৩৫. নতুন গুলাগ

চ্যাপ্টার

আজর ওয়াইজম্যানের চোখ দু’টি তার সামনে টেবিলে রাখা দু’টি ফটোর উপর স্থিরভাবে নিবদ্ধ।
দু’টি ফটোই আহমদ মুসার বলে কথিত। একটি ফটো ওয়াইজম্যানদের ফটো। আহমদ মুসার ফটো হিসাবে ফাইলে সংরক্ষিত। আরেকটি ফটো স্ট্রাসবার্গ পুলিশের কাছ থেকে সদ্য সংগৃহীত। ফটোটি পুলিশ তুলেছে আহমদ মুসার হোটেল কক্ষে দু’জন নিহত হওয়ার ঘটনার পর।
আজর ওয়াইজম্যানের হাতে একটা পাওয়ারফুল এ্যামপ্লিফায়ার লেন্স। সেটা ‍দিয়ে খুঁটে খুঁটে সে পরীক্ষা করছে ফটো দু’টিকে।
আজর ওয়াইজম্যান ওয়ার্ল্ড ফ্রিডম আর্মির (WFA) প্রধান। সাও তোরাহ দ্বীপ থেকে মাত্র কিছুক্ষণ আগে সে স্ট্রাসবার্গে পৌছেছে।
ফটো দুটি গভীর মনোযোগের সাথে পরীক্ষা করার পর মুখ তুলল আজর ওয়াইজম্যান। হাতের লেন্সটা টেবিলে রেখে সামনে বসা WFA এর স্ট্রাসবার্গ এর স্টেশন চীফ লাইবারম্যানকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘আমাদের ফাইল ফটোর সাথে হোটেলের কথিত আহমদ মুসার ফটোর মুখের আদল হুবহু মিলে যাচ্ছে। কিন্তু চোখ-মুখের মাইক্রো রিডিং মিলছে না। একেবারেই আলাদা। এটা কি করে সম্ভব বুঝতে পারছি না।’
আজর ওয়াইজম্যান থামতেই লাইবারম্যান বলে উঠল, ‘কিন্তু হোটেলের এই লোক আহমদ মুসা হতেই হবে। গ্রীন সার্কেল ও হোটেলের সাংঘাতিক ঘটনা প্রমাণ করছে লোকটি আহমদ মুসা না হয়েই পারে না। হোটেলের ঘটনায় পুলিশ পর্যন্ত বিস্মিত হয়েছে। সাফল্যের সাথে আমাদের লোকেরা হোটেল কক্ষে প্রবেশ করেছিল। পুলিশের মতে তারা প্রথমে আক্রমণ করারও সুযোগ পেয়েছিল। ক্লোরোফরম ভেজা রুমাল খাটের পাশে পাওয়ার অর্থ আহমদ মুসাকে তারা নিদ্রিত অবস্থায় পেয়েছিল এবং তাকে সংগাহীন করার জন্যে ক্লোরোফরমসহ রুমালও তারা বের করেছিল। কিন্তু নিদ্রিত অবস্থায় প্রথমে আক্রমণ করেও দু’জনে আহমদ মুসাকে এঁটে উঠতে পারেনি। আহমদ মুসার মত অসাধারণ কেউ না হলে এটা সম্ভব ছিল না।’
‘আমার কথাও এটাই। মদিনা থেকে স্ট্রাসবার্গে আসা আহমদ মুসার সিডিউলের সাথে এ লোকটির স্টাসবার্গে আসার সিডিউল মিলে যাচ্ছে। চেহারা ও মুখের আদলটাও মিলে যাচ্ছে। কিন্তু আসল জায়গায় তো মিলছে না’, বলল আজর ওয়াইজম্যান।
‘কোন কারণ নিশ্চয় আছে। কিন্তু লোক যে একই এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।’ লাইবারম্যান বলল।
‘সে কারণটা কি হতে পারে?’ জিজ্ঞেস করল আজর ওয়াইজম্যান।
‘হতে পারে দুটি ফটোগ্রাফের কোন একটিতে আহমদ মুসার ছদ্মবেশ আছে।’ বলল লাইবারম্যান।
‘কিন্তু ছদ্মবেশ তো মুখের মাইক্রোরিডিং পাল্টাতে পারে না।’ আজর ওয়াইজম্যান বলল।
‘পারে স্যার। প্লাস্টিক মেকআপ সম্পর্কে আমার বিশেষ পড়াশুনা আছে। আমি জানি, সর্বাধুনিক এমন কিছু প্লাস্টিক মেকআপ আছে যা সব দিক দিয়ে চামড়ার মত। চামড়ার মতই এতে রেখা, লোম ও লোমকূপ আছে। আলট্রা মাইক্রো লেন্সেও চামড়ার সাথে এর কোন ভিন্নতা ধরা পড়ে না।’ বলল লাইবারম্যান।
‘ধন্যবাদ লাইবারম্যান। আপনার এ মত আমি গ্রহন করছি এবং আমরা এখন এ সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে, হোটেলের এই লোকটি আহমদ মুসাই।’ আজর ওয়াইজম্যান বলল।
‘অবশ্যই।’ বলল লাইবারম্যান।
‘তাহলে একথাও বলা যায় যে, সে এখন আমাদের হাতের মুঠোয়।’ আজর ওয়াইজম্যান বলল।
‘তা আমরা বলতে পারি। হোটেল কক্ষে নিহত হওয়ার ঘটনার পুলিশ রিপোর্টটি আহমদ মুসার পক্ষে গেলেও পুলিশ আমাদেরকে সহযোগিতা করবে তার ব্যবস্থা হয়েছে। পুলিশ কমিশনার পুলিশের প্রতি কিছু নির্দেশ দিয়েছেন। তারা সুযোগমত আহমদ মুসাকে গ্রেপ্তার করে আমাদের হাতে তুলে দেবে।’ বলল লাইবারম্যান।
‘পুলিশের সাহায্য একটা বাড়তি বিষয়। তাদের উপর নির্ভর করে বসে থাকা যাবে না।’ আজর ওয়াইজম্যান বলল।
‘না স্যার। আমরা বসে নেই। হোটেলের চারদিকে আমরা ২৪ ঘন্টা পাহারা বসিয়ে রেখেছি। আমরা আহমদ মুসাকে চোখের আড়াল হতে দেব না। সুযোগ পেলে আমরা পুলিশের অপেক্ষা করব না। আমরা নিজেরাই তাকে জালে আটকাব।’ বলল লাইবারম্যান।
‘আমি চাই আহমদ মুসাকে ‘সাও তোরাহ’ দ্বীপের খাঁচায় পুরতে। তাকে খাঁচায় ভরতে পারলে শুধু বহু তথ্য পাওয়া যাবে তা নয়, গোটা দুনিয়ায় আমাদের মিশন নিরাপদ হয়ে যাবে।’ আজর ওয়াইজম্যান বলল।
‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের এতবড় বিপর্যয় ঘটাতে আহমদ মুসা পারল কিভাবে?’ জিজ্ঞেস করল লাইবারম্যান।
‘আহমদ মুসা শৃগালের মত ধূর্ত, বাঘের মত ক্ষিপ্র, সিংহের মত সাহসী এবং স্যার এ.এইচ. ডুনান্টের চেয়েও মানবিক এবং পোপের চেয়েও দয়ালু। কোন গুণের ঘাটতি তার ভেতর নেই। নিজের জীবন বিপন্ন করে বিপজ্জনক ওহাইও নদীতে ডুবে যাওয়া থেকে এফবিআই চীফ মি.জর্জের নাতিকে উদ্ধার করে আহমদ মুসা এফবিআই চীফের হৃদয় জয় করে নেয়। সবুজ পাহাড় ও লস আলামাসের মধ্যকার আণবিক ও সামরিক তথ্য পাচারের ইহুদী গোয়েন্দা সুড়ঙ্গ আবিষ্কার করে তা মার্কিন সরকারের হাতে তুলে দেয়াসহ বহু নিঃস্বার্থ ও উপকারী কাজের মাধ্যমে সে মার্কিন প্রেসিডেন্টের আস্থা অর্জন করে। অন্যদিকে সে আমাদের বেশ কিছু অপরাধমূলক বড় ধরনের কাজকে হাতে নাতে ধরিয়ে দেয়। এভাবেই সে গত একশ বছরে মার্কিন মাটিতে প্রোথিত আমাদের শেকড়কে আমূল উপড়ে ফেলার ব্যবস্থা করেছে। মার্কিন সরকার, মার্কিন কংগ্রেস ও মার্কিন সমাজে আমাদের শক্তিশালী লবি আজ সম্পূর্ণই অকার্যকর হয়ে পড়েছে এক আহমদ মুসার তৎপরতায়। এই আহমদ মুসাই এসেছে স্ট্রাসবার্গে। স্পুটনিক যে কাজ হাতে নিয়েছিল, সে কাজ করার জনেই সে যদি স্ট্রাসবার্গে এসে থাকে, তাহলে আমাদের সর্বনাশ হয়ে যাবে। কয়েক বছর আগে সংঘটিত নিউইয়র্কের ‘লিবার্টি ও ডেমোক্র্যাসি’ টাওয়ার ধ্বংস আমরাই করেছি একথা যদি সে প্রমাণ করতে পারে, তাহলে দুনিয়ার কোথাও আমাদের জায়গা হবে না। সুতরাং স্ট্রাসবার্গে এখন আমাদের একমাত্র কাজ সর্বশক্তি দিয়ে আহমদ মুসাকে ধ্বংস করা।’
দীর্ঘ বক্তব্য দেয়ার পর থামল আজর ওয়াইজম্যান। তার চোখে-মুখে সফরের ক্লান্তি এবং কন্ঠে হতাশার সুর।
‘স্যার, আপনি কি নিশ্চিত আহমদ মুসা ‘স্পুটনিক মিশন’ নিয়ে স্টাসবার্গ এসেছে?’ বলল লাইবারম্যান উদ্বিগ্ন কন্ঠে।
‘এছাড়া কোন কাজে সে স্ট্রাসবার্গ আসবে? আহমদ মুসার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, এ ধরনের মিশন নিয়ে সে বার বার বিভিন্ন জায়গায় গেছে। আর ‘স্পুটনিক মিশনে’র ব্যাপারটা সফল হয়, তাহলে একদিকে মুসলিম জাতিকে তারা ইতিহাসের জঘণ্য অপরাধের দায় থেকে বাচাঁতে পারবে, অন্যদিকে আমাদের তারা আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারবে।’ আজর ওয়াইজম্যান বলল।
‘স্পুটনিকের সবই তো ধ্বংস হয়ে গেছে। তাছাড়া স্পুটনিকের সাত শয়তানও আমাদের হাতে। আহমদ মুসা যতই করিতকর্মা হোক, আমার বিশ্বাস খুব বেশি সামনে এগুতে পারবে না। আরেকটা বড় বিষয় হলো, স্ট্রাসবার্গ পুলিশের কাছ থেকে সে ভাল সহায়তা পাবে না।’ লাইবারম্যান বলল।
লাইবারম্যানের চোখে-মুখে যতটা স্বস্তির ভাব ফুটে উঠেছিল, ততটাই অস্বস্তি প্রকাশ পাচ্ছিল আজর ওয়াইজম্যানের মুখে। তার কপাল কুঞ্চিত। অস্বস্তিকর ভাবনায় ডুবে যাওয়া তার মুখমন্ডল। লাইবারম্যান থামার পর একটু সময় নিয়ে ধীরে ধীরে সে বলল, ‘স্পুটনিক অফিসের সবরকমের দলিল দস্তাবেজ আমরা ধ্বংস করেছি। কিন্তু অফিসের দলিল দস্তাবেজই যে সবটুকু এটা কে বলবে। এ সবের কপি তারা অন্যকোন নিরাপদ জায়গায় রাখবে, এটাই স্বাভাবিক। এগুলো তো আহমদ মুসা পেয়েও যেতে পারে। কারণ, স্পুটনিকের সাথে জড়িত সব পরিবার থেকেই সে সমান সহযোগিতা পাবে।’ থামল আজর ওয়াইজম্যান।
উদ্বেগে ভরে উঠেছে লাইবারম্যানের চোখ-মুখ। বলল, ‘তাহলে এ দলিলগুলো তো আমাদের যে কোন মূল্যে খুঁজে পেতে হবে। সাও তোরাহে ওদের কাছ থেকে কিছু জানতে পারেননি, বলেনি কিছু তারা?’ লাইবারম্যানের কন্ঠে উত্তেজনা।
‘না কিছুই বলেনি। কোনওভাবেই তাদের মুখ খোলা যায়নি। যে নির্যাতনে হাতিও চিৎকার করবে, সে নির্যাতনও তারা হজম করে।’ আজর ওয়াইজম্যান বলল।
‘মানুষ এমন হতে পারে?’ বিস্ময় লাইবারম্যানের কন্ঠে।
‘তারা ভিন্ন মানুষ।’ বলল ওয়াইজম্যান।
‘কেমন?’
‘মৃত্যুকে ওরা সাফল্যের সিংহদ্বার বলে মনে করে। সেই সাফল্যের তুলনায় এই কষ্টটা নাকি খুবই ছোট।’ ওয়াইজম্যান বলল।
‘তাহলে?’
‘পথ একটাই, আহমদ মুসাকে সরিয়ে দেয়া।’ বলল ওয়াইজম্যান।
‘সেটা তো এক নাম্বার কাজ। স্পুটনিক পরিবারে কি হানা দেয়া যায় না এই দলিল দস্তাবেজের সন্ধানে?’ লাইবারম্যান বলল।
‘কেন, গত রাতে তো স্পুটনিকের ৭ নেতার বাড়িসহ ওদের আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের বাড়ি আদ্যপান্ত সার্চ করেছ।’ বলল আজর ওয়াইজম্যান।
‘আচ্ছা, তাহলে এসব কাগজই কি খুঁজেছি গত রাতে? কিন্তু কিছুই তো মেলেনি!’ লাইবারম্যান হতাশ কন্ঠে বলল।
‘মিলবে কি এত সহজে! ওদের বৌ-বেটিকেও নিয়ে যেতে হবে সাও তোরাহতে। দেখা যাবে তারপর তাদের মুখ বন্ধ থাকে কতক্ষণ।’ বলল ওয়াইজম্যান।
‘ঠিক বুদ্ধি। ওদের দেহ যতটা শক্ত, তাদের নৈতিকতা ততটাই স্পর্শকাতর। বৌ বেটির ইজ্জত যেতে দেখলে, স্রোতের মত বেরিয়ে আসবে ওদের মুখ থেকে কথা।’
বলে একটু থেমেই সে আবার বলা শুরু করল, ‘তাহলে এই কাজে আমরা দেরি করছি কেন? নির্দেশ দিন আমরা শুরু করি।’
‘না মি.লাইবারম্যান। আহমদ মুসাকে ধ্বংস করাই প্রথম কাজ। তাকে শেষ করলে, অন্য কাজ ধীরে সুস্থে করায় কোন ক্ষতি হবে না।’
এ সময় টেলিফোন বেজে উঠল লাইবারম্যানের।
টেলিফোন কানের কাছে তুলে নিল লাইবারম্যান। ওপ্রান্তের কথা শুনে সে বলে উঠল, ‘জরুরী খবর? বল বল।’
ওপারের খবর শুনল। তারপর এক ঝলক তাকাল সে ওয়াইজম্যানের দিকে এবং বলল ওপ্রান্তকে, ‘একটু হোল্ড কর, কথা বলি স্যারের সাথে।’
বলে টেলিফোন এক পাশে সরিয়ে নিয়ে ওয়াইজম্যানকে লক্ষ্য করে দ্রুতকন্ঠে বলল, ‘স্যার, আহমদ মুসা হোটেল থেকে বেরিয়েছে। সে একা একটি ট্যাক্সিতে চড়ে বিষমার্ক রোড ধরে এদিকেই এগিয়ে আসছে।’ থামল লাইবারম্যান।
লাইবারম্যান থামতেই আজর ওয়াইজম্যান বলে ঊঠল, ‘ওরা যারা আছে সবাইকে পিছু নিতে বল। ঈল পার্কের মোড়ে ওকে চারদিক থেকে আটকাতে হবে। এ অঞ্চলটায় মানুষের যাতায়াত খুবই পাতলা। এখানেই ওর নিপাত ঘটাতে হবে। বলে দাও আমরা আসছি।’
লাইবারম্যান সব কথা ওদের বুঝিয়ে বলে টেলিফোন রাখল।
ওয়াইজম্যান লাইবারম্যানকে লক্ষ্য করে বলল, ‘আরও যাদের দরকার তাদের বলে দাও সেখানে যেতে। দেখ, আমাদের ব্যর্থ হওয়া চলবে না। আর তৈরী হও এখনি।’
বলে ওয়াইজম্যান উঠে দাঁড়াল।
উৎসাহের সাথে উঠে দাড়াল লাইবারম্যানও।
ওয়াইজম্যান তার কক্ষের দিকে পা বাড়াতে গিয়ে পাশে ফিরে তাকিয়ে লাইবারম্যানকে বলল, ‘পুলিশ কমিশনারকে কি আমাদের এই মিশনের কথা বলবে?’
‘হ্যাঁ, বলল তাদের সাহায্যও পাওয়া যেতে পারে।’ লাইবারম্যান বলল।
চিন্তা করছিল ওয়াইজম্যান। বলে উঠল, ‘না লাইবারম্যান, পুলিশকে জড়িয়ে লাভ নেই। তাদের কারণে কোন সমস্যারও সৃষ্টি হতে পারে।’
বলে সে পুনরায় চলতে শুরু করল তার কক্ষের দিকে তৈরী হওয়ার জন্যে।
লাইবারম্যানও এগুলো তার কক্ষের দিকে।
ঈল পার্কটি স্ট্রাসবার্গ শহরের মতই পুরাতন।
পার্কটি নদীর সমান্তরালে। বিরাট জায়গা জুড়ে।
পার্কের পাশ দিয়ে রাস্তা। রাস্তার সমান্তরালে নদীর তীর ঘেঁষে মাঝে মাঝে হোটেল ও ট্যুরিস্ট ভিলায় মাঝে মাঝে রয়েছে বাগান। এ বাগানগুলো নদীর পানি পর্যন্ত নেমে গেছে।
শান্ত নিরিবিলি এলাকা। শহরের হৈ-হুল্লোড়ের বিন্দুমাত্রও এখানে নেই।
পার্কের পাশের সড়ক ধরে চলছে আহমদ মুসার গাড়ি।
আহমদ মুসার টার্গেট নগরীর মেয়র অফিস। মেয়র অফিসের রেজিস্ট্রেশন বিভাগ থেকে আহমদ মুসা একটা ঠিকানা যোগাড় করতে চায়। গতকাল বিকেলে তাড়া খেয়ে যে গাড়ি ছেড়ে ওরা পালিয়েছিল, সে আমেরিকান গাড়িটার কাগজপত্রে যে নাম ঠিকানা পাওয়া গেছে, তাতে রাস্তার নাম আছে, কিন্তু বাড়ির নাম ও নাম্বার নেই। মেয়র অফিস থেকে এই নাম নাম্বার পাওয়া যায় কিনা, সেটাই সে দেখতে চায়।
আহমদ মুসার গাড়ি চলছিল মধ্যম গতিতে।
সামনেই ঈল পার্কের একটা মোড়। মোড়টা ত্রিরাস্তার একটি সংযোগ স্থল। এই মোড় থেকে একটা রাস্তা ঈল নদীর কিনারা পর্যন্ত নেমে গেছে।
মোড়টাতেও তেমন ভীড় ও গাড়ি ঘোড়ার সমাগম নেই। তবে বেশ কিছু গাড়ি পার্ক করা আছে দেখতে পেল আহমদ মুসা। সবগুলো গাড়িরই মুখ মোড়ের দিকে। হয়তো আরোহীরা নেমে পার্কে ঢুকেছে ভাবল আহমদ মুসা।
মোড়ে প্রবেশ করল আহমদ মুসার গাড়ি।
আহমদ মুসার গাড়ি তখন মোড়ের মাঝামাঝি এসে পৌঁছেছে। হঠাৎ আহমদ মুসা বিস্ময়ের সাথে দেখল, সামনে ও বাম দিক থেকে এক জোড়া করে দুই জোড়া গাড়ি তীরবেগে এগিয়ে আসছে। প্রথমে আহমদ মুসা মনে করেছিল মোড় ঘুরে গাড়িগুলো কোন দিকে চলে যাবে। কিন্তু পরক্ষনেই তার বুঝতে বাকি রইল না গাড়িগুলো তার গাড়ি লক্ষ্য করেই পাগলা গতিতে এগিয়ে আসছে।
হঠাৎ করেই ব্রেক কষেছে আহমদ মুসা তার গাড়ি। সামনে এগুনো যায় না, বামেও না। আর ডাইনে পার্কের দেয়াল। পেছনে হটা ছাড়া পথ নেই।
কিন্তু পেছনে হটতে গিয়ে রিয়ারভিউতে চোখ পড়তেই দেখল, পেছন থেকে আর এক জোড়া গাড়ি সেই একই গতিতে তার দিকে এগিয়ে আসছে।
গাড়িতে আবার ব্রেক কষে গাড়ি থেকে আহমদ মুসা বেরোতে যাবে এমন সময় তিন দিক থেকে বৃষ্টির মত গুলী শুরু হলো।
তিন দিকের গুলির বৃষ্টি এসে ছেঁকে ধরল তার গাড়িকে। গাড়ির সামনে ও পেছনের উইন্ড স্ক্রিন ও সব জানালা মুহূর্তেই উড়ে গেল। ঝাঁঝরা হতে লাগল গাড়ি।
হোটেল থেকে ভাড়ায় আনা গাড়িটার জন্যে কষ্ট লাগল আহমদ মুসার। গাড়ির মেঝেয় শুয়ে নিজের আত্মরক্ষার ব্যবস্থা করল।
পাল্টা আক্রমনের কোন সুযোগ পেল না আহমদ মুসা। তিন দিকের অবিরাম গুলিবৃষ্টির মধ্যে মুহূর্তের জন্যেও মাথা তোলার কোন সুযোগ নেই। আর একটা মাত্র রিভলবার দিয়ে সে সামলাবে কোন দিকে।
হঠাৎ গুলীবর্ষণ তিন দিক থেকেই থেমে গেল। কি ব্যাপার? মুখ ঘুরিয়ে চোখ উপরে তুলল আহমদ মুসা। দেখল, চারদিক থেকেই ছয়টি স্টেনগানের নল প্রবেশ করেছে আহমদ মুসার গাড়ির মধ্যে।
আহমদ মুসা গাড়ির মেঝে থেকে উঠে বসল। শান্ত স্বাভাবিক কন্ঠে বলল, ‘কি ব্যাপার? কে তোমরা? এভাবে কেন আমাকে আক্রমন করেছ, আমার গাড়ি ধ্বংস করেছ?’
‘বাঃ আহমদ মুসা বাঃ! ছয় ছয়টি স্টেনগানের মুখে দাঁড়িয়েও এমন স্বাভাবিক কন্ঠে কথা বলতে পার তুমি?’ বলল সাড়ে ছয় ফুট লম্বা ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ও নেতা গোছের একজন লোক।
বলেই সে একজনকে নির্দেশ দিল, ‘ওকে বের করে আন।’
তাদের পেছন থেকে আরও দু’তিন জন লোক ছুটে এল। তাদের একজন টান দিয়ে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া একটা দরজা খুলে ফেলল।
দু’জনে হিড় হিড় করে টেনে আহমদ মুসাকে গাড়ি থেকে বের করল এবং শুইয়ে দিল রাস্তায়।
সাড়ে ছয় ফুট লম্বা সেই লোকটি এগিয়ে এল আহমদ মুসার কাছে। বলল, ‘ওয়েলকাম আহমদ মুসা। গত দুদিন ছিল তোমার, আজ তৃতীয় দিনটা আমাদের এবং এই তৃতীয় দিনটাই ফাইনাল। তোমাকে হত্যা করতেই চেয়েছিলাম। কিন্তু দেখলাম, তোমার পেটের অনেক কথা তাহলে চিরদিনের জন্যে হারিয়ে যাবে। সে কথাগুলো আমাদের খুবই দরকার। এ জন্যেই এখনও তুমি প্রাণে বেঁচে আছ।’
‘আমার সৌভাগ্য।’ বলল আহমদ মুসা লোকটির দিকে তাকিয়ে। এই সাথে ভাবল আহমদ মুসা, এই লোকটিই কি স্পুটনিক ধ্বংসের নেতা? নেতা না হলে নেতা গোছের যে কেউ হবেন তাতে কোন সন্দেহ নেই।
‘সৌভাগ্য নয়, প্রমাণ হবে এটাই চরম দুর্ভাগ্য, যখন যাবে ‘সাও তোরাহ’তে। আলেকজান্ডার সোলঝেনিৎসিনের ‘গুলাগ’টা কাল্পনিক ছিল, ঈশ্বরের এই ‘গুলাগ’ কিন্তু কাল্পনিক নয়।’
‘ঈশ্বরের কোন ‘গুলাগ’ থাকে না মি.। তাঁর আছে জাহান্নাম।’ আহমদ মুসা বলল।
‘হ্যাঁ ‘গুলাগ’ না বলে ‘জাহান্নাম’ও একে বলতে পার। কারণ এখানেও লোক ঢোকে, কিন্তু বের হয় না।’ বলল সেই সাড়ে ছয় ফুট লম্বা লোকটা।
‘দুনিয়ার সাজা নকল ঈশ্বরদের জাহান্নাম সম্পর্কে এ দাবী করা যায় না মি.।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমরা দুনিয়ার ঈশ্বর নই, অধীশ্বর আহমদ মুসা। জাহান্নাম সম্পর্কে ঐ কথা বলছ? ঠিক আছে তোমাকে দিয়েই তার প্রমাণ হবে, তুমি দেখতে পাবে।’
বলেই লোকটি যারা আহমদ মুসাকে টেনে বের করেছিল, তাদের একজনকে লক্ষ্য করে বলল, ‘একে ক্লোরোফরম লাগাও।’
সংগে সংগেই লোকটি এগিয়ে এল।
আহমদ মুসার কাছে এসে পকেট থেকে বের করল ক্লোরোফরম স্প্রেয়ার।
আহমদ মুসাও তাকাল ক্লোরোফরম স্প্রেয়ার কনটেইনারের দিকে। দেখেই চিনল ওটা ভয়ংকর ধরনের একটা ক্লোরোফরম। এ ক্লোরোফরম দিয়ে কাউকে অজ্ঞান করলে দশ বারো ঘন্টার আগে তার জ্ঞান ফেরে না। এর কার্যকারিতাও অত্যন্ত দ্রুত। কারো নাকে স্প্রে করার দুই তিন সেকেন্ডের মধ্যে সে সম্পূর্ণ জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। আবার এর আরেকটা গুণ হলো, কোথাও এটা স্প্রে করলে তিন চার গজের মধ্যে কেউ থাকলে সেও জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। সুতরাং এটা যে ব্যবহার করে তাকে একটা ছোট গ্যাস মাস্ক পরতে হয়। তবে এর একটা অসুবিধা রয়েছে। সেটা হলো, এর সংজ্ঞাহীন করার কার্যকারিতা স্প্রে করার এক মিনিটের বেশি স্থায়ী হয় না।
লোকটি ক্লোরোফরম স্প্রেয়ার হাতে নেয়ার সাথে সাথে নাকে গ্যাস মাস্কও পরে নিয়েছে।
গ্যাস মাস্কের ট্রিগারে তার তর্জনি স্থাপন করল লোকটি।
আহমদ মুসাকে ঘিরে রাখা স্টেনগানধারীরা তাদের স্টেনগান আহমদ মুসার দিকে উদ্যত রেখেই ওরা চার পাঁচ গজ দূরে সরে গেল।
আহমদ মুসাকে চিৎ করে শুইয়ে রাখা হয়েছে।
লোকটি স্প্রে করতে লাগল আহমদ মুসার নাকে। প্রায় পাঁচ সেকেন্ড সে স্প্রেটা ধরে রাখল আহমদ মুসার নাকের উপর।
পাঁচ সেকেন্ড স্প্রে করার পর স্প্রে বন্ধ করে সে দু’তিন সেকেন্ড অপেক্ষা করল। তারপর হঠাৎ আকষ্মিকভাবে সে লোহার স্পাইকওয়ালা জুতার গোড়ালী দিয়ে প্রচন্ড এক ঘা দিল আহমদ মুসার বাম হাতের তালুতে। আহমদ মুসার দেহ নড়ল না, হাতও নয়। শুধু মুখ থেকে অস্ফুট ‘আ….আ’ শব্দ বেরিয়ে এল। তার গলার স্বরটা ঘুমিয়ে পড়ছে এমন মানুষের কন্ঠস্বরের মত শোনাল।
লোকটি আবার সেকেন্ড খানেক সময় নিয়ে আহমদ মুসার নাকে স্প্রে করল।
তারপর সেকেন্ড দেড়েক অপেক্ষ করে আগের মত লোহার স্পাইক দেয়া গোড়ালি দিয়ে আকষ্মিকভাবে প্রচন্ড এক আঘাত করল আহমদ মুসার পায়ের পাতায়।
কিন্তু এবার আর আহমদ মুসার মুখ দিয়ে কোন শব্দ বেরুল না।
‘ধন্যবাদ জ্যাকব, তোমার কাজ শেষ। এখন তুমি ওকে টেনে নিয়ে লাইবারম্যানের মাইক্রোটার কাছে চল।’ বলল সেই সাড়ে ছয়ফুট লম্বা লোকটি ক্লোরোফরম স্প্রে করা ‘জ্যাকব’ নামক লোকটিকে লক্ষ্য করে।
জ্যাকব আহমদ মুসাকে টেনে নিয়ে এল লাইবারম্যানের মাইক্রোর কাছে।
লোকটি এখানে পৌঁছে তার নাক থেকে গ্যাস মাস্ক খুলে ফেলল।
সবাই সেখানে এল।
সেই সাড়ে ছয়ফুট লম্বা লোকটিও।
সে বলল লাইবারম্যানকে লক্ষ্য করে, ‘লাইবারম্যান, মিশন সফল। পূর্ণ সফল হবে যখন একে ‘সাও তোরাহ’তে নিয়ে খাঁচায় পুরতে পারব। এর জন্যে সেখানে একটা সোনার খাঁচা তৈরী করব। অন্য খাঁচায় একে মানায় না।’
বলে একটু থেমে লাইবারম্যানকে লক্ষ্য করে আবার বলে উঠল, ‘আহমদ মুসাকে নিয়ে তোমার মাইক্রোর মেঝেতে শুইয়ে দাও। আরও চারজন স্টেনগানধারীকে নাও তোমার মাইক্রোতে। সে দশ বারো ঘন্টার আগে জাগবে না। তবু সাবধান থাকবে। নিয়ে গিয়ে হাত পা বেঁধে খাঁচায় ফেলে রাখবে। আমি ‘রাইন ইন্টারন্যাশনাল হোটেল’ হয়ে ঘাঁটিতে ফিরব।
‘রাইন ইন্টারন্যাশনাল হোটেলে কেন মি.আজর ওয়াইজম্যান?’ বলল লাইবারম্যান।
‘আহমদ মুসার নতুন রুম কোনটি, তার হ্যান্ডব্যাগসহ তার লাগেজ কোথায় সে সব খোঁজ নিয়ে আসব। ওগুলো হাত করার ব্যবস্থা করতে হবে। যে ডকুমেন্টগুলো আমি খুঁজছি তা আহমদ মুসার কাছে থাকার সম্ভাবনাই সবচেয়ে বেশি। সাত গোয়েন্দার অসমাপ্ত কাজ এর পক্ষেই করা সম্ভব। দেখা যাক, এর কাছে ঐ সব কোন কিছু তথ্য পাওয়া যায় কিনা।’ বলল সাড়ে ছয় ফুট লম্বা আজর ওয়াইজম্যান লোকটি।
‘ঐ ছুঁড়ি-ছোঁড়া ‍দু’জনের কি করা যায়?’ লাইবারম্যান বলল।
‘ওরা জিরো। ওদের গায়ে হাত দিয়ে খামাখা কেন পুলিশের ঝামেলায় পড়তে যাবে?’ বলল ওয়াইজম্যান।
‘ঠিক আছে স্যার।’ লাইবারম্যান বলল।
কথা শেষ করেই লোকজনের দিকে চেয়ে বলল, ‘তোমরা আহমদ মুসাকে আমার মাইক্রোতে তোল। আর স্টেনগানওয়ালা চারজন ওঠ আমার গাড়িতে।’
বলে লাইবারম্যান এগুলো তার গাড়িতে ওঠার জন্যে।
ওয়াইজম্যানও এগুলো তার কারের দিকে।
অল্পক্ষনের মধ্যেই এলাকাটা ফাঁকা হয়ে গেল। শুধু পড়ে থাকল আহমদ মুসার ভাড়া করে আনা ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া গাড়িটা।
চলছে লাইবারম্যানের মাইক্রোবাসটি। গাড়ির মেঝের উপর উপুড় হয়ে আছে আহমদ মুসা।
তার পাশেই গাড়ির সিটে পাশপাশি বসে আছে চারজন লোক।
আর গাড়ির ফ্রন্ট সিটে বসে আছে লাইবারম্যান। তার পাশে ড্রাইভিং সিটে আরেকজন ড্রাইভ করছে গাড়ি।
স্টেনগানধারী একজন তার জুতা দিয়ে আহমদ মুসার গায়ে টোকা দিয়ে বলল, ‘ব্যাটা নাকি খুব সাংঘাতিক। কিন্তু আমাদের বুদ্ধির কাছে কুপোকাত!এমন ফাঁদে ফেলা হয়েছে যে, কিছুই করতে পারল না।’
‘আমাদের দু’জন লোক মেরেছে গত রাতে এই লোক। মজা করে শোধ নেয়া যাবে।’ বলল তার পাশের আরেকজন স্টেনগানধারী।
‘কি শোধ নেবে, এতো দেখছি লিকলিকে ছেলে মানুষ। এর সম্পর্কে শোনা কথাগুলো আমার খুব বিশ্বাস হয় না।’ বলল আরেকজন।
‘একে আমার কোথায় নিচ্ছি, শার্লেম্যানের ৫নং বাড়িতে, না বড় বসের ফ্ল্যাটে?’ চতুর্থজন বলে উঠল।
‘কেন বলছ একথা?’ প্রথমজন বলল।
‘শোধ তোলার কথা বলছ তাই। ফ্ল্যাটে নিলে তো সেখানে আমাদের শোধ নেয়া যাবে না।’ চতুর্থজন উত্তর দিল।
‘চিন্তা করো না, তোমাদের সব ইচ্ছা পূরন হবে। তোমরা যেখানে চাচ্ছ সেখানেই নেয়া হবে।’ বলল লাইবারম্যান।
তাদের এই সব গল্প কথা চলতেই থাকল।
আহমদ মুসা সবই শুনছিল। ক্লোরোফরম তাকে সংজ্ঞাহীণ করতে পারে নি। ক্লোরোফরম স্প্রে করার সময় থেকে পাকা দেড় মিনিট সে নিঃশ্বাস বন্ধ করে ছিল। তাকে গাড়ির দিকে টেনে নেয়ার সময় যখন সে নিঃশ্বাস নিয়েছে, তখন ক্লোরোফরম এর কার্যকারিতা শেষ।
সংজ্ঞাহীন হওয়ার ভান করতে গিয়ে তাকে দারুণ কষ্ট করতে হয়েছে। জুতার লোহার স্পাইকওয়ালা গোড়ালী দিয়ে তার হাতের তালুতে আকষ্মিক এমন আঘাত করেছে যে চুপ করে থাকা অসম্ভব। আহমদ মুসা ধৈর্য্যের সব শক্তি একত্রিত করে চুপ থেকেছে শুধু একটা ক্ষীণ ‘আহ’ শব্দ করার মাধ্যমে। এটুকু শব্দ আহমদ মুসা ইচ্ছা করেই করেছে এটা প্রমাণ করার জন্যে যে, আহমদ মুসা সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েছে। পায়ের তালুতে দ্বিতীয় আঘাতও তাকে হজম করতে হয়েছে কোন শব্দ না করে।
তাদের গল্পের মাঝে আহমদ মুসা একবার পলকের জন্যে চোখ খুলল। তার ভাগ্য ভাল যে উপুড় অবস্থায় তার মুখ স্টেনগানধারীদের দিকে ফেরানো ছিল। ফলে পলকটুকুতেই দেখতে পেল তার পাশেই গাড়ির সিটে বসা চারজনকে। তাদের পাগুলো আহমদ মুসার গা প্রায় স্পর্শ করে আছে। তাদের একজনের স্টেনগানটা কোলে। অন্য তিনজনের স্টেনগান মাটিতে রেখে ব্যারেল কোলে ঠেসে দেয়া। একজনের স্টেনগানের গোড়া আহমদ মুসার ডান বাহু স্পর্শ করে আছে।
আহমদ মুসা হিসেব কষল, সামনে থেকে লাইবারম্যানের এ্যাকশনে আসতে কতক্ষন সময় নেবে? এর মধ্যে সে কি পেছনটা নিকেশ করতে পারবে? কিন্তু এছাড়া তো উপায় নেই।
মসৃণ রাজপথের উপর দিয়ে মাইক্রোটা চলছিল তীরের বেগে।
চোখ দুটি আহমদ মুসা আবার অর্ধ নির্মিলিতের মত খুলে স্টেনগানের বাটটা আবার দেখে নিল।
তারপর চোখের পলকে আহমদ মুসা বাট ধরে স্টেনগানটা টেনে নিয়েই দেহটা ঘুরিয়ে চিৎ হয়ে গেল।
ওদের চারজনেরই চোখ পড়ে গিয়েছিল আহমদ মুসার উপর। কিন্তু ভুত দেখার মত আৎকে উঠেছিল সবাই। তাদের এই আৎকে ওঠার ভাব তারা কাটিয়ে ওঠার আগেই আহমদ মুসার হাতের স্টেনগান ওদের চারজনের উপর দিয়ে ঘুরে এল।
কি রেজাল্ট হয়েছে না দেখেই শোয়া অবস্থাতেই মুখটা ডানদিকে ঘুরিয়ে নিয়ে স্টেনগান তাক করলো লাইবারম্যানকে।
চেয়ারের আড়ালে সে। তবু তার চেয়ারের ডানপাশ দিয়ে তার শরীরে ডান পাশের কিছু দেখা যাচ্ছে। কিন্তু আহমদ মুসার হাতে নিখুঁত টার্গেট নেবার সময় ছিল না। সঠিক লক্ষ্যেই আহমদ মুসার স্টেনগান থেকে গুলির ঝাঁক বেরিয়ে গেছে।
গুলি করেই আহমদ মুসা উঠে দাড়াল। গাড়ি কিন্তু ছুটে চলছে তীর বেগেই।
আহমদ মুসার হাতের স্টেনগান তাক করা ড্রাইভারের দিকে। বলল, ‘ড্রাইভার, সামনে গাড়ি দাঁড় করাও। মনে রেখ দ্বিতীয়বার বলব না, গুলী করব।’
বলার সংগে সংগেই ড্রাইভার গাড়ির লেন চেঞ্জ করে রাস্তার কিনারে নিয়ে গেল। কয়েক গজ গিয়েই গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়ল।
আহমদ মুসা হাতের স্টেনগানটা গাড়ির পেছনে ছুঁড়ে দিয়ে দরজা খুলে নামতে নামতে বলল, ‘ড্রাইভার, এখনি এদের কোন ক্লিনিকে নিলে এদের কেউ কেউ বেঁচে যেতে পারে।’
কথা শেষ হবার আগেই আহমদ মুসা গাড়ি থেকে নেমে পড়েছিল।
আহমদ মুসা গাড়ি থেকে নেমে ওখানেই দাড়িয়ে থাকল। মাইক্রোটি চোখের আড়ালে চলে যাবার পর একটা ট্যাক্সি ডেকে তাতে উঠে বসতে বসতে বলল, ‘হোটেল রাইন ইন্টারন্যাশনাল’।
হোটেল রাইন ইন্টারন্যাশনাল যাওয়ার কথা আহমদ মুসা বলল বটে, কিন্তু পরে চিন্তায় এল, ওদের বড় বস আজর ওয়াইজম্যান তো হোটেল রাইনেই গেছে। সে সেখানে কি করবে, কি বলবে কে জানে!হুট করে হোটেলে যাওয়া তার ঠিক হবে কিনা। কিন্তু হোটেলে না গেলে সে যাবে কোথায়? সে যে লাইবারম্যানদের হাত থেকে মুক্ত হয়েছে একথা আজর ওয়াইজম্যান এখনি জানতে পারবে। জানতে পারার সংগে সংগে সে নিশ্চয় এবার পুলিশকে লেলিয়ে দেয়ার ব্যাপারে তৎপর হবে। এই সাথে ওয়াইজম্যানরাও আরও মরিয়া হয়ে উঠবে। এই অবস্থায় খোঁজ খবর না নিয়ে হোটেলে প্রবেশ করা তার জন্যে ঠিক হবে কিনা। তাছাড়া হোটেলের টুরিস্ট সেকশনের যে গাড়ি সে ভাড়ায় নিয়ে গিয়েছিল, সেটা কোথায় এ প্রশ্নও উঠবে। গাড়ি হারিয়ে গেছে এ কথাও বলা যাবে না, আবার যে হাল হয়েছে গাড়ির সেটাও বলা যাবে না। কারণ তাতে অনেক প্রশ্ন উঠবে, যার জবাব সে দিতে পারবে না।
এসব চিন্তার মধ্যেই আহমদ মুসা পৌঁছে গেল হোটেলের কাছে। সে ঠিক করল হোটেলে না গিয়ে আপাতত সে গীর্জার সামনে নেমে যাবে।
গীর্জার পার্কিং এ নেমে পাশের একটা গাড়ির দিকে তাকাতেই খুশি হয়ে উঠল আহমদ মুসা। দেখল, ফাতিমা ও যায়েদ একটা গাড়িতে বসে।
ওদের দেখে খুশি হওয়ার পরক্ষনেই আবার চিন্তিত হয়ে পড়ল আহমদ মুসা। ফাতিমারা হোটেলের বদলে গীর্জার পার্কিং এ কেন? হোটেলে কি কিছু ঘটেছে?
আহমদ মুসা এগুলো ওদের দিকে।
ওরাও দেখতে পেয়েছে আহমদ মুসাকে।
ওরা ছুটে এল আহমদ মুসাকে দেখে।
ওদের মুখে এ সময় যে হাসিটা থাকা স্বাভাবিক সেটা নেই।
ওদের এই অবস্থা দেখে আহমদ মুসাও হাসতে পারল না।
ওরা কাছে আসতেই আহমদ মুসা বলল, ‘কি ব্যাপার, তোমরা এখানে? ভাল আছো তো?’
আহমদ মুসার জিজ্ঞাসার কোন জবাব না দিয়ে ফাতিমা ও যায়েদ এক সাথে বলে উঠল, ‘আপনি সুস্থ আছেন, আপনি ভাল আছেন তো ভাইয়া?’ তাদের কন্ঠে উদ্বেগ।
‘তোমরা একথা বলছ কেন? উদ্বিগ্ন কেন তোমরা এত?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘ভাইয়া আপনাকে ওরা ধরে নিয়ে যায়নি?’ বলল যায়েদ চোখ কপালে তুলে।
‘হ্যাঁ গিয়েছিল। মুক্ত হয়ে আসলাম। কিন্তু তুমি জানলে কি করে?’
‘এই তো ক’মিনিট আগে আমি আসার সময় ঈল পার্কের মোড়ে আপনার গাড়ি ঝাঁঝরা অবস্থায় দেখলাম। আমি গাড়ির নাম্বার দেখে চিনতে পারি ও গাড়ি থেকে নেমে পড়ি। জিজ্ঞেস করে সেখানে জড়ো হওয়া লোকদের একজনের কাছে শুনলাম, ছয় সাতটা গাড়ি এ গাড়িটাকে ঘিরে ফেলে বিরামহীন মেশিনগানের গুলী চালিয়ে গাড়ির এ হাল করেছে। এ গাড়ি থেকে একজনকে বের করে ঐ গাড়িওয়ালারা ধরে নিয়ে গেছে। কি ঘটেছিল ভাইয়া, কি করে আপনি মুক্ত হলেন?’ বলল যায়েদ।
আহমদ মুসা সংক্ষেপে ঘটনাটা ওদের বলল। ঘটনা শুনে ওদের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। বলল ফাতিমা, ‘ভাইয়া মাত্র ১২ ঘন্টার মধ্যে আপনি দ্বিতীয়বার জীবন পেলেন।’
তারপর যায়েদ ও ফাতিমা দু’জনেই হাত উপরে তুলে বলল, ‘আলহামদুলিল্লাহ। হে আল্লাহ, আমাদের ভাইয়ার বুদ্ধি, শক্তি, সাহস আরও বাড়িয়ে দিন। এ ধরনের সব বিপদেই তিনি যেন জয় করতে পারেন।’
তারা থামতেই আহমদ মুসা বলল, ‘তোমরা এখানে কি করছ? ঐ শয়তানদের একজন নেতা আজর ওয়াইজম্যান তো হোটেলে আসার কথা আমার রুমের খোঁজ খবর নেবার জন্যে!’
‘সে এসেছিল এবং খোঁজ নিতে আপনার কক্ষেও ঢুকেছিল। সে যখন কাউন্টারে কথা বলছিল, তখন আমি কাউন্টারের পাশে ছিলাম। সব আমি শুনি এবং তাকে ফলো করি। তার ছবিও আমি নিয়েছি। যেভাবে অথরিটির সাথে সে কথা বলছিল এবং কাজ করছিল, তাতে আমার মনে হয়েছে সে ষড়যন্ত্রকারীদের একজন বড় কেউ হবেন। যাই হোক, তার কথা শুনে আমি বুঝে যে, আপনার কোন বিপদ হয়েছে। সেজন্যে হোটেলের লবিতে বসেই আমি যায়েদের অপেক্ষা করি। সে এলে তার কাছে সব শুনে গাড়ি নিয়ে আমরা হোটেল থেকে সরে এসে এখানে অপেক্ষা করি। আমাদের ভয় হচ্ছিল আপনাকে হস্তগত করার পর আমাদের কক্ষেও ওরা হানা দেবে।’ বলল ফাতিমা কামাল।
‘দিতে পারে। কারণ তারা যে জিনিস খুঁজছে তা আমার সুটকেসে পায়নি। আমার হ্যান্ডব্যাগ ও তোমাদের ব্যাগেজ দেখার জন্যে তোমাদের কক্ষেও হানা দিতে পারে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কি খুঁজছে ভাইয়া ওরা?’ বলল যায়েদ।
‘স্পুটনিকের গোয়েন্দারা নিউইয়র্কের টুইন (লিবার্টি ও ডেমোক্রাসি) টাওয়ার ধ্বংসের প্রকৃত ঘটনা সম্পর্কে যে দলিল দস্তাবেজ যোগাড় করেছিল, সে সবেরই কতকগুলো বা কোনটি সম্ভবত তারা খুঁজছে। লা-মন্ডের রিপোর্টে গোয়েন্দা অপহরণ করার কারণ হিসাবে এ ধরনের কিছুকেই সন্দেহ করা হয়েছিল। আজ আজর ওয়াইজম্যানের মুখেও এ ধরনের কথাই শুনেছি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ভাইয়া, আপনি ওদের জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসার পর ওরা নিশ্চয় দারুণ ক্ষেপে গেছে। এই অবস্থায় হোটেল আপনার জন্যে আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে, আমাদের জন্যেও। কি করা যায় এখন। বাড়ি একটা পেয়েছি। ভাড়া একটু বেশি হলেও আপনি যেমন চেয়েছিলেন, সেরকমই বাড়িটা। বাড়িটাতে কালকে উঠলে ভাল হয়, ‘তবে আজকেও উঠা যায়।’ বলল যায়েদ।
‘আমরা এখনি হোটেল ছেড়ে দেব। আমি ও যায়েদ গিয়ে উঠব ভাড়া করা বাড়িতে। আর ফাতিমা উঠবে আপাতত তার আত্মীয়ের বাড়িতে।’ আহমদ মুসা বলল।
ম্লান হয়ে গেল ফাতিমা কামালের মুখমন্ডল। পরক্ষনেই লজ্জায় ছেয়ে গেল তার মুখ। ফুটে উঠল ঠোঁটে লজ্জা মিশ্রিত হাসি। বলল, ‘ভাইয়া, আপনার জন্যে আরও কিছু খবর আছে। কামাল সুলাইমান ভাইয়ার বাসা থেকে অল্পক্ষন আগে জানিয়েছে, আজ বাদ আসর স্ট্রাসবার্গ মসজিদ কম্যুনিটি হলে দু’পক্ষই বিয়ের আয়োজন করার ব্যাপারে রাজী। আপনার মত পেলেই এটা চূড়ান্ত হবে।’
আহমদ মুসার মুখে ফুটে উঠল মিস্টি হাসি। বলল, ‘ওয়েলকাম বোন। আমার আগের কথা বাতিল। তুমিও আজ যায়েদের সাথে ভাড়াবাড়িতে উঠবে। ওদের বলে দাও। শুভস্য শীঘ্রম।’
‘ধন্যবাদ ভাইয়া।’ মুখ নত করে বলল ফাতিমা কামাল।
আহমদ মুসার মুখে সংকোচ জড়িত এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘ফাতিমা, যায়েদ, মনে করতে পারো আমি তোমাদের উপর অন্যায় চাপিয়ে দিয়েছি। ভাবতে পার যে, তোমাদের ইনটিগ্রিটিকে আমি সন্দেহ করছি। আমি………’।
আহমদ মুসার কথায় বাধা দিয়ে ফাতিমা কামাল বলে উঠল, ‘ভাইয়া আপনার কথা ঠিক নয়। আপনি আমাদের সত্যিকার অভিভাবকের কাজ করেছেন। আপনি আমাদের শিখিয়ে দিয়েছেন, আমরা আমাদের অল্পই জানি, স্রষ্টা জানেন সবটুকুই। সুতরাং আমাদের জন্যে তাঁর নির্দেশই চূড়ান্ত।’ ফাতিমার কন্ঠ আবেগাপ্লুত ও দৃঢ়।
‘ধন্যবাদ বোন’, বলে একটু থামল আহমদ মুসা। তারপর বলল, ‘চল হোটেলের বিল চুকিয়ে আমরা চলে আসি।’
আহমদ মুসাসহ ওরা দু’জন আবার গিয়ে গাড়িতে বসল।
গাড়ি চলতে শুরু করল হোটেলের দিকে।
‘ভাইয়া, আমরা হোটেল থেকে বেরিয়ে কোথায় যাচ্ছি?’ বলল ফাতিমা কামাল।
‘বাদ আসরের অনুষ্ঠান পর্যন্ত তুমি তোমার ভাইয়া কামাল সুলাইমানের বাড়িতে থাকবে। আমি যায়েদকে নিয়ে ভাড়া বাড়িতে উঠব। যায়েদ বাসায় উঠে বাড়ি গুছাবে। আর আমি পরবর্তী অভিযানের জন্যে কিছু খোঁজ-খবর নেয়ার চেষ্টা করব।’
‘কি অভিযান?’ জিজ্ঞেস করল ফাতিমা।
‘ও কথা এখন থাক। পরে বলব।’ বলল আহমদ মুসা।
গাড়ি প্রবেশ করল হোটেলের কার পার্কিং এ।

সত্যিই আহমদ মুসা যেমন চেয়েছিল, সে রকমই বাড়িটা।
আহমদ মুসার কক্ষটি বেশ বড়। এটাচড বাথ। কক্ষ থেকে ফ্ল্যাটের বাইরে বেরুবার ইন্ডিপেনডেন্ট প্যাসেজ। অন্যদিকে দুটি বেডরুম আর একদিকে গেস্টরুম নিয়ে ফাতিমা যায়েদদের অংশ। আহমদ মুসার কক্ষ থেকে ডাইনিং ড্রইং এ প্রবেশের একটা দরজা রয়েছে। এই দরজা বন্ধ থাকলে ফ্ল্যাটের দুই অংশ বলা যায় আলাদাই হয়ে পড়ে। দরজাটা দুই দিক থেকেই বন্ধ করা যায়। সিদ্ধান্ত হয়েছে দরজাটা দুই দিক থেকেই বন্ধ রাখা হবে। দুই পক্ষের কারও প্রয়োজন হলে নক করে দরজা খুলতে হবে। ফ্ল্যাট থেকে বাইরে বেরুবার জন্য ফাতিমা-যায়েদদের প্যাসেজও আলাদা।
নতুন দম্পতি হিসেবে ফাতিমা ও যায়েদ ফ্লাটে উঠেছে মাগরিবের নামাজের আধা ঘন্টা আগে। স্ট্রাসবার্গ মসজিদ কম্যুনিটি হলে তাদের বিয়ের অনুষ্ঠানটি হয়েছে খুবই সুন্দর, কিন্তু সংক্ষিপ্ত। স্ট্রাসবার্গের পনেরটি মুসলিম পরিবার যোগ দিয়েছিল এই বিয়ের অনুষ্ঠানে। বিয়ের পর ফাতিমা ও যায়েদের আত্মীয় স্বজনরা তাদেরকে ফ্ল্যাটে তুলে দিয়ে গেছে।
রাত ১১টা। আহমদ মুসা নক করল ফাতিমা-যায়েদদের অংশে ঢোকার পার্টিশন ডোরে।
খুলে গেল দরজা।
দরজা খুলে দিয়েছে যায়েদ।
আহমদ মুসা সালাম দিল যায়েদ ও ফাতিমা দুজনকে।
ফাতিমা কামাল বসেছিল সোফায়।
আহমদ মুসা দরজায় এসে সালাম দিতেই সালামের জবাব দিয়ে উঠে দাড়াল ফাতিমা। আরও বলল, ‘ওয়েলকাম ভাইয়া।’
বিয়ের পোশাকটা নেই ফাতিমা কামালের পরনে। কিন্তু যে পোশাক পরেছে তাতেও তাকে নববধুই লাগছে। ফুলহাতা কামিজ তার পা পর্যন্ত নেমেছে। মাথার রুমাল কপাল ঢেকে গলা জড়িয়ে বুক পর্যন্ত নেমে এসেছে। ফাতিমা কামালের শ্বেতাভ গোলাপী দেহে গোলাপী এই পোশাক তাকে অপরূপ করে তুলেছে।
নত দৃষ্টিতে আহমদ মুসা যায়েদের সাথে গিয়ে সোফায় বসল।
ফাতিমা কামালও বসল।
যায়েদ গিয়ে বসেছে ফাতিমার পাশে। আর আহমদ মুসা তাদের সামনের আরেকটি সোফায়।
ফাতিমার চোখে মুখে লজ্জার ছাপ। লাল হয়ে উঠেছে মুখ।
যায়েদও অনেকটাই বিব্রত।
প্রথম নিরবতা ভাঙল আহমদ মুসাই। বলল, ‘নতুন সংসার, কোন অসুবিধা নেই তো তোমাদের?’
‘আলহামদুলিল্লাহ। কোন অসুবিধা নেই ভাইয়া।’ বলল যায়েদ। তার মুখে সলজ্জ হাসি।
‘ভাইয়া, আমরা তো জানি না, আপনি কি বাইরে বেরিয়েছিলেন? ফিরলেন এখন?’ বলল ফাতিমা।
‘না তো, কোথাও বের হইনি? কেন বলছ এ কথা?’ আহমদ মুসা বলল।
‘বাইরের পোশাক আপনার পরনে।’ বলল ফাতিমা।
‘ও’ বলে হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘বাইরে বের হইনি, বের হবো। সে কথাই তোমাদের বলতে এসেছি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘এই রাত ১১টায় বাইরে বেরুবেন? কোথায়?’ বলল ফাতিমা ও যায়েদ একই সাথে। তাদের কন্ঠে বিস্ময়।
‘বলেছিলাম তো এক অভিযানে বেরুতে হবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কোথায়?’ বলল যায়েদ।
‘ওদের একটা আস্তানার সন্ধান পেয়েছি। আমি যখন সংজ্ঞাহীন হওয়ার ভান করে ওদের গাড়ির মেঝেতে পড়েছিলাম, তখন ওদের কথাবার্তার মধ্য দিয়ে আমি ওদের একটা ঘাঁটির ঠিকানা পেয়ে যাই। সেখানেই যাব। দেখি, ওদের পরিচয়, পরিকল্পনা এবং অপহৃত সাতজনকে কোথায় রেখেছে-এসব ব্যাপারে কোন তথ্য উদ্ধার করা যায় কিনা।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আজই একটা বড় ঘটনা ঘটেছে। ওরা সাংঘাতিক ক্ষেপে আছে আপনার উপর। এই অবস্থায় এত রাতে আপনার একা তাদের ঘাঁটিতে যাওয়া ঠিক হবে না।’ বলল ফাতিমা দৃঢ় প্রতিবাদের কন্ঠে।
‘না ফাতিমা। শত্রুকে আঘাত করার পর শত্রু পাল্টা আঘাত করার আগেই যদি তাকে আবার আঘাত করা যায়, তাহলে শত্রুকে তাড়াতাড়ি কাবু করা যায়। আজ ওরা যে আঘাত খেয়েছে, তার পাল্টা আঘাতের চিন্তায় ওরা এখন ব্যস্ত। নতুন আঘাত আসতে পারে এটা তারা ভাবছে না এবং আত্মরক্ষারও কোন চিন্তা তাদের মাথায় নেই। সুতরাং এটা একটা বড় সুযোগ।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আপনার সাথে যুক্তিতে পারবো না ভাইয়া। আপনার এই যুক্তির জবাবে কি বলতে হবে আমার জানা নেই। কিন্তু আমি যেটা জানি, সেটা হলো আপনার একা ঐ শত্রুপুরীতে যাওয়া ঠিক নয়’।
আহমদ ‍মুসা হাসল। বলল, ‘এসব অভিযান দল বেধে হয় না ফাতিমা। দলবল নিয়ে গেলে শত্রুদের আগাম জেনে ফেলার সম্ভাবনা থাকে। তাতে লোকক্ষয় হলেও লক্ষ্য অর্জন হয় না। এ জন্যে একা যাওয়াটাই নিরাপদ ও ফলপ্রসু’।
‘কিন্তু একা গিয়ে যদি আপনি বিপদে পড়েন, কোন সাহায্যের যদি আপনার দরকার হয়? না ভাইয়া, আপনার একা যাওয়া হবে না’। বলল ফাতিমা।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘সবচেয়ে বড় সাহায্যদাতা যিনি, তিনি তো সাথেই আছেন। তিনিই সাহায্য করবেন ফাতিমা। আমাদের তার উপরই নির্ভর করা উচিত’।
‘আল্লাহর কথা বলছেন ভাইয়া? তিনি তো আছেনই। তিনি অবশ্যই সাহায্য করবেন। কিন্তু তিনিই তো শত্রু মোকাবিলায় আমাদের উপযুক্ত প্রস্তুতি নিতে বলেছেন। কিন্তু আপনি তা করেছেন না ভাইয়া’। বলল ফাতিমাই।
‘আমার সাধ্য যা সেভাবেই আমি প্রস্তুতি নিয়েছি ফাতিমা। বলতে পার, লোক সাথে নেই, একা যাচ্ছি। কিন্তু শত্রুর বিরুদ্ধে এমন অনেক কাজ আছে যা একা করতে হয়। আমি সে রকম একটা কাজেই যাচ্ছি। আমি গোপনে তাদের ঘাঁটিতে ঢুকব। অনুসন্ধান করব। তাদের সম্পর্কে তথ্যাদি যোগাড়ের চেষ্টা করব। এমন ধরনের কাজে একা যেতে হয়। আমি সেটাই করছি বোন’। আহমদ মুসা বলল।
‘বুঝলাম। কিন্তু ভাইয়া, এ ধরনের কাজেও তো সংঘর্ষ হয়। প্রয়োজনীয় সাহায্যের দরকার হয়’। বলল ফাতিমা।
‘দোয়া কর তোমরা বোন। এই সাহায্য যেন আল্লাহ করেন, আমাকে তোমরা বাধা দিওনা। আমি এই কাজ নিয়ে একাই তো এসেছি শুধুমাত্র আল্লাহর উপর ভরসা করে। সর্বজ্ঞ আল্লাহ এটা জানেন এবং তিনিই আমাকে সাহায্য করবেন’।
ফাতিমা কোন জবাব দিল না। তার অপলক দু’চোখ তাকিয়ে আছে আহমদ মুসার দিকে।
যায়েদের বিস্ময় বিমুগ্ধ দু’চোখ নিবদ্ধ আহমদ মুসার মুখের উপর।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘ভাই বোনরা এভাবে তাকিয়ে কেন?’
‘ভাবছি ভাইয়া’। ফাতিমা বলল।
‘কি ভাবছ?’ বলল আহমদ মুসা।
‘ভাবছি, ভাইয়ার পরিচয় জানার ভাগ্য কি আমাদের এখনও হলো না? আমি নিশ্চিত ভাইয়া, আপনার এমন একটা পরিচয় আছে যা এত বড় যে আমরা সামান্য মানুষ হয়ে তা জানা ঠিক নয়’। ফাতিমা বলল।
আহমদ মুসা ম্লান হাসল। বলল, ‘ফাতিমা, যায়েদ, গত দু’তিন দিনের পরিচয় থেকে, আমার আচরণ থেকে কি তোমাদের এই বিশ্বাসই হয়েছে?’
‘না ভাইয়া, এ বিশ্বাস নয় বরং উল্টো বিশ্বাসই হয়েছে এবং এ কারণেই মনে কষ্ট লাগছে যে, এত আপন করে যিনি আমাদের নিয়েছেন, স্নেহ ও অভিভাবকত্বের ছত্রছায়া যিনি আমাদের পরম আকাঙ্খিত এক নতুন জীবনে নিয়ে এসেছেন, তার পরিচয় আমরা জানি না, আমাদের জন্যে এটা অবশ্যই বড় কষ্টের ভাইয়া’। বলল ফাতিমা আবেগে ভারী কন্ঠ তার।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘তোমার কথা বুঝতে পারছি বোন। তোমাদের কাছ থেকে আমার পরিচয় গোপন করার কোন সিদ্ধান্ত আমি নেইনি। আমি এই মিশনে এখানে আসার আগে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, আমার পরিচয় আমি কোথাও প্রকাশ করব না। তাতে আমার কাজ অনেকখানি সহজ হবে এবং শত্রুকে অনেকখানি অসতর্ক ও অপ্রস্তুত অবস্থায় পাওয়া যাবে। কিন্তু শত্রুরা আমার পরিচয় যেভাবেই হোক জেনে ফেলেছে। আমার পরিচয় আগাম জেনেই আজ সকালে ওরা আমাকে ঐভাবে আট-ঘাট বেঁধে বন্দী করতে এসেছিল। শত্রুদের কাছ থেকে আমার পরিচয় গোপন রাখার জন্যেই নিজের পরিচয় গোপন রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। শত্রুরা সেই পরিচয় যখন জেনেই ফেলেছে, তখন আর পরিচয় গোপনের প্রয়োজন দেখি না’।
বলে আহমদ মুসা সামনের টি টেবিল থেকে স্লিপ পেপারের একটা পাতা ছিড়ে নিয়ে তাতে খস খস করে নিজের নাম লিখল এবং তা স্লিপ প্যাডের নিচে চাপা দিয়ে একটু হেসে বলল, ‘আমি আমার পরিচয় লিখে রাখলাম, পরে পড়ে নিও’।
বলে আহমদ মুসা একটু থামল। গম্ভীর হয়ে উঠল তার মুখ। পকেট থেকে এক টুকরো কাগজ বের করে তা যায়েদের হাতে দিয়ে বলল, ‘এতে আমি যেখানে যাচ্ছি তার ঠিকানা লেখা আছে। আমি যদি ভোর পর্যন্ত না ফিরি, তাহলে তোমার পরিচিত পুলিশ অফিসারকে এবং পুলিশ স্টেশনকে এই ঠিকানা জানিয়ে বলবে, স্পুটনিক যারা ধ্বংস করেছে, স্পুটনিকের ৭ গোয়েন্দাকে যারা কিডন্যাপ করেছে, তাদের একটা ঘাঁটির ঠিকানা এটা। ঠিকানাটায় আপনারা এখনি রেড করুন’।
যায়েদ স্লিপটা হাত পেতে নিল। কিন্তু কোন কথা বলল না।
ফাতিমাও কিছু বলল না।
হঠাৎ করে তাদের দু’জনের দু’চোখ ছল ছল করে উঠেছে। উদ্বেগে-আশঙ্কায় তাদের মুখ পান্ডুর।
ফাতিমার দু’চোখের অশ্রু তার দু’গন্ড বেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল।
আহমদ মুসা তাদের অশ্রু দেখে আরও গম্ভীর হয়ে উঠল। বলল, ‘তোমাদের এই মমতার জন্যে আমি কৃতজ্ঞ। কিন্তু তোমরা চিন্তা করো না। আল্লাহই আমাদের সহায়’।
বলে উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা।
সালাম দিয়ে ঘুরে দাড়িয়ে আহমদ মুসা ফ্ল্যাটের গেটের দিকে এগুলো।
ফাতিমা ও যায়েদ দু’জনেই উঠল। তারা আহমদ মুসার পেছন পেছন গেট পর্যন্ত এগুলো। তারপর ‘ফি আমানিল্লাহ, আল্লাহ হাফেজ’ বলে বিদায় জানাল আহমদ মুসাকে।
আহমদ মুসাও ‘আল্লাহ হাফেজ’ বলে লিফটের দিকে এগুলো।
লিফট নেমে গেলেও ফাতিমা ও যায়েদ দু’জনেই গেটের দু’চৌকাঠে ঠেস দিয়ে সামনে শূণ্য দৃষ্টি মেলে দাঁড়িয়ে থাকল।
অনেকক্ষন পর ফাতিমা একইভাবে সামনের দিকে দৃষ্টি মেলে বলে উঠল, ‘যায়েদ, ভাইয়া তো আসলেই আমাদের কেউ নন। কিন্তু মন মানছে না কেন? তার বিপদের ভয় এমন করে মনকে পীড়া দিচ্ছে কেন? এ কিসের টান যায়েদ?’
যায়েদও ঐভাবেই স্বগতোক্তির মত জবাব দিল, ‘আমিও জানি না ফাতিমা। তবে এটুকু অনুভব করি, তিনি তার অসীম মমতা দিয়ে আমাদের মন জয় করে নিয়েছেন। বলতে পার ফাতিমা, তার মত এত মমতা এত দায়িত্ববোধ, এত মধুর শাসন আর কারও কাছ থেকে কখনও আমরা পেয়েছি?
‘কিন্তু কেন তিনি এত আদর করেন, কেন তাঁর এই দায়িত্ববোধ, কেন এই মধুর শাসন যায়েদ? আমরা তো তাঁর কেউ নই’। বলল ফাতিমা উদাস কন্ঠে।
‘হতে পারে এটা এক আদর্শের সহমর্মিতা’। যায়েদ বলল।
‘কিন্তু আদর্শিক ভাইদের সাথে তো আমাদের কম দেখা হয়নি। এমন তো দেখিনি কখনও’।
‘হতে পারে খাঁটি আদর্শে গড়া এক মানুষের সন্ধান আমরা এই প্রথম পেলাম’। যায়েদ বলল।
কে তাহলে আমাদের অদেখা, অচেনা অতুলনীয় এই মানুষটি? জিজ্ঞাসা ফুটে উঠল ফাতিমার কন্ঠে।
‘চল দেখি, তাঁর পরিচয়, তিনি কি লিখে গেছেন’। বলে যায়েদ সোজা হয়ে দাঁড়াল।
সম্বিত ফিরে পাওয়ার মত চমকে উঠে ঘুরে দাঁড়াল ফাতিমা। ভেতর দিকে ছুটতে ছুটতে বলল, ‘ধন্যবাদ যায়েদ, তুমি স্মরণ করিয়ে দিয়েছ। এস তুমি’।
ফাতিমা ছুটে গিয়ে না বসেই স্লিপ প্যাডের নিচ থেকে আহমদ মুসার রাখা কাগজটা তুলে নিল। কাগজের উপর চোখ বুলাতে বুলাতে সোজা হয়ে দাঁড়াল ফাতিমা।
স্লিপে লেখা ‘আহমদ মুসা’ নাম পড়ে প্রচন্ড এক ধাক্কা খেল ফাতিমা। সমস্ত সত্তায় তার যে ধাক্কাটা ব্যঙ্ময় হয়ে উঠল তা হলোঃ ‘আহমদ মুসা। কোন আহমদ মুসা? ক্যারিবিয়ান, আমেরিকা ও সুরিনামের ঘটনায় সদ্য আলোচিত সেই আহমদ মুসা, যিনি ফ্রান্সে, সুইজারল্যান্ড, কংগো, ফিলিস্তিন, রাশিয়া, মধ্য এশিয়া, মিন্দানাওয়ের অসংখ্য সুঘটনার জনক?’
এই সব জিজ্ঞাসার মধ্যে হারিয়ে গেল ফাতিমা। কাগজের স্লিপটা তার হাতে ধরা। তার উপর আঠার মত লেগে আছে ফাতিমার চোখ। মূর্তির মত নিরব-নিশ্চল ফাতিমা।
যায়েদও ফাতিমার কাছে এসে পৌছাল। বলল, ‘কি ফাতিমা, কি দেখলে? কি নাম, কি পরিচয় লিখেছেন তিনি?’
কোন কথা বলল না ফাতিমা।
নির্বাক মূর্তির মত হাতের কাগজটা যায়েদের হাতে তুলে দিয়ে ধপ করে বসে পড়ল সোফায়।
কাগজটিতে দ্রুত চোখ বুলাল যায়েদ।
‘আহমদ মুসা’র নাম পড়ে চমকে উঠল যায়েদ। কয়েকবার পড়ল নামটা। না তার পড়া ঠিক। এই নামটাই লেখা আছে কাগজে। কাগজ থেকে মাথা তুলে ভাবল একটু আহমদ মুসার কথা। তারপর ‘ও গড’ বলে বসে পড়ল সোফায় ফাতিমার পাশে।
দু’জন পাশাপাশি বসে।
দু’জনেই নিরব।
দু’জনের চোখে-মুখেই বিস্ময় ও বিহবলতার ভাব।
নিরবতা ভাঙল যায়েদ। বলল, ‘আমি ভাবতে পারছি না ফাতিমা। আমরা তিন দিন ধরে আহমদ মুসার সাথে আছি। ভাবলেই আমার কাছে স্বপ্ন মনে হচ্ছে যে, ঐ ঘরটিতে বিশ্ব বিখ্যাত আহমদ মুসা থাকেন, আর এইমাত্র তিনি বেরিয়ে গেলেন আমাদের সাথে কথা বলে’।
ধীরে ধীরে ফাতিমা মুখ খুলল। সম্মোহিত কন্ঠে স্বগতোক্তির মত বলল, ‘বিশ্বাস হচ্ছে না আমারও, আহমদ মুসা এত সহজ, এত সরল, এত সাধারণ। আবার বিশ্বাস হচ্ছে এই কারণে যে, গত তিন দিনে তিনি যা করেছেন সেটা আহমদ মুসারই কাজ। আজকের পাশ্চাত্যের দুর্বিনীত, অহংকারী যোগ্যতাকে এভাবে ধুলায় মিশিয়ে দিতে আহমদ মুসাই পারেন, আর কেউ নয়’। আবেগে কন্ঠ ভারী হয়ে উঠেছে ফাতিমার।
‘আমার কাছে স্বপ্ন মনে হচ্ছে যে, আহমদ মুসা স্ট্রাসবার্গে এসেছেন, স্পুটনিক ধ্বংসের কেসটাকে তিনি গ্রহন করেছেন এবং মুসলামানদের এইটুকু বিপদও তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে’। আবেগে ভারী হয়ে উঠেছে যায়েদের কন্ঠও।
ফাতিমার স্বগত কন্ঠ আবার, ‘বড়ত্বের প্রকাশ একটুও তাঁর মধ্যে নেই। কিন্তু স্নেহ-মমতার সিড়ি বেয়ে তিনি কখন যেন আমাদের মাথার উপর উঠে বসেছেন। তিনি যা বলেন তা করা আমাদের জন্য অমোঘ হয়ে যায়। এ ভাবেই বুঝি তিনি নেতা না হয়েও সবার নেতা’।
‘আলহামদুলিল্লাহ ফাতিমা। আমি আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ। স্ট্রাসবার্গে আহমদ মুসার সাথী হবার জন্যে আল্লাহ আমাদেরকেই বেছে নিয়েছেন’। বলল আবেগ জড়িত কন্ঠে যায়েদ।
ফাতিমা একটু ঘুরে বসে যায়েদের দু’হাত চেপে ধরে বলল, ‘তুমি ঠিক বলেছ যায়েদ। এটা আমাদের জন্যে পরম গর্বের’। থামল ফাতিমা।
যায়েদ কিছু বলল না। দু’জনেই নিরব।
একটু পর নিরবতা ভাঙল ফাতিমাই। বলল, ‘কিন্তু আমরা তাকে কোন সহযোগিতা করতে পারছি কই? বিপজ্জনক ও সংঘাতের সব কাজ তিনি একাই করেছেন। আজও তাই গেলেন। আজ সকালের ঘটনায় তিনি বন্দী হয়েছিলেন। ভাবতে পার, যদি তিনি মুক্ত হতে না পারতেন। তার মত এত মূল্যবান মানুষ এতটা নিরাপত্তাহীন থাকা কি ঠিক?’
‘আমরা কি সহযোগিতা করব, আর কি সহযোগিতা তিনি নেবেন। আমরা রিভলবার চালাতে পারা ছাড়া এই লাইনে আর কোন অভিজ্ঞতাই নেই। আচ্ছা বল, এখন যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তাতে আমাদের কি করণীয়?’ বলল যায়েদ।
‘আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে’। বলল ফাতিমা।
‘কি বুদ্ধি?’ জিজ্ঞেস করল যায়েদ।
‘পরে বলছি। বুদ্ধিটা একটু পাকিয়ে নেই’।
কথা শেষ করে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল ফাতিমা, ‘তার আগে একটু গড়িয়ে নেব’।
যায়েদও উঠে দাড়িয়েছে। বলল, ‘আমি?’
‘তোমার পথ তুমি দেখ? তোমার বেডরুম ওদিকে’। বলল ফাতিমা। তার ঠোঁটে হাসি।
‘কিন্তু আজ দুই পথ তো এক হয়ে গেছে।’ বলল যায়েদ। তারও মুখে হাসি।
‘তা ঠিক। কিন্তু আমরা তো যুদ্ধক্ষেত্রে।’ ফাতিমা বলল।
হাসল যায়েদ। বলল, ‘যুদ্ধক্ষেত্রে নয়, বলতে পার যুদ্ধের তাঁবুতে। এক্ষেত্রে আল্লাহর রাসূলের (স.) দৃষ্টান্তই আমাদের পথ দেখাতে পারে’। হাসল যায়েদ।
সলজ্জ হাসিতে রাঙা হয়ে উঠল ফাতিমার মুখ। বলল, ‘মনে থাকে যেন সব ক্ষেত্রেই আল্লাহর রাসূলের (সঃ) এর দৃষ্টান্ত এভাবে খোঁজ করা হবে’।
‘অবশ্যই’। বলে যায়েদ তার এক হাত বাড়িয়ে দিল ফাতিমার দিকে।
ফাতিমার এক হাত এগিয়ে এসে ধরল যায়েদের হাত।
দু’জনেই এক সাথে পা বাড়াল সামনে।

Top