৩৮. ধ্বংস টাওয়ার

চ্যাপ্টার

আহমদ মুসা গাড়িতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। গেটে দাঁড়িয়েছিল দুজন সিকিউরিটির লোক।
হাইম বেঞ্জামিন ও বারবারা ব্রাউন বেরিয়ে এল বাড়ির ভেতর থেকে।
হাইম বেঞ্জামিন ও বারবারা দুজনেই তাকাল আহমদ মুসার দিকে। দুজনেরই প্রথম প্রতিক্রিয়া হলো, গেটের ওপারে গাড়ির উপর ঠেস দিয়ে দাঁড়ানো লোকটি অস্বাভাবিক চরিত্রের কোন মানুষ নয়। নিজের অজান্তেই তাদের মন যেন প্রসন্ন হয়ে উঠল। তবে অবাক হলো আহমদ মুসার সুন্দর কাটিং-এর স্যুটকে ধুলি ধুসরিত দেখে।
ভেতরে দাঁড়িয়েই হাইম বেঞ্জামিন সিকিউরিটির লোকদের উদ্দেশ্য করে বলল, ‘ওঁকে আসতে দাও।’
হাইম বেঞ্জামিনের পাশে দাঁড়ানো বারবানা ব্রাউনের চোখে-মুখে একটা চাঞ্চল্য নেমে এল। সে বলল সিকিউরিটিদের উদ্দেশ্য, ‘সার্চ করে দেখো কোন অস্ত্রপাতি আছে কিনা।’
আহমদ মুসা গেটে এসে দাঁড়ালে একজন সিকিউরিটি তাকে সার্চ করল। তার সার্ট কোর্ট-প্যান্টের পকেট, কোমর, শোল্ডার হোলস্টার পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকল। সার্চ করে কোন অস্ত্র পেল না।
আহমদ মুসা ভেতরে প্রবেশ করল।
আহমদ মুসা কিছু বলার আগেই হাইম বেঞ্জামিন বলে উঠল, ‘গুড ইভনিং, মি…………। ওয়েলকাম।’
‘গুড ইভনিং। ধন্যবাদ। আমি আইজ্যাক দানিয়েল। নামটা বোধ হয় আগেও বলেছিলাম।’ মুখ ভরা হাসি টেনে বলল আহমদ মুসা।
হাসল হাইম বেঞ্জামিনও। বলল, ‘স্যরি। একটু পরীক্ষা করলাম যে, যাঁর সাথে কথা বলেছি তিনিই এসেছেন কিনা।
হাইম বেঞ্জামিন ও আহমদ মুসা হ্যান্ডশেক করল।
হ্যান্ডশেক করেই হাইম বেঞ্জামিন বারবারা ব্রাউনের দিকে ইংগিত করে আহমদ মুসাকে বলল, ‘ইনি আমার বন্ধু ও আমাদের পরিবারের শুভাকাংখী।’
বারবারা ব্রাউন হাত বাড়াল আহমদ মুসার দিকে হ্যান্ডশেকের জন্য।
আহমদ মুসার হাত না বাড়িয়ে উপায় ছিল না। কারণ, বলা যাবে না বাধাটি কি।
আহমদ মুসা ও বারবারা ব্রাউন হ্যান্ডশেক করল। এই সাথে বারবারা ব্রাউন বলল, ‘আমি বেঞ্জামিনের কাছে সব শুনেছি। ওয়েলকাম। আমি মনে করি, আপনার সাথে বেঞ্জামিন পরিবারের এই সাক্ষাত গুরুত্বপূর্ণ।’
‘ঈশ্বর আমাদের সাহায্য করুন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আসুন বলে ভেতরে যাবার জন্যে হাঁটা শুরু করল হাইম বেঞ্জামিন।
হাইম বেঞ্জামিন আগে আগে হাঁটছিল।
পেছনে পাশাপাশি আহমদ মুসা ও বারবারা ব্রাউন।
তিনজন এসে ড্রইংরুমে বসল।
পাশাপাশি এক সোফায় বসল হাইম বেঞ্জামিন ও বারবারা ব্রাউন। তাদের সামনে এক সোফায় বসল আহমদ মুসা।
বসে একটু সপ্রভিত হেসে হাইম বেঞ্জামিন বলল আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে, ‘একটা অপ্রয়োজনীয় প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করি মি. দানিয়েল?’
‘অবশ্যই।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আপনার কোট-প্যান্ট ধুলি-ধুসরিত হবার চিহ্ন দেখছি। পরার সময় এমনটা থাকার কথা নয়।’ বলল হাইম বেঞ্জামিন।
আহমদ মুসা হেসে উঠল। বলল, ‘ঠিক ধরেছেন। পরার সময় এমনটা থাকার কথা নয়। ছিলও না।’
‘তাহলে?’ জিজ্ঞাসা করল হাইম বেঞ্জামিন।
‘পথে আত্মরক্ষার জন্যে লড়াই করতে হয়েছে। সেজন্যে ধুলায় গড়াগড়িও খেতে হয়েছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কি ব্যাপার?’ প্রশ্ন করল দুজনেই বিস্ময়ে চোখ কলাপে তুলে।
আহমদ মুসা পথের সব ঘটনা বিস্তারিত তাদের জানাল।
‘সর্বনাশ। সাংঘাতিক কিছু ঘটতে পারতো। অলৌকিকভাবে আপনি বেঁচে গেছেন। ঈশ্বর আপনাকে সাহায্য করেছে।’ বলল হাইম বেঞ্জামিন। তার কন্ঠে রাজ্যের উদ্বেগ ঝরে পড়ল।
বারবানা ব্রাউন নিরব। তার মুখ মলিন হয়ে উঠেছে। বুঝতে পারল, ইহুদী গোয়েন্দা সংস্থাই এটা করেছে। কেন তারা করবে? ড. হাইম হাইকেলের পরিবার যদি কারও সাথে সাক্ষাত করতে চায়, তাহলে তাতে বাধা দেয়া হবে কেন? তাছাড়া তাদের গোয়েন্দা বিভাগ এ মিথ্যাচার কেন করল? বেঞ্জামিন নিশ্চিত হয়েছে এবং সেও নিউইয়র্ক পুলিশে অফিসে টেলিফোন করে জেনেছে ইয়র্কভিল ডিস্ট্রিক্ট-এ কিংবা নিউইয়র্কের কোন পুলিশ জোনেই এ্যালেন শেফার নামে কোন পুলিশ অফিসার নেই। তাহলে তাদের ইহুদী গোয়েন্দা সংস্থা মহামিথ্যাচার কেন করল? এসব ঘটনার পিছনে কি তাহলে আরও ঘটনা আছে যা বারবারারা জানে না? কিন্তু যাই থাক, ড. হাইম হাইকেলের পরিবারের সাথে মিথ্যাচার কেন? এ্যালেন শেফার যদি মিথ্যা হয়ে থাকে, তাহলে তার বলা সব কথাই মিথ্যা হয়ে যায়। মিথ্যা হয়ে যায় ড. হাইম হাইকেল সর্ম্পকে সে যা বলেছে তাও!
বারবারা ব্রাউনের চিন্তায় ছেদ নামল আহমদ মুসার কথার শব্দে। আহমদ মুসা বলছিল হাইম বেঞ্জামিনের কথার উত্তরে, ‘হয়তো মেরে ফেলাই তাদের টার্গেট, কিন্তু আপাতত তারা আটক করতেই চেয়েছিল আমাকে।’
‘তাদেরকে কি আপনি চেনেন? তারা কেন আপনাকে আটক করত চেয়েছিল? বেঞ্জামিন বলল।
‘না তাদের কাউকে আমি চিনি না। আমি এখানে আসতে না পারি, আমি আপনাদের সাথে কথা বলতে না পারি, সেই ব্যবস্থাই তারা করতে চেয়েছিল।’ বলল আহমদ মুসা।
হঠাৎ বিদ্যুত চমকের মত হাইম বেঞ্জামিনের মনে পড়ল তার সাথে দেখা করতে আসা নিউইয়র্কের সেই ভূয়া পুলিশ অফিসার বলে প্রমাণিত এ্যালেন শেফারের কথা। তিনি বলেছিলেন যে, ড. হাইম হাইকেলের শত্রুরা আমাদের বাসার উপর চোখ রেখেছে। তারা আমাদের সাথেও দেখা করতে চেষ্টা করবে। তাহলে আইজ্যাক দানিয়েল কি সেই দেখা করার পক্ষ এবং তাকে কি এ্যালেন শেফারের লোকেরাই বাধা দিয়েছিল! এ্যালেন শেফার যে ভূয়া তা প্রমাণিত হয়েছে। তাহলে আইজ্যাক দানিয়েল কি ঠিক পক্ষ? এ প্রশ্নের জবাব তার কাছে নেই।
হাইম বেঞ্জামিন মনোযোগ দিল আহমদ মুসার দিকে। আহমদ মুসার কথার উত্তরে বলল, ‘আপনি ওদের চেনেন না। কেন তাহলে ওরা আপনাকে বাধা দেবে এখানে আসতে?’
‘লোক হিসাবে ওদের চিনি না বটে, কিন্তু ওরা কারা আমি জানি। আমি নিউইয়র্কে এসে যেদিন থেকে ড. হাইম হাইকেলের কেন কিভাবে অন্তর্ধান ঘটল, তাকে উদ্ধারের জন্যে কি করা হয়েছে, কিভাবে তার সন্ধান পাওয়া যাবে, ইত্যাদি ব্যাপারে সন্ধান শুরু করেছি, সেদিন থেকেই ওরা আমার প্রতি পদে বাধার সৃষ্টি করেছে। প্রথম দিনেই রাব্বানিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. হাইম হাইকেলের বন্ধু ড.জ্যাকব যখন ড. হাইকেলের অন্তর্ধানের ব্যাপারে আমাকে তথ্য দিচ্ছিলেন, সে সময় ড. জ্যাকবকে হত্যা করার জন্যে তার উপর হামলা হয়। অস্ত্র ও বোমা সজ্জিত ছিল বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকেরা তাকে ধরতে পারেনি।’ এই কাহিনী দিয়ে কথা শুরু করে আহমদ মুসা কিভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্টের বাড়িতে গিয়েছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট, তাঁর মেয়ে নুমা ইয়াহুদ ও পি,এ লিসা কিভাবে সহযোগিতা করতে এগিয়ে এসেছিলে, এই সহযোগিতা করতে গিয়ে লিসা কিভাবে ওদের হাতে নিহত হয় এবং সবশেষে বলল বালক জুনিয়ার প্যাকারের কাহিনী ও তার গুলীবিদ্ধ হবার কথা।
হাইম বেঞ্জামিন ও বারবারা ব্রাউনের মন্ত্রমুগ্ধের মত মুসার কথা শুনছিল। বিস্ময় ও উদ্বেগে তাদের চোখে-মুখে নেমে এসেছিল অন্ধকারের একটা ছায়া। আহমদ মুসা থামলেও ওরা কিছুক্ষণ কথা বলতে পারল না। ওদের চোখ আঠার মত লেগেছিল আহমদ মুসার উপর।
একটু সময় নিয়ে হাইম বেঞ্জামিন ধীর কন্ঠে বলল, ‘এত কিছু ঘটে গেছে? আহত-নিহত হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে? কিন্তু ……………।’
হাইম বেঞ্জামিন কথার মাঝখানে আহমদ মুসা বলে উঠল, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট ড. আয়াজ ইয়াহুদ অথবা তাঁর মেয়ে নুমা ইয়াহুদের কাছে টেলিফোন করে বিষয়টা আরো একটু জানুন। আমার অনুরোধ।’
আহমদ মুসা থামতেই বারবারা ব্রাউন বলে উঠল, ‘আমি নুমা ইয়াহুদকে চিনি। সে গত বছর ফিলাডেলফিয়া ক্যাম্পিং-এ এসেছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রপস নিয়ে। পনের দিন আমরা একসাথে ছিলাম। আমি তাকে টেলিফোন করতে পারি। আমার মোবাইলে তার নাম্বার আছে।’
বলেই বারবারা ব্রাউন কথা বলার জন্যে একটু আড়ালে চলে গেল।
দশ মিনিট পর বারবারা ব্রাউন ফিরে এল হাসিমুখে। বসতে বসতে বলল আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে, ‘মি. দানিয়েল, নুমা ইয়াহুদ আপনার যেভাবে প্রশংসা করল তাতে মনে হলো আপনি ওর হৃদয় সিংহাসনের অবিসংবাদিত হিরো।
‘ওসব কথা পরে বলো। এখন কাজের কথায় এস।’ বারবারা ব্রাউন থামতেই কথা বলে উঠল হাইম বেঞ্জামিন।
‘বল কি! কাজের কথাই তো শুরু করেছি। বুঝতে পারছি না, নুমা ইয়াহুদ ও ড. আয়াজ ইয়াহুদের কাছে যিনি শার্লক হোমস ও আলেকজান্ডার শেয়ার্জনেগার এর যোগফল, তাঁর সম্পর্কে ওঁরা আর কি বলতে পারেন?’ বলল বারবারা ব্রাউন।
‘তুমি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ড ড. আয়াজ ইয়াহুদ স্যারের সাথে কথা বলেছ?’ হাইম বেঞ্জামিন জিজ্ঞাসা করল।
‘হ্যাঁ। তিনিও লিসা নিহত হওয়া, ড.জ্যাকব ও বালক আহত হওয়ার বিষয়টি কনফার্ম করলেন। বললেন যে, তাঁর কাছ থেকেই তোমাদের বাসার ঠিকানা নিয়েছেন। তিনি আরও বললেন, যতটা পারা যায় আইজ্যাক দানিয়েলকে সাহায্য করা উচিত। তিনি জানালেন, একটি চক্র, যাদেরকে তিনি চেনেন না, ড. হাইম হাইকেলের অনুসন্ধান, তার সম্পর্কে কাউকে কোন তথ্য দেয়া, এমনকি তার সম্পর্কে আলোচনাতেও বাধা দিচ্ছে। এদের ভয়েই ড. হাইম হাইকেলের সন্ধানে কোন কিছুই তারা করতে পারেনি। প্রথমবারের মত আইজ্যাক দানিয়েলই নির্ভীকভাবে এপথে এগিয়েছেন। এখনও কোন বাধাই তার পথরোধ করতে পারেনি।’ বলল বারবারা ব্রাউন।
‘এই যদি হয় ব্যাপার, তাহলে আমরা পুলিশকে খবর দিতে পারি। আমরা তাদের সাহায্য নিতে পারি।’ হাইম বেঞ্জামিন বলল।
‘হ্যাঁ ও ব্যাপারেও ড. আয়াজ আংকেল বলেছেন। তিনি বললেন, পুলিশ তাদের প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করেনি। পুলিশকেও তারা নিস্ক্রিয় করে রেখেছে।’ বলল বারবারা ব্রাউন।
‘তাহলে উর্ধতন পুলিশ কর্তৃপক্ষকে বিষয়টা জানাতে পারি।’ সোজা হয়ে বসে জোরের সাথে বলল হাইম বেঞ্জামিন।
‘দেখুন মি.হাইম বেঞ্জামিন, ড. হাইকেলের সুস্থ ও জীবিত উদ্ধার করা আমাদের টার্গেট হওয়া উচিত। পুলিশের সর্বস্তরেই ওদের লোক আছে। পুলিশ যখন জোরে-শোরে এ্যাকশনে যাবে, পুলিশের মাধ্যমেই ওরা খবর পেয়ে যাবে। যদি দেখে ওরা ধরা পড়ে যাচ্ছে, তাহলে অভিযুক্ত হওয়া থেকে বাঁচার জন্য ওরা ড. হাইম হাইকেলকে চিরতরে গায়েব করে ফেলতে পারে।’ আহমদ মুসা বলল।
আহমদ মুসার শেষ কথায় কেঁপে উঠল হাইম বেঞ্জামিন ও বারবারা ব্রাউন দুজনেই। উদ্বেগ-আংতকে পান্ডুর হয়ে গেল তাদের মুখ। বলল হাইম বেঞ্জামিন, ‘তাহলে কি করা যাবে?’ তার কণ্ঠে অসহায় সুর।
আহমদ মুসা বলল, ‘এগুতে হবে সন্তর্পনে। এমন কি পুলিশকেও না জানিয়ে। কৌশলে বা যে কোন মূল্যে ড. হাইম হাইকেলের অবস্থান জানতে হবে। তারপর তাঁকে উদ্ধার।’
‘কিন্তু কঠিন দায়িত্ব কে নেবে? আমরা পারব?’ বলল হাইম বেঞ্জামিন।
‘সেজন্যে আমি আপনাদের কাছে এসেছি। আমি আপনাদের সাহায্য চাই।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কি সাহায্য?’ বলল হাইম বেঞ্জামিন।
‘ড. হাইম হাইকেলকে ওরা কোথায় রেখেছে, এই তথ্য জানতে হবে। পুলিশ অফিসার ছদ্মবেশে ওরা আপনাদের কাছে এসেছিল। আমার বিশ্বাস ওরা আবারও আসবে। ওরা চেষ্টা করবে হাইম হাইকেলের পরিবারের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে। আর এই সুযোগ নিতে হবে হাইম হাইকেল পরিবারকে।’ আহমদ মুসা বলল।
হাইম বেঞ্জামিন তাকাল বারবারা ব্রাউনের দিকে। তারপর আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে প্রশ্ন করল, ‘মি. আইজ্যাক দানিয়েল, আপনি এত বড় দায়িত্ব নেবেন কেন? আপনার কোন পরিচয় আমরা জানি না।’
প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গেই জবাব দিল না আহমদ মুসা। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর ধীর কণ্ঠে বলল,‘সংগত প্রশ্ন করেছেন। পরিচয় ছাড়া একসাথে চলা যায় না। কিন্তু পরিচয় দিতে সময় লাগবে। তার আগে আপনাদের আস্থা আমার উপর বাড়তে হবে, আমার আস্থাও বাড়তে হবে আপনাদের উপর। আমি ভয় করি আমার পরিচয় যদি ওরা পেয়ে যায়, তাহলে আমাদের ক্ষতি করতে পারে ওরা নানাভাবে। আপাতত পরিচয় ছাড়াও আমরা একসাথে এগুতে পারি। আপনি চান আপনার পিতা উদ্ধার হোক, আমিও চাই ড. হাইম হাইকেল উদ্ধার হোক।’
‘মাফ করবেন। আগের প্রশ্নটাই আবার করছি। আমার পিতা উদ্ধার হলে আপনার কি লাভ? প্লিজ, কোন সন্দেহ করে আমি এ কথা বলছি না। আমার কৌতূহল।’ বলল হাইম বেঞ্জামিন।
এবারও সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল না আহমদ মুসা। গম্ভীর হয়ে উঠেছে আহমদ মুসা। একটু ভেবে নিয়ে বলল, ‘আমি কেন ড. হাইম হাইকেল উদ্ধার হোক চাই, এটা জানতে হলে জানা প্রয়োজন ওরা কেন ড. হাইম হাইকেলকে আটক রাখতে চায়।’
হাইম বেঞ্জামিনের চোখ দুটি উজ্জল হয়ে উঠল। বলল, ‘হ্যাঁ, সেটা তো অবশ্যই জানার বিষয়।’
‘মি. হাইম বেঞ্জামিন আপনি জানেন, আপনার পিতা অতীতের বিশ্বাস ও আচরণ পরিত্যাগ করেছেন। তার…………।’
হাইম বেঞ্জামিন আহমদ মুসার কথার মাঝখানে বলে উঠল, ‘এ বিষয়টা আমরা সকলেই জানি। কিন্তু কেন এই পরিবর্তন, সেটাই আমাদের সকলের প্রশ্ন।’
‘আমি যতদূর জানি, ড. হাইম হাইকেল তার জাতির কোন বিশেষ কাজ এবং কাজের পন্থাকে মেনে নিতে পারেননি। শুধু মেনে নিতে পারেননি নয়, জাতির ঐ পন্থারই তিনি বিরোধী হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন এবং তার নিজ অতীতের তিনি বোধ হয় প্রতিবিধানও করতে চেয়েছিলেন। জাতির একটা বিশেষ গোষ্ঠী এটা মেনে নেয়নি এবং নিশ্চিত হয়েছে যে, ড.হাইকেলের এই পরিবর্তন এবং তার প্রতিবিধান করার মনোভাব তাদের ক্ষতি করবে। এরাই ড. হাইম হাইকেলকে আটক করে রেখেছে।’ আহমদ মুসা বলল।
ভ্রুকুঞ্চিত হয়ে উঠল হাইম বেঞ্জামিনের। পুলিশ অফিসার এ্যালেন শেফারের কথা মনে পড়েছে তার। বলেছিল সে, শত্রুরা ড. হাইম হাইকেলকে দিয়ে কিছু তথ্যের ব্যাপারে কনফেশন করাতে চায়, যা ইতিহাস কে বদলে দেবে। এই কনফেশনই কি মি. আইজ্যাক দানিয়েলের ভাষায় আব্বার প্রতিবিধানমূলক কাজ? মি. আইজ্যাক দানিয়েল কি সেই কনফেশন বা প্রতিাবধানের সুবিধাভোগী পক্ষ? হাইম বেঞ্জামিন তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘ওদের ক্ষতির সুবিধাভোগী পক্ষ কি আপনি বা আপনারা? আপনারা কি কনফেশন করাতে চান আব্বাকে দিয়ে?’
‘কনফেশন শব্দে বিস্মিত হলো আহমদ মুসা। মনে পড়ল ‘স্পুটনিক’-এর নেয়া ড. হাইম হাইকেলের কনফেশন স্টেটমেন্টের কথা। হাইম বেঞ্জামিন নিশ্চিত এই ‘কনফেশন’-এর দিকেই ইংগিত করেছেন। কিন্তু হাইম বেঞ্জামিনের তো এটা জানার কথা নয়। হতে পারে পুলিশ অফিসারের ছদ্মবেশে আসা এ্যালেন শেফার কোন ফর্মে এই কথা হাইম বেঞ্জামিনকে বলেছে। বলল আহমদ মুসা হাইম বেঞ্জামিনকে উদ্দেশ্য করে, ‘মি. হাইম বেঞ্জামিন, কনফেশন করাবার প্রশ্ন নেই। আতীতের প্রতিবিধান হিসাবে নিজেই স্বতঃস্ফুর্তভাবে কোথাও কনফেশন করেছেন। এটাই ওদের কাছে তার সবচেয়ে বড় অপরাধ। আর সুবিধাভোগীর কথা বলছেন! ড. হাইম হাইকেল কারও সুবিধার্থে এই কনফেশন দেননি, সত্য প্রকাশের স্বার্থেই তিনি এটা করেছেন। আর সত্য প্রকাশ হলে এবং মিথ্যার ভার অপসৃত হলে কারও না কারো তো উপকার হবেই।’
‘বুঝলাম। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আব্বা যদি কনফেশন করে ফেলেই থাকেন, তাহলে সবই তো শেষ। আটকে রেখেছে কেন আব্বাকে তাহলে তারা?’ জিজ্ঞাসা বেঞ্জামিনের।
‘আমার মতে এর দুটো কারণ। এক, কনফেশনে সত্যের একটা অংশের মাত্র প্রকাশ ঘটেছে, সত্যের সবটা নয়। অবশিষ্ট সিংহভাগ সত্যকে তারা ড. হাইম হাইকেলকে আটক রাখার মাধ্যমে চেপে রাখতে চায়। দুই. ওরা মনে করে ড. হাইম হাইকেলের সেই কনফেশন তারা উদ্ধার করে এনেছে। এর কোন কপিই আর বাইরে নেই। সুতারাং ড. হাইম হাইকেল এখন আটক থাকলে সত্য প্রকাশ হওয়ার আর ভয় নেই। কিন্তু তারা জানে না যে, কনফেশনের মূল কপিই বাইরে রয়ে গেছে। তারা যা উদ্ধার করেছে এবং আরও যেগুলো ধ্বংস করেছে সেগুলো মূলটার নকল কপি মাত্র।’ আহমদ মুসা বলল।
বিস্ময় ভরা চোখে হাইম বেঞ্জামিন বলল, ‘সত্যটা’ কি মি. আইজ্যাক দানিয়েল? কনফেশনে কি আছে? সত্যটা প্রকাশ হলে এমন কি ঘটবে?’
‘এ প্রশ্নগুলোর উত্তর আজ থাক।
আপনার আব্বাই এর উত্তর ভালো দিতে পারবেন। আপনার আব্বা উদ্ধার হওয়া পর্যন্ত এটুকু অবশিষ্ট থাক।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আরও কিছু অবশিষ্ট থাকল। আপনার পরিচয় এখনও আমরা পাইনি।’ বলল হাইম বেঞ্জামিন।
‘পরিচয়ের ব্যাপারটা এমন কিছু নয় যে, সেজন্যে উন্মুখ হয়ে থাকতে হবে।’ আহমদ মুসা বলল।
হাসল হাইম বেঞ্জামিন। বলল, পরিচয়ের মধ্যে ‘এমন কিছু’ না থাকলে পরিচয় প্রকাশে ভয় করতেন না মি. আইজ্যাক দানিয়েল।’
‘আসুন, কাজের কথায় আসি। আমাকে আপনারা সাহায্য করবেন কিনা?’ বলল আহমদ মুসা।
গম্ভীর হলো হাইম বেঞ্জামিন। বলল, ‘এ জিজ্ঞাসা বরং আমাদের। আমরা আপনার সাহায্য চাই মি. আইজ্যাক দানিয়েল।’
‘ধন্যবাদ। আমি সাহায্য নিতে এবং সাহায্য দিতেই এসেছি মি. হাইম বেঞ্জামিন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘বলুন আমাদের কি করণীয়?’ জিজ্ঞাসা হাইম বেঞ্জামিনের।
‘এ্যালেন শেফার মানে আপনার আব্বার আটককারীরা যে আপনাদের সাথে যোগাযোগ করেছে, এটা খুবই আনন্দের খবর। এখন ওদের সাথে আপনার সর্ম্পক বৃদ্ধি করতে হবে এবং জেনে নিতে হবে, আপনার আব্বাকে ওরা কোথায় রেখেছে।’ আহমদ মুসা বলল।
খুশি হয়ে উঠল হাইম বেঞ্জামিন। বলল, ঠিক পরামর্শ। আব্বার নিকটবর্তী হবার এটাই সবচেয়ে সহজ পথ। ইতিমধ্যেই ওরা প্রস্তাব করেছে যে, আমাদেরকে আব্বার কাছে নিয়ে যাবে। তবে দূর থেকে দেখাবে মাত্র, কথা বলতে দেবে না এবং তার সাথে সাক্ষাতও করাবে না।’
আহমদ মুসা দারুন খুশি হয়ে উঠল। বলল, ‘থ্যাংকস গড। ওটুকু যথেষ্ট। উনার থাকার লোকেশানটা জানতে পারলেই হলো।’
‘নাম, ঠিকানা না জানলেও আমরা এটুকু জানতে পেরেছি, আংকেল ড. হাইম হাইকেলকে একটা মানসিক চিকিৎসা কেন্দ্রে রাখা হয়েছে।’ বলল বারবারা ব্রাউন।
‘মানসিক হাসপাতালে? ওরা বলেছে?’ বলে উঠল আহমদ মুসা।
‘জি হ্যাঁ। তিনি নাকি অপ্রকৃতিস্থ।’ বলল বারবারা ব্রাউন।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘মানসিক হাসপাতালে রেখেছে, এটা সত্য। কিন্তু অপ্রকৃতিস্থ, এই কথা ডাহা মিথ্যা।’
‘আপনি এটা মনে করেন? আপনার কথাকে ঈশ্বর সত্য করুন।’ প্রার্থনার সুরে বলল হাইম বেঞ্জামিন।
‘সুস্থ ড. হাইম হাইকেল নিউইয়র্কের যে মানসিক ডাক্তার কৌশলগত কারণে মানসিক হাসপাতালে রাখার পরামর্শ দিয়েছিল, আমি সে ডাক্তারের বাড়িতে গিয়েছিলাম। কিন্তু পাইনি তাকে। যা বুঝেছি, নিউইয়র্ক থেকে তাকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে।’
এরপর আহমদ মুসা বলল ডাক্তারের বাড়িতে ওদের লোকেরা তাকে বন্দী বা হত্যা করার চেষ্টা করেছিল এবং সংঘর্ষে ওদের দুজন লোক মারা যায়।
বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলে বারবারা ব্রাউন বলল, ‘ইতিমধ্যে ওদের দুজন লোক মারা গেছে আপনার হাতে?’
‘আমি দুঃখিত। না মারতে পারলে ওখানে আমাকেই লাশ হয়ে পড়ে থাকতে হতো।’ আহমদ মুসা বলল।
হাইম বেঞ্জামিন একথায় অংশ নিল না। সে আগের প্রশ্নই আবার করল, ‘আপনি নিশ্চিত মি.দানিয়েল যে, আব্বা অপ্রকৃতিস্থ হননি?’ হাইম বেঞ্জামিনের কণ্ঠ কান্নার মত ভারী।
‘আমি নিশ্চিত মি. হাইম বেঞ্জামিন। আমি যে বালক প্যাকারের কথা কিছুক্ষণ আগে বলেছি, সে বালকের মা মিসেস প্যাকার ঐ মানসিক ডাক্তারের একজন প্যাসেন্ট ছিলেন। তিনি নিজ কানে ডাক্তারকে এ বিষয়ে আলাপ করতে শুনেছেন। তাছাড়া আমি রাব্বানিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট আয়াজ ইয়াহুদসহ অনেকের সাথে আলোচনা করে বুঝেছি, ড. হাইম হাইকেল সম্পূর্ণ সুস্থ ছিলেন। তাঁর মানসিক রোগের কথা ওরা ছড়িয়েছে তাঁর অন্তর্ধানকে যুক্তিসংগত করার জন্যে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘থ্যাংকস গড। আপনার প্রতিটি কথা ঈশ্বর সত্য করুন।’ বলল হাইম বেঞ্জামিন। তার দুচোখ খেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল।
‘বারবারা ব্রাউন বেঞ্জামিনের কাঁধে হাত রাখল তাকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্যে।
সান্ত্বনার সুরে নরম কণ্ঠে আহমদ মুসা বলল, ‘ধৈর্য্য ধরুন। সব ঠিক হয়ে যাবে মি. হাইম বেঞ্জামিন। ড. হাইম হাইকেলের মত সৎ-সজ্জন ব্যাক্তির কেউ ক্ষতি করতে পারবে না। ঈশ্বরও তো আছেন।’
আহমদ মুসা একটু থামার পরেই আবার বলে উঠল, ‘মি. হাইম বেঞ্জামিন, আমি চলে যাবার পর থানায় একটা ডাইরী করাবেন এই বলে যে, ‘একজন অপরিচিতি লোক আমাদের বাসায় এসেছিল। মনে হয় সে ড. হাইম হাইকেলের অন্তর্ধান ঘটনার সাথে জড়িত। তার থেকে পরিবারের আরও ক্ষতির আশংকা করছি।’
‘আপনার বিরুদ্ধে এই ডাইরী?’ বলল হাইম বেঞ্জামিন ও বারবারা ব্রাউন একই সাথে।
‘হ্যাঁ। যাতে এ্যালেন শেফাররা বুঝে যে আপনারা তাদের সাথেই আছেন। আমি এলেও আমার সাথে ফলপ্রসু আলোচনা আপনাদের হয়নি।’ আহমদ মুসা বলল।
বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলেছে হাইম বেঞ্জামিন ও বারবারা ব্রাউন। বলল, ‘এই সুবিধার জন্যে আপনার মাথায় এতবড় বিপদ ডেকে আনবেন?’
আহমদ মুসা কিছু বলতে যাচ্ছিল, এ সময় বাইরে হৈচৈ-এর শব্দ শোনা গেল।
হৈচৈটা দ্রুত এগিয়ে আসছে। বলতে বলতে ভেতরে ঢুকে গেল।
আহমদ মুসারা তিনজনই উঠে দাঁড়াল।
হাইম বেঞ্জামিন কয়েক ধাপ এগিয়ে গেল ব্যাপার কি দেখার জন্যে। কিন্তু বেশি দূর যেতে হল না।
ঝড়ের বেগে ড্রইংরুমে প্রবেশ করল ৪ জন অপরিচিত লোক আর তাদের বাধা দিতে আসা দুজন সিকিউরিটির লোক।
ড্রইংরুমে প্রবেশ করেই ওরা চারজন সোজা হয়ে এসে দাঁড়াল আহমদ মুসার সামনে। তাদের হাতের চার রিভলবার তারা তাক করল আহমদ মুসার লক্ষ্যে। বলল তাদের একজন চিৎকার করে, ‘আমাদের সংজ্ঞাহীন করে গাড়িতে বন্ধ করে রেখে মনে করেছিলে এখানে কাজ সেরে চলে যাবে। কিন্তু তা আমরা হতে দিচ্ছি না। চল, এবার আমরা তোমাকে কি করি দেখবে।’
প্রথমে বেঞ্জামিন ও বারবারা ব্রাউন আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু এখন বুঝতে পারল, এদেরকে আহমদ মুসা গাড়িতে বন্ধ করে এসেছিল। এরা এ্যালেন শেফারের লোক। পাহারা দিচ্ছে যাতে কেউ ড. হাইম হাইকেলের বাড়িতে তার পরিবারের সাথে মিশতে না পারে। এদের ক্রোধ আইজ্যাক দানিয়েলের উপর। আইজ্যাক দানিয়েলের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল তারা দুজনেই। এর বাইরেও বারবারা ব্রাউন যে বিষয়টা ভাবছিল তা হলো, এরা নিশ্চয় ইহুদী গোয়েন্দা সংস্থার লোক। কিন্তু তাদের সে চেনে না কেন? এদের কি অন্য জায়গায় থেকে আনা হয়েছে! কিন্তু তাকে বলা হয়নি কেন? হতে পারে, বারবারা ব্রাউন ইহুদী গোয়েন্দা সংস্থার বিশ্বাসের পরীক্ষায় উর্ত্তীন হতে পারেনি। সেটাই ভাল। এসব অস্বচ্ছ ‘হাইড এন্ড সীক’ খেলার কাজ তার মোটেই পছন্দ নয়।
আর আহমদ মুসা ওদের চারজনকে চিনতে পেরেছিল। ওদের একজন চিৎকার করে আহমদ মুসাকে শাসানো শেষ হলে আহমদ মুসা হাসিমুখে বলল, ‘তোমাদের তো আমার প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত তোমরা এখনও বেঁচে আছ এবং এখানে আসার সুযোগ পেয়েছ এজন্যে।’
ওরা চারজন তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল আরও। ওদের তর্জন-গর্জনের মধ্যে একজন তার রিভলবারের ট্রিগারে তর্জনী চেপে বলল, ‘আর একটু চাপলেই বুলেট তোমার কপাল ফুটো করে মগজ লন্ড ভন্ড করে দেবে।’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘তোমার রিভলবারের গুলী আছে কিনা পরীক্ষা করেছ?’
একথা বলতেই লোকটিই চমকে উঠে তার রিভলবার পরীক্ষা করল। গুলী নেই। তার চোখ ছানা-বড়া হয়ে উঠল গুলী নেই দেখে। সে তাকাল অন্য তিনজনের দিকে। ওরা তিনজনও একে একে রিভলবার পরীক্ষা করল। প্রত্যেকেরই চোখ ছানাবড়া হয়ে উঠল বিস্ময়ে। কারও রিভলবারে গুলী নেই।
আহমদ মুসা ওদের বিপর্যস্ত চোখের সামনে ঝুঁকে পড়ে দুহাত দিয়ে দুপায়ের মোজায় আটকানো দুটি রিভলবার বের করে আনল। আহমদ মুসা সরে এল ড্রইংরুমের দরজার দিকে। ওরা চারজনসহ হাইম বেঞ্জামিন ও বারবারা ব্রাউনও এবার তার সামনে।
আহমদ মুসা তাক করেছে তার রিভলবার দুটো ওদের চারজনের দিকে। বলল, ‘দেখলে তো নাটকের দৃশ্য কিভাবে পাল্টে গেল? তোমরা কি করে ধরে নিলে যে বুলেট ভরা রিভলবারগুলো আমি তোমাদের কাছে ফেলে এসেছি? মাত্র মৃত্যুই এ ধরনের ভুলকে ডেকে নিয়ে আসে।’
ওদের চারজনের বিমুঢ় মুখে এবার আতংক নেমে এল। বলল, দেখ আমরা সরকারী লোক। গায়ে হাত দিলে ভাল হবে না। আমরা নিজে করিনি। সরকারী হুকুম তামিল করার জন্যেই আমরা এসেছিলাম।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘ভয় করো না আমার রিভলবারের মূল্যবান বুলেট তোমাদের জন্যে নয়। সামান্য কয়টা পয়সার বিনিময়ে এসেছ আমাকে মারতে। এই ধরনের খারাপ কাজ আর করো না।’
বলেই আহমদ মুসা তাকাল রিভলবার দুটো পকেটে ফেলে তাকাল হাইম বেঞ্জামিনের দিকে। বলল, ‘জানি আমি বেরোনের পর আপনারা থানায় গিয়ে কেস করবেন যে, আমি আপনাদের হুমকি দিতে বা হত্যা করতে এসেছিলাম। তবে আমার অনুরোধ এই চারজন নকল গোয়েন্দা সম্পর্কেও থানায় অভিযোগ করবেন। ওরা সরকারী গোয়েন্দার পোশাকে এসেছিল নিজেদের উদ্দেশ্য সাধন করতে। এটা অপরাধ।’
হাইম বেঞ্জামিন ভালভাবে তাকাল লোক চারজনের দিকে। ঠিক তো, ওদের চারজনেরই পরনে সরকারী গোয়েন্দা পোশাক।
আহমদ মুসা থামতেই ওদের চারজনের একজন বলে উঠল, ‘মিথ্যা কথা। সরকারী হুকুমেই আমরা এসেছি।’
‘সরকারী কোন লোকের হুকুম হতেই পারে। কিন্তু সেটা সরকারী হুকুম নয় এবং তোমরা সরকারী লোক নও। ফিলাডেলফিয়ার পুলিশ প্রধানকে জিজ্ঞাসা করলেই এটা জানা যাবে।’ বলল আহমদ মুসা।
তারপর আহমদ মুসা ‘সকলকে গুডবাই’ বলে ড্রইংরুম থেকে বেরিয়ে এল।
আহমদ মুসার পরপর বেরিয়ে গেল ওরা চারজনই। যাবার সময় বেঞ্জামিনকে বলল, ‘স্যরি স্যার আমরা শয়তানটাকে আটকাতে পারিনি। আপনাদের কোন ক্ষতি করেনি তো? ভীষণ চালাক আর ধড়িবাজ লোকটা। আমরা এসে পড়ে ভালই হয়েছে। চলে যেতে বাধ্য হলো।’
‘আপনাদেরকে এই দায়িত্ব দিয়েছিল কে? জিজ্ঞাসা বারবারা ব্রাউনের।
‘দুঃখিত, আমরা বলতে পারব না ম্যাডাম।’ বলে তারা চারজন বেরিয়ে গেল ড্রইংরুম থেকে।
ওরা চলে গেলে বারবারা ব্রাউন বলল, ‘বেঞ্জামিন তুমি একটু দাঁড়াও। আমি একটা টেলিফোন করে আসি।’ বলে মোবাইল নিয়ে টেলিফোন গাইডের খোঁজে হাইম বেঞ্জামিনের ঘরে গেল।
মিনিট তিনেক পর ফিরে এল বারবারা ব্রাউন। তারপর সে ও হাইম বেঞ্জামিন সোফায় ফিরে এসে পাশাপাশি বসল। বারবারা ব্রাউনই প্রথম কথায় বলল, ‘অনেক প্রশ্নেরই সমাধান আজ হলো বেঞ্জামিন। মি.আইজ্যাক দানিয়েল ঠিকই বলেছেন, এরা চারজনই ভূয়া গোয়েন্দা। আমি ফিলাডেলফিয়ার পুলিশ প্রধান মি. টেলারের কাছে টেলিফোন করেছিলাম। তিনি খোঁজ নিয়ে জানালেন, কোন ওয়াচার বা গোয়েন্দাকে ড. হাইকেলের বাসায় পাঠানো হয়নি আজ।’
‘তাহলে এই প্রতারণামূলক কাজ করল কে?’ জিজ্ঞাসা হাইম বেঞ্জামিনের।
‘যারা এ্যালেন শেফারকে পুলিশ অফিসার সাজিয়েছিল, তারাই সাজিয়েছে এদেরকেও।’ বলল বারবারা ব্রাউন।
‘কিন্তু আশ্চর্য হচ্ছি, আইজ্যাক দানিয়েল এদের ঠিক ঠিক চিনে ফেলল কি করে!’ হাইম বেঞ্জামিন বলল।
‘আইজ্যাক দানিয়েল সাধারণ কেউ নয় বলেই আমি মনে করি। দেখলে না, ওরা চারজন তাকে ঘিরে ফেলল, তখন তার চোখে-মুখে ভয়ের সামান্য কোন প্রকাশ ঘটেনি। আর দেখ ওদের রিভলবার আগেই খালি করে ওখানে রেখে এসেছিল। কি বিস্ময়কর দুরদৃষ্টি। আরেকটা ব্যাপার, তাঁকে সার্চ করে তার পকেটের রিভলবার গেটে রেখে দেয়া হয়েছে। কিন্তু আমরা কি কল্পনা করতে পেরেছি যে, তার দুমোজার সাথে গোজা রয়েছে আরো দুটি রিভলবার! এখানেও অদ্ভুত দুরদৃষ্টির পরিচয় দিয়েছেন। আমার ………………।’ শেষ করতে পারলো না বারবারা ব্রাউন তার কথা।
তার কথার মাঝখনেই হাইম বেঞ্জামিন বলে উঠল, ‘কিন্তু এখানে সে কি আমাদের সাথে প্রতারণা করেনি? সে আমাদের সার্চকে ফাঁকি দিয়েছে, অস্ত্র নিয়ে প্রবেশ করেছে।’
‘তোমার কথা একদিক দিয়ে ঠিক। কিন্তু প্রয়োজনেই এটা সে করেছে। আমরা তো ভেবেছি আমাদের কথা। কিন্তু তিনি ভেবেছেন আমাদের বিষয় ছাড়াও তার আরও শত্রুর কথা। সুতারাং তাকে প্রস্তুত থাকতে হয়েছে। তা যে ঠিক তা প্রমাণই হলো।’ বলল বারবারা ব্রাউন।
‘ঠিক বলেছ বারবারা। ওদের একটা করে রিভলবার খালী করে রেখেছিল। ওদের কাছে আরও রিভলবার যদি থাকতো।’ হাইম বেঞ্জামিন বলল।
হাইম বেঞ্জামিন একটু থেমেই আবার বলা শুরু করল, ‘দেখ আইজ্যাক দানিয়েল কেমন চালাক। তার সাথে আমাদের সম্পর্কের বিষয়টা ওদের চারজনকে জানতে দিল না, বরং বিপরীতটাই বুঝিয়ে দিল তার বিরুদ্ধে থানায় কেস করার প্রসঙ্গটি অন্যভাবে ঘুরিয়ে বলে।’
‘তার মানে তার দৃষ্টি দেখ সব দিকেই আছে। আবার দেখ যেমন তার বুদ্ধি, তেমনি এক্সপার্ট দেখ ফাইটিং-এও। আমার মনে হচ্ছে, নুমা ইয়াহুদ তাঁর সম্পর্কে যা বলেছে, তার চেয়েও তিনি বড়। দেখ এক সিটিং-এই তিনি আমাদের সামনের অন্ধকারকে একদম স্বচ্ছ, ঝরঝরে করে দিয়েছেন।’ বলল বারবারা ব্রাউন।
‘ঠিক বলেছ। আমার আনন্দ লাগছে, আব্বার উদ্ধারে তার মত লোকের সাহায্য পাব। এখন বল বারবারা, আমরা এগুবো কিভাবে। আমাদের উপর দায়িত্ব হলো, এ্যালেন শেফারদের মাধ্যমে আমাদের আব্বার অবস্থান জানার ব্যবস্থা করা। এখন কেমন করে ওদের সাথে যোগাযোগ করব।’ হাইম বেঞ্জামিন বলল।
‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাইরেক্টর মি. ফ্রান্সিসের সাথে যোগাযোগ করতে হবে। তিনি সব ব্যবস্থা করবেন বলে মনে হয়।’ বলল বারবারা ব্রাউন।
‘ঠিক আছে কালই মি. ফ্রান্সিসের সাথে যোগাযোগ করব। দরকার হলে নিউইয়র্ক যাব।’ বলল হাইম বেঞ্জামিন।
‘ঠিক আছে বেঞ্জামিন। আমি তাহলে এখন উঠি।’ বারবারা ব্রাউন বলল।
‘না চল, ডিনার খেয়ে যাবে। টেবিলে বোধ হয় রেডি।’ বলে উঠে দাঁড়াল হাইম বেঞ্জামিন।
বারবারা ব্রাউনও উঠে দাঁড়াল।

আজর ওয়াইজম্যানের সামনের টেবিলের ওপাশে বসেছিল বিল পুলম্যান।
বিল পুলম্যান ওয়ার্ল্ড ফ্রিডম আর্মি (WFA) ও ইহুদী গোয়েন্দা সংস্থার নিউইয়র্ক অফিসের প্রধান সমন্বয়কারী।
কথা বলছিল বিল পুলম্যান, ‘স্যার আইজ্যাক দানিয়েলকে এ পর্যন্ত যে কয়জন দেখেছে, তাদের বর্ণনা থেকে নিশ্চিত প্রমানিত হয় না যে তিনিই আহমদ মুসা।’
‘কিন্তু তার প্রতিটি কাজ প্রমাণ করে যে সে আহমদ মুসা না হয়ে পারে না।’ বলল আজর ওয়াইজম্যান।
‘তা ঠিক স্যার। অবশ্য আহমদ মুসা ছদ্মবেশ ধরতে উস্তাদ। সাধারণ ছদ্মবেশেও সে নিজেকে পাল্টে ফেলতে পারে। বিশেষ করে খুব অভ্যস্ত চোখ না হলে তার ছদ্মবেশ ধরা মুশকিল। অতএব আমি মনে করি, তাকে আহমদ মুসা হিসাবে ধরেই আমাদের অগ্রসর হওয়া দরকার।’ বিল পুলম্যান বলল।
‘যদি তা ধরে নিতে হয়, তাহলে সেটা এক বিপদের কথা। কারণ মার্কিন সরকার ও প্রসাশনের সকল পর্যায়ের সে সহযোগিতা পাবে। তবু কিন্তু এ লড়াইয়ে আমাদের জিততে হবে পুলম্যান।’ বলল আজর ওয়াইজম্যান।
‘অবশ্যই স্যার। নিউইয়র্কের লিবাটি টাওয়ার ও ডেমোক্র্যাসি টাওয়ার ধ্বংসের সত্যটা যদি প্রকাশ হয়ে পড়ে, তাহলে স্যার ইহুদীবদীরা আবার রোমান যুগের মত অন্ধকার যুগে ফিরে যাবে। সুতরাং যে কোন মূল্যে সত্যের প্রকাশ রোধ করতে হবে।’ বিল পুলম্যান বলল।
‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে, স্পুটনিকের যোগাড় করা সব ডকুমেন্ট আমরা ধ্বংস করতে পেরেছি এবং অবশিষ্ট যেগুলো ওদের হাতে ছিল, সেগুলোর সবটাই আমাদের হাতে এসে গেছে। না হলে আমরা মহাবিপদে পড়ে যেতাম। সে ডকুমেন্টগুলো ওরা হারিয়েছে বলেই খোদ আহমদ মুসাই পাগলের মত ছুটে এসেছে ড. হাইম হাইকেলের সন্ধানে। ড. হাইম হাইকেলকে পেলে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট তারা নতুন করে তৈরি করতে পারবে। সুতারাং যেভাবেই হোক ড. হাইম হাইকেলকে আড়ালে রাখতে হবে। তাকে না পেলে আহমদ মুসারা এক ইঞ্চিও সামনে এগুতে পারবে না।’ বলল আজর ওয়াইজম্যান।
‘মাফ করবেন স্যার। দেখা যাচ্ছে ড. হাইম হাইকেল প্রকৃত অর্থেই আমাদের জাতির জন্যে এক বিপজ্জনক বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের এখনকার সব শক্তিই তাকে আড়ালে রাখার চেষ্টায় ব্যায়িত হচ্ছে। এই অবস্থায় এই বোঝা আমাদের জাতিদেহ থেকে ঝেড়ে ফেলার মধ্যেই জাতির কল্যাণ।’ বিল পুলম্যান বলল।
‘কোন আমেরিকানের কাছে তুমি কখনই এ ধরনের কথা বলবে না। কোন আমেরিকান ইহুদীর কাছে তো নয়ই। যতদিন মার্কিন রাষ্ট্র থাকবে ততদিন হাইম সলমন মাকির্নীদের মধ্যে বেঁচে থাকবে এবং হাইম পরিবারও জাতীয় সম্মানের এক কেন্দ্রস্থল হিসাবে বর্তমান থাকবে। যদি ড. হাইম হাইকেলের কিছু হয়, তাহলে আজ না হয় কাল তা প্রকাশ পাবেই। তখন যে প্রতিক্রিয়া হবে সেটা আমরা ইহুদীবাদীরা বহন করতে পারবো না। অন্যভাবে তাকে ধীর প্রক্রিয়ায় মুছে ফেলতে হবে। অবশ্যই তাকে আড়াল করার শেষ রক্ষা যদি নাই হয়, তাহলে আশু জাতীয় স্বার্থকেই বড় করে দেখব। তাকে সরিয়ে দেয়ার দরকার হলে সরিয়েই দেব।’ বলল আজর ওয়াইজম্যান।
‘ধন্যবাদ স্যার। তাকে শুধু পাগল প্রমাণ করা নয়, সত্যিই পাগলে পরিণত করার কাজটাই সবচেয়ে অগ্রাধিকার দিতে হবে। কেন এই কাজটা আমরা করতে পারছি না।’ বিল পুলম্যান বলল।
‘এই কাজ আমরা প্রথম থেকে শুরু করেছি। কিন্তু ডাক্তারদের বক্তব্য হলো ড. হাইকেল অত্যন্ত শক্ত মন ও নিখাদ চরিত্রের লোক। ঈশ্বরমুখিতা তার এতই দৃঢ় যে, তার মনকে, চিন্তাকে বিছিন্ন ও বহুমুখী করার কোন পন্থাই এখনও সফল হয়নি। এই চেষ্টা আমাদের জারি আছে। আমরা সম্প্রতি তার ব্রেনের উপর ইলেক্ট্রনিক ওয়েভকে কার্যকর করার চেষ্টা শুরু করেছি। এই চেষ্টা যদি যথেষ্ট পরিমাণে সফল হয়, তাহলে তার চিন্তা-পদ্ধতিকে বিকৃত করা সম্ভব হবে।’ বলল আজর ওয়াইজম্যান।
‘ধন্যবাদ স্যার। স্যার আরেকটা কথা। আহমদ মুসাকে ‘শুট এট সাইট’ এর নির্দেশ দিন। এটা প্রমাণ হয়েছে, তাকে বন্দী করে আমরা এঁটে উঠতে পারছি না, অতীতেও পারিনি। সুতরাং তাকে বন্দী নয় দেখামাত্র হত্যার নির্দেশ দিন।’ বিল পুলম্যান বলল।
‘ঠিক বলেছ বিল। আমিও এ রকমই ভাবছি। আমরা যদি এতদিন এ সিদ্ধান্ত নিতাম, তাহলে অনেক আগেই আমরা আহমদ মুসার হাত থেকে মুক্তি পেতাম। আমাদের………………….।’
কক্ষের দরজায় এসে দাঁড়াল আজর ওয়াইজম্যানের পার্সোনাল সেক্রেটারী। বলল আজর ওয়াইজম্যানকে, ‘স্যার পুলিশ অফিসার এ্যালেন শেফার ও রাব্বানিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিরেক্টর মি. ফ্রান্সিস এসেছেন।’
‘ওঁদের নিয়ে এস।’ নির্দেশ দিল আজর ওয়াইজম্যান।
‘ফিলাডেলফিয়ার কোন খবর আছে স্যার।’ জিজ্ঞাসা করল বিল পুলম্যান।
‘ঐ ব্যাপারেই আসছেন এ্যালেন শেফার ও ফ্রান্সিস। বলল ওয়াইজম্যান।
কক্ষে প্রবেশ করল ফ্রান্সিস ও এ্যালেন শেফার।
তারা কক্ষে প্রবেশ করে আজর ওয়াইজম্যানকে রাজাসুলভ দীর্ঘ বাও করল।
আজর ওয়াইজম্যান তাদের ইংগিত করলে তারা বসল গিয়ে বিল পুলম্যানের বাম পাশে পাশাপাশি।
ওরা বসতেই আজর ওয়াইজম্যান চেয়ারে হেলান দিয়ে তাকাল এ্যালেন শেফারের দিকে। বলল,‘মি. শেফার বলুন ফিলাডেলফিয়ার খবর কি?’
এ্যালেন শেফারের প্রকৃত নাম জোসেফ এরাম। তিনি ইয়র্কভিল ডিস্ট্রিক্টের ইনভেস্টিগেটিভ অফিসার। সেদিন এ্যালেন শেফার নাম নিয়ে ফিলাডেলফিয়ায় ড. হাইম হাইকেলের বাসায় গিয়েছিলেন। সে একজন কট্টর ইহুদীবাদী।
‘স্যার আজই আমি ফিলাডেলফিয়া থেকে জানতে পেরেছি, বারবারা ব্রাউন আমাদের সহযোগিতা করতে অস্বীকার করেছে।’ আজর ওয়াইজম্যানের প্রশ্নের উত্তরে বলল ‘এ্যালেন শেফার ওরফে জোসেফ এরাম।’
‘তার মানে সেদিন আইজ্যাক দানিয়েল ড. হাইম হাইকেলের ছেলে হাইম বেঞ্জামিনের সাথে কি আলাপ করেছে তার কিছুই আমরা জানতে পারিনি!’ আহত কন্ঠে জিজ্ঞাসা করল আজর ওয়াইজম্যান।
‘জি হ্যাঁ, বারবারা ব্রাউন জানিয়ে দিয়েছে, হাইম পরিবারের বিরুদ্ধে যায় এমন কোন কাজ সে করতে পারবে না এবং সেদিনের আলোচনা সম্পর্কেও সে কোন কথা বলবে না। তবে এটুকু বলেছে যে, এ্যালেন শেফারের প্রস্তাবে হাইম বেঞ্জামিন রাজী আছে এবং হাইম বেঞ্জামিনের সাথে দেখা করতে আসা আইজ্যাক দানিয়েল লোকটিকে সে সন্দেহের চোখে দেখছে। সে কেস করেছে এ কারণেই।’ বলল এ্যালেন শেফার।
‘বারবারা ব্রাউনের এ পরিবর্তনের কারণ কি? সে তো একজন ভালো ইহুদী গোয়েন্দা কর্মী।’ আজর ওয়াইজম্যান বলল।
‘সে জানিয়েছে এটা তার নীতিগত সিদ্ধান্ত। হাইম পরিবারের সম্পর্কিত কোন কিছুই সে নিজেকে জড়িত করবে না।’ এ্যালেন শেফার জানাল।
‘দেখা যাচ্ছে হাইম বেঞ্জামিন আসার পরই তার এ পরিবর্তন। কারণ কি?’ আবার প্রশ্ন করল আজর ওয়াইজম্যান।
‘স্যার অনেকেই ভাবছেন প্রেম ঘটিত কোন ব্যাপার রয়েছে এর পেছনে। সে হয়তো মনে করছে বেঞ্জামিনের উপর কোন গোয়েন্দাগিরী করা তার ঠিক হবে না। এ রকম কিছু ঘটেছে বলে মনে করা হচ্ছে।’ বলল এ্যালেন শেফার।
এ্যালেন শেফার থামতেই আজর ওয়াইজম্যান বলে উঠল, ‘তার এই পরিবর্তন বা কোন প্রকার ঠুনকো সেন্টিমেন্ট গ্রহণযোগ্য নয়। তার ব্যাপারে আমরা পরে ভাবব।’ বলে আজর ওয়াইজম্যান তাকাল ফ্রান্সিসের দিকে। বলল, ‘মি. ফ্রান্সিস হাইম পরিবারের সাথে যোগাযোগের ব্যাপারটা সবাইকে বলুন।’
রাব্বানিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাইরেক্টর নেইল ফ্রান্সিস নড়ে-চড়ে বসে বলল, ‘হাইম বেঞ্জামিনের সাথে আমরা দেখা করে আসার পর হাইম বেঞ্জামিনই আমার সাথে প্রথম যোগাযোগ করেছে। প্রথম দিনেই সে বলেছে, এ্যালেন শেফারের দেয়া প্রস্তাব অনুসারে আমাদের দেখা করার ব্যবস্থা করুন। এরপর আরও তিনবার সে টেলিফোন করেছে। প্রতিবারেই সে ঐ ব্যাপারে জোর তাগিদ দিয়েছে। অধৈর্য হয়ে পড়েছে তারা। এ ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত না নিলে তাদের বুঝিয়ে রাখা যাচ্ছে না।’
নেইল ফ্রান্সিস থামলে আজর ওয়াইজম্যান বিল পুলম্যানকে বলল, ‘তুমিও তো ব্যাপারটা জান। তুমি কি ভাবছ বল।’
‘জি স্যার, আমি সব শুনেছি। আমি তাদের অধৈর্য হওয়াটাকে পছন্দ করছি না। এ্যালেন শেফার যে প্রস্তাব দিয়ে এসেছেন, আমরা তা আমাদের সুবিধা অনুযারী বাস্তবায়ন করব। দেখা করানোর ব্যাপারটাকে যতটা পারা যায় আমি ‘ডি’লে’ করানোর পক্ষপাতী।’ বিল পুলম্যান বলল।
আজর ওয়াইজম্যান আবার তাকাল এ্যালেন শেফারের দিকে। বলল, ‘জোসেফ এরাম তুমি এ ব্যাপারে কি বলতে চাও?’
জোসেফ এরাম ওরফে এ্যালেন শেফার তাকাল আজর ওয়াইজম্যানের দিকে। বলল, ‘স্যার আমার হাইম পরিবারকে এই প্রস্তাব দেওয়ার আসল কারণ হলো তাদের শান্ত রাখা, আমাদের হাতে রাখা। যাতে এ নিয়ে তারা হৈচৈ না বাধায়। এ দৃষ্টিকোণ থেকে স্যার আমি মনে করি, ড. হাইম হাইকেলকে দেখার ওদের সুযোগ দেয়া দরকার। দেখা হলে তারা নিশ্চিত হবে যে, ড. হাইম হাইকেল বেঁচে আছেন। তিনি অসুস্থ। তার চিকিৎসা হচ্ছে। তারা এ নিয়ে কোন উচ্চবাচ্য করার প্রয়োজন অনুভব করবে না। এতে আমাদের কাজের সুবিধা হবে।’ থামল পুলিশ অফিসার জোসেফ এরাম।
আজর ওয়াইজম্যান এবার সোজা হয়ে বসল। বলল, ‘হাইম পরিবারকে দেয়া আমাদের প্রস্তাব নিয়ে আমরা কি করব, এ ব্যাপারে তোমাদের প্রত্যেকের কথার পেছনেই যুক্তি আছে। কিন্তু তোমরা কেউই বারবারা ব্রাউনের পরিবর্তনের বিষয়টাকে সামনে রেখে হাইম পরিবার সর্ম্পকে আমাদের করণীয় বিচার-বিবেচনা করে দেখনি। বারবারা ব্রাউনের এই পরিবর্তন ছোট বিষয় নয়। তার চিন্তা-ধারার এই পরিবর্তনের মত হাইম পরিবারের চিন্তা ধারায় কোন পরিবর্তন এসেছে কিনা আমরা জানতে পারছি না। যতদিন এটা জানা না যাবে ততদিন হাইম হাইকেলের সাথে তার পরিবারকে দেখা করানো যাবে না।’
‘কিন্তু স্যার বেশি দিন দেরি হলে করলে তারা বিরক্ত হবে, বিক্ষুব্ধ হবে এবং ধৈর্য্যহারা হলে এই বিষয়টা সরকার ও সংবাদপ্রত্রের কাছে চলে যেতে পারে।’ বলল নেইল ফ্রান্সিস।
‘কিন্তু মি. ফ্রান্সিস, এমন ধরনের কিছু যাতে তারা না করতে পারে তার ব্যবস্থা করা যাবে। কিন্তু দেখা করার পর কেউ যদি হোস্টাইল হয়, কিংবা হোস্টাইল কাউকে যদি দেখা করানো হয়, তাহলে যে ক্ষতি হবে তার প্রতিবিধানের কোন পথই থাকবে না। তার ফলে গোটা প্ল্যান আমাদের ভন্ডুল হয়ে যাবে। যে কোন মূল্যেই এটা হতে দেয়া যাবে না।’ বলল আজর ওয়াইজম্যান।
‘স্যার ঠিকই বলেছেন। কিন্তু স্যার এখন ওদের মুখ বন্ধ করা যাবে কিভাবে?’ বলল নেইল ফ্রান্সিস।
‘খুব সহজে। বিল পুলম্যান একদিন যাবে ফিলাডেলফিয়ায় ড. হাইম হাইকেলের বাড়িতে। বলবে বেঞ্জামিনকে শত্রুপক্ষের সাথে যেন পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ কোনভাবেই তারা যোগাযোগ না করে। অন্যথা যদি হয় তাহলে তারাও বিপদে পড়বে, ড. হাইম হাইকেলকেও মেরে ফেলবে। তাদের আচরণের উপরই নির্ভর করবে কবে কখন তারা ড.হাইম হাইকেলের সাথে দেখা করতে পারবে। অন্যথায় ড. হাইম হাইকেলের মতই বেঞ্জামিনও একদিন হারিয়ে যাবে।’ আজর ওয়াইজম্যান বলল।
‘বুঝলাম। তার আগ পর্যন্ত আমি কি বলব ওদের। ওরা আজ কিংবা যেকোন সময় যোগাযোগ করতে পারে।’ বলল ফ্রান্সিস।
‘জানাবেন, ক’দিনের মধ্যেই আমাদের লোক আপনাদের ওখানে যাবে আলোচনার জন্যে। এ বিষয়ে তারাই কথা বলবে।’ আজর ওয়াইজম্যান বলল।
‘স্যার, আহমদ মুসা যদি সত্যিই এসে থাকে, তাহলে সে কি শুধু হাইম পরিবারের উপরই নির্ভর করবে? সরকার ও প্রশাসনের ক্ষমতাবান অনেকের সাথেই তার সখ্যতা রয়েছে। এসব ক্ষেত্রে সে যোগাযোগ করছে কিনা আমরা কি তার খোঁজ রাখছি?’ বলল বিল পুলম্যান।
‘আহমদ মুসার এ সুবিধা আছে। জেনারেল শ্যারন জেলে থাকায় আমাদের বিরাট অসুবিধা হয়েছে এক্ষেত্রে। বিরাট ভীতি ও হতাশাও ছড়িয়ে পড়েছে আমাদের যারা অবশিষ্ট আছে তাদের মধ্যে। এরপরও তাদের যথাসাধ্য সাহায্য আমরা পাচ্ছি।’ আজর ওয়াইজম্যান বলল।
কথা শেষ করেই আজর ওয়াইজম্যান উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘তোমরা এস। আমার জরুরি এনগেজমেন্ট আছে। আমি চললাম।
আজর ওয়াইজম্যান বেরিয়ে গেলে অন্যরা সবাই উঠে দাঁড়াল।

Top