৩৫. নতুন গুলাগ

চ্যাপ্টার

আহমদ মুসা বসে আছে ড্রইংরুমে পুবের জানালার পাশে এক সোফায়।
আহমদ মুসাদের এ ফ্ল্যাটটি আট তলায়। বাড়িটা দাঁড়ানো একেবারে ঈল নদী তীর ঘেঁষে।
আহমদ মুসার দৃষ্টি জানালা দিয়ে বাইরে নিবদ্ধ। ঈল নদী পেরিয়ে সুন্দর রাইন উপত্যকার অনেকখানিই দেখা যায় এ জানালা দিয়ে। আহমদ মুসা চোখ বুলাচ্ছে রাইন উপত্যকার সবুজ বুকের উপর।
আহমদ মুসার চোখ দুটি রাইন উপত্যকার নরম সবুজের উপর নিবদ্ধ থাকলেও মন তার হারিয়ে গেছে ফেলে আসা এক অতীতের দিকে। তার দু’চোখে ভেসে উঠল রাইনের সবুজের অন্তরালে জমাট রক্তের এক সাগর। পৃথিবীর দুর্ভাগা যতগুলো ভুখন্ড আছে তার মধ্যে সুন্দর সবুজ এই রাইন উপত্যকাও একটি। ফ্রান্স-জার্মান আধিপত্যের লড়াই সবচেয়ে বেশি পীড়িত করেছে এই রাইন উপত্যকাকে। সপ্তম শতাব্দি শেষে এই উপত্যকা সম্রাট শার্লেম্যানের সম্রাজ্যের অংশে পরিণত হয়। শার্লেম্যানের উত্তরসুরীদের কাছ থেকে জার্মানি এই উপত্যকা কেড়ে নেয়। ১৫ শতক পর্যন্ত এখানে চলে জার্মানির আধিপত্য। পরে ফ্রান্স কেড়ে নেয় এই উপত্যকা জার্মানির কাছ থেকে এবং শুরু করে এখানে ফরাসীকরণ। বিশেষ করে ফরাসী বিপ্লবের পর এখানকার জনগণ এতটাই ফরাসী হয়ে যায় যে, অষ্টাদশ শতাব্দির শেষভাগে যখন এই উপত্যকা জার্মানি দখল করে নেয় এবং পাল্টা জার্মানিকরণ শুরু করে তখন এখানকার ৫০হাজার মানুষ ফ্রান্সে হিজরত করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ফ্রান্স রাইন উপত্যকার উপর তার অধিকার ফিরে পায়। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতেই জার্মানি এটা আবার দখল করে নেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই উপত্যকার উপর ফ্রান্সের আধিপত্য পুনঃ প্রতিষ্ঠত হয়। তার পর অর্ধ শতাব্দির বেশি কাল ধরে এখানে চলে ফ্রান্সের শাসন। আবার জার্মানরা এখানে ফিরে আসবে না এ গ্যারান্টি ইতিহাস দিতে পারেনা।
দুই আধিপত্যবাদী শক্তির মাঝে রাইন উপত্যকার মানুষ তৃতীয় শক্তি। কিন্তু তারা দূর্বল। দূর্বল বলেই তাদের স্বাতন্ত্র, স্বাধিকার ও স্ব-মতের কোন মূল্য নেই। এই দূর্বলতার কারণে সুন্দর এই রাইন উপত্যকার মানুষ শুধু নয়, তাদের মত শত শত জাতি-গোষ্ঠি আজ শক্তিমানদের দ্বারা পদদলিত হচ্ছে একইভাবে। স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্র, স্বাধীকার, মানবাধিকার সবই শক্তি নির্ভর। যাদের শক্তি আছে তাদের এসব নিশ্চিত থাকবে, আর যাদের তা নেই, এ অধিকার ভোগের অধিকার তাদের পদদলিত হচ্ছে। স্বাধীনতা, স্বাধীকার, মানবাধিকার, সন্ত্রাস এসব কিছুরই সংগা শক্তি নির্ভর হয়ে উঠেছে। শক্তিমানরা এসবের যে সংগা দেয় সেটাই হয়ে উঠে অনুসরণীয়। বার্মা’র সুচি’র আন্দোলন গনতন্ত্র, কিন্তু আলজিরিয়ার আব্বাস মাদানীর আন্দোলন তা নয়। সূচী পেল নোবেল পুরস্কার, আর আব্বাস মাদানী পেল জেল-দন্ড। পূর্ব তীমুরের আন্দোলন স্বাধীনতা সংগ্রাম, কিন্তু কাশ্মীর ও ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা সংগ্রাম অভিহিত হয়েছে সন্ত্রাস হিসেবে। এ সবের সংগায়নের ব্যাপারে জাতিসংঘের কিছু করনীয় নেই। জাতিসংঘ শক্তিমানরা গঠন করেছিল এবং তা শক্তিমানদের কথা শুনতেই বাধ্য। জাতিসংঘ আজ ভারবাহী গাধার মত। সে শুধু ভার বহনকারী, ভার নির্ধারণ, নিয়ন্ত্রণের কোন সুযোগ তার নেই। জাতিসংঘ ত্বরিত গিয়ে পূর্ব তীমুরের ভারটা গ্রহণ করেছিল, কিন্তু কাশ্মীর ও ফিলিস্তিন কিংবা চেচনিয়ার ভার সে গ্রহণ করতে পারেনি। এদিক থেক জাতিসংঘ কিছুটা সাম্প্রদায়িক হয়ে পড়তেও বাধ্য হয়েছে। যেমন ………..।
হঠাৎ আহমদ মুসার চিন্তায় ছেদ এসে পড়ল ফাতিমার কথায়। বলছিল ফাতিমা, ‘রাইন উপত্যকা নিয়ে এত গভীর ভাবে কি ভাবছেন ভাইয়া ?
এর আগেই ফাতিমা ও যায়েদ আহমদ মুসার সামনে এক সোফায় এসে পাশাপাশি বসে পড়েছিল।
দু’জনকেই সুনদর পোশাকে খুব ফ্রেশ লাগছিল। ফাতিমাকে ঐতিহ্যবাহী মুসলিম পরিপারের একজন গৃহবধু বলে মনে হচ্ছে। তার পরনে পা পর্যন্ত নেমে যাওয়া ঐতিহ্যবাহী ঘাগরা। গায়ে ফুলহাতা ঢিলা কামিজ। মাথার রুমালটা গলা পেঁচিয়ে কাঁধ ও বুক পর্যন্ত নেমে এসেছে।
আহমদ মুসা ফাতিমার কথা শুনে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে সামনের দিকে তাকাল। দু’জনের দিকে পলকের জন্য দৃষ্টি দিয়ে সোফায় গা এলিয়ে উপরের দিকে শুন্য দৃষ্টি তুলে ধরে বলল, ‘হ্যাঁ, ফাতিমা, আমি রাইন উপত্যকা নিয়েই ভাবছিলাম। তোমরা দু’আসামীই আমার সামনে হাজির। তোমরা জার্মান ও ফরাসীরা সুন্দর সবুজ অতি মনোহর এই রাইন উপত্যকাকে এবং তার মানুষদেরকে ফুটবল বানিয়েছ।
ফাতিমা ও যায়েদ দু’জনে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। ফাতিমা যায়েদের দিকে ইশারা করল উত্তর দেবার জন্য। কিন্তু যায়েদ ইশারা করল ফাতিমাকে উত্তর দেবার জন্য। ফাতিমা বলল, ভাইয়া আপনি জার্মান-ফরাসীদের দুষছেন কেন! ভূমি নিয়ে এমন লড়াই তো দুনিয়ার সব চেয়ে প্রাচীন ইতিহাস। কোন দেশ, কোন জাতি কি এই দোষ থেকে মুক্ত আছে?’
‘কিন্তু ছোট বিশেষ একটা ভুখন্ড নিয়ে এমন রক্তক্ষয়ী টাগ অব ওয়ার পৃথিবীর আর কোথাও নেই ফাতিমা।’ আহমদমুসা বলল।
‘কোন দুই দেশের সীমান্তে রাইন উপত্যকার মত এমন সুন্দর ও বিশেষ অবস্থানের ল্যান্ডও দুনিয়ার কোথাও নেই ভাইয়া। পাহাড়ের দেয়াল একে বিচ্ছিন্ন করেছে ফ্রান্স থেকে, আবার রাইনের মত
আন্তর্জাতিক নদী একে বিচ্ছিন্ন করেছে জার্মান থেকে। দুই দেশই এই ন্যাচারাল ব্যারিয়ারের অজুহাত তুলে এলাকাটা দখলে রাখতে চায়। নিশ্চয় এ বিষয়গুলো বিশেষ বিবেচনার বিষয় ভাইয়া।’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘তার মানে সংগত কারনেই আধিপত্ত্যের এ লড়াই চলতেই থাকবে?’
হাসল ফাতিমা। বলল, ‘আমরা তা চাইনা। চাইনা বলেই তো জার্মান এবং ফ্রান্স এক হয়ে গেছি।’
আহমদ মুসা ও যায়েদ দু’জনেই এক সংগে হেসে উঠল।
আহমদ মুসা কিছু বলতে যাচ্ছিল।
বাধা দিয়ে ফাতিমা বলে উঠল, ‘এ নিয়ে আর কথা নয়। বলুন, ওদের নতুন গুলাগ ‘সাও তোরাহ’ নিয়ে আর কি ভাবছেন।
আবার সোফায় হেলান দিয়ে বসল আহমদ মুসা। গম্ভীর হয়ে উঠল তার মুখ। সংগে সংগেই কোন উত্তর দিল না। পরে ধীরে ধীরে বলল, ‘ভেবেছি, কিন্তু ভেবে কোন কুল পাইনি। আমরা শুধু দ্বীপটার নামটাই জানতে পেরেছি, আর কিছু নয়। এবং আমি নিশ্চিত এই নামটা আসল নয়।’
‘সর্বনাশ নামটাও যদি নকল হয় তাহলে? বলল ফাতিমা। কন্ঠ তার আর্তনাদের মত শোনাল।
‘দ্বীপটাকে কিভাবে চেনা যাবে, এটাই এখন প্রধান সমস্যা আমাদের কাছে। সে জন্যই আমি চেয়েছিলাম ওদের কাউকে জীবন্ত ধরতে। কিন্তু পারলাম না।’ আহমদ মুসা বলল।
‘চেষ্টা তো সেদিন করেছিলেন। আচ্ছা আপনি যদি ও দু’জনকে গুলি না করতেন, তাহলে কি ঘটত? ওরা কি গুলি করত?
যায়েদ ‘কি ঘটত আমি জানিনা। তবে ওদের প্রথম গুলি করা থেকে বুঝা যায়, ওদের মারতে না পারলে ওদের হাতে আমাদের মরতে হতো।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আরেকটা বিকল্প হয়তো ছিল। সেটা হলো অস্ত্র ফেলে দিয়ে ওদের কাছে আত্মসমর্পন করা। যা হতো আমাদের জন্য মৃত্যুর চেয়েও ভয়ংকর।’ যায়েদ বলল।
হ্যাঁ, এটাও বিকল্প হতে পারতো।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আল্লাহ আমাদের বাঁচিয়েছেন। আমার বিস্ময় এখনো কাটেনি ভাইয়া, আপনি বুঝলেন কি করে যে, আপনাকে শুয়ে পড়ে গুলী করতে হবে?’ বলল ফাতিমা।
‘ওরা আগেই আমাদের দিকে রিভলবার তাক করেছিল। আমরা রিভলবার ওদের দিকে তুলতে গেলেই ওদের গুলী খেতে হতো। মাটিতে নিজেকে ছিটকে দিয়েছিলাম ওদের চোখের আড়ালে রিভলবার তাক করার সুযোগ নেয়া এবং যদি ওরা গুলী করে বসে তাও এড়াতে পারার জন্য।’
‘ধন্যবাদ ভাইয়া। আপনার দু’লক্ষ্যই অর্জিত হয়েছিল।’ বলল যায়েদ।
‘আল্লাহ সাহায্য করেছেন।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আলহামদুলিল্লাহ।’ বলে একটু দম নিয়েই ফাতিমা আবার বলে উঠল, ‘আগের কথায় ফিরে আসি ভাইয়া।’ সাও তোরাহে’র সন্ধান করার জন্য আপনি এখন কি চিন্তা করছেন।
‘চিন্তা করে কোন কিনারায় পৌঁছাতে পারিনি আমি। নানাভাবে বিষয়টা নিয়ে ভাবছি। দ্বীপটার নামের দু’টি শব্দআছে একটি ‘সাও’ অন্যটি ‘তোরাহ’। এর মধ্যে ‘সাও’ ল্যাটিনীয় স্প্যানেশ। আর ‘তোরাহ’ শব্দ ওল্ড টেস্টামেন্টের। শব্দ-প্রকৃতির বিচার থেকে আমি মনে করি, দ্বীপটা মিড-উত্তর আটলান্টিকের পূর্বাংশে অথবা মিড-দক্ষিণ আটলান্টিকের মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার ল্যাটিন এলাকার কোথাও হবে।’
ফাতিমা ও যায়েদ তাকিয়েছিল আহমদ মুসার মুখের দিকে।
তাদের চোখে-মুখে বিস্ময়। কিছু বলতে যচ্ছিল যায়েদ। এ সময় দরজায় নক হলো। ওঠে দিয়ে দরজা খুলল যায়েদ।
নিচ থেকে বেয়ারা আজকের কয়েকটি কাগজ নিয়ে এসেছে।
দরজা বন্ধ করতে করতে যায়েদ উপরে যে কাগজটা আছে তার দিকে নজর বুলাচ্ছিল।
নজর বুলিয়েই চিৎকার করে উঠল যায়েদ। বলল, ‘সেদিনের ঘটনাকে লা-মন্ডে লিড আইটেম করেছে ভাইয়া।’
বলে দরজা বন্ধ করে ছুটে এল যায়েদ। কাগজটা আহমদ মুসার হাতে দিল।
আহমদ মুসা কাগজ হাতে নিয়ে তাকাল হেডিংটার উপর। পড়ল হেডিংটাঃ
‘ঘটনার চাঞ্চল্যকর মোর, স্পুটনিক ধ্বংসের সাথে জড়িতদের আরও ১৪ জন নিহত ও কম্পিউটার থেকে পুলিশ কর্তৃক মূল্যবান দলিল উদ্ধার।’
হেডিংটা পড়েই চোখ দু’টি উজ্জ্বল হয়ে উঠল আহমদ মুসার। চোখ বুলাল ক্রেডিট লাইনের উপর। দেখল লেখা আছে ‘ষ্ট্রাসবার্গ থেকে বুমেদিন বিল্লাহ।’ আরও খুশি হয়ে উঠল আহমদ মুসা বুমেদিন বিল্লাহর নাম দেখে। সে নাম গোপন করেনি। সাহস আছে তার।
যায়েদ ও ফাতিমা তখন আন্য পত্রিকায় নজর বুলাচ্ছিল। যায়েদ বলে উঠল, প্যারিসের আর মাত্র দু’টি পত্রিকা এবং ষ্ট্রাসবার্গের একটি পত্রিকা সিংগল কলামে নিউজটি দিয়েছে। বলছে, অজ্ঞাতনামা আততায়ীর গুলিতে ১৪ জন অজ্ঞাত নামা নিহত।’
‘লা-মন্ডেই যথেষ্ট যায়েদ। আল্লাহর শুকরিয়া, লা-মন্ডে বিস্ময়কর ভাবে ইহুদী চাপ উপেক্ষা করেছে। আমি………।’
আহমদ মুসার কথার মাঝখানেই যায়েদ বলে উঠল, ‘এর কারণ আছে ভাইয়া। অতি-সম্প্রতি লা-মন্ডে দ্য গলপন্থীদের হাতে এসেছে।
এর সম্পাদকও নিযুক্ত হয়েছে একজন ন্যাশনালিষ্ট।’
‘ও, কারণ তাহলে এটাই।’ বলে আহমদ মুসা তার হাতের লা-মন্ডেটি যায়েদের দিকে তুলে ধরে বলল, ‘যায়েদ পড় নিউজটা। কি লিখেছে দেখা যাক।’
যায়েদ হাতে নিল কাগজটা।
সে আবার কাগজটা ফাতিমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘পড় না, পড়ায় তুমি খুব ভাল।’
‘তোমাদের ফরাসী তুমিই পড়।’ বলল ফাতিমা।
‘ভাইয়া দেখুন, অল্পক্ষণ আগেও বলছে আমরা জার্মান-ফরাসী এক হয়ে গেছি। আর এখন কি বলছে শুনুন।’ যায়েদ বলল।
ফাতিমা হাসল। যায়েদের মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বলে উঠল, ‘ভাইয় কথা সে অন্য দিকে ঘুরিয়ে নিচ্ছে। আমি ভাষার কথা বলছি। আর প্রত্যেক জাতির জন্যে তার ভাষা আল্লাহর দান।’
‘আচ্ছা, তোমাদের ঝগড়ার ফয়সালা পরে করব। এবার খবরটা পড়। লা-মন্ডে তোমাদের কাগজ যায়েদ, তুামই এটা পড়বে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমিও ভাইয়াকে সমর্থন করছি।’ বলল ফাতিমা মুখ টিপে হেসে।
‘ভোট তুমি না দিলেও আমি পড়ছি।’ বলে যায়েদ কাগজ গুছিয়ে নিয়ে সামনে ধরল এবং পড়তে শুরু করলঃ
‘স্ট্রাসবার্গ থেকে বুমেদিন বিল্লাহ্। গত পরশু গভীর রাতে স্ট্রাসবার্গের শার্লেম্যান রোডের ৫নং বাড়ি থেকে পুলিশ স্পুটনিক ধ্বংসের সাথে জড়িত বলে কথিত ১৪ জনের লাশ উদ্ধার করেছে। সেই বাড়িটির তৃতীয় তলায় তাদের অফিস কম্পিউটার থেকেমূল্যবান দলীল দস্তাবেজ ও উদ্ধার করেছে পুলিশ। এই উদ্ধারের কাজের সময় লা-মন্ডের এই রিপোর্টারও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। ১৪ জনের মধ্যে ১২ জনের লাশ পাওয়া যায় ভূগর্ভস্থ একটি কক্ষ। আর বার জনের মধ্যে ১১ জনের কাছেই একটি করে ষ্টেনগান পাওয়াগেছে, অবশিষ্ট একজনের কাছে পাওয়া গেছে একটি রিভলবার।
কক্ষটিকে বন্দিখানা বলে সন্দেহ করা হয়েছে। ঘরে একটা সিংগেল খাট দেখা গেছে এবং খাটের উপর পাওয়া গেছে একটি হ্যান্ডকাফ। হ্যান্ডকাফের তালা ল্যাসার বীম দিয়ে পুড়িয়ে ফেলা। পুলিশ মনে করছে একজন লোককে এখানে বন্দী করে রাখা হয়েছিল। সেই বন্দী হ্যান্ডকাফের তালা গলিয়ে মুক্ত হয় এবং ঘরে প্রবেশকারী ১২ জনকে তাদেরই ষ্টেনগান দিয়ে হত্যা করে পালাতে সমর্থ হয়।
উল্লেখ্য, ক’দিন আগে হোটেল রাইন ইন্টারন্যাশনালের একটি কক্ষে দু’জনের লাশ পাওয়া যায়। তারাও কক্ষের বাসিন্দাকে হত্যা বা কিডন্যাপ করতে গিয়ে নিহত হয় বলে পুলিশ নিশ্চত হয়েছে। এরা দু’জন এবং উপরোক্ত চৌদ্দজন একই দলের বলে পুলিশ নিশ্চিত ভাবে মনে করছে। তাদের সকলেরই কলার ব্যান্ডে একই ধরনের ইনসিগনিয়া পাওয়া গেছে।
শার্লেম্যান রোডের ৫ নং বাড়িতে অবশিষ্ট ২ জনের লাশ পাওয়া যায় নীচের এক করিডোরে। পুলিশ মনে করছে বন্দী পালাবার সময় এ দু’জনকে হত্যা করে। এ দু’জনের হাতেও একটি করে রিভলবার পাওয়া গেছে।
নিহতদের সব অস্ত্রই লাইসেন্স বিহীন অবৈধ বলে পুলিশ উল্লেখ করেছে।
তিন তলার অফিস কক্ষ কম্পিউটারে যে দলিল দস্তাবেজ পাওয়া গেছে তার মধ্যে স্পুটনিক ধ্বংসের ব্লু- প্রিন্টও রয়েছে। পুলিশ তাদের তদন্তের স্বার্থে এ ব্লু-প্রিন্টের বিবরণ সম্পর্কিত কোন কিছু জানাতে রাজী হয়নি। তবে পুলিশ বলছে, নিছক ঐ ব্লু-প্রিন্ট দিয়ে সংশ্লিষ্ট দল বা ব্যাক্তিকে চিহ্নিত করা মুস্কিল।
নিহতদের সূত্র ধরে ক্রিমিনাল দলটির সন্ধান করা যায় কিনা এ সম্পর্কিত প্রশ্নের জবাবে পুলিশ বলেছে তারা তা চেষ্টা শুরু করেছে।
ক্রিমিনাল দলটির পরিচয় সম্পর্কে পুলিশ বলতে না পারলেও ইনসিগনিয়ার বৈশিষ্টের প্রতি ইংগিত করে ওয়াকিফহাল মহল বলেনে, কোন ইহুদী সংগঠন স্পুটনিক ধ্বংসের ঘটনার সাথে জড়িত।
ক্রিমিনাল এই ইহুদী সংগঠনটির সাথে কাদের সংঘাত বেধেছে, যাকে সেদিন তারা হেটেলে মারতে বা ধরতে গিয়েছিল তার পরিচয় কি এবং কাকে তারা শার্লেম্যান রোডের ৫ নাম্বার বাড়িতে বন্দী করেছিল, সে সম্পর্কে পুলিশ এবং পর্যবেক্ষক মহল কিছুই বলতে পারছে না। তবে তাদের মতে পুলিশের তদন্ত আগাতে ব্যার্থ হওয়ার পটভুমিতে প্রতিকার ও সাত গোয়েন্দাকে উদ্ধারের জন্যে কোন তৃতীয় পক্ষ এগিয়ে এসেছে কিংবা স্পুটনিক পরিবাররা এই তৃতীয় পক্ষকে নিয়োগ করেছে। অবশ্য কয়েকটি স্পুটনিক পরিবারের সাথে এই প্রশ্ন নিয়ে যোগাযোগ করা হলে তারা এধরনের কোন পদক্ষেপের চিন্তাই করেনি বলে জানিয়েছে।
এই তৃতীয় পক্ষের পরিচয় সম্পর্কে হোটেল রাইনে আক্রান্ত ব্যাক্তিটি আসল কথা জানতে পারেন বলে মনে করা হচ্ছে। কিন্তু জিজ্ঞাসাবাদের জন্য লোকটিকে খুঁজে পাওয়া যায় নি। লোকটি হোটিল থেকে চলে গেছেন এবং গা ঢাকা দিয়েছে। ক্রিমিনাল দলটির ভয়ে এবং তাদের আক্রমন থেকে আত্মরক্ষার জন্যই লোকটা এটা করেছে বলে পুলিশও মনে করেছে। তবে তাকে পুলিশের এখন খুব বেশি প্রয়োজন।
স্পুটনিক ধ্বংস থেকে শুরু করে গত পরশু রাত পর্যন্ত সংঘটিত ঘটনা দেশের সচেতন ও শান্তিকামী মানুষকে ভাবিয়ে তুলেছে। কোন ইহুদী সংগঠন যদি স্পুটনিক ধ্বংস ও সাত গোয়েন্দাকে অপহরনের সাথে জড়িত থাকে, তাহলে প্রশ্ন ওঠে এ ইইহুদী সংগঠন স্পুটনিকের বিরুদ্ধে খড়গহস্ত হওয়ার কারণ কি? উল্লেখ্য, সাত গেয়েন্দার স্পুটনিক সংস্থা নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ার ধ্বংস সম্পর্কে নতুন করে তদন্ত শুরু ও কিছু দলিল হাত করার পরেই তাদের উপর ধ্বংসও বিপর্যয় নেমে আসে।’
পড়া শেষ করেই কাগজটা টি টেবিলে রাখতে রাখতে বলল যায়েদ, ‘ভাইয়া পুলিশ আপনার খোঁজ করছে বন্ধু হিসাবে না শত্রু হিসাবে?
‘আমি কে? ইহুদী সংগঠনটির সাথে যাদের সংঘাত বেঁধেছে, তাদের পরিচয় জানার জন্য আমাকে তাদের প্রয়োজন। শুরুটা ওদের বন্ধুত্বপূর্ন হলেও পরে বন্ধু থাকবে বলে আমি মনে করিনা।’
‘কেন থাকবে না? আপনার দেয়া তথ্য ও আপনার কাজ তো পুলিশের তদন্তে বাড়তি শক্তি যোগাবে।’ বলল, যায়েদ।
‘আমরা হোটেল থেকে কেন তাড়িঘড়ি চলে এলাম, এত তাড়াতাড়ি ভূলে গেছ? পুলিশের একটা গ্রুপ উর্ধ্বতন পুলিশের নির্দেশে আমাকে আন অফিসিয়ালী গ্রেপ্তার করে ঐ ইহুদী সংগঠনের হাতে তুলে দেবে, এটা জানতে পেরেই তো চলে এসেছি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘বুঝেছি ভাইয়া।’ বলল যায়েদ।
‘পুলিশ যে আন্তরিক নয়, লা-মন্ডের এ রিপোর্ট থেকেও তা বুঝা যাচ্ছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কি থেকে বুঝা গেল ভাইয়া?’ বলল ফাতিমা।
‘কম্পিউটারে স্পুটনিক ধবংসের যে ব্লু প্রিন্ট ছিল তার কিছুই পুলিশ জানায় নি। উপরন্তু বলেছে, নিছক ঐ ব্লু প্রিন্ট থেকে সংশ্লিষ্ট দল বা ব্যাক্তিকে চিহ্নিত করা যাবে না। এর অর্থ ব্লু প্রিন্টটিকে অকেজ একটা দলিল হিসাবে কোল্ড স্টোরেজে ঠেলে দিতে পারে। সব চেয়ে বড় কথা হলো ক্রিমিনালরা নিজেরাই যাকে নতুন গুলাগ হিসাবে অভিহিত করেছে, সেই ‘সাও তোরাহ’ দ্বীপের মানচিত্রটি নিউজে নেই। পুলিশরা সাংবাদিকের কাছ থেকে বিষয়টা একদম গোপন করে ফেলেছে। কোন দিনেই হয়তো সাংবাদিকরা বা বাইরের দুনিয়া পুলিশের কাছ থেকে ‘সাও তোরাহে’র কথা আর জানতে পারবে না।’ আহমদ মুসা বলল।
আহমদ মুসা থামল ও সংগে সংগে কোন কথা বলল না ফাতিমা ও যায়েদ। তাদের চোখ-মুখে ভাবনা ও হতাশার চিহ্ন।
একটু পরে ফাতিমা হতাশা জড়িত কন্ঠে বলল, ‘আমরা পুলিশের ভুমিকায় এ ব্যাখ্যা করতে পারি যে, ‘পুলিশ তদন্তের স্বার্থেই এটা প্রকাশ করে নি। সাও তোরাহ দ্বীপের মানচিত্র পুলিশের হাতে পড়েছে জানলে ক্রিমিনালরা সাবধান হয়ে যাবে এবং দ্বীপ থেকে সব কিছু তারা অন্যত্র সরিয়ে ফেলবে।’
আহমদ মুসা হাসল।বলল, ‘এ যুক্তি খাটেনা ফাতিমা। কম্পিউটার পুলিশের হাতে পড়ার পর ওরা নিশ্চিত হয়েছে, সাও তোরাহের মানচিত্রও পুলিশ পেয়ে গেছে। বিশেষ করে স্পুটনিক ধ্বংসের ব্লু প্রিন্টটা পুলিশ যখন পেয়েছে, এটা ক্রিমিনালরা বুঝতে মুহুর্তও দেরি হবার কথা নয়।’
‘ধন্যবাদ ভাইয়া। আপনি ঠিক বলেছেন। তা হলে ব্যাপারটা এই দাঁড়াচ্ছে যে, পুলিশের কোন সহযোগিতা আমরা পাচ্ছি না।’ বলল ফাতিমা হতাশ কন্ঠে।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, একটা সহযোগিতা আমরা পেলাম।
‘কি সেটা? ত্বড়িত কন্ঠে প্রশ্ন করল যায়েদ।
‘পুলিশ দলিলগুলো প্রকাশ না করায় এবং ক্রিমিনালদের সাথে আঁতাত করায় আমরা এখন নিশ্চিত হতে পারছি যে, ক্রিমিনালদের নতুন গুলাগ ‘সাও তোরাহ’ দ্বীপেই থাকছে। পুলিশ ক্রিমিনালদের সাথে যোগসাজোশে না গিয়ে মানচিত্রসহ দলিল প্রকাশ করলে, ফাতিমা যেটা বলেছে, ক্রিমিনালরা সাবধান হতো এবং সাও তোরাহ থেকে সব কিছু সরিয়ে নিত। তাতে আমরা যে টুকু এগিয়ে ছিলাম, সে টুকু পিছিয়ে পড়তাম।’ আহমদ মুসা থামল।
আহমদ মুসা থামতেই ফাতিমা ও যায়েদ আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠল। ফাতিমা বলল, ‘তাহলে আজকের নিউজের এটাই একমাত্র লাভ ভাইয়া।’
‘না, আরও লাভ।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আরও লাভটা কি?’ জিজ্ঞাসা যায়েদের।
‘এই নিউজটা প্রথম বারের মত এ কথা সামনে নিয়ে এল যে, স্পুটনিক ধ্বংস ও সাত গোয়েন্দাকে অপহরণের কাজ ইহুদী একটা ক্রিমিনাল সংগঠন করেছে। নিউজটি আরেকটি বড় বিষয় সামনে নিয়ে এসেছে সেটা হলো, নিউইয়র্কের টুইনটাওয়ার ধ্বংসের সাথে ক্রিমিনাল ইহুদী সংগঠনটি জড়িত থাকতে পারে। তা না হলে টুইন টাওয়ারের ঘটনার উপর নতুন ভাবে তদন্তকারী স্পটনিকের উপর ক্রিমিনাল ইহুদী সংগঠনটি খড়গহস্ত হলো কেন? নিউজটি স্পুটনিকের তদন্ত কাজে পুলিশের ব্যার্থতাকেও তুলে ধরেছে এবং বলেছে যে, প্রতিকার ও সাত গোয়েন্দাকে উদ্ধারের জন্য অবশেষে তৃতীয় একটি পক্ষ কাজে নেমেছে। এই তৃতীয় পক্ষকে ধ্বংসের জন্যও ইহুদী ক্রিমিনাল সংগঠনটি উঠে পড়েলে গেছে এবং এর খেসারত হিসাবে সংগঠনটির এপর্যন্ত কম পক্ষে ষোল জনকে বলী হতে হয়েছে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কিন্তু নিউজটা সবচেয়ে বড় খবর তৃতীয় পক্ষ হিসাবে স্বয়ং আহমদ মুসা আবির্ভূত একথা বলতে পারেনি।’ বলল ফাতিমা। তার মুখে আনন্দের হাসি।
‘রিপোর্টারকে এ জন্য ধন্যবাদ ফাতিমা।’ হেসে উঠে বলল যায়েদ।
ফাতিমা হাসিতে যোগ দিল না। হঠাৎ গম্ভীর হয়ে উঠল সে। বলল, ‘স্যরি ভাইয়া। হালকা চিন্তার সময় এটা নয়। পুলিশের সাহায্য আমরা পাচ্ছি না। আপনি কার্যতঃ একা। কি ভাবছেন ভাইয়া?
‘সত্যি নিউজটা আমাদের উপকার করেছে। পুলিশের যোগসাজস অন্তত একটি ক্ষেত্রে আমাদের ‘শাপেবর’ হয়েছে। বলে আহমদ মুসা সোফায় গা এলিয়ে দিল। গম্ভীর হয়ে উঠল তার মুখ। মুহুর্ত কয়েক নিরব থাকার পর সে ধীরে ধীরে বলতে শুরু করল, কোন ভাবনার কথা বলব ফাতিমা। শেষ নেই। আমাদের সামনে দীর্ঘ পথ। স্পুটনিকের সাত নেতাকে উদ্ধার করতে হবে, তারপর আসবে
স্পুটনিক মিশন সফল করার কাজ করবে। এই পথের গোটাটাই আজ অন্ধকারে।’
ফাতিমার দুই চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, ‘ভাইয়া স্পুটনিকের মিশন’ মানে নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ার ধ্বংসের তদন্তের দায়িত্ব আপনি নেবে?
‘দায়িত্ব তো স্পুটনিক নিয়েছে্ স্পুটনিককে সাহায্য করতে পারলে আমি খুশি হবো। আর এটা এমন একটা কাজ যার সাথে বিশ্বের প্রতিটি মুসলমানের স্বার্থ আজ জড়িত আছে। মুসলমানদের মাথা থেকে পুরানো একটা কলংকের বোঝা নামাতে হলে যে সত্য মিথ্যার স্তুপে ঢাকা পড়েছে তাকে উদ্ধার করতে হবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘এত দিন পর সত্যটা আসলেই উদ্ধার করা যাবে? আপনিও অনেক দিন আমেরিকা ছিলেন, তখন কিছু কি ভেবেছিলেন? জিজ্ঞেস করল যায়েদ।
‘উদ্ধার করা যাবে না কেন? আমি শুনেছি, স্পুটনিক অনেক এগিয়েছিল। তাছাড়া এখন এ ব্যাপারে মার্কিন সরকারের সহযোগিতা পাওয়া যাবে। তোমরা জান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এখন দাবার ছক পাল্টে গেছে। ‘ধরাকে সরা’ জ্ঞান কারী জেনারেল শ্যারণ সেখানে আজ বন্দী এবং বিচারের সম্মুখিন।’
বলে একটু থামল আহমদ মুসা। তারপর আবার বলা শুরু করল, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থাকার সময় ডেমোক্রাসি টাওয়ার’ ও ‘লিবার্টি টাওয়ার’ বিষয় নিয়ে ভাবার আমার সুযোগ হয়নি। আমি আনন্দিত যে, স্পুটনিক গুরুত্বপূর্ণ কাজটা শুরু করেছে।’
বলতে বলতে আহমদ মুসা সোজা হয়ে বসল। বলল, ‘স্পুটনিকের সাত নেতা উদ্ধার হলে এ বিষয়ে কাজ করার সময় আসবে, এখন নয়। এখন তাদের উদ্ধারই আমাদের সামনে একমাত্র বিষয়।’
‘ঠিক ভাইয়া, ‘সাও তোরাহ’ দ্বীপ কোথায়, এ প্রশ্নটাই এখন সব চেয়ে বড়।’ বলল যায়েদ।
‘ভাইয়া আমরা আগামী কাল কামাল সুলাইমান ভাইয়ার বাসায় যাচ্ছি। লতিফা ভাবী কিন্তু একজন ভুগোলবিদ। তার সাথে ‘সাও তোরাহ’ নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে।’ ফাতিমা বলল।
‘উনি কি কোথাও অধ্যাপনা করেন? জিজ্ঞেস করল আহসদ মুসা।
‘হ্যাঁ উনি স্ট্রসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের একজন শিক্ষক।’ বলল ফাতিমা।
খুশি হলো আহমদ মুসা। বলল, ভালই হলো, দেখা যাক তিনি কোন আলো দেখাতে পারেন কিনা।’
বলতে বলতে উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা।
‘আপনি কোথাও যাবেন ভাইয়া?’ জিজ্ঞাসা করল যায়েদ।
‘হ্যাঁ, আমি একটু বেরুচ্ছি।’ বলে ওদের সামনে দিয়ে আহমদ মুসা তার কক্ষের দিকে হাঁটা শুরু করল।
‘ভাই সাহেব, আমাদের পরিবারে গত কয়েক জেনারেশনের মধ্যে মোস্তফা কামাল একজনই হয়েছেন। মোস্তফা কামালের জন্ম আর হয়নি। অতএব ইসলাম সম্পর্কে মোস্তফা কামালের বিশেষ দৃষ্টিভংগি আমাদের পরিবারের আর কারও মধ্যেই আর দেখা যায় নি। বরং ইতিহাস হলো, আমাদের পরিবারের তৃতীয় জেনারেশনের যিনি তুরস্ক ছেড়ে জার্মানীতে এসে স্থায়ী বসতি গড়েন, তিনি চেয়ে ছিলেন মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের স্মৃতি ঘেরা পরিবেশ থেকে দূরে সরে আসতে। তিনি বলতেন, তার পূর্বপুরুষ মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক নিজের মত করে একটি জাতি গড়তে গিয়ে যা করেছেন, সে স্মৃতি একটি সুন্দর ও সুস্থ পরিবারের জন্য দুঃসহ। এই দুঃসহ স্মৃতির হাত থেকে বাঁচার জন্যই তিনি জার্মানীতে হিজরত করেন।’
আহমদ মুসার এক জিজ্ঞাসার জবাবে কথাগুলো বলছিলো লতিফা কামাল। স্পুটনিকের প্রধান গোয়েন্দা ও প্রধান পরিচালক কামাল সুলাইমানের স্ত্রী সে।
আহমদ মুসার সামনের এক সোফায় বসে কথা বলছিলো লতিফা কামাল। মোস্তফা কামাল তুর্কি মহিলাদের ইংরেজী পোশাক পড়িয়ে ছিলেন। মাথা থেকে খুলে ফেলেছিলেন রুমাল এবং নামিয়ে দিয়েছিলেন গা থেকে চাদর। কিন্তু মোস্তফা কামাল পরিবারের সদস্য লতিফা কামালের পরনে তুরস্কের ঐতিহ্যবাহী মুসলিম গৃহবধুর পোশাক।
লতিফা কামালের পাশে বসেছে ফাতিমা কামাল। আর আহমদ মুসার পাশের সোফায় বসেছে যায়েদ।
এটা লতিফা কামাল ও কামাল সুলাইমানের বাড়ি। স্বামী কামাল সুলাইমান কিডন্যাপ হবার পর লতিফা কামালের বাপ-মা এবং মাঝে মাঝে ভাইরা এসে থাকছে এখানে।
লতিফা থামতেই আহমদ মুসা বলল, বোন মিসেস কামাল, ‘বড় আনন্দের খবর দিলেন আপনি। ধন্যবাদ আপনাকে। এ থেকে আবারও প্রমাণিত হলো, সব কিছু মূলের দিকেই ফেরে।’
‘মোস্তফা কামালের পরিবার মূলের দিকে ফিরেছে। তবে মোস্তফা কামালের দেশ কিন্তু এখনও মূলের দিকে ফিরতে পারেনি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘অধিকাংশ মানুষ মূলের দিকে ফিরছে, কিন্তু অধিকাংশ নেতা মূলের দিকে ফেরেননি ভাইয়া।’ বলল ফাতিমা।
‘ফাতিমা ঠিক বলেছে ভাই সাহেব।’ লতিফা কামাল বলল আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে। ‘হ্যাঁ মিসেস কামাল, ফাতিমা ঠিকই বলেছে। তবে আমার মতে নেতারা বড় বাধা নয়, বাধা সেখানকার কামালীয় সংবিধান। গণতন্ত্রে জনতা জননেতাদের গড়ে নিতে পারে, কিন্তু সেখানকার সংবিধান জনতার ধরা-ছোঁয়ার উর্ধে বলল আহমদ মুসা।
হাসি ফুটে উঠল লতিফা কামালের মুখে। বলল, ‘ভুলেই গিয়েছিলাম যে আপনি আহমদ মুসা। ফাতিমা ও আমাদের জানা এবং আপনার জানার মধ্যে যোজন পার্থক্য। আপনি যেটা বলেছেন, সেটাই ঠিক। সংবিধানই আসল বাধা।
বলে একটু থামল লতিফা কামাল। মুহুর্তের জন্যে মাথাটা নীচু করল। তার চোখে মুখে ফুটে উঠল গাম্ভীর্য। আহমদ মুসার দিকে চোখ তুলে সে বলল, ‘কামাল সুলাইমান প্রায়ই বলত, , আমাদের দেশ ছাড়া হওয়াটা আমাদের পারিবারিক পাপের একটা প্রায়শ্চিত্ত। মোস্তফা কামাল যে ইউরোপীয় হতে চেয়ে ছিলেন, তার পরিবার আজ সে ইউরোপীয় হয়েছে। কিন্তু এতেই আমাদের প্রয়শ্চিত্ত হয়েছে বলে কামাল সুলাইমান মনে করতেন না। বলতেন, আমাদের পরিবারকে আরও মূল্য দিতে হবে। স্পুটনিকের ঘটনা, তিনি নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা তার কথিত সেই মূল্য কিনা কে জানে।’
থামল লতিফা কামাল। চাঁপা কান্নায় তার কন্ঠ প্রায় রুদ্ধ হয়ে উঠেছিল। হঠাৎই ড্রইংরুমের পরিবেশ ভারী হয়ে উঠল। বেদনার ছায়া নেমে এল উপস্থিত সবার মুখে।
নেমে এসেছিল এক নিরবতাও।
নিরবতা ভাঙল আহমদ মুসা। বলল, আমি কামাল সুলাইমানের সাথে একমত নই। আল্লাহ একের পাপে অন্যকে শাস্তি দেন না। আর কামাল পরিবারের জার্মানিতে হিজরত আল্লাহর শাস্তি নয় পুরুস্কার। আল্লাহ কামাল পরিবারের কাছ থেকে ইউরোপের মাটিতে ইসলামের পক্ষে খেদমত নিতে চান। সেই খেদমত কামাল পরিবার করছে।
স্পুটনিক তারই একটা অমর দৃষ্টান্ত। স্পুটনিকে যা ঘটেছে, কামাল সুলাইমানের যা ঘটেছে তা আদর্শের সৈনিকের জন্য একটা স্বাভাবিক ঘটনা। এ ঘটনা প্রমাণ করেছে অন্যান্যদের সাথে কামাল পরিবাকেও আল্লাহ কবুল করেছেন।’
লতিফা কামাল চোখ মুছে বলল, ‘ধন্যবাদ ভাই সাহেব। আপনার মত বুঝ আল্লাহ আমাদের দান করুন। কামালের দুর্ভাগ্য যে সে আপনার দেখা পেলনা।’
‘দোয়া করুন ভাবী, এ ভাইয়ার সাথে কামাল ভাইয়ার দেখা হবে।
ভাইয়া তো তাঁদের জন্যেই ফ্রান্সে এসেছেন ভাবী।’
‘আল্লাহ সাহায্য করুন। তোমাদের কাছে যেদিন আমি ভাই সাহেবের কথা শুনেছি, সেদিন গত কয়েক সপ্তাহের মধ্যে প্রথমবারের মত বুকটা আমি হাল্কা অনুভব করেছি, বুক ভরে আমি নিঃশ্বাস নিতে পেরেছি। মনে হয়েছে, আল্লাহ তাঁর বিশেষ দয়ার দৃষ্টি আমাদের উপর দিয়েছেন।’ বলল আবেগ–কম্পিত কন্ঠে লতিফা কামাল।
‘ভাবী আপনার একটা সাহায্য আমাদের প্রয়োজন।’ বলল ফাতিমা।
‘সাহায্যের কথা বলছ কেন? বল কি কাজ আমাকে করতে হবে?’
বলল লতিফা কামাল। তখনও ভারী তার কন্ঠস্বর।
লতিফা থামতেই কথা বলে উঠল আহমদ মুসা। ‘আমরা একটা দ্বীপের সন্ধান করছি, যে দ্বীপে কামাল সুলাইমানরা বন্দী থাকতে পারেন বলে সন্দেহ।’
‘দ্বীপের নাম কি? উদগ্রীব কন্ঠে বলল লতিফা কামাল।
‘সাও তোরাহ।’ আহমদ মুসা বলল।
‘সাও তোরাহ’ নামটি মুখে উচ্চারণ করে ভাবল কিছুক্ষণ লতিফা কামাল। তারপর বলল, ‘এই ধরনের কোন দ্বীপ আছে বলে আমি জানি না। এটা কোন ছদ্মনাম হবে।’
আহমদ মুসা পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে সেটা লতিফা কামালের দিকে মেলে ধরে বলল, ‘এটা দ্বীপটার আকার। আকার দেখে কোন আন্দাজ করতে পারেন কিনা দেখুন।’
লতিফা কামাল কাগজটি কিছুক্ষণ হাতে দেখে বলল, ‘স্যরি, আমার এবিদ্যা নেই ভাই সাহেব। ‘সমুদ্র পৃষ্ট ও দ্বীপত্তত্ব বিষয়ে যারা পড়া শুনা করেছেন, তাদের পক্ষেই শুধু এব্যাপারে কিছু বলা সম্ভব।’
এই সময় কলিংবেল বেজে উঠল টেবিলে রাখা কলিং বক্স থেকে।
লতিফা কামাল ‘এক্সকিউজ মি’ বলে কলিং বক্সটা টেনে সামনে নিয়ে একটা সুইচ অন করে বলল, ‘মিসেস কামাল বলছি, কে আপনি দয়া করে বলুন’
ওপারের কথা শুনল লতিফা কামাল। শুনেই প্রবল একটা বিব্রতভাব ফুটে উঠল তার চোখ মুখে। বলল সে ওপারের লোককে উদ্দেশ্য করে, ‘হোল্ড অন প্লিজ।’
বলে কলিং বক্স নিরব করে দিয়ে বলল, ‘স্যরি ভাই সাহব, একটা কান্ড ঘটে গেছে। আমি লা-মন্ডের রিপোর্টার বুমেদীন বিল্লাহকে সময় দিয়েছিলাম। আমি ভুলেই গিয়েছিলাম এই এ্যাপয়েন্টমেন্টের কথা। তিনি এসেছেন। কি করি এখন?
‘বুমেদী বিল্লাহ?’ কোন অসুবিধা নেই মিসেস কামাল। তাঁকে ডাকুন। তাঁর সাথে দেখা হলে আমরাও খুশি হবো। তিনি আপনার সাথে একান্তে কথা বলতে চাইলে আমরা পাশের ঘরে সরে যাবে’ বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ ভাই সাহেব।’ বলে লতিফা কামাল কলিং বক্স অন করে বলল, ‘স্যরি ফর ট্রাবল, প্লিজ আপনি আসুন।’
লতিফা কামাল কলিং বক্স অফ করতেই আহমদ মুসা বলে উঠল, মিসেস কামাল, বুমেদীন বিল্লাহর সাথে আমাদের এই দেখা হওয়াকে আমি আল্লাহর এক সাহায্য বলে মনে করছি। মনে মনে তাঁকে আমি চাইছিলাম।
যদি উনি রাজী হন আমরা কথা বললে আপনার আপত্তি নেই তো?
বিষণ্ণতা ফুটে উঠল লতিফা কামালের মুখে। বলল, ‘এভাবে অনাত্মীয়ের মত কথা বলছেন কেন? আমি এবং আপনারা কি আলাদা ভাই সাহেব?
‘ধন্যবাদ বোন লতিফা কামাল।’ বলল আহমদ মুসা।
‘যাই উনি এসে পড়বেন’ বলে লতিফা কামাল উঠে গেল দরজার দিকে মেহমানকে রিসিভ করার জন্য।
আধা মিনিটের মধ্যে মেহমানকে রিসিভ করে সাথে নিয়ে ড্রইংরুমে প্রবেশ করল লতিফা কামাল।
আহমদ মুসা, ফাতিমা ও যায়েদ উঠে দাঁড়িয়েছে মেহমানকে স্বাগত জানানোর জন্য।
বুমেদীন বিল্লাহকে দেখে বিস্মিত হলো আহমদ মুসা। একেবারে আলজেরিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা ‘আহমদ বেন বেল্লা’র চেহারা।
বেন বেল্লাহর যে চেহারা আহমদ মুসার চোখে ভাসছে তার বয়স একটু বেশি, এর বয়স একটু কম।
আহমদ মুসা বুমেদীন বিল্লাহকে স্বাগত জানিয়ে হ্যান্ডশেকের জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, আপনাকে ‘বুমেদীন বিল্লাহ’ না বলে ‘বেন বেল্লাহ’ বললেই মানাত ভাল।’
বুমেদীন বিল্লাহ হ্যান্ডশেকের জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়ে হেসে বলল, ‘আহমদ বেন বেল্লাহর’ বেল্লাহ’ তো আছেই, আমার মাতৃকূলের ঐতিহাসিক ব্যাক্তি ‘হুয়ারী বুমেদিনে’র ‘বুমেদীন’ বাদ দেবেন কেন। আমার পিতা আমার পিতৃকুল মাতৃকুলকে এক সঙ্গে ধরে রাখার জন্যই দুই ইতিহাসকে যোগ করে আমার নাম রেখেছেন।’
আহমদ মুসা তাকে কাছে টেনে নিয়ে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘দুই ইতিহাসের যোগ ফল হয়ে আপনি তাদের চেয়ে বড় ইতিহাস।’
বুমেদীন বিল্লাহ আহমদ মুসাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আমি মৃত ইতিহাসের সাক্ষী বটে, কিন্তু আপনি ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। পুলিশ আপনাকে খুঁজছে, তার চেয়েও বেশি খুঁজছি আমি। আমি কিন্তু আপনাকে ছাড়ছিনা।’
আহমদ মুসা জড়িয়ে ধরা থেকে ছেড়ে দিয়ে তাকে নিয়ে এক সোফায় পাশাপাশি বসতে বসতে বলল, ‘আমিও আপনাকে ছাড়ছি না মিঃ বুমেদীন বিল্লাহ। বিশেষ করে আপনার দ্বিতীয় নিউজ পড়ার পর আপনাকে দারুণভাবে প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।’
‘চমৎকার, দু’জনকে দু’জনার প্রয়োজন। আসুন তাহলে, আরেকবার হ্যান্ডশেক করি।’ বলল বুমেদীন বিল্লাহ।
‘দু’জনে হ্যান্ডশেক করল আবার।
আহমদ মুসা হ্যান্ডশেক করে বুমেদীন বিল্লাহকে ধরে রেখেই বলল, ‘আপনি আমাকে চিনলেন কি করে?
‘সেদিন রাতে হোটেল কক্ষে দু’জন লোক নিহত হওয়ার ঘটনার পর পুলিশের সাথে আমিও গিয়েছিলাম। দেখেছি আপনাকে।
আপনার ভোলার কথা নয়। পুলিশ যাই ভাবুক, সেদিন রাতেই কিন্তু আমার মনে হয়েছে পুরো পরিচয় আপনার পাওয়া গেল না।
তারপর সেদিন রাইন পার্কের মোড়ে গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যওয়া যে গাড়ি পাওয়া গেছে তার আরোহী ছিলেন আপনি, সেটা অনুসন্ধানে আমি জানতে পেরেছি। এরপর শার্লেম্যানের ৫ নং বাড়ির ১৪ জনের হত্যার যে ঘটনা সেও আপনিই ঘটিয়েছেন বলে আমি নিশ্চিত।
আপনি সেখানে বন্দী ছিলেন। ওদের হত্যা করে আপনি মুক্ত হয়েছেন। এ সব থেকে আমার নিশ্চিত ধারনা হয়েছে, স্পুটনিকের ঘটনায় আপনি তৃতীয় পক্ষ। এই তৃতীয় পক্ষের কোন পরিচয় আমার জানা নেই। এটা না জানলে আমি ঘটনা নিয়ে আমি আগাতে পারছি না।’ বলল বুমেদীন বিল্লাহ।
‘রাইন পার্কের মোড়ে গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া গাড়ির আমি আরহী ছিলাম, এটা হোটেল রাইনের গাড়ি রেজিষ্টার থেকে জানা সম্ভব, কিন্তু শার্লেম্যানের ৫ নং বাড়িতে ১৪ জন নিহত হওয়ার ঘটনার সাথে আমাকে জড়িত করছেন কিসের ভিত্তিতে? জিজ্ঞেসা করলে আহমদ মুসা।
‘দুই কারণে আমি এটা মনে করছি। এক, হোটেলের নিহত দু’জন এবং শার্লেম্যান ৫ নং বাড়িতে নিহত ১৪ জন একই গ্রুপের। দ্বিতীয়তঃ স্পুটনিক ধ্বংসকারী এই গ্রুপের সাথে আপনি ছাড়া আর কারো সাথে সংঘাত বাধেনি। বলল বুমেদীন বিল্লাহ।
‘ঘটনার পেছনে মোটিভ একটা বড় জিনিস। আমাকে আপনি তৃতীয় পক্ষ ধরে নিয়েছেন। কিন্তু এই তৃতীয় পক্ষ আমি হবো কেন? আমার স্বার্থ কি এখানে? আহমদ মুসা বলল।
‘এটা আমারও প্রশ্ন। এই প্রশ্নের সমাধান আমি করতে পারিনি। এই কারণেই আমি আপনাকে খুঁজছি। আপনার পরিচয় জানতে পারলে মোটিভটা পরিস্কার হতে পারে’ বলল বুমেদীন বিল্লাহ।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, মিঃ বুমেদীন বিল্লাহ, আমরা কিন্তু মিসেস কামালের প্রতি অবিচার করছি। আপনার এপয়েন্টমেন্ট হয়েছে মিসেস কামালের সাথে। আর এসে কথা বলছেন আপনি আমার সাথে।
এটা ঠিক নয়। এবার আপনি………….।’
কথার মাঝখানে আহমদ মুসাকে থামিয়ে বুমেদীন বিল্লাহ লতিফা কামালের দিকে তাকিয়ে হাত জোড় করে বলে উঠল, ‘ম্যাডাম মিসেস কামাল আমাকে মাফ করুন। আসলে তৃতীয় পক্ষ সম্পর্কে আপনি কি জানেন, কিংবা জানার ব্যাপারে কি সাহায্য করতে পারেন, আপনার আত্মীয় এই ফাতিমা কামালকে কোথায় পাওয়া যাবে, এসব জিজ্ঞাসার জন্যেই আমি আপনার এপয়েন্টমেন্ট নিয়েছিলাম। এখন আপনার এখানে এসে দেখি শুধু ফাতিমা কামাল ও যায়েদ নয়, স্বয়ং তৃতীয় পক্ষ এখানে হাজির। সুতরাং তার সাথেই কথা বলছি। আমি আপনার সহযোগিতা চাই।’
হাসল লতিফা কামাল। বলল, আমি এখানে এখন তৃতীয় পক্ষ। আপনাদের দু’পক্ষকেই আমি সমান সহযোগিতা করব।’ দেখুন মিঃ বুমেদীন বিল্লাহ, আপনি আসার প্রায় পূর্ব মুহুর্তে মিসেস লতিফা কামাল আমাকে বলেছেন, তিনি এবং আমরা একপক্ষ। এখন তিনি আলাদা হতে চাচ্ছেন।’ আহমদ মুসা বলল মুখে কৃত্রিম গাম্ভীর্য টেনে।
হাসল লতিফা কামাল। বলল, ঠিক আছে। আপনার কথা আমি অস্বীকার করছিনা। কিন্তু এক পক্ষের হয়েও অন্য পক্ষকে সহযোগীতা করা যায়, যদি স্বপক্ষের স্বার্থের বিরুদ্ধে না যায়। তাছাড়া হোষ্ট হিসাবে আমার মেহমানদারীরও একটা ভুমিকা আছে।
‘এরপর আর কোন কথা নেই। মেহমানদারীর প্রয়োজনটা আসন্ন হয়ে উঠেছে। সুতরাং মিসেস কামালের প্রস্তাবের প্রতি আমার পূর্ণ সম্মতি আছে।’ বলল আহমদ মুসা হাসতে হাসতে।
আহমদ মুসা কথা শেষ করতেই বুমেদীন বিল্লাহ বলে উঠল, ‘নিঃস্পত্তি হয়ে গেল। আসুন তাহলে আমরা আমাদের কথায় ফিরে আসি।’
‘অবশ্যই। তবে শুরুটা এবার আমি করব।’ বলল আহমদ মুসা।
বুমেদীন বিল্লাহ থমকে গিয়ে একটু চিন্তা করে বলল, ‘ঠিক আছে মি.আহমদ আবদুল্লাহ। শুরু করুন।’
‘আচ্ছা মি. বুমেদীন বিল্লাহ, সেদিন শার্লেম্যান রোডে ওদের অফিস কম্পিউটারটা কি আপনি দেখে ছিলেন?’
‘হ্যাঁ দেখেছি। পুলিশ পরীক্ষা ও ডিকোড করার জন্য কম্পিউটার তাদের অফিসে নিয়ে যায়।’
‘কম্পিউটারে পাওয়া দলিল-দস্তাবেজ সম্পর্কে প্রেস ব্রিফিংকালে পুলিশ কি দলিলগুলো আপনাদের দেখিয়েছিল?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘তাদের নোট থেকে আমাদের বলেছিল।’ বুমেদীন বিল্লাহ বলল।
‘নতুন গুলাগ’ সম্পর্কে কিছু বলেছিল? জিজ্ঞেসা করল আহমদ মুসা।
‘নতুন গুলাগ?’ কাদের নতুন গুলাগ? বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলে বলল। ‘বলছি। কিন্তু তার আগে আপনাকে একটা কথা দিতে হবে যে, ‘আমাদের এখানকার গোটা আলোচনা ‘অফ দ্যা রেকর্ড।’ এর কোন কিছুই পত্রিকায় দিতে পারবেন না। মনে করুন আপনি আমার সাথে কথা বলছেন বেন বেল্লাহ ও হুয়ারী বুমেদীনদের একজন উত্তরসূরী হিসাবে, সাংবাদিক হিসাবে নয়। বলল আহমদ মুসা শান্ত এবং দৃঢ় কন্ঠে।
‘আপনি মজার কথা বলছেন আহমদ আব্দুল্লাহ। আমার পরিচয়কে এভাবে কেউ কোন দিন তুলে ধরেনি।’ বলেই আহমদ মুসার দিকে হাত বাড়িয়ে তার হাত ধরে বলল, হ্যাঁ আমি কথা দিচ্ছি আহমদ আবদুল্লাহ।’
‘ধন্যবাদ মি. বুমেদীন বিল্লাহ।’ বলে একটু থেমেই আহমদ মুসা আবার বলতে শুরু করল, ‘‘আলেকজান্ডার সোলঝে-নিৎসীনের উপন্যাসে ‘গুলাগ দ্বীপপুঞ্জে’র কথা আছে। মানবতার দোজখ অমন ‘গুলাগ’ সোভিয়েত দেশে অনেক ছিল। তবে সে অতীতের কথা। কিন্তু ইহুদী সন্ত্রাসবাদী সংগঠন ‘ওয়ার্ল্ড ফ্রিডমআর্মি’(WFA) সোভিয়েত ও নাজী স্টাইলে ‘নতুন গুলাগ’ স্থাপন করেছে।’
বিস্ময় জেগে উঠল বুমেদীন বিল্লাহর চোখে-মুখে। বলল, কি উদ্দেশ্যে স্থাপন করেছে? নতুন গুলাগে কারা আছে?
‘তাদের গুলাগ লোক চক্ষুর সামনে এখনো আসেনি। তবে আমি মনে করি, সক্রিয়বাদী মুসলিম ও কামাল সুলাইমানদের মত সত্যসন্ধানীরা আছেন।’
ভ্রু কুচকে গেল বুমেদীন বিল্লাহর। বলল, ‘তার মানে কি আপনি মনে করেন কামাল সুলাইমান সহ স্পুটনিকের সবাইকে ঐ নতুন গুলাগে রাখা হয়েছে?
‘আমি এ চিন্তা করতে চাইনা, কিন্তু এ চিন্তার কোন বিকল্প নেই।’ আহমদ মুসার কন্ঠ শান্ত এবং দৃঢ়।
আহমদ মুসার এ কথা শোনার সাথে সাথে ভয় ও উদ্বেগ ফুটে উঠল লতিফা কামালের চোখে মুখে।
বুমেদীন বিল্লাহর চোখে-মুখেও ভাবান্তর। আহমদ মুসা থামলেও সে কথা বললনা। একটু পর সে বলে উঠল, ‘এই গুলাগের কথা কি শার্লেম্যান রোডে সেদিন ধারা পড়া কম্পিউটারে আছে? ‘ওয়ার্ল্ড ফ্রিডম আর্মি’ নামটাও কি ঐ কম্পিউটারে আছে?
‘হ্যাঁ আছে।’ আহমদ মুসা বলল। ‘কিন্তু আপনি জানলেন কি করে? জিজ্ঞাসা বুমেদীন বিল্লাহর।
‘ওখান থেকে ফেরার আগে আমরা সেদিন তিন তলার অফিস-কম্পিউটারটা চেক করেছিলাম এবং সব দলিল-দস্তাবেজের প্রিন্ট নিয়ে এসেছি।’ আহমদ মুসা বলল।
প্রবল বিস্ময়ে ছেয়ে গেল বুমেদীন বিল্লাহর মুখ। বলল সে, ‘কোড ভেঙ্গেছিলেন আপনারা? কিন্তু পুলিশ তো পারেনি। অফিসে নিয়ে বিশেষজ্ঞ এনে তবেই কম্পিউটারের গোপন ফাইলগুলো ওপেন করা সম্ভব হয়।’
‘হ্যাঁ কোড ভাঙা সম্ভব হয়েছিল।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমারা যাওয়ার কথা আপনি বললেন। ‘আমরা’- এর মধ্যে আর কে ছিল।’ জিজ্ঞাসা করল বুমেদিন বিল্লাহ।
‘ফাতিমা ও যায়েদ।’ আহমদ মুসা বলল।
বুমেদীন বিল্লাহ বিস্মিত চোখে তাকাল ফাতিমা ও যায়েদের দিকে। বলল, ‘আপনারা এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ। বিশ্ববিদ্যালয়ে আপনাদের পড়ার বিষয় কি ছিল?
হাসল যায়েদ। বলল, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের সাবজেক্ট কম্পিউটার বিজ্ঞান নয়। আমি সেদিন কম্পিউটার অপারেট করেছি বটে, কিন্তু ভাইয়া আমাকে কতগুলো কোড ট্রাই করতে বলেছিল এবং তারই দু’টি দিয়ে দুই কম্পিউটারের লক খুলে গিয়েছিল।’
বুমেদিন বিল্লাহ বিস্মিত চোখে তাকাল আহমদ মুসার দিকে।
বুমেদিন বিল্লাহর কিছু বলার আগে আহমদ মুসা বলে উঠল, নিশ্চয় আপনি এখন প্রশ্ন করবেন, কম্পিউটারের নতুন গুলাগে কি ছিল?
বুমেদিন বিল্লাহ গম্ভীর কন্ঠে বলল, ‘না’ আমার প্রশ্ন আপনি আসলে কে? শুনেছি, যার হাতে বন্দুক খুব বেশি চলে তার মাথা বেশি চলে না। কিন্তু আপনি দেখছি, বন্দুক চালনা ও মাথা চালনায় সমান দক্ষ। যাক এ প্রশ্ন। আপনি ঐ প্রশ্নের জবাব দিন, বলুন নিউ গুলাগে কি আছে?’ নিউ গুলাগ ফাইলে আছে একটা দ্বীপের স্কেচ এবং নিউ গুলাগের উদ্দেশ্য সম্পর্কে কিছু কথা।’ আহমদ মুসা বলল।
‘দ্বীপের স্কেচ তার মানে ঐ দ্বীপটাই নিউ গুলাগ? দ্বীপটার নাম কি? দ্রুত ও এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলল বুমেদীন বিল্লাহ।
‘দ্বীপের নাম ‘সাও তোরাহ।’ আহমদ মুসা বলল।
‘সাও তোরাহ?’ কোথায় এদ্বীপ? বলল বুমেদীন বিল্লাহ।
‘এই প্রশ্নেরই জবাব আমি সন্ধান করছি বুমেদীন বিল্লাহ। মিসেস লতিফা কামালের কাছেও এসেছিলাম এই উদ্দেশ্যে। তিনি ভূগোলবিদ, দ্বীপটার সন্ধান নিশ্চয় তিনি দিতে পারবেন, এ আশা নিয়েই আমরা ছুটে এসেছিলাম।’ আহমদ মুসা বলল।
আহমদ মুসার কথা শুনে বুমেদীন বিল্লাহ একবার তাকাল মিসেস কামালের দিকে। তারপর আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘পেয়েছেন দ্বীপের সন্ধান?’
‘দ্বীপের সন্ধান পাইনি, তবে দ্বীপের সন্ধান কার কাছে পাওয়া যেতে পারে সেটা তিনি আমাদের জানিয়েছেন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আমি কি জানতে পারি দ্বীপের সন্ধানটা কোথায় পাওয়া যাবে?’ বুমেদীন বিল্লাহ বলল।
‘উনি বলেছেন, সমুদ্রপৃষ্ঠ ও দ্বীপতত্ত্ব বিশেষজ্ঞের কাছে এর সন্ধান পাওয়া যেতে পারে।’ বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা থামতেই লতিফা কামাল বলে উঠল, হ্যাঁ, আমি এটাই বলছি। ‘সমুদ্রপৃষ্ঠ ও দ্বীপতত্ত্ব’ বিশারদরা দ্বীপের সাইজ দেখে সমুদ্র স্রোত নির্ণয় করতে পারেন এবং সমুদ্র স্রোত বিচার করে সমুদ্রের স্থানটাও চিহ্নিত করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব হয়। এছাড়া আরও উপাদান ও উপলক্ষ তাঁদের বিচার্য আছে।
‘ধন্যবাদ মিসেস কামাল। আপনার একথায় আমার মনে আশা জাগছে যে, দ্বীপটার সন্ধান আমরা পাব। আমার মনে হয় তারা দ্বীপের নাম দেখ ও দ্বীপের এলাকা নির্ধারণ করতে পারবেন। যেমন আমি ভাবছি, মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার ল্যাটিন অঞ্চলের কোথাও অথবা উত্তর আটালান্টিকের স্পেন ও পর্তুগাল বরাবর পশ্চিমে কোথাও এ দ্বীপটা থাকতে পারে।’
‘ভাই সাহেব, এই ভাবনার আপনার ভিত্তি কি? জিজ্ঞেস করল মিসেস কামাল।
‘দ্বীপের নামের দুটি অংশ আছে। তার এক অংশ হিব্রু, অন্য অংশ ল্যটিন। আমি মনে করছি হিব্রু শব্দটা এসেছে ইহুদীদের ঐতিহ্য বোধ থেকে এবং ল্যাটিন অংশটা এসেছে আঞ্চলিক বিবেচনা বা প্রভাব থেকে। আমি যে অঞ্চল গুলোর উল্লেখ করছি সেগুলো ল্যাটিন ভাষা প্রভাবিত।’ আহমদ মুসা বলল।
চমৎকার। আপনার যুক্তি অকাট্য মিঃ আহমদ আবদুল্লাহ। আমার বিশ্বাস আপনার এ যুক্তি বিশেষজ্ঞদের এই দ্বীপ সন্ধানে সাহায্য করবে।’ বলল বুমেদীন বিল্লাহ।
‘আপনাকে ধন্যবাদ ভাই সাহেব। আপনি যে চিন্তা করছেন, আমার মাথায় এই চিন্তা কোন দিন আসত কিনা সন্দেহ’ লতিফা কামাল বলল।
‘মিসেস কামাল, দ্বায়িত্ব মানুষকে দ্বায়িত্বশীল বানায়। দ্বায়িত্ব এসে পড়লেই চিন্তা এমনিতেই মাথায় চাপত।’
বলে আহমদ মুসা একটু থামল, তারপর বলে উঠল, মিসেস কামাল, পরামর্শ দিন কার কাছে আমরা যেতে পারি। আমি তো কাউকে চিনি না।
‘আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ যিনি, তিনি এখন দেশের বাইরে। অন্য কাউকে তো আমি দেখছিনা।’ বলল মিসেস কামাল।
মিসেস কামাল থামতেই বুমেদীন বিল্লাহ বলল, মিঃ আবদুল্লাহ, একজন প্রবীণ আটলান্টিক বিশেষজ্ঞের সাথে আমার পরিচয় আছে। তিনি প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এমিরিটাস। বাস করেন এই স্ট্রাসবার্গেই।
আটলান্টিক সমুদ্র স্রোত, ভূতত্ব, দ্বীপের গঠন ও প্রকৃতি ইত্যাদি আটলানিটক সংক্রান্ত বিষয়ের উপর তাঁর অনেক বই আছে। আমি মনে করি তার সাথে আপনি কনসাল্ট করতে পারেন। আমি সাথে করে নিয়ে যেতে পারি। কিন্তু তার আগে একটা কথা বলুন, আপনি কেন এসব করবেন। আপনার লক্ষ্য কি?
‘আপনি তো আগেই আমাকে তৃতীয় পক্ষ বলে অভিহিত করেছেন। আসলেই আমি তৃতীয় পক্ষ। আমি স্পুটনিকের অপহৃত নেতাদের উদ্ধার করতে চাই। এবং সেটা করতে গিয়ে স্পুটনিক ধ্বংসের আসল লক্ষ্য সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেয়া এবং এ বিষয়ে কিছু করণীয় থাকলে করতে চাই।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কিন্তু যত দূর জানি আপনি একা। একাকি করতে পারবেন।’ বলল বুমেদীন বিল্লাহ।
‘না একা নই, সাথে আল্লাহ আছেন।’ আহমদ মুসা বলল।
বুমেদীন বিল্লাহর মুখ উজ্জল হয়ে উঠল। বলল, আরেকটা কথা, স্পুটনিক নিউইয়র্কের ডেমোক্রাসি ও লিবার্টি টাওয়ার ধ্বংসের উপর তদন্ত করছিল। এ ব্যাপারে আপনার মত কি?
‘আমি মনে করি স্পুটনিক সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ হাতে দিয়েছে। এই তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। স্পুটনিক চাইলে আমিও তাদের সাথে থাকব।’ আহমদ মুসা বলল।
‘এবার আমি আমার পুরানা প্রশ্ন করতে চাই মিঃ আহমদ আবদুল্লাহ।
সেটা হলো, আপনি কে? কেন আপনি তৃতীয় পক্ষ হতে এলেন? বলল বুমেদীন বিল্লাহ।
‘আমার প্রশ্নের জবাব দেবার আগে আমি আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে চাই, আপনি এই স্পুটনিক কেসে কেন বিশেষ আগ্রহ দেখাচ্ছেন?
কেন আপনি আমাদের সহযোগিতা করতে চাচ্ছেন? ফ্রান্সের সাংবাদিকদের মধ্যে আপনি ব্যাতিক্রম কেন ? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
আহমদ মুসার কথা শেষ করার পর সংগে সংগে জবাব দিল না বুমেদীন বিল্লাহ। মুখটা সে একটু নীচু করছে। গম্ভীর হয়ে উঠেছে তার মুখমন্ডল।
কয়েক মুহুর্ত চুপ করে থাকার পর ধীরে ধীরে বলল, স্পুটনিক ধ্বংসযজ্ঞ আমাকে আহত করেছে। পুলিশের নিস্ক্রিয়তা আমি মেনে নিতে পারিনি, সাংবাদিকদের বৈষম্য দৃষ্টি আমাকে ভীষণ কষ্ট দিয়েছে। তাই স্পুটনিকের পাশে এসে দাঁড়িয়েছি।’
‘স্পুটনিকের ধ্বংসযজ্ঞ আপনাকে আহত করেছে কেন? সেটা কি শুধু স্পুটনিক একটা ভাল মানবতাবাদী সংস্থা বলেই? জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
আবার নিরবতা বুমেদীন বিল্লাহর। একটু পরে সে বলে উঠল, কি আপনি জানতে চাচ্ছেন, আমি বুঝতে পেরেছি। হ্যাঁ, মিঃ আহমদ আবদুল্লাহ, কিন্তু ফরাসী পুলিশও কিছু ফরাসী সাংবাদিক খৃষ্টান ও ইহুদী হওয়ার কারণে যেমন মুসলিম প্রতিষ্ঠানের সাথে অসহযোগিতা করেছে, তেমনি আমি মুসলিম হিসাবে স্পুটনিককে সহযোগিতা করতে চাচ্ছি।’
বুমেদীন বিল্লাহ থামতেই আহমদ মুসা বলে উঠল, ধন্যবাদ মিঃ বিল্লাহ। আপনার মত ঐ একই কারণেই আমি স্ট্রসবার্গ ছুটে এসেছি। কারণ আমিও একজন মুসলিম। নিউইয়র্কের ডেমোক্রাসি ও লিবার্টি টাওয়ার ধ্বংসের পুরানো দায়টা আমরা মুসলমানরা এখনও বয়ে বেড়াচ্ছি। স্পুটনিক এ দায় থেকে আমাদের মুক্ত করতে চেয়েছিল। তাই স্পুটনিকের উপর ধ্বংসযজ্ঞ আপনার মত আমাকেও আহত করেছে। স্পুটনিকের সাত গোয়েন্দার মহান মিশনকে সহযোগিতা করার জন্য আমি এসেছি।’
‘মি. আহমদ আবদুল্লাহ আপনাকে ধন্যবাদ। আপনার কাছে আমার দু’টি প্রশ্ন ছিল। দু’টির মধ্যে ‘আপনি কেন এসেছেন’ এ প্রশ্নের জবাব আপনি দিলেন। কিন্তু ‘আপনি কে’ এই প্রশ্নের জবাব কিন্তু এখনও হয়নি।’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, আজই হলো প্রথম সাক্ষাত। প্রথম দিনেই জানা শোনা সব শেষ হয়ে যাওয়া ঠিক নয়। পরের জন্য কিছু রাখুন।’
বুমেদীন বিল্লাহও হাসল। বলল, আমার আপত্তি নেই। তবে আগ্রহটা আমার আরও বাড়ল।
বুমেদীন বিল্লাহ কথা শেষ করতেই লতিফা কামাল উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘খাবার টেবিলে নাস্তা এসেছে। আমি সকলকে নাস্তা খাবার আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।
‘খাবার সামনে রেখে নামাজও চলে না, কথা তো চলতেই পারে না। সুতরাং চলুন।’ বলতে বলতে উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা।
তার সাথে সাথে সবাই উঠে দাঁড়াল।

‘শুনলেন তো অধ্যাপক ডেভিড দানিয়েল, আমরা কত বড় শনির দশায় পড়েছি!’ বলল আজর ওয়াইজম্যান।
‘কিন্তু এত বড় বস্নানডার কিভাবে হলো? আমি বুঝলাম, আপনার লোকেরা প্রাণপণ লড়াই করেছে। সবাই মারা গেছে এটাই তার প্রমাণ। কিন্তু লড়াই-এর মত সমান গুরুত্বপূর্ণ ছিল কম্পিউটারের রেকর্ড নষ্ট করে দেয়া। কিন্তু তারা সেটা করেনি।’ অধ্যাপক ডেভিড দানিয়েল বলল।
‘আহমদ মুসা বন্দী হবার পর এত বড় বস্নান্ডার ঘটবে, এটা কারও কল্পনাতেও ছিল না। যাক, যখন বিপর্যয় ঘটেছে তখন আমাদের দূর্বলতাতেই ঘটেছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। এখন বলুন শেষ রক্ষার উপায়, স্পুটনিক ধবংসের পরিকল্পনা, ওদের সাত জনকে কিডন্যাপ করার ডকুমেন্ট, সাও তোরহ দ্বীপের মানচিত্র, সবই গিয়ে পড়েছে পুলিশের হাতে। স্ট্রসবার্গের পুলিশ কমিশনারকে অনুরোধ করে কোন রকমে মানচিত্র ও ডকুমেন্টের বিস্তারিত প্রেসে দেয়া আটকাতে পেরেছি। কিন্তু ডকুমেন্টগুলো প্যারিস থেকে চেয়ে পাঠানো হয়েছে। ডকুমেন্টগুলো প্যারিসে গেলেই পত্রিকায় এসে যাবে। পুলিশ প্রধান যে ধরনের লোক, আমি কোন কথা-ই তাকে মানাতে পারবো না। যে টুকু পত্রিকায় এসেছে, তাতেই আমাদের বাইরে বেরুবার উপায় নেই। এর পর ডকুমেন্টের সব কথা যদি পত্রিকায় আসে তাহলে আমরা শেষ হয়ে যাব।’
‘আমর মন কিছুতেই মানছে না মি.ওয়াইজম্যান, একজন লোক একাই এভাবে আপনাদের তুলা ধুনা করল।’ বলল অধ্যাপক ডেভিড দানিয়েল।
‘আমাদের কথা আর কি বলব। আপনি জানেন, বলতে গেলে আহমদ মুসার একার হাতেই ইহুদীবাদের গর্ব জেনারেল শ্যারণ তার দলবল সহ শেষ হয়ে গেল। গোটা ইহুদীবাদই আজ মহা বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ছে অধ্যাপক ডেভিড। যে কোন ভাবে ডকুমেন্টগুলোর প্রেসে যাওয়া আটকাতে হবে।’ আজর ওয়াইজম্যান বলল।
‘আমাকে কি করতে হবে বলুন।’ অধ্যাপক ডেভিড দানিয়েল বলল।
‘জনাব প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে সম্মানিত প্রফেসর এমিরেটাস আপনি। তার উপর প্রেসিডেন্ট আপনার ব্যাক্তিগত বন্ধু। এই সুযোগ আপনাকে কাজে লাগাবার অনুরোধ করছি।’ বলল আজর ওয়াইজম্যান।
‘প্রেসিডেন্টকে আমি কি বলব? অধ্যাপক ডেভিড দানিয়েল বলল।
‘ডকুমেন্টগুলো ভূয়া বলে গোটা বিষয়টাই ধামা চাপা দিতে হবে। বলতে হবে যে, মুসলিম মৌলবাদীরা ইহুদীদের ফাঁসাবার জন্য এই ভূয়া ডকুমেন্ট সাজিয়েছে।’ বলল আজর ওয়াইজম্যান।
‘কিন্তু মি.ওয়াইজম্যান, এটুকু করলেই আপনার বিপদ কেটে যাবে। মূল বিপদ তো বলছেন আহমদ মুসা। তার কি করবেন! এত কিছু পারছেন, ফরাসী পুলিশের সাহায্য নিয়ে তাকে পথ থেকে সরাতে পারছেন না? অধ্যাপক ডেভিড দানিয়েল বলল।
‘সেখানেও এক বিপদ আছে। ফরাসী রাজকুমারীকে আহমদ মুসা বিয়ে করার পর ফরাসী পুলিশের কাছে সে অনেকটা আপন হয়ে গেছে। তার উপর আমেরিকার সাম্প্রতিক ঘটনাবলীতে ফরাসী পুলিশের কাছে আহমদ মুসার ইমেজ অনেক অনেক বেড়ে গেছে। এই অবস্থায় ফরাসী পুলিশের কাউকে কাউকে তার বিরুদ্ধে পাওয়া যাবে, সবাইকে পাওয়া যাবে না।’ বলল আজর ওয়াইজম্যান।
‘কিন্তু এই যে বললেন, পুলিশ স্ট্রাসবার্গে কোথাও আহমদ মুসাকে দেখতে পেলে ধরে তাকে আপনাদের হাতে তুলে দেবে। সেটা কিভাবে? অধ্যাপক ডেভিড দানিয়েল বলল।
‘স্ট্রাসবার্গের পুলিশের কাছে আহমদ মুসার পরিচয় আহমদ আবদুল্লাহ হিসাবে। তারা আহমদ আবদুল্লাহকে আমাদের হাতে তুলে দেবে, আহমদ মুসাকে নয়।’ বলল আজর ওয়াইজম্যান।
অধ্যাপক ডেভিড দানিয়েল কিছু বলতে যাচ্ছিল। আজর ওয়াইজম্যানের মোবাইলটি বেজে উঠল।
থেমে গেল অধ্যাপক ডেভিড দানিয়েল।
‘মাফ করুন’ বলল আজর ওয়াইজম্যান টেলিফোন ধরল।
ওপারের কথা শুনেই ভ্রু কুঁচকে উঠল আজর ওয়াইজম্যানের। বলল দ্রুত কন্ঠে, ‘তোমার দু’জন বাড়ির সামনে পাহারায় থাক আমি লোকজন নিয়ে আসছি।
বলে মোবাইল অফ করে দিয়ে আজর ওয়াইজম্যান অধ্যাপক ডেভিডের উদ্দেশ্যে দ্রুত কন্ঠে বলল, ‘অধ্যাপক ডেভিড আহমদ মুসার সন্ধান পাওয়া গেছে। একটা বাড়িতে সে আরও দু’জনকে সাথে নিয়ে থাকে। আমাদের দু’জন লোক বাড়িটার সামনে পাহারায় আছে।
লোকজন নিয়ে আমি ওখানেই যাচ্ছি। পরে আবার কথা বলব আপনার সংগে।’ বলে অধ্যাপক ডেভিড দানিয়েলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এল আজর ওয়াইজম্যান।
চারজন লোক নিয়ে ছুটল সে আহমদ মুসার বাড়ির উদ্দেশ্যে।
কিন্তু আজর ওয়াইজম্যান যখন তার লোকজন নিয়ে আহমদ মুসার আটতলায় গিয়ে পৌছল, তার বেশ কিছু আগে আহমদ মুসা বুমেদীন বিল্লাহকে নিয়ে আটলান্টিক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এমিরিটাস জ্যাক সাইমনের সাথে দেখা করার জন্য বেরিয়ে গেছে। আর তখন ফাতিমা এবং যায়েদ ও বাসা থেকে বেরিয়ে লিফটের দিকে এগুচ্ছিল। এই সময় তারা দেখল লিফঠ থেকে বেরিয়ে তাদের ফলাটের দিকে এগুচ্ছে ক’জন লোক। এটা দেখে ফাতিমা এবং যায়েদ দুজনে একটা আড়াল নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল ব্যাপার কি তা দেখার জন্যে। ওরা পাঁচজন যখন ফাতিমাদের দরজায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে, সে সময় ওদের একজনের মোবাইল বেজে উঠল। লোকটি মোবাইল তুলে নিয়ে চাপা কন্ঠে বলল, ‘ইয়েস, আজর ওয়াইজম্যান।’
লোকটা ওপারের কথা শুনল। শুনেই গা ঝাড়া দিয়ে সটান হয়ে দাঁড়াল। উত্তেজনা ঠিকরে পড়তে লাগল তার চোখ মুখ থেকে। অনেকটা স্বাগতঃই বলে উঠল লোকটা, ‘আমরা আহমদ মুসার তালাশে এসেছি তার বাড়িতে, আর আহমদ মুসা গিয়ে বসে আছে আমাদের হাতের মুঠোর মধ্য। চল সকলে।
তারা পাঁচজন আবার লিফটে গিয়ে উঠল।
চলে গেল তারা।
আড়াল থেকে বাইরে বেরিয়ে গেল ফাতিমা ও যায়েদ।
দু’জনেরই চোখ মুখ শুকনো।
চোখ-মুখে তাদের উদ্বেগ।
আজর ওয়াইজম্যান স্বাগতোক্তিতে যা বলেছে তা শুনতে পেয়েছে ফাতিমা ও যায়েদ দুজনেই।
দু’জন কারো মুখে কোন কথা নেই। অবশেষে নিরবতা ভাঙল ফাতিমা। বলল, ‘আহমদ মুসা ভাইয়ারা আজর ওয়াইজম্যনদের হাতের মুঠোয় যাবেন কি করে? ওরা তো গেলেন অধ্যপক সাইমনের সাথে দেখা করতে। তাহলে কি বুমেদীন বিল্লাহ বিশ্বাসঘাতকতা করেছে?
আহমদ মুসা ভাইকে অন্য কোথাও নিয়ে তুলছে? থামল ফাতিমা।
আতংক ফুটে উঠল যায়েদের চেখে-মুখে। বলল, ‘আমারও এই রকমই সন্দেহ হচ্ছে।
ফাতিমা স্থির দাঁড়িয়েছিল। নড়ে উঠল। চলতে শুরু করল ফ্ল্যাটের দরজার দিকে। বলল, এস যায়েদ, নোট বুকে অধ্যাপক জ্যাক সাইমনের ঠিকানা লেখা আছে।’
যায়েদ ফতিমার সাথে হাঁটতে হাঁটতে বলল, ‘অধ্যপক জ্যাক সাইমনের ঠিকানা দিয়ে কি করবে?
‘কিছু একটা তো করতে হবে আগে জ্যাক সাইমনের ঠিকানা তো দেখি!
দরজা খুলে দু’জনেই ফ্ল্যাটে প্রবেশ করল।