৩৫. নতুন গুলাগ

চ্যাপ্টার

আন্তর্জাতিক পুলিশ ইন্টারপোলে’র ইউরোপীয় সদর দফতর প্যারিসে ইউরোপীয় ‘ইন্টারপোল’ বৈঠক। এ বৈঠকে ইন্টারপোলের ইউরোপীয় কমিটি ছাড়াও ফ্রান্স সহ কয়েকটি দেশের পুালশ প্রধানও হাজির।
বৈঠকে স্বাগতিক দেশের পুলিশ প্রধান মিঃ মিতেরাঁ তার স্বাগতিক বক্ত্যবে এজেন্ডার উপর ব্রিফিং দিচ্ছিলেন। বলছিলেন, ‘ইন্টারপোলকে ধন্যবাদ যে, আমাদের আবেদনে বিশেষ এক এজেন্ডার উপর আলোচনা করতে রাজি হয়েছে।’
এজেন্ডার বিষয়ে আমার প্রথমিক বক্তব্য হলো, আপনারাও কিছুটা হলেও স্ট্রাসবার্গের দুটি ঘটনা সম্পর্কে জেনেছেন। এ দুই ঘটনার একটি ঘটনা ঘটে গেছে, আরেকটি ঘটতে চলছে। কিছুদিন আগে ইউরোপের বিখ্যাত একটা অনুসন্ধানী সংস্থা স্পুটনিককে সমূলে ধবংস করা হয়েছে এবং এর ৭ জন কর্মকর্তাকে অপহরণ করা হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। এতই নিপুন ভাবে কাজটা করা হয়েছে যে, কোন ক্লুই পাওয়া যায়নি সামনে এগুবার। তার ফলেই গত কয়েক মাসে এর তদন্তে কোন অগ্রগতি হয়নি। কিন্তু গত এক পক্ষকালে ঐ স্ট্রাসবার্গেই কিছু ঘটনা ঘটেছে যার সাথে স্পুটনিক ধবংসের ঘটনা সম্পর্কিত হয়ে পড়েছে। স্ট্রাসবার্গের শার্লেম্যান রোডের ৫ নং বাড়ি থেকে ১৪টি লাশ ও দু’টি কম্পিউটার পাওয়া গেছে। এ সম্পকির্ত খবর পত্রিকায় ছাপা হয়েছে, আপনারা দেখেছেন। তবে রিপোর্টে অনেক কিছুই ছাপা হয়নি।
ঐ রিপোর্ট ও আমাদের অনুসন্ধান থেকে জানা গেছে ‘ওয়ার্ল্ড ফ্রিডম আর্মি’ নামে একটা ইহুদী সংস্থা সুপরিকল্পিতভাবে স্পুটনিক ধ্বংসের ঘটনা ঘটিয়েছে এবং কম্পিউটার থেকে আরও তথ্য পাওয়া যেতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।’ থামল ফ্রান্সের পুলিশ প্রধান।
পুলিশ প্রধান থামতেই ইন্টারপোলের প্রধান জর্জ জ্যাকব বিরক্তির স্বরে বলে উঠল, মিঃ মিতেরাঁ কম্পিউটার থেকে পাওয়া কোন তথ্য দলিল নয়। কম্পিউটারে যে কেউ যে কোন জিনিস ঢুকিয়ে দিতে পারে।
আপনি বলুন, স্ট্রাবার্গে এ পর্যন্ত দেড় ডজনের ও বেশি লোক খুন হয়েছে। এই খুনগুলো কে করলো? যারা এই খুনগুলো করতে পারে, তারা কম্পিউটারে কোন তথ্য ঢুকিয়ে দিতে পারে।’
‘মি.জ্যাকব, যারা খুন হয়েছে তারা সকলেই এক দলের লোক এবং এরা আক্রমনকারী হিসাবে খুন হয়েছে।’ বলল ফ্রান্সের পুলিশ প্রধান।
‘কাকে এবং কেন তারা আক্রমন করতে গিয়েছিল? যাকে তারা আক্রমন করতে গিয়েছিল সেই কালপ্রিটকে আপনারা বের করার কি চেষ্টা করেছেন? সে কি করছে ফ্রান্সে, তা কি সন্ধান করেছেন? মাফ করবেন, আমার মনে হয় ফ্রান্সের পুলিশের মধ্যে নাজী পন্থী না হলেও এ্যান্টি সেমেটিক প্রবনতার বিস্তার ঘটেছে।’ বলল ইনটারপোলের প্রধান স্পষ্ট ও দৃঢ় কন্ঠে।
ফ্রান্সের পুলিশ প্রধানের মিতেরাঁর মুখ লাল হয়ে উঠেছে। বলল, ‘সব জাতির মধ্যেই ক্রিমিনাল আছে, ক্রিমিনাল গ্রুপ আছে। তেমনি ইহুদীবাদীদের মধ্যেও ক্রিমিনাল গ্রুপ থাকতে পারে। কিন্তু তারা কোন অপরাধে জড়িত হবার ঘটনা ঘটলেই একথা বলা অভ্যাসে পরিনত হয়েছে যে, এটা এ্যান্টি -সেমেটিকদের ষড়যন্ত্র। আপনাদের সবার কাছে ফাইল দেয়া হয়েছে। ফাইলই সুস্পষ্টভাবে প্রমান করছে, ওয়ার্ল্ড ফ্রিডম আর্মি বিরুদ্ধে অভিযোগ এ্যান্টি সেমেটিক কোন ষড়যন্ত্র নয়।’ থামল মিতেরাঁ।
সংগে সংগেই বলে উঠল ইন্টারপোলের প্রধান জ্যাকব, ‘ফাইল দেখেছি। প্রমাণগুলো সবই অবস্থাগত এবং কম্পিউটার রেকর্ড ভিত্তিক। যারা মারা গেছে, তারা সবাই একদলের বলা হচ্ছে এবং রেসিয়াল টেষ্টেও প্রমান করছে তারা সবাই ইহুদী। সবগুলো হত্যাকান্ড ঘটেছে আহমদ মুসার দ্বারা, সেটা যে পরিস্থিতিতেই হোক। প্রতিপক্ষ এখানে আহমদ মুসা। নিছক কম্পিউটারে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে স্ট্রাসবার্গের সাম্প্রতিক কয়েকটা ঘটনাকে স্পুটনিকের সাথে জুড়ে দেয়া ঠিক হবে না। বিষয়টাকে আহমদ মুসার সাথে সংঘাত হিসাবে দেখতে হবে।’
ইন্টারপোল প্রধান জ্যাকব থামতেই বৈঠকে উপস্থিত অনেকেই এক সাথে বলে উঠল, ‘সন্দেহাতীত আরও প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত মাঝামাঝি এই সিদ্ধান্তই যুক্তিযুক্ত হবে।’
সংগে সংগেই ফরাসী পুলিশ প্রধান বলে উঠল, ‘আমি দুঃখিত যে, আপনাদের এই মতের সাথে আমি একমত হতে পারলাম না। ফরাসী পুলিশ মনে করে, স্পুটনিকের ঘটনার সাথে স্ট্রাসবার্গের সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো গভীর ভাবে সম্পর্কিত। স্পুটনিকের অপহৃতদের আত্মীয় স্বজনের পক্ষ থেকেই আহমদ মুসা স্পুটনিক ধবংসের ঘটনা নিয়ে কাজ করছে। সুতরাং আহমদ মুসার সাথে ওয়ার্ল্ড ফ্রিডম আর্মীর সংঘাতকে বিচ্ছিন্ন বলে চলাবার কোন যুক্তি নেই। তাছাড়া আহমদ মুসা কাজ শুরু করার পর স্পুটনিকের ঘটনায় অপহৃত ৭ জনের আত্মীয় স্বজন ও বন্ধু-বান্ধব সবার বাসা তছনছ হয়েছে। আহমদ মুসার উপর বার বার আক্রমনকারী ওয়ার্ল্ড ফ্রিডম আর্মীই যে এই তছনছের কাজ করেছে এতে আমাদের পুলিশের কোন সন্দেহ নেই। স্পুটনিকের সাথে সম্পর্কিত লোকদের বাসাবাড়ির উপর তারা চোখ রাখছে এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য। সর্বশেষ হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটে স্পুটনিকের প্রধান গোয়েন্দা কামাল সুলাইমানের বাড়ির সামনে। প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য অনুসারে কামাল সুলাইমানের বাড়ি থেকে একজন লোক বেরিয়ে এলে তার উপর আক্রমন চালানো হয়। কিন্তু সংঘর্ষে আক্রমনকারী লোকটি এবং তার কুকুর মারা যায়। যে লোকটি মারা যায় সে ওয়ার্ল্ড ফ্রিডম আর্মীর সদস্য। সুতরাং আহমদ মুসাকে এবং স্ট্রাবার্গের সাম্প্রতিক ঘটনাকে স্পুটনিকের ঘটনা থেকে বিচ্ছিন্ন করা কোনভাবেই সম্ভব নয়। এই বাস্তবতাকেই যদি ইন্টারপোল অস্বীকার করে তাহলে তাদের সাহায্য আমরা পাব কি করে? আমরা ইন্টারপোলের সাহায্য এই জন্যই চেয়েছিলাম যে, স্পুটনিক যারা ধবংস করেছে এবং এর লোকদের যারা কিডন্যাপ করেছে, তারা ফ্রান্সে সীমাবদ্ধ নয়। আমদের নিশ্চিত বিশ্বাস স্পুটনিকের লোকদের আটকেও রেখেছে ফ্রান্সের বাইরে। এদিক থেকেই ইন্টারপোলের সাহায্য আমাদের প্রয়োজন ছিলো।’ বলল ফ্রান্সের পুলিশ প্রধান মিঃ মিতেরাঁ।
ইন্টারপোলের বৃটিশ প্রতিনিধি মিঃ উইলসন বলল, ‘আমি মিঃ মিতেরাঁর যুক্তিকে সমর্থন করছি। স্পুটনিক ও স্ট্রাবার্গের সাম্প্রতিক ঘটনা বিচ্ছিন্ন নয়। ফ্রান্সকে এই ক্ষেত্রে আমাদের সাহায্যও করা উচিত। তবে একটা কথা। ফ্রান্সের জামাই আহমদ মুসার প্রতি ফ্রান্সের দুর্বলতার অর্থ আমরা বুঝতে পারছি। কিন্তু ইহুদীদের প্রতি মিতেরাঁ এত কঠোর হয়ে উঠলেন কেন?
আবার মিতেরাঁ বলে উঠল, ‘স্পুটনিকের মত কোন কিছু ধবংসের ঘটনা যদি ওয়ার্ল্ড ফ্রিডম আর্মী বৃটেনে ঘটাত, তাহলে মিঃ উইলসন আমার চেয়েও কঠোর হতেন আমি হলফ করে বলতে পারি।’
এইভাবে আলোচনা চলল।
দীর্ঘ আলোচনার পর বৈঠক তিনটি সিন্ধান্তে উপনীত হলোঃ এক, বিশ্ব মুক্তি সেনা বা ওয়ার্ল্ড ফ্রিডম আর্মীকে (WFA) স্ট্রাসবার্গের ঘটনাবলীর জন্য দায়ী বলে প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত করা হলো, তবে এই সংস্থাকে ইহুদী সংগঠন হিসাবে প্রকাশ করা হবে না, দুই, ঘটনার সাথে
‘ওয়ার্ল্ড ফ্রিডম আর্মী’ (WFA) জড়িত থাকা সম্পর্কে ফ্রান্সকে আরও প্রত্যক্ষ প্রমান সংগ্রহ করতে হবে এবং তিন, ইন্টারপোল ফ্রান্সকে সব রকম সহযোগিতা করবে।
বৈঠক থেকে বেরিয়ে যাবার সময় মিতেরাঁ, উইলসান এবং জার্মান পুলিশ প্রধান ভন ক্রয়েগার এক সাথে হাঁটছিল। ফ্রান্সের পুলিশ প্রধান মিতেরাঁ বলল, ‘ইহুদীবাদীদের এ ধরনের পাপকে আর কতদিন আমরা ঢেকে রাখব? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক ঘটনাবলী বিশেষ করে বিজ্ঞানী জন জ্যাকব ও জেনারেলে শ্যারণদের অপকীর্তি থেকে কি আমরা শিক্ষা গ্রহন করবো না?
বৃটিশ পুলিশ প্রধান জর্জ উইলসনের মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল। বলল, ‘মিটিং এ অনেক সময়েই পোষাকী কথা বলতে হয়। কিন্তু ফ্যক্ট হলো আমাদের প্রশ্রয় কিন্তু ইহুদীদের আরও ক্রিমিনাল বানাচ্ছে এবং এর মাধ্যমে তাদেরই ক্ষতি করছি আমরা।’
উইলসন থামতেই ভন ক্রয়েগার বলে উঠল, ‘এর পরিনতি হতে পারে ভয়ংকর। ‘নাজী’রা হয়তো কোনদিনই আর ফিরবে না। কিন্তু ‘নাজী’দের ভাইয়েরা তো ফিরতে পারে।’
‘সাংঘাতিক কথা বলছেন মিঃ ক্রয়েগার।’ বলে উঠল জর্জ উইলসন।
কিছু বলতে যাচ্ছিল ভন ক্রয়েগার। কিন্তু বলা হলো না ইনটারপোল প্রধান মিঃ জন জ্যাকব তাদের মধ্যে এসে পড়ায়।
কথার প্রসংগ পাল্টাল ভন ক্রয়েগার।
হাঁটতে লাগল চারজন।

টেলিফোন ধরে ওপারের কথা শুনেই চমকে উঠে সোজা হয়ে দাঁড়াল ফাতিমা। বলল, এক্সেলেন্সি, প্লিজ হোল্ড করুন। উনি আছেন, ওনাকে দিচ্ছি আমি।
বলে ফাতিমা মহাব্যস্ত হয়ে টেলিফোটা আহমদ মুসার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘ভাইয়া ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্টের টেলিফোন।’
হাঁ ফাতিমা গলা শুনেই বুঝতে পেরেছি।’ বলে আহমদ মুসা টেলিফোন সেট সামনে টেনে নিল। আহমদ মুসা সালাম দিয়ে কথা বলা শুরু করল। বলল, ‘মাহমুদ কেমন আছ?’
‘ভাল ভাইয়া। আপনি কেমন আছেন? কতদিন পর আপনার সাথে কথা বলছি।’ ওপার থেকে বলল ফিলিস্তিন প্রেসিডেন্ট মাহমুদ।
‘তুমি খুব ব্যাস্ত, তা আমি জানি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আমার প্রতি অবিচার করবেন না ভাইয়া। আমার কিছু ব্যাস্ততা আছে এ কথা ঠিক, কিন্তু আপনাকে খুঁজে পাওয়াই আমাদের জন্য কঠিন হয়ে যায়।’ বলল মাহমুদ।
‘তুমি ঠিক বলেছ মাহমুদ। অবস্থার কারণে সব খবর তোমাদের আমি সব সময় জানাতে পারি না। যাক, এসব কথা। তোমার স্ত্রী এমিলিয়ার কাছে সব শুনেছি। এখন বল, হাসান তারিক কোথায়? বলল আহমদ মুসা।
‘আমার পাশে বসে আছে ভাইয়া। তাকে টেলিফোন দেব, তার আগে বলুন, আপনার ডাক পাবার এই সৌভাগ্য হাসান তারিকের কেন হলো? বলল মাহমুদ।
‘এটা সৌভাগ্য নয় মাহমুদ, দুর্ভাগ্য। কঠিন এক অভিজানে ওকে সাথী করতে চাচ্ছি। কিছু দিনের জন্য ওকে সকল সুখ কোরবানি দিতে হবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কোরবানির সুযোগ তো মুসলমানদের জন্য সৌভাগ্যের ভাইয়া? বলল মাহমুদ।
‘এটা হাসান তারিকই বলুক।’ হেসে বলল আহমদ মুসা।
পরক্ষণেই টেলিফোনে হাসান তারিকের কন্ঠ শোনা গেল। বলল ‘আমার উপর আপনার এই রাগের কারন কি ভাইয়া?’
‘রাগ কোথায় দেখলে?’ আহমদ মুসা বলল।
‘এই যে আপনি বললেন কোরবানী আমি দিতে পারব কিনা তা আমাকেই বলতে হবে। এটা তো অনাস্থা অথবা রাগের কথা ভাইয়া।’ বলল হাসান তারিক।
আহমদ মুসা হাসল। তারপর গম্ভীর হয়ে উঠল তার মুখ।
বলল, ‘হাসান তারিক তোমার উপর খুব রাগ, খুব অবিশ্বাস তো, তাই কঠিন এক অভিযানে সাথি হবার জন্যে তোমাকেই স্মরণ করছি।’
‘আমার সৌভাগ্য ভাইয়া যে, আপনি আমাকে এত ভালবাসেন।’ বলতে বলতে কেঁদে ফেলল হাসান তারিক।
‘তোমার আবেগ দেখি আগের মতই আছে। মুছে ফেল চোখের পানি। বল, আয়েশা আলিয়েভা কেমন আছে?’ বলল আহমদ মুসা।
‘ভাল। আমি যাচ্ছি শুনলে সে কিন্তু পিছু নেবে। আপনার হুকুমই শুধু তাকে থামাতে পারে। ‘হাসান তারিক বলল।
‘সে আমি দেখব। তুমি তৈরী হও আসার জন্য।’ আহমদ মুসা বলল।
‘শোনা কি যাবে অভিযানটা কোথায়? বলল হাসান তারিক।
‘বলা গেলে শুরুতেই বলতাম।’ আহমদ মুসা বলল।
‘স্যরি ভাইয়া।’ বলল হাসান তারিক।
‘ধন্যবাদ হাসান তারিক। এখন রাখি।’ বলে, সালাম দিয়ে আহমদ মুসা টেলিফোটা রেখে দিল।
ড্রইংরুমে যায়েদ, ফতিমা ও লতিফা কামাল উদগ্রীব হয়ে শুনছিল আহমদ মুসাদের কথা-বার্তা।
আহমদ মুসা টেলিফোন রাখতেই ফাতিমা বলে উঠল, ‘আপনি কোন অভিযানে মানে কোথাও যাচ্ছেন ভাইয়া?
আহমদম মুসা তাকাল যায়েদ ও ফাতিমার দিকে। বলল, ‘হ্যাঁ বোন এবার যেতে হবে ‘সাও তোরাহ’ দ্বীপে।’
মলিন হয়ে উঠল যায়েদ, ফাতিমা ও লতিফা কামালের মুখ। ফাতিমাই আবার বলল, সেদিন প্রফেসর জ্যাক সাইমনের কাছে সাও তোরাহ দ্বীপের যে পরিচয় শুনেছি, তাতে আমার মনে হয়েছে ওটা রূপকথার এক দানবীয় দ্বীপ। ওখানে যেতে হলে সৈন্য-সেনাপতি দরকার। আপনি সত্যিই সেখানে যাবেন ভাইয়া? ভারি কন্ঠ ফাতিমার।
আহমদ মুসা ম্লান হাসল। বলল, ‘ওটা রূপকথার দ্বীপ নয় ফাতিমা, আটলান্টিকের বুকের এক বাস্তব সত্য। আর ওটা দানবীয় দ্বীপ নয়, আমার অনুমান সত্য হলে ওটা কিছু অমানুষের অক্টোপাশে বাঁধা একটা অশ্রুর দ্বীপ, এক ‘নিউ গুলাগ’। ওখানে যেতে সৈন্য-সেনাপতির দরকার নেই, দরকার শুধু মানুষের প্রতি মমতার অস্ত্র।’
‘আপনি কি নিশ্চিত ভাই সাহেব, ওখানেই কামাল সুলাইমানদের রাখা হয়েছে? বলল মিসেস লতিফা কামাল।
‘কম্পিউটারের ডকুমেন্টগুলো পাওয়ার পর আমি নিশ্চিত হয়েছি, সাও তোরাহ দ্বীপেই বন্দীদের রাখা হয়েছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তাই যদি হয়, তাহলে পুলিশ ও সরকারকে বলতে পারি এবং সরকার দ্রুত তাদের উদ্ধারের ব্যাবস্থা করতে পারে।’ বলল লতিফা কামাল।
‘যে কম্পিউটার থেকে আমরা তথ্য পেয়েছি সে কম্পিউটার এখন পুলিশের হাতে। পুলিশ তাদের প্রেস ব্রিফিংকালে সাও তোরাহ দ্বীপের কথা গোপন করেছে। এটা দুই কারণে হতে পারে, এক, কৌশলগত কারণে পুলিশ এটা প্রকাশ করেনি। দুই, পুলিশ উদ্দেশ্যমূলকভাবেই এই তথ্যটা গায়েব করেছে। আমার যতদুর মনে হচ্ছে পুলিশকে দিয়ে এটা গায়েব করানো হয়েছে। কা্রণ পুলিশ সাও তোরাহ দ্বীপের ব্যাপারে কোন এ্যাকশনে যাবার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এই অবস্থায় সাও তোরাহ দ্বীপের সন্ধান যদি পুলিশকে বা সরকারকে দেয়া হয়, তাহলে এ খবর সংগে সংগেই শত্রুদের কানে পৌছে যাবে এবং শত্রুরা যখনই জানবে, সাও তোরাহ দ্বীপের কথা ফাঁস হয়ে গেছে, সংগে সংগেই বন্দীদেরকে ওরা সাও তোরাহ দ্বীপ থেকে অন্য কোথাও সরিয়ে নিতে পারে, এমনকি হত্যাও করে ফেলতে পারে।’
আহমদ মুসার শেষ কথায় ভীষন কেঁপে উঠেছে মিসেস লতিফা কামাল, ফাতিমা ও যায়েদ। তাদের সবার মুখ পাংশু হয়ে গেছে। মিসেস কামাল আর্তকন্ঠে বলে উঠল, ‘ভাই সাহেব আমি আমার কথা প্রত্যাহার করছি।
সরকার কিংবা পুলিশকে জানানোর দরকার নেই।’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘তাহলেই দেখুন, আমাদের সেখানে যাওয়ার কোন বিকল্প নেই।’ আহমদ মুসা থামল।
তিনজনের কেউ কোন কথা বলল না।
কিছুক্ষণ পর যায়েদ ধীরে ধীরে বলল, ‘ভাইয়া আমরা সেখানে যেতে পারি না? আমরা একসাথে যাতে আপনার সংগে কাজ করতে পারি, এ জন্যেই তো আপনি বিয়ে করিয়েছেন।’
‘না যায়েদ, এই অভিযান ফাতিমার জন্য উপযুক্ত নয়।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ঠিক আছে তাহলে আমাকে নিন। তাহলে এই অভিযানে স্পুটনিক পরিবারের অংশ গ্রহণও থাকল।
‘না যায়েদ ফাতিমা ও স্পুটনিক পরিবারের সাথে তুমি থাক।’
‘বুঝেছি আমি যোগ্য নই।’
‘অযোগ্যতার কোন প্রশ্ন নেই যায়েদ। হাসান তারিক ছাড়াও ডজন ডজন যোগ্য সহকর্মী আছে যারা ডাক পেলেই ছুটে আসবে। তাদের বাদ দিয়ে আমি হাসান তারিককে নিচ্ছি কেন? নিচ্ছি এই কারণে যে, সে ইহুদীবাদী বিশেষজ্ঞ হওয়া ছাড়াও একজন মেরিন ইঞ্জিয়ার। এই অভিজানে যারা যাবে তাদের এই জ্ঞানের দরকার হবে।’ আহমদ মুসা বলল।
মাথা নিচু করল। কোন কথা বলল না যায়েদ।
মুখ তুলল মিসেস লতিফা কামাল। বলল, ‘আমি গর্বিত ভাই সাহেব আল্লাহ আপনার মত একজনকে মুসলমানদের মধ্যে সৃষ্টি করেছেন। আপনাকে আমাদের বুক ভরা কৃতজ্ঞতা ও দোয়া ছাড়া দেবার কিছু নেই।’ শেষে কান্নায় রুদ্ধ হয়ে গেল লতিফা কামালের কন্ঠস্বর।
ফাতিমা কিছু বলতে যাচ্ছিল তার আগেই আহমদ মুসা হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দ্রুত বলে উঠল, ‘আমার খুব ক্ষুধা লেগেছে। অনেক্ষণ ধরে নাস্তা টেবিলে অপেক্ষা করছে। চলো উঠি। আমাকে এখনি একটু বাইরে বেরুতে হবে।’
বলে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
তার সাথে সাথে ফাতিমা, যায়েদ ও লতিফা কামালও উঠল।

লিবসন শহরতলীতে অন্ধকার ঘেরা আলোকজ্জ্বল এক বাড়ি। বাড়িটার ড্রইংরুমে বসে আছে লালমুখ দীর্ঘদেহী একজন মানুষ। তার চোখে-মুখে দারুন উত্তেজনা। বেশিক্ষণ সে বসে থাকতে পারছে না। উঠে পায়চারি করে বেড়াচ্ছে ঘরময়। মাঝে মাঝেই তাকাচ্ছে টেলিফোনের দিকে, আবার ঘড়ির দিকেও। বুঝা যাচ্ছে আকাঙিখত একটা টেলিফোন কল সে পাচ্ছে না, অন্যদিকে সময় বয়ে যাচ্ছে।
লোকটির নাম মারিও জোসেফ। সে WFA এর লিসবন ষ্টেশন চীফ। সে এই মাত্র ইসরাইলী গোয়েন্দা সংস্থা সুত্রে খবর পেয়েছে, দু’জন মুসলমান নাম ভাড়িয়ে দুটি পর্তুগীজ পাসপোর্ট জোগার করেছে এবং আজ রাত ১২টার দিকে পর্তুগীজ ইয়ারে আজরস দ্বীপপুঞ্জের ‘লেজে’ এয়ারপোর্ট যাত্রা করছে। কোন নামে পাসপোর্ট কোন নামে টিকিট তার কিছুই জানা যায়নি। এই নাম জানার জন্যেই মারিও জোসেফ পাগল হয়ে উঠেছে। নাম জানলে তবেই তাদের আজোরস দ্বীপপুঞ্জে যাওয়া আটকানো যাবে।
ওয়ার্ল্ড ফ্রিডম আর্মি সম্প্রতি সিদ্ধান্ত নিয়েছে কোন মুসলমানকেই আজোরস দ্বীপপুঞ্জে যেতে দেয়া হবে না। এই সিদ্ধান্তের পর অনেকের যাত্রা তারা ঠেকিয়েছে। এ বিষয়টা ইতিমধ্যে মুসলমানদের মধ্যে জানা জানি হয়ে গেছে। এরপর মুসলমানরা নাম ভাঁড়িয়ে আজোরসে যাবার চেষ্টা করছে। এ ধরনেরই একটা চেষ্টার খবর আজ মারিও জোসেফ পেয়েছে। যে কোন মুল্যে তাকে এদের এই যাত্রা বন্ধ করতে হবে। না পারলে আজর ওয়াইজম্যানের ক্রোধের আগুনে জ্বলে পুড়ে মরতে হবে।
টেলিফোন বেজে উঠল মারিও জোসেফের। পায়চারি করছিল মারিও জোসেফ। দাঁড়িয়ে পড়ে দ্রুত গিয়ে টেলিফোনের ভয়েস বোতামে চাপ দিল। সংগে সংগে ওপার থেকে কন্ঠ ভেসে এল, মিঃ মারিও জোসেফ দুঃখিত, বহু চেষ্টা করেও লোক দু’জনের নাম পাওয়া গেল না। তবে এই টুকু জানা গেছে, আজ রাত ১২ টার প্লেনের টিকেট যারা কিনেছে তারা সবাই শ্বেতাংগ তিনজন ছাড়া। একজন তুর্কি চেহারার এশীয় দু’টি টিকিট কিনেছে এবং একজন আফ্রিকান কিনেছে একটি। লিসবনের হোটেল চেক করে আরেকটা বিষয় জানা গেছে, গত সাত দিনে মাত্র তুর্কি চেহারার বা এশীয় দু’জন লিসবনের হোটেলে উঠছে এবং এরা দু’জনেই ভাস্কোডাগামা শেরাটন হোটেলের ৭১১ ও ৭১২ নাম্বার কক্ষে রয়েছেন।
এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে থামলো ওপারের কন্ঠটি। কন্ঠটি লিসবনের একজন শীর্ষ গোয়েন্দা অফিসারের।
‘ধন্যবাদ মি. এ্যানটোনিও। নাম দিতেনা পারলেও যে তথ্য দিয়েছেন, সেটা কম মূল্যবান নয়। আবারও ‘ধন্যবাদ আপনাকে।’
বলে টেলিফোন অফ করে দিল মারিও জোসেফ। তারপর সোফায় সোজা হয়ে বসেই ডাকল, ‘সিলভা।’
কোমরে রিভলবার ঝুলানো ষ্টেনগানধারী একজন ঘরে প্রবেশ করল।
লোকটি প্রবেশ করতেই মারিও জোসেফ বলল, ‘সবাই কে তৈরী হতে বল। দুটি গাড়ি রেডি কর। এখনি যাব ভাস্কোডাগামা শেরাটনে।’ কথা শেষ করেই উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘যাও, আমি তৈরী হয়ে আসছি।’
পাঁচ মিনিটের মধ্যেই বাড়িটা থেকে দুটি গাড়ি বেরিয়ে এল। একটি জীপ, অন্যটি মাইক্রো। গাড়ি দু’টি ছুটছে হোটেল ভাস্কোডাগামা শেরাটন লক্ষ্যে।

পরবর্তী বই
গুলাগ অভিযান

Top