর গণহত্যা চালায়, তাদের আমি বিশ্বাস করি না।’ কাঁদতে কাঁদতে বলল নাবিলা।
নাবিলার কথা শেষ হতেই জেনারেল শ্যারন ঝাঁপিয়ে পড়ল নাবিলার উপর এবং নাবিলাকে সারা জেফারসনের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে ছুড়ে দিল আলফ্রেডের কাছে।
আলফ্রেড তাকে বুকে জড়িয়ে কামড় বসাল নাবিলার রক্তাক্ত গালে। জেনারেল শ্যারন সারা জেফারসনের এক ফুটের ব্যবধানে দাঁড়িয়েছিল। তার কোটের সাইড পকেটে রিভলবার। রিভলবারের ভারীতে পকেটের মুখ কিছুটা ফাঁক হয়ে আছে।
সারা জেফারসন এটা লক্ষ করার সংগে সংগে চোখের পলকে ডান হাত দিয়ে তার পকেট থেকে রিভলবারটি তুলে নিয়ে রিভলবারের নল জেনারেল শ্যারনের মাথায় ঠেকিয়ে বলল, ‘জেনারেল শ্যারন, নাবিলাকে ছেড়ে দিতে বল আলফ্রেডকে। না হলে এখনি তোমার মাথা উড়ে যাবে।’
ঘটনার আকস্মিকতায় বিমূঢ় হয়ে পড়েছিল জেনারেল শ্যারন। সে দ্রুত বলল, ‘আলফ্রেড ছেড়ে দাও নাবিলাকে।’
আলফ্রেড নাবিলাকে ছেড়ে দিল।
ছাড়া পেয়ে ডেভিড উইলিয়াম জোনসের সামনে দিয়ে নাবিলা আসছিল সারা জেফারসনের কাছে।
হঠাৎ ডেভিড জোনস একটু নিচু হয়ে দু’হাত নাবিলার কোমর বরাবর নিয়ে দেহের সমস্ত শক্তি দিয়ে তাকে ছুঁড়ে দিল সারা জেফারসনের দিকে।
নাবিলা হুমড়ি খেয়ে গিয়ে পড়ল সারা জেফারসনের উপর।
ঘটনা এতটাই আকস্মিকভাবে ঘটে গেল যে, সারা জেফারসন সাবধান হবারও সুযোগ পেল না। নাবিলা তার গায়ের উপর এসে পড়ায় সারা জেফারসন ভারসাম্য রক্ষা করতে না পেরে পড়ে গেল।
সংগে সংগে জেনারেল শ্যারন ঝাঁপিয়ে পড়ে রিভলবার কেড়ে নিল সারা জেফারসনের হাত থেকে।
উঠে দাঁড়াল জেনারেল শ্যারন।
বিকট শব্দে হো হো করে হেসে উঠল সে। বলল সে, ‘ধন্যবাদ ডেভিড জোনস।’
তারপর সে ফিরে দাঁড়াল সারা জেফারসনের দিকে শয়তানের মত ক্রুর দৃষ্টি নিয়ে। বলল, ‘শয়তানি। তোকে আমরা যথেষ্ট সম্মান দিয়েছি, আর নয়। তুই বাঁচাতে চেয়েছিলি নাবিলাকে আলফ্রেডের হাত থেকে। এবার তাহলে তুইই প্রথমে আলফ্রেডের স্বাদটা গ্রহণ কর।’
বলে জেনারেল শ্যারন নিচু হলো সারা জেফারসনকে ধরার জন্যে।
সারা জেফারসন তখন মাটিতে পড়েছিল। সে লক্ষ করছিল জেনারেল শ্যারনকে।
হঠাৎ সারা জেফারসনের একটি পা বিদ্যুত বেগে ছুটে গেল জেনারেল শ্যারনের রিভলবার ধরা হাত লক্ষে।
জেনারেল শ্যারনের হাত থেকে রিভলবার ছিটকে গিয়ে পড়ল সারা জেফারসনের মাথার পেছনে।
রিভলবার মাথার পেছনে পড়তেই সারা জেফারসন তার দু’পা পেছন দিকে ছুড়ে দিয়ে দেহটা উল্টিয়ে রিভলবারের উপর গিয়ে পড়ল।
রিভলবার হাতে নিয়েই উঠে দাঁড়াল সারা জেফারসন। তার রিভলবারের নল তাক করা জেনারেল শ্যারনের দিকে।
কিন্তু সারা জেফারসন লক্ষ করেনি ডেভিড উইলিয়াম জোনস তার রিভলবার বের করে নিয়েছে হাতে। তার রিভলবারের নল উঠে আসছে সারা জেফারসনের লক্ষে।
ডেভিড জোনসের গুলী এসে বিদ্ধ করল সারা জেফারসনের রিভলবার ধরা হাতকে।
হাত থেকে রিভলবার ছিটকে পড়ে গেল।
আকস্মিক এই গুলী খেয়ে সারা জেফারসন কঁকিয়ে উঠে বাঁ হাত দিয়ে চেপে ধরল আহত ডান হাতটা।
জেনারেল শ্যারন ক্ষীপ্র গতিতে মেঝে থেকে তুলে নিল রিভলবার।
আবার সেই অট্টহাসি জেনারেল শ্যারনের। বলল সারা জেফারসনকে লক্ষ করে, ‘তুই যে এতবড় বাঘিনী তা জানতাম না। ‘ফ্রি আমেরিকার’ নেত্রী যে তুই ভুলেই গিয়েছিলাম।’
বলে একটু দম নিল জেনারেল শ্যারন। তারপর হেসে উঠে বলল, ‘সারা জেফারসন, তোর মত বাঘিনী আলফ্রেডের মত গেরিলার বাহু বন্ধনে পড়লে কেমন হয় দেখতে ভালই লাগবে আমাদের।’
কথা শেষ করে জেনারেল শ্যারন সারা জেফারসনকে হিড় হিড় করে টেনে নিয়ে ছুড়ে দিল আলফ্রেডের কাছে।
আলফ্রেড গেরিলার মত দু’হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরল তাকে।
চিৎকার করে উঠল নাবিলা, ‘জেনারেল শ্যারন ছেড়ে দাও সারা জেফারসনকে। ক্যাসেটের খবর তোমাদেরকে দিচ্ছি।’
‘বল।’ বলল জেনারেল শ্যারন।
‘শশাংককে দিয়েছি।’
‘শশাংককে দিয়েছ? সে তো এখন জর্জ আব্রাহাম জনসনের কাছে। সন্দেহ হয়েছিল। কিন্তু ধরতে চেষ্টা করেও আমরা পারিনি।’
বলেই পাগলের মত হেসে উঠল। বলল, ‘শয়তানি আমাদের সর্বনাশ করেছিস, তোদের সর্বনাশ আমরা করব।’
তারপর আলফ্রেডকে বলল, ‘তুমি ছেড় না আলফ্রেড, ও বড় শয়তানি। আমরা চাই, শয়তানির শাস্তি যেন সে সারা জীবন মাথায় বয়ে বেড়ায়।’
ঘুরে দাঁড়াল আবার সে নাবিলার দিকে। নাবিলাকে তাক করে তুলল তার রিভলবার।
অন্যদিকে আলফ্রেড সারা জেফারসনকে মেঝেয় ছুড়ে ফেলে ঝাঁপিয়ে পড়ল তার উপর।
এ সময় তার রিভলবারের একটা গর্জন জেনারেল শ্যারনের কানে এসে পৌছল। রিভলবারের ট্রিগারে জেনারেল শ্যারনের তর্জনি স্থির হয়ে গেল। সে তাকাল দরজায় দাঁড়ানো ষ্টেনগানধারীর দিকে। দেখতে পেল দু’জন ষ্টেনগানধারীর মধ্যে একজনকে। বলল,‘দেখ হারজেল কোথায় গেল? শব্দটা তার রিভলবারের?
ষ্টেনগানধারী দরজার দিকে ঘুরে দাঁড়াল।
আলফ্রেডও তখন থমকে গেছে।
মুখ ঘুরিয়ে তাকাল আলফ্রেড জেনারেল শ্যারনের দিকে।

টার্গেট বাড়িটার আর একটা বাড়ির পরেই জর্জ আব্রাহাম জনসন গাড়ি দাঁড় করাতে বলল।
| ← Previous | | | Next → | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top