৪
শার্লেম্যান রোডের ৫ নাম্বার বাড়িটা বেশ বড়। তিনতলা বাড়ি। প্রাচীর ঘেরা।
গেটের উপর বিরাট সাইনবোর্ড। তাতে লেখা, ‘হিউম্যান রাইটস ইউনিভার্সাল গ্রুপ, স্ট্রাসবার্গ’। সাইনবোর্ডে রাস্তার নামও নেই, বাড়ির নাম্বারও নেই।
আহমদ মুসা বিকেলে এসে দেখে না গেলে এই বাড়ি খুঁজে পাওয়া মুস্কিল হতো। আশে পাশের লোকদের জিজ্ঞেস করে তবেই আহমদ মুসা ‘হিউম্যান রাইটস ইউনিভার্সাল গ্রপে’র অফিসকে ৫ নাম্বার বাড়ি বলে চিনতে পেরেছিল।
বাড়িটা চেনা আছে বলে আহমদ মুসা খুব নিশ্চিন্তে বাড়ি থেকে বেশ দূরে গাড়ি থেকে নেমে গাড়িটা ছেড়ে দিল।
পথচারীর মত হেঁটে হেঁটে বাড়িটার প্রান্তে এসে মুহূর্তের জন্যে থমকে দাঁড়াল আহমদ মুসা।
আর কিছুটা এগুলে গেট। কিন্তু আহমদ মুসা গেট দিয়ে প্রবেশ করতে চায় না।
আহমদ মুসা যেখানে এসে দাড়িয়েছিল, সেখান থেকেই বাড়িটার প্রাচীর শুরু। সেখান থেকে একটা প্রাচীর শার্লেমান সড়কের পাশ ঘেঁষে দক্ষিণে এগিয়ে গেছে। এই প্রাচীরেই বাড়িতে প্রবেশের গেট। আরেকটা প্রাচীর বাড়ির উত্তর সীমান্ত দিয়ে পশ্চিমে এগিয়ে গেছে। এই প্রাচীরটাই বাড়ির পশ্চিম ও দক্ষিণ সীমানা ঘুরে শার্লেম্যান রোডের প্রাচীরের সাথে এসে মিশেছে।
আহমদ মুসা তাঁর হাত ঘড়ির দিকে তাকাল। দেখল, রাত সাড়ে এগারটা বাজে।
সে উত্তরের প্রাচীরের ধার ঘেঁষে পশ্চিম দিকে এগুলো।
আহমদ মুসা ঠিক করেছে প্রাচীর টপকে সে ভেতরে ঢুকবে। এভাবে সবার অলক্ষ্যেই সে ভেতরে ঢুকবে। মারামারি বা শত্রু নিধনে তার কোন লাভ নেই। তার চাই কিছু দলিল-প্রমাণ। যা থেকে জানা যাবে, স্পুটনিকে কি ঘটছে, কেন ঘটছে এবং স্পুটনিকের ৭ গোয়েন্দা কোথায়। এজন্যে গোপনে সে বাড়ি সার্চ করতে চায়। সে নিশ্চিত যে, এভাবেই সে একদিন এখান থেকে বা সেখান থেকে প্রয়োজনীয় দলিল দস্তাবেজ পেয়েই যাবে।
আহমদ মুসা পশ্চিম প্রাচীরের মাঝামাঝি জায়গায় গিয়ে দাড়াল।
এ প্রাচীরের পর একটা ফলের বাগান। তারপর বাড়িটা। বাড়িটার উত্তর, পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে ফুলের বাগান। ফলের বাগান শুধু পশ্চিম দিকেই।
বাড়িটাতে পৌঁছা পর্যন্ত গাছের আড়াল পাওয়া যাবে বলেই আহমদ মুসা এ দিকটা বেছে নিয়েছে। প্রাচীরটা সাত ফুটের মত উঁচু।
কোন কষ্টই হলো না আহমদ মুসার প্রাচীর ডিঙ্গাতে।
একটু দৌড়ে এসে কয়েক ফুট প্রাচীর বেয়ে উঠে গিয়ে প্রাচীরের মাথা ধরে ফেলে খুব সহজেই প্রাচীর ডিঙ্গিয়ে গেল আহমদ মুসা।
বাগানের গাছগুলো বেশ দূরে দূরে। তার ফলেই গাছগুলো বড় বড়।
আহমদ মুসা বিড়ালের মত নিঃশব্দে এগোচ্ছে বাড়ির দিকে।
বাড়ির চারদিকে চারটি আলোর ব্যবস্থা আছে। সেই আলোতে বাড়ি পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, কিন্তু বাগানের জমাট অন্ধকার একটুও দূর হয়নি। অনেকটা অন্ধের মতই হাঁটছে আহমদ মুসা।
চোখে কিছু দেখছে না বলেই কান দু’টি সে বেশি সতর্ক রেখেছে। হঠাৎ তার মনে হলো, নরম ঘাসের উপর তার পায়ের যে শব্দ, সে রকম অনেকগুলো শব্দ তার কানে আসছে। যেন তার ডানে, বামে, পেছনে অনেকগুলো পা তার মত করেই সামনে অগ্রসর হচ্ছে, এই অনুভূতি হওয়ার সাথে সাথেই থমকে দাঁড়াল আহমদ মুসা।
চারদিকে সতর্ক চোখ বুলাচ্ছে সে।
এই সময় একটা গম্ভীর কন্ঠে ধ্বনিত হলো, ‘ঠিকই সন্দেহ করেছ আহমদ মুসা। আমরা ঘিরে ফেলেছি তোমাকে চারদিক থেকে। ডজনখানেক স্টেনগান তোমাকে তাক করে আছে। আমাদের প্রত্যেকের চোখে ইনফ্রারেড গগলস। তোমার সবকিছুই আমরা দেখছি। কোন বেয়াদবীর দূর্মতি হলে একেবারে ভর্তা হয়ে যাবে। যেভাবে হাঁটছিলে, সেভাবেই সামনে এগুতে থাক’। কন্ঠটি থেমে গেল।
তার প্রত্যেকটি কথাই আহমদ মুসা বিশ্বাস করল। মনে খুব কষ্ট লাগল আহমদ মুসার, এমন দিনেই সে তার ইনফ্রারেড গগলস নিয়ে আসেনি।
হাঁটতে লাগল আহমদ মুসা। সেই কন্ঠটি অন্ধকারে হো হো করে হেসে উঠল। বলল, আজ গাড়িতে আমাদের একজন লোক বোকার মত এই ৫ নাম্বার বাড়ির কথা উচ্চারণ করেছিল, তুমি পালাবার পর আমরা বুঝেছি তুমি ৫ নাম্বার বাড়িতে আসবে। কিন্তু এত দ্রুত আসবে, আজই আসবে, সেটা আমরা কল্পনাতেও ভাবিনি। কিন্তু আহমদ মুসা তুমি চালাক হয়েও এই বোকামি কেন করলে। প্রকাশ্যে দিবালোকে তুমি বাড়ি দেখতে আসবে, বাড়ি দেখে যাবে, আর তোমাকে কেউ দেখবে না, এটা তুমি ভাবতে পারলে কেমন করে। এটাই ঈশ্বরের মার বুঝলে?’
‘তোমরা ঈশ্বর মান নাকি?’ আহমদ মুসা বলল। তার কন্ঠে বিদ্রুপ।
‘মায়ের কাছে মাসির কথা বল না আহমদ মুসা। তুমিও জান ইহুদীরা মানে বনি ইসরাইলা ঈশ্বরের চিরকালীন বাছাই করা সন্তান’। বলল কন্ঠটি।
‘বাছাই করা ঠিকই, তবে সেটা বেহেশতে যাওয়ার জন্যে নয় নিশ্চয়’। আহমদ মুসা বলল।
বাড়ির পেছনে তখন তারা পৌঁছে গেছে। আলোর মধ্যে সবাই দাড়িয়ে।
আহমদ মুসা দেখল, ঠিকই প্রায় চৌদ্দজন স্টেনগানধারী তাকে ঘিরে আছে।
‘আহাম্মকের কথার কোনো জবাব হয় না আহমদ মুসা’।
আহমদ মুসা দেখল কন্ঠটি ওয়ার্ল্ড ফ্রিডম আর্মির স্ট্রাসবার্গের স্টেশন চীফ লাইবারম্যানের।
লাইবারম্যানের বাম হাতে রিভলবার। আর ডান হাতটা গলার সাথে ঝুলিয়ে রাখা। আহমদ মুসা বুঝল, লাইবারম্যান সকালের ঘটনায় শুধু আহতই হয়েছিল।
কথা শেষ করেই লাইবারম্যান ঘুরে দাঁড়াল বাড়ির দিকে। তারপর রিভলবারটা পকেটে রেখে পকেট থেকে বাঁ হাত দিয়ে ক্ষুদ্র মোবাইল সেটের মত একটা কিছু বের করল।
সামনেই ছিল একটা দরজা। বাড়ির পেছনের দরজা এটাই।
লাইবারম্যান তার বাম হাত উঁচু করল দরজাটির সমান্তরালে। সংগে সংগে দরজাটা খুলে গেল। আহমদ মুসা বুঝল লাইবারম্যানের হাতের ওটা রিমোট কনট্রোল।
দরজা খুলে যেতেই একজন লোক বেরিয়ে এল দরজা দিয়ে। তার হাতে একটি হ্যান্ডকাফ।
তাকে দেখেই লাইবারম্যান বলে উঠল, ‘হ্যাঁ, তুমি আহমদ মুসাকে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে দাও। সকালের ভুল আমরা করব না’।
আহমদ মুসাকে হ্যান্ডকাফ পরানো হলে তাকে নিয়ে সবাই বাড়ির ভেতর প্রবেশ করল। সবার আগে লাইবারম্যান। তার পেছনে আহমদ মুসা। অন্য অস্ত্রধারীরা আহমদ মুসার পেছনে।
বাড়ির ভেতরে ঢুকে আহমদ মুসাকে নিয়ে সবাই এল একটা সিড়ি ঘরে। এখান থেকে সিড়ি উঠে গেছে দু’তলা, তিনতলায়।
সিঁড়ি ঘরে ঢুকেই বৈদ্যুতিক বোর্ডের সুইচের সারি থেকে একটা সুইচে চাপ দিল লাইবারম্যান। সুইচটা অন করার সাথে সাথেই সিড়িঘরের মেঝের একাংশ সরে গেল। বেরিয়ে পড়ল নিচে নামার সিড়ি।
সিড়ি দিয়ে নামল ওরা আহমদ মুসাকে নিয়ে।
নিচের আন্ডারগ্রাইন্ড ফ্লোরটার মাঝখানে সোফা সজ্জিত একটা লবী ছাড়া গোটাটাই ছোট বড় বিভিন্ন কক্ষে ভরা।
আহমদ মুসাকে নিয়ে ওরা একটি কক্ষে তুলল। কক্ষটি বেশ বড়। কক্ষের একপ্রান্তে সিংগল সাইজের লোহার খাট। খাটটি মেঝের সাথে ফিক্সড করা।
আহমদ মুসাকে কক্ষে ঢুকিয়েই লাইবারম্যান বলল, ‘আহমদ মুসা এটাই তোমার ঘর। তবে বেশিক্ষণ তোমাকে এখানে থাকতে হবে না। ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই আজর ওয়াইজম্যান আসছেন। তিনি ফিরে এলেই আমরা এখানে আসব। আমরা আসার আগ পর্যন্ত তুমি শুয়ে শুয়ে তোমার জীবনের একটা হিসেব নিকেষও করে নিও। কারণ আমরা আসার পর আর তুমি সুযোগ পাবে না’। থামল লাইবারম্যান।
‘পাব না যদি তুমি ঈশ্বর হও। কিন্তু তুমি ঈশ্বর নও মি.লাইবারম্যান’। বলল আহমদ মুসা।
‘ঈশ্বর হওয়ার প্রয়োজন নেই আহমদ মুসা। ঈশ্বর অনেক স্বাধীনতাই মানুষকে দিয়ে দিয়েছেন’। থামল লাইবারম্যান।
কিন্তু আহমদ মুসা কোন উত্তর দিল না। ভাবল, বেহুদা আলোচনায় কোন লাভ নেই।
লাইবারম্যানই আবার কথা বলে উঠল। বলল, ‘আহমদ মুসা আজ সকাল পর্যন্ত তুমি অসংখ্যবার সুযোগ পেয়েছ। কিন্তু সব কিছুরই একটা শেষ আছে আহমদ মুসা। সেই শেষ মাথায় তুমি পৌঁছে গেছ। আর তোমাকে নিয়ে আমরাও ধৈর্য্য সহ্যের শেষ মাথায় পৌঁছেছি। তোমার লাশ পড়ত ঐ অন্ধকার বাগানেই। কিন্তু আজর ওয়াইজম্যান নিজেই তোমার শেষ বিচারটা করতে চান বলেই তুমি কিছুটা সময় পেয়ে গেলে’।
বলেই ঘুরে দাঁড়াল লাইবারম্যান। কিন্তু ঘুরে দাঁড়িয়েই আবার ফিরল সে। বলল সে একজনকে লক্ষ্য করে, ‘লেগ চেইনটা আননি?’
‘ইয়েস বস’। বলল লোকটি।
‘লাগাওনি কেন এতক্ষণ?’ ক্রুদ্ধ কন্ঠে বলল লাইবারম্যান।
‘বস আমি আপনার নির্দেশের অপেক্ষা করছি’। বলল লোকটি।
কথা শেষ করেই লোকটি তড়িঘড়ি করে আহমদ মুসার পায়ের কাছে বসে পড়ল। পায়ে বেড়ি পরিয়ে দিল আহমদ মুসার এবং সেটা লক করে দিল।
লাইবারম্যান বলে উঠল, ‘তোমার ব্যাপারে আমরা আর কোন ঝুঁকি নিতে চাই না আহমদ মুসা। সকালে তোমার হাত-পায়ে শৃঙ্খল পরালে আমাদের তিনজন লোককে জীবন দিতে হতো না, আমিও আহত হতাম না’।
‘এখন তোমরা নিশ্চয় নিশ্চিন্তই লাইবারম্যান?’ আহমদ মুসা বলল।
‘বলতে পার। তুমি পালাতে পারছ না, তোমার হাত-পা নিষ্ক্রিয় করা গেছে এব্যাপারে আমরা নিশ্চিত। সকালের ভুল আমরা শুধরে নিয়েছি’।
বলে ঘুরে দাঁড়াল লাইবারম্যান। বেরিয়ে গেল সে ঘর থেকে।
তার সাথে সাথে অন্য সকলেও।
লাইবারম্যান তার শেষ কথাটার কোন জবাব পেল না আহমদ মুসার কাছ থেকে। কিন্তু ঘুরে না দাঁড়িয়ে আহমদ মুসার মুখের দিকে তাকালে সে দেখতে পেত একটা হাসি। এ হাসি বিদ্রুপ করছে লাইবারম্যানকে।
আহমদ মুসার পেছনে দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল।
দরজা বন্ধ হতেই বসে পড়ল আহমদ মুসা মেঝেতে।
তার হাতের হ্যান্ডকাফের মতই পায়ের চেইনটা। ছয়সাত ইঞ্চির বেশি লম্বা নয়।
দুই হাঁটু দুই দিকে ছড়িয়ে বসতে পারল না আহমদ মুসা। ঐভাবে বসতে পারলে জুতার গোড়ালী হাতের বেশি কাছে পেত। দুই হাটু একদিকে নিয়ে দুই পা এক সাথে ছড়িয়ে বসল আহমদ মুসা।
পা দু’টি গুটিয়ে যথাসম্ভব কাছে নিয়ে এল সে। তারপর দু’হাত দিয়ে ডান জুতায় হুক দিয়ে আটকানো গোড়ালিটা খুলে ফেলল।
জুতার গোড়ালী হাতে নিয়ে আহমদ মুসা গোড়ালীর ভেতরের পাশের একটা বিশেষ স্থানে চাপ দিতেই গোড়ালীর গোটা সারফেসটাই ক্লিক করে উঠে গেল। বেরিয়ে পড়ল একটা কেবিন। কেবিন থেকে আহমদ মুসা বের করে আনল সিগারেটের চেয়ে সরু এবং আধা সিগারেটের মত লম্বা সুচবিহীন সিরিঞ্জের মত একটা ছোট বস্তু। এটাই ‘মাইক্রো লেসার টর্চ’। এর লেসার বীম দিয়ে যে কোন তালা, সরু সাইজের যে কোন আইরন বার এবং আধা ইঞ্চি পরিমাণ পুরু স্টিলশিট গলিয়ে ফেলা যায়, কেটে ফেলা যায়।
আহমদ মুসা জুতার গোড়ালিটা আবার লাগিয়ে দিয়ে হাত-পায়ের শৃঙ্খল কাটার দিকে মনোযোগ দিল।
লেসার বীম দিয়ে হ্যান্ডকাফের লক এবং পায়ের চেইনের লক গলিয়ে শেষ করে দিতেই হাত পায়ের চেইন খুলে গেল আহমদ মুসার।
আহমদ মুসা লেসার টর্চ পকেটে পুরে হ্যান্ডকাফ ও পায়ের চেইন কুড়িয়ে নিয়ে উঠে দাড়াল। এগুলো খাটের দিকে।
স্টিলের খাটের উপর রঙিন কাপড়ে মোড়া ফোমের তোষক। পায়ের দিকে একটা কম্বল মুড়িয়ে রাখা। কম্বল দেখে খুশি হলো আহমদ মুসা। কম্বল মুড়ি দিয়ে তার হাত-পাকে সে ওদের চোখের আড়ালে রাখতে পারবে।
আহমদ মুসা হাতের হ্যান্ডকাফ ও পায়ের চেইন তোষকের তলে রেখে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল।
ঘুমাবার আগে আহমদ মুসার একটাই অস্বস্তি ছিল যে, তার কাছে কোন অস্ত্র নেই। সার্চ করে সব অস্ত্রই ওরা কেড়ে নিয়েছে। এমনকি ঘড়ি, কলমও। তার ভাগ্য ভাল যে জুতা জোড়া খুলে নেয়নি তারা।
দরজা খোলার শব্দে আহমদ মুসার তন্দ্রা ভাঙল। কিন্তু চোখ খুলল না সে। কিন্তু অনুভব করল ঘরে অনেক লোক প্রবেশ করেছে।
প্রথম কন্ঠ শুনতে পেল সে লাইবারম্যানের। বলছিল সে, ‘ঘুমাচ্ছে আহমদ মুসা’।
‘এই অবস্থায় মানুষের ঘুম আসে। আচ্ছা লোক এই আহমদ মুসা’। একটি ভারী কন্ঠ বলে উঠল। আহমদ মুসা বুঝতে পারল এ কন্ঠ আজর ওয়াইজম্যানের।
‘শেষ ঘুম তো স্যার’। বলল লাইবারম্যান।
বলে একটু থেমেই বলে উঠল সে আবার, ‘এই ঘুমটাই তার শেষ ঘুম হোক স্যার’।
‘না লাইবারম্যান, মৃত্যুটা তাহলে খুব শান্তির হবে তার। সে মরবে খুবই অসহায়ভাবে এবং অসহ্য যন্ত্রনা তাকে পেতে হবে’।
বলে একটা দম নিয়ে হাতের রিভলবারটাকে একবার চেক করে একজনকে লক্ষ্য করে বলল, ‘তুমি গিয়ে ওকে লাথি মেরে জাগিয়ে দাও। দেখুক সে যম তার শিয়রে’।
আহমদ মুসা অনুভব করল একজন তার দিকে এগিয়ে আসছে। লোকটির পায়ের শব্দ যখন প্রায় মাথার পাশ পর্যন্ত এল, তখন আহমদ মুসা চোখ ও মুখকে ঘুম কাতর রেখেই দু’চোখের পাতা সামান্য খুলল। দেখতে পেল, স্টেনগানধারী একজন লোক দু’হাতে স্টেনগান ধরে ব্যারেল উচু করে রেখে তার ডান পা তুলছে আহমদ মুসার বুকে লাথি মারার জন্যে।
তার লাথিটা আহমদ মুসার বুক স্পর্শ করার আগেই চোখের পলকে আহমদ মুসার দু’হাত ছুটে গিয়ে লোকটির স্টেনগান কেড়ে নিল এবং শুয়ে থেকেই তার আগুন ঝরা স্টেনগানকে ঘরের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ঘুরিয়ে নিতে লাগল।
তার মধ্যেই সে দেখতে পেল একজনকে ঢাল সাজিয়ে তার আড়ালে দাঁড়িয়ে পিছু হটে কে একজন ঘর থেকে দ্রুত বেরিয়ে গেল।
ঘরে তখন কেউ দাড়িয়ে নেই। সবার রক্তাক্ত দেহ মাটিতে লুটানো। রক্তে ভাসছে তারা।
আহমদ মুসা ষ্টেনগান হাতে রেখেই উঠে দাঁড়াল। লাশগুলোর দিকে একবার নজর করল। লাইবারম্যানের লাশ সে দেখতে পেল, কিন্তু আজর ওয়াইজম্যানকে দেখতে পেলনা। বুঝল সে, আজর ওয়াইজম্যানই তাহলে তাদের একজনকে ঢাল সাজিয়ে নিজেকে রক্ষা করে পালিয়ে গেছে। কিন্তু তাকে পেলে তো সব পাওয়া হয়ে যায়।
চিন্তাটা মাথায় আসতেই আহমদ মুসা ছুটল তার পিছু নেবার জন্য।
আহমদ মুসা ঘর থেকে বেরিয়ে দৌড়ে সিঁড়িতে এল।
সিঁড়ি মুখটা বন্ধ।
আহমদ মুসা দেখল সিঁড়ি মুখের কোথাও কোন বোতাম বা কোন সুইচ নেই।
দ্রুত নেমে এলো আহমদ মুসা সিঁড়ি ঘরে। সিঁড়ি ঘরে সে পেয়ে গেল সুইচবোর্ড। দেখল, সব সুইচ অন, শুধু একটাই অফ। অফ সুইচটাকে অন করে দিয়ে আহমদ মুসা সিঁড়ির গোড়ায় ছুটে এল। দেখতে পেল, সিঁড়ির মুখ খুলে গেছে।
আহমদ মুসা দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠল। সিঁড়ি ঘরে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত চোখে পড়ল তার। ফোঁটা ফোঁটা রক্তের দাগ দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেছে।
আহমদ মুসা নিশ্চিত হলো যে, আজর ওয়াইজম্যান আহত হয়েছে।
রক্তের দাগ অনুসরন করে ছুটল আহমদ মুসা।
বাইরের গেটে যখন এসে দাঁড়াল, দেখতে পেল ছুটন্ত একটা গাড়ির পেছনের লাল আলো।
‘ঐ গাড়িতেই পালাল আজর ওয়াইজম্যান, ভাবল আহমদ মুসা।
এ সময় পাশে একাধিক পায়ের শব্দ শুনে ষ্টেনগান তাক করে তাড়াক করে ঘুরে দাঁড়াল আহমদ মুসা।
‘ভাইয়া, আমরা বলে চিৎকার করে উঠল সামনে থেকে।
আহমদ মুসা তার ষ্টেনগানের ব্যারেল সংগে সংগেই নিচু করল।
এক ঝাঁক গুলী গিয়ে মাটিতে বিদ্ধ হলো। আহমদ মুসা ততক্ষনে ষ্টেনগানের ট্রিগার থেকে তার তর্জ্জনি সরিয়ে নিয়েছে।
হাঁপাতে হাঁপাতে তার সামনে এসে দাঁড়াল যায়েদ এবং ফাতিমা।
প্রচন্ড বিস্ময় ও বিরক্তি আহমদ মুসার চোখে মুখে। ধমকের স্বরে বলল, এ তোমরা কি পাগলামী করেছ, এখনি সাংঘাতিক কিছু ঘটে যেতে পারতো।
‘আমাদের ভুল হয়েছে ভাইয়া। কথা না বলে এভাবে এগোনো ঠিক হয়নি।’ ভয় মিশ্রিত ভেজা গলায় বলল ফাতিমা।
‘তার চেয়ে বড় ভুল হয়েছে এভাবে তোমাদের আসা।’ বলল
আহমদ মুসা।
‘ফাতিমা প্রস্তাব করল। আমিও ঠিক মনে করলাম। তাই……..।’
কথা শেষ না করেই থেমে গেল যায়েদ।
যায়েদ থামতেই ফাতিমা বলে উঠল, ‘মাফ করবেন ভাইয়া, আমরা সব জানার পর ঘরে শুয়ে থাকতে পারিনি। বিশেষ করে যখন ভেবেছি আমরা বাসায় রাত যাপন করছি, আর আমাদের এক ভাই আমাদের জন্য মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে, তখন ঘরে থাকা আমাদের পক্ষে অসম্ভব হয়েছে।’ ফাতিমার আবেগ জড়িত কন্ঠে কান্নার সুর।
আহমদ মুসার মুখে হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘ধন্যবাদ তোমাদের দায়িত্ববোধের জন্য। আমি হয়তো ঠিক মনে করছি না। কিন্তু তোমরা যা করা উচিত, সেটাই করেছ।’
‘ধন্যবাদ ভাইয়া। আপনার মন, আপনার বিচারবোধ এবং আপনার স্নেহ এত বড় বলেই আপনি এত বড় এবং আহমদ মুসা। আপনার প্রতি আমাদের অভিনন্দন। আজ আমরা দু’জন আমাদের কে সব চেয়ে ভাগ্যবান মনে করছি।’
‘ওয়েলকাম বোন তোমাদের। তোমাদের কান্ড দেখে আমার স্ত্রী জোসেফাইনের কথা মনে পড়ছে। ঘটনাগুলো বিয়ের আগের। আমি ওকে নির্দেশ দিয়ে আসতাম। কিন্তু আমার অনুপস্থিতির সময় সে তার বিচারবোধ দ্বারা পরিচালিত হতো। বেশ কিছু অভিযানে সে আমার নির্দেশ অমান্য করে আমার পিছু নিয়েছে এবং আসন্ন মৃত্যুর হাত থেকে আমাকে বাঁচিয়েছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ভাইয়া, ভাবীকে এজন্যে কি আপনি বকেছেন?’ বলল ফাতিমা মুখে হাসি টেনে।
‘বকেছি। কিন্তু তার যুক্তিতে তিনি অনড়। আমার অনুপস্থিতিতে তাঁর বিচারবোধ দ্বারা পরিচালিত হবার অধিকার তাঁর রয়েছে বলে তিনি মনে করেন।’
ফাতিমার মুখে মিষ্টি হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘এ জন্যেই তিনি আমাদের ভাবী এবং আপনার উপযুক্ত সঙ্গিনী।’
ফাতিমা থামতেই যায়েদ তড়িঘড়ি বলে উঠল, ‘ভাইয়া আপনি শুধু আমাদের ভাইয়া নন, আমাদের মানে ফরাসীদের জামাই আপনি। এটা আমাদের একটা বড় গর্ব, যেটা ফাতিমাদের নেই।’ কি রকম? বুঝলাম না। ভাইয়া ফরাসীদের জামাই কি করে? বলল ফাতিমা। তার কন্ঠে বিস্ময়।
‘ও, তুমি জানই না। ভাবী তো মারিয়া জোসেফাইন লুই, ফ্রান্সের সর্বশেষ রাজবংশ বরবুনদের রাজকুমারী। ‘লুই দ্যা গ্রেট’ নামে পরিচিত ফ্রান্সের শক্তিমান সম্রাট চতুর্দশ লুই-এর তিনি সরাসরি বংশধর।’ বলল যায়েদ চোখ–মুখ উজ্জল করে।
‘ও গ্রেট নিউজ আমাদের জন্যে। কিন্তু যায়েদ ফরাসী হিসাবে তোমার যে গর্ব, তার চেয়ে আমার গর্ব বড়, মুসলমান হিসাবে।
আমার একজন ভাই বিয়ে করেছেন তোমাদের রাজকুমারীকে।’
ফাতিমা বলল।
‘সেই হিসাবে তো আমার গর্ব ডবল। ফরাসী হওয়ার পাশা পাশি আমি মুসলমানও।’ চট করে বলল যায়েদ।
ফাতিমা কিছু বলতে যাচ্ছিল। আহমদ মুসা তাকে বধা দিয়ে বলল, তোমরা ঝগড়াটা বাড়িতে গিয়ে করো। এখন কাজের কথায় এস।
তোমরা এসে ভালই হয়েছে, এত বড় বাড়ি সার্চ করতে হবে, তোমাদের সাহায্য দরকার। চলো ভেতরে। বলে আহমদ মুসা চলতে শুরু করল।
যায়েদ ও ফাতিমা চলল তার পেছনে পেছনে।
সিঁড়ি রুমে ঢুকে আহমদ মুসা বলল, ‘চলো যাই আগে আন্ডার গ্রাউন্ড ফ্লোরে। ওখানে ডজন খানেক মানুষ মরে পড়ে আছে। ওদের সার্চ করা থেকেই কাজ শুরু করি।’
আহমদ মুসা সুইচ অন করে সিঁড়ি মুখ উন্মুক্ত করে নামতে লাগল সিঁড়ি বেয়ে। যায়েদ ও ফাতিমা তার পেছনে পেছনে চলল।
তারা পৌছল সেই রক্ত প্লাবিত কক্ষ।
ঘরে রক্তের বন্যা ও লাশের স্তুপ দেখে আঁৎকে উঠল ফাতিমা।
বলল, এত রক্ত এত লাশ।
‘ফাতিমা, এই কক্ষ আমার লাশ পড়ে থাকার কথা ছিল, কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায় পড়ে আছে তাদের লাশ। আমি এখানে আসব, আগেই ওরা আঁচ করতে পেরেছিল। তার ফলে আমি এসেই ওদের ফাঁদে পড়ে যাই এবং বন্দী হই। হাত পায়ে বেড়ি লাগিয়ে এ ঘরেই ওরা আমাকে বন্দী করে রেখেছিল। আজ রাতেই আমাকে হত্যা করার কথা। সে উদ্দেশ্যেই-অল্প ক’মিনিট আগে ওরা আমার ঘরে ঢুকেছিল। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছা ছিল ভিন্ন। মারতে এসে সবাই ওরা মরেছে শুধু পালাতে পেরেছে ওদের শীর্ষনেতা লোকটি।’ বলে থামল আহমদ মুসা।
ফাতিমা ও যায়েদ দু’জনেরই বিস্ময় বিমুগ্ধ দৃষ্টি আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসা থামলেও সংগে সংগে কথা বলল না ওরা।
একটু পর যায়েদ বলে উঠল, ‘একজন আহত, রক্তাক্ত লোককে আমরা গাড়ি করে পালাতে দেখলাম। সেই তাহলে নেতা?’
যায়েদ থামতেই ফাতিমা বলল, ‘আলহামদুলিল্লাহ। আপনাকে অভিনন্দন ভাইয়া।’ মাত্র দুই দিনে চারটি অভূতপূর্ব বিজয়। আগের অবস্থায় বিস্মিত হতাম, কিন্তু এখান সেই অবস্থা নেই। এসব বিজয় আহমদ মুসার জন্য কিছুই নয়। শুধু বলব, আল্লাহ আপনাকে দীর্ঘজীবী করুন।
আহমদ মুসা তখন মৃতদের সার্চ শুরু করে দিয়েছে। যায়েদ ও আহমদ মুসাকে সহযোগিতা করতে লাগল। কিন্তু তাদের কাছে কিছুই পাওয়া গেল না।
আহমদ মুসা সোজা হয়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, ওদের পকেটে কোন তথ্য-প্রমাণ না পেলে ও একটা বড় জিনিস পাওয়া গেছে। সেদিন হোটেলে মৃত দু’জনের সার্টের কলারে যে ইনসিগনিয়া পাওয়া গিয়েছিল, এদেরও সার্টের কলারে সেই ইনসিগনিয়াই রয়েছে। তারা যে একই দলের লোক পুলিশ এটা সহজেই বুঝতে পারবে।এটা স্পুটনিক কেসের জন্য ভালই হবে।
‘কিন্তু এই ঘটনায় পুলিশ কি আপনাকে সন্দেহ করবে?’ বলল ফাতিমা।
‘পুলিশ বুঝবে কিনা জানি না, কিন্তু পুলিশকে বুঝানো হবে। আজর ওয়াইজম্যান বেঁচে গেছে। সেই পুলিশের বিশেষ কাউকে জানাতে পারে এবং আমার পিছনে পুলিশকে লেলিয়ে দেয়ার কাজ জোরদার করতে পারে। তবে আইনগতভাবে পুলিশের চিন্তা আজর ওয়াইজম্যানদের বিরুদ্ধেই যাবে।’
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা দরজার দিকে হাঁটা শুরু করল। বলল, ‘এস উপরে সব ফেলার সার্চ করতে হবে, নিশ্চয় কিছু পাওয়া যাবে।’
ফাতিমা ও যায়েদ আহমদ মুসার পিছে পিছে চলল।
নিচের তলায় তারা কিছুই পেল না। দেখে তাদের মনে হলো, নিচের তলাটা এক সময় ষ্টোর ও চাকর বাকরদের বাসস্থান হিসেবেই ব্যবহৃত হতো। অবশ্য কয়েকটিতে কিছুক্ষন আগেও লোক ছিলো বলে তাদের মনে হলো।
দু’তলাটা সুসজ্জিত। দু’তলার ঘরগুলো প্রায় সবগুলই চেয়ার- টেবিল-সোফায় সাজানো অফিস ও সিটিং কক্ষ। তবে কাগজপত্র নেই কোন টেবিলে। আফিসগুলো পরিত্যক্ত মনে হলো তাদের। টেবিলের ড্রয়ার, আলমারি হাতড়িয়ে কিছু কাগজপত্র ও কয়েকটা টেলিফোন ইনডেক্স যা পেল তা সবই ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানের এবং পুরানা।
তিন তলার অধিকাংশ কক্ষই ফাঁকা। দক্ষিন দিকে পেল চারটা বেড রুম একই সারিতে। দেখে মনে হলো, এ বেড রুমগুলো ব্যবহৃত হচ্ছে। চারটি বেড রুমের পাশে একটা কম্পিউটার কক্ষ খুঁজে পেয়ে গেল। ঘরটি একদম তাজা। কিছুক্ষন আগেও ব্যবহৃত হয়েছে বলে মনে হলো তাদের। কয়েকটি বাটনে ক্লিক করে আহমদ মুসা নিশ্চিত হলো যে, কম্পিউটার আজও ব্যবহৃত হয়েছে।
ঘুরে দাঁড়াল আহমদ মুসা ফাতিমা ও যায়েদের দিকে। বলল, যায়েদ, ফাতিমা এবার তোমাদের বিদ্যার পরীক্ষা হবে। দু’টা কম্পিউটার টার্মিনালের সব ফাইল, সব কিছু তোমাদের খুঁটে খুঁটে সার্চ করতে হবে। আমি ততক্ষণে অন্য কক্ষগুলো দেখে আসি।’
বলে আহমদ মুসা ঘর থেকে বেরুতে যাচ্ছিল। যায়েদ পেছন থেকে বলে উঠল, কম্পিউটারের সিক্রেট ফাইলগুলো আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বেশি। নিশ্চয় ওগুলোর কোড কোথাও রেখে যায় নি। কোন ফাইলে বা কোন প্রোগ্রামে কোড বা কোডগুলোকে ক্যামোফ্লেজ করে রেখে গেলেও তা এত তাড়াতাড়ি বের করা অসম্ভব হতে পারে। ওদের কোড কি হতে পারে, এ ব্যাপারে আপনি কিছু অনুমান করেন কি না।
থমকে দাঁড়িয়েছিল আহমদ মুসা। তার চেখে মুখে নেমে এল ভাবনার ছাপ। মুখ নিচু হলো তার। চোখ দু’টিও বন্ধ হয়ে গেল মুহুর্তের জন্য। বুঝা গেল গোটা ভাবনাকে সে কেন্দ্রীভূত করার চেষ্টা করছে।
একটু পর চোখ খুলল আহমদ মুসা। মুখ তুলল সে।
যায়েদর মুখে দুই চোখ নিবদ্ধ করে বলল আহমদ মুসা, ‘অত্যন্ত কঠিন, মানে অসম্ভব একটা প্রশ্ন করেছে যায়েদ। তবে আমি যদি ওদের কেউ হতাম, তাহলে যে কোডগুলো আমি ব্যবহার করতাম, সেটা তোমাকে বলতে পারি।’
বলে আহমদ মুসা মুহূর্তকাল চিন্তা করে বলল, ‘তোমাকে অনেকগুলো অপশন নিয়ে ট্রাই করতে হবে। তার প্রথমটি হলো, ‘Harzel’ অথবা ‘H’, দ্বিতীয় ‘Azr Wiseman’ অথবা AW, তৃতীয় ‘World Freedom Army’ অথবা ‘WFA, চতুর্থ ‘HAWWFA’, পঞ্চম ‘HAWFA’ এবং ষষ্ঠ ‘New Gulag’ অথবা ‘NG’, হলো সর্বশেষ।’
আহমদ মুসা থামতেই বিস্মিত কন্ঠে ফাতিমা বলল, ‘World Freedom Army’(WFA) থেকে যে কোড নিয়েছেন তার যুক্তি
বুঝলাম।ওটা ওদের সংগঠনের নাম। সংগঠনের নামে কোড হতে পারে। কিন্তু অন্য কোডগুলোর যুক্তি বুঝছি না। ওগুলো কি আপনার নিছক কল্পনা?
‘কোনটাই কল্পনা নয় ফাতিমা। ইহুদীরা ইতিহাস ও ঐতিহ্য প্রিয়। Hazrel (H) ইহুদীবাদের জনক। Azr Wiseman (AW) এর Wiseman একজন বৃটিশ ইহুদী বিজ্ঞানী, তিনি বলা যায় ইসরাইল রাষ্ট্রের জনক। আর ‘Azr’ হলো ‘World Freedom Army’ (WFA) আন্দোলনের জনক। ‘HAWWFA’ and ‘HAWFA’ উপরোক্ত তিনটি নামের শব্দগুলোর আদ্যাক্ষরের সমাহার। সব শেষ সাবেক সোভিয়েতের ‘New Gulag’ সংস্কৃতির প্রতি ইহুদীদের আকর্ষণ খুব বেশি। সর্ব কনিষ্ঠ হিসাবে সাবেক সোভিয়েতের ‘নির্মূলকরণ’ সংস্কৃতি তারা অনুসরণ করছে। সুতরাং তাদের জন্য ‘New Gulag’ সুন্দর কোড ওয়ার্ড হতে পারে। বলল, আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ ভাইয়া। কিন্তু একটা কথা। ইহুদীরা ইতিহাস-ঐতিহ্য প্রিয় হলে তো’ Temple’ ‘Solomon’ ‘Sabat’ ইত্যাদি ঐতিহ্যবাহী শব্দও তো তাদের কোড ওয়ার্ড হতে পারে। কিন্তু এগুলোকে তো আপনি বাদ দিয়েছেন।’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘ইসরাইল, ইহুদী গোয়েন্দা সংস্থা ‘মোসাদ’ ‘ইরগুনজাইলিউমি’ ‘ওয়ার্ল্ড ফ্রিডোম আর্মি’ প্রভৃতি ধর্মবাদী নয়, ইহুদীবাদী, আধিপত্যবাদী ঐতিহ্যের প্রতি তাদের আগ্রহ বেশি। এ কারণে ওদের ধর্মবাদী ঐতিহ্যের চেয়ে ইহুদীবাদী ঐতিহ্যের প্রতিই নজর দিতে হবে।
‘ধন্যবাদ ভাইয়া।’
হাসি মুখে এক সাথে বলে উঠল ফাতিমা ও যায়েদ। পরে যায়েদ আবার বলল, ‘আল্লাহ আপনার চিন্তাকে কবুল করুন এবং আমাদের কামিয়াব করুন।’
বলে যায়েদ কম্পিউটারের দিকে ঘুরে দাঁড়াল। ফাতিমাও।
আহমদ মুসাও আবার ঘুরে দাঁড়িয়ে হাটা শুরু করেছে।
আধা ঘন্টা পরে আহমদ মুসা ফিরে এলো হতাশ হয়ে। তিনতলার অবশিষ্ট ঘরগুলো সার্চ করে কিছুই পাওয়া যায়নি।
আহমদ মুসা কম্পিউটার রুমে ঢুকতেই ফাতিমা চাপা চিৎকার করে বলে উঠল, ‘ইউরেকা, ইউরেকা। আমরা যা খুঁজছিলাম তা বোধ হয় পেয়ে গেছি ভাইয়া। সব আমরা বুঝছি না, আপনি বুঝবেন। আসুন।
আহমদ মুসা গিয়ে যায়েদের পাশে বসল।
কথা শেষ করেই ফাতিমা আবার বলে উঠল, আপনাকে আরও অভিনন্দন ভাইয়া। আপনার অনুমান সত্য। আপনার দেয়া কোড দিয়ে দুই কম্পিউটারের সিক্রেট ফাইলগুলো খোলা গেছে।’
‘কোন দু’টি?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘New Gulag এবং Harzel’ উত্তর দিলো ফাতিমা।
আহমদ মুসা আর কোন কথা না বলে মনোযোগ দিল কম্পিউটারের স্ক্রীণের দিকে।
‘ভাইয়া মনে হয় আমরা সাংঘাতিক জিনিস পেয়ে গেছি।’ বলল যায়েদ। তারপর যায়েদ ‘কিবোর্ডে’ একটা বোতাম চাপ দিয়ে স্ক্রীনের একটা জিনিসের দিকে ইংগিত করে বলল, ওটা কি চিনতে পারছেন ভাইয়া।
হ্যাঁ , ওটা ‘স্পুটনিক।’ রাশিয়ার প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ধন্যবাদ ভাইয়া।’ স্পুটনিকের নিচের হেডিংটা পড়ুন। বলল, যায়েদ।
‘এর বিপজ্জনক পরিকল্পরা’-পড়ল শিরোনামটি আহমদ মুসা।
স্ক্রীনের শিরনাম দেয়া পাতাটি যায়েদ ধীরে ধীরে উপরে তুলল। বলল, ‘ভাইয়া, এবার স্পুটনিকের বিপজ্জনক পরিকল্পনাটা, পড়ুন।
পড়তে লাগল আহমদ মুসা। পাতাটি ধীরে ধীরে উপরে উঠছে আর পড়ছে তা আহমদ মুসা।
পড়ার এক পর্যায় এসে আহমদ মুসা আনন্দে যায়েদের পিঠ চাপড়ে চিৎকার করে উঠল, ‘যায়েদ, এ তো আমাদের স্পুটনিকের পরিকল্পনা!
নিউইয়র্কের ‘লিবার্টি’ ও ডেমোক্রাসি’ টাওয়ার ধ্বংসের রহস্য উন্মোচনে স্পুটনিক তদন্তের যে পরিকল্পনা করেছিল এবং এর যে উদ্দেশ ছিল, এ সবইতো এখানে বলা হয়েছে ! আলহামদুলিল্লাহ। থামল আহমদ মুসা।
কম্পিউটার স্ক্রীনে পাতাটি থেমে গিয়েছিল। আবার তা উপরে উঠতে লাগল। সামনে এসে দাঁড়াল পাতার দ্বিতীয় শিরনাম। যায়েদ বলল, ‘ভাইয়া পড়েন শিরোনামটা।’
‘ষ্টার ওয়ারঃ স্পুটনিককে গুলি করে নামানো’ পড়ল শিরোনামটি আহমদ মুসা। বলল, ‘তার মানে এবার স্পুটনিক ধ্বংসের পরিকল্পনা। আগাও যায়েদ।’
কম্পিউটার স্ক্রীনে পাতা উপরে উঠতে লাগল। উম্মুক্ত হতে লাগল পাতার লেখাগুলো। বলল যায়েদ, ‘ধীরে ধীরে পড়তে থাকুন ভাইয়া’ পড়তে লাগল আহমদ মুসা। তার পড়া যতই এগুলো, তার চোখে-মুখে আনন্দ-বিস্ময়ের খেলা ততই বাড়তে লাগল।
এক সময় পাতাটা কম্পিাউটার স্ক্রীনে স্থির হয়ে গেল। তার মানে দ্বিতীয় শিরোনামের বক্তব্য শেষ।
যায়েদ বলল, ‘কি বুঝলেন ভাইয়া?’
আহমদ মুসা ভাবছিল। তার ভাবনায় ছেদ নামল যায়েদের কথায়।
তাকাল সে যায়েদের দিকে। বলল, একটু ক্যামোফ্লেজ করেছে। কিন্তু ষড়যন্ত্র বুঝতে একটুও কষ্ট হয় না। ওদের ‘ষ্টার ওয়ার’ টা হলো নিউইয়র্কের টাওয়ার ধ্বংসের রহস্য অনুসন্ধানে স্পুটনিকের পরিকল্পনা। ‘ষ্টার ওয়ার’ বর্জন মানে স্পুটনিকের তদন্ত বর্জন করার জন্য তারা স্পুটনিকের পিসফুল ডেথ ঘোষনা করেছে। ষড়যন্ত্রের এই প্রকল্পে আরও দেখা যাচ্ছে ওদের কাছে স্পুটনিকের চেয়ে বড় হলো স্পুটনিকের সাত নির্মাতা। কারণ ‘স্পুটনিক ওয়ান’ হারালে ‘স্পুটনিক টু’ তৈরী করতে পারে। তাই স্পুটনিকের জন্য যে দন্ড সেই দন্ড সাত নির্মাতার জন্যও। তবে তার আগে সাত নির্মাতার এক্সরে প্রয়োজন ‘ষ্টারওয়ার’ অর্থাৎ টুইন টাওয়ার ধ্বংসের রহস্য সন্ধানে তারা কতটুকু এগিয়েছে, কাদেরকে আরও তারা জানিয়েছে তা বের করার জন্য।’ থামল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ ভাইয়া, আমরা এটাই বুঝেছি। তবে স্পুটনিকের ‘পিসফুল ডেথ’ ব্যাপারটা বুঝিনি।’ বলে উঠল যায়েদ ও ফাতিমা প্রায় এক সংগেই।
‘পিসফুল ডেথ’ মানে উত্তাপ-উত্তেজনাহীন নিরব মৃত্যু। স্পুটনিককে এভাবেই ধ্বংস করা হয়েছে। স্পুটনিকের সবই ধ্বংস হয়ে গেছে। কিন্তু বিল্ডিং-এর গায়ে কোন আঁচড় লাগেনি, আসবাবপত্রও সব ঠিক আছে। শুধু নেই ফাইল কাগজ-পত্র, ফিল্ম এবং কম্পিউটারের সফটওয়ার ও ডিস্কগুলো। এগুলো নেই, কিন্তু কি হয়েছে এগুলোর সামান্য নির্দশনও কোথাও নেই। মনে হতে পারে, স্পুটনিকের সাত গোয়েন্দা অফিস ছেড়ে দিয়ে ফাইল-পত্র নিয়ে কোথাও উধাও হয়েছে। এটাকে বলা হয়েছে স্পুটনিকের পিসফুল ডেথ।’ আহমদ মুসা বলল।
‘অদ্ভুত এ কৌশল ভাইয়া। ফারাসী গেয়েন্দারা যদি স্পুটনিকের অফিসের কেমিকেল টেষ্ট না করত, তাহলে যে ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছে তার কিছুই জানা যেত না, বলল ফাতিমা।
ফাতিমা থামতেই যায়েদ বলে উঠল, আরও মজার জিনিস ভাইয়া, আমরা যার কিছুই বুঝতে পারিনে।’
কথা বলতে বলতেই যায়েদ কস্পিউটারের কীবোর্ডে তার আঙুল চালনা শুরু করেছে। আহমদ মুসা তাকিয়ে আছে কম্পিউটারের স্ক্রীনের দিকে। বলল, মজার জিনিসটা কি যায়েদ?
‘একটা মানচিত্র ভাইয়া।’ বলেই যায়েদ কম্পিউটার স্ক্রীনের দিকে আঙুলি সংকেত করল, দেখুন ভাইয়া তৃতীয় একটা শিরোনাম।’
আহমদ মুসা আবার চোখ ফিরাল কম্পিউটার স্ক্রীনের দিকে। তাকাতেই চোখে পড়ল ‘নিউগুলাগ’ শিরোনামটা। ভ্রুকুঞ্চিত হলো আহমদ মুসার।
শিরোনামটা উপরে উঠে এল।
তার সাথে সাথে স্ক্রীনে ভেসে উঠল একটা মানচিত্র।
মানচিত্রটা যে একটা দ্বীপের, তা পরিস্কার বুঝা যায় তার চারদিকের রং দেখে। মানচিত্রেও বিভিন্ন বর্নের ল্যান্ড স্কেপ। মানচিত্রের নীচে লেখা ‘নিউ গুলাগ সাও তোরাহ।’
কম্পিউটার স্ক্রীনের উপর ঝুঁকে পড়েছে আহমদ মুসা।
যায়েদ, ফাতিমাও নিরব।
কিছুক্ষন পর মাথা সোজা করে বসল আহমদ মুসা। চোখ বন্ধ তার।
ভাবছে আহমদ মুসা।
মূহূর্ত কয়েকপর চোখ খুলল আহমদ মুসা। বলল, ‘এটা মজার জিনিস নয় যায়েদ। এটা ভয়ংকর একটা স্থানের মানচিত্র। মানচিত্রের নিচে ফুট নেট আকারে তারকা চিহ্নিত দু’টো প্যারাগ্রাফ পড়েছ যায়েদ?’
‘জ্বি, ভাইয়া।’ যায়েদ বলল।
‘দেখ এক নাম্বার প্যারাগ্রাফে বলা হয়েছে, ধর্মহীন ও ধর্মনিরপেক্ষ ছিল বলে, ‘ওল্ড গুলাগ’ ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু ‘নিউ গুলাগে’র ভিত্তি হবে ঈশ্বরের মনোনীত ধর্ম এবং নিউ গুলাগ পরিচালনা করবে ঈশ্বরের সহস্র সহস্র বছরের পরীক্ষিত ও মনোনীত লোকেরা। দ্বিতীয় প্যারাগ্রাফে আছে, নিউ গুলাগ ঈশ্বরের বিশ্ব গড়ার একটা কারখানা এবং ল্যাবরেটরী। পৃথিবীর পথভ্রষ্ট মিলিট্যান্ট-মৌলবাদীদের এখানে এনে এক্সরে করা হবে এবং তার ফলাফলের ভিত্তিতে চিকিৎসা চলবে, গোটা পৃথিবীতে যাতে দ্রুত ইসরাইলের ঈশ্বরের রাজত্ব কায়েম হয়।’
থামল আহমদ মুসা। একটু থেমেই আবার বলল, কি বুঝলে যায়েদ, ফাতিমা।
‘বুঝলাম, ধর্মহীন কম্যুনিষ্টদের গুলাগ ব্যর্থ হয়েছিল, কিন্তু ইহুদীদের ধর্মের নিউ গুলাগ সফল হবে। কিন্তু ঝুঝতে পারছিনা এক্সে-রে এবং তার ফলাফলের ভিত্তিতে বিশ্বব্যাপী চিকিৎসার ব্যাপারটা।’ বলল, ফাতিমা।
‘ব্যাপারটা আমার কাছেও খুব স্পষ্ট নয়। তবে যতটুকু বুঝতে পেরেছি তাতে বিষয়টা এই রকম হতে পারে, প্রতিদ্বন্দ্বীদের নিউ গুলাগে ধরে নিয়ে যাবে। সেখানে তাদের সব কথা বের করে নেয়া হবে বা জেনে নেয়া হবে যেমন এক্সরে’র মাধ্যমে করা হয়। এর ফলাফলের ভিত্তিতেই অতঃপর গোটা দুনিয়ায় তারা অপারেশন পরিচালনা করবে।’
আহমদ মুসা বলল।
‘ধন্যবাদ ভাইয়া। আমারও তাই মনে হয়।’ বলল যায়েদ।
‘সবটাই ভয়ংকর ব্যাপার ভাইয়া। ঐ এক্সরের পর নিশ্চয়ই ওখানে
কাউকে বাঁচিয়ে রাখা হবে না। আর বিশ্বব্যাপী ওদের অপারেশনটা ওল্ড গুলাগের ষ্ট্যালিনের মত।’ বলল ফাতিমা। তার চোখে-মুখে আতংক।
‘ঠিক বলেছ ফাতিমা। তবে ইহুদীবদীরা এটা করবে ধর্ম, মানবতা, মানবাধিকার ও সন্ত্রাস দমনের পোশাক পরে।’ বলে একটা দম নিয়েই আহমদ মুসা আবার বলল, ‘আমার অনুমান যদি মিথ্যা না হয়ে থাকে, তাহলে আমাদের স্পুটনিকের সাত গোয়েন্দাকে নিউ গুলাগ সাও তোরাহ দ্বীপেই রাখা হয়েছে।’
চমকে উঠল ফাতিমা ও যায়েদ দু’জনেই। তাদের দু’জনের চোখে-মুখেই নেমে এল অন্ধকার। দু’জনে এক সাথে বলে উঠল, ‘কোথায় এই দ্বীপ?’ কান্নার মত ভারী শোনাল তাদের কন্ঠস্বর।
আহমদ মুসা গা এলিয়ে দিল চেয়ারে। বলল, এটাই এখন প্রধান প্রশ্ন।’
সংগে সংগেই আবার সোজা হয়ে বসল আহমদ মুসা। বলল, ‘যায়েদ সবগুলোর প্রিন্ট নাও। আর চল যাবার আগে পুলিশকে টেলিফোনে সব কিছু বলে যাই।’
উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা। বলল, ‘যায়েদ তুমি প্রিন্টগুলো তাড়াতাড়ি সেরে ফেল। আমি এখনি আসছি।’
আহমদ মুসা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ফিরে এল পাঁচ মিনিট পরে দ্রুত। বলল, ‘যায়েদ প্রিন্ট শেষ?’
‘জি ভাইয়া।’ বলল যায়েদ।
‘তাহলে তোমরা দু’জন দ্রুত আমার পেছনে এস।’ বলেই আহমদ মুসা ঘর থেকে বেরুবার জন্য হাঁটা শুরু করল।
ফাতিমা উঠে দাঁড়িয়েছিল সংগে সংগেই। যায়েদও কাজ গুছিয়ে নিয়ে আহমদ মুসার পেছনে হাঁটতে লাগল।
তারা দ্রুত নেমে এল নিচের তলায়।
এসে বাড়ির ভেতরে প্রবেশের গেট থেকে যে করিডোরটা ভেতরে এগিয়ে এসেছে তার মুখে দেয়ালের আড়ালে ওঁৎ পেতে দাঁড়াল তারা। আহমদ মুসা তার হাতে রিভলবার তুলে নিয়েছে।
ফাতিমা ও যায়েদ দু’জনেরই চোখে-মুখে উদ্বেগ। বলল, যায়েদ ‘কি ব্যাপার ভাইয়া?’ ফিস ফিস কন্ঠ যায়েদের।
‘একটা প্রাইভেট কারকে আমি বাইরের গেটে দাঁড়াতে দেখেছি। দেখেছি দু’জন লোক নামতে। এরা নিশ্চয় WFA-এর লোক। ওদের রিল্যাক্স মুড দেখে মনে হয়েছে ওরা এখানকার ভেতরের খবর জানে না।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তাহলে আমরা এখানে দাঁড়িয়ে কেন? আমরা এগুচ্ছিনা কেন?’ ফাতিমা বলল।
‘সামনে এগিয়ে ওদের মুখোমুখি হয়ে আমি আর লড়াই বাধাতে চাই না। আমি ওদের ধরতে চাই। এ পর্যন্ত ওদের কাউকে আমরা জীবন্ত হাতে পাইনি। ওদের কাউকে জীবন্ত হাতে পেলে ‘নিউ গুলাগ সাও তোরাহ’ দ্বীপ কোথায় জানার চেষ্টা করা যেত।
ফাতিমা ও যায়েদের মুখ উজ্জল হয়ে উঠল। ফাতিমা বলে উঠল, ‘আপনার এ চিন্তা ঠিক ভাইয়া।’
‘কিন্তু ওরা তো এতক্ষনে ভেতরে প্রবেশ করার কথা। আসছেনা কেন? ঠিক আছে, তোমরা এখানে দাঁড়াও। আমিএকটু ওদিকে…..।’
আহমদ মুসা কথা শেষ করতে পারলনা। পেছন থেকে একটা কর্কশ কন্ঠ ধ্বনিত হলো, ‘ও দিকে নয়, এ দিকে তোমার যম আহম …….। তারও কথা শেষ হতে পারল না।
পেছনের দিকে কর্কশ কন্ঠ ধ্বনিত হবার সাথে সাথেই আহমদ মুসা অদ্ভুত ক্ষিপ্রতার সাথে নিজেকে ছুড়ে দিল মেঝেতে এবং সেই সাথেই তার হাতের রিভলবার গর্জন করে উঠল পরপর কয়েকবার।
ওদিকে পেছন থেকে যে কন্ঠ গর্জন করে উঠছিল তারা ছিল দু’জন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। দু’জনের হাতে উদ্যত রিভলবার। তাদের কন্ঠ থেমে যাবার সাথে সাথে তাদের রিভলবার ও গর্জন করে উঠেছিল।
আহমদ মুসা আগেই মেঝেয় ছিটকে পড়ার ফলে গুলি দু’টি তার উপর দিয়ে চলে যায়। তারা দ্বিতীয় গুলি করার আগেই আহমদ মুসার গুলি তাদের বিদ্ধ করল। বুকে গুলি খেল তারা দু’জনেই। তাদের রক্তাক্ত দেহ লুটোপুটি খাচ্ছিল মেঝেতে।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
ভয় ও আকস্মিকতায় কাঠ হয়ে ফাতিমা ও যায়েদ পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়েছিল। বাকরোধ হয়ে গেছে যেন তাদের। মৃত্যুকে যেন তারা একদম চোখের উপর নাচতে দেখল। জীবন ও মৃত্যু এত কাছাকাছি!
আহমদ মুসা যদি ঠিক সময়ে মেঝতে নিজেকে ছুঁড়ে দিতে না পারতো, তাহলে ওদের প্রথম গুলিই তার বক্ষ ভেদ করত। তারপর আহমদ মুসা যদি তার গুলিগুলো করতে কয়েক মুহুর্তও বিলম্ব করতো, তাহলে ওদের দ্বিতীয় গুলীর শিকার হতো আহমদ মুসা। তারপর ওদের তৃতীয় গুলি নিশ্চয় ছুটে আসতো যায়েদ ও ফাতিমার লক্ষ্যে। তাদের পকেটে একটি করে রিভলবার আছে, কিন্তু বের করার কথা মনে হয় নি, কখন বের করবে তাও বুঝতে পারেনি। আহমদ মুসা এত দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন!এত ক্ষিপ্র তিনি !যা ঘটে গেল তা অবিশ্বাস্য এক ঘটনা বলে মনে হচ্ছে তাদের কাছে। তাদের স্থির চোখের শূন্য দৃষ্টি আহমদ মুসার উপর নিবদ্ধ।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘এস যায়েদ এদের একটু চেক করি।’
বলে আহমদ মুসা ওদের দিকে এগুলো।
আহমদ মুসার কথা শুনল যায়েদ। কিন্তু কোন প্রতিক্রিয়া হলোনা তার মধ্যে। যেমন নিশ্চল দাঁড়িয়েছিল, তেমনি দাঁড়িয়ে রইল।
আহমদ মুসা প্রথমেই ওদের জামার কলার ব্যান্ড পরীক্ষা করল। তারপর তাদের পকেটগুলো সার্চ করল। দু’জনের পকেটে দু’টি মানিব্যাগ ছাড়া আর কিছুই পেলনা। মানিব্যাগে কোন কাগজপত্র পেলনা। এমনকি কোন নেমকার্ডও নয়। শুধু কিছু ইউরো মুদ্রা রয়েছে মানিব্যাগে। মানিব্যাগ দু’টি আবার ওদের পকেটে রেখে দিয়ে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল এবং বলল, ‘যায়েদ ফাতিমা এ দু’জনের কলার ব্যান্ডে ঐ একই ইনসিগনিয়া রয়েছে।’
কথা শেষ করে একটু থেমেই আবার বলল, চলো আমরা যাই।
আশে-পাশের কোন টেলিফোন বুথ থেকে পুলিশকে এখনি খবরটা জানাতে হবে। যাতে WFA -এর কেউ এখানে আসার আগেই পুলিশ আসতে পারে, সেটাও আমাদের দেখতে হবে।
আহমদ মুসা ‘এসো’ বলে হাঁটতে শুরু করল।
নিশ্চল মূর্তির আবস্থা থেকে ওরা নড়ে উঠল এবং আহমদ মুসার সাথে হাঁটতে শুরু করল। হাঁটতে হাঁটতে ফাতিমা বলল, ‘এ ধরনের সংঘাতে জীবন-মৃত্যু যে কত কাছাকাছি, তা আজ প্রথম দেখলাম।
আপনার খারাপ লাগেনা ভাইয়া? একটুও চিন্তা হয়না আপনার? আমার বুক এখনোও কাঁপছে। যদি মেঝেয় ছিটকে পড়েগুলী করতে একমুহুর্তও দেরী করতেন তাহলেই তো আপনি আর থাকতেন না। আমি ভাবতেই পারছিনা এ সব কথা।’ কন্ঠস্বর ভারী হয়ে উঠছিল ফাতিমার।
‘জীবন-মৃত্যু কোন বুলেটের বা কোন অস্ত্রের হাতে নয়। এর ফায়সালা আসে আল্লাহর কাছ থেকে এবং তা আসে যখন তা আসার কথা। সুতরাং এ নিয়ে ভাবনার কিছু নেই।’ তারা গেটে পৌছে গিয়েছিল।
‘ভাইয়া সামনেই রাস্তার পূর্ব পাশে টেলিফোন আছে। আমি আসার আগে দেখেছি।’ বলল, যায়েদ গেটে পৌছেই।
‘যায়েদ চল, টেলিফোনটা করবে তুমি। টেলিফোন করে আমরা পাশেই কোথাও অপেক্ষা করব। এ বাড়িটা পাহাড়া দিতে হবে, যাতে পুলিশ আসার আগে ওরা কেউ আসতে না পারে।’
আহমদ মুসা ‘এস’ বলে আবার হাঁটা শুরু করল।
‘টেলিফোনে কি বলব ভাইয়া?’ বলল যায়েদ।
‘বলবে, ‘অমুক নাম্বার বাড়িতে গোলাগুলির আওয়াজ শুনেছি। বড় কিছু ঘটছে সেখানে। ব্যস আর কিছু নয়।’ আহমদ মুসা বলল।
টেলিফোন করে আহমদ মুসারা পাশেই অপেক্ষা করল। দশ মিনিটও পার হলো না। পুলিশের দু’টি গাড়ি ছুটে এল তীব্রবেগে এবং তাদের অতিক্রম করে চলে গেল বাড়িটার দিকে।
এবার যায়েদ গাড়ি ষ্টার্ট দিল যাবার জন্যে। গভীর রাতের নিরবতা ভেঙে ছুটে চলছে গাড়ি। যায়েদের পাশে আহমদ মুসা।
পেছনের সিটে ফাতিমা।
চোখ বন্ধ করে গাড়ির সিটে গা এলিয়ে দিয়েছে আহমদ মুসা।
তিন জনেই নিরব।
নিরবতা ভাঙল যায়েদ। বলল, ‘আলহামদুলিল্লাহ, আমাদের স্বরণীয় রাত চির স্বরণীয়ভাবে কাটল ভাইয়া। আমরা খুব খুশি।’
‘তোমাদের অভিনন্দন। কিন্তু মনে রেখ, তোমাদের দু’জনের নতুন জীবন যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে শুরু হয়েছে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘এবং সে যুদ্ধটা অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়েকে প্রতিষ্ঠার জন্য। সুতরাং এটা আমাদের সৌভাগ্য।’ যায়েদ বলল।
‘ধন্যবাদ যায়েদ, তোমাদের মত করে সব মুসলমান যে দিন ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের প্রতিরোধের সংগ্রাম কে তাদের জন্য সৌভাগ্যের মনে করবে, সেদিন গোটা দুনিয়ার মুসলমানদের জীবন থেকে, অন্ধকারের অমানিশা কেটে যাবে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘সেদিন কত দূরে ভাইয়া? ফাতিমা বলল।
‘সেটা নির্ভর করছে তোমরা তরুন-তরুনীরা কত দ্রুত সামনে আগাতে পারছো তার ওপর।’ বলল আহমদ মুসা।
ফাতিমা কোন কথার উত্তর দিল না। তার নিরব দৃষ্টি প্রসারিত হলো সামনে।
যায়েদের দৃষ্টিও সামনে প্রসারিত।
আবার আহমদ মুসা তার চোখ বন্ধ করেছে। ভাবছে সে।
এক সময় যায়েদ মুখ তুলল আহমদ মুসার দিকে। বলল, কি ভাবছেন ভাইয়া?
চোখ খুলল আহমদ মুসা। গম্ভীর হয়ে উঠল তার মুখ। বলল, ‘ভাবছি ওদের নিউ গুলাগ ‘সাও তোরাহ’ দ্বীপের কথা। কেথায় এই ভয়ংকর দ্বীপটা? কিন্তু এই মুহুর্তে তার চেয়েও বেশি ভাবছি আজকের রাতের ঘটনাকে পুলিশ কতটা, কিভাবে ব্যাবহার করবে? তারা প্রেসকে এ চাঞ্চল্যকর বিষয়টা জানতে দিবে কিনা?
বলেই আহমদ মুসা হঠৎ সোজা হয়ে বসল। তার চেখে- মুখে চাঞ্চল্যের চিহ্ন দেখা দিল। বলল দ্রুত কন্ঠে, যায়েদ ফাতিমা কোন সাংবাদিকের ঠিকানা তোমাদের কাছে আছে?
ফাতিমা, যায়েদ দু’জনেই সোজা হয়ে বসল। যায়েদ বলল, আমার কাছে কোন সাংবাদিকের টেলিফোন নাম্বার নেই। তবে আবদুল্লাহ ভাইয়ের বাসায় সাংবাদিক বুমেদিন বিল্লাহর টেলিফোন নাম্বার থাকতে পারে। কাল ঐ সাংবাদিক ভাইয়ার পরিবারের সাথে যোগাযোগ করে ছিলেন।’
‘বুমেদিন বিল্লাহ’ মানে লা-মন্ডের সাংবাদিক যিনি প্রথম নিউজটা করেছিলেন।’
‘হ্যাঁ ভাইয়া।’ বলল যায়েদ।
খুশি হলো আহমদ মুসা। বলল, তাকেই আজ বেশি দরকার। কিন্তু তিনি কি স্ট্রাসবার্গে আছেন?
‘শুনেছিলাম আছেন। তিনি নাকি এই কেসটার ব্যাপারে আগ্রহী।’ যায়েদ বলল।
‘আলহামদুলিল্লাহ। তাহলে যায়েদ মোবাইলে তুমি তোমার ভাইয়ার বাসায় টেলিফোন কর। সাংবাদিক বুমেদীন বিল্লাহর টেলিফোন নাম্বার নাও।’ দ্রুত কন্ঠে বলল আহমদ মুসা।
গাড়ির ষ্টিয়ারিং এ এক হাত রেখে অন্য হাতে মোবাইলে টেলিফোন করল যায়েদ। প্রথমবার ও দ্বিতীয়বারের চেষ্টাতেও টেলিফোন কেউ ধরল না। তৃতীয় বারের চেষ্টায় টেলিফোন রিসিভ করল ওপার থেকে। খুশিতে মুখ উজ্জল হয়ে উঠল যায়েদের। বুমেদীন বিল্লাহর নাম্বার সে নিয়ে নিল।
টেলিফোন অফ করে দিয়ে বলল যায়েদ, ‘আলহামদুলিল্লাহ, নাম্বারটা পেয়েছি ভাইয়া।’
‘আলহামদুলিল্লাহ। এবার, মিঃ বুমেদীন বিল্লাহকে দেখ। পেলে তাকে বল, ‘শার্লেম্যান রোডের ৫নং বাড়িটা স্পুটনিক ধ্বংসকারী ও সাত গোয়েন্দাকে অপহরনকারীদের একটা ঘাঁটি। আজ রাতে ওখানে ওদের বার চৌদ্দজন লোক মারা গেছে। ওখানে ওদের ঐ অফিসে কয়েকটা কম্পিউটার রয়েছে। কম্পিউটারে স্পুটনিক ধ্বংস ও সাত গোয়েন্দাকে অপহরনের ব্যাপারে চাঞ্চলকর তথ্য পাওয়া যেতে পারে।
ব্যাস, এই টুকুই বললে হয়ে যাবে। এই মাত্র পুলিশ সেখানে গেছে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ ভাইয়া’ বলে যায়েদ মোবাইল তুলে নিল। টেলিফোন করল। প্রথম বারেই ওপার থেকে সাড়া পেয়ে গেল যায়েদ। আহমদ মুসা যেভাবে বলেছিল সেই ভাবেই সব কথা যায়েদ সাংবাদিক বুমেদিন বিল্লাহকে জানাল। তারপর ওপারের কথা সে শুনল। চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল যায়েদের। ধন্যবাদ বলে সে মোবাইলটা অফ করে দিল।
আহমদ মুসা ও ফাতিমা উদগ্রীব হয়ে শুনছিল যায়েদের কথা।
যায়েদ কথা শেষ করতেই ফাতিমা দ্রুত কন্ঠে বলল, কি রেজাল্ট? কি বলল সাংবাদিক বুমেদীন বিল্লাহ?
‘খুব খুশী হয়েছেন। এখনি যাচ্ছেন উনি ৫নং শার্লেম্যান রোডে। আমাকে অনেক করে ধন্যবাদ দিয়েছেন তিনি।’ বলল যায়েদ।
‘আলহামদুলিল্লাহ। ধন্যবাদ যায়েদ তোমার এ সফল মিশনের জন্য। যদি বিষয়টা পত্রিকায় আনা যায় তাহলে তো একটা বিরাট ব্যাপার হবে। ফরাসি পুলিশও তখন চাপে পড়বে।’ থামল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা থামতেই যায়েদ বলে উঠল, ‘মিশন আমার কোথায় ভাইয়া! আমি তো মাত্র আপনার প্রক্সি দিলাম।’
‘রাখ এসব কথা। বল, আরও কিছু বলেছেন উনি? বলল আহমদমুসা।
‘একটা প্রশ্ন উনি করেছেন। সেটা হলো, কে তাদের হত্যা করল। প্রশ্ন করে তিনিই আবার তার উত্তর দিয়েছেন। বললেন সেদিন হোটেলে যে ভাবে যে কারনে মরেছে, সে ধরনের ঘটনাই বোধহয় ঘটেছে। দেখলেই বোঝা যাবে। বাড়তি একথা টুকুই তিনি বলেছেন।’ যায়েদ বলল।
‘এ কথাটুকুই অনেক কথা যায়েদ। সাংবাদিক বুমেদীন বিল্লাহ দেখছি খুব বুদ্ধিমান। আমার বিশ্বাস ওখানকার সব কিছুই তার কাছে ধরা পড়ে যাবে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তাই যেন হয় ভাইয়া।’ বলে উঠল ফাতিমা ও যায়েদ দু’জনেই।
আহমদ মুসা আর কিছু বললনা। গাড়ির চেয়ারে গা এলিয়ে দিল ফাতিমা ও যায়েদ নিরব। আশায় উজ্জ্বল তাদের চারটি চোখ সামনে নিবদ্ধ।
ছুটে চলছে গাড়ি।