৩৩. সুরিনামের সংকটে

চ্যাপ্টার

নিও নিকারী থেকে একটা মাত্র হাইওয়ে দক্ষিণে বেরিয়ে টটনস ও গ্রোনজা শহর হয়ে গেছে রাজধানী পারামারিবোতে।
আহমদ মূসার গাড়ি বেরিয়ে এল নিও নিকারী শহর থেকে।
শহর থেকে বের হওয়া বিভিন্ন রাস্তা গিয়ে মিশেছে হাইওয়েতে।
আহমদ মূসার গাড়ি গিয়ে সেই হাইয়েওতে প্রবেশ করল।
একজন পুলিশ অফিসার দাঁড়িয়েছিল রাস্তার পাশে। তার কোমরে ঝোলানো রিভলবার এবং তার হাতে একটা দূরবীন।
পুলিশ অফিসারটি রাস্তার পাশ থেকে হাত তুলে আহমদ মূসাকে গাড়ি দাঁড় করাতে বলল।
চেকপোস্ট নয়, অথচ গাড়ি দাঁড় করাতে বলা হোল।
এভাবে গাড়ি দাঁড় করার আদেশ পাওয়ায় বিরক্ত হলো আহমদ মুসা।
গাড়ি দাঁড় করাল।
গাড়ি দাঁড় করাতেই পুলিশ অফিসারটি জানালা দিয়ে ভেতরে উঁকি দিয়ে বলল, মাফ করবেন, ‘আমরা একজন লোক খুঁজছি’।
‘কাকে খুঁজছেন?’ প্রশ্ন করল ড্রাইভার রূপী আহমদ মুসা।
পুলিশ অফিসারটি একটা ফটো আহমদ মুসার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘এই লোকটি।’
ফটোটির দিকে তাকিয়ে আহমদ মুসা চমকে উঠলো। এ যে আহমদ হাত্তা নাসুমনের ফটো।
আহমদ মুসা জিজ্ঞেস করল, লোকটি চোর-ডাকাত, হাইজ্যাকার নাকি?
‘না ইনি পলিটিশিয়ান। ফেরার। এখন শোনা যাচ্ছে, সে গোপনে সুরিনামে প্রবেশ করেছে’।
‘কোথায় গিয়েছিল সে?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘দেশের বাইরে কোথাও।‘
‘কি করে জানা গেল সুরিনামে প্রবেশ করেছেন তিনি।‘
‘সেটা জেনে লাভ নেই। এখন দরকার তাকে পাওয়া। ছবিটা দেখে রাখুন। তাকে পেলে পুলিশে ফোন করবেন।‘
বলে লোকটি গাড়ির জানালা থেকে মুখ সরাতে গিয়ে হাত্তা নাসুমনের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল। বলল, ‘আপনাকে পরিচিত মনে হচ্ছে’।
পুলিশ অফিসারের কথা শেষ না হতেই আহমদ মুসা সামনের সিটের দরজা খুলে দিয়ে বলল, ‘স্যার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলার চাইতে গাড়িতে বসুন। বসে কথা বলুন’।
পুলিশ অফিসারটি উঠে বসল। তার মুখ গম্ভীর। চোখে সন্ধানী দৃষ্টি। আহমদ মুসার পাশের সিটে উঠে বসতে বসতে হাত্তা নাসুমনকে সে বলল, ‘আপনার নাম কি?’
‘আবুল হাত্তা’। বলল আহমদ হাত্তা নাসুমন।
‘আবুল হাত্তা, না আহমদ হাত্তা?
বলেই পুলিশ অফিসারটি পেছনের সিটে বসেই চোখের পলকে তার বাম হাতটা আহমদ হাত্তার দিকে চালনা করে তার দাড়ি ধরে টান দিল। দাড়ি খসে এল তার হাতে। সংগে সংগে চিৎকার করে উঠল পুলিশ অফিসার, ‘ও গড, পাওয়া গেছে। ইউরেকা, ইউরেকা’।
আবার পরক্ষণেই চিৎকার থামিয়ে পুলিশ অফিসারটি গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠল, ‘গাড়ি থেকে নামুন মি. আহমদ হাত্তা নাসুমন। আপাতত নাম ভাঁড়ানো, ছদ্মবেশ নিয়ে প্রতারণা, ফেরার হওয়া, দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা, ইত্যাদি অভিযোগে আপনাকে আমি গ্রেফতার করলাম’।
বলে গাড়ির দরজা খুলতে গেল পুলিশ অফিসার।
ড্রাইভার রূপী আহমদ মুসা বলল, দরজা লক করে দিয়েছি পুলিশ অফিসার। আপাতত আমরা আপনাকেই এরেস্ট করলাম।
আহমদ মুসার কথা শুনে পুলিশ অফিসার হুংকার দিয়ে আহমদ মুসার দিকে মুখ ঘুরাল। মুখ ঘুরিয়ে দেখল, আহমদ মুসার রিভলবার তার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে।
‘একি ড্রাইভার কি করছ তুমি। পুলিশের দিকে তুমি রিভলবার তাক করেছ, এর পরিণতি কি জান?’ ধমকের সুরে কথা কয়টি বলল পুলিশ অফিসার।
‘পরে জানলেও চলবে পুলিশ অফিসার, আপনার রিভলবারটি আমাকে দিন। দেরি করলে আমার প্রথম গুলিটার লক্ষ্য হবে আপনার ডান হাত’। কঠোর কন্ঠে বলল আহমদ মুসা।
পুলিশ অফিসার একবার আহমদ মুসার চোখের দিকে তাকাল। তারপর আস্তে রিভলবারটা বের করে আহমদ মুসার হাতে দিল।
‘ধন্যবাদ পুলিশ অফিসার’। বলে আহমদ মুসা পুলিশের রিভলবার পেছনের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলল, ‘মি. হাত্তা, আপনি পুলিশ অফিসারের মাথা তাক করে রাখুন। কোন বেয়াদবি করার চেষ্টা করলে তার মাথাটা একেবারে উড়িয়ে দেবেন’।
আহমদ মুসা নিজের হাতের রিভলবারটা স্টিয়ারিং হুইলের সামনের ড্যাশ বোর্ডে রেখে পুলিশ অফিসারের দিকে চেয়ে বলল, মি. পুলিশ অফিসার আপনি মি. হাত্তার যে অপরাধের তালিকা দিলেন, তার মধ্যে তাঁর আসল দোষটাই তো নেই। জানেন দোষটা কি? দোষটা হলো, একুশ তারিখে তিনি তাঁর মনোনয়ন পত্র জমা দেয়ার জন্যে দেশে এসেছেন’।
পুলিশ অফিসারটি মুখ হাঁড়ি করে বসেছিল। সে ভীতও। কোন কথা বলল না সে। তাকাল না সে আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসা আবার বলল, ‘মি. পুলিশ অফিসার, আপনি বললেন মি.হাত্তা ফেরার। তিনি কি ফেরার হয়েছিলেন, না তাঁকে কিডন্যাপ করা হয়েছিল? তাঁর মেয়েকে কারা দেশ ছাড়া করেছে পুলিশ অফিসার? কারা তাঁর হবু জামাতাকে পণবন্দী করে রেখেছে? দেশে অপহরণ, কিডন্যাপের সয়লাব সৃষ্টি করেছে কারা? এসব অপরাধ কি মি. হাত্তার?
‘তুমি একজন ড্রাইভার। এসব তুমি জান কেমন করে? বলছ কোন স্বার্থে? মরার জন্যে পাখা উঠেছে বুঝি! চল চেকপোষ্টে, দেখবে, কি ঘটে?’ সাহস দেখিয়ে অপমান-ক্ষুব্ধ কন্ঠে বলল পুলিশ অফিসারটি।
‘ভালো কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন মি. পুলিশ অফিসার। চেকপোষ্টগুলোর ঝামেলা এড়াবার জন্যে আপনার সাহায্য আমাদের প্রয়োজন এবং আমরা আশা করি আপনি তা করবেন’। বলল আহমদ মুসা মুখে মৃদু হাসি টেনে।
‘চল দেখা যাবে। ওখানে গিয়ে রিভলবার তোমাদের লুকাতে হবে। তারপর কি ঘটে দেখবে’। পুলিশ অফিসারটি রাগে গরগর করতে করতে বলল।
‘মি. পুলিশ অফিসার, একজন উচ্চ পদস্থ পুলিশ অফিসারের গাড়ি চেকপোস্টে চেক হতে যাবে কেন? দেখবেন, আপনি তা হতে দেবেন না’।
‘পাগলের প্রলাপ থামাও ড্রাইভার’। বলে ভিন্ন দিকে মুখ ঘুরাল পুলিশ অফিসার।
আহমদ মুসার ঠোঁটে মিষ্টি হাসি ফুটে উঠল।
আহমদ মুসা পেছনে না তাকিয়েই আহমদ হাত্তা নাসুমনকে লক্ষ্য করে বলল, ‘মি. হাত্তা, একটু বিশ্রাম করতে চাই। সামনে কোথাও কি আড়াল পাওয়া যাবে?’
আহমদ হাত্তা নাসুমন পুলিশ অফিসারের দিকে তার রিভলবার তাক করেছিল বটে, কিন্তু তার মনে কোন জোর ছিল না। একজন পুলিশ অফিসারকে এভাবে কিডন্যাপ করায় ভীত হয়ে পড়েছে সে। বিষয়টা জানাজানি হবেই। তখন সাংঘাতিক বিপদে পড়তে হবে তাদেরকে। কিন্তু আহমদ মুসার সিদ্ধান্তের বাইরে তার করার কিছু নেই। সে পুলিশ অফিসারের সাথে আহমদ মুসার কথার কোন অর্থ খুঁজে পাচ্ছেনা। পুলিশ অফিসারকে আহমদ মুসা কি পুতুল মনে করছে! পুলিশ অফিসারের ধমককেই যুক্তি মনে হচ্ছে তার কাছে। আহমদ মুসা না হয়ে অন্য কেউ হলে হাত্তা এসব অর্থহীন কথাবার্তা থামিয়ে দিত ও বাস্তববাদী হতে বলত। কিন্তু আহমদ মুসার ক্ষেত্রে এ ধরনের কিছু ভাবার অবকাশ নেই। আহমদ মুসা কি ভেবে, কোন পরিকল্পনায় কি বলছে তা তার মত লোকদের মাথায় আসার কথা নয়।
আহমদ মুসার কথা আহমদ হাত্তা নাসুমনের চিন্তার সূত্র ছিন্ন করে দিল।
আহমদ মুসার বিশ্রাম নেবার কথা শুনে বিষ্মিত হলো হাত্তা নাসুমন। কিন্তু পরক্ষণেই তার মনে হলো, নিশ্চয় আহমদ মুসা নতুন কিছু ভাবছে। আহমদ মুসার প্রশ্নের জবাবে বলল সে, ‘আধা মাইল সামনে রাস্তার বাম পাশেই একটা বাগান পাওয়া যাবে। বাগানে একটা পুকুরও আছে’।
‘ধন্যবাদ মি. হাত্তা। আমাকে দেখিয়ে দেবেন’।
আহমদ মুসা থামল।
সবাই নিরব।
ছুটে চলছে গাড়ি।
রাস্তার বাম পাশে একটা বাগান আহমদ মুসা দেখতে পেল। বলল, ‘মি. হাত্তা ওটাই কি আপনার সেই বাগান?’
‘হ্যাঁ’। বলল হাত্তা নাসুমন।
হাইওয়ে থেকে একটা মেঠো রাস্তা বাগানে গিয়ে প্রবেশ করেছে।
আহমদ মুসা গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে মেঠো পথ ধরে বাগানে প্রবেশ করল।
বাগানটা ফলের নয়, বনজ। মূল্যবান বনজ গাছে ভরা বাগান। সেই সাথে ঝোপ-ঝাড়ে ভর্তি।
খুশি হলো আহমদ মুসা। এ ধরনের বাগানই তার চাই।
আহমদ মুসা একটা ঘন ঝোপের আড়ালে নিয়ে গাড়ি দাঁড় করাল। বলল, ‘মি. হাত্তা আপনি রিভলবারসহ বের হোন’।
বের হলো হাত্তা নাসুমন।
তারপর আহমদ মুসা পুলিশ অফিসারের পাশের দরজা আনলক করে দিয়ে বলল, ‘মি. পুলিশ অফিসার আপনি বের হোন’।
চারদিকে তাকাল পুলিশ অফিসার।
তার চোখে-মুখে ভয়ের চিহ্ন দেখা গেল। বলল, ‘কেন নামতে হবে এখানে?’
‘কাজ না থাকলে এমনি তো আর আসিনি মি. পুলিশ অফিসার। নামুন মি. অফিসার, এক আদেশ আমি দুবার করি না’। আহমদ মুসার কন্ঠ কঠোর শোনাল।
গাড়ি থেকে নামল পুলিশ অফিসার।
ব্যাগ থেকে বেল্ট জাতীয় একটা ভারী জিনিস এবং সেই সাথে রিভলবার হাতে নিয়ে নামল আহমদ মুসা।
গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে আছে পুলিশ অফিসারটি। তার সামনে উদ্যত রিভলবার হাতে দাড়িয়ে আছে হাত্তা নাসুমন।
আহমদ মুসা গিয়ে পুলিশ অফিসারকে তার জামা খুলতে বলল।
পুলিশ অফিসার ভীত দৃষ্টিতে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। মৃত্যুভয় ফুটে উঠেছে তার চোখে-মুখে।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘ভয় নেই মি. পুলিশ অফিসার, এখানে তোমাকে মারতে নিয়ে আসিনি। দেরি করো না’।
পুলিশ অফিসার জামা খুলে ফেলল।
আহমদ মুসা পুলিশ অফিসারের পেছনে দাড়িয়ে হাতের বেল্টটা তার বুকের উপর দিয়ে পরিয়ে দিল।
পেছনে হুক দিয়ে আটকে দিল বেল্ট।
বেল্ট দেখেই চোখ ছানাবড়া হয়ে গেছে পুলিশ অফিসারের।
‘ঠিক অনুমান করেছ পুলিশ অফিসার। তোমার বুকের উপর বেল্টের সাথে আটকানো ওটা বিশেষ ধরনের একটি এক্সপ্লোসিভ বুলেট, ঠিক বোমা নয়।বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে চারদিক ধ্বংস করে দেয়। আর এই এক্সপ্লোসিভ বুলেটের বিস্ফোরণ চারদিকে ছড়ায় না। বুলেটের মত ভেতরে ঢুকে গিয়ে বিস্ফোরণ ঘটায়। সেই লোকটির ভেতরের সবকিছু শেষ হয়ে যায় কিন্তু বাইরে অক্ষত থাকে। আশে-পাশের লোকদের গায়ে আঁচড় ও লাগেনা’। বলল আহমদ মুসা।
‘আমাকে তোমরা এভাবে হত্যা করতে চাইছ কেন?’ লোকটির কন্ঠ আর্তনাদ করে উঠল।
‘না, আমরা তোমাকে হত্যা করছি না। আমাদের কথা মেনে চললে তোমার কোন ক্ষতি হবে না’। বলল আহমদ মুসা।
‘তোমাদের কি কথা?’ বলল পুলিশ অফিসার।
‘চেকপোস্টগুলোতে যাতে গাড়ি না দাঁড় করাতে হয় সেই ব্যবস্থা তোমাকে করতে হবে’।
কথা শেষ করেই আবার বলল, ‘জামাটা এবার পরে নাও পুলিশ অফিসার।
যন্ত্রের মত হুকুম তামিল করল সে।
তারপর পুলিশ অফিসারকে গাড়িতে তুলে দিয়ে হাত্তা নাসুমনকে গাড়িতে উঠতে বলে আহমদ মুসা আবার ড্রাইভিং সিটে বসল।
বসার পর ব্যাগ থেকে সাদা রংয়ের একটা যন্ত্র বের করে স্টিয়ারিং হুইলের বাটে বাঁধল এবং পুলিশ অফিসারকে লক্ষ্য করে বলল, ‘এই সাদা যন্ত্রটা আপনার বুকে পাতা ‘বিস্ফোরণ বুলেট’টার রিমোট কনট্রোল। সাদা যন্ত্রটায় এই যে লাল বোতাম দেখছেন, এটা ডেটোনেটর। এটায় চাপ দিলেই আপনার বুকে বোমাটার বিস্ফোরণ ঘটবে’।
পুলিশ অফিসারের মুখ রক্তহীন সাদা হয়ে গেল।
‘কি আমাদের প্রস্তাবে রাজি তো মি. পুলিশ অফিসার?’ বলল আহমদ মুসা।
‘ঠিক আছে। কিন্তু জেনে রেখ একজন পুলিশ অফিসারের উপর জুলুম করার ফল ভাল হবে না’। ভীত ও ক্ষুব্ধ কন্ঠে বলল অফিসার।
‘মনে রেখ, তোমরা জুলুম করার জন্যে আহমদ হাত্তা নাসুমনকে গ্রেফতার করতে এসেছিলে এবং আরও যে সব জুলুম করেছ, তার কিছু শাস্তি তোমারও পাওনা’।
বলে একটু থেমেই আবার স্মরণ করিয়ে দিল পুলিশ অফিসারকে, মনে রেখ, পুলিশরা গাড়ি চেক করতে আসলেই কিন্তু লাল সুইচে চাপ দিয়ে আমি বিস্ফোরণ ঘটাব’।
‘দেখ, পুলিশ গাড়ির দিকে আসার অর্থ গাড়ি সার্চ হওয়া নয়। হঠাৎ আবার লাল বোতামে চাপ দিয়ে বসো না। আমি বলছি গাড়ি সার্চ হবে না’।
বলল পুলিশ অফিসার ভীত কন্ঠে।
‘দেখ অফিসার তুমি এমন ব্যবস্থা করবে যাতে গাড়ি না দাঁড় করাতে হয়। আমরা এটা চাই’। আহমদ মুসা বলল।
‘ঠিক আছে’। বলল পুলিশ অফিসার।
‘ধন্যবাদ মি. পুলিশ অফিসার’। বলে আহমদ মুসা গাড়ি স্টার্ট দিল।
গাড়ি আবার উঠে এল হাই ওয়েতে। ছুটতে লাগল গাড়ি আবার।
সামনেই মধ্য উপকূলের একমাত্র শহর টটনস। টটনস শহরের মুখে একটা চেকপোস্ট।
চেকপোস্টের কাছাকাছি হলো গাড়ি। পুলিশ রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে। দেখা গেল তারা দুটি গাড়ি দাঁড় করিয়ে চেক করছে।ও দুটি গাড়ি চেক শেষ হওয়ার আগেই আহমদ মুসার গাড়ি তাদের বরাবর পেৌঁছে গেল।
আহমদ মুসার গাড়িতে বসা পুলিশ অফিসার তার মাথার টুপি ড্যাশ বোর্ডে খুলে রেখেছিল। চেকপোস্টের কাছাকাছি হতেই সে টুপি পরে নিয়েছে।
আহমদ মুসার গাড়ি চেকপোস্টের কাছাকাছি পৌছতেই দুজন পুলিশ আহমদ মুসার গাড়ির দিকে তাকিয়েছিল। একজন পুলিশ অফিসারকে গাড়িতে দেখেই তারা স্যালুট দিল এবং গাড়ি চালিয়ে যেতে ইশারা করল।
আহমদ মুসার গাড়িতে বসা পুলিশ অফিসার হাত তুলে তাদের স্যালুট গ্রহণ করল এবং হাত নেড়ে হাসি মুখে তাদের ধন্যবাদ জানাল।
গাড়ি চেকপোস্ট পেরিয়ে এল।
আহমদ মুসা ধন্যবাদ জানাল পুলিশ অফিসারকে।
তারপর শস্যশ্যামল উপকূল-উপত্যকার পথ ধরে গাড়ি পাড়ি দিল এক দীর্ঘ পথ। দু’ঘন্টা পর গাড়ি পৌছল ট্যুরিস্টদের বড় আকর্ষনীয় উপকূল শহর গ্রোনিনজনে। শহরে ঢোকার পথে কোন চেকপোস্ট নেই। চেকপোস্ট এল শহর থেকে বের হবার পথে। এখানেও গাড়ি দাঁড় করাতে হলো না। গাড়িতে একজন পুলিশ অফিসারকে দেখেই গাড়ি চালিয়ে চলে যেতে ইশারা করল।
গ্রোনিনজন শহরের তিরিশ কিলোমিটার দক্ষিণে রাজধানী পারামারিবো।
রাজধানীর উপকন্ঠে রয়েছে বড় চেকপোস্ট। আহমদ মুসা আশংকা করল এ চেকপোস্টে উচ্চপদস্থ পুলিশ অফিসার থাকতে পারে। গাড়ি তারা দাঁড় করাতেও পারে। কিন্তু দাঁড় করাতে হলো না গাড়ি। চেকপোস্টের কাছে এসেই আহমদ মুসাদের পুলিশ অফিসারটি রাস্তার পাশে দাঁড়ানো পুলিশদের উদ্দেশ্যে হাত নেড়ে স্বাগত জানাল। পুলিশরাও হাত নেড়ে শুভেজ্ছা জ্ঞাপন করল।
ওঁরা গাড়ি দাঁড় করাতে ইশারা করল না।
হাঁফ ছেড়ে বাঁচল আহমদ মুসা। বলল, ‘ধন্যবাদ মি. পুলিশ অফিসার’।
‘ধন্যবাদ দিতে হবে না। সামনে আর চেকপোস্ট নেই। এবার দয়া করে আমার বুক থেকে আজরাইলটাকে নামান’। বলল পুলিশ অফিসারটি।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘আপনার ডিউটি অফিসের টেলিফোন নম্বর দিন’।
‘কেন?’ পুলিশ অফিসারের চোখে-মুখে বিস্ময়।
আমি ওদের সাথে যোগাযোগ করে দিচ্ছি, ওদের সাথে আপনাকে কথা বলতে হবে’। বলল আহমদ মুসা।
‘কি কথা?’
‘আপনি অফিসকে বলবেন, পারিবারিক জরুরী পরিস্থিতিতে হঠাৎ আপনাকে পারামারিবো আসতে হয়েছে। আরও তিনদিন আপনার ছুটি প্রয়োজন’। আহমদ মুসা বলল।
আমার তো ছুটির প্রয়োজন নেই। আপনারা পারামারিবো পেৌঁছে গেছেন, আমি আজই ফিরব’। বলল পুলিশ অফিসার।
‘আপনার ছুটির প্রয়োজন নেই, কিন্তু আমাদের আছে’।
‘তার অর্থ?’ ভ্রু কুঞ্চিত করে বলল পুলিশ অফিসার।
‘নির্বাচনের নমিনেশন পেপার সাবমিট হবার পর আগামী ২২ তারিখে আপনি ছাড়া পাবেন। আমরা কোন ঝুঁকি নিতে চাইনা। আহমদ হাত্তা পারামারিবো এসেছেন, এটা শুধু আপনিই জানেন। আপনি ফেরার সঙ্গে সঙ্গে সবাই এটা জানবে এবং এমন কিছু করা হবে, যাতে মি. হাত্তা নমিনেশন পেপার সাবমিট করতে না পারেন, ভোটে দাঁড়াতে না পারেন’।
‘তার মানে আপনারা আমাকে বন্দী করে রাখতে চান’।
‘হ্যাঁ একে বন্দী বলতে পারেন’। বলল আহমদ মুসা।
একটু থেমেই আবার বলল আহমদ মুসা, ‘বলুন আপনার ডিউটি অফিসের নম্বর বলুন’।
হঠাৎ পুলিশ অফিসারটির চোখেমুখে ভয়ের চিহ্ন ফুটে উঠল। বলল একটু সময় নিয়ে, ‘মোবাইল আমাকে দিন, আমি টেলিফোন করছি’।
‘না। আমি যোগাযোগ করে দেব, আপনি কথা বলবেন। আমি নিশ্চিত হতে চাই, ডিউটি অফিস আপনার কথা জেনেছে’। আহমদ মুসা বলল।
‘না জানালেও তো চলে’। বলল পুলিশ অফিসারটি।
‘অবশ্যই জানাতে হবে। না হলে একজন পুলিশ অফিসার নিখোঁজ হওয়া নিয়ে দেশব্যাপী হুলস্থুল পড়ে যাবে। আপনাকে রাস্তার চেকপোস্টে পুলিশরা দেখেছে। সুতরাং আমাদের গাড়ি উদ্ধার ও আমাদের ধরার জন্য পুলিশরা হন্যে হয়ে উঠবে’।
পুলিশ অফিসারটি কথা বলল না। তার চোখে-মুখে সেই ভয়ের চিহ্নটা আরও বাড়ল।
আহমদ মুসার মুখ কঠোর হয়ে উঠল। বলল, ‘আমাদের সময় নষ্ট করছেন মি. পুলিশ অফিসার। আপনি যদি নাম্বারটা না বলেন, তাহলে পুলিশরা যাতে কোন দিনই আপনাকে খুঁজে না পায় সেই ব্যবস্থা করব। সে জন্যে ডেটোনেটরের ঐ লাল বোতামটায় একটা চাপ দিতে হবে মাত্র’।
ভয়ে আঁৎকে উঠল পুলিশ অফিসার। বলল ভীত কন্ঠে, ‘নাম্বারটা এই মুহূর্তে আমার মনে পড়ছে না’।
ভ্রুকুঞ্চিত হলো আহমদ মুসার। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সে তাকাল পুলিশ অফিসারটির দিকে। একটু চিন্তা করল। বলল তারপর, ‘আপনি কি তাহলে পুলিশ নন, ভুয়া পুলিশ? এজন্যেই কি আপনার ইউনিফর্মে নেমপ্লেট নেই?’
পুলিশ অফিসারটির মুখ ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেল। কথা বলল না।
‘আপনার নাম কি?’ তীব্র কন্ঠে জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
পুলিশ অফিসারটি আহমদ মুসার দিকে একবার চোখ তুলে তাকাল। তার চোখে-মুখে মৃত্যু ভয়। মুখ আবার নিচু করল। বলল, ‘রবার্ট ম্যাকভাল রায়’।
‘জম্ম ইউরোপে, না ভারতে?’
‘ইউরোপে’।
‘আপনাকে কেউ নিয়োগ করেছে, না আপনি নিয়োগকর্তাদের একজন?’
আহমদ মুসার জিজ্ঞাসার কোন জবাব দিল না রবার্ট ম্যাকভাল রায়। আহমদ মুসা আবার জিজ্ঞেস করল, ‘আপনাদের কত জন ভূয়া পুলিশ অফিসার এভাবে আহমদ হাত্তাদের বিরুদ্ধে কাজে নেমেছেন?’
এবারও জবাব দিল না রবার্ট রায়।
‘মি হাত্তা তাহলে আমরা আর হোটেলে যাচ্ছি না। আপনি পারামারিবোর যে ঠিকানাগুলো আমাকে দিয়েছিলেন, তার এক নম্বর ঠিকানায় আমি যেতে চাই’। পেছনে না তাকিয়েই আহমদ হাত্তা নাসুমনকে উদ্দেশ্য করে বলল আহমদ মুসা।
‘কেন ওখানে কেন? হোটেল নয় কেন?’ বলল হাত্তা নাসুমন।
‘রবার্ট রায়ের ব্যাপারটা আগে সেটেল করতে চাই মি. হাত্তা’। আহমদ মুসা বলল।
এয়ারপোর্ট থেকে জায়গাটা অনেক দূরে হবে। কালকে ফাতেমাকে নিয়ে প্রোগ্রামে কোন অসুবিধা হবে না তো?’
‘অবশ্যই না’।
‘ঠিক আছে চলুন। ওখানে কোন অসুবিধা নেই’।
‘এখন তো শহরে ঢুকেছি। রাস্তা বলে দিবেন মি. হাত্তা’। আহমদ মুসা বলল।
‘ঠিক আছে’। বলল হাত্তা নাসুমন।
‘বুঝলেন মি. হাত্তা, এরা আট-ঘাট বেঁধে নেমেছে। বর্ডার সীল করার আরেকটা কারণ দেখা যাচ্ছে আপনাকে ঠেকানো’। আহমদ মুসা বলল।
‘তাই তো মনে হচ্ছে’। হাত্তা নাসুমন বলল।
‘আচ্ছা রবার্ট রায়, আপনাকে একটা সহজ প্রশ্ন করি। আহমদ হাত্তা নাসুমন উদ্ধার পেয়েছেন, সুরিনামে আসছেন, এটা আপনারা জানলেন কি করে?’ রবার্ট রায়ের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করল আহমদ মুসা।
রবার্ট রায় নির্বিকার। কোন জবাব দিল না।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘বুঝেছি আপনি এখন নিশ্চিত, আপনার সব কথা না জেনে আপনাকে আমরা হত্যা করব না। অতএব আর কোন কথা নেই আপাতত। ঠিক আছে তাই হোক’।
বলে আহমদ মুসা চুপ করল।
সবাই চুপচা্প।
চলছে গাড়ি।

‘মি. রবার্ট রায় আবার আপনাকে স্মরণ করিয়ে দেই এক প্রশ্ন আমি দুবার করি না। প্রথমে আপনাকে সেই সহজ প্রশ্নটাই করছি, ‘আহমদ হাত্তা মুক্ত হয়েছেন, সুরিনামে আসছেন, এটা আপনারা কিভাবে জেনেছেন?’ প্রশ্ন করল আহমদ মুসা রবার্ট ম্যাকভাল রায়কে।
রবার্ট রায় বসে আছে আহমদ মুসার সামনে এক চেয়ারে। মাঝখানে একটা টেবিল।
বেশ বড় ঘরটি। আগা-গোড়া কার্পেট মোড়া।
আহমদ মুসাদের পাশেই কিছু দূরে সোফায় বসে আছে আহমদ হাত্তা নাসুমন।
দরজায় দাঁড়িয়ে দুজন লোক। হাতে তাদের কোন অস্ত্র নেই। কিন্তু পকেটে তাদের রিভলবার রয়েছে। এরা হাত্তা নাসুমনের লোক। পার্টি ক্যাডারের সদস্য এরা।
এ বাড়িটাও পার্টির একটি রেস্টহাউজ। সুরিনাম নদীর ধার ঘেষে বাড়িটা। সুরিনাম নদীর ভেতর থেকেই উঠে এসেছে বাড়িটার দক্ষিণের দেয়াল। দক্ষিনের জানালায় দাঁড়ালে সুরিনাম নদীর স্নিগ্ধ বাতাসের পরশ পাওয়া যায়।
যে ঘরটিতে আহমদ মুসা বসে আছে, সে ঘরটিও দক্ষিণের নদী প্রান্তের একটি ঘর।
সুরিনাম নদীর দুপাড় নিয়েই গড়ে উঠেছে পারামারিবো শহর। তবে শহরের মূল অংশ নদীর উত্তর প্রান্তে।
পারামারিবোতে প্রবেশের পর নদীর পাড় বলতে আর কিছুই নেই। নদী-তীরের বাড়িগুলো নদীর পানিতে যেন ভাসছে।
আহমদ মুসার প্রশ্ন শুনে রবার্ট রায় আহমদ মুসার দিকে তাকাল। বোধ হয় আহমদ মুসাকে বুঝতে চেষ্টা করলো। বলল, আমি যতটুকু জানি তা হলো, তার উদ্ধার হওয়ার খবর নাকি সেখানকার কোন কাগজে বের হয়। সেই খবর টেলিফোনে সুরিনামে জানানো হয়’।
‘উনি সুরিনামে আসছেন, এটা জানা গেল কি করে?’
রবার্ট রায় একটু ভাবল। তারপর বলল, ‘আমি সব কথা জানি না। তবে মনে হয় ব্যাপারটা এরকম যে, তিনি মুক্তি পেলে দ্রুত সুরিনামে চলে আসবেন এটা মনে করাই স্বাভাবিক’।
‘আহমদ হাত্তাকে কারা কিডন্যাপ করেছিল, তাদের মধ্যে আপনি ছিলেন?’
‘না’।
‘কারা ছিল?’
‘আমি তাদের চিনি না। ঐ কিডন্যাপের সাথে জড়িত ছিল পারামারিবোর লোকেরা, নিও নিকারীর কেউ ছিল না’।
‘আপনাদের নেতাকে তো চিনেন?’
উত্তর দিল না রবার্ট রায়। সে মাথা নিচু করল।
আহমদ মুসা টেবিল থেকে রিভলবারটা হাতে তুলে নিল। বলল, ‘প্রথমে হাত যাওয়া পছন্দ করবেন, না কান যাওয়া পছন্দ করবেন?’
রবার্ট রায় মুখ তুলে ভীত দৃষ্টিতে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘বলছি স্যার’।
বলে একটু থামল। তারপর শুরু করল, মাসুস(মায়ের সূর্য সন্তান) নামে একটি সংগঠন আছে। গোটা দেশে হিন্দুদের মধ্যে এই সংগঠন গড়ে তোলা হয়েছে। এই সংগঠনের নেতা হলেন ‘তিলক লাজপত পাল’। তার নির্দেশেই সব কিছু হয়। ইউরোপীয় ও ইন্ডিয়ান কম্যুনিটির রাজনীতি এদেশে তিনিই নিয়ন্ত্রণ করেন’।
‘ওর হেড কোয়ার্টার কোথায়?’
‘ব্লুমেন্টেইন হ্রদের তীরে ব্রুকোপনডো’তে।
ব্রুকোপনডো’তো একটা বড় শহর। এ শহরের কোথায় তার হেড কোয়ার্টার?’
জবাব দিল না রবার্ট রায়।
‘বিরক্ত করবেন না রবার্ট রায়। বার বার রিভলবার নাচাতে আমি পারবো না। যা জিজ্ঞেস করব, সঙ্গে সঙ্গে ঠিক ঠিক তার জবাব দেবেন’। তীব্র কন্ঠে বলল আহমদ মুসা।
চমকে উঠে মুখ তুলল রবার্ট রায়। ভযে চোখ-মুখ তার কুঞ্চিত। বলল, স্যার আমি ব্রুকোপনডো’তে যাইনি। তবে আমি শুনেছি, সেখানে ‘শিবাজী কালী মন্দির’ নামে একটা মন্দির আছে। সেখানে বা তার পাশেই তিলক লাজপত পালের হেড কোয়ার্টার’।
‘গুম, হত্যা, অপহরণ, ইত্যাদি করছে কে? তিলকের লোকরা?’
‘এই কাজে ‘মাসুস’ কে সহযোগিতা করছে ইউরোপীয় ইন্ডিয়ান রাজনৈতিক দল ‘সুরিনাম পিপলস কংগ্রেস পার্টি’।
‘পারামারিবো’তে তিলক লাজপত পালের অফিস বা ঘাঁটিগুলো কোথায়?’
একটু দেরী করে আবার দ্রুত মুখ তুলল এবং বলতে লাগল সে, ‘সুরিনাম ও সাবামাক্কা নামে দুটি কালী মন্দিরে বা তার পাশে তিলকের দুটি অফিস বা ঘাঁটি আছে পারামারিবোতে। আর প্রত্যেক মহল্লায় মাসুস-এর একটা করে ইউনিট আছে। তার অফিসই ‘মাসুস-এর অফিস বলে পরিচিত’।
‘এ মন্দিরগুলো কোথায়?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
দুটি মন্দিরই সুরিনাম নদীর ধারে এবং উত্তর পাশে। নদী পথ ও সড়ক পথ দুপথেই যাওয়া যায়। অধিকাংশ মন্দিরেই মন্দিরের পাশে পুরোহিতদের বাড়ি থাকে।
‘মাসুস-এর অফিস বা ঘাঁটি কি ঐ ধরনের বাড়িতে?’
‘ওয়াং আলীকে ওরা কোথায় রেখেছে?
আমি জানিনা। তবে আমি জানি যে, প্রত্যেক মন্দিরেই বন্দীখানা আছে। এ রকম জায়গায় বন্দী করে রাখা সবচেয়ে নিরাপদ। পুলিশরা মন্দিরকে সাধারণত এড়িয়ে চলে’।
‘আপনি জানেন ওয়াং আলীকে কোথায় রাখা হয়েছে?’ কঠোর কন্ঠে বলল আহমদ মুসা।
রবার্ট রায় মুখ তুলে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। তার মুখে একটা অসহায় ভাব ফুটে উঠল। বলল, ‘সত্যিই আমি জানি না। একদিন আলোচনায় ওয়াং আলীর কথা উঠলে একজন বলেছিল, ওয়াং আলীকে কেউ উদ্ধার করতে পারবে না। পাশেই থানা। থানাও আমাদের। সংকেত পেলেই পুলিশ এসে পড়বে’।
আহমদ মুসার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, ‘মি. রবার্ট রায়, আপনি ‘মাসুস’ এর কোন দায়িত্বে?’
রবার্ট রায় আহমদ মুসার দিকে মুখ তুলে চাইল। তার চোখে ভয়। বলল, ‘আমি কোন দায়িত্বে নেই, নির্বাহী কমিটির সদস্য মাত্র’।
‘নির্বাহী কমিটির সদস্য কয়জন?’
‘দশজন’।
‘মাত্র দশজন?’
‘মহাকালী দশভূজা বলে ‘মায়ের সূর্য সন্তান’দের শীর্ষ কমিটিও দশজন’।
তাহলে তো আপনি অনেক কিছুই জানেন। আপনি মিথ্যা কথা বলছেন যে, আপনি ব্রুকোপনডোতে যান নি’।
‘না স্যার, আমি ব্রুকোপনডোতে যাইনি। ওখানে নির্বাহী কমিটির কোন মিটিং হয় না। ওটা হেড কোয়ার্টার হলেও তিলক লাজপত পাল তার পাসোর্নাল স্টাফদের নিয়ে ওখানে থাকেন। বাইরের লোকদের কোন যাতায়াত সেখানে নেই’। বলল রবার্ট রায়।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘ধন্যবাদ মি. রবার্ট রায়’।
আহমদ মুসা যেতে শুরু করলে রবার্ট রায় বলল, ‘স্যার আমাকে আর দরকার আছে? নিও নিকারীতে আমার পরিবার খুব অসুবিধায় আছে’।
‘আগে দেখি আপনার দেয়া তথ্য কতটা সত্য। আমাদের কাজ শেষ হলেই আপনি ছাড়া পাবেন’। আহমদ মুসা বলল।
আহমদ মুসা বেরিয়ে এল ঘর থেকে। তার সাথে সাথে বেরিয়ে এল হাত্তা নাসুমনও।
দুজন গিয়ে বসল আহমদ মুসার কক্ষে।
‘কেমন মনে হলো রবার্টের কথাকে?’ জিজ্ঞেস করল হাত্তা নাসুমন।
‘আমার মনে হয় ও যা বলেছে সত্য বলেছে। তাকে তো ছাড়ছি না। সত্য না বলে যাবে কোথায়’। আহমদ মুসা বলল।
‘এখন কি করণীয়? ওয়াং আলী ঠিক কোথায় আছে তাতো বলতে পারল না’। বলল হাত্তা নাসুমন।
‘যে ঠিকানাগুলো ও দিয়েছে তা যাচাই করার জন্য এখনই আমি বের হচ্ছি। আপনাদের লোকদের বলুন ছোটখাট একটা বোট জোগাড় করতে’।
‘বোট আমাদেরই আছে। কিন্তু এতবড় জার্নি করে আসার পর এখনি আবার বেরুবেন এটা ঠিক নয়’।
‘এখন সময় আমাদের খুব মূল্যবান। আগামী কাল সকালেই ওদের মুখোমুখি হতে হবে। তার আগেই ওদের সম্পর্কে যতটা পারা যায় জানা দরকার।
‘নদী পথে কেন?’
‘পারামারিবোতে ওদের যে দুটো ঘাঁটির সন্ধান রবার্ট দিয়েছে, সে দুটোই নদীর তীরে কালী মন্দির বা তার পাশে। নদী পথে গেলে নদী তীরের কালী মন্দির সহজেই বের করা যাবে’।
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘যাই পোশাক পাল্টে নেই’।
বলে আহমদ মুসা এগুলো ড্রেসিং রুমের দিকে।
‘আমি কি পোশাক পরব?’ বলল আহমদ হাত্তা নাসুমন।
থমকে দাঁড়াল আহমদ মুসা। বলল, ‘আপনি তো এখন বেরুচ্ছেন না’।
‘কেন? তাহলে কে যাবে সাথে?’
‘কেউ নয়। এমন কি বোটও আমিই চালাব’।
হাত্তা নাসুমন যেন আকাশ থেকে পড়ল। চোখে-মুখে এমন বিষ্ময় নিয়ে সে বলল, ‘যে সাংঘাতিক পরিস্থিতি তাতে এ ধরনের কাজে আপনার একা বেরুনো ঠিক নয়। তার উপর আপনি এখানে নতুন’।
‘মি. হাত্তা, অবস্থা সাংঘাতিক বলেই দলে ভারী হয়ে নয়, একা বেরুনো দরকার। আমি বিদেশী ট্যুরিস্ট, শহর দেখতে বেরিয়েছি। সাথে লোক দরকার কি’।
একটু থেমেই আহমদ মুসা আবার বলল, মি. হাত্তা, আপনার জরুরী কাজ আছে। আপনি কি দেশের সব জায়গায় এ মেসেজ দিয়েছেন যে, যাদের ভোটে দাঁড়ানোর কথা সবাইকেই ভোটে দাঁড়াতে হবে। জেল বা হাজতে যারা আছে তাদেরকেও’।
‘ব্যবস্থা করেছি। সকালের মধ্যে সবাই খবার পেয়ে যাবে’। বলল হাত্তা নাসুমন।
‘২১ তারিখে নমিনেশন পেপার সাবমিট হবে, এই তারিখেই বিকালে জনসভার ব্যবস্থা করুন। সে জনসভায় বলে দেবেন আপনাকে কারা কিডন্যাপ করেছিল এবং কিভাবে মার্কিন প্রশাসন আপনাকে উদ্ধার করেছে’।
‘এত তাড়াতাড়ি এই কনফ্রন্টেশনে যাওয়া কি ঠিক হবে?’ বলল হাত্তা নাসুমন।
কনফ্রন্টেশন নয়, প্রকৃত ঘটনা জনগনকে অবহিত করবেন মাত্র। বর্তমান অবস্থায় অবশ্য এটা কিছুটা আক্রমণাত্মক হবে বটে, কিন্তু এটাই হবে আপনাদের সবচেয়ে বড় ডিফেন্স। অত:পর আপনাকে নিরাপত্তা দেয়া হবে সরকারের দায়িত্ব। সরকার যদি আপনাকে গ্রেফতারও করে সেটা হবে আপনার জন্যে লাভজনক।‘ আহমদ মুসা বলল।
‘ওয়াং আলী তো এখনও ওদের হাতে’। হাত্তা নাসুমনের মধ্যে দ্বিধা।
‘একুশ তারিখ বিকেল আসতে এখনও ৪৩ ঘন্টার মত বাকি। আল্লাহর উপর ভরসা করুন’।
বলে আহমদ মুসা ঢুকে গেল ড্রেসিং রুমে।
মিনিট দশেক পর বেরিয়ে এল ইউরোপীয় ট্যুরিস্ট হয়ে। তার হাতে পারামারিবো শহরের ট্যুরিস্ট গাইড।
ইঞ্জিন বোটটা স্টার্ট দেবার আগে আহমদ মুসা শহরের মানচিত্রটার উপর চোখ বুলাল। দেখল, সে যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেটা শহরের পূর্ব প্রান্তে। এর একটু পূর্বেই সাগর। আটলান্টিকের গর্জন বেশ কানে আসছে। তার মানে তাকে যেতে হবে পশ্চিম দিকে। শহরটির নব্বই ভাগই পশ্চিমে।
বোট স্টার্ট দিল আহমদ মুসা।
বোটটি সুরিনাম নদী ধরে এগিয়ে চলল।
আহমদ মুসার চোখ নদীর ডান পাড়ে, উত্তর পাশে। তার চোখ দুটি সন্ধান করছে কালী মন্দিরের ঐতিহ্যবাহী চূড়া।
সুরিনাম সুন্দর নদী। দেশের দীর্ঘতম এ নদীটি পশ্চিম সুরিনামের ইভার্ট দা মাউন্টেন থেকে বের হয়ে আটলান্টিকে গিয়ে পড়েছে।
নানা বর্ণ ও নানারকম বোটের আনাগোনায় মুখরিত থাকে নদীর বুক। কিন্তু নদীর বুক এখন অনেকটাই শান্ত। রাত বেশ হয়েছে।
সবচেয়ে সুন্দর লাগছে নদীর দুপাশে আদিগন্ত আলোর মেলা। যেন নদীটি পরেছে আকাশী তারার মালা।
মিনিট পনের চলার পর আহমদ মুসা দেখতে পেল একটা মন্দিরের আলোকজ্জ্বল চূড়া। মন্দিরটি নদীর তীর ঘেঁষে।
মন্দিরের একটা ঘাট রয়েছে। বেশ বড় ঘাট। একটা অংশ জেটির আকারে তৈরী।
আহমদ মুসা মানচিত্রে দেখেছে এ মন্দিরের আশে-পাশে কোথাও থানা নেই, থানা আছে সামনের সাবামাক্কা মন্দিরের কাছে। থানা আছে ব্রুকোপনডোর শিবাজী মন্দিরের পাশেও।
মন্দিরটা দেখার জন্যে নামতে ইচ্ছা হলো আহমদ মুসার। কিন্তু পরক্ষণে ভাবল, দ্বিতীয় মন্দিরটাও তার খুঁজে পাওয়া দরকার। সাবামাক্কা মন্দির দেখে এসে ফেরার পথে এ মন্দির দেখা যাবে।
আবার জোরে ছুটতে শুরু করল আহমদ মুসার বোট।
আরও বিশ মিনিট চলার পর অন্য আর একটা মন্দিরের চূড়া দেখতে পেল আহমদ মুসা।
কাছে এসে দেখল এ মন্দিরের ও একটা ঘাট আছে। ঘাটের সাথে জেটিও। জেটিতে একটা মটর বোট বাঁধা।
আহমদ মুসার বোট ধীরে ধীরে পা বাড়াল জেটির দিকে। ইতোমধ্যে আহমদ মুসা মন্দিরের চারদিকে যতটা সম্ভব চোখ বুলাল।
মন্দিরটা প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। প্রাচীর ও মন্দির বিল্ডিং এর মাঝখানে কিছুটা ফাঁকা জায়গা আছে আন্দাজ করা যাচ্ছে। মন্দিরের পশ্চিম পাশেই থানাটা। সুরিনামের পতাকা উড়তে দেখেই বুঝল ওটা থানা।
মন্দিরের জেটিতে বোট বেঁধে নামল আহমদ মুসা ঘাটে। এক দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে মন্দিরের চত্বরে পা রাখল সে। মন্দির দক্ষিণ মুখী। মন্দিরের উত্তরের প্রাচীরে আরেকটা বড় গেট আছে। প্রাচীরের বাইরে দিয়ে প্রাচীর ঘেঁষে রাস্তা।
আহমদ মুসা চারদিকটা দেখে ফিরে এল মন্দিরের সম্মুখ চত্বরে।
মন্দিরটা গোল পিরামিড আকৃতির।
মন্দিরে ঢোকার একটাই দরজা।
অনেকগুলো সিঁড়ি ভেঙ্গে সে দরজায় পেৌঁছতে হয়। দরজা দুতলা পরিমাণ উঁচুতে।
দরজা পেরুলে বিশ ফুটের মত দীর্ঘ এক করিডোর। করিডোরের পর বিল্ডিং এর ঠিক কেন্দ্রে ডিম্বাকৃতি এক বিশাল হলঘর। হলঘরের চারদিকে অসংখ্য ঘর ও কুঠরী। হলঘরের অবস্থানই বলে দেয় হলঘরের নিচেও রয়েছে অনেক ঘর। আন্ডার গ্রাউন্ড বেজমেন্টেও থাকতে পারে গোপন কুঠরী।
ডিম্বাকৃতি হলঘরের শেষ কৌণিক প্রান্তে প্রতিষ্ঠিত রয়েছে বিশাল কালী মূর্তি।
কালী মূর্তির সামনে বসেছে কীর্তনের আসর। ধুপের ধোঁয়ায় চারদিক প্লাবিত, বাতাস ভারী।
দুজন পুরোহিত কালী মূর্তির সামনে ধ্যানমগ্ন। আরেকজন পুরোহিত সার্বিক তদারকিতে রয়েছে। সে বসছে, আবার মাঝে মাঝে উঠেও যাচ্ছে।
ট্যুরিস্ট রূপী আহমদ মুসা কীর্তন আসরের একপাশে দাঁড়িয়ে। তার বামদিকে একটু সামনেই কালী মূর্তি। ঠিক তার সামনেই একটু দূরে বসে আছে ধ্যানমগ্ন দুই পুরোহিত। তৃতীয় পুরোহিতও তার সামনে দিয়েই যাওয়া আসা করছে।
একবার পুরোহিতটি উঠে এলে আহমদ মুসা তার দিকে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে বলল, ‘মহারাজ, আমি একজন ট্যুরিস্ট। মন্দিরটা আমি ঘুরে ফিরে দেখতে চাই’।
পুরোহিত লোকটি থমকে দাঁড়াল এবং দেখল আহমদ মুসাকে। বলল, ‘এইতো দেখছেন, আর কি দেখতে চান?’
‘যেখানে যাই, মন্দির আমি দেখি। মন্দিরের নির্মাণ শৈলীর ব্যাপারে আমি খুব আগ্রহী’। বলল আহমদ মুসা।
পুরোহিত আবার তার চোখ স্থির করল আহমদ মুসার দিকে। তারপর মুখ ঘুরিয়ে একটু ভাবল। তারপর বলল, ‘হ্যাঁ ট্যুরিস্টরা কেউ কেউ মন্দির এভাবে দেখতে চায়। ঠিক আছে। আজ শনিবার আষাঢ়ের অমাবস্যা, এখনি কীর্তন শেষ হবে। তারপরই শুরু হবে ভৈরবী নৃত্য। ওটা চলবে শেষ রাত পর্যন্ত। নাচ শুরু হলেই আমি আপনাকে ঘুরিয়ে সব দেখাব’।
‘অনেক ধন্যবাদ’। বলল আহমদ মুসা।
‘নমস্তে’। বলে হাঁটতে শুরু করল পুরোহিত।
আহমদ মুসা ফিরে এল যেখানে সে আগে দাঁড়িয়ে ছিল সেখানে। পনের মিনিট পর শুরু হলো ভৈরবী নৃত্য।
পুরোহিত এসে ডেকে নিয়ে গেল আহমদ মুসাকে।
হল সংলগ্ন বড় একটা ঘরে প্রবেশ করল তারা। ঘরটি বসার ঘর। ঘরে কার্পেট আছে। গোটা ঘর সোফায় সাজানো।
পুরোহিত বলল, ‘যে হল ঘর থেকে আমরা এলাম, সেই হলঘরের চারদিকে এই রকমের দু’সারি ঘর আছে। প্রথম সারিতে এই ধরনের কয়েকটা বসার ঘর আছে। প্রথম সারির বাদ বাকি ঘরগুলো বিভিন্ন দেবতা ও মুনি-ঋষির নামে উৎসর্গিত। দ্বিতীয় সারির ঘরগুলো পুরোহিতদের অফিস। এই ঘরগুলোর উপরে অর্থাৎ মন্দিরের তৃতীয় তলায় পুরোহিত ও মেহমানদের আবাসস্থল। আর মন্দিরের চতুর্থ তলা প্রধান পুরোহিতের বাসস্থান। হল রুমের নিচে মন্দিরের প্রথম তলা মন্দিরের সংগ্রহশালা। এই তো আমাদের ছোট্ট এই মন্দিরের বিবরণ’।
পুরোহিত থামতেই আহমদ মুসা চোখে-মুখে দারুন আগ্রহ এনে জিজ্ঞেস করল, ‘সংগ্রহশালায় কি আছে?’
পুরোহিতের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। গর্বের ঔজ্জ্বল্য। বলল, ‘বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করা দেব-দেবীর মূর্তি, মুনি-ঋষিদের মূর্তি, চিত্র, ভারতের অজন্তার মত মন্দিরের দেয়াল চিত্রের অনুচিত্র, রামকৃষ্ঞ পরমহংসদেব, স্বামী বিবেকানন্দ, মহাত্মা গান্ধীর মত হিন্দু মহাগুরুদের ছবি, বাণী, চিত্র, ইত্যাদি।
‘অপূর্ব সংগ্রহশালা। না দেখলেই নয়। সব বাদ দিয়ে এই সংগ্রহ শালাই আমি দেখতে চাই’। বলল আহমদ মুসা এমন ভাব করে যে এই সংগ্রহশালা দেখতে তার দারুণ আগ্রহ।
‘রাতে তো এটা দেখানো যাবে না’। বলল পুরোহিত।
‘সর্বনাশ। আমি তো ব্যস্ত। আমার তো আর সময় হবে না!’ বলল আহমদ মুসা চরম হতাশ কন্ঠে। আহমদ মুসার চিন্তা, যে কোনভাবেই হোক মন্দিরের নিচের অংশটা দেখতে হবে। আহমদ মুসা আরো ভাবল, পুরোহিত তো বেসমেন্ট ফ্লোরের (আন্ডার গ্রাউন্ডের) কথা কিছু বলল না। সে কি এড়িয়ে গেল, না এ ধরনের কোন ফ্লোর এখানে নেই?
আহমদ মুসা হতাশা প্রকাশের পর পুরোহিত ভাবছিল। একটু পরে বলল, ঠিক আছে চলুন। মা দশভূজার পেছন দিক দিয়ে সিঁড়ি। ওদিক দিয়েই নামতে হবে’।
সিঁড়ি দিয়ে নামল তারা গ্রাউন্ড ফ্লোরে।
আলো জ্বালালো পুরোহিত।
গ্রাউন্ড ফ্লোর একটা হলঘর। কিন্তু এত পিলার যে এক নজরে কিছুই দেখা যায় না। তার উপর প্রত্যেক দুই পিলার আবার অর্ধ বৃত্তাকার গাঁথুনি দ্বারা সংযুক্ত। দু’ পিলার কার্যতঃ একটা দরজার আকার নিয়েছে। ফলে গোটা হলঘর চার দরজাওয়ালা অনেকগুলো ঘরের সমাহার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সত্যি হলঘরটা দেব-দেবতার মূর্তি, চিত্র ও চিত্রলিপিতে ঠাসা। দেখার মত সংগ্রহ বটে। আহমদ মুসা জিজ্ঞেস করল, ‘এত বড় বড় মূর্তি কি করে ঢুকালেন? ঐ সংকীর্ণ সিঁড়ি দিয়ে?’
পুরোহিত হাসল। বলল, ‘নিশ্চয় লক্ষ্য করেছেন বা সামনে দেখবেন হলের বাইরের অংশে মা্ঝে মাঝে স্টিলের দেয়াল। আসলে ওটা দেয়াল নয় দরজা। যার গা তালা দিয়ে লক করা। এরকম মোট চারটা দরজা আছে হলঘরে। এগুলো দিয়েই মূর্তিগুলো আনা হয়েছে’।
অযাচিতভাবে এই তথ্যটি জানতে পেরে দারুণ খুশি হলো আহমদ মুসা।
পুরোহিতের সাথে সে ঘুরে ঘুরে দেখছে বটে, কিন্তু তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে একটাই চিন্তা। এই মন্দিরেই কি ওয়াং আলী বন্দী আছে? পারামারিবো শহরে সুরিনাম নদী তীরের দুই মন্দিরের মধ্যে এ মন্দিরের সাথেই একটা থানা আছে। রবার্ট রায়ের কথা অনুসারে থানা সংলগ্ন এ মন্দিরেই তো ওয়াং আলী থাকার কথা।
ঘুরতে ঘুরতে তারা মেঝের উপর এক বেঢ়প দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। বিল্ডিং এর সাইড ওয়াল থেকে চার ফুট দুরত্বের সমান্তরালে দুটি দেয়াল মেঝের অনেকখানি ভেতরে চলে এসেছে। দু’ দেয়ালের মুখে এক বিশাল দরজা।
বেশ দূরত্বে অবস্থিত বেঢ়প এই দরজা আহমদ মুসার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। এটা ঘর হওয়ার মত প্রশস্ত নয়, আবার আলমারী হওয়ার মত ছোট নয়। তাহলে কি?
এ সময় আহমদ মুসার কানে একটা চিৎকার ভেসে এল।
উৎকর্ণ হলো আহমদ মুসা। সেই চিৎকার আর তার কানে এল না। কিন্তু একটু পরেই সেই ক্ষীণ চিৎকার ভেসে এল আবার।
উৎকর্ণ আহমদ মুসার মনে হলো বেঢপ ঐ দরজার দিক থেকেই চিৎকারটা ভেসে আসছে।
চমকে উঠল আহমদ মুসা। দরজাটা কি বন্দী সেলের? কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো চিৎকারটা এত কাছের নয়। চিৎকারটা মনে হয় কোন দূরবর্তী স্থান হতে ভেসে আসছে।
চট করে এ সময় আহমদ মুসার মাথায় এল, তাহলে এ দরজাটি কোন সিঁড়ি ঘরের? চিৎকারটা কি সিঁড়ি দিয়ে আন্ডার গ্রাউন্ড থেকে ভেসে আসা কোন শব্দ?
এই কথা মনে হতেই আহমদ মুসার গোটা দেহে উত্তেজনার একটা ঊষ্ঞ স্রোত বয়ে গেল। গোটা সত্ত্বা জুড়ে একটা প্রশ্ন জেগে উঠল, ওয়াং আলী কি এই আন্ডার গ্রাউন্ডে বন্দী আছে?
আহমদ মুসা পুরোহিতের দিকে মুখ ফিরাল। বলল, ‘এই বড় দরজাওয়ালা ঘরটি কি জন্যে মহারাজ?’
পুরোহিত চমকে উঠে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। প্রথম দিকের একটা বিব্রতভাব কাটিয়েই সে বলে উঠল, ‘এর ভিতরে বিশেষ কিছু মূল্যবান বস্তু রাখা হয়েছে’।
বলেই পুরোহিত চলতে শুরু করল। বলল, ‘আসুন দেরি হয়ে যাচ্ছে’।
আহমদ মুসা পকেট থেকে রিভলবার বের করল। রিভলবার পুরোহিতের দিকে তাক করে বলল, ‘দাঁড়ান মহারাজ। দরজাটা খুলুন’।
পুরোহিত ঘুরে দাঁড়াল। তার দিকে রিভলবার তাক করা আহমদ মুসাকে দেখে ভূত দেখার মত চমকে উঠল সে।
‘দরজা খুলুন মহারাজ’। রিভলবার নাচিয়ে নির্দেশ দিল আহমদ মুসা।
‘প্রধান পুরোহিত ছাড়া এ দরজা কেউ খুলতে পারেনা’। ভয়ার্ত কন্ঠে বলল পুরোহিত।
আহমদ মুসা রিভলবারের ট্রিগারে আঙুল চেপে বলল, ‘আমার রিভলবারে সাইলেন্সার লাগানো আছে। আপনাকে হত্যা করব, একটুও শব্দ হবে না’।
‘আমাকে মেরে ফেললেও আমি দরজা খুলতে পারবো না। এর চাবি থাকে প্রধান পুরোহিতদের কাছে’। বলল পুরোহিতটি কাঁদো কাঁদো কন্ঠে।
আহমদ মুসা তার কথা বিশ্বাস করল। বলল, ‘ঠিক আছে তাহলে বল, নিচে কি বন্দী খানা?
পুরোহিত কম্পিত কন্ঠে বলল, হ্যাঁ।
আহমদ মুসা রিভলবার ঘুরিয়ে নিল দরজার দিকে। দরজার কী হোলে তাক করল তার রিভলবারের নল।
এ সময় পুরোহিত বলে উঠল, ‘তালা ভাঙলেও আপনি ভেতরে ঢুকতে পারবেন না। দরজার সাথে এ্যালার্ম সংযুক্ত আছে। দরজা খুললেই এলার্ম বেজে উঠবে। ছুটে আসবে মন্দিরের প্রহরীরা নিচে। এক রিভলবার দিয়ে আপনি কিছুই করতে পারবেন না’।
কিন্তু এই ভবিষ্যত ভাবার সময় তার ছিল না।আহমদ মুসা নিশ্চিত যে, এখানেই ওয়াং আলী বন্দী আছে। তাকে উদ্ধার করতেই হবে।
আহমদ মুসা গুলী করল কী হোলে।
কী হোল উড়ে গেল।
খুলে গেল দরজা।
আহমদ মুসা পুরোহিতের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘চল’।
দরজা থেকেই একটা সিঁড়ি নেমে গেছে নিচের দিকে।
পুরোহিত তার দিকে রিভলবার তাক করা আহমদ মুসার কঠোর মুখের দিকে একবার চেয়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে শুরু করল।
আহমদ মুসা দরজা বন্ধ করে পুরোহিতের পিছু পিছু সিঁড়ি দিয়ে আন্ডার গ্রাউন্ড ফ্লোরে নামতে শুরু করল।
নিচে সিঁড়ির পরেই বড় গোলাকার একটা হলঘর। হলঘরটিতে অনেকগুলো বড় বড় বাক্স। হলঘরের চারদিক ঘিরে অনেক কক্ষ।
সিঁড়ির সামনে দুটি ঘরের পরের ঘর থেকেই চিৎকার শোনা যাচ্ছে।
আহমদ মুসা পুরোহিতকে নিয়ে সেই ঘরের সামনে এসে হাজির হলো।
‘দরজা খোল মহারাজ’। বলল আহমদ মুসা পুরোহিতকে।
‘স্যার আমার কাছে চাবি নেই। এসব চাবি থাকে প্রধান পুরোহিতের কাছে’। অসহায় কন্ঠে বলল পুরোহিত।
আহমদ মুসাকে আবার রিভলবার ব্যবহার করতে হলো।
দরজার কী হোলে গুলী করে দরজা খুলে ফেলল আহমদ মুসা।
ঘরে ঢুকে দেখল একজন যুবককে উবু করে টাঙিয়ে রাখা হয়েছে। আহমদ মুসাকে রিভলবার হাতে ঘরে ঢুকতে দেখে যুবকটি আরো জোরে চিৎকার করে উঠল, ‘আমি কিছুই করিনি, আমি কিছুই জানি না। আমাকে আর কষ্ট দেবেন না, মেরে ফেলুন আমাকে’।
যুবকটি খুব ফর্সা। তার চেহারার মধ্যে চীনা বৈশিষ্ট্য আছে, ইউরোপীয় বৈশিষ্ট্যও আছে, আবার রেড ইন্ডিয়ান বৈশিষ্ট্যও আছে।
আহমদ মুসা ভাবল এই-ই ওয়াং আলী।
যুবকটিকে দেখে আহমদ মুসা একটু বেশী এগিয়ে গিয়েছিল। রিভলবার ধরা হাতটাও তার নিচে নেমে এসেছিল। আর পেছনে পড়ে গিয়েছিল পুরোহিত।
পেছনে পড়া পুরোহিতের মুখটা হঠাৎ পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল। শক্ত হয়ে উঠেছিল তার মুখ।
হঠাৎ তার হাতটা চলে গেল তার গৈরিক চাদরের ভেতরে।
আহমদ মুসা একটু মুখ ঘুরিয়ে বলল, ‘মহারাজ আপনার ছুরিটার খুবই দরকার। ছুরিটা বের করে ওর পায়ের বাঁধন কেটে দিন’।
পুরোহিতের মুখ ছাইয়ের মত ফ্যাকাশে হয়ে গেল। কম্পিত হাতে ছুরি বের করল সে। ঘরের খাটিয়াটা টেনে এনে তার উপর উঠে যুবকটির পায়ের বাঁধন কেটে দিল সে।
যুবকটির দেহ আহমদ মুসা দুহাত দিয়ে ধরে নিল এবং ধীরে ধীরে দাঁড় করাতে লাগল।
আহমদ মুসার মনোযোগ পুরোহিতের দিক থেকে একটু বিচ্ছিন্ন হয়েছিল।
পুরোহিত এরই সুযোগ গ্রহণ করল। ছুরি বাগিয়ে সে ঝাঁপিয়ে পড়ল আহমদ মুসার উপর।
আহমদ মুসার দুহাত তখনও যুবকটিকে ধরে আছে। তাই পুরোহিতকে শেষ মূহুর্তে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখতে পেয়েও আত্মরক্ষার জন্যে কিছুই করতে পারল না সে। শুধু সেই মূহুর্তে যুবকটিকে নিয়ে সামনের দিকে সে ঝুঁকে গিয়েছিল।
পুরোহিত ঝাঁপিয়ে পড়েছিল আহমদ মুসার উপর। আহমদ মুসা তার মাথার বাম কানের পাশে তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করল।
যুবকটিকে নিয়ে আহমদ মুসা পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু পুরোহিত যা চেয়েছিল সেভাবে আহমদ মুসাকে ছুরি বসিয়ে জাপটে ধরে পড়তে পারেনি। তার ছুরির ফলা লাগে আহমদ মুসার মাথার বাম পাশে। শেষ মূহূর্তে আহমদ মুসা তার দেহটা সামনের দিকে সরিয়ে নেয়ায় পুরোহিতের দেহটা কিছুটা ভারসাম্য হারায় ও আহমদ মুসার পাশে পড়ে যায়। তবে তার হাতের ছুরিটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হলেও আহমদ মুসার মাথার বাম পাশের অনেকটা জায়গা চিরে বেরিয়ে যায়।
আহমদ মুসা পড়ে গিয়েই তার হাত থেকে খসে পড়া রিভলবার কুড়িয়ে নিয়ে রিভলবারের ট্রিগারে হাত চেপেই নিজেকে ঘুরিয়ে নিল পুরোহিতের দিকে। দেখল পুরোহিতের চেহারা হয়ে উঠেছে হিংস্র বাঘের মত। তার হাতের উদ্যত ছুরি ছুটে আসছে তার বুক লক্ষ্য করে।
আহমদ মুসা তার তর্জনি চাপল রিভলবারের ট্রিগারে।
আহমদ মুসার বুক লক্ষ্যে ছুটে আসা পুরোহিতের ছুরি তখন মাঝ পথে।
আহমদ মুসার রিভলবারের গুলি পুরোহিতের ছুরি ধরা ডান হাতের কব্জীতে গিয়ে আঘাত করল।
ছুরি পড়ে গেল তার হাত থেকে।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
বা হাত দিয়ে আহমদ মুসা তার মাথার আহত স্থানটার একটা ধারণা নেয়ার চেষ্ট করল। দেখল ছুরির ফলায় চার ইঞ্চি পরিমাণ জায়গা চিরে গেছে।
যুবকটিও এ সময় ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ইস, আপনার মাথার আহত জায়গা দিয়ে ভীষণ রক্ত বেরুচ্ছে’।
উপরে এ সময় অনেকগুলো উত্তেজিত কথা-বার্তা ও পায়ের শব্দ শোনা গেল।
আহমদ মুসা বুঝল, দরজা খোলার সংকেত পেয়েই নিশ্চয় ওরা এসেছে। এখনি ওরা নিচে আসবে।
আহমদ মুসা দ্রুত বলল যুবকটিকে, ‘তুমি রিভলবার চালাতে জান?’
যুবকটিও উপরের কথাবার্তা ও দৌড়াদৌড়ির শব্দ শুনতে পেয়েছে। ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে তার মুখ। বলল, ‘পারব’।
আহমদ মুসা তার পায়ের মোজায় গুঁজে রাখা একটা রিভলবার বের করে যুবকটির হাতে দিল।
তার পর আহমদ মুসা পুরোহিতকে টেনে তুলে দাঁড় করাল। বলল, ‘চল আমাদের সাথে’।
আহমদ মুসা তাকে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে এল। পেছনে পেছনে এল যুবকটি।
সিঁড়ির গোড়ায় আসতেই আহমদ মুসা সিঁড়ির মুখেই অনেকগুলো পায়ের শব্দ পেল।
এক ঝটকায় আহমদ মুসা পুরোহিতকে টেনে নিয়ে পেছনে সরে এল। পুরোহিতকে যুবকটির দিকে ঠেলে দিয়ে বলল, ‘তুমি এর দিকে নজর রাখ। কোন শয়তানী যেন না করতে পারে’।
যুবকটি পুরোহিতকে টেনে নিয়ে তার দিকে রিভলবার বাগিয়ে সিঁড়ির তলায় গিয়ে দাঁড়াল।
আহমদ মুসা তার ডান হাতে এম-১০ বাগিয়ে সিঁড়ির গোড়ায় গিয়ে গুঁড়ি মেরে বসল। ঘরের আলোটা সিঁড়ির বিপরীত দিকের প্রান্তে থাকায় সিঁড়ির ছায়া পড়েছে এদিকে। সে কারণে সিঁড়ির গোড়াটা মোটামুটি অন্ধকার।
সিঁড়ি মুখের দরজাটা প্রচন্ড শব্দে খুলে গেল। আহমদ মুসা সিঁড়ি দিয়ে নামার আগে দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে এসেছিল।
আহমদ মুসা বুঝল, কারও প্রচন্ড লাথিতে দরজাটা খুলে গেছে।
দরজা খুলে যাবার পরই গুলির বৃষ্টি ছুটে এলো সিঁড়ি দিয়ে নিচে।
পায়ের শব্দ পাচ্ছে আহমদ মুসা। অনেকগুলো পায়ের শব্দ। বুঝল, গুলী করতে করতে ওরা নামছে।
যতই ওরা নামছে, গুলি বৃষ্টির গতি সিঁড়ির গোড়া থেকে ততই সরে যাচ্ছে।
এক সময় গুলীর গতি সিঁড়ির গোড়া থেকে আরও সরে গেল এবং অনেকটা মেঝের সমান্তরাল হয়ে উঠল।
আহমদ মুসা বুঝল, ওরা সিঁড়ির মাঝামাঝি অংশে পৌঁছে গেছে।
আহমদ মুসা এম-১০ এর ট্রিগারে তর্জনি চেপে এক ধাপ পরিমাণ সামনে এগিয়ে এক ঝটকায় উঠে দাঁড়াল। তার এম-১০ মেশিন রিভলবারের নল তখন সিঁড়ির সমান্তরালে উপরের দিকে।
সিঁড়িতে ওরা তখন চারজন আর সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়েছিল দুজন। আহমদ মুসার আকস্মিক আক্রমণের মুখে ওরা ওদের স্টেনগান আহমদ মুসার দিকে ঘুরিয়ে নিতে পারল না।
আহমদ মুসা তার ভয়ংকর এম-১০ এর ট্রিগার মাত্র কয়েক সেকেন্ড চেপে রেখে সিঁড়ির ঐ লোকদের উপর ঘুরিয়ে নিয়ে এল। ছয়টি দেহ বুলেটের আঘাতে ঝাঁঝরা হয়ে গেল। ঝরে পড়ল সিঁড়ির উপর।
গুলি থামিয়েই আহমদ মুসা ডাকল যুবকটিকে। যুবকটি পুরোহিতকে সঙ্গে করে নিয়ে আহমদ মুসার কাছে এল। আহমদ মুসা পুরোহিতকে সামনে নিয়ে বলল, ‘ওঠ সিঁড়ি দিয়ে’।
পুরোহিত গুলিবিদ্ধ তার ডান হাতকে বাঁ হাত দিয়ে চেপে ধরে আছে। সে আহমদ মুসার নির্দেশের সংগে সংগে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে লাগল। আহমদ মুসা তার ঠিক পেছনে। আর যুবকটি আহমদ মুসার পেছনে।
সিঁড়ির মুখের কাছাকাছি গিয়েই আহমদ মুসা তার বাঁ হাত দিয়ে পুরোহিতের গলা পেঁচিয়ে নিজের দেহের সাথে সেঁটে নিয়ে যুবকটিকে নির্দেশ দিল, ‘তুমি ঠিক আমার পেছনে থাকবে এবং পেছন দিকটা সামলাবে’।
পুরোহিতকে ঢাল হিসেবে সামনে রেখে আহমদ মুসা উঠে এল সিঁড়ির মাথায়। তার ডান হাতে উদ্যত এম-১০ মেশিন রিভলবার।
সিঁড়ির মাথায় উঠতেই আহমদ মুসা দেখল ওরা আরও চারজন ছুটে আসছে সিঁড়ির মুখের দিকে। ওদেরও হাতে উদ্যত স্টেনগান। কিন্তু গুলি করতে গিয়ে মুহূর্তের জন্যে দ্বিধার সৃষ্টি হয়েছিল তাদের মধ্যে। তারা দেখল, তারা গুলি করলে প্রথমেই মারা পড়ে পুরোহিত।
তাদের এই দ্বিধার সুযোগ নিল আহমদ মুসা। তার এম-১০ রিভলবার এক ঝাঁক গুলি ওদের চারজনকে ছেঁকে ধরল। ওদের চারজনের রক্তাক্ত দেহ ঝরে পড়ল মাটিতে।
দুতলা থেকে নেমে আসা সিঁড়ি দিয়ে আরো দুজন নামছিল। তারা চারজনের এই অবস্থা দেখে ছুটে পালাল সিঁড়ি দিয়ে উপরে।
শোনা যাচ্ছে, উপরে বিরাট হৈ চৈ চলছে।
আহমদ মুসা ভাবল দোতালার পথে প্রধান গেট দিয়ে বেরুনো সম্ভব নয়। মনে পড়ল তার পুরোহিতের কাছে শোনা এ হলঘরের চারটি স্টিলের গেটের কথা।
খুশি হয়ে উঠল আহমদ মুসা। তার বাঁ পাশেই এ হলঘরের দক্ষিণ দেয়াল। এ দেয়ালে খুব সামনেই এ ধরনের একটা গেট।
আহমদ মুসা পুরোহিতকে ঐভাবে সামনে ধরে রেখে পিছু হটে চলল দক্ষিণ দেয়ালের সেই স্টিল গেটের কাছে।
আহমদ মুসা আরও খুশি হলো এই ভেবে যে, এ দেয়ালের পর চত্বরটা। তার পরেই নদী।
বন্ধ স্টিল গেটের সামনে গিয়ে আহমদ মুসা ছেড়ে দিল পুরোহিতকে। সে বিস্মিত হলো, ওরা আর কেউ এ হলঘরে আসছে না কেন? নিহত এই দশজনই কি ওদের সশস্ত্র প্রহরী ছিল, না অন্য কোন পরিকল্পনা?
আহমদ মুসা স্টিলের দরজার কী হোলটা পরীক্ষা করতে করতে পুরোহিতকে জিজ্ঞেস করল, ‘মন্দিরে আপনাদের প্রহরী কতজন?’
‘চেৌদ্দজন। দুজন ছুটিতে’। বলল পুরোহিত।
‘এতক্ষণে কি পুলিশ এসে পৌঁছেছে বাইরে?’ বলল আহমদ মুসা।
‘পুলিশ?’ বিস্ময় প্রকাশ করল পুরোহিত।
আহমদ মুসা তার দিকে রিভলবার তাক করে বলল, ‘ভনিতা ছাড় মহারাজ। কোন ঘটনা ঘটলে সংগে সংগে পুলিশকে সংকেত দেবার ব্যবস্থা মন্দিরে আছে। আমি জিজ্ঞেস করছি, পুলিশ নিশ্চয় এসেছে। কিন্তু তারা এখানে আসছে না কেন?’
পুরোহিত বেদনায় কুঁকড়ে গিয়ে বিস্মিত চোখে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। আহমদ মুসা ঐ গোপন বিষয়টা কি করে জানল এটাই বোধ হয় তার বিস্ময়ের কারণ। একটু সময় নিয়ে বলল সে, ‘পুলিশ উপরের হলরুমে এসে অপেক্ষা করতে পারে, আবার মন্দিরের চত্বরে পজিশন নিতে পারে। আমি ঠিক জানি না’।
আহমদ মুসা যুবকটির দিকে তাকাল। বলল, ‘এই দরজার পরে একটা চত্বর। তার পরেই নদী। নদীর ঘাটে গিয়ে আমাদের নৌকায় উঠতে হবে। আমার পেছন পেছন আসবে। যদি দরকার হয় পেছন দিকটা সামাল দেবে’।
আহমদ মুসা এবার ফিরে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে মনোযোগ দিল। গুলি করে তালা ভাঙা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। কিন্তু এ তালা ভাঙার শব্দে শত্রু পক্ষ আমাদের অবস্থান জেনে যাবে এবং আমাদের পরিকল্পনা কি তাও বুঝতে পারবে। কিন্তু গুলি করে তালা ভাঙা ছাড়া কোন উপায়ও নেই।
দরজার কী হোলে রিভলবারের নল ঠেকিয়ে গুলি করল আহমদ মুসা।
খুলে ফেলল দরজা এক ঝটকায়। তার হাতে উদ্যত এম-১০। অন্যদিকে পুরোহিতকে ধরে রেখেছে সামনে।
জায়গাটা মন্দিরের বিশালাকার মূল প্রবেশ সিঁড়ির পাশেই। সোজা এগুলে সিঁড়ির পাশ দিয়ে তারা প্রাচীরের দক্ষিণ দরজায় পৌঁছে যাবে।
আহমদ মুসা সামনে কাউকেই দেখল না। তবে সিঁড়ির উপর দিকে মানুষের হৈ চৈ ও পায়ের শব্দ পাওয়া গেল। আহমদ মুসা বুঝতে পারল ওরা নিচে শব্দ শুনে আসছে।
পেছনে তাকিয়ে আহমদ মুসা দ্রুত কন্ঠে যুবককে বলল, ‘তুমি সব সময় আমার পেছনে থাকবে’।
বলেই আহমদ মুসা পুরোহিতকে ঠেলে নিয়ে ছুটল সিঁড়ির গোড়া বরাবর।
সিঁড়ির গোড়ায় পৌঁছেই আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়াল। এম-১০ এর ট্রিগারে ছিল তার আঙুল। ঘুরবার সময় ট্রিগারে চেপে বসেছিল তার তর্জনিটা।
বৃষ্টির মত গুলি ছুটে গেল গোটা সিঁড়ি কভার করে উপর দিকে।
সিঁড়ি ধরে নামছিল কয়েকজন পুলিশ ও আরও কয়েকজন মানুষও।
গুলি বৃষ্টি হওয়ার সংগে সংগে পুলিশ ও লোকগুলো সিঁড়ির উপর পড়ে গেল। কয়জন গুলী খেয়ে পড়ল আর কয়জন বাঁচার জন্যে শুয়ে পড়ল তা বুঝল না আহমদ মুসা। বুঝার সময়ও তার নেই।
পুলিশ ও লোকগুলো সব সিঁড়ির উপর পড়ে যেতেই আহমদ মুসা পুরোহিতকে ছেড়ে দিয়ে বাম হাত দিয়ে পকেট থেকে ডিমের মত স্মোক বোমা বের করে ছুঁড়ে মারল সিঁড়ি লক্ষ্যে।
বোমা ফাটার চেয়ে হাল্কা শব্দে স্মোক বোমা বিস্ফোরিত হলো। সংগে সংগে কালো ধোঁয়ায় ছেয়ে গেল সিঁড়ি ও তার আশ পাশটা।
প্রাচীরের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে যুবককে বলল, ‘দৌড় দাও’।
তারপর আহমদ মুসা পুরোহিতকে বলল, ‘তুমি এখানে শুয়ে পড়, না হলে গুলীতে মরবে’। বলে সে ছুটল প্রাচীরের দরজার দিকে। তার পেছনে ছুটছে যুবকটি। সিঁড়ির দিক থেকে গুলীর শব্দ হতে লাগল। কিন্তু আন্দাজের উপর ছোঁড়া গুলীর দু’একটা গুলী আশ-পাশ দিয়ে চলে গেল। আহমদ মুসারা নিরাপদে পার হল প্রাচীরের দরজা।
প্রাচীরের পাশের রাস্তা ধরে ছুটে চলল আহমদ মুসা ও যুবকটি। আহমদ মুসার লক্ষ্য ঘাটে বেঁধে রেখে আসা বোট।
বোটে উঠল তারা দুজন।
আহমদ মুসা বসল গিয়ে ড্রাইভিং সিটে। বোট স্টার্ট দিয়ে তার রিভলবার তাক করল জেটিতে বেঁধে রাখা অন্য একটি বোটকে। ট্রিগার টিপল আহমদ মুসা। কয়েকটা গুলী গিয়ে বিদ্ধ করল বোটের ওয়াটার লাইন ঘেঁসে। বোটের গায়ে কয়েকটা গর্তের সৃষ্টি হলো। আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘ওরা ঐ বোটটা নিয়ে পঞ্চাশ গজও এগুতে পারবে না’।
আহমদ মুসার বোট তখন চলতে শুরু করেছে। তারা দেখল তিনজন পুলিশ ও আরও কয়েকজন লোক মন্দিরের দিক থেকে ছুটে এসে জেটিতে বাঁধা সেই বোটে উঠল। স্টার্ট নিয়ে ছুটে চলতে শুরু করল তাদের বোট।
মাত্র কয়েক মিনিট, দূর থেকেই আহমদ মুসারা আলোর আঁকা বাঁকা গতি দেখে বুঝল ঐ বোটে হৈ চৈ শুরু হয়ে গেছে। আলোর গতি বেঁকে গেল। বোট তারা কুলে ভেড়াবার চেষ্টা করছে বুঝল আহমদ মুসারা। কিন্তু পারল না। আলোটা তলিয়ে গেল। তলিয়ে গেল বোট। অনুমান করল আহমদ মুসারা পানিতে হাবুডুবু খাচ্ছে নিশ্চয় ওরা সাত আটজন মানুষ।
আহমদ মুসারা তখন অনেক দূর চলে এসেছে। পুলিশরা বা ওরা নতুন করে বোট জোগাড় করে আবার আহমদ মুসাদের পিছু নেবে সেটা অসম্ভব।
স্বস্তির চিহ্ন ফুটে উঠেছে যুবকটির চোখে মুখে। বলল সে আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে, ‘ওদের বোট ফুটো করে আসতে হবে এই চিন্তাটা তখন আপনার মাথায় এলো কি করে?’
‘দেখ বাঁচার চেষ্টা যখন মানুষের মধ্যে মুখ্য হয়ে উঠে, তখন কত বুদ্ধি বের হয়!’ বলল আহমদ মুসা।
‘আপনাকে ধন্যবাদ স্যার। আপনি রীতিমত এক যুদ্ধ করেছেন। আমি নিজ চোখে না দেখলে একে মনে হতো এক সিনেমার গল্প। একজন মাত্র লোক এমন অসাধ্য সাধন করতে পারে, তা আমার কাছে এতদিন অবিশ্বাস্য ছিল’। বলল যুবকটি।
আহমদ মুসা কোন জবাব দিল না।
যুবকটিই আবার কথা বলল। বলল সে, ‘স্যার আজকের রাতই আমার শেষ রাত ছিল। আপনি আমাকে বাঁচিয়েছেন। কে আপনি স্যার?
যুবকটির প্রশ্নের জবাব না দিয়ে আহমদ মুসা জিজ্ঞেস করল,
‘তুমি কি ওয়াং আলী?’
‘জি না। আমি ওভানডো এল টেরেক। আপনি ওয়াং আলীকে চেনেন?’ বলল ওভানডো এল টেরেক নামের যুবকটি।
‘তুমি চেন?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘চিনি না। ওদের কথাবার্তায় ওয়াং আলীর নাম শুনেছি। উনি তো এখানেই ছিলেন। আজ বিকেলে অন্য কোথাও নিয়ে গেছে’।
‘কোথায় নিয়ে গেছে?’
‘তা জানতে পারিনি। তবে ওদের কথা থেকে শুনেছি আগামী কাল বিশ তারিখের পর তারা ওয়াং আলীকে হত্যা করবে। কিন্তু আপনি তাকে চেনেন?’
‘চিনি না, কিন্তু জানি। তাকে উদ্ধার করার জন্যেই আমার এই ঘোরাঘুরি’।
‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ তাকে উদ্ধার করতে এসে আমাকে উদ্ধার করলেন’।
‘আমিও ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিচ্ছি। আমার অভিযান ব্যর্থ হয়নি। ওয়াং আলীকে উদ্ধার করত না পারলেও তোমাকে উদ্ধার করেছি’।
‘কিন্তু স্যার বিপদ আমার কাটেনি। আজ সন্ধ্যায় ওদের একজনের কাছে শুনলাম, আজই ওরা আমার স্ত্রীকে কিডন্যাপ করবে। তাকে এনে অত্যাচার করে আমাকে কথা বলতে বাধ্য করবে’। ভেঙে পড়া কন্ঠে বলল ওভানডো।
‘তোমাকে কি বলাতে চায়? কি শত্রুতা ওদের সাথে তোমার?’
‘বলল, ‘সে অনেক কথা স্যার। বলছি। কিন্তু তার আগে আপনার মাথার আঘাত থেকে রক্ত বন্ধ করা দরকার’।
উঠে দাঁড়াল ওভানডো।
‘না, ওভানডো বস। রক্ত যা পড়ার তা পড়ে গেছে। এখন তেমন একটা পড়ছে না।এখনই বন্ধ হয়ে যাবে।তুমি বল তোমার কথা’।
ওভানডো বসল আহমদ মুসার কাছাকাছি এসে। বলল, ‘স্যার এই সুরিনাম নদীর মুখে নদীর ঠিক উত্তর উপকুল ঘেঁষে, এই পারামারিবো শহরের পূর্ব প্রান্তে আমাদের পাঁচশ একরের একটা স্টেট আছে। স্টেটের ঠিক মাঝ বরাবর আমাদের বাড়ি। বাড়িটা প্রায় বিলীন হয়ে গেছে সেই দুর্গের মধ্যে। দুর্গকে ‘কাপ্তান দুর্গ’ বলত। সেই হিসেবে আমাদের বাড়িকেও ‘কাপ্তান বা টেরেক বাড়ি’ বলা হয়। ওদের চোখ দুর্গ এলাকার উপর। ওরা আমাদের গোটা স্টেটটাই দ্বিগুন-তিনগুন দাম দিয়ে কিনতে চেয়েছিল। আমরা রাজী হইনি। শেষে ওরা দুর্গ এলাকা কিনতে চায় এবং আমাদেরকে বাড়ি সরিয়ে নিতে বলে। ওরা কয়েক গুন বেশি দামে জায়গাটা কিনবে এবং অন্যত্র বাড়িও তারা তৈরী করে দেবে। কিন্তু এতে আমরা সম্মত হইনি। এটা নিয়েই বিরোধের সূত্রপাত। শেষ পর্যন্ত ওরা আমাকে কিডন্যাপ করেছে। ওরা আমার কাছে দুটি জিনিস জানতে চাচ্ছে। একটি হলো, পরিবারের পুরনো কাগজ পত্রের বাক্সটা কার কাছে, কোথায় আছে? দ্বিতীয়টি হলো, দুর্গ এলাকা বিক্রি করার সম্মতি’।
‘জায়গাটা তোমরা ছাড়ছো না কেন? পুরনো কাগজ পত্রে কি আছে?’
‘ঐ স্টেট-এর সাথে, ঐ দুর্গের সাথে আমাদের শতশত বছরের পারিবারিক ইতিহাস জড়িত। কোন মূল্যেই এটা আমরা কাউকে দিতে পারি না’।
‘আর পারিবারিক পুরনো কাগজ পত্র?’
‘ওটাও আমাদের পরিবারের এক অতি মূল্যবান সম্পদ। ঐ কাগজ পত্রের আমরা অনেক কিছুই বুঝিনা। ব্যবহারিক কোন মূল্যও নেই। তবু আমাদের পরিবার ওটা এতদিন যক্ষের ধনের মত আগলে রেখেছে। কাউকে কোন মূল্যেই আমরা দিতে পারিনা ওটা’।
‘এ সবের জন্য ওরা এমন মরিয়া হয়ে উঠেছে কেন?’
‘আমরা এর রহস্য জানতাম না। কিন্তু ওদের কাছ থেকে একটা কাহিনী শুনেছি। কয়েকদিন আগে চোখ বন্ধ করে মরার মত পড়েছিলাম। দীর্ঘক্ষণ নানারকম নির্যাতন চালাবার পর ওরা বসে জিরিয়ে নিচ্ছিল।ওরা মনে করেছিল আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছি। ওরা দুজন গল্প করছিল। ওদের গল্প থেকে জানলাম, দুর্গের কোন এক বিশেষ স্থানে জাহাজ ভরে আনা সোনা পুঁতে রাখা আছে। আমাদের পারিবারিক কাগজপত্রে কোথায় স্বর্ণ রাখা আছে তার সংকেত পাওয়া যাবে’।
‘এ ধরণের গুপ্তধনের কথা তোমার পরিবার জানে না, কিন্তু এরা জানল কি করে?’
‘ওদের গল্পে এ বিষয়েও কিছু জানলাম। ওরা বলল, ত্রিনিদাদের সামনে কোথায় যেন কলম্বাসের জাহাজ বহর হ্যারিকেনের কবলে পড়েছিল। সবাই জানে সে হ্যারিকেনে বিশটি জাহাজ ডুবে যায়, কিন্তু আসলে ডুবে উনিশটি। একটি জাহাজ ক্যাপ্টেনের অদ্ভূত দক্ষতায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েও বেঁচে যায়। কিন্তু হ্যারিকেন তাড়িত হয়ে চলে আসে সুরিনাম উপকুলে। ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত জাহাজ ডুবে যাবার আগেই জাহাজের ক্যাপ্টেন আরহমেন এল টেরেক জাহাজ বোঝাই সোনা কূলে নামিয়ে নেয়’।
‘শুনতে রূপকথার মত লাগল। সোনা পাগল ইউরোপীয়দের এমন হাজারো গল্প আছে। আবার হতে পারে এটা সত্য ঘটনা’।
‘আপনি ঠিকই বলেছেন। আমার কাছেও একে রূপ কথার মত মনে হয়েছে। ইউরোপের কথা বলছেন কেন, সোনা নিয়ে লাখো কাহিনী আছে আমাদের আমেরিকাতেও’।
‘আর সে গল্পের অনুসরণে সোনা খুঁজতে গিয়ে কত লোক যে কতভাবে হারিয়ে গেছে তার ইয়াত্তা নেই’।
‘যেমন আমরা ওদের সোনা খোঁজার পাল্লায় পড়ে সব হারাতে বসেছি’।
কথা বলেই ওভানডো দ্রুত চোখ তুলে আহমদ মুসার দিকে তাকাল এবং দ্রুত কন্ঠেই বলল, স্যার আমার ওয়াইফকে কিডন্যাপ করতে ওদের আজ যাওয়ার কথা, যদি গিয়ে থাকে!’ ওভানডো’র কথায় যেন কান্না ঝরে পড়ল।
আহমদ মুসা বোটের স্পিড বাড়িয়ে দিল। বলল, ‘আল্লাহ ভরসা ওভানডো। চল দেখা যাক। কিডন্যাপ করলে ওরা ওকে কোথায় নিয়ে যাবে?’
‘আমি যেখানে বন্দী ছিলাম সেখানে আমার কাছে ওঁকে নিয়ে যাবার কথা’।
‘আচ্ছা চল দেখা যাক’।
বলে আহমদ মুসা আবার সামনের দিকে মনোযোগ দিল।
ওভানডো বলে উঠল, ‘স্যার, আপনি আমার বাসায় যাবেন?’
‘কেন, আমাকে নিয়ে যাবার ইচ্ছা নেই?’
‘আছে বলেই জিজ্ঞেস করছি স্যার। আমার মা, আমার দাদী আপনাকে পেলে খুব খুশী হবে’।
‘তোমার দাদী আছে? কত বয়স?’
‘একশ পাঁচ’।
‘তাহলে বিরাট বহুদর্শী তো তিনি। আর কে আছে তোমার?’
‘আব্বার কথা বলছেন তো? তিনি নেই’।
‘স্যরি’। বলল আহমদ মুসা।
কোন উত্তর দিল না ওভানডো।
আহমদ মুসার দৃষ্টি সামনে নিবদ্ধ।
সবটুকু শক্তি দিয়ে এগিয়ে চলেছে বোট।