৩৮. ধ্বংস টাওয়ার

চ্যাপ্টার

নিউইয়র্ক রাব্বানিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট আয়াজ ইয়াহুদের বাসভবন। ভেতরের ফ্যামিলি ড্রইং রুমে বসে গল্প করছে আয়াজ ইয়াহুদ, মিসেস আয়াজ ইয়াহুদ, নুমা ইয়াহুদ ও বারবারা ব্রাউন।
বারবারা ব্রাউন কথা বলছিল। সে থামতেই হেসে মুখ খুলল নুমা ইয়াহুদ। কিন্তু তার আগেই আয়াজ ইয়াহুদ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, ‘আটটা বাজছে। বুঝতে পারছি না মি. দানিয়েল এখনও পৌঁছল না কেন। এ বেঠকের সেই আয়োজক। সে দেরি করার ছেলে নয়।’
‘স্যরি আব্বা তোমাকে জানানো হয়নি। বিকেল ৫টায় তিনি টেলিফোন করেছিলেন। কি এক কাজে তিনি আটকে পড়েছেন। তাঁর কিছু দেরি হবে আসতে। তিনি সকলের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন।’ বলল নুমা ইয়াহুদ।
‘কিন্তু তার বন্ধু দুজন শুনলাম সন্ধ্যায় আসবে।’ আয়াজ ইয়াহুদ বলল আবার।
‘হ্যাঁ ওদের সাথে আমার দেখা হয়েছে আব্বা। আমি ওদেরকে শহরের কয়েক জায়গায় নিয়ে গিয়েছিলাম। ওদের সিডিউলে কিছু পরিবর্তন ঘটেছে। কিছুটা দেরি হচ্ছে। অল্পক্ষণের মধ্যেই এসে পড়বেন।’ বলল নুমা ইয়াহুদ।
আয়াজ ইয়াহুদ সোফায় হেলান দিয়ে একটু রিল্যাক্স করে বসল। একটু চোখ বুঝল। তারপর ধীরে ধীরে অনেকটা স্বগত কন্ঠে বলল, দানিয়েল ছেলেটাকে যতই দেখছি বিস্ময় বাড়ছে। হাইম বেঞ্জামিনের কাছ থেকে বারবারা ব্রাউনের উদ্ধার কাহিণীসহ ওখানকার কাহিনীও শুনলাম। আমি ভেবে পাচ্ছি না, হাইম হাইকেলের সাহায্যে এমন একটা বিস্ময়কর চরিত্রের আর্বিভাব কি করে ঘটল। কেন ঘটল? গত কয়েক দিনে এই এক মানুষ বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেছে। হাইম হাইকেলের গোটা ব্যাপার অন্ধকার থেকে আলোতে এসে গেছে।’
‘ঠিক বলেছেন আংকেল, কঠিন পরিস্থিতিতেও তিনি বিস্ময়কর ধরনের নির্ভীক ও নিশ্চিন্ত। পেশাদার শীর্ষ গোয়েন্দাও আমি অনেক দেখেছি, কিন্তু এমন মানুষ আমি দেখিনি। আপনাকে তো সব বলেছি। বারবারা ব্রাউনকে উদ্ধারের সাংঘাতিক কাজ তার ছেলে-খেলার মতই সহজ ছিল।’ হাইম বেঞ্জামিন বলল।
‘ছেলে-খেলা বলছ বেঞ্জামিন! উনি সেখানে জীবন নিয়ে খেলেছেন। সাব মেশিনগানসহ দুপ্রহরীকে হত্যা করার পর উনি দুহাতে রিভলবার নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন দরজায়। তাঁর উপর দিয়ে দুই সাব মেশিনগানের এক ঝাঁক গুলী ছুটে গিয়েছিল। উনি তখন মাটিতে। মাটিতে ঝাঁপিয়ে পড়েই তিনি তার দুরিভলবারের গুলীতে হত্যা করেছিলেন অ্যালেক স্টিভেন্স ও রক্সীকে। তিনি গুলী করতে দেরি করলে কিংবা তাঁর গুলী লক্ষ্যভ্রষ্ট হলে তাঁর দেহ ঝাঁঝরা হয়ে যেত ওদের গুলীতে। অন্যদিকে ঠিকমত ঝাঁপিয়ে পড়তে না পারলেও তিনি ঝাঁঝরা হয়ে যেতেন। একটি মেয়ে যে তার কেউ নয় তাকে উদ্ধারের জন্যে এইভাবে তিনি মৃত্যুর মুখে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। তিনি মানুষ নন, ফেরেশতা!’ বলল বারবারা ব্রাউন। তার কণ্ঠ ভারী হয়ে উঠেছিল।
‘তুমি ঠিক বলেছ বারবারা ব্রাউন। আমি ছেলে-খেলা বলছি এই অর্থে যে, জীবন-মৃত্যুর এই লড়াই তার কাছে খেলার মত যেন।’ হাইম বেঞ্জামিন বলল।
সোজা হয়ে বসেছিল আয়াজ ইয়াহুদ। বলল,‘মা নুমা, দানিয়েল সম্পর্কে কি এক শ্বাসরুদ্ধকর খবর আছে তোমার কাছে বলেছিলে! সেটা তো বলনি!’
নুমা ইয়াহুদের দুই ঠোঁট ভরা হাসি। চোখ দুটি তার অস্বাভাবিক উজ্জল। বলল, ‘হ্যাঁ বাবা, খবরটা শ্বাসরুদ্ধকর। কিন্তু কিভাবে বলব, কোথা থেকে বলব তাই বলা হয়নি।’
‘তার কোন খারাপ দিক নয়তো নুমা? হলে না বলাই ভাল।’ বলল বারবারা ব্রাউন শান্ত কন্ঠে।
‘না সেরকম তো নয়ই।’ বলে একটু থামল নুমা ইয়াহুদ। তারপর বলল। ‘বলব কিন্তু মি. দানিয়েলকে কেউ কিছু জানাতে পারবে না।’ নুমা ইয়াহুদ বলল।
‘ঠিক আছে। অব্যশই আমরা বলব না।’ প্রায় সমস্বরেই বলে উঠল সকলে।
নুমা ইয়াহুদ একটু ভেবে নিল। তারপর বলতে শুরু করল, ‘বিখ্যাত জেফারসন পরিবারের সারা জেফারসন আমার বন্ধু। আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের মিলিত যে স্টুডেন্ট ডেলিগেশন বছর দেড়েক আগে ইউরোপ সফর করেছিল, আমি ও সারা তার সদস্য ছিলাম। সেই থেকে আমাদের সবসময় যোগাযোগ আছে। সে আমার বাসায় এসেছে, আমিও তার বাসায় গেছি। গতকাল সে আমাকে টেলিফোন করে। বলে যে, সে আসছে উইক এন্ডে, সে নিউইয়র্ক আসবে এবং আমার এখানে উঠবে। আমি তাকে ওয়েলকাম করে আংকেল হাইম হাইকেলকে কেন্দ্র করে যা ঘটেছে, আইজ্যাক দানিয়েল নামের লোক যা করেছে, তা বিস্তারিত তাকে বলি। সে আগ্রহের সাথে সব শোনে। আর সে আইজ্যাক দানিয়েল সম্পর্কে খুঁটে খুঁটে অনেক প্রশ্ন করে। তারপর বলে, তুমি যে কাজের বর্ণনা দিলে এবং যে স্বভাব ও চেহারার বর্ণনা দিলে, তাতে আমি নিশ্চিত বলছি, উনি আইজ্যাক দানিয়েল নন।’ আমি জিজ্ঞাসা করি, ‘তাহলে উনি কে? তুমি কি আইজ্যাক দানিয়েলকে চেন।’ সারা বলে যে আইজ্যাক দানিয়েল নামের কোন লোককে সে চেনে না। আমি বলি, তাহলে কেমন করে বলছ, আইজ্যাক দানিয়েল নন তিনি? উত্তরে সারা বলে, তোমার সব বর্ণনা, বিবরণ আর একজনের সাথে সম্পূর্ণ মিলে যায়।’ আমি জিজ্ঞাসা করি যে, ‘সে কে?’ সারা বলে যে, যে কারণে তিনি ছদ্মনাম ব্যবহার করেছেন, সে কারণে তার নাম প্রকাশ ঠিক হবে না।’ আমি বলি যে, আমরা এবং হাইম পরিবার তার সাথে আছি এবং তাকে সাহায্য করছি। আমাদের কাছে তার পরিচয় বলা যাবে না কেন? তথ্যটা আমাদের ও হাইম পরিবারের বাইরে যাবে না এই শর্তে তিনি আইজ্যাক দানিয়েলের নাম ও পরিচয় বললেন। শেষে সারা কয়েকটা আইডেনটিফিকেশন মার্কের কথা বললেন। বললেন যে, তাঁর ঠোঁটের দুপ্রান্তে দুটি নীলাভ তিল আছে এবং ডান হাতের কনুই-এর নিচে প্রায় গোলাকার লালচে একটা ক্ষতচিহ্ন আছে। গতকাল মি. দানিয়েল আমাদের বাসায় আসেন, তখন তার হাত-মুখ ধোবার সময় আমি চেষ্টা করে তার ঠোঁটের তিল এবং কনুই-এর নিচের ক্ষতিচিহ্নটা দেখেছি। সুতারাং সারা আন্দাজে যা বলেছিলেন তা একশতভাগ সত্য প্রমাণিত হয়েছে। আর…………।’
‘মা নুমা, তুমি কি আমাদের ধৈর্য্যের টেস্ট নিচ্ছ? আমরা আর অপেক্ষা করতে পারছি না। তুমি তার নাম পরিচয় বল। তারপর অন্য কথা।’ নুমা ইয়াহুদকে থামিয়ে বলে উঠল তার পিতা আয়াজ ইয়াহুদ।
হাসল নুমা ইয়াহুদ। বলল, ‘পরিচয় বলতে হবে না আব্বা। নামেই তার পরিচয়।’
‘আবার কথা নুমা………।’ অধৈর্য্য কণ্ঠে বলল আয়াজ ইয়াহুদ।
গম্ভীর হলো নুমা। বলল, ‘আব্বা, আমাদের আইজ্যাক দানিয়েল হলেন মুসলমানদের সৌভাগ্যের বরপুত্র এবং মেজরিটি মার্কিনীদের কাছে যিনি নতুন সেভিয়ার…………।’
‘তার মানে ‘আহমদ মুসা’ তিনি!’ নুমা ইয়াহুদের কথার মাঝখানে তাকে থামিয়ে চিৎকার করে বলে উঠল বারবারা ব্রাউন।
‘হ্যাঁ বারবারা। আহমদ মুসাই তোমাকে উদ্ধার করেছে।’ বলল নুমা ইয়াহুদ।
সোফায় সোজা হয়ে বসে আছেন আয়াজ ইয়াহুদ। উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে গেছে হাইম বেঞ্জামিন ও বারবারা ব্রাউন। তাদের চোখে-মুখে রাজ্যের বিস্ময়।
তারা কেউই কথা বলল না। কথা বলতে পারল না।
ধীরে ধীরে সোফায় হেলান দিল আয়াজ ইয়াহুদ এবং এক সময় আস্তে আস্তে সোফায় বসে পড়ল হাইম বেঞ্জামিন ও বারবারা ব্রাউন।
তখনও কেউ কথা বলেনি।
কোন ভাবনার গভীরে তারা যেন হারিয়ে গেছে।
এক সময় ক্লান্ত সুরে স্বগত কণ্ঠে আয়াজ ইয়াহুদ বলল, ‘আমরা যাকে ইহুদীদের শত্রু ভাবছি, সেই আহমদ মুসা এসেছেন গোঁড়া ইহুদী হাইম হাইকেলকে উদ্ধার করতে তাদের হাত থেকে যারা ইহুদীদের পক্ষের শক্তি! সেই আহমদ মুসাই ইহুদীদের এক নিবেদিত কর্মী বারবারা ব্রাউনকে উদ্ধার করলেন ধর্ষিত ও নিহত হওয়ার চরম পরিণিতি থেকে সেই তাদেরই হাত থেকে যারা ইহুদীদের শক্তি! এবং আমরা নিষ্ঠাবান ইহুদীরা সাহায্য করছি আহমদ মুসাকেই!’
থামল আয়াজ ইয়াহুদের স্বগত কণ্ঠ।
পিতা থামতেই নুমা ইয়াহুদ বলল, ‘আব্বা, ধর্মভীরু ও নিষ্ঠাবান ইহুদীরা এর আগেও আহমদ মুসাকে সাহায্য করেছে। ডা. বেগিন বারাকের মত সৎ, সজ্জন ও বিখ্যাত ইহুদী ব্যক্তিত্ব সাহায্য করেছেন আহমদ মুসাকে ইহুদী পক্ষের জেনারেল শ্যারনদের বিরুদ্ধে। আবার ইয়াহুদীদের শীর্ষ গোয়েন্দা কর্মী নোয়ান নাবিলা সম্পূর্ণভাবে নিজ পক্ষের বিরুদ্ধে গিয়ে নিউ হারমান হত্যাকান্ডের মুখোশ উন্মোচন করে শুধু আহমদ মুসা ও আমেরিকান মুসলমানদেরই বাঁচিয়ে দেয়নি, জেলে পুরেছেন নিজ পক্ষের জেনারেল শ্যারনদেরকে এবং কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন আমেরিকান ইহুদীবাদীদের। আব্বা আমি মনে করি, আহমদ মুসা শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রী ও শান্তিবাদীদেরই সেভিয়ার নন, তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ধর্মপ্রাণ ইহুদীদেরও রক্ষা করেছেন ইহুদীবাদীদের হাত থেকে। জেনারেল শ্যারন ও আজর ওয়াইজম্যানদের রাজনৈতিক ইহুদীবাদ এবং আমাদের তাওরাতভিত্তিক ইহুদী ধর্ম এক নয় আব্বা। বলতে পারি, মেজরিটি ইহুদীর সমর্থনও তাদের পেছনে নেই।’
থামল নুমা ইয়াহুদ।
সঙ্গে সঙ্গেই কথা বলে উঠল বারবারা ব্রাউন, ‘ঠিক বলেছ নুমা, লস আলামসের ইহুদীবাদী গোয়েন্দাবৃত্তি ধরা পড়া এবং নিউ হারমানের হত্যাকান্ডের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইহুদী কম্যুনিটির প্রায় ৯০ ভাগ সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় সংগঠন জেনারেল শ্যারনের ইহুদীবাদী সংগঠনের সাথে তাদের নিসম্পর্কতার ঘোষণা দেয় এবং ইহুদীবাদীদের নিন্দা করে। তখন দেশব্যাপী বহু চেষ্টা করেও সেসব সংগঠনকে আমরা নিরপেক্ষ ও নিরব রাখতেও সমর্থ হইনি।’
‘হাইম হাইকেলকে আটকে রাখাও তো ওদের একটা ক্রাইম।’ বলল আয়াজ ইয়াহুদ।
‘অবশ্যই আব্বা। ওদের যদি ক্রিমিনাল না বলি, তাহলে ক্রিমিনাল বলতে হবে হাইম হাইকেল আংকেলকেই। কিন্তু তা সম্ভব নয়। তাঁর মত নির্লোভ ও স্বার্থত্যাগী দেশ ও জাতির সাথে কোন ক্রাইম করতে পারেন না। জীবন থাকতে জাতির জন্যে ক্ষতিকর কিছু করতে পারেন না।’ নুমা ইয়াহুদ বলল।
‘তাহলে হাইম হাইকেলকে উদ্ধারের জন্যে আমরা যে আহমদ মুসাকে সাহায্য করছি এবং সাহায্য নিচ্ছি, এটা ঠিক আছে?’ বলল আয়াজ ইয়াহুদ।
‘অবশ্যই আব্বা। আমাদের মনে করা উচিত যে, ঈশ্বরই তাকে পাঠিয়েছেন আমাদের সাহায্যে। দেশের কারো কাছ থেকে আমরা সাহায্য পাব না বলেই ঈশ্বর এই ব্যবস্থা করেছেন।’ নুমা ইয়াহুদ বলল।
‘তোমার এ কথার মধ্যে দিয়ে কিন্তু দেশের মানুষের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ পাচ্ছে নুমা।’ বলল আয়াজ ইয়াহুদ।
‘না আব্বা, এর দ্বারা আমি দেশের মানুষের ইনাবিলিটি বা অসহায় অবস্থার দিকে অংগুলি সংকেত করছি। এই ইনাবিলিটি বা অসহায়ত্বের কারণেই যুগ যুগ ধরে চলা ইহুদীবাদী ষড়যন্ত্র ধরতে তারা ব্যর্থ হয়েছে। অথচ কত তাড়াতাড়ি আহমদ মুসা তার মূলোচ্ছেদ করলেন।’ নুমা ইয়াহুদ বলল।
হাসল আয়াজ ইয়াহুদ। বলল, একটু দ্বিধায় পড়েছিলাম। তোমার কথায় সাহস পেলাম মা। সত্যিই আমরা কোন অন্যয় করছি না এবং যা করা উচিত তাই করছি। তোমকে ধন্যবাদ নুমা।’
‘আংকেল, শ্রদ্ধেয় হাইম হাইকেল ও তাঁর পরিবার এবং আমাদের সাথে ওরা যে আচরণ করেছে, সেটাই প্রমাণ করছে ওরা কোন ষড়যন্ত্রের মধ্যে যুক্ত আছে। ষড়যন্ত্রের সে লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য তারা কোন নীতি-নৈতিকতার ধার ধারছে না। ধর্ম, মানবতা সবকিছু বিসর্জন দিয়ে তারা তাদের লক্ষ্যের বাস্তবায়ন চায়। সুতরাং তারা ধর্ম ও জাতির কল্যাণে কিছু করছে না।’ বলল বারবারা ব্রাউন।
‘ঠিক মা। হাইম হাইকেলকে তারা কিডন্যাপ করার পর আমাদের সাথে তাদের আচরণও তুমি যা বলেছ তাই প্রমাণ করে। রীতিমত সন্ত্রাসী আচরণ করেছে ওরা আমাদের সাথে।’ আয়াজ ইয়াহুদ বলল।
‘নুমা, আহমদ মুসা সম্পর্কে মিস সারা জেফারসনের মনোভাব কেমন বুঝলে?’ জিজ্ঞাসা বারবারা ব্রাউনের।
হাসল নুমা ইয়াহুদ। বলল এক বাক্যে জবাবটা হলো, পূজ্যের প্রতি পূজারীর মনোভাব যেমন।’
‘উদাহারণটা বড় বেশি আকাশ-চারী হয়ে গেল না কি?’ বলল বারবারা ব্রাউন।
আবার হাসলো নুমা ইয়াহুদ। বলল,‘তুমি যদি শুনতে ‘আহমদ মুসা’ নামটি সারা জেফারসন কেমন সংকোচ, সম্মান, সংবেদনশীল কণ্ঠে উচ্চারণ করেছে, তাহলে আকাশ-চারী হওয়ার কথা তুমি বলতে না। তাছাড়া বিশ্বাসের ব্যাপারে প্রশ্ন করলে সারা জেফারসন বলেছে, নিজের উপর আমার যতটা বিশ্বাস আছে, তার চেয়ে বেশি বিশ্বাস আছে আমার ওর উপর। জেফারসন পরিবারের গৌরবদীপ্ত একটি মেয়ে এবং আমেরিকার শ্রেষ্ট ছাত্র প্রতিভা সারা জেফারসন কোন অবস্থায় এ ধরনের এ উক্তি করতে পারে বলত?’
নুমা ইয়াহুদ থামতেই কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছিল বারবারা ব্রাউন। এ সময় সিকিউরিটির দুজন লোক কামাল সুলাইমান ও বুমেদীন বিল্লাহকে নিয়ে প্রবেশ করল।
উঠে দাঁড়াল নুমা ইয়াহুদ। ওদের স্বাগত জানাল এবং তার পিতাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘আব্বা এঁরাই আইজ্যাক দানিয়েলের বন্ধু।’
সবাই উঠে দাঁড়াল।
নুমা ইয়াহুদ কামাল সুলাইমানকে দেখিয়ে বলল, ‘আব্বা, ইনি আলফ্রেড স্মিথ।’ আর বুমেদীন বিল্লাহকে দেখিয়ে বলল, আর ইনি একজন বিখ্যাত সাংবাদিক আমর আব্রাহাম।’
‘ওয়েলকাম ইয়ংম্যান। তোমাদের বন্ধু আইজ্যাক দানিয়েল খুবই ভাল মানুষ, খুবই কাজের মানুষ। খুব খুশি হলাম তোমাদের পেয়ে।’ বলল আয়াজ ইয়াহুদ।
‘ধন্যবাদ স্যার। আমরা বন্ধুর কাছে আপনার কথা শুনেছি। আপনার মূল্যবান সহযোগিতার জন্যে কৃতজ্ঞ।’ কামাল সুলাইমান বলল।
একটু ভ্রু কুঁচকিয়ে মিষ্টি হাসল আয়াজ ইয়াহুদ। বলল, ‘ইয়ংম্যান, তোমার বন্ধুকে সহযোগিতা করছি, না তোমার বন্ধুই আমাদের সহযোগিতা দিচ্ছেন আমাদের লোককে উদ্ধারের জন্য?’
ধরা পড়ে যাবার মত একটু চমকে উঠেছিল কামাল সুলাইমান। তাড়াতাড়ি বলল, ‘স্যার দুটোই ঠিক। তবে সহযোগিতার জন্য আমাদের বন্ধুই তো প্রথম আপনার সাথে দেখা করে।’
হাসল আয়াজ ইয়াহুদ। বলল, ‘তার মানে তুমি তোমার কথার উপরই দাঁড়িয়ে থাকলে!
হাসল কামাল সুলাইমানও। বলল, ‘আমি ঘটনার বর্ণনা দিয়েছি মাত্র স্যার। মিথ্যা নিশ্চয়ই বলিনি।
উত্তর না দিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল আয়াজ ইয়াহুদ। বলল এক সময়, ‘মিথ্যা কথা তুমি নিশ্চয় বল না। বলত আইজ্যাক দানিয়েলের আসল নাম কি? ‘আহমদ মুসা’ কিনা?’
সন্দেহ ও কঠোরতায় ঢেকে গেল কামাল সুলাইমানের মুখ। তার ডান হাত তার অজ্ঞাতসারেই প্রবেশ করে চেপে ধরল রিভলবারের বাট। বুমেদীন বিল্লাহর চোখে-মুখেও সন্দেহ ও বিস্ময়।
হেসে উঠল নুমা ইয়াহুদ। বলল, ‘মি. আলফ্রেড স্মিথ, রিভলবার বের করার দরকার নেই। আমরা আইজ্যাক দানিয়েলকে নয়, আহমদ মুসাকে চাই। হাইম হাইকেলকে উদ্ধারের জন্যে আহমদ মুসাকে প্রয়োজন। আর মি. আমর আব্রাহাম আপনার সন্দেহ-বিস্ময়ের কোন প্রয়োজন নেই।’
একরাশ নতুন বিস্ময় এবার কামাল সুলাইমান ও বুমেদীন বিল্লাহ দুজনের চোখে মুখে। বলল কামাল সুলাইমান, আপনাদের সাথে নাটকীয়তার যুক্তি আছে। কিন্তু আহমদ মুসা ভাই আমাদের অন্ধকারে রাখার কারণ বুঝতে পারছি না।’
‘মি আহমদ মুসা নিজেই এখনও অন্ধকারে আছেন। তিনি আহমদ মুসা এটা আমরা জেনে ফেলেছি তা তিনি জানেন না।’ বলল নুমা ইয়াহুদ।
‘আপনারা জানলেন কি করে?’ বলল বুমেদীন বিল্লাহ।
আমার বন্ধু সারা জেফারসনের কাছ থেকে।’ নুমা ইয়াহুদ বলল।
কিছু বলতে যাচ্ছিল বুমেদীন বিল্লাহ। কিন্তু তার আগেই নুমা ইয়াহুদ আবার বলল, ‘এবার মি. স্মিথ আপনার সম্পর্কে সত্য কথা বলুন। আর মি. আমর আব্রাহাম আপনার সুন্দর আরবীয় চেহারার পরিচয়টাও এবার দিন।’
‘আইজ্যাক দানিয়েল ‘আহমদ মুসা’ হলে আলফ্রেড স্মিথকে ‘কামাল সুলাইমান’ হতে হবে।’ আর সুন্দর আরবীয় চেহারা তার পরিচয় নিজে দেবে। হেসে বলল কামাল সুলাইমান।
‘আমেরিকার আসার আগে আটলান্টিকের ওপারে যে নামটা রেখে এসেছি, তা মনে পড়ছে না এখন। কারণ কখনও ভাবিনি যে, পুরানো নামটা দরকার পড়বে।’ বুমেদীন বিল্লাহ বলল গম্ভীর কণ্ঠে।
হাসল কামাল সুলাইমান। বলল, ‘সাংবাদিকরা জবাব শুনতে অভ্যস্ত, জবাব দিতে নয়। আমিই বলছি। ওঁর নাম,‘বুমেদীন বিল্লাহ।’ জন্ম আলজিরিয়ায়। স্থায়ী নিবাস ফ্রান্সে। লা’মন্ডের সাংবাদিক।’
‘তার মানে ‘স্পুটনিক’ ও ‘সাও তোরাহ’-এর উপর যে চাঞ্চলকর রিপোর্ট করেছিলেন, ইনি সেই বুমেদীন বিল্লাহ?’ বিস্ময়ের সাথে বলল নুমা ইয়াহুদ।
‘আপনি রিপোর্টগুলো পড়েছেন?’ জিজ্ঞাসা কামাল সুলাইমানের।
‘হ্যা ইন্টারনেটে পড়েছি।’ নুমা ইয়াহুদ বলল।
একটু থেমে নুমা ইয়াহুদ আবার বলে উঠল,‘মি. বিল্লাহ, নামের মত সাংবাদিকতাকেও তো আটলান্টিকের ওপারে রেখে আসেননি?’ মুখে হাসি নুমা ইয়াহুদের।
‘সাংবাদিকতা করতে নাম লাগে না। নিউজে নাম না থাকলেও চলে। সুতারাং ওটা রেখে আসার দরকার হয়নি।’ বুমেদীন বিল্লাহ বলল।
‘যাক বাঁচা গেল।’ বলল নুমা ইয়াহুদ।
কি বাঁচা গেল?’ জিজ্ঞাসা কামাল সুলাইমানের।
‘শিক্ষানবীস হয়ে ওঁর পেছনে ঘোরার একটা সুযোগ হয়ে গেল। সাংবাদিকতা করা ও লেখা আমার শখ। এখন………..।’
কথা শেষ করতে পারল না নুমা ইয়াহুদ। দরজায় নক করেই ড্রইং রুমে প্রবেশ করল আহমদ মুসা। তার হাতের মোবাইল কানে ধরে রাখা। কথা বলছে সে।
আহমদ মুসা রুমে প্রবেশ করে হাত তুলে ইংগিতে সবাইকে শুভেচ্ছা জানিয়ে একটা সোফায় বসে পড়ল। চলছিল তার কথোপকথনঃ
‘জি জনাব আমি উদগ্রীব আছি রেজাল্টটা জানার জন্যে।’ বলল আহমদ মুসা।
তুমি বলার সঙ্গে সঙ্গেই কাজ শুরু করে দিয়েছিলাম। কিন্তু ওই পথে ভাল রেজাল্ট পাওয়া যায়নি। সরকারী বেসরকারী কোন হাসপাতাল-ক্লিনিকেই ঐ নামের লোক ভর্তি নেই। এমনকি দুচার বেডের ডিসপেন্সারীও আমরা চেক করেছি। ঐ নামের লোকের সন্ধান পাইনি। হাসপাতাল-ক্লিনিক-ডিসপেন্সারী থেকে মানসিক চিকিৎসা সেবা নিয়েছে এমন তালিকাও আমরা চেক করেছি। কিন্তু কোথাও ঐ নামের লোক পাওয়া যায়নি। পরে আমি মি. ডবল এইচের ফটো ইন্টারনেটে আমাদের গোটা নেটওয়ার্কে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। এতে ফল পাওয়া গেছে। তাঁর সন্ধান পাওয়া গেছে। ঠিকানাটা আমি তোমাকে টেলিফোনে এইভাবে বলব না। তোমার মোবাইলেই তুমি আজই একটা কোড-মেসেজ পেয়ে যাবে।’ বলল ওপার থেকে।
‘আপনাকে অসংখ্যা ধন্যবাদ জনাব। আমার জন্য আপনি অনেক পরিশ্রম করেছেন। আমি কৃতজ্ঞ জনাব।’
‘এত ধন্যবাদ, কৃতজ্ঞতা কেন? কাজটা আমাদের। আমাদের করা উচিত ছিল। তুমি আমাদের কাজ করে দিচ্ছ। ধন্যবাদ, কৃতজ্ঞতা তো আমরা তোমাকে জানাব।’
‘কিন্তু এই কাজটা আপনারা করলেন না, করছেন না কেন?’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমি হেড কোয়ার্টার থেকে সুযোগমতই কাজ শুরু করতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু তুমি বিষয়টাকে টেক আপ করার পর আমরাও কাজটা তোমাকেই দিয়ে দিয়েছি। আমরা যদি তাঁকে উদ্ধার করি তাহলে তুমি যা চাও তা তোমার পাওয়া কঠিন হতো।’ টেলিফোনের ওপ্রান্ত থেকে বলল।
‘বুঝেছি। ধন্যবাদ জনাব। বলল আহমদ মুসা।
‘সারা জেফারসনের সাথে তো আপনার যোগাযোগ হয়নি।’
‘জি না জনাব। সুযোগ হয়নি। আর আমি জানি না সে কোথায়। কিন্তু আপনি কি করে জানলেন?’
‘তোমার আগে সে আমাকে কয়েকদিন আগে টেলিফোন করে। তার কাছে জানতে পারি তুমি কি করছ। সে আমাকে অনুরোধ করে আমি যেন এই বিপদজনক মিশনে তোমাকে ফলো করি।’
‘কিন্তু সে কি করে জানল?’
‘আমি জিজ্ঞাসা করিনি। কিন্তু তুমি আমেরিকায় এসেছ। তার খোঁজ নেয়া উচিত ছিল।’
‘আমি ভীষণ ব্যস্ত ছিলাম জনাব।
‘ওকে, ইয়ংম্যান। এখনকার মত এটুকুই। ঠিকানা পাওয়ার পর তুমি কি করছ, প্রয়োজন হলে আমাকে জানিও। সালাম।’
‘সালাম, জনাব।’ বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা তার মোবাইল বন্ধ করেই বলল, ‘স্যরি টু অল। খুব জরুরি টেলিফোন ছিল। বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলাও সম্ভব ছিল না।’
‘আমাদের লজ্জা দিবেন না আহমদ মুসা। আপনার দুঃখিত হবার কোন কারণ নেই। আমরাই দুঃখিত যে, আপনি কথা বলতেই নিশ্চয়ই অসুবিধা বোধ করেছেন।’ বলল আয়াজ ইয়াহুদ।
আয়াজ ইয়াহুদের মুখে নিজের নাম শুনে বিস্ময়ে তার চোখ দুটি ছানাবড়া হয়ে উঠেছে। সে প্রথমেই চোখ ভরা প্রশ্ন নিয়ে তাকাল কামাল সুলাইমানদের দিকে।
সুলাইমান কিছু বলার জন্যে মুখ খুলছিল। কিন্তু তার আগেই নুমা ইয়াহুদ বলে উঠল, ‘এক্সলিন্সি আহমদ মুসা, মি. কামাল সুলাইমানদের কাছ থেকে আপনার পরিচয় আমরা পাইনি। আপনার পরিচয় আমরা জেনেছি অন্যসূত্রে।’ হেসে বলল নুমা ইয়াহুদ।
‘কার কাছ থেকে জেনেছেন?’ জিজ্ঞাসা করল আহমদ মুসা নুমা ইয়াহুদকে।
‘জবাবটা কি এখনি প্রয়োজন এক্সেলেন্সি?’ বলল নুমা ইয়াহুদ।
‘এজন্যে প্রয়োজন যে, আমার পরিচয়টা কোন পর্যন্ত পৌঁছেছে তা জানার উপর আমার সামনে এগুনো নির্ভর করছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘সে ধরনের কোন চিন্তার প্রয়োজন নেই এক্সিলেন্সি আহমদ মুসা। বিষয়টা আমি জেনেছি জেফারসন পরিবারের সারা জেফারসনের কাছ থেকে। সে আমার বন্ধু। এক্সেলেন্সি আসার পর থেকে হাইম হাইকেলের ঘটনা নিয়ে যা ঘটেছে তা আমি জেফারসনকে বলেছিলাম। সব শোনার পর সে বোধ হয় নিশ্চিত হয়েছিল যে, আমরা এক্সিলেন্সির পক্ষের শক্তি। তখন সে এক্সিলেন্সির পরিচয় আমাদের দিয়েছিল।’ নুমা ইয়াহুদ বলল।
‘কিন্তু এসব ঘটনার সাথে আহমদ মুসা জড়িত, এটা সারা জেফারসন জানল কি করে?’ আহমদ মুসার জিজ্ঞাসা।
হাসল নুমা ইয়াহুদ। বলল, ‘সারা সব শোনার পর বলেছিল, এই কাজ, এই ধরনের আচরণ এবং এই চেহারা দুনিয়াতে একজনেরই হতে পারে। পরে আলোচনা শেষে নামটাও বলেছিলেন। আজ সকালেও তার সাথে আমি কথা বলেছি। কথায় কথায় সে আজ বলল, ওঁর পরিচয় তোমাদের দিয়েছি এজন্যে যে, ওঁর দিকে তোমাদের লক্ষ্য রাখা উচিত। যিনি সবার জন্য ভাবেন, নিজের জন্যে ভাবার অবসর তার থাকে না। তাই তার জন্য সবাইকে ভাবতেই হবে। তবে আজ একটা খারাপ খবরও দিয়েছে। এ সপ্তাহেই তার নিউইয়র্ক আসার কথা তার অফিসের এক কাজ নিয়ে। কিন্তু আজ জানালেন, তোমরা এখন সাংঘাতিক ব্যস্ত। এখন আমি নিউইয়র্ক যাচ্ছি না।’
থামল নুমা ইয়াহুদ।
নুমা ইয়াহুদ থামতেই আয়াজ ইয়াহুদ বলে উঠল, ‘মি. আহমদ মুসা, আপনার পরিচয় আমাদের সীমাহীন আনন্দ দিয়েছে শুধু নয়, বুকে আমরা সাহস ফিরে পেয়েছি এবং অপার স্বস্তি লাভ করেছি। বিনা অষুধেই মনে হচ্ছে আমার ব্লাড প্রেসার এখন স্বাভাবিক। অন্য সবার অনুভূতিও আমার মতই। সুতারাং আপনার অসন্তুষ্ট হওয়া উচিত নয়।’
‘আর আপনি নিশ্চিত থাকুন আহমদ মুসা। আপনার এই পরিচয় এখানে উপস্থিত চারজন ছাড়া বাইরে যাবে না।’
‘ধন্যবাদ। কিন্তু আপনি আমাকে ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করছেন কেন হঠাৎ? আর নুমার কাছে হঠাৎ ‘এক্সিলেন্সি’ হয়ে গেলাম কেন?’ বলল আহমদ মুসা।
‘আমি আইজ্যাক দানিয়েলকে ‘তুমি’ বলেছি, আহমদ মুসাকে নয়। সুতরাং আহমদ মুসার ক্ষেত্রেই নতুন সম্বোধন হবে।’ বলল আয়াজ ইয়াহুদ।
নুমা ইয়াহুদও বলল, ‘আমারও এটাই জবাব। কিন্তু আমাকে আপনার আপনি সম্বোধন চলে না। আপনি বদলেছেন, আর আমি সে নুমাই আছি।’
‘ঠিক আছে, আইজ্যাক দানিয়েল ইহুদী বলে তাকে কাছে টেনে নিয়েছিলেন আপনারা। কিন্তু এখন আহমদ মুসা সেই ট্রিটমেন্ট পেতে পারে না! যাক, এখন আসুন আমরা কাজের আলোচনায় আসি।’ বলে একটু থেমেই আহমদ মুসা কথা বলা শুরু করতে যাচ্ছিল।
ওদিকে আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই আয়াজ ইয়াহুদ তার আসন থেকে এক লাফে উঠে এসে জড়িয়ে ধরল আহমদ মুসাকে। বলল, ‘দেখ, আমাদের বিস্মিত করেছ, মুগ্ধ করেছ, আমাদের চোখ খুলে দিয়েছ তুমি, আইজ্যাক দানিয়েল নামটা নয়। কিন্তু তোমার নতুন পরিচয় হঠাৎ তোমাকে সন্তানের আসন থেকে তুলে নিয়ে মাথায় বসাচ্ছিলাম। কিন্তু তুমি মাথা নয় বুক পছন্দ করেছ। তোমাকে ধন্যবাদ। তুমি মাথা থেকে নেমে কিন্তু আরও বেশি মাথায় উঠলে আমাদের।’ আবেগে ভারী হয়ে উঠেছে আয়াজ ইয়াহুদের কণ্ঠ।
আয়াজ ইয়াহুদের আবেগাপ্লুত কণ্ঠ গোঠা পরিবেশকেই ভারী করে তুলেছে। নুমা ইয়াহুদের চোখের দুকোণায় অশ্রু চিক চিক করছে। বারবারা ব্রাউন ঠোঁট কামড়ে মাথা নিচু করেছে। একটা উচ্ছাস সে দমন করতে চেষ্টা করছে। আর হাইম বেঞ্জামিনের উজ্জ্বল চোখ সম্মোহিতের মত তাকিয়ে আছে আহমদ মুসার দিকে।
আয়াজ ইয়াহুদ আহমদ মুসাকে তার সিটে বসিয়ে ফিরে গেল আসনে। বলল,‘হ্যাঁ আহমদ মুসা তোমার কাজের কথা শুরু কর। কিন্তু তার আগে বল, ঐ জরুরি টেলিফোনটা কার ছিল? আলোচনা শুনে বুঝা গেল হাইম হাইকেলের বিষয় নিয়েই তোমরা কথা বলেছ।’ ‘জি, আমরা ড. হাইম হাইকেলের বিষয় নিয়েই আলোচনা করেছি। টেলিফোনটা করেছিলেন ওয়াশিংটন থেকে FBI-এর প্রধান জর্জ আব্রাহাম। তিনি………..।
আহমদ মুসার কথার মাঝখানেই বলে উঠল আয়াজ ইয়াহুদ, ‘FBI-এর চীফকে তুমি চেন? তিনি চেনেন তোমাকে?
‘জি হ্যাঁ, তিনি আমাকে তাঁর ছেলের মতই স্নেহ করেন।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কেন আব্বা, ‘লস আলামোস’ ও নিউ হারম্যান’ ঘটনার পর এ সংক্রান্ত রিপোর্টগুলো পড়নি? ওতেই তো আছে, গোয়েন্দা, সেনাবাহিনী, এমনকি রাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায়ে তার যোগাযোগ ও তাঁদের সাথে সহযোগিতা বিনিময়ের কথা।’ বলল নুমা ইয়াহুদ।
‘ঠিক ঠিক নুমা। পড়েছি আমি স্টোরিগুলো। কিন্তু আহমদ মুসা বুঝতে পারছি না, ওরা থাকতে ওদের সহযোগিতা না নিয়ে একা এইভাবে লড়তে এসেছ কেন?’ বলল আয়াজ ইয়াহুদ।
‘পুলিশ ও গোয়েন্দাদের সাহায্য নিতে গেলে বিষয়টা জানাজানি হয়ে যাবে। কারণ গোয়েন্দা ও পুলিশের মধ্যে ঐ শত্রু পক্ষের লোকও আছে। আর যদি ওরা জানতে পারে, তাহলে ওরা ধরা পড়ার আগে হাইম হাইকেলকে খুনও করতে পারে। এজন্যেই আমরা একা, নিরিবিলি কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। শত্রুদের যতদূর সম্ভব জানতে না দিয়ে আমরা তার উপর চড়াও হতে চাই।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ওরা ধরা পড়ার আগে হাইম হাইকেলকে খুন করতে পারে।’ এই কথা শুনে হাইম বেঞ্জামিন ও বারবারা ব্রাউন দুজনেরই মুখ উদ্বেগে চুপসে গিয়েছিল। কিন্তু আহমদ মুসার শেষ কথা শুনে তাদের মুখে স্বস্তি ফুটে উঠল।
‘ধন্যবাদ আহমদ মুসা। এক যুগ পরের কথা তুমি এক যুগ আগেই চিন্তা করতে পার। তুমি যা চিন্তা করেছ তা অক্ষরে অক্ষরে সত্য।’ বলল আয়াজ ইয়াহুদ আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই।
আহমদ মুসা সোফায় একটু গা এলিয়ে দিয়েছিল। সোজা হয়ে বসল আবার। আয়াজ ইয়াহুদ থামতেই আহমদ মুসা বলতে শুরু করল, ‘একটা সুখবর এবং অত্যন্ত গোপন খবর হলো, ‘হাইম হাইকেলের সন্ধান পাওয়া গেছে। আমি জর্জ আব্রাহামকে অনুরোধ করেছিলাম, তার বিশ্বস্ত গোয়েন্দা দিয়ে এবং কম্পিউটার রেকর্ড মনিটর করার মাধ্যমে দেশের সব মানসিক হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে হাইম হাইকেলের খোঁজ নিতে। কিন্তু ঐ নামের কাউকে হাসপাতালে পাওয়া যায়নি। শেষে তিনি ফটো সরবরাহের মাধ্যমে খোঁজ করেছেন। সফল হয়েছেন। আজই আমি পেয়ে যাচ্ছি ঠিকানা। তারপরেই বেরুতে হবে অভিযানে।’
সকলের চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। আনন্দ-উদ্বেগ ঠিকরে পড়েছে হাইম বেঞ্জামিন ও বারবারা ব্রাউনের মুখ থেকে। হাইম বেঞ্জামিন বলে উঠল আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে, ‘স্যার, পুলিশের সাহায্য নিয়ে তো আপনি আরও দ্রুত তাঁকে উদ্ধার করতে পারেন!’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘কিন্তু বললাম তো, পুলিশ জানতে পারলে সঙ্গে সঙ্গে শত্রুরা জানতে পারবে, এ ভয়ে আছে। জানতে পারলে হয় তাঁকে অন্যত্র সরিয়ে ফেলবে ওরা, নয়তো মেরেও ফেলতে পারে। এজন্যেই ওপথে যাওয়া যাবে না।’
‘স্যরি স্যার। আমার কথা প্রত্যাহার করছি। আপনি ঠিকই বলেছেন। নিউইয়র্ক, ফিলাডেলাফিয়ার অধিকাংশ পুলিশকেই আন্তরিক পাওয়া যায়নি। সবাই মিলে এই ঘটনাকে চাপা দিচ্ছিল। আপনি ঠিকই বলেছেন স্যার। আপনাকে ধন্যবাদ স্যার।’ বলল কম্পিত কণ্ঠে হাইম বেঞ্জামিন।
‘ধন্যবাদ বেঞ্জামিন।’ আহমদ মুসা বলল।
একটু নিরবতা।
পরক্ষণেই নিরবতা ভাঙল আয়াজ ইয়াহুদ। বলল, ‘একটা প্রশ্নের উত্তর আমরা পাইনি আহমদ মুসা। হাইম হাইকেলকে উদ্ধার করার জন্যে আহমদ মুসার আগমন কেন? এখানে দ্বন্দ্বটা ইহুদী ইহুদীতে!’
‘না এখানে দ্বন্দ্বটা ষড়যন্ত্রের সাথে সত্যের।’ আহমদ মুসা বলল।
‘দ্বন্দ্বের বিষয়টাকে তুমি ঠিকই ধরেছ। কিন্তু ষড়যন্ত্রের দুটি পক্ষই ইহুদী।’
‘কিন্তু তাতে কি? ইহুদীদের সাথে আমার কোন শত্রুতা নেই। আমার বিরোধ ষড়যন্ত্রকারীদের সাথে। তারা ছাড়া সকলের সাথেই আমার শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমরা বিরোধের ব্যাপারটাই জানতে চাচ্ছি। তারা হাইম হাইকেলকে অপহরণ করে আটকে রেখেছে শুধু এটা কি? আমি মনে করি এটা নয়। কারণ এমন কিডন্যাপ ও আটকের ঘটনা আমেরিকায় অসংখ্যা হয়েছে, হচ্ছে। সত্য ও ষড়যন্ত্রের লড়াইও হচ্ছে। কিন্তু তুমি ছুটে এসেছ শুধুমাত্র হাইম হাইকেলের সাহায্যার্থে। তোমার এই বিশেষ সিলেকশনই প্রমাণ করে এর পেছনে বিশেষ কারণ কাজ করছে। সে কারণটা কি?’
‘আপনি ঠিকই ধরেছেন। কিন্তু সে কারণ বলতে গেলে অনেক কিছু বলতে হবে। আমরা চাচ্ছি এই বলার কাজটা হাইম হাইকেল করবেন। তিনিই সবচেয়ে ভাল বলতে পারবেন। আমি কিছু কথা বেঞ্জামিনদের জানিয়েছি। আপনাদের প্রাথমিক অবগতির জন্য এটুকু বলতে পারি যে, জনাব হাইম হাইকেল যে ষড়যন্ত্রকে ঘৃণা করেছেন, সেই ষড়যন্ত্রকে আমরা দিনের আলোয় আনতে চাই। এখানেই তাঁর সাথে আমাদের উদ্দেশ্যের ঐক্য।’
থামল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা আর কোন কথা বলল না। ভাবনার চিহ্ন সবার চোখে-মুখে।
আহমদ মুসা ঘড়ির দিকে তাকাল। চোখ তুলল কামাল সুলাইমানের দিকে। আস্তে করে বলল, ‘তোমাদের কি অজু আছে। আসরের নামাজ পড়ে নিতে হয়।’
‘আমাদের অজু আছে মুসা ভাই।’ বলল কামাল সুলাইমান।
এবার আহমদ আহমদ মুসা তাকাল আয়াজ ইয়াহুদের দিকে। বলল, ‘মাফ করুন। আপনাদের ভাবনার মধ্যে ডিস্টার্ব করছি।’ একটু থেমে আবার বলল, ‘আমাদের আসর নামাজের সময় হয়েছে। আপনারা অসুবিধা মনে না করলে এখানেই পড়ে নিতে চাই।’
আয়াজ ইয়াহুদ একটু নড়ে চড়ে বসেই দ্রুত কণ্ঠে বলল, ‘নো প্রোব্লেম। কোথায় পড়তে চাও?’
পাশেই ফাঁকা জায়গা দেখিয়ে আহমদ মুসা বলল, ‘ওখানেই পড়ে নেয়া যায়।’
‘কিছু লাগবে?’ আয়াজ ইয়াহুদের জিজ্ঞাসা।
‘অজু আমাদের আছে। একটা পরিষ্কার চাদর হলে চলে, না হলেও ক্ষতি নেই।’ আহমদ মুসা বলল।
আয়াজ ইয়াহুদ নুমা ইয়াহুদের দিকে তাকাল। কিন্তু কিছু বলার আগেই নুমা ইয়াহুদ উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘আমি চাদর আনছি।’
আসরের চার রাকাত নামাজ শেষে আহমদ মুসারা ফিরে এল তাদের আসনে।
নামাজের সময় এরা চারজন কেউ কথা বলেনি। তারা সবাই অপলক চোখে ওদের নামাজ পড়া দেখছিল।
আহমদ মুসা বসার পর আয়াজ ইয়াহুদ বলে উঠল, ‘আহমদ মুসা মি. হাইম হাইকেলের সাথে তোমাদের উদ্দেশ্যের ঐক্যের কথায় আমাদের কৌতূহল কিছুটা নিবৃত্ত হলো। এখন আরেকটা কৌতূহলের উত্তর দাও। তোমাদের পরিচয় প্রকাশ না হলে আজ এই নামাজ তোমরা কি করে পড়তে? এতদিন তোমরা কি করে নামাজ পড়েছ?’
‘বিশেষ বিশেষ অবস্থায় নামাজ কাজা রেখে পরে পড়ে নেয়া যায়। আর আমি চেষ্টা করি নামাজের সময় এড়িয়ে প্রোগ্রাম করতে। আজকের আসরের নামাজ আমরা ঠিক সময়ে পড়েছি। পরিচয়ের ব্যাপারটা না ঘটলে আলোচনা শেষে আস্তানায় ফিরে গিয়ে পড়ে নেবার চেষ্টা করতাম।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আপনাদের নামাজ আমার খুব ভালো লেগেছে। এই নামাজ প্রমাণ করেছে আপনারা আধুনিকতা, শৃঙ্খলা ও সামরিকতার সাথে আধ্যাত্মিকতার অদ্ভূত সংযোগ ঘটিয়েছেন।’ বলল নুমা ইয়াহুদ।
‘আমরা ঘটাইনি, আল্লাহ ঘটিয়েছেন।’ আহমদ মুসা বলল।
‘স্যরি। তাহলে সংযোগটা আরও স্বাভাবিক, আরও মজবুত ও কার্যকরী হলো।’ নুমা ইয়াহুদ বলল।
‘ইসলামের অনেক বিউটির মধ্যে এটা একটা নুমা।’ বলল আহমদ মুসা।
‘একটা দেখলাম। অন্যগুলোও দেখতে হবে।’ নুমা ইয়াহুদ বলল।
‘হঠাৎ এতটা আগ্রহী হয়ে উঠলে কেন নুমা?’ বলল নুমার মা মিসেস আয়াজ ইয়াহুদ।
‘হঠাৎ নয় আম্মা। আমার মধ্যে এই আগ্রহ সৃষ্টি করেছে সারা জেফারসন। জেফারসন পরিবারের সারা জেফারসন যদি ইসলাম ধর্মকে আজকের যুগোপযোগিতার ক্ষেত্রে এক ‘মিরাকল রিলিজিওন’ বলতে পারেন, তাহলে আমি হব না কেন?’
এ সময় একজন সিকিউরিটির লোক সিঁড়ি ভেংগে দ্রুত উপরে উঠে এল।
আয়াজ ইয়াহুদ প্রশ্নবোধক দৃষ্টি তুলে তাকাল তার দিকে।
সিকিউরিটির লোকটি কম্পিত কণ্ঠে বলল, ‘স্যার কিছু লোক আমাদের গেটের সামনে এবং পেছনে দরজার ওপাশে পজিশন নিয়েছে। গায়ে ওদের লম্বা কোট। নিশ্চয় অস্ত্র আছে কোটের আড়ালে। গেটের বাইরে ওদের দুটো গাড়ি দাঁড়ানো।’
‘তোমরা ওদের বাধা দাওনি কেন? পুলিশে খবর দিয়েছ?’ শুকনো কণ্ঠে বলল আয়াজ ইয়াহুদ। তাঁর চোখে-মুখে ভয়ের চিহ্ন।
‘স্যার আপনার নির্দেশ হলেই জানাব।’ বলল সিকিউরিটির লোক।
আয়াজ ইয়াহুদ তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘দেখ ওরা আমার বাড়ি আক্রমণ করতে এসেছে। পুলিশের দায়িত্ব একে ফেস করা। তোমরা কেউ এর সাথে জড়িয়ে না পড়া ভাল হবে। তোমার মত কি?’
‘আপনার সাথে আমি একমত। কিন্তু পুলিশকে এখনও বলা হয়নি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘বলছি’ বলেই মোবাইলে টেলিফোন করল পুলিশকে।
পুলিশের সাথে কথা বলা শেষ করে বলল, পাঁচ সাত মিনিটের মধ্যেই পুলিশ এসে পৌঁছে যাবে।’ বলল দ্রুত কণ্ঠে আয়াজ ইয়াহুদ। তার চোখে-মুখে উদ্বেগ।
আহমদ মুসা খবর দিতে উপরে আসা সিকিউরিটির লোককে বলল, ‘তুমি গেটে যাও আমি আসছি। ওদের গতিবিধির দিকে নজর রাখ, কিন্তু বুঝতে দিওনা যে তাদের তুমি দেখেছ।’
সঙ্গে সঙ্গেই সিকিউরিটির লোক নিচে নেমে গেল।
কয়েক মুহূর্ত পরে আহমদ মুসা নিচে নামার জন্য সিঁড়ির দিকে এগুচ্ছে, এই সময় সিকিউরিটির লোকটি চিৎকার করে ভেতরে ঢুকল। বলছিল সে চিৎকার করে, ‘ওরা এসে গেছে। ওরা বাড়িতে ঢোকার জন্যে ছুটে আসছে। আমি যাচ্ছি ওদিকে।’
সঙ্গে সঙ্গে আহমদ মুসা থমকে দাঁড়াল। ফিরে তাকাল কামাল সুলাইমানদের দিকে। বলল, সুলাইমান তুমি বাড়িতে প্রবেশের দরজায় দাঁড়াও। আর বুমেদীন বিল্লাহ তুমি এদের নিয়ে উপরে থাক। দুতালার সামনে গিয়ে নিচেরটা দেখা যায় এমন নিরাপদ জায়গায় পজিশন নিতে পার। আর আমি বাইরে যাচ্ছি। সুলাইমান ও বিল্লাহ আমি এ্যাকশনে যাবার আগে তোমরা সুযোগ পেলেও গুলী করবে না।
‘কিন্তু ভাইয়া, আপনার কি বাইরে যাবার প্রয়োজন আছে? ঢোকার পথে ওদের আক্রমণ করাই তো নিরাপদ বেশি।
‘সেটার জন্যে তোমরা থাকলে। আমি খালি হাতে বাইরে যাচ্ছি। দেখি পুলিশ আসা পর্যন্ত ওদের ঠেকানো যায় কিনা।’ বলে আহমদ মুসা তার জ্যাকেটের চেনটা খুলে দিতে দিতে ছুটল সিঁড়ি দিয়ে নিচের দিকে।
আহমদ মুসা কামাল সুলাইমানকে দরজার আড়ালে দাঁড় করিয়ে রেখে খালি হাতে বিস্ময়ের একটা চিহ্ন চোখে-মুখে এঁকে স্বাভাবিকভাবে হেঁটে বাইরে বেরিয়ে এল।
ওরা আট দশ জন গেটের ভেতর ঢুকে গেছে। সিকিউরিটির দুজন লোককে বেঁধে ফেলে রেখেছে।
আহমদ মুসাকে দেখে ওরা অস্ত্র বাগিয়ে আহমদ মুসার দিকে ছুটে এল।
আহমদ মুসা থমকে দাঁড়িয়ে বলল ওদের লক্ষ্য করে, ‘দাঁড়াও তোমরা। এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্টের বাড়ি। ডাকাতির জায়গা এটা নয়। কি চাও তোমরা?’
আহমদ মুসা এই কথা গুলো এমন স্বাভাবিক কণ্ঠে এমন মাষ্টারি ঢং-এ বলল যে, ওদের চোখে-মুখে একটা বিস্ময়ের ভাব ফুটে উঠল। থমকে গেল ওরা।
কিন্তু অবিলম্বে তা সামলে নিয়েই ওদের মধ্যে লম্বা-চওড়ায় বড় একজন অস্ত্র উঁচিয়ে একধাপ সামনে এগিয়ে বলল, ‘তুমি কে? রাস্তা থেকে সরে দাঁড়াও। আমরা ডাকাতি করতে আসিনি। আমরা এসেছি কয়েকজন লোকের সন্ধানে। ওরা ভেতরে আছে। ওদেরই আমরা চাই।’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘ভেতরে যাবার দরকার নেই। তোমরা কাকে চাচ্ছ? ড. নিউম্যানের বাড়িতে তোমাদের লোকদের যে হত্যা করেছিল, বারবারা ব্রাউনকে যে তোমাদের কবল থেকে উদ্ধার করেছিল তাকে?’
‘সামনে এগিয়ে এসেছিল যে লোকটি তার চোখ দুটি ছানাবড়া হয়ে গেল। বলল, ‘তুমি এত কথা জান কি করে? তুমি কে?’
আবার হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘তোমরা এবং তোমাদের নেতা আজর ওয়াইজম্যান যাকে খুঁজছে, আমি সেই।’
লোকটার মধ্যে ভুত দেখার মত একটা ভীতিকর বিস্ময় ফুটে উঠল। কিন্তু শিঘ্রই নিজেকে সামলে নিয়ে সহজ হয়ে গেল সে। বলল চিৎকার করে, ‘চালাকি করো না। আসল লোককে বাঁচাবার এটা একটা ফন্দী। আমরা যেন কিছুই বুঝি না! ঐ শয়তান হলে কি তুমি এভাবে খালি হাতে আসতে ধরা দেবার জন্যে!’
কথাটা শেষ করেই পেছনের সাথীদের উদ্দেশ্য বলল, এই তোমরা একজন একে বেঁধে ফেলে গাড়িতে তোল, আর সবাই এস বাড়িতে ঢুকতে হবে।’
লোকটির পেছনে অস্ত্র উঁচিয়ে আট-দশ জন লোক দাঁড়িয়েছিল।
লোকটির নির্দেশ পেয়েই একজন তার পকেট থেকে সরু নাইনল কর্ড বের করে হাতে নিয়ে পা বাড়াল আহমদ মুসার কাছে আসার জন্যে।
কিন্তু লোকটির কথা শেষ হতেই উচ্চ হাসির সাথে আহমদ মুসা বলে উঠল, ‘তা আর হলো না মি. …………………….। ঐ দেখো, পুলিশ এসে গেছে।’
লোকটিসহ তার পেছনের সবাই যন্ত্রচালিতের মত পেছনে ফিরে তাকাল।
চোখের পলকে শোল্ডার হোলস্টার থেকে নতুন কেনা এম-১০ মেশিন রিভলবার আহমদ মুসার হাতে চলে এল।
পেছনে পুলিশকে না দেখে প্রতারিত হওয়ার ক্ষোভে ফেটে পড়ে যখন মুখ ফিরাচ্ছিল, তখন আহমদ মুসার মেশিন রিভলবার হাঁ করে ওদের লক্ষ্যে তাকিয়ে।
ওরা মুখ ফিরাতে আহমদ মুসা কঠোর কণ্ঠে বলল, ‘সবাই অস্ত্র ফেলে দাও, তা না………।’
আহমদ মুসার কথা শেষ হবার আগেই ওদের কয়েকজনের হাতের ভয়ংকর কারবাইন জাতের স্টেনগান আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে উঠে আসতে লাগল।
আহমদ মুসারও মুখের শেষ কথাগুলো হারিয়ে গেল। তার মেশিন রিভলবারের লক্ষ্য আগে থেকেই স্থির ছিল। এখন আহমদ মুসা ট্রিগার চেপে মেশিন রিভলবার ওদের ওপর দিয়ে দুবার ঘুরিয়ে নিয়ে এল।
চেখের পলকেই সামনে এগিয়ে আসা লোকটিসহ দশ-বারো জন সকলেরই দেহ ভূমি শয্যা নিল। কারো দেহ সঙ্গে সঙ্গেই স্থির হয়ে গেল। কারো দেহ গড়াগড়ি খেতে লাগল।
এ সময় চারদিক থেকে পুলিশের বাঁশি বেজে উঠল। একদল পুলিশ গেট দিয়ে ঢুকে দ্রুত ছুটে আসল হত্যাকান্ডের স্থানের দিকে।
এদিকে দরজার আড়াল থেকে কামাল সুলাইমান এবং দুতালা থেকে ওরা সবাই ছুটে আহমদ মুসার কাছে এল।
একজন পুলিশ অফিসার ছুটে এসে আয়াজ ইয়াহুদের সামনে দাঁড়াল। ছড়িয়ে পড়ল অন্যান্য পুলিশ চারদিকে।
পুলিশ অফিসারের হাতে ওয়াকিটকি। সে ওয়াকিটকিতে কথা বলতে বলতেই আসছিল।
পুলিশ তার কথা শেষ করে আয়াজ ইয়াহুদকে বাউ করে বলল, ‘স্যার বাড়ির চারপাশে যে কয়জন ছিল তারা সবাই ধরা পড়ে গেছে। আর সামনের এদেরতো আপনারাই সামাল দিয়েছেন। ধন্যবাদ স্যার।’
‘ধন্যবাদ পুলিশ অফিসার’ বলে আয়াজ ইয়াহুদ সবাইকে পরিচয় করিয়ে দিল। হাইম বেঞ্জামিন ও বারবারা ব্রাউনকে পরিচয় করিয়ে কামাল সুলাইমান ও বুমেদীন বিল্লাহকে দেখিয়ে বলল, এঁরা একটা ইন্টারন্যাশনাল ডিটেকটিভ ফার্মের লোক। আর আহমদ মুসার পরিচয় দিতে গিয়ে বলল। ইনিও ঐ ফার্মের সাথে জড়িত এবং আমাদের পারিবারিক বন্ধু।
‘ও বুঝেছি, আপনি হাইম পরিবারের লোকদের নিয়ে ডিটেকটিভ ফার্মের লোকদের সাথে পরামর্শ করছিলেন। এই খোঁজ পেয়ে বুঝি এরা ছুটে এসেছিল। তাহলে কি এদের কোন সর্ম্পক আছে হাইম হাইকেলকে নিখোঁজ করার পেছনে? ভাববেন না স্যার। আমি সব দেখছি। আমি একদিন আগে নায়াগ্রা থেকে এই অফিসে এসে জয়েন করেছি।’ বলেই অফিসারটি তার লোকদের দিকে তাকিয়ে নির্দেশ দিল, লাশগুলো গাড়িতে তোল। আহতদের প্রতি লক্ষ্য রাখ যেন পালাতে না পারে। গাড়িতে ওদেরকে পাহারায় রাখ। আর বন্দীদের ‘সেল’ গাড়িতে তুলে নাও।’
তারপর আবার ফিরল ড. আয়াজ ইয়াহুদের দিকে। বলল, ‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ স্যার। ডিটেকটিভ ফার্মের লোকেরা আপনার সাথে থাকায় এই শয়তানদের বাধা দিতে পেরেছেন। বড় অঘটন থেকে আপনারা বেঁচে গেছেন।’ বলে পুলিশ অফিসার হ্যান্ডশ্যাক করল আহমদ মুসা, কামাল সুলাইমান, বুমেদীন বিল্লাহ, বারবারা ব্রাউন ও হাইম বেঞ্জামিনের সাথে। তারপর ড. আয়াজ ইয়াহুদকে লক্ষ্য করে বলল, ‘স্যার আমরা চলি। রাত্রে একবার আমি খোঁজ নেব। দরকার হলে কষ্ট করে একটু টেলিফোন ঘুরাবেন।’ গুড বাই স্যার।
চলে গেল পুলিশ অফিসার।
পুলিশের গাড়ি গেট থেকে বের হয়ে গেলে আয়াজ ইয়াহুদ গেটম্যান ও সিকিউরিটির লোকদের নির্দেশ দিল জায়গাগুলো পরিষ্কার করার এবং গেটের দিকে নজর রাখার জন্যে।
আয়াজ ইয়াহুদ সকলকে নিয়ে ভেতরে চলল। বলল, ‘ডিনার না করিয়ে কাউকে ছাড়ছি না। এমন কি দরকার হলে রাতেও সকলকে থাকতে হতে পারে। আতংক কাটতে অনেক সময় লাগবে।’
‘পুলিশের কাছে আমাদের পরিচয় দেয়াটা আপনার চমৎকার হয়েছে স্যার। আমাদের ডিটেকটিভ বলে পরিচয় দেয়ায় হত্যাকান্ডের ঘটনাটা তাদের কাছে স্বাভাবিক হয়ে গেছে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আর ডিটেকটিভদের সাথে হাইম পরিবারের লোকেরা এখানে উপস্থিত থাকায় ওদের আক্রমণটাও স্বাভাবিক হয়ে গেছে।’ নুমা ইয়াহুদ বলল।
সবাই এসে আবার সোফায় বসল।
‘এই নতুন পুলিশ অফিসারটা ভাল মনে হলো। মনে হচ্ছে ক্রিমিনালদের বিহিত উনি করবেন। কিছু কথাও আদায় করতে পারেন, যা প্রয়োজনে আসবে।’ বলল আবার নুমাই।
‘না নুমা। কাজের কিছু এদের কাছ থেকে পাওয়া যাবে না। এ লোকেরা পুতুল। নিছকই হুকুমের দাস। এরা ভেতরের কিছুই জানে না। সামনের লোকটা কিছুটা নেতা গোছের ছিল। সে বাঁচলে হয়তো কিছু জানার সম্ভাবনা ছিল।’ আহমদ মুসা বলল।
আহমদ মুসা থামতেই আয়াজ ইয়াহুদ বলল, ‘ফ্লোর এখন আমার। সবার তরফ থেকে বিশেষ করে আমার ও হাইম পরিবারের তরফ থেকে আহমদ মুসাকে শুকরিয়া ও অভিনন্দন জানাতে চাই। তিনি আমাদের গায়ে কোন আচঁড় পর্যন্ত লাগতে না দিয়ে যে ঝুঁকি নিয়ে …………।
আহমদ মুসা আয়াজ ইয়াহুদের কথার মাঝখানে বলে উঠল, ‘যা ঘটে গেছে তা বাদ দিয়ে প্লিজ আসুন কাজের কথায় আসি।’
আয়াজ ইয়াহুদ থেমে গিয়েছিল। কিন্তু কথা বলে উঠল নুমা ইয়াহুদ আহমদ মুসা থামার সাথে সাথেই, ‘ঐভাবে ওদের মুখোমুখি হওয়া কি আপনার ঠিক হয়েছে। ওরা যদি দেখা মাত্রই গুলী চালাত কিংবা পেছনে পুলিশের কথা বলে ওদের যদি আপনি বিভ্রান্ত করতে না পারতেন, তাহলে কি ঘটত?’
‘যা ঘটেছে, সে রকমই কিছু ঘটত। আমার খালি হাত দেখার পর ওদের গুলী করার ইচ্ছা ৯০ ভাগই চলে গিয়েছিল। জেগে উঠেছিল আমাকে বাজিয়ে দেখার ইচ্ছা। ওরা যদি গুলী করারও সিদ্ধান্ত নিত, তাহলেও একজন নিরস্ত্রের বিরুদ্ধে ওদের বন্দুক উঠতে যে সময় নিত, সে সময়ে আমার মেশিন রিভলবার তার কাজ শেষ করে ফেলত। আর পেছনে পুলিশ দাঁড়াবার কথাটা মানে আমার প্রতারণার ফাঁদে ওদের পা না দিয়ে উপায় ছিল না। ফাঁদে পা না দেবার মত যোগ্য ওরা যদি হতোও, তবু গুলী করার আগে দুএকটা বাচালতা ওরা করতো, সেটুকু সময়ই যথেষ্ট ছিল আমার জন্যে ওদেরকে গুলীর শিকার বানাবার।’ আহমদ মুসা বলল।
‘অদ্ভূত! আপনার সময়ের এই হিসাব অংকের মতই নিখুঁত। ঐ টেনশনের মধ্যেও এই হিসাব আপনার মাথায় এল কি করে। অপশনসগুলোকে এইভাবে সাজালেন কি করে?’ বলল বারবারা ব্রাউন।
‘শুধু চোর পালালেই বুদ্ধি বাড়ে তা নয়, চোর দেখলেও বুদ্ধি বাড়তে পারে।’ হেসে কথাটা বলেই আহমদ মুসা আবার বলা শুরু করল, ‘আমি মনে করি আজকের ঘটনার পর সরকার এ বাড়িতে সার্বক্ষণিক পাহারার ব্যবস্থা করবে। পুলিশের প্রতি আপনাদের আস্থা যদি না থাকে তাহলে কয়েকদিন সরে থাকাই আমি ভাল মনে করি। মিস ব্রাউন ও হাইম বেঞ্জামিন সম্পর্কেও আমার এই কথা। কিছু সময় সরে থাকা ভাল।’
‘মনে হচ্ছে তুমি কোথাও যাবার আগে আমাদের বিদায়ী উপদেশ দিচ্ছ। ব্যাপার কি?’ বলল আয়াজ ইয়াহুদ।
‘জি স্যার। ঠিক ধরেছেন। FBI চীফ জর্জ আব্রাহামের কোডেড ম্যাসেজ আমি মোবাইলে পেয়ে গেছি। আজ রাত্রেই আমরা সেখানে যাত্রা করছি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তার মানে হাইম হাইকেলকে যেখানে আটকে রেখেছে, সে ঠিকানা তুমি পেয়ে গেছ?’ জিজ্ঞাসা আয়াজ ইয়াহুদের। আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল তার দুটি চোখ।
‘জি হ্যাঁ।’ বলল আহমদ মুসা।
খুশির বান ডেকে উঠল বেঞ্জামিন ও বারবারা ব্রাউনের চোখে-মুখেও।
‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। তোমার চেষ্টাকে ধন্যবাদ। কিন্তু যাত্রা এই রাতে কেন? রাতটা রেস্ট নিয়ে সকালে রওনা হয়ে যাও।’ আয়াজ ইয়াহুদ বলল।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘এটা আত্নীয়ের বাড়ি যাওয়া নয় স্যার। এই ধরণের কাজের সংস্কৃতি হলো, দেখা ও শোনার সাথেই কাজ চলবে। না হলে স্টেশনে পৌঁছে দেখা যাবে ট্রেন চলে গেছে।’
কথা শেষ করতেই আহমদ মুসার মোবাইলটা বেজে উঠল।
মোবাইল তুলে নিয়ে স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে দেখল FBI চীফ জর্জ আব্রাহামের টেলিফোন।
দ্রুত কানে লাগাল টেলিফোন।
ওপ্রান্ত থেকে আহমদ মুসাকে সালাম দিয়ে জর্জ আব্রাহাম বলল, ‘মাই সান, তোমার জন্যে দুটি খবর। একটা ভাল, অন্যটা মন্দ। ভালো খবরটা হলো, প্রেসিডেন্ট তোমাকে তার সাথে একদিন ডিনার খাওয়ার জন্যে দাওয়াত করেছেন। আর খারাপ খবরটা হলো চিড়িয়া উড়ে গেছে। ডবল এইচকে তোমাকে দেয়া ঠিকানা থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে।’
খবরটা শুনতেই বুকের কোথায় যেন একটা আঘাত লাগল আহমদ মুসার। নিঃশ্বাসের তার ছন্দপতন ঘটল। সামলে নিতে মুহূর্ত কেটে গেল। সঙ্গে সঙ্গেই জবাব দিতে পারল না আহমদ মুসা।
জর্জ আব্রাহামই আবার কথা বলে উঠল, ‘স্যরি মাই সান, তোমার খারাপ লাগছে জানি। আমাদের লোকেরা নতুন লোকেশনের সন্ধানে লেগে গেছে।’
‘ধন্যবাদ জনাব। এই চিড়িয়া উড়ে যাওয়ার কারণ সর্ম্পকে কি ভাবছেন আপনি?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘একেবারে সোজা অর্থ। আমার FBI-এর কোন লোক নিশ্চয় ওদের কাছে খবর বিক্রি করেছে।’
‘তা আবারও তো করবে।’
‘তা হতে পারে। যথেষ্ট সাবধান ও সিলেকটিভ হওয়ার পরও এই ঝুঁকি থাকছে বেটা। কি করব? আমার FBI-তে বিশ্বাসের দুটি সমান্তরাল ধারা কাজ করছে। একটি হলো, ইহুদীবাদীদের স্পর্শ ও প্রভাব থেকে আমেরিকাকে চিরদিনের জন্যে মুক্ত করা। দ্বিতীয় ধারার বিশ্বাস হলো কিছু কিছু ক্ষেত্রে ইহুদীবাদীরাও আমাদের মিত্র হতে পারে, তাদের সাথে সহযোগিতা চলতে পারে। এই দ্বিতীয় ধারাকে প্রমোট করেছে ইহুদীবাদীদের অর্থ ও লোভের অন্যান্য বস্তু। সুতারাং বিশ্বাস ভংগের সংকট থেকে FBI কে খুব শীঘ্র মুক্ত করা যাবে না।
‘ধন্যবাদ জনাব। একটা বাস্তবতাকে আপনি তুলে ধরেছেন। এই বাস্তবতা আমাকে আশা ভংগের কষ্টের মধ্যে ফেলল।’ একটু হাসির সাথে বলল আহমদ মুসা।
‘খুবই স্বাভাবিক, কিন্তু হতাশ হয়ো না। আমি সামনে আরও সিলেকটিভ হবো। দেখা যাক । হ্যাঁ শোনো, খারাপ খবরের স্তুপে আমার সুখবরটা যে হারিয়ে গেল। কিছু বললে না যে!’
‘এক্সিলেন্সির এই দাওয়াতে আমি নিজেকে নতুন করে সম্মানিত বোধ করছি। মহামান্য প্রেসিডেন্টকে জানাবেন আমার এই মিশন শেষ করেই আমি ওয়াশিংটনে আসছি।’
‘ধন্যবাদ বেটা। তুমি যে সুখবরটা চাও, আশা করছি তাড়াতাড়িই তা তোমাকে দিতে পারবো। গুড বাই মাইসান।’
আহমদ মুসা টেলিফোন রাখতেই আয়াজ ইয়াহুদ বলে উঠল, ‘প্রেসিডেন্টও তোমাকে দাওয়াত করেন! হিপ হুররে! তুমি সত্যিই ভাগ্যবান আহমদ মুসা।’
‘তার সাথে খারাপ খবরও আছে স্যার।’
‘কি সেটা?’ উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল আয়াজ ইয়াহুদ।
‘যে ঠিকানা পেয়েছিলাম, সে ঠিকানা থেকে জনাব হাইম হাইকেলকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে।’
‘নিশ্চয় তাহলে শয়তানরা জানতে পারে?’ শুকনো কণ্ঠে আয়াজ ইয়াহুদের।
হাইম বেঞ্জামিন, বারবারা ব্রাউন ও নুমা সকলের চোখে-মুখে হতাশা নেমে এসছে।
‘নিশ্চয় স্যার। FBI-এর কেউ তথ্যটা ফাঁস করে দিয়েছে ওদের কাছে। FBI চীফ জর্জ আব্রহাম এ কথাই বললেন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘সর্বনাশ! তাহলে এখন কি হবে?’ নুমা ইয়াহুদ বলল।
‘মি. জর্জ আব্রাহাম চেষ্টা করছেন। বাকি আল্লাহ ভরসা।’
আয়াজ ইয়াহুদের টেলিফোন বেজে উঠেছিল। আহমদ মুসা থামতেই আয়াজ ইয়াহুদ টেলিফোন ধরল।
ও প্রান্তের কথা শুনেই সে বলল, ‘ঠিক আছে অফিসার। ওঁরা এখানে আছেন। পাঠিয়ে দিন। আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।’
টেলিফোন রেখে দিয়ে আয়াজ ইয়াহুদ উদগ্রীব আহমদ মুসাকে বলল, ‘পুলিশ অফিসারটার টেলিফোন ছিল। উনি জানালেন, এখানে নিহত নেতা গোছের লোকটার মানিব্যাগে একটা চিরকুট পেয়েছে। সেটা একটা ই-মেইল। ই-মেইল মেসেজটা তারা বুঝতে পারছে না। তার একটা কপি পাঠাচ্ছে আমাদের ডিটেকটিভদের কাছে।’
‘আল্লাহকে ধন্যবাদ যে তিনি আমাদের কথা মনে করেছেন।’ আহমদ মুসা বলল।
‘পুলিশ অফিসারটিকে একটু আলাদা মনে হচ্ছে।’ বলল আয়াজ ইয়াহুদ।
‘পুলিশ অফিসারটা আনকোরা। ষড়যন্ত্রকারীদের ছায়া এখনও ওঁর উপর পড়েনি। না হলে চিরকুটটা আমাদের এখানে আসতো না।’
আয়াজ ইয়াহুদ ও আহমদ মুসারা ডিনার শেষ করে ড্রইংরুমে ফিরে আসতেই পুলিশ অফিস থেকে পাঠানো পুলিশটি এল।
গেটের সিকিউরিটি তাকে নিয়ে এল আয়াজ ইয়াহুদের কাছে। পুলিশটা একটা স্যালুট দিয়ে একটি চিরকুট তুলে দিল। আয়াজ ইয়াহুদ ধন্যবাদ দিয়ে চিরকুটটি গ্রহণ করল।
পুলিশটিকে দেখে ভ্রু কুঞ্চিত হলো আহমদ মুসার।
তার ইউনিফরম ও বেল্ট অতিমাত্রায় টাইট। আবার তার পায়ে কেটস, পুলিশের বুট নয়। তার মাথার চুলও পুলিশ কাট নয়। হ্যাটের পাশ দিয়ে চুল বাইরে বেরিয়ে এসেছে।
পুলিশটি চিরকুট আয়াজ ইয়াহুদের হাতে দিয়েই আরেকটা স্যালুট শেষ করে পিছু হটছিল। তার দুহাত ছিল তার প্যান্টের দুপকেটে।
আহমদ মুসা হঠাৎ তার ভেতর থেকে এটা অশ্বস্তি অনুভব করল। পুলিশটির মুখে অস্বভাবিকতা দেখতে পেল সে। পকেটে হাত রাখাকেও সন্দেহজনক মনে হলো তার কাছে। সঙ্গে সঙ্গেই বেরিয়ে এল তার রিভলবার। পুলিশটির দিকে রিভলবার তাক করে বলল, ‘দাঁড়াও, হাত উপরে তোল পুলিশ অফিসার।’
আহমদ মুসা তখন দাঁড়িয়ে গেছে।
পুলিশটি বোঁ করে ঘুরল আহমদ মুসার দিকে। কিন্তু পকেট থেকে তার হাত বের হওয়ার নাম মাত্র নেই। বরং তার দুচোখে হায়েনার দৃষ্টি।
আহমদ মুসা ব্যাপারটা বুঝল। মুহূর্তের বিলম্বে সর্বনাশ ঘটে যেতে পারে।
আহমদ মুসার রিভলবার গুলী বর্ষণ করল। গুলী পুলিশটির কপাল গুড়িয়ে মাথা ছাতু করে দিল।
টলে উঠে পড়ে যাচ্ছিল পুলিশটি।
আহমদ মুসা ছুটে গিয়ে তাকে ধরে ফেলে ধীরে ধীরে শুইয়ে দিল চিৎ করে যাতে তার প্যান্টের দুপাশের পকেটে কোন চাপ না লাগে।
বিম্ময় ও আতংকে চিৎকার করে উঠে আয়াজ ইয়াহুদ, নুমা ইয়াহুদ, বারবারা ব্রাউন ও বেঞ্জামিন উঠে দাঁড়িয়েছে।
চোখে-মুখে অপার কৌতূহল নিয়ে বসে আছে কামাল সুলাইমান ও বুমেদীন বিল্লাহ।
‘আহমদ মুসা পুলিশকে হত্যা করলে কেন?’ আতংকগ্রস্ত কণ্ঠে বলল আয়াজ ইয়াহুদ।
‘এ পুলিশ নয়। পুলিশ অফিসে টেলিফোন করুন।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কি বলছ! এ পুলিশ নয়?’ আয়াজ ইয়াহুদ বলল।
‘না পুলিশ নয়। আমার অনুমান মিথ্যা না হলে এর দুপকেটেই বিস্ফোরক আছে। পুলিশ অফিসারকে টেলিফোন করুন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কিন্তু যদি পুলিশ হয় তাহলে মহাবিপদ ঘটবে। ডাকব পুলিশকে?’
‘হ্যাঁ ডাকুন।’
পুলিশে টেলিফোন করল আয়াজ ইয়াহুদ।
সেই পুলিশ অফিসার একটা পুলিশ টীমসহ এসে পৌঁছল অল্পক্ষণের মধ্যেই।
পুলিশ অফিসার পুলিশবেশী লোকটির দিকে একবার তাকিয়েই বলল, ‘এ পুলিশ নয়। ব্যাপার কি স্যার? কি ঘটেছে? এ কোত্থোকে এল?’
আয়াজ ইয়াহুদ পুলিশবেশী লোকটির আসা থেকে সব কথা খুলে বলল।
শুনে বিস্ময় বিস্ফারিত চোখে তাকাল আহমদ মুসার দিকে পুলিশ অফিসারটি। বলল, এ পুলিশ নয়, এটা ঠিকই ধরেছেন, কিন্তু একে গুলী করে মারলেন কেন?’
‘একে মারতে মুহূর্তও দেরি হলে এ আমাদের সবাইকে মারত।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কি করে বুঝলেন? এর দুহাতই প্যান্টের পকেটে। আপনার রিভলবারের সামনে সেতো পকেট থেকে হাতই বের করতে পারতো না।’ বলল পুলিশ অফিসার।
‘উত্তরের জন্যে এর দুপকেট পরীক্ষা করুন।’ আহমদ মুসা বলল।
পুলিশ অফিসার পকেট দুটির উপর চোখ বুলিয়ে বুঝল, কোন গোলাকার বস্তু পকেটে আছে, রিভলবার নয়।
ভ্রু কুঁচকালো পুলিশ অফিসারটি। ডাকল তার বিস্ফোরক এক্সপার্টকে। বলল, ‘আমার সন্দেহ হচ্ছে এর পকেটে বোমা জাতীয় কিছু থাকতে পারে। দেখ ব্যাপারটি কি।’
বিস্ফোরক এক্সপার্ট পুলিশ অফিসারটি হাঁটু গেড়ে বসে কাঁচি দিয়ে আস্তে আস্তে, পকেট কেটে ফেলল। বেরিয়ে পড়ল ক্রিকেট বলের মত গোলাকার দুটি বস্তু।
বিস্ফারিত হয়ে গেল বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞের দুচোখ। চিৎকার করে উঠল, ‘আপনারা সবাই সরে যান’।
সবাই দ্রুত নিচে নেমে গেল।
বিস্ফোরণ বিশেষজ্ঞ পুলিশ অফিসার বোমা দুটির মুখ থেকে টেমপোরারি সেফটি কভার খুলে ডেটোনিটিং পিনটি খুলে নিল।
সবাই উপরে উঠে এল।
‘ঈশ্বর সকলকে রক্ষা করেছেন।’ বলে সে আস্তে করে একটি বিস্ফোরক তুলে তার লেবেলটা দেখাল তার ইনচার্জ অফিসারকে।
দেখেই আঁৎকে উঠল পুলিশ অফিসার। বলল, ‘সর্বনাশ, এর একটি বিস্ফোরণ ঘটলে তো এই বাড়ি ধূলা হয়ে যেত।’ বলেই সে ফিরল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘ধন্যবাদ আপনাকে। বাহককে একমাত্র হত্যাই এই বোমার বিস্ফোরণ রোধ করার উপায় ছিল। আপনি তাই করেছেন। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। এখন আমি ভাবছি, আমার পাঠানো পুলিশের অবস্থা কি?’
‘আমার ধারণা এই সন্ত্রাসীদের এক বা একাধিক লোক পুলিশ অফিস কিংবা এই বাড়ির আশে-পাশে ওঁৎ পেতে ছিল। তারাই আপনার পুলিশকে ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করে জেনেছে যে, সে আজ বিশ্বাবদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট আয়াজ ইয়াহুদের বাসায় আসছে। তাকে আটকে তার ইউনিফর্ম খুলে নিয়ে তাদের লোককে তা পরিয়ে এখানে পাঠিয়েছিল বোমা ফেলার জন্যে। লোকটি কোনভাবে ইউনিফর্ম পরেছিল, কিন্তু জুতা কিছুতেই পরতে পারেনি। আর আপনার পুলিশ ওদের হাতেই আটকে আছে। অথবা পুলিশকে ওরা ছেড়েও দিতে পারে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ধন্যবাদ মি. ডিটেকটিভ। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে, আপনারা আজ এখানে হাজির ছিলেন।’ বলেই পুলিশ অফিসার ফর্মালিটি সারার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। তারপর লাশ নিয়ে পুলিশরা বেরিয়ে গেল। যাবার সময় আয়াজ ইয়াহুদকে বলে গেল, আপনার বাড়িতে পুলিশ পাহারার ব্যবস্থা করে যাচ্ছি। তবে আপনাকে ও হাইম পরিবারকে বলছি, এই ডিটেকটিভদের ছাড়বেন না। এঁদের সাহায্য আমাদেরও দরকার।’
পুলিশরা বেরিয়ে যেতেই আয়াজ ইয়াহুদ ও বেঞ্জামিন একসাথে আহমদ মুসাকে জড়িয়ে ধরল। বলল আয়াজ ইয়াহুদ, ‘তুমি মানুষ নও ফেরেশতা। বিকাল থেকে দুবার আমাদের সকলকে বাঁচিয়েছ।’ আর বেঞ্জামিন বলল, ‘আমার, আমার পরিবারের ও আমার পিতার অসীম সৌভাগ্য যে ঈশ্বর আপনাকে পাঠিয়েছেন আমাদের সাহায্যে। ইদানিং আমার পিতা মুসলমানদের ব্যাপারে দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। মুসলমানদের জন্মগত বিদ্বেষের কারণে আমি একে ভালোচোখে দেখিনি। কিন্তু আজ দেখছি, মুসলমানরা সন্ত্রাস ও ষড়যন্ত্রের প্রতিপক্ষ হিসাবে আভির্ভুত হয়েছে। আর সন্ত্রাস-ষড়যন্ত্রের প্রতিভূ হয়ে দাঁড়িয়েছি আমি…….।’
আহমদ মুসা নিজেকে ওদের বাহুর পাশ থেকে খুলে নিল এবং বেঞ্জামিনের মুখে হাতচাপা দিয়ে তাকে থামিয়ে দিল। বলল আহমদ মুসা, ‘আসুন আমরা বসি। ভূয়া পুলিশের দেয়া চিরকুট কি, ওটা ভূয়া না আসল, তা দেখা হয়নি। ভূয়া হলে আসলটা কি করে পাওয়া যায়, সে চেষ্টা করা যেতে পারে।’
সবার সাথে আহমদ মুসা তার তার আসনে ফিরে এল। নিজের সোফায় ফিরে যাবার সময় আয়াজ ইয়াহুদ ভূয়া পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া চিরকুটটা আহমদ মুসার হাতে দিল। দেবার সময় বলল,‘আমি তো এর আগাগোড়া কিছুই বুঝিনি। কিছু বুঝার থাকলে তুমি বুঝবে।’
আহমদ মুসা চিরকুটের উপর চোখ বুলাল। নিঃসন্দেহ এটা ই-মেইলের ফটোকপি। তবে প্রেরকের জায়গায় যেখান থেকে এসেছে তার নাম নেই। ডেট আছে, পাতার নম্বরও আছে। দুবাক্যের ই-মেইল। প্রথম বাক্যে বলা হয়েছে ‘DH Shifted to 776 from 833 stop AW asked you to reach there by Eleven.’
আহমদ মুসা ই-মেইলের উপর চোখ বুলিয়ে সেটা তুলে দিল কামাল সুলাইমানের হাতে। কামাল সুলাইলমান ই-মেইল পড়ল। বলল, DH এবং AW এর ভেতরেই রহস্য লুকিয়ে আছে ভাইয়া কিন্তু সংকেত আমি ভাঙতে পারছি না।
‘যাদের কাছে ই-মেইলটা পাওয়া গেছে তাদের পরিচয় ও তাদের বর্তমান অবস্থার সাথে মেলালে ই-মেইলের একটা অর্থ পরিষ্কার হয়ে উঠে। আরও একটা মজার ব্যাপার হলো, আমরা FBI চীফের কাছ থেকে কিছুক্ষণ আগে যে খবর পেলাম, বিস্ময়করভাবে তারই ফলো আপ এটা। সে খবরে আমরা জেনেছিলাম হাইম হাইকেলকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। কোথায় সরিয়ে ফেলা হয়েছে এই খবর FBI চীফ দিতে পারেনি। কিন্তু এই ই-মেইল সেই খবরই আমাদের দিচ্ছে। দেখ……….।’ আহমদ মুসা বাধা পেয়ে গেল।
আহমদ মুসাকে থামিয়ে সোৎসাহে কথা বলে উঠল কামাল সুলাইমান, ‘তাহলে DH অর্থ ডবল এইচ মানে হাইম হাইকেল। আর AW এর অর্থ নিশ্চয় আমরা ধরে নিতে পারি ‘আজর ওয়াইজম্যান।’
‘ঠিক, কামাল সুলাইমান।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ই-মেইল অনুসারে তাহলে তো দেখা যাচ্ছে ভাইয়া, জনাব হাইকেলকে একই রাস্তার বা একই এলাকার এক জায়গায় থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে।’
‘হ্যাঁ, কামাল সুলাইমান। আল্লাহ আমাদের সাহায্য করেছেন। বলল আহমদ মুসা।
তারপর তাকাল আয়াজ ইয়াহুদের দিকে। বলল, ‘স্যার শাপ অনেক সময় বর হয়ে দাঁড়ায়। আমরা বুঝতে পারি না। খারাপ ঘটনাও ভাল বার্তা বয়ে আনে।’
‘তাইতো দেখছি আহমদ মুসা, ওরা আজ বাড়ি আক্রমণ করতে না এলে এই চিরকুট পাওয়া যেত না। চিরকুটটা পাওয়া না গেলে আমাদের হাইকেলেরও সন্ধান পাওয়া যেত না। সত্যিই আহমদ মুসা আল্লাহ আমাদের সাহায্য করেছেন, বিশেষ করে তোমাকে।’ আয়াজ ইয়াহুদ বলল।
‘আমি বিশেষ হলাম কিভাবে?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘বিশেষ এর কারণ হলো সাহায্যটা ঈশ্বর তোমার কাছেই পাঠিয়েছেন। তুমিই মেসেজটির সংকেত ভেঙেছ। আমরা যেখানে সংকেত বুঝিইনি, সাহায্য নিতাম কি করে?
‘যাক, সব প্রশংসা আল্লাহর।’ বলেই আহমদ মুসা ঘড়ির দিকে তাকাল। বলল, আমরা উঠছি জনাব। কামাল সুলাইমান চল। আর বুমেদীন বিল্লাহ তুমি এখানেই থাকবে।’
‘আপনারা যাবেন, আমি থাকব কেন?’ বুমেদীন বিল্লাহর কণ্ঠে কিছুটা বিদ্রোহের সুর।
‘নিউইয়র্কে এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় আশ্রয়। এখানকার পাহারায় আমাদের কাউকে থাকতে হবে না? সান্ত্বনার সুরে বলল আহমদ মুসা।
‘আপনার সিদ্ধান্ত ঠিক আছে ভাইয়া। এর আগে আপনারা দুজন যখন নিচে গিয়েছিলেন ঘোর বিপদের মুখে, তখনও তো ওঁকেই রেখে গিয়েছিলেন। আজ বিকালে মার্কেটে গিয়েছিলেন আপনি ও মি. কামাল সুলাইমান। যখন কোথাও গেলেন তখন তাঁকেই রেখে গেলেন। নিশ্চিতভাবেই উনি গুড কাস্টোডিয়ান।’ বলল নুমা ইয়াহুদ।
ফুঁসে উঠল বুমেদীন বিল্লাহ। বলল, ‘কাস্টোডিয়ান হওয়া সাংবাদিকের দায়িত্ব নয়। কাস্টোডিয়ান ঠিক কাজ করছে কিনা, সেটা দেখা সাংবাদিকের দায়িত্ব।’
‘তাহলে তো একজন সাংবাদিক কাস্টোডিয়ানের চেয়ে বড় কাস্টোডিয়ান।’
ত্বরিত জবাব হিসাবে কিছু বলতে যাচ্ছিল বুমেদীন বিল্লাহ। তাকে বাধা দিয়ে আহমদ মুসা হেসে বলল, ‘আমরা শান্তিপূর্ণভাবে নিষ্ক্রান্ত হই, তোমরা ঝগড়াটা পরে করো।’
বলেই উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা। বলল সকলকে লক্ষ্য করে, ‘আপনারা সকলে আল্লাহর কাছে দোয়া করুন। আমাদের এ যাত্রা যেন শুভ হয়। আমরা যেন লক্ষ্য অর্জন করতে পারি। হাইম হাইকেল যেন মুক্ত হন।’
সকলেই উঠে দাঁড়িয়েছে। প্রত্যেকের চোখে-মুখেই একটা প্রবল ভাবাবেগ। কারও মুখে কথা নেই। নিরবতা ভাঙল আয়াজ ইয়াহুদ। বলল, ‘আল্লাহ আমাদের সাহায্য করুন। আর আমি জানি তোমার মত এক হাতেম তাই-এর সাথে আল্লাহর সাহায্য না থেকেই পারে না।’ আবেগে ভারী আয়াজ ইয়াহুদের গলা।
‘কিন্তু ভাইয়া, হাইম হাইকেল আংকেল মুক্ত হলেই কি আপনারা চলে যাবেন?’ নুমা ইয়াহুদের এ প্রশ্নটা অত্যন্ত বেসুরো শোনালেও এর মধ্যে একটা হৃদয়স্পর্শী কাতরতা ছিল।
আহমদ মুসা হাসল। একটু ভাবল তারপর বলল, ‘নুমা এত তাড়াতাড়ি আমরা আমেরিকা ছাড়তে পারবো না। তাকে উদ্ধারের পরই তো আমাদের আসল কাজ শুরু হবে, ধ্বংস টাওয়ারের নিচে যে সত্য চাপা পড়ে আছে সে সত্য উদ্ধারের কাজ।’
একটা নতুন কৌতূহল জাগল আয়াজ ইয়াহুদের, বেঞ্জামিন ও বারবারা ব্রাউনের মুখে। কিন্তু সরল আনন্দে মুখ ভরে গেল নুমা ইয়াহুদের। বলল ‘ধন্যবাদ’ ভাইয়া।
বুমেদীন বিল্লাহকে সালাম দিয়ে, অন্যদের গুডবাই জানিয়ে পেছনে ফিরে দ্রুত সিঁড়ির দিকে এগুলো নিচে নামার জন্যে আহমদ মুসা।

Top