৩৮. ধ্বংস টাওয়ার

চ্যাপ্টার

আহমদ মুসা ‘ডেট্রয়েট’-এর ‘অলিভার এইচ পেরী’ রোডটা দেখে বিস্মিতই হলো।
অলিভার এইচ পেরী রোডটা ডেট্রয়েট-এর অভিজাত উত্তর এলাকার মাঝখান দিয়ে পুবে এগিয়ে কানাডা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বিভক্তকারী সেন্টক্লিয়ার কেনাল-এর তীর ঘেঁষে উত্তর-দক্ষিণে প্রলম্বিত কেনাল এভিনিউতে গিয়ে পড়েছে।
সংকীর্ণ সেন্টক্লিয়ার কেনাল-এর মাঝখান দিয়ে কানাডা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্ত। সেন্টক্লিয়ার কেনালটা দক্ষিণে গিয়ে ‘লেক ইরী’তে, আর উত্তর প্রান্তটা মিশেছে গিয়ে ‘লেক সেন্টক্লিয়ার’-এর সাথে।
অলিভার এইচ পেরী রোডের পুব প্রান্তে দাঁড়িয়ে চারদিকটাকে অদ্ভূত সুন্দর লাগল আহমদ মুসার। সেই সাথে তার মনটা ছুটে গেল কয়েকশ বছর আগের অতীতে। সে অতীতটা বড়ই রক্তরঞ্জিত। এই অঞ্চলেও বাস ছিল রেড ইন্ডিয়ানদের। ১৬৬৮ সালে প্রথম এই অঞ্চলে ফরাসি বসতি প্রতিষ্ঠিত হয়। আদিবাসী রেড ইন্ডিয়ানদের সাথে বিদেশীদের সংঘাত শুরু সেই থেকেই। বৃটিশরা এই অঞ্চল দখল করে নেয় ১৭৬৩ সালে। রেড ইন্ডিয়ানদের সাথে তাদের শেষ ভয়ংকর যুদ্ধ হয় ১৭৯৪ সালে। এই মিচিগান এলাকা বৃটিশরা ১৮১৩ সালে শেষবারের মত দখলে আনে। এই দখলের ‘লেক ইরী’ যুদ্ধের বিজয়ী বৃটিশ সেনাপতি ছিলেন অলিভার এইচ পেরী। সেই বৃটিশ সেনাপতি অলিভারের নামেই ডেট্রয়েটের এই রাস্তা।
ডেট্রয়েটের এই রাস্তার সৌন্দর্য্য ও সিচুয়েশন আহমদ মুসাকে যতখানি অভিতূত করল, ঠিক ততখানি বিরক্ত হলো বাড়ির নম্বরটা খুঁজতে গিয়ে। আজর ওয়াইম্যানের ঐ লোকের কাছ থেকে পাওয়া ই-মেইল অনুসারে যে বাড়িতে এনে হাইম হাইকেলকে তোলা হয়েছে তার নম্বর হলো ৭৭৬, কিন্তু সাত শতের ঘরে কোন নাম্বারই এই রাস্তায় নেই। আবার যেখান তাকে শিফট করা হয়েছে, সেই নম্বর হলো ৮৩৩ ই-মেইল অনুসারে। কিন্তু যেখানে ৭শ’র ঘরের নম্বরই নেই, সেখানে ৮ শতের ঘরের নম্বর আসবে কোত্থেকে?
দেখে-শুনে হতাশ কণ্ঠে কামাল সুলাইমান বলল, ‘মনে হচ্ছে ভাইয়া ই-মেইলটাই ভূয়া।’
আহমদ মুসার চোখে-মুখে হতাশার কোন চিহ্ন নেই। কিন্তু ভাবছে সে। বলল, ‘যেখান থেকে যেভাবে ই-মেইলটা পাওয়া গেছে, তাতে এটা ভূয়া হবার সম্ভবনা নেই কামাল সুলাইমান।’
‘কিন্তু নম্বর দুটা যে ভূয়া তা দেখাই তো যাচ্ছে।’ বলেই কামাল সুলাইমান হঠাৎ লাফ দিয়ে ঘুরে আহমদ মুসার মুখোমুখি দাঁড়াল। বলল দ্রুতকণ্ঠে ভাইয়া নম্বরের মধ্যে কোন ধাঁধা আছে কি না!’
‘সেটাই ভাবছি কামাল সুলাইমান।’ বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার কথা স্বগতোক্তির মত শোনাল। ভাবছিল আহমদ মুসা। এক সময় সে বলে উঠল, ‘যেখান থেকে হাইম হাইকেলকে শিফট করা হয়েছে, সেই ঠিকানা জর্জ আব্রাহামের মেসেজে আছে। কিন্তু তাতে বাড়ি নাম্বার নেই, বাড়ির নাম আছে। আমরা যদি বাড়ির নাম ধরে খুঁজে বাড়িটা বের করতে পারি, তাহলে বাড়ির নম্বর পাওয়া যাবে এবং সে নম্বরের সাথে এই ই-মেইলের নম্বর মিলালেই নম্বরের ধাঁধাঁ পরিষ্কার হয়ে যাবে।’
বলেই আহমদ মুসা তার মোবাইল বের করে মেসেজটা দেখে নিল। বাড়িটার নাম ‘অলিভার হাউজ।’
‘বাড়ির নাম ‘অলিভার হাউজ’ কামাল সুলাইমান। নামটা বিখ্যাত। নিশ্চয় বড় আকারেই লেখা থাকবে নামটা। চল খুঁজে বের করি।’
বলে আহমদ মুসা হাঁটা শুরু করল।
সন্দেহ সৃষ্টি না করে এমনভাবে দীর্ঘ কয়েক ঘন্টার কষ্টকর সন্ধান শেষে ‘অলিভার হাউজ’ তারা পেয়ে গেল। রাস্তার দক্ষিণ পাশের পুব প্রান্তের শেষ বাড়ি ওটা। বাড়িটার ছাদ থেকে সেন্টক্লিয়ার কেনালে প্রায় থু থু ফেলা যায়। আর ছাদ সোজা নিচে তাকালেই কেনাল এভেনিউ।
বাড়িটার সামনে গিয়ে মুহূর্তের জন্যে দাঁড়াল আহমদ মুসা। পুরাতন ধরনের বিশাল বাড়িটার শ্বেত পাথরের নেম প্লেটে বাড়িটার নামের নিচেই জ্বল জ্বল করছে বাড়িটার নম্বরঃ ৩৩৮ অলিভার এইচ পেরী রোড।
আহমদ মুসা কামাল সুলাইমান দুজনেই পাশাপাশি দাঁড়িয়ে দেখল বাড়ির নাম ও নম্বর।
‘ই-মেইল যে ভূয়া, এই বাড়ির নাম ও নম্বরই আবার তা প্রমান করল ভাইয়া।’ বলল কামাল সুলাইমান।
‘তুমি একজন গোয়েন্দা। চিন্তা না করে কমেন্ট করা তোমার সাজে না। তুমিই বলেছ ই-মেইলের নম্বরের মধ্যে ধাঁধাঁ থাকতে পারে। সে কথা তুমি ভুলে যাচ্ছ কেন?’ আহমদ মুসা বলল।
‘স্যরি ভাইয়া, আপনি পাশে থাকায় আমি গোয়েন্দা সে কথা ভুলে গেছি। কারণ সূর্য যখন আকাশে থাকে, তখন চাঁদের কোন দায়িত্ব থাকে না।’
আহমদ মুসা কামাল সুলাইমানের এই কথার কোন জবাব দিল না।
ভাবছিল সে।
এক সময় আহমদ মুসার মুখটা আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, ‘কামাল সুলাইমান ই-মেইলের বাড়িটার নম্বর কত আছে?’
‘৮৩৩ ভাইয়া।’
‘এ বাড়িটার নম্বরটা ডান দিকে পড়তো কত দাঁড়ায়?’
কামাল সুলাইমানের মুখও উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ‘ইউরেকা’, ইউরেকা’, পাওয়া গেছে ভাইয়া। ই-মেইলে এ বাড়ির নম্বর ডান দিক থেকে লিখে ৩৩৮ কে ৮৩৩ বানিয়েছে।’
‘নতুন বাড়ির যেখানে হাইম হাইকেলকে শিফট করা হয়েছে, তার নম্বর লেখার ক্ষেত্রেও তাহলে ওরা ঐ নীতির অনুসরণ করেছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ঠিক ভাইয়া। তাহলে নতুন নম্বর দাড়াচ্ছে ৬৭৭ যাকে ডান দিক থেকে লিখলে দাঁড়ায় ৭৭৬ যা ই-মেইলে লিখা হয়েছে।’ সাফল্যের আনন্দে মুখ উজ্জ্বল করে বলল কামাল সুলাইমান।
‘এতক্ষণ ধরে রাস্তার বাড়িগুলোর নম্বর সম্পর্কে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, তাতে রাস্তার উত্তর পাশের পুব প্রান্তের কোন বাড়ি হবে এটা। যতদূর মনে পড়ছে শেষ বাড়িটাই নম্বরই এই নম্বর ছিল। সে বাড়িটাও দেখেছি এ বাড়িটার মতই বিশাল ও পুরানো ধাঁচের।’ আহমদ মুসা বলল।
‘চলুন ভাইয়া, যাওয়া যাক।’
‘চল, নম্বরটা দেখা যাক। তবে বাড়িতে এখন ঢুকব না।’
রাস্তা ক্রস করে আহমদ মুসা ও কামাল সুলাইমান চলল অলিভার এইচ পেরী রোডের উত্তর পাশে পুব প্রান্তের দিকে।
দুজনে গিয়ে দাঁড়াল বাড়ির সামনে।
দুজনেরই পরণে ট্যুরিস্ট পোশাক। কাঁধে ট্যুরিস্ট ব্যাগ। দুজনের মাথার চুল কালো-লালে মেশানো, কাঁধ পর্যন্ত নেমে এসেছে। মুখ ভরা দাড়ি। লাল। মুখে রয়েছে লাল মেক আপ। সব মিলিয়ে তারা দুজন নিখুঁত ইউরোপীয় ট্যুরিস্ট পরিণত হয়েছে।
বাড়িটা প্রাচীর ঘেরা।
রাস্তার পাশে কারুকাজ করা বড় গেট।
গেটের পরে বাগান। বাগানের পর বিশাল এলাকা নিয়ে তিনতলা বাড়িটা দেখা যাচ্ছে। বাড়িটার অন্য তিন পাশেও দক্ষিণ পাশের মত বাগান হবে মনে করল আহমদ মুসা। এ ধরনের বাড়িতে কোন অভিযানে যাওয়া সুবিধাজনক, ভাবলো আহমদ মুসা।
আহমদ মুসারা গেটের সামনে দাঁড়িয়ে বাড়িটার নম্বর আনন্দের সাথে দেখছে আর এসব ভাবছে। আর পথচারীরা ভাবছে দু’বিদেশী ট্যুরিস্ট বাড়িটার ঐতিহ্য, বিশাল ও সুন্দর গেটটার কারুকাজ দেখছে হাঁ করে।
হঠাৎ এক সময় আহমদ মুসা ও কাসাল সুলাইমান দুজনেই অনুভব করল, তাদের পেছনে কয়েকজন লোক এসে দাঁড়াবার পরমুহূর্তেই শক্ত দুটি বস্তু এসে তাদের পিঠে ঠেকল। স্পর্শের ধরন থেকে তারা নিশ্চিতই বুঝল তা বাঘা সাইজের রিভলবারের নল হবে।
সঙ্গে সঙ্গে তারা দুজনই একসাথে ফিরে তাকাচ্ছিল। কিন্তু পেছন থেকে কে একজন শক্ত কণ্ঠে বলল, ‘রিভলবারের সাইলেন্সার আছে। মাথা ঘোরাবার চেষ্টা করলেই গুলী করে দেব। চল সামনে চল।’
তার কথার সাথে সাথেই রিভলবারের নলের গুতো খেল তারা পিঠে।
ঘাড় আর ফেরানো হলো না আহমদ মুসাদের। লোকদের দেখতেও পেল না, জানাও হলো না কয়জন তারা। রিভলবারের গুতো খেয়ে তারা সুবোধ বালকের মত হাঁটতে লাগল সামনের দিকে। পেছনের লোকেরাও ছায়ার মত আসতে লাগল তাদের পেছনে।
তারা গেটের মুখোমুখি হতেই গেট খুলে গেল।
আহমদ মুসারা ও পেছনের লোকেরা ভেতরে প্রবেশ করতেই পেছনে দরজা বন্ধ হয়ে গেল স্বয়ংক্রিয়ভাবেই।
আহমদ মুসারা চারদিকটা দেখার জন্যে চোখ তুলে মাথা ঘুরাচ্ছিল। এমন সময় ঘাড়ে কানের নিচটায় প্রচন্ড হাতুড়ির মত একটা আঘাত এসে পড়ল।
গোটা দেহ তার ঝিম ঝিম করে উঠল। ঘুরে গেল মাথা। দুই চোখ তার বন্ধ হয়ে গেল। বোধশক্তি হারিয়ে গেল এক নিকশ অন্ধকারে।
আহমদ মুসা ও কামাল সুলাইমানের দেহ এক সাথেই সংজ্ঞা হারিয়ে খসে পড়ল মাটিতে।

Top