গাড়ির ম্যাপ স্ক্রীনে গাড়ির চলার পথ সুন্দরভাবে ফুটে উঠছে। গাড়িটা ফিলাডেলফিয়া ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে উত্তর-পূর্বমুখী পেনরস এ্যাভেনিওতে প্রবেশ করেছিল। পেনরস এ্যাভেনিউ থেকে প্রবেশ করেছে বিখ্যাত ব্রডষ্ট্রিটে। ব্রডষ্ট্রিট থেকে গাড়ি এখন ওয়ালমাট ষ্ট্রিটে প্রবেশ করে পুব দিকে এগিয়ে চলেছে।
ড. হাইম হাইকেল আহমদ মুসার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, ‘আমরা দেলোয়ার নদীর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। আমার মনে হয়, দেলোয়ার নদী ও সিটিহলের মাঝখানের পুরানো অফিসিয়াল এলাকার কোথাও আমাদের নিয়ে যাচ্ছে।’
ড. হাইম হাইকেলের কথা শেষ হতেই গাড়িটা উত্তর দিকে টার্ণ নিয়ে ষষ্ঠ ষ্ট্রিট ধরে এগিয়ে চলল। কিন্তু মাত্র ১০০ মিটার গিয়েই গাড়ি পুবদিকে বাঁক নিয়ে ষ্ট্রিট থেকে নেমে সামনে এগুলো। তারপর আরও পঞ্চাশ মিটার গিয়ে পাঁচিল ঘেরা একটা বাড়ির গেটে গিয়ে দাঁড়াল।
দাঁড়িয়েই ড্রাইভার তরুণী আহমদ মুসাদের দিকে তাকিয়ে ‘এক্সকিউজ মি স্যার’ বলে গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে গেল।
তরুণী এগুলো গেটের দিকে।
গেটের সিকিউরিটিকে কি যেন সে বলল। সংগে সংগে সিকিউরিটি লোকটি মোবাইল তুলে কথা বলল।
মিনিটখানেকের মধ্যেই ভেতর থেকে একজন লোক বেরিয়ে এল। সে সিকিউরিটির সাথে কথা বলেই ছুটে এল গাড়ির কাছে। গাড়ির দরজা খুলে বলল, ‘ওয়েলকাম স্যার, আসুন।’
লোকটি চল্লিশোর্ধ। সুন্দর সাদাসিধা পোশাক। সরল, হাসিমাখা মুখ।
গাড়ি থেকে বেরুল প্রথম আহমদ মুসা। তারপর ড. হাইম হাইকেল এবং শেষে বুমেদীন বিল্লাহ।
লোকটি সবার সাথে হ্যান্ডশেক করে বলল, ‘আমি হেনরিক হফম্যান। ম্যাডামের কর্মচারী। এই বাড়ির কেয়ারটেকার। আপনাদের ব্যাপারে সবকিছু আমাকে বলা হয়েছে।’
একটু দম নিয়ে ড. হাইম হাইকেলে দিকে ইংগিত করে বলল, ‘ইনি নিশ্চয় ড. মুর হ্যামিল্টন। ম্যাডামের শিক্ষক। অসুস্থ। আর…………..।’
তার মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে আহমদ মুসা বলল, ‘আর আমি জোসেফ জন।’ তারপর বুমেদীন বিল্লাহকে দেখিয়ে বলল, ‘ইনি ক্রিশ্চিয়ান কার্টার।’
‘জানি স্যার। আসুন। ওয়েলকাম।’ বলে গেটের দিকে হাঁটতে শুরু করল।
ড্রাইভার তরুণী এগিয়ে এল আহমদ মুসাদের দিকে। স্যালুট দিয়ে বলল, ‘হ্যাভ অ্যা নাইস টাইম। বাই স্যার।’
‘থ্যাংক ইউ ম্যাডাম।’ বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসারা হফম্যানের সাথে গেটের দিকে হাঁটতে শুরু করল।
গেটের ডানপাশে বাড়ির একটা নেম প্লেট। কাঠের ব্রাউন প্লেটের উপর সাদা অক্ষরে বড় করে লেখা ‘জেফারসন হাউজ।’ তার নিচে ব্র্যাকেটের মধ্যে ছোট অক্ষরে ‘ব্যক্তিগত মালিকানা’ শব্দ দ্বয় লেখা।
বাড়িটার নাম পড়ে ভ্রু কুঁচকালো আহমদ মুসা। কোন জেফারসন? টমাস জেফারসন নিশ্চয়। না হলে আর কোন জেফারসনের নামে এমন হাউজ হবে এবং এই খানে? ভাবনা বাড়ল আহমদ মুসার। এটা জেফারসন হাউজ হলে ম্যাডাম কে? বিরাট পরিবার, অনেক শাখা। ম্যাডাম অনেকেই হতে পারে। ফিলাডেলফিয়ার ‘জেফারসন হাউজ’-এর কথা আহমদ মুসা সারাহ জেফারসনের কাছে কোনদিনই শোনেনি।
আহমদ মুসারা গেট পার হয়ে প্রবেশ করল ভেতরে।
গেট থেকে লাল পাথরের একটা সুন্দর রাস্তা এগিয়ে গেছে বাড়ির দিকে। দুধারে ফুলের বাগান। বাগানটা বাড়ির চারদিক ঘিরেই। চারদিকের ফুল বাগানের মাঝখানে লাল পাথরের সুন্দর তিনতলা বাড়িটি।
লাল পাথরের রাস্তাটি বাড়ি থেকে একটু সামনে বেরিয়ে আসা গম্বুজাকৃতির ছাদে ঢাকা সুন্দর সাদা পাথরের চত্বরে গিয়ে শেষ হয়েছে। এটা গাড়ি বারান্দা হিসেবেই ব্যবহার হয়। তিনটা ধাপ পেরিয়েই সে বারান্দায় উঠা যায়। ছোট্ট অর্ধ চন্দ্রাকৃতি বারান্দার পরেই বাড়িতে প্রবেশের বিরাট দরজা। হেনরিক হফম্যানকে অনুসরণ করে ঐ দরজা পথে আহমদ মুসা বাড়িতে প্রবেশ করল।
দরজার পরে ছোট্ট একটা করিডোর পথ। তার পরেই বিশাল একটা লাউঞ্জ। তাঁরা লাউঞ্জে পৌঁছল।
হেনরিক হফম্যান বলল, ‘স্যার এটা বাড়ির পার্টি কর্ণার। এই নিচের তলাতেও আগে অফিস রুম ছিল, এখন তার কিছু অংশে কিচেন ও ষ্টোর করা হয়েছে। আমরা যারা আছি তাদেরও থাকার ব্যবস্থা এই ফ্লোরে। একতলা ও দুতলা রিমডেলিং হয়ে গেছে। তিনতলার কাজ বাকি। আপনাদের থাকার জায়গা দুতলায়। চলুন স্যার।’
দাঁড়িয়ে এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে দুতলায় উঠার সিঁড়ির দিকে আবার হাঁটা শুরু করল হেনরিক হফম্যান।
আহমদ মুসারা চলল তার পেছনে পেছনে।
দুতলায় উঠে হেনরিক হফম্যান আহমদ মুসাদের প্রত্যেককে তার ঘরে নিয়ে গেল। সবাইকে বলল, ‘ফ্রেশ হয়ে দুতলার লাউঞ্জে আসুন স্যার। ওখানেই চা-নাস্তা দিতে বলেছি। নাস্তার সাথে কথাও বলা যাবে। আর কাপড় ছাড়ার দরকার হলে আলমারিতেই সব পাবেন স্যার। প্রয়োজনীয় সব জামাকাপড় সেখানে রাখা আছে। কোন কিছুর দরকার হলে বলবেন।’
হেনরিক হফম্যান দুতলার লাউঞ্জে ফিরে এল। লাউঞ্জটা দুতলার সিঁড়ির মুখেই।
মিনিট পনেরোর মধ্যে আহমদ মুসা, ড. হাইম হাইকেল ও বুমেদীন বিল্লাহ লাউঞ্জে চলে এল।
গরম নাস্তা ও গরম চায়ের জন্যে ধন্যবাদ দিয়ে ড. হাইম হাইকেল বলল, ‘নাইস লোকেশান বাড়িটার। বাড়ির পুব পাশে ফিলোসফিক্যাল হল, উত্তর পাশে ইনডিপেনডেন্স হল এবং তার পাশেই কংগ্রেস হল। বলা যায় ফিলাডেলফিয়ার প্রাণকেন্দ্র এটা।’
বলে একটু থেমেই ড. হাইম হাইকেল তাকাল হেনরিক হফম্যানের দিকে। বলল, ‘মি. হফম্যান, এ বাড়িটার নাম ‘লিবার্টি হাউজ’ এবং এ বাড়িটা ‘ন্যাশনাল চাইল্ড ফাউন্ডেশন’এর অফিস ছিল। এ পরিবর্তনটা কি করে হলো?’
‘আপনি ঠিকই বলেছেন স্যার। দুমাস আগে এই পরিচয়ই ছিল। দুমাস হলো এই পরিবর্তন ঘটেছে। বাড়ির মালিকই এ পরিবর্তন ঘটিয়েছেন।’ বলে একটু থেমেই হফম্যান আবার বলা শুরু করল, ‘স্যার, এই বাড়িটা তৈরি করেন দুবার নির্বাচিত সাবেক প্রেসিডেন্ট টমাস জেফারসন। ফিলাডেলফিয়ায় থাকাকালিন সময়ে এ বাড়িতে তিনি বাসও করেন। তিনিই বাড়িটির নাম দেন ‘লিবার্টি হাউজ’। এই বাড়িতে বসেই তিনি মার্কিন সংবিধান ‘বিল অব রাইটস’এর খসড়া তৈরি করেন। বোধ হয় এ কারণেই তিনি বাড়িটার নাম ‘লিবার্টি হাউজ’ রাখেন। তিনি ওয়াশিংটনে চলে গেলে বাড়িটা ভাড়ায় চলে যায়। সর্বশেষ ভাড়ায় ছিলেন ন্যাশনাল চাইল্ড ফাউন্ডেশন। দুমাস আগে তারা চলে যান। তারা চলে যাওয়ার পর বর্তমান মালিক ম্যাডাম মানে টমাস জেফারসনের গ্রান্ড গ্রান্ড ডটার মিস সারা জেফারসন সিদ্ধান্ত নেন বাড়িটা আর ভাড়া দেবেন না। বাড়িটাকে তিনি তার গ্রান্ড গ্রান্ড ফাদার টমাস জেফারসনের ‘ফ্যামিলি মেমোরিয়াল’ বানাবেন। ভার্জিনিয়ায় টমাস জেফারসনের বাড়ি এখন প্রকৃত অর্থে পাবলিক প্লেসে পরিণত হয়েছে। ওখানে কোন ফ্যামিলি প্রাইভ্যাসি আর সম্ভব নয়। এ কারণেই তিনি জেফারসনের ‘ফ্যামিলি মেমোরিয়াল, হিসেবে এই বাড়ি বেছে নিয়েছেন। নামও পরিবর্তন করেছেন উদ্দেশ্যের সাথে সংগতি রেখে।’
সবাই যখন হফম্যানের কথা শোনায় বুঁদ হয়ে গিয়েছিল, তখন আহমদ মুসার একটা ভিন্ন অস্বস্তি। মনের একটা চিন্তা থেকেই এই অস্বস্তি। সারাহ জেফারসনের মায়ের মন্তব্য তার মনে আছে। অতীতের সব কিছু মুছে ফেলার জন্যে সারা জেফারসনের সময় ও সুযোগ প্রয়োজন। আহমদ মুসা কোনভাবেই আর তার বিব্রত হওয়ার কারণ হতে চায় না। যে কারণে আহমদ মুসা এবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এসে সারার সাথে কোন যোগাযোগ করেনি। সারা জেফারসন তার খবর রাখছে জানতে পেরেও তার সাথে সৌজন্যমূলক কথা বলা থেকেও আহমদ মুসা বিরত থেকেছে। কিন্তু এত কিছুর পরেও সে আজ সারা জেফারসনের বাড়িতে এসে উঠেছে। এফ.বি.আই. চীফ জর্জ আব্রাহাম জনসন বিষয়টা জেনেও কেন এটা করলেন? এটা তিনি ঠিক করেননি। মনে কিছু ক্ষোভেরই সৃষ্টি হলো তার।
ওদিকে গল্প চলছিল। কিন্তু আহমদ মুসার কানে ওদের গল্প ঢুকছে না। অস্বস্তিকর বিষয় তার মনকে অসুস্থ করে তুলেছে।
ওদের কথা বলার মাঝখানেই আহমদ মুসা অনেকটা বেসুরোভাবে বলে উঠল, ‘সকলে মাফ করবেন, আমি একটু রেষ্টে যেতে চাই।’
‘অবশ্যই, অবশ্যই। আপনারা ক্লান্ত। আমি উঠি। আমি নিচে আছি। ডাকলেই পাবেন।’ বলে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াল হেনরিক হফম্যান।
সবাই উঠে দাঁড়াল।
ড. হাইম হাইকেলের রুমটা আহমদ মুসার রুমের সামনেই। আর বুমেদীন বিল্লাহর রুম ড. হাইম হাইকেলের রুমের পাশে।
আহমদ মুসা ড. হাইম হাইকেলকে তার কক্ষে পৌছে দিয়ে বলল, ‘স্যার, ঘরটা সব সময় লক করে রাখবেন। আপনি একা দয়া করে বেরুবেন না। রুম টেলিফোনে আমাকে ডাকবেন।’
‘ধন্যবাদ আহমদ মুসা। আমাদের অবস্থা আমি বুঝতে পারছি।’ বলে একটু থামল ড. হাইম হাইকেল। তারপর বলল, ‘আপনার কাছে আমার অনেক জিজ্ঞাসা আছে। আপনি তো আমার বাড়িতে গেছেন।’
‘স্যার, আমি আপনার ছেলের মত। আমাকে সেইভাবে কথা বললে বাধিত হবো।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ধন্যবাদ। কিন্তু তুমি তো মাথায় থাকার মত।’ ড. হাইম হাইকেল বলল।
‘না স্যার, মাথা থেকে বুকটা মনে হয় আরও কাছে।’ বলে আহমদ মুসা একটা দম নিয়েই ড. হাইম হাইকেলকে তার বাড়ির কিছু খবর দিয়ে বলল, ‘যা ঘটেছে তা বিস্তারিত বলার জন্যে আজই সুযোগ নেব।’
আহমদ মুসা থামতেই ড. হাইম হাইকেল বলল, ‘তুমি বলেছিলে, আমার কাছে তোমার কিছু কাজ আছে, সেটা কি?’
‘খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ স্যার। আপনার সাহায্য আমি চাই। সব বলব আপনাকে। এখন যাই স্যার। আপনি রেষ্ট নিন।’
আহমদ মুসা বেরুবার জন্যে পা বাড়াল।
‘আহমদ মুসা, তোমাকে সাহায্য করতে পারা আমার জন্যে গৌরবের ব্যাপার হবে।’ বলল ড. হাইম হাইকেল।
‘অনেক ধন্যবাদ স্যার।’ বলে আহমদ মুসা ঘর থেকে বেরিয়ে এল।
আহমদ মুসা রুম থেকে বেরুতেই তার দিকে ছুটে আসতে দেখল হেনরিক হফম্যানকে। তার হাতে একটা মোবাইল। তার কাছে কোন টেলিফোন এসেছে কি, ভাবল আহমদ মুসা।
হেনরিক হফম্যান তার কাছে এসে হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, ‘স্যার, আপনি আপনার মোবাইল ফেলে এসেছিলেন। ড্রাইভার মেয়েটা দিয়ে গেল।’
বলে সে তার হাতের মোবাইল আহমদ মুসার হাতে তুলে দিল।
আহমদ মুসা মোবাইলটি হাতে নিয়ে বলল, ‘কোন ড্রাইভার?’
‘স্যার, আপনাদের ড্রাইভার। আপনি যে গাড়িতে আসলেন সেই গাড়ির ড্রাইভার। ’ বলল হেনরিক হফম্যান।
ভ্রুকুঞ্চিত হল আহমদ মুসার। মুখে বলল, ‘ঠিক আছে, ধন্যবাদ মি. হফম্যান।’
হেনরিক হফম্যান চলে গেল।
আহমদ মুসা তাকাল মোবাইলটার দিকে। দেখল, মোবাইলের স্ক্রীনে জলজল করছে তার নতুন নাম ‘জোসেফ জন’। ভাবল সে, এটাও এফ.বি.আই. চীফ জর্জ আব্রাহামেরই কীর্তি। তিনি নিশ্চয় চান না আমি সাধারণ টেলিফোনে তার সাথে বা কারো সাথে কথা বলি। তবু একবার টেলিফোন করে বিষয়টা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হবে।
খুশি হলো আহমদ মুসা। ঘরে প্রবেশ করল।
আহমদ মুসা হ্যাংগারে কোটটি খুলে রেখে প্রথমেই দুরাকাত নামাজ পড়ল। শোকরানার নামাজ। আল্লাহ কঠিন কাজকে অনেক সহজ করে দিয়েছেন। ড. হাইম হাইকেলকেও দিয়েছেন সহযোগিতাকারী হিসাবে। ধ্বংস টাওয়ারের তলায় লুকানো ষড়যন্ত্রের রূপ কেমন, তার উদ্ধারকেও আল্লাহ সহজ করে দিন। এই প্রার্থনা আহমদ মুসা জানাল আল্লাহর কাছে।
আহমদ মুসা বিছানায় গা এলিয়ে দিল। বিরাট ধকল গেছে শরীরের উপর দিয়ে গত দুদিনে। শয্যাকে মনে হচ্ছে ভীষণ মধুর। মনটাকে বাইরের জগত থেকে ফিরিয়ে এনে আত্মস্থ হতে চেষ্টা করল নিশ্চিন্ত রেষ্টের জন্যে। কিন্তু আত্মস্থ হতেই মন চারপাশের জগত থেকে অন্য এক জগতে চলে গেল। মনের আকাশ জুড়ে ভেসে উঠল ডোনা জোসেফাইনের মুখ, হাসি মাখা প্রাণবন্ত একটি মুখ। মুখে এক চির বসন্তের রূপ। ওতে শীতের বিশীর্ণতা কিংবা বর্ষার কালো মেঘের ঘনঘটা কোনদিন সে দেখিনি। শত বেদনাতেও কোন অনুযোগ, অভিযোগ তার নেই। হঠাৎ বাঁধ ভাঙা এক আবেগ এসে আছড়ে পড়ল তার হৃদয়ে। আবেগটা অশ্রু হয়ে বেরিয়ে এল তার দুচোখ দিয়ে।
চোখ মুছল না আহমদ মুসা। গড়াতে লাগল অশ্রু তার দুগন্ড বেয়ে। এ অশ্রু তাকে যন্ত্রণা নয়, দিল প্রশান্তি।
আহমদ মুসা হিসেব করে দেখল নিউইয়র্ক থেকে ডোনা জোসেফাইনের সাথে কথা বলার পর আজ ৯ম দিন পার হয়ে যাচ্ছে। তার সাথে ওয়াদা আছে টেলিফোন করার ক্ষেত্রে কোনক্রমেই সাতদিন অতিক্রম করবে না। গত কিছুদিনের মধ্যে প্রথম ব্যতিক্রম এবার ঘটল। সাতদিনের পর আরও দুদিন চলে গেছে। নিশ্চয় সে অস্থির হয়ে উঠেছে। তাকে তো এখন এমন অস্থির হওয়া চলবে না। বাচ্চা হওয়ার সময়টা ঘনিয়ে আসছে। ঘড়ির দিকে তাকাল আহমদ মুসা। এখন হয় তো সে ঘুমিয়ে পড়েছে। থাক। সন্ধ্যার দিকে মানে সউদি আরবের সকাল বেলায় ভাল হবে টেলিফোন করা।
পাশ ফিরল আহমদ মুসা। কিন্তু ঘুমানোর চেষ্টা সফল হলো না। মোবাইল বেজে উঠল।
উঠে বসে টেনে নিল মোবাইল টেবিল থেকে। মোবাইলের স্ক্রীনের উপর চোখ রাখতেই দেল নাম্বারটি এফ.বি.আই. চীফ জর্জ আব্রাহাম জনসনের।
মোবাইলটি কানের কাছে তুলে ধরতেই ওপার থেকে জর্জ আব্রাহাম জনসন বলে উফল, ‘আসসালাম জোসেফ জন, সব ঠিকঠাক? কোন অসুবিধা হয়নি তো?’
‘জি জনাব, সব ঠিক-ঠাক। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। কিন্তু…………।’ কথা শেষ না করেই আহমদ মুসা থেমে গেল কিভাবে বলবে সেটা ভেবে নেবার জন্যে।
‘কিন্তু কি, জোসেফ জন?’
‘আপনি যে স্থানকে আমাদের জন্যে আমেরিকার মধ্যে সবচেয়ে নিরাপদ স্থান বলে আমাদের এখানে এনেছেন। কিন্তু সে স্থানের মালিক এ বিষয়টা জানেন বলে আমার মনে হচ্ছে না।’
হো হো করে হেসে উঠল জর্জ আব্রাহাম জনসন। বলল, ‘ঠিকই বলেছ জোসেফ জন। তার অনুমতি ছাড়াই আমি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তবে ঠিক অনুমতি ছাড়াও নয়। ক’দিন আগে আমাকে সারাহ জেফারসন বলেছিল যে, তোমার মিশনের জন্যে তোমাকে অনেক দূর যেতে হতে পারে। তার জন্যে তোমাকে লম্বা একটা সময় আমেরিকায় থাকতে হবে। তোমার জন্যে নিরাপদ একটা ঠিকানা দরকার। এই কথা বলার সাথে সাথে সে বলেছিল তার ঐ ফিলাডেলফিয়ার বাড়ির কথা। ‘ফ্যামিলি মেমোরিয়াল’ গড়ে তোলার কাজ শুরু করতে বেশ সময় লাগবে। তার আগে বাড়িটা খালিই পড়ে থাকবে। গতকাল তোমার সাথে আলোচনা করার পর আমি চিন্তা করলাম ড. মুর হ্যামিল্টনকে নিয়ে তুমি কোথায় যেতে পার! কোন জায়গাটা তোমাদের জন্যে নিরাপদ হতে পারে! এটা চিন্তা করতে গিয়েই সারা জেফারসনের সেদিনের কথা মনে পড়েছিল। সংগে সংগেই আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে জুলিয়া রবার্টসকে এ ব্যবস্থার করথা জানিয়ে দিয়েছিলাম। পরে আমি সারা জেফারসনকে আমার গৃহিত ব্যবস্থার কথা বলি। সে খুশি হয়ে বলে, আংকেল, আমি যা করতাম, আপনি তাই করেছেন।’ সুতরাং জোসেফ জন, মালিকের অনুমতি নেই তা বলতে পার না।’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘আমন্ত্রণ আর বাধ্য হয়ে আতিথ্য দান বোধ হয় এক জিনিস নয় জনাব।’
‘জোসেফ জন, তুমি জান তুমি ঠিক বলছ না।’ বলে একটু থেমেই সে আবার বলে উঠল, ‘আমি বুঝতে পারছি না তোমাদেরকে। তুমি যেমন সত্যকে পাশ কাটাতে চাচ্ছ, হাসির ছলে হলেও, তেমনি তার ব্যাপারটাও আমাকে বিস্মিত করেছে। আজ সাত সকালে সারা আমাকে টেলিফোন করে বলল, ‘সে ইউরোপ চলে যাচ্ছে তিন মাসের সফরে। তুরষ্কের বসফরাস, মর্মরা ও কৃষ্ণ সাগর আর ইস্তাম্বুলের অলিতে-গলিতে প্রাণ খুলে ঘুরে বেড়াবে তিন মাস ধরে। তার একটা স্বপ্ন এটা। অথচ গত রাতে ১৫ মিনিট ধরে কথা হলো তার সাথে, কিছুই সে বলেনি। এত বড় একটা স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রোগ্রাম রাতের অবশিষ্ট কয়েক ঘণ্টায় কেন, কিভাবে সম্ভব হলো! যাক, এসব কথা জোসেফ জন। কাজের কথায় আসি। তোমাকে অবশিষ্ট কাজের ব্যাপারে দ্রুত হতে হবে। ড. মুর হ্যামিল্টনকে এভাবে বেশি দিন রাখা যাবে না। আর ওখানে তোমাদের কোন অসুবিধা হবে না। হেনরিক হফম্যান লোকটা সবদিক দিয়েই ভাল এবং যোগ্য। মনে কর বাড়িটার এখন আমিই মালিক। আইনিসহ এর সবরকম তত্বাবধানের দায়িত্ব তিন মাসের জন্যে সারা আমাকেই দিয়ে গেছে।’ থামল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
আহমদ মুসা একটু আনমনা হয়ে পড়েছিল। জর্জ আব্রাহামের শেষ কথায় সে সম্বিত ফিরে পেল। তাড়াতাড়ি কথা গুছিয়ে হাসার চেষ্টা করে বলল, ‘সুখবর জনাব, এখন ভাড়া দাবী না করলেই আমরা বাঁচি।’
‘জোসেফ জন, তোমরা আমেরিকার বাইরেটাই দেখ, অন্তর দেখ না।’ বলল আব্রাহাম জনসন।
‘অস্ত্রের কোন অন্তর থাকে না। আর ‘আমেরিকা’ আজ হৃদয়হীন সে অস্ত্রই হয়ে দাঁড়িয়েছে জনাব।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ঠিক বললে না জোসেফ জন। আমেরিকার শিক্ষা-সংস্কৃতি ও সাহায্য-সহযোগিতার বিশ্বব্যাপী ভূমিকা তুমি অস্বীকার করতে পারো না।’
‘ঠিক জনাব। তবে দেখা যাচ্ছে, আমেরিকার শিক্ষা-সংস্কৃতি ও সাহায্য-সহযোগিতা আমেরিকার শক্তির কাঁধে সোয়ার, অথবা আমেরিকার শক্তি তার শিক্ষা-সংস্কৃতি ও সাহায্য-সহযোগিতার কাঁধে সওয়ার। সুতরাং শক্তি মানে অস্ত্রই আজ সবদিক থেকে আমেরিকার ইমেজ, অবয়ব হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
‘কিন্তু জোসেফ, আমেরিকা এটা নয়। এই অবয়ব আমেরিকার নেই। এক রাহুর গ্রাস থেকে বেরিয়ে আসছে জর্জ ওয়াশিংটন, জেফারসন ও আব্রাহাম লিংকনের আমেরিকা। তোমার সাহায্য নতুন সূর্যের উদয় ঘটিয়েছে আমেরিকায়। তোমার বর্তমান অনুসন্ধান যদি সফল হয়, তাহলে আলোর পথে আমেরিকার আরেকটা উল্লস্ফন ঘটবে।’ জর্জ আব্রাহাম জনসন বলল।
‘আমিন।’ আহমদ মুসা উচ্চারণ করল। তারপর বলল, ‘আমি কৃতজ্ঞ আপনার অমূল্য সহযোগিতার জন্যে।’
‘না জোসেফ জন। আমি তোমাকে সাহায্য করছি না, সাহায্য করছি আমাকে, আমার প্রিয় আমেরিকাকে।’
‘ঠিক বলেছেন জনাব। কিন্তু আমি কাজ করছি সত্যের জন্যে, আমার জাতির জন্যে। ধ্বংস টাওয়ারের তলদেশে যে সত্য লুক্কায়িত আছে তা যদি উদ্ধার হয়, তাহলে বিজয় হবে সত্যের। কিন্তু তার চেয়ে বড় বিষয় হলো বাঁচবো আমরা সন্ত্রাসী হওয়ার দায় থেকে। এ দায়-মুক্তিই আমার কাছে আজ সবচেয়ে বড়। এই বড় কাজে আপনার সাহায্য চাওয়ার চেয়েও অনেক বেশি। ধন্যবাদ আপনাকে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ওয়েলকাম, জোসেফ জন। এখন বিদায় নেই জোসেফ।’ জর্জ আব্রাহাম বলল।
‘অশেষ ধন্যবাদ জনাব। বাই।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আসসালাম। গুড বাই।’ বলে ওপার থেকে লাইনটা কাট করল জর্জ আব্রাহাম।
আহমদ মুসা মোবাইলটি রেখে দিয়ে আবার বিছানায় গা এলিয়ে দিল।
সব চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে চোখ বন্ধ করতে চেষ্টা করল।
আবার রুম টেলিফোন বেজে উঠল।
তুলল টেলিফোন আহমদ মুসা।
‘স্যরি জোসেফ, একটা জররি কথা জিজ্ঞেস করতে চাই। এখান থেকে আমার বাড়ি তো খুব কাছে। আমি মুর হ্যামিল্টন নাম নিয়ে অপরিচিতের মতই কথা বলতে চাই। আমার বাড়ির সাথে কথা বলতে পারি?’ বলল ওপ্রান্ত থেকে ড. হাইম হাইকেল।
‘আমি বুঝতে পারছি আপনার মনের অবস্থা। কিন্তু না পারেন আপনি নিজ নাম নিয়ে টেলিফোন করতে, না পারেন মুর হ্যামিল্টন নাম নিয়ে, কারণ আপনার বাসার টেলিফোন মনিটর করা হয়। এখন আরও বেশি হচ্ছে। তারা ধরে ফেলবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কিন্তু আমি মুর হ্যামিল্টন নাম নিয়ে করলে তারা চিনবে কি করে?’ বলল ড. হাইম হাইকেল।
‘জনাব, গত রাতে আপনি ডেট্রোয়েট থেকে উধাও হওয়ার পর একজন ড. মুর হ্যামিল্টন বিমানে ফিলাডেলফিয়া এসেছেন। সেই ড. মুর হ্যামিল্টন ড. হাইম হাইকেলের বাসায় টেলিফোন করেছেন, এর অর্থ ওদের কাছে কি দাঁড়াবে? তারা নিশ্চিত ধরে নিতে পারে ডেট্রোয়েট থেকে আসা মুর হ্যামিল্টনই আসলে ড. হাইম হাইকেল।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ধন্যবাদ, তুমি ঠিক বলেছ। এদিকটা আমার মাথায় আসেনি। সত্যিই তুমি অসাধারণ। গড ব্লেস ইউ।’ বলল ড. হাইম হাইকেল।
‘ধন্যবাদ। চিন্তা করবেন না। আমিই ওদের সাথে যোগাযোগের ব্যবস্থা করে দেব।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন। রাখছি টেলিফোন। ডিষ্টার্ব করার জন্যে দুঃখিত। বাই।’
বলে ওপার থেকে টেলিফোন রেখে দিল ড. হাইম হাইকেল।
আহমদ মুসা টেলিফোন রেখে আবার শুয়ে পড়ল।
শরীরটাকে নিঃশেষে ছেড়ে দিল বিছানার উপর নিরংকুশ এক বিশ্রামের সন্ধানে। | ← Previous | | | Next → | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »
৩৯. ধ্বংস টাওয়ারের নীচে

Tags