১
রাব্বানিক্যাল ইউনিভার্সিটি নিউইয়র্ক-এর অভ্যর্থনা কক্ষ। ক্লান্ত দেহটা সোফায় এলিয়ে বসে আছে আহমদ মুসা। ড. হাইম হাইকেল এই ইউনিভার্সিটির ‘ফেইথ স্টাডিজ’ বিভাগের প্রধান রাব্বি। ড. হাইম হাইকেলের সাথে দেখা করতে চায় আহমদ মুসা। এই খবর সে পাঠিয়েছে মিনিট পাঁচেক আগে। ড. হাইম হাইকেল আসবেন, অথবা ভেতরে তার ডাক আসবে, এরই অপেক্ষা করছে আহমদ মুসা।
শান্ত, নিস্পৃহভাবে বসে থাকলেও বুকটা আহমদ মুসার আশা-নিরাশার দ্বন্দ্বে অনেকটাই অস্থির।
আহমদ মুসার এই নতুন আমেরিকান মিশনে রাব্বি ড. হাইম হাইকেলই তার প্রাইম টার্গেট, প্রধান অবলম্বন। নিউইয়ের্কের লিবার্টি টাওয়ার ও ডেমোক্রোসি টাওয়ার ধ্বংসের রহস্য উদঘাটনে অনুসন্ধান চালাতে গিয়ে কামাল সুলাইমানদের স্পুটনিক যে সত্যের সন্ধান পায় তার প্রধান সাক্ষী এই ধর্মনেতা ইহুদী জগতের বিশিষ্ট রাব্বি ড.হাইম হাইকেল।
আজ থেকে বিশ বছর আগে নিউইয়ের্কের টুইনটাওয়ার, লিবার্টি টাওয়ার ও ডেমোক্রাসি টাওয়ার, ধ্বংস হয় বিস্ময়কর অভূতপূর্ব এক আক্রমণে। এর জন্যে দায়ী করা হয় একটি মুসলিম গ্রুপকে। সন্দেহের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয় সব মুসলমানকেই। তারপর মুসলিম বিশ্বের এ প্রান্ত থেকে সে প্রান্ত পর্যন্ত ধ্বংস-বিপর্যয়ের ঝড় বয়ে যায়। মুসলমানদের অনেকেই একে তাদের অপরিণামদর্শী কিছু সদস্যের অপরাধ থেকে সৃষ্ট ভ্যগ্যলেখা হিসাবে মেনে নেয়। আবার অনেকেই একে গোপন ষড়যন্ত্রের পাতা ফাঁদে জড়িয়ে পড়া ভুল সিদ্ধান্ত বলে মনে করে। দীর্ঘ বিশ বছর পর এই শেষোক্ত ধারণা থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই কামাল সুলাইমানদের গোয়ান্দা সংস্থা ‘স্পুটনিক’ এই ব্যাপারে সত্য উদঘাটনের জন্যে অনুসন্ধান শুরু করে। সন্ধান পায় তারা এক গোপন ষড়যন্ত্রের। অনেক দলিল-দস্তাবেজ তারা যোগাড় করে এর সমর্থনে। তার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল ছিল ইহুদী সিনাগগের কনফেশন টেবিলে ‘সর্বশক্তিমান ও শেষ দিনের বিচারক’ ‘জিহোবা’র সামনে পেশ করা ‘কনফেশন’-এর একটি অডিও টেপ। এই কনফেশনে তিনি নিউইয়র্কের টাওয়ার ধ্বংসে তার অপরাধ অংশের কথা স্বীকার করেছিলেন। এই কনফেশন ঘটনাক্রমেই রেকর্ড হয়ে গিয়েছিল এবং ঘটনাক্রমেই সে টেপের একটি কপি কামাল সুলাইমানরা পেয়ে যায়। কিন্তু টাওয়ার ধ্বংসে তাদের সামনে ইহুদীদের ভয়াবহ ষড়যন্ত্রের বিষয়টি প্রমাণের জন্য এই কনেফেশন যথেষ্ট নয়। এজন্য যে তথ্য-প্রমাণ প্রয়োজন তা যোগাড়ে রাব্বি ড. হাইম হাইকেলের পক্ষেই সাহায্য করা সম্ভব। এই ষড়যন্ত্রের জগতে প্রবেশের পথে সেই একমাত্র প্রত্যক্ষ সোর্স। এ কারণেই আহমদ মুসা ছুটে এসেছে তার কাছে।
রাব্বি ড.হাইম হাইকেল লোকটি কেমন সে আহমদ মুসাকে কিভাবে গ্রহণ করবে, কনফেশনের টেপের কথা স্বীকার করতে রাজি হবে কিনা, ইত্যাদি ভাবনাপীড়িত দুরু দুরু মন নিয়ে অপেক্ষা করছে আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার পরণে কালো হ্যাট, কালো লম্বা কোট। এটাই হাসিডিক ইহুদীদের পোশাক। রাব্বি ড. হাইম হাইকেলও হাসিডিক পন্থী ইহুদী। অবশ্যই ড. হাইম হাইকেল পৈতৃক সূত্রেই ছিলেন ‘হাসকলা’ পন্থী ইহুদী। হাসকলারা বাইরের জীবনে ধর্মের ভূমিকাকে তেমন একটা আমল দেয় না। জ্ঞান ও বিজ্ঞানের মাধ্যমে জীবনকে ও জাতিকে সমৃদ্ধ করাকেই এরা প্রধান কর্তব্য মনে করে। অন্যদিকে হাসিডিকরা লেখাপড়া চর্চার চাইতে ‘দয়া’ ও ‘সানন্দ উপাসনাকে’ বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। ড. হাইম হাইকেল টাওয়ার ধ্বংসের কিছুকাল পর এই হাসিডিক মত গ্রহণ করেন।
আহমদ মুসা একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল।
হঠাৎ তার নাম ধরে সম্বোধনের শব্দে সে সম্বিত ফিরে পেল। মুখ তুলে দেখল, তার সামনে একজন লোক দাঁড়িয়ে। পঞ্চাশোর্ধ। পরণে রাব্বির পোশাক। বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা। বলছিল সে, ‘আপনি মি. আইজ্যাক দানিয়েল?’
আহমদ মুসা ‘আইজ্যাক দানিয়েল’ নাম নিয়েই এসেছে এই ইহুদী বিশ্ববিদ্যালয়ে ড. হাইম হাইকেলকে খোঁজ করার জন্যে। সে ফিলিস্তিন থেকে এই নামে পাসপোর্ট করে রেখেছিল। এবার এই পাসপোর্ট নিয়েই আহমদ মুসা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এসেছে।
আহমদ মুসা লোকটির দিকে তাকিয়েই উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘গুড মর্নিং স্যার। হ্যাঁ, আমি আইজ্যাক দানিয়েল।’
‘ওয়েলকাম।’ বলে হাত বাড়িয়ে লোকটি বলল, ‘আমি জ্যাকব, হাইকেলের সহকর্মী।’
আহমদ মুসা তার সাথে হ্যান্ডশেক করে বলল, ‘পরিচিত হয়ে খুশি হলাম স্যার।’
‘আমিও।’ বলল রাব্বি জ্যাকব।
আহমদ মুসা কিছু বলতে যাচ্ছিল। জ্যাকব বাধা দিয়ে বলল, ‘স্যরি, আসুন আমার সাথে।’
জ্যাকব চলতে শুরু করল।
আহমদ মুসাও তার সাথে সাথে চলল।
পাশের একটি কক্ষে গিয়ে দুজনে বসল।
বসেই রাব্বি জ্যাকব বলল, ‘দয়া করে বলবেন কি রাব্বি ড. হাইকেলের সাথে আপনার কি সম্পর্ক? কেন দেখা করতে চান তার সাথে?’
‘তিনি আমার শুভাকাঙ্ক্ষী ও বন্ধু। বাকি প্রশ্নের জবাব তিনিই তো চাইবেন।’ বলল আহমদ মুসা। তার শেষের বাক্যটা একটু শক্ত হয়েছিল।
রাব্বি জ্যাকবের চেহারায় পরিবর্তন দেখা গেল না। শান্ত কন্ঠে সে বলল, ‘রাব্বি ড. হাইকেল নেই। তার দেখা আপনি পাবেন না।’
‘কোথায় তিনি?’ বলল, আহমদ মুসা।
‘সেটাও আপনি জানবেন না। কারণ আমিও জানি না।’ রাব্বি জ্যাকব বলল।
ভ্রু কুঁচকে গেল আহমদ মুসার। বলল দ্রুতকন্ঠে, ‘আপনি জানবেন না কেন? অফিস তো নিশ্চয় জানে।’
‘অফিসও জানে না।’ রাব্বি জ্যাকব বলল।
‘এটা অসম্ভব। আমি অফিসকে জিজ্ঞাসা করতে চাই।’ বলল আহমদ মুসা।
‘সাক্ষাৎ প্রাথী হওয়ার স্লিপ তো অফিসেই পাঠিয়েছিলেন। অফিস আমাকে পাঠিয়েছে। ভিন্নভাবে অফিস আর কথা বলবে না।’ রাব্বি জ্যাকব বলল।
স্তম্ভিত হলো আহমদ মুসা। ড. হাইকেল এখানে এক উচ্চপদে চাকুরী করেন। তিনি কোথায় আছেন বা কোথায় গেছেন কেউ জানবে না, এটা কি করে হতে পারে! বলল আহমদ মুসা, ‘তিনি কি এখানে চাকুরী করেন না? চাকুরী ছেড়ে দিয়ে চলে গেছেন? একমাস আগে প্রকাশিত নিউইয়র্কের এডুকেশন গাইড বইতেও দেখেছি, তিনি এখানকার ‘ফেইথ স্টাডিজ’ বিভাগের প্রধান।’ আহমদ মুসার কন্ঠে বিস্ময়।
‘এডুকেশন গাইডের তথ্য ঠিক। তিনি আমাদের ফেইথ স্টাডিজ বিভাগের প্রধান। কিন্তু তিনি নেই। দিন পনের আগে তিনি হঠাৎ উধাও হয়ে গেছেন। কাউকেই কিছু বলে যাননি।’ বলল রাব্বি জ্যাকব।
‘বাড়ির লোকেরা কি বলে?’ আহমদ মুসা বলল।
‘তারাও আমাদের মত অন্ধকারে। তার বাড়িতে মা ছাড়া তেমন কেউ নেই। একমাত্র ছেলে বাইরে লেখা-পড়া করছে।’ বলল রাব্বি জ্যাকব।
‘পুলিশ কি এ বিষয়ে কিছু জানে?’ আহমদ মুসা বলল।
‘পুলিশ চেষ্টা করছে, কিন্তু কোন সন্ধান পায়নি বলে জানি।’
‘স্যার, তার উধাও হওয়া সম্পর্কে আপনি কি মনে করেন?’
জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
আহমদ মুসার জিজ্ঞাসার সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল না রাব্বি জ্যাকব। তার চোখে-মুখে ফুটে উঠল ভয়ের চিহ্ন। কয়েক মুহূর্ত পর এদিক ওদিক তাকিয়ে ধীর কন্ঠে বলল,‘আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। সবাই বিষয়টাকে এড়িয়ে চলতে চাচ্ছে। আমাদের অধিকাংশ শিক্ষক বলছেন, তিনি হয়তো নিজেই কোথাও চলে গেছেন? আমরা কয়েকজন শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট রাব্বি ড.আইয়াজ ইয়াহুদের কাছে গিয়েছিলাম ড. হাইকেলের সন্ধানের ব্যাপারে আরও তৎপর হবার জন্য। বিষয়াটি পত্র-পত্রিকায় আনার জন্যে অনুরোধ করেছিলাম আমরা। তিনি আমাদেরকে আবেগপ্রবণ না হবার জন্যে উপদেশ দিয়ে বলেছিলেন, ‘পুলিশকে বলা হয়েছে। প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার দায়িত্ব তাদের। বহুদিন থেকে ড. হাইকেল ফ্রাস্ট্রেশনে ভুগছিলেন। এক সময় তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। সেখান থেকে নিজেই নেমে গিয়ে ‘ফেইথ স্টাডিজ’ বিভাগের মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখলেন। সাম্প্রতিককালে তিনি চিন্তারও ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন। তার ব্যাপারে সব চিন্তা আপনারা মন থেকে ঝেড়ে ফেলে দিন।’
আহমদ মুসা স্তম্ভিত হলো ড. হাইকেলের মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলার কথা শুনে। আহমদ মুসা বলল, ‘ড. হাইকেল মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলার কথা কি সত্য?’
‘ড. হাইকেল আমার ঘনিষ্ঠ সহকর্মী। আমি কখনও এমন কিছু লক্ষ্য করিনি।’
‘তাহলে ড. আয়াজ ইয়াহুদ এটা বললেন কেন? মানে তার কথা মন থেকে ঝেড়ে ফেলার কথা বললেন কেন? তিনি কি তাহলে আপনাদের চেয়ে বেশি জানেন ড. হাইকেল সম্পর্কে?’ প্রশ্ন তুলল আহমদ মুসা।
‘আমারও তাই মনে হয়। আমরা সবাই উদ্বিগ্ন, কিন্তু তার মধ্যে কোন উদ্বেগ দেখিনি।’ বলল রাব্বি জ্যাকব।
‘ড. আয়াজ ইয়াহুদ তাহলে কিছু সহযোগিতা করতে পারেন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কিন্তু আপনি তার সাক্ষ্যত পাবেন না। আর ড. হাইকেলের ব্যাপারে আপনার সাথে কোন আলোচনায় তিনি রাজি হবেন না।’ রাব্বি ড. জ্যাকব বলল ।
‘কেন বলছেন একথা?’ বলল আহমদ মুসা।
‘তিনি প্রশাসন বিভাগকে একটা নির্দেশ দিয়েছেন যে, ড. হাইকেল সম্পর্কে কোন কথা আর তার বলার নেই। যা জানার তা যেন মানুষ পুলিশের কাছ থেকে জেনে নেয়। এ বিষয়ে কোন সাক্ষাতকার কাউকে তিনি দেবেন না।’ রাব্বি জ্যাকব বলল।
‘দেখুন রাব্বি ড. হাইম হাইকেল আমার অকৃতিম শুভাকাঙ্ক্ষী ও বন্ধু। এসেছিলাম তার সাথে সৌজন্য সাক্ষাতকারের উদ্দেশ্য। তেমন কোন কাজ ছিল না। কিন্তু এখন দেখছি, তাকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা আমাকে করতে হবে। আমার এমন কিছু হলে তিনি অবশ্যই এটা করতেন।’
রাব্বি ড. জ্যাকব সঙ্গে সঙ্গে কোন কথা বলল না। ভাবছিল সে। কিছুক্ষণ পর ধীরে ধীরে বলল, ‘তাতে কোন লাভ হবে না। আপনিই বিপদেই পড়বেন। দেখুন আমরা বিনা কারণে চুপ করে বসে নেই। ড. হাইকেলের ব্যাপারে আমাদের মুখ খুলতে নিষেধ করা হয়েছে। এরপর আমরা গিয়েছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্টের কাছে। তিনিও আমাদের হতাশ করেছেন।’
‘কে নিষেধ করেছে? আর নিষেধ আপনারা মানবেন কেন?’ আহমদ মুসা বলল।
‘কে নিষেধ করেছে জানি না। হুমকি এসেছে টেলিফোনে। না মেনে আমরা কি করব? বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বয়ং প্রধান যখন বিষয়টাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না, পুলিশও যেখানে গতানুগতিক, সেখানে আমরা কার উপর নির্ভর করব?’ বলল রাব্বি জ্যাকব।
‘বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট ড. আয়াজ ইয়াহুদের বাসায় তাঁর আর কে কে আছেন?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘তার এক মেয়ে ও স্ত্রী। এই দুজনসহ তিনজন নিয়ে তার সংসার।’ বলল রাব্বি জ্যাকব।
‘বিশ্ববিদ্যালয়ের তার অফিসের একটা এক্সটেনশন তো তাঁর বাসায় আছে, তাই না?’ বলল আহমদ মুসা।
হ্যাঁ। অফিসের নিরিবিলি কাজগুলো তিনি বাসায় বসে করাই পছন্দ করেন।’ রাব্বি জ্যাকব বলল।
‘তার অর্থ অফিসের কম্পিউটার নেটওয়ার্কের সাথে তাঁর রেসিডেন্সিয়াল অফিসের কম্পিউটারগুলো যুক্ত কি বলেন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘সেটাই স্বাভাবিক।’ রাব্বি জ্যাকব বলল। বলে সে তার হাত ঘড়ির দিকে তাকাল।
‘প্লিজ স্যার, আর একটি কথা। রাব্বি ড. হাইম হাইকেলের বাসা এখানে কোথায় ছিল?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘ফিফথ এভেনিউতেই সবকিছু। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ও জুইস মিউজিয়ামের মাঝের জায়গাটুকুও বিশ্ববিদ্যালয়ের। এখানে বিশ্বাবদ্যালয়ের অনেক কয়টি রেসিডেন্সিয়াল ব্লক আছে। এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট ও তার পার্সোনাল স্টাফদের বাসা। আর পশ্চিমের সর্বশেষ লাইনে ‘ফিফথ’ এভিনিউ-এর লাগোয়া যে ব্লক সেটিই ‘আই’ ব্লক। এ ব্লকের দুতলায় সর্ব উত্তরের ফ্লাটে থাকতেন রাব্বি ড. হাইম হাইকেল।’
‘তিনি নিখোঁজ হবার পর তার বাড়িতে আপনারা গেছেন?’ আহমদ মুসা বলল।
‘গেছি। কেন এ কথা বলছেন।’ রাব্বি জ্যাকব বলল।
‘এখন কে আছেন তাঁর বাড়িতে?’ আহমদ মুসা বলল।
‘পুলিশ তার বাড়ি সীল করে রেখেছে। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত এ রকম থাকবে। তিনি বাসায় একাই থাকতেন।’ রাব্বি জ্যাকব বলল।
’ধন্যবাদ স্যার।’
‘ধন্যবাদ’ বলে উঠতে উঠতে রাব্বি জ্যাকব বলল, ‘আমার চোখ দেখতে যদি ভুল না করে থাকে, তাহলে আপনি আমাদের মত চুপ করে থাকার মত লোক নন বলেই মনে হচ্ছে। তবু আমি বলব, পাগলামী করবেন না। ওদের গায়ে হাত দিতেও পারবেন না।’
আহমদ মুসাও উঠে দঁড়াল। বলল, ‘ওদের তো আপনি জানেন না, তাহলে একথা বলছেন কেন?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা। তার চোখে বিস্ময়।
‘আমি ওদের জানি না। কিন্তু ড. হাইকেল মনে হয় ওদের জানতেন। কথাচ্ছলে একদিন তিনি আমাকে বলে…………’
রাব্বি ড. জ্যাকবের কথা শেষ হলো না, অস্পষ্ট একটা শব্দ লক্ষ্যে দরজার দিকে আহমদ মুসা চাইতেই দেখল একটা রিভলবারের নল উঠে এসেছে রাব্বি জ্যাকবকে লক্ষ্য করে। রিভলবারে সাইলেন্সার লাগানো। সঙ্গে সঙ্গেই আহমদ মুসা এক হ্যাচকা টানে সরিয়ে নিল রাব্বি জ্যাকবকে। তারপরেই অ্যাক্রোব্যাটিক ঢংয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল লোকটির উপর। শীষ দেওয়ার মত শব্দ করে একটা গুলী তার আগে বেরিয়ে এসেছে। তার সাথে একটা আর্তনাদও উঠেছে জ্যাকবের মুখ থেকে।
আহমদ মুসার দেহ চরকির পুরো এক রাউন্ড ঘুরে দ্বিতীয় রাউন্ডের প্রথমেই তার জোড়া পা গিয়ে আঘাত করল লোকটার তলপেটে।
লোকটা পেছন দিকে ছিটকে দরজার বাইরে পড়ে গেল। হাত থেকে রিভলবারটাও পড়ে গেছে।
জোড়া পায়ে আঘাত করার পর আহমদ মুসা চিৎ হয়ে পড়ে গিয়েছিল মাটিতে। মুহূর্ত পরেই আহমদ মুসা উঠল। ছুটল লোকটির দিকে এবং চিৎকার করে উঠল, ‘খুনি, সন্ত্রাসী পালাচ্ছে। ধরুন তাকে।’
লোকটি আগেই উঠে দাঁড়িয়েছিল এবং ছুটে পালাচ্ছিল।
রাব্বি ড. জ্যাকবের আর্তনাদও সবাই শুনতে পেয়েছিল।
লোকটি অভ্যর্থনা কক্ষের মধ্যে দিয়েই দৌড় দিয়েছিল।
অভ্যর্থনা কক্ষ ও আশ পাশের সবাই লোকটির দিকে ছুটছিল। কিন্তু লোকটি দুটি বোমা ফাটিয়ে পালানোর নিরাপদ পথ করে নিল। আহমদ মুসা লোকটিকে পালাতে দেখেই দ্রুত আবার ফিরে এসেছিল রাব্বি ড. জ্যাকবের কক্ষে।
রাব্বি জ্যাকব তার ডান হাত দিয়ে বাম বাহু চেপে ধরে বসেছিল। গুলী লেগেছে তার বাম বাহুর উপরের অংশে।
আহমদ মুসা তার পাশে বসে ক্ষতস্থানটা একটু পরীক্ষা করে বলল, ‘ঈশ্বর আপনাকে বাঁচিয়েছেন। বাহুর আঘাতও খুব মারাত্মক নয়।’
রাব্বি জ্যাকব মুখ তুলে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। । বলল, ‘হ্যাঁ, ঈশ্বর আজ আপনার রূপ ধরে এসেছিল। আপনি চোখের পলকে ওভাবে টেনে না নিলে গুলীটা আমার বুক বিদ্ধ করতো।’
সবাই এসে দাঁড়িয়েছিল তাদের চারপাশে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট ছুটে এসেছিল। এসেই বলল, ‘তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিতে হবে। এ্যাম্বুলেন্স রেডি।’
কথা কয়টি বলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট আয়াজ ইয়াহুদ রাব্বি জ্যাকবকে লক্ষ্য করে বলল, ‘কি করে, কেন এসব ঘটল ।’ তারপর অপরিচিতি আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ইনি কে? এ সময়ে কেন এখানে?
রাব্বি জ্যাকব বলল, ‘স্যার ইনিই আজ আমাকে বাঁচিয়েছেন। ইনি দেখা করতে এসেছিলেন। আমি তার সাথে এখানে বসে কথা বলছিলাম। একপর্যায়ে দরজায় এসে ঐ সন্ত্রাসী আমাকে গুলী করে। ইনি অদ্ভুত ক্ষিপ্রতায় আমাকে সরিয়ে না নিলে বাহুতে যে গুলী লেগেছে তা বুকে লাগত। তারপর ইনি আমাকে সরিয়ে দিয়েই আক্রমণকারীর উপর ঝাঁপিয়ে না পড়লে সন্ত্রাসী দ্বিতীয় গুলী করার সুয়োগ পেয়ে যেতো।’
রাব্বি জ্যাকব থামতেই বিশ্বাবদ্যালয়ের প্রেসিন্ডেট আয়াজ ইয়াহুদ আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘ধন্যবাদ ইয়ংম্যান। বুদ্ধি, শক্তি ও সাহসে যুবকরা এ রকমই হওয়া উচিত।’
এ্যাম্বুলেপ্স থেকে স্ট্রেচার এসে পৌঁছল। রাব্বি ড. জ্যাকবকে আহমদ মুসাই স্ট্রেচারে শুইয়ে দিল।
স্ট্রেচার নিয়ে চলা শুরু হলে রাব্বি জ্যাকব আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল,’আপনি হাসপাতালে আসছেন তো।
‘আবশ্যই আপনার সাথে দেখা করবো।’ বলে আহমদ মুসা তাকাল ড. আয়াজ ইয়াহুদের দিকে। বলল, ‘স্যার অনধিকার চর্চা হলেও আমি বলতে চাই. ড. জ্যাকবের উপর শত্রু তার উদ্দেশ্য হাসিলে ব্যর্থ হয়েছে। সুতারাং সফল হবার জন্য আবারও তারা চেষ্টা করতে পারে।’
ভ্রুকুঞ্চিত হলো ড. আয়াজ ইয়াহুদের। বলল, ‘ইয়ংম্যান, তুমি তো সাংঘাতিক বুদ্ধিমান। ঠিক বলেছ তুমি। আমি এখনি পুলিশকে বলছি। আর পুলিশকে তোমার তো একটা জবানবন্দী দিতে হবে। তুমি লিখে দাও তাতেই চলবে। ড. জ্যাকব তো সবকিছুরই সাক্ষী। সবাই বেরিয়ে এল ঘর থেকে।
আহমদ মুসা ধীরে ধীরে নিকটবর্তী হল রাব্বিনিক্যাল ইউনিভার্সিটি অব নিউাইয়র্ক-এর প্রেসিডেন্ট ড. আয়াজ ইয়াহুদের বাসার।
এইমাত্র আহমদ মুসা বেরিয়ে এসেছে রাব্বি ড. হাইম হাইকেলের বাসা থেকে।
ড. হাইকেলের বাসা সীল করা। আহমদ মুসা প্রবেশ করে পেছনের এমারজেন্সী এক্সিট দিয়ে। আহমদ মুসা ল্যাসার বীম দিয়ে এক্সিটটির দরজা খুলতে গিয়ে দেখে জরুরি দরোজারটার তালা খোলা। বুঝে নেয় আহমদ মুসা তার আগে আরোও এক পক্ষ এ পথ দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করেছিল। সে পক্ষ যে আজর ওযাইজম্যান বা জেনারেল শ্যারনদেরই কেউ হবে সে ব্যাপারেও তার কোন সন্দেহ নেই। আহমদ মুসা আরও বুঝে নেয়, যে তথ্যের সন্ধানে আহমদ মুসা ড. হাইম হাইকেলের বাড়িতে প্রবেশ করেছে তা পাবার কোন সম্ভাবনা নেই।
| | | Next → | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »