৩৬. গুলাগ অভিযান

চ্যাপ্টার

‘চিন্তার কিছু নেই স্যার। ভাল খবরই আমরা আশা করছি।’ বলল জ্যাক শামির আজর ওয়াইজম্যানকে উদ্দেশ্য করে।
‘জ্যাক শামির WFA-এর একজন নেতা এবং আজোরস দ্বীপপুঞ্জের রাজধানী ‘পন্ট ডেলগাডা’র ষ্টেশন চীফ হিসেবে কাজ করছে বর্তমানে।
‘পাঁচ ঘন্টার জন্যে ওরা হেলিকপ্টার ভাড়া করেছিল। কিন্তু এখন পার হয়ে গেছে ৬ ঘন্টা। তারা অবশ্যই ফেরার কথা। কিন্তু তারা কিছু জানাচ্ছে না, আবার তাদের মোবাইলও বন্ধ। কারণটা তাহলে কি?’ বলল আজর ওয়াইজম্যান সামনে বসা জ্যাক শামিরকে লক্ষ্য করে।
আজর ওয়াইজম্যান কথা বলছে জ্যাক শামিরকে লক্ষ্য করে, কিন্তু তার চোখ জানালা পেরিয়ে আজোরস সাগরের উপর নিবদ্ধ।
আজোরস সাগরকে তার যতটা সুন্দর লাগতো, আজ ততটা সুন্দর লাগছে না। সুন্দরের পাশে সেখানে ভয়ংকর একটা রূপও সে দেখছে। মাত্র দুজন লোকে তার চল্লিশজন লোক শেষ করে দিল, এই ভয়ংকর চিন্তা যেমন তার সমগ্র সত্তাকে আচ্ছন্ন করেছে, তেমনি গ্রাস করছে যেন সামনের সাগরটাকেও।
জ্যাক শামির বলছিল, ‘এদিকটা ভাববার বিষয়ই বটে। তবে স্যার এটা ঘটতে পারে যেহেতু তারা পাঁচ ঘন্টার মধ্যে ফিরতে পারেনি।’
আজর ওয়াইজম্যান মুখ ফিরিয়ে নিল সাগরের দিক থেকে। তাকাল জ্যাক শামিরের দিকে। তার কথার প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে বলল, ‘কি যেন বললেন, পুলিশ প্রধান আসবেন, না আমাকে যেতে হবে?’
‘পুলিশ প্রধান মি. বারবোসা পোর্টে কি এক মিটিং-এ যাচ্ছেন, এদিক দিয়ে ফিরবেন, সে সময় এখানে উঠবেন।’
আবার আজর ওয়াইজম্যান সাগরের দিকে ফিরে তাকাল। কিছু বলতে যাচ্ছিল। এ সময় বেজে উঠল তার টেলিফোন।
ঘুরল আজর ওয়াইজম্যান মোবাইলের দিকে। তুলে নিল টেলিফোনটা।
ওপার থেকে বলে উঠল, ‘ডেভিড ডায়ার বলছি।’
‘তোমাদের কি খবর? আমাদের ওখানকার চীফ এডাম এরিয়েল কোথায়? এত দেরিতে টেলিফোন করছ কেন?’ এক সাথে প্রশ্নগুলো করে চুপ করল আজর ওয়াইজম্যান।
তারপর ওপারের কথা শুনতে লাগল আজর ওয়াইজম্যান। শুনতে গিয়ে মুখের ভাব পাল্টে যেতে লাগল তার। শেষে তার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গিয়ে রাগে-দুঃখে যেন কাঁপতে লাগল তার ঠোঁট।
সব শুনে শেষে ছোট্ট করে সে বলল, ‘ও দুজনকে ঐ তেরসিয়েরা দ্বীপ থেকে বের হতে দেয়া যাবে না। তোমরা অপেক্ষা কর। আমি ব্যবস্থা করছি।’
বলে টেলিফোন রেখে দিল আজর ওয়াইজম্যান।
শ্বাসরুদ্ধ অবস্থায় অপেক্ষা করছিল জ্যাক শামির। আজর ওয়াইজম্যান টেলিফোন রাখতেই বলল, ‘ওখানকার কি খবর স্যার।’
টেলিফোন রাখার পর মুহূর্তকাল সোজা হয়ে মাথা নিচু করে বসে থাকল চেয়ারে। বলল, ধীরে ধীরে, ‘আমাদের হেলিকপ্টার অভিযান ধ্বংস হয়েছে। গ্রাউন্ডে নামানো দশজন কমান্ডোই নিহত। একটি হেলিকপ্টার ধ্বংস হওয়ার ফলে একজন ক্রুসহ এডাম এরিয়েল নিহত হয়েছে। আরেকটা হেলিকপ্টারও ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। ডেভিড ডায়ার আহত। ঐ হেলিকপ্টারের একজন ক্রু মাত্র অক্ষত আছে।’
বিস্ময় ও বেদনার ধাক্কার সংগে সংগে কথা বলতে পারল না জ্যাক শামির। নিজেকে সামলে নিয়ে একটু পর বলল, ‘এমন অবিশ্বাস্য ঘটনা আবারও ঘটতে পারল কি করে? ওদের সাথে আর কেউ কি যোগ দিয়েছে?’
‘তার কোন প্রমান পাওয়া যায়নি। প্রথম অভিযানের প্রথম আক্রমণের পর যে দুজন বেঁচে গিয়েছিল, তারা স্বচক্ষে দুজনকেই মাত্র দেখেছে। মোবাইল করার পর ওরাও সম্ভবত নিহত হয়।’ বলল আজর ওয়াইজম্যান।
জ্যাক শামির কিছু বলবে এমন সময় এটেনড্যান্ট ঘরে প্রবেশ করে জ্যাক শামিরকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘স্যার, পুলিশ প্রধান মি. বারবোসা এসেছে।’
সংগে সংগে উঠে দাঁড়াল জ্যাক শামির ও আজর ওয়াইজম্যান।
তারা ঘরের বাইরে গিয়ে স্বাগত জানাল আজোরস দ্বীপপুঞ্জের পুলিশ প্রধান বারবোসাকে।
তিনজনই ঘরে এসে তিন সোফায় মুখোমুখি বসল।
পুলিশ প্রধান বারবোসা বসতে বসতেই বলে উঠল, ‘মি. ওয়াইজম্যান আপনাকে খুব চিন্তিত দেখাচ্ছে। ব্যাপার কি?’
আজর ওয়াইজম্যান ম্লান হাসল। বলল, ‘দুজন সন্ত্রাসী মুসলমান আমাদের সাংঘাতিক কষ্ট দিচ্ছে মি. বারবোসা।’
‘কোথায় তারা? কোন কেস করেছেন?’ জিজ্ঞেস করল পুলিশ প্রধান।
‘সবে গত রাতে তারা ‘লিজে’ এয়ারপোর্টে নেমে তেরসিয়েরা দ্বীপে প্রবেশ করেছে।’ আজর ওয়াইজম্যান বলল।
‘আজোরস দ্বীপপুঞ্জে মুসলমানদের একটা সন্ত্রাসী দলের প্রবেশ করার পরিকল্পনা আছে, আপনাদের এই ইনফরমেশনের ভিত্তিতে সরকার তো আজোরস দ্বীপপুঞ্জে মুসলমানদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন। তারা প্রবেশ করল কিভাবে?’ বলল পুলিশ প্রধান।
‘ওরা ছদ্মনাম নিয়ে প্রবেশ করেছে।’ আজর ওয়াইজম্যান বলল।
‘তাদের ছদ্মনাম জানেন কি না?’
‘হ্যাঁ। একজনের নাম ‘রুই জর্জ’, অন্যজনের নাম ‘পেড্রো পেট্রিট।’
‘পুলিশকে আগে জানাননি কেন?’ জিজ্ঞাসা পুলিশ প্রধানের।
‘ওরা এয়ারপোর্টে নামার পর সন্দেহ হওয়ায় ওদের ফলো করতে গিয়ে আমরা এটা জানতে পেরেছি।’ উত্তর দিল আজর ওয়াইজম্যান।
‘কেন আপনারা সন্দেহ করলেন? আমাদের পুলিশ তো সন্দেহ করতে পারেনি।’ বলল পুলিশ প্রধান।
‘এয়ারপোর্টের বাইরে ওদের কথাবার্তা শুনে আমাদের লোকদের সন্দেহ হয়। পরে খোঁজ নিয়ে এই তথ্য জানা গেছে।’ আজর ওয়াইজম্যান বলল।
‘এখন বলুন ওরা কি কষ্ট দিচ্ছে, আমরা কি করতে পারি? আর একটা উপকার করুন, আপনারা যেহেতু প্রথম জেনেছেন তাই আপনারা ওদের দুজনের বিরুদ্ধে একটা মামলা দায়ের করুন যে, তারা নাম ভাঁড়িয়ে অবৈধভাবে এখানে প্রবেশ করেছে।’ বলল পুলিশ প্রধান।
‘আমাদের লোকরা ওদের তাড়া করলে ওরা আশ্রয় নেয় গনজালো উচ্চভূমিতে। আমাদের দুটি হেলিকপ্টার ওদের তাড়া করেছিল। ওদের ধরতে চেষ্টা করতে গেলে ওরা আমাদের একটা হেলিকপ্টার ধ্বংস করে এবং দশজন লোককে হত্যা করে। অন্য হেলিকপ্টারও আমাদের ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।’ বলল আজর ওয়াইজম্যান। কণ্ঠে সে অসহায় সুর ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করল।
ভ্রুকুঞ্চিত হয়ে উঠেছে পুলিশ প্রধানের। বলল, ‘সাংঘাতিক ঘটনা ঘটেছে। পুলিশকে না জানিয়ে আপনারা এভাবে গেলেন কেন? সন্ত্রাসীদের বাগে আনা কি আপনাদের কাজ?’
‘পুলিশকে জানানোর আমরা সুযোগ পাইনি। ওরা পালিয়ে যাবে এই আশংকায় আমাদের লোকরা তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিয়ে ওদের অনুসরণ করে।’ আজর ওয়াইজম্যান বলল।
‘একটা কথা বলুন মি. ওয়াইজম্যান, যে কাজ পুলিশের সে কাজ আপনারা কাঁধে তুলে নিতে গিয়েছিলেন কেন? ওদের সাথে আপনাদের কি কোন বিশেষ শত্রুতা আছে?’ বলল পুলিশ প্রধান।
একটু বিব্রত দেখাল আজর ওয়াইজম্যানকে। একটু চুপ করে থাকল, তারপর বলল ধীর কণ্ঠে, ‘মুসলিম সন্ত্রাসীরা আমাদের ইসরাইল রাষ্ট্রের বিরোধী ছিল, আমাদের অস্তিত্বেরও ওরা বিরোধী। আমাদের অবস্থান যেখানে ওদের সন্ত্রাসও সেখানে। বিশ বছর আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল, কিন্তু যুদ্ধটা তারা শেষ করেনি। বরং মার্কিনীরা এখন ক্রমান্বয়ে হয়ে উঠছে মুসলমানদের বন্ধু। এর ফলে ওদের সন্ত্রাসের প্রধান লক্ষ্য হয়ে পড়েছি আমরা। এই আজোরস দ্বীপপুঞ্জেও ওরা আমাদের শান্তিতে থাকতে দিতে চায় না।’ থামল আজর ওয়াইজম্যান। শেষ দিকে তার কণ্ঠ হতাশ ও করুণ হয়ে পড়েছিল।
সহানুভূতি ফুটে উঠল পুলিশ প্রধান বারবোসার চোখে-মুখে। বলল, ‘মি. ওয়াইজম্যান চিন্তা করবেন না। আমাদের এই দ্বীপপুঞ্জ শান্তির দেশ। এখানে কোন সন্ত্রাসীর জায়গা হবে না। আপনি দয়া করে একটা অভিযোগ দায়ের করুন। আমরা দেখছি ব্যাপারটা?’
‘কিন্তু স্যার ব্যাপারটা খুব জরুরী। এই মুহূর্তে ওদের যদি পাকড়াও করা না যায়, তাহলে আরও খুনোখুনি তারা করবে। আর একবার নাগালের বাইরে চলে গেলে ওদের খুঁজে পাওয়া যাবে না।’ বলল আজর ওয়াইজম্যান।
‘ওরা কোথায় এখন?’ জিজ্ঞেস করল পুলিশ প্রধান।
‘আমরা মনে করছি, গনজালো উচ্চভূমি থেকে দক্ষিণ দিকে সরে ট্রাইবাল এরিয়া সিলভার ভ্যালি’তে তারা প্রবেশ করেছে। এখান থেকে তাদের পরিকল্পনা মোতাবেক দ্বীপপুঞ্জের অন্য কোথাও যাওয়া তাদের জন্যে সহজ হবে।’ আজর ওয়াইজম্যান বলল।
‘ঠিক আছে মি. ওয়াইজম্যান, আমি তেরসিয়েরা দ্বীপের পুলিশ প্রধানকে নির্দেশ দিচ্ছি তিনি যেন সিলভার ভ্যালি’ থেকে বেরুবার পথগুলোর উপর নজর রাখেন এবং এই ঘটনার তদন্ত যেন তিনি শুরু করেন।’ বলল পুলিশ প্রধান।
একটু থেমেই আবার সে বলে উঠল, ‘আমাকে এখন উঠতে হয় মি. ওয়াইজম্যান।’
আজর ওয়াইজম্যান উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমার অফিসে আপনার এই পদধুলির জন্যে আমি কৃতজ্ঞ মি. বারবোসা। আরও ধন্যবাদ সহযোগিতার আশ্বাস পেয়েছি তার জন্যে।’
বলে আজর ওয়াইজম্যান হাত বাড়ালো পুলিশ প্রধানের দিকে।
‘ধন্যবাদ। বাই।’ বলে হ্যান্ডশেক করে বেরিয়ে গেল পুলিশ প্রধান।
গাড়ি বারান্দা পর্যন্ত পুলিশ প্রধানকে পৌছে দিয়ে ফিরে এল আজর ওয়াইজম্যান ও জ্যাক শামির।
বসল তারা আবার মুখোমুখি সোফায়।
সোফায় গা এলিয়ে ক্রুব্ধ কণ্ঠে আজর ওয়াইজম্যান বলল, ‘এই বেটা পুলিশ প্রধান জার্মান অরিজিন। নাজিদের রক্ত আছে এর শরীরে। ইহুদীরা যেন ওর কাছে কিছুই নয়। বলে তদন্ত করব। গোল্লায় যাক তোর তদন্ত। তেরসিয়েরার পুলিশ প্রধান তোর চেয়ে হাজার গুণ ভাল তার সাথে অলরেডি যোগাযোগ হয়েছে। ডলার একটু বেশি চেয়েছে। তা হোক, আমাদের আজকের প্রয়োজনের চেয়ে এটা বড় কিছু নয়।’
‘তাহলে তো মি. বারবোসাকে এসব বলে ভুল হলো। তিনি যদি এখন তেরসিয়েরা দ্বীপের পুলিশ প্রধানের কাজে হস্তক্ষেপ করেন।’ বলল জ্যাক শামির।
‘তুমি এসব নিয়ে ভেব না। এখন তুমি বল, আজোরস এর শীর্ষ সন্ত্রাসী নেতা ‘ফিগো’কে খবর দিয়েছ?’ আজর ওয়াইজম্যান বলল।
জ্যাক শামির ঘড়ির দিকে তাকাল। বলল, ‘খবর দিয়েছি। এখনি এসে পড়বে।’
‘ঠিকই বলেছ তুমি, পুলিশ প্রধান মি. বারবোসাকে এসব কথা না বললেই ভাল ছিল। এদিকটা ভেবেই কিন্তু আমি তোমাকে ফিগোকে খবর দিতে বলেছিলাম। মাঝখানে আবার বলে ফেললাম পুলিশ প্রধানকে। থাক, একদিক দিয়ে ভালই হলো। ওনাকে তো জানিয়েই দিলাম, ত্বরিৎ কিছু না করলে ওরা খুনোখুনির সুযোগ পেয়ে যাবে। এখন এই দ্বীপে বিশেষ করে সিলভার ভ্যালি অঞ্চলে যা কিছুই ঘটুক এর জন্যে দায়ী হবে আহমদ মুসা। এটা ভালই হলো আমাদের জন্যে।’ বলল আজর ওয়াইজম্যান।
কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছিল জ্যাক শামির। দরজায় নক করে ঘরে ঢুকল এ্যাটেনডেন্ট। বলল জ্যাক শামিরকে, ‘স্যার মি. ফিগো নামে একজন লোক এসেছেন।’
শুনেই উঠে দাঁড়াল জ্যাক শামির। ‘স্যার আপনি বসুন। আমি ওঁকে নিয়ে আসছি।’ বলে বেরিয়ে গেল জ্যাক শামির।
মিনিট খানেক পরেই বিরাট বপু একজনকে নিয়ে ঘরে ঢুকল জ্যাক শামির।
সাদাকালো ষ্ট্রাইফের টিসার্ট গায়ে। পরনে সাদা প্যান্ট। মাথায় সাদা হ্যাট।
এরই নাম আলফ্রেড ফিগো।
একেবারে খাঁটি পর্তুগীজ চেহারা। দেখেই মনে হয় সিউর এক জলদস্যু। তবে ফিগো জলে দস্যুতা করে না। সে আজোরস দ্বীপপুঞ্জের আন্ডারওয়ার্ল্ডের নেতা। তার বাহিনী এই দ্বীপপুঞ্জে অপ্রতিদ্বন্দ্বী।
ফিগো ঘরে ঢুকতেই আজর ওয়াইজম্যান উঠে দাঁড়াল। কয়েক ধাপ এগিয়ে হ্যান্ডশেক করে বলল, ‘ওয়েলকাম ওয়েলকাম, আমি আপনারই অপেক্ষা করছি।’
‘গুড ইভনিং স্যার’ বলে বসতে বসতে আবার বলে উঠল, ‘মনে হলো পুলিশ প্রধান এখান থেকে বেরিয়ে গেল?’
‘হ্যাঁ, এসেছিলেন। পোর্ট থেকে ফেরার পথে একটু ঢুঁ মেরে গেলেন। অনেক দিন থেকে জানাশোনা তো!’ বলল আজর ওয়াইজম্যান।
‘বলুন স্যার। আমাকে ডেকেছেন কেন? আমরা আপনার কোন কাজে লাগতে পারি?’ বলল ফিগো। একদম নিরস কণ্ঠ তার।
‘মি. ফিগো, আমরা আপনার সাহায্য চাই।’ আজর ওয়াইজম্যান বলল।
‘কি কাজ? কোন ধরনের কাজ?’ বলল ফিগো।
‘আমাদের বিদেশী দুজন শত্রু প্রবেশ করেছে তেরসিয়েরা দ্বীপে। গত রাতেই ‘লিজে’ এয়ারপোর্ট হয়ে এসেছে ওরা। আমাদের লোকরা তাদের তাড়া করেছিল। কিন্তু আমাদের লোকদের হত্যা করে ওরা পালিয়েছে। এ দুজনকে জীবন্ত অথবা মৃত আমরা চাই।’ আজর ওয়াইজম্যান বলল।
‘ওরা কোথায়, মানে কোন অঞ্চলে এখন?’ জিজ্ঞেস করল ফিগো।
‘দুপুরে পাওয়া তথ্য অনুসারে ওরা সিলভার ভ্যালিতে প্রবেশ করেছে। দুএকদিন সময় পেলে ওরা অন্য দ্বীপে পালাবে। আমরা চাই তেরসিয়েরা দ্বীপেই যাতে ওদের জীবনের ইতি ঘটে।’ বলল আজর ওয়াইজম্যান।
‘সিলভার ভ্যালি হলো গনজালোদের এলাকা। ওখানে তো কোন বিদেশী আশ্রয় পাবার কথা নয়।’ ফিগো বলল।
‘আশ্রয় হয়তো পাবে না। ওদিক দিয়ে হয়তো তারা পালাবার চেষ্টা করবে। আমরা চাই তারা পালাতে না পারুক। আমরা চাই তারা মরুক, অথবা ধরা পড়ুক।’ বলল আজর ওয়াইজম্যান।
‘বলুন আমাদের কি করতে হবে।’ বলল ফিগো।
‘ওরা ঐ অঞ্চল থেকে পালাবার আগেই ওদের ধরতে হবে, না হয় মারতে হবে।’ আজর ওয়াইজম্যান বলল।
‘আমরা কি পাব?’ বলল ফিগো।
‘বলুন কি চান?’ আজর ওয়াইজম্যান বলল।
‘কম করে হলেও মিলিয়ন ডলারের নিচে আমরা এসব কাজে হাত দেই না।’ বলল ফিগো।
‘আমরা রাজী। কিন্তু অর্ধেকটা এখন পাবেন, বাকি অর্ধেকটা পাবেন কাজ শেষ হওয়ার পর।’
‘ঠিক আছে। তাই হবে। আর কোন কথা আছে?’ বলল ফিগো।
‘আমরা দ্রুত কাজ চাই। আগামী তিন দিনের মধ্যে সবকিছুর ইতি ঘটাতে হবে। প্রথম সুযোগেই তারা দ্বীপ ছেড়ে পালাবে। সেটা হোক আমরা তা চাই না।’ বলল আজর ওয়াইজম্যান।
‘সেই দুজন লোকের ফটো আমাদের দিন এবং টাকাও।’ বলে ফিগো উঠে দাঁড়াল।
আজর ওয়াইজম্যান ইশারা করল জ্যাক শামিরকে।
শামির চলে গেল। মিনিট খানেক পরেই প্রবেশ করল বড় একটা ব্রীফকেস নিয়ে।
আজর ওয়াইজম্যান ব্রীফকেস খুলে ফিগোর দিকে মেলে ধরে বলল, ‘আমরা টাকা নিয়ে দর কষাকষি করিনি। আশা করি, কাজের ক্ষেত্রেও আমাদের কোন ওজর শুনতে হবে না। গুণে নিন টাকাগুলো।’
ফিগো ব্রীফকেস হাতে নিয়ে তা বন্ধ করে দিয়ে বলল, ‘আমি কোন সময়ই টাকা গুণে নেই না। আমরা বিশ্বাসের উপর বিজনেস করি।’
‘গুডবাই’ বলে ঘর থেকে গট গট করে চলে গেল ফিগো।
স্বস্তির চিহ্ন ফুটে উঠল আজর ওয়াইজম্যানের চোখে-মুখে।
‘বিরাট একটা কাজ হলো স্যার।’ ফিগো চলে যাওয়ার পর বলল জ্যাক শামির।
‘কাজ হলো নয়, কাজ দেয়া হলো মাত্র। ঈশ্বর সাহায্য করুন।’ বলল আজর ওয়াইজম্যান।
‘ফিগোদের অসাধ্য কিছু নেই স্যার। পুলিশও তাদের হাতের মুঠোয়।’ জ্যাক শামির বলল।
‘তোমার কথা সত্য হোক শামির।’ বলল আজর ওয়াইজম্যান।
‘আমিন।’ বলে উঠল জ্যাক শামির।

আহমদ মুসা মাগরিবের নামাজ পড়ে হোটেলের কক্ষ থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এসে বসেছে।
হোটেলটি দোতলা। বারান্দাটা হোটেলের দক্ষিণের ব্যালকনি।
ব্যালকনির নিচেই রাস্তা। রাস্তাটা সিলভার ভ্যালির গভীর থেকে এসে পুবে কিছু দূর এগিয়ে গিয়ে দক্ষিণ দিকে বাঁক নিয়ে দক্ষিণ উপকূলের সবচেয়ে বড় শহর আংগ্রা ডে হেরেমা বন্দর পর্যন্ত এগিয়ে গেছে। এই রাস্তারই আরেকটা শাখা দ্বীপের পূব উপকূলের একটা অখ্যাত বন্দরে সাও সিভালায় গিয়ে শেষ হয়েছে।
রাস্তাটাকে ঠিক রাস্তা বলা যায় না। বলা যায় রাস্তার একটা চিহ্ন এটা। ঘোড়া ও মানুষের যাতায়াত এই পথ-চিহ্নের সৃষ্টি করেছে।
রাস্তার পরেই নিউ টাগুস নদী। রাস্তাটা নদীকে অনুসরণ করেই এগিয়ে গেছে আংগ্রা ডে হেরেমা পর্যন্ত। পাহাড় ও চড়াই-উৎরাই বাধার কারণে রাস্তাটা সব সময় নদীর তীর বেয়ে এগুতে পারেনি।
নদীটা খুবই খরস্রোতা। সিলভার ভ্যালিতেই শুধু এটা কিছুটা নাব্য, তারপর গোটাটাই অনাব্য।
হোটেলটা সিলভার ভ্যালির পূব মুখের উপর দারোয়ানের মত দাঁড়িয়ে।
হোটেলটা উত্তর থেকে এগিয়ে আসা একটা পাহাড়-শ্রেণীর দক্ষিণ প্রান্তের শেষ টিলার উপরে। হোটেলের পরেই রাস্তা, রাস্তার পর নদী এবং নদীর পরেই পাহাড়-শ্রেণীটা প্রথমে দক্ষিণে কিছু দূর এগিয়ে দুভাগ হয়ে একটা দক্ষিণে, অন্যটি পশ্চিমে এগিয়ে গেছে।
পুব দিক থেকে সিলভার ভ্যালিতে প্রবেশের পথ এই একটাই। এই প্রবেশ পথেরই দ্বাররক্ষী যেন হোটেলটা।
হোটেলটাও আবার ঠিক হোটেল নয়। অনেকটাই সরাইখানার মত। সিলভার ভ্যালিতে উৎপাদিত শস্য, ফল-মুল কেনার জন্যে যে ব্যাপারী, পাইকার ও যেসব ফড়িয়ারা উপত্যকায় আসেন, তারাই এই সরাইখানায় উঠে থাকেন। হোটেল বা সরাইখানায় নিয়মিত রান্নার কোন ব্যবস্থা নেই। অতিথি কেউ আসলে তার জন্যে রান্না হয়। এই হোটেলের মালিক ও তার পরিবার থাকেন পাশেই পাহাড়ের এক গুহাকে কেন্দ্র করে তৈরি বাড়িতে।
হোটেলের মালিক নব্বই বছর বয়সের এক বৃদ্ধ। নাম নুনো কাপুচো। আফ্রিকান, রেড ইন্ডিয়ান ও এস্কিমো সবারই কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য নিয়ে তার চেহারা। তার ভাষাও এই ধরনের মিশ্র। গত দেড় দিনে আহমদ মুসার সাথে তার বেশ ভাব হয়ে গেছে। কাপুচো ইতিমধ্যেই আহমদ মুসাকে গর্বের সাথে জানিয়েছে, তারাই দ্বীপপুঞ্জের আদি বাসিন্দা, তাদের ভাষাই দ্বীপপুঞ্জের নিজস্ব ভাষা। বিদেশীদের একদিন এই দ্বীপপুঞ্জ ত্যাগ করতেই হবে। তবে আহমদ মুসাকে সে বিদেশী বলে না, বলে মেহমান।
আহমদ মুসা ইজি চেয়ারে বসে ছিল। তার মুখ পশ্চিমে সিলভার ভ্যালির দিকে। জোৎস্না-স্নাত ভ্যালির বুকে তার চোখ দুটি নিবদ্ধ। গত দেড়টা দিন সে ভ্যালিতে ঘুরে বেড়িয়েছে। উপত্যকাটার নাম সিলভার ভ্যালি। নামটা স্বার্থক। সিলভার ভ্যালির চারদিকেই পাহাড়। পাহাড় থেকে ভ্যালিতে নেমে এসেছে অনেক সফেদ ঝর্ণা। এই ঝর্ণাগুলো সমৃদ্ধ ও বেগবান করেছে উপত্যকার একমাত্র নদী নিউ টাগুসকে। এই পাহাড়ী টাগুসের জন্ম আরও পশ্চিমের উঁচু পাহাড়ে। সফেদ ঝর্ণা, রূপালী নদী, সবুজ সোনালী শস্যক্ষিত এবং ফলের অজস্র বাগান ও সবুজে আচ্ছাদিত পাহাড়ের দেয়াল অপরূপ করে তুলেছে সিলভার ভ্যালিকে। সন্ধ্যার হালকা আঁধারের ওপর রূপালী জ্যোৎস্নার বিচ্ছুরণ এক মায়াময় দৃশ্যের সৃষ্টি করেছে উপত্যকাটিকে ঘিরে। আহমদ মুসা এই দৃশ্যই উপভোগ করছে।
উপত্যকার গভীরে তারার মত একটা আলো জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। আহমদ মুসা নিশ্চিত ওটা সার্গিও ভ্যানিসাদের বাড়ির আলো।
সার্গিও ভ্যানিসাদের বাড়ি সিলভার উপত্যকার মাঝখানে একটা পাহাড়ের উপর। পাহাড়ের গোড়া দিয়ে বয়ে যাচ্ছে নিউ টাগুস নদী।
চারদিকের সবুজের মাঝখানে ওদের সাদা পাথরের সফেদ বাড়িটা ছবির মত সুন্দর।
কিন্তু আহমদ মুসা তাদের বাড়িতে উঠতে রাজী হয়নি। আহমদ মুসা ওদের বাড়িতে উঠতে অস্বীকার করলে কেঁদে ফেলেছিল ভ্যানিসা। সার্গিও কাঁদেনি বটে, কিন্তু দুঃখ পেয়েছিল, কিছুটা অপমানিতও বোধ করেছিল। আহমদ মুসা ওদের বুঝাতে চেষ্টা করলে সার্গিও বলেছিল, ‘আপনি সিলভার ভ্যালিতে এলেন, অথচ আমাদের বাড়িতে না উঠে গিয়ে থাকবেন চাল-চুলোহীন একটা সরাইখানায়, এটা আমাদের জন্যে চরম দুঃখের এবং অপমানেরও।’ ভারী হয়ে উঠেছিল সার্গিওর কণ্ঠস্বর।
গম্ভীর হয়ে উঠেছিল আহমদ মুসা। ধীর কণ্ঠে বলেছিল, ‘তোমাদের ওখানে উঠতে পারলে তোমাদের চেয়ে আমিই খুশি হতাম বেশি। কিন্তু বৃহত্তর স্বার্থে আমি এই খুশিকে কুরবানী দিতে চাই।’
‘সে স্বার্থটা কি?’ ত্বরিত কণ্ঠে বলে উঠেছিল ভ্যানিসা।
‘তোমরা কঠিন ও মহান এক দায়িত্ব পালন করছ তোমাদের জনগনের পক্ষে। আমি চাই, কোনভাবেই যেন আমার দ্বারা তোমাদের এ আন্দোলনের কোন ক্ষতি না হয়।’ আহমদ মুসা বলেছিল।
‘এ প্রশ্ন উঠছে কেন? আপনি যাচ্ছেন আমাদের বাড়িতে। আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের ক্ষতির প্রশ্ন এখানে ওঠে কি করে?’ বলেছিল ভ্যানিসা।
‘তোমাদের বাড়িতে যাওয়া বড় কথা নয়। এই যাওয়ার মাধ্যমে তোমাদের সাথে আমার পরিচয় ও সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা সবাই জানবে, এটা বড় কথা। এই বিষয়টাকে তোমাদের শত্রুরা, তোমাদের সরকার তোমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পারে।’ আহমদ মুসা বলেছিল।
‘কিভাবে?’ বলেছিল ভ্যানিসা।
‘বলবে, এটা ওদের স্বাধীনতা আন্দোলন নয়, বরং দেশ বিক্রি করার একটা ষড়যন্ত্র। ওরা দেশকে বিদেশ, বিধর্মী ও মৌলবাদের চারণক্ষেত্র বানাতে চায়। সম্প্রতি সন্ত্রাসী ও মৌলবাদী নেতা আহমদ মুসা নাম ভাড়িয়ে এদেশে প্রবেশ করে ওদের বাড়িতে গোপনে অবস্থান করেছে। সুতরাং গনজালো পরিবার বিদ্রোহী, ষড়যন্ত্রকারী ও বিদেশীদের এজেন্ট। ব্যস, কেল্লাফতে। তোমরা তো বলতে পারবে না আমি আসিনি, আমি তোমাদের সাথে থাকিনি।’ আহমদ মুসা বলেছিল।
সংগে সংগে কথা বলেনি সার্গিও ও ভ্যানিসা। তাদের চোখে-মুখে ফুটে উঠেছে ভাবনার চিহ্ন।
একটু পরে ম্লান হেসেছিল সার্গিও। বলেছিল, ‘ঠিক বলেছেন ভাই, এই কথা তারা বলতে পারে।’
‘বলতে পারে নয় মি. সার্গিও, তারা বলবে। আরও একটা কথা মি. সার্গিও। আমার আশংকা যদি সত্য হয়, তাহলে নিশ্চিত জানবেন ওরা আমাদের সন্ধানে আসছে। ওরা এসে পড়ার আগেই যদি আমি সিলভার ভ্যালি ত্যাগ করতে না পারি, তাহলে সংঘাত বাধতে পারে। সেই সংঘাতে গনজালো পরিবার জড়িয়ে পড়লে মহাক্ষতি হবে আপনাদের পরিবারের এবং আপনাদের মহান আন্দোলনের। আমি যদি এই ভ্যালিতেই আলাদা থাকি, তাহলে সংঘাত বাধলেও সেটা হবে আমার ও ওদের মধ্যে। মনে করা হবে, আমি ভ্যালিতে এসে লুকিয়েছিলাম। ভ্যালির কারো সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই।
ম্লান হাসি ফুটে উঠেছিল ভ্যানিসার মুখেও। বলেছিল আহমদ মুসা থামতেই, ‘আপনার কথা সত্য ভাইয়া, কিন্তু এখন আপনার নিজের কথা ভাবার কথা, আমাদের কথা ভাবছেন কেন?’
‘কৌশল নির্ধারণ করতে হলে সবটা বিষয়ই এক সাথে ভাবতে হবে ভ্যানিসা।’ বলেছিল আহমদ মুসা।
গম্ভীর হয়ে উঠেছিল ভ্যানিসার মুখ। বলেছিল, ‘জনাব আহমদ মুসার সাথে যুক্তি বুদ্ধি কোন দিক দিয়েই পারবো না। কিন্তু আমি জিজ্ঞাসা করি, আপনি কি আমাদেরকে অমন তৃতীয় শ্রেণীর সরাইখানায় রাখতে পারতেন?’
আবেগে রুদ্ধ হয়ে উঠেছিল ভ্যানিসার কণ্ঠ। ছলছলে হয়ে উঠেছিল তার চোখ।
ম্লান হাসি ফুটে উঠেছিল আহমদ মুসার ঠোঁটে। বলেছিল সান্তনা দেওয়ার সুরে, ‘তুমি ঠিক বলেছ ভ্যানিসা। আমিও পারতাম না তোমাদেরকে তৃতীয় শ্রেণীর সরাইখানায় রাখতে। কিন্তু আমাদের তো এখন সেই শান্তির সময় নয়। আমরা যুদ্ধক্ষেত্রে এখন। থাকা, খাওয়া, ঘুম ইত্যাদির যুদ্ধকালিন অবস্থা শান্তির সময় থেকে একদমই আলাদা। তুমি যদি এদিকটা ভাব ভ্যানিসা তাহলে আর খারাপ লাগবে না।’
চোখ ভরা অশ্রু নিয়ে হেসে উঠেছিল ভ্যানিসা। বলেছিল, ‘আপনি কেন বন্দুক হাতে নিতে গেলেন ভাইয়া। এক শান্তির নীড়ে, এক স্নেহময় ভাইয়ের প্রতিচ্ছবি আপনি। মাত্র কয়েক ঘন্টার পরিচয় আপনার সাথে। তবু আমি ভাবছি, আপনার জাতীয় ও সামাজিক রূপের চাইতে আপনার পারিবারিক রূপটাই হবে মনোমুগ্ধকর বেশি।’
একটু থামল ভ্যানিসা। কিন্তু আহমদ মুসাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মুহূতর্কালের মধ্যেই আবার বলে উঠেছিল, ‘আপনার প্রস্তাবে এক শর্তে রাজী।’
‘কি সেই শর্ত?’ বলেছিল আহমদ মুসা।
‘সরাইখানার বিছানা ব্যবহার করতে পারবেন না, খাবার খেতেও আপনি পারবেন না। বিছানা আমাদের বাসা থেকে ওখানে যাবে, খাবারও যাবে নিয়মিত সেখানে।’ ভ্যানিসা বলেছিল।
‘আমি তোমার প্রস্তাবে রাজী, তবে একটা শর্তে।’ বলেছিল আহমদ মুসা।
‘কি শর্ত?’ জানতে চেয়েছিল ভ্যানিসা।
‘বিছানা, খাবার তোমাদের বাসা থেকে আসতে পারবে, আমরা তাতে পরম আনন্দও বোধ করব, তবে শর্ত হলো এ বিষয়টা কাকপক্ষীরও জানা চলবে না।’ বলেছিল আহমদ মুসা।
‘আমি রাজী এ শর্তে।’ ভ্যানিসা বলেছিল আনন্দিত কণ্ঠে।
‘কিন্তু ভ্যানিসা, কাকপক্ষী না জানার শর্ত পূরণ করে কিভাবে তুমি নিয়মিত খাবার পাঠাবে?’ বলেছিল সার্গিও।
হেসেছিল ভ্যানিসা। বলেছিল, ‘আমাদের ভেড়া-ছাগল-গরুর পালটা এখন উপত্যকার পুব-মুখ ঘেঁষেই অবস্থান করছে। পালের সাথে চার পাঁচজন রাখাল রয়েছে। তাদের যাতায়াত আছে সরাইখানায়। ওরাই খাবার পৌছাবে।’
খুশি হয়েছিল সার্গিও। ভ্যানিসাকে ধন্যবাদ দিয়ে সে বলেছিল, ‘এ চিন্তা তোমার মাথায় এল কি করে? যতই চিন্তা করি এ বিষয়টা আমার মাথায় আসতো না।’
আহমদ মুসাও ধন্যবাদ দিয়েছিল ভ্যানিসাকে।
সত্যি ভ্যানিসা তার কথা অক্ষরে অক্ষরে রক্ষা করেছে। রাখালরাই তিন বেলা তার খাবার নিয়ে আসে। হোটেল মালিক নুনো কাপুচোর কাছ থেকেও খাবার আসে। ওগুলো রাখালরা নিয়ে যায় নিজেরা ভোজ করার জন্যে।
আহমদ মুসা শুকরিয়া আদায় করল যে, এখন পর্যন্ত কোন দিক থেকে কিছু ঘটেনি। ভালই যাচ্ছে সময়। মনে মনে আহমদ মুসা কৃতজ্ঞতা জানাল সার্গিও ও ভ্যানিসাদের।
আহমদ মুসা তার চোখ ফিরিয়ে আনল ভ্যানিসাদের বাড়ির দিক থেকে।
পেছনে পায়ের শব্দ পেয়েছে আহমদ মুসা।
দৃষ্টিটা ফিরিয়ে তাকাল আহমদ মুসা পেছন দিকে। দেখল হাসান তারিক ও হোটেলের মালিক নুনো কাপুচো ব্যালকনিতে প্রবেশ করেছে।
এই অসময়ে হোটেল মালিক নুনো কাপুচোকে আসতে দেখে কিছুটা বিস্মিতই হলো আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়িয়ে একটা চেয়ার টেনে সামনে এনে বসতে বলল নুনো কাপুচোকে।
আহমদ মুসার পাশের চেয়ারে বসল হাসান তারিক।
বসেই হাসান তারিক বলে উঠল, ‘ভাইয়া, মি. কাপুচো বলছেন কিছু লোক নাকি ভ্যালীতে বিদেশীদের খোঁজ করছে।’
ভ্রুকুচকালো আহমদ মুসা। চেয়ারে নড়ে-চড়ে বসল। বলল, ‘মি. কাপুচো, ঘটনা কি?’
‘হ্যাঁ, হঠাৎ যেন সবাই আজ বিদেশী খোঁজ করতে লেগে গেছে। আজ বাজারে আমাদের তিনজন কাবিলা প্রধান আমাকে জিজ্ঞেস করেছে আমাদের সিলভার ভ্যালিতে আমি দুজন বিদেশীকে দেখেছি কিনা। আজ দুপুরের পর দুজন বাইরের লোক এসেছিল হোটেলে। জিজ্ঞেস করেছিল, হোটেলে কোন বিদেশী এসেছে কিনা, এসেছিল কিনা। আমি বুঝতে পারছি না ঘটনা কি!’ বলল নুনো কাপুচো।
‘বাইরে থেকে এসেছিল ওরা কারা?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা। তার চোখে-মুখে ভাবনার ছাপ।
‘ওরা ফল ব্যবসায়ীর লোক। মাঝে মাঝেই ওরা আসে ফল মূলের পাইকারী মার্কেটে।’ বলল নুনো কাপুচো।
‘ওরা কাকে খুঁজছে, কেন খুঁজছে বলেছে কিছু?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘সে রকম সুনির্দিষ্টি করে কিছু বলেনি। বলেছে, দুজন বিদেশী হারিয়ে গেছে, তাদেরকেই ওরা খুঁজছে। ওরা নাকি গনজালো প্যালেসেও খোঁজ করেছে। সেখানেও কোন বিদেশী নেই।’ বলল নুনো কাপুচো।
‘দেখা যাচ্ছে, অনেক লোক লেগেছে খোঁজ করতে?’ আহমদ মুসা বলল।
‘হ্যাঁ অনেক লোক। ভ্যালিরও অনেক লোক লেগেছে। কয়েকজন কবিলা প্রধানও। যে কোন মূল্যে বিদেশীদের নাকি ওদের খুঁজে বের করা চাই।’ বলল নুনো কাপুচো।
‘আমরাও তো বিদেশী। কেউ তো আমাদের খোঁজ করেনি?’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমি তো বিদেশী বলিনি। আমি বলেছি আমার দুজন মেহমান আছে, আর কেউ নেই আমার হোটেলে।’ বলল নুনো কাপুচো।
‘আপনার কথা ওরা বিশ্বাস করেছে?’ আহমদ মুসা বলল।
‘তারা বিশ্বাস করা বা না করার সাথে আমার কিছু এসে যায় না। তারা নিজেরাও খোঁজ নিতে পারে। তাছাড়া তারা শুধু তো আমাকে নয়, আরও অনেককেই জিজ্ঞাসাবাদ করছে।’ বলল নুনো কাপুচো।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘ঠিকই বলেছেন আপনি।’
নুনো কাপুচো উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘উঠি আমি এখন, বাইরে কাজ আছে।’
‘দুয়ে দুয়ে চার যেমন সত্য, এটাও তেমনি সত্য হাসান তারিক। ওরা আসবে এটা অবধারিত ছিল।’ বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই ব্যালকনিতে প্রবেশ করল যুটো, সার্গিওদের হেড রাখাল।
‘কি ব্যাপার যুটো? তুমি এ সময়?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘স্যার, কিছুটা সামনে ভ্যালির বাইরে দুটি ট্রাক ও একটি মাইক্রো বোঝাই লোক এসেছে। তার সাথে এসেছে একটা জীপ। আমি কথাবার্তায় শুনেছি, তারা এই হোটেল রেড করবে। দুজন বিদেশীকে তারা ধরবে। আমি খবরটা নিয়ে গিয়েছিলাম আমাদের স্যারের কাছে। তিনি আপনাকে এই চিঠি দিয়েছেন।’
বলে যুটো একটা চিঠি তুলে দিল আহমদ মুসার হাতে।
আহমদ মুসা তাড়াতাড়ি চিঠিটা খুলল।
পড়লঃ
‘ভাই সাহেব,
আপনাদের অবস্থান শত্রুদের কাছে ধরা পড়ে গেছে। যুটো আপনাকে বলবে। আমি ও ভ্যানিসা গোপন একটা গিরিপথে চারটা ঘোড়া নিয়ে অপেক্ষা করছি। যুটোর সাথে আপনারা চলে আসুন। শত্রুকে কাঁচকলা দেখিয়ে আমরা উপত্যকা থেকে বেরিয়ে যাব। সংঘাত এড়ানোর আপনার কৌশল সামনে রেখেই আমি এই ব্যবস্থা করেছি।’’
আপনার ভাই,
‘সার্গিও’
চিঠিটা আহমদ মুসা পড়ে হাসান তারিকের হাতে তুলে দিল পড়ার জন্যে।
তারপর তাকাল যুটোর দিকে। বলল, ‘উপত্যকার মুখে ওরা কখন এসেছে?’
‘এক ঘন্টা আগে।’ বলল যুটো।
‘কিন্তু ওরা বাইরে অপেক্ষায় কেন? ঢুকছে না কেন ভেতরে?’ বলল আহমদ মুসা।
আড়াল থেকে ওদের কথা যতটুকু শুনেছি তাতে ধারণা হয়েছে ওরা লোক পাঠিয়েছে ওদের পরিচিত কয়েকজন কাবিলা প্রধানের কাছে উপত্যকায় ঢোকার অনুমতির জন্যে। অনুমতি পেলে মনে হয় ওরা ঢুকবে।
‘কাবিলা প্রধানরা অনুমতি দেবে?’ আহমদ মুসা জিজ্ঞেস করল।
‘সরাসরি দেবে না। আমাদের স্যার উপত্যকা কমিটির প্রধান। তাঁর কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে। সে অনুমতি ওরা পাচ্ছে না। কারণ আমাদের স্যার ইতিমধ্যেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছেন।’ বলল যুটো।
‘তাহলে অনুমতি ওরা পাচ্ছে না। অনুমতি না নিয়ে কি ওরা ঢুকবে?’ বলল আহমদ মুসা।
‘উপত্যকাবাসীদের সাথে লড়াই-এ ওরা নামতে চাইবে না। গাড়ি বোঝাই হয়ে না ঢুকে এমনি দু’চারজন ঢুকতে পারে।’ চিঠি পড়া হয়ে গিয়েছিল হাসান তারিকের। বলল, ‘ভাইয়া কি সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন?’
‘সার্গিও ঠিকই বলেছে। চল আমরা বের হই।’ আহমদ মুসা বলল।
পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ওরা তৈরী হয়ে দুতলার সিঁড়ির মুখে এসে মিলিত হলো।
তাকাল আহমদ মুসা হাসান তারিকের দিকে। বলল, ‘তোমার মেশিন রিভলবারটা কোথায়?’
‘আমার ব্যাগে।’ বলল হাসান তারিক।
‘না, ওটা শোল্ডার হোলষ্টারে নাও। কোটের বোতাম খুলে রাখ।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ঠিক আছে ভাইয়া।’ বলে হাসান তারিক ব্যাগ থেকে রিভলবার শোল্ডার হোলষ্টারে পুরল।
সিঁড়ি দিয়ে নামল আহমদ মুসারা।
হোটেলের কাউন্টারের সামনে আসতেই বিভিন্ন দিক থেকে বেরিয়ে এসে জনাছয়েক লোক আহমদ মুসাদের ঘিরে ধরল। কাপড়ের ভেতর থেকে তারা বের করল রিভলবার। এক সাথে ছয়টা রিভলবার তাক করা আহমদ মুসাদের দিকে।
ছয় দিক থেকে ছয়টা রিভলবারকে হা করে উঠতে দেখে আর্তনাদ করে উঠল যুটো।
আহমদ মুসা তাকাল হাসান তারিকের দিকে। বলল, ‘তুমি যুটোর মত চিৎকার করো না। না জেনে-শুনে এরা নিশ্চয় গুলী করবে না। নিশ্চয় কোথাও ভুল হয়েছে এদের।’
বলে আহমদ মুসা রিভলবারধারী ছয়জনের দিকেই একবার করে তাকাল। তারপর এক জনের দিকে চোখ স্থির করে বলল, ‘আপনিই নিশ্চয় এদের চীফ। এখন বলুন ঘটনা কি?’
‘ঘটনা কিছুই নয়, আমাদের সাথে চলুন। একটু জিজ্ঞাসাবাদ আছে।’ বলল লোকটি।
‘কোথায় যেতে হবে?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘এই একটু সামনে।’ বলল লোকটি।
‘জিজ্ঞাসা কেন বলুন তো? কোন কেস-টেস আছে নাকি আমাদের বিরুদ্ধে।’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘সবই জানতে পারবেন।’ বলল লোকটি।
‘না জেনে যেতে যদি না চাই?’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমার নাম ফিগো। আমি পাখির মত মানুষ মারতে পারি। দ্বিতীয়বার আমি আর আদেশ করব না। এই মুহূর্তে যাবার জন্যে পা না তুললে গুলী করবে আমার লোকরা।’ বলল ফিগো লোকটা।
কৃত্রিম ভয় ফুটিয়ে তুলল আহমদ মুসা তার চোখে-মুখে। বলল, ‘গুলীর দরকার নেই। আমরা যাব, এবং আপনাদের কি জিজ্ঞাসাবাদ আছে শুনব।’
একটু থামল। থেমেই আবার বলে উঠল, ‘মি. ফিগো, হোটেলের বিল মিটিয়ে দিয়ে কি আমরা বেরোবো?’
বিস্ময় ফুটে উঠল ফিগোর চোখে-মুখে। বলল, ‘বিল নিয়ে এখন আপনি ভাবছেন? ঠিক আছে বিল মিটিয়ে দিন।’
আহমদ মুসা হোটেলের কাউন্টারের দিকে এগুলো। কাউন্টারে একজন অল্প বয়সি বয় কাঠ হয়ে বসেছিল, যেন ফাঁসির আসামী। আহমদ মুসা তার সামনে একটা পাঁচশ ডলারে নোট রেখে বলল, ‘বিল কত হয়েছে তুমি তো বলতে পারবে না। মি. কাপুচোকে এই টাকাটা দিয়ে দিয়ো। যদি কিছু বাকি থাকে পরে শোধ করব।’
আহমদ মুসা কাউন্টার থেকে সরে এল। তাকাল হাসান তারিকের দিকে। বলল, ‘চল, না গিয়ে তো বাঁচা যাচ্ছে না।’
বলে আগে আগে হাঁটতে লাগল আহমদ মুসা। তার পেছনে হাসান তারিক শুরু করল হাঁটা। তাদের পেছনে ঐ ছয়জন। তাদের রিভলবারগুলো এখন আগের মত আহমদ মুসাদের দিকে তাক করা নয় এবং ট্রিগার পয়েন্টেও নয়।
রাস্তায় নামার পরেই শুরু হলো অন্ধকারে পথ চলা।
হোটেল থেকে পুবে দুশ’গজ পরে পাহাড় ও নদীর মাঝের প্যাসেজটা সবচেয়ে সংকীর্ণ। কোন রকমে দুটি গাড়ি এই প্যাসেজ দিয়ে পাশাপাশি চলতে পারে। এটাই সিলভার উপত্যকায় প্রবেশের গেট।
কিন্তু গেটে কোন দরজা নেই।
গেট পার হয়ে ওপারে পৌছে গেল সবাই।
ওপারে পৌছতেই পেছন থেকে ফিগোর কণ্ঠ শোনা গেল। বলে উঠছে সে, ‘যে যেভাবে আছ সেভাবে দাঁড়াও।’
ফিগোর কণ্ঠ চাপা বজ্রের মত শোনাল।
সবাই দাঁড়িয়ে গেল।
আবার ধ্বনিত হলো ফিগোর কণ্ঠ। বলল তার দুজন সাথীকে লক্ষ্য করে, ‘জেভি ও কষ্টা, তোমরা শয়তান দুটোকে বেঁধে ফেল।’
আহমদ মুসা দাঁড়াবার আদেশ পেতেই হাসান তারিকও তার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। হাসান তারিক পাশে দাঁড়াতেই আহমদ মুসা ফিসফিস কণ্ঠে বলে উঠল, ‘ওরা দ্রুত কিছু ঘটাতে পারে। প্রস্তুত।’
ফিগোর নির্দেশ পাবার পর জেভি ও কষ্টা নামের দুই ব্যক্তি এগুলো আহমদ মুসাদের দিকে।
আহমদ মুসা ও হাসান তারিক পুবমুখো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
জেভি ও কষ্টা পেছন থেকে এগুচ্ছে ওদের দিকে। চারদিকের নিশ্ছিদ্র নিরবতার মাঝে তাদের পায়ের কেডস পাথুরে রাস্তার বুকে শব্দ তুলছে। আহমদ মুসার কান দুটি উৎকর্ণ সেই শব্দের দিকে। প্রতিটি পদক্ষিপ যেন গুণছে।
পায়ের শব্দটি আহমদ মুসার পেছনে এসে দাঁড়াবার সাথে সাথে আহমদ মুসা একদিকে তার ডান হাতকে এগিয়ে দিল শোল্ডার হোলষ্টারে রাখা তার এম-১০ মেশিন রিভলবারের দিকে। অন্যদিকে বোঁ করে এবাউট টার্ণে তার বাঁ হাতকে ছুঁড়ে দিল পেছনে দাঁড়ানো লোকটির গলার দিকে। হাতটি অক্টোপাশের মত লোকটির গলা পেঁচিয়ে তাকে যখন টেনে নিয়ে আসছিল আহমদ মুসার দিকে, তখন আহমদ মুসার ডান হাতে উঠে আসা এম-১০ বুলেট বৃষ্টি শুরু করেছিল সামনে দাঁড়ানো লোকদের দিকে।
ভোজবাজীর মত এ ঘটনা বুঝে ওঠার আগে তাদের রিভলবারের ট্রিগার টেপার সময় পেছনের লোকরা পেল না। শুধু রিভলবারের ট্রিগার টেপার সময় পেয়েছিল ফিগো। দুটো গুলীও ছুঁড়েছিল আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে। কিন্তু গুলী দুটো আহমদ মুসার বক্ষ ভেদ না করে তার বুকে চেপে ধরা ফিগোর সাথীরই পিঠ ফুটো করে দিল। তৃতীয় গুলী ছোঁড়ার সুযোগ ফিগো আর পায়নি। আহমদ মুসা ও হাসান তারিকের গুলীবৃষ্টি তাকেও ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল।
আহমদ মুসা গুলী বর্ষণ শুরু করার সাথে সাথে হাসান তারিক হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছিল। সেই সাথে তার হাতে আসা মেশিন রিভলবার প্রথমেই গুলী করেছিল তাকে বাঁধতে আসা লোকটিকে এবং তারপর সামনের দিকে ব্রাশ-ফায়ার করেছিল অনির্দিষ্ট লক্ষ্যে।
আহমদ মুসা ও হাসান তারিকের রিভলবার যখন নিরব হলো, তখন অন্ধকারেই দেখা গেল সামনে কেউ দাড়িয়ে নেই। তবে অন্ধকারের কারণে বুঝার উপায় নেই কার কি অবস্থা।
‘নিশ্চয় কেউ বেঁচে নেই।’ প্রথম কথা বলল হাসান তারিক।
‘হ্যাঁ তাই। বেঁচে থাকলে গুলী করার এই সুযোগ তারা নিত।’ বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই তারা শুনতে পেল তাদের পেছনে ইঞ্জিনের গর্জন।
আহমদ মুসা ও হাসান তারিক দুজনেই পেছন ফিরে পুব দিকে তাকাল। দেখতে পেল অল্প সামনে তিনটি গাড়ির ছয়টি হেডলাইট জ্বলে উঠেছে। এগিয়ে আসছে গাড়িগুলো।
‘গুলীর শব্দ শুনে কি ঘটেছে তা দেখার জন্যই নিশ্চয় ওরা আসছে।’ বলল হাসান তারিক।
‘এবং তারা মনে করছে, যে গুলীর শব্দ তারা শুনেছে তা তাদের লোকদেরই।’ হাসান তারিক থামতেই বলে উঠল আহমদ মুসা।
‘তাহলে এখন আমরা কি করব?’ হাসান তারিক বলল।
‘আমরা কিছু করব না, ওরা কি করে সেটা দেখতে চাই।’
কথাটা বলে একটু থেমেই আবার বলে উঠল, ‘চল, আমরা সিলভার ভ্যালির দিকে হেঁটে গিয়ে ভ্যালির মুখের ওপাশে দাঁড়াই। ওরা এস সাথীদের লাশ দেখুক। তারপর কি করে দেখা যাক।’
বলে আহমদ মুসা সিলভার ভ্যালির দিকে হাঁটা শুরু করল।
হাঁটতে লাগল হাসান তারিক আহমদ মুসার পেছনে।
তিন গাড়ির বহরটি লাশগুলোর সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেল। সামনের গাড়ির হেডলাইটের আলো ছড়িয়ে পড়ল লাশগুলোর উপর।
তিনটি গাড়ির হেডলাইটই জ্বলছে।
হেডলাইটের আলোতে গাড়িগুলোও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সবার সামনে মাইক্রো। মাইক্রোর ছাদে বিশাল সাইজের একটা মেশিনগান ফিট করা।
গাড়ি তিনটি লাশের সামনে থামার সাথে সাথে মাইক্রোর পেছনের জীপ থেকে দুজন দ্রুত নেমে এল।
তারা মাইক্রোর আড়াল থেকে লাশগুলো দেখে আবার দ্রুত ফিরে গেল জীপে। তারা জীপে ফিরে যেতেই মাইক্রোর ছাদে ফিট করা মেশিনগান গর্জন করে উঠল। গুলীর বৃষ্টি প্রবেশ করল সংকীর্ণ পথ দিয়ে উপত্যকরা ভেতরে।
আহমদ মুসা ও হাসান তারিক পাহাড়ের আড়ালে না থাকলে তাদের দেহ ঝাঁঝরা হয়ে যেত।
গুলীবৃষ্টির মধ্যে মাইক্রো থেকে মানুষ নামল। তারা এক এক করে লাশগুলো নিয়ে গাড়িতে তুলতে লাগল।
আহমদ মুসা ফিসফিস করে বলল, ‘তারিক, ওরা আক্রমণে আসছে না। ওদের মেশিনগানের গুলী ওদের লাশ সরিয়ে নেবার ঢাল মাত্র।’
‘কিন্তু এত তাড়াতাড়ি ওরা রণে ভংগ দেবে?’ বলল হাসান তারিক। তার চোখে বিস্ময়।
‘একটি কারণে হতে পারে। সেটা হলো যারা মারা গেছে তাদের মধ্যে তাদের সর্দার রয়েছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘হ্যাঁ ভাইয়া, ঠিক বলেছেন। ওদের লিডার যে ছিল সে কোন বড় নেতাই হবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, তাদের লাশ নিয়ে যাবার এই গরজ কেন?’ বলল হাসান তারিক।
‘লাশ পড়ে থাকলে লাশের মাধ্যমে তাদের পরিচয় প্রকাশ হয়ে পড়বে, হয়তো এটা ওরা চায় না।’ আহমদ মুসা বলল।
অব্যাহত গুলীর আড়ালে তারা সবগুলো লাশ তুলে নিল গাড়িতে। গুলী তাদের বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু গাড়িগুলো নড়ল না। নিজেদের জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে রইল।
আহমদ মুসা ও হাসান তারিক পাহাড়ের আড়াল থেকে বেরিয়ে উপত্যকার সংকীর্ণ মুখটায় এসে দাঁড়াল।
‘ওরা দাঁড়িয়ে কেন। সামনেও এগুচ্ছে না, পেছনেও সরছে না। কারণ কি?’
ভ্রু-কুঞ্চিত হয়ে উঠল আহমদ মুসার।
বোঁ করে আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়াল। ঘুরা অবস্থায় আহমদ মুসা তার এম-১০ এর ব্যারেল তুলে নিচ্ছিল।
কিন্তু আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়িয়ে স্থির হবার আগেই একই সাথে দুটি গুলী এসে আঘাত করল তার এম-১০ মেশিন রিভলবারটিকে। আঘাতে তার তর্জনীও আহত হলো।
রিভলবার পড়ে গেল তার হাত থেকে।
আহমদ মুসার চেয়েও অবস্থা খারাপ হাসান তারিকের। তার দিকে গুলী এসেছিল সেকেন্ড খানেক পরে। হাসান তারিক রিভলবার তুলেছিল গুলী করার জন্যে। কিন্তু তার ট্রিগার টেপার আগেই গুলী এসে বিদ্ধ করেছে তার ডান বাহুকে। ছিটকে পড়ে গেছে তার হাত থেকে রিভলবার।
সামনে থেকে অট্টহাসি ভেসে এল।
আহমদ মুসা তাদের সামনে তিনজন লোককে দেখতে পেয়েছিল। কিন্তু অন্ধকারে তাদের অবয়ব পরিষ্কার ছিল না। আহমদ মুসা বুঝতে পারছিল না ওরা কারা? উপত্যকার ভেতরের লোক ওরা, না ওদের সাথে আসা একটা অংশ। লাশ তুলে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে ওদের সময় ক্ষেপণের কৌশল এবং লাশ তুলে নেয়ার পরও দাঁড়িয়ে থাকা দেখেই আহমদ মুসার শেষ মুহূর্তে মনে হয়েছিল, লাশ তোলা নাটকের দৃশ্যের দিকে তাদের মনোযোগ সরিয়ে নিয়ে আক্রমণের ভিন্ন কৌশল তারা গ্রহণ করেছে এবং সেটা তাদের পেছন দিক থেকেই হওয়া স্বাভাবিক। এ ভাবনার সাথে সাথেই আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়িয়েছিল, কিন্তু তখন দেরি হয়ে গেছে।
অট্টহাসিটা শুনেই কিন্তু আহমদ মুসা চিনতে পারল ওটা আজর ওয়াইজম্যানের গলা।
অট্টহাসি থামল এবং সেই সাথে ভেসে এলো আজর ওয়াইজম্যানের কন্ঠ। বলল আহমদ মুসা, এবার আমরা ভুল করিনি। অধ্যাপক দানিয়েলের বাড়িতে যে ভুল আমরা করেছিলাম, সেটা আর হবেনা। তোমাকে কাউন্টার আক্রমনের আর সুযোগ আমরা দেবনা।
আজর ওয়াইজম্যানের কথা শেষ হতেই তার পাশের ছায়ামূর্তিটির লম্বা ও মোটা ব্যারেলের বন্দুক চোখের পলকে উপরে উঠল। গর্জন করে উঠল ক্ষিপণাস্ত্রের মত। পর মুহূর্তেই দেখা গেল একটা জাল গিয়ে জড়িয়ে ফেলেছে আহমদ মুসা ও হাসান তারিককে।
জালটা অদ্ভুত ইলাষ্টিক ধরনের।
বেশ প্রশস্ত জালটি আহমদ মুসাদের জড়িয়ে ফেলার পর সংকুচিত হয়ে একেবারে লাগেজ ব্যাগে পরিণত হয়েছে। হাত-পা নড়ানো ও মুখ এদিক-ওদিক করার সামান্যতম সুযোগও নেই।
আজর ওয়াইজম্যান আবার হেসে উঠল হো হো করে। হাসির পর বলে উঠল আবার, ‘আহমদ মুসা, আমি তোমাকে হত্যা করতে পারতাম। হত্যা করতে চেয়েছিলামও। কিন্তু হত্যা করিনি। তুমি মৌলবাদী ও মিলিট্যান্টদের ব্যাপারে যা জান, দুনিয়ার কেউ তা জানে না। আজকের মুসলিম রেনেসাপন্থীদের তুমি এক অনন্য অভিধান। তোমাকে হত্যা করলে এই অমূল্য অভিধান চিরতরে হারিয়ে যাবে। আমরা তোমাকে এক্সরে করে ধীরে ধীরে সব তথ্য বের করে নিতে চাই। তবে তুমি বেয়াড়া হলে হত্যা করতে এক সেকেন্ডও দেরি করা হবে না।’
কথা শেষ করেই পকেট থেকে মোবাইল বের করল। টেলিফোন করল কাউকে। মোবাইলটা কানে ধরে ওপার থেকে সাড়া পেয়েই বলে উঠল, ‘সুসংবাদ নাও, দুজনকেই জালে আটকেছি। ওদিকের খবর কি?’
ওপারের কথা শুনে আবার বলে উঠল, ‘আহ বেচারা আলফ্রেড ফিগো! আমি এটাইতো আশংকা করেছিলাম। বিরাট ক্ষতি হলো আমাদের। তোমরা চিন্তা করো না। ফিগোর কাছে কমিট করা পুরো অংকই তোমরা পেয়ে যাবে। আবার চাইলে তোমরা আমার সাথেও কাজ করতে পারবে। যাক, এখন জলদি গাড়ি নিয়ে এস।’
কথা শেষ করেই মোবাইল বন্ধ করল আজর ওয়াইজম্যান। সংগে সংগেই সে তার বাম পাশের দুই সাথীসহ অস্বাভাবিক দ্রুত গতিতে পেছনে ফিরছে। বিস্মিত হয়ে আজর ওয়াইজম্যান পেছন ফিরল। ফিরেই গুলীর মুখোমুখি হলো সে। তার চোখে পড়ল অল্প দূরে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে দুটি ছায়ামূর্তি। তাদের হাতে উদ্যত রিভলবার। আরও চোখে পড়ল, তার পাশের দুই সাথী গুলী বিদ্ধ হয়ে ভূমিশয্যা নিল।
উরুতে গুলীবিদ্ধ হয়েছে আজর ওয়াইজম্যান।
সে দাড়িয়েছিল নদীর তীর ঘেষেই।
তার জামা-কাপড় দিয়ে তখনও পানি ঝরছে। পরিকল্পনা করে নদীর উজান বেয়ে সামনে এসেই তারা পেছন থেকে আক্রমণ করেছিল আহমদ মুসাদেরকে।
পাল্টা আক্রমণের সুযোগ দেখল না আজর ওয়াইজম্যান। ডান হাতের রিভলবার তুলতে গেলেই ওদের গুলীতে ঝাঁঝরা হতে হবে।
মুহূর্তেই তার সিদ্ধান্ত হয়ে গিয়েছিল।
তার দেহটা ছিটকে দক্ষিণ দিকে পড়ে গেল। তারপর আরেকটা গড়া দিয়েই নদীতে গিয়ে পড়ল। ছায়ামূর্তি দুটি এবার দ্রুত এগিয়ে এল জালে জড়ানো লাগেজে পরিণত হওয়া আহমদ মুসাদের কাছে।
দুটি ছায়ামূর্তির একজন সার্গিও গনজালো, অন্যজন ভ্যানিসা।
সার্গিও গনজালো তাড়াতাড়ি তার মোজার মধ্যে গুজে রাখা একটা চাকু বের করে জালটা কেটে ফেলল।
আহমদ মুসা ও হাসান তারিক উঠে দাঁড়াল।
‘ধন্যবাদ মি. সার্গিও, আপনি ঠিক সময়ে এসে পড়েছিলেন।’
‘ভাই সাহেব, ধন্যবাদটা জুটোর প্রাপ্য। আপনি ও মি. হাসান তারিক আকস্মিকভাবে বন্দী হলে সে ওদের চোখ এড়িয়ে পালায় এবং ছুটে যায় আমাদের কাছে। তা না হলে ওখানে আমরা আপনাদের জন্যে কতক্ষণ দাঁড়াতাম কে জানে!’ বলল সার্গিও।
‘আল্লাহর শুকরিয়া যে, জুটোকে তারা আমাদের সাথে ধরেনি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ভাইয়া, আপনার কৌশল কাজে লেগেছে। উপত্যকার কেউ আপনার সাথে নেই, আপনারা পালিয়ে এসে উপত্যকার হোটেলে উঠেছেন, এটাই তারা সম্ভবত মনে করেছে।’ বলল ভ্যানিসা।
‘কিন্তু আপনারা ওদের মেরে আমাদের উদ্ধার করেছেন, এ থেকে ওরা কি ভাববে সেটা এখন চিন্তার বিষয়।’ হাসান তারিক বলল।
হাসান তারিকের কথা শেষ হতেই আহমদ মুসা দ্রুত লাশ দুটির দিকে এগুলো।
ওদের একবার দেখে বলে উঠল আহমদ মুসা, ‘হ্যাঁ মি. সার্গিও, তৃতীয়জন মানে আজর ওয়াইজম্যান কোথায়?’
‘আহত হবার পর যিনি নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। উনি কি আজর ওয়াইজম্যান ছিলেন? ও গড! উনিই তো প্রথম শিকার হওয়া উচিত ছিল।’ বলল সার্গিও গনজালো।
আপনি কি করবেন মি. সার্গিও, আল্লাহ ওকে আরেকটু সময় দিয়েছেন তার পাপের ভারটা পূর্ণ করার।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তাই হবে ভাই সাহেব।’ বলে একটু থামল সার্গিও। পরক্ষণেই আবার বলে উঠল, ‘আমরা আসার পথে প্রচন্ড গুলী-গোলার শব্দ শুনেছিলাম। আর আজর ওয়াইজম্যানের টেলিফোন টকে বুঝলাম, আলফ্রেড ফিগো নামে নেতা গোছের কেউ মারা গেছে। ঘটনা কি ভাই সাহেব?’
আহমদ মুসা সংক্ষেপে তাদের বন্দী করে নিয়ে আসা, ওদের ছয়জনকে হত্যা করে তাদের মুক্ত হওয়া, মেশিনগানের অব্যাহতগুলীর আড়ালে ওদের লাশ তুলে নিয়ে যাওয়া এবং পেছন থেকে আকস্মিক আক্রমণের মাধ্যমে তাদের বন্দী হওয়ার কাহিনী বলল।
‘তাহলে ঐ ছয়জনের একজনই ফিগো হবে। তাকেই আজর ওয়াইজম্যান ভাড়া করেছিল আপনাদের হত্যা অথবা বন্দী…………….।’
সার্গিও’র কথা শেষ হলো না।
পেছন থেকে তিনটি ইঞ্জিন প্রচন্ড গর্জন করে উঠলে আহমদ মুসা ও সার্গিওসহ সকলে পুব দিকে ফিরে তাকাল। দেখল, তিনটি গাড়ি উপত্যকার দিকে আসছে।
সার্গিও দ্রুতকণ্ঠে বলে উঠল, ‘ভাই সাহেব, বন্দী হিসেবে আপনাকে নিয়ে যেতে আসছে। আজর ওয়াইজম্যান ওদের আসার নির্দেশ দিয়েছিল।’
‘আজর ওয়াইজম্যানের এই ইচ্ছাও পূরণ হলো না। কিন্তু আমরা রক্তপাত এড়াতে চাই।’ বলল আহমদ মুসা।
সবাই ছুটে আসা গাড়ির দিকে মুখ করেই দাঁড়িয়েছিল।
কিছু বলতে যাচ্ছিল হাসান তারিক। কিন্তু থেমে গেল।
সবাই দেখল, উপত্যকার মুখে পৌছার আগেই থেমে গেল গাড়িগুলো।
‘থেমে গেল কেন গাড়িগুলো? আজর ওয়াইজম্যানের নির্দেশ মোতাবেক গাড়িগুলো দ্রুত এখানে চলে আসার কথা।’ বলল সার্গিও বিস্মিতকণ্ঠে।
ভাবছিল আহমদ মুসা।
হঠাৎ তার মুখে নেমে এল প্রসন্নতা। বলল, ‘যিনি ওদের আসার নির্দেশ দিয়েছিলেন, তিনিই ওদের থামিয়ে দিয়েছেন মি. সার্গিও।’
‘তার মানে আহত আজর ওয়াইজম্যান নদী থেকে কাজ শুরু করে দিয়েছেন।’ হাসান তারিক বলল।
‘হ্যাঁ তাই হাসান তারিক। এ ছাড়া গাড়িগুলো থেমে যাবার আর কোন যুক্তি নেই।’ বলল আহমদ মুসা।
হঠাৎ ভ্যানিসা চাপাকণ্ঠে আর্তচিৎকার করে উঠল, ‘সার্গিও ভাইয়া, ওরা তো আহত। দেখ, আহমদ মুসা ভাইয়ার ডান হাতে এবং হাসান তারিক ভাইয়ার ডান বাহুতে রক্ত।’
আহমদ মুসা তৎক্ষণাৎ বলে উঠল, ‘চিন্তার কারণ নেই ভ্যানিসা, বুড়ো আঙুলের গোড়াটা গুলীর ধাক্কায় একটু ছিঁড়ে গেছে। আজর ওয়াইজম্যানের গুলী আমার পিস্তলকে আঘাত করেছিল।’
হাসান তারিকও বলে উঠল, ‘আমার বাহুটাও ছিঁড়ে গেছে। গুলী অল্প একটু জায়গা ছিঁড়ে নিয়ে বেরিয়ে গেছে, এখন রক্ত খুব অল্পই বের হচ্ছে।’
ভ্যানিসা তাড়াতাড়ি তার ব্যাগের চেইনটা খুলে গলায় বাঁধা একটা স্কার্ফ বের করল। তাড়াতাড়ি তা ছিঁড়ে একটা অংশ দিয়ে হাসান তারিকের বাহু ও আহমদ মুসার আঙুল বেঁধে দিল। তার বাঁধার ষ্টাইল দেখে হাসান তারিক বলল, ‘আপনি ডাক্তার নাকি?’
‘ডাক্তার নয়, নার্স বলতে পারেন। আমাদের গনজালো পরিবার এবং আমাদের পাহাড়ী ও যাযাবর সব উপজাতির মহিলাদেরই এই ট্রেনিং আছে। আমরা দীর্ঘ এক যুদ্ধে জড়িত। আমাদের মহিলাদেরকেই ডাক্তার ও নার্সের কাজ বেশি করতে হয়।’ বলল ভ্যানিসা।
‘ধন্যবাদ বোন।’ আহমদ মুসা বলল।
ভ্যানিসা কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছিল। কিন্তু থেমে গেল। ইঞ্জিনের শব্দে তারা সামনে ফিরে তাকাল। দেখতে পেল সামনের গাড়িটা আবার এগিয়ে আসতে শুরু করেছে।
ওদিকে চোখ রেখে আহমদ মুসা ধীরে ধীরে বলল, ‘আজর ওয়াইজম্যান কি আবার নতুন করে আক্রমণে আসতে চায়? কিন্তু এই রক্তপাত আমাদের জন্যে অপ্রয়োজনীয় এবং সিলভার ভ্যালির জন্যে ক্ষতিকর। এই অবস্থায় আমাদের কি করণীয়।’
আহমদ মুসা থামল।
আহমদ মুসা থামার সাথে সাথে গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দও থেমে গেল।
গাড়িটা উপত্যকার প্রবেশ পথের মুখে থেমে গেছ। দাঁড়িয়েছে পাহাড়ের দেয়ালের ঠিক গা ঘেঁষে। পর মুহূর্তে পেছনের গাড়িটাও এসে তার পাশে দাঁড়াল।
উপত্যকার প্রবেশ মুখে গাড়ি দুটি এমনভাবে দাঁড়াল যে, তৃতীয় কোন গাড়ি যাওয়া আসার পথ বন্ধ হয়ে গেল। এখন গাড়ি দুটির দুপাশ দিয়ে শুধু পায়ে হাঁটা লোকই চলাচল করতে পারবে।
গাড়ি দুটির হেডলাইট উপত্যকার মুখসহ অনেকখানি এলাকা আলোকজ্জ্বল করে তুলেছে। এখন উপত্যকার বাইরে যেই যেতে চাইবে, গাড়ির পড়ে যাবে।
দুটি গাড়ির ছাদের উপর মেশিনগান সাজানো। মেশিনগানের ব্যারেল হা করে আছে উপত্যকার দিকে।
আহমদ মুসার কপাল কুঞ্চিত।
ভাবছিল সে।
বলল একটু পর, ‘মি. সার্গিও ওরা উপত্যকা অবরোধ করে বসল।’
‘অবরোধ? অবরোধ করে কি করবে?’ বলল সার্গিও।
‘আমাকে ও হাসান তারিককে ধরবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কিভাবে? অবরোধ করে বসে থাকলেই কি ধরা যাবে? কয়দিন ওভাবে বসে থাকবে তারা?’ বলল সার্গিও।
‘উপত্যকার মুখে ওরা এভাবে বেশি সময় বসে থাকবে না। আমার ধারণা তারা তাদের শক্তি বৃদ্ধির চেষ্টা করবে এবং পুলিশেরও সাহায্য চাইবে বিশ্বাসযোগ্য কোন কাহিনী ফেঁদে। উপত্যকার ভেতরের কারও সাথে যোগাযোগ করবে। সবশেষে প্রবেশ করবে উপত্যকায়।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আর আমরা এ সময় উপত্যকায় বসে হাওয়া খাব তাই না? আপনারা যে পথে এসেছেন, সেই পথেই আবার বেরিয়ে যেতে পারেন, এটা কি তারা জানে না?’ সার্গিও বলল।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘সে দিকের ব্যবস্থাও তারা নিশ্চয় করছে।’
‘তার মানে তারা ঐ পথ অবরোধেরও ব্যবস্থা নেবে?’ বলল সার্গিও।
‘শুধু অবরোধ নয়, ঐ পথে এ উপত্যকায় তারা অভিযানেরও ব্যবস্থা করতে পারে। তাদের ক্ষতি কম হয়নি। তারা নিশ্চয় মনে করছে এ সব আহমদ মুসার কাজ। আহমদ মুসাকে ধরার এটুকু ব্যবস্থা তারা করবেই।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তাহলে আমাদের এখন কি করণীয় ভাই সাহেব?’ বলল সার্গিও।
‘আমরা যেভাবে নিরবে উপত্যকায় এসেছিলাম, সেভাবেই বেরিয়ে যাব অর্থাৎ যে পথে এসেছিলাম সে পথেই।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কিন্তু আপনি যে বললেন ঐ পথেও ওরা অবরোধ বসাচ্ছে বা অভিযানে আসছে?’ বলল সার্গিও।
‘পাহাড়ে ওদের চোখ এড়ানো সম্ভব হবে। সাউন্ড মনিটরিং আমাদের সাহায্য করতে পারে ওদের আগমন চিহ্নিত করার কাজে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কিন্তু এরপরও সংঘাত বাধতে পারে। কিন্তু আপনি চাচ্ছেন সংঘাত এড়াতে।’ বলল সার্গিও।
‘সংঘাত সব সময় এড়ানোর চেষ্টা করা উচিত। তবে কেউ ঘাড়ে এসে পড়লে জবাব দিতেই হয়। সে যাক। আমাদের এখন যাত্রা করা উচিত মি. সার্গিও।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কিন্তু তার আগে আমাদের বাসায় যেতে হবে, এটা আপনার ওয়াদা ছিল।’ বলল ভ্যানিসা।
একটু থামল আহমদ মুসা। বলল, ‘এই উপত্যকার প্রতি একটা মমতার সৃষ্টি হয়েছে। এই মমতা আর বাড়াতে চাই না। আর সময়ও নেই তোমাদের বাড়িতে যাবার।’
‘আপনার কোন কথা শুনব না। যেতে হবে আমাদের বাড়িতে।’ বলে ভ্যানিসা তাকাল সার্গিও গনজালোর দিকে। বলল, ‘ভাইয়া’ এস ওদের নিয়ে।’
কথা শেষ করে হাঁটতে লাগল ভ্যানিসা।
সার্গিও আহমদ মুসার দিকে চেয়ে বলল, ‘চলুন, উপায় নেই।’

Top