৩৪. সুরিনামে মাফিয়া

চ্যাপ্টার

‘হ্যালো।’ টেলিফোন কানেকশন পেতেই বলে উঠল ফাতিমা নাসুমন।
‘হ্যালো, ফাতিমা আপা, কেমন আছেন?’ টেলিফোনের ও প্রান্ত থেকে বলল লিসা টেরেক, ওভানডো টেরেকের বোন।
‘ভালো, কিন্তু খোঁজ তো নাওনা।’ বলল ফাতিমা।
‘দুদিন মাত্র তো টেলিফোন করিনি। সময়টা খুব টেনশনে যাচ্ছে আপা। আপনারও তো।’ লিসা টেরেক বলল।
‘ঠিক বলেছ লিসা, আব্বাকে নিয়ে খুব উদ্বেগের মধ্যে আছি।’ বলল ফাতিমা।
‘এ সময় আহমদ মুসা না থাকলে যে কি হতো! কল্পনা করতেও ভয় লাগে।’ লিসা টেরেক বলল।
‘উনিতো সাক্ষাত আল্লাহর সাহায্য। উনি না থাকলে হয়তো আব্বাকেই উদ্ধার করা যেত না, তাঁর দেশে আসা ও নির্বাচন করা তো দূরের কথা।’ বলল ফাতিমা।
কথা শেষ করেই ফাতিমা নাসুমন আবার বলে উঠল, ‘উনি কোথায়? জরুরী কথা আছে।’
‘নামাজ পড়ছেন।’ লিসা জানাল।
‘তুমি নামাজ পড়ছ তো?’ বলল ফাতিমা।
‘আমি শুধু একা কেন সবাই পড়তে শুরু করেছে। এদিকে কি হয়েছে তাতো জানেন না।’
‘কি হয়েছে?’ উদগ্রীব কণ্ঠে বলল ফাতিমা।
‘গত পরশু আহমদ মুসা ভাই আমাদের পরিবারের লাইব্রেরীর একটা পুরানো বইয়ের ভেতর থেকে কাগজের কয়েকটা শিট পেয়েছেন, তা পরীক্ষা করে এক অকল্পনীয় জিনিস আবিষ্কার করেছেন।’
কথায় একটু ছেদ নেমে আসতেই ফাতিমা বলে উঠল, ‘অকল্পনীয় জিনিসটা কি?’
‘বলছি, সাংঘাতিক জিনিস, অকল্পনীয় ব্যাপার।’ বলে আবার থামল লিসা টেরেক।
অস্থির কণ্ঠে বলল ফাতিমা নাসুমন, ‘আমাকে আর অন্ধকারে রেখ না। তাড়াতাড়ি বল।’
‘আমাদের পুরনো দলিল বইয়ের ভেতর থেকে পাওয়া কগজের শিটগুলো আরবী ভাষায় লেখা একটা খসড়া দলিলের কয়েকটা পাতা। তা তিনি পেয়েছেন সুরিনামে আমাদের বংশের প্রতিষ্ঠাতা ও টেরেক দুর্গের নির্মাতা ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে স্পেনের প্রথম গভর্নর এবং তিনি ওভানডোর একজন ক্যাপ্টেন ছিলেন। ১৫০২ সালে আটলান্টিকে কথিত ডুবে যাওয়া জাহাজগুলোর একটি ছিল তার জাহাজ। জাহাজটি ছিল সোনা বোঝাই। আসলে জাহাজটি তখন ডোবেনি, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল এবং ঝড়ের ধাক্কায় ভাসতে ভাসতে এসে ঠেকেছিল আমাদের সুরিনাম উপকূলে।’ একটু থামল লিসা টেরেক।
সঙ্গে সঙ্গেই বলে উঠল ফাতিমা, ‘টেরেক দুর্গের স্বর্ণ-সন্ধানীরা তো এই একই কথাই বলে। তাহলে তাদের কথা তো দেখা যাচ্ছে ঠিক। এই কথা বলতে চাচ্ছিলে?’
‘না। আসল কথাই তো বলিনি।’ বলল লিসা টেরেক।
‘সেটা আবার কি? বল তাড়াতাড়ি।’
‘আমাদের ঐ পূর্ব পুরুষ মুসলমান ছিলেন। নাম আব্দুর রহমান আল-তারিক। তার আল-তারিক নাম অনুসারেই দুর্গের ও আমাদের পরিবারের নাম ‘এল-টেরেক’ হয়েছে।’
লিসা টেরেক কথা শেষ করলেও এদিক থেকে ফাতিমা কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলো না। বিস্ময়ের ধাক্কা কাটিয়ে উঠে একটু পর বলল, ‘সত্যি বলছ লিসা? আমার সাথে মজা করছ না তো?’
‘কাগজের কয়েকটা শিটে তার যেটুকু অসম্পূর্ণ জীবন কাহিনী আছে তাও এক রুপকথা আপা।’
‘তোমাদের অভিনন্দন লিসা। ভাগ্যবান তোমরা। কাহিনী পড়তে আসব আমি সুযোগ পেলেই।’
‘পরবেন কি করে, সে তো আরবী ভাষায় লেখা। শুধু………।’
আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল লিসা, আহমদ মুসা এ সময় এসে পড়ল।
লিসা তার মাথার কাপড়টা কপাল পর্যন্ত টেনে নিতে নিতে বলল, ‘ফাতিমা আপা, ভাইয়া এসে গেছে। তুমি তার সাথে কথা বল। পরে এক সময় আমি তোমার সাথে কথা বলব।’
আহমদ মুসা টেলিফোন হাতে নিল। বলল, ‘আসসালামু আলাইকুম। ফাতিমা, কি খবর?’
‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম। ভাইয়া, আপনি কি আব্বার পিএসকে কিছুক্ষণ আগে টেলিফোন করেছিলেন?’
‘না। এ প্রশ্ন কেন? এ ধরনের টেলিফোন তিনি পেয়েছিলেন?’
‘হ্যাঁ, তিনি বললেন, আপনি কিছুক্ষন আগে টেলিফোন করেছিলেন।’ বলল ফাতিমা।
‘বুঝেছি, কেউ আমার নামে টেলিফোন করেছিলেন। তিনি কি বলেছিলেন?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘আব্বা আছেন কিনা জিজ্ঞেস করেছিলেন। পিএস সাহেব যখন বলেন, ‘আছেন ঘুমুচ্ছেন’ তখন তিনি বলেন, ‘ঠিক আছে ডিস্টার্ব করব না। পরে আবার টেলিফোন করব’ বলে টেলিফোন রেখে দেন। পিএস সাহেব এ খবর আমাকে জানাবার পর আমি আপনাকে টেলিফোন করলাম কি কারণে টেলিফোন করেছিলেন তা জানার জন্যে।’
‘বুঝেছি ফাতিমা। ওটা শত্রুর টেলিফোন ছিল। তোমার আব্বা কোথায়?’
‘ঘুমুচ্ছেন।’
‘ঠিক আছে। আমি আসছি। তোমরা সাবধানে থেকো। গেটে পুলিশ পাহারা আছে তো?’
আহমদ মুসার কণ্ঠে উদ্ধেগ।
‘হ্যাঁ ভাইয়া, গেটে পুলিশ পাহারা আছে। খারাপ কিছু আশংকা করছেন?’ ফাতিমা নাসুমনের কণ্ঠেও উদ্ধেগ।
ফাতিমার প্রশ্ন এড়িয়ে আহমদ মুসা বলল, ‘আল্লাহ ভরসা। আমি আসছি।’
বলে আহমদ মুসা সালাম দিয়ে টেলিফোন রেখে দিল।
দ্রুত ছুটল ঘরের দিকে তৈরি হওয়ার জন্যে।
আহমদ মুসা যখন তৈরি হয়ে ঘর থেকে বেরুচ্ছিল তখন সামনে পড়ে গেল ওভানডো। লিসাও দাঁড়িয়েছিল ওখানে।
আহমদ মুসাকে ওভাবে তাড়াহুড়ো করে বেরুতে দেখে ওভানডো জিজ্ঞেস করল, ‘কোথায় বেরুচ্ছেন ভাইয়া?’
মি. হাত্তার ওখানে। আমার অনুমান মিথ্যা না হলে সেখানে একটা ঘটনা ঘটতে পারে।’
‘আমি যেতে পারি?’ বলল ওভানডো।
আহমদ মুসা থমকে দাঁড়িয়ে ওভানডোর দিকে ফিরে বলল, ‘না ওভানডো বাসায় থাকা দরকার। গেটে পুলিশ থাকলেও সাবধানতার প্রয়োজন আছে।’
বলে আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়িয়ে পা বাড়াল বাইরে বেরুবার জন্যে।

একটা কার এবং তার পিছে একটা মাইক্রো সেন্ট্রাল রোড ধরে এসে নর্থ-সাউথ রোডে পড়ে তীব্র গতিতে এগিয়ে চলল।
এ রাস্তাতেই আহমদ হাত্তার বাড়ি। বাড়িটা রাস্তার একদম শেষ প্রান্তে সুরিনাম নদীর একেবারে তীর ঘেঁষে।
কারে আরোহী চারজন। দুজন সামনের সিটে দুজন পেছনে। চারজন আরোহী মাইক্রোতেও।
৮ জন আরোহীর সকলেই সুরিনাম সেনাবাহিনীর কমান্ডোর পোশাক পরা। মাথায় বাঁধা কাল কাপড় পিঠ পর্যন্ত নেমে এসেছে। গায়ে কাল জামা, পরনে কাল ট্রাউজার। আর চোখে কাল গগলস।
কার যে ড্রাইভ করছে তার কাঁধে দুটি লাল স্টার। আটজনের টিমটির সেই সবচেয়ে বড় অফিসার। মুখটা তার পাথরের মত শক্ত। তার চোখ দুটির দৃষ্টি মানুষকে ভীত করে তোলার মত কঠোর। অন্য সকলের মত তার কোমরে ঝুলানো ফুট খানেকের মত লম্বা ভয়ংকর ‘উজি’ স্টেনগান। একটা রিভলবার, একটা খাপবদ্ধ ছুরি ও একটা ওয়্যারলেস সেট। কাঁধ ঝুলে থাকা একটা বোমা ভর্তি থলে, তবে যে জিনিসটা তার কাছে বেশি আছে সেটা হলো তার গলায় ঝুলানো একটা পকেট কম্পিউটার। এই কম্পিউটারে রেকর্ড করা আছে শহরের বিভিন্ন রাস্তা ও উল্লেখযোগ্য বাড়ি-ঘরের অবস্থান এবং বাড়ি-ঘরের অভ্যন্তরীণ নক্সা। এ ধরনের গোনী কম্পিউটার গোয়েন্দা বিভাগের শীর্ষ পর্যায়ের জন্যে সংরক্ষিত।
একই গতিতে এক লাইনে চলছিল কার ও মাইক্রোটি।
কারের ড্রাইভিং সিটে বসা লোকটি সামনে প্রসারিত তার দৃষ্টি না ঘুরিয়েই পাশের লোকটিকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘এনড্রা, সবাইকে তাদের ‘উজি’তে সাইলেন্সার লাগাতে বল।’
এনড্রা নামের পাশের লোকটি ওয়্যারলেস তুলে নির্দেশ দিল সবাইকে এবং সেই সাথে নিজের ‘উজি’তেও সাইলেন্সার লাগিয়ে নিল।
‘নিচের তলায় ছয়জন পুলিশ গার্ড ছাড়া আর তো কোন প্রহরী নেই মনে হয়।’ বলল এনড্রা নামের লোকটি।
ড্রাইভিং সিটের লোকটি আগের মত সামনে চোখ রেখেই ধীর কণ্ঠে জবাব দিল, ‘পুলিশ গুনছ কেন? পুলিশের সংখ্যা বেশি হলে কি ফিরে যাবে?
ধীর কিন্তু কঠোর শুনাল তার কথা।
মুহূর্তে মুখের ভাব পরিবর্তিত হয়ে গেল এনড্রার। ভয় পেয়েছে বুঝা গেল। বলল সে, ‘মাফ করুন বস। ভয় শব্দটি মাফিয়া কিনিক কোবরা-এর অভিধানে নেই। আমি ভয় পেয়ে পুলিশের সংখ্যা গুণিনি, আমি সাবধান হতে চেয়েছি।’
‘কিন্তু তোমার সাবধানী চিন্তা এই প্রথম দেখলাম।’
এনড্রা নামের লোকটা সঙ্গে সঙ্গে উত্তর না দিয়ে একটু চিন্তা করে বলল, ‘ধন্যবাদ বস। আপনি ঠিক ধরেছেন। কি জানি ব্রুকোপনডো হাইওয়েতে আমাদের ভেলাকুয়েজ ও হামবারটো নিহত হওয়ার ঘটনা আমি কিছুতেই ভুলতে পারছি না। ওরা ‘কিনিক কোবরা’-এর দুই অজেয় সদস্য ছিল। প্রথম পরাজয় ও মৃত্যু তাদের একই সাথে ঘটল।’
‘পরাজিত হবার পর বাঁচার তাদের অধিকার ছিল না।’ কঠোর কণ্ঠ ধ্বনিত হলো বসের।
‘কিনিক কোবরা’-এর এটাই বিধান এবং এজন্য তাদের মৃত্যুতে আমি গর্বিত। কিন্তু ‘ব্রুকোপনডো’র ঐ ঘটনা আমি স্মরণ করছি অন্য কারণে। আমি বুঝতে পারছি না বস আমরা কার মোকাবিলা করছি? সেকি আহমদ হাত্তা নাসুমন?’ বলল এনড্রা।
‘তাহলে কি আমরা মোকাবিলা করছি শিখ ড্রাইভারকে?’
‘তাও ভাবতে পারছি না বস।’
‘কেন পারছ না, এখন পর্যন্ত সব ঘটনার কেন্দ্রবিন্দুতে তো সে-ই?’
‘কিন্তু অজেয় ‘কিনিক কোবরা’-এর প্রতিদ্বন্দ্বী হবে কি একজন ড্রাইভার?’
‘তুমি ঠিক বলেছ এনড্রা। আমরা সত্যিই এক ধাঁধায় পড়েছি। অতীতে কোন সময়ই এমন হয়নি। টার্গেট হিসেবে আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে আহমদ হাত্তা নাসুমন। কিন্তু সে কিছুই করছেই না। অদৃশ্য কে যেন হাত্তার পক্ষ থেকে সব কিছু সম্পাদন করে চলছে।’
‘বস আমার মনে হয়, কান টানলে মাথা আসার মত, সব কিছুই আমরা জানতে পারব যদি আহমদ হাত্তাকে হাতের মুঠোয় আনি।’
‘আমিও সেই কথাই ভাবছি এনড্রা। আমরা আহমদ হাত্তাকে কিডন্যাপ করব। রঙ্গলালের সাথে আমাদের চুক্তি তাকে খুন করার। কিন্তু খুন করলে সব ক্লু হারিয়ে যেতে পারে। তাহলে ভেলাকুয়েজ ও হামবারটো হত্যার প্রতিশোধ নেয়া হবে না। এখন আমাদের দুটি টার্গেট। এক, রঙ্গলালদের দেয়া মিশন পুরা করা এবং দুই, আমাদের লোক হত্যার প্রতিশোধ নেয়া।’
‘তাহলে আমরা আজ আহমদ হাত্তাকে হত্যা না করে তাকে কিডন্যাপ করব এই তো?’
‘হ্যাঁ। তার পেছনে অদৃশ্যে কে কাজ করছে তা জানার এটাই পথ।’
‘অল রাইট বস। এই পরিকল্পনার জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ।’
বলে মুহুর্তের জন্যে থেমেই আবার শুরু করল এনড্রা। বলল, ‘একটা বিষয় লক্ষ্য করুন বস, আহমদ হাত্তা আমেরিকায় বন্দীদশা থেকে মুক্ত হবার পর হঠাৎ করে যেন শক্তিশালী হয়ে গেছে। তার বিজয় শুরু হয়ে গেছে সে সময় থেকেই। আমি ভাবছি, মার্কিন সরকার মানে সিআইএ তাকে সাহায্য করছে কিনা। জানা গেছে, বন্দী দশা থেকে মুক্ত হবার সে সামরিক হাসপাতালের ভিআইপি সেকশনে চিকিৎসা পেয়েছে। এই চিন্তার সমর্থনে আরেকটা বিষয়ও সামনে আনা যায়। সেটা হলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইহুদীদের বিপর্যয় ঘটার পর মার্কিন সরকার মুসলমানদের বন্ধু হয়ে গেছে। আহমদ হাত্তাও একজন মুসলিম রাজনীতিক।’ থামল এনড্রা।
ড্রাইভিং সিটে বসা ‘বস’ সম্বোধন পাওয়া লোকটি এই প্রথমবারের মত এনড্রার দিকে তাকাল। কিন্তু তার মুখের পাথুরে কাঠিন্যে একটুও পরিবর্তন আসেনি। বলল সে গম্ভীর কণ্ঠে, ‘ধন্যবাদ এনড্রা, তোমার এই ভাবনার জন্যে। যুগ-যুগান্তের ইহুদী ষড়যন্ত্র ধ্বংসে মুসলমানদের সাহায্য পাবার পর মার্কিন সরকার মুসলমানদের বন্ধু হয়ে গেছে একথা ঠিক। কিন্তু সিআইএ আহমদ হাত্তাকে সাহায্য করলে ‘কিনিক কোবরা’ তা জানতে পারতো। তোমার অজানা নয়, সব মাফিয়া দলের সাথে সিআইএ-র গোনী সম্পর্ক আছে, পারস্পরিক সহযোগিতা আছে যদি প্রয়োজন পড়ে। সুতরাং আহমদ হাত্তার সাথে সিআইএ যুক্ত থাকলে আমরা জানতে পারতাম এবং সেক্ষেত্রে রঙ্গলালদের সাথে কোন ‘ড্রীল’ আমরা করতাম না।’
‘তাহলে কারা জুটল আহমদ হাত্তার সাথে? আহমদ মুসা আমেরিকায় অসাধ্য সাধন করেছেন। তিনি কি আসতে পারেন আহমদ হাত্তার সাহায্যে?’ বলল এনড্রা।
এতক্ষণে ‘বস’ লোকটার ঠোঁটে এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল। তাচ্ছিল্যের হাসি। বলল, ‘কিসে আর কিসে ধানে আর তুষে। আহমদ মুসা আসবে সুরিনামে! জান তার মাথার মূল্য এখন কত? বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার। ইহুদীরা তাকে পাওয়ার জন্যে যা চাইবে তাই দেবে। চুনোপুটি আহমদ হাত্তার জন্যে সে আসতে যাবে কেন?’
‘যাই বলুন আহমদ মুসা লাকী মানুষ। সে যেখানে যায়, সাফল্য তার আগে আগে যায়।’ বলল এনড্রা।
‘না তা ঠিক নয় এনড্রা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তার অমানুষিক কষ্ট করতে হয়েছে সাফল্য ছিনিয়ে আনার জন্যে। এক সময় এমন হয়েছিল মার্কিন সরকারসহ গোটা দেশ তার বৈরী। পা রাখার নিরাপদ জায়গা ছিল না তার জন্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে।’
‘কিন্তু আমার মনে হয় আহমদ মুসা বাঁচতে পারবে না ইহুদীদের হাত থেকে।’ বলল এনড্রা।
‘আমারও তাই মনে হয়। ইতিমধ্যেই ইহুদী গোয়েন্দা সংস্থা আমেরিকা ইউরোপের সব মাফিয়া গ্রুপের সাথে আলোচনা করেছে। সকলের সাহায্য চেয়েছে আহমদ মুসাকে ধরে দেয়ার জন্যে।’
‘আহমদ মুসা একজন ব্যক্তিমাত্র। তার কোন দল নেই। সে কি করে মাতব্বরী করছে?’ এনড্রার কণ্ঠে বিস্ময়।
‘তিনি দল নিয়ে ঘুরে বেড়ান না এটা ঠিক। কিন্তু তার দল নেই কে বলল? যেখানে যে দেশেই বাস করুক প্রতিটি মুসলিম তার দলের সদস্য। এখন অজস্র খৃষ্টানও তার পক্ষ হয়ে গেছে।’
‘এটা কি করে সম্ভব হলো?’ বলল এনড্রা।
‘তিনি এক নীতিবোধের পক্ষে কাজ করছেন। সেটা জালেমের বিরুদ্ধে মজলুমকে সাহায্য। এ জন্যেই দুনিয়ার সব মজলুম ও বিবেকবানরা তাকে ভালোবাসে।’
‘কিন্তু সে তো দেখছি শুধু মুসলমানদের পক্ষেই কাজ করে।’
‘কারণ মুসলমানরাই আজ জাতি হিসেবে নির্যাতন-নিপীড়ন ও ষড়যন্ত্রের শিকার। যেমন দেখছ এই সুরিনামে। রঙ্গলালরা কিছুতেই মুসলমানদের শাসন ক্ষমতায় আসতে দেবে না।’
‘কিন্তু আমরা যে এই রঙ্গলালদেরই সাহায্য করছি?’
‘কারণ আমরা আহমদ মুসার নীতিবোধকে বহু আগেই পদ-পিষ্ট করে শেষ করে এসেছি। ‘কিনিক কোবরা’র এখন টাকা কামানোর যন্ত্র। ‘কিনিক কোবরা’র অর্থ সূর্যের ছোবল জান? মানুষ একে দেখে না, জানে না, বুঝে না, কিন্তু এর সর্বগ্রাসী দহনজ্বালায় সে শেষ হয়ে যায়। আমরা পৃথিবীটাকেই জ্বালিয়ে দিতে চাই। আহমদ মুসাকেও।’
‘বস’ লোকটি থামল।
কিন্তু কোন জবাব এল না এনড্রার কাছ থেকে। ‘বস’ লোকটিই আবার বলল, ‘জান, কেন?’
‘জানি না।’ বলল এনড্রা সম্ভ্রমের সাথে।
‘স্বার্থের সর্প গোটা পৃথিবীকে তার অক্টোপাসে বেঁধে ফেলেছে। তার বিষ নিঃশ্বাসে জ্বলছে গোটা দুনিয়া। এ দুনিয়া আজ ধংসের যোগ্য। আর……।’
আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল ‘বস’ লোকটি। তাকে বাঁধা দিয়ে এনড্রা বলে উঠল, ‘বস’ এই তো আমরা এসে গেছি। ঐ সামনের পুব পাশের গেটটাই আহমদ হাত্তা নাসুমনের।’
‘বস’ বলে কথিত লোকটির হাত ছিল স্টিয়ারিং হুইলে। এনড্রার কথা শুনে সে সোজা হয়ে বসল।
তার দু’চোখে ছুটে গেল আহমদ হাত্তা নাসুমনের বাড়ির দিকে। নিবদ্ধ হলো গিয়ে বাড়ির উপর।
আহমদ হাত্তার তিন তলা বাড়িটি বিরাট। বন্ধ গেট।
দুটি গাড়ি গিয়ে গেটের সামনে দাঁড়াতেই ‘বস’ বলে কথিত লোকটি লাফ দিয়ে গেটের সামনে দাঁড়াল। একই সময়ে দুজন পুলিশ পাশের গার্ড রুম থেকে বেরিয়ে এল। তারা সুরিনাম আর্মির কমান্ডো অফিসারকে দেখেই কড়া একটা স্যালুট দিল।
‘আমরা স্যারকে নিতে এসেছি।’ বলল কমান্ডো অফিসারের পোশাকে ‘বস’ বলে কথিত লোকটি।
এসময় আরও দুজন পুলিশ বেরিয়ে এল। তারা সালাম ঠুকে গেট খোলার কাজে অন্য দুজন পুলিশকে সাহায্য করতে লেগে গেল।
গেট খুলতেই কমান্ডো অফিসারের পোশাক পরা ‘বস’ লোকটি গট গট করে ভেতরে ঢুকে গেল। তিনজন কমান্ডো তার পেছন পেছন চলল। অবশিষ্ট চারজনের দুজন গেটের দরজা একটু ভেজিয়ে দিয়ে চারজন পুলিশ কে সামনে রেখে গেটের ভেতরে দাঁড়াল। অন্য দুজন গেটের বাইরে গাড়ির পাসে এ্যাটেনশন অবস্থায় দাঁড়িয়ে রইল।
কমান্ডো অফিসারবেশী ‘বস’ লোকটি ভেতরে ঢুকেই সিঁড়ি দিয়ে এক লাফে দোতলায় উঠে গেল। তার পেছনে তিনজন কমান্ডোও।
দোতলায় উঠার সিঁড়ির মুখেই অভ্যর্থনা কক্ষ। সেখানে বসেছিল আহমদ হাত্তার পিএস হাসান মুসতো।
কমান্ডো অফিসারকে দেখেই সে ছুটে বেরিয়ে এল। কমান্ডো অফিসারের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, ‘কি ব্যাপার? আপনারা?’
‘আমরা স্যারকে নিয়ে যেতে এসেছি।’ বলল অফিসারবেশী কমান্ডো।
‘আমরা তো কিছু জানি না। এ ধরনের কোন নির্দেশ তো আমাদের কাছে আসেনি।’ বলল হাসান মুসতো।
‘তা আমরা জানি।’ বলে কমান্ডো অফিসার তিন তলায় উঠার জন্য পা বাড়াল সিঁড়ির দিকে।
দু’ধাপ এগিয়ে গেলে বাঁধা দিল হাসান মুসতো। বলল, ‘একটু দাঁড়ান, আমি স্যারকে জিজ্ঞেস করি।’
বলে মোবাইল বের করলো হাসান মুসতো। সঙ্গে সঙ্গে অফিসারবেশী কমান্ডোর ‘উজি’র নল উঠে এল হাসান মুসতোর লক্ষ্যে। বেরিয়ে এল এক ঝাঁক গুলী নিঃশব্দে।
ছিটকে পড়ল হাসান মুসতোর দেহ সিঁড়ির মুখে এবং গড়িয়ে পড়ে গেল নিচে, এক তলায়।
চারজন পুলিশেরই বোধ হয় চোখে পড়েছিল ব্যাপারটা। হাসান মুসতোর দেহ গড়িয়ে পড়ে স্থির হবার আগেই ছুটে আসা চারজন পুলিশকে সেখানে এসে দাঁড়াতে দেখা গেল। তারা তাকাল উপরে। দেখল, অফিসারবেশী কমান্ডোর ‘উজি’ ধরা হাত তখনও উদ্যত।
অকস্মাৎ অভাবিত দ্রুততায় উঠে এল পুলিশের চারটি স্টেনগানের নল।
কিন্তু পরক্ষণেই পেছন থেকে এক ঝাঁক গুলী এসে ঝাঁঝরা করে দিল তাদের দেহ। হাসান মুসতোর লাশের পাশেই পড়ে গেল তাদের লাশ।
গেটের ভেতরে দাঁড়ানো দুজন কমান্ডো ওদের গুলী করেছিল।
‘থ্যাংকস টু আওয়ার শুটারস’ বলে অফিসারবেশী ‘বস’ কমান্ডো লাফিয়ে উঠতে লাগল তিন তলার সিঁড়ি দিয়ে।
সাথের তিনজন কমান্ডোর একজন দোতলার সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে থাকল। আর দুজন উঠে গেল অফিসারবেশী কমান্ডোর সাথে। অফিসার কমান্ডো লোকটি তিন তলায় উঠেই লিভিং রুমের মধ্যে দিয়ে ছুটল এবং ছোট্ট একটা করিডোর অতিক্রম করে একটা দরজায় প্রচণ্ড জোরে একটা লাথি মারল।
তার যেন সব মুখস্ত। কোন পথে কোথায় কোন ঘরে যেতে হবে তা আগে থেকেই যেন ঠিক করে রাখা। আসলেই তাই। এখানে আসার আগে বিস্তারিত মুখস্ত করে কোন ঘরে এ সময় আহমদ হাত্তা রেস্ট নেন তা জেনেই তারা এসেছে।
অফিসার কমান্ডোর সাথে তিনতলায় উঠে আসা দুজন কমান্ডোর একজন তিন তলার সিঁড়ির মুখে অবস্থান নিলে, অন্যজন অফিসার কমান্ডোর পেছনে ছুটে এল।
প্রচণ্ড লাথিতে দরজার হুক ছিটকে গিয়ে দরজা খুলে গেল। আফিসার কমান্ডো দেখতে পেল আহমদ হাত্তা বিছানায় বসা এবং একজন তরুণী টেলিফোনে ব্যস্ত।
কমান্ডো অফিসারকে দরজায় দেখতে পেয়েই আহমদ হাত্তা শক্ত কণ্ঠে বলে উঠল, ‘অনুমতি না নিয়ে তোমরা এখানে কেন? তোমরা পুলিশকে খুন করেছ কেন?’ ভয় মিশ্রিত উত্তেজিত কণ্ঠ আহমদ হাত্তার।
কমান্ডো অফিসার কোন উত্তর দিল না। পাশে দাঁড়ানো তার কমান্ডোকে একটা ইংগিত করলো। তারপর রিভলবারের ব্যারেল ফাতিমার হাতে ধরা টেলিফোনের দিকে ফিরিয়ে গুলী করলো। টেলিফোনের রিসিভার ধরা থাকল আহমদ হাত্তার মেয়ে ফাতিমার হাতে, কিন্তু টেলিফোন সেটটি গুঁড়ো হয়ে গেল।
এদিকে অফিসারের ইংগিত পাওয়ার পর সাথে সাথে অন্য কমান্ডো ঝাঁপিয়ে পড়েছে আহমদ হাত্তার উপর এবং ক্লোরোফরম ভেজানো একটা রুমাল চেপে ধরেছে তার নাকে। সেই অবস্থাতেই হাত-পা ছোঁড়া রত আহমদ হাত্তাকে সে কাঁধে তুলে নিল।
‘আমার আব্বাকে নিয়ে যেও না’ বলে প্রচণ্ড চিৎকার দিল ফাতিমা নাসুমন এবং পরে তার সংজ্ঞাহীন দেহ লুটিয়ে পড়ল মেঝের উপর।
আহমদ হাত্তার দেহ কাঁধে তুলে নিয়েই ছুটল কমান্ডোটি। ইতিমধ্যেই কমান্ডো অফিসারটি ঘরের বাইরে গিয়ে পৌঁছেছিল।
কাঁধে নেয়ার পরও হাত-পা ছুঁড়ছিল আহমদ হাত্তা। কিন্তু কয়েক মুহূর্ত পরেই নিস্তেজ হয়ে পড়ল তার দেহ।
কমাডো অফিসারটি ও অন্য কমান্ডোরা দ্রুত নামছিল নিচে সংজ্ঞাহীন আহমদ হাত্তাকে নিয়ে।
দুতলা থেকে নামার সিঁড়ির মুখে পৌঁছতেই বাইরে থেকে ব্রাশ ফায়ারের শব্দ কানে এল।
কমান্ডো অফিসারটি দুতলায় নামার সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল এবং বলল, ‘নিশ্চয় বাইরে পুলিশ এসেছে। হাত্তার ঐ মেয়েটাই তাহলে পুলিশকে ডেকেছে।’
তারা সিঁড়ি দিয়ে এক তলায় নেমে এসে সেই লাশগুলোর পাশে দাঁড়াল। বাইরে ব্রাশ ফায়ার তখনও চলছে।
যে দুজন কমান্ডো গেটের ভেতরের চত্বরে দাঁড়িয়ে ছিল, তারা তখনও সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। কমান্ডো অফিসারের সাথে তিনজন কমান্ডোও গিয়ে তাদের পাশে দাঁড়াল। তাদের একজন বলল কমান্ডো অফিসারকে লক্ষ্য করে, ‘বস, আমরা কি বাইরে বেরুব?’
‘বাইরে পরিস্থিতি ট্যাকেল করার দায়িত্ব তাদের দুজনের। শত্রুরা ভেতরে এলে, তবেই তোমাদের দায়িত্ব বর্তাবে ওদের মোকাবিলা করার।’
বলে একটু থামল, তারপর আবার শুরু করলো, ‘চিন্তা করো না, প্রথম দিকে পুলিশের পাল্টা গুলীই ছিল প্রবল, কিন্তু এখন চলছে আমাদের এক তরফা গুলী। সম্ভবত পুলিশ ভিতরে ঢোকার জন্যে এক সাথে সবাই নেমেছিল। সুতরাং সবাই এক সাথে গুলীর মুখে পড়েছে। আমাদের লোকরা ছিল গাড়িতে, আড়ালে, আর ওরা উন্মুক্ত রাস্তার উপর। তাই লড়াই বেশিক্ষণ চলেনি।’
কমান্ডো অফিসারের কথা থামতেই বাইরের গুলীও থেমে গেল।
‘অল ক্লিয়ার। চল গাড়িতে সকলে।’ বলল দ্রুত কণ্ঠে কমান্ডো অফিসার এবং নিজেও ছুটল বাইরে বেরুবার জন্যে।
বাইরে বেরিয়ে গেটের সামনেই পাঁচজন পুলিশের লাশ দেখতে পেল।
আহমদ হাত্তাসহ ওরা মাইক্রোতে উঠার পর কমান্ডো অফিসার কার-এ উঠার সময় মাইক্রোর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘জরগ, ইউরিকো তোমাদের ধন্যবাদ, পুলিশ তোমাদের প্রতিরক্ষা লাইন অতিক্রম করতে পারেনি।’
কার ও মাইক্রো গাড়ি দুটি এবাউট টার্ন করে যে দিক থেকে এসেছিল সেদিকে আবার এগিয়ে চলল।

তীব্র গতিতে ছুটে আসছিল আহমদ মুসার গাড়ি। কিন্তু ওসেয়ান রোড থেকে নর্থ-সাউথ রোডে পড়ার সময় সাবধানতার জন্যে গতি কমিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু তারপরও তীব্র গতিতে ছুটে আসা একটা প্রাইভেট কার আহমদ মুসার কার-এর ফ্রন্ট গার্ডারের সাথে ঠোকর খেল।
সঙ্গে সঙ্গে আহমদ মুসার কার বাম দিকে বেঁকে গিয়ে কয়েকবার ঘুরপাক খেয়ে উল্টে গিয়েও আবার সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেল রাস্তার কিনারায় এসে। অন্যদিকে প্রবল বেগে ধাক্কা দেয়া কারটি ডান দিকে ছিটকে যায় এবং কারের পেছনের দরজাটি খুলে যায়। ফলে অন্য গাড়ির সাথে এ্যাক্সিডেন্ট হওয়া থেকে বেঁচে যায়।
এই এ্যাক্সিডেন্টের পর পরই আগের কারটির মতই বিদ্যুৎবেগে ধেয়ে আসা একটা মাইক্রো এ্যাক্সিডেন্ট এর জায়গায় হার্ড ব্রেক কষে থেমে যায়। হার্ড ব্রেকের ফলে প্রবল ঝাঁকুনি খায়।
মাইক্রোটি থামতেই সামনের কারটিও থেমে যায়। বেরিয়ে আসে কারের পেছনের সিট থেকে একজন। চিৎকার করে বলে মাইক্রোটিকে লক্ষ্য করে, ‘জরগ, ইউরিকো, তোমরা ওকে?’
মাইক্রো থেকেও একজন লোক নেমে এসেছিল। সে জবাব দিল। বলল, ‘ওকে ট্রিজিল্লো, তোমরা ঠিক আছ?’
‘হ্যাঁ তাড়াতাড়ি এস।’ বলে সামনের গাড়ির ট্রিজিল্লো নামের লোকটি গাড়ির দরজা খুলে যাওয়ার ফলে রাস্তায় ছিটকে পরা হাতব্যাগটা তুলে নিয়ে গাড়িতে ঢুকে গেল।
প্রায় একই সাথে মাইক্রোর লোকটিও গাড়িতে উঠে গেছে।
ভাবছিল আহমদ মুসা, সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে এ্যাকসিডেন্ট ঘটাল, অথচ একটু দুঃখ প্রকাশ করল না! সুরিনাম আর্মির সৌজন্যবোধের মান কি এত নিচু! এ্যাকসিডেন্ট ঘটানো কার ও মাইক্রো থেকে বেরিয়ে আসা লোক দুজনের পোশাক দেখেই আহমদ মুসা বুঝতে পেরেছিল ওরা সুরিনাম আর্মির কমান্ডো ইউনিটের লোক।
হঠাৎ আহমদ মুসার মনে আরেকটা চিন্তার উদয় হলো, কারের লোকটি কলম্বিয়া রাষ্ট্রের একটা ক্ষুদ্র গোষ্ঠী মোল্লটোদের ভাষায় কথা বলল কেন? আর মাইক্রোটির লোকই বা গুয়েতেমালা রাষ্ট্রের মায়া ভাষায় কথা বলল কেন? এই প্রশ্ন আহমদ মুসাকে আরেকটা প্রশ্নের দিকে টেনে নিয়ে গেল। লোক দুটিকে আহমদ মুসা যতটুকু দেখেছে, তাতে মনে হয়েছে ওরা সুরিনামের লোক নয়। ওদের একজন কলম্বিয়ার মোল্লটো গোষ্ঠীর, অন্যজন গুয়েতেমালার মায়া গোষ্ঠীর লোক হবে। তাহলে কি সুরিনাম আর্মিতে কলম্বিয়া, গুয়েতেমালাসহ মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার অন্যান্য দেশের লোকও আছে? কিন্তু আহমদ মুসার মন মানতে চাইলো না, একটা দেশের কমান্ডো ইউনিটে কি করে অন্য দেশের লোক থাকতে পারে! তাহলে কি ওরা সুরিনামের নাগরিক? বাইরে থেকে এসে এখানে বসতি গড়েছে। যদি তাই হয় তাহলে সেনাবাহিনীর সবচেয়ে এলিট অংশে চাকুরী করেও বিদেশের ভাষায় ওরা কথা বলবে এবং দুজন দুই ভিন্ন ভাষায়!
অবাক হলো আহমদ মুসা।
এসব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে সোজা হয়ে দাঁড়াল আহমদ মুসা। নিজের গাড়ির দিকে ঘুরে দাঁড়াতে গিয়ে তার চোখ পড়ল রাস্তার উপর। দেখল একটা ক্যাশ মেমোর মত কাগজ রাস্তার ওদিক থেকে উড়ে এসে তার গাড়ির চাকায় আটকে গেল।
মেমোটিকে আনকোরা নতুন দেখে খেয়াল বশেই উদ্দেশ্য বিহীনভাবে তুলে নিল আহমদ মুসা। শহরের একটা বিখ্যাত লন্ড্রীর মেমো। নামের দিকে চোখ পড়তেই আগ্রহ বেড়ে গেল আহমদ মুসার। ‘ট্রিজিল্লো’ মানে যে কার তার গাড়িকে ধাক্কা দিয়েছিল, সেই গাড়ি থেকে নেমে আসা লোকটিরই তাহলে স্লিপটা। তারিখ দেখল, সেটা মাত্র একদিন আগে। তার মানে লন্ড্রীর স্লিপটা তার জন্যে খুব মূল্যবান। আপাতত স্লিপটা নিজের কাছে রেখে দেয়ার চিন্তা করল আহমদ মুসা। পকেটে রাখার আগে ঠিকানার দিকে নজর বুলাল সে। দেখল ঠিকানা ও টেলিফোন নম্বর দুই-ই আছে। খুশি হলো আহমদ মুসা। ওদের কারটা তাকে আঘাত করলেও তাদের সে একটা উপকার করতে পারবে।
মেমোটা পকেটে ফেলে আহমদ মুসা গাড়িতে উঠে বসল। আহমদ মুসা খুশি হলো গাড়ির সামনের পাশটা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও গাড়ির সবকিছু ঠিক আছে।
গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে ছুটে চলল নর্থ-সাউথ রোড ধরে।
বেশ কিছুটা সময় নষ্ট হয়েছে এই ঘটনায়। গতি বাড়িয়ে দিল সে গাড়ির।
ফাতিমা নাসুমনের টেলিফোন পাওয়ার পর থেকেই একটা অস্বস্তি তাকে পেয়ে বসেছে। অস্বস্তিটা দূর হচ্ছে না কিছুতেই। আহমদ মুসার পরিচয় দিয়ে কারা টেলিফোন করতে পারে আহমদ হাত্তার খোঁজ নেবার জন্যে, নিশ্চয় তারা সহজ এবং সাধারণ কেউ নয়। আহমদ মুসা বেশ কিছু দিন আহমদ হাত্তার গাড়ি ড্রাইভ করছে, কিন্তু তার পরিচয় ড্রাইভার তা কেউ মনে করছে না। সবাই মনে করছে ড্রাইভাররূপী ব্যক্তিটি আহমদ হাত্তার নিরাপত্তার দায়িত্বশীল কিংবা আরও ঘনিষ্ঠ কেউ। আহমদ মুসার পরিচয় ব্যবহার করে যা তারা জানতে চেয়েছে সেটা নিশ্চয় খুব বড় ও গুরুতর বিষয়। নিশ্চয় ঐ টেলিফোনের দ্বারা তারা নিশ্চিত হতে চেয়েছে আহমদ হাত্তা বাসায় আছেন কিনা। কিন্তু কেন? দিনের বেলায় পুলিশ প্রহরাধীন বাসায় হামলা হওয়ার কথা নয়। তাহলে?
অস্বস্তিটার কোন কিনারা হলো না। ভাবনাও তার শেষ হলো না।
গাড়ি এসে গেছে।
বাঁকটা ঘুরলেই আহমদ হাত্তা নাসুমনের গেট দেখা যাবে।
বাঁক ঘুরল গাড়ি।
আহমদ হাত্তার বাড়ি নজরে এল আহমদ মুসার। আহমদ হাত্তার গেটে পুলিশের অনেকগুলো গাড়ি ও পুলিশের ছুটাছুটি দেখে বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল আহমদ মুসার। বড় কিছু না ঘটলে পুলিশের এত গাড়ি ও এত পুলিশের সমাগম হতে পারে না।
কি ঘটতে পারে?
নানা আশংকায় দুলে উঠল আহমদ মুসার মন।
গেটের আরও কাছে আসতেই পুলিশ চলাচলের ফাঁক দিয়ে গেটের সামনে এবং আরও একটু পিছনে রাস্তার উপর বিক্ষিপ্ত কিছু লাশ দেখতে পেল।
প্রবল আশংকায় কেঁপে উঠল তার মন। বড় ধরনের সংঘাত ছাড়া তো এত লাশ পড়তে পারে না।
সংঘাতের কেন্দ্র বিন্দুতে আহমদ হাত্তা নিশ্চয়। তিনি কেমন আছেন?
আহমদ মুসার আশংকা কাতর মনে কথাগুলো একের পর এক উঠে আসতে লাগল।
আহমদ হাত্তার গেটের কয়েক গজ সামনে দাঁড়াল আহমদ মুসার গাড়ি।
গাড়ি থেকে নামল আহমদ মুসা। এগুলো গেটের দিকে।
দেখল গেটের ওপাশের লাশগুলো পুলিশের। ডানদিকে একটু এদিকে যে লাশগুলো পড়ে আছে তাও পুলিশের। সে লাশগুলোর পাশেই পুলিশের পেট্রোল গাড়ি।
আহমদ মুসা বুঝল, গেটের ওপাশের লাশগুলো বাড়ির প্রহরী পুলিশদের। কিন্তু এই পুলিশরা কোত্থেকে এল, মারা পড়ল কিভাবে?
আহমদ মুসা গেটের দিকে অগ্রসর হলে পুলিশ বাঁধা দিল। বলল, ‘উপরের স্যারদের হুকুম ছাড়া ভেতরে কাউকে যেতে দেয়া হবে না।’
‘আপনার স্যারদের বলুন আমাকে ভেতরে যেতে হবে। কিন্তু তার আগে বলুন আহমদ হাত্তা ঠিক আছেন তো?’
‘স্যার ঠিক থাকলে কি আর হুলস্থুল হতো? কারা যেন তাকে কিডন্যাপ করেছে।’ বলল একজন পুলিশ।
আহমদ হাত্তার কিডন্যাপের খবরটি দারুণভাবে বিদ্ধ করল আহমদ মুসার হৃদয়কে।
দ্রুত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘তাঁর মেয়ে ফাতিমা নাসুমন কেমন আছে?’
‘ভাল আছেন, তবে আহত।’ বলল পুলিশটি।
‘আমাকে তাড়াতাড়ি যেতে হবে। সময় এখন খুব মূল্যবান। আপনি আপনার স্যারদের খবর দিন।’ আহমদ মুসা বলল।
এই সময় পুলিশ কমিশনারকে দ্রুত আসতে দেখা গেল আহমদ মুসার দিকে। একটু কাছাকাছি এসেই বলে উঠল, ‘সর্বনাশ হয়ে গেছে মি. আব্দুল্লাহ। এত কিছু করেও শেষ রক্ষা করতে পারলেন না। স্যারকে ওরা নিয়ে গেছে।’
পুলিশ কমিশনার থামতেই আহমদ মুসা বলে উঠল, ‘মি. কমিশনার, তাকে কিডন্যাপ হতে কে দেখেছে?’
‘যারা দেখেছেন তাদের মধ্যে ম্যাডাম ফাতেমাই শুধু বেঁচে আছেন। নিচের তলার চাকর-বাকরদেরও দুএকজন দেখেছে।’ বলল পুলিশ কমিশনার।
‘মি. কমিশনার, আমি ম্যাডাম ফাতেমার সাথে কথা বলতে চাই। দয়া করে তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা করুন।’
‘ঠিক আছে একজন অফিসার পাঠাচ্ছি। তার অনুমতি নিয়ে আসার। উনিও কিছুটা আহত।’ বলে পুলিশ মুখ ঘুরিয়ে একজন পুলিশ অফিসারকে নির্দেশ দিল।
এ সময় তিন তলার বারান্দা থেকে একটা কণ্ঠ ভেসে এল, ‘ভাইয়া আপনি আসুন।’ ভারী ও কান্না চাপা কণ্ঠটি।
আহমদ মুসাসহ সবাই তাকাল সেদিকে। দেখল, তিন তলার বারান্দায় মুখে রুমাল চেপে দাঁড়িয়ে আছে ফাতিমা নাসুমন।
‘আসছি ফাতিমা।’ বলে ভেতরে যাবার জন্যে পা বাড়াল আহমদ মুসা।
‘চলুন।’ বলল পুলিশ কমিশনার।
ফাতিমা নাসুমন দাঁড়িয়েছিল তার আব্বার ঘরের দরজায়।
আহমদ মুসা তিন তলায় উঠে ফাতিমা নাসুমনের নিকটবর্তী হতেই ফুফিয়ে কেঁদে উঠল ফাতিমা।
‘ধৈর্য ধর ফাতিমা সব ঠিক হয়ে যাবে।’ গম্ভীর কণ্ঠে বলল আহমদ মুসা।
একটু থেমেই আবার বলল, ‘চল কোথা থেকে ওঁকে নিয়ে গেছে একটু দেখতে চাই।’
ফাতিমা নাসুমন রুমালে চোখ মুছে বলল, ‘আসুন।’
তারা প্রবেশ করল আহমদ হাত্তার শোবার ঘরে।
ঘরের ডিভানটা দেখিয়ে বলল ফাতিমা, ‘আব্বা এখানে শুয়েছিলেন। ওরা দরজা ভেঙ্গে ঘরে ঢুকলে তিনি উঠে বসেন। ঐ অবস্থা থেকেই তাকে ক্লোরোফরম করে ধরে নিয়ে গেছে।’ কান্নায় আবার ভেঙ্গে পড়ল ফাতিমার কণ্ঠ।
আহমদ মুসা বেড এবং চারদিকটায় ভালো করে নজর বুলাল। না বাড়তি কোন চিহ্ন কোথাও নেই। ঘর, করিডোর সব জায়গায় কার্পেট থাকায় জুতার দাগও কোথাও পড়েনি। কিন্তু হতাশ হলো না সে।
‘চল ফাতিমা আমরা বসি। বসে কথা বলি।’ বলল আহমদ মুসা ফাতিমা নাসুমনকে। পাশেই একটা প্রশস্ত করিডোর। করিডোরের টি সার্কেলে গিয়ে দাঁড়াল তারা। পুলিশ কমিশনারও তাদের সাথে গেল। গিয়ে তারা একটা টি টেবিল ঘিরে তিনজন তিন সোফায় বসল।
বসেই আহমদ মুসা পুলিশ কইমিশনারকে বলল, ‘ঘটনার যেটুকু ফাতিমা নাসুমন জানেন, সেটুকু তো আপনারা জেনে নিয়েছেন, না?’
‘হ্যাঁ সেটা জেনেই আমরা চারদিকে খোঁজ-খবর নেবার নির্দেশ দিয়েছি। সহকারী পুলিশ কমিশনার নিজে এ ব্যাপারটা হাতে নিয়েছেন।’ বলল পুলিশ কমিশনার।
‘এখন আমিও একটু জেনে নিতে চাই।’ আহমদ মুসা বলল।
‘মাফ করবেন, আপনার কথা আমার সহকারী কমিশনারের কাছ থেকে অনেক শুনেছি। অবশ্য আমি এখনও জানি না, আপনার সাথে মি. হাত্তার সম্পর্ক কি।’ বলল পুলিশ কমিশনার অনেকটা সংকোচের সাথে। সংকোচ ভাবটা মেকি। আসলে আহমদ মুসার আগমন তার পছন্দ হয়নি।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘আমেরিকায় ওনার সাথে আমার পরিচয় হয়। ওনার নানা রকম বিপদ আপদ যাচ্ছে। ওনার সাথে থাকার জন্যে এমন সার্বক্ষণিক একজন লোকের প্রয়োজন পড়ে যিনি তাকে পরামর্শও দিতে পারবেন। সেই সময় হতে আমি তার সাথে থেকে যাই, তারপর এখনও আছি।’
‘আপনি তো সব সময় তার সাথে আছেন, আজ যা ঘটল এমন ঘটনার কি তিনি কোন আশংকা করেছিলেন?’ বলল পুলিশ কমিশনার।
‘সব সময়ই তিনি নানা আশংকার মধ্যে ছিলেন। কিন্তু বাসায় হামলা হবে, এমন আশংকা তিনি কখনও করেননি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আজ যারা ভূয়া নামে টেলিফোন করে স্যারের বাড়িতে থাকা সম্পর্কে কনফার্ম হয়েছিল, তারাই তাকে কিডন্যাপ করেছে। তারা আপনার নাম নিয়ে যেহেতু টেলিফোন করেছে, বুঝা যাচ্ছে তারা আপনাকে চেনে।’ বলল পুলিশ কমিশনার কূটনৈতিক ডায়ালগের ঢংগে।
‘আহমদ হাত্তা সাহেবের যারা শত্রু, তারা তো অবশ্যই আমাকে চিনবে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তা ঠিক তা ঠিক। ঠিক আছে আপনি ওর সাথে কথা বলুন।’ কিছুটা অপ্রস্তুত হওয়ার ভঙ্গিতে বলল পুলিশ কমিশনার।
আহমদ মুসা সোফায় হেলান দিল। একটু ভাবল। তারপর আবার সোজা হয়ে বসল। ফাতিমাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘ফাতিমা ঘটনা যা দেখেছ বল।’
‘টেলিফোনে যখন আপনি আমাদের এখানে এক্ষুনি আসছেন বললেন এবং সাবধান থাকতে বললেন, তখনি অজানা আশংকায় আমার বুক কেঁপে ওঠে। আপনার টেলিফোন রাখার তিন চার মিনিটের মধ্যেই আমাদের গেটে দুটি গাড়ি দাঁড়াবার শব্দ পেলাম। কেন জানি বুকটা আমার ছ্যাৎ করে উঠল সঙ্গে সঙ্গেই। আপনি তো অতদূর থেকে এসময় আসার প্রশ্নই ওঠে না, তাহলে কে এল? আমি বেরিয়ে গিয়ে ব্যালকনি থেকে উঁকি দিলাম গেটে। দেখলাম একটা সাদা কার ও একটা সাদা মাইক্রো গেটে এসে দাঁড়িয়েছে। তা থেকে নামছে আমাদের সেনাবাহিনীর কালো ইউনিফরম পরা কমান্ডোরা। সেটি………।’
ফাতিমাকে বাঁধা দিয়ে বলল, ‘তুমি কি বললে একটা সাদা কার ও একটা সাদা মাইক্রো। তুমি এটা ঠিক দেখেছো তো?’
‘হ্যাঁ ঠিক দেখেছি।’
‘তুমি কি ঠিক বলছ ওরা সেনাবাহিনীর কমান্ডোর কালো পোষাকে অন্য কেউ তো হতে পারে!’ আহমদ মুসা বলল।
‘তা হতে পারে। কিন্তু আমি ওদের ইউনিফর্মে আমাদের সেনাবাহিনীর ইনসিগনিয়ার সাথে কমান্ডো ইউনিটের ইনসিগনিয়া পরিষ্কার দেখেছি।’ বলল ফাতিমা দৃঢ়তার সাথে।
‘ঠিক আছে, বলে যাও।’ আহমদ মুসা বলল।
একটু থেমেই সে আবার বলতে শুরু করল, ‘সেনাবাহিনীর কমান্ডোদের নামতে দেখে আমি খুশি হলাম। ভাবলাম, সরকার আমাদের নিরাপত্তার জন্যে ওদের পাঠিয়েছি। আমি ব্যালকনিতে দাঁড়িয়েই থাকলাম এই আশায় যে, নিশ্চয় আব্বার পিএ হাসান মুসতো আমাকে ডাকবে এবং আমাকে কিছু বলতে হবে। ওরা ঢুকে গেল ভেতরে। আমি দাঁড়িয়েই আছি। মাত্র কয়েক মুহূর্ত। হঠাৎ দেখলাম চত্বরের চারজন পুলিশ বাড়ির ভেতরে দিকে কাউকে লক্ষ্য করে স্টেনগান তুলছে। পরক্ষণেই চারজন পুলিশ একসাথে গুলী বিদ্ধ হয়ে পড়ে গেল। গুলীগুলো ভেতর দিক থেকে এসেছে এবং সাইলেন্সার লাগানো থাকায় কোন শব্দ হয়নি। সঙ্গে সঙ্গেই আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল কমান্ডোরা আমাদের মিত্র নয়, শত্রু। বিষয়টা বুঝতে পেরেই আমি দ্রুত ছুটে এলাম আব্বার ঘরে আব্বাকে সব কিছু জানাবার ও পুলিশকে টেলিফোন করার জন্যে।
এরপর আমি ঘরে এসেই ছিটকিনি লাগিয়ে দিয়ে আব্বার কাছে গেলাম তাঁকে জাগাবার জন্যে। কিন্তু ভাবলাম এতে দেরী হয়ে যাবে টেলিফোন করতে। আব্বাকে না ডেকে ছুটলাম টেলিফোন করতে। পুলিশকে টেলিফোন করা প্রায় শেষ হওয়ার পথে এই সময় দরজা ভেঙ্গে দু’জন কমান্ডো ঘরের ভেতরে ঢুকল। তাদের একজন গুলী করে আমার টেলিফোনের সেট ভেঙ্গে ফেলল। আরেকজন আব্বাকে নিয়ে ক্লোরোফরম করে তাকে কাঁধে তুলে নিল। ‘আমার আব্বাকে নিয়ে যেও না’ বলে চিৎকার করে উঠেছিলাম, তারপরে আর কিছু মনে নেই। সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেছিলাম আমি।’ থামল ফাতিমা নাসুমন।
‘ঠিক আছে আপনারা কথা বলুন আমি ওদিকে একটু দেখি।’ বলে উঠে দাঁড়াল পুলিশ কমিশনার। চলে গেল সে।
সে চলে যেতেই আহমদ মুসা প্রশ্ন করল ফাতিমাকে, ‘আচ্ছা বলত, তুমি কার ও মাইক্রো এই গাড়ি দুটোকে যখন গেটে দেখলে, তখন গাড়ি দুটোর মাথা কোন দিকে ছিল?’
‘উত্তর দিকে।’
‘মাইক্রোর দরজা দুপাশে, না এক পাশে ছিল, মনে করতে পার তুমি?’
‘অবশ্যই, মাইক্রোর পশ্চিম পাশের দরজা দিয়ে নেমে গাড়ি ঘুরে ওরা এদিকে এসেছে। সুতরাং দরজা একপাশেই ছিল।’
আহমদ মুসা চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
কথা শেষ করে ফাতিমা একটু থেমেই আবার বলে উঠল, ‘এ তথ্যে সাংঘাতিক আগ্রহ দেখছি আপনার! কিন্তু কি হবে এসব দিয়ে?’
‘পরে বলব। তুমি খুবই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে। এখন বল, কমান্ডোদের মুখের চেহারা তো দেখেছ, বিশেষ করে যারা কিডন্যাপ করতে ঘরে ঢুকেছিল?’
‘হ্যাঁ দেখেছি। ওদের কাউকেই সুরিনামের বলে মনে হয়নি।’
‘কোথাকার লোক বলে মনে হয়েছে?’
‘ওদের যে দুজন ঘরে ঢুকেছিল তাদের একজন ‘মায়া’, আরেকজনের চেহারায় ‘মোল্লাটো’র ভাব বেশি ছিল।’
ভ্রু-কুঞ্চিত হলো আহমদ মুসার। রাস্তায় যে কারটির সাথে তার এক্সিডেন্ট হয়েছিল, তার একজনের নাম সে শুনেছে ‘ট্রিজিল্লো’ এবং ‘জারগো ইউরিকো’। এ দুটির একটি ‘মায়া’ নাম, আরেকটা ‘মোল্লাটো’ জাতির মানুষের নাম এবং এরা কেউ সুরিনামের নয়। ‘মায়া’দের প্রধানত বাস গুয়েতেমালায় আর ‘মোল্লাটো’ জাতির প্রধান আবাস কলম্বিয়ায়। তাহলে তো ফাতিমার বর্ণনার সাথে সবকিছু মিলে যাচ্ছে। তাহলে ঐ গাড়ি দুটিই কি আহমদ হাত্তাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে ঐ ভাবে পাগলের মত ছুটছিল!
‘আপনি কি কিছু ভাবছেন?’ বলল ফাতিমা।
ফাতিমার কথায় সম্বিত ফিরে পেল আহমদ মুসা।
‘হ্যাঁ ভাবছি ফাতিমা। আল্লাহ্‌কে ধন্যবাদ। মি. হাত্তাকে যারা কিডন্যাপ করে নিয়ে যাচ্ছিল, তাদের সাথে মনে হয় রাস্তায় সাক্ষাত হয়েছিল।’ বলল আহমদ মুসা।
বিস্ময় ও প্রবল উত্সুক্য ফুটে উঠল ফাতিমা নাসুমনের চোখে-মুখে। সোজা হয়ে বসল। বলল, ‘দেখা হয়েছিল? কিভাবে?’
আসার সময় তার এক্সিডেন্টের উল্লেখ করে আহমদ মুসা বলল, ‘বেপরোয়া গতির একটা কার আমার কারকে ধাক্কা দেয়। চরকির মত আমার কারটি ঘুরপাক খেলেও আমার গাড়ি বড় ধরনের এক্সিডেন্ট থেকে বেঁচে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। এই সময় একটা মাইক্রোও সেখানে এসে দাঁড়িয়ে যায় এবং আমার গাড়িকে ধাক্কা দেয়া কারটাও সামান্য একটু এগিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। ঐ কার ও মাইক্রো থেকে দুজন লোক নামে। তারা একে অপরের নাম ধরে ডেকে কথা বলছিল। তোমার বর্ণনা শুনে মনে হচ্ছে তারাই মি. হাত্তাকে কিডন্যাপ করেছে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কিন্তু কেন মনে হচ্ছে? কি প্রমাণ পেয়েছেন?’ ফাতিমা নাসুমন বলল।
‘প্রথম প্রমাণ হলো কিডন্যাপকারীদের একটা কার ও একটা মাইক্রো ছিল, ওখানেও তাই। দুই ক্ষেত্রেই গাড়ির রং সাদা। তুমি বলেছ কমান্ডোরা সুরিনামের নয়, আমি যে দুজনকে দেখেছি তারাও সুরিনামের নয়। সবচেয়ে বড় কথা হলো, যে দুজন ঘরে ঢুকেছিল তাদের একজনকে ‘মায়া’ অন্যজনকে ‘মোল্লাটো’ বলে তোমার মনে হয়েছে। অন্যদিকে আমি যে দুজনকে দেখেছি তাদের একজনের নাম ‘মায়া’দের অন্য নামটি ‘মোল্লাটো’ গোষ্ঠীর।’ থামল আহমদ মুসা।
কথা বলল না ফাতিমা। বিমর্ষভাব তার চেহারায়। একটু পর ভাঙ্গা গলায় বলল, ‘ওরা তো চলে গেছে। এখন কি হবে। গাড়ির নম্বর আপনি দেখেছেন?’
হতাশ কণ্ঠ ফাতিমার।
‘দেখার চেষ্টা করিনি। দেখলেও এবং মনে রাখলেও কোন লাভ হতো না। গাড়িতে লাগানো নম্বর অবশ্যই ভূয়া ছিল।’
কথা শেষ করেই আহমদ মুসার মনে পড়ে গেল লন্ড্রির স্লিপের কথা। ওতে তো গাড়ির অন্যতম আরোহী ট্রিজিল্লোর ঠিকানা আছে।
খুশিতে ভরে গেল আহমদ মুসার মুখমন্ডল। মুখ ফুড়ে সে বলে ফেলল, ‘আল হামদুলিল্লাহ।’ আনন্দের উচ্ছাস তার কণ্ঠে।
‘কি ব্যাপার ভাইয়া, কি হল?’ বলল ফাতিমা।
‘আমি এখন বেরুতে চাই ফাতিমা।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কোথায়?’
‘মি. হাত্তার সন্ধানে।’
‘ওদের ঠিকানা জেনেছেন তাহলে?’ বলল ফাতিমা। তার চোখ-মুখে ফুতে উঠেছে আশার আনন্দ।
‘মনে হচ্ছে।’ বলে আহমদ মুসা লন্ড্রির স্লিপের সব কথা তাকে জানিয়ে বলল, ‘আল্লাহ্‌ তার বান্দাহদের প্রয়োজনে এভাবেই সাহায্য করে থাকেন।’
‘আল হামদুলিল্লাহ। আপনি এখনি বের হবেন?’ ফাতিমা বলল।
‘হ্যাঁ।’
‘পুলিশকে বলবেন না?’
‘পুলিশ কমিশনারকে বলব না। আমি নিঃসন্দেহ যে রঙ্গলালের লোকরাই আহমদ হাত্তাকে কিডন্যাপ করেছে এবং এখন আমার মনে হচ্ছে, রঙ্গলালরা বাইরে থেকে মাফিয়া ভাড়া করে এনেছে। সেদিন ব্রুকোপনডো হাইওয়ের ঘটনায় যারা মরেছে, তারা এবং আজকের কিডন্যাপকারীরা একই গ্রুপের লোক, রঙ্গলালরা নিজে না পেরে মাফিয়াদের ডেকে এনেছে। সাংঘাতিক কিছু ঘটানো ওদের লক্ষ্য। আমি একটা ঠিকানা পেয়েছি এটা পুলিশ কমিশনার জানতে পারলে সঙ্গে সঙ্গেই সে তা জানিয়ে দেবে রঙ্গলালকে। তার ফলে আমি ঠিকানায় পৌঁছার আগেই ওরা হাওয়া হয়ে যাবে।’ থামল আহমদ মুসা।
‘বুঝেছি ভাইয়া। আপনি একা মাফিয়া ও রঙ্গলালদের বিরুদ্ধে এভাবে যাওয়া কি ঠিক হবে?’ বলল ফাতিমা চোখে-মুখে অসহায় ভানব নিয়ে।
‘তুমি টেলিফোনে ওভানডো বা লিসাকে ঠিকানাটা জানিয়ে দাও। আর বলে দাও এখনি যেন তারা এটা বার্নারডোকে জানিয়ে দেয়। বার্নারডো সহকারী পুলিশ কমিশনারকে বিষয়টা জানাবে এবং নিজের কর্তব্যও সে ঠিক করে নেবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘বার্নারডো আপনার সাহায্যে সঙ্গে সঙ্গে যেন যায় এটা বলব না?’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘সেটা বার্নারডোকেই ঠিক করতে দাও।’
‘আপনি আশ্চর্য লোক ভাইয়া। তাকে আপনি হুকুম দেবেন না, সব দুর্বহ ভার একাই বইবেন।’ বলল ফাতিমা ভারী কণ্ঠে।
‘তা নয় ফাতিমা। নিউ নিকারী থেকে গতকাল সে সিনিয়র গোয়েন্দা অফিসার হিসেবে বদলী হয়ে এসেছে পারামারিবোতে। সে তো এখন আমার হুকুমের অধীন নয়।’
বলে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।

Top