৩৭. গুলাগ থেকে টুইনটাওয়ার

চ্যাপ্টার

সান্তাসিমা উপত্যকার পাশে হাইওয়ে থেকে একটু নেমে গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়ল।
গাড়ির ড্রাইভিং সিট থেকে প্রথমে নামল হাসান তারিক।
আহমদ মুসাও নামল তার পরে পাশের সিট থেকে।
‘ঠিক এখান দিয়েই সুলিভানের গাড়িকে রাস্তায় উঠতে দেখেছিলাম।’ বলল হাসান তারিক।
আহমদ মুসা চারদিকে তাকাল। দেখল, তারা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে বড় গাছ পালা মুক্ত একটা করিডোর এঁকে-বেঁকে সামনে এগিয়ে গেছে। তার দুপাশেই ঝোপ-ঝাড় ও গাছ-পালা। পাথরে-মাটিতে মেশানো ভূমি। ঘাসে ঢাকা।
‘সুলিভান নিশ্চয় গাড়িটা সড়ক থেকে দেখা যাবে এমন জায়গায় পার্ক করেনি। মনে হয় যতটা পেরেছে ভেতরে নিয়েছে। এখন দেখ, গাড়ি যাওয়ার চিহ্নটা খুঁজে পাওয়া যায় কিনা। তাহলে কিছুটা অন্তত পরিষ্কার হবে যে, কেন সে এখানে এসেছিল? এদিকে তাদের নতুন কোন আস্তানা আছে কিনা।’ আহমদ মুসা বলল।
আহমদ মুসা ও হাসান তারিক দুজনেই গাড়ির চাকার চিহ্ন খুঁজতে লাগল। যে গাড়ি সুলিভান ব্যবহার করেছিল তা বড় গাড়ি না হলেও আমেরিকান কারটির ওজন কম নয়। এ ওজনের চাপে কচি ঘাস যে থেতলে যাবে, পাতা ছিঁড়ে যাবে, কচি গাছগুলো ভেঙে যাবে, তা খুবই সাধারন দৃশ্য।
আহমদ মুসারা এই চিহ্নই সন্ধান করতে লাগল।
অবাক হলো তারা সন্ধান করতে গিয়ে। দেখল, ঘাসে ঢাকা করিডোরটার মাঝামাঝি লম্বা-লম্বি গোটা জায়গারই ঘাস অনেকটা থেতলানো, পাতা ছেঁড়া এবং কচি গাছও মাঝে মাঝে পিষ্ট হওয়া। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, থেতলানো ও ছেঁড়া কোন ঘাস বা কচি গাছ মরে শুকিয়ে গেছে, কোনটা আবার থেতলানো ও ছেঁড়া হলেও ঐভাবে মরে যায়নি। বিস্মিত আহমদ মুসা বিষয়টার দিকে হাসান তারিকের দৃষ্টি আকর্ষণ করল।
ভ্রুকুঞ্চিত হলো হাসান তারিকের। বলল, ‘ঠিক বলেছেন ভাইয়া। বিষয়টা এতক্ষণ আমি খেয়াল করিনি। এটা একটা বিরাট ব্যাপার। এর অর্থ হলো, শুধু সুলিভানের গাড়ি নয়, এ ধরনের গাড়ি এখানে আগেও এসেছে। হয়তো বার বারই এসেছে।’
ভাবছিল আহমদ মুসা। বলল, ‘আর সুলিভানদের মত গাড়ি বার বার আসার অর্থ হলো, সামনে এমন কিছু আছে, যেখানে গাড়িগুলো এসেছে।’
‘ঠিক বলেছেন ভাইয়া। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সান্তাসিমা উপত্যকার পাথুরে জেটি ছাড়াও তাদের আর কোন ঘাঁটি কি এদিকে আছে, কেলভিনের কথায় কিন্তু এটা বুঝা যায়নি।’ বলল হাসান তারিক।
‘সান্তাসিমার এ পাশটাকে সান্তাসিমা উপত্যকার বাইরে ধরছ কেন?’ আহমদ মুসা বলল।
‘তাও হতে পারে।’
‘চল, গাড়ির এ ট্রাক ধরে আমরা এগিয়ে যাই।’
বলে হাঁটা শুরু করল আহমদ মুসা।
হাসান তারিকও চলল পাশাপাশি।
যতই সামনে, মানে উত্তরে এগুতে লাগল তারা, ততই এঁকে-বেঁকে অনেক ঝোপ-ঝাড় পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যাওয়া ঘাসের করিডোরটায় ছোট-খাট আগাছা ও গাছ-গাছড়ার সংখ্যা বাড়তে লাগল। এখানে গাড়ি যাতায়াতের ট্রাকটা আরও ষ্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
বিস্ময় বাড়তে লাগল আহমদ মুসা ও হাসান তারিকের। জংগলের মধ্যে এভাবে গাড়ি নিয়ে আসার রহস্য কি! রহস্য কি না বুঝলেও কোন একটা বড় ব্যাপার আছে, সে বিষয়ে তারা নিশ্চিত হলো।
একটা পাহাড়ের বড় টিলার গোড়ায় এসে তাদের এই যাত্রা শেষ হয়ে গেল। দেখল, টিলাটার গোড়ায় এসে গাড়ি চলার সেই ট্রাকটা শেষ হয়ে গেছে।
আহমদ মুসারা থমকে দাঁড়াল সেখানে।
চারদিকে তাকাল আহমদ মুসা।
‘ভাইয়া উপকূল কিন্তু খুব বেশি দূরে নয়।’ বলল হাসান তারিক।
‘কিন্তু সামনেটা আরও উঁচু হয়ে উঠেছে। সান্তাসিমা উপত্যকার মত ভূমি হঠাৎ নিচু হয়ে উপকূলের সমান্তরাল হয়ে যায়নি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘হ্যাঁ ভাইয়া। আমার মনে হয় সামনের পাহাড়টা সাগর থেকে উঠে এসেছে। সেখানে হয়তো আমরা কোন নাব্য উপকূল পাব না।’ বলল হাসান তারিক।
‘আমরা উপকূলে যাচ্ছি না হাসান তারিক। গাড়ির লোকরা কোথায় এসেছিল সেটা খুঁজছি। আমার ধারণা এটা ওদের উপকূলে যাবার কোন রাস্তা নয়। মিনি-সাবের নোঙরের জন্যে তারা যে সান্তাসিমার পাথুরে জেটিটাকেই ব্যবহার করে, সেটা তো সেদিন আমরা নিজেদের চোখেই দেখিছি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘এই জংগলে তাহলে তারা কেন আসবে?’ বলল হাসান তারিক।
ভাবছিল আহমদ মুসা। বলল এক সময় সে উৎসাহিত কণ্ঠে, ‘খেয়াল করেছ হাসান তারিক, সেদিন মিনি-সাব যখন সান্তাসিমা জেটিতে এসেছিল, সে সময়টাতেই সুলিভান এই জংগলে বা এই এলাকায় ছিল।’
‘ভাইয়া তাহলে আপনি বলতে চাচ্ছেন, মিনি-সাব নোঙর করা ও সুলিভান এখানে আসার মধ্যে একটা যোগসূত্র আছে।’ হাসান তারিক বলল।
‘যোগসূত্র না থাকলে ঠিক এ সময় সুলিভান এখানে এসেছিল কেন?’ স্বগত প্রশ্ন আহমদ মুসার।
‘জেটিতেই তো আমরা লুকিয়ে ছিলাম। সুলিভান তো সেখানে যায়নি।’ বলল হাসান তারিক।
‘হতে পারে সুলিভান বা মিনি-সাব আমাদের অবস্থান টের পেয়েছিল। সুলিভানও সেখানে যায়নি এবং মিনি সাবও জেটিতে নোঙর করেনি।’ বলে মুহূর্ত খানেক থামল আহমদ মুসা। তারপর আবার বলে উঠল, ‘কিন্তু এমন কিছু ঘটার অর্থ হলো, সুলিভান আমাদের অবস্থান টের পেয়েছিল। যদি তা পেয়ে থাকে, তাহলে সংগে সংগে তা ডেভিড ডেনিমদের জানাবার কথা। কিন্তু ডেভিড ডেনিমদের কথা বার্তায় এমন কিছু আঁচ করা যায়নি।’
‘আমরা বিরাট ধাঁধায় পড়ে গেলাম ভাইয়া। কোনটাকে সত্য বলে গ্রহণ করব’। বলল হাসান তারিক।
‘সুলিভানদের গাড়ি এখানে বার বার আসে এটাকেই সত্য বলে গ্রহণ করব। এস, কেন এসেছিল এ সত্যটা বের করি, তাহলে সবকিছুই পরিষ্কার হয়ে যাবে।’ বলে আহমদ মুসা মনোযোগ নিবিষ্ট করল তার চারপাশে। বুঝার চেষ্টা করল, গাড়ি থেকে নেমে কোন দিকে গেছে।
এ সময় হাসান তারিক একটু পুব দিকে এগিয়ে ঝুঁকে পড়ে একটা কচি চারা হাতে তুলে নিয়ে আহমদ মুসাকে দেখিয়ে বলল, ‘দেখুন এ চারা গাছটা গোড়া ভেঙে পড়েছিল, অনেকখানি শুকিয়ে গেছে।’
‘আহমদ মুসার মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, ‘চল আমাদের ডান দিকেই এগুতে হবে।’
একটু এগিয়ে আহমদ মুসা দেখল, একটা পাথর তার জায়গা থেকে উপড়ে উল্টে আছে। আহমদ মুসা হাসান তারিককে পাথরটা দেখিয়ে বলল, ‘আমরা ঠিক পথেই এগুচ্ছি হাসান তারিক।’
আহমদ মুসারা এইভাবে ছোট-খাট চিহ্ন অনুসরণ করে টিলাটার দক্ষিণ পাশ হয়ে পূব পাশ ঘুরে উত্তর পাশে গিয়ে পৌছল। টিলাটার উত্তর পাশে একটা অগভীর উপত্যকা। উপত্যকাটার পরেই একটা পাথুরে পাহাড়। পাহাড়টার নিচের দিকটা জংগলে ঢাকা হলেও উপরের অংশ অনেকটাই নাংগা, সলিড পাথরের। মাঝে মাঝে গাছ আছে।
আহমদ মুসারা চিহ্ন ধরে পাথুরে পাহাড়টারও উত্তর প্রান্তে গিয়ে পৌছল। সামনে তাকাতেই দেখতে পেল পাহাড়ের গোড়ায় একটা আগের মতই অগভীর, কিন্তু সংকীর্ণ উপত্যকা। উপত্যকার পরেই উঁচু হয়ে উঠেছে একটা উচ্চভূমি এবং ছাদের আকারে তা কিছুটা এগিয়ে গেছে। তার পরেই সাগর।
নিচের সংকীর্ণ উপত্যকাটা ঘন গাছ-পালায় ঢাকা। জংগলের উপর চোখ পড়তেই একটা বিষয়ের প্রতি তার দৃষ্টি দারুণভাবে আকৃষ্ট হলো। দেখল, অনেকগুলো গাছের মধ্যে দাঁড়ানো একটা দেবদারুর মত সোজা লম্বা হয়ে ওঠা গাছের মাথাটা ভাঙা। ভাঙা মাথাটা ঝুলে আছে। ভাঙা অংশটা শুকিয়ে গেছে।
আহমদ মুসার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। গাছের ভাঙা মাথাটা হাসান তারিককে দেখিয়ে বলল, ‘আমার মনে হয় ওটা একটা সংকেত হাসান তারিক।’
‘আপনি মনে করেন, কেউ ডালটা ভেঙে রেখেছে?’ হাসান তারিক বলল।
‘আমার তাই মনে হয়।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ঝড় বা অন্য কোন কারণেও তো ভাঙতে পারে?’ হাসান তারিক বলল।
‘দেখ, গাছটার পূব, পশ্চিম ও উত্তর সব দিকেই গাছের প্রাচীর। দক্ষিণ দিকটা ফাঁকা। কিন্তু এদিকে আবার পাহাড়ের প্রাচীর। সুতরাং এই অবস্থায় অপেক্ষাকৃত ছোট গাছটা এইভাবে ভাঙতে পারে না।’ বলল আহমদ মুসা।
‘যুক্তিটা ঠিক ভাইয়া।’ হাসান তারিক বলল।
‘চল ওদিকে দেখি ব্যাপারটা কি?’ বলল আহমদ মুসা।
বলে আহমদ মুসা পাহাড় থেকে উপত্যকার দিকে নামতে শুরু করল।
সাথে হাসান তারিকও।
উপত্যকায় নেমে এল আহমদ মুসারা।
উপত্যকার তলাটা ঘন আগাছায় ভরা।
‘ভাইয়া এখানেও লোক চলাচলের চিহ্ন পাওয়া যাচ্ছে।’ হাসান তারিক বলল।
‘কিন্তু হাসান তারিক একটা জিনিস দেখ, পেছনে আমরা যেমনটা দেখে এসেছি, এখানকার ঘাস ও আগাছা সে রকম দলিত-মত্থিত নয়। এখানে চলাফেরা হয়েছে খুব সাবধানে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কারণ বোধ হয় এই যে, এখানে ওদের আগমন ওরা লুকাতে চেয়েছে। কিন্তু কেন?’
‘ব্যাপারটা মনে হয় ঠিকানা লুকাবার মত। আমরা হয়তো ওদের গুরুত্বপূর্ণ কোন কিছুর কাছাকাছি পৌছে গেছি।’ আহমদ মুসা বলল।
আহমদ মুসা ও হাসান তারিক দুজনেই চারদিকে সতর্কভাবে চোখ বুলাতে লাগল। কিন্তু দৃষ্টি আকর্ষণের মত কোন কিছুই কোথাও দেখল না।
‘চল আমরা মাথা ভাঙা গাছটার দিকে আগাই।’ আহমদ মুসা বলল।
গাছের গোড়ায় পৌছার আগেই গাছের উত্তর পাশে গাছের নিচেই গাছ-আগাছার একটা বৃত্ত তার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। বৃত্তটার বহিঃসীমা অস্পষ্ট হলেও বৃত্তটা চারপাশের জংগল থেকে আলাদা হয়ে গেছে তা একটু সতর্ক দৃষ্টিতেই চোখে পড়ে। বৃত্তের ভেতরের ঘাস-আগাছার জংগল প্রাকৃতিকভাবে বিন্যস্ত নয়, পরিকল্পিতভাবে সাজানো। এই পার্থক্যই বৃত্তকে আলাদা করেছে।
আহমদ মুসা বৃত্তটা দেখাল হাসান তারিককে।
বিস্মিত কণ্ঠে হাসান তারিক বলল, ‘উপরে গাছের ডাল ভেঙে রাখা, নিচে জংগলের একটা ম্যান-মেড বৃত্তের নিশ্চয় একটা অর্থ আছে ভাইয়া।’
আহমদ মুসা কোন জবাব দিল না। এগুলো গাছের গোড়ায় বৃত্তটার দিকে।
হাসান তারিকও।
বৃত্তটার পাশে পৌছতেই হাসান তারিক বলে উঠল, ‘বৃত্তটাকে এখন কিন্তু ভাইয়া চারদিক থেকে জংগল এলাকা থেকে আলাদা করা যাচ্ছে না।’
‘হ্যাঁ তাই হয়। শিল্পীদের এক শ্রেণীর ছবিকে কাছ থেকে দেখালে তার কোন আকার বুঝা যায় না। কিন্তু দূর থেকে দেখলে আকার পরিষ্কার হয়ে ওঠে। এ ব্যাপারটাও সে রকম। এ বৃত্তটাকে অন্য মানুষের চোখ থেকে লুকাবার জন্যে এটা একটা কৌশল।’ বলেই আহমদ মুসা বৃত্তের চারদিকটা দেখতে লাগল।
মাটির উপর ঝুঁকে পড়ে পরীক্ষা করতে গিয়ে আহমদ মুসা দেখল, ‘বাইরের সাথে বৃত্তের প্রান্ত বরাবর ফাটল এবং তার সাথে কিছুটা আলগা মাটিও ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা।
ব্যাপারটা হাসান তারিকেরও নজরে পড়েছিল। সে বিস্মিত। বলল সে আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে, ‘ভাইয়া মনে হচ্ছে যেন বৃত্ত একটা আলগা জিনিস।’
‘তোমার চিন্তায় আরেকটা বিষয়ও যোগ কর। দেখ বৃত্তের প্রান্ত ধুলি ধূসরিত হলেও খুব শক্ত। যেন সিমেন্টে তৈরী । তার অর্থ প্রান্তটা প্রাকৃতিক নয় বিশেষভাবে তৈরী করা হয়েছে।’ বলে উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা। তার কপাল কুঞ্চিত। ভাবছে আহমদ মুসা।
হাসান তারিকও উঠে দাঁড়িয়েছে। তারও চোখে-মুখে বিস্ময়।
আহমদ মুসা আবার ঘুরে এল বৃত্তটার কাছে। বলল, ‘বৃত্তটাকে ম্যানহোলের ঢাকনার মত কিছু বললে কেমন হয়?’
চোখ কপালে তুলল হাসান তারিক। তার মানে জংগল-ঢাকা এই গোটা বৃত্তটা সরানো যাবে?’
‘প্রান্ত বরাবর আলগা মাটি দেখে মনে হচ্ছে এটা উঠেছে-নেমেছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কিন্তু কিভাবে সম্ভব? কেনইবা উঠবে? এই জংগলে এমন বিদঘুটে জায়গায় কি থাকতে পারে?’ হাসান তারিক বলল।
আহমদ মুসা ভাবছিল। তাকিয়েছিল পূব দিকে। বলল, ‘আমরা সান্তাসিমা পাথুরে জেটির প্রায় সমান্তরালে দাঁড়িয়ে আছি। এখান থেকে পাথুরে জেটিটা কতগজ হবে হাসান তারিক?’
হাসান তারিক পূব দিকটা একটু ভাল করে দেখে বলল, ‘ভাইয়া আমরা তো পাথুরে জেটিটার পাশেই দাঁড়িয়ে আছি। পাথুরে জেটির পশ্চিম পাশে যে পাথুরে দেয়াল দেখেছি, যাকে আমরা পাহাড় ভেবেছি, সেটা আমাদের সামনের উচ্চভূমির দেয়াল। আমাদের এখান থেকে সে দেয়ালের দূরত্ব বিশ-পঁচিশ গজের বেশি হবে না।’
আহমদ মুসার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, ‘এই বৃত্তটা যদি কোন ঢাকনা জাতীয় কিছু হয়, তাহলে আমার মনে হচ্ছে এই হাইল্যান্ডের নিচে কোন স্থাপনা তৈরী করা হয়েছে যার সাথে পাথুরে জেটির সম্পর্ক আছে।’
হাসান তারিক সংগে সংগে কথা বলল না। তার চোখে-মুখে আনন্দ ও বিস্ময়ের সমাহার। পরে ধীরে ধীরে বলল, ‘তাহলে ভাইয়া, সান্তাসিমা উপত্যকার এই আসল ঘাঁটি। এখানে ঢোকার পথও তাহলে এই বৃত্ত-মুখটাই।’
বলে একটু থেমেই আবার বলা শুরু করল হাসান তারিক, ‘বৃত্তটা একটা ঢাকনা হলে বাইরে খোলার একটা পথ অবশ্যই থাকবে। সেটাই এখন আমাদের দেখা দরকার ভাইয়া।’
‘হ্যাঁ, এটা কোন ঢাকনা হলে তা খোলার উপায় তো অবশ্যই থাকবে।’ বলে আহমদ মুসা বসে পড়ল। বৃত্তের উপর আবার চোখ বুলাতে লাগল। কিন্তু চারদিক ঘুরেও সন্দেহ করার মত কিছু পেল না। আহমদ মুসা নিশ্চিত যে, কোন ইলেক্ট্রনিক ব্যবস্থা ছাড়া এ ধরনের দৈত্যাকার ঢাকনা উঠানো নামানো সম্ভব নয়। ইলেক্ট্রনিক ব্যবস্থার সে ধরনের কৌশল খুঁজে পেল না আহমদ মুসা।
কিন্তু মাথা ভাঙা গাছটার বরাবরে এসে আহমদ মুসা বৃত্তের বাইরে আগাছার ভেতর আলগা মাটির একটা অস্পষ্ট লাইন দেখতে পেল। আগাছার মধ্যে এ ধরনের আলগা মাটি অস্বাভাবিক।
আহমদ মুসা দুহাতে আগাছা দুদিকে সরিয়ে ভালো করে দেখল আলগা মাটির লাইনটাকে।
আলগা মাটির এ লাইনটি শুরু হয়েছে বৃত্তের প্রান্তের সাথে লেগে থাকা বাইরের মাটির প্রায় কোনা থেকে। আর শেষ হয়েছে গাছের গোড়ায় গিয়ে। আহমদ মুসা মাটির ট্রাকটি অনুসরণ করে গাছের গোড়ায় গিয়ে পৌছল।
ঘাস ও আগাছার ভিড়ে গাছের গোড়াটা দেখাই যায় না।
আহমদ মুসা আলগা মাটির লাইন সোজা গাছের জায়গাটার আগাছার ফাঁক দিয়ে তাকাল গাছের গোড়ার দিকে। দেখতে পেল মাটি থেকে পাঁচ-ছয় ইঞ্চি উপরে গাছের গোড়ার একটা জায়গা চার বর্গ ইঞ্চি আকারে গোল করে কাটা এবং মাটি থেকে কাটা পর্যন্ত জায়গাটা গাছের পাতা দিয়ে ঢেকে দেয়া।
আহমদ মুসা ডান হাতে জংগল ফাঁক করে রেখে বাঁ হাত দিয়ে পাতাগুলো সরিয়ে ফেলল। সংগে সংগেই তার নজরে পড়ল গাছের গা বেয়ে মাটি থেকে উঠে আসা একটা বিদ্যুতের তার।
দুচোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল আহমদ মুসার। কাটা অংশটা ধরে টান দিল। হাতের সাথে কাটা অংশটা উঠে এল।
কাটা অংশটা ছিল ঢাকনার মত লাগানো। ঢাকনা তুলতেই দেখা গেল প্লাষ্টিকের একটা ক্ষুদ্র সুইচ বক্স। সুইচ প্যানেলের একটা প্রান্ত নীল, অন্য প্রান্তটা লাল। সুইচটা নীল প্রান্তে টেনে দেয়া আছে।
আহমদ মুসা সোজা হয়ে দাঁড়াল।
পেছনেই দাঁড়িয়েছিল হাসান তারিক। হাসান তারিকও দেখতে পেয়েছিল সবকিছু।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াতেই হাসান তারিক বলে উঠল, ‘ভাইয়া, সত্যিই আমরা ঠিক জায়গায় এসে গেছি। এখানে সুইচ টিপেই এই দৈত্যাকার ঢাকনাটা খোলা যাবে।’
‘হ্যাঁ হাসান তারিক। সুইচটা নীল প্রান্ত থেকে লাল প্রান্তে আনলেই সিঁড়ি বা গুহা মুখের ঢাকনাটা খুলে যাবে। কিন্তু আমি ভাবছি হাসান তারিক, এটা দরজা খোলার সুইচ, না দরজা খোলার জন্যে সংকেত পৌছাবার সুইচ।’ চিন্তা জড়িত কণ্ঠে বলল আহমদ মুসা।
‘যেটাই হোক ভাইয়া, সুইচ টিপলে দরজা খুলে যাবে।’ বলল হাসান তারিক।
‘তা ঠিক। কিন্তু এটা দরজা খোলার সংকেত হলে, দরজার মুখেই লোক থাকবে আমাদের স্বাগত জানানোর জন্যে।’
‘এর পরেও তো আমাদের সামনে এগুতে হবে ভাইয়া।’ হাসান তারিক বলল।
‘হ্যাঁ হাসান তারিক তৈরী হও। রিভলবারটা হাতে নাও। ঢাকনাটার প্রান্তে গিয়ে দাঁড়াও। আমি সুইচ টিপছি।’
বলে আহমদ মুসা হাত বাড়াল সুইচের দিকে। আর বাম হাত দিয়ে পকেট থেকে তুলে নিল মেশিন রিভলবার। অন্যদিকে হাসান তারিক পকেট থেকে রিভলবার তুলে নিয়ে ছুটল ঢাকনার প্রান্তে।
আহমদ মুসা সুইচ বক্সের সাদা বোতামটাকে টেনে আনল নীল প্রান্ত থেকে লাল প্রান্তে।
সংগে সংগে শীষ দেয়ার মত একটা শব্দ হলো।
আহমদ মুসা তাকাল বৃত্তাকার ঢাকনার দিকে। দেখল বৃত্তাকার ঢাকনা নিচে নেমে যাচ্ছে। ফুট দুয়েক নামার পর ঢাকনাটা দ্রুত পাশে সরে গেল।
আহমদ মুসা দৌড়ে গিয়ে হাসান তারিকের পাশে দাঁড়াল। দেখল, তারা একটা সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে। সিঁড়ির গোড়াটা একটা আলোকিত ঘরে। পাথুরে মেঝের একটা ঘর ওটা।
আহমদ মুসা সিঁড়িতে পা রেখে বলল, ‘আমি নামছি, তুমি এস।’
আহমদ মুসা ও হাসান তারিক দুজনেই তরতর করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল।
আহমদ মুসারা পা রাখল ঘরে। চতুষ্কোণ একটা ঘর। পাথুরে মেঝে, পাথুরে ছাদ। পাশের দেয়াল ছোট-বড় পাথর গেঁথে তৈরী। ঘরে জানালা নেই, একটি দরজা। ঘরটা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। ঘরে কোন আসবাবপত্র নেই। তবে সিঁড়ির পেছনের দেয়ালে অনেকগুলো বাক্স সাজিয়ে রাখা।
‘বাক্সগুলো একটু দেখা দরকার।’ ফিসফিস করে বলল আহমদ মুসা ।
সংগে সংগেই হাসান তারিক ছুটল বাক্সগুলোর দিকে।
পকেট থেকে ছুরি বের করে একটা বাক্সের উপরের কভারটা কেটে ফেলল।
বাক্সে বই ভর্তি।
একটা বই হাতে তুলে নিল আহমদ মুসা। নজর বুলাল শিরোনামের উপর ঃ ‘বাইফেইথ ইসলামিষ্টস আর টেররিষ্ট’। ইংরেজী ভাষার এ গ্রন্থ লিখেছেন ‘ এ গ্রুপ অব ইউরোপীয়ান পিপল।’ প্রকাশকের জায়গায় লেখা ‘ক্রিশ্চিয়ান চ্যারিটি প্রেস, বেলফার্ষ্ট, উত্তর আয়ারল্যান্ড।’ প্রকাশকের বক্তব্য যিনি দিয়েছেন, তার নাম ‘মেরি ক্রিশ্চিয়ানা’। তার ঠিকানা লেখা হয়েছে ‘রোম, ইটালী।’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘বইটা লিখেছে, ছেপেছে ও ছড়াচ্ছে ইহুদীরা, কিন্তু দেখানো হচ্ছে বইটা খৃষ্টানরা লিখেছে, ছেপেছে এবং তাই তারাই প্রচার করছে।’
‘নতুন কি ভাইয়া, ইহুদীবাদীরা খৃষ্টানবাদের ঘাড়ে বন্দুক রেখেই তো শিকার করে চলেছে।’ হাসান তারিক বলল।
‘এত বই এখানে কেন?’ অনেকটা স্বগত প্রশ্ন আহমদ মুসার।
‘আমার মনে হয় ভাইয়া, বইগুলো এখানে আনা হয়েছে উত্তর আজোরসের দ্বীপগুলোর জন্যে।’
‘মনে হয় হারতাকেই ওরা উত্তর আজোরসের ঘাঁটি বানিয়েছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তাহলে সাও তোরাহ কি?’ জিজ্ঞাসা হাসান তারিকের।
‘সাও তোরাহ ওদের ভয়াবহ এক জেলখানা, ঠিক আলেকজান্ডার সোলঝেনিৎসিনের ‘গোলাগ’ দ্বীপের মত।’
আহমদম মুসা কথা শেষ করেই এগুতে লাগল দরজার দিকে।
সাথে সাথে চলল হাসান তারিকও।
দরজাটা ষ্টিলের। দরজার এপারে হুক আছে, লক সিষ্টেমও রয়েছে। হুক খোলা। লক করা থাকতেও পারে, না থাকতেও পারে।
‘লক করা না থাকুক’ আহমদ মুসা কামনা করল।
ডান হাতে মেশিন রিভলবার ধরে বাম হাতে দরজার হাতলে চাপ দিল আহমদ মুসা। নিশব্দে ঘুরে গেল হাতল। সেই সাথে কিঞ্চিত সরে এল দরজা। লক করা নেই বুঝল আহমদ মুসা। পরক্ষণেই এক ঝটকায় খুলে ফেলল দরজা। মেশিন রিভলবার বাগিয়ে আহমদ মুসা ও হাসান তারিক দুজনেই দরজা থেকে মুখ বাড়িয়ে চারদিকে তাকাল।
দরজার বাইরে ওটা কোন ঘর নয়, একটা প্রশস্ত করিডোর। তার দুদিকেই ঘরের সারি।
আহমদ মুসা ও হাসান তারিক দুজনেই অনেকক্ষণ অপেক্ষা করল দরজায়। কিন্তু কাউকে দেখল না। এমনকি কোন দিক থেকে কোন সাড়াশব্দও পেল না।
‘আমার মনে হয়, এখন কেউ নেই। প্রয়োজনের সময়ই শুধু ওরা আসে হয়তো।’ ফিসফিসে কণ্ঠে বলল হাসান তারিক।
‘চল সার্চ করে দেখা যাক।’ বলে আহমদ মুসা সাবধানে পা ফেলল করিডোরে।
হাসান তারিকও করিডোরে নেমে এল।
‘চল আগে করিডোর ঘুরে সবটা দেখে আসি। তারপর সব সার্চ করা যাবে। আগে আমাদের দেখা দরকার মিনি-সাবমেরিনের সংযোগটা কিভাবে। এখন আমার মনে হচ্ছে, সেই রাতে দুটি মিনি সাবমেরিনকে জেটিতে আধাডোবা অবস্থায় অপেক্ষা করে চলে যেতে দেখেছিলাম। ওরা কিন্তু অপেক্ষা করে ফিরে যায়নি। কাজ সম্পন্ন করেই তারা চলে যায়। শেখুল ইসলামকে এক মিনি সাবমেরিন এসে রেখে যায়, পরের মিনি সাব মেরিনটা এসে তাকে নিয়ে যায়। পানির ভেতরে হস্তান্তরটা কিভাবে করেছিল সেটা আমাদের জানা দরকার।’
ফিস ফিসিয়ে কথাগুলো বলল আহমদ মুসা হাসান তারিককে।
দরজা থেকে বের হবার পর হাতের ডান দিকে মানে দক্ষিণে করিডোরটা ছয়সাত গজের বেশি এগোয়নি। অতএব আহমদ মুসারা হাঁটছিল করিডোর ধরে উত্তর দিকে।
দু’পাশেই ঘর।
কয়েকটা ঘর পেরুতেই পূর্বমুখী আরেকটা করিডোরের সংযোস্থলে তারা গিয়ে পৌছল।
সেখান থেকে মূল করিডোরটা আরও উত্তরে এগিয়ে গেছে। আর পূবমুখী শাখা করিডোরটা পনের বিশ গজ পূবে গিয়েই শেষ হয়ে গেছে।
‘আমাদেরকে উত্তরেই এগুতে হবে।’ বলে আহমদ মুসা মূল করিডোর ধরে সামনে এগুল।
হাসান তারিকও তার পাশাপাশি হাঁটছিল।
আহমদ মুসারা ত্রিমুখী করিডোরের সংযোগস্থলের মাঝখানে এসে পৌছেছে, এ সময় চারদিক থেকে অনেকগুলো ফাঁস এসে তাদের জড়িয়ে ফেলল। ফাঁসগুলো তাদের গলা এবং হাতসহ বুক বরাবর দেহকে কঠিনভাবে বেঁধে ফেলল। আত্মরক্ষার কোন চেষ্টা করার আগেই মাটিতে আছড়ে পড়ে গেল তারা।
আহমদ মুসাদের উপর ফাঁস নিক্ষেপ করেছিল ছাদের চারদিকের ব্যালকনি থেকে। আহমদ মুসারা করিডোরে ঢোকার পর ঘর ও করিডোরের দিকেই শুধু নজর রেখেছে, উপরে তাকায়নি। উপরে ছাদের চারদিক ঘিরে ব্যালকনি। ব্যালকনির রেলিং-এ পর্দা টাঙানো। এরই আড়ালে লুকিয়ে ছিল ওরা ছয়জন। প্রত্যেকের হাতেই ষ্টেনগান। কিন্তু ওরা গুলী করে চোখের পলকে শত্রু মারার চেয়ে ফাঁসিতে আটকে খেলিয়ে মারার মধ্যেই আনন্দ খুঁজে পেয়েছে।
ফাঁসিতে আটকে আহমদ মুসাদের মেঝেতে আছড়ে ফেলার পর ওরা ছয়জন লাফিয়ে নেমে এল মেঝেতে।
ওরা ফাঁস ধরে টেনে আহমদ মুসা ও হাসান তারিককে ত্রিমুখী করিডোরের সংযোগ স্থলের উত্তর পাশের বড় একটা ঘরে নিয়ে এল।
ঘরটা অনেকটা মিডিয়া রুমের মত। অনেকগুলো লাল-কাল টেলিফোন, ফ্যাক্স, টিভি ও কম্পিউটারে সজ্জিত ঘরটা। বসার জন্যে সোফা-চেয়ারও আছে অনেকগুলো।
ঘরে ঢুকিয়েই একজন মোবাইল নিয়ে কোথাও কল করল। সংযোগ হতেই টেলিফোনকারী লোকটি শরীরটা সামনে বেঁকিয়ে মাথা নিচু করে বিনীত কণ্ঠে বলল, ‘এক্সিলেন্সি, আমাদের এই ঘাঁটিতে দুজন লোক প্রবেশ করেছিল। আমরা তাদের ধরে ফেলেছি। আমাদের নির্দেশ নিয়ম অনুসারে ওদের খুন করাই একমাত্র শাস্তি। তবু মনে হলো আপনাকে জানিয়ে তবেই কিছু করা দরকার। আপনি নির্দেশ করুন।’
ওপারের কথা শুনে লোকটি বলল, ‘হ্যাঁ দুজনেই বিদেশী।’
কথঅ শেষ করে ওপারের কথঅ শুনল। শুনেই তার দুচোখ বিস্ময়ে ছানাবড়া হয়ে উঠল। বলল, ‘সাংঘাতিক এক্সিলেন্সি, আমরা তো এতটা ভাবিনি। আমরা ভালোভাবে ওদের বেঁধে রেখেছি।’
ওপারের কথা শুনল আবার সে। তারপর বলল, ‘ঠিক আছে এক্সিলেন্সি। বুঝতে পেরেছি। আপনি যেভাবে বলেছেন, সেভাবেই ওদের রাখব। আপনারা কখন আসছেন? এখনি যাত্রা করছেন? ঠিক আছে এক্সিলেন্সি। আমরা হুশিয়ার থাকব।’
কথা শেষ করে মোবাইল অফ করে রেখে দিয়ে উঠে দাঁড়াল লোকটা। তার চোখে হিং¯্র দৃষ্টি। সে তার লোকদের উদ্দেশ্য করে বলল, ‘জানো এই দুজন লোক আমাদের অসংখ্য লোককে খুন করেছে। আমাদের কর্তারা যাদের হন্যে হয়ে খুঁজছেন, সেই আহমদ মুসা এরা হতে পারে। মিনি-সাব নিয়ে কর্তারা এখনি যাত্রা করছেন। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এসে যাবেন। এখন এদের ব্যাপারে আমাদের খুব সাবধান থাকতে হবে।’
লোকটি থেমেই আবার বলে উঠল, ‘তোমরা ওদের সব অস্ত্র কেড়ে নিয়েছ তো?’
একজন উত্তরে বলল, ‘হ্যাঁ, ওদের কাছে আর কিছুই নেই।’
‘ঠিক আছে, এখনই ওদের দুপা বেঁধে ফেল, দুহাত যেভাবে দেহের ফাঁসে বাঁধা পড়েছে, সেটাকে আরও শক্ত করো। ওদের চোখ বেঁধে ফেল এবং মুখও আটকে দাও টেপ দিয়ে। বলে লোকটি আহমদ মুসার দিকে এগিয়ে এল। বলল, ‘আমরা তোমাদের শিকার বানাতে পারলাম না। তোমরা যাদের শিকার তারা আসছে। তোমরা আমাদের ডেভিড ডেনিম, সুলিভান, কেলভিনসহ বহুলোককে হত্যা করেছ। তার ফল তোমাদেরকে তিল তিল করে ভোগ করতে হবে।’
কথা শেষ করেই হেসে উঠল লোকটি। বলল, ‘তোমরা বোকার মত ঢুকেছিল এ ঘাঁটিতে। মনে করেছিলে বোধ হয় তোমাদের চেয়ে বুদ্ধিমান আর কেউ নেই। কিন্তু জানতে না তোমরা, গাছের সুইচে চাপ দেবার সংগে সংগে শুধু সিড়ির দরজাটাই খুলে যায়নি ভেতরে এলার্মও বেজে উঠেছিল। সংগে আমাদের এই টিভিতে তোমাদের ছবি ভেসে উঠেছিল। টিভি ক্যামেরা লুকানো ছিল বৃত্তাকার ঢাকনার কৃত্রিম গাছ-গাছড়ার মধ্যে। আমরা ভেতরে তোমাদের জন্যে ফাঁদ পেতে বসেছিলাম। ফাঁদে তোমরা পরিকল্পনা মোতাবেকই ধরা পড়েছ। এখানে কেউ ঢুকলে তার জন্যে মৃত্যু ছাড়া দ্বিতীয় আর কোন পথ থাকে না। এতক্ষণ তোমরা লাশ হয়ে যেতে, কিন্তু তোমাদের মৃত্যুটা লেখা আছে আরও উপরের কর্তাদের হাতে। তার আগে তোমাদের নিয়ে নাকি অনেক কাজ আছে।’
কথা শেষ করে হঠাৎ সে চমকে উঠার মত সোজা হয়ে দাঁড়াল। বলল একজনকে লক্ষ্য করে, ‘ভেতরের সুইচ টিপে সিঁড়ির দরজা কি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে?’
ওরা পাঁচজন আহমদ মুসা ও হাসান তারিককে বাধার কাজে ব্যস্ত ছিল। হাত-পা ওদের নতুন করে বাঁধা হয়ে গিয়েছিল। চোখ-মুখ বাঁধতে যাচ্ছিল ওদের। নেতা লোকটির কথা শুনে ওরা পাঁচজনই অপরাধীর মত উঠে দাঁড়াল। বলল একজন, ‘আমরা এদের ধরে সোজা এখানে নিয়ে এসেছি। ভুলেই গেছি আমরা সিঁড়ির দরজার কথা।’
বলে এ লোকটিসহ আরও একজন ঘর থেকে বেরিয়ে ছুটল সিঁড়ি ঘরের দিকে।
আহমদ মুসা লোকটির টেলিফোন আলাপ শুনে এবং আজর ওয়াইজম্যানদের কেউ তাদেরকে এখান থেকে নিয়ে যাবার জন্যে আসছে জানতে পেরে খুশি হয়ে উঠেছিল। সে মনে মনে প্রার্থনা করছিল তাদেরকে যেন সাও তোরাহ দ্বীপে নিয়ে যাওয়া হয়। বন্দী হয়ে যাওয়ার মধ্যে ঝুঁকি আছে, কিন্তু আরও মন্দের চেয়ে এটা তো ভালো। বলল আহমদ মুসা লোকটিকে লক্ষ্য করে, ‘তোমার কর্তারা আমাদের কোথায় নিয়ে যেতে চান? তোমাদের কর্তারা থাকেন কোথায়? তোমাদের কর্তারা আমাদের এত ভয় করেন? আর তোমাদের এত দূর্বল ভাবেন যে, আমাদের সাথে কথা বললেই তোমাদের আমরা পটিয়ে ফেলব?’
লোকটি কোন কথা বলল না। যে চেয়ার থেকে উঠে এসেছিল সেই চেয়ারে গিয়ে বসল।
আহমদ মুসাই আবার কথা বলল, ‘তোমাদের কর্তারা বলছেন, আমরা তোমাদের অনেক লোককে হত্যা করেছি। কিন্তু তোমরা নিশ্চয় জান, বাড়িতে ডাকাত পরলে ডাকাতকে হত্যা করা অপরাধ নয়, কিন্তু ডাকাতরা যদি হত্যা করে সেটা অপরাধ। তোমাদের কর্তারা কত লোককে খুন করেছে, কত লোককে সাও তোরাহতে এনে পশুর মত নির্যাতন করছে তা তোমাদের অবশ্যই জানার কথা।’
ক্রোধে জ্বলে উঠল চেয়ারে বসা লোকটা, কিছু বলতে যাচ্ছিল আহমদ মুসাদের পাশে দঁড়ানো লোকদের উদ্দেশ্যে।
কিন্তু তার আগেই ওদের একজন বলে উঠল, ‘সিঁড়ির দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ তো এখনো আমরা পেলাম না। দেখে আসি ওরা কি করছে।’
‘তাই তো, এতক্ষণ ওদের ফেরার কথা।’ বলল একজন।
‘যাও তোমরা দুজন ওদিকে। হাওয়া খেতে দেখলে ঘাড় ধরে নিয়ে এস।’ উত্তরে বলল চেয়ারে বসা লোকটি।
নির্দেশ পেয়ে দুজন বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
চেয়ারে বসা লোকটি কাল টেলিফোনটা টেনে নিয়ে একটা টেলিফোন করা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
মিনিট তিনেক কেটে গেল তার টেলিফোন কলে।
টেলিফোন রেখেই ভ্রুকুঞ্চিত করে লোকটা আহমদ মুসার পাশে দাঁড়ানো অবশিষ্ট লোকটিকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘ওরা কি শুরু করল? আরও কিছু জরুরী কাজ আছে। ওরা দেরি করছে কেন? যাও ডাক ওদের।’
লোকটি বেরিয়ে গেল।
দুমিনিটেও যখন কেউ ফেরত এল না, তখন চেয়ারে বসা লোকটি অগ্নিমূর্তি হয়ে উঠে দাঁড়াল। চিৎকার করে উঠল, ‘সব অপদার্থের দল। সবাইকে পিটিয়ে আজ লাশ করে দেব।’ বলে সে ষ্টেনগানটা তুলে নিয়ে দরজার দিকে হাঁটা শুরু করল।
কিন্তু দরজার মুখোমুখি হতেই তার দুচোখ ছানা বড়া হয়ে গেল। কাল প্যান্ট, কাল সার্ট ও কাল হ্যাট পরা দুজন লোক দরজায় যমদূতের মত দাঁড়িয়ে।
কিন্তু প্রথম দেখার চমক কাটিয়ে উঠেই লোকটি তার ষ্টেনগান তুলছিল দরজার দাঁড়ানো আগন্তুকদের উদ্দেশ্যে।
কিন্তু আগন্তুক দুজনের দুহাত বিদ্যুত বেগে উঠে এল এবং এক সাথেই গুলী বর্ষিত হলো তাদের দুই রিভলবার থেকে।
লোকটির ষ্টেনগান মাঝপথেই থেমে গেল এবং বুকে একসাথে দুই গুলী খেয়ে ছিটকে পড়ল তার দেহটা দরজার এক পাশে।
দরজা থেকে কালো মূর্তি দুজন ঘরে ঢুকল। দুজনেই এসে দাঁড়াল আহমদ মুসাদের পাশে। তারপর দুজনেই একসাথে মাথার হ্যাট খুলে হেসে উঠল। বলল আহমদ মুসাদের লক্ষ্য করে, ‘আপনাদের এভাবে দেখতে মজাই লাগছে।’
আহমদ মুসাও হাসল। বলল, ‘পাঁচ কুমির ছানাকে দুই দুই এক করে তোমরা যে গ্রাস করলে তাও আমাদের মজা দিয়েছে। এখন বল সোফিয়া সুসান ও পলা জোনস, ওদের কাউকেই বাঁচিয়ে রাখনি কিছু জানার জন্যে?’
‘স্যরি মি. আহমদ মুসা, ওদের মুখ বন্ধ করতে হলে ওদের না মেরে উপায় ছিল না।’ বলল সোফিয়া সুসান।
‘তার মানে এখানেও কাউকে জীবিত পাওয়া গেল না।’ বলল আহমদ মুসা।
পলা জোনস আহমদ মুসাদের বাঁধন কাটা শুরু করে দিয়েছিল। সোফিয়া সুসানও তার সাথে যোগ দিল।
বাঁধন মুক্ত হয়ে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘সিঁড়ি মুখটা নিশ্চয় বন্ধ করে দেয়া হয়নি এখনও?’
‘জি না, হয়নি। আমরা সে চেষ্টা করিনি। তার সময়ও হয়নি।’ বলল সোফিয়া সুসান।
‘হাসান তারিক তুমি যাও দরজাটা বন্ধ করে এস। সিঁড়ির শেষ ধাপের উপরের ধাপে সুইচ দেখতে পাবে।’ নির্দেশ দিল আহমদ মুসা।
‘জি ভাইয়া।’ বলে হাসান তারিক উঠে গেল।
আহমদ মুসাও এগুল নিহত লোকটার সেই মোবাইলের দিকে। মোবাইলটি নিয়ে আহমদ মুসা ‘কল প্রেরণ’ উইনডোটা বের করল। আহমদ মুসার উদ্দেশ্য, কিছুক্ষণ আগে লোকটা তার যে কর্তাদের সাথে কথা বলল, তাদের অবস্থান কোথায়? সাও তোরাহ, না অন্য কোথাও। কিন্তু বের হলো একটা মোবাইল নাম্বার। আহমদ মুসা জিজ্ঞেস করল পলা জোনসদেরকে যে মোবাইল নাম্বার দেখে এলাকার পরিচয় জানা যাবে কিনা।
কথা বলে উঠল সোফিয়া সুসান। বলল, ‘না সম্ভব নয় জনাব। আজোরস দ্বীপপুঞ্জের মোবাইলগুলো সেন্ট্রালি এ্যালোট করা।’
মিনিট খানেক না যেতেই হাসান তারিক ফিরে এল। বলল, ‘হ্যাঁ ভাইয়া দরজা বন্ধ করেছি।’
বলেই তাকাল হাসান তারিক পলা জোনসের দিকে। বলল, ‘ছুরি দিয়ে আপনারা কাবু করেছেন পাঁচজনকে!’
‘এক সাথে তো নয় তিনবারে। গুলী করা সম্ভব ছিল না অন্যেরা সাবধান হবে এই ভয়ে। অসুবিধা হয়নি। সোফিয়া সুসান তো কমান্ডো। সেই কাজ করেছে আমি সাথে ছিলাম।’ পলা জোনস বলল।
‘আমরা ধরা পড়ার কথা কি আপনারা জেনেছিলেন?’ বলল হাসান তারিক।
‘জেনেছিলাম নয়, দেখেছিলাম।’ পলা জোনস বলল।
‘আপনারা কি আমাদের পেছনে পেছনেই ভেতরে ঢুকেন?’ বলল হাসান তারিক।
‘হ্যাঁ। তবে ততটা পেছনে, যতটা পেছনে থাকলে আপনাদের চোখে পড়া থেকে বাঁচা যায়। আপনারা করিডোরে ঢোকার পর আমরা সিঁড়ি ঘরে নেমে আসি।’ পলা জোনস বলল।
‘আমার বিস্ময় লাগছে, আহমদ মুসা ভাইকে না জানিয়ে এমন সিদ্ধান্ত আপনারা নিলেন কি করে!’ অনেকটা স্বগতকণ্ঠে বলল হাসান তারিক।
‘আমরা এসেছি ঈশ্বরের নির্দেশে। মি. আহমদ মুসা অবশ্যই আমাদের মাফ করবেন।’ বলল সোফিয়া সুসান। তার ঠোঁটে এক টুকরো হাসি।
আহমদ মুসা মোবাইলটা রেখে দিয়ে একটা চেয়ারে বসেছিল। তার মুখেও হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘ঈশ্বরের নির্দেশে আসলে আহমদ মুসার কাছে মাফ চাওয়ার প্রয়োজন কি?’
‘ঈশ্বরেরই তো নির্দেশ নেতার আনুগত্য করতে হবে।’ বলল সোফিয়া সুসান।
‘আমি আপনার নেতা হলাম কবে?’ আহমদ মুসা বলল। তার কণ্ঠে কৃত্রিম বিস্ময়ের সুর।
‘আপনি হননি, আপনাকে নেতা বানিয়েছি। আর এই আনুগত্য আমার একান্তই পারসোনাল ব্যাপার।’ বলল সোফিয়া সুসান। তার চোখে-মুখে একটা ঔজ্জ্বল্য।
‘ভাইয়া, সোফিয়া সুসান শুধু যে এক বাপের এক মেয়ে তা নয়। আপনি জানেন না হারতা ও পাশের নেসকুইন দ্বীপের সবচেয়ে দীর্ঘদিন রাজত্বকারী আলতামোরা রাজবংশের একমাত্র মেয়ে। সে যা ইচ্ছা করে তাই করে থাকে। সুখের জীবন বাদ দিয়ে কমান্ডো বাহিনীতে সে যোগ দিয়েছে নিজের জেদেই। সে আমাকে জোর করে সাথে নিয়ে এসেছে ভাইয়া।’
‘না, এবার জেদের বশে নয়, ঈশ্বরের নির্দেশ পেয়ে এসেছে ও।’ হেসে বলল আহমদ মুসা।
একটু থেমেই আবার বলে উঠল, ‘তোমাদের দুজনকেই ধন্যবাদ। এখন কাজের কথায় আসি।’
বলে একটু থামল আহমদ মুসা।
একটু ভাবল। তারপর শুরু করল, ওরা মিনি-সাব নিয়ে আমাকে ও হাসান তারিককে নিতে আসছে। কতক্ষণে ওরা পৌছবে জানি না। ওদের মধ্যে আজর ওয়াইজম্যান থাকবে বলে মনে হয় না। তবে তাদের লোকরাই আসছে। আমাদের জন্য এটা একটা মহা সুযোগ। আমরা যদি ওদের মিনি-সাব দখল করতে পারি, তাহলে সাও তোরাহ পৌছা অনেক সহজ হয়ে যাবে। কিন্তু এ জন্যে অনেকগুলো কাজ আমাদের করতে হবে। প্রথমত মিনি সাবের সাথে কিভাবে এই ঘাঁটির সংযোগ হবে, কোন পথে কিভাবে মিনি-সাব থেকে এখানে নামার ব্যবস্থা হবে তা আমরা জানি না, দ্বিতীয়ত ওদের সন্দেহমুক্ত ভাবে কিভাবে এই ঘাঁটিতে নিয়ে আসা হবে এবং তৃতীয় কাজটা হলো মিনি-সাবটা দখল করা। তৃতীয় কাজটা অবস্থার বিচারে করা হবে, কিন্তু প্রথম দুটো কাজ নিয়ে আমাদের অনেক ভাবতে হবে। এই ভাবনার জন্যে আমি তোমাদের আহ্বান জানাচ্ছি।’
থামল আহমদ মুসা।
কথা বলে উঠল হাসান তারিক, ‘ওদের কথা থেকে বুঝা গেছে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার মাধ্যমে বাইরের দৃশ্য মনিটর করা হয়। সুতরাং আমরা বন্দী অবস্থায় ওদের যে আলোচনা শুনেছি এবং টিভি মনিটরিং-এর মাধ্যমে যা আমরা দেখব তার ভিত্তিতে প্রাথমিক যোগাযোগের কাজ হয়তো করা যাবে। কিন্তু ওদের মনে যাতে সন্দেহের সৃষ্টি না হয় এ জন্যে ওদেরকে মিনি-সাব থেকে ঘাঁটির ভেতরে আনার কাজটা কিভাবে স্বাভাবিক করা যাবে সেটা নিয়ে আরও ভাবতে হবে। কিন্তু প্রথমত ঘাঁটি অনুসন্ধান করে দেখা প্রয়োজন কোন ক্লু পাওয়া যায় কিনা, সাহায্য পাওয়া যেতে পারে এমন কিছু পাওয়া যায় কিনা।’
‘ঠিক বলেছ, চল সার্চটা শুরু করা যাক।’
বলেই উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা।
ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে সোফিয়া সুসান ও পলা জোনসকে বলল, ‘তোমরা টিভি মনিটরিং এবং ফ্যাক্স ও টেলিফোনগুলোর উপর নজর রাখ।’
আহমদ মুসারা ঘাঁটির প্রতিটি ঘর সার্চ করল। প্রয়োজনীয় তথ্য গুলো সংগ্রহ করল। অবশেষে তারা উত্তর প্রান্তের প্রশস্ত করিডোরটি দিয়ে একটা তালাবদ্ধ ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল। আহমদ মুসা পকেট থেকে ষ্টিলের একটা তার বের করে তালাটা খুলে ফেলল।
বেশ বড় ঘর।
ঘরের পূব দেয়ালের দিকে তাকিয়ে তারা বিস্মিত হলো। দেয়ালে পাঁচ ফুট উঁচু ও চার ফুঁট প্রস্তের একটা কাঠামো। ঠিক প্লেন বা স্পেসশীপের দরজার মত।
আহমদ মুসা ও হাসান তারিক দুজন দুজনের দিকে তাকাল। দুজনেরই চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে আনন্দে।
প্রথম আহমদ মুসা কথা বলল, ‘কি বুঝছ হাসান তারিক?’
‘মিনি সাবমেরিন ও ঘাঁটির মধ্যেকার গ্যাংওয়ের এটা এপাশের দরজা ভাইয়া।’ আনন্দের সাথে বলল হাসান তারিক।
‘আলহামদুলিল্লাহ, এক রহস্যের উন্মোচন হলো হাসান তারিক। দরজাটা যন্ত্র নিয়ন্ত্রিত তা বুঝাই যাচ্ছে। ঐ দেখো দরজার পাশে ডিজিটাল প্যানেল দেখা যাচ্ছে। এসো দেখি।’ কথাগুলো বলে আহমদ মুসা দরজার দিকে হাঁটতে লাগল।
আহমদ মুসা ও হাসান তারিক দুজনে দরজার পাশের ডিজিটাল প্যানেলের মুখোমুখি দাঁড়াল। ডিজিটাল প্যানেলে অনেকগুলো পয়েন্ট। প্রথম পয়েন্টে লাল আলো দপদপ করে জ্বলছে। উপরে লেখা ডিসি (D.C)। দ্বিতীয় পয়েন্টের উপর লেখা জি ডব্লিউ মিসফিটেড (G.W. missfitted) এবং চতুর্থটিতে ডিও (D.O)। ডিও পয়েন্টের সাথেই একটা ডিজিটাল কি বোর্ড।
আহমদ মুসা ও হাসান তারিক দুজনেই প্যানেলের উপর চোখ বুলাচ্ছিল। আহমদ মুসা বলে উঠল, ‘প্রথম পয়েন্টটায় লাল আলো জ্বলছে। উপরের D.C-এর অর্থ নিশ্চয় ‘ডোর ক্লোজড’ মানে ‘দরজা বন্ধ’। দরজা বন্ধ থাকারই লাল সংকেত দিচ্ছে পয়েন্টটা। কিন্তু অন্যগুলোর অর্থ বের কর হাসান তারিক।’
‘পরবর্তী দুপয়েন্টের সমাধান করছি ভাইয়া। ‘জি ডব্লিউ মিসফিডেট’ অর্থ হলো গ্যাংওয়ে-মিসফিডেট’। এর অর্থ মিনি-সাব থেকে বেরিয়ে আসা গ্যাংওয়ে এই দরজার সাথে ঠিকভাবে ফিট হয়নি। তৃতীয় পয়েন্টের ‘জি ডব্লিউ ফিটেড’ অর্থ গ্যাংওয়েটি দরজার সাথে ঠিকভাবে ফিট হয়েছে। আর…………..।’ হাসান তারিক কথা শেষ করতে পারলো না।
কথার মাঝখানে আহমদ মুসা বলল, ‘তার মানে মিনি-সাব থেকে বেরিয়ে আসা গ্যাংওয়ে ঠিকভাবে ফিট হলে তৃতীয় পয়েন্টে আলো জ্বলবে, আর ফিট না হলে দ্বিতীয় পয়েন্টে জ্বলবে।’
‘ঠিক ভাইয়া। কিন্তু চতুর্থ পয়েন্ট D.O-এর অর্থ কি হতে পারে?’
‘শুরুতে দেখছ দরজা বন্ধ। তারপর দেখলে গ্যাংওয়ে ঠিকভাবে লাগল, এখন কি করতে হবে?’ বলল আহমদ মুসা সরাসরি উত্তর না দিয়ে।
হেসে উঠল হাসান তারিক। বলল, ‘তার মানে D.O-ডোর ওপেন-দরজা খোলা।’
হাসান তারিক হাসলেও আহমদ মুসার মুখে ফুটে উঠেছে চিন্তার ছায়া। বলল, ‘হাসান তারিক ডোর অপেন হবে ডিজিটাল লকে। ডোর ওপেনের জন্যে সঠিক ডিজিটাল কোড খুঁজে পাওয়াই হবে এখন আমাদের প্রধান সমস্যা।’
বলে ঘনিষ্ঠভাবে ডিজিটাল প্যানেল দেখার জন্যে আহমদ মুসা এগুলো প্যানেলের শেষ পয়েন্টটার দিকে।
হাসান তারিকও এগুলো পয়েন্টটার দিকে।
ডিজিটাল লকের উপর চোখ বুলাতেই কপাল কুঞ্চিত হয়ে উঠল আহমদ মুসার। ডিজিটাল লকে কতকগুলো জিরো অংকের সাথে শুরুতে কয়েকটা বর্ণমালাও যুক্ত আছে। সব মিলিয়ে ডিজিটাল লকটা দাঁড়ায় ‘FAMS 00654123’
ডিজিটাল লকটার উপর চোখ বুলাতেই আহমদ মুসার মনে হলো যে কোথাও এ ধরনের সংখ্যা সে পড়েছে।
হঠাৎ তার মনে পড়ল ডেভিড ডেনিমের লকেট থেকে পাওয়া দুটি চীপসের কথা। দ্রুত সে জ্যাকেটের ভেতরের এক গোপন পকেট থেকে বের করল চীপস দুটি। দুটি চীপসে চোখ বুলিয়ে একটি ডান হাতে তুলে ধরে বলল, ‘হাসান তারিক সমাধান হয়ে গেছে। দেখ এই চীপসের বর্ণমালা ‘FAMS’-এর সাথে ডিজিটাল লকের বর্ণমালা মিলে গেছে। তার মানে এই চীপসের ডিজিট কোড দিয়ে গ্যাংওয়ের এই দরজা খোলা যাবে। এখন শুধু জিরো চীপসের অংকগুলো টাইপ করলেই আমরা দরজা খুলতে পারব।’
হাসান তারিকও চীপসটা হাতে নিয়ে দেখল এবং বলে উঠল, ‘আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ আমাদেরকে অভাবনীয়ভাবে সাহায্য করেছেন ভাইয়া।’
‘ঠিক তাই হাসান তারিক। আমরা ভাবিনি এবং চাইওনি যে, সুসান ও পলা জোনসরা এখানে আসবে। ঠিক সময়ে দেখ তারা এসে গেছে। তার ফলে নাটকের দৃশ্যটা পাল্টে গেল। ঘটনার হুইল এখন আমাদের হাতে।’
হাসান দ্বিতীয় চীপসটার দিকে ইংগিত করে বলল, ‘দ্বিতীয় চীপসে যে কোন নাম্বার সেটাও কি এখানেই লাগবে? আপনি বলেছিলেন একটা আগে, অন্যটা পরে ব্যবহার করতে হবে।’
‘আগে ও পরের অর্থ এই নয় যে, দুটা কোড একই লকে ব্যবহার হবে। আমি জানি না। তবে কোডের প্রথম চারটি বর্ণমালা থেকে স্পষ্ট প্রথমটার মত দ্বিতীয়টাও আজর ওয়াইজম্যানের ওয়ার্ল্ড ফ্রিডম আর্মির সাও তোরাহ দ্বীপের কোন কিছুর কোড।’ বলল আহমদ মুসা।
‘সা তোরাহ দ্বীপ কি করে বুঝা গেল ভাইয়া?’ জিজ্ঞাসা হাসান তারিকের।
আহমদ মুসা দুটো চীপস হাসান তারিকের সামনে তুলে ধরে বলল, ‘প্রথমটার অর্থ যেমন ‘Freedom Army Mini-Sub’ (FAMS), তেমনি দ্বিতীয়টার অর্থ হলো ‘Freedom Army Sao Torah’ (FAST) ।’
‘ধন্যবাদ ভাইয়া, বুঝেছি। সাও তোরাহের কোড চীপসটা নিশ্চয় এই কোডের মতই গুরুত্বপূর্ণ হবে।’ বলল প্রসন্ন মুখে হাসান তারিক।
হাসান তারিক কথা শেষ করতেই তারা তাদের পেছনে পায়ের শব্দ শুনতে পেল।
বোঁ করে তারা দুজনেই ঘুরে দাঁড়াল।
দেখল পলা জোনস দৌড়ে আসছে। তার চোখে উত্তেজনা।
আহমদ মুসার সাথে চোখাচোখি হতেই সে বলে উঠল, ‘ভাইয়া, টিভি স্ক্রিনে মিনি-সাবের পেরিষ্কোপ দেখা যাচ্ছে। এদিকেই আসছে।’
‘গুড নিউজ। চল দেখি।’ বলে আহমদ মুসা ছুটতে শুরু করল।
তার পেছনে হাসান তারিক ও পলা জোনসও দৌড়াতে শুরু করল।
টিভি মনিটরিং-এ বসেছিল সোফিয়া সুসান। আহমদ মুসারা পৌছতেই সোফিয়া সুসান একটু পাশে সরে গিয়ে টিভির ছবি ওদের সামনে নিয়ে এল। আহমদ মুসারা দেখল, তারা যেমন আগে দেখেছিল ঠিক সেভাবেই মিনি-সাব পাথুরে জেটির পশ্চিম প্রান্তে এসে ভিড়ছে।
ভিড়ল মিনি সাবমেরিনটা।
পেরিষ্কোপ ধীরে ধীরে উপরে উঠতে লাগল।
মিনি সাবমেরিনটি ভেসে উঠছে।
আধা-ভাসা অবস্থায় মিনি-সাব স্থির হয়ে গেল।
এরপর কি ঘটবে, আহমদ মুসাদের কি করণীয় এসব নিয়ে রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা আহমদ মুসাদের।
অপেক্ষার জবাব পেয়ে গেল আহমদ মুসারা। তারা দেখল, মিনি-সাব থেকে গ্যাংওয়ে বেরিয়ে তাদের এ ঘাঁটির দিকে আসছে।
আহমদ মুসা দ্রুত হাসান তারিককে বলল, ‘হাসান তারিক তুমি গেটে যাও। আমি দেখি কয়জন ও কারা মিনি-সাব থেকে গ্যাংওয়েতে নামছে এখানে আসার জন্যে। তাদের সাথে কি অস্ত্র থাকবে, থাকবে কিনা সেটাও দেখা যাবে। সেটা হিসাবে রেখেই আমাদের এগুতে হবে। আমি দরজা খোলার ঠিক আগের মুহূর্তে আসব।’
হাসান তারিক উঠে দাঁড়িয়ে ছুটল গ্যাংওয়ের গেটের দিকে।
পল পল করে সময় বয়ে চলল।
আহমদ মুসা দেখল, মিনি-সাবমেরিনের ‘নোজ’ এর পেছনে যেখানে সাধারণত ক্রুদের কেবিন থাকে। সেখান থেকে গ্যাংওয়ে বেরিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। গ্যাংওয়ে দেখা যাচ্ছে, কিন্তু গ্যাংওয়ের বাইরেটা দেখা যাচ্ছে, ভেতরটা নয়। ‘ভেতরে টিভি ক্যামেরা সেট করা নেই’ বুঝতে পারল আহমদ মুসা। আশার গুড়ে বালি পড়ল তার। ভেবেছিল ভেতরটা যদি দেখা যায়, তাহলে কাজ সহজ হয়ে যাবে। তা হলো না।
এই সময় টেবিলের মোবাইলটা বেজে উঠল।
এ রকম একটা টেলিফোনের আশংকা করছিল আহমদ মুসা মিনি-সাব থেকে। তাহলে কি মিনি-সাব এরই টেলিফোন এটা? কথা বলতে গিয়ে যদি ধরা পড়ে যায়। টেলিফোন কি সে ধরবে, নাকি ধরবে না। না ধরলে সাবমেরিনের ওরা সন্দেহ করতে পারে। উভয় সংকট। করবে কি সে? ইতিমধ্যে টেলিফোনে তিন বার রিং হয়েছে। এখনি না ধরলে হয়তো লাইন কেটে দিতে পারে। শেষে কথা বলার ঝুকিই নিল আহমদ মুসা।
হঠাৎ আহমদ মুসা কাশতে শুরু করল। কাশতে কাশতে টেলিফোন ধরল আহমদ মুসা। টেলিফোন ধরে ওপার থেকে ভারী কণ্ঠের ‘হ্যালো’ সম্বোধন শুনেই আহমদ মুসা কাশি পীড়িত ভাঙা গলায় বলে উঠল, ‘স্যরি, আমি বেগিন এক্সিলেন্সি। হঠাৎ কাশিতে…………….।’
ওপার থেকে কথায় বাধা দিয়ে বলে উঠল, ‘ও.কে। আমরা আসছি। সব ঠিক আছে তো?’
সেই কাশির মধ্যে গলা সামলাতে, সামলাতে বলে উঠল আহমদ মুসা, ‘ইয়েস এক্সিলেন্সি।’
‘থ্যাংকস। আসি।’ বলল ওপার থেকে।
‘ওয়েলকাম এক্সিলেন্সি।’ বলেই ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ল। বলল, ‘আমরা ধরা পড়তে পড়তে বেঁচে গেছি।’
সোফিয়া সুসান ও পলা জোনস টেলিফোনে আহমদ মুসার কথা শুনছিল। তার চোখে-মুখে উৎকণ্ঠা। আহমদ মুসা মোবাইল রাখতেই সোফিয়া সুসান বলল, ‘কথা কি মিনি সাবমেরিন থেকে কেউ বলল মি. আহমদ মুসা?’
‘হ্যাঁ সুসান।’ আহমদ মুসা বলল।
‘বুঝলেন কি করে যে বেঁচে গেলেন?’ বলল সোফিয়া সুসান।
‘কাশির ক্যামোফ্লেজ দিয়ে আমি আমার কণ্ঠকে আড়াল করতে পেরেছি বলে মনে হয়। আমাকে সে চিনতে পারেনি বলেই আমি মনে করছি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘খুশির খবর ভাইয়া। তবে ভাইয়া, ওদের চেয়ে ধড়িবাজ দুনিয়ায় কেউ নেই, এটা আপনি জানেন।’ বলল পলা জোনস।
‘ধন্যবাদ পলা। তোমরা দুজন মনিটরিংটা পাহারা দাও। আমি গ্যাংওয়ের গেটে যাচ্ছি।’
বলে আহমদ মুসা ছুটল গেটের দিকে।
সোফিয়া সুসান ও পলা জোনস দুজনে টিভি স্ক্রীণের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল।
অল্পক্ষণের মধ্যেই তারা টিভি স্ক্রীনে দেখল, গ্যাংওয়ে এসে ফিট হচ্ছে ঘাঁটির প্রবেশ দরজার চারদিকের এয়ারটাইট প্যানেলের সাথে। পরক্ষণেই তাদের নজরে পড়ল, গ্যাংওয়ের মুখ থেকে এয়ারটাইট ঢাকনা সরে যাচ্ছে। ঢাকনা সরে যাওয়ার সাথে সাথে তাদের নজরে পড়ল ৬ জন তিন তিন করে গ্যাংওয়ের দুপাশে ঘাঁটির দরজার দিকে ষ্টেনগান বাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর মাথায় হ্যাট পরা সুবেশধারী দীর্ঘকায় একজন লোক হাত নেড়ে তাদেরকে নির্দেশ দিয়ে এগোচ্ছে গ্যাংওয়ের মুখে ঘাঁটির দরজার দিকে। তারও হাতে রিভলবার। রিভলবার সমেত হাতটা সে কোটের পকেটে ঢুকাল।
সোফিয়া সুসানের মুখ কালো হয়ে উঠেছে। বলল সে পলা জোনসকে, রিভলবারধারী লোকটি হাত নেড়ে যে নির্দেশ দিল তার ছয়জন লোককে, তার অর্থ হলো দেখামাত্র গুলী করতে হবে।’
উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে পলা জোনস। বলল, ‘তাহলে এদিকের সব ব্যাপার ওরা জানতে পেরেছে। কিন্তু কিভাবে?’
‘কিভাবে আমি জানি না। হতেও পারে আমরা যেমন ওদের দেখছি, ওরাও তেমন আমাদের দেখছে। বলল সুফিয়া সুসান।
‘সর্বনাশ, ভাইয়াদের সাবধান করা দরকার।’ বলল দ্রুতকণ্ঠে পলা জোনস।
দ্রুত উঠে দাঁড়াল সোফিয়া সুসান। বলল, ‘পলা তুমি এদিকটা দেখ। আমি ওদের কাছে যাচ্ছি।’ বলে সোফিয়া সুসান দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
ছুটল সে গ্যাংওয়ের গেটের দিকে।
সোফিয়া সুসান যখন গেট রুমের দরজায় পৌছেছে, তখন দেখল গ্যাংওয়ের মুখের গেট দেয়ালের ভেতরে ঢুকে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। গেটের এক পাশে দাঁড়ানো আহমদ মুসা ও হাসান তারিক উন্মুক্ত হয়ে উঠছে গ্যাংওয়ের মুখে দাঁড়ানো লোকদের উদ্যত ষ্টেনগানের সামনে। দেখামাত্র গুলীর মোকাবিলা করার মত প্রস্তুতি আহমদ মুসাদের নেই।
‘সামনে গুলী মি. আহমদ মুসা।’ বলে চিৎকার দিয়ে উঠে কমান্ডো সোফিয়া সুসান নিজের মাথাটাকে নিচে ঠেলে দিয়ে পা দুটোকে মেঝের সমান্তরালে তীরের মত ছুড়ে দিল গ্যাংওয়ের গেটের দিকে। গুলীর এক পশলা বৃষ্টি বয়ে গেল তার দেহের তিন ফিট উপর দিয়ে।
সোফিয়া সুসানের তীর বেগে ছুটা দেহ গিয়ে সুবেশধারী নেতা লোকটিসহ গ্যাংওয়ের মাঝখানে ক্লোজ হয়ে আসা দুজন ষ্টেনগানধারীকে আঘাত করল। তারা তিনজনই পড়ে গেল। তাদের দেহ সুসানের দেহের উপর দিয়ে সামনে ছিটকে পড়েছিল।
সোফিয়া সুসানের দেহ স্থির হয়েছিল পড়ে যাওয়া তিনজনের পায়ের দিকটায় এসে। ওদের হাত থেকে ছিটকে পড়া একটা ষ্টেনগান সে হাতের কাছে পেয়ে গিয়েছিল।
ওদিকে সোফিয়া সুসানকে নতুন করে টার্গেট করার জন্য গ্যাংওয়ের অন্য চারজন ষ্টেনগানধারী ফিরে দাঁড়াচ্ছিল। ঠিক সময় দরজার পাশে দাঁড়ানো আহমদ মুসারাও তাদের মেশিন রিভলবার থেকে গুলী বর্ষণ শুরু করেছে।
আর সোফিয়া সুসানও ষ্টেনগান পেয়ে শুয়ে থেকেই গুলী বর্ষণ শুরু করল।
দুআক্রমণের মাঝে পড়ে প্রতিআক্রমণের সময় মিনি-সাবের ষ্টেনগানধারীরা পেল না। ওদের সাতটি লাশই গ্যাংওয়ের মেঝেতে গড়াগড়ি দিতে লাগল।
সোফিয়া সুসান উঠতে যাচ্ছিল এসময় গ্যাংওয়ের মিনি-সাব প্রান্ত থেকে পায়ের শব্দ পেল সে।
ষ্টেনগানের ট্রিগারে হাত রেখে বোঁ করে দেহটা ঘুরিয়ে নিল সোফিয়া সুসান। দেখল, তিনজন বেরিয়ে এসেছে মিনি সাব থেকে গ্যাংওয়েতে। তাদের এক জনের হাত খালি অন্য দুজনের হাতে দুটি ষ্টেনগান। তারা মনে হয় পরিস্থিতি আঁচ করার চেষ্টা করছিল। তাদের ষ্টেনগানের ব্যারেলগুলোও নামানো ছিল। সোফিয়া সুসানকে ষ্টেনগান হাতে ঘুরে দাঁড়াতে দেখেই তারা তাদের ষ্টেনগান তুলল সোফিয়া সুসানকে লক্ষ্য করে। কিন্তু তাদের ষ্টেনগানের নল যখন উঠে আসছিল সোফিয়া সুসানকে লক্ষ্য করে, সে সময় সোফিয়া সুসানের ট্রিগার চাপা হয়ে গিয়েছিল। এক ঝাঁক গুলী বেরিয়ে গিয়ে গ্রাস করেছিল ওদের তিনজনকে।
উঠে বসল সোফিয়া সুসান।
তার পেছনে এসে দাঁড়াল আহমদ মুসা এবং হাসান তারিক।
‘ধন্যবাদ সুসান। বুঝলাম, তোমাদের আজোরস দ্বীপের কমান্ডো ট্রেনিং খুবই উন্নতমানের।’ গম্ভীর কণ্ঠে আহমদ মুসা বলল।
‘কেন একথা বলছেন?’ সোফিয়া সুসান বলল।
‘বলছি কমান্ডো সোফিয়া সুসানের কাজ দেখে। সত্যি সুসান, ওরা আমাদের সন্দেহ করেছে সেটা বুঝিনি। তাই ওদের তাৎক্ষণিক আক্রমণের জন্যে আমাদের প্রস্তুতি ছিল না। ওদের ঠেকাবার জন্যে সত্যি তুমি দুঃসাহসের কাজ করেছো। তোমাকে ধন্যবাদ সুসান।’
‘আজোরসের কমান্ডোদের প্রতি আপনার এ স্বীকৃতির জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ। আসলে আমার কোন কৃতিত্ব নেই। টিভি স্ক্রীনে আমি ওদের দেখে বুঝেছিলাম যে ওরা ‘শুট এ্যাট সাইট’-এর প্রস্তুতি নিয়েছে। এ জন্যেই আমি ছুটে এসেছিলাম।’ বলল সোফিয়া সুসান।
এ সময় পলা জোনস এসে দাঁড়াল সোফিয়া সুসানের পাশে। তার চোখে-মুখে নতুন উত্তেজনা। বলল সে দ্রুতকণ্ঠে, ‘মিনি-সাব কন্ট্রোল রুমের আউটার প্যানেলে রেড লাইট ব্লিপ করছে। তার মানে মিনি-সাবের ভেতরে ইমারজেন্সি ঘোষণা করা হয়েছে। অন্যদিকে মোবাইলে অবিরাম কল আসছে প্রকৃত ঘটনা জানতে চেয়ে। কোন কলেরই জবাব দিচ্ছি না। আমার মনে হয় এই অবস্থায় মিনি-সাব সরে পড়ার চিন্তা করতে পারে।’
‘ঠিক বলেছ পলা। পরবর্তী কাজ আমাদের সাবমেরিন দখল করা। সময় নষ্ট করা যাবে না। এস তোমরা।’
বলে গ্যাংওয়ে ধরে হাঁটতে লাগল আহমদ মুসা। তার পাশে হাসান তারিক। পেছনে পাশাপাশি হাঁটছে পলা জোনস ও সোফিয়া সুসান।
মিনি সাবমেরিনের প্রবেশ দরজার কাছাকাছি এসে দাঁড়াল আহমদ মুসা। সবাই তার দুপাশে এসে দাঁড়াল। বলল আহমদ মুসা নিচু কণ্ঠে সবাইকে লক্ষ্য করে, ‘ভেতর থেকে আর আক্রমণ আসছে না। এর অর্থ দুটি হতে পারে। এক. ভেতরে কমব্যাটে আসার ফাইটিং লোক নেই, আছে নিছক কয়েকজন ক্রু। দুই. এ হতে পারে যে ফাইটিং লোক থাকলেও সংখ্যায় কম আছে। তারা ভেতরে অবস্থান নিয়েছে চোরাগোপ্তা আক্রমণের জন্যে। এ দুটি বিষয় সামনে রাখার পর তৃতীয় যে বিষয়টি আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে, সেটা হলো ওদের কনট্রোল রুমের টিভি মনিটরিং-এ আমাদের অবস্থান তারা দেখতে পাচ্ছে। তবে আশার কথা মনিটরিং রেজাল্ট প্রয়োজন অনুসারে পৌছাতে পারবে না তার লোকদের কাছে। এই অবস্থায় আমাদের প্রথম কাজ হবে সাবমেরিন কনট্রোল হাতে নেয়ার জন্যে কনট্রোল রুম দখল করা। কনট্রোল রুম নিয়ন্ত্রণ দখল করার পর কনট্রোল রুম নিয়ন্ত্রণ করবে হাসান তারিক। সাবমেরিন সম্পর্কেও বিশেষজ্ঞ হাসান তারিক। আমি তার সাথে থাকব। আগের মতই রিয়ার গার্ড হিসাবে কাজ করবে সোফিয়া সুসান ও পলা জোনস।’
আহমদ মুসা কথা শেষ করল।
সোফিয়া সুসান বলল, ‘ধন্যবাদ মি. আহমদ মুসা। তবে আমার মনে হয় তেমন কোন ফাইটিং ষ্ট্রেংথ ওদের এখন নেই।’
‘আমারও তাই মনে হয়। WFA-এর লোকদের শক্তি থাকলে এতক্ষণ ভেতরে বসে থাকার মত ওরা নয়।’ বলল পলা জোনস।
‘ধন্যবাদ তোমাদের। এস আমরা এগোই, বলে আহমদ মুসা হাঁটতে শুরু করল।
আহমদ মুসা ও হাসান তারিক পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করেছে।
আহমদ মুসারা মিনি-সাবের দরজায় পৌছে গেছে। সোফিয়া সুসানরা ধীরে ধীরে পা ফেলে এগুতে লাগল।
আহমদ মুসা ও হাসান তারিক মিনি-সাবের দরজায় পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। তাদের নাক বরাবর সামনে একটা সিঁড়ি উপরে উঠে গেছে। তাদের সামনে দিয়ে মিনি-সাবের একটা করিডোর লম্বালম্বি প্রসারিত। আহমদ মুসার মেশিন রিভলবার বাম দিকে করিডোর বরাবর এবং হাসান তারিকের রিভলবার ডান দিকে করিডোর বরাবর উদ্যত।
হাসান তারিকের একটু ডানে সিঁড়িরও ডান পাশে ক্রুদের কক্ষ। তাদের কক্ষের পাশেই টর্পেডো রুম। তার পরেই ব্যাটারী সেলগুলোর জন্যে নির্ধারিত জায়গা। তার পরেই সোনার ডোম (ঝড়হধৎ ফড়সব)। আর সিঁড়ির বাম পাশে সাবমেরিনের গোটা মাঝ অংশ জুড়ে যুদ্ধ সাবমেরিনের যেখানে থাকে ব্যালষ্টিক মিসাইল বা ইলেক্ট্রনিক যুদ্ধাস্ত্র ও নিউক্লিয়ার চুল্লী, সেখানে দেখা যাচ্ছে প্যাসেঞ্জার কেবিনসমূহ। প্যাসেঞ্জার কেবিনগুলোর পরেই রয়েছে মেশিনারী রুম ও ইঞ্জিন রুম। সবশেষে রয়েছে প্রপেলার অংশ।
চারদিকে চোখ বুলাবার পর হাসান তারিকই প্রথম কথা বলল, ‘ভাইয়া সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেলেই কনট্রোল রুম।’
‘ঠিক আছে, চল কনট্রোল রুমে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘নিচের কক্ষগুলো একবার সার্চ করলে হয় না?’ বলল হাসান তারিক।
‘এটা সুসানদের জন্যে থাকল। কক্ষগুলোতে কেউ যদি থাকে, তাহলে ওদের আমাদের পিছু নিতে দাও, নিশ্চিন্তে।’ আহমদ মুসা বলল।
আর কোন কথা না বলে হাসান তারিক এগুলো সিঁড়ির দিকে এবং দ্রুত ও বিড়ালের মত নিঃশব্দে উপরে উঠতে লাগল।
আহমদ মুসা একটু দূরত্ব রেখে হাসান তারিকের পেছনে উঠতে লাগল।
সিঁড়ি যেখানে শেষ হয়েছে, সেখানে প্রশস্ত একটি ল্যান্ডিং স্পেস। তাকে একটা মিনি করিডোরের অংশও বলা যায়। করিডোরটার বাম মাথায় একটা দরজা। দরজা খোলা। তাতে খাট পাতা দেখা যাচ্ছে। আর ডান প্রান্তটি ‘সেইলে’র গায়ের একটা বন্ধ দরজায় গিয়ে শেষ হয়েছে।
কনট্রোল রুমের দরজা খোলা। হাসান তারিক ল্যান্ডিং-এ উঠে মুহূর্ত অপেক্ষা না করে কনট্রোল রুমে প্রবেশ করল।
প্রশস্ত কনট্রোল রুম।
ঘরে কাউকে দেখতে পেল না।
হাসান তারিক দ্রুত এগুলো তিন দিক জুড়ে থাকা কনট্রোল প্যানেলের মাঝখানের বড় স্ক্রীনটার দিকে যেখানে ফুটে উঠার কথা গোটা সাবমেরিনসহ সবগুলো ঘর ও স্থানের দৃশ্য। স্ক্রীনটা অফ করা।
হাসান তারিক স্ক্রীনের সুইচ বোর্ডটার উপর ঝুঁকে পড়তেই দরজার পাশের একটা ষ্টিল আলমারির আড়াল থেকে একজন লোক বিড়ালের মত নিঃশব্দে বেরিয়ে এল হাসান তারিকের দিকে রিভলবার তাক করে।
হাসান তারিকের সমস্ত মনোযোগ স্ক্রীন ও সুুইচ প্যানেলের দিকে নিবদ্ধ থাকায় কিছুই আঁচ করতে পারল না।
রিভলবারধারী, একজন তরুণ, এগিয়ে গিয়ে তার রিভলবারের নলটা হাসান তারিকের মাথায় চেপে ধরে বলল, ‘হাত উপরে তুলুন, না হলে গুলী করব।’
হাসান তারিক হাত উপরে তুলল।
আহমদ মুসা ততক্ষণে কনট্রোল রুমের দরজায় পৌছে গেছে। তার নজরে পড়ল দৃশ্যটা।
কিন্তু সংগে সংগেই ঘরে না ঢুকে একটু সময় চারদিকে দেখার জন্যে যে আর কোন শত্রু আশে-পাশে লুকিয়ে আছে কিনা। সন্দেহজনকত কিছু দেখল না সে। তারপর আহমদ মুসাও নিশব্দে কনট্রোল রুমে প্রবেশ করল এবং সেও রিভলবারধারীর মাথায় তার মেশিন রিভলবারের ভারী নল চেপে ধরে বলল, রিভলবার ফেলে দিয়ে হাত তুলে দাঁড়াও।
কিন্তু আহমদ মুসাও খেয়াল করেনি যে তারা সিঁড়ি দিয়ে উপরে ওঠা শুরু করলে টর্পেডো মেশিনারিজ রুম থেকে দুজন রিভলবারধারী দ্রুত বেরিয়ে এসে আহমদ মুসার পিছু নিয়েছিল নিশব্দে।
আহমদ মুসার কথা শেষ হবার সাথে সাথেই ওরা ল্যান্ডিং-এ গিয়ে পৌছেছিল। তাদের একজন দ্রুত রিভলবার তুলল আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে।
আহমদ মুসা শেষ মুহূর্তে টের পেয়েছিল, পেছনে পায়ের শব্দ টের পেয়েই বিদ্যুত গতিতে বসে পড়ল। ততক্ষণে ট্রিগার টিপে ফেলেছিল পেছনের রিভলবারধারী। বুলেটটি গিয়ে আঘাত করল হাসান তারিকের পেছনে দাঁড়ানো রিভলবারধারী যুবকটার ডান কাঁধে।
রিভলবার পড়ে গেল আহত যুবকটার হাত থেকে। আর্তনাদ করে উঠে সেও বসে পড়ল।
পেছনের দুরিভলবারধারী কিছুটা অপ্রতিভ হয়ে পড়েছিল তাদের গুলী তাদের লোককে হিট করায়। কিন্তু পরক্ষণেই তাদের রিভলবার তাক করেছিল আহমদ মুসাকে। আহমদ মুসার মেশিন রিভলবারের ব্যারেল ঘুরে আসছিল তাদের দিকে।
কিন্তু তাদের রিভলবার থেকে গুলী বেরুবার আগেই তাদের পেছন থেকে দুটি রিভলবার এক সঙ্গে গর্জে উঠার শব্দ উঠল। তার সাথে সাথে ল্যান্ডিং-এ দাঁড়ানো দুজন রিভলবারধারী মাথায় গুলী খেয়ে পড়ে গেল।
সিঁড়ি থেকে গুলী দুটো করেছিল সোফিয়া সুসান ও পলা জোনস। তারা আহমদ মুসাকে অনুসরণকারী দুজনকে ফলো করে উপরে উঠে আসছিল।
গুলী করেই ল্যান্ডিং-এ উঠে এল সোফিয়া সুসান ও পলা জোনস।
হাসান তারিকের পেছনের যুবকটি গুলীবিদ্ধ হওয়ার পর আহমদ মুসা তার দিকে নজর রেখেছিল। ল্যান্ডিং-এ দাঁড়ানো দুজনকে মাথায় গুলী খেয়ে পড়ে যেতে দেখে লোকটি তার বাম হাত উপরে তুলে অনামিকার গোল্ড রিংটি কামড়ে ধরতে যাচ্ছিল। সংগে সংগে আহমদ মুসা তার বাম হাত টেনে নিয়ে আংটিটা খুলে নিয়ে বলল, ‘তোমার বসরা তাদের স্বার্থ সিদ্ধির জন্যে তোমাকে মারতে চায়, কিন্তু আমরা মানুষের কল্যাণের জন্যে তোমার বেঁচে থাকা এখন জরুরী মনে করি।’
যুবকটির উদ্দেশ্যে কথা কয়টি বলেই আহমদ মুসা তাকাল হাসান তারিকের দিকে। বলল, ‘তুমি কনট্রোল রুমটা বুঝে নাও।’
তারপর সোফিয়া সুসানদের উদ্দেশ্য করে বলল, ‘তোমাদের ধন্যবাদ। আগের মতই ঠিক সময়ে এসে পড়েছিলে। সুসান, এখন তোমরা দুজন গোটা সাবমেরিনটা চেক করে এস। আমি ততক্ষণে এর আহত জায়গাটা পরীক্ষা করি। রক্ত বন্ধের ব্যবস্থা করতে হবে।’
আহমদ মুসাকে ধন্যবাদ দিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামার জন্যে ঘুরে দাঁড়াল সোফিয়া সুসান। ‘চল পলা’ বলে সিঁড়ি দিয়ে নামা শুরু করল সোফিয়া সুসান।
ওদিকে হাসান তারিক কনট্রোল রুমের রিডিং শুরু করেছে।
আহমদ মুসা মনোযোগ দিল লোকটির দিকে। তার গায়ের জামাটা ছিঁড়ে ফেলে তার ডান কাঁধটাকে উন্মুক্ত করল।
আহমদ মুসা জায়গাটা পরীক্ষা করে বলল, ‘সুসংবাদ তোমার জন্যে ক্ষতটা খুব গভীর নয়। বুলেটটাও ভেতরে নেই। গোশত তোমার কিছু ছিঁড়ে নিয়ে গেলেও বড় কষ্ট থেকে তোমাকে বাঁচিয়ে দিয়ে গেছে।’ হাসিমুখে হাল্কা সুরে কথাগুলো বলল আহমদ মুসা।
যুবকটি আহমদ মুসার দিকে তাকাল। তার চেহারায় কিছু বিস্ময়। এমন নির্দোষ হাসি ও অন্তরঙ্গ কথা সে এমন শত্রুর কাছ থেকে বোধ হয় আশা করেনি। পরে সে চোখ নামিয়ে নিল এবং গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘আমি বাঁচতে চাই না মরতে চাই। আমার কাছে কিছু পাবেন না। বাঁচিয়ে লাভ নেই। বেঁচে গেলেও আমি নিজেকে এখন মৃত বলে মনে করছি।’
‘বাঃ সুন্দর কথা বলতো! যাক, এখন বল তোমাদের ফাষ্ট এইডের সরঞ্জাম কোথায়?’ আহমদ মুসা বলল।
যুবকটি মাথা ঘুরিয়ে দরজার পাশে একটা আলমিরার মাথার উপর দেয়ালের সাথে হুক দিয়ে আটকানো একটা বাক্স দেখিয়ে দিল।
আহমদ মুসা বাক্সটি নামিয়ে এনে খুলে দেখল ঔষধপত্রসহ ফাষ্ট এইডের সবরকম সরঞ্জাম প্রচুর পরিমাণে আছে।
কাজে লেগে গেল আহমদ মুসা।
যথাসম্ভব কম কষ্ট দিয়ে অত্যন্ত যতেœর সাথে আহত জায়গাটা পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিল এবং ঔষধও খাইয়ে দিল। তারপর হাসান তারিককে দিয়ে লোকটির কামরা থেকে জামা আনিয়ে তাকে পরিয়ে দিল।
লোকটার চোখে-মুখে বিস্ময়। সুযোগ পেলেই চোরা চোখে আহমদ মুসাকে বুঝতে চেষ্টা করছে সে। জামাটা পরে নেবার পর সে বলে উঠল, ‘আপনি কি ভুলে গেছেন আমি আপনার শত্রু?’
যুবকটি বয়সে একেবারে তরুণ।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘তোমার আরও একটা পরিচয় আছে। তুমি মানুষ। এই পরিচয়ে আমরা আদমের সন্তান হিসেবে পরষ্পর ভাই।’
‘গ্যাংওয়েতে যে দশজনকে হত্যা করেছেন এবং এই যে ল্যান্ডিং-এ দুজন নিহত হলো, তারা সবাই তো আদমের সন্তান, আপনাদের ভাই।’ বলল তরুণটি।
‘অবশ্যই। কিন্তু ওদের হত্যা না করলে ওরা আমাদের হত্যা করতো। আত্মরক্ষার্থেই এই হত্যা না করে উপায় ছিল না। ওরা আদমের সন্তান বটে, কিন্তু কুসন্তান।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কিন্তু ওরা আপনার ঘরে যায়নি। আপনারাই এখানে কয়েকজন লোককে হত্যা করে অনধিকার প্রবেশ করেছেন।’ লোকটি বলল।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘ক্রিমিনাল, কিডন্যাপারদের ঘরে প্রবেশের জন্যে অনুমতি নিতে হয় না এবং এটা অনধিকার চর্চা নয়।’
‘ক্রিমিনাল, কিডন্যাপার কারা?’ বলল যুবকটি।
‘সাও তোরাহ দ্বীপ একটা দোজখখানা তা তুমি জান না? জান না সেখানে শত শত নিরপরাধ লোককে বন্দীশালায় রেখে অকথ্য নির্যাতন চালানো হচ্ছে। আজর ওয়াইজম্যানদের এই নিপীড়নের রাজত্ব গোটা দুনিয়া ব্যাপী বিস্তৃত, তা তুমি জান না?’ আহমদ মুসা বলল। আবেগ এসে ভারী করেছিল তার কণ্ঠ।
বিস্ময়ে বিস্ফোরিত হয়ে গেল যুবকটির চোখ। বলল, ‘কিন্তু আমরা তো জানি যাদেরকে ওখানে রাখা হয়েছে তারা সবাই বড় বড় ক্রিমিনাল।’
‘কয়েক দিন আগে শাইখুল ইসলাম আহমদ মুাহাম্মাদ নামে একজন প্রৌঢ় ব্যক্তিকে তোমরা সাও তোরাহ দ্বীপে নিয়ে গেছ, তাকে কি ক্রিমিনাল মনে হয়েছে তোমার কাছে?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
সংগে সংগে কথা বলল না যুবকটি। আত্মস্থ হওয়ার মত সে মাথা নত করল। একটু পরে বলল, ‘না তাঁকে ক্রিমিনাল মনে হয়নি। তিনি একজন ধর্মনেতা। অমন প্রশান্ত চেহারার লোক ক্রিমিনাল হয় না।’
‘সাও তোরাহ দ্বীপে যাদের আটকে রাখা হয়েছে, তাঁরা তাঁর মতই প্রশান্ত চিত্তের মানুষ। তুমি মনে করতে পার, সাও তোরাহ হিটলারের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের নতুন সংস্করণ।’ আহমদ মুসা বলল।
মুখটি চুপসে গেল যুবকটির। বলল, ‘কিন্তু ওদের সাথে আপনাদের সম্পর্ক কি? আপনারা কেন এই হত্যাকান্ড ঘটালেন এখানে প্রবেশ করে?’ বলল যুবকটি।
‘আমরা সাও তোরাহ দ্বীপের বন্দীদের মুক্ত করতে চাই। তাদের মধ্যে আমাদের কয়েকজন বন্ধু রয়েছেন। এই উদ্দেশ্যে সাও তোরাহ যাবার জন্যেই আমরা এই মিনি-সাব দখল করেছি।’ আহমদ মুসা বলল।
ভয় ও আতংকে পাংশু হয়ে উঠল যুবকটির মুখ। বলল, ‘সর্বনাশ তেরসিয়েরা দ্বীপের সেই লোকরাই কি আপনারা, যারা হারতায় আমাদের ইমানুয়েল, কেলভিন ও সুলিভানদের খুন করেছেন?’
একটা ঢোক গিলল যুবকটি। তারপর আবার শুরু করল, ‘আপনারা সাও তোরাহ থেকে বন্দীদের উদ্ধার করবেন কি করে, আপনাদেরই তো প্রাণে বাঁচা দায়। যে কোন মূল্যে আপনাদের শেষ করা হবে!’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘তোমাদের আজর ওয়াইজম্যান এই চেষ্টা করছেন। আর আমরা চেষ্টা করছি সাও তোরাহ থেকে বন্দীদের উদ্ধার করতে। জেনে রাখ, আমাদের ‘ন্যায়’-এর সংগ্রামই জয়ী হবে।’
‘আমরা ইহুদীরাও ন্যায়ের জন্যে লড়াই করছি। হিটলারের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে আমরাই গণহত্যা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আবার আমাদের বিপদের মুখে ফেলা হয়েছে।’ বলল যুবকটি।
‘কিন্তু হিটলারের নির্যাতন ইহুদীদের সক্রিয় অংশকে আজ হিটলার বানিয়েছে, মানুষ বানায়নি। ফিলিস্তিনে ইসরাঈলের আচরণ এটাই প্রমাণ করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইহুদীরা ‘রাম-রাজত্ব’ করার সুযোগে বিশ্বাসঘাতক বিভীষণের মত আচরণ করেছে। সাও তোরাহতে আজর ওয়াইজম্যান যা করছে, তার পেছনে কোন ন্যায়-নীতি কাজ করছে?’ বলল আহমদ মুসা। গম্ভীর কণ্ঠ তার।
যুবকটি সংগে সংগে কথা বলল না। একটু ভাবল। তারপর বলল, ‘আপনি যা বললেন তা একটা গ্রুপের জন্যে প্রযোজ্য হতে পারে, সব ইহুদীর ক্ষেত্রে নয়।’
‘কিন্তু এই ইহুদী গ্রুপই আজ ইহুদীদের পরিচালনা করছে। সব জেনেও ইহুদীরা কেউ তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়নি। যেমন সাও তোরাহতে যে অমানুষিকতা ও বর্বরতা চলছে তার প্রতিবাদ দূরে থাক সহযোগিতা করছ তোমরা অনেকে।’
যুবকটিকে খুব অপমানিত ও বিব্রত দেখাল। বলল, ‘সাও তোরাহ সম্পর্কে আপনি যা বললেন, তা সত্য বলে এখনও আমি জানি না।’ তার কণ্ঠে ক্ষোভ।
‘তোমার নাম কি?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘এ্যারন।’ বলল যুবকটি।
‘এ্যারন, অপরাধমূলক কাজ হয় গোপনে, কিন্তু বিচার হয় প্রকাশ্যে। আজর ওয়াইজম্যান যাদের বন্দী করে সাও তোরাহ নিয়ে গেছে, তারা যদি ক্রিমিনাল হয়, তাহলে তাদের নিয়ে এত রাখ ঢাক কেন? কেন তাদের দুনিয়ার সব চোখের আড়ালে জন-মানবহীন এক দ্বীপে এনে রাখা হয়েছে? কেন এমনকি তোমরাও তাদের সম্পর্কে জান না? আলেকজান্ডার সোলজেৎসিনের লেখা ষ্ট্যালিনের গোলাগ দ্বীপের কথা জান। সে গোলাগ দ্বীপের সাথে সাও তোরাহ দ্বীপের কোন পার্থক্য আছে?’ বলল আহমদ মুসা।
এ্যারন তৎক্ষণাত কিছু বলল না। চোখ বন্ধ করে ভাবছিল। একটু পর চোখ খুলে বলল, ‘আচ্ছা বলুন তো আপনার বন্ধুদেরকে কেন এখানে ধরে আনা হয়েছে?’
‘আমাদের সাত বন্ধুদের সকলেই সত্য-সন্ধানী গোয়েন্দা। ফ্রান্সে তাদের গোয়েন্দা ফার্ম আছে। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীদের পাকড়াওয়ে তাদের সাফল্যের জন্যে দুবার তারা ইউরোপীয় গোল্ড মেডেল পেয়েছে। সবশেষে তারা কাজ করছিল নিউইয়র্কের ‘লিবার্টি’ ও ‘ডেমোক্র্যাসি’ টাওয়ার ধ্বংসের সত্য উদঘাটনে। মনে করা হয় তারা তাদের কাজ প্রায় সম্পূর্ণ করে ফেলেছিল। অমূল্য সব দলিল-দস্তাবেজ সম্পর্কে দুনিয়াবাসী যাতে জানতে না পারে, সত্য যাতে প্রকাশ না পায় এজন্যেই আজর ওয়াইজম্যান সাত গোয়েন্দাকে গ্রেফতার করেছে এবং তাদের ফার্ম সমূলে ধ্বংস করে দিয়েছে।’ আহমদ মুসা বলল।
রাজ্যের বিস্ময় এসে জমা হয়েছে এ্যারনের চোখে-মুখে। বলল, ‘আজর ওয়াইজম্যান কেন এটা করবেন? তার কি স্বার্থ এতে?’
‘তাদেরই তো স্বার্থ! টুইনটাওয়ার তো তারা মানে ইহুদীবাদীরাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি মাফিয়া চক্রের যোগসাজসে ধ্বংস করেছে।’
এ্যারনের চোখ বিস্ময়ে ছানাবড়া হয়ে উঠল। বলল, ‘আপনি কি বলছেন? গত বিশ বছরের প্রতিষ্ঠিত একটা সত্যকে আপনি পাল্টে দিতে চান?’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘না, ওরা বিশ বছর ধরে চালু ভুয়া ইতিহাস মুছে দিয়ে সত্যিকার ইতিহাস মানুষকে জানাতে চেয়েছিল।’
বিস্ময়ের ঘোর এ্যারনের মুখ থেকে এখনও কাটেনি। আহমদ মুসা থামলেও সে কথা বলল না। ভাবছে সে। অনেকক্ষণ পর সে বলল, ‘বলতে চান, বিশ বছর ধরে এতবড় একটা মিথ্যা চালু আছে?’
‘শুধু চালু আছে নয় এ্যারন, সে মিথ্যা ঢেকে রাখার জন্যে আজর ওয়াইজম্যানরা আবার জঘন্য অন্যায়ও করছে।’ আহমদ মুসা বলল।
এ্যারন উত্তরে কিছু বলল না। নিরব হয়ে গেল।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। মনোযোগ দিল হাসান তারিকের দিকে। বলল, ‘কনট্রোল প্যানেল ষ্টাডি তোমার হলো?’
‘হ্যাঁ ভাইয়া। মোটামুটি দেখা হয়ে গেছে।’ বলল হাসান তারিক।
‘যুদ্ধ সাবমেরিন থেকে এই প্যাসেঞ্জার সাবমেরিনের খুব কি পার্থক্য আছে?’ আহমদ মুসার জিজ্ঞাসা।
‘কিছু আছে। সেটা মাত্র কিছু যোগ কিছু বিয়োগের ব্যাপার। নতুন কোন টেকনলজি এখানে নেই।’
‘কাজ শুরু করো হাসান তারিক। গ্যাংওয়ে গুটিয়ে নাও। আর……….।’
আহমদ মুসা কথা শেষ করতে পারলো না। কনট্রোল রুমে প্রবেশ করল সোফিয়া সুসান ও পলা জোনস। দরজায় পা দিয়েই সুসান বলে উঠেছিল, ‘মি. আহমদ মুসা ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। গোটা সাবমেরিন শত্রুমুক্ত। এখানে এখন শাসন শুরু হতে পারে।’
‘আল-হামদুলিল্লাহ। তোমাদেরকে ধন্যবাদ সুসান এই বিজয়ে অগ্রগামী ভূমিকা পালনের জন্যে।’ বলে আহমদ মুসা তাকাল পরিপূর্ণভাবে সোফিয়া সুসান ও পলা জোনসের দিকে। বলল, ‘সুসান, পলা আমরা এখন সাও তোরাহ যাত্রা করব। তার আগে তোমাদের নামতে হবে সাবমেরিন থেকে।’
বিস্ময় ফুটে উঠল সোফিয়া সুসান ও পলা জোনসের চোখে-মুখে। কয়েক মুহূর্ত তারা যেন কথা বলতে পারলো না। একটু সময় নিয়ে প্রথম কথা বলে উঠল সোফিয়া সুসান, ‘দেখুন আমি একজন মেয়ে হিসাবে এখানে আসিনি, এসেছি একজন কমান্ডো হিসাবে। আর পলা জোনস এসেছে একজন গোয়েন্দা অফিসার হিসাবে। আমরা সাও তোরাহ যাবার জন্যে প্রস্তুত। আপনি নামতে নির্দেশ দিলে আমরা নির্দেশ অমান্য করব। এই আজোরসে আমরা মেজবান, আর আপনারা মেহমান। মেজবানকে ঘর থেকে বের করে দেবার অধিকার মেহমানের নেই।’
বলে একটু থামল সোফিয়া সুসান। তারপর আবার বলা শুরু করল, ‘আমিও কিছু জানতাম। পলার কাছ থেকেও আপনাদের নৈতিকতা-সংস্কৃতি সম্পর্কে আরও কিছু শুনেছি। আমি আপনাকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি আপনাদের সংস্কৃতি আমরা মেনে চলব। আমরা সাবমেরিনকে দুভাগে ভাগ করে নিচ্ছি। নিচের জগতটা আমাদের আর উপরটা আপনাদের। কোন আদেশ দেয়ার দরকার হলে ইন্টারকম ব্যবহার করবেন। অথবা ডেকে নির্দেশ দেবেন। আমরা উপরে আসবো না।
গম্ভীর হয়ে উঠেছিল আহমদ মুসার মুখ। বলল, ‘সংস্কৃতির প্রশ্ন তো আছে সুসান। তাছাড়াও একটা বিপদের মধ্যে তোমাদের জড়াতে চাইনি। তোমরা জড়িত হওয়া মানে আজোরস জড়িত হওয়া। আমি আজোরসকে জড়িত করতে চাচ্ছিলাম না।’
‘আজর ওয়াইজম্যানদের ইতিমধ্যে জানা হয়ে গেছে আজোরস সরকারের সিদ্ধান্তের সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই। আর থাকলেও ক্ষতি কি? আজোরস জড়িত হবে না কেন? মিথ্যা কথা বলে আজোরস সরকারের কাছ থেকে সাও তোরাহ লীজ নিয়ে সেখানে তারা জঘন্য অপরাধমূলক কাজ করে যাচ্ছে। এর শুধু প্রতিবাদ নয় প্রতিকার হওয়া দরকার। প্রতিকারের জন্যেই এই মিশনে আমরা অংশ নিতে চাই।’ বলল সোফিয়া সুসান।
‘হাসান তারিক, তুমি কি প্রস্তুত? তোমার সামনে কি সাও তোরার রুট ম্যাপ আছে?’
‘আমি প্রস্তুত। তবে রুট ম্যাপ আমার সামনে নেই। কম্পিউটারে পাওয়া যেতে পারে। মি. এ্যারনের কাছে এ ব্যাপারে আমরা সাহায্য চাইতে পারি।’ হাসান তারিক বলল।
আহমদ মুসা কিছু বলার আগেই এ্যারন বলে উঠল, ‘সাও তোরাহ যাত্রা করে লাভ নেই। সেখানে আপনারা প্রবেশ করতে পারবেন না, এমনকি সাও তোরাহতে নোঙর করতেও পারবেন না।’ তার চোখে উদ্বেগের প্রকাশ।
‘কেন প্রবেশ করা যাবে না? কেন নোঙর করা যাবে না?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘নোঙরের স্থান খুঁজে পাবেন না। তাদের কৌশল ও প্রতিরোধ ডিঙিয়ে প্রবেশ করাও অসম্ভব।’ বলল এ্যারন।
ভ্রুকুঞ্চিত হয়েছে আহমদ মুসার। একটু ভাবল। তারপর বলল, ‘নোঙরের কোন সারফেস জেটি নেই। এই সান্তাসিমা উপত্যকায় নোঙরের মত ওখানেও আন্ডার ওয়াটার নোঙরের ব্যবস্থা আছে এই তো? আন্ডার ওয়াটার এর সেই ব্যবস্থা খুঁজে পাওয়া যাবে না এই তো?’
বিস্ময় এ্যারনের চোখে-মুখে। বলল, ‘ও গড, আপনি সাংঘাতিক লোক। আপনি ঠিক ধরে ফেলেছেন। তবে সান্তাসিমা উপত্যকা থেকে ওখানকার প্রটেকশন ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা অনেক অনেক বেশি হবে, তা আপনি নিশ্চয় বুঝবেন।’
‘আমরা সাও তোরাহ যাবই। ন্যায়-অন্যায়ের তোয়াক্কা না করে যদি তুমি আগের অবস্থানেই থাক, তাহলে তোমাকে মেরে ফেলা যাবে, কিন্তু তথ্য আদায় করা যাবে না, সাহায্য পাওয়া যাবে না, এটা আমি জানি। এর ফলে আমাদের অসুবিধা হবে, কিন্তু পিছু হটবো না। জয় অবশেষে আমাদেরই হবে।’ বলল আহমদ মুসা।
বলে একটু থেমেই আবার নির্দেশ দিল, ‘হাসান তারিক, তুমি গ্যাংওয়ে গুটিয়ে নিয়ে সাবমেরিন ষ্টার্ট দাও। কনট্রোল-কম্পিউটারে দেখ ‘সাও তোরাহ’ শিরোনাম অথবা FAST শিরোনামে সাও তোরার ম্যাপ ও রুটম্যাপ আছে কিনা।’
কাজে লেগে গেল হাসান তারিক।
অল্পক্ষণ পরেই আনন্দে চিৎকার করে উঠল, ‘ধন্যবাদ ভাইয়া, সাও তোরার ম্যাপ ও রুট দুটই পেয়ে গেছি FAST কোডে।’
এ্যারনের চোখ ছানাবড়া। বলল আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে, ‘স্যার, আপনি কি সবজান্তা। এই ‘কোড নাম্বার’ আপনি জানলেন কি করে?’
‘সবজান্তা নই, সত্য-সন্ধানী। এ কোডসহ দুটি কোড আমি পেয়েছিলাম ডেভিড ডেনিমের গলায় ঝুলানো খৃষ্টের ক্রস থেকে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘খৃষ্টের ক্রসটাও আপনি ভেঙে দেখেছিলেন? সন্দেহ হয়েছিল কেমন করে স্যার?’ এ্যারন বলল রাজ্যের বিস্ময় চোখে নিয়ে।
‘ইহুদী ডেভিড ডেনিমের গলায় খৃষ্টের প্রতিকৃতি ঝোলানোটা অস্বাভাবিক হিসেবে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ধন্যবাদ আপনাকে। আপনার সাত বন্ধুর মত আপনিও দেখছি গোয়েন্দা।’ বলল এ্যারন।
এ্যারন থামতেই হাসান তারিক বলে উঠল, ‘বিসমিল্লা, ষ্টার্ট অন করলাম ভাইয়া।’
চলতে শুরু করল মিনি-সাবমেরিন।
‘মি. আহমদ মুসা, আমরা নিচে আমাদের জগতে চললাম। খাবার ডিপার্টমেন্ট নিচে আমাদের ওখানে। খাবার দেবার জন্যে উপরে আসার অনুমতি আছে তো?’
আহমদ মুসা একটু গম্ভীর হয়ে উঠল। বলল, ‘সুসান, আমাদের ধর্মে পর্দার ভিত্তিটা হলো মানুষের মানসিকতা। তারপর চোখের নিয়ন্ত্রণ। সবশেষে ফিজিক্যাল সেপারেশন। মানসিকতার ব্যাপার হলো, অবৈধ সকল চিন্তা থেকে মনকে পবিত্র রাখা। মানসিকতা যদি পবিত্র হয়, তাহলে চোখ আপনাতেই পবিত্র ও নিয়ন্ত্রিত হয়ে যায়। আর ফিজিক্যাল সেপারেশনের বিষয়টা হলো, বৈধ সম্পর্কহীন নারী ও পুরুষ পরষ্পরকে নিরাপদ দূরত্বে রাখা। নিরাপদ দূরত্বে থাকলেও জীবন পরিচালনা ও সমাজ সম্পর্কের প্রয়োজনে তাদেরকে শালীনতা সহকারে কাছাকাছি আসতেই হয়। একে ইসলাম নিষিদ্ধ করেনি। নিষিদ্ধ করেনি বলেই তো মনকে পবিত্র ও চোখকে নিয়ন্ত্রিত রাখার শিক্ষা দেয়া হয়েছে। এখন চিন্তা করে দেখ সুসান খাবার নিয়ে আসা যাবে কিনা।’
সোফিয়া সুসানও গম্ভীর হলো। বলল, ‘আমি ও পলা মুসলমান নই। ঐ পবিত্রতা তো আমাদের উপর বর্তায় না।’
‘ইসলামের এ বিধানগুলো মানবিক, তাই সব মানুষের জন্যে। মুসলমান হওয়ার পরই শুধু ইসলামের বিধান মানতে হবে তা নয়। সব মানুষই ইসলামের এ মানবিক ও কল্যাণকর বিধান মানতে পারে। অবশ্য ইসলামের এগুলো যারা মানে তাদেরকেই মুসলমান বলা হয়।’
সোফিয়া সুসান ও পলা জোনস এক সাথে হেসে উঠল। বলল, ‘তার মানে ইসলামের বিধান মেনে নিয়ে আমরা মুসলমান হয়ে যাই।’
আহমদ মুসা একটু থামল। বলল, ‘আমি তা বলছি না। কিন্তু একে অপরকে ভালোর দিকে কল্যাণের দিকে ডাকবার অধিকার অবশ্যই আছে।’
‘কল্যাণের বিধান তো দুনিয়াতে একটা নেই মি. আহমদ মুসা।’ বলল সোফিয়া সুসান।
‘সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ, সবচেয়ে উৎকৃষ্ট এবং সবচেয়ে জীবন্তটাকেই তো মানুষ গ্রহণ করবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তার মানে বলছেন যে ইসলামই সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ, সবচেয়ে উৎকৃষ্ট এবং সবচেয়ে জীবন্ত।’ সুসানই আবার বলল।
‘আমি বললেই তুমি গ্রহণ করবে, মানুষ বিশ্বাস করবে তা নয়। তোমাকেই অনুসন্ধান করতে হবে এবং তোমার রায়ই তোমার কাছে চূড়ান্ত হবে।’
হাসিতে মুখ ভরে উঠল সোফিয়া সুসানের। বলল, ‘ধন্যবাদ। অনুসন্ধান করব। আশা করি আপনি সাহায্য করবেন। এখন আমরা চলি।’
বলে সোফিয়া সুসান ও পলা জোনস ঘুরে দাঁড়িয়ে নিচে নামতে শুরু করল।
বিস্ময়-বিমুগ্ধ চোখে এ্যারন আহমদ মুসাদের কথা শুনছিল। সোফিয়া সুসান ও পলা জোনস নিচে নেমে যেতেই এ্যারন আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলে উঠল, ‘আপনাকে একটা কথা বলব?’
‘অবশ্যই।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আপনি খুব সংবেদনশীল মনের একজন ভালো লোক। খুনো-খুনীর জগতে আপনার আসা ঠিক হয়নি।’
‘কি করব আজর ওয়াইজম্যানরাই তো আমাকে এ পথে নিয়ে এসেছে। দেখ, আমার বন্ধুদের বন্দী করে সাও তোরাহতে না আনলে, সাও তোরাহকে মানুষের উপর বর্বর নির্যাতন চালানোর জেলখানায় পরিণত না করলে তো আমি এখানে আসতাম না।’ বলল আহমদ মুসা।
এ্যারন কোন উত্তর দিল না। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বলল, ‘আরেকটি কথা, আমাদের ইহুদী ধর্ম সম্পর্কে আপনার মত কি?’
একটু হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘আমার মত না নেয়াই ভালো। তুমি খুশি হবে না আমার কথা শুনে।’
‘না তবু আপনি বলুন। আমি বুঝতে পারছি, আপনি অনেক জ্ঞান রাখেন ধর্ম সম্পর্কে এবং আপনি কোন অসত্য কথা বলবেন না।’ বলল এ্যারন একটু আবেগ জড়িত কণ্ঠে।
‘দেখ, এ ব্যাপারে অনেক কথা বলার আছে। কিন্তু তোমাকে আমি একটা কথাই বলব। ইহুদী দর্শন এখন আর কোন ধর্ম পদবাচ্য নেই। এটা উৎকট এক সাম্প্রদায়িক ও রাজনৈতিক বিশ্বাসে পরিণত হয়েছে। ধর্ম তো মানুষের কল্যাণের জন্য খোদায়ী ব্যবস্থা। তাই ধর্মকে সব মানুষের জন্যে উন্মুক্ত থাকতে হয় যাতে সব মানুষ সে ধর্ম গ্রহণ করে উপকৃত হয়। কিন্তু ইহুদী ধর্ম তা নয়। অইহুদী কেউ ইহুদী ধর্ম গ্রহণ করে ইহুদী হয়ে যেতে পারে না, ইহুদী হতে হয় জন্মগতভাবে। সুতরাং ইহুদী ধর্ম এখন মানুষের ধর্ম নয়। আজর ওয়াইজম্যানদের মত ইহুদীবাদীরা ইহুদী ধর্মকে আধিপত্যবাদী এক রাজনীতিতে পরিণত করেছেন।’ আহমদ মুসা বলল।
এ্যারন গভীর মনোযোগের সাথে আহমদ মুসার কথাগুলো শুনছিল। আহমদ মুসার কথা শেষ হলেও সে কোন কথা বলল না। তার চোখে শূন্য দৃষ্টি। একটা আত্মস্থভাব। যেন গভীর ভাবনায় ডুবে গেছে সে।
মিনি-সাব তখন অনেক পানির গভীরে।
চলছে মিনি-সাব।
হারতার উপকূল সমান্তরালে ছুটে চলছে মিনি-সাবটি।
আহমদ মুসা কথা শেষ করেই তাকাল হাসান তারিকের দিকে। বলল, ‘তোমার ট্রাভেল প্ল্যান কি হাসান তারিক?’
‘সাও তোরাহ এখান থেকে তিনশ কিলোমিটার। মধ্যম গতিতে চলব। রাতে পৌছতে চাই সাও তোরাহ উপকূলে।’ হাসান তারিক বলল।
‘ঠিক আছে। আল্লাহ ভরসা।’
‘আমিন।’ বলল হাসান তারিক।