৩২. অক্টোপাশের বিদায়

চ্যাপ্টার

নোয়ান নাবিলার চোখ দু’টি খবরের কাগজের উপর নিবদ্ধ।
গোগ্রাসে গিলছে নোয়ান নাবিলা নিউজটা।
নিউজ পড়া শেষ হয়েছে।
কিন্তু তার চোখ দু’টি উঠে আসেনি খবরের কাগজ থেকে। তার শূন্য দৃষ্টি নিবদ্ধ খবরের কাগজে। বসে আছে সে পাথরের মত স্থির হয়ে।
তার সামনে গরম চা ঠান্ডা পানি হয়ে গেছে।
নোয়ান নাবিলার শূন্য দৃষ্টিতে ফুটে উঠেছে তখন গতকাল সন্ধ্যায় তার দেখা নিউ হারমানের গণহত্যার দৃশ্য। খবরের কাগজে যা লিখেছে তার চেয়ে সহস্রগুণ ভয়াবহ তা। লাল রক্তের স্রোত এবং লাশের স্তুপ তার চোখের সামনে আবার জীবন্ত হয়ে উঠল। শিউরে উঠলো নোয়ান নাবিলা। তার গোটা সণায়ুতন্ত্রীতে জাগল একটা শীতল শিহরণ। তার সাথে তার মনে ছুটে এল প্রশ্নের এক তীর-বিদ্ধ-ধাক্কা। আহমদ মুসা এই গণহত্যা সংঘটিত করেছে? ঠান্ডা মাথায় এক এক করে এই মানুষ মারার কাজ আহমদ মুসা করেছে?
জগত জোড়া ক্রোধ, ঘৃণায় ভরে গেল নোয়ান নাবিলার মন। হিটলার যেমন ছিল, আহমদ মুসাও তো সে ধরনেরই কশাই। কিন্তু কেন? হিটলারের একটা রাজ্য ছিল, কমপক্ষে গোটা ইউরোপ নিয়ে তার রাজ্য গড়ার শখ ছিল। তাই ইহুদীদের হত্যা করে তার দেশের, জাতির, রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি নিষ্কন্টক করা তার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু আহমদ মুসা মার্কিন ইহুদীদের উপর এই গণহত্যা চালাল কিসের আশায়? কোন প্রয়োজনে?
বিস্ময়ের শেষ নেই নোয়ান নাবিলার। আহমদ মুসাই, মার্কিন ইহুদীদের আজ কাঠগড়ায় তুলেছে। তার হিংসারতো প্রশমন ঘটার কথা। কিন্তু তা না হয়ে হিংসায় আরও উদ্দীপ্ত হয়ে উঠল কি করে?
কিন্তু আহমদ মুসা কি রক্ষা পাবে?
অপরাধ সে চাপা রাখতে পারেনি। ঘটনার নিউজের সাথে তার অপরাধও প্রকাশ হয়ে পড়েছে। তাকেও আইনের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে এবং সেটা গণহত্যার দায়ে। তার বাঁচার পথ নেই।
হঠাৎ নোয়ান নাবিলা প্রচন্ড ধাক্কা খেল তার চিন্তায়। তার মনে পড়ল গতকাল বিকেলে জেনারেল শ্যারন ও উইলিয়াম জোনসের আলোচনার কথা। জেনারেল শ্যারন তাকে বলেছিল, আহমদ মুসা মার্কিন ইহুদীদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। এই গণহত্যাই কি সেই ষড়যন্ত্র? আর জেনারেল শ্যারন উইলিয়াম জোনসের সাথে আলোচনায় বলেছিলেন, বিজয়ের আনন্দে আহমদ মুসা এমন কিছু করে বসবে যাতে সে আমেরিকানদের কাছে ঘৃণার পাত্রে পরিণত হবে। ‘এমন কিছু’ বলতে কি এই ঘটনার দিকেই ইংগিত করা হয়েছিল? এই ঘটনাতো নিশ্চিতই আহমদ মুসাকে আমেরিকানদের ঘৃণার পাত্রে পরিণত করবে। দেখা যাচ্ছে জেনারেল শ্যারনের গতকাল বিকেলের বলা কথা পরবর্তী রাতেই ফলে গেল। এমন নিশ্চিত কথা তিনি বললেন কি করে? এত নিখুঁতভাবে তিনি জানলেন কি করে আহমদ মুসার ষড়যন্ত্র এবং কি ষড়যন্ত্র সেই কথাও? তাছাড়া ষড়যন্ত্রের কথা জানার পর তো প্রতিকার-প্রতিরোধের পদক্ষেপ নেয়া উচিত ছিল। তা তিনি করেননি কেন?
আরেকটি ধাক্কা খেল নোয়ান নাবিলা তার চিন্তায়। খুব বড় হয়ে তার সামনে এসে দাড়াল জেনারেল শ্যারন ও শ্যারনের দক্ষিণ হস্ত ইহুদী স্পাই মাষ্টার বেন ইয়ামিনের কথোপকথন। ওরা একটা মিশনের কথা বলেছিলেন। যে মিশনটা যাত্রা করার কথা গতকাল সন্ধ্যা ৬টায়। যে মিশনটা কোন রেসিষ্ট্যান্সের সম্মুখীন হবে না ওরা বলছিলেন। এই ‘রেসিষ্ট্যান্স হবে না’ কথাটার ব্যবহার প্রমাণ করে মিশনটা আক্রমণাত্মক। ভাবল নোয়ান নাবিলা। ওদের কথোপকথনের মাধ্যমে একথা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে, মিশনটা যেখানে যাবে সেটা ইহুদী বসতি। এবং তা পূর্ব উপকূলের প্রথম ইহুদী বসতি যেখানে দি গ্রেট ডেভিড দানিয়েল জন্মগ্রহণ করেন।
এ কথা মনে হতেই শিউরে উঠল নোয়ান নাবিলা। দি গ্রেট ডেভিড দানিয়েল তো নিউ হারমানে জন্মগ্রহণ করেন এবং নিউ হারমানই এ অঞ্চলের সবচেয়ে পুরোনো ইহুদী বসতি। ভ্রু কুঞ্চিত হলো নোয়ান নাবিলার। তাহলে কি জেনারেল শ্যারন গত সন্ধ্যায় বেন ইয়ামিনদেরকে নিউ হারমানে কোন আক্রমণাত্মক মিশনে পাঠিয়েছিলেন যা আহমদ মুসার বিরুদ্ধে আমেরিকানদের মনে ঘৃণার সৃষ্টি করবে? ভীষণ কেপে উঠল নোয়ান নাবিলার বুক। নিউ হারমানের ইহুদী বসতিতে কি বেন ইয়ামিনরাই আক্রমণ করেছিল? সেখানকার গণহত্যা কি তাদের কাজ? নোয়ান নাবিলা মরিয়া হয়ে ভাবতে চেষ্টা করল, বেন ইয়ামিনদের মিশন ছিল নিউ হারমানে আহমদ মুসাদের আক্রমণ প্রতিরোধ করা কি। কিন্তু যুক্তিটা নোয়ান নাবিলা মেলাতে পারল না। অভিযানটা নিউ হারমানে আহমদ মুসার আক্রমণ ঠেকানোর জন্যে হলে বেন ইয়ামিন কেমন করে নিশ্চিতভাবে বলেছিল যে, সেখানে কোন রেসিষ্ট্যান্স হবে না। বেন ইয়ামিনের এই কথার অর্থ হলো, নিউ হারমান থেকে তাদের অভিযানের বিরুদ্ধে কোন রেসিষ্ট্যান্স হবে না এবং এটাই প্রমাণ হয়েছে নিউ হারমানের ইহুদী অধিবাসিরা কোন রেসিষ্ট্যান্স করতে পারেনি। জেনারেল শ্যারন ও বেন ইয়ামিনের গোটা কথোপকথনে তাদের মিশন আহমদ মুসাদের বিরুদ্ধে কিংবা তাদের মিশন মোকাবিলায় আহমদ মুসার কোন ভূমিকা থাকবে তার উল্লেখ নেই। বরং যে কথাটা তাদের বক্তব্যে এসেছে সেটা হলো, এমন কিছু ঘটবে যাতে আহমদ মুসা আমেরিকানদের ঘৃণার পাত্র হবে। অন্যকথায় নিউ হারমানের গণহত্যা ঘটনার দায় আহমদ মুসার উপর বর্তাবে। সেটাই বর্তেছে। এবং জেনারেল শ্যারনাই তাদের গণহত্যার দায় চাপিয়েছে আহমদ মুসার উপর।
তাহলে নিউ হারমানের কাজ কি কোন আত্মঘাতি কাজ? জেনারেল শ্যারনরা ইহুদী স্বার্থের রক্ষক সেজে নিরপরাধ ইহুদীদের ছাগল-ভেড়ার মত করে হত্যা করল? এই প্রশ্ন নোয়ান নাবিলার গোটা সত্তা, সমস্ত সণায়ুতন্ত্রীতে যেন আগুন ধরিয়ে দিল।
হাতের কাগজটা ছুড়ে ফেলে লাফ দিয়ে উঠে দাড়াল নোয়ান নাবিলা।
অস্থিরভাবে সে পায়চারি করতে লাগল।
তার কাছে অসহনীয় হয়ে উঠেছে এই জ্বালা যে, আমাদের কম্যুনিটির শীর্ষস্থানীয় যারা কম্যুনিটির স্বার্থরক্ষার জন্যে কাজ করছে তারাই নৃশংসভাবে হত্যা করল কম্যুনিটির লোকদের। অবিশ্বাস্য এটা! কি করে এটা সম্ভব হতে পারে! তার হিসেবে কি কোন ভুল হচ্ছে? সে কি জেনারেল শ্যারন ও বেন ইয়ামিনের কথার ভুল অর্থ করছে? আসলেই বেন ইয়ামিনের মিশন নিউ হারমান না হয়ে অন্য কোথাও ছিল? আহমদ মুসাকে ঘৃণার পাত্র করার মত ঘটনা আরও কোথাও ঘটবে? নিউ হারমানের ঘটনা কি কাকতালীয়ভাবে মিলে গেছে জেনারেল শ্যারন ও বেন ইয়ামিনের কথার সাথে?
নিউ হারমানকে নিয়ে এইভাবে হাজারো কথা ভাবতে গিয়ে হঠাৎ নোয়ান নাবিলার মনে পড়ল নিউ হারমানে একজন নিহত ব্যক্তির কাছ থেকে নেয়া ভিডিও ক্যাসেটের কথা। ওতে কি আছে? কেন মৃত লোকটির হাতে ওটা ছিল?
ক্যাসেটটা জ্যাকেটের পকেটেই ছিল।
ছুটে গেল নোয়ান নাবিলা। ক্যাসেট নিয়ে ফিরে এল। ওটা কম্পিউটারে ঢুকিয়ে সুইচ অন করে সোফায় এসে বসল সে।
কম্পিউটার স্ক্রীনে দৃশ্য ফুটে উঠার সাথে সাথেই গুলীর অনেকগুলো শব্দ শুনতে পেল নোয়ান নাবিলা। শব্দগুলোর কোনটা খুব কাছের, কোনটা অপেক্ষাকৃত দূর থেকে ভেসে আসা। সেই সাথে শুনতে পেল মানুষের কান্না ও চিৎকার।
শব্দের সাথে সাথে স্ক্রীনে যে দৃশ্যটি ফুটে উঠল তাতে সে দেখল দু’জন পৌঢ় নারী পুরুষ, একজন যুবতি ও একজন শিশু একটা দরজা দিয়ে ছুটে এসে একটা বড় ঘরে প্রবেশ করল।
ঘরটি একটা বড় শোবার ঘর।
ঘরে একটা বড় খাট। ঘরের এক কোণে ছোট একটা রাইটিং টেবিল। খাটের শিয়রে দেয়ালে টাঙানো একটা পেইন্টিং। রাইটিং টেবিলের পাশে দেয়ালে একটা আলমিরা।
দৌড়ে সবচেয়ে শেষ ঘরে প্রবেশ করেছে প্রৌঢ় লোকটি। সে ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করতে চাইল। কিন্তু পারল না। এক ঝাঁক গুলী এসে দরজাটাকে ছিটকে খুলে দিল। আর গুলীর ঝাঁকে পড়ে গেল পৌঢ় লোকটি।
গুলীতে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া দেহ নিয়ে দরজাতেই পড়ে গেল লোকটি।
প্রৌঢ়ের সাথের অন্যেরা তখন মেঝেতে শুয়ে পড়েছে।
গুলী ছুড়তে ছুড়তে একজন লোক ঘরে ঢুকল। লাথি মেরে দরজার সামনে থেকে প্রৌঢ়ের লাশটি এক পাশে একটু ঠেলে দিয়ে মেঝেয় শুয়ে পড়া প্রৌঢ়া মহিলা, যুবতি ও শিশুর দিকে এগুলো। তার ষ্টেনগানের ব্যারেল একটু নিচু করে তাক করল তাদেরকে।
ওদের কারো মুখে তখন আর কান্না নেই।
ভয়ে কুঁকড়ে গেছে ওরা সবাই। ভয়ে চোখগুলো ওদের যেন বেরিয়ে আসতে চাইছে।
লোকটার ষ্টেনগানের নল গুলী বর্ষণ করল। গুলীর ঝাঁক গিয়ে ঘিরে ধরল ওদের তিনজনকে।
মুহুর্তেই রক্তের বন্যায় ডুবে গেল ওরা।
হঠাৎ মাথা ঘুরিয়ে ষ্টেনগানধারী লোকটি ডানদিকে ডাকাল এবং তীব্র কণ্ঠে বলে উঠল, ‘কোন হারামজাদার বাচ্চা তুমি দেখাচ্ছি মজা।’ তার ষ্টেনগানের নল চোখের পলকে ডানদিকে ঘুরে গেল। আর সেই সাথেই নড়ে গেল দৃশ্য। অন্তর্হিত হয়ে গেল ঘরের দৃশ্য। তার বদলে ঝড়ের বেগে একের পর এক দৃশ্য আসছে আর মিলিয়ে যাচ্ছে। কখনও দেয়ালের ছবি কখনো করিডোরের ছবি, ইত্যাদি।
বুঝা গেল ক্যামেরাম্যান পালাচ্ছে।
এক সময় দৃশ্য উঠে গেল।
অন্ধকার নেমে এল কম্পিউটার স্ক্রীনে।
এসব দেখছিল বটে নোয়ান নাবিলা। কিন্তু ষ্টেনগানধারীকে দেখার পর বিস্ময় বিস্ফোরিত নোয়ান নাবিলার শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা।
কম্পিউটার স্ক্রীনে ষ্টেনগান হাতে গুলী করতে করতে বেন ইয়ামিনকে ঘরে ঢুকতে দেখে প্রথমে ভুত দেখার মত আঁৎকে ওঠে নোয়ান নাবিলা। দৃশ্যটা তার বিশ্বাস হতে চায়নি। মনে হয়েছে সে যেন এক দুঃস্বপ্ন দেখছে।
কিন্তু দুঃস্বপ্ন তো নয়।
সে সকাল থেকে নিজের বাড়িতে বসে গত সন্ধ্যায় নিউ হারমান থেকে উদ্ধারকৃত ভিডিও ক্যাসেটটি বারবার দেখছে তার নিজের কম্পিউটার স্ক্রীনে।
আরও অবাক হলো নোয়ান নাবিলা যে, গতকাল বিকেলে জেনারেল শ্যারনের সাথে সাক্ষাতের সময় বেন ইয়ামিনকে যে কালো পোশাকে দেখেছিল, এখানে সে পোশাকেই দেখছে।
দৃশ্যটার দর্শন শুরু হলে নোয়ান নাবিলা উত্তেজিত অবস্থায় দাঁড়িয়ে পড়েছিল, এখন ধপ করে বসে পড়ল। তার দেহের সমস্ত শক্তি যেন কোথায় উবে গেল। দেহের যেন এক ফোটা ওজনও তার নেই। তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লেও এতটা বিস্মিত হতো না যতটা বিস্মিত হয়েছে সে বেন ইয়ামিনকে নিজ হাতে তার ইহুদী ভাইদের নৃশংসভাবে খুন করতে দেখে।
তার কেবলই মনে হতে লাগল, জেনারেল শ্যারন, বেন ইয়ামিনরা কারা? তাদের আসল পরিচয় কি? ওরা ইহুদী, কিন্তু কি চায় ওরা? ওরা আহমদ মুসাকে ধ্বংস করতে চায়, কিন্তু সেটা কি নিউ হারমানের নারী, শিশু বৃদ্ধ নির্বিশেষে সকলকে হত্যা করে তার দায় আহমদ মুসার ঘাড়ে চাপিয়ে? এদের তুলনায় আহমদ মুসা তো দেবতুল্য নিষ্পাপ। আহমদ মুসা এক মুসলমান হওয়া ছাড়া তার কোন অপরাধ দেখি না। সে তার জাতির জন্যে কাজ করে বটে, কিন্তু অন্য জাতির ক্ষতি করে নয়। দু’একটি ঘটনায় সে আহমদ মুসাকে নিকট থেকে দেখেছে। আহমদ মুসা আত্মরক্ষার প্রয়োজন ছাড়া কাউকে হত্যা করেনা। আহমদ মুসাকে ধরা অথবা হত্যা করার জন্যেই নাবিলা ইহুদী কমান্ডোদের নিয়ে এসেছিল ডা. বেগিন বারাকের বাড়িতে। এদিক থেকে নোয়ান নাবিলাকে আহমদ মুসা জানের শত্রু মনে করার কথা। কিন্তুও সে সাগরিকাকে বলেছে, নোয়ান নাবিলা যেটা করেছে, তার জায়গায় আমি হলে আমিও সেটাই করতাম। কোন দিক দিয়েই সে অন্যায় কিছু করেনি। আহমদ মুসার এই মানবিকতার পাশে জেনারেল শ্যারন বেন ইয়ামিনরা একেবারেই অমানুষ।
ভীষণ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠল নোয়ান নাবিলার মন। ডা. বারাক আংকেলরা ঠিকই বলেন, জেনারেল শ্যারন, ডেভিড উইলিয়াম জোনস এবং বিজ্ঞানী জন জ্যাকবরা মার্কিন ইহুদীদের জন্যে ‘শনি’ হিসাবে আবির্ভূত হয়েছেন। ওরা মার্কিন ইহুদীদের একটা পলিটিক্যাল ইউনিটে পরিণত করতে চাচ্ছে যাদের একমাত্র লক্ষ মার্কিন জনগণের উপর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা। নোয়ান নাবিলার মনে হলো, এটা অন্যায় ও অসংগত একটা অভিলাষ। অন্যায় অসংগত বলেই এই লক্ষ অর্জনের পথে নিউ হারমানের নিরপরাধ স্বজাতিকে তাদের খুন করতে হলো। ডা. বারাক ইহুদী হয়েও ঘৃণা করেন জেনারেল শ্যারনদের এবং ভালোবাসেন আহমদ মুসাকে। মনে পড়ল ডা. বারাকের কথা। তিনি বলেন, মুসলমানদের কোন ইসরাইল নেই, প্রমিজড ল্যান্ড নেই। তাই তাদের নেই কোন পিছু টান। তারা যে দেশে যায়, সে দেশেরই হয়ে যায়…………।
‘নাবিলা।’ পেছন থেকে ডেকে উঠল শশাংক সেন।
চিন্তা সূত্র ছিন্ন হয়ে গেল নোয়ান নাবিলার।
ঘুরে বসল সে।
‘হ্যালো নাবিলা কেমন আছ?’ বলে শশাংক এসে নাবিলার পাশে বসে তাকে জড়িয়ে ধরল। বলল, ‘ডার্লিং তোমাকে কিন্তু খুব বিমর্ষ দেখাচ্ছে।’
প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে নোয়ান নাবিলা বলল, ‘তুমি তো এ সময় আস না, ব্যাপার কি?’
‘তুমি খুব খুশী হবে, এমন একটা খবর তোমাকে দিতে এসেছি।’
‘কি খবর?’ বলল নাবিলা।
‘আহমদ মুসার খুব বিপদ। খবর তুমি নিশ্চয় আজকের কাগজে পড়েছো। সাগরিকা কিছুক্ষণ আগে টেলিফোনে বলল, আহমদ মুসা নিউ হারমানে গণহত্যার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়ে যাচ্ছে। এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম। ভাবলাম বলে যাই তোমাকে খবরটা।’
চমকে উঠল নোয়ান নাবিলা।
কিন্তুও নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘তোমার জন্যে এটা তো খুশীর খবর নয়।’
‘অবশ্যই না। আমি মনে করি আহমদ মুসাকে অন্যায়ভাবে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। সে এ কাজ করতেই পারে না।’
মনে আবার একটা খোঁচা খেল নোয়ান নাবিলা। অস্থির একটা ভাবনা জাগল তার মনে, কে অপরাধ করেছে, আর কে পাকড়াও হচ্ছে। এই প্রথম বারের মত আহমদ মুসার জন্যে একটা দরদের সৃষ্টি হলো নোয়ান নাবিলার মনে। সে ভাবল নিউ হারমান থেকে পাওয়া ক্যাসেটের কথা শশাংক সেনকে বলা দরকার।
মুখ খুলেছিল নাবিলা শশাংককে বলার জন্যে। এ সময় কলিংবেল বেজে উঠল।
কথা বলা হলো না নাবিলার। সে উঠে গিয়ে গেট-ইন্টারকমের সুইচে চাপ দিয়ে বলল, ‘হ্যালো ওখানে কে?’
‘গুড মর্নিং। আমি জেনারেল শ্যারন ম্যাডাম। আপনার সাথে আমার জরুরী কাজ আছে।’ ও প্রান্ত থেকে কথা ভেসে এল।
জেনারেল শ্যারনের কণ্ঠ শুনেই মুখ অন্ধকার হয়ে গেল নোয়ান নাবিলার।
কিন্তু মুহুর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে গেট ওপেনের সুইচে চাপ দিয়ে বলল ‘গুড মর্নিং স্যার। ভেতরে এসে ড্রইং-এ বসুন। আমি নিচে আসছি।’ বলে অফ করে দিল গেট-ইন্টারকম।
নোয়ান নাবিলার দিকে বিস্মিত চোখে তাকিয়ে আছে শশাংক সেন। বলল, ‘নাবিলা তোমাকে খুব বিমর্ষ ও ভীত দেখাচ্ছে। তুমি কি অসুস্থ? শশাংকের কণ্ঠে উদ্বেগ।
নাবিলা ধীরে ধীরে চোখ তুলল শশাংকের দিকে বলল, ‘বিপদ শুধু আহমদ মুসার নয়। বিপদ মার্কিন ইহুদীদেরও। জেনারেল শ্যারনদের ষড়যন্ত্র আমাদের ধ্বংস করবে। তোমাকে সব কথা বলার সময় নেই। জেনারেল শ্যারন এসেছেন, আমি নিচে যাচ্ছি।’
কথা শেষ করেই নাবিলা কম্পিউটারের দিকে এগুলো। কম্পিউটার থেকে একটা ক্যাসেট বের করে শশাংকের দিকে তুলে ধরে বলল, ‘এই ক্যাসেটটা নাও। ক্যাসেটটা সাগরিকা অথবা আহমদ মুসার হাতে পৌছাতে হবে। মনে রেখ? এই ক্যাসেটের মুল্য আমার, তোমার জীবনের চেয়ে অনেক বেশী।’
নোয়ান নাবিলার অবস্থা দেখে শশাংকের মুখে বিস্ময় লেগেই ছিল। এবার সেখানে উদ্বেগ দেখা দিল। বলল, ‘এত মুল্যবান জিনিস। তাড়াহুড়া কেন। তুমিই ওদের কাছে এটা পৌছে দিও। আমি অন্য এক জায়গায় যাবার জন্যে বেরিয়েছি।’
নোয়ান নাবিলার চোখ-মুখ উদ্বেগে ভরে গেল। বলল, ‘না শশাংক। ক্যাসেটটা নিয়ে এক্ষনি তোমাকে চলে যেতে হবে। হঠাৎ করে এখানে এ সময় জেনারেল শ্যারনের আগমনের কারণ বুঝতে পারছি না। আমার ভয় করছে। জেনারেল শ্যারন যে কোন মুল্যে এই ক্যাসেট হাত করতে চাইবে। তুমি এই মুহুর্তে ক্যাসেটটি এই বাড়ি থেকে সরিয়ে নিয়ে যাও।’
শশাংকের চোখেও ভয়ের চিহ্ন ফুটে উঠল। বলল, ‘তোমার কোন বিপদ হবে না তো?’
‘আমি কিছুই বুঝতে পারছি না শশাংক। যাই হোক। আহমদ মুসাকে এবং মার্কিন ইহুদীদের বাঁচাতে হবে। ক্যাসেট তুমি তাড়াতাড়ি আহমদ মুসার হাতে পৌছাও।’
‘আমিও তোমার কিছুই বুঝতে পারছি না নাবিলা।’
‘ক্যাসেটটি আহমদ মুসাকে দাও, উনিই সব বুঝিয়ে দেবেন। যাও তুমি, আমি নিচে নামার আগেই তোমাকে বেরিয়ে যেতে হবে।’ অনুনয়ের সুরে বলল নোয়ান নাবিলা।
ক্যাসেটটি হাতে নিয়ে নোয়ান নাবিলার দিকে একবার গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘যাচ্ছি ডার্লিং। গড ব্লেস ইউ।’
শশাংক ঘুরে দাঁড়িয়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
শশাংক বেরিয়ে যাবার কিছু পরে নোয়ান নাবিলা নিচে নেমে এল।
সিড়ি মুখের বিরাট হল ঘরটাই ড্রইং রুম।
‘দুঃখিত স্যার। একটু ঝামেলায় ছিলাম। সেরে আসতে দেরী হলো।’ মুখে হাসি টেনে বিনয়ের সাথে বলল নোয়ান নাবিলা।
‘না, না। অল রাইট। আমিই বরং অসময়ে বিনা নোটিশে এসে গেছি। এটা ঠিক হয়নি। কিন্তু কি করব জরুরী পরিস্থিতি তো!’ বলল জেনারেল শ্যারন।
জেনারেল শ্যারনের কথায় পুরান অস্বস্তিটা বাড়ল নোয়ান নাবিলার।
ভেতরের ভাবটা চেপে নাবিলা বলল, ‘বলুন স্যার। নিশ্চয় কোন জরুরী ব্যাপার?’
‘নাবিলা, আমরা নিউ হারমানের ব্যাপারে তথ্য যোগাড় করতে শুরু করেছি। খবর পেয়েছি, শয়তান আহমদ মুসা জঘন্য গণহত্যা সংঘটিত করার পর তুমিই প্রথম নিউ হারমানে গেছ সেই জন্যেই তোমার কাছে ছুটে এসেছি। তোমার কাছ থেকে কিছু জানা দরকার।’
‘হ্যাঁ, আপনার ওখান থেকে বেরিয়ে একজন ফ্রেন্ডের বাসায় গিয়েছিলাম। সেখান থেকে বাসায় ফেরার পথে ঐ ঘটনার মুখে পড়েছিলাম।’ খুব সহজ কণ্ঠে বলল নোয়ান নাবিলা।
‘তুমি কি দেখলে, কি বুঝলে, তোমার এই কথাগুলো আমাদের জন্য খুবই মুল্যবান।’ জেনারেল শ্যারন শান্ত ও উদগ্রীব কণ্ঠে বলল।
নোয়ান নাবিলা ভাবল, ধড়িবাজ শ্যারনের লোকরা হয়তো তাকে দেখে থাকবে, এমনকি তাকে হয়তো ফলোও করেছে। সবই তারা দেখেছে। এখন তাকে বাজিয়ে দেখতে এসেছে, আমি তাদেরকে কতটুকু দেখেছি। সুতরাং তার সব কথাই বলা দরকার। এই চিন্তা করে নোয়ান নাবিলা বলল, ‘দু’একটা গুলীর শব্দ ও চিৎকারের শব্দে আমি গাড়ি থামাই। যেহেতু শব্দগুলো নিউ হারমানের বিভিন্ন দিক থেকে আসছিল। আমার সন্দেহ হওয়ায় গাড়ি থেকে নামি। এই সময় নিউ হারমানের বিভিন্ন স্থান থেকে কয়েকটা গাড়িকে আমি দ্রুত বের হয়ে যেতে দেখি। এর পরই দেখতে পাই, একজন লোক টলতে টলতে রাস্তার দিকে এগিয়ে আসছে। দেখে আমার মনে হলো, লোকটি আহত। আমি দ্রুত তার দিকে এগুলাম। কিন্তু আমি তার কাছে পৌছার আগেই সে মাটিতে পড়ে গেল। আমি ছুটে গিয়ে তার কাছে যখন বসলাম তখন তার দেহ নিশ্চল-নিথর। আমি হাত দিয়ে পরীক্ষা করে বুঝলাম যুবকটি মারা গেছে। সে ছিল গুলী বিদ্ধ।
আমি উঠে দাড়ালাম। সেই সময় আমার চোখে পড়ল, যুবকটির ডান হাত সামনের দিকে ছড়ানো। তার হাতে একটি ক্যাসেট……………।’
নোয়ান নাবিলার মুখের কথা শেষ না হতেই জেনারেল শ্যারন দ্রুত কণ্ঠে বলে উঠল, ‘ক্যাসেট?’
নোয়ান নাবিলা ধীর কণ্ঠে বলল, ‘হ্যা ক্যাসেট।’
‘ক্যাসেট তোমার কাছে?’ হাতে আকাশের চাঁদ পাওয়ার মত বলে উঠল জেনারেল শ্যারন।
‘বলছি।’
বলে নোয়ান নাবিলা আবার শুরু করল, ‘গুলীর শব্দ শোনা চিৎকার, তারপর এই যুবককে গুলীবিদ্ধ দেখে আমার আন্টির কথা মনে……।’
‘এসব কথা পরে শুনব, আগে বল ক্যাসেটটা কোথায়, তোমার কাছে?’ জেনারেল শ্যারন নোয়ান নাবিলার কথায় বাধা দিয়ে বলে উঠল। তার অধৈর্য্য কণ্ঠ।
এই ভাবে বাধা পেয়ে নোয়ান নাবিলা বিব্রত হয়ে পড়েছিল। তাছাড়া জবাবে কি বলবে, সেটাও রেডি ছিল না। কি বলবে তা ঠিক করতে একটু সময় গেল। বলল সে, ‘আমি ওটা পুলিশকে দিয়েছি। আমি আহত আন্টিকে নিয়ে ফেরার পথে পুলিশ আমাকে আটকেছিল। আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল। আমি তাদের ক্যাসেট দিয়ে বলেছিলাম। একজন মুমুর্ষ লোক মনে হয় এটা কাউকে পৌছবার চেষ্টা করছিল। আমার মনে হয়েছিল পুলিশের ওটা কাজে লাগতে পারে।’
ক্রোধে জেনারেল শ্যারনের চোখ মুখ লাল হয়ে উঠেছিল। ক্রোধ ও ক্ষোভের একটা তীব্র ঝড় এক সাথে তার ভেতর থেকে বের হতে যাচ্ছিল। ফলে সে প্রায় বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিল। মুহূর্ত কয়েক পরে বলল, ‘পুলিশকে দিয়েছ? পুলিশের নাম চেহারা মনে আছে?’ গর্জন করে উঠল জেনারেল শ্যারনের কণ্ঠ।
‘চারদিকের অবস্থায় তখন আমি দারুণ ভীত। আহত আন্টিকে নিয়ে ব্যস্ত। তার উপর পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করায় আমি আরও বিব্রত হয়ে পড়েছিলাম। মনের এ অবস্থা নিয়ে আমি পুলিশের মুখের দিকে মাত্র একবার তাকিয়েছিলাম। তার চেহারা আমার মনে নেই।’ কথাটা এইভাবে বলতে পেরে খুশি হলো নোয়ান নাবিলা। মিথ্যাটা সত্যের মতই হয়েছে।
নোয়ান নাবিলার কথা শুনে মুখটি চুপসে গেল জেনারেল শ্যারনের। উদ্বেগের চিহ্নও তার চোখে-মুখে স্পষ্ট হয়ে উঠল। বলল, ‘ঐ মৃত লোকটি একজন সাংবাদিক। ঐ ক্যাসেটে শয়তান আহমদ মুসাদের সম্পর্কে জীবন্ত সাক্ষ্য পাওয়া যাবে। ক্যাসেটটা আমাদের অবশ্যই চাই। নিউ হারমানে গতকাল যেসব পুলিশ অফিসার গিয়েছিল, তাদের যদি ছবি দেখ বলতে পারবে না?’
‘বলা মুষ্কিল। একেতো রাত, তার উপর তার মাথায় হ্যাট ছিল। হ্যাটের ছায়া ছিল তার চোখে-মুখে। উপরন্তু মুখটা তার আমি ভাল করে দেখিনি।’ দ্বিধাগ্রস্ত কণ্ঠে বলল নোয়ান নাবিলা।
‘না তাকে খুঁজে পেতেই হবে নাবিলা এবং আজকেই। তুমি তার কণ্ঠ শুনলে অবশ্যই চিনতে পারবে।’ কণ্ঠটা কঠোর শুনাল জেনারেল শ্যারনের।
কথা শেষ করেই জেনারেল শ্যারন তার হাতের মোবাইলে একটা কল করল।
তারপর মোবাইলটা কানে তুলে নিয়ে বলল, ‘গুড মর্নিং বেন ইয়ামিন। শুন, গতকাল যে পুলিশ অফিসাররা নিউ হারমানে গিয়েছিল, তাদের সবার কণ্ঠ আমাদের দরকার। কারা গিয়েছিল তা তো আমরা জেনেই গেছি। আমাদের অডিও লাইব্রেরীতে যদি তাদের কণ্ঠ না থাকে, তাহলে পুলিশ রেকর্ড থেকে এখনি তোমাকে যোগাড় করে আনতে হবে। পারবে না?’
‘অবশ্যই। রেকর্ড কিপার অফিসার আমাদের লোক। বলে দিচ্ছি। আপনি এলেই পেয়ে যাবেন।’ বলল ওপার থেকে বেন ইয়ামিন।
‘ধন্যবাদ বেন। আমি আসছি। বাই।’
বলে জেনারেল শ্যারন মোবাইল অফ করে দিয়ে তাকাল নোয়ান নাবিলার দিকে। বলল, ‘নাবিলা, তোমাকে যেতে হবে আমার সাথে।’ তার কণ্ঠে সুস্পষ্ট নির্দেশ।
নোয়ান নাবিলার মুখ চুপসে গেল। ভয়ও পেল সে। বলল সে, ‘কিন্তু স্যার। এখন তো আমার যাওয়া হবে না।’
‘না, কোন কথা নয়। তোমাকে যেতেই হবে।’ গর্জন করে উঠল যেন জেনারেল শ্যারনের গলা।
‘আমার আব্বা আম্মা দু’জনেই সকালে বাইরে গেছেন, তারা না ফেরা পর্যন্ত……..।’ কথা শেষ না করেই থেমে গেল নোয়ান নাবিলা। ভয় মিশ্রিত তার কণ্ঠ।
‘না নাবিলা। এখনি আমার সাথে তোমাকে যেতে হবে। এখন প্রতিটি সেকেন্ড আমাদের কাছে এক একটি বছর।’
বলে উঠে দাড়াল জেনারেল শ্যারন।
শুধু ভয় পাওয়া নয়, ভেতরটা তখন কাঁপতে শুরু করেছে নোয়ান নাবিলার। তার চোখে ফুটে উঠেছে নিউ হারমান হত্যার দৃশ্য। নাবিলার চোখে জেনারেল শ্যারনরা কশাই ছাড়া আর কিছুই নয়। তার মিথ্যা ধরা পড়লে তাকে হত্যা করতে এক মুহুর্তও দেরী করবে না।
আনমনা হয়ে পড়েছিল নোয়ান নাবিলা।
জেনারেল শ্যারন তাকে হাত ধরে টেনে তুলল। বলল, ‘এক মুহূর্তও আমি দেরী করতে পারছি না।’
নোয়ান নাবিলা শংকিত হয়ে পড়ল। তাকে জেনারেল শ্যারন জোর করেই নিয়ে যাবে। নিজের ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বেগ বোধ করল নোয়ান নাবিলা। হঠাৎ তার মাথায় একটা চিন্তা ঝিলিক দিয়ে উঠল, তাকে যেখানে যেখানে নিয়ে যেতে পারে, তার ঠিকানা শশাংকের কাছে রেখে যাওয়া দরকার। তাহলে উপরে গিয়ে তাকে টেলিফোন করতে হবে মোবাইলে। এবার মনে একটু সাহস ফিরে পেল সে। বলল, ‘স্যার, আপনি একটু দাঁড়ান। আমি কাপড় পাল্টে আসি।’
নোয়ান নাবিলার পরণে তখনও ব্রেকফাস্টের পোশাক। সুতরাং জেনারেল শ্যারন সময় দিতে আপত্তি করল না।
নোয়ান নাবিলা উপরে উঠে গেল।

ডা. বেগিন বারাক ও সাগরিকা সেন পাথরের মত বসেছিল।
শশাংক প্রবেশ করল।
শশাংককে দেখেই সাগরিকা সেন বলে উঠল, ‘শশাংক আহমদ মুসাকে এফবিআই পুলিশরা গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেল।’ ভারী কণ্ঠস্বর সাগরিকা সেনের।
শশাংক সাগরিকা সেনের পাশে বসতে বসতে বলল, ‘আমি কিছু বুঝতে পারছি না দিদি। ওদিকে জেনারেল শ্যারন নাবিলাকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে গেল।’ শুষ্ক কণ্ঠে বলল শশাংক সেন।
‘জেনারেল শ্যারন নাবিলাকে ধরে নিয়ে গেল? অবিশ্বাস্য কথা বলছ তুমি শশাংক।’ বিস্মিত কণ্ঠে বলল সাগরিকা সেন।
‘অবিশ্বাস্য, কিন্তু সত্য দিদি। একটা ভিডিও ক্যাসেটের সন্ধানে এসেছিল জেনারেল শ্যারন নাবিলার কাছে। তার আসার কথা জানতে পেরেই নাবিলা তাড়াতাড়ি ক্যাসেটটি আমার হাতে পাঠিয়ে দিয়েছে তোমাকে অথবা আহমদ মুসাকে দেবার জন্যে। ক্যাসেটটি উদ্ধারের জন্যে নাবিলাকে জেনারেল শ্যারন ধরে নিয়ে গেছে।’
‘ক্যাসেটে কি আছে শশাংক?’ বিস্মিত কণ্ঠে দ্রুত জিজ্ঞেস করল সাগরিকা সেন।
‘জানি না। জেনে নেবার সময়ও দেয়নি আমাকে নাবিলা। তবে নাবিলা বলেছে, তার ও আমার জীবনের চেয়েও ক্যাসেটটি মুল্যবান। জেনারেল শ্যারন যে কোন মুল্যে ক্যাসেটটি উদ্ধার করতে চাইবে।’ শশাংক বলল।
ভ্রুকুঞ্চিত হলো সাগরিকা সেন ও ডা. বেগিন বারাকের। উদগ্রীব কণ্ঠে ডা. বারাক বলল, ‘ক্যাসেট কাকে দিতে বলেছে, সাগরিকা বা আহমদ মুসাকে?’
‘হ্যাঁ।’ বলল শশাংক।
‘তাহলে ওতে সাংঘাতিক কিছু আছে সাগরিকা।’ ডা. বারাক বলল।
‘আমারও তাই মনে হয়। চলুন ক্যাসেটে কি আছে দেখা যাক।’ বলল সাগরিকা সেন।
তারা উঠে এল কম্পিউটার টেবিলে।
শশাংক কম্পিউটার চালু করে দিয়ে ক্যাসেটটা কম্পিউটারে সেট করে তারপর সাগরিকা সেনের পাশে এসে বসল।
নিউ হারমানের সেই দৃশ্যাবলী কম্পিউটার স্ক্রীনে একের পর এক ফুটে উঠতে লাগল।
ঘরে পিনপতন নিরবতা।
ওরা গোগ্রাসে গিলছে দৃশ্যগুলো।
এক সময় নিরবতা ভেঙে খান খান হয়ে গেল ডা. বারাকের চিৎকারে। সে চিৎকার করে বলে উঠল, ‘গুলী করছে ঐ লোকটি বেন ইয়ামিন। জগৎবিখ্যাত ইহুদী গোয়েন্দা। জেনারেল শ্যারনের দক্ষেণ হস্ত।’ উত্তেজিত কণ্ঠস্বর ডা. বারাকের।
ডা. বারাকের উত্তেজিত কণ্ঠ আবার ধ্বনিত হলো, ‘ঘটনা কোথাকার? নিউ হারমানের?’
চমকে উঠল সাগরিকা ও শশাংক সেন দু’জনেই। তারা এক সাথেই মাথা ঘুরিয়ে তাকাল ডা. বারাকের দিকে। বলল তারা দু’জনেই বিস্ময়মিশ্রিত দ্রুত কণ্ঠে, ‘নিউ হারমানের? তাহলে যে বললেন গুলী করছে ইহুদী গোয়েন্দা, জেনারেল শ্যারনের লোক!’
‘আমি ঠিক ঠিক বলতে পারছি না দৃশ্যগুলো নিউ হারমানের কিনা। কিন্তুও খবরের কাগজে নিউ হারমানের হত্যাকান্ডের যে বিবরণ বেরিয়েছে, তার সাথে দৃশ্যগুলো মিলে যায়।’ ডাক্তার বারাকের কন্ঠ শুষ্ক ও উত্তেজিত। চোখে-মুখে তার বিস্ময় বিমূঢ় ভাব।
কোন কথা বলতে পারল না সাগরিকা ও শশাংক। প্রশ্ন ঠিকরে বেরুচ্ছে তাদের চোখ-মুখ থেকেও।
ডাক্তার বারাকই আবার বলে উঠল, ‘ঘটনা কোথাকার নাবিলা জানত এবং সে জন্যেই ক্যাসেটটি আহমদ মুসার কাছে পাঠিয়েছে। এ থেকে প্রমাণ হয় ক্যাসেটটি আহমদ মুসার খুবই প্রয়োজন। অন্যদিকে জেনারেল শ্যারনও ক্যাসেটটি যে কোন মূল্যে পেতে চায় এবং ক্যাসেট উদ্ধারের জন্য নাবিলাকে পর্যন্ত ধরে নিয়ে গেছে। আর এই ঘটনা ঘটেছে নিউ হারমানের ঘটনার একদিন পরে। সুতরাং নিউ হারমানের ঘটনার সাথে এই ক্যাসেটের সম্পর্ক আছে আমরা ধরে নিতে পারি।’
‘এর অর্থ কি দাঁড়ায় ডাক্তার আংকেল? প্রশ্ন করল শশাংক। তার কণ্ঠে উত্তেজনা।
বিস্ময় বিমূঢ় ভাব আরও গভীর হয়ে উঠল ডাক্তার বারাকের চোখে-মুখে। বলল, ‘অর্থ পরিষ্কার জেনারেল শ্যারনরা খুন করেছে আমাদের একটি ইহুদী বসতির কিছু নিরপরাধ মানুষকে।’
‘কেন করেছে? উদ্দেশ্য কি?’ বলল শশাংক।
ডা. বারাকের মনে পড়ল জর্জ আব্রাহামকে বলা আহমদ মুসার কথা। আহমদ মুসার কথার পুনরাবৃত্তি করে ডাক্তার বারাক বলল, ‘নিজেদের নাক কেটে আহমদ মুসার যাত্রা ভংগ করতে চেয়েছে। আহমদ মুসার ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করতে সমর্থ হয়েছে।’
‘তাহলে তো এই ক্যাসেট অবিলম্বে ওয়াশিংটনে আহমদ মুসা বা জর্জ আব্রাহাম জনসনের হাতে পৌছাতে হয়।’ বলল দ্রুত কণ্ঠে সাগরিকা সেন।
‘অবশ্যই সাগরিকা। আমরা এখনই রওয়ানা হতে পারি।’ ডাক্তার বারাক বলল সোজা হয়ে বসে।
‘আমিও যাব।’ বলল শশাংক।
‘হ্যা, তোমাকে যেতেই হবে, তুমিই ক্যাসেট এনেছ নাবিলার কাছ থেকে।’ সাগরিকা সেন বলল।
উঠে দাড়াল ডাক্তার বারাক। বলল, ‘আমি গাড়িটা ঠিকঠাক করে নিচ্ছি। তোমরা এস।’
দশ মিনিটের মধ্যেই ডাক্তার বারাকের গেট দিয়ে একটা গাড়ি বেরিয়ে এল। গাড়ির ড্রাইভিং সিটে শশাংক। তার পাশের সিটে ডা. বারাক। পেছনের সিটে বসেছে সাগরিকা সেন।
ওয়াশিংটন-আনাপোলিশ ফ্রি ওয়ে ধরে ঝড়ের গতিতে চলেছে গাড়িটি।
ডিষ্ট্রিক্ট অব কলামবিয়া অর্থাৎ ওয়াশিংটনে প্রবেশের আগে মেরিল্যান্ডের শেষ শহর হলো শিভারলী।
শিভারলীতে ঢুকতে যাচ্ছে ডা. বারাকের গাড়ি। ফ্রিওয়ের লেনের বাইরে ফুটপাতের উপর একটা গাড়ি দাড়িয়েছিল। গাড়ির গায়ে ঠেস দিয়ে দাড়িয়েছিল একজন লোক।
ডা. বারাকের গাড়ি কাছাকাছি আসতেই লোকটি হাত তুলল।
শশাংক ডা. বারাকের দিকে একবার তাকিয়ে গাড়ি দাড় করাল ফুটপাতে দাঁড়ানো গাড়ির পাশে।
শশাংকরা দেখল গাড়ির ভেতরে আরও তিনজন লোক। তাদের একজনের হাতে দূরবীন।
শশাংক গাড়ি দাড় করাতেই গাড়ি থেকে আরও একজন লোক বেরিয়ে এল। চোখের পলকে তারা দু’জন ডা. বারাকের গাড়ির দু’পাশে এসে দাঁড়াল। শশাংকরা কিছু বুঝে উঠার আগেই দু’জন দু’পাশ থেকে সাগরিকার দু’পাশে উঠে এসে বসল।
বসেই দু’জন রিভলবার বের করে একজন তাক করল ড্রাইভিং সিটে বসা শশাংককে। বলল তাকে লক্ষ করে, ‘চালাও গাড়ি।’
কি ঘটতে যাচ্ছে শশাংক বুঝতে পেরেছিল। লোকটির কথা শেষ হবার আগেই শশাংক দেহটাকে গুটিয়ে সিটের আড়ালে নিয়ে গাড়ির দরজা খুলে বাইরে গড়িয়ে পড়ল।
পেছনে যে লোকটি শশাংকের দিকে রিভলবার তাক করেছিল সে বুঝতে পারল ড্রাইভিং সিটের লোকটি পালাল। সেও দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে পড়ল এবং এগুলো শশাংকের দিকে।
শশাংক পড়ে গিয়ে পা গুটিয়ে ছিল। ভাবটা এই রকম যেন সে ভীষণ ভয় পেয়েছে।
লোকটি কাছাকাছি আসতেই শশাংক গুটানো পা স্প্রিঙের মত পেছনে ঠেলে আঘাত করল লোকটির পায়ের গোড়ালির উপরের জায়গাটায়।
লোকটি অপ্রস্তুত ছিল। এই আঘাত খেয়ে লোকটি পড়ে গেল।
সংগে সংগে শশাংক লোকটির হাতের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে রিভলবার কেড়ে নিল।
রিভলবার হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়েই শশাংক দেখল পাশের গাড়ি থেকে দু’জন রিভলবার হাতে নিয়ে বেরিয়ে আসছে।
ঠিক এই সময়েই পুলিশের একটা গাড়ি শশাংকের গাড়ির ঠিক পেছনে এসে দাঁড়াল এবং সংগে সংগেই দু’জন পুলিশ রিভলবার বাগিয়ে বেরিয়ে এল।
পুলিশের গাড়ি দেখে পাশের গাড়ির যে দু’জন রিভলবার হাতে বেরিয়ে আসছিল তারা আবার গাড়িতে উঠে গাড়ি ষ্টার্ট দিয়ে ছুটতে লাগল।
পুলিশের গাড়ি দেখে পাশের গাড়ির যে দু’জন রিভলবার হাতে বেরিয়ে আসছিল তারা আবার গাড়িতে উঠে গাড়ি ষ্টার্ট দিয়ে ছুটতে লাগল।
আর শশাংকের সামনে মাটিতে পড়ে যাওয়া লোকটি উঠে দাঁড়িয়ে দৌড়ে পালাতে লাগল। রিভলবার হাতে যে লোকটি গাড়িতে সাগরিকা ও ডাক্তার বারাককে পাহারা দিচ্ছিল, সেও গাড়ি থেকে বেরিয়ে দৌড় দিল।
পুলিশ দু’জন ফাকা ফায়ার করে উচ্চ স্বরে আদেশ দিল, এরপরও পালাতে চেষ্টা করলে গুলী করব।
লোক দু’টি দাঁড়িয়ে গেল।
পুলিশ দু’জন এগিয়ে গিয়ে লোক দু’টির হাতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে তাদের গাড়িতে নিয়ে এল।
ততক্ষণে ডা. বারাক ও সাগরিকা গাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিল। ডা. বারাক পুলিশকে তাদের পরিচয় দিল এবং বলল, ‘ওরা হাত তুলে আমাদের গাড়ি থামিয়ে আকস্মিকভাবে আমাদের গাড়িতে উঠে রিভলবার বাগিয়ে তাদের নির্দেশ মত গাড়ি চালাবার হুকুম দিয়েছিল। শশাংকের বুদ্ধিতে ওরা বাধা পায়। আপনারা এসে আমাদের বাঁচিয়েছেন। অনেক ধন্যবাদ আপনাদের।’
‘স্যার কারণ কি বলুন তো? আপনাদের এরা চেনে? না, এটা কোন ছিনতাই-এর ঘটনামাত্র?’ একজন পুলিশ বলল।
ডা. বারাক সংগে সংগে জবাব দিল না। একটু চিন্তা করে বলল, ‘নিছক কোন ছিনতাই-এর ঘটনা নয় বলেই আমার বিশ্বাস। কোন বড় কারো দ্বারা নিয়োজিত লোক এরা হতে পারে। ওদের একজনের হাতে দূরবীন ছিল। ওরা আগে থেকে দেখে-শুনেই আমাদের গাড়ি থামিয়েছে। আমরা এফবিআই চীফ আব্রাহাম জনসনের কাছে যাচ্ছি। আমাদের বাধা দেয়াই ওদের লক্ষ হতে পারে বলে আমার মনে হচ্ছে।’
এফবিআই চীফের কাছে যাওয়ার কথা শুনে পুলিশ অফিসারটি নড়ে-চড়ে দাঁড়াল। একটু সমীহের সুরে বলল, ‘স্যার, তাহলে এদেরকে একটি ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে অপহরণ ও হত্যা প্রচেষ্টা’র অভিযোগে গ্রেপ্তার দেখাতে পারি। অভিযোগকারী হিসাবে আপনাদের নাম থাকবে।’
‘ঠিক আছে।’
‘ধন্যবাদ। চলুন স্যার, আপনাদের পৌছে দিয়ে আমরা অফিসে ফিরব।’ বলল পুলিশ অফিসারটি।
‘কিন্তু এর কি দরকার হবে?’
‘স্যার, যা ঘটেছে তার পরিপ্রেক্ষেতে এটাকে আমরা আমাদের দায়িত্ব মনে করছি। ওদের দু’জন পালাতে পেরেছে বলেই এই প্রয়োজনটা আমরা বেশি অনুভব করছি।’
‘ধন্যবাদ অফিসার, চলুন।’
সবাই গাড়িতে উঠল। চলতে শুরু করল গাড়ি।
আগে ডা. বারাকের গাড়ি, পেছনে চলছে পুলিশের গাড়ি।
‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ আংকেল। আপনি ঠিকই বলেছেন ক্যাসেটের ঘটনার সাথে এর সম্পর্ক আছে।’ ডা. বারাকের দিকে চেয়ে বলল সাগরিকা সেন।
‘কিভাবে সেটা সম্ভব দিদি? আমরা সন্দেহের মধ্যে পড়ব কেন? বলল শশাংক।
‘নাবিলার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে জেনারেল শ্যারন তোমাকে দেখেছে না?’ সাগরিকা বলল।
‘দেখেছে।’ বলল শশাংক।
‘জেনারেল শ্যারন তোমাকে চেনে না?’
‘চেনে’
‘সুতরাং অবস্থার প্রেক্ষিতে নাবিলার পর দ্বিতীয় সন্দেহ তোমাকে করবে। তাছাড়া, কোন চাপে পড়ে নাবিলা তোমার নাম বলে দিতে বাধ্য হতে পারে।’
মুখ শুকনো হয়ে গেল শশাংকের। উদ্বেগ ফুটে উঠল তার চোখে-মুখে। বলল, ‘তা হতে পারে দিদি?’
‘ইচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক আমরা একটা বড় যুদ্ধে জড়িয়ে গেছি শশাংক।’ বলল ডা. বারাক।
‘ওরা কি নাবিলার সাথে খারাপ ব্যবহার করবে?’ শশাংকের কণ্ঠে উদ্বেগ।
‘ভেব না শশাংক, ঈশ্বর আছেন।’ সান্তনার সুরে বলল সাগরিকা সেন।
‘ওরা কিন্তু আমাদের আব্বাকে এবং আমাদের ইন্ডিয়ান-আমেরিকান কম্যুনিটিকে ব্যবহার করছে দিদি। এটা আমরা হতে দিতে পারি না।’ ক্ষুব্ধ কণ্ঠ শশাংকের।
‘জেনারেল শ্যারন ও ইহুদীবাদীরা মার্কিন ইহুদীদেরও ব্যবহার করছে শশাংক।’ বলল ডা. বারাক।
‘তবু তারা একই কম্যুনিটি ভুক্ত। কিন্তু ইন্ডিয়ান-আমেরিকান কম্যুনিটি তাদের স্বার্থের বলি হবে কেন?’ শশাংক বলল।
‘কারণ ইহুদীবাদীদের আধিপত্যবাদী অভিলাষের সাথে ইন্ডিয়ান-আমেরিকান কম্যুনিটির অনেকের আকাঙ্খার মিল আছে।’ বলল ডা. বারাক।
‘আমাদের আব্বাও কি এই আকাঙ্খা পোষণ করেন?’ শশাংক বলল।
‘এই প্রশ্নের উত্তর তুমি দাও সাগরিকা?’ ডা. বারাক সাগরিকাকে উদ্দেশ্য করে বলল।
‘নিজের স্বার্থ দেখা মানুষের একটা প্রকৃতি। এই প্রকৃতি ইন্ডিয়ান-আমেরিকান কম্যুনিটির আছে। আব্বারও আছে। স্বার্থের একটা ঐক্য ইহুদীবাদীদের সাথে ইন্ডিয়ান-আমেরিকান কম্যুনিটির রয়েছে। কিন্তু আব্বা ইহুদীবাদীদের কোন ষড়যন্ত্রে যুক্ত আছেন বলে আমি বিশ্বাস করি না। ওদের বিপদে আব্বা সাহায্য করেছেন মাত্র।’ বলল সাগরিকা সেন।
‘আমারও তাই বিশ্বাস সাগরিকা।’ ডা. বারাক বলল।
ডা. বারাক থামল।
কোন কথা কেউ বলল না।
সবার দৃষ্টি সামনে। এফবিআই হেড কোয়ার্টার প্রায় এসে গেছে। চলছে দু’টি গাড়ি পরপর একই গতিতে।

জর্জ আব্রাহাম জনসনের অফিস কক্ষ।
জর্জ আব্রাহাম তার চেয়ারে বসে।
তার টেবিলের সামনে বসে আছে পুলিশ প্রধান বিল বেকার, আহমদ মুসা, সাগরিকা সেন, শশাংক ও ডা. বেগিন বারাক।
টেবিলের এক পাশে কম্পিউটার স্ক্রীনে ডা. বারাকদের নিয়ে আসা ভিডিও ক্যাসেটের শেষ দৃশ্য এই মাত্র কম্পিউটার স্ক্রীন থেকে মিলিয়ে গেল।
ঘরে পিনপতন নিরবতা।
জর্জ আব্রাহাম জনসন ও পুলিশ প্রধান বিল বেকারের চোখে-মুখে আনন্দের উজ্জ্বল্য ঝিকমিক করে উঠেছে। আহমদ মুসার চেহারা ভাবলেশহীন।
ডা. বারাক, সাগরিকা ও শশাংক তাকিয়ে আছে এখন তাদের মুখের দিকে।
‘ধন্যবাদ ডা. বারাক, সাগরিকা ও শশাংক। অনেক ধন্যবাদ আপনাদের সর্বকালের জঘন্য এক ষড়যন্ত্রের মুখোশ উন্মোচনে আপনারা সাহায্য করেছেন।’ নিরবতা ভেঙে প্রথম কথা বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
‘ধন্যবাদ নাবিলার প্রাপ্য। সে নিজেকে বিপদের মধ্যে ঠেলে দিয়ে এই কাজ করেছে।’ বলল ডা. বারাক।
‘ঠিক বলেছেন ডাক্তার বারাক। সে মিত্র পক্ষের বিরুদ্ধে যাবার ঝুঁকি নিয়ে নিজের কম্যুনিটি ও নিজ দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছে। এই ভিডিও ক্যাসেট না পেলে জঘন্য ষড়যন্ত্রের মুখোশ উন্মোচনের আর কোন পথ ছিল না। নিরপরাধ হয়েও আহমদ মুসা শুধু নয়, মুসলমানদের ঘাড়ে সর্বকালের জঘন্য এক অপরাধের দায় চেপে বসত।’
‘বেন ইয়ামিনকে দেখে ঘটনার সাথে জেনারেল শ্যারন ও ইহুদীবাদীদের জড়িত থাকার কথা বুঝা গেল, কিন্তু দৃশ্যের ঘটনা যে নিউ হারমানের তা কি করে প্রমাণ হবে?’ বলল ডা. বারাক।
‘প্রথমতঃ নাবিলার স্বাক্ষ্য। দ্বিতীয়ত, দৃশ্যে যাদের পালাতে ও নিহত হতে দেখা যাচ্ছে, নিউ হারমানের নিহতদের মধ্য থেকে তাদের চিহ্নিত করা। তৃতীয়ত, যে ঘরগুলোর দৃশ্য ছবিতে দেখা যাচ্ছে, নিউ হারমানের সে ঘরগুলো খুঁজে বের করা। এই প্রমাণই যথেষ্ট হবে।’
বলে জর্জ আব্রাহাম জনসন একটু থামল এবং বিল বেকারের দিকে তাকাল। বলল, ‘আপনি শিঘ্রই এই ক্যাসেটের একটা কপি পুলিশ হেড কোয়ার্টারে পাঠান এবং একজন দায়িত্বশীল অফিসারকে নির্দেশ দিন প্রমাণগুলো রেকর্ডে আনার জন্যে। ফিল্মে ঘরগুলো ও মানুষের ছবি যে এ্যাংগলে, সে এ্যাংগলেই যেন ছবিগুলো নেয়া হয়। ফিল্মের ছবির লোকদের নাম, ঠিকানাও রেকর্ডে আনতে হবে। ঘরে যে রক্তের আলামত পাওয়া যাবে, তা যে এই ফটোর লোকদেরই তাও নিশ্চিত করতে হবে।’
‘ধন্যবাদ মি. জর্জ। এখনই ব্যবস্থা করছি।’
বলেই সে মোবাইল তুলে নিয়ে হেড কোয়ার্টারে টেলিফোন করল। প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিল এবং এখনি আসতে বলল এফবিআই হেড কোয়ার্টারে।
টেলিফোনে কথা শেষ করে বিল বেকার বলল, ‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। আমরা চোখে অন্ধকার দেখছিলাম। তিনি আলো জ্বেলে দিলেন অন্ধকারে।’
বলে বিল বেকার তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘আপনি ভাগ্যবান আহমদ মুসা। ঈশ্বর আপনার পক্ষে কাজ করেছেন।’
‘আল-হামদুলিল্লাহ। আল্লাহ সত্যপন্থীদের সব সময়ই সাহায্য করেন। আল্লাহ এবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেও বিশেষভাবে সাহায্য করেছেন।’ দীর্ঘ নিবরতা ভেঙে বলল আহমদ মুসা।
‘বিশেষ সাহায্যটা কি?’ প্রশ্ন করল পুলিশ প্রধান বিল বেকার।
‘লস আলামোসের গোয়েন্দা সুড়ঙ্গ উদঘাটন ও সংশিস্নষ্ট ঘটনার মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপর যে অদৃশ্য ষড়যন্ত্র চেপে বসেছিল তার মুখোশ উন্মোচিত হয়েছে এবং অবশেষে নিউ হারমানের ঘটনার মধ্যে দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ধার্মিক শান্তি প্রিয় ইহুদী এবং ষড়যন্ত্রকারী ইহুদীবাদীদের আল্লাহ আলাদা করে দিলেন। এর মাধ্যমে আল্লাহ মার্কিন জাতীয় সংহতিকে আরও নিরুপদ্রব করে দিলেন।’ আহমদ মুসা বলল।
‘সুন্দর ব্যখ্যা দিয়েছেন আহমদ মুসা। আমি প্রেসিডেন্টকে এটা জানাব।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
‘ধন্যবাদ। মি. জর্জ আব্রাহাম, আমি উদ্বিগ্ন সারা জেফারসন ও নোয়ান নাবিলাকে নিয়ে। জেনারেল শ্যারন কতটা জঘন্য, খুনি হয়ে উঠেছে নিউ হারমানের ঘটনা তার প্রমাণ। সারা জেফারসন ও নোয়ান নাবিলাকে যা ইচ্ছে তাই করতে তার একটুও বিবেকে বাধবে না।’ আহমদ মুসা বলল। তার কণ্ঠস্বর ভারী।
গম্ভীর হয়ে উঠল জর্জ আব্রাহাম ও পুলিশ প্রধান দু’জনেরই মুখ।
জর্জ আব্রাহাম বলল, ‘আমি এখনি প্রেসিডেন্টের কাছে যাচ্ছি। তাঁকে সব জানাব। তার নির্দেশ বলে আজই এই ক্যাসেটের সচিত্র বিবরণ সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেলে যাবে। আমি আশা করছি, আজই আপনি মুক্ত মানুষ হিসেবে আপনার বাসায় ফিরে যাবেন। সারা জেফারসন ও নোয়ান নাবিলাকে উদ্ধার করার জন্যে আপনার সাহায্য আমরা চাই।’
‘ধন্যবাদ মি. জর্জ।’ বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা থামতেই শশাংক বলে উঠল দ্রুত কণ্ঠে, ‘নাবিলা জেনারেল শ্যারনদের হাতে পড়ার পূর্বক্ষণে আমাকে টেলিফোন করে ওয়াশিংটনের দু’টি ঠিকানা দিয়েছে। বলেছে, এখানেই নাবিলাকে এবং সারা জেফারসনকেও পাওয়া যাবে।’
শশাংক থামার প্রায় আগেই আহমদ মুসা বলে উঠল, ‘ঠিকানা তোমার কাছে এখন আছে?’
‘আছে।’ বলল শশাংক।
শশাংক পকেটে হাত দিয়ে এক টুকরো কাগজ বের করল এবং আহমদ মুসার দিকে তুলে ধরল।
আগ্রহের সাথে আহমদ মুসা কাগজটি হাতে নিয়ে ঠিকানা দু’টির উপর ভালোভাবে চোখ বুলিয়ে নিল। স্মৃতিতে তার গেঁথে নিল ঠিকানা দু’টো। তারপর আহমদ মুসা কাগজটি এগিয়ে ধরল জর্জ আব্রাহামের দিকে।
জর্জ আব্রাহাম ঠিকানা দু’টির উপর চোখ বুলিয়ে নিয়ে তা এগিয়ে দিল বেকারের দিকে। বলল, ‘টুকে নিন ঠিকানা দু’টো বিল বেকার।’
তারপর দ্রুত আব্রাহাম জনসন নক করল ইন্টারকমের একটা কি’তে।
সংগে সংগেই কথা বলে উঠল এফবিআই-এর অপারেশন কমান্ডার। জর্জ আব্রাহাম তাকে ঠিকানা দু’টো দিয়ে নির্দেশ দিল, কারো সন্দেহের সৃষ্টি না হয় এভাবে ঠিকানা দু’টোর উপর সার্বক্ষণিক নজর রাখ। কেউ সেখানে ঢুকুক ক্ষতি নেই, কিন্তু কেউ বেরুলে তাকে দূরে সরিয়ে এনে সবার অলক্ষে গ্রেপ্তার করতে হবে। এর অর্থ কেউ যেন ঠিকানা দু’টো থেকে বেরিয়ে পালিয়ে যেতে না পারে।’
কথা শেষ করে জর্জ আব্রাহাম তাকাল বিল বেকারের দিকে। বলল, ‘বলুন মি. বেকার। আর কি করণীয়।’
‘ঠিকানা দু’টোতে আজই অভিযান হওয়া দরকার এবং এই অভিযান আহমদ মুসার হাতে দিলে কেমন হয়।’ বলল বিল বেকার।
‘ধন্যবাদ মি. বেকার। আমিও একথাই ভাবছিলাম। আহমদ মুসা আমাদের সাথে থাকবেন শুধু নয়, সব দায়িত্ব তাকেই পালন করতে হবে।
কথাগুলো বলে একটু থেমে আহমদ মুসার দিকে চেয়ে বলল, ‘এবার আপনি বলুন আহমদ মুসা।’
‘আমি সাথে থাকব অবশ্যই।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আপনি এর বেশী কিছু বলবেন না তা জানি।’
বলে জর্জ আব্রাহাম জনসন তাকাল শশাংকের দিকে। বলল, ‘শশাংক তোমাকে সহস্র ধন্যবাদ দিলেও ধন্যবাদ শেষ হবে না। দেশ তোমার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে।’
‘স্যার আমি বাহক মাত্র। যা করার সব করেছে নাবিলা।’ বলল শশাংক।
‘নাবিলা এ দেশের ইহুদীদের আদর্শ হতে পারে। তার কম্যুনিটির স্বার্থে, দেশের স্বার্থে আমাকে ধরিয়ে দেয়াকে যখন সে ঠিক মনে করেছে, তখন আমার সাথে তার পরিচয়, সাগরিকার সাথে তার বন্ধুত্ব, শশাংকের সাথে তার সম্পর্ক সব ভুলে গিয়ে সে ইহুদী কমান্ডোদের সাথে নিয়ে আমাকে ধরতে ছুটে এসেছিল। আর আজ দেশ ও তার কম্যুনিটির স্বার্থেই সে একান্ত মিত্র জেনারেল শ্যারনদের মৃত্যুবান শুধু আমাদের হাতে তুলে দেয়া নয়, নিজেকেও বিপদের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। ধন্যবাদ নাবিলাকে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমাদের ডা. বারাক আংকলের প্রকৃত শিষ্য সে।’ বলল সাগরিকা সেন।
‘আমরা তার জন্যে গর্বিত।’ ডা. বারাক বলল।
‘মানুষে মানুষে কত পার্থক্য। একই কম্যুনিটির, কিন্তু নাবিলাকে যদি বলা হয় ফেরেশতা, তাহলে জেনারেল শ্যারনকে বলতে হয় শয়তান।’
‘জার্মানীতে যে ইহুদী হত্যাকান্ড ঘটেছে, তা শুধু নাজীদের কাজ নয়, তার মধ্যে এই শয়তানদের হাত ছিল।’ বলল আহমদ মুসা।
‘নিউ হারমানে হত্যাকান্ডের উদ্দেশ্য ছিল আপনাকে ফাঁদে ফেলা, জার্মানীর হত্যাকান্ডে যদি তাদের হাত থাকে, তাহলে তার উদ্দেশ্য কি ছিল?’ সাগরিকা সেন বলল।
‘ইহুদীদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করে ফিলিস্তিনে মাইগ্রেট করতে বাধ্য করা। দ্বিতীয় আর একটি কারণ ছিল, বিশ্বের মানুষের মধ্যে ইহুদীদের প্রতি দরদ সৃষ্টি করা এবং ফিলিস্তিনে ইহুদী রাষ্ট্রের পক্ষে বিশ্ব জনমত সৃষ্টি করা। দুই উদ্দেশ্যই তাদের সফল হয়েছে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘জার্মানীর ব্যাপারটা অনেক আগের, যুদ্ধকালীন অবস্থায় তা ঘটেছিল। সে সব আমাদের কাছে খুব স্পষ্ট নয়। কিন্তু নিউ হারমানের ঘটনা আমেরিকানদের হতবাক করে দেবে।’ বিল বেকার বলল।
‘শুধু হতবাক নয়, অর্ধশতকেরও বেশি কাল ধরে ইহুদীবাদীরা যে ইমেজ গড়ে তুলেছিল তা ধুলিস্মাত হয়ে যাবে। আর আমেরিকানদের জন্যে এর খুব বেশী প্রয়োজন ছিল।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
জর্জ আব্রাহাম থামতেই আহমদ মুসা বলে উঠল, ‘বেঞ্জামিন বেকনের সাথে আমার জরুরী যোগাযোগ প্রয়োজন মি. জর্জ।’
‘অল রাইট আহমদ মুসা আপনি আপনার রেষ্ট রুমে ফিরে যান। ওখানে গিয়েই সুসজ্জিত একটা ব্যাগ পেয়ে যাবেন। তাতে সবরকম যোগাযোগ এবং আপনার অভিযানের রশদ-পত্রও পেয়ে যাবেন। আমিও এখন উঠছি। প্রেসিডেন্টের ওখানে যাব।’
একটু থামল জর্জ আব্রাহাম। তারপর সাগরিকা সেনদের দিকে চেয়ে বলল, ‘অনুগ্রহ করে আপনারাও কি মি. আহমদ মুসার সাথে যাবেন। সেখানে আপনাদের রেষ্টের ব্যবস্থা হচ্ছে। অন্তত প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে ফিরে আসা পর্যন্ত আপনারা আমাকে সময় দিন।
‘অবশ্যই মি. জর্জ। আমরা যাচ্ছি আহমদ মুসার সাথে।’
‘ধন্যবাদ আপনাদের সকলকে।’
আহমদ মুসা, ডা. বারাকসহ সকলে উঠে দাড়াল।
উঠে দাড়াল জর্জ আব্রাহাম জনসন এবং পুলিশ প্রধান বিল বেকারও।
জর্জ আব্রাহাম বিল বেকারের দিকে চেয়ে বলল, ‘আপনি একটু বসুন মি. বেকার। আপনি আমার সাথে প্রেসিডেন্টের কাছে যাবেন। আমি তৈরী হয়ে আসছি।’
আহমদ মুসারা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আর জর্জ আব্রাহাম জনসন কয়েকটা ফাইল, ক্যাসেট, কয়েকটা টুকিটাকি জিনিস ব্রীফকেসে পুরে তার পাশের কক্ষের দিকে এগুলো।
বিল বেকার মনোযোগ দিল খবরের কাগজের দিকে।

Top