৩৭. গুলাগ থেকে টুইনটাওয়ার

চ্যাপ্টার

আজর ওয়াইজম্যানের পলায়নরত লোকদের ধাওয়া করে দুতলায় উঠার সিঁড়ির গোড়ায় পৌছতেই শুনতে পেল সিঁড়িতে গোলাগুলীর শব্দ।
আহমদ মুসা থমকে দাঁড়াল। তার হাতে ষ্টেনগান। সে সোফিয়া সুসান ও পলা জোনসকে দাঁড় করাল হাতের ইশারায়। বলল, ‘সিঁড়িতে দুপক্ষের মধ্যে গুলী হচ্ছে। বুঝা যাচ্ছে একপক্ষ আজর ওয়াইজম্যানের লোকরা কিন্তু অন্যপক্ষে কারা গুলী গুলী ছুড়ছে?’
বিস্মিত হলো আহমদ মুসা।
এটা একটা নতুন পরিস্থিতি।
এ পর্যন্ত সময়টা তাদের ভালই গেছে।
আহমদ মুসাদের কোনই অসুবিধা হয়নি সাও তোরাহ দ্বীপের মিনি-সাবের ল্যান্ডিং পোর্ট খুঁজে পেতে।
সাও তোরাহর পশ্চিম প্রান্তের সেই জংগল ঢাকা খাড়ি দিয়ে যখন মিনি-সাব প্রবেশ করছিল, তখন আহমদ মুসা এ্যারনকে লক্ষ্য করে বলেছিল, ‘ধন্যবাদ এ্যারন, সত্যিই এই খাড়িটা খুঁজে পেতে কয়েক ঘণ্টা নয় কয়েক দিন হয়তো লেগে যেত। তোমাকে মোবারকবাদ।’
এ্যারন আহমদ মুসাদের একজন হয়ে গিয়েছিল। সাও তোরার সাগরে মিনি-সাব আসার পর এ্যারন বলেছিল আহমদ মুসাকে, শুধু আপনাদের সাহায্য নয় আহমদ মুসা, আপনার ধর্মও আমি গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আপনারা আমার চোখ খুলে দিয়েছেন। মনে হচ্ছে, এই প্রথম আমি প্রকৃত মানুষ দেখলাম, যারা মানুষকে ভালোবাসে এবং নীতিবোধকে সবার উর্ধে স্থান দেয়।
মিনি-সাব রাত দেড়টায় ল্যান্ড করেছিল পোর্টে। মিনি-সাবের কনট্রোল রুম অপারেট করছিল এ্যারন। তার পাশে হাসান তারিক ও আহমদ মুসা।
পোর্টে ল্যান্ড করার পর মিনি-সাবের গ্যাংওয়ে গিয়ে সেট হয়েছিল পোর্টেল প্রবেশ-দরজায়। বলে উঠেছিল এ্যারন, ‘মি. আহমদ মুসা সান্তাসিমায় দরজা খুলেছিলেন ভেতর থেকে, কিন্তু এখানে খুলতে হবে বাইরে থেকে। মনে করুন আমি নেই, এখন কি করবেন দেখতে চাই।’
আহমদ মুসা বলেছিল, ‘সেটা দরজার ডিজিট দেখে বলব। কিন্তু তার আগে বল, আমরা টিভি স্ক্রীনে ভেতরের মনিটরিং পাচ্ছি না, ওরা ভেতর থেকে আমাদের দেখছে কিনা?’
চিন্তার প্রকাশ ঘটেছিল এ্যারনের চোখে-মুখে। ভাবছিল সে। একটু পর আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে বলেছিল, ‘ব্যাপারটা রহস্যজনক। মনে হচ্ছে, ভেতরে মনিটরিং-এর কাজটাই বন্ধ আছে। এই কারণে আমরা ভেতরের কিছু দেখতে পাচ্ছি না। আমরা ভেতরের কিছু দেখতে না পেলে তারাও আমাদের কিছু দেখতে পাবে না। কিন্তু এ রকম তো হবার কথা নয়। এখানকার সেন্ট্রাল কনট্রোল খুবই শক্তিশালী। চব্বিশ ঘণ্টা খোলা থাকে।’
‘ব্যাপারটা অবশ্য চিন্তার। কিন্তু আপাতত আমাদের জন্যে ভাল হয়েছে। আমরা নিশ্চিন্তে মুভ করতে পারব।’ বলেছিল আহমদ মুসা।
কথা শেষ করেই ইন্টারকমের বোতাম টিপে সোফিয়া সুসানকে লক্ষ্য করে বলেছিল, ‘সুসান তুমি ও পলা প্রস্তুত হয়ে গ্যাংওয়ের মুখে যাও। হাসান তারিক মিনি-সাবের দায়িত্বে থাকবে। আমি ও এ্যারন আসছি।’
ইন্টারকম থেকে ঘুরে তাকিয়েছিল আহমদ মুসা এ্যারনের দিকে। বলেছিল, ‘এ্যারন তুমি নিচে গিয়ে আর্মস ষ্টোর থেকে আমাদের চারজনের অস্ত্র বাছাই কর। আমি আসছি।’
সংগে সংগে এ্যারন বেরিয়ে গেল।
এ্যারন চলে গেলে হাসান তারিক বলেছিল, ‘ভাইয়া আপনার সাথে আমি গেলে ভালো হতো না?’
‘হতো, কিন্তু মিনি-সাব ও কনট্রোল রুমের দায়িত্ব কাকে দিয়ে যাব। এ্যারনকে এই পরিমাণ বিশ্বাসের সময় এখনও আসেনি, তাছাড়া যোগ্যতাও পরীক্ষা করে দেখা হয়নি। এই দায়িত্বে সুসানদেরও রাখা যায় না। সবকিছুর পরেও তারা মেয়ে মানুষ।’
‘ঠিক আছে ভাইয়া। আপনার সিদ্ধান্তই ঠিক।’ বলেছিল হাসান তারিক।
‘ধন্যবাদ হাসান তারিক। মিনিট দশেক দেখবে। এর মধ্যে যদি মনিটরিং কাজ শুরু না করে, তাহলে তুমি সশস্ত্র হয়ে গ্যাংওয়ের মুখে এসে দাঁড়াবে। ওরা পালাতে চাইলে মিনি-সাব দখল করা ওদের জন্যে অপরিহার্য হয়ে দাঁড়াবে। মিনি-সাব রক্ষা করা আমাদের জন্যে অপরিহার্য।’
বলেই আহমদ মুসা নিচে নামার জন্যে বেরিয়ে এসেছিল কনট্রোল রুম থেকে।
আহমদ মুসা এ্যারনকে সাথে নিয়ে গ্যাংওয়ের মুখে পৌছে দেখে সোফিয়া সুসান ও পলা জোনস গ্যাংওয়ের মুখে দুপাশে দুজন অবস্থান নিয়েছে।
‘ধন্যবাদ সুসান ও পলা। তোমরা গোটা রাস্তা আমাদের কিচেন সামলিয়েছ, এখন বেরুতে হবে লড়াই-এর ময়দানে। তোমাদের একজন আমার বাম, অন্যজন ডান হাত।’ সুসান ও পলা দুজনকে লক্ষ্য করে বলেছিল আহমদ মুসা।
সোফিয়া সুসান আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলেছিল, ‘অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে। আহমদ মুসা আমাদের দায়িত্ব দেয়ার যোগ্য মনে করেছেন, এটা আমাদের জন্যে গৌরবের, বিশেষ করে আহমদ মুসার কিচেনের দায়িত্ব পাওয়া অপরিসীম আনন্দের। তবে সামনের কথা ভাবার আগে আমি জানতে চাচ্ছি টিভি মনিটরিং ভেতরের অবস্থা সম্পর্কে কি বলছে?’
‘মনিটরিং ডেড সুসান।’ বলেছিল আহমদ মুসা।
‘তাহলে ভেতরটা আমাদের জন্যে অন্ধকার, তাই কি?’ বলেছিল সোফিয়া সুসান।
‘হ্যাঁ তাই।’ আহমদ মুসা বলেছিল।
‘তাহলে জনাব, আমাদের কমান্ডো তত্ত্ব মোতাবেক অগ্রসর হওয়ার ষ্ট্রাটেজী আমাদের পাল্টাতে হবে।’ বলেছিল সোফিয়া সুসান।
‘কি রকম?’ বলেছিল আহমদ মুসা।
‘একটা হবে অগ্রবাহিনী, আরেকটা হবে মূল বাহিনী। যেমন আমি হবো অগ্রবাহিনী, আর আপনি অন্যদের সাথে হবেন মূলবাহিনী।’ সুসান বলেছিল।
‘তারপর?’ বলেছিল আহমদ মুসা।
‘একটা হবে অগ্রবাহিনী, আরেকটা হবে মূল বাহিনী। যেমন আমি হবো অগ্রবাহিনী, আর আপনি অন্যদের সাথে হবেন মূলবাহিনী।’ সুসান বলেছিল।
‘তারপর?’ বলেছিল আহমদ মুসা।
‘অগ্রবাহিনী পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে, আপনি পরিস্থিতির মোকাবিলা করবেন।’ বলেছিল আহমদ মুসা।
‘কিন্তু অগ্রবাহিনী যদি আমি হই?’ বলেছিল আহমদ মুসা।
হেসে উঠেছিল সোফিয়া সুসান। বলেছিল, ‘মুলবাহিনী তাহলে কে হবে? আমি ও পলা মূল দায়িত্ব পালনের অযোগ্য। আমরা ঘটনা সৃষ্টি করতে পারি, ঘটনা সামাল দেয়ার সামর্থ আমাদের নেই। এটা আপনি পারেন।’
গম্ভীর হয়েছিল আহমদ মুসা। বলেছিল, ‘অন্ধকারের এক অনিশ্চয়তার মধ্যে তোমাকে সবার আগে ঠেলে দেব কেমন করে?’
‘একা এবং আগে তো যাচ্ছি না। আপনি তো পেছনে থাকছেনই। সৃষ্ট ঘটনার নিয়ন্ত্রণ তো আপনাকেই নিতে হবে।’ বলেছিল সুসান।
‘সেটা ঠিক আছে। কিন্তু গুলীর মুখে তো তোমাকেই প্রথম গিয়ে পড়তে হবে।’ আহমদ মুসা বলেছিল।
‘না জনাব, বরং আমিই প্রথম গুলীর সুযোগ পাব। কারণ আমি আগেই পরিকল্পনা করব, কিন্তু ওদের কোন পরিকল্পনা থাকবে না। আমাকে দেখার পর ওরা সিদ্ধান্ত নেবে। কিন্তু ততক্ষণে আমার এ্যাকশন শুরু হয়ে যাবে। এজন্যেই কমান্ডোরা ঝুঁকি নিলেও তারা সব সময় সুবিধাজনক অবস্থানে থাকে।’ বলেছিল সোফিয়া সুসান।
হেসেছিল আহমদ মুসা। তারপর বলেছিল, ‘তুমি মনে-প্রাণে একজন রিয়েল কমান্ডো সুসান।’
‘ধন্যবাদ। আহমদ মুসার এই সার্টিফিকেট আমার জীবনের সবচেয়ে গৌরবজনক সঞ্চয়।’ বলেছিল সুসান। তার চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়েছিল অভাবিত এক আনন্দে।
‘বুঝতে পারছি না, কমান্ডো হিসেবে তুমি শপথ নিয়েছ দেশ রক্ষার জন্যে। কিন্তু এখন তুমি ঝুঁকি নিচ্ছ কোন স্বার্থে?’
আবেগ জড়িত এক মিষ্টি হাসি ফুটে উঠেছিল সুসানের ঠোঁটে। বলেছিল, ‘সত্য ও ন্যায় দেশের চেয়ে বড়। কিন্তু তার চেয়েও বড় জীবনবাজী রাখা সত্য ও ন্যায়ের সংগ্রামীরা। তাদের পাশে থাকার যে গৌরব, তার চেয়ে বড় স্বার্থ আর কি আছে?’ আবেগে ভারী সুসানের কণ্ঠ।
‘সুসান, আল্লাহ তোমার মঙ্গল করুন।’ বলে আহমদ মুসা তাকায় এ্যারনের দিকে। বলেছিল, ‘দরজা এবার খুলতে হয় এ্যারন।’
‘লকটা ডিজিটাল, আপনি একটু দেখুন জনাব।’ বলেছিল এ্যারন।
একটু হেসেছিল আহমদ মুসা। বলেছিল, ‘বুঝেছি এ্যারন, তুমি আমার টেষ্ট নিতে চাও।’
‘না জনাব, এটা আমার একটা কৌতূহল।’ বলেছিল এ্যারন একটু হেসে।
আহমদ মুসা দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। দেখেছিল, ডিজিটাল লকের প্রথমে চারটি ইংরেজী বর্ণ, তারপর আটটি জিরো অংক। প্রথম চারটি বর্ণ হলো, ‘FAST’।
হাসল আহমদ মুসা। তার মনে পড়ে গেল তার পকেটের দ্বিতীয় কোড স্লিপটার কথা, যা ডেভিড ডেনিমের গলায় পাওয়া খৃষ্টের মূর্তির মধ্যে থেকে জানা গেছে। সে বুঝেছিল প্রথম কোড স্লিপের মত প্রথম চারটি বর্ণ ‘FAST’ এরপর কোড স্লিপে যে আটটা অংক বসান আছে তা দরজার ডিজিটাল জিরো অংকের জায়গাগুলোতে বসালেই দরজা খুলে যাবে, যেমন খুলেছিল সান্তাসিমার গ্যাংওয়ে মুখের দরজা।
আহমদ মুসা পকেট থেকে কোড স্লিপটি বের করে এ্যারনের হাতে দিয়ে বলে, ‘ডিজিটাল লকের জিরো অংকগুলোর স্থানে এই ক্রমিক নাম্বারগুলো বসালেই দিলেই দরজা খুলে যাবে।’
এ্যারন কোড স্লিপের উপর একবার নজর বুলিয়ে বলে ওঠে, ‘ঠিক। কোথায় পেলেন এই কোড নাম্বার? কি করে বুঝলেন এই কোড নাম্বারটি এই ডিজিটাল লকের?’
‘ডিজিটাল অংকগুলোর আগে চারটি ইংরেজী বর্ণ হলো FAST, যার অর্থ ‘Freedom Army Sao Torah’ এই অর্থ থেকেই বুঝেছি সাও তোরাহতে ঢুকতে বা সাও তোরাহর কোথাও এই কোড কাজে লাগবে।
এ্যারনের চোখ দুটি আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠে। বরে, ‘ধন্যবাদ আপনাকে। আজর ওয়াইজম্যানদের সাথে লড়ার সামর্থ আপনাদেরই আছে।’
বলে এগিয়েছিল সে দরজার দিকে। লকের ডিজিটাল প্যানেলে নক করার আগে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলেছিল, ‘আপনারা রেডি তো? দরজা কিন্তু পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকের দেয়ালে ঢুকে যাবে।’
আহমদ মুসা ও সুসান এ্যারনের দেয়া ঘাঁটির ড্রইং-এ আরো একবার চোখ বুলায়। তারপর সুসান গিয়ে দরজার পূব পাশে দরজা ঘেঁসে দাঁড়ায় এবং আহমদ মুসা দাঁড়ায় দরজার পশ্চিম পাশে। আহমদ মুসার পাশে এসে দাঁড়ায় পলা জোনস। তাদের সকলের হাতে খাটো ব্যারেলের মিনি ষ্টেনগান।
ডিজিটাল প্যানেলে নক সম্পূর্ণ করেই এ্যারন ছুটে একপাশে চলে যায়।
দরজা পূব দিক থেকে পশ্চিম দিকে সরে যেতে থাকে। দেহটা পার করার মত দরজায় একটা ফাঁক সৃষ্টি হতেই সুসান মাথাটা পায়ের কাছে মেঝেতে ছুড়ে দিয়ে দেহটাকে কুন্ডলি পাকিয়ে নিয়ে ফুটবলের মত গড়িয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ে।
দরজা তখন পর্যন্ত অর্ধেকও উন্মুক্ত হয়নি। সুসানের দেহের কুন্ডলি যেখানে গিয়ে খুলে যায়, সেখান থেকে গোটা গেটরুম তার নজরে পড়ে। সে দেখতে পায় দরজার পূব পাশে চেয়ারে বসা দুজন প্রহরী দরজা খুলতে দেখেই উঠে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু তাদের ষ্টেনগান তখনও কোন দিককেই লক্ষ্য করে ওঠেনি।
সুসান দেহটা সোজ করেই গুলী করেছিল প্রহরী দুজনকে লক্ষ্য করে। বৃষ্টির মত গুলীর মুখে পড়ে ওদের দেহ ঝাঁঝরা হয়ে চেয়ারের উপরই থেকে যায়।
গুলী করেই সুসান গড়িয়ে দ্রুত বিপরীত দিকের দরজায় চলে গিয়েছিল। দরজার পরেই ড্রইং রুম। ড্রইংরুমের ওপাশের দরজা দিয়ে একটা করিডোর দেখা যাচ্ছিল। এ্যারনের দেয়া নক্সা অনুসারে করিডোরটা উত্তর দিকে গিয়ে পূব দিকে ঘুরেছে। তারপর দক্ষিণ দিকে ঘুরে দক্ষিণের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত পৌছেছে। এই ঘুরানো করিডোরের দুপ্রান্তে সারিবদ্ধ ঘর। এখানেই রক্ষীদের এবং অতিথিদেরও থাকার জায়গা।
সুসান উঠে দাঁড়িয়ে ছুটেছিল করিডোরের দিকে। করিডোর ধরে দৌড়ে পশ্চিম-উত্তর কোণে যখন সে পৌছে, তখন দেখতে পায় পশ্চিমমুখী করিডোর দিয়ে বেশ কয়জন ছুটে আসছে।
ষ্টেনগান তোলার তখন সময় ছিল না। সুসান চোখের পলকে কোণের কক্ষটায় ঢুকে গেল এবং বন্ধ করে দিল দরজা। রক্ষীরা এসে দরজা ভাঙার চেষ্টা শুরু করে দিল।
আহমদ মুসা ও পলা জোনস ড্রইং রুমের দরজার কাছে এসে গিয়েছিল। দরজায় ধাক্কানো লোকগুলো তাদের ষ্টেনগানের মুখে পড়ে যায়। এক সাথেই গর্জে উঠেছিল দুজনের ষ্টেনগান। সুসানের কক্ষের সামনে লাশের স্তুপ পড়ে যায়।
ধীরে ধীরে সামান্য একটু দরজা খুলে সুসান সামনে পূব দিক থেকে আসা কিছু পায়ের শব্দ শুনেই পুরোটা দরজা খুলেছিল সে উদ্যত ষ্টেনগান হাতে।
দরজা খুলেই ট্রিগার চেপে ধরে সে। ওরা আট দশজন এগিয়ে আসছিল। গুলীর ঝাঁক গিয়ে ঘিরে ধরে ওদের। পূবমুখী উত্তর করিডোরের মাঝখানে ওরা লাশ হয়ে পড়ে যায়।
সুসান ঘর থেকে বের হয়।
ছোটে উত্তর করিডোর ধরে পূব দিকে। আবার অনেকগুলো পায়ের শব্দ কানে আসে তার। পূব-উত্তর কোণে পৌছে দেখে দক্ষিণ দিক থেকে পূব করিডোর ধরে ছুটে আসছে আরও দশ বারোজন রক্ষী।
তার বাম পাশে কোণের উপর দক্ষিণমুখী দরজার কক্ষটি খোলা দেখে সুসান। সুসান মাথা নিচে চালিয়ে এ্যাক্রোবেটিক কৌশলে দেহটা উল্টিয়ে ঘরের মধ্যে ছিটকে পড়ে। মাটিতে পড়েই সে পা দিয়ে লাথি মেরে দরজা বন্ধ করে দেয়। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই এক ঝাঁক গুলী এসে লোহার দরজাটায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। অজ¯্র লাথিও পড়তে শুরু করে দরজার উপর।
আহমদ মুসা, পলা জোনস ও এ্যারন পশ্চিম দিকের করিডোর ধরে ছুটে এসে করিডোরের পশ্চিম-উত্তর কোণে তারা থমকে দাঁড়ায় উত্তর-পূর্ব কোণে সুসানের দরজার সামনে দাঁড়ানো রক্ষীদের দেখে এবং ষ্টেনগানের ব্যারেল লক্ষ্যে স্থির করে ট্রিগার চেপে ধরে আহমদ মুসা ও পলা জোনস।
শেষ মুহূর্তে রক্ষীরাও টের পেয়ে গিয়েছিল আহমদ মুসাদের। ওদের কয়েকজন তাদের ষ্টেনগান ঘুরিয়ে নিচ্ছিল। কিন্তু তাদের ষ্টেনগানের ঘুরে আসার আগেই গুলীর ঝাঁক গিয়ে ঘিরে ধরল ওদের সবাইকে। লাশের আরেকটা স্তুপের সৃষ্টি হলো উত্তর-পূব কোণে।
গুলী করেই আহমদ মুসারা ছুট দিয়েছিল পূব দিকে। যখন তারা উত্তর-পুব কোণে পৌছে তখন সুসানও বেরিয়ে আসে।
‘সুসান মনে হচ্ছে তুমি তোমার কমান্ডো ট্রেনিং-এর ডেমোনেষ্ট্রেশন দিচ্ছ। কিন্তু এটা তোমার কমান্ডো ট্রেনিং নয়। এভাবে ঝুঁকি নেয়া ঠিক নয়। এখন……….।’
আহমদ মুসার কথার মাঝখানেই হঠাৎ সুসানের ষ্টেনগান বিদ্যুত বেগে দক্ষিণ লক্ষ্যে উঠে আসে এবং শুরু করে গুলী বৃষ্টি।
কথা বন্ধ করে আহমদ মুসা তাকায় পুবের করিডোর দিয়ে দক্ষিণ দিকে। দেখে করিডোরের দক্ষিণ প্রান্তে দুজন রক্ষী মাটিতে পড়ে কাতরাচ্ছে। আর অবশিষ্টরা দৌড়ে পশ্চিম দিকে আড়াল হয়ে গেল।
‘ওখানেই দুতলা তিন তলায় উঠার সিঁড়ি মি. আহমদ মুসা।’ বলছিল এ্যারন।
‘চল সবাই।’ বলে ছুটা শুরু করে দিয়েছিল আহমদ মুসা দক্ষিণে উপরে উঠার সিঁড়ির দিকে।
তারা পুব-দক্ষিণ কোণে পৌছে পশ্চিমে সিঁড়ির দিকে উঁকি দিয়েছিল। সংগে সংগে সিঁড়ির গোড়া থেকে ছুটে আসে গুলীর ঝাঁক।
সরে আসে আহমদ মুসারা।
তারপর তারা আড়ালে দাঁড়িয়ে তাদের চারটি ষ্টেনগানের ব্যারেল পশ্চিম দিকে বাড়িয়ে দিয়ে সিঁড়ি লক্ষ্য করে গুলী বৃষ্টি শুরু করে।
গুলী করতে করতেই তারা বেরিয়ে আসে আড়াল থেকে সিঁড়ির মুখে।
ওদিক থেকে কোন পাল্টা গুলী আর আসে না।
আহমদ মুসারা গুলী অব্যাহত রেখেই সিঁড়ির গোড়ায় নিরাপদ অবস্থানে চলে যায়।
আহমদ মুসারা তখন গুলী বন্ধ করে ইঞ্চি ইঞ্চি করে এগুচ্ছিল সিঁড়ির দিকে ওদেরকে প্রত্যক্ষ টার্গেটে আনার জন্যে। এই সময়ই সিঁড়ি ও সিঁড়ির উপর এলাকায় দুপক্ষের মধ্যে গোলা-গুলী শুরু হয়ে যায়।
কিছু অপেক্ষার পর আহমদ মুসা যখন নিশ্চিত বুঝল ঐ দুপক্ষের এক পক্ষ আজর ওয়াইজম্যান বিপক্ষে, তখন ধরে নিল, ওদিকে আজর ওয়াইজম্যানের বিরোধী যারা, তারা আহমদ মুসাদের মিত্র। তাদের দুপক্ষের উদ্দেশ্য আজর ওয়াইজম্যানদের লোকদের পরাজিত করা। হতে পারে ঐ পক্ষ বন্দীদের পক্ষে এবং আজর ওয়াইজম্যানের লোকদের আক্রান্ত হতে দেখে তারা কাজ শুরু করেছে।
আহমদ মুসা নির্দেশ দিল সুসানদের আক্রমণ শুরু করার জন্যে।
সিঁড়ির গোড়ায় আড়াল থেকে আহমদ মুসারা গুলী বর্ষণ শুরু করে দিল।
সিঁড়িতে লুকাবার কোন জায়গা ছিল না। অল্পক্ষণ পরেই সিঁড়ি থেকে ষ্টেনগানের আওয়াজ বন্ধ হয়ে গেল। উপর থেকে রিভলবারের আওয়াজও আর শোনা গেল না।
আহমদ মুসা গুলী বন্ধ করে সিঁড়ির গোড়ায় গিয়ে দাঁড়াল এবং চিৎকার করে বলে উঠল, ‘সিঁড়িতে আজর ওয়াইজম্যানের কেউ বেঁচে নেই। উপরে কারা………।’
আহমদ মুসার কথা শেষ হবার আগেই সিঁড়ির মুখে এসে দাঁড়াল বুমেদীন বিল্লাহ। চিৎকার করে উঠল, ‘আহমদ মুসা ভাই, থ্যাংকস গড। তাড়াতাড়ি আসুন। আজর ওয়াইজম্যানের হেলিকপ্টার উড়ার কাজ শুরু করেছে। তাড়াতাড়ি আসুন।’
আহমদ মুসা বুমেদীন বিল্লাহকে সালাম দিয়ে বলল, ‘আসছি বিল্লাহ।’
বলে দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠতে শুরু করল।
দুতলার ল্যান্ডিং-এ উঠে আসতেই বুমেদীন বিল্লাহ জড়িয়ে ধরল আহমদ মুসাকে।
আহমদ মুসার সাথে সুসানরাও উঠে এসেছিল।
‘চল বিল্লাহ, আজর ওয়াইজম্যানরা কোথায়?’
‘চলুন।’ বলে দুতলার চলন্ত সিঁড়ির দিকে দৌড়াতে শুরু করল বুমেদীন বিল্লাহ। তার পেছনে ছুটল আহমদ মুসা এবং অন্যান্য সবাই।
যখন তারা ছাদে উঠল দেখল আজর ওয়াইজম্যানের হেলিকপ্টার অনেক খানি উপরে উঠে গেছে।
হেলিকপ্টার থেকে একটা আলোর ফ্লাশ ঘুরে গেল আহমদ মুসাদের উপর দিয়ে। একটা উচ্চহাসির আওয়াজ ভেসে এল উপর থেকে। তার সাথে একটা উচ্চ কণ্ঠ, ‘আমার শূন্য ঘাঁটিতে জিরো কামাল সুলাইমানদের নিয়ে পরাজয়ের মহোৎসব করো। বিজয় আমার পকেটে। স্পুটনিকের দলিলগুলো নিয়ে গেলাম।’
কথা শেষ হলো।
কথা শেষ হবার সাথে সাথে আবার সেই উচ্চ হাসির শব্দ।
হেলিকপ্টার ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল আকাশের অন্ধকারে।

Top