৩
সাও তোরাহ দ্বীপের আন্ডার গ্রাউন্ড জেলখানা।
জেলখানা বলা ঠিক নয়। আসলে বিশাল এক কনসেনট্রেশন ক্যাম্প এটা। WFA-এর নেতা আজর ওয়াইজম্যান শত নির্যাতনে নিষ্পিষ্ট বন্দীদের বিদ্রুপ করে বলে, ‘আল্লাহ নাকি তোমাদের জন্যে মহাসাড়ম্বরে মহাসুখের বেহেশ্ত সাজিয়ে রেখেছেন, সেখানে যাবার আগে দোজখের স্বাদটা নিয়ে যাও।’
আর বন্দীখানা বা কনসেনট্রেশন ক্যাম্পটা আন্ডার গ্রাউন্ড এই অর্থে যে, মাঝে মাঝে এ বন্দীখানা মাটির উপর থেকে আন্ডার গ্রাউন্ডে নেমে আসে। বন্দীখানাটার ছাদ জুড়ে বাগান। উপর থেকে দেখলে মনে হবে সুন্দর সবুজ পরিচ্ছন্ন একটা ভূমিখ-। যখন বন্দীখানাটা আন্ডার গ্রাউন্ডে চলে যায়, তখন তো কথাই নেই। কেউ উপর থেকে দেখে হাজার চেষ্টা করেও বলতে পারবে না যে, বাগানটা কৃত্রিম কিছু এবং এর নিচে এক বিশাল বন্দীখানা আছে। কেন এটা দুনিয়ার অদ্বিতীয় দোজখখানা তার পক্ষে আজর ওয়াইজম্যান যুক্তি দেন যে, আমরা এই দোজখখানার জন্যে যে টেকনলজি ব্যবহার করেছি, হিটলার তার কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের জন্যে তা কল্পনাও করেননি। আরেকটা পার্থক্যের কথা আজর ওয়াইজম্যান বলে থাকে। সেটা হলো, হিটলার ছিলেন স্বৈরাচারী, আর আমরা দুনিয়ায় গণতন্ত্র প্রমোট করছি।
একদল বন্দী বন্দীখানার ময়লা পরিষ্কার ও মাজা-ঘসা করছিল।
সপ্তাহে একদিন বন্দীখানা মাজা ঘসা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়।
সাও তোরাহ-এর বন্দীদের জন্যে সপ্তাহের এ দিনটি বহুল আকাঙ্খিত দিন। কাজ করতে গিয়ে সবার এদিন একত্র হবার সুযোগ হয়। হাতে পায়ে পরানো হয় নতুন শেকল। শেকল দেড়ফুট লম্বা হওয়ায় চলা-ফেরায় কিছুটা সুবিধা হয়। সবচেয়ে বড় কথা পায়ে পরানো কাঁটার জুতা খুলে নেয়া হয়ে থাকে, বন্দীদের জন্যে এই কাঁটার জুতা খুবই ভয়ংকর। জুতার সুখতলীতে বসানো থাকে অতিসূক্ষè কাঁটার সারি। এই কাঁটা অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক। এ জুতা পায়ে দিয়ে হাঁটা তো দূরের কথা দাঁড়ানোও যায় না। জুতা পায়ের সাথে লক করা থাকে বলে খোলাও যায় না। এ জুতা বন্দীদের উপর নির্যাতনের ক্ষেত্রে নতুন সংযোজন।
সত্যি বন্দিখানাকে আজর ওয়াইজম্যান দোজখে পরিণত করেছে। বন্দীদের কম্বল ও কাপড় আরামদায়ক না হলেও কষ্টদায়ক ছিল না শুরুর দিকে। কিন্তু এখন কম্বল ও কাপড়-চোপড় হয়ে দাঁড়িয়েছে আরেক ভীতির কারণ। ওগুলোতে ছারপোকা জাতীয় এক ধরনের পোকার বাসা। গায়ে দিলেই ওগুলো গায়ে চরে বেড়াতে শুরু করে এবং কামড়াতে থাকে। তাছাড়াও কম্বল ও কাপড়ত-চোপড় গায়ে দিলেই সর্বাঙ্গ চুলকাতে শুরু করে। ভীষণ জ্বালা-যন্ত্রণায় কম্বল ও পোশাক গায়ে রাখা খুবই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। আবার প্রচ- শীতের মধ্যে ওগুলো গা থেকে নামানোও যায় না। এক ভয়ংকর অবস্থার মধ্য দিয়ে বন্দীদের প্রতিটি মুহূর্ত অতিবাহিত হয়।
সুতরাং সাতদিনের এই একটা দিন তাদের জন্যে পরম আকাক্সক্ষার, যদিও এ দিন তাদের যে কাজটা করতে হয় তা ক্লিনার ও মেথরদের কাজ। ৬ দিনে বন্দীখানায় যে মল-মূত্র ও ময়লা জমে ৭ম দিনে তা পরিষ্কার করতে হয়। তবু পায়ে কাঁটার জুতা থাকে না এবং ভিন্ন ধরনের কাপড় পরা যায় বলে এই কাজটাই সবার কাছে পরম আরামদায়ক।
আজর ওয়াইজম্যানের মতে সপ্তাহের সপ্তম দিনকে কিছুটা আরামদায়ক করা হয়েছে ছয়দিনের কষ্টকে তীব্র করে তোলার জন্যে। কষ্ট অভ্যাসে পরিণত হলে কষ্ট কমে যায়। এটা যাতে না হয় এ জন্যেই আজর ওয়াইজম্যানের এই ব্যবস্থা।
একদল বন্দী একটু সুযোগ পেয়ে আলাপ করছিল। ইন্দোনেশিয়ার একজন বন্দী ভাঙা ইংরেজীতে জিজ্ঞেস করল তুরষ্কের একজন বন্দীকে, ‘মি. বায়ার গত সপ্তাহে আপনার কাছ থেকে ব্যাপারটা জানার পর থেকেই আমি ভাবছি। আমার মনে হচ্ছে কি জানেন, দুনিয়ার এ দোজখখানাটা মুসলমানদের প্রায়শ্চিত্ত করার শেষ মনজিল। মুক্তির সূর্যোদয় খুব সামনেই।’
‘কোন ব্যাপারটা মি. হাদি আমর?’ বলল জালাল বায়ার।
জালাল বায়ার তুরষ্কের একটা মুসলিম চ্যারিটি ফান্ডের প্রধান। তুরষ্ক ভিত্তিক এ ফান্ডটি গোটা দুনিয়ায় বিজ্ঞান বিষয়ক শিক্ষার উন্নয়নে কাজ করে। সেই সাথে অসহায় কিন্তু প্রতিভাবান এমন মুসলিম শিক্ষার্থীদের আর্থিক সহায়তা দান করে। আজর ওয়াইজম্যানের WFA এই ফান্ড ধ্বংসের এক অংশ হিসেবে জালাল বায়ারকে কিডন্যাপ করেছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো শিক্ষা-সহায়তার নামে তার ফান্ড ইসলামী রেঁনেসা তথা মুসলমানদের মধ্যে হিংসা উদ্দীপ্ত করার কাজ করছে।
আর ইন্দোনেশিয়ার হাদি আমর ‘লিভিং মস্ক মুভমেন্ট’ বা ‘মসজিদ আবাদ আন্দোলন’-এর নেতা। এ আন্দোলনের কাজ হলো, মসজিদ সংস্কার করা, মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের ব্যবস্থা করা এবং মসজিদকে এলাকার শান্তি-শৃঙ্খলার কেন্দ্রে পরিণত করা। আজর ওয়াইজম্যানের ওয়ার্ল্ড ফ্রিডম আর্মি (WFA)-এর কাছে এটা খুবই আপত্তিকর মনে হয়েছে। হাদী আমরকে কিডন্যাপ করা হয়েছে এই অভিযোগে যে, সে সাম্প্রদায়িকতাকে উদ্দীপ্ত করে সন্ত্রাসবাদকে সাহায্য করছে। তার কাছে এখন দাবী করা হচ্ছে তার জনশক্তির একটা পূর্ণ তালিকা।
‘কেন মনে নেই, আপনি বলেছিলেন দুনিয়ার এই দোজখখানায় আমাদের ইন্দোনেশিয়ার পিতৃস্থানীয় আহমদ সুকর্নের বংশধর মোহাম্মদ সুকর্নের সাথে রয়েছেন আপনাদের পিতা কামাল আতাতুর্কের উত্তর সুরী কামাল সুলাইমান, মিসরের বাদশাহ ফারুকের প্রত্যক্ষ বংশধর আবদুল্লাহ ফারুক, লিবিয়ার বাদশাহ ইদরিসের উত্তরসূরী আহমদ আল সেনুসি, তুরষ্কের শেষ খলিফা আবদুল হামিদের উত্তর-পুরুষ ওসমান আবদুল হামিদ, ইরানের রেজাশাহ পাহলবীর বংশধর মোহাম্মদ আলী রেজা এবং স্পেনের সোনালী ইতিহাসের নির্মাতা ওমাইয়া শাসকদের ধ্বংসাবশেষের সপ্তদশ পুরুষ আবদুল রহমান। দুনিয়ার এই দোজখখানায় এঁদের ঐতিহাসিক এই সম্মেলন কাকতালীয় বলা যাবে, কিন্তু আমার মনে হয়েছে এটা আল্লাহ তাআলারই এক পরিকল্পনা। এই সাত ব্যক্তি ঐতিহাসিক যে সাত ব্যক্তির উত্তরসূরী, সেই সাত ব্যক্তিকে আল্লাহ তাদের নিজ নিজ দেশে সব দ–মু-ের কর্তা বানিয়েছিলেন, কিন্তু তারা জাতি গঠনের পরিবর্তে জাতিকে বিজাতীয়দের হাতে তুলে দিয়েছেন। এই ঐতিহাসিক সাতের পাপেরই প্রায়শ্চিত্ত করতে এসেছেন আপনারা, বলা যায় সেই সাতজনই এখন দুনিয়ার এই দোজখখানায়।’ বলল হাদি আমর।
দুঃখের মধ্যেও হাসল জালাল বায়ার। বলল, ‘আপনি চমৎকার একটা ইকুয়েশন করেছেন। কিন্তু মুক্তির সূর্যোদয় আপনি কোথায় দেখতে পেলেন?’
‘ঠিক দেখতে পাইনি। কল্পনার দিগন্তে তৃতীয় নয়ন দিয়ে অবলোকন করছি। অনেক খবর এ জেলখানার বাতাসেও ভাসছে। তার একটি হলো, আহমদ মুসা আজোরস দ্বীপপুঞ্জে এসেছেন। আহমদ মুসা আল্লাহর এমন এক বান্দাহ যাকে সংগ্রাম এবং সাফল্য অনুসরণ করে থাকে।’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, আহমদ মুসার কথা আমিও শুনলাম। কয়েক মিনিট আগে আমাদের কামাল সুলাইমান ও ওসমান আবদুল হামিদ বলল যে, আহমদ মুসা তেরসিয়েরা দ্বীপে WFA-কে বিধ্বস্ত করে ‘হারতা’ দ্বীপে এসেছেন।’ বলল জালাল বায়ার।
‘সত্যি? কার কাছ থেকে তারা জানলেন?’ হাদি আমর আনন্দে চোখ উজ্জ্বল করে বলল।
‘ফ্রান্স থেকে সাংবাদিক বুমেদীন বিল্লাহকে ওরা ধরে এনেছে। তাঁর কাছ থেকেই এরা শুনেছেন।’ বলল জালাল বায়ার।
‘বুমেদীন বিল্লাহ? আলজেরিয়ার পিতৃস্থানীয় বেন বেল্লাহর কি কেউ?’ জিজ্ঞাসা হাদী আমর-এর।
‘শুনলাম, শুধু বেন বেল্লাহ নয়, আলজেরিয়ার দীর্ঘ দিনের শাসক হুয়ারী বুমেদীনের বংশের সাথেও তিনি সম্পর্কিত। তিনি যেমন বেন বেল্লাহর ‘গ্রেট গ্রেট গ্রান্ড সান’, তেমনি তিনি হুয়ারী বুমেদীনেরও গ্রেট গ্রেট গ্রান্ড-ডটারের স্বামী।’
স্থান-কাল-পাত্র ভুলে গিয়ে হাদী আমর হাততালি দিয়ে উঠল। বলল উচ্চ স্বরে, ‘তাহলে বংশীয় প্রায়শ্চিত্ত করার সংখ্যা আট-এ দাঁড়াল। আর বুমেদীন বিল্লাহ প্রায়শ্চিত্ত করবেন দুজনে………….’
কথা শেষ করতে পারল না হাদী আমর। পাশ থেকে উত্থিত বাঘের মত হিং¯্র গর্জনে তার কন্ঠ থেমে গেল। মুখ ফিরিয়ে দেখল, দুজন তাদের দিকে তেড়ে আসছে। কাঁধে তাদের ষ্টেনগান, হাতে পেরেক বিছানো ব্যাটন। এই ব্যাটন ষ্টেনগানের গুলীর চেয়ে ভয়াবহ। ষ্টেনগান নিমিষেই মানুষকে মেরে ফেলে, কিন্তু পেরেক বিছানো ব্যাটনের প্রহার মৃত্যুর চেয়েও ভীতিকর ও অসহনীয়। এই পেরেক বিছানো ব্যাটন WFA-এর নির্যাতন-অস্ত্রের তালিকায় আরেকটি নতুন সংযোজন।
হাদী আমররা চারজন দাঁড়িয়ে গল্প করছিল।
ব্যাটনধারী দুজন এসে চারজনকে এলোপাথাড়ী প্রহার শুরু করে দিল। জালাল বায়ার ও হাদী আমরকে সবচেয়ে নির্দয়ভাবে প্রহার করতে লাগল। শীঘ্রই রক্তের পিন্ডে পরিণত হলো দুটি দেহ। অন্য দুটি দেহও রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিল।
অন্যান্য বন্দীরা চারদিক থেকে সারিবদ্ধভাবে এগিয়ে আসছিল রক্তের পিন্ডে পরিণত হওয়া তাদের সাথীদের দিকে।
এমন ঘটনা বন্দীখানার সাধারণ ব্যাপার। সুযোগ পেলে একে অপরকে সেবা-শুশ্রুষা করে থাকে বন্দীরা।
ব্যাটনধারীরা তাদের রক্ত¯œাত ব্যাটন ফেলে দিয়ে হাতে নিয়েছিল ষ্টেনগান।
এ সময় চারদিকে একটা গম্ভীর কণ্ঠ ধ্বনিত হলো, ‘ধন্যবাদ ঈশ্বরের সন্তান প্রহরীরা। চারজন বন্দীকে কাজের সময় অকাজ করার শাস্তি হিসাবে যে রক্তের পোশাক পরিয়েছ সেজন্যে তোমাদের ধন্যবাদ। এখন বড় একটি সার্কেল দাও ওদের চারদিকে। কয়েকটা চেয়ার সাজিয়ে দাও রক্তের পোশাক পরা চারজনের সামনে।
বিখ্যাত নতুন মেহমান নিয়ে আমরা আসছি।
রক্তাপ্লুত হাদী আমরদের সামনে কয়েকটা চেয়ার উঠে এল।
তার সাথে উপর থেকে নেমে এল একটা সিঁড়ি। সিঁড়ি দিয়ে নেমে এল রাজপুরুষের সাজসজ্জা পরিহিত একজন দীর্ঘকায় মানুষ। সে এসে বসল সিংহাসনের মত একটা সুন্দর চেয়ারে।
তার পরেই নেমে এল সফেদ শ্মশ্রুওয়ালা স্বর্গীয় চেহারার একজন লোক। তাকে ধরে নামিয়ে নিয়ে এসেছিল আরেকজন। তাকে বসানো হলো সিংহাসনাকৃতি চেয়ারের সামনের একটা চেয়ারে। সে নেমে আসতেই বন্দীদের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হয়ে গিয়েছিল। কেউ কেউ উঠে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু একজন প্রহরী চিৎকার করে উঠল, ‘কেউ কথা বলবে না, কেউ নড়বে না। দ্বিতীয়বার আদেশ দেয়া হবে না।’
বন্দীরা সব চুপ করল। কিন্তু সকলের চোখে-মুখে বিস্ময় ও বেদনার ছাপ।
সফেদ শ্মশ্রুওয়ালা স্বর্গীয় চেহারার লোকটিই শেখুল ইসলাম আহমদ মুহাম্মাদ। ইনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক ‘আন্তর্জাতিক হিউম্যান ডেভলপমেন্ট এন্ড এইডস ফর অপ্রেসড’ (IHDAAFD)-এর প্রধান। তাকে কিডন্যাপ করে সাও তোরাহে আনা হয়েছে।
শেখুল ইসলাম বসার পর সিঁড়ি দিয়ে নেমে এল মাঝবয়সী কঠিন চেহারার একজন লোক। সে বসল শেখুল ইসলামের ডান পাশে মুখোমুখি।
সিঁড়ি দিয়ে প্রথম নেমে আসা সিংহাসনাকৃতির চেয়ারে বসা রাজসিক পোশাকের লোকটি আজর ওয়াইজম্যান। আর সর্বশেষ নেমে আসা কঠোর চেহারার লোকটি বেন্টো বেগিন। আজর ওয়াইজম্যানের নতুন অপারেশন চীফ।
সবাই এসে বসলে আজর ওয়াইজম্যান তার সিংহাসনে নড়ে-চড়ে সোজা হয়ে বসল। তাকাল রক্ত পিন্ডের মত পড়ে থাকা চারজনের দিকে।
ওদের গা থেকে তখনও রক্ত ঝরছে। কাতরাচ্ছে ওরা যন্ত্রণায়। ওদের একজন ‘পানি’ ‘পানি’ বলে বিলাপ করছে।
আজর ওয়াইজম্যানের দৃষ্টি তার প্রতিই নিবদ্ধ হলো। বলল, ‘ধৈর্য ধর হাদি আমর। দুনিয়ার পানি খেয়ে কি হবে, বেহেশতের শরাবন তহুরা তোমাদের জন্যে অপেক্ষা করছে।’
বলেই তাকাল একজন প্রহরীর দিকে। বলল, ‘যাও হাদী আমরকে এক গ্লাস পানি দেখিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে এস।’
থামল আজর ওয়াইজম্যান। হাসল একটু। তারপর চারদিকে বসা বন্দীদের দিকে একবার চোখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলল, ‘তোমরা বিস্মিত হয়েছ শেখুল ইসলামের মত বিখ্যাত একজন জনসেবক ও সকলের শ্রদ্ধাভাজন লোককে কেন আমরা দুনিয়ার এই দোজখে নিয়ে এলাম। কারণ একটাই সেটা হলো, যারা আমাদের বন্ধু নয়, তারাই আমাদের শত্রু। শেখুল ইসলাম সব মানুষের বন্ধু, কিন্তু আমাদের বন্ধু হতে রাজী হননি। তাই তিনি এখানে।’
একটু থেমেই আজর ওয়াইজম্যান তার চোখ শেখুল ইসলামের দিকে ঘুরিয়ে নিল।
শেখুল ইসলাম দেখছিল চারদিকের বন্দীদের। বন্দীদের অধিকাংশই বিখ্যাত লোক এবং শেখুল ইসলামের পরিচিত। প্রথমে তার বিস্ময়ের পালা। তাহলে নিখোঁজ বলে প্রচারিত সবাইকে এখানে এনে বন্দী রাখা হয়েছে! এ সবই WFA -এর কাজ! তার মন কেঁদে উঠল সকলের অবস্থা দেখে। বিশেষ করে হাদী আমরদের অবস্থা তাকে দিশেহারা করে তুলল। বিশেষ করে জালাল বায়ার ও হাদী আমর দুজনেই তার খুব প্রিয় ব্যক্তি।
‘জনাব শেখুল ইসলাম, আপনি সবই দেখলেন এবং দেখছেন, এখন বলুন আপনি আমাদের সহযোগিতা করতে রাজী কিনা।’ বলল আজর ওয়াইজম্যান শেখুল ইসলামকে লক্ষ্য করে।
‘নতুন কোন সহযোগিতার বিষয় হলে বলুন।’ শেখুল ইসলাম বলল নির্লিপ্ত ও নিরুত্তাপ কণ্ঠে।
‘আমাদের প্রয়োজনের কথা আবার বলছি। এক. আপনার ‘হিউম্যান ডেভলেপমেন্ট’ ও ‘এইড ফর অপ্রেসড’ প্রোগ্রামে যারা সাহায্য করে আসছে তাদের একটা পূর্ণ তালিকা আমরা চাই। দুই. স্পুটনিক তার ডকুমেন্টগুলো কোথায় লুকিয়ে রেখেছে, তারও সন্ধান আমাদের প্রয়োজন।’ শক্ত কিন্তু শান্ত কণ্ঠে বলল আজর ওয়াইজম্যান।
শেখুল ইসলাম তার চেয়ারে সোজা হয়ে বসল। বলল ধীর কণ্ঠে, ‘তালিকা আপনার প্রয়োজন নেই, সুতরাং তা আপনারা পাবেন না, এ কথা আগেই বলেছি। আর মি. কামাল সুলাইমানদের স্পুটনিক-এর ডকুমেন্ট সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। তারা আমার পরিচিত, মাঝে মাঝেই তাদের সাথে আমার কথা হয়েছে, কিন্তু ডকুমেন্ট নিয়ে কোন কথা কোন দিন হয়নি, এ কথাও আমি আপনাদের বলেছি।’
‘তালিকার প্রশ্নে পরে আসছি জনাব। ডকুমেন্টের ব্যাপারে আপনার কথা যদি শেষ হয়, তাহলে এ ডকুমেন্টের খবর কে জানবে জনাব। কামাল সুলাইমানরা নিশ্চয়?’ বলল আজর ওয়াইজম্যান।
‘তা অবশ্যই জানবে।’ শেখুল ইসলাম বলল।
‘তাহলে দয়া করে ওদের বলে দিন যেন ডকুমেন্টগুলো কোথায় তা আমাদের বলে দেয়।’ বলল আজর ওয়াইজম্যান।
‘স্পুটনিক ধ্বংস হবার সাথে সাথে ওদেরও অন্তর্ধান ঘটেছে। ওরাও কি তাহলে আপনার এখানে বন্দী?’ শেখুল ইসলাম বলল।
‘হ্যাঁ, ওরাও আমার এ দোজখখানার বিশেষ মেহমান। এখনি ওদের নিয়ে আসা হচ্ছে। তারা আপনাকে শ্রদ্ধা করে। আপনি ওদের রাজী করান।’ বলল আজর ওয়াইজম্যান।
আজর ওয়াইজম্যানের কথা শেষ হতেই তাদের এবং হাদী আমরদের মাঝখানে ছয় সাত বর্গফুটের একটা সেল টিউব উঠে এল। তার মধ্যে কামাল সুলাইমানসহ স্পুটনিকের ওরা ছয়জন দাঁড়িয়ে।
সেল টিউবটি মেঝের সমান্তরালে এসে স্থির হতেই সেলের চারদিকের প্রাচীর আবার নিচে ফিরে গেল। উন্মুক্ত মেঝের উপর দাঁড়ানো কামাল সুলাইমানরা ছয়জন।
ওদের ছয়জনেরই বিধ্বস্ত অবয়ব। ভেঙে পড়া স্বাস্থ্য। দূর্বল দেহ। কিন্তু চোখ-মুখে তাদের সুস্থতার অদ্ভুত দ্যুতি ও আত্মবিশ্বাসের অপরূপ আলো।
শায়খুল ইসলাম এক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল ওদের সাতজন অর্থাৎ কামাল সুলাইমান, আবদুল্লাহ আল ফারুক, আহমদ আল সেনুসি, ওসমান আবদুল হামিদ, মোহাম্মদ আলী রেজা, মোহাম্মদ সুকর্ণ, আবদুল রহমান উমাইয়া-এর দিকে। ওদের অবস্থা দেখে অন্তর কেঁদে উঠেছিল শেখুল ইসলামের। হতাশা ও দূর্বলতা এসে তাকে চেপে ধরেছিল চারদিক থেকে। কিন্তু ওদের চোখ-মুখের দিকে তাকিয়ে দূর্বলতা ও হতাশা মুহূর্তে বিদায় নিল তার। কান্নার বদলে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠল তার মন। যেন ওদের চোখ-মুখের দীপ্তিতে মূর্তিমান হয়ে উঠেছে দয়ালু আল্লাহর অশেষ দয়া।
আত্মবিশ্বাসের আলো ফিরে এল শেখুল ইসলামের চোখে-মুখেও।
আজর ওয়াইজম্যান শেখুল ইসলামকে বলল, ‘আপনি ওদের বোঝান। টুইনটাওয়ার ধ্বংসের অন্তরালের ঘটনা সম্পর্কে যে দলিলপত্র ওরা সংগ্রহ করেছে, তা আমাদের দিয়ে দিক।’
বিস্ময় ফুটে উঠল শেখুল ইসলামের চোখে-মুখে। বলল, ‘টুইনটাওয়ার ধ্বংসের অন্তরালের ঘটনা কি? সে ঘটনা সম্পর্কিত ডকুমেন্ট আপনি কেন চান?’ বলল শেখুল ইসলাম আজর ওয়াইজম্যানকে লক্ষ্য করে।
আজর ওয়াইজমানের দুচোখ জ্বলে উঠল। বলল, ‘আপনাকে এখানে আনা হয়েছে প্রশ্ন করার জন্যে নয়, প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্যে। আপনাকে যা বলেছি তাই করুন।’
আজর ওয়াইজম্যানের কথা শেষ না হতেই ওদের ৭ জনের একজন ওসমান আবদুল হামিদ বলে উঠল, ‘মুহতারাম, উনি জবাব দেবেন কি করে? ঐ ষড়যন্ত্রকারীরাই নিউইয়র্কের লিবার্টি ও ডেমোক্রাসি টাওয়ার ধ্বংস করে মুসলমানদের ঘাড়ে চাপিয়েছিল, এ কথাই আমরা মানে স্পুটনিক প্রমাণ করতে যাচ্ছিলাম। দলিল কিছু আমরা উদ্ধারও করেছি। এটাই আমাদের অপরাধ।’
বিস্ময়ে বিস্ফোরিত হয়ে উঠেছে শেখুল ইসলামের দুই চোখ। এই তথ্য তার কাছে খুবই নতুন। পত্র-পত্রিকায় এ ধরনের কিছু খবর প্রকাশিত হয়েছিল স্পুটনিক ধ্বংসের ফলো-আপ হিসাবে। কিন্তু সে বিষয়টাকে কেউই তেমন গুরুত্ব দেয়নি, কারণ টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পরও এ ধরনের আশংকা ও সম্ভাবনার কথা নানাভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। যা গুরুত্ব না পাওয়ায় আপনাতেই থেমে গিয়েছিল।
কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছিল শেখুল ইসলাম। মুখের মধ্যেই কথা তার থেমে গেল। দেখল সে, আজর ওয়াইজম্যানের ইংগিতে একজন প্রহরী পেরেক বিছানো একটা ব্যাটন হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে ওসমান আবদুল হামিদের উপর। মুহূর্তেই তার দেহ রক্তাপ্লুত হয়ে উঠল। পড়ে গেছে সে। শোয়া অবস্থায়ই তাকে পেটানো হচ্ছে। অবাক ব্যাপার। মুখে কোন অভিব্যক্তি নেই ওসমান আবদুল হামিদের। তার চোখ বন্ধ। জ্ঞান হারাল নাকি সে। আঁৎকে উঠল শেখুল ইসলাম। আজর ওয়াইজম্যানের দিকে তাকিয়ে অনেকটা অনুরোধের কণ্ঠে বলল, ‘এই বর্বরতা থামান মি. ওয়াইজম্যান।’
‘আপনি ওদের বলুন ডকুমেন্টগুলো কোথায় তা বলতে। সংগে সংগেই অপারেশন থেমে যাবে।’ বলল আজর ওয়াইজম্যান নির্লিপ্ত কণ্ঠে।
শেখুল ইসলাম কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছিল, তার আগেই কামাল সুলাইমান বলে উঠল, ‘মুহতারাম শেখুল ইসলাম, আপনি এই ষড়যন্ত্রকারী দুর্বৃত্তদের কোন সহযোগিতা করবেন না। আর আমরা মরে গেলেও ডকুমেন্টের কথা বলব না। আমরা যে কোন পরিণতির জন্যে প্রস্তুত। আল্লাহ ছাড়া এদের কোন কৃপা আমাদের কাম্য নয়। মুসলমানদের কৃপা করার কোন যোগ্যতাই এরা রাখে না।’
কামাল সুলাইমানের কথা শেষ না হতেই গর্জে উঠেছে আজর ওয়াইজম্যান। তার দুচোখে আগুন। গর্জে উঠেই সে ইংগিত করেছে আরেকজন প্রহরীকে। সংগে সংগেই সে প্রহরী পেরেক বিছানো সেই ব্যাটন হাতে ছুটল কামাল সুলাইমানের দিকে।
অন্ধেল মতই এলোপাথাড়ী ব্যাটন চার্জ শুরু করল কামাল সুলাইমানের উপর। প্রতিটি আঘাতেই কামাল সুলাইমানের দেহ থেকে রক্ত ঝরণাধারার মত ফিনকি দিয়ে বেরুতে লাগল।
কয়েখ মুহূর্তের মধ্যেই কামাল সুলাইমানের দেহ মাটিতে আছড়ে পড়ল। রক্তের লাল রংয়ে ঢাকা পড়ে গেল কামাল সুলাইমানের দেহ।
ওসমান আবদুল হামিদের মতই কামাল সুলাইমানের মুখ থেকে একটি শব্দও বেরুলো না। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে চোখ বন্ধ করে মাটিতে পড়ে আছে সে।
অসহনীয় এই দৃশ্য থেকে বাঁচার জন্যে চোখ বন্ধ করেছে শেখুল ইসলাম। বেদনায় মুখ তার নীল হয়ে গেছে।
শেখুল ইসলামকে লক্ষ্য করে আজর ওয়াইজম্যান কঠোর কণ্ঠে বলল, ‘চোখ বন্ধ রাখলে বাইরের ঘটনা বন্ধ থাকবে না শেখুল ইসলাম। চোখ খুলুন। ওদের বোঝান।’
চোখ খুলল শেখুল ইসলাম। বলল, ‘আমি ভয়ে চোখ বন্ধ করিনি মি. ওয়াইজম্যান। মানুষের এই বর্বরতা সত্যিই অসহনীয়। আর ওদের বোঝাবার কথা বলছেন। কেন ওরা বুঝবে, যদি সে বুঝটা জাতির স্বার্থের বিরুদ্ধে হয়। যারা ভয়কে জয় করতে পারে, হুমকি, নির্যাতন ইত্যাদিতে তাদের কিছুই হয় না। নিজ চোখেই তো তা দেখছেন।’
হাসল আজর ওয়াইজম্যান। বলল, ‘যারা নিজের উপর নির্যাতনকে হাসি মুখে সহ্য করতে পারে, তারাই আবার অনেক ক্ষেত্রে অন্যের উপর নির্যাতন সহ্য করতে পারে না, ভেঙে পড়ে।’
কথা শেষ করেই একজন প্রহরীর দিকে চেয়ে বলল, ‘তুমি শেখুল ইসলামকে ওদের কাছে নিয়ে যাও। রঙীন সাজে একেও সাজাও। দেখি ব্যাটারা মুখ খোলে কিনা।’
সঙ্গে সঙ্গে প্রহরীটি ছুটে এল শেখুল ইসলামের কাছে। প্রহরী তাকে ধরতে যাবে এসময় শেখুল ইসলাম বলল, ‘ধরে নিতে হবে না, আমি নিজেই যাচ্ছি যেখানে নিতে চাও।’
‘অত বড়াই করো না শেখুল ইসলাম, তুমি কোন দিন আঙুলের আঘাতও খাওনি, এই দোজখী ব্যাটন-চার্জ খেয়ে তুমি হাতির মত চিৎকার করবে। সে চিৎকার ওদের মুখ খুলতে বাধ্য করবে।’ বলল আজর ওয়াইজম্যান ঠান্ডা স্বরে।
‘তোমার কথা ঠিক ছিল আজর ওয়াইজম্যান কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত। এখন আর সে অবস্থা নেই। আমি শিক্ষা নিয়েছি এই ছেলেদের কাছ থেকে। সারা জীবনের বিদ্যা আমাকে যা শেখায়নি, তা আমি শিখেছি ছেলেদের দীপ্ত চেহারা দেখে এবং যে কোন কষ্ট জয় করার ধৈর্য্য দেখে। তুমি একবার পরীক্ষা করে দেখ আজর ওয়াইজম্যান।’ পাথরের মত শক্ত আর ঠান্ডা স্বরে কথাগুলো বলে শেখুল ইসলাম হাঁটতে শুরু করল।
এ সময় বেন্টো বেগিন উঠে এল তার আসন থেকে। বন্দীদের সারিতে বসা নতুন বন্দী সাংবাদিক বুমেদীন বিল্লাহর দিকে ইংগিত করে আজর ওয়াইজম্যানের কানে ফিসফিস করে বলল, ‘শেখুল ইসলাম আমাদের শেষ তুরুপের তাস। সবশেষের জন্যে তাকে রেখে সাংবাদিক বুমেদীন বিল্লাহকে টেষ্ট করতে পারি আমরা। সাংবাদিক বুমেদীন বিল্লাহ স্পুটনিক ধ্বংসের আগের ও পরের ঘটনার সাথে সব চেয়ে বেশি সংশ্লিষ্ট।’
কথা শুনে একটু ভাবল আজর ওয়াইজম্যান। তার চোখে-মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠল। বলল, ‘তুমি ঠিক বলেছ বেগিন। নিয়ে এস বুমেদীন বিল্লাহকে।’
বেন্টো বেগিন উঠে এগোল তার ডান পাশের বন্দীর সারির দিকে।
আজর ওয়াইজম্যান শেখুল ইসলামকে বলল, ‘আপনি ওখানেই ওদের কাছে বসুন। আপনার টার্মটা একটু পরে। সাংবাদিক বুমেদীন বিল্লাহ আমাদের দোজখখানার বাসিন্দা হিসেবে আপনার সিনিয়ার। তার দাবীটাই আগে।’
বেন্টো বেগিন নিয়ে এল সাংবাদিক বুমেদীন বিল্লাহকে। বুমেদীন বিল্লাহর চেহারায় গাম্ভীর্য। কিন্তু মুখে ভয়ের চিহ্ন নেই।
বুমেদীন বিল্লাহ আসতেই আজর ওয়াইজম্যান তাকে শেখুল ইসলামের রেখে যাওয়া চেয়ারে বসতে বলল।
বেন্টো বেগিন তার চেয়ারে বসেছে।
বুমেদীন বিল্লাহ সেই নির্দেশিত চেয়ারে গিয়ে বসল।
বুমেদীন বিল্লাহ বসতেই আজর ওয়াইজম্যান হালকা কণ্ঠে বলল, ‘তুমি তো সাংবাদিক, আমাদের কথা শুনলে। তোমার মতামত বলার মত কিছু আছে?’
‘অমিত বলশালী বাঘ শিকার ধরেও তাকে বাগে আনতে পারছে না, এটাই বুঝলাম আমি।’ বলল বুমেদীন বিল্লাহ।
‘চমৎকার, চমৎকার। তোমার উপমা একশ’ভাগ ঠিক। মনে হচ্ছে তুমি খুব বুদ্ধিমান ছেলে। যে সাহায্য আমরা চাচ্ছি, সে সাহায্য তুমি করতে পারবে।’
তৎক্ষণাৎ উত্তর দিল না বুমেদীন বিল্লাহ। মাথা নিচু করেছে সে। যেন সে গভীর ভাবনায় পড়েছে।
খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল আজর ওয়াইজম্যানের মুখ। সে নিশ্চিত বুঝল বুমেদীন বিল্লাহর কাছে মূল্যবান তথ্যটি আছে, না হলে সংগে সংগেই সে অস্বীকার করতো। বুমেদীন বিল্লাহর কথঅ বলতে দেরি দেখে উদগ্রীব কণ্ঠে আজর ওয়াইজম্যান বলে উঠল, ‘বুমেদীন বিল্লাহ আমাদের সাহায্য কর। আমরা সাহায্য চাই যে কোন মূল্যে।’
মুখ তুললো বুমেদীন বিল্লাহ। বলল গম্ভীর কণ্ঠে, ‘আমি আপনাদের সাহায্য করব। কিন্তু এই অমূল্য তথ্যের জন্যে আমি কি মূল্য পাব?’
শেখুল ইসলাম কথাগুলো শুনছিল। কামাল সুলাইমানসহ সবার কানেই কথাগুলো পৌছেছিল। বুমেদীন বিল্লাহর শেষ কথা কামাল সুলাইমানের কানে পৌছতেই নড়ে উঠল কামাল সুলাইমানের রক্তপিন্ড আকারের দেহ। অনেক কষ্টে মাথা তুলল সে। বলল সে বুমেদীন বিল্লাহকে লক্ষ্য করে, ‘মি. বিল্লাহ টাকার জন্যে জাতির এতবড় সর্বনাশ করবেন না। এদের আপনি চেনেন না। ডকুমেন্টগুলোর খবর ওদের দিলেও ওরা আপনাকে বাঁচতে দেবে না। কোন মুসলমানের প্রতিই তাদের আস্থা নেই।’
ক্লান্ত কণ্ঠ থামল কামাল সুলাইমানের।
কামাল সুলাইমান থামতেই আজর ওয়াইজম্যান বলে উঠল, ‘বিল্লাহ এ শয়তানদের কথা বিশ্বাস করবে না। এদের দুর্ভাগ্যের সাথে সব মুসলমানকে জড়াতে চাচ্ছে, তোমাকেও জড়াতে পারলে ওরা খুশি হয়। আমরা তোমার মত মানে কামাল আতাতুর্কের মত মুসলমানদের বন্ধু। এটা তুমি নিজেই দেখতে পাবে।’
আজর ওয়াইজম্যানের কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে বুমেদীন বিল্লাহ বলে উঠল কামাল সুলাইমানকে লক্ষ্য করে, ‘মি. সুলাইমান আমি কোন প্রকার সাম্প্রদায়িকতার মধ্যে নেই। আমাকে দোষ দেবেন না। আমি আপনা পূর্ব পুরুষ কামাল আতাতুর্কের অনুসারী। আমি মনে করি টুইনটাওয়ার ধ্বংসের বিশ বছর পর এ নিয়ে সাম্প্রদায়িক সংঘাত বাধাবার কোন যুক্তি নেই। সুতরাং ডকুমেন্টগুলো ওদের হাতে তুলে দিয়ে এ সংঘাত-সম্ভাবনার ইতি ঘটাতে চাই। এতে আপনাদেরও উপকার হবে, উপকার হবে আপনাদের পরিবারগুলোর। জানেন, আপনাদের পরিবার সার্বক্ষণিক উদ্বেগ নিয়ে কিভাবে পালিয়ে বেড়াচ্ছে? আমি ওদেরকেও বাঁচাতে চাই।’
থামল বুমেদীন বিল্লাহ।
‘আমাদের এবং আমাদের পরিবার নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না মি. বিল্লাহ। আজর ওয়াইজম্যান আপনার জন্যে কতটা করবেন জানি না, কিন্তু আমাদের জন্যে আল্লাহ আছেন। তাঁর উপর আমরা নিশ্চিত ভরসা করতে পারি। ইতিহাস বলে, অসাম্প্রদায়িক সেজে কেউই অতীতে লাভবান হয়নি, আপনিও হবেন না মি. বিল্লাহ।’
‘আমিও বলছি ইতিহাসও বলবে। সেটা দেখার জন্যে আজর ওয়াইজম্যান আপনাদের জীবিত রাখুন, এটা আমি চাইব।’ বলল বুমেদীন বিল্লাহ।
‘হ্যাঁ, বিল্লাহ। অন্তত তোমার ইতিহাস তারা দেখেই মরবে। এখন বল তুমি কি বিনিময় চাও। আমরা দ্রুত আগাতে চাই।’
বুমেদীন বিল্লাহ একটু ভাবল। তারপর বলল, ‘বিনিময় হিসাবে তিনটি শর্ত। এক. আমার মুক্তি, দুই. বৃটেন ও ফ্রান্সের দুটি কাগজে খবর ছাপতে হবে যে, আপনি আমাকে সাংবাদিক হিসেবে সাও তোরাহ দ্বীপের বোটানিক্যাল রিসার্চ পরিদর্শন ও রিপোর্ট করার জন্যে এই দ্বীপে নিয়ে এসেছেন, তিন. এক বিলিয়ন ডলার এক্সপ্রেস ব্যাংকে আমার একাউন্টে জমা দিতে হবে। শেষ দুটি কাজ আপনাদের তথ্য দেবার আগেই সম্পন্ন হতে হবে এবং ব্যাংকের ডিপোজিট শ্লীপ এবং নিউজসহ পত্রিকা আমাকে পেতে হবে।’
সংগে সংগেই উত্তর দিল না আজর ওয়াইজম্যান। ভাবল একটুক্ষণ। তারপর বলল, ‘কোন শর্তেই আমার কোন আপত্তি নেই। তবে নিউজ প্রকাশ করতে হবে কেন?’
‘ওটা আমার নিরাপত্তার গ্যারান্টি মি. আজর ওয়াইজম্যান। নিউজ প্রকাশিত হলে আমাকে হত্যা করা আপনার জন্যে কঠিন হবে। হত্যা করলেও আপনি শুধু নন, সাও তোরাহ দ্বীপও আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়াবে। ওটুকু গ্যারান্টি আমার জন্যে না থাকলে আমি নিঃশর্ত কোন ঝুঁকি নিতে পারি না।’ বলল বুমেদীন বিল্লাহ।
‘ঠিক আছে তোমার তিনটি শর্তই আমি মেনে নিলাম। কিন্তু আমার একটা শর্ত আছে। সেটা হলো, ‘ডকুমেন্ট আমাদের হাতে না আসা পর্যন্ত তোমাকে এখানেই থাকতে হবে।’ আজর ওয়াইজম্যান বলল।
‘এখানে এই জেলখানায় থাকব কি করে। প্রথম সুযোগেই তো ওরা আমাকে মেরে ফেলবে।’ বলল বুমেদীন বিল্লাহ চোখে-মুখে উদ্বেগ টেনে।
‘হ্যাঁ সেটা চিন্তার বিষয়। তোমাকে ওদের সাথে রাখা যাবে না। ঠিক আছে তুমি আমাদের লোকদের সাথে এ্যাডমিনিষ্ট্রেশন সেকশনে থাকবে।’ আজর ওয়াইজম্যান বলল।
বলেই আজর ওয়াইজম্যান উঠে দাঁড়ালো।
উঠে দাঁড়ালো বেন্টো বেগিনও।
‘বেগিন, বুমেদীন বিল্লাহকে তোমাদের সাথে নিয়ে এস। এখন থেকে সে তোমাদের সাথে থাকবে।’
বলে সিঁড়ির দিকে এগুলো আজর ওয়াইজম্যান।
আজর ওয়াইজম্যান উঠে যাবার পর বুমেদীন বিল্লাহকে নিয়ে সিঁড়িতে উঠতে উঠতে বলল একজন প্রহরীকে লক্ষ্য করে, বুমেদীন বিল্লাহর সেলে এখন থেকে থাকবে শেখুল ইসলাম।’
সিঁড়ি দিয়ে উঠার সময় বুমেদীন বিল্লাহ কামাল সুলায়মানদের দিকে চেয়ে বলল, ‘মি. সুলায়মান, ইতিহাস আমার শুরু হলো।’
‘আপনার ইতিহাস আপনি লিখবেন না, লিখবেন ঐতিহাসিকরা।’ বলল কামাল সুলায়মান ক্ষীণ কণ্ঠে।
‘যা ঘটে ঐতিহাসিকরা তাই লেখে। আমি ঘটাব, ইতিহাস তাই লিখবে।’ বুমেদীন বিল্লাহ বলল।
‘বিশ্বাসঘাতক বিশ্বাসঘাতক হিসাবে ঘটনা ঘটায় না। কিন্তু ইতিহাস তাকে বিশ্বাসঘাতক বলে।’ বলল কামাল সুলাইমান দুর্বল ও কাঁপা কণ্ঠে।
হাসল বুমেদীন বিল্লাহ। বলল, ‘সে ইতিহাস দেখা পর্যন্ত আপনারা বেঁচে থাকুন, আমি চাই।’
কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছিল কামাল সুলাইমান। কিন্তু বুমেদীন বিল্লাহ উপরে উঠে অদৃশ্য হয়ে গেছে। সিঁড়িও উঠে যাচ্ছে।
আহমদ মুসা ধীরে ধীরে গাড়ি চালিয়ে ৭১ বে ষ্ট্রিট-এর সামনে দিয়ে একবার দক্ষিণে চলে গেল।
| ← Previous | | | Next → | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »