৪
আহমদ মুসা লাফ দিয়ে একটা চলন্ত এক্সালেটরে গিয়ে পড়ল। নরম স্পঞ্জে ঢাকা এক্সালেটর না হলে তার মাথা শরীর আস্ত থাকতো না।
এক্সালেটর চলছে ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে।
জেনারেল শ্যারন এই এক্সালেটরেই আছে। পাঁচ ছয় সেকেন্ডর বেশী ব্যবধান হয়নি তাদের দু’জনের লাফ দেয়ার মধ্যে। সুতরাং খুব বেশী দুরে নয় জেনারেল শ্যারন।
এই ভাবনার মধ্যেই আহমদ মুসা ছিটকে পড়ল একটা শক্ত মেঝেতে।
জায়গাটা একটা ছোট্ট চত্বর, দেখল আহমদ মুসা।
পড়েই লাফ দিয়ে উঠে বসল সে। দেখতে পেল জেনারেল শ্যারন চত্বরে দাঁড়ানো একটা গাড়িতে উঠছে।
আহমদ মুসা আশে-পাশে তাকিয়ে দেখল আর কোন গাড়ি নেই। আহমদ মুসা উঠে দাঁড়িয়ে ছুটল জেনারেল শ্যারনের দিকে। ততক্ষণে ষ্টার্ট নিয়েছে শ্যারনের গাড়ি।
আহমদ মুসা গাড়ির পেছনে ছুটে গিয়ে রাস্তায় উঠল।
তার সামনেই পড়ল একটা গাড়ি। স্পোর্টস কার। একজন তরুনী চালাচ্ছে। হাত দিয়ে ইশারা করে গাড়ি থামাতে আবেদন করল আহমদ মুসা।
গাড়ি থামাল তরুণী।
‘আপনি কি হাসপাতালে যাচ্ছেন?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘না।’ বলল তরুণীটি
‘কোন জরুরী কাজে?’
‘না।’
‘তাহলে আমাকে গাড়িটি দিন। ঐ গাড়িতে বড় একজন ক্রিমিনাল যাচ্ছে, তাকে আমি ফলো করব।’
তরুণীটি চোখ তুলে আহমদ মুসাকে একবার দেখল। তারপর নেমে এল ড্রাইভিং সিট থেকে।
আহমদ মুসা ড্রাইভিং সিটে বসতে বসতে বলল, ‘ধন্যবাদ বোন। এফবিআই প্রধান জর্জ আব্রাহামকে টেলিফোন করলে সব জানতে পারবেন।’
কথা শেষ হওয়ার আগেই চলতে শুরু করেছে আহমদ মুসার গাড়ি।
চলছে দুটি গাড়ি।
খুশি হলো আহমদ মুসা যে, শ্যারনের গাড়িটা নজরের মধ্যেই রয়েছে।
আরও খুশি হলো আহমদ মুসা গাড়িটা একেবারে নতুন আমেরিকান গাড়ি। ভালো স্পীড আছে।
শ্যারনের গাড়ি ছুটছে অরলিংটনকে ডাইনে রেখে হাইওয়ে ধরে স্পিংফিল্ডের দিকে।
ভার্জিনিয়ার প্রান্তর দিয়ে চলছে তখন দু’টি গাড়ি। গাছ-গাছালিতে ভরা চড়াই উতরাই এর মধ্য দিয়ে। মাঝে মাঝেই দু’পাশে ছবির মত সবুজ বসতি চোখে পড়ছে।
কোথায় যাচ্ছে শ্যারন? তার ডান হাত বিধ্বস্ত। বাম হাত মাত্র সচল। গাড়ি চালানো অবস্থায় রিভলবার চালাতে পারবে না। টেলিফোন করতে চাইলেও তাকে থামতে হবে। এ অবস্থায় দ্রুত তাকে কোন আশ্রয়ের সন্ধান করতে হবে।
গাড়ির গতির মতই দ্রুত এই চিন্তাগুলো আবর্তিত হচ্ছে আহমদ মুসার মাথায়।
সন্ধ্যা নামার খুব দেরী নেই।
আহমদ মুসা গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিল।
গাড়ি চলছিল উপত্যকার মত এক নিচু এলাকা দিয়ে। সামনেই একটা টিলা। সুন্দর সাজানো একটা বাড়ি দেখা যাচ্ছে টিলার মাথায়।
টিলার পাশ দিয়ে চলে গেছে হাইওয়ে। হাইওয়ে থেকে একটা রাস্তা উঠে গেছে টিলার বাড়িটার দিকে।
আহমদ মুসা বিস্ময়ের সাথে লক্ষ করল আহমদ মুসার গাড়ির স্পীড বাড়লেও শ্যারনের গাড়ি একই গতিতে চলছে।
স্পীড বাড়ালো না মানে এখন সে লড়াই করতে চায়? কিন্তু কি ভাবে? তার তো লড়াই করার অবস্থা নেই। ভাবল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার গাড়ি জেনারেল শ্যারনের গাড়ির বিশ পঁচিশ গজের মধ্যে পৌছে গেছে।
আহমদ মুসা পায়ের মোজার সাথে গুজে রাখা রিভলবারটা হাতে নিল।
হঠাৎ আহমদ মুসা লক্ষ করলো জেনারেল শ্যারনের গাড়ির পেছনের টপটা উঠে যাচ্ছে। তার আড়াল থেকে বেরিয়ে এল কয়েকটা ব্যারেল।
আঁতকে উঠল আহমদ মুসা। মেশিন গান ও গ্রেনেড লাঞ্চারের ব্যারেল দেখেই সে চিনতে পেরেছে। মাত্র সুইচ টিপে ওগুলো অপারেট করা যায়।
আহমদ মুসার চিন্তা শেষ হবার আগেই সামনে থেকে গর্জন করে উঠল মেশিনগান। এক ঝাঁক গুলী এসে আহমদ মুসার গাড়ির উইন্ডস্ক্রিন উড়িয়ে নিয়ে গেল। ঝাঁঝরা করে দিল গাড়ির সামনের দিকটা।
আহমদ মুসা সিটের উপর কাত হয়ে পড়ে নিজেকে রক্ষা করল। কিন্তু সেই সাথে বুঝল আরও কি ঘটতে পারে।
আহমদ মুসা গাড়ির ষ্টার্ট বন্ধ করে দিয়ে তাড়াতাড়ি হাতড়িয়ে গাড়ির কাগজপত্র যা পেল নিয়ে দেহটাকে নিচে গড়িয়ে দিল।
কিন্তু তার দেহটা মাটিতে পড়ার আগেই তার ডান বাহুর একটা মাসল ছিড়ে নিয়ে গেল বুলেট।
আহমদ মুসা সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে দেহটাকে গাড়ির রাস্তার পাশে নিয়ে গেল।
ঠিক সে সময়েই একটা গ্রেনেড বিস্ফোরিত হলো আহমদ মুসার গাড়িতে। মুহূর্তেই টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ল গাড়ি। দাউ দাউ করে জ্বলতে লাগল আগুন।
শুয়ে থেকেই আহমদ মুসা দেখল জেনারেল শ্যারনের গাড়ি দ্রুত এগিয়ে বাঁক নিয়ে টিলার রাস্তা ধরে উপরে উঠে গেল।
আহমদ মুসা বাঁ হাত দিয়ে ডান বাহু চেপে ধরে উঠে দাঁড়াল।
উঠে দাঁড়িয়েই দেখতে পেল বিপরীত দিক থেকে একটা গাড়ি ছুটে আসছে।
আহমদ মুসা একটু এগিয়ে হাত তুলল। সেই সাথে দেখল গাড়ি একটি নয় দুটি। একটি জীপ, আরেকটি পিকআপ।
গাড়ি দু’টি আহমদ মুসার বরাবর এসেই থেমে গেল। সংগে সংগেই খুলে গেল গাড়ির দরজা। গাড়ি থেকে নেমে এল সামরিক ইউনিফর্ম পরা একজন লোক। ছুটছে সে আহমদ মুসার দিকে। তার পেছনে আরও দু’জন অফিসার।
আহমদ মুসা ছুটে আসা সামনের জনকে দেখেই চিনতে পারল। খুশি হলো এই দুঃসময়ে মার্কিন সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটনকে দেখে।
‘গুড ইভনিং।’ বলে স্বাগত জানাল আহমদ মুসা রোনাল্ড ওয়াশিংটনকে।
কিন্তু জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন আহমদ মুসার কথার দিকে খেয়াল করল না। সে দ্রুত আহমদ মুসার কাছে এসে তার আহত বাহুটা একবার দেখে গোটা দেহের দিকে নজর বুলিয়ে বলল, ‘মি. আহমদ মুসা আর কোন ক্ষতি হয়নি তো? আপনি ঠিক আছেন তো? কি ঘটেছে? কেন এমন ঘটল? আপনি………..।’ জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটনের কণ্ঠে উদ্বেগ।
আহমদ মুসা জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটনের কথায় বাধা দিয়ে বলল, ‘মি. জেনারেল, আমি ভাল আছি। সব বলছি আমি। কিন্তু তার আগে আপনি দয়া করে ঐ টিলার বাড়িটা ঘিরে ফেলার নির্দেশ দিন। জেনারেল শ্যারন ওখানে পালিয়েছে্’।
আহমদ মুসা যখন এ কথাগুলো বলছিল, তখন আরও একটা গাড়ি এসে দাঁড়াল এবং তা থেকে ২ জন নারী পুরুষ নেমে ছুটে এসে আহমদ মুসার পাশে দাঁড়িয়েছিল।
আহমদ মুসা কথা বলতে বলতেই তাদের দিকে তাকিয়েছিল। সান ওয়াকার ও মেরী রোজ আলেকজান্ডারকে দেখে হাসিতে মুখ ভরে গিয়েছিল আহমদ মুসার।
‘জেনারেল শ্যারন দি কালপ্রিট?’ আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই ফুসে উঠল জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটনের কণ্ঠ।
বলেই জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন তার পাশে দাড়ানো দু’জন অফিসারের একজনকে বলল, ‘কর্ণেল বব আপনি কর্ণেল ষ্টিভেনকে বলুন তিনি লোকদের নিয়ে যেন টিলার বাড়িটা চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেন।’
নির্দেশের সাথে সাথে কর্ণেল বব ছুটল পিকআপ গাড়িটার দিকে। জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন যখন ববকে নির্দেশ দিচ্ছিল, সেই সময় আহমদ মুসা সান ওয়াকারের দিকে ফিরে বলল, ‘তোমরা? এ সময় কোত্থেকে? ভাল আছ তো? ওগলালা কেমন আছে?’
আহমদ মুসার এত প্রশ্নের কোনটির জবাব না দিয়ে সান ওয়াকার বলল, ‘আহমদ মুসা ভাই, আপনি সাংঘাতিক আহত। মারাত্মক ব্লিডিং হচ্ছে।’ কণ্ঠে উদ্বেগ সান ওয়াকারের।
ববকে নির্দেশ দিয়েই জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন তার দ্বিতীয় অফিসারকে বলল, ‘কর্ণেল টনি স্মিথ তুমি গিয়ে গাড়ি থেকে ফাস্ট এইড নিয়ে এসে ওর আহত জায়গাটা বেঁধে দাও, রক্ত বন্ধ হওয়া দরকার।’
কথা শেষ করে জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন আহমদ মুসার দিকে ফিরতেই আহমদ মুসা সান ওয়াকারদের দেখিয়ে তাকে বলল, ‘এ সান ওয়াকার, তুখোড় ছাত্র, রেডইন্ডিয়ান মুভমেন্ডের একজন নেতা এবং ও মেরী রোজ আলেকজান্ডার, চীফ জাষ্টিস আলেকজান্ডারের মেয়ে। এরা আমার ভাই বোন।’
জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন ওদের সাথে সম্ভাষণ বিনিময় করে আহমদ মুসার দিকে ফিরে বলল, ‘ঘটনা কি মি. আহমদ মুসা?’
জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটনের অফিসার কর্ণেল টনি স্মিথ তখন আহমদ মুসার ডান বাহুর আহত জায়গাটা বাঁধছিল। আহমদ মুসা জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটনের জিজ্ঞাসার জবাবে বলল, ‘জেনারেল শ্যারনদের এক ঘাটিতে অভিযান চালিয়ে সারা জেফারসন ও নোয়ান নাবিলাকে উদ্ধার করা হয়েছে। ডেভিড উইলিয়াম জোনস বন্দী হয়েছেন। আহত অবস্থায় পালাতে পেরেছিলেন জেনারেল শ্যারন। তাকে ফলো করেই আমি এখানে এসেছি।’
জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটনের চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, ‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ।’
বলে মুহুর্তকাল থেমেই আবার শুরু করল, ‘কিন্তু আপনার গাড়ি ও আপনার এই অবস্থা হলো কি করে?’
‘জেনারেল শ্যারনের গাড়িটা ছিল বিশেষ ধরনের। গাড়ির পেছনে টপের কভারে অটোমেটিক মেশিনগান ও গ্রেনেড লাঞ্চার ফিট করা ছিল। আমি সেটা বুঝতে পারিনি। তাকে ধরার জন্যে তার গাড়ির কাছে এসে পড়েছিলাম। তারপর যা ঘটার তাই ঘটেছে। আমি মাটিতে পড়ে থেকেই দেখতে পেলাম, শ্যারন গাড়ি নিয়ে টিলার বাড়িটিতে উঠে গেল।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। মৃত্যুর মুখ থেকে তিনি আপনাকে বাঁচিয়েছেন।’ এক সাথেই বলে উঠল জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন এবং সান ওয়াকাররা।
কথা শেষ করেই জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন তাকাল সান ওয়াকারের দিকে। বলল, ‘মি. সান ওয়াকার, আমি একজন ষ্টাফ সার্জেন্টকে সাথে দিচ্ছি। আপনারা আহমদ মুসাকে পেন্টাগনের সামরিক হাসপাতালে দয়া করে পৌছে দিন।’
‘কিন্তু আমি জেনারেল শ্যারনের শেষটা না দেখে যাই কি করে?’ জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটনের প্রস্তাব শুনেই বলে উঠল আহমদ মুসা।
‘প্লিজ মি. আহমদ মুসা, প্লিজ। আপনার এখনই ট্রিটমেন্ট দরকার। শ্যারনকে খুঁজে বের করতে এবং ধরতে কতটা সময় যাবে বলা যাচ্ছে না। আপনাকে সে সময় পর্যন্ত রাখা যায় না, উচিত নয়। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, নিউ হারমানের দুষকর্মই তার শেষ দুষকর্ম। ওকে আমরা ধরে নিয়ে আসছি। আপত্তি করবেন না। যান এদের সাথে। প্লিজ।’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘ঠিক আছে জেনারেল। আল্লাহ আপনাদের সফল করুন।’
খুশি হয়ে উঠল সান ওয়াকার ও মেরী রোজ আলেকজান্ডারের মুখ। ওরা আহমদ মুসাকে নিয়ে চলল ওদের গাড়ির দিকে।
সান ওয়াকার ড্রাইভিং সিটে বসে আহমদ মুসাকে বলল, ‘ভাইয়া মেরী আপনার সাথে পেছনে উঠুক।’
‘না সান ওয়াকার, সাথী হিসেবে অস্ত্রধারী এবং সার্জেন্ট আমার জন্যে ভাল হবে।’ বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার কথা শুনেই সান ওয়াকার তার ভুল বুঝতে পারল। বিকল্প থাকা অবস্থায় কোন মেয়েকে আহমদ মুসা তার পাশে বসা এ্যালাউ করবেন না।
সান ওয়াকার হাসল। বলল, ‘ভুল হয়েছে আমার ভাইয়া। ইসলামের সব এটিকেট এখনও শিখে উঠতে পারিনি। পদে পদেই ভুল হয়।’
হাসল আহমদ মুসাও। বলল, ‘মেরী রোজ দেখবে তোমাকে ছাড়িয়ে যাবে এ ব্যাপারে।’
‘ভাইয়া সান ওয়াকারকে জিজ্ঞেস করুন তো, সে প্রতিদিন কতটুকু কোরআন শরীফ পড়ে, এ পর্যন্ত কতগুলো হাদিস ও পড়েছে।’ বলল মেরী রোজ গাড়িতে উঠতে উঠতে।
‘এখন পড়ার খুব চাপ যাচ্ছে। এ কারণেই কিছুটা পিছিয়ে পড়েছি ভাইয়া।’ বলল গম্ভীর মুখে সান ওয়াকার।
‘কোন চিন্তা নেই সান ওয়াকার। মেরী রোজ দেখবে তোমাকে ঠিক করে দেবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ধন্যবাদ ভাইয়া। আগাম কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি মেরীকে।’ বলল সান ওয়াকার।
সবাই গাড়িতে উঠেছে।
ছুটতে শুরু করল গাড়ি।
হোয়াইট হাউজের একটি কমিটি কক্ষ।
প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা কমিটির একটা বৈঠক চলছে। অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত আছেন প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা উপদেষ্টাসহ সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন, সিআইএ প্রধান এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার, এফবিআই প্রধান জর্জ আব্রাহাম জনসন, পুলিশ প্রধান বিল বেকার। আজ বিশেষ আমন্ত্রণে উপস্থিত আছেন সিনেটের গোয়েন্দা বিষয়ক স্পেশাল কমিটির চেয়ারম্যান আনা প্যাট্রেসিয়া, প্রতিনিধি পরিষদের গোয়েন্দা বিষয়ক সিলেক্ট কমিটির চেয়ারম্যান এ্যান্ড্রু জ্যাকবস এবং সিনেটের পররাষ্ট্র বিষয়ক বিশেষ কমিটির চেয়ারম্যান বব এইচ ব্রুস।
আলোচনা চলছিল।
কথা বলছিল তখন সিনেট ইনটেলিজেন্স কমিটির চেয়ারম্যান আনা প্যাট্রেসিয়া। বলছিল যে, ‘আমি উদ্বিগ্ন, আমাদের মিডিয়ার ক্রেডিবিলিটি মারাত্মক হুমকির মুখে। সেবার আমাদের ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়াতে দারুণ ফলাও করে খবর বেরুলো যে, লস আলামোসের গোয়েন্দা সুড়ঙ্গের ব্যাপারটা ভুয়া। ওটা আহমদ মুসার কল্পনার সৃষ্টি, মার্কিন ইহুদীদের বিপদে ফেলার জন্যে এবং তার সাথে সাথে বলা হলো লস আলামোসের ঘটনার পরবর্তী যে কিলিং ও সান্তাফে বিমান বন্দরে বিমান ধ্বংস হওয়ার যে ঘটনা ঘটাল, তা আহমদ মুসার নৃশংসতা। কিন্তু একদিন পরেই মূলত আহমদ মুসা ও ফ্রি আমেরিকার চেষ্টায় মিডিয়াতে একদম বিপরীত খবর বেরুল। একেবারে অকাট্য দলিল দস্তাবেজ দিয়ে প্রমাণ করা হলো যে, লস আলামোস ও সবুজ পাহাড়ের সংযোগকারী গোয়েন্দা সুড়ঙ্গটা ইহুদীদের তৈরী এবং পরবর্তী কিলিং ও বিমান ধ্বংসের ঘটনা ইহুদীবাদী শ্যারনরাই ঘটিয়েছে লস আলামোস ঘটনার তদন্তকারী টিমকে হত্যার জন্যে। আবার গতকালই মিডিয়া সাংঘাতিক খবর দিল, আহমদ মুসাই নিউ হারমানে গণহত্যা ঘটিয়েছে। এই অভিযোগে আহমদ মুসাকে গ্রেপ্তারও করা হলো। কিন্তু আজকেই আবার আমাদের মিডিয়া সম্পূর্ণ উল্টো খবর প্রকাশ করতে বাধ্য হলো। যাতে ভিডিও টেপের মাধ্যমে প্রমাণ করা হলো মার্কিন ইতিহাসের এই জঘন্য হত্যাকান্ড ইহুদীবাদী জেনারেল শ্যারনরাই ঘটিয়েছে। সেই সাথে খবর বেরুল, আহমদ মুসা সারা জেফারসন ও নাবিলাকে উদ্ধার এবং ডেভিড উইলিয়াম জোনস ও জেনারেল শ্যারনকে বন্দী করার ব্যাপারে প্রধান ভূমিকা পালন করেছে।’
একটু থামল আনা প্যাট্রেসিয়া, তারপর আবার বলল, ‘আমি একথাগুলো বললাম এজন্যে যে, নিজেরা কিছু অনুসন্ধান না করে, মোটামুটি নিশ্চিত না হয়ে খবর ছাপানোর ফলে মিডিয়ার এই যে ক্রেডিবিলিটি বিপর্যয় তার কারণ হচ্ছে আমাদের মিডিয়ার বৃহত্তর অংশ আজ ইহুদীবাদী শ্যারনদের দখলে।’ থামল আনা প্যাট্রেসিয়া।
‘আমি মিস আনা প্যাট্রেসিয়া সাথে একমত। কিন্তু সমস্যা হলো মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করার কোন আইন মার্কিন গণতন্ত্রে নেই। একটাই বিকল্প, সেটা হলো দেশ প্রেমিক মিডিয়া সৃষ্টি করা। যাহোক, বিষয়টা এখানেই থাক। আমার মনে হয় প্রসঙ্গ থেকে আমরা একটু সরে এসেছি।’ বলল সিনেটের পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান বব এইচ ব্রুস।
প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা উপদেষ্টা দ্রুত ফ্লোর নিল। বলল, ‘লস আলামোস ও নিউ হারমানের ঘটনা মার্কিন জনগনের বিশ্বাস ও সেন্টিমেন্টে মারাত্মক ঘা দিয়েছে। জেনারেল শ্যারন, ডেভিড উইলিয়াম জোনস ও বেন ইয়ামনিসহ প্রধান কালপ্রিটরা ধরা পড়েছে। অবশিষ্টরাও ধরা পড়বে। আইন অনুসারে তাদের বিচার হবে। ইহুদীবাদী যে প্রবণতা নিউ হারমানে গণহত্যা চালাল নিজ কম্যুনিটির উপর এবং লস আলামোসে বিশ্বাসের ঘরে ডাকাতি করল, তা এ ধরনের ডাকাতি কত করেছে, আরও কত করবে কে জানে! এরা বিপদে ফেলেছে মার্কিন জনগণকে, বিপদে ফেলেছে মার্কিন ইহুদী জনগোষ্ঠিকেও। এখন ভাববার বিষয় হলো, এদের হাত থেকে মার্কিন জনগণকে উদ্ধারের জন্যে আমরা কি করব?’ থামল প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা উপদেষ্টা।
‘কিছু একটা অবশ্যই করতে হবে। ডেভিড উইলিয়াম জোনস মার্কা ইহুদীবাদীরা আমেরিকান নয়, প্যাট্টিয়ট তো নয়ই। এদের আনুগত্য প্রমিজড ল্যান্ড ইসরাইলের প্রতি। তারা ইসরাইলের জন্যেই কাজ করে। টাকা-পয়সা থেকে বৈজ্ঞানিক তথ্য পর্যন্ত সবই তারা ইসরাইলের জন্য যোগাড় করে। জন জ্যাকবসের মত সম্মানিত বিজ্ঞানীও আমেরিকান হতে পারেননি। গোয়েন্দা সুড়ঙ্গ গড়ে লস আলামোস থেকে ইসরাইলের জন্যে বৈজ্ঞানিক তথ্য পাচার করে তিনি বিশ্বাসের ঘরে চরম ডাকাতি করেছেন। জন জ্যাকব যখন বিশ্বাসী হননি, তখন কোন ইহুদীবাদীকেই বিশ্বাস করা যায় না। এরা অক্টোপাশের মত। এই অক্টোপাশের বিদায় করা ছাড়া আমেরিকানদের মুক্তির কোন উপায় দেখি না।’ বলল সিনেট ইনটেলিজেন্স কমিটির চেয়ারম্যান আনা প্যাট্রেসিয়া।’
‘ধন্যবাদ মিস আনা প্যাট্রেসিয়া। আপনি যেটা বললেন, সেই বিদায়টা কি? কিভাবে? বলল প্রেসিডেন্ট।
‘এই বিদায় আক্ষরিক, অনাক্ষরিক দুই-ই হতে পারে মি. প্রেসিডেন্ট। অনাক্ষরিক বিষয়টা হলো, আমরা আমাদের প্রশাসন, অর্থনীতি, ব্যবসায়-বাণিজ্য, শিক্ষা-স্বাস্থ্যে কোন ক্ষেত্রেই ইহুদীবাদীদের কোন আশ্রয় প্রশ্রয় দেব না। তাহলে তারা নিজেরাই ধীরে ধীরে আমাদের দেশ ত্যাগ করবে। দ্বিতীয়ত, ইহুদীবাদীদের প্রমিজড ল্যান্ড ইসরাইলের সাথে সর্বনিম্ন পর্যায়ের কূটনৈতিক সম্পর্কের বাইরে কোন সহযোগিতা, সমঝোতায় আমরা থাকব না।’ আনা প্যাট্রেসিয়া বলল।
‘এটা শুধু অনুকূল জনমত, গণসচেতনতা ও গণ পর্যায়ের প্রতিরোধের মাধ্যমেই সম্ভব। সরকারের এখানে বেশি কিছু করার সুযোগ খুবই কম।’ বলল প্রেসিডেন্ট এ্যাডামস হ্যারিসন।
‘মি. প্রেসিডেন্ট ঠিক বলেছেন। আমার মনে হয় এই গণ সচেতনতা ও জনমত সৃষ্টি হবে। ইতিমধ্যেই যে মামলাগুলো ইহুদীবাদীদের বিরুদ্ধে হয়েছে এবং নিউ হারমানের গণহত্যা, সারা জেফারসন ও নাবিলার কিডন্যাপকে কেন্দ্র করে আরও যে কেসগুলো হতে যাচ্ছে সে সবই এই সচেতনতা সৃষ্টি করবে। কেসের প্রসিডিংসগুলো যেভাবে মিডিয়াতে আসবে তাতে আমরা যা চাই সেই জনমতের সৃষ্টি হয়ে যাবে। প্রতিরোধ উঠে আসবে জনগণের পর্যায় থেকেই।’ বলল এফবিআই প্রধান আব্রাহাম জনসন।
‘এমন যদি শুরু হয়, তাহলে মুসলমানদের নিয়েও তো প্রশ্ন উঠতে পারে?’ প্রেসিডেন্ট এ্যাডামস হ্যারিসন বলল।
‘না মি. প্রেসিডেন্ট, এ ধরনের প্রশ্ন তোলার কোন সুযোগ হবে না। মুসলিম জাতীয়তার একটা আন্তর্জাতিক রূপ আছে সত্য, কিন্তু মুসলমানদের ভূমিগত কোন আন্তর্জাতিক কেন্দ্র নেই। মক্কা মুসলমানদের প্রার্থনা ও তীর্থ কেন্দ্র, কিন্তু মক্কা বা আরবের প্রতি মুসলমানদের কোন রাজনৈতিক আনুগত্য বা কমিটমেন্ট নেই। আরবকে তারা তাদের জাতীয় আবাসভূমি মনে করে না এবং সেজন্য অর্থ-বিত্ত, শ্রম, বুদ্ধি ইত্যাদি দিয়ে একে গড়ে তোলারও কোন প্রয়োজনীয়তা তারা অনুভব করে না। মুসলমানরা গোটা দুনিয়াকেই আল্লাহর ভূমি মনে করে এবং তাই যে দেশেই তারা বসতি স্থাপন করে সে দেশকেই তারা নিজের দেশ হিসেবে গ্রহণ করে। সুতরাং মুসলমান আমেরিকানরা সত্যিকারের আমেরিকান। ইহুদীবাদীদের সাথে তাদের তুলনা হয় না। তাই তাদের ব্যাপারে কোন প্রশ্ন উঠবে না। পৃথিবীতে মাত্র দুটি জাতি আছে, ইহুদী ও হিন্দু, যারা তাদের ধর্ম বিশ্বাসের সাথে তাদের ভূমিকে এক করে ফেলেছে। ইসরাইল ইহুদীদের প্রমিজড ল্যান্ড। তেমনি হিন্দুস্তানকে হিন্দুরা তাদের জাতীয় আবাসভূমি মনে করে। এ জন্যে হিন্দুরা হিন্দুস্তানে অন্যজাতির অস্তিত্ব বরদাশত করতে পারে না। হিন্দুস্তানে আসা সব জাতিকেই তারা গ্রাস করেছে। বৌদ্ধদের মত বড় জাতিকেও তারা ভারত থেকে নির্মূল করেছে। পারেনি শুধু মুসলমানদের। তাই বলে চেষ্টা তারা পরিত্যাগ করেনি।’ বলল আনা প্যাট্রেসিয়া।
‘ধন্যবাদ মিস প্যাট্রেসিয়া, আপনি ভাল কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন। শ্যারনদের তৎপরতার সাথে ভারতীয় আমেরিকানদেরও তো জড়িত দেখা যাচ্ছে। এ ব্যাপারটাও আমাদের বিবেচনায় আসা দরকার।’ প্রেসিডেন্ট বলল।
‘ইয়েস মি. প্রেসিডেন্ট ইহুদীবাদী শ্যারনদের সাথে ইন্ডিয়ান আমেরিকানরা দেখা যাচ্ছে গভীরভাবেই জড়িয়ে পড়েছে। শ্যারনরা আহমদ মুসাকে বন্দী করে রেখেছিল ভারতীয় আমেরিকান এ্যাসোসিয়েশনের চীফ প্যাট্রোন শিব শংকর সেনের বাড়িতে ও তার ফ্যাক্টরী গোডাউনে, আবার সারা জেফারসন ও নাবিলাকেও বন্দী অবস্থায় পাওয়া গেছে তারই আরেক বাসায়। সর্বশেষে আমরা শ্যারনকে যেখান থেকে উদ্ধার করলাম, সে বাড়িটাও ঐ এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ভারত ভূষণ শিবাজীর। প্রেসিডেন্টের মনে আছে জেনারেল শ্যারনদের পক্ষে তদ্বির করতে এসেছিলেন ভারতীয় আমেরিকান এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ভারত ভূষণ শিবাজী, নির্বাহী ডাইরেক্টর বিনোদ বিহারী মালাকার, উপদেষ্টা শরৎসিং বর্মন এবং চীফ প্যাট্রোন শিব শংকর সেন। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে ভারতীয় আমেরিকানরা ব্যক্তিগতভাবে নয়, সামষ্টিকভাবে জেনারেল শ্যারনদের ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
‘মি. প্রেসিডেন্ট, জেনারেল শ্যারনদের বিরুদ্ধে যে সব মামলা দায়ের হয়েছে, তার সাথে শিব শংকর সেন এবং ভারত ভূষণ শিবাজী জড়িত হয়ে পড়েছেন।’ পুলিশ প্রধান বিল বেকার বলল।
‘আমার মনে হয় এখনকার জন্যে এতটুকুই যথেষ্ট। দেখা যাক আইন তাদের কতটা জড়ায়। তাদের এ ভূমিকা তাদের ভুল বোঝার কারণেও হতে পারে।’ প্রেসিডেন্ট বলল।
‘ধন্যবাদ মি. প্রেসিডেন্ট, এভাবেই চিন্তা করা হবে। তবে তাদের এই আতাতটা ট্রেডিশনাল। এই দুই কম্যুনিটির মধ্যে সম্পর্ক ও সহযোগিতার বিষয়টা খুবই পুরানো। ইহুদীবাদী শ্যারনদের আজকের বিপর্যয়ে তাদের কোন প্রকার ভূমিকা অব্যাহত থাকতে পারে। এমনকি ওদের কাজ কিছুটা এরাও আনজাম দিতে পারে।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
‘ধন্যবাদ মি. জর্জ। এদের উপর চোখ রাখতে হবে এবং এদের মধ্যে আবার শ্যারনদের সৃষ্টি না হয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।’ প্রেসিডেন্ট বলল।
‘ইয়েস মি. প্রেসিডেন্ট।’ জর্জ আব্রাহাম জনসন বলল।
‘অবাক লাগছে মি. প্রেসিডেন্ট। ঈশ্বর কখন কাকে দিয়ে কি কাজ করান! আমরা কি কেউ ভাবতে পেরেছিলাম, আহমদ মুসা এদেশে এসে যুগ যুগ ধরে চলে আসা একটি প্রাণঘাতি ষড়যন্ত্রজাল ছিন্ন করে আমেরিকাকে রক্ষা করবেন!’ বলল আনা প্যাট্রোসিয়া।
‘সত্যিই অভাবনীয় মিস আনা প্যাট্রোসিয়া। শ্যারনদের ষড়যন্ত্রে আমরা বারবার তাকে সন্দেহ করেছি, তাকে গ্রেপ্তার করেছি, গ্রেপ্তারের জন্যে পুলিশ লেলিয়ে দিয়েছি। কিন্তু তার কাজ সে করেই গেছে। লাখ লাখ টাকা দিয়ে নিয়োগ করলেও কারো কাছ থেকে এই ধরনের কাজ পাওয়া দুষ্কর। সত্যি আহমদ মুসা অতুলনীয়। এ ধরনের লোক পৃথিবীর সম্পদ, পৃথিবীর মানুষের সম্পদ।’ প্রেসিডেন্ট শেষোক্ত বাক্যটা পূর্ণ করেই পানির গ্লাস তুলে নিলেন। পানি খেলেন। মনে হয় পানি খাওয়ার জন্যেই তিনি থেমেছিলেন।
প্রেসিডেন্ট তার হাতের গ্লাসটা টেবিলে রাখার আগেই জেনারেল রোনাল্ড ওয়াশিংটন বলল, ‘এই লোকটি মৌলবাদী বলে তার কি ভয়ংকর রূপ আমাদের সামনে তুলে ধরা হয়েছিল! অথচ তার মধ্যে যে মানবিকতা দেখেছি তা অনন্য। তিনি তার ধর্মের প্রতি অত্যন্ত নিষ্ঠাবান, তিনি ধর্মের ছোট-খাট নির্দেশও অত্যন্ত যত্নের সাথে পালন করেন। তিনি তার জাতিকে ভালোবাসেন, জাতির কাজেই তিনি তার জীবনকে বিলিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু এই সাথে তিনি অন্য ধর্মকে অশ্রদ্ধা করেন না। অন্য ধর্মের লোকদের তিনি ভালোবাসেন, নিজের লোকদের যেমন ভালোবাসেন। মানুষ হিসেবে সবাই তার কাছে সমান। তাঁর এই অবস্থানকে বিপরীতমুখী এক দ্বৈত রূপ মনে হতে পারে। কিন্তু আহমদ মুসা এই বৈপরিত্যকে জয় করেছেন। তিনি অত্যন্ত গোঁড়া ধার্মিক এবং অত্যন্ত গোঁড়া এক মানবতাবাদী।’
জর্জ আব্রাহাম জনসনের মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। বলল সে, ‘মি. প্রেসিডেন্ট আহমদ মুসা কি বলেন জানেন। তিনি বলেন, যে যত ভালো মুসলমান, সে তত ভালো মানবতাবাদী। তার যুক্তি হলো, ‘আল্লাহ সকলের স্রষ্টা, সকলের পালনকর্তা, সকলের প্রত্যাবর্তন তাঁরই কাছে। তিনি সকল মানুষকে ভালোবাসেন। অন্যদিকে একজন ভালো মুসলমান আল্লাহকে ভালোবাসে নিজের জীবনের চেয়ে বেশি এবং এ কারণেই দুনিয়ার মানুষকেও সে ভালোবাসে অনুরূপভাবে। এটা তাদের রাসুলেরও শিক্ষা। আহমদ মুসা তাদের রাসুলের মানব প্রেমের অনেক কাহিনী বলেন। তার মধ্যে একটি হলো, অন্য ধর্মের এক বৃদ্ধা রাসুল মোহাম্মদকে কষ্ট দেবার জন্যে তার চলার পথে প্রতিদিন কাঁটা বিছিয়ে রাখত। একদিন রাসুল তার চলার পথে কাঁটা দেখলেন না। তিনি বৃদ্ধের খোঁজ নিলেন। জানলেন, বৃদ্ধা অসুস্থ। সংগে সংগে রাসুল বৃদ্ধার বাড়িতে গেলেন। রাসুলের সাহায্য ও শুশ্রুসাতেই বৃদ্ধা ভালো হয়ে উঠে। আহমদ মুসা বলেন, মানুষকে ভালোবাসা আল্লাহকে ভালোবাসারই অংগ।’ থামল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
‘চমৎকার মি. জর্জ। এই আহমদ মুসা যদি মৌলবাদী হয়, তাহলে এই মৌলবাদ দুনিয়ার জন্যে সবচেয়ে বেশি কাম্য।’ বলল প্রেসিডেন্ট।
‘কিন্তু একটা জিনিস আমি বুঝতে পারি না মি. প্রেসিডেন্ট, ইসলাম প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অব্যাহত যুদ্ধের নির্দেশ দিয়েছে এবং আল্লাহর ধর্ম প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ অব্যাহত রাখতে বলেছে। ইসলামের শান্তিবাদিতার সাথে এটা মিলে কি করে?’ বলল প্রতিনিধি পরিষদের গোয়েন্দা কমিটির চেয়ারম্যান এ্যান্ড্রু জ্যাকবস।
‘কিন্তু মিঃ জ্যাকবস আমরা আলোচনা করছি আহমদ মুসাকে নিয়ে, ইসলামকে নিয়ে নয়।’
এ কথা বলে প্রেসিডেন্ট জর্জ আব্রাহাম জনসনের দিকে চেয়ে বলল, ‘মি. জর্জ, মি. জ্যাকবস যা বললেন সে ব্যাপারে আপনি কি কিছু বলবেন?’
‘ইয়েস মি. প্রেসিডেন্ট।’ বলে একটু থামল জর্জ আব্রাহাম। তারপর আবার শুরু করল, ‘আহমদ মুসা ও ইসলাম আলাদা নয়। আহমদ মুসা ইসলামেরই প্রতিকৃতি, প্রতিটি সত্যিকার মুসলমানও তাই। মি. জ্যাকবস যে বিষয়ে বলেছেন সেটা পরিভাষাগত ভুল বুঝাবুঝির ফল। ইসলাম কোন ব্যক্তি বা গ্রুপ কিংবা কোন ধর্মকে লড়াইয়ের প্রতিপক্ষ মনে করেনা। ইসলামের লড়াই জুলুম, অশান্তি ও অবিচারের বিরুদ্ধে। এ হিসেবে জালেম ও শান্তিভংগকারীরাই ইসলামের প্রতিপক্ষ। মি. প্রেসিডেন্ট, মুসলিম রাষ্ট্র আরব সীমান্তে রোমান শাসনকর্তা সুহরাবিল বহুদিন রাজত্ব করেন। ইসলামের নবী তাকে আক্রমণ করেননি, তার সাথে কোন বিরোধও বাধেনি। কিন্তু সুহরাবিল যখন বিনা কারণে আন্তর্জাতিক রীতি লংঘন করে একজন মুসলিম দূতকে হত্যা করল, তখন ইসলামের নবী এই জুলুম ও অবিচারের প্রতিকারের জন্যে যুদ্ধ যাত্রার নির্দেশ দিলেন। সুহরাবিলের অধীনে তখন লক্ষাধিক সৈন্য, কিন্তু মুসলমানরা তিন হাজারের বেশি সৈন্য যোগাড় করতে পারেনি। এরপরও ইসলামের নবী পরিণতির কথা চিন্তা না করে অবিচারের প্রতিকারকেই বড় করে দেখেন। প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ইসলামের যুদ্ধের হুকুমের অর্থ এটাই। আল্লাহর ধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্যে অব্যাহত লড়াইয়ের নির্দেশের অর্থও এই ধরনের। ইসলামে ইহকালীন ও পরকালীন শান্তি, স্বস্তি ও মুক্তির পথকেই আল্লাহর ধর্ম বলা হয়েছে। জুলুম, অশান্তি ও অবিচারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নীতি হিসাবেই ইসলাম মানুষের জন্যে শান্তি, স্বস্তি ও সুবিচারের প্রতিষ্ঠা চায় এবং এ জন্যে অব্যাহত লড়াইয়ের নির্দেশ দেয়। এ লড়াইকে তারা মানবতার জন্যে অপরিহার্য মনে করে। আর এ লড়াই কলমের লড়াই এবং বুদ্ধি ও যুক্তির লড়াই। প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে অস্ত্রের লড়াইও এর সাথে শামিল। এ অস্ত্রের লড়াইয়ের দৃষ্টান্ত সুহরাবিলের সাথে মুসলমানদের যুদ্ধ যাত্রা।’
দীর্ঘ বক্তব্যের পর থামল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
‘ধন্যবাদ মি. জর্জ। ভালো বলেছেন। দেখছি, ইসলাম যে কারণে যুদ্ধ করে তা সার্বজনীন। এ কারণে সবাই যুদ্ধ করে এবং করতে বাধ্য। ‘আল্লাহর ধর্ম’ এর যে অর্থ করেছেন তা চমৎকার। তাঁর শান্তি, সুবিচার, ইত্যাদির কথাতো সব ধর্মই বলে। তাহলে ইসলামের আলাদা বৈশিষ্ট্য কোথায়?’ বলল প্রেসিডেন্ট।
‘সব একত্ববাদী ধর্মই ঈশ্বরের। তবে ওদের দাবী হলো, ইসলাম সর্বকনিষ্ঠ ও পূর্ণাংগ। মানব জীবনের সকল বিভাগে শান্তি ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার পূর্ণাংগ দার্শনিক ও প্রায়োগিক বিধান ইসলাম দেয়, যা অন্য কোন ধর্মে নেই।’ জর্জ আব্রাহাম বলল।
‘এ বিষয়গুলো খুবই নাজুক মি. জর্জ, আসুন আমরা আমাদের আলোচনার মূল প্রসংগে ফিরে যাই। অক্টোপাশের মত যারা আমাদের আবদ্ধ করে রেখেছিল, শ্যারনের সেই ইহুদীবাদীরা শুধু আমেরিকায় নয় বাইরেও আসন গেড়ে বসে আছে। তারা প্রভাবশালীও। তাদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া অবশ্যই হবে। চাপও আসবে শ্যারনদের ছেড়ে দেবার। এ দিকটি নিয়ে আপনারা কেউ কিছু বলেননি।’ বলল প্রেসিডেন্ট।
‘মি. প্রেসিডেন্ট, এটা বড় কোন সমস্যা হবে না। আমরা জনগণের স্বার্থে কঠোর ভূমিকা গ্রহণ করবো। বিশ্ব জনমতের কাছে তাদের স্বরূপ আমরা বিস্তারিতভাবে তুলে ধরব। এর ফলে তারা আত্মরক্ষামূলক অবস্থানে যেতে বাধ্য হবে। তারা বেশি কিছু করার অবকাশ পাবে না। তারা এক সময়ের চরম অবিশ্বস্ত ও নিন্দিত অবস্থানে আবার ফিরে যেতে বাধ্য হবে।’ বলল সিনেটের ফরেন রিলেশন্স কমিটির চেয়ারম্যান বব এইচ ব্রুস।
‘সকলকে ধন্যবাদ। আমরা এখন উঠতে পারি। তার আগে মি. জর্জ বলুন, আহমদ মুসা কেমন আছেন? সুরিনামের আরেকজন লোককে উদ্ধার করেছিলেন, তার খবর কি?’ প্রেসিডেন্ট বলল।
‘আহমদ মুসা সুস্থ হয়ে উঠেছেন মি. প্রেসিডেন্ট। দু’একদিনের মধ্যেই ছাড়া পাবেন। সুরিনামের লোকটি সেখানকার সাবেক প্রধানমন্ত্রী আহমদ হাত্তা নাসুমন। দৈহিক নির্যাতন ছিল তার অসুস্থতার কারণ। সেও সুস্থ হয়ে উঠেছে। আহমদ মুসার পাশের ঘরে তাকে রাখা হয়েছে।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
প্রেসিডেন্ট সকলের দিকে একবার তাকিয়ে বলল, ‘দেখুন আমি মনে করছি, আহমদ মুসাকে মার্কিন নাগরিকত্ব অফার করা উচিত। সে যে এলাকা প্রেফার করবে সেখানে একটা বাড়িও দিতে চাই। আমি যতদূর জানি সৌদি সরকার মক্কা ও মদিনায় তাকে দু’টি বাড়ি দিয়েছে। এ ছাড়া কোন দেশে তার কিছু নেই। তার অবদান মার্কিন জাতি কোন দিন ভুলবে না। ইহুদীবাদী অক্টোপাশ আমাদেরকে আমাদের ফাউন্ডার ফাদারসদের নির্দেশিত জাতীয় লক্ষ থেকে অনেক দূর সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। সেখান থেকে আমরা ফিরে আসছি। অবশ্য সারা জেফারসনের ‘ফ্রি আমেরিকা’ এই লক্ষে আগে থেকেই কাজ করছিল। কিন্তু আহমদ মুসা না এলে, তাঁর সহযোগিতা না হলে এই কামিয়াবী আসতো না। সত্যিকার ‘ফ্রি আমেরিকা’ তার পরশ পেয়েই ধন্য হয়েছে। এই কথা মার্কিন জাতির ভোলা উচিত নয়।’ থামল প্রেসিডেন্ট।
‘আমরা মি. প্রেসিডেন্টের সাথে একমত। সবাই খুশি হবে এই প্রস্তাবে। সবচেয়ে বেশি খুশি হবে ‘ফ্রি আমেরিকা’ ও সারা জেফারসন।’ সমবেত কণ্ঠে বলে উঠল সবাই।
‘ধন্যবাদ সকলকে।’ বলেই প্রেসিডেন্ট তাকাল জর্জ আব্রাহামের দিকে। বলল, ‘সারা জেফারসন ও আহমদ মুসার সম্পর্কের ব্যাপারে মি. জর্জ কি নতুন কিছু জানেন?’
‘দু’জনই এতটা চাপা, এতটা সংযত, এতটা সতর্ক যে আমরা কিছুই জানতে পারছি না। মি. প্রেসেডিন্ট।’ বলল জর্জ আব্রাহাম।
‘মি. জর্জ ওরা দুই সাগর। পৃথক একটা সংযোগ খাল তৈরী ছাড়া ওদের মিলন হবে না। এই সংযোগের জন্যে তৃতীয় পক্ষ চাই।’ প্রেসিডেন্ট বলল।
হাসল জর্জ আব্রাহাম। বলল, ‘মি. প্রেসিডেন্টের ইচ্ছা আমি বুঝেছি। এই দায়িত্ব আমি নিলাম।’
‘সকলকে আবারও ধন্যবাদ।’ বলে প্রেসিডেন্ট উঠে দাড়াল।
উঠে দাঁড়াল সবাই।
পেন্টাগন মিলিটারী হাসপাতাল। হাসপাতালের ভিআইপি উইং।
| ← Previous | | | Next → | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »