৩৩. সুরিনামের সংকটে

চ্যাপ্টার

ওভানডো এল টেরেকের স্টেটে প্রবেশ করল ওভানডোদের গাড়ি। ড্রাইভ করছিল আহমদ মুসা।
স্টেটের মাঝখানে ওভানডোদের বাড়ি। বাড়ির চারদিকে স্টেট জুড়ে বাগান ও ফসলের ক্ষেত। মাঝে মাঝে জংগালাকীর্ণ টিলা।
নদীর তীর থেকে একটা প্রশস্ত পাথুরে রাস্তা স্টেটের গেট পেরিয়ে স্টেটের ভেতর দিয়ে এগিয়ে গেছে বাড়ির দিকে।
পাথুরে রাস্তার দুধারে ফসলের ক্ষেত। দু একটা টিলাকেও অতিক্রম করতে হয়েছে রাস্তাকে।
স্টেটের উত্তর ও পশ্চিম অংশে বাগান।
গোটা স্টেটটাই প্রাচীর দিয়ে ঘেরা।
স্টেটের রাস্তা দিয়ে বাড়িতে পেৌঁছার মাঝামাঝি পথে এসেছে আহমদ মুসার গাড়ি।
আহমদ মুসা দেখল ওভানডোর বাড়ির দিক থেকে চারটি হেডলাইট দ্রুত এগিয়ে আসছে।
‘তোমাদের কয়টি গাড়ি ওভানডো?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘দুটো গাড়ি। এই একটা আর বাড়িতে আছে একটা’। বলল ওভানডো।
‘তাহলে এত রাতে তোমাদের বাড়ি থেকে দুটো গাড়ি একসাথে বেরিয় আসছে কেন?’ প্রশ্ন আহমদ মুসার।
‘আমিও তাই ভাবছি? তাহলে কি…..?’
কথা শেষ না করেই থেমে গেল ওভানডো। তার কন্ঠে ঝরে পড়ল উদ্বেগ।
‘তোমার আশংকা মনে হয় ঠিক ওভানডো’।
বলেই আহমদ মুসা তার গাড়ি রাস্তার ঠিক মাঝ বরাবর নিয়ে এগিয়ে চলল।
রাস্তা প্রশস্ত হলেও পাশাপাশি দুটি গাড়ি চলার মত পথ।
আহমদ মুসার গাড়ি রাস্তার মাঝখানে আসায় তার গাড়ি পাশ কাটিয়ে যাবার আর পথ থাকলো না।
রাস্তার দুপাশেই ধানের ক্ষেত। ক্ষেত রাস্তা থেকে নিচু এবং তাতে পানি রয়েছে।
‘ওভানডো গাড়ি দুটির গতি দেখে মনে হচ্ছে শত্রু পক্ষেরই। মনে হয় মিশন শেষ করে পালাচ্ছে’। আহমদ মুসা বলল।
‘তাহলে কিডন্যাপ করেছে ওরা আমার স্ত্রীকে?’ প্রায় আর্তনাদ করে উঠল ওভানডোর কন্ঠ।
‘ওভানডো দুর্বল হয়ে পড়ার সময় এটা নয়’।
বলে আহমদ মুসা তার গাড়ি ডেড স্টপ করার মত থামিয়ে দিল।
ঝোঁক সামলাতে না পেরে ওভানডো ড্যাশ বোর্ডের উপর মুখ থুবড়ে পড়তে যাচ্ছিল। আহমদ মুসা বাঁ হাত দিয়ে তাকে আটকে দিল।
সোজা হয়ে বসে ওভানডো বলল, ‘গাড়ি থামিয়ে দিলেন যে’।
‘থামিয়ে দেইনি। বলতে হবে আমাদের গাড়ি নষ্ট হয়ে গেছে’। আহমদ মুসা বলল।
‘তাতে কি হবে?’ জিজ্ঞেস করল ওভানডো। তার কন্ঠে বিস্ময়।
‘আমাদের গাড়ির পাশ কাটিয়ে ওরা যেতে পারবে না। থামাতে বাধ্য হবে ওদের গাড়ি। তারপর দেখবে কি ঘটে’। আহমদ মুসা বলল।
সামনের দুটি গাড়ি একদম কাছে চলে এসেছে। সাইড দেবার জন্যে অবিরাম হর্ন দিচ্ছে।
আহমদ মুসা তার রিভলবারটা কোটের বাম পকেটে রেখে ডান হাতে নিল এম-১০ মাইক্রো মেশিন গান। বলল ওভানডোকে, ‘তুমি গাড়িতেই বসে থাকবে। গোলাগুলী শুরু হলে তখন তুমি গাড়ির মেঝেয় শুয়ে পড়বে’।
আহমদ মুসা গাড়ি থেকে নামার সময় ওভানডো বলল, ‘আমার কাছেও রিভলবার আছে। আমিও নামতে পারি’।
‘তোমার পরিবারের কেউ যদি ওদের গাড়িতে থাকে, তাহলে আমাদের পক্ষ থেকে গুলী-গোলায় সাবধান হতে হবে। আপাততঃ গাড়িতেই থাক’।
আহমদ মুসা নামল গাড়ি থেকে। তারপর দ্রুত এগিয়ে গাড়ির সামনের ঢাকনা তুলে ফেলল। একটু ঝুঁকে পড়ে গাড়ির ইঞ্জিনের এটা ওটা পরীক্ষা করতে লাগল। যেন খারাপ গাড়ি সারাবার চেষ্টা করছে সে।
বাম হাত দিয়ে ইঞ্জিনের এটা ওটা দেখলেও তার কান সতর্ক এবং ডান হাতে তার এম-১০ প্রস্তুত।
ওদের দু গাড়ি এসে আহমদ মুসার গাড়ির পাঁচ ছয় গজ সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল।
গাড়ি দাঁড় করিয়েই দু গাড়ি থেকে চার পাঁচজন এক সাথে নেমে পড়ল। প্রায় সমস্বরে চিৎকার করে উঠল। অকথ্য গালি দিয়ে তারা বলে উঠল, ‘শুয়োরের বাচ্চা গাড়ি সরা’।
আহমদ মুসা সোজা হয়ে দাঁড়াল। নরম কন্ঠে বলল, ‘কি করব স্যার, হঠাৎ গাড়ি খারাপ হয়ে গেল’।
‘কি করবি, গাড়ি ঠেলে ফেলে দে নিচে’। ওদের একজন চিৎকার করে বলল।
‘স্যার একটু অপেক্ষা করুন। আমি ‘কাপ্তান বাড়ি’ থেকে এক খন্ড তার নিয়ে আসি। তাহলেই গাড়ি ঠিক হয়ে যাবে’। আহমদ মুসার কন্ঠে অনুনয়ের সুর।
আরও দুজন ওদের গাড়ি থেকে নামল। ওরা এক সাথে চিৎকার করে উঠল, ‘এক মুহূর্তও সময় দেবনা। ঠেলে ফেলে দাও গাড়ি নিচে’।
‘স্যার, কাপ্তান বাড়ির একজন সম্মানিত মেহমান আছে গাড়িতে’। আহমদ মুসার অসহায় সুর।
‘শালা আবার কথা বলে। জাহান্নামে যাক কাপ্তান বাড়ির মেহমান। শালা সরা গাড়ি। না হলে গুলী খাবি কিন্তু’। বলল ওদের একজন চিৎকার করে।
‘আমি তো একা গাড়ি ঠেলে ফেলতে পারবো না স্যার। ফেললে তুলতে পারবো না। আপনারা একটু রহম করুন স্যার। আপনারাও তো কাপ্তান বাড়ি থেকেই এলেন’। আহমদ মুসা যেন ওদের বুঝাবার জন্য মরিয়া।
‘হ্যাঁ এলাম। আমরা কাপ্তান বাড়ির মাথায় বাড়ি মেরে এলাম। একটু কান পেতে শোন, ও বাড়ির কান্না শুনতে পাবি। আমরা ওদের ধ্বংস করতে চাই’।
বলেই লোকটি ওদের সবাইকে আহবান করে বলল, ‘এসো তোমরা সবাই। ও শালাকে দিয়ে হবে না। আমরা গাড়ি ফেলে দিয়ে পথ পরিষ্কার করি।
ওর সবাই এগিয়ে আসছে আহমদ মুসার গাড়ির দিকে।
দু’পক্ষের গাড়ির মাঝের ফাঁকা জায়গাটায় ওরা এসে পৌঁছেছে। সাতজন ওরা।
আহমদ মুসার ডান হাত বিদ্যুত বেগে বেরিয়ে এল তার কোটের আড়াল থেকে। তার তর্জনি ছিল এম-১০ এর ট্রিগারেই। শুধু তর্জনি চেপে ধরল সে ট্রিগারটায়। আর ঘুরিয়ে নিল এম ১০এর নল ওদের উপর দিয়ে।
আহমদ মুসার এম-১০ এর নল থেকে তখনও ধোঁয়া বেরুচ্ছিল। এ সময় দেখতে পেল সামনের কারটির এদিকের দরজা আস্তে আস্তে খুলে যাচ্ছে। একজন লোক আধখোলা দরজার ফাঁক দিয়ে গড়িয়ে পড়ল মাটিতে। তার হাতে তাক করা রিভলবার। সে মাটিতে পড়ার সাথে সাথেই তার রিভলবার থেকে গুলি বেরিয়ে আসত। কিন্তু আহমদ মুসা প্রস্তুত ছিল তার আগে থেকেই। তার এম ১০-এর এক ঝাঁক গুলি গিয়ে দরজা ও লোকটিকে আঘাত করল। গুলীর ধাক্কায় দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় লোকটির গোটা দেহই চলে এল আহমদ মুসার এম-১০ এর আওতায়। গুলীর ঝাঁক লোকটিকে একেবারে ভর্তা করে ফেলল।
এম ১০ বাগিয়েই আহমদ মুসা ছুটল গাড়ি দুটির দিকে।
কিন্তু সামনের গাড়িতে কাউকে দেখল না। পেছনের গাড়িতে লোকটির লাশ যেখানে পড়েছিল, সেই দরজার জানালা দিয়ে আহমদ মুসা দেখল একজন মেয়ে মুখ বাঁধা অবস্থায় পেছনের সিটে বসে আছে।
মেয়েটিকে দেখেই আহমদ মুসা মুখ ফিরিয়ে ডাকল, ‘ওভানডো বেরোও গাড়ি থেকে, এদিকে এসো’।
ছুটে এল ওভানডো।
আহমদ মুসা গাড়ির দরজা আগেই খুলে ফেলেছিল। ওভানডো দরজা দিয়ে একবার তাকিয়ে ঢুকে গেল ভেতরে। মুখের বাঁধন খুলে ফেলল মেয়েটির। বলল দ্রুত কন্ঠে, ‘জ্যাকি তুমি ঠিক আছ তো?’
ঢুকরে কেঁদে উঠল মেয়েটি। ঝাঁপিয়ে পড়ল ওভানডোর বুকে।
ওভানডো মেয়েটির পিঠ চাপড়ে বলল, ‘আর ভয় নেই জ্যাকি। আমি ফিরে আসতে পেরেছি, তুমি মুক্ত হয়েছ’।
ওভানডো মেয়েটিকে গাড়ি থেকে বের করে আনল।
এখান থেকে ওভানডোর বাড়ি বেশি দুরে নয়।
সেদিকে তাকিয়ে ওভানডো চিৎকার করে ডাকল, ‘জন, আলফ্রেড, দিয়েগো’।
তার ডাকার সাথে সাথেই ওদিকের অন্ধকার থেকে কয়েকটি টর্চ জ্বলে উঠল এবং কয়েকটি কন্ঠ চিৎকার করে উঠল, ‘আমরা আছি, আমরা আসছি’।
অল্পক্ষণের মধ্যেই ছুটে এল পাঁচজন লোক।
পাঁচজনের মধ্যে রয়েছে একজন তরুণী। সে এসেই কেঁদে উঠে জড়িয়ে ধরল ওভানডোকে।
ওভানডো তাকে সান্ত্বনা দিয়ে আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে তরুণীটিকে দেখিয়ে বলল, ‘এ আমার ছোট বোন লিসা টেরেক’।
আহমদ মুসা হাতের এম-১০ মেশিন রিভলবার কোটের নিচে শোল্ডার হোলস্টারে রাখতে রাখতে তরুণীটিকে স্নেহের স্বরে বলল, ‘কান্না কেন? ভাইকে ফিরে পেয়েছ, এখন হাসতে হবে’।
‘শুধু ভাইকে নয় ভাবীকেও ফিরে পেয়েছ’। বলল ওভানডো।
তরুণীটি সংগে সংগেই ওভানডোর পেছন দিকে তাকিয়ে ছুটে গেল। জড়িয়ে ধরল ভাবীকে।
‘ও! আমি ভূলে গিয়েছিলাম। তাহলে আনন্দ তো ডবল’।
বলে থামল আহমদ মুসা। অন্যান্য যারা এসেছে তাদের দিকে তাকাল।
ওভানডো বলল, ‘ওরা সবাই আমাদের স্টেটের কর্মচারী’।
একজন মাঝবয়সীকে দেখিয়ে বলল, ‘ইনি আমাদের স্টেটের ম্যানেজার’।
ওভানডো থামতেই আহমদ মুসা বলল, ‘ওভানডো তোমার এখানে কোন কাজ নেই। তুমি ম্যাডামকে নিয়ে বাড়িতে যাও’।
‘আপনিও চলুন’। বলল ওভানডো।
‘কথা বলো না। তুমি যাও। এদিকের কাজ সেরে ওদের নিয়ে আমি আসছি’। আহমদ মুসা বলল।
‘এখানে তো আর কোন কাজ নেই’। বলল ওভানডো।
‘ওভানডো আমি এদের আটজন এবং গাড়ি দুটো সার্চ করে দেখব। তারপর লাশগুলো ও গাড়ির ব্যবস্থা করে আমি আসছি’। আহমদ মুসা বলল।
‘লাশগুলোর ব্যবস্থা কি? ম্যানেজার পুলিশকে খবর দিলেই সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে’। বলল ওভানডো।
‘আমি মনে করি পুলিশ জটিলতার সৃষ্টি করবে। যারা এই ঘটনা ঘটাল, সেই গ্রুপের সাথে বর্তমান সরকারের গভীর সম্পর্ক আছে এবং সেই সুত্রে পুলিশও এদের কথাই শুনবে’। আহমদ মুসা বলল।
উদ্বিগ্ন দেখাল ওভানডোকে। একটু চিন্তা করে বলল, ‘ঠিকই বলেছেন আপনি। আমি বন্দী থাকাকালে ওদের মুখে এ ধরনের কথাই শুনেছি। গতকাল বিকেলেও ওরা আমাকে বলেছে, সরকারও আমাদের, পুলিশও আমাদের। কারও সাহায্য তোমরা পাবে না’।
বলে একটু চিন্তা করে ওভানডো বলল, ‘তাহলে আপনি কি করতে চান?’
‘গাড়িতে তুলে তোমার লোকরা লাশগুলো নদীতে ফেলে দিয়ে আসবে। অল্পক্ষণেই ওগুলো চলে যাবে সাগরে’। আহমদ মুসা বলল।
‘ঠিক আছে আপনি তাই করুন। কিন্তু তাড়াতাড়ি চলে আসুন আপনি’।
বলে বোন লিসাকে নিয়ে স্ত্রী জ্যাকির হাত ধরে বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করল ওভানডো।

ওভানডোর শোবার ঘরে ওভানডো, তার স্ত্রী জ্যাকুলিন, তার মা ও দাদী বসে গল্প করছিল। ঘরে প্রবেশ করল ওভানডোর ছোট বোন লিসা টেরেক। বলল, ‘সাতটা বাজে ভাইয়া। তোমার মেহমানকে তো ডাকতে হবে সাড়ে ৭টায়’।
‘এই তো ঘুমালো সাড়ে চারটায়, সাড়ে ৭টায় উঠবে কি করে?’ বলল ওভানডোর মা।
‘কিন্তু উনি বার বার বলেছেন সাড়ে ৭টায় ওঁকে উঠতে হবে’।
জোর দিয়ে বলল লিসা টেরেক।
‘ওঁর চেয়ে দেখি তোমার গরজ বেশি’।
মুখ লাল হয়ে উঠল লিসার।
লিসার বয়স ২০ বছরের মত হবে। পারামারিবো স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পড়ে।
লিসা নিজেকে সামলে নিয়ে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠল। বলল, ভাবী, মাত্র ঘন্টা দুয়েকের কথা-বার্তায় আমরা সবাই দেখেছি উনি কথা কম বলেন। কিন্তু যা বলেন, তার মধ্যে কথার কথা থাকেনা’।
‘তুমি এত খেয়াল করেছ লিসা?’ বলল তার ভাবী জ্যাকি।
মুখ লাল করে কিছু বলতে যাচ্ছিল লিসা। তার মা তাকে বাধা দিয়ে বলল, ‘ছেলেটার মাথা কিন্তু সাংঘাতিক আহত হয়েছে। নিশ্চয় অনেক রক্ত পড়েছে’।
‘হ্যাঁ মা, গোটা পথই রক্ত পড়েছে। আমি একবার কাপড় দিয়ে বেঁধে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তিনি রাজী হননি। বলেছিলেন, রক্ত পড়া কমে গেছে, এমনিতেই বন্ধ হয়ে যাবে। অদ্ভূত লোক মা, মাথায় অতবড় আঘাত পেয়েছে, তার কথা বার্তা ও আচার আচরণে কখনও তা মনেই হয়নি’। বলল ওভানডো।
‘ও মানুষ নয় বেটা। ও নিশ্চয় কোন দেবদূত। তোমার কাছে ও বৌমার কাছে যা শুনলাম, যেভাবে তোমাকে ও জ্যাকিকে সে উদ্ধার করেছে, তা কোন একজন মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। ভেবে দেখো এই রাতে আঠার উনিশজন লোক মরেছে তার হাতে। নিজের জীবন বিপন্ন করেই সে এটা করেছে। ঈশ্বর বাছার মঙ্গল করুন’। বলল ওভানডোর মা।
‘যে ওয়াং আলীকে তিনি উদ্ধার করতে গিয়েছিলেন, সে ওয়াং আলী কে ভাইয়া?’ বলল লিসা।
‘তা ওঁকে জিজ্ঞেস করিনি’। বলল ওভানডো।
‘এক ওয়াং আলীর কথা আমি জানি। উনি আমাদের বিশ্ব বিদ্যালয়ের বোধ হয় শেষ বর্ষের ছাত্র। খুব ভালো ছাত্র, কিন্তু রাজনৈতিক কর্মী। ছাত্র আন্দোলনে সব সময় সক্রিয়। খুব জনপ্রিয়। শুনেছি উনি নিখোঁজ। ওর সাথে আমাদের সাবেক প্রধান মন্ত্রী আহমদ হাত্তা নাসুমনের মেয়ে ফাতিমা নাসুমনের বিয়ের কথা ছিল’। বলল লিসা।
‘সে ওয়াং আলীও হতে পারে। আমি জানি না’। ওভানডো বলল।
‘তোমার মেহমানের নাম কি ভাইয়া?’
ওভানডোর মুখে বিব্রত ভাব দেখা দিল। তারপর হাসল সে। বলল, ‘তাঁর নাম জিজ্ঞেস করার সুযোগ আমি পাইনি। বিরাট ভূল আমার এটা’।
‘আমার মনে হয় সে মুসলমান ভাইয়া’। বলল লিসা।
‘কেমন করে বুঝলি?’ জিজ্ঞেস করল ওভানডো।
‘সে শোবার আগে প্রার্থনা করছিল। মুসলমানরা ওভাবে প্রার্থনা করে’। বলল লিসা।
‘হতে পারে যাকে খুঁজছেন তিনি সেই ওয়াং আলীও তো মুসলমান’। বলল ওভানডো।
‘তোরা কি জানিস, আমাদের দুর্গে একটা ‘মস্ক’ মানে মসজিদ ছিল’। বলল ওভানডোর দাদী।
‘বল কি দাদী, আমাদের দুর্গে মসজিদ ছিল?’ ওভানডো বলল।
‘হ্যাঁ ওভানডো। আমি যখন নতুন বউ হয়ে আসি এ বাড়িতে, সে সময় একদিন দাদী শ্বাশুড়ী আমাকে ঘুরে ঘুরে দুর্গ দেখাচ্ছিলেন। একটা বড় ভাঙা ঘরের সামনের পাকা চত্বর পার হতে গিয়ে হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেলেন। বললেন, বোন পায়ের জুতা খুলে ফেলো। বলে তিনিও তাঁর পায়ের জুতা খুলে ফেললেন। আমি জুতা খুলতে খুলতে বললাম, পায়ের জুতা খুলতে হবে কেন দাদী? তিনি বললেন, ‘এই ঘর একটা প্রার্থনার জায়গা। এই চত্বরও তার অংশ’। এ পবিত্র জায়গায় জুতা পায়ে ওঠা নিষেধ। আমি বললাম, কি বলছ তুমি দাদীমা, মন্দির, গীর্জা সব প্রার্থনার ঘরেই জুতা পায়ে ঢোকা যায়। তিনি বললেন, এটা মন্দির বা গীর্জা নয়, এটা মুসলমানদের মস্ক। এ প্রার্থনা গৃহে জুতা পায়ে ঢোকা যায় না। প্রার্থনা ঘরটির দেয়াল কোন কোন জায়গায় এখনও খাড়া আছে’।
ওভানডোর দাদী কথা শেষ করল।
ওভানডোর চোখে-মুখে বিষ্ময়। বলল, ‘কিন্তু দাদী, এ দুর্গে মুসলমানদের মসজিদ এল কি করে?’
‘আমি জানিনা। তোমার দাদা একটা গল্প করেছিলেন। গল্পটা তিনি শুনেছিলেন তার আব্বার কাছে। সে সময় নাকি একজন পুরাতত্ববিদ পর্যটক দুর্গ এলাকা পর্যবেক্ষণ করে বিষ্ময় প্রকাশ করেছিলেন। তিনি নাকি বলেছিলেন, এ দুর্গের কথা ইউরোপীয় বা আমেরিকান কোন বিবরণে নেই। অথচ বিশাল এই দুর্গটা তৈরী হয়েছে কলম্বাসের সময়ে। কলম্বাসের কোন জাহাজ সুরিনামে ল্যান্ড করার কোন দলীল নেই। দুর্গের মসজিদ দেখেও তিনি বিষ্ময় প্রকাশ করেছিলেন এবং তিনি বলেছিলেন, দুর্গের অবস্থানের বিচারে এই মসজিদই ছিল দুর্গের কেন্দ্রবিন্দু। তার মতে দুর্গের ভবনগুলোর মধ্যে মসজিদটাই সবচেয়ে সুনির্মিত। তার কথা সত্য। দেখ, গোটা দুর্গ মাটির সাথে মিশে গেছে। কিন্তু মসজিদের দেয়ালের অনেকাংশ এখনও খাড়া। আর মেঝে প্রায় অক্ষত’।
থামল ওভানডোর দাদী।
হঠাৎ ওভানডোর মুখটা ম্লান হয়ে গেল। বলল, ‘দাদী এই রহস্যের সাথে আরও রহস্য যোগ হয়েছে। আমাকে কিডন্যাপ করা হযেছিল কেন জান?’
হ্যাঁ, সেটা বলেছিস। স্টেট, স্টেট না হলে দুর্গ এলাকা বিক্রিতে রাজী হতে বাধ্য করার জন্যে’। বলল ওভানডোর মা।
‘কিনতে চায় কেন তার মধ্যেই রয়েছে আসল রহস্য আম্মা। আমি আড়ি পেতে ওদের আলোচনা শুনে জানতে পেরেছি, এই দুর্গ এলাকার কোথাও জাহাজ বোঝাই করে আনা স্বর্ণ পুঁতে রাখা হয়েছে। কোথায় পুঁতে রাখা হয়েছে, সেটাও নাকি পাওয়া যেতে পারে আমাদের পারিবারিক পুরনো কাগজ পত্রে। সে জন্যেই ওরা দুর্গ এলাকা কিনতে চায় এবং আমাদের পারিবারিক পুরনো কাগজ-পত্র চায়। শত নির্যাতনেও যখন রাজী হচ্ছিলাম না, তখন জ্যাকিকে ওরা কিডন্যাপ করার সিদ্ধান্ত নেয়। যাতে তার উপর অত্যাচার করলে বাধ্য হই বলতে’।
থামল ওভানডো।
সবার চোখে উদ্বেগ ও বিষ্ময়।
ওভানডোর মা-ই প্রথম কথা বলে উঠল। বলল, ‘ঈশ্বরকে অসংখ্য ধন্যবাদ। জ্যাকিকে তিনি রক্ষা করেছেন। কিন্তু তুমি একি খবর শোনালে। ওরকম গুপ্তধন থাকলে সেটা আমাদের জন্যে একটা বড় ঘটনা। কিন্তু তার চেয়েও বড় ঘটনা হলো, এ গুপ্তধন পাওয়ার জেদ যখন ওদের মাথায় চেপে বসেছে, তখন আমরা শান্তিতে থাকতে পারবো না। যে কোন সময় যে কোন ঘটনা ওরা ঘটাতে পারে। এর থেকে বাঁচার পথ বাড়ি-ঘর সব ছেড়ে চলে যাওয়া। কিন্তু………..!’
কান্নায় ভেঙে পড়ল ওভানডোর মা।
ওভানডোর মা কাঁদছে। আর অন্য সবার চোখে-মুখে ছড়িয়ে পড়েছে আতংক।
‘এভাবে ভেঙে পড়ো না আম্মা। দেখ ওদের কথা আমি শুনেছি, শুনেও কিন্তু ঠিক আছি’। বলল ওভানডো।
‘ঠিক থাকবি কি করে? আসলেই মহাবিপদ আমাদের উপরে। আমার ভয় হচ্ছে, ওরা দরকার হলে আমাদের গোটা পরিবারকেই ধ্বংস করবে’। বলল ওভানডোর মা।
ওভানডোর মা’র কথা এবার ওভানডোকেও উদ্বিগ্ন করে তুলল। বুঝল তার মা’র ভেঙে পড়ার মধ্যে যুক্তি আছে। মায়ের কথার উত্তরে কি বলবে ওভানডো তা খুঁজে পাচ্ছিল না।
এ সময় কাজের মেয়ে এসে খবর দিল, ‘মেহমান ঘুম থেকে উঠেছেন। ডাকছেন।
লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল ওভানডো।
ওভানডোর মাও উঠল। বলল, ‘চল আমিও যাব’।
ওভানডোর দাদীও তার হাতের লাঠিটা খাড়া করে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, ‘চল আমরাও যাই। রাতে তো কথা বলা হয়নি’।
‘নাস্তা কি রেডি?’ কাজের মেয়েকে জিজ্ঞেস করল ওভানডোর মা।
‘হ্যাঁ রেডি’।
‘তাহলে টেবিলে দাও’। বলে ওভানডোর মা ওভানডোর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘যাও মেহমানকে নিয়ে এস।নাস্তা করে কথা বলা যাবে’।
ওভানডো চলে গেল মেহমানখানার দিকে। ওভানডোর মা চলল নাস্তার টেবিলের দিকে।
নাস্তা শেষে সবাই এসে ওভানডোদের ফ্যামিলি ড্রইংরুমে বসল।
ওভানডোর দাদী সোফায় আহমদ মুসার পাশে বসতে বসতে বলল, ‘ভাই, রাতেও তুমি মুরগী, খাসি কিছুই খাওনি। শুধু ডিম খেয়েছ। এখনও শুধু ডিম আর ব্রেডই খেলে। সবজিও খেলে না। কারণ কি বলত?’
আহমদ মুসাকে একটু বিব্রত দেখাল। বলল, ‘স্যরি দাদী আপনাদের বিপদে ফেলেছি। কিন্তু কি করব, আমাদের ধর্মের বিধান হলো, আল্লাহর নাম নিয়ে জবাই করা নয় এমন গোশত খাওয়া যাবে না। সাধারণত আমেরিকান দেশগুলোতে সবজিতে শুকরের গোশত ব্যবহার করে। এজন্যে আমি সবজি খাওয়া এড়িয়ে গেলাম’।
‘তুমি আগে বলনি কেন ভাই?’ বলল ওভানডোর দাদী।
হাসল আমদ মুসা। বলল, ‘খুবই ছোট একটা ব্যাপার জানিয়ে আপনাদের কষ্ট দেয়া আমি ঠিক মনে করিনি’।
‘কিন্তু নিজেকে কষ্ট দেয়া ঠিক বুঝি’।
বলেই ওভানডোর দাদী প্রসংগ পরিবর্তন করে বলে উঠল, ‘তোমাদের ঐ বিধানের তাৎপর্য কি বলত?’
আহমদ মুসা গম্ভীর হলো। বলল, ‘দু’ এক কথায় এর জবাব দেয়া মুশকিল। স্রষ্টা ও সৃষ্টির সম্পর্ক, সৃষ্টির পেছনে স্রষ্টার উদ্দেশ্য, স্রষ্টার প্রতি সৃষ্টির দায়িত্ব ইত্যাদি অনেক কথা বলতে হয়। সংক্ষেপে এটুকু বলতে পারি, সব কিছু আল্লাহর সৃষ্টি। এক সৃষ্টির অধিকার নেই আরেক সৃষ্টিকে হত্যা করার। তা করতে পারা যায় শুধু আল্লাহর বিধান অনুসারে। সে বিধান হলো, এক সৃষ্টিকে আরেক সৃষ্টির জন্য হালাল করা। আল্লাহ মুরগী, খাসি, গরু মানুষের জন্যে হালাল করেছেন। মানে খেতে বলেছেন। সুতরাং ওগুলো মানুষ জবাই করে খেতে পারে। কিন্তু জবাই করতে হবে আল্লাহর নাম নিয়ে, অর্থাৎ আল্লাহর বিধানকে স্মরণ করে’। তাহলেই জবাই বৈধ হবে, খাওয়াও বৈধ হবে’।
‘চমৎকার, চমৎকার দাদী’। বলল লিসা।
‘আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়েছিস লিসা। আমি ওকথা বলতে যাচ্ছিলাম’। বলে লিসার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ভাই তুমি জান না, তুমি কি সাংঘাতিক কথা বলেছ। আমার এখন কি মনে হচ্ছে জান, এতদিন আমাদের গোশত খাওয়াটা অবৈধ হয়েছে। যাক আল্লাহকে স্মরণ করার মন্ত্রটা তুমি শিখিয়ে দিও’।
বলে একটু থামল। তারপরে আবার বলল, ‘তুমি বোধ হয় খুব ধর্ম পালন কর ভাই?’
‘হ্যাঁ দাদী। আল্লাহর নাম স্মরণ না করলে যেমন গোশত খাওয়া অবৈধ হয়ে যায়, তেমনি ধর্ম না মানলে মানুষের জীবন অবৈধ ও ক্ষতির পথে পরিচালিত হয়’। বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা কথা শেষ করল।
কিন্তু সংগে সংগে কোন উত্তর দিতে পারলো না ওভানডোর দাদী। হা করে তাকিয়ে থাকল আহমদ মুসার দিকে। তার চোখে-মুখে বিষ্ময়। বলল কিছুক্ষণ সময় নিয়ে, ‘তোমার কথার তাৎপর্য অনুভব করতে পারছি, বোঝার জন্যে যুক্তি খুঁজে পাচ্ছি না। একটু বুঝিয়ে বলতে পার?’
‘এখানেও অনেক কথা বলতে হবে। বিষয়টা সংক্ষেপে এভাবে বলা যায় যে, শান্তি না থাকার অর্থ অশান্তি, সুখ না থাকলে দুঃখের সৃষ্টি হয়, সমাজ-সম্পর্ক বিপর্যস্ত হলে মানুষের জীবন সংকট হয়, মানুষের জীবনধারা অসুস্থ হলে অন্যায়, অবিচার ইত্যাদির সৃষ্টি হয়। আর মানুষের জীবনধারা অসুস্থ হয়, মানুষের সমাজ-সম্পর্ক বিপর্যস্ত হয় এবং মানুষের শান্তি সুখ ধ্বসে পড়ে তখন, যখন আল্লাহর সার্বভৌমত্ব অস্বীকার করে, তার দেয়া বিধান বা ধর্ম উপেক্ষা করে কোন মানুষ নিজে প্রভূ সেজে বসে এবং অপরাপর মানুষকে তার স্বার্থের শিকার হিসেবে গণ্য করে। মানুষের এই স্বেচ্ছাচারিতাই সকল অন্যায়, অবিচার, চুরি, ডাকাতি, হত্যা, লুন্ঠন, আত্মসাৎ ইত্যাদি অপরাধের মূল উৎস। সুতরাং যে সমাজ ও যে মানুষ ধর্মের বিধান মেনে চলবেনা, সে মানুষ ও সে সমাজ ক্ষতি ও ধ্বংসের পথে পরিচালিত হবে’।
থামল আহমদ মুসা।
ওভানডোর দাদীসহ সকলের চোখে-মুখে স্তম্ভিত দৃষ্টি।
আহমদ মুসার উপর পলকহীন চোখ রেখে ওভানডোর দাদী বলল, আসলেই কি তুমি একজন ধর্ম প্রচারক ভাই? কিন্তু তাই বা কি করে বলি? গত রাতে তুমি নাকি দু’ডজন লোক হত্যা করেছ, ওভানডোদের মুক্ত করেছ’।
‘কেন দাদী, যাঁরা ধর্ম মেনে চলে, তারা কি অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করে না!’ আর আমাদের ধর্মে ধর্ম প্রচারক বলে কোন গোষ্ঠী নেই। যারা ধর্ম মেনে চলে, তারা অন্যকেও ধর্ম মানাবার চেষ্টা করে। সুতরাং যে ধর্ম মেনে চলে সে ধর্মের প্রচারকও’। বলল আহমদ মুসা।
ওভানডোর দাদী কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই বলে উঠল লিসা টেরেক, ‘আপনি ধর্মের যে রূপ তুলে ধরেছেন, সে রূপ সব ধর্মের নেই। যেমন আমাদের খৃষ্ট ধর্ম। তা থেকে আমরা আমাদের প্রাত্যাহিক জীবনের জন্যে কোন নির্দেশই পাই না’।
আহমদ মুসা লিসার দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। বলল, ‘তোমার কথা ঠিক লিসা। তোমাদের কাছে মাফ চেয়ে বলছি, খৃষ্ট ধর্ম সর্বযুগের ধর্ম নয়। ঐ ধর্ম দুহাজার বছর আগের একটা সময়ের এক শ্রেণীর মানুষের জন্যে এসেছিল। এই ধর্ম সেই মানুষের জন্যে যথেষ্ট ছিল। কিন্তু এখন অচল হয়ে পড়েছে। পরবর্তীকালে ইসলাম এসেছে সর্বযুগের সকল মানুষের জন্যে। আধুনিক, উত্তর-আধুনিক সব মানুষের প্রয়োজন পূরণ করে ইসলাম’।
লিসার মুখে হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘আপনার সাজেশন আমি বুঝেছি। কিন্তু সব মানুষ কি ইসলাম গ্রহন করবে? আমরা না হয় আপনার চমৎকার ব্যাখ্যায় সব বুঝলাম, আপনি ক’জনকে……’।
‘লিসা এখন থাম, এ জটিল বিষয় নিয়ে পরে ওঁর সাতে আলোচনা করো’।
বলে একটু থামল ওভানডোর মা। তারপর আহমদ মুসার দিকে তাকাল। বলল, ‘বাছা, তোমাদের কথায় বাধা দেয়ার জন্য আমি দুঃথিত। এটা আমি করছি, কারণ তোমাকে কিছু কথা বলার জন্যে অস্থির হয়ে উঠেছি’।
‘কি কথা আম্মা, বলুন’। আহমদ মুসা বলল।
‘ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন বাবা। তুমি আমার ছেলেকে উদ্ধার করেছ নিজের জীবন বিপন্ন করে। আমার বউমাকেও বাঁচিয়েছ। এর ফলে আমরা মরা দেহে প্রাণ ফিরে পেয়েছি। কিন্তু বাবা আমরা হাসবার সুযোগ পাচ্ছিনা। আরও গুরুতর বিপদ আমাদের উপর চেপে বসেছে’।
থামল ওভানডোর আম্মা।
‘ওরা আবার হামলা করবে, কিডন্যাপ করবে সেই চিন্তা করছেন?’ বলল আহমদ মুসা।
‘এই বিরান দুর্গের কোথাও জাহাজ বোঝাই সোনা এনে পুঁতে রাখা হয়েছে কিনা জানিনা। কিন্তু এই বিষয়টা যখন ওদের মাথায় ঢুকেছে, তখন আমাদের রক্ষা নেই। আমাদের গোটা পরিবারকে ধ্বংস করে হলেও ওরা শেষ দেখে ছাড়বে’। বলতে বলতে কান্নায় ভেংঙে পড়ল ওভানডোর মা।
আহমদ মুসার চোখে-মুখে একটা বিব্রত ভাব ফুটে উঠল।
‘আমার বৌমা ঠিকই বলেছে ভাই। আগে ছিল ওদের আমাদের উৎখাত করার টার্গেট। এবার প্রতিশোধ স্পৃহাও যোগ হলো।
গতরাতের প্রতিশোধ নিতে ওরা আসবে অবশ্যই। কিংবা আরও কোনভাবে প্রতিশোধ নিতে পারে’। বলল ওভানডোর দাদী।
আহমদ মুসা ভাবছিল। বলল, ‘ঠিক দাদীমা, ওরা এটা করতে পারে। পরাজয় ও ক্ষতির প্রতিশোধ ও ওরা নিবে। তবে ভয় পাবেন না। আল্লাহই সাহায্য করবেন’।
‘তুমি ক’দিন থাক বাবা। তাছাড়া তুমি অসুস্থ। ক’দিন বিশ্রামও নেয়া হবে’। বলল ওভানডোর মা।
‘কিন্তু আমাকে তো এখনি যেতে হবে’। বলল আহমদ মুসা চিন্তিত কন্ঠে।
‘কোথায়?’ বলল ওভানডোর মা।
‘আপনাদের সাবেক প্রধানমন্ত্রী আহমদ হাত্তা নাসুমনের মেয়ে সকাল দশটায় নামছে পারামারিবো বিমান বন্দরে। আমাকে সে সময় বিমান বন্দরে থাকতে হবে’। আহমদ মুসা বলল।
‘তোমার শরীরের এ অবস্থা নিয়ে?’ বিষ্ময় প্রকাশ করল ওভানডোর মা।
‘আমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসেছি এয়ারপোর্টে হাজির থাকার জন্যে। আজ ২০ তারিখ সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে যদি আহমদ হাত্তার মেয়ে ফাতিমা নাসুমন ওদের হাতে ধরা না দেয়, তাহলে ওরা ফাতিমা নাসুমনের ভাবী স্বামী ওয়াং আলীকে হত্যা করবে। বাধ্য হয়ে ফাতিমা নাসুমনকে দেশে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে। ওয়াং আলী……..’।
আহমদ মুসার কথায় বাধা দিল লিসা টেরেক। বলল, ‘আপনারা ফাতিমা নাসুমনকে ওদের হাতে তুলে দিবেন?’ লিসার কন্ঠে বিষ্ময়।
‘আমরা ফাতিমা নাসুমন ও ওয়াং আলী দুজনকেই বাঁচাতে চাই। ফাতিমা নাসুমনের পারামারিবো বিমান বন্দরে ল্যান্ড করার কথা ছিল আজ সন্ধ্যা ৬টায়। সন্ধ্যা ৬টায় সন্ত্রাসীদের গাড়ি অপেক্ষা করবে ফাতিমা নাসুমনের জন্যে। আমরা সময়টা এগিয়ে সকাল দশটায় এনেছি। শুরুতেই ফাতিমাকে ওদের হাতে তুলে দিতে চাই না’। বলল আহমদ মুসা।
‘এই যে বললেন ওয়াং আলী ও ফাতিমা নাসুমন দুজনকেই বাঁচাতে চান। তাহলে আবার ফাতিমা নাসুমনকে ওদের হাতে তুলে দেবার প্রশ্ন উঠছে কেন?’ বলল লিসা।
‘ফাতিমা নাসুমনকে ওদের হাতে তুলে দেয়া দরকার ওদের সন্ধান লাভের জন্যে। যাতে ফাতিমা নাসুমন ও ওয়াং আলী দু’জনকেই বাঁচানো যায়’। আহমদ মুসা বলল।
‘তাহলে আবার সন্ধ্যা ৬টার বদলে ফাতিমা নাসুমনকে সকাল ১০টায় আনছেন কেন? সন্ত্রাসীদের গাড়িতো সন্ধ্যা ৬টায় থাকবে ফাতিমার জন্যে!’
‘ফাতিমা নাসুমন যাতে আমাদের চোখের সামনেই ওদের হাতে পড়ে, সে জন্যেই এই ব্যবস্থা। সন্ধ্যা ৬টায় সন্ত্রাসীরাও বিমান বন্দরে থাকবে। বিমান বন্দরের ভেতর থেকেও ফাতিমাকে তারা কিডন্যাপ করতে পারে। তাহলে আমরা কিছুই জানতে পারবো না এবং তাদের ফলোও করতে পারবো না। তাতে ওদের দুজনকে বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়বে। এ জন্যে আমরা ফাতিমাকে আগে নিয়ে আসছি। সন্ধ্যা ৬ টায় সে এয়ারপোর্টে আসবে। তখন আমরা ফাতিমার পেছনে পেছনেই থাকব’। আহমদ মুসা বলল।
‘বুঝতে পারছি বাছা, তুমি যাবে। কিন্তু আমাদের কি হবে’। বলল ওভানডোর মা উদ্বিগ্ন কন্ঠে।
ওভানডোর মা থামতেই ওভানডোর দাদী বলে উঠল, ‘তুমি কোথায় থাকছ ভাই? উঠেছো কোথায়?’
‘কোথাও থাকার সুযোগ পেলাম কই? পারামারিবোতে পেৌঁছার কিছুক্ষন পরই বেরিয়ে এসেছি। প্রথম তো ঘুমালাম আপনাদের এখানেই। আপনাদের সাবেক প্রধানমন্ত্রী রেস্টহাউস জাতীয় বাড়িতে তুলেছিলেন। আমাদের সাথে একজন বন্দী ছিলেন। কয়েক ঘন্টা ছিলাম সেখানে’। আহমদ মুসা বলল।
‘তাহলে ভাই আমাদের বাসাতেই থাক। আমরা সাহস পাব’। বলল ওভানডোর দাদী।
‘আমাদের একটা গাড়ি আপনার সাথে থাকবে। চলা ফেরায় কোন অসুবিধা হবে না’। ওভানডো বলল।
‘ঘটনা আমাকে কখন কোথায় নিয়ে যাবে, আমি জানি না। রাতে যদি ঘুমাবার সময় পাই, তাহলে আপনাদের এখানেই আসব’। বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ বেটা। মায়ের অনুরোধ তুমি শুনেছ। সত্যিই আমি আতংক বোধ করছি’। ওভানডোর মা বলল।
‘ওয়াংকে যারা কিডন্যাপ করেছে, ফাতিমা নাসুমনের পেছনে যারা লেগেছে, যারা দেশে একটা বিরাট রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি করেছে, তারা আপনাদের পেছনেও লেগেছে। এদের বিরুদ্ধে কাজ শুরু হয়েছে। আল্লাহর কাছে দোয়া করুন’। বলল আহমদ মুসা।
‘এরা তাহলে তো খুব বড় শক্তি! এরা কারা?’ জিজ্ঞেস করল ওভানডো।
‘কারা ঠিক জানি না। তবে তোমাদের সাবেক প্রধানমন্ত্রী হাত্তা নাসুমনের বিরুদ্ধে যে রাজনৈতিক জোট তৈরী হয়েছে, তাদের সাথে এদের যোগ রয়েছে’। আহমদ মুসা বলল।
‘রাজনৈতিক সংকটের কথা কি যেন বললেন?’ বলল ওভানডো।
‘এরা সুরিনামের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে নির্বাচন পিছিয়ে দিতে বাধ্য করেছে। আহমদ হাত্তার পক্ষের লোকদের ওরা ব্যাপকভাবে কিডন্যাপ করছে। ওরা আহমদ হাত্তার পক্ষের কাউকে নির্বাচনে দাঁড়াতে দিবে না। আহমদ হাত্তাকেও ওরা কিডন্যাপ করেছিল। ওদের হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করে গত রাতে তিনি এখানে এসে পেৌঁছেছেন। এই সংকটের কথাই তোমাকে বলেছি’।বলল আহমদ মুসা।
‘জনগন ওদের এ ষড়যন্ত্র মানবে কেন? আমরা তো সকলে আহমদ হাত্তার সমর্থক’। বলল ওভানডো।
‘জনগণ জানতে পারলে তো? যেমন তোমরাও ব্যাপারটা জানতে না’।
‘আমরা এমনিতেই আহমদ হাত্তার পক্ষের’। বলল ওভানডো।
‘সব সময়?’ প্রশ্ন আহমদ মুসার।
‘শুধু তাঁকে নয়, সব সময় আমরা মুসলমানেদের সাথে আছি’। ওভানডো বলল।
‘কেন?’ প্রশ্ন করল আহমদ মুসা।
‘জানি না। আমি আমার আব্বাকে এ রকমই করতে দেখেছি। তবে আজ দাদীর কাছে এক মজার কথা শুনলাম। আমাদের ধ্বংস হওয়া দুর্গের মধ্যে নাকি একটা মসজিদ ছিল’। বলল ওভানডো।
‘মসজিদ ছিল?’ আহমদ মুসা বলল। চোখে-মুখে তার বিষ্ময়ের প্রকাশ।
প্রশ্ন করেই আহমদ মুসা একটু থেমে আবার বলল দাদীকে লক্ষ্য করে, ‘সত্যি দাদীমা? ওভানডো ঠিক বলছে?’
‘হ্যাঁ ভাই’। বলল ওভানডোর দাদী।
‘মসজিদটা নিশ্চয়ই এখন নেই। কি করে চেনা গেল মসজিদ?’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমি চিনতে পারিনি’। বলে ওভানডোর দাদী দুর্গ দেখেতে গিয়ে যা ঘটেছিল, দাদী শ্বাশুড়ীর কাছে যা শুনেছিল সব বলল।
‘মসজিদের কোন চিহ্ন এখন নিশ্চয় নেই?’ আহমদ মুসার চোখে-মুখে আনন্দ। কন্ঠে ঝরে পড়ল অপার আগ্রহ।
‘গোটা দুর্গের মধ্যে মসজিদের দেয়ালেরই কিছুটা এখনও দাঁড়িয়ে আছে, মেঝেও অক্ষত আছে’। বলল ওভানডোর দাদী।
‘এখনি মসজিদের ধ্বংসাবশেষটা দেখতে ইচ্ছা করছে। ভাবতে ইচ্ছা করছে সুরিনামের প্রাচীন ও একমাত্র দুর্গে এই মসজিদ এল কি করে?’ আহমদ মুসা বলল।
‘চলুন, এখনি চলুন। আমরা সবাই যাব’। বলল লিসা টেরেক।
আহমদ মুসা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘না এখন আর সময় হবে না। আমাকে ৯টার মধ্যে বিমান বন্দরে পৌঁছাতে হবে। আহমদ হাত্তা নাসুমনের সাথে টেলিফোনে কথা হয়েছে। উনিও ৯-টার মধ্যে বিমান বন্দরে এসে পৌঁছবেন’।
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা সবার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তাহলে আমাকে এখন উঠতে হয়’।
‘তাহলে আমিও তৈরী হয়ে নেই। আমি আপনাকে পৌঁছে দেব এয়ারপোর্টে’। বলল ওভানডো।
‘না ওভানডো, তোমার রেস্ট দরকার। তাছাড়া তোমার বাড়ি ছাড়া চলবেনা এখন’। আহমদ মুসা বলল।
ওভানডোর মুখ ম্লান হয়ে গেল। বলল, ‘আপনি কোন কিছুর আশংকা করেন?’
‘দিনের বেলা তেমন আশংকা করি না। তবে ওদের কেউ না কেউ যে কোনভাবে খোঁজ নিতে আসবে, এটা নিশ্চিত। ফেরিওয়ালা বা কোন প্রকার হোম সার্ভিসের ছদ্মবেশেও আসতে পারে’। আহমদ মুসা বলল।
ওভানডোসহ সবার মুখ উদ্বেগ-আতংকে ভরে গেল। কেউ কোন কথা বলল না। বলতে পারলো না।
আহমদ মুসাই আবার বলল, ‘ভয়ের কিছু নেই দিনের বেলা তেমন কিছু ঘটবে না বলে মনে করি। তবে আমার অনুরোধ কেউ একা শহরে বেরুবেন না। কথা দিচ্ছি ওদিকের কাজ শেষ হলেই আমি চলে আসব। আহমদ মুসা বলল।
মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল ওভানডোর মায়ের। বলল, ‘বাবা তুমি আমাদের জন্যে ঈশ্বরের সাহায্য। আমরা তোমার পথ চেয়ে থাকব’।
মায়ের কথা শেষ হতেই ওভানডো আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘তাহলে একটা গাড়ি নিয়ে যান। অসুবিধা হবে না’।
‘দরকার হবে না ওভানডো। একটু হাঁটতে ভালই লাগবে। রাস্তায় উঠলেই গাড়ি পেয়ে যাব। আর যে গাড়ি নিয়ে আমরা গতকাল নিও নিকারী থেকে এসেছি, সে গাড়ি বিমান বন্দরে আমাদের জন্যে অপেক্ষা করবে’।
বলে আহমদ মুসা উঠতে যাচ্ছিল। ওভানডোর মা বাধা দিয়ে বলল, ‘একটু বস বাবা। সবই হলো, কিন্তু তোমার নাম পরিচয়টাই জানা হয়নি আমাদের’।
এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল আহমদ মুসার ঠোঁটে। মুখ নিচু করে থাকল। তারপর বলল, ‘আমি একজন মানুষ। আপনাদের শুভাকাঙ্খী। এটুকু পরিচয় থাকলে চলে না?
‘কি বল বাবা, তোমার নাম ধরে ডাকবো না?’ তোমার বাড়ি-ঘরের কথা জানবো না?’ বলল ওভানডোর মা মিষ্টি হেসে।
‘নাম আমার একটা আছে। কিন্তু আমার তো সে রকম কোন বাড়ি ঘর নেই’। আহমদ মুসা বলল।
‘কি বল বাছা! অমন কথা মুখে এনো না। প্রাসাদ দরকার নেই। একটা ঠিকানা হলেই চলে’। বলল ওভানডোর মা।
‘অমন একটা স্থায়ী ঠিকানা তো আমার নেই আম্মা’। বলল আহমদ মুসা।
ম্লান হয়ে গেল ওভানডোর মায়ের মুখ।
‘এরপর কি বলবে ভাই যে, তোমার নামও নেই?’ মিষ্টি হেসে বলল ওভানডোর দাদী।
‘না দাদী তা বলব না, আমার নাম আহমদ মুসা’। হাসতে হাসতে বলল আহমদ মুসা। উঠেও দাঁড়াল সেই সাথে।
নাম শুনেই বিষ্ময় বিস্ফারিত চোখে লিসা ছুটে এল আহমদ মুসার সামনে। বলল দ্রুত কন্ঠে, ‘কিছুদিন আগে টার্কস দ্বীপপুঞ্জের ঘটনা এবং সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কিছু ঘটনা নিয়ে যার নাম পত্র-পত্রিকা ও টেলিভিশনে এসেছে সেই আহমদ মুসা আপনি?’
‘ধরে নাও তাই’। হাসি মুখে কথাটা বলেই আহমদ মুসা সবার উদ্দেশ্যে বলল, আসি আমি, দেরি হয়ে যাবে আমার’। তারপর ওভানডোকে বলল, ‘এস তুমি আমাকে একটু এগিয়ে দেবে’।
আহমদ মুসা পা বাড়াল ঘর থেকে বেরুবার জন্যে।
ঘরের সবাই নির্বাক। সবার চোখে বিষ্ময় ও অসংখ্য প্রশ্ন। ওভানডোর অবস্থাও তাই। আহমদ মুসার নির্দেশ পেয়ে সে মন্ত্রমুগ্ধের মত তার পেছন পেছন চলল।
ওভানডো তাদের স্টেটের গেট পর্যন্ত আহমদ মুসাকে এগিয়ে দিয়ে এল। গোটা রাস্তায় ওভানডো একটা কথাও বলতে পারেনি। শুধু শুনেছে অহমদ মুসার কথা। নাম শুনে আহমদ মুসাকে সে চিনতে পারেনি। পরে লিসার কথা শুনে তার মনে পড়েছে আহমদ মুসার কথা। টার্কস দ্বীপপুঞ্জে যে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যে ঐতিহাসিক কান্ড ঘটাল সেই আহমদ মুসা ইনি, তার পাশে, তার বাড়িতে? এ কথা মনে আসতেই তার বাকরোধ হয়ে যাচ্ছে।
আহমদ মুসাকে বিদায় দিয়ে ফিরে এসে ওভানডো ঘরে ঢুকতেই লিসা ছুটে তার সামনে গিয়ে বলল, ‘ভাইয়া উনি আর কিছু বলেছেন?’
‘অন্য বিষয়ে বলেছেন। তার বিষয়ে শুধু বলেছেন, তাঁর সুরিনামে আসার ব্যাপারটা এই মুহূর্তে কাউকে না জানাতে’।
বলে ওভানডো ধপ করে বসে পড়ল সোফায়। বলে উঠল, ‘আজ বুঝতে পারছি, আমাকে যেভাবে উদ্ধার করেছেন, যেভাবে জ্যাকিকে বাঁচিয়েছেন, তা আহমদ মুসা বলেই সম্ভব হয়েছে। ঈশ্বর সবচেয়ে বড় সাহায্যটাই আমাদের জন্যে পাঠিয়েছেন। আমার আর কোন ভয় নেই’।
লিসা ওভানডোর পাশে বসতে বসতে বলল, ‘ভয় নেই বলছ কেন ভাইয়া?’
‘কারণ আহমদ মুসা বলেছেন ভয় নেই’। বলল ওভানডো।
‘আমার বিশ্বাস হতে চাচ্ছে না ভাইয়া যে, আহমদ মুসা আমাদের বাসায় এসেছিলেন, রাতে আমাদের বাসায় ঘুমিয়েছেন এবং এখন তিনি আমাদের সবার সামনে দিয়ে চলে গেলেন। সবই স্বপ্ন বলে মনে হচ্ছে। জানো ভাইয়া, পরশু আমাদের সেমিনার ক্লাসে সমসাময়িক ঘটনার আলোচনায় আহমদ মুসার প্রসঙ্গ উঠেছিল। আমাদের ভিসি স্যার তার সমাপনী বক্তব্যে বলেছিলেন, বিপ্লব যে কল্যাণের হতে পারে, বিপ্লবীর বুলেট যে মঙ্গলের হতে পারে, বিপ্লবী যে মহান মানবতাবাদী হতে পারেন, বিশ্বব্যাপী অসংখ্য ঘটনায় আহমদ মুসা তা প্রমাণ করেছেন’।
‘আমার এখন ভয় করছে, এত বড় বিশ্ব ব্যক্তিত্বকে কোথায় রাখবো। তিনি আসতে চেয়েছেন, অবশ্যই আসবেন’। আবেগ ঝরে পড়ল ওভানডোর কন্ঠে।
‘কি যে বলছিস! আমি তো দেখছি ও শান্ত, সুন্দর, লাজুক এক ছেলে আমার। থাকা, খাওয়া নিয়ে কোন চাওয়া নেই, অহংকার নেই। আমাদের অসুবিধা হবে ভেবে তার অসুবিধার কথা আমাদের জানতে দেয়নি। ওভানডো তুই তো এমনটা কোনদিনই পারবি না’। বলল ওভানডোর মা।
‘তুমি ঠিকই বলেছ বউমা, সামান্য সময়েই সে আমার শতবছর পরিচয়ের নাতি হয়ে গেছে। এক নিমিষে যে অমনভাবে মিশে যেতে পারে, সে বড়ত্বহীন খুব বড় মানুষ। তাকে নিয়ে ভাবছিস ওভানডো!’ ওভানডোর দাদী বলল।
‘কিন্তু দাদী আমার খুব ভয় করছে। আমরা না কোন ভূল করে বসি, কোন অমর্যাদা হয়ে যায় তাঁর। উনি কোন গোশতই খান নি আল্লাহর নাম নিয়ে জবাই করা নয় বলে। এটার আমরা কি করব?’ বলল জ্যাকি, ওভানডোর স্ত্রী।
‘আমরা আল্লাহর নাম নিয়েই জবাই করতে পারি তো’। বলল ওভানডোর মা।
‘কিভাবে আল্লাহর নাম নিয়ে জবাই করলে খাওয়া যায় তাতো আমরা জানি না’। ওভানডো বলল।
‘ঠিক আছে, আহমদ মুসা আজ এলে তার কাছ থেকে শিখে নিয়ে জবাই করলেই হবে’। বলল ওভানডোর মা।
‘দেখেছ মা, ওঁর প্রার্থনাটা কত সুন্দর। আমরা শিখতে পারি না?’ লিসা বলল।
‘তাহলে মুসলমান হবে নাকি? উনি তো মুসলমান’। বলল জ্যাকি। তার মুখে হাসি।
‘আমরা তো মন্দির, গীর্জা কোথাও যাই না। ক্ষতি কি, মুসলমান হলে? তাহলে বাড়িতে বসেও তো প্রার্থনা করা যাবে। আর আমাদের দুর্গে তো এককালে মসজিদ ছিলই’। বলল লিসা।
‘ঠিক বলেছিস লিসা। ভাইটি আমার আসুক। বলব যে, মুসলমান হতে হলে কি কি করতে হবে আমাদের শিখিয়ে দাও’। বলল ওভানডোর দাদী।
‘তাহলেতো ভালই হবে দাদীমা। আহমদ হাত্তা নাসুমনদের সাথে এক জাতি হয়ে যাব আমরা’। ওভানডো বলল।
‘আর তাহলে তো আমি ফাতিমা নাসুমনকে বলতে পারব, আমিও মুসলমান’। বলল লিসা।
‘দুর্গের মসজিদটাকেও তো তাহলে আমরা নতুন করে গড়তে পারব’। ওভানডোর মা বলল।
বলেই ওভানডোর মা উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘যাই ওদিকে অনেক কাজ পড়ে আছে’।
তার সাথে সাথে ওভানডোর স্ত্রী জ্যাকিও উঠে দাঁড়াল। বলল সে ওভানডোকে লক্ষ্য করে, ‘তুমি গিয়ে রেস্ট নাও’।
ওরা সবাই বেরিয়ে গেলে লিসা গিয়ে দাদীর পাশে বসে তার গলা জড়িয়ে ধরল।
‘কিরে তোকে তো খুব খুশি দেখাচ্ছে। ব্যাপার কি?’ বলল ওভানডোর দাদী নাতনীকে আরও কাছে টেনে নিয়ে।
‘ব্যাপার কি আবার? ভাইয়া উদ্ধার পেয়েছে, ভাবী রক্ষা পেয়েছে। তুমি খুশি হওনি?’ লিসা বলল।
‘কিন্তু তোর খুশিতে লাল রং দেখছি’।
‘তোমার চশমা আবার বদলাতে হবে দাদী’।
‘আমার নতুন ভাইটিকে কেমন দেখলিরে? নাত জামাই…..’।
লিসা তার দাদীর কথা শেষ হতে দিল না। দাদীর মুখে আঙুল চাপা দিয়ে বলল, ‘যাকেই দেখ সেই তোমার নাত জামাই হয়ে যায়, অন্তত এঁকে তুমি রক্ষা কর’।
লিসার দাদী মুখ থেকে লিসার হাত সরিয়ে দিয়ে বলল, ‘কেন? আমার নাতনি কম কি! তার জন্যে সবচেয়ে ভালটাই আমি চাই’।
লিসা তার দাদীর দুই হাত জড়িয়ে ধরে বলল, ‘তোমার হাত ধরে অনুরোধ করছি দাদী, তোমার পাগলামী যেন ওঁর কান পর্যন্ত না যায়। তুমি জান না তোমার নাতনীর মত লক্ষ নাতনী জোড়া দিলেও তাঁর সমান হবে না। তাঁকে তুমি অপমান করো না দাদী’।
‘তুই আমার এ ভাইটিকে চিনতেই পারিস নি। এক নিমিষে আমি তাকে শত বছরের চেনা চিনেছি’। বলল দাদী হাসতে হাসতে।
দাদীকে ছেড়ে দিয়ে এক ঝটকায় উঠে দাঁড়াল লিসা। বলল, দাদী তুমি যদি এই কথা দ্বিতীয় বার আর কারো কাছে বল, তাঁর যদি কানে যায়, তাহলে জেনো এক দন্ড আর এ বাড়িতে থাকব না আমি’।
বলে মধ্যমা আঙুলের একটা গাট্টা দাদীর মাথায় মেরে ছুটে বেরিয়ে গেল লিসা।

Top