৩৪. সুরিনামে মাফিয়া

চ্যাপ্টার

খাওয়ার টেবিল থেকে ড্রইংরুমের সোফায় এসে বসল আহমদ মুসা। সোফায় গা এলিয়ে দিল সে। নিজেকে খুব পরিতৃপ্ত ও প্রশান্ত অনুভব করছে আহমদ মুসা।
এর একটা কারণ বোধ হয় এই যে, দীর্ঘ ঘুম দিয়েছে সে। ফজরের নামাজ পড়ে ৫ টায় সে ঘুমিয়েছিল, উঠেছে বেলা ১ টায়।
গোসল, নামাজ ও খাওয়া সেরে এই এসে বসল ড্রইং রুমে।
তার পরিতৃপ্তি ও প্রষণ্নতার আরেকটা কারণ হতে পারে মারিয়া জোসেফাইনের চিঠি। ঘুম থেকে উঠেই স্ত্রী মারিয়া জোসেফাইনের চিঠি পেয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসার সময় সে জোসেফাইনকে চিঠি লিখে এসেছিল। সেই চিঠিরই জবাব পেয়েছে সে আজ। প্রিয় হাতের স্পর্শ জড়িত চিঠি তার জন্যে নিয়ে এসেছে অমৃতের স্বাদ। বারবার সে পড়েছে চিঠিটা।
পকেট থেকে আবার সে বের করল সেই চিঠি। পড়তে লাগলঃ
প্রিয়তম, আসসালামু আলাইকুম।
আমার এ চিঠি যখন সুরিনামে ওভানডোদের বাড়িতে পৌঁছবে, তখন তুমি সুরিনামে থাকবে কিনা জানি না। তবু আমার এ চিঠি তোমার হাতে পৌঁছবে এ আশা নিয়েই লিখছি। পাখির মত তোমার এই উড়ে বেড়ানোর মধ্যে প্রয়োজনটাই নিয়ামক শক্তি, তা তোমার মত আমিও জানি এবং মানি। কিন্তু এর মধ্যে, আমার মনে হয় তোমার জন্যে একটা বাড়তি রোমাঞ্চ আছে, কিন্তু আমার জন্যে রয়েছে অনিশ্চয়তার দ্বারা তাড়িত হবার বাড়তি একটা কষ্ট, একথা তোমাকে না বললে অবিশ্বস্ততা হয়। তবে, প্রিয়তম, এই কষ্টের মধ্যেও প্রাপ্তির একটা প্রশান্তি আছে যা আমার কাছে অমূল্য। এই অমূল্যের স্বাদ আমাকে সৌভাগ্যের শীর্ষে তুলেছে।
তোমার আমেরিকার চিঠি এবং তার সাথে সারা জেফারসনের চিঠি, যা তুমি পাঠিয়েছ, আমি বার বার পড়েছি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে আমি যেন নতুন করে আবিষ্কার করলাম। বুঝলাম, ইহুদী বিজ্ঞানী জন জ্যাকবদের পদপীড়িত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, আর সারা জেফারসনের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এক জিনিস নয়। সারা জেফারসনের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমাকে মুগ্ধ করেছে। যে দেশে বিশাল হৃদয় সারা জেফারসনের বাস, সে দেশটিকে আমি একবার দেখতে চাই প্রিয়তম। একবার যাব আমি সেখানে। সারা জেফারসনের ‘মন্টিসেলো’ আমার কাছে যেন এক খন্ড স্বপ্নের স্বর্গ। তাই বলে আমি সুরিনামকে কোনভাবেই ছোট করছি না, একথা ওভানডো, লিসা, ফাতিমাদের বলো। আমার একটা পরামর্শ তোমার কাছে, জোয়াও বার্নারডো এবং লিসাকে এক সাথে মানাবে বেশ। তুমি ভেবে দেখো।
আমি ভাল আছি। আমাদের ‘ভাবী ভবিষ্যত’ নিয়ে মাঝে মাঝেই স্বপ্ন দেখি জান। একদিন দেখলাম, একটা সাদা সামরিক হেলিকপ্টারে সওয়ার হয়ে সে এসে রাহমাতুল্লিল আলামিনের শয়নাগার, মসজিদে নববীর নীল গম্বুজে কলেমাখচিত ও জাতিসংঘের মোহরাংকিত সবুজ পতাকা উড্ডীন করছে। পারবে কি সে বিজয় যুগের এমন একজন সিপাহসালার হতে!
তুমি কেমন আছ জানতে চাইব না। তুমি ভাল থাক এটা আমার সব সময়ের প্রার্থনা। এক সময় খুব উদ্বেগে থাকতাম। কিন্তু ধীরে ধীরে বুঝেছি, এই উদ্বেগে পীড়িত হওয়া রাব্বুল আলামীনের উপর একজন মুমিনের অটুট আস্থার বুকে দুর্বলতার একটা কালো দাগ। এই দুর্বলতার স্পর্শ থেকে বাঁচবার জন্যে অবিরাম চেষ্টা করি। তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ যে, তুমি সব সময় সব খবর জানিয়ে আমাকে সাহায্য কর।
চিঠি শেষ করার আগে একটা বিষয়ের দিকে তোমার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, কারণ বিষয়টা তোমার নজর এড়িয়েও যেতে পারে। আজার বাইজান, কুর্দিস্তান, আফগানিস্তান, মধ্যএশিয়া জুড়ে নতুন যে কালোদানব তার ছায়া ফেলতে যাচ্ছে সেটা তুমি জান। ঠিক এই বিষয়টির সাথে সংশ্লিষ্ট এক কাহিনী বের হয়েছে ফ্রান্সের লা’মন্ডের এই মাসের প্রথম তারিখের ইস্যুতে। খবরটি খুবই উদ্বেগজনক। কাটিংটি এই মুহূর্তে খুঁজে পাচ্ছি না। তুমি খুঁজে পাবে কাগজটা। অথবা ইন্টারনেটেও পেতে পার। পড়ে নিও।
আজ এ পর্যন্তই। আসি। ওয়াসসালাম।
তোমার মারিয়া জোসেফাইন।
চিঠি পড়া অনেকক্ষণ আগে শেষ হয়েছে। কিন্তু চিঠির দিকে নিস্পলক তাকিয়ে আছে আহমদ মুসা। তার চোখে শূন্য দৃষ্টি। হারিয়ে গেছে যেন সে চিঠির জগতে।
ড্রইং রুমে একে একে প্রবেশ করল ওভানডোর মা, লিসা, ওভানডোর স্ত্রী জ্যাকুলিন, ওভানডো এবং লিন্ডা।
সবাই বসল। কিন্তু লিসা এগুলো আহমদ মুসার দিকে। বিড়ালের মত নিঃশব্দ পায়ে আহমদ মুসার কাছে পৌঁছে ডান হাতের তর্জনী দিয়ে আহমদ মুসার হাতের চিঠিতে একটা টোকা দিয়ে বলল, ‘ভাইয়া, ভাবীর চিঠি নিয়ে কি দিবাস্বপ্ন দেখছেন?’
সম্বিত ফিরে পেল আহমদ মুসা। হাসল।
চিঠিটা ভাঁজ করে হাতের মুঠোয় নিয়ে আহমদ মুসা তাকাল লিসার দিকে। আহমদ মুসা কথা বলার জন্যে মুখ খুলেছিল। কিন্তু তার আগেই লিসা বলে উঠলো, ‘গোয়েন্দা সাহেব আপনাকে টেলিফোন করেছিলেন।’
‘কোন গোয়েন্দা সাহেব?’ আহমদ মুসা বলল।
‘গোয়েন্দা অফিসার।’
‘কোন গোয়েন্দা অফিসার?’ আহমদ মুসা মুখ টিপে হেসে বলল।
‘তাও বলতে হবে? মিঃ মোহাম্মদ জোয়াও বার্নারডো ’। বলল লিসা মুখটা উজ্জ্বল করে।
‘বার্নারডোর নামে তো “মোহাম্মদ” নেই! এটা পেলে কোথায়?’ বলল আহমদ মুসা। আগের হাসি তখনও তার মুখে।
‘জোয়াও বার্নারডো’ নাম শুনলে ‘মুসলমান’ বলে বুঝা যায় না। তাই মোহাম্মদ লাগিয়ে দিলাম।’ বলল লিসা খুব হালকা কণ্ঠে।
‘আরো অনেকের নাম শুনলে মুসলমান বলে বুঝা যায় না। সেখানে তো ‘মোহাম্মদ’ লাগাও নি!’ হেসে বলল আহমদ মুসা।
মুহুর্তের জন্যে একটা বিব্রত, সলজ্জ্বভাব ফুটে উঠল লিসার মুখে। সঙ্গে সঙ্গেই সে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে উঠল, ‘কারণ খুব ভালো মুসলমান হওয়ার জন্যে সে উঠে পড়ে লেগেছে।’
‘তুমি জানলে কি করে?’ অনেকটা চোর ধরার আনন্দ নিয়ে বলল আহমদ মুসা।
‘আমার প্রশ্নের উত্তর এখনও দেন নি। আপনার সব প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে কেন?’ মাথা ঝাঁকিয়ে বলল লিসা।
হাসল আহমদ মুসা। ঠিক আছে তোমার প্রশ্নের জবাব দিচ্ছি। তারপর বলল আহমদ মুসা, ‘আমি দিবা স্বপ্ন দেখছিলাম না, ভাবছিলাম।’
‘কি ভাবছিলেন?’ লিসা বলল।
‘তোমার ভাবী একটা পরামর্শ দিয়েছে, সেই পরামর্শ নিয়ে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কি পরামর্শ?’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘চিঠির ঐ অংশটা তোমাকে দেখাচ্ছি। তুমিই পড়ে দেখ কি পরামর্শ।’
বলে আহমদ মুসা চিঠির ভাঁজ খুলে চিঠির ঐ অংশটা লিসার সামনে তুলে ধরল।
লিসা আহমদ মুসার সামনে কার্পেটের উপর বসে আহমদ মুসার হাতে ধরা চিঠি থেকে ঐ অংশটা পড়তে লাগল। পড়তে পড়তে তার মুখ লাল হয়ে উঠল। পড়া শেষ করেই চিঠি ছেড়ে দিয়ে দু’হাতে মুখ ঢেকে চিৎকার করে উঠল, ‘ভাবীকে পেলে আমি মারব।’ বলে উঠে দাঁড়িয়ে ছুটে পালাল ড্রইংরুম থেকে।
ড্রইংরুমে উপস্থিত সবাই উদগ্রিব হয়ে উঠেছে। লিসা ছুটে পালাতেই ওভানডোর স্ত্রী জ্যাকি বলে উঠল, ‘কি পরামর্শ দিয়েছেন উনি ভাইজান?’
‘আমি পড়ছি, শুনুন।’ বলে আহমদ মুসা চিঠির অংশটা পড়ে শোনাল। পড়া শেষ হবার সাথে সাথেই ওভানডোর স্ত্রী ‘ওয়েলকাম, ওয়েলকাম’ বলে চিৎকার করে উঠল। মুখ টিপে হাসতে লাগল ওভানডোর মা। আর ‘হিপ হিপ হুররে’ বলে লাফিয়ে উঠল ওভানডো।
ওভানডো থামতেই ওভানডোর মা আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘বৌমা তো তোমাকে পরামর্শ দিয়েছে বেটা। এখন তোমার কথা বল।’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘আপনার বৌমা আমার মনের কথা জানতে পেরেছেন।’
‘আল হামদুলিল্লাহ।’ সংগে সঙ্গে বলে উঠল ওভানডোর মা।
‘কিসের ‘আল হামদুলিল্লাহ’ পড়ছ বৌমা?’ ড্রইংরুমে প্রবেশ করতে করতে বলল ওভানডোর দাদী।
ওভানডোর দাদী বসল আহমদ মুসার পাশে।
ওভানডোর মা চিঠির পরামর্শসহ যা ঘটেছে সব কথা খুলে বলল। শুনে ওভানডোর দাদীও ‘আল হামদুলিল্লাহ’ পড়ে বলল, ‘ও এজন্যেই লিসা মুখ লাল করে ওদিকে পালাল। খুব ভালো হলো, কথাটা এভাবে এসে যাওয়ায়। বৌমা, আমার মদিনার নাতবৌকে তুমি ধন্যবাদ পাঠাও।’
কথা শেষ করে ফিরল ওভানডোর দাদী আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘তুমি আজ একটা ঘুম দিয়েছো বটে। দু’তিনবার এসে ফেরত গেছি।’
‘কেন কি ব্যাপার দাদী? বলুন।’
‘বলব কি ভাই। তুমি আল্লাহর ফেরেশতা হয়ে এ বাড়িতে এসেছ।একের পর এক বিপদ থেকে আমাদের উদ্ধার করছ, এটাই শুধু নয়, তুমি আমাদের অতীতকে ফেরত দিয়েছ। আমাদের পুর্ব পুরুষ মুসলমান ছিল, এটা তোমার কাছ থেকেই আমরা জানার সুযোগ পেয়েছি। সব শেষে তুমি ভাই আমাদের ভাঙ্গা পরিবারকে আবার জুড়ে দিয়েছ। তুমি আমাদের ফিরিয়ে দিয়েছ লিন্ডা লোরেন এবং ক্রিষ্টিনাকে আমাদের কাছে। আজ থেকে চার পুরুষ আগে লিন্ডার গ্রেট গ্র্যান্ড ফাদার সুরিনাম থেকে চলে যাবার পর পরিবারটা ভেঙ্গে পড়েছিল, সম্পর্কহীন হয়ে পড়েছিল। আজ লিন্ডা ও ক্রিষ্টিনা ফিরে আসার পর পরিবারটা আবার জোড়া লাগল। এর সবটা তোমার কৃতিত্ব ভাই!’ বলতে বলতে আবেগে কণ্ঠ ভারী হয়ে উঠল ওভানডোর দাদীর কণ্ঠ। থামলো ওভানডোর দাদী।
‘লিন্ডার সাথে আপনাদের সব পরিচয় হয়ে গেছে দাদী?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘সব পরিচয় কোত্থেকে আসবে ভাই। লিন্ডা তার গ্রেট গ্র্যান্ড ফাদারের নাম এবং তিনি সুরিনাম থেকে গেছেন, এটুকু ছাড়া আর কিছুই জানে না।’ বলল দাদী।
‘তাহলে পরিচয় হলো কি করে?’
‘ওর গ্রেট গ্র্যান্ড ফাদারের নাম শুনেই আমি চিনতে পেরেছি।’
‘আপনি তাঁকে চিনতেন?’
‘আমার শ্বশুরের ছোট ভাই চিনবো না কেন? তবে খুব বেশী দিন দেখিনি। আমি নতুন বউ হয়ে এ বাড়িতে আসার কয়েক মাস পরেই আলফ্রেড টেরেক, ওর গ্রেট গ্র্যান্ড ফাদার, পড়তে যায়। এরপর কয়েকবার সে এসেছে। একবার এসে পারিবারিক দলিল পত্র কপি করে নিয়ে যায়। সেই তার শেষ যাওয়া। খুব বেশিদিন না দেখলেও আলফ্রেডের চেহারা আমার বেশ মনে আছে।’ কথা বলতে বলতে দাদীর চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
দাদী থামলে আহমদ মুসা বলল, ‘ওরা এবং আপনারা কেউ আর কখনও যোগাযোগ করেননি?’
‘কিছুদিন মানে আলফ্রেড টেরেক বেঁচে থাকা পর্যন্ত কিছু কিছু চিঠি যোগাযোগ ছিল। তার এক চিঠিতে তার বিয়ে করার খবর জানতে পারি। আর এক চিঠিতে সে তার প্রথম ছেলে ‘জোস ভাসকুয়েজ’ হবার কথা জানিয়েছিল।’
‘লিন্ডার দুঃখের কথা শুনেছেন দাদী?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘সব বলেছে। সবই ভাগ্য। সে যদি পরিবারের মধ্যে থাকতো, একা না পড়ে যেতো, তাহলে কি এসব ঘটতে পারতো! তোমাকে ধন্যবাদ ভাই, আমাদের দুঃখী লিন্ডাকেও তুমি বাঁচিয়েছ।’ দাদী বলল।
‘লিন্ডাও আমাকে বাঁচিয়েছেন দাদী।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কিন্তু সেটা আপনি ক্রিস্টিনাকে বাঁচিয়েছেন বলেই। আপনাকে আমার বাঁচানোটা নিঃস্বার্থ ছিল না।’ মিষ্টি প্রতিবাদ করে বলল লিন্ডা।
আহমদ মুসা কিছু বলতে যাচ্ছিল। তাকে থামিয়ে দিয়ে দাদী বলল, ‘তোমাদের আশেপাশের ঝগড়াটা একটু পরে করো। সকাল থেকে যে কথা বলার জন্য ঘুরছি, সেটা আগে বলতে দাও।’
‘সেটা আবার কি দাদী?’
‘লিন্ডার কাছে শুনলাম, আমাদের পারিবারিক দলিলের একটা কপি তুমি লিন্ডাকে পড়ে শুনিয়েছ। লিন্ডার কাছে তার বিস্তারিত আমরা শুনেছি। ভাই, আরব্য উপন্যাসের চেয়েও চাঞ্চল্যকর এবং মর্মান্তিক এ কাহিনী। কিন্তু সেই সাথে আমাদের পরিবারের জন্য মহা আনন্দের। আমরা আমাদের শিকড় খুঁজে পেয়েছি। খুঁজে পেয়েছি আমাদের পরিচয়। আর ভাই, তুমি আমাদের সৌভাগ্য সূর্য। তুমি আসার পর একের পর এক সুখবরই তুমি দিচ্ছ। আল্লাহকে অশেষ ধন্যবাদ যে তিনি তোমাকে মূর্তিমান সাহায্য হিসেবে আমাদের কাছে পাঠিয়েছেন। এখন…।’
‘দাদী, আপনাদের নিয়ে আমার আনন্দটাই বেশি। সুরিনামে এসে আপনাদের আতিথ্যে থেকে একমাত্র আপনাদের পরিবারের সাথেই মিশেছি। একটা গভীর সম্পর্কেরও সৃষ্টি হয়েছে। যখন বুঝলাম, জানলাম আপনাদের পূর্ব পুরুষ মুসলমান ছিলেন তখন যে আনন্দ পেয়েছি, সে আনন্দ দাদী আপনারা পাননি। আপনারা আপনাদের অতীত পরিচয় জানার পর এখন আপনাদেরকে বিশ্বাস ও সংস্কৃতির পরিবর্তন করতে হচ্ছে, অন্যদিকে আমার বিশ্বাস ও সংস্কৃতির নতুন সাথী হিসাবে আপনাদের পেয়েছি। আপনারা একটা হারিয়ে আরেকটা পেলেন। আর আমি কোন কিছু হারাইনি, বরং আরও পেয়েছি। সুতরাং আমাকেই আল্লাহ্‌র শুকরিয়া আদায় করে আপনাদের ধন্যবাদ দিতে হবে ।’ বলল আহমদ মুসা।
দাদী কিছু বলতে যাচ্ছিল। তাঁকে থামিয়ে দিল ওভানডো। বলল, ‘স্যরি দাদী, আমি আগে বলে নিই। আমি প্রমাণ করবো যে, আমরাই বেশি আনন্দ পেয়েছি আহমদ মুসা ভাই আমাদের মাঝে আসার কারণে।’ বলে একটু থেমেই ওভানডো আবার শুরু করল, ‘ভাইয়া আপনার সাহায্যে শুধু আমরা নই, সুরিনামের সব মুসলমানরা যে উপকার পেয়েছে তা বলে শেষ করা যাবে না। আপনি তাদের নতুন জীবন দিয়েছেন। আপনি আহমদ হাত্তা নাসমুনকে আমেরিকা থেকে নিয়ে এসে, তাঁকে নিরাপত্তা দিয়ে, রঙ্গলালদের সব ষড়যন্ত্র বানচাল করে দিয়ে আহমদ হাত্তাসহ আরও মুসলিম রাজনীতিককে এবং তাদের দলকে শুধু ক্ষমতায় পাঠিয়েছেন তা নয়, সুরিনামের রাজনীতির গোটা মানচিত্রই আপনি পাল্টে দিয়েছেন। রঙ্গলালদের ‘সুরিনাম পিপলস কংগ্রেস’ এবং শিবরাম শিবাজীদের ‘মায়ের সূর্য সন্তান’ সংগঠন আহমদ হাত্তা নাসুমনকে কিডন্যাপ করে, সক্রিয় মুসলিম নেতা, যুবক ও তরুণদের কিডন্যাপ ও নিধনের মাধ্যমে মুসলমানদেরকে প্রথমে সুরিনামের রাজনীতি থেকে উচ্ছেদ এবং পরে দেশ থেকে তাদের নির্মূল করতে চেয়েছিল। এই কাজে তারা অনেক দূর অগ্রসর হয়েছিল। কয়েক হাজার মুসলিম যুবক ও তরুণ ইতিমধ্যেই নিখোঁজ হয়েছে। এই ভাবেই তারা সুরিনামকে আরেক স্পেনে পরিণত করতে চেয়েছিল। আপনি সুরিনামের মুসলমানদের রাজনীতি এবং তাদের অস্তিত্ব রক্ষা করেছেন। অন্যদিকে দেশ বিদেশের মিডিয়াকে আপনি ব্যবহারের যে কৌশল করেছেন, তাতে রঙ্গলাল ও শিবরাম শিবাজীদের অপরাধ দেশের জনগণসহ বিশ্ববাসীর কাছে প্রকাশ হয়ে পড়েছে। তাদের বিচার ও শাস্তির বিষয়টা অবধারিত হয়ে পড়েছে। জানেন ভাইয়া, রঙ্গলালরা এখন আপোশের জন্যে উঠে-পড়ে লেগেছে। ওরা ‘মায়ের সূর্য সন্তান’-এর মত মুসলিম বিদ্বেষী সংগঠনকে ভেঙ্গে দিয়েছে এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী কিছু শীর্ষ নেতাকেও তারা সুরিনাম পিপলস কংগ্রেস থেকে বহিষ্কার করতে রাজি হয়েছে। সুরিনামে মুসলিম রাজনীতির এই সাফল্যের একক স্থপতি আপনিই আহমদ মুসা ভাই। কিন্তু দুঃখ হলো, আপনার এই মহান অবদানের কথা সুরিনামবাসীরা জানে না, এমনকি প্রধানমন্ত্রী আহমদ হাত্তা এবং তার মেয়ে ফাতিমা ছাড়া সরকার এবং মুসলমানদেরও কেউ জানে না। সুতরাং আপনি আমাদের ধন্যবাদ জানাবেন তার কোন সুযোগ নেই। আমরা শত-কোটি ধন্যবাদ কিংবা কোন কিছু দিয়ে সুরিনামের মুসলমানরা আপনার দান শোধ করতে পারবে না।’ থামল ওভানডো।
ওভানডো থামতেই আহমদ মুসা কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছিল। কিন্তু তার আগেই ওভানডোর মা বলে উঠল, ‘তোমার কথা তুমি মানুষকে, এমনকি সরকারের অন্যদেরকেও জানতে দিতে চাও না কেন?’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘প্রথম কথা হলো, এর কোন প্রয়োজন নেই। দ্বিতীয়ত, এই কাজটা করা হলে সুরিনামের বর্তমান ঘটনাবলির সাথে আহমদ মুসা জড়িয়ে গেলে সুরিনাম আন্তর্জাতিকভাবে কারো শ্যেন দৃষ্টিতে পড়ার সম্ভাবনা আছে। বিনা কারণে সুরিনামের মুসলমানদের এমন বিপদে জড়ানো হবে কেন?’
আহমদ মুসা থামলেও সংগে সংগে কেউ কথা বলল না। একটু পরে ওভানডোর মা’ই বলে উঠল, ‘আল্লাহ তোমার উপর রহম করুন বাছা। এ ধরণের ভাবনা ভাবা শুধু তোমার পক্ষেই সম্ভব। আমাদের ভালোটাও আমাদের বুঝার শক্তি নেই বাছা!’
ওভানডোর মা থামতেই ওভানডোর দাদী বলে উঠল, ‘তোমরা আমার আলোচনা অন্যদিকে অনেক দূর ঠেলে নিয়ে গেছ। আমি যা বলতে এসেছি তা এখনও বলাই হয়নি।’
‘কিন্তু আপনি তো বললেন অনেক কথা। ঠিক আছে বলুন। আমি প্রস্তুত দাদী।’ হেসে বলল আহমদ মুসা।
দাদী নড়ে-চড়ে বসল। গম্ভীর হয়ে উঠল তার মুখ। বলল, ‘টেরেক দুর্গের কোথাও আমাদের পূর্ব পুরুষ পরম সম্মানিত আব্দুর রহমান আল-তারিক যে স্বর্ণ মওজুদ রেখেছেন সেই সম্পর্কেই বলব। লিন্ডার কাছেও এ ব্যাপারে শুনেছি। কিন্তু দেখলাম সে এ বিষয়ে একেবারেই আগ্রহী নয়। তার একটাই এখন স্বপ্ন সে পিতৃপুরুষের বাসস্থান স্পেনের ‘ওয়াদিউল গানী’তে যাবে। আমি তাকে অভিনন্দন জানাই। সেই সাথে আমি ওভানডোদেরও বলব, আমাদের পরিবারের শিকড় সন্ধানে তারাও স্পেনে যাক। শুধু তো স্পেন নয়। স্পেনে আমাদের শিকড়ের মূল পাওয়া যাবে না, সে মূল পেতে হলে আমাদের যেতে হবে আরব ভূমিতে, হেযাযে এবং মক্কায়। আর…।’ আবেগে ভারী হয়ে উঠল দাদীর কণ্ঠ। অবশেষে তা রুদ্ধ হয়ে গেল।
সামলে নিল দাদী নিজেকে। একটু থেমেই আবার বলতে শুরু করল, ‘আর শিকড় খুঁজতে গেলে বিচিত্র ইতিহাস এবং ভয়াবহ এক বাস্তবতার সম্মুখীন আমরা হবো। যে ব্যাপারে তোমার চেয়ে আর কেউ বেশি জানে না ভাই। সুরিনামে মুসলমানদের যে অবস্থা হয়েছিল, সে অবস্থা মুসলমানদের বহু দেশেই। এতদিন এগুলো শুধু পড়েছি, আজ এই নির্যাতিতদের একজন হিসাবে দায়িত্বও অনুভব করছি। টেরেক দুর্গে যে অর্থ আছে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুব বেশি হয়তো হবে না। কিন্তু যতটাই পারা যায় তাকে কাজে লাগাতে চাই। তাই সম্পদগুলো-টেরেক দুর্গ থেকে উদ্ধার করা হোক তা আমি চাই। এই মুহুর্তেই সেই কাজ শুরু কর ভাই।’
বলে কাপড়ের ভেতর থেকে একটা কাগজের প্যাকেট বের করে দাদী আহমদ মুসার দিকে বাড়িয়ে ধরল এবং বলল, ‘এগুলো মূল দলিল। লিন্ডার কাছে যা দেখেছ সেগুলো ফটোকপি। তুমি এ দলিলগুলোর ভেতর থেকে স্বর্ণ মজুদ সংক্রান্ত দলিলটা বের কর। দেখে বল, এখন আমাদের কি করতে হবে।’
আহমদ মুসা প্যাকেটটি হাতে নিয়ে দলিলগুলো থেকে স্বর্ণ মজুদ সংক্রান্ত দলিল আলাদা করে হাতে নিল। নজর বুলাল দলিলটির উপর।
দলিলটার শীর্ষে একটা শিরোনাম
‘পবিত্র আমানত”।
এরপর কয়েকটা লাইন আরবিতে লেখা। তার নিচে একটা ডায়াগ্রাম এবং কিছু সংকেত। আহমদ মুসা দলিল থেকে মুখ তুলে বলল, ‘এ দলিলের শিরোনাম দেয়া হয়েছে “পবিত্র আমানত” তারপর শিরোনামের নিচে আরবিতে কয়েকটা বাক্য লেখা হয়েছে। আমি অনুবাদ পড়ছিঃ ‘আমি আল্লাহর দেয়া স্বর্ণের একটা বিশাল ভান্ডার আমানত হিসাবে রেখে যাচ্ছি। আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে আমার প্রার্থনা, আমার বংশের কোন উপযুক্ত বংশধর এই আমানত উদ্ধার করুন এবং নিজেদের বৈধ প্রয়োজনে কিছু রেখে অবশিষ্ট সব অর্থ আমাদের নতুন দেশ সুরিনাম ও মুসলিম উম্মাহর কল্যাণে খরচ করুন। আমার বংশের যে বা যারা এই দায়িত্ব পালন করবেন, তাদের উপর আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তার রহমত বর্ষন করুন। তাদের জন্য রইলো আমার প্রাণঢালা ভালোবাসা।’ পড়া শেষ করে থামল আহমদ মুসা।
উদগ্রীব হয়ে সমস্ত মনোযোগ দিয়ে সবাই আহমদ মুসার পড়া শুনছিল। আবেগে ভারী হয়ে উঠেছে সবার চোখ-মুখ।
আহমদ মুসা থামতেই দাদী বলে উঠল, ‘ওভানডো, লিন্ডা, লিসা তোমরা কি পারবে না মহান পুর্ব পুরুষের দেয়া এ দায়িত্ব গ্রহণ করতে? পারবে না আল্লাহ্‌র রহমত ও সেই মহান পুর্ব পুরুষের প্রাণঢালা ভালোবাসার মালিক হতে? আবেগ-কম্পিত কণ্ঠ দাদীর।
চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে ওভানডো, লিন্ডা ও লিসার। তারা সমস্বরে বলল, ‘পারব দাদী।’ বলতে গিয়ে তাদের কণ্ঠও কাঁপল। লিন্ডা ও ওভানডোর চোখ ভিজে উঠেছে অশ্রুতে।
চোখ মুছে লিন্ডা বলল, দাদী আমিও এ দায়িত্ব গ্রহণ করলাম। কিন্তু এ দায়িত্বের সব কার্যকরী ভার ও অধিকার আমি ওভানডোর উপর অর্পণ করলাম।
‘আমিও।’ বলল লিসা।
লিসা অনেক আগেই আবার ফিরে এসেছে ড্রইংরুমে।
ওভানডো ছিল নতমুখে। মুখ তুলল সে। বলল, ‘বোনরা পাশে থাকলে বোনদের দেয়া দায়িত্ব আমি গ্রহণ করতে রাজি আছি। তবে মুসলিম উম্মাহর কল্যাণে খরচ করার যে দায়িত্ব তা গ্রহণ করতে আমি ভাইয়া আহমদ মুসাকে সবার তরফ থেকে অনুরোধ করছি।’
‘অবশ্যই সে এই দায়িত্ব গ্রহণ করবে। সেকি আমাদের বড় ছেলে নয়?’ বলল ওভানডোর মা।
‘বৌমা ঠিকই বলেছ। আর আমার ভাইটার এটাই তো কাজ।’ দাদী সমর্থন করল ওভানডোর মাকে।
‘দায়িত্ব নেবার প্রয়োজন পড়ে না। আমি তো ওভানডোকে সাহায্য করবই।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ঠিক আছে ভাই, দায়িত্ব পালনটা যদি সাহায্যের আকারে হয় ওভানডো আপত্তি করবে কেন? এ নিয়ে কথা খরচ না করে বরং তারপর দলিলে কি লেখা আছে সেটা পড়।’ বলল দাদী।
আহমদ মুসা নজর বুলাল আবার দলিলের উপর। দলিলের পরবর্তী অংশটা দুর্গের নক্সা। নক্সার কেন্দ্র বিন্দুতে রয়েছে মসজিদ। চারদিকে গভীর রেখা দিয়ে ঘেরা বাক্সের মধ্যে দুর্গের নক্সা। দুর্গের নক্সার উপর একটা দুই লাইনের কবিতা। কবিতায় বলা হয়েছে
‘অপূর্ণকে পূর্ণ কর,
পূর্ণের নিচের পথ ধর।’
আরবী এ কবিতা পড়েই আহমদ মুসার মনে হলো, এ কবিতাই গুপ্তধনের কোড বা চাবি।
আহমদ মুসা গভীরভাবে দুর্গের নক্সা পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। কিন্তু এতে কোন প্রকার সংকেত পেল না। কোড বা কবিতা থেকে বুঝা যাচ্ছে, একটা অপূর্ণতাকে পূর্ণ করতে হবে। কিন্তু দুর্গের কাঠামোতে বা অংকনে কোথাও অপূর্ণতা খুঁজে পেল না আহমদ মুসা।
দুর্গের নক্সার আউট লাইন রেখার নিচে দৃষ্টি পড়তেই সে দেখতে পেল কতকগুলো বিক্ষিপ্ত ছবি। প্রথমেই দাঁড়ানো আরবী পোষাকে দাড়িওয়ালা একজন বুজর্গ। তার মাথায় গোল টুপি। তার পাশে পড়ে আছে লম্বালম্বি ভাঁজ করা লম্বা এক প্রস্থ সাদা কাপড়। তারও একটু দূরে পড়ে আছে একটা লম্বা লাঠি। তারপর রয়েছে তিন স্টেপের একটা সিঁড়ি।
সবগুলো জিনিসের উপর একবার নজর পড়তেই আহমদ মুসার কাছে বিষয়টা অনেকখানি পরিস্কার হয়ে গেল। জিনিসগুলো আলাদা আলাদাভাবে অপূর্ণ। এগুলোকে পূর্ণ করা যায়।
বুজর্গের পাশে পড়ে থাকা লম্বা-লম্বি কাপড়কে পাগড়ী হিসেবে ধরে বুজর্গের মাথায় পাগড়ী বাঁধা যায় তারপর তার হাতে লাঠি তুলে দিলে একজন চলমান বৃদ্ধ বুজর্গের চিত্র পূর্ণ হয়ে যায়। কিন্তু তিন ষ্টেপের সিঁড়িটার অর্থ কি? বুজর্গ ব্যক্তিটি কি লাঠি হাতে সিঁড়ি দিয়ে কোথাও উঠবেন? কিন্তু তিন ষ্টেপের সিঁড়ি দিয়ে কোথায় উঠবেন? তিন ষ্টেপের সিঁড়ি কেন?
হঠাৎ বিদ্যুত চমকের মত একটা চিন্তা এসে তার মাথায় ঢুকল। বুজর্গ ব্যক্তিটি লাঠি হাতে প্রথম ষ্টেপে পা রেখে তৃতীয় ষ্টেপে বসলেই তো সিঁড়িটা জুমআ মসজিদের মিম্বর হয়ে যায়। মসজিদের মিম্বরের সিঁড়ির ধাপ তো তিনটাই হয়।
খুশি হলো আহমদ মুসা। কোড-এর প্রথম শর্তের অপূর্ণতাকে পূর্ণ করা গেছে। কিন্তু পরক্ষণেই তার মনে হলো মিম্বরে ইমাম বসলেই তো মিম্বর পূর্ণতা পায় না। মিম্বরের পূর্ণতার জন্য জুমআ মসজিদ অপরিহার্য।
হঠাৎ চমকে উঠার মত আহমদ মুসার দুই চোখ ছুটে গিয়ে দুর্গের নক্সায় আছড়ে পড়ল মেহরাবের ডান পাশের স্থানটিতে। না সেখানে মিম্বরের জায়গায় মিম্বর নেই। দেখেই আহমদ মুসা আনন্দে উচ্চস্বরে বলে উঠল, ‘আল্লাহু আকবার।’
সকলের দৃষ্টি আহমদ মুসার উপর নিবদ্ধ। সবাই জানে আহমদ মুসা দলিলের নক্সা ও সংকেত পরীক্ষা করছে, বুঝার চেষ্টা করছে। হঠাৎ আহমদ মুসার উচ্চস্বরে ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি সবাইকে কিছুটা চমকে দিল। আহমদ মুসা সব সময় মৃদু ভাষী, মিষ্ট ভাষী। উচ্চস্বরে কথা সে বলে না।
সবার আগে বিস্মিত দাদীই বলে উঠল, ‘কি ভাই, কি হল?’
‘পেয়ে গেছি দাদী, স্বর্ণ ভান্ডারের সন্ধান পেয়ে গেছি। ধাঁধার সমাধান করতে পেরেছি।’
বলে আহমদ মুসা সামনের টি টেবিলটা কাছে টেনে নিল। রাখল নক্সার দলিলটা টেবিলের উপর। তারপর ডাকল সবাইকে। বলল, ‘আপনারা আসুন, দেখুন ধাঁধাটা। কিছু বুঝতে পারেন কি না।’
সবাই এসে টি টেবিলের চারপাশে কার্পেটের উপর বসল। শুধু ওভানডোর দাদী ও মা বসল সোফায় আহমদ মুসার দু’পাশে।
প্রথমে আহমদ মুসা নক্সার মাথার আরবী কবিতার অর্থ করে শোনাল। তারপর দুর্গের নক্সা ও এর মধ্যেকার মসজিদ দেখালো। পরে নক্সার নিচের আরবী পোশাক পরিহিত দাড়ী ও টুপিওয়ালা বুজর্গ, লম্বা-লম্বি ভাঁজ করা কাপড় খন্ড, লাঠি ও তিন ধাপের সিঁড়ি দেখাল এবং বলল, ‘এখন বের করতে হবে স্বর্ণ ভান্ডারে পৌঁছার পথ কোথায় হবে।’
সবাই নক্সার উপরে ঝুঁকে পড়ে দুর্গের নক্সা ও সংকেত বুঝার চেষ্টা করতে লাগল।
কিছুক্ষণ পর দাদী ও ওভানডোর মা বলল, ‘কিছুই মাথায় ঢুকছে না, কিছুই বুঝতে পারছি না।’
ওভানডো বলে উঠল, ‘অপূর্ণতাই খুঁজে পাচ্ছি না, পূর্ণ করব কি?’
লিসা তার আগেই হাল ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে বসে আছে।
লিন্ডা বলল, ‘কোড বা কবিতার নির্দেশ বুঝতে পারছি এবং বুঝতে পারছি যে, নক্সার নিচের আইটেমগুলোর কোড-এ এর সমাধান রয়েছে। কিন্তু নক্সার সংকেতগুলো একেবারেই দুর্ভেদ্য। ওভানডোর মত আমিও কোথাও অপূর্ণতা খুঁজে পাচ্ছি না।’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘আপনাদের পুর্ব পুরুষ আব্দুর রহমান আল তারিক তার স্বর্ণ ভান্ডারকে এমন এক ধাঁধাঁয় আটকে রেখে গেছেন, যার সমাধান মুসলিম সমাজ জীবন সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান ছাড়া কারো পক্ষে বুঝা সম্ভব নয়। তার অর্থ তিনি চাননি অমুসলমানরা এই স্বর্ণ ভান্ডার খুঁজে পাক।
‘আমাদের বুঝিয়ে বলুন ভাইয়া, আমরা কিছুই বুঝতে পারছি না।’ বলল ওভানডো।
‘ধাঁধার মূল কথা হলো…’ বলতে শুরু করল আহমদ মুসা, ‘অপূর্ণকে পূর্ণ করতে হবে। কিভাবে করতে হবে? সংকেতের উপস্থিতি বলে দিচ্ছে, সংকেতগুলোর ব্যবহারের মাধ্যমেই তা করতে হবে। এ থেকে বুঝা যাচ্ছে সংকেতগুলো অপূর্ণ। মুসলমানদের রীতি নীতি, পোশাক, সামাজিকতা সম্পর্কে জ্ঞান থাকলে ও কিছুটা বুদ্ধিমান হলে এই অপূর্ণতা পরিস্কার হয়ে যায়। আপনারা দেখুন, প্রথমেই রয়েছে আরবী পোশাক পরা টুপি ও দাঁড়িওয়ালা একজন লোক, তার পাশেই রয়েছে লম্বা-লম্বি গুটানো এক খণ্ড কাপড়। কাপড়টা পাগড়ী। পাশে পাগড়ী থাকায় লোকটির পোশাক হয়েছে অপূর্ণ। তাকে মাথায় পাগড়ী পরতে হবে। আবার তার পাশেই রয়েছে লম্বা লাঠি। পাশের লাঠি ছাড়াও লোকটি অপুর্ণ থেকে যায়। তাকে লাঠি হাতে নিতে হবে। এরপর থাকে তিন ষ্টেপের সিঁড়ি। ধাঁধার এই অংশটা জটিল। কিন্তু একজন প্র্যাকটিসিং মুসলমানের জন্যে মোটেই কঠিন নয়। লাঠিটা অস্বাভাবিক লম্বা, প্রায় বুক পর্যন্ত দীর্ঘ। এ ধরণের লাঠি পথ চলার জন্যে কোন মানুষ ব্যবহার করে না। যে নিয়মিত জুমআর নামাজ পড়ে সে জানে জুমআর খোৎবা দেয়ার সময় ইমাম সাহেব এই ধরণের লাঠি ব্যবহার করেন । এই বিষয়টি তার মনে হবার সংগে সংগে সে বুঝবে তিন ষ্টেপের সিঁড়িটা মসজিদের মিম্বর যা ইমাম সাহেব খোৎবা দেয়ার সময় বসা ও দাঁড়াবার জন্যে ব্যবহার করেন। লাঠি ধরা পাগড়ী পড়া লোকটি তিন ষ্টেপের মিম্বরে বসার পর সংকেতগুলোর অপূর্ণতা পূর্ণ হয়ে যায়। কিন্তু এর পরেও আরেকটা অপূর্ণতা থাকে, সেটা হলো ইমাম সাহেবের বসার মিম্বর যেখানে আছে সেখানে থাকে না, থাকে মসজিদের মেহরাবের পাশে নির্দিষ্ট স্থানে। সুতরাং মিম্বরের অবস্থানকে পূর্ণ করতে হলে একটা জামে মসজিদ দরকার। এরপর মসজিদের সন্ধানে দুর্গের মসজিদের দিকে নজর দিন। দেখুন সেখানে মিম্বরের জায়গা খালি আছে কিনা।’
বলে আহমদ মুসা তার তর্জনিটা নিয়ে গেল দুর্গের মসজিদে মিম্বরের পাশে একটা নির্দিষ্ট স্থানে। বলল, ‘ঠিক এই জায়গায় মিম্বর থাকার কথা, কিন্তু নেই। ফলে মসজিদ এখানে অপূর্ণ হয়ে যায়। অন্যদিকে সংকেতের মিম্বরটা মসজিদ ছাড়া অপূর্ণ হয়ে রয়েছে। এখন সংকেতের মিম্বর মসজিদের খালি জায়গাটায় নিয়ে এসে বসালেই মসজিদ ও মিম্বর দুই-ই পূর্ণতা পেয়ে যায়। এই মিম্বরের নিচে বা পাশেই রয়েছে স্বর্ণ ভান্ডারে যাবার পথ।’ থামল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা থামলেও কেউ কোন কথা বলল না। বোবার মত নির্বাক সকলে। সকলের অপলক দৃষ্টি আহমদ মুসার প্রতি নিবদ্ধ।
প্রথম কথা বলল লিন্ডা। বলল, ‘ওয়ান্ডারফুল! মনে হচ্ছে দলিলটা আপনার তৈরি, ধাঁধা আপনার পরিকল্পনা! এক মুহূর্তে দেখেই শত শত বছরের পুরনো একটা জটিল ধাঁধার এই ‘জলবৎ তরলৎ’ ব্যাখ্যা কি করে সম্ভব!’
ওভানডোর মা বলল, ‘ঠিকই বলেছ লিন্ডা মা। আমরা কেন সুরিনামের কারো পক্ষেই এই ধাঁধার আসল রহস্য উদ্ধার করা সম্ভব ছিল না। কিনিক কোবরা’র জোয়াও লেগার্টরা এই দলিল হাত করতে চেয়েছিল। পেলেও তাদের কোনই লাভ হতো না। হাজার বছরেও ধাঁধার সমাধান তারা করতে পারতো না।’
‘আমি অন্য কথা ভাবছি আম্মা। স্বর্ণ ভান্ডারের চাবি হিসেবে এই ধাঁধাটি রেখে যাওয়ার মাধ্যমে আমাদের পুর্ব পুরুষরা আশা করেছিলেন তাদের উত্তর পুরুষরা সবাই মুসলমান থাকবে। কিন্তু আমরা তো মুসলমান থাকতে পারিনি। আমরা আধা খৃষ্টান, আধা জংলী ধর্মে বিশ্বাসী হয়ে গিয়েছিলাম। আমি ভাবছি, এই স্বর্ণ ভান্ডার আমাদের পুর্ব পুরুষরা তাদের ‘উপযুক্ত বংশধর’দের জন্যে রেখেছেন, যাদের জন্যে তারা দোয়া করেছেন এবং প্রাণঢালা ভালোবাসা দিয়েছেন। আমরা তাদের সেই ভাগ্যবান বংশধর নই।’ বলল ওভানডো গম্ভীর কন্ঠে।
আহমদ মুসা কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছিল, কিন্তু তার আগেই দাদী বলে উঠল, ‘তোমার অনুভূতি ঠিক ওভানডো, কিন্তু গোটা ব্যাপারকে তুমি এক সাথে করে দেখছো না কেন? তুমি আমাদের পুর্ব পুরুষদের যে উপযুক্ত বংশধরদের কথা বলছ, সে উপযুক্ত বংশধর গড়ে দেয়ার জন্যেই তো আল্লাহ্‌ আহমদ মুসাকে সুরিনামে পাঠিয়েছেন। আমরা আধা খৃষ্টান ও আধা জংলী ধর্মে ছিলাম বটে, কিন্তু এখন তো নেই। আমরা সকলেই ইসলাম ধর্মে ফিরে গিয়েছি। সেই ‘উপযুক্ত পুর্বপুরুষ’ তোমরা হয়ে গিয়েছ। এর আরেকটা প্রমাণ হলো ধাঁধার সমাধান হয়ে গিয়েছে। দায়িত্ব গ্রহণের জন্য উপযুক্ত পুর্বপুরুষ না থাকলে আল্লাহ্‌ অবশ্যই ধাঁধার সমাধান করে দিতেন না।’ থামলো দাদী।
দাদী থামতেই চট করে ওভানডো বলে উঠল, ‘ধাঁধার সমাধান তো আহমদ মুসা ভাই করেছেন, আমরা করিনি।’
‘আহমদ মুসা ভাই শুধু ধাঁধার সমাধানই করেনি, আমাদের মুসলমানও বানিয়েছে এবং আমাদের ভাঙ্গা পরিবারকে একত্রিতও করেছে। তুমি তার এই কাজগুলোকে একটি থেকে আরেকটিকে আলাদা করছ কেন? বলল দাদী।
‘ঠিক দাদী। বিষয়টাকে আপনি ঠিকভাবে তুলে ধরেছেন। আপনাকে ধন্যবাদ। একটা জিনিস বুঝতে চেষ্টা করো ওভানডো, শত শত বছর গেছে কিন্তু তোমাদের পরিবারের সামনে স্বর্ণ ভান্ডারের ধাঁধাটা আসেনি, তার সমাধানও হয়নি, শত শত বছর গেছে তোমরা ইসলাম ধর্মে ফিরে আসার সুযোগও পাওনি। কিন্তু আজ তোমাদের ইসলামে ফিরে যাওয়া এবং স্বর্ণ ভান্ডারের ধাঁধা তোমাদের সামনে আসা ও সমাধান হওয়ার ঘটনা এক সাথে ঘটল কেন? ওভানডো এর অর্থ এই যে, তোমরাই সেই ‘উপযুক্ত’ ও ‘সৌভাগ্যবান’ উত্তর পুরুষ যাদের জন্যে তোমাদের সেই পুর্বপুরুষরা আন্তরিক দোয়া ও প্রাণঢালা ভালোবাসা দিয়ে গেছেন।’
‘কিন্তু ভাইয়া আমি কি আমরা কি এই দায়িত্ব গ্রহণের উপযুক্ত, তাঁদের সেই মহান দোয়া ও ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য?’ বলতে বলতে আবেগ রুদ্ধ হয়ে গেল ওভানডোর কণ্ঠ। দু’হাতে মুখ ঢেকে কান্না রোধের চেষ্টা করতে লাগল সে।
আহমদ মুসা ওভানডোর কাঁধে হাত রেখে নরম কণ্ঠে বলল, ‘দায়িত্বের প্রতি যে লোভ করে না, সে-ই প্রকৃতপক্ষে দায়িত্ব গ্রহণের উপযুক্ত। তোমার ও তোমাদের এ গুণের জন্যেই তোমাদের পুর্বপুরুষদের সেই ‘উপযুক্ত বংশধর’ হিসেবে আল্লাহ তোমাদের মনোনীত করেছেন। এ দায়িত্ব গ্রহণ করে ‘আল হামদুলিল্লাহ’ বল।’
ওভানডো আহমদ মুসার হাত জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আল হামদুলিল্লাহ।’
ওভানডোর সাথে সাথে লিসা, লিন্ডা, ওভানডোর দাদী, মা, স্ত্রী সকলেই বলে উঠল, ‘আল হামদুলিল্লাহ।’
আহমদ মুসাও বলল, ‘আল হামদুলিল্লাহ।’ এর পর সবাই নিরব। কিছু সময় কেটে গেল এই নিরবতার মধ্য দিয়ে।
নিরবতা ভাঙল ওভানডোর দাদী। বলল আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে, ‘ভাই এখনি তাহলে বিরান ঐ মসজিদটার আসল জায়গাটা দেখিয়ে দাও, কোথায় খুঁড়তে হবে। পরিবারের কয়েকজন বিশ্বস্ত লোককে লাগিয়ে দাও খোঁড়ার জন্যে।’
‘এত তাড়া কেন দাদী?’ বলল আহমদ মুসা।
‘কখন তোমাকে পাব কখন পাব না তার ঠিক নেই ভাই। আমি চাই স্বর্ণের সব ফায়সালা তোমার উপস্থিতিতে তোমার দ্বারা হতে হবে।’ বলল দাদী এবং সেই সাথে উঠে দাঁড়াল।
উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা এবং সবাই।
আহমদ মুসা মসজিদের দিকে হাঁটা শুরু করে বলল, ঠিক আছে সন্ধ্যা পর্যন্ত আমার হাতে সময় আছে, সন্ধ্যায় যাব প্রধানমন্ত্রী আহমদ হাত্তার ওখানে। হাতের সময়টা এখন কাজে লাগানো যাক।’
চলল সবাই দুর্গের বিরান মসজিদের দিকে।

Top