৩৭. গুলাগ থেকে টুইনটাওয়ার

চ্যাপ্টার

সাও তোরাহ দ্বীপের আন্ডার গ্রাউন্ড জেলখানা।
জেলখানা বলা ঠিক নয়। আসলে বিশাল এক কনসেনট্রেশন ক্যাম্প এটা। WFA-এর নেতা আজর ওয়াইজম্যান শত নির্যাতনে নিষ্পিষ্ট বন্দীদের বিদ্রুপ করে বলে, ‘আল্লাহ নাকি তোমাদের জন্যে মহাসাড়ম্বরে মহাসুখের বেহেশ্ত সাজিয়ে রেখেছেন, সেখানে যাবার আগে দোজখের স্বাদটা নিয়ে যাও।’
আর বন্দীখানা বা কনসেনট্রেশন ক্যাম্পটা আন্ডার গ্রাউন্ড এই অর্থে যে, মাঝে মাঝে এ বন্দীখানা মাটির উপর থেকে আন্ডার গ্রাউন্ডে নেমে আসে। বন্দীখানাটার ছাদ জুড়ে বাগান। উপর থেকে দেখলে মনে হবে সুন্দর সবুজ পরিচ্ছন্ন একটা ভূমিখ-। যখন বন্দীখানাটা আন্ডার গ্রাউন্ডে চলে যায়, তখন তো কথাই নেই। কেউ উপর থেকে দেখে হাজার চেষ্টা করেও বলতে পারবে না যে, বাগানটা কৃত্রিম কিছু এবং এর নিচে এক বিশাল বন্দীখানা আছে। কেন এটা দুনিয়ার অদ্বিতীয় দোজখখানা তার পক্ষে আজর ওয়াইজম্যান যুক্তি দেন যে, আমরা এই দোজখখানার জন্যে যে টেকনলজি ব্যবহার করেছি, হিটলার তার কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের জন্যে তা কল্পনাও করেননি। আরেকটা পার্থক্যের কথা আজর ওয়াইজম্যান বলে থাকে। সেটা হলো, হিটলার ছিলেন স্বৈরাচারী, আর আমরা দুনিয়ায় গণতন্ত্র প্রমোট করছি।
একদল বন্দী বন্দীখানার ময়লা পরিষ্কার ও মাজা-ঘসা করছিল।
সপ্তাহে একদিন বন্দীখানা মাজা ঘসা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়।
সাও তোরাহ-এর বন্দীদের জন্যে সপ্তাহের এ দিনটি বহুল আকাঙ্খিত দিন। কাজ করতে গিয়ে সবার এদিন একত্র হবার সুযোগ হয়। হাতে পায়ে পরানো হয় নতুন শেকল। শেকল দেড়ফুট লম্বা হওয়ায় চলা-ফেরায় কিছুটা সুবিধা হয়। সবচেয়ে বড় কথা পায়ে পরানো কাঁটার জুতা খুলে নেয়া হয়ে থাকে, বন্দীদের জন্যে এই কাঁটার জুতা খুবই ভয়ংকর। জুতার সুখতলীতে বসানো থাকে অতিসূক্ষè কাঁটার সারি। এই কাঁটা অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক। এ জুতা পায়ে দিয়ে হাঁটা তো দূরের কথা দাঁড়ানোও যায় না। জুতা পায়ের সাথে লক করা থাকে বলে খোলাও যায় না। এ জুতা বন্দীদের উপর নির্যাতনের ক্ষেত্রে নতুন সংযোজন।
সত্যি বন্দিখানাকে আজর ওয়াইজম্যান দোজখে পরিণত করেছে। বন্দীদের কম্বল ও কাপড় আরামদায়ক না হলেও কষ্টদায়ক ছিল না শুরুর দিকে। কিন্তু এখন কম্বল ও কাপড়-চোপড় হয়ে দাঁড়িয়েছে আরেক ভীতির কারণ। ওগুলোতে ছারপোকা জাতীয় এক ধরনের পোকার বাসা। গায়ে দিলেই ওগুলো গায়ে চরে বেড়াতে শুরু করে এবং কামড়াতে থাকে। তাছাড়াও কম্বল ও কাপড়ত-চোপড় গায়ে দিলেই সর্বাঙ্গ চুলকাতে শুরু করে। ভীষণ জ্বালা-যন্ত্রণায় কম্বল ও পোশাক গায়ে রাখা খুবই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। আবার প্রচ- শীতের মধ্যে ওগুলো গা থেকে নামানোও যায় না। এক ভয়ংকর অবস্থার মধ্য দিয়ে বন্দীদের প্রতিটি মুহূর্ত অতিবাহিত হয়।
সুতরাং সাতদিনের এই একটা দিন তাদের জন্যে পরম আকাক্সক্ষার, যদিও এ দিন তাদের যে কাজটা করতে হয় তা ক্লিনার ও মেথরদের কাজ। ৬ দিনে বন্দীখানায় যে মল-মূত্র ও ময়লা জমে ৭ম দিনে তা পরিষ্কার করতে হয়। তবু পায়ে কাঁটার জুতা থাকে না এবং ভিন্ন ধরনের কাপড় পরা যায় বলে এই কাজটাই সবার কাছে পরম আরামদায়ক।
আজর ওয়াইজম্যানের মতে সপ্তাহের সপ্তম দিনকে কিছুটা আরামদায়ক করা হয়েছে ছয়দিনের কষ্টকে তীব্র করে তোলার জন্যে। কষ্ট অভ্যাসে পরিণত হলে কষ্ট কমে যায়। এটা যাতে না হয় এ জন্যেই আজর ওয়াইজম্যানের এই ব্যবস্থা।
একদল বন্দী একটু সুযোগ পেয়ে আলাপ করছিল। ইন্দোনেশিয়ার একজন বন্দী ভাঙা ইংরেজীতে জিজ্ঞেস করল তুরষ্কের একজন বন্দীকে, ‘মি. বায়ার গত সপ্তাহে আপনার কাছ থেকে ব্যাপারটা জানার পর থেকেই আমি ভাবছি। আমার মনে হচ্ছে কি জানেন, দুনিয়ার এ দোজখখানাটা মুসলমানদের প্রায়শ্চিত্ত করার শেষ মনজিল। মুক্তির সূর্যোদয় খুব সামনেই।’
‘কোন ব্যাপারটা মি. হাদি আমর?’ বলল জালাল বায়ার।
জালাল বায়ার তুরষ্কের একটা মুসলিম চ্যারিটি ফান্ডের প্রধান। তুরষ্ক ভিত্তিক এ ফান্ডটি গোটা দুনিয়ায় বিজ্ঞান বিষয়ক শিক্ষার উন্নয়নে কাজ করে। সেই সাথে অসহায় কিন্তু প্রতিভাবান এমন মুসলিম শিক্ষার্থীদের আর্থিক সহায়তা দান করে। আজর ওয়াইজম্যানের WFA এই ফান্ড ধ্বংসের এক অংশ হিসেবে জালাল বায়ারকে কিডন্যাপ করেছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো শিক্ষা-সহায়তার নামে তার ফান্ড ইসলামী রেঁনেসা তথা মুসলমানদের মধ্যে হিংসা উদ্দীপ্ত করার কাজ করছে।
আর ইন্দোনেশিয়ার হাদি আমর ‘লিভিং মস্ক মুভমেন্ট’ বা ‘মসজিদ আবাদ আন্দোলন’-এর নেতা। এ আন্দোলনের কাজ হলো, মসজিদ সংস্কার করা, মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের ব্যবস্থা করা এবং মসজিদকে এলাকার শান্তি-শৃঙ্খলার কেন্দ্রে পরিণত করা। আজর ওয়াইজম্যানের ওয়ার্ল্ড ফ্রিডম আর্মি (WFA)-এর কাছে এটা খুবই আপত্তিকর মনে হয়েছে। হাদী আমরকে কিডন্যাপ করা হয়েছে এই অভিযোগে যে, সে সাম্প্রদায়িকতাকে উদ্দীপ্ত করে সন্ত্রাসবাদকে সাহায্য করছে। তার কাছে এখন দাবী করা হচ্ছে তার জনশক্তির একটা পূর্ণ তালিকা।
‘কেন মনে নেই, আপনি বলেছিলেন দুনিয়ার এই দোজখখানায় আমাদের ইন্দোনেশিয়ার পিতৃস্থানীয় আহমদ সুকর্নের বংশধর মোহাম্মদ সুকর্নের সাথে রয়েছেন আপনাদের পিতা কামাল আতাতুর্কের উত্তর সুরী কামাল সুলাইমান, মিসরের বাদশাহ ফারুকের প্রত্যক্ষ বংশধর আবদুল্লাহ ফারুক, লিবিয়ার বাদশাহ ইদরিসের উত্তরসূরী আহমদ আল সেনুসি, তুরষ্কের শেষ খলিফা আবদুল হামিদের উত্তর-পুরুষ ওসমান আবদুল হামিদ, ইরানের রেজাশাহ পাহলবীর বংশধর মোহাম্মদ আলী রেজা এবং স্পেনের সোনালী ইতিহাসের নির্মাতা ওমাইয়া শাসকদের ধ্বংসাবশেষের সপ্তদশ পুরুষ আবদুল রহমান। দুনিয়ার এই দোজখখানায় এঁদের ঐতিহাসিক এই সম্মেলন কাকতালীয় বলা যাবে, কিন্তু আমার মনে হয়েছে এটা আল্লাহ তাআলারই এক পরিকল্পনা। এই সাত ব্যক্তি ঐতিহাসিক যে সাত ব্যক্তির উত্তরসূরী, সেই সাত ব্যক্তিকে আল্লাহ তাদের নিজ নিজ দেশে সব দ–মু-ের কর্তা বানিয়েছিলেন, কিন্তু তারা জাতি গঠনের পরিবর্তে জাতিকে বিজাতীয়দের হাতে তুলে দিয়েছেন। এই ঐতিহাসিক সাতের পাপেরই প্রায়শ্চিত্ত করতে এসেছেন আপনারা, বলা যায় সেই সাতজনই এখন দুনিয়ার এই দোজখখানায়।’ বলল হাদি আমর।
দুঃখের মধ্যেও হাসল জালাল বায়ার। বলল, ‘আপনি চমৎকার একটা ইকুয়েশন করেছেন। কিন্তু মুক্তির সূর্যোদয় আপনি কোথায় দেখতে পেলেন?’
‘ঠিক দেখতে পাইনি। কল্পনার দিগন্তে তৃতীয় নয়ন দিয়ে অবলোকন করছি। অনেক খবর এ জেলখানার বাতাসেও ভাসছে। তার একটি হলো, আহমদ মুসা আজোরস দ্বীপপুঞ্জে এসেছেন। আহমদ মুসা আল্লাহর এমন এক বান্দাহ যাকে সংগ্রাম এবং সাফল্য অনুসরণ করে থাকে।’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, আহমদ মুসার কথা আমিও শুনলাম। কয়েক মিনিট আগে আমাদের কামাল সুলাইমান ও ওসমান আবদুল হামিদ বলল যে, আহমদ মুসা তেরসিয়েরা দ্বীপে WFA-কে বিধ্বস্ত করে ‘হারতা’ দ্বীপে এসেছেন।’ বলল জালাল বায়ার।
‘সত্যি? কার কাছ থেকে তারা জানলেন?’ হাদি আমর আনন্দে চোখ উজ্জ্বল করে বলল।
‘ফ্রান্স থেকে সাংবাদিক বুমেদীন বিল্লাহকে ওরা ধরে এনেছে। তাঁর কাছ থেকেই এরা শুনেছেন।’ বলল জালাল বায়ার।
‘বুমেদীন বিল্লাহ? আলজেরিয়ার পিতৃস্থানীয় বেন বেল্লাহর কি কেউ?’ জিজ্ঞাসা হাদী আমর-এর।
‘শুনলাম, শুধু বেন বেল্লাহ নয়, আলজেরিয়ার দীর্ঘ দিনের শাসক হুয়ারী বুমেদীনের বংশের সাথেও তিনি সম্পর্কিত। তিনি যেমন বেন বেল্লাহর ‘গ্রেট গ্রেট গ্রান্ড সান’, তেমনি তিনি হুয়ারী বুমেদীনেরও গ্রেট গ্রেট গ্রান্ড-ডটারের স্বামী।’
স্থান-কাল-পাত্র ভুলে গিয়ে হাদী আমর হাততালি দিয়ে উঠল। বলল উচ্চ স্বরে, ‘তাহলে বংশীয় প্রায়শ্চিত্ত করার সংখ্যা আট-এ দাঁড়াল। আর বুমেদীন বিল্লাহ প্রায়শ্চিত্ত করবেন দুজনে………….’
কথা শেষ করতে পারল না হাদী আমর। পাশ থেকে উত্থিত বাঘের মত হিং¯্র গর্জনে তার কন্ঠ থেমে গেল। মুখ ফিরিয়ে দেখল, দুজন তাদের দিকে তেড়ে আসছে। কাঁধে তাদের ষ্টেনগান, হাতে পেরেক বিছানো ব্যাটন। এই ব্যাটন ষ্টেনগানের গুলীর চেয়ে ভয়াবহ। ষ্টেনগান নিমিষেই মানুষকে মেরে ফেলে, কিন্তু পেরেক বিছানো ব্যাটনের প্রহার মৃত্যুর চেয়েও ভীতিকর ও অসহনীয়। এই পেরেক বিছানো ব্যাটন WFA-এর নির্যাতন-অস্ত্রের তালিকায় আরেকটি নতুন সংযোজন।
হাদী আমররা চারজন দাঁড়িয়ে গল্প করছিল।
ব্যাটনধারী দুজন এসে চারজনকে এলোপাথাড়ী প্রহার শুরু করে দিল। জালাল বায়ার ও হাদী আমরকে সবচেয়ে নির্দয়ভাবে প্রহার করতে লাগল। শীঘ্রই রক্তের পিন্ডে পরিণত হলো দুটি দেহ। অন্য দুটি দেহও রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিল।
অন্যান্য বন্দীরা চারদিক থেকে সারিবদ্ধভাবে এগিয়ে আসছিল রক্তের পিন্ডে পরিণত হওয়া তাদের সাথীদের দিকে।
এমন ঘটনা বন্দীখানার সাধারণ ব্যাপার। সুযোগ পেলে একে অপরকে সেবা-শুশ্রুষা করে থাকে বন্দীরা।
ব্যাটনধারীরা তাদের রক্ত¯œাত ব্যাটন ফেলে দিয়ে হাতে নিয়েছিল ষ্টেনগান।
এ সময় চারদিকে একটা গম্ভীর কণ্ঠ ধ্বনিত হলো, ‘ধন্যবাদ ঈশ্বরের সন্তান প্রহরীরা। চারজন বন্দীকে কাজের সময় অকাজ করার শাস্তি হিসাবে যে রক্তের পোশাক পরিয়েছ সেজন্যে তোমাদের ধন্যবাদ। এখন বড় একটি সার্কেল দাও ওদের চারদিকে। কয়েকটা চেয়ার সাজিয়ে দাও রক্তের পোশাক পরা চারজনের সামনে।
বিখ্যাত নতুন মেহমান নিয়ে আমরা আসছি।
রক্তাপ্লুত হাদী আমরদের সামনে কয়েকটা চেয়ার উঠে এল।
তার সাথে উপর থেকে নেমে এল একটা সিঁড়ি। সিঁড়ি দিয়ে নেমে এল রাজপুরুষের সাজসজ্জা পরিহিত একজন দীর্ঘকায় মানুষ। সে এসে বসল সিংহাসনের মত একটা সুন্দর চেয়ারে।
তার পরেই নেমে এল সফেদ শ্মশ্রুওয়ালা স্বর্গীয় চেহারার একজন লোক। তাকে ধরে নামিয়ে নিয়ে এসেছিল আরেকজন। তাকে বসানো হলো সিংহাসনাকৃতি চেয়ারের সামনের একটা চেয়ারে। সে নেমে আসতেই বন্দীদের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হয়ে গিয়েছিল। কেউ কেউ উঠে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু একজন প্রহরী চিৎকার করে উঠল, ‘কেউ কথা বলবে না, কেউ নড়বে না। দ্বিতীয়বার আদেশ দেয়া হবে না।’
বন্দীরা সব চুপ করল। কিন্তু সকলের চোখে-মুখে বিস্ময় ও বেদনার ছাপ।
সফেদ শ্মশ্রুওয়ালা স্বর্গীয় চেহারার লোকটিই শেখুল ইসলাম আহমদ মুহাম্মাদ। ইনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক ‘আন্তর্জাতিক হিউম্যান ডেভলপমেন্ট এন্ড এইডস ফর অপ্রেসড’ (IHDAAFD)-এর প্রধান। তাকে কিডন্যাপ করে সাও তোরাহে আনা হয়েছে।
শেখুল ইসলাম বসার পর সিঁড়ি দিয়ে নেমে এল মাঝবয়সী কঠিন চেহারার একজন লোক। সে বসল শেখুল ইসলামের ডান পাশে মুখোমুখি।
সিঁড়ি দিয়ে প্রথম নেমে আসা সিংহাসনাকৃতির চেয়ারে বসা রাজসিক পোশাকের লোকটি আজর ওয়াইজম্যান। আর সর্বশেষ নেমে আসা কঠোর চেহারার লোকটি বেন্টো বেগিন। আজর ওয়াইজম্যানের নতুন অপারেশন চীফ।
সবাই এসে বসলে আজর ওয়াইজম্যান তার সিংহাসনে নড়ে-চড়ে সোজা হয়ে বসল। তাকাল রক্ত পিন্ডের মত পড়ে থাকা চারজনের দিকে।
ওদের গা থেকে তখনও রক্ত ঝরছে। কাতরাচ্ছে ওরা যন্ত্রণায়। ওদের একজন ‘পানি’ ‘পানি’ বলে বিলাপ করছে।
আজর ওয়াইজম্যানের দৃষ্টি তার প্রতিই নিবদ্ধ হলো। বলল, ‘ধৈর্য ধর হাদি আমর। দুনিয়ার পানি খেয়ে কি হবে, বেহেশতের শরাবন তহুরা তোমাদের জন্যে অপেক্ষা করছে।’
বলেই তাকাল একজন প্রহরীর দিকে। বলল, ‘যাও হাদী আমরকে এক গ্লাস পানি দেখিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে এস।’
থামল আজর ওয়াইজম্যান। হাসল একটু। তারপর চারদিকে বসা বন্দীদের দিকে একবার চোখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলল, ‘তোমরা বিস্মিত হয়েছ শেখুল ইসলামের মত বিখ্যাত একজন জনসেবক ও সকলের শ্রদ্ধাভাজন লোককে কেন আমরা দুনিয়ার এই দোজখে নিয়ে এলাম। কারণ একটাই সেটা হলো, যারা আমাদের বন্ধু নয়, তারাই আমাদের শত্রু। শেখুল ইসলাম সব মানুষের বন্ধু, কিন্তু আমাদের বন্ধু হতে রাজী হননি। তাই তিনি এখানে।’
একটু থেমেই আজর ওয়াইজম্যান তার চোখ শেখুল ইসলামের দিকে ঘুরিয়ে নিল।
শেখুল ইসলাম দেখছিল চারদিকের বন্দীদের। বন্দীদের অধিকাংশই বিখ্যাত লোক এবং শেখুল ইসলামের পরিচিত। প্রথমে তার বিস্ময়ের পালা। তাহলে নিখোঁজ বলে প্রচারিত সবাইকে এখানে এনে বন্দী রাখা হয়েছে! এ সবই WFA -এর কাজ! তার মন কেঁদে উঠল সকলের অবস্থা দেখে। বিশেষ করে হাদী আমরদের অবস্থা তাকে দিশেহারা করে তুলল। বিশেষ করে জালাল বায়ার ও হাদী আমর দুজনেই তার খুব প্রিয় ব্যক্তি।
‘জনাব শেখুল ইসলাম, আপনি সবই দেখলেন এবং দেখছেন, এখন বলুন আপনি আমাদের সহযোগিতা করতে রাজী কিনা।’ বলল আজর ওয়াইজম্যান শেখুল ইসলামকে লক্ষ্য করে।
‘নতুন কোন সহযোগিতার বিষয় হলে বলুন।’ শেখুল ইসলাম বলল নির্লিপ্ত ও নিরুত্তাপ কণ্ঠে।
‘আমাদের প্রয়োজনের কথা আবার বলছি। এক. আপনার ‘হিউম্যান ডেভলেপমেন্ট’ ও ‘এইড ফর অপ্রেসড’ প্রোগ্রামে যারা সাহায্য করে আসছে তাদের একটা পূর্ণ তালিকা আমরা চাই। দুই. স্পুটনিক তার ডকুমেন্টগুলো কোথায় লুকিয়ে রেখেছে, তারও সন্ধান আমাদের প্রয়োজন।’ শক্ত কিন্তু শান্ত কণ্ঠে বলল আজর ওয়াইজম্যান।
শেখুল ইসলাম তার চেয়ারে সোজা হয়ে বসল। বলল ধীর কণ্ঠে, ‘তালিকা আপনার প্রয়োজন নেই, সুতরাং তা আপনারা পাবেন না, এ কথা আগেই বলেছি। আর মি. কামাল সুলাইমানদের স্পুটনিক-এর ডকুমেন্ট সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। তারা আমার পরিচিত, মাঝে মাঝেই তাদের সাথে আমার কথা হয়েছে, কিন্তু ডকুমেন্ট নিয়ে কোন কথা কোন দিন হয়নি, এ কথাও আমি আপনাদের বলেছি।’
‘তালিকার প্রশ্নে পরে আসছি জনাব। ডকুমেন্টের ব্যাপারে আপনার কথা যদি শেষ হয়, তাহলে এ ডকুমেন্টের খবর কে জানবে জনাব। কামাল সুলাইমানরা নিশ্চয়?’ বলল আজর ওয়াইজম্যান।
‘তা অবশ্যই জানবে।’ শেখুল ইসলাম বলল।
‘তাহলে দয়া করে ওদের বলে দিন যেন ডকুমেন্টগুলো কোথায় তা আমাদের বলে দেয়।’ বলল আজর ওয়াইজম্যান।
‘স্পুটনিক ধ্বংস হবার সাথে সাথে ওদেরও অন্তর্ধান ঘটেছে। ওরাও কি তাহলে আপনার এখানে বন্দী?’ শেখুল ইসলাম বলল।
‘হ্যাঁ, ওরাও আমার এ দোজখখানার বিশেষ মেহমান। এখনি ওদের নিয়ে আসা হচ্ছে। তারা আপনাকে শ্রদ্ধা করে। আপনি ওদের রাজী করান।’ বলল আজর ওয়াইজম্যান।
আজর ওয়াইজম্যানের কথা শেষ হতেই তাদের এবং হাদী আমরদের মাঝখানে ছয় সাত বর্গফুটের একটা সেল টিউব উঠে এল। তার মধ্যে কামাল সুলাইমানসহ স্পুটনিকের ওরা ছয়জন দাঁড়িয়ে।
সেল টিউবটি মেঝের সমান্তরালে এসে স্থির হতেই সেলের চারদিকের প্রাচীর আবার নিচে ফিরে গেল। উন্মুক্ত মেঝের উপর দাঁড়ানো কামাল সুলাইমানরা ছয়জন।
ওদের ছয়জনেরই বিধ্বস্ত অবয়ব। ভেঙে পড়া স্বাস্থ্য। দূর্বল দেহ। কিন্তু চোখ-মুখে তাদের সুস্থতার অদ্ভুত দ্যুতি ও আত্মবিশ্বাসের অপরূপ আলো।
শায়খুল ইসলাম এক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল ওদের সাতজন অর্থাৎ কামাল সুলাইমান, আবদুল্লাহ আল ফারুক, আহমদ আল সেনুসি, ওসমান আবদুল হামিদ, মোহাম্মদ আলী রেজা, মোহাম্মদ সুকর্ণ, আবদুল রহমান উমাইয়া-এর দিকে। ওদের অবস্থা দেখে অন্তর কেঁদে উঠেছিল শেখুল ইসলামের। হতাশা ও দূর্বলতা এসে তাকে চেপে ধরেছিল চারদিক থেকে। কিন্তু ওদের চোখ-মুখের দিকে তাকিয়ে দূর্বলতা ও হতাশা মুহূর্তে বিদায় নিল তার। কান্নার বদলে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠল তার মন। যেন ওদের চোখ-মুখের দীপ্তিতে মূর্তিমান হয়ে উঠেছে দয়ালু আল্লাহর অশেষ দয়া।
আত্মবিশ্বাসের আলো ফিরে এল শেখুল ইসলামের চোখে-মুখেও।
আজর ওয়াইজম্যান শেখুল ইসলামকে বলল, ‘আপনি ওদের বোঝান। টুইনটাওয়ার ধ্বংসের অন্তরালের ঘটনা সম্পর্কে যে দলিলপত্র ওরা সংগ্রহ করেছে, তা আমাদের দিয়ে দিক।’
বিস্ময় ফুটে উঠল শেখুল ইসলামের চোখে-মুখে। বলল, ‘টুইনটাওয়ার ধ্বংসের অন্তরালের ঘটনা কি? সে ঘটনা সম্পর্কিত ডকুমেন্ট আপনি কেন চান?’ বলল শেখুল ইসলাম আজর ওয়াইজম্যানকে লক্ষ্য করে।
আজর ওয়াইজমানের দুচোখ জ্বলে উঠল। বলল, ‘আপনাকে এখানে আনা হয়েছে প্রশ্ন করার জন্যে নয়, প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্যে। আপনাকে যা বলেছি তাই করুন।’
আজর ওয়াইজম্যানের কথা শেষ না হতেই ওদের ৭ জনের একজন ওসমান আবদুল হামিদ বলে উঠল, ‘মুহতারাম, উনি জবাব দেবেন কি করে? ঐ ষড়যন্ত্রকারীরাই নিউইয়র্কের লিবার্টি ও ডেমোক্রাসি টাওয়ার ধ্বংস করে মুসলমানদের ঘাড়ে চাপিয়েছিল, এ কথাই আমরা মানে স্পুটনিক প্রমাণ করতে যাচ্ছিলাম। দলিল কিছু আমরা উদ্ধারও করেছি। এটাই আমাদের অপরাধ।’
বিস্ময়ে বিস্ফোরিত হয়ে উঠেছে শেখুল ইসলামের দুই চোখ। এই তথ্য তার কাছে খুবই নতুন। পত্র-পত্রিকায় এ ধরনের কিছু খবর প্রকাশিত হয়েছিল স্পুটনিক ধ্বংসের ফলো-আপ হিসাবে। কিন্তু সে বিষয়টাকে কেউই তেমন গুরুত্ব দেয়নি, কারণ টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পরও এ ধরনের আশংকা ও সম্ভাবনার কথা নানাভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। যা গুরুত্ব না পাওয়ায় আপনাতেই থেমে গিয়েছিল।
কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছিল শেখুল ইসলাম। মুখের মধ্যেই কথা তার থেমে গেল। দেখল সে, আজর ওয়াইজম্যানের ইংগিতে একজন প্রহরী পেরেক বিছানো একটা ব্যাটন হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে ওসমান আবদুল হামিদের উপর। মুহূর্তেই তার দেহ রক্তাপ্লুত হয়ে উঠল। পড়ে গেছে সে। শোয়া অবস্থায়ই তাকে পেটানো হচ্ছে। অবাক ব্যাপার। মুখে কোন অভিব্যক্তি নেই ওসমান আবদুল হামিদের। তার চোখ বন্ধ। জ্ঞান হারাল নাকি সে। আঁৎকে উঠল শেখুল ইসলাম। আজর ওয়াইজম্যানের দিকে তাকিয়ে অনেকটা অনুরোধের কণ্ঠে বলল, ‘এই বর্বরতা থামান মি. ওয়াইজম্যান।’
‘আপনি ওদের বলুন ডকুমেন্টগুলো কোথায় তা বলতে। সংগে সংগেই অপারেশন থেমে যাবে।’ বলল আজর ওয়াইজম্যান নির্লিপ্ত কণ্ঠে।
শেখুল ইসলাম কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছিল, তার আগেই কামাল সুলাইমান বলে উঠল, ‘মুহতারাম শেখুল ইসলাম, আপনি এই ষড়যন্ত্রকারী দুর্বৃত্তদের কোন সহযোগিতা করবেন না। আর আমরা মরে গেলেও ডকুমেন্টের কথা বলব না। আমরা যে কোন পরিণতির জন্যে প্রস্তুত। আল্লাহ ছাড়া এদের কোন কৃপা আমাদের কাম্য নয়। মুসলমানদের কৃপা করার কোন যোগ্যতাই এরা রাখে না।’
কামাল সুলাইমানের কথা শেষ না হতেই গর্জে উঠেছে আজর ওয়াইজম্যান। তার দুচোখে আগুন। গর্জে উঠেই সে ইংগিত করেছে আরেকজন প্রহরীকে। সংগে সংগেই সে প্রহরী পেরেক বিছানো সেই ব্যাটন হাতে ছুটল কামাল সুলাইমানের দিকে।
অন্ধেল মতই এলোপাথাড়ী ব্যাটন চার্জ শুরু করল কামাল সুলাইমানের উপর। প্রতিটি আঘাতেই কামাল সুলাইমানের দেহ থেকে রক্ত ঝরণাধারার মত ফিনকি দিয়ে বেরুতে লাগল।
কয়েখ মুহূর্তের মধ্যেই কামাল সুলাইমানের দেহ মাটিতে আছড়ে পড়ল। রক্তের লাল রংয়ে ঢাকা পড়ে গেল কামাল সুলাইমানের দেহ।
ওসমান আবদুল হামিদের মতই কামাল সুলাইমানের মুখ থেকে একটি শব্দও বেরুলো না। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে চোখ বন্ধ করে মাটিতে পড়ে আছে সে।
অসহনীয় এই দৃশ্য থেকে বাঁচার জন্যে চোখ বন্ধ করেছে শেখুল ইসলাম। বেদনায় মুখ তার নীল হয়ে গেছে।
শেখুল ইসলামকে লক্ষ্য করে আজর ওয়াইজম্যান কঠোর কণ্ঠে বলল, ‘চোখ বন্ধ রাখলে বাইরের ঘটনা বন্ধ থাকবে না শেখুল ইসলাম। চোখ খুলুন। ওদের বোঝান।’
চোখ খুলল শেখুল ইসলাম। বলল, ‘আমি ভয়ে চোখ বন্ধ করিনি মি. ওয়াইজম্যান। মানুষের এই বর্বরতা সত্যিই অসহনীয়। আর ওদের বোঝাবার কথা বলছেন। কেন ওরা বুঝবে, যদি সে বুঝটা জাতির স্বার্থের বিরুদ্ধে হয়। যারা ভয়কে জয় করতে পারে, হুমকি, নির্যাতন ইত্যাদিতে তাদের কিছুই হয় না। নিজ চোখেই তো তা দেখছেন।’
হাসল আজর ওয়াইজম্যান। বলল, ‘যারা নিজের উপর নির্যাতনকে হাসি মুখে সহ্য করতে পারে, তারাই আবার অনেক ক্ষেত্রে অন্যের উপর নির্যাতন সহ্য করতে পারে না, ভেঙে পড়ে।’
কথা শেষ করেই একজন প্রহরীর দিকে চেয়ে বলল, ‘তুমি শেখুল ইসলামকে ওদের কাছে নিয়ে যাও। রঙীন সাজে একেও সাজাও। দেখি ব্যাটারা মুখ খোলে কিনা।’
সঙ্গে সঙ্গে প্রহরীটি ছুটে এল শেখুল ইসলামের কাছে। প্রহরী তাকে ধরতে যাবে এসময় শেখুল ইসলাম বলল, ‘ধরে নিতে হবে না, আমি নিজেই যাচ্ছি যেখানে নিতে চাও।’
‘অত বড়াই করো না শেখুল ইসলাম, তুমি কোন দিন আঙুলের আঘাতও খাওনি, এই দোজখী ব্যাটন-চার্জ খেয়ে তুমি হাতির মত চিৎকার করবে। সে চিৎকার ওদের মুখ খুলতে বাধ্য করবে।’ বলল আজর ওয়াইজম্যান ঠান্ডা স্বরে।
‘তোমার কথা ঠিক ছিল আজর ওয়াইজম্যান কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত। এখন আর সে অবস্থা নেই। আমি শিক্ষা নিয়েছি এই ছেলেদের কাছ থেকে। সারা জীবনের বিদ্যা আমাকে যা শেখায়নি, তা আমি শিখেছি ছেলেদের দীপ্ত চেহারা দেখে এবং যে কোন কষ্ট জয় করার ধৈর্য্য দেখে। তুমি একবার পরীক্ষা করে দেখ আজর ওয়াইজম্যান।’ পাথরের মত শক্ত আর ঠান্ডা স্বরে কথাগুলো বলে শেখুল ইসলাম হাঁটতে শুরু করল।
এ সময় বেন্টো বেগিন উঠে এল তার আসন থেকে। বন্দীদের সারিতে বসা নতুন বন্দী সাংবাদিক বুমেদীন বিল্লাহর দিকে ইংগিত করে আজর ওয়াইজম্যানের কানে ফিসফিস করে বলল, ‘শেখুল ইসলাম আমাদের শেষ তুরুপের তাস। সবশেষের জন্যে তাকে রেখে সাংবাদিক বুমেদীন বিল্লাহকে টেষ্ট করতে পারি আমরা। সাংবাদিক বুমেদীন বিল্লাহ স্পুটনিক ধ্বংসের আগের ও পরের ঘটনার সাথে সব চেয়ে বেশি সংশ্লিষ্ট।’
কথা শুনে একটু ভাবল আজর ওয়াইজম্যান। তার চোখে-মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠল। বলল, ‘তুমি ঠিক বলেছ বেগিন। নিয়ে এস বুমেদীন বিল্লাহকে।’
বেন্টো বেগিন উঠে এগোল তার ডান পাশের বন্দীর সারির দিকে।
আজর ওয়াইজম্যান শেখুল ইসলামকে বলল, ‘আপনি ওখানেই ওদের কাছে বসুন। আপনার টার্মটা একটু পরে। সাংবাদিক বুমেদীন বিল্লাহ আমাদের দোজখখানার বাসিন্দা হিসেবে আপনার সিনিয়ার। তার দাবীটাই আগে।’
বেন্টো বেগিন নিয়ে এল সাংবাদিক বুমেদীন বিল্লাহকে। বুমেদীন বিল্লাহর চেহারায় গাম্ভীর্য। কিন্তু মুখে ভয়ের চিহ্ন নেই।
বুমেদীন বিল্লাহ আসতেই আজর ওয়াইজম্যান তাকে শেখুল ইসলামের রেখে যাওয়া চেয়ারে বসতে বলল।
বেন্টো বেগিন তার চেয়ারে বসেছে।
বুমেদীন বিল্লাহ সেই নির্দেশিত চেয়ারে গিয়ে বসল।
বুমেদীন বিল্লাহ বসতেই আজর ওয়াইজম্যান হালকা কণ্ঠে বলল, ‘তুমি তো সাংবাদিক, আমাদের কথা শুনলে। তোমার মতামত বলার মত কিছু আছে?’
‘অমিত বলশালী বাঘ শিকার ধরেও তাকে বাগে আনতে পারছে না, এটাই বুঝলাম আমি।’ বলল বুমেদীন বিল্লাহ।
‘চমৎকার, চমৎকার। তোমার উপমা একশ’ভাগ ঠিক। মনে হচ্ছে তুমি খুব বুদ্ধিমান ছেলে। যে সাহায্য আমরা চাচ্ছি, সে সাহায্য তুমি করতে পারবে।’
তৎক্ষণাৎ উত্তর দিল না বুমেদীন বিল্লাহ। মাথা নিচু করেছে সে। যেন সে গভীর ভাবনায় পড়েছে।
খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল আজর ওয়াইজম্যানের মুখ। সে নিশ্চিত বুঝল বুমেদীন বিল্লাহর কাছে মূল্যবান তথ্যটি আছে, না হলে সংগে সংগেই সে অস্বীকার করতো। বুমেদীন বিল্লাহর কথঅ বলতে দেরি দেখে উদগ্রীব কণ্ঠে আজর ওয়াইজম্যান বলে উঠল, ‘বুমেদীন বিল্লাহ আমাদের সাহায্য কর। আমরা সাহায্য চাই যে কোন মূল্যে।’
মুখ তুললো বুমেদীন বিল্লাহ। বলল গম্ভীর কণ্ঠে, ‘আমি আপনাদের সাহায্য করব। কিন্তু এই অমূল্য তথ্যের জন্যে আমি কি মূল্য পাব?’
শেখুল ইসলাম কথাগুলো শুনছিল। কামাল সুলাইমানসহ সবার কানেই কথাগুলো পৌছেছিল। বুমেদীন বিল্লাহর শেষ কথা কামাল সুলাইমানের কানে পৌছতেই নড়ে উঠল কামাল সুলাইমানের রক্তপিন্ড আকারের দেহ। অনেক কষ্টে মাথা তুলল সে। বলল সে বুমেদীন বিল্লাহকে লক্ষ্য করে, ‘মি. বিল্লাহ টাকার জন্যে জাতির এতবড় সর্বনাশ করবেন না। এদের আপনি চেনেন না। ডকুমেন্টগুলোর খবর ওদের দিলেও ওরা আপনাকে বাঁচতে দেবে না। কোন মুসলমানের প্রতিই তাদের আস্থা নেই।’
ক্লান্ত কণ্ঠ থামল কামাল সুলাইমানের।
কামাল সুলাইমান থামতেই আজর ওয়াইজম্যান বলে উঠল, ‘বিল্লাহ এ শয়তানদের কথা বিশ্বাস করবে না। এদের দুর্ভাগ্যের সাথে সব মুসলমানকে জড়াতে চাচ্ছে, তোমাকেও জড়াতে পারলে ওরা খুশি হয়। আমরা তোমার মত মানে কামাল আতাতুর্কের মত মুসলমানদের বন্ধু। এটা তুমি নিজেই দেখতে পাবে।’
আজর ওয়াইজম্যানের কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে বুমেদীন বিল্লাহ বলে উঠল কামাল সুলাইমানকে লক্ষ্য করে, ‘মি. সুলাইমান আমি কোন প্রকার সাম্প্রদায়িকতার মধ্যে নেই। আমাকে দোষ দেবেন না। আমি আপনা পূর্ব পুরুষ কামাল আতাতুর্কের অনুসারী। আমি মনে করি টুইনটাওয়ার ধ্বংসের বিশ বছর পর এ নিয়ে সাম্প্রদায়িক সংঘাত বাধাবার কোন যুক্তি নেই। সুতরাং ডকুমেন্টগুলো ওদের হাতে তুলে দিয়ে এ সংঘাত-সম্ভাবনার ইতি ঘটাতে চাই। এতে আপনাদেরও উপকার হবে, উপকার হবে আপনাদের পরিবারগুলোর। জানেন, আপনাদের পরিবার সার্বক্ষণিক উদ্বেগ নিয়ে কিভাবে পালিয়ে বেড়াচ্ছে? আমি ওদেরকেও বাঁচাতে চাই।’
থামল বুমেদীন বিল্লাহ।
‘আমাদের এবং আমাদের পরিবার নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না মি. বিল্লাহ। আজর ওয়াইজম্যান আপনার জন্যে কতটা করবেন জানি না, কিন্তু আমাদের জন্যে আল্লাহ আছেন। তাঁর উপর আমরা নিশ্চিত ভরসা করতে পারি। ইতিহাস বলে, অসাম্প্রদায়িক সেজে কেউই অতীতে লাভবান হয়নি, আপনিও হবেন না মি. বিল্লাহ।’
‘আমিও বলছি ইতিহাসও বলবে। সেটা দেখার জন্যে আজর ওয়াইজম্যান আপনাদের জীবিত রাখুন, এটা আমি চাইব।’ বলল বুমেদীন বিল্লাহ।
‘হ্যাঁ, বিল্লাহ। অন্তত তোমার ইতিহাস তারা দেখেই মরবে। এখন বল তুমি কি বিনিময় চাও। আমরা দ্রুত আগাতে চাই।’
বুমেদীন বিল্লাহ একটু ভাবল। তারপর বলল, ‘বিনিময় হিসাবে তিনটি শর্ত। এক. আমার মুক্তি, দুই. বৃটেন ও ফ্রান্সের দুটি কাগজে খবর ছাপতে হবে যে, আপনি আমাকে সাংবাদিক হিসেবে সাও তোরাহ দ্বীপের বোটানিক্যাল রিসার্চ পরিদর্শন ও রিপোর্ট করার জন্যে এই দ্বীপে নিয়ে এসেছেন, তিন. এক বিলিয়ন ডলার এক্সপ্রেস ব্যাংকে আমার একাউন্টে জমা দিতে হবে। শেষ দুটি কাজ আপনাদের তথ্য দেবার আগেই সম্পন্ন হতে হবে এবং ব্যাংকের ডিপোজিট শ্লীপ এবং নিউজসহ পত্রিকা আমাকে পেতে হবে।’
সংগে সংগেই উত্তর দিল না আজর ওয়াইজম্যান। ভাবল একটুক্ষণ। তারপর বলল, ‘কোন শর্তেই আমার কোন আপত্তি নেই। তবে নিউজ প্রকাশ করতে হবে কেন?’
‘ওটা আমার নিরাপত্তার গ্যারান্টি মি. আজর ওয়াইজম্যান। নিউজ প্রকাশিত হলে আমাকে হত্যা করা আপনার জন্যে কঠিন হবে। হত্যা করলেও আপনি শুধু নন, সাও তোরাহ দ্বীপও আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়াবে। ওটুকু গ্যারান্টি আমার জন্যে না থাকলে আমি নিঃশর্ত কোন ঝুঁকি নিতে পারি না।’ বলল বুমেদীন বিল্লাহ।
‘ঠিক আছে তোমার তিনটি শর্তই আমি মেনে নিলাম। কিন্তু আমার একটা শর্ত আছে। সেটা হলো, ‘ডকুমেন্ট আমাদের হাতে না আসা পর্যন্ত তোমাকে এখানেই থাকতে হবে।’ আজর ওয়াইজম্যান বলল।
‘এখানে এই জেলখানায় থাকব কি করে। প্রথম সুযোগেই তো ওরা আমাকে মেরে ফেলবে।’ বলল বুমেদীন বিল্লাহ চোখে-মুখে উদ্বেগ টেনে।
‘হ্যাঁ সেটা চিন্তার বিষয়। তোমাকে ওদের সাথে রাখা যাবে না। ঠিক আছে তুমি আমাদের লোকদের সাথে এ্যাডমিনিষ্ট্রেশন সেকশনে থাকবে।’ আজর ওয়াইজম্যান বলল।
বলেই আজর ওয়াইজম্যান উঠে দাঁড়ালো।
উঠে দাঁড়ালো বেন্টো বেগিনও।
‘বেগিন, বুমেদীন বিল্লাহকে তোমাদের সাথে নিয়ে এস। এখন থেকে সে তোমাদের সাথে থাকবে।’
বলে সিঁড়ির দিকে এগুলো আজর ওয়াইজম্যান।
আজর ওয়াইজম্যান উঠে যাবার পর বুমেদীন বিল্লাহকে নিয়ে সিঁড়িতে উঠতে উঠতে বলল একজন প্রহরীকে লক্ষ্য করে, বুমেদীন বিল্লাহর সেলে এখন থেকে থাকবে শেখুল ইসলাম।’
সিঁড়ি দিয়ে উঠার সময় বুমেদীন বিল্লাহ কামাল সুলায়মানদের দিকে চেয়ে বলল, ‘মি. সুলায়মান, ইতিহাস আমার শুরু হলো।’
‘আপনার ইতিহাস আপনি লিখবেন না, লিখবেন ঐতিহাসিকরা।’ বলল কামাল সুলায়মান ক্ষীণ কণ্ঠে।
‘যা ঘটে ঐতিহাসিকরা তাই লেখে। আমি ঘটাব, ইতিহাস তাই লিখবে।’ বুমেদীন বিল্লাহ বলল।
‘বিশ্বাসঘাতক বিশ্বাসঘাতক হিসাবে ঘটনা ঘটায় না। কিন্তু ইতিহাস তাকে বিশ্বাসঘাতক বলে।’ বলল কামাল সুলাইমান দুর্বল ও কাঁপা কণ্ঠে।
হাসল বুমেদীন বিল্লাহ। বলল, ‘সে ইতিহাস দেখা পর্যন্ত আপনারা বেঁচে থাকুন, আমি চাই।’
কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছিল কামাল সুলাইমান। কিন্তু বুমেদীন বিল্লাহ উপরে উঠে অদৃশ্য হয়ে গেছে। সিঁড়িও উঠে যাচ্ছে।

আহমদ মুসা ধীরে ধীরে গাড়ি চালিয়ে ৭১ বে ষ্ট্রিট-এর সামনে দিয়ে একবার দক্ষিণে চলে গেল।
‘ভাইয়া, ৭১ বে ষ্ট্রিট তো একটা বদ্বীপ।’ বলল হাসান তারিক।
‘হ্যাঁ, নিশ্চয় বাড়িটা ব-দ্বীপের কেন্দ্রস্থলে হবে। গাড়ি চালিয়ে যাওয়া যাবে না। প্রধান সড়ক থেকে ৭১ বে ষ্ট্রিট-এর গেট পেরিয়ে অনেকটা হাঁটতে হবে মনে হচ্ছে।’ আহমদ মুসা বলল।
কিছুটা এগিয়ে গাড়ি আবার ফেরাল আহমদ মুা। ৭১ বে ষ্ট্রিট-এর কাছাকাছি এসে গাড়িটা একটা ঝোপের আড়ালে রেখে দুজন হেঁটে হেঁটে ৭১ বে ষ্ট্রিট বাড়িটার দিকে এগুতে লাগল।
বে ষ্ট্রিটটা সাগরের ধার ঘেঁষে তৈরি। রাস্তার পরে সেফটি ফেঞ্চ বা নিরাপত্তা বেড়া। তার পরেই সাগর। তবে কোন কোন স্থানে ভূখন্ড মাথা বাড়িয়ে সাগরে ঢুকে গিয়ে বদ্বীপের আকার নিয়েছে। এসব স্থানে কিন্তু বাঁক না নিয়ে রাস্তা সোজা চলে গেছে। এই ধরনেরই স্থান হলো ৭১ বে ষ্ট্রিট।
তখন সন্ধ্যা পুরোপুরি নেমেছে। কিন্তু সাগর তীরের সন্ধ্যা আলো-আঁধারীর এক মিশ্রণ।
আলো-আঁধারীর বুক চিরে এগিয়ে যাচ্ছে আহমদ মুসা ও হাসান তারিক প্রশস্ত ফুটপাত ধরে।
চারদিকটা নিরব।
মাঝে মাঝে শিশ দিয়ে যাচ্ছে রাস্তার চলমান গাড়ি। কদাচিৎ দুএকজন লোক দেখা যাচ্ছে ফুটপাতে চলাচল করতে।
৭১ বে ষ্ট্রিট-এর দুপাশেই সাগর তীরের কিছু দূর পর্যন্ত ছোট-খাট গাছ-গাছড়া ও ঝোপ-ঝাড়। ঝোপ-ঝাড় মিশেছে গিয়ে ৭১ বে ষ্ট্রিট গেটের দুপ্রান্তে। নিশ্চয় এই ধরনের ঝোপ-ঝাড় কেটেই গেটটা তৈরি করা হয়েছে। গেট থেকে যে রাস্তা ব-দ্বীপের অভ্যন্তরে এগিয়ে গেছে তাও দুপাশের ঘন ঝোপ-ঝাড়ের মধ্য দিয়ে।
গোটা ব-দ্বীপটাই ঘন জঙ্গলের বর্মে ঢাকা।
৭১ বে ষ্ট্রিট এর গেট তখন দো যেতে শুরু করেছে।
ফুটপাতের প্রান্ত ঘেঁষে ঝোপ-ঝাড়ের ছায়া-ঘন অন্ধকারে নিজেদের আড়াল করে গেটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে আহমদ মুসা ও হাসান তারিক।
গেটের একেবারে পাশে এসে গেছে তারা।
গেটে দরজা আছে, কিন্তু খোলা।
হয়তো দরজা রাতে বন্ধ হয় কিছু সময়ের জন্য, কিংবা হয়ই না।
গেটের ভেতরের রাস্তাটা নির্জন।
রাস্তায় আলো আছে, কিন্তু যথেষ্ট নয়।
গেটের ভেতরের রাস্তাটা প্রাইভেট। আলোর ব্যবস্থা দূরে দূরে। সেই আলো রাস্তাকে যথেষ্ট আলোকিত করতে পারেনি।
আহমদ মুসা হাতঘড়ির দিকে তাকালো। রাত ৮টা বাজে। সূর্য অস্ত যাবার পর আধা ঘণ্টা পার হয়েছে। এই সময়টাকেই প্রকৃত সন্ধ্যা বলা হয় এই অঞ্চলে।
‘গেট খোলা, তার উপর গেটে ওদের লোক নেই কেন হাসান তারিক বলতে পারো?’ আহমদ মুসা বলল।
‘ভাইয়া কদিন এখানে থেকে বুঝেছি, এখানকার প্রাইভেট বাড়ির প্রাইভেট রোডগুলোর সংস্কৃতি এক ধরনের নয়। কোথাও গেট আছে, কোথাও গেট নেই। কোথাও প্রহরী থাকে, কোথাও থাকে না।’ বলল হাসান তারিক।
‘কিন্তু হাসান তারিক, ভালো করে দেখ। ওপাশে গেটের পাশেই ছোট একটা গার্ডরুম। গার্ডরুমের দরজা খোলা। ভেতরে এই অন্ধকারেও একটা ছোট কিছুর অস্তিত্ব দেখা যাচ্ছে। ওটা চেয়ারই হবে। যদি তাই হয়, তাহলে চেয়ারে মানুষ থাকে। কিন্তু এখন নেই। সে গেল কোথায়? বিশেষ করে আজ সন্ধ্যায় যখন ওদের বিশেষ অনুষ্ঠান।’
‘ঠিক, সার্বক্ষণিক লোকের তো গেট ফেলে কোথাও চলে যাওয়ার কথা নয়। তাই আমাদের কিছুটা অপেক্ষা করা উচিত। ব্যাপারটা আরও পরিষ্কার হবে।’
‘হ্যাঁ, হাসান তারিক, এটাই যুক্তিসংগত। তবে চল………।’
কথা শেষ করতে পারলো না আহমদ মুসা। একটা হাত এসে সাঁড়াশির মত তর গলা চেপে ধরল। আরেকটা হাত এসে চেপে বসল তার নাকে।
সংগে সংগেই আহমদ মুসা বুঝল তাকে ক্লোরোফরম করা হচ্ছে।
আহমদ মুসা সে মুহূর্তেই শ্বাস বন্ধ করে গোটা দেহের ভার নিচের দিকে ছুঁড়ে দিয়েই দুহাত জোরে সামনের দিকে ছুড়ে দিল। ফলে দেহের ভারে বাড়তি গতির সৃষ্টি হলো এবং আকস্মিক এই গতির শক্তিই আক্রমণকারীর দেহকে সামনে উল্টে দিল। তার হাত খসে পড়লো আহমদ মুসার নাক ও গলা থেকে।
লোকটি উল্টে গিয়ে পড়েছিল আহমদ মুসার সামনে। তার মাথা আহমদ মুসার একদম দুহাতের মধ্যে।
লোকটি পড়ে গিয়েই পাশ ফিরে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করছিল। আহমদ মুসা তার ডান হাতের একটি তীব্র কারাত চালাল তার কানের নিচের জায়গায়। তার দেহটা আবার পড়ে গেল মাটির উপর।
আহমদ মুসা তাকে উপুড় করে ফেলে তার দুহাতদ পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলল পকেট থেকে অ্যাডেসিভ টেপ বের করে।
তাকাল এবার আহমদ মুসা হাসান তারিকের দিকে। সে আক্রান্ত হবার আগেই বুঝতে পেরেছিল। দেখল, হাসান তারিক তার আক্রমণকারীকে ধরাশায়ী করে ফেলেছে। আহমদ মুসা তার দিকে তাকাতেই হাসান তারিক ফিস ফিস করে বলে উঠল, ‘এ একটু স্লো ছিল, আমার উপর এসে পড়ার আগেই টের পেয়ে যাই।’
‘হাসান তারিক, ওকে বেঁধে ফেল। চল একটু দূরে ওদের সরিয়ে নিয়ে যাই। এদের কাছ থেকে কিছু জানা যায় কিনা দেখতে হবে।’ বলল আহমদ মুসা।
ওদের টেনে নিয় গেল একদম সাগরের কিনারে। একটা পাথরের উপর ওদের আছড়ে ফেলে দিয়ে আহমদ মুসা বলল, ‘বল তোরা আমাদের উপর আক্রমণ করেছিস কেন?’ হাতের রিভলবারটা ওদের দিকে তাক করল আহমদ মুসা।
প্রবল ক্ষোভ ফুটে উঠেছে লোক দুটির চোখে-মুখে। কিন্তু কথা বলল না।
আহমদ মুসার রিভলবার নড়ে উঠল। প্রায় নিশব্দে একটা গুলী বেরিয়ে ওদের একজনের মাথার কিছু চুল ছিঁড়ে নিয়ে চলে গেল। বলে উঠল তার সাথে সাথেই আহমদ মুসা, ‘একটা সুযোগ দিলাম। দ্বিতীয় গুলীটায় এবার কিন্তু তোমার ডান কানটা উড়ে যাবে। মরার আগে তোমাকে অনেকবার মরতে হবে।’
আহমদ মুসার রিভলবারের নল নড়ে-চড়ে আবার স্থির হলো তার দিকে।
লোকটি মিট মিট করে চাইল। চোখ মুখ তার হঠাৎ শক্ত হয়ে উঠেছে। অকস্মাৎ তার মুখটি ডান দিকে নিচু হয়ে তার সার্টের একটা বোতাম কামড়ে ধরল।
আহমদ মুসা বুঝতে পেরেই হাত থেকের রিভলবারটি ফেলে দিয়ে লোকটির জামার কলার ধরে জোরে টান দিয়ে জামার বোতামটি লোকটির মুখ থেকে সরাতে চাইল কিন্তু পারল না। জামা তার মুখ থেকে সরে এল, কিন্তু বোতাম রয়ে গেল লোকটির মুখেই।
যখন আহমদ মুসা এদিকে ব্যস্ত, তখন হাসান তারিক দ্বিতীয় লোকটির জামা তার গা থেকে ছিঁড়ে খুলে ফেলেছে।
আহমদ মুসা তাকিয়েছিল প্রথম লোকটির লাশের দিকে। বিস্ময় তার চোখে-মুখে। এই হারতাতেই তার চোখের সামনে এ পর্যন্ত WFA-এর তিন জন লোক ধরা পড়ার চাইতে জীবন দেয়া বেশি পছন্দ করল! তার মানে নিজেদের আড়াল করাকে তারা তাদের জীবনের চেয়েও বেশি মূল্যবান মনে করে।
আহমদ মুসা লাশের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে তাকাল হাসান তারিকের দিকে। বলল, ‘ধন্যবাদ হাসান তারিক। তুমি একজনকে জীবন্ত হাতে রাখতে পেরেছো।’
বলেই আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়াল দ্বিতীয় লোকটির দিকে, লোকটি বলা যায় একজন নব যুবক। চোখে-মুখে একটা দুর্বিনীত ভাব। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে যা হয়। আহমদ মুসা তাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘তোমার সঙ্গী বিনা কারণেই নিজেকে শেষ করল।’
লোকটি কথা বলল না। শুধু একবার তাকাল আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসা আবার বলল, ‘তুমি কি ডেভিড ডেনিমের চাকুরী কর?’
লোকটি চমকে উঠে মুখ তুলল। বলল, ‘তুমি কি করে তাকে জান?’
‘আমরা তো তার কাছেই যাচ্ছিলাম।’ আহমদ মুসা বলল।
‘হ্যাঁ তোমাদেরই এ সময় আসার কথা।’ বলল লোকটি।
‘তুমি কি করে জান?’ আহমদ মুসার জিজ্ঞাসা।
‘তোমরাই সুলিভান ও কেলভিনদের খুনী।’ বলল লোকটি।
‘কে বলেছে, ডেভিড ডেনিম? তাহলে তুমি তো সবই জান। তুমি আমাদের সাহায্য করতে পারবে।’ শীতল কণ্ঠে বলল আহমদ মুসা।
‘আমি তোমাদের সাহায্য করব?’ বলল লোকটি। তার কণ্ঠে বিস্ময়।
আহমদ মুসা বলল, ‘হ্যাঁ, তুমি আমাদের সাহায্য করবে। সেটা হলো, আমরা ডেভিড ডেনিম-এর কাছ থেকে না ফেরা পর্যন্ত তুমি এখানে থাকবে এবং বেঁচে থাকবে। তোমাকে দিয়ে আমাদের অনেক কাজ আছে।’
হাসল লোকটিও। বলল, ‘তোমরা ডেভিড ডেনিম-এর কাছে যেতে পারার আশা করছ? আবার সেখান থেকে ফিরে আসার আশাও করছ?’
‘তিনি আসমানে থাকেন না। কোথায় থাকেন আমরা জানি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তোমরা আমাদের দুজনকে পরাভূত করে সব জয় করেছ মনে করো না। একবার চেষ্টা করে দেখ।’ লোকটি বলল।
আহমদ মুসা তাকাল হাসান তারিকের দিকে। বলল, ‘তুমি এর মুখটা ভালো করে টেপ দিয়ে আটকে দাও। তারপর পাটা বেঁধে ঐ গাছের কান্ডটার সাথে শক্ত করে বেঁধে রাখ।’
হাসান তারিক লোকটিকে নিয়ে একটু উত্তরে তীর ঘেঁষে দাঁড়ানো গাছটার দিকে এগুল।
লোকটি যাওয়ার জন্যে পা তুলে আবার ফিরে তাকিয়ে আহমদ মুসাকে বলল, ‘আবার রেখে যাওয়া কেন। আমাকেও মেরে ফেল।’
‘বললাম তো তুমি আমাদের অনেক কাজে লাগবে।’ বলল আহমদ মুসা।
তারপর হাসান তারিককে লক্ষ্য করে বলল, ‘তুমি ওকে বেঁধে সার্চ করে এস। ওকে সার্চ করে দেখা হয়নি। আমি ওকে দেখছি।’
বলেই আহমদ মুসা লাশটির পাশে বসে তাকে সার্চ করতে শুরু করল।
মাত্র কয়েক মুহূর্ত, এক মিনিটও পার হয়নি।
‘দাঁড়াও, না হলে গুলী করব।’ হাসান তারিকের এই চিৎকার শুনতে পেল আহমদ মুসা।
চমকে পেছন ফিরে দেখল, হাত বাঁধা লোকটি সাগরে ঝাঁপিয়ে পড়ছে, আর হাসান তারিক গুলী ছুড়ছে তার রিভলবার থেকে।
আহমদ মুসা দ্রুত উঠে দাঁড়াল।
দেখল হাসান তারিকও সাগরে ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছে।
‘হাসান তারিক দাঁড়াও।’ বলে চিৎকার করে উঠল আহমদ মুসা।
হাসান তারিক আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে থমকে দাঁড়াল।
আহমদ মুসা দৌড়ে গিয়ে পৌছল হাসান তারিকের কাছে।
‘কেন নিষেধ করলেন ভাইয়া। তার তো হাত বাঁধা আছে। সাঁতরাতে পারবে না। ধরা যাবে তাকে।’ দ্রুতকণ্ঠে বলল হাসান তারিক। তার চোখে-মুখে অনুমতি চাওয়ার ভাব।
আহমদ মুসা শান্ত কণ্ঠে বলল, ‘হয়তো তাকে ধরা যেত। কিন্তু এতে তোমার বিপদ বাড়ত। তুমি খেয়াল করনি, যে টেপ দিয়ে ওকে বাঁধা হয়েছিল তা ওয়াটার সলিউল। পানিতে পড়ার সাথে সাথেই ওটা গলে গেছে। দ্বিতীয়ত, খাড়া তীর দেখেই বোঝা যাচ্ছে এখানে সাগর গভীর। তৃতীয়ত, জোৎ¯œার আলো থাকলেও গাছ-গাছড়ার কারণে উপকূলটা অন্ধকার। তার উপর এলাকাটা ওর চেনা। সুতরাং ধরার চেষ্টা বৃথাই হতো।’
‘একটা সুযোগ আমরা হারালাম।’ হতাশ কণ্ঠে বলল হাসান তারিক।
ভাবছিল আহমদ মুসা সাগর এবং ডেভিড ডেনিমের বাড়ির দিকে তাকিয়ে। সেই ৭১ বে ষ্ট্রিট-এর ডেভিড ডেনিমের বাড়িটা একটু উত্তরে সাগরের মধ্যে ঢুকে যাওয়া এই উপদ্বীপাকৃতি ভূখন্ডের মাথার দিকেই নিশ্চয় হবে। আহমদ মুসা নিশ্চিত, লোকটি সাঁতরে ডেভিড ডেনিমের বাড়িতে গিয়েই উঠতে পারে।
হঠাৎ আহমদ মুসার মুখটি আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
আহমদ মুসা হাসান তারিকের কথার দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে বলল, ‘হাসান তারিক আমাদেরকেও সাগরে নামতে হবে।’
ভ্রু কুঞ্চিত হলো হাসান তারিকের। একটু ভাবল। বিস্ময় ফুটে উঠল হাসান তারিকের চোখে-মুখে। বলল, ‘সাগরের পথে ডেভিড ডেনিমের ওখানে যেতে চাচ্ছেন ভাইয়া?’
‘হ্যাঁ হাসান তারিক। এই পথে সংঘাতের সম্ভাবনা কম। অন্তত বিনা সংঘাতে আমরা ডেভিড ডেনিমের বাড়ি পর্যন্ত পৌছতে পারব।’ বলল আহমদ মুসা।
‘একটা বিষয় ভাইয়া, ওদের সতর্কতা ও আমাদের উপর আক্রমণ দেখে মনে হচ্ছে, আমরা আসব ওরা জানত। তাই সব দিক থেকেই আট-ঘাট বেঁধে রেখেছে ওরা।’ হাসান তারিক বলল।
‘তোমার কথা ঠিক হাসান তারিক। কিন্তু জানবে কি করে ওরা?’ বলল আহমদ মুসা।
‘হতে পারে সুলিভানের অন্তর্ধানের বিষয় তারা যেভাবে জানতে পেরেছে, সেভাবেই জানতে পারে।’ হাসান তারিক বলল।
‘তাতে প্রমাণ হয় না আমরা এখানে আসব। ওদের অনেক লোকই তো এভাবে মারা গেছে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ঠিক ভাইয়া। কিন্তু এ কথায় কোন সন্দেহ নেই যে, ওরা বড় কোন সন্দেহ করেছে।’
আহমদ মুসা কোন উত্তর না দিয়ে একটু ভেবে বলল, ‘তোমার ব্যাগটা ওয়াটার প্রুফ নয়, আমারটাও নয়। কোন ধরনের বোমাই নেয় যাচ্ছে না। ওগুলো ফেলে দিয়ে চল যাই। আমার বিশ্বাস ওগুলোর প্রয়োজনও হবে না।’
আহমদ মুসা ও হাসান তারিক দুজনেই ধীরে ধীরে পানির কিনারায় নেমে গিয়ে সাগরের পানিতে গা ভাসিয়ে দিল।
৭১ নং বে ষ্ট্রিট বাড়িটি সাগরে ঢুকে যাওয়া দ্বীপের একেবারে শেষ প্রান্তে গড়ে উঠেছে। দ্বীপের এই শেষ প্রান্তে হঠাৎ করেই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে ছোট ছোট পাহাড়ের টিলায় ভরা পাথরের দেয়াল। সেখান থেকে পাহাড় নেমে গেছে সাগরের পানিতে। উপকূল এখানে দুর্গম। পানির প্রান্ত রেখা থেকে পাথর ও টিলার ফাঁকে ফাঁকে গজিয়ে উঠেছে গাছ। ঢেকে দিয়েছে টিলাকে।
পাহাড়ের দেয়ালকে পেছনে রেখেই তৈরি হয়েছে ৭১ বে ষ্ট্রিট বাড়িটি।
সাগর থেকে সোজাসুজি তাকালে বড় বড় গাছ ও তার ফাঁকে পাথুরে টিলার দৃশ্য ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না। দুপাশ থেকেও ঘন জংগল বাড়িটাকে ঢেকে রেখেছে।
আহমদ মুসারাও মিনি উপদ্বীপটার নাক বরাবর সামনে এসে উপকূলে উঠে বসল। তারা উপরের দিকে তাকিয়ে আলো-আঁধারে ঘেরা জংগল ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেল না।
‘তাহলে দেখা যাচ্ছে ভাইয়া উপকূলের সাথে বাড়ির কোন সম্পর্ক নেই। আমার দক্ষিণ পাশেও দেখেছি ঘন জংগল। মনে হয় বাড়িটা উপকূল থেকে দূরে দ্বীপের মাঝ বরাবর হবে।’ বলল হাসান তারিক।
‘বাড়িটা উপকূল ঘেঁষে না হলেও পানি পর্যন্ত নামার কোন প্যাসেজ তারা রাখবে না, তা স্বাভাবিক নয়।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমরা কি খুঁজব সে প্যাসেজ?’ বলল হাসান তারিক।
‘তার প্রয়োজন নেই। সেটা খুঁজতে যে শ্রম এবং সময় যাবে, তা দিয়ে আমরা উপরে পৌছে যাব।’ আহমদ মুসা বলল।
প্রায় আধ ঘণ্টার প্রচেষ্টায় আহমদ মুসারা ৩০ ফুট উপরে পাহাড়ের এক গলি পথে উঠে এল। ঘুটঘুটে অন্ধকার। গাছ-পালার বাধা অতিক্রম করে চাঁদের আলো নিচে পর্যন্ত পৌছতে পারেনি। এর মধ্যেই পশ্চিমমূখী লক্ষ্য ঠিক রেখে এঁকে বেঁকে, কোথাও কোথাও পাহাড় টিলার ছোট ছোট বাধা ডিঙিয়ে তারা এগুতে লাগল।
পনের মিনিট চলার পর একটা টিলার দেয়াল ডিঙিয়ে একটা সমতলে এসে নামতেই তারা একটা বিরাট বাড়ির মুখোমুখি হলো।
বাড়িটা তিনতলা।
বাড়ির ধবধবে সাদা রঙের উপর চাঁদের আলো বাড়িটাকে চারদিকের নিরব পরিবেশে এক স্বপ্নপুরীতে পরিণত করেছে। বিদ্যুতের ঝাঁঝালো আলো ও ইট-পাথরের নগ্ন চেহারা দেখায় অভ্যস্ত আহমদ মুসারা যেন অভিভূত হয়ে পড়ল বাড়িটার দিকে তাকিয়ে।
বাড়িটা এখনও চল্লিশ পঞ্চাশ গজ দূরে। মাঝখানে ছোট ছোট গাছ-গাছড়া ও ঘাসের সবুজ চত্বর।
বাড়ির দুতলা ও তিনতলার কোন কোন জানালা দিয়ে আলোর রেশ বাইরে ছড়িয়ে আছে। গ্রাউন্ড ফ্লোরের গোটাটাই অন্ধকার। বোধ হয় কোন জানালা খোলা নেই, অথবা হতে পারে সবগুলো আলো নিভানো।
আহমদ মুসা চারদিকটা একবার দেখল। পেছনে পাহাড়ের দেয়াল। সামনে দাঁড়িয়ে আছে বাড়িটা, আর সামনের সবুজ চত্বরের উত্তর ও দক্ষিণ দুপাশেই ঘন গাছ-পালার সারি। গাছের সারির নিচটায় ঘুটঘুটে অন্ধকার।
‘চল আমাদেরকে চত্বরের পাশে গাছ-পালার অন্ধকারের কভার নিয়ে এগুতে হবে।’ হাসান তারিককে লক্ষ্য করে কথাগুলো বলে হাঁটতে লাগল আহমদ মুসা চত্বরের দক্ষিণ পাশ লক্ষ্যে।
হাসান তারিকও হাঁটতে লাগল পাশা-পাশি। দুজনেই শোল্ডার হোলষ্টার থেকে মেশিন রিভলবার বের করে হাতে নিয়েছে।
তারা দুজন হাঁটতে লাগল অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে বাড়ির দিকে।
বাড়ির কাছাকাছি পৌছে গেছে তারা।
এক জায়গায় এসে ডান পা মাটিতে ফেলেই আহমদ মুসার মনে হলো, মাটিটা নরম ও পিচ্ছিল।
থমকে দাঁড়াল আহমদ মুসা।
বাঁ হাত দিয়ে মাটি স্পর্শ করল। মাটি ভেজা। ‘হঠাৎ এখানে মাটি ভিজল কি করে?’ নিজেকেই প্রশ্ন করল আহমদ মুসা।
বসে পড়ল আহমদ মুসা। পরীক্ষা করে দেখল এক দেড় বর্গফুট জায়গা জুড়ে মাটি ভেজা।
‘কি ভাইয়া।’ হাসান তারিক ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞাসা করল আহমদ মুসাকে।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। বলল ‘বেশ একটু জায়গা জুড়ে মাটি ভেজা। এটা হতে পারে যে, পালানো লোকটি এখানে এসে তার কাপড় চিপেছে। যদি তাই হয়, তাহলে এখানেই কোথাও সাগরে নামার তাদের প্যাসেজ আছে।
‘খুঁজে দেখলে হয় না ভাইয়া?’ বলল হাসান তারিক।
‘বোধ হয় তার প্রয়োজন নেই। চল সামনে এগোই। সাবধান, ওরা কিন্তু সব জানতে পেরেছে।’ আহমদ মুসা বলল।
বিড়ালের মত নিশব্দ পা ফেলে এগুচ্ছে আহমদ মুসারা।
বাড়ির দক্ষিণ-পশ্চিম কোণায় পৌছে গেছে তারা। গাছের অন্ধকার থেকে বেরিয়ে একটু ডানে ঘুরে ছয় সাত গজ হাঁটলেই বাড়ির দেয়াল স্পর্শ করা যাবে।
এখান থেকে বাড়ির পুব ও দক্ষিণ পাশটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। দুপাশেরই দুতলা তিন তলার অনেকগুলো জানালা দিয়ে আলো দেখা যাচ্ছে।
বাড়ির এ পাশটা পেছন দিক। রাস্তার মুখোমুখি পশ্চিম দিকটা বাড়ির সম্মুখভাব তা নিশ্চিত।
বাড়ির ভেতরটাতেও একদম পিনপতন নিরবতা।
দাঁড়িয়ে পড়েছে আহমদ মুসা।
বাড়িটা কি ফ্যামিলী রেসিডেন্স, না অফিস! ফ্যামিলি রেসিডেন্স হলে এমন ভর সন্ধ্যায় বাড়ি এমন নিরব থাকবে তা স্বাভাবিক নয়।
হঠাৎ তার মনে পড়ল পালিয়ে আসা লোকটির মাধ্যমে নিশ্চয় ইতিমধ্যে সবকিছু জানাজানি হয়ে গেছে। তাই কি এই নিরবতা? ঝড় ওঠার কি পূর্বাভাস এটা?
আহমদ মুসার এই চিন্তা শেষ হবার আগেই তীব্র আলোর একটা ঢেউ এসে তাদের চারদিকটা ভাসিয়ে দিল।
আহমদ মুসা ও হাসান তারিক দুজনেই পশ্চিমমুখো হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তারা দেখল, তাদের সামনে চারগজের মধ্যে দাঁড়িয়ে উদ্যত ষ্টেনগান হাতে চারজন। তাদের একজনের হাতেই ফ্লাশ লাইট।
সেই চারজনের একজন কোন নির্দেশ দিতে যাচ্ছিল আহমদ মুসাদেরকে।
কিন্তু তার মুখ থেকে কথা বের হবার আগেই আহমদ মুসার দেহ ডান দিকে ছিটকে পড়ল। তার পা দুটি শূন্যে উঠল। আর শূন্য থেকে তার দেহ যখন মাটিতে পড়ছিল তখন তার হাতের এম-১০ গুলী করছিল সেই চারজন লক্ষ্যে।
চোখের পলকে ঘটে গেল ঘটনাটা। চারজন গুলী বৃষ্টির অসহায় শিকারে পরিণত হলো। চারজনেরই গুলীতে ঝাঁঝরা দেহ মাটিতে ঝরে পড়েছে। ফ্লাশ লাইটও পড়ে গেছে মাটিতে। এমনভাবে পড়েছে যাতে আলোর ফ্লাশ দক্ষিণ দিকে ঘুরে গেছে।
আহমদ মুসার সাথে সাথে হাসান তারিকও মাটিতে শুয়ে পড়েছিল শত্রু পক্ষের কোন আক্রমণ হলে তা থেকে বাঁচার জন্যে।
আহমদ মুসা ও হাসান তারিক মাটিতে শুয়ে একটুক্ষণ অপেক্ষা করল ওপক্ষের প্রতিক্রিয়া জানার জন্যে। ওদের চারজনের সবাই মারা গেছে কিনা, ওপক্ষের কোন আক্রমণ আসে কিনা! আহমদ মুসা ও হাসান তারিক দুজনেরই চোখ পশ্চিম দিকে অর্থাৎ ওরা যেখানে গুলী খেয়ে পড়ে গেছে সে দিকে নিবদ্ধ।
ওদিকে অনুসন্ধিৎসু চোখ রেখেই আহমদ মুসা ও হাসান তারিক উঠে বসল। দুজন পাশাপাশি।
আহমদ মুসা ফিস ফিস করে কিছু বলার সাথে সাথে উঠতে যাচ্ছিল। এ সময় আহমদ মুসা ও হাসান তারিক দুজনেই অনুভব করল তাদের পিঠে ভারী কিছু একটার স্পর্শ এবং শুনতে পেল পেছন থেকে শান্ত ও শক্ত একটি কণ্ঠ, ‘আমাদের সাথীদের যেভাবে হত্যা করলে আমরাও এখন তোমাদের সেভাবেই হত্যা করতে পারি। কিন্তু তা করব না যদি অস্ত্র রেখে হাত ওপরে তোল এ মুহূর্তেই।’
ইতিমধ্যে পেছন থেকে আক্রমণকারীদের একজন ফ্লাশ লাইটটি তুলে নিয়ে তার ফ্লাশটা এদিকে ফিরিয়ে দিয়েছে।
আলোতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে চারদিক আবার।
আহমদ মুসা ও হাসান তারিক দুজনেই হাত তুলেছে। ভারী বস্তুর স্পর্শটা এখনও তাদের পিঠে লেগেই আছে।
ভারী বস্তুর স্পর্শটা ষ্টেনগানের নলের এ কথা শুরুতেই বুঝে নিয়েছে আহমদ মুসা।
আলো জ্বলে উঠতেই পেছন থেকে একজন লোক এসে আহমদ মুসা ও হাসান তারিকের দুহাত পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলল।
পিঠে ঠেসে থাকা ষ্টেনগানের নল ধাক্কা মেরে আহমদ মুসাদের সামনের দিকে ঠেলে দিল। সেই সাথে পেছন থেকে আগের সেই কণ্ঠ বলে উঠল, ‘সামনে আগাও। পালাবার চেষ্টা করলে কুকুরের মত গুলী করে মারব।’
যে লোকটি হাত বেঁধেছিল, সেই লোকটি আগে আগে চলল। তার পেছনে চলতে লাগল আহমদ মুসা ও হাসান তারিক।
দুতলায় উঠে একটা হলঘরে প্রবেশ করল তারা।
পুরো কার্পেট মোড়া সোফায় সাজানো ঘর। ঘরের মাঝখানে বড় সোফায় বসে আছে একজন। দীর্ঘ দেহ, রাজসিক পোষাক।
আহমদ মুসারা দরজায় পৌছতেই লোকটি বসে থেকেই বলে উঠল আহমদ মুসাদের লক্ষ্য করে, ‘আমি ডেভিড ডেনিম। আপনাদের জন্যেই অপেক্ষা করছি। তবে আর একটু অপেক্ষা করতে হবে। ভিক্টর রাইয়া ও সোফিয়া সুসানকে আনার জন্যে লোক পাঠিয়েছি। ওদেরও সাহায্য চাই।’
কথাটা শেষ করে লোকটি চোখ ঘুরাল আহমদ মুসাদের পেছনের ষ্টেনগানধারীর দিকে। বলল, ‘ধন্যবাজদ জীম। পেছন থেকে তোমার আক্রমণ খুবই কার্যকরী হয়েছে। যাও ওদের পাশের ঘরে বন্ধ করে রাখ। ওরা এলে এদের নিয়ে আসবে।’
ষ্টেনগানধারী জীম লোকটি আহমদ মুসাদের হলঘর থেকে বের করে নিয়ে পাশের একটি ছোট ঘরে ঢুকিয়ে ঘর বন্ধ করে দিল।
ঘরটার দরজা বন্ধ হতেই অন্ধকারে ডুবে গেল ঘর। ঘরটাতে কোন আলো নেই।
‘এই ওয়েটিং রুমের ব্যবস্থা আল্লাহই আমাদের জন্য করেছেন হাসান তারিক।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কেন একথা বলছেন ভাইয়া?’ হাসান তারিক বলল।
‘মুক্তির পথ বের করার জন্যে একটা এক্সক্লুসিভ সময় পাওয়া গেল।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তা ঠিক। কিন্তু জানালাহীন এ বন্ধ ঘরে পথ কি আমরা পাব?’ হাসান তারিক বলল।
‘আমাদের কি দিয়ে বেঁধেছে দেখেছ?’ বলল আহমদ মুসা।
‘অটো প্লাষ্টিক কর্ড।’ হাসান তারিক বলল।
‘হ্যাঁ। এ কর্ডে গিরা দেয়া যায় না। বাঁধার পর দুই প্রান্ত মুড়ে দিলে প্লাষ্টিক কর্ডের গিরার চেয়ে শতগুণ শক্তিশালী হয়। কিন্তু মুড়ে দেয়া প্রান্ত খোলা খুব সহজ। শুধু উল্টোদিকে ঘুরিয়ে দিলেই হলো।’
হেসে উঠল হাসান তারিক। বলল, ‘বুঝেছি ভাইয়া। আপনারটা আমি, আর আমারটা আপনি।’

খুলে গেল দরজা।
খুলে যাওয়া দরজা দিয়ে প্রবেশ করল এক রাশ আলো।
পিছমোড়া করে বাঁধা অবস্থায় পাশাপাশি বসে ছিল আহমদ মুসা ও হাসান তারিক।
আলোর ফ্লাশ গিয়ে পড়েছে তাদের উপর।
জীম নামের লোকটা দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে। তার হাতে আগের মতই ষ্টেনগান। তার পেছনে আরও দুজন ষ্টেনগানধারী।
‘উঠে এস দুজন।’ বলল জীম নামের লোকটা।
উঠল আহমদ মুসা ও হাসান তারিক দুজনেই।
জীম আগে আগে চলল। পেছনে আহমদ মুসারা দুজন। তাদের পেছনে দুজন ষ্টেনগানধারী।
ঘরে ঢুকে আহমদ মুসা দেখল, ডেভিড ডেনিম বসে আছে তার সেই সোফায়। তার সামনে পাশাপাশি সোফায় বসে আছে ভিক্টর রাইয়া ও সোফিয়া সুসান। তাদের পেছনটা আহমদ মুসার দিকে। কিন্তু পেছনটা দেখেই আহমদ মুসা চিনতে পারল ওদের।
দরজার ভেতরে দুপাশে আরও দুজন ষ্টেনগানধারী দাঁড়িয়েছিল।
আহমদ মুসা ঘরে ঢুকতেই ডেভিড ডেনিম বলে উঠল জীমকে লক্ষ্য করে, ‘ওদের এদিকে নিয়ে এস।’ বলেই ইংগিত করল তার ডান পাশে ও সোফিয়া সুসানদের বাম পাশ অর্থাৎ দরজার সোজাসুজি জায়গাটার দিকে।
জীম আহমদ মুসা ও হাসান তারিককে নিয়ে এল সে জায়গাতেই।
ডেভিড ডেনিম-এর কথা শুনে সোফিয়া সুসান ও ভিক্টর রাইয়া তাকিয়েছিল পেছন দিকে। আহমদ মুসাকে দেখে তারা দুজনেই চমকে উঠল।
বিশেষ করে ছানা-বড়া হয়ে গেছে সোফিয়া সুসানের চোখ। পর মুহূর্তেই ভয় ও উদ্বেগে ফ্যাঁকাসে হয়ে উঠল সোফিয়া সুসানের মুখ।
আহমদ মুসা ও হাসান তারিককে এনে দাঁড় করানো হলো ডেভিড ডেনিমের ডানপাশ ও সোফিয়া সুসানদের বাম পাশের মধ্যবর্তী ফাঁকা জায়গাটায়।
আহমদ মুসার মুখোমুখি হবার জন্যে ডেভিড ডেনিম একটু ডানদিকে ঘুরে বসল। ভিক্টর রাইয়া ও সোফিয়া সুসানকেও বামদিকে ঘুরে তাকাতে হলো আহমদ মুসাদের দেখার জন্যে।
ষ্টেনগান বাগিয়ে জীম দাঁড়াল আহমদ মুসাদের বাম পাশে ডেভিড ডেনিমের কাছাকাছি জায়গায় আহমদ মুসার দিকে ষ্টেনগান তাক করে।
ঘরে আসা অবশিষ্ট চারজন ষ্টেনগানধারী দাঁড়াল দরজায় আহমদ মুসাদের দিকে চোখ রেখে।
আহমদ মুসা স্থির হয়ে দাঁড়াবার আগেই ডেভিড ডেনিম হো হো করে হেসে উঠল। বলল, ‘ভাবছ বোধ হয় তোমার জন্যে ফাঁদ পাতা হলো কি করে? আমরা জানলাম কি করে যে তুমি আসছ!’
থামল ডেভিড ডেনিম। হো হো করে হেসে উঠল আবার। বলল, ‘সুলিভানকে খুন করে তার পকেটে চিরকুট পেয়ে ধেয়ে আসছিলে আমাকে পরবর্তী শিকার বানাতে। কিন্তু জানতে না সুলিভানের কাছে যেমন চিরকুট ছিল, তেমনি ছিল একটা ট্রান্সমিটার চীফ যা খুঁজে পাওয়া তোমার সাধ্য ছিল না।’
‘আমরা সুলিভানকে জিন্দা চেয়েছিলাম। কিন্তু কেলভিনের মত সুলিভানও নিজেকে নিজেই হত্যা করেছে, এটা আপনি জানেন। সুলিভান হাতছাড়া হবার পরেই চিরকুট থেকে সন্ধান পাওয়ার পর আপনার সন্ধানে এসেছি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘সুলিভানকে কেন জিন্দা চেয়েছিলে? আমার সন্ধানে কেন?’ বলল ডেভিড ডেনিম।
‘এ প্রশ্নের উত্তর প্রশ্নকর্তার নিজেরই জানা আছে।’ আহমদ মুসা বলল।
আহমদ মুসার উত্তরের সঙ্গে সঙ্গে কথা বলল না ডেভিড ডেনিম। আগুন ঝরা তার দৃষ্টি তুলে ধরল সে আহমদ মুসার দিকে। বলল একটু সময় নিয়ে ধীরে ও শক্ত কণ্ঠে, ‘তুমি কে জানি না। অনেকেই তোমাকে আহমদ মুসা বলে। কিন্তু আমি তোমাকে অতবড় ভাবতে চাই না। তোমার প্রসংগে পরে আসব। আজ ডেকেছি ভিক্টর রাইয়া ও সোফিয়া সুসানকে। ওদের কেসটা সেটে করার জন্যে সুলিভানকে ডেকেছিলাম। সে নেই। কিন্তু তাই বলে ক্ষতি হয়নি কিছু। তার বদলে পেয়েছি তোমাদেরকে, মানে প্রধান আসামীকে। প্রধান আসামীর সামনে বিচার হবে কলাবরেটর আসামীদের।’
বলে ডেভিড ডেনিম তাকাল ভিক্টর রাইয়ার দিকে। বলল, ‘ভিক্টর রাইয়া আপনাদের কেন ডেকেছি জানেন?’
ভিক্টর রাইয়া কোন জবাব দিল না। প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে তাকাল শুধু।
‘ডেকেছি আপনাকে উপলব্ধি করাবার জন্যে যে আজর ওয়াইজম্যানের ‘ওয়ার্ল্ড ফ্রিডোম আর্মি’র বিরুদ্ধে যাওয়ার শাস্তি কত ভয়াবহ।’ বলল ডেভিড ডেনিম।
‘মি. ডেভিড আপনি আমার দেশে বসে এ দেশেরই একজন দায়িত্বশীল অফিসারকে হুমকি দিচ্ছেন।’ ভিক্টর রাইয়া।
হাসল ডেভিড ডেনিম। বলল, ‘দেশে জন্ম নিলেই দেশের মালিক হওয়া যায় না। দেশে যাদের শাসন চলে সেই হয় দেশের মালিক। তোমাদের সরকার পার্লামেন্ট ও প্রশাসন ইচ্ছা-অনিচ্ছায় আমাদের শাসনের অধীন। আমরা যা চাই, তাই এখানে হয়। গোলাম বেয়াদব ও বিদ্রোহী হলে তার কি পরিণাম হওয়া উচিত ভিক্টর রাইয়া?’
‘মি. ডেভিড, ভালো লোকদের শুভেচ্ছাকে, করুণাকে গোলামী বলে ভুল করছেন। দেশ কেউ বিক্রি করেনি আপনাদের কাছে।’ বলল ভিক্টর রাইয়া।
আবার হাসল ডেভিড ডেনিম। বলল, ‘ভিক্টর রাইয়া, শুভেচ্ছার বিনিময়ে করুণার বিনিময়ে কেউ বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার হস্তগত করে না, আবার কেউ বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার দিয়ে শুভেচ্ছা, করুণা কেনে না। যখন এ ধরনের বিনিময় হয়, তখন সেটা হয়ে থাকে ক্রয়-বিক্রয়। সুতরাং আপনারা বিক্রি হয়েছেন, আমরা কিনে নিয়েছি। ক্রীতদাসরা নিছক গোলামের চেয়েও নিকৃষ্ট কিছু।’
চুপসে গেল ভিক্টর রাইয়ার মুখ। কোন উত্তর সে দিল না।
সেই হাসি হাসল আবার ডেভিড ডেনিম। বলল, ‘ভিক্টর রাইয়া, পলা জোনসের বাড়ির হত্যাকান্ড, এ্যামানুয়েলের বাড়িতে সংঘটিত হত্যাকান্ড এবং গোয়েন্দা সদর দফতরের হত্যাকান্ড আপনার জ্ঞাতসারে হয়েছে। বিশেষ গোয়েন্দা সদর দফতরের হত্যাকান্ডে আপনি ও সোফিয়া সুসান শরীক ছিলেন। হত্যার বদলে হত্যার নির্দেশ এসেছে আমাদের কাছে।’
উদ্বেগ ফুটে উঠেছে ভিক্টর রাইয়ার চোখে-মুখে। এবারও কোন কথা বলল না ভিক্টর রাইয়া।
কথা বলল সোফিয়া সুসান। তার চোখ-মুখ লাল হয়ে উঠেছিল। প্রবল ক্রোধ ঠিকরে পড়েছিল তার চোখ-মুখ থেকে। বলল সে, ‘টাকায় বিক্রি হওয়া কয়েকজন লোক দেশের মালিক নয়। দেশের মালিক দেশের জনগণ। তারা কখনো আপনাদের গোলাম নয়, দেশও আপনাদের কেনা সম্পত্তি নয়। আর মি. ডেভিড, আপনাদের ক্রাইম আপনাদেরকে যে পরিণতির শিকার করেছে, তার দায় অন্যের ঘাড়ে চাপাবেন না।’ ভীষণ উত্তেজিত কণ্ঠ সোফিয়া সুসানের।
কথাগুলো বলে একটু থামল সোফিয়া সুসান। একটু দম নিয়েই সোফিয়া সুসান আবার বলে উঠল, ‘আব্বা উঠুন, আর এক মুহূর্ত নয় এখানে।’
উঠে দাঁড়াল সোফিয়া সুসান।
সোজা হয়ে বসল ডেভিড ডেনিম। বলল সোফিয়া সুসানকে লক্ষ্য করে, ‘এটা তোমার কমান্ডো হেডকোয়ার্টার নয়, এটা তোমার প্রভুর হেডকোয়ার্টার।’
বলে একটু থেমেই আবার বলা শুরু করল, ‘তোমার শরীর বোধ হয় একটু বেশি গরম। আমরা ঠান্ডা করতেও জানি। কথা শেষ করেই ডেভিড ডেনিম তাকাল দরজায় দাঁড়ানো একজন ষ্টেনগানধারীর দিকে। বলল, ‘ডগ, তুমি তো মেয়েদের সঙ্গ একটু বেশি পছন্দ কর। এস সুসানকে একটু ঠান্ডা করে দিয়ে যাও। তার পূজনীয় পিতাসহ সবাই দেখুক, তার দেহের গরম কিভাবে ঠান্ডা হয়।’
বলে ডেভিড ডেনিম তাকাল আহমদ মুসা ও ভিক্টর রাইয়ার দিকে। বলল, ‘ভাববেন না ওর একটুকুও লজ্জা আছে। ওকে আদর করে সবাই আমরা ডগ বলে ডাকি। এ ডগ কুস্তি লড়তো। এখন আমাদের বাহিনীতে।’
‘ডগ’ নামের লোকটা সোফিয়া সুসানের সামনে এসে দাঁড়াল। তার হাতের ষ্টেনগানটা সে কাঁধে ঝুলাল। তারপর দুহাত বাড়িয়ে সুসানকে ধরে দাঁড় করাতে গেল।
সঙ্গে সঙ্গেই স্প্রিং এর মত উঠে দাঁড়াল ভিক্টর রাইয়া। প্রচন্ড এক ঘুষি চালাল ‘ডগ’কে লক্ষ্য করে। ঘুষিটা তার চোখের নিচটাকে আহত করল। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এল সেখান থেকে।
ডগ এর নিচু হয়ে যাওয়া হাতটা ঘুরে এল ভিক্টর রাইয়ার দিকে। দুহাত তার জড়ো হলো। তারপর তা গিয়ে আঘাত করল ভিক্টর রাইয়ার কপালে। ভিক্টর রাইয়ার দেহটা টলে উঠে ঘুরপাক খেয়ে পড়ে গেল মেঝের উপর।
চোখের পলকে ঘুরে গেল ডগ এর দুহাত আবার সুসানের দিকে।
পড়ে গিয়ে টলতে টলতেই আবার উঠে দাঁড়াচ্ছিল ভিক্টর রাইয়া। বলছিল সে, ‘আমি বেঁচে থাকতে আমার মেয়ের গায়ে হাত দিতে পারবে না কুকুর।’
ঠিক সে সময়েই চোখের পলকে বেরিয়ে এল ডেভিড ডেনিম-এর হাত পকেট থেকে রিভলবার সমেত। রিভলবার থেকে একটা গুলী বেরিয়ে এল। তা গিয়ে আঘাত করল ভিক্টর রাইয়ার ডান হাতের কব্জীকে। বলে উঠল ডেভিড ডেনিম সেই সাথে, ‘এ কিছু নয় ভিক্টর রাইয়া, আমার ডগের গায়ে হাত তোলার ছোট্ট শাস্তি। একটু অপেক্ষা কর সুসানের পর তোমার পালা আসছে।’
ভিক্টর রাইয়া আর্তনাদ করে উঠে বাম হাত দিয়ে ডান হাতটা চেপে ধরে বসে পড়েছিল।
সোফিয়া সুসান ডগ-এর হাতকে পাশ কাটিয়ে চেষ্টা করল তার আহত পিতার দিকে ছুটে আসতে। কিন্তু ডগ তার বাঁ হাত দিয়ে খামচে ধরল সুসানের সার্টের কলার এবং একটা হ্যাচকা টান দিয়ে টেনে নিল নিজের দিকে। সার্টের বাম পাশটা ছিড়ে কাঁধের নিচে নেমে গেল।
সোফিয়া সুসানের বাঁম কাঁধটা আহত ছিল। ওখানে আঘাত পাওয়ায় ককিয়ে উঠল সে। কিন্তু কঁকিয়ে উঠলেও সে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েই তার ডান হাতের ঘুষি চালাল ডগ-এর বাম চোখের সেই আহত জায়গাতেই।
কমান্ডো সুসানের এ ঘুষিটা খুবই কার্যকর হয়েছিল। থমকে গিয়েছিল ডগ। সে দুহাতে চেপে ধরেছিল তার বাম চোখটা।
কিন্তু পরক্ষণেই দুহাত তার নেমে এল চোখ থেকে। তার রক্তাক্ত চেহারা ভয়ংকর হয়ে উঠল। কুস্তির প্রতিপক্ষের মতই সে ঝাঁপিয়ে পড়ল সুসানের উপর।
কমান্ডো সুসান চকিতে নিজেকে সরিয়ে নিল। ডগ উপুড় হয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল গিয়ে সোফার উপর।
সঙ্গে সঙ্গে সুসান তার ডান হাতের কনুইটাকে তীব্র বেগে ছুড়ে দিল ডগ-এর পিঠের ডান পাশটা লক্ষ্যে।
আঘাত করেই ডগ-এর ষ্টেনগানটা কেড়ে নিল।
কিন্তু ষ্টেনগান নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াবার আগেই ডেভিড ডেনিমের রিভলবারের গুলী গিয়ে বিদ্ধ করল সোফিয়া সুসানের ডান হাতকে।
তার হাত থেকে ষ্টেনগান পড়ে গেল।
‘জীম, তুমি ষ্টেনগানটা সরিয়ে নাও। ডগটা এখনি উঠবে। তার কাজটা শেষ করা পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করব।’ বলল ডেভিড ডেনিম জীমকে লক্ষ্য করে।
জীম তার ষ্টেনগান আহমদ মুসাদের দিকে তাক করে মূর্তির মত দাঁড়িয়েছিল। তার দৃষ্টি সে মুহূর্তের জন্যে আহমদ মুসাদের থেকে বিচ্ছিন্ন করেনি। ডেভিড ডেনিম-এর নির্দেশ পেয়ে সে নড়ে উঠল। মাথা ঘুরিয়ে সে তাকাল সুসানের কাছে পড়ে থাকা ষ্টেনগানের দিকে।
আহমদ মুসা এই সুযোগেরই অপেক্ষা করছিল।
পিছমোড়া করে বাঁধা আহমদ মুসার দুহাত নড়ে উঠল। তার হাতের খোলা বাঁধনটি খসে পড়ল হাত থেকে। চোখের পলকে আহমদ মুসার দুহাত ছুটে গেল জীমের ষ্টেনগানের দিকে। কেড়ে নিল ষ্টেনগান।
কেড়ে নিয়েই আহমদ মুসা ব্রাশ ফায়ার করল দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা তিনজনকে লক্ষ্য করে।
জীম ঘুরে দাঁড়িয়েছিল।
কিন্তু ততক্ষণে আহমদ মুসার ষ্টেনগানের ব্যারেল ঘুরে এসেছে জীমকে লক্ষ্য করে।
ওদিকে হাসান তারিক ঝাঁপিয়ে পড়েছে ডেভিড ডেনিমের উপর। সে তার রিভলবার তুলছিল আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে।
ডেভিড ডেনিম আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে ট্রিগার টিপতে যাচ্ছিল। হাসান তারিক তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ায় ডেভিড ডেনিমের হাতটি বেঁকে যায় এবং সেই সাথে ফায়ারও হয়ে যায়। বুলেটটি গিয়ে বিদ্ধ হয় ডেভিড ডেনিমের দুচোখের সন্ধিস্থলে। মাথাটা এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে যায়।
ওদিকে ডগ উঠে দাঁড়িয়ে তার ষ্টেনগান হাতে তুলে নিয়েছিল। তার ষ্টেনগানের ব্যারেল ঘুরছিল আহমদ মুসার দিকে। কিন্তু তার আগেই সে আহমদ মুসার তৃতীয় ব্রাস ফায়ারের শিকার হলো।
হঠাৎ উৎকর্ণ হয়ে উঠল আহমদ মুসা। বাইরে অনেকগুলো পায়ের শব্দ। এদিকেই ছুটে আসছে।
আহমদ মুসা নিজের জ্যাকেটটি খুলে সোফিয়া সুসানের দিকে ছুড়ে দিয়ে ছুটল দরজার দিকে। বলল, ‘হাসান তারিক তুমিও এস।’
আহমদ মুসা দরজায় পৌছার আগেই কয়েকজন দরজায় এসে গিয়েছিল। প্রত্যেকের হাতেই ষ্টেনগান।
দরজায় যারা এসে দাঁড়িয়েছিল তারা ভেতরের অবস্থা বুঝার জন্যে একটু সময় নিয়েছিল। এ সময়টুকুই ছিল আহমদ মুসার জন্যে বোনাস সময়। আহমদ মুসা দরজার দিকে এগুনো অবস্থাতেই তার ষ্টেনগানের ট্রিগার টিপে দরজার উপর দিয়ে ঘুরিয়ে নিল।
পাঁচজন ওরা এসে দাঁড়িয়েছিল দরজায়। দরজার উপরই স্তুপ হয়ে পড়ে গেল ওদের লাশ।
আহমদ মুসা ও হাসান তারিক দুজনেই গিয়ে দরজায় দাঁড়াল। দুজন দুদিকে উকি দিল।
আহমদ মুসা উকি দিয়েছে বাঁ দিকে। এদিকেই নিচে নামার সিঁড়ি।
আহমদ মুসা দেখল সিঁড়িমুখ থেকে একটু এদিকে দুজন দাঁড়িয়ে। দ্বিধাগ্রস্তভাবে ওরা এগিয়ে আসছিল। ওদের ষ্টেনগানের ব্যারেল কিছুটা নিচু।
আহমদ মুসা ওদের দেখেই বলে উঠল, ‘ষ্টেনগান হাত থেকে ফেলে দাও।’
ওরাও দেখে ফেলেছে আহমদ মুসাকে। সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে ওরা। ওদের ষ্টেনগান উঠে আসছে আহমদ মুসা লক্ষ্যে।
কিন্তু লক্ষ্য পর্যন্ত উঠে আসার সুযোগ পেল না ওদের ষ্টেনগান। তার আগেই আহমদ মুসার ষ্টেনগান থেকে ছুটে যাওয়া এক ঝাঁক গুলী দুই ষ্টেনগানধারীর দেহকে ঝাঁঝরা করে দিল।
হাসান তারিক আহমদ মুসার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল।
‘হাসান তারিক, তুমি দুপাশের ঘরগুলো দেখ, কোন কাগজ-পত্র পাওয়া যায় কিনা। আমি এদের সার্চ করে দেখি।’ বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা ঘরে প্রবেশ করল। দেখল, সোফিয়া নিজের ছেঁড়া জামাটা ছিড়ে ফেলে সেই টুকরো দিয়ে তার পিতা ভিক্টর রাইয়ার হাতে ব্যান্ডেজ বাঁধার চেষ্টা করছে। তার পিতা বাঁ হাত দিয়ে সহযোগিতা করছে। কিন্তু দুই বাম হাত মিলেও কাজটা ভালভাবে করতে পারছে না।
আহমদ মুসা দ্রুত গিয়ে বলল, ‘সুসান দাও মি. রাইয়ার ব্যান্ডেজটা আমি বেঁধে দেই।’
বলে সুসানের হাত থেকে কাপড় নিয়ে ভিক্টর রাইয়ার হাতে ব্যান্ডেজ বাঁধতে বাঁধতে বলল, ‘আল্লাহকে ধন্যবাদ মি. রাইয়া, বুলেটটা কব্জীর হাড়কে আঘাত করলেও তা পাশ কেটে গেছে। বড় রকমের ফ্রাকচার মনে হয় হয়নি।’
‘ঈশ্বরের আগে ধন্যবাদ আপনার প্রাপ্য আহমদ মুসা। আমরা কৃতজ্ঞ।’ বলল ভিক্টর রাইয়া আবেগ জড়িত কণ্ঠে।
আহমদ মুসা ভিক্টর রাইয়ার ব্যান্ডেজ শেষ করে সোফিয়া সুসানের দিকে এগুতে এগুতে বলল, ‘আমি যেটা করেছি, সেটা ঈশ্বরই করিয়েছেন। সুতরাং সব প্রশংসা তাঁরই প্রাপ্য মি. রাইয়া।’
আহমদ মুসা মেঝে থেকে সুসানের ছেঁড়া জামা তুলে নিয়ে একটু ছিঁড়ে নিয়ে বলল, ‘তোমার হাতটা দাও সুসান।’
আহমদ মুসার দেয়া জ্যাকেটটা পরতে পারেনি সুসান। বাঁম কাঁধটা আহত থাকায় বাঁ হাত নাড়ানো তার জন্যে কষ্টকর ছিল। ডান হাতটা গুলী বিদ্ধ হওয়ায় সেটাও কাজ করছিল না। তবুও বাম হাত দিয়ে কষ্ট করে জ্যাকেটটা সে ধরে রেখেছিল গায়ের উপর। ধীরে ধীরে সে তার ডান হাতটা আহমদ মুসার দিকে এগিয়ে দিল এবং বলল, ‘ঈশ্বর কিন্তু সবাইকে দিয়ে কাজ করান না।’
‘হ্যাঁ, ঠিক। আপনাকে দিয়ে আল্লাহ আজ মূল কাজটি করিয়ে নিয়েছেন এজন্যে আপনাকে ধন্যবাদ।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কিভাবে?’ বলল সোফিয়া সুসান।
‘আপনি’ ডগকে কাবু করে ও জীমকে আমাদের সার্বক্ষণিক পাহারা থেকে সরিয়ে এনে আমাদেরকে এ্যাকশনে আসার সুযোগ করে দিয়েছেন।’
হাসল সোফিয়া সুসান। বলল, ‘লড়াই-এর পথ দেখানো আর লড়াই করা এক জিনিস নয়। যাক। আমি বিস্মিত হয়েছি, আপনাদের বাঁধা হাত কখন কিভাবে খুলে গেল?’
‘পিছমোড়া করে বেঁধে দুজনকে যদি একই জায়গায় নিরিবিলি রাখা হয়, তাহলে তাদের বাঁধন খোলা সমস্যা হয় না। আমাদেরকে বেঁধে ওরা পাশের ঘরে রেখেছিল।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। আপনাদের বাঁধন খোলা না থাকলে, আপনারা সাহায্য করতে না পারলে সর্বনাশ রোধ করা যেত না। মরতেও হতো আমাদের দুজনকেই। আব্বা ঠিকই বলেছেন। সত্যিই আমরা কৃতজ্ঞ।’ বলল সোফিয়া সুসান।
আহমদ মুসা ততক্ষণে সোফিয়া সুসানের ব্যান্ডেজ বাঁধা শেষ করে ফেলেছে।
সুসানের কথার উত্তরে কোন কথা না বলে আহমদ মুসা লাশগুলোর পকেট সার্চ শুরু করে দিল। জীম থেকেই সে প্রথম কাজ শুরু করল।
হাতে ব্যান্ডেজ বাঁধার পর সোফিয়া সুসান আহমদ মুসার জ্যাকেটটা কষ্ট করে হলেও পরতে পারল। জ্যাকেট পরে নিয়ে সোফিয়া সুসান বলল, ‘সার্চে আমিও আপনাদের সাহায্য করতে পারি।’
বলে সোফিয়া সুসান সার্চের জন্যে ডেভিড ডেনিমের দিকে এগুলো।
‘আসলে আপনি কি চাচ্ছেন আহমদ মুসা?’ প্রশ্ন করল ভিক্টর রাইয়া আহমদ মুসাকে।
‘সাও তোরাহ দ্বীপ সম্পর্কে জানতে চাই, জানতে চাই সাও তোরাহ দ্বীপে ওদের যাতায়াতের মাধ্যম মিনিসাব-এর গতিবিধি সম্পর্কে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘মিনি সাব এর গতিবিধি দিয়ে কি করবেন। সাও তোরাহ যাবার জন্যে কি মিনিসাব ব্যাবহার করতে চান?’ জিজ্ঞাসা ভিক্টর রাইয়ার।
‘ঠিক তাই।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কেন, যে কোনভাবেই তো সাও তোরাহ যাওয়া যায়।’ সোফিয়া সুসান বলল।
‘যাওয়া যায়, কিন্তু তাতে মিশন সফল হওয়ার সম্ভাবনা কম। আকাশ পথ কিংবা সী-সারফেস দুপথের যে দিক দিয়েই যাওয়া হোক ওদের চোখে ধরা পড়তে হবে। তাতে তারা বন্দীদেরকে নিয়ে পালাবার সুযোগ পাবে মিনি-সাব এ করে। অথবা বন্দীদের হত্যা করে তারা আমাদের মিশনটাকেই ব্যর্থ করে দিতে পারে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘বুঝেছি।’ বলল সোফিয়া সুসান। তারপর তাকাল তার পিতা ভিক্টর রাইয়ার দিকে। বলল, ‘তাহলে আব্বা তুমিই একটা ব্যবস্থা কর না ‘মিনি-সাবে’র। সেটাতে চড়ে ওঁরা যাবেন।’
‘মিনি-সাব বা সাবমেরিন আমাদের গোয়েন্দা বিভাগের নেই। নৌবাহিনীর আছে। কিন্তু সেসব ডিফেন্স কমান্ডোর অধীন।’ বলল ভিক্টর রাইয়া।
‘হ্যাঁ, আমরা কমান্ডো ইউনিটও মিনি-সাব ব্যবহার করি। কিন্তু এ মিনি-সাবগুলোর যাতায়াত কেন্দ্রীয়ভাবে মনিটর করা হয়। নিশ্চয় সাও তোরাহ দ্বীপে এ্যালাও করবে না। তবে সাও তোরাহের জন্যে বিশেষ প্রোগ্রাম তৈরী করা যায় আজ এদের যে ভয়াবহ রূপ দেখলাম তার ভিত্তিতে।’ সোফিয়া সুসান বলল।
‘না সুসান, এভাবে প্রোগ্রাম তৈরী করলেও তা কোন কাজ দেবে না। কারণ এ খবর ফাঁস হয়ে যাবে এবং সাও তোরাহ সাবধান হয়ে যাবে। দ্বিতীয়ত আমি শুনেছি, সাও তোরাহ দ্বীপের আকাশ থেকে তোলা গোয়েন্দা ফটোতে সাও তোরাহ দ্বীপে কোন ডেক বা কোন জেটি খুঁজে পাওয়া যায়নি। এমনকি মানুষের বসবাসযোগ্য কোন স্থাপনাও নয়। এই অবস্থায় তোমাদের মিনি সাব ওখানে পৌছলেও লাভ হবে না। ওদের ঘাঁটি খুঁজে পাওয়া যাবে না।’ বলল আহমদ মুসা।
সার্চ করা ফেলে সোফিয়া সুসান সোজা হয়ে দাঁড়াল। তাকাল সে আহমদ মুসার দিকে। তার চোখে বিস্ময় বিমুগ্ধ দৃষ্টি।
কিছু বলার জন্যে সে মুখ হা করেছিল। কিন্তু তার আগেই তার পিতা ভিক্টর রাইয়া বলে উঠল, ‘ঠিক বলেছেন। এমন গোয়েন্দা ছবি আমিও দেখেছি। আপনার কথা ঠিক।’
ভিক্টর রাইয়া থামতেই সোফিয়া সুসান বলে উঠল, ‘আপনি এত কিছু চিন্তা করছেন? এত দুরদৃষ্টি আপনার? আপনি তথ্য ফাঁস হওয়ার কথা বললেন। কিন্তু সিদ্ধান্ত হবে কমান্ডো অপারেশন কমান্ড থেকে। সেখান থেকে তথ্য ফাঁস হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই।’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘তোমার কথাই হয়তো ঠিক। কিন্তু একটু আগে ডেভিড ডেনিমের কাছ থেকে জেনেছ ওরা টাকা দিয়ে সবকিছুই কিনে থাকে। এটা সত্য হলে এদের কেনার হাত কোন পর্যন্ত পৌছেছে কিনা কি করে জানবে? সুতরাং সন্দেহ থেকেই যায়।’
মুখ ম্লান হয়ে গেল সোফিয়া সুসানের। ছোট্ট করে বলল, ‘স্যরি মি. আহমদ মুসা। আমাদের জাতির দুর্ভাগ্য যে, তাদের শ্রেষ্ঠ সন্তানরাও বিক্রি হয়।’
বলে আবার সার্চ করায় মনোযোগ দিল সোফিয়া সুসান।
‘এটা আপনার জাতির একার দুর্ভাগ্য নয়। পৃথিবীর বহুদেশের বহুজাতির অসংখ্য শ্রেষ্ঠ সন্তান ইহুদীবাদীদের টাকার কাছে বিক্রি হয়েছে অথবা ওদের ষড়যন্ত্রের ফাঁদে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছে। শতাধিক বছর ধরে জর্জ ওয়াশিংটন আব্রাহাম লিংকন-টমাস জেফারসনের দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ওদের কুটবুদ্ধির দ্বারা ডোমিনেটেড হয়েছে, ওদের স্বার্থের বাহন সেজে শান্তির নামে অশান্তির ধ্বজা উড়িয়েছে দুনিয়ায়। সবে সে দেশটি মুক্তি লাভ করেছে ওদের অক্টোপাশ থেকে। অনেক দেশ এখনও মুক্তি পায়নি। তোমাদের আজোরস তারই একটু ক্ষুদ্র দৃষ্টান্ত।’ বলল আহমদ মুসা।
আবার সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে সোফিয়া সুসান। তাকাল আহমদ মুসার দিকে। আবেগে তার চোখ-মুখ ভারী হয়ে উঠেছে। বলল, ‘মার্কিনীদের এই মুক্তির একটা নিমিত্ত আপনিও ছিলেন। আমরা এবং আমাদের জাতীয় মর্যাদা কোথায় পৌঁছেছে তার কিছুটা তো আজ জানলেন। আপনি কি আমাদের আজোরসকে সাহায্য করবেন।’ আবেগে রুদ্ধ হয়ে গেল সোফিয়া সুসানের কণ্ঠ। দুচোখে তার টলটল করতে লাগল অশ্রু।
ম্লান হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘এ সুযোগ যদি আমার ভাগ্যে ঘটে, আমি আনন্দিত হবো সুসান।’
সোফিয়া সুসান সামনে মাথা ঝুঁকিয়ে কোমর বাঁকিয়ে বাও করল আহমদ মুসাকে। তার দুচোখ থেকে নেমে এল দুফোটা অশ্রু।
চোখ মুছে আবার সার্চের কাজ শুরু করল সোফিয়া সুসান।
আহমদ মুসা ও সোফিয়া সুসান মোট ১৪টি মৃতদেহ সার্চ করল। কিন্তু আশ্চর্য কারও পকেটেই কিছু পেল না। একেবারে শূন্য পকেটগুলো। পকেটে তাদের মানিব্যাগ আছে, কিন্তু তাতে টাকা ছাড়া আর কিছুই নেই।
এ সময় ফিরে এল হাসান তারিকও। বলল, ‘দুতলার সবগুলো কক্ষই বেড রুম। এই হলঘরের পাশে একটা অফিসরুম রয়েছে, সেখানে টেবিল, চেয়ার ও একটি কম্পিউটার। কম্পিউটারটিও শূন্য।’
‘ঠিক ওদের পকেটের মত।’ বলল আহমদ মুসা।
বলেই একটু ভাবল আহমদ মুসা। তারপর আবার বলে উঠল, ‘আমার মনে হচ্ছে মি. ভিক্টর রাইয়া ও সোফিয়া সুসানের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার পর তারা তাদের সব ডকুমেন্ট সরিয়েছে, কম্পিউটারও খালি করেছে।’
‘কেন?’ বলল ভিক্টর রাইয়া।
‘আপনাদের হত্যার পর প্রশাসনের অন্তত একটা অংশ থেকে রিটালিয়েশন হতে পারে, এ ভয়েই তারা তাদের পরিচয়ের সব রকম চিহ্ন গোপন করে ফেলেছে।’
‘ঠিক বলেছেন মি. আহমদ মুসা। এটাই এর একমাত্র ব্যাখ্যা।’ বলল ভিক্টর রাইয়া।
ভিক্টর রাইয়া দাঁড়িয়েছিল ডেভিড ডেনিমের লাশের পাশে।
তাকাল আহমদ মুসা ভিক্টর রাইয়ার দিকে কিছু বলার জন্যে।
ভিক্টর রাইয়ার দিকে তাকাতে গিয়েই আহমদ মুসার নজর পড়ল ডেভিড ডেনিমের গলায় থাকা একটা চকচকে জিনিসের উপর। পাশেই দাঁড়িয়েছিল সোফিয়া সুসান। আহমদ মুসা সোফিয়া সুসানকে জিজ্ঞেস করল, ‘মি. ডেভিডের গলায় চকচকে ওটা কি?’
‘সোনার একটা ক্রস।’ বলল সোফিয়া সুসান।
‘ইহুদী ডেভিডের গলায় খ্রীষ্টের ক্রস!’
বলে আহমদ মুসা দ্রুত এগিয়ে একটু ঝুঁকে পড়ে সোনার ক্রসটা সোনার চেন থেকে ছিঁড়ে নিল। ধরল চোখের সামনে। বলল স্বগত কণ্ঠে, মোটা-সোটা এতবড় ক্রস তো কারও গলায় কখনও দেখিনি। আর একজন কট্টর ইহুদীবাদী ক্রস পরবে এটাও অবিশ্বাস্য ঘটনা।
বলে উল্টে-পাল্টে দেখতে লাগল আহমদ মুসা ক্রসটিকে।
হঠাৎ ভ্রুকুচকে গেল আহমদ মুসার। সে দেখল ক্রসের দুপাশেই লম্বা-লম্বি জোড়া লাগানোর মত সোজা সরল রেখা।
আহমদ মুসা ক্রসটা দুহাতে ধরে জোড়ার মত লাইনের দুপাশে দুহাতের দুআঙুলের নখ সেট করে দুদিকে টান দিল।
সংগে সংগে দুভাগ হয়ে গেল ক্রসটি। ভেতর থেকে বেরিয়ে এল দুটি ফাইবার চীপ। চীপ দুটি হাতে তুলে নিল আহমদ মুসা। বিস্ময় তার চোখে-মুখে।
চোখ বুলাল চীপস দুটির উপর। দেখল দুটিতেই কয়েকটি ইংরেজী বর্ণ ও কয়েকটি করে ইংরেজী অংক খোদাই করা। পড়ল আহমদ মুসা। প্রথমটিতে লেখা ‘FAMS 00654123’ এবং দ্বিতীয়টিতে খোদাই করা হয়েছে ‘FAST 00456321’
সবাই দেখছিল আহমদ মুসাকে। সবার চোখে-মুখে বিস্ময়। ক্রসও কোন কিছু লুকানোর আধার হতে পারে তাহলে!
‘ওগুলো মনে হচ্ছে ফাইবার চীপস। ওগুলোতে কিছু লেখা আছে?’ বলল সোফিয়া সুসান।
আহমদ মুসা কোন কথা না বলে চীপস দুটি তুলে দিল সুসানের হাতে।
ওরা একে একে সবাই দেখল চীপস দুটিকে। সর্বশেষে হাতে পেল ভিক্টর রাইয়া।
ভিক্টর চীপস দুটিতে চোখ বুলিয়েই বলে উঠল, ‘চীপস দুটি গুরুত্বপূর্ণ কোড নাম্বার বহন করছে।’
‘জি সেটা পরিষ্কার। কিন্তু কোড নাম্বার কিসের হতে পারে?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘চীপসের কোডে ৮টি ডিজিট থেকে ধরে নেয়া যেতে পারে ওগুলো কোন লককে আনলক করার কোড নাম্বার। সে লক কম্পিউটারেরও হতে পারে। কিন্তু বর্ণমালাগুলো দ্বারা কি বুঝাচ্ছে তা জানতে পারলে রহস্যের সমাধান সহজ হতো।’ বলল ভিক্টর রাইয়া।
গভীর চিন্তায় ডুবে গিয়েছিল আহমদ মুসা।
সে চীপস দুটি ভিক্টর রাইয়ার হাত থেকে নিয়ে আবার নজর বুলাতে লাগল। উল্টে-পাল্টে দেখতে লাগল ভালো করে। এক জায়গায় গিয়ে তার চোখ আটকে গেল। দেখল, প্রথম চীপসের শেষ ডান প্রান্তে সোনালী রংয়ের চীপসে সোনালী রংয়ের একটা এ্যারো আরও ডান দিককে মানে বাইরের দিককে ইংগিত করছে। এর বিপরীত দৃশ্য দ্বিতীয় চীপসটিতে। সেটার বাম প্রান্তে একটি এ্যারো। এ্যারোর মাথা ভেতর দিকে, মানে কোডকে ইংগিত করছে।
আহমদ মুসা দেখাল এ্যারোটি সকলকে। বলল, ‘দুচীপসের দুকোডের মধ্যে সম্পর্ক রয়েছে। যে চীপসের এ্যারো বাইরের দিককে ইংগিত করছে, সেটা প্রথম ব্যবহার করতে হবে এবং যে চীপসের এ্যারো ভেতরমুখি হয়ে কোডকে ইংগিত করছে সেটা দ্বিতীয়, একে প্রথমটার পরে ব্যবহার করতে হবে।’
হাসি ফুটে উঠল ভিক্টর রাইয়ার মুখে। বলল, ‘আপনার রহস্যভেদী জ্ঞান অতুলনীয়। এখন বাকি থাকল বর্ণমালাগুলোর অর্থ উদ্ধার।’
হঠাৎ আহমদ মুসার চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে সে স্বাভাবিক হয়ে গেল। তারপর চীপসগুলো ক্রসে পুরে পকেটে রাখতে রাখতে বলল, ‘রহস্য উদ্ধার যখন শুরু হয়েছে, তখন শেষও শীঘ্রই হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।’
কথা শেষকরে একটু থেমেই আবার বলে উঠল, ‘না এখানে আর দেরি নয়। আপনারা আহত। চলুন আমরা যাই। যাবার সময় নিচের ফ্লোরটা একটু দেখে যেতে হবে।
বলেই তাকাল হাসান তারিকের দিকে। বলল, ‘তুমি আগে চলবে সাবধানে, দেখে-শুনে। শত্রু লুকিয়ে থাকতে পারে সুযোগের অপেক্ষায়। আর পেছন দিকটা দেখার দায়িত্ব আমার।’
নির্দেশের সাথে সাথেই ষ্টেনগান হাতে নিয়ে হাঁটতে শুরু করল হাসান তারিক।
ভিক্টর রাইয়া ও সোফিয়া সুসানও হাঁটতে শুরু করেছে।
আহমদ মুসা হাঁটতে শুরু করেই আবার থমকে দাঁড়াল। বলল, ‘দাঁড়াও হাসান তারিক।’
দাঁড়িয়ে পড়ল সবাই।
‘হাসান তারিক, ডেভিড ডেনিমের মৃতদেহ রেখে যাওয়া যাবে না। তুলে নিয়ে সাগরে ডুবিয়ে রাখতে হবে, অথবা অন্য কোথাও লুকাতে হবে যাতে তার মৃতদেহ কেউ না পায়।’
‘কেন? এর কি প্রয়োজন? সবার মৃতদেহই তো থাকছে।’ আহমদ মুসা কথা শেষ করতেই বলে উঠল সোফিয়া সুসান।
‘তার লাশ এখানে থাকলে আজর ওয়াইজম্যান অবশ্যই জেনে যাবে যে, ডেভিড ডেনিমের গলায় ক্রসটা নেই, তখন সে অবশ্যই সন্দেহ করতে পারে যে, দুটি কোড নাম্বার শত্রুর হাতে পড়ে গেছে। তার ফলে এই কোড দিয়ে আর কোন লাভ হবে না।’ বলল আহমদ মুসা।
সোফিয়া সুসানের বিমুগ্ধ দৃষ্টি আহমদ মুসার উপর। বলল, ‘কিন্তু একথাও তো মনে করতে পারে টাকার লোভেই কেউ ক্রসটা নিয়ে গেছে।’
‘টাকার লোভ থাকলে এতগুলো মানিব্যাগ তারা নেয়নি কেন? তাছাড়া আজর ওয়াইজম্যান জানে যারা এই লড়াই করেছে, তারা টাকার জন্যে লালায়িত নয়।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ধন্যবাদ।’ বলল সোফিয়া সুসান। অসীম মুগ্ধতায় আলোকিত সোফিয়া সুসানের গোটা চেহারা।
‘আমারও ধন্যবাদ গ্রহণ করুন আহমদ মুসা। আপনাকে যতই দেখছি, ততই অভিভূত হয়ে পড়ছি।’ ভিক্টর রাইয়া বলল।
ভিক্টর রাইয়া যখন কথাগুলো বলছিল, তখন এদিকে কান না দিয়ে আহমদ মুসা এগিয়ে গিয়ে ডেভিড ডেনিমের লাশ কাঁধে তুলে নিচ্ছিল।
ছুটে এল হাসান তারিক।
‘আপনি জানেন ভাইয়া, এ ধরনের ভার বইতে আমার খুব ভাল লাগে।’ বলে আহমদ মুসার হাত থেকে ডেভিড ডেনিমের লাশ ছিনিয়ে নিয়ে তা নিজের কাঁধে তুলে নিল।
সোফিয়া সুসান তার আহত হাত দিয়েই একটা ষ্টেনগান তুলে নিল এবং গুলীর ম্যাগাজিনটা পরীক্ষা করল। তারপর বলল আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে, ‘এবার মি. হাসান তারিকের দায়িত্ব আমি পালন করব।’
বলে সামনে এগিয়ে সবার সামনে সে হাঁটতে লাগল।
‘ধন্যবাদ সুসান। তুমি সত্যিই একজন কমান্ডো।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ভুলে যাচ্ছেন বোধ হয় যে, আপনি আহমদ মুসা। সাধারণ কারও জন্যে আপনার মুখ থেকে এতবড় প্রশংসা মানায় না।’
‘এটা প্রশংসা নয়, সত্যের স্বীকৃতি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আপনার এই কথা এবং সবকিছু আমার কাছে স্বপ্ন মনে হচ্ছে। ভয় হচ্ছে স্বপ্ন না আবার ভেঙে যায়।’ আবেগে গলাটা কাঁপল সুসানের।
বলেই দ্রুত চলতে শুরু করেছে সুসান।
সবাই চলতে শুরু করল।
আহমদ মুসাও।

Top