৩৯. ধ্বংস টাওয়ারের নীচে

চ্যাপ্টার

জুলিয়া রবার্টসের বাড়ি। দুতলার ভিআইপি গেষ্ট রুম।
আহমদ মুসা একটি সোফায় বসে।
ঘরের ওপাশে সুসজ্জিত বেড। ক্লান্ত শরীরটা চাচ্ছে শুয়ে একটা লম্বা ঘুম দিতে। কিন্তু আহমদ মুসার কাছে এই লোভের চেয়ে একটা চিন্তা বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আহমদ মুসার চোখ ঘুরে ফিরে বার বার জানালা দিয়ে বাইরে চলে যাচ্ছে। জানালা দিয়ে বাড়ির এ্যাপ্রোচ রোডটা দেখা যায়।
ঘরে প্রবেশ করল বুমেদীন বিল্লাহ। আহমদ মুসাকে দেখে বলল, ‘কি ব্যাপার, ভাইয়া এখনও কাপড়-চোপড় ছাড়েননি?’
আহমদ মুসা বিল্লাহর প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বলল, ‘ড. হাইম হাইকেলের খবর নিয়েছ?’
ড. হাইম হাইকেলকে বাড়ির ওপাশের আরেকটি ঘরে রাখা হয়েছে।
আহমদ মুসার প্রশ্নের ধরণ দেখে বিল্লাহ বলল, ‘কেন কিছু ঘটেছে? আপনি কি ভাবছেন?’ বিল্লাহর চোখে-মুখে ভাবনার প্রকাশ।
আহমদ মুসা কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু অস্পষ্টভাবে ভেসে আসা একটা শব্দের অনুসরণে জানালা দিয়ে ছুটে গেল তার দুচোখ। একটি কার এবং ছোট একটি মাইক্রো প্রবেশ করল জুলিয়া রবার্টসের বাড়িতে। চোখ ফিরিয়ে ঘড়ির দিকে তাকাল আহমদ মুসা, রাত ৯টা।
‘ভাইয়া, কারো কি অপেক্ষা করছিলেন? তারা কি এসে গেছে?’ বলল বিল্লাহ।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘কারও অপেক্ষা করছি না। তবে কিছু একটা পাহারা দিচ্ছি।’
বসল বিল্লাহ। ভ্রুকুঞ্চিত হয়েছে তার। বলল, ‘এখানে আবার কি পাহারা দিচ্ছেন ভাইয়া। কিছু ঘটেছে?’
‘হয় তো ঘটতে পারে।’ আহমদ মুসা বলল।
উদ্বেগ ফুটে উঠল বিল্লাহর চোখে মুখে। ছোট কোন ঘটনা নিয়ে আহমদ মুসা এভাবে মাথা ঘামায় না। কিন্তু কি ঘটেছে? জুলিয়া রবার্টসকে তো তার ভালই মনে হয়েছে। নি:সন্দেহে সে সহানভুতিশীল ও আন্তরিক। বলল বিল্লাহ, ‘ভাইয়া আপনি কি ম্যাডাম জুলিয়া রবার্টসকে সন্দেহ করছেন?’
‘সন্দেহ নয়, তিনি তার দায়িত্ব পালন করতে পারেন।’ আহমদ মুসা বলল।
বিল্লাহ কিছু বলতে যাচ্ছিল। এ সময় দরজা নক করে ঘরে প্রবেশ করল জুলিয়া রবার্টস।
ঘরে ঢুকেই বলল, ‘আমি বসব না মি. আহমদ মুসা। চলুন ড্রইং রুমে একটু বসি। আরও কয়েকজন এসেছে। জরুরি কথা আছে।’
‘ওঁরা তো এফ.বি.আই-এর লোক। ওঁদের মধ্যে কি ডেট্রয়েটের এফ.বি.আই চীফ হেনরী শ্যারন রয়েছেন।’ বলল আহমদ মুসা সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে।
জুলিয়া রবার্টসের দুচোখ ছানাবড়া। বলল, ‘আপনি কি করে জানলেন ওঁরা এফ.বি.আই-এর লোক?’
‘আপনি যেভাবে আমার পুরো নাম জেনেছেন, বলা যায় সে ভাবেই। আমার প্রশ্নের জবাব দেননি মিস জুলিয়া রবার্টস।’
‘আরও কি জেনেছেন?’ প্রশ্ন জুলিয়া রবার্টসের।
‘আপনিও এফ.বি.আই-এর লোক।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ওঁরা আসবেন তাও কি জানতেন? ওঁদের অপেক্ষাতেই কি কাপড়ও ছাড়েননি?’ জুলিয়া রবার্টস বলল।
‘জি হ্যাঁ, জানতাম।’ বলল আহমদ মুসা।
তৎক্ষণাত আর কোন কথা বলল না জুলিয়া রবার্টস। বিস্ময়ের চিহ্ন তার চোখ-মুখ থেকে চলে গেছে। ঠোঁটে এক টুকরো মুগ্ধ হাসি। বলল অল্পক্ষণ চুপ থাকার পর, ‘আহমদ মুসর জন্যে কোন কিছুই বিস্ময়কর নয়, এ কথা ভুলে গিয়েছিলাম।’
বলে একটু থেমেই আবার বলে উঠল, ‘হ্যাঁ মি. আহমদ মুসা, যাঁরা এসেছেন, তাঁদের মধ্যে ডেট্রয়েটের এফ.বি.আই. কর্মকর্তা হেনরী শ্যারনও রয়েছেন। চেনেন তাঁকে?’
আহমদ মুসা একটু হাসল। বলল, ‘নাম জানি।’
‘ওকে, তাহলে আপনারা আসুন। আমি চলি।’ বলে জুলিয়া রবার্টস ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
জুলিয়া রবার্টস বের হয়ে যেতেই বিল্লাহ বলে উঠল, ‘আপনি কি করে জানলেন ভাইয়া যে, ওরা এফ.বি.আই.-এর লোক এবং ওরা আসবে এখানে। জুলিয়া রবার্টসের পরিচয়ই বা কি করে পেলেন?’
‘এফ.বি.আই. এর লোকরা বিশেষ কোডে হর্ণ বাজায়। জুলিয়া রবার্টসের হর্ণ বাজানো দেখে চিনেছি। তার টেলিফোনের আলোচনা শুনে জানতে পেরেছি ডেট্রয়েটের এফ.বি.আই কর্মকর্তারা রাত ৯টায় এখানে আসছেন।’ আহমদ মুসা বলল।
‘জুলিয়া রবার্টসের নাম কিভাবে জেনেছিলেন? তাঁর ঠিকানায় আমাদের খোঁজ করবেন বলেছিলেন। ঠিকানা জানলেন কিভাবে?’
হাসল আহম মুসা। বলল, ‘আমার সামনে গাড়ির ড্যাশবোর্ডের উপর একটা নেম কার্ড পড়েছিল। তাতেই ওঁর নাম-ঠিকানা লেখা ছিল। কার্ড ওঁর কিনা এজন্যেই গাড়ি থেকে নামার সময় ওঁর নাম জিজ্ঞাসা করেছিলাম।’
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা দুপকেট থেকে দুরিভলবার বের করে লোড পরীক্ষা করল। তারপর বলল, ‘চল।’
বিল্লাহর চোখে-মুখে বিস্ময়। এ সময় আহমদ মুসা রিভলবার পরীক্ষা করল কেন? বলল, ‘ভাইয়া, এ সময় রিভলবার চেক করছেন কেন?’
‘রুটিন চেক।’ হেসে বলল আহমদ মুসা।
‘আমিও রুটিন চেক করি তাহলে।’ বলল বিল্লাহ এবং নিজের রিভলবার বের করল।
আহমদ মুসা তখন চলতে শুরু করেছে। বিল্লাহও আহমদ মুসার পেছন পেছন চলল। ড্রইংরুমে প্রবেশ করল আহমদ মুসা। ড্রইংরুমটা বিশাল ঘর। গোটা ঘরটাই সোফায় সাজানো। ড্রইংরুমের তিনটি দরজা।
পুব দিকের দরজা বাইরে থেকে প্রবেশের। উত্তরের দরজা গেষ্ট ও সাধারণ আবাসিক উইং-এর দিকে। আর দক্ষিণের দরজা ষ্টোর ও কিচেন উইং-এর সাথে যুক্ত।
আহমদ মুসা দুতলা থেকে সিঁড়ি দিয়ে ঘরের পশ্চিম দিয়ে ঘরে প্রবেশ করল।
আহমদ মুসা দেখল, জুলিয়া রবার্টস ও মি. হাইম হাইকেলসহ ছয়জন ড্রইংরুমে বসে আছে। ওরা চারজন কেন? ওরা তো কারের চারজন। মাইক্রোর লোকজন কোথায়?
নিজেকে প্রশ্ন করে নিজের মনেই হাসল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসাকে দেখে উঠে দাঁড়িয়েছে জুলিয়া রবার্টস। সে স্বাগত জানাল আহমদ মুসাকে।
ওরা চারজন যেমন বসেছিল, তেমনি বসে থাকল। শুধু ওদের ৮টি চোখ একসাথে গিয়ে স্থির হলো আহমদ মুসার উপর।
ওরা চারজন বসেছিল পুবমুখী ও উত্তরমুখী হয়ে দু’সোফায়। আর জুলিয়া রবার্টস ও ড. হাইম হাইকেল পশ্চিমমুখী এক সোফায়। ড্রইংরুমের সেন্ট্রাল সার্কেলেল দক্ষিণমুখী একটা সোফাই শুধু খালি আছে। সোফাটা বাইরের দরজার সোজাসুজি। খুশি হলো আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা ও বুমেদীন বিল্লাহ গিয়ে সেই খালি সোফাটায় বসল।
আহমদ মুসারা বসার আগেই জুলিয়া সবাইকে সবার সাথে পরিচয় করে দিয়েছে।
আহমদ মুসা বসতেই ডেট্রোয়েটের এফ.বি.আই. চীফ হেনরী শ্যারন বলে উঠল, ‘আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ আহমদ মুসা। অনেক বিপদ পাড়ি দিয়ে, অনেক কষ্ট করে আপনি মি. হাইম হাইকেলকে উদ্ধার করেছেন।’
‘ওয়েলকাম। তবে আমি আমার কাজ করেছি। এ জন্যে ধন্যবাদের প্রয়োজন হয় না।’ একটু হেসে বলল আহমদ মুসা।
‘এটা আপনার বদান্যতা।’ বলে একটু থেমেই হেনরী শ্যারন আবার কথা বলে উঠল, ‘মি. আহমদ মুসা, আমরা ড. হাইম হাইকেলকে নিয়ে যাচ্ছি। আপনাকেও আমাদের সাথে যেতে হবে।’
বিস্মিত হলো না আহমদ মুসা। এ ধরনের কথা আসবে, আগেই তা ভেবেছে সে। কিন্তু শুরুতেই এমন নগ্নভাবে আসবে ভাবেনি আহমদ মুসা।
ঠোঁটে এক টুকরো হাসি টেনে আহমদ মুসা বলল, ‘কিন্তু ড. হাইম হাইকেলের সাথে আমার জরুরি কিছু কথা আছে, সেটা এখনও হয়নি।’ খুব স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল আহমদ মুসা।
সংগে সংগে উত্তর দিল না হেনরী শ্যারন। দেখা গেল আহমদ মুসার কথায় তার চোখ-মুখ শক্ত হয়ে গেছে। একটু সময় নিয়ে বলল, ‘আপনি তো তার সাথে পরিচিতও নন, সম্পর্কিত নন। সুতরাং তেমন কি আর কথা থাকবে। ঠিক আছে, আপনিও যাচ্ছেন। আপনাদের কথা বলার সুযোগ করে দেব।’
আহমদ মুসার ভেতরটা শক্ত হয়ে উঠল। কিন্তু মুখে তার কিছুই প্রকাশ পেল না। সে পাশে বসা বিল্লাহকে কানে কানে কিছু বলল। সংগে সংগে বিল্লাহ উঠে দাঁড়াল।
বিল্লাহ যখন দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছিল, আহমদ মুসা তাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘তাড়াতাড়ি ফিরে এস।’
বলেই জুলিয়া রবার্টসের দিকে ফিরে তাকিয়ে আহমদ মুসা বলল, ‘ওকে একটু বাইরে পাঠাচ্ছি মিস জুলিয়া রবার্টস।’
‘ধন্যবাদ সৌজন্যের জন্যে।’ বলল জুলিয়া রবার্টস।
জুলিয়া রবার্টস যখন আহমদ মুসার কথার জবাব দিচ্ছিল, তখন হেনরী শ্যারন তার মোবাইলে কথা বলছিল।
হেনরী শ্যারনের কথা শেষ হতেই আহমদ মুসার তার কথার উত্তরে বলল, ‘আমি আপনাদের সাথে যাচ্ছিই এটা কিভাবে নিশ্চিত হলেন?’
সংগে সংগে উত্তর দিল না হেনরী শ্যারন। তার চোখে-মুখে ক্রোধের প্রকাশ। বলল শক্ত কণ্ঠে, ‘এফ.বি.আই. কারো মর্জি মাফিক নয়, নিজের মর্জি মাফিক কাজ করে।’
জুলিয়া রবার্টসের চোখে-মুখে চরম বিব্রতভাব ফুটে উঠেছে। তাকাল হেনরী শ্যারনের দিকে। বলল, ‘মি. শ্যারন, এমন তো কথা ছিল না? ড. হাইম হাইকেলকে তার পরিবারে ফিরিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করা হবে, এটাই তো বলেছিলেন।’
‘মিস জুলিয়া রবার্টস, সে সময়ের পর অনেক ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে। অনেক পরিবর্তনের জন্যে এই সময় যথেষ্ট।’ বলেই হেনরী শ্যারন তাকাল ড. হাইম হাইকেলের দিকে। বলল, ‘চলুন স্যার। আপনি ক্লান্ত। আপনার বিশ্রাম দরকার।’
‘মি. শ্যারন, আমি তো যাবই। আপনারা আমাকে বাড়ি পৌছাবেন, এটাই আমার জন্যে নিরাপদ। কিন্তু তার আগে আহমদ মুসার সাথে আমার প্রয়োজন শেষ করতে চাই।’ বলল ড. হাইম হাইকেল।
‘স্যার সেটা হবে। আমরাই তার ব্যবস্থা করব। আহমদ মুসা আমাদের সাথে যাচ্ছেন।’ হেনরী শ্যারন বলল।
‘আমি যাচ্ছি না মি. শ্যারন। আমি আপনার মর্জির অধীন নই।’ বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার কথা শেষ হবার সাথে সাথেই স্প্রিং-এর মত উঠে দাঁড়াল হেনরী শ্যারন। উঠে দাঁড়াবার সাথেই তার হাতে উঠে এসেছে রিভলবার।
রিভলবার আহমদ মুসার দিকে তাক করে ক্রুব্ধ হেনরী শ্যারন কিছু বলতে যাচ্ছিল।
এরই সুযোগে অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতার সাথে আহমদ মুসার হাত রিভলবার সমেত বেরিয়ে এল এবং আগুন উদগীরন করল।
গুলী গিয়ে আঘাত করল শ্যারনের রিভলবারের নলকে। তার হাত থেকে ছিটকে পড়ে গেল রিভলবার।
আহমদ মুসার বাম হাতও তুলে নিল আর একটি রিভলবার।
অবশিষ্ট তিনজন ইতিমধ্যে পকেটে হাত দিয়েছিল তাদের রিভলবার বের করার জন্যে। কিন্তু ততক্ষণে তারা আহমদ মুসার টার্গেটে এসে গেছে। বলল আহমদ মুসা শ্যারনকে লক্ষ্য করে, ‘মি. হেনরী শ্যারন, মানুষের সব ইচ্ছা পূরণ হয় না। আপনার ইচ্ছাও পূরণ হবার কোন উপায় নেই।’
ক্রোধে ফুসছিল হেনরী শ্যারন। আগুনে তেল পড়ার মত জ্বলে উঠল সে। চিৎকার করে উঠল, ‘জন তোমরা এদিকে এস।’
কোন সাড়া এল না ওদিক থেকে।
আরও জোরে চিৎকার করল মি. শ্যারন।
‘মি. শ্যারন এক সময় ঘুম থেকে তারা জাগতেও পারে।’ মুখ টিপে হেসে বলল আহমদ মুসা।
চোখ দুটি ছানাবড়া হয়ে উঠেছে হেনরী শ্যারনের।
এ সময় ঘরে প্রবেশ করল বিল্লাহ।
আহমদ মুসা বলল, ‘বিল্লাহ, তুমি মি. শ্যারনকে একটু বল কিভাবে তুমি জনদের ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছো।’
‘তুমি এতটা এগুবে, সেটা বুঝিনি আহমদ মুসা। কিন্তু এটাই শেষ নয়। তোমার ঔদ্ধত্য সহ্য করা হবে না।’ ক্রোধের চোটে কাঁপতে কাঁপতে বলল হেনরী শ্যারন।
‘অপেক্ষা করুন মি. শ্যারন।’ বলেই আহমদ মুসা বিল্লাহকে লক্ষ্য করে বলল, ‘এদেরকেও ঘুম পাড়িয়ে দাও বিল্লাহ। শান্তিতে থাকবেন ওঁরা। তবে বিল্লাহ, মিস জুলিয়া রবার্টসের ডোজটা যেন একটু কম হয়। কারণ ওঁকে জেগে উঠে এদেরকে হাসপাতালে নিতে হবে। একটু থামল আহমদ মুসা। তারপর হেনরী শ্যারনকে লক্ষ্য করে বলল, ‘হ্যাঁ মি. শ্যারন, বিশেষ ধরনের এবং সিগারেট সাইজের এই ক্লোরোফরম আমরা পেয়েছি আপনার বন্ধু ব্রিগেডিয়ার শেরিল শ্যারনের বন্দীখানা থেকে। আমাদের সংজ্ঞাহীন করার জন্যে এনেছিলেন। আমাদের বাঁধতে গিয়ে একটা প্যাকেট পড়ে যায় ওদের পকেট থেকে। এ্যান্টিডোজ ব্যবহার না করলে এই ক্লোরোফরম ঘুম ভাঙে না।’
বিল্লাহ এক হাতে রিভলবার, অন্য হাতে ক্লোরোফরম স্প্রে নিয়ে ওদের কাছে পৌছে গিয়েছিল।
বিল্লাহ প্রথমে গেল হেনরী শ্যারনের দিকে। তার নাকের কাছে স্প্রে নিয়ে মাথায় রিভলবারের নল ঠেকিয়ে বলল, ‘নিশ্বাস টানতে থাকুন, এক সেকেন্ড দেরী করলেই গুলী করব। নিশ্বাস টানুন।’
হেনরী শ্যারনের দুচোখ থেকে আগুন বেরুচ্ছে। কিন্তু সুবোধ বালকের মত নির্দেশ পালন করল সে। নি:শ্বাস টানল। আর তার সাথে সাথেই ঢলে পড়ল সংজ্ঞা হারিয়ে। ওদের চারজনেরই একই পরিণতি হলো।
বিল্লাহ ফিরে গিয়ে আহমদ মুসার পাশে বসল।
উঠে দাঁড়িয়েছে জুলিয়া রবার্টস। তার বিব্রত বেদনার্ত মুখ। বলল, ‘মি. আহমদ মুসা, বিল্লাহ বসলেন কেন? আমি বাকি রয়ে গেছি।’
‘আপনি বাকিই থাকবেন। আপনাকে ক্লোরোফরম করার প্রয়োজন নেই।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কিন্তু আপনি তো বলেছেন।’ বলল জুলিয়া রবার্টস।
‘সেটা মি. হেনরী শ্যারনকে শুধু জানাবার জন্যেই।’ আহমদ মুসা বলল।
‘শুধু জানাবার জন্যে? বুঝলাম না।’ জুলিয়া রবার্টস বলল।
‘আপনাকে ক্লোরোফরম না করলে, তার অর্থ তারা বুঝত আপনি আমাদের সহযোগিতা করছেন। সেটা আপনার জন্যে বিপজ্জনক হতো। এজন্যেই তাদের জানিয়েছি যে আপনাকেও সংজ্ঞাহীন করা হবে।’ বুঝিয়ে দিল আহমদ মুসা।
‘কিন্তু সংজ্ঞাহীন করার প্রয়োজন নেই বলছেন যে!’ জুলিয়া রবার্টস বলল।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘ওরা জেনেছেন আপনিও সংজ্ঞাহীন হয়েছেন। কিন্তু ওরা জানবে না যে আপনি সংজ্ঞা হারাননি, আপনাকে ক্লোরোফরম করা হয়নি।’
বিস্ময়ে হা হয়ে উঠল জুলিয়া রবার্টসের মুখ। বলল, ‘এতটা আট-ঘাট বেঁধে আপনি কথা বলতে পারেন?’
আহমদ মুসা উত্তর দিল না। একটুক্ষণ চুপ করে থেকে গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘যা ঘটে গেল তার জন্যে আমি দু:খিত মিস জুলিয়া রবার্টস। আপনি…..।’
আহমদ মুসার কথায় বাধা দিয়ে বলে উঠল জুলিয়া রবার্টস, ‘আপনার ব্যাপারে ওঁরা বাড়াবাড়ি করেছেন বলে আমি মনে করি। কিন্তু আপনি বাইরের লোকদের নিস্ক্রিয় করার আগাম ব্যবস্থা নিয়েছিলেন কি করে? ওঁদের মনোভাব আঁচ করতে পেরেছিলেন কিভাবে?’
‘আমি নিউইয়র্ক থাকতেই খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম ডেট্রোয়েটের এফ.বি.আই. চীফ হেনরী শ্যারন ইহুদী এবং শ্যারন-আজর ওয়াইজম্যান নেটওয়ার্কের তিনি সদস্য। তারপর আপনার সাথে গাড়িতে আসার সময় যখন দেখলাম আপনি অধ্যাপক হাইম হাইকেলসহ আমার খবর তাকে জানালেন এবং ৯টায় ওঁরা আসছেন জানলাম, তখনই আমি নিশ্চিত হয়েছিলাম ওরা যে কোন মূল্যে এই মহাসুযোগের সদ্ব্যবহার করবে। আর যখন দেখলাম ওরা একটা কার ছাড়াও একটা মাইক্রো সাথে করে নিয়ে এসেছে, তখন এটা বুঝা গেল, তাদের উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্যে প্রয়োজনীয় জনশক্তি তারা নিয়ে এসেছে।’ আহমদ মুসা বলল।
জুলিয়া রবার্টসের চোখে-মুখে বিস্ময়। বলল, ‘আমিও যেহেতু ব্যাপারটার সাথে জড়িত, তাই বোধ হয় আপনি আমাকে কিছুই জানাননি।’ কণ্ঠে কিছুটা অনুযোগের সুর।
‘না, আপনাকে জড়িত মনে করিনি। আপনি যেটা করেছেন, সেটা আপনার রুটিন ডিউটি। আপনাকে না জানাবার কারণ হলো, আপনাকে বিব্রত না করা এবং আপনাকে অসুবিধায় না ফেলা।’
হাসল জুলিয়া রবার্টস। বলল, ‘এতদিন আপনার কথা শুনেছি, আজ দেখলাম। নিজের লাভের চাইতে, অন্যের যাতে ক্ষতি না হয় সেটাকে আপনি বড় করে দেখেন। কিন্তু এই নীতি সমাজ সেবক, সমাজ সংস্কারকের হতে পারে, কিন্ত্ আপনার মত একজন যোদ্ধার এই নীতি কিভাবে?’
‘এটা নির্ভর করে যুদ্ধ ও যোদ্ধার লক্ষ্যের উপর। যুদ্ধ যদি হয় মানব সেবা ও মানব সমাজের সংস্কারের জন্যে, তাহলে যুদ্ধ ও যোদ্ধার নিজের লাভের চেয়ে মানুষের ক্ষতিকে বড় করে দেখা হয়। ইসলামে এই যুদ্ধকেই বলে ‘জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ’ বা ‘আল্লাহর জন্যে যুদ্ধ করা’। আল্লাহর জন্যে যুদ্ধ হলে সেটা কোন ব্যক্তি, গোষ্ঠী, দেশ বা জাতির স্বার্থে হয় না, হয় মানুষের জন্যে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তাহলে ব্যক্তি, গোষ্ঠী, জাতি বা দেশ যুদ্ধ করবে কেন, ক্ষতি স্বীকার করবে কেন, জীবন দেবে কেন?’ জুলিয়া রবার্টস বলল।
‘এই ধরনের যুদ্ধ তারা করতে পারে যারা স্রষ্টাকে পালনকর্তা, বিচারকর্তা এবং পুরষ্কার দাতা বা শাস্তিদাতা মানে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কিন্তু এই বিশ্বাসের সাথে মানুষের জন্যে কাজ করার সম্পর্ক কি?’ জুলিয়া রবার্টস বলল।
‘সম্পর্ক স্রষ্টা, পালনকর্তা, বিচারকর্তা ও পুরষ্কার বা শাস্তিদাতার উদ্দেশ্যে সাথে। স্রষ্টা চান তাঁর চাওয়া অনুসারে মানুষ মানুষের শান্তি ও কল্যাণের জন্যে কাজ করুক।’ বলল আহমদ মুসা।
‘এটা তো সমাজ সেবা, খুব বেশি হলে সমাজ সংস্কারের কাজ। যুদ্ধের কোন প্রশ্নই তো এখানে ওঠে না। কিন্তু আপনি বলেছেন যুদ্ধের লক্ষ্য এটা হতে পারে।’ জুলিয়া রবার্টস বলল।
‘এই লক্ষ্যে যুদ্ধ নয়, কিন্তু যুদ্ধ হলে তার লক্ষ্য এটাই হওয়া উচিত।’ বলে একটু থামল আহমদ মুসা। বলল আবার, ‘মানুষের শান্তি ও মংগলের জন্যে কাজ করার দুটো দিক আছে। একটা হলো ন্যায়ের প্রতিষ্ঠার জন্যে কাজ করা, অন্যটা হলো অন্যায়ের প্রতিরোধ করা। এই দুটি দিকের প্রথমটি দ্বিতীয়টির উপর নির্ভরশীল। ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্যেই অন্যায়ের প্রতিরোধ প্রয়োজন। তার মানে…….।’
‘তার মানে মানুষের শান্তি ও মংগলের লক্ষ্যে অশান্তি ও অমংগলের প্রতিরোধের জন্যে যুদ্ধ প্রয়োজন। এর অর্থ আপনাদের ইসলামে যুদ্ধ একটা একান্ত আবশ্যকীয় অস্ত্র।’ আহমদ মুসার মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বলল জুলিয়া রবার্টস।
‘হ্যাঁ, যতদিন অশান্তি ও অমংগলের শক্তির হাতে এই অস্ত্র থাকবে।’ বলল আহমদ মুসা।
মুখ টিপে হাসল জুলিয়া রবার্টস। বলল, ‘এই দৃষ্টি কোণ থেকে সন্ত্রাস যুদ্ধকে আপনি বৈধ বলবেন? কারণ সবল পক্ষ যেটাকে যুদ্ধ বলে, সবলের বিরুদ্ধে দুর্বলের সেই যুদ্ধই সন্ত্রাস নামে অভিহিত হয়। দুর্বলের এই যুদ্ধ সংগত কারণেই কৌশলের দিক দিয়ে ভিন্নতর হয়ে থাকে। দুর্বল এক্ষেত্রে সবলের বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে না গিয়ে গেরিলা পন্থা অনুসরণ করে।’
‘আপনার কথিত দুর্বল পক্ষ যদি বৈধ কোন ষ্টেট (যদি তা বিদ্রোহের মাধ্যমেও) হয় এবং ষ্টেট-অথরিটি যদি যুদ্ধের ঘোষণা দিয়ে সবল শত্রুর যতটা পারা যায় ক্ষতি করার জন্যে গেরিলা ধরনের আক্রমণ শুরু করে, তাহলে এটা সন্ত্রাস হবে না। কিন্তু ষ্টেট অথরিটি ছাড়াই যদি কোন গ্রুপ বা পক্ষ তার শত্রুর বিরুদ্ধে এই ধরনের আক্রমণ শুরু করে, তাহলে সেটা সন্ত্রাসের পর্যায়ে পড়বে। আমাদের নবী (স.) মক্কায় ১৩ বছর ষ্টেটলেস অবস্থায় মানুষের জন্যে শান্তি ও মংগলের বাণী, অর্থাৎ ইসলাম প্রচার করেছেন। এই তের বছর তিনি সবল শত্রুর দ্বারা অকথ্য নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। কিন্তু পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ কোনভাবেই তিনি শত্রুর উপর পাল্টা আঘাত হানেননি। অথচ মদিনায় গিয়ে ষ্টেট-অথরিট অর্জন করার পর প্রতিটি আঘাত-আক্রমণের তিনি মোকাবিলা করেছেন। শত্রুর প্রস্তুতিকে দুর্বল বা নস্যাত করার জন্যে অভিযান পরিচালনা করেছেন। সুতরাং আপনার প্রশ্নের জবাব হলো, ন্যায়সংগত হলেও আপনার কথিত সবলের বিরুদ্ধে দুর্বলের অথরিটি বিহীন সন্ত্রাস যুদ্ধকে বৈধ বলে মনে করে না ইসলাম। ‘ক’এর অপরাধে ‘খ’কে শাস্তি দেবার অনুমতি ইসলামে নেই। অথচ সন্ত্রাসের অধিকাংশ ক্ষেত্রে এটাই ঘটে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কেন এটা আপনাদের ‘ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের প্রতিরোধ’ তত্বের মধ্যে পড়ে তো।’ জুলিয়া রবার্টস বলল।
‘ব্যক্তি পর্যায়ে অন্যায় প্রতিরোধে গিয়ে কোন সময় শক্তি প্রয়োগের প্রয়োজন হতে পারে। সে শক্তি প্রয়োগ যদি সামনাসামনি কোন অন্যায় থেকে কাউকে বিরত রাখার জন্যে হয়, তাহলে এটা সন্ত্রাস হবে না, কেউ একে সন্ত্রাস বলবে না। কিন্তু কেউ যদি অন্যায়কারীকে এভাবে সামনাসামনি প্রতিরোধ করার প্রকাশ্য ও বাঞ্জনীয় দায়িত্ব পালন না করে এক সময় গোপনে গিয়ে তার বাড়িতে আগুন লাগায়, তাহলে এটা সন্ত্রাস হবে। কারণ এর দ্বারা নির্দিষ্ট অন্যায়টির প্রতিরোধ হয় না এবং এই কাজে অন্যায়কারী ছাড়াও আরও অনেকে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় খোদ এই কাজটিই অন্যায়ে পরিণত হয়।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কিন্তু এর আগে আপনি বলেছেন, আপনাদের নবী ষ্টেট-অথরিটি বিহীন অবস্থায় মক্কা জীবনের তের বছরে কোন পর্যায়েই অন্যায় ও জুলুম নির্যাতনের প্রতিরোধ করেননি শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে। এখন বললেন ব্যক্তিপর্যায়ে অন্যায়ের প্রতিরোধে শক্তি প্রয়োগ করা যাবে। এটা ইসলাম সম্মত হলে আপনাদের নবী মক্কার জীবনে তা করেননি কেন?’ জুলিয়া রবার্টস বলল।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘আমি এখানে বলেছি ব্যক্তি বা বিচ্ছিন্ন গ্রুপ পর্যায়ের অন্যায়ের কথা এবং ব্যক্তি বা বিচ্ছিন্ন গ্রুপ পর্যায়ের প্রতিরোধের কথা। এটা মানুষের অপরিহার্য দায়িত্বশীলতার অংশ বলেই মানব সমাজে এই কাজ চলে আসছে এবং চলা উচিত। ইসলাম একে উৎসাহিত শুধু নয় অবশ্য পালনীয় করেছে। কিন্তু অন্যায় ও জুলুম নির্যাতনকারী যদি ষ্টেট-অথরিটি হয়, জুলুম-নির্যাতন-অন্যায় যদি ষ্টেট অথরিটির অধীনে চলে তাহলে এর বিরুদ্ধে ব্যক্তি বা বিচ্ছিন্ন গ্রুপ পর্যায়ের শক্তি প্রয়োগ বা সন্ত্রাসী কর্মকান্ডকে ইসলাম অনুমোদন করেনি। আমাদের নবী (স.) মক্কা জীবনে এটা করেননি।’
‘এর অর্থ হলো, ষ্টেট অথরিটির সব অন্যায় ও জুলুম অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করে যেতে হবে। এই কি?’ জুলিয়া রবার্টস বলল।
‘না, রাষ্ট্রের নাগরিকরা তা অবশ্যই মুখ বুজে সহ্য করবে না। প্রতিবাদ ও আন্দোলনের মাধ্যমে তাদেরকে অবস্থার পরিবর্তনের চেষ্টা অবশ্যই করতে হবে। এটাও ইসলামের দৃষ্টিতে জিহাদ, যাকে আপনার পাশ্চাত্যের সবাই ভুল বুঝে থাকে।’ বলল আহমদ মুসা।
জুলিয়া রবার্টস হাসল একটু মুখ টিপে। বলল, ‘অস্ত্রের যুদ্ধও তো জিহাদ?’
‘হ্যাঁ, কিন্তু দুয়ের ক্ষেত্র আলাদা।’ বলল আহমদ মুসা।
‘বুঝেছি। কিন্তু বিদ্রোহ বা স্বাধীনতা ঘোষণা সম্পর্কে আপনার মত কি? ষ্টেট অথরিটির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও আন্দোলন কোন সময় বিদ্রোহ বা মুক্তি সংগ্রামের পর্যায়ে পৌছতে পারে।’ জুলিয়া রবার্টস বলল।
‘বিদ্রোহ বা মুক্তি সংগ্রাম ষ্টেট অথরিটির প্রতিপক্ষ আরেক ষ্টেট অথরিটি হয়ে দাঁড়াতে পারে। সেক্ষেত্রে যে যুদ্ধ বা সংঘাতটা হয়, তা যেমন প্রকাশ্য ও ঘোষিত, তেমনি তা শুধু ষ্টেট অথরিটির নিয়ন্ত্রণে সংঘটিত হয়। এই ধরনের বিদ্রোহ বা মুক্তি সংগ্রামমুলক কাজ সন্ত্রাসের পর্যায়ে পড়ে না। এই বিদ্রোহ, মুক্তি সংগ্রাম যদি ‘আল্লাহর জন্যে’, মানে মানুষের শান্তি ও কল্যাণের জন্যে হয়, তাহলে ইসলাম একে অনুমোদন করে।’
‘ধন্যবাদ।’ বলল জুলিয়া রবার্টস।
থামল সে। হেসে উঠল। বলল আবার, ‘আপনি আমেরিকায়, সুরিনামে, ক্যারিবিয়ানে, আফ্রিকায়, ইউরোপে যা করেছেন এবং করছেন, তা কোন পর্যায়ে পড়ে? আপনি অস্ত্র ব্যবহার করছেন, মানুষও মারছেন।’
হাসল আহমদ মুসাও। উত্তরের জন্যে মুখ খুলেছিল। এ সময় ড. হাইম হাইকেল আহমদ মুসাকে বাধা দিয়ে বলে উঠল, ‘এই উত্তরটা আমি দিতে চাই।’
বলে একটু থামল। তারপর বলা শুরু করল, ‘মি. আহমদ মুসা জিহাদকে চার ভাগে ভাগ করেছেন। ব্যক্তি বা বিচ্ছিন্ন গ্রুপ পর্যায়ে অন্যায়ের প্রতিরোধ, ব্যক্তি বা সামষ্টিক নাগরিক পর্যায়ে প্রতিবাদ ও আন্দোলন, বিদ্রোহ বা মুক্তি সংগ্রাম পর্যায়ে সংঘাত ও যুদ্ধ এবং আন্তঃ ষ্টেট পর্যায়ের যুদ্ধ সংঘাত। আহমদ মুসা প্রথম ধরনের জিহাদ করছেন। অস্ত্রের ব্যবহার ও মানুষ মারা নিয়ে মিস জুলিয়া প্রশ্ন তুলেছেন। আপনাদের আলোচনায় পরিষ্কার হয়েছে, দ্বিতীয় প্রকারের জিহাদে ইসলামী নীতি অনুসারে অস্ত্রের ব্যবহার নিষিদ্ধ, কিন্তু প্রথম প্রকারের জিহাদে অস্ত্রের ব্যবহার প্রয়োজনীয় হতে পারে। কারণ অন্যায়কারীর হাতে যা থাকবে, তা নিয়েই তো তাকে প্রতিরোধ করতে হবে। আহমদ মুসা এটাই করছেন। মি. বুমেদীন বিল্লাহ এবং আমাকে উদ্ধার করতে এসে বন্দী খানাতেই আহমদ মুসার হাতে দু’ডজনের মত লোক মরেছে। এই লোকদের না মারলে তিনি আমাকে মুক্ত করতে পারতেন না। এটাই শুধু নয়, তাঁকেও নিহত হতে হতো। তার এই যুদ্ধ বা জিহাদকে শুধু ইসলাম নয়, দুনিয়ার অন্য ধর্ম ও শাসন ব্যবস্থাও অনুমোদন করে।’ থামল ড. হাইম হাইকেল।
‘ধন্যবাদ স্যার। আপনি ঠিকই বলেছেন। কিন্তু সন্ত্রাস সম্পর্কে আপনার অভিমত কি?’ বলল জুলিয়া রবার্টস।
‘মি. আহমদ মুসার সব কথা আমি ভালোভাবে শুনেছি। সন্ত্রাস সম্পর্কে তিনি যা বলেছেন তার সাথে আমি একমত। তিনি তার ধর্মের জিহাদের যে দৃষ্টিকোন তুলে ধরেছেন তার সাথে আমি কয়েকটা কথা যোগ করব। জিহাদ বা যুদ্ধের ব্যাপারে ইসলামের নীতি খুবই স্বচ্ছ, বিস্তারিত ও বাস্তবমুখী। এদিক থেকে ইসলাম অন্যান্য ধর্ম থেকে একেবারেই আলাদা। ইসলাম সর্বকনিষ্ঠ এবং নবুওতের ধারায় সর্বশেষ ধর্ম হওয়ার দাবীদার বলেই হয়তো। ইসলাম মানুষের মতামতের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। কারো উপর ধর্মমত চাপিয়ে দেবার বিরোধী। ইসলামের নবী তার জীবদ্দশায় মদিনার মুনাফিকদের বিকৃত বিশ্বাসকে সহ্য করে গেছেন, কিন্তু তাদের বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারীকে সহ্য করেননি। যেমন তাদের ভিন্ন ‘মসজিদ’ তৈরির উদ্যোগ নস্যাত করে দিয়েছিলেন। মদিনার ইহুদীদের সাথে স্বাক্ষরিত চুক্তির ভিত্তিতে মৈত্রী গড়েছিলেন। কিন্তু ইসলামের নবী নিজে যেমন চুক্তি লংঘন করেননি, তেমনি তিনি ইহুদীদের ষড়যন্ত্রমূলক চুক্তি লংঘনকে বরদাশত করেননি। বিচার ও বিচার কার্যকরী করার ক্ষেত্রে তিনি অত্যন্ত কঠোর ছিলেন। সুতরাং দেখা যাচ্ছে ইসলামের নবী মানুষের চিন্তা ও বিশ্বাসের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু বিভ্রান্তি, অনর্থ, অশান্তি সৃষ্টিকারী উদ্যোগের প্রতিরোধকে একান্ত আবশ্যকীয় বলেছেন। ইসলাম অশান্তি বিশৃঙ্খলা ও সন্ত্রাসকে ‘হত্যা’র চেয়ে মারাত্মক অপরাধ বলে অভিহিত করেছে। এমনকি একজন লোকের হত্যাকেও গোটা মানবজাতিকে হত্যা বলে আখ্যায়িত করেছে। এ কারণেই ইসলাম অপরাধের প্রতিরোধ ও প্রতিবিধানে অত্যন্ত কঠোর। ইসলামের মানবিক রূপ আমাদের পশ্চিমী দেশসমুহে যুদ্ধবাদী, সহ অবস্থান বিরোধী, অশান্তি সৃষ্টিকারী বলে চিত্রিত হয়েছে। মুসলমানদেরকে সন্ত্রাসী হিসেবে চিত্রিত করার কসরত চলছে এই দৃষ্টিকোন থেকেই। পশ্চিমের এই চিন্তা বুঝার ভুল অথবা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রসূত। নিরপেক্ষ ও নীতিনিষ্ঠ হয়ে একটু চিন্তা করলেই দেখা যাবে ইসলামের মৌলবাদিতা অর্থাৎ মানবতা ও মানব সমাজ বিরোধী অপরাধের প্রতিরোধ, প্রতিবিধান ও বিচার প্রশ্নে ইসলামের অনড়তা, আপোষহীনতা মানব সমাজের শান্তি ও কল্যাণের জন্যেই প্রয়োজন। খোদ জাতিসংঘও এ বিষয়টা এখন উপলব্ধি করতে শুরু করেছে। এক সময় জাতিসংঘ শুধু শান্তি রক্ষা করে চলাকেই তার কাজ মনে করতো, কিন্তু এখন শান্তি প্রতিষ্ঠাকেও তার কাজ হিসাবে গ্রহণ করছে। জাতিসংঘ তার এই লক্ষ্য বাস্তবায়িত করতে গেলে অন্যদের অমঙ্গলের শক্তির বিরুদ্ধে তাকে যুদ্ধ করতে হবে। জাতিসংঘ ইতিমধ্যেই যুদ্ধ শুরু করেছে। জাতিসংঘ তার কুয়েত যুদ্ধ ও আফগান যুদ্ধকে এই দৃষ্টিকোণ থেকেই অপরিহার্য করেছে। এমনকি আমাদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার অনেক আগ্রাসনকে অনুরূপ যুক্তিতে বৈধ মনে করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্রসহ গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক দেশসমূহের নিরাপত্তার জন্যে প্রয়োজন হলে অশান্তি ও অমংগলের শক্তির বিরুদ্ধে আগাম আক্রমণকেও বৈধ করে নিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক আক্রমণ ও দখন তার এই নীতিরই একটা নগ্ন দৃষ্টান্ত। সুতরাং ইসলাম……….।’
ড. হাইম হাইকেলের কথায় বাধা দিল জুলিয়া রবার্টস। ড. হাইম হাইকেলের কথার মাঝখানেই সে বলে উঠল, ‘স্যার, তাহলে তো দেখা যাচ্ছে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ইসলামের যুদ্ধ নীতিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘ গ্রহণ করেছে।’
হো হো করে হেসে উঠল ড. হাইম হাইকেল। বলল, ‘হ্যাঁ, গ্রহণ করেছে। ইসলামের বন্দুকটা নিয়েছে ঠিকই, কিন্তু টার্গেট উল্টো দিকে স্থির করেছে। ইসলামের ‘যুদ্ধ’কে নিলেও যুদ্ধের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যকে নেয়নি। মি. আহমদ মুসা বলেছেন, ইসলামের জিহাদ বা যুদ্ধ ‘আল্লাহর জনে’, মানে মানুষের মুক্তি, শান্তি ও কল্যাণের জন্যে, কিন্তু আমাদের আমেরিকার যুদ্ধ আমেরিকার জন্যে, তার নিজ সম্পদ ও সমৃদ্ধির জন্যে। মুসলমানদের ‘আল্লাহর জন্যে’ যুদ্ধকে মৌলবাদ বলে গালি দিলেও তা মানুষের জন্যে শান্তি আনে, কল্যাণ আনে, আর আমরা স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের শ্লোগানের আড়ালে যুদ্ধ করি নিজের জন্যে। তাই অশান্তি ও অমংগলের সৃষ্টি করে এবং সংশ্লিষ্ট জনগণের কাছে আমরা দখলদার ও খুনি হিসেবে চিত্রিত হই। অথচ ইসলামের সোনালী যুগের মুসলিম বিজেতাদের বিজিত দেশের মানুষ স্বাগত জানিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরেছে, আর বিজয়ীরাও বিজিতদের বিজিত হিসেবে নয় ভাই হিসেবে বুকে টেনে নিয়েছে। সুতরাং দুযুদ্ধই যুদ্ধ, তবে দুয়ের মধ্যে স্বর্গ ও নরকের মত …………।’
ড. হাইম হাইকেলের কথার মাঝে আবার বাধা দিয়ে জুলিয়া রবার্টস বলে উঠল, ‘স্যার, আপনি কিন্তু দেশের বিরুদ্ধে কথা বলছেন।’
‘না, দেশের বিরুদ্ধে নয়, আমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফাউন্ডার ফাদারসদের স্বাধীনতা ও গনতন্ত্র নীতির পক্ষে কথা বলছি।’ বলল ড. হাইম হাইকেল।
‘আপনি তো ধর্মপ্রাণ ইহুদী, ইসলামকে আসলেই আপনি কেমন মনে করেন?’ জিজ্ঞাসা জুলিয়া রবার্টসের।
‘ইসলাম আধুনিক মানুষের জীবন-দর্শন।’ জবাব দিলেন ড. হাইম হাইকেল।
‘স্যার আমি জানি, আপনি আপনার আগের ইহুদী বিশ্বাস থেকে সরে এসে এখন এমন একটি ইহুদী বিশ্বাস অনুসরণ করেন যেখানে দয়া ও ভালোবাসাই মাত্র ধর্মের হাতিয়ার, যেখানে যুদ্ধ ও রক্তপাতের কোন স্থান নেই। কিভাবে আপনি তাহলে ইসলামকে আধুনিক মানুষের অনুসরণীয় ধর্ম বলেছেন যেখানে প্রতিরোধ-প্রতিবিধানের জন্যে যুদ্ধ অপরিহার্য?’
সংগে সংগে জুলিয়া রবার্টসের প্রশ্নের জবাব দিল না ড. হাইম হাইকেল। যেন দম নিচ্ছিল সে। একটু পর বলল, ‘আমি আমার জীবনের এক বিশেষ অবস্থায় যে বিশ্বাস বেছে নিয়েছি, তা আমার মনের শান্তির জন্যে প্রয়োজনীয় হলেও সে বিশ্বাস দুনিয়ায় শান্তি ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না। কারণ দুনিয়ায় সবল ও ষড়যন্ত্র পটু অমংগলের শক্তি দুর্বল ও নীরিহ মংগল কামনাকে গলা টিপে মারছে ও মারতেই থাকবে। পথহারা দূর্বল ও নিরীহ মানুষের মুক্তির জন্যে আজ খোদায়ী বিধানের অধীন একমাত্র জীবন্ত ধর্ম ইসলামের প্রয়োজন। ইসলামের প্রতিরোধ ও প্রতিকারের যুদ্ধই পারে মানুষের জন্যে শান্তি ও মংগল আনতে।’ থামল ড. হাইম হাইকেল।
ড. হাইম হাইকেল থামতেই জুলিয়া রবার্টস বলে উঠল, ‘স্যার, আপনি খুব বেশি হতাশ। কেন জাতিসংঘের মাধ্যমে তো আমরা মানুষের জন্যে এ শান্তি ও কল্যাণ আনতে পারি।’
হাসল ড. হাইম হাইকেল। বলল, ‘মিস জুলিয়া রবার্টস, দুনিয়ায় সকল মানুষের জন্যে পক্ষপাতহীন শান্তি, সুবিচার ও মংগল প্রতিষ্ঠার জন্যে প্রয়োজন ব্যক্তি-নিরপেক্ষ, দেশ-নিরপেক্ষ অনড় নীতিবোধ। এই নীতিবোধ জাতিসংঘ নয়, একমাত্র স্রষ্টাই দিতে পারেন। কারণ স্রষ্টা সব মানুষের এবং মানুষও স্রষ্টার। আর একটা মৌলিক কথা হলো, যিনি নীতি প্রণয়নকারী, তিনিই যদি আবার তার বাস্তবায়নকারী হন, তাহলে তিনি সময় ও অবস্থার পরিবর্তনে নীতি পাল্টাতে পারেন। সুতরাং মানুষ কিংবা মানুষের দ্বারা পরিচালিত জাতিসংঘ একই সাথে বিধান দাতা ও বিধানের অনুসরণকারী দুই-ই হতে পারে না। এ জন্যেই মানুষের জন্যে খোদায়ী বিধান প্রয়োজন যা সকলের উপর সমভাবে প্রযোজ্য এবং এই বিধানই মানুষের শান্তি ও কল্যাণের পাহারাদার হবে। আমার মত ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের কাছে এটা দুর্ভাগ্যজনক হলেও স্বীকার করতে হবে যে, এই খোদায়ী বিধান আজ শুধু ইসলামের কাছেই আছে।’
বিস্মিত, বিব্রত, মুগ্ধ জুলিয়া রবার্টস বলল, ‘কেন, তাহলে স্যার আপনি ইসলাম গ্রহণ করেননি, করছেন না?’
হাসল ড. হাইম হাইকেল। বলল, ‘আমি দুনিয়ার মানুষের কথা বলছি, নিজের কথা নয়। ব্যক্তিগত প্রসংগ থাক।’ থামল ড. হাইম হাইকেল।
মুগ্ধ দৃষ্টিতে আহমদ মুসা ‘কম্পারেটিভ ফেইথ ষ্টাডিজ’-এর প্রবীণ প্রফেসর ড. হাইম হাইকেলের কথা গোগ্রাসে গিলছিল। ড. হাইম হাইকেল থামতেই সে বলে উঠল, ‘ধন্যবাদ স্যার। আমার বিশ্বাসকে আপনি আরও মজবুত করছেন যে, ইসলাম একদিন অবশ্যই বিশ্বের সব মানুষের একমাত্র জীবন-দর্শন হয়ে উঠবে।’
বলে একটু থামল আহমদ মুসা। তারপর ড. হাইম হাইকেলকে ‘মাফ করবেন স্যার’ বলে জুলিয়া রবার্টসের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মিস জুলিয়া রবার্টস, এদেরকে হাসপাতালে নিতে হবে। কিন্তু তার আগে আপনি এফ.বি.আই.-এর চীফ জর্জ আব্রাহাম জনসনের সাথে একটু কথা বলুন।’
‘সুপ্রীম বস জর্জ আব্রাহাম জনসনের সাথে? আমি? কেন?’ দুচোখ ছানা-বড়া করে বলল জুলিয়া রবার্টস।
‘আমার কথা তাকে বলুন। সব ব্যাপার তাকে জানান?’ বলল আহমদ মুসা।
‘উনি তো সবই জানতে পারবেন। সবই তাকে জানানো হবে অফিসিয়ালি।’ জুলিয়া রবার্টস বলল।
‘সেটা তো পরে। আমি এখান থেকে যাওয়ার আগেই তাঁকে জানানো দরকার। যাতে অন্তত আপনার কাছে পরিষ্কার হয় যে, সুযোগ নিয়ে আমি আইনের হাত থেকে পালাচ্ছি না। এফ.বি.আই. চীফ যখন ইচ্ছা ডাকলেই আমাকে পেতে পারেন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তাহলে আপনি কথা বলুন। আমি সরাসরি তাঁর সাথে কথা বলার এক্তিয়ার রাখি না।’ জুলিয়া রবার্টস অনুরোধের সুরে বলল।
‘ঠিক আছে, সংযোগ লাগিয়ে দিন, আমি কথা বলব।’ বলল আহমদ মুসা।
ঠিক আছে। আমার পার্সোনাল ও অফিসিয়াল মোবাইল ছাড়াও নাম্বারহীন একটা মোবাইল আছে। সেটা নিয়ে আসি। আমি চাই, আমার সহযোগিতার কোন রেকর্ড স্যারের কাছে না থাক।’ বলে উঠে এক দৌড়ে উঠে গেল দুতলায়। এক মিনিটের মধ্যেই ফিরে এল সে মোবাইল নিয়ে।
আহমদ মুসা এফ.বি.আই.-চীফ জর্জ আব্রাহাম জনসনের পার্সোনাল মোবাইল নাম্বার জুলিয়া রবার্টসকে বলল।
জুলিয়া রবার্টস নাম্বারগুলো টিপে সংযোগ দিয়েই দ্রুত তুলে দিল আহমদ মুসার হাতে।
টেলিফোন ধরে ওপারের কণ্ঠ শুনেই চিনতে পারল। বলল, ‘গুড ইভিনিং। জনাব আমি আহমদ মুসা।’
ওপার থেকে কণ্ঠ ভেসে এল, ‘আসসালামু আলাইকুম। তুমি তো ডেট্রয়েটে। কেমন আছ? নিশ্চয় কোন বিশেষ খবর?’
‘ড. হাইম হাইকেলকে ওদের হাত থেকে মুক্ত করেছি জনাব।’ আহমদ মুসা বলল।
ভেসে এল ওপার থেকে কণ্ঠ, ‘থ্যাংকস গড। অসংখ্য ধন্যবাদ তোমাকে। কখন, কিভাবে কোত্থেকে তাকে উদ্ধার করা গেল?’
আহমদ মুসা সংক্ষেপে কাহিনীটি বলল। সেই সাথে বলল জুলিয়া রবার্টস কিভাবে তাদেরকে নিরাপদ স্থানে সরে আসতে সাহায্য করেন।
‘থ্যাংকস গড। রীতিমত থ্রিলিং ব্যাপার? তুমি এখন কোথায়?’ বলল ওপার থেকে জর্জ আব্রাহাম জনসন।
‘এখন মিস জুলিয়ার ড্রইংরুমে। আমার সামনে ডেট্রয়েটের এফ.বি.আই.-চীফ হেনরী শ্যারনসহ তার ৮জন লোক সংজ্ঞাহীন অবস্থায় পড়ে আছে। আমি আপনাকে টেলিফোন করেছি একথা জানাবার জন্যে যে, আমি ডক্টর হাইম হাইকেলকে আমার সাথে নিয়ে যাচ্ছি। তিনি এ বাড়িতে মুহূর্তের জন্যেও নিরাপদ নন। আপনি তার নিরাপত্তা ও অবস্থানের জন্যে ব্যবস্থা করলে তাকে আপনাদের কাছে হাজির করব।’ এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলল আহমদ মুসা।
‘থ্যাংকস। হেনরী শ্যারন কি তোমাদের আক্রমণ করেছিল? তোমাকে ও ড. হাইম হাইকেলকে ধরে নিয়ে যাবার চেষ্টা করেছিল?’ ওপার থেকে বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
আহমদ মুসা জুলিয়া রবার্টসের গাড়ি করে আসার সময় থেকে যা ঘটেছে তার সব কথা বলল জর্জ আব্রাহাম জনসনকে।
‘থ্যাংকস গড। তুমি ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলে। হেনরী শ্যারনদের হাতে পড়া মানে আজর ওয়াইজম্যানদের হাতে পড়া। এবার ওদের হাতে পড়লে তোমার ও ড. হাইম হাইকেলের নিহত হওয়ার শতভাগ সম্ভাবনা ছিল। আর নিশ্চয় এই কারণেই হেনরী শ্যারন বিষয়টা আমাদের কাছ থেকে গোপন রেখেছে। সে আজ রাত পৌনে ৯টায়, মানে সে তোমার ওখানে পৌছার মাত্র পনের মিনিট আগে আমার অফিসের সাথে কথা বলেছে। কিন্তু সে তোমাদের সম্পর্কে, তার অভিযান সম্পর্কে কিছুই জানায়নি। ভাল হয়েছে, তুমি ওদের সংজ্ঞাহীন করে আত্মরক্ষা করেছ, কাউকে হত্যা করতে হয়নি। থ্যাংকস গড।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
‘জনাব, আমিও আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি যে, আমি আপনাকে ও জুলিয়া রবার্টসকে বিব্রত অবস্থার মধ্যে ফেলিনি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ঠিক, আমাদেরকে বিব্রত অবস্থা থেকে বাঁচিয়েছ। মিস জুলিয়া রবার্টস কি তোমার পাশে আছে? ওকে টেলিফোনটা দাও।’
‘দিচ্ছি স্যার। এইসাথে আমি আপাতত বিদায় নিচ্ছি। আমি কি করছি আপনাকে জানাব। থ্যাংকস। বাই।’
আহমদ মুসা মোবাইলটি তুলে জুলিয়া রবার্টসের হাতে নিল।
জুলিয়া রবার্টস মোবাইল হাতে নিয়ে মুখের সামনে ধরে ‘গুড ইভিনিং স্যার’ বলতে বলতে উঠে দাঁড়াল। কথা বলল তার চীফ বস জর্জ আব্রাহাম জনসনের সাথে।
কথা শেষ করে ধপ করে সোফার উপর বসে পড়ে হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, ‘আজ দ্বিতীয়বার কথা বললাম তার সাথে। একবার বলেছিলাম চাকুরিতে যোগ দেবার সময়। আর আজ।’
এই স্বগোতোক্তির পর তাকাল সে আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘স্যার বলেছেন, আপনারা আমার সাথে বেরুবেন। আমি হেনরী শ্যারনদেরকে হাসপাতালে রেখে আপনাদের নিয়ে যাব এয়ারপোর্টে। এয়ারপোর্টে আপনাদের জন্যে তিনটা টিকিট থাকবে ফিলাডেলফিয়ার জন্যে। আপনাদের বিমানে তুলে দিয়ে তারপর আমার ছুটি। তবে এখান থেকে বেরুবার আগে আপনাদের ছদ্মবেশ নিতে হবে, স্যার বলেছেন।’
‘ফিলাডেলফিয়া কেন? আমি তো তাকে বলেছি, ড. হাইম হাইকেল তার বাড়িতে একদিনের জন্যেও নিরাপদ নন।’ বলল আহমদ মুসা।
হাসল জুলিয়া রবার্টস। বলল, ‘আমার কথা এখনও শেষ হয়নি। আপনারা ড. স্যারের বাড়ি যাচ্ছেন না। আপনারা ফিলাডেলফিয়া এয়ারপোর্টে যাওয়ার পর পার্কিং নাম্বার ওয়ানে একটা নীল রংয়ের গাড়ি পাবেন। নাম্বার ‘FA 1876’ এবং সে গাড়ির ড্রাইভার থাকবেন একজন তরুণী। তরুণীটি একটি বিশেষ কোডে হর্ণ দিয়ে আপনাদের স্বাগত জানাবেন। সে কোড আপনি জানেন। গাড়ি যেখানে আপনাকে নিয়ে যাবে সেটা হবে, স্যার বলেছেন, আমেরিকায় আপনার জন্যে সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা। ব্যস। এবার চলুন ছদ্মবেশ নেবেন।’
জুলিয়া রবার্টসসহ আহমদ মুসারা তিনজন উপরে উঠে গেল। একটু পর চারজন নিচে নেমে এল। সবাই ধরাধরি করে সংজ্ঞাহীন দেহগুলো বাইরে মাইক্রোতে নিয়ে তুলল। তারপর বেরিয়ে এল বাড়ি থেকে।
গাড়ির কাছে গিয়ে জুলিয়া রবার্টস বলল, ‘মি. আহমদ মুসা, আপনি ড. স্যার ও বিল্লাহকে নিয়ে আমার গাড়িতে উঠুন। আর আমি হেনরী শ্যারনদের মাইক্রোতে ওঁদেরকে নিয়ে ওটা আমি চালিয়ে নেব।’
জুলিয়া রবার্টস নিজের গাড়ির চাবি আহমদ মুসার হাতে দিয়ে মাইক্রোতে গিয়ে উঠল।
আহমদ মুসারাও গিয়ে জুলিয়া রবার্টসের কারে উঠল।
গাড়ি ষ্টার্ট দিতে দিতে জুলিয়া রবার্টস গাড়ির জানালা দিয়ে আহমদ মুসাকে বলল, ‘আপনি আমাকে ফলো করবেন। হাসপাতাল থেকে বের না হওয়া পর্যন্ত পার্কিং-এ আমার জন্যে অপেক্ষা করবেন। গুড লাক। বাই।’
জুলিয়া রবার্টসের গাড়ি চলতে শুরু করল। তার পেছনে আহমদ মুসার গাড়িও।

গাড়িটা যেমন যান্ত্রিক। ড্রাইভার তরুণীটাও তেমনি যন্ত্রের মত। সামনে তাকিয়ে স্থির বসে আছে ড্রাইভিং সিটে। হাত দুটি তার ড্রাইভিং হুইলে। হুইলটার মাঝে মাঝে নড়া-চড়া ছাড়া আর সবকিছুই স্থির। গাড়িতে তোলার সময় যান্ত্রিক কণ্ঠে স্বাগত জানানো ছাড়া মেয়েটি আর একটা কথাও বলেনি। আহমদ মুসা ভাবল, মেয়েটি বোধ হয় এফ.বি.আই.-এর কেন্দ্রীয় স্পেশাল ফোর্সের সদস্য। বলা হয়, এরা বলেও না, শুনেও না, শুধুই হুকুম তামিল করে।
গাড়ির ম্যাপ স্ক্রীনে গাড়ির চলার পথ সুন্দরভাবে ফুটে উঠছে। গাড়িটা ফিলাডেলফিয়া ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে উত্তর-পূর্বমুখী পেনরস এ্যাভেনিওতে প্রবেশ করেছিল। পেনরস এ্যাভেনিউ থেকে প্রবেশ করেছে বিখ্যাত ব্রডষ্ট্রিটে। ব্রডষ্ট্রিট থেকে গাড়ি এখন ওয়ালমাট ষ্ট্রিটে প্রবেশ করে পুব দিকে এগিয়ে চলেছে।
ড. হাইম হাইকেল আহমদ মুসার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, ‘আমরা দেলোয়ার নদীর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। আমার মনে হয়, দেলোয়ার নদী ও সিটিহলের মাঝখানের পুরানো অফিসিয়াল এলাকার কোথাও আমাদের নিয়ে যাচ্ছে।’
ড. হাইম হাইকেলের কথা শেষ হতেই গাড়িটা উত্তর দিকে টার্ণ নিয়ে ষষ্ঠ ষ্ট্রিট ধরে এগিয়ে চলল। কিন্তু মাত্র ১০০ মিটার গিয়েই গাড়ি পুবদিকে বাঁক নিয়ে ষ্ট্রিট থেকে নেমে সামনে এগুলো। তারপর আরও পঞ্চাশ মিটার গিয়ে পাঁচিল ঘেরা একটা বাড়ির গেটে গিয়ে দাঁড়াল।
দাঁড়িয়েই ড্রাইভার তরুণী আহমদ মুসাদের দিকে তাকিয়ে ‘এক্সকিউজ মি স্যার’ বলে গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে গেল।
তরুণী এগুলো গেটের দিকে।
গেটের সিকিউরিটিকে কি যেন সে বলল। সংগে সংগে সিকিউরিটি লোকটি মোবাইল তুলে কথা বলল।
মিনিটখানেকের মধ্যেই ভেতর থেকে একজন লোক বেরিয়ে এল। সে সিকিউরিটির সাথে কথা বলেই ছুটে এল গাড়ির কাছে। গাড়ির দরজা খুলে বলল, ‘ওয়েলকাম স্যার, আসুন।’
লোকটি চল্লিশোর্ধ। সুন্দর সাদাসিধা পোশাক। সরল, হাসিমাখা মুখ।
গাড়ি থেকে বেরুল প্রথম আহমদ মুসা। তারপর ড. হাইম হাইকেল এবং শেষে বুমেদীন বিল্লাহ।
লোকটি সবার সাথে হ্যান্ডশেক করে বলল, ‘আমি হেনরিক হফম্যান। ম্যাডামের কর্মচারী। এই বাড়ির কেয়ারটেকার। আপনাদের ব্যাপারে সবকিছু আমাকে বলা হয়েছে।’
একটু দম নিয়ে ড. হাইম হাইকেলে দিকে ইংগিত করে বলল, ‘ইনি নিশ্চয় ড. মুর হ্যামিল্টন। ম্যাডামের শিক্ষক। অসুস্থ। আর…………..।’
তার মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে আহমদ মুসা বলল, ‘আর আমি জোসেফ জন।’ তারপর বুমেদীন বিল্লাহকে দেখিয়ে বলল, ‘ইনি ক্রিশ্চিয়ান কার্টার।’
‘জানি স্যার। আসুন। ওয়েলকাম।’ বলে গেটের দিকে হাঁটতে শুরু করল।
ড্রাইভার তরুণী এগিয়ে এল আহমদ মুসাদের দিকে। স্যালুট দিয়ে বলল, ‘হ্যাভ অ্যা নাইস টাইম। বাই স্যার।’
‘থ্যাংক ইউ ম্যাডাম।’ বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসারা হফম্যানের সাথে গেটের দিকে হাঁটতে শুরু করল।
গেটের ডানপাশে বাড়ির একটা নেম প্লেট। কাঠের ব্রাউন প্লেটের উপর সাদা অক্ষরে বড় করে লেখা ‘জেফারসন হাউজ।’ তার নিচে ব্র্যাকেটের মধ্যে ছোট অক্ষরে ‘ব্যক্তিগত মালিকানা’ শব্দ দ্বয় লেখা।
বাড়িটার নাম পড়ে ভ্রু কুঁচকালো আহমদ মুসা। কোন জেফারসন? টমাস জেফারসন নিশ্চয়। না হলে আর কোন জেফারসনের নামে এমন হাউজ হবে এবং এই খানে? ভাবনা বাড়ল আহমদ মুসার। এটা জেফারসন হাউজ হলে ম্যাডাম কে? বিরাট পরিবার, অনেক শাখা। ম্যাডাম অনেকেই হতে পারে। ফিলাডেলফিয়ার ‘জেফারসন হাউজ’-এর কথা আহমদ মুসা সারাহ জেফারসনের কাছে কোনদিনই শোনেনি।
আহমদ মুসারা গেট পার হয়ে প্রবেশ করল ভেতরে।
গেট থেকে লাল পাথরের একটা সুন্দর রাস্তা এগিয়ে গেছে বাড়ির দিকে। দুধারে ফুলের বাগান। বাগানটা বাড়ির চারদিক ঘিরেই। চারদিকের ফুল বাগানের মাঝখানে লাল পাথরের সুন্দর তিনতলা বাড়িটি।
লাল পাথরের রাস্তাটি বাড়ি থেকে একটু সামনে বেরিয়ে আসা গম্বুজাকৃতির ছাদে ঢাকা সুন্দর সাদা পাথরের চত্বরে গিয়ে শেষ হয়েছে। এটা গাড়ি বারান্দা হিসেবেই ব্যবহার হয়। তিনটা ধাপ পেরিয়েই সে বারান্দায় উঠা যায়। ছোট্ট অর্ধ চন্দ্রাকৃতি বারান্দার পরেই বাড়িতে প্রবেশের বিরাট দরজা। হেনরিক হফম্যানকে অনুসরণ করে ঐ দরজা পথে আহমদ মুসা বাড়িতে প্রবেশ করল।
দরজার পরে ছোট্ট একটা করিডোর পথ। তার পরেই বিশাল একটা লাউঞ্জ। তাঁরা লাউঞ্জে পৌঁছল।
হেনরিক হফম্যান বলল, ‘স্যার এটা বাড়ির পার্টি কর্ণার। এই নিচের তলাতেও আগে অফিস রুম ছিল, এখন তার কিছু অংশে কিচেন ও ষ্টোর করা হয়েছে। আমরা যারা আছি তাদেরও থাকার ব্যবস্থা এই ফ্লোরে। একতলা ও দুতলা রিমডেলিং হয়ে গেছে। তিনতলার কাজ বাকি। আপনাদের থাকার জায়গা দুতলায়। চলুন স্যার।’
দাঁড়িয়ে এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে দুতলায় উঠার সিঁড়ির দিকে আবার হাঁটা শুরু করল হেনরিক হফম্যান।
আহমদ মুসারা চলল তার পেছনে পেছনে।
দুতলায় উঠে হেনরিক হফম্যান আহমদ মুসাদের প্রত্যেককে তার ঘরে নিয়ে গেল। সবাইকে বলল, ‘ফ্রেশ হয়ে দুতলার লাউঞ্জে আসুন স্যার। ওখানেই চা-নাস্তা দিতে বলেছি। নাস্তার সাথে কথাও বলা যাবে। আর কাপড় ছাড়ার দরকার হলে আলমারিতেই সব পাবেন স্যার। প্রয়োজনীয় সব জামাকাপড় সেখানে রাখা আছে। কোন কিছুর দরকার হলে বলবেন।’
হেনরিক হফম্যান দুতলার লাউঞ্জে ফিরে এল। লাউঞ্জটা দুতলার সিঁড়ির মুখেই।
মিনিট পনেরোর মধ্যে আহমদ মুসা, ড. হাইম হাইকেল ও বুমেদীন বিল্লাহ লাউঞ্জে চলে এল।
গরম নাস্তা ও গরম চায়ের জন্যে ধন্যবাদ দিয়ে ড. হাইম হাইকেল বলল, ‘নাইস লোকেশান বাড়িটার। বাড়ির পুব পাশে ফিলোসফিক্যাল হল, উত্তর পাশে ইনডিপেনডেন্স হল এবং তার পাশেই কংগ্রেস হল। বলা যায় ফিলাডেলফিয়ার প্রাণকেন্দ্র এটা।’
বলে একটু থেমেই ড. হাইম হাইকেল তাকাল হেনরিক হফম্যানের দিকে। বলল, ‘মি. হফম্যান, এ বাড়িটার নাম ‘লিবার্টি হাউজ’ এবং এ বাড়িটা ‘ন্যাশনাল চাইল্ড ফাউন্ডেশন’এর অফিস ছিল। এ পরিবর্তনটা কি করে হলো?’
‘আপনি ঠিকই বলেছেন স্যার। দুমাস আগে এই পরিচয়ই ছিল। দুমাস হলো এই পরিবর্তন ঘটেছে। বাড়ির মালিকই এ পরিবর্তন ঘটিয়েছেন।’ বলে একটু থেমেই হফম্যান আবার বলা শুরু করল, ‘স্যার, এই বাড়িটা তৈরি করেন দুবার নির্বাচিত সাবেক প্রেসিডেন্ট টমাস জেফারসন। ফিলাডেলফিয়ায় থাকাকালিন সময়ে এ বাড়িতে তিনি বাসও করেন। তিনিই বাড়িটির নাম দেন ‘লিবার্টি হাউজ’। এই বাড়িতে বসেই তিনি মার্কিন সংবিধান ‘বিল অব রাইটস’এর খসড়া তৈরি করেন। বোধ হয় এ কারণেই তিনি বাড়িটার নাম ‘লিবার্টি হাউজ’ রাখেন। তিনি ওয়াশিংটনে চলে গেলে বাড়িটা ভাড়ায় চলে যায়। সর্বশেষ ভাড়ায় ছিলেন ন্যাশনাল চাইল্ড ফাউন্ডেশন। দুমাস আগে তারা চলে যান। তারা চলে যাওয়ার পর বর্তমান মালিক ম্যাডাম মানে টমাস জেফারসনের গ্রান্ড গ্রান্ড ডটার মিস সারা জেফারসন সিদ্ধান্ত নেন বাড়িটা আর ভাড়া দেবেন না। বাড়িটাকে তিনি তার গ্রান্ড গ্রান্ড ফাদার টমাস জেফারসনের ‘ফ্যামিলি মেমোরিয়াল’ বানাবেন। ভার্জিনিয়ায় টমাস জেফারসনের বাড়ি এখন প্রকৃত অর্থে পাবলিক প্লেসে পরিণত হয়েছে। ওখানে কোন ফ্যামিলি প্রাইভ্যাসি আর সম্ভব নয়। এ কারণেই তিনি জেফারসনের ‘ফ্যামিলি মেমোরিয়াল, হিসেবে এই বাড়ি বেছে নিয়েছেন। নামও পরিবর্তন করেছেন উদ্দেশ্যের সাথে সংগতি রেখে।’
সবাই যখন হফম্যানের কথা শোনায় বুঁদ হয়ে গিয়েছিল, তখন আহমদ মুসার একটা ভিন্ন অস্বস্তি। মনের একটা চিন্তা থেকেই এই অস্বস্তি। সারাহ জেফারসনের মায়ের মন্তব্য তার মনে আছে। অতীতের সব কিছু মুছে ফেলার জন্যে সারা জেফারসনের সময় ও সুযোগ প্রয়োজন। আহমদ মুসা কোনভাবেই আর তার বিব্রত হওয়ার কারণ হতে চায় না। যে কারণে আহমদ মুসা এবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এসে সারার সাথে কোন যোগাযোগ করেনি। সারা জেফারসন তার খবর রাখছে জানতে পেরেও তার সাথে সৌজন্যমূলক কথা বলা থেকেও আহমদ মুসা বিরত থেকেছে। কিন্তু এত কিছুর পরেও সে আজ সারা জেফারসনের বাড়িতে এসে উঠেছে। এফ.বি.আই. চীফ জর্জ আব্রাহাম জনসন বিষয়টা জেনেও কেন এটা করলেন? এটা তিনি ঠিক করেননি। মনে কিছু ক্ষোভেরই সৃষ্টি হলো তার।
ওদিকে গল্প চলছিল। কিন্তু আহমদ মুসার কানে ওদের গল্প ঢুকছে না। অস্বস্তিকর বিষয় তার মনকে অসুস্থ করে তুলেছে।
ওদের কথা বলার মাঝখানেই আহমদ মুসা অনেকটা বেসুরোভাবে বলে উঠল, ‘সকলে মাফ করবেন, আমি একটু রেষ্টে যেতে চাই।’
‘অবশ্যই, অবশ্যই। আপনারা ক্লান্ত। আমি উঠি। আমি নিচে আছি। ডাকলেই পাবেন।’ বলে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াল হেনরিক হফম্যান।
সবাই উঠে দাঁড়াল।
ড. হাইম হাইকেলের রুমটা আহমদ মুসার রুমের সামনেই। আর বুমেদীন বিল্লাহর রুম ড. হাইম হাইকেলের রুমের পাশে।
আহমদ মুসা ড. হাইম হাইকেলকে তার কক্ষে পৌছে দিয়ে বলল, ‘স্যার, ঘরটা সব সময় লক করে রাখবেন। আপনি একা দয়া করে বেরুবেন না। রুম টেলিফোনে আমাকে ডাকবেন।’
‘ধন্যবাদ আহমদ মুসা। আমাদের অবস্থা আমি বুঝতে পারছি।’ বলে একটু থামল ড. হাইম হাইকেল। তারপর বলল, ‘আপনার কাছে আমার অনেক জিজ্ঞাসা আছে। আপনি তো আমার বাড়িতে গেছেন।’
‘স্যার, আমি আপনার ছেলের মত। আমাকে সেইভাবে কথা বললে বাধিত হবো।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ধন্যবাদ। কিন্তু তুমি তো মাথায় থাকার মত।’ ড. হাইম হাইকেল বলল।
‘না স্যার, মাথা থেকে বুকটা মনে হয় আরও কাছে।’ বলে আহমদ মুসা একটা দম নিয়েই ড. হাইম হাইকেলকে তার বাড়ির কিছু খবর দিয়ে বলল, ‘যা ঘটেছে তা বিস্তারিত বলার জন্যে আজই সুযোগ নেব।’
আহমদ মুসা থামতেই ড. হাইম হাইকেল বলল, ‘তুমি বলেছিলে, আমার কাছে তোমার কিছু কাজ আছে, সেটা কি?’
‘খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ স্যার। আপনার সাহায্য আমি চাই। সব বলব আপনাকে। এখন যাই স্যার। আপনি রেষ্ট নিন।’
আহমদ মুসা বেরুবার জন্যে পা বাড়াল।
‘আহমদ মুসা, তোমাকে সাহায্য করতে পারা আমার জন্যে গৌরবের ব্যাপার হবে।’ বলল ড. হাইম হাইকেল।
‘অনেক ধন্যবাদ স্যার।’ বলে আহমদ মুসা ঘর থেকে বেরিয়ে এল।
আহমদ মুসা রুম থেকে বেরুতেই তার দিকে ছুটে আসতে দেখল হেনরিক হফম্যানকে। তার হাতে একটা মোবাইল। তার কাছে কোন টেলিফোন এসেছে কি, ভাবল আহমদ মুসা।
হেনরিক হফম্যান তার কাছে এসে হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, ‘স্যার, আপনি আপনার মোবাইল ফেলে এসেছিলেন। ড্রাইভার মেয়েটা দিয়ে গেল।’
বলে সে তার হাতের মোবাইল আহমদ মুসার হাতে তুলে দিল।
আহমদ মুসা মোবাইলটি হাতে নিয়ে বলল, ‘কোন ড্রাইভার?’
‘স্যার, আপনাদের ড্রাইভার। আপনি যে গাড়িতে আসলেন সেই গাড়ির ড্রাইভার। ’ বলল হেনরিক হফম্যান।
ভ্রুকুঞ্চিত হল আহমদ মুসার। মুখে বলল, ‘ঠিক আছে, ধন্যবাদ মি. হফম্যান।’
হেনরিক হফম্যান চলে গেল।
আহমদ মুসা তাকাল মোবাইলটার দিকে। দেখল, মোবাইলের স্ক্রীনে জলজল করছে তার নতুন নাম ‘জোসেফ জন’। ভাবল সে, এটাও এফ.বি.আই. চীফ জর্জ আব্রাহামেরই কীর্তি। তিনি নিশ্চয় চান না আমি সাধারণ টেলিফোনে তার সাথে বা কারো সাথে কথা বলি। তবু একবার টেলিফোন করে বিষয়টা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হবে।
খুশি হলো আহমদ মুসা। ঘরে প্রবেশ করল।
আহমদ মুসা হ্যাংগারে কোটটি খুলে রেখে প্রথমেই দুরাকাত নামাজ পড়ল। শোকরানার নামাজ। আল্লাহ কঠিন কাজকে অনেক সহজ করে দিয়েছেন। ড. হাইম হাইকেলকেও দিয়েছেন সহযোগিতাকারী হিসাবে। ধ্বংস টাওয়ারের তলায় লুকানো ষড়যন্ত্রের রূপ কেমন, তার উদ্ধারকেও আল্লাহ সহজ করে দিন। এই প্রার্থনা আহমদ মুসা জানাল আল্লাহর কাছে।
আহমদ মুসা বিছানায় গা এলিয়ে দিল। বিরাট ধকল গেছে শরীরের উপর দিয়ে গত দুদিনে। শয্যাকে মনে হচ্ছে ভীষণ মধুর। মনটাকে বাইরের জগত থেকে ফিরিয়ে এনে আত্মস্থ হতে চেষ্টা করল নিশ্চিন্ত রেষ্টের জন্যে। কিন্তু আত্মস্থ হতেই মন চারপাশের জগত থেকে অন্য এক জগতে চলে গেল। মনের আকাশ জুড়ে ভেসে উঠল ডোনা জোসেফাইনের মুখ, হাসি মাখা প্রাণবন্ত একটি মুখ। মুখে এক চির বসন্তের রূপ। ওতে শীতের বিশীর্ণতা কিংবা বর্ষার কালো মেঘের ঘনঘটা কোনদিন সে দেখিনি। শত বেদনাতেও কোন অনুযোগ, অভিযোগ তার নেই। হঠাৎ বাঁধ ভাঙা এক আবেগ এসে আছড়ে পড়ল তার হৃদয়ে। আবেগটা অশ্রু হয়ে বেরিয়ে এল তার দুচোখ দিয়ে।
চোখ মুছল না আহমদ মুসা। গড়াতে লাগল অশ্রু তার দুগন্ড বেয়ে। এ অশ্রু তাকে যন্ত্রণা নয়, দিল প্রশান্তি।
আহমদ মুসা হিসেব করে দেখল নিউইয়র্ক থেকে ডোনা জোসেফাইনের সাথে কথা বলার পর আজ ৯ম দিন পার হয়ে যাচ্ছে। তার সাথে ওয়াদা আছে টেলিফোন করার ক্ষেত্রে কোনক্রমেই সাতদিন অতিক্রম করবে না। গত কিছুদিনের মধ্যে প্রথম ব্যতিক্রম এবার ঘটল। সাতদিনের পর আরও দুদিন চলে গেছে। নিশ্চয় সে অস্থির হয়ে উঠেছে। তাকে তো এখন এমন অস্থির হওয়া চলবে না। বাচ্চা হওয়ার সময়টা ঘনিয়ে আসছে। ঘড়ির দিকে তাকাল আহমদ মুসা। এখন হয় তো সে ঘুমিয়ে পড়েছে। থাক। সন্ধ্যার দিকে মানে সউদি আরবের সকাল বেলায় ভাল হবে টেলিফোন করা।
পাশ ফিরল আহমদ মুসা। কিন্তু ঘুমানোর চেষ্টা সফল হলো না। মোবাইল বেজে উঠল।
উঠে বসে টেনে নিল মোবাইল টেবিল থেকে। মোবাইলের স্ক্রীনের উপর চোখ রাখতেই দেল নাম্বারটি এফ.বি.আই. চীফ জর্জ আব্রাহাম জনসনের।
মোবাইলটি কানের কাছে তুলে ধরতেই ওপার থেকে জর্জ আব্রাহাম জনসন বলে উফল, ‘আসসালাম জোসেফ জন, সব ঠিকঠাক? কোন অসুবিধা হয়নি তো?’
‘জি জনাব, সব ঠিক-ঠাক। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। কিন্তু…………।’ কথা শেষ না করেই আহমদ মুসা থেমে গেল কিভাবে বলবে সেটা ভেবে নেবার জন্যে।
‘কিন্তু কি, জোসেফ জন?’
‘আপনি যে স্থানকে আমাদের জন্যে আমেরিকার মধ্যে সবচেয়ে নিরাপদ স্থান বলে আমাদের এখানে এনেছেন। কিন্তু সে স্থানের মালিক এ বিষয়টা জানেন বলে আমার মনে হচ্ছে না।’
হো হো করে হেসে উঠল জর্জ আব্রাহাম জনসন। বলল, ‘ঠিকই বলেছ জোসেফ জন। তার অনুমতি ছাড়াই আমি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তবে ঠিক অনুমতি ছাড়াও নয়। ক’দিন আগে আমাকে সারাহ জেফারসন বলেছিল যে, তোমার মিশনের জন্যে তোমাকে অনেক দূর যেতে হতে পারে। তার জন্যে তোমাকে লম্বা একটা সময় আমেরিকায় থাকতে হবে। তোমার জন্যে নিরাপদ একটা ঠিকানা দরকার। এই কথা বলার সাথে সাথে সে বলেছিল তার ঐ ফিলাডেলফিয়ার বাড়ির কথা। ‘ফ্যামিলি মেমোরিয়াল’ গড়ে তোলার কাজ শুরু করতে বেশ সময় লাগবে। তার আগে বাড়িটা খালিই পড়ে থাকবে। গতকাল তোমার সাথে আলোচনা করার পর আমি চিন্তা করলাম ড. মুর হ্যামিল্টনকে নিয়ে তুমি কোথায় যেতে পার! কোন জায়গাটা তোমাদের জন্যে নিরাপদ হতে পারে! এটা চিন্তা করতে গিয়েই সারা জেফারসনের সেদিনের কথা মনে পড়েছিল। সংগে সংগেই আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে জুলিয়া রবার্টসকে এ ব্যবস্থার করথা জানিয়ে দিয়েছিলাম। পরে আমি সারা জেফারসনকে আমার গৃহিত ব্যবস্থার কথা বলি। সে খুশি হয়ে বলে, আংকেল, আমি যা করতাম, আপনি তাই করেছেন।’ সুতরাং জোসেফ জন, মালিকের অনুমতি নেই তা বলতে পার না।’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘আমন্ত্রণ আর বাধ্য হয়ে আতিথ্য দান বোধ হয় এক জিনিস নয় জনাব।’
‘জোসেফ জন, তুমি জান তুমি ঠিক বলছ না।’ বলে একটু থেমেই সে আবার বলে উঠল, ‘আমি বুঝতে পারছি না তোমাদেরকে। তুমি যেমন সত্যকে পাশ কাটাতে চাচ্ছ, হাসির ছলে হলেও, তেমনি তার ব্যাপারটাও আমাকে বিস্মিত করেছে। আজ সাত সকালে সারা আমাকে টেলিফোন করে বলল, ‘সে ইউরোপ চলে যাচ্ছে তিন মাসের সফরে। তুরষ্কের বসফরাস, মর্মরা ও কৃষ্ণ সাগর আর ইস্তাম্বুলের অলিতে-গলিতে প্রাণ খুলে ঘুরে বেড়াবে তিন মাস ধরে। তার একটা স্বপ্ন এটা। অথচ গত রাতে ১৫ মিনিট ধরে কথা হলো তার সাথে, কিছুই সে বলেনি। এত বড় একটা স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রোগ্রাম রাতের অবশিষ্ট কয়েক ঘণ্টায় কেন, কিভাবে সম্ভব হলো! যাক, এসব কথা জোসেফ জন। কাজের কথায় আসি। তোমাকে অবশিষ্ট কাজের ব্যাপারে দ্রুত হতে হবে। ড. মুর হ্যামিল্টনকে এভাবে বেশি দিন রাখা যাবে না। আর ওখানে তোমাদের কোন অসুবিধা হবে না। হেনরিক হফম্যান লোকটা সবদিক দিয়েই ভাল এবং যোগ্য। মনে কর বাড়িটার এখন আমিই মালিক। আইনিসহ এর সবরকম তত্বাবধানের দায়িত্ব তিন মাসের জন্যে সারা আমাকেই দিয়ে গেছে।’ থামল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
আহমদ মুসা একটু আনমনা হয়ে পড়েছিল। জর্জ আব্রাহামের শেষ কথায় সে সম্বিত ফিরে পেল। তাড়াতাড়ি কথা গুছিয়ে হাসার চেষ্টা করে বলল, ‘সুখবর জনাব, এখন ভাড়া দাবী না করলেই আমরা বাঁচি।’
‘জোসেফ জন, তোমরা আমেরিকার বাইরেটাই দেখ, অন্তর দেখ না।’ বলল আব্রাহাম জনসন।
‘অস্ত্রের কোন অন্তর থাকে না। আর ‘আমেরিকা’ আজ হৃদয়হীন সে অস্ত্রই হয়ে দাঁড়িয়েছে জনাব।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ঠিক বললে না জোসেফ জন। আমেরিকার শিক্ষা-সংস্কৃতি ও সাহায্য-সহযোগিতার বিশ্বব্যাপী ভূমিকা তুমি অস্বীকার করতে পারো না।’
‘ঠিক জনাব। তবে দেখা যাচ্ছে, আমেরিকার শিক্ষা-সংস্কৃতি ও সাহায্য-সহযোগিতা আমেরিকার শক্তির কাঁধে সোয়ার, অথবা আমেরিকার শক্তি তার শিক্ষা-সংস্কৃতি ও সাহায্য-সহযোগিতার কাঁধে সওয়ার। সুতরাং শক্তি মানে অস্ত্রই আজ সবদিক থেকে আমেরিকার ইমেজ, অবয়ব হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
‘কিন্তু জোসেফ, আমেরিকা এটা নয়। এই অবয়ব আমেরিকার নেই। এক রাহুর গ্রাস থেকে বেরিয়ে আসছে জর্জ ওয়াশিংটন, জেফারসন ও আব্রাহাম লিংকনের আমেরিকা। তোমার সাহায্য নতুন সূর্যের উদয় ঘটিয়েছে আমেরিকায়। তোমার বর্তমান অনুসন্ধান যদি সফল হয়, তাহলে আলোর পথে আমেরিকার আরেকটা উল্লস্ফন ঘটবে।’ জর্জ আব্রাহাম জনসন বলল।
‘আমিন।’ আহমদ মুসা উচ্চারণ করল। তারপর বলল, ‘আমি কৃতজ্ঞ আপনার অমূল্য সহযোগিতার জন্যে।’
‘না জোসেফ জন। আমি তোমাকে সাহায্য করছি না, সাহায্য করছি আমাকে, আমার প্রিয় আমেরিকাকে।’
‘ঠিক বলেছেন জনাব। কিন্তু আমি কাজ করছি সত্যের জন্যে, আমার জাতির জন্যে। ধ্বংস টাওয়ারের তলদেশে যে সত্য লুক্কায়িত আছে তা যদি উদ্ধার হয়, তাহলে বিজয় হবে সত্যের। কিন্তু তার চেয়ে বড় বিষয় হলো বাঁচবো আমরা সন্ত্রাসী হওয়ার দায় থেকে। এ দায়-মুক্তিই আমার কাছে আজ সবচেয়ে বড়। এই বড় কাজে আপনার সাহায্য চাওয়ার চেয়েও অনেক বেশি। ধন্যবাদ আপনাকে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ওয়েলকাম, জোসেফ জন। এখন বিদায় নেই জোসেফ।’ জর্জ আব্রাহাম বলল।
‘অশেষ ধন্যবাদ জনাব। বাই।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আসসালাম। গুড বাই।’ বলে ওপার থেকে লাইনটা কাট করল জর্জ আব্রাহাম।
আহমদ মুসা মোবাইলটি রেখে দিয়ে আবার বিছানায় গা এলিয়ে দিল।
সব চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে চোখ বন্ধ করতে চেষ্টা করল।
আবার রুম টেলিফোন বেজে উঠল।
তুলল টেলিফোন আহমদ মুসা।
‘স্যরি জোসেফ, একটা জররি কথা জিজ্ঞেস করতে চাই। এখান থেকে আমার বাড়ি তো খুব কাছে। আমি মুর হ্যামিল্টন নাম নিয়ে অপরিচিতের মতই কথা বলতে চাই। আমার বাড়ির সাথে কথা বলতে পারি?’ বলল ওপ্রান্ত থেকে ড. হাইম হাইকেল।
‘আমি বুঝতে পারছি আপনার মনের অবস্থা। কিন্তু না পারেন আপনি নিজ নাম নিয়ে টেলিফোন করতে, না পারেন মুর হ্যামিল্টন নাম নিয়ে, কারণ আপনার বাসার টেলিফোন মনিটর করা হয়। এখন আরও বেশি হচ্ছে। তারা ধরে ফেলবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কিন্তু আমি মুর হ্যামিল্টন নাম নিয়ে করলে তারা চিনবে কি করে?’ বলল ড. হাইম হাইকেল।
‘জনাব, গত রাতে আপনি ডেট্রোয়েট থেকে উধাও হওয়ার পর একজন ড. মুর হ্যামিল্টন বিমানে ফিলাডেলফিয়া এসেছেন। সেই ড. মুর হ্যামিল্টন ড. হাইম হাইকেলের বাসায় টেলিফোন করেছেন, এর অর্থ ওদের কাছে কি দাঁড়াবে? তারা নিশ্চিত ধরে নিতে পারে ডেট্রোয়েট থেকে আসা মুর হ্যামিল্টনই আসলে ড. হাইম হাইকেল।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ধন্যবাদ, তুমি ঠিক বলেছ। এদিকটা আমার মাথায় আসেনি। সত্যিই তুমি অসাধারণ। গড ব্লেস ইউ।’ বলল ড. হাইম হাইকেল।
‘ধন্যবাদ। চিন্তা করবেন না। আমিই ওদের সাথে যোগাযোগের ব্যবস্থা করে দেব।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন। রাখছি টেলিফোন। ডিষ্টার্ব করার জন্যে দুঃখিত। বাই।’
বলে ওপার থেকে টেলিফোন রেখে দিল ড. হাইম হাইকেল।
আহমদ মুসা টেলিফোন রেখে আবার শুয়ে পড়ল।
শরীরটাকে নিঃশেষে ছেড়ে দিল বিছানার উপর নিরংকুশ এক বিশ্রামের সন্ধানে।

Top