৩৭. গুলাগ থেকে টুইনটাওয়ার

চ্যাপ্টার

সাও তোরাহ দ্বীপের রাত ১২টা।
দ্বীপ জুড়ে নিকষ অন্ধকার, নিñিদ্র নিরবতা।
দ্বীপের পশ্চিম উপকূল বরাবর পাহাড়ের কালো দেয়াল। এই দেয়ালের মাঝখানে সংকীর্ণ একটা ফাটল। সমুদ্র থেকে ১০ গজ প্রশস্ত একটা খাড়ি পাহাড়ের দেয়ালকে দুপাশে রেখে দ্বীপের ভেতরে সিকি মাইলের মত ঢুকে গেছে। দুপাশের পাহাড় থেকে নেমে আসা গাছ-পালা খাড়িটাকে প্রায় ঢেকে দিয়েছে।
খাড়িটা যেখানে শেষ হয়েছে, সেখান থেকে আধা বর্গমাইলের একটা সমতলভূমির শুরু। ‘সমতলভূমিটা বড় বড় ঘাস ও গাছ-পালায় ঢাকা। তবে খাড়ি যেখানে, সেখান থেকে কয়েক একরের মত জায়গা একটু ভিন্নতর। এখানে বড় বড় ঘাস এবং ছোট ছোট গাছ-গাছড়া রয়েছে। ওভার ভিউ, এমনকি পাশে দাঁড়িয়ে দেখলেও কোন অস্বাভাবিকতাই নজরে পড়ে না। কিন্তু হাত দিয়ে স্পর্শ করলেই বোঝা যায় ঘাস ও গাছ-গাছড়া সবই কৃত্রিম। এটাই সাও তোরাহ দ্বীপে আজর ওয়াইজম্যানের জিন্দানখানা, যাকে দুনিয়ার দোজখ বানিয়ে রাখা হয়েছে কিছু মানুষের জন্যে। ত্রিতল এই জিন্দানখানাটিকে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে মোভেবল করা হয়েছে। সুইচ টিপলে তৃতীয় তলাটি মাটির উপরে চলে আসে। কিন্তু তাদের ছাদের উপর তখনও থাকে কৃত্রিম ঘাস ও গাছ-গাছড়ার বাগান। উপর থেকে দেখলে কিছুতেই বোঝা যাবে না যে, এর নিচে একটা স্থাপনা আছে। জিন্দানখানাটির একতলা ও দোতলা সবসময় মাটির নিচে থাকে। সুইচ টিপে আবার তৃতীয় তলাসহ সবটাই মাটির তলায় নিয়ে যাওয়া যায়।
ঠিক রাত ১২টায় কৃত্রিম ঘাসে ঢাকা চত্বরটির পূর্ব প্রান্তের কাছাকাছি জায়গার দুই বর্গগজ গোলাকৃতি একটা অংশ কয়েকফুট নিচে নেমে গেল, তারপর একপাশে অদৃশ্য হয়ে গেল। উন্মুক্ত হয়ে পড়ল একটা চলন্ত সিঁড়ি। সেই চলন্ত সিঁড়ি দিয়ে উঠে এল আজর ওয়াইজম্যানের অপারেশন চীফ বেন্টো বেগিন এবং এই জিন্দানখানার আজরাঈলরুপী দানিয়েল ডেভিড, হাইম হারজেল এবং আইজ্যাক জোসেফ।
ওরা চারজন সিঁড়ি থেকে মাটিতে উঠে এসেই পুব আকাশের দিকে তাকাতে লাগল।
প্রথমে কথা বলে উঠল বেন্টো বেগিন, ‘করভো দ্বীপ অতিক্রমের পরই গোপনীয়তার জন্যে হেলিকপ্টারের আলো নিভিয়ে দেয়া হবে। সুতরাং আলো দেখা যাবে না। শব্দ শোনা যাবার মত কাছাকাছি হেলিকপ্টারটি এখনও আসেনি।’
‘তাই হবে। কিন্তু এখনই আমাদের নীল আলো দেখানো উচিত। না হলে হেলিকপ্টার দিক ভুল করতে পারে।’ বলল আইজ্যাক জোসেফ।
বেন্টো বেগিন আইজ্যাকের কথায় সায় দিল এবং তার হাতের প্লাষ্টিকের লম্বা দ-টির বটমটা উপরে তুলে পকেট থেকে একটা নীল বাল্ব বের করে তাতে সেট করে দিল। তারপর দ-টির গায়ের একটা সুইচ টিপে দিতেই নীল আলো জ্বলে উঠল। দ-ের মাথায় নীল আলোটি নির্দিষ্ট নিয়মে জ্বলা-নিভা করতে লাগল।
দ-টি উর্ধে তুলে ধরল হাইম হারজেল।
দুমিনিটও যায়নি দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে হেলিকপ্টারের শব্দ ভেসে এল।
খুশিতে উচ্ছল হয়ে উঠল চারজনই।
পাঁচ মিনিটের মধ্যে হেলিকপ্টারটি এসে ল্যান্ড করল ঘাসের সে চত্বরের উপর।
হেলিকপ্টার থেকে নেমে এল হাস্যোজ্জ্বল মুখে আজর ওয়াইজম্যান। তার হাতে সুন্দর একটি ব্রীফকেস। এসে সে প্রথমেই জড়িয়ে ধরল বেন্টো বেগিনকে। তারপর একে একে অন্য তিনজনকে। বলল, ‘এখানে কোন কথা নয়। চল নিচে নেমে যাই।’ বলে আজর ওয়াইজম্যান হাঁটতে শুরু করল সুড়ঙ্গের চলন্ত সিঁড়ির দিকে।
সবাই তাকে অনুসরণ করল।
চলন্ত সিঁড়ি তিন তলা হয়ে নেমে এল দুতলায় আজর ওয়াইজম্যানের অফিস কক্ষে।
আজর ওয়াইজম্যান তার রিভলভিং চেয়ারে বসে গা এলিয়ে দিল। সামনে বিরাট ওয়ার্কিং টেবিল।
ওরা চারজন আজর ওয়াইজম্যানের সামনের চেয়ারে জড়োসড়ো হয়ে বসল।
আজর ওয়াইজম্যানের চোখ বন্ধ। চেয়ারে দুলছে তার দেহটা। আনন্দ উপছে পড়ছে তার চোখ-মুখ দিয়ে। এমন আনন্দিত তাকে বহুদিন দেখা যায়নি।
চোখ বন্ধ রেখেই সে এক সময় বলে উঠল, ‘আজ বিজয়ের দিন নয় বেন্টো, মুক্তির দিন আমাদের আজ। স্পুটনিকের উদ্ধার করা দলিলের সর্বশেষ যে কপি আমি হাইজ্যাক করে নিয়ে এলাম তা যদি প্রকাশ হয়ে পড়ত, তাহলে পৃথিবী আমাদের কাছে অবাসযোগ্য হয়ে উঠত। টুইনটাওয়ার ধ্বংসের যাবতীয় দায় মাথায় নিয়ে শুধু বিশ্ববাসীর অপরিসীম ঘৃণা নয়, গণহত্যার জন্যে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হতো। পৃথিবীর সবার বিশ্বাস আমরা হারাতাম। কোথাও আমাদের স্থান হতো না। ফিরে যেতে হতো আমাদেরকে আবার অতীতের সেই অন্ধকার যুগে।’
থামল আজর ওয়াইজম্যান। আবেগের উত্তাপে তার চোখ-মুখ লাল হয়ে উঠেছিল। ভারী হয়ে উঠেছিল তার কণ্ঠ।
আজর ওয়াইজম্যানের সামনে বসা বেন্টো বেগিনদের চোখে-মুখেও ভয় ও উদ্বেগ। বেন্টো বেগিন বলল, ‘টুইন টাওয়ার ধ্বংসের বিশ বছর পর এই দলিল তারা উদ্ধার করল কি করে?’
‘ওরা সাতজন সত্যিই অসাধারণ প্রতিভাবান গোয়েন্দা।’ বলল আজর ওয়াইজম্যান।
আজর ওয়াইজম্যান কথা শেষ করতেই তার টেলিকম কথা বলে উঠল। গলা সাংবাদিক বুমেদীন বিল্লাহর। বলল সে, ‘শুনলাম এক্সিলেন্সি আপনি এসেছেন। আমি উদ্বেগের মধ্যে আছি। ইউরোপ থেকেই আপনার মিশন সম্পর্কে আমাদের জানানো উচিত ছিল আপনিই বলুন এক্সিলেন্সি।’
‘আমি বলব না। তুমি এস বিল্লাহ এখনি।’ বলল আজর ওয়াইজম্যান।
‘এক মিনিটের মধ্যেই দরজায় নক হলো। আজর ওয়াইজম্যান বলল, ‘এস বিল্লাহ।’
ঘরে ঢুকল বুমেদীন বিল্লাহ।
তাকে দেখেই আজর ওয়াইজম্যান চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল।
বেন্টো বেগিন এগিয়ে আসছে। আজর ওয়াইজম্যানও তার দিকে এগুলো। আজর ওয়াইজম্যান বুকে জড়িয়ে ধরল বুমেদীন বিল্লাহকে এবং তাকে টেনে নিয়ে চেয়ারে বসাল। বলল বুমেদীন বিল্লাহকে লক্ষ্য করে, ‘তোমাকে অভিনন্দন বিল্লাহ। আমরা তোমার কাছে ঋণী। যেভাবে আছে বলেছিলে, সেভাবেই ব্যাংকের ভল্টে দলিলগুলো পেয়েছি। তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ বিল্লাহ।’
বুমেদীন বিল্লাহর চেহারায় শান্ত ভাব। আজর ওয়াইজম্যান যতটা উদ্দীপ্ত, ততটা বুমেদীন বিল্লাহ নয়। বলল সে, ‘ওয়েলকাম এক্সিলেন্সি। কোন অসুবিধা তো হয়নি?’
‘অসুবিধা আর কি? আমরা বিরাট প্রস্তুতি নিয়ে গিয়েছিলাম। সাহায্য নিয়েছিলাম ইউরোপের সেরা ব্যাংক ডাকাত গ্রুপের। ব্যাংকের নৈশ সব প্রহরীকেই আমরা হত্যা করি। পথ রোধকারী ব্যাংকের সব দরজাই আমরা ‘ল্যাসার বীম’ দিয়ে নিঃশব্দে ধ্বংস করে দিয়েছি। লকার খুঁজে পেতেও আমাদের অসুবিধা হয়নি। তোমার দিক-নির্দেশনা ছিল একেবারে নির্ভূল। তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।’
আজর ওয়াইজম্যানের মোবাইল বেজে উঠেছিল। কথা শেষ করেই মোবাইলটা হাতে নিল। বলল, ‘গোল্ডা তুমি লাজেন থেকে বলছ? কি, খবর?’
লাজেন সাও তোরাহ থেকে ৭০ কিলোমিটার দক্ষিণের একটা দ্বীপের বন্দর নগরী। ওখানে WFA-এর একটা ষ্টেশন আছে। গোল্ডা মায়ার তার ষ্টেশন চীফ।
আজর ওয়াইজম্যান তার প্রশ্নের উত্তরে ওপারের কথা শুনছে। শুনতে শুনতে তার মুখ অন্ধকার হয়ে উঠল। শোনা শেষ করে আজর ওয়াইজম্যান শুধু বলল, ‘না গোল্ডা, তোমার হারতা যেতে হবে। আমি বিষয়টা নিয়ে ভাবছি।’
মোবাইল অফ করে টেবিলে রেখে দিয়ে বেন্টো বেগিনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘দেখছি, তেরসিয়েরা দ্বীপে আমাদের যে বিপর্যয় ঘটেছিল তার চেয়েও বড় বিপর্যয় ঘটল হারতায়। ইমানুয়েল, কেলভিন, সুলিভান ও ডেভিড ডেনিমরাসহ প্রায় অর্ধশত আমাদের লোক নিহত হওয়া ও ঘাঁটিগুলো ধ্বংস হবার পর অবশিষ্ট ছিল শুধু সান্তাসিমা উপত্যকার সাবমেরিন ঘাঁটিটা। সেটারও ভবিষ্যত অনিশ্চিত বেন্টো।’ শুকনো কণ্ঠ আজর ওয়াইজম্যানের।
‘ঘটনা কি এক্সিলেন্সি?’ বলল বেন্টো বেগিন। তার কণ্ঠে উদ্বেগ।
‘গোল্ডা জানাল, সান্তাসিমা উপত্যকার সাবমেরিন ঘাঁটিতে আহমদ মুসা ও তার সহকারী প্রবেশ করে ও বন্দী হয়। সান্তাসিমা থেকে সাবমেরিনে টেলিফোন করা হয় বন্দীকে ওখানে থেকে নিয়ে আসার জন্যে। মিনি-সাবটি তখন ছিল লাজেনে। গোল্ডা তখনই সেখানকার অপারেশন কমান্ডারের নেতৃত্বে ১২ জন লোক দিয়ে মিনি-সাব সান্তাসিমায় পাঠিয়ে দেয়। মিনি-সাব সান্তাসিমা ঘাঁটিতে নোঙর করা পর্যন্ত খবর পেয়েছে গোল্ডা। তারপর ছয়ঘণ্টা পার হলো কোন খবর নেই। না রেসপনস করছে সাবমেরিন থেকে, না কথা বলছে ঘাঁটি থেকে কেউ।’ বলল আজর ওয়াইজম্যান।
বেন্টোও তার সাথী তিনজনের মুখও অন্ধকার হয়ে গেল উদ্বেগে। আর বুমেদীন বিল্লাহর চোখে-মুখে দপ করে এক ঝলক আলো জ্বলে উঠেই আবার নিভে গেল।
‘কি ঘটতে পারে এক্সিলেন্সি? আহমদ মুসা কি…….।’ কথা শেষ না করেই থেমে গেল বেন্টো বেগিন।
‘সব কিছুই ঘটতে পারে সেখানে? আমাদের সান্তাসিমা ঘাঁটির লোকরা আহমদ মুসাকে ধরে রাখার সাধ্য রাখে না। আমি ভাবছি, সাবমেরিনটাও বোধ হয় আমাদের শেষ হয়ে গেল।’ আজর ওয়াইজম্যান বলল।
‘আমরা চেষ্টার ত্রুটি করিনি এক্সিলেন্সি। কিন্তু আহমদ মুসা আপদটাকে বাগে আনা গেল না। কেউ তার সামনে দাঁড়াতে পারছে না।’ বেন্টো বেগিন বললল।
‘আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ যোদ্ধা ও গোয়েন্দা প্রতিভা জেনারেল শ্যারন যার কাছে বার-বার পরাজিত হয়েছেন, যার ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমাদের হাত থেকে বেরিয়ে গেল, সেই আহমদ মুসাকে তোমরা আটকাবে কি করে! আমাদের চরম দুর্ভাগ্য যে, তার আজোরসে আসা আমরা আটকাতে পারিনি। এখন আমার মনে হচ্ছে, সাও তোরাহ নিয়েই এখন আমাদের ভাবতে হবে।’ বলেই আজর ওয়াইজম্যান তাকাল বুমেদীন বিল্লাহর দিকে। বলল, ‘বিল্লাহ, কিছু বলবে তুমি?’
‘এক্সিলেন্সি আমাকে পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করুন। আমি অবিলম্বে চলে যেতে চাই্’। বুমেদীন বিল্লাহ বলল।
আজর ওয়াইজম্যান মুখটা নিচু করল। পরক্ষণেই মুখ তুলে একটু হেসে বলল, ‘সব মনে আছে বিল্লাহ। কিন্তু মিনি-সাবটা হঠাৎ নিখোঁজ হলো। আমি দেখছি। প্রথম সুযোগেই তোমাকে পাঠাবার ব্যবস্থা করব।’
‘আরেকটা কথা এক্সিলেন্সি, তাদের দলিলগুলো যে এখন আর তাদের হাতে নেই, আপনি উদ্ধার করেছেন, এ খবরটা আমি কামাল সুলাইমানদের একটু দিতে চাই। তাদের বুঝাতে চাই যে, তাদের কানাকাড়ি মূল্যও এখন নেই।’
হাসল আজর ওয়াইজম্যান। বলল, ‘হ্যাঁ এ মজাটা তুমি করতে পার। তার সাথে তাদের বলে দিও যে এক বিলিয়ন ডলারের চেক তোমার একাউন্টে জমা হয়ে গেছে।’
বুমেদীন বিল্লাহ হাসল। বলল, ‘বেচারাদের কাটা ঘায়ে একেবারে নুনের ছিটা পড়বে।’
‘ঠিক আছে বিল্লাহ। তুমি লাউঞ্জে গিয়ে বস। বেন্টো তোমাকে কামাল সুলাইমানদের কাছে নিয়ে যাবে।’ বলল আজর ওয়াইজম্যান।
‘ধন্যবাদ এক্সিলেন্সি।’ বলে উঠে দাঁড়াল বুমেদীন বিল্লাহ। বেরিয়ে এল ঘর থেকে।
বাইরের ঘরটায় আজর ওয়াইজম্যানের পি.এ বসেন। বুমেদীন বিল্লাহ দেখল, পি.এ-এর ইন্টারকমটা খোলা। সে এই ইন্টারকম থেকেই আজর ওয়াইজম্যানের সাথে কথা বলেছিল। কিন্তু ইন্টারকম অফ করতে ভুলে গিয়েছিল। ইন্টারকমটা অফ করে দেবার জন্যে এগুলো টেবিলের দিকে। এই সময় ইন্টারকম কথা বলে উঠল। গলা বেন্টো বেগিনের। সে বলল, ‘এক্সিলেন্সি এখন আমাদের কি করণীয়?’
বুমেদীন বিল্লাহ নিজের মনেই হাসল। তাহলে আজর ওয়াইজম্যানও ইন্টারকম অফ করে দেয়নি।
বুমেদীন বিল্লাহ ইন্টারকম অফ করার জন্য হাত বাড়িয়েও হাতটা টেনে নিল। তার কৌতুহল হলো, আজর ওয়াইজম্যান কি উত্তর দেয় দেখা যাক।
গলা শোনা গেল আজর ওয়াইজম্যানের। তিনি বলছেন, ‘সান্তাসিমার ঘটনা কোন দিকে গড়াচ্ছে আমি জানি না। মিনি-সাব যদি আহমদ মুসার হাতে যায়, তাহলে বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। স্পুটনিকের দলিলগুলো পাওয়ার পর আমাদের বর্তমান প্রধান লক্ষ্যটা অর্জন হয়েছে। আপাতত সাও তোরাহতে আমাদের কাজ নেই।’
‘বন্দীদের স্থানান্তর?’ বলল বেন্টো বেগিন।
‘বন্দীরা যেখানে আছে, সেখানেই তাদের কবর হবে। আমরা যাবার সময় গ্যাস সিলিন্ডারের লকটা আনলক করে দিয়ে যাবো। আমরা দ্বীপটা ত্যাগ করার আগেই ওরা সবাই লাশ হয়ে যাবে।’ আজর ওয়াইজম্যান বলল।
‘এক্সিলেন্সি আমরা কি আজই দ্বীপ ছাড়ছি?’ বলল বেন্টো বেগিন।
‘হ্যাঁ, সূর্যোদয়ের আগেই।’ আজর ওয়াইজম্যান বলল।
আজর ওয়াইজম্যানের পরিকল্পনা শুনে উদ্বেগ-আতংকে পাংগু হয়ে উঠেছিল বুমেদীন বিল্লাহর মুখ। এমন কিছু ঘটবে বুমেদীন বিল্লাহ জানত, কিন্তু সেটা এত তাড়াতাড়ি ঘটবে এটা ভাবতে পারেনি। কোন প্রস্তুতিরও সময় তার নেই। তাহলে কি আজর ওয়াইজম্যানের পরিকল্পনাই সফল হবে!
পরক্ষণেই বুমেদীন বিল্লাহর মুখ কঠোর হয়ে উঠল। কিছু করতে হবে। কিন্তু কি করবে? টুইন টাওয়ারের দলিল আজর ওয়াইজম্যানের হস্তগত হওয়ার খবর কামাল সুলাইমানদের দেয়ার অজুহাতে সে তাদের কাছে এই সংকেত পৌছাতে চেয়েছিল যে, মুক্তির একটা উপায়ের লক্ষ্যে সে কাজ করছে, তারা যেন প্রস্তুত থাকে। কিন্তু এই কাজ করার আর সময় কোথায়? কিন্তু তবু তাকে কিছু করতে হবে।
উঠে দাঁড়াল বুমেদীন বিল্লাহ। তার আগে সে ইন্টারকম বন্ধ করে দিয়েছে।
বুমেদীন বিল্লাহ বেরিয়ে এসে ড্রইং রুমে বসল। চিন্তা তখন রকেটের গতিতে ঘুরপাক খাচ্ছে তার মাথায়। এই সময় হঠাৎ তার মনে পড়ল সেদিন সে বেন্টো বেগিনের ষ্টোর থেকে সিগারেটের লাইটার সাইজের একটা ল্যাসার কাটার চুরি করেছে। সেটা তার এখুনি দরকার।
ভাবনার সাথে সাথেই বুমেদীন বিল্লাহ ছুটল তার ঘরের দিকে। ঘরে গিয়ে সে লুকিয়ে রাখা ল্যাসার কাটারটা পকেটে পুরল। টেবিলে বসে দ্রুত একটা চিরকুটে লিখল, ‘আহমদ মুসা সম্ভবত হারতা দ্বীপ থেকে এখন সাও তোরাহের পথে। কিন্তু অপেক্ষার সময় নেই। সাও তোরাহতে আগামীকালের সূর্যোদয় ঘটবে না। দ্রুত প্রস্তুত হোন।’ লেখা শেষে চিরকুটটি মুড়ে ল্যাসার কাটারের প্যাকেটে ঢুকাল।
তারপর দৌড়ে ফিরে এল আজর ওয়াইজম্যানের ড্রইং রুমে। সে সময় বেন্টো বেগিনও ড্রইংরুমে প্রবেশ করল।
বুমেদীন বিল্লাহকে দেখেই বেন্টো বেগিন বলে উঠল, ‘চলুন কামাল সুলাইমানদের কাছে। হাতে সময় খুব কম।’
‘সময় কম কেন?’ কৃত্রিম বিস্ময়ের সুরে বলে উঠল বুমেদীন বিল্লাহ।
‘জিনিসপত্র প্যাক করতে নামতে হবে এখনি। মূল্যবান ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রপাতি তো ফেলে যাওয়া যাবে না। অবশ্য ওদের বলে দিয়েছি, ওরা সবকিছু গুটিয়ে নেয়া ও প্যাক করা শুরু করে দিয়েছে। চলুন।’ বলে হাঁটা শুরু করল তিন তলায় ওঠার সিঁড়ির দিকে বেন্টো বেগিন।
‘বুঝলাম না মি. বেগিন। কোথাও যাচ্ছেন নাকি? হাঁটতে হাঁটতে বলল বুমেদীন বিল্লাহ ঠোঁটে কৃত্রিম হাসি টেনে।
‘সবই দেখতে পাবেন। আপনিও যাচ্ছেন। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আমরা দ্বীপ ছাড়ছি।’ বলল বেন্টো বেগিন।
‘দলিলগুলো হস্তগত হয়েছে। আসল কাজ হয়েছে। আপাতত দ্বীপে কোন কাজ নেই।’ একটু থেমে পুনরায় বলে উঠল বেন্টো বেগিন।
কৃত্রিম আনন্দ প্রকাশ করে বুমেদীন বিল্লাহ বলল, ‘তাহলে আজই যাত্রা করতে পারছি! অনেক ধন্যবাদ এ সিদ্ধান্তের জন্যে।’
তৃতীয় তলায় উঠে এল তারা।
তৃতীয় তলায় দুটি সিঁড়ি ঘর, একটা বিশাল ষ্টোর রুম বাদে গোটাটাই বন্দীদের ব্যারাক। দুটি সিঁড়ির একটি চলন্ত। চলন্ত সিঁড়িটি একতলার ল্যান্ডিং রুম, দুতলার আজর ওয়াইজম্যানের অফিস হয়ে তিন তলা দিয়ে ছাদে চলে গেছে। দ্বিতীয় সিঁড়িটি একতলার রক্ষী ব্যারাক থেকে দুতলার প্রশাসনিক অফিস হয়ে তিনতলায় চলে গেছে। তিনতলার এই সিঁড়ি ঘরেই বন্দী ব্যারাকে প্রবেশের বিশাল সিংহ দরজা। লোহার তৈরী।
বেন্টো বেগিন তালা খুলে বন্দীখানায় প্রবেশ করল।
বেন্টোর পেছনে পেছনে প্রবেশ করল বুমেদীন বিল্লাহ।
তিন তলার ছাদ প্রায় পনের ফিট উঁচু। কিন্তু বন্দীখানার ছাদ ৭ ফুটের বেশি নয়। এ ছাদের উপরে ৮ ফুট উঁচু বন্দীখানা আকারের বিশাল হলঘর নানা যন্ত্রপাতিতে ঠাসা। যন্ত্রপাতি অনেকগুলোর সাথেই বন্দীখানার সংযোগ আছে।
বন্দীখানার বন্দীদের সেল। সেল না বলে ওগুলোকে খাঁচা বলাই ভাল। তবে পাখির খাঁচার মত নয়। পাখির খাঁচা পাখির তুলনায় অনেকগুণ বড় হয়। কিন্তু বন্দীদের খাঁচা বন্দীদের চেয়ে ছোট।
বেন্টো বেগিন এগুলো কামাল সুলাইমানের খাঁচার দিকে।
কামাল সুলাইমানসহ সাত গোয়েন্দার খাঁচা একই সারিতে পরপর। কামাল সুলাইমানের পর ওসমান আব্দুল হামিদ। তারপর অন্যান্যরা।
বেন্টো বেগিন গিয়ে দাঁড়াল কামাল সুলাইমানের খাঁচার কাছাকাছি। বলল, ‘মি. বিল্লাহ যা বলার, তাড়াতাড়ি তা সেরে ফেল।’
বুমেদীন বিল্লাহ বেন্টো বেগিনকে ছাড়িয়ে কামাল সুলাইমানের খাঁচার একদম পাশে গিয়ে দাঁড়াল।
‘মি. বুমেদীন বিল্লাহ ইতিহাস রচনার কতদূর এগুলেন?’ খাঁচার ভেতরে জড়সড় হয়ে বসে থাকা কামাল সুলাইমান বলল বুমেদীন বিল্লাহকে। তার চোখে-মুখে তীব্র ঘৃণা ও বিদ্রুপ।
‘ইতিহাস সৃষ্টির শেষ অধ্যায়ে পৌছেছি। ব্যাংকের ভল্ট থেকে স্পুটনিকের টুইনটাওয়ার সংক্রান্ত সব দলিল-দস্তাবেজ আজর ওয়াইজম্যান আজ নিয়ে এসেছেন।’ বলল বুমেদীন বিল্লাহ।
‘জাতির পরাজয়ের মধ্য দিয়ে আপনার বিশ্বাসঘাতকতার জয় হলো, এই হলো আপনার ইতিহাসের শেষ অধ্যায়।’ কামাল সুলাইমান বলল।
‘হ্যাঁ মি. কামাল সুলাইমান, এটা আমার ইতিহাসের শেষ অধ্যায়, কিন্তু শেষ কথা নয়।’ বলে বুমেদীন বিল্লাহ বেন্টো বেগিনের দিকে ফিরে বলল, ‘চলুন, মি. ওসমান আব্দুল হামিদকে এবার সুখবরটা দেই।’
‘আসুন।’ বলে বেন্টো বেগিন ঘুরে দাঁড়িয়ে ওসমান আব্দুল হামিদের খাঁচার দিকে হাঁটতে লাগল।
এই সুযোগেরই অপেক্ষা করছিল বুমেদীন বিল্লাহ। সে দ্রুত পকেট থেকে ল্যাসার বীমের বক্সটি বের করে কামাল সুলাইমানের খাঁচায় ঢুকিয়ে দিয়ে হাঁটতে শুরু করল।
কয়েক ধাপ এগিয়েই বুমেদীন বিল্লাহ বেন্টো বেগিনকে লক্ষ্য করে বলল, ‘একে একে বলা আর নয়। দাঁড়ান। আমার গলায় যথেষ্ট জোর আছে। একসঙ্গে সবাইকে জানিয়ে দেই। ’
বলে বুমেদীন বিল্লাহ দৌড়ে গিয়ে খাঁচাগুলোর মাঝ বরাবর এক জায়গায় গিয়ে চিৎকার করে উঠল, ‘সাত গোয়েন্দা শুনুন। টুইনটাওয়ার সম্পর্কিত আপনাদের সব দলিল এখন আজর ওয়াইজম্যানের হাতে। ব্যাংকের ভল্ট থেকে আজ তিনি এগুলো নিয়ে এসেছেন। আপনারা এখন এক বিগ জিরো। আজ রাতেই এক ইতিহাসের সমাপ্তি ঘটছে। নতুন ইতিহাস পর্যন্ত গুডবাই।’
বুমেদীন বিল্লাহ ও বেন্টো বেগিন বেরিয়ে এল বন্দীখানা থেকে।
ফিরে এল বুমেদীন বিল্লাহ তার ঘরে। দরজা লাগিয়ে দিয়ে সে আসন্ন পরিস্থিতির জন্যে নিজেকে প্রস্তুত করার কাজ শুরু করে দিল। খাটের ফোম তুলে ফেলে তার তলা থেকে কয়দিন ধরে আর্মস ষ্টোর থেকে চুরি করা ডজন দুয়েক রিভলবার বের করল। হ্যান্ড ব্যাগে পুরল সে রিভলবারগুলো।
সব ঠিকঠাক করে বিছানায় বসল সে। হাতঘড়ির দিকে তাকাল। দেখল রাত পৌনে একটা। রাত একটার দিকে বেরুবে সে। প্রধান কাজ হবে অস্ত্রগুলো কামাল সুলাইমানদের হাতে পৌছানো।
দেহটা একটু বিছানায় রাখল বুমেদীন বিল্লাহ। তার দরজায় নক হলো এসময়। বুমেদীন বিল্লাহ তাড়াতাড়ি উঠে হ্যান্ড ব্যাগটা আড়ালে সরিয়ে রেখে দরজা খুলে দিল। দরজা খুলতেই দরজার ফাঁকে আটকানো একটা কাগজ নিচে পড়ে গেল। কিন্তু দরজার বাইরে কাউকেই দেখল না।
বুমেদীন বিল্লাহ তাড়াতাড়ি কাগজটা তুলে নিয়ে দরজা লাগিয়ে দিল।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই কাগজটার ভাঁজ খুলল। একটা চিঠি। কয়েক লাইন লেখা। পড়ল সে, ‘প্রিয় সাংবাদিক, আপনি যথেষ্ট বুদ্ধিমান। সবই বুঝার কথা। তবু বলছি, WFA সম্পর্কে বা তার লোকদের পরিচয় সম্পর্কে সামান্য কিছু জানে এমন বাইরের কোন ব্যক্তিকেই বাঁচতে দেয়া হয় না। আপনার সাবধান হওয়ার সময় চলে যাচ্ছে।’
চিঠিটা পড়ে ঠোঁটে একটা হাসি ফুটে উঠল বুমেদীন বিল্লাহর। স্বগতকণ্ঠে অস্ফুট স্বরে বলল, ‘তুমি কে জানি না বন্ধু। আল্লাহ তোমার মঙ্গল করুন। তুমি জেনে রাখ বন্ধু, যে মুহূর্তে আমি আজর ওয়াইজম্যানের প্রস্তাবে রাজী হয়েছি, সে মুহূর্ত থেকেই আমি জানি তার কাজ শেষ হবার পর আজর ওয়াইজম্যান আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে না। এমনিতেই তো তারা আমাকে মারতো, তাই আমি বাঁচার ও বাঁচাবার চেষ্টা করে মরতে চেয়েছি।’
আবার ঘড়ির দিকে তাকাল বুমেদীন বিল্লাহ। দেখল একটা বাজতে দশ মিনিট বাকি।
বিছানায় আবার গা এলিয়ে দিল বুমেদীন বিল্লাহ।

বুমেদীন বিল্লাহ ও বেন্টো বেগিন বন্দীখানা থেকে বেরিয়ে যেতেই কামাল সুলাইমান ছোট ল্যাসার বক্সটি খুলে ফেলল। খুলতেই বেরিয়ে পড়ল চিঠিটা। সেই সাথে নজর পড়ল লাইটার সাইজের ল্যাসার কাটারের উপর। দেখেই বুঝতে পারল ওটা ল্যাসার কাটার। চোখ দুটি তার উজ্জ্বল হয়ে উঠল আনন্দে। তাড়াতাড়ি খুলল চিঠিটা। পড়ল। চিঠিটা পড়ে আনন্দে নেচে উঠল তার মন। আহমদ মুসা সাও তোরাহ আসছে জেনে। কিন্তু চিঠির পরবর্তী কয়েকটি লাইন তাকে উদ্বিগ্ন করে তুলল। আগামীকাল সাও তোরাহতে সূর্যোদয় ঘটবে না-এর অর্থ তার কাছে পরিষ্কার যে, আজকের রাতই তাদের শেষ রাত। সূর্যোদয়ের আগেই তাদের হত্যা করা হবে। বাঁচার জন্যে চেষ্টা করার সময় খুব কম। দ্রুত তাদের এজন্যে প্রস্তুত হতে হবে। বুমেদীন বিল্লাহ তাদেরকে প্রস্তুত হবার জন্যেই ল্যাসার কাটার সরবরাহ করেছে। বিস্মিত হলো সে, টুইনটাওয়ার সংক্রান্ত দলিল আজর ওয়াইজম্যানদের হাতে তুলে দেয়ার মত সর্বনাশ করে আবার আমাদের বাঁচাবার চেষ্টা কেন? দলিলগুলো তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। যাক। আল্লাহ যে সুযোগ দিয়েছেন তার সদ্ব্যবহার করা প্রয়োজন।
কামাল সুলাইমান তাকাল ওসমান আবদুল হামিদের দিকে। ওসমান আবদুল হামিদ কৌতুহলী চোখে তাকিয়েছিল কামাল সুলাইমানের দিকে। বুমেদীন বিল্লাহর ল্যাসার বক্সটি কামাল সুলাইমানের খাঁচায় দেবার সময় সে দেখেছিল।
কামাল সুলাইমান চিঠিটা ও ল্যাসার কাটার ওসমান আবদুল হামিদসহ সবাইকে দেখিয়ে ইংগিতে বলল, অবিলম্বে তাদের মুক্ত হতে হবে।
কামাল সুলাইমান কাজে লেগে গেল। হাত ও পায়ের চেইন ও বেড়ি কাটা কয়েক সেকেন্ডে হয়ে গেল। তারপর খাঁচার লক কেটে মুহূর্তেই খাঁচা থেকে বেরিয়ে এল।
খাঁচা থেকে বেরিয়ে কামাল সুলাইমান ল্যাসার কাটার ওসমান আবদুল হামিদকে দিয়ে এল। ওসমান আবদুল হামিদ মুক্ত হয়ে ল্যাসার কাটারটা দিয়ে এল তার পাশের আবদুল্লাহ আল ফারুককে।
এইভাবে দেড় ঘণ্টার মধ্যে ২০৭ জন বন্দীর সবাই মুক্ত হয়ে গেল।
সবাই মুক্ত হবার পর কামাল সুলাইমানরা সাতজন শেখুল ইসলাম আহমদ মুহাম্মাদকে সাথে নিয়ে পরামর্শ করল। কামাল সুলাইমান বলল, ‘আমাদের বন্দীখানার ভেতরের সব দৃশ্য নিশ্চয় টিভি ক্যামেরার মাধ্যমে মনিটর করা হচ্ছে, তাই যে কোন সময় আমাদের উপর আক্রমণ হতে পারে। ওদিকে আহমদ মুসা সাও তোরাহতে কখন পৌছবে আমরা জানি না। এই অবস্থায় আমাদের করণীয় কি?’
কামাল সুলাইমানের সাথের ছয়জন একই ধরনের মত প্রকাশ করল যে, ‘ওরা আক্রমণে আসার আগেই আমাদেরই আক্রমণে যাওয়া দরকার। যুদ্ধ করার মধ্যেই আমাদের বাঁচার সম্ভাবনা আছে। মরতে হলে যুদ্ধ করেই আমরা মরব।’ শেখুল ইসলামও অনুরূপ মত প্রকাশ করল।
কামাল সুলাইমান অবশিষ্ট সবাইকে ডাকল। পরিস্থিতি বুঝতেই সবাই বলে উঠল, ‘মরতে হলে যুদ্ধ করে আমরা মরব।’
অস্ত্র হিসেবে সবাই চেনগুলোকে কুড়িয়ে নিল।
কামাল সুলাইমানদের সাত জনের নেতৃত্বে ২০৭ জনকে ৭টি গ্রুপে ভাগ করা হলো।
ঠিক রাত দুটার সময় কামাল সুলাইমানের নেতৃত্বে প্রথম গ্রুপটি অগ্রসর হলো বন্দীখানার দরজার দিকে। তাদের পেছনে অন্য গ্রুপগুলো সারিবদ্ধভাবে অগ্রসর হলো দরজার দিকে।
কামাল সুলাইমান ল্যাসার বীম দিয়ে দরজার লক কেটে ফেলল।
কাটা শেষ ঠিক এই সময় দরজায় নক হলো। পরপর তিনবার নক করার শব্দ অন্যেরাও শুনতে পেয়েছে। কামাল সুলাইমানের ছয় বন্ধু এগিয়ে এল তার কাছে। ওসমান আবদুল হামিদ বলল ফিসফিসে কণ্ঠে, আমার মনে হয় আজর ওয়াইজম্যানের লোক হলে দরজায় নক না করে দরজা খুলে ফেলত। কারণ তাদের কাছে চাবি আছে। আমাদের কোন মিত্র মানে বুমেদীন বিল্লাহই নক করতে পারে। লেসার কাটার ব্যবহার করে আমরা মুক্ত হবো এবং আমরা দরজা খুলতে পারব, এটা শুধু সেই জানে। আর দেখ ঠিক সময়েই সে নক করেছে।’
ওসমান আবদুল হামিদের যুক্তি সবাই সমর্থন করল।
ঠিক এই সময় আবার সেই একই নিয়মে নক হলো দরজায়। পরপর তিনবার।
এবার কামাল সুলাইমানও সেই একই নিয়মে নক করল দরজায়। সংগে সংগে বাইরে থেকেও সে নিয়মে নক হলো।
কামাল সুলাইমান দরজা খুলে ফেলল।
দরজার বাইরে একটা ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে বুমেদীন বিল্লাহ।
দরজা খুলে যেতেই সালাম দিল বুমেদীন বিল্লাহ কামাল সুলাইমানদের লক্ষ্য করে।
সালাম দিয়েই উত্তরের অপেক্ষা না করে কামাল সুলাইমানদের দিকে দুধাপ এগিয়ে ব্যাগটা তার দিকে তুলে ধরে বলল, ‘এতে ২৪টি রিভলবার আছে।’
কামাল সুলাইমান ব্যগটি নিয়ে তাড়াতাড়ি ভেতরে ঢুকে গেল। তাড়াতাড়ি রিভলবারগুলো বণ্টন করে ফেলল।
তারপর দরজার বাইরে এসে বলল, ‘মি. বিল্লাহ আমরা প্রস্তুত।’
এ সময় প্রচ- গুলী-গোলার শব্দ ভেসে এল।
উৎকর্ণ হলো বুমেদীন বিল্লাহ। বলল, ‘এই শব্দ নিচ তলা থেকে আসছে। কি ব্যাপার আমি একটু শুনে আসি। আপনারা এখানেই দাঁড়ান।’ উদ্বিগ্ন কণ্ঠ বুমেদীন বিল্লাহর।
বুমেদীন বিল্লাহ বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। ছুটল সে দোতলার দিকে।
দুতলার সিড়ির গোড়ায় সে দেখা পেল বেন্টো বেগিনের। বেগিনকে দেখেই বুমেদীন বিল্লাহ বলে উঠল, ‘কি ঘটেছে নিচ তলায়? গোলাগুলী কেন?’
বুমেদীন বিল্লাহর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বেগিন বলে উঠল, ‘আমি তোমাকে খুঁজছি। চল এক্সিলেন্সি তোমাকে ডেকেছেন।’
‘কোথায় তিনি?’ বলল বুমেদীন বিল্লাহ।
‘তিন তলার ছাদে, হেলিকপ্টারে। তুমি তাড়াতাড়ি ফিরতে চাচ্ছ তাই তোমাকে নিয়ে যাবেন তিনি।’
বলেই সে তার পেছনে দাঁড়ানো হাইম হারজেলকে বলল, ‘তুমি বুমেদীন বিল্লাহকে এক্সিলেন্সির কাছে নিয়ে যাও। আমি আসছি।’
‘আপনি কোথায় যাচ্ছেন?’ বুমেদীন বিল্লাহ জিজ্ঞাসা করল বেগিনকে।
‘আমি তিন তলা থেকে আসছি। তুমি যাও।’ বলে সে সিঁড়ি ভেঙে উঠতে লাগল তিন তলার দিকে।
বুমেদীন বিল্লাহ হাইম হারজেলের পেছন পেছন চলন্ত সিঁড়ির দিকে চলল।
সিঁড়ির কাছাকাছি গিয়ে বুমেদীন বিল্লাহ থমকে দাঁড়াল। বলল হাইম হারজেলকে লক্ষ্য করে, ‘শুনুন, আমার একটু কাজ আছে। আমি আসছি।’
বাঘের মত ঘুরে দাঁড়াল হাইম হারজেল। তার হাতে রিভলবার। বলল, ‘মি. বিল্লাহ পেছন দিকে এক পা গেলে গুলী করব। নষ্ট করার মত এক সেকেন্ডও সময় নেই। আসুন।’
হাইম হারজেলের এই ব্যবহারে প্রথমে বিস্মিত হলেও বুমেদীন বিল্লাহ শীঘ্রই বুঝল যে সে কার্যত বন্দী এবং তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তাও সে বুঝল।
বুমেদীন বিল্লাহ সামনে পা বাড়াল। হাইম হারজেল ফিরে দাঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করল।
শক্ত হয়ে উঠেছে বুমেদীন বিল্লাহর মুখ। পকেট থেকে রিভলবার বের করে গুলী করল হাইম হারজেলকে। মনে মনে বলল, এক তলায় কি ঘটছে তা এরা লুকাচ্ছে। ধরা পড়া থেকে রক্ষার জন্যে নিজেদেরকে নিজেরাই হত্যা করছে কি? বেন্টো বেগিন কেন তিন তলায় গেল তাও সে বুঝেছে। জীবনঘাতি গ্যাস ছেড়ে সে হত্যা করতে গেছে বন্দীদের। অন্যদিকে আজর ওয়াইজম্যান নিশ্চয় পালাচ্ছে। বুমেদীন বিল্লাহকে কেন হেলিকপ্টারে তুলতে চায় তাও তার অজানা নয়।
মাথায় গুলী খেয়ে হাইম হারজেল সিঁড়ির গোড়ায় আছড়ে পড়েছে।
বুমেদীন বিল্লাহ ছুটল তিন তলায় বন্দীখানায় উঠার সিঁড়ির দিকে।
বুমেদীন বিল্লাহ যখন তিন তলায় উঠার সিঁড়ির কাছাকাছি, তখন সে দেখল বেন্টো বেগিন তিন তলার সিঁড়ি থেকে বেড়ালের মত নিশব্দে নেমে এগুচ্ছে তার আর্মস রুমের দিকে। তার কানে মোবাইল ধরা, কথা বলছে সে। রিভলবার বাগিয়ে বুমেদীন বিল্লাহ এগুলো তার পেছনে। শুনতে লাগল সে বেগিনের কথা, ‘এক্সিলেন্সি স্যরি, আমি তিন তলার গ্যাস ট্যাংকের কাছে যেতে না পেরে যাচ্ছি আর্মস ষ্টোরে, সেখানেও পটাসিয়াম সাইনায়েড গ্যাসের একটা ট্যাংক আছে। স্যার ওটার মুখটা খুলে দিয়েই আমি আসছি।’
একটু থেমে ওপারের কথা শুনেই বেগিন আবার বলে উঠল, ‘ওরা কিভাবে বন্দীদশা থেকে মুক্ত হলো, কিভাবে বন্দীখানা থেকে বেরিয়ে এল কিছুই বুঝে আসছে না এক্সিলেন্সি।’
আবার নিরবতা। ওপারের কথার উত্তরেই সে আবার বলে উঠল, ‘বুমেদীন বিল্লাহকে হাইম হারজেলের সাথে আপনার কাছে পাঠিয়েছি। বুঝতে পারছি না কেন এতক্ষণ পৌছল না? অবশ্য একটা গুলীর আওয়ার ওদিক থেকে পেয়েছি এক্সিলেন্সি।’
পুনরায় মুহূর্তের জন্যে একটু নিরব হয়েই আবার বলে উঠল, ‘আপনি ভাববেন না এক্সিলেন্সি, সাইনায়েড গ্যাসের প্রসারণ গতিটা প্রথম দুতিন মিনিট কম থাকলেও পরে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়ে থাকে। গোটা বিল্ডিং কভার করতে ১ মিনিটও লাগবে না। এ বিল্ডিং এর কোন মানুষ কোন পোকামাকড়ও বাঁচবে না এক্সিলেন্সি। আপনি নিশ্চিত থাকেন।’
মোবাইল তার নেমে এল কান থেকে। মোবাইল পকেটে রেখে আর্মস রুমের দরজার দিকে সে হাত বাড়াল। দরজায় ডিজিটাল লক। লকের ডিজিটাল বোর্ডের অংকগুলোর উপর দ্রুত তার তর্জনীর টোকা পড়তে লাগল।
পরবর্তী মুহূর্তেই তার হাতটা নেমে এল দরজার হাতলে।
লক খুলে দরজা এখন সে খুলছে। আতংকিত কম্পিত বুমেদীন বিল্লাহ আর সময় দিল না তাকে। তার তর্জনী চেপে ধরল তার রিভলবারের ট্রিগারে।
সেই একইভাবে মাথায় গুলী খেল বেন্টো বেগিন। দরজার উপরেই পড়ে গেল তার লাশ।
পাশেই সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শুনে চোখের পলকে রিভলবার ঘুরিয়ে নিল। কিন্তু ট্রিগার টেপার আগেই দেখল কামাল সুলাইমানরা কয়েক জন রিভলবার হাতে নেমে আসছে।
বুমেদীন বিল্লাহ কিছু বলার আগেই কামাল সুলাইমান বলে উঠল, ‘ধন্যবাদ মি. বিল্লাহ, এই বেগিন তিন তলায় গিয়েছিল। আমাদের টের পেয়েই ফিরে এসেছে। আমরা ঠিক করলাম সে যখন আমাদের টের পেয়েছে এখন এর পিছু নেয়া দরকার।’ কথাটুকু শেষ করেই আবার উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠল, ‘নিচে কি ঘটেছে? কিছু জানতে পারলেন?’
‘জানতে এসে প্রায় বন্দী হয়েছিলাম। আমাকে জোর করে একজন নিয়ে যাচ্ছিল তিন তলার ছাদে হেলিকপ্টারে তোলার জন্য আজর ওয়াইজম্যানের কাছে। আমি তাকে হত্যা করে এদিকে এসেই দেখতে পেলাম বেন্টো বেগিনকে। সে যাচ্ছিল আর্মস রুমে সাইনায়েড গ্যাসের ট্যাংক খুলে দিতে এ বিল্ডিং-এর সবাইকে সেকেন্ডের মধ্যে মেরে ফেলার জন্যে। আল্লাহ রক্ষা করেছেন’। বলল বুমেদীন বিল্লাহ।
কথা শেষ করে একটা দম নিয়েই আবার বলে উঠল বুমেদীন বিল্লাহ, ‘আজর ওয়াইজম্যানের কমব্যাট বাহিনীর ব্যারাক নিচ তলায়। ওদের সংখ্যা প্রায় পঞ্চাশের মত। আমি বুঝতে পারছি না ওদের কি হলো? উপরেও কেউ আসছে না।’
‘বুঝা যাচ্ছে দুপক্ষের মধ্যে গোলাগুলী হচ্ছে। আহমদ মুসারা এসে পৌছল কিনা! চলুন ওদিকে যাই।’ বলল কামাল সুলাইমান।
সম্বিত ফিরে পেল যেন বুমেদীন বিল্লাহ। উৎসাহের সাথে বলল, ‘ঠিক, হতে পারে। বোধ হয় এই কারণেই আজর ওয়াইজম্যান পালাচ্ছে। আর নিচে কি হচ্ছে এ ব্যাপারটা চেপে যাচ্ছে।’ এক তলার সিঁড়ির দিকে ছুটতে ছুটতেই কথাগুলো বুমেদীন বিল্লাহ বলল।
বুমেদীন বিল্লাহর সাথে ছুটছিল কামাল সুলাইমানরা সবাই।
‘সবাই শুয়ে পড়–ন, আজর ওয়াইজম্যানের সৈন্যরা ওরা………..।’ সিঁিড়র ল্যান্ডিং-এর উপরে শুয়ে পড়তে পড়তে চিৎকার করে উঠল বুমেদীন বিল্লাহ।
কামাল সুলাইমানরাও শুয়ে পড়েছিল ল্যান্ডিং ও পেছনের করিডোরে।
সিঁড়ি থেকে এক ঝাঁক গুলী এল উপর দিকে। গুলীগুলো বুমেদীনদের মাথার উপর দিয়ে গিয়ে পেছনের দেয়ালে আঘাত করতে লাগল।
বুমেদীন বিল্লাহ ও কামাল সুলাইমানরাও হাত বাড়িয়ে সিঁড়ি লক্ষ্যে গুলী চালাতে শুরু করেছে।
দুপক্ষই আন্দাজে গুলী করছে।
গুলী চলতেই থাকল।